একদা এক পানশালাতে – ৬

৷৷ ৬ ৷৷

আজ মঙ্গলবার৷ সেদিন রাতে বিদিশা থেকে অপূর্ব ঘোষালের সঙ্গে পানাহার করে ফিরে আসার পর তিনটে দিন যেন দেখতে দেখতেই কেটে গেল৷ নিজের বেশ কয়েকটা লেখার চাপ, তার ওপর চন্দনের কয়েকটা বই সামনের মাসে পয়লা বৈশাখ প্রকাশিত হতে চলেছে৷ সে সব লেখার সংশোধন, প্রুফ দেখা ইত্যাদি কাজে তিন দিন ব্যস্ত ছিল চন্দন৷ তবে দুপুরের দিকে অথবা রাত্রের দিকে যখনই একটু অবসর মিলেছে তখনই তার মনে পড়েছে বিদিশা বারের কথা৷ সত্যিই হয়তো জায়গাটার প্রতি আকর্ষণ বেড়ে চলেছে চন্দনের৷ শুধু লেখার রসদ সংগ্রহের জন্য নয়, দু-দিন মদ্যপানের জন্য নয়, জায়গাটার প্রতি যেন একটা অদ্ভুত ভালা লাগা তৈরি হয়েছে চন্দনের মনে৷ এমনও হতে পারে যে মানুষ দেখার আকর্ষণই তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাচ্ছে বিদিশাতে৷ সঠিক কারণটা চন্দনের জানা না থাকলেও চন্দন অনুভব করছে এই আকর্ষণের ব্যাপারটা৷ আজ থেকে পরপর কয়েকদিন চন্দনকে কলেজ স্ট্রিট যেতে হবে বেশ কয়েকজন পাবলিশারের কাছে৷ চন্দন ঠিক করে নিয়েছে এ-কদিন একবার করে ঘুরে আসবে সেখানে৷ তবে এক ঘণ্টার বেশি সেখানে চন্দনের থাকা হবে না৷ সন্ধ্যার মধ্যে বাড়ি ফিরে আবার পরদিন কলেজ স্ট্রিট যাবার জন্য কাজ গোছাতে হবে৷

এগারোটা নাগাদ কলেজ স্ট্রিটে পৌঁছোল চন্দন৷ মনে মনে সে এদিনের পরিকল্পনা ছকে নিয়েছে৷ তিনটে নাগাদ কলেজ স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে সাড়ে তিনটে নাগাদ সে পৌঁছোবে বিদিশাতে৷ সেখানে এক ঘণ্টা কাটিয়ে শিয়ালদা যাবার জন্য বাস ধরবে যাতে সে সন্ধ্যার মধ্যে বাড়ি ফিরতে পারে৷

কলেজ স্ট্রিটে ঢুকে সে প্রথমে এক প্রকাশকের ঘর থেকে একটা বইয়ের প্রুফের বান্ডিল সংগ্রহ করল৷ তারপর অন্য এক প্রকাশকের ঘরে গিয়ে সেখান থেকে তার যে বই প্রকাশিত হতে চলেছে তার ফাইনাল প্রুফ দেখতে বসল৷ বইয়ের কাউন্টারে কাস্টমারদের আনাগোনা, রাস্তাতে লোকজনের চিৎকার- হাঁকডাক৷ তারই মধ্যে বই বিপণির মধ্যে বসে কাজ করে চলল চন্দন৷ একবার কাউন্টারে এক কাস্টমার ভিতরে বসে থাকা চন্দনকে চিনতে পেরে তার থেকে একটা বইতে অটোগ্রাফ করিয়ে নিল৷ সময় এগিয়ে চলল, কাজের মধ্যে একবার তাকে চা আর ফিশফ্রাই দিয়ে গেল এক কর্মচারী৷ তিনটে নাগাদ কাজ শেষ করে চন্দন যখন বেরোতে যাচ্ছে ঠিক তখনই সেখানে ঢুকলেন প্রবীণ কথাসাহিত্যিক অঞ্জন বসাক৷ লোকটা মানুষ হিসাবে ভালো৷ চন্দন যখন প্রথম লেখার জগতে পা রাখে তখন অনেক কাগজের সঙ্গে অঞ্জনদা চন্দনের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন৷ চন্দন তাঁকে শ্রদ্ধা করে৷ কাজেই তিনি ভিতরে প্রবেশ করাতে বাইরে বেরিয়ে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল চন্দন৷ তাকে দেখেই অঞ্জনদা মিষ্টি হেসে বললেন, ‘কেমন আছ চন্দন? আমি তোমার কথা অনেককে বলি৷ এই বয়সে কী ভালো লিখছ তুমি! পাঠকদের মুখে যখন তোমার লেখার প্রশংসা শুনি তখন খুব আনন্দ হয় আমার৷’

চন্দনদের লেখালেখির জগতে পারস্পরিক আকচাআকচি লেগেই থাকে৷ প্রায় কোনো লেখকই তাঁর সহ-লেখকদের প্রশংসা করেন না৷ অঞ্জনদা ব্যতিক্রমী মানুষ৷ প্রবীণ লেখকের মুখে নিজের লেখার প্রশংসা শুনে চন্দন তাঁর কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘এ সবই আপনাদের মতো মানুষদের আশীর্বাদ দাদা৷ যতটুকু করতে পেরেছি আপনাদের কয়েকজনের জন্য৷ আপনারাই তো একদিন আমার হাত ধরে প্রকাশকের দরজা চিনিয়েছেন, তাদের সুপারিশ করেছেন আমার লেখা ছাপাবার জন্য৷’

তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘সে তো অনেকের জন্যই করেছি৷ ওটা কোনো বড়ো ব্যাপার নয়৷ সুপারিশের কারণে প্রকাশক হয়তো একটা লেখা বা একটা বই ছাপাতেন তোমার, কিন্তু তার বেশি নয়৷ তুমি টিকে গেলে তোমার লেখার জোরে৷’

এ কথা বলার পর অঞ্জনদা বললেন, ‘এর মধ্যে একদিন চাঁদনিতে গেছিলাম রবিবারের কাগজের জন্য গল্প জমা দিতে৷ আমি তোমাকে একটা বারে ঢুকতে দেখলাম৷ একবার ভাবলাম ডাকি, তারপর আর ডাকলাম না৷’

অঞ্জনদার কাছে কথাটা গোপন করার ব্যাপার নেই, চন্দন তাই বলল, ‘ডাকতে পারতেন দাদা৷ একসঙ্গে বসে কিছু খাওয়া যেত৷ আসলে সামনের একটা পুজোসংখ্যার জন্য পানশালা নিয়ে একটা উপন্যাস লিখব ভাবছি৷ তাই ওখানে ক’দিন ধরে আসা-যাওয়া করছি৷ আমার এক বন্ধু ওই পানশালার মালিকের সঙ্গে পরিচিত৷ সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছে৷’

কথাটা শুনে অঞ্জনদা বললেন, ‘বাঃ, বেশ ভালো সাবজেক্ট৷ বাংলা বইয়ের পাঠক বলতে তো এখন আমাদের কাছে মধ্যবিত্ত বাঙালি, কিছু বয়স্ক পাঠকও বটে৷ এখনও তাদের কাছে ‘পানশালা’ মানে একটা প্রায় নিষিদ্ধ জায়গা৷ আর যে কোনো নিষিদ্ধ জায়গা নিয়ে লিখলে তার প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি হয়৷ তবে সব জায়গাতে তো নেগেটিভ আর পজেটিভ ব্যাপার থাকে৷ সেদিকটাও তুলে ধরার চেষ্টা কোরো৷’

চন্দন বলল, ‘আপনার পরামর্শ মনে রাখব দাদা৷ এ ব্যাপারে আপনার কোনো অভিজ্ঞতা আছে?’

চন্দনের প্রশ্ন শুনে তিনি প্রথমে বললেন, ‘পানশালার ব্যাপারে খুব বেশি অভিজ্ঞতা না থাকলেও কয়েকটা পানশালাতে আমি গেছি৷ না, কোনো বিখ্যাত সাহিত্যিকদের সঙ্গে নয়৷ ইলাসট্রেটর প্রশান্ত চৌধুরী আমার পুরোনো বন্ধু৷ তার উৎসাহতেই যেতাম, ওই যেমন পার্ক স্ট্রিটের ‘ড্রিংক-আস’ বার সহ আরও কয়েকটা বারে৷ আমার হার্ট অ্যাটাক হবার আগে, অর্থাৎ এই সাত-আটবছর আগে আমি শেষ গেছিলাম লেনিন সরণি আর ধর্মতলা ক্রসিং-এর কাছে ‘সোনা বার’ নামের একটা বারে৷ ভারী অদ্ভুত লেগেছিল সেটা৷ ওই ‘ড্রিংক-আস’ বা পার্ক স্ট্রিট, চাঁদনি চত্বরে আমরা বার বলতে যা বুঝি সেটা ঠিক তেমন নয়, একটা বিরাট হলঘরের মধ্যে স্কুলে যেমন বেঞ্চ পাতা থাকে, তেমনই সার সার কাঠের হাইবেঞ্চ, লোবেঞ্চ পাতা৷ পাঁচ টাকা বা দশ টাকা টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতে হয়৷ তার বিনিময় পাওয়া যায় একটা কাচের গ্লাস আর এক বোতল জল৷ যারা ড্রিংস সার্ভ করে তারা বাদামঅলার ডালার মতো কাঠের ডালাতে সস্তা বিলিতি মদের বোতল গলায় ঝুলিয়ে ঘোরে৷ পয়সা দিলে পেগ মেপে তারা গ্লাসে ঢেলে দেয়৷ আগে পয়সা তার পর মদ৷ মাতাল হয়ে পয়সা না দেবার হ্যাঙ্গাম এড়াতে এই ব্যবস্থা৷ ছোলা, বাদাম, এসবও পাওয়া যায় কিন্তু ওই একই নিয়ম৷ অফিস-ফেরতা ব্রিফকেস হাতে কেরানি, কলকাতাতে কাজে আসা মধ্যবিত্ত মানুষ খুব সস্তায় মদ খেতে যায় ওখানে৷’ এ কথা বলার পর তিনি বললেন, ‘আমার জীবনের একটা মজার অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল৷ তখন আমার তেইশ-চবিবশ বছর বয়স৷ উত্তরপাড়া থেকে ট্রেনে চেপে হাওড়া হয়ে কলকাতাতে ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করতে আসি৷ এক সহপাঠীর মুখে শুনেছিলাম, হাওড়া স্টেশন থেকে বেরিয়ে গঙ্গার পাড় বরাবর এগোলে একটা বাংলা মদের ঠেক আছে৷ চাঁদনি রাতে গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে বাংলা মদ খাওয়া নাকি এক স্বর্গীয় ব্যাপার! যে বয়সের কথা বললাম সে বয়সে এ সব ব্যাপারে প্রবল আকর্ষণ থাকে৷ তার ওপর আমি আবার সে বয়সে কবিতা লিখতাম৷ কাজেই একদিন যেদিন আমার বাড়িতে সেদিন রাতে কেউ ছিল না, সেদিন ইউনিভার্সিটি ফেরত ট্রেন ধরার আগে এক সন্ধ্যায় গিয়ে হাজির হলাম নির্দিষ্ট বাংলা মদের ঠেকে৷ ফাঁকা জায়গাতে রাস্তার ওপরই গঙ্গার ঠিক গায়ে একটা ঝাঁপবন্ধ দোকান৷ তার পিছনের দরজা দিয়ে মদ বিক্রি হয়৷ দোকানটার আড়ালে গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে মদ খায় খদ্দেররা৷ আমি ছাড়াও আরও দু-তিনজন খদ্দের এখন জড়ো হয়েছে সন্ধ্যাবেলা বাংলা মদ খাবার জন্য৷ তাদেরই সঙ্গে আমি প্রথমে একটা মাটির গ্লাসে বাংলা মদ নিয়ে গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে খেতে শুরু করলাম৷ বেশ কড়া মদ৷ এক ভাঁড় খেতেই মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করতে শুরু করেছে গঙ্গার ফুরফুরে বাতাসে৷ এরপর আমি দ্বিতীয় ভাঁড় মদ নিয়ে ধীরে ধীরে চুমুক দিতে লাগলাম৷ ততক্ষণে চাঁদ উঠতে শুরু করেছে আকাশে৷ সোনার থালার মতো গোল চাঁদের প্রতিবিম্ব গঙ্গার জলে৷ পায়ের কাছেই নদীর জলের ছলাৎ ছল শব্দ আর তার সঙ্গে গঙ্গার ঠান্ডা বাতাস৷ কোথাও কোনো শব্দ নেই কাছাকাছি৷ মদ্যপ্রেমীদের জন্য আদর্শ পরিবেশই বটে৷ আমার ঠিক পাশে দাঁড়িয়েই মদ খাচ্ছিল আর একজন লোক৷ নদীর দিকে তাকিয়ে আমি একসময় তার উদ্দেশে বললাম, ‘চাঁদের আলোতে নদীটা কী সুন্দর লাগছে তাই না?’

আমার প্রশ্ন শুনে লোকটা প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে আমাকে পালটা প্রশ্ন করল, ‘আপনি সাঁতার জানেন তো?’

আমি লোকটার দিকে ফিরে জবাব দিলাম, ‘জানি না৷ কিন্তু কেন বলুন তো?’

লোকটা মদের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে নিস্পৃহভাবে জবাব দিল, ‘আসলে এখানে মাঝেমধ্যেই পুলিশ রেইড করে৷ তখন আমরা গঙ্গাতে ঝাঁপ দেই৷ যারা জানে না তারা ধরা পড়ে৷ এক রাত অন্তত লকাপে থাকতে হয়৷’

তার সে কথা শুনে আমার নেশা কেটে গেল৷ মদের ভাঁড় আমি সেই মুহূর্তেই গঙ্গায় ছুড়ে ফেলে সে জায়গা ছেড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করলাম হাওড়া স্টেশনের দিকে৷’—গল্পটা শেষ করে হো হো করে হেসে উঠলেন প্রবীণ কথাসাহিত্যিক অঞ্জন বসাক৷ চন্দনও তাঁর জীবনের মজার কাহিনি শুনে হাসল কিছুক্ষণ৷ এরপর আরও কয়েকটা কথা তাঁর সঙ্গে বলে চন্দন বেরিয়ে পড়ল বিদিশাতে যাবার জন্য৷

ভিড় বাস৷ গরমও তেমনই৷ অন্যদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে মাথার ওপরের রড ধরে দাঁড়িয়ে ছিল চন্দন৷ বুকের কাছে অন্য হাতে ধরা পাণ্ডুলিপির ব্যাগ৷ চাঁদনীর ঠিক আগের ক্রসিং-এ মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল৷ কোনো রকমে সে অবস্থাতেই ফোন বার করে কলটা রিসিভ করল চন্দন৷ শীর্ষেন্দুর ফোন৷ সে কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শীর্ষেন্দু চাপা গলাতে বলল, ‘বিদিশার ব্যাপারে কিছু শুনেছিস? টিভিতে খবরটা দেখাচ্ছে!’

‘কী খবর?’ জানতে চাইল চন্দন৷

শীর্ষেন্দু বলল, ‘একটা রেপ কেস৷ বিদিশার নাম জড়িয়ে গেছে!’

কথাটা শুনে চন্দন বিস্মিতভাবে জানতে চাইল, ‘ঘটনাটা কী ঘটেছে?’

কিন্তু এরপরই যান্ত্রিক শব্দ তুলে লাইনটা কেটে গেল৷ চন্দন দু-বার চেষ্টা করল তাকে ফোন করার জন্য৷ কিন্তু শীর্ষেন্দুর ফোনে কল ঢুকল না সম্ভবত নেটওয়ার্ক প্রবলেমের জন্য৷ দেখতে দেখতে চাঁদনি স্টপেজ এসে গেল৷ বাস থেকে নেমে পড়ল চন্দন৷ খবরটা শোনার পর থেকেই একটা উত্তেজনা কাজ করতে শুরু হল চন্দনের মনে৷ ব্যাপারটা ঠিক কী ঘটেছে? বিদিশা কি তবে বন্ধ আছে? বাস থেকে নেমে চন্দন রাস্তা ক্রস করে এগোল বিদিশার দিকে৷

বার খোলাই আছে৷ দরজাতে রমানাথও দাঁড়িয়ে৷ ব্যাপারটা দেখে একটু আশ্বস্ত হল চন্দন৷ চন্দন রমানাথের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে অন্যদিনের মতোই দরজা খুলে দিল৷ কিন্তু তার মুখে চন্দনের প্রতি অন্যদিনের মতো হাসি নেই৷ কিছু জিজ্ঞেস করলে তা রমানাথকে জিজ্ঞেস না করে অপূর্ববাবুকেই করা উচিত, তাই রমানাথের সঙ্গে কথা না বলে বিদিশার ভিতর ঢুকে পড়ল চন্দন৷ বারের ভিতরটা আপাতদৃষ্টিতে একই রকম মনে হল চন্দনের৷ দুপুরের দিকে অন্যদিন বারের ভিতর যেমন অবস্থা থাকে ঠিক তেমনই৷ বেশি ভিড় নেই৷ কিছু টেবিল খালি, আবার কিছু টেবিলে বসে মদ্যপান করছে কয়েকজন৷ তবে ওয়েটারদের মুখে কেমন যেন একটা চাপা উত্তেজনার ভাব৷ কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল চন্দন৷ ভিতরে বসে চাপা স্বরে কী যেন আলোচনা করছেন ক্যাশিয়ার শুভঙ্কর আর বিরাজ৷ চন্দনকে দেখে তাঁরাও কিন্তু হাসলেন না৷ বিরাজ, চন্দনকে বললেন, ‘আপনি একটা টেবিলে বসুন, অপূর্বদা কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়বেন৷

চন্দন একটা টেবিলে গিয়ে বসল৷ চারপাশে তাকিয়ে চেনা মুখ বলতে সেই বৃদ্ধ পরিমল ভট্টাচার্যকে দেখতে পেল৷ যিনি সময় কাটাবার জন্য, একাকিত্ব কাটাবার জন্য এখানে খেতে থাকেন৷ ভদ্রলোক সম্ভবত চন্দনকে খেয়াল করেননি৷ চন্দনের দিকে পিছন ফিরে কিছুটা তফাতে তিনি বসে৷ চন্দন আর কাছে গেল না৷ অপূর্ব ঘোষালের জন্য সে প্রতীক্ষা করতে লাগল৷

কাচের দরজা ঠেলে রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষাল ভিতরে ঢুকলেন৷ তাঁকে দেখেই ওয়েটাররা কাজ করতে করতে কৌতূহলী ভাবে তাকাতে লাগল তাঁর দিকে৷ সবার মুখেই যেন একটা চাপা উত্তেজনার ভাব৷ অপূর্ব ঘোষালের মুখেও যেন কেমন একটা বিধ্বস্ত ভাব৷ অপূর্ব তাঁকে দেখে উঠে দাঁড়াতে তিনিও আজ গুড ইভিনিং সম্ভাষণ জানালেন না৷ হাতের ইশারাতে চন্দনকে সেখানেই বসে থাকতে বলে প্রথমে চলে গেলেন ওয়াশরুমে৷ সম্ভবত তিনি সেখানে গিয়ে হাতে-মুখে জল দিয়ে সোজা গিয়ে ঢুকলেন কাউন্টারের ভিতর৷ কাউন্টারে কাচের পর্দার আড়ালে সহকর্মীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা সেরে বাইরে বেরিয়ে চন্দনের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘আসুন, ওপরে যাব৷’

চন্দন উঠে এগোল সিঁড়ির দিকে৷ নিশ্চুপভাবে চন্দনকে নিয়ে ওপরে উঠে গতদিনের সেই পারসোনাল কেবিনে ঢুকে ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষাল৷ ক্যাম্পখাটটাতে পাশাপাশি বসল তারা দুজন৷ স্পষ্টতই থমথম করছে তাঁর মুখ৷ একটু চুপ থাকার পর অপূর্ব ঘোষাল চন্দনকে প্রশ্ন করলেন৷ ‘আমাদের বার নিয়ে কোনো কথা কোথাও শুনেছেন? কোনো বাজে খবর?’

চন্দন একটু ইতস্তত করে বলল, ‘এখানে বাসে আসার পথে শীর্ষেন্দুর একটা ফোন এসেছিল৷ সে বলল, টিভিতে নাকি দেখাচ্ছে, একটা রেপ কেস হয়েছে, আর তার সঙ্গে বিদিশার নাম জড়িয়েছে৷ ব্যস এটুকুই শুনেছি৷ তারপরই লাইনটা কেটে গেল৷’

অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘তার মানে খবরটা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে! এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম! পুলিশ চেষ্টা করলেও কি এসব খবর গোপন রাখতে পারে? আমি এখন লালবাজার থেকেই ফিরলাম৷ আবারও একটু পর সেখানে যেতে হবে৷ হ্যাঁ, খবরটা সত্যি৷ মারিয়া নামের এক ব্রিটিশ তরুণী গতরাতে ধর্ষিতা হয়েছেন বাইপাসের ধারে একটা ফাঁকা জায়গাতে৷ বাইশ বছর বয়স মেয়েটার৷ গতরাতে সে আমাদের এখানে খেতেও এসেছিল৷ কলকাতায় সে কয়েকদিন আগে এসেছিল কী একটা গবেষণার কাজে৷’

চন্দন জানতে চাইল, ‘কিন্তু ওই দুর্ঘটনার সঙ্গে বিদিশার নাম জড়াল কীভাবে? এখানে খেতে এসেছিল বলেই কি?

অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘আপনাকে সব কথা খুলে বলছি৷ মেয়েটা গতকাল আটটা নাগাদ আমাদের এখানে ঢোকে৷ তিন পেগ ভোদকা আর খাবার খেয়ে ঠিক দশটাতে সে বার ছাড়ে৷ একলাই সে এখানে এসেছিল৷ পার্ক স্ট্রিট, ধর্মতলা, চাঁদনির বারগুলোতে মাঝে মাঝেই বিদেশিরা কাজ করে৷ ব্যাপারটা নতুন নয় আমাদের কাছে৷ যাই হোক কাল রাত বারোটা নাগাদ একটা নির্মাণ সংস্থার কয়েকজন শ্রমিক কাজ সেরে সাইকেল করে ও পথে বাড়ি ফিরছিল৷ বাইপাসের ওই জায়গাটা বেশ ফাঁকা, বড়ো বড়ো ঝোপঝাড় আছে৷ হঠাৎই তারা তাদের রাস্তার অন্যপাশে একটা বড় ঝোপের আড়াল থেকে একটা চিৎকার শুনতে পায়৷ তারা দেখে ওই ঝোপ-জঙ্গলের বাইরে একটা গাছের আড়ালে একটা মোটরবাইকও রয়েছে৷ ওই তিনজন শ্রমিক চিৎকার শুনে আর বাইকটা দেখে রাস্তার অন্যপাশে দাঁড়িয়ে পড়ে৷ তাদের একজন বলে ওঠে, ‘এত রাতে কে ওখানে?’

আর ঠিক সেই মুহূর্তে একজন লোক বেরিয়ে আসে ঝোপের আড়াল থেকে৷ সে লোকগুলো রাস্তা পেরিয়ে লোকটাকে ধরার আগেই মুহূর্তের মধ্যে লোকটা বাইকে উঠে চম্পট দেয়৷ এরপর ওই শ্রমিকরা ঝোপের কাছে গিয়ে দেখতে পায় ঝোপের আড়ালে যন্ত্রণাতে কাতরাচ্ছে এক উলঙ্গ বিদেশিনি! কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা পুলিশের গাড়িকে হাত দেখিয়ে থামায় লোকগুলো৷ পুলিশই মেয়েটাকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যায়৷’

এ কথা বলে একটু থেমে বোতল থেকে ঢক ঢক করে জল খেয়ে বিদিশা বারের ম্যানেজার আবার বলতে শুরু করলেন, ‘জ্ঞান হারাবার আগে পুলিশের গাড়িতে হাসপাতালে যাবার আগে ভয়ার্ত-ধর্ষিতা মেয়েটা নিজের নাম-পরিচয় ছাড়া যতটুকু বলতে পেরেছে তা হল এই বার থেকে বেরিয়ে রাস্তার ক্রসিং-এ সে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছিল ওই বাইপাসের ধারেই তার হোটেলে ফিরে যাবার জন্য৷ দু-একটা ট্যাক্সিকে সে থামালেও তারা তাকে রিফিউজ করে৷ সাড়ে দশটা নাগাদ হেলমেট পরা এক বাইক আরোহী এসে দাঁড়ায় তার কাছে৷ সে বলে সে বিদিশা বারের কর্মী৷ ম্যাডাম যে এতক্ষণ সেখানে খাচ্ছিলেন তা সে দেখেছে৷ রাতে মাঝে মাঝে সে কাস্টমারদের তার বাইকে গন্তব্যে পৌঁছে দেয় উপযুক্ত বখশিশ পেলে৷ তখন মারিয়া বলে সে বাইপাসে যেতে চায়, এবং তা শুনে লোকটা বলে যে দুশো টাকা বখশিশ দিলে সে মারিয়াকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেবে৷ ব্যাপারটাতে রাজি হয়ে মেয়েটা উঠে বসে লোকটার বাইকে৷ বাইপাসের দিকেই মারিয়াকে নিয়ে এগিয়ে ছিল লোকটা, কাজেই মারিয়ার সন্দেহের কিছু ছিল না৷ কিন্তু ওই নির্জন স্থানে গিয়ে বাইক থামিয়ে দেয় সে৷ তারপর একটা ছুরি দেখিয়ে মেয়েটাকে ঝোপের আড়ালে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে৷ এ কথা বলার পরই মেয়েটা সেই যে জ্ঞান হারিয়েছে, আর তার জ্ঞান ফেরেনি৷’ কথা শেষ করে থামলেন অপূর্ব ঘোষাল৷

তাঁর কথা শুনে চন্দন বিস্মিতভাবে বলল, ‘আপনার বারের কেউ এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত? নাকি মিথ্যা পরিচয় দিয়ে কেউ তাকে তুলে নিয়ে গেছিল?’

অপূর্ব ঘোষাল জবাব দিলেন, ‘আমার ধারণা, দ্বিতীয়টা৷ মিথ্যা পরিচয় দিয়েই মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল৷’

চন্দন বলল, ‘ওই বিদেশিনি, বিদিশা বারে খেতে এসেছিল, আর ধর্ষক তাকে বিদিশা বারের কর্মী হিসাবে পরিচয় দিয়েছিল বলেই কি আপনাদের হ্যারাস হতে হবে? পুলিশ নিশ্চয়ই খতিয়ে দেখবে ঘটনাটা?’

অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘হ্যারাস হতে হবে নয়, হওয়া শুরু হয়েছে৷ দুটো কারণে পুলিশের সন্দেহ কিন্তু আমাদের দিকে৷ লালবাজারের পুলিশ অফিসার প্রথমেই আমাকে যে প্রশ্ন করলেন তা হল, আমাদের কর্মীরা কালো প্যান্ট, সাদা শার্ট পরেন কি না? কারণ, ওই মেয়েটা পুলিশকে বলেছে যে তাকে ধর্ষণ করেছে তার পরনে কালো প্যান্ট, সাদা শার্ট ছিল৷ যারা লোকটাকে পালাতে দেখেছিল তারাও একই সাক্ষ্য দিয়েছে৷ মেয়েটা পুলিশকে বলেছে যে বিদিশা বারে সে ওই পোশাকের ওয়েটার দেখেছে৷ তাই সে বিশ্বাস করে বাইকের পিছনে উঠেছিল৷ মেয়েটা নীচে বসলেও ওপরের ফ্লোরে ও পোশাকে ডিউটিতে ছিল পল্টু, বিকাশ আর শ্যামল৷ হয়তো তারা যখন নীচের ফ্লোরের থেকে খাবার আর ড্রিংস আনার জন্য যাওয়া-আসা করছিল তখন মেয়েটার চোখে পড়েছিল তাদের পোশাক৷ এই পোশাকের ব্যাপারটা হল আমাদের প্রতি সন্দেহের প্রথম কারণ৷ আর দ্বিতীয় সন্দেহের পিছনে অবশ্য আমারই একটু গাফিলতি আছে৷ দিন তিনেক হল আমাদের সিসি টিভির ক্যামেরাগুলো কানেকশনের গণ্ডগোলের কারণে কাজ করছে না৷ লোক ডেকে সারাব ভেবেও কাজটা হয়নি৷ পুলিশ গতরাতের সিসি টিভির ফুটেজ চাচ্ছে৷ যেটা আমি দিতে পারছি না৷ ফলে আমাদের ওপর পুলিশের সন্দেহ বাড়ছে৷’

চন্দন জানতে চাইল, ‘ওয়েটারদের সঙ্গে কথা বলেছেন? তারা কী বলছে?’

তিনি জবাব দিলেন, ‘কাল মোটামুটি দশটা নাগাদই বার ফাঁকা হয়ে গেছিল৷ যে তিনজন কাল ও পোশাকে ছিল তারা সবাই সাড়ে দশটার মধ্যেই বাইরে বেরিয়ে গেছিল৷ তিনজনই কলকাতাতেই থাকে৷ ওরা তো বলছে বার থেকে বেরিয়ে ওরা সোজা যে যার বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেছিল৷ রাস্তায় মেমসাহেবকে তারা দেখেই নি৷ এখন আমাকে এখানকার সব কর্মচারীদের ছবি তুলে, ঠিকানা, ফোন নম্বর নিয়ে লালবাজারে জমা দিতে যেতে হবে৷ আর কাল সকাল দশটাতে তাদের নিয়ে হাজির হতে হবে লালবাজারে৷ আগামী রবিবার বিদিশার পঞ্চাশতম জন্মদিন৷ মালিকের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হয়েছিল ওই দিন পুরোনো কাস্টমারদের ইনভাইট করা হবে৷ এখন কী হবে কে জানে?’ —শেষ কথাটা বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষাল৷

মালিকের প্রসঙ্গ উঠতেই চন্দন জানতে চাইল, ‘আপনাদের মালিক দীনেশবাবুও কি লালবাজারে গেছিলেন?’

অপূর্ব ঘোষাল বললেন ‘সেখানেই তো আরো সমস্যা৷ স্যার তাঁর মায়ের চিকিৎসার জন্য তাঁকে নিয়ে আমেরিকা রওনা হয়েছিলেন৷ সেখানে তিনি পৌঁছেও গেছেন৷ লালবাজার থেকে ফোন করা হয়েছিল তাঁকে, আমিও করেছিলাম৷ তিনি এখানে থাকলে নিজেই ব্যাপারটা সামলাবার চেষ্টা করতে পারতেন, এখন আমার ওপরই সব দায়িত্ব৷ মেয়েটার যতক্ষণ জ্ঞান না ফিরছে ততক্ষণ আর কিছু করার নেই৷ সে যদি আমাদের কর্মচারীদের তার ধর্ষক হিসাবে শনাক্ত না করে তবেই বাঁচব আমরা৷ নইলে কী হবে কে জানে? তবে আমি এখনও বিশ্বাস করি আমার কর্মীরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়৷’—এ কথা বলে উঠে দাঁড়ালেন অপূর্ব ঘোষাল৷

চন্দন বুঝতে পারল তাঁকে আর এ সময় কোনো প্রশ্ন করে আটকে রাখা ঠিক নয়৷ বিপদ নেমে এসেছে বিদিশা বারের ম্যানেজারের ওপর৷ চন্দনও তাই উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে বলল, ‘মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করবেন৷ বিপদ নিশ্চয়ই কেটে যাবে৷ কাল দুপুর বা বিকালের দিকে কলেজ স্ট্রিট হয়ে আমি একবার এখানে আসব ব্যাপারটা সম্বন্ধে খোঁজ নিতে৷’

অপূর্ব ঘোষাল চন্দনের কথার জবাবে চিন্তিতভাবে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার মাথা তো ঠান্ডা রাখতেই হবে৷ হ্যাঁ, আসবেন৷ আর আপনার থেকে কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হলে তা পাব আশা করি?’

চন্দন বলল, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই৷ ফোন নম্বর তো আপনার কাছে আছেই, প্রয়োজন হলে ফোন করবেন৷’

তারা দুজন এরপর নীচে নেমে এল৷ সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল ফিরোজ৷ তাকে দেখে অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘আশাবরী বা পম্পা এলে ওদের বলে দিও আজ আর গান হবে না৷ আর অর্জুনকে, রমানাথকেও বলো যারা আসবে -যাবে তাদের ওপর নজর রাখতে৷ ফালতু লোক মনে হলে কাউকে যেন ঢুকতে না দেওয়া হয়৷’ কথাগুলো বলে, চন্দনের থেকে বিদায় নিয়ে তিনি চলে গেলেন কাউন্টারের ভিতর৷ আর চন্দনও বারের বাইরে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে নিল৷

সন্ধ্যা নামার আগেই চন্দন এদিন বাড়ি ফিরে এল৷ এ বাড়িতে চন্দন আর তার মা থাকে৷ মায়ের ঘরেই টেলিভিশন সেটটা৷ মা সেটা খুলে নিউজ চ্যানেল দেখছেন৷ সে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চন্দন দেখল টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজ হিসাবে দেখানো হচ্ছে—‘বিদেশিনি ধর্ষণ৷’

বেশ বড়ো বড়ো হরফেই দেখাচ্ছে খবরটা৷ অর্থাৎ খবরটা এবার দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে৷ হাত-মুখ ধুয়ে টিফিন সেরে প্রকাশকের ঘর থেকে আনা পাণ্ডুলিপি নিয়ে কাজে বসল চন্দন৷ কিন্তু কিছুতেই যেন তার কাজে মন বসছে না৷ খালি তার মনে ঘুরপাক খেতে লাগল দুর্ঘটনার কথাটা৷ কে ধর্ষণ করেছে ওই বিদেশিনিকে? সত্যিই কি বিদিশা বারের চন্দনের মুখচেনা কোনো লোক যুক্ত এই পাশবিক ঘটনার সঙ্গে?