একদা এক পানশালাতে – ৫

৷৷ ৫ ৷৷

মাঝের তিনদিন বাড়িতে বসে লেখালিখি করেই সময় কেটেছে চন্দনের৷ তবে একটা জিনিস তার মাঝেমধ্যেই লেখার অবসরে মনে হচ্ছিল, সে যেন কোনো একটা ব্যাপার মিস করছে৷ তবে শেষ পর্যন্ত অবশ্য ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে সে৷ দু-দিন অন্তর অন্তর বিদিশাতে যাবার ফলে নিজের অজান্তেই যেন সে জায়গার প্রতি একটা আকর্ষণ, একটা হাতছানি অনুভব করছে সে৷ হয়তো বা জায়গাটা ঘরের কাছে হলে এ তিনদিনের মধ্যে একবার বিদিশা থেকে ঘুরে আসত চন্দন৷ মাত্র তিনদিনেই সেখানে কত অদ্ভুত চরিত্রর সঙ্গে পরিচয় হল তার, কত অদ্ভুত ঘটনা শুনল সে৷ অথবা, এই মানুষেরা কেউই হয়তো অদ্ভুত নয়, তাদের কাহিনিও নতুন কিছু নয়৷ সমাজের ভিড়ে এসব মানুষ, এ সব ঘটনা চারপাশেই অবিরাম ঘটে চলে৷ পানশালা একটা আয়নার মতো, যেখানে প্রতিফলিত হয় তাদের ছবি৷

একটা ভাড়ার গাড়ি বলে রেখেছিল চন্দন৷ বিকালবেলা সেটা নিয়েই পাড়ি দিয়েছিল কলকাতার উদ্দেশে৷ অনুষ্ঠানের জন্য যতটা নয় তার থেকে বেশি যেন তার ভালো লাগছিল তিনদিন পর আবার সে বিদিশাতে যাবে বলে৷ নির্দিষ্ট সময়ই নন্দন চত্বরে পৌঁছে গেল সে৷ চত্বরের ভিতর পরিচিত একটা সভাগৃহে অনুষ্ঠান৷ আমন্ত্রিত কবি-সাহিত্যিকরা অনেকেই মোটামুটি চন্দনের সঙ্গে পরিচিত৷ এ ধরনের অনুষ্ঠান যেমন চলে ঠিক তেমনই চলল৷ অতিথিদের সংবর্ধনা, বই প্রকাশ, কোনো কোনো লেখকের গলা কাঁপিয়ে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে বক্তৃতা, আর তার মধ্যে টুকরো টুকরো আত্মপ্রচার আর নিজের বিজ্ঞাপন গুঁজে দেওয়া৷ চন্দনও বলল, তবে এসব অনুষ্ঠানে বেশি কথা বলে না সে৷ মিনিট পাঁচেক বলল সে৷ যদিও এই মুহূর্তে বাংলার পাঠক মহলে উপস্থিত লেখক-কবিদের তুলনাতে চন্দনের পাঠক সংখ্যা বেশি৷ যাই হোক সাড়ে সাতটাতেই শেষ হয়ে গেল অনুষ্ঠান৷ চত্বরের পিছনের গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে মুক্তমঞ্চর সামনে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে গাড়ির ড্রাইভারকে ফোন করে সেখানেই আসতে বলল সে৷ গাড়ি উপস্থিত হতে অন্তত দশ মিনিট সময় লাগবে, তাই এক ভাঁড় চা নিল চন্দন৷ চায়ের পয়সা মিটিয়ে চন্দন সবে চায়ে একটা চুমুক দিয়েছে, ঠিক সেই সময় পাশ থেকে যে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, ‘আরে ভাই তুমিও এখানে!’

চন্দনের সামনে হাতে চায়ের ভাঁড় নিয়ে হাজির হলেন তার পরিচিত কবি সুখেন হালদার৷ একটু আগে তিনিও চন্দনের সঙ্গেই সভাঘরে ছিলেন৷ লম্বা, ফর্সা চেহারা৷ বয়স সত্তর-বাহাত্তর হবে৷ তবে এখনও গাঢো কলপ, টিপিকাল কবি-সাহিত্যিকের মতোই সাজপোশাক৷ পরনে পাজামা, পাঞ্জাবি, কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা৷ অনুষ্ঠানে দেওয়া উত্তরীয়টা এখনও গলাতে জড়ানো আছে, সম্ভবত তিনি যে একটু আগে সংর্বর্ধিত তা রাস্তার লোকজনকে বোঝাবার জন্য৷ চন্দন তাঁর সঙ্গে পূর্ব পরিচয়ের সূত্রে জানে যে ভদ্রলোক একটু বেশি কথা বলেন, বানিয়েও বলেন৷ আর সব ব্যাপারে তাঁর অদম্য কৌতূহল৷ চন্দন এ ধরনের লোকদের সচরাচর এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে৷ তবে একদম তাঁর মুখোমুখি পড়ে যাওয়াতে চন্দন বলল, ‘এই তো দাদা একটু চা খেয়ে নিচ্ছি৷ একটা গাড়ি আসবে, উঠে পড়ব৷’

সুখেন হালদার বললেন, ‘শুনলাম তুমি নাকি মদ্যপ্রেমীদের নিয়ে লেখা শুরু করেছ?’

প্রশ্নটা শুনে চন্দন বেশ অবাক হয়ে বলল, ‘আপনাকে কে বলল?’

তিনি জবাব দিলেন, ‘বুঝলে পঞ্চাশ বছর ধরে বইপাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছি৷ কলেজ স্ট্রিটের নাড়িনক্ষত্রের খোঁজ আমার কাছে আসে৷ সোমবার বইপাড়াতে সুবীরবাবুর দোকানে গেছিলাম৷ তাঁর এক কর্মচারী আমাকে বিশেষ শ্রদ্ধা করে৷ সে আমাকে বলল, তুমি নাকি মদ নিয়ে কী একটা লেখা লিখছ, সে জন্য সুবীরবাবু তোমাকে নিয়ে বেরিয়েছেন কারো সঙ্গে দেখা করার জন্য৷’

সুখেন হালদারের কথা শুনে তার বক্তব্যর সত্যতা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য না করে, প্রসঙ্গটা অন্যদিকে ঘোরাবার জন্য চন্দন তাঁকে প্রশ্ন করল, ‘আপনার শরীর ভালো আছে তো দাদা?’

কবি সুখেন হালদার চন্দনের প্রশ্নে কোনো আমল না দিয়ে বললেন, ‘মদ্যপান নিয়ে লিখলে তুমি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে তো! আমার থেকে এ লাইনের ব্যাপারে বেশি কেউ জানেন কি? আমি হলাম যাকে বলে অলরাউন্ডার৷ তুমি কোনো দিন শিয়ালদহ স্টেশনের গায়ে মিনার বারে গরমের দুপুরে কাতলা মাছ ভাজা দিয়ে ভোদকা খেয়েছ? শক্তিদা, মানে তোমাদের শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমাকে নিয়ে গিয়ে খাইয়েছিল৷ আর খালাসিটোলাতে শক্তি-সুনীলের সঙ্গে কতবার যে গেছি তার হিসাব নেই৷ সেখানে বাংলা মদের সঙ্গে চাট বলতে শুধু বিটনুন আর কাঁচালংকা৷ আমি যেমন এ সব জায়গাতে মদ্যপান করেছি তেমন বড় বড় ক্লাবেও খেয়েছি৷ যেখানে মেম্বার বা গেস্ট ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না৷ একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে৷ কোহিনুর ক্লাবে একবার আমার এক ফ্যান হুইস্কি খাওয়াতে নিয়ে গেছে৷ দেখি আমার পাশের টেবিলেই বসে তোমাদের বিখ্যাত ফুটবলার, একদা ইন্ডিয়া টিমের ক্যাপ্টেন পল্লব মুখার্জি৷ ওয়েটার ভোদকার সঙ্গে লেমন কার্ডিয়াল দিয়ে গেছে, কিন্তু সেটা কি পরিমাণ ভোদকাতে মেশাতে হয় তা তিনি জানেন না৷ শেষে আমি তাঁকে লেমন কার্ডিয়াল মিশিয়ে ভোদকার পেগ বানানো শিখিয়ে দিলাম৷ আমি নিজের নাম বলাতে এরপর তিনি গড়গড় করে আমার বেশ কয়েকটা কবিতার নামও বলে দিলেন৷’’—একটানা কথা বলে আত্মপ্রমাদের হাসি হাসলেন তিনি৷ সুখেন হালদার যা বললেন, হয়তো তার কিছুটা সত্যি, আবার কিছুটা অতিরঞ্জিত৷ তাঁর কথা শুনতে শুনতেই লম্বা চুমুকে চা শেষ করে ফেলেছিল চন্দন৷ তিনি আবার মুখ খুলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু চায়ের ভাঁড়টা বিনে ছুড়ে ফেলে চন্দন রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি যাই সুখেনদা৷ আমার গাড়িটা মনে হয় এসে গেছে৷’

সুখেন হালদার মৃদু বিমর্ষ ভাবে বললেন, ‘আচ্ছা যাও৷ সুবীরবাবুর কাছে আমার বইয়ের একটা পাণ্ডুলিপি অনেকদিন ধরে পড়ে আছে৷ ওটার ব্যাপারে একটু বলো ওনাকে৷’

চন্দন ‘আচ্ছা বলব’ বলে কোনোরকমে তাঁকে এড়িয়ে গিয়ে দাঁড়াল রাস্তার ধারে৷ একটা সিগারেট ধরাবার পরই গাড়ি চলে এল৷ চন্দন রওনা হয়ে গেল বিদিশা বারের দিকে৷

চাঁদনিতে যখন সে পৌঁছোল তখন আটটা বাজে৷ অপূর্ব ঘোষালের জন্য সে তার লেখা কয়েকটা বই এনেছে৷ পার্কিং পেতে কিছুটা সুবিধা হবে বলে বিদিশার থেকে কিছুটা তফাতেই সে গাড়ি থেকে বইয়ের প্যাকেটটা নিয়ে নেমে, ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করল, রাস্তার গায়ে সব আলো ঝলমলে দোকান৷ শোরুম, রেস্টুরেন্ট৷ রাস্তায় গাড়ি, ভিড় আর ফুটপাতে লোকজন তখনও বেশ ভালোই৷ কোনো কোনো পানশালার ভিতর থেকে অস্পষ্ট ভাবে বাজনার শব্দ ভেসে আসছে দরজার ফাঁক গলে৷ একটা জায়গাতে কয়েকজন তরুণী সিগারেট হাতে জটলা করছে৷ তাদের পোশাক দেখে পয়সাঅলা অবস্থাপন্ন ঘরের বলেই মনে হয়৷ তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় চন্দন শুনল, একজন তরুণী তার সঙ্গিনীদের বলছে, ‘ফাক ইওর সোসাইটি৷ ছেলেরা মাল খেলে আমরা খাব না কেন? তিন পেগ খেয়েছি, আরও দু-পেগ খাব৷’

তাদের পাশ কাটিয়ে চন্দন প্রায় বিদিশার কাছে পৌঁছে গেছে, হঠাৎ চন্দন পাশ থেকে একটা নারীকণ্ঠ শুনতে পেল, ‘বারে যাবেন? আমাকে সঙ্গে নেবেন?’

চন্দন হাঁটতে হাঁটতেই পাশে তাকিয়ে দেখল তার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে তার দিকে তাকাচ্ছে একজন মহিলা৷ এক ঝলক দেখলে ভদ্রঘরের মহিলাই মনে হয়৷ শ্যামবর্ণা, মিষ্টি মুখশ্রী, সিঁথিতে সিঁদুর, পরনে শাড়ি-ব্লাউজ, কাঁধে একটা ভ্যানিটি ব্যাগ৷ চন্দন তার দিকে তাকাতেই সে আবার চন্দনকে বললে—‘সঙ্গে নেবেন? আমার চেনা বারের কেবিন আছে৷ ঘণ্টা প্রতি আমাকে পাঁচশো টাকা দিলেই হবে৷’

চন্দন মৃদু বিস্মি¬ত হলেও ব্যাপারটা বুঝতে পারল৷ সে বলল, ‘না, আমার প্রয়োজন নেই৷’

কিন্তু মেয়ে বা বউটা হাল না ছেড়ে তার সঙ্গে সঙ্গে বিদিশার প্রায় মুখ পর্যন্ত পৌঁছে বলল, ‘তাহলে কেবিন না হোক আপনার পছন্দ মতো কোনো বারে গিয়েও এক ঘণ্টার জন্য বসতে পারি৷ তিনশো টাকা দিলেই হবে৷’

বিদিশার গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল রমানাথ৷ মহিলা তখনও বলছে—‘চলুন না, তিনশো টাকা দিলেই হবে৷’

রমানাথ মেয়েটার উদ্দেশে বলল, ‘তোমাদের বলেছি না আমাদের বারের সামনে আসবে না? ভদ্রলোক দেখে চিনতে পারো না? যাও এখান থেকে৷ ভাগো—’

রমানাথের কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল মহিলা, তারপর রমানাথের উদ্দেশে বলল, ‘ভারী ভদ্রলোক দেখাচ্ছে! তোমাদের এখানে আসা অনেক ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার-উকিল-ব্যারিস্টার ভদ্রলোকরা যে কত ভদ্রলোক আমার তা জানা আছে!’—কথাগুলো বলে রাতের কলকাতার জন-অরণ্যে মিশে গেল৷

বিদিশার গেটের দিকে এগিয়ে চন্দন রমানাথকে প্রশ্ন করল, ‘মেয়েটা আপনার পরিচিত নাকি?’

রমানাথ জবাব দিল, ‘এমনি পরিচয় নেই তবে মুখচেনা৷ সন্ধ্যার পর ওরা খদ্দের ধরার জন্য এ পাড়াতে ঘুরে বেড়ায়৷’ এরপর সে দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘তাড়াতে খারাপ লাগে৷ ওরাও তো পেটের ধান্ধাতেই এ ধান্ধাতে নেমেছে৷ কিন্তু না তাড়ালে বারের বদনাম৷ বিশেষ করে ফ্যামিলি নিয়ে যারা আসে তাদের অসুবিধা হবে৷’

চন্দন বারের ভিতর পা রাখল৷ সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল তার৷ এতক্ষণ রাস্তায় বা নন্দন চত্বরে সভাঘরেও সে অনুভূতি হয়নি তার৷ চন্দনের কেমন জানি মনে হল একদম নিজের কোনো জায়গাতে পা রাখলে যেমন স্বচ্ছন্দ, নিরাপদ অনুভূতি হয়, তেমনই লাগছে তার৷ প্রায় সবকটা টেবিলই ভর্তি৷ ওয়েটাররা টেবিলগুলোতে যাওয়া-আসা করছে৷ এসির ঠান্ডা বাতাসে অন্য দিনের মতোই মিশে আছে মদ আর খাবার মিশ্রিত গন্ধ৷ সিলিং থেকে নেমে আসা বাতিগুলো একই রকম মায়াবী আলো ছড়াচ্ছে টেবিলগুলোর ওপর৷ বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষাল কাছেই একটা টেবিলে দাঁড়িয়ে কাস্টমারের সঙ্গে কথা বলছিলেন৷ চন্দনকে দেখতে পেয়ে কাছে এগিয়ে এসে তিনি বললেন ‘গুড ইভিনিং৷ আপনার প্রোগ্রাম কেমন হল?’

চন্দন তাঁর দিকে বইয়ের প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভালো হয়েছে প্রোগ্রাম৷ এই নিন আপনার বই৷ নাম লিখে দিয়েছি৷’

অপূর্ব ঘোষাল প্যাকেটটা হাতে নিয়ে হেসে বললেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ৷ তাহলে আমার পট থেকেও তো আপনার জন্য কিছু করতে হয়৷ আজ তো সঙ্গে গাড়ি আছে৷ বাড়িতে ফেরার তাড়া নেই নিশ্চয়ই?’

চন্দন বলল, ‘এখান থেকে বাড়ি ফিরতে এক ঘণ্টার মতো সময় লাগবে গাড়িতে৷ বারোটার মধ্যে ফিরলেই হবে৷’

অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘এগারোটাতে আজ আপনাকে ছাড়ব৷ একটু কষ্ট করে আমার জন্য থাকতে হবে৷ কারণটা আপনাকে পরে বলব৷’

এ কথা বলার পর তিনি ঘরের এক কোণে একটা টেবিলের দিকে ইশারায় দেখালেন৷ চন্দনদের দিকে পিছন ফিরে একজন বসে আছে সেখানে৷ চন্দন প্রশ্ন করল, ‘কে উনি?’

অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘নাট্যকার অসীম রায়৷ যাঁর কথা প্রথম দিন আপনাকে বলেছিলাম৷ যদিও দুপুরের বদলে আজ সন্ধ্যাতেই এসেছেন৷ ওঁর মদ্যপানও প্রায় শেষের পথে৷ ঠিক তিন পেগ রাম খান৷ একবার কথা বলবেন নাকি ওনার সঙ্গে? উনি আসার পর আপনার কথা বলেছি৷ উনি আপত্তি করবেন না৷’

চন্দন কথাটা শুনেই উৎসাহিত ভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, চলুন৷’

অপূর্ববাবু চন্দনকে নিয়ে সেই টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মুখ তুলে তাকালেন ভদ্রলোক৷ চন্দনের অনুমান ষাটের বেশ খানিকটা ওপরেই হবে নাট্যকার-অভিনেতা অসীম রায়ের বয়স৷ তবে চেহারাটা এখনও সুঠাম আছে৷ ব্যাকব্রাশ করা কাঁচাপাকা চুল আর মুখ ভর্তি দাড়ি৷ পরনে স্ট্রাইপ শার্ট আর টেরিলিনের প্যান্ট৷ হাতে ধরা আধখাওয়া একটা রামের গ্লাস৷ এত বড় একটা মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে চন্দন মৃদু রোমাঞ্চ বোধ করল৷ নাটক-থিয়েটারের জগতে তাঁকে লিভিং লিজেন্ডই বলা যায়৷ বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষাল চন্দনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেবার পর তিনি ভরাট গলায় বললেন ‘দাঁড়িয়ে কেন? বসুন৷ যদিও আমার ওঠার সময় হয়ে গেছে, তবু পাঁচ-দশ মিনিট কথা বলাই যায়৷’

চন্দনকে এ কথা বলার পর তিনি অপূর্ব ঘোষালকে বললেন, ‘কাইন্ডলি বিলটা একটু পাঠিয়ে দিতে বলুন৷’

‘হ্যাঁ স্যার’ বলে অপূর্ববাবু কাউন্টারের দিকে চলে গেলেন৷ অপূর্ববাবুর এগোবার পর অসীম রায়ের মুখোমুখি বসল চন্দন৷ কথা শুরু করার জন্য সে বলল, ‘আপনার নাটক আমি মিনার্ভা থিয়েটারে দেখেছি৷’

অসীম রায় মৃদু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, বছর দশেক আগের নাটক—‘নবমী নিশি পোহাইল’ ছিল নাটকের নাম৷ টানা একশো সন্ধ্যা চলেছিল৷ আমারই ডিরেকশন৷ এক মাতাল-লম্পট কারখানা মালিকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম৷’

চন্দন বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তাই৷ অসাধারণ আপনার অভিনয়৷ অনেকে আপনাকে উৎপল দত্তর সঙ্গে তুলনা করেন৷’

কথাটা শুনে অসীম রায় বললেন, ‘হ্যাঁ, সে সময় একটা বড় কাগজ কথাটা লিখেছিল বটে৷ বাড়াবাড়ি করেই লিখেছিল৷ উৎপলবাবু নাট্যজগৎ, অভিনয় জগতের অবিসংবাদী পুরুষ৷ তাঁর সঙ্গে কোনো দিন আমার কোনো তুলনা হয় না৷’ একথা বলার পর তিনি একটু থেমে বললেন, ‘‘উৎপলবাবু একবার উত্তরবঙ্গের একটা সভায় বলেছিলেন—আমাদের সামনে দুটো পথ খোলা আছে৷ একদিকে ‘নকশালবাড়ি’ অন্যদিকে ‘বেশ্যাবাড়ি’৷ যার মোটামুটি অর্থ হল, একদিকে মেহনতি জনতার আন্দোলন-সংগ্রাম, অন্যদিকে ধনী-শোষক মানুষরা৷ শিল্পী- সাহিত্যিকদের ঠিক করে নিতে হবে তিনি কোন পথে হাঁটবেন৷ নকশালবাড়ির দিকে এগোতে এগোতে যদিও তিনি শেষ পর্যন্ত বেশ্যাবাড়ির পথই নিয়েছিলেন৷ টালিগঞ্জ বা মুম্বাইয়ে ফিল্মইন্ডাস্ট্রি তো নকশালবাড়ির টাকায় চলে না৷ তবে আজকাল আমার কি মনে হয় জানেন? ওই বেশ্যাবাড়ির পথটাই ঠিক৷ খ্যাতি-গ্ল্যামার-পুরস্কার সব কিছুই জোটে৷’—কথাটা বলে রামের গ্লাসে একটু চুমুক দিলেন৷

চন্দন বলল, ‘আমি শুনেছি আপনি তো বামপন্থী, তাই না?’

অসীম রায় বললেন, ‘যদি বলেন সাধারণ মানুষের কথা বলা মানে বামপন্থা, তবে আমি বামপন্থী৷ তবে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য কোনো দিন ছিলাম না, আজও নই৷ তবে ওই যে বললাম, আজ মনে হয় বেশ্যাবাড়ির পথটাই ঠিক পথ৷ একটা সরকারি পুরস্কারও তো জুটল না কোনো দিন৷’—একটা মৃদু বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল তাঁর কণ্ঠস্বরে৷ টেবিলে বিল চলে এল৷ ওয়ালেট থেকে টাকা বার করে বিল মেটালেন অসীম রায়৷

চন্দন বিস্মিতভাবে বলল, ‘কিন্তু একজন অভিনেতার কাছে, শিল্পীর কাছে সরকারি পুরস্কার বা অন্য কোনো পুরস্কারের দাম আর কতটুকু? মানুষের ভালোবাসাই তো তাদের কাছে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার৷’

চন্দনের কথা শুনে অসীম রায় কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন তার দিকে৷ তারপর বললেন, ‘হাততালিতে বা সংবাদপত্র প্রশংসাতে যারা পেশাদার শিল্পী তাদের পেট ভরে না৷ শিল্প সৃষ্টির জন্যও অর্থের প্রয়োজন৷ পুরস্কার মানে শুধু সম্মান নয়, টাকাও৷ অনেক পথ খুলে যায় পুরস্কার পেলে৷ সেই টাকা, সে সব পথ শিল্প রচনার কাজে ব্যবহার করতে পারে সৃজনশীল মানুষরা, যাদের সৃজনশীলতাই একমাত্র জীবিকা৷’

এ কথা বলার পর নাট্যকার অসীম রায় এক চুমুকে বাকি মদটা শেষ করে, গ্লাসটা ঠক করে টেবিলে নামিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনি কোথাও লিখতে পারেন যে নাট্যকার অসীম রায় একজন ফ্রাস্টেটেড মানুষ, ফ্রাস্টেশন ভোলার জন্য মদ খায়৷ হ্যাঁ, লিখবেন, তাহলে খুশি হবে ওই সব বেশ্যাবাড়ির মানুষরা৷’—কথাগুলো বলে টেবিল থেকে উঠে লম্বা লম্বা পা ফেলে বারের বাইরে বেরিয়ে গেলেন বিখ্যাত নাট্যকার অসীম রায়৷ চন্দন চারপাশে তাকিয়ে অপূর্ব ঘোষালকে দেখতে পেল না৷ সে টেবিল ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় ওয়েটার পল্টু অসীম রায়ের গ্লাসটা উঠিয়ে নিতে এসে বলল, ‘আপনি বসুন স্যার৷ আরও দুটো টেবিল এখনও খালিই আছে৷’

টেবিলটাতে বসে চন্দন ভাবতে লাগল অসীম রায়ের বলা কথাগুলো৷ লোকটা কি সত্যিই ফ্রাস্টেটেড? এত বড় একজন মানুষ কি শেষ পর্যন্ত মদের গ্লাসে আশ্রয় খুঁজছেন? কেমন যেন মন ভার হয়ে এল চন্দনের৷

কাচের দরজা খুলে চারজন ছেলে প্রবেশ করল বারে৷ খুব সাধারণ পোশাক৷ ওয়েটার পল্টু তাদের চারজনকে এনে বসাল কাছের একটা টেবিলে৷ বাইশ-চবিবশ বছরের ছেলে সব৷ তাদের যেন চারপাশের টেবিলের লোকজনের মধ্যে কেমন একটু বেমানান লাগছে৷ আর তাদের মধ্যেও কেমন একটা জড়তা, আড়ষ্ঠ ভাব৷ দুজন ছেলে বিস্মিতভাবে চারপাশে তাকিয়ে দেখছে৷ পল্টু জানতে চাইল, ‘কী দেব আপনাদের৷’

একজন ছেলে বলল, ‘কমদামি বিলিতি মদ যা আছে তা দ্যান দুই পেগ করে৷ আর কিছু লাগবে না৷’

পল্টু অর্ডার নিয়ে চলে যাবার পর ছেলেগুলোর মধ্যে একজন ‘এত বড়ো হোটেলে কোনো দিন খাই নাই৷ জীবনের সাধ মেইটে গেল৷’ চন্দনের তাদের কথা শুনে বুঝতে পারল তাদের কথার মধ্যে একটা গ্রাম্য টান আছে৷

কথাটা শুনে তার এক সঙ্গী বলল, ‘হ্যাঁ, এবার মরণ হলেও দুঃখ নাই৷ এই, মোবাইলে একটা ছবি তুলে রাখ৷ আর কোনো দিন এখানে আসা হবে না৷’

তার কথা শুনে আর একজন ছেলে বলল ‘ধান কাটার মজুরি থেকে কত কষ্ট করে সারা বছর ধরে পাঁচশো টাকা জমিয়ে রেখেছি এখানে খাব বলে৷ হ্যাঁ, গেলাসগুলো আসার আগে ছবি তোল৷’

একজন পকেট থেকে একটা মোবাইল ফোন বার করল৷ তারপর চারপাশে তাকিয়ে চন্দনকে বলল, ‘দাদা একটা ছবি তুলে দেবেন চারজনের?’

চন্দন মোবাইলটা নিল৷ তারা দ্রুত হাত দিয়ে নিজেদের চুল, জামার অবিন্যস্ত ভাব ঠিক করে নিয়ে হাসিমুখে একসঙ্গে চন্দনের দিকে তাকাল ছবি তোলার জন্য৷ কী নির্মল হাসি! না, তার মধ্যে কোনো ক্ষোভ লুকিয়ে নেই৷ চন্দনের মনে অসীম রায়ের কথাগুলো শুনে যে মৃদু বিষণ্ণ ভাব জেগেছিল তা কেটে গেল৷ ছবি তুলে মোবাইলটা ফেরত দিয়ে চন্দন প্রশ্ন করল, ‘তোমরা কোথায় থাকো?’

একটা ছেলে জবাব দিল, ‘বেলডাঙা, মুরশিদাবাদ৷ পার্টির মিছিলে আসছিলাম৷ রাতের লালগোলা লোকালে ফিরব৷’

চন্দন বলল, ‘ও তোমরা পার্টি করো?’

একটা ছেলে বলে উঠল, ‘না, পার্টি করি না৷ প্রধান একশো দিনের কাজ দেয়৷ সে তার সাথে মিছিলে আসতে বলল তাই এলাম৷ একশো টাকা করে দিয়েওছে প্রত্যেককে৷ আমার টিকিট লাগে নাইকো৷ তার ওপর এখানে আমার সাধ পুরোণ হল৷ আমরা ওসব পার্টিটার্টি বুঝি না৷’

তার কথা শেষ হতেই তার অপর এক সঙ্গী বলল, ‘আমরা জন খাটি৷ এমন জায়গার ছবি শুধু টিভিতে দেখেছি৷ ভয়ও লাগছিল ভিতরে ঢুকতে৷ আচ্ছা এখানে বসে যারা খাচ্ছে তাদের পুলিশ ধরে নিয়ে যায় না তো?’

চন্দন হেসে বলল, ‘না, ধরবে না, নিশ্চিন্তে খাও৷’

ছেলেগুলোর সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল চন্দনের৷ সরল কথাবার্তা, সরল প্রশ্ন-উত্তর৷ কোনো ভান নেই, ভড়ং নেই৷ আজ রাতে বিদিশার আনন্দ নিয়ে ওরা ঘরে ফিরে যাবে৷ হয়তো বা এরা কোনো দিন এখানে আসবে না, কিন্তু এই স্মৃতি তাদের বুকের মধ্যে রয়ে যাবে৷ তারুণ্যের আনন্দ নিতে এখানে এসেছে এই সরল গ্রাম্য যুবকেরা৷ পল্টু ট্রেতে করে তাদের টেবিলে মদের গ্লাস আর চানাচুরের প্লেট নামিয়ে রেখে গেল৷ তা দেখে তারা এমন উৎফুল্ল হয়ে উঠল যে তাদের সামনে কেউ যেন ফাইভস্টার হোটেলে স্কচের বোতল আর কোনো মহার্ঘ খাবার রেখে গেল৷ ছোটো ছোটো মানুষের কত ছোটো ছেটো চাহিদা, যা মিটলে তারা আর কিছু চায় না৷ অল্পতেই সন্তুষ্ট হয় জীবন৷ খেতে খেতে গল্প শুরু করল ছেলেগুলো৷ মিছিল শেষ হবার পর তারা ভিক্টোরিয়ার মাঠ দেখতে গেছিল তা নিয়ে আলোচনা৷ চন্দন এরপর দেখতে পেল কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন অপূর্ব ঘোষাল৷ রাত নটা বাজে৷

চন্দন টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়ে অপূর্ব ঘোষালের সামনে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, ‘হুইস্কির পেটি ডেলিভারি দিতে এসেছিল৷ গাড়ি থেকে সেগুলো নিয়ে স্টোর রুমে রাখার কাজ তদারকি করছিলাম৷ তা নাট্যকারের সঙ্গে কথা বলে রসদ কিছু মিলল?’

চন্দন হেসে বলল, ‘খুব বেশি তেমন কথা হয়নি৷ তবে ওঁর কথায় যতটুকু যা বুঝলাম উনিও সাম্যবাদী ভাবনায় দীক্ষিত৷ তবে মনে হল তাঁর সে ভাবনায় একটু চিড় খেয়েছে৷ মনে হল তিনি একটু কনফিউজড৷ হয়তো বা অবসাদ কাটাতেই এখানে মদ খেতে আসেন৷’

‘সাম্যবাদ’ শব্দটা শুনে বিদিশা বারের ম্যানেজার বললেন, ‘হ্যাঁ, সাম্যবাদ৷ এই পানশালাতে আরও একধরনের সাম্যবাদ আছে জানেন?’

চন্দন প্রশ্ন করল, ‘সেটা কী?’

অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘এই যে টিভিতে, সংবাদপত্রে এত সাম্প্রদায়িক হানাহানির খবর বেরোয়, তা সবই কিন্তু মুছে যায় এই পানশালাতে এসে৷ হিন্দু-মুসলমানের ভেদাভেদও মুছে যায় এখানে৷ টিকিধারী-পৈতেধারী ব্রাহ্মণ এখানে অবলীলাতে খাবার খায় ফিরোজের হাত থেকে৷ আবার মুসলমান খদ্দের কাবাব অর্ডার করার সময় জানতে চায় না প্রাণীটাকে হালাল করা হয়েছিল কি না৷ পানশালার সব পানীয়ই গঙ্গাজলের মতো পবিত্র, আর কোনো মাংসই হারাম নয়, সব হালাল৷’

কথাটা শুনেই চন্দনের একটা বিখ্যাত হিন্দি কবিতা মনে পড়ে গেল৷ সে বলল, ‘ঠিক৷ বিখ্যাত হিন্দি কবি হরবংশ রাই বচ্চনের মধুশালাতেও একই কথা লেখা আছে—‘মন্দির মসজিদ বৈর করাতে, মেল করাতি মধুশালা৷’

বিদিশা বারের ম্যানেজার বললেন, ‘ওনার নাম শুনেছি৷ বিগ বি-র পিতা ছিলেন৷ তবে কবিতাটা আমি পড়িনি৷ আমি আমার ভাবনা আর অভিজ্ঞতা থেকে বললাম৷’

এ কথা বলার পর তিনি বললেন, ‘চলুন ওপরে যাই৷’

কথা বলতে বলতে আবারও উঠে এল তারা৷ স্বর্গের সিঁড়ির মুখটাতে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল অর্জুন৷ দরজা খুলে দিল সে৷ ড্রিংস ফ্লোরে একই রকম উদ্দাম শব্দ৷ পম্পা বলে মেয়েটা কর্ডলেস মাইক্রোফোন হাতে গাইছে—‘দো ঘুট মুঝেভি পিলা দে শরাবি, দেখ ফির হোতা হ্যায় ক্যেয়া…৷’

মেয়েটার গানের তালে তালে মদের গ্লাস হাতে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে মাথা নাড়ছে অনেকে, কেউ গানের সঙ্গে গলা মেলাবার চেষ্টা করছে৷ বাতাসে কড়া মদের গন্ধ আর সিগারেটের ধোঁয়ার কুণ্ডলি৷ তুরীয় মেজাজে মধুশালার আনন্দ উপভোগ করছে মদ্যপায়ীরা৷ একজন লোক একটা পঞ্চাশ টাকার নোটের বান্ডিল বার করে তুলে ধরল৷ সেটা দেখেই পম্পা নামের মেয়েটা ডায়াস থেকে নেমে এল৷ তার পরনে আজ জিন্স আর টপ৷ আর তার মাঝখানে পেটের কাছে বেশ কয়েক ইঞ্চি জায়গা অনাবৃত৷ সে ডায়াস থেকে নেমে এগিয়ে আসতেই বার সিঙ্গারের গভীর নাভিটা স্পষ্ট দৃশ্যমান হল, যা উপভোগ করছে উদ্বেল জনতা৷ টাকার বান্ডিল হাতে লোকটার সামনে গান গাইতে গাইতে পৌঁছে গেল পম্পা৷ লোকটা বান্ডিল থেকে একগোছা নোট বার করে মেয়েটার হাতে দিল৷ এরপর মনে হয় লোকটা হাত দিয়ে পম্পার কোমর জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিল, কিন্তু কৌশলে সরে গেল মেয়েটা৷ আরও কয়েকজন কাস্টমার টাকা বার করেছে লাস্যময়ীর হাতে তুলে দেবার জন্য৷ পম্পা এবার তাদের দিকেও এগোতে শুরু করল৷ তা দেখে বিদিশার ম্যানেজার বললেন, ‘আজকের কাস্টমাররা সব অপরিচিত৷ মেয়েটা একটা কাণ্ড ঘটাবে মনে হয়! রাত দশটাতে শেষ অর্ডার সার্ভ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে এখানেই থাকতে হবে৷’—এ কথা বলে তিনি দরজার কাছ থেকে এগিয়ে গেলেন ঘরের ভিতর দিকে৷ পম্পাকে আর কারোর দিকে এগোতে না দিয়ে, চোখের ইশারাতে তাকে ডায়াসে ফিরে যেতে বলে নিজেই টাকা তুলতে শুরু করলেন৷

চন্দন বেশ কিছুক্ষণ একই জায়গাতে দাঁড়িয়ে রইল৷ একটার পর একটা গান ধরছে পম্পা৷ মাঝে মাঝে সে চোখের ইশারা ছুড়ে দিচ্ছে টেবিলগুলোর দিকে৷ আর অপূর্ব ঘোষাল সতর্কভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ফ্লোরে, যাতে কোনো অঘটন না ঘটে তার জন্য৷ দু-চারজন কাস্টমার খাওয়া সেরে বাইরে বেরিয়ে গেল, আবার নতুন কয়েকজন ভিতরে প্রবেশ করল৷ চন্দন এরপর বাইরে এসে দাঁড়াল৷ আরও আধঘণ্টা সময় এর মধ্যেই কেটে গেছে৷ তার সামনেই নীচ থেকে স্বর্গের সিঁড়ি ওপরে উঠে এসেছে৷ এ সিঁড়ি সে কোনো দিন ব্যবহার করেনি, গলিটাতেও ঢোকেনি৷ চন্দন নামতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে৷

চন্দন নীচে নেমে দাঁড়াল৷ সরু গলি৷ রাস্তার দু-ধারেও কিছু পানশালার প্রবেশমুখ আছে৷ এখানে-ওখানে দু-তিনজনের ছোটোখাটো দলে জটলা করছে কিছু মানুষ৷ কয়েকজন অল্পবয়সি মেয়েকেও উলটোদিকের ফুটপাতে একটা ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে৷ মুখে চড়া মেকআপ৷ নিজেদের মধ্যে তারা হাসি-ঠাট্টা করছে, কখনও বা ইশারা ছুড়ে দিচ্ছে বারের বাইরে জটলা করা লোকদের বা পথচারীদের উদ্দেশে৷ রাতের কলকাতার রাতপরির দল সব৷ পানশালাগুলোর বড় রাস্তার দিকে যে গেটগুলো আছে সেখানে গেলে তাড়া খাবার সম্ভাবনা আছে বলে মেয়েগুলো গলির ভিতর সুবিধাজনক জায়গাতে এসে দাঁড়িয়েছে৷ তা ছাড়া এই পানশালাগুলোর গলির দরজা দিয়ে তথাকথিত ভদ্রজনরা খুব বেশি যাওয়া-আসা করে মনে হয় না৷ যারা আসে তারা অনেকেই ওই পম্পার কোমর ধরার জন্য চেষ্টা করা খদ্দেরের দল৷ ফলে এখানে দাঁড়ালে রাতপরিদের নিজেদের খদ্দের পেতেও সুবিধা হয়৷ স্বর্গের সিঁড়ি দিয়ে তিনটে ছেলে রাস্তায় নেমে এগিয়ে গেল মেয়েগুলোর দিকে৷ কিছুক্ষণ কথা বলার পর একটা মেয়েকে নিয়ে ছেলে তিনজন গলির অন্যপ্রান্তে কোথায় যেন হারিয়ে গেল৷ একটা সিগারেট ধরে চন্দন দেখতে লাগল সব কিছু৷ বিদিশার ভিতর না হলেও এ গলিটাও তো বিদিশার অবিচ্ছেদ্য অংশ৷ বিদিশা আর অন্য পানশালাগুলোকে কেন্দ্র করেই তো এ গলির রাতের কাহিনি বহমান৷

রাত বেড়ে চলল৷ কাস্টমাররা এবার এক এক করে নামতে শুরু করেছে বিদিশার মেহেফিল ছেড়ে৷ চন্দন তার ড্রাইভারকে ফোন করে জানিয়ে দিল, ঠিক এগারোটা নাগাদ যেন সে বিদিশার গেটের সামনে দাঁড়ায়৷ ঠিক রাত দশটা নাগাদ অর্জুন নীচে নেমে এসে বলল, ‘ম্যানেজার স্যার আপনাকে ডাকছেন৷’

তার সঙ্গে স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল চন্দন৷ সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বিদিশার ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষাল৷ তিনি চন্দনকে বললেন, ‘মাফ করবেন, আপনাকে এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখলাম৷ বার প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে৷ এবার নিশ্চিন্ত৷ তবে আর এক ঘণ্টার মধ্যেই আপনাকে ছেড়ে দেব৷ আসুন, আমার সঙ্গে আসুন৷’

দোতলার করিডোর দিয়ে কয়েক পা হেঁটে একটা স্লাইডিং ডোর ঠেলে চন্দনকে নিয়ে একটা কেবিনের মতো ঘরে ঢুকে ভিতর থেকে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিলেন অপূর্ব ঘোষাল৷ একটা ক্যাম্পখাট, স্টিলের একটা বেবি আলমারি রাখা আছে ঘরে৷ হ্যাঙ্গার থেকে কয়েকটা শার্টও ঝুলছে৷ একটা টেবিল আর চেয়ারও রয়েছে ঘরে৷ তাতে পরিপাটি করে প্লেটে সাজানো আছে খাবার, গ্লাস আর একটা ছোটো মদের বোতল৷ দরজাটা ঠেলে দিয়ে বিদিশা বারের ম্যানেজার গলার কাছে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললেন, ‘এটা আমার রেস্টরুম৷ বাস-ট্রাম বন্ধ থাকলে বা কোনো কারণে খুব বেশি রাত হলে কোনো কোনো দিন রাতেও এখানে থেকে যাই৷ নিন, এবার চেয়ারে বসে পড়ুন৷’

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চন্দন বলল, ‘আপনি কিন্তু মশাই এবার আমাকে সত্যিই লজ্জাতে ফেলেছেন! একে তো আমি আপনার কাজের সময় এসে উপস্থিত হই৷ তার ওপর যদি আপনি আমার জন্য এ সব ব্যবস্থা করেন তা সত্যিই লজ্জার! হাজার হোক এটা আপনাদের ব্যবসার জায়গা৷’

তিনি চন্দনের কথা শুনে বললেন, ‘লজ্জার কিছু নেই৷ সামান্য রুটি, মাংস, স্যালাড যা দেখছেন তা এখানকার কিচেনে বানানো হলেও তার দাম আমি দিয়ে দিয়েছি৷ আর যে বোতলটা দেখছেন তা আপনি এখানে পয়সা দিলেও পাবেন না৷ ওটা খাঁটি পোর্ট ওয়াইন৷ পর্তুগাল থেকে আমার এক বন্ধু ওটা এনে আমাকে উপহার দিয়েছিল৷ আমি সাধারণত মদ্যপান করি না৷ আজ একটা বিশেষ দিন বলে ওটা আপনার সঙ্গে নিয়ে একটু সেলিব্রেট করব ভাবলাম৷’

চন্দন প্রশ্ন করল, ‘বিশেষ দিন মানে?’

অপূর্ব ঘোষাল এগিয়ে গিয়ে টেবিলের সামনে খাটে বসে ওয়াইনের বোতলের সিলটা খুলতে খুলতে বললেন, ‘মানে, আজ আমার এই ধরাধামে অবতীর্ণ হবার দিন৷ বার্থডে৷’

চন্দনের এ কথা শোনার পর আর অপূর্ব ঘোষালের আপ্যায়ন অস্বীকারের পথ নেই৷ তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে চেয়ারে বসল চন্দন৷ নিজের হাতেই খাবার সার্ভ করার পর গ্লাস দুটোকে পূর্ণ করলেন তিনি৷ ‘চিয়ার্স’ বলে চন্দনের হাতের গ্লাসের সঙ্গে তাঁর গ্লাস ছুঁইয়ে ওয়াইনে চুমুক দিয়ে পরিতৃপ্ত ভাবে বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘জীবনটা বেশ মজার তাই না? এ ধরাধামে সাতান্নটা বছর কেমন দেখতে দেখতে কাটিয়ে দিলাম৷ এমন ভাবেই হয়তো আরও বেশ কিছু বছরও কেটে যাবে৷’

চন্দন গ্লাসে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘জীবন সম্বন্ধে আপনার ধারণা কী? যে জীবনটা আপনি পেরিয়ে এলেন তা নিয়ে কোনো ক্ষোভ আছে আপনার মনে?’

স্যালাডের প্লেট থেকে এক টুকরো শশা মুখে দিয়ে অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘দেখুন আমি ওই পরজন্মের ব্যাপারে ঠিক বিশ্বাসী নই৷ আমার মনে হয় জীবন একটাই৷ মদের পাত্রের মতোই তার রূপ, রস, গন্ধ-বর্ণের প্রতিটা বিন্দু উপভোগ করা উচিত৷ কারণ, জীবন তো একটাই৷ অন্যের ক্ষতি না করে জীবনকে উপভোগ করা উচিত৷ ওই যে একটা গান আছে—‘শুক বলে ওঠো সারী ঘুমায়ো না আর, এ জীবন গেলে ফিরে আসে না আবার৷’

এ কথা বলে চন্দনের দ্বিতীয় প্রশ্নটার উত্তর একটু যেন ভেবে নিয়ে তিনি বললেন, ‘ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়তো জীবনে হতে পারিনি তবে জীবন সম্পর্কে তেমন ক্ষোভ আমার নেই৷ এক জীবনে কত মানুষকে দেখলাম এখানে, কত ঘটনার সাক্ষী হলাম৷ এই বিদিশাতে কাজ না করলে হয়তো এত ধরনের মানুষ দেখার সুযোগ ঘটত না৷ তা ছাড়া এখানকার কাজের পয়সাতেই তো আমি নিজে জমি কিনে ছোটো একটা বাড়ি বানিয়েছি৷ মেয়েটা সেক্টর ফাইভে একটা আই-টি কোম্পানিতে চাকরি করছে৷ মোটামুটি ভদ্র বেতন পায়৷ ছেলেটাও সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে৷ সেও হয়তো আর কিছুদিনের মধ্যে একটা চাকরি জুটিয়ে নেবে৷ একজন সাধারণ মানুষের জীবনে আর কী চাই?’ কথাটা বলে ওয়াইনের গ্লাসের বাকি অংশটা গলায় ঢাললেন তিনি৷

চন্দন নিজের গ্লাসে আবারও চুমুক দিয়ে বলল, ‘একটা পার্সোনাল প্রশ্ন জানতে চাইছি৷ প্লিজ কিছু মনে করবেন না৷ এখনও বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ ‘মদ’, পানশালা এসব শব্দ শুনলে আঁতকে ওঠে, নাক সিঁটকোয়৷ অনেকের কাছে তো পানশালা শব্দটা বেশ্যালয়ের সমার্থক৷ আপনার পরিবারের লোকজন আপনার চাকরির ব্যাপারটা কীভাবে দেখেন?’

তিনি বললেন, ‘না, মনে করার কোনো ব্যাপার নেই, বরং আজকের দিনে কথাটা বলতে আমার ভালোই লাগবে৷ আমার স্ত্রী দেখেছেন আমি কীভাবে পরিশ্রম করে সংসারটাকে দাঁড় করিয়েছি৷ আর সেটা সম্ভব হয়েছে আমার স্ত্রী আমার পাশে ছিলেন বলে৷ আমি বা সে কেউ কাউকে কোনো দিন প্রতারণা করিনি৷ আমরা পরস্পরকে শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি৷ বিশ্বাসটাই জীবনের আসল কথা৷ হ্যাঁ, বর পানশালাতে চাকরি করে বলে একসময় তার আত্মীয়দের বক্রোক্তি শুনতে হয়েছে তাকে৷ আর ছেলেমেয়েরা ব্যাপারটা ছোটোবেলাতে জানত না৷ যাতে তারা শিশু বয়সে কথাটা শুনে ফেলে কোনো সামাজিক চাপের মুখে পড়ে তাই তাদের জানানো হয়নি ব্যাপারটা৷ তবে তারা এখন জানে৷ আমাকে তারা ভালোও বাসে৷ আমার মেয়ে তার এক সহকর্মীর সঙ্গে প্রেম করে৷ হয়তো বা তারা বিয়েও করবে৷ সম্পর্ক শুরু করার সময়ই কিন্তু আমার মেয়ে, ছেলেটাকে জানিয়ে রেখেছে যে তার বাবা পানশালার ম্যানেজার৷ এবং বেশ আত্মসম্মানের সঙ্গেই ব্যাপারটা জানিয়েছে৷ আর আমার নিজের পরিবারের বাইরে কে কী ভাবল তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই৷ এই পানশালাই আমার, পরিবারের পেটের ভাত জুগিয়েছে, প্রতিবেশী বা আত্মীয়রা নন৷’—ধীরে ধীরে একটানা কথাগুলো বলে থামলেন তিনি৷

চন্দন দেখল একটা অদ্ভুত প্রশান্তির হাসি ছড়িয়ে আছে বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষালের চোখে-মুখে৷ পানশালা সম্পর্কে এক শ্রেণির মানুষের মনে যত ঘৃণা বা নাক সিটকানোর ব্যাপারই থাকুক না কেন তা স্পর্শ করতে পারে না চন্দনের সামনে বসা ওই মানুষটাকে৷

ওয়াইন আর খাবার খেতে খেতে নানা গল্প চলতে লাগল দুজনের মধ্যে৷ রাত ঠিক এগারোটায় ওপর থেকে নেমে বিদিশার বাইরে বেরিয়ে এল চন্দন৷ আশেপাশের দোকানগুলোর সাইনবোর্ডের আলোগুলো সব নিভে গেছে৷ পানশালাগুলোর দরজাও একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ ফুটপাতে দু-একজন লোক ছাড়া কেউ নেই৷ ফাঁকা রাস্তাতে ট্রাফিক সিগনালের আলো শুধু জ্বলছে নিভছে৷ তিন দিন পর থেকে বেশ কয়েকদিন কলেজ স্ট্রিটে আসতে হবে চন্দনকে৷ কলেজ স্ট্রিট ফেরত বিদিশাতে সে আসবে বলে চন্দন জানিয়ে দিয়েছে অপূর্ব ঘোষালকে৷ চন্দনের গাড়িটা এসে দাঁড়িয়েছে সামনে৷ বিদিশার গেটে দাঁড়িয়ে থাকা রমানাথের উদ্দেশে গুড নাইট জানিয়ে হাত নেড়ে চন্দন উঠে বসল গাড়িতে৷