একদা এক পানশালাতে – ৪

৷৷ ৪ ৷৷

চাঁদনির মোড়ে বাস থেকে নেমে ফুটপাতে উঠে এল চন্দন৷ প্রায় দুটো বাজতে চলেছে৷ সামনের ফুটপাতের একপাশে ছোটো ছোটো বেশ কয়েকটা গুমটি পান-বিড়ি, চা-সিগারেটের৷ চন্দনের সিগারেট শেষ৷ একটা দোকানে গিয়ে সিগারেট-দেশলাই কিনে আবার পা বাড়াতে যেতেই তার কানে এল—‘স্যার কি আমাদের ওখানে যাচ্ছেন?’ গেটম্যান রমানাথ৷ তার হাতে একটা ছোটো ঠোঙা৷

চন্দন হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, বিদিশাতেই যাচ্ছি৷’

সে বলল, ‘চলুন, আমিও যাচ্ছি৷ দুপুরের খাবার নিতে এসেছিলাম৷ এর পর তো আর গেট ছাড়তে পারব না৷ এই সময় একটু ফাঁকা থাকে বলে খেয়ে নি৷’

চন্দন বলল, ‘এখানে খাবারের দোকান কোথায়? ভাত-ডাল পাওয়া যায়?’

রমানাথ চন্দনের সঙ্গে বিদিশা বারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে হাতে ধরা মুড়ির ঠোঙাটা একটু তুলে ধরে বলল, ‘ভাত-ডাল না৷ পাঁচ টাকার বাদাম আর তিন টাকার মুড়ি৷’

চন্দন মৃদু বিস্মিতভাবে বলল, ‘দুপুরের খাবার এতেই মিটে যায়?’

রমানাথ এ প্রশ্নর কোনো জবাব না দিয়ে শুধু বলল, ‘কোম্পানি থেকে চা-বিস্কুট দেয়৷’

চন্দন হাঁটতে হাঁটতে এরপর জানতে চাইল, ‘তুমি একাই ডিউটি করো?’

রমানাথ বলল, ‘হ্যাঁ, একাই, আমার কোনো ছুটি নেই৷ আগে আরও একজন বিহারি লোক ছিল৷ সে দেশে চলে যাবার পর ম্যানেজারবাবুকে বলে আমিই গেটের পুরো দায়িত্ব নিয়েছি৷’

চন্দন জানতে চাইল, ‘এ ভাবে দশ-বারো ঘণ্টা রোজ দাঁড়িয়ে থাকতে অসুবিধা হয় না তোমার?’

ঠোঙা থেকে একমুঠো মুড়ি তুলে মুখে পুরে রমানাথ বলল, ‘অভ্যাস হয়ে গেছে৷ কাজ করলে তবে তো পয়সা৷ পঁচিশ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে আসার পর উলটোডাঙার একটা বস্তিতে মাথা গোঁজার আশ্রয় পেয়েছিলাম৷ এই দারোয়ানের কাজ করার আগে অনেক কাজ করেছি৷ বড়বাজারে মুটের কাজ থেকে শুরু করে ট্রেনে হকারি৷ নিজে তেমন পড়াশোনা করতে না পারলেও ছেলেটাকে কিন্তু এরই মধ্যে পড়িয়েছি৷ বস্তির পরিবেশ কেমন হয় তা তো আপনি নিশ্চয়ই জানেন৷ কিন্তু বলতে নেই তারই মধ্যে মন দিয়ে পড়াশোনা করে ছেলেটা৷ একমাত্র ছেলে৷ সুরেন্দ্রনাথ কলেজে বি.এ ফাইনাল ইয়ার৷ পাশ করে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দেবে৷ আর সেই চাকরির পরীক্ষার জন্য যেখানে ভরতি হবে, সেখানে ভরতি হতে নাকি ষাট-সত্তর হাজার টাকা লাগে৷ তাই আমি রোজ ডিউটি নিয়েছি৷ গেটে দাঁড়িয়ে না থাকলে আমার চলবে? ছেলেটা একটা সরকারি চাকরি জোটাতে পারলে নিশ্চিন্ত৷’

চন্দনরা পৌঁছে গেল বিদিশার সামনে৷ অভ্যাস মতো চন্দনকে একটা স্যালুট ঠুকে কাচের দরজা খুলে দিল রমানাথ৷ ভিতরে প্রবেশ করল চন্দন৷

দু-তিনটে টেবিল ছাড়া ভিতরে ভিড় নেই৷ চন্দন কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তার ভিতরে বসা ক্যাশিয়ার শুভঙ্করবাবু বললেন, ‘গুড আফটারনুন স্যার৷ একটু আগেই অপূর্বদা ফোন করেছিলেন৷ জ্যামে আটকে আছেন বাসে৷ তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন৷ আপনি ভিতরে এসে আমার এখানে বসতে পারেন৷’

তাঁর কথা শুনে চন্দন একটু মজা করে বলল, ‘না, ভিতরে নয়৷ ধরে নিন আজ আমি কাস্টমার৷ টেবিলেই বসব৷ দু-পেগ হুইস্কি আর এক প্লেট ফিশফিঙ্গার৷ সঙ্গে নর্মাল জল৷’

চন্দনের কথা শুনে শুভঙ্কর মৃদু হেসে হুইস্কির ব্র্যান্ডটা তার থেকে জেনে নিয়ে বললেন, ‘যে কোনো একটা টেবিলে বসুন, আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি৷’

যে দুটো-তিনটে টেবিলে বসে কাস্টমাররা পানাহার করছে, ইচ্ছা করেই তাদেরই কাছে একটা টেবিলে বসল চন্দন৷ তার একপাশের টেবিলে একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক আর অন্যপাশে একজন মাঝবয়সি লোক নিশ্চুপভাবে বসে মদ্যপান করছে৷ আর কিছুটা তফাতে একটা অল্পবয়সি ছেলে কানে মোবাইলের ইয়ারফোন গুঁজে বিড়বিড় করে কথা বলতে বলতে কাচের বিয়ার গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে৷ তাদের লক্ষ করার জন্য মাঝে মাঝে চন্দন তাকাতে লাগল তাদের দিকে৷ ছেলেটা একই ভাবে বিড়বিড় করে কথা বলেই চলেছে, আবার মাঝে মাঝে হাসছেও৷ চকাস করে একবার সে চুমুও খেল মোবাইল ফোনে৷ অর্থাৎ প্রেয়সীর সঙ্গে কথা বলছে সে৷ মাঝবয়সি লোকটা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে টেবিলের ওপর রাখা মদের গ্লাসটার দিকে৷ যেন, বিশ্বসংসারের সব কিছু, লোকটার সব ভাবনা ডুবে আছে গাঢ় রক্তবর্ণের মদের পাত্রে৷ বৃদ্ধভদ্রলোক অবশ্য তার বাইফোকাল লেন্সের ফাঁক দিয়ে চন্দনের মতোই মাঝে মাঝেই তার দিকে তাকাচ্ছে৷

হেড ওয়েটার ফিরোজ চন্দনের টেবিলে হুইস্কির গ্লাস, জলের বোতল আর সাপ্লিমেন্ট চানাচুরের প্লেট এনে রাখল৷ জিনিসগুলো দিয়ে সে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু চন্দন তাকে সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বলল, ‘বসুন, একটু কথা বলি?’

চন্দনের কথা শুনে একটু ইতস্তত করেই জড়োসড়ো ভাবে চেয়ারটাতে বসল বৃদ্ধ ফিরোজ৷ তারপর বলল, ‘বলুন মালিক?’ চন্দন বলল, ‘ম্যানেজার সাহেব বলছিলেন, আপনি তো এখানে বহু বছর আছেন তাই না?’

বৃদ্ধ ফিরোজ জবাব দিল, ‘জি মালিক, পঞ্চাশ বছর হবে৷ বিদিশা যখন খুলল তারপর থেকেই আছি৷ আমার উমর তখন হবে বিশ সাল৷’

চন্দন হুইস্কির গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বলল, ‘তবে তো আপনি অনেক কিছু দেখেছেন এখানে?’

ফিরোজ তার মাথার পাগড়িটা একটু ঠিক করে নিয়ে বলল, ‘জি সাব, বহুত কুছ৷ এই পঞ্চাশ বছরে সাতজন মালিকের কাম করেছি এই বিদিশাতে৷ বহু আদমি ভি দেখেছি৷ ভালা লোগ, বুরা লোগ, হরেক কিসম কা আদমি৷’

‘এখানকার দু-একটা ঘটনা বলুন না, যা আপনার মনে আছে?’

ফিরোজ হেসে তার সাদা জুলফিতে হাত বুলিয়ে প্রথমে হেসে বলল, ‘পুরানা বাত, সব কি আর ইয়াদ আছে বাবু?’ তারপর একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘দুটো ঘটনা ইয়াদ আসছে৷ বিদিশা তখন নতুন হয়েছে, আমি তখন কাজে ঢুকেছি৷ নকশাল পিরিয়ড৷ একরোজ ঠিক এমন সময় বারে বসে একজন লোক খাচ্ছিল৷ হঠাৎ তিনজন নকশাল লড়কা চাকু নিয়ে ঢুকে পড়ল ভিতরে৷ একজন কাস্টমারকে মারতে ঢুকেছে তারা৷ ওই যে বাঁদিকে কোনার টেবিলে বসেছিল সেই কাস্টমার৷ তখন আমি জোয়ান, শরীরে তাকাতও ছিল, সাহসভি ছিল৷ কাস্টমারকে বাঁচাবার জন্য আমি তাকে আড়াল করে দাঁড়ালাম৷ একটা লড়কা চাকু চালাল, সেটা এসে আমার হাতে লাগল৷ কিন্তু আমি ভয় না পেয়ে ঘুসি মারলাম তাকে৷ দুবলা চাকুঅলা লড়কা মাটিতে পড়ে গেল৷ একটু ঘুসাঘুসি হল তারপর তারা পালিয়ে গেল, কাস্টমার বেঁচে গেল৷‘ কথা বলতে বলতেই ফিরোজ তার ডান হাতের জামার হাতাটা একটু উঠিয়ে ফেলে দেখাল৷ তার কবজির নীচে কুঁচকে যাওয়া চামড়াতে একটা ইঞ্চি তিনেক লম্বা দাগ সেদিনের ছুরির স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে৷

ফিরোজ বলল, ‘আর একটা রাত খুব ইয়াদ আছে৷ চল্লিশ সাল আগের ঘটনা হবে৷ অনেক রাত, কাস্টমাররা সবাই চলে গেছে, বার বন্ধ হবে৷ একটা বিরাট গাড়ি এসে দাঁড়াল দরজার বাইরে৷ গাড়ি থেকে নেমে বারে ঢুকলেন আপনাদের বাংলা সিনেমার এক নম্বর হিরো উজ্জ্বলকুমার! সত্যিই হিরোর মতো দেখতে তাঁকে৷ বারে ঢুকে টেবিলে বসে তিনি হুইস্কি দিতে বললেন, ম্যানেজার তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে জোড় হাত করে বলল, ‘স্যার, বার বন্ধ হবার সময় হয়ে গেছে৷ এরপর ড্রিংস সার্ভ হলে পুলিশ আসবে৷’

লেকিন হিরো বললেন, ‘পুলিশ এলে আমি বুঝব৷ নিশ্চিন্তে থাকুন৷’

এরপর স্কচ সার্ভ করা হল তাঁকে, সঙ্গে কাজু৷ অন্য কিছু খাবার খেতে চাইলেন না তিনি৷ আমরা ওয়েটাররা কিছুটা তফাত থেকে অবাক হয়ে নজর করছি তাঁকে৷ তিনি সে সময় বাংলা সিনেমার এক নম্বর হিরো আছেন, আর আজ তাঁর এন্তেকালের পর ভি৷ বার খোলা দেখে পুলিশ পেট্রল জিপ ঠিক চলে এল৷ কিন্তু বারে ঢুকে উজ্জ্বলকুমারকে দেখে তারা ভি অবাক৷ উজ্জ্বলকুমার তাদের বলল, ‘বারের কোনো দোষ নেই৷ ফাইন করতে হলে আমাকে করুন৷’

পুলিশ অফিসার ফাইন নেবেন কী! তিনি কাগজ বের করে অটোগ্রাফ নিলেন হিরোর৷ তারপর বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন হিরোকে গার্ড দেবার জন্য৷ ম্যানেজার সাব হুইস্কির দাম নিতে চাননি৷ কিন্তু উজ্জ্বলকুমার দাম ভি দিলেন তার সাথে প্রত্যেক ওয়েটারকে একশো রুপিয়া বকশিশ ভি৷ আজকে ও টাকা দো-তিন হাজার রুপিয়া হবে৷ তখন আমি তনখা পেতাম ষাট রুপিয়া৷’

কথা বলতে বলতেই ফিরোজের চোখ ঘুরছে অন্য টেবিলগুলোর দিকে, কারো কিছু প্রয়োজন আছে কি না তা বোঝার জন্য৷ চন্দন এবার জানতে চাইল, ‘আপনি কোথায় থাকেন? বাড়িতে স্ত্রী, সন্তান কে কে আছেন?’

বৃদ্ধ ওয়েটার ফিরোজ জবাব দিল, ‘রাজাবাজার৷ দেশ মুরাদাবাদ, ইউ. পি৷ আমার বুঢিঢ দশ বরষ হল গুজর গেছে৷ দো বেটা আছে, চার পোতা ভি আছে, তবে তারা আমার সাথে থাকে না৷ কাম-কাজের ধান্দাতে একজন দিল্লি থাকে, আর একজন কানপুর, আমি একলা থাকি এখন৷’

চন্দন বলল, ‘এত বয়সেও আপনি কাজ করে চলেছেন! ছেলেরা পয়সা পাঠায় না?’

ফিরোজ বলল, ‘পাঠাত৷ আমি বারণ করে দিয়েছি৷ তারাও তো আমারই মতো ছোট কাজ করে৷ বালবাচ্চা আছে, এত রুপিয়া কোথায় পাবে?’

এ কথা বলার পর ফিরোজ বলল, ‘আরও এক-দো বরষ নোকরি করব এখানে৷ তারপর কলকাতা ছেড়ে চলে যাব৷’

‘কোথায় যাবেন? ছেলেদের কাছে?’ জানতে চাইল চন্দন৷

বৃদ্ধ ফিরোজ তার চশমার ঘষা কাচের ভিতর দিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘মুরাদাবাদে আমার বাড়িতে৷ যেখানে আমার দাদা-পরদাদার কবর আছে৷ ওখানে গিয়ে একটা ঘর তুলব৷ উমর তো অনেক হল৷ ওখানে বাপ-পরদাদার কবরের পাশে ঘুমাব খোদার ডাক এলে৷ উমর যত বাড়ছে সেই গাঁওয়ের কথা মনে পড়ে আমার৷ ঘর তোলা আর কবরের জন্য রুপিয়া জমাচ্ছি৷ ওই জন্য নোকরি করছি৷’

ফিরোজ হয়তো আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ হাঁক শোনা গেল, ‘ফিরোজ ভাই?’

কাচের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করেছে দুজন৷ মাঝবয়সি একজন লোক, আর তার সঙ্গে একটা সাতাশ-আঠাশ বছরের ছেলে৷ ফর্সা, সুন্দর দেখতে, পরনে একটা লাল টিশার্ট আর জিন্স৷ তবে তার চুল-পোশাক সবই যেন একটু অবিনস্ত৷ মাঝবয়সি লোকটা ফিরোজকে বলল, ‘দাদাকে দিয়ে গেলাম৷ যেমন নিতে আসি তেমনই আসব৷ তবে কিন্তু…৷’—এ কথা বলে লোকটা আঙুল তুলে দুটো আঙুল দেখাল৷ সম্ভবত দুটো পেগের কথা বলল৷ ফিরোজ লোকটার উদ্দেশে বলল, ‘আপনি যান৷ আমি আছি, চিন্তা নেই৷’

টেবিল ছেড়ে উঠে কাস্টমার সার্ভিস দিতে চলে গেল ফিরোজ৷ খাবার খেতে খেতে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিতে লাগল চন্দন৷ তার একপাশের টেবিলের সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোকের দিকে বারকয়েক চোখাচোখি হতেই চন্দনের মনে হল সেই বৃদ্ধ যেন চশমার ফাঁক দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন৷ চন্দনের অনুমানই একসময় সত্যি হল৷ তিনি চন্দনের উদ্দেশে বললেন, ‘ভাইকে এখানে নতুন মনে হচ্ছে!’

চন্দন হেসে জবাব দিল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ আপনি এখানে রোজ আসেন নাকি?’

গোলগাল চেহারার, পাঞ্জাবি-পাজামা পরা ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘রোজ না হলেও সপ্তাহে তিন-চার দিন আসি৷ আমার নাম পরিমল ভট্টাচার্য৷ একসময় ডালহাউসিতে একটা অফিসের বড়বাবু ছিলাম৷ তা ভাইয়ের বাড়ি কোথায়? কী করেন?’

চন্দন বুঝতে পারল, পরিমল ভট্টাচার্য নামের লোকটির তার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা৷ চন্দন বলল, ‘আমার নাম চন্দন সেনগুপ্ত৷ ব্যারাকপুরে থাকি৷ একটা সাধারণ চাকরি করি কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে৷’ ইচ্ছা করেই নিজের আসল পরিচয় এড়িয়ে গেল সে৷ কথাটা শুনে পরিমল ভট্টাচার্য বললেন, ‘ও বদ্যি বামুন৷ লোকে বলে আপনারা খুব মেধাবী আর চালাক হন৷ আপনাদের নিয়ে একটা প্রচলিত ছড়া আছে জানেন তো—‘মরা বদ্যি ভাসে জলে, কাক দেখে ভাবে, ব্যাটা ভেসে আছে কোন তালে!’ কথাটা বলে ফেলে তিনি বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না ভাই৷ ছড়াটা মনে পড়ল, তাই মজা করে বললাম৷’

চন্দন হেসে বলল, ‘না, না, কিছু মনে করিনি, ছড়াটা আমিও শুনেছি, আপনি যে মজা করে বললেন তাও বুঝেছি৷’

বৃদ্ধ খুশি হলেন তার কথা শুনে৷ তিনি হেসে বললেন, ‘আজকাল সবাই মজা নিতে পারে না৷ তবে, ‘সেন্স অব হিউমার’ বললে শিবনাথের কথাই বলতে হয়৷ এই যে আমার টেবিলে আর একটা ভোদকার গ্লাস দেখলে ওটা ওর৷’

চন্দন বললে, ‘উনি আপনার বন্ধু হন? ওনার জন্য অপেক্ষা করছেন বুঝি?’

বৃদ্ধ হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, বন্ধু৷ চল্লিশ বছরেরও বেশি সম্পর্ক ওর সঙ্গে৷ যতদিন আমি বেঁচে থাকব, ততদিন বন্ধুত্ব থাকবে৷ তবে সে আসবে না৷ আসলে আমরা দুজনে একসঙ্গে মদ্যপান করতাম৷ কেউ আগে কোনো পানশালাতে গেলে দুটো গ্লাস ভোদকা নিয়ে একে অপরের জন্য অপেক্ষা করতাম৷ সে অভ্যাসটা আজও রয়ে গেছে৷ ও গ্লাসটা ওভাবেই টেবিলে পড়ে থাকে আমি উঠে যাবার আগে পর্যন্ত৷ তবে শিবনাথ আর আসবে না৷ বছর খানেক আগে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ে আমাকে ফেলে রেখে চলে গেল!’

চন্দন তার একটা হুইস্কির গ্লাস শেষ করে ফেলেছে৷ দ্বিতীয় গ্লাসে মৃদু চুমুক দিয়ে চন্দন বলল, ‘ভদ্রলোক আত্মহত্যা করলেন!’

পরিমল ভট্টাচার্য বললেন, ‘হ্যাঁ, জীবনে একটা বড় ভুল করে ফেলেছিল সে৷ আবার হয়তো বা ভুল নয়, ভালোবেসে সে ঠকে গেল৷ একটা বড় চা-কোম্পানির ডিরেক্টর ছিল শিবনাথ৷ পঞ্চাশ বছর বয়সে তার অর্ধেক বয়সি সেক্রেটারির প্রলোভনে পড়ে তাকে বিয়ে করে ফেলল সে৷ বিয়ের পর থেকেই স্ত্রীর সঙ্গে তুমুল অশান্তি৷ একাধিক পুরুষ বন্ধু তার স্ত্রীর, বলা ভালো শয্যাসঙ্গী৷ বছর পনেরো ওভাবে চলার পর আর মানসিক চাপ নিতে না পেরে আত্মহত্যা করল সে৷ আমার থেকে বয়সে আট-দশ বছরের ছোটোই ছিল শিবনাথ৷’

চন্দন জানতে চাইল, ‘আপনি কোথায় থাকেন?’

তিনি জবাব দিলেন, ‘বাইপাসের ধারে একটা ফ্ল্যাটের দশতলাতে৷’

চন্দন বলল, ‘ওখানেই তো অনেক বড়ো-ছোটো বার-রেস্টুরেন্ট আছে৷ এত দূরে আসেন কেন?’

ভদ্রলোক বললেন, ‘আসলে এখানকার ছিমছাম পরিবেশটা আমার বড় ভালো লাগে৷ বারের ওয়েটার, ম্যানেজার এমনকী মালিকও আমার চেনা৷ ট্যাক্সিতে আসা-যাওয়ার পথে সময়টা অনেকটা কেটে যায়৷ একমাত্র মেয়ে, জামাইয়ের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল্ড৷ মেয়ে তার মাকে সে দেশে বেড়াতে নিয়ে গেছিল কিছুদিনের জন্য৷ স্ত্রীর সেখানে গিয়ে স্ট্রোক হয়ে দেহের একটা পাশ অচল, সে আর কোনো দিন দেশে ফিরতে পারবে না৷ একলাই থাকি ফ্ল্যাটে, কিন্তু কথা বলার কোনো লোক নেই, কিছুতেই সময় কাটতে চায় না৷ এখানে এলে কর্মচারীদের সঙ্গে, আপনাদের মতো দু-চারজনের সঙ্গে কথা হয়, গল্প হয়৷ বলতে পারেন, এ জায়গাটা আমাকে মানসিক আশ্রয় দেয়৷ ব্যাপারটা কিছুই হয়তো নয়, আবার আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার এ জায়গাতে সময় কাটানো৷’

এ কথা বলে তিনি হাতে ধরা গ্লাসটা এক চুমুকে শেষ করে একজন ওয়েটারের উদ্দেশে বললেন, ‘ভাই পল্টু, আর একটা সিক্সটি দাও৷’ ভরা ভোদকার গ্লাসটা কিন্তু আগের মতোই তাঁর টেবিলে পড়ে রইল৷

পল্টু নামের সেই অল্পবয়সি ওয়েটার একটা কাচের গ্লাসে আর একটা ফুল ভোদকা দিয়ে গেল৷

সেই নতুন গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে পরিমল ভট্টাচার্য হেসে বললেন, ‘বলছিলাম না, শিবনাথের খুব সেন্স অব হিউমার ছিল৷ ও বলত, জীবন হল মদের মতো৷’

চন্দন বলল, ‘কেমন ব্যাপারটা?’

তিনি হেসে বললেন, ‘প্রথম পেগ মদ খাবার পর দেখবেন একটা ফুরফুরে ভাব আসে৷ সেটা হল মানুষের জীবনের শৈশব, কৈশোর, সব থেকে আনন্দের কাল৷ দ্বিতীয় পেগ পান করলে শরীর গরম হয়ে যায় ঠিক যৌবনের মতো৷ তৃতীয় পেগে শরীর শিথিল হতে শুরু করে অর্থাৎ প্রৌঢ়ত্ব৷ আর চার পেগ খেলে চারপাশে সব ঝাপসা শূন্য হতে শুরু করে, ঠিক বৃদ্ধ অবস্থার মতো৷’

এ কথা বলার পরই কেমন যেন গম্ভীর হয়ে তিনি বললেন, ‘শূন্য, আমারও তো সবই শূন্য চারপাশ৷ এই বারটা যদি না থাকে তবে আমাকে একদিন কি শিবনাথের মতোই…’

তিনি তাঁর বাক্যটা শেষ না করলেও তাঁর অনুচ্চারিত কথাটা বুঝতে চন্দনের অসুবিধা হল না৷ বৃদ্ধ ভদ্রলোক এরপর আর কোনো কথা বললেন না৷ কেমন গুম হয়ে গেলেন৷ চন্দনও আর তাঁকে প্রশ্ন করে বিরক্ত করা সমীচীন বোধ করল না৷ ফিশফিঙ্গার খেতে খেতে সে হুইস্কির গ্লাসটা শেষ করতে লাগল৷

চন্দনের হুইস্কির গ্লাস আর খাবারের প্লেট যখন শেষ হল তখন ঘণ্টাখানেক সময় কেটে গেছে৷ চন্দন তাকাল চারদিকে৷ ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা টেবিলে আরও কয়েকজন কাস্টমার এসেছে৷ সেই যে লাল টি শার্ট পরা উসকোখুসকো চুলের সুন্দর দেখতে যুবককে একজন এনে ভিতরে বসিয়ে দিয়ে গেছিল, সে নিজের টেবিলে বসে ঘাড় নেড়ে চারদিকে দেখছে৷ কিন্তু তার দৃষ্টির মধ্যেও কেমন যেন একটা অদ্ভুত শূন্যতার ভাব৷ হুইস্কির প্রভাবে চন্দনের মাথাটাও একটু ঝিমঝিম করছে৷’

‘স্যার আপনার কিছু লাগবে?’ কথাটা শুনে চন্দন পিছনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই দেখল অপূর্ব ঘোষাল তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন৷

চন্দন তাঁকে বলল, ‘আপনি কখন ঢুকলেন? আবার ‘স্যার’ বলছেন!’

অপূর্ববাবু হেসে বললেন, ‘এখন আপনি বিদিশার কাস্টমার৷ তাই স্যার বলাটাই দস্তুর৷ পনেরো মিনিট আগেই ঢুকেছি৷ একটা পলিটিকাল পার্টির মিছিল বেরিয়েছে তার জন্য রাস্তা বন্ধ৷ আমাদের দক্ষিণ কলকাতা এখন মিছিলের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে৷ রোজই একটা না একটা মিছিল হয়৷ আর পারা যাচ্ছে না!’

অপূর্ববাবু এ কথা বলার পর চন্দনের টেবিলের অন্যপাশে বসে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘রাতপরিকে নিয়ে শনিবার রাতে আপনি কোথায় গেলেন?’

প্রশ্নটা শুনে চন্দন একই সঙ্গে মৃদু বিব্রত এবং বিস্নিত বোধ করল৷ সে বলল, ‘না, না, তেমন কোনো ব্যাপার নয়৷ আমি শিয়ালদা যাবার জন্য ট্যাক্সিতে উঠছিলাম, তখন উনি বৌবাজার যাবার জন্য লিফট চাইলেন৷ আমি বৌবাজারে নামিয়ে দিলাম৷ কিন্তু এ কথা আপনাকে কে বলল?’

অপূর্ববাবু বললেন, ‘রমানাথ দেখেছে৷ কী একটা কথা প্রসঙ্গে সে বলল আমাকে৷’

চন্দন জানতে চাইল, ‘লিফট দেওয়া কি আমার ঠিক হয়নি?’

অপূর্ববাবু হেসে বললেন, ‘না, না, তেমন কিছু ব্যাপার নয়৷ আপনার সঙ্গে একটু মজা করার লোভ সামলাতে পারলাম না৷ তা ছাড়া আশাবরী বার সিঙ্গার হলেও ওর মধ্যে এখনও পর্যন্ত তেমন বেচাল কিছু দেখিনি৷ তিন বছর ধরে আমাদের এখানে যাওয়া-আসা করছে, বাড়িতে বরও আছে৷’

অপূর্ববাবুর কথা শুনে চন্দন বিস্মিতভাবে বলল, ‘বর আছে! তবে যে আপনি সেদিন বললেন ওর নাম মিস আশাবরী!’

বিদিশা বারের ম্যানেজার হেসে বললেন, ‘বর থাকুক বা না থাকুক, বার সিঙ্গাররা সবাই ‘মিসই হন’৷ আসলে পুরুষের কাছে ‘মিস’ শব্দের অ্যাট্রাকশন মিসেসের থেকে বেশি৷ বিশেষত পানশালার অপরিচিত পুরুষের কাছে তো বটেই৷ তবে আশাবরীর প্রতি আমার একটা মৃদু শ্রদ্ধাবোধও আছে৷ বর শিক্ষিত ছেলে, প্রেম করে বিয়ে৷ সরকারি চাকরি না পেলেও প্রাইভেট টিউশন করে সংসার চালিয়ে নিত৷ তারপর বছর দশেক আগে তার কিডনির অসুখ ধরা পড়ল৷ সে শয্যাশায়ী হয়ে গেল আর আশাবরীকে পুরোদস্তুর বার সিংগিং-এ নামতে হল৷ গান গেয়েই বরের চিকিৎসার খরচ চালায় রাতপরি আশাবরী৷ বরের ঘটনাটা মিথ্যা নয়, আমি একদিন ওর বাড়িতে গিয়ে ওর বরের সঙ্গে দেখা করে এসেছি৷ তবে ওর বর জানে না যে আশাবরী বারে গান করে৷’

অপূর্ববাবুর কথা শুনে চন্দন বলল, ‘কাউকে বাইরে থেকে দেখে বোঝাই যায় না তার ভিতর, তার পরিবারের ভিতর কী ঘটে চলেছে!’

বিদিশা বারের ম্যানেজার এরপর টেবিলগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে চাপা স্বরে বললেন, ‘তবে ওই পম্পা বলে যে মেয়েটা গান গায়, ও কোনো সময় পরিচয় করতে এলে বা সাহায্য চাইতে এলে একটু সাবধানে থাকবেন৷ বেশি পাত্তা দেবেন না৷’

চন্দন বলল, ‘সাবধানে থাকব কেন?’

অপূর্ব ঘোষাল বললেন ‘পম্পার গলা আশাবরীর থেকে ভালো৷ বয়সও কম, কিন্তু যে পথে ও যাচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে নিজেকে ধরে রাখতে পারবে বলে মনে হয় না৷ কানে আসছে কাস্টমারদের সঙ্গে পয়সার জন্য ও এদিক- ওদিক যাওয়া শুরু করেছে৷ বারে পয়সাঅলা কাস্টমার এলে নিজে থেকেই তাকে মোবাইল নাম্বার দিচ্ছে৷ মাত্র বছরখানেক হল মেয়েটা বারে সিঙ্গারের কাজ করছে আর আমাদের এখানে মাস তিনেক৷ এর মধ্যেই ওর এই অবস্থা৷ বারে গান গেয়ে জীবন শুরু করে অনেককে কলকাতা-মুম্বাইয়ের স্টার গায়িকা হতে দেখেছি আবার পম্পার মতো অনেক মেয়েকে বার থেকে প্রসকোয়ার্টারেও যেতে দেখেছি৷ বারেরও বদনাম হয় এ সব মেয়ে থাকলে৷ ভালো সিঙ্গারের খোঁজে আছি৷ পেলে পম্পাকে ছাড়িয়ে দেব৷’ এ কথা বলার পর তিনি উঠে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলেন ‘আপনি এখন কতক্ষণ থাকবেন?’

চন্দন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বাড়ি থেকে আজ সাড়ে আটটায় বেরিয়েছিলাম৷ কলেজ স্ট্রিটের ওদিকে আগে এসেছিলাম৷ তারপর এখানে৷ আজ এখনই বেরিয়ে যাব ভাবছি৷ ট্রেন কিছুটা ফাঁকা পাব৷ দেরি হলে ভিড় হবে৷ তখন মুখে মদের গন্ধ পেলে যাত্রীরা নাক সিঁটকোবে৷’

বিদিশা বারের ম্যানেজার হেসে বললেন, ‘তবে তাই করুন৷ আপনারা নামি লোক, বলা যায় না, ট্রেনে আপনার পরিচিত পাঠক-পাঠিকা কেউ থাকতে পারেন৷ কিন্তু আপনি আবার কবে এদিকে আসছেন? আপনার একটা বই কিনে, অটোগ্রাফ করিয়ে রাখব ভাবছি৷’

অপূর্ব ঘোষালের কথা শুনে চন্দন প্রথমে বলল, ‘না, আপনার বই কিনতে হবে না৷ আমারই দেওয়া উচিত৷ সামনের দিন আনব৷’

এরপর একটু ভেবে নিয়ে চন্দন বলল, ‘তিন দিন আসব না৷ শুক্রবার সন্ধ্যাতে নন্দন চত্বরে একটা সাহিত্য ম্যাগাজিন প্রকাশ হবে৷ আয়োজকরা অতিথি হিসাবে ডেকেছেন৷ গাড়ি ভাড়াও দেবেন৷ তাই গাড়ি নিয়েই আসব৷ নন্দন হয়ে এখানে আসতে রাত আটটা মতো হবে৷ তবে সঙ্গে গাড়ি থাকবে বলে বাড়ি ফেরার অসুবিধার চিন্তা তেমন থাকবে না৷’ চন্দন ওয়েটারের বিল নিয়ে আসার অপেক্ষা না করে অপূর্ব ঘোষালের সঙ্গে কাউন্টারে গিয়ে দাম মেটাল৷ অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘চলুন বাইরে গিয়ে একটা সিগারেট টেনে তারপর যাবেন৷ আমারও একটা খাওয়া হবে আপনার সঙ্গে৷’

কিন্তু বেরোতে গিয়েও একটা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়তে হল অপূর্ব ঘোষালকে৷ আর চন্দনও দাড়িয়ে পড়ল তাঁর পিছনে৷ সেই টেবিল, যেখানে বসে আছে উসকোখুসকো চুলঅলা লাল টিশার্ট গায়ে সুন্দর দেখতে ছেলেটা৷ যে মাঝবয়সি লোকটা তাকে পৌঁছে দিয়েছিল সে ছেলেটাকে বলছে, ‘এবার বাড়ি ফিরতে হবে দাদাবাবু, ওঠো৷’

ছেলেটা বলল, ‘না, উঠব না৷ আজ দশ তারিখ৷ তার আসার কথা৷’

মাঝবয়সি লোকটা ছেলেটাকে বলল, ‘বিল মিটিয়ে দিয়েছি৷ এখানে বসে থাকলে সবাই তোমাকে এবার বকবে৷ ওঠো৷ বাইরে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছি৷’

আর এরপর বিদিশা বারের ম্যানেজারের দিকে তাকাতেই যেন মৃদু উজ্জ্বল হয়ে উঠল ছেলেটার ঘোলাটে চোখ দুটো৷ সে অপূর্ব ঘোষালকে বলল, ‘মধুরা এখানে এসেছে? আপনি তো চেনেন তাকে৷’

অপূর্ব ঘোষাল জবাব দিলেন, ‘না, তিনি আসেননি৷’

জবাব শুনে যেন হতাশা নেমে এল ছেলেটার চোখে৷ ঈষৎ জড়ানো গলাতে ছেলেটা বলল, ‘আসেনি! তাহলে হয়তো আসবে৷ দেখুন না, ও কেমন আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাচ্ছে! আর বসতে দিচ্ছে না৷’

বিদিশা বারের ম্যানেজার ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে নরম স্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ, ভাই, এবার উঠুন, বাড়ি ফিরে যান৷’

ছেলেটা বলল, ‘কিন্তু মধুরা এসে যদি ফিরে যায়, তখন কী হবে? সে যখন দশ তারিখ আসবে বলেছে তখন আসবেই৷’

অপূর্ব ঘোষাল এবার তাঁর গলাটা আরও মোলায়েম করে বললেন, ‘এলে আপনার চিন্তা নেই ভাই৷ আপনার বাড়ির ফোন নম্বর তো আমার কাছে আছেই৷ তিনি এলে আমি আপনাকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে ডেকে আনব৷ নিশ্চিন্তে থাকুন৷ নিন এবার উঠুন৷’

ছেলেটা এবার বলল, ‘আপনি ঠিক বলছেন তো? কিন্তু ওর বাড়ির লোক যদি চলে আসে?’

অপূর্ববাবু ছেলেটাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘চলে এলেও তারা কিছু করতে পারবে না৷ দেখছেন না আমরা এখানে কতজন জোয়ান লোক৷ সে এলেই আমরা সঙ্গে সঙ্গে ডেকে নেব৷’

বিদিশা বারের ম্যানেজারের কথা শুনে ছেলেটা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল৷ তারপর সঙ্গের মাঝবয়সি লোকটার কাঁধ ধরে এগোল বাইরে বেরোবার জন্য৷

তাদের পিছন পিছন চন্দন আর অপূর্ব ঘোষালও বাইরে বেরিয়ে এল৷ কাছেই একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল৷ মাঝবয়সি লোকটা ছেলেটাকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বেরিয়ে যাবার পর চন্দন সিগারেট বার করে জানতে চাইল, ‘এই ছেলেটার কেস কী?’

চন্দনের সঙ্গে সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘সেই আদিম, অকৃত্রিম বিচ্ছেদ কাহিনি৷ ছেলেটার নাম অনিরুদ্ধ৷ পরিবারের অবস্থা ভালো৷ ওর বাবা-মা দুজনেই ব্যাংকে চাকরি করেন৷ একমাত্র ছেলে৷ প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিল ছেলেটা৷ প্রেম হল মধুরা নামের এক সহপাঠিনীর সঙ্গে৷ সুন্দর-ফর্সা দেখতে এক অবাঙালি মাড়োয়ারি মেয়ে৷ বছর তিনেক আগে ওরা আসা-যাওয়া শুরু করে এখানে৷ মূলত খাবার খাওয়ার জন্য আর দুপুরবেলা নিভৃত প্রেমালাপের জন্য৷’—এ কথা বলে একটু থামলেন তিনি৷

সিগারেটে টান দিয়ে চন্দন জানতে চাইল, ‘তারপর?’

অপূর্ব ঘোষালও সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, ‘তারপর মেয়েটার বাড়িতে একদিন খবরটা জানাজানি হল৷ রক্ষণশীল মাড়োয়ারি পরিবার ‘মছলি’ খাওয়া বাঙালির সঙ্গে মেয়ের সম্পর্ক মানবে কেন? তা ছাড়া ছেলেটার বাবা-মা যত ভালো চাকরি করুন না কেন, ব্যবসায়ী মাড়োয়ারি পরিবারের কাছে সে টাকা নস্যি৷ মেয়েকে তারা বোঝাবার চেষ্টা করল, কিন্তু মেয়ে মানল না৷ ছেলেটার সঙ্গে যাতে মেয়েটা যোগাযোগ করতে না পারে সে জন্য মেয়েটার কলেজ যাওয়া বন্ধ করল তার বাড়ির লোক, ফোনও কেড়ে নিল৷ তবুও মেয়েটা সুযোগ তৈরি করে ছেলেটার সঙ্গে দেখা করার জন্য চলে আসত এখানে৷ যোগাযোগের উপায় না থাকাতে মেয়েটা আগের দিন এলে ছেলেটাকে বলে যেত, পরে কোন তারিখে সে আবার আসবে৷ শেষ যেবার সে এখানে এসেছিল সেবার সে ছেলেটাকে বলেছিল আগামী দশ তারিখ সে আসবে৷ কিন্তু এরপর ছেলেটা আর কোনো দিন মেয়েটার দেখা পায়নি৷ সম্ভবত মেয়েটার পরিবার মেয়েটাকে অন্যত্র কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছিল, বিয়েও দিয়ে দিতে পারে৷ এই মাধুরী নামের মেয়েটার সন্ধান না পেয়ে প্রথমে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছিল অনিরুদ্ধ৷ বছর দুই অ্যাসাইলামে থাকার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে৷ কিন্তু তার মধুরা যে দশ তারিখ আসবে বলেছিল সেটা ওর মাথা থেকে যায়নি৷ প্রতি মাসের দশ তারিখ হলেই ও দুপুরে এখানে আসার জন্য ছটফট করে৷ ওকে বাড়িতে ধরে রাখা যায় না৷ চাকরটা তাই ওকে এখানে দিয়ে যায়, নিয়ে যায়৷ ঠিক দু-পেগ মদ দেওয়া হয় ছেলেটাকে৷ সেটা নিয়ে বসে মধুরার জন্য প্রতীক্ষা করে সে৷’—ছেলেটার কাহিনিটা বলে সিগারেটে কয়েক টান দিয়ে বারের ভিতর ফিরে গেলেন অপূর্ব ঘোষাল৷