৷৷ ১০ ৷৷
আজ রবিবার৷ বেলা দশটা নাগাদ চন্দন তার লেখার টেবিলে বসে ছিল একটা লেখা নিয়ে৷ লেখক অঞ্জনদার টোটকাটা বেশ কাজে এসেছে৷ গত দু- দিন ধরে টেলিভিশন অথবা সংবাদপত্রের পাতা খোলেনি চন্দন৷ শুক্রবার ফ্রাইডে ক্লাব থেকে ফিরতে রাত এগারোটা বেজে গেছিল৷ শনিবার অর্থাৎ গতকাল সে বই পড়ে আর ইউটিউবে সিনেমা দেখেই কাটিয়েছে৷ বিদিশার কথা বা সেই অদেখা ধর্ষিতা রমণীর কথা মাঝে মাঝে তার মনে যে কখনও উকি দেয়নি তা নয়, কিন্তু ঘটনাটাকে কেন্দ্র করে চন্দনের মনে যে চঞ্চলতা, বিহ্বলতার সৃষ্টি হয়েছিল, তার মনোজগতে যে আলোড়ন তৈরি হয়েছিল তা যেন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে এসেছে, লেখার জন্য অনেকটাই মনোসংযোগ ফিরে পেয়েছে চন্দন৷ তাই সকাল আটটা নাগাদ লিখতে বসেছিল সে, ঘণ্টা দুই সময়ে লেখাটা বেশ খানিক এগিয়েছে৷ একটা ছোটো গল্প৷ চন্দনের ইচ্ছা, সারাদিন লিখে আজই গল্পটা শেষ করে ফেলবে৷ লিখতে লিখতে লেখা থামিয়ে টেবিলেই রাখা অভিধান তুলে নিয়ে একটা শব্দের অর্থ খুঁজতে যাচ্ছিল চন্দন৷ হঠাৎই তার কানে একটা ক্ষীণ শব্দ ভেসে এল৷ ঘরের ভিতর টেবিলে রাখা মোবাইল ফোনটা বাজতে শুরু করেছে৷ শব্দটা শুনে মৃদু বিরক্ত হলেও কোনো দরকারি ফোন হতে পারে ভেবে লেখার টেবিল ছেড়ে উঠে ঘরে ঢুকে মোবাইলটা হাতে নিল চন্দন৷ স্ক্রিনে ফুটে ওঠা নামটা দেখে চন্দন মৃদু চমকে উঠল৷ বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষালের ফোন কল!
চন্দন কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অপূর্ব ঘোষালের কণ্ঠস্বর ভেসে এল—‘আরে! আমাকে কি তিনদিনের মধ্যেই ভুলে গেলেন! সকাল থেকে এই নিয়ে পাঁচবার রিং করলাম৷’
চন্দন বলল, ‘না, তেমন ব্যাপার নয়৷ লেখার ঘরে বসে লিখছিলাম৷ বেডরুমে মোবাইল বেজেছে খেয়াল করিনি৷ বলুন, কী খবর?’
অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘আপনি যে আমাদের ভোলেননি তা জানি৷ এ কয়দিনে অনেক মানুষ চিনে ফেললাম৷ আজ সন্ধ্যায় যেভাবেই হোক আপনাকে আসতেই হবে৷’
চন্দন জানতে চাইল, ‘কোথায়?’
অপূর্ব ঘোষাল উত্তর দিলেন, ‘কেন, বিদিশাতে আসবেন৷ আজ তো বিদিশার জন্মদিন৷ পঞ্চাশতম জন্মদিন৷ আমরা তাই কিছু সিলেকটেড গেস্টকে নিমন্ত্রণ করছি বিদিশার পক্ষ থেকে ট্রিট দেবার জন্য৷ যদিও সিংগিং ফ্লোর সাধারণ কাস্টমারদের জন্য খোলা থাকবে৷ আপনাকে কিন্তু যেভাবেই হোক, এই শেষবারের জন্য হলেও আসতেই হবে৷’
বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষালের কথা শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্য বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল চন্দন৷ ওপাশ থেকে অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘কী মশাই, কথা বলছেন না কেন? আসছেন তো?’
প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠে সংবিৎ ফিরে পেয়ে চন্দন বিস্মিত ভাবে বলে উঠল, ‘বিদিশা খুলে গেছে! মেয়েটা সুস্থ হয়েছে? সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে?’
অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘হ্যাঁ, সুস্থ হয়ে উঠেছেন ওই বিদেশিনি৷ মানে জ্ঞান ফিরেছে, কথাবার্তাও বলছেন৷ আর অপরাধীও গ্রেপ্তার হয়েছে৷ আর তার সঙ্গে বিদিশার কোনো সম্পর্ক নেই৷ আর সব থেকে বড় কথা মালিক মত পরিবর্তন করেছেন৷’
অপূর্ব ঘোষালের কথা শুনে মুহূর্তের মধ্যেই আবারও একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হল চন্দনের মনে৷ তবে এ উত্তেজনা আনন্দের, ভালোলাগার৷ সে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, আমি নিশ্চয়ই যাব৷ কিন্তু এ সব কবে ঘটল? কখন হল?’
বিদিশা বারের ম্যানেজার বললেন, ‘আপনি এলে সামনাসামনি সব বলব৷ আজকের দু-একটা কাগজে ঘটনাটা ছোটো করে বেরিয়েছে৷ এবার তাহলে রাখি৷ আমার এখন অনেক কাজ৷ সন্ধ্যাতে দেখা হচ্ছে৷’ এই বলে ফোনের লাইন ছেড়ে দিলেন অপূর্ব ঘোষাল৷
আনন্দবিহ্বল ভাবে মোবাইলটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল চন্দন৷ এই আনন্দ অনুভূতিও যেন আবারও চন্দনকে বুঝিয়ে দিল বিদিশাতে মাত্র কয়েকদিনের যাওয়া-আসাতে তার সঙ্গে কত গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বিদিশার৷ আর এই সম্পর্ক তৈরির সঙ্গে অবশ্যই বিদিশার ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষাল৷
চন্দন এরপর কল করল শীর্ষেন্দুকে৷ সে কলটা রিসিভ করতেই চন্দন বলল, ‘তোর তো আজ অফিস নেই৷ বিকালে তোর গাড়িটা একবার পাঠাতে পারবি? কলকাতা যেতে হবে৷ তেল আর ড্রাইভার খরচ লাগলে দেব৷’
শীর্ষেন্দু বলল, ‘না, আজ আমার কোনো কাজ নেই৷ টাকা দিতে হবে না৷ চারটে নাগাদ ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে তোর ওখানে হাজির হবে৷ হঠাৎ গাড়ির দরকার? কোনো অনুষ্ঠান আছে নাকি?’
চন্দন হেসে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, হঠাৎই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ এল৷ একটা সংস্থার গোল্ডেন জুবিলি অনুষ্ঠান আছে৷’
শীর্ষেন্দু বলল, ‘ঠিক আছে, ঘুরে আয়৷ আমি এখনও বিছানাতে৷ আবার ঘুমাব৷’—এই বলে ফোন ছেড়ে দিল শীর্ষেন্দু৷
চন্দন এরপর বারান্দাতে গিয়ে এদিনের সংবাদপত্রটা তুলে নিয়ে খুলল৷ দু-দিন আগে পর্যন্ত সংবাদপত্রের শিরোনামে যে বিদেশিনি ধর্ষণের খবরটা জ্বলজ্বল করত, সে স্থান এখন দখল করে আছে পলিটিক্যাল নেতার ঘুষ খাবার খবরে আর তা সংক্রান্ত রাজনৈতিক বিতর্কের খবরে৷ তবে প্রথম পাতাতেই নীচের দিকে তিন লাইনের একটা সংবাদ ছাপা হয়েছে ‘ধর্ষক ধৃত’ শিরোনামে৷ তাতে লেখা—‘বাইপাসে বিদেশিনি ধর্ষণ কাণ্ডের অপরাধীকে অবশেষে গ্রেপ্তার করেছে কলকাতা পুলিশ৷ ধৃতের নাম রাকেশ জয়সোয়াল৷ সোমবার তাকে আদালতে পেশ করা হবে৷ ক্রমে সুস্থ হয়ে উঠছেন ধর্ষিতা বিদেশিনি৷’
ব্যস সারা কাগজে এ ব্যাপারে খবর বলতে শুধু এটুকুই৷
দৈনিক সংবাদপত্র দেখার পর এ সংক্রান্ত নতুন খবরের আশাতে টেলিভিশনও খুলল চন্দন৷ বেশ কয়েকটা চ্যানেল ঘুরিয়ে দেখল৷ সর্বত্রই শুধু পলিটিক্যাল নেতার ঘুষ নেওয়া, স্টিং অপারেশন সংক্রান্ত খবর৷ যথারীতি তিনদিন আগে যে বিশিষ্টজনরা ‘ধর্ষণ কাণ্ড’ নিয়ে আলোচনাতে বসেছিলেন, তাঁরাই আজকে স্নো-পাউডার মেখে ‘ঘুষ কাণ্ড’ নিয়ে আলোচনাতে বসে পড়েছেন৷ চন্দন এক এক সময় বিস্মিত হয় এই ভেবে যে এই সব মানুষরা এমন সর্বজ্ঞানী হন কীভাবে? সামনে বৈশাখ মাস আসছে৷ চন্দন নিশ্চিত রবি ঠাকুরের জন্মদিনে এই মানুষগুলোই আবার রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে আলোচনা করবেন৷ একটা চ্যানেলে এক সংবাদপাঠিকা শুধু কাগজে যে খবরটুকু ছাপা হয়েছে সেটুকুই বলল৷ ধর্ষণ কাণ্ডের বিষয়ে খবর যেন প্রায় ভ্যানিশ হয়ে গেছে সর্বত্র৷ আর তার জায়গাতে এখন পাঠক-দর্শকদের উন্মাদনার খোরাক, উত্তেজনার খোরাক ‘ঘুষ কাণ্ড!’ সংবাদ মাধ্যম যে তার বিক্রি, টি-আর-পি-র জন্য এক সংবাদকে মুছে ফেলে অন্য সংবাদে দ্রুত চলে যেতে পারে এ সব ঘটনা তার প্রমাণ৷
তবে চন্দন একটা জিনিস বুঝতে পারল যে আজ আর তার গল্পটা লেখা হবে না৷ যতক্ষণ না সে পুরো ঘটনাটা জানতে পারছে ততক্ষণ আর লেখাতে মন বসাতে পারবে না৷ তা ছাড়া ভালো খবরের আনন্দ অনুভূতিও, দুঃখ-বেদনার মতো মনোসংযোগে বাধা দেয়৷
না, চন্দন আর লিখল না৷ সময়ের নিয়মেই ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলল৷ দুপুরে স্নান-খাওয়া সেরে একটু ঘুমাবার চেষ্টা করল চন্দন৷ কিন্তু উত্তেজনাতে তার ঘুম এল না৷ সাড়ে তিনটেয় উঠে বাইরে বেরোবার জন্য চন্দন প্রস্তুত হতে শুরু করল৷ বিকাল চারটে বাজতে না বাজতেই রাস্তায় গাড়ির হর্ন শুনতে পেল সে৷ গাড়ি এসে পড়েছে৷
চন্দন যখন চাঁদনিচকে বিদিশার সামনে গাড়ি থেকে নামল তখন বিকাল সাড়ে পাঁচটা বাজে৷ চন্দন একটু আগেই উপস্থিত হয়ে গেছে৷ আজ রবিবার বলে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে গাড়ির ভিড় একটু কম৷ কিছু দোকানও বন্ধ৷ তা ছাড়া অন্য দিনের সঙ্গে আজও এ জায়গার তেমন কোনো ফারাক নেই৷ আসন্ন সন্ধ্যাকে আহ্বান জানাবার জন্য বিরাট বিরাট বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং-এর আলো, রাস্তার নিয়নের আলোগুলো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে৷ চন্দন গাড়ি থেকে নামতেই বিদিশার দরজার সামনে থেকে হাসিমুখে রমানাথ গাড়িটার দিকে এগিয়ে এল৷ তার পরনে আজ কড়া ইস্ত্রি করা ইউনিফর্ম, পায়ে পালিশ করা জুতো৷ চন্দনকে অভ্যর্থনা জানিয়ে রমানাথ বলল, ‘আসুন স্যার, আসুন৷ আর গাড়িটাকে গলির ভিতর অর্থাৎ স্বর্গের সিঁড়ির কাছে পার্ক করতে বলুন৷ আজ রবিবার, অসুবিধা হবে না৷’ রমানাথের কথা মতো গাড়ির ড্রাইভারকে বিদিশার গায়ে গলির ভিতর রাখতে বলে রমানাথের সঙ্গে চন্দন এগোল বিদিশার সদর দরজার দিকে৷ সেদিকে এগোতে এগোতেই চন্দনকে রমানাথ বলল, ‘উফ এ-কটা দিন যা ঝড় গেল স্যার! বললে বিশ্বাস করবেন না এ-কটা রাত ঘুমাতে পারিনি৷ আমার স্ত্রী তো শুধু দিনরাত ঠাকুরকে ডেকেছে, আর লুকিয়ে কেঁদেছে৷ বিদিশা না খুললে আমার ছেলেটার ভবিষ্যৎ কী হত বলুন তো?’
চন্দন রমানাথের পিঠে হাত রেখে বলল, ‘আমি অনুমান করতে পারছি আপনাদের মনের অবস্থা কী হয়েছিল৷’
বিদিশার বাইরে কাচের দরজার গায়ে একটা থার্মোকলের শিট টাঙানো হয়েছে৷ তার গায়ে ঝলমলে রঙিন চুমকি আর জরি দিয়ে লেখা—‘ওয়েলকাম৷ ফিফটি ইয়ারস অব বিদিশা, বার কাম রেস্টুরেন্ট৷’
নিখুঁত কায়দাতে স্যালুট করে কাচের দরজাটা খুলে দিল রমানাথ৷ চন্দন বিদিশার ভিতরে পা রাখল৷
বিদিশার ভিতরে আজ আলো ঝলমল করছে৷ অন্য দিনের থেকেও আজ বেশি আলো৷ মাথার ওপরের সিলিং, দেওয়ালের গা থেকে ঝুলছে রঙিন বেলুন৷ প্রতিটা টেবিলে রয়েছে একটা করে ফ্লাওয়ার ভাস৷ অতিথিরা এবার একে একে আসতে শুরু করবেন৷ বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষাল হেড ওয়েটার ফিরোজকে সঙ্গে করে প্রতিটা টেবিল ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন শেষ মুহূর্তে কোথাও কোনো খুঁত নজরে আসে কি না? ওয়েটাররা সবাই ধোপ দুরস্ত পোশাকে দাড়িয়ে আছে কাউন্টারের সামনে৷ বৈদ্যুতিক বাতির উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে পড়েছে তাদের মুখমণ্ডলে৷ চন্দনকে দেখতে পেয়েই অপূর্ব ঘোষাল তার কাছে এগিয়ে এসে তাঁর ডান হাতটা করমর্দনের জন্য বাড়িয়ে দিলেন৷ মুখে তাঁর ঝকঝকে হাসি৷ বিদিশা বারের ম্যানেজারের হাত স্পর্শ করল চন্দন৷ এ এক অদ্ভুত উষ্ণ অনুভূতি৷ বেশ কয়েক মুহূর্ত পরস্পরের হাত স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে রইল তারা দুজন৷ তাদের সামনে গোলাপের ট্রে নিয়ে হাজির হল বৃদ্ধ ফিরোজ৷ অপূর্ব ঘোষাল এরপর সেই ট্রে থেকে রাংতা মোড়া একটা টকটকে লাল গোলাপ অপূর্বর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘আমি জানতাম আপনি আসবেন৷ দুঃসময়ে আপনি যেভাবে পাশে ছিলেন তার জন্য আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই৷’ চন্দন কথাটা শুনে মৃদু লজ্জিতভাবে বলল, ‘না, না, এভাবে বলবেন না৷ আমি তো কিছুই করতে পারিনি আপনাদের জন্য৷ তবে এটা সত্যি যে আমি আপনাদের কথা ভেবেছি৷ আপনার মুখে বিদিশা খোলার খবরটা শুনে খুব খুশি হয়েছি৷’
এ কথা বলে চন্দন জানতে চাইল, ‘তা আজকে আপনাদের এখানে আয়োজন কী?’
অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘আয়োজন অতি সামান্যই৷ আজকে এই নীচের ফ্লোরটা আমাদের নিমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য সংরক্ষিত৷ তাদের আমরা দু-পেগ করে স্কচ হুইস্কি অথবা ভোদকা, স্ন্যাক্স এবং ডিনার দিয়ে আপ্যায়ন করব৷ আমাদের উপহার, নো বিল৷ তবে পুরোনো কাস্টমার হলেই যে তাদের আমন্ত্রণ করা হয়েছে তা নয়৷ তাদেরই আমন্ত্রণ করেছি যাদেরকে মনে হয়েছে তারা বিদিশার সুখ-দুঃখর সঙ্গে জড়িত৷ আজ এ ফ্লোরে নিমন্ত্রিত ছাড়া অন্যদের প্রবেশাধিকার নেই৷ ওপরের সিংগিং ফ্লোরে অবশ্য যে কেউ যেতে পারেন৷ সাধারণ কাস্টমাররা যেমন আসেন৷’
এ কথা বলে অপূর্ব ঘোষাল জানতে চাইলেন, ‘আপনি কীভাবে এলেন?’
চন্দন জবাব দিল, ‘গাড়িতে৷ স্বর্গের সিঁড়ির গলিতেই গাড়িটা রাখতে বলল রমানাথ৷’
অপূর্ব ঘোষালের কথার জবাব দিয়ে চন্দন বলল, ‘এবার ভিতরের ব্যাপারটা খুলে বলুন তো? যেটা জানার জন্য আর তর সইছে না৷ খাদের কিনার থেকে উঠে দাঁড়ালেন কীভাবে?’
বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘ঠিকই বলেছেন, খাদেই পড়ে যাচ্ছিলাম সবাই৷ ভগবানের আশীর্বাদে বৃহস্পতিবার রাতেই মারিয়া নামের ওই বিদেশিনি যুবতীর জ্ঞান ফেরে৷ কিন্তু তদন্তে যাতে বিঘ্ন না ঘটে, অপরাধী যাতে সতর্ক হয়ে পালিয়ে না যেতে পারে সে জন্য পুলিশের নির্দেশে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেয়েটার জ্ঞান ফেরার খবর কাকপক্ষীকে জানতে দেয়নি৷ আমিও খবরটা জেনেছি অপরাধী গ্রেপ্তার হবার পরে৷ এক সূত্র মারফত পুলিশ জানতে পারে যে প্রকৃত অপরাধী রয়েছে দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত আবাসনে৷ ইতিপূর্বে বেশ কয়েকটা অসামাজিক কাজকর্মের অভিযোগে পুলিশের খাতায় নাম ছিল ধর্ষকের৷ পুলিশ ওই রাকেশ জয়সোয়ালের ছবি তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে সংগ্রহ করে মারিয়াকে দেখায়৷ মারিয়া ছবি দেখে শনাক্ত করে তার ধর্ষককে৷ শনিবার ভোর রাতে দক্ষিণ কলকাতার ওই আবাসনে লুকিয়ে থাকা রাকেশ জয়সোয়ালকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ আমি আপনাকে বলেছিলাম না যে অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার মিস্টার রেড্ডি ঘটনার তদন্ত করছেন তাঁকে আমার ন্যায়পরায়ণ, কর্মঠ লোক বলেই মনে হয়েছিল৷ বলতে গেলে এ ঘটনার দ্রুত নিষ্পত্তি হবার অনেকটা কৃতিত্বই তাঁর প্রাপ্য৷’—একটানা কথাগুলো বলে থামতে হল অপূর্ব ঘোষালকে৷ একজন ভদ্রলোক ভিতরে প্রবেশ করলেন৷ চন্দন তাঁকে না চিনলেও তিনি যে অতিথি তা সে বুঝতে পারল৷ তাঁর হাতেও গোলাপ তুলে দিল ফিরোজ৷ অপূর্ব ঘোষাল তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে একটা টেবিলে যত্ন করে বসিয়ে দিয়ে আবার চন্দনের কাছে ফিরে এলেন৷
চন্দন এবার জানতে চাইল, ‘কিন্তু আপনাদের মালিক দীনেশ খাস্তগীর বার খুলতে রাজি হলেন কীভাবে?’
অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘অপরাধী গ্রেপ্তার হবার পর কমিশনার রেড্ডি সাহেব যখন জানালেন যে বার খুলতে এখন কোনো সমস্যা নেই তখন আমি খবরটা জানালাম মালিককে৷ আসল ব্যাপারটা হল রেপ কেসের সঙ্গে বিদিশার নাম জড়িয়ে পড়াতেই উনি সামান্য ঘাবড়ে গেছিলেন৷ তার ওপর প্রকাশ জয়সোয়ালের চাপ ছিল৷ আপনাকে একটা খবর দিয়ে রাখি৷ কাকতালীয় ভাবে রাকেশ জয়সোয়াল হল প্রকাশ জয়সোয়ালের ভাইপো৷ ব্যাপারটা তেমনই শুনেছি আমি৷ যাই হোক সমস্যার সমাধান হবার পর আমি মালিককে বার খোলার ব্যাপারে আবার বোঝাবার পর শেষ পর্যন্ত তিনি রাজি হয়ে গেলেন, বিদিশা খোলার অনুমতি দিলেন৷’
এ কথা বলার পর তিনি বললেন, ‘অপরাধী কীভাবে ধরা পড়ল সে ব্যাপারে একটা চমকপ্রদ বিষয় আছে৷ সে ঘটনা কেউ না জানলেও আপনাকে জানাব৷ তবে তার জন্য আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে আপনাকে৷’—কথা শেষ করে রহস্যময়ভাবে হাসলেন তিনি৷
ঠিক ছটা বাজতেই কাচের দরজা আবার খুলে গেল৷ ভিতরে প্রবেশ করলেন বিদিশা বারের কাস্টমার সেই পরিমল ভট্টাচার্য৷ তাঁর পরনে আজ গরদের পাঞ্জাবি, কোঁচানো ধুতি, পায়ে ঝকঝকে পামশু৷ বিদিশা বারের ম্যানেজার তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য এগিয়ে যেতেই বৃদ্ধ পরিমল ভট্টাচার্য শিশুর মতো সারল্যের হাসি হেসে বললেন, ‘এবার বাঁচলাম৷ বিদিশা বন্ধ হবার খবর শুনে আমার কী অবস্থা হয়েছিল জানেন? জল থেকে মাছকে তুলে নিলে যেমন হয়! খাবি খাচ্ছিলাম৷ আর সর্বক্ষণ টেলিভিশনের সামনে বসে থাকতাম যদি কোনো ভালো খবর মেলে তার জন্য৷ এ জায়গা ছেড়ে আমি কোথায় যাব?’
অপূর্ব ঘোষাল তাঁর উদ্দেশে বললেন, ‘অন্য কোথাও যেতে হবে না আপনাকে৷ এখানে যেমন আসেন তেমনই আসবেন৷ আপনারা ঠিক আমাদের কাস্টমার নন, তার চেয়েও বড়, আমাদের আত্মীয়৷ আপনাদের মতো মানুষদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই৷ বিদিশা মানেই তো আপনারা৷’
পরিমল ভট্টাচার্যকে কথাগুলো বলে অপূর্ব ঘোষাল চন্দনকে বললেন, ‘জানেন চন্দনবাবু, এই পরিমলবাবু কিন্তু ওই ঘটনা ঘটার পর প্রতিদিন সকালবেলা নিয়ম করে আমাকে ফোন করতেন খোঁজখবর নেবার জন্য৷’
ফিরোজ এসে দাঁড়াল গোলাপের থালা নিয়ে৷ সে একটা গোলাপ পরিমল ভট্টাচার্যের হাতে ধরিয়ে দিতেই তিনি ট্রে থেকে আর একটা গোলাপ তুলে নিয়ে চন্দন আর অপূর্ব ঘোষালের উদ্দেশে বললেন, ‘এটা কার জন্য নিলাম জানেন৷ আমার বন্ধু শিবনাথের জন্য৷ ঠিক যেমন তার জন্য আমি হুইস্কির গ্লাস সাজিয়ে বসি৷ কে বলতে পারে যে শিবনাথ এখন এখানে উপস্থিত নেই? সবার অলক্ষে সেও হয়তো উপস্থিত হয়েছে এই আনন্দ উৎসবে৷ তার জন্য গোলাপ না নিলে সে অভিমান করবে৷’
চন্দনের মুহূর্তের জন্য যেন মনে হল পরিমল ভট্টাচার্যের চোখের কোলটা যেন তাঁর প্রয়াত বন্ধুর কথা ভেবে চিকচিক করে উঠল বেদনামিশ্রিত আনন্দ অশ্রুতে৷ পরমুহূর্তেই অবশ্য তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে কিছুটা তফাতে দাঁড়ানো ওয়েটার পল্টুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাবা পল্টু, আমি কিন্তু আমার টেবিলেই বসছি৷ আর অন্য দিনের মতোই আজও টেবিলে দুটো গ্লাসই দেবে৷’
চন্দনদের থেকে বিদায় নিয়ে পরিমল ভট্টাচার্য নিজের টেবিলে বসতেই বারের ভিতর প্রবেশ করে অপূর্ব ঘোষাল আর চন্দনের সামনে এসে দাঁড়াল রাতপরি আশাবরী৷ ঝলমলে পাড় দেওয়া ময়ূরকণ্ঠী রঙের শাড়ি তার পরনে৷ সে কাছে আসতেই মৃদু ন্যাপথলিনের গন্ধ এসে লাগল চন্দনের নাকে৷ সম্ভবত আশাবরীর নীলাম্বরী শাড়িটা দীর্ঘদিন আলমারি বা বাক্সের মধ্যে ন্যাপথলিন দিয়ে রাখা ছিল৷ আজ এই বিশেষ দিন উপলক্ষ্যে শাড়িটা গায়ে দিয়েছে সে৷ আজ আরও একটা জিনিস খেয়াল করল চন্দন৷ আশাবরীর সিঁথিতে জ্বলজ্বল করছে সিঁদুর রেখা! যা দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে আশাবরী ‘মিস’ নয় আসলে ‘মিসেস’ আশাবরী৷ রাতপরি আশাবরী অন্য পাঁচটা গৃহবধূর মতনই তার অসুস্থ, রুগ্ন স্বামীর মঙ্গল কামনাতে সিঁথি রাঙিয়েছে৷ এ যাত্রায় হয়তো বেঁচে যাবে সেই লোকটা৷ আশাবরীর চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক৷ না, তা বিদিশা বারের খদ্দেরের দিকে মাইক্রোফোন হাতে ছুড়ে দেওয়া কৃত্রিম হাসি নয়, নির্মল হাসি৷ কিছুটা লাজুকতাও যেন মিশে আছে তার সে হাসিতে৷ একটু লাজুক স্বরেই সে অপূর্ব ঘোষালকে বলল, ‘নতুন একটা গান তুলেছি স্যার৷ একটা বাংলা গান৷ আজ ভাবছি সেটা গাইব৷’ সেটা শুনে অপূর্ব ঘোষাল হাতের ঘড়িটা দেখে নিয়ে বললেন, ‘আজ সিংগিং ফ্লোর খোলা হবে সাতটা থেকে৷ ঠিক আছে গেয়ো৷ তবে এবার থেকে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে আমাদের সবাইকে৷ কোনো দুর্ঘটনা যেন না ঘটে৷ তবে পম্পা শুনলাম অন্য বারে জয়েন করেছে৷ তাকে অবশ্য আমি আর রাখতাম না৷ সিংগিং ফ্লোরের পুরো দায়িত্ব এখন তোমার৷ সভ্য-ভদ্র কোনো মেয়ের খোঁজ পেলে জানিয়ো৷’
কথা শেষ করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরের ফ্লোরে উঠে গেল আশাবরী৷ ওয়েটারের দল ইতিমধ্যে খাদ্য-পানীয় সার্ভ করতে শুরু করেছে৷ হুইস্কির গ্লাস আর স্ন্যাক্স নিয়ে দরজার কাছাকাছি একটা টেবিলে বসল চন্দন৷ অপূর্ব ঘোষাল এ টেবিল ও টেবিল ঘুরে অতিথি-অভ্যাগতদের আপ্যায়নের তদারকি করছেন৷ আর মাঝে মাঝে রিস্টওয়াচ দেখছেন৷ হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে চন্দন দেখতে লাগল সব কিছু৷ একসময় সেই অনিরুদ্ধ নামের ছেলেটা এল৷ তার সঙ্গে তাকে দেখাশোনার লোকটা৷ তাদের দেখে অপূর্ববাবু কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই অনিরুদ্ধ নামের ছেলেটা একটু অপ্রকৃতিস্থ ভাবে চারপাশে তাকাতে তাকাতে বলল, ‘কত আলো! কতো আলো! মধুরা কি আজ আসবে?’
অপূর্ব ঘোষাল তার উদ্দেশে বললেন, ‘হ্যাঁ, সে আসতেও পারে৷—এই বলে ছেলেটাকে যত্ন করে নিয়ে গিয়ে একটা টেবিলে বসিয়ে দিয়ে চন্দনের টেবিলের সামনে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন তিনি৷
কিছুটা তফাতে একটা টেবিলে বসা অনিরুদ্ধর দিকে তাকিয়ে চন্দন অপূর্ব ঘোষালকে বলল, ‘পৃথিবীতে কত আশ্চর্য ঘটনাই তো ঘটে! হয়তো বা কোনোদিন সত্যিই এখানে ফিরে এল সেই মধুরা নামের মেয়েটা?’
অপূর্ব ঘোষাল জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, তা তো হতেই পারে৷ দেখুন না, তিনদিন আগেই তো এ জায়গা এ সময় কেমন অন্ধকারে ডুবে ছিল! আর এখন কেমন আলো ঝলমল করছে!’—কথাটা বলে আবারও ঘড়ি দেখলেন অপূর্ব ঘোষাল৷ তাঁর বারবার ঘড়ি দেখা দেখে চন্দনের মনে হল অপূর্ববাবু যেন বিশেষ কারো আসার জন্য অপেক্ষা করছেন৷ চন্দন নিজেও ঘড়ি দেখল, পৌনে সাতটা বাজে৷ আশেপাশের টেবিলগুলো প্রায় ভরে গেছে৷ মৃদু কথাবার্তা আর পানীয়ের গ্লাসের টুংটাং শব্দ হচ্ছে চারপাশে৷ চন্দনের হুইস্কির গ্লাসটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আর একটা হুইস্কির গ্লাস দিয়ে গেল একজন৷ অপূর্ব ঘোষাল একটু চাপাস্বরে চন্দনকে বললেন, ‘আপনার পানীয়ের ব্যাপারে কিন্তু আমাদের কোনো কার্পণ্য হবে না৷ আর একটা একস্ট্রা ডিনারের প্যাকেট আপনার গাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি৷’
কথাটা শুনে চন্দন বলতে যাচ্ছিল, ‘আপনি আবার এসব করতে গেলেন কেন?’ কিন্তু কাচের দরজা ঠেলে ঠিক সেই মুহূর্তে যে ভিতরে প্রবেশ করল তাকে দেখে বিস্ময়ে কথা বন্ধ হয়ে গেল চন্দনের৷ অনিরুদ্ধর সেই হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকা মধুরাও যদি এখন এখানে এসে উপস্থিত হত তবে তাকে দেখেও হয়তো এতটা বিস্মিত হত না চন্দন বা অপূর্ব ঘোষাল৷ কাচের দরজার ভিতরে ঢুকলেন সেই ট্রেড ইউনিয়ন নেতা রাতুল ঘোষ! পরনে ঢোলা পা-জামা আর পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ৷ যে লোকটা তিনদিন আগেই বিদিশা বন্ধ করার দাবিতে, বিদিশার অসামাজিক কাজের প্রতিবাদে বিক্ষোভের নেতৃত্ব ছিলেন, টিভিতে বাইট দিচ্ছিলেন! আর তাঁর পিছন পিছনই ঢুকল রমানাথ৷ অপূর্ব ঘোষাল দরজার কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন৷ রাতুল ঘোষকে দেখিয়ে রমানাথ বিদিশা বারের ম্যানেজারকে বলল, ‘স্যার, ওনাকে ভিতরে ঢুকতে বারণ করলাম, কিন্তু উনি শুনলেন না!’ ট্রেড ইউনিয়ান তথা এক পলিটিক্যাল পার্টির লিডার রাতুল ঘোষ কিন্তু রমানাথের কথায় কর্ণপাত করলেন না৷ তিনি অপূর্ব ঘোষালের দিকে কান এঁটো করা হাসি হেসে বললেন, ‘আমরা রাজনীতি করি, রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় অনেক কিছু করতে হয়৷ এ পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম৷ শুনলাম বিদিশা খুলেছে, বিদিশার জন্মদিনের পার্টি হচ্ছে তাই ভিতরে ঢুকে পড়লাম৷ কতদিনের সম্পর্ক আমার বিদিশার সঙ্গে৷’—এই বলে তিনি সম্ভবত কাছের একটা টেবিলের দিকে এগোতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই অপূর্ব ঘোষাল বলে উঠলেন৷ ‘আজ এখানে শুধু তাঁরাই বসবেন, যাঁদের আমরা নিমন্ত্রণ করে এনেছি৷ বাইরের লোককে আজ আমরা এখানে অ্যালাউ করছি না৷’
কথাটা শুনে মৃদু থতমত খেয়ে রাতুল ঘোষ বললেন, ‘তার মানে আমি এখন এখানে বসতে পারব না?’
বিদিশা বারের ম্যানেজার বললেন, ‘না, পারবেন না৷’
রাতুল ঘোষ এবার নেতাসুলভ ভঙ্গিমাতে বললেন, ‘আমি আইন জানি৷ বার খোলা রেখে আপনি কিন্তু কাউকে বলতে পারেন না যে এখানে বসা যাবে না৷’
বিদিশা বারের ম্যানেজার বললেন, ‘হ্যাঁ, সে আইন আমিও জানি৷ তাই বিকল্প ব্যবস্থা করা আছে৷ আপনার যদি এ বারে বসতেই হয় তবে পাশের গলি দিয়ে ঢুকে দোতলায় চলে যান৷ ওখানে বাইরের লোকেদের বসার ব্যবস্থা আছে৷’ কথাটা শুনে রাতুল ঘোষ নাক সিঁটকে বললেন, ‘ওপরে মানে যেখানে গান হয়, যত রাজ্যের লুম্পেনরা এসে বসে?’
অপূর্ব ঘোষাল হেসে বললেন, ‘ঠিক তাই৷ তবে আপনার সম্বন্ধে জানলে ওই লুম্পেনরাও আপনার পাশে বসবে কি না সন্দেহ!’
রাতুল ঘোষ এবার মৃদু গলা চড়িয়ে বললেন, ‘আপনি কিন্তু আমাকে এ ভাবে অপমান করতে পারেন না৷ আমি কে তা আপনার ভালো করে জানা নেই৷ জানেন আমি কী করতে পারি?’ লাল হয়ে উঠেছে ট্রেড ইউনিয়ন নেতার মুখ৷
অপূর্ব ঘোষাল ঠান্ডা গলাতে বললেন, ‘সে আপনি যা খুশি করতে পারেন, আপনার সঙ্গে কথা বলার মতো সময় আমার এখন নেই৷ আপনাকে যদি বসতে হয় তবে ওপরেই বসতে হবে৷ আর একটা কথা আপনার ভালোর জন্য জানিয়ে দিই৷ ওপর-নীচে নতুন সিসি টিভি লাগানো হয়েছে৷ লালবাজার থেকে আমাকে বলা হয়েছে প্রতি সপ্তাহে তার ফুটেজ জমা দিতে৷ আর কোনো কাস্টমারকে আমার সন্দেহজনক মনে হলেই ফুটেজে তাকে মার্ক করে দিতে৷’
অপূর্ব ঘোষালের শেষ কথাটা শুনে রাতুল ঘোষের চোয়ালটা কেমন যেন ‘হাঁ’ হয়ে গেল৷ তাঁর পিছনে দাঁড়ানো রমানাথ এবার তাঁর উদ্দেশে মৃদু ব্যঙ্গের স্বরে বলল, ‘দরজা খুলে দিয়েছি স্যার৷ আপনার বেরোতে কোনো অসুবিধা হবে না৷’ এবার আর কোনো কথা না বলে বাইরে বেরিয়ে গেলেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা সমাজসংস্কারক রাতুল ঘোষ৷
লোকটা বাইরে বেরিয়ে যেতেই অপূর্ব ঘোষাল চন্দনের টেবিলের সামনে এসে বললেন, ‘লোকটা কী নির্লজ্জ দেখলেন! অন্য কেউ হলে ওই বিক্ষোভ করার পর এ জায়গার ছায়া মাড়াত না৷ তার ওপর এখানে বসা যাবে না বলাতে আবার আইন দেখাচ্ছিল! আজকাল পলিটিক্সের লোকরা মনে হয় এমনই হয়! স্কাউন্ড্রেল!’
‘‘স্কাউন্ড্রেল’ কথাটা কি আপনি আমাকে বলছেন?’—আর একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে চন্দন দেখল ভিতরে প্রবেশ করেছেন নাট্যকার অসীম রায়!
তাঁর দিকে তাকিয়ে অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘আসুন, আসুন৷ আরে ও কথা আপনাকে বলার মতো ধৃষ্টতা যেন আমার কখনও না হয়৷ অন্য একজনের সম্পর্কে কথাটা বলছিলাম৷’
অসীম রায় অপূর্ব ঘোষালের কথা শুনে বললেন, ‘তাও ভালো! আজকাল অনেকেই লেখক-শিল্পী-নাট্যকার-বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে এসব শব্দ ব্যবহার করে, তাই ভাবলাম আমাকেই কথাটা বললেন৷ অবশ্য যারা আমাদের সম্পর্কে এ কথা বলে তাদের আমি তেমন দোষ দিই না৷ অনেকেই তো বেশ্যাবাড়ির খাতায় নাম লেখান শেষকালে৷ তবে অসীম রায়রাও এখনও আছে৷’
এ কথা বলে তিনি এরপর চন্দনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ও আপনিও আছেন দেখছি! সেদিন আপনাকে বলেছিলাম, নাট্যকার অসীম রায় হতাশা থেকে মদ খায়৷ কথাটা কিন্তু ঠিক নয়৷ যারা মনের মধ্যে বিপ্লব নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তাদের মধ্যে হতাশা কখনও আসে না৷ অসীম রায় এখানে আসে বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাকে, মনের ভিতরের আগুনটাকে নিভতে না দেবার জন্য৷ বিপ্লব একদিন আসবেই৷ আর সেটা দেখে যাবার জন্য মনটাকে তারুণ্যের উন্মাদনায় বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন৷’—এই বলে তিনি এগিয়ে গেলেন একটা টেবিলের দিকে বসার জন্য৷
অপূর্ব ঘোষালের দিকে তাকিয়ে চন্দন হেসে বলল, ‘এই সব জিনিয়াস মানুষদের মনের গভীরে ঢোকা কঠিন কাজ৷ বাইরে থেকে চট করে এদের বোঝা যায় না৷’
অপূর্ব ঘোষাল চন্দনের কথা শুনে হেসে ঘড়ি দেখে বললেন, ‘চলুন, এবার আমার সঙ্গে আপনাকে ওপরে যেতে হবে৷ একজন আসবে সেখানে৷ আপনাকে না-বলা অজানা কথাটা এবার জানতে পারবেন৷’
হাতের গ্লাসটা শেষ করে চন্দন এগোল অপূর্ব ঘোষালের সঙ্গে৷
দোতলায় উঠে এসে স্বর্গের সিঁড়ির মুখটাতে সিংগিং ফ্লোরের কাচের দরজাটার সামনে এসে দাঁড়াল চন্দনরা৷ সাতটা বাজতে আর ঠিক পাঁচ মিনিট বাকি৷ সাধারণ কাস্টমাররা দু-একজন করে ওপরে উঠে আসছে৷ অর্জুন এসে অপূর্ব ঘোষালের হাতে একটা ফুলের বোকে দিয়ে গেল৷ সেই বোকে হাতে ধরে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন অপূর্ব ঘোষাল৷
ঠিক সাতটা৷ স্বর্গের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এল একজন শান্তশিষ্ট চেহারার মাঝবয়সি লোক৷ পরনে সাধারণ শার্ট-প্যান্ট৷ পায়ে সাদা চপ্পল, চোখে চশমা৷
লোকটা উঠে আসতেই অপূর্ব ঘোষাল ফুলের বোকেটা তার হাতে ধরিয়ে দিলেন৷ ব্যাপারটাতে একটু হকচকিয়ে গিয়ে লোকটা অপূর্ব ঘোষালকে বলল, ‘এটা আমাকে দিলেন কেন?’
অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘এটা আপনার প্রাপ্য তাই৷ আপনার কাছে আমি এবং বিদিশার সবাই চিরকৃতজ্ঞ রইলাম৷’
বিদিশা বারের ম্যানেজারের কথা শুনে মুহূর্তের জন্য যেন আবছা হাসি ফুটে উঠল লোকটার মুখে৷ ফুলের তোড়াটা আবার অপূর্ব ঘোষালের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে লোকটা বলল, ‘জীবনে এই প্রথম ফুলের তোড়া পেয়ে ভালো লাগল৷ তবে ওটা আপনার কাছেই রাখুন৷ এ সব ঠিক আমাদের জন্য নয়৷ তবে ব্যাপারটা কিন্তু গোপন রাখবেন৷’—এই বলে কাচের দরজা ঠেল সিংগিং ফ্লোরে ঢুকে পড়ল লোকটা৷
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই লোকটাকে চিনতে পেরে চন্দন মৃদু বিস্মিতভাবে চাপাস্বরে অপূর্ব ঘোষালকে বলল, ‘এই সেই বন্দর অঞ্চলের আন্ডার ওয়ার্ল্ডের তাজ নামের লোকটা না! যাকে আপনি এখানে দেখিয়েছিলেন আমাকে?’
অপূর্ব ঘোষাল হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, ওই সেই তাজ৷ আপনার খেয়াল আছে দেখছি!’
চন্দন বলল, ‘ব্যাপারটা কী?’
অপূর্ব ঘোষাল দরজার সামনে থেকে একটু সরে এসে বললেন, ‘কথাটা আমি কাউকে জানাব না বলে ওকে কথা দিলেও আপনাকে বলব৷ কারণ আপনি তো এ জায়গা নিয়ে ভবিষ্যতে লিখবেন, কথাটা না বললে এ জায়গাতে আসা লোকগুলোকে আপনার চেনা সম্পূর্ণ হবে না৷ তবে আপনিও ঘটনাটা বাইরের পৃথিবী থেকে গোপন রাখবেন৷’
চন্দন বলল, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই৷’
অপূর্ব ঘোষাল একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘যখন আমার চারপাশে সব অন্ধকার হয়ে এসেছে, বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য তথাকথিত ভদ্রলোকদের দরজাতে ঠোক্কোর খেয়ে বেড়াচ্ছি তখন বৃহস্পতিবার মাঝরাতে তাজের ফোন কল আমি পাই৷ সে আমাকে বলে ধর্ষকের নাম রাকেশ জয়সোয়াল৷ আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সূত্রে সে তার মুখ চেনে৷ যেদিন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে সেদিন এই সিংগিং বারে মদ্যপান করতে এসেছিল রাকেশ৷ ওই বিদেশিনিকে রাকেশের বাইকের পিছনেও উঠতে দেখেছে তাজ৷ সে তখন এ চত্বরেই ছিল৷ ঘটনাটা শুনেই আমি তার কাছে জানতে চাইলাম ওই রাকেশ জয়সোয়ালের সন্ধান তাজ কোনোভাবে দিতে পারবে কি না? ও বলে সে চেষ্টা করবে৷ বাকি রাতটুকুর মধ্যেই তাজ তার আন্ডার ওয়ার্ল্ডের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অনুসন্ধান চালিয়ে জানিয়ে দেয় রাকেশ জয়সোয়াল ঠিক কোথায় আত্মগোপন করে আছে৷ আন্ডার ওয়ার্ল্ডের নেটওয়ার্ক অনেক সময়ই পুলিশের নেটওয়ার্কের থেকে শক্তিশালী হয়৷ শুক্রবার সকালে খবরটা পাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ছুটলাম লালবাজারে রেড্ডি সাহেবের কাছে৷ আর এর পরের ব্যাপারটা তো আপনি নিশ্চই অনুমান করতে পারছেন৷ তাজের জন্যই ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হল৷ মালিক মত পরিবর্তন করলেন৷ এতগুলো লোককে বাঁচিয়ে দিল তাজ৷’
অপূর্ব ঘোষালের মুখে পুরো কাহিনি শুনে চন্দন অবাক হয়ে বলল, ‘রাকেশের খবর ও আপনাকে জানাল কেন? আন্ডার ওয়ার্ল্ডের কোনো রেষারেষির কারণে?’
বহুদর্শী অপূর্ব ঘোষাল হেসে বললেন, ‘ব্যাপারটা সম্ভবত তা নয়৷ আমি নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি অন্ধকার জগতের মানুষদের মধ্যেও কোথাও কিছুটা মূল্যবোধ থেকে যায়৷ পরিবেশ-পরিস্থিতি কাউকে অন্ধকার জগতের দিকে ঠেলে দিলেও ঈশ্বরের দেওয়া আলোককণা মানুষের মধ্যে থেকে যায়৷ আমার বিশ্বাস বিদিশার প্রতি ভালোবাসা থেকে, এখানকার মানুষদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তাজ কাজটা করেছে৷ এবং এই বিশ্বাস নিয়েই থাকতে চাই আমি৷’
চন্দন অপূর্ব ঘোষালের কথা শুনে বলল, ‘সত্যি, এ ঘটনাটা না জানলে, এ জায়গার মানুষদের বোঝা সম্পূর্ণ হত না আমার৷ আজ আমার এখানকার সে বোঝা সম্পূর্ণ হল৷’
অপূর্ব ঘোষাল এরপর চন্দনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবার কবে এখানে আসবেন আপনি?’
প্রশ্নটা শুনে চন্দনের হঠাৎ মনে পড়ে গেল অগ্রজ কথাসাহিত্যিক অঞ্জনদার বলা কথাটা—‘হাঁসের মতো পাত্রের ভিতর থেকে, জলের ভিতর থেকে দুধটা আলাদা করে তুলে নেওয়া, অর্থাৎ লেখার জন্য প্রয়োজনীয় রসদটুকু সংগ্রহ করাই আমাদের কাজ৷ জলের গভীরে নামলে বা পাত্রের ভিতরে প্রবেশ করলে সেখানে আটকে যাবার সম্ভাবনা থাকে৷’ পানশালা নিয়ে লেখার জন্য চন্দনের এ জায়গা সম্বন্ধে যতটুকু জানার ছিল আজ তা সম্পন্ন হয়েছে বলেই মনে হয়৷ আর এরপরও যদি তার কোনো কিছু জানার দরকার থাকে তবে তা চন্দন মোবাইল, ইন্টারনেট, বইপত্র ঘেঁটে জেনে নিতে পারবে৷
বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষালের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে কথাগুলো ভেবে নিয়ে চন্দন তাঁর হাত দুটো ধরে বলল, ‘এবার আমি আসি? আমি আবার এখনে আসব লেখাটা ছাপা হলে বইটা আপনাকে দেবার জন্য৷ এখানে আমি যা দেখলাম, যা জানলাম তার জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ৷’
কথাটা শুনে বিদিশা বারের ম্যানেজারের মুখে হাসি ফুটে উঠল৷ অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘আমি আপনার লেখাটার জন্য প্রতীক্ষা করে রইলাম৷’
স্বর্গের সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত চন্দনকে এগিয়ে দিয়ে অপূর্ব ঘোষাল সিংগিং ফ্লোরের দরজাটা খুললেন ভিতরে প্রবেশ করার জন্য৷ সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নামতে নামতে চন্দনের কানে গেল খোলা দরজার ফাঁক গলে ভেসে আসছে রাতপরি আশাবরীর কণ্ঠে তোলা নতুন গান, চন্দনের প্রিয় একটা রবীন্দ্রসংগীত—
‘‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো
সেই তো তোমার আলো!
সকল দ্বন্দ্ববিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো
সেই তো তোমার ভালো৷”
সমাপ্ত