।।১।।
‘সাম্যবাদ কাকে বলে জানেন? না, বইয়ের পাতায় লেখা সাম্যবাদ বা রাজনৈতিক দলের স্লোগানের সাম্যবাদ নয়, প্রকৃত সাম্যবাদ৷ আর তা যদি বুঝতে চান তবে এই পানশালার থেকে ভালো জায়গা কোথাও নেই৷ আমি আপনার সব লেখা না হলেও বেশ কিছু লেখা পড়েছি নানা ম্যাগাজিনে৷ লেখার মতো খোরাক এ জায়গাতে অনেক পাবেন স্যার৷’ কথাগুলো বলে চন্দনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন বিদিশা বারের সিনিয়ার ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষাল৷
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের গায়ে এই পানশালাটা বড় না হলেও পঞ্চাশ বছরের পুরোনো৷ ভিতরের পরিবেশটা ছিমছাম, একটা মৃদু আভিজাত্যও যেন আছে৷ এ পানশালার ডাইনে-বাঁয়ে আছে আরও বেশ কিছু পানশালা, সংবাদপত্রের বিরাট অফিস আর ইলেকট্রনিক্স গুডসের শপিংমল৷ এ চত্বরে চন্দন নানা কাজে বেশ কয়েকবার এলেও, কয়েকটা বারে-রেস্তোরাঁতে পানাহার করলেও এই বিদিশা বারে আজই সে প্রথম পা রাখল শীর্ষেন্দুর সঙ্গে৷ দীনেশ খাস্তগীর এই বারের মালিক, শীর্ষেন্দুর চাটাড অ্যাকাউন্ট ফার্মের ক্লায়েন্ট৷ ইতিপূর্বে শীর্ষেন্দু বেশ কয়েকবার এসেছে এই বারে৷ সেই সূত্রে অপূর্ব ঘোষাল তাকে চেনেন৷ তা ছাড়া এই বার-কাম-রেস্তোরাঁর মালিকও টেলিফোনে অপূর্বর আগমনের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে জানিয়ে রেখেছেন তাঁর সিনিয়ার ম্যানেজারকে৷
শীর্ষেন্দুর অফিসের কী একটা কাজের তাড়া আছে৷ হাতের চায়ের কাপটা এক চুমুকে শেষ করে প্লেটটা সামনের টেবিলে নামিয়ে রেখে শীর্ষেন্দু অপূর্ব ঘোষালকে বলল, ‘আমি এবার চলি৷ আমার লেখক বন্ধুকে তবে আপনার হাতেই দিয়ে গেলাম৷ ও ওর প্রয়োজন মতো এখানে আসা-যাওয়া করবে৷ দেখবেন ওর যেন কোনো অসুবিধা না হয়৷ ওকে যতটুকু সাহায্য করতে পারেন করবেন৷’
অপূর্ব ঘোষাল শীর্ষেন্দুর কথার জবাবে হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ স্যার, নিশ্চই৷ আপনারা হলেন মালিকের লোক৷ এই পঞ্চান্ন বছর বয়সে যদি চাকরি যায় তবে নতুন করে কোথায় চাকরি পাব?’
চন্দন আর শীর্ষেন্দু দুজনেই হাসল তাঁর কথা শুনে৷ এরপর শীর্ষেন্দু কাচের দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে গেল৷
বিদিশার ম্যানেজার সাম্যবাদ নিয়ে যে কথাটা বলছিলেন, মৃদু ছেদ পড়েছিল তাতে৷ শীর্ষেন্দু বেরিয়ে যাবার পর চন্দন তাকে প্রশ্ন করল, ‘সাম্যবাদের ব্যাপারটা নিয়ে কী যেন একটা বলছিলেন?’
অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘ও, হ্যাঁ৷ প্রকৃত সাম্যবাদ কিন্তু এখানেই দেখা যায়, এই সব পানশালাগুলোতে৷’ এ কথা বলার পর তিনি কিছুটা তফাতে চোখের ইশারাতে দুটো টেবিল দেখিয়ে গলা খাদে নামিয়ে বললেন, ‘ওই যে পাশাপাশি টেবিলে বসা একজন আর একজনের থেকে সিগারেট ধরাবার জন্য লাইটার নিচ্ছে দেখুন৷ যে লাইটার দিল তার নাম অভয় মিত্র৷ বিরাট বড় সরকারি অফিসার৷ নীলবাতি লাগানো গাড়ি বারের কিছুটা তফাত থেকে ওকে তুলে নিয়ে যায় আবার পৌঁছেও দিয়ে যায়৷ আর তার কাছ থেকে যে লাইটার নিয়ে সিগারেট ধরাচ্ছে তার নাম গণেশ৷ এই চাঁদনিতেই একটা দোকানের সাধারণ কর্মচারী৷ ওই গণেশ নামের লোকটা যদি এই পানশালার বাইরে অভয় মিত্রের সঙ্গে দেখা করতে চায় তবে সাতদিন আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে, টেবিলের দশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে জোড় হাত করে কথা বলতে হবে৷ অথচ এখানে অবলীলায় তারা লাইটার চালাচালি করছে, কথা বলছে৷ এমন নয় যে তারা কেউ কারো পরিচয় জানে না৷ তারপর আপনার ওই কোনার টেবিলটা দেখুন৷ মুখোমুখি বসে একটা টেবিল শেয়ার করে যারা পান করছে তাদের একজন ভবতোষ মল্লিক আর একজন রাতুল ঘোষ৷ দুজনেই ট্রেড ইউনিয়ন লিডার৷ ভবতোষ মল্লিক হল শাসক দলের আর রাতুল ঘোষ সরকার-বিরোধী দলের নেতা৷ বারের বাইরে পাবলিকের চোখে দুজনের মধ্যে দা-কুড়োল সম্পর্ক৷ অথচ দেখুন এখানে এসে ওদের রাজনীতির রং হাতে ধরা ইমপোর্টেড ভোদকার মতোই বর্ণহীন হয়ে গেছে৷ এমন আরও কত লোক আসে ওখানে৷ এই পালশালার দরজার বাইরে পা রাখলেই যাদের মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক৷ ক’দিন এখানে এলেই আপনার চোখে সব ধরা পড়বে৷ যতটুকু প্রয়োজন তা কলমের ডগায় তুলে নেবেন৷’—একটানা কথাগুলো বলে থামলেন অপূর্ব ঘোষাল৷
চন্দন বলল, ‘বেশ বললেন তো আপনি৷ কাস্টমারদের আপনি নামে চেনেন?’
তিনি জবাব দিলেন, ‘না, সব কাস্টমারকে আমি নামে চিনি না৷ চেনা সম্ভবও নয়৷ তবে যারা দীর্ঘদিন ধরে আসা-যাওয়া করছে তাদের সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচয় হয়ে যায়৷ তখন পরিচয় জানতে পারি৷ অবশ্য যদি তারা সত্যি পরিচয় দেন৷ পানশালা আর রেড লাইট এরিয়াতে গেলে অনেকেই তাদের পরিচয় গোপন রাখে৷ যাদের দেখালাম তাদের পরিচয় অবশ্য সত্যি৷ ওরা পুরোনো কাস্টমার৷’
এ কথা বলার পর একটু থেমে তিনি বললেন, ‘আপনি যদি কোনো বারে যান তবে সেখানে কারা সেই বারের নিয়মিত কাস্টমার আর কারা কখনও -সখনও ফুর্তি করার জন্য বারে এসেছে তা মোটামুটি আপনি একটা আন্দাজ করতে পারবেন তাদের ব্যবহারে৷ ব্যতিক্রম অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে থাকে৷ তবুও যারা নিয়মিত কাস্টমার তারা নিজেদের মতো চুপচাপ খায়, নিজেদের মধ্যে কথা বলে চাপা স্বরে, যাতে অন্য কেউ তাদের কথায় বিরক্ত না হয়৷ আর দ্বিতীয় অংশ যারা, তারা দু-পেগ পেটে গেলেই নিজেদের মধ্যে হই-হট্টগোল বা চিৎকার শুরু করে, সোজা কথায় যাকে মাতলামি বলে তাই৷ এদের নিয়েই মাঝে মাঝে সমস্যা হয়, বার থেকে বের করে দেবার জন্য অর্জুনকে বলতে হয়৷’
চন্দন জানতে চাইল, ‘অর্জুন কে?’
অপূর্ব ঘোষাল জবাব দিলেন, ‘সিকিওরিটি গার্ড৷ তবে এখানকার ভাষায় বলে ‘বাউন্সার’৷ শক্তপোক্ত চেহারার লোক৷ আগে আর্মিতে ছিল৷ এখন এখানে কাজ নিয়েছে৷ খুচরো ঝামেলাগুলো ওই সামলে নেয়৷ এখনও আসেনি৷ সবার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব৷’
চন্দন একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা এখানে যে সব কাস্টমাররা আসে তারা নেশার ঘোরে আপনাদের সুখ-দুঃখের ব্যক্তিগত গল্প শোনায়?’
বিদিশার বারের ম্যানেজার বললেন, ‘দেখুন, সাধারণত কাস্টমারদের সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা করি না বা গল্প করি না৷ তাতে অনেক সময় পরবর্তীতে সমস্যা হয়৷ সাধারণত তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে—ওই, স্যার কেমন আছেন? গুড আফটারনুন বা গুড ইভিনিং পর্যন্ত৷ তবে কখনও-সখনও একটু পুরোনো কাস্টমার হলে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়৷ অনেকেই তো মদ্যপানের পর একটু মুখ খুলতে চান৷ টুকরো-টুকরো কথা বা ঘটনা৷ তবে এই তিরিশ বছরের চাকরি জীবনে সে সব কথা যদি লিখে রাখতাম তবে পাঁচ খণ্ডের বই হয়ে যেত৷ যে ঘটনাগুলো মনে আছে পরে বলব আপনাকে৷’
চন্দন বলল, ‘হ্যাঁ, ওসব লেখার প্রয়োজনে আমার কাজে লাগতে পারে৷’
কাচে ঘেরা কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল চন্দন আর অপূর্ব ঘোষাল৷ ভিতরে ম্যানেজার আর ক্যশিয়ারের বসার জায়গা৷ কাউন্টারের পিছনের দেওয়ালের প্রায় সিলিং পর্যন্ত নানা খোপে সাজানো আছে নানা ধরনের, নানা ব্র্যান্ডের মদের বোতল—ওয়াইন—হুইস্কি, রাম, ভোদকা থেকে শুরু করে বিয়ারের বোতল৷ সুদৃশ্য ফলস সিলিং-এ বসানো নীল আলোতে কেমন যেন মায়াবী, মোহময়ী দেখাচ্ছে কাউন্টারের ভিতরটা৷ চওড়া কোমরবন্ধ আর মাথায় পাগড়ি পরা ওয়েটাররা এই কাউন্টারের ভিতরে ঢুকেই পিতলের পেগ মাপার পাত্রে মদ ঢেলে নিয়ে যাচ্ছে৷ অপূর্ব ঘোষাল একবার তাঁর রিস্টওয়াচটা দেখে নিয়ে বললেন, ‘আমার আজকের মতো ডিউটি শেষ৷ বিরাজ এখনই ঢুকবে৷ জুনিয়ার ম্যানেজার৷ সন্ধ্যা ছটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ওই সামলাবে৷ নীচের ফ্লোরটা তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন৷ আটটা টেবিল৷ এবার চলুন ওপরের ফ্লোরটা আপনাকে দেখিয়ে আনি?’
চন্দন বলল, ‘হ্যাঁ, চলুন৷’
গ্রাউন্ড ফ্লোরের এককোনা দিয়ে সরু একটা সিঁড়ি ওপর দিকে উঠে গেছে৷ নীল রংয়ের কার্পেটে মোড়া৷ সেই সিঁড়ি দিয়ে চন্দনকে নিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে অপূর্ব বললেন, ‘সিঁড়ির নীচে যে ঘরটা দেখছেন ওটা কিচেন, আর তার সঙ্গে স্টোর রুম৷ ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল চন্দন৷ একটা করিডোর, তার দু-পাশে ওয়াশরুম সহ বেশ কয়েকটা খুপরি খুপরি ঘর৷ তিনি বললেন, ‘এ ঘরগুলো স্যার আমাদের রেস্টরুম সহ অন্য কাজে ব্যবহার করা হয়৷ অনেকদিন তো অনেক সময় বাড়িই ফেরা হয় না৷’
চন্দন জানতে চাইল, ‘বার কতক্ষণ খোলা থাকে?’
তিনি জবাব দিলেন, ‘শেষ অর্ডার নেওয়া হয় রাত দশটাতে৷ সার্ভিস মিটতে এগারোটা৷ তবে থারটিফার্স্ট ডিসেম্বর সহ আর বেশ কয়েকটা দিন, সারা রাতই খোলা থাকে৷’
ম্যানেজার ঘোষাল চন্দনকে এনে দাঁড় করালেন একটা কাচের দরজার সামনে৷ করিডোরের অন্য প্রান্ত থেকে সেখানেও একটা সিঁড়ি এসে মিশেছে৷ সেটা দেখিয়ে চন্দনকে অপূর্ব বললেন, ‘এটা আমাদের অন্য একটা এন্ট্রান্স৷ আমরা এটাকে মজা করে ডাকি ‘স্বর্গের সিঁড়ি’৷ ওপরের কাস্টমাররা এ পথেই ওপরে ওঠে৷ দোতলার এই ফ্লোরটা সন্ধ্যা ছটায় খোলে’৷ কথা বলতে বলতে দরজা ঠেলে পানশালার দ্বিতীয় ঘরটাতে প্রবেশ করলেন ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষাল৷ এই ফ্লোরটা আয়তনে নীচের পানাহার স্থানের দ্বিগুণ৷ অন্তত কুড়িটা টেবিল আছে৷ তার একপ্রান্তে লাল ভেলভেটে মোড়া একটা ছোট মঞ্চের ওপর সাজানো আছে মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্ট৷ সেটা দেখে চন্দন জানতে চাইল ‘এখানে, নাচ-গানও হয় নাকি?’
অপূর্ব জবাব দিলেন, ‘নাচ একসময় হত ঠিকই৷ তবে বহু বছর হল বন্ধ৷ তবে গান হয়৷ আপনি জানেন কি না জানি না, কলকাতা, মুম্বাইয়ের অনেক গায়ক-গায়িকা কিন্তু তাঁদের জীবন শুরু করেছিলেন আমাদের কলকাতার এই পানশালা থেকেই৷ কাঞ্চনকুমারও কিন্তু এখানেই গাইতেন একসময়৷’
কথাটা শুনে চন্দন বিস্মিতভাবে বলল, ‘মুম্বাইয়ের ব্লকব্লাস্টার গায়ক কাঞ্চন- কুমার!’
তিনি বললেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ আমি আমার ছেলেকে প্রথম যেদিন কথাটা বলেছিলাম, তখন তো সে কথাটা বিশ্বাসই করতে চায় না৷ ভাগ্যিস তার সঙ্গে আমার একটা পুরোনো ছবি ছিল, সেটা দেখাবার পর ছেলের কথাটা বিশ্বাস হল৷ তা ছাড়া এ তিরিশ বছরে কত সিনেমা আর্টিস্টকে, লেখক, খেলোয়াড়কে যে দেখেছি তার হিসাব নেই৷ খোকা ব্যানার্জির নাম নিশ্চয়ই আপনি জানেন? বিখ্যাত ফুটবলার৷ সত্তরের দশকে কলকাতার তিনটে নামী ফুটবল ক্লাবেই খেলতেন৷ আমরা টিকিট কেটে ওঁর খেলা দেখতে যেতাম৷ শেষ বয়সে তিনি নিয়মিত আসতেন এই বারে৷ তারপর একদিন খবরের কাগজে দেখলাম তিনি নেই৷’
চন্দন কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন, ‘এখন বিখ্যাত মানুষরা কেউ এখানে আসেন মদ্যপান করতে?’
অপূর্ব বললেন, ‘সবাইকে তো আমি চিনি না৷ টিভির পর্দাতে বা খবরের কাগজের পর্দাতে যাদের মুখ দেখা যায় তাদের চিনি৷ মাঝে মাঝে কোনো গেস্টকে দেখলে মনে হয়, ওনাকে কোথায় যেন দেখেছি৷ তবে অসীম রায় নামে একজন একসময় নাটক করতেন, তিনি মাঝে মাঝে আসেন দুপুরের দিকে৷ কয়েকটা সিনেমাতেও তিনি অভিনয় করেছেন৷ আমার সঙ্গে পরিচয় আছে, এলে পরিচয় করিয়ে দেব৷ তবে আপনার পরিচিত লেখক, সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে৷ কাছেই তিনটে বড় সংবাদপত্রের অফিস৷ যে কারণে তাঁরা এখানে যাওয়া-আসা করেন৷’
অসীম রায়ের নামটা শুনে চন্দন বলল, ‘অসীম রায়ের অভিনয় আমি দেখেছি একবার মিনার্ভাতে৷ দুর্ধর্ষ মঞ্চ অভিনেতা৷ কেউ কেউ তো বলেন উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর এত বড় চরিত্র অভিনেতা বাংলার থিয়েটার মঞ্চে আসেননি৷ পরিচয় করার ইচ্ছা রইল৷’
অপূর্ব হেসে বললেন, ‘হতে পারে৷ আমি নাটক, থিয়েটার দেখিনি৷ দু-একটা ছবিতে ওঁর অভিনয় দেখেছিলাম৷ ভালো অভিনয়৷’
এ কথা বলার পর তিনি ঘরটা দেখিয়ে বললেন, আমাদের নীচের ফ্লোরটা হল৷ ফ্যামেলিবার৷ অর্থাৎ ফিমেল অ্যালাউড সেখানে৷ যদিও পরিবারের ফিমেলদের নিয়ে কেউ বড় একটা খেতে আসেন না৷ আসেন বান্ধবী, প্রেমিকা অথবা অন্য মহিলাদের নিয়ে৷ সঙ্গে মহিলা থাকলে এখানে ওঠার নিয়ম নেই৷ এখানে গানবাজনা হয়, কিছুটা হুল্লোড়ও হয়৷ অনেকসময় কাস্টমারদের কেউ কেউ নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণও হারিয়ে ফেলে৷ ব্যবসার কাজে, আমাদের কাছে সব কাস্টমারই সমান, তবু বলি এখানে যে সব কাস্টমার আসেন, তাঁরা একটু সস্তা ধরনের৷ না, পয়সার দিক থেকে বলছি না৷ বরং অকারণে বেশি পয়সা ওড়ে এখানে৷ কেউ কেউ তাস সাফল করার মতো নতুন নোটের বান্ডিল খুলে টাকা ওড়ায় গান শুনে৷ আমি বলতে চাচ্ছি, আচার-ব্যবহারের দিক থেকে এখানকার কাস্টমাররা একটু খেলো প্রকৃতির হয়৷ রাত যত বাড়ে, ফুর্তি তত জমে ওঠে৷ চিৎকার চেঁচামেচি তত বাড়ে৷ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই লোক আসতে শুরু করে এখানে৷’
ঘরটার চারপাশটা দেখে নেবার পর চন্দনকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে নীচে নামার সিড়ির দিকে এগোতে এগোতে বিদিশা বারের ম্যানেজার প্রশ্ন করলেন, ‘স্যার আপনি মদ্যপান করেন?’
চন্দন বলল, ‘হ্যাঁ, করি৷ তবে রোজ না করলে চলবে না এমন নয়৷ কলকাতার বেশ কয়েকটা ছোটো-বড়ো বারেও গেছি৷ আমার বড় ইন্টারেস্টিং মনে হয় এ জায়গা৷ অনেকদিন ধরেই পানশালা নিয়ে একটা উপন্যাস লিখব ভাবছিলাম৷ শীর্ষেন্দু আমার ছোটোবেলার বন্ধু৷ ওকে কথাটা বলতে ও আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিল৷’
চন্দনের কথা শুনে সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে অপূর্ব ঘোষাল হেসে বললেন ‘হ্যাঁ, ইন্টারেস্টিং জায়গা তো বটেই৷ আমি বি.এসসি পাশ করেছিলাম৷ জানেন, আমি একটা সরকারি চাকরিও পেয়েছিলাম কলকাতার বাইরে৷ ততদিনে আমার এখানে বছর সাতেক চাকরি হয়ে গেছে৷ এ জায়গার একটা মোহ আছে৷ আমি সে মোহতে ততদিনে জড়িয়ে গেছি৷ ছেড়ে যেতে পারলাম না এ জায়গা৷ রয়ে গেলাম৷’
চন্দন জানতে চাইল, ‘আপনার তা নিয়ে কোনো আক্ষেপ আছে?’
বিদিশা বারের সিনিয়ার ম্যানেজার জবাব দিলেন, ‘আমি নিজের ভাবনাটা ঠিক বুঝি না৷ চাকরি পাবার ঘটনাটা যে সময়ের তখন আমার বিয়ে না হলেও স্ত্রীর আক্ষেপ আছে ব্যাপারটাতে৷ তিনগুণ বেশি বেতন হত, চাকরির নিরাপত্তা হত সরকারি চাকরি করলে৷ তবে এখানে চাকরি করেই কিন্তু সংসার চালিয়েছি, দুই ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছি৷’—এ কথা বলার পর তিনি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সিঁড়ির মুখেই নীচ থেকে উঠে এলেন এক মহিলা৷ ফর্সা, লম্বা, মৃদু স্বাস্থ্যবতী৷ মুখশ্রী মোটামুটি সুন্দরই বলা চলে৷ চোখে আইলাইনার আর লিপস্টিক রঞ্জিত ঠোঁট, পরনে শিফনের শাড়ি৷ বয়স মনে হয় তিরিশ-পঁয়ত্রিশ হবে৷ অপূর্বকে দেখে সে বলল, ‘গুড ইভিনিং৷’ প্রত্যুত্তরে অপূর্বও জবাব দিলেন, ‘গুড ইভিনিং৷ সব ঠিক আছে তো?’ মৃদু হেসে সেই মহিলা জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, ঠিক আছে৷’—এ কথা বলে সে চন্দনদের পাশ কাটিয়ে ওপরে উঠে গেল৷ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে চন্দন জানতে চাইল ‘ওই ভদ্রমহিলা কে?’
বিদিশা বারের ম্যানেজার বললেন, ‘বার সিঙ্গার৷ ওর নাম ‘মিস আশাবরী’, যদিও কাস্টমাররা ওকে ‘রাতপরি’ বলে ডাকে৷ আরও একটা মেয়ে আছে পম্পা নামের৷ জানেন, দিন আর রাতের মধ্যে পানশালার পরিবেশে চেহারা-পরিবেশ অনেকটাই পালটে যায়৷ কাল আমার ইভিনিং ডিউটি৷ অর্থাৎ সন্ধ্যা ছটা থেকে রাত দশটা৷ শনিবারের সন্ধ্যাতে অন্যদিনের থেকে পানশালা বেশি জমে ওঠে৷ আসবেন নাকি কাল রাতের পানশালা দেখতে?’
চন্দন বলল, ‘আমার অসুবিধা নেই৷ দেখার জন্য, বোঝার জন্যই তো এখানে আসা৷’
অপূর্ব বললেন, ‘ঠিক আছে৷ চলুন এবার কয়েকজনের সঙ্গে যাবার আগে পরিচয় করিয়ে দেই৷ ক’দিন এলে ধীরে ধীরে আপনা থেকেই সবার সাথে পরিচয় হয়ে যাবে৷’
নীচের ফ্লোরে এসে কাচে ঘেরা কাউন্টারের সামনেই দাঁড়ালেন অপূর্ব৷ কাউন্টারে তখন আর একজন মাঝবয়সি লোক এসে উপস্থিত হয়েছেন৷ অপূর্ব লোকটার সঙ্গে চন্দনের পরিচয় করিয়ে দিলেন৷ ভদ্রলোক সহকারী ম্যানেজার বিরাজ মণ্ডল৷ কাউন্টারে বসা আর একজন লোক ক্যাশিয়ারবাবু শুভঙ্করের সঙ্গে এখানে ঢোকার পর চন্দনদের সঙ্গে প্রথমেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন অপূর্ব ঘোষাল৷ চন্দনের পরিচয় জানতে পারার পর অপূর্ব ঘোষালের সহকারী চন্দনের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘অপূর্বদা না থাকলেও আমি তো ওনার বদলে থাকবই, আপনার কোনো অসুবিধা হবে না৷’
বিদিশা বারের ম্যানেজার এরপর ইশারাতে একজন ওয়েটারকে ডাকলেন৷ সে এসে দাঁড়াল তাঁদের সামনে৷ বৃদ্ধ লোক, পাগড়ির নীচ থেকে সাদা জুলপি দেখা যাচ্ছে৷ চোখে চশমা, বয়সের ভারে একটু ন্যুজ৷ ম্যানেজার তাকে চন্দনকে মালিকের লোক বলে পরিচয় করিয়ে দিতেই বৃদ্ধ কপালে হাত দিয়ে সেলাম ঠুকল চন্দনকে৷ লোকটাকে দেখিয়ে অপূর্ব বললেন—‘ওর নাম ফিরোজ৷ ও এই বারের হেড ওয়েটার৷ বিদিশার জন্মলগ্ন থেকে আছে৷ এই বার সম্পর্কে ওর থেকে বেশি কেউ জানে না৷ বারে কাস্টমারের চাপ কম থাকলে ওর কাছ থেকে বিদিশার পুরোনো ইতিহাস জানতে পারবেন৷’
পানশালায় ভিড় বাড়তে শুরু করেছে৷ প্রায় প্রত্যেক টেবিলে কাস্টমারেরা বসে আছে৷ প্লেট আর গ্লাসের টুংটাং শব্দে, নানারকম মদ আর খাবারের মিশ্রিত গন্ধে ভরে উঠেছে চারপাশ৷ অপূর্ববাবু বললেন, ‘চলুন এবার বেরোনো যাক৷’ টেবিলগুলোর মধ্যে যে প্যাসেজ আছে, তার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে কাচের দরজা ঠেলে বাইরে বেরোবার মুখে কালো উর্দি পরা যে লোকটার সঙ্গে বিদিশা বারের সিনিয়ার ম্যানেজার পরিচয় করিয়ে দিলেন সে লোকের নাম রমানাথ৷ গেটম্যান রমানাথ৷ তিনি তাকে বললেন, ‘এই স্যার কাল সন্ধ্যায় আসবেন৷ হয়তো মাঝে মধ্যেই আসবেন৷ কাস্টমার নয়, মালিকের লোক, অর্জুন এলে ওনার কথা বলে রাখবে৷’
কথাটা শুনে রমানাথ সেলাম ঠুকে কাচের দরজা টেনে খুলে ফেলল৷ বাইরের ফুটপাতে এসে দাঁড়াল চন্দন আর বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষাল৷ তিনি চন্দনকে বললেন, ‘আপনি কোন দিকে যাবেন? আমার বাড়ি সাউথে৷ গড়িয়া, মেট্রো ধরে নেব৷’
চন্দন বলল, ‘আমার বাড়ি তো সেই ব্যারাকপুর৷ শিয়ালদা যাব ট্রেন ধরতে৷’
অপূর্ব ঘোষাল এগোলেন কাছেই মেট্রো স্টেশনের দিকে৷ আর চন্দন লাফিয়ে উঠল শিয়ালদাগামী একটা বাসে৷ ক’টা দিন বিদিশা বারে আসা-যাওয়া করতে হবে তাকে সব কিছু জানা-বোঝার জন্য৷ তা ছাড়া চন্দনের বইয়ের প্রকাশক সুবীরদা বলেছেন ‘প্রাণগোপাল লাহা নামে এক ভদ্রলোকের কাছে চন্দনকে নিয়ে যাবেন৷ উত্তর কলকাতার বনেদি ভদ্রলোক সুবীরদার কাস্টমার৷ তার নাকি পানশালার ইতিহাস জানা আছে৷
ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরতে চন্দনের সাড়ে আটটা বেজে গেল৷ খাওয়া ও অন্য কাজ সেরে রাত দশটা নাগাদ লেখার টেবিলে বসল সে৷ তার নোট লেখার জন্য একটা বাঁধানো খাতা আছে৷ বিদিশার অভিজ্ঞতা তাকে লিখে রাখতে হবে৷ তাই খাতাটা খুলল সে৷ নোট লেখা শুরু করার আগে একটা শিরোনাম লেখা তার অভ্যাস৷ অনেক সময় হয়তো সেটা গল্প বা উপন্যাসের নামও হয়ে যায় লেখার শেষে৷ তবে হবেই যে তার কোনো মানে নেই৷ একটু ভেবে নিয়ে সে খাতার পৃষ্ঠার মাথায় লিখল—‘বারের নাম বিদিশা’৷ বেশ একটা ব্যঞ্জনা আছে এ নামটাতে৷ এরপর তার মনে পড়ে গেল বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষালের বলা সেই কথাটা৷ চন্দনের কথাটা বেশ মনে ধরেছে৷ সে লিখতে শুরু করল—‘সাম্যবাদ কাকে বলে জানেন? না বইয়ের পাতায় লেখা সাম্যবাদ বা রাজনৈতিক দলের সাম্যবাদ নয়, প্রকৃত সাম্যবাদ যদি দেখতে চান তবে তা দেখা যায় এই পানশালাতে…৷’