ঋজুদার সঙ্গে লবঙ্গি বনে — ঋজুদা — বুদ্ধদেব গুহ
বহুদিন পরে এলাম রে। ভারী ভাল লাগছে। জানিস। ঋজুদা বলল।
আমি বললাম, কত বছর পর?
এই বাংলোতে? তা প্রায় কুড়ি-বাইশ বছর হবে। যদিও এর আশেপাশে এসেছি পনেরো বছর আগেও।
ভটকাই বলল, জায়গার কী নাম রে বাবা! বাঘ্যমুণ্ডা। বাঘের মাথা নাকি?
দারুণ নাম। যাই বলিস। আরও দারুণ নাম আছে। বাঘ্যমুণ্ডা। মানুষখেকো বাঘে-খেকো মানুষদের নাম, যারা ভূত হয়ে যায়। কালাসাণ্ডি জেলাতে। ঋজুদা বলল।
আমরা শুনে হেসে উঠলাম সকলে।
এই বাংলোতে আমি একবার শীতকালে ছিলাম। তার আগের বছরই আমাদের বিশেষ পরিচিত মানিক, মানিক দাস, সুধীরঞ্জন দাস মশায়ের ছোট ছেলে, টেস্ট-পাইলট সুরঞ্জনদার ছোট ভাই, এই বাংলোতে ছিলেন সপরিবারে। ঢেঙ্কানল রাজ্যের নিনিকুমারও। মানিকবাবু এখানেই মারা যান।
বাঘের হাতে? তিতির উৎকণ্ঠিত হয়ে শুধোল।
না। যদিও সেই বছরই একটি বড় বাঘ মেরেছিলেন মানিকবাবু এবং এই বাংলোতেই। সামনের ওই গাছ দুটোতে টানা দিয়ে তার চামড়া ছাড়ানো হয়েছিল রাতের বেলা হ্যাজাকের আলোতে কিন্তু বাঘের হাতে মারা যাননি।
তুমি জানলে কী করে কোন্ গাছটাতে টানা দিয়েছিল? ভটকাই শুধোল।
আমিও যে এসেছিলাম সে বছরে। তবে বাঘ্যমুণ্ডাতে ছিলাম না। ছিলাম, অঙ্গুল শহরে। কটকের সুরবাবুদের বাড়িতে। সম্বলপুরে যে পথ চলে গেছে অঙ্গুল হয়ে, সেই পথের উপরে তাঁদের বাড়ি।
তা হলে? জানলে কী করে বাঘ মারার খবর?
অঙ্গুলের ফরেস্ট কনট্রাকটরদের মুখে খবর পেয়েই জিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়া গেল সকলে মিলে মানিকবাবুকে কনগ্রাচুলেট করতে গিয়ে দেখি ড্রেসিংগাউন পরে বাংলোর হাতায় বাঘের চামড়া ছাড়ানোর তদারকি করছেন মানিকবাবু আর নিনিকুমার। মানিকবাবুর স্ত্রী ও দুই মেয়েও ছিলেন। মানিকবাবুর স্ত্রী ছিলেন আমাদের পশ্চিমবঙ্গের পুলিশের ইনসপেকটর জেনারেল শ্রীহীরেন্দ্রনাথ সরকারের কন্যা। সুরঞ্জনদা এবং সরকারসাহেব আমাদের প্রথম যৌবনে টালিগঞ্জের গলফ ক্লাব রোডের রাইফেল ক্লাবে আসতেন মাঝে-মাঝেই। অনিল চ্যাটার্জি আসতেন। মহিষাদলের শক্তিপ্রসাদ গর্গ। জোর আড্ডা ছিল তখন।
সন্ধে হয়ে আসছিল। বাংলোর সামনে একটু দূরে কুয়ো। বাঘ্যমুণ্ডা বস্তির মেয়েরা সন্ধের আগে জল ভরে নিচ্ছিল রাতের মতো। ঘড়া কলসির ধাতব আওয়াজ ভেসে আসছিল। এ-অঞ্চলে অনেক গাছ আছে, যেগুলোকে দেখলে মনে হবে তাল বা ইংরেজি পাম গাছ কিন্তু আসলে এগুলো অন্য গাছ।
লেসার ইন্ডিয়ান হর্নবিলসরা জোড়ায়-জোড়ায় ডানা-না-নাড়িয়ে গ্লাইডিং করে ভেসে যাচ্ছিল পশ্চিমের আকাশে। অস্তগামী সূর্যের লাল আলোতে মোহময় গা-ছমছমে দেখাচ্ছিল পাহাড়শ্রেণী আর গভীর জঙ্গলের রেখাকে। এই অঞ্চলে হাতি ও গাউর, ওড়িয়া নাম গন্ধ, প্রচুর আছে। বাঘও আছে।
ভটকাই আঙুল তুলে তালগাছের মতো গাছগুলোকে দেখিয়ে বলল, কী গাছ ওগুলো ঋজুদা?
পাইপটা মুখ থেকে নামিয়ে অ্যাশট্রেতে রেখে ঋজুদা বলল, এগুলোকে বলে সল্প গাছ। এর ফল থেকে স্থানীয় লোকেরা তাড়ির মতো একরকম পানীয় তৈরি করে। তার ক্রিয়া একেবারে মারাত্মক। আমি একবার দশপাল্লার বিড়িগড়ে, খন্দমাল-এর অন্তর্গত, খন্দদের বাসভূমিতে কজন খন্দকে দেখেছিলাম এই সল্প রস খেয়ে শালপাতাদের তাস করে বড় একটা শালগাছের তলায় বসে তাস খেলতে খেলতে খেলতে হঠাৎই একজনের মনে হল, অন্যজন জোচ্চুরি করছে। আর যায় কোথায়? সঙ্গে-সঙ্গে টাঙ্গির এক কোপে ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করে দিল বেচারির। নিরুপায় সাক্ষী হিসেবে পরে থানা-পুলিশের ঝকমারিও কম পোয়াতে হয়নি আমাকে।
তিতির বলল, দুর্গা মহান্তি আর রাজেনদা কিন্তু এখনও ফিরল না।
চিন্তিত গলায় ঋজুদা বলল, তাই তো দেখছি। তবে এতক্ষণে এবিকাকু আর ফুটুদাদেরও তো ফেরা উচিত ছিল। গাড়ি বা জিপ খারাপ হল নাকি?
কঘণ্টা লাগবে কটক থেকে আসতে?
ভটকাই শুধোল।
আজকাল এমন চমৎকার সব রাস্তা হয়ে গেছে। আগে অনেকক্ষণই লাগত। সময় লাগছে আসলে ফুটুদার জন্যে। ঢেঁকি স্বর্গে নিয়েও যেমন ধান ভানে ফুটুদাও তাই। ঠিকাদার মানুষ। ফেরার পথে চৌদুয়ার, হিন্দোল, ঢেঙ্কানল, অঙ্গুল সব জায়গাতেই একবার থামতে-থামতে আসবে তো?
তিতির বলল, ফেরার সময় পম্পাশরের মোড় থেকে দুর্গা মহান্তি আর রাজেনদাকে তুলে আনতে ভুলে যাবেন না তো?
ওরা তুললে কী হবে, দুর্গা মহান্তিরা পথের উপরেই বসে থাকবে হয়তো। নইলে অন্ধকারে পুরুনাকোটের মুখ থেকে বাঘ্যমুণ্ডা অবধি হেঁটে আসার সাহস পাবে না ওরা। এখানে হাতি খুব।
ভটকাই বলল, ওদের এত সাহস আর এতেই ভয় পাবে?
জঙ্গলের মানুষেরা যতই সাহসী হোক, রাত নামার পর তারা ঘরের বাইরে বেরোয় না। অবশ্য শিকারে গেলে আলাদা কথা। কিন্তু শিকার তো এখন বন্ধই বলতে গেলে। খালি হাতে, বাতি ছাড়া অন্ধকারের পর কারও বনে-জঙ্গলে চলাফেরা করা উচিত নয়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তো করতেন। তিতির বলল।
তিনি সাধক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তা ছাড়া জঙ্গলের সমস্তরকম ভয় সম্বন্ধে উনি হয়তো সচেতন ছিলেন না। নয়তো সচেতন থেকেও হয়তো গ্রাহ্য করতেন না। ওঁর কথা আলাদা।
আর তুমি?
ঋজুদা হেসে বলল, আমার কাছে তো মন্ত্রগুপ্তি আছে।
বাজে কথা। ভটকাই বলল।
এই ভটকাইকে নিয়ে আমরা সকলেই মহা ঝামেলায় পড়েছি। ঋজুদাকে ও মোটেই মান্যগণ্য করছে না। ঋজুদার সঙ্গে নিনিকুমারীর বাঘ মারতে গিয়ে কাগা-বগা-না-মারা শিকারি বাঘিনী দিয়ে অ্যাকাউন্ট ওপেন করার পর থেকেই ভটকাই বাবাজির বোলচাল আরও তেজ হয়েছে। একে নিয়ে আমরা সমস্তক্ষণ টেনশনে ভুগি। ঋজুদার হাসিই দেখেছে। রাগ তো দ্যাখেনি!
নকুল ভেতর থেকে চা নিয়ে এল আমাদের জন্যে, সঙ্গে মুচমুচে করে ভাজা বড় নিমকি, আলুর ঝাল-তরকারি আর লেবুর আচার। তিতির চা খায় না। দুগ্ধপোষ্য শিশু। তার জন্যে গ্লাসে করে দুধ।
ঋজুদা বলল, যাই বলিস তিতির, পশুরাজ্যেও কিন্তু বড় হয়ে ওঠার পর দুধ খাওয়ার রেওয়াজ নেই। মানুষেরা কেন এই বদভ্যাস ছাড়ে না, ভেবে পাই না।
ঋজুদার কথায় আমরা হেসে উঠলাম।
তিতিরও হাসল। তারপর বলল, কথাটা ভাববার মতো। কিন্তু পশুদের মায়েরাই যদি না দেয়, তা হলে বেচারিরা দুধ পাবে কোত্থেকে!
এটাও একটা ভাববার মতো কথা। ঋজুদা বলল।
ঋজুদার কথা শেষ হতে-না-হতে বাংলোর চওড়া বারান্দায় যেখানে আমরা বসে ছিলাম, তার বাঁ দিক থেকে হাতির বৃংহণ ভেসে এল।
গরমের দিন। সূর্য ডোবার পরে হাওয়া যেন পাগল হয়ে উঠেছে। বনুময় ঝরা পাতা, লাল ধুলো এবং ঝরা ফুল ঝাঁট দিয়ে বেড়াচ্ছে দৌড়ে-দৌড়ে। দুটো পেঁচা বাংলোর পেছনের মিকুনিয়া গাছ থেকে প্রচণ্ড জোরে উড়ে-উড়ে ঝগড়া করতে-করতে ঘুরে-ঘুরে দূরে চলে গেল কুয়োটার কাছে।
ভটকাই আধখানা নিমকি মুখে দিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল, টেনশান।
কেন? হাতি?
না রে। যদি পেঁচা দুটো কুয়োয় পড়ে যায় তা হলেই কেলো। বল?
ভটকাইয়ের ভাবনাচিন্তার রকমটাই এরকম। আর যাই হোক, কেউই ওর ওরিজিনালিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না।
এমন সময় দূর জঙ্গলের মধ্যে জিপের এঞ্জিনের আওয়াজ শোনা গেল। পুরুনাকোট আর টুকা যাওয়ার মোড়ের কাছ থেকে এলে পুরুনাকোট থেকে নতুন ফরেস্ট বাংলো যেদিকে, সেদিকের পথে বোস্টম নালাকে পাশে রেখে এলে কিছু চড়াই-উতরাই পড়ে। তবু এ রাস্তাটিতে অনেক বাঁক আছে। জিপ টপ গিয়ারে দিয়েই আবার থার্ড গিয়ারে ফেলে দিচ্ছেন ফুটুদা। এঞ্জিনের শব্দে পরিষ্কারই বোঝা যাচ্ছে। ঋজুদার গাড়িটা চালাচ্ছে ফুটুদার ড্রাইভার।
এল ওরা।
ভটকাই বলল।
দেখা যাক, এখন গ্রেট দুর্গা মহান্তি কী সংবাদ নিয়ে আসে আমাদের জন্য। ঋজুদা বলল।
দুপুরের পর থেকেই আমরা ওদের পথ চেয়ে ছিলাম। সকাল আটটাতে লবঙ্গি থেকে আট-দশজন লোক পায়ে হেঁটে এসে পৌঁছেছিল হাতির খবর দিতে। ঋজুদা বলেছিল দুঃখ করে, আমার কপালে পৃথিবীর কোনও জঙ্গলেই অবিমিশ্র ছুটি কাটানো নেই। এসেছিলাম তোদের নিয়ে মহানদীর দুপাশের জঙ্গলকে নতুন করে দেখতে, তোদের চেনাতে, তা না দ্যাখ, মাত্র একদিন কাটতে-না-কাটতেই এই বিপত্তি।
লবঙ্গির মানুষেরা অনেক কাকুতি-মিনতি করল। হাতিটাকে রোগ ডিক্লেয়ার করা হয়েছে জেলা কর্তৃপক্ষ থেকে। মারার চেষ্টাও করেছেন ভুবনেশ্বর ও কলকাতার দুজন শিকারি। অঙ্গুলের ডি. এফ. ও-ও ঋজুদাকে অনুরোধ করেছেন। লবঙ্গির লোকেদের সঙ্গে পম্পাশরের লোকও ছিল পাঁচজন। হাতিটা নাকি পম্পাশরেও এসে ঝামেলা করেছে। মানুষ মেরেছে এ পর্যন্ত পাঁচজন। তিনজন পুরুষ। দুজন মেয়ে। বাড়ি-ঘর ভেঙেছে অগুনতি। গোর-মোষ আছড়ে মেরেছে কুড়িটা।
ওরা বড় গরিব যে, তা মনে হল ওদের জামাকাপড় আর চেহারাতেই। ঋজুদা এসেছে যে বেড়াতে, সে-খবর ডি. এফ. ও. সাহেবের অফিস থেকে ফরেস্ট-গার্ডই এনে ওদের দিয়েছে কাল। বাস সার্ভিস আছে অস্কুল থেকে পম্পাশর হয়ে, পুরুনাকোট হয়ে। সেই বাস চলে যায় মহানদীর পারে টিকরপাড়াতে। তারপর টিকরপাড়াতে বাঁশের ভেলাতে মহানদী পেরিয়ে ওপারে নানান জায়গায়। বৌধ, ফুলবানী, দশপাল্লা ইত্যাদি জায়গাতে।
ঋজুদার উপরে সকলেরই যেমন ডিম্যান্ড দেখছি তাতে মনে হচ্ছে এ-যাত্রা আমাদের ফ্যামিলিয়ারাইজেশান ট্যুরের এখানেই ইতি। তিতির সখেদে বলল।
ফুটুদারা এসেই বললেন, চান করতে ঢুকছি। সারাদিন গাড়িতে একেবারে ঝলসে গেছি।
সারাদিন মানে?
ওই হল। কটক থেকে বেরিয়েছিলাম খাওয়া-দাওয়ার পর। দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর গরম আরও বেশি লাগে। এই কথা বলেই ফুটুদা বাথরুমে চলে গেলেন।
এবিকাকুও অন্য বাথরুমে।
ফুটুদার পাখির আহার। তবে এবিকাকু ঋজুদার সঙ্গে সমানে সমানে পাল্লা দিয়ে খেতে পারেন, যখন খান। আর পদেরই বা কী রকমারি!
দুর্গাদা আর রাজেনদা মালপত্র সব নামিয়ে-টামিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে নিল কুয়োতলায়, তারপর বারান্দায় এল।
ঋজুদা বলল, চা-টা খেয়ে তারপরেই এসো। তারপরে শুনব। তোমাদের কাহিনী তো আর ছোট হবে না।
ওরা চলে গেলে ঋজুদা বলল, মুখ-চোখ দেখে মনে হল, এখানের ক্যাম্প তুলে আমাদের লবঙ্গিতেই যেতে হবে কাল-পরশু।
কী করে বুঝলে?
বুঝলাম। অনেক বছরের সঙ্গী এরা। কিছু তো বুঝব মুখ-চোখ দেখে।
ভটকাই বলল, হতি কী যে মারে লোকে! অত বড় জানোয়ার। তাকে মারতে আর বাহাদুরি কী? ওর চেয়ে তো স্নাইপ মারা সোজা।
ঋজুদাকে এমন করে বলল ও, তাতে আমি বললাম, ফ্লুক-এ একটা বাঘ মেরে দিয়ে তোর বোলচাল খুব বেশি হয়েছে।
ঋজুদা বলল, ‘হাতি রোগ’ হয়ে গেলে তার মতো সাঙ্ঘাতিক জানোয়ার খুব কমই হয়। এ তো দলের হাতির নয় যে, ধীরেসুস্থে ভাল ট্রফি দেখে ভাল করে এইম নিয়ে নিজে অ্যাডভান্টেজাস্ পজিশন বেছে নিয়ে ভাইটাল জায়গা দেখে গুলি করলি আর পড়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে অন্যান্যরা হুড়মুড় করে পালিয়ে গেল। রোগ হাতিকে তোর খুঁজতে হবে না। সেই তোকে খুঁজে বের করবে। অতবড় জানোয়ার চড়াই-উতরাই সব জায়গাতে যে কী জোরে, দৌড়তে পারে আর কতখানি নিস্তব্ধ হয়ে নিঃসাড়ে জঙ্গলের মধ্যে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, অনড় শুড়টি চকিতে বিদ্যুৎচমকের মতো নেমে এসে কখন যে কার ভবলীলা শেষ করে দেবে তা যার অভিজ্ঞতা নেই সে বুঝতেও পারবে না। হাতি-শিকার সকলের পক্ষে সহজ নয়। হাতি সম্বন্ধে জ্ঞানও বেশি লোকের নেই।
আমি বললাম, ঋজুদা, লালজির কথা বলো। ওরা তো জানে না।
অসমের গৌরীপুরের ছোটকুমার লালজির সমস্ত জীবনই কেটেছিলো হাতিদেরই সঙ্গে। গত মার্চ মাসে উনি মারা গেলেন। ওঁর মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে একটি জ্ঞানভাণ্ডারও মুছে গেল। অথচ আমাদের এমনই পোড়া দেশ যে, ওঁকে নিয়ে কোনও ডকুমেন্টারি ছবি অথবা একটি টেলিফিল্মও হল না। ভাবলেও দুঃখ লাগে। আর কত হাজার মিটার ফিল্ম যে প্রতিদিন ফালতু নেতাদের ছবি তুলে খরচ হচ্ছে!
নাম কী ছিল ওঁর?
ভাল নাম প্রকৃতীশচন্দ্র বড়ুয়া। ডাক নাম লালজি। হাতি মারতেন না উনি। হাতি ধরতেন। হাতি খেদিয়ে বেড়াতেন। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের প্রথম দিকের, সাইলেন্ট পিকচারের সময় থেকেই; একজন দিকপাল ছিলেন প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়া; তাঁরই ছোট ভাই হলেন লালজি।
তাই? ভটকাই বলল।
কলকাতায়ও কয়েকজন ভাল হাতি-শিকারি আছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ও আছে। যেমন, ধূতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরি, জর্জ ট্র এবং চঞ্চল সরকারের। চঞ্চলের সঙ্গে রঞ্জিতও যায়। চঞ্চল যত রোগ হাতি মেরেছে, তত খুব কম শিকারিই মেরেছেন। ওর বাড়িতে একদিন নিয়ে যাব তোদের। এলিয়ট রোডে থাকে। হাতির দাঁত আর পায়ের কালেকশান দেখে অবাক হয়ে যাবি। চঞ্চল ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের বড় ঠিকাদার। ধূতিকান্তবাবু অধ্যাপক, বরেন্দ্রভূমের নামী জমিদার বংশের ছেলে। চেহারাটিও চমৎকার। আর জর্জ ট্রব হল নামকরা ডেনটিস্ট। ওর বাবার পসার পেয়েছে ও। বাবা ছিলেন অসমের চা-বাগানগুলোর ডেনটিস্ট। এক বাগান থেকে অন্য বাগানে তখনকার দিনে মোষের গাড়িতে করে ঘুরে-ঘুরে রোগী দেখতেন। জর্জ শিশুকাল থেকেই বাবার সঙ্গে ঘুরে-ঘুরে শিকারি হয়েছিল।
ওঁদের মধ্যে ডাকবে নাকি কাউকে?
যদি তেমন দেখি, আমার দ্বারা যদি এই হাতি মারা না হয়, তবে ওঁদেরই কাউকে খবর পাঠাতে হবে শেষ পর্যন্ত।
তিতির বলল, তুমি যদি হাতির পেছনেই ঘুরে বেড়াও তা হলে আমাদের তো এ-যাত্ৰা মহানদীর দুপাশের জঙ্গল দেখাই হবে না। পনেরো দিনের জন্যে আসা, তার মধ্যে তো চারদিন চলেই গেল।
দেখি। তিনদিন সময় দেব। না পারলে, আমরা চলে যাব, ওঁদেরই কাউকে আসবার জন্যে নিমন্ত্রণ জানাতে বলব অঙ্গুলের ডি. এফ. ও. সাহেবকে, এবং ডিভিশনাল কমিশনারকেও।
রোগ হয়ে যাওয়া মানে কী ঋজুদা? এ কি কোনও রোগ? ভটকাই শুধোল।
ঋজুদা হেসে উঠল ভটকাইয়ের কথা শুনে।
আমরাও হাসলাম।
তিতির বলল, না হে বোকামশায়। রোগ মানে গুণ্ডা। শুধু হাতিই নয়, যে-সমস্ত জানোয়ার যূথবদ্ধ, মানে দলে থাকে, তাদের প্রত্যেক দলে একজন করে সর্দার থাকেই। হাতি, গাউর (ইন্ডিয়ান বাইসন), শম্বর, বারাশিঙা, চিতল ইত্যাদি জানোয়ারেরা দলে থাকে। যা বললাম, তাদের প্রত্যেক দলে একজন করে সর্দার থাকে। সর্দার সবসময়েই পুরুষ হয়। মানুষের মধ্যে অবশ্য মেয়েরাও হতে পারেন, যেমন ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন। সে-কথা ভাবলে মনে হয়, জানোয়ার না হয়ে মানুষ হওয়াতে খুব বেঁচে গেছি। যাই হোক, দলে যখন কোনও উঠতি যুবক বলশালী হয়ে ওঠে, তখন দলের সদারি নিয়ে সদারের সঙ্গে তার খিটিমিটি লাগে। তারপর একদিন এক চূড়ান্ত লড়াই বা ডুয়েল হয় তাদের মধ্যে।
একদিন বলিস না তিতির। ঋজুদা বলল।
ঠিক বলেছ। ওই লড়াই একদিন আরম্ভ হয় ঠিকই, কিন্তু তা যে একদিনেই শেষ হয় এমন নয়। কখনও কখনও চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। কখনও সর্দার জেতে, কখনও বা উঠতি-সর্দার। কখনও লড়াই শেষ হয় অন্য পক্ষের মৃত্যুতে। এক পক্ষ মরে গেলে ঝামেলা চুকে যায়। কিন্তু যখন এক পক্ষ অন্য পক্ষের কাছে সেই সাঙ্ঘাতিক লড়াইয়ে হেরে গিয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েও বেঁচে যায়, তখনই বিপদের সূত্রপাত হয়। সে শরীরের ক্ষত নিয়ে, মনের জ্বালা নিয়ে, জঙ্গলের গভীরে গিয়ে, প্রথমে বিশ্রাম নিয়ে তার ক্ষতগুলি সারিয়ে নিতে চায়। সুস্থ হয়ে গেলেও অনেক সময়ই সম্পূর্ণ সুস্থ হয় না। তবে কোনও-কোনও সময় হয়ও। কিন্তু সে যে দল-তাড়িত, অপমানিত সেই অপমান ও গ্লানির কথা সে কোনও সময়েই মন থেকে মুছতে পারে না। তখন অনেক সময় ক্ষতবিক্ষত অবস্থাতেই মানুষের বা গোরু-মোষের বা যানবাহনের কাছাকাছি এলে সে সঙ্গে-সঙ্গে আক্রমণ করে। মানুষকে মেরে ফেলে।
হাতির কবলে পড়ে যাদের মৃত্যু হয়, বাঘ বা ভাল্লুকের হাতে মৃত্যুর চেয়েও তা বীভৎস। হাতি মানুষকে তালগোল পাকিয়ে দেয়। মুখ ঢুকে যায়, হাত-পা ঢুকে যায় পেটের মধ্যে। কখনও খুঁড়ে জড়িয়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে দেয়। কখনও-বা আছাড় মারে। তারপর পা দিয়ে থেঁতলে থেঁতলে রাগ মেটায়। মানুষের বাসস্থান চালাঘর ভেঙে তছনছ করে দেয়। ছাদ-চাপা পড়ে মরে মানুষ। গোরু-মোষের অবস্থাও সেরকমই করে। জিপগাড়ি বা গাড়ি ধাক্কা মেরে খাদে ফেলে দেয় বা দুমড়েমুচড়ে তাদের, তোমার ভাষায় বলতে গেলে, জিওগ্রাফিও পালটে দেয়। বাস বা ট্রাকও গুণ্ডা হাতির সামনে পড়ে গেলে রেহাই পায় না। মানুষখেকো বাঘের হাত থেকে না হয় শক্তপোক্ত ঘরের দরজা বন্ধ করে বাঁচা যায় কিন্তু হাতির বাসস্থান যেরকম জঙ্গল-পাহাড়ঘেরা এলাকাতে হয়, তা ভারতের বা আফ্রিকারও যে-কোনও অঞ্চলেই হোক না কেন; পাকা বাড়ি প্রায় কোথাও থাকে না। সেইসব গ্রামঞ্চলের বাড়ি নামেই বাড়ি। তাই হাতির হাত থেকে ঘরে থেকেও তাদের বাঁচার উপায় থাকে না।
দিন রাতের কোন সময় যে কোন গ্রামে গুণ্ডা উপস্থিত হবে, তাও আগে থেকে বলা যায় না। রোগ হাতির আতঙ্ক সাঙ্ঘাতিক আতঙ্ক। তা ছাড়া, বাঘ-ভাল্লুককে গ্রামের লোকেরা যথেষ্ট সাহসী বলে বিষমাখানো তীর বা বল্লম দিয়ে মারলেও মারতে পারে, কিন্তু হাতির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে পারে এমন কোনও অস্ত্রই ওদের নেই। রাতের বেলা হলে হাতিকে আগুন দেখিয়ে ভয় দেখায়। কিন্তু যে হাতি রোগ হয়ে গেছে, তার মনে এত জ্বালা-যন্ত্রণা থাকে যে, তার মৃত্যুভয়ও লোপ পেয়ে যায়।
ঋজুদা তিতিরকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তোদের মনে আছে তিতির, সিমলিপালের জেনাবিল বাংলোর সামনে তিন-চারশো গজ দূরে একটি হাতির কঙ্কাল পড়ে থাকতে দেখেছিলাম আমরা?
আমি আর তিতির একসঙ্গে বলে উঠলাম মনে আছে।
তা হলে তোদের এও মনে আছে যে, জেনাবিল বস্তির লোকেরা বলেছিল যে, কোনও দলের সর্দার আর উঠতি-সদারের মধ্যে লড়াইয়ের ফয়সালা হয়েছিল ওখানে।
হ্যাঁ, বলেছিল। তিতির বলল।
হাতিদের খুব বুদ্ধি হয়, না? ভটকাই শুধোল।
হাতির বুদ্ধির নানারকম গল্প শোনা যায়। সত্যিই বুদ্ধিমান প্রাণী হাতি। লালজিকেও আমি এই প্রশ্ন করেছিলাম।
কোথায়?
তখন উনি উত্তরবাংলার গোরুমারা অভয়ারণ্যের কাছে মূর্তি নদীর পাশে তাঁর একটি গণেশ এবং একটি মাকনা হাতি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুরোধে ক্যাম্প করেছিলেন বুনো হাতি খেদিয়ে দেবার কড়ার নিয়ে।
কী বলেছিলেন লালজি? আমি শুধোলাম।
ঋজুদা হেসে বলল, লালজি বলেছিলেন, হাতির যদি এতোই বুদ্ধি থাকত, তা হলে সে তো ডি. এফ. ও-ই হত।
আমরা সবাই হেসে উঠলাম ওই কথাতে।
এমন সময় দুর্গাদা আর রাজেনদা বারান্দায় এসে উঠল। ওদের পায়ের তলাটা কর্কশ হয়ে গেছে শিশুকাল থেকে শীত-গ্রীষ্ম পাহাড়-জঙ্গলে হেঁটে-হেঁটে। সিমেন্ট-বাঁধানো বারান্দায় খসস খসস শব্দ হল কর্কশ পায়ের।
ঋজুদা বলল, দুর্গা, এই হ্যারিকেনটা ভিতরে নিয়ে যাও তো। আজ শুক্লানবমী। চাঁদটা কী দারুণ উঠেছে পাহাড়ের রেখা আর ঘন বনকে আলো করে। এই ব্যারিকেনের আলো চোখের উপর পড়াতে তা দেখা পর্যন্ত যাচ্ছে না।
রাজেন বিড়বিড় করে বলল, এটি সাপপ অচ্ছি গণ্ডা গণ্ডারে।
কঁড় সাপপ? ঋজুদা বলল।
কঁড় সাপপ নাহি আইজ্ঞা? তম্প সাপপ অছি জুড়ে।
মানে, কী সাপ নেই তাই বলুন। একজোড়া শঙ্খচূড় সাপও আছে।
ঋজুদা বলল, হউ! সাপ মানে আচ্ছি তাংকু মনেরে, মত্বে কাঁই কাটিবাকু আসিবি সে? নেই যা দুর্গা, সে বত্তিটা।
মানে হল, হোক। সাপেরা আছে তাদের মনে, খামোখা আমাকে কামড়াতে আসবে কেন? বাতিটা নিয়ে যা দুর্গা।
বাতি নিয়ে যাওয়ার পর শুক্লানবমীর রাত যেমন স্পষ্ট উজ্জ্বল হল, নির্জনতাও যেন বেড়ে গেল অনেক। কলকাতায় লোডশেডিং হয়ে গেলেই নির্জন হয়ে যায় শহর। সেটা অবশ্য লক্ষ লক্ষ ফ্যান আর হাজার এয়ারকন্ডিশনারের শব্দ বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্যও হতে পারে। কিন্তু আলোর সঙ্গে শব্দের কোনও আপেক্ষিক সম্পর্ক আছে কি নেই এ নিয়ে গবেষণা হওয়া বোধহয় দরকার। সম্পুর্ক যে আছে এই কথা কোনওদিন কোনও বিজ্ঞানী হয়তো প্রমাণও করবেন। কে জানে!
ঋজুদা বলল, কঁড় দেখিলি দ্বিজ-জনে লবঙ্গি যাইকি, ক। শুনিবি।
গলা খাঁকরে নিয়ে দুর্গাদা আর রাজেনদা একসঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করল।
আরে! পিলেমানে কোরাস গীত ধরি পাইলু যে!
ঋজুদা হেসে বলল।
রাজেনদা একটু লাজুক প্রকৃতির। সে বলল দুর্গাদাকে, তু সববে ফ্যাকটো তাংকু কহি দে।
ফ্যাকটো শব্দটি ইংরেজি। রাজেনদারা কথায় কথায় ফ্যাকটো শব্দটি ব্যবহার করে।
দুর্গাদা যা বলল, তা শুনেই তো নাড়ি ছেড়ে যাবার যোগাড়।
হাতিটা নাকি ধোপ যেমন পুকুরের পাটে ধাঁই-ধপাধপ করে কাপড় কাচে, তেমনই করে লোকজন গাইবলদ শুড় জড়িয়ে তুলছে আর কাঁচছে।
একটার পর একটা ঘটনা বলছে দুর্গাদা তার ঠাণ্ডা একঘেয়ে গলাতে আর আমরাও তা শুনে ঠাণ্ডা মেরে যাচ্ছি।
সব শুনেটুনে ঋজুদা শুধোল, পায়ের ছাপ দেখলে কোথাও?
হ্যাঁ। মাঠিয়াকুদু নালাতে দেখলাম। হাতিটা, মনে হয়, দিনের বেলা ওই নালার কাছের গভীর জঙ্গলে থাকে। সন্ধের পর উঠে আসে ফরেস্ট রোড ধরেই লবঙ্গির আশপাশের গ্রামে। লবঙ্গিতেও।
কী কী গাছ আছে নালার কাছে? ঋজুদা শুধোল।
প্রাচীন সব জংলি আম, গেণ্ডুলি, নিম, বয়ের; শিমুল আর নানারকম জ্বালকাঠ।
জ্বালকাঠ মানে যেসব গাছ চেলাকাঠ করে উনুনে জ্বালাবার জন্য ব্যবহার হয়। হরজাই গাছও বোঝায়, জ্বালকাঠ কথাটাতে। মানে উল্লেখযোগ্য বা দামি যা নয়, তাই জ্বালকাঠ।
কত বড় হাতি?
ও বাপ্পালো বাপ্পা। সে ষড়া তো গুট্টে ঐরাবত হেলা।
ওরা দুজনে সমস্বরে বলে উঠল।
দুর্গাদা বলল, গোদা হাতিটা, টুকার জঙ্গলে যে দল ছিল, তারই পুরনো সর্দারটা হবে। বয়সও হবে কম করে ষাট। তাকে তো আমরা পিলাবেলে অর্থাৎ শিশুকাল থেকে দেখে আসছি।
ঋজুদা বলল, তা হলে বল-বুদ্ধিতেই শুধু আমাদের চেয়ে বড় নয় সে, বয়সেও বড় বোঝা যাচ্ছে। তাকে গোদাদাদা বলেই ডাকা হবে তা হলে।
বড্ড ভয় ধরিলানি ঋজুবাবু। মো, পুও-ঝিও সব্ব সেঠি অছি। কোনদিন্থ সেমানংকু মারি সারিবে সে ষড়া হাতি তার কিছি ঠিক অছি কি?
দুর্গা মহান্তির বাড়ি পম্পাশরে। পম্পাশর হয়েই লবঙ্গি যেতে হয়। সেখানে একটি ছোট্ট চালাঘরে দুর্গার বউ আর ছেলেমেয়েরা থাকে। আমি গিয়েছিলাম একবার শীতকালে অষ্ঠমী পুজোর সময়ে। গুলগুলা আর এণ্ডুলি পিঠে খাওয়ার উৎসব ছিল ওদের তখন। ওদের বাড়ির সামনে কন্দমূলের খেত ছিল সেই সময়টিতে। মনে আছে। সত্যিই অমন নিরাপত্তাহীন বাড়িতে বউ-বাচ্চাদের একা রাখলে ভয় হওয়া তো স্বাভাবিকই।
তিতির শুধোল, কন্দমূল মানে কী, ঋজুদা?
কন্দমূল মানে হল গিয়ে, আরে কী যেন বলে, কী যেন বলি আমরা বাংলাতে, বল না রুদ্র, ও, মনে পড়েছে, রাঙা আলু।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, আমাদের দেশের বন-পাহাড়ের মানুষেরা বছরের বেশিটা সময় এমন মূল আর ফল খেয়েই তো বেঁচে থাকে। পালাতে খায় কান্দা-গেঠি। গরমের দিনে কী কষ্ট করে ভালুক, শুয়োর আর শজারুদের সঙ্গে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তারা সেই মূল খুঁড়ে বের করে! কিন্তু গেঠি এতই তেতো হয় যে, ঝুড়ি ভরে তা সারারাত ঝরনার স্রোতের বা প্রপাতের নীচে রেখে দেয় ওরা। তাতেও তেতো ভাব তেমন কমে না। তারপর কোনওক্রমে খায় অন্য কিছুর সঙ্গে মিশিয়ে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
দুর্গাদারাও কোনও কথা বলছে না।
ঋজুদা বলল, এখানেও আমি এমন অনেক মানুষ দেখেছি যাদের গায়ের চামড়া সাপের চামড়ার মতো উঠে যায় চৈত-বৈশাখ মাসে।
কেন? কেন? তিতির আর ভটকাই শুধোল।
তিতির এ-অঞ্চলে আগে আসেনি, তাই ওদের অজ্ঞতা উৎসাহকেই চাগিয়ে দিচ্ছে বারবার।
কারণ, তারা এতই গরিব যে, পুরো বছর একটি গামছাকে দুভাগ করে পরে আর গায়ে দেয়। ছিঁড়ে গেলে অবশ্য বছর শেষ হওয়ার আগেই আর-একখানা কেনে। ওড়িশার গামছা অবশ্য খুব বড়-বড় হয়। তবে পাতলা তো বটেই।
গায়ের চামড়া উঠে যায় কেন? তিতির আবার শুধোল।
শীতের সময় ঘরের মধ্যে আগুন করে আগুনের দিকে বুক করে শোয়। প্রথম রাতে, তারপর অসহ্য হয়ে গেলে আগুনের দিকে পিঠ দিয়ে শোয়। এমনি করে-করেই রোস্টেড হয়ে যায় শীতের শেষে। ফাঙ্গুন-চৈত্র মাসে তাদের সেই পুড়ে-যাওয়া চামড়া পরতের পর পরত উঠে যায়।
সত্যি ঋজুকাকা? ভটকাই বলল, অবিশ্বাসী গলায়।
সত্যি রে। এই আমাদের আসল দেশ। কলকাতা নয়, নতুন দিল্লি বা চণ্ডীগড়ও নয়। ফ্লাইওভার আর পাতাল রেল আর ফোয়ারা নয়। যেদিন আমাদের দেশের এই সাধারণ, ভাল, গ্রামীণ মানুষরা দৃবেলা খেতে পাবে, ভদ্রভাবে পোশাক পরে থাকতে পারবে, শীতে কষ্ট পাবে না, গরমে খাবার জল আর চাষের জল পাবে, সেদিনই জানবি যে আমাদের দেশের কিছু হল।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, তোদের আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি এই গরমে শুধু মহানদীর দুপারের ভয়াবহ ও সুন্দর সব পাহাড়-জঙ্গল দেখাবার জন্যই নয়, নিয়ে এসেছি আমাদের দেশকেও দেখাতে। কীভাবে সাধারণ মানুষেরা থাকে, কী পরে, কী খায়? মানুষকে বাদ দিলে প্রকৃতির কোনও ভূমিকাই থাকে না।
ভটকাই বলল, আরও বলো।
আমাকে আমার ছেলেবেলায় যখন প্রথম ক্যামেরা কিনে দেন আমার বাবা, তখন কোডারমার জঙ্গলে গিয়ে অনেকগুলো ছবি তুলি। বাবা ফোটোগুলি দেখে বলেছিলেন, শুধুই প্রকৃতি, বিষয় হিসেবে বড় একঘেয়ে, ম্যাড়ম্যাড়ে। প্রকৃতির পটভূমিতে মানুষ যদি না থাকে, নিদেনপক্ষে অন্য কোনও প্রাণীও; তা হলে অন্য মানুষের চোখে তার দাম কমে যায়, প্রকৃতির বিরাটত্বকে অনুভব করতে অসুবিধে হয়। আজকে এতদিন পরে বুঝি, বাবা কী বোঝাতে চেয়েছিলেন ন বছর বয়সী আমাকে।
ঋজুদা থেমে যেতেই আমরাও সবাই চুপ করে গেলাম।
চাঁদটা আরও অনেকখানি উপরে উঠেছে। দুটি পিউ-কাঁহা বা ব্রেইন-ফিভার পাখি পাগলের মতো ডেকে চলেছে বাংলোর দুপাশ থেকে। আবার একবার হাতির দলের বৃংহণের আওয়াজ শোনা গেল। ওরা বোধহয় জলে যাচ্ছে। অথবা জলের মধ্যেই রয়েছে। জল খাচ্ছে, শুড় দিয়ে একে অন্যকে চান করাচ্ছে, বাচ্চাদের ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করছে।
দুর্গাদা বলল, কঁড় করিবে বাবু? যিব্বেনি সিয়াড়ে? সে মানে বড্ড কান্দা কাটা করিলা। সে হাতিটাকু নাশ না করিলে সে কাশ্ম সারিবে। পোশর আউ লবঙ্গি গাঁয়েরে আউ বাঁচিবা হেব্বনি।
রাজেনদা হাঁটুর উপরে ধুতি তুলে দুহাঁটু ভাঁজ করে দুহাঁটুর উপরে দুহাতের কনুই রেখে দুহাতের পাতার উপর মুখ রেখে বসে ছিল বারান্দায়। সে হঠাৎ মুখ তুলে বলল, দুর্গা যা কহিলা বাবু তা সত্য। কিছি বন্দোবস্ত করি না পারিলে আউ বাঁচা হেব্বনি সে গাঁ-দ্বিটার ঝিও-পুওংকু।
মু কঁড় করিবি, ক। ঋজুদা অনেকক্ষণ পর পাইপটা তুলে নিয়ে আগুন ধরিয়ে বলল।
ডান-হিল তামাকের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে গেল বারান্দাময়। গ্রীষ্মবনের গা থেকে যে একটা গোড়া-পোড়া ঝাঁঝালো গন্ধ বের হয়, অথচ যে গন্ধটা উত্তরবঙ্গে বা অসমে, বা সুন্দরবনে বা বিহারে বা ওড়িশায় বা মধ্যপ্রদেশে একটু আলাদা-আলাদা, সেই গন্ধের সঙ্গে মিশে গেল টোব্যাকোর গন্ধ।
কালই যীবী। জিপ ধরিকি। কঁড় কহিচ্ছন্তি তমমানে? ঋজুদা শুধোল।
আউ কহিবি কঁড়? নিশ্চয় যীবা-হেব্ব।
ওরা দুজনে সমস্বরে বলল।
লবঙ্গি ফরেস্ট বাংলোরে আম্মেমানে রহিবি আউ সারা দিনমান জঙ্গলরে বুলিবুলিকি চালিবি সে হাতি পাঁই।
কেত্তেদিন রহিবে সেটি? রাজেনদা শুধোল।
মু তম্বে কহি দেলু সর্বসমেত কেবন্ধু তিনদিন মু রহিপারিবি সেট্টি। ঈ পিলামানংকু ঈ প্রচণ্ড গরম মধ্যে কলকাতাটু নেই কি আসিলি, সেমানংকু কোহ উঠিবে।
হেব্ব। হেব্ব। ঠাকুরানির দয়া হেন্ধে তিনদিনই যথেষ্ট আইজ্ঞা। শুনন্ত ঋজুবাবু, তস্বপরু সে গাঁ-দ্বিটার সব্বে মানুষংকু পূর্ণ বিশ্বাস অচ্ছি। তমকু দেব পাঁই সব্বে মানিছি। তমকু যীবা হব নিশ্চয়ই।
যীবী। কঁহিলু তো যীবী বলিকি কাল সক্কালবেলে। আউ কাঁই পাট্টি করিচি। বুঝিলু। এব্বে তমমানে যাইকি গা-ধেইকি খাই-পীকি শুই পড়। কাল সক্কালবেলে মত্বে উঠাইবি।
হ আইজ্ঞা। এব্বে চালিলি।
ওরা চলে গেলে ঋজুদাকে একটু চিন্তান্বিত দেখাল। যা কথাবার্তা হল ঋজুদা আর ওদের মধ্যে আন্দাজে কিছুটা তিতির আর ভটকাইও বুঝেছিল। ওড়িয়া বড় মিষ্টি ভাষা, ওড়িয়া মানুষদেরই মতো।
যা ভেবেছিলাম, ভটকাই বলল, পাঁই, পিলামানংকু, ঠাকুরানি আর গা-ধেইকি শব্দগুলোর মানে বুঝলাম না ঋজুদা। অন্যগুলোর মানে আন্দাজে বুঝে নিয়েছি। ওড়িয়া আর বাংলাতে তফাত বিশেষ নেই!
না নেই। তবে যে-কোনও ভাষা বলতে হলে গান গাইবারই মতো কান চাই। যার কান যত ভাল, সে তত তাড়াতাড়ি অন্য ভাষা সেই ভাষাভাষীদের মতো বলতে পারে।
মানেগুলো বললে না শব্দগুলোর?
হ্যাঁ। পাঁই মানে জন্য। ইংরেজি, ফর। পিলামানংকু মানে ছেলেদের বা ছেলেমেয়েদের বা তাদের জন্য। ঠাকুরানি হচ্ছেন অরণ্যদেবী। গা-ধেইকি মানে চান করে।
একটু যত্ন করে শুনবি, তা হলেই শিখে নিতে পারবি, অন্তত বলবার মতো।
তারপর বলল, সরি, তিতির আর ভটকাই, তোমাদের এই বাঘ্যমুণ্ডাতেই থাকতে হবে তিনদিন। আমরা ফিরে এলে তারপর সকলে মিলে রওনা হওয়া যাবে। টুকাতে দুদিন, পুরানাকোটে একদিন, টিকরপাড়ায় একদিন, দুদিন দুদিন করে বৌধে আর ফুলবানীতে, তারপর দশপাল্লার কাছে টাকা গ্রামে একদিন, তারপর ওইদিক দিয়ে ফিরে কটুক হয়ে কলকাতা। মহানদী, তোদের বড়সিলিডার আশ্চর্য সুন্দর জঙ্গলও দেখিয়ে আনব। মন ভরে যাবে। দেখিস।
আমরা কি সত্যিই যেতে পারি না তোমাদের সঙ্গে? রোগ এলিফ্যান্টের খোঁজে?
তিতির বলল অনুনয় করে।
না তিতির। লবঙ্গির যে-ফরেস্ট বাংলো সেটি বাঘ্যমুণ্ডার মতো এইরকম হলে তোদের নিশ্চয়ই নিয়ে যেতাম। কোনও কথাই ছিল না। লবঙ্গির ফরেস্ট বাংলো খড়ের চালের গোল একটি ঘর। শীত-গ্রীষ্মের হাত থেকে বাঁচার জন্য গোল করে উলটানো বাটির মতো করে তৈরি। দেখে মনে হয়, আফ্রিকার কোনও উপজাতিদের বাড়ি। সেই বাংলোয় এত লোকের থাকাও অসুবিধেজনক হবে। দুর্গা, রাজেন, আমি আর রুদ্রই যাই। তোদের জন্য গাড়ি থাকবে। ফুটুদা আর এবিকাকুও থাকবেন। টিকরপাড়ায় কুমির বাড়ানোর জন্য যে প্রকল্প হচ্ছে, তাও দেখে আসতে পারবি। আমরা যখন এসব অঞ্চলে শিকার করেছি পঞ্চাশের দশকে এবং ষাটের দশকের গোড়ার দিকে তখন এসব কিছুই হয়নি। তিনটে দিন। দেখতে-দেখতেই তোদের সময় কেটে যাবে। আর এবিকাকু ফুটুদা যখন সঙ্গে রয়েছেন, তখন খাওয়া-দাওয়ার কোনও কষ্টের কথা তো ভাবাই যায় না। বরং খেয়েই কষ্ট পাবি। এবিকাকু তো মিস্টার আর-একটু খান প্রশান্তকাকুরই ভাই। লাইক ব্রাদার, লাইক ব্রাদার। বুঝলি না!
ঋজুদার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হতেই বারান্দায় আবার নিস্তদ্ধতা নেমে এল।
গ্রীষ্মবনে এখন শুক্লানবমীর চাঁদ পুরো আধিপত্য বিস্তার করেছে। দূরে জঙ্গলের সীমানা আর ঝটিজঙ্গলের মধ্যে ডিড-ড্য-ডু-ইট, ডিড-ড্য-ডু-ইট করে ডেকে ফিরছে একজোড়া পাখি। পাহাড়, প্রান্তর, বন এবং ওই রাতপাখির ডাকের উপর চাঁদের যে প্রভাব তাতে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে, ভন্টুদা এই মুহূর্তে আমেরিকায় চাঁদের মাটি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে করেছে এবং করবে। বিজ্ঞান বোধহয় বড়ই বেশি কৌতূহলী। এর চেয়ে একটু কম হলেও বোধহয় এই পৃথিবীর এবং পৃথিবীর যারা বাসিন্দা, তাদের ক্ষতি হত না কোনওই। কিন্তু এই কৌতূহল আর জিজ্ঞাসাই অবশ্য যুগ যুগ ধরে মানুষকে ছুটিয়ে নিয়ে গেছে এক দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্তে। এ না থাকলেও মানুষের মস্তিষ্কে হয়তো মরচে ধরে যেত। দৌড়ে চলার আর-এক নামই জীবন। সামনে কী আছে? জানার বাইরে কী আছে? তাকে জানার চেষ্টা আর বেঁচে থাকা আজকের আধুনিক মানুষের কাছে সমার্থক।
হঠাৎ গমগমে গলায় ঋজুদা বলল, তুই আড্ডা না মেরে, এবারে যা রুদ্র। রাইফেল দুটো ঠিকঠাক করে নে। কাল অত ভোরে বেরোব। সময় পাওয়া যাবে না।
কোনটা-কোনটা দেব? আমি শুধালাম।
ফোর-সেভেনটি-ফইভ ডাবল ব্যারেলটা, আর ফোর-ফিফটি ফোর-হান্ড্রেড ডাব ব্যারেলটা, আর গুলি। বেশির দরকার নেই। পাঁচ রাউন্ড করে নে। হার্ড নোজড।
হার্ড-নোজড নেব? সক্ট-নোজড নয়? না। হাতির বেলা আমি হার্ড-নোজড দিয়ে মারাই পছন্দ করি। যদিও অনেকে সক্ট-নোজই পছন্দ করেন?
এ-গুলিগুলো ফুটবে তো? নিনিকুমারীর বাঘের বেলা যেমন হয়েছিল, তেমন হবে না তো?
এবারে তো ইস্ট ইন্ডিয়া আর্মস কোম্পানির এবিকাকু, অর্থাৎ অনন্ত বিশ্বাসবাবু খোদ হাজিরই আছেন, এবারে ওঁকে ধরব না সঙ্গে-সঙ্গে।
তা তো ধরবে। কিন্তু নিনিকুমারীর বাঘের মতো হাতিও যদি ঠাকুরানির হাতি হয়।
ঋজুদা বলল, বলিস না, বলিস না। এক ঠাকুরানির বাঘেই অনেক মহাত্ম দেখিয়েছেন ঠাকুরানি। হাতজোড় করছি তাঁর কাছে। আর দেখতে চাই না।
.
ভোর চারটেতে দুর্গাদা আর রাজেনদা চানটান করে তৈরি হয়ে আমাদের দুজনকেই ডেকে দিল। তখনও পুবের আকাশ ভাল ফরসা হয়নি।
ভটকাই পাশ ফিরে শুয়ে বলল, জ্বালালি। আমাকে না নিয়ে কেমন কী হয় দেখা যাবে।
বলেই, আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
আকাশে এখনও চাঁদ আছে। আমরা চান করে রাক্-স্যাকে অলিভ গ্রিন রঙের ট্রাউজার আর হাওয়াইন শার্টস-এর একটি করে চেঞ্জ, টর্চ এবং কটি বিস্কিটের প্যাকেট নিয়ে নিলাম।
এবিকাকু একটি মস্ত ঝুড়িতে আমাদের চারজনের জন্য তিনদিনের মতো কাঁচা রসদ, মায়-চাউচিনি পর্যন্ত গুছিয়ে দিয়েছিলেন। গত রাতে ফেয়ারওয়েল ডিনার এমনই হয়েছিল যে, দুপুরের আগে আমাদের দুজনের কারও খিদে পাবে বলে মনে হয় না। এবিকাকু নিজে দাঁড়িয়ে তত্ত্বাবধান করে কালকে রাঁধিয়েছিলেন। পোলাউ, মুরগির মাংস, টাটকা রুই মাছ ভাজা, স্যালাড এবং ঢেঙ্কানল থেকে আনা পোড়া-পিঠা। তবু এক কাপ করে চা এবং একটি করে ডিমের পোচ খেতেই হল, চান করার পর, বেরোবার আগে, এবিকাকুর পীড়াপীড়িতে।
জিপে যখন বসলাম গিয়ে, তখন পুবের আকাশ ফরসা হয়েছে। সমস্ত বন জেগে উঠেছে। আমাদের সি-অফ করার জন্য ফুটুদা, এবিকাকু, তিতির, ভটকাই এবং বাংলোর সমুদয় খিদমদগার জিপ অবধি এলেন।
গুড লাক বলল মিস্টার ভটকাই। মনে-মনে ব্যাড লাক উইশ করে।
তিতির বলল, রুদ্র, কিপ ইওর কুল।
এবিকাকু বললেন, হাতি তো খাওয়া যায় না, এই হৃতির মাংস আনতে বলছি না। দাঁত দুটো তো তোমাদেরই হবে। ভাল করে কেটে এনো। আর পা চারটেও গোড়ালির উপর থেকে। আমার অনেক দিনের শখ হাতির গোদা পায়ের মোড়ায় বসে লুঙ্গি পরে মুড়ি আর বাগবাজারের তেলেভাজা খাব।
ফুটুদা অতিশয় স্বল্পভাষী। মনের মধ্যে হাজার কথা কিলবিল করলে মুখ ফুটে একটা-দুটো কষ্টেসৃষ্টে বেরোয়। চোখ দুটোই বলে, যতটুকু বলার। বললেন, আচ্ছা, তা হলে..
স্টিয়ারিং-এ আমিই বসে ছিলাম। পাশে ঋজুদা। মুখে সদ্য-ধরানো পাইপ নিয়ে। রাইফেল দুটি বাক্স বন্ধ করা আছে। সেগুলো ও অন্যান্য মালপত্রসমেত পেছনে বসেছে দুর্গাদা আর রাজেনদা।
পুরানাকোটের দিকে জিপ চলেছে। বৈশাখের ভোরের হাওয়া ভারী মিষ্টি লাগে।
জঙ্গল এখনও ঠাণ্ডাই আছে। তা ছাড়া, ঘন সেগুন বনের মধ্যে দিয়ে পথ। বৈশাখের ঠাণ্ডা ভোরের হাওয়া এসে লাগছে চোখে-মুখে। আলো এসে পড়েনি এখনও পথে। বেলা দশটা বাজার পর থেকে গরম হয়ে উঠবে পথ আস্তে-আস্তে। তারপর হাওয়ার দাপাদাপি শুরু হবে। মনে হবে যেন স্কুল-পালানো ছেলের দল হুড়দাড় করে জঙ্গলময় পিটু খেলে বেড়াচ্ছে। হাওয়াটা নানারঙা শুকনো পাতাদের অগণ্য বহুরঙা ছাগলের মতো তাড়িয়ে উড়িয়ে আফ্রিকান মাসাই উপজাতির রাখাল ছেলের মতো বনময় দাপাদাপি করে বেড়াবে। বড়কি ধনেশ, কুচিলা খাঁই গাছেদের ডাল থেকে ডেকে উঠবে, হ্যাঁ-হঁ, হ্যাঁ-হ্যাঁ। কুম্ভাটুয়া পাখি, রং তার বাদামি কালো, লেজ ঝোলা; লাফিয়ে লাফিয়ে বনের ছায়ায় এক্কা-দোক্কা খেলবে একা-একা। গম্ভীর মুখে। যেন বউ মরে যাওয়া কোনও একলা বুড়ো। কাঁচপোকা উড়বে বুবঁঝুঁইইই আওয়াজ করে। নানারঙা প্রজাপতি স্বপ্নের বাগানে উড়বে আর বসবে। শব্দ হবে না কোনও। কাঠবেড়ালি হঠাৎ উল্লাসে চার পায়ে গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে লেজটা ক্রমাগত ওঠাতে-নামাতে, নামাতে-ওঠাতে তারস্বরে অনেকক্ষণ ধরে ডাকবে চিররর-চি- চির, চিরির…। সারা বন সরগরম হয়ে উঠবে তার ডাকে। জিপের সামনে দিয়ে তাড়াতাড়ি পথ পেরোবে মস্ত লেজ নিয়ে ময়ূর আর ময়ূরী। শিমুল গাছতলাতে শিমুল ফুল খেতে খেতে কোটরা হরিণ হঠাৎ-আসা জিপের শব্দ শুনে চমকে উঠে সাদা লেজটি নাড়াতে-নাড়াতে দৌড়ে যাবে বনের গভীরে, তার সাবধান বাণী ছড়াতে-ছড়াতে, বাক! বাক! ব্বাক! ব্বাক!
বড় তেতরা বা মিটকুনিয়া গাছের উঁচু ডালে, রোদে বাদামি ঝিলিক তুলে চমকে বেড়াবে এ-ডাল থেকে ও-ডালে নেপালি ইঁদুর বা জায়ান্ট-স্কুইরেলরা। মিটকুনিয়া গাছেদের ডালের পাতায়-পাতায় ঝরনার শব্দ উঠবে ঝরঝর করে। রোদ ছিটকে যাবে ঘন সবুজ ক্লোরোফিল-ভরা পাতায়-পাতায়।
ঋজুদা বলল, রাজেনদা, প্রথমেই লবঙ্গি বাংলোতে যাবে? না মাঠিয়াকুদু নালায়, যেখানে পায়ের ছাপ দেখেছ গুণ্ডাটার?
সেখানেই প্রথম চলুন। মানে, নালায়। দেখেটেখে এসে তারপর বুদ্ধি আঁটা যাবে।
বেশ। রুদ্রকে পথ বলে দিও। আমি তো অনেক বছর পরে আসছি। এদিকে।
ঋজুদা বলল।
পুরানাকোটের মোড়ে এসে পৌঁছলাম। সামনে টুকা যাবার পথ চলে গেছে। আর ডান দিকে গেলে পুরানাকোট। আমরা বাঁয়ে অঙ্গুলের পথ ধরলাম। এই পথেই পম্পাশর পৌঁছে আমরা ডাইনে মোড় নেব। তারপর পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে এগোব লবঙ্গির দিকে।
ঋজুদা বলল, এই নালাই কি সেই নালা যেখানে ফুটুদারা একবার কাঠ কাটার জন্য ক্যাম্প করেছিল বছর কুড়ি আগে? আমিও এসে ছিলাম কদিন? এবিকাকু একদিন থেকে চলে গেছিল?
হ্যাঁ, সেই নালাই তো! মনে নেই? ট্রাকে করে কাঠ টানার মোষ আনবার সময় একটা মোষ ট্রাক থেকে খাদে পড়ে গেছিল? তারপর জড়িবুটির বৈদ্য কম্ফু তাকে ধীরে-ধীরে সারিয়ে তুলল? কম্ফুর বউও ছিল সীতা। ছেলে কুশ।
আছে মনে। কম্ফু কেমন আছে? কোথায় আছে এখন?
সে আর জিজ্ঞেস করবেন না ঋজুবাবু। তার সঙ্গে হয়তো জঙ্গলেই দেখা হয়ে যাবে আমাদের। ভাবলেই কষ্ট হয়।
কেন, কী হয়েছে তার? এই গুণ্ডা হাতির জঙ্গলে কী করছে সে?
কম্ফু পাগল হয়ে গেছে ঋজুবাবু। তার বউটা তার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকেই পাগল-পাগল ভাব হয়েছিল। এখন উন্মাদ। একেবারেই উন্মাদ।
সে কী! থাকে কোথায়? কোনও ডেরা-টেরা নেই?
ওই লবঙ্গির জঙ্গলেই। বাংলোতে, না বস্তিতে?
না বাবু, জঙ্গলে। গান গায়! কখনও খালি গায়ে চাঁদনি রাতে বনময় ঘুরে বেড়ায়। গুহাতে বা নদীর ধারে গাছের ছায়ায় থাকে। এই গরমের আর বর্ষার দিনেই ভয়। যে-কোনওদিন সাপ বা বিছের কামড়ে মারা যাবে। আর মরে গেলে কেউ জানতেও তো পারবে না। হায়েনাতে শেয়ালে শকুনে ছিঁড়ে-খুঁড়ে খাবে। জংলি জানোয়ারে আর কম্ফুতে কোনও তফাত নেই এখন আর।
ইশ। খায় কী কম্ফু?
ঋজুদা দুঃখিত গলায় বলল।
খাবে আর কী! নদীর জল আর বনের ফলমূল। ওই অঞ্চলে খুব বড়-বড় আমগাছ যে আছে, তা তো জানেনই। গরমের সময় আম খেয়েই পেট ভরে যায়। তবে ভয়ও আছে সেখানে। আম তো হাতি আর ভালুরও প্রিয় খাদ্য। আর এখানে যে কী প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ভালু আছে তা তো আপনি দেখছেনই। আর এখন তো হাতির দল নয়, গুণ্ডা হাতির রাজত্ব। দুটো ভালুকেও থেঁতলে দিয়েছে গুণ্ডাটা। কাল দেখে এলাম আমরা। শকুন পড়েছে তাদের তালগোল পাকানো পিণ্ডর উপরে। হাতিটা কাছেই ছিল কি না তা কে জানে! জঙ্গলে হাতি যখন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, গুণ্ডা হাতি হলে তো কথাই নেই, তখন তার গায়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগার আগে তো বোঝা পর্যন্ত যায় না।
তা ঠিক। ঋজুদা বলল।
তারপর আমাকে বলল, বুঝলি রুদ্র, হাতিদের পথঘাট, চড়াই-উতরাই সম্বন্ধে এমনই জ্ঞান যে এঞ্জিনিয়াররাও তাদের সম্মান করে। ঠাট্টা নয় কিন্তু। যে-কোনও জায়গাতেই পি-ডব্লু-ডি অথবা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট, অথবা জঙ্গলের ঠিকাদাররা কাঠ গভীর জঙ্গল থেকে বের করে নিয়ে আসবার জন্য রাস্তা যখন তৈরি করে তখন হাতিদের চলাচলের পথ ধরেই সে রাস্তা তৈরি করা হয়। বিশেষ জরিপ, এ্যাডিয়েন্টের হিসেবপত্রের ঝামেলা অনেক কমে যায়। অবশ্য এই সুবিধা পাওয়া যায় যে-জঙ্গলে হাতি থাকে সেখানেই। কোন জংলি নদীর ঠিক কোনখানে ব্রিজ হবে তাও ঠিক করা হয় অনেক সময় হাতিদের নদী-পারাপারের জায়গা দেখে।
এবার পম্পাশরের মোড়ে এলাম আমরা। বড় রাস্তা ছেড়ে ডান দিকের পাহাড়ে চড়ালাম জিপ। খুব খাড়া নয় পাহাড়। সেকেন্ড গিয়ারেই টেনে নিল। একটু গিয়েই ডান দিকে দুর্গার্দার বাড়ি। দুর্গাদা তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবে বলে নামল জিপ থেকে। ঋজুদাকে বলল, একটু কিছু খেয়ে যাবেন না? রুদ্রবাবু তো এই প্রথম পম্পাশরে এল।
ঋজুদা বলল, তোমাদের বাড়িতে অনেকবার খেয়েছি। আর রুদ্র তো তোমার জামাই নয়। এবার শুধু জল খাব। তাড়াতাড়ি করো।
জামাইয়ের কথা বলায় দুর্গাদা আর আমি দুজনেই লজ্জিত হলাম।
দুর্গাদা জিপ থেকে নেমে দৌড়ল।
রাজেনদা বিড়ি খাওয়ার জন্য জিপ থেকে নেমে গাছের আড়ালে যাচ্ছিল। ঋজুদা তাকে বকে দিয়ে বলল, তোমাকে অনেকদিন বারণ করেছি। বলেছি না, আমার সামনেই বিড়ি খাবে।
দুর্গাদা একটু পরেই ফিরে এল ঝকঝকে করে মাজা পেতলের ঘটি হাতে করে। সঙ্গে দুগর্দার ত্রয়োদশী, লাল শাড়ি পরা, নাকে পেতলের নোলক আর হাতে লালরঙা কাঁচের চুড়ি পরা লজ্জাবতী মেয়ে। তার হাতেও ঝকঝকে করে মাজা পেতলের থালা, তাতে দুটি ঝকঝকে গ্লাস উপুড় করা আর কটি বাতাসা। লজ্জাবতী ঝোপের পাশে দাঁড়ানো দুর্গাদার উজ্জ্বল মেয়েকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছিল।
ঋজুদা শুধোল, তোমার নাম কী?
সে বলল, পঞ্চমী।
আমি ভাবলাম, ত্রয়োদশীর পঞ্চমী হতে আরও দুবছর বাকি।
দুর্গাদা বলল, মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছি। সামনের শীতে। আপনি আসবেন তো ঋজুবাবু? রুদ্রবাবুদের সকলকে নিয়ে আসবেন। তিতির দিদিমণি, ভ্যাটকালুবাবুকে।
আমি বলল, ওর নাম ভ্যাটকালু নয়, ভটকাই।
দুর্গাদা জিভ কাটল।
ঋজুদা বলল, আসতে পারি আর না পারি নেমন্তন্নের চিঠি যেন অবশ্যই পাই তারিখ জানিয়ে। খুব জরুরি কাজ না থাকলে অবশ্যই আসব।
গেলাস দুটো সোজা করে দিয়ে শক্ত হাতে থালাটা ধরল পঞ্চমী। দুর্গাদা জল ঢেলে দিল ঘটি থেকে। আঃ, কী মিষ্টি, ঠাণ্ডা জল। ঝরনার জল বোধহয়।
জামাই করে কী? ও দুর্গা?
দুর্গাদা বলল, জামাই বিনকেইতে থাকে। ওদের একটা নৌকো আছে। তার বাবা আর সে চৌকো চালায়। যখন ভাড়া না পায় তখন মাছ ধরে। সাতকোশিয়া গণ্ডে।
আমি ভাবলাম, বাঃ। কলকাতার খবরের কাগজগুলোতে পাত্র-পাত্রীর কলামে বিজ্ঞাপন বেরোয় পাত্র সুদর্শন, ব্যাঙ্কের চাকুরে অথবা ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার, চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। তারপর থাকে, কলিকাতায় পৈত্রিক/নিজস্ব বাড়ি। আর পঞ্চমীর বিয়ে হবে যার সঙ্গে তার পরিবারের দুপুরুষের সম্পত্তি বলতে একখানি নৌকো। অবশ্য মাথা গোঁজার মতো ঘর ডাঙাতেও নিশ্চয়ই থাকবে একটা!
দুর্গাদা যেন আমার মনের কথাই শুনতে পেয়ে বলল, জমিজমা থাকলে কি আর নৌকো চালিয়ে খায়। ওই গভীর গণ্ড। তাতে কুমির ভরা। কিন্তু কী করব। গরিবের তো কোনও চারা নেই। যেমন জুটল তেমনই দিলাম। তাও আবার ছেলের বাপ একটা সাইকেল চায়। দশজন বরযাত্রীকেও খাওয়াতে হবে বিয়ের রাতে। খরচ কি কম!
ঋজুদা বলল, তোমার জামাইয়ের সাইকেলটা না হয় আমিই দিয়ে দেব। ও নিয়ে মোটেই চিন্তা কোরো না তুমি। আর পঞ্চমীকে দেব একটা সম্বলপুরি সিল্কের শাড়ি। এইরকমই লাল। যেমন লাল ও পরেছে। লাল রং বুঝি তোমার খুব পছন্দ? কী পঞ্চমী? মধ্যে হাতির কাজ করা থাকবে। কী রে, পঞ্চমী, পছন্দ হবে তো?।
পঞ্চমী লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিল। মনে হল, কেউ যেন ওর পায়ের কাছে লজ্জাবতীর ঝোপে আঙুল ছুঁইয়েছে। পঞ্চমী দাঁড়িয়েই ছিল লজ্জাবতীর ঝাড়ে। এমনও কি হয়? ভাবছিলাম আমি।
দুর্গাদাও কম খুশি নয়। বলল, বাবু, পূর্বজন্মে আপুনি মোর বাপ্প থিলা।
ঋজুদা হেসে ফেলে বলল, ভালই বলেছ।
তারপর বলল, সময় নষ্ট না করে নাও এবার চললো। যদি এ যাত্রা বেঁচে ফিরি তে ফেরার সময় তোর আর তোর মায়ের হাতে ডাল-ভাত খেয়ে ফিরব। বুঝলি পঞ্চমী?
পঞ্চমী সঙ্গে-সঙ্গে হেসে মুখ সামনে করে বলল, কী ডাল খাবে?
ঋজুদা বলল, বিরি ডাল।
পঞ্চমী মাথা হেলিয়ে বলল, আচ্ছা। তখন না বললে হবে না কিন্তু।
আমি ভাবছিলাম, খুব সপ্রতিভ, ঝকঝকে মেয়ে এই পঞ্চমী।
বিরি ডাল মানে কলাই ডাল। গরমে ঋজুদার খুবই প্রিয়।
রাজেনদাকে, যেকটা বাতাসা ছিল, দুর্গাদা জোর করে খাইয়ে দিল। ঘটি থেকে রাজেনদা ঢকঢকিয়ে জল খেল, তারপর তার নীলরঙা ফুলহাতা শার্টের হাতা দিয়ে মুখটা মুছে নিল।
আমি জিপটা স্টার্ট করলাম।
দুর্গাদা পঞ্চমীকে বলল, মু চলিলি রে মা। সাবধানে রহিবি তমমান্তে।
পঞ্চমী মাথা হেলাল।
মাথা হেলানো দেখে মনে হল কথা বললে ওকে অত সুন্দরী দেখাত না। আমার এই সুন্দর দেশের গরিব ঘরের ঘর-আলোকরা রাজকন্যে!
পাহাড় চড়তে-চড়তে আমি শুধোলাম, সাতকোশিয়া গণ্ড কী ব্যাপার ঋজুদা?
সে কী রে! তুই ভুলে গেলি?
অবাক গলায় বলল ঋজুদা। সেই যে প্রথমবার তুই এসেছিলি আমার কাছে, যখন আমার সাতটা দিশি কুকুর ছিল জঙ্গলে, যাদের নাম ছিল, সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি। আর তুই তো সেবারের আসা নিয়ে ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে না কী একটা বইও লিখেছিলি!
ও তাই তো! ভুলেই গেছিলাম। নয়নামাসিরাও তখন এসেছিল টিকরপাড়া বাংলোতে। তাই না?
হ্যাঁ। ঋজুদা বললে।
তারপর বলল, সাতকোশিয়া গণ্ড হচ্ছে সাত ক্রোশ বা চোদ্দ মাইল লম্বা GORGE বা গিরিখাত, যার আরম্ভ হচ্ছে বিকেইতে। চৌদুয়ারে পৌঁছবার আগেই হঠাৎ চওড়া হয়ে ছড়িয়ে গেছে মহানদী, তিস্তা যেমন কালিঝোরার পর করোনেশন ব্রিজ পেরিয়েই হয়েছে, জব্বলপুরের মার্বেল রক পেরিয়েই যেমন নর্মদা। এই গণ্ডের দুপাশেই গভীর জঙ্গল-পাহাড়। এখানের নদীতে মাছ আর কুমিরের ছড়াছড়ি। হাজার-হাজার বাঁশের ভেলা বানিয়ে ঠিকাদাররা বাঁশ চালান দেয় কাগজকলে। সেই ভেলা করে একবার গিয়েছিলাম টিকরপাড়া থেকে চৌদুয়ার। তার ডায়েরিও রেখেছিলাম একটা। খুঁজে বের করতে হবে। সে এক অভিজ্ঞতা।
এইবার জিপ বেশ উঁচুতে চলে এসেছে। পাহাড়ের একেবারে গায়ে-গায়ে নাবাল মাটির রাস্তা আর তার ডান দিকে গভীর খাদ। গভীর জঙ্গলে ভরা তা। কিন্তু নীচের সব কটি গাছই গেণ্ডুলি। একটি শিমুলও আছে। গেলি গাছে এখন একটি-দুটি পাতা এসেছে, শিমুল গাছেও নতুন পাতা এসেছে। ওই ন্যাড়া, রুক্ষ পটভূমিতে শিমুল গাছগুলোর গায়ে কিছু কিছু কিশলয় কী যে সৌন্দর্য এনে দিয়েছে তা বলবার নয়।
ঋজুদা বলল, এই গেলি গাছগুলো কেন বড় করা হচ্ছে জানিস? লালনপালন?
কেন?
এই গাছ দিয়ে, সম্ভবত এর আঠা দিয়ে, পলিয়েস্টার ফাইবার তৈরি হয়। নরম গাছ তো! আঁশ থাকে এতে। যেসব মানুষ পলিয়েস্টারের জামা পরতে ভালবাসেন, তাঁদের যদি ওই গাছগুলোকে গ্রীষ্মে বা শীতে বা বর্ষায় বা বসন্তে একবার দেখবার সুযোগ দেওয়া হত, তা হলে তাঁরা সকলেই বলতেন, থাক, থাক। এই গাছগুলো বাঁচুক, বন বাঁচুক। পলিয়েস্টারের জামা আমরা পরব না। বিজ্ঞানের অগ্রগতিটুকুই আমাদের চোখ ধাঁধাঁয়, কিন্তু সমস্ত চোখ-ধাঁধানো নতুন-নতুন পণ্যের পেছনে যে প্রকৃতি চোখের জল ফেলতে-ফেলতে রিক্ত, বিবস্ত্র, নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষে-ভরা এই দেশে, তার খবর কজন আর রাখে বল?
দুর্গাদা আমাকে বলল, রুদ্রবাবু, এবার একটু আস্তে চলোলা। সামনে পর পর বাঁক আছে কয়েকটা। হাতির জায়গায় তো পৌঁছেই গেছি আমরা। বিশ্বাস কী তাতে? জিপের শব্দ শুনেই হয়তো বাঁকের মুখে এসে দাঁড়িয়ে রইল। এক ধাক্কায় জিপকে ফেলে দেবে নীচে।
ঋজুদা বলল, জিপটা একটু দাঁড়ই করা রুদ্র। রাইফেল আর গুলিগুলো বের করে নে।
রাজেনদা বলল, পরে বের করলেও হবে। আমার হাতে তো দুনলা বন্দুক আছে।
ঋজুদা বলল, এ যদি তোমার বন্দুকেরই কম্ম হত রাজেন, তবে কি আমাকে কষ্ট দিয়ে ডেকে আনতে তোমরা? নিজেরাই কখন কাজ সেরে রাখতে যে, না জানতে পেতাম আমি, না ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট!
রাজেনদা লজ্জা পেল।
আমি জানতাম যে, রাজেনদা চোরা শিকার করে। দুর্গাদাও করে। কিন্তু তা করে একটু মাংস খেয়ে মুখ বদলাবারই জন্যে। নমাসে-ছমাসে একটু মাংস খেতে পায় ওরা। সেজন্য বন-জঙ্গলের বেশি মানুষই প্রোটিন ডেফিসিয়েন্সিতে ভোগে। সমস্ত ন্যায়-অন্যায়ই রিলেটিভ, মানে আপেক্ষিক। প্রত্যেক মানুষকে তার পটভূমিতে ফেলে বিচার করে তারপরই রায় দিতে হয়। তাই বোধহয়। কথায় বলে, ল ইজ নাথিং বাট কমন সেক্স।
তোর রাইফেলে গুলি ভরিস না। আমার রাইফেলটা দে। হাতে ধরে বসে থাকি।
ঋজুদা বলল আমাকে, রাইফেল দুটো বের করার পর।
পথটা এঁকেবেঁকে চলেছে। বাঁ দিকে একেবারে সোজা পাহাড়। কোথাওবা একটু ন্যাড়া-ন্যাড়া দেখায়। সেরকম একটি ন্যাড়া জায়গাতে দেখি বাঁদরদের সভা বসেছে। ওদের পঞ্চায়েত নির্বাচন বোধহয় এসে গেছে। নেতা বক্তৃতা করছে। অন্যেরা শুনছে, কেউ গালে, কেউ মাথায় হাত দিয়ে বসে। কেউবা শুনছে মাথার উকুন বাছতে-বাছতে। অনেকেরই মুখ বাঁদরদের ভবিষ্যৎ চিন্তায় উদ্বিগ্ন। জনগণ সম্বন্ধে ভেবে ওদের নেতাদেরও রাতে ঘুম হচ্ছে না। মাথার চুলও পাতলা হয়ে গেছে।
রাজেন বলল, এবারে পথটা ছেড়ে ডান দিকের নীচের পথে নামতে হবে মাঠিয়াকুদু নালার দিকে।
দেখতে-দেখতে গভীর জঙ্গলের দিকে জিপ গড়িয়ে যেতে লাগল। বেলা দশটাতে ছায়াচ্ছন্ন জায়গাটা। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল।
মাঠিয়াকুদু নালার কাছাকাছি পৌঁছে জিপ থামিয়ে দিলাম।
রাজেনদা বলল, জিপটাকে ছেড়ে যাওয়া চলবে না। রুদ্রবাবু আর দুর্গা জিপেই থাকুন। এবং জিপটা ঘুরিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় নিয়ে দাঁড় করান। গায়ে রোদ লাগলে লাগবে। তবু হাতি এলে তাকে দেখার সুযোগ পাবেন। জঙ্গল থেকে একটু দূরেই থাকুন। আমি আর ঋজুবাবু একটু নেমে দেখে আসি।
রাজেনদার কথামতোই কাজ করলাম।
ঋজুদা বলল, এবার তোর রাইফেলে গুলি ভরে নে। তবে হাতি এলেও তুই একা গুলি করবি না। জোরে জিপ চালিয়ে চলে যাবি। দুর্গা লবঙ্গির ফরেস্ট বাংলোর পথ চেনে।
কেন?
যা বললাম তাই করিস। এখন তর্কাতর্কির সময় নয়।
আমরা না হয় হেঁটেই ফিরব তেমন হলে। তবে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে। দেরি দেখলে আবার জিপ নিয়ে ফিরে আসিস, বা নালা অবধি না ফিরে, দূরে দাঁড়িয়ে থাকিস। ফাঁকায়। গুলি করতে পারিস নেহাত প্রাণ বাঁচানো জরুরি হয়ে পড়লে। ওই হাতি শিকারের জন্যে তোর রাইফেল দিয়ে গুলি করিস না আমি সঙ্গে না থাকলে। আবারও বলছি। মনে রাখিস।
চলে যাবার আগে, ঋজুদা বলল, হাতির কোথায় গুলি করতে হবে জানিস তো? মনে আছে? রুআহাতে ভাল করে শিখিয়েছিলাম তোকে।
হ্যাঁ, মনে আছে। বিরক্ত গলায় বললাম।
ঋজুদাটা বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। একই কথা বারবার বলে আজকাল।
গুলি কিন্তু তুই করছিস না। নেহাত প্রাণ বিপন্ন না হলে।
ঠিক আছে।
আরও বিরক্ত হয়ে বললাম।
ঋজুদা আর রাজেনদা গাছগাছালির মধ্যে হারিয়ে গেল।
রোদের মধ্যে বসে বা দাঁড়িয়ে থেকে ছায়াচ্ছন্ন জঙ্গলের দিকে চাইলে জঙ্গলকে আরও বেশি ছায়াচ্ছন্ন ও স্নিগ্ধ লাগে। দুর্গাদাকে বললাম, তুমি জিপের পেছনে বসে সামনের দিকে দ্যাখো আর ডান দিকে।
আমি বসে ছিলাম লোডেড রাইফেল নিয়ে জঙ্গলের দিকে মুখ করে, ঋজুদারা এগিয়ে গেল সেইদিকেই।
দুর্গাদা বলল, তেষ্টা পেয়ে গেল যে। তুমি বোসো। আমি নালা থেকে একটু জল খেয়েই আসছি।
সাবধানে যাবে। নিজের বাড়িতে জল খেতে পারলে না? হাতির ফুটবল হওয়ার ইচ্ছে হয়েছে বুঝি তোমার?
আমি বললাম।
দুর্গাদা বলল, রাখো তো। হাতি সেটি মু পাঁই ঠিয়া রহিছি। হঃ। অর্থাৎ ছাড়ো তো, হাতি যেন আমার জন্য সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।
নালাটা তো দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে। তুমি যাচ্ছটা কোথায়?
কাছেই।
বলেই দুর্গাদা জঙ্গলের দিকে এগোল। যাবার আগে বলে গেল, চুপ করে থাকলে জল বয়ে যাওয়ার কলকুলানি শব্দ তুমিও শুনতে পাবে।
ঘড়িতে চেয়ে দেখলাম, প্রায় এগারোটা বাজে। কী করে যে সময় যায়! দুর্গাদা চলে গেছে বেশ কিছুক্ষণ। জল খেয়ে ফিরে আসতে এতক্ষণ সময় লাগার কথা নয়। আমার মন কীরকম যেন করছে। কখনও এমন করে না। গুণ্ডা হাতি সম্বন্ধে কোনও অভিজ্ঞতাই আমার নেই। তিতিরটা সঙ্গে থাকলে বেশ হত।
ঋজুদার কাছে গল্প শুনেছিলাম, ডুয়ার্সের এক চা-বাগানের একজন ইংরেজ, অল্পবয়সী অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজার, সার্গেসান, একদিন বর্ষাকালের এক বিকেলে মুরগি মারতে গেছিল। ঝোপের মধ্যে মোরগের ডাক শুনেই যেই না ঢুকেছে পাশে মেঘমেদুর বিকেলে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাতি অমনি খুঁড়ের এক ঝটকানিতে তাকে তুলে নিয়ে মাটিতে ফেলে পা চাপিয়ে দিয়েছিল তার মাথার উপর। সে না ফেরাতে, রাতে দুশো কুলি নিয়ে মশাল জ্বেলে তার বাগানের এবং অন্যান্য বাগানের ম্যানেজাররা রাইফেল নিয়ে গিয়ে খুঁজতে খুঁজতে তার বীভৎস মৃতদেহ পায়।
দুর্গাদাটা তো আচ্ছা লোক। এমন খামোখা চিন্তা করাতে পারে না। ভারী বিরক্ত লাগছে আমার। জল খেতে গেল তো ভগবানের নামেই গেল।
পথের পাশের বড় বড় সব প্রাচীন গাছে নেপালি ইঁদুররা একে অন্যকে তাড়া করে ফিরছে। ঝরঝর শব্দ হচ্ছে পাতায়। স্নিগ্ধ বৈশাখী সকালে রোদ ছিটকে যাচ্ছে বড় গাছেদের সবুজ পাতা থেকে, তাদের দৌড়াদৌড়িতে। এমন সময় একটি বিরাট শিঙাল শম্বর বন থেকে বেরিয়ে এসেই জিপটা ও আমাকে দেখে চমকে উঠে ঘ্যাক করে একবার ডেকেই বনের ভিতরে চলে গেল। জল খেতে যাচ্ছিল বোধহয়। লবঙ্গির জঙ্গল এমনিতেই অত্যন্ত গভীর এবং জনমানবশূন্য। হাতির অত্যাচার তাকে আরও ভয়াবহতা দিয়েছে। এই নির্জনে অন্ধকার নামা পর্যন্ত জলে যাবার জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন বোধ করছে না। আর জানোয়ারেরা।
এমন সময় মনে হল, দুর্গাদার গলার স্বর শোনা গেল। তা হলে কি ঋজুদারাও ফিরে এল? এত তাড়াতাড়ি? কথা বলল, কার সঙ্গে?
উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইলাম নালাটা যেখানে থাকার কথা সেদিকে।
সবুজ অন্ধকারের গভীর থেকে যে-লোকটি বেরিয়ে এল, সে কিন্তু দুর্গাদা নয়। অন্য লোক। সম্পূর্ণ নগ্ন। বড় বড় চুল-দাড়ি। প্রকাণ্ড বড়-বড় নখ হাত-পায়ের। কানের চুলও ঝুপড়ি হয়ে আছে। নাকের চুলও। লোকটা বেশ লম্বা। আর তার চোখ দুটোতে আগুন জ্বলছে। তার হাত-পায়ের নখের মধ্যে লাল মাটি ঢুকেছে এমন করে যে মনে হচ্ছে, রক্ত খেয়েছে হাত দিয়ে কোনও কিছুর মাংস ছিঁড়ে।
লোকটা কী যেন বিড়বিড় করে বলতে-বলতে সোজা আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
কাছে আসতেই শুনলাম, বলছে, আলো শুকিলা সারু, মন মরি গলা দ্বিপাহারু।
বারবার এই এক কথাই বলছে।
বাক্যটির মানে হল, ওরে শুকনো কচু! তোর মন মরে গেল দ্বিপ্রহরেই!
লোকটা আমার সামনে এসে দাঁড়াল। তীক্ষ্ণ চোখে আমার চোখে চেয়ে রইল। তারপর বলল, মু হেৰা বারুঙ্গা আউ তু ভদ্দরনোক। মু মারিলে তু বাঁচিবি? চা। গোণ্ডুলি বন-মধ্যরে আজি তমকু কব্বর দেবি মু।
কী বিপদেই পড়লাম রে বাবা। বনের প্রাণীদের মোকাবিলা করতে পারি, কিন্তু বনের মানুষকে নিয়ে কী করি?
তার ভাবগতিক দেখে আমি রাইফেলটাকে তুলে নিয়ে কোলের উপরে রাখলাম।
তা দেখেই লোকটা হাহা করে হেসে উঠল। তার হাসিতে ছায়াচ্ছন্ন বন আর রৌদ্রদগ্ধ গেণ্ডুলি বনও যেন হাহা করে উঠল।
বলল, মত্বে মারিবি তু? গুলি মত্বে বাজিবনি।
বলেই দুটো হাত দুপাশে তুলে ঝরনা খেলাল।
আমি ততক্ষণে জিপের বনেট থেকে নেমে দাঁড়িয়েছি রাইফেল হাতে।
হঠাৎ লোকটা দুহাত তার মুখের কাছে নিয়ে, যেদিকের বনে শিঙাল শম্বরটা ঢুকে গিয়েছিল, সেদিকে মুখ ঘুরিয়ে খুব জোরে ডাকল, কুয়ারে পলাইলিরে ঐরাবত্ব। চঞ্চল করিকি আ তু! আ রে। চঞ্চল করিকি আ।
বলতেই, ওইদিকের জঙ্গলের গভীরে একটি আলোড়নের শব্দ শুনতে পেলাম আমি। গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠল আমার। উত্তেজনায়। তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে পাহাড়ের মতো এক হাতি সত্যিই জঙ্গল ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে এক মুহূর্ত দাঁড়াল। তার দাঁত দুটো মাটিতে লুটোচ্ছিল। এত বড় হাতি যে, মনে হল আফ্রিকাতেও দেখিনি। হতবাক হয়ে গেলাম আমি। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল তার চেহারা দেখেই।
হাতিটা পাঁচ মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে এক দৌড়ে এগিয়ে এল খুব আস্তে-আস্তে। আমি রাইফেল তুলে তার কপালে নয়, কানের পাশে কাভার করে রইলাম। যদি সত্যিই চার্জ করে। কিন্তু ঋজুদার কথাও মনে পড়ে গেল সঙ্গে-সঙ্গে। এক ধাক্কায় আমি সেই লোকটাকে জিপের পেছনের সিটে ফেলে স্টিয়ারিং-এ বসে যত তাড়াতাড়ি পারি এঞ্জিন স্টার্ট করে জিপ ছোটালাম রাইফেল পাশে শুইয়ে রেখে।
শিকারে যাওয়ার সময় যে জিপেই যাই, জিপের হুড খোলা থাকে। সামনের উইন্ডস্ক্রিনও শোয়ানো থাকে বনেটের উপর। এই কারণেই সেডান বডির জিপ আমরা কখনওই নিই না। কিন্তু এতখানি পথ আসতে হবে বলে, হুড যদিও খোলা ছিল উইন্ডস্ক্রিন নামানো ছিল না চোখে হাওয়া লাগে বলে। বোধহয় কুড়ি গজও উঠিনি চড়াই-এ এমন সময় পেছন থেকে এক চিৎকার শুনে রিয়ার-ভিউ-মিরারে চেয়ে দেখি, লোকটা পেছন দিক দিয়ে জিপ থেকে এক লাফ মেরে নেমে হাতিটার দিকেই দৌড়ে যাচ্ছে।
ব্রেক করে মুখ ঘুরিয়ে আমি তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। কী হয়, কী হয়!
হাতিটা বন থেকে বেরিয়ে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই তখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এই লোকটা যে কে আমি জানি না, তবে টারজান বা অরণ্যদেবের মতো কেউ হবে বোধহয় এইটুকু মনে হচ্ছিল, নইলে কোনও গুণ্ডা হাতি কোনও মানুষের কথা এমন শোনে!
লোকটা টালমাটাল পায়ে হাতিটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ডান হাত তুলে হাতিকে কী বোঝাতে বোঝাতে।
হাতিটা মুহূর্তের মধ্যে ক্যানাডিয়ান লোকোমোটিভ স্টিম এঞ্জিনের মতো এক দমে শুঁড় লটপটিয়ে ছুটে এসে লোকটাকে শুড় দিয়ে এক ঝটকাতে উপরে তুলে নিল। এবার তার পিঠে বসাবে মনে হল। কিন্তু পিঠে না বসিয়ে পথের পাশের কতগুলো বড় পাথরের স্তূপে লোকটাকে এক প্রচণ্ড আছাড় মারল হাতিটা। এবং সঙ্গে-সঙ্গেই শব্দ করে লোকটার কপাল ফেটে গেল। হাড়গোড় সব চুরচুর হয়ে গেল। থকথকে ঘিলু ছিটকে গিয়ে লাগল কালো পাথরে। ই। রে! লালচে-হলদেটে রঙের ঘিলু।
তারপর হাতিটা লোকটাকে মাটিতে ফেলে প্রথমে বাঁ পা তারপর ডান পা দিয়ে তাকে যেন ঘন ঘৃণার সঙ্গে বারেবারে মাড়াল। মাড়িয়ে, জিপের দিকে এবং রাইফেল-হাতে দাঁড়িয়ে থাকা শিকারি, আমার দিকে ভ্রূক্ষেপমাত্রও না করে পথটা পেরিয়ে যেদিক দিয়ে এসেছিল, তার ঠিক উলটো দিকের পত্রশূন্য, রোদ-ঝাঁঝাঁ-করা গেণ্ডুলি বনে ঢুকে গেল। পত্রশূন্য বলেই, দেখতে পেলাম, অবিশ্বাস্য গতিতে চোখের পলকে সে এত দূরে চলে গেল যে, কিছু পরে তাকে আর দেখাই গেল না।
এমন সময় দেখলাম, ঋজুদারা দৌড়ে আসছে।
ওঁদের দেখেই আমি সঙ্গে সঙ্গে জিপ ব্যাক করে তাড়াতাড়ি ওঁদের দিকে নিয়ে গেলাম।
নিজের উপর বড়ই ঘেন্না হচ্ছিল আমার। আর প্রচণ্ড রাগও হচ্ছিল ঋজুদার উপরে। হাতে ফোর-ফিফটি ফোর-হান্ড্রেড লোডেড ডাবল-ব্যারেল রাইফেল থাকতেও আমার সামনে একটা লোক দিনদুপুরে খুন হয়ে গেল, অথচ তাকে বাঁচাতে পারলাম না আমি। এমনকী বাঁচাবার চেষ্টাও করলাম না। ছিঃ। এই না হলে শিকারি। এবার থেকে ঋজুদার চামচেগিরি করাই ছেড়ে দেব। মনে-মনে ঠিক করলাম।
ঋজুদা একবার দ্রুত গেণ্ডুলি বনের দিকে তাকাল, তারপর পড়ে-থাকা মানুষটার দিকে। তাকে মানুষ বলে চেনার আর উপায় ছিল না কোনও। তাকে তালগোল পাকিয়ে দিয়ে হাতি তার লজ্জামোচন করছিল।
দুর্গার্দা, রাজেনদা আর ঋজুদা আমাকে ধর্তব্যের মধ্যে না এনে নিজেরা নিচু গলায় কীসব আলোচনা করল দ্রুত। পরক্ষণেই রাজেনদা আর ঋজুদা আমাকে কিছু না বলেই খুব দ্রুত গেণ্ডুলি-বনের উপত্যকাতে নেমে গেল। এবং দ্রুতগতি হাতিটারই মতো অদৃশ্য হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে।
দুর্গাদা গুটিগুটি ওই মানুষটার কাছে এগিয়ে গেল। তারপর তাকে ভাল করে দেখে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নালার দিকে ফিরে গিয়ে গাছের ছায়ায় বসে পড়ল। বসে পড়ে আমাকেও ডাকল ইশারাতে।
জিপের এঞ্জিন তখনও চলছিল। সেটাকে বন্ধ করে রাইফেল হাতেই আমি দুর্গাদার কাছে গিয়ে পাশে বসলাম একটা পাথরের উপরে। তারপর ফিসফিস করে বললাম, তুমি দেরি করলে কেন? জল খেতে কতক্ষণ লাগল তোমার?
দুর্গাদা বলল, জল খেতে আর পারলাম কোথায়?
সে কী! কী করলে তা হলে এতক্ষণ!
নালার কাছে গিয়ে একটু পরিষ্কার জল দেখে নিচু হয়ে বসেছি, আর দেখি হাতি।
কোথায়?
আমার ঠিক পেছনে।
বলো কী! তারপর?
আর কী। জল খাওয়া তো মাথায় উঠল। সামনেই একটা মস্ত আমগাছ। কিন্তু সেটা এতই মোটা যে, দুহাতে তার বেড় পাওয়া অসম্ভব। অতএব তার পাশেই যে কসি গাছ ছিল, সেই গাছে বাঁদরের চেয়েও তাড়াতাড়ি উঠে গেলাম তরতর করে। হাতি একবার শুড় বাড়িয়ে ধরার চেষ্টাও করল আমাকে, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, সে আমার প্রতি আর মনোযোগী নয়। একটুও শব্দ করল না কিন্তু।
হাতি ওখানে ছিল তো ঋজুদাদের ধরল না কেন?
আমিও তো তাই ভাবছি।
হাতি একবার শুড় দিয়ে ধরবার চেষ্টা করে যখন আমার নাগাল পেল না, তখনই তোমার দিক থেকে একটা শম্বর ডাকল ধ্বক করে। তুমি কোনও শম্বর দেখেছিলে?
হ্যাঁ। শম্বরটা বন থেকে বেরিয়ে আমাকে দেখেই ডেকে আবার বনের ভিতরে চলে গেল।
কী শয়তান হাতি দ্যাখো। শম্বরের ডাক শুনে ও বুঝেছিল যে, শম্বরটা কিছু দেখে অবাক হয়েছে। তবে বাঘ দ্যাখেনি। বাঘ দেখলে শম্বরেরা যেমন করে ডাকে, সে ডাক অন্য।
হাতিটা শম্বরের ডাক শুনেই সঙ্গে-সঙ্গে জঙ্গলের ছায়ায়-ছায়ায় সোজা ডান দিকে চলে গিয়ে বাঁ দিক দিয়ে গিয়ে তোমার দিকে চলে এসেছিল।
ওই লোকটা এল কোথা থেকে? লোকটা কে?
কোথা থেকে এল তা কী করে জানব। তবে ও তো আমাদের কল্ফ। আহা, কার কী পরিণতি! ও কত বড় ডাক্তার ছিল, তোমরা বিশ্বাস করবে না, জানলেও। ওর কাছে কর্কট রোগের ওষুধ ছিল জানো?
মানে, ক্যানসারের ওষুধ?
হ্যাঁ। না তো কী?
আমাদের একটা মোষের ভেঙে যাওয়া পা ও যেমনভাবে সারিয়েছিল অল্প দিনে, তেমনভাবে কটকের নামী হাড়ের-ডাক্তার আর ছুরি-চালানো ডাক্তারেরাও পারত না। পুটুকাসিয়া লতার গোড়া, কচি শিমুলের গোড়ার শিকড়, হাড়কালির ছাল, জড়া তেলের সঙ্গে বেটে সেই ওষুধটা তৈরি করেছিল। তারপর সেই ওষুধ লাগিয়ে ডবা বাঁশ কেটে প্রিন্টার তৈরি করে তা দিয়ে বেঁধে দিয়েছিল পা। ক্যুর মতো বদ্যি এদিকের পাহাড়-বনে কমই ছিল। সপরস খেয়ে লোকে অসুস্থ হলে কফ্ একটি বটি দিত আর সঙ্গে-সঙ্গে সব ঠিক। বুঝে দ্যাখো। একটি মাত্র বটি।
এতই বড় বদ্যি যদি সে, তা হলে তোমরা তাকে এমন করে মরতে দিলে কেন দুর্গাদা? তাকে ঘরে কেউই জায়গা দিলে না কেন?
দুর্গাদা ডান হাতটা কোমর অবধি তুলল। তারপর অনেক কিছু বলতে চেয়েও থেমে গিয়ে সংক্ষেপে বলল, বন যাকে জাদু করে, মরণ যাকে ডাকে, তাকে ঘরে ধরে রাখে এমন সাধ্যি আছে কার? সবই আমাদের কপাল রুদ্রবাবু।
তা হাতিটা যদি ওখানেই ছিল, ঋজুদা আর রাজেনদাকে ধরল না কেন? ওরাই বা দেখতে পেল না কেন? অবাক কাণ্ড!
সত্যিই তাই। হতি তো ছিলই। একেবারে ওদের পাশেই ছিল। দোষ তো রাজেনের। মাঠিয়াকুদু নালাতে হাতির পায়ের ছাপ কাল যেখানে দেখেছিল সটান সেখানেই নিয়ে যাচ্ছিল ঋজুবাবুকে। আরে, কাল যেখানে হাতি ছিল আজও যে ঠিক সেখানেই থাকবে, এ-কথা কোনও শিকারির পক্ষে কী করে বিশ্বাস করা সম্ভব হল, তা তো আমি ভেবে পাই না। আসলে ঋজুবাবুর পোশাক, হাতের রাইফেল আর পাইপের গন্ধে হাতি সামলে নিয়েছিল। নিজেকে। রাজেন একা থাকলে আজ কম্ফু বেঁচে যেত। ওই মরত।
ঋজুদারা গেল কোথায়?
হাতির পিছনে।
দেখা পাবে? পেছনে-পেছনে দৌড়ে?
পাগল! হাতি ততক্ষণে দুমাইল চলে গেছে। গেণ্ডুলি বনের বাঁ দিকে একটা বড় দহ আছে। মাঠিয়াকুদু নালাটা গিয়ে পড়েছে সেখানেই। ওই নদীতে দহমতে আছে একটা। হাতি নিশ্চয়ই দুপুরবেলাটা সেখানেই গা ডুবিয়ে থাকবে।
তুমি যদি জানোই তবে সঙ্গে গেলে না কেন?
আমাকে নিয়ে গেলে তো। রাজেন এ-জঙ্গলের কী জানে? ও রেড়াখোল আর ঢেক্কানলের জঙ্গলের মুহুরি। এই মাঠিয়াকুদুতে আমি পরপর পাঁচ বছর ক্যাম্প করে থেকেছি। ফুটুবাবুদের লক্ষ লক্ষ টাকা লাভ হয়েছে এই জঙ্গল থেকে। এমন ভাল কাঠ খুব বেশি জঙ্গলে নেই। তা রাজেন মাতব্বরের আমার সঙ্গে শলা করারও সময় হল না! থাকগে! মরুকগে ঘুরে।
তা তো বুঝলাম। কিন্তু ঋজুদা কি জানে না তোমার অভিজ্ঞতার কথা?
জানবে না কেন?
তবে?
ওই রাজেনের লোভ।
কিসের লোভ? অবাক হয়ে বললাম আমি।
ঋজুদা বলেছে না ওকে একটা থ্রি-ফিফটিন রাইফেল কিনে দেবে এবং ডিভিশনাল কমিশনারকে বলে লাইসেন্সও করিয়ে দেবে। তাই ও তেল দিচ্ছে ঋজুবাবুকে। তেল দিতে গিয়ে ঋজুবাবুর প্রাণটাই নিয়ে নেবে। যা মনে হচ্ছে তাতে।
তেল দিলে ঋজুদা কি বুঝতে পারত না?
কী যে বলেন রুদ্রবাবু! ভগবানও পর্যন্ত বুঝতে পারেন না, আর ঋজুবাবু! তেলের মতো সাঙ্ঘাতিক বিষ আর নেই। তা ছাড়া রাজেন আমাদের হুঁশিয়ার লোক। তেল কি সকলে দিতে জানে? মবিলের ফুটোয় পেট্রল, আর পেট্রলের ফুটোয় মবিল দিয়ে দিলেই সব গোলমাল। রাজেন তেমন ভুল করে না। চালু পাট্টি।
রাজেনদা তো খুব ঠাণ্ডা লোক। মুখে কথাটি নেই। কারও নিন্দা করে না কখনও। তুমি তার সম্বন্ধে এমন খারাপ কথা বলছ কেন আমাকে? শুনে আমার কী লাভ?।
ভাবছ তাই। ও জায়গা বুঝে চলে। হাড়কেপ্পন বদমাশ লোক। জায়গা বুঝে দাতা। জায়গা বুঝে বক্তা। নিজে হাতে পিঁপড়ে মারে না বলে মানুষে জানে। অথচ বাঘ-ভাল্লুক ওই মারে আকছার। তবে অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে। কারও জানবার জো-টি পর্যন্ত নেই। বড় সাঙ্ঘাতিক মানুষ আমাদের এই ভাজা মাছটি উলটে খেতে-না-জানা ভাবকরা রাজেন মুহুরী। আমাদের এই গুণ্ডা হাতির চেয়েও ও বেশি ভয়ের।
এতোই যদি খারাপ ধারণা রাজেনের সম্বন্ধে তা হলে সঙ্গে থাকো কেন?
ওই তো। আমাদের মালিক যে এক। মালিক যদি চোখ বন্ধ করে থাকেন, নাকে তেল দিয়ে ঘুমোন, শুধুই নিজের লাভের কড়ি গোনেন তবে রাজেনের মতো মানুষের বাড় বাড়বে না? লাভ-লোকসান ছাড়াও কিছু অঙ্ক থাকে জীবনে, যা সময়ে না মেলালে পরে আর মেলে না। বুঝেছ রুদ্রবাবু? সেটাই আমার মালিক বুঝলেন না।
এতসব বড় বড় এবং গোলমেলে কথা আমার মাথা গোলমাল করে দিল। দুর্গার্দাকে আমার যেমন ভাল লাগে, তেমনই রাজেনদাকেও লাগে। এসব শুনতে আমার ভাল লাগছিল না।
আমার মনের কথাই যেন বুঝতে পেরে দুর্গাদা বলল, পৃথিবীর সব মানুষ, সব জানোয়ারই ভাল ঋজুবাবু, এমনকী এই হাতিটাও ভাল। ভাল, যতক্ষণ না তোমার স্বার্থে সে হাত দিচ্ছে। স্বার্থে হাত পড়লেই শুধু বোঝা যায়, স্বার্থ ভাগাভাগি করে খাওয়ার সময়েই জানা যায় কে কত্ত ভাল। তার বাইরের ভাল-মন্দ নেহাতই পোশাকি। বুঝেছ?
ঋজুদা আর রাজেনদার গলা শুনতে পেলাম। ওরা ফিরে আসছে।
ওদের গলা শুনে আমি ও দুর্গাদা উঠে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম।
কী হল? আমি বললাম।
ঋজুদা হাসছিল।
বলল, কিছু হয়নি এখনও, তবে হতে পারে।
দুর্গাদা বলল, বড় নদীর দহটার দিকে গেছিলে?
ঋজুদা অবাক হয়ে বলল, কোন্ দহ?
দুর্গাদা বলল, রাজেন কি জানো দহটার কথা?
বিরক্তির গলায় রাজেনদা বলল, কোন্ দহ? এ-জঙ্গলে কোনও দহ-টহ নেই। মাঠিয়াকুদুতে চাকরি করেছ সুরবাবুদের ক্যাম্পে, তা বলে জঙ্গল আমার চেয়ে তুমি ভাল চেনো দুর্গা তা আমি বিশ্বাস করি না।
দুর্গাদা চুপ করে রইল মাথা নামিয়ে। তা
রপর বলল, তবে তাই।
ঋজুদা বলল, রাজেন, আগে কম্ফুর কী বন্দোবস্ত করবে, তা ঠিক করো। ওর কোনও আত্মীয়স্বজন নেই?
এক ভাই আছে।
কোথায়?
চৌ-দুয়ারে।
সে তো অনেক দূর। এক্ষুনি নিয়ে যাওয়া যাবে না। তা ছাড়া যে-ভটকাই দাদাকে এইভাবে আজ দু বছর ছেড়ে রেখেছে জঙ্গলে-পাহাড়ে, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায়, সে মুখে আগুন দিল কি দিল না তাতে যায় আসে না কিছুই। ওকে আমরাই দাহ করব মাঠিয়াকুদু নালার ধারে। সেখানেই বহু বছর ও থেকেছে। ক্যাম্পে কাজ করেছে। চলো, আমরা ওকে সেখানেই বয়ে নিয়ে যাই। দাহ করব রাতে।
যদি পুলিশে গোলমাল করে? পুলিশের একমাত্র কাজই তো গোলমাল করা।
দুর্গাদা বলল।
না, তা না। তবে পোস্টমর্টেমের মতো দুর্গন্ধ, লজ্জাকর প্রহসনের কোনও দরকার নেই। গ্রামাঞ্চলের দু-একটি পোস্টমর্টেমের অভিজ্ঞতা আমার আছে। ওসব ভুলে যাও তোমরা। পুলিশ তো গ্রেপ্তার করবে আপনাকে এই মৃতদেহ জ্বালিয়ে দিলে। সে আমি বুঝব এখন। তোমাদের চিন্তা নেই।
রাজেন তুমি বন্দুক হাতে গাছে বসে ওর শব পাহারা দেবে। ততক্ষণে দুর্গাকে নিয়ে আমরা হাতিটার একটু খোঁজ করে আসি।
এখন যাবেন? এই রোদে! দুটো প্রায় বাজতে চলল। খাওয়াদাওয়া? রাজেন বলল।
এই কথাতে অত্যন্ত বিরক্ত মুখে তাকাল ঋজুদা রাজেনের দিকে।
কম্ফুকে তো আমার চেয়ে তোমরা অনেক বেশি চেনো। তোমাদেরই সহকর্মী ছিল সে। তার মৃত্যুর কারণে আমাদের সকলেরই আজ উপোস। তার আত্মার প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য।
দুর্গাদা বলল, নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই। তাই তো করা উচিত।
ঋজুদা বলল, চল, নালা থেকে পেট ভরে জল খেয়ে নিই। যা রোদ। কখন আবার খাওয়া জোটে তার ঠিক কী।
আদৌ কোনওদিন জোটে কি না, তারই বা ঠিক কী!
আমি বললাম, কম্ফুর দিকে চেয়ে।
যা বলেছিস।
বললাম, চলো।
ঋজুদা বলল, তার আগে চল সকলে ধরাধরি করে কম্ফুকে ছায়াতে নিয়ে গিয়ে শোওয়াই। বড় রোদ লাগছে বেচারার। একটা মানুষের মতো মানুষ ছিল রে কস্ফু। ওর বউ ওর মতো মানুষের দাম বোঝেনি।
আমি বললাম, যদি নাই-বা দাম বোঝে কেউ তা হলেও চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার তো কোনও মানে নেই।
নিশ্চয়ই নেই।
ঋজুদা বলল।
আগে আমরা রাইফেলগুলো জিপে রাখলাম। জিপটাকেও ছায়াতে নিয়ে এসে দাঁড় করালাম। তারপর চারজনে হাত লাগিয়ে ওই রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডকে বয়ে নিয়ে এসে নালার পাশে ঠাণ্ডা স্নিগ্ধ জায়গাতে রাখলাম। রেখে, নালার জলে হাত ধুলাম ভাল করে। মানুষের রক্তেও জানোয়ারের রক্তের মতো বগন্ধ থাকে। তারপর উজানে গিয়ে পরিষ্কার জল দেখে চোখে-মুখে-ঘাড়ে কানের পিছনে জল দিয়ে পেট ভরে জল খেলাম।
ঋজুদা বলল, চল এবার। ডে-লং-নাইট-লং ভিজিত্। হাতিটাকে যখন চাক্ষুষকরা গেছে এই সুযোগ নষ্ট করলে চলবে না। তা ছাড়া কম্ফুকে ও এমন করে চোখের সামনে মারাতে ওর সঙ্গে আমাদের এক ধরনের ব্যক্তিগত শত্রুতাও জন্মে গেল। এখন ভেত্তো র সময়। খুনের বদলা খুন।
রাজেনকে নিজের পাইপের টোব্যাকো-পাউচ থেকে একটু সুগন্ধি তামাক দিয়ে ঋজুদা বলল, আচ্ছা রাজেন, আমরা তা হলে এগোচ্ছি। তুমি পারলে কিছু জ্বাল কাঠ কেটে রাখো এখনই। ফিরে এসে আমরা ক্যুকে দাহ করব।
দুর্গাদা বলল, আমাদের মধ্যেও কাউকে করতে হতে পারে। কে বলতে পারে?
ঋজুদা ধমকে বলল, বাজে কথা বলবে না দুর্গা। ভাল কাজে বেরনোর আগে আজেবাজে কথা ভাল লাগে না।
তারপর বলল চলি আমরা রাজেন।
আইজ্ঞাঁ। রাজেনদা বলল।
আমরা তিনজনে গেলি বনের মধ্যে মাইলখানেক যাওয়ার পর ঋজুদা বলল, হাতিটা কিন্তু ওই দহ না কী বলছে দুর্গা, সেদিকেই গেছে। এতক্ষণে হাতির কাছে পৌঁছে যাওয়া যেত। কেন যে রাজেন বলল না।
রাজেন জানতই না ঋজুবাবু।
তা তুমি এলে না কেন? আমি তো এবার শিকার করতে আসিনি। সঙ্গে-সঙ্গে গুলি করার সুযোগ পেলে ঝামেলাই মিটে যেত।
আমাকে তো ডাকলেনই না। ঝড়ের মতো চলে গেলেন। আমাকে তো থাকতেই বলে গেছিলেন।
তাও তো থাকলে না। হাতির হাতে মরার কথা তো তোমারই ছিল আজ।
আমি বললাম।
তাই?
অবাক হয়ে ঋজুদা বলল।
তাই নয়?
মাথা নিচু করে দুর্গাদা বলল, জল খেতে গেছিলাম আর আমগাছ থেকে কিছু কাঁচা আমও পাড়তাম। পঞ্চমী কাঁচা আম খেতে খুব ভালবাসে। বিয়ে হয়ে চলে যাবে মেয়েটা।
ঋজুদা সহানুভূতির গলায় বলল, যাই হোক, এমন মূখার্মি আর কোরো না।
এটুকু বলেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল ঋজুদা।
কী, হল? আমি বললাম।
হাওয়া ঘুরে গেছে।
দুর্গা সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু গেড়ে বসে মাটি থেকে একমুঠো ধুলো নিয়ে উড়িয়ে দিল। ধুলোগুলো আমাদের সোজা সামনে উড়ে গেল। দুর্গাদার মুখ প্রসন্নতায় ভরে গেল।
কী? ঋজুদা শুধোল।
না ঠিক আছে। আমরা দু মাইল গিয়ে তারপর অপেক্ষা করব। এই। হাওয়াতে হাতি গন্ধ পাবে আমাদের। কারণ দহটা, আমরা যেখান থেকে বাঁয়ে মোড় নেব, সেখান থেকে প্রায় আধমাইলটাক ভেতরে।
ঋজুদা বলল, বাঁচালে দুর্গা। তবে কথাবাতা এখন থেকে একদম বন্ধ। কথাবার্তা হবে মাঠিয়াকুদু নালাতে কম্ফুর মৃতদেহের কাছে ফিরে গিয়ে।
দুর্গাদাও সে কথাতে সায় দিল।
বৈশাখের মাঝামাঝি। রোদ বেশ কড়া। গাছে পাতা থাকলে রোদ অবশ্য বোঝাই যেত না। লু-এর মতো দমকে দমকে বাতাস বইছে শুকনো পাতা আর লাল ধুলো উড়িয়ে। নাকের মধ্যে দিয়ে সে হাওয়া গিয়ে মাথার মধ্যে, যেখানে যা-কিছু আর্দ্রতা ছিল, তা শুকিয়ে দিচ্ছে।
আমরা সিঙ্গল ফরমেশনে হেঁটে চলেছি, নরম সাদা গেলি বনের ঝাঁঝ-ওঠা জঙ্গলে। মাথার নীচের খুলি গরম হয়ে উঠছে। গরম হয়ে উঠছে রাইফেল। যেখানে হাত লাগছে ইস্পাতে, ছেকা লেগে যাচ্ছে। আস্তে-আস্তে হাঁটছি আমরা। কিন্তু আস্তে হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে এই রোদে। ঘড়িতে দুটো বেজে পনেরো এখন। সকাল থেকে সেই ডিমের পোচ আর চা ছাড়া পেটেও কিছু পড়েনি।
ঋজুদা ফিসফিস করে কানের কাছে মুখ লাগিয়ে বলল, এক কাপ চা পেলে বেশ হত। কী বল?
মাথা নাড়লাম আমি। ভাবছিলাম, ভটকাই আর তিতির, এবিকাকু আর ফুটুদার তত্ত্বাবধানে জম্পেশ করে খেয়েদেয়ে এখন হয় ঘুম লাগিয়েছে, নয় ওয়ার্ড-মেকিং খেলছে। দরজা-জানলা বন্ধ ঠাণ্ডা ঘরে। এই গেণ্ডুলির বনে যদি কেউ পথ হারায় তো পথ সে খুঁজে পাবে না বছরের অন্য সময়ে। এখন ন্যাড়া বলে আমাদের ডান দিকের উঁচু পাহাড়, মায় লালমাটির রাস্তাটাসুদু দেখা যাচ্ছে। সেই শিঙাল-শম্বরটা ওই রাস্তা দিয়ে পাহাড়ের গায়ে গায়ে একা হেঁটে যাচ্ছে শিঙ উঁচিয়ে খাঁখাঁ খর রোদে।
ভাবছিলাম, যত পাগল এসে জুটেছে এখানে, কী মানুষ, কী জানোয়ার!
কতক্ষণ হাঁটলাম, খেয়াল ছিল না। একসময় ঘড়িতে দেখলাম, সাড়ে-তিনটে বাজে।
দুর্গা ইশারাতে বলল, এবার আমাদের বাঁয়ে মোড় নিতে হবে। আধ মাইল গেলেই দহ। সেখানে গভীর জঙ্গল। ছায়াচ্ছন্ন। নিবিড়। এই গ্রীষ্মেও আরাম।
ভাবলাম, হাতিও সে কারণেই গেছে। এয়ার কন্ডিশন্ড কমফর্টে।
ঋজুদা একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে কী যেন ভেবে নিল। তারপর পাইপটাকে নিভিয়ে, ছাই ঝেড়ে বেল্টের সঙ্গে গুঁজে রাখল।
দুর্গাদা একটা বিড়ি ধরিয়েছিল। বিড়িটা শেষ না-হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল ঋজুদা। তারপর আমরা বাঁ দিকে মোড় নিয়ে আস্তে-আস্তে এগোলাম।
কিছুক্ষণ চলার পরই অন্যান্য গাছ দেখা যেতে লাগল। এমন গাছ, যাদের পাতা ঝরে না এবং ঝরলেও ঝরে শীতকালে। একটু-একটু ছায়া পেতে লাগলাম এখন। হাওয়াটাও তত গরম লাগছে না আর। জলের দিকে এগোচ্ছি বলেও হয়তো-বা। আর-একটু যেতেই লাল কাদা মেখে লালমুখো সাহেব-হয়ে-যাওয়া একদল শুয়োরের সঙ্গে দেখা হল আমাদের। তাদের মধ্যে কয়েকটি বেশ বড় দাঁতাল ছিল।
আমরা থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। সম্মান দেখালাম ওদের, যোগ্য সম্মান। শুয়োর-টু যেই খেয়েছে, সেই সম্মান দেখায়। আমরা সকলেই কখনও-না-কখনও খেয়েছি।
শুয়োরেরা জলের দিকে চলে গেল। আমরা যেদিক দিয়ে গেণ্ডুলি বনে ঢুকেছিলাম, ওরা তার উলটো দিক থেকে এসেছিল। তার পর দেখা হল একদল বিরাট-বিরাট গল্বর সঙ্গে। গাউর বা ইন্ডিয়ান বাইসন। তারা শুয়োরেরা যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকে চলে গেল। মানে, দহর দিকে। তারাও আমাদের কিছু বলল না।
কোনও বার্কিং-ডিয়ার বা হনুমানের দল আমাদের দেখে ফেললেই মুশকিল ছিল। তাদের এলার্ম-কল-এ হাতি হয়তো সাবধান হয়ে যাবে। ডিড-ড্য-ডু-ইট পাখির নজরে পড়লেও বিপদ ছিল। জানাজানি কানাকানি হয়ে যেত। মুশকিল হত ধারেকাছে অন্য হাতিরা থাকলে। তা নিশ্চয়ই নেই। থাকলে, গুণ্ডা হাতি এসে এখানে থাকত না।
ঋজুদাও বলছিল, পথে আসতে-আসতে যে, বহুবারই মাঠিয়াকুদু নালার ক্যাম্পে এসে থেকেছে ফুটুদার সঙ্গে। কিন্তু এখানে হাতি কখনওই দ্যাখেনি। জায়গাটা উপত্যকা, তায় একটা খোলের মধ্যে। এখানে ঢোকা সোজা। বেরনো মুশকিল। তা ছাড়া বসতিও খুব দূরে দূরে। খেতের ফসল, যেমন ধান, এই খোলের মধ্যে আদৌ হয় না মানুষের বসতি না থাকাতে। গুণ্ডা হয়ে গেছে বলেই বোধহয় হাতিটা এই নিরিবিলি গর্তে এসে রয়েছে। এর দৌড় এখান থেকে লবঙ্গি ও পম্পাশর।
কুড়ি মিনটি পথ খুব আস্তে-আস্তে গিয়ে আমরা গভীর জঙ্গলের মধ্যে পৌঁছে গেলাম। এতক্ষণ দুর্গাদা আর ঋজুদা হাতিটার পায়ের দাগ নজর করে-করেই আসছিল। এখন এই জায়গাটা ঘন ঘাসে ভরা থাকায় পায়ের দাগ নজর করার অতখানি সুবিধে হচ্ছিল না, কিন্তু জমি নরম বলে হাতির ওজনের কারণে সুবিধেও হচ্ছিল পায়ের দাগ খুঁজতে।
চারদিক দিনমানেই এখন অন্ধকার। আন্দাজে আর এগনোও যায় না। সামনে শখানেক গজ দুরেই মস্ত দহটা। নালাটা এখানে এসে ছড়িয়ে গেছে যে, শুধু তাই-ই নয়, প্রতি বছর নানা জানোয়ারে গরমকালে এখানে এসে গা ডুবিয়ে বসতে বসতে বা ওয়ালোয়িং করতে করতে জায়গাটা খুব গভীরও হয়ে গেছে নিশ্চয়ই।
ঋজুদা, দুর্গাদাকে ইশারাতে বলল, ঝাঁকড়া একটা বসি গাছে চড়ে দেখতে। এবং হাতিকে দেখতে যদি পায়, তবেই আমাদের ইশারা করে জানাতে। নইলে চুপ করে থাকতে। দুর্গাদাই এখন আমাদের স্কাউট।
হাতি যতক্ষণ দহতে গা ডুবিয়ে থাকবে, যদি আদৌ এখানে থেকে থাকে, তবে তখন গুলি করা চলবে না। সেটা আনস্পোর্টসম্যানসুলভ হবে। তা ছাড়া কাদায়-থাকা অবস্থায় হাতি মারা গেলেও তাকে তোলা যাবে না। দাঁত এবং গোড়ালি কেটে নেবার অনেক অসুবিধে হবে।
দুর্গাদা খুব আস্তে-আস্তে কসি গাছটাতে চড়তে লাগল। এই গাছের ডাল খুব শক্ত হয় বলে এই গাছেরই কাঠ দিয়ে ওড়িশার গ্রামাঞ্চলে গোরুর গাড়ির চাকা তৈরি করে মানুষেরা।
ঋজুদা দুর্গাদাকে বলে দিয়েছিল যে, হাতিকে দেখতে পেলেই মাত্র একবারই ডান হাতটি নাড়াবে। হাতি যদি কাদায় বসে থাকে তবে দুর্গাদা নিজের মাথায় হাত দেবে। তারপর হাতি যখন কাদা ছেড়ে উঠবে, তখন দুবার পরপর মাথায় হাত দেবে।
ভাবছিলাম, অত হাত-নাড়ানাড়ি ও মাথায় হাতাহাতি হাতির যদি চোখে পড়ে যায়? হাতি অবশ্য তেড়ে এলে দুর্গাদা চেঁচিয়েই সে বাতা আমাদের জানাতে পারে। বড় গাছে চড়ে থাকলে হাতি কিছু ক্ষতি করতে পারবে না। তা ছাড়া একলা হাতি। দলে তো নেই। চেঁচিয়ে বললে, বার্তা পাব ঠিকই, কিন্তু আমাদের কাছে বার্তা পৌঁছনোর সঙ্গে-সঙ্গে হাতিও হয়তো পৌঁছে যাবে।
আমরা দেখলাম, দুর্গাদা খুব সাবধানে একটু একটু করে উপরে উঠল। তারপর বেশ উঁচু ডালে উঠে পাতার আড়ালে বসে চারধারে ইতিউতি চাইতে লাগল। ঠাহর দেখে মনে হল, সে এখনও দেখার মতো কিছু দেখতে পায়নি।
তা হলে? হাতি কি চলে গেছে দহ ছেড়ে?
অথবা দহতে নামেইনি আদৌ?
একটুক্ষণ পর নাক উঁচিয়ে যেন অনেক দূরে তাকিয়ে হাতিকে দেখতে পেয়েছে এমন ভাব-ভঙ্গি করে একবার ডান হাত নাড়ল সে। পরক্ষণেই নিজের মাথায় হাত দিল। তখন আমাদেরও আক্ষরিকভাবে মাথায় হাত দেবারই অবস্থা।
তারপরই আমাদের দিকে চেয়ে হাত প্রসারিত করে বোঝাল যে, হাতি একটু দূরে আছে। কাছের দহে নেই।
ঋজুদা হাত নেড়ে বলল, ঠিক আছে।
মানে, আমরা বুঝেছি তার সঙ্কেতের অর্থ।
ভাবছিলাম, কম্যান্ডোদেরই মতো প্রত্যেক ভাল শিকারিরই সিগন্যালিং-এ ভাল ট্রেনিং থাকা দরকার। তারপর ঋজুদা আমাকে কানে কানে বলল, বিশ্রাম করে নে একটু।
জায়গাটা বিশ্রাম করার উপযুক্তই বটে। কুসুম গাছের লাল ফুলে ফুলে মনে হচ্ছে যেন আগুন লেগেছে বনে বনে। চারধারে গ্রীষ্মবনের মধ্যেও নানা জলজ গন্ধ ও শব্দ। তার মধ্যে স্কার্লেট-মিনিভেট, বুলবুলি, বউ কথা কও, কোকিল, আরও কত পাখি যে ডাকতে-ডাকতে ফুল ঝরিয়ে ওড়াউড়ি করছে, তা কী বলব। বড় বড় সব গাছের নীচে-নীচে অঞ্জন গাছ। ভারী সুন্দর দেখতে এদের পাতা। চেরা-চেরা বটল-গ্রিন রঙা এদের পাতা। কার্তিক-মাঘ মাসে সুপুরির মতো দেখতে, ফলসারঙা গোল-গোল ফল ধরে এই গাছগুলোতে। জলপাই-এর মতো স্বাদ। টক করে খায় পাহাড়বনের গ্রামের লোকেরা। অণ্ঠনের কচি পাতাও বর্ষাকালে টক করে খায়। অগুন ফল বিছানাতে রাখলে ছারপোকা হয় না বিছানাতে।
কুসুম আর হরজাই বনের ওধারে শুধুই গেলি। শিমুল এবং পলাশও আছে। বাঁশের বনে ফুল ফোঁটা শেষ। মরার পালা এবার। কিন্তু জংলি আমগাছগুলোতে বোল এসেছে। জংলি কাঁঠাল গাছে মুচি। রুখু হাওয়াতে তাদের মিষ্টি গন্ধ ভাসছে। অনেক গাছে পন্বস ধরে গেছে। ওড়িয়াতে কাঁঠালকে বলে পন্থস। এঁচড় এবং কাঁঠালের একই নাম। আদিগন্ত লাল ফুলের মাঝে-মাঝে আমের সাদা-সাদা ফুলগুলোকে দারুণ দেখাচ্ছে।
বেলা পড়ে আসছে। নানা জানোয়ার দলে দলে আসছে। নানা পাখি। দূর থেকে হু-য়া-ও করে বাঘ ডেকে উঠল। জলে আসছে বোধহয়। এখনও দূরে আছে অনেক। বাঁশে-বাঁশে কটকটি আওয়াজ উঠছে। ঝরা পাতারা উসখুস করে ঝরে পড়ছে। মৌটুসি পাখি তারই মধ্যে ফিসফিস করছে। শেষ বিকেলের হাওয়ায় পাতা দুলছে। আলো-ছায়ার চিরুনি বুলোচ্ছে দীর্ঘ-চুলের গাছেরা সন্ধের আগে। কাঁপা কাঁপা চিলতে চিলতে রোদ ঝলকাচ্ছে তাদের পাতায়-পাতায়। একজোড়া নীলচেরঙা রক-পিজিয়ন গুটিগুটি পায়ে পাথরের আলসেতে পায়চারি করছে। যেন, রিটায়ার্ড বুড়োর সঙ্গে বুড়ি। চারদিকের এই গন্ধের সমারোহ ও শব্দমঞ্জরির মধ্যে আমার ক্লান্ত চোখ মুহূর্তে জড়িয়ে এল। ঋজুদা পাশে থাকলে কোনও ভয় নেই। যমদুয়ারেও ঘুমোতে পারি আমি। ঘুমিয়ে পড়লাম।
হাতিটাও কি ঘুমোচ্ছে এখন? লাল থকথকে কাদার মধ্যে গা ডুবিয়ে গাছের ছায়াতে? কী স্বপ্ন দেখছে ও কে জানে? হয়তো গাইছে নয়নামাসির মতো, সেই রবীন্দ্রসঙ্গীতটি;
এ পরবাসে রবে কে হায়!
কে রবে এ সংশয়ে সন্তাপে শোকে।
হেথা কে রাখিবে দুখভয়সঙ্কটে
তেমন আপন কেহ নাহি হে প্রান্তরে হায় রে ॥
হাতিটারও একদিন সব ছিল। সবাই ছিল। আজ কেউই নেই। কস্ফুরই মতো। কম্ফুর ইতিহাস জানলে উন্মাদ হাতিটা উন্মাদ কল্ফকে হয়তো ক্ষমা করে দিত। একজন বিতাড়িত, অপমানিত মানুষ আর একটি হাতির মধ্যে হয়তো এক-ধরনের সখ্য জন্মাত। যা জন্মালে স্বজন-বিরোধ ঘটাত না হাতিটা।
হাতির চোখ দিয়ে তো জল পড়ে দুঃখ হলে। হাতিটা কি কাঁদছে এখন? তার চোখের জল নিঃশব্দে গিয়ে মিশছে দহর জলে।
এ-ছায়াচ্ছন্ন দহর মধ্যে আমি মৃত্যুর গন্ধ পাচ্ছিলাম। আজ কেউ মরবে। হয় আমাদের মধ্যে কেউ। নয় হাতিটা। মৃত্যুর গন্ধটা কোনও ঝাঁঝালো নাম-না-জানা ফুলের গন্ধের মতো। হাওয়ার দমকে ভেসে আসে। নাক জ্বালা করে। পরমুহূর্তে ভেসে চলে যায়।
কতক্ষণ পরে ঠিক জানি না, যেন একযুগ পরে, ঋজুদা ঠেলা মারল আমাকে আস্তে করে। পেটে।
তাকিয়ে দেখি ঋজুদা হাঁটু গেড়ে বসে সাবধানে মাথা উঁচিয়ে দেখছে।
আমিও তাই করলাম।
শুনতে পেলাম খ, হাপুস-হুঁপুস, পকাত্-চকাত্ বিচিত্র সব শব্দ। লাল কাদা-জল মেখে একটা লাল পাহাড়ের মতো ঘোলা, বিচ্ছিরি, লাল কাদা দহ থেকে উঠল গুণ্ডা হাতিটা। আমাদের সামনে যে দহ, তাতে সে ছিল না, ছিল তার পেছনের দহে। তার প্রকাণ্ড দাঁত দুটোও লাল কাদাতে লাল হয়ে গিয়েছিল। হাতি শুকনো ডাঙায় উঠেই বড়-বড় পা ফেলে নালা পেরিয়ে ঘন হরজাই বনের মধ্যে দিয়ে চলতে লাগল, আমরা যেদিক থেকে এসেছিলাম সেই দিকে মুখ করে।
বোধহয় গেলি বনের দিকেই যাচ্ছে।
ঋজুদা বুকে হেঁটে ঠিক নয়, নিচু হয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাতিটার দিকে এগোতে লাগল ঝোপঝাড়ের আড়ালে আড়ালে। আমাকেও এগোতে ইশারা করে। হাতিটা প্রথম চা-এ অনেকখানিই এগিয়ে গিয়েছিল। হাতি জোরে চললে মানুষের পক্ষে তার নাগাল পাওয়া ভার। তবে এখন চলছে বেশ আস্তে। তবুও গজেন্দ্রগমন বলে কথা।
গতি কমিয়েছে। কেন যে, সে সেই জানে।
এবারে আমরা প্রায় হাতিকে ধরে ফেলেছি। কিন্তু আমাদের আসার কথাটা সে যেন না জানে। এখানে এই দহর কাছে জঙ্গল খুবই গভীর। সব গাছেই পাতা আছে। অস্তগামী সূর্যের আলো খুব কমই পৌঁছেছে। যখন হাতিকে প্রায় ধরে ফেলেছি, হাতির বেশ কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, ঠিক তখনই হঠাৎ হাতিটা হারিয়ে গেল।
কোথায় যে লুকিয়ে পড়ল অতবড় জানোয়ারটা বুঝতে পর্যন্ত পারলাম না একটুও। আমাদের দুজনের কেউই নয়। আর ঠিক সেই সাঙ্ঘাতিক মুহূর্তেই ঋজুদা আঁক শব্দ করে একটা বড় গর্তের মধ্যে পড়ে গেল। মস্ত বড় শিমুলের শিকড়ের আঘাত লাগল কোমরে। মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। মনে হল, কোমরের হাড় ভেঙে গেছে বুঝি।
যে ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঋজুদা পড়ল, তারা ঝরঝর শব্দ করে নড়েচড়ে উঠল। ভয়ে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। এই নিবিড় জঙ্গলে গরমের দিনে রাত নামার ঠিক আগে-আগে জলের পাশে সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে খুনি গুণ্ডা হাতিটাও ইচ্ছে করে হারিয়ে গেল আর ঋজুদাও পড়ে গেল এমনভাবে যে, শিগগিরই যে সে উঠতে পারবে, মনে হল না।
ঋজুদার দিকে আমি অসহায়ের মতো তাকালাম এক ঝলক। তখন সমবেদনা জানাবার সময় ছিল না।
ঋজুদা কথা না বলে, নিজের রাইফেলটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আমার রাইফেলটা নিজে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে রইল রাইফেলটার নল সামনে করে। আমাকে ইশারাতে বলল, এগিয়ে যেতে।
কমান্ডারের আদেশ। এবং সামনে অমিত পরাক্রমশালী অদৃশ্য শত্রু। এগিয়ে যেতে লাগলাম আমি নিচু হয়ে। প্রায় লেপার্ড-ক্রলিং করে। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল কম্ফু-বদ্যির তালগোল পাকানো রক্তাক্ত পিণ্ডের মতো মৃতদেহ।
ভাবছিলাম, মানুষের মৃত্যু কত বিভিন্ন রূপ ধরেই না আসে।
ঋজুদা আছাড় খেয়ে পড়বার সময় শব্দ হয়েছিল আগেই বলেছি। তার চেয়েও বড় কথা গুলি ভরা রাইফেলের গুলি ছুটে যেতেও পারত। এবং দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। তা ঘটেনি। একটাই ভরসার কথা ছিল এই যে, হাতিটাকে আমরা হারিয়ে ফেলার আগে হাতির মুখ ছিল সামনে। মানে, আমাদের ঠিক উলটো দিকে এবং ঋজুদার পড়ে যাওয়ার আওয়াজ যদি সে শুনেও থাকে তবুও সে হয়তো আমাদের অবস্থানটি দ্যাখেনি। এই ভেবেই সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম নিজেকে। হাতি শব্দ শুনলে বা ঋজুদাকে দেখতে পেলে এতক্ষণে রে! রে! করে তেড়ে আসত নিশ্চয়ই!
এগিয়ে তো গেলাম, কিন্তু প্রায়ান্ধকারে হারিয়ে-যাওয়া গুণ্ডা হাতির পেছনে আন্দাজে যাবটা কী করে? ঋজুদার কাছ থেকে আমি প্রায় পঞ্চাশ গজ এগিয়ে এসেছি। ঋজুদাকে এখন আর দেখাও যাচ্ছে না। অতি দ্রুত আমার চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। বনের চন্দ্রাতপের নীচে আছি। বড়জোর মিনিট-পাঁচেক রাইফেল দিয়ে গুলি করার মতো আলো থাকবে আর এখানে। ভয়ে হাত-পা অবশ হয়ে এল। ঘাম দিতে লাগল খুব। আর না এগিয়ে উবু হয়ে বসে আমি ফ্রিজ করে গেলাম রাইফেলটাকে রেডি-পজিশানে ধরে।
রাইফেলটাও তেমন। চোদ্দ পাউন্ড ওজন। ফ্রিজ করে গিয়ে খুব আস্তে-আস্তে ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে দেখতে লাগলাম। এতই আস্তে যে, কোনওরকম চাঞ্চল্য যেন কারও চোখেই না পড়ে তা নিশ্চিত করে। কিন্তু কিছুই যে দেখতে পাই না। চারধারেই গাছের কাণ্ড। গাছেরা চারপাশে আমাকে ঘিরে আছে। তাদের সোঁদা গন্ধ গা নিয়ে। মোটা গাছ, মাঝারি গাছ, সরু গাছ। সার-সার নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা। একটা কুটুরে ব্যাঙ ঠিক সেই সময়ে কুটুর-কুটুর ডেকে উঠল। হয়তো আমাকে ভয় পাওয়াবারই জন্য।
একবার ডাইনে থেকে বাঁয়ে আর-একবার বাঁ থেকে ডাইনে ঘাড় পুরো ঘুরিয়ে নিয়ে দেখলাম এবং ঘাড়টা ঘোরানো দ্বিতীয়বার যখন শেষ করে এনেছি প্রায় ঠিক সেই সময়েই আমার হৃৎপিণ্ড একদম বন্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ লক্ষ করলাম যে, আমার ডান দিকে খুবই কাছে দুটো গাছের কাণ্ডর রং সাদাও নয় কালোও নয়। লাল। এবং সেই দুটি গুঁড়ি থেকে তখনও কাদা ও জল ঝরছে। চোখের দৃষ্টি যতখানি তীক্ষ্ণ করা যায়, ততখানি তীক্ষ্ণ করে আমি সেই লাল গুঁড়ি দুটিকে লক্ষ করে দেখলাম আরও একটি মড়া গুঁড়ি সামনে আছে। তারপর দুটি মোটা লাল গুঁড়ির মধ্যে এবং একটি গুঁড়ির সঙ্গেই প্রায় আরও একটা গুঁড়ি চোখে পড়ল।
আমার মধ্যে থেকে অদৃশ্য কে যেন চিৎকার করে বলে উঠতে গেল : হাতি-ই-ই-ই।
কিন্তু অদৃশ্য অন্য কেউ যেন আমার মুখ সজোরে চেপে ধরল দুহাতে। কম্ফুর চেহারাটা আবারও মনে পড়ল।
পেশি এবং স্নায়ু যথাসাধ্য শক্ত করে আবারও আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পেছনে চেয়ে দেখলাম। না, কেউ নেই। তখনও ঋজুদা সেই গর্ত থেকে উঠে আসতে পারেনি।
কিন্তু দুর্গাদা?
পরমুহূর্তেই ভাবলাম, সেই বা খালি হাতে এসে কী করবে?
ঋজুদার সঙ্গে দেশে-বিদেশে অনেক বিপজ্জনক প্রাণীর মুখোমুখি হয়েছি, আজ অবধি কিন্তু এমনটি বিপদ আর কখনও হয়নি।
নিজেকে শক্ত করতে লাগলাম। ভটকাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। ব্রাদার, লাইফে তোমার আসলে কেউই নেই। একা এসেছ, একা যাবে। তুমি পটল তোলার পর তোমাকে কেউ বারোটি ঘণ্টাও মনে রাখবে না। এই হচ্ছে সার কথা। তবে আর ভয়-ভাবনা করা কেন?
হাতিটা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতিই তো? এত কাছে? মেরুদণ্ড বেয়ে একটা ঠাণ্ডা সাপ নেমে গেল। পাগুলো ও গুঁড়টাতে এতটুকুও কম্পন নেই। এত বড় একটা জানোয়ার কী করে যে এমন নিশূপে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, তা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে দ্রুত। হাতিটার মাথা বা কান কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। শরীরের কোনও ভটকাইটাল অংশই নয়, যেখানে গুলি করতে পারি।
নিশ্বাস বন্ধ করে, তাকে আর-একটু ভাল করে দেখতে পাওয়ার আশায় আমি এক গজ এগোলাম। চুলচল করে করে। যেন, একযুগ ধরে। এবং এগোতেই, ডালপালার আড়াল সরে গিয়ে হাতির শরীরটা এবারে নজরে এল। তাও লাল কাদা-মাখা। হাতিটা আমার এতই কাছে দাঁড়িয়ে আছে যে, ইচ্ছে করলেই আমাকে খুঁড় দিয়ে জড়িয়ে নিতে পারে। হাতিটার শুড় দেখে বুঝলাম যে, ঋজুদা যেখানে গর্তে পড়েছে সেই মস্ত শিমুলের দিকেই সে চেয়ে আছে। একদৃষ্টে। দুর্গাদাটা আবার নড়াচড়া না করে! হাতিটা কি দেখতে পেল ঋজুদাকে?
আর ভাববার সময় নেই। হাতির মাথা বা কানের পাশে গুলি করার সুযোগ যখন নেই, তখন আমি মায়ের মুখ স্মরণ করে হাতির হার্টটা যেখানে থাকতে পারে বলে অনুমান করলাম, সেইদিকে নিশানা নিয়ে চুলচুল করে রাইফেলটা ওঠালাম। ফোর-সেভেনটি-ফাইভ ডাবল ব্যারেল রাইফেলটার ওজন চোদ্দ পাউন্ড। এ রাইফেল কপিকলে করে তুললে মানায়। ঋজুদার মতো লম্বা-চওড়া মানুষ বলেই এই রাইফেল অবহেলায় নাড়াচাড়া করে। অত ভাবার সময় আর নেই। আমি এখন আর আমি নেই। রোবট হয়ে গেছি কোনও। রিমোট কন্ট্রোলে ঋজুদাই যেন নির্দেশ দিচ্ছে।
নিনিকুমারীর বাঘ মারতে গিয়ে ভটকাইয়ের গুলিকা বাঘিনী যে ডান হাতটা জখম করে দিয়েছিল গত শীতে তা এখনও মাঝে-মাঝেই কষ্ট দেয়। হাতটা এখনও, এত ভারী আর বড় বোরের রাইফেল চালাবার মতো পোক্ত হয়নি। কিন্তু এখন শুধু ঋজুদার আর দুর্গার্দারই নয়, আমার নিজেরও প্রাণ-সঙ্কট।
রাইফেলের নলটা সোজা হতেই ব্যাক-সাইট আর ফ্রন্ট-সাইট যতখানি ভাল করে পারি দেখে নিয়ে সেফটি ক্যাচ অন করতে করতেই ট্রিগারে ফাস্ট প্রেশার দিলাম এবং পর মুহূর্তেই সেকেন্ড প্রেশার।
উপত্যকার ওই ছায়াচ্ছন্ন নিবিড় বনময় ঘেরাটোপের মতো নিশ্চিদ্র জায়গাটিতে যেন কেউ কামান ছুঁড়ল। এইরকম শব্দ হল। দহর কাছে যত জীবজন্ত ও পাখি ছিল এবং যত জীবজন্তু ও পাখিও এই রাইফেলের বজ্রনির্ঘোষ শুনল তারা সকলে মিলে একই সঙ্গে প্রচণ্ড হইচই তুলল। তাদের ভয়ার্ত চিৎকার আহত হাতির ভয়কে আরও একশো গুণ বাড়িয়ে দিল। এবং সেই ক্যাকোফোনির মধ্যে হতভম্ব আমি দেখলাম যে, হাতিটা যেমন দাঁড়িয়ে ছিল, ঠিক তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। ফোর-সেভেনটি-ফাইভ-এর গুলিও হজমি-গুলির। মতো হজম করে নট-নড়ন-নট-কিচ্ছু হয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল।
গুলি কি তবে মিস করলাম? এত কাছ থেকে?
নাভার্স হয়ে গেলে সবই হতে পারে। বড়-বড় ওলিম্পিকে কমপিটকরা শিকারি দেড় হাত দূরে খরগোশ মিস করে কিন্তু খরগোশ তো গুণ্ডা হাতি নয়। হয়তো ট্রিগার-পুলিং ঠিক হয়নি গুলি হাতির পিঠের উপর দিয়ে চলে গেছে। কিন্তু গুলি মিস করলে আওয়াজ তো অন্যরকম হত। রাইফেল তুলে নিশানা নিয়েই মেরেছিলাম। তাও এত কাছ থেকে। হাতির গায়ে না লাগলে কোনও-না-কোনও গাছের ডালে লাগতই।
বাঁ দিকের ব্যারেলেও হার্ড-নোজড বুলেট আছে আমি জানি। কারণ দুটি রাইফেলেরই গুলি আমিই এনেছি বাঘ্যমুণ্ডা থেকে। তবে যে গুলিটি করলাম তা সফট-নোজড হলে আমার মতো সুখী কেউ হত না। জানোয়ারকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে সফট-নোজড-এর জুড়ি নেই।
কী হল ভাবছি, আর রাইফেলের ট্রিগার গার্ডে আঙুল ছুঁইয়ে বসে একদৃষ্টে সেই ভৌতিক হাতির দিকে চেয়ে আছি। ঠাকুরানির বাঘের পরে কি ঠাকুরানির হাতির খপ্পরে পড়লাম! অবিশ্বাস্য ব্যাপারস্যাপার বেশিদিন ভাল লাগে না আমার। মন দুর্বল হয়ে যায় বড়।
একদৃষ্টে চেয়ে আছি রাইফেল হাতে। মনে হল, হাতির লাল পাগুলো একটু একটু কাঁপছে যেন। তারপরই মনে হল থরথর করে কাঁপছে। যেই অমন মনে হল সঙ্গে-সঙ্গে কে যেন কোন মন্ত্রবলে হাতির গায়ে একটি ফোয়ারা ফুটিয়ে দিল, আর মুহূর্তে সে ফোয়ারা খুলে গেল। ঝরঝর করে ফিনকি দিয়ে নয়, ফোয়ারারই মতো মোটা এবং শব্দময় উৎসারে হাতির বুক থেকে রক্ত ছুটতে লাগল। হাতিটা আমার এতই কাছে ছিল যে যদি গুলি খেয়ে সে আমার দিকে হঠাৎ পড়ত তো আমি হাতির নীচে চাপা পড়েই মরতাম।
ওখান থেকে পালাব কি না ভাবছি, এমন সময় দেখি রক্তের ফোয়ারা আরও জোর হল এবং হাতিটা হাঁটু গেড়ে আস্তে আস্তে বসে পড়ল। যেন প্রার্থনা করবে হাতিদের দেবতাদের কাছে, স্তোত্র পড়বে যাবার বেলায়।
তখন আমি দাঁড়িয়ে উঠে কিছুটা বাঁ পাশে সরে গেলাম। মনটা ভীষণই খারাপ লাগতে লাগল। হাতিটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম আবার ওঠে কি না তার উপর নজর রেখে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর দুটি ছোট গাছ এবং একটি অগুন গাছ ভেঙে হাতিটা ডান পাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। খুব জোরে নিশ্বাস নিল একবার। তারপর আরও জোরে নিশ্বাস ফেলল।
আমি রাইফেলের সেফটি ক্যাচটাকে অফফ করে দিয়ে এবারে পেছন ফিরলাম। দেখি, দুর্গাদা সেই গর্তের মধ্যে থেকে দাঁড়িয়ে উঠেছে, দুহাত মাথার উপর তুলে ধেইধেই নাচ নাচছে। এবং আমার রাইফেলটাকে রেডি পজিশনে ধরে ঋজুদা শিমুলের শিকড়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। চোখ এদিকে। তখনও যে-কোনও ইভেনচুয়ালিটির জন্য তৈরি।
হাতি যে আর কোনও দিনও উঠতে পারবে না তার ওই শয্যা ছেড়ে এই কথা বুঝতে পেরে দুর্গাদা গর্ত ছেড়ে তিড়িং-বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। আমি বললাম, চুপ করো। কারও মৃত্যুর সময়েই গোলমাল করতে নেই। যে যাচ্ছে তাকে শান্তিতে যেতে দাও। মৃত্যুপথযাত্রী বা মৃত প্রত্যেক জীবিতর চেয়ে বেশি সম্মানের। সে যে চলে যাচ্ছে এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে।
দুর্গাদা বলল, পিলা। তু গুট্টে কাণ্ড ঘটাইলু আজি। কঁড় কহিবি মু।
বলেই, গুণ্ডিপানের গন্ধভরা মুখে আমার মাথায় একটা জব্বর চুমু খেল।
আমার কথা শুনল না দুর্গাদা। কী বলতে চাই বোঝে না।
ঋজুদা গর্ত থেকেই চেঁচিয়ে বলল, ব্র্যাভো রুদ্র। ওয়েল ডান্। এদিকে আয়।
ঋজুদার কাছে যেতেই অনেকক্ষণ পর পাইপটা বের করে তাতে আগুন দিয়ে সেটা ধরিয়ে মুখে পুরে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।
আছ কেমন এখন? পারবে উঠতে? আমি বললাম। ঠিক আছি। ঠিক হয়ে যাব। এখন হাতির কথা বল। এমন সময়ই আছাড়টা খেলাম, আর এমনভাবে যে, আজ তোর এবং আমাদের অবস্থাও কম্মুর মতো হলেও আশ্চর্য হবার কিছু ছিল না।
তুমি শেষ মুহূর্তে রাইফেল বদল করলে কেন?
কেন করলাম তা রাইফেলের মার দেখেও বুঝলি না? ওই গুলিটাই তোর নিজের রাইফেল দিয়ে করলে হাতি হয়তো তোকে এবং আমাদের মেরে দিত নিজে মরবার আগে। আফ্রিকার বিখ্যাত হাতি-শিকারি এবং বিশেষজ্ঞ পোণ্ডারো-সাহেব, জন টেলর, লিখেছিলেন যে, এই ফোর-সেভেনটি-ফাইভ রাইফেল দিয়ে ইভন ইফ ড্য শুট অ্যাট দ্য রুট অব দ্য টেইল অব অ্যান এলিফ্যান্ট, ইট উইল রান থু দ্য হল লেথ অব ইটস বডি অ্যান্ড রিচ দ্য ব্রেইনস। এতই ক্ষমতা এই রাইফেলের। আমি আশঙ্কা করেছিলাম যে, গুলি করতে হলে তোকে অত্যন্তই শর্ট-রেঞ্জ থেকে করতে হবে এবং সেগুলি যদি হাতিকে সে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সেই জায়গাতেই থামাতে না পারে তা হলে তোর তো নিশ্চিতই, আমাদের সকলেরও বিষম বিপদ।
হাতি কিন্তু তোমাদের দিকেই তাকিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দ্যাখেইনি। শোনেওনি। তোমার জন্যই আমি বেঁচে গেলাম এ-যাত্ৰা।
ঋজুদা একগলা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, আমিও, মানে, আমি আর দুর্গাও তোরই জন্যে।
দুর্গাদা হেসে বলল, আমাকে একটু ভাল বাসনার তামাকু দাও, খৈনি করে খাব।
ঋজুদা পাইপের টোব্যাকোর পাউচটা বের করে দিল। ৩৫০
ঋজুদার কোমরে চোট সত্যিই খুব জোর হয়েছিল, হাড় ভেঙেছে কি ভাঙেনি, তা অবশ্য অঙ্গুলে গিয়ে এক্স-রে না করালে বোঝা যাবে না। নিজে দু-একবার ওঠার চেষ্টা করল তারপর দুর্গাদা বলল, আমি টাঙ্গি দিয়ে তোমার জন্যে একটা লাঠি কেটে আনছি, তারপর আমাদের দুজনের কাঁধে হাত দিয়ে আস্তে-আস্তে চলতে পারবে।
ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছিল। যে বাঘের ডাক অনেকক্ষণ আগে শুনেছিলাম, তারই বিরক্তির চাপা আওয়াজ শুনলাম দহর একেবারে কাছে। গর-র-র-র-র-র করে। আমরা যে সেখানে আছি তা সে জেনেছে, কিন্তু এও জেনেছে যে, আমরা তাকে শিকার করতে আসিনি। শিকারি যারা, তারা এত অসাবধান হয়ে জোরে জোরে কথাবার্তা বলে না। বাঘেরাও কোন্ মানুষ কী করতে কোথায় উপস্থিত, তা বিলক্ষণই জানে।
বাঘ জল ছেড়ে চলে গেল। একদল গন্ধ এল। তাদের মেজাজ শরিফ থাকলে ভয়ের কিছুই নেই।
দুর্গাদা যে কোন্ চুলোয় বাঁশ কাটতে গেল টাঙ্গি হাতে অন্ধকারে, গন্থদের ঘাড়ে গিয়ে না পড়ে।
গল্বরাও ওঁয়াও-বোঁয়াও আওয়াজ করে জল ছেড়ে চলে গেল। এখন এই খোলের মধ্যে অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। যেখানে-যেখানে সামান্য ফাঁকফোকর আছে, সেখানে-সেখানে অন্ধকার একটু হাল্কা মনে হচ্ছে। অন্য সব জায়গায় ঝুপড়ি ঝুপড়ি অন্ধকার। এই ঘেরাটোপের বাইরে শুক্লাদশমীর চাঁদ এতক্ষণে বিশ্বচরাচর উদ্ভাসিত করে উঠেছে নিশ্চয়ই আর উঠেছে পশ্চিম দিগন্তে সন্ধ্যাতারা। কিন্তু তাতে রূপ খুলেছে মেমসাহেবদের গায়ের রঙের মতো ফরসা গেলি বনেরই কিন্তু সে-বনে পৌঁছতে পারলে তবেই না! বাঁশের ঝাড় আছে দূরের দহর কাছে।
বাঘ ও গল্বদের বিদায় করার পরই বাঁশ কাটতে লাগল দুর্গাদা। বাঁশের উপর টাঙ্গির কোপ পড়ছে তো মনে হচ্ছে বোমা পড়ছে। এই খোলের মধ্যের ঘন জঙ্গলের অডিটোরিয়ামের এমনই অ্যাকুস্টিকস্।
একটু পরই একটি পোক্ত লাঠি নিয়ে ফিরে এল দুর্গাদা। যে-দিকে ঋজুদা ধরবে, সেদিকে যাতে তার হাতে না লাগে, সেজন্য নানারকম পাতা মুড়ে লতা দিয়ে বেঁধে নিয়ে এসেছে ভাল করে। আমরা দুজনে দুহাতে ধরে ঋজুদাকে দাঁড় করালাম। কিছুক্ষণ মুখ-বিকৃতি করে দাঁড়িয়ে রইল ঋজুদা। তারপর আমাদের দুজনের কাঁধে হাত দিয়ে লাঠি ভর করে গর্ত থেকে উঠে দাঁড়াল। খুবই আস্তে-আস্তে।
বললাম, দেখি, এবার হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে একটু-একটু এগোও। ব্যথা কমে আসবে।
ঋজুদা হেসে বা হাসবার চেষ্টা করে বলল, অসহায় একেই বলে।
হাতি এবং গুণ্ডা-হাতির সামনেই ওই বিপজ্জনক মুহূর্তে পড়ে যাওয়াতে ব্যথার সঙ্গে শও মিশে ছিল নিশ্চয়ই। মানুষের উপরে তার মনের প্রভাব, শরীরের প্রভাবের চেয়ে অনেকই বড়।
ঐরাবত ধরাশায়ী হওয়াতে এখন শক্টা চলে গেছে মনে হল। মনে হল কোমরের হাড়ও ভাঙেনি। ভাঙলে, ঋজুদা হাঁটতে পারত না আদৌ। প্রথমে দুর্গাদা ঋজুদার রাইফেল এক কাঁধে নিয়ে অন্য কাঁধে টাঙ্গি ঝুলিয়ে আগে আগে থেকে অন্ধকারে সাবধানে দেখে পা ফেলতে লাগল। পেছনে ঋজুদা। তার পেছনে আমার রাইফেল কাঁধে আমি।
কিছুদূর যেতেই গাছগাছালির কাণ্ড ও ডালপালার ফাঁকফোকর দিয়ে যেন এক স্বপ্নরাজ্য ধীরে-ধীরে ভাস্বর হয়ে উঠতে লাগল আমাদের সকলের মুগ্ধ চোখের সামনে।
দুর্গাদা বলল, সাপে না কাটে! গরমের দিন। তায় অন্ধকার। একটা টর্চ থাকলে ভাল হত।
যা নেই তার চিন্তা করে আর কী হবে। ঋজুদা বলল।
তারপর বলল, দুর্গা, তোমার আর রাজেনের ভার, কাল ভোরে লবঙ্গি আর পম্পাশর থেকে লোক এনে দাঁত দুটো এবং চারটে গোড়ালির ব্যবস্থা করার। হাতির লেজের চুল যেন লোপাট না হয়ে যায়।
তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, বালা আর লকেট বানিয়ে দিতে হবে রুদ্রর মাকে। নয়নাও চেয়েছিল।
একসময় আমরা সেই অন্ধকার অডিটোরিয়াম-এর ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে গেণ্ডুলির বনে দাঁড়ালাম।
আহা!
জ্যোৎস্নার কী রূপ! মাথা ঘুরে গেল। মস্ত ন্যাড়া শিমুলের মগডালে একটি লাল বুক ঈগল স্থবির হয়ে বসে ছিল। যেন মহাকাল। দূরের একটা ছোট গেণ্ডুলির ন্যাংটো ডালে বসে কোনও পাগলা কোকিল ডেকে যাচ্ছিল অবিরত। আর ব্রেইন-ফিভার পাখিরা উড়ে উড়ে ডাকছিল, ব্রেইন-ফিভার ব্রেইন-ফিভার, পিউ-কাঁহা, পিউ-কাঁহা।
দূর থেকে তার দোসর সাড়া দিচ্ছিল।
আমাদের মস্তিষ্কেও জ্বর। অনেক জ্বর। অনেকই কারণে।
আমরা কোনাকুনি এগোলাম শর্টকাট করার জন্য।
ঋজুদা খুবই আস্তে-আস্তে হাঁটছিল পা টেনে টেনে। এবার আমরা পাতা ঝরা গেণ্ডুলি বনের মাঝামাঝি চলে এসেছি। এখানে শুধুই গেলি। যেন হাজার-হাজার মেমসাহেবদের সটান উরুর মধ্যে মধ্যে হেঁটে চলেছি আমরা। সুন্দর একরকম গন্ধ গেলি বনের গায়ে। জ্যোৎস্নায় ভরে গেছে দশ দিক।
বাঁ দিকে দূরে নীল মেঘের মতো দাঁড়িয়ে আছে লবঙ্গির পাহাড়শ্রেণী। ডান দিকে ঘন গভীর বন। যেখানে হাতিটা পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে তার শরীরের এবং মনের সব জ্বালা নিভিয়ে দিয়ে। চিরশান্তির ঘুম।
অত বড় একটা প্রাণী, বয়সে সে হয়তো আমার ঠাকুমার বয়সীই হবে, তাকে মেরে আমার মন বড় ভারী হয়েছিল।
ঋজুদা বলল, দুর্গা, তুমি এগিয়ে গিয়ে কচ্ছুর দাহর বন্দোবস্ত এগিয়ে রাখো। বুঝেছ! রাজেন জ্বাল-কাঠ কেটে রেখেছে কি না কে জানে! আমাদের পৌঁছতে তো সময় লাগবে। রাইফেলটা নিয়েই যাও। বাঁদিকের ব্যারেলে গুলি আছে। সেফটি ক্যাচটা দেখিয়ে দে রুদ্র দুর্গাকে।
ঠিক আছে ঋজুবাবু। ভয় আর কিছুকেই করি না। এক ভালু ছাড়া। কথা নেই, বার্তা নেই খামোখা তেড়ে এসে নাক-মুখ খুবলে নেয় পাজিরা।
আমি ওকে সেফটি ক্যাচটা কোথায় আছে দেখিয়ে দিলাম। দুর্গাদা বাঁ কাঁধে টাঙ্গি ঝুলিয়ে ডান কাঁধে ঋজুদার রাইফেলটা নিয়ে হনহন করে এগিয়ে গেল চাঁদের বনে। বন্যেরা বনে সত্যি সুন্দর।
একটু এগোতেই দুর্গার্দার গান ভেসে এল। জ্যোৎস্নায় ভেসে এসে নিমেঘ নীল তারাভরা আকাশে অকলুষিত, আর বাঁ দিকের লবঙ্গি পাহাড়শ্রেণীতে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলে সে গান ফিরে আসছিল। দুর্গাদা গাইছিল :
ফুলরসিয়ারে মন মোর ছুঁয়ি ছুঁয়ি যা
তো লাগি বিকশি চাহিছে এ কুঞ্জে
গুঞ্জন দেই যা যা।
যা না রে ফেরি, আসসি পাশে যা না
গা মন ভরি, করো না তু মনা
ঝুরিলে কি আউ আসিবে এ দিম্ব
হসসি, লেটি, গাই যা যা
সাজি কেতে কুঞ্জে, কেতে ফুম্ব সেজে
মহক ছটাই মরে নিতি লাজে
লাজ ত্যজি আজি করুছি আরতি
থরে ধীরে চাহি যা যা।
চমৎকার সুরেলা গান।
কী গান এটা? আমি শুধোলাম।
ঋজুদা হাসল।
বলল, টিকরপাড়ায় ঘাটের বাঁশের ভেলা-ভাসানো মাঝিরা এইসব গান। গাইতে গাইতে এমন চাঁদনি রাতে চলে সারারাত সাতকোশিরা গণ্ডে। টিকরপাড়ার ঘাসিয়ানি মেয়েরাও গায়।
তারপরেই বলল, জানিস, রুদ্র, ভারী চমৎকার এই আমাদের দেশ। এই ভারতবর্ষ, না রে? অতি চমৎকার এই দেশের মানুষ।
বলেই, চুপ করে গেল।
আমি জানতাম, কী ভাবছে ঋজুদা।
পরক্ষণেই বলল, একটা গান গা রুদ্র।
কী গান?
ধন ধান্য পুষ্পে ভরা।
আমি খোলা গলায় গান ধরলাম একেবারে তারায়।
ধন ধান্য পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক
সকল দেশের সেরা।
সে যে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি।
সে-দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
ঋজুদার গলা গাঢ় হয়ে এল।
বলল, গা-গা থামলি কেন, পুরোটা গা।
এগিয়ে চললাম আমরা যেখানে ক্যু পড়ে আছে সেদিকে।
কম্ফুর বউ সীতা আর ছেলে কুশ তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল বলে সেই দুঃখেই সে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। কম্ফুর কথা বিস্তারিত ঋজুদা নিজেই লিখেছে লবঙ্গীর জঙ্গলে উপন্যাসে। অনেকদিন আগেই। বড় গুণী লোক ছিল কম্ফু।
হাতিটাও উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল প্রায় একই কারণে। তার প্রিয়জনে ভরা দল, পরিবার এবং গোষ্ঠী থেকে ক্ষতবিক্ষত অপমানিত হয়ে বিতাড়িত হয়ে।
আমরা পাগলা কোকিল আর পিউ-কাঁহার অবিশ্রান্ত ডাকের মধ্যে, পরিষ্কার ধবধবে সুন্দরী গেণ্ডুলি বনের মধ্যে মধ্যে, শুক্লাদশমীর বনজ্যোৎস্নায় আর নক্ষত্ৰজ্যোৎস্নায় ভেসে ভেসে হাঁটতে লাগলাম, খিদে এবং তৃষ্ণার সব কথা ভুলে গিয়ে।
ঋজুদা খুবই আস্তে-আস্তে হাঁটছিল।
আমার মনে হচ্ছিল, আমরা যেন কতদিন ধরেই চলেছি এমনি করে। উদ্ভাসিত আলোয় এবং ক্কচিৎ অন্ধকারে আমরা চলবও।
কম্ফু হাতিটা আমি ঋজুদা।
আমরা সকলেই।