1 of 2

উড়ান

উড়ান

অফিস থেকে ফিরতে বড়োই দেরি হল মীর। ক-দিন ধরে খাটনিও যাচ্ছে খুব। রাঁচির কাছে। ওদের কোম্পানি এডিবল অয়েলের নতুন একটা ফ্যাক্টরি খুলছে। উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুরের। কার্পেট, পাথরের মূর্তির। কার্পেট আর পাথরের আবার এক্সপোর্ট মার্কেট খুবই ভালো। এই দুটি প্রজেক্টের ভারই ওদের এত বড়ো গোষ্ঠির ফিনান্স ডিপার্টমেন্টের মধ্যে বেছে একমাত্র মহিলা। সিনিয়র একজিকিউটিভ ভ্ৰমী রায়ের ওপরেই বোর্ড অফ ডিরেক্টরস দিয়েছেন।

কস্ট-অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং এম বি এ–এই তিন ডিগ্রি, গোষ্ঠীর আরও চারজন পুরুষ একজিকিউটিভ-এর আছে। কিন্তু চেয়ারম্যান এম ডি-র সবচেয়ে বেশি ভরসা ওরই ওপর। এ নিয়ে গাত্রদাহ, বুক-জ্বালা যে কম নেই খুব তাও নয়। তার উপরে ভ্ৰমী সুন্দরী মেয়ে। পুরুষরা, ভ্রমীরই গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে ভদ্রতা দেখায়, আগে যেতে দেয়। কিন্তু সেটা। দেখাবারই জন্যে। নয়তো আর কোথাওই ঘরেই মেয়েদের অগ্রাধিকার নেই। উলটে তারা পথ। জুড়ে দাঁড়িয়েই থাকে। একথা ভ্ৰমী খুব ভালো করেই জানে পুরুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায়। নেমে।

সিলিকন আর ফসফেট প্রজেক্ট দুটোও পুরোপুরি ভ্ৰমীর সুপারভিশানেই গত পাঁচ বছরে তিল তিল করে গড়ে উঠেছে। মাত্র পাঁচ বছর আগে শেয়ার ছাড়া হয়েছিল বাজারে। এখন এক-শো টাকা। শেয়ারের দর উঠেছে দু-শো দশ টাকা। একেবারে ফেনোমেনাল ইনক্রিজ। খুব কম গোষ্ঠীতেই ঘটেছে এরকম ঘটনা। এই দুটি ইউনিটই ওদের পুরো গ্রুপের প্রেস্টিজ ইউনিটস হয়ে উঠেছে।

ড্রাইভার গাড়ির চাবি দিয়ে গেল দুখীকে। আজ ওভারটাইম হল ওর তিন ঘন্টা। সকলেরই ওভারটাইম আছে। শুধু ভ্রমীদের মতো একজিকিউটিভদেরই নেই। অবশ্য বদলে ওরা অনেক কিছুই পায়। সবচেয়ে বেশি যা পায়, তা ক্ষমতা। যার চেয়ে বড়ো চাওয়া এবং পাওয়া একজন মানুষের জীবনে আর কিছুই নেই।

কাঞ্চী জিজ্ঞেস করল চা খাবে কি না?

খাবে না বলেই, বেডরুমে ঢুকে দ্রুত হাতে শাড়ি জামা সব খুলে বাথরুমে শাওয়ারের নীচে গিয়ে দাঁড়াল।

ঠিক সেই সময়ই ফোনটা বাজল। বাথরুমেও এক্সটেনশন আছে তাই বাথরুমেও বাজে একই সঙ্গে।

হ্যালো।

ভেজা হাতেই রিসিভার তুলে বলল।

হাই ভ্রমী। আমি অসিত। কী করছ এই উইক-এন্ডে?

ঠিক করিনি কিছু।

একটু বিরক্ত গলায় বলল ভ্রমী। ভাবল, এভরিথিং হ্যাজ আ লিমিট।

টলিতে যাবে? নাচানাচি হবে। তারপর ডিনার।

তুমি কাল ফোন কোরো। অফিসে। বিকেল চারটে নাগাদ।

ঠান্ডা গলায় বলল ভ্রমী।

এখন ব্যস্ত?

একটু। আই হ্যাড আ ভেরি লং ডে। এখন চান করছি।

চান? ও, তাই জল-পড়ার শব্দ শুনছি। জল পড়ে পাতা নড়ে, ফোয়ারা হতে… হাউ সুদিং। তোমার চানের শব্দেই আমার নিজেরও মনে হচ্ছে যেন চান করছি।

ভ্ৰমী কথা কেটে বলল, বাঈ।

বলেই, ফোন রেখে দিল।

বড়ো বিরক্ত করে ছেলেটা। ছেলেমাত্রই বিরক্ত করে ভ্ৰমীকে। অবশ্য যারা ওর কাছে আসার সুযোগ ও সাহস রাখে।

বেশিরভাগ পুরুষেরই কোনো আত্মসম্মানজ্ঞান নেই। যতই হাই-আপস হোক না কেন। ভালোলাগার মতো পুরুষ সত্যিই খুব কম দেখা যায় এক জীবনে। আর যে দু-একজনকে ভালো লাগলও তাদের আবার ভালো লাগল না ওকে। ব্যক্তিত্বসম্পন্না এবং শুধুমাত্রস্বাবলম্বীই নয়, অত্যন্ত সচ্ছল যেসব মেয়েরা, খুব কম পুরুষেরাই সহ্য করতে পারে তাদের। ভ্ৰমীর মতো বেশির ভাগ মেয়েরই জীবনে পুরুষ সঙ্গী যদি-বা জোটেও তাদের মধ্যে প্রায় বেশিরভাগই স্বর্ণলতারই মতো ডেকরিটিভ, রামছাগলের মতোই নির্বোধ, পরগাছা হয়। অনেকটা ঘর-জামাই-এরই মতো। তাদের সম্মান করতে যে বড়ো বাধে। আর সম্মান না করতে পারলে কি কাউকে ভালোবাসা যায়? কিন্তু এও সত্যি যে নিজের মনোমতো পুরুষ ছাড়া মিশবই না এমন ধনুক ভাঙা পণ করে থাকাও যায় না। অমনোনীতদের মধ্যে থেকেই কে যে পরম মনোনীত হয়ে ওঠে কোন মুহূর্তে, তাই বা কে বলতে পারে আগে থেকে। দেখার, পছন্দর রকমও তো পালটে যায়।

মাঝে মাঝেই তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব পরিচিতদের কাছে তার কষ্টার্জিত সাফল্য, সাচ্ছল্য এবং এই স্বাতন্ত্র্যও বড়ো দোষের, বড়ো দূরন্তর হয়ে ওঠে। তখন ভ্ৰমীর বার বারই মনে হয় যে, জীবনে সফল হতে না-পারার যে দুঃখ, তার চেয়ে সফল হতে-পারার দুঃখটাও কিছু কম নয়।

চান করে ঘরে এসে একেবারেই নাইটি পরে নিল। তার ওপরে ড্রেসিং-গাউনটাও গলিয়ে নিল। আজ তাড়াতাড়িই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। কাল সকালে ঠিক ন-টাতে একটা মিটিং আছে। বিকেলের প্লেনে বম্বে যেতে হবে। সেখান থেকে পরদিন দিল্লি। তার পরদিন ভোপাল। ভোপাল থেকে কলকাতার ডায়েরেক্ট ফ্লাইট নেই। হয় দিল্লি, নয় বম্বে হয়ে ফিরবে রাতের ফ্লাইটে শনিবার।

দিল্লি হয়ে ফেরার টিকিটই করা আছে।

ওর বেডরুমের কোণে রাখা রকিং-চেয়ারের হাতলের সঙ্গে লাগানো বেলের সুইচ টিপল ভ্রমী।

কাঞ্চী ঘরে আসতেই বলল, এক গ্লাশ ফ্রেশ-লাইম সোডা নুন দিয়ে নিয়ে এসো, অল্প বরফ দিয়ে। আর বাবুর্চিকে বললো যে, ডিনার লাগাবে ঠিক ন-টায়। আর শোনো, যা যা বলেছিলাম সব ভরে দিয়েছ তো স্যুটকেসে?

জি মেমসাব।

কাল অফিসে যাওয়ার সময় দুখীকে বলবে যে গাড়িতে তুলে দিতে ওটাকে। ভুলে যায় না আবার।

তারপর একটুক্ষণ কী ভেবে বলল, দুখী কী করছে? দেখলাম না তো ওকে?

আপনার জুতো আর চামড়ার হাত-ব্যাগে কালি লাগাচ্ছে। কুমিরের চামড়ার ব্যাগটাই নিয়ে যাবেন তো?

হ্যাঁ। ঠিক আছে।

কাঞ্চী চলে যাবার আগে বলল, একটা চিঠি এসেছিল। রাখা আছে বেড-সাইড টেবলে।

উঠতে ইচ্ছে করছে না আর। এনে দাও।

ভ্ৰমী বলল।

কাঞ্চী চিঠি আর স্পেন-থেকে-আনা মাতাদোরদের ছোরার মতো রেপ্লিকার লেটার-ওপেনার এনে দিল ওর কাছে, ছোট্ট ট্রেতে বসিয়ে। তারপর চলে গেল।

খাম একটি।

খুলেই দেখল, ভ্ৰমীর কাজিন পৃথা লিখেছে।

ওরা তো কলকাতাতেই থাকে। তা ছাড়া এইতো সেদিনই এল ওর জাকে নিয়ে ভাসুরঝি তিতির বিয়ের নেমন্তন্ন করতে।

পরশুদিনই কি?

হ্যাঁ। তা-ই তো!

এরই মধ্যে চিঠি লেখার কী দরকার পড়ল ওর?

হিন্দুস্থান পার্ক
পঁচিশে মে, ৮৬

ভ্ৰমীদি,

ফোন করলেও হয়তো হত। কিন্তু ফোনে বা মুখে সব কথা ঠিকমতো বলা হয়ে ওঠে না। কথার পিঠে কথা ওঠেই। তাই-ই…। সেদিন আমার বড়ো জায়ের ব্যবহারে আমি খুবই লজ্জিত।

তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে।

তুমি নিশ্চয়ই জানো যে, আমার বড়োজা সুস্মিতা প্রেসিডেন্সির নামকরা ছাত্রী ছিলেন। ইংরেজিতে ফাস্ট-ক্লাস-ফাস্ট হওয়ার পর তাঁর বড়লোক বাবা তঁকে ইংল্যান্ডে আইন পড়তে পাঠান। আইন পড়ে তো বটেই তার সঙ্গে লানডান স্কুল অফ ইকনমিকস-এ বি এসসি (ইকন)ও করেন। এবং ইনকরপরেটেড অ্যাকাউন্ট্যান্সিও। ফিরে এসে গুচু চৌধুরির জুনিয়র হিসেবে প্র্যাকটিসও শুরু করেন। প্র্যাকটিস, ব্যারিস্টার হলেই হয় না। হাইকোর্টের উকিল, ব্যারিস্টারদের মধ্যে ব্রিফ লেসদের সংখ্যাই বেশি। এ্যাকটিস-এ সুবিধে হল না বলেই এখন সে ল অফিসার। কোন কোম্পানির তা তুমি জানই।

তার পরের ঘটনাও তুমি সবই জানই।

আমার খুবই খারাপ লেগেছে যে, মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে এসেও উনি একটু সংযত হতে পারলেন না। তোমার বাড়ি বয়ে এসে তোমাকেই উনি অপমান করলেন। অথচ তুমি আমার বাপের বাড়ির আত্মীয়া, নিজেরই মামাতো বোন। আমার সম্মানের কথাটাও ভাবলেন না একটুও।

তুমি অ্যাকাউন্ট্যান্সি জান কি জান না তা আমি জানি না। অ্যাকাউন্ট্যান্সির আমি কিছুই বুঝিনা। শুধু এইটুকু জানি যে স্কুল-কলেজের বাইরের পরীক্ষা-টরিক্ষা ছাড়াও জীবনের মধ্যেও নানা রকমের পরীক্ষা থাকে। একটি পরীক্ষাতে তিনি আমার সামনেই তোমার কাছে ফেল করলেন। আমার বড়ো জায়ের ব্যবহার কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য নয়।

আমি সত্যিই লজ্জিত।

আমার কথা তোমার অজানা কিছুই নেই। যেসব মেয়েদের স্বামীরা যথেষ্ট যোগ্য নয় এবং যাদের নিজেদেরও তেমন যোগ্যতা নেই তোমার মতো বা আমার বড়ো জা সুস্মিতাদির মতো, তাদের। এই দেশে এখনও অনেকই অসম্মান অপমানের বোঝা বইতে হয়ই, যে সব অসম্মান-অপমান নিজস্ব কারণে তার বইবার কথা ছিল না আদৌ।

আমি শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও রোজগার তো করি না। অসফল পুরুষের স্ত্রীর ব্যক্তিজীবনে সফলতা যতটুকুই থাকুক না কেন, সমাজে সে অসফল, অপাংক্তেয়ই। এমনকী প্রাচীন ঐতিহ্যময় যৌথ পরিবারেও।

জানি না, এমীদিদি, আমার মেয়ে দুটি কেমন হবে। আমি ওদের সবসময়ই তোমার দৃষ্টান্ত দিই। বলি, ভ্ৰমী মাসিকে দ্যাখ। পুরুষের চেয়ে কীসে কম? ভ্ৰমীমাসির অফিসের চেম্বারের সামনে বাঘা বাঘা পুরুষেরা হনুমানের মতো হাতজোড় করে লেজ বের করে দাঁড়িয়ে থাকে। ভ্ৰমীমাসিরই মতো হতে হবে তোদের।

মেয়ে মানুষ করা আর সংসার করা তো কিছুই করার মধ্যেই পড়ে না। এসব তো কোনো কাজই নয়। আমাদের জীবনে তো গর্ব করার মতো কিছুমাত্রই নেই ভ্ৰমীদি। যদি ছেলে-মেয়েরা বড়ো হয়ে তাদের মায়ের মূল্য একটুও দেয় তবেই শুধু শেষ বয়সে পৌঁছে, আমরা সার্থক হলেও হতে পারি।

কিছু মনে কোরো না ভ্ৰমীদিদি। আমার জায়ের অভব্যতার কারণে আমাকে ক্ষমা না করলে বড়োই ছোটো হয়ে থাকব তোমার কাছে চিরদিনই।

তিতির বিয়েতে আসবে তো? ও মেয়েটা কিন্তু তোমার মস্ত অ্যাডমায়ারার। ওর মায়ের কারণে ওকে দুঃখ দিয়ো না তুমি।

–ইতি তোমার পৃথা।

পুনশ্চ. গত রবিবার দেরাজের ড্রয়ারের বহু পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমাদের কলেজের একটা ছেড়া ম্যাগাজিন বেরোলো। তাতে তোমার একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল। বাংলায়। তুমি তখন ফোর্থ ইয়ারের ছাত্রী, আমি ফার্স্ট ইয়ারে ঢুকেছি সবে। কবিতাটির নাম আজ সকালে। প্রেমের কবিতা।

এখনও কবিতা লেখো? প্রেমের কবিতা? না, অ্যাকাউন্ট্যান্সির ব্লটিং-পেপার তোমার সব কবিত্বই শুয়ে নিয়েছে?

আবারও ক্ষমা চেয়ে।

তোমার বোন পৃথা।

কাঞ্চী ঘরে এসে ফ্রেশ-লাইম পানি দিয়ে গেল।

অনেকক্ষণ চিঠিটা কোলে ফেলে বসে রইল ভ্রমী।

যে-ব্যথাটাকে ভুলে গেছিল তা আবারও এই চিঠি বয়ে নিয়ে এল। ব্যথা ঠিক বলবে না, বলবে, এক ধরনের অবশতা।

ঘরের আলো নিবিয়ে দিয়ে জানালার দিকে মুখ করে বসে তার প্রিয় রকিং-চেয়ারে দুলতে দুলতে বিভিন্নরঙা আলোজ্বলা মাথা-তোলা দেশলাইয়ের খোপের মতো অসংখ্য মালটিস্টোরিড বাড়ির দিকে আর হ্যালোজেন-ভেপার ল্যাম্পের বাদামি আলোতে আলোকিত দূরের বালিগঞ্জ ফাঁড়ি মোড়ের রাস্তাগুলিকে তেরোতলা ফ্ল্যাটের ওপর থেকে অন্যমনস্ক চোখে দেখতে দেখতে মনে মনে অনেকই দূরে চলে গেল ভ্রমী।

কাঞ্চীর হঠাৎ গলার আওয়াজে চমকে গেল ও।

ভাবছিল সব কিছুকেই বাঁধা যায় শুধু সময়কে ছাড়া। সময় একজন মানুষকে যেমনভাবে রিক্ত অথবা পূর্ণ করতে পারে তেমন বোধহয় আর কিছুই পারে না।

কাঞ্চী আবারও জিজ্ঞেস করল, একতলার ভিডিয়ো-ক্যাসেট লাইব্রেরি থেকে ক্যাসেট আনতে হবে কি না।

মাথা নেড়ে না করল ভ্রমী।

যথাসময়ে ডিনার সার্ভ করে বাবুর্চি কাঞ্চীকে পাঠাল ভ্ৰমীকে খবর দিতে। খাওয়ার সময় কাঞ্চী ও বাবুর্চির আদর-যত্নের উত্তরে দু-একটি সংক্ষিপ্ত হ্যাঁ এবং না বলে খাওয়া শেষ করল ও। সুফলে করেছিল বাবুর্চি পেরেরা।

ভ্ৰমী বলল, খাবে না।

খাওয়ার পর, বেডরুমে না গিয়ে স্টাডিতে গেল ও। এয়ারকন্ডিশনারটা চালিয়ে দিয়ে কাগজ কলম নিয়ে বসল পৃথাকে চিঠি লেখার জন্যে। পৃথা হয়তো ঠিক বলেছে যে, তেমন কিছু বলার থাকলে তা লিখে জানালেই ভালো। নইলে কথার তোড়ে কথা সত্যিই উড়ে যায়। যা বলতে চাওয়া, তাই হয়ে ওঠে না বলা।

লিখল–

কলকাতা
০৫/০৪
পৃথা, কল্যাণীয়াসু,

তোর চিঠি পেয়ে সত্যিই অবাক হলাম। তবে মিথ্যে, বলব না, ভালোও লাগল। আমার আপন ভাই-বোনেদের চেয়েও তুই হয়তো আমাকে বেশি বুঝিস। তোর কাছে খুবই কৃতজ্ঞ থাকি এই কারণে। তোর চিঠির জবাব দেওয়ার কিছুই ছিল না। কারণ, জবাব হয় না। কিন্তু দুটি কারণে জবাব দিতে বসলাম।

প্রথম কারণ হচ্ছে এই যে, অন্যের অপূর্ণতা এবং মানসিক দৈন্যের কারণে আমরা নিজেরা কষ্ট পেতে যাব কেন? নিজেদের নিজস্ব কষ্টর কোনো ঘাটতি আছে কি আমাদের? কারোই?

দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে এই যে, সুস্মিতাদির ব্যাপারটা কোনো ব্যক্তির ব্যাপার নয়, ওটি বোধহয় এক বিশেষ শ্রেণির মানসিক ব্যাধিরই ব্যাপার। সুস্মিতাদিই একমাত্র মানুষ নন, যিনি বাড়ি বয়ে অপমান করে গেলেন। অনেকেই করেন।

পৃথা, সংসারে ছোটো-বড়ো শিক্ষিত-অশিক্ষিত প্রত্যেক মানুষেরই একটি মাপ পূর্বনির্ধারিত থাকে। সেই মাপের কিছু রদবদল তিনি নিজের চেষ্টায় অনুষঙ্গের গুণে নিশ্চয়ই করতেও পারেন। কিন্তু যতটুকু তাঁর ভিতরে আঁটবার, যতটুকুতে তাঁর যোগ্যতা তার বেশি ঠেলাঠেলি করে সীমিত আধারে আঁটাতে গেলেই তা উপচে পড়ে যায় পথেরই মাঝে। তেমন ঘটনা সেই মানুষটিকে গৌরবান্বিত তো করেই না বরং হেয়ই করে।

এই প্রাঞ্জল, পুরোনো কথাটা বোঝার মতো ক্ষমতা সুস্মিতাদির নেই যে কেন তা বুঝতে পারি না। ইউনিভার্সিটির ডিগ্রিই যে বিদ্যা নয়, ভালো চাকরিই যে যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি নয়, জীবনে সফল হওয়ার আকাশকুসুম প্রত্যাশা আর সত্যিকারের সাফল্যের মধ্যে ব্যবধান যে অনেকই, এই সহজ কথাটাই কিছু মানুষ সারা জীবনেও বুঝে উঠতে না পেরে, যারা সফল হল, গায়ের জোরেই তাদেরই কাছে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চান। হীনম্মন্যতার এ এক করুণ পরাকাষ্ঠা।

আমি ভালো চাকরি করি যে, সেইটেই আমার সাফল্যের একমাত্র মাপ নয়। সাধারণ মানুষ এবং সুস্মিতাদির মতো অনেক অসাধারণ মানুষও আমার চাকরিটাকেই দেখেন শুধু। যা-কিছু উপাদান দিয়ে নিজেকে আমি তিল তিল করে গড়েছি শিশুকাল থেকে, সেটা তাঁদের চোখের আড়ালেই থেকে যায়।

শিক্ষার অনেকখানিই একজন মানুষকে গড়ে নিতে হয় নিজের ভেতর থেকে। নইলে, শুধুমাত্র বড়োলোকের ছেলে-মেয়েরাই, যারা সবরকম সুযোগসুবিধা পায়, জীবনে বড়ো হত। আসলে বাস্তবে সেরকম তো আর ঘটে না!

তুই জানিস কি না জানি না, সুস্মিতাদির একাধিক সহপাঠীদের কাছেই শুনেছিলাম যে কলেজ জীবনে অত্যন্তই রোগা ছিলেন বলে তিন-তিনটি পেটিকোট পরে কলেজ যেতেন উনি। সহপাঠী এবং প্রফেসরদের ইমপ্রেস করার জন্যে। হ্যাঁ রে! প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো কলেজে! এবং সেই সময়কার প্রেসিডেন্সি! বুঝে দেখ!

সুস্মিতাদের কথা না-হয় ছেড়েই দিলাম। যদি শুধুমাত্র শরীর দিয়েই কোনো শরীরী পরীক্ষা জেতার প্রশ্ন উঠত তা হলেও শরীরের পরীক্ষার দিনে তো সব কটি পেটিকোট এবং শাড়ি খুলে ফেলেই বিচারটুকু করা হত। কী? হত না? পুরুষদের চর্মহীন চোখের পরীক্ষাতে তো তিনটি পেটিকোট-মোড়া শরীর নম্বর পায়নি কোনোদিনও।

সুস্মিতাদি, শরীরেরই মতো, গুণের ক্ষেত্রেও হয়তো ওই মানসিকতা নিয়েই বড়ো হয়েছেন। বেঁচে এসেছেন। তাই, যে-সাফল্যে তাঁর যোগ্যতা নেই তা অন্য কারো কুক্ষিগত হয়েছে দেখেই কুৎসা করতে শুরু করেছেন তাঁর নামে। তাই-ই হয়তো মনের শরীরেও একাধিক পেটিকোট জড়াবার প্রয়োজন হয়েছে তাঁর।

না রে! অপমানিত হইনি আমি। তবে, খারাপ লেগেছিল, নিজের মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে এসেও কথাটা না-বলে উনি পারলেন না বলে। আনন্দের সময়ে, নিজের সুখের সময়ে অনেক খাটো মাপের মানুষও বড়ো হয়ে ওঠেন তো! তাই-ই ভেবেছিলাম। আমি খাটো বলতে মনের মাপের কথাই বলছি অন্য কোনো মাপের নয়। অর্থ, শিক্ষা, মান যত এসব তাঁদের অনেকই থাকতে পারে।

বছরখানেক আগে আমাদেরই অফিসের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট, সুব্রতা সেন, আমাকে বলেছিল যে, তাকে সুস্মিতাদি এক পার্টিতে অনেকের সামনেই নাকি ওই একই কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন .ভ্ৰমী অ্যাকাউন্ট্যান্সির আর ম্যানেজমেন্টের কী বোঝে? পরীক্ষাতে এক চান্স-এ তো পাশ করেনি। ভ্ৰমীর চেহারা সুন্দর, ভালো কথা বলে, সুন্দর করে সাজে, তার ওপরে ঢঙি তো আছেই। এক নম্বরের। এমন অবিবাহিতা খেলুড়ে-মেয়ে জীবনে উন্নতি করবে না, তো কি সুস্মিতা রায় করবে?

কথাটা আগেই শুনেছিলাম বলেই নতুন করে দুঃখ পাইনি কোনো। সুস্মিতাদি তো বার-এ প্র্যাকটিস আরম্ভ করেছিলেন এবং এখন ল অফিসার। তাঁর অ্যাকাউন্ট্যান্সির ডিগ্রি নিয়ে আমার সঙ্গে কোনো প্রতিযোগিতাও ছিল না।

তবুও কেন…?

বিফল মানুষের পক্ষে অন্যের সাফল্যকে সরলভাবে মেনে নেওয়া হয়তো চিরদিনই কঠিন। আমি সুস্মিতাদিদেরই অনুকম্পা করি, দুঃখ বোধ করি এক ধরনের, ওঁদের মানসিকতার সব মানুষদেরই জন্যে।

অনেকেই জানে যে, আমি চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সির পরীক্ষায় অ্যাকাউন্টস-গ্রুপে ফেল করেছিলাম। আমার এই ফেল করার কথা আমি কারো কাছেই লুকোইনি। যেসব মানুষ আয়নার সামনে দাঁড়াতে ভয় পায় তাদের মনুষ্যত্ব এখনও সম্পূর্ণতা পায়নি বলেই মনে হয় আমার।

আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারার শিক্ষাটাও একটা মস্ত শিক্ষা।

ইনসিওরেন্স কোম্পানি আর ব্যাঙ্কিং কোম্পানির ব্যালান্স শিটের ফর্ম মুখস্থ থাকলেও তিন ঘন্টাতে ছ-টি ব্যালান্স-শিট মেলাতে পারিনি। তাই-ই ফেল করেছিলাম। তা ছাড়া তখন সুজয়ের সঙ্গে প্রেমও করছিলাম, নন্দিতাদের মতো ভালো মুহুরি হতেও চাইনি আমি। লিটল থিয়েটার নিয়ে মেতেছিলাম। সি এ পরীক্ষার ফলটার চেয়ে অন্য অনেক কিছু অনেক বেশি দামি ছিল তখন আমার কাছে। রিলেটিভ ব্যাপার! জীবিকার চেয়ে জীবনের দাম অনেকই বেশি আমার কাছে। পৃথা। আজও মনে করি, যা নিয়ে এত লোকের গাত্রদাহ তাও ছেড়ে দিতে পারি হঠাৎ। বাঁচা মরাটা আমারই শর্তে, অন্যের নয়। তুই ছেলেবেলা থেকে আমাকে জানিস যখন সেই। নান্তিদিদিদের বাড়িতে পুতুল খেলতাম আমরা, তখন থেকে। তোকে দূরের ভাবিনি কখনোই।

সুস্মিতাদি ইংল্যান্ডের ফুক-লিঞ্চ-কোচিং নিয়ে এক চান্সেই পরীক্ষা পাশ করেছিলেন। এবং তাতে তাঁর ধারণা হয়েছিল যে, জীবনের সব প্রাপ্তিই বুঝি পরীক্ষা পাশের পর আর তিন-ঘন্টায় মেশিনের মতো ব্যালান্স-শিটের দু-দিক মিলিয়ে আসার পর বড়ো সহজেই হস্তগত হয়। উনি। তখনও বোঝেননি যে, জীবনের এমনকী শুধুমাত্র সময়ের মাপেও অমন সাফল্যর দাম কিছুই নয়। ইনসিওরেন্স কোম্পানি আর ব্যাঙ্কিং-এর ব্যালান্স-সিট ফর্ম মুখস্থ করার চেয়েও অনেক অনেক কঠিন বিষয়ের পরিচয় ঘটে জীবনের পরীক্ষাতে। সেই সময়কার বেশি প্রশ্নই আবার। থাকে জীবনের একেবারেই বাইরে। আনসিন। জীবনের অন্য পরীক্ষাগুলো, জীবনের পরীক্ষার কাছে নিছকই ছেলেখেলা।

সুস্মিতাদিরই মতো, নিজের ডিগ্রির বোঝায় ন্যুজ থেকে, সারাজীবন মিথ্যে উচ্চম্মন্যতায় ভুগে যাঁরা সাফল্য যে কাকে বলে, তা জানার চেষ্টাটুকু পর্যন্ত করলেন না তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি রাগ থাকে দেখি সফল মানুষদের ওপরে।

তুই একটুও ভাবিস না। সুস্মিতাদির মেয়ে তিতির বিয়েতে আমি নিশ্চয়ই যাব, কোম্পানির গাড়ি নয় রে, আমার পার্সোনাল গাড়ি, নতুন স্ট্যান্ডার্ড টু-থাউজ্যান্ড গাড়িতে। দারুণ শাড়িতে। সেজেও যাব। বম্বের জাভেরি-ব্রাদার্স-এর হিরের গয়নাতে নিজেকে মুড়ে, মুখে দারুণতর একটি হাসি নিয়ে নামব এক্কেবারে তোদের বাড়ির আলো-ঝলমল গেটে। ওই গাড়ি থেকে। আফটার। অল, তোর সুবাদেই তো আত্মীয়তা। না যদি যাই, তা হলে তো তোকেই ছোটো করা হবে। আমার মান-অপমান জ্ঞানটা চিরদিনই কম। তোর সম্মান রাখতেই তো যাওয়া। যাব। নিশ্চয়ই যাব।

ভালো থাকিস।

লাইফ ইজ ভেরি ইন্টারেস্টিং অ্যান্ড ভেরি ইয়াং, ডেসপাইট সুস্মিদাদি। মিছিমিছিই প্যানপ্যান-ঘ্যানঘ্যান করিস না জীবন নিয়ে। জমিয়ে বাঁচ পৃথা।

ইতি-তোর ভ্ৰমীদিদি।

২.

অফিস থেকেই বেরোতে ভ্ৰমীর দেরি হয়ে গেল। বিকেলের বম্বের ফ্লাইটটাও এক উদ্ভট সময়ে। পাঁচটা পঁয়তাল্লিশে ছেড়ে যায়।

একটি ওভার নাইট ব্যাগ নিয়েছে শুধু। গোটা চারেক সিল্কের শাড়ি। ম্যাচকরা শায়া-ব্লাউজ, প্যান্টি-ব্রা। এবং জুতোও। একজিকিউটিভ ক্লাসের টিকিট। সঙ্গে বুকিং-এর লাগেজ না থাকলে ডিপারচারের মিনিট পনেরো আগেই গিয়ে পৌঁছোয় ও। আরও আগে পৌঁছোনো উচিত কিন্তু। ওতেই চলে যায়। তা ছাড়া এতই বেশি ট্রাভল করতে হয় যে, যেতে-আসতে এয়ারপোর্টে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে একেবারেই ভালো লাগে না আর আজকাল।

যেখানেই ভ্ৰমী যাক না কেন, এয়ারপোর্টে তার জন্যে এয়ারকন্ডিশানড গাড়ি আসে। ড্রাইভার ছাড়াও অন্য কেউ রিসিভ করতে আসে। লাগেজ ছাড়াবার জন্যে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে নষ্ট করার মতো উদবৃত্ত সময়ও ওর নেই। এমনিতে একটি হ্যান্ড ব্যাগ নিয়েই ট্র্যাভেল করে। কিন্তু কখনো বেশিদিন থাকতে হলে লাগেজ সঙ্গে থাকে যদি তাহলে দুটি গাড়ি রিসিভ করতে আসে তাকে। একটিতে ও চলে যায়, অন্যটির ড্রাইভার মাল নিয়ে পরে আসে। সোজা প্লেন থেকে নেমে গাড়িতে গিয়ে বসে, সেখান থেকে সোজা হোটেলে।

কলকাতায় যখন ফেরে তখন ড্রাইভার সঙ্গে জমে-থাকা চিঠিপত্র নিয়ে আসে সব অফিস থেকে। পি এর নোটও। পেছনের সিটের ছোট্ট আলো জ্বেলে চিঠিগুলো পড়ে ফেলে। সময়টাকে ইউটিলাইজ করে। মার্ক করে ওর পি এ মিস্টার মাথুর জন্যে। ইনস্ট্রাকশান্স বিল করে গাড়িতে বসেই। পরদিন অফিসের সময়ের অনেকখানিই বেঁচে যায় এতে।

বম্বে গেলে তাজ, দিল্লি গেলে হায়াট-রিজেন্সি, হায়দারাবাদে বানজারা, ব্যাঙ্গালোরে বার্টন-কোর্ট। নিজস্ব ঘর-বাড়িই হয়ে গেছে এখন এই সব ফাইভ-স্টার হোটেলগুলো। মনেই হয় না যে, নিজের বাড়িতে নেই। ভোপালে অবশ্য তেমন ভালো হোটেল নেই। প্যাট আর রিঙ্কুকে ফোন করেছিল। এবারে ওদেরই গেস্ট হবে। রিঙ্কু বহুবার বলেছিল ওকে। তবে, থাকবে তো একটা রাতই মাত্র।

বাইরে গেলে একটা জিনিস করা হয়। রাত দুটো অবধি রোজই নিজের ঘরে বসে ছবি দেখে ও ভিডিয়োতে!

কাজ শেষে ফিরে চান করে নাইটি পরে নেয়। তারপর ড্রেসিং-গাউনটা হাতের কাছে রেখে, পিঠের কাছে বালিশ দিয়ে জোড়াসনে বসে ছবি দেখে। একটা কি দুটো ব্লাডি-মেরি বা জন কলিন্স-এর অর্ডার দেয় রুম-সার্ভিসে। তারপর রাত এগারোটা নাগাদ চাইনিজ খাবার নিয়ে আসতে বলে। যে-বেয়ারা ড্রিঙ্কস নিয়ে আসে, তাকেই চাইনিজ খাবারের মেনু নিয়ে আসতে বলে দেয়।

কলকাতাতে ছবি-টবি তো দেখা হয়ই না। মৃণালদা, অপর্ণা বা গৌতম যখন নতুন ছবি দেখার জন্যে গোর্কি সদনে নেমন্তন্ন করে তখনই যায়। তাও, সব ছবি দেখে উঠতে পারে না। অবশ্য এই ছবি দেখার কারণেই বাইরে গিয়ে এখন আর অন্য কারো বাড়ি যাওয়াই হয়ে ওঠে না। বন্ধু বান্ধবেরা খুবই রাগ করে জানতে পেলে। পাটি-ফাটিতেও তো যায়ই না।

পুরুষদের লুব্ধ দৃষ্টি একটা সময় অবধি ভালো লাগত। আজকাল পুরুষের মতো পুরুষের বোধ। হয় মড়কই লেগেছে দেশে। চোখেই পড়ে না তেমন পুরুষ। ওই বাজে সব স্টিরিওটাইপড। ভিড়ের মধ্যে গিয়ে সময় নষ্ট করার সময় নেই আর। জীবনটা আসলে বড্ড ছোটো। আগে বুঝত না, এখন বোঝে ভ্রমী। এখন নষ্ট করার মতো সময় সত্যিই আর নেই এই জীবনে। যা ভালো লাগে, শুধু তাই করে।

হ্যান্ড-ব্যাগেজ চেক করিয়ে ভ্ৰমী ভেতরে ঢুকতেই দেখল, সুস্মিতাদি! একেবারে সিকিওরিটি চেক-এর গেট-এর সামনেই চেয়ারে বসে। গেটের দিকে মুখ করে।

চোখাচোখি হতেই হাসল ভ্রমী। কিন্তু সুস্মিতাদির মুখটা কালো হয়ে গেল। হাসি ফোঁটাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ফুটল না।

কোথায় চললে? সুস্মিতাদি বললেন।

আমি? ব্যাঙ্কের হেড-অফিসে।

ক্যাজুয়ালি বলল ভ্রমী।

আপনি?

কাল বম্বে হাইকোর্টে আমাদের কোম্পানির একটা ম্যাটার আছে। অশোক সেনকে দিয়ে মুভ করাতে হবে। গপ্পর সাহেব অবশ্য গতকালের প্লেনেই চলে গেছেন।

গলায় ইমপর্ট্যান্স এনে বললেন সুস্মিতাদি।

বাঃ। ভালো তো। আপনার তো বড়ো বড়ো ঝামেলা লেগেই আছে।

ভ্ৰমী বলল।

ভালো?

আমি তো এই প্রথমবার যাচ্ছিনা। এসব তো করছি সেই কবে থেকে। টায়ার্ড লাগে এখন। আই হেইট টু ট্র্যাভেল।

তা তো হবেই। আপনি তো কত সিনিয়র। সব ব্যাপারেই।

হেসে বলল ভ্রমী।

যদি খুশি করা যায় ওঁকে এই ভেবে। সকলকেই খুশি দেখতে ভালো লাগে ওর। সকলকেই।

তোমার সন্দেহ আছে কি কোনো?

সুস্মিতাদি গলা নামিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন ভ্ৰমীকে।

অবাক এবং একটু ব্যথিতও হল ভ্রমী। বলল, কীসে?

আমি সিনিয়র যে, তাতে।

ও মা। না, না।

তারপরই ভাবল, অন্য কোথাও গিয়ে বসে। কিন্তু উনি কী মনে করবেন ভেবে, গেল না।

কোন রোতে তোমার সিট বোর্ডিং-পাস-এর নাম্বার কী?

আমার! বলে নাম্বার দেখবে বলে ভ্রমী ওর হ্যান্ড ব্যাগ থেকে বোর্ডিং পাসটা বের করল।

সুস্মিতাদি বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে, ঈর্ষাকাতর গলায় বললেন, ওঃ বাবা। তোমার তো দেখছি জে ক্লাস।

এই। আমাদের কোম্পানিতে আমার লেভেলের সব অফিসারই জে ক্লাসেই ট্র্যাভেল করেন।

একজিকিউটিভ ক্লাসে ট্রাভেল করার অপরাধকে লঘু করার চেষ্টা বলল ভ্রমী।

ও।

সুস্মিতাদি বললেন গম্ভীর গলায়।

ফ্লাইট অ্যানাউন্সড হয়ে গেল।

ভ্ৰমী বলল সুস্মিতাদিকে, চলুন যাই।

আজ লেট করবে না মনে হয়।

তুমি এগোও না। তোমার তো জে ক্লাস।

সুস্মিতাদি ঝংকার তুলে বললেন।

দুঃখ হল খুবই ভ্ৰমীর। তারপর ও এগিয়ে চলল গেটের দিকে।

অন্যকে এবং অন্যদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবার সময় যে মানুষের দুঃখ হয় না, সে বোধ হয় মানুষই নয়। অথচ তবুও জীবনে প্রতি মুহূর্তেই কাউকে না কাউকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হয়ই। থেমে থাকার যে কোনো উপায়ই নেই। হয় এগিয়ে যাও, নয় পিছিয়ে পড়ো। Lack of Progress means decay.

সত্যিই খুব কষ্ট হল ভ্ৰমীর সুস্মিতাদির জন্যে। সাধারণত মেয়েরা বোধ হয় ছেলেদের চেয়ে অনেকই বেশি ঈর্ষাকাতর হন। কেন, কে জানে?

বাসে এসে বসল ভ্রমী। একটু পরে বাসটা ছেড়েও দিল। এখন খুব জোরে চলেছে বাস টারম্যাকের ওপর দিয়ে, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা তিনতলা বাড়ির সমান উঁচু এয়ারবাসের দিকে।

সুস্মিতাদি কি এখনও বসেই আছেন লাউঞ্জে? কে জানে?

পেছনে তাকিয়ে দেখার সময় নেই। উপায়ও নেই কোনো। জীবন এমনই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *