উন্নতি

উপরে যাবার সিঁড়ি,
         তারি নীচে দক্ষিণের বারান্দায়
             নীলমণি মাস্টারের কাছে
                 সকালে পড়তে হত ইংলিশ রীডার।
  ভাঙা পাঁচিলের কাছে ছিল মস্ত তেঁতুলের গাছ।
                 ফল পাকবার বেলা।
ডালে ডালে ঝপাঝপ বাঁদরের হ’ত লাফালাফি।
      ইংরেজি বানান ছেড়ে দুই চক্ষু ছুটে যেত
             লেজ-দোলা বাঁদরের দিকে।
      সেই উপলক্ষে–
আমার বুদ্ধির সঙ্গে রাঙামুখো বাঁদরের
         নির্ভেদ নির্ণয় করে
             মাস্টার দিতেন কানমলা।
 
ছুটি হলে পরে
      শুরু হত আমার মাস্টারি
             উদ্ভিদ্‌-মহলে।
      ফলসা চালতা ছিল, ছিল সার-বাঁধা
             সুপুরির গাছ।
অনাহূত জন্মেছিল কী করে কুলের এক চারা
      বাড়ির গা ঘেঁষে;
  সেটাই আমার ছাত্র ছিল।
      ছড়ি দিয়ে মারতেম তাকে।
  বলতেম, “দেখ্‌ দেখি বোকা,
      উঁচু ফলসার গাছে ফল ধরে গেল–
কোথাকার বেঁটে কুল উন্নতির উৎসাহই নেই।’
      শুনেছি বাবার মুখে যত উপদেশ
তার মধ্যে বার বার “উন্নতি’ কথাটা শোনা যেত।
         ভাঙা বোতলের ঝুড়ি বেচে
      শেষকালে কে হয়েছে লক্ষপতি ধনী
             সেই গল্প শুনে শুনে
উন্নতি যে কাকে বলে দেখেছি সুস্পষ্ট তার ছবি।
         বড়ো হওয়া চাই–
অর্থাৎ, নিতান্ত পক্ষে হতে হবে বাজিদপুরের
      ভজু মল্লিকের জুড়ি।
  ফলসার ফলে ভরা গাছ
বাগান-মহলে সেই ভজু মহাজন।
      চারাটাকে রোজ বোঝাতেম,
  ওরই মতো বড়ো হতে হবে।
কাঠি দিয়ে মাপি তাকে এবেলা ওবেলা–
      আমারি কেবল রাগ বাড়ে,
         আর কিছু বাড়ে না তো।
সেই কাঠি দিয়ে তাকে মারি শেষে সপাসপ্‌ জোরে–
      একটু ফলে নি তাতে ফল।
             কান-মলা যত দিই
         পাতাগুলো ম’লে ম’লে,
                 ততই উন্নতি তার কমে।
 
এ দিকে ছিলেন বাবা ইন্‌কম্‌-ট্যাক্সো-কালেক্টার,
         বদলি হলেন
             বর্ধমান ডিভিজনে।
      উচ্চ ইংরেজির স্কুলে পড়া শুরু করে
                 উচ্চতার পূর্ণ পরিণতি
                     কোলকাতা গিয়ে।
             বাবার মৃত্যুর পরে সেক্রেটারিয়েটে
                 উন্নতির ভিত্তি ফাঁদা গেল।
         বহুকষ্টে বহু ঋণ করে
                 বোনের দিয়েছি বিয়ে।
         নিজের বিবাহ প্রায় টার্মিনসে এল
                 আগামী ফাল্গুন মাসে নবমী তিথিতে।
      নববসন্তের হাওয়া ভিতরে বাইরে
             বইতে আরম্ভ হল যেই
                 এমন সময়ে, রিডাক্‌শান্‌।
             পোকা-খাওয়া কাঁচা ফল
                 বাইরেতে দিব্যি টুপ্‌টুপে,
                     ঝুপ্‌ করে খসে পড়ে
                         বাতাসের এক দমকায়,
                            আমার সে দশা।
      বসন্তের আয়োজনে যে একটু ত্রুটি হল
             সে কেবল আমারি কপালে।
      আপিসের লক্ষ্মী ফিরালেন মুখ,
         ঘরের লক্ষ্মীও
             স্বর্ণকমলের খোঁজে অন্যত্র হলেন নিরুদ্দেশ।
      সার্টিফিকেটের তাড়া হাতে,
         শুক্‌নো মুখ,
             চোখ গেছে বসে,
                 তুবড়ে গিয়েছে পেট,
                     জুতোটার তলা ছেঁড়া,
                         দেহের বর্ণের সঙ্গে চাদরের
                            ঘুচে গেছে বর্ণভেদ–
      ঘুরে মরি বড়োলোকদের দ্বারে।
                 এমন সময় চিঠি এল
                     ভজু মহাজন
                 দেনায় দিয়েছে ক্রোক ভিটেবাড়িখানা।
 
    বাড়ি গিয়ে উপরের ঘরে
জানলা খুলতে সেটা ডালে ঠেকে গেল।
        রাগ হল মনে–
ঠেলাঠেলি করে দেখি,
           আরে আরে ছাত্র যে আমার!
        শেষকালে বড়োই তো হল,
               উন্নতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিলে
        ভজু মল্লিকেরই মতো আমার দুয়ারে দিয়ে হানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

উন্নতি
1 of 2

উন্নতি

দিনেমার দার্শনিক হারাল্‌ড্‌ হ্যফ্‌ডিং জুলাই “মনিস্ট্‌’ পত্রিকায় মঙ্গলের মূলতত্ত্ব নামক এক প্রবন্ধ প্রকাশ করিয়াছেন, তাহার যে অংশ ভারতবর্ষীয় পাঠকদের পক্ষে বিশেষ অবধানের যোগ্য, আমরা সংকলিত করিয়া দিলাম।

যে-সকল জীবনের চিত্তবৃত্তি নিতান্ত আদিম অবস্থায় আছে তাহাদের পরিবর্তন সহজে ঘটে না। তাহাদের জীবনধারণের সামান্য অভাবগুলি যতদিন পূরণ হইতে থাকে ততদিন তাহারা একভাবেই থাকে। ইন্‌ফ্যুসেরিয়া, রিজোপড্‌ প্রভৃতি নিম্নতম শ্রেণীর জন্তুগণের আজও যে দশা, যুগ-যুগান্তর পূর্বেও অবিকল সেই দশা ছিল। তাহাদের আভ্যন্তরিক অবস্থার সহিত বাহ্য অবস্থার এমনি সম্পূর্ম সামঞ্জস্য যে, কোনোরূপ পরিবর্তনের কোনো কারণ ঘটে না। মনুষ্যের মধ্যেও ইহার উদাহরণ পাওয়া যায়। যাহাদের অভাববোধ অল্প, যাহারা আপনার চারি দিকের অবস্থার সহিত সম্পূর্ণ বনিবনাও করিয়া থাকিতে পারে তাহাদিগকে পরিবর্তন এবং উন্নতির দিকে প্রবর্তিত করিবার কোনোরূপ উত্তেজনা থাকে না। সংকীর্ণ সীমার মধ্যে সংকীর্ণ মনোবৃত্তি লইয়া তাহারা নিশ্চন্তে কালযাপন করিতে থাকে। জটিল এবং বিচিত্র অবস্থাপন্ন মানবদের অপেক্ষা ইহাদের সুখ-সন্তোষ অনেকটা সম্পূর্ণ এবং অবিমিশ্র তাহাতে আর সন্দেহ নাই। ছোটো পাত্র বড়ো পাত্র অপেক্ষা ঢের কম জলে ঢের বেশি পরিপূর্ণতা লাভ করিতে পারে।

তবে তো সেই ছোটো পাত্র হওয়াই সুবিধা। জীবনের কেবল কতকগুলি একান্ত আবশ্যক পূরণ করিয়া হৃদয়ের কেবল কতকগুলি আদিম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিয়া নির্বিকার শান্তি লাভ করাই তো ভালো। ফ্যুজিদ্বীপবাসীরা তো বেশ আছে– দক্ষিণ আমেরিকার আদিম নিবাসীরা কদলীবনের মধ্যে তো চিরকাল সমভাবেই কাটাইয়াছিল,সভ্যতার নব নব অশান্তি এবং বিপ্লবের কোনো ধার তাহারা ধারে না।

কিন্তু সে আক্ষেপ এখন করা বৃথা। সভ্য জাতিদের পক্ষে এরূপ জীবনযাত্রা নিতান্ত অসহ্য। তাহার কারণ, সভ্যতাবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে একটি নূতন মনোবৃত্তির উদ্ভব হইয়াছে, তাহার নাম কাজ করিবার ইচ্ছা, উন্নতির ইচ্ছা। এক কথায়,তাহাকে অসন্তোষ বলা যাইতে পারে। এ মনোবৃত্তি সকল জাতির সকল অবস্থায় থাকে না।

প্রথম প্রথম বাহিরের তাড়ায় মানুষ উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে থাকে। ক্রমে, কাজ করিতে করিতে অন্তরের মধ্যে কর্মানুরাগ নামক একটা স্বতন্ত্র শক্তির সঞ্চার হয়; তখন বাহিরের উত্তেজনার অভাব সত্ত্বেও সে ভিতর হইতে আমাদিগকে অহর্নিশি কাজে প্রবৃত্ত করাইতে থাকে। তখন মানুষ বাহিরের শাসন হইতে অনেকটা মুক্তি লাভ করে; বাহ্য অভাব মোচন হইলেও অন্তরের সেই নবজাগ্রত শক্তি বিশ্রাম করিতে চাহে না, তখন নব নব উন্নত আদর্শের সৃষ্টি হইতে থাকে; তখন হইতে আমাদের পক্ষে নির্জীব নিস্পন্দভাবে থাকা অসাধ্য হইয়া উঠে, এবং তাহাতে আমরা যথার্থ সুখও পাই না।

জাতীয় আত্মরক্ষার পক্ষে এই প্রবৃত্তির একটা উপযোগিতা আছে, তাহা বিচার করিয়া দেখা কর্তব্য। প্রকৃতিতে সম্পূর্ণ স্থায়িত্ব কোথাও নাই। তোমার অব্যবহিত চতুষ্পার্শ্বে যদি বা পরিবর্তন তেমন খরস্রোতে প্রবাহিত না হয় তথাপি অনতিদূরে কোনো-না-কোনো জাতির মধ্যে পবির্তন ঘটিতেছেই, সুতরাং কোনো-না-কোনো সময়ে তাহাদের সহিত জীবিকাযুদ্ধের সংঘর্ষ অনিবার্য। সে সময়ে, যাহারা বহুকাল স্থিরভাবে সন্তুষ্টচিত্তে আছে তাহাদের পক্ষে নূতন আপৎপাতের বিরুদ্ধে নূতন পরিবর্তন সহজসাধ্য হয় না; যাহারা কর্মানুরাগী উদ্যোগী জাতি তাহারাই পরিবর্তনে অভ্যস্ত এবং সকল সময়েই প্রস্তুত, সুতরাং এই চঞ্চল সংসারে টিঁকিবার সম্ভাবনা তাহাদেরই সব চেয়ে বেশি।

কেবল জাতি নহে, ব্যক্তিবিশেষের পক্ষেও সংকীর্ণ সীমার মধ্যে আপনাকে সম্পূর্ণ নিহিত করিয়া সুখী হওয়ার অনেক বিপদ আছে। দৃষ্টান্তস্বরূপে দেখা যায়, ঘরের আদুরে ছেলে হইয়া চিরকাল খোকা হইয়া থাকার অনেক সুবিধা থাকিতে পারে; কিন্তু চিরদিন ঘরের মধ্যে কাটাইয়া চলে না, এক সময়ে কঠিন সংসারের সংস্রবে আসিতে হয় তখন নিতান্ত নিঃসহায় হইয়া পড়িতে হয়। সংকীর্ণ সম্পূর্ণতা লাভ অপেক্ষা বৃহৎ বিকাশের উদ্যম ভালো।

উন্নতি বলিতে সর্বকামনার পর্যবসানরূপিণী একটা নির্বিকার নিরুদ্যম অবস্থা বুঝায় না। ভবিষ্যতের নব নব মঙ্গল সম্ভাবনার জন্য নব নব শক্তি সঞ্চয় করিয়া চলাই উন্নতি। সেই-সমস্ত শক্তির উত্তেজনায় ক্রমাগত নূতন নূতন উদ্দেশ্যের পশ্চাতে নূতন নূতন চেষ্টা ধাবিত হইতে থাকে। সেইসঙ্গে কেবল উদ্যমেই কার্যে বিকাশেই একটা সুখ জাগ্রত হইয়া উঠে, সমগ্র প্রকৃতির পরিচালনাতেই একটা গভীর আনন্দ লাভ হয়। সেই আনন্দে সভ্য জাতিরা এমন সকল দুঃসহ কষ্ট সহ্য করিতে পারে যাহার পেষণে অসভ্য জাতিরা মারা পড়ে। এই যে একটি স্বতন্ত্র উন্নতির প্রবৃত্তি, এই যে কর্মের প্রতিই একটা স্বতন্ত্র অনুরাগ, ইহা লইয়াই সভ্য ও অসভ্য জাতির মধ্যে প্রধান প্রভেদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *