উনি – অনুবাদক: বুদ্ধদেব বসু

উনি

প্রথম যেদিন তাদের বিয়ে ঠিক হল, সেদিন থেকেই বার্তোলিনো তার ভাবী স্ত্রীকে বলতে শুনেছে:

‘জানো তো, আমার সত্যিকার নাম কিন্তু লিনা নয়। আমার নাম আসলে কারোলিনা, কিন্তু উনি আমাকে লিনা বলে ডাকতেন, আর সেই থেকে আমার নাম লিনাই হয়ে গেছে। আহা ভারী— ভাল মানুষ ছিলেন উনি, ওই দেখো না তাঁর ছবি’ —

বলে লিনা বড় একটি ফোটোগ্রাফের দিকে আঙুল তুলল। বার্তোলিনো দেখল, তার ভাবী স্ত্রীর প্রথম স্বামী সিনোর কোসিমো তাদ্দেয়ি তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে টুপি তুলছেন।

প্রায় নিজের অজান্তে, বার্তোলিনো মৃত ভদ্রলোকের অভিবাদনের প্রত্যুত্তরে নিজের মাথাটি অর্ধেক নিচু করে ফেলেছিল।

তাদ্দেয়ি ছিলেন একজন বিখ্যাত স্থপতি। তিনি গত হবার পরে তাঁর ছবিটি দেয়াল থেকে নামিয়ে রাখবার কথা তাঁর বিধবা স্ত্রী লিনা সারুল্লির একবারও মনে হয়নি। কেনই বা হবে। তাঁর কাছে লিনার কৃতজ্ঞতা তো কম নয়। তার মান সম্মান, বাড়ি ঘর, সুন্দর সুন্দর আসবাবপত্র সব তো তিনিই তার জন্য করে গেছেন।

ভাবী দ্বিতীয় স্বামীর অপ্রতিভ ভাব কিছুমাত্র লক্ষ না করে লিনা আরও বলেছে, ‘আমি অবশ্য নাম বদল করতে চাইনি, কিন্তু উনি যা বলতেন, তার উপর আমি আর না বলতে পারতুম না। তুমিও আমাকে ওই নামেই ডেকো, কেমন? কিছু মনে করবে না তো?’

বার্তোলিনো থতমত খেয়ে বলেছে, ‘না…ইয়ে…না…তা তো ঠিকই।’ দেয়ালের বড় ছবিটি থেকে সে যেন আর চোখ ফেরাতে পারেনি— ভদ্রলোক তারই দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে টুপি তুলে অভিবাদন জানাচ্ছেন।

তিন মাস পরে যখন আত্মীয়-বন্ধুরা লিনা আর তার স্বামীকে তাদের হানিমুন-যাত্রায় তুলে দিতে স্টেশনে এল, তখন লিনার প্রিয় সখী অর্তেনসিয়া মোত্তা স্বামীর দিকে তাকিয়ে একটি অদম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, ‘বেচারা বার্তোলিনো— লিনার মতো মেয়ের সঙ্গে…’

‘কেন, বেচারা কেন?’ তার স্বামী বলে উঠল। ভদ্রলোকের বয়েস হয়েছে, লিনার দ্বিতীয় বিবাহের ঘটকালি বলতে গেলে তিনিই করেছেন, তাই এ বিয়ের কোনওরকম সমালোচনা শুনলেই তাঁর রাগ হত। ‘বেচারা হবার কী হয়েছে? বার্তোলিনো তো বোকা নয়, কেমিস্ট্রিতে তার অসাধারণ দখল।’

‘হ্যাঁ, কেমিস্ট্রিতে,’ বললে অর্তেনসিয়া।

‘দেখো তুমি, বার্তোলিনো একেবারে আদর্শ স্বামী হবে। কেমিস্ট্রির কথাই বা কী— যদি একটু গা করে ওর সব কাজ ও ছাপিয়ে বের করত তা হলে দেশের একজন আদর্শ শিক্ষক হতে পারত। তা ছাড়া ও এমন মনখোলা ভালমানুষ—’

‘ঠিক বলেছ, নিতান্ত মনখোলা ভালমানুষ।’ লিনার এই দ্বিতীয় হানিমুনের কথা ভেবে অর্তেনসিয়া মনে মনে একটু না হেসে পারল না। প্রথম বারেও রোমে গিয়েছিল লিনা— এবারেও রোমে যাচ্ছে। প্রথম বারে ছিল ফুর্তিবাজ, ধূর্ত, উৎসাহী (কখনও কখনও একটু-বা বেশি উৎসাহী) সিনোর তাদ্দেয়ি, আর এবারে তার জায়গায় এই ছোকরা বার্তোলিনো— মাথায় টাক, অথচ চেহারায় আর অভিজ্ঞতায় ছেলেমানুষ।

ট্রেন ছাড়বার আগে আনসেলমো-খুড়ো বউকে বলেছিলেন, ‘বার্তোলিনোর একটু দেখাশুনো কোরো… একটু যত্ন-টত্ন কোরো ওকে।’

লিনা তার প্রথম হানিমুনে আগে একবার রোমে এসে গেছে, দেশ ভ্রমণের সব রহস্য তার জানা— সে সমস্তটা পথ বার্তোলিনোকে প্রায় ছেলেমানুষের মতো হাতে ধরে নিয়ে এল। শেষ পর্যন্ত গাড়ি যখন রোমে পৌঁছোল, সে স্বামীকে বললে, ‘তুমি কিছু ভেবো না— আমি সব করে নিচ্ছি।’ যে-কুলিটা তাদের মালপত্র গোছাচ্ছিল তার দিকে তাকিয়ে সে বললে, ‘হোটেল ভিক্টোরিয়া।’

স্টেশনের বাইরেই হোটেল ভিক্টোরিয়ার বাস অপেক্ষা করছিল। ড্রাইভারকে চিনতে পেরে লিনা তার দিকে তাকিয়ে একটু মাথা নাড়ল।

‘সুন্দর হোটেলটি দেখো। ছোট্ট ফিটফাট, চাকর-বাকররা চটপটে, একেবারে শহরের মধ্যিখানে, অথচ খরচও খুব বেশি নয়।… ছ’বছর আগে ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম হানিমুনে এসে এ হোটেলেই উঠেছিলাম।… তোমারও এটা ভাল লাগবে, দেখো।’

হোটেলটা লিনার প্রায় বাড়ি-বাড়ি লাগল। তাকে যে কেউ চিনতে পেরেছে এমন মনে হল না, কিন্তু সে সকলকেই ঠিক চিনতে পারছে। ওই তো বুড়ো ‘পিপ্পো’, ছ’বছর আগে এই লোকই তাদের যত্ন-আত্তি করেছিল। সে তাদের দোতলায় এন ১২ নম্বর ঘরে নিয়ে গেল— বেশ বড় ঘরটি, ভাল করে সাজানো, কিন্তু লিনার সে ঘর পছন্দ হল না।

‘পিপ্পো, উনিশ নম্বর ঘর কি খালি আছে?’ পিপ্পো খবর নিতে বেরিয়ে গেল, সে ফাঁকে লিনার মনে পড়ল যে ছ’বছর আগে তাঁরও ঠিক এই রকমই হয়েছিল। ওঁর জন্য দোতলায় একটা ঘর ঠিক করে রেখেছিল ওরা, কিন্তু উনি চেয়েছিলেন তেতলায় এন ১৯ নম্বর ঘর।

‘শুনছ, ওখানেই আমরা ভাল থাকব। গোলমাল কম, হাওয়া বেশি। ওই একই ঘর…’

পিপ্পো ফিরে এসে যখন বললে যে এন ১৯ খালি আছে, লিনা ছেলেমানুষের মতো হাততালি দিয়ে হেসে উঠল। ঠিক সেই ঘরেই সে আবার থাকবে, সেই সব আসবাব, সেইরকম করে সাজানো, জানলার ধারে ঠিক সেই কুলুঙ্গি! কী মজা!

বলা বাহুল্য, বার্তোলিনো তার আনন্দে অংশগ্রহণ করতে পারেনি।

‘কী গো, ঘরটি ভাল লাগছে না তোমার?’ লিনা জিজ্ঞেস করলে।

উদাসভাবে বার্তোলিনো জবাব দিল, ‘মন্দ কী— তোমার ভাল লাগলেই হল…’

তারপর লিনা যখন কাপড় ছাড়তে পরদার পিছনে গেল— সে ঘরের খাটটির দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল যে এখানেই, এই বিছানায় তার স্ত্রী তার প্রথম বিবাহিত রাত্রি কাটিয়েছে— কাটিয়েছে তার প্রথম স্বামী সিনোর তাদ্দেয়ির সঙ্গে।… আর অনেক দূর থেকে, তার স্ত্রীর বাড়ির দেয়ালে ঝোলানো ছবিটি থেকে, সিনোর তাদ্দেয়ির মূর্তি তার চোখের সামনে জেগে উঠল— মুচকি হেসে তার দিকে তাকিয়ে তিনি টুপি তুলছেন!

হানিমুনের সময়টা তারা যে শুধু সেই একই বিছানায় শুল তা নয়, সেই একই রেস্তোরাঁয় খেল, সেইসব দৃশ্যই দেখে বেড়াল, সেইসব জাদুঘর, সেইসব চিত্রশালা, সেইসব গির্জে, এমনকী সেইসব বাগান— যেখানে-যেখানে ছ’বছর আগে, লিনা তার ‘উনি’র সঙ্গে গিয়েছিল। বার্তোলিনো ভারী লাজুক স্বভাবের মানুষ— কিছুতেই সে মুখ ফুটে বলতে পারলে না যে সেই প্রথম স্বামীর উপদেশ, অভিজ্ঞতা, রুচি, ইচ্ছা-অনিচ্ছা পদে পদে অনুসরণ করে চলতে কত খারাপ তার লাগছে। লিনাও লক্ষ করলে না যে তার ব্যবহারে তার তরুণ স্বামী মনে মনে কী রকম মর্মাহত। আঠারো বছর বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল, তখন সে বলতে গেলে খুকি, কিছুই বোঝে না, জানে না, ওই মানুষটিই তাকে শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে মানুষ করেছে, সে তার প্রথম স্বামীরই তো সৃষ্টি। যা কিছু তার আছে সবই কি ওঁর কাছ থেকেই সে পায়নি— এমনকী, ওঁর থেকে ভিন্নভাবে ভাববার কি অনুভব করবার শক্তিও তার লোপ পেয়ে গিয়েছিল।

সে যে আবার বিয়ে করেছে তাও তো সিনোর তাদ্দেয়িরই উপদেশ। তিনিই তাকে শিখিয়ে গেছেন যে অশ্রুজলে জীবনের শুশ্রূষা হয় না, জীবিতের জন্য জীবন, আর মৃতের জন্য মৃত্যু। শুধু এই কথা মনে করেই সে বার্তোলিনোকে স্বামীরূপে গ্রহণ করেছিল— আর কোনও কারণে নয়। বার্তোলিনো যদি তাকে ভালবাসে তা হলে তার মতামত মেনে নিয়েই চলবে সে— আর তার মানেই সিনোর তাদ্দেয়ির ইচ্ছা-অনিচ্ছার অনুসরণ করা। তিনিই কর্তা, জীবন-রথের তিনিই সারথি।

কিন্তু —যৌবনের অন্ধ অনভিজ্ঞতার বশে বার্তোলিনো ভাবল— অতি সামান্য কিছুও কি লিনা তাকে দিতে পারে না— একটি চুম্বন, একটু আদর, তার প্রথম স্বামী তাকে যা-সব শিখিয়ে গেছে তা থেকে যা আলাদা? এমন কিছু যা ওই মৃত মানুষের কর্তৃত্ব থেকে লিনাকে তখনকার মতো মুক্তি দিতে পারে? কিন্তু কথাটা উল্লেখ করতেও তার লজ্জা, আর বিদ্রোহ করবার কথা সে তো ভাবতেই পারে না।

হানিমুন থেকে ফিরে এসে একটি অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদ পেল তারা। সিনোর মোত্তা— যিনি তাদের বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন— হঠাৎ মারা গেছেন।

সে নিজে যখন বিধবা হয়েছিল তখন এই মোত্তার স্ত্রী অর্তেনসিয়া তার জন্য যে কত করেছিল তা কি লিনা ভুলতে পারে। সেও ছুটে গেল সখীকে সান্ত্বনা দিতে, সাহায্য করতে। কিন্তু সে বুঝতেই পারলে না যে স্বামীর মৃত্যুর দশ দিন পরেও অর্তেনসিয়া অমন শোকাচ্ছন্ন হয়ে আছে কেন।

‘ওর কী হয়েছে বলো তো?’ ফিরে এসে সে তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করলে।

স্ত্রীর বোধশক্তির অভাবে বার্তোলিনো লজ্জায় লাল হল।— ‘মানে— যাই বলো না, ওর স্বামী তো মারা গেছে।’

‘ওর স্বামী? তা মরেছে তো কী হয়েছে? বাপের বয়সি স্বামী, তার আবার…’

‘তা হলেই বা, তাই বলে কি দুঃখ হতে নেই?’

‘বাপের বয়সি, কিন্তু বাপ তো নয়।’ লিনা জোর করেই বললে।

লিনার কথাই ঠিক। অর্তেনসিয়া লক্ষ করেছিল যে লিনার মুখে বারবার তার মৃত স্বামীর কথা শুনে শুনে বার্তোলিনোর ঘেন্না ধরে গেছে। সে তাই দুঃসহ দুঃখের ভাব ধরে তার মন ভোলাবার চেষ্টা করলে। তার দুঃখ বার্তোলিনোকে এমন গভীরভাবে বিচলিত করলে যে এই প্রথমবার, প্রাণপণে লজ্জা কাটিয়ে উঠে, সে তার স্ত্রীর কাছে বিদ্রোহ করলে।

‘তুমি… তুমিও কি কাঁদোনি!’

সে আরও কিছু বলত হয়তো, কিন্তু লিনা তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘ওর সঙ্গে আমার তুলনা। প্রথম কথা, উনি ছিলেন…’

স্ত্রীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বার্তোলিনো বলল, ‘উনি তখনও বুড়ো হননি— এই তো?’

‘তা ছাড়া… আমিও কি কাঁদিনি? হ্যাঁ, কেঁদেছি বই কী, কত কেঁদেছি… কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিয়েছি আমি। কিন্তু অর্তেনসিয়া কী করছে? কেবলই কাঁদছে আর কাঁদছে আর কাঁদছে— যেন জীবন ভরে ও কাঁদবেই। জানি, জানি, ওসব মেকি কান্না!’

মেকি! অসম্ভব! কথাটা শুনে বার্তোলিনোর আরও রাগ হল যত না স্ত্রীর উপর, তার চেয়েও বেশি রাগ হল স্ত্রীর ওই মৃত স্বামী, ওই সিনোর তাদ্দেয়ির উপর। লোকটা এখনও দেয়াল থেকে তাকিয়ে তার দিকে মুচকি হেসে টুপি তুলে আছে, এখনও তার ইচ্ছার, তার মতামতের বশ করে রেখেছে তার স্ত্রীকে!

ওই ছবি! ওই চিরন্তন হাসি! আর সহ্য হয় না। যেখানেই সে যায়, ভূতের মতো লেগে আছে তার পিছনে। ওই তো, তার চোখের সামনে, হেসে হেসে টুপি তুলে যেন বলছে:

‘এবার তোমার পালা— হাত পা ছড়িয়ে বেশ আরাম করে নাও। এ ঘর এককালে আমার আপিস-ঘর ছিল, এখন তোমার কেমিস্ট্রির ল্যাবরেটরি হয়েছে। জীবিতের জন্য জীবন, মৃতের জন্য মৃত্যু। সুখে থাকো, শান্তিতে কাজ করো।’

হয়তো সে শোবার ঘরে ঢুকেছে, সেখানেও সিনোর তাদ্দেয়ির মূর্তি মুখের ক্রূর হাসিটি নিয়ে উপস্থিত!

‘এসো, এসো। তারপর, ভাল তো? আমার স্ত্রীকে কেমন লাগছে তোমার? আমি তাকে সুশিক্ষা দিয়েছিলাম কি না, বলো! জীবিতের জন্য জীবন, মৃতের জন্য মৃত্যু।’

না, আর সহ্য হয় না। বাড়ির প্রতিটি কোণ ওই মানুষটা ভরে আছে। বার্তোলিনো এমন যে নির্বিবাদী মানুষ সেও অস্থির হয়ে উঠল, ছটফট করতে লাগল, স্ত্রীর কাছে মনের ভাব লুকোবার চেষ্টা আর তার সফল হল না।

শেষ পর্যন্ত মনের ভাব লুকোবার চেষ্টাই সে ছেড়ে দিলে। চেষ্টা করল খাপছাড়া হতে, অদ্ভুত হতে, যাতে তার স্ত্রীর পুরনো অভ্যেসগুলি নাড়া খায়। কিন্তু এবারেও সে সফল হল না।

‘তোমার চালচলন ঠিক ওঁর মতোই হয়ে উঠছে,’ ঈষৎ শাসনের সুরে লিনা বললে। ‘উনিও বড্ড বেহিসেবি ছিলেন— আহা ভালমানুষ বেচারা!’

শিগগিরই বার্তোলিনো বুঝতে পারল যে তার খাপছাড়া ব্যবহার লিনা মনে মনে উপভোগই করেছে। তার এসব কারসাজি লিনাকে ঠিক সেই মানুষটির কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে, যাকে সে স্ত্রীর মন থেকে মুছে দিতে চায়।

শেষটায় বিশ্রী একটা ফন্দি তার মনে এল।

সত্যি বলতে, স্ত্রীর সঙ্গে প্রবঞ্চনা করবার ইচ্ছা তার ততটা ছিল না, যতটা ছিল প্রতিহিংসার উত্তেজনা। সেই মানুষের উপরেই তার আক্রোশ, যে-মানুষ তার আগেই তার স্ত্রীকে দখল করেছিল এবং মরে গিয়েও সে দখল ছাড়েনি। তার অজ্ঞান অনভিজ্ঞ মনে ধারণা হল যে এই দুষ্টুমির ফন্দি একান্তই তার নিজের সৃষ্টি। সে ভাবতে পারল না যে এ দুর্বুদ্ধি অর্তেনসিয়াই তার অবচেতন মনে একটু একটু করে ঢুকিয়েছিল। যখন সে বিয়ে করেনি, তখন তাকে তার পড়াশুনো থেকে চ্যুত করবার অনেক চেষ্টাই অর্তেনসিয়া করেছে, করে ব্যর্থ হয়েছে।

কুচক্রী অর্তেনসিয়া এবার চালের পিঠে চাল ছাড়ল। ইনিয়ে-বিনিয়ে বার্তোলিনোকে সে বোঝাল যে লিনার মতো প্রিয় সখীর সঙ্গে প্রবঞ্চনা করতে দুঃখে তার বুক ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু বার্তোলিনোকে অনেক আগে থেকেই সে ভালবেসে আসছে, লিনা তখন তাকে চোখেও দেখেনি। সে ভালবাসা নিয়তির মতোই অনতিক্রম্য।

এর পরে যা হল, তাতে যে নিয়তির কী হাত থাকতে পারে, বার্তোলিনো কিন্তু তা ভেবে পেল না। বেচারা ভালমানুষ! তার গূঢ় অভিসন্ধিটি যে এত সহজে সম্পন্ন হল তাতে একটু হতাশই হল সে। মনে হল সে যেন ঠকে গেছে। তার পুরনো বন্ধু মোত্তার শোবার ঘরে সে যখন একলা হল, একটু পরেই অনুশোচনায় তার মনটা ভরে গেল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল যে বিছানার ধারে মেঝের উপর একটা চকচকে জিনিস পড়ে আছে। ছোট্ট সোনার একটা লকেট, নিশ্চয়ই অর্তেনসিয়ার গলার। সে সেটা কুড়িয়ে নিয়ে অর্তেনসিয়ার অপেক্ষা করতে লাগল। নাড়াচাড়া করতে করতে তার উত্তেজিত আঙুলের চাপে হঠাৎ লকেটের মুখটা গেল খুলে। নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারল না।

লকেটের ভিতরে একটা ছবি খুব ছোট করে খোদাই করা; সিনোর কোসিমো তাদ্দেয়ির সেই ছবি, তিনি মুচকি হেসে তার দিকে তাকিয়ে টুপি তুলে আছেন।

—বুদ্ধদেব বসু

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *