উত্তর কথন
এবার কিছু পরের কথা বলা যাক। কি সব ঘটেছে জর্জ অরওয়েলের ‘নাইনটিন এইটি-ফোর’ বইটি নিয়ে? পাঠক এই উপন্যাসটিকে মাথায় তুলে নিয়েছে, গোগ্রাসে গিলেছে, সেসব কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সমালোচক-পর্যালোকরা? তারাও কিন্তু বইটি প্রকাশের পর প্রথম থেকেই খুব ভালোভাবে নিয়ে নিলেন। নিউ স্টেটসম্যানে ভি এস প্রিচে তার পর্যালোচনায় লিখলেন : মনেই করি না এমন ভয়ের আর হতাশার প্রকাশ আর কোনো উপন্যাসে আমি পেয়েছি। আর বাস্ত বতার এমন উপস্থাপনা, পুরো ঘটনা জুড়ে টান টান উত্তেজনা, গতিময়তা আর এমন শুকনো ক্রোধ জাগানিয়া লেখনি উপন্যাসটিকে কোথাও সামান্য পড়ে যেতেও দেয়নি। দ্য লিসনার ম্যাগাজিনের জন্য একটি পর্যালোচনা লিখেছিলেন পিএইচ নিউবি। তিনি এই উপন্যাসটিকে রেক্স ওয়ার্নারের দ্য এ্যারোড্রম-এর পর কোনো ইংলিশ লেখকের সবচেয়ে আক্রমণাত্মক রাজনৈতিক উপন্যাস বলে আখ্যা দেন। বার্ট্রান্ড রাসেল, ই এম ফস্টার, হ্যারল্ড নিকোলসনও এর প্রশংসায় হন পঞ্চমুখ।
তবে সমালোচনার বান যে আসেনি তা নয়। দ্য সানডে টাইমস-এ এডওয়ার্ড শাঙ্কস লিখলেন, নাইনটিন এইটি-ফোর আমার কাছে ফালতু ভবিষ্যত কথন ছাড়া আর কিছুই নয়। সিএস লুইস উপন্যাসটির সমালোচনায় বলেছিলেন, জুলিয়া আর উইনস্টনের মধ্যে সম্পর্ক আর যৌনতার প্রতি পার্টির যে দৃষ্টিভঙ্গি এতে তুলে ধরা হয়েছে তা স্রেফ বাস্তবতা বিবর্জিত, বিশ্বাসযোগ্যতার অভাবদুষ্ট। ওই অংশটুকুকে করুণরসাত্মক মনে না হয়ে বরং কদর্যতার প্রকাশই মনে হয়েছে, বলেন লুইস।
তবে সে যাই হোক ‘নাইনটিন এইটি-ফোর’র প্রভাব কিন্তু ছাড়িয়ে গেছে অনেক উপন্যাসকেই। প্রাককথনেই জানিয়েছি উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর ইংরেজি ভাষায় এর নানা শব্দের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। বিগ ব্রাদার, রুম ১০১, থট পুলিশ, থটক্রাইম, আনপারসন, মেমরিহোল, ডাবলথিংক, আর স্বয়ং নিউস্পিক মানুষের কথ্য ভাষায় পরিণত হয়।
নাইনটিন এইটি-ফোর’র প্রতিপাদ্য এসেছে আরও অনেক শিল্প-সংস্কৃতি কর্মে, বিশেষ করে জনপ্রিয় সংগীতে, বিনোদনচিত্রে। গোটা বিশ্বে ভীষণ হিট টেলিভিশন শো বিগ ব্রাদার চলছে বছরের পর বছর ধরে। এই রিয়েলিটি শোতে দেখা যায় একটি বড় বাড়িতে কতগুলো মানুষ একসাথে থাকছে, তাদের সঙ্গে বাইরের জগতের কোনো যোগাযোগ নেই, কিন্তু টেলিভিশন ক্যামেরার চোখ তাদের ওপর পাকিয়ে রয়েছে সারাক্ষণ। আর কিছু হলেই আসছে বিগ ব্রাদারের নির্দেশনা। বিগ ব্রাদারের অধস্তন আর অনুরক্ত তারা সবাই। আর এটাই তো নাইনটিন এইটি-ফোর’র মূল প্রেক্ষাপট।
১৯৭৭ সালে ব্রিটিশ রক ব্যান্ড দ্য জ্যাম তার দিস ইস দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড প্রকাশ করে। এই অ্যালবামের শেষ ট্র্যাকে কথাগুলো ছিল এমন: ‘… আর অজ্ঞানতাই শক্তি, ঈশ্বর আছেন আমাদের সাথে, দেখো, তোমরা তো জানো উইনস্টনের ওপর কি হয়েছিল।’ এ যেন- উইনস্টন ছিল এক সত্যিকারের মানুষ; কোনো উপন্যাসের চরিত্র নয়।
২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে ইংল্যান্ডের প্রগতিশীল ব্যান্ড দল মিউজ প্রকাশ করে দ্য রেসিসট্যান্স। এই অ্যালবামে ১৯৮৪’র সবগুলো গানই অন্তর্ভুক্ত ছিল।
১৯৮৪ সালে উপন্যাসটির ভিত্তিতে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। যাতে উইনস্টনের চরিত্রে অভিনয় করেন জন হার্ট। ২০০৬ সালে ‘ভি ফর ভেনডেটা’ নামে আরেকটি চলচ্চিত্র হয় যার কাহিনি বিন্যাসের পরতে পরতে ছিল নাইনটি এইটি-ফোর’র প্রতিফলন, সেটিরও মূল চরিত্রে ছিলেন জন হার্ট। তবে এবার উইনস্টন হিসেবে নয় টোটালিটারিয়ান পার্টির প্রধানের চরিত্রে। ডক্টর হু ধারাবাহিকের ‘দ্য গড কমপ্লেক্স’ নামের পর্বে রুম-১০১ এর ব্যবহার রয়েছে। সেখানে ১৯৮৪’র নার্সারি রাইমগুলোরও ব্যবহার রয়েছে।
মানুষের ব্যক্তিগত জীবন ব্যবস্থায় সরকারের সার্বক্ষণিক নজরদারির যে কথা এই বইয়ে বলা হয়েছে তারই প্রকাশ পাওয়া যায়, ২০১৩ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের এনএসএ’র পক্ষে গোটা বিশ্বের ইন্টারনেট ট্রাফিক মনিটরিংয়ের বিষয়টি প্রকাশিত হয়ে যায়। এমনকি ই-মেইল, ফোনকলও তাদের মনিটরিংয়ের বাইরে ছিল না। সেসময়টিতে ‘নাইনটিন এইটি-ফোর’র বিক্রি সাতগুণ বেড়ে যায়।
জনপ্রিয় মিডিয়াতেও নাইনটি এইটি-ফোর’র উপস্থিতি দেখা গেছে বার বার। দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে এই নামেই প্রথমটি ১৯৫৬ সালে আর দ্বিতীয়টি ১৯৮৪ সালে। দ্বিতীয় চলচ্চিত্রটিকে আরও বাস্তবিক করে তুলতে মূল উপন্যাসে যেই তারিখগুলোর ও সময়ের কথা বলা হয়েছে তার সঙ্গে মিল রেখেই চিত্র ধারণ করা হয়। উইনস্টন যেমন তার ডায়রিতে এপ্রিল ৪, ১৯৮৪ লিখেছিলেন ঠিক সেই দিনেই ওই চিত্র গ্রহণ করেন এর পরিচালক। ২০১২ সালে হলিউডের একটি কনসর্টিয়াম থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, তারা অরওয়েলের উপন্যাস অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চান। যার নাম হবে ইকুয়ালস।
মঞ্চ নাটকে এই উপন্যাস এসেছে বার বার। নাট্যকার অ্যালান লিডিয়ার্ড আর মাইকেল জিনি সুলিভানসহ অনেকেই এর নাট্যরূপ দিয়েছেন। ২০১৩ সালে ‘হেডলং’ থিয়েটার কোম্পানি এই উপন্যাসের নিউস্পিক সূচিপত্রকে ধরে নাটক বানায় যা গোটা যুক্তরাজ্য জুড়ে সাড়া ফেলে দেয়।
রেডিও ব্রডকাস্টে প্রথম নাইনটিন এইটি-ফোর ধারবাহিকভাবে প্রচারিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের এনবিসি-তে। ১৯৪৯ সালের ২৭ আগস্ট শুরু হয়ে ৫৫ পর্বে তা প্রচারিত হয়। এরপর ১৯৫৩ সালে আরও একবার এনবিসি আরেকটি নাটক প্রচার করে যাতে স্মিথ চরিত্রে রিচার্ড উইডমার্ক ও জুলিয়া চরিত্রে ম্যারিয়ান সেলডেস অভিনয় করেন।
যুক্তরাজ্যে বিবিসি হোম সার্ভিস ৯০ মিনিটের একটি নাটক তৈরি করে যার মূল চরিত্রে অভিনয় করেন প্যাট্রিক ট্রোটন ও সিলভিয়া সিমস। ১৯৬৫ সালের ১১ অক্টোবর এটি প্রচার করে বিবিসি। ২০০৫ সালে বিবিসি রেডিও-২ আট সপ্তাহ ধরে এটি ধারাবাহিকভাবে প্রচার করে। ২০১৩ সালে বিবিসি-৪ প্রচার করে দ্য রিয়েল জর্জ অরওয়েল সিজন। এতে স্মিথ চরিত্রে ক্রিস্টোফার একলেসটন, জুলিয়া চরিত্রে পিপ্পা নিক্সন আর ও’ব্রায়েন চরিত্রে টিম পাইগট-স্মিথ অভিনয় করেন।
টেলিভিশনে নাইনটিন এইটি-ফোর প্রথম দেখা যায় ১৯৫৩ সালে সিবিএস স্টুডিও ওয়ানের একটি ধারাবাহিকে। আমেরিকান অভিনেতা এডি অ্যালবার্ট সেবার উইনস্টন স্মিথের ভূমিকায়। আর কানাডীয় লোর্ন গ্রিন ছিলেন ও’ব্রায়েনের ভূমিকায়। ১৯৫৪ সালে বিবিসির সানডে নাইট প্লেতে প্রচারিত হলো যাতে পিটার কাশিং ছিলেন স্মিথ চরিত্রে, আঁদ্রে মোরেল ও’ব্রায়েনের আর ইভোন মিশেল ছিলেন জুলিয়া চরিত্রে। একই স্ক্রিপ্টে ১৯৬৫ সালে বিবিসি-২ নাটকটি প্রচার করে ৬২৫ পর্বে।
২০১১ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার দেশটির সুপ্রিম কোর্টের সামনে জানাল, তারা জিপিএস ট্র্যাকিং এর মাধ্যমে মানুষের গতিবিধির ওপর নজরদারি করতে চায়। উত্তরে নাইনটিন এইটি-ফোর’র রেফারেন্স টেনে বিচারপতি স্টেফেন ব্রেয়ার জানতে চাইলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে এর মানে আর কীই হতে পারে? জাস্টিস ব্রেয়ার সেদিন আরও বলেছিলেন, এই মামলা যদি আপনারা জিতে যান তাহলে দেশের সাধারণ মানুষের চব্বিশ ঘণ্টার জীবন-যাত্রার ওপর সরকার আর পুলিশের নজরদারি চলবে। আর সে ব্যবস্থার কথা ‘নাইনটিন এইটি-ফোর’ এই বলা হয়েছিল।
উপন্যাস ছিল ১৯৮৪ কাল্পনিক বছর। কিন্তু এই বছরটির সঙ্গে স্থায়ীভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে জর্জ অরওয়েলের নাম। উপন্যাসটি রচনার ৩৬ বছর পর মহাকাশ বিজ্ঞানী অ্যান্টোনিও মার্কোস একটি গ্রহাণুপুঞ্জ আবিষ্কার করলেন। আর তখন জর্জ অরওয়েলের নামেই তার নামকরণ করা হলো।
উপন্যাস দিয়ে মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে যার অবস্থান তার স্থান রয়েছে ওই মহাকাশের লক্ষকোটি গ্রহ-নক্ষত্রের মাঝেও। মাত্র একটি সাহিত্য কর্ম এত দারুণভাবে সবকিছুতে ছড়িয়ে পড়তে পারে তার অন্যতম উদাহরণ জর্জ অরওয়েলের এই ‘নাইনটিন এইটি-ফোর’।