উড়ন্ত ঝাণ্ডা

উড়ন্ত ঝাণ্ডা

১৯১৫ এর ১লা জানুয়ারী। অষ্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এমন এক ফৌজ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো যার নজির পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। কারণ, সে ফৌজের সদস্য ছিলো মাত্র দুজন। তাদের যুদ্ধের সরঞ্জাম ছিলো এরকম- ঝং ধরা দুটি রাইফেল। প্রায় দেড় রাউন্ড গুলি। তাদের একজন ছিলো, ঘোড়ায় চড়ে পথে ঘাটে ঘুরে আইসক্রিম বিক্রেতা প্রায় বৃদ্ধ এক লোক। তার নাম গুল মুহাম্মদ। আরেকজন হলো মোল্লা আব্দুল্লাহ। ত্রিশ বছরের নওজোয়ান।

তাদের ঝাণ্ডা ছিলো এরকম, এক লাল রঙের টেবিলক্লথের ওপর রঙ দিয়ে কয়েকটি তারকার ছবি একে দেয়া হয়। তুর্কিদের পতাকা এমন হয়।

দক্ষিণ অষ্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ভিলেজের ছোট একটি জায়গা- ব্রকন হলের লোকেরা তাদের প্রতিবেশী দুই মুসলমান গুল মুহাম্মদ ও মোল্লা আব্দুল্লাহকে আফগান বলে জানতো। তখন অষ্ট্রেলিয়ার অধিকাংশ জায়গাতেই মরু অঞ্চল ছিলো। তাই সেখানে সাধারণ বাহন ছিলো উট। এসব হাজার হাজার উটের চালক ছিলো আফগানিস্তানের লোকেরা। ইংরেজরা তাদেরকে সেখানে নিয়ে যায়।

অনেক পরে প্রকাশ পায় যে, গুল মুহাম্মদ ও মোল্লা আব্দুল্লাহ তুর্কি। যারা নিজেদের মাতৃভূমির ক্ষেত্রে একেবারেই অন্ধ। বরং বলা যায় উন্মাদ দেশ প্রেমিক।

১৯১৪ সনে ইংরেজ ও তাদের মিত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে তুর্কিরা যুদ্ধ শুরু করে। কিন্তু ষাট বছরের গুল মোহাম্মদ সেটা ১৯১৫ এর ১লা জানুয়ারি শুনতে পায়, তুর্কিরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা দিয়েছে। আর অষ্ট্রেলিয়া ইংরেজদের করদ রাজ্য।

গুল মুহাম্মদ এটা শুনেই জিহাদের জোশ জযবায় উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে তার তুর্কি সঙ্গী মোল্লা আব্দুল্লাহর বাড়িতে দৌড়ে গিয়ে হাজির হলো। মোল্লা আব্দুল্লাহ ব্ৰকন হলে ধোপর কাজ করতো। ব্রন হলে এ দুজনেই তুর্কি ছিলো।

শোন ভাই- গুল মুহাম্মদ মোল্লা আব্দুল্লাহকে বললো, আমাদের প্রিয় তুর্কিস্তান ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা দিয়েছে। এর অর্থ হলো, তুর্কিরা যেখানেই থাকুক তাদেরকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। আর জানোই তো অষ্ট্রেলিয়া ইংরেজদের দেশ। তাই এদেশের সবার বিরুদ্ধে আমরা জিহাদের ঘোষণা দিলাম।

দুজনে তখনই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলো। তারা দুই যোদ্ধা বহু বছরের পুরনো রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। যেগুলো তারা কোন কালে শখের বশে কিনেছিলো। তিনটি চামড়ার বেল্ট ছিলো তাদের কাছে। তিনটি চামড়ার বেল্টে তারা দেড়শ রাইন্ড গুলি ভরে নিলো।

যুদ্ধের মাঠে অস্ত্র ছাড়াও আরেকটা জিনিসের প্রয়োজন হয়। সেটা হলো নিজ দেশের পতাকা। কাপড়ের টেবিলক্লথ নিয়ে তারা স্বহস্তে তারকাযুক্ত পতাকা বানিয়ে নিলো। সেটা বেঁধে নিলো একটা বাঁশের আগায়। ব্যস, ঝাণ্ডা তৈরী হয়ে গেলো। গুল মুহাম্মদ যে বাক্সে করে আইসক্রিম বিক্রি করতো সেটা বহনের জন্য একটা ঘোড়ার গাড়ি তৈরী করেছিলো সে। বাচ্চারা সে গাড়ি দেখলেই কিকার করে উঠতো খুশিতে। গুল মুহাম্মদের আইসক্রিম নিউ সাউথ ভিলেজে বেশ জনপ্রিয় ছিলো। সেই ঘোড়ার গাড়িতে করে গুল মুহাম্মদ ও মোল্লা আব্দুল্লাহ বেরিয়ে পড়লো।

যুদ্ধের ময়দানের জন্য যে জায়গাটা নির্বাচন করলে সেটা ছিলো শহর থেকে দুই মাইল দূরে। এলাকাটি গম্বুজ আকারের টিলা টক্করে ছাওয়া। সেখানে এই দুই তুর্কির প্রতিনিধিত্বকারী যোদ্ধা নিজেদের মোর্চা স্থাপন করলো। জায়গাটি এ্যম্বুশের জন্য চমৎকার। কাছ দিয়ে একটি ব্রিটিশ অস্ট্রেলিয়া ট্রান্সশিপমেন্ট পরিচালিত রেললাইন চলে গেছে নিউ সাউথ ভিলেজের দিকে। একটু পরেই এখান দিয়ে একটি মেইল ট্রেন যাবে। তাতে অনেক ব্রিটিশ ইংরেজ থাকবে।

***

গুল মুহাম্মদ ও মোল্লা আব্দুল্লাহ শর্কর আগমনের অপেক্ষায় সময় কাটাতে লাগলো। আধ ঘন্টা পর হুইসেল বাজিয়ে একটি মেইন ট্রেন এসে গেলো। এট্রেনটি ব্রিটিশদের। এতে অধিকাংশ যাত্রীই ইংলন্ডের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিজেদের পরিবার নিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই নববর্ষের অবসর যাপনের জন্য বিভিন্ন জঙ্গলে ক্যাম্পিং এর জন্য যাচ্ছিলো। তরুণী মেয়েরা ও বাচ্চা ছেলে মেয়েরা হাসতে হাসতে গাইতে যাচ্ছিলো।

একটি কম্পার্টমেন্টের জানালা দিয়ে কয়েকটি বাচ্চা ছেলে হাত তালি দিয়ে উঠলো। কারণ, তারা তাদের প্রিয় আইসক্রিমের গাড়িটি দেখে ফেলেছে। গুল মুহাম্মদ দেখলো বাচ্চাদের পেছনে তিন ইংরেজ দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেন চলছিলো ধীরগতিতে। ঐ কম্পার্টমেন্টটি যেই গুল মুহাম্মদের রাইফেলের নল বরাবর এলো সঙ্গে সঙ্গে দুই তুর্কির রাইফেল গর্জে উঠলো। প্রথম দুই গুলিতে দাঁড়ানো দুই ইংরেজ মারা গেলো। পরের দুই গুলিতে এক ইংরেজ মাহিলা ও এক ইংরেজ যুবক মারা গেলো।

গুলি লেগে কয়েকটি জানালার কাঁচ ভেঙ্গে গেলো। এতে কয়েকটি বাচ্চাসহ বেশ কিছু যাত্রী আহত হলো। যাত্রীদের মধ্যে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেলো। আতংকে কয়েকজন যাত্রী চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়লো। কেউ একজন ট্রেনের শিকল টেনে দেয়াতে ট্রেন থেমে পড়লো।

রেল লাইনের কাছে পিঠেই রেল কর্মীদের ব্যবহারের জন্য একটি স্টিলের টেলিফোন বক্স ছিলো। ইঞ্জিনের ফোরম্যান সেই বক্স খুলে পুলিশ স্টেশনে ফোন করলো। জানালো, অমুক স্থানে আচমকা ট্রেনের ওপর ফায়ারিং হচ্ছে। কয়েকজন যাত্রী মারা গেছে। অনেক আহত হয়েছে। পুলিশ ইনস্পেক্টর এডওয়ার্ড মিল্লার ফোনের কথাগুলো শুনে ভাবলেন, যে ফোন করেছে সে হয় কোন রসিক লোক। না হয় সে এক ড্রাম মদ খেয়ে টাল হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু ফোরম্যান যখন তাকে বললো, যেখান থেকে গুলি আসছে সেখানে একটি পতাকা উড়ছে। পাতাকাটির জমিন লাল এবং তাতে তারকা খচিত রয়েছে। আর সেখানে একটি আইসক্রিমের গাড়িও দাঁড়িয়ে আছে। ইনস্পেক্টর এই ঘোড়া সমেত আইসক্রিমের গাড়ি চিনতেন এবং গাড়ির মালিক গুল মুহাম্মদকেও চিনতেন। তিনি বুঝে গেলেন, অষ্ট্রেলিয়ায়ও বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে।

ইনস্পেক্টর এডওয়ার্ড মিল্লার লাফিয়ে উঠে তার অফিসের কাছেই অবস্থিত ফৌজি ক্যাম্পে গিয়ে জানালেন, এখান থেকে দুই মাইল দূরে কি ঘটছে। তাকে আশিজন ফৌজ দেয়া হলো। এই ফোর্সে তার অনেক কনস্টেবল নিয়ে নিলেন। ফৌজ ও পুলিশের এই বিশাল দল তখনই পৌঁছে গেলো যুদ্ধের ময়দানে।

তুর্কিরা ততক্ষণে আগের পজিশন ছেড়ে আরো দূরের এক পাহাড়ে চলে গেছে। পাহাড়ের উঁচু এক জায়গায় স্থাপন করেছে তাদের পতাকা। তারা নিশ্চিত জানতো, পুলিশ বা ফৌজ অবশ্যই আসবে। তখনই শুরু হবে আসল যুদ্ধ। এজন্য তারা পাহাড়ের ওপর পজিশন নেয়াটাই নিরাপদ মনে করলো।

আর্মি ও পুলিশে গঠিত অস্ট্রেলিয়ান এই বাহিনী চাঁদ তারা খচিত পতাকা দেখেই সেদিকে ফায়ার করতে করতে এগিয়ে যেতে লাগলো। তারা এগুচ্ছিলো এমনভাবে যেন মজা করে চোর পুলিশ খেলছে। কিন্তু তুর্কিরা তাদের এই মজা মজা ভাব আর আনন্দ দূর করে দিলো। তাদের ফায়ারগুলো মিস হচ্ছিলো না একটিও। অষ্ট্রেলিয়ানরা থেমে গেলো। তারপর এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বা শুয়ে শুয়ে এগুতে লাগলো। কিন্তু দুই তুর্কি কয়েকজন সৈনিককে যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। আরো কয়েকজন আহত হলো। গালি দিতে দিতে অন্যরা পিছু হটে এলো।

***

সরাসরি এই হামলা যখন ব্যর্থ হলো ইনস্পেক্টর এডওয়ার্ড মিল্লার তখন এক পাশ থেকে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তার প্রধান কনস্টেবল জেক মিলাজকে নিয়ে তিনি তুর্কিদের পেছন দিক থেকে এগুতে শুরু করলেন। দুজনই চাপা পায়ে এগুচ্ছিলো। দুশ গজ যাওয়ার পর তুর্কিরা তাদের দেখে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে তিনবার ফায়ার হলো। একটি গুলি কনস্টেবল জেক মিলাজের পেটে গেঁথে গেলো। সে পেটে চেপে ধরে পড়ে গিয়ে ছটফট করতে লাগলো। আরেকটি গুলি এডওয়ার্ডে মিল্লারের উরু ছিঁড়ে বেরিয়ে গেলো। তার গলা দিয়ে গগণ বিদারী চিৎকার বেরিয়ে এলো। দুজনে বড় কষ্টে গড়াতে গড়াতে পিছু হটে এলো।

ট্রেন আর সামনে বাড়লো না। যেখান থেকে এসেছিলো সেই ব্রন হলে ফিরে এলো। সঙ্গে সঙ্গে সারা এলাকায় খবর ছড়িয়ে পড়লো, গুল মুহাম্মদ ও মোল্লা আবদুল্লাহ ট্রেনে গুলি চালিয়েছে। প্রথমে কেউ বিশ্বাসই করতে চাচ্ছিলো না এই দুই সাধাসিধে আফগান মুসলমান এধরনের ভয়াবহ কাজ করতে পারে। তারা বলতে লাগলো আমরা তো মোল্লা আবদুল্লাহর কাছ থেকে মাংস আনি। আর আমাদের ছেলে মেয়েরা গুল মুহাম্মদের আইস ক্রিমের জন্য পাগল। ভিনদেশী ও ভিন্ন ধর্মমতাবলম্বী এই দুজন তো সেখানকার প্রতিটি ঘরেরই প্রিয়পাত্র ছিলো।

কিন্তু ট্রেন থেকে যখন তারা মৃতদের লাশ ও আহতদের স্ট্রেচারে করে নামাতে দেখলো তখন তো সবাই রাগে ক্রোধে প্রতিশোেধর আগুনে জ্বলে উঠলো। যাদের কাছে রাইফেল পিস্তল ছিলো তারা এই বলে ঘটনাস্থলের দিকে দৌড়াতে লাগলো,

শালার দুই মুসলে (মুসলমান)! তোমরা এত বড় বেইমান নিমক হারাম।

 প্রায় শতাধিক শহরবাসী সশস্ত্র হয়ে অস্ট্রেলিয়ান সেই বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিলো। সবাই মিলে তুর্কিদের ঘাটি ঘেরাও করে ফেললো। শহরের লোকেরা দাঁতে দাঁত পিষে পিষে বলতে লাগলো, গুল মুহাম্মদ ও মোল্লা আব্দুল্লাহকে যদি জীবিত পাওয়া যায় তাহলে দুটোকে কিমা বানিয়ে ফেলা হবে।

কিন্তু কিমা বানানোর জন্যতো আগে ওদেরকে সশরীরে ধরতে হবে। সমস্যা ছিলো এখানেই। দুই তুর্কির ঘাটিতে দুইশ এরও অধিক রাইফেল চারদিক থেকে ফায়ার করছিলো অনবরত। যখন কারো মাথা তুর্কিদের চোখে পড়তো তখনই সেই মাথা লক্ষ্য করে ফায়ার হতো। আর সঙ্গে সঙ্গে মাথাটি ঢলে পড়তো বা গায়েব হয়ে যেতো।

তুর্কিরা এবার দেখে দেখে এবং টার্গেট ঠিক করে গুলি চালাচ্ছিলো। কতজনের ঘেরাওয়ের মধ্যে তারা রয়েছে সেটাও তারা আন্দাজ করতে পারছিলো না। তারা উঁচু আওয়াজে যুদ্ধ সংগীত গাইতে শুরু করলো। তারপর আরম্ভ করলো কুরআন তেলাওয়াত। তাদের আওয়াজ এত জোরালো ছিলো যে, পাহাড়ি এলাকার দূরদূরান্ত পর্যন্ত তা শোনা যাচ্ছিলো। মাঝে মধ্যে তারা শ্লোগানও দিতে লাগলো। নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবার।

ওদের মাথার ওপর পতপত করে উড়ছিলো চাঁদ তারা খচিত তুর্কি ঝান্ডা।

 মাস জানুয়ারি হলেও দুনিয়ার এ অংশে এখন গরম শুরু হয়ে গিয়েছে। অবরোধকারীরা ক্রমেই তুর্কিদের গলার স্বরে স্বতস্ফূর্ততার অভাব লক্ষ্য করতে লাগলো। সবাই বুঝতে পারলো, তুর্কিরা পিপাসার্ত হয়ে পড়ছে এবং তাদের কাছে পানি নেই। প্রথমে তো তাদের গলার স্বরে দারুণ তাজা ভাবছিলো। সূর্যের তাপ যতই বাড়তে লাগলো তাজাভাব ততই হ্রাস পেতে লাগলো। এখন তাদের স্বর ভাঙ্গা ভাঙ্গা শুনাচ্ছিলো। কিন্তু তাদের রাইফেলের নল ছিলো তরতাজা। তাদের ছোঁড়া গুলিরও একটা নষ্ট হচ্ছিলো না, কেউ না কেউ নিহত বা আহত হচ্ছিলোই।

***

অস্ট্রেলিয়ান বাহিনীর কেউ কেউ তুর্কিদের ঝান্ডাটির দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলো- দেখো, গুলি লাগতে লাগতে পতাকাটির চারধার কেমন শতছিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু মাঝখানে চাঁদ তারা অক্ষত আছে এবং বাতাসে পতপত করে উড়েই যাচ্ছে। ঝাণ্ডাধারী খুঁটিটাও অক্ষত।

একটুপর এই দলের সঙ্গে সেনা সাহায্য স্বরূপ আরো কিছু সৈনিক যোগ দিলো। সশস্ত্র শহরবাসীও ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে লাগলো। এখন তারা হামলার কৌশল পাল্টে দিলো। পঞ্চাশজন অভিজ্ঞ নিশানাধারী সৈনিককে আড়াআড়িভাবে ছড়িয়ে দিয়ে তাদেরকে বলা হলো, তারা যেন তুর্কিদের ঘাটিতে অনবরত ফায়ার করে যায়। যাতে ওরা মাথা উঠাতে না পারে। একশজনকে একত্রিত করে নির্দেশ দেয়া হলো, তারা ফায়ারও চালিয়ে যাবে এবং বিভিন্ন দিক দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে তুর্কি ঘাটিতে পৌঁছতে চেষ্টা করবে। তারপর সব এক সঙ্গে হামলে পড়বে।

শুরু হয়ে গেলো এই অপারেশন। গুল মুহাম্মদ ও মোল্লা আবদুল্লার মোর্চার আশ পাশের এলাকায় গুলি বৃষ্টি হতে লাগলো। পাথরে গুলি লেগে চার দিক পাথর গুঁড়ায় ঝাপসা হয়ে উঠলো। তখন আর তুর্কিদের কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছিলো না। ওদের ফায়ারও কমে এলো অনেকখানি।

অবশেষে একশজনের এই কমাণ্ডো দল দুই তুর্কির মোর্চার ওপর গিয়ে হামলে পড়লো। কিন্তু সেখানে জীবিত ছিলো শুধু মোল্লা আব্দুল্লাহ। গুল মুহাম্মদ শহীদ হয়ে গিয়েছিলো। তার দেহে ছয়টি গুলি লেগেছিলো। প্রথমে একটি গুলি তার বাহুতে লাগার পর আরেক হাত দিয়েই ফায়ার চালিয়ে যাচ্ছিলো গুল মুহাম্মদ।

মোল্লা আব্দুল্লাহ ফায়ার করতে পারছিলো না। কারণ, একটি গুলি তার গালের চোয়ালের হাড় ভেঙ্গে বের হয়ে গিয়েছে। আরেকটি গুলি তার খুপড়ির হাড় ভেঙ্গে বের হয়ে গেছে। তবে মাথার ভেতর দিক খতগ্রস্ত হয়নি। সেখান থেকে অঝোরধারায় রক্ত ঝরছিলো। তাকে স্ট্রেচারে করে পাহাড় থেকে নামানো হলো। আশংকা করা হচ্ছিলো লোকেরা তাকে দেখে তার ওপর হামলে পড়বে। কিন্তু তাকে দেখেই সমবেত জটলা দূরে সরে গেলো। তখন অনেকের চোখেমুখে বিস্ময়, মুগ্ধতা ও শ্রদ্ধার ঝলক দেখা যাচ্ছিলো। কয়েকজন বলে উঠলো—

এদের মতো সত্যিকারের দেশ প্রেমিক বীর সাহসী আর কেউ কখনো দেখেনি এবং দেখবেও না হয়তো।

মোল্লা আব্দুল্লাহ হাসপাতাল শুয়ে শুয়ে কোনক্রমে মাথা উঠালো। ভেঙ্গে যাওয়া চোয়াল নিয়েও প্রাণবন্ত আওয়াজে বলে উঠলো

আমরা নিজেদের প্রিয় মাতৃভূমির সম্মান অক্ষুণ্ণ রেখে মারা যাচ্ছি। আহ! এটা যে কতটা গর্বের … সম্মানের।

এর কয়েক মিনিট পরই মোল্লা আব্দুল্লাহ শহীদ হয়ে গেলো। জড়িপ করে দেখা গেলো, অস্ট্রেলিয়ান বাহিনীর ৭৭ জন নিহত হয়েছে এবং শতাদিক আহত হয়েছে।

দুই তুর্কির ঝং ও মর্চে ধরা রাইফেল, গুলির তিনটি খালি বেষ্ট, আইস ক্রিমের বক্স এবং সহস্র ছিন্ন পতাকাটি আজও নিউ সাউথ ভিলেজ মিউজিয়ামের দর্শকদের বিস্ময়াভিভূত করে যাচ্ছে। যেন আজও পতপত করে উড়ছে তাদের ঝান্ডাটি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *