উজানিবেলায় প্রত্যাবর্তন

উজানিবেলায় প্রত্যাবর্তন

রাধার প্রদেশ থেকে প্রত্যাবর্তন করেছেন বেশ কয়েক মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। ব্যাসদেবের মহাভারত রচনার কার্যে অনভিপ্রেত সাময়িক বিরতি ঘটেছে। কৃষ্ণের তিরোধানের পর তিনিও অনেকাংশে বিভ্রান্ত। নায়কের প্রস্থান বীরোচিত হয়নি। অতিরঞ্জনের লঘু কাব্যও তিনি পরিহার করতে পছন্দ করেন। তবুও কোথাও যেন শূন্যতার হাহাকার রয়েছে। এই মহাকাব্যে তিনিও স্বয়ং চরিত্র। মাতা সত্যবতীর আহ্বানে কৌরব বংশের ইতিহাসে তাঁর প্রবেশ। লোকক্ষয়কারী মহাযুদ্ধের বহু পূর্বেই তিনি মাতা সত্যবতাঁকে হস্তিনাপুরের রঙ্গমঞ্চ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর দূরে সরে থাকা সম্ভব হয়নি, বার বার অংশ নিতে হয়েছে; যদিও যাবতীয় ঘটনার নিয়ন্ত্রক ছিলেন কৃষ্ণ। বিপুলা ভারতবর্ষের বীরভূমি আর্যাবর্ত। ক্ষত্রিয় পুরুষদের হাতে সমূহ অস্ত্রসম্ভারে ভীষ্ম, দ্রোণ, অর্জুন, কর্ণ, অশ্বত্থামা প্রভৃতি সকলেই বিবিধ অস্ত্রাদি দ্বারা সজ্জিত। কৃষ্ণ চেয়েছিলেন এই মরণমুখী সভ্যতাকে ক্ষত্রিয়মুক্ত করতে, ধ্বংস হোক যাবতীয় অস্ত্রসম্ভারের। ব্যক্তির শৌর্যের প্রাবল্য থাকলে ভাগবত অর্থনীতি, রাজনীতি সম্পূর্ণতা পায় না। কেশবও বার বার এসেছেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবের কাছে। তিনি ব্যাসদেবের বিভূতিময় সত্তা সম্বন্ধে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। মাতা সত্যবতী মনে করতেন তাঁর লেখকপুত্রের মধ্যে ঈশ্বরের অংশসম্ভব তেজ রয়েছে। এই তেজ ধর্মের এবং কবিত্বের। রাধার কাছে তিনি ধর্ম প্রার্থনা করেছেন কারণ তিনি জানতেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রস্তুতিকালের কৃষ্ণ এবং রাধার প্রেমে বিজড়িত রাধারমণ ভিন্ন ব্যক্তি। কৃষ্ণা দ্রৌপদী এর মুখ্য কারণ।

দ্রৌপদী কি শুধু সখা কৃষ্ণের? যজ্ঞাণি থেকে উদ্ভূত যাজ্ঞসেনীর চরিত্রনির্মাণে তাঁর কবিত্ব যাবতীয় ব্যয় করেছেন ব্যাস। এই মহাকাব্যে ভারতবর্ষের জাতি-বর্ণ-সমাজ মিলেমিশে গেছে। নারী ও শূদ্রের সমান। অধিকার রয়েছে এই কাব্যপাঠে। কবি ব্যাসদেব অন্তরাল থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন কৃষ্ণ স্বয়ং কতখানি প্রভাবিত পাঞ্চালীর দ্বারা। একটি কৃষ্ণবর্ণের মানুষ যুদ্ধের নিত্য রক্তপাত প্রত্যক্ষ করে এবং অনুঘটকের ক্ষিপ্রতায় সংঘটিত করে উপভোগ করছেন পাঞ্চালীর প্রেম। ঋষি হয়েও তিনি জানেন কেশব প্রকৃতপক্ষে কবি এবং প্রেমিক। দ্রৌপদীর প্রেমে তিনি। যে স্বাভাবিক বুদ্ধিও হারিয়ে ফেলেছেন– ব্যাসদেব ভারতবর্ষ পরিব্রাজন কালেও লোকমুখে সেই গুঞ্জন শুনতে পেয়েছেন। দ্রৌপদীর প্রেমাগ্নিতে পুড়ে পুড়ে স্বয়ং কেশবও রাধাকে নিজের জীবন থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন। পাপের ভারে তিনিও জর্জরিত। ইতিহাসের কথকের তাই রাধার কাছে। প্রত্যাবর্তনের কোনো পথ নেই। শুধুমাত্র ভবিষ্যতের কবির কাছে এই নারীকে সমর্পণ করা ভিন্ন ব্যাসদেবেও পরিত্রাণ নেই।

.

লিপিকরের সাক্ষাৎ নেই দীর্ঘ দিবস। অবশেষে গণেশের সাক্ষাৎ পাওয়া গেল মন্দাকিনীর তীরে। ব্যাসদেবকে দেখেই গণেশ বললেন, ‘লিপিকরের স্থূল কর্মে আমার আর স্পৃহা নেই। এই কার্য থেকে এবার আপনি আমাকে অব্যাহতি দিন।’

–কেন? এক নিয়ম-সংযত ক্রমিকতার কারণে ভগবান ব্রহ্মা এই দায়িত্ব আপনাকে অর্পণ করতে বলেছিলেন।

–ভয়ংকর হিনাদে বসুন্ধরা পরিব্যাপ্ত, অশ্বত্থামা রোদন করছেন। কলি তার শাখা বিস্তার করেছে। আর সম্ভব নয় সভ্যতার অবলুপ্তির মর্মান্তিক বর্ণন শ্রবণ ও তার অনুগমন।

–কিন্তু হে দেব গণেশ, কাম-লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্য অতিক্রম করে সবারই তো মোক্ষজয়ের যাত্রা শুরু হবে।

–মোক্ষধর্ম সবার জন্য নয়, মহাত্মন। আমি জনগণনায়ক, তাদের অর্থাৎ সাধারণ মানুষের মুক্তির বার্তা কোথায়? আপনি মোক্ষতত্ত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত, কারণ জন্মলগ্নেই আপনি পিতার সঙ্গে তপস্যায় গেছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ যারা এই অনাদি সংসার পরম্পরা ধারণ করে ধর্ম পালন করছে, তাদের কথা মহাভারতে কোথায়? এই উপলব্ধি প্রাপ্ত না হলে আমি আর লিখব না।

–প্রিয় লিপিকর, এই মহাভারতের অপর নাম পঞ্চম বেদ। নারী, শূদ্র সকলেই পাঠ করে মোক্ষমার্গের শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করতে পারবে। আমার এই মহাভারত একদিকে যদি কামশাস্ত্র হয় তবে অন্যদিকে মুক্তিকামীর সাধনগ্রন্থ।

গণেশ বললেন, ‘এই হিনাদ আমার আত্মার ক্ষয় ঘটাচ্ছে। অস্ত্রের নিবীর্যিকরণের উত্তরান্তেও কেন এই হিনাদ শ্রুত হচ্ছে?’

–আসলে আপনি লিপিকরের স্থূল কর্ম অতিক্রমণ করেছেন। নিজস্ব কল্পনা মিশ্রিত হয়েছে এবং আপনার আত্মার ক্রন্দনধ্বনি অস্ত্রের হিনাদের মতোই আকাশ-পাতাল পরিব্যাপ্ত করছে। এই কালে এর বাইরে উপনীত হওয়ার কোনো উপায় ব্যাসের জানা নেই। ধর্ম, রাজনীতি, সমাজনীতির দুরূহ অভিসন্ধিগুলি আপনিও আত্মস্থ করেছেন। তাই আসুন আমরা আবার মহাভারতের কালে প্রবেশ করি। বিবৃতিকারের কার্যও তো সমাপ্ত করতে হবে।

–আমি অঙ্গীকারবদ্ধ, নতুবা যে-কালে স্বয়ং রাধারমণ নিষ্কামভাবে রাজধর্ম পালন করেননি, যুদ্ধ শুধুমাত্র প্রতিশোধের ভাবনায় সংকীর্ণ, শ্রীরাধিকার প্রেম লাঞ্ছিত এবং নিতান্ত কুয়াশাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের গর্ভে উৎক্ষেপিত– সেই কালের শ্ৰতিলিখন আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। সমাজে পশুশক্তির প্রাবল্য রয়েছে, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের ধীরতাও নষ্টপ্রাপ্ত এবং রাধারমণ প্রত্যক্ষ পক্ষপাতে জড়িয়ে পথভ্রষ্ট সেই কালকে বর্তিকা দর্শাতে পারে সাধারণ জনতার ঔচিত্যবোধ।

–হে গণেশ, আমি কালের দর্পণ রেখে গেলাম। প্রতিবিম্বের বিচার আমাদের কার্য নয়। এই কালে দাঁড়িয়ে আমরা ব্ৰহ্মবাদীও হতে চাই না। কবিত্ব তাই নিরপেক্ষ নয়। যুদ্ধের যাবতীয় পাপটুকু আত্মস্থ করছেন রাধারমণ কৃষ্ণ, আর তাঁকে পরিক্রম করছেন শ্রীরাধিকা। কিন্তু বার্তা অব্যক্ত থাকা শ্রেয়। রাধিকার গর্ভস্থ ভ্রূণ যেদিন জন্ম নেবে, পৃথিবীতে শুদ্ধসত্ত্ব প্রেম পুনরায় প্রত্যাবর্তন করবে। মহাকালের সেই বীজ অপ্রকাশিত থাকবে না, আলোর অভিমুখে তার যাত্রা শুরু হয়েছে, ফলে আপনার আত্মগ্লানির কোনো কারণ নেই। এই অক্ষমতা লেখক ব্যাসের, লিপিকরের নয়।

গণেশ সম্মত হলেন। অবশেষে।