ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী
শওকত ওসমান
আমরা সহপাঠী ছিলাম। হৃদ্যতার বন্দি।
বলা বাহুল্য, একই স্কুল। রূপচাঁদ ভুক্ত ছিলেন এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তি। তাঁরই বদান্যতায় বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রামের নাম নন্দনপুর। শ্রীযুক্ত রূপচাঁদ উক্ত গ্রামের অধিবাসী ছিলেন না। সুতরাং এখন উপলব্ধি করা যায়, বদান্যতার সঙ্গে বিশেষ মহানুভবতা ছিল। প্রতিষ্ঠাতা নিজের গ্রাম নয়, কেন্দ্রীয় একটি গ্রাম বেছে নেন যেন আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিদ্যার্থীরা স্কুলে আসতে পারে। পাশ দিয়েই চলে গিয়েছিল সেকালের সরকারি জেলা বোর্ডের সড়ক। পাড়াগাঁয়ে যাতায়াতের কথাও ভাবতে হয়। চষা ক্ষেত, মাঠের আল, খানাখোন্দল, এবড়োখেবড়ো জমি—বিদ্যার্জন এবং লোক-চলাচলের আদ্যে অনুকূল নয়। শ্রীযুক্ত ভুক্ত তা জানতেন—সেদিক থেকেও তাঁর দৃষ্টি প্রশংসনীয়।
আরো একটি কথা বলে রাখা যায়। ষাট বছর পূর্বে অর্থাৎ সে যুগে স্কুলের শ্রেণিবিভাগ আজকের মতো ছিল না। সপ্তম শ্রেণী থেকে উচ্চ ইংরেজি স্কুল বা ইংলিশ হাই স্কুলের ক্লাস শুরু হোত। তারপর ষষ্ঠ শ্রেণী। এইভাবে ক্রমে ক্রমে কমে-কমে প্রথম শ্রেণী বা ফার্স্ট ক্লাস। বর্তমান যুগে গতি বিপরীত। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত কোথাও কোথাও যায়। এইসব কথা বলা অতীতের কিছু আঁচ দেওয়ার জন্যে।
পল্লী অঞ্চলে স্কুলের সংখ্যা সে-যুগে ছিল খুব কম। চার-পাঁচ মাইল দূর থেকে অনেককে বিদ্যাভ্যাসে আসতে হোত। শিক্ষাবিস্তারের কারো তাগিদ তাই কৃতজ্ঞতার তুলাদণ্ডে ওজন করা কঠিন ছিল ওই যুগে।
রূপচাঁদ ভুক্ত হাই স্কুলে মুরারি পাচাল ছিল আমার সহপাঠী—ষষ্ঠ শ্রেণীতে। পাচাল পদবিটি সচরাচর দেখা যায় না। আমি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম মুরারির মিষ্টি ব্যবহারে। তার চেহারাটিও ছিল আকর্ষণীয়। স্কুলে পণ্ডিতমশাই কবিতা মুখস্থ করতে দিতেন। মুরারি পাচালের আবৃত্তি হোত সবচেয়ে শ্রুতিমধুর। কৈশোরকাল ভবিষ্যতে সূচারুরূপে ধরা হয়। ক্লাসে মুরারি ফার্স্ট হোত না বটে, কিন্তু উপরের দিকে—অর্থাৎ, প্রথম চার-পাঁচজনের মধ্যে তার পজিশন ছিল বাঁধা।
ইংরেজি প্রবাদ : প্রত্যুষকাল দিনের সূচনা। কথাটা মুরারির ক্ষেত্রে মিথ্যে হয়ে গেল।
ষষ্ঠ থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে প্রমোশন পাওয়ার পরই মুরারির মাথার গণ্ডগোল দেখা দিল। খেয়ালের বশে কখন কী করে বসবে বলা দায়। হাফ-ইয়ার্লি বা ষাণ্মাসিক পরীক্ষায় দেখা গেল সে ফার্স্ট হয়ে বসে আছে। সব বিষয়ে ফার্স্ট। কিন্তু বার্ষিক পরীক্ষা দিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে মাঠে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে, বিকেলে ‘ফিট’ হয়ে পড়ে গেল স্কুলের কম্পাউন্ডে। মাইল দুই দূরে গ্রাম। খবর পেয়ে বাড়ির লোকেরা ওকে তুলে নিয়ে যায়। পাঁচ দিন মুরারি বিছানায় পড়ে রইল। আশ্চর্য, এক জল ছাড়া আর কিছু আহার করল না। সাত দিনের মাথায় সে আবার স্বাভাবিক, যেন কিছুই ঘটেনি।
উদ্বিগ্ন মা-বাবা মুরারির চিকিৎসার দিকে মন দিলেন। সে যুগে মনোরোগের বৈজ্ঞানিক কেতায় চিকিৎসার কোনো বন্দোবস্ত ছিল না। হাতুড়ে কবিরাজ, তুকতাক, ফুঁকফাঁক অথবা কোনো ঠাকুরের থানে মানত—এসবই ছিল দাওয়াই। কোনো মন্দির বা দরগায় ‘হত্যে’ দিয়ে পড়ে থাকারও রেওয়াজ ছিল। সেখানে হিন্দু-মুসলমান বিপদে পড়ে এক গোয়ালের গরু। ঠাকুরের থান বা পিরের দরগার ক্ষেত্রে সে যুগে কোনো সাম্প্রদায়িকতা ছিল না।
মুরারির বাবা-মা মুষড়ে পড়লেন। অমন ব্রিলিয়ান্ট ছেলে শেষে এমন ব্যাধির খপ্পরে পড়ল। তখন মুরারি স্কুলে আসত খেয়ালের বশবর্তী হয়ে। গার্জেনদের সঙ্গে স্কুল-কর্তৃপক্ষের একটা অলিখিত চুক্তি ছিল। মুরারি স্কুলে যাক বা না যাক, বেতন দিয়ে যাবেন বাবা। তিনি উচ্চবিত্ত কৃষক। টাকাপয়সার তেমন অভাব ছিল না।
মুরারি স্বাভাবিক অথবা অস্বাভাবিক—যেকোনো অবস্থায় আমার কাছে এলে শান্ত হয়ে যেত, কথা বলত আমার সঙ্গে। তার বেশির ভাগ অবিশ্যি অসংলগ্ন। কিন্তু তার আদব-কায়দার পরিধি একচুল এদিক-ওদিক হোত না। মুরারির বাবা তাই আমাকে তাঁদের বাড়ি যেতে বলতেন। আমার মা-বাবা আবার দু’মাইল রাস্তা একা একা আমাকে ছেড়ে দিতে রাজি হতেন না। কাজেই সঙ্গী খুঁজতে হোত। তবু মুরারি অসুস্থ হলে আমি তাদের বাড়ি যেতাম। সকালে গিয়ে বিকেলে ফেরা। আমারও তো লেখাপড়া আছে। তবু সব অবহেলায় পাশে ঠেলে মুরারিদের বাড়ি যেতে আমার ভালোই লাগত। কিন্তু কাছে গেলে মন হাঁকাহাঁকি জুড়ে দিত ভেতরে-ভেতরে—’পালাও, পালাও।’ কারণ, অসংলগ্ন প্রলাপ মাঝে মাঝে শোনার ধৈর্য কতক্ষণ আর থাকে?
রেহাই পাওয়া যেত বৈকি। যখন সে স্বাভাবিক তখন তো সে বহু সুবোধ বালকের চেয়েও ঢের বেশি শিষ্টাচারী। মাঝে মাঝে সে ক্লাস করত। টিচার পড়া ধরলে জবাব দিত একদম ঠিক ঠিক। ছেলে তো খারাপ নয়। একদিক থেকে তুখখার (তীক্ষ্নধার) বলা যায়। ক্লাসের ফার্স্ট বয় হয়তো নয়, তবে কাছাকাছি তো বটেই।
মুশকিল ওইখানে-কখন শ্রীমান মুরারি পাচালের মাথা বিগড়াবে, তার তো ঠাঁই-ঠিকানা নেই। বিগড়ে গেলে তো সে আর এক চিজ অথবা চিড়িয়া। হয়তো মাঠে মাঠে দৌড় মেরে শেষে কোনো পাড়ার কাছে এসে চিৎকার পাড়বে, ‘আমি এই কলিযুগের ত্রাণকারী। পাপে ভরে গেছে পৃথিবী। পাপ ঘরের ভেতর পোকার মতো কিলবিল করছে। আমি ফুঁ দিলেই সব উড়ে যাবে। ফুঁ-ফুঁ-ফুঁ…।’ তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে ফুৎকার-ধ্বনি প্রদান চলবে বহুক্ষণ।
এসব কাণ্ড বিসদৃশ কিছু নয়। আশপাশে যারা থাকে তাদের কিছু হাসির খোরাক। কিন্তু আরো নানা রকম ব্যাপার বাধিয়ে বসত মুরারি। কথায় বলে, পাগলের কাণ্ড। মাথা ভালো থাকলে সে সোজা স্কুলে চলে আসত। কামাই করত না। চুপচাপ বসে যেত পিছনের বেঞ্চিতে। অবিশ্যি মুরারির আবির্ভাবে ক্লাসের পরিবেশ সঙ্গে সঙ্গে অস্বাভাবিক হয়ে উঠত। শিক্ষক ক্লাসে, তাই ছাত্ররা হল্লার সুযোগ পেত না। কিন্তু গা টেপাটেপি করত চাপা-হাসিতে।
একদিন ক্লাসে সত্যি এক কাণ্ড ঘটে গেল। বলা বাহুল্য, মুরারির বেহাল হালৎ। আগে ওর ব্লাডপ্রেশার ছিল না। সম্প্রতি তাও এসে জুটেছে। মুরারি ক্লাসে ঢুকেই সম্বোধনী বক্তৃতা জুড়ে দেয়, ‘ভদ্রমহোদয় সঙ্গীগণ, আমি শ্রীমুরারি পাচাল, পিতা শ্রীঅমুকচন্দ্র পাচাল তস্য সন্তান আমি কোনো বদ্ধ পাগল নই। তবে আমি পাগাল। তা-ও ঠিক। ডিগ্রির হেরফের। হ্যাঁ আমি, কাল থেকে নয়, পাঁচ শ বছর আগে থেকে সন্ন্যাসী হয়ে গেছি। সংসারত্যাগী। আমার ইহজগতের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। আমি সন্ন্যাসী…’
ভালো কথা, আমাদের অঙ্কের মাস্টারমশাই উপেনবাবু তখন ক্লাস নিচ্ছিলেন। তাঁর টেবিলের পাশে দাঁড়িয়েই মুরারি চার-পাঁচ মিনিট আরো উপদেশমূলক বক্তৃৃতা দিল। চমৎকার যুক্তির গাঁথুনি। কে বলে মুরারি পাগল। কিন্তু উপেনবাবু বোধ হয় ভুল করে তাকে বাধা দিয়ে ফেললেন। না, বাধাও ঠিক নয়। তিনি কেশে উঠেছিলেন। তখনো মুরারি সকলকে সম্বোধন করে বলে চলে, ‘বন্ধুগণ, আমি সন্ন্যাসী। ইহজগতের সঙ্গে আমার নীল-ইংরেজি নীল-বাংলার নয়। আমি সন্ন্যাসী—ঠিকই।’
ঠিক এই সময়ে উপেনবাবু বলে ফেললেন, ‘বেশ। তারপর?’
‘তারপর?’ পাল্টা মুরারির প্রশ্ন।
‘হ্যাঁ, তারপর।’ শিক্ষকের সায়।
‘এখানে একটা কিন্তু আছে।’
‘বলে ফেলো।’ শিক্ষকের তাগিদ।
‘স্যার, আমি সন্ন্যাসী হয়ে গেছি। তা নির্ঘাত অতীব সত্য। কিন্তু, স্যার আমার এখনও ‘নাইট-পলিশান’ হয়ে যায়।’
সেদিন উপেনবাবুর মতো রাশভারী শিক্ষক ক্লাসে না থাকলে আমরা যে কী নাদে চিৎকারে-হল্লায় হেসে উঠতাম, তা ঈশ্বর জানেন। আমাদের মুখ চাপা হাতের তালুর ভেতর। উপেনবাবু গম্ভীর গলায় ছড়ি নাচিয়ে (তা ছাড়া তিনি ক্লাসে আসতেন না) প্রায় যুগপৎ ধমক ও চিৎকারের সংযোগ ঘটালেন। আমাদের কানে শুধু বাড়ি পড়তে থাকে, ‘বেরো শুয়ার, বেরো।’
নিমেষে মুরারি হাওয়া।
ক্লাস শেষ হতে তখনো পাঁচ মিনিট বাকি।
উপেনবাবুর মতো নীতিপরায়ণ মানুষ, যিনি পুরো সময় ক্লাসে থাকেন, সেদিন আদেশের সুরেই বললেন, ‘ক্লাস শেষ। চুপচাপ বসে থাকো, অন্য টিচার না আসা পর্যন্ত। গোলমাল কোরো না।’
বলা বাহুল্য, তিনি চোখের আড়াল হওয়া মাত্র আমরা কিছু অকালপক্ব বালক (সংখ্যা শতকরা আশি) সশব্দে হো হো করে হেসে উঠলাম। কয়েকজন নিরীহ কিশোর মুরারির উচ্চারিত ইংরেজি শব্দের মানে খোঁজাখুঁজি করতে লাগল আশপাশের সহপাঠীদের কাছ থেকে। ফলে হাসির হররা আর সহজে থামতে চায় না, তাদের বিলম্বে যোগদান-হেতু।
এহেন মুরারি কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিল। দু-তিন বছর নষ্ট হলো তার। কিন্তু সে ম্যাট্রিক পাস করে ফেলল এবং প্রথম বিভাগে। বাপ-মা তো তার ভবিষ্যতের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। তবু নসিব ফেরে। পাতা-চাপা আর পাথর-চাপা কপালে তফাত আছে।
এখানে দেখা গেল, কপাল প্রথম পর্যায়ে পড়ে। খুব ভালো রেজাল্ট, মুরারি আই-এ পাস করে ফেলল। বাপ-মা খাতিরজমা। দু-তিন বছর উপর্যুপরি কেটে গেছে। আর বোধ হয় মাথার গেরো নেই।
তা ছাড়া ম্যাট্রিক পাসের পর যখন মুরারির মামা বিজয়বাবু ওকে শহরে কলেজে ভর্তির প্রস্তাব দিয়েছিলেন, মুরারির মা বেঁকে বসেছিলেন, “দাদা, চাষিবাসির ছেলে অত ‘নেকাপড়ায়’ কাজ নেই। মুরারি আমার কাছে থাকবে। স্বাভাবিক হলে আলাদা কথা ছিল। ওকে শহরে পাঠাব না।”
বিজয়বাবু এই এলাকায় সকলের শ্রদ্ধাভাজন। কৃষক-পল্লী থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কেরানির চাকরি পেয়েছেন। তা কম গৌরবের কথা নয়। তাঁর কথার দাম আছে। বোন নিজের মতামত দিল। কিন্তু ভগ্নীপতির শ্যালকের মতে মত। শ্যালক বয়সে বড়। তদুপরি সরকারি চাকুরে। বোনের বায়না টিকল না। তা ছাড়া শহরে কলেজের পড়ার হাতছানি মুরারিকে বেশ উত্তেজিত রেখেছিল। মাকে সে নিজের রাস্তায় টেনে নিয়ে এলো সহজে।
দু’বছর পর বিজয়বাবুর মর্যাদা প্রায় দেবতার পর্যায়ে পৌঁছায় আর কী। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী সব অক্ষরে অক্ষরে ফলতে শুরু করেছে। যাকে সবাই বাতিল করে দিয়েছিল, সে পরীক্ষায় অমন ফল দেখাবে, কেউ ভাবতে পারেনি।
মুরারি বি-এ ক্লাসে ভর্তি হলো। শহরের পথঘাট চেনা হয়ে গেছে। চালচলন রপ্ত হতে বেশি দেরি লাগেনি। ফিটফাট থাকে সে। মাথার চুল বেশ পরিপাটি করে রাখে। কিন্তু টেরি কাটে না। তার বাবা বলেন, অমন টেরিকাটা ছেলেরা নাকি গোল্লায় যায় আর ওরা দুশ্চরিত্র হয়। মামা বিজয়বাবুও সেই পন্থী। মুরারি তা মেনে নিয়েছিল।
এককথায়, শহুরে দু’বছর বসবাসের ফলে মুরারি আদব-কায়দায় পিছিয়ে পড়ে থাকেনি। ছুটিতে গাঁয়ে ফিরলে বাবা খুব আনন্দিত হতেন। মা তো ঠাকুরের সিন্নি মানত, পুত্রের কল্যাণ-প্রার্থনায়। এক নয়, কত ঠাকুরের, তা তাঁরই জানা। বিজয়বাবু প্রায়ই বলতেন, ‘তোমার এই ছেলে আখেরে কাজ দেবে।’ ভগ্নীপতি এমন কথার জবাব দিতেন বৈকি, ‘দাদা, আপনি ওকে আশীর্বাদ করুন, ও যেন সুস্থ থাকে। নইলে ওর কাছে থেকে আমি কিছু পিত্যেশ করি নে।’
সবই ঠিকঠিক চলছিল। মুরারির বি-এ ক্লাসে কয়েক মাস কেটে গেল। প্রথম প্রথম কলেজের ডিবেটিং, অন্যান্য অনুষ্ঠানে সে যোগ দিত না। ইদানীং শুধু যোগ না, সে রীতিমতো শরিক হতে লাগল। ছড়িয়ে পড়ল মুরারির খ্যাতি ভালো ডিবেটার হিসেবে। আকর্ষণ, মুখর চেহারা। তেমনই কণ্ঠ। পূর্বে স্কুলে আবৃত্তির সময় তো বোঝা যেত। এখন তর্কস্থলে আর একরকমের খোলতাই রূপ দেখা গেল। শিক্ষকরা খুব আশান্বিত। আন্তকলেজ তর্ক-প্রতিযোগিতায় তাঁরা মুরারিকে প্রতিনিধিরূপে পাঠাবেন। শুধু বাচনভঙ্গি নয়, মুরারির ধারালো যুক্তি সেই সঙ্গে ঝিলিক দিয়ে উঠত। শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ। প্রতিপক্ষ ঘায়েল বা ধরাশায়ী।
এ হেন মুরারি।
কিন্তু ঠিক পাঁচ-ছ’মাস পরে তার মাথার ব্যাধি আবার দেখা দিল। তখন সে আর নিয়মিত ক্লাস করত না। কলেজে গেলে একদিকে চুপচাপ বসে থাকত। ব্যক্তিত্বে, গুণে মুগ্ধ অনেকে মুরারির বন্ধুত্বলোভী। তারা মুরারির ভেতরগোঁজা ভাব দেখে ভাবলে, ‘ব্যাটা ভালো ডিবেটার। সেই গুমরে আর কারো সঙ্গে মিশতে অনিচ্ছুক।’ অনেকে ওর পরিবর্তন দেখে ক্ষুব্ধ। ডিবেটিং ক্লাবেও সে আর রীতিমতো যায় না। যেদিন যায়, প্রতিপক্ষকে প্রায় মেরে বসার উপক্রম করে। তর্ক আর তার কাছে বাকযুদ্ধ নয়। সুযোগ পেলে সে অন্য দলের মাথা গুঁড়িয়ে দিয়ে তবে শান্ত হবে। একদিন তো হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম। এক অধ্যাপক মাঝখানে পড়ে ব্যাপারটা আর এগোতে দিলেন না। কলেজের আবহাওয়া সামান্য তেতে রইল। কারণ, দলাদলি। মুরারির সমর্থক অবিশ্যি কম ছিল না। কিন্তু সে নিয়মিত কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিল। প্রথম দিকে তিন চার দিন বাদ যেত হ্নায়। পরে হ্নায় সাত দিন এবং তা আরো গড়িয়ে যেতে লাগল।
মামা বিজয়বাবু ভাগ্নে পরিবর্তনে কোনো খোঁজ পাননি গোড়ার দিকে। মুরারি ভালো ছেলে, লেখাপড়ায় ফাঁকি দেওয়ার অভ্যেস নেই। রেজাল্টই প্রমাণ।
মেসে থাকে মামা-ভাগ্নে। এক কামরায় ডবল সিট। মামা-ভাগ্নে অবিশ্যি কথাবার্তা হয় কম। কিন্তু মুরারির হালেচালে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। কথাবার্তা কম। তা গুরুজনের সঙ্গে বয়োকনিষ্ঠের চিরাচরিত আদবের ব্যাপার। মুরারি কলেজে না গিয়ে শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। পার্কে, গাছতলায় শুয়ে আকাশ-পাতাল বিচরণ করে—মামা এসবের বিন্দুবিসর্গ জানতেন না।
একদিন আপিস যাওয়ার সময় বিজয়বাবুর চোখে পড়ল, ভাগ্নে নিজের সিটে শুয়ে আছে। একটা বই খোলা বুকের ওপর। মামা ভাবলেন, হয়তো ক্লান্তির চোখে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। আপিস থেকে ফিরে এসে তিনি মুরারিকে যে অবস্থায় দেখেছিলেন ঠিক সেই অবস্থায় পড়া শুরু করেছিল। ফলে ক্লান্তির চোটে ওই দশা। কিন্তু টেবিলের ওপর ভাত-তরকারি চাপা রয়েছে। বামনঠাকুরকে বলা আছে, মেসে কারো আবশ্যক পড়লে টেবিলে খাবার ঢাকা দিয়ে রাখবে—সময়মতো যার যখন খুশি খাবে। ঢাকনি তুলে বিজয়বাবু দেখেন, মুরারি কিছু স্পর্শ করেনি।
মামা বিচলিত হয়ে পড়লেন। গোয়ালপোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ-দর্শন। আপিস-ফেরত তিনি নিজেও ক্লান্ত। হাতমুখ ধুয়ে টিফিন সেরে অকুস্থলে পৌঁছলেন।
মুরারি তখনো নির্বিকার, গভীর ঘুমে মগ্ন। মামার অস্তিত্ব কি গতিবিধির খোঁজ তার কাছে ছিল না।
বিজয়বাবু কিছুক্ষণ ভাগ্নের দিকে অপলক তাকিয়ে ডাক দিলেন, ‘মুরারি-মুরারি।’ বেশ কয়েকবার।
মুরারি আচমকা উঠে বসে এবং ঘুমভাঙা উচ্চারণ করে, ‘মামা—!’
—এ কী? তুই এখনো খাসনি? শরীর খারাপ?
—না।
—তবে?
—ক্ষিধে নেই।
—তাহলে শরীর খারাপ।
—না।
কথোপকথনের ভেতর মুরারি একসময় বলে বসে, ‘মামা, আমি মুখহাত ধুয়ে আসি। আপনার সঙ্গে কথা আছে।’
—জলদি আয়। খাবি নে?
—না। অবেলা অসময়ে না খাওয়াই শরীরের জন্যে ভালো।
বিজয়বাবু কিছু আশ্বস্ত হন। মনের চতুর্দিকে নানা আশঙ্কা। আবার কি পুরাতন ব্যাধি ফিরে এলো? অবহেলায় আহার স্বাস্থ্যপ্রদ নয়। এতটুকু যার চেতনায় স্বাক্ষর আছে, তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা অনর্থক।
মেসের উঠানে চৌবাচ্চা। সেখানেই বারোয়ারি স্নানের ব্যবস্থা। একটু পরে মুরারি ফিরে এলো গামছায় মাথা মুছতে মুছতে। সে কেবল মুখহাত ধোয়নি, মাথায়ও প্রচুর জল ঢেলেছে। তা মামার চোখ এড়িয়ে যায়নি।
কে বলবে, ওই ব্যক্তির ভেতর অপ্রকৃতিস্থ হওয়ার কোনো লক্ষণ আছে? এমনকি মুরারি ঠাকুরকে চা দিয়ে যেতে বললে। এক টিনে মামা-ভাগ্নের বিস্কুট থাকে এজমালি। মুরারি তা খেতে খেতে মামাকে জানায় যে, তার মাথায় কয়েক মাস থেকে একটা প্রশ্ন জেগেছে। এখন মাতুলের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষ।
বিজয়বাবু অমন কথায় মনে মনে খুব খুশি হলেন। তাঁর পূর্বাশঙ্কা তাহলে অমূলক। হয়তো শারীরিক কারণে মুরারি এতক্ষণ ঘুমিয়েছে এবং কিছু খায়নি।
জলখাবার শেষে মাতুল-ভাগ্নের সংলাপ শুরু হলো।
মুরারি। ক’মাস থেকে আমার মনে হচ্ছে, ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। মানুষও তা হতে পারে।
বিজয়। তা কী করে সম্ভব?
মুরারি। সম্ভব। কেউ কোনোদিন চেষ্টা করে দেখেছে কি?
বিজয়। তা দেখেনি।
মুরারি। তাহলে কী করে আপনি বলতে পারেন মানুষের পক্ষে সর্বত্র বিরাজমান হওয়া অসম্ভব?
বিজয়। খামকা চেষ্টা করে লাভ কী?
মুরারি। খামকা না। চেষ্টা করে দেখা যাক। যদি সফল না হই, তখন বলা যাবে অসম্ভব।
বিজয়। যদি কেউ বলে আমি প্রশান্ত মহাসাগর এক গণ্ডূষে শুষে নেব, তা কী সম্ভব, না বিশ্বাসযোগ্য?
মুরারি। তা আলাদা ব্যাপার। বিরাজমানতার সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। আমার মতে চেষ্টা করে দেখা উচিত।
বিজয়। অনর্থক চেষ্টা। সম্ভব নয়। সব জায়গায় যাবি কী করে? তোর কাছে মোটর আছে, এরোপ্লেন আছে, না ট্রেন আছে?
মুরারি। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়ে যাবে।
বিজয়। অনর্থক চেষ্টা।
মুরারি। চেষ্টার পর অনর্থক বলতে পারেন। কেউ চেষ্টা করেনি। আমি মানুষের ইতিহাসে পথিকৃৎ হতে চাই। জনপ্রিয়তার একটি লক্ষ্য : মানুষের মধ্যে সর্বত্র বিরাজমানতা। প্রকৃতি বাদ যায়। তা যাক। মানুষের দিক থেকে জনপ্রিয়তার মধ্যে ঐশ্বরিক বিভূতি আছে। তাই মানুষ জনপ্রিয় হতে চায়।
বিজয়। কিন্তু ঈশ্বর নিরাকার। তার পক্ষে সর্বত্র বিরাজমানতা সম্ভব। মানুষের আকার আছে। সে একই সময়ে সর্বত্র কিভাবে বিরাজমান হবে?
মামাও সেদিন সহজে ভাগ্নের নিকট হার মানতে রাজি ছিলেন না।
মুরারি। চেষ্টা করলে হবে।
বিজয়। চেষ্টা—?
মুরারি। হ্যাঁ। কেউ কখনো তা করেনি। আমি বলছি, আমি চেষ্টা করব। সফল হব না কেন। একবার ফেল করলে আবার তেড়ে ধরব। এইভাবে সফল না হলে বুঝব অসম্ভব।
বিজয়। খোকা, তোর মাথায় এই খেয়াল কেন চেপে বসল?
কোনো জবাব দিল না মুরারি। মামা নিজের মনে বলে উঠলেন, ‘সব জায়গায় যেতে টিকিট লাগে, তা বুঝি তোর হিসেবে নেই?’
ভাগ্নে তারও কোনো উত্তর দিল না। বরং সেই মুহূর্তে মেস থেকে বেরিয়ে পড়ল সর্বত্র বিরাজমানতার সাধনায়।
মুরারি রিপোর্ট দিল ওই দিন রাত্রি এগারোটার সময় বাসায় ফিরে। তার প্রথম পরিকল্পনা : সে শহরের এক ইঞ্চি জায়গা বাদ দিবে না যেখানে তার পা বা হাত পড়বে না। বিকেলে বেরিয়ে সে প্রচুর হেঁটেছে। প্রত্যেক জায়গায় তার উপস্থিতি সে এইভাবে জানান দেবে।
মামা বাধা দিলেন না বা কোনো তর্কে গেলেন না। তিনি ভাবলেন : পুরাতন ব্যাধি, বোধ হয়, আবার নতুন আকারে দেখা দিয়েছে।
মুরারির বাড়িতে এসব খবর পৌঁছাল না।
মামার জিদেই সে শহরে পড়াশোনা শুরু করে। এখন সব অপরাধের বোঝা তার মাথার ওপর পড়বে। তাই তিনি স্থির করলেন, কী ঘটে দেখা যাক আরো কিছুদিন। নেহাত বেগতিক কিছু হলে ওকে আবার গাঁয়ে ফিরিয়ে নেয়া যাবে।
তেমন কোনো গোলমাল বাধায় না মুরারি। খেয়ালমতো সে বেরিয়ে যায় আবার আস্তানায় ফিরে আসে। মেসে বিজয়বাবুকে সকলে শ্রদ্ধা করে। তিনি তাদের পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। কোনো ভায়োলেন্ট, উগ্র পাগল নয়। মাথায় কিছু ছিট আছে। তাই আচরণ অস্বাভাবিক। নচেৎ মেসে কোনো উচ্ছৃঙ্খলতা নেই তার।
মুরারির লেখাপড়া শিকেয় উঠেছে, তা বলা চলে না। মাঝে মাঝে সে কলেজে যায়, ক্লাস করে। তখন তার মধ্যে পাগলামির সামান্য রেশ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। বিজয়বাবু তাই ভাগ্নে সম্বন্ধে আশান্বিত। এসব একদিন কেটে যাবে।
কিন্তু তেমন কোনো লক্ষণ দেখা গেল না।
মেসে খবরের কাগজ নেওয়া হয়—একখানা ইংরেজি ও একখানা বাংলা দৈনিক। মুরারি প্রথমে সভাসমিতির কলামে নজর রাখে। বড় বড় মিটিং হলে তো আর কথা নেই। সে ঠিক সময়মতো পৌঁছে যাবে। কিন্তু সভায় কিছু শোনার প্রয়োজন নেই তার। সে এক জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকবে! রামঃ, রামঃ! তেমন বান্দা নয় মুরারি। সে সভায় এক প্রান্ত থেকে উজিয়ে আরেক প্রান্তে গিয়ে ঠেকবে। ভিড় থাকলে তা ঠেলে ঠেলেই এগোবে। সভা শেষে মেসে ফিরে সে মামাকে দেবে রিপোর্ট। মিটিংয়ের নয়, তার নিজের। ‘যদ্দূর পারা যায় আমি নিজেকে ছড়িয়ে দিচ্ছি। ঈশ্বরের সঙ্গে আমার প্রতিযোগিতা।’ এমনধারা মন্তব্য করত মুরারি মামার কাছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হাঁ-হুঁ করে তিনি সেরে দিতেন। আবার মাঝে মাঝে সতর্কবাণী শোনাতেন।
—শোনো বাপু, ঈশ্বরের সঙ্গে খামকা লড়তে চাও কেন?
—কেউ লড়ে না, আমি লড়ে দেখতে চাই!
—অসম প্রতিযোগিতা। কোথায় দুনিয়ার স্রষ্টা আর কোথায় তুমি! কোথায় রাজাভোজ আর…। বাক্য অসমাপ্ত থাকে।
—তবু চেষ্টা ভালো।
—অসম প্রতিযোগিতা আখেরে সব্বনাশ টেনে আনে।
—মামা, ওসব বস্তাপচা বুলি রেখে দিন।
এমন অবজ্ঞার সুরে মুরারি কোনোদিন গুরুজনের সঙ্গে কোনো কথা উচ্চারণ করেনি।
মামা তো ভাগ্নের সব খবর রাখতেন না। তিনি ছাপোষা কেরানি মানুষ। নিজের চাকরি এবং ঝামেলা নিয়ে মানসিকভাবে ক্লান্ত। কাজেই মুরারির সব হালচালের খবর রাখা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
একদিন মুরারি শহরের জলের ট্যাংকের ছাদের কাছাকাছি পৌঁছে বক্তৃতা জুড়ে দিয়েছিল। পথচারীরা বিস্মিত, যেকোনো মুহূর্তে একটা দুর্ঘটনার আশঙ্কা তারা করছিল। লোক জমে গেল তামাশা দেখতে। শেষে ফায়ার ব্রিগেডে খবর দেওয়া হলো। তারা সে সিঁড়ি বেয়ে মুরারির কাছাকাছি পৌঁছে নানা আর্জি-মিনতি করে। পরে সুবোধ বালকের মতো মুরারি নেমে আসে। নামাও তো কম বিপজ্জনক নয়। খুব গালাগাল খেয়েছিল সেদিন মুরারি পুলিশের কাছে।
বিজয়বাবু ভাগ্নের এসব কীর্তিকলাপ সম্পর্কে আদৌ ওয়াকিবহাল ছিলেন না। কারণ, খবর পৌঁছত না তাঁর কাছে। উপরিউক্ত খবর তিনি কাগজে পড়েছিলেন, ‘খামখেয়ালি যুবকের কাণ্ড’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে। তিনি ভাবতে পারেননি গুণধর যুবক তাঁর ভাগ্নে। রিপোর্টে নামের উল্লেখ ছিল না।
আর একবার টেলিফোনের তারগুচ্ছের ওপর বসে গান গাইতে শুরু করেছিল মুরারি। ইলেকট্রিক তার হলে তো চরম একটা কিছু ঘটে যেত।
বিজয়বাবুর জবাবদিহি ছিল নিজের বিবেকের কাছে। তাঁর পরামর্শেই তো ভাগ্নে আজ শহরে। তবে তখনো তিনি হাল ছাড়ার বান্দা নন। ভাবতেন ব্যাধি সাময়িক এবং পূর্বের মতো একদিন সেরে যাবে।
কলেজের ছুটিতে বাড়ি যায়নি মুরারি। বাবার চিঠি আসে। মামা উত্তর দেন। বাহানার অভাব হয় না। পরীক্ষা প্রস্তুতি বা ওই জাতীয় আর কিছু। গাঁয়ে গেলে ঘুরে বেড়াবে, পড়াশোনার ক্ষতি হবে।
কিন্তু পরিস্থিতি কূলে ওঠে না। মামা-ভাগ্নের সংলাপ তিক্ত হতে থাকে।
—খোকা, ঈশ্বরের সঙ্গে কি মানুষ পারে?
—হয়তো পারে না। কিন্তু চেষ্টা করে দেখা উচিত। জানো, মামা—।
মামা ভাগ্নের মুখের দিকে তাকান। ওদিকে বাক্যস্রোত যথা-প্রবাহিত, ‘আমি আজকাল কোনো বড় মিটিং বাদ দিইনে। সব জায়গায় যাই। সর্বত্র বিরাজমানতার এই এক উপায়।’
কীভাবে? কৌতূহলে মাতুলের প্রশ্ন।
মিটিংয়ে হাজার হাজার লোক জমে। সেখানে তাদের নিশ্বাস মিশে যাচ্ছে। তুমি এক জায়গায় থেকেও আর একই জায়গায় নেই। তোমার নিশ্বাস তখন প্রবাহপথ পেয়েছে, ধেয়ে চলেছে ওই জোয়ারে।
ভাগিনা থামে। সে ফিলসফির ছাত্র এবং ভালো ছাত্র। মামা আর তর্কে প্রবৃত্ত হন না। আপন দুর্বলতা-সচেতন মামা তাই কথার মোড় ফেরাতে বলেন, ‘খোকা, অসম প্রতিযোগিতা আসলে ভালো নয়। ঈশ্বরের সঙ্গে বেয়াদবি পাপ। তা আখেরে সর্বনাশ ডেকে আনে।’
—বাজে কথা। আমি কোনো বেয়াদবি করছি না, আমি মানুষ হিসেবে চেষ্টা করছি।
মামা হটে গেলেন। কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণী ফলতে বেশি দেরি লাগল না।
সাধারণত যেখানেই যাক, মুরারি রাত্রি দশটা কি এগারোটার মধ্যে ফিরে আসত। মামা নিশ্চিন্ত থাকতেন। অন্তত নিরাপত্তার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেনি তাঁর ভগিনীপুত্র।
শীতের এক রাত্রে মুরারি বিছানা ছেড়ে বাইরে পা বাড়িয়েছিল। মামা আদৌ টের পাননি। মুরারির সেই রাত্রির অ্যাডভেঞ্চার পুলিশ ও অন্যান্য সূত্র ধরে পরে রিপোর্টের আকারে পাওয়া যায়।
মুরারির গায়ে ছিল শুধু সুতি চাদর আর ভেতরে গেঞ্জি। পৌষের শেষ। কিন্তু শীতের প্রকোপ কিছু কম ছিল না। মুরারি পাড়া থেকে বেরিয়ে শহরের রাস্তায় পয়লা দফা না হেঁটে গড়িয়ে-গড়িয়ে গায়ে ধুলো মেখেছিল। পরে চাদর খুলে বগলে তুলে নেয় সে। অত রাত্রে পথে কোনো লোক ছিল না। তবু এক বিরল পথচারী তাকে পাগল ভেবে আর কাছে যায়নি বটে, তবে মুরারির প্রলাপ তথা চিৎকার তার কানে পড়েছিল : ‘তিনি সর্বত্র আছেন। জনপ্রিয়তার মধ্যে সেই লক্ষণ মেলে, যা সর্বত্র বিরাজমানতার মধ্যেও পাওয়া যায়। আমিও তেমন সর্বত্র থাকব। কেন থাকব না?’ পথিক-জন গায়ে গরম কোট চাপিয়েও শীতের জুলুমে কাঁপছিল। তখন তার চোখে পড়েছিল, মুরারির উদোম গা, ধুতি মালকোঁচা-মারা আর চাদর বগলে। পাগলের কাণ্ড দেখার ধৈর্য ছিল না পথিকের, এই রিপোর্টটুকু পুলিশের সংগ্রহ।
শীতের রাত্রি গভীর এবং বিস্তৃত। মুরারি অতক্ষণ কী করছিল, তার সব হদিস তো জানার উপায় নেই। তবে পরিমাণ দেখে কিছু কিছু অনুমান করা যায়।
সে মাটির ওপর গড়াগড়ি ছেড়ে কোনো একপর্যায়ে হেঁটেছিল বা দৌড় দিয়েছিল—অথবা এই জাতীয় কিছু করেছিল, যার ফলে সে তিন মাইল দূরে শহরতলিতে পৌঁছায়। বর্ধিষ্ণু শহরের শিং ষাঁড়ের মতো মাটি গুঁতিয়ে-গুঁতিয়ে এগোয়। শিঙের আগায় ধুলোবালি-ময়লা, অন্যান্য আবর্জনা লেগে থাকা স্বাভাবিক। নগর সম্প্রসারণের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। এই এলাকায় বাস করে সমাজেও যারা আবর্জনা বিশেষ—মেথর, মুদ্দাফরাস, দীনদরিদ্র, ছিন্নমূল মানুষ। বস্তি তাঁরাই জাঁকিয়ে তোলে সেখানে নর্দমা এবং আকাশের মুখোমুখি অবস্থান ঘটে।
মুরারিকে এমন নর্দমায় পাওয়া যায় পরদিন ভোরে। তখন সে মৃত। মেথরপট্টির পালিত শুয়োরের লীলাভূমি এইসব নর্দমা। মুরারির আশপাশে শুয়োর চরছিল। পোস্টমর্টেম থেকে জানা যায়, ওর শরীর থেকে অনেক রক্ত ঝরেছিল। দেহের কয়েক জায়গায় জখম। অনুমান করা যায়, পুলিশেরও তাই ধারণা, কোনো দাঁতাল শুয়োরের চারণভূমিতে মুরারি অনধিকার প্রবেশ করতে গিয়েছিল। জন্তু তাকে আদৌ শ্রদ্ধা দেখায়নি।
মুরারি জীবনের শেষ অঙ্ক এমনই অনুমানের ব্যাপার হয়ে রইল। ছোট মানিব্যাগে-রক্ষিত চিরকুট থেকে ঠিকানা পাওয়া যায়। ভোর থেকে উৎকণ্ঠিত বিজয়বাবুর কাছে সব খবর পৌঁছায় সন্ধ্যায়—পুলিশের কল্যাণে।
অনেককাল পূর্বের ঘটনা।
অনেক কিছু ভুলে যাওয়ার কথা।
কেবল আজও মুরারি আমার স্মৃতির রাজ্যে সর্বত্র বিরাজমান।
আহা মুরারি!
শেষমেশ দাঁতাল শুয়োরের আঘাতে মৃত্যু?
বর্তমানে দাঁতাল শুয়োরের সংখ্যা অনেক অনেক বেড়ে গিয়েছি।
আসলেই,অসম প্রতিযোগিতা আখেরে সর্বনাশ বয়ে আনে।শেষমেশ,দাঁতাল শুয়োরদের কাছে অসহায় মুরারি পাচালরা।দাঁতাল শুয়োরদের দাঁতে অনেক ধার!
পাতা চাপা আর পাথর চাপা কপাল এক নয়-দারুণ উক্তিটি।