ইনকুইজিশন

ইনকুইজিশন

১৫৬০। আগস্ট। গোয়া

ঘনকালো অন্ধকারে মেঠো রাস্তা ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে পাগলের মতন দৌড়চ্ছিলেন ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণী।

আমোনা গাঁয়ের মহাবেতাল মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণী পাণ্ডিত্যে, প্রজ্ঞায়, সদাচরণ ও ধর্মবেত্তায় শুধু আমোনা নয়, শুধু গোয়াপুরি নয়, সমগ্র দক্ষিণ কোঙ্কণে শ্রদ্ধার শীর্ষবিন্দুটি অধিকার করে আছেন। সুদূর গোপাকপত্তন থেকে কপর্দকদ্বীপ, সোপারা থেকে অঘনাশিনী নদীর তীর অবধি পণ্ডিত প্রবর ত্রিলোচনের খ্যাতির আলোকে উদ্ভাসিত।

সেই সম্মানের দিন বোধ হয় ফুরোল। একটা আসান গাছের নীচে দাঁড়িয়ে একটু জিরিয়ে নিতে নিতে এই কথাটাই ভাবছিলেন উনি। প্রৌঢ় মানুষ, জীবনে দৌড়ঝাঁপ করেননি, শাস্ত্রালোচনাতেই কালাতিপাত করেছেন। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ দেহ দরদর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। চঞ্চল চোখে ব্যাকুল দৃষ্টিতে পিছনের দিকে তাকান, কেউ ধেয়ে আসছে না তো? আবার দৌড়তে থাকেন প্রৌঢ় ব্রাহ্মণ, রাত ফুরোবার আগেই ওনাকে সাত ক্রোশ দূরের কুশস্থলী পৌঁছতে হবে। কোমরের কষিতে গুঁজে রাখা অমূল্য ধনটিকে পৌঁছে দিতে হবে কুশস্থলীর মঙ্গেশি মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের হাতে। তারপর সেই মহাপবিত্র, মহাশক্তির আধারখণ্ডটিকে লুকিয়ে রাখা হবে মন্দিরের মধ্যেই। আমোনা গ্রাম আর নিরাপদ নয়।

না, প্রধান মন্দির, বা গর্ভগৃহের মধ্যে না। ওসব জায়গায় খোঁজাখুঁজির সম্ভাবনা প্রবল। তা ছাড়া ভগবান রুদ্রের পবিত্র লিঙ্গ অস্ত্রদ্বারা স্পর্শ করার কথা কোনো গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণ স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না।

মন্দিরের মধ্যে নয়, মন্দিরের পেছনে আছে আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামদেবতা এবং কুলদেবতাদের ছোটো মন্দির, যেমন বীরভদ্র, সানতেরি, লক্ষ্মীনারায়ণ, সূর্যনারায়ণ এবং কালভৈরব! মনস্থির করে ফেললেন ত্রিলোচন, কালভৈরবের মন্দিরটিই এই অমিত শক্তির আধারটিকে লুকিয়ে রাখার প্রকৃষ্ট স্থান। এই অলৌকিক বেতাল শক্তিখণ্ড আর কেই বা অবলীলাক্রমে ধারণ করতে পারেন, কালভৈরব ছাড়া?

থেমে এক বার আকাশের দিকে তাকালেন ত্রিলোচন। বিড়বিড় করে নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করলেন, দেবাদিদেব মহাদেব যদি সুদিন দেন, তাহলে তিনি, মহাজ্ঞানী বেতালসিদ্ধ তন্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণী, তিনি নিজের হাতে সপ্তসিন্ধু আর সপ্তনদীর জলে বোধন করে, মহা আড়ম্বরে এই শক্তিখণ্ড মহাবেতালমন্দিরে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন। হাত দুটো মুঠো করে কপালে ঠেকিয়ে নেন এক বার, তারপর আবার দৌড়তে থাকেন।

সামনেই মাণ্ডবী নদী। ঘাটে দ্রুত নেমে যান উনি। একটা নৌকো থাকার কথা এখন। কিন্তু কিছু দেখা যাচ্ছে না কেন? থমকে দাঁড়ান ত্রিলোচন, ধরা পড়ে গেল নাকি সবাই? ধরা পড়ে গেলেন নাকি উনি? বুকটা ধড়ফড় করতে থাকে প্রৌঢ়ের। নিজের জন্যে ভয় করেন না উনি, কিন্তু যে মহাশক্তিশালী আধারখণ্ডটি নিয়ে যাচ্ছেন, তার সামান্য অপব্যবহারে প্রলয় আসতে পারে যে!!

নাঃ, ওই তো, একটা ছায়ামূর্তি যেন অন্ধকার থেকেই উদয় হয় ওনার সামনে, সামান্য ঝুঁকে প্রণাম করে, ‘প্রণাম হই জ্যেঠঠাকুর, এদিকে আসুন, আজ আপনাকে ওপারে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব এই অধমের ওপরে।’

গলাটা চিনতে কষ্ট হয় না, তাই আশ্বস্ত হন ত্রিলোচন, আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাতটা তুলে স্বস্তিবাচন উচ্চারণ করেন, ‘অভীষ্ট পূর্ণ হোক বিঘ্ননাশ, কিন্তু তোমার নাও কোথায়?’

‘একটু কষ্ট করে এদিকে আসতে হবে ঠাকুর, কেউ যাতে দেখতে না পায়, তাই ঘাটের পাশে লুকিয়ে রেখেছি, এইদিকে, সাবধানে আসবেন ঠাকুর, বর্ষার সময়, ঝোপেঝাড়ে সাপ থাকতে পারে…’

এত বলার দরকারই ছিল না, শিয়রে মহাসর্বনাশ উপস্থিত থাকলে অনেক দুরূহ কাজই মানুষ প্রতিবর্তক্রিয়ায় এমন অনায়াসে করে ফেলে, যা হয়তো সে স্বাভাবিক অবস্থায় নিজে করার কথা ভাবতেই পারত না। কোনোরকমে হাঁচড়পাঁচড় করে নাওতে উঠে চিত হয়ে পড়লেন ত্রিলোচন। কোমরের গেঁজেতে হাত দিয়ে দেখলেন, নাহ ঠিকই আছে সব।

নাও চলতে থাকে, চিত হয়েই শুয়ে থাকেন ত্রিলোচন। আকাশের মেঘ ছিঁড়ে নীল আকাশ অনেকটা বেরিয়ে পড়েছে। ঘনকৃষ্ণ রাতের আকাশ। দু-একটা তারা দেখা যাচ্ছে। ওই তো শুক্র আর বৃহস্পতি, এইসময়ে বড়ো কাছাকাছি আসে। ওটা কি বীণা নক্ষত্র? আহা ওই যে, ধনুরাশি। মনটা স্ত্রী আর ষোড়শবর্ষীয় পুত্রটির জন্যে বড়ো ব্যাকুল হয়ে ওঠে ত্রিলোচনের। মন্দিরে নিত্যপূজায় ব্যস্ত ছিলেন উনি। যবনেরা মন্দির অপবিত্র করতে আসছে শুনেই মহাশক্তিটি বিশেষ ক্রিয়ায় তুলে নিয়ে মন্দিরের পেছনের দরজা দিয়ে দ্রুত দৌড়ে বেরিয়েছেন, স্ত্রী-পুত্রকে খবর দেবার সময় পাননি। তবে ওরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে সব জেনে গেছে। পূর্বনির্ধারিত নিরাপদ পথে পালাতে পেরেছে কি? সবই তো বলে দেওয়া ছিল। আশা করা যায় নিশ্চয়ই পেরেছে। বুদ্ধিমান ছেলে ওঁর, নিজেই মৃদু হাসেন ত্রিলোচন। সামান্য বেশি বয়সেই একে পেয়েছেন উনি, তাও বিশেষ বেতালসাধনার পর। রূপে, গুণে, বুদ্ধিতে, স্থৈর্যে এ ছেলের জুড়ি গোটা গোয়াপুরিতে নেই, এ বিষয়ে স্থির নিশ্চিত উনি।

প্রায় অর্ধশতক আগে আলবুকার্ক নামের এক যবন সেনাপতি আদিল শাহি শাসন হটিয়ে যাবনিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু এই জয় এত সহজে আসত না, যদি না বিজাপুরী সুলতানশাহি দ্বারা বিতাড়িত এক হিন্দু গোষ্ঠী অধিপতি, নাম তিমায়া, এই বিদেশি যবনদের সম্পূর্ণ সহায়তা দিত। তাতেও আপত্তি ছিল না ত্রিলোচনের, ধর্মেকর্মে হাত না পড়লে এসব নিয়ে বিশেষ ভাবেননি উনি। রাজা রাজধর্ম পালন করবেন, পণ্ডিত কুলধর্ম, এই তো নিয়ম।

কিন্তু এই বিদেশি যবনরা বড়ো ক্রূর, নিষ্ঠুর আর নির্মম অত্যাচারী। ইউসুফ আদিল শাহ বিধর্মী শাসক ছিলেন বটে, কিন্তু এদেশেরই ছিলেন। পার্থক্যটা শুধু ধর্মেই ছিল, পাশাপাশি বাস করায় নয়, বিজাপুরী সুলতানশাহি হিন্দুদের ধর্মেকর্মে হাত দেয়নি কখনো। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ত্রিলোচন। তিমায়া, হে তিমায়া, মুসলমান রাজত্ব শেষ করার উদগ্র বাসনায় কী সর্বনাশ করলে তুমি? খাল কেটে এ কোন কুমির আনলে? এই বিদেশি যবনদের হাতে মহাসর্বনাশের কোন নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে গোয়াপুরিতে, তার আঁচ কিছু কিছু এখনই পেতে চলেছে গোয়ার হিন্দু আর মুসলমানরা।

চোখ বুজলেন ত্রিলোচন।

২০১৬। জুলাই। উত্তর আফগানিস্তান

মাথা নীচু করে নিজের ল্যাপটপে ডেইলি রিপোর্ট টাইপ করছিলেন কর্নেল মার্টিনহো ভাজ। রোজের রিপোর্ট রোজ যাওয়াটাই নিয়ম। বিরক্তি লাগছিল কর্নেল ভাজের। মাথা তুলে ঘাড়টা এদিক-ওদিক করে জড়তা ছাড়িয়ে নিলেন উনি। শরীরটা পেছন দিকে ধনুকের মতন বাঁকিয়ে একটা আড়মোড়া ভাঙলেন। তারপর এগিয়ে গেলেন জানলার দিকে।

জানলার বাইরে অপূর্ব দৃশ্য। বিকেলের পড়ন্ত রোদে হিন্দুকুশ পর্বতমালার বিস্তীর্ণ রেঞ্জ পুরো দৃষ্টিসীমা জুড়ে ঝলমল করছে। মার্টিনহো জানেন, এই রেঞ্জের ওপারেই তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান আর তাজিকিস্তান। তুর্কমেনিস্তান থেকে বয়ে এসেছে আমুদরিয়া। স্ট্র্যাটেজিকালি এমন ইম্পর্ট্যান্ট প্রদেশ মধ্য এশিয়াতেও কমই আছে। তাই এই বলখ প্রদেশের প্রধান শহর মাজার-ই-শরিফ স্মরণাতীত কাল থেকেই এত গুরুত্বপূর্ণ, মিলিটারি স্ট্র্যাটেজির দিক দিয়ে। এই শহর দখল করতে পারলেই কেল্লাফতে। হেরাত, কুন্দুজ আর কাবুল, তিনটেতেই ঢোকার পথের ওপর প্রশ্নাতীত আধিপত্য, বলতে গেলে, সমগ্র উত্তর আফগানিস্তান আর হিন্দুকুশ রেঞ্জ হাতের মুঠোয়।

আফগানিস্তানের এই বলখ প্রদেশ পুরো পাহাড়ি অঞ্চল, যেমন উঁচু, তেমন শুকনো। সর্বোত্তম মাউন্টেন ওয়ারফেয়ারের ট্রেনিং না থাকলে এই পাহাড়ি অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে বসে যুদ্ধ বা ছায়াযুদ্ধ, দুই-ই চালিয়ে যাওয়া কঠিন।

মৃদু হাসলেন মার্টিনহো। কঠিন কাজটাই তো করার জন্যে ওনারা রেঞ্জার্স। পর্তুগালের বিশেষ কম্যান্ডো ফোর্স ‘স্পেশাল অপারেশনস ট্রুপ সেন্ত্রো দে ত্রোপাস অপেরাশোস এসপেশিয়ালসের’ বা সিটিওই। উজ্জ্বল নক্ষত্র মার্টিনহো ভাজ জানেন, যেকোনো কমব্যাট পরিস্থিতিকে মুহূর্তে নিজের সপক্ষে নিয়ে আসতে সিটিওই-এর রেঞ্জার্সদের সমকক্ষ বলতে শুধু ইউ এস-এর ডেল্টা ফোর্স বা ইউ কে-র স্যাস। অবশ্য ইজরায়েলের সায়ারেত মটকাল বা ইন্ডিয়ার মার্কোসেরও খুব প্রশংসা শুনেছেন মার্টিনহো। রেঞ্জার্সদের ছাড়া, এই শত্রুবেষ্টিত সংকুল জায়গায় ন্যাটোর রেজোলিউট সাপোর্ট মিশনের পার্ট হয়ে এই টাফ কভার্ট অপারেশনস ক-জন পালন করতে পারত, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

বিরক্ত হয়ে যাচ্ছেন মার্টিনহো। তালিবান, আলকায়েদা এসব এদিকে অনেকটাই ঠান্ডা। এখন যা অ্যাকশন তো সিরিয়া আর ইরাকে। অ্যাকশনের মানুষ তিনি, বসে বসে রিপোর্ট পাঠাতে পাঠাতে শরীরে জং ধরে গেল। আহা, দু-চারটে আইসিস ধরে ইন্টারোগেট করবেন, তবে না সুখ। দু-চারটে ইয়েজিদি মেয়েদের হাতের কাছে পেয়ে নিজেদের খুব বীরপুঙ্গব ভাবছে এই জাহান্নমের শয়তানগুলো…

ভাবতে ভাবতেই অত্যাধুনিক লোরান সিস্টেমসের ভিডিয়ো স্ক্রিনটা ব্লিঙ্ক করতে থাকে, ইনকামিং কলের সিগন্যাল ভেসে আসে। দ্রুত টেবিলের কাছে ফিরে আসেন মার্টিনহো। সামান্য বিস্ময়ে ভ্রূ-দুটো ওপরে ওঠে, তারপরেই স্বাভাবিক হয়ে অ্যাকসেপ্টন্স বাটনটা টেপেন উনি। হেডকোয়ার্টার ল্যামেগো থেকে কল, অন মোস্ট সিকিওরড চ্যানেল। সামথিং মাস্ট বি গোয়িং হরিবলি রং… ভাবতে ভাবতেই অভ্যস্ত গলায় বলেন ‘রেঞ্জার্স ফিফটি থ্রি আলফা হ্যাশ। গুড আফটারনুন কমান্ডান্ট।’ স্ক্রিনে সিটিওই-এর প্রধানের কঠিন চৌকো খুনি মুখটা ভেসে ওঠে, এমনিতে ঠান্ডা মাথার লোকটাকে বেশ উত্তেজিত লাগে আজ, প্রতি অভিবাদনের ধার ধারেন না, ‘রেঞ্জার্স টুয়েন্টি নাইন ল্যামডা কাপা। কর্ণেল, আপনার কাছে ঠিক তেরো মিনিট সময় আছে টু রিচ আলিয়াবাদ স্কুল, হুইচ ইজ আন্ডার সিজ ফ্রম সাম ফ্যাকশনস অফ তালিবান। ক্লোজ টু ওয়ান হান্ড্রেড স্টুডেন্টস, ইনক্লুডিং ফিউ টিচার্স আর টেকেন ক্যাপটিভ। টোটাল সিক্স মিলিট্যান্টস আর ইন অ্যাকশন।’

প্রথমে চমকে ওঠেন, তারপরেই ঘেন্নায় চোয়ালটা শক্ত হয়ে ওঠে মার্টিনহোর। এই বেজন্মাগুলো এখন বাচ্চাদের ওপর পৌরুষ ফলাতে গেছে। বাঞ্চ অফ মোরোনস। সামনাসামনি লড়ার দম নেই এই বাস্টার্ডসদের, যত বীরত্ব নিরস্ত্র নিরীহ লোককে ক্যামেরার সামনে হত্যা করার সময়। ঘেন্নায় আর রাগে গা-টা রি রি করে ওঠে মার্টিনহোর, আজ এদের এক-একটাকে ধরে ধরে…

‘টেক কেয়ার মার্ট, বি এক্সট্রিমলি কশাস। মোস্ট অফ দ্য কিডস আর অফ টেন টু টুয়েলভ ইয়ার্স অফ এজ।’ বলে একটু দম নেন চিফ, ‘অলমোস্ট অ্যাজ ইয়াং অ্যাজ তিয়াগো। ভাবো, আজ তুমি তোমার এক-শো-টা ছেলেকে বাঁচাতে যাচ্ছ। একটা বাচ্চার গায়েও যেন আঁচড় না পড়ে। অ্যান্ড লিকুইডেট দোজ অ্যাসহোলস। থারটিন মিনিটস টু রিচ। ওভার।’ ‘ওভার অ্যান্ড আউট’ বলে চুপচাপ ফোনটা রেখে মাস ইন্ট্রাকমের দিকে এগিয়ে যান মার্টিনহো। তিয়াগো ওঁর ছেলে, একমাত্র ছেলে। বুকের পাঁজরের থেকেও মার্টিনহো ভালোবাসেন নিজের ছেলেকে। পাথরের মতন রসকষহীন শুকনো মানুষটা, হাই অলটিচিউড ওয়ারফেয়ার থেকে জাঙ্গল কমব্যাটে যার সমান ঈর্ষনীয় দক্ষতা, খালি হাতে যে একাই দশ বারোটা সশস্ত্র লোকের মহড়া নিতে পারে, ক্লোজ কোয়ার্টার কমব্যাট টেকনিক ক্রাভ মাগাতে যার তুল্য কমান্ডো গোটা ইউরোপে নেই, শুধু হাতে শত্রু খুন করাটা যার বিশেষ স্পেশিয়ালিটি, কম করে গোটা কুড়ির ওপর জঙ্গিহানা সামলানোতে নেতৃত্ব দিয়েছে যে লোকটা, সেই লোকটাই তিয়াগোর শুধু সর্দি হবার খবরে পাগলের মতন করতে থাকে। কঠিন নাস্তিক লোকটা চার্চে মোমবাতি জ্বালাতে দৌড়য় তিয়াগোর সামান্য জ্বর হলে।

এসব আরও করে সিসিলিয়া মারা যাবার পর। সিসিলিয়ায় তিয়াগোর মা।

আজ এক-শো-টা তিয়াগোকে বাঁচাতে হবে। চোয়ালটা শক্ত হয়ে আসে মার্টিনহোর।

দ্রুত মাস ইন্ট্রাকমটা তুলে নেন হাতে, ‘এমার্জেন্সি কল রেঞ্জার্স, রেটিং এক্স। অনলি টেন মিনিটস টু রেসপন্ড। একটি শিশুদের স্কুল দখল করা হয়েছে। প্রায় এক-শো-টি শিশু বন্দি। সিক্স মিলিট্যান্টস টু নিউট্রালাইজ। নট আ সিঙ্গল কিডস টু গেট হার্মড। নিড টুয়েলভ ভলান্টিয়ার্স। আলিয়াবাদ স্কুল, এখান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দেড় কিলোমিটার, ডাউনটাউন। গেট আর্মড টু দ্য টিথ। লেটস মুভ ফাস্ট।’

বারো জন ঠান্ডা মাথার খুনে রেঞ্জার্স নিয়ে খ্যাপা প্যান্থারের মতোই ছুটে চললেন কর্নেল মার্টিনহো ভাজ।

১৫৬০। অাগস্ট। গোয়া

সন্ধের অন্ধকারে লোকগুলো চুপচাপ মশাল জ্বালিয়ে হেঁটে আসছিল। ঠান্ডা বাদলা হাওয়ায় বেঁকে যাচ্ছিল আগুন, উড়ে যাচ্ছিল মশালের কালো ধোঁয়া। জঙ্গল পেরিয়ে মাঠের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া দলটিতে আছে দশ বারো জন বিদেশি সৈন্য, সামনে দু-জন দেশীয় পথপ্রদর্শক। দু-জন বিদেশি ঘোড়ায় চড়ে পাশে পাশে যাচ্ছিলেন, তাঁদের সাজপোশাক আর কঠিন চোয়ালে স্পষ্ট যে এই দুইজনই অত্যন্ত উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী।

ছোটো দলটি যতদূর সম্ভব কম আওয়াজ করে হেঁটে যাচ্ছিল। কারো মুখে কোনো কথা নেই, পথঘাটও জনহীন। শুধু ঘোড়ায় বসা দীর্ঘকায় রাজকর্মচারীটি এক বার জিজ্ঞেস করলেন চাপা গলায় ‘আর কতদূর? আকাশে মেঘ করেছে, বৃষ্টি এল বলে।’ ‘বেশিদূর নয় সেইনর’ এক বিদেশি সৈনিক সম্ভ্রমভরা গলায় উত্তর দেয়, ‘এই মাঠটা পেরিয়েই সেই মন্দির।’

একটু পরেই একটি মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াল ক্ষুদ্র দলটি। মশাল উঁচু করে তুলে ধরল কয়েক জন। ধীরে ধীরে মেঘকালো অন্ধকারের প্রেক্ষাপটে জমাটবদ্ধ এক পাথুরে অন্ধ পাহাড়ের মতোই শতাব্দীপ্রাচীন সেই মন্দিরটির অবয়ব ফুটে উঠল। দুইজন বিদেশি সিপাহি এসে ঘোড়া দুটির লাগাম ধরতে ঘোড়া থেকে নেমে আসেন দুই রাজপুরুষ। দু-জনেই আকাশের দিকে তাকান। ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ, স্তব্ধ অশনিসংকেত ব্যপ্ত এই চরাচরে। ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা মুখে এসে লাগছে। মাথার টুপি উড়ে যাচ্ছিল, সেটাকে ধরে আবার মাথায় বসিয়ে নিয়ে দীর্ঘকায় রাজপুরুষটি আঙুলের ইঙ্গিতে দেশীয় দু-জনকে আদেশ দেন মন্দিরে উঠতে। চকিতে পা জড়িয়ে শুয়ে পড়ে দু-জনেই, ‘গরিবকে মাফ করুন হুজুর। মেরে ফেলুন, কেটে ফেলুন, কিন্তু দয়া করে এই মহাজাগ্রত রুদ্রবেতাল মন্দিরের দরজা খোলাবেন না আমাদের দিয়ে। প্রধান পুরোহিত ছাড়া দিনের বেলাতেই কেউ এর দরজা খোলে না, আর আমরা রাতের বেলা দেবতার ঘুম নষ্ট করে অভিশাপ ডেকে আনব নাকি? আমাদের চৌদ্দপুরুষ নরকে যাবে হুজুর। আমাদের রেহাই দিন হুজুর… রাস্তা দেখাতে বলেছিলেন, রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছি। এখন…’

আচমকা একটা জুতোর ঠোক্কর এসে প্রথম দেশীয় লোকটির মুখে সপাটে আছড়ে পড়ে, যন্ত্রনায় কঁকিয়ে ওঠে সে। অন্য লোকটি ভয়ে জড়সড় হয়ে যায়। কঠিন মুখে থুতু ছিটিয়ে আদেশ দেন দীর্ঘকায় রাজপুরুষটি, ‘শয়তান হিন্দু, এইসব খেলা আমাদের সঙ্গে খেলিস না, অনেক দেখেছি তোদের। নোংরা, অবিশ্বাসী, নর্দমার কীট তোরা। তোদের এইসব পুতুলগুলোও নোংরা, আর বেজন্মার বাচ্চা তোরাও নরকের এই পুতুলগুলোকে পুজো করে চলেছিস। ভিখিরি শয়তানের দল, ওঠ, মন্দিরে ওঠ, দরজা খোল। ওরে, কে আছিস, বেয়নেটটা এই অপবিত্র পশুটার গলায় ধর তো, বিন্দুমাত্র বেচাল দেখলে গলাটা ফালাফালা করে দিবি।’

অঙ্গবস্ত্রে মুখের রক্তটা মুছে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় সেই দেশীয় লোকটি, এক বার চোখ তুলে তাকায় দীর্ঘকায় রাজপুরুষটির দিকে। অন্ধকারের মধ্যে চোখ দুটো ধক করে জ্বলে উঠেই নিভে যায়। তারপর মাথা নীচু করে পা বাড়ায় মন্দিরের সিঁড়ির দিকে। দ্বিতীয় দেশি লোকটিও তার পিছনে পিছনে যেতে থাকে। পিছনে পিছনে বাকিরা।

ধীরে ধীরে মন্দিরের পাথুরে সিঁড়িতে পা রাখে প্রথম লোকটি। সঙ্গেসঙ্গে শোঁ শোঁ করে বাদুলে হাওয়ার দাপট বেড়ে ওঠে। মাঠের মধ্যে একটা ছোটো হাওয়ার ঘূর্ণি কাঠকুটো ধুলো মিশিয়ে ঘুরতে থাকে। অন্ধকারেই তার মধ্যে একটা শূন্য হাহাকারের ডাক মিশে গেল কি? দেশীয় দু-জন যেন একটু কেঁপে ওঠে সেই আওয়াজে। তবুও ধীরে ধীরে চাতালে ওঠে ওরা। চওড়া পাথুরে চাতাল পেরিয়ে যায় ভারী পা দুটো টেনে টেনে। পেছনে বিদেশি হানাদারদের দল, আর সেই রাজপুরুষ দু-জন। কয়েক পা হাঁটা, তারপর কাঠের সেই ভারী দরজা। দরজায় কোনো আগল নেই, এমনকী বন্ধ করার কোনো ব্যবস্থাই নেই। কারণ অন্ধকারে চুপিসারে রুদ্রবেতালের মন্দিরের চাতালে ওঠার, বা দরজা খোলার দুঃসাহস শুধু আমোনা গাঁ কেন, গোটা বিচোলিম তালুকা, এমনকী সমগ্র দক্ষিণ কোঙ্কণে কারও নেই। হিন্দুধর্মে বহু দেব-দেবীর পূজা হয়, কিন্তু সমগ্র ভারতে বেতাল শুধু মাত্র এইখানেই পূজিত হন রুদ্রবেতাল রূপে, দেবাদিদেব শিবের অনুচর হিসেবে। একমাত্র মহাতন্ত্রধারক, অঘোরীদীক্ষিত, বেতালসিদ্ধ প্রধান পুরোহিত ছাড়া এই মন্দিরের দরজা কেউ খোলে না। প্রধান পুরোহিতের অনুমতি ছাড়া কেউ চাতালে ওঠে না, পূজার্চনাও করতে আসে না। এই বেতাল মহাভয়ংকর, মহাক্রোধী, স্বয়ং মহাকাল, পূজার্চনার তিলমাত্র ত্রুটিতে মহাঅনর্থ উপস্থিত হয়।

ধীরে ধীরে মানুষের হাতের ধাক্কায় খুলে যায় সেই প্রাচীন কাঠের বিশাল দরজা। সঙ্গেসঙ্গে তুমুল বজ্রপাত হয় কাছেপিঠেই কোথাও। সকলে সচকিত হয়ে ওঠে। বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটা ধেয়ে আসে চারিদিক জুড়ে। কাঁপাকাঁপা পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে দেশীয় দুইজন, প্রায় তৎক্ষণাৎ হুড়মুড় করে ভেতরে ঢোকে বাকিরা। ঢুকেই দরজা কবাট বন্ধ করে দেয় কেউ।

‘মশালগুলো তুলে ধরো’ কড়া গলায় আদেশ দেন দীর্ঘদেহী রাজপুরুষটি। এই গর্ভগৃহে কোনো জানলা নেই। তাই ফুল, তেল, অগুরু, সিঁদুর আর রক্তচন্দনের চাপা গন্ধে ভরে আছে ভেতরটা। চারিদিকে নিকষ কালো দেওয়াল, যেন খেয়ে ফেলবে অনধিকার প্রবেশকারীদের! আর সব কিছু ভেদ করে, ওপাশের দেওয়ালে বিশাল একটা অবয়ব।

রুদ্রবেতালমূর্তি!!

আস্তে আস্তে মশালগুলো ওপরে ওঠে। কাঁপা কাঁপা হাতে কয়েক জোড়া বেয়নেটও। বেতালমূর্তি প্রকটিত হয়।

মুহূর্তে দেশীয় দুইজন সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত হয় মূর্তির সামনে। উচ্চৈঃস্বরে স্তবমন্ত্র আওড়াতে থাকে। লালরঙের মেটে সিঁদুর, যজ্ঞভস্মের কালি আর এরণ্ড তেল মাখানো ভয়াবহ সেই মূর্তির সামনে বিদেশিরাও একটু ঘাবড়ে যায় প্রথমে। সবাই বুকে হাত দিয়ে ক্রুশচিহ্ন আঁকে। দীর্ঘদেহী রাজপুরুষটি অস্ফুটে বলে ওঠেন ‘মাই গড। কী ভয়ানক দেখতে এদের দেবতা। নরক থেকে উঠে এসেছে মনে হয়, কি বলেন মনসেইনর রেভারেন্ডো?’

অপেক্ষাকৃত খর্বকায় দ্বিতীয় রাজপুরুষটি এতক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে মূর্তিটাকে দেখছিলেন। ভয়াবহই বটে। বেলেপাথরের তৈরি মূর্তি, ফুট দশেক মতন লম্বা। চোখের দিকে তাকালে ভয় করে, পাথরের চোখে এত ক্রূরতা আর ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলা যায় কে জানত? ওস্তাদ স্কাল্পটর, মানতেই হবে! তার ওপর অস্বাভাবিক বড়ো কান দুটি, তাতে আরও ভীতিজনক দেখায় মূর্তিটিকে। তবে যেটা আশ্চর্যজনক লাগে ওনার কাছে, সেটা হল দাড়ি। গত কয়েক বছরে অনেক জায়গায় অনেক হিন্দু মূর্তি দেখেছেন উনি, কিন্তু কোনো মূর্তিরই দাড়ি ছিল না। এখানে আছে। মূর্তির ডান হাতে একটা পাথরের দণ্ড বা স্টিক, বাঁ-হাতটা কিছু নেবার ভঙ্গিতে এগোনো, মুঠি করা। দুটি পায়ে বেয়ে দুটি সাপ উঠছে। তবে মূর্তির সবচেয়ে কদর্য অংশ হচ্ছে দীর্ঘ, অনাবৃত লিঙ্গটি!

বিরক্তিতে এবং বিবমিষায় গা গুলিয়ে ওঠে ওঁর। হোলি জিশাস, মনে মনে বিড়বিড় করেন উনি। এইসব ফিলদি আগলি ডেমনদের পুজো করে এই নোংরা লোকগুলো? এ তো সাক্ষাৎ শয়তানের প্রতিমূর্তি! বিড়বিড় করতে করতে বুকে ক্রুশ আঁকেন তিনি। তিনি স্বয়ং উপস্থিত থাকতে এই ইন্ডিয়ান পিশাচগুলো এইভাবে জাহান্নমের রাস্তায় এগিয়ে যাবে? এইসব নীচু, অপরিষ্কৃত অবিশ্বাসী ইন্ডিয়ানদের উদ্ধার করে প্রভু যিশুর রাস্তায় নিয়ে আসার জন্যেই তো ওঁরা এই গড ফরসেকেন ল্যান্ডে এসেছেন। বিপথগামীদের উদ্ধার করাই তো একজন ক্রাইস্টের সেবকের জীবনের চরমতম ব্রত। তাই তো কষ্ট করে পোপ পঞ্চম নিকোলাসের প্যাপাল বুল রোমানাস নিয়ে, সম্রাট তৃতীয় জনের আদেশ শিরোধার্য করে, প্রভু যিশুর প্রেমের পথে সবাইকে টেনে নিতেই ওনার আগমন এই গোয়াতে।

এবং তার রাস্তায় যদি কেউ বিন্দুমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাকে বা তাদের সমূলে উচ্ছেদ করতে উনি বদ্ধপরিকর এবং এ বিষয়ে উনি বজ্রাদপি কঠোর। অনিচ্ছুক পতিত লোকজনকে উদ্ধার করে প্রেমের প্রভু যিশুর পথে আনতে গেলে একটু রক্তপাত তো হবেই। স্থানীয় সমস্ত শয়তান পুতুলদের পুজো বন্ধ না করলে প্রভু যিশুর বার্তা প্রচার করা বড়ো কঠিন হয়ে পড়ে যে! তার ওপর আবার পুতুল পুজো থেকে মন না সরালে ক্রুশ পুজোতে মন দেবে কী করে এরা? সম্রাট বা পোপ কি তা সইবেন? পর্তুগালের রাজদরবার ছেড়ে আসার সময় দরবার রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ওঁর নজর এড়ায়নি। সম্রাট তৃতীয় জনের বয়েস হয়েছে। এর পর, অঘটন কিছু না ঘটলে সম্রাট হবেন সেবাস্টিয়ান। অবশ্য বকলমে রাজত্ব থাকবে রানি ক্যাথারিনের হাতেই, সে নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। ইনি আবার জেস্যুইটদের একনিষ্ঠ সেবক, মানে চলবেন তাদের কথাতেই। মনে মনে একটা বাজে গালি দেন মহিলার উদ্দেশ্যে, বুড়ি যেমন গোঁড়া, তেমনই বোকা। সে যাই হোক, মালিক বা মালকিন বোকা হলে সবারই সুবিধা। কিন্তু পর্তুগালের রাজদণ্ডটির নীচে পাকাপাকিভাবে মাথা গুঁজতে গেলে কিছু একটা তো করে দেখাতে হয়!! এখন এই বাজারে পড়ে থাকে দুটিমাত্র কাজ, এক, নতুন দেশ জয়, যা খুবই পরিশ্রমসাধ্যকাজ!! ইনি আবার তলোয়ার কেন, চামচ ছাড়া কিছুই নাড়াতে জানেন না। সেক্ষেত্রে, তদভাবে দ্বিতীয় পন্থা, বিজিত নতুন দেশে খ্রিস্টধর্ম প্রসারণ, আর কি? তলোয়ার আর খ্রিস্টধর্ম, এ ছাড়া সম্প্রসারণ করার মতন ইউরোপের আর আছেটাই বা কি এখন?

উনি অবশ্য এদেশে এসেছেন বিশেষ কাজে, পোপের আদেশে। সে আদেশের বিন্দুবিসর্গ পোপ ছাড়া আর কেউ জানে না, সম্রাট অবধি না !

আজ থেকে দশ বছর আগে স্বয়ং পোপ ওঁকে বিশেষ আদেশবলে ডেকে পাঠান। এক বিষন্ন বর্ষণক্লান্ত বিকেলে সেই সংক্ষিপ্ত আলাপ এখনও মনে আছে ওঁর। ভ্যাটিকানের এক রুদ্ধকক্ষে, এক সান্ধ্য আলাপের আসরে মিলিত হয়েছিলেন দু-জনে, টেবিলের ওপর খোলা ছিল একটি শতাব্দীপ্রাচীন বৃহৎ বই। আকারে ইঙ্গিতে অনুমান করেছিলেন তিনি, ভ্যাটিকানের সবচেয়ে সুরক্ষিত ভল্ট থেকে তুলে আনা এই বইটি। যে ভল্টে একমাত্র স্বয়ং পোপ ছাড়া আর কারো প্রবেশাধিকার নেই। উৎকৃষ্ট বেলজিয়ান সুরা পানের পর পোপ চতুর্থ পায়াস একটি বিশেষ কাজের ভার তাঁকে দিয়েছিলেন, বইটির রেফারেন্স দিয়ে। কাজটা আর কিছুই না, পশ্চিম ইন্ডিয়াতে, যেখানের রাস্তা সবে উন্মুক্ত হয়েছে, সেখানকার একটি বিশেষ স্থানে নাকি একটি অতিপ্রাকৃতিক আধিদৈবিক মহাশক্তির আধার আছে, সেটি তুলে এনে পোপের হাতে সমর্পণ করতে হবে। এই পোপ না হোক, পরের পোপ। এইটাই আদেশ, এবং সম্রাট তৃতীয় জন যেন এর বিন্দুমাত্র আঁচ না পান। এ আদেশ অমান্য করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা, কোনোটাই অবশ্য ওঁর ছিল না। কারণটা বক্তব্যের আসল জায়গাটা তিনি ঠিকই বুঝেছেন, ‘এই পোপ না হোক পরের পোপ!’ মানে ইচ্ছেটা পোপ চতুর্থ পায়াসের ব্যক্তিগত নয়, সমগ্র খ্রিস্টান ধর্মজগতের, এবং পরিকল্পনাটি আজকের নয়, বেশ অনেকদিনের। এ কাজে অনেক সাহস করেই হাত দিতে হয়, এবং শেষমেশ এই পোপই দিয়েছেন। তার অবশ্য কারণ আছে। ইনি অতি প্রতাপশালী লোক, শুধু পোপই নন, ইতালির মহা ক্ষমতাধর মেদিচি পরিবারের সন্তানও বটে!

তা এই মহাশক্তিধর ব্ল্যাক মাজিক আর্টিকেলটির খোঁজ হিজ হোলিনেস পোপ পেলেন কী করে? এ প্রশ্নও করেছিলেন তিনি, জবাবে পোপ মৃদু হেসে সামনে খোলা বইটির প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন। কী বই, কার লেখা, কী বৃত্তান্ত, এ নিয়ে আর কৌতূহল দেখাননি তিনি। পোপের অনুরোধ খ্রিস্টীয় অনুশাসনের যেকোনো সৈনিকের কাছে কালান্তক আদেশের সমান। তিনিও আর প্রশ্ন করেননি, এক-শো বছর আগে জারি করা পোপ পঞ্চম নিকোলাসের আদিষ্ট ‘প্যাপাল বুল রোমানাস পন্টিফে’ বা পোপের বিশেষ আদেশ নিয়ে সোজা এখানে এসে ঘাঁটি গেড়েছেন। ইতিমধ্যে পদোন্নতিও ঘটেছে ওঁর, গোয়াতে পর্তুগিজ রাজত্ব স্থাপন করার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার জন্যে পর্তুগালের রাজদ্বারে বিপুল প্রতিপত্তি জুটেছে তাঁর, কিন্তু পোপের আদেশ ভোলেননি। তাই প্রথম সুযোগেই ইনি এখানে। তারপর তন্নতন্ন করে খুঁজে, লক্ষণ মিলিয়ে, অজস্র উপকথা আর জনশ্রুতি শুনে আজ যখন তিনি সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত স্থানে এসে উপস্থিত, তখন দেখছেন যে, যার জন্যে এত প্রাণপাত, সেই জিনিসটিই ফুড়ুৎ!!!

মূর্তির পাদদেশে একটি ছোটো চৌকো পীঠস্থান মতো আছে। তার ওপরেই এই পাথুরে মূর্তিটি। হিসেবমতো তারই মধ্যে বিশেষ প্রকৌশলে লুকোনো থাকার কথা সেই পোপের আদিষ্ট মহাশক্তিধর জিনিসটির। উনি প্রস্তুত হয়েই এসেছিলেন, দরকার পড়লে পীঠস্থানটি খুঁড়ে দেখবেন বলে। এখন বোঝাই যাচ্ছে যে তার আর দরকার নেই। কারণ চৌকোণা পীঠস্থানটির সামনে একটি ছোট্ট চৌকো গহ্বর খালি। বোঝাই যাচ্ছে যে ওখানে বহু যত্নে কিছু লুকিয়ে রাখা ছিল, হয়তো বহু প্রাচীন কাল থেকে। এবং এখন আর নেই!! চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে মনসেইনর রেভারেন্ডোর। চোখ দুটো একটু সরু হয়েই স্বাভাবিক হয়ে যায়।

এই জিনিসের খোঁজ এক জনের পক্ষেই জানা সম্ভব, এবং সেই-ই সরিয়েছে জিনিসটা। একটা শীতল ক্রোধ ওনার মেরুদণ্ড বেয়ে মাথায় উঠতে থাকে।

‘এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত কোথায়? তাকে আমার চাই, এক্ষুনি, যে করে হোক’, সেই পাথুরে মন্দিরের মধ্যে গমগম করতে থাকে ওনার স্বর।

দীর্ঘদেহী রাজপুরুষটি একটু সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে আসেন, ‘ইয়ে, একটা ছোটো অসুবিধা হয়েছে মনসেইনর। আমি আদেশ দিয়েছিলাম প্রধান পুরোহিত, আর তার পরিবারকে বন্দি করতে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রধান পুরোহিত কোনোভাবে টের পেয়ে পালায়। আমরা অবশ্য তার স্ত্রী আর ছেলেকে আটক করেছি, ফোর্ট আঞ্জেদিভেতে বেঁধে রেখেছি দু-জনকেই, দু-জনের ওপরেই ইনকুইজিশন চলছে’, একটু দম নিয়ে নেন তিনি, ‘আর অলরেডি এক প্ল্যাটুন সোলজার পাঠিয়েছি লোকটাকে ধরে আনতে। সৌভাগ্যক্রমে আমরা জানতে পেরেছি, লোকটা কোর্টালিম যাচ্ছে। আশা করছি আজ রাতের মধ্যেই লোকটাকে ধরে কাল সকালে আপনার সামনে হাজির করতে পারব, রেভারেন্ডো।’

ভ্রূকুটিকুটিল চোখে খর্বকায় লোকটি পেছনে ফিরে তাকান, ‘আপনি কী করে এত নিশ্চিত হচ্ছেন, সেইনর?’

দীর্ঘদেহী রাজপুরুষটি ধূর্ত হাসি হেসে বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি, যে লোকটা নিজের ছেলেকে পাগলের মতন ভালোবাসে। আজ না হয় কাল, ওকে ফিরতেই হত মনসেইনর।’

‘আচ্ছা? খুব ভালোবাসে?’ একটা নিষ্ঠুর ক্রূর হাসি খেলে যায় সেই প্রতাপশালী রাজপুরুষটির মুখে, ‘কাল বিকেলে, তিন জনকেই বেঁধে আনবে, এই মন্দিরের সামনে। পুট দেম টু ডেথ, ডেথ বাই ফায়ার। এক্সেকিউশনের আদেশ কাল সকালেই আমার কাছ থেকে নিয়ে নেবেন সেইনর।’

বলে, মন্দির থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে একটু থামেন তিনি, ‘মেক শিওর দ্যাট হি সিইজ হিস সন বার্নিং। অলসো মেক ইট শিওর দ্যাট দ্য এন্টায়ার ভিলেজ ইস প্রেজেন্ট ডিউরিং দ্যাট। আমাদের একটা কড়া উদাহরণ রাখতে হবে। লোকে যেন বোঝে মহান করুণাময় যিশুর পথে না চলার শাস্তি কী।’ বলে একটু থামেন তিনি, তারপর যোগ করেন, ‘দে নিড টু পে আ প্রাইস, আ ভেরি হেভি প্রাইস, বাই ব্লাড অ্যান্ড ডেথ।’

এই বলে বৃষ্টির মধ্যেই ঘোড়ায় চড়ে চলে যেতে থাকেন মনসেইনর রেভারেন্ডো, গোয়ার ভাইকার জেনারেল, মিগুয়েল ভাজ।

২০১৬। জুলাই। আফগানিস্তান

স্কুলটা একটা উপত্যকার গা ঘেঁষেই। স্কুলের পিছনের চাতাল থেকে ঠিক বারো ফুট দূর থেকে পাহাড়ের খাদ শুরু। সেদিকে যাতে বাচ্চারা চলে না যায়, তারজন্য স্কুল বিল্ডিঙের দু-পাশ দিয়ে বেশ কিছুটা দূর অবধি লম্বা চলে গেছে কাঁটাতারের ফেন্সিং। উপত্যকার ওপারে হিন্দুকুশ রেঞ্জের অপার্থিব নয়নাভিরাম দৃশ্য। দূর, অতি দূর অবধি ঢেউ খেলে গেছে পাহাড়ের সারি। মাথায় মাঝে মাঝে মেঘেদের আনাগোনা।

কিন্তু আজ এই অপার্থিব দৃশ্য দেখার সময় কারও নেই, একটা নিঃসীম বীভৎসতার আশঙ্কা যেন কালো ডানা মেলে নেমে আসতে চাইছে পুরো এলাকাটা জুড়ে।

স্কুলের সামনের দিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে দীর্ঘ উপবৃত্তাকার এলাকা কর্ডন করে রেখেছে আফগান ন্যাশনাল পুলিশ। খবর পেয়েই আর্মির টু হান্ড্রেড নাইন্থ কর্প্স এসে উপস্থিত। বড়ো বড়ো পুলিশ ভ্যান আর জিপ, আফগান আর্মির কমব্যাট ভেহিকল, সার্চ লাইটের আলো, স্থানীয় কিছু সংবাদদাতা সংস্থার ভ্যান, এর পিছনে বুকচাপড়ানো আফগান মায়েদের দল, আর হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তাদের সামলে রাখা আফগান বাবাদের ভিড়, রঙ্গ দেখতে আসা ইতর জনগণ, সব মিলিয়ে নরক গুলজার হয়ে রয়েছে জায়গাটা। খবর পেয়ে সি এন এন আর বিবিসির স্থানীয় সংবাদদাতারা বিশাল বিশাল ছাতাওয়ালা ভ্যান নিয়ে এসে হাজির। আস্তে আস্তে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে যাচ্ছে এই সর্বনাশা খবর। আতঙ্কে, ঘেন্নায়, শিউরে উঠে নিশ্বাস বন্ধ করে পৃথিবী অপেক্ষা করছে আরেকটা নৃশংস গণশিশুহত্যার জন্যে, বেসলান আর পেশওয়ারের পর। আরেকটা!!

পুলিশ আর আর্মির সঙ্গে জঙ্গিদের প্রাথমিক আলোচনা ব্যর্থ। তার প্রধান কারণ জঙ্গিরা নির্দিষ্ট করে কিছু চায় না। তারা শুধু দেখাতে চায় আল্লাহর সৈনিকরা কতটা অকুতোভয়, এবং পৃথিবীতে শরিয়ত কায়েম করার জন্যে তারা কত বৃহৎ আত্মত্যাগের নজির রাখতে পারে। স্থানীয় জিরগার এক বৃদ্ধ প্রধানকে ডেকে আনা হয়েছে কথাবার্তা চালিয়ে যাবার জন্যে। তিনি পুলিশের মাইকে জঙ্গিদের কাছে উচ্চৈঃস্বরে আবেদন জানাচ্ছেন শান্তিপূর্ণ ভাবে আত্মসমর্পণের জন্যে, ইসলামে নরহত্যার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সুরা আর আয়াত পেশ করছেন, নাবালক শিশুদের প্রাণের জন্যে দোহাই পাড়ছেন, নিজেকে জিম্মি রাখবার প্রস্তাব দিচ্ছেন, বলছেন দরকার হলে তাঁকে ছিড়ে হাজার টুকরো করুক জঙ্গিরা, কিন্তু শিশুদের যেন কিছু না হয়…

উত্তরে মাঝে মাঝে শুধু কিছু বুলেট ছুটে এলে তৎক্ষণাৎ লোকজন নীচু হয়ে প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। কিছুক্ষণ পরে পরে সেই একই নাটক। জিরগার বৃদ্ধ প্রধান হাউহাউ করে কাঁদছেন, আর শিশুদের জীবনের ভিক্ষা চাইছেন। পুলিশের কাজ আরও শক্ত হয়ে উঠছে বাবাদের জন্যে। জোয়ান আফগান রক্ত, জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্যেরই সমান, সবারই দাবি দুটো বন্দুক দিলে তারাই এই শয়তানগুলোকে নিকেশ করে আসতে পারে। হায়রে বাবাদের মন!!!

ঘন ঘন ঘড়ি দেখছিলেন দোয়াহম ব্রিডমান, অর্থাৎ লেফট্যানেন্ট শের আবদুল বারি করিমি। অনেক্ষণ হল খবর পাঠানো হয়েছে ল্যামেগোতে, জার্মানদের মাধ্যমে। কোনো সাড়াশব্দ নেই কেন?

এমন সময় ওনার জিপ থেকে নিজস্ব সর বাজ, অর্থাৎ প্রাইভেট সার্জেন্ট দিলবার নজারি ওয়াকিটকিটা নিয়ে দৌড়ে আসে, সেটাকে কানে চেপে দূরে সরে যান কুশলী ও ধূর্ত লেফট্যানেন্টটি, বলখ প্রদেশের টু হান্ড্রেড নাইন্থ কর্প্সের প্রধান আবদুল করিমি। খানিকক্ষণ পরে মুখে একটা হালকা স্বস্তির ভাব ফুটে ওঠে, ‘ওভার অ্যান্ড আউট’ বলে সিগন্যাল কেটে দেন।

এইবার পালটা লড়াই শুরু।

দ্রুত উনি আর্মি ও পুলিশের কাছে এগিয়ে আসেন, বলেন সামনের দিকটায় আরও অ্যাকটিভিটি বাড়াতে। নেগোশিয়েশন চালিয়ে যেতে বলেন আরও জোরদার। ইতিমধ্যে মাজার-ই-শরিফ আর কুন্দুজের দুই সম্মানীয় বৃদ্ধ ওলেমারা এসে হাজির। তাদেরও হাতে মাইক দিয়ে আরও কিছু সার্চ লাইট জ্বেলে দেওয়া হল। ইতিমধ্যেই বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে জায়গাটা।

স্কুলের সামনের দিকেই ওদের টেনে আনতে হবে। যাতে পেছন দিকটা ফাঁকা থাকে!

এদিকে স্কুলের পিছন দিকের উপত্যকা পাহাড়ের গা ঘেঁষে, স্পেশাল হারনেস বেঁধে টিকটিকির ক্ষিপ্রতায় পাশাপাশি সরে সরে স্কুলের পেছন দিকে পাহাড়ের গায়ে জড়ো হচ্ছে তেরো জন রেঞ্জার্স, যারা প্রত্যেকে ইউ এস-এর ফোর্ট কারসন, কলোরাডোর স্পেশাল ফোর্সেস মাউন্টেন অপারেশনস স্কুল থেকে বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত। চৌকো চোয়াল শক্ত, ভাবলেশহীন মুখ। প্রত্যেকের পিঠে ঝুলছে পঁচিশ কিলোর অপারেশনস লোড।

প্রত্যেকের কাছে আছে হেকলার অ্যান্ড কোখের দুটো করে হ্যান্ডগান, একটা করে উজি সাবমেশিনগান। মেইন কমব্যাট ইন্সট্রুমেন্ট যদিও সিগ সয়েরের এসজি ৫৪৩ অ্যাসল্ট রাইফেল। এর সবকটাতেই অটোমেটিক সাইলেন্সার লাগানো। পর্যাপ্ত অ্যামুনিশনস পিঠে ও টাইট ব্ল্যাক ইউনিফর্মের বিভিন্ন খাঁজে। আর প্রত্যেকের দুই হাঁটুর কাছে লুকিয়ে আছে দুটি করে গ্লকা বি-ওয়ান ওয়ার নাইফ। শুধু এই ওয়ার নাইফ দিয়ে এই তেরো জন রেঞ্জার্স হ্যান্ড টু হ্যান্ড ক্লোজ লড়াইতে কমসেকম পঞ্চাশ থেকে সত্তর জনের মহড়া নিতে পারে। সারা মুখ কালো কাপড়ে জড়ানো, শুধু চোখ আর নাক ছাড়া।

সবাই কাছাকাছি পৌঁছতেই মার্টিনহো থুতনির কাছে নেমে আসা সরু স্যাটকমের এলপিআই নেভিগেশনে আদেশ দিলেন ‘মুভ আপ’।

পাহাড়ের গা ঘেঁষে যেন তেরোটা মাকড়সাই উঠে এল স্কুলের পিছনে ছোট্ট চাতালটায়।

১৫৬০। অগাস্ট। গোয়া

ছোটো নৌকোটা ঘাটে এসে থামতেই একটা মৃদু ধাক্কায় উঠে পরলেন ত্রিলোচন। নৌকো থেকে লাফিয়ে হাঁটুজলে নেমে একটা গাছের শিকড়ের সঙ্গে বাঁধে বিঘ্ননাশ। একটা তক্তা এনে পেতে দেয় নৌকো থেকে ঘাট অবধি, যাতে ঠাকুর নির্বিঘ্নে নেমে আসতে পারেন। ঈষৎ স্খলিত পায়ে সেই তক্তা বেয়ে নেমে আসেন ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণী। কোমরে হাতে দিয়ে দেখে নেন জিনিসটা ঠিকঠাক আছে কিনা। তারপর আশীর্বাদ করেন বিঘ্ননাশকে। মাথা নীচু করে সেই আশীর্বাদ নেয় হতভাগ্য ছেলেটি, আর তারপর ফুঁপিয়ে ওঠে, ‘এই শয়তানগুলোর হাত থেকে কি আমাদের মুক্তি নেই জ্যেঠঠাকুর?’

প্রশ্নটা তিরের মতন বুকে এসে বেঁধে ত্রিলোচনের। এই বিঘ্ননাশ গায়তোণ্ডেকে ছোটোবেলা থেকে দেখছেন উনি। বিঘ্ননাশের বাবা দার্শিক ছিলেন ত্রিলোচনের বিশেষ প্রিয়পাত্র। তাঁর সামনেই হেসে-খেলে বড়ো হল ছেলে, বিয়ে করল পাশের পালিগাঁওয়ের বাদন্য মালশের মেয়ে জ্যোতিকে। আহা, জোড়ায় জোড়ায় যেদিন দু-জনে এসেছিল রুদ্রভৈরব মন্দিরে, প্রাণভরে ওদের আশীর্বাদ করেছিলেন তিনি।

কিন্তু তার বছর দশেক পরে ভিনদেশি যবনদের উৎপাত যখন আছড়ে পড়ল এই গোয়াপুরি সহ সমগ্র কোঙ্কণ অঞ্চলে, তার প্রথম ঝটকাটা যাদের ওপর দিয়ে গেল, তাদের একজন এই গাইতোণ্ডে পরিবার। বিঘ্ননাশ সৈনিক পুরুষ, আদিল শাহি সেনাদলে ছিল, তার ওপর তার রক্তও কিঞ্চিৎ বেশি গরম। বাজারে এক যবন সৈনিকের সঙ্গে সামান্য কথা কাটাকাটি হওয়াতে একদিন তারা দল বেঁধে বিঘ্ননাশকে ধরতে আসে। ছোকরা সেদিন কাজে অন্যত্র গেছিল। সেই যবন সৈনিকের দল বিঘ্ননাশকে না পেয়ে তার বাড়িঘরে আগুন দিয়ে দেয়, জোর করে ধরে নিয়ে যায় জ্যোতিকে। চিৎপাবন ব্রাহ্মণের কুলবধূকে বিদেশি যবন সৈন্য প্রকাশ্য রাস্তায় অর্ধউলঙ্গ করে চুল ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে, খুব সম্ভবত এই দৃশ্য দেখেই দার্শিক আর তার বউ লজ্জায়, ঘেন্নায় আতঙ্কে মারা যায়, বা হয়তো আত্মহত্যাই করে, সঠিক বলা যায় না। তাদের মরদেহ দুটি সেই ঘরের সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে অবশ্য বেশি দেরি হয়নি।

বিঘ্ননাশ ক্রোধে উন্মাদ হয়ে একটা খোলা তলোয়ার হাতে সেদিনই ছুটে যাচ্ছিল প্রতিশোধ নিতে, তাকে আটকান ত্রিলোচনই। নইলে বন্ধুপুত্রের সেদিনই ইহলীলা সাঙ্গ হত। সেই থেকে গোয়াপুরির আরেক প্রান্তে সঙ্গোপনে একে লুকিয়ে রেখেছেন ত্রিলোচন, এর কাজই হচ্ছে স্থানীয় তৃণমূল স্তরে ছেলেপিলেদের সংগঠিত করা এই বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে। ত্রিলোচনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোকেদের মধ্যে প্রথমেই থাকবে এই অগ্নিবর্ষী যুবা।

প্রিয় অনুচরের মাথায় হাত রাখেন ত্রিলোচন, নিজের হাতটাও সামান্য কেঁপে উঠল কি? ফিসফিস করে বলেন, ‘দিন বদলাবে বিঘ্ননাশ, অত্যাচারীর শাসন কখনো একটানা চলতে পারে না। স্বয়ং বেতাল মহারাজ সাক্ষী এই অনাচারের, তিনি সব দেখছেন, সব শুনছেন, তাঁর দরবারে পাপের শাস্তি ভয়াবহ মৃত্যু। তুমি তোমার কাজ চালিয়ে যাও বিঘ্ননাশ, আবার দেখা হবে।’

এই বলে ঘন অন্ধকারের মধ্যেই পা ফেলেন ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণী। আর দু-ক্রোশ দূরেই কুশস্থলী, ঠিকঠাক হাঁটলে আর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া উচিত। ভোরের আলো ফোটার আগেভাগেই পৌঁছতে হবে, আর তারপর কালভৈরব মন্দিরে… নাহ, অনেক কাজ বাকি। দ্রুত হাঁটা লাগান তিনি।

বেশি দূর অবধি অবশ্য যেতে হয় না। আধঘন্টাটাক হাঁটার পরেই রাস্তার পাশে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শুনে ঝোপের আড়ালে আঁধারে মিশে গিয়েছিলেন ত্রিলোচন। কিছুক্ষণ বাদেই মশাল জ্বালিয়ে পুরো এলাকাতে খোঁজ করা শুরু করে দেয় একগাদা যবন সৈন্য। ঝোপের আড়াল থেকে বলির পাঁঠার মতন কাঁপতে থাকা ত্রিলোচনকে খুঁজে বার করতে তাদের কোনই অসুবিধা হয় না। এবং ত্রিলোচন সভয়ে দেখেন উনি একা নন, ধরা পড়েছে বিঘ্ননাশও, এবং তার দু-হাত বেঁধে ঘোড়ার সঙ্গে হাঁটিয়ে আনা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে যে এই অল্প সময়ের মধ্যেই তার ওপরে একটা ঝড় বয়ে গেছে, বাঁ-চোখের নীচে কালশিটে, ঠোঁটের কষ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, চোখে সব কিছু গুলিয়ে যাওয়া উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। রাতের অন্ধকারে ঝিল্লিমুখর সেই মধ্যরাত্রে যেন এক ঘটতে চলা অশুভ নাটকের মুখ্য চরিত্র হিসেবেই বৃত্তাকারে সাজানো সেই সৈন্যদলের মাঝে দাঁড় করানো হয় ত্রিলোচনকে, সৈন্যদলের অধিপতি লালমুখো বিশালদেহী মানুষটি সামনে এসে ভাঙা ভাঙা কোঙ্কণি ভাষায় জিজ্ঞেস করল, ‘এই কালা নেংটি ইঁদুরের বাচ্চা, এই জন্তুটাকে চিনিস?’

সর্বজনশ্রদ্ধেয় বেতালসিদ্ধপুরুষ ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণীকে সমগ্র কোঙ্কণে কেউ এই ভাষায় সম্বোধন করতে পারে, এ ওঁর স্বপ্নেরও অগোচর। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন নীচু হওয়া মাথাটা সামান্য উঁচু করে লাল চোখ মেলে এই যবন সেনাপতিকে দেখছে বিঘ্ননাশ, ঠোঁট থেকে রক্তমেশা লাল গড়িয়ে পড়ল খানিকটা। ভয় পেলেন ত্রিলোচন, নিজের জন্যে না, বিঘ্ননাশের জন্যে। বড়ো মাথাগরম ছেলে, খণ্ডমুহূর্তে প্রলয় বাঁধিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এখন মাথা ঠান্ডা রাখা দরকার, একদম ঠান্ডা রাখা দরকার। অকম্পিত স্বরে ত্রিলোচন বললেন, ‘না চিনি না।’ ভারী হাতের একটা থাপ্পড় এসে গালে পড়তেই চোখে অন্ধকার দেখলেন তিনি, হিংস্র শ্বাপদের মতোই গর্জন ভেসে এল, ‘একদম মিথ্যা কথা বলবি না নোংরা হিন্দু। এই জন্তুটা একটু আগে তোকে নৌকো করে পৌঁছে দেয়নি?’

অতি কষ্টে চোখ দুটো খুললেন ত্রিলোচন, রাগে, অপমানে মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করছিল। শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ক্রোধ সংবরণ করলেন তিনি, শান্তি, শান্তি, শান্তি, তিন বার বিড়বিড় করলেন। তারপর মাথা তুলে দৃপ্ত অথচ মৃদু স্বরে বললেন, ‘বৃথাই গায়ে হাত তুলছ বিদেশি। আমি একে চিনি না। আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ, অন্য গাঁয়ে বেদপাঠের আমন্ত্রণে যাচ্ছি। অন্যায় কাজ করা তোমাদের মানায় না, হিন্দুদের শাস্ত্রকর্মে বাধা দিও না।’ শব্দ করে ওঁর মুখে থুতু ছিটিয়ে দিল লোকটা, ঘেন্নায় কুঁকড়ে গেলেন উনি, শিব শিব উচ্চারণ করে শিউড়ে উঠলেন। তারপর চোখ খুলে সেই বিদেশি হানাদারকে কিছু বলার আগে চোখ গেল বিঘ্ননাশের দিকে, আর বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি। খেপা বাঘের মতোই ফুলে উঠেছে বিঘ্ননাশ গাইতোণ্ডে। ঘাড়টা সামান্য উঁচু করে তীব্র লাল চোখ মেলে সে এক বার এই বিদেশি সেনাধ্যক্ষকে দেখছে, আরেক বার চারিদিকের সৈন্য সমাবেশকে। আরেক বার ভয় পেলেন ত্রিলোচন, ছেলেটা উত্তেজনায় কিছু করে না বসে। আদিল শাহি সৈন্যদলে একটা ছোটোখাটো দলের সর্দার ছিল বিঘ্ননাশ। চিৎপাবন ব্রাহ্মণ হলে কী হবে, সাহসে, শক্তিতে আর দৈহিক ক্ষমতায় শ্রেষ্ঠতম ক্ষত্রিয় সে, দুর্জয় সাহস এই যুবকের বুকে, আর তলোয়ার চালানোয় তো সে সাক্ষাৎ সিদ্ধপুরুষ।

এত কিছু খেয়াল করেনি সেই বিদেশি। একটানে তলোয়ারটা খুলে তার ডগাটা ত্রিলোচনের বুকে চেপে ধরে, একটানে ছিঁড়ে নেয় উত্তমাঙ্গের উত্তরীয়টি, তারপর ব্যঙ্গের হাসি হাসতে হাসতে খেলাচ্ছলেই সামান্য চালিয়ে দেয় তলোয়ারটা, ফিনকি দিয়ে সামান্য রক্ত বেরিয়ে আসে দক্ষিণ কোঙ্কণের সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বজনমান্য পণ্ডিত ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণীর বুক থেকে। একটা অস্ফূট আর্তনাদই কি করে উঠলেন তিনি? আর সেটাই বোধ হয় কাল হল। ঘন গম্ভীর গলায় একটা ধমক ভেসে এল পেছন থেকে, ‘নোংরা বিদেশি কুত্তা, দূরে সরে দাঁড়া। তোর সাহস হয় কী করে ওঁর অঙ্গস্পর্শ করার? তোর কী জিজ্ঞাসা করার আছে আমাকে কর। সাহস থাকে তো হাত দুটো খুলে একটা তলোয়ার দে না, তোদের কুকুরের মতো লাথি মারতে মারতে কোপাতে কোপাতে দেশের বাইরে বার করে দিই…’

ধীরেসুস্থে সেদিকে ফেরে সেই বিশালদেহী যবন সেনাপতি, ব্যঙ্গের সুরে বলে, ‘এই তো, পোষা কুত্তার মুখে বুলি ফুটেছে দেখছি…’ পাশ থেকে আরও এক যবন সৈন্য একটা নোংরা ফুট কাটে, ভাঙা কোঙ্কণিতেই, ‘খুব তেজ দেখছি ছোকরার। তুই সেই হিন্দু জানোয়ারটা না, যার বউকে তুলে এনেছিলাম আর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে এসেছিলাম? তাই ভাবি, কবুতরি বিছানায় এত চেল্লায় কেন, এমন জোয়ান কবুতরের জুড়িদার বলেই না…’

সহসা মহাকালসর্পের মতোই ফণা তুলে দাঁড়ায় সেই মারাঠি যুবক, হিসহিস আওয়াজ করে বলে, ‘হাত দুটো খুলে দে না রে বেজন্মার বাচ্চা, তোদের সিধে নরকের রাস্তাটা দেখিয়ে দিই। হারামজাদারা মেয়েদের আর নিষ্পাপ বৃদ্ধদের ওপরেই যত বীরত্ব দেখাতে পারিস দেখছি। কীসের দুধ খেয়ে বড়ো হয়েছিস রে নোংরা কীটের দল, তোদের মায়ের, না জংলি শুয়োরদের?’

হেলেদুলে ধীরেসুস্থে বিঘ্ননাশের দিকে হেঁটে যেতে যেতে একটা কুৎসিত হাসি ভেসে ওঠে সেনাধ্যক্ষকের মুখে, ‘শাব্বাস, এমনই তো চাই। যখন তোর বউকে বিছানায় শুইয়ে ভোগ করছিলাম, সেও এরকমই তেজ দেখাচ্ছিল বটে, তবে কিনা সে মাগির গুমোর ভাঙতে বেশ মজাই লেগেছিল। অবশ্য পুরো পল্টনের প্রসাদ হওয়ার পর বেশ্যা মাগিটার অত তেজ ছিল না। শ-খানেকের ভোগ হওয়ার পরেই তো পটল তুললো শালি। আহা, এখন ভাবি অমন চাম্পি মাল বাঁচিয়ে রাখলেও হত, সময়ে সময়ে আমাদের পালা করে সেবা করতে পারত। হিন্দু ব্রাহ্মণের মেয়েগুলো বড়ো নরমসরম…আহা… বেশ্যাগুলো বিছানা গরম করতেও…’

এরপর আর সরেনি সেই কুৎসিত জিহ্বা। বোধ হয় অতি উৎসাহিত হয়েই এক জন সৈন্য ঘোড়ার মাথার কাছে সরে আসে এই সরস আলোচনা শুনতে, যে ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল বিঘ্ননাশ গাইতোণ্ডেকে। মুহূর্ত, শুধু একটিমাত্র অসতর্ক মুহূর্ত, দক্ষ তলোয়ারবাজ বিঘ্ননাশ সামান্য ডান দিক ঝুঁকে, দু-হাত বাঁধা অবস্থাতেই সেই অতি উৎসাহী বিদেশি সৈনিকের কোষ থেকে বার করে আনে দীর্ঘ তলোয়ারটি, আর সেই একই ভরবেগের সঙ্গে সমস্ত শরীর ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে চালিত করে তরবারিটি গেঁথে দেয় বিদেশি সেনাপতিটির গলা বরাবর। ঘটনাটা ঘটে যায় চকিতের মধ্যে, কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই। অত্যন্ত অবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের গলার অর্ধেকটা অবধি গাঁথা তলোয়ারটা দেখতে দেখতে দুম করে মাটিতে পড়ে যায় সেই বিশালদেহী মানুষটি, আর সঙ্গেসঙ্গে একটা বন্দুকের আওয়াজ ভেসে আসে, মাথার অর্ধেকটা উড়ে যায় বিঘ্ননাশ গাইতোণ্ডের। রক্তে, ঘিলুতে, দীর্ণ খুলির ভগ্নাংশে আর টুকরো নরমাংসে ত্রিলোচনের সর্বাঙ্গ ভরে যায়, পুরো দৃশ্যটা এক ভয়ংকরতম অলৌকিক নারকীয়তা নিয়ে তাঁর চৈতন্যে আঘাত করে।

তিনি আর্তনাদ করে মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান।

২০১৬। জুলাই। আফগানিস্তান

প্রধান সমস্যাটা হচ্ছে ফার্স্ট ফ্লোরে ওঠা, সেটা স্কুলের ম্যাপ দেখামাত্র বুঝলেন মার্টিনহো। ইতিমধ্যে ছয় ইঞ্চি বাই ছয় ইঞ্চি পাতলা ভিজিকম ডিভাইসটা খুলে লোকেশন দেখে নিয়েছেন তিনি ও তাঁর বারো জন খুনে কম্যান্ডো। জিনিসটা স্পেশাল ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক কোনো নতুন মেটেরিয়ালে তৈরি, একটা পাতলা প্যাডের মতন, যেটা বাঁ-বাহুতে জড়িয়ে রাখা যায়, প্রয়োজনে খুলে স্লেটের মতন আকারেও নিয়ে আসা যায়। ল্যামেগো থেকে এর মধ্যেই ইউ এস-এর ল্যাংলেতে বার্তা পাঠানো হয়ে গেছে। তারই ফলাফল হিসেবে কাছাকাছির মধ্যে থাকা দুটি ড্রোন উড়ে এসেছে ওঁদের সাহায্যার্থে। গ্রাউন্ড লেভেলে কেউ নেই। ওরা বাচ্চাগুলোকে নিয়ে গেছে ফার্স্ট ফ্লোরে। পেছন দিকে একটা দরজা আছে বটে, কিন্তু তার ওধারে যে সিঁড়িটা আছে, সেটা সোজা উঠে গেছে ফার্স্ট ফ্লোরে এবং তার সামনে অবশ্যই যে এক জন গার্ড আছে সেটা অনুমান করার জন্যে কোনো পুরষ্কার নেই।

প্রথমে পরিকল্পনাটা মনে মনে ছকে নিলেন মার্টিনহো। একটু আগে লেফটেন্যান্ট আবদুল করিমির কোডেড মেসেজ পেয়েছেন তিনি, টেররিস্টদের অ্যাটেনশন ড্র করার জন্যে স্কুলের সামনের দিকে মহড়া চলছে খুব। সময় কম, সাত মিনিট কেটে গেছে অলরেডি। ওপরে উঠবে কী করে রেঞ্জার্সরা? কোনো টেকনিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করার প্রশ্নই ওঠে না, বিন্দুমাত্র আওয়াজ করা মানে শুধু এদের নয়, শিশুদেরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলা।

প্রত্যেক রেঞ্জার্স তাদের ব্যাগ থেকে একটা করে দেড় ফুট লম্বা পাইপ বার করল প্রথমে, সেগুলো পরস্পর জোড়া যায়। স্পেশাল মিলিটারি গ্রেড ফাইবারের তৈরি ঘাতসহ এবং নমনীয় এই পাইপগুলো বিভিন্ন কাজে লাগে, যেমন ব্লো পাইপ হিসেবে, অথবা অ্যাসল্ট রাইফেলের সামনে ফিট করে লং রেঞ্জ রাইফেল হিসেবে ব্যবহার করতে, অথবা শুধুমাত্র পোল বা লম্বা দণ্ড হিসেবে, এই যেমন এখন ব্যবহার করা হবে। ফটাফট তেরো পিস ফাইবার পাইপ জোড়া লাগিয়ে একটা লম্বা শক্তপোক্ত কিন্তু নমনীয় পোল তৈরি হয়ে যেতেই এক জন তার একপ্রান্ত দু-হাতে ডান দিকে কোমরের কাছে ধরে দেওয়ালের কাছে দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়াল। পোলের অন্য দিকটা দু-জন রেঞ্জার্স ধরে রইল। এরপর যেটা ঘটল সেটা স্রেফ ম্যাজিক। প্রথম রেঞ্জার্স পোলটাকে শক্ত করে ধরে খাড়া দেওয়ালে প্রথম পা রেখেই খুব দ্রুত দ্বিতীয় পা রাখল এবং পোলের অন্য প্রান্ত অন্য দুই রেঞ্জার্স চেপে ধরে কৌণিক ভাবে চাপ দিয়ে যেতে লাগল। প্রথম রেঞ্জার্স স্রেফ নিউটনের তৃতীয় সূত্রানুযায়ী সেই পোলটাকে ধরে সমতলে হাঁটার মতো করেই খাড়া দেওয়াল বেয়ে তরতর করে হেঁটে উঠে দোতলার বারান্দায় পৌঁছেই বারান্দার পাঁচিলের নীচে মাথা নীচু করে অদৃশ্য হয়ে গেল। লিখতে যতক্ষণ লাগল, তার অনেক কম সময়ে ঘটে গেল এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটা, যেটা ঘটতে পনেরো থেকে কুড়ি সেকেন্ডের বেশি লাগেনি!

পরের তিন মিনিটের মধ্যে মার্টিনেজ সহ বারো জন রেঞ্জার্স, পৌঁছে গেল দোতলায়। এক জন রয়ে গেল নীচেই, ছায়ার সঙ্গে মিশে, সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের মতন।

দোতলায় পৌঁছেই পরিস্থিতিটা সরেজমিনে বুঝে নিলেন মার্টিনেজ। বারান্দাটা দু-দিকে ছড়িয়ে গিয়ে বাঁক নিয়েছে সামনের দিকে। ভিজিকমে এক বার ম্যাপটা দেখে নিলেন মার্টিনেজ। এই বারান্দাটা পুরো স্কুলের ফার্স্ট ফ্লোরকে ঘিরে রেখেছে। সামনের দিকে একের-পর-এক ক্লাসরুম। আর যেখানে বারান্দাটা সামনের দিকে বাঁক নিয়েছে, সেদিক দিয়ে দুটো সিঁড়ি নেমে গেছে নীচে। তার মানে পেছনের দরজার সামনের সিঁড়িটা ল্যান্ডিং ফ্লোরে এসে মিশেছে। ওইখান থেকে দুটো সিঁড়ি সামনের প্রধান দরজার দিকে গিয়ে মিশেছে। আর মাঝের সিঁড়িটা এসেছে পেছনের দিকে। ঠিক এগারো সেকেন্ড লাগল বাকি এগারো জন রেঞ্জার্সকে বুঝিয়ে দিতে কী করতে হবে। নো সাউন্ড, নো গানশট। সেপারেট দেম আউট অ্যান্ড নিউট্রালাইজ।

ছ-জন বাঁ-দিকের পথ নিল, বাকি ছয় জন ডান দিকের।

মার্টিনেজ প্রথম বাঁকের কাছে পৌঁছে একটু থামলেন। স্কুলের সামনের দিকে প্রচুর আলো আর আওয়াজ, এ তিনি জানতেনই কেন আর কীসের জন্যে। কীভাবে যেন তারই একটা টুকরো আলোর রেখা মার্টিনেজের সামনে এসে পড়েছে। আর সেই আলো-আঁধারির সিল্যুয়েটে একটা মানুষের অর্ধেক ছায়ার ভগ্নাংশ এখন মিশে আছে তঁার পায়ের কাছে। অর্থাৎ এই সরু বারান্দাপথে কেউ আছে পাহারারত। একটু নীচু হলেন মার্টিনেজ, তাঁর পেছনে দেওয়ালের দু-দিকে কুঁজো হয়ে পজিশন নিয়েছে বাকি পাঁচ জন রেঞ্জার্স, টানটান ছিলার মতন ভঙ্গি, যেকোনো মুহূর্তে উড়ে গিয়ে প্রলয়কাণ্ড বাঁধাবার জন্যে দৃঢ়চিত্ত। নীচু হয়ে ডান পায়ের হাঁটুর ভাঁজের কাছে যে পকেটটা আছে সেখান থেকে মুঠো করে কী একটা বার করে আনলেন। হাত খুললে দেখা গেল মুঠোর মধ্যে বড়ো সাইজের গুবরেপোকার মতন কী একটা। মার্টিনেজ তালুটা খুলে প্রসারিত করে ওটার তলায় আঙুল দিয়ে একটা সুইচ অন করে হাতটা সামান্য উঁচু করে ধরলেন। সেই যান্ত্রিক কালো ভ্রমরটির মাথার কাছে আট হাজার আর পি এম রেটে ঘুরতে থাকা পাখাটি চালু হতেই সেটি হাতের তালু থেকে উড্ডীন হতে থাকে। এর টেকনিক্যাল নাম সোয়ার্মবটস, রেঞ্জার্সরা ডাকে হাই-মেমস নামে।

সঙ্গেসঙ্গে সবচেয়ে কাছাকাছি উড়তে থাকা মার্কিন ড্রোনটির অপারেটিং কন্ট্রোলের কাছে একটি কোডেড মেসেজ আসে, এবং ল্যাংলেতে বসে থাকা অপারেটরটি ডাবল লেয়ারড আলফানিউমেরিক কোডটি পাসওয়ার্ড হিসেবে এন্টার করে, যেটি তার কাছে ল্যামেগো থেকে আগেই চলে এসেছিল। মার্টিনেজের কানে এল পি আই নেভিগেশন বেয়ে নেমে এল শীতল কনফার্মেশন, ‘ব্ল্যাকবার্ড আল্ফা টু, আন্ডার সেন্ট্রাল কমান্ড নাউ।’ এইবার শূন্যে স্থির হয়ে থাকা যন্ত্রভ্রমরটি ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে উড়ে প্যাসেজের একদম ওপরে গিয়ে শেষের দিকে তার যন্ত্রমুখ নির্দেশ করে স্থির হল। আর সঙ্গেসঙ্গে দ্রুত বাঁ-হাত সামনে এনে ভিজিকমটা অন করলেন মার্টিনেজ। মার্কিন ড্রোনটির ইনপুট ফ্রিকোয়েন্সিতে সেই যন্ত্রভ্রমরের যান্ত্রিক চোখ এবং তড়িতাহত নার্ভ থেকে একইসঙ্গে দুটি সিগন্যাল ভেসে আসে, ইনফ্রারেড ইরকন এবং থার্মাল ইমেজিং। শত সহস্র কিলোমিটার ওপরে ভেসে থাকা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের স্যামোস-এনলর-এফ নামের ইলেকট্রনিক রিকনিস্যান্স স্যাটেলাইটটি দুটো সিগন্যালকেই ডিজিটালি প্রসেস করে মুহূর্তের মধ্যে স্ট্রিমিং ভিডিয়োতে ভরে দেয় মার্টিনেজের হাতে ধরা ভিজিকমের স্ক্রিনটা।

দেখা গেল যে মাপা পদক্ষেপে, আফগানি পোশতু পোশাক পরা বিশাল একটি শরীর শ্বাপদের সতর্ক হিংস্রতায় আশেপাশে তাকাতে তাকাতে এদিকেই আসছে। হাতে কালান্তক কালাশনিকভ। কাঁধে আরও দুটি রাইফেল ঝুলছে, সারা শরীরে রয়েছে আরও বিভিন্ন অস্ত্রাদি, তার মধ্যে কিছু আধুনিক কিছু প্রাচীন। যেমন কোমরের বাঁ-দিক থেকে ঝুলছে পুলওয়ার, বিরাশি সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের আফগান তরবারি, যে আফগান নরঘাতক অস্ত্রটির দৌলতে ব্রিটিশ সিংহকে নাকানিচোবানি খাইয়ে দিয়েছিল এই তথাকথিত ‘অর্ধসভ্য’ পাহাড়ি পোশতু জনজাতি।

লোকটা প্রায় বাঁকের কাছে এসে পৌঁছেছে, মার্টিনেজ সামান্য পেছন ঘুরে দাঁতের ফাঁক দিয়ে একাক্ষরে ঠিক পেছনের রেঞ্জার্সটিকে কি যেন বললেন। সে ঠিক ক্রিকেট মাঠের উইকেটরক্ষকের ভঙ্গিতে দুটি হাতে দুটি হ্যান্ডগান নিয়ে উবু হয়ে বসল আর মার্টিনেজ এল পি আইয়ের নেভিগেশন সিস্টেমে হিসহিস করে উচ্চারণ করলেন শুধু একটি শব্দ, ‘ব্লেজ’। মুহূর্তের মধ্যে সেই যন্ত্রভ্রমরের কপালের কাছ থেকে নির্গত হল এক তীব্র অগ্নিদীপ্ত আলোকরেখা, সিধে গিয়ে পড়ল সেই আফগান মুজাহিদিনের দুই চোখে। যত চৌকস যুদ্ধবাজ লোকই হোক না কেন, হঠাৎ করে ওরকম তীব্র আলো চোখে এসে পড়লে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ারই কথা, আর সেই মুহূর্তটারই অপেক্ষায় ছিলেন মার্টিনেজ, ভাঁজ করা ডান পা-টা বাড়িয়ে সাইলেন্সার লাগানো হ্যান্ডগানটা তুলে ঠিক গলা বরাবর পরপর চারটে ফায়ার করেন। মার্ক তেইশ হচ্ছে হেকলার অ্যান্ড কোখের সবচেয়ে সেরা হ্যান্ডগান। তার তিরিশ মিলিমিটারের চার চারটে বুলেট গলা এফোঁড়ওফোঁড় করে দেওয়ার পরেও দাঁড়িয়ে থাকতে খুব কম লোককেই দেখা গেছে, বিশেষত যদি তার মধ্যে খান দুয়েক বুলেট ঘাড়ের দিকে প্রথম এবং দ্বিতীয় ভার্টিব্রার মধ্যের অংশটা ভেঙে দেয়। চোখে প্রচুর অবিশ্বাস আর মৃত্যুর আতঙ্ক নিয়ে বিশাল দেহটা মেঝের ওপর নেমে আসার আগেই মার্টিনেজ দু-হাত বাড়িয়ে তার পতন রোধ করলেন। তারপর মৃতদেহটি এদিকে সরিয়ে এনে এল পি আই-তে মেসেজ দিলেন মার্টিনেজ, ‘ফিফটি থ্রি আলফা হ্যাশ। ওয়ান টার্গেট লিক্যুইডেটেড।’ কয়েক সেকেন্ড বাদে সবার কানেই ভেসে আসে আরেকটা কন্ঠস্বর, সেকেন্ড ছয় জনের দলের টিমলিড আদ্রিয়ানো জবাব দেয়, ‘ট্যুয়েন্টি ট্যু ডেল্টা হ্যাশ, অ্যানাদার হিয়ার।’ দুটি শয়তান নিকেশ। যন্ত্রভ্রমর উড়ে গেল সামনের দিকে। স্ক্রিনে ট্যাপ করে ভিজিকম অন করলেন মার্টিনেজ। আস্তে আস্তে সামনের দিকের ছবিটা পরিষ্কার হয়ে আসে। দূর থেকে জ্বালিয়ে রাখা বিশাল সার্চলাইটের আলোতে স্কুলের সামনেটা আলো হয়ে আছে। সামনের বারান্দায় দাঁড়ানো দুই আফগান, স্থির এবং অকম্পিত। তাদের হাতে একটা করে কালাশনিকভ, কাঁধেও তাই আর কোমরে ঝুলছে পুলাওয়ার। এরাও খুব ভালো করেই জানে যে লড়াইয়ের সময় এইভাবে বীরের মতো বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা নির্বুদ্ধিতার চূড়ান্ত, এ প্রায় মৃত্যুকে সাদরে ডেকে নিয়ে আসার সমান। যে কোনো দক্ষ স্নাইপার এদের পেড়ে ফেলতে মিনিটখানেকের বেশি সময় নেবে না। কিন্তু ওরাও জানে যে এই মুহূর্তে ওদের দিকে বুলেট দূরে থাকুক, একটা ঢিল ছোঁড়ার সাহসও কারও নেই।

ওদের হাতেই এখন প্রায় এক-শো জন শিশুদের টুঁটি!

আস্তে আস্তে, নিঃশব্দ ঘাতকের মতোই সেই কালো যন্ত্রভ্রমর উড়ে গেল সামনের বারান্দার দিকে, এদিক থেকে ওদিকে। ভিজিকমে নজর বুলিয়ে নিলেন মার্টিনেজ। স্কুলের সমস্ত ক্লাসরুমের মুখ সামনের দিকে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে চারটে ক্লাসরুম, ওপরেও তাই। তার সামনে বারান্দা, যে বারান্দা সারা স্কুলকে ঘিরে রেখেছে বলয়ের মতন। পেছনের দিকটাই অরক্ষিত রেখেছে জঙ্গিরা, ওই খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠে কেউ যে স্কুলের দোতলার বারান্দা অবধি উঠে আসতে পারে, একথা স্বপ্নেরও অগোচর ছিল তাদের। একমাত্র এয়ার ড্রপ ছাড়া উপায় নেই, আর সশব্দ হেলিকপ্টারের আওয়াজ কানে আসা মাত্র এক-একটি শিশু জবাই হবে, এ কথাটা খুব স্পষ্ট করেই বলে দেওয়া হয়েছে তাদের পক্ষ থেকে। সেই ক্ষুদ্র গুবরেপোকার আকারের যন্ত্রটি এপার থেকে ওপারে এক বার পাড়ি দেওয়ার সঙ্গেসঙ্গে পুরো দৃশ্যটা বুঝতে পারলেন কর্নেল মার্টিনেজ ভাজ। মাঝের দুটি ক্লাসরুমের মাঝখান থেকে একটি সিঁড়ি নেমে গেছে নীচের দিকে। স্কুলের সমস্ত শিশুদের ওই মাঝের দুটি রুমেই পণবন্দি বানানো হয়েছে। দুটি রুমেই দু-জন করে লিডার গোছের লোক, তাদের ওপরেই যে অপারেশনের ভার, বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাদের মধ্যে এক জনের সামনে অত্যাধুনিক স্যাটেলাইট ফোন। আফগান সরকারের সঙ্গে যাবতীয় দরাদরি সেই-ই করছে। সবার পরনে একটি বিশেষ ধরণের পোশাক, এবং তাই দেখেই মার্টিনেজের মনে হল যে এর পেছনে আফগানিস্তানের একটি প্রতিবেশী দেশের ভূমিকা থাকা আশ্চর্যের কিছু না।

আফগানিস্তান প্রাচীন কাল থেকেই তাজিক, পাশতুন, ওয়াজিরি, হাজারা, উজবেগ ইত্যাদি বেশ কিছু মধ্য এশীয় জনজাতির মিশ্রণস্থল। এদের মধ্যে গোষ্ঠীচেতনা এতই প্রবল যে একমাত্র ধর্ম বাদ দিয়ে যে-যার দেশীয় সংস্কৃতি কঠোরভাবে মেনে চলে, একে যথাসাধ্য অন্যের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলে। যে পোশাক সাধারণ আফগানি পুরুষ সচরাচর পরে তাকে বলে সালোয়ার-কামিজ, কিন্তু তারও রকমফের আছে। সাধারণ আফগানি পুরুষ যে সালোয়ার-কামিজ পরে তাকে বলে খেট পার্তুগ। ওপরের অংশকে বলে খেট, নীচেরটাকে বলে পার্তুগ। পাশতুনরা পরে পেরহান আর পাগড়ি। কিন্তু এরা যেটা পরে আছে সেটা উত্তর আফগানিস্তান আর উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের এক অত্যন্ত ক্ষুদ্র জনজাতির পোশাক। এই জনজাতিটির উৎস প্রাচীনতম হিন্দু ধর্ম থেকে, এদের অধিকাংশ ধর্মীয় বিশ্বাস এখনও প্রোটো ইন্দো ইরানীয় ধর্মানুযায়ী যার পরের অংশ হচ্ছে বৈদিক হিন্দু ধর্ম। ধবধবে ফর্সা আর নীল চোখের মালিক এরা, অনেকের ধারণা এরাই আদিতম এরিয়ান বা আর্য। এদের গোষ্ঠীগত ধর্মকৃত্য দেখলে এরাই যে আদিতম হিন্দু সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না এদের ওপরে ষাট ও সত্তরের দশকে ইসলামিক জঙ্গিরা রাষ্ট্রীয় মদতে অকথ্য সন্ত্রাস চালিয়েছে, এমনকী এদের বাসস্থানকে কাফিরিস্থান বলত পাকিস্তানের ধর্মান্ধ জনগণ। উগ্র ইসলামিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে এই বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে সদ্য এরা মুসলিম হয়েছে। তারপর যা হয়, নিজেকে সাচ্চা মুসলমান প্রমাণ করার তাগিদে, অত্যধিক ইমানি যোশে, এই কাণ্ড ঘটাতে নেমে পড়েছে তাদেরই একাংশ। হয়তো সেই ‘কাফিরিস্তান’-এর অপবাদ ঘোচাতেই ইসলামিক সন্ত্রাস কায়েম করার জন্যে এদের এই অত্যুৎসাহ। সাধারণত উত্তর পাকিস্তানের খায়বার-পাশতুন এলাকার চিত্রাল অঞ্চলেই এরা থাকে, এদের এলাকার শতাব্দীপ্রাচীন আরেকটি নাম আছে, নুরিস্তান! আপাতত এরাই উত্তর আফগানিস্তান আর উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানে সন্ত্রাসের উগ্রতম মুখ হিসেবে উঠে আসছে। যে পোশাক এরা পরে আছে, তাকে স্থানীয় ভাষায় বলে শোউক বা চোগা। এর থেকেই প্রমাণিত যে এই সন্ত্রাসের পেছনে পাকিস্তানের মদত থাকতে বাধ্য।

আর এই জনজাতির নাম হল কলাশ।

১৫৬০। অগাস্ট। গোয়া

অতি কষ্টে চোখ খুলেই আবার বন্ধ করে ফেললেন ত্রিলোচন। সমস্ত শরীরে তীব্র বিষের যন্ত্রণা। চোখটা খুলতে গিয়েই বুঝেছেন যে বাঁ-দিকের চোখটা বিশ্রীভাবে ফুলে আছে। ঘাড়ের কাছটা টাটিয়ে আছে, বোধ হয় পেছন থেকে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে কেউ মেরেছিল। তবে সব কিছু ছাপিয়ে যেটা অসহনীয় হয়ে উঠছে সেটা হচ্ছে তেষ্টা, অসম্ভব তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে ত্রিলোচনের। প্রচণ্ড মেরেছে ওরা। বিঘ্ননাশ বেঁচে থাকলে যে অসহনীয় অত্যাচার নেমে আসত তার ওপর, বিঘ্ননাশকে না পেয়ে তারই কিছুটা ত্রিলোচনের ওপর দিয়েই গেছে কাল রাত থেকে। সারা গা যেন ব্যথার বিষে অসাড় হয়ে আছে। কানের পাশ থেকে গলা অবধি একটা ক্ষীণ তরলের ধারা শুকিয়ে এসেছে। ত্রিলোচন জানেন যে ওটা রক্ত। সারা গায়ে দগদগে কালশিটে, না দেখেই বুঝতে পারছেন ত্রিলোচন। চাবুক দিয়ে ওরা নির্মমভাবে পিটিয়েছে, গায়ে থুতু দিয়েছে, অশ্লীলতম কুবাক্য উচ্চারণ করেছে ওঁর পরিবারের মহিলাদের নিয়ে। লজ্জায়, ভয়ে, আতঙ্কে, ঘৃণায় সিঁটিয়ে গেছিলেন ত্রিলোচন, শরীরের ওপর দিয়ে যে ঝড়টা বয়ে যাচ্ছে, তার থেকেও বেশি অভিভূত করে ফেলেছিল অপমানটা। গায়ে হাত তোলা দূরের কথা, আজ অবধি বেতালসিদ্ধ শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণীর সামনে কেউ মাথা তুলে কথা অবধি বলত না, এতটাই সম্মানের অধিকারী ছিলেন তিনি। আর আজ! হা ঈশ্বর, গতজন্মের কোন পাপে আজ শাস্তি পেতে হচ্ছে তাঁকে?

তবে যেটা একবারে দিশেহারা করে দিয়েছিল ত্রিলোচনকে সেটা হচ্ছে মহাশক্তিখণ্ডটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়া। তাঁর কোমরের গেঁজেতে হাত দিয়ে খুব সহজেই ওটা হাতে পেয়ে যায় সৈন্যরা, আর ওই সময়েই, একমাত্র ওই সময়েই তীব্র রোষে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন তিনি, বলেছিলেন, ‘আরে মূর্খের দল, হাত দিস না, একদম হাত দিস না ওতে, সর্বনাশ হবে যদি ওই মহাবস্তু অপবিত্র করেছিস তো, নিজের ভালো চাস তো…’ আর বলতে পারেননি তিনি, একটা থাপ্পড় আছড়ে পরেছিল তাঁর গালে। আর তারপরেই নেমে এল হিংস্র আক্রমণ। যেন ক্ষুধার্ত নেকড়ের দল ঝাঁপিয়ে পড়ল অসহায় মানুষটির ওপর। চড়, থাপ্পড়, লাথির পর শুরু হল চাবুক আর লাঠি দিয়ে পেটানো, লোকে বোধ হয় নিরীহ জন্তুকেও এমন প্রহার করে না। তারই মধ্যে কে একজন পেছন থেকে এসে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে মাথার পেছনে সজোরে আঘাত করতেই জ্ঞান হারান ত্রিলোচন।

আহ, বড়ো কষ্ট গায়ে। একটু নড়তে গিয়ে কঁকিয়ে উঠলেন তিনি, আর তখনই খেয়াল করলেন যে তিনি নড়তে পারছেন না, একটা খুঁটির সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে তাঁকে। মাথাটা কাজ করছিল না ওঁর, তবুও বহুকষ্টে চোখ তুলে চাইলেন, আর মূক অপমানে আর বিস্ময়ে যেন পাথর হয়ে গেলেন। একটা গোরুর গাড়িতে বসে আছেন উনি, গাড়ির মাঝখানে একটি দণ্ড দৃঢ়ভাবে পাটাতনের মধ্যে প্রোথিত। আর তার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে ওঁকে। ধীরে ধীরে যে গ্রামপথ দিয়ে, যেসব সহস্র স্তব্ধ চোখের সামনে দিয়ে ওঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এই পথ, সেই গ্রাম, সেইসব স্তব্ধবাক চোখ, এ সবই উনি আশৈশব চেনেন, বড়ো নিবিড় ভাবে চেনেন।

আমোনা, ওঁর ছেলেবেলার খেলার মাঠ, যৌবনের প্রেম, প্রৌঢ়ত্বের সাধনভূমি, বড়ো প্রেমের আমোনা গ্রামেই আনা হয়েছে ওঁকে। যে গ্রামে উনি সম্মানের সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করতেন, যেখানে ব্রাহ্মণরাও তাঁর রৌদ্রলাঞ্ছিত ছায়ায় শ্রদ্ধায় পা ফেলতেন না, যেখানে গ্রামের পশুরাও তাঁকে দেখে ভালোবেসে মাথা নীচু করে গা ঘষতে এগিয়ে আসত, সেই আমোনা গ্রামেই তাঁকে আজ সাধারণ চোর ডাকাতের মতন বেঁধে আনা হয়েছে, বেঁধে আনা হয়েছে যেভাবে বনের পশুকে সর্বসমক্ষে পিটিয়ে মারার জন্যে আনা হয়। অর্ধনগ্ন, রক্তাক্ত, সর্বাঙ্গ ধূলিধূসরিত এই ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণীকে দেখতে হবে, একথা বোধ হয় আমোনা গ্রাম নিজেও স্বপ্নে ভাবেনি।

কিন্তু আজ তা সত্যি, বড়ো উগ্র, নগ্ন, জান্তব সত্যি! সারা আমোনা গ্রামের লোক আজ বিস্ফারিত চোখে দেখছে যে মানুষটিকে তারা শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় প্রায় দেবতার সম্মান দিয়েছিল, আজ তাকে এই যবন পাপমূর্তিরা প্রায় উলঙ্গ করে বেঁধে নিয়ে আসছে, যেভাবে কার্তিকের কৃষ্ণাচতুর্দশীতে আমোনার বেতালমূর্তির সামনে বলির জন্যে টেনে নিয়ে আসা হয় অনিচ্ছুক মোষ ও পাঁঠাদের! আজ সমস্ত আমোনা গ্রাম চোখে অনেক কান্না জমিয়ে, অনেকটা ভয় আর আতঙ্ক বুকে নিয়ে, এই যবন শাসকদের আদেশে সাক্ষী হতে এসেছে এক মহা ক্রূর কর্মের।

রাস্তায় যেতে যেতেই এক বার যেন গাড়িটা কার আদেশে থেমে দাঁড়াল, বহুকষ্টে চোখ খুললেন ত্রিলোচন। আর সেই চোখ বন্ধ হল না তাঁর, বুকের মধ্যে সহস্র কাঁটা ফোটার যন্ত্রণা নিয়ে তিনি দেখতেই থাকলেন! তাঁর বাড়ি, তাঁর আশৈশবের বাড়ির সামনে থামতে বলা হয়েছে সেই গো-শকটটিকে। বাড়ি বলে বোধ হয় ভুল বলা হল, বাড়ি বলে যাকে চিনতেন, গাড়ি থামানো হয়েছে সেই ধ্বংসস্তূপটির সামনে। চারিদিকে শুধু আসান গাছের মধ্যে বয়ে যাওয়া হাওয়ার শব্দ, গোরুর গলায় বাঁধা ঘন্টির টুং টুং আওয়াজ আর কোনো কোনো মেয়েলি ফুঁপিয়ে ওঠা, এ ছাড়া এই বিশ্বচরাচরে যেন আর কোনো শব্দ নেই। রক্তক্ষরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণী, তাকিয়েই থাকলেন। তাঁর সেই বড়ো সাধের, বড়ো ভালোবাসার বাড়িটি আজ জ্বলে পুড়ে ছাই। শুধুমাত্র বেড়াটা আর ইতিউতি পড়ে থাকা বড়ো চেনা কিছু আধপোড়া গৃহস্থালীর সামগ্রী ছড়িয়ে আছে। যে বারান্দায় শিশু বয়েসে গাছের ছায়ার নাচন দেখে খিলখিলিয়ে হেসেছেন ত্রিলোচন, তার চিহ্নমাত্র নেই। যে শয্যাগারে নববধূর মুখচুম্বন করে জীবন ধন্য করেছিলেন তিনি, আজ সেই ঘর পোড়া বিধবার মতন দগদগে জ্বলনক্ষত নিয়ে পড়ে আছে। চারিপাশের সেই বাগান, যা তাঁর বাবা সযত্নে তৈরি করেছিলেন, আজ সেখানেই শ্মশানের পোড়া অভিশাপের স্তব্ধতা!

শুধু স্তব্ধতা? শুধুই এই বোধের অতীত জাগতিক স্তব্ধতা? নাকি আরও কিছু নারকীয়তা মিশে ছিল সেই ক্ষণিকের সর্বনাশা দৃশ্যটির মধ্যে?

বোবা চোখ নিয়ে ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণী দেখলেন যে সেই পোড়া ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে দু-দিকে দুটি মোটা দণ্ড প্রোথিত, প্রতিটি দণ্ড আসান গাছের গুঁড়ি কেটে তৈরি। আর সেই দুটি গুঁড়িতে সম্পূর্ণভাবে বাঁধা অবস্থায় লটকে আছে দুটি পোড়া মানব শরীর। তাদের প্রায় বুক অবধি পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া কাঠের স্তূপ।

জীবন্ত দাহ করা হয়েছে ওঁদের!!

কেউ বলে না দিলেও ত্রিলোচনের অস্তিত্বের প্রতিটি কণা বলে দিচ্ছিল এই দুটি পোড়া শরীর কার!

ওঁর মা আর বাবার!

অজ্ঞানই হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি, মনে হচ্ছিল যেন তাঁর হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে এসে বোবা কান্নায় আটকে আছে, মনে হচ্ছিল যেন তাঁর মস্তিষ্ক শতসহস্র টুকরোয় ভেঙে ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে কোনো কালো নিয়তির দিকে। তবে এর পরেও যেন এক দৈব ইশারায় তাঁর সেই ঘোলাটে দৃষ্টি চারিয়ে যায় আরও সামনের দিকে।

তাঁর বাড়ির থেকে কয়েক-শো গজ দূরেই সেই বেতালমন্দির। আজ সেই রাস্তার দু-ধারে কালো কালো ছায়া। না ছায়া নয়, চোখটা এক বার বুজেই খুললেন ত্রিলোচন, আমোনা আর আশেপাশের সমস্ত গ্রাম ঝেঁটিয়ে আনা হয়েছে যেন এক নিষ্ঠুর তামাশার সাক্ষী হতে। আর কিছু দূরে দূরে সেই মোটা আসান গাছের গুঁড়ি পোঁতা আছে কম করে ছয় থেকে সাতটি। আর প্রতিটির সঙ্গে লটকে আছে একটি করে হতভাগ্যের পোড়া মৃতদেহ! কারা ওরা? তাঁর নিয়তি আর কোন কোন হতভাগ্যের জীবনে নামিয়ে এনেছে কালরাত্রি? কার একটা চাপা গলার আদেশ শোনা গেল, টুংটাং আওয়াজ করতে করতে এগিয়ে চললো গোরুর গাড়িটি। তার সঙ্গে মিশেছে সেই গাড়ির চাকার ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ, আর জনতা ক্রমে বধির বিস্ময়ে সরে গিয়ে পথ করে দিচ্ছে সামনে, আর সেই নারকীয় দৃশ্য ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ত্রিলোচনের চোখের সামনে।

বাঁ-দিকে এটা কার শরীর? কে ও? যদিও খুব দ্রুতই উত্তর পেয়ে গেলেন তিনি। পুড়ে কাঠ হয়ে যাওয়া শরীরের নীচে বোবা দৃষ্টি নিয়ে বসে আছে এক উন্মাদিনী, তাকে দেখামাত্র বুঝলেন ত্রিলোচন, এ পুড়ে যাওয়া শরীর কার!

বিরোচন তাম্বে। তাঁর একনিষ্ঠ সেবকদের মধ্যে একজন।

পরের কাষ্ঠদণ্ডটি, চিনতে কষ্ট হল না তাঁর, এই চত্ত্বরে ওই পাহাড়ের মতন বিশাল শরীর আর একজনেরই হতে পারে, প্রভঞ্জন মহাজন! দুর্ধর্ষ এই মারাঠি বীর ফৌজে ইস্তফা দিয়ে এসে চাষাবাদে মন দিয়েছিল, আর ত্রিলোচন গ্রামান্তরে গেলে এই হত তাঁর দেহরক্ষী। একবার এক বন্য নেকড়েকে স্রেফ লেজ ধরে আছড়ে আছড়ে আর গলা টিপে মেরেছিল প্রভঞ্জন। তাকে এরা ধরতে পারল কী করে?

মৃতদেহটা কাছে আসতেই বুঝতে পারলেন তিনি, ওই পোড়া বিশাল শরীরে অজস্র গভীর ক্ষত। মানে অনেকে ঘিরে ধরে বল্লম বা তলোয়ার দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে প্রভঞ্জনকে। এই প্রথম দুঃখ হল ত্রিলোচনের, এই প্রথম কোনো কষ্ট অনুভব করলেন তিনি। গলার কাছটা একদলা ব্যাথায় মুচড়ে উঠল তাঁর। শুধুমাত্র তাঁর জন্যে না জানি আর কত নিরপরাধের ঘর আজ শ্মশান হয়ে গেছে, কত অভাগীর সুখের সংসার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে এই নিষ্ঠুর যবনের অত্যাচারে। ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল তাঁর তিরতির করে। এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তে চাইল বসে যাওয়া চোখের কোটর থেকে।

আর ঠিক তখুনি পিছনে গাড়ির ওপরে উঠে এল তিন জন এদেশীয় সেপাই। পাটাতনের মধ্যে যে মোটা খুঁটিটার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল ত্রিলোচনকে, তার আশেপাশে গাদাগাদা শুকনো কাঠ এনে জড়ো করতে লাগল। শেষ হলে এইবার তিন জনে মিলে তাঁর বাহুমূল ধরে হ্যাঁচকা টানে তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সেই মোটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিল, লোহার বেড়ি দিয়ে। এর মানে বুঝতে বেশি কষ্ট হল না ত্রিলোচনের, যেসব হতভাগ্যের পোড়া লাশ এখনও বিভিন্ন শ্মশানকাষ্ঠে ঝুলছে তাদেরই পরিণতি পেতে চলেছেন তিনি।

তারপর গাড়িটা এগিয়ে চলল বেতালমন্দিরের দিকে।

চোখটা এক বার বুজলেন তিনি। ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করতে লাগলেন বিড়বিড় করে, প্রভুম প্রাণনাথম বিভুম বিশ্বনাথম জগন্নাথ নাথম সদানন্দ ভাজম, ভবদ্ভব্য ভূতেশ্বরম ভূতনাথম… আচ্ছা খুব কি ব্যথা লাগবে পোড়ার সময়? চামড়াগুলো কি গলে গলে পড়ে যাবে? নিজেকে দু-চোখ মেলে দেখতে হবে জ্বলছে নিজের ত্বক, মাংস আর হাড়? নাকি তার আগেই মরে যাবেন উনি? কত তাড়াতাড়ি মরে যেতে পারে একটা মানুষ? যতই ভাবতে লাগলেন ততই যেন মনে হতে লাগল যে সারা দেহে মনে আর কোনো সাড় নেই।

তবুও একটা চিনচিনে স্বস্তির ভাব বুকের মধ্যে খেলা করে যাচ্ছিল তাঁর। যাক, ছেলেটা আর বউটা অন্তত রয়ে গেল, ওরা বেঁচে থাকুক লুকিয়ে। কোথাও যেন একটা স্বস্তির শ্বাস তাঁর উগ্রতপ্ত স্নায়ুগুলোকে সামান্য শান্তি দিল। আর একইসঙ্গে একটা কান্নার দলা যেন পাকিয়ে উঠতে লাগল ত্রিলোচনের গলার কাছটায়। এই ছেলে ত্রিলোচনের প্রাণ, বুকের পাঁজর, সাত রাজার ধন এক মাণিক। বুড়ো বয়সের ছেলে, বেশিক্ষণ তাকে না দেখে থাকতে পারেন না ত্রিলোচন। আর আজ চলে যাওয়ার আগে তাকে একটি বারের মতন দেখতে পাবেন না? বন্ধ চোখ থেকে হু হু করে জল পড়তে লাগল ত্রিলোচনের। আর ঠিক সেইসময়েই গাড়িটা থেমে যায় এবং একটি ভারী কন্ঠ বলে ওঠে, ‘কী রে শয়তান হিন্দু, কোথায় পালাচ্ছিলি এটা নিয়ে?’ চমকে চোখ খোলেন ত্রিলোচন। দেখেন যে মন্দিরের প্রায় সামনে এসে গেছে তাঁর গাড়ি। সঙ্গেসঙ্গে গোরুটাকে খুলে নিয়ে যায় কেউ। বাকি দেশীয় সেপাইরা আরও গাদা গাদা চেরাই করে রাখা কাঠ এনে দ্রুত গাড়ির মধ্যে ফেলতে থাকে, যাতে সেই স্তূপের উচ্চতা ত্রিলোচনের বুকের সমান উচ্চতায় পৌঁছয়। যদিও এত কিছু খেয়াল করেন না ত্রিলোচন, স্থির চোখে তাকিয়ে থাকেন সামনে।

২০১৬। জুলাই। আফগানিস্তান

গুঁড়ি মেরে মেরে পুরো বারান্দটা পেরিয়ে এলেন মার্টিনেজ, পেছন পেছন বাকি পাঁচ জন। স্পেশাল রাবারাইজড জুতোর সোল, হিংস্র শ্বাপদের থাবার মতোই নিঃশব্দ সে। মোড়টার কাছে এসে কঠিন নৈঃশব্দে বসল সবাই। হাতের ভিজিকমে পরিস্থিতিটা এক বার দেখে নিলেন মার্টিনেজ। সেই দু-জন প্রহরী এখনও কালাশনিকভ হাতে স্থির দাঁড়িয়ে। স্কুল বিল্ডিঙের সামনেটায় অর্ধবৃত্তাকারে কর্ডন করে রাখা হয়েছে বিশাল এলাকা। সেখানে পুলিশ ও মিলিটারি জিপ, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা, দেশি বিদেশি টিভি চ্যানেলের ওবি ভ্যান, বেসামাল জনতায় জায়গাটা লোকারণ্য হয়ে আছে। থেকে থেকে মাইকে পোশতু ভাষায় আবেদন ভেসে আসছে স্থানীয় জিরগার বৃদ্ধ ধর্মীয় নেতাদের। কিন্তু তাতে কেউ কান দিলে তো। তবে যেটা কানে সবার আগে ভেসে আসছে, সেটা হচ্ছে মাঝেমধ্যেই শিশুদের ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠার আওয়াজ আর তার প্রত্যুত্তরে ভারী গলার ধমক। আর দলের পাণ্ডাটির আফগান সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালাবার অতি উচ্চকিত উগ্রকণ্ঠটি।

এমন সময় কানের কাছে নেভিগেশনে আদ্রিয়ানোর গলা ভেসে আসে ‘টোয়েনটি টু ডেল্টা হ্যাশ, অ্যাট দ্য ফ্রন্ট বেন্ড।’ হিসহিস করেন মার্টিনেজ, ‘ফিফটি থ্রি আল্ফা হ্যাশ, পুল আউট হেল অ্যাভেঞ্জার, নিউট্রালাইজ নিয়ারেস্ট টার্গেট বাই নেক্সট থার্টি সেকেন্ডস।’

এই বলে পিঠের ব্যাগ থেকে একটা অদ্ভুত দর্শন যন্ত্রবন্দুক বার করলেন মার্টিনেজ। সাধারণ বন্দুকের তুলনায় এটি অনেকটা লম্বা, আর গোড়ার দিকটা, অর্থাৎ যাকে বাটস্টক বলে, সেটা এতটাই চওড়া যে মার্টিনেজের কাঁধ থেকে পেট অবধি কভার করে, দেখে মারণাস্ত্র কম, অত্যাধুনিক গিটার মনে হয় বেশি! প্রায় দশ কিলো ওজনের এই অত্যাধুনিক বন্দুকটি মার্কিন মিলিটারির সর্বশেষ সংযোজন, এবং মার্কিন সহযোগী দেশগুলির সর্বোচ্চ স্তরের কমান্ডো ফোর্সকেই এগুলো দেওয়া হয়েছে পরীক্ষানিরীক্ষার জন্যে। এভাবেই খান দশেক এসেছে পর্তুগালে। এসব এখনও নিয়মিত নিয়োগের জন্যে সার্টিফিকেট পায়নি। মার্টিনেজই ভালোবেসে এর নাম দিয়েছেন হেল অ্যাভেঞ্জার! বেশ কয়েক বছর আগে অ্যামোস গোলান নামের এক ইজরায়েলি কমান্ডার তৈরি করেন এক অদ্ভুতদর্শন বন্দুক, নাম কর্ণারশট। এই বন্দুকের মাঝামাঝি থেকে বাকি অংশটা অনুভূমিকভাবে নব্বই ডিগ্রি ডান দিকে বা বাঁ-দিকে বাঁকানো যায়। বন্দুকের ট্রিগার যেখানে থাকে তার ওপরেই, অর্থাৎ যাকে অপটিক মাউন্ট বলে, সেখানে রাখা থাকে ছোট্ট ভিডিয়ো ইউনিট। এতে আপনি কোনো দেওয়ালের এক কোণায় দাঁড়িয়েও বন্দুকের মাথাটা নব্বই ডিগ্রি কোণে বাঁকিয়ে দেওয়ালের অন্যদিকে থাকা শত্রুকে নিকেশ করতে পারেন, ঝুঁকি নিয়ে শত্রুর সামনাসামনি হওয়ার দরকারই নেই! এই আইডিয়ার সঙ্গেই মার্কিন মিলিটারির গবেষণা বিভাগ যোগ করে আরও এক মারাত্মক মারণক্ষমতা। মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ! মাইক্রোওয়েভ বন্দুক বা ম্যাগনেট্রন, যা কিনা বন্দুকের বদলে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মারাত্মক ইলেক্টোম্যাগনেটিক ওয়েভ নিক্ষেপ করে শত্রুদের উদ্দেশ্যে, তার তুল্য নিঃশব্দতম ঘাতক আজ অবধি আবিষ্কার হয়নি মারণাস্ত্রের ইতিহাসে। চার্জ করার সঙ্গেসঙ্গে প্রথমেই টার্গেট অনুভব করে সারা শরীরে হাজার ডিগ্রির জ্বলনযন্ত্রনা। আর তারপরেই সেই কয়েক-শো কিলোওয়াটের বিকিরণ আঘাত করে টার্গেটের মস্তিষ্কে, টার্গেট বুঝতেই পারে না কোথা থেকে কে তাকে আক্রমণ করল। বিনা প্রতিরোধে, বিনা শব্দে সে ঢলে পড়ে জ্ঞানহীনতার কোলে। তৎক্ষণাৎ মরে না যদিও, তার জন্যে সিক্রেট সার্ভিসের ঘাতকবাহিনি সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর যাবতীয় উপকরণ নিয়ে প্রস্তুত থাকে ইন্টারোগেশন চেম্বারে!

এই ম্যাগনেট্রন প্রযুক্তি জোড়া হয়েছে কর্ণারশটের সঙ্গে। কোণা থেকে অদৃশ্য হয়ে বিন্দুমাত্র আওয়াজ না করে শত্রুনিপাত করতে এর তুলনা নেই। সিক্রেট আর্মস সার্কেলে এর সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম হচ্ছে প্লাজমা ফায়ারফোর্স! তৈরি হয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সেই হেল অ্যাভেঞ্জারের সামনের ফ্রন্ট সাইটটা নব্বই ডিগ্রি বাঁকিয়ে মাজলটা নিঃসাড়ে দেওয়ালের ওদিকে ঘুরিয়ে দিলেন মার্টিনেজ। তারপর এল পি আই নেভিগেশনে ফিসফিস করে বললেন, ‘ফিফটি থ্রি আল্ফা হ্যাশ, ডেথ বিউটি ইন অ্যাকশন।’ ওধার থেকে জবাব ভেসে এল, ‘টোয়েনটি টু ডেল্টা হ্যাশ, অ্যায় অ্যায় ক্যাপ্টেন।’

আঙুল দিয়ে ভিজিকমের রেজোলিউশন আরও বাড়ালেন মার্টিনেজ। সেই দুই প্রহরী একই ভাবে স্থির। ভেতরের দুটো ঘর থেকে উত্তেজিত চেঁচামেচি ভেসে আসছে পোশতু ভাষায়, বোঝা যাচ্ছে দরকষাকষির খুবই উত্তেজক পর্ব চলছে। যন্ত্রভ্রমরে দেখা যাচ্ছে যে প্রতিটি শিশুর মুখে অব্যক্ত আতঙ্কের ছাপ। প্রত্যেকে বেঞ্চে তারা বসে আছে যেন মোমের নির্বাক পুতুল বসিয়ে রাখা আছে সারিসারি। মার্টিনেজের দিকের ক্লাসরুমেই দলের পাণ্ডাটি বসে। সে পায়চারি করছে ক্রমাগত আর স্যাটেলাইট ফোন কানে নিয়ে চেঁচিয়ে আফগান কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে যাচ্ছে যে আল্লাহর নামে, ইসলামের নামে, পবিত্র জিহাদের নামে শিশু জবাই করা কতটা শরিয়তসসম্মত, বিশেষত যাদের যৌনকেশ সদ্য উদ্গত হয়েছে!

ঠিক এইসময়ে সামনের বেঞ্চের এক বছর দশেকের শিশু আর সহ্য করতে না পেরে কেঁদে উঠল হাউহাউ করে, কান্না জড়িত গলায় তার দাবি, সে তার মায়ের কাছে যাবে! তৎক্ষণাৎ সেই বিশালদেহী পাণ্ডাটি সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিল শিশুটির গালে। হতভম্ভ ছেলেটির মাথা পাশে সামান্য নীচু হয়েই সোজা হল আবার, চোখে আহত অপমানের দৃষ্টি নিয়ে সেই অবোধ শিশুটির ঠোঁট ফুলে উঠল অভিমানে, আর সেই ঠোঁটের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এল শিশুটির নিষ্পাপ রক্ত!

আর সহ্য হল না মার্টিনেজের, নেভিগেশনে আদেশ দিলেন, ‘ফায়ার’। সঙ্গেসঙ্গে তাঁর হেল অ্যাভেঞ্জারের সামনের বাঁকানো নব্বই ডিগ্রি অংশটি সচল হয়ে ওঠায় কয়েক-শো কিলোওয়াটের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ ধেয়ে গেল বারান্দায় পাহারা দেওয়া দুই বীরপুরুষের দিকে। দু-জনে প্রথমে বুঝতেই পারল না কোথা থেকে কোন সর্বনাশা মৃত্যু এসে তাদের আঘাত করল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তাদের শরীরের চামড়া আগুন ছাড়াই জ্বলে উঠল প্রায় হাজার ডিগ্রির কাছাকাছি তাপমাত্রায়, সেই হতভম্ভ ভাব কাটাবার আগেই তাদের মস্তিষ্কে এসে আঘাত করল ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক চৈতন্যহীনতার আবেশ। দু-জনেই কোমরসমান উঁচু পাঁচিলের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল, জ্ঞান হারাতেই দু-জনেই পাঁচিল টপকে ঝরে পড়ল নীচে, নীচ থেকে শোনা গেল ধুপ ধুপ করে দুটি আওয়াজ।

এইবার দলের পাণ্ডা আর অন্য ক্লাসরুমে পাহারা দেওয়া তার শাগরেদের নজর এল এদিকে। চাপা গলায় আগে তারা সঙ্গীদের নাম ধরে স্যাটেলাইট নেভিগেশনে ডাকাডাকি করল খানিকক্ষণ। তারপর তাদের সাড়া না পেয়ে ব্যর্থতার আক্রোশে দু-জনেই আগে কালাশনিকভ বার করে বাইরের দিকে এলোপাথাড়ি বন্দুক চালিয়ে দিল পাঁচমিনিটের জন্যে। স্কুলের সামনে জড়ো হওয়া জনগণ সঙ্গেসঙ্গে আশ্রয় নিল মিলিটারি ব্যারিকেডের পেছনে।

তারপর কিছুক্ষণের ভয়ার্ত নৈঃশব্দ! এইবার দু-জনে নীচু হয়ে গুঁড়ি মেরে বাইরে আসে, দু-জনেরই হাতে দুই শিশুর ভয়ার্ত শরীর, তাদের গলায় ধরা ছুরি! টেনশনের ছাপ সেই দুই মূর্তিমান শয়তানের সর্বাঙ্গে।

বাঁকা হাসলেন মার্টিনেজ, এতই যাদের মৃত্যুভয়, তারা নাকি শাহাদত বরণ করে স্বর্গে যাওয়ার জন্যে এতই উতলা। নেভিগেশনে ধীরে আদেশ দিলেন তিনি, ‘ফিফটি থ্রি আলফা হ্যাশ, কম্যান্ড টু টোয়েনটি টু ডেল্টা হ্যাশ, এনগেজ হেলবয় অ্যাট ইয়োর এন্ড, টেক নিয়ারেস্ট টার্গেট ডাউন।’ আদ্রিয়ানো ধীরে পেছনে সরে গেলে তার জায়গা নিল গুস্তাভো, এই ইউনিটের হেলবয়। তিরিশ ফুট দূর থেকে যেকোনো সাইজের ছুরি, বা ব্লো পাইপ দিয়ে শত্রুকে শায়েস্তা করতে গুস্তাভো এক্সপার্ট, প্রতিটি প্ল্যাটুনে একটি করেই হেলবয় থাকে। এদের ভুলচুক হয় না একেবারেই, সে টার্গেট স্থির হোক বা চলমান। আর নিক্ষিপ্ত বস্তুটি হৃদপিণ্ড বা কণ্ঠনালী বা অন্য প্রাণঘাতী স্থান ছাড়া অন্য কোথাও বেঁধে না।

গুস্তাভো পেছনে সামান্য মাথা হেলিয়ে কী একটা বলল, সঙ্গেসঙ্গে আদ্রিয়ানো ক্রিকেট মাঠের উইকেট কিপারের মতো হাতের চেটো দুটিকে সামনে সামান্য পেতে বসলো। এরপর যেটা ঘটল সেটা শুধু ম্যাজিক। গুস্তাভো নিজের জায়গায় দাঁড়িয়েই দু-বার জগিং করার ভঙ্গিতে অল্প লাফিয়ে তৃতীয়বারে একটু জোরে লাফায়, আর সঙ্গে সঙ্গে আদ্রিয়ানো গুস্তাভোর গোড়ালিদুটো আলতো করে ধরে সামনের দিকে শুধু উড়িয়ে দেয়, যেভাবে শৌখিন পুরুষ উড়িয়ে দেয় পোষা লক্কা পায়রা!

যেদিকে মার্টিনেজ ছিলেন তার উলটোদিকের কালাশ সন্ত্রাসবাদীটির হঠাৎই তাক লেগে যায় তার চোখের সামনে এক আজব দৃশ্য দেখে। যেন হঠাৎই, শূন্য থেকে তার চোখের সামনে চাকার মতন ঘুরতে ঘুরতে উড়ে আসে এক মানুষপাখি, তার শরীর জলপাই রঙের, মাথাটা বিলকুল কালো। অবাক হওয়া সরিয়ে সেই মানুষপাখির দিকে কালাশনিকভ তাক করার আগেই একটি গ্লকা বি ওয়ান ছুরি তার কণ্ঠনালীতে আমূল বিঁধে যায়। অবাক হয়ে খানিকক্ষণ সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে সেই সন্ত্রাসী যোদ্ধা, কিন্তু বেশিক্ষণ সময় পায় না, পর পর দুটো ছোটো ছুরি তার দুটো চোখের মণিতে এসে বিঁধে তাকে অন্ধ করে দেয়, ফিনকি দিয়ে রক্ত ছড়িয়ে পড়ে বারান্দায়। বিশাল শরীরটা যেন খানিকটা অবাক হয়েই বারান্দায় ধপ করে পড়ে এবং কাটা পাঁঠার মতন ছটফট করতে থাকে!

পুরো ঘটনাটা ঘটতে লাগে ঠিক একচল্লিশ সেকেন্ড!

এই প্রথম শব্দ হয় পুরো অপারেশনে, মৃতপ্রায় সন্ত্রাসবাদীটির হাতে ধরা শিশুটি অত রক্ত দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে এবং ঘটনার অভিঘাতে অজ্ঞান হয়ে যায়। দলের নেতাটি এবার ক্ষিপ্র হায়েনার মতন পিছনে ফিরে দেখে তার সঙ্গীর ছটফটানি, আর গলা থেকে ভলকে ভলকে বেরিয়ে আসা রক্ত। তখনই সে মেজাজ হারিয়ে চিৎকার করে গালি দিয়ে ওঠে। তার সামনে তখন তার সঙ্গীর দেহ ছাড়াও এক অজ্ঞান শিশু, আর বারান্দার শেষে দাঁড়ানো খাটো চেহারার এক কম্যান্ডো শরীর, ইতিমধ্যেই যার দু-হাতে উঠে এসেছে দুটি হ্যান্ডগান। সে দ্রুত তার হাতে ধরা শিশুটিকে কাছে টেনে আনে ঢাল হিসেবে, আর তার সঙ্গেই চেষ্টা করে তার কালাশনিকভ তুলে এই কাফেরের বাচ্চাটাকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়ার, কিন্তু তার আগেই তিন তিনটি বুলেট পেছন থেকে তার মাথা ফুঁড়ে দেয়, গুলিগুলো তার মাথা ফুটো করে মেঝেতে পড়ে ঠনঠনান আওয়াজ তোলে। অবিশ্বাস্য মৃত্যুর অভিশাপ চোখে নিয়ে লোকটা সামনে দুম করে পড়ে যায় মেঝের ওপর। পেছনে দাঁড়ানো সিগ সয়্যারের অ্যাসল্ট রাইফেলটা নামিয়ে রাখেন মার্টিনেজ। তারপর তাঁর চোখের ইশারায় গুস্তাভো আর ক্লদিও দ্রুত গিয়ে দুটো ক্লাসরুমে ঢুকে শিশুদের দায়িত্ব নেয়। মার্টিনেজ বাকি টিমকে আদেশ দেন বিল্ডিঙের প্রতিটি কোণা খুঁজে দেখার জন্যে। এরপর নেভিগেশনে সেন্ট্রাল কম্যান্ডকে বলেন সোয়ার্মবটসটিকে তাঁর হাতের কাছে এনে দেওয়ার জন্যে। সেটিকে তালুবন্দি করে শান্তস্বরে খবর দেন, ‘অল টার্গেটস লিক্যুইডেটেড। অল কিডস আর সেফ, নো ক্যাজুয়ালটি, নো মেজর ইনজুরি। এনটায়ার পেরিমিটার বিইইং স্যানিটাইজড।’ ওপার থেকে একটা ভারী গলা ভেসে আসে, ‘গুড জব কমান্ডার, ওয়েল ডান।’

* * *

রাতে পার্টি হচ্ছিল ক্যাম্পে, সবার সঙ্গে মিশে আনন্দ উপভোগ করছিলেন মার্টিনেজ। জেরেনিমো চমৎকার মিমিক্রি করে। হাতে একটা ভদকার পেগ নিয়ে তাই দেখে হেসে কুটোপাটি হচ্ছিলেন তিনি। যেহেতু রেঞ্জার্সদের প্রকাশ্যে মুখ দেখানো নিষিদ্ধ, তাই তাঁদের ক্যামেরার সামনে আনা হয়নি। দ্রুত একটি টয়োটার এসইউভিতে তুলে ক্যাম্পের দিকে রওয়ানা করে দেওয়া হয়। তবু মার্টিনেজের মনে আছে তাঁদের গাড়ি ঘিরে ধরে আফগান বাবা-মায়েদের আকুল কান্না, গাড়ির বনেটে আর জানালায় পাগলের মতন চুমু খাওয়া। দরিদ্র আফগান মায়ের কৃতজ্ঞতার অশ্রুর দাগ বোধ হয় সেই গাড়ির বনেটে এখনও খুঁজলে পাওয়া যাবে। আসার সময় সাইড ভিউ মিররে দেখছিলেন মার্টিনেজ, তাঁদের গাড়ির টায়ারের দাগের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়া মানুষের আল্লাহর কাছে শুক্রিয়া আদাহ করা। মার্টিনেজদের মঙ্গলপ্রার্থনায় উর্ধ্বাকাশে উত্থিত সেই প্রার্থনার হাতগুলিকে ভোরের সূর্যমুখীর মতোই পবিত্র মনে হয়েছিল মার্টিনেজের।

মনটা খারাপ হয়ে গেল তাঁর। কবে যে ধর্মের বিষচক্র থেকে এই সরল দরিদ্র মানুষগুলির মুক্তি ঘটবে!

এমন সময় একজন রেঞ্জার্স দৌড়ে আসে তাঁর কাছে, মাথা ঝুঁকিয়ে তাঁর কানের কাছে ফিসফিস করে, ‘আর্জেন্ট কল ফ্রম ল্যামেগো কমান্ডার, ফর ইউ।’

একটু ভাবিতই হয়ে পড়েন মার্টিনেজ। আবার কোথাও কোনো জঙ্গি হামলা নাকি? ভেবেই শরীরটাকে শক্ত করে নেন তিনি, হলে হবে, কমান্ডার ডাকলে যেতে হবে বই কী! ডিউটি ইজ ডিউটি। লোরান সিস্টেমের সিকিওরড চ্যানেলে ভিডিয়ো স্ক্রিন অন হতেই সামনে সিটিওই-র সর্বাধিনায়কের চৌকো খুনি মুখটা ভেসে ওঠে, ‘টোয়েনটি নাইন ল্যামডা কাপা, এই মুহূর্তে একটা কমব্যাট হেলিকপ্টার নিয়ে কাবুল চলে আসুন কর্নেল। সেখানে আপনার জন্যে সুপারসোনিক আর্মি জেট তৈরিই আছে। ইউ নিড টু রিচ লিসবন বাই নেক্সট টেন আওয়ার্স।’ অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে ওঠে মার্টিনেজের, ‘ফিফটি থ্রি আল্ফা হ্যাশ, এনিথিং রং চিফ? এনিথিং সিরিয়াস দেয়ার?’ চিফের ভাবলেশহীন মুখটা কি একটু অপ্রস্তুত দেখায় ক্ষণমুহূর্তের জন্যে? সামান্য গলা নামিয়ে বলেন, ‘তিয়াগো ইজ সিরিয়াসলি ইল মার্টি। ডক্টরস আর ফাইটিং আ রিয়্যাল টাফ ব্যাটল। কাম শার্প অ্যান্ড মিট তিয়াগো। হি ইজ লুকিং ফর ইউ ফ্র্যানটিক্যালি।’

মার্টিনেজের সামনে পুরো দুনিয়াটা অন্ধকার হয়ে এল।

১৫৬০। অাগস্ট। গোয়া

মন্দিরের চাতালের ওপর দুই যবন, এবং তাঁদের সাজপোশাক দেখলে বোঝাই যায় যে তাঁরা যথেষ্ট উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। এক জন অপেক্ষাকৃত দীর্ঘকায়, আরেকজন খর্ব। যদিও এই খর্বকায় ব্যক্তিটিই যে প্রধান সে নিয়ে সন্দেহ নেই। লোকটির দাঁড়ানোর মধ্যেও এক কর্তৃত্বব্যঞ্জক দৃঢ়তা আছে, যা বাকি লোকগুলির মধ্যে নেই। কথাটা এসেছে ওই খর্বকায় মানুষটির গলা থেকেই, উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, ডান হাত সামনে তোলা, আর সেই হাতেই ধরা সেই মহাবেতাল শক্তিখণ্ডটি। এত দুঃখ, কষ্ট, নির্যাতন, আসন্ন মৃত্যুর করাল ছায়া, তার মধ্যেও একটা মহাভয়ের শিরশিরে হিমেল স্রোত তাঁর অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দিল।

আমোনার মহাবেতাল মন্দিরের পুরোহিতরা পুরুষানুক্রমে পুরোহিত পদে অধিষ্ঠিত হন না। তাঁরা নিজেদের উত্তরাধিকারী খুঁজে নেন। শ্রদ্ধায়, নিষ্ঠায়, প্রতিভায়, নিয়মানুবর্তিতায় এবং সর্বোপরি মন্ত্রগুপ্তিতে সিদ্ধ এমন ব্রাহ্মণ যুবককেই উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করা হয়। তার কারণ একটিই, প্রলয়ংকরী শক্তির উৎস এই আধারটিকে রক্ষা করা এবং সর্বসাধারণের নজর থেকে লুকিয়ে রাখা। ত্রিলোচনের গুরু এবং পূর্ববর্তী পুরোহিত আচার্যশ্রেষ্ঠ প্রথমেশ যেদিন অভিষেক করেন ত্রিলোচনের, সেদিনই এই শক্তিপীঠটি তাঁর হাতে অর্পণ করেছিলেন। দেখিয়ে দিয়েছিলেন গুপ্ত প্রকোষ্ঠটি, বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সেটি খোলার কলাকৌশল। নইলে খালি চোখে দেখে ওই গুপ্তপ্রকোষ্ঠ আবিষ্কার করা বা সেটি খুলতে পারা স্বয়ং ঈশ্বরের পক্ষেও অসম্ভব!

সেইদিনই ধীরে ধীরে এর মাহাত্ম্য ত্রিলোচনের সামনে উন্মোচন করেছিলেন প্রথমেশ। সৃষ্টির আদিতে নাকি পাতাল থেকে উঠে এসেছিল এই শক্তিপিণ্ডটি। বলা হয় একাদশ রুদ্রের তেজ আর মহাকালের ক্রোধ একত্রিত হয়ে এই শক্তিখণ্ডটির উদ্ভব। যে বস্তুতে এই আধারটি নির্মিত তা পার্থিব কোনো উপাদান নয়, শত সহস্র নীহারিকাপুঞ্জের ওপারের কোনো অলৌকিক অপার্থিব মায়ারাজ্যের উপাদান। সপ্তসমুদ্রের প্রচণ্ডমূর্তি, বা লক্ষকোটি ঝঞ্ঝাবর্ত এই শক্তিখণ্ডটির ক্ষমতার সামনে শিশুতুল্য। পাতালের শতসহস্র উগ্রতেজা আগুনখেকো রাক্ষসের চণ্ডরোষ আর মেরুপ্রদেশের অযুত অর্বুদ মহাবলশালী তুষারদৈত্যদের সম্মিলিত তেজ দিয়ে এই মহাবেতালপীঠটির মজ্জা তৈরি। আর স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেবের ত্রিনয়নের আগুনে এর শোধন। অশুভ শক্তির হাতে পড়লে এই শক্তি মুহূর্তে প্রলয় ঘটাতে পারে, লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে এই জগৎ ও সৃষ্টি। মহাবেতাল ছাড়া আর কেউ এই শক্তিখণ্ডটির ধারণের উপযুক্ত নয়, তাই এই দিয়েই মহাবেতালের হৃদয় গড়েছেন দেবাদিদেব, আর দিয়েছেন অমিত প্রতাপের অধিকার। এই মহাবেতাল তাই মহাশক্তিধর, মহাপ্রলয়ংকর। মৃত্যুভয়ের অতীত, ভূতপ্রেতাদির একচ্ছত্র অধীশ্বর। স্বয়ং যম এঁর সামনে প্রণত থাকেন…

‘কি রে কালো জন্তু, চিনতে পারছিস এটা?’ বিদ্রুপের সুরে বলে ওঠা কথাটা শুনে হুঁশে ফেরেন ত্রিলোচন। আর তীব্র ক্রোধে এই প্রথম কুবাক্য উচ্চারণ করেন তিনি, ‘আরে মূর্খ, যেখানকার জিনিস সেখানে রেখে দে। অপবিত্র পশুর দল, কী জিনিস নিয়ে ছেলেখেলা করছিস সেটা বোঝা তোদের পশুবুদ্ধির অগম্য। যদি নিজেদের সর্বনাশ না চাস, এখুনি ফিরিয়ে দে ওটা।’

চোয়ালটা শক্ত হয়ে ওঠে সেই যবন রাজপুরুষটির, লাল চোখ মেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন ত্রিলোচনের দিকে। তারপর হিসহিস করে ওঠেন, ‘ব্রিং হিজ সন অ্যান্ড ওয়াইফ। পুট দেম টু ফায়ার, বাই প্যাপাল অর্ডার।’

এতক্ষণ খেয়াল করেননি ত্রিলোচন, ধীরে ধীরে তাঁর দুইপাশে আরও দুটি হাতে টানা গাড়ি এসে থামে। সেখানেও গাড়ির পাটাতনে গাঁথা মোটা খুঁটির সঙ্গে বাঁধা দুটি মানুষ। তাদের দেহের অর্ধাংশ ইতিমধ্যেই শুকনো আসান কাঠে ঢাকা।

অতি কষ্টে ডান দিকে ঘাড়টা ঘোরাতেই যেন ত্রিলোচনের ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে পায়ের পাতা অবধি একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল!

মালতী, ওঁর স্ত্রী আরেকটি খুঁটির সঙ্গে বাঁধা! তার মানে ধরা পড়ে গেছে ওরাও!

মাথার চুল কেটে ফেলা হয়েছে মালতীর, গায়ে যেটুকু কাপড় আছে তাতে কোনোমতে লজ্জা নিবারণ হয়! হাত দুটো ওপরে খুঁটির সঙ্গে লোহার বেড়ি দিয়ে বাঁধা। সারা গায়ে নির্যাতনের চিহ্ন স্পষ্ট, থেকে থেকে রক্ত জমাট বেঁধে আছে সারা শরীতে। ঠোঁটের কশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা ও রক্ত। এখানে ওখানে আগুনের ছ্যাঁকা দেওয়ার দাগ। যেটুকু চুল রয়েছে, তারাও হাওয়ায় উড়ছে অভিশাপের মতন। মালতীও চেয়ে আছে এদিকে, চোখে পাগলের মতন উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ‘অনেক রাত হল, খেতে বসবে না?’

বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণী। হিমশীতল কি একটা যেন তাঁর মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল। এই উন্মাদিনীকে কি তিনি চেনেন? এই কি তাঁর বড়ো আদরের, বড়ো ভালোবাসার স্ত্রী? মালতী আরও এক বার চারিদিকে তাকালেন উদ্ভ্রান্তের মতন, তারপর হাউহাউ করে আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘আমাকে ছেড়ে দাও, উঃ, খুব লাগছে, ও গো তোমাদের দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে আর মেরো না, মা গো, আর পারছি না…’

গায়ের সমস্ত রোম শিউরে উঠল ত্রিলোচনের, ক্রোধে, ক্ষোভে তাঁর সর্বাঙ্গ কাঁপতে লাগল। তাঁর সমস্ত চেতনা অবলুপ্ত হয়ে শুধু এক বিন্দুতে সংহত হতে লাগল। সমস্ত মস্তিষ্ক, সমস্ত স্নায়ু, শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু শুধু একটি শব্দ ধ্বনিত করে তুলল, প্রতিশোধ চাই, প্রতিশোধ! চাই সেই ভয়ংকরতম অভিশাপ, যা একমাত্র বেতালমন্দিরের পুরোহিতরাই জানেন গত সহস্রবছর ধরে। যে শাপের মূর্তি ধরে স্বয়ং ঈশ্বরীয় ত্রাসদল তাড়িয়ে বেড়ান সেই মহাপাতককে! যে শাপ থেকে সৃষ্টির শেষ অবধি অভিশপ্তের মুক্তি নেই!

নরকবেতালশাপ!

এইবার ধীরে ধীরে ঘাড়টা বাঁ-দিকে ঘোরালেন ত্রিলোচন। আর লালচোখ মেলে শুধু চেয়ে রইলেন, চেয়েই রইলেন।

বীরভদ্র, তাঁর সদ্যকৈশোরোত্তীর্ণ সন্তান। তাঁর বুকের পাঁজর, চোখের মণি, সাত রাজার ধন এক মাণিক! সেও একই ভাবে বাঁধা বটে। তবে তার সারা শরীরে একটি বই আর কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। অবশ্য আঘাতের আর দরকার কি? কারণ যেভাবে সে ঘাড় মটকে আছে তাতে বোঝা যায় যে তার শরীরে বিন্দুমাত্র প্রাণও আর অবশিষ্ট নেই। আর না থাকার কারণ সারা শরীরের সেই একমাত্র আঘাতটি!

শিশুপুত্রের যে বুকে চুমু খেয়ে স্বর্গসুখ অনুভব করতেন ত্রিলোচন, যেখানে কান পেতে হৃদস্পন্দন শুনে হৃদয় জুড়োতেন, আজ সেই সন্তানের বুকে একটি বড়ো গর্ত। হ্যাঁ, গর্ত। সাধারণ আঘাত নয়, এক পাঞ্জা চওড়া, বুক ফেড়ে দেওয়া গভীরতম ক্ষত। আর সেইজন্যই বোধ হয় সোনার বরণ ছেলের সারা বুকে রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে। ছেলের পায়ের কাছে পড়ে তার রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ডটি। মানেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না ত্রিলোচনের। জীবিতাবস্থাতেই ছেলের বুক থেকে উপড়ে নেওয়া হয়েছে তার হৃদয়টি!

মাথাটা সোজা করে সেই খর্বকায় যবন রাজপুরুষটির দিকে তাকালেন ত্রিলোচন। তখনও উদ্ধত ব্যঙ্গের হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে ত্রিলোচনের দিকে তাকিয়ে আছে সেই মূর্তিমান পাপ। বিড়বিড় করতে করতে হঠাৎ করে থেমে, চোখটা এক বার মাত্র বুজেই ধক করে খুললেন ত্রিলোচন, আর সেই অভিজাত যবন, মনসেইনর রেভারেন্ডো, গোয়ার ভাইকার জেনারেল শয়তানশ্রেষ্ঠ মিগুয়েল ভাজ যেন একটা শক্ত শীতল পাথরে ধাক্কা খেয়ে থেমে যান।

চোখ কোথায়? এ তো দু-খানা জ্বলন্ত কয়লার টুকরো জ্বলছে এই পুরোহিতের অক্ষিকোটরে! সেই চোখের দিকে তাকানো যায় না, এতই ভয়ানক সেই অশুভ আগুনে দৃষ্টি। তার সঙ্গেই এই ব্রাহ্মণের সমস্ত দেহ জুড়ে শুরু হয় এক সূক্ষ্ম কম্পন, যেটা অভিজ্ঞ ক্রিশ্চান ধর্মকর্তার চোখ এড়ায় না।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা অপার্থিব গোঁ গোঁ আওয়াজের সঙ্গে হঠাৎ করে তাঁদের ঘিরে, শুধু তাঁদেরই ঘিরে মহাসর্পের মতন মাথা তুলে দাঁড়ায় একটা ঘূর্ণিঝড়! মিগুয়েল দেখছিলেন যে পাঁচ-শো গজ দূরে মাঠের ওইপাশের গাছগুলোর একটি পাতাও নড়ছে না, কিন্তু এদিকে যেন এক সর্বগ্রাসী মহাসর্বনাশী ঝড় তার বিষধর কালফণা তুলেছে দংশন করবে বলে। এরই সঙ্গে এক ভয়াল অন্ধকারে ছেয়ে গেল চারিদিক, কর্কশ আওয়াজ করে কতগুলো শকুন আর কাক উড়তে থাকে সবার মাথার ওপরে। অনির্দেশ্য নিয়তির মতন ওই ক্ষুদ্র ভূমিখণ্ডটি জুড়ে ঘনিয়ে আসে ঘনকৃষ্ণ মেঘরাজি, অকস্মাৎ কড়কড়াৎ শব্দে বিকটভাবে ফেটে পড়ে একটা বাজ।

কী হচ্ছেটা কি? ভয়মিশ্রিত একটা ফাঁকা আতঙ্ক বুকে চেপে বসে মিগুয়েল ভাজের। তিনি একজন ইউরোপশ্রেষ্ঠ এক্সরজিস্ট, অতিপ্রাকৃত ঘটনার লক্ষণগুলি তাঁর থেকে ভালো চেনে এমন লোক ইউরোপে কমই আছে। কিন্তু তাঁরও মেরুদণ্ড বেয়ে একটা ভয়ের হিমশীতল স্রোত নেমে যায়। এর প্রতিকার তাঁর ক্ষমতার পক্ষে অসাধ্য!

বিড়বিড় করতে করতে তিন দিকে তিন বার থুতু ছিটিয়ে দেন ত্রিলোচন। এবার শব্দগুলো আরও স্পষ্ট ও উচ্চকিত হয়, যদিও অপার্থিব সুরেলা উচ্চারণে গাওয়া সেই অর্থহীন হৃং ক্লিং ফট স্বাহা সমন্বিত শব্দসমষ্টি কারোরই বোধগম্য হয় না।

প্রবল আতঙ্কে ভীত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন মিগুয়েল ভাজ, ‘পুট দেম টু ফায়ার, ক্যুইক।’ তৎক্ষনাৎ ঝপাঝপ করে তিনটি কাঠের স্তূপে জ্বলন্ত মশাল এসে পড়ে বেশ কয়েকটা। ইতিমধ্যে পাগলের মতন মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে থুতু ফেলতে ফেলতে দুর্বোধ্য মন্ত্রোচ্চারণ করতে শুরু করেছেন ত্রিলোচন, সেই অনৈসর্গিক পাগলামির সুরে বিদেশীয় সৈনিকদের মুখের রেখায় ভয়ের ছায়া পড়ে। এদেশীয় প্রাজ্ঞরা জানেন এ কোন অশনিসম্পাতের চিহ্ন, তাঁরা ততক্ষণে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়েছেন বেতালমন্দিরের দিকে মুখ করে। বেসামাল হাওয়ায় টুপি সামলে রাখা দায় হয় দুই যবন রাজপুরুষেরই।

আর কোথা থেকে হঠাৎ করে একটা পচা মৃতদেহের কটু গন্ধ ঘিরে নেয় সমস্ত স্থানটিকে। তারপর সেই দুর্গন্ধ দ্রুত বেড়ে ওঠে অনেকগুন, আর অলৌকিক খলখল হাসির শব্দে ভরে চারিদিক। যেন হাজারে হাজারে স্খলিতমাংস, গলিতদেহ প্রাচীন মৃতদেহের সারি পাতালের হিম অন্ধকার থেকে উঠে এসে এই স্থানটিকে ঘিরে নাচতে থাকে। তাদের হাড়ের খট খট শব্দ মিশে যায় ঝোড়ো ঘূর্ণি হাওয়ার ক্রুদ্ধ গর্জনের সঙ্গে।

শুকনো কাঠ আর ঝোড়ো হাওয়া, তিনটি স্তূপই জ্বলে উঠতে সময় নেয়নি বেশি। আর সেই দাউদাউ আগুনের মধ্যে দিয়ে ভেসে আসে মহাবেতালসাধক, অঘোরীতন্ত্রশ্রেষ্ঠ ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণীর স্বর। সেই জ্বলে ওঠা আগুন পেরিয়ে, স্বর্গ মর্ত্য পাতাল ভেদ করে, উত্তাল ঝড়ের শোঁ শোঁ শব্দের মধ্যে দিয়ে মিগুয়েল ভাজের দিকে ভেসে আসে একটা অতিলৌকিক কর্কশ কন্ঠস্বর, ‘শোন রে পাপাত্মা হানাদার যবন, আমি ত্রিলোচন ক্ষেমকল্যাণী, আমার পিতৃকুল ও মাতৃকুলের নামে, স্বর্গ ও নরকের নামে, ত্রিলোক ও একাদশ রূদ্রের নামে, অভিশাপ দিচ্ছি যে তোদের পরিবারের প্রতিটি প্রথম সন্তান অশেষ কষ্ট পেয়ে মৃত্যুর মুখ দেখবে, যেভাবে তোরা কষ্ট দিয়ে মেরেছিস আমার একমাত্র সন্তানকে। সৃষ্টির শেষ দিন পর্যন্ত তোর উত্তরপুরুষদের তাড়া করে ফিরবে নিয়তি, ততদিন পর্যন্ত এই শাপ থেকে তোদের মুক্তি নেই নেই নেই…’

২০১৬। জুলাই। লিসবন

লিসবন শহরের সবচেয়ে অভিজাত পল্লিটির নাম পার্খে দাস নাসোয়েস। তার শেষ প্রান্তে যে বাদামি রঙের প্রাসাদোপম বাড়িটি পর্যটক মাত্রেরই সম্ভ্রম এবং পর্তুগালের ধনীতম ধনীদের ঈর্ষামিশ্রিত তারিফের উদ্রেক করে, তার নাম ভাজ পালাসেতে, অর্থাৎ ভাজ প্যালেস।

এক বিষণ্ণ বিকেলে সেই প্রাসাদের দোতলার ঘরে একটি ছোটো ভিক্টোরীয় গোলটেবিলের দু-পাশে বসেছিলেন দুই পুরুষ, এক জনের বয়েস সত্তরের কোঠায়, আরেকজনের বয়েস চল্লিশের কাছাকাছি। খুব ভোর বেলায় লিসবনের আমাডোরা মিলিটারি এয়ারবেসে মার্টিনেজকে নিয়ে এসে ল্যান্ড করে পর্তুগাল সেনাবিভাগের সর্বশ্রেষ্ঠ সুপারসোনিক জেটটি। মাটিতে পা রেখেই তাঁর জন্যে অপেক্ষারত ল্যান্ড ক্রুজারের সিটে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েন মার্টিনেজ এবং পর্তুগালের জনবহুল রাস্তা ধরে সেই ল্যান্ড ক্রুজার প্রায় উড়েই যায়। উড়ে যায় লিসবনের, শুধু লিসবন কেন, সমগ্র পর্তুগালের শ্রেষ্ঠতম হাসপাতাল মিজেরিকর্দিয়া দে এভোরার দিকে।

ভাজ পরিবারের টাকার অভাব নেই বললে কম বলা হয়। গত সাত-শো আট-শো বছর ধরে পর্তুগালের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে এই পরিবার। রাজনীতি, যুদ্ধক্ষেত্র, ধর্মীয় পরিমণ্ডল সর্বক্ষেত্রে ভাজ পরিবারের অঙ্গুলিহেলনে পর্তুগালের রাজপাটের পটপরিবর্তন হত। এমনকী এক কালে রাষ্ট্রীয় টাঁকশাল এবং ব্যাঙ্ক, দুটিই নিয়ন্ত্রণ করত এই পরিবার। শুধু তাই নয়, মন্ত্রীপরিষদ নিয়োগ থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ পদটিতে কাকে বসানো হবে সেসবও ঠিক হত এই ভাজ পালাসেতে থেকে। এই ওয়াই-ফাই যুগেও পর্তুগালের ক্ষমতার অলিন্দে ভাজ পরিবারর দাপট অপ্রতিহত।

আর সেই বিপুল প্রতাপশালী ভাজ পরিবার, যার কুবেরীর্ষিত সম্পদ সমগ্র ইউরোপে এখনও প্রবাদের মতন, তার একমাত্র উত্তরাধিকারী কর্নেল মার্টিনেজ ভাজ আজকে সকালে মিজেরিকর্দিয়া হাসপাতালের সবচেয়ে সেরা কেবিনটির কাঁচের দরজার সামনে পথের ভিখিরির মতন বসে হাউহাউ করে কাঁদছিলেন। ইউরোপের শ্রেষ্ঠতম কম্যান্ডোদের মধ্যে একজন তিনি, সমগ্র ইউরোপ এবং ইউ এস এ জুড়ে কঠিনতম কম্যান্ডো ট্রেইনিং সেশন পরিচালনা করতে যাঁর সর্বাগ্রে ডাক পড়ে, সেই তীক্ষ্ণাগ্রবুদ্ধি, কম্যান্ডোবিক্রমে অতুল কীর্তির অধিকারী যোদ্ধৃশ্রেষ্ঠ মার্টিনেজ ভাজ আজ একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত সংসারী বাবার মতন চিকিৎসকের হাত জড়িয়ে ধরে তিয়াগোর প্রাণভিক্ষা চাইছিলেন।

যদিও পর্তুগালের সেরা চিকিৎসকরা কোনো আশ্বাসবাণীই শোনাতে পারেননি। শোনানো দূরস্থান, তাঁরা এখনও বুঝতেই পারেননি যে অসুখটা কি! দুরন্ত ছেলে দিব্যি খেলছিল পালাসেতের বাগানে, একাই। সন্ধে নামার সময় হঠাৎ অত্যন্ত ভয়ার্ত মুখে দৌড়তে দৌড়তে উঠে আসে ঠাকুরদার কাছে। ঠাকুরদা ফার্নান্দো তখন দোতলার বারান্দায় আরামকেদারায় বসে খুবই মনোযোগ সহকারে সোনার জলে লেখা, মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো একটি প্রাচীন বই পড়ছিলেন। তাঁর কাছে এসে তিয়াগো উত্তেজনা আর ভয়ে মেশামেশি আরক্তিম চোখ আর রক্তাভ মুখ নিয়ে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলে ‘হি হ্যাজ কাম, হি হ্যাজ কাম’, আর তারপরেই মুখে গ্যাঁজলা তুলে অজ্ঞান হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ ফার্নান্দোর আর্তচিৎকারে যাবতীয় কর্মচারীরা জড়ো হয় দোতলার বারান্দায়। তিনি সমগ্র পালাসেতে দ্রুত তল্লাশির আদেশ দেন, আর এমারজেন্সি কল দেন পারিবারিক ডাক্তারকে। এমনিতেই জনা চারেক প্রশিক্ষিত কম্যান্ডো দুটি ভয়ালদর্শন রটওয়েলার নিয়ে চব্বিশ ঘণ্টাই পাহারা দেয় এই প্রাসাদ। রটওয়েলার দুটি অত্যন্ত হিংস্র ও মানুষখেকো। শোনা যায় তারা একবার ভাজ পালাসেতেতে ভুল করে ঢুকে পড়া এক ছিঁচকে চোরকে ঘন্টাখানেকের মধ্যে ছিঁড়ে খেয়ে উদরস্থ করে। আর তা ছাড়া ভাজ পরিবারের অত্যাধুনিক নিজস্ব সুরক্ষা ব্যবস্থা তো আছেই। ফলে কেউ এখানে ঢুকে কিছু একটা অপকর্ম করে নিরাপদে পালিয়ে যাবে এরকম হতে পারে না। কিন্তু কোথাও কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুধু বাগানের এক কোণে একটা তীব্র মড়াপচা গন্ধ সার্চপার্টির নাকে এসেছিল বটে, তবে সেই দুর্গন্ধ উবে যেতে বেশি সময় নেয়নি। নাহ, সেই গন্ধের উৎস অনেক খুঁজেপেতেও পাওয়া যায়নি। আর হ্যাঁ, সেই যমদূতের মতন রটওয়েলার দুটি পোষা খরগোশের মতন জবুথবু হয়ে বসেছিল তাদের কেনেলে, অতি কষ্টেও তাদের বাগানের দিকে আনা যায়নি, কিছুতেই না!

ভাজ পরিবারের পারিবারিক ডাক্তার এসে পৌঁছোন এগারো মিনিটের মাথায়। তাঁরই পরামর্শ মতন অচৈতন্য তিয়াগোকে আধঘন্টার মধ্যে ভরতি করা হয় মিজেরিকর্দিয়াতে। ডাক্তাররা চিকিৎসার ত্রুটি করেননি বলাই বাহুল্য। প্রথমে বিভিন্ন রকম প্রাথমিক স্টিমুলাস দিয়ে সাড়া না পেয়ে শরীরের অত্যন্ত সংবেদনশীল জায়গায় আঘাত করে দেখা হয়। তারপর এক্স রে, আল্ট্রাসাউন্ড, ইসিজি, এম আর আই, সিটি স্ক্যান, থেকে শুরু করে ইএমজি, মায়েলোগ্রাম, নিউরোসোনোগ্রাফি যাবতীয় ভাবে তন্নতন্ন করে খুঁটিয়ে দেখা হয়েছে ওই দশ বছর বয়সি শিশুটির শরীর। ইতিমধ্যেই পর্তুগালের ইন্সতিতুতো নাসিওনাল দে এমার্জেন্সিয়া মেডিকা থেকে উঠিয়ে আনা হয়েছে দেশের সেরা ট্রমা বিশেষজ্ঞ ডক্টর ওরল্যান্দো হার্নান্দেজকে। তিনি অনেক চেষ্টা করেও সাড়া না পেয়ে জানান যে ইতিমধ্যেই সেই হতভাগ্য শিশু আচ্ছন্ন হয়েছে গভীর কোমাতে! ফল, দ্রুত আই সি ইউ-তে স্থানান্তরণ!

কিন্তু না, তিনিও বলতে পারলেন না, কোন আকস্মিক দুর্ঘটনার বলি হল এই নিষ্পাপ প্রাণোচ্ছল বালক!

বলা বাহুল্য এরপর লন্ডন থেকে ইউরোপের সেরা পেডিয়াট্রিশিয়ানকে উড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়। এর সঙ্গে সঙ্গেই তিয়াগোর জন্যে গঠিত মেডিক্যাল বোর্ড আমেরিকার জন হপকিন্স, বস্টন চিলড্রেন্স হসপিটাল এবং সেইন্ট জুড চিলড্রেনস হসপিটালের সঙ্গে ভিডিয়ো কনফারেন্সে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

ফার্নান্দো আর মার্টিনেজ অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলেন। বাইরে একটা জ্যাকারান্ডা গাছের ডালে অনেকক্ষণ ধরে একটা উডকক পাখি বিষন্ন সেই দুঃখবিকেলের সঙ্গে মানানসই ক্লান্ত একঘেয়ে সুরে ডেকে যাচ্ছিল। তার পর সে উড়ে গেলে নৈঃশব্দ ভেঙে প্রথম কথা বললেন ফার্নান্দো, ‘আমি সত্যিই দুঃখিত মার্ট। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না।’

থমথমে মুখ তুলে তাকালেন মার্টিনেজ, গলা ঝেড়ে বললেন, ‘জানি পাপাই, ডাক্তাররাও যখন কিছু বুঝতে পারছেন না…’

আবার বেশ কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। তারপর যেন অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়িয়ে অত্যন্ত ক্ষীণ স্বরে ফার্নান্দো বললেন, ‘একটা কথা ছিল মার্ট। অনেকদিন ধরে তোমাকে বলব বলব ভেবেও চেপে রেখেছি। তোমার মা অবশ্য অনেক আগেই তোমাকে জানিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু আমি ঠিক সাহস পাইনি। কিন্তু নিয়তিকে আর ক-দিন ঠেকিয়ে রাখা যায় বল? আজই সেইদিন, আজই যদি তোমাকে সব খুলে না বলি, একটা বড়ো অঘটন হয়তো আর এড়ানো যাবে না।’ অবাক বিস্ময়ে মুখ তুলে নিজের বাবার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইলেন মার্টিনেজ। কিছু বলতে হল না, ওই নজরেই প্রশ্নটা লেখা ছিল স্পষ্টাক্ষরে।

কিছুক্ষণ ইতস্তত করলেন ফার্নান্দো, তারপর গলা ঝেড়ে বললেন, ‘মার্ট, এই মুহূর্তে এই কথাটা বলার জন্যে ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করুন, কিন্তু তোমার কি মনে আছে, সিসিলিয়া মারা যাওয়ার পর আমরা তোমাকে আরেক বার বিয়ে করতে বলেছিলাম?’

একটু বিরক্তই হলেন মার্টিনেজ, ‘পাপাই, এখন কি এসব আলোচনা করার সময়? আমি তো বলেইছিলাম তখন, আমি চাই না অন্য কোনো মহিলাকে মা বলে মানিয়ে নিতে তিয়াগোর কোনো সমস্যা হোক। বার বার একই কথা বলে, তাও এইসময়ে…’

হাত তুলে মার্টিনেজকে থামালেন ফার্নান্দো, ‘আমি জানি মার্ট, সেটুকু ঔচিত্যবোধ তোমার বাবার আছে বলে বিশ্বাস রাখতে পার। এই শোকের আবহের মধ্যেও এই কথা বলছি তোমাকে, নিশ্চয়ই তার পিছনে কারণ আছে?’

ফার্নান্দোর স্বরে এমন কিছু একটা ছিল যে মার্টিনেজ সোজা হয়ে বসলেন, তাঁর চোখে সেই কম্যান্ডোসুলভ খরদৃষ্টি ফিরে এল, ‘কী বলতে চাইছ পাপাই? স্পষ্ট করে বলতো।’

জানালার বাইরে দিয়ে উদাস দৃষ্টি মেলে দেন ফার্নান্দো। এই রাজসিক প্রাসাদের অনেক বাইরে নাগরিক লিসবনের জীবনযাত্রা অখণ্ড স্রোতের মতো বয়ে চলেছে। সেই প্রবহমান চঞ্চল উচ্ছলতার মধ্যে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে জেগে আছে এই বাড়ি, আর সেই বাড়ির চারিদিক জুড়ে কালই নেমে এসেছে এক বিষাদের অমঙ্গলছায়া। কে জানে, কবে তার থেকে পরিত্রাণ মেলে এই ক-টি জীবন্মৃত প্রাণীর!

ফিরে তাকান ফার্নান্দো, তারপরে নীচু অথচ স্পষ্টস্বরে বলেন, ‘তোমার কি রডরিগো’র কথা মনে পড়ে মার্ট?’

মুহূর্তে যেন কেউ হ্যাঁচকা টান মেরে মার্টিনেজকে তাঁরই নিজের অমলিন শৈশবের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। মুহূর্তে কয়েক দশক পিছনে চলে গেলেন তিনি।

রডরিগো ছিল মার্টিনেজের সহোদর বড়ো দাদা, এবং একইসঙ্গে ফ্রেন্ড ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড। পাঁচ বছরের বড়ো এই দাদাটিকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতেন মার্টিনেজ। পর্তুগালের সেরা স্কুল সেইন্ট ডোমিনিকে পড়ত রডরিগো, গত কয়েক বছর ধরে ওখানেই পড়াশুনা করে আসছে ভাজ পরিবারের ছেলে-মেয়েরা। সেখানেও অল্পবয়সেই শিক্ষকদের নজর কেড়েছিল রডরিগো। পড়াশোনায় যেমন তুখোড় ছেলে ছিল সে, খেলাধুলায় তেমনই অসামান্য প্রতিভার অধিকারী। স্কুলের যাবতীয় ক্যুইজ কম্পিটিশন জেতা থেকে শুরু করে অ্যাক্টিং ক্লাসে অসামান্য অভিনয় প্রতিভা দেখিয়ে সবার তাক লাগিয়ে দিয়েছিল সে। তার ওপর তার আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটস ক্লাসের নৈপুণ্য দেখে শিক্ষকরাও ব্যোমকে যেতেন।

বড়ো দাদাটিকে হিরো জ্ঞানে প্রায় পুজোই করতেন মার্টিনেজ। দু-জনে মিলে প্ল্যান করতেন বড়ো হলেই একটা বড়ো জাহাজ চুরি করে নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করতে বেরিয়ে পড়বেন, ক্রিস্টোফার কলম্বাস, বার্থালোমিউ দিয়াজ আর ভাস্কো দি গামার পর মহাপরাক্রান্ত সমুদ্রজিৎ হিসেবে অক্ষয় হয়ে থাকবে এই দুই ভাইয়ের নাম। প্ল্যান করতেন ফাইটার প্লেন চালানোর। কত বিকেল, কত সন্ধে দুই ভাইয়ের কেটেছে ক্রুসেডার বা নাইট টেম্পলার সেজে লড়াই করার মধ্যে দিয়ে…

রডরিগোর ষোলো বছরের জন্মদিন উদ্্যাপন করতে সবাই মিলে গেছিল লিসবনের সবচেয়ে অভিজাত বিপণীপল্লি অ্যাভেনিদা দে লিবারদাদে। সেদিন কিছু হুল্লোড় হয়েছিল বটে। অভিজাততম রেস্তরাঁতে পার্টি, নাচ, গান, শ্যাম্পেন, কেক, পাপাইয়ের স্নেহমিশ্রিত প্রশ্রয়ে রডরিগোর প্রথম বার কিঞ্চিৎ স্কচ পান, তারপর ডিনার, কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। সেই ডিনারের মাঝখানেই এক বার ‘এক্সকিউজ মি’ বলে উঠে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেছিল রডরিগো। আধঘন্টা বাদেও সে না ফেরায় ভাজ ফ্যামিলি ত্রস্ত হয়ে রেস্তরাঁতে শোরগোল তুলে ফেলেন, এবং খোঁজাখুঁজি করতে করতে সেই রেস্তরাঁর পেছনে রাস্তার ওপরে পাওয়া যায় রডরিগোর মৃতদেহ।

মৃতদেহে কোনো আঘাতের দাগ বা ধস্তাধস্তির চিহ্ন, কিছুই পাওয়া যায়নি। দামি ট্যুইডের শার্ট যেমনকার সাফসুতরো টিপটপ থাকার কথা, ঠিক তেমনই ছিল। কোথাও একফোঁটা রক্ত গড়ায়নি, কোনো গুলির শব্দ শোনা যায়নি। ওয়ালেট বা দামি ঘড়ি অথবা সোনার চেন কিছুই খোয়া যায়নি। শুধু মৃত কিশোরটির চোখে এক মরণান্তিক আতঙ্কের ছায়া গাঢ় করে আঁকা ছিল। সেই ভয়ের ছবি চাইলেও এড়ানো যায় না। মার্টিনেজ এখনও দুঃস্বপ্নে রডরিগোর সেই ভয়ে, আতঙ্কে বেঁকে যাওয়া মুখখানি দেখেন, এখনও তাঁর বমি উঠে আসে!

সন্ধে সাতটার সময় জনবহুল লিসবন শহরের মধ্যিখানে এমনকী ভয় পেল এক ষোলো বছরের কিশোর যে সে হার্ট ফেইল করে মরেই গেল? ডাক্তাররা তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো কারণ বার করতে পারেননি। শরীরের বাকি সমস্ত অর্গ্যান সম্পূর্ণ সুস্থ সবল, অথচ কি থেকে কী হয়ে গেল কেউই বুঝতে পারেনি। যেমন এটাও কেউ বুঝতে পারেনি, যে ওয়াশরুমে থেকে রেস্তরাঁর পেছনের রাস্তায় রডরিগো গেল কী করে? সেখান দিয়ে যাওয়ার কোনো রাস্তাই নেই। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সেই রাস্তায় যেতে গেলে রেস্তরাঁর মধ্যে দিয়েই যেতে হবে, আর সেখান দিয়ে বেরোলে পরিবারের বাকিরা তো দেখতেই পেত!

বলা বাহুল্য, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পর্তুগালের পুলিশ বা পোলিজিয়া কিছুই সমাধান করে উঠতে পারেনি। ‘আনসলভড মিস্ট্রি’ বলে কেস ফাইল ক্লোজ করে দেয় তারা, বাড়ি বয়ে এসে ফার্নান্দোর কাছে টুপি খুলে ক্ষমা চেয়ে যায়। মার্টিনেজের বয়েস তখন এগারো বছর, সেই বিভীষিকাময় আতঙ্কের দিনগুলি কাটাতে অনেক সময় লেগেছে তাঁর। মাঝেমধ্যে তাঁর নার্ভাস ব্রেকডাউন হতে শুরু করে, তাঁর জন্যে রীতিমতো ব্যক্তিগত মনোবিদ নিয়োগ করতে হয় ফার্নান্দোকে।

ক্লান্ত ম্লান স্বরে কথা বলেন মার্টিনেজ, ‘আবার রডসির কথা এখন কেন পাপাই?’

প্রশ্নটার কোনো সিধে জবাব দেন না ফার্নান্দো, শুধু মাথা নীচু করে একই স্বরে ফের প্রশ্ন করেন, ‘আমার দাদা ফ্রান্সিসকোর কথা কিছু শুনেছ মার্ট?’

না, ফ্রান্সিসকোর কথা মার্টিনেজ বিশেষ কিছু শোনেননি, শুনে থাকার কথাও নয়। কারণ মার্টিনেজের জন্মের অনেক আগেই, মানে প্রায় উনিশ-শো উনষাট বা ষাট সাল নাগাদই অত্যন্ত কিশোর বয়সে ফ্রান্সিসকো মারা যান। কানাঘুষোয় শুনেছেন সেই মৃত্যুও খুব একটা স্বাভাবিক না। এখন কথা হচ্ছে যে এসব পারিবারিক কথা মার্টিনেজের জানা উচিত ছিল। কিন্তু রডরিগোর মৃত্যুর পর পরই মার্টিনেজকে খানিকটা জোর করেই এক রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে ভরতি করে দেওয়া হয়। সেই থেকে শুরু করে যৌবনের অনেকটা কাল অবধি পরিবারের খুব একটা কাছাকাছি আসেননি মার্টিনেজ। কোথাও যেন মা-বাবার সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয় তাঁর, কোথাও যেন তাঁর মনে হত যে তাঁর বাবা বা মা চাইলেই রডরিগোর মৃত্যু আটকাতে পারতেন! নিয়তি যেন মার্টিনেজ তাঁর ও তাঁর পরিবারের মধ্যে অভিমানের একটা দুর্লঙ্ঘ পাঁচিল তুলে দিয়েছিল। তাই এসব পারিবারিক গল্পগাছা তিনি বিশেষ কিছুই শোনেননি। অবশ্য সিসিলিয়াকে বিয়ে করার পর থেকে পরিস্থিতি অনেক পালটায়। অভিজাত পরিবারের এই বুদ্ধিমতী মেয়েটি ব্যাপারটি বুঝতে বেশি সময় নেয়নি, এবং অনেক যত্ন ও ধৈর্যের সঙ্গে ফার্নান্দোর ও মার্টিনেজের সুসম্পর্ক আবার ফিরিয়ে আনে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মার্টিনেজ, হায় সিসিলিয়া, দেখ তোমার একমাত্র সন্তানকে কোন অযোগ্য বাবার হাতে দিয়ে গেলে। হঠাৎই খুব অসহায় বোধ করতে থাকেন তিনি। তাঁর শীত করতে থাকে।

‘ফ্রান্সিসকোর মারা যাওয়াটাও এইরকমই অদ্ভুতুড়ে ছিল মার্ট’, সেই নীচু চাপা স্বরে বলে যেতে থাকেন, ‘আশা করি তুমি যথেষ্ট ভালো করে পর্তুগালের ইতিহাস পড়েছ। আমাদের কলোনিগুলো কোথায় কোথায় ছিল নিশ্চয়ই মনে আছে তোমার। এর মধ্যে আফ্রিকাতে সবচেয়ে বড়ো কলোনি ছিল গিনি অ্যান্ড কেপ ভার্দ, অ্যাঙ্গোলা আর মোজাম্বিক।’

এতটা বলে একটু থামলেন ফার্নান্দো। মার্টিনেজ চুপ করে রইলেন। তিনি তাঁর বাবাকে চেনেন, এবং এও জানেন যে পর্তুগালের গৌরবময় অতীতের প্রতি ফার্নান্দোর একটা চোরা টান আছে। মার্টিনেজেরও সেই টান ছিল কিশোর বয়সে। কিন্তু তাঁর চিন্তাধারা পালটে যায় পরবর্তীকালে, মানে কৈশোর ও যৌবনের প্রাক্কালে। মার্টিনেজ প্রথম যৌবনে যে মেয়েটির প্রেমে পড়েন সে ছিল পারতিদো কম্যুনিস্তার, অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ সমর্থক। তার কাছেই সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের কথা শোনেন মার্টিনেজ। শোনেন সোভিয়েতের বিপ্লবের গল্প, পারী কমিউনের আখ্যান। সেই থেকে সাম্রাজ্যবাদের প্রতি মোহ কেটে যায় মার্টিনেজের। না, তিনি কোনোদিনই কমিউনিস্ট হয়ে যাননি, কারণ সেই সূত্রেই তিনি জানতে পারেন গুলাগের কথা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জার্মানি ও পোল্যান্ডে রেড আর্মির অমানুষিক অত্যাচার আর অগণিত ধর্ষনের কথা। তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের গণহত্যার বীভৎস ছবি তো কৈশোরে তিনি নিজেই দেখেছেন। সেই থেকে তিনি রাজনৈতিক দিক থেকে মধ্যপন্থা নিয়ে চলেন। সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার প্রতি তাঁর সুতীব্র ঘৃণা আছে, সে জাতীয়তার নামেই হোক কী কোনো আদর্শের নামে। মুশকিল হচ্ছে ফার্নান্দো বৃদ্ধ হয়েছেন, তাঁর সঙ্গে এসব নিয়ে তর্ক করতে আর ইচ্ছে করে না মার্টিনেজের।

ফের শুরু করেন ফার্নান্দো, ‘উনিশ-শো উনষাট সালে একটা অঘটন ঘটে যায়। পশ্চিম আফ্রিকাতে আমাদের কলোনি ছিল গিনি বিসও। বিসও এর প্রধান পোর্ট ছিল জেবা নদীর মোহনায়, পোর্ট অফ বিসও। তবে লোকে চিনত পোর্তো পিদজিগুইতি বলে।’

মার্টিনেজ জানেন এরপর কীসের কথা আসবে, তবুও চুপ করে রইলেন তিনি।

‘ঘটনার বছর তিনেক আগে গিনি ও কেপ ভার্দে একটি পর্তুগিজ বিরোধী বিদ্রোহী বাহিনী তৈরি হয়, আফ্রিকান পার্টি ফর দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্স অফ গিনি অ্যান্ড কেপ ভার্দ, ছোটো করে বলতে গেলে পাইজিসি। এই পাইজিসির প্ররোচনায় ওই বছর পোর্তো পিদজিগুইতির ডক শ্রমিক ও মজদুররা মজুরি বাড়ানোর দাবিতে ধর্মঘট করে। ব্যাপারটা আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে নেওয়া উচিত ছিল কিন্তু তার বদলে যা করা হয় তা অত্যন্ত লজ্জাজনক।’ এতটা বলে ফার্নান্দো ফের থামেন, একটু জল খেয়ে নেন। তারপর ভুরু কুঁচকে কী যেন ভেবে নিয়ে ফের শুরু করেন ‘তুমি তো জানোই আমাদের বাবা চাকরি করতেন পুলিশে। তখন তিনি ছিলেন একটি বিশেষ পুলিশবাহিনীর, যার নাম পি আই ডি ই, তার অন্যতম কর্তাব্যক্তি। এখন আর এর অস্তিত্ব নেই, তখনকার প্রধানমন্ত্রী অলিভিয়েরা সালাজার বিশেষ আদেশবলে এই বাহিনী তৈরি করেন। ওই ধর্মঘটের সময় বাবা তখন পিদজিগুইতিতে পোস্টেড। তার এক সপ্তাহ আগেই তিনি ওখানে গেছেন, সঙ্গে ফ্রান্সিসও। আমি মায়ের সঙ্গে মামার বাড়িতে আছি, ভিয়েনাতে। আচমকাই পিদজিগুইতির পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। দিনটা ছিল তেসরা অাগস্ট। পাইজিসির নেতারা এই ধর্মঘটের পিছনে মদত দিচ্ছে জেনে লিসবনের পি আই ডি ই-র হেডকোয়ার্টার থেকে আদেশ যায় যেকোনো মূল্যে ধর্মঘট ভাঙতে। বাবা আলোচনার মাধ্যমে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিতে ইচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু লিসবন শুনতে রাজি ছিল না। বাবা বাধ্য হয়ে গুলি চালানোর আদেশ দেন।’ এরপর দু-জনেই চুপ করে থাকেন। এতটা বলার দরকারই ছিল না মার্টিনেজকে, এসবই জানেন তিনি। পিদজিগুইতি ম্যাসাকার পর্তুগালের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। এই গুলিচালনার ফলে সেদিন কমপক্ষে পঞ্চাশ জন ডক শ্রমিক মারা যান। মার্টিনেজ খুব ভালো জানেন তাঁর ঠাকুরদার কী ভূমিকা ছিল সেইদিন। এখনও মাঝেমধ্যে পর্তুগালের রাজনৈতিক আলোচনার আসরে এই গণহত্যার কাহিনি উঠে আসে, চুলচেরা বিশ্লেষণ হয় সেই নিয়ে।

কিন্তু তার সঙ্গে ফ্রান্সিসকোর মৃত্যুর কী সম্পর্ক?

এইবার ঘোলাটে চোখ তুলে তাকালেন বৃদ্ধ, ‘সেই দিন রাতেই মারা যায় ফ্রান্সিস। বাবা ওকে কোয়ার্টারে রেখে গেছিলেন, সঙ্গে শুধু এক জন আফ্রিকান মহিলা অ্যাটেন্ডেন্ট ছিলেন। মধ্যরাত্রে বাবা ক্লান্ত শরীরে টলতে টলতে ফিরে দেখেন দরজা খুলছে না কেউ। শেষে দরজা ভাঙতে হয়। দরজার কাছেই সেই মহিলা অ্যাটেনডেন্টের মৃতদেহ পড়ে ছিল, আর রান্নাঘরের সামনে মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছিল ফ্রান্সিস। বাবার কোলে মাথা রেখেই মারা যায় সে, তার আগে অত্যন্ত কর্কশ ও অপরিচিত গলায় শুধু বলে যায়, ‘‘পাপের বেতন মৃত্যু, চাবুকের বেতন রক্ত।’’ তারপরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আমার দাদা।’

এইবারে সোজা হয়ে বসেন মার্টিনেজ, স্পষ্টতই ফ্রান্সিসকোর মৃত্যু আর তিয়াগোর অসুস্থ হওয়ার ঘটনা দুটোর মধ্যে আশ্চর্যরকম সাদৃশ্য আছে। কিন্তু… যেন মার্টিনেজের মনের কথা জেনেই বলে যেতে থাকেন ফার্নান্দো, ‘সেবারেও কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি, না ফ্রান্সিসের শরীরে, না সেই মহিলা। দু-জনের মুখই অজানা আতঙ্কে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে ছিল। আর একটা বিশ্রী পচা গন্ধ অনেকক্ষণ সেই ঘরে রয়ে গেছিল।’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকেন মার্টিনেজ। এর মানে কী?

এরপর এক অদ্ভুত ভৌতিক স্বরে ফিসফিস করে বলে ওঠেন ফার্নান্দো, ‘আমি জানি তুমি কী ভাবছ মার্টিনেজ। আজ তোমাকে সব বলব বলেই ডেকেছি। জানি না তুমি জানো কি না, বা লক্ষ করেছ কি না, আমাদের ফ্যামিলিতে কারও কোনো বড়ো ছেলে বাঁচে না। কোনো-না-কোনো অপঘাতে মারা যায়। শুধু অপঘাত নয়, প্রতিটিই ব্যাখ্যাহীন দুর্ঘটনা। সেই থেকে আমাদের পরিবারে অলিখিত নিয়ম দুটি সন্তানের জন্ম দেওয়া, সে ছেলে হোক বা মেয়ে। আমরা জেনেই এসেছি যে আমাদের জ্যেষ্ঠ সন্তানটিকে হারাতে হবে, এবং তার কোনো কারণ থাকবে না। সেইজন্যই যখন একটি সন্তানের জন্ম দিয়ে সিসিলিয়া মারা গেল, তোমাকে আরেকটা বিয়ে করতে বলেছিলাম। কারণ আমি জানতাম, তোমার মা-ও জানত যে তিয়াগো বাঁঁচবে না, বাঁচতে পারে না।’

মার্টিনেজ শুনলেন, কিন্তু কিছুই বুঝলেন না। শক্ত মানুষ তিনি, বীরশ্রেষ্ঠ, কম্যান্ডোশাস্ত্রে মহারথী। তিনিও এর কোনো থই পেলেন না। চোয়াল শক্ত করে খরদৃষ্টি মেলে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

এইবার ফার্নান্দোর মুখে যেন সারা শরীরের রক্ত এসে জমা হল। কোনো এক অব্যক্ত উত্তেজনায় ফেটে পড়তে চাইল সেই বৃদ্ধের সমস্ত শরীর, এবার যখন তিনি মুখ খুললেন মনে হল ফার্নান্দো ভাজ নয়, যেন এক অলৌকিক দৈবীস্বর কথা বলে উঠল, ‘তোমাকে কখনো বলিনি মার্ট, কারণ তুমি এসবে বিশ্বাস কর না। কিন্তু তবুও বলছি শোনো, আমাদের পরিবারের ওপর একটি অতি প্রাচীন অভিশাপ আছে, প্রায় পাঁচ-শো বছরের পুরোনো অভিশাপ। পুরুষানুক্রমে আমরা সেই অভিশাপের ব্যাপারে জেনে এসেছি এবং তার উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি। এই অভিশাপের জন্যে আমাদের পরিবারের কোনো জ্যেষ্ঠ সন্তান বাঁচে না।’

মুহূর্তের জন্যে চুপ করেন তিনি, দম নিয়ে ফের শুরু করেন। স্থাণুবৎ বসে থাকেন মার্টিনেজ।

‘ইট ওয়াজ অ্যারাউন্ড ফিফটিন সিক্সটি। ইন্ডিয়াতে যখন আমরা কলোনি স্থাপন করছি, মোস্ট স্পেসিফিক্যালি গোয়াতে। সেখানকার ভাইকার জেনারেল ছিলেন আমাদেরই এক পূর্বপুরুষ, মিগুয়েল ভাজ। তিনি পোপের আদেশে একটি অসামান্য শক্তিশালী রিলিজিয়াস আর্টিকেল দখল করতে গিয়ে একটি ঘোর অন্যায় করেন। ইনকুইজিশনের আশ্রয় নিয়ে কোনো এক হিন্দু প্রিস্টকে খুন করেন। শুধু তাই নয়, খুন করার আগে তাঁর সামনে তাঁর স্ত্রী আর একমাত্র সন্তানকে খুন করে জ্বালিয়ে দেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই পুরোহিত ছিলেন একজন অসামান্য শক্তিধর অকাল্টিস্ট। তিনি মারা যাওয়ার আগে আমাদের, সমগ্র ভাজ পরিবারের আত্মাকে অভিশপ্ত করে যান, বলে যান যে আমাদের পরিবারের কোনো জ্যেষ্ঠ সন্তান বাঁঁচবে না। এবং সেই থেকে এই পরিবারের কোনো জ্যেষ্ঠ সন্তান বাঁচেনি। তিনি এও বলে যান শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত এই অভিশাপ আমাদের তাড়া করে ফিরবে, এর থেকে আমাদের মুক্তি নেই।’

এতটা একসঙ্গে বলে সামান্য হাঁপাতে থাকেন ফার্নান্দো। মার্টিনেজ শুনছিলেন। এতক্ষণ, এবার প্রশ্ন করেন, ‘সাউন্ডস রাবিশ! ইজ দিস সিরিয়াস, পাপাই?’

‘ড্যাম সিরিয়াস মার্ট।’

‘আমি এসবে বিশ্বাস করি না পাপাই। কো ইন্সিডেন্স হতে পারে, অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে, হাজারো একটা কারণ হতে পারে…’

‘সব জেনারেশনেই অ্যাক্সিডেন্ট আর কো ইন্সিডেন্স মার্ট? প্রতিটি মৃত্যুর কোনো এক্সপ্লানেশন নেই। আজ অবধি একটি মৃত্যুরও কোনো সুরাহা হয়নি। কোন কারণ হতে পারে মার্ট?’

‘তার কারণ নিশ্চয়ই ঠিক ভাবে তদন্ত হয়নি তাই। পাপাই, খুব স্পষ্ট করে বলছি এসবে আমি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করি না…’

ঝুঁকে পড়ে ছেলের হাতটা খপ করে ধরেন ফার্নান্দো, ‘তোমার বিশ্বাস করা না করায় কিছু এসে যায় না মার্টিনেজ। গত পাঁচ-শো বছর ধরে আমাদের পরিবারের প্রতিটি জ্যেষ্ঠ সন্তান মারা গেছে, আজ অবধি এর অন্যথা হয়নি। এবং প্রতিবারেই, আই রিপিট, প্রতিবারেই কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। সব আমাদের পারিবারিক ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে, তোমাকে কোনোদিন এসব বলতে পারিনি, তার কারণ… কারণ… দশ বছর বয়েস থেকেই তুমি বাড়ির বাইরে মানুষ হয়েছ। তোমার মা ও চাননি তোমাকে সব কথা বলতে। কিন্তু আজ বলতে খারাপ লাগছে মার্ট, তিয়াগোর জন্যে আমি কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না।’

আকাশের দিকে তাকান মার্টিনেজ। বিজ্ঞান আর যুক্তির বাইরে আর কিছু ভাবতে পারেন না তিনি, ভাবা উচিতও নয়। কিন্তু মিজেরাকর্দিয়ার আই সি ইউ কেবিনে শুয়ে থাকা একটা ছোট্ট অসহায় শরীর তাঁর মানসিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে দিয়েছে। ফার্নান্দো যা বলছেন তাতে ভুল নেই, অথচ মেনে নিতেও মন চায় না। তিয়াগো… তিয়াগোর জন্যে সব করতে পারেন মার্টিনেজ। সত্যিই যদি তাই হয়? ফার্নান্দো যা বলছেন তা যদি সত্যি হয়েই থাকে…তাহলে?

ঝুঁকে আসেন মার্টিনেজ, স্টিলের মতন শক্ত এবং শীতল স্বরে জিজ্ঞেস করেন, ‘যদি তোমার কথা সত্যি হয় পাপাই, তাহলে আমাকে বল এর থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় আছে কিছু?’

চুপ করে থাকেন ফার্নান্দো, তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়তে থাকেন, ‘একটা উপায় আছে মার্ট, আমরা আগে জানতাম না আছে বলে। আমি সারাজীবন চেষ্টা করে গেছি এর কোনো প্রতিকারের জন্যে। নানা জায়গায় ছুটে গেছি, হাজারো লোকের সঙ্গে আলোচনা করেছি, কয়েক হাজার বই ঘেঁটেছি। এত পরিশ্রমের পর সদ্য, এই মাস দুয়েক আগে হয়তো একটা রাস্তা খুঁজে পেয়েছি। জানি না কতটা ঠিক, আর তার থেকেও বড়ো কথা হল যে তার মতন শক্ত আর কঠিন কাজ কিছু নেই।’

চোখ সরু করে নৈর্ব্যক্তিকস্বরে জিজ্ঞেস করলেন মার্টিনেজ, ‘সেই রাস্তা নিলে কি তিয়াগোকে বাঁচানো গেলেও যেতে পারে?’

‘আ-আই বিলিভ সো। কিন্তু তার দাম বড়ো কড়া মার্ট। প্রায় অসম্ভব সেই উপায়, অবিশ্বাস্য রকমের কঠিন সে রাস্তা…’

‘প্লিজ টেল মি অ্যাবাউট ইট।’

‘আমি তোমাকে হারাতে চাই না মার্ট। ভেবে দেখো, তুমি ছাড়া আর কেই বা আছে আমার?’ চোখ ছলছল করে ওঠে সেই বৃদ্ধের, গলা বুজে আসে।

‘পাপাই, প্লিজ টেল মি অ্যাবাউট দ্য ওয়ে।’

খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন ফার্নান্দো। তারপর গলা খাঁকড়ে পরিষ্কার করে বলেন, ‘ওকে। লেট মি শো ইউ সামথিং। কী সেই অসাধারণ পাওয়ারফুল রিলিজিয়াস আর্টিকেল।’

এই বলে ধীরে ধীরে উঠে নিজের ঘরের দিকে যান ফার্নান্দো। পাথরের মতন শক্ত মুখ করে বসে থাকেন মার্টিনেজ। তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে। বাটলাররা এসে বারান্দার আলো জ্বেলে দিয়ে গেল। এতক্ষণ ধরে বাবা কি করছেন না জেনে মার্টিনেজ উশখুশ করেছিলেন। বারান্দার পাশেই ফার্নান্দোর শোবার ঘর। খানিকক্ষণ পরেই সেখান থেকে একটা মৃদু ঘটাংঘট শব্দ মার্টিনেজের কানে আসতে উনি বিস্মিত হয়ে উঠলেন।

ফার্নান্দোর একটি গোপন দেরাজ আছে। ফার্নান্দোর বললে ভুল বলা হবে, এই পরিবারের কর্তাদের। মানে যিনিই এই পরিবারের কর্তৃত্ব হাতে পেয়েছেন, তিনিই ওই বিশাল মাস্টার বেডরুমের অধিকার পেয়েছেন, এবং সেইসঙ্গে তাঁর ওপরেই দেওয়ালে গাঁথা গোপন দেরাজটির মালিকানা ন্যস্ত হয়েছে। বাড়ির কর্তাব্যক্তি না হওয়া ইস্তক ভাজ পরিবারের কারো পক্ষে সে দেরাজে হাত দেওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এই দেরাজে এমন কিছু জিনিস আছে যা অমূল্য, মানে আক্ষরিক অর্থেই তার কোনো দাম হয় না। তার দ্বিতীয় জোড়া থাকা তো সম্ভবই নয়, আর ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, ধর্মীয় বা সামাজিক দিক থেকেও সেসব জিনিসের অভিনবত্ব বা স্বাতন্ত্র্য অদ্বিতীয় বললে কম বলা হয়। ফার্নান্দো একবার মার্টিনেজকে বলেছিলেন এর কথা। এখানে এমন দুটি প্রামাণ্য পুঁথি আছে যার জন্যে ক্রিশ্চিয়ানিটির ইতিহাস সম্পূর্ণ পালটে দিয়ে নতুন করে লেখা যায়। রয়েছে কাপড়ের ওপর চারকোল আর বিভিন্ন জৈব রঙে আঁকা এমন একটি পোর্ট্রেট যা বোধ হয় প্রভু যিশুর, খুব সম্ভবত মেরি ম্যাগদালেনের আঁকা। সেখানে যিশুর চুল কোঁকড়া কালো, নাক থ্যাবড়া, কপাল উঁচু আর দু-চোখে আশ্চর্য মায়াময় দৃষ্টি। অথবা মধ্যপ্রাচ্যের অসামান্য প্রতিভাধর বৈজ্ঞানিক ইবনে সিনা বা আভিসেন্নার নিজের হাতে লেখা চিকিৎসাবিদ্যার ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ বই, যার কথা আজও কেউ শোনেনি। মার্টিনেজ সেদিন কোনোই উৎসাহ দেখাননি। কিন্তু আজকের মার্টিনেজ সেই সেদিনের মার্টিনেজ নয়। সকালে মিজেরাকর্দিয়াতে আই সি ইউ-এর সামনে কাটানো কয়েকটা ঘন্টা লোকটাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। তিনি আজ তিয়াগোকে বাঁচাবার জন্যে দরকার হলে বুজরুকিতেও বিশ্বাস করতে রাজি!

ফার্নান্দো এসে সামনের চেয়ারে বসলেন। তারপর একটা লাল রেশমে জড়ানো চৌকোনা কিছু একটা রাখলেন টেবিলের ওপরে। রেশমের কাপড় খুলে বেরোলো একটি হাতির দাঁতে তৈরি বাক্স, যার গায়ের অসামান্য অলংকরণ দেখলে এর দুষ্প্রাপ্যতা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। সেই হাতির দাঁতের বাক্সের ডালা খুলে বাক্সটা মার্টিনেজের দিকে ঘুরিয়ে দেন ফার্নান্দো, ‘কথা ছিল মিগুয়েল এইটা হস্তগত করে তখনকার পোপ ‘‘তৃতীয় জুলিয়াসের’’ হাতে তুলে দেবেন। কিন্তু যখন ওই ঘটনা ঘটে তার কয়েক বছর আগেই পোপ মারা যান। মিগুয়েল আর কোনোদিন জিনিসটা পোপের হাতে তুলে দিতে পারেননি, তার অবশ্য যথেষ্ট কারণ ছিল’, বলে সাময়িকভাবে চুপ করেন ফার্নান্দো।

ততক্ষণ ধরে নিবিষ্টমনে বাক্সের মধ্যে সযত্নে রক্ষিত বস্তুটিকে দেখছিলেন মার্টিনেজ। তাঁর সেই একাগ্রদৃষ্টি দেখে বোঝার উপায় ছিল না তাঁর কানে ফার্নান্দোর কথাগুলো যাচ্ছে, না যাচ্ছে না!

এই তাহলে সেই?? এর জন্যেই তাঁর পরিবারের ওপর রক্ত আর অশ্রুর ডানা মেলে আছে এক পাঁচ-শো বছরের প্রাচীন অভিশাপ? এর জন্যেই তাঁর তিয়াগো আজ কোমাতে? খানিকটা অবিশ্বাসের সঙ্গেই চুপ করে তাকিয়ে ছিলেন তিনি।

জিনিসটা মুঠোর মধ্যে ধরা যায় এমন একটা পাথুরে কিছু। আকারটা ডিমের মতন গোলাকার, তাও একটু অদ্ভুত। আর কালো, মানে কুচকুচে কালো। এমন স্ফটিককালো মসৃণ পাথর আর দেখেননি মার্টিনেজ। না শুধু কালো নয়। আরও একটা কিছু আছে ওর মধ্যে, মনে হল মার্টিনেজের। হিরের থেকে যেমন উজ্জ্বল দ্যুতি বার হয়, এই কালো পাথরটা থেকেও যেন তেমনই একটা ঘনকৃষ্ণ উজ্জ্বল অন্ধকার বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আহা, কালোরও যে এত মনোহারি ঔজ্জ্বল্য হয়, অন্ধকারেরও যে এমন চোখ ধাঁধানো রূপ হয় সে মার্টিনেজ আজ অবধি কখনো দেখেননি। তিনি নির্নিমেষে এর দিকে চেয়েছিলেন, তাকিয়ে ছিলেন মোহগ্রস্তের মতন।

ডান হাত বাড়িয়ে তিনি জিনিসটাকে হাতে তুলে নিলেন, এবং সঙ্গেসঙ্গে দুটো জিনিস অনুভব করে সামান্য শিউড়ে উঠলেন। এক, জিনিসটা তার আকারের তুলনায় ভারী। শুধু ভারী নয়, একই আকারের লোহার তুলনায় কম করে চার থেকে পাঁচ গুণ ভারী। এবং দুই, বস্তুটি শুধু ভারী নয় শীতলও বটে, এমনকী হিমশীতল বললেও কম বলা হয় তাকে। এতদিন ধরে হাতির দাঁতের বাক্সে বন্দি হয়ে দেওয়ালে গাঁথা দেরাজে থেকে ওই শৈত্য সম্ভব নয়। স্পর্শ মাত্রেই এই কঠিন শৈত্য চৈতন্যে অশরীরী বোধ জাগ্রত করে। জিনিসটা হাতে তুলে চোখের আরও কাছাকাছি আনলেন মার্টিনেজ। আর তখনই আরও তিনটি জিনিস লক্ষ্য করে আশ্চর্য হলেন তিনি। এই মুঠোর মধ্যে ধরতে পারা বস্তুটির গা মসৃণ। বোধ হয় বলা ভুল হল, মসৃণ নয়, অবিশ্বাস্য রকমের মসৃণ। পর্তুগালের সেরা কম্যান্ডো নেতা হওয়ার খাতিরে মার্টিনেজকে আরও বিবিধ কৃত্রিম পদার্থের কার্যকারিতা ব্যবহার করে দেখতে হয়, সেসব সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু মার্টিনেজ হলফ করে বলতে পারেন যে এই বস্তুটি তাঁর অভিজ্ঞতায় সম্পূর্ণভাবে নতুন। আর দ্বিতীয়টি হল, যেটাকে তিনি ঘনকৃষ্ণ কালো বলে মনে করছিলেন, কাছে আনলে দেখা যাচ্ছে যে তার সারা গা জুড়ে বিদ্যুতের মতন খেলে যাচ্ছে এক রক্তলাল আভা। খুবই সূক্ষ্ম সেই লাল রঙের আলোর নাচন, কিন্তু এই প্রথম মার্টিনেজের মনে হল জিনিসটা জ্যান্ত! ওর মধ্যে প্রাণ আছে, আর এই তড়িদ্্গতি বিদ্যুৎশিখাই তার চিহ্ন। সামান্য শিউড়ে উঠে জিনিসটা রেখেই দিতেন মার্টিনেজ, এমন সময় তিনি এর আকারটি লক্ষ্য করলেন। আর তাঁর মনে হল যেন এই আকার বা আকৃতি তিনি আগে কোথাও দেখেছেন। কোথায় দেখেছেন উনি? ভুরু কুঁচকে ভাববার চেষ্টা করলেন। ‘কংখ শেল’, যেন মার্টিনেজের মনের কথা ভেবেই বলে উঠলেন ফার্নান্দো, ‘হিন্দুরা বলে শঙ্খ, হিন্দুদের কাছে পবিত্রতম ধর্মীয় বস্তুগুলির মধ্যে একটি। এই স্পেশ্যাল বস্তুটি এক্স্যাক্টলি একটি শঙ্খের আকারের। এবং শুধু তাই নয়, এর একটি স্পেশ্যালিটি আছে, এর মাথাটা চোখের সামনে ধর।’

বাবার কথা মতন তাই করলেন মার্টিনেজ, প্রথমে কিছু বুঝলেন না। তারপর চোখ সয়ে আসতে ব্যাপারটা উনি ঠাহর করতে পারলেন। প্রায় আসল কংখ শেলের মতোই এই বস্তুটিরও একটি স্পাইরাল আছে। এবং যে লাল রঙের সূক্ষ্ম বিদ্যুৎপ্রভা উনি দেখেছিলেন আগে, সেগুলো যেন খেলে যাচ্ছে স্পাইরালের ভাঁজ বরাবর। সামান্য বিচলিত মুখ তোলেন উনি, ‘ইয়েস পাপাই, আই ক্যান সি দ্য স্পাইরাল।’ এই বলে জিনিসটা আইভরি বাক্সে রেখে, বাক্সটা বন্ধ করলেন মার্টিনেজ। তারপর সেটা বাবার দিকে ঠেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হ্যাঁ পাপাই, কী যেন বলছিলে?’

ততক্ষণে তাঁদের সামনে উৎকৃষ্ট কফি এনে হাজির করেছে পরিচারক। তাতে একটা চুমুক দিয়ে শুরু করলেন ফার্নান্দো, ‘মিগুয়েল তখন দেশে ফিরে এসেছেন, তখন পোপ চতুর্থ পায়াস। ইনি একটু গুছিয়ে বসেই গোপন এত্তেলা পাঠান মিগুয়েলের কাছে, জিনিসটা তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে। কিন্তু পোপ যেটা অসম্ভব ভেবেছিলেন, তাই হল। মিগুয়েল প্রথমে পোপের আদেশ এড়িয়ে গেলেন কয়েক বার। শেষে আরও চাপ বাড়লে মিগুয়েল এটি পোপের হাতে তুলে দিতে সরাসরি অস্বীকার করেন। স্বাভাবিক ভাবেই পোপ চতুর্থ পায়াস এবার পর্তুগাল সম্রাটের দ্বারস্থ হন। পোপের ব্যক্তিগত সচিব পোপের চিঠি নিয়ে স্বয়ং হাজির হন সম্রাটের দরবারে। সালটা ১৫৬৫, তখন পর্তুগালের শাসক বালক সম্রাট প্রথম সেবাস্তিয়ান।

সম্রাট সেবাস্তিয়ানের লাইফটা খুব অদ্ভুত, জানো মার্ট। ইনি তিন বছর বয়সেই রাজা হন এবং নাবালক রাজার রিজেন্সি বা রাজপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্বভার নেন তাঁর ঠাকুমা, অস্ট্রিয়ার বিখ্যাত হ্যাপ্সবার্গ রাজবংশের মেয়ে রানি ক্যাথরিন।

ক্যাথরিন অত্যন্ত ধর্মভীরু মহিলা ছিলেন, জেসুইটদের কথায় উঠতেন ও বসতেন। পোপ নিশ্চিন্ত ছিলেন যে রানির আদেশ না মেনে মিগুয়েলের উপায় থাকবে না। কিন্তু দেখা গেল যে মিগুয়েলও কূটনীতিতে কম প্রতিভাধর ছিলেন না। তিনি রানির সঙ্গে গোপনে দেখা করে এমন জিনিস উপঢৌকন হিসেবে দিলেন যে পুরো ঘটনার মোড় ঘুরে গেল।

রানি ক্যাথরিন সমগ্র ইউরোপে কালেক্টর বা সংগ্রাহক হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। কথিত আছে অন্য অনেক অদ্ভুত জিনিসের সঙ্গে তাঁর সংগ্রহে নাকি একটি ইউনিকর্নের শিং-ও ছিল। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহই এই সমগ্র পশ্চিম ইউরোপের প্রথম কুন্সটক্যামার।’

‘কি? কুন্স হোয়াট?’ শেষ শব্দটা ভালো করে বুঝতে পারলেন না মার্টিনেজ।

‘কুন্সটক্যামার, শব্দটা জার্মান। ওর মানে হচ্ছে ক্যাবিনেট অফ কিউরিওসিটি বা ক্যাবিনেট অফ ওয়ান্ডার। এই ধরণের ব্যক্তিগত কুন্সটক্যামার বা কুন্সটকাবিনেট থেকেই পরে মিউজিয়ামের ধারণা আসে।’ ব্যাখ্যা করেন ফার্নান্দো। একটু দম নিয়ে ফের বলতে থাকেন, ‘কিন্তু বিশেষ করে যে জিনিসের বিপুল সংগ্রহের জন্যে রানি ক্যাথরিন ইউরোপের নজর কেড়ে নিয়েছিলেন তা হচ্ছে চীন থেকে আনা পোর্সিলিনের বাসনপত্র এবং অন্যান্য শিল্পদ্রব্য। এ ব্যাপারে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এবং তাঁর কাছে এই পোর্সেলিনের শিল্পদ্রব্যের সম্ভার পর্তুগালের রাজবৈভবের প্রতীক ছিল। আর এইখানেই বোঝা গেল মিগুয়েলের বুদ্ধিমত্তা।

তুমি নিশ্চয়ই জানো যে এশিয়াতে আমাদের সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল গোয়া। গোয়া ছাড়াও, পনেরো-শো সাতান্ন নাগাদ আমরা আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বন্দরশহর দখল করি এশিয়াতে। উনিশশো নিরানব্বই অবধি আমাদের অধিকারে ছিল সে শহর।’

‘ম্যাকাও’, বলে ওঠেন মার্টিনেজ। বাণিজ্যবন্দর হংকং এর কাছে ছোট্ট দ্বীপ ম্যাকাও। ক্যাসিনো এবং বিলাসের স্বর্গরাজ্য, বছর দেড়েক আগে সেখানে একবার গেছিলেন বটে মার্টিনেজ। মৃদু হাসেন ফার্নান্দো, ‘চীনে তখন মিং রাজবংশের শাসন, পোর্সেলিন শিল্পের রমরমা সময়। গোয়া থেকে চলে আসার আগে মিগুয়েল প্রচুর পোর্সেলিনের ভাস আর অন্যান্য জিনিসপত্র ম্যাকাও থেকে আমদানি করেন ও সেইসব নিয়ে পর্তুগাল চলে আসেন। সেই অসামান্য কারুকার্যখচিত পোর্সেলিনের সম্ভার নিয়ে মিগুয়েল সোজা রানি ক্যাথরিনের কাছে হাজির। আর রানিমাও গলে জল! ফলে যা হওয়ার তাই হল, পোপের সচিবকে খালি হাতেই রোমে ফিরতে হল। রাজদরবারে মিগুয়েলের প্রতিপত্তি বেড়ে দ্বিগুণ হল। এরপরেও রোমের পক্ষ থেকে অনেক চেষ্টা হয়েছে এই জিনিসটি উদ্ধার করার। অন্য কোনো পরিবার হলে হয়তো এতদিনে জিনিসটা ভ্যাটিকানের গোপন প্রকোষ্ঠে শোভা পেত। কিন্তু পর্তুগালের বুকে দাঁড়িয়ে ভাজ পরিবারের হাত থেকে কোনো জিনিস কেড়ে নেওয়া কতটা অসম্ভব সে তুমিই জানো।’

একটা খটকা মার্টিনেজের মনে রয়েই গেল, ‘কিন্তু পোপের হাতে তুলে দিতেই বা কী অসুবিধা ছিল? মানে মিগুয়েল হঠাৎ এটা ফেরত দিতে অস্বীকার করলেনই বা কেনো? পোপকে দেবেন বলেই তো দখল করেছিলেন ওটা।’

চশমাটা খুলে দু-আঙুলে দুই চোখের সংযোগস্থলটা একটু চেপে ধরেন ফার্নান্দো, ফের চশমাটা পরে নেন। তারপর ধীর এবং অনুচ্চ গলায় শুরু করেন, ‘এই কথাটা বলার জন্যেই এত বিশদে ঘটনাগুলো তোমাকে জানাচ্ছি মার্ট। মিগুয়েলের একটি ডায়েরি আমি উদ্ধার করি কয়েক বছর আগে। তার সঙ্গে আর একটি গোটানো ডিক্লারেশন পাই, লিওনার্দো বলে আমাদেরই এক পূর্বপুরুষের লেখা একটি ঘোষণাপত্র। রডরিগো মারা যাওয়ার পর বাকি সারাজীবন ধরে আমি এই অভিশাপ ও তার থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় খুঁজে ফিরেছি। তুমি তো জানোই আমার নিজেরই উৎসাহ আছে এই বিষয়ে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি মাত্র উপায়ই আছে, এবং তা কোনো অলৌকিক আধিদৈবিক উপায়। সাধারণ মানুষী উপায়ে এর কোনো সমাধান সম্ভব নয়। সে যাই হোক, এই করতে করতে শেষতক বছর পাঁচেক আগে আমাদেরই পারিবারিক লাইব্রেরিতে দেওয়ালের মধ্যে গাঁথা একটি গুপ্ত দেরাজ থেকে মিগুয়েলের ডায়েরি উদ্ধার করি।

সেই ডায়েরিতে অনেক কথা লেখা আছে। সব তোমাকে বলার দরকার নেই। মিগুয়েল দেশে ফিরে শোনেন তাঁর বড়ো ছেলের দৈব দুর্বিপাকে মারা যাওয়ার খবর। ছেলের শোকে মিগুয়েলের স্ত্রী আত্মহত্যা করেন। বড়ো ছেলের পরেও মিগুয়েলের আরও একটি ছেলে ও মেয়ে ছিল, তাঁদের তিনি বহু পরিশ্রমে মানুষ করেন। ছেলে মারা যাওয়ার খবর শুনে মিগুয়েলের মনে ভয় এবং অনুশোচনা, দুইই ঢোকে। তিনি ভেবেছিলেন যে করেই হোক তিনি ইন্ডিয়া ফিরে গিয়ে যেখানকার জিনিস সেখানে ফিরিয়ে দিয়ে আসবেন। ফলে পোপের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা তাঁকে নাকচ করতে হয়। তার থেকেও বড়ো কথা, বস্তুটি হাতে নিয়ে মিগুয়েলের মনে এক আশ্চর্য অতীন্দ্রিয় অনুভূতির সৃষ্টি হয়। কোনোমতেই তিনি এটা হাতছাড়া করতে চাননি। মিগুয়েলের সেই বেঁচে থাকা ছেলেটির নাম ছিল আলমাও। আলমাওয়ের দুটি সন্তান হয়, বড়োটি মেয়ে, নাম বেথানিয়া। নিজের বিয়ের দিন সম্পূর্ণ অলৌকিক উপায়ে জ্বলে গিয়ে বেথানিয়া মারা যান। এই ঘটনাটা এতই অবিশ্বাস্য, যে তোমাকে না বলে পারছি না। ভাজ পরিবারের বড়ো মেয়ের বিয়ে। রাজপরিবার থেকে শুরু করে সারা দেশের গণ্যমান্যরা উপস্থিত, বিদেশাগত অতিথিও কম নেই। স্বয়ং রাজা বিশেষ আশীর্বাদ পাঠিয়েছেন, উপহার দিয়েছেন বহুমূল্য হিরের নেকলেস। লিসবনের সবচেয়ে পুরোনো এবং বড়ো ক্যাথিড্রাল সে দে লিসবোয়ার আর্চবিশপ স্বয়ং নিজে বিয়ে দিতে উপস্থিত। দামি গাউন পরে বেথানিয়া চার্চের আইল ধরে হেঁটে এসেছেন এইমাত্র, আর্চবিশপ মন্ত্রোচ্চারণ করছেন। শপথ নেওয়ার ঠিক সেই স্মরণীয় মুহূর্তে হাসিমুখে বেথানিয়া সলজ্জ ভঙ্গিতে বলবেন, ‘ইয়েস আই ডু’, এমন সময় হল ভরতি লোকের সামনে, সম্পূর্ণ অলৌকিক ভাবে বেথানিয়া সমস্ত কাপড়চোপড় নিয়ে দপ করে জ্বলে ওঠেন। মানে একটুখানি আগুন লেগে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়া নয়, যেখানে দূরদূরান্ত অবধি কোথাও আগুনের চিহ্নমাত্র ছিল না সেখানে পুরো মানুষটাই দপ করে একসঙ্গে জ্বলে ওঠে। যেন তুলোভরা কাগজের পুতুল কেউ আপাদমস্তক পেট্রোলে ভিজিয়ে তার ওপর দেশলাইকাঠি ছুঁড়ে মেরেছে! এই বুদ্ধির অতীত, ব্যাখ্যার অতীত অনৈসর্গিক দৃশ্য দেখে উপস্থিত মহিলারা আতঙ্কে অজ্ঞান হয়ে যান, আর্চবিশপও তাই। বর বেচারির হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে সেখানেই মারা যায়। বেথানিয়ার মরণপণ আর্তনাদ, জ্বলন্ত গাউন নিয়ে দৌড়াদৌড়ি, পোড়া মাংসের গন্ধ, বাচ্চাদের কান্নার শব্দে জায়গাটা প্রায় নরক হয়ে ওঠে। সমস্ত অতিথিরা হুড়োহুড়ি করে পালাতে থাকেন, তাতে আবার মন্ত্রীপরিষদের দু-এক জন সদস্য সামান্য চোটও পান। অত বড়ো ক্যাথেড্রালের দামি কার্টেনে আগুন লেগে যায়। সামনের সারির কিছু বেঞ্চও পুড়ে যায়, পুড়ে কালো হয়ে যায় পূর্ব দিকের দেওয়ালের মিকেলেঞ্জেলোর অনুকরণে আঁকা বিশাল মুরাল।

প্রভাবশালী হওয়ার জন্যে অনেক কষ্ট করে হলেও প্রচুর টাকা ছড়িয়ে ভাজ পরিবার এই ঘটনা ধামাচাপা দেয়। নইলে সে দে লিসবোয়া তো প্রথমে দাবিই তুলেছিল যে ভাজ পরিবার শয়তানি কালাজাদু প্র্যাকটিস করে, তারা খ্রিস্টবিরোধী। ভাজ পরিবারকে দেশছাড়া করা হোক।’

ধৈর্য হারাচ্ছিলেন মার্টিনেজ। তাঁর কাছে সময় বড়ো অল্প, তিয়াগো আজ মৃত্যুশয্যায়, এবং তাকে বাঁচানোর জন্যে তিনি নিজের শরীরের শেষ রক্তবিন্দুটুকু অবধি আজ খরচ করতে রাজি। এত সব গালগল্প কি এখন না শুনলেই না? একটু রূঢ়ভাবেই বললেন, ‘পাপাই, সব বুঝলাম, এখন প্লিজ বলবে তিয়াগোকে বাঁচাবার জন্যে ঠিক কী কী করতে হবে?’

থমকালেন কি ফার্নান্দো? সন্তানের রূঢ়ভাষা কি কোনোভাবে আঘাত করল তাঁকে? হয়তো করল, কিন্তু তিনি মার্টিনেজের এই উদ্ভ্রান্ত উদ্বেগ বুঝলেন, হাজার হোক, তিনিও যে বাবা, মার্টিনেজেরই বাবা! রডরিগোর সময়ে তিনি নিজেও কি এমন উদ্ভ্রান্ত, এমন অধৈর্য হননি?

‘সবই বলছি মার্ট। সব কথা যতটা সম্ভব খুলে না বললে তোমার পক্ষে হয়তো পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া অসুবিধা হয়ে যাবে। এরপর যা বলব তার প্রতিটি শব্দ শুনবে, মন দিয়ে শুনবে, ওকে? নাউ লিসন…’ তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা, দেওয়ালে খেলতে থাকা দুটি ছায়া আরও নিবিড় হয়ে ঝুঁকে বসল পরস্পরের দিকে। জুলাই মাসের আশ্চর্যরকম পরিষ্কার আকাশ। বৃশ্চিকরাশি স্পষ্টতই যেন চোখ মেলে তাকাল এই পিতাপুত্রের দিকে, জ্যেষ্ঠা নক্ষত্র তার সবটুকু আলো ঢেলে দিতে চাইল সেই গোলটেবিলটি ঘিরে। পাঁচ-শো বছর ধরে আবর্তিত এক বিশেষ নক্ষত্রমণ্ডলের চলন ধীর হয়ে আসতে লাগল।

‘আগেই বলেছি বেথানিয়ার ঘটনা ঘটার সময় মিগুয়েল যথেষ্ট বৃদ্ধ। অনুতাপের আগুনে পুড়তে পুড়তে তিনি ভাবলেন যে এটা তিনি যেখান থেকে এনেছিলেন সেখানেই ফিরিয়ে দিয়ে আসবেন। কিন্তু তখনই তাঁর যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, তিনি বুঝতে পারছিলেন যে আরেকটা লম্বা সমুদ্রযাত্রার ধকল তাঁর শরীর আর নিতে পারবে না। তা ছাড়া ফেরত কাকে দেবেন? কীভাবে দেবেন? এসব প্রশ্নও তাঁকে বিচলিত করছিল খুবই। আর তার থেকেও উদগ্র হয়ে উঠছিল তাঁর জিজ্ঞাসা, জিনিসটা আসলে কী? এমন কী জিনিস যার জন্যে খ্রিস্টধর্মের সর্বোচ্চ পদাধিকারী এত উতলা? কী সেই জিনিস যার জন্যে তাঁর পরিবারের ওপর নেমে এসেছে এই চরম অভিশাপ?’

এইখানে ফের থামলেন ফার্নান্দো। তারপর খানিকটা ইতস্তত করে বললেন, ‘জানি তুমি এসবে বিশ্বাস কর না, তবুও বলি, গ্রিমোয়ার শব্দটা শুনেছ মার্ট?’

শব্দটা অবশ্যই শুনেছেন মার্টিনেজ। গ্রিমোয়ার মানে ব্ল্যাক আর্ট বা ব্ল্যাক ম্যাজিক সম্পর্কিত বই। বিভিন্ন তন্ত্রমন্ত্র, তাবিজকবচ, শত্রুর ওপর অভিশাপ বর্ষণ, কারও আত্মাকে ডাকা, এসব সংক্রান্ত বই। এসব বইয়ে লেখা মন্ত্র উচ্চারণ করে নাকি দেবদূত, পরী, অপদেবতা বা স্বয়ং শয়তানকে ডেকে এনে বা নিজের অনুগত করে কার্যসিদ্ধি করা যেত। চার্চের চোখ এড়িয়ে এইধরনের বই চিরকালই পাওয়া যেত। আর গুটেনবার্গ ছাপার যন্ত্র বানাবার পর তো এই ধরনের বইতে ইউরোপ ছেয়ে গেছিল। তারপর যা হয়, ধর্মান্ধ জনগণের একাংশ চার্চের বারণ সত্ত্বেও নির্জনে বা একান্তে এইসব প্র্যাকটিস করতে শুরু করে। এইসব বিষয়ে অনেক অবিশ্বাস্য কাহিনি এখনও ইউরোপের পুরোনো পাবগুলোতে কান পাতলে শোনা যায়। মার্টিনেজ যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণেই এসবে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু আজ সেসব নিয়ে তর্ক করার দিন নয়। তিনি নির্নিমেষ চোখে তাঁর বাবার দিকে চেয়ে রইলেন।

‘আজ অবধি আমরা যেসব গ্রিমোয়ারের খোঁজ পেয়েছি, তার প্রায় বেশিরভাগই জাল। সবই সেযুগের অনামি কোনো-না-কোনো লেখকের উদগ্র কল্পনার ফসল। যদিও সেসব কল্পনার তারিফ করতে হয়, কিন্তু দিনের শেষে সেসবই জাল গ্রিমোয়ার। আসল গ্রিমোয়ার বেশিরভাগই চার্চের কড়া তত্ত্বাবধানে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মিগুয়েলের সময় এইসব বিভিন্ন জাদুমন্ত্রের বইতে ছেয়ে গেছিল ইউরোপের প্রতিটি শহর।

বিবেকের দংশনে মিগুয়েল তখন জর্জরিত। প্রায়শ্চিত্তের জ্বালায় ছটফট করা আর নিজের বংশধারাকে অভিশাপের হাত থেকে বাঁচাতে বদ্ধপরিকর সেই বৃদ্ধ এই অভিশাপ থেকে বাঁচতে বিভিন্ন গ্রিমোয়ারের শরণাপন্ন হলেন। এইখানে বলে রাখা ভালো যে আজ অবধি যেসব গ্রিমোয়ারের কথা আমরা জানি বা শুনি, তার মধ্যে বেশিরভাগই জাল হলেও সব নয়। অন্তত তার কয়েকটির প্রাচীনত্ব নিয়ে তো সন্দেহের কোনো কারণই নেই। তারমধ্যে অন্যতম প্রাচীন গ্রিমোয়ারটির নাম হল দ্য কি অফ সলোমন, বা ক্ল্যাভিস সলোমনিস।’

ততক্ষণে বেশ রাত হয়ে এসেছে। ডিনারের সময় হয়ে এল প্রায়। নীচে বাগানের কোনো এক কোণা থেকে রটওয়েলারের চাপা গরগর আওয়াজ ভেসে এল, কিছু একটা দেখেছে বোধ হয়। আশ্চর্য উজ্জ্বল আকাশ আজকে, ঠান্ডাটা আজকে বোধ হয় একটু বেশি। হঠাৎ একটু শিউড়ে উঠলেন মার্টিনেজ, কোনো কারণ ছাড়াই।

‘দাবি করা হয় যে এই কি অফ সলোমন নামের গ্রিমোয়াটি মহান রাজা সলোমনের নিজের হাতে লেখা। তিনি পৃথিবীর সর্বকালের জ্ঞানী রাজা বলে খ্যাত, ওয়াইজ অফ দ্য ওয়াইজেস্ট। সলোমনের লেখা হোক না হোক, বইটি প্রাচীন হিব্রু এবং তৎকালীন মধ্যপ্রাচ্যের আরব উপজাতিদের প্রাচীনতম তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে পরিপূর্ণ। বলা হয় যে এই বইয়ে উল্লিখিত কালাজাদু প্র্যাকটিস করতে পারলে স্বয়ং শয়তানকে বশ করা যায়, তাকে দিয়ে যা খুশি করিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু হ্যাঁ, তার আগে নিজের সমস্ত কৃত পাপ স্বীকার করে শুদ্ধ হতে হবে।

কিন্তু যতটা সহজ ভাবা গেছিল, কাজটা ততটা সহজ নয়। বাজার ছেয়ে আছে জালি বইতে। শেষে মিগুয়েল খোঁজে পেলেন যে সিরিয়াতে এক আর্চবিশপের কাছে আসল বইটি আছে। এই আর্চবিশপের বাবা ছিলেন একজন শখের অভিযাত্রী, বিভিন্ন পুরাতাত্ত্বিক জিনিস খুঁজে বার করতে তাঁর বিপুল উৎসাহ ছিল। অনেকদিনের পরিশ্রমের পর তিনিই প্রথম খোঁজ পান বইটির এবং সেইটিই বহু রৌপ্যমুদ্রা ব্যয়ে মিগুয়েল হস্তগত করেন। আর্চবিশপের ছেলে অবশ্য অনেক পরে তার একটি সংস্করণ বাইরে প্রকাশ করে, অবশ্যই আসল মন্ত্রগুলো বাদ দিয়ে। সেটাকেই আজ লোকে ক্ল্যাভিস সলোমনিস বলে চেনে।

যাই হোক। পনেরো-শো নব্বই সালের এক শনিবার, অমাবস্যার রাত। লিসবনের উপকণ্ঠে এক পরিত্যক্ত চার্চ সংলগ্ন প্রাচীন গোরস্থানে মিগুয়েল সেই ক্ল্যাভিস সলোমনিস নিয়ে শয়তানের সাধনায় ব্রতী হলেন। বইয়ের কথা অনুযায়ী যাবতীয় কর্তব্যকর্ম করে শেষ মন্ত্রটির উচ্চারণ করা মাত্র তিনি শয়তানের দর্শন পেলেন।’

‘হো…হোয়াট?’ নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারলেন না মার্টিনেজ। গোঁড়া এবং প্র্যাকটিসিং না হলেও ধর্মে ক্রিশ্চান তিনি। শয়তানের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা তিনি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। ‘আর ইউ সিরিয়াস পাপাই? মিগুয়েলের সামনে শয়তান এসেছিল? স্যাটান হিমসেল্ফ?’

মাথা নাড়লেন ফার্নান্দো, ‘নিজের ডায়েরিতে যা লিখে গেছেন মিগুয়েল, হুবহু তাই বলছি মার্ট। আমারও প্রথমে তোমার মতোই কথাটা বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু শয়তানের আগমন থেকে শুরু করে তারপর তার সঙ্গে মিগুয়েলের কথোপকথন যে হয় তা লিখে রাখা আছে। মিগুয়েলের ডায়েরির বিবরণ মতো শেষ মন্ত্রটির উচ্চারণ মাত্র উল্কাপাতের মতোই একটি আগুনে গোলা মিগুয়েলের সামনে এসে সশব্দে আছড়ে পড়ে এবং মিগুয়েল ছিটকে পড়ে যান। তারপর উঠে দেখেন যে তাঁর সামনে একটা আগুনের পিণ্ড মানুষের আকার নিয়ে দাঁড়িয়ে, সেই শয়তান।’

‘তারপর?’ আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন মার্টিনেজ।

‘তারপর যেটা লিখেছেন মিগুয়েল সেটাই সবচেয়ে আশ্চর্যের। শয়তানের সঙ্গে ঠিক কী কথা হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ তিনি দেননি। তার বদলে যেটা উনি লিখেছেন…দাঁড়াও তোমাকে পড়াচ্ছি।’

এই বলে উঠে যান ফার্নান্দো। বারান্দায় চুপ করে বসে থাকেন মার্টিনেজ।

এই তো কয়েক দিনের কথা। সেদিনই তো জন্মালো ছেলেটা। সারা বাড়িতে আনন্দের হুল্লোড় খেলে গেছিল। কমান্ডান্ট নিজে এসেছিলেন ছেলেকে দেখতে, স্বরাষ্ট্রসচিব স্বয়ং অভিনন্দন বার্তা পাঠান। আর সিসিলিয়া, আহা এখনও চোখ বন্ধ করলেই তার মুখের ঔজ্জ্বল্য দেখতে পান মার্টিনেজ।

বুকের মধ্যে একটা প্রায় ভুলে যাওয়া ব্যথা তিরের মতোই এসে বিঁধল মার্টিনেজের বুকে। সিসিলিয়া মারা যাওয়ার পর দিশেহারা হয়ে গেছিলেন মার্টিনেজ। ভেবেছিলেন চাকরি ছেড়ে দেবেন। হাজার হোক জীবনধারণের জন্যে ভাজ পরিবারের কোনো ছেলেকে কোনোদিন ভাবতে হয়নি। কিন্তু চাকরি তাঁকে ছাড়েনি, কোনো মূল্যেই এমন সুদক্ষ কম্যান্ডোকে ছাড়তে সেনাবাহিনী রাজি ছিল না। সিসিলিয়াকে হারাবার দুঃখ ভুলতে মার্টিনেজ তিয়াগোকে আরও বেশি করে জড়িয়ে ধরেন, আর শিশু তিয়াগো মার্টিনেজকে। বুক ফেটে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মার্টিনেজের। আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর হু হু করে কেঁদে ফেললেন কম্যান্ডো সার্কেলে ইউরোপের ইস্পাত বলে খ্যাত মার্টিনেজ ভাজ।

পেছনে পায়ের শব্দ পেয়ে দ্রুত চোখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। পরক্ষণেই সামনের চেয়ারে এসে বসলেন ফার্নান্দো। ফার্নান্দো নিজেও খুব উত্তেজিত ছিলেন, নাহলে একটু চেষ্টা করলেই হয়তো ছেলের চোখের জল দেখতে পেতেন। কে জানে, হয়তো দেখতে পেয়েছিলেন, দেখেও দেখেননি। নিজের সন্তানের চোখে জল কে-ই বা দেখতে চায়?

একটি প্রাচীন ঝুরঝুরে বই নিয়ে এসে বসলেন ফার্নান্দো। তারপর অতি সন্তর্পণে কয়েকটা পাতা খুললেন। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘শোনো, কী লিখছেন মিগুয়েল।

‘শয়তান অট্টহাস্য করিয়া বলিলেন, ‘‘পাপিষ্ঠ যাহা করিয়াছিস ইহা অতি উত্তম। ভোগ, লালসা, হিংসা এসবই আমার বড়ো প্রিয়, বড়োই ঈপ্সিত। তবুও কেন প্রায়শ্চিত্তের অগ্নিতে জ্বলিতেছিস? শোন মূঢ়, মৃত্যুর ওপর কাহারও অধিকার নাই, আমারও নাই, তোর পূজ্য ঈশ্বরেরও নাই। তবুও কেন উত্তরাধিকারীদের জীবনাকাঙ্ক্ষা হেতু এ-মতো বিচলিত হইতেছিস? তুই মূর্খ, তবুও তোর আরাধনা আমার সবিশেষ প্রীতিবর্ধন করিয়াছে, তাই তোর বাঞ্ছা পূরণ করিবার নিমিত্ত আবির্ভূত হইয়াছি। শোন রে মন্দবুদ্ধি, যাহাকে তুই সপরিবারে হত্যা করিয়াছিস, তিনি তোর ঈশ্বরের বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত ছিলেন। তুই তোরই ঈশ্বরের প্রীত্যার্থে তাহারই সেবককে হত্যা করিয়াছিস। মূর্তিভেদে কি ঈশ্বরভেদ হয় রে পাপমতি? তোদের ক্রুশও কি একটি মূর্তি নহে? এখন শোন, যে অভিশাপের কৃষ্ণচ্ছায়া তোর ও তোর পরিবারের ওপর উদ্যত হইয়াছে, উহা হইতে পরিত্রাণের কোনোই উপায় নাই। নিজ সন্তানের প্রতি অসীম স্নেহসঞ্জাত ক্রোধ হইতে সেই গাঢ়কৃষ্ণ অভিশাপের উৎপত্তি। আরেক পিতার নিজ সন্তানের প্রতি অসীম স্নেহসঞ্জাত সাহস ও আত্মবলিদান হইতেই একমাত্র ইহার নিবৃত্তি হইলেও হইতে পারে। কিন্তু উহা সহজ নহে, সেই শাপমোচনের পথ অতি দুরূহ, শানিত ক্ষুরধারের ন্যায় দুরতিক্রম্য এবং দুর্গম।

শোন রে হীনমতি, এই শাপমোচন অত সহজ নহে। পাপের পূজায় বলিদান আবশ্যক, এই কর্মে তোর বংশধরদের অন্তত আরও তিন জনকে আত্মোৎসর্গ করিতে হইবে। শুধু আত্মোৎসর্গ নহে, জাগাইতে হইবে মৃতদের জগত, মহাক্রোধী দেবতাকে পূজার্চনার দ্বারা প্রসন্ন করিতে হইবে, অলৌকিক শক্তি দ্বারা অসম্ভবকে সম্ভব করিতে হইবে। উত্তরের হিমাঞ্চলাবৃত দেশের এক প্রাচীন সৌধের মৃত্তিকাগর্ভে এক লোহিত চর্মাবৃত মহাযোগী শেষ শয়ানে সমাহিত আছেন। আজ হইতে প্রায় দুই শত বৎসর পর তোর পরিবারে এক অতিসাহসী তন্ত্রসিদ্ধ পুরুষ জন্মগ্রহণ করিবে। তোর সেই উত্তরপুরুষ অসামান্য মন্ত্রসাধন দ্বারা সেই ক্রূরশ্রেষ্ঠ মহাযোগীকে মৃত্যুর অপর পার হইতে আহ্বান করিয়া আনিতে সমর্থ হইবে। সেই মহাযোগী পথ নির্দেশ করিয়া দিবেন এবং তদন্তে সেই মন্ত্রসিদ্ধ পুরুষের প্রাণহরণ করিবেন। আজ হইতে আনুমানিক অর্ধসহস্র বৎসর পর এই অভিশাপ প্রত্যাহৃত হইবে। তৎকালে মৃত্যুর সম্রাট তোর পরিবার হইতে শেষ শিকারটি সংগ্রহ করিয়া উর্ধ্বে নক্ষত্রলোকে প্রত্যাগমন করিবেন। সেইদিন তোর পাপের অন্তিম নিবৃত্তি হইবে।’’

আমি ভীত হইয়া করজোড়ে বলিলাম, ‘‘প্রভো, তিনটি আত্মোৎসর্গের উল্লেখ করিলেন, একবার উত্তরের হিমাঞ্চলাবৃত দেশে, আর এক বার অভিশাপ খণ্ডনকালে। কে সেই হতভাগ্য তৃতীয় জন?’’

মহামহিম শয়তান যেন সহসা সহস্রাক্ষ হইয়া, তাঁহার সমস্ত ভীতিপ্রদ অগ্নিভ রূপ লইয়া ক্রূর হাসিয়া উঠিলেন, বলিলেন, ‘‘কেন, তুই!’’ ’

১৭৫৫। সেপ্টেম্বর। স্বিনভান লেকের ধার, হোলার, আইসল্যান্ড

সেপ্টেম্বর মাসের হিমশীতল সন্ধে। সমগ্র উত্তর গোলার্ধ যখন শীতের চাদর গায়ে টেনে নিচ্ছে, তখন পৃথিবীর এই প্রান্তে শীত যে শুধু জাঁকিয়ে বসেই আছে তাই নয়, তার কামড় মাংস ভেদ করে হাড়ে রীতিমতো কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে।

হবেই, মনে মনে ভাবলেন জর্জিনহো। উত্তর গোলার্ধ হলে কী হবে, জায়গাটা দরকারের থেকে অনেক বেশিই উত্তরঘেঁষা। আর তার ওপর এখন তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এক হ্রদের ধারে। হ্রদের হিমশীতল জল ছুঁয়ে আসা বাতাস তাঁর যাবতীয় পোশাকের স্তর ভেদ করে তাঁর অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।

দেশটার নামই আইসল্যান্ড, আক্ষরিক অর্থেই বরফের দেশ, হিম তুষারের রাজ্য। এখানকার আকাশের বুকে খেলে বেড়ায় বিচিত্র সব আলোর ভুলভুলাইয়া ম্যাজিক, লোকে তার নাম দিয়েছে অরোরা বরিয়ালিস। তার ওপর জায়গাটা আইসল্যান্ডের আরও উত্তরে, উত্তরমেরুর আরও কাছে। মে থেকে অাগস্টের মাঝামাঝি অবধি এখানে সূর্য অস্ত যায় না। জর্জি অনেক ভেবেচিন্তেই সেপ্টেম্বর মাসটা বেছে নিয়েছে। এসব কাজ অন্ধকার ছাড়া হয় না, অাগস্ট অবধি এই এলাকা আলোয় আলোকময়। তার ওপর সবে গ্রীষ্ম ঋতু শেষ হয়েছে, ফলে হ্রদে এখনও জল আছে, এই সেপ্টেম্বর মাসে এখনও নাব্য সেই হ্রদ, কিন্তু শীতের তীক্ষ্ণ নখরের তীব্রতা আরও বেড়ে উঠেছে সেই জল ছুঁয়ে আসা হাওয়ার কামড়ের থেকে।

জর্জিনহোর পিছনে ছিল লিওনার্দো। এই প্রবল ঠান্ডায় লিওনার্দোর দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়ার শব্দ শুনে সামান্য কৌতুক বোধ করছিলেন জর্জিনহো। ভাইটা আর মানুষ হল না! নেহাত দাদার তন্ত্রমন্ত্রের শক্তির ওপর অপার শ্রদ্ধা আছে তাই। নইলে পরিবারের সবার চক্ষুশূল এই কালাপাহাড়ি বড়ো দাদাটির এত ন্যাওটা হয়ে পড়ত না লিওনার্দো।

দু-জনের পরনেই শীতরোধক পোশাক, তবে তাতে শীত খুব একটা আটকাচ্ছে বলে দু-জনের কারোরই মনে হচ্ছে না, ওই মন্দের ভালো আর কী। অবশ্য দিনের এই সময়টাও শীতের কামড় শুরু হওয়ার মুখে, প্রায় সন্ধে হওয়ার কাছাকাছি। ক্ষীণ সূর্যের আলো এখনও রয়ে গেছে আকাশে। গ্রীষ্মের পর ছ-মাস এই এলাকা ডুবে থাকবে আঁধার রাত্রিতে। সেই আলো-আঁধারিতে লেকের অন্য পাড়ে এক প্রাচীন সৌধের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। জর্জিনহো জানেন ওটা কি, ওখানে যাওয়ার জন্যেই তাঁর এখানে আসা।

হোলার চার্চ। মানে প্রাচীন হোলার চার্চ, এখন পরিত্যক্ত। নতুন হোলার চার্চ শহরের আরও মাঝখানে তৈরি হয়েছে। এই চার্চটি পরিত্যক্ত কেন হল সেটা জর্জিনহো জানেন, ভালো করেই জানেন। এবং সেইজন্যই সেদিকে আজকে যেতে চাইছেন তিনি। আর সঙ্গী করেছেন নিজের ভাইকে।

লিওনার্দো। নিজের থেকে প্রায় দশ বছরের ছোটো এই দুর্বল ভীরু ভাইটির প্রতি প্রায় অপত্যস্নেহ বোধ করেন জর্জিনহো। আজ ওকে আনা হয়তো ঠিক হয়নি। আজ হয়তো ও এমন অনেক কিছু দেখবে যা ওর দেখা উচিত নয়। কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় ছিল না জর্জিনহোর। আর কাকেই বা নিজের থেকে বেশি ভরসা করতে পারেন জর্জিনহো? এই দুনিয়ায় সেই জিপসি রমণী ছাড়া আর কাকেই বা এত ভালো বেসেছেন তিনি? আর এ ছাড়া আরও একটি কারণ আছে।

একদম ভেতরের জামার বুকপকেটে কতগুলো কাগজ এখনও সযত্নে রাখা আছে জর্জিনহোর। তাঁরই নিজের হাতে লেখা কতগুলো পাতা। কপি করা, বহু কষ্টে খুঁজে পাওয়া তাঁরই এক পূর্বপুরুষের লেখা ডায়েরির কয়েকটা পাতা থেকে কপি করা কয়েকটা পাতা। সেগুলো এক বার ছুঁয়ে মনটা স্থির করলেন তিনি। তারপর আড়চোখে এক বার লিওনার্দোর দিকে তাকালেন জর্জিনহো। যদি তাই হয়, ডায়েরিতে যা লেখা আছে যদি তাই-ই সত্যি হয়, তবে লিওনার্দোকে দেখেই মরতে চান জর্জিনহো, পৃথিবীতে আর কারও ওপর অত টান নেই তাঁর।

তা ছাড়া সেই জিপসি রমণী বলে দিয়েছিল না, জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য পালন করতে যাওয়ার দিনে নিজের ছায়াকে সঙ্গে রাখতে? লিও ছাড়া আর কে-ই বা আছে তাঁকে ছায়ার মতন অনুসরণ করে?

ছোট্ট নৌকোটা লেকের পাশেই একটা ঝোপের মধ্যে লুকোনো ছিল। দুইজনে টেনে বার করলেন সেটা, তারপর জলে ভাসিয়ে চেপে বসলেন। তারপর দুইজনেই বইঠা ফেললেন জলের বুকে। সামনে জর্জিনহো ভাজ, পেছনে লিওনার্দো ভাজ।

২০১৬। ৬ অক্টোবর, পঞ্চমী, শুক্রবার। মুম্বাই

মুম্বাইতে নেমেই যেটা সবচেয়ে বিরক্তিকর লাগল মার্টিনেজের, সেটা হচ্ছে গরম আর আর্দ্রতা। এই অক্টোবর মাসেও উত্তর গোলার্ধের কোনো শহরে যে এত গরম আর বাতাসে এত জলীয়বাষ্প থাকতে পারে, ভাবতেই পারেননি মার্টিনেজ। যদিও তিনি অনেক আগেই শুনেছেন মুম্বাইয়ের কুখ্যাত ভিড় আর গরমের কথা, তবে শোনা কথা এক, আর তাকে প্রত্যক্ষ করা আরেক। ভুরু কুঁচকে এক বার ভারতবর্ষের প্রখর সূর্যের দিকে তাকালেন তিনি, তারপর অ্যাভিয়েটর সানগ্লাসটা পরে নিলেন।

এয়ারপোর্টের লাউঞ্জ ছাড়িয়ে একটু বাইরে আসতেই দেখলেন প্ল্যাকার্ড হাতে কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে, তারই মধ্যে এক খর্বকায় ভারতীয়ের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘মিস্টার মার্টিনেজ ভাজ। ওয়েলকাম টু ইন্ডিয়া।’ নীচে পর্তুগাল কনসুলেটের নাম। যাক, বেকার অপেক্ষা করতে হল না, স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন মার্টিনেজ। ভারতীয় লোকটি দৌড়ে এসে মার্টিনেজের লাগেজ নিয়ে নেয়। আগে এসবে অস্বস্তি হত মার্টিনেজের, পরে বুঝেছেন এই উপমহাদেশে বা তার আশেপাশের অঞ্চলে এটাই শিষ্টাচার। তার পেছন পেছন পার্কিং-এ এলেন তিনি। তারপর লোকটি একটি কালো রঙের মার্সিডিজের বুটস্পেসে লাগেজ রেখে পেছনের দরজা খুলে সামান্য ঝুঁকে দাঁড়াল, অর্থাৎ সাহেব, পদার্পণ করুন! মার্টিনেজ ভেতরে আরাম করে বসতেই লোকটি চট করে ড্রাইভারের সিটে বসে স্টিয়ারিং-এ হাত দিল।

মুম্বাইয়ের কথা অনেক শুনেছেন মার্টিনেজ, যেকোনো পর্তুগিজ শিশুকেই তাদের ইতিহাসের কথা, প্রাক্তন সাম্রাজ্যের কথা পড়তেই হয়। এককালে পূর্বে পর্তুগিজ উপনিবেশের পত্তনের সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এই শহর। ব্রিটিশদের সঙ্গে দু-এক-বার যুদ্ধও হয় পর্তুগিজদের, এই বন্দরনগরীর দখল নিয়ে। শেষে ষোলো-শো একষট্টি নাগাদ ব্রিটেনের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সঙ্গে পর্তুগালের রাজকুমারী ক্যাথারিন ডি ব্র্যাগাঞ্জার বিয়ে হলে সেই বিয়ের যৌতুকস্বরূপ মুম্বাইনগরী ব্রিটিশদের উপহার দেওয়া হয়। সামান্য হাসলেন মার্টিনেজ, এখন না হয় নাম হয়েছে মুম্বাই, এই শহরের পুরোনো নাম বম্বে, সেও পর্তুগিজদেরই দেওয়া। বম— বেইম, নিজের মনেই আওড়ালেন তিনি, পর্তুগিজে এর অর্থ ভালো উপসাগর। ভালো হোক, সবার ভালো হোক এই শহরে। ভালো কিছু করার জন্যেই তো এসেছেন মার্টিনেজ এখানে। ভালো হোক তিয়াগোরও। তিয়াগোর কথা মনে আসতেই বুকের বাঁ-দিকটা চিনচিন করে উঠল মার্টিনেজের। বেঁচে আছে সে। এখনও। যদিও না বেঁচে থাকার মতোই। কোমাতে লোকজন বছরের পর বছর বেঁচে থাকতে পারে, মার্টিনেজকে তাই বলেছেন ডাক্তার, বেঁচে থাকবে ভেজিটেটিভ স্টেটে! ভেজিটেটিভ স্টেট, কথাটা মনে পড়তেই রাগ, অসহায়তা আর ক্ষোভ মিলে যেন বুকটা মুচড়ে দিল তাঁর। তাঁর সাগরছেঁচা ধন, সাত রাজার ধন এক মাণিক, চোখের মনি তিয়াগো নিঃসাড় জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে থাকবে তাঁর সামনে? তিনি বাবা হয়ে অসহায়ের মতন দেখবেন? চলে ফিরে বেড়াবেন, আনন্দ করবেন, হাসবেন, খাবেন ঘুরবেন? হয় না। এ কিছুতেই হয় না। ডাক্তাররা যা করার করুক, নিজে একটা চেষ্টা করবেনই মার্টিনেজ, দরকার হলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও। যা হয় হোক, নিজের ছেলেকে ওই অবস্থায় কিছুতেই দেখতে পারবেন না মার্টিনেজ, কিছুতেই না। মরতে হলে মরবেন, কিন্তু শেষ চেষ্টাটুকু করতে ছাড়বেন না। তাতে অন্তত ওপারে গিয়ে সিসিলিয়ার সামনে দাঁড়াতে পারবেন, ক্ষমা ভিক্ষা করার জায়গাটুকু অন্তত তাঁর থাকবে। বলতে পারবেন যে হ্যাঁ শেষ চেষ্টা তিনি করেছিলেন, নিজের সবটুকু দিয়েই করেছিলেন।

ফার্নান্দোর কাছে যদিও তিয়াগোর এতদিন বেঁচে থাকাটা শুভ সংকেত বলেই মনে হয়েছে, সে হোক না জীবন্মৃত অবস্থাতেই। ‘আজ অবধি কেউ এতদিন বাঁচেনি মার্ট’, এয়ারপোর্টে মার্টিনেজকে ছাড়তে এসে কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন তিনি। ‘যখনই মৃত্যু নেমে এসেছে আমাদের ওপর, এসেছে কেউটের ছোবলের মতো, বাজপাখির ছোঁ-এর মতন। কাউকে মুহূর্তকাল সময় দেয়নি সে। সেখানে তিয়াগোর এতদিন বেঁচে থাকাটা খুবই ভালো কিছু ঈঙ্গিত দিচ্ছে। আমার মন বলছে তুমিই সেই লোক মার্ট, যার কথা লিওনার্দোর ডিক্লারেশনে আছে। ভাজ ফ্যামিলিকে তুমিই হয়তো রক্ষা করবে মার্টি।’ বলে চুপ করে ছিলেন ফার্নান্দো। মার্টিনেজ জানেন কেন। সত্যিই যদি মার্টিনেজ সেই চিহ্নিত লোকটি হন, তবে এই হয়তো ফার্নান্দোর সঙ্গে মার্টিনেজের শেষ দেখা।

লিওনার্দোর ডিক্লারেশনে এমন একজনের উল্লেখ আছে যিনি অসমসাহসী, বীর যোদ্ধা এবং নিজ কর্মফল হেতু বিপুল পুণ্যের অধিকারী। তিনিই নাকি কোনো এক প্রাচ্যদেশীয় মহাপুরুষের সহায়তায় সেই অত্যন্ত দুরূহ কাজটি সমাপন করবেন, ভাজ পরিবারকে সেই মহাশাপ থেকে উদ্ধার করবেন। সময়টাও প্রায় হুবহু মিলে যাচ্ছে। কিন্তু তার বিনিময়ে সেই ভাজ বংশাবতংসকে উৎসর্গ করতে হবে নিজের প্রাণ! হালকা চালেই জিজ্ঞেস করেছিলেন মার্টিনেজ, ‘কিন্তু পাপাই, আমার তো তেমন কোনো ভালো কর্মফল নেই। এমন কোনো পুণ্যকাজ করেছি বলে তো মনে পড়ে না আমার।’ ‘সে কি মার্ট? লোকের কোনো পুণ্য করোনি তুমি আজ অবধি? তাই বলতে চাও? এই যে এখানে আসার আগে অতগুলো শিশুর প্রাণ বাঁচিয়ে এলে তুমি, তার মতন পুণ্য কিছু আছে? খুন করলে ঈশ্বরের দরবারে তার শাস্তি আছে, আর অতগুলো প্রাণ বাঁচালে তার পুণ্যফল বলে কিছু থাকে না?’

জবাব ছিল না মার্টিনেজের কাছে। কিছুক্ষণ পর যখন চোখ তুললেন ফার্নান্দো, তখন তাঁর দু-চোখ জলে ভেজা, ধরা গলায় বললেন, ‘আর যদি সেই বেতালের মুখোমুখি হওয়ার দুর্ভাগ্য তোমার হয় মার্ট, তবে তাঁকে প্রশ্ন করতে ভুলো না, এত মৃত্যু, এত কষ্ট, এত প্রায়শ্চিত্তের পরেও কি আমাদের দুর্ভোগ শেষ হয়নি? কতদিন থাকে পূর্বপুরুষের পাপের উত্তরাধিকার? কেন বইতে হবে আমাদের এই অভিশাপের জের? আমি চাই তুমি কাজ শেষ করে সুস্থ সবল ফিরে এসো মার্ট। আর যদি ফিরে নাও আসো, আমার কোনো দুঃখ থাকবে না। আমি জানব আমার ছেলে মহৎ কাজের জন্যে আত্মবলিদান দিয়েছে। আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ মার্ট। অ্যান্ড রিমেম্বার, আই লাভ ইউ।’

১৭৫৫। সেপ্টেম্বর । স্বিনভান লেক, হোলার, আইসল্যান্ড

নিস্তরঙ্গ হ্রদের জলে বইঠার ছপাছপ আওয়াজ ছাড়া আর বিশেষ কোনো আওয়াজ নেই এই বিশ্বচরাচরে। শুধু মাঝেমধ্যে মাথার ওপর উড়ে যাওয়া পাখিদের কর্কশ আওয়াজ ছাড়া। সন্ধে হয়ে এল, ওরা বাসায় ফিরছে। প্রায় হ্রদের মাঝামাঝি চলে এসেছেন দু-জনে, সন্ধে নেমে এসেছে অনেকটাই। ওপারের চার্চের প্রায় পুরোটাই দেখা যাচ্ছে এখন। মাথার উপর তারাভরা বিশাল আকাশ, আর তার সামনে নিশ্ছিদ্র নিরন্ধ্র জমাট অন্ধকার পাহাড়ের মতোই দিগন্তের অনেকটা আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে সেই চার্চ।

‘জর্জি, কথাগুলো সত্যি, মানে এখনও অবধি যা যা বলেছ, সবই কি সত্যি?’

‘আমি এ বিষয়ে একদম নিশ্চিন্ত লিও’, দৃঢ়স্বরে উত্তর দেন জর্জিনহো, ‘আর এতদিন ধরে এ বাড়িতে আছ, তোমার তো এগুলো আমার থেকে বেশি জানার কথা। প্রতিটি পুরুষে প্রথম সন্তানের মৃত্যু তো আর আজগুবি হতে পারে না। আশা করেছিলাম এটুকু তুমি বুঝবে।’

‘কিন্তু… কিন্তু সেগুলো তো দুর্ঘটনাবশতও হয়ে থাকতে পারে জর্জি, বা দুর্ভাগ্যজনক সমাপতন। হতে পারে না?’ যেন সমস্ত ব্যাপারটা থেকে কোনোভাবে যাবতীয় অলৌকিক ছোঁয়াচ অস্বীকার করতে পারলেই বাঁচে লিওনার্দো, এমনই আকুতি তার গলায়। হেসে ফেলেন জর্জিনহো, ‘না লিও। এতগুলো ব্যাখ্যাতীত মৃত্যু কোনোভাবেই সমাপতন হতে পারে না। আর সে ব্যাপারে পাক্কা প্রমাণ আমার কাছে আছে। সেই প্রমাণ হাতে আসার পরই আমি এই কাজে নেমেছি।’

‘কী প্রমাণ জর্জি?’

‘মিগুয়েলের ডায়েরি।’

এরপর অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকে দুই ভাই। গলানো সিসের মতন কালো হ্রদের জলে বইঠার ছপছপ আওয়াজ তুলে এগিয়ে যেতে থাকে ছোট্ট নৌকাটি।

মিগুয়েলের ডায়েরি এ পরিবারে প্রায় প্রবাদের মতন। সবাই জানে ডায়েরিটার ব্যাপারে, কিন্তু সেটা কোথায় আছে কেউ জানে না। শুধু জানে যে মিগুয়েলের সময় থেকেই ভাজ পরিবারের প্রথম সন্তানের নিহত হওয়ার দুর্ভাগ্যজনক কাহিনিটি শুরু হয়। মৃত্যুর আগের দিন মিগুয়েল ভাজ বলে যান যে তাঁর ডায়েরিতে এই অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায় লেখা আছে, এবং তিনি এটি বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে রেখে যাচ্ছেন, যাতে কি না ‘একমাত্র উপযুক্ত সময়েই ইহা ঈশ্বরেচ্ছায় প্রকাশিত হয় এবং উপযুক্ত অধিকারীর পথপ্রদর্শক হইতে পারে।’ ছোটবেলা থেকেই এ নিয়ে খোঁজখবর শুরু করে জর্জিনহোই। তখন থেকেই তার ব্ল্যাক ম্যাজিক, তন্ত্রমন্ত্র, অপদেবতার আরাধনা, গ্রিমোয়ার এসব নিয়ে প্রবল উৎসাহ। বলা বাহুল্য গোঁড়া ক্রিশ্চান ভাজ পরিবারে কেউই এসব ভালো চোখে দেখত না। কিন্তু অসম্ভব জেদি ছেলেটি তার লক্ষ্য থেকে একচুলও সরেনি। ধীরে ধীরে কৈশোরেই তার মধ্যে বেশ কিছু অতিপ্রাকৃতিক শক্তির প্রকাশ ঘটে। সামান্য খ্যাপাটে, মুখচোরা এবং অসম্ভব গম্ভীর ছেলেটিকে এড়িয়ে চলতে থাকে সহপাঠীরা এবং কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষকরাও। এতে করেও চলে যাচ্ছিল যাহোক নাহোক। কিন্তু এক ক্রিসমাসের ছুটি হওয়ার আগের দিন তাদের এস্কোলা বা স্কুলে একদিন যা কাণ্ড ঘটায় সে, ভাবলে লিওনার্দো এখনও শিউরে ওঠে। তার পরেই ঘর ছাড়তে হয়ে জর্জিনহোকে, সেইদিনই তার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে যায়।

লিওনার্দো তখন অনেক নীচু ক্লাসে পড়ে, জর্জিনহোর পড়ে সেকুন্দারিয়া, মানে উঁচু ক্লাসে, তখন তার বয়েস ষোলো।

সব ক্লাসেই কিছু বখাটে গুন্ডা গোছের ছেলে থাকে, কিন্তু জর্জিনহোর ক্লাসে এমন তিন জন ছিল, তাদের মূর্তিমান শয়তান বললে কম বলা হয়। রাস্তায় মারপিট করা থেকে শুরু করে গোপনে মাদক সেবন করা, পতিতালয়ে রাত কাটানো এসবই তাদের কাছে ছিল জলভাত। আর তাদের প্রিয় ব্যসন ছিল নিরীহ ছেলে ছোকরাদের একলা পেলে হেনস্থা করা। মারধোর থেকে শুরু করে জঘন্য মানসিক নির্যাতন, কিছুই বাদ যেত না। এমনকী নতুন শিক্ষকরা অবধি এদের সমঝে চলতেন। এদের বিরুদ্ধে ভূরি ভূরি নালিশ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা পড়লেও কোনোই ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, কারণটা অবশ্য সহজেই অনুমান করা যায়। তিন জনের বাবাই ছিলেন শহরের বিত্তশালী ব্যবসায়ী বা প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা।

সারা স্কুলে শুধুমাত্র একটি ছেলেকেই সমঝে চলত তারা, জর্জিনহো। যদিও জর্জির সঙ্গে এদের কোনোদিন সেভাবে কথাকাটাকাটিও হয়নি। কিন্তু জর্জি নিজেও একে ভাজ পরিবারের ছেলে, তার ওপর প্রেত যত শয়তানই হোক না কেন, ওঝাকে সে সমঝেই চলে সচরাচর। জর্জির ভাই বলেই লিওর ওপরেও এরা কখনো তেমন চড়াও হয়নি। লিওনার্দোও জর্জির পরামর্শ মতন এদের ত্রিসীমানায় থাকত না। কাণ্ডটা ঘটে ক্রিসমাসের ছুটি শুরু হওয়ার আগের দিন।

স্বাভাবিক ভাবেই স্কুল সেদিন প্রায় ফাঁকাই ছিল। এক জন শিক্ষক, এক জন অশিক্ষক কর্মচারী, দু-জন অভিভাবক আর গুটিকয় ছাত্র ছাড়া কেউই ছিল না। জর্জি স্কুলে গেছিল ধর্মতত্ত্ব আর জ্যোতির্বিদ্যার ওপর লাইব্রেরি থেকে দু-একটা বই আনতে। লিওনার্দোও যথারীতি দাদার সঙ্গী হয়। লিও স্কুলচত্ত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল আপনমনে। এমনসময়ে স্কুলের একদম পেছনের কোণার দিকে ক্লাসরুমটা থেকে একটা গোঙানির আওয়াজ শুনে নেহাত কৌতূহল বশতই সেদিকে এগিয়ে যায় সে। ক্লাসরুমটার দরজা বন্ধ দেখে, এবং গোঙানির আওয়াজটা বাড়ছে শুনে একেবারে পেছনের দিকে জানালায় উপস্থিত হয় লিও, প্রায় টিকটিকির মতন দেওয়াল বেয়ে বেয়ে। জানালাটা সামান্য ফাঁক করে যে দৃশ্য দেখে লিও, সে দৃশ্য এখনও মাঝে মাঝে তার দুঃস্বপ্নে হানা দেয়। দেখে যে ওরই প্রিয় বন্ধু ভিসিয়েন্তেকে মাটিতে উপুড় করে পেড়ে ফেলেছে সেই মূর্তিমান তিন শয়তান। ভিসিয়েন্তের নিম্নাঙ্গের বস্ত্রটি ঘরের এককোণে লুটোচ্ছে, তার দুই হাত ধরে আছে সেই তিন শয়তানের এক জন, আরেকজন ভিসিয়েন্তের চুলের মুঠি ধরে মুখে কিছু একটা গুঁজে দেওয়ার চেষ্টারত। আর তৃতীয় জন? তারও নিম্নাঙ্গের বস্ত্র নেই, সে ভিসিয়েন্তের উলঙ্গ পশ্চাদ্দেশের ওপর ঝুঁকে বসে সেখানে কিছু একটা সজোরে প্রবিষ্ট করার চেষ্টা করছে! ভিসিয়েন্তের চোখে যে অসহায় কষ্টের দৃষ্টি দেখেছিল লিও, সেই দৃষ্টি শুধুমাত্র ডুবে মরার আগের মুহূর্তে মানুষের চোখে-মুখে দেখা যায়। কোনোরকমে, ঘাড়টা এদিকে বাঁকানোর ফলে লিওকে দেখতে পায় সে, আর ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরতে চায় তেমনই শরীরের শেষ শক্তি জড়ো করে লিওনার্দোর নাম ধরে চেঁচিয়ে ওঠে সে। আর সঙ্গেসঙ্গে সেই তিন মূর্তির মাথা এদিকে ফেরে। সেই তিন জনের চোখে ক্রূর জিঘাংসার যে অমানুষিক ছাপ দেখে লিও তাতে তার প্রাণ উড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রায় টিকটিকির মতোই দেওয়াল ধরে সে অন্য ধারে এসে পড়ে এবং দৌড় লাগায় স্কুলের মাঠের কোণাকুণি বরাবর, আর জর্জির নাম ধরে চেঁচাতে থাকে। কিন্তু বেশিদূর যেতে হয় না তাকে। ‘ধর এই বেজন্মার বাচ্চাটাকে, যেন পালাতে না পারে’ —বলতে বলতে একটা বলিষ্ঠ হাত এসে লিওনার্দোর ঘাড় ধরে শূন্যে তুলে ফেলে, ‘এটাই সেই পাগলা জর্জির ভাইটা না? ভালোই হল বেচারি ভিসিয়েন্তেকে আর একাই তিন জনকে সুখ দেওয়ার কষ্ট করতে হবে না’, হিসহিসিয়ে বলতে থাকে আরেকজন। মাটিতে নামাতেই একটা চড় এসে পড়ে লিওনার্দোর গালে, আর তারস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে সে। লিওর চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে যাবে বলে পিছন ফিরেছে তারা, এমন সময় পেছন থেকে রূঢ় কর্কশ আদেশ ভেসে আসে, ‘এই হারামজাদার দল। ওর গায়ে হাত দিয়েছিস, এত সাহস তোদের? সাহস থাকলে আমার মুখোমুখি হয়ে দেখ বেজন্মার বাচ্চারা, কুত্তার মতন পিটিয়ে যদি না মেরেছি…’ সবাই একসঙ্গে পেছন ফেরে। সামনে দাঁড়িয়ে জর্জিনহো।

দাদাকে দেখে ভয়ে আঁতকে ওঠে লিও। হিংস্র নেকড়ের মতন ফুলে উঠেছে জর্জির শরীর। চোখ দুটো লাল, মাথার চুল উশকোখুশকো হয়ে উড়ছে। আর ঠোঁটের কোণে হাসি।

এই হাসিটাই যে কারও অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ডান দিকে সামান্য ঠোঁট বাঁকিয়ে অন্তরের যাবতীয় ক্রোধ, অশ্রদ্ধা আর ক্রূরতা যে দগদগে হাসিতে কারো বুকে গেঁথে দেওয়া যায়, আগে না দেখলে বিশ্বাস হত না লিওর। একধাক্কায় তাকে পাশে ঠেলে ফেলে দেয় এক জন। তারপর শিকারি কুকুরের মতন তিন দিকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পরে তারা। ‘আজ তোকে বাগে পেয়েছি শয়তানের বাচ্চা, অনেকদিন ধরে সুযোগ খুঁজছিলাম তোকে হাতে পাওয়ার। আজ তোর সব শয়তানি আর কালাজাদুর শখ ঘুচিয়ে দেব শুয়ার’ —বলতে বলতে তিন জন এগোয় জর্জির দিকে। ঠিক যেভাবে শিকারের দিকে এগোয় হায়েনার দল।

এরপর ঠিক কী হয় সেটা পুরোটা লিওর স্মরণে নেই। শুধু মনে আছে হঠাৎ করে জর্জির চোখ দুটো ভয়াবহ ভাবে উলটে যায়, মুখ থেকে উচ্চারিত হতে থাকে দুর্বোধ্য মন্ত্রসমষ্টি এবং হাত দুটো এক আশ্চর্য মুদ্রায় হাওয়ায় আঁকে অশনিসংকেত। আর সেই তিন মূর্তিমান পাপকে হঠাৎই যেন হাওয়ায় তৈরি ময়াল সাপেদের দল এসে শূন্যে তুলে ফেলে। আগেই স্নায়ু যথেষ্ট উত্তেজিত ছিল লিওর। এই অপার্থিব দৃশ্য দেখার পর স্বাভাবিকভাবেই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।

ঠিক কী ঘটেছিল সেটা পরে অবশ্য শুনতে হয়েছিল তাকে। ঘটনার সময় এক অশিক্ষক কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন। তিনি এসে দেখেন তিনটি ছেলে উর্ধপদ হেঁটমুণ্ড হয়ে বাতাসে ঝুলছে। শুধু ঝুলছে না, শূন্যে ঝুলতে ঝুলতেই সারা স্কুল প্রাঙ্গন প্রদক্ষিণ করছে। প্রাঙ্গনের ঠিক মাঝখানে জর্জিনহো, তার ডান হাত সামনে তোলা, বাঁ-হাত দিয়ে ধরে আছে ডান হাতের কনুই। আর ডানহাতের কবজি থেকে তর্জনী অবধি অস্বাভাবিক নমনীয়তার সঙ্গে দ্রুত ঘুরে চলেছে। ছেলে তিনটির কিন্তু হুঁশ নেই, মৃতদেহের মতন তাদের হাতগুলো নীচে ঝুলছে, পা-গুলো কিন্তু টানটান, কে যেন দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে ওপরে! যথারীতি ভদ্রলোক আঁ আঁ করে আর্তচিৎকার শুরু করেন। সেই শুনে দৌড়ে আসেন উপস্থিত শিক্ষকটি। তিনি প্রথমে এই কাণ্ড দেখে আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েন। তারপর গলায় ঝোলানো ক্রুশ বার করে হাঁটু গেড়ে বসে বাইবেল আওড়াতে থাকেন।

পুরো ব্যাপারটা অবশ্য পাঁচ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয়নি। এরপরই ছেলে তিনটেকে মাটিতে নামিয়ে লিওকে কোলে তুলে চম্পট দেয় জর্জিনহো।

সেইবার ভাজ পরিবারকে একটা বড়ো ধরনের ঝামেলায় পড়তে হয়। খুবই স্বাভাবিক ছিল ঝামেলায় জড়ানোটা, কারণ ছেলে তিনটি এরপর সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যায়। আইন অনুযায়ী জর্জিনহোর কপালে দুঃখ ছিল, কিন্তু ত্রাতা হয়ে দাঁড়ায় আরেকজন, ভিসিয়েন্তে। তারই সাক্ষ্যের জোরে বড়ো কোনো শাস্তির হাত থেকে বেঁচে গেলেও একবারে রেহাই পায় না জর্জি। তিন তিনটি প্রভাবশালী পরিবার তাদের এত বড়ো ক্ষতি মেনে নেবে, এটা ভাবার স্বভাবতই কোনো কারণ নেই। তারা তো পারলে জর্জিনহোকে ছিঁড়েই খায় কি জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে। এমনকী তিন পরিবারে মিলে গুপ্তঘাতকও নিয়োগ করে বলে গোপনসূত্রে খবর পান অগাস্তিনহো। সে নিয়ে আবার মন্ত্রীপরিষদের কাছে নালিশ জানান তিনি। শেষে অশান্তি যখন চরমে উঠেছে, স্বয়ং সম্রাট পঞ্চম জনের মধ্যস্থতায় ব্যাপারটার মিটমাট হয়। বিনিময়ে ভাজ পরিবারকে মেনে নিতে হয় যে ভূতপ্রেতের খপ্পরে পড়েছে তাদের ছেলে। যথারীতি চার্চ থেকে জর্জিকে এক্সরসিজ করার জন্যে ফতোয়া বেরোয়।

এক্সরসিজমও অবশ্য কম যন্ত্রণার নয় এবং দৈহিক অত্যাচারেরও শেষ থাকে না তাতে। দুর্বল শরীরের অনেকেই ওতে মারা যায়, অনেকেই পঙ্গু হয়ে পড়ে। এক্সরসিজমের পরেও সুস্থ সবল ভাবে বেঁচে থাকতে খুব কম লোককেই দেখা গেছে। তবে এত হ্যাপা পোয়ানোর আগেই এক রাতে বেশ কিছু টাকাপয়সা হাতিয়ে চম্পট দেয় জর্জি। সালটা সতেরো-শো ছত্রিশ।

ভাজ পরিবার ছেলে হারানোর কষ্টে থাকলেও একদিক দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিল। জর্জিনহো পরিবারের বড়ো ছেলে। স্মরণকালের মধ্যে এই প্রথম ভাজ পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান ষোলো বছরের গণ্ডি পার করেছে। যেখানেই থাকুক না কেন সে, নিশ্চয়ই বেঁচেবর্তে আছে। এই আশাতেই দিনাতিপাত করছিলেন জর্জি আর লিওর বাবা-মা, অগাস্তিনহো আর কাসান্দ্রা। তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে লিওনার্দোর ওপর। হাসিখুশি ছেলেটি ক্রমশ জেদি, ভীতু, কুঁড়ে ও ঘরকুনো হয়ে পড়ে।

আর তারও উনিশ বছর পর এই বছর মার্চের সন্ধায় হঠাৎ ছদ্মবেশে জর্জির উদয়। কাসান্দ্রা প্রথমে চমকে গেছিলেন, তারপর বুকে জড়িয়ে ধরেন, বিহ্বল হয়ে পড়েন অগাস্তিনহোও। তারপরেই কয়েক জন বিশ্বস্ত কর্মচারীদের দায়িত্বে চিলেকোঠার ঘরে লুকিয়ে রাখা হয় জর্জিকে। পঞ্চম জন মারা গেছেন দু-বছর আগে, এখন সম্রাটের আসনে অধিষ্ঠিত প্রথম জোসেফ। প্র‍য়াত সম্রাটের আদেশ নাকচ করে নতুন আদেশ জারি করার জন্যে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। গোপনে সেই ব্যবস্থাই করতে শুরু করেন অগাস্তিনহো। জর্জির বয়েস এখন পঁয়ত্রিশ, লিও এখন পঁচিশ বছরের তরুণ। দাদাকে দেখে সব থেকে বেশি আনন্দ তারই হয়। সারাদিন ধরে সে পড়ে থাকে চিলেকোঠায়, শোনে এই ষোলো বছরে কী কী করেছে দাদা।

পড়াশোনায় জর্জির কোনোদিনই তেমন মন ছিল না। তার মন জুড়ে ছিল—তন্ত্রমন্ত্র জাদুবিদ্যা অতিপ্রাকৃতিক শক্তির খোঁজ। বাড়ি থেকে পালিয়ে সে প্রথমে যায় বাভারিয়াতে। সেখানকার জঙ্গলে ‘বুড়ো শয়তান’ নামে খ্যাত এক বৃদ্ধ শামানিস্টের কাছে সে দানবমন্ত্রে সিদ্ধিলাভ করে। তারপর ফ্র্যাঙ্কোনিয়া আর স্যাক্সনি পেরিয়ে যায় অস্ট্রিয়ার উত্তরে মোরাভিয়াতে। সেখানে রাজপরিবারে এক জন ডাইনি রাজকন্যার বেশ ধরে অবস্থান করছিলেন, তাঁর সঙ্গে জর্জির আলাপ হয় এক বিচিত্র উপায়ে। সেই ডাইনির কাছে জর্জি শেখে শবসাধনা, শেখে মৃতদেহর মধ্যে নিজের আত্মাকে প্রবেশ করানোর বিদ্যা। তারপর সেখান থেকে তার পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়লে সে প্রাণ হাতে করে পালিয়ে যায় হাঙ্গেরি। ততদিনে তার কাছে জমানো টাকা প্রায় শেষ। সেখানে প্রায় ভিক্ষা করে বেঁচে ছিল সে। শেষে এক পথচারীর কাছ থেকে কিছু টাকা চুরি করে সে পাড়ি দেয় ট্র্যানসিলভানিয়াতে।

ট্র্যানসিলভানিয়াতে এক জিপসি দলে ভিড়ে যায় জর্জি। ভালো ব্যবহার আর চমৎকার কথা বলতে পারার জন্যে অল্পদিনের মধ্যেই দলের কর্ত্রীর প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে সে। সঙ্গে বংশগত ভাবে পাওয়া রূপ তো ছিলই। সেই মহিলার কাছেও বলকান অঞ্চলের এবং স্যাক্সন জনজাতির অনেক হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন জাদুবিদ্যা শেখে সে। শেখে পশুপাখির ভাষা, শেখে কেউটে সাপ আর জংলি নেকড়ে পোষ মানানোর মন্ত্র, শেখে সাপের বিষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষের প্রতিষেধক প্রক্রিয়া। আরও শেখে মানুষের ভাগ্য গণনা করার পদ্ধতি। সেই মধ্যবয়সি রমণী যত্ন করে জাদুর জগতের অনেক ঝাঁপি তার সামনে খুলে দেয়। শোনে জাদুবিদ্যা আর ব্ল্যাক আর্টের ওপর অসংখ্য বই এবং পাণ্ডুলিপির কথা, যার অধিকাংশই চার্চের আদেশে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। শোনে গ্র্যান্ড গ্রিমোয়ার বা রেড ড্র্যাগন, দ্য নেক্রোম্যান্সিয়া, ওয়েরা লিন্ডা, দ্য পিকাট্রিক্স ইত্যাদি জাদুজগৎ কাঁপানো বিখ্যাত গ্রিমোয়ার গুলির কথা। বদলে সেই জাদুকরীর কাছে নিজের কৌমার্যটুকু হারাতে হয় জর্জিনহোকে।

আর সেখানেই সে শোনে আইসল্যান্ডের এই হোলার অঞ্চলের কথা। শোনে ইউরোপের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে শক্তিশালী শয়তানের উপাসকের কথা। শোনে তাঁর লেখা সবচেয়ে অলৌকিক, সবচেয়ে রহস্যময়, সবচেয়ে ভয়ংকরী ডাকিনীবিদ্যার বইটির নাম। যে বইটির একটিই মাত্র কপি ছিল, এবং সেই অসীম শক্তিশালী তন্ত্রসাধকের মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহের সঙ্গে সেই বইটিকেও কবর দেওয়া হয়।

এরপর আজ থেকে পাঁচ বছর আগে জিপসির দল তাকে এক বসন্তের প্রারম্ভে ছেড়ে দেয় অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী ইস্তানবুলের বাইরে। ছেড়ে দেওয়ার আগে সেই মধ্যবয়সি মহিলা বিদায়চুম্বনের পর একটি অদ্ভুত কথা বলেন, ‘সিংহ রাশির উদয়কালে মঙ্গল ও রাহুর গ্রহযোগে তোমার জন্ম। আজ থেকে আর পাঁচটির বেশি বসন্ত দেখার সৌভাগ্য তোমার নেই। শুধু শুনে রাখো অনন্ত বিষাদের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে মহত্ত্বের সৌন্দর্য, কুটিল মরণের মধ্যেও শোনা যায় মুক্তির গাথা। মৃত্যুও তোমার পায়ে চুম্বন করার অপেক্ষায় ধন্য করবে নিজেকে। আর শোনো, জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কর্তব্য পালন করতে যাওয়ার দিনে নিজের ছায়াকে সঙ্গে রেখো।’

২০১৬। ৯ অক্টোবর, সপ্তমী, সোমবার। মুম্বাই

কনসুলেটের কাজ মেটাতে বিকেলই হয়ে গেল মার্টিনেজের। তাঁর আসল পরিচয় জানতেন শুধু কনসাল জেনারেল। তিনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে সব ব্যবস্থা করে দিলেন। গোয়াতে ফ্লাইটেই যেতে পারতেন মার্টিনেজ, কিন্তু তিনি শুনেছেন কোঙ্কণ রেলপথের অপূর্ব সৌন্দর্যের কথা। কাজেই তাঁর ইচ্ছেমতোই একটা ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কাটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওখানে এখনও কিছু পর্তুগিজ প্রপার্টি আছে, মুম্বাইয়ের কনসুলেটই তার দেখভাল করে। সেখানেই তাঁর থাকার ব্যবস্থাও করা আছে। এ ছাড়াও তাঁর ঘোরাফেরার জন্যে একটা গাড়ি সর্বক্ষণের জন্যে প্রস্তুত থাকবে, যেখানে বলবেন সেখানেই যেতে পারেন তিনি।

আমোনা নামের কোনো ভিলেজ আছে গোয়ার আশেপাশে? প্রশ্ন শুনে ভুরু কুঁচকোলেন কনসাল জেনারেল। তারপর ম্যাপ আনিয়ে দেখে জানালেন যে আছে তো বটেই। যেখানে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, সেই ক্যালাঙ্গুট বিচ থেকে তিরিশ চল্লিশ কিলোমিটার দূরে, ঘন্টা খানেক কি ঘন্টা দেড়েকের রাস্তা। কিন্তু গোয়াতে এত দেখার জায়গা থাকতে হঠাৎ সেই অজপাড়াগাঁয়ে কেন? এনি স্পেশ্যাল রিজন?

‘এমনিই’, কাষ্ঠহাসি হেসে কনসাল জেনারেলের কৌতূহল নিবৃত্ত করতে হয়েছে মার্টিনেজকে, ‘জাস্ট ম্যাপে দেখছিলাম তাই আর কী।’

অফিস থেকে বেরিয়ে মেরিন ড্রাইভে যাওয়া মনস্থ করলেন তিনি। আসার আগে ইন্টারনেট থেকে দেখে এসেছেন মুম্বাইয়ের বিভিন্ন জায়গার ছবি। মেরিন ড্রাইভ তখনই নজর কেড়েছে তাঁর। ড্রাইভারকে বললেন সেদিকে গাড়ি নিয়ে যেতে। যেতে যেতে শহরটাকে দেখতে লাগলেন তিনি। ব্যস্তসমস্ত মানুষজন, যন্ত্রের মতন যে-যার কাজে চলেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেউ আড্ডা মারছে বা গল্পগুজব করছে দেখাই যায় না। তবে যেটা দেখে মার্টিনেজের বেশ ভালো লাগল, সেটা হচ্ছে বান্দ্রা ওরলি সি লিঙ্ক। প্রযুক্তিবিদ্যার সঙ্গে সৌন্দর্যের মেলবন্ধন আগেও দেখেছেন তিনি। এই ব্রিজটির তারিফ করতে তাই আটকাল না তাঁর।

আধঘন্টা মেরিন ড্রাইভে সমুদ্রের ধারে বসে বেশ ভালো লাগল মার্টিনেজের। চমৎকার চওড়া ফুটপাথ। লোকে বসে আছে, ঘুরছে, বাচ্চারা খেলছে, কেউ কেউ গিটার বাজিয়ে গান গাইছে। বাঁধানো তীরভূমি আধখানা চাঁদের মতন বেঁকে গেছে। সমুদ্রের ওধারে মুম্বাইয়ের স্কাইলাইন। ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাই, তার সুউচ্চ বহুতল আর মহার্ঘ দ্যুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গরবিনী রানির মতন। আর সবচেয়ে যেটা ভালো লাগল তাঁর, বিদেশি বলে কেউ তাঁর দিকে অসভ্যের মতন হাঁ করে তাকিয়ে নেই, প্রাচ্যের অনেক দেশেই এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে তাঁকে পড়তে হয়েছে অনেক বার। স্বস্তিবোধ করলেন তিনি।

সন্ধ্যা নেমে আসছিল দ্রুত। আপনমনে হাঁটতে হাঁটতে বাঁধানো রাস্তার একদম শেষে চলে এসেছিলেন মার্টিনেজ। রাস্তা শেষ হতেই ছোট্ট একটা বিচ। তাতে যেন কার্নিভ্যাল বসেছে। একই সঙ্গে এত মানুষ, এত আলো, এত রং, এত উল্লাস কমই দেখেছেন তিনি। বুড়ো, জোয়ান, শিশু, পুরুষ, মহিলা, বেলুনবিক্রেতা, কাচের চুড়ি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা, রোস্টেড কর্ন থেকে শুরু করে লোকাল ক্যান্ডি আর স্ন্যাকসের দোকানে জায়গাটা জমজমাট। উলটো দিকে ফিরলেন তিনি। রাস্তা পার হবেন, তারপর ওদিকের রাস্তায় গিয়ে ডান দিকের ফুটপাথ ধরবেন, তিন চার কিলোমিটার পরেই কোথাও তাঁর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কাছাকাছি গিয়ে ড্রাইভারকে কল করে নিলেই হল। সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, এমন সময় পাশেই চোখ গেল তাঁর।

এক চল্লিশোর্ধ পুরুষ, মার্টিনেজের সমবয়সিই হবে প্রায়, ফুটপাথের ধারে একটা উঁচু স্টুলে বসে এক বছর দশেকের ছেলের সঙ্গে আলাপচারিতায় মগ্ন, খুব সম্ভবত বাবা আর ছেলে। বাবা কানে কানে কিছু একটা মজার গল্প বলছে, আর ছেলে সেই শুনে হেসে গড়িয়ে কুটিপাটি।

ধক করে বুকে একটা শেল এসে বিঁধল মার্টিনেজের। সব ঠিক থাকলে আজ তিনি ফয়েসিয়া বা গুঁইশো বিচের ধারে বসে তিয়াগোর সঙ্গে এমনই মুহূর্ত কাটাতে পারতেন। তিনি তো আজ অবধি সজ্ঞানে কোনো পাপ করেননি। তবে কেন? তাঁকেই কেন তাঁর স্নেহপুত্তলিটির জন্যে এইরকম উদ্ভ্রান্তের মতন ঘুরে বেড়াতে হবে? জায়গায় জায়গায় দরজায় দরজায় ভিক্ষা করে বেড়াতে হবে? কী দোষ ছিল তাঁর? কী দোষ ছিল ওই দশ বছরের ছোট্ট শিশুটার? কবেকার কোন পূর্বপুরুষের পাপের দায় তাঁর ছেলেকে ভুগতে হবে কেন?

রাস্তার সিগন্যালের আলো পালটাতেই শোকে অভিভূত অন্ধের মতনই রাস্তা পেরোলেন মার্টিনেজ। তারপর ডান দিকে ঘোরার বদলে পথ ভুলে সোজা উলটোদিকের রাস্তায় ঢুকে পড়লেন। অক্টোবর মাসের ভারতের উজ্জ্বল আকাশ মাথার ওপর। পূর্ব দিকের আকাশে তখন বৃষরাশির উদয় হচ্ছে, রোহিণী নক্ষত্র পূর্ণপ্রেমদৃষ্টিতে চাইলেন সদ্য উদয় হওয়া চাঁদের প্রতি। পশ্চিম আকাশে তখন শৌরি বা হারকিউলিস নক্ষত্রমণ্ডল। আর মাথার ওপর পূর্ব ও উত্তর ভাদ্রপদ নক্ষত্র দ্বারা বেষ্টিত পেগাসাস নক্ষত্রক্ষেত্র।

পেগাসাস উড়তে শুরু করল!

১৭৫৫। সেপ্টেম্বর । স্বিনভান লেক, হোলার, আইসল্যান্ড

ইস্তানবুলে তখন আপাতশান্তির আড়ালে ঘনিয়ে আসছে ক্ষয়িষ্ণুতার কাল। অটোমান সাম্রাজ্যের তখন বদ্ধতার সময়, শাসনক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত সুলতান প্রথম মেহমুদ। রাশিয়া তখন ইউরোপের নতুন উদীয়মান শক্তি। তাদের সঙ্গে লড়াই বেধেছিল সুইডেনের। সেই গ্রেট নর্দান ওয়রের সময় সুইডেনের পক্ষ নেওয়ার জন্যে, এবং পরাজিত সুইডেন সম্রাট দ্বাদশ চার্লসকে আশ্রয় দেওয়ার জন্যে ইতিমধ্যেই অটোমান সাম্রাজ্য রাশিয়ার চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে। তার ওপর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতন এই ক্ষীয়মাণ সাম্রাজ্যের শিরঃপীড়া হয়ে উঠেছে ইয়েনিসারি বা জ্যানিসারিদের বিদ্রোহ। এককালে যারা ছিল ইউরোপের দুর্দ্ধর্ষতম প্রতিরক্ষাবাহিনী, তুর্কী সাম্রাজ্যের সেরা অস্ত্র, আজ তারাই সম্রাটের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত!

এই গোলমালের মধ্যেই জর্জিনহো দৈবাৎ এক অসাধারণ মন্ত্রশক্তির অধিকারী ভারতীয় পুরুষের সাক্ষাৎ পায়। সেই ভারতীয় লোকটি তার বছর বিশেক আগে তুরস্কে এসেছিলেন ক্রীতদাস হিসেবে। তখন ভারতের মুঘল সাম্রাজ্য ভাঙনের মুখে, মারাঠা নামের এক হিন্দু শক্তি তখন অর্ধেক ভারতের অধীশ্বর। তারাই লুঠপাট করে, সমর্থ চেহারার মানুষজন ধরে বেঁধে বিদেশি দাসব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে বিপুল সম্পত্তি উপার্জন করেছিল। ভারতবর্ষের পূর্ব দিকের ‘বাংগালা’ নামের প্রদেশের বাসিন্দা এই মানুষটি তেমন করেই প্রথম যৌবনে মারাঠা দস্যুদের খপ্পরে পড়েন এবং আফগানি দাসব্যবসায়ীদের হাতফেরতা হয়ে ইস্তানবুলে আসেন। পরে এঁর বুদ্ধি ও ধীশক্তি দেখে এঁর মালিক এঁকে মুক্ত করে নিজের জীবিকানির্বাহের ব্যবস্থা করে দেন।

এই মানুষটি প্রাচ্যের যাবতীয় তন্ত্রমন্ত্র এবং জাদুকরী বিদ্যার আধার ছিলেন। অষ্টসিদ্ধি থেকে শুরু করে ভূতবন্ধন বা প্রেতকল্পে সিদ্ধহস্ত ছিলেন এই মানুষটি। এ ছাড়াও চরাচরের সমস্ত ডাকিনীবিদ্যায় ছিলেন অদ্বিতীয় অতিরথ। কায়াধারণ থেকে শুরু করে নিজের আত্মাকে দেহের বাইরে নিয়ে যাওয়া, অন্যের জীবিত শরীরে প্রবিষ্ট হওয়ার অসামান্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। হাওয়া থেকে অদ্ভুত জিনিস সৃষ্টি করতে পারতেন, পারতেন নিজের শরীর হালকা তুলোর মতন করে ফেলতে।

জর্জির অধ্যবসায় দেখে তিনিই জর্জিকে পিশাচবিদ্যা দান করেন। এই পৃথিবীতে খুব কম লোকেরই যা অধিগত, শেখান সেই মৃতদের জগৎ জাগ্রত করার মন্ত্র। তবে এও বলেন যে জীবনে মাত্র এক বারই কেউ পারে এই ভয়ংকর কাজে ব্রতী হতে। এমনকী বিন্দুমাত্র বিচ্যুতিতে প্রাণসংকট অবধি উপস্থিত হতে পারে।

জর্জিনহোর সমস্ত কথা তিনি শুনেছিলেন। জর্জি সমস্ত কথা জানিয়ে তাঁর আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। প্রিয় শিষ্যকে বিমুখ করেননি সেই শাস্ত্রবেত্তা, একদিন গোরস্থান গিয়ে বিশেষ তন্ত্রসাধনা করেন। তারপর ফিরে এসে জানান, যে অভিশাপ ভাজ পরিবারের ওপর আছে, তা খণ্ডন করা প্রায় অসম্ভব। কোটিকে গুটিক পারে, তাও ঈশ্বরের বিশেষ অনুগ্রহ না হলে তা কিছুতেই সম্ভব নয়। তিনি আরও নক্ষত্রবিচার করে বলেন উত্তরের হিমাবৃত দেশের এক মহাভৈরব সিদ্ধ পুরুষকে জাগানোর কথা। সেখান থেকেই নাকি চূড়ান্ত নির্দেশ আসবে।

বিদায় দেওয়ার দিন জর্জিনহোকে জড়িয়ে তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন দেশে তিনি একটি ছোটো ভাইকে দেখে এসেছিলেন অপহৃত হওয়ার সময়। যদি সে বেঁচে থাকে, আজ নিশ্চয়ই সে জর্জিনহোর মতোই বড়োটি হয়েছে!

আজন্মকালের জন্যে তাঁর কেনা গোলাম হয়ে রয়েছে জর্জিনহো ভাজ!

চুপচাপ বইঠা বাইতে বাইতে কথাগুলো নিজের মনে ভাবছিল লিওনার্দো। আজ সে জানে জর্জি কারও টানে ভাজ পালাসেতেতে ফিরে আসেনি। ফিরে এসেছিল অন্য এক উদ্দেশ্য নিয়ে। আসার মাসখানেকের মধ্যেই সে লাইব্রেরি ঘরের গোপন ভল্টে আবিষ্কার করে মিগুয়েলের লুকোনো ডায়েরি, আজ অবধি যা কেউ চোখেই দেখেনি, আছে বলে শুনেছে শুধু।

সব কিছু পড়ার পর, সব কিছু জানার পর, জর্জি বুঝতে পারে মিগুয়েলের ডায়েরিতে উল্লিখিত সেই উত্তরের হিমাঞ্চলাবৃত দেশে মৃত্তিকাগর্ভে শায়িত ‘লোহিত চর্মাবৃত’ মহাযোগীর নাম কী। তাঁকে কেনই বা সেই জিপসি রমণী উল্লেখ করেছিল ইউরোপের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শয়তানের উপাসক বলে। কেনই বা ইস্তানবুলের সেই ভারতীয় তন্ত্রসাধক উত্তরের হিমাবৃত দেশের মহান মন্ত্রসিদ্ধ পুরুষের কথা বলেছিলেন। এবং জেনেছিল সেই সবচেয়ে অলৌকিক, সবচেয়ে রহস্যময়, সবচেয়ে ভয়ংকরী ডাকিনীবিদ্যার বইটির নামও। যে বইটির একটিই মাত্র লিখিত রূপ ছিল, এবং সেই ভয়াল তন্ত্রসাধকের মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহের সঙ্গে বইটিকেও কবর দেওয়া হয়।

সেই মহাসিদ্ধ ঘোরভৈরব তন্ত্রপুরুষের নাম আজ জানে লিওনার্দোও, একটু আগেই জর্জি জানিয়েছে তাকে। জানে সেই অলৌকিক শক্তির ধারক গ্রিমোয়ারটির নামও, এও জানে কেন মিগুয়েলের ডায়েরিতে সেই অলৌকিক পুরুষের বিশেষণ হিসেবে ‘লোহিত চর্মাবৃত’ কথাটি বলা হয়েছে।

কারণ যে বইটি তার লেখকের সঙ্গেই সমাহিত করা হয়, সেই তন্ত্রচিহ্নধারী, শয়তানের মন্ত্রসিদ্ধ বইটির নাম হল রওডস্কিনা। ভাষাটা আইসল্যান্ডিক।

আর ইংরেজিতে এর নাম রেড স্কিন বা লাল চামড়া। লোহিত চর্ম।

আর সেই তন্ত্রবেত্তা মহাসাধকের নাম?

গটস্কলখ।

গটস্কলখ ‘গ্রিমি’ নিকুলসন।

২০১৬। ৯ অক্টোবর, সপ্তমী, সোমবার। মুম্বাই

রাস্তাটা চওড়া হলেও সামান্য অন্ধকার। সেটা আগে খেয়াল করেননি মার্টিনেজ। অন্ধের মতন রাস্তার ডান দিক ধরে সোজা হাঁটছিলেন। আশেপাশের জনস্রোত, তাদের বদলে যাওয়া প্রকৃতি, কিছুই লক্ষ্য করেননি। মাথার মধ্যে দপদপ করছিল ক্রোধ, কান্না আর যন্ত্রণা। মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর হাত ঢুকিয়ে নিজের হৃৎপিণ্ডটা যদি বার করে আনতে পারতেন এক বার… তিয়াগো.. ওহ তিয়াগো… এইভাবেই সারা জীবন একটা নির্জীব পদার্থের মতন বেঁচে থাকবে তাঁর ছেলে? রাত নেমে এসেছে এই মহানগরীর শরীরে, রন্ধ্রে রন্ধ্রেও বটে। খানিকক্ষণ পথ চলার পর সচেতন হলেন তিনি, পা দুটি ধীর হয়ে এল। তিনি জানেন না কতক্ষণ হেঁটে এসেছেন তিনি, কত দূর। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখানে তাঁর না থাকাই শ্রেয় ছিল। জায়গাটা একটা আলো-আঁধারি রাস্তা তেমাথা মোড়। যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন তার ঠিক উলটোদিকে একটা সরু গলি। আকাশে সপ্তমীর বাঁকা চাঁদের ক্ষীণ আলো লুটিয়ে পড়েছে পিচের রাস্তায়। রাস্তার পাশের ভাঙা ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলো যেন বিষাদের চাদরের মতন ছড়িয়ে আছে চারপাশে। চোখ তুলে মার্টিনেজ বুঝলেন যে জায়গায় তিনি এসে পড়েছেন সেখানে এই মুহূর্তে আসাটা তাঁর উচিত হয়নি।

সামনের গলিটার দু-পাশে অনেকগুলো ঘর। প্রতিটি ঘরের সামনে উজ্জ্বল রঙের দৃষ্টিকটু পোশাকে বসে আছে একদঙ্গল মেয়ে। তাদের রং মাখানো মুখ, উগ্র সাজগোছ, খিলখিল হাসি, উচ্চকিত আলাপ আলোচনা, বসার ভঙ্গি, এসবই বলে দিচ্ছিল ওরা কারা!

গলির মুখটায় আর চারিদিকে কাঠের গাড়ি, তাতে কিছু সস্তা খাবার বিক্রি হচ্ছে। মোড়ে একটা ছোট্ট দোকান, সামনে ঝুলছে রং-বেরঙের স্যাশে। সেখানে সিগারেট থেকে শুরু করে হরেক জিনিসের বিক্রি, তারস্বরে একটা রেডিয়ো চলছে। বাইরে থেকে আসা লোকজন মাথা নীচু করে একেকটা বাড়িতে ঢুকছে, আবার কেউ কেউ বেরিয়েও আসছে। এক জায়গায় ছোটো জটলা দেশি মদের উগ্র গন্ধে আর মৌতাতলোভী লোকেদের ভিড়ে নরকগুলজার হয়ে আছে জায়গাটা। মার্টিনেজ খেয়াল করলেন ইতিমধ্যেই তাঁর পাশে ঘনিয়ে এসেছে একটা লোক, তার নোংরা চেহারা, মলিন পোশাক-আশাক সবই বিবমিষা উদ্রেককারী। টলতে টলতে ফিসফিস করে সে বলল, ‘ওয়ান্ট গুড কলেজ গার্ল স্যার? ফ্রেশ গার্ল স্যার, ভেরি ইয়ং, ভেরি চিপ।’ স্থানীয় মদের কড়া গন্ধে মার্টিনেজের গা গুলিয়ে ওঠার উপক্রম হয়। তিনি মুখে রুমাল চাপা দিয়ে হাতের ঈঙ্গিতে লোকটাকে সরে যেতে বলতেই সে আরও গা ঘেঁষে আসে, শ্লেষ্মাজড়িত কণ্ঠে মার্টিনেজের জামার হাতা ধরে টানতে থাকে, ‘টিপস সাহিব, টিপস। গিভ মি টেন ডলার…­’

মার্টিনেজের ইচ্ছা হল টেনে একটা থাপ্পড় মারেন এই নোংরা ভিখিরির বাচ্চা বেশ্যার দালালটাকে। বহু কষ্টে মনের ইচ্ছা সংবরণ করে জামাটা ছাড়াবার জন্যে হাতটা শুধু এক বার সজোরে ঝাড়া দিতে লোকটা মাটি থেকে সামান্য উঁচু হয়ে ছিটকে পড়ে, মাথাটা সজোরে লাগে একটা ল্যাম্পপোস্টে ও স্থির হয়ে যায়।

মার্টিনেজ খেয়াল করলেন আশেপাশের দেওয়ালের গা ঘেঁষে থাকা অন্ধকারগুলো যেন একটু নড়ে উঠল। ইতিউতি জ্বলতে থাকা আগুনের বিন্দুগুলো একটু সচল হয়, দু-চারটে ছায়া উঠে এল এদিকে। বিদেশবিভুঁইতে কোনো ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ, স্থানীয় কনসুলেট বা দেশের টুর গাইড সেকথাই পই পই করে বলে দেয় বার বার। আর যে কাজটার জন্যে এসেছেন, তার আগে যথাসম্ভব ঝামেলা এড়িয়েই চলতে চাইছিলেন মার্টিনেজ। কিন্তু ঝামেলা নিজে থেকে ঘাড়ের ওপর এসে পড়লে আর কী করা! ঘুরেই দাঁড়ালেন ইউরোপের ইস্পাত।

ঠিক সেই মুহূর্তে, সেই মুহূর্তেই ঝড়ের মতন একটা গাড়ি এসে থামল গলিটার মুখে। পাশের দরজা দুটো স্লাইড করে খুলে যেতে দু-পাশ থেকে দুটো করে মোট চারটে মোটাসোটা হুলিগান টাইপের লোক নামে পাথুরে রাস্তায়। না, শুধু তারা নয়, নামল একটা অল্পবয়সি মেয়েও।

মেয়েটা যে স্বেচ্ছায় আসেনি, সেটা না বললেও চলবে। গাড়ি থেকে টেনে নামানোর পর থেকেই তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে বাচ্চাটা। যাবে না, ওই গলির মধ্যে কিছুতেই যাবে না সে। ছটফট করছে মেয়েটা আর কাঁদছে। হাউহাউ করে কাঁদছে, বুক ফাটিয়ে কাঁদছে। ডান হাতটা দিয়ে নিজের বুক থাবড়ে থাবড়ে কাকুতিমিনতি করছে, পায়ে পড়ছে ওই চারটে লোকের। সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার। বলা বাহুল্য, চার জন মুশকো গুন্ডার কাছে এসব গা জোয়ারি কিছুই না। তার ওপর ভাবগতিক দেখে মনে হল এসব কাজ তাদের গা সওয়া। এক জন আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে সজোরে বায়ুত্যাগ করাতে সেই নিয়ে আবার হেসে লুটিয়ে পড়ল বাকি দু-জন। শেষের জনের হাতেই ধরা ছিল বাচ্চাটা, সে আবার এসবে ক্যাঁচরম্যাচরে বিরক্ত হয়ে সে সজোরে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিল মেয়েটাকে। আঁক করে ওঠার সঙ্গেসঙ্গে মেয়েটার মাথাটা স্প্রিং এর মতন বাঁ-দিকে ঘুরে যায়, আর দৃশ্যটা দেখে চড়াৎ করে মাথায় রক্ত চড়ে যায় মার্টিনেজ ভাজের।

অনেক কষ্টে রাগ সামলালেন তিনি, যদিও ভেবে পাচ্ছিলেন না যে এই মুহূর্তে তাঁর কি করা উচিত। তাঁর স্বাভাবিক বুদ্ধি তাঁকে বলছিল এখান থেকে চুপচাপ কেটে পড়াই আপাতত ঠিক। পরে না হয় কনসুলেটের সাহায্যে পুলিশে একটা অভিযোগ…

ভাবতে ভাবতেই একটা অভাবনীয় কাণ্ড ঘটে গেল। মেয়েটা তাকে ধরে থাকা হাতটায় সজোরে একটা কামড় দিতেই লোকটা উঃ আওয়াজ করে হাতটা আলগা দেয়। আর সেইটুকু সময়ের মধ্যেই মেয়েটি পালাতে গিয়ে সোজা এসে মার্টিনেজের পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, এতে একটু চমকেই যান তিনি। দ্রুত মেয়েটাকে দু-হাতে ধরে তোলেন, আর তারপর তার মুখের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে যান তিনি! যতটা ভেবেছিলেন তার থেকেও অনেক বাচ্চা হবে মেয়েটা। দশ কি এগারো। প্রায় তিয়াগোর বয়সি! মেয়েটাকে দাঁড় করিয়ে নিজের পিছনের দিকে ঠেলে দিলেন মার্টিনেজ। নাহ, ঝামেলাটা আর এড়ানো গেল না।

ইতিমধ্যেই টি-শার্ট, জিন্্স আর স্নিকার্স পরা চার মূর্তিমান ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে এদিকে। দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো ছায়াগুলো তাদের অনুসরণ করে তৎক্ষণাৎ। ছায়াদের কেউ একজন চেঁচিয়ে চার জনের দলের নেতাগোছের লোকটিকে বলে কিছু, আর তারপর রাস্তার পাশে শুয়ে থাকা দালালটিকে দেখায়। নেতাগোছের লোকটি এগিয়ে এসে মার্টিনেজের থেকে ফুট তিনেক দূরে কোমরে হাত রেখে দাঁড়ায়। কুতকুতে লাল চোখ, গলায় সোনার মোটা চেইন, চুইংগাম চিবোনো লোকটার সারা শরীর থেকে যেন ঔদ্ধত্য চুঁইয়ে পড়ছে। হোঁতকা কালো মুখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে লোকটা বলল, ‘ইউ ইংলিশ? আই ইংলিশ। গিভ গার্ল। নো ফাইটিং। গার্ল ইজ বিজনেস। ইউ গো সি বিচ।’ চোয়াল শক্ত করে সরু চোখে তাকিয়ে থাকেন মার্টিনেজ। লোকটা বোধ হয় বুঝতে পারে যে সাহেবের কথাটা ঠিক পছন্দসই হয়নি। সে আবার বলে, ‘ইউ ফরেনার, নো ফাইটিং, নো ট্রাবল। উই কিং হিয়ার। গিভ গার্ল। গো ব্যাক। অর ইউ পে ডলার, এনজয় দ্য গার্ল।’ স্থির চোখে সাপের চাউনি নিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকেন মার্টিনেজ আর সেই দৃষ্টি দেখে যেন হঠাৎ করেই হাসিটা উবে যায় তার মুখ থেকে। লোকটা নোংরা একটা মুখভঙ্গি করে চুইংগামটা থু করে ছুঁড়ে দেয় মার্টিনেজের মুখে, আর বেরিয়ে আসে অশ্রাব্য খিস্তি, ‘নো হিয়ারিং বাস্টার্ড? ফাক ইউ অ্যাসহোল, মাদারফা…’ একটা লোক যে শরীরের উর্ধ্বাংশ যৎসামান্য বাঁকিয়ে আর বাঁ-হাতটা মুখের কাছে এনে, সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে শরীরের ভারসাম্যটা বাঁ-পায়ের ওপর চালান করে দিতে পারে, আর পারে ডান পা-টা প্রায় পাঁচ ফুট তুলে দিতে, সেটা নেতাগোছের লোকটি আন্দাজই করতে পারেনি। অবশ্য আন্দাজ করে লাভও হত না একটুও। পাঁজরের ঠিক নীচে, পেটের একটু ওপরে অংশটাকে বলে সোলার প্লেক্সাস। মানব শরীরের যে যে জায়গায় আঘাত করলে মুহূর্তের মধ্যে শত্রুকে অকেজো করা যায়, তার প্রথম তিনের মধ্যেই এর নাম আসবে। আঘাতটা আসে ডায়াফ্রামের ওপর, এবং স্বভাবতই সেখানে সজোরে আঘাত করলে নিশ্বাস নেওয়াটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এসবই হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাটের একদম গোড়ার দিকের কথা। লোকটার অবশ্য এসব জানার কথাও নয়। লাথিটা খাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে তার মনে হয় যেন একটা লোহার মুগুর তার ফুসফুসটা ফাটিয়ে দিয়েছে। পড়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে যে দৃষ্টিটা তার চোখে ঝুলে ছিল তার মধ্যে যন্ত্রণার সঙ্গে মিশে ছিল বেশ খানিকটা বিস্ময় ও ভয়। মরণান্তিক ভয়।

এরপরে স্বাভাবিকভাবেই বাকিরা তেড়ে আসে মার্টিনেজের দিকে। আর তারপর যেন একটুকরো ক্যারিবিয়ান হ্যারিকেনই উঠে এল মুম্বাইয়ের কামাথিপুরার বুকে। পুরো লড়াইটা শেষ হতে সময় লাগে ঠিক এগারো মিনিট। তারপর সেই ধ্বংসস্তূপের চারিপাশে যখন তাকালেন মার্টিনেজ, তখন এলাকা পুরো খালি। সটাসট বন্ধ হয়ে গেছে পান সিগারেট আর বাকি দোকানগুলো। যে মেয়েগুলো দরজার সামনে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে কাস্টমারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল, তারাও অবস্থা বুঝে ঘরের মধ্যে সেঁধিয়েছে, জানলার ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে এদিকেই।

ভয়ে আতঙ্কে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বাচ্চা মেয়েটার নড়া ধরে দাঁড় করালেন মার্টিনেজ। তারপর মেয়েটাকে প্রায় টানতে টানতে পেছন ফিরে দৌড়তে থাকেন তিনি। বাচ্চাটাকে নিয়ে এক্ষুনি এখান থেকে পালাতে হবে তাঁকে, তাঁর মন বলছিল বড়ো একটা ঝামেলা বাধতে চলেছে বলে। দৌড়তে দৌড়তেই দু-একটা ট্যাক্সি থামাবার চেষ্টা করলেন তিনি, এবং তাদের এই দু-জনকে দেখেই দ্রুতবেগে উধাও হয়ে যাওয়া দেখে বুঝলেন খবরটা এই এলাকায় এর মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে ভালোই। বাঁ-দিকে একটা বাঁক নিলেন মার্টিনেজ। এবার রাস্তাটা একটু চওড়া, দোকানপাট আছে। লোকজন একটু-আধটু তাকাচ্ছেও দু-জনের দিকে। ভাবখানা যেন, রেড লাইট এরিয়া থেকে সাহেব মেয়ে তুলে পালাচ্ছে নাকি? একটা ক্যাব যেন অন্ধকার ফুঁড়েই পাশে এসে দাঁড়াল মার্টিনেজের পাশে। সেদিকে এক বার তাকিয়েই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন তিনি, ক্যাবটা ভরতি। পেছনের সিটে প্যাসেঞ্জার বসে আছে। ‘সাহেব, কাম হিয়ার। আই অ্যাম হিয়ার টু হেল্প ইউ।’ থেমে পেছনে ফিরলেন উত্তেজিত, ঘর্মাক্ত মার্টিনেজ। ট্যাক্সিটাও তাঁর পাশে এসে থামে। পেছনের প্যাসেঞ্জারটি মুখ বার করেন, ‘কাম হিয়ার সাহেব, জলদি। উই ডোন্ট হ্যাভ মাচ টাইম।’ এটা কি একটা ফাঁদ? হতেও পারে। কিন্তু ক্যাবের জানলা থেকে মুণ্ডু বার করে রাখা লোকটাকে দেখে তাঁর কী মনে হল কে জানে, মেয়েটাকে প্রায় পাঁজাকোলা করে নিজের অত বড়ো শরীরটা নিয়ে ট্যাক্সির পেছনে সেঁধিয়ে গেলেন মার্টিনেজ।

১৭৫৫। সেপ্টেম্বর। স্বিনভান লেকের ধার, হোলার, আইসল্যান্ড

‘নিয়তির কী আশ্চর্য গতিপ্রকৃতি দেখ লিও, গটস্কলখ যে বছর মারা যান, ঠিক সেই বছরেই মিগুয়েলের জন্ম’, নিস্তরঙ্গ লেকে নৌকো বাইতে বাইতে বলে জর্জি। দাঁড় টানতে টানতে চুপচাপ শুনছিল লিও। আর মিনিট দশেকের মধ্যেই তারা পৌঁছে যাবে অপর পাড়ে। বিশাল অন্ধ পাহাড়ের মতন সেই প্রাচীন চার্চ এখন তাদের দৃষ্টিসীমার প্রায় অনেকটাই জুড়ে আছে। এক বার করে সেদিকে চোখ যাচ্ছে লিওর, আর বুকটা একটু করে দমে যাচ্ছে। বিশ্বচরাচরে আর কেউ নেই, কোত্থাও নেই। চারিদিকে নিরেট জমাট অন্ধকার যেন ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছে এই দুই দুঃসাহসী অভিযাত্রীর দিকে। সামনে সেই পরিত্যক্ত চার্চ, যেখানে গত দু-শো বছরে কেউ সাহস করে দিনের বেলাতেই পা দেয়নি, রাতের বেলায় আসা তো অসম্ভব! বরফ ঠান্ডা জলে ছোটো ছোটো ঢেউয়ে ভেঙে যাচ্ছে দশমীর বাঁকা চাঁদ। লিও-র মনে হল অত বড়ো চার্চটা যেন হাঁ করে আছে, তাকে গিলে খাওয়ার জন্যে। নেহাত জর্জি সঙ্গে আছে তাই…

‘গটস্কলখ ছিলেন আইসল্যান্ডের তো বটেই, সেযুগে ইউরোপের শ্রেষ্ঠতম তন্ত্রসিদ্ধ অঘোরী উপাসক। এযুগেও তাঁর মতন প্রতিভা নিয়ে খুব কম লোকই জন্মেছে। হোলার চার্চের বিশপ ছিলেন তিনি। একজন খ্রিস্টীয় উপাসক হয়ে তিনি কী করে যে মন্ত্রসাধনা আর তন্ত্রবিদ্যায় আসক্ত হয়ে পড়লেন কে জানে! লোকে বলত তিনি নাকি যেকোনো পশু বা প্রাণীর রূপ ধারণ করতে পারতেন, পারতেন কিছুক্ষণের জন্যে কাউকে মেরে ফেলতে ও আবার বাঁচিয়ে তুলতে। লোকে বলে চার্চে তাঁর অধীনে যত শিষ্য ছিলেন, সবাইকেই তিনি তন্ত্রসাধনায় দীক্ষা দেন। ধীরে ধীরে হোলার চার্চে লোকজন প্রার্থনা করতে আসা বন্ধ করে দেয়, লোকজনের যাতায়াত কমে আসে। এখনও লোকে যেমন অতিপ্রাকৃত শক্তিকে ভয় পায়, তখনও পেত, ফলে লোকটার নামে উলটোপালটা প্রচুর বদনাম রটানো হয়। গটস্কলখ নাকি রোজ রাত্রে ওয়্যারউল্ফ হয়ে ঘুরে বেড়াতেন আর অসতর্ক পথিক বা শিশুদের আক্রমণ করে তাদের কাঁচা রক্ত-মাংস খেতেন।’ এবার সত্যিই ঠান্ডা লাগতে শুরু করল লিওর। ‘লোকে বলে তিনি নাকি শয়তানের উপাসনা করতেন। ধীরে ধীরে তাঁর নামই হয়ে যায় নিষ্ঠুর গটস্কলখ।’

‘সত্যি?’ ভীত স্বরে জিজ্ঞাসা করে লিও।

‘শয়তান কাকে বলে লিও? সাধারণত তন্ত্রসাধকরা প্রকৃতির মধ্যেই অদৃশ্য ভাবে মিশে থাকা অতিপ্রাকৃতিক শক্তির উপাসনা করেন। অশিক্ষিত লোকজন তাকেই বলে শয়তানের উপাসনা। শয়তান বলে কিছুই নেই লিও। ইতিহাসের শুরু থেকে আজ অবধি মানুষের মনে যত অন্ধকার ইচ্ছা, যত গহীন আকাঙ্ক্ষা, যত গোপন পাপ, যত অব্যক্ত কামনা জমেছিল, বা জমে আছে, সেসবই পৃথিবীতে রয়ে গেছে লিও। আমাদের চৈতন্যের স্তরে স্তরে তার প্রতিটি পরত রয়ে গেছে, রয়ে গেছে আমাদের অস্তিত্বে আলজিভের মতন। তাকেই আমরা শয়তান বলে জানি, আমাদের মধ্যে মিশে থাকা অন্ধকার আমিটাকেই আমরা শয়তান বলে চিনি, জানি যে সে আছে। আর আমাদের সেই সম্মিলিত অবচেতনের গহীনে লুকিয়ে থাকা শয়তানকে যে বা যাঁরা একটি মাত্র রূপদান করে তাকে আহ্বান করতে পারেন, তাঁদেরই আমরা তন্ত্রশাস্ত্রজ্ঞ মহাপুরুষ বলে জানি। গটস্কলখ তাঁর সাধনবলে এরও অনেক ওপরের স্তরে পৌঁছেছিলেন লিও। তিনি সেই ক্ষণজন্মা পুরুষদের মধ্যে একজন ছিলেন, যিনি শুধু যে ইচ্ছেমতো শয়তানকে আহ্বান করতে পারতেন তা নয়, শয়তানকে যিনি নিয়ন্ত্রণও করতে পারতেন!’

চুপ করে রইল লিও। তার মনে চলছিল বিচিত্র এক ছায়াখেলা। একদিকে আজন্মলালিত গোঁড়া ক্রিশ্চান সংস্কার, আরেক দিকে জর্জির হাত ধরে নতুন এক অজানা রোমাঞ্চকর জগতের উদ্ভাস। দুনিয়ার তাহলে সবটা যে শুধু সাদা আর কালো তা নয়, তাই না?

‘আজ আমরা কী করব জর্জি?’

‘গটস্কলখ একটি অসামান্য বইতে তাঁর আজন্মকাল সঞ্চিত জ্ঞান লিখে রাখেন। লিখে রাখেন মৃতদের জগত জাগানোর প্রক্রিয়া। লিখে রাখেন শয়তানকে আহ্বান করার যাবতীয় মন্ত্র, প্রক্রিয়াদি এবং বিশদ বিবরণ। বইটির মলাট ছিল নিহত এক মাদী শুকরের মন্ত্রসিদ্ধ চামড়া দিয়ে। লাল রঙে রাঙানো চামড়া দিয়ে বাঁধানো বইটি নাকি লেখা হয় কমন রাভেনের রক্ত, কুকুরির দুধ, আর বাদুড়ের মুখের লালা দিয়ে তৈরি কালিতে।’ একটু চুপ করল জর্জিনহো। তারপর ফিসফিস করে বলে, ‘লোকে বলে মৃত মানুষের কাটা আঙুল নাকি ব্যবহৃত হয়েছিল কলম হিসেবে। গটস্কলখ নাকি শুধু বলে যেতেন, আর সেই কাটা আঙুল নিজে নিজে পাতায় আঁচড় কেটে সেইসব লিখে যেত।’

স্তম্ভিত হয়ে দাদার দিকে তাকিয়ে থাকে লিও!

‘লোকে বলে বইটি নিজেও অসামান্য ক্ষমতার আধার ছিল। অনুমতিহীন অনেকেই বইটি ছুঁতে গিয়ে অভিশাপগ্রস্ত হয় বলে শোনা যায়। লেখকের অনুমতি ছাড়া অনধিকারী কেউই এই বইটি হাতে নেওয়ার সাহস করেনি কখনো। জনশ্রুতি অনুযায়ী তার নামই হয়ে যায় লাল চামড়া, বা রেড স্কিন। আইসল্যান্ডীয় ভাষায় রওডস্কিনা।

পনেরো-শো কুড়ি সালে যখন গটস্কলখ মারা যান, হোলার চার্চে তখন আর কেউ আসে না। তাকে শয়তানের আখড়া বলে ত্যাজ্য ঘোষণা করেছেন আইসল্যান্ডের আর্চবিশপ। তাঁরই আদেশক্রমে গটস্কলখেরই এক প্রিয় শিষ্য মৃতদেহের সঙ্গে তাঁর লেখা বইটিও একই কবরে সমাহিত করে। আর তার পর পরই এই চার্চ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। নতুন হোলার চার্চ এখন হোলার শহরের মধ্যিখানে। সেই থেকে এই চত্বরে কেউ পা রাখার কথা ভাবতেই পারে না।’

এইটি বলার সঙ্গেসঙ্গে ছোট নৌকোটি তীরে ভেড়ে। লাফিয়ে তীরে নামে জর্জিনহো এবং নৌকোটিকে টেনে ডাঙায় তোলে। তারপর লিও নামে নৌকো থেকে। তীরে দাঁড়িয়ে আগের প্রশ্নটাই ফের করে সে, ‘আজ এখানে আমরা কী করতে এসেছি জর্জি?’ নৌকোটা টেনে একটা বড়ো পাথরের পেছনে এনে ফেলে জর্জিনহো, একাই। তারপর সেই ক্ষীণ চন্দ্রালোকিত হ্রদের তীরে দাঁড়িয়ে, অপার্থিব আলো-আঁধারির মধ্যে প্রায় মিশে যাওয়া জর্জির গলা থেকে সামান্য কৌতুকময় কথাটা ভেসে এল, ‘আজ আমরা কবর থেকে গটস্কলখকে জাগাতে এসেছি লিও। জানতে এসেছি আমাদের পরিবারের ওপর ছেয়ে থাকা এই ভয়ংকর অভিশাপ থেকে মুক্তির কী উপায়। শয়তানেরও ওপরে প্রভুত্ব করা একমাত্র ইনিই আমাদের সঠিক রাস্তা দেখাতে পারেন।’

আতঙ্কটা লিওর বুকে পুরোপুরিভাবে চেপে বসার আগে ফিসফিস করে ফের বলে ওঠে জর্জিনহো ভাজ, ‘এইটাই নিয়তির বিধান লিও, শয়তান এসে মিগুয়েলকে এটাই বলে গেছিলেন। আর আজ যা করতে এসেছি তাতে তুমি এমন অনেক অলৌকিক কিছু দেখবে, যা দেখে তোমার হুঁশ উড়ে যেতে পারে। সাহস রেখো লিও, যদি কিছু ক্ষতি হয় তো আমার হবে। তোমার গায়ে একটি আঁচড়ও পড়বে না, পড়তে পারে না, সে ব্যবস্থা আমি করে রাখব। আজ যা ঘটবে, তার প্রতিটি মুহূর্তের নিখুঁত বর্ণনা নিজের মগজে গেঁথে নিও তুমি। আজ রাত থেকে ভাজ পরিবারের রক্ষার একমাত্র উপায় তোমার কাছেই গচ্ছিত থাকবে মিস্টার লিওনার্দো ভাজ। কিপ ইট সেফ।’

২০১৬। ১০ অক্টোবর, অষ্টমী, মঙ্গলবার। মুম্বাই

জুহু বিচের একটা কোণায় অনেকক্ষণ বসে ছিলেন মার্টিনেজ। তাঁর মনে বিচিত্র আলোর খেলা চলছিল, চলছিল অবশ্য কাল রাত থেকেই। রাতেই মেয়েটিকে নিয়ে সটান নিজের কনসুলেটে চলে যান মার্টিনেজ। গিয়ে সেখান থেকেই পুলিশে ফোন করেন। সেই নিয়ে যথারীতি হুলুস্থুলু কাণ্ড বেঁধে যায় কনসুলেটের মধ্যেই। বিভিন্ন প্রোটোকলের গেরো পেরিয়ে যখন মেয়েটিকে পুলিশের হাতে সমর্পণ করা হয়, তখন প্রায় শেষরাত বা ভোর। পুলিশ কমিশনার জয়ন্তী মুদলিয়ার কেসের গুরুত্ব বুঝে নিজে এসে উপস্থিত হন অকুস্থলে। খুব সম্ভবত নিজে মহিলা হওয়ার কারণেই খুব দ্রুত ব্যাপারটা মিটে যায়। তিনি নিজে মার্টিনেজের দু-হাত ঝাঁকিয়ে কনগ্র্যাচুলেট করে যান, ‘গুড জব ডান, মিস্টার ভাজ। প্লিজ অ্যাক্সেপ্ট মাই সিনসিয়ার রিগার্ডস।’ কনসাল জেনারেল বলা বাহুল্য এতে বিশেষ প্রসন্ন হননি, হওয়ার কথাও নয়। এসব ঝামেলা থেকে শতহস্ত দূরে থাকাই তাঁদের ট্রেনিং মোতাবেক শিক্ষা। মার্টিনেজ অবশ্য এসব চাপা অসন্তোষ বিশেষ পাত্তা দেন না। যা উচিত মনে করেছেন তাই করেছেন। বেশ করেছেন।

তাঁর পাশে বসে নির্বিকার মুখে ভেলপুরি নামের অত্যন্ত আনহাইজিনিক ইন্ডিয়ান স্ন্যাক্স খাচ্ছিলেন যে পাঁচ ফুট দু-ইঞ্চির টেকো ভদ্রলোক, তিনিই কাল মার্টিনেজকে ট্যাক্সিতে তুলে উদ্ধার করেন। সেই থেকে তিনি কেন কে জানে, মার্টিনেজকে ছাড়তেই চাইছেন না। রাত্রে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছিলেন, সকাল হতে না হতেই ফের এসে জুটেছেন।

এমনিতে লোকটার মধ্যে বৈচিত্র্যময় কিছুই নেই। অতি সাধারণ স্থূলোদর মধ্যবয়সি ভারতীয় শরীর। বয়েস পঞ্চাশের ওপরেই। পরনে হাফ স্লিভ শার্ট আর ট্রাউজার্স, সঙ্গে পায়ে একটা লেদারের তৈরি সস্তা লোফার্স। বাঁ-হাতে একটা প্রাচীন রিস্টওয়াচ আর মাথায় সুবৃহৎ টাক। মুখে সদাসর্বদাই একটা অমলিন হাসি লেগে রয়েছে। আর চোখে…

হ্যাঁ চোখে। লোকটার সারা বৈশিষ্ট্য ওই দুটো চোখেই যেন ফুটে উঠেছে। অমন ঝকঝকে, বুদ্ধিমান, খুশিয়াল আর অতলান্ত গভীর চোখ আর দেখেননি মার্টিনেজ। মেধা আর কৌতুকে যেন ঝকমক করছে চোখের মণি দুটি। শান্ত, ধীর, স্থিতধী সেই চোখ দুটির সামনে এসে নিজের অজান্তেই নম্র হয়ে পড়েন মার্টিনেজ। লোকটাকে তাই তাড়িয়ে দেবেন দেবেন করেও তাড়াতে পারেননি তিনি। অথচ লোকটার প্রায় কিছুই জানেন না মার্টিনেজ। লোকটা অত্যন্ত অদ্ভুত দেশীয় উচ্চারণে নির্ভুল ইংরেজি বলে। ব্যাকরণগত দিক থেকে এমন স্পষ্ট সঠিক ইংরেজি তিনি অদ্যাবধি গোটা ইউরোপ বা আমেরিকাতেও শোনেননি, ওভাবে কথ্য ইংরেজি আর বলাই হয় না। তার উপরে লোকটার আদবকায়দাও প্রায় প্রাচীন ব্রিটিশদের মতন, একটু নাটুকে। তবে সবমিলিয়ে লোকটাকে মোটামুটি ভালো না লেগে উপায় নেই। অল্প কিছু কথাবার্তা হয়েছে অবশ্য। লোকটা থাকে বম্বেতেই, যদিও এখানে ওর বাড়ি নয়। আসল বাড়ি ইন্ডিয়ার ইস্টার্ন পার্টে, বেঙ্গলে। ‘বাড়ি তো অন্য জায়গায়, এখানে তাহলে কী করতে?’ জিজ্ঞেস না করে পারলেন না মার্টিনেজ। ‘পেটের ধান্ধায় সাহেব’, অল্প হেসেছেন সেই ভদ্রলোক, চোখ দুটো ঝলসে উঠেছে কৌতুকে, ‘একটা ওষুধ কোম্পানির সেলসে চাকরি করি, যাকে লোকে বলে বেচুগিরি। আপাতত এখানেই পোস্টিং।’

এরপর না হেসে পারা যায় না, হেসেই জিজ্ঞেস করেন মার্টিনেজ, ‘একাই থাকো এখানে? বউ বাচ্চা?’ ‘তারা দেশে থাকে সাহেব। ইচ্ছে আছে আরও কিছু টাকা জমিয়ে দেশে ফিরে যাব। বিদেশবিভুঁইতে আর ভালো লাগে না।’ বোঝেন মার্টিনেজ, মাথা নাড়েন, ‘ক-টি সন্তান তোমার?’ ‘চার জন’ একটু লজ্জিতই দেখায় নাকি লোকটাকে? ‘চারটিই ছেলে।’ ‘হুমম, এইবারে বল তো চাঁদ, সেইদিন তুমি ওখানে কী করতে গেছিলে?’ প্রশ্নটা করেই ফেলেন মার্টিনেজ, যে প্রশ্নটা তাঁর মনে কাল থেকেই ঘোরাফেরা করছে।

সশব্দে হেসে ওঠেন ভদ্রলোক, চোখে ঝলসে ওঠে বিদ্যুৎ। ‘জানতাম সাহেব, তুমি এই প্রশ্নটা করবেই। তাহলে শোনো, কাল যে এলাকায় গেছিলে সাহেব, তার পাশেই আছে গ্রান্ট মেডিক্যাল কলেজ…

বাকিটা গুছিয়ে বলে লোকটা। গ্রান্ট মেডিক্যাল কলেজে নানা কাজকম্মে তার সেদিন রাত হয়ে যায় অনেক। এমনিতে গ্রান্ট মেডিক্যাল কলেজ থেকে মেরিন ড্রাইভে আসার একটা অন্য রাস্তা আছে। যে রাস্তাটা শর্টকাট, সেটাই সেই কুখ্যাত বেশ্যাপল্লির মধ্যে দিয়ে যায়। সেদিন নেহাত বাধ্য হয়েই শর্টকাটটা নিয়েছিল সে আর তারপর মার্টিনেজকে ওখানে দেখে হয়তো একটু কৌতূহল ভরেই দাঁড়িয়ে যায়। কাহিনির শুরুটা প্রায় পুরোটাই চাক্ষুষ করেছে লোকটা। মারামারি শুরু হতেই সে বোঝে যে গুরুতর একটা গণ্ডগোল হতে চলেছে। চট করে সে কোম্পানির টাকায় সারাদিনের জন্যে ভাড়া করা ক্যাবটা নিয়ে আড়ালে চলে যায়। তারপর পলায়মান মার্টিনেজকে অনুসরণ করে আসতে আর কতক্ষণ?

উপস্থিত বুদ্ধি দেখে তারিফ না করে পারেন না মার্টিনেজ। তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়, ‘তুমি তো পালিয়ে যেতে পারতে, হঠাৎ আমাকে সাহায্য করার জন্যে দাঁড়ালে কেন?’ ঝকঝকে হাসিটা ধরে রেখেই মার্টিনেজের দিকে তাকায় লোকটা, এবং তাতেই যেন যা বলার বলে দেয়। এই প্রথম হঠাৎ করে মার্টিনেজ আবিষ্কার করেন যে এই লোকটার সমস্ত না বলা কথাও তিনি বুঝতে পারছেন, দু-জনের মধ্যে যেন একটা টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ আছে। যেন এই লোকটা তাঁর অনেকদিনের চেনা, বা যেন তাঁর জন্যেই লোকটা অনেকদিন ধরে অপেক্ষায় আছে। একটু মাথাটা ঠান্ডা হল মার্টিনেজের, কোথা থেকে যেন তাঁর বিক্ষুব্ধ চিত্তে একটা উদ্যমী সাহসের উদয় হল।

অনেকক্ষণ চুপ রইলেন দু-জনে। সামনে তখন ম্লান সূর্য জুহু বিচের ঘোলাটে জলে সিঁদুর গুলে দিয়ে অস্ত যাচ্ছেন। মুম্বাইতে সন্ধে নামে চট করে। দ্রুতই বিচে নেমে এল শত শহুরে রোশনাইতে ঝলমলানো সাঁঝ। তারই মাঝে সেই স্তব্ধতা পেরিয়ে যখন লোকটার পরের কথাটা বরফের শান্ত ছুরির মতন আছড়ে পড়ল, ইউরোপের ইস্পাতের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা অবিশ্বাস্য শিরশিরানিই নেমে চলে গেল যেন।

‘এইবার ঠিকঠাক করে বল তো সাহেব, কে তুমি? আর কেনই বা এখানে এসেছ? আর তোমার মাথার পেছনে কেনই বা মৃত্যুর কালো ছায়া ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সবসময়? তোমার শরীরের বাইরে তোমার আরেকটা ছায়াশরীর হাঁটছে, কে সে? আসলে কে তুমি?’

স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন মার্টিনেজ, কে এই লোক? এসব কথা কী করে বলছে? অভিশাপ, মৃত্যু, এসব তো এর জানার কথা নয়! তিনি তো কাউকে বলেননি তাঁর এদেশে আসার উদ্দেশ্য, এক ফার্নান্দো ছাড়া। কোনো ‘প্রাচ্যদেশীয় মহাপুরুষ’-এর খোঁজও করেননি, জুটলে নিজেই জুটবে ভেবে। কী বলছে এ লোকটা? তারপরেই তাঁর সন্দেহ হল, লোকটা বুজরুক, ধাপ্পাবাজ নয় তো? ভাবলেন, দেখা যাক, দেখাই যাক একটা চান্স নিয়ে, কত দূর এর দৌড়!

‘কী করে জানলে এসব তুমি? কে বলেছে তোমাকে?’

মৃদু হাসলেন ভদ্রলোক, ‘আমি জানি সাহেব। আমি স্পষ্ট দেখছি মৃত্যুর বাজপাখি তোমার মাথার ওপর উড়ছে, যেকোনো মুহূর্তে তোমাকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাবে। একটা কালো অভিশাপের ছায়া সবসময় তোমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে। এবং এ জিনিস বড়ো সহজ জিনিস নয় সাহেব। হাজার বছরে এক বার কারো ওপরে এই অভিপাপ নেমে আসে।’

‘তুমি, তুমি কি তান্ত্রিক? ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ান?’

‘বলতে পার, সাহেব। প্রকৃতির মধ্যে ওতপ্রোতভাবে যে শক্তি জড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে লতায়, পাতায় ও ফুলে, বাতাসে ও বৃক্ষে, জড়িয়ে আছে নদীতে ও পাহাড়ে, জড়িয়ে আছে প্রাণীজগৎ ঘিরে, তারই আরাধনা করি। তাকে তুমি তন্ত্র বললে আমি তান্ত্রিক তো বটেই। শোনো সাহেব, ওসব থাক, একটা কথা বলি মন দিয়ে শোনো। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি তোমার সঙ্গে আমার থাকা দরকার, খুব দরকার। আমাকে তুমি চলে যেতে বল না সাহেব, আখেরে তোমার মঙ্গলই হবে। এখন তুমি কে, কেন এসেছ সব কিছু খুলে বল তো দেখি।’

লোকটার বলার মধ্যে কী ছিল কে জানে, মার্টিনেজ চুপ করে রইলেন। না বলার কথা তাঁর মাথাতেই এল না। কিছুক্ষণ বাদে যদিও আগের প্রশ্নটাই ফের করলেন তিনি, ‘কিন্তু কেন ব্রাদার, আমার ওপর এত দয়া কেন? আমাকে সাহায্য করার জন্যে এত উৎসাহ কেন তোমার?’

অন্ধকারে মুখ দেখা গেল না লোকটার, তারপর খানিকটা তিক্ত গলায় ভেসে এল এই কথাগুলো, ‘আমাদের দেশ বড়ো আজব দেশ সাহেব। আমরা একদিকে নারীকে দেবী বলে পূজা করি, অন্যদিকে টাকার জন্যে তাদের পুড়িয়ে মারতে আমাদের হাত কাঁপে না। একদিকে নারী ভ্রূণ হত্যা করতে আমরা দ্বিতীয় বার ভাবি না, আবার আমরাই অন্য বাড়ি থেকে বাচ্চা মেয়েদের চেয়ে আনি কুমারীপুজো করার জন্যে। কাল তুমি বাচ্চা মেয়েটাকে উদ্ধার করে যা করেছ সাহেব, সে মহাপুন্যের কাজ। এখন আমাদের দেশজুড়ে দেবীপক্ষ চলছে সাহেব, জগন্মাতার বোধন চলছে। আমরা বলি দুর্গাপূজা। মায়ের পুজোর দিনে তুমি আরেক মা-কে নিজের জীবন বাজি রেখে উদ্ধার করেছ। মায়ের আশীর্বাদ তোমার ওপর থাকবে সাহেব, দেখে নিও। আর আমি যদি তন্ত্রবিদ্যা কিছুমাত্র শিখে থাকি, যদি পিতৃপুরুষের সামান্যতম আশীর্বাদও আমার সঙ্গে থাকে, যদি মহামায়া আমার ওপর বিন্দুমাত্র কৃপা করে থাকেন তবে আমি কথা দিচ্ছি, এই ব্রাহ্মণের শরীরে বিন্দুমাত্র প্রাণ থাকতে এই অভিশাপের ছায়া তোমার অঙ্গস্পর্শ করতে পারবে না।’

স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন মার্টিনেজ। এই কি সেই? সব কি মিলে যাচ্ছে? মিলে যাচ্ছে মিগুয়েলের ডায়েরির ভবিষ্যদ্্বাণী? লিওনার্দোর ডিক্লারেশনের সতর্কবার্তা? তবুও এক বার বাজিয়ে দেখা দরকার, দরকার আরও সতর্ক হওয়ার।

‘কিন্তু কেন? তুমি আমার জন্যে এত বড়ো ঝুঁকি নেবেই বা কেন ব্রাদার?’

‘নিয়তি সাহেব, নিয়তি। ধরে নাও আমার তন্ত্রজ্ঞান আমাকে সেই শিক্ষাই দিয়েছে সাহেব। আজ সেইজন্যই নিয়তি আমাদের দু-জনকে একত্রে মিলিয়ে দিয়েছে। আরেকটা ব্যাপার কি জানো সাহেব?’

‘আর কী?’

‘একটা শিশুর জন্যে যে এত বড়ো ঝুঁকিটা নিতে পারে, তার বুকটা কত বিশাল সে আমি বুঝি। আমি এও বুঝি সেখানে কতটা ভালোবাসা থই থই করছে। জেনে রেখো সাহেব, ভালোবাসাই হল সবচেয়ে বড়ো তন্ত্র, সবচেয়ে বড়ো জাদু।’

কিছুক্ষণ চুপ থেকে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন মার্টিনেজ, ‘এত কথা হল, তোমার নামটা কিন্তু জানা হল না এখনও যে।’

ক্ষণমুহুর্তের নৈঃশব্দ ভেঙে জবাব দিল লোকটা, ‘তুমি আমাকে কৃষ্ণা বলেই ডেকো সাহেব। আমার নাম কে এন মৈত্র, পুরো নাম কৃষ্ণানন্দ মৈত্র।’ বলে খানিকক্ষণ বাদে ফের মুখ খোলেন ভদ্রলোক, ‘অবশ্য আমার আরেকটা নামও আছে। লোকে ডাকে আগমবাগীশ বলে, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ।’

১৭৫৫। সেপ্টেম্বর। প্রাচীন হোলার চার্চ, হোলার, আইসল্যান্ড

‘ভয় পেও না লিও। যা দেখবে, যা শুনবে তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হবে না, ভয় পাবে না। ভয় পেলেই কিন্তু মহাসর্বনাশ।’ শুকনো পাতা মাড়িয়ে চার্চের চৌহদ্দিতে ঢোকার সময় লিওকে সতর্ক করে দিচ্ছিল জর্জি। তাতে যে লিও খুব ভরসা পাচ্ছিল তা নয়। কাঁপা গলায় সে জিজ্ঞেস করে জর্জিকে, ‘কী কী সর্বনাশ হতে পারে জর্জি? কী কী দেখতে পারি?’ হেসে ফেলে জর্জি, ‘মৃতদের জগৎ জাগাতে এসেছি লিও, খুব সাধারণ কিছু দেখবে বা শুনবে বলে আশা করছ কি? তবে তোমার ভয় নেই। আজ আমার দিন, গটস্কলখের আত্মার সঙ্গে আমার বোঝাপড়ার দিন। তুমি শুধু সতর্ক থেকো। আর যা দেখবে যা শুনবে, মাথায় গেঁথে নিও।’

ঢোকার মুখেই বাঁ-দিকে একটা উঁচু মিনার। তার মাথায় চার্চের ভারী ঘণ্টা ঝোলানো থাকার কথা, কারণ ওটা বেল টাওয়ার। এখন টাওয়ারের সারা গা বেয়ে হাজারো সাপের মতন নেমে এসেছে লতাপাতা ও জংলি গাছ। ঘণ্টার অবস্থাও নিশ্চয়ই সেরকমই, ভালো লিও। আকারে বিশাল এই হোলার চার্চ, যদিও স্থাপত্যের দিক দিয়ে লিসবনের পাড়ার চার্চও এর থেকে অনেক বেশি জাঁকজমকের। চারিদিকে পাথরের স্ল্যাব দিয়ে তৈরি দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, তার উচ্চতা ফুট দুয়েকের বেশি হবে না। মাঝখানে একটা চার্চের মূল বাড়ি, পেছন দিকে লম্বাটে হয়ে গেছে। প্রধান গেটের মাথায় বিশাল একটি ক্রুশ। আর দু-দিকে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া ছাদ। সব মিলিয়ে এই। চার্চের ভেতরে ঢুকলই না জর্জি। লিওর হাত ধরে সোজা চার্চের দেওয়াল ঘেঁষে এগিয়ে যেতে লাগল পেছন দিকে। যেতে যেতে চারিদিক লক্ষ্য করছিল লিও। ডান দিকে দূরদূরান্ত অবধি পাথরের ছোটো ছোটো টিলা ছাড়া আর কিছু নেই। মাঝে মাঝে সেখান থেকে বয়ে আসা শিরশিরে হাওয়া তীক্ষ্ণ বল্লমের মতো বুকে বিঁধছিল তার। নজরটা সে এবার বাঁ-দিকে ঘোরায়। চার্চের পাথুরে দেওয়ালে এখন জংলি বুনো ঘাস আর লতাপাতার রাজত্ব। অযত্নে আর অবহেলায় শেষ হয়ে গেছে গটস্কলখ ‘গ্রিমি’ নিকুলাসনের সাধের হোলার চার্চ। মাঝে মাঝে উঁচু জানালা, তার মধ্যে দিয়ে চার্চের ভেতরের ঘন অন্ধকার যেন নিষিদ্ধ তরলের মতন বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। চার্চের দেওয়াল শেষ হতেই, ম্যাজিক!

জায়গাটা যে একটা সমাধিক্ষেত্র সে বোঝাই যাচ্ছে। সামনে রয়েছে ধাপেধাপে উঠে যাওয়া একটা ছোটো পাহাড়। চাঁদের আলোয় বোঝা যাচ্ছে যে লিওনার্দো ও জর্জিনহোর পায়ের নীচ থেকে শুরু করে পাহাড়ের প্রায় মাথা অবধি ছেয়ে আছে গোড়ালি অবধি ডুবে থাকা নরম ঘাসে। আর তার মাঝে মাঝে মাথা তুলে আছে ক্রুশকাঠ আর ছোটো ছোটো সমাধিফলক। এই এলাকায় বড়ো গাছ তেমন নেই। মাথার ওপর সেপ্টেম্বরের পরিষ্কার গাঢ় নীল আর কালোয় মেশানো আকাশ, ঝলমল করছে তারাদের জগৎ। যেন রাতের চাঁদোয়া ঝালরে হাজার হাজার হিরের কুচি বিছিয়ে দিয়েছে কেউ। ভারি মায়াময় নরম দশমীর চাঁদ পাহাড়ের প্রায় মাথা ঘেঁষে ঝুলে আছে। সামনে পিছনে আর কেউ নেই, কিছু নেই, কোত্থাও নেই। আহা, কী অনাবিল শান্তির মধ্যে মাটির নীচে ঘুমিয়ে আছে মৃতদের দল।

চার্চের ঠিক পেছনে একটা কুয়ো ছিল, বেশ উঁচু গোছের। তার মাথায় ছোট্ট একটা ছাউনি, তাতে কপিকল লাগানো। এত কাছে অত বড়ো হ্রদ থাকতে কুয়োর দরকারটা কী ভাবছিল লিও। এমন সময় জর্জির গলা ভেসে আসে, যেন লিওর মনের কথা ভেবেই বলে ওঠে সে, ‘তন্ত্রসাধনায় সচরাচর মৃত্তিকাগর্ভের জলই ব্যবহার করা হয় লিও, বৃষ্টির জলের জন্যে অনেক বাড়তি শোধন প্রক্রিয়া দরকার হয়। গটস্কলখ নিজে এই কুয়ো খুঁড়িয়েছিলেন বলেই আমার বিশ্বাস। যদিও এসবের কোনো লিখিত প্রমাণ নেই, থাকার কথাও নয়। সে যাই হোক, এইবার তোমার কাজ লিও। ভালো করে দেখ কী করছি।’

এই বলে পোশাকের ভেতর হাত চালিয়ে একটা ছোটো শিশির মতন কী একটা বার করে আনে জর্জি। তারপর বার করে আনে কালো মতন বিশ্রী দেখতে একটা কিছু। ‘ওটা কী জর্জি?’ ‘শকুনের পা।’ লিও আর কিছু বলতে সাহস পেল না।

এরপর জর্জি যেটা করল সেটা অদ্ভুত। কুয়োর চারদিকে মাটিতে চারটে কী যেন আঁকল, আঁকল সেই শকুনের পা দিয়ে। আর প্রত্যেক বারই বিড়বিড় করে কী যেন মন্ত্র আবৃত্তি করল। তারপর উঠে দাঁড়ায়, তাকায় সেই পঞ্চমীর চাঁদের দিকে। দু-হাত ধরে সেই শিশিটা তুলে ধরে উচ্চৈঃস্বরে কী যেন বলতে থাকে সে, যার বিন্দুবিসর্গ লিওর বোধগম্য হয় না। খানিকক্ষণ পর হাত দুটো নামিয়ে আনে সে। তারপর শিশিটা খুলে ভেতরকার তরলটা খানিক হাতে নেয়, আর ফের বিড়বিড় করতে করতে কুয়োর চারিদিকে ছিটোতে থাকে। ফুরিয়ে গেলে আবার ঢেলে নেয়, আর এই কাজ চলতেই থাকে যতক্ষণ না শিশির ভেতরের সমস্ত তরল ফুরিয়ে যায়। এইভাবে কুয়ো থেকে প্রায় ফুট চারেক দূরত্বে সমকেন্দ্রিক একটি অদৃশ্য বৃত্ত তৈরি করে সে।

তারপর চারিদিক থেকে খুঁজেপেতে কতগুলো শুকনো কাঠি আনে জর্জি। চারটে কাঠি প্রথমে কুয়োর চারিদিকে পুঁতে দেয়, ঠিক যেখানে শকুনের পা দিয়ে কিছু এঁকেছিল সে। তারপর বাকি কাঠি গুলো কুয়োর চারিপাশে বৃত্তাকারে গুঁজে দেয়, ঠিক যে বৃত্ত ধরে সেই মন্ত্রপূত তরল ছিটিয়েছিল সে।

একটা রাতচরা পাখি কর্কশ আওয়াজ করে উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে।

‘এদিকে এসো লিও’, গম্ভীর গলায় ডাকে জর্জি। পায়ে পায়ে সেদিকে এগোতেই লিওকে দৃঢ়মুষ্ঠিতে ধরে কুয়োর কাছাকাছি টেনে নেয় সে।

‘এই যে বৃত্ত দেখলে, এর বাইরে যাবে না। যা খুশি হোক, দুনিয়া এদিক থেকে ওদিক হয়ে যায়, আকাশ খসে পড়ুক, হ্রদের জল ভীমবেগে জমিতে উঠে আসুক, ভূমিকম্প হোক, ধেয়ে আসুক দাবানল, কিছুতেই তুমি এই বৃত্ত ছেড়ে বেরোবে না। যতক্ষণ তুমি এর মধ্যে আছ, স্বয়ং শয়তানেরও সাহস নেই তোমার কেশাগ্র স্পর্শ করে। যত ভয়ংকর কিছুই তুমি দেখ না কেনো, নড়বে না আর এই সীমানার বাইরে পা রাখবে না। এই যে দেখছ চাঁদের আলোয় মাটিতে অল্প ছায়া পড়েছে কুয়োর, চেষ্টা করবে এই ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে। ছায়া সরে গেলে তুমিও সরে যাবে। যা বললাম মনে থাকবে তো?’ ভীত মুখে মাথা নাড়ায় লিও। সেই দিকে খানিকক্ষণ স্নেহভরে তাকিয়ে থাকে জর্জি। তারপর খানিকটা যেন জোর করেই এগিয়ে যায় সামনে। লিও স্থির দাঁড়িয়ে থাকে।

খানিকটা এগিয়ে একটু পরিষ্কার জায়গায় দাঁড়ায় জর্জি। তারপর কিছু শুকনো কাঠি আর গাছের ডাল একত্র করে এবং সেই শকুনের পা দিয়ে একটা বর্গাকার ক্ষেত্র আঁকে মাটিতে। তারপর সেই কাঠকুটো গুলো স্তূপ করে রাখে সেই বর্গাকার ক্ষেত্রের ঠিক মধ্যিখানেই। শুধু যে রাখে তা নয়। রাখে এক বিশেষ পদ্ধতিতে। প্রথমে তিনটি কাঠি দিয়ে একটি ত্রিকোণ বানায়। তার ওপরে একটি উলটো ত্রিকোণ বানায় আরও তিনটি কাঠি দিয়ে। এই প্রক্রিয়া ঠিক তিন বার করে সে। তারপর তার চারিপাশে একটি বৃত্ত আঁকে, এমনভাবে আঁকে যেন ওপর থেকে দেখলে মনে হয় ত্রিভুজের কোণগুলি বৃত্তের পরিধি ছুঁয়ে আছে। এরপর নিজের পোশকের ভেতর থেকে আরও বেশ কিছু সামগ্রী বার করে আনে জর্জি। শুকনো গাছের ডাল ছিল দুটি, তাদের ভেঙে সেই ত্রিভুজের মাঝখানে রাখে। তারপর বার করে আনে একটি ছোটো বাক্স, খুলে কিছু গুঁড়ো ছড়িয়ে দেয় সেই গাছের ডালের মধ্যে। বাক্স থেকে বার করে আনে আরেকটি রুপোর তৈরি ছোটো লম্বাটে শিশি। তার মধ্যেকার তরল পুরোটাই ঢেলে দেয় সে সেই কাঠকুটোর মধ্যে।

আর তারপরে যেটা বার করল জর্জি, সেটাকে বলে স্ট্রাইকিং ফ্লিন্ট। এই দিয়েই এখন আগুন জ্বালানো হয়। অনেক কষ্টে সেই ফ্লিন্টের দুটো অগ্রভাগ ঘষে ঘষে আগুনের ফুলকি ফেলতেই জ্বলে উঠল সেই কাঠ ও ডালপালার স্তূপ। এরপর জর্জি দাঁড়িয়ে উঠে প্রদক্ষিণ করতে থাকে সেই অগ্নিকুণ্ড, আর বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ করতে থাকে। এরপর তাতে আহুতি দেয় শকুনের পা। তারপর তাতে ভেঙে কালো রঙের একটা ছোটো ডিমের মতন কিছু একটা।

এরপর যেটা করে জর্জি, তাতে ভয়ে বুকটা ঠান্ডা হয়ে যায় লিওর। হঠাৎ করে যেদিকে লিও আছে সেদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে পড়ে জর্জি, আর মুখ দিয়ে একটা উৎকট শিসের মতো আওয়াজ করে দু-হাত বাড়িয়ে কাকে যেন ডাকতে থাকে। করুণ কান্নার মতন সেই তীক্ষ্ণ আওয়াজ কে যেন লিওর কানের মধ্যে উগ্র চিতিসাপের বিষের মতোই ঢেলে দেয়। কী যেন একটা অপার্থিব ঘোর অমঙ্গলকর আছে ওই ডাকের মধ্যে। এক জন মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ আর্তনাদ যেন ঘুরে বেড়াতে লাগল সমস্ত জায়গাটা জুড়ে। ঘাড়ের সমস্ত রোঁয়া দাঁড়িয়ে যায় লিওর, বুকের ভেতরটা বরফ হয়ে আসে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কোথা থেকে যেন একটা কমন রাভেন উড়তে উড়তে আসে এদিকে, তারপর আগুনের ওপরে পাক খেতে খেতে ঘুরতে থাকে। দেখে অসম্ভব বিস্মিত হয় লিও। এত রাতে কমন রাভেনের তার বাসা ছেড়ে আসার কথাই নয়!

এদিকে দুটো হাত দু-দিকে বিছিয়ে দিয়েছে জর্জি। আর সেই শিস দিয়ে করুণ মৃত্যুর গান চলতেই থাকে। আস্তে আস্তে রাভেনটা ওড়ার বৃত্ত ছোটো করতে করতে নীচে নেমে আসে এবং শেষে জর্জির মাথার ওপর উড়তে উড়তে এক পর্যায়ে তার বাঁ-হাতে এসে বসে।

আর ঠিক তক্ষুনি ডান হাত দিয়ে রাভেনটাকে ধরে জর্জি। দ্রুতবেগে মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে বাঁ-হাত দিয়ে অমানুষিক শক্তিতে রাভেনের মুণ্ডুটা একটানে মুচড়ে ছিঁড়ে আনে সে, আর রক্তটা ঢেলে দিতে থাকে সেই আগুনের মধ্যে।

কাজটা ঘটতে লাগে এক মিনিটের একটু কম সময়, আর এই নৃশংস দৃশ্যটা দেখে সাদা হয়ে যায় লিওর মুখ, ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে সে। এই কি জর্জিনহো? তার দাদা জর্জিনহো? আগুনের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে সম্পূর্ণ অচেনা লাগে জর্জির। এই নৃশংস, নিষ্ঠুর, ভাবলেশহীন চোখে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওটা কে? নিজের দাদার এমন ভয়ংকর রক্তখেকো রূপ দেখবে, স্বপ্নেও ভাবেনি সে। সে যদি জানত এখানেই শেষ নয়, তার আতঙ্কের তো সবে শুরু এখন!

এরপর জর্জি পকেট থেকে একটা দীর্ঘ ছুরি বার করে। বাঁ-হাতটা তুলে ধরে আগুনের ওপর, আর তারপর দীর্ঘ ছুরিটা চালিয়ে দেয় তালু বরাবর। টপটপ করে রক্ত পড়তে থাকে আগুনের মধ্যে আর সঙ্গে চলতে থাকে সেই অদ্ভুত ভাষায় মন্ত্রোচ্চারণ। আর দেখতে পারে না লিও। হাঁটু দুটো দুর্বল লাগে তার। মাটিতে বসে পড়ে সে।

খানিকক্ষণ পর আবার উঠে দাঁড়ায় সে। জর্জি বলেছে পুরোটা আজ তাকে দেখতে হবে, হুবহু গেঁথে রাখতে হবে স্মৃতিতে। তার হাতেই নাকি ভাজ পরিবারের এই অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায়। আর আজ সে হেরে যাবে? পিছিয়ে যাবে লিও? সেই জন্যেই কি জর্জি ভরসা করে তাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে এই দুরূহ কাজে? এই তার বুকের খাঁচা? জর্জির বিশ্বাসের প্রতিদান দেবে না লিও?

দেবে। অবশ্যই দেবে। উঠে দাঁড়ায় লিও।

ততক্ষণে আরও কতগুলো কাঠকুটো জুটিয়েছে জর্জি, তার মাথায় জড়িয়েছে একটা কাপড়ের টুকরো। তাই দিয়ে সেই অগ্নিকুণ্ড থেকে আগুন জ্বালিয়ে মশাল বানিয়ে জর্জি শুরু করে সেই সমাধিক্ষেত্রকে প্রদক্ষিণ করা! সঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে মন্ত্র আবৃত্তি করা তো আছেই। কিন্তু এবার শব্দগুলো এমন চেনা চেনা লাগছে কেন? আগের বারের উচ্চারণগুলো শুনে তো কিছুই বোঝেনি লিও! আরও খানিকক্ষণ শুনতেই লিও স্পষ্ট বুঝতে পারে কী আওড়াচ্ছে জর্জি।

বাইবেল!

এত ভয়ের আর আতঙ্কের মধ্যেও প্রথমে খুব অবাক হয়ে যায় লিও। এত তন্ত্রমন্ত্র অভ্যাস তাহলে কীসের জন্যে, যদি বাইবেলের শ্লোকই আওড়াতে হবে শেষে? জর্জি কি পাগল হয়ে গেল? আরও মন দিয়ে শোনে সে। তারপরই বিস্ময়ে আর ভয়ে তার হাতের সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে পড়ে! জর্জি বাইবেল আওড়াচ্ছে বটে, কিন্তু সে অন্য বাইবেল! বাইবেলে শ্লোকে যেখানে যেখানে ঈশ্বরের প্রশংসা আছে, সেখানে সেখানে সে ঈশ্বরের জায়গায় শয়তানের উল্লেখ করছে। ঈশ্বরের আরাধনাকে জর্জি শয়তানের আরাধনার মন্ত্রে পরিণত করছে! সাপ যেমন বেদের বাঁশি শুনে স্থির হয়ে থাকে, ঠিক সেই ভাবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল লিও। আস্তে আস্তে সমগ্র দৃশ্যপটের মধ্যে কী যেন একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন লক্ষ করে লিও। কি সেটা ঠিক করে বোঝে না সে, শুধু মনে হয় চারিপাশ যেন সামান্য ঘোলাটে হয়ে গেছে, যেন একটু অপরিষ্কার। মনে হয় চারিপাশে যে পরিষ্কার দৃশ্যমানতা এতক্ষণ বজায় ছিল, তাতে যেন সামান্য অন্ধকারের পোঁচ লেগেছে। মানে আশেপাশের দৃশ্যগুলি আগের মতন অত উজ্জ্বল বা ধারালো নয়। শীতের মধ্যেও যেন খুব সামান্য হলেও সোঁদা জলীয়ভাব এসেছে চারিপাশে। আকাশের তারাগুলোও আগের মতন অত উজ্জ্বল দেখাচ্ছে না।

এই ব্যাপারটা ক্রমে একটু করে বাড়তেই থাকে। ক্রমশই যেন একটা বদ্ধ সোঁদা গন্ধ ছেয়ে ফেলে চারিদিক। দৃষ্টি যেন আরও অপরিষ্কার হয়ে আসতে থাকে লিওর, সব কিছু খুব ঘোলাটে মনে হয়। শুধু দূরে সেই অগ্নিকুণ্ড এখনও জ্বলছে আর জর্জির প্রদক্ষিণরত অবয়ব এখনও নজরে পড়ছে লিওর…

ভাবতে ভাবতেই তার সামনে ঠিক তিন থেকে চার ফুট দূরে একটা সমাধিফলক নীচের থেকে সামান্য নড়ে ওঠে!

পাথরের মূর্তির মতন আস্তে আস্তে ঘাড়টা ওপরে তোলে লিও। এতক্ষণ দেখেনি সে, মাটি থেকে দশ বারো ফুট ওপর থেকে একটা কালো পর্দার মতন ছায়াপুঞ্জ সমস্ত সমাধিক্ষেত্রের আকাশ দখল করে রেখেছে। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার যে সেই ছায়াপুঞ্জ বড়ো সচল, মুহুর্মুহু তার আকার আকৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে। বড়োই প্রাণবান ও চঞ্চল সেই ছায়াশরীর, যেন তার সক্রিয় চৈতন্য আছে, আছে রিরংসু একটি সত্তা। মাঝেমধ্যে সাপের ছোবলের মতন খানিকটা ছায়া বিদ্যুদ্্বেগে নেমে আসছে জর্জির দিকে, কিন্তু বার বার সেই মশালের আগুন দেখে ফিরে যাচ্ছে ব্যর্থকাম হয়ে। আরও অনুভব করে লিও, যে সেই ছায়াপুঞ্জ ক্রোধে ফুটছে। অব্যক্ত ক্ষোভে রি রি করছে তারা। সেই হাহাকার করা নিষ্ফল ক্রোধে গুমরে গুমরে তারা কাতরাচ্ছে, চাইছে মৃত্যুর বিষ ঢেলে দিতে অব্যর্থ ছোবলে। কিন্তু প্রতিটি ব্যর্থ আক্রমণ বাড়িয়ে দিচ্ছে তার রোষ। তাদের সমস্ত স্নায়ু, সমস্ত অস্তিত্ব থেকে যেন ঝরে পড়ছে তীব্র বিষের নিশ্বাস…

মন্দ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠল জর্জি, ‘হে ইউরোপের শ্রেষ্ঠতম তন্ত্রশাস্ত্রজ্ঞ মহান গটস্কলখ, শয়তানেরও প্রভু জ্ঞানী গটস্কলখ, আপনি কি আমাদের মধ্যে উপস্থিত?’

উত্তরে লিওর সমস্ত চৈতন্য শিউরে তুলে, সেই ক্রুদ্ধ ছায়াপুঞ্জ থেকে ভেসে এল এক অশরীরী কর্কশ আওয়াজ, ‘ফিরে যা রে মূর্খ, সম্রাট ঘুমিয়ে আছেন। তাঁকে জাগাস না।’ জবাবে পোশাকের ভেতর থেকে কিছু গুঁড়ো বার করে আগুনের ওপর ছড়িয়ে দেয় জর্জি, তারপর আরও সোচ্চারে আওড়াতে থাকে বাইবেলের সেই বিকৃত শ্লোক। আকাশটা যেন লাল হয়ে আসে, রাতের অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পায় লিও। ঝড় আসছে নাকি? আশেপাশের একটি ঘাসও নড়ছে না। লিওর সঙ্গে প্রকৃতিও যেন দমবন্ধ করে দেখছে এই অত্যাশ্চার্য লড়াই। সেই ছায়াপুঞ্জ থেকে যেন জেগে ওঠে আর্ত কোলাহল, সহস্র কান্নার আওয়াজ যেন এই স্থানটিকে ঘিরে নাচতে থাকে। মার্বেল পাথরের গায়ে ছুরি দিয়ে আঁচড়ানোর মতন আওয়াজ তুলে হাহাকার ভেসে আসে, ‘ফিরে যা রে মূর্খ পথিক, সম্রাটকে জাগাস না। তিনি অনন্তশয্যায় শুয়ে আছেন, তাঁকে জাগাস না, জাগাস না, জাগাস না…।’

এমন সময়ে পায়ের তলার মাটি বীভৎসভাবে কেঁপে ওঠে। লিও পড়েই যেত, কুয়োর পাড় ধরে বসে পড়ে সে। তীরে ধাক্কা খেয়ে গর্জন করে ওঠে স্বিনভান লেকের জল, চার্চের গা থেকে খসে পড়ে কিছু পাথর আর টালি। পাঁচিলের একপাশ ধ্বসে ভগ্নস্তূপ হয়ে যায়। আর ঠিক সেই সেইসময় একটা বিকট গম্ভীর ‘গং’ শব্দে সচকিত হয়ে ওঠে চারিদিক। হোলার চার্চের শতাব্দীপ্রাচীন ঘণ্টা এই ভূমিকম্পের ধাক্কায় বেজে উঠেছে!

ঠিক পনেরো সেকেন্ডের মাথায় ভূমিকম্প থামলে উঠে দাঁড়ায় লিও, এখন সে সমস্ত ভয় বা আতঙ্কের উর্ধ্বে। তার সমস্ত অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গিয়েছে।

এই বার সে দেখে যে এক রক্তবর্ণ ধূম্রপুঞ্জ আবির্ভূত হয়েছে, আবির্ভূত হয়েছে সেই কালো ছায়াশরীরের পিণ্ডগুলির মাঝখানে। আর তার দিকে দু-হাত উঁচু করে বলছে জর্জি, ‘হে মহান তন্ত্রবেত্তা গটস্কলখ, অন্ধকারের সম্রাট গটস্কলখ, এই অধমের অভিবাদন গ্রহণ করুন।’

জবাবে যেন যেই মেঘপুঞ্জের মধ্যে থেকেই কর্কশগম্ভীর স্বর ভেসে এল, ‘হে মানবসন্তান, তোমার ধীশক্তি ও মেধায় আমি প্রসন্ন। আজ অবধি এতদূর না কেউ পৌঁছতে পেরেছে, আর না কেউ পারবে। তন্ত্রের জগতে অক্ষয়কীর্তি স্থাপন করেছ তুমি। বল হে মানবপুত্র, কী জানতে চাও?’

১৭৫৫। অক্টোবর। ভাজ পালাসেতে

প্রবল শীতের কামড়ে এইবার পুরো ইউরোপ জবুথবু। স্তব্ধ দুপুরে চিলেকোঠার ঘরে বসে একাগ্রচিত্তে পার্চমেন্ট পেপারের ওপর খাগের কলম দিয়ে লিখে যাচ্ছিল লিওনার্দো। একমাসও হয়নি হোলার চার্চের সেই অভিযান থেকে ফিরেছে সে। ফিরেই অবশ্য ঘোরতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সপ্তাহ দুয়েক যমে মানুষে প্রাণান্তকর টানাটানি গেছে। আজ তুলনায় একটু সুস্থ বোধ করছে সে। আর সেইজন্যই আজই বসেছে কাগজ কলম নিয়ে। স্মৃতিতে জাগরূক থাকতে থাকতে লিখে ফেলতে হবে, লিখে ফেলতে হবে সেদিন যা যা ঘটতে দেখেছে লিও। তারপর তাকে যত্নসহকারে লুকিয়ে রাখতে হবে যেখানে মিগুয়েলের ডায়েরি রাখা আছে সেখানে। ভবিষ্যতে যে উদ্ধার করতে আসবে ভাজ পরিবারকে, সেই বংশধরটির জন্যে সযত্নে সাজিয়ে রেখে যেতে হবে সব। নিজের উত্তরপুরুষদের প্রতি এই দায়িত্বটাই তাকে দিয়েছে জর্জি। দিয়েছে নয়, দিয়ে গেছে!

ধক করে বুকের ব্যাথাটা আবার চাগাড় দেয় লিওর, কিন্তু দমে না সে। কালির দোয়াতে খাগের কলমটা ডুবিয়ে তরতর করে লিখে যেতে থাকে।

দুপুরের গায়ে নেমে আসে বিকেলের আঁচল। সোনালি নরম রোদ লুটিয়ে পড়ল ভাজ পালাসেতের বাগানে, বারান্দায়। আকাশের নীল থেকে চোখ সরে না, এতই মায়া জড়িয়ে আছে সেখানে। মাঝে মাঝেই লেখা থামিয়ে সেদিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকছিল লিওনার্দো।

সন্ধের মুখে পরিচারক এসে ফায়ারপ্লেসে আগুন দিয়ে যেতেই একটু ওম বাড়ে, তাতে বেশ আরাম বোধ করে লিও। লিখতে লিখতেই থেমে যায় মাঝে এক বার, তারপর ফের চালু হয় তার কলম,

‘অতঃপর সেই রক্তবর্ণ মেঘপুঞ্জ থেকে উচ্চারিত হইল, ‘হে মানবপুত্র, বল কী জানিতে চাও?’

জর্জিনহো আভূমি প্রণত হইয়া অভিবাদন করিয়া কহিল, ‘হে প্রভো, সবই তো আপনার অবগত। ইহাও আপনার অবিদিত নহে যে কোন নিয়তিনির্দিষ্ট হইয়া এক্ষণে উপস্থিত হইয়াছি। হে প্রভু, অদ্য অনুরোধ এই যে, দুই শত বৎসর ব্যাপী যে অভিশাপ আমাদিগের পরিবারের উপর পক্ষ বিস্তার করিয়া আছে, উহার স্বরূপ বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করিয়া অধমকে বাধিত করুন। অতঃপর উহা হইতে পরিত্রাণের পথ নির্দেশ করিয়া এই অধমকে চিরন্তন কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করুন।’

সেই মেঘপুঞ্জ হইতে ধ্বনি নির্গত হইল, ‘শোন হে মানব। যাঁহাকে সপরিবারে ধ্বংস করিয়া তোমার পূর্বপুরুষ এই অভিশাপের করালগ্রাসে পতিত হইয়াছেন, তিনি ঈশ্বরের অনুগৃহীত এক মহাশক্তিধর পুরুষ ছিলেন। তাঁহার কাছে রক্ষিত যে বস্তুটির জন্যে এত বীভৎস রক্তপাত, এত অমানুষিক নিষ্ঠুরতা, সেটি একটি অসামান্য দৈবী শক্তির আধার, উহার নাম সৃষ্টিবিন্দু। উহা পৃথিবীর আদিতম শক্তির ভাণ্ডার, আদিমতম শক্তির জন্মচিহ্ন। উহার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই, আদি নাই, অন্ত নাই, সৃষ্টি নাই, লয় নাই। সৃষ্টির প্রথমে যখন স্থান ও কাল কিছুই ছিল না, চৈতন্যের আদি ও অন্ত ছিল না, তৎকালে ঈশ্বরীয় ইচ্ছায় অকস্মাৎ সময় ও শক্তির উদ্ভব ঘটে। সেই আদিশক্তির উৎস বীজাকারে এই সৃষ্টিবিন্দুতে সন্নিহিত আছে। যে পরাশক্তি ও অপরাশক্তি যুগ্মভাবে এই সৃষ্টির প্রাণ ও চৈতন্য আনয়ন করিয়াছে, উহারা দুইটি ক্ষুদ্র রক্তবর্ণ সর্পের আকারে এই দৈবী খণ্ডের মধ্যে যোগনিদ্রায় শায়িত। উহাদের জাগ্রত করিলে মহাপ্রলয় উপস্থিত হয়, ঈশ্বরীয় ত্রাসদল সংহারমূর্তি ধরিয়া এই জগতকে গ্রাস করেন। আদিকাল হইতে জ্ঞানী ঋষিরা ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ প্রাপ্তিপূর্বক এই শক্তিবিন্দুটিকে লোকচক্ষু হইতে সুরক্ষিত রাখিবার প্রযত্ন করেন। সেই হেতু শতাব্দীপ্রাচীন আধিদৈবিক তন্ত্রমন্ত্রাদি দ্বারা উহাকে আচ্ছাদিত করেন, উহাকে স্থায়ী যোগস্থিতিতে নিবিষ্ট করেন। তোমাদিগের সেই পূর্বপুরুষ স্বীয় ক্ষুদ্র বাসনা পূরণের নিমিত্ত এই যোগস্থিতি বিনষ্ট করিতে উদ্যত হয়েন, অকারণ নিষ্ঠুরতার সহিত কয়েকটি নিরীহ মানুষকে বধ করেন। সেই হেতু অসহ ক্রোধাগ্নিতে উন্মত্ত হইয়া এই ভয়ানক নরকাভিশাপ প্রদান করেন সেই অসামান্য শক্তিধর পুরোহিত। অভিশাপ প্রদানকালে অন্য কোনো আধার অনুপস্থিত থাকিতে তিনি নিজ পুত্র হনন সঞ্জাত যাবতীয় ক্রোধ উপস্থিত নরকরাজ বেতালের মধ্যে সঞ্চারিত করেন। সেই হইতে মৃত্যুর রাজা অদ্যাবধি তোমার পরিবারের প্রথম পুরুষদের সংহার করিয়া ফিরিতেছে।’

শুনিয়া ভয় ও আতঙ্কে আমার অন্তর শীতল পাষাণবৎ স্থবির হইয়া আসিতেছিল। জর্জি কিঞ্চিদধিক কাল স্থাণু রহিয়া পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, ‘এই মহাশাপ খণ্ডনের উপায় কী প্রভু?’

সেই মেঘপুঞ্জ হইতে সেই গম্ভীর এবং অলৌকিক স্বর ধ্বনিত হইল, ‘অদ্য হইতে আনুমানিক তিন শত বৎসর পশ্চাৎ তোমার পরিবারে এক অসীম সাহসী, জিতেন্দ্রিয়, পরোপকারী, অদ্ভুতকর্মা বীরশ্রেষ্ঠর আবির্ভাব হইবে। সেই পুণ্যকর্মা বীর নিজ সন্তানের প্রাণহানির শঙ্কাহেতু এই বিশালকর্মে ব্রতী হইবে। তৎকালে এক বিশেষ ক্ষণে পাঁচ শত বৎসর পূর্বেকার নক্ষত্রাদি পুনরায় একত্রিত হইবে, পৃথিবী হইতে মহাকাশ অবধি স্থাপিত হইবে অদৃশ্য আধিভৌতিক যোগাযোগ। শিকারের সন্ধানে প্রাচীন প্রেতের দল নরক হইতে উঠিয়া আসিবে। নক্ষত্রমালা উৎক্ষিপ্ত হইবার উপক্রম হইবে, পাতালের রক্ত ও বসাপায়ী লোলুপ আত্মাদের অস্থি ও মাংস পুনর্বার জাগ্রত হইবে। জাগ্রত হইবে দশ দিকের দিকপালের দল, মূর্তি পরিগ্রহ করিবে মৃত্তিকা সঞ্জাত পাপসমূহ। সেই রাত্রে আকাশ হইবে রক্তচক্ষু, বাতাস হইবে পূতিগন্ধময়। তৎকালে সেই সাহসী পুরুষের সম্মুখে স্বয়ং মৃত্যুর দেবতা জাগ্রত হইবেন। সেই বিশেষ নক্ষত্রকালে যদি তোদের উত্তরপুরুষ যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে সৃষ্টিবিন্দুটি প্রত্যর্পণ করিতে পারে, তবেই সেই অভিশাপ প্রত্যাহৃত হইবে, তৎপরবর্তী উত্তরপুরুষেরা পাপমুক্ত হইবে। তদন্তর, সেই মৃত্যুর দেবতা তোদের সেই পুরুষের প্রাণহরণ করিবেন, উহাই হইবে এই মৃত্যুপূজার শেষ বলি।’

কিয়ৎক্ষণের স্তব্ধতার পর পুনরায় উচ্চারিত হইল,

‘কিন্তু ইহা একমাত্র তখনই সম্ভব হইবে, যখন ঈশ্বরী শক্তিতে বলীয়ান কোনো তন্ত্রসাধক তোর সেই উত্তরপুরুষের সাহায্যার্থে অগ্রসর হইবেন। ইহা ভিন্ন পাতাল হইতে নক্ষত্রলোকের পথ উন্মুক্ত করিবার আর কোনো উপায় নাই। একমাত্র কোনো সিদ্ধ সাধকই তাঁহার দৈবী ক্ষমতার প্রয়োগ করিয়া মৃত্যুর দেবতাকে আহ্বান করিতে পারেন। ইহা ব্যতীত অন্য কোনো উপায় নাই, নাই, নাই।’

এতটা লিখে চুপচাপ বসে থাকে লিও। দরজা বন্ধ, দরজার ওদিকে বয়ে যাচ্ছে ক্লান্তিকর জীবন, ঘরের মধ্যে ফায়ারপ্লেসের পাশে বসে মাসখানেক আগেই ঘটে যাওয়া সেই ভয়াবহ রাতের কথা মনে করে লিও।

সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পর দু-জনে ছোটো নৌকোটি করে ফিরে আসছিল এপারে। আসার সময়ে খুবই অস্থির লাগছিল জর্জিকে, ক্রমশ ছটফটানি বেড়েই চলেছিল তার। দেখে একটু আশ্চর্যই হয়েছিল লিও, কাজ তো হয়েই গেছে। এই তো আর কিছুক্ষণ, তার পরেই তো তীরে পৌঁছবে নৌকো। এতেই এত ভয় পাওয়ার কী আছে?

কালো ভারী সিসের মতন নিস্তরঙ্গ জল। জল শেষ হলে মাটি। মাটি শেষ হলে দিগন্ত। দিগন্তে মিশেছে তারায় ভরা আকাশ। থেকে থেকেই সেদিকে চোখ চলে যাচ্ছিল লিওর। আহা, কী অপরূপ দৃশ্য! যেন রেশমি মখমলের চাদরে কেউ অকাতরে ঢেলে দিয়েছে ছোটো-বড়ো হিরের কুচি। এই ক-দিনে লিওকে অনেক নক্ষত্রমণ্ডল চিনিয়েছে জর্জি। বইঠা টানতে টানতে আকাশের দিকে তাকিয়ে সেইসব নক্ষত্রদের চিনে নেওয়াটা একবার ঝালিয়ে নিচ্ছিল লিও। তারপর কিছু একটা বলার জন্যে মুখ নামিয়ে জর্জির দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় সে।

বইঠা টানছে বটে জর্জি, কিন্তু তার চোখে-মুখে এক অসম্ভব অস্থির আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে যেন। এদিকেওদিকে তাকাচ্ছে বার বার, উদ্ভ্রান্ত চোখে লিওকে দেখছে, আর বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। অবাক হয়ে সেদিকে চাইতেই আশেপাশে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখে আপনা থেকেই থেমে গেল লিও।

নৌকোটা তীর থেকে আর বেশি দূরে নয়, আশি নব্বই গজ হবে মাত্র। লিও তাকিয়ে দেখল তাদের নৌকো ঘিরে ছোটো-বড়ো বিভিন্ন আকারের বুড়বুড়ি উঠতে শুরু করেছে হ্রদে। তার মধ্যে কয়েকটা রীতিমতো বড়ো হওয়া শুরু করেছে। সেদিকেই অবাক হয়ে তাকিয়েছিল লিও। তারপর একটা জিনিস দেখে কী যেন একটা মাথায় ঘাই মারতে লাগল তার… গাঢ় কালো রঙের তরল যেন ফুটতে ফুটতেই একটু করে সরে যাচ্ছে। আর তার যায়গায় জেগে উঠছে ছোট্ট ছোট্ট ঘূর্ণি। প্রথমে ধীরে এবং পরে দ্রুত সেই ঘূর্ণিগুলো বড়ো হয়ে উঠছে আর তৈরি করছে নানা আকারের ঘূর্ণিস্রোত!

এতক্ষণে মুখ খুলল জর্জি, বিকট স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ঝাঁপ দাও, এক্ষুণি জলে ঝাঁপ দাও লিও… আর সময় নেই… ঝাঁপাও… এক্ষুণি…’ হতভম্ভ হয়ে গেল লিও। অক্টোবর মাসে এই বরফঠান্ডা জলে ঝাঁপ দেওয়ার মানে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে ডেকে আনা। জর্জি কি পাগল হয়ে গেছে? জেনেশুনে লিওকে এর মধ্যে ঠেলে দিতে চাইছে? আর হয়েছেই বা কী? এসব ছোটো ছোটো ঘূর্ণি নানা কারণে আসেই… নৌকো তো আর বেশি দূরে নেই, নব্বই গজ হবে বড়োজোর। দুই ভাইতে মিলে জোরে বইঠা টানলে আর কতক্ষণ… ভাবতে ভাবতেই ছোটো নৌকোটা এক বার সজোরে দুলে উঠল। দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো জলেই পড়ে যেত দু-জনে। মনে হল জলের নীচে কে যেন দু-হাতে নৌকোটা ধরে সজোরে এক বার ঝাঁকিয়ে দিল। আর্তস্বরে চিৎকার করে উঠল জর্জি, ‘ঈশ্বরের দোহাই লিও, ঝাঁপ দাও এক্ষুনি। তীরে পৌঁছবার আগে এদিকে তাকাবে না। কথা দাও তুমি, কথা দাও।’ হাঁ করে দাদার দিকে তাকিয়ে থাকে লিও। ঘণ্টাখানেক আগেই মৃতদের জগৎ জাগিয়ে তুলেও কুশলী ও স্থিতধী ছিল যে লোকটা, তার সঙ্গে এই জর্জির কোনো মিলই নেই। অজানা আতঙ্কে ও উত্তেজনায় কাঁপছে লোকটা। লিওর দিকে তাকিয়েই আরেক বার চিৎকার করে উঠল সে, ‘এই হারামজাদা, কথা শুনতে পাচ্ছিস না? ঝাঁপ মার, এক্ষুনি জলে ঝাঁপ দে তুই…’ অত্যন্ত অবাক হয়ে এই রেগে যাওয়া, কুবাক্য উচ্চারণ করা অসংলগ্ন ও উত্তেজিত লোকটাকে দেখছিল লিও। না, হতে পারে না, এই লোকটা তার দাদা হতেই পারে না…

ভাবতে ভাবতেই আবারও নৌকোটা ফের ভয়াবহ ভাবে দুলে ওঠে। কোনোরকমে দু-হাতে নৌকোর দু-পাশ ধরে নিজেকে সামলায় লিও। তার হাত থেকে বইঠাটি জলে পড়ে যায়, এবং মুহূর্তেই একটি বড়ো আকারের ঘূর্ণির মধ্যে তলিয়ে যায়। এইবার ভয় পেয়ে যায় সে, হে ভগবান, এটা আবার কী? এবার কী করে… ‘নাম শুয়ার, জলে ঝাঁপ দে এক্ষুনি, নইলে তোর মাথা ফাটিয়ে ঘিলু বার করে দেবো বেজন্মার বাচ্চা’, —বলতে বলতে উন্মত্তের মতো নিজের হাতের বইঠাটি মাথার উপর ধরে তেড়ে আসে জর্জি। সেই হিংস্র লোকটাকে দেখে ভয় পেয়ে যায় লিও। বলা যায় না, সত্যিই হয়তো মাথায় মেরে দেবে লোকটা…

ভাবতে ভাবতেই তৃতীয় ঝাঁকুনি, আরও প্রবল এবং ভয়ংকরতম। নৌকোটা প্রায় উলটেই যেত, জর্জিও প্রথমে বসে পড়ে। তারপর ফের পাগলের মতো উঠে দাঁড়ায় হাতে বইঠা নিয়ে, চোখে-মুখে সেই উন্মাদ আগ্রাসী ভঙ্গি। দ্বিবিধ আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে নেহাত বাধ্য হয়েই বাইরের কোটটা রেখে জলে ঝাঁপ মারে লিওনার্দো। এবং প্রায় জমে যায়। আর সপ্তাহ দুয়েক বাদে হয়তো জল বরফ হতে শুরু করবে এই এলাকায়। সেই বরফঠান্ডা জলে প্রথম ঝাঁপটা দিতেই যেন মনে হল হাজার মোটা দাগের বল্লম দিয়ে কেউ খোঁচাচ্ছে লিওকে। কয়েক গজ সাঁতার কেটেই বুঝল লিও, হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে তার। দাঁতে দাঁত লেগে ঠক ঠক করে কাঁপছিল সে। সারারাত ধরে যা যা হয়েছে, তাতে তার স্নায়ুকোষের ওপর যথেষ্টরও বেশি অত্যাচার হয়েছে। তার শরীরমন আর বিশেষ কিছু ধকল নিতে পারছিল না। ভেবেছিল সেসবের পালা বোধ হয় শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ভুল ভেবেছিল সে, এইবার তার শারীরিক ও মানসিক সহ্যশক্তির চরমতম পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয়েছে। এই পরীক্ষায় তাকে জিততেই হবে, দাঁতে দাঁত চেপে ভাবে সে। ভাজ পরিবারের রক্ষার একমাত্র উপায় তার কাছে, এমনটাই বলেছে জর্জি। যদিও শুধু তার কাছেই কেন সেটা তখনও বোঝেনি লিও। কিন্তু এত বড়ো দায়িত্ব সে ছেড়ে যেতে পারে না। কিছুতেই না। এত ঠান্ডাতেও তো মানুষ বাঁচে, বাঁচে না? এই কিছুক্ষণের কষ্ট সহ্য করতে পারবে না সে? তারই কত না পূর্বপুরুষ প্রাণ দিয়েছেন মৃত্যুর দেবতার হাতে? তাঁদের নামে, তাঁদের স্মরণে কিচ্ছু করতে পারবে না লিও, লিওনার্দো ভাজ?

শরীরের সমস্ত শক্তি, মনের সমস্ত ক্ষমতা, স্নায়ুর সমস্ত ইচ্ছা সংহত করে সাঁতার দেওয়া শুরু করল লিও।

প্রায় দশ মিনিট পর যখন তীরে উঠে থরথর কাঁপছে সে, ঘুরে এক বার নৌকোর দিকে তাকাল। তাকাল আর স্থির হয়ে গেল।

সারা দিগন্ত জুড়ে এখন ভূতুড়ে ছায়ার খেলা। হ্রদের ওপারে সেই বিশাল হোলার চার্চ, দাঁড়িয়ে আছে স্থবির বিভীষিকার মতন। দশমীর চাঁদ সরে এসেছে অনেকটা, দিগন্তের প্রায় অন্যদিকে। তার ক্ষীণ আলোয় যা দেখল লিও, সম্ভবত শেষ বিচারের দিন অবধি তার মনে থাকবে। নৌকোর চারিদিকে তৈরি হয়েছে অজস্র ছোটো-বড়ো ঘূর্ণি। আর সেই ঘূর্ণি থেকে উঠে আসছে শত শত জীবন্ত লতানে কী যেন। পাতালের কোন অতল থেকে ক্রমাগত উঠে আসছে সেইসব শুকনো শিকড়ের মতো জীবন্ত লতানে অভিশাপ…

লতা? না তো… লতা কই… ওসব তো…

সহসা শিহরিত হয়ে উঠল লিও। দেখতে পেয়েছে সে, এইবার সে দেখতে পেয়েছে সে। কিন্তু যা দেখেছে সেটা তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। এই পৈশাচিক দৃশ্য তাকে দেখতে হবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি! যেগুলোকে সে ভূতুড়ে লতা ভেবেছিল, সেগুলো আসলে হাত! শত শত কালো, শীর্ণ, অস্থিসর্বস্ব সেইসব হাত, হাতের আঙুল আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে সেই ক্ষুদ্র নৌকোটিকে, আর প্রবল আকর্ষণে চাইছে টেনে নিয়ে যেতে। নিয়ে যেতে চাইছে জলের তলায়, অতল গাঢ় নিঃসীমে। দৃশ্যটা আমূল নাড়িয়ে দিল লিওকে। শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রার জলে সাঁতরে আসার যাবতীয় কষ্ট ভুলে গেল সে। নির্নিমেষে সে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। যেন নরকের রসাতল থেকে উঠে আসছে প্রেতেদের সর্বগ্রাসী খিদে, উঠে আসছে তারা সাপের মতন, অভিশপ্ত লতার মতো। শয়ে শয়ে তারা উঠে আসছে সেই কালো জলের অতল থেকে। শীর্ণ বুভুক্ষু শিকড়ের মতো তাদের আঙুলগুলো একের-পর-এক পেঁচিয়ে ধরছে সেই ক্ষুদ্র নৌকোটিকে। শ-খানেক ভৌতিক হাত উঠে এসেছে নৌকোর ওপরেও, তারা মরণপাশে জড়িয়ে ধরেছে জর্জির পা, সমগ্র নিম্নাঙ্গ। ক্রমেই তাদের সেই মৃত্যুবাঁধন আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকে, জড়িয়ে থাকে এমনভাবে যেন জর্জির শরীর আর সেই নৌকো এখন এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা। মৃত্যুর এই নিবিড় বাঁধন থেকে রক্ষা নেই, রক্ষা নেই কারও। আস্তে আস্তে ডুবতে থাকে সেই নৌকো। বিষাক্ত সাপের মতন হিংস্র হাতগুলো যেন আরও সজীব, আরও হিংস্র হয়ে ওঠে, যেন স্পষ্ট করে তাদের নারকীয় উল্লাসের শব্দ শুনতে পায় লিও। তার সমগ্র আত্মা থরহরি কেঁপে ওঠে এই দৃশ্য দেখে।

আর জর্জি?

ডুবে যাওয়ার শেষ মুহূর্ত অবধি নৌকোর মাঝখানে বীরের মতন দাঁড়িয়েছিল সে। সমগ্র নৌকো আর কোমর অবধি তার শরীর তখন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। হাত দুটো ওপরের দিকে তোলা ছিল তার, যেন নিজের ঈশ্বরের কাছে শেষ বারের মতো প্রার্থনা জানাচ্ছে সে। প্রার্থনা জানাতে জানাতেই, পঞ্চমীর চাঁদকে সাক্ষী রেখেই, লিওর আতঙ্কিত চোখের সামনেই নৌকোসুদ্ধু জলের নীচে তলিয়ে যায় জর্জি। ভাজ পরিবারকে মুক্তির আলো দেখানো জর্জিনহো ভাজ।

২০১৬। ১২ অক্টোবর, দশমী। আমোনা গ্রাম, বেতাল মন্দির, গোয়া

‘ভয় পেও না সাহেব। আজ তুমি এমন অনেক কিছুই দেখবে বা শুনবে যা তোমার বোধবুদ্ধি যুক্তির অতীত। তাতে কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত হবে না, ভয় পাবে না। ভয় পেলেই কিন্তু মহাসর্বনাশ। জানবে যা দেখছ সব মায়া, কিছুই সত্যি নয়।’

গতকাল সকালেই দু-জনে ফ্লাইটে করে চলে এসেছেন গোয়া। উঠেছেন উত্তর গোয়াতেই, ক্যালাঙ্গুট বিচের কাছে। পর্তুগিজ কনসুলেটের একটা পার্মানেন্ট গেস্ট হাউস আছে এখানে। কাল সারা সকাল ধরে তাঁর এই গোয়া অভিযানের যাবতীয় ইতিবৃত্ত এই পণ্ডিতকে বলেছেন মার্টিনেজ। জানিয়েছেন সব কথাই, একটা কিচ্ছু বাদ দেননি। বর্ণনা করেছেন ইনকুইজিশনের নামে মিগুয়েলের হত্যাকাণ্ডের কথা, জানিয়েছেন সেই প্রাচীন অভিশাপের ইতিবৃত্ত। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবৃত করেছেন মিগুয়েলের ডায়েরি আর অনুতাপে দগ্ধ হওয়ার কথা। বলেছেন মিগুয়েলের শয়তান আরাধনার কথাও। লিওনার্দোর ডিক্লারেশন প্রায় হুবহু বিবৃত করেছেন, জানিয়েছেন ফার্নান্দোর সঙ্গে মার্টিনেজের এই বিষয়ে বিশদ আলোচনার ইতিকথা। সব কথাই খুলে বলেছেন তিনি, কিছুই বাদ রাখেননি। আর বলেছেনে তিয়াগোর কথা। তাঁর ধুঁকতে থাকা হৃৎপিণ্ডটার কথা, যাকে তিনি সেই সুদূর লিসবনে মিজেরিকর্দিয়া হাসপাতালের বিছানায় রেখে এসেছেন।

আশ্চর্য জীবনীশক্তি এই ভারতীয় ব্রাহ্মণের, অবাক হয়ে ভাবেন মার্টিনেজ। কাল এসে দুপুরের পরেই তিনি উধাও হয়ে গেলেন কোথায়। তারপর এসে উদয় হলেন বিকেল নাগাদ। নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে কীসব যেন করেন, ফের কোথায় বেরিয়ে যান তিনি। ফিরেছেন অনেক রাত করে, ততক্ষণে মার্টিনেজ ঘুমিয়ে কাদা।

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই পণ্ডিতের ঘরে ডাক পড়ে মার্টিনেজের। সেখানেই আজকের রাতের এই অভিযানের প্ল্যান চূড়ান্ত করা হয়।

জায়গাটা ক্যালাঙ্গুট থেকে একটু দূর, প্রায় ঘন্টাদেড়েকের রাস্তা। সময়টাও সন্ধের শেষের দিকে। গাড়িটা বেশ খানিকটা দূরেই রেখে আসতে হয়েছে, কারণ গ্রামের মধ্যে গাড়ি নিয়ে ঢুকে অযথা লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মানেই হয় না। ড্রাইভার অবশ্য মৃদু আপত্তি তুলেছিল, ওদিকে যে বিশেষ কিছুই দেখার নেই, এই ছিল তার বক্তব্য। তাকে কিছু এক্সট্রা পয়সা দেওয়ার কড়ারে চুপ করিয়ে রেখে দু-জনে পায়ে হেঁটে এসেছেন এতটা। গতকালই এদিকে এসেছিলেন কৃষ্ণানন্দ, দেখে গেছিলেন রাস্তাঘাট। তিনি গ্রামের বাইরের সুঁড়িপথটি ধরে ছোটো জঙ্গল পেরিয়ে দ্রুতপায়ে চলে এলেন মন্দিরের একেবারে সামনে। আজ এই চত্বর একদম শুনশান। দূরে কোনো ময়দান থেকে ঢাক ঢোল আর হইচইয়ের মৃদু আওয়াজ আসছে। একটু পরেই শুরু হবে দশেরার রাবণ পোড়ানো। তারপর সারারাত ধরে যাত্রা হবে পৌরাণিক আখ্যান নিয়ে। সমস্ত গ্রাম ঝেঁটিয়ে সেখানে গিয়ে তামাশা দেখতে হাজির, এইদিকে এখন দূরদূরান্ত অবধি জনমানব নেই।

মন্দিরটি ছোটোখাটো, ভারতের অগুনতি মন্দির যেমন হয় তেমনই। পোড়া ইটের মন্দির, মাথার ওপরে টালি দেওয়া। মন্দিরটা আবার দোতলা। দ্বিতীয় তলার মাথাতেও টালির আচ্ছাদন। চারিপাশে বিভিন্ন ফুলের আর ফলের গাছ লাগানো, তার কোনোটাকেই চেনেন না মার্টিনেজ। সামনের চত্বরটা সম্পূর্ণ খালি আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।

মন্দিরের প্রধান দরজা থেকে বেশ কিছুদূরে একটা বড়ো গাছের আড়ালে দাঁড়িয়েছিলেন মার্টিনেজ। সংবিৎ ফেরে সেই ব্রাহ্মণের গলায়, কৃষ্ণানন্দ ডাকছেন তাঁকে। ধীর পায়ে এগিয়ে আসেন তিনি এবং একটি সাদা বস্ত্রখণ্ড তুলে দেন মার্টিনেজের হাতে। গম্ভীর গলায় বলেন, ‘বাকি সমস্ত পোশাক ছেড়ে এই কাপড়টা পরে নাও সাহেব। আর সেই শক্তিখণ্ডটি সঙ্গে এনেছ তো? ওটিকে হাতে নিয়ে এসে বসো আমার সঙ্গে।’ এই বলে তিনি ফিরে যান।

আদেশ পালন করেন মার্টিনেজ। তারপর ধীরপায়ে এগিয়ে যান সামনের দিকে। কৃষ্ণানন্দ তখন মন্দিরের প্রধান দরজা থেকে প্রায় কুড়ি ফুট দূরে মন্দিরের দিকে মুখ করে, দক্ষিণাস্য হয়ে একটি কুশাসনের ওপরে বসেছিলেন। পাশে আরেকটি কুশাসন রাখা ছিল। হাতের ইশারায় তিনি মার্টিনেজকে সেই আসনের ওপর পূর্বাস্য হয়ে বসতে বলেন। সামনে একটা মাটির পাত্রে আগুন জ্বলছিল, আর তার পাশে মাটিতে পেতে রাখা কাগজের ওপর স্তুপ করে রাখা ছিল কিছু গাছের ছালের গুঁড়ো।

‘ভয় পেও না সাহেব। আজ তুমি এমন অনেক কিছুই দেখবে, বা শুনবে যা তোমার বোধবুদ্ধি যুক্তির অতীত। তাতে কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত হবে না, ভয় পাবে না। ভয় পেলেই কিন্তু মহাসর্বনাশ। জানবে যা দেখছ সব মায়া। কিছুই সত্যি নয়।’ এই বলে পাশে রাখা পাত্র থেকে খানিকটা জল অঞ্জলিবদ্ধ হাতে নেন আগমবাগীশ, বিড়বিড় করে তিন বার মন্ত্রোচ্চারণ করেন আর তারপর জলটিকে ভূমিতে ফেলে দেন। এই কাজ তিন বার করার পর সামনে একটি বড়ো সবুজ পাতা বিছিয়ে রাখেন। কোন গাছের পাতা, সেটা চিনতে ভুল হয় না মার্টিনেজের। ব্যানানা! দিস ইজ ব্যানানা লিফ।

সেই পাতার ওপর প্রথমে গাঢ় লাল রঙের কী একটা খানিকটা লাগিয়ে রাখেন তিনি। নিশ্চয়ই ভার্মিলিয়ন পেস্ট, ভাবেন মার্টিনেজ। তারপর সাদা রঙের একটুখানি সান্দ্র তরল রাখেন। তার সুন্দর গন্ধেই প্রকাশ পায় যে সেটা কীসের মিশ্রন, চন্দন! এরপর রাখেন জলে ধোওয়া একমুঠো চাল, তিনটি শিস আছে এমন দেখতে একরকমের ঘাস কিছুটা, বেশ কয়েকটা রেড হিবিসকাস ফুল আর একটা মালা। মোটা করে গাঁথা মালা। তাতে প্রচুর রকমের ফুল আছে, যার অর্ধেক মার্টিনেজ চিনতেই পারলেন না! আর পাতাটির ওইপাশে নৌকোর মতন দেখতে একটি তামার তৈরি জলপূর্ণ পাত্র।

‘শক্তিখণ্ডটি এই পাতার ওপর রাখো সাহেব।’ ধীরে ধীরে হাতের মুঠো খুলে সেই ঘনকৃষ্ণ শক্তিপীঠটিকে পাতার মধ্যিখানে রাখেন মার্টিনেজ। আর সঙ্গেসঙ্গে তাঁর মনে হয় যেন তাঁর চারপাশের পৃথিবীটা অকস্মাৎ একটু দুলে উঠেই স্থির হয়ে গেল। যেন এতদিন একটা বিশাল বড়ো গিয়ারহুইলের একটা ছোট্ট ঘাট ঠিকঠাক লাগছিল না। এক্ষুনি যেন হাতুড়ির একটা ছোটো ধাক্কায় সেটা ঠিক বসে গেল, বহুকষ্টে যেন এক প্রাচীন যন্ত্র ধীরে, অতি ধীইইইরে চলতে শুরু করল। ‘শোনো সাহেব। এই আসন মন্ত্রসিদ্ধ আসন। যতক্ষণ তুমি এখানে বসে আছ কোনো মানুষ, ভূত, প্রেত, যক্ষ, রক্ষ, দানব কেউ তোমার একগাছি চুলও ছুঁতে পারবে না। যা খুশি হোক, দুনিয়া এদিক থেকে ওদিক হয়ে যাক, চন্দ্রমণ্ডল মাটিতে খসে পড়ুক, ভূমিকম্প হোক, সমুদ্র গ্রাস করতে আসুক, ধেয়ে আসুক দাবানল, কিছুতেই তুমি এই আসন ছেড়ে উঠবে না। যতক্ষণ তুমি এই আসনে বসে আছ, স্বয়ং যমরাজেরও সাহস নেই যে তোমার কেশাগ্র স্পর্শ করেন। আর শোনো, এই যে দেখছ আগুন জ্বলছে, কিছুতেই যেন এ নিভে না যায়। নিভু নিভু হয়ে এলেই এই গুঁড়ো ছিটিয়ে দেবে। এই চলবে যতক্ষণ না সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া শেষ হয়।’

‘প্রক্রিয়া কখন শেষ হবে পণ্ডিত?’ এতক্ষণে কথা বলেন মার্টিনেজ। শান্ত সমাহিত কণ্ঠস্বর, কোনো আবেগের বিন্দুমাত্র উচ্ছ্বাস নেই। ঠিক যে তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার আবেগহীন বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অ্যাকশনে নামেন মার্টিনেজ, ঠিক সেরকমই ঠান্ডা মাথায়, শান্তচিত্তে, খোলা তরবারির মতো শিরদাঁড়া সটান করে কুশাসনে বসে আছেন ইউরোপের ইস্পাত, কর্নেল মার্টিনেজ ভাজ!

‘আমরা প্রথমে কালভৈরবের আরাধনা করব সাহেব। তিনি সমস্ত ভীরুতা নাশ করেন, সমস্ত ক্ষুদ্রতার বন্ধন ছিন্ন করেন। ইনি সময়ের রক্ষাকর্তা, সৃষ্টি ও প্রলয়ের চাবিকাঠি এঁরই হাতে। কালভৈরব অজ্ঞানপাশ ভেদ করেন ও বোধিচিত্ত জাগ্রত করেন, সাধককে দান করেন বরাভয়, দেখিয়ে দেন অভীষ্ট সিদ্ধির পথ। পিণাকপানি মহাদেবের ক্রোধ থেকে এঁর উৎপত্তি। ইনি প্রসন্ন হলে আর ভয় নেই সাহেব, দেবাদিদেব স্বয়ং প্রসন্ন হলে স্বর্গ মর্ত্য কি পাতাল, সমস্ত ভয় থেকে তুমি মুক্ত, বেতালের প্রতিশোধস্পৃহা থেকে তুমি মুক্ত। কালভৈরবকে প্রসন্ন করে আমরা সেই মহান বেতালকে আহ্বান করব সাহেব। তুমি প্রস্তুত থেকো।’

এই বলে ব্রাহ্মণ প্রথমে নিজের হাতের আঙুলগুলিকে বিচিত্র মুদ্রায় ধারণ করলেন। তারপর বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে সেই তামার পাত্র থেকে জল নিয়ে ছিটোতে লাগলেন চারিদিকে। তারপর তর্জনীর ডগায় লাল রঙের আর চন্দনের মিশ্রণ একসঙ্গে নেন তিনি। মধ্যমা আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে খানিকটা সেই চালের দানা আর তিনটে শিসওয়ালা ঘাসের টুকরো তুলে ধরেন। তারপর সেই মিশ্রণটি শক্তিখণ্ডটির মাথায় লাগিয়ে দেন, ছিটিয়ে দেন চাল ও ঘাসের টুকরো। তারপর গম্ভীর স্বরে মন্ত্রোচ্চারণ করতে থাকেন, ‘ভ্রাজচ্চণ্ডজটাধারং ত্রিনয়নং নীলাঞ্জনাদিপ্রভং, দোর্দ্দণ্ডাত্তগদাকপাল মরুণস্রদ্বগবস্ত্রোজ্জ্বলম। ঘণ্টামেখলঘর্ঘরধ্বনিমিলজঝঙ্কারভীমং…’

স্থির বসেছিলেন মার্টিনেজ। হেমন্তের নির্মেঘ আকাশ। চারিদিকে ঝিরঝিরানি হাওয়া, গাছের পাতাগুলোয় ঝুমুরের আওয়াজ তুলছে। দূরদূরান্ত অবধি কেউ নেই। আকাশে দশমীর চাঁদ, অনেকটাই বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আলো বলতে চাঁদের মায়াবী নরম আলো আর সামনের এই অগ্নিকুণ্ডে জ্বলতে থাকা আগুন, যাতে মাঝেমধ্যে গাছের ছালের গুঁড়ো ফেলতে হচ্ছে মার্টিনেজকে। সামনে বসে থাকা লোকটি চোখ বুজে অত্যন্ত গম্ভীর গলায় উচ্চারণ করে চলেছে বিজাতীয় মন্ত্র সমূহ। লোকটিকে লক্ষ্য করেন মার্টিনেজ। এ তাঁর কেউ নয়, সম্পূর্ণ অনাত্মীয় একটি লোক। কে জানে কীসের কোন টানে তাঁর বিপদকে নিজের বিপদ বলে টেনে নিয়েছে। আধ ঘন্টাটাক পর মার্টিনেজের মনে হয় চারিপাশে সামান্য ধোঁয়াটে অস্বচ্ছতার সৃষ্টি হয়েছে যেন। যেখানে তাঁরা বসে আছেন, সেখান থেকে চার পাঁচ ফুট দূরে যেন ধীরে ধীরে নেমে আসছে ভারী ধোঁয়ার পর্দা। পরতে পরতে তার ঘনত্ব বেড়েই চলেছে। এত ধোঁয়া এল কোথা থেকে? আশ্চর্য হলেন মার্টিনেজ। আশেপাশে কিছুই আর দেখা যায় না ঠিকঠাক, মন্দিরের অবয়বও এখন অস্পষ্ট… মাথার ওপর তাকালেন মার্টিনেজ… আকাশও প্রায় ঢেকে এসেছে… হঠাৎ হলটা কী? ভাবতে ভাবতেই মাথা নামালেন তিনি, আর তাঁর হৃদস্পন্দন প্রায় বন্ধ হয়ে এল!

এই কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অলৌকিক ভাবে তাঁদের মধ্যে আবির্ভাব হয়েছে এক প্রাণীর। একটি বিশালদেহী কুকুরের!

এই জীবনে ভয়ংকর কুকুর কম দেখেননি মার্টিনেজ। তিনি একজন আদ্যন্ত কুকুরপ্রেমী মানুষ। তাঁর নিজের বাড়িতেই পাহারা দেয় দুটো ভয়ালদর্শন রটওয়েলার। এ ছাড়াও ব্যানডগ, ম্যাস্টিনো, ক্যানারিয়ান ম্যাস্টিফ, বুলম্যাস্টিফ, বা জাগুয়ার শিকার করা ব্রাজিলিয়ান কুকুর ফিলা ব্রাজিলিয়েরো, কুকুর কম ঘাঁটেননি তিনি। এরা প্রত্যেকেই হিংস্র প্রজাতির কুকুর বলে অত্যন্ত কুখ্যাত। ডেঞ্জারাস ব্রিডের কুকুর ট্রেইন করে আনন্দ পান তিনি। কিন্তু তাঁর সামনে যেটি বসে আছে, সেটি এতই ভয়ংকর দেখতে, এতই ভয়াবহ তার উপস্থিতি, যে একটু ভয় পেতে শুরু করলেন মার্টিনেজ। কুকুরটা উচ্চতায় চার ফুটের কম হবে না, দৈর্ঘ্যে প্রায় ছয়ের কাছাকাছি, অনুমান করলেন মার্টিনেজ। কুচকুচে কালো গা আর চোখ দুটো অস্বাভাবিক লাল। সারা মুখে একটা উগ্র, জান্তব ক্রোধ এবং ক্রূরতা মেশানো আছে। কুকুরটার মুখের দু-পাশ দিয়ে একটু একটু করে লালা ঝরছে। এ কুকুর যদি পাগল হয়, ভাবতেই একফোঁটা ঘাম শিরদাঁড়া বরাবর নেমে গেল মার্টিনেজের! প্রাণীটার প্রতিটি নিশ্বাসে কাঁচা মাংস ও রক্তের গন্ধ! উহ, কী বীভৎস। যেন নরক থেকে উঠে এসেছে এই ভীতিপ্রদ জন্তুটা। অথচ কুকুরটা কিন্তু কিছু করছে না। চুপ করে কৃষ্ণানন্দের সামনে থাবা পেতে বসে স্থির ভাবে লাল চোখ মেলে তাকিয়ে আছে সেই ব্রাহ্মণের দিকে। যেন খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে গম্ভীর গলায় উচ্চারিত সেই সুরেলা আবৃত্তি।

ঠিক সেইসময় আরেকটা! হুবহু অবিকল একইরকম আরও একটা ভয়ালদর্শন কুকুর ধোঁয়ার পর্দার মধ্যে থেকে এসে প্রথমটার থেকে একটু দূরে থাবা পেতে বসল। সেই এক দৃষ্টি, খরশান চোখে তাকিয়ে পণ্ডিতের দিকে! এইবার সতর্ক হয়ে উঠলেন মার্টিনেজ। যেটা ঘটছে, সেটা ঠিক স্বাভাবিক বুদ্ধির এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে কিনা, সেই নিয়ে সন্দেহ হতে থাকল তাঁর। তিনি খেয়াল করলেন যে কুকুর দুটির নজর তাঁর ওপর একদমই নেই। তারা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মন্ত্রকর্তার দিকে। এবং আরেকটা! আবার ধোঁয়ার কুণ্ডলী থেকে আরেকটি কালান্তকদর্শন কুকুর এসে পণ্ডিতের পাশে বসল, পণ্ডিতের দিকে মুখ করেই।

এইবার ঘটনাটার অতিপ্রাকৃতিক দিক নিয়ে আর সন্দেহ রইল না মার্টিনেজের। তিন তিনটে এইরকম যমপুরীর প্রহরীর মতন ভয়াবহ দর্শন কুকুর এখানে আসা আর চুপ করে বসে থাকা কিছুতেই স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে না। উত্তেজনায়, এবং বেশ কিছুটা ভয়ে তিনি স্থির কাষ্ঠপুত্তলিবৎ বসে রইলেন। ওদিকে কৃষ্ণানন্দের কোনো হুঁশই নেই। তিনি চোখ বুজে উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করে যাচ্ছেন, ‘দেবরাজসেব্যমানপাবনাঙ্ঘ্রিপঙ্কজম ভালযজ্ঞসূত্রমিন্দুশেখরং কৃপাকরম। নারদাদিযোগীবৃন্দবন্দিতং দিগম্বরং কাশিকাপুরাধিনাথকালভৈরবম্ ভজে।’

এর পরে আরও একটা!

একাদিক্রমে ছ-টা সেই বিশাল আকারের ভয়ালদর্শন কুকুর তাঁদের ঘিরে বসল। তাদের নিশ্বাসের আওয়াজ প্রতি মুহূর্তে ভয় ধরিয়ে দিতে লাগল মার্টিনেজের মতন শক্ত স্নায়ুর লোককেও। কাঁচা রক্ত মাংসের বমনোদ্রেককারী গন্ধে ভরে উঠেছে চারিপাশ। তাদের শ্বাসের ভারী শব্দে যেন চারিপাশের আবহাওয়াও ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। মার্টিনেজ বসে আছেন চিত্রার্পিতের মতন, খুব সাবধানে নিশ্বাস নিচ্ছেন। ভয়ে ও উত্তেজনায় তাঁর শরীর থেকে স্বেদবিন্দু গড়িয়ে পড়ছে নীচের দিকে, ঘামে জবজবে ভিজে যাচ্ছেন তিনি। আড়চোখে নিজের হাতের দিকে তাকান তিনি, প্রতিটি রোম দাঁড়িয়ে আছে! অথচ এই ব্রাহ্মণপণ্ডিতের কোনো হুঁশই নেই! তিনি সুরেলা গলায় গেয়ে চলেছেন, ‘ভানুকোটিভাস্বরম্ ভবাধ্বিতারকং পরম্নী লকণ্ঠমীপ্সিতার্থদায়কং ত্রিলোচনম্। কালকালম্বুজাক্ষমক্ষশূলক্ষরম্কা শিকাপুরাধিনাথকালভৈরবম্ ভজে।’

ধীরে ধীরে মার্টিনেজের মনে হল তিনি যেন চারিপাশ থেকে আস্তে আস্তে বিযুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। তাঁর চৈতন্য আর বোধ যেন তাঁর অস্তিত্ব থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে, পরতে পরতে কী যেন উঠে আসছে তাঁর শরীর থেকে। তিনি যেন তাঁর দেহের বাইরে জেগে থাকা অন্য একটি সত্তা। পুরো দৃশ্যটাই যেন তিনি স্বপ্নে দেখছেন, তিনি আসলে এখানে নেই। আসলে তিনি ভাজ পালাসেতের চিলেকোঠার ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। একটু পর তাঁর দাদা রডরিগো তাঁকে ডাকতে আসবে, দুই ভাই মিলে আজ ঠিক করেছেন যে পিছনের বাগানে খেলতে যাবেন। ওই তো সিসিলিয়া, কিশোরী সিসিলিয়া। তাঁর দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসছে, যেমন হাসতো আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে। হাত নাড়ছে তাঁর দিকে তাকিয়ে, তারপর একটি শিশুকে কোলে তুলে নিল… আরে ওই তো তিয়াগো… তিয়াগো তার দিকে তাকিয়ে হাসছে, হাত নাড়ছে…

হঠাৎ করে ঝটকা মেরে উঠে বসলেন তিনি। তিনি কি পাগল হয়ে গেলেন? এসব কী উলটোপালটা ভাবছেন তিনি? কোথায় রডরিগো? কোথায় সিসিলিয়া? তিয়াগোর জন্যে কোন মুল্লুকে এসে বিচিত্র সব তন্ত্রসাধনার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। সেই কুকুরগুলো, উফ্ কী ভয়ংকর সব কুকুরগুলো…

চোখ রগড়ান তিনি, কোথায় কুকুর? কোথায় কী? সেই আগুনের কুণ্ড জ্বলছে সমানে। আর তাঁর দিকেই সটান তাকিয়ে আছেন কৃষ্ণানন্দ। তাকিয়ে আছেন সাগ্রহে, ‘সাহেব কী হল তোমার?’

‘কুকুরগুলো কোথায় গেল?’ হতভম্বের মতন বলেন মার্টিনেজ, আর চারিপাশে তাকাতে থাকেন ‘সেই ভয়ংকর ছ-টা কুকুর? উফ্, কী বীভৎস ছ-টা জন্তু। কোথায় গেল তারা?’

‘ছ-টা কুকুর? ঠিক দেখেছ তুমি সাহেব?’ আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেন কৃষ্ণানন্দ।

‘কী বলছ পণ্ডিত? দেখেছি মানে? তোমাকে যেমন দেখেছি, তেমনই তাদেরও দেখলাম যে। ছ-টা কুকুর, কী ভয়ংকর, কী বীভৎস বাপ রে… যেন নরক থেকে উঠে এসেছে… উফ্…’

দু-হাত তুলে কপালে ঠেকালেন সেই ভূয়োদর্শী ব্রাহ্মণ, তাঁর গলা উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে, ‘ধন্য তুমি সাহেব। ধন্য তোমার পুণ্যকর্ম। যাদের দেখেছ তারা কুকুর নয় সাহেব, তারা মানুষের ষড়রিপুর রক্ষক, নিয়ন্তা। জাগতিক বন্ধনের প্রতীক তারা। তাদের দেখা পাওয়া মানে এই জীবনে তুমি উদ্ধার হয়ে গেলে সাহেব, তোমার যাবতীয় মোহপাশ ছিন্ন হয়ে গেল। তোমার যাবতীয় বিচারবুদ্ধি, মায়াবন্ধন, আজ শুদ্ধ হয়ে গেল। জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে যা পাপ করেছ, স্বয়ং কালভৈরব আজ নিজে এসে সেই পাপরাশি ধ্বংস করেছেন, তোমায় আশীর্বাদ করেছেন সাহেব। হা ঈশ্বর, কতই না হতভাগ্য আমি। এতদিন জপতপ ভজনপূজন করেও যে সৌভাগ্যের কণামাত্র পাইনি, তুমি অশেষ পুণ্যবলে আজ তার অধিকারী হলে, আমি ঈর্ষা করি তোমার ভাগ্যকে সাহেব’, ব্রাহ্মণের প্রশংসা শেষই হতে চায় না। সংকুচিত হয়ে পড়েন মার্টিনেজ, ‘কিন্তু পণ্ডিত, আমি তো ক্রিশ্চিয়ান। তোমার হিন্দু গড কি…’

‘এক-শো-টা বাচ্চাকে প্রাণের বাজি রেখে উদ্ধার করার সময় ভেবেছিলে সাহেব, ওরা কোন ধর্মের? সেদিন যে বাচ্চা মেয়েটার জন্যে অতগুলো অমানুষের সঙ্গে খালি হাতে লড়ে গেলে, জিজ্ঞেস করেছিলে মেয়েটা ক্রিশ্চান কিনা? কীসের ধর্ম সাহেব? কে কার ভগবান? পাপের যদি ধর্মাধর্ম না থাকে সাহেব, পুণ্যের কেন হবে?’ চুপ করে থাকেন মার্টিনেজ। এখানে আসার আগে ফার্নান্দোও এমনই কিছু বলছিলেন।

এই পর মোটা মালাটি তিনি পরিয়ে দেন মার্টিনেজের গলায়, ‘এইবারে আসল কাজ সাহেব। আমি সেই বেতালকে আহ্বান করব। তিনি আসবেন, তাঁর হাতে তুমি এই শক্তিখণ্ড তুলে দিও। তারপর দেখি কে জেতে, শয়তানের ভবিষ্যদ্্বাণী না আমার গুরুর আশীর্বাদ। তুমি কিন্তু এই আসন ছেড়ে উঠবে না, যতক্ষণ না বেতালের আবির্ভাব ঘটে’, বলে নিজে আসন থেকে উঠে দাঁড়ান।

এরপর দক্ষিণ দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেলেন, থমকে দাঁড়ালেন, তারপর মৃদুকণ্ঠে কয়েকটি মন্ত্র উচ্চারণ করলেন। এরপর ফিরে এসে আসনে বসে আরও কিছু মন্ত্র বলতে বলতে আগুনের মধ্যে কিছু গুঁড়ো নিক্ষেপ করলেন। এরপর ফের উঠে দাঁড়িয়ে পূর্ব দিকে গেলেন, একই কাজের পুনরাবৃত্তি করলেন, ফের ফিরে এসে আসনে বসলেন। এইভাবে চারদিকের জন্যে চার বার উঠেলেন তিনি। এরপর এসে বসে, ‘ওং হ্রীং ক্লীং শ্রীং ফট স্বাহা’ বলে মেরুদণ্ড ঋজু করে ধ্যানে বসলেন। নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলেন মার্টিনেজ, এরপর কী হবে? আধ ঘণ্টা বাদে দূরে একটা বিদ্যুৎশিখা দেখতে পেলেন মার্টিনেজ। ঘন নীল দীপ্তিময় সেই শিখা, মনে হল যেন মন্দিরের সামনে নেমে এসেছে। কৃষ্ণানন্দ তৎক্ষণাৎ তার দিকে আঙুল তুলে বললেন ‘তিষ্ঠ’। আশ্চর্যের বিষয়, সেই আলোকশিখা যেন থিরবিজুরি হয়ে সেখানেই অধিষ্ঠান করতে লাগল!

অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছেন মার্টিনেজ, হঠাৎ তিনি গুরুগুরু ডাকে সচকিত হয়ে উঠলেন। একী! বৃষ্টি হবে নাকি? এ তো মেঘের ডাক! ভাবতে ভাবতেই যেন আকাশ থেকে তাঁর হাঁটু ঘেঁষে কী একটা গড়িয়ে পড়ল, মার্টিনেজ সভয়ে তাকিয়ে দেখলেন, একটা মানুষের পায়ের হাড়! এরপর শুরু হল হাড়বৃষ্টি! কাঁচা হাড়, শুকনো হাড়, কাটা আঙুল, মাথার খুলি, কানের টুকরো, কিছুরই আর কোনো বাছবিচার রইল না। একের-পর-এক সদ্যকাটা দেহাংশ মার্টিনেজের দেহের বিভিন্ন অংশে পড়তে লাগল। দাঁতে দাঁত চেপে তিনি সহ্য করতে লাগলেন। তাঁর সারা দেহ রক্তে লাল হয়ে উঠল। হঠাৎ করে একটা কাটা মাথা তাঁর কোলে এসে পড়তে চমকে উঠলেন মার্টিনেজ। আরে…এ যে রডরিগোর মাথা! সেই যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ, যা তিনি শেষ দেখেছিলেন অ্যাভেনিদা দ্য লিবারদাদের রাস্তায়, এক মহার্ঘ রেস্তরাঁর পেছনের গলিতে!

স্থির হয়ে বসেছিলেন মার্টিনেজ, তাঁর বুকটা মুচড়ে যাচ্ছিল। রডসি… রডসি… কত কষ্ট পেয়েছিলে তুমি? কে এসেছিল সেদিন তোমার মৃত্যুদূত হয়ে? মুহূর্তের জন্যে চোখ বন্ধ করেছিলেন মার্টিনেজ, চোখ খুলে দেখলেন কোথায় কী? সব ভোঁ ভাঁ! অবাক হয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছিলেন তিনি, এমন সময় ডান দিকের কাঁধে একটা শীতল স্পর্শ পেয়ে ঘাড় ঘোরাতেই স্থির হয়ে গেলেন তিনি। একটা মোটা মতন সাপ তাঁর ঘাড় বেয়ে মাথায় ওঠার চেষ্টা করছে। সাপটাকেও বিলক্ষণ চেনেন তিনি, কিং কোবরা, বিষধর সাপেদের রাজা! এদেশে বলে শঙ্খচূড়! এর এক ছোবলে হাতি পর্যন্ত মারা যায়! নিশ্বাস বন্ধ নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখার মতন স্থির হয়ে রইলেন মার্টিনেজ। তারপর অনুভব করলেন যে তাঁর ডান হাঁটুতে সুড়সুড়ি দিচ্ছে কিছু একটা। অতিসাবধানে নীচে তাকালেন মার্টিনেজ।

অন্তত শতখানেক সাপ তাঁকে ঘিরে! সবকটাই দীর্ঘ ও ভয়ানক বিষধর! অগ্নিকুণ্ডের আলোয় এর মধ্যে ব্ল্যাক মাম্বা আর রাসেল ভাইপার চিনতে পারলেন মার্টিনেজ। তাঁর বাঁ-হাত পেঁচিয়ে উঠছে কালোতে হলুদে ওটা কী? সর্বনাশ, ও যে ইন্ডিয়ান ক্রেইট! যমের দোসর! দাঁতে দাঁত চিপে নিজেকে স্থির রাখলেন মার্টিনেজ। মায়া, সবই মায়া…বিড়বিড় করলেন তিনি। যতক্ষণ এই আসনে বসে আছেন… ভাবতে ভাবতেই শরীরে দুনো বল এল তাঁর। পেশি আলগা করে হাত বাড়িয়ে সেই আগুনে কিছু গুঁড়ো ছড়িয়ে দিলেন তিনি। ম্যাজিকের মতন সমস্ত সাপ উধাও!

এরপর শুরু হল চারিদিকে কান্না, চাবুক আর শিকলের শব্দ। একের-পর-এক মূঢ়, মূক, ম্লান মুখের ছায়াশরীর তাঁর সামনে দিয়ে চলে ফিরে বেড়াতে লাগল। তাদের পিছনে ভয়ালদর্শন একেকটা লোক, তারা চাবুকের সাঁই সাঁই আওয়াজ তুলে এদের পিঠে মারছে। আর ঝনঝানি শেকল জড়ানো হাত তুলে নিজেদের বাঁচাবার জন্যে সে কী আকুতিবিকুতি সেই হতভাগ্যদের! সেই অসহায় কান্নার শব্দ, ফোঁপানো আর্তির আওয়াজ, করুণ অনুনয়-বিনয় যেন মার্টিনেজের কানের ভেতরে কেউ ঢেলে দিতে লাগল গরম সিসের মতন। খরদৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে রইলেন তিনি, সারা শরীর ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতন টানটান হয়ে রইল… এক বার, শুধু এক বার আজ্ঞা মিলুক এই ব্রাহ্মণের কাছ থেকে…

দেখতে দেখতে তারা কোথায় উধাও হয়ে গেল, চারিদিক এক অপার্থিব অলৌকিক কান্নার শব্দে আর্ত হয়ে উঠল। মার্টিনেজের সামনে কয়েক ফুট দূরে যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হল তিনটে মানুষের মূর্তির। দুটো সম্পূর্ণ উলঙ্গ পুরুষ যেন মারতে মারতে একটি উলঙ্গ নারীকে এদিকে নিয়ে আসছে। মেয়েটির করুণ কান্নায় চারিদিক ভেসে যেত লাগল। অমন ভীষণ মারের থেকে মুহূর্তের পরিত্রাণ চাইছে মেয়েটি, এক ফোঁটা জল ভিক্ষা চাইছে। জবাবে সে ভীষণদর্শন উলঙ্গ পুরুষ দুটি বার বার তার মাথায় ডাঙ্গশ মারছে। ধীরে ধীরে তারা সেই আগুনের কাছাকাছি এসে দাঁড়াতে রক্তাক্ত, নগ্ন মেয়েটিকে চিনতে পারলেন মার্টিনেজ! এ যে সিসিলিয়া! চোখ বুঝলেন মার্টিনেজ। মায়া। সবই মায়া। চোখ খুললেন তিনি। সামনে কিছু নেই। কেউ নেই।

তারপর খট খট শব্দে ভরে গেল চারিদিক। কাদের যেন উল্লাসের খলখল হাসিতে চারিপাশ শিউরে উঠতে লাগল। সভয়ে চারিদিক চেয়ে দেখলেন মার্টিনেজ, রাশি রাশি কঙ্কাল যেন করতালি দিয়ে বেরিয়ে এল অন্ধকারের গর্ভ থেকে। ছায়ায় মেশানো তাদের অবয়ব, তারা করতালি দিয়ে নাচতে লাগল এই দুইজনকে ঘিরে। কে যেন একটা অশুভ খনখনে শব্দে হেসে উঠল, হাড়ের খটাখট শব্দে কান পাতা দায়। অসম্ভব বিশ্রী পূতিগন্ধে মার্টিনেজের পেটের নাড়িভুঁড়ি অবধি উঠে আসার জোগাড়! এমন সময় তিনি দেখলেন মন্দিরের দিক থেকে ধীর পায়ে কে যেন এক জন আসছে তাঁর দিকে। তার প্রসারিত দুই হাতে কী যেন একটা রাখা! আগুনের কাছাকাছি আসতে লোকটিকে চিনতে পারলেন তিনি, ফার্নান্দো! তার দু-হাতে কী তুলে এনেছেন ফার্নান্দো? লাশ। তিয়াগোর লাশ!

এইবার আর পারলেন না মার্টিনেজ। স্তম্ভিত চোখে চেয়ে রইলেন সামনে। তাঁর সমগ্র চৈতন্য ঘুরপাক খেতে লাগল। দুনিয়াটা তাঁর চোখের সামনে দুলতে লাগল ছেঁড়া পর্দার মতন। হল না? এত কাছে এসেও হল না? থরথর কাঁপতে লাগলেন তিনি, বুকটা মনে হল ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। ফার্নান্দোও তাঁর দিকে সজল চোখে চেয়ে আছেন, যেন বলতে চাইছেন যে পারলেন না, তিনিও শেষপর্যন্ত পারলেন না। আর বসে থাকতে পারলেন না মার্টিনেজ, ভুলে গেলেন কৃষ্ণানন্দের সতর্কবার্তা। একটি বার, শেষ বারের মতন প্রিয়তম পুত্রের মৃতদেহ ছোঁয়ার জন্যে উদগ্রীব হলেন মার্টিনেজ। আসন ছেড়ে উঠতে যাবেন, এমন সময় চোখ খুলে হুংকার দিয়ে উঠলেন কৃষ্ণানন্দ, সব কিছু ভোজবাজির ছায়ার মতন মিলিয়ে গেল।

এরপর আকাশ বাতাস জুড়ে একটা হাহাকার উঠল। একটা করুণ কান্না যেন চারিদিক থেকে গলে গলে পড়তে লাগল তাঁদের ঘিরে। মার্টিনেজ খেয়াল করলেন একটা ক্ষীণ ধুলোর আলোড়ন যেন সাপের মতোই পাকিয়ে উঠতে শুরু করেছে মন্দিরের ঠিক সামনে। ঠিক তখনই কৃষ্ণানন্দ ফিসফিস করে, অথচ গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আসছেন, তিনি আসছেন।’

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই যেন মন্দিরের সামনের জমিতে সেই ক্ষীণ নীলবর্ণ স্থির বিদ্যুৎলতাটিকে ঘিরে ধুলোর ঝড় ক্রমশ আরও বেড়ে উঠল। ক্ষুধার্ত অজগরের মতন হাওয়ার স্রোত, ধুলোর রাশি এসে যোগ দিল সেই দুরন্ত ঘূর্ণিতে। চারিদিকের আকাশ বাতাস প্রকৃতি যেন গলে গলে মিশতে লাগল সেই ঝড়ে। স্থির চোখে তাকে দেখতে লাগলেন মার্টিনেজ। সেই করুণ আর্তি যেন, খেয়াল করলেন মার্টিনেজ, ধীরে ধীরে সেই আর্তস্বর যেন বদলে যাচ্ছে গর্জনে।

হ্যাঁ, গর্জন। যেটাকে হাহাকার বলে ভুল করছিলেন মার্টিনেজ, সেটা আস্তে আস্তে ক্রুদ্ধ গর্জনের আকার নিতে লাগল। স্পষ্ট শুনতে পেলেন তিনি, একটা অব্যক্ত রুদ্ধ হতাশা যেন ক্রমশই মূর্তিমান হয়ে উঠতে লেগেছে তাঁদের সামনে। আরও লক্ষ্য করলেন মার্টিনেজ, সেই ধুলোর ঝড় যেন একটা মূর্তি পরিগ্রহ করার চেষ্টা করছে। না, চেষ্টা কই, ওই তো স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে তার হিংস্র অবয়ব। ক্রূর আক্রোশে দুই ঝোড়ো হাত দিয়ে প্রবল হাওয়াকে মুঠির মধ্যে ধরতে চাইছে সেই মূর্তি। ধুলো আর ঝড়ে বানানো তার শরীর, আর সেই উলঙ্গতা যেন আরও বাড়িয়ে তুলেছে এই ছায়াময় বিভীষিকা। অসম্ভব নোংরা মড়াপচা গন্ধে ভরে গেল চারিদিক। ক্রুদ্ধ অথচ হতাশ গর্জনে যেন জেগে উঠলেন মৃতদের জগতের রাজা! আরেকটা জিনিস খেয়াল করলেন মার্টিনেজ। এই মূর্তি রোষে উন্মত্ত, অথচ অন্ধ। সে ক্রোধে হাতড়াচ্ছে চারিদিক, কিন্তু তাতে তার গতিবিধিতে যতটা ক্রোধোন্মত্ত ভাব আছে, ততটাই মিশে আছে অসহায়তা। কারণটা বুঝতে দেরি হল না মার্টিনেজের! তিনি দেখলেন যে মূর্তির বুকের কাছটা ফাঁকা! কে যেন হিংস্র আক্রোশে এই অমানুষী ছায়ামূর্তির বুকের ভেতর থেকে উপড়ে এনেছে তার হৃৎপিণ্ডটা। ওটাই যেন তার চোখ, তার অস্তিত্ব, তার চৈতন্য! যেন তারই খোঁজে সে দিশেহারা, তার অভাবেই সে বুঝতে পারছে না যে সে কোথায়!

কার মতন এই মূর্তি? কোথায় যেন পড়েছেন মার্টিনেজ বুক চিরে হৃৎপিণ্ড উপড়ে নেওয়ার কথা? খুব চেনা চেনা লাগছে অথচ… চকিতে মার্টিনেজের মনে পড়ে গেল মিগুয়েলের ডায়েরির কথা। সেই হিন্দু প্রিস্টের ছেলেকেও খুন করা হয়েছিল জ্যান্ত অবস্থায় তার বুকের থেকে হৃৎপিণ্ড উপড়ে এনে! চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা যেন সরে গেল মার্টিনেজের। পাঁচ-শো, পাঁচ-শো বছর ধরে সেই নিহত হিন্দু পুরোহিতের খুন হওয়া ছেলের আত্মার দায়ভার বহন করে চলেছে এই বেতাল, সেই অভিশাপই দিয়ে গেছিলেন সেই পুরোহিত। এই বেতালই সেই মৃত্যুর দেবতা, কয়েক শতাব্দী ধরে এই বেতালের বুভুক্ষু আত্মাই ভাজ পরিবারের প্রতিটি জ্যেষ্ঠ সন্তানের প্রাণহরণ করে এসেছে। তাই কখনোই বোঝা যায়নি আততায়ী কে, মরণকালে কে উপস্থিত হয় সেই হতভাগ্যদের সামনে! লিওনার্দোর ডিক্লারেশনের প্রতিটি বাক্য যেন সজীব হয়ে অগ্নিআখরে ফুটে উঠল তাঁর চোখের সামনে। আজ পাঁচ-শো বছর পর সেই নির্দয় অমানুষিকতা যেন আরও বীভৎসতা বহন করে আনল মার্টিনেজের কাছে! আজ তার অন্তিম প্রতিশোধের সময়, আজ সেই ছায়াময় অশরীরীর শেষ হিসেব বুঝে নেওয়ার দিন।

সেই শক্তিপিণ্ডটি হাতে নিয়ে ভূতগ্রস্তের মতন উঠে দাঁড়ালেন মার্টিনেজ। আসনে বসে থাকার সময় শেষ হয়ে গেছে তাঁর। তিনি তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের মধ্যে ধরে সেই শক্তিপিণ্ডটি ধূলিময় বেতাল মূর্তির দিকে তুলে ধরলেন। সঙ্গেসঙ্গে মার্টিনেজের মনে হল কী যেন এক মহাশক্তিশালী চৌম্বক আকর্ষণ স্থাপিত হল এই শক্তিপীঠ ও বেতালের মধ্যে। ক্রুদ্ধ রিরংসায় মত্ত বেতাল যেন হঠাৎই এদিকে মুখ করে স্থির হয়ে গেল। হিংস্র পশু যেমন শিকারের গন্ধ পেলে স্থির হয়ে যায়, বাতাসে কীসের যেন অশরীরী স্পন্দন এসে সমস্ত মনোযোগ আকর্ষণ করে নিল সেই বেতাল মূর্তির। আরও অনুভব করলেন মার্টিনেজ, তাঁর হাতে ধরা শক্তিপীঠটি হঠাৎ করেই অসম্ভব গরম হয়ে উঠতে লাগল। এত গরম যে তাকে হাতে ধরে রাখা যায় না। দু-আঙুলে তাকে ধরে রাখতে কষ্ট হতে লাগল মার্টিনেজের। কে যেন অমোঘ আকর্ষণে টানছে সেই শক্তিপীঠটিকে, টানছে সেই বেতালমূর্তির দিকে। সেই ছায়ামূর্তি সতর্কতার সঙ্গে এদিক-সেদিক মুখ ঘুরিয়ে শেষে এদিকে তাকাতেই দেখলেন মার্টিনেজ, অবয়বহীন সেই কাল মূর্তিতে দপ করে জ্বলে উঠেছে দুটি চোখ! আর সেই আগুনে দৃষ্টি মেলে এদিকেই তাকিয়ে আছে সে। বেতাল! তারপর সেই বেতালের দুই হাত যেন উঠে এল এদিকে। সেই শরীরী ভাষা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হল না মার্টিনেজের। আর পারলেন না তিনি, সেই অলৌকিক শক্তিখণ্ডটি সজোরে ছুঁড়ে মারলেন বেতালের দিকে।

যেন একটা আলোর বিস্ফোরণ ঘটে গেল মার্টিনেজ আর কৃষ্ণানন্দের চোখের সামনে। দপ করে যেন জ্বলে উঠল বিশ্বচরাচর। চোখ ধাঁধানো আলোর হাজার খানেক শব্দহীন রোশনাই যেন একসঙ্গে ফেটে পড়ল দু-জনের চোখে-মুখে। আকাশ জুড়ে একটা সুগভীর উল্লাসের স্বর যেন মহাসর্পের মতোই নেমে এল সেই জায়গাকে বেষ্টন করে, আকাশ থেকে যেন আতশবাজির মতোই খসে পড়তে লাগল নক্ষত্রমণ্ডল, অশ্লীল আনন্দের উন্মত্ত গর্জন বধির করে দিতে লাগল এই বিশ্বচরাচরকে… সেই আলোর নৃশংস উল্লাসে নীচু হয়ে বসে পড়লেন দু-জনেই। আর তখনই কে যেন মার্টিনেজের বুকের ভেতর বলে উঠল, পেরেছেন! তিনি পেরেছেন ফিরিয়ে দিতে সেই অভিশপ্ত শক্তিখণ্ডটিকে। পেরেছেন তিনি সেই শতাব্দীব্যাপী পাপের দায় খণ্ডন করতে! পেরেছেন তাঁর পরিবারকে মুক্তির পথ দেখাতে, পেরেছেন পাঁচ-শো বছর ধরে চলে আসা একটি বৃত্তকে সম্পূর্ণ করতে। মুক্ত, আজ তিনি মুক্ত! মিগুয়েল থেকে শুরু করে জর্জিনহো, ফ্রান্সিসকো হয়ে রডরিগো… ভাজ পরিবারের প্রতিটি অকালমৃতের আত্মা আজ শান্তি পাবে। শান্তি পাবেন বুড়ো ফার্নান্দোও… আলোর সেই উল্লাস উদ্্যাপন কমলে সটান উঠে দাঁড়ালেন মার্টিনেজ। দেখলেন সেই ছায়াবেতাল আজ পূর্ণ! মিশে গেছে তার বুকের ক্ষত। জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতন গভীর জিঘাংসায় জ্বলছে তার চোখ দুটি। এবং সেই চোখ দুটি তাকিয়ে আছে সোজা এদিকেই! সেই রক্তলোলুপ দৃষ্টির সামনে এই প্রথম বার ভয় পেলেন মার্টিনেজ। সেই দৃষ্টি যেন জ্বলন্ত লোহার শলাকা দিয়ে তাঁর চৈতন্যের মধ্যে, সমস্ত অনুভূতির মধ্যে অগ্নিঅক্ষরে খোদাই করে দিল একটি মাত্র শব্দ!

মৃত্যু!

এই প্রথম মৃত্যুভয় পেলেন মার্টিনেজ। জীবনে অনেক জীবন বিপন্ন করা প্রাণঘাতী কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন তিনি। সেখানে মুহূর্তের ভুলচুকে নিহত হতে পারতেন তিনি, তা ছিল তাঁর কর্তব্যের অংশ, প্রফেশনাল হ্যাজার্ডস! কিন্তু প্রতিবারেই তিনি উতরে গেছেন তাঁর অসামান্য বুদ্ধিমত্তা, দুর্জয় সাহস আর অসামান্য দক্ষতা দিয়ে। কিন্তু এই প্রথম তিনি বুঝলেন যে এর কোনোটাই আজ তাঁর কোনো কাজে আসবে না! তাঁর বহুপ্রশংসিত কর্মদক্ষতা আর অমানুষী সাহসের কোনো দরকারই নেই আজ। স্বয়ং মৃত্যু যদি পাশদণ্ড হাতে ঘাতকের রূপ ধরে সামনে দাঁড়ান, তাহলে আর কীসের কী?

থরহরি কাঁপতে লাগলেন মার্টিনেজ। তাঁর হাঁটু দুটো দুর্বল বোধ হতে লাগল। দরদর করে ঘামতে লাগলেন তিনি, উজ্জ্বল গৌরবর্ণের সুগঠিত শরীর ভেসে যেতে লাগল অবিশ্রান্ত স্বেদে। তিনি আর এক পা-ও এগোবার শক্তি বা সাহস কিছুই পেলেন না। এবং ঠিক সেইসময়েই, সেই বেতাল মূর্তি তাঁর দিকে প্রথম পা ফেলল। মার্টিনেজের মনে হল এই যেন মৃত্যু তাঁর দিকে নিল তার প্রথম পদক্ষেপ।

প্রথম বারের মতন কৃষ্ণানন্দকে উত্তেজিত হতে দেখলেন মার্টিনেজ। সেই ব্রাহ্মণ এগিয়ে এলেন দু-পা, ডান হাত তুলে সরোষে উচ্চারণ করলেন, ‘তিষ্ঠ’। এক মুহূর্তের জন্যে হয়তো থমকালো সেই বেতালমূর্তি। তারপর যেন অনেক কষ্টে হলেও পরের পা ফেলল সে, কৃষ্ণানন্দের আদেশ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই।

বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ করে আবার উচ্চগ্রামে চিৎকার করলেন কৃষ্ণানন্দ, ‘তিষ্ঠ’। ক্ষণকালের জন্যে ফের থমকাল সেই কাল মূর্তি, তারপর পরের পদক্ষেপে মাটি কাঁপিয়ে অগ্রসর হল আরও এক পা!

চকিতে নিজের আসনে ফিরে গেলেন কৃষ্ণানন্দ। বজ্রাসনে বসে জ্বলন্ত আগুনে আহুতি দিলেন কিছু মন্ত্রপূত চাল ও সিঁদুর চর্চিত দূর্বা ঘাস! দাউদাউ করে জ্বলে উঠল সেই অগ্নিকুণ্ড। বার বার মন্ত্র উচ্চারণ করে সেই আগুনে নানা উপচার আহুতি দিতে লাগলেন তিনি। কিন্তু হায়, আজ যেন মৃত্যু তার অব্যর্থ গাণ্ডীবে অমোঘ তূণীর সাজিয়ে বসেছে! মুক্তি নেই, মুক্তি নেই মার্টিনেজের সেই নিশ্চিত মরণের হাত থেকে। বিফল হতে লাগল কৃষ্ণানন্দের যাবতীয় মন্ত্রোচ্চারণ। ধীরে কিন্তু আরও স্পষ্ট পদক্ষেপে সেই ধুলো ছায়ার মূর্তি এগিয়ে আসতে লাগল মার্টিনেজের দিকে।

ভয়ে সর্বাঙ্গ কাঁপতে লাগল মার্টিনেজের। সারাজীবনে যা মনে রাখার মুহূর্ত আছে, সবই এক এক করে সিনেমার রিলের মতন তাঁর চোখের সামনে দিয়ে চলে যেতে লাগল। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে এল তাঁর। শুধু অস্ফুটে এক বার তাঁর মুখে উচ্চারিত হল, ‘তিয়াগো’।

ঠিক সেইসময়েই অসম্ভব গম্ভীরকণ্ঠে উচ্চারিত এই মন্ত্রগুলো ভেসে এল তাঁর কানে,

‘সর্বরুহাম মহাভীম ঘোরদ্রংষ্ট্রম হসন্মুখীম চতুর্ভুজম্ খড়্গমুন্ডবরং ভয়ংকরম্ শিবম্মুন্ডমালা ধরম্ দেবী লোলজিহ্বান্ দিগম্ব‍রম্ এবম্ সচ্চিন্তয়েৎ কালীম্ শ্মশানালয়বাসিনীম্ ক্রিং ক্রিং ক্রিং হ্রিং হ্রিং হুম্ হুম্ স্বাহা…. ওম তারেতুত্তারেতুরে সর্ব উপদ্রবেভয়ো রক্ষম কুরু স্বাহা ওম তারেতুত্তারেতুরে সর্ব দুঃস্বপ্নেভয়ো রক্ষম কুরুস্বাহা ওম তারেতুত্তারেতুরে সর্ব শত্রুভয়ো রক্ষম কুরু স্বাহা…’

কোনোরকমে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন মার্টিনেজ। বজ্রাসনে বসে দুই হাত দু-হাঁটুতে বিশেষ মুদ্রায় রেখে অনর্গল মন্ত্র উচ্চারণ করছেন কৃষ্ণানন্দ। ঘামে ভিজে যাচ্ছে তাঁর সর্বাঙ্গ, শরীরের সমস্থ মাংসপেশি ফুলে উঠেছে তাঁর, কপালে ঘনিয়ে উঠেছে গভীর ভ্রূকুটি ও স্বেদবিন্দু।

বেতালমূর্তি নিল তার পরের পদক্ষেপ, আর তার সঙ্গে সঙ্গেই কোথা থেকে যেন ধেয়ে এল এক প্রবল তুফান! শনশন আওয়াজ তুলে হঠাৎই যেন তুমুল বাতাস ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁদের ঘিরে। দমকা হাওয়ার উড়ে গেল সেই জ্বলন্ত অগ্নিপাত্র, সমস্ত পূজার উপচার। উড়ে যেতে লাগল আশেপাশের মাটি ও ধুলোর রাশি। ভয়ংকর ভাবে মাথা দোলাতে লাগল আশেপাশের বাগানের গাছগুলো, এই যেন তাদের শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলবে কে! মার্টিনেজের মনে হল মুহূর্তে মুহূর্তে যেন বেড়ে উঠছে সেই ঝড়ের তেজ। ক্রুদ্ধা প্রকৃতি যেন প্রলয়ংকরী রূপ ধারণ করেছেন পৃথিবীর টুঁটি ধরে সব কিছু নাড়িয়ে দেবেন বলে। মার্টিনেজের মনে হল আর কিছুক্ষণ এই ঝড় চললে তাঁদেরই যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে এই প্রবল হাওয়ার দামাল স্রোত।

একইসঙ্গে তিনি সামনে তাকিয়ে দেখলেন, এইবার যেন কিছু ব্যত্যয় এসেছে সেই বেতালমূর্তির চালচলনে। ঝড়ের সেই উন্মত্ত প্রকোপ যেন ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে চাইছে সেই ছায়ামূর্তিকে, আর সেই বেতালমূর্তি তাতে প্রাণপণ বাধা দিয়ে চলেছে। সেই প্রবল প্রলয়ঙ্কর ঝড় যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে চাইছে সেই বেতালকে, যেভাবে ময়াল সাপ পেঁচিয়ে ধরে তার শিকারকে। সেই বেতালমূর্তিও সমস্ত শক্তি সংহত করে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে চাইছে, চাইছে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে। ক্রুদ্ধ গর্জনের সঙ্গে ঝড়ের এক একটা ছোবল যেন ছিন্নভিন্ন করতে চাইছে সেই ছায়াশরীর। আর প্রবল পরাক্রমের সঙ্গে নিজের অন্ধকারের প্রতিটি পরত যেন ধরে রাখতে চাইছে সেই বেতালমূর্তি। আর সেই ঝড়ের গগনভেদী গর্জন ছাপিয়ে ভেসে এল কৃষ্ণানন্দের গম্ভীর উদাত্ত আবৃত্তি,

শূলেন পাহি নো দেবি পাহি খড্গেন চাম্বিকে।

ঘণ্টাস্বনেন নঃ পাহি চাপজ্যানিঃস্বনেন চ॥

প্রাচ্যাং রক্ষ প্রতীচ্যাং চ চণ্ডীকে রক্ষ দক্ষিণে।

ভ্রামণেনাত্মশূলস্য উত্তরস্যাং তথেশ্বরি॥

সৌম্যানি য়ানি রূপাণি ত্রৈলোক্যে বিচরন্তি তে।

য়ানি চাত্যন্তঘোরাণি তৈ রক্ষাস্মাংস্তথা ভুবম্॥

খড্গশূলগদাদীনি য়ানি চাস্ত্রানি তেঽম্বিকে।

করপল্লবসঙ্গীনি তৈরস্মান্রক্ষ সর্বতঃ।

সাপের চোখে চোখ রাখা ইঁদুরের মতন মোহগ্রস্ত হয়ে এই অনৈসর্গিক আসুরিক সংগ্রাম দেখছিলেন মার্টিনেজ। হঠাৎ করে পুরো দৃশ্যপটে একটি ক্ষীণ পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন তিনি। বাঁ-চোখের কোণা দিয়ে তিনি দেখলেন সামনের বেতাল মন্দিরের দরজা যেন ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। ঘাড়টা সামান্য ঘুরিয়ে মন্দিরের দিকে তাকালেন তিনি আর ওই বিপুল অনৈসর্গিক শক্তিমত্ততার মধ্যেও, আসন্ন মৃত্যুর মধ্যেও চমকে উঠলেন।

বেতাল মন্দিরের দরজা গেছে খুলে, আর সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি শিশু বালিকা!

এত আশ্চর্য জীবনে কখনো হননি মার্টিনেজ। এই বিপুল বিভীষিকার মধ্যে কোথা থেকে এল এই মেয়ে? এখনই কি তার এখানে আসতে হল? এতক্ষণ কী করছিল সে মন্দিরের ভেতর? এখন এর মধ্যে এলে যে শিশুটির সর্বনাশ হয়ে যাবে! বালিকাটির জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন তিনি!

অথচ মেয়েটির কিন্তু সেদিকে বিন্দুমাত্র হুঁশ নেই। নয় কি দশ বছর বয়েস হবে তার, একঢাল কালো চুল হাওয়ায় উড়ছে উন্মাদিনীর মতন। দৃপ্ত পায়ে সে এসে দাঁড়াল মন্দিরের চাতালে। আর তখনই তাকে দশমীর চাঁদের আলো-আঁধারিতে সামান্য দেখতে পেলেন মার্টিনেজ। পরণে একটি লাল রঙের বস্ত্রখণ্ড শাড়ির মতো করে পরেছে সে। তার গায়ের রং ঘোর কালো। কিন্তু আহা, কালোর মধ্যেও অমন ভুবনমোহিনী রূপ কোনোদিন দেখেননি মার্টিনেজ। চোখ দুটো যেন ধক ধক করে জ্বলছে সেই মেয়েটির। ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে মাটিতে নেমে এল সেই বালিকা, আর ডান হাতটা তুলে যেন থামতে বলল সেই বেতাল মূর্তিকে।

মার্টিনেজের মনে হল সেই ছায়াবেতালের মাথার মধ্যে যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। দু-হাত দিয়ে যেন মাথাটা চেপে ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সেই অশরীরী। তার সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে পড়ল এইবার। ঝড়ের প্রকোপে এবার ধীরে ধীরে উড়ে যেতে লাগল তার শরীরের ছায়ার স্তর। একটু একটু করে অন্ধকারের পরত যেন টুকরো টুকরো অভিশাপের মতোই হাওয়ায় মিশে যেতে লাগল, প্রথমে ধীরে, পরে দ্রুত! আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে উঠতে লাগল সেই বেতাল শরীর। যখন শেষ ছায়ার টুকরোটিও মিশে গেল হাওয়ার সঙ্গে, একটা হাহাকারের শব্দ যেন মাটির ভেতর থেকে উঠেই আকাশের দিকে মিলিয়ে যেতে লাগল, মিশে যেতে লাগল সেই ঝড়ের মধ্যে! মাথা তুলে দেখলেন মার্টিনেজ, অন্ধকারের ছায়াপুঞ্জ ধাবিত হয়েছে উর্ধ্বাকাশে নক্ষত্রলোকের দিকে।

চরম বিস্ময়ে সেই শিশুটির দিকে তাকালেন মার্টিনেজ। আর একটা জিনিস দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি! মেয়েটির উন্মুক্ত করতলে খেলে যাচ্ছে লাল রঙের বিদ্যুতের প্রভা। সেই কালোর মধ্যে যেন ঝিকিয়ে উঠছে দুইটি রক্তপায়ী তরবারির দীপ্তি। একইসঙ্গে বড়ো মায়াময় ও ভয়ানক ভীতিপ্রদ সেই আলোর খেলা।

চকিতে মনে পড়ে গেল মার্টিনেজের, লিওনার্দোর ডিক্লারেশন অনুযায়ী সেই শক্তিখণ্ডটির বর্ণনার কথা! আদিশক্তি। আদিমতম শক্তির বীজাধার। পরা ও অপরা, এই দুই শক্তি দুই রক্তবর্ণ সর্পের মতন খেলা করে সৃষ্টিবিন্দুর দেহ জুড়ে।

এ কে? কে এই মেয়ে? কোথা থেকে এল?

দু-পা পিছিয়ে মুহূর্তের জন্যে দাঁড়ালেন মার্টিনেজ। তারপর মুখ ফিরিয়ে দৌড়ে গেলেন যেখানে কৃষ্ণানন্দ ধ্যান করছেন। কে এই মেয়ে? মৃত্যুর দেবতাকেও ফিরিয়ে দিতে পারে এমন অসামান্য অলৌকিক ক্ষমতা কী করে পেল সে? ব্যাকুল হয়ে ডাকতে লাগলেন তিনি, ‘পণ্ডিত ওঠো। দেখ একটি মেয়ে এসেছে কোথা থেকে, কী অসম্ভবকেই না সম্ভব করেছে সে! ওঠো পণ্ডিত, দেখো তাকে।’

চোখ খুললেন না কৃষ্ণানন্দ। তাঁর সর্বাঙ্গ থরথর কাঁপতে লাগল, দু-চোখ উপচে নেমে এল অশ্রুনদী। ফিসফিস করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এসেছে? সে এসেছে সাহেব?’ বিস্ময়ের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন মার্টিনেজ, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে আসবে পণ্ডিত? এই মেয়েটা? তুমি জানতে তার কথা? তুমি জানতে সে আসবে?’ ঠোঁট দুটো কামড়ে ধরলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ, ধরা গলায় বললেন, ‘সে আসে সাহেব, ডাকার মতন ডাকলে সে যে না এসে পারে না।’ কিছুই বুঝলেন না মার্টিনেজ, শুধু মূঢ়বিস্ময়ে এটুকুই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কার কথা বলছ? এই বাচ্চা মেয়েটির কথা? ডাকলেই এ চলে আসে? এই মেয়েটি কে? তুমি একে চেনো, পণ্ডিত?’ দরবিগলিত অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে কৃষ্ণানন্দের বুক। চোখ বন্ধ করেই তিনি বহুকষ্টে ঠোঁট দুটো ফাঁক করে শুধু বললেন, ‘চিনি সাহেব, খুব চিনি। ও আমার মেয়ে।’ ঘোর অবিশ্বাসের চোখে খানিকক্ষণ কৃষ্ণানন্দের দিকে তাকিয়ে রইলেন মার্টিনেজ। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে মন্দিরের দিকে ঘুরলেন মেয়েটিকে আরেক বার দেখবেন বলে।

কে কোথায়? কোথায় সেই বালিকা? মন্দিরের দরজা যেমন কে তেমন বন্ধ। মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে চলেছে, পরিষ্কার আকাশে উজ্জ্বল দশমীর চাঁদ। কোথাও কেউ নেই, কিছু নেই। কে বলবে একটু আগে ঘটে যাচ্ছিল এক মহাপ্রলয়! সেই অলৌকিক যুদ্ধের চিহ্নমাত্র নেই। ভারি অবাক হয়ে পিছনে ফিরলেন মার্টিনেজ। এও কি মায়া? পণ্ডিতকে এর মানে জিজ্ঞেস করতে হবে।

কোথায় পণ্ডিত? কোথায় কে? কেউ কোত্থাও নেই! সব ফাঁকা!

হু হু করে একঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে যেন স্নান করিয়ে দিয়ে গেল আমোনা গ্রামের বেতাল মন্দিরের সামনে একলা দাঁড়িয়ে থাকা মার্টিনেজ ভাজকে।

২০১৮। ২৭ জানুয়ারি। গুঁইশো বিচ। পর্তুগাল

সি-বিচে বেশ বিকেল হয়ে এসেছে তখন। গুঁইশো পর্তুগালের খুবই জনপ্রিয় বিচ, তাই শীতের মধ্যেও কম লোকজন ভিড় জমায়নি এখানে। বিচের এক কোণে একটা ছাতার তলায় সত্তরোর্ধ বৃদ্ধটি বসে ঝিমোচ্ছিলেন। অদূরে হাঁটাচলা করছিলেন এক চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর বয়সি সুগঠিত শরীরের পুরুষ। আর তাঁর হাত ধরে হাঁটছিল একটি বারো বছরের ছেলে। নানা প্রশ্নে সে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছিল তার বাবাকে। ‘তাহলে বলছ অন্যকে কষ্ট দিলে পাপ হয় পাপা?’

‘হ্যাঁ সোনা। কখনোই কাউকে কষ্ট দিতে নেই, দুঃখ দিতে নেই।’

‘আর কেউ যদি আমাকে কষ্ট দেয়? আমার কোনো দোষ না থাকলেও?’

‘তাহলে তুমি প্রতিবাদ করবে বাবা, অন্যায়ের জবাবে চুপ থাকাটাও অন্যায়। তবে জিসাস কি বলেছেন জানো তো? পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়।’

‘হুমম, আর যদি আমার খুব ইচ্ছে করে অন্যের কিছু নিয়ে নিতে?’

‘সেটা অন্যায় বাবা। কখনো অন্যের জিনিসে লোভ করতে নেই, না বলে ছিনিয়ে নিতে নেই। ওতে পাপ হয়।’

‘আচ্ছা পাপা, তুমি কি ম্যাজিক জানো?’

‘কই, না তো।’

‘জানো পাপা, আমাকে না দাদাই বলেছে ম্যাজিক শেখাবে। যাতে করে আমার অনেক পাওয়ার হয়, আর কেউ যেন না আমার কোনো ক্ষতি করতে পারে।’

অপাঙ্গে এক বার বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সেই পুরুষ। তারপর হাঁটু গেড়ে বসলেন তিনি তাঁর ছেলের সামনে, দুই হাত তার দুই কাঁধে রেখে বললেন, ‘শোনো তিয়াগো। সবসময় সব্বার ভালো চাইতে হয়, সব্বাইকে ভালোবাসতে হয়। কখনো কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে নেই, কাউকে ঠকাতে নেই, কষ্ট দিতে নেই। দেখবে, কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে চাইবে না। সব্বাইকে প্রয়োজনের সময় সাহায্য করবে, দেখবে তোমার দরকারের সময় ঈশ্বর ঠিক কাউকে না কাউকে জুটিয়ে দেবেন। বি গুড টু দিস ওয়ার্ল্ড, দিস ওয়ার্ল্ড উইল বি গুড টু ইউ। তারজন্য ম্যাজিক শিখতে হবে না সোনা, ভালোবাসতে শিখলেই হবে। সবসময় মনে রাখবে, ভালোবাসাই হল সবচেয়ে বড়ো ম্যাজিক, সবচেয়ে বড়ো জাদু।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *