আলথুসার – ২

সে এক নাটকীয় মুহূর্ত। আমি উচ্চারণ করে ফেলেছি আলথুসার নামটা। ফারজানা ভয় পেয়েছে যে আমি বোধ হয় আলথুসারের মার্ক্সিস্ট, সাবভারসিভ তত্ত্বগুলো এবার ভড়ভড় করে বলতে থাকব এবং সেভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করব অন্ততপক্ষে দুদিনের হাজতবাসের মধ্যে। আইজ্যাক ও তার সহকর্মী আলথুসার শব্দটা শুনে এমন কোনো কিছু শোনার মতো ভঙ্গি করেছে যে যেনবা এই ঘরের মধ্যে কোনো বিরাট হাতি আছে একটা, যাকে আমরা কেউই দেখতে পাচ্ছি না, তবে হাতি যে আছে তা জানার পর থেকে হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হওয়ার ভয়ের হেতু কোনো কিছু আর আগের মতো স্বস্তির নেই।

‘হু ইজ আলথুসার?’ জিজ্ঞেস করল আইজ্যাক, ঠিক যেমন আন্দাজ করেছিলাম আমি।

‘ফ্রেঞ্চ দার্শনিক।’

দীর্ঘ নীরবতা।

‘তো?’ ‘সো?’

‘আই লাইক হিম। আই লাইক হিম আ লট। সো আই ওয়ান্টেড টু সি দ্য প্লেস হয়ার হি লিভড ইন লন্ডন।’

‘তিনি তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন ওখানে?’

‘তা কীভাবে করবেন? লুই আলথুসার মারা গেছেন সেই ১৯৯০ সালে। খুব বড় মাপের স্ট্রাকচারালিস্ট মার্ক্সিস্ট ফিলসফার ছিলেন তিনি, প্রফেসর ছিলেন প্যারিসের ইকোল নরমাল সুপিরিয়রের। জাক দেরিদা, মিশেল ফুকোদের টিচার ছিলেন। টিচার ছিলেন চে গুয়েভারার সঙ্গে বলিভিয়ায় লড়াই করা বিখ্যাত রেজি দেব্রেরও। আর কী বলব?’

‘আমরা এখনো কানেকশনটা ধরতে পারছি না। ইউ মাস্ট এক্সপ্লেইন।’

অতএব আমাকে খুলে বলতে হলো সবকিছু। একেবারে প্রথম থেকে। পারহেসিয়া।

বলতে হলো আলথুসার ১৯৮০ সালে তার স্ত্রী সমাজতত্ত্ববিদ হেলেন রাইটমানকে গলা টিপে হত্যা করেন। ঠিক কী কারণে আলথুসার হেলেনকে মেরেছিলেন, এখনো কারও জানা নেই, এমনকি এ বিষয়ে আলথুসারের লেখা সাড়ে তিন শ পৃষ্ঠার বই, আত্মজীবনীমূলক স্মৃতিচারণা দ্য ফিউচার লাস্টস ফরএভার পুরো পড়ার পরেও তুমি বুঝবে না যে কী সেই খুনের কারণ। এবং ঠিক সে কারণেই আলথুসারের স্ত্রী হত্যা প্রসঙ্গ আজও মানুষকে ভাবায়, যেমন আমাকে, বিশেষ করে যখন রেজি দেৱে কিংবা জাঁ গিতঁর মতো দার্শনিকেরা বলেন যে ওই খুন ছিল স্ত্রীর প্রতি আলথুসারের ভালোবাসার একটা প্রকাশ, আর রেজি দেৱে এটাও বলেন যে ওই হত্যা ছিল একধরনের মানবকল্যাণমূলক আত্মহত্যা। কেউ কেউ বলে আলথুসার হেলেনের মুখ বালিশচাপা দিয়ে ধরে রেখেছিলেন, কারণ তিনি হেলেনকে তার নিজের বেঁচে থাকার যন্ত্রণা, বেঁচে থাকার নিরর্থক পীড়ন থেকে মুক্তি দিতে চাইছিলেন। ভালোবাসার কী সুন্দর এক প্রমাণ এটা—নিজের ওপরেই বেঁচে থাকার সব কষ্ট নিয়ে রেখে অন্যকে সেই কষ্ট থেকে মুক্তি দেবার চেষ্টা করা, অর্থাৎ মারা না, বাঁচানো।

আইজ্যাক ও রাইসিংগার মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আমার কথা শুনছে বলে মনে হলো। কিন্তু না, আমি হঠাৎ ওদের দুজনের চোখাচোখি দেখে ফেললাম—এক দ্রুত দৃষ্টি বিনিময়, এক দুর্দান্ত ঠাট্টার সে দৃষ্টি। তার মানে তারা আমাকে নিয়ে মজা করছে। মজা করছে? করুক। আমি সত্য তবু বলবই এবং আমার সত্য হবে পূর্ণাঙ্গ, খোলা ও ঝুঁকিপূর্ণ।

আমি বলতে লাগলাম, ‘তো, সেই আলথুসার ১৯৭৮- এর বসন্তে লন্ডনে আসেন, এসে ওঠেন অক্সফোর্ড স্ট্রিটের কাছে হারলি স্ট্রিটে। আমি এগজাকট ঠিকানাটা জানি না, কিন্তু খুঁজে নেব। তিনি ওখানে ওঠেন তার বন্ধু ডগলাস জনসনের বাসায়, যে জনসন আবার সুন্দর একটা মুখবন্ধ লিখেছেন আলথুসারের ওই দ্য ফিউচার লাস্টস ফরএভার বইয়ের। সেই মুখবন্ধে জনসন বলেছেন কীভাবে তার লন্ডনের বাসা থেকে একটু পরপর স্ত্রী হেলেনকে প্যারিসে ফোন দিতেন আলথুসার এবং কীভাবে হেলেনের সঙ্গে কথা শেষ হলে আবার ফোন করতেন তাদের দুজনেরই কমন সাইকিয়াট্রিস্টকে। তারা দুজনে রোগী ছিলেন ওই একই সাইকিয়াট্রিস্টের। তবে জনসন বলছেন, “স্ত্রীর ফোন শেষ করেই সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে কথা বলা এখানে বড় বিষয় না। বড় বিষয় হচ্ছে আমার লন্ডনের ফ্ল্যাটে আমরা প্রথমবারের মতো আবিষ্কার করি যে লুই আলথুসার, আন্তোনিও গ্রামসির পাশাপাশি পশ্চিমে মার্ক্সবাদের সবচেয়ে বড় তাত্ত্বিক, সেই লুই আলথুসার একজন স্লিপওয়াকার। তিনি রাতে ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়াতেন ফ্ল্যাটজুড়ে, যে ঘরে আমি ও আমার স্ত্রী ঘুমাতাম সেখানেও অন্ধকারে চলে আসতেন, আমাদের গ্রামোফোন রেকর্ডটা বাজাতেন, কিন্তু সবই তার ঘুমের মধ্যে। আর এসবের কিছুই তিনি মনে করতে পারতেন না পরদিন সকালে। আপনাদের নিশ্চয়ই এমন লোকের কাহিনি জানা আছে যে কিনা স্বপ্নে দেখেছে যে সে তার সবচেয়ে বড় কোনো শত্রুকে গলাটিপে মেরে ফেলল, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সে আসলে ঘুমের মধ্যে তার পাশে শুয়ে থাকা নিজের স্ত্রীকেই ওভাবে খুন করে বসেছে। আলথুসার আমাদের ফ্ল্যাটে থাকতে যেভাবে স্লিপওয়াক করতেন, আমি বলতে চাচ্ছি যে ইংল্যান্ডে সাম্প্রতিক সময়েও স্লিপওয়াকার স্বামীর হাতে ঘুমের মধ্যে খুন হওয়া স্ত্রীর সত্যিকারের কেস আছে একটা, তার মানে…

আমার কথা শেষ হলো না, আমাকে থামিয়ে দিল আইজ্যাক। বলল, ‘তার মানে’–– আমার শেষ কথা ‘দ্যাট মিনস’কে তার শুরুর কথা বানিয়ে বলল সে—’তুমি এখন অক্সফোর্ড স্ট্রিটে নেমে পাশের হারলি স্ট্রিটে যাবে একজন ইন্টেলেকচুয়ালের বাসায়, যেখানে কিনা তোমার দার্শনিক লুই আলথুসার এসে উঠেছিলেন ১৯৭৮ সালে আজ থেকে একচল্লিশ বছর আগে, আর তুমি কিনা সে বাসার ঠিকানা ও জানো না?’

আমি অসংকোচে তাকে বললাম, ‘হ্যাঁ। ঠিক বলেছ। ওই বাসার প্রতি আমার আকর্ষণ অনেক, কারণ ওটা আলথুসারের দীর্ঘদিনের স্লিপওয়াকের বাসা, আর জনসনের মতো আমারও অনুমান যে আলথুসারের স্ত্রী হত্যার পেছনে আছে তার ওই স্লিপওয়াক। অতএব আমার কাছে বাসাটার হিস্টরিক্যাল গুরুত্ব অনেক। তাই আমি ভাবলাম, যেহেতু আজ বছরখানেক হয় আমি শুধু আলথুসার পড়ছি এবং যেহেতু আমি ঘটনাক্রমে এখন আছি লন্ডনে, তাহলে বাসাটা খুঁজে বের করে একবার দেখে যাই না কেন?

ফারজানা স্পষ্ট খুশি হলো যে আমি আলথুসারের ‘নিপীড়ক রাষ্ট্রযন্ত্র’ বা ‘আদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র’ নামের তত্ত্ব দুটোর দিকে যাইনি, উল্টো তার স্ত্রীর খুনের প্রসঙ্গকে বড় করে টেনে এনে এটাকে আমার একটা পার্সোনাল ডিটেকটিভ কোয়েস্টের মতো কিছু বানিয়ে ফেলেছি। মানুষের অনেক রকম নেশা। বিশেষ করে ক্রিমিনলজি বলে যে, কোনো খুনের আদ্যোপান্ত বের করার নেশা একবার কাউকে পেয়ে বসলে তা থেকে সে লোকের নিস্তার নেই, আর পুলিশ কনস্টেবল বা ডিটেকটিভ কনস্টেবল হিসেবে এদের নিশ্চয়ই তা অজানা থাকার কথা নয়। অতএব আমি ধরে নিতে পারি আমার বিষয়টাকে তারা একটা মিস্টিক্যাল সার্চ ফর ট্রুথ, সার্চ ফর খুনবিষয়ক ট্রুথ হিসেবে ক্যাটেগরাইজ করে আমাকে এই জেরা থেকে রেহাই দেবে, আর আমি এখনো—যদিও দ্রুত বিকেল পড়ে যাচ্ছে- অক্সফোর্ড স্ট্রিটের শেষ মাথায় মার্বেল আর্চের ওখানে হাইড পার্কের কোনায় দাঁড়িয়ে অসংখ্য ফ্র্যাগর‍্যান্ট অলিভ, ক্যামফর, ইউরোপিয়ান বিচ ও চায়নিজ হর্স-চেস্টনাটগাছের মাথায় সন্ধ্যার শেষ আলো কীভাবে তার বর্ণসুষমা ছড়ায়, তা দেখার সুযোগটা পাব এবং তারপর যেতে পারব পাশের হারলি স্ট্রিটে আলথুসারের স্লিপওয়াকের বাসাটার খোঁজে। কিন্তু আমার দুশ্চিন্তা হলো এটা ভেবে যে রাত যদি বেশি গভীর হয়ে যায়, তাহলে কীভাবে সম্ভব কোনো বাসার—যদিও আমার অনুমান আছে যে কোন বাসাটা—গেটে দাঁড়িয়ে সেখানকার সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করা যে, ‘ভাই এটা কি ইতিহাসবিদ ডেভিড জনসন সাহেবের বাসা, যেখানে ১৯৭৮ সালে বিখ্যাত লুই আলথুসার এসে থেকেছিলেন?’ যে প্রশ্ন বিকেল চারটা বা সকাল দশটায় করা সম্ভব, তা কি রাত একটায় করা যায় নাকি? কিংবা উল্টোটা? আমি ভাবলাম, হায় কীভাবে আমাদের কথার সঙ্গে, প্রশ্নগুলোর সঙ্গে সময়, ঘড়ির সময়, শর্ত রেখে রেখে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে আছে!

আইজ্যাক বলল, ‘ওকে। ইউ আর ইমপসিবল। ইউ মে গো নাউ। বাট ট্রাস্ট মি ইউ উইল বি আন্ডার সিরিয়াস ওয়াচ।’

জোসেফ ও ফারজানা তাদের চেয়ার থেকে উঠে দৌড়ে চলে এল আইজ্যাকের কাছে, তাকে ও রাইসিংগারকে ধন্যবাদ দিতে যে তারা তাহলে সত্যটা বুঝতে পেরেছে। জোসেফের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, সে আইজ্যাককে তার বাসায় দাওয়াত করে এবং সেই দাওয়াত কবুল করিয়ে তবেই ছাড়বে। আইজ্যাক এ মুহূর্তে আছে লজ্জার মধ্যে—লজ্জা ও গৌরব, দুটোই। লজ্জা তার এই এত এত ধন্যবাদ হজম করা নিয়ে, আর গৌরব তার তরফ থেকে অচেনা মানুষের মনের ভেতরটা—একেবারে আত্মা পর্যন্ত, একেবারে মনের গভীরতম প্রদেশে চলতে থাকা গোপন জিনিসগুলোসহ-পড়ে ফেলতে পারার সক্ষমতা এভাবে তিন-তিনজন লোকের সামনে দেখানো গেল বলে। এটাই আলথুসারের বলা ‘ক্ষমতার সম্পর্ক’, কংক্রিট অর্থে ‘ক্ষমতা’ নয়। তিনি বলেছেন, আঠারো শতক থেকে যে ইউরোপের সমাজগুলোকে- -এর মধ্যে এই লন্ডনও পড়ে- শাসনটাসন করে ভালোই লাইনে আনতে পারা গেল, এর কারণ এটা না যে ওই সমাজের মানুষেরা দিনকে দিন আরও বাধ্যগত ধরনের মানুষ হয়ে গিয়েছিল, কিংবা এমনও না যে ওই সমাজগুলো চরিত্রে জেলখানা, আর্মি ব্যারাক বা স্কুলের মতো সিস্টেমেটিক ছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল বরং এ কারণে যে শাসকেরা উৎপাদনব্যবস্থা, কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ও ক্ষমতার আন্তসম্পর্কের বিষয়গুলো আরও বেশি নিয়ন্ত্রিত, বেশি যৌক্তিক, বেশি কম খরচে সারার পথ বের করে ফেলতে পেরেছিলেন। লন্ডনের এই তিন পুলিশ (না, তিন না, দুই; মার্ক নামের তালু-পেষা পুলিশটা তার দুই সহকর্মীর বকা খেয়ে সম্ভবত মন খারাপ করে চলে গেছে কোথায়ও একটা সিস্টেমের অংশ, সেই সিস্টেমকে গোড়ায় গিয়ে চালায় ইংল্যান্ডের উৎপাদনব্যবস্থা, আবার একটা কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক সব সময় সচল রাখে লন্ডনের পুলিশ ও নাগরিকের প্রতি মুহূর্তের আন্তসম্পর্ককে এবং সেই আন্তসম্পর্কের ভিত্তিমূলে থাকে পুলিশের ডমিনেশন আর নাগরিকদের ডমিনেটেড হতে রাজি থাকার আজ্ঞানুবর্তিতা—এ রকমই কিছু, আলথুসার বলেছেন, এ রকম একটা কারণেই আমরা তিনজন আজ শুরুতে ওভাবে লাফাচ্ছিলাম উঁচু আইজ্যাকের মুখ বা কানের কাছে, ‘আমাদেরকে ছেড়ে দিন’ আরজিটুকু পেশ করার জন্য, আর এ রকম একটা কারণেই ওরা তিনজন তখন ওভাবে নিবিষ্ট মনে অন্যের ফোন ঘাঁটতে পারছিল যখন কিনা আমি ‘বসার চেয়ার নেই’ বলামাত্র এই তারাই আবার আমাকে মুখের ওপর বলে দিতে পারল যে, তাহলে দাঁড়িয়েই থাকো। এর ভেতরে ওদের বেতনের কথা আছে, সেই বেতনের ভেতরে আবার ইংল্যান্ডের নাগরিকদের সুষ্ঠুভাবে ট্যাক্স দেওয়া বা না দেওয়ার সত্যটাও আছে। অতএব তারা জানে এই ধরনের উৎপাদনব্যবস্থায়, জনগণের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলা বেতন ব্যবস্থায় সেবা তোমাকে দিতেই হবে, কিন্তু সেই সঙ্গে শাসনও করে যেতে হবে মিষ্টিমুখে, আর সে কারণেই পুলিশের ঘরটা বানাতে হবে এমনভাবে, যেন তাতে একটা চেয়ার কম থাকে সব সময়।

পুলিশ স্টেশনের ভেতরের এই যে অভ্যন্তরীণ জীবন, আর যেসব অঙ্ক কষা নিয়মকানুন বা প্রথা চালায় থানার এই জীবনটাকে, তার সঙ্গে কী সম্পর্কে বাধা পড়ে যায় থানায় আমার মতো বেড়াতে আসা মানুষগুলো—যে যার নির্দিষ্ট কারণ ও কাজে এখানে আসে তারা, যে যার জন্য নির্দিষ্ট পুলিশ অফিসারের কাছেই আসে তারা, হয় স্বেচ্ছায়, না হয় ধরা খেয়ে—তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে, আলথুসারের ফর মার্ক্স বইটা থেকে কোনো কোনো জায়গা এলোমেলো মনে করতে করতে (বলা হয়ে থাকে, আলথুসার এই বিখ্যাত বই লিখেছিলেন মার্ক্সের ক্যাপিটাল পুরো না পড়েই) আমি, আমার শ্যালিকা ও তার স্বামীসহ, শেষমেশ এসে দাঁড়ালাম বাইরের মুক্ত বাতাসে।

.

অক্সফোর্ড স্ট্রিট। আমি জানি আমার হাতের বাঁয়ে সোজা চলে গেলে হাজার ট্যুরিস্টে ভরা মস ব্রাদারস, ইউনিক্লো, পুল অ্যান্ড বেয়ার, সোয়ারভস্কি দোকানগুলোর শেষে, ওয়াফলমেইস্টার নামের খাবার দোকানটার পরে বন্ড স্ট্রিট স্টেশন এবং তারপরে আর একটু আগালে রাস্তার ওপারের ফরএভার টোয়েন্টি ওয়ান কাপড়ের দোকান ও এপারের অ্যাডিডাস-জারা-প্রাইমার্কের শেষে মার্বেল আর্চ, আর সেখানেই হাইড পার্কে আছে সেই পাতায় পাতায় শেষ বিকেলের ওষ্ঠরাগ মাখা, আগুন ধরা গাছগুলো। আমি ওদেরকে বললাম, ‘তাড়াতাড়ি চলো, সোজা বাঁয়ে চলো।’

কিন্তু না। রাস্তায় উঠতেই সব চলা বন্ধ হয়ে গেল আমাদের। স্টেশনের ঠিক বাঁয়ে অক্সফোর্ড স্ট্রিট ও রিজেন্ট স্ট্রিটের বিশাল মোড়টায় – অক্সফোর্ড সার্কাসে – কমপক্ষে তিন-চার শ মানুষ দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে একটা মঞ্চ ঘিরে। মঞ্চ না, একটা গোলাপি রং নৌকা, আধুনিক স্পিডবোটের মতো দেখতে বিশাল এক বোট, যার গায়ে কালো রঙে বড় করে লেখা TELL THE TRUTH। ওই বোটে দেখা যাচ্ছে চড়ানো বিরাট সব সাউন্ড সিস্টেম, স্পিকার, আর বোটটার মাঝখান থেকে একটা স্টিল রং দণ্ড, এ ক্ষেত্রে মাস্তুল, উঠে গেছে আকাশের দিকে এবং সেই মাস্তুল থেকে বোটের বিভিন্ন দিকে নেমে গেছে ছ-সাতটা দড়ি, যেগুলোতে আবার ‘এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন’-এর লোগো আঁকা, কীটপতঙ্গ, পাখির ছবি আঁকা নানা পতাকা-টতাকা টানানো। আমি সামনে এগোলাম।

ফারজানা আমাকে অত ভেতর দিকে না গিয়ে এখানে থেকেই, বাইরের বৃত্ত থেকেই, ট্যুরিস্টের ধরনে বিষয়টা দেখে যেতে বলল। বলল, ‘বি আ ট্যুরিস্ট, অ্যাক্ট জাস্ট লাইক আ ট্যুরিস্ট, ডোন্ট বিহেভ লাইক ওয়ান অব দেয়ার মেম্বারস, ভাইয়া। মনে নেই ওই পুলিশটা বলল, হাজারের ওপরে অ্যারেস্ট হয়ে গেছে?’

কিন্তু না, আমি তার কথা শুনলাম না। ফারজানা ও জোসেফকে রিজেন্ট স্ট্রিটের ওপরে সম্ভবত আট বা নয় নম্বর দর্শকের বৃত্তটায় ফেলে রেখে, আমি হাইড পার্কে সন্ধ্যা ও হারলি স্ট্রিটে আলথুসারের স্লিপওয়াকিংয়ের বাসা দেখবার স্বপ্নকে ঝেড়ে ফেলে সাত বা ছয় নম্বর মানুষের বৃত্তটায় ঢুকলাম, তারপর আবার ভিড়ের মধ্যে সাবধানে পথ করে নিয়ে ছয় বা পাঁচ নম্বর মানুষের বৃত্ত, তারপর আবার কনুই দিয়ে গুঁতো দিয়ে, হাত দিয়ে মানুষ সরিয়ে পাঁচ বা চার নম্বর মানুষের বৃত্ত—এভাবেই, এভাবেই অবশেষে একসময় আমার সামনে স্রেফ পিংক বোটটা, আর সেটা ঘিরে শুয়ে থাকা, বসে থাকা, গল্প করতে থাকা, গান গাইতে থাকা, গিটার বাজাতে থাকা, কলা খেতে থাকা, বিয়ার পান করতে থাকা মোটামুটি শ খানেক ‘এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন’-এর সবচেয়ে হার্ডকোর কর্মীদল। এবার?

এবার গানের উৎস তাহলে খুঁজে পাওয়া গেল। একটা মেয়ে গিটার বাজাচ্ছে ও গান গাইছে। গানের মূল লাইন : Cancel on me। সুরটা সুন্দর। বাকি কথাগুলো বোঝা যাচ্ছে না, বারবার শুধু কানে আসছে এটুকুই যে, Cancel on me, Cancel on me। আমি পাশে একটা ছাত্রমতো তরুণ ছেলে পেয়ে গেলাম। তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলাম, বললাম যে আমি ট্যুরিস্ট, বাংলাদেশ থেকে এসেছি। সে ‘বাংলাদেশ’ শুনেই বলল, ‘আমি রোনাল্ড। তুমি যদি বাংলাদেশের হও, তবে তোমার তো অবশ্যকর্তব্য আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া।’

রোনাল্ডের বান্ধবী মেগান, সে-ও হ্যান্ডশেক করল আমার সঙ্গে। রোনাল্ড মেগানকে বলল, ‘হি ইজ ফ্রম বাংলাদেশ, হোয়ার ফ্রম উই গেট অল আওয়ার প্রিটি ট্রাউজার্স, টি-শার্টস। হা হা।’

মেগানের মাথায় একটা লাল ব্যান্ড, তাতে লেখা ‘TELL THE TRUTH’, ঠিক যেমন সেটা লেখা ওই পিংক বোটের গায়ে। মেগানের মুখটা অনেক ভরাট, দেখতে তবু সে যথেষ্ট সুন্দর, একেবারে তেরো-চৌদ্দ বছরের শিশুদের মতো। মেগানই বলল আমাকে রোনাল্ড যা বলতে চেয়েছিল। ‘তোমাদের বাংলাদেশ তো কয়েক বছরের মধ্যেই পানিতে ডুবে যাবে। মেরুতে বরফ গলছে, সমুদ্রের পানি বাড়ছে। তোমরা তো আছ আরও ভয়াবহ বিপদের মাঝখানে।’

আমি রোনাল্ড ও মেগান দুজনকেই একসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম, এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন” কী? আমাকে সংক্ষেপে বলতে পারবে?’

আমরা ওখানেই দাঁড়ানো। আমাদের চারপাশে অসংখ্য মানুষের অসম্ভব আওয়াজ। আমি শুধু ওই মেয়েটাকে গান গাইতে দেখেছি আগে, আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখন দেখছি মঞ্চের টটেনহ্যাম কোর্ট রোডের দিকটাতে একজন আবৃত্তি করছে কবিতা, রিজেন্ট স্ট্রিটের দিকে মুখ করে আরও একজন গাইছে বিটলসের ‘ইমাজিন’ গান, আর একটু আগের ‘ Cancel on me’ গাওয়া সেই মেয়ে এবার জ্বালাময়ী এক বক্তৃতা রাখছে ভিড়ের উদ্দেশে। আমি রোনাল্ড ও মেগানকে বললাম যে, তোমরা থামো, আগে আমি মেয়েটার কথা শুনি, দাঁড়াও। মেয়েটা তাদের নেত্রী হয়, মানে এই অর্গানাইজেশনের ওপরের দিকের একজন। মেগান আমাকে বলল, ‘ওর নাম জেসি। ওর নিজের ব্যান্ড আছে, নাম “সেক্সপিরিয়েন্স থ্রি”‘। জেসির ভাষণে আমি শুনলাম এই কথাগুলো : ‘This is a period of abrupt climate breakdown. We are in the midst of mass extinction. Hey crowd, don’t ignore the current environmental situation. Hey crowd, don’t you belive we are going to experience’ —এক্সপেরিয়েন্স কথাটা সে বলল এক্সও পিরি ও য়েন্স এভাবে তিন ভাগ করে করে—’an unprecedented level of disruption within our lifetimes? ‘

এ রকম। অনেক হইচই হচ্ছে এবার জেসির কথার প্রত্যুত্তরে। দর্শকের দিক থেকে চিৎকার উঠছে : ‘পি পল’, ‘পি পল’। তারা ছন্দের মতো করে পিপল শব্দটা দুভাগে ভাগ করে নিয়েছে। এর ফলে শব্দটায় একটা তরঙ্গ উঠছে, আর এ প্রথম বৃত্ত ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের, গোয়েন্দা সংস্থার, স্ট্রাইক ফোর্সের মানুষগুলোর মধ্যে এই বোধ তখন স্পষ্ট জাগছে যে এরা পিপলকে গভর্নমেন্টের ও এস্টাবলিশমেন্টের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে, ওখানে যারা যারা কাজ করে, তারা ওদের এই পিপলের অংশ না। চারজন মহিলা পুলিশ এবার জেসিকে ঘিরে ধরল, তার কানে কানে তারা কী যেন বলছে। জেসির মুখে যে চুয়িংগাম ছিল, তা আমি আগে অনুমান করতে পারিনি। জেসি তার মুখের চুয়িংগামে ফুঁ দিয়ে মুখের ওপরেই একটা বড় বল বানিয়ে এবার তেড়ে গেল ওই মহিলা পুলিশগুলোর দিকে। দর্শকেরা হাসছে তা দেখে এবং হাসতে হাসতেই তারা স্লোগান ধরল এইবার। একজন বেঁটেমতো লোক মুখে থুতুভরা উচ্চারণে হ্যান্ডফোনে বলল : ‘Time for denial’। আর সঙ্গে সঙ্গে পুরো তিন-চার শ লোকের ভিড়ের একটা বড় অংশ উত্তর করল : ‘over, over’। আবার ‘Time for denial’, আবার পর মুহূর্তে ‘over, over’, যেমন করে আমাদের দেশের মিছিলে বলা হয়, ‘শহীদের রক্ত’, তারপর বাকি সবাই বলে, ‘বৃথা যেতে দেব না’, কিংবা ‘জ্বালো রে জ্বালো’, তারপর ‘আগুন জ্বালো।’

এই মিনিট পাঁচেকের হইচইয়ের পরে সব কিছুটা আবার শান্ত। দেখলাম মেগান এখন রোনাল্ডের কোমর তার দুহাতে বেড় দিয়ে ধরে আছে। আমি দেখছি মেগানের বুক পিষে গেছে রোনাল্ডের পিঠে এবং সম্ভবত, সম্ভবত মেগান তার বুক ঘষছে ওই পিঠে, কিংবা অতি সংগোপনে রোনাল্ড তার পিঠ ঘষছে মেগানের বুকে। আমি মেগানকে বললাম, ‘বলো।’

ওরা দুজন আমাকে বোঝানোটা তাদের অর্গানাইজেশনের তরফ থেকে ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছে যেন। ওরা সিরিয়াসলি আমাকে বোঝাচ্ছে, ধাপে ধাপে বোঝাচ্ছে যে, তাদের মূল নেতার নাম গেইল ব্র্যাডরুক, চাইলে আমি ইউটিউবে তার অসংখ্য সাক্ষাৎকার দেখতে পারি। তো, ব্র্যাডরুক যেই দেখল ১৫ এপ্রিল তারিখে প্যারিসের নটর ডেম ক্যাথেড্রালে আগুন লাগার পর চোখের নিমেষে প্রায় ১ বিলিয়ন ইউরোর তহবিল জোগাড় হয়ে গেল নটর ডেমকে বাঁচাতে, নটর ডেমের পুনর্নির্মাণের কাজে, সেই সে বুঝল এবার মাঠে নামতেই হবে। ‘তোমরা নটর ডেম বাঁচাবা কারণ সেটা একটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, আর চার্চের হাতে টাকা আছে, পাওয়ার আছে, কিন্তু সেই তোমরা পৃথিবী বাঁচাবা না, মাই ফুট’, বলল মেগান।

রোনাল্ড আমাকে বোঝাতে লাগল যে, নটর ডেম বাঁচানো নিয়ে তার কোনো আপত্তি নেই, নটর ডেমের বিরাট কালচারাল ভ্যালু আছে এই সভ্যতার জন্য, কিন্তু ‘মেগান বলতে চাইছে যে, মিজ ব্র্যাডরুক ধাক্কা খেল এত দ্রুত নটর ডেমের জন্য এত বিশাল পরিমাণ টাকা উঠতে দেখে। তাই আমরা সোজা অক্সফোর্ড স্ট্রিটে চলে এলাম। এখানে অ্যাডিডাস-নাইকি মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার-গুচি- শ্যানেল সেলফরিজেসের মতো বড় বড় ব্র্যান্ডরা দোকান খুলে বসেছে, কাঁড়ি কাঁড়ি কামাচ্ছে। তোমার দরকার নেই, তোমার দরকার নেই তবু তুমি’-আমাকেই আঙুল দিয়ে দেখাল রোনাল্ড—’দশটার পরে এগারো নম্বর টি- শার্টটাও কিনছ ওই জারা, মাসিমো দুতি আর মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার থেকে এবং এগুলোর উৎপাদনের পেছনে ধ্বংস করছ পরিবেশ, গাছ কাটছ, মাটির উর্বরতা কমাচ্ছ তুলা চাষ করে, গাছ কাটছ তোমাদের প্যাকেট, কার্টন, গিফট প্যাক বানাতে, আর ওদিকে শ্রমের মূল্য ন্যূনতমটুকু না দিয়ে গরিব বাংলাদেশ থেকে, হ্যাঁ তোমাদের বাংলাদেশ থেকে বানিয়ে নিয়ে আসছ সেই সব টি-শার্ট, সেই সব লঞ্জারি, ট্রাউজার, পুলওভার, মাথার ক্যাপ। নাহ্। আর না। তাই আমরা রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিয়ে বললাম, তোমাদের ব্যবসা বন্ধ। আগে পৃথিবী বাঁচানোর যুদ্ধে নটর ডেম বাঁচানোর মতো করে টাকা ঢালো, অনুদান দাও, তবেই আমরা রাস্তা ছাড়ব।’

রোনাল্ডের কথার মধ্যেই আমি মুরগির ক-ক-ক আওয়াজ পেলাম। এই ইকো-ওয়ারিয়রদের (নিজেদেরকে সেটাই বলে তারা – পরিবেশ-যোদ্ধা) একজন তার দুই হাতে দুটো বড় মুরগি (বা মোরগ) নিয়ে প্রথম বৃত্তে এসে বসেছে, সে বারবার চুমু দিচ্ছে একটা মুরগির ঠোঁটে। আমি দেখলাম হঠাৎ তার বাম হাতের মুরগিটা তাকে একটা ঠোকর দিয়ে বসল, তার কপালে। অনেক হাসি উঠল চারপাশে এবং যেই সে তার ডান হাত দিয়ে ঠোকর খাওয়া জায়গা মালিশ করতে গেল, অমনি তার হাত থেকে ছুটে গেল অন্য মুরগিটা। বেশ খানিক হইহই শব্দ হলো ওই দিকে। আমার খুব ইচ্ছা হলো আমিই সবচেয়ে জোরে ছুটে যাব ওটা ধরতে। আহা, কী মজাই না হবে তাহলে। গেলামও আমি সে পথে এক পা, কিন্তু একদিকে রোনাল্ড আমাকে বলল, ‘ডোন্ট বদার’, অন্যদিকে আমি দেখলাম যে পথে আমি যেতে চাইছিলাম, সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে আমার শ্যালিকা ও তার স্বামী। আমার শ্যালিকার চেহারায় আগুন, সে মহাবিরক্ত আমার আচরণে। তার ওই চোখ গরমের মধ্যেই মুরগি ধরার দৌড়ে অংশ নেওয়ার আশা প্রত্যাহার করে আমি শুনতে লাগলাম মেগানের কথা, আবার।

‘তো, আওয়ারস ইজ আ মুভমেন্ট ফুয়েলড বাই লাভ। আমরা অহিংস। গতকাল শেল করপোরেশনের বিল্ডিংয়ের কাচ ভাঙা হয়ে গেছে দুর্ঘটনাবশত। অন্যরা আমাদেরকে বিপদে ফেলার জন্যও করে থাকতে পারে ওই কাজ। তো, একদিকে এটা যেমন ফুয়েলড বাই লাভ, অন্যদিকে এটা ফুয়েলড বাই ফিয়ারও। কিসের ফিয়ার জানো?’

খেয়াল করলাম মেগানের হাত ভেজা ভেজা। কেন? তার হাতও কি আবেগে কাঁদছে এটা ভেবে যে আমরাই নৌকা, আমরা ‘এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন’-এর কর্মীরাই পৃথিবীর

আমি বললাম, ‘জানি না। কিসের ফিয়ার? কিসের মানুষকে বাঁচাব ভয়াবহ দুর্বিপাক থেকে, যেমনভাবে নুহের ভয়?’

মেগান রোনাল্ডের হাত চেপে ধরল। তার ভয় লাগছে কথাটা আমাকে বলতে। রোনাল্ড বলল, ‘যা সত্য তা বলো। ভয় পেয়ো না। বলো।’

মেগান বলল, ‘আমার বলতে সত্যি ভয় লাগছে।’

রোনাল্ড তখন বলল, ‘ওর, আমার, আমাদের ফিয়ার এটাই যে, আমরা যদি কিছুই এখন না করি তাহলে, তাহলে প্রতিদিন যে পরিমাণ কার্বন এমিশন হচ্ছে, প্রতিদিন যেভাবে ওজন লেয়ার ফুটো হচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে পৃথিবী আর মাত্র বারো বছর টিকবে। মাত্র বারো বছর। টুয়েলভ ইয়ারস অ্যান্ড নো মোর।’

ভালোই দৃঢ়তা রোনাল্ডের কণ্ঠস্বরে, এতখানিই যে আমি তাকে বিশ্বাস করতে চাইলাম। বললাম, ‘সত্যি? মাত্র বারো বছর?’

মেগান বলল, ‘সে কারণেই তো আমাদের বোটে লেখা’—পিংক বোটটাকে আঙুল দিয়ে দেখাল সে— ‘ TELL THE TRUTH। ট্রুথ ইজ, কিছু কোরো না, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গী হয়ে পরিবেশগত হুমকিকে অগ্রাহ্য করে বসে থাকো, প্যারিস অ্যাকর্ড থেকে সে যেমন আমেরিকাকে সরিয়ে নিয়েছে, তেমন তুমিও সব পরিবেশবাদী আন্দোলন- আলোচনা- কার্যক্রম ও অ্যাকশন থেকে নিজেকে সরিয়ে নাও, তারপর দ্যাখো এই পৃথিবী আর কত দিন টেকে? মাত্র টুয়েলভ ইয়ারস। এটা আমি বলছি না। বলছে বিজ্ঞানীরা। তাদেরকে তো বিশ্বাস করবে, নাকি?’

আমি ওদের কাছে জানতে চাইলাম বোটটার মানে, অর্থাৎ এই পিংক নৌকার প্রতীকী তাৎপর্য।

রোনাল্ড বলল যে ওই বোটের অর্থ দুটো। ‘ওটার নাম বেরতা কাসারেস, মানে ওই বোটটার নাম বেরতা কাসারেস। হন্ডুরান পরিবেশকর্মী যে বেরতা কাসেরেস খুন হলো, তার স্মৃতিকে সম্মান করে আমাদের অর্গানাইজিং কমিটি ওটার ওই নাম রেখেছে। আর দ্বিতীয় অর্থ হলো, ওটা নুহের নৌকা। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে যদি তুমি এখনই ঘুমের থেকে না জাগো, আর তখন সবদিকে পানি বাড়লে ওই নুহের নৌকায় উঠেই তোমাকে বাঁচতে হবে। কিন্তু ওই নৌকায় তখন তুমি জায়গা পাবা না, এত ভিড় থাকবে যে তখন তোমার এখনকার কাজকর্ম নিয়ে আফসোস করতে করতে নৌকার পাশের পানিতে ডুবে মরা ছাড়া অন্য কোনো গতি থাকবে না।’

তার কথা শেষও হয়নি, পিংক বোটটার ওপরে মাথায় নেভাল ক্যাপ ও গায়ে সমুদ্র নাবিকের পোশাক পরাযে পোশাকের ওপরে আবার এক রাজকীয় শাল চড়ানো— এক তরুণ উঠে দাঁড়িয়ে ভেঁপু বাজাল একটা, ভোঁ-ও- ও-ও, যেমন করে ডাকে আমাদের কাপ্তাইয়ের বন্দরে দাঁড়ানো জাহাজগুলো। ঠিক তখনই রিজেন্ট স্ট্রিটের মোড়ে ‘TEZENIS’ বিল্ডিংটার সামনে থেকে প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোকের চিৎকার উঠল। তারা ভেঁপুর উদ্দেশে স্যালুট দিচ্ছে ও চিল্লিয়ে বলছে : ‘WE ARE THE BOAT WE ARE THE BOAT”।

মেগান এবার আমার হাত ধরেছে। ‘উই আর দ্য বোট’ কথাটার গূঢ় মহিমায় তার চোখ ছলোছলো করছে আবেগে ও অতিরিক্ত তাতচিত্ততার দোলাচল থেকে। আমি নৌকা জীব ও উদ্ভিজ্জগতের প্রতিটা প্রজাতিকে একদিন বাঁচিয়েছিল দূর ইতিহাসের সেই মহাপ্লাবন থেকে?

ভেঁপু বাজানো নাবিক এবার নৌকার মাস্তুল ধরে বসেছে। একবার ধরল সে মাস্তুলটা হাতে বেড় দিয়ে, একটু পরে ছেড়ে দিল, আর এবার পৃথিবীর আকাশের উদ্দেশে তাকিয়ে একটা বড় স্যালুট ঠুকল তুলো তুলো সাদা মেঘেদের প্রতি। সাউন্ড সিস্টেমে তার সেই স্যালুটের পা ঠোকার প্রচণ্ড আওয়াজ শোনা গেল : ঠাক। এবং সেই সঙ্গে অজস্র মানুষ স্লোগান উচ্চারণের কাব্যভঙ্গিমায় চিৎকার করে উঠল, ‘POWER TO THE PEOPLE’, ‘POWER TO THE PEOPLE’।

আমি ওখান থেকে বেরোবার জন্য প্রস্তুতি নিলাম, কারণ ফারজানা এবার থেমে থেমে আমাকে এক হাত ধরে টানছে। সে বুঝতে পারছে কোথায় কীভাবে যেন পরিস্থিতি গরম হয়ে উঠছে এবং এই ভিনদেশের বৈরী পরিবেশে সে তার বোনের স্বামীকে ‘রেবেল রাউজার’ হিসেবে পুলিশের কাছে চিহ্নিত হতে দিতে চায় না। কিন্তু আমাকে আটকাল মেগান। সে ফারজানাকে জিজ্ঞেস করল, ‘হোয়াটস ইওর নেইম, লেডি?’ ফারজানা বলল, ‘ফারজানা’। মেগান বলল, ‘থ্যাংক ইউ, ফারজানা। বাট দিস ইজ ইমপরট্যান্ট। দিস। দিস’ – হাতের আঙুল ঘুরিয়ে চারপাশের তিন-চার শ লোককে দেখাতে দেখাতে বলল সে—’দিস ইজ ড্যাম ইমপরট্যান্ট।’

আমি রোনাল্ডকে বললাম, ‘সরি, আমাকে যেতেই হবে।’

রোনাল্ড জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন?’

মেগান জিজ্ঞাসা করল, ‘হোয়াই ডু ইউ হ্যাভ টু লিভ? হোয়াই? উই মে নট গ্র্যাব হেডলাইনস অল ওভার দ্য ওয়ার্ল্ড, বাট উই হ্যাভ স্টার্টেড দ্য প্রসেস দ্যাটস চেঞ্জিং দ্য ওয়ার্ল্ড। এ রকম অবস্থায় কেন চলে যেতে চাইছ, তা-ও তুমি যে কিনা বাংলাদেশের ছেলে, আর যে বাংলাদেশ কিনা আছে পরিবেশ বিপর্যয়ে এক্সটিংকট হয়ে যাওয়ার, বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাজনক দেশগুলোর তালিকার একদম ওপরের দিকে?’

আমি বললাম, ‘আমার যথেষ্ট সম্মান আছে তোমাদের এই ক্লাইমেট ও ইকোলজিক্যাল ক্রাইসিস নিয়ে করা আন্দোলনের প্রতি। আমি গাছ প্রচণ্ড ভালোবাসি, আমার মোবাইল ফোনে গত চার দিনে প্রায় আঠারো শ গাছের ছবি তুলেছি আমি।’

ফারজানা চিৎকার করে উঠল, ‘নো।’

ওরা কেউই বুঝল না কী হলো। ফারজানা ভয় পেয়েছে যে আমি যদি ওই গাছগুলোর ছবি ওদের দেখাই, তাহলে ওরা বুঝি আমাকে সোজা ওই মূল মঞ্চে দাঁড়া করিয়ে দেবে, আর তখন দূর থেকে আইজ্যাক, মার্ক ও রাইসিংগার সে দৃশ্য দেখে ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ড ধরে ঠিক করে রাখবে যে আমাকে কখন অ্যারেস্ট করতে হবে। জোসেফ বলল, ‘ভাইয়া চলেন। চলেন তো।’

আমি রোনাল্ড ও মেগানকে বললাম, ‘আমাকে যেতেই হবে, আমি লুই আলথুসারের বাড়ির খোঁজে যাব।’

‘কে লুই আলথুসার?’ মেগান জিজ্ঞাসা করল।

‘ফ্রেঞ্চ মার্ক্সিস্ট ফিলসফার, দেরিদা-ফুকোর শিক্ষক। তিনি লন্ডনে এলে এখানকারই একটা বাড়িতে থাকতেন।’ বললাম আমি।

রোনাল্ড বলল, ‘আমি আলথুসারের কথা শুনিনি, কিন্তু ফুকোর নাম শুনেছি। আর একটা কী বললে, দেরিদা? জাক দেরিদা? তার বন্ধু নোয়াম চমস্কির ভাষণ পড়ে শোনানো হবে একটু পরেই। তো, তাহলে তুমি তো আমাদের লোক।’

মেগান কার কার কানে যেন এরই মধ্যে কী বলে ফেলেছে, দেখলাম একজন মেগাফোনে চিৎকার তুলে জনতার উদ্দেশে জিজ্ঞাসা করছে, ‘ডাজ এনিবডি নো লুই আলথুসার, ফ্রেঞ্চ ফিলসফার? উই হ্যাভ আ ফ্রেন্ড হিয়ার ফ্রম বাংলাদেশ।’

এই ঘোষণা মোট তিনবার হলো শুনলাম। কেউ শুনল সেটা, কেউ শুনল না। রোনাল্ড আমাকে অনুরোধ জানাল আমি যেন এখন না যাই, কারণ এখনই মার্বেল আর্চের দিক থেকে বড় সাম্বা ব্যান্ডটা আসবে, নাম রেড ব্রিগেড, তখন অনেক মজা হবে। আমার নাকে প্রচণ্ড গাঁজার গন্ধ ভেসে এল ঠিক এ সময়টায় এবং সেই সঙ্গে লাতিন আমেরিকান- বলিভিয়ান কলম্বিয়ান চেহারার এক মানুষ, বয়স তার পঞ্চাশের শেষ দিকে, এসে হাজির হলেন আমাদের মাঝখানে। সঙ্গে তার দুই সঙ্গী, তাদের চেহারাও বেশ খানিকটা হিস্পানিক।

‘দিস ইজ লুই স্যামুয়েল। হু ওয়ান্টস টু নো অ্যাবাউট লুই আলথুসার হিয়ার?’ রোনাল্ডকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি। রোনাল্ড আমাকে দেখিয়ে দিল। আমরা হ্যান্ডশেক করলাম, করতে করতে আমি জানলাম যে তার নামের লুই ও আলথুসারের নামের লুইয়ের মধ্যে কোনো সম্বন্ধ নেই।

‘তো মাই ফ্রেন্ড, আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি দ্যাট ইউ গাইজ স্টাডি আলথুসার ইন বাংলাদেশ। দ্যাটস আ গুড সাইন, দোউ আলথুসার ইজ ওভার, আলথুসার ইজ ডেড।’

আমি অবাক হলাম তার কথা শুনে। ‘আলথুসার ইজ ওভার?’ কোথায় ওভার? বলে কী এই লোক? কিছু একটা উত্তর দিতে চাইলাম আমি, কিন্তু আমাকে আর ভাবতে বা বলতে না দিয়ে স্যামুয়েল জানালেন তিনি গ্লাসগোর একটা কলেজের প্রফেসর এবং এরা দুজন – ডেনিস ও টিমোথি -তারই আন্ডারে ডক্টরাল থিসিস করছে ‘অন হিস্টরিসিজম অব কার্ল মার্ক্স’স আরগুমেন্টস ইন রিলেশনস টু ডেভিড রিকার্ডো’স কনসেপ্টস অব রেন্ট, প্রফিট অ্যান্ড ইন্টারেস্ট।’ স্যামুয়েল এ কথা বলে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি সাবস্ট্যানস ইউজ করব কি না, অর্থাৎ গাঁজা- টাজা খাব কি না। আমি ফারজানার এখানে উপস্থিতি লক্ষ করে বললাম, ‘না’, এবং ফারজানা ও জোসেফের সঙ্গে স্যামুয়েলকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। স্যামুয়েল আমাদের পুরো গ্রুপটার—সে সহ মোট আমরা আটজন—উদ্দেশে বললেন যে আমাদের উচিত এই বেশি আওয়াজের কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে ওই ফুটপাতে বসা। আমরা তা-ই করলাম। আমি লক্ষ করলাম জোসেফ ও ফারজানা আর এখন আমাকে নিয়ে টানাটানি করছে না। ভালো। তারা বুঝে গেছে যে এই প্রফেসরের সঙ্গে পরিচয়ের পর এখন আমি অন্তত আরও আধা ঘণ্টার জন্য—তিন ঘণ্টা যদি না-ও হয় তো—এখান থেকে নড়ছি না।

ফুটপাতে মেগান আমাকে তার পাশে বসতে বলল আর ফারজানাকে বলল তার কোলে বসতে। এই প্রথম ফারজানা হাসল। আমরা সবাই সেভাবেই বসলাম পাশাপাশি, কেবল রোনাল্ড প্রায় মেগানের গায়ের ওপর গিয়ে বসে পড়েছে, তার মাথা প্রায় মেগানের বুকের ওপরে কিংবা পেটে। স্যামুয়েল, একমাত্র স্যামুয়েল, রাস্তায় দাঁড়ানো, আর ডেনিস ও টিমোথি সার্বিক লক্ষ রাখছে তাদের প্রফেসরের ভালো-মন্দ সবকিছুর দিকে। টিমোথি স্যাক থেকে একটা পানির বোতল বের করে প্রফেসরের হাতে দিয়েছে এবং প্রফেসর সেই বোতল রাস্তার ওপরে রেখে তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বললেন এই কথা, আমার উদ্দেশে: ‘নোয়াম চমস্কি তোমার লুই আলথুসারের বন্ধু ছিলেন। এরা সবাই মার্ক্সিস্ট, যেমন আমি, যেমন তুমিও। তো আমি শুরু করতে চাই চমস্কিকে দিয়ে, যিনি আমাদের আন্দোলনের প্রতি আজ একটা বক্তব্য রেখেছেন, যা একটু পরে ওই পিংক বোট, ওই বেরতা কাসারেস থেকে পড়ে শোনানো হবে বড় মাইক্রোফোন সিস্টেমে। এই যে আমার হাতে চলে এসেছে চমস্কির বক্তব্যের একটা কপি। আমি এটা দিয়েই শুরু করতে চাই। চমস্কি লিখেছেন : “আমরা এখন যে চ্যালেঞ্জ ফেস করছি তার ভয়ংকর অবস্থাটা নিয়ে অত্যুক্তি করা অসম্ভব, কারণ চ্যালেঞ্জ এতই বড়। আমাদের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এটা বোঝা যে এই সংঘবদ্ধ মানবসমাজ এখন যে আকারে আছে, উইদিন দ্য নেক্সট ফিউ ইয়ারস সেই আকারে সে আর টিকে থাকতে পারবে কি না। গত ৬৫ মিলিয়ন বছরে যে হারে জীব ও উদ্ভিজ্জগতের নানা প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে, তার থেকে অনেক অনেক বেশি হারে এখনকার প্রজাতিগুলো ধ্বংস হচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে। বিশাল বিপর্যয় এড়ানোর জন্য আমাদের চলার পথ এখন র‍্যাডিক্যালি পরিবর্তন করা নিয়ে আর দেরি করার কোনো অবকাশ নেই। ‘এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন’ – এর কর্মী বাহিনী এ অবস্থায় আমাদেরকে পথ দেখাচ্ছে এই ইমেন্স চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার, তারা পথ দেখাচ্ছে সাহস ও সততার সঙ্গে। তাদের এই অর্জন ঐতিহাসিক তাৎপর্যে ভরা এক অর্জন, যা নিয়ে আমাদের জরুরি ভিত্তিতে আরও বেশি করে কথা বলতে হবে।’

স্যামুয়েলের শেষ হলে শ্রোতা সাতজনের মধ্যে জোসেফ ও ফারজানা ছাড়া আমরা বাকি পাঁচজন – আমি, মেগান, রোনাল্ড, টিমোথি ও ডেনিস—ইয়া বা ওয়াও বলে একসঙ্গে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। রোনাল্ড মেগানের গালে হালকা একটা চুমু খেল, মেগান তার ঠোঁটটা রোনাল্ডের দিকে বাড়িয়ে দিতে গিয়েও ফিরিয়ে নিল, তারপর তাদের মোটামুটি দু-চার সেকেন্ডের শুধু গালে চুম্বন, যখন কিনা রোনাল্ড ওভাবেই বেকায়দা মেগানের গায়ের ওপরে শুয়ে বসে আছে ওই ফুটপাতে। এভাবেই আমরা সেলিব্রেট করলাম নোয়াম চমস্কির পরবর্তীকালে পৃথিবী বাঁচানোর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এমন বক্তব্যটাকে।

কিন্তু ফারজানা ও জোসেফের একদমই ভালো লাগেনি ব্যাপারটা যে আমি ওই পরিবেশবাদীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওভাবে, একটা বাচ্চা ছেলের মতো, ওয়া বা ইয়া বা ওয়াও বলে চিৎকার দিয়ে উঠেছি। সত্যি বলতে আমার এই এনভায়রনমেন্টাল আন্দোলনগুলোর প্রতি প্রকৃত কোনো ভালোবাসা বা দরদ নেই। কারণ, আমি আসলে সত্যিই জানি না যে পরিবেশবাদীদের উদ্বেগগুলো সত্য কি না। আসলেই কি পৃথিবী ধ্বংস করছি আমরা? পৃথিবী কি এতটাই লিমিটেড রিসোর্সেস দিয়ে ভরা যে হঠাৎ দু-তিন শ বছরের উন্নয়নের চাপে সে শেষ হয়ে যাবে? পৃথিবী এই আকার নিয়েছে ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে, মানে ৪৫০ কোটি বছর, আর জীবের উদ্ভব হওয়ার বয়স ৩৮০ কোটি বছর, আর মানবপ্রজাতি এসেছে, তা-ও ২.৫ মিলিয়ন মানে ২৫ লাখ বছর হয়।

তো, আমি ভাবি, এত দিন লাখ লাখ বছর পৃথিবী চলল ঠিকঠাকমতো, আর এখন মাত্র আড়াই শ বছরের—অর্থাৎ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশনের পর থেকে এ পর্যন্ত যা পৃথিবীর বয়স—চাপে ও তাপে পৃথিবী পুড়ে যাবে, গলে যাবে, ভস্মীভূত হয়ে যাবে, বাসযোগ্য থাকবে না পরের প্রজন্মের জন্য? তা-ও যে পৃথিবী এত সবুজ এবং এখনো যার মোট আয়তনের মাত্র, খুব বেশি হলে মাত্র ২.৭ শতাংশ শহর আর বাকি ৯৭.৩ শতাংশ গ্রাম, মানে সবুজ, মানে ঘাস, গাছ, প্রান্তর, তৃণভূমি, পুকুর, জলাশয়, যাতে চরে ঘুরে বেড়াচ্ছে রাজহাঁসের দল ও কানিবকের পরিবার?

র‍্যাডিক্যাল এনভায়রনমেন্টালিস্টদের দল আছে (তাদের আবার আছে যার যার মতো আলাদা আলাদা বায়োস্ফিয়ার এবং পৃথিবীর ক্ষয়ের তত্ত্ব, ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স ও সব প্রাণ ও উদ্ভিদের মধ্যেকার সিমবায়োসিস তত্ত্ব) যেমন গ্রিন অ্যানার্কিস্টস, অ্যানিমেল লিবারেশনালিস্টস, বায়োরিজিয়নালিস্টস, ডিপ ইকোলজিস্টস, ইকোসাইকোলজিস্টস, ইকোফেমিনিস্টস, অ্যান্টি-গ্লোবালাইজেশনিস্টস, আর্থ লিবারেশনিস্টস, নিও-প্যাগানস, থার্ড পজিশনিস্টস, আর্থ লিবারেশন ফ্রন্ট (ইএলএফ), আর্থ লিবারেশন আর্মি (ইএলএ), আর্থ ফার্স্ট! এনভায়রনমেন্টাল লাইফ ফোর্স, গ্রিনপিস, এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন ইত্যাদি ইত্যাদি, এদের কথাবার্তা আজকাল প্রায়ই ছাপা হয় এখানে-ওখানে, পত্রিকায়, ইন্টারনেটে। তার দু-একটা আমি পড়ি এবং আমার মাথা ঘোরে। কারণ পৃথিবীর জন্য, এর জীববৈচিত্র্যের জন্য এবং এর টিকে থাকার জন্য অসম্ভব মায়াভরা সেসব কথাবার্তার মধ্যে আমি—আলথুসারের প্রতি মোহ থেকেই কি না জানি না—দেখি ইকো-ফ্যাসিজম—একধরনের রাজনৈতিক টোটালিটারিয়ান বিশ্বাস যে, সরকারগুলোকে প্রকৃতির অর্গানিক পূর্ণাঙ্গতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই কাজ করতে হবে। কিন্তু ব্যাপারটা শুধু তা-ই না, যেভাবে ইকো-ওয়ারিয়ররা তাদের বিশ্বাসটা প্রকাশ করে, কখনো র‍্যাঞ্চ জ্বালিয়ে, কখনো ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংকচুয়ারি পুড়িয়ে কিংবা কখনো ফ্যাক্টরি মিল-কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য করে, তার মধ্যে বিরাট একটা মিলিটারস্টিক চেতনা লক্ষ করা যায়, তার মধ্যে উন্নত বিশ্বের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্লান্তি থেকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর উন্নয়নকে দেখার ও ব্যাহত করার একটা আধিপত্যবাদী ভাবও থাকে।

আমি যেদিন প্রথম জানলাম, গ্রিনপিসের লোকেরা পেরুর নাজকা লাইনের হামিংবার্ডটার ওপরে দাঁড়িয়ে মাটি ফুটো করে তাদের ব্যানার টাঙানোর চেষ্টা করেছে এবং কখনোই আর প্রতিকার-অসম্ভব এক ক্ষতি করে ফেলেছে আধিভৌতিক ওই নাজকা লাইনের এবং সেটা তারা করতে পেরেছে, করতে সাহস পেয়েছে কারণ জায়গাটা পেরু, তৃতীয় বিশ্বের একটা গরিব দেশ (যদিও তারা পরে ক্ষমা চেয়েছিল পেরুর সরকারের কাছে), ওই আমার মনে হলো এরা সম্ভবত ক্ষমতাশালী দেশের প্রতিনিধিত্বকারী কিছু সোশ্যাল রিঅ্যাকশনারি এবং সম্ভবত ছদ্মবেশী রেসিস্ট, যারা পরিবেশকে ব্যবহার করছে তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা সামনে এগিয়ে নিতে, যেভাবে প্রকৃতিবিদেরা, সংঘবাদীরা, সোশ্যাল র‍্যাডিক্যালরা, এমনকি ফেমিনিস্টরাও ইকোলজি শব্দটাকে ব্যবহার করে চলেছে তাদের নানা কাজে। এ রকমই এক ক্রুড পরিবেশবাদী ব্রুটালিজম থেকেই একদিন হিটলার জনসংখ্যার জাতিগত মিশ্রণ নিয়ন্ত্রণের নামে তার রক্ত ও মাটির তত্ত্ব খাড়া করেছিলেন।

আর পত্রিকায় পড়ি, এখনকার গ্রিনপিসের মতো প্রতিষ্ঠান নরওয়ের তিমি শিকারের বিরুদ্ধে কী ভয়াবহ আন্দোলনে নামে, কারণ তাহলে আমেরিকার টাকা পাওয়া যাবে অনুদান হিসেবে। কিন্তু তারাই আবার হাঙর হত্যাবিরোধী আন্দোলনে নামে না কখনো (যদিও পৃথিবীতে হাঙর হত্যা হচ্ছে তিমি হত্যার চেয়ে অনেক বেশি হারে), কারণ আমেরিকা হাঙর পছন্দ করে না বলে হাঙর হত্যাবিরোধী আন্দোলনে কোনো টাকা দেবে না। পরিষ্কার হিসাব।

ডিপ ইকোলজিস্টরা কীভাবে বিশ্বাস করে যে তৃতীয় বিশ্বের মানুষগুলো তাদের ধানখেত ও তালগাছগুলোর মাঝখানে, ওগুলোকে অক্ষুণ্ণ রেখে, না খেয়ে শুয়ে পড়ে থেকে মরেই যাক, তবু ওখানকার প্রকৃতিটা বাঁচুক, আর তারা কীভাবে চায় যে, যেভাবে হোক আমেরিকা বেপরোয়া গরিব লাতিন আমেরিকানগুলোকে বর্ডার পার হওয়া ঠেকাক, কারণ না হলে তারা আমেরিকার পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে দেবে! বিজ্ঞানের শক্তি দিয়ে প্রকৃতির ওপরে প্রভুত্ব করে পৃথিবীকে মানুষের জন্য স্বর্গ বানিয়ে তোলো—এটা যেমন ফ্যাসিবাদী কথা, তেমন মানুষকে কোনো কিছুর ওপরে রেখো না, একটা মানুষ এবং একটা ফড়িংয়ের মূল্য সমান, আজ যদি ফড়িং মারো তো কাল তুমি মানুষও মারবে, আজ যদি মুরগি রান্না করে খাও তো কাল তুমি মানুষও রান্না করে খাবে, এ কথাবার্তাগুলোও তেমনই। ভোগের সংস্কৃতি বদলে দাও, সামর্থ্যের মধ্যে বাস করো, কিংবা দেড় ডিগ্রির বেশি এই গ্রহকে গরম হতে দিয়ো না, না হলে জলবায়ু বিপর্যয় হবে, কিংবা জীববৈচিত্র্যকে যে করে হোক তার সম্পূর্ণ রূপ ও রঙে ধরে রাখো—এসব শুনতে সুন্দরমতো সব কথাবার্তা, কিন্তু ক্লাইমেট, এনার্জি, ফরেস্ট ক্যাম্পেইন, টক্সিক বর্জ্য নিয়ে যারা কাজ করে, তারা যেভাবে তাদের পেশি দেখায়, প্রাকৃতিক শুদ্ধতার তত্ত্ব তুলে ধরে তারা যেভাবে কথা বলে এবং তারপর প্রকৃতির সঙ্গে রিকানেক্টেড হতে তারা যেভাবে সেলফি তুলতে তুলতে জঙ্গলের দিকে দৌড় দেয়, তাতে আমার ভয় হয় যে তারাও দমন-পীড়নমূলক সুখী ও ক্ষমতায় বসা রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ, আর তারা এভাবেই শেষমেশ আমাকে এক গোছা থানকুনিপাতার সমান বানিয়ে ফেলবে একদিন।

এদের কথাবার্তাগুলো অনেক সুন্দর, হয়তো জরুরিও, সন্দেহ নেই। কিন্তু এরাও একটা মতবাদ, যার ফোকাস পলিটিক্যাল ও সোশ্যাল। সামনে সোশ্যাল – সামাজিক পুনর্গঠনের অর্থে—আর পেছনে সুন্দর গোছানো কিন্তু সাদাচোখে বোঝা যায় না এমন ধরনের পলিটিক্যাল। ঠিক যেমন আমাদের স্কুল ব্যবস্থা নিয়ে আলথুসারের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট : স্কুলে ছাত্রদের জ্ঞানার্জন ও সঠিক আচার-ব্যবহার শেখানো হয় একগাদা সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা মারফত, যেমন সিলেবাস, পাঠ্যবই, তার পৃষ্ঠার ও কালির রং, তার প্রচ্ছদগুলো, প্রশ্ন ও উত্তর, সঠিক প্রশ্ন ও তার সঠিক উত্তর ব্যবস্থা, উদ্বুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া, বাধ্যগত ছাত্র হবার জন্য দরখাস্তের শেষে লেখা Yours most obedient | কিন্তু ওটুকুই নয়, আলথুসার বলছেন যে ওগুলোকে ছেয়ে থাকে একরাশি ক্ষমতাপ্রক্রিয়া, যেমন ছাত্রদের ব্যাপারে গোপনে তথ্য সংগ্রহ, তাদেরকে ক্লাসের শেষে আটকে রাখা, পুরস্কার ও শাস্তি, বেতের ভয়, ফেল করানোর ভয় এবং সেরা ছাত্র-খারাপ ছাত্র, ভালো শিক্ষক-খারাপ শিক্ষক, সেরা পিতামাতা-উপেক্ষিত পিতামাতা থেকে নিয়ে একদম প্রিন্সিপাল বা হেডমাস্টার পর্যন্ত স্পষ্ট ওপরমুখো (কিংবা নিচমুখো) সিঁড়ির ধাপের পরে ধাপ।

জোসেফ আমাকে তাড়া দিল ওঠার। সন্ধ্যা নামবে সাড়ে আটটায়। ঘড়িতে দেখলাম পৌনে আটটা বেজে গেছে। এতক্ষণ হয়ে গেল আমরা ডাগেনহ্যামের বাসা থেকে বেরিয়েছি? চার ঘণ্টা? কীভাবে সময় চলে যায়, আর কীভাবে আমি আটকে গেছি মানুষের কুহকবিদ্যায় ভরা বিভিন্ন ঔৎসুক্য ও আস্ফালনের ভেতরে! কোথায় কথা ছিল আমি এখন থাকব হাইড পার্কে বিস্ময়মৌন সন্ধ্যার স্থিরত্বের মাঝখানে আর তার কেন্টাকি ব্লুগ্রাসের ওপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব কীভাবে আকাশে এপ্রিলের তারাগুলো ঝিকমিক করে, যেন মনে হয় যে ওরা ওখান থেকে চলে আসতে চাইছে আমার সত্যসন্ধানে থাকা দুহাতের মুঠোয়, যাতে করে ওরা মুঠোর ছোট আয়তনের মাঝখানে ঝুলে থেকে ছুঁতে পারে একে অন্যকেওরা, নিঃসীম মহাশূন্যের পড়শিরা, যারা সারাটা জীবন, মহাজীবন কাটিয়ে দেয় দূর থেকে একজন আরেকজনকে জ্বলতে দেখে এবং কোনো দিন একে অন্যের ভ্রাতৃসুলভ উত্তাপ অনুভব না করেই।

কিন্তু না। আমি কিনা বসে আছি অক্সফোর্ড স্ট্রিটের ভরা ফুটপাতে, যেখানে পরিবেশবাদীরা বন্ধ করে দিয়েছে সমস্ত গাড়ির চলাচল, আর মানুষ— আন্দোলনকর্মী ও আমার মতো দর্শক মিলে–এমনভাবে ঘেঁষে আছে একজন আরেকজনের সঙ্গে যে, এতটাই ঠাসাঠাসি যে, এই হালকা শীতের সন্ধ্যায়ও আমাদের কারও ঠান্ডা লাগছে না; এবং আমার সঙ্গে আছে পৃথিবী বদলে দেওয়ার যুক্তিযুক্ততায় মাথা ভরা দুই সম্ভবত নেশাখোর বালক-বালিকা ও এক স্কটিশ প্রফেসর যিনি শ্রেণিসংগ্রামের মাঠে কিছু করতে না পেরে এখন নরওয়েজিয়ান তিমিদের সমুদ্রজুড়ে বেঁচেবর্তে থাকার পক্ষে লড়ার ব্রত নিয়েছেন এবং তার দুই ছোকরা ছাত্র যারা জীবনে খুব শিগগির হতাশ হবে তাদের শিক্ষকের স্থূলদর্শিতা ও রং চড়িয়ে সমাজের ক্ষতগুলো নিয়ে কথা বলার অভ্যাসের কারণে।

জোসেফকে আমি বললাম, খুব ক্ষীণ গলায় বললাম, ‘তোমরা বাসায় চলে যাও। ফারজানাকে একটু ম্যানেজ করো।’

ফারজানা শুনে ফেলল আমার কথা। আমার ওপর তার দাবি ও অধিকার অন্য স্তরের, কারণ আমি তার মাত্র তিন বছর বয়সে বড় বোনের স্বামী। সে স্পষ্ট বলে দিল, ‘আপনি থাকেন এখানে। আমরা যাচ্ছি না। আমরা থাকব আশপাশেই। যত্তসব।’

প্রফেসর স্যামুয়েল আমাকে বললেন, ‘তো তুমি আলথুসারে আগ্রহী? কী জানতে চাও, বলো। আমি আলথুসার পড়াতাম একসময়।’

আমি তাকে বললাম, ‘কিছুই জানতে চাই না। ধন্যবাদ।’

স্যামুয়েল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি ক্ষিপ্ত হয়ে আছ কেন? কার ওপরে?’

আমি বললাম, ‘আমার কপালের ওপরে।’

তিনি জানতে চাইলেন, ‘কেন?’

আমি তাকে সংক্ষেপে ট্রেনস্টেশনে তিন পুলিশের আমার আজকের বিকেলটা মাটি করার কথা বললাম।

স্যামুয়েল বললেন, ‘বিকেলটার কী প্রয়োজন ছিল তোমার?’

নির্দিষ্ট কোনো সময়ের কী প্রয়োজন থাকে আমাদের? সময়গুলো মুড়ে থাকে আমাদের কাজের ও ইচ্ছার তালিকা দিয়ে। সময়গুলো কখনো কি স্রেফ সময় হয়ে থাকে? সময়ের আবরণের মাঝ দিয়ে আমাদেরকে অনবরত ডাক দেয় আমাদের কাজগুলো, আমাদের বেঁচে থাকা―হয় আইসক্রিম খেতে চেয়ে, না হয় হিউম্যানিস্ট হিসেবে নিজেকে ভেবে নিয়ে মানুষের এই বিভক্ত-বিশ্বাস বা প্রতিলিপি করা মতবাদগুলোর সমালোচনা করে করে। আমি স্যামুয়েলকে বললাম, ‘আমার হাইড পার্কে গিয়ে সন্ধ্যা দেখার ইচ্ছা ছিল, তারপর আলথুসার লন্ডনে এলে যে বাড়িতে এসে উঠতেন, তা দেখার পরিকল্পনা ছিল।’

তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন সেই বাড়ির কথা, কারণ লন্ডনে লুই আলথুসারের আবাস ছিল, এমন কোনো ঠিকানার কথা তিনি শোনেননি কোনো দিন। আমি তাকে আলথুসারের স্লিপ-ওয়াকিংয়ের গল্পটা বললাম। তিনি শুনলেন এবং আমাকে বললেন, ‘একমাত্র তার মতো মার্ক্সবাদীর পক্ষেই সম্ভব ও রকম রাতবিরেতে স্লিপওয়াক। আউটগ্রো আলথুসার প্লিজ। আলথুসার ইজ ডেড-ইন প্যারিস, ইন মস্কো, ইন ফ্রাংকফুর্ট অ্যান্ড এভরিহয়ার এলস।’

এমন সময় মাইক্রোফোন সিস্টেমে আন্দোলনের এক নেতা পড়া শুরু করলেন চমস্কির বক্তব্যটুকু : ‘It is impossible to exaggerate the awesome nature of the challenges we face…’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বক্তব্যপাঠের শেষে বিরাট আওয়াজ উঠল চারপাশে : চমস্কি চমস্কি। তারা একবার বলছে চমস, তারপর কি-থেমে থেমে, স্লোগানের ধরনে। আমি আর বুঝতে পারলাম না এখানে আমার কী কাজ। আমি উঠলাম। কিন্তু মেগান আমাকে, আমার চোখের দিকে গভীর করে তাকিয়ে থেকে, বলল কোনোমতেই আমার এখন ওঠা উচিত না, কারণ সে স্পষ্ট টের পাচ্ছে যে মার্বেল আর্চ থেকে রেড ব্রিগেড সাম্বা ব্যান্ড রওনা দিয়েছে। ‘শুনতে পাচ্ছ না স্যাক্সোফোনের ধীরে বাড়তে থাকা আওয়াজ?’ আমাকে জিজ্ঞেস করল সে। স্যামুয়েল আমাকে বললেন যে আমি পার্কে সন্ধ্যা দেখতে পাইনি তো কী হয়েছে, জীবনে প্রথম কোনো ‘TELL THE TRUTH’ গায়ে লেখা এ রকম শকিং পিংক বোট তো দেখলাম, তা-ও আবার ভরা রাস্তার ওপরে। নাকি?

মেগানের ও রোনাল্ডের অনেক অনুরোধ উপেক্ষা করে, স্যামুয়েল ও তার দুই ছাত্রকে পেছনে ফেলে আমি শেষমেশ একা। জোসেফ ও ফারজানা সেলফরিজেসের দিকে গেছে তাদের এক বন্ধুকে দেখতে, যার বাসা তাদের বাসার পাশেই। তারা যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেছে মস ব্রাদারসের এই এরিয়াটায় তারা আমাকে খুঁজে নেবে, আর মোবাইল ফোন তো আছেই। আমি একটু সামনে হেঁটে ওয়াফলমেইস্টার পার হয়ে একটা বড় ক্যান্ডি ও কনফেকশনারি-মার্কা দোকানে ঢুকলাম। আমার কানে বাজছে ওঠার সময় পেছন থেকে শোনা স্যামুয়েলের কথাগুলো। তিনি তার ছাত্র টিমোথি ও ডেনিসকে বলছিলেন, ‘হি ইজ অ্যাকচুয়ালি নট ইন্টারেস্টেড ইন আলথুসার। হি অ্যাকচুয়ালি হেইটস আস। হি হেইটস দিস গ্যাদারিং বিকজ ইন ইট হি সিস দ্য ডেথ অব বাংলাদেশ গার্মেন্টস এক্সপোর্টস।’ হাহ।

দোকানের ভেতরে লোকজন একদমই নেই। আমি দোকানের ম্যানেজার আফগানিস্তানের করিমকে রাস্তার এই আন্দোলনের কারণে তার দোকান এ রকম খালি কি না জিজ্ঞেস করতেই, করিম আমাকে একবাক্যে আমি যে বাংলাদেশি সেটা সে আমার ইংরেজি উচ্চারণ শুনে ও চেহারা দেখে বুঝতে পেরেছে কথাটুকু বলবার পরে বলল, ‘তো কী, ব্রাদার?’

দোকানের ভেতর দিক থেকে এবার করিমের পাশে এসে দাঁড়াল কাহ্‌হার, তার যমজ ভাই। তারা দেখতে হুবহু একই রকম, শুধু কাহহারের চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা আর করিমের চোখ খালি।

তারা দুজন, আমার মনে হলো তারা পরস্পরের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুও, আমাকে পালা করে করে বলতে লাগল এই আন্দোলন নিয়ে তাদের অনুভূতিগুলোর কথা।

করিম বলল, ‘কতগুলো বড় লোকের ছেলেপেলে, নেশা করে, জীবনে আর কী করার আছে জানে না, মানুষের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই, নিজেদের মা-বাবা- পরিবারের সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ নেই, তারা সব এখন ডাবল-ব্যারেলড অ্যাক্টিভিস্টস, আমাদেরকে জ্ঞান দিচ্ছে যে ইমার্জেন্সি প্রয়োজন ছাড়া বিমানভ্রমণ করা যাবে না, কারণ জেট ফুয়েল পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। কাল একটা মেয়ে এসে আমাকে হিসাব করে দেখাল যে এখান থেকে কাবুল যাওয়ার পথে দুবাইয়ের একটা ফ্লাইটে, লন্ডন-দুবাই একটা ফ্লাইটে যে পরিমাণ কার্বন ফুটপ্রিন্ট আকাশে পড়ে, তার ক্ষতিপূরণ করার জন্য আমাকে কয়টা গাছ লাগাতে হবে। কয়টা বলল ও?’ কাহ্‌হারকে জিজ্ঞেস করল সে।

কাহ্‌হার বলল, ‘মনে নেই। মনে হয় এক হাজার গাছ। ‘ করিম খেপে গেল। বলল, ‘ধুর। এক হাজার না। সম্ভবত ষাট হাজার। কিংবা ষাট লাখ।‘

কাহ্‌হার বলল, ‘গাছ লাগাতে সমস্যা নেই। চারা কিনে দিক না। আমাদের টাকায় আমরা অত চারা কীভাবে কিনব? আজ চার দিন ব্যবসা নেই। সব বন্ধ। সপ্তাহে আমাদের এ দোকানের ভাড়া পঁচিশ হাজার পাউন্ড। সপ্তাহে পঁচিশ হাজার। ভাবতে পারো? কারণ, এটা হচ্ছে অক্সফোর্ড স্ট্রিট, লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিট। তো আমার এই সপ্তাহের ভাড়ার টাকা আমি কোথায় পাব? একটা গাড়ি, একটা ট্রাম চলছে না। ওরা সব বসা রাস্তার মাঝখানে। পুলিশ প্রতিদিনই বলছে ওরা কাল উঠবে। আর আজ সকালে ওদের নেত্রী, দ্যাট স্টুপিড লেডি ব্র্যাডরুক, জানো ওই বেটি ২০১৬ সালে কোস্টারিকা বেড়াতে গিয়ে সাইকেডেলিক সাবস্ট্যান্স অ্যাবিউজ করে করে, তুমি নামও শোনোনি ওসবের, ইবোগা, আয়াহুয়াসকা, শুনেছ ওসবের নাম? ওগুলো দেদার এখন বিক্রি হচ্ছে রিজেন্ট স্ট্রিটের মোড়টায়। ওই পিংক বোটের ডান কোনায় কাউন্টার খুলে বিক্রি হচ্ছে ইরোগা, বিক্রি হচ্ছে আয়াহুয়াসকা। তো ওই বেটি কোস্টারিকায় ওইগুলো খেয়ে পড়ে থেকে হঠাৎ ভাবল, পৃথিবীর বায়োডাইভারসিটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, একটা কিছু করতে হবে। কী করা? তার নাকি রি-অয়্যারড হলো, দেশে ফিরে এসে সে তার হাজবেন্ডকে ছাড়ল, তারপর শুরু করল ‘এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন’, যেন এ-জাতীয় গ্রুপ, গোষ্ঠী, দলের কমতি ছিল কোনো। শালা কুত্তির বাচ্চা, শালী মাকে…তেরি তো! জানো সে প্রতিদিন yoni steaming করে? কী সেটা, জানো? হারবাল এইটা- সেইটা পানিতে দিয়ে পানি গরম করে গামলায় ঢেলে তার ওপর নিজের পুসিটা নিয়ে বসে পড়ার নাম হচ্ছে yoni steaming, পুসি স্ট্রিমিং। হা হা। নেচার লাভার। কালকে শালীর দুই নেত্রী, খন্ডারনি চেহারার দুই নারী জল্লাদ এসে আমাকে বলে, “হ্যাজ ইট ল্যান্ডেড উইদ ইউ দ্যাট ইওর কিডস ওনট হ্যান্ড এনাফ ফুড টু ইট ইন আ ফিউ ইয়ারস টাইম?” আমি বললাম, “এ আবার কেমন কথা?” তখন দুজনের মধ্যে যে আবার বড় নেত্রী, সে আমাকে শুনাল যে আফগানিস্তানের বাচ্চারা এখন খেতে পায় না, আর কয়দিন পরে সারা পৃথিবীর কোনো বাচ্চাই আর খেতে পারে না, কারণ ফুড সিকিউরিটি থাকছে না দুনিয়াতে, কারণ প্রতি এক ডিগ্রি পৃথিবী গরম হলে পৃথিবীর এক পারসেন্ট ইকোনমিক গ্রোথ পড়ে যায়। তো, পৃথিবীর গ্রোথই হয় বছরে মোট চার পারসেন্ট হারে। অতএব চার ডিগ্রি পৃথিবীর গরম বাড়লেই গ্লোবাল ইকোনমি শেষ। ফিনিশ। শালী বিগ মাউথেড বিচ।’

আমি একবারও বুঝিনি যে কাহহার এত রাগী একটা মানুষ। তার বয়স আমার মনে হলো চল্লিশ বা বিয়াল্লিশ হবে। আমি জানলাম, আমাকে তার যমজ ভাই করিম বলল, সে আসলেই প্রচণ্ড বদরাগী এক লোক, কারণ তাদের বাবা, এই দোকানের মালিক, যিনি এখন বসে আছেন পেছনের ঘরে এবং মাগরিবের আগে জায়নামাজে বসে কোরআন তিলাওয়াত করছেন, তিনিও প্রচণ্ড বদরাগী মানুষ। দুই ছেলেকে বড় করেছেন রীতিমতো পিটিয়ে পিটিয়ে। ‘আফগান রক্ত’, বলল করিম। আমি বুঝলাম, জানি না কী করে বুঝলাম যে কাহ্‌হারের সবচেয়ে খারাপ লেগেছে ব্র্যাডরুকের শিষ্যের মুখ থেকে ওই কথাটা শোনা যে আফগানিস্তানের বাচ্চারা খেতে পায় না।

আমি খেয়াল করলাম করিমের ইংরেজি অনেক সুন্দর, একদম খাঁটি ব্রিটিশ, খাঁটি অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ অ্যাকসেন্ট এবং অসাধারণ তার শব্দচয়ন। সে তার দুহাত বুকের ওপরে আড়াআড়ি রেখে আমাকে বলল, যখন কিনা আমি কাউন্টারের ওই পাশে শুনতে পাচ্ছি ফ্লোরে বসা কাহ্‌হারের ক্ষোভের ফোঁসফোঁস আওয়াজ (তবে তাকে দেখতে পাচ্ছি না আমি), সে বলল, ‘ট্রাস্ট মি, দিজ ক্লাইমেট চেঞ্জ প্রোটেস্টারস, দে আর গুড ফর নাথিং। দে উইল প্রিচ ইউ অ্যাবাউট এয়ার ট্রাভেল, অ্যান্ড নেক্সট ডে ইউ উইল সি দেয়ার পিপল ফ্লাডিং দ্য ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টস উইথ পিকচারস ফ্রম দেয়ার রিসেন্ট স্কিয়িং হলিডেজ ইন দ্য আলপস। আই অ্যাম আটারলি ফেড আপ উইথ বিয়িং টোল্ড বাই সাম অ্যাপারেন্টলি নাইস বাট ড্রাংক ইয়ং পিপল দ্যাট দেয়ার অপিনিয়নস আর মোর ইম্পরট্যান্ট দ্যান মাই ওন,

বিকজ দে উইল বি অ্যারাউন্ড আ লট লঙ্গার দ্যান মি, অ্যান্ড দেয়ারফোর দে হ্যাভ গ্রেটার স্টেক ইন দ্য ফিউচার অব দ্য প্ল্যানেট। সত্যি বলি, বয়সে আমি ওদের চাইতে হয়তো বিশ বছরের বড়, আমি মারা যাবার পর ওরা হয়তো আরও বিশটা বছর বেশি বাঁচবে আমার থেকে, কিন্তু সে অনুমান তাদের এই অধিকার দেয় না যে তারা আমাকে বলবে আমি যেহেতু তাদের চেয়ে খানিক কম দিন থাকব পৃথিবীতে, তাই আমার এথিক্যাল দায়িত্ব তাদের বেশি দিন থাকার স্বার্থে আমাকে পৃথিবীর ইকোলজি ও নেচারের জন্য কিছু করে যেতে হবে। অসভ্য কথাবার্তা এসব, একদম গুন্ডাদের মতো কথাবার্তা। আর তিমি তিমি তিমি, সারা দিন তিমি। তিমি এত বড় বিষয় হয়ে গেল পৃথিবীর বায়োডাইভারসিটি ও ওশান লাইফের চলমানতা ও মেরিন-রিদমের জন্য? কী সব শব্দ! আহা! মেরিন-রিদম। শালা গান্ডু তু যাকে তেরা মাকি সাথ…

দুজন মাত্র-ঢোকা কাস্টমারের পেছনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল করিম। ওখান থেকেই আমাকে হিন্দিতে বলল (আমি তাকে বলেছি যে আমি হিন্দি জানি), বাংলাদেশের অবস্থা সে শুনেছে খুব ভালো যাচ্ছে, কারণ তার মতে–স্ট্যাবিলিটি, পলিটিক্যাল স্ট্যাবিলিটি। সে খুশি যে বাংলাদেশ এখন অর্থনীতিতে পাকিস্তানের চাইতে ভালো করছে।

ঠিক এ সময় ‘এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন’-এর সাত- আটজনের এক কর্মী বাহিনী দোকানে ঢুকল চকলেট ইত্যাদি কিনতে এবং তাদের পেছন পেছন ‘আমি দেখলাম ঢুকছে সেই তালু-পেষা পুলিশ অফিসার মার্ক। করিম ক্রেতাদের ফেলে মার্কের দিকে এগিয়ে গেল, হ্যান্ডশেক করল ও মার্ককে জিজ্ঞাসা করল, ‘হাউ ইজ জেসিকা ডুয়িং, মার্ক?’ আমি বুঝলাম জেসিকা মার্কের হয় স্ত্রী, না হয় বান্ধবী।

মার্ক আমাকে দেখল এবং সাধারণ সামাজিক ভদ্রতাবশত প্রশ্ন করল, ‘হাউ ইজ ইওর ডে গোয়িং জেন্টলম্যান? আর ইউ নট হেডিং টুওয়ার্ডস হারলি স্ট্রিট, টু ইওর ফিলসফার আলথুসার’স হাউস?’

আমি উল্টো মার্কের উদ্দেশে প্রশ্ন রাখলাম, ‘আর ইউ ফলোয়িং মি?’

করিম আমাদের দুজনের মাঝখানে। মার্ক আমার প্রশ্ন শুনে বিব্রত বোধ করল খানিক। করিম মার্কের কাছে জানতে চাইল, তার বাংলাদেশের বন্ধুকে কেন ফলো করা হচ্ছে? ‘যেহেতু মার্ক তুমি বলোনি যে ইউ আর নট ফলোয়িং হিম, সেহেতু আমি ধরে নিচ্ছি যে ইউ আর ইনডিড ফলোয়িং হিম। কিন্তু কেন? সে মুসলমান বলে?’

মার্ক করিমকে বলল, ‘করিম, ইউ নো মি। স্টপ ইট।’ আমি জানি না কেন করিম হঠাৎ খেপে গেল তার আগের পরিচিত এই মার্কের প্রতি। হঠাৎ। আর কাহহার এসে যোগ দিল তার ভাইয়ের সঙ্গে এবং কাহ্‌হারের পেছন পেছন ‘এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন’-এর ওই সাত-আটজন।

কাহ্‌হার এই দফা গলা চড়িয়ে মার্ককে অভিযুক্ত করে বসল আসল কাজ বাদ দিয়ে মুসলমানদের পেছনে পড়ে থাকা নিয়ে। সে মিন করছে না যে ঠিক এই মার্ক, তাদের চেনা এই মার্ক সেই কাজ করে, কিন্তু সে নিশ্চিত যে লন্ডন পুলিশে মার্কের যে সহকর্মী বন্ধুরা আছে, তাদের একটা বিরাট অংশ স্রেফ এ কাজটাই করে। ‘ইউ গাইজ আর মেকিং লন্ডন দ্য বার্লিন অব হিটলার এরা। অল রেসিস্টস, অল উইদ আ টুইস্টেড ভিউ অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ারস, অল উইথ আ রং অ্যান্ড হার্মফুল ওয়ার্ল্ডভিউ। ইউ ডোন্ট ডু ইওর জব অ্যাবাউট মেকিং ইট পসিবল ফর আস টু ডু আওয়ার অনেস্ট বিজনেস। উই আর সাফারিং ফর ফোর লং ডেজ নাউ। দেয়ার ইজ নো বিজনেস, ইভেন দেয়ার ইজ নো প্রসপেক্ট অব বিজনেস ইন দ্য নেক্সট টু উইকস অ্যাজ মিজ ব্র্যাডরুক সেইড ইন দ্য মর্নিং টুডে যে এই আন্দোলন আরও অন্তত দুসপ্তাহ চলবে, ইয়েট ইউ হ্যারাস আ জেন্টলম্যান ফ্রম বাংলাদেশ বিকজ অব হিজ স্কিন কালার, হিজ রিলিজিয়াস বিলিফ। ইউ আর ইমপসিবলি সোয়াইনহেডড অ্যান্ড ডান্ডারহেডেড, মার্ক।’

মার্ক নিতে পারল না কাহ্‌হারের এই তীব্র গালি ও সমালোচনা। সে ঘুষি মেরে বসল কাহ্‌হারের মুখে। কাহ্‌হারের মুখ থেকে রক্ত পড়তে লাগল, তার নাক ফেটে গেছে।

করিম কাহ্‌হারকে ধরতে গিয়ে ভাবছে সে ইউনিফর্ম পরা এক পুলিশ অফিসারকে আঘাত করবে কি করবে না, যে কিনা তার আবার পূর্বপরিচিত, যার বউ বা বান্ধবী জেসিকা আবার তার নিজেরও সম্ভবত বন্ধু। মার্ক চরকির মতো ঘুরল একবার, সে ঘুরছে আর চিৎকার করছে ‘স্টুপিড, স্টুপিড’ বলে, আর তখনই ‘এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন’-এর আটজনের দলটা দুই ভাগ হয়ে এক ভাগ ধুমধাম পেটাতে লাগল মাটিতে পড়ে থাকা কাহ্‌হারকে তাদের খালি হাত দিয়ে, কারণ কাহ্‌হার তার শেষ ভাষণে তাদের আন্দোলনকে অপমান করে কথা বলেছে। এ দৃশ্য দেখে মার্ক যেই কাহ্‌হারকে সাহায্য করতে ওই যুদ্ধের মাঝখানে ঢুকল, সময় ওদের দলের দুই ভাগের অন্য ভাগটা, মার্কের জন্য তৈরি হয়ে থাকা ভাগটা, মার্ককে লাথি মেরে, ঘুষি মেরে ফেলে দিল মেঝেতে। করিম এক দৌড়ে গিয়ে বন্ধ করল দোকানের ঝাঁপি, অতএব আমরা সবাই এখন দোকানের ভেতরে। আটকা। মার্ক মেঝেতে পড়া অবস্থায় কোনোমতে মার খেতে খেতেই তার হাতে তুলে নিল তার পুলিশের স্ট্যান্ডার্ড ইস্যু গ্লক পিস্তল এবং চিৎকার করে বলল, ‘ফ্রিজ এভরিওয়ান, অর এলস আই উইল শুট।’

তখনই কাহ্‌হার, নাক থেকে বিরামহীন রক্ত ঝরছে তার এবং একমাত্র তারই এ অবস্থায় দুদল শত্রু -একদিকে পুলিশ অফিসার মার্ক, যে তাকে মেরেছে ও রক্তাক্ত করেছে, অন্যদিকে রেবেলিয়নের কর্মীরা, তারাও তাকে মেরেছে ও মারছে—কিন্তু তারপরও কীভাবে সে সবাইকে ধোঁকা দিয়ে এক ঝটকায় মেঝেয় পড়ে থাকা মার্কের হাতের থেকে পিস্তল কেড়ে নিয়ে তীব্র আফগানি গর্জন করে উঠল, ‘ফ্রিজ এভরিওয়ান, অর এলস আই উইল শুট। অ্যান্ড ইউ বাংলাদেশি, হারি আপ, ইউ লিভ ফ্রম দ্য ব্যাক ডোর আউট দেয়ার।’

আমি দৌড়ে দোকানের পেছন দিকের দরজায় এলাম, ভেতরে ঢুকলাম, দেখলাম করিম ও কাহ্‌হারের বাবা উদ্বিগ্নহীনভাবে মাগরিবের নামাজ পড়ছেন, আর আমি ওই বৃদ্ধের জায়নামাজের ওপর দিয়ে সোজা লাফিয়ে এসে একটা মোটামুটি বড় দরজা, যা আমি আজও জানি না কীভাবে সে মুহূর্তে অটোমেটিক আমার জন্য খুলে গিয়েছিল, পার হয়ে অক্সফোর্ড স্ট্রিটের পেছনের আধো অন্ধকার রাস্তায় এসে পড়লাম।

রাস্তা যত অন্ধকার ভেবেছিলাম, ততটা না। আসলে আমার চোখ এই অর্ধপরিস্ফুট সন্ধ্যা সন্ধ্যা আলোতে নিজেকে সইয়ে নিতে সময় নিচ্ছিল। না, যথেষ্টই আলো আছে চারদিকে, স্রেফ কোথাও একটা মানুষও নেই। কেমন এক হালকা-পলকা, যা কিনা বাতাসে নড়েমতো, গলিপথ ধরে কিছুটা হেঁটে, অনেক বাসাবাড়ি-দালানের পেছন দিকটা পার হয়ে (যে দিকটা সব সময়ই স্বাভাবিকভাবে থাকে সামনের চাইতে অপরিচ্ছন্ন ও ঘোলাটে) হঠাৎ আমি দেখি আমার সামনে সুন্দর এক দালান, তার সাইনেজে লেখা : ‘শেফ একাডেমি, লন্ডন’। তো, এখানেই রান্না শেখানো হয় নানা পদের আর তার সুগন্ধিতে ভরে যায় পৃথিবীর ভোর ও সন্ধ্যাগুলো? আমার মনে হলো, নিশ্চিত ভেতরে এখন মনখারাপ এক মাস্টার শেফ নিয়ম ভেঙে নাক মুছতে মুছতে শেফ হতে চাওয়া একদল মানুষকে চিৎকার করে শেখাচ্ছে কী করে শেফার্ড পাই, পর্ক পাই ও ইয়র্কশায়ার পুডিং বানাতে হয় এবং কেন চাটনি ও চিকেন টিক্কা খেতে যতই ভালো লাগুক, তবু অস্বাস্থ্যকর ওরা এবং কখনো ওরা ব্রিটিশ ফুড নয়। আমি শুনতে পেলাম বাড়ির ভেতরে কে যেন কাকে বলছে, ‘ডোন্ট বদার, জাস্ট ডোন্ট বদার। ওরা কখনোই ব্রিটিশ ফুড হবে না। ব্যবসা আর রন্ধনশিল্প এক জিনিস না, কুকুরের বাচ্চারা।’

তাহলে এ পৃথিবীর সবাই এখন রেগে আছে। ভালো। রাগের থেকেই কাহ্‌হার একগাদা কড়া সমালোচনা করল মার্কের, রাগের থেকেই মার্ক হঠাৎ মেরে বসল কাহ্‌হারকে এবং আমি মানুষের তাজা রক্ত দেখলাম এত এত বছর পরে। আবার রাগের থেকেই (কিংবা এ ক্ষেত্রে হতে পারে আয়াহুয়াসকা নামের সাইকেডেলিক ড্রাগের প্রভাবে ) রেবেলিয়নের (যাদের সংক্ষিপ্ত নাম XR, অর্থাৎ কায়দা করে লেখা Extinction Rebellion, যা আমার এই স্মৃতিচারণা লেখার এত পাতা পরে এসে মনে পড়ল এ মুহূর্তে) সাত-আটজন ওরা মেরে বসল কাহ্‌হার ও মার্ককে, আবার চূড়ান্ত রাগের থেকেই করিম দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়ে ভেতরটাকে বানিয়ে তুলল বিপজ্জনক ড্যাগার- শুটিংয়ের এরিনা কিংবা আগুনের মালসা।

কী চলছে ওই দোকানের ভেতরে আমি পালিয়ে আসবার পরে? আমি কিছুই অনুমান করতে পারলাম না, কিন্তু আমার তীক্ষ্ণ ঈশ্বরপ্রদত্ত সিক্সথ সেন্স বলল যে গুলি চলেনি ওখানে—কাহ্‌হার ও করিম ঠান্ডা হয়েছে, গাঁজাখোরগুলো তাদের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চেয়েছে পুলিশের কাছে এবং মার্ক গলা জড়িয়ে ধরেছে নাক থেকে অবিরল রক্ত পড়া কাহ্‌হারের। এটাই হতে পারে আমার আজকের এই দপ করে জ্বলে ওঠা বিকেল ও সন্ধ্যার সত্যিকারের সুন্দর এক পরিসমাপ্তি। কিন্তু কে জানে বাস্তব, রূঢ় বাস্তব, আমার ওই মহাপ্রভাব আশার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে সত্যি হাঁটবে কি না? আমি ভাবতে চাই না।

‘শেফ একাডেমি লন্ডন’ পার হয়ে আমি এসে উঠে দাঁড়ালাম টেনটারডেন স্ট্রিটে, অক্সফোর্ড স্ট্রিটের পেছনের গলিটায়। কী আজব ব্যাপার যে সারা পৃথিবী লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটের নাম জানে, আর এর ঠিক পেছনের গলিরই নাম তো দূরে থাক, তারা আমার মতোই এর অস্তিত্ব সম্বন্ধেও সচেতন নয়। আমি টেনটারডেন স্ট্রিটের সাইন দেখে লজ্জা পেলাম। ভাবলাম মানুষের শেষমেশ ওই মোটা দাগই পছন্দ। লাইনের আড়ালে ওই যে সূক্ষ্মতর লাইন, শব্দের আড়ালে ওই যে আরেক শঠতানিপুণ শব্দ, গানের মূল সুরের আড়ালে ওই যে চোরা সুর, আর রক্তের আড়ালে আড়ালে ওই যে তুমুল রক্ত মোছার আয়োজন, মানুষের সেসব অনুধাবনের বুঝি আর সময় বা ইচ্ছা কোনোটাই নেই।

রাস্তায় উঠে দিক ঠিক করে উঠতে পারলাম না কিছুক্ষণ। এখানেই কাছে ধারে একটা টেইলর শপ আছে, নাম ‘রাজ মিরপুরী বিস্পোক ক্লদিয়ারস সিন্স 1976’, যার মালিক ইকবাল সাহেবকে আমি ভালোভাবে চিনি। ওটার খোঁজে গুগল সার্চ দেব ভাবলাম, কিন্তু ফোনে হাত রাখতে যাওয়ার মুহূর্তে দিকের দিশা পেয়ে পেলাম আকস্মিক। ওই দোকান আমার হাতের ডানে, বন্ড স্ট্রিটের দিকে, আর আমাকে যেতে হবে বাঁয়ে, যেখানে রাস্তা নিশ্চিত গিয়ে মিলেছে রিজেন্ট স্ট্রিটে। আর একবার রিজেন্ট স্ট্রিট পেয়ে গেলে চিন্তা নেই, সোজা ওতে উঠে যাও এবং বাঁয়ে যেতে থাকো। তখন সামান্য গেলে সামনে পড়বে অক্সফোর্ড সার্কাসের মোড়, অর্থাৎ পিংক বোটটা, যার আবার পাশেই ট্রেন স্টেশন। আমার এ মুহূর্তের পরিকল্পনা হচ্ছে : আর কোথাও থামাথামি নেই। আমি সোজা একবার শুধু ওই ফানি, ওই বেমক্কাদর্শন ও ওই প্রতারণাত্মক মিষ্টি পিংক বোটটাকে দুনয়নে দেখে নিয়েই অক্সফোর্ড সার্কাস স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে সেন্ট্রাল লন্ডন থেকে পালাব এবং টিকিট চেঞ্জ করে কালকেই ঢাকায় ফেরত যাব। আফগান চকোলেটিয়ারের দোকানে খুন হয়েছে কি হয়নি, জানি না; জানি যে আইনি জটিলতা তৰু আমার দিকে ধেয়ে আসতে পারে, রাষ্ট্রের রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস বা আরএসএর একটা বড় অ্যাপারেটাস পুলিশ ও গোয়েন্দা আমাকে এই কেসে বিশেষ কারণে, যেহেতু ওই মারামারির কারণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলাম আমি, বিরাট হাবিজাবির মধ্যে ফেলে দিতে পারে।

আমি পার হলাম হারটল অ্যান্ড লুইস। কিসের দোকান জানি না। ছবি তুললাম। পৌঁছালাম হেয়ারউড প্লেসে গিয়ে। ছবি তুললাম। পৌঁছালাম এক মোড়মতো কিন্তু বাস্তবে বকযন্ত্র আকারের স্থানে, নাম হ্যানোভার স্কোয়ার। ছবি তুললাম না এই জার, এই কনিক্যাল ফ্লাস্কের চেহারার জায়গাটার। এরপর একটা দোকান, নাম ড্রাই মার্টিনি। ছবি তুললাম। তারপর স্যালভেশন আর্মির হোটেল, যার কোনায় দেখলাম অনেকগুলো প্যাকিং বাক্স রাখা এবং সেগুলোর আরেক কোনায় মাথায় লাল ব্যান্ড পরা দুই দুই চারটা XR দলের তরুণ-তরুণী যৌনবাসনায় এই রাস্তার ওপরেই একে অন্যকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে। খাক। আমি তাদের বীণাবাজানো ধরনের চিকন সুর, যা আবার একটু পরে পরে সাগরের ঢেউয়ের আওয়াজ ভেঙে পড়ে শেষ হয়ে যাওয়ার মতো অবিরাজমান, ওই ধরনের শীৎকারধ্বনি শুনলাম। ছবি তুললাম না। চার দিন ধরে ওজন লেয়ারের জন্য মায়া করা এই চার বালক-বালিকার বৈধ অধিকার আছে নিজেদের ক্রোধ এভাবে খালাস করার

এদেরকে পার হতেই আমার হাতের বাঁয়ে ইতালিয়ান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইত্যাদি ইত্যাদি (ছবি তুললাম) রেখে আমি অবশেষে রিজেন্ট স্ট্রিটে, আমার উল্টো দিকে ন্যাটওয়েস্ট ব্যাংক আর আমার সামনে হাজার হাজার মানুষের ভিড়, কারণ সামান্য দূরের মূল মঞ্চ থেকে আসা শব্দেই পরিষ্কার যে, মার্বেল আর্চ থেকে আসা ওই ‘রেবেল রাউজিং’ সাম্বা ব্যান্ড রেড ব্রিগেডের হাউমাউ গান শুরু হয়ে গেছে। পরিবেশ এখন ইলেকট্রিক বললেও কম বলা হবে। গান ছাপিয়ে আবার শুনলাম আসছে এক নতুন স্লোগান। এই দলটা আসছে পিকাডিলি সার্কাসের দিক থেকে। তারা বলছে : ‘We’ve got’, তারপর থেমে, ‘more & more boats’। ‘We have got, more and more boats’। কিন্তু তারা ‘more and more boats’ কথাটা তাদের মাতৃভাষায় এত দ্রুত বলছে যে শুনতে লাগছে ‘মোয়ানমো বোস’। আমি ওই দলটার ভিড়ের মধ্যে মিশে—নিশ্চিত আমার অবচেতনে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে— মূল মঞ্চের কাছে পৌঁছে গেলাম। নিজে পৌঁছালাম না, ভিড় আমাকে ঠেলে কূলে ভিড়িয়ে দিল।

এই প্রথম দেখলাম গেইল ব্র্যাডরুককে। সুদর্শনাই বলতে হবে তাকে, আর তার চোখে মুখে প্রত্যয়ের এক বেপরোয়া মন্দ্রতা। সে পুরো Extinction Rebellion- এর বিশ্বনেত্রী, দ্য XR কুইন (তবে তার সঙ্গে দলটার আরেকজন যৌথ প্রতিষ্ঠাতাও আছে, নাম সাইমন ব্রামওয়েল, বর্তমানে যে কিনা ব্র্যাডরুকের যৌনসাথি)। আমি ভাবলাম, নিশ্চয় এ মুহূর্তে এ রকম পিংক পোশাক পরে পিংক বোটের ওপরে এত হাজার লোকের সামনে রেড ব্রিগেডের ড্রামসের প্রবল আওয়াজের মধ্যে তাদের রয়্যাল নেভির পোশাক পরা নাবিকের কাছ থেকে জাহাজের চাবি নিতে নিতে ব্র্যাডরুকের এখন নিজেকে মনে হচ্ছে সে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাইতেও বড় কেউ, সে ভ্লাদিমির পুতিন লেভেলের, বিশ্ব কিনা যার দয়াপরতন্ত্রের মুখাপেক্ষী এবং—আরও বড় কথা—তারটা শুধু পুতিনের মতো মানবের বিশ্বই নয়, তারটা মানুষের পাশাপাশি থানকুনিপাতা, পপলার, কালিজিরে, ঘোড়ানিম আর সেই সঙ্গে নদীর ঢেউয়ের না থাকা ফেনা, তারার হারিয়ে যাওয়া আলো, তিমি মাছেদের সমুদ্রপৃষ্ঠের ওপরে ছোড়া দ্রুত নিম্নগামী ফোয়ারা এবং কালবাউশ মাছ ও উগান্ডার হিপোপটেমাসদেরও বিশ্ব। মঞ্চের চারপাশ থেকে ব্র্যাডরুকের মুখের ওপরে পড়া সাদা আলোয় আমার মনে হলো আমি ইহজীবনে এই প্রথম পৃথিবীর আলো-পানি-

মানুষ-হাওয়া অগ্নি-উদ্ভিদ-পশু-পাখি এবং মেঘলা ও নীল আসমানের সম্রাজ্ঞীকে দেখলাম।

ব্র্যাডরুক শুধু তার হাতটা তুলল, আর অমনি রেড ব্রিগেড তাদের গান বন্ধ করে দিল অসম্পূর্ণ কলিতেই। ব্র্যাডরুক বলল, ‘হেই ক্রাউড,’ আর অমনি আমরা সবাই মিলে বললাম, ‘হেই ব্র্যাডরুক’। আর সেই সঙ্গে দক্ষিণ আকাশ থেকে গ্রিনিচের দিকে ছুটে যেতে থাকা ধূমকেতু আকাশের মাঝপথে দাঁড়িয়ে গেল। ব্র্যাডরুক বলল শুধু এ দু-তিনটে লাইন :

– We live in a toxic system, but no one individual to blame.

– We actively mitigate for power- breaking down hierarchies of power for more equitable participation.

– We openly challenge ourselves and this toxic system- leaving our comfort zones to take action for change.

.

আমি দেখলাম ভিড়, যাদেরকে সে সম্বোধন করেছে হেই ক্রাউড বলে, সেই ভিড় এখন প্রায় উন্মত্ত। তারা অনেকটা এমন যেন আজকেই এই ২৫ লাখ বছরের মানুষের পৃথিবীর সব অন্যায়-অনাচার, সব হরিণ শিকার ও সব মুরগি জবাই, সব মাটিতে সার প্রয়োগ ও পানিতে জাল ফেলা, সব ক্ষমতা ও ক্ষমতা-সম্পর্কের সর্বপ্রকার জাল-সুতোজাল এবং দোষ আরোপ ও লজ্জা প্রদানের এই সব প্রতিষ্ঠিত কায়দাকানুন, এমনকি প্রধানমন্ত্রীদের হাই তোলা ও গ্লাভস পরে হ্যান্ডশেক করার সব শিষ্টাচার, এর সবকিছু তারা আজ সন্ধ্যায়ই চিরদিনের মতো ঠিক করে ছাড়বে।

আমার পাশে যে ভদ্রলোক, হাতে তার ব্রিফকেস এবং মাথায় একটা ডার্ক ব্রাউন স্টেটসন হ্যান্ডমেড ফেদোরা হ্যাট (তার মানে পয়সাওয়ালা মানুষ), চেহারা তার শিল্পী উইন্ডহ্যাম লুইসের, সেই একই রকম মোচ, একই রকম মাঝখানে সিঁথি কাটা দুপাশে মাথা ভরা সিমেট্রিক্যাল পরিপাটি চুল, তিনি আমাকে একটুখানিকের জন্য তার ব্রিফকেস ধরতে বললেন। আমি ধরলাম, এমনভাবে ব্রিফকেসটা উঁচুতে তুলে ধরলাম যাতে তিনি ওটা ভালোমতো খুলতে পারেন এবং তার কাজ সারতে পারেন। তিনি ব্রিফকেস খুললেন আর ভেতর থেকে একটা সুন্দর-দর্শন চুরুট বের করে ধরালেন। আমার কাছে চুরুটের ধোঁয়ার গন্ধটা লাগল বাচ্চা গরুর গায়ের গন্ধের মতো। দারুণ। আমাকে ধন্যবাদ বললেন তিনি। আমি বললাম, ‘ওয়েলকাম’।

তিনি চুরুট মুখ থেকে নামিয়ে আমার কানের মধ্যে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, ‘আমি চার্লস বেরেসফোর্ড। তুমি?’

আবার বাছুরের গায়ের গন্ধে আমি বিভোর। সেই সম্মোহনের মধ্যেই আমি আমার নাম বললাম, দেশ বললাম এবং উত্তরে তিনি বললেন এই কথা, আমার কানের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে, কখনো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আর কখনোবা ধোঁয়াবিহীন ঘন নিশ্বাসে :

‘বিলিভ মি, সব ফালতু। অক্সফোর্ড সার্কাসে এত দিন পর সত্যিকারের সার্কাস চলছে একটা। আমার তো মনে হয় ব্রেক্সিটের লজ্জা লুকাতে অনারেবল প্রাইম মিনিস্টার হা হা এই সার্কাসের আয়োজন করেছেন হিহি। এই XR- দের যে ডিমান্ড আর যে অ্যামবিশন তা টেকনিক্যালি, ইকোনমিক্যালি ও পলিটিক্যালি কোনোকালে বাস্তবায়িত হওয়ার অ্যাবসুলিউটলি কোনো চান্স নেই। নেট জিরোতে পৌঁছাতে চায় তারা, হিহি। তার মানে যাবতীয় এয়ার ট্রাভেল বন্ধ করতে হবে, আর রাস্তা থেকে হটাতে হবে পেট্রল- ডিজেল মিলে প্রায় ৪ কোটি গাড়ি, আর তার সঙ্গে পৃথিবী থেকে সরাতে হবে ২৬ মিলিয়ন [২ কোটি ৬০ লাখ] গ্যাস বয়লার। হা হা হা হা হা।’

আমি বেরেসফোর্ডকে ধন্যবাদ দিলাম আমাকে এই নতুন পারসপেকটিভ দেবার জন্য। মঞ্চে তখন নীরবতা। গেইল ব্র্যাডরুক একটা বড় কুইনস স্কার্ফ পেয়েছে তথাকথিত এক অ্যাডমিরালের কাছ থেকে। অ্যাডমিরাল বা রিয়ার অ্যাডমিরাল তাকে স্যালুট জানিয়ে কাঁধে পরিয়ে দিচ্ছে স্কার্ফটা এবং মাইক্রোফোনে বলছে যে এটা XR- এর মেয়েদের হাতে বোনা, পার্সোনালি ক্রোশেড কুইনস স্কার্ফ। আমি কল্পনা করতে পারলাম নগ্ন গেইল ব্র্যাডরুক, যে তার গলায় শুধু এই পিংক রং কুইনস স্কার্ফ পরে তার বাসার বাথরুমে পিংক রঙের এক গামলার ওপরে দুদিকে দুপা দিয়ে বসেছে নানা ভেষজ পাতায় ভরা গরম পানির ওপরে, তার হারবাল পদ্ধতিতে পুসি স্টিমিংয়ের জন্য। না, নিজেকেই অপরাধী লাগল আমার এত বড় স্বপ্নচারী রানিকে নিয়ে—যে কিনা পনেরো-বিশ দিনের জন্য লন্ডনের মতো শহরকে অচল করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে- এ ধরনের অর্ধমাচারী ও অপ্রশস্তচিত্ত এবং আদতে হিংসাশ্রয়ী চিন্তাটা করবার জন্য।

ওই নীরবতা, ওই গুঞ্জনের মধ্যেই ফোনে কথা বলার মোক্ষম সময়টা বেছে নিয়ে আমি এতক্ষণে পকেট থেকে বের করলাম আমার ফোন। দেখলাম ফারজানা ও জোসেফের মিলে তাতে মোট ২২টা মিসড কল উঠে আছে। হায়!

আমার আর মনে থাকল না অক্সফোর্ড স্ট্রিটের ওদিকটায় যাওয়ার বিপদের কথা, যেদিকে আফগান চকোলেটিয়ারে আমাকে নিয়েই ঝরেছে অনেক রক্ত, আর শেষে এক নির্দিষ্ট শত্রুর বুক তাক করে যেখানে ঝিলিক দিয়েছে গ্লুক 17C পিস্তলের ট্রিগারের ওপরের এক্সট্রা ক্রস পিন আর এক রিশেপড এক্সট্রাক্টর। কবে গ্লুকে রিশেপড এক্সট্রাক্টর বসাল তারা? কেন? চেম্বার লোডেড আছে কি নেই তার ইন্ডিকেটর হিসেবে? আর বাইশটা ফোন কেউ করে মানুষকে? মার্ক কি মারা গেছে কাহ্‌হারের গুলিতে? মারা গেছে কি একের অধিক লোক—মার্ক ও ধরা যাক করিম? নাকি কাহ্‌হার নিজেই, যে কিনা মার্কের হাত থেকে গ্লকটা কেড়ে নিয়ে ওই মুহূর্তে রাষ্ট্রযন্ত্রের শত্রু হয়ে গেছে, অতএব পরবর্তী অপারেশনে তার উচ্ছেদ, পৃথিবী থেকে উচ্ছেদ, অনিবার্য?

আফগান চকোলেটিয়ারের দোকান পর্যন্ত অত দূর যেতে পারলাম না। যাওয়া লাগল না। ঠিক যেখানে বসা থেকে উঠেছিলাম আমি, সেখানেই দেখলাম আমার সেই দল—— সেই টিমোথি ও ডেনিস এবং তাদের শিক্ষক স্যামুয়েল; সেই মেগান, কিন্তু তার বয়ফ্রেন্ড রোনাল্ড নেই; আর ফারজানা ও জোসেফের মাঝখানে দাঁড়ানো অক্ষত মার্ক।

আমি মার্ককে বললাম, ‘থ্যাঙ্কস গড, মার্ক তুমি বেঁচে আছ? আমি ঝামেলা এড়াতে পালিয়ে গিয়েছিলাম।’

স্যামুয়েল আমাকে বলল, ‘কেউ মরেনি। সব গল্প শুনলাম। রেবেলিয়নের (খেয়াল করলাম ‘এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন’ বা ‘XR’ বললেন না তিনি) সাতজন ওই দোকানে ভ্যান্ডালিজম ও পুলিশের গায়ে হাত তোলার অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছে।’

পুলিশ অফিসার মার্ক আমাকে বলল তার সঙ্গে একটু পাশে যেতে। আমি গেলাম। ফারজানা ও জোসেফের চোখে তখন রাজ্যের উদ্বেগ, কিন্তু ওই মুহূর্তে আমি ভয়হীন। মার্ক বলল, আমার কানের অনেক কাছে মুখ এনে বলল, যার ফলে আমাকে সহ্য করতে হলো তার শ্বাসের ব্রিটিশ দুর্গন্ধ, সে বলল : ‘শোনো, দোকানে, অ্যাট করিম’স, যা ঘটেছে তার জন্য তোমার কোনো দোষ নেই। দোষ যদি কিছু থাকে তো তা করিম ব্রাদারসের, যারা আমাকে মুসলিম- হেটার হিসেবে চিহ্নিত করে উত্তেজিত করে তুলেছিল। আই ওয়াজ প্রোভোকড, আই ওয়াজ সেটআপ টু হিট। আমার দুঃখ যে আমার বন্ধু করিম এটা করল, যে আবার জেসিকার এক্স বয়ফ্রেন্ড, আই মিন জেসিকা, মাই নিউলি ম্যারিড ওয়াইফ। আমি চাচ্ছি পুরো ঘটনাটা ভুলে যেতে। XR- এর যাদেরকে ওখান থেকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে তারা কোনো ব্যাপার না। ওদেরকে সাবস্ট্যানস ইউজার হিসেবে কেউ এমনিতেও বিশ্বাস করে না। করিমের বাবা সব ঠিকঠাক করে দিয়েছেন। কাহহার আমাকে নিজের মুখে শেষে বলেছে, আফগানিস্তানের কোনো পুরুষের নাক ফাটা ও সামান্য রক্ত পড়া পৃথিবীতে কোনো ব্যাপারই না। আমি খুঁজতে খুঁজতে তোমার দু আত্মীয়কে পেয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম স্রেফ এটুকু বলতেই যে, তোমার পেছনে যেভাবে আইজ্যাক পুলিশ ও গোয়েন্দা লাগিয়েছে, তাতে তুমি যেকোনো সময় পিকডআপ হয়ে যেতে পারো, আর তা যদি হও তো প্লিজ ওই দোকানের ঘটনাটা পুলিশকে কখনো বোলো না। আমি নতুন বিয়ে করা, আমার ক্যারিয়ার আছে, আমি তাতে কোনো দাগ পড়ুক তা চাই না। মাই ওয়াইফ ইজ অব আ ডিফারেন্ট কাইন্ড। আর জানোই তো আজ তিন রাত আমি বাসায় যাই না, ঘুমাই না। সো, মাথাও কাজ করছে না। আমাকে এই হেল্পটুকু কোরো। পুলিশে আমার বলতে গেলে কোনো বন্ধু নেই। দেখলে না ওরা দুজন আমাকে থানা থেকে তখন কীভাবে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল?’

মার্ক আমাকে, ফারজানা ও জোসেফকে শুভরাত্রি জানিয়ে এবং বাসায় চলে যাওয়ার অনুরোধ রেখে বিদায় নিল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম না যে তার মতে কী কারণে আইজ্যাক আমার পেছনে এত পুলিশ বা গোয়েন্দা লাগিয়ে রেখেছে? রাষ্ট্রের আরএসএগুলোর কাজই ওই। ওগুলো নিয়ে কোনো মোহ বা কাঙ্ক্ষা যেমন রাখতে নেই, তেমন কোনো বিশেষ ঔদাসীন্য ও অপ্রত্যাশারও দরকার নেই। আরএসএগুলোর কাজকর্মের সঙ্গে ডিল করার সেরা পথ হচ্ছে ওদের এড়িয়ে চলা বা ওদের যত দিন যত দূর পর্যন্ত পারা যায় একটা সাদা পর্দার ওপরে একটা কালো ফ্লাট লাইন, একটা ওঠানামাহীন বিরক্তিকর ও একঘেয়ে ফ্লাট লাইন বলে ভেবে যাওয়া।

আমরা উঠব উঠব। আমি ফারজানার কাছ থেকে এইমাত্র কিছু কড়া কথা শুনেছি যে ঢাকায় ফেরত গেলে আমার বউয়ের হাতে আমার খবর আছে এবং আমি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যে কী পরিমাণ অ্যানয়িং একটা আনরুলি হিউম্যান বিয়িং হয়ে গেছি, সেসব। আর আমি জোসেফকে কানে কানে বলেছি দরকার নেই আলথুসারের বাড়ি খুঁজতে যাওয়ার, ওটা পরে অন্য কোনোবার দেখা যাবে। তখনই মেগান আমাকে বলল, মাইক্রোফোনে যে এখন কবিতা পড়ছে সে তার বড় বোন মেলিন্ডা, আর মেলিন্ডা এখন যেটা পড়ছে, সেটা সিমাস হিনির বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য উড রোড’। ‘শোনো শোনো, এখনই ও ওটা পড়বে, আমার মা বলে মেলিন্ডার মতো করে “উড রোড” আর কেউই পড়তে পারে না।’

এটা বলেই গুনগুন করা শুরু করল মেগান, মাথা নাড়তে লাগল ডানে ও বাঁয়ে, যখন কিনা তারই বোন মেলিন্ডা পিংক বোটে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করছে :

রিসারফেসড, নেভার ওয়াইডেনড
দ্য ভারজেস গ্রাসি অ্যাজ হোয়েন
বিল পিকারিং লে উইদ হিজ গান
আন্ডার দ্য সামার হেজ
নাইটওয়াচিং, ইন ইউনিফর্ম—

স্পেশাল মিলিশিয়াম্যান।

মুনলাইট অন রাইফেল ব্যারেলস,
অন দ্য উইন্ডস্ক্রিন অব আ ভ্যান
রোডব্লকিং দ্য রোড,
দ্য রেস্ট অব হিজ স্টনচ প্যাট্রল
ইন প্রোফাইল, সেন্ট্রি-লয়াল,

হ্যারাসিং মালহল্যান্ডসটাউন।

ইত্যাদি।

কবিতাটা তত ভালো না যতটা মেলিন্ডা এটাকে করে তুলল তার মধু দিয়ে ধোয়া গলায়, আর তার স্বর্গীয় মাথা ও মুখ খেলনা পুতুলের মতো, তবে প্রখর আত্মনির্ভরশীলতা নিয়ে, নাড়িয়ে নাড়িয়ে। কবিতা পড়ার পুরোটা সময় আমরা সবাই নিশ্চুপ–শুধু স্যামুয়েল দুবার বোতল থেকে পানি খেল আর ডেনিস একটা গাঁজার দলা ছোট কাঁচি দিয়ে চুপচাপ কাটাকুটি করল তার নিজেরই এক হাতের নোংরা তালুর ওপরে রেখে, আর প্রচণ্ড উসখুস উসখুস করল ফারজানা। আমি হঠাৎ লক্ষ করলাম মেগান আমার হাত ধরেছে এবং ধরেই আছে। তার বোনের কবিতা পড়া শেষ হলে যখন চতুর্দিকে হাততালি, তখনই কেবল হাত আমার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সে হাততালি দিল প্রায় নীরবে, বেশি শব্দ না করে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘রোনাল্ড কোথায়?’

সে বলল, ‘রোনাল্ডের গার্লফ্রেন্ড এলা এসেছে।’

‘মানে? রোনাল্ড তোমার বয়ফ্রেন্ড না?’

‘রোনাল্ডকে আমি চিনলামই তো চার দিন আগে। আর রোনাল্ডের মতো ব্রুট ব্রিটিশ আমার বয়ফ্রেন্ড হবে কেন?’

‘তো? কে হবে?’

“তোমার ব্রাদার-ইন-ল জোসেফের মতো কোনো এশিয়ান।’

আমি এবার তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কাঁদছ কেন, মেগান?’

মেগান অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে জানাল, তার বোন তার সঙ্গে আজ দুবছর হয় কথা বলে না, তারা দুটোই বোন, তার মায়ের বড় লন্ড্রি ব্যবসা, তার বাবা থাকে স্টকহোমে এবং তাদের কোনো খোঁজখবর নেয় না, যদিও সে ছিল তার বাবার অত্যন্ত অত্যন্ত আদরের মেয়ে। আরও বলল যে, তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছে, বউ রাশিয়ান আর ওই ঘরে রাজপুত্রের মতো একটা ছেলে হয়েছে, নাম পিটার, যে কিনা এই সামারে লন্ডনে আসবে বলে সে শুনেছে এক অদ্ভুত অবিশ্বাস্য সোর্স থেকে। এমনকি লন্ডনে এসে তার বাবা, তার নতুন রাশিয়ান স্ত্রী ও পিটার কোথায় এসে উঠবে, সেই ঠিকানাও তার জানা, কিন্তু সে এই জরুরি তথ্যটা তার একমাত্র বোন মেলিন্ডাকে জানাতে পারছে না, কারণ মেলিন্ডা তার সঙ্গে কথা বলে না।

স্যামুয়েল শুনে ফেলল মেগানের কথাগুলো। আমি তার মধ্যে পিতৃসুলভ এক স্নিগ্ধ স্নেহশীল আচরণ দেখলাম। আর ওই মুহূর্তে আমার রাগ পড়ে গেল স্যামুয়েলের ওপর থেকে, যে কিনা বিনা আক্রমণে, বিনা কারণে আমাকে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করেছিল ‘আলথুসার ইজ ডেড, আলথুসার ইজ ওভার’ এসব বলে, এবং শেষমেশ এটাও বলে যে আমি যে তাকে এড়িয়ে চলছি, তার সঙ্গে আলসার নিয়ে গল্প করছি না, তার কারণ নাকি আমি XR এর এই আন্দোলনের শেষে গিয়ে বাংলাদেশের গার্মেন্টস রপ্তানি বন্ধ হওয়ার দুশ্চিন্তায় আছি। তখন আমি ভেবেছিলাম, হায় রে ব্যাটা স্যামুয়েল, তোর XR- এর নেশাখোর লোকেদের যদি ক্ষমতা থাকত সতেরো কোটি লোকের দেশের দু কোটি লোক জড়িয়ে থাকা ইন্ডাস্ট্রিটাকে বন্ধ করবার, তাহলে তো হতোই। তোরা এত শক্তিশালী ভাবছিস কেন নিজেদেরকে, তোরা, পৃথিবীর পথে পথ ও গতি হারিয়ে ফেলা ব্রিটিশরা?

আর এখন মেগানের হৃদয়বিদারক গল্পের শেষে স্যামুয়েল যে তার ব্যাগ খুলে মেগানকে একটা নতুন না- খোলা পানির বোতল, একটা টিস্যু পেপার ও দুটো গ্রানোলা এনার্জি বের খেতে দিল, তাতে আমার মনে হলো এই লোক আপাদমস্তক হিউম্যানিস্ট বা রেনেসাঁ হিউম্যানিস্ট, সে মনের থেকে কোনোই মার্ক্সিস্ট না এবং সে কারণেই আলথুসারকে, আলথুসারের মতো অ্যান্টি-হিউম্যানিস্টকে সে পছন্দ করে না। তবে আমি খুশি যে সে বাচ্চা মেয়ে মেগানকে পছন্দ করেছে, তার দুঃখের মুহূর্তে তাকে মায়া করেছে। মায়া। মায়া শব্দটা ভাবতেই মুহূর্তে আমার মাথা চক্কর খেল একটা। আমি নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করলাম : তাহলে আমি কী? হিউম্যানিস্ট না অ্যান্টি-হিউম্যানিস্ট?

আলথুসার পুরো মাত্রায় অ্যান্টিহিউম্যানিস্ট ছিলেন, যেমন মিশেল ফুকো অ্যান্টিহিউম্যানিস্ট, জাঁক দেরিদাও অ্যান্টিহিউম্যানিস্ট। ব্রেখট যখন বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত মায়ার ভুল দিয়ে ভরা মানবতাবাদী আহা-উঁহুগুলো নিয়ে এবং সোশালিস্ট হিউম্যানিজম নিয়ে সমালোচনা করলেন, তখন আলথুসার মার্ক্সিস্ট হিউম্যানিস্টদেরকে বলে বসলেন তারা সংশোধনবাদী, তারা মার্ক্সকে না বুঝে শুরুর দিকের মার্ক্স নিয়ে লাফাচ্ছে। তিনি বললেন, ব্যক্তির সচেতনতা ও কাজকর্ম সবকিছু সামাজিক কাঠামো ও সামাজিক সম্পর্কগুলো দিয়ে নির্ধারিত—কাঠামো আগে, ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছাটিচ্ছা পরে, আর আসলে ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছা বলে কিছু নেই। আলথুসারের হিসাবে, ব্যক্তিমানুষের বিশ্বাস, ইচ্ছা, পছন্দের প্রেফারেন্স, বিচারবোধ ও বিবেচনা, এগুলো সামাজিক রীতিনীতির হাতে বন্দী, কারণ সমাজই তার নিজের ইমেজে ব্যক্তিকে গড়ে তোলে তার আদর্শিক মতবাদগুলো দিয়ে।

অতএব মানুষের ভালো করতে হবে, মানবতার পক্ষে দাঁড়াতে হবে, মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের অবস্থাগুলো বদলাতে হবে, ইত্যাদি কথা কারও পলিটিক্যাল এজেন্ডা হিসেবে হয়তো ভালো, কিন্তু ঐতিহাসিক বিচারে এই কথাগুলোর (‘মানুষ’, ‘মানুষের স্বভাব’, ‘মানবতা’ ইত্যাদি শব্দগুলোসহ) দেশ থেকে দেশে, অবস্থা থেকে অবস্থায়, সমাজ থেকে সমাজে অর্থ আলাদা আলাদা বলে এরা আপেক্ষিক কথাবার্তা, এরা মেটাফিজিক্যাল কিছু ধারণা মাত্র। লিবারাল হিউম্যানিস্ট ইমানুয়েল কান্ট বলেছিলেন বিশ্বমানবের একটা সর্বজনীন, ইউনিভার্সাল, নৈতিক মনোভূমি আছে—এক অদৃশ্য ভালো-মন্দ, আলো-অন্ধকার বিবেচনার বিশ্বজনীন মনের আইন। তিনি বলেছিলেন, যুক্তিই চালাচ্ছে সবকিছু এবং যুক্তির এ বিশ্বজনীনতাই নিশ্চিত করবে অনাচার ও অরাজকতা থেকে মানবের মুক্তিকে। কিন্তু আমার আলথুসার বললেন, সব ভুল কথা, এই ‘এনলাইটেনমেন্ট-হিউম্যানিজমের’ গোড়ার চিন্তাগুলোই কিছু ভুল ও স্বপ্নবিলাসী চিন্তা, এর সঙ্গে বাস্তব পৃথিবীর বাস্তব ক্ষমতাকাঠামোগুলো কীভাবে মানুষকে নির্দিষ্ট কিছু আচরণ করায়, তার কোনো যোগাযোগ নেই এবং বিশ্বাত্মার একটা নৈতিক গোড়া, একটা বিবেকবান মনোভূমি আছে, কথাটাও ভুল। আলথুসার বললেন, নৈতিকতা বিশ্বজনীন কিছু নয়, ভালো-মন্দের বিচার পরিস্থিতি থেকে পরিস্থিতিতে পুরো আলাদা এবং এরপর তিনি ডেঞ্জারাসলি আরও বললেন যে, এ-জাতীয় গালভরা বুলি বরং মানুষকে শোষণ ও বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তির বদলে তাদের আরও বেশি শোষণের জালে জড়াচ্ছে, আর আরও বড় কথা স্বাধীনতার ধারণা নিয়ে মানবতাবাদীদের বাড়াবাড়ি যত বেশি হয়, রাষ্ট্রও তত বেশি ব্যক্তিমানুষকে শাসনে রাখতে ও তাদেরকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে-শিখিয়ে- পিটিয়ে ‘স্বাভাবিক’ মানুষে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর হয়।

না, আমার এত কিছু ভাবার দরকার নেই। মানবতাবাদে বিশ্ববাসীরা তাদের মতো করে মেগানদের কান্নার সময়ে তাদের দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিক, আমার অসুবিধা কী? আর মানবতাবাদের বিরোধীরা, যারা মানবতাবাদ ও মানবমুক্তির আন্দোলনের ধোঁকাটা বুঝে গেছে বলে নিজেদেরকে দাবি করে, তারা বলতে থাকুক যে তুমি যে মেগানের জন্য মায়া দেখাচ্ছ, সেটার মধ্যে হয় আছে তোমার মেগানকে আচ্ছন্ন করবার লোভ, তোমার গোপন যৌন ইচ্ছা, না হয় নিজেকে পরোপকারী মানুষ হিসেবে নিজের ও অন্যের মনের আয়নায় দেখবার খায়েশ, কিংবা আরও বড় করে দেখলে তোমার এই মায়া, এই মানবিকতা মেগানদেরকে আরও বিরাট মায়ার জালে আটকে আটকে ফেলে এক ভুল পৃথিবীর মায়ায় পড়তে প্ররোচিত করবে শুধু, আর তখন মেগানরা তাদের বাবারা কেন নতুন ঘরের সন্তান পিটারদেরকে পেয়ে আগের ঘরের আদরের মেগানদেরকে ভুলে যায়, তা নিয়ে আফসোস করে করে একটা খর্বাকৃতির জীবন যাপন করবে শুধু।

না, বিষয়টা অনেক জটিল। এর ডিসকোর্স, এর পক্ষে – বিপক্ষের যুক্তি-কুযুক্তি অনেকগুলো। ক্ষমতা, যৌনতা, লিঙ্গবৈষম্য, পরিবার, বিজ্ঞান, ধর্ম, কবিতা, মিথ ইত্যাদি মিলে অনেক বেশি পরিমাণে ডিসকোর্স এখানে। আমি আলথুসারেই পড়েছি যে, এক কার্ল মার্ক্সের জীবনেই যে দুই কার্ল মার্ক্স, তা জার্মানির দুই ইতিহাসের দুই আলাদা মানুষ। তরুণ মার্ক্স একজন মানবপ্রেমী বা মানবতাবাদী, যিনি বিশ্বমানবের কল্যাণের আলগা স্বপ্নচারী তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন; আবার পরিণত মার্ক্সকে আমরা দেখি মানবাধিকার বিষয়ে ক্ষিপ্ত, ওসব মানবাধিকার-টাধিকারকে তিনি বলছেন ইউটোপিয়ান, ঝিমধরা-আদর্শবাদী রোমান্টিকতা। মানবাধিকারবাদীরা যে ডি-হিউম্যানাইজেশনের বিরুদ্ধে লড়তে চায়, সেটার থেকেই উদ্ভূত ওই মানবাধিকার। আলথুসারের কাছ থেকে আমি শিখেছি যে পরিণত মার্ক্স ‘বিশ্বাস করতেন, পুঁজিবাদী ভোগ ও সম্পদ অর্জন এবং সেই সম্পদ আঁকড়ে রেখে সম্পদের ব্যক্তিমালিকানাকরণের এই সমাজে মানুষ স্বার্থপর ও আত্মপ্রেমী হতে বাধ্য, অতএব, তাদের পরস্পরের মধ্যে নিরন্তর ঠোকাঠুকি হওয়াটাই স্বাভাবিক, আর তাই তাদের দরকার পড়েছে কতগুলো মানবাধিকারের, যাতে করে তারা এই লোভী নিজেদেরকে অন্য লোভীদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে কিছুটা।

স্যামুয়েল আমার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটালেন। তিনি আমার হাঁটুতে জোর বাড়ি মেরে বললেন, ‘লেট আস গো অ্যান্ড টক টু মেলিন্ডা। হোয়াট ডু ইউ সে?’ স্যামুয়েল তার মানে স্বপ্ন দেখছেন মেগান ও মেলিন্ডার মধ্যে মিল করিয়ে দেবার।

আমি বললাম, ‘না।’

আমার মনে হলো স্যামুয়েলের প্রস্তাবের চাইতে আমার না-টাই বরং মেগানের ভালো লেগেছে বেশি। আমার খুব ইচ্ছা করতে লাগল মেগানের কান্নার বার্নিশ-রং মেশা ফোলা ফোলা গাল দুটো আমি একটু টিপে দেব এবং তার মাথার পেছনের তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ চুলগুলো হালকা মুঠো করে ধরে, তার পেছন দিকটায় বসে, তার কানের মধ্যে মুখ নিয়ে আমি তাকে সিমাস হিনির একটা তীব্র প্রেমের খাঁটি আইরিশ কবিতা (সারবত্তা অর্থে) আবৃত্তি করে শোনাব। আর ঠিক তখন, আমার কবিতা পড়া শেষ হলে, এ রকম রাস্তার আন্দোলন করে করে পৃথিবীর রং-ঢং-নাটক সম্বন্ধে তার কিছুটা ধারণা হয়ে গেছে বলে সে আমার কোমরের নিচ দিকে তাকিয়ে আমাকে বলে বসবে : ‘তুমি কী চাও, তা আমি জানি।’ আর তখন আমি তাকে উত্তরে বলব, ‘আজ থেকে তবে সাবধানে থেকো। মানবের জন্য মায়া একটা কথার কথা ছাড়া আর কিছুই না। এটা ধর্মবিশ্বাসের একটা ধর্মনিরপেক্ষ ভার্সন, মেগান। তোমাদের XR- এর পৃথিবী বাঁচানো কার্যকলাপও আমার এইমাত্র তোমার কানে কানে কবিতা পড়ারই মতন একটা কিছু। তুমি যেমন জানো আমি কী চাই তোমার কাছে, তেমন তোমার গেইল ব্র্যাডরুকরা কী চায়, তা আমি জানি।’

মঞ্চে আবার গান শুরু হয়েছে। স্ট্রিট লাইটগুলো সব এখন জ্বলছে। তার মানে রাত নেমেছে। স্যামুয়েল আমাকে বললেন, ‘রাত বেশি হলে তো তোমার আলথুসারের বাসা খুঁজে পেতে সমস্যা হয়ে যাবে। মে আই জয়েন ইউ?’

আমি স্যামুয়েলকে, একই সঙ্গে জোসেফ ও ফারজানাকে শুনিয়ে, বলে দিলাম যে আমি আলথুসারের ওই বাসায় এই দফা যাব না, পরে অন্য কোনো দিন যাব। স্পষ্টত ফারজানা খুশি হলো আমার এ কথা শুনে। ফারজানার মুখে উদ্ভাসিত খুশির আভা দেখে আমার মনে হলো, আমরা মানবতাবাদবিরোধী বা অ্যান্টিহিউম্যানিস্ট হতে পারি, তাতে ক্ষতি নেই, তবে আমাদেরকে ইনহিউম্যান বা অমানুষ হওয়া চলবে না।

ফারজানার হাসি হাসি মুখের উত্তরে আমি তাকে বাংলায় জানালাম, ‘সোজা এখন বাসায় যাব।’ শুনে আরও খুশি হয়ে উঠল ফারজানা এবং স্পষ্টত জোসেফও। তারা দুজনে আসলে ঝামেলায় পড়ে গেছে আমাকে নিয়ে, এমনটাই মনে হলো আমার; এবং যতক্ষণ আমরা ডাগেনহ্যামের বাসার তথাকথিত স্থির নিশ্চিতির মধ্যে না পৌঁছাচ্ছি, ততক্ষণ তাদের এ ঝামেলার ইতি নেই। এটা ভাবতে গিয়ে আমি বুঝলাম, জানি না কী করে বুঝলাম, মানুষের পক্ষে অমানুষ না হওয়ার ততক্ষণই সুবিধা, যতক্ষণ মানুষটা না জানে যে রাষ্ট্রের ও সমাজের কী কী যন্ত্র কীভাবে তাকে শেপ ও রিশেপ করে চলেছে।

স্যামুয়েল বুঝলাম আমার সঙ্গে খুব গল্প করতে চাইছেন। তার সঙ্গে আমার এই টানা গম্ভীর ও দূরে দূরে থাকাটাই আমার প্রতি তার আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এবং এর মধ্যে আবার আছে বাংলাদেশের একটা ছেলে হয়ে লুই আলথুসারে আমার আগ্রহী হওয়া, অন্যদিকে আলথুসার নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেই রহস্যময় এক ঢঙে আমার চুপ হয়ে থাকা। স্যামুয়েল আর পারলেন না। তিনি আমাকে বললেন, ‘কেন তুমি হঠাৎ তোমার মন বদলালে? তুমিই আমাকে বললে যে, ওই বাড়িতে ঘটা স্লিপওয়াকগুলোর মধ্যেই আছে আলথুসারের স্ত্রী হত্যার মূল কারণ। এত বড় একটা কথা আমাকে বললে তুমি, আর এখন বলছ ওই বাড়িতে তুমি যাবে না, এখান থেকে সামান্য দূরত্বের ওই বাড়ি?’

আমি একটু খাড়ামতো হলাম এবং আমার হালকা খাকি রং চিনোস প্যান্টের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলাম। একটা ফটোকপি করা কাগজ, আলথুসারের লেখা বই দ্য ফিউচার লাস্টস ফরএভার -এর একটা পৃষ্ঠা। আমি স্যামুয়েলকে বললাম, ‘শোনেন, আলথুসার কী লিখেছেন, শোনেন।’

‘হেলেন খুব সাদাসিধাভাবে আমাকে প্রস্তাব দিল যে আমি যেন তাকে মেরে ফেলি। এই কথাটা—এর হরর অচিন্তনীয়, এ কথাটার হরর অসহ্য অবর্ণনীয়-আমার শরীর কাঁপিয়ে দিল, আমি কাঁপলাম অনেকক্ষণ। কথাটা ভাবলে আমার এখনো কাঁপন ওঠে… আমরা দুজনে, একসঙ্গে, পৃথিবীর দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমাদের ছোট নরকটার হাঁসফাঁস বদ্ধতার মধ্যে বাস করতাম।…মানসিক বিভ্রান্তির এক সংকটজনক সময়ে আমি ওই নারীকে খুন করি যে ছিল আমার সবকিছু, যে আমাকে ভালোবাসত নিজে মরে যেতে চাওয়ার শেষ বিন্দু পর্যন্ত, কারণ আর বেঁচে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। কোনো সন্দেহ নেই যে আমার অবচেতন এক মুহূর্তে, বিভ্রান্তিভরা এক মুহূর্তে আমি তার হয়ে তাকে ওই “সেবাটা” দিয়ে দিই সেদিন, যে সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে সে কোনো ঝামেলা বা প্রতিবাদ করেনি, বরং ওটার থেকেই, ওটারই একপর্যায়ে তার জীবন নিভে যায়।’

স্যামুয়েল বিচলিত হয়ে পড়লেন আলথুসারের লেখা এই অনুচ্ছেদটা শুনে। তিনি বললেন, ‘আমি আলথুসারের অনেক প্রবন্ধ পড়েছি। আর সবার ক্ষেত্রে যেটা হয় যে, আলথুসার ও লেভি স্ত্রস পড়তে পড়তেই একসময় মিশেল ফুকোতে চলে গেছি। যাহোক, বলতে চাচ্ছি যে, এত আলথুসার পড়লাম, পড়ালাম কিন্তু আমি কিনা তার এই আত্মজীবনীটার কথা আসলে ওভাবে জানতাম না।’

আমরা আবার চুপচাপ। আমাদের সবার মন খারাপ হয়ে গেছে লেখাটুকু পড়ে। আমি শুধু ভাবছি প্যারিসের ইকোল নরমাল সুপিরিয়র বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্ল্যাটটার কথা, যেটাকে স্পষ্ট এক কাপট্যবর্জিত জীবন্ত নরক বলেছেন আলথুসার। আমাদের মধ্যে এই পৃথিবীতে আর কে কে আছে, যারা তাদের স্ত্রী ও বৃদ্ধা মা অথবা বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে (বা অন্য কোনো রিক্ত সম্পর্কের ফাঁপা নেই-নেই ভাব সঙ্গীকে নিয়ে) এ রকম নরকে বাস করে? পূর্ণত্ব কিসে? পূর্ণতা, ভরা-ভরা ভাব কোথায় ও কিসে? আমার হাত-পা কেঁপে উঠল আপাদমস্তক। এই হরর তার খুঁটিনাটিসহ এবং তার আনুপাতিক সমানুপাতিক দফায় দফায় ক্রমে ক্রমে কিস্তিতে কিস্তিতে টুকটুক করে আমাদের জীবনে–মা-বাবা, ভাই- বোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু এবং এমনকি নিজের সন্তান একে একে চলে যেতে থাকার এই জীবনে –বিরাজিত থাকা নিয়ে আমাকে কাঁপিয়ে তুলল এক ক্রমাগত থির থির স্পন্দনশীল মন্দ্রসপ্তকে। খুব ঢিমে লয়ের গা-ছাড়া সে সুর, কিন্তু তা কাছের ওই পিংক বোটটাকে এক লহমায় আমার কাছে অর্থহীন করে তুলবার জন্য যথেষ্ট।

কোত্থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে ফেরত এসেছে টিমোথি। সে আমাদের সঙ্গে বসে থাকা, নেশার ঘোরে ঝিম মেরে চন্দ্ৰাহত হয়ে বসে থাকা ডেনিসকে উত্তেজিত গলায় বলছে, ‘ডেনিস ডেনিস, বোটটার পেছন দিক দেখলাম এই প্রথম, মানে স্টার্নের দিকটা, ওই যে স্টার্নের বড়ি, কী যেন বলে ট্রানসম না যেন কী, ধুর, বাবার সঙ্গে এত দিন বোট ঘেঁটেও শিখিনি কিছু, ডেনিস ডেনিস, পিংক বোটের ওখানটায় কী অংশ, তার সঙ্গে ফাইট করে করে আমি জীবনে এত দূর লেখা, জানো?’

ডেনিস তার মাথা দুহাতের মধ্যে ধরে বসে আছে, তার কোনো সাড়াশব্দ নেই।

টিমোথি ডেনিসের মাথার চুলে হাত রেখে, কিছুটা আঁকড়ে ধরে বলল, ওখানে লেখা ‘বেরতা কাসারেস, তোমার রক্ত বৃথা যাবে না।’

ধুর। আমি বাংলায় বললাম ধুর এবং উঠে দাঁড়ালাম। অন্যদিকে আমাকে এক হাতে টেনে নামাতে চাইলেন প্রফেসর লুই স্যামুয়েল। তিনি বললেন, ‘যেয়ো না। লেটস অল হ্যাভ ডিনার টুগেদার। লেটস গো টু দ্য ম্যাকডোনাল্ডস বিসাইড দ্য মার্বেল আর্চ স্টেশন। হোয়াট ডু ইউ সে?’

আমি প্রফেসরকে বললাম, এটা আমার তাকে এবার বলতেই হতো, ‘আপনি আপনার তিমি মাছগুলো নিয়ে থাকুন, আপনি আমার বেরতা কাসারেসের রক্তের মূল্য পরিশোধ করা নিয়ে থাকুন। এ পৃথিবী এমনিতেই যথেষ্ট পরিমাণে চিরস্থায়ীভাবে নরক। এখন আপনাদের আমাকে এসব আন্দোলন করে করে এ পৃথিবীকে স্বর্গ বানানোর ইচ্ছার কথা বলে বারবার দেখিয়ে দিতে হবে না যে এ পৃথিবী আসলেই একটা নরক। আই অ্যাম সরি, আই অ্যাম সরি দ্যাট আই হ্যাভ স্পেন্ট অ্যান অলমোস্ট হাফ ডে উইথ দিজ মুভমেন্ট অব ইওরস। ইস সো সিলি, সো ফানি অ্যান্ড সো রিপ্রেসিভ টু।’

প্রফেসর দাঁড়িয়ে গেছেন। ডেনিস ও টিমোথি তার পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রফেসরের ব্যাগ অক্সফোর্ড স্ট্রিটে গত চার দিনে জমা হওয়া ধুলোময়লা খোসাটোসার মধ্যে পড়ে আছে। ফারজানা ও জোসেফ বসেই আছে। তারা আমার এই উত্তেজনাকর বক্তব্যের কিছুই টের পায়নি, কারণ তারা স্বামী-স্ত্রী সম্ভবত কথা বলছিল তাদের বাসার জন্য সাবান, শ্যাম্পু, পেঁয়াজের কলি ও গুঁড়া মসলা কেনা নিয়ে। মেগান আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। মনে হয় কোনো এক অজানা কারণে তার আমাকে কম নিপীড়ক এক পুরুষ বলে (যা কিনা তার ভুল অনুমান) মনে হয়েছে। প্রফেসর বিস্ফারিত চোখে আমার চোখের গভীরে তাকিয়ে আছেন। তাঁর দৃষ্টিতে যতটা না ক্রোধের নাটুকেপনা, তার চাইতে বেশি অবিশ্বাস ও অরুচি এবং স্পষ্টতই ধিক্কারজনক এক দেখতে না পারা বোধ। হ্যাঁ, আমাকে আর দেখতে পারছেন না তিনি (সহ্য করা অর্থে), যে আমি সারা দিন তার সঙ্গে ভালো করে কথা বলিনি, উল্টো তার ধারণায় কীভাবে কীভাবে যেন অনেক কথা বলা মেগানেরও কথা বন্ধ করে দিয়েছি এবং আবারও কীভাবে কীভাবে যেন আমার নীরবতা দিয়েই তার চাইতে বেশি আধিপত্য বিস্তার করেছি মেগানের ওপরে, এমনকি তার গায়ের একই রঙের চামড়ার পুলিশ অফিসার মার্কের ওপরেও। তিনি পুরো ৩৬০ ডিগ্রি লাটিমের মতো একবার ঘুরলেন। একমুহূর্তের জন্য আমার মনে হলো তিনি ঘোরার সময়টায় বুঝি তার মানবতার দুহাত দুপাশে প্রসারিত করে পাখি হবেন এবং ওভাবে তার ঘোরা পূর্ণ করবেন। কিন্তু না, হাত স্বাভাবিক রেখেই ঘুরলেন তিনি, আর ঘোরা শেষ হতে যেই আমার মুখোমুখি, আমার প্রতি অশ্রদ্ধাসূচক বিদ্রূপে ফেটে পড়লেন :

‘আমি আগেই বুঝেছিলাম, আগেই বুঝেছিলাম। কিন্তু না, আমার আরও আগেই বোঝা উচিত ছিল যে তুমি একটা মানবতার বিপক্ষে দাঁড়ানো পশু, যার কাছে কোনো কিছুরই আর কোনো অর্থ নেই স্রেফ ফোনের ক্যামেরায় কিছু গাছের ছবি অকারণে তোলা ছাড়া। তোমরা যে সিন্ডিকেটের অংশ, তার সঙ্গে ফাইট করে করে আমি জীবনে এত দূর এসেছি। কিছু একটা, কিছু একটা তো করার চেষ্টা করেছি (এ সময়ে আমার মনে হলো তাকে বলি যে, কে আপনাকে কিছু একটা করতে বলল? আপনি কিছু একটা না করলেও আমাদের চলবে ভ্রাতা!), আর তুমি ও তোমার মতো মানুষেরা আমাদেরকে না বুঝে অ্যানার্কিস্ট বলে গালি দিচ্ছ। আলথুসার পড়ে তুমি যে রাষ্ট্রযন্ত্র রাষ্ট্রযন্ত্র, নিপীড়ক রাষ্ট্রযন্ত্র ইত্যাদি করছ, তা তুমি কি মনে করো, আমি বুঝি না যে তুমি কী বলতে চাও? নিজেই দাঁড়িয়ে আছ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের ধারণার বিরুদ্ধে, কিন্তু তোমার এই আলথুসারের মতোই তুমি জানো না যে রাষ্ট্র ছাড়া কীভাবে আমাদের চলবে, এত এত কোটি লোককে কে কীভাবে লাইনে রাখবে। অ্যানার্কিস্ট তুমি। আমরা বায়োস্ফিয়ারের সবকিছুর সঙ্গে আত্তীকৃত যে হিউম্যান সাবজেক্টের কথা বলছি, তা নিঃসন্দেহে জাতিরাষ্ট্রগুলোর সব বর্ডার পার হয়ে বিশ্বমানব সংঘের কথা বলে, কোনো রাষ্ট্র রাষ্ট্র ভাগ ভাগ কৃত্রিমতার কথা বলে না। কিন্তু যা বলে, আমাদের কথাগুলো যা বলে, তা রাষ্ট্রের নতুন এক রূপের কথা, বর্তমান রূপের পরবর্তী এক আবিশ্ব রূপ এবং সেটা কোনোভাবেই আদিমতার কাছে যাওয়ার কথা না, ঘরবাড়ির পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস সব বন্ধ করে গুহায় গিয়ে বসে থাকার কথা না। আর তোমাদেরটা ক্ল্যাসিক্যাল অ্যানার্কি—রাষ্ট্রবিরোধী, রাষ্ট্রের ধারণাবিরোধী, অতএব অবাস্তব এবং মানবতাবিরোধী। ছি! কী জঘন্য মানুষের সব মানুষবিরোধী চিন্তাগুলো।’

তিনি থামলেন। আমার মায়া হলো ষাট ছুইছুই এ মানুষটাকে এত কথা বলতে হলো দেখে। আমি তার হাত ধরলাম। টিমোথি মাটি থেকে তুলে তাকে তার প্রিয় পানির বোতলটা দিল। মেগান আমার কানের কাছে একদম ঘন ফিসফিস (আমি তার শ্বাসে ইট চাপা দেওয়া ঘাস থেকে ইট সরানোর পরের মুক্ত হাওয়া চলাচলের একধরনের আশ্চর্যসুন্দর গন্ধ টের পেলাম) গলায় বলল, ‘ইউ শুড সে সরি টু হিম। হি ইজ টু নাইস আ ম্যান অ্যান্ড হি হ্যাজ নো বডি ইন দিস ওয়ার্ল্ড।’

তিনি এক ঝটকা মেরে আমার হাত সরিয়ে দিলেন এবং সোজা আমার মুখের একেবারে ওপরে এসে, কিছুটা পানি তার মুখের ভেতরে তখনো নিয়ে, বললেন (অতএব আমার সারা মুখ ভিজে গেল পানির ছোট ছোট অজস্র ফোঁটায়) : ‘আর তুমি আমাকে তিমি নিয়ে কী বলেছ? জানো তুমি কিছু? আদৌ কি জানো আমাদের “এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন” লোগোটার অর্থ কী? ওটা একটা আওয়ার-গ্লাস, বালুঘড়ি এক্সটিংকশনের সিম্বল। আমাদের এই হলোসিন যুগটার সিম্বল, যে যুগে সিক্সথ মাস এক্সটিংকশন, ষষ্ঠ সবচেয়ে বড় প্রাণিজগতের ও উদ্ভিজ্জগতের বিলুপ্তি চলছে আমাদের সবার চোখের সামনে দিয়ে—কোরাল রিফগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে, রেইনফরেস্টগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে, কী হারে কী হারে কী অসম্ভব হারে (তিনবার তিনি ইংরেজিতে অ্যাট হোয়াট আ রেট, অ্যাট হোয়াট অ্যান ইমপসিবল রেট কথাটা বললেন আমার মুখে তিন দফা পানি বৃষ্টি ঝরিয়ে, কারণ তিনি এখন বোতল থেকে পানি মুখে নিচ্ছেন এবং সোজা তারপরই কথা বলছেন; ক্রোধ থেকে তিনি ভুলেও গেছেন যে আমি কোনো বাথরুমের সিঙ্ক বা বাগানের গাছ না) বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে হাওয়াইয়ান কাক, পেয়রে ডেভিড হরিণ, মিলু হরিণ, লেদারব্যাক সি টারটল, ওরাংওটাং, গাছে চড়া ক্যাঙারু, কিলার হোয়েল অরকা, বাকিতা পরপয়েজের মতো অত বড় সুন্দর স্তন্যপায়ী মাছ, টুঘি ব্যাঙ, কোস্টারিকার সোনালি ব্যাঙ, ব্লুফিন টুনা, পঞ্চাশ ধরনের হাঙর, সাত ধরনের জঙ্গলবাসী মানুষের গোত্র, যার একটা থাকে তোমাদের বাড়ির কাছের আসামে। আহ্, কীভাবে সব বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে গ্লোবাল গ্রিনহাউস গ্যাস এমিশনে, জ্বলন্ত ফসিল ফুয়েলের চাপে, কয়লার পোড়ায়, ক্যাপিটালিজমের সফিস্টিকেড ট্রানজ্যাকশনের চাপে। আর তুমি (রাগে আমার কপালে তিনি একটা বড় পানির ফুঁ দিলেন এবার, আর উচ্চতায় তিনি আমার চেয়ে অনেক বেশি বলে আমার চুল কীভাবে যেন ভিজে গেল মাথার শুধু এক পাশে), তুমি আমাকে তিমি নিয়ে টিটকারি করছ? হ্যাঁ? চলো, তোমাকে আমি দেখাব, আমি তোমাকে দেখাবই।’

চিৎকার দিয়ে এ পর্যায়ে আমার হাত আঁকড়ে ধরলেন প্রফেসর স্যামুয়েল এবং প্রচণ্ড দ্রুতগতিতে ফুটপাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন বন্ড স্ট্রিট ট্রেন স্টেশনের দিকে।

জোসেফ ও ফারজানা দেরি করে ফেলেছে তাদের মধ্যকার সাংসারিক কথাবার্তা চালাতে থেকে, টিমোথি ও ডেনিস দেরি করে ফেলেছে তাদের আয়াহুসকা – জাতীয় সাইকেডেলিক ড্রাগসের চক্করে থেকে; কেবল মেগান, কেবল মেগান স্তম্ভিত পাথরমূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে আঁকড়ে থেকেছে আমার গা। সেইভাবে বাকিরা যখন হয় আমাদেরকে হারিয়ে ফেলে দিগ্‌ভ্রান্ত কিংবা ভিড়ের চাপে নিশ্চিত আমাদের থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়ার ফলে হতাশ, মেগান তখন ট্রেনের কামরায় আমার ও স্যামুয়েলের সঙ্গে। সে ট্রেনের কামরার পোল বাদ দিয়ে ধরে আছে আমার ১০০% সুতির শার্টের ডান হাতা, যখন কিনা আমার পুরো বাম হাতটা, কাঁধ-কনুই থেকে নিয়ে বুড়ো আঙুল পর্যন্ত, স্যামুয়েলের অধিকারে।

আমরা স্টেশনের পরে স্টেশন পার হচ্ছি—গ্রিন পার্ক, ভিক্টোরিয়া, ওয়েস্টমিনস্টার, জ্যাক দ্য রিপার, ঘোস্ট স্ট্রিট, বিয়ার ফ্লাড রোড, রুম থ্রি থ্রি থ্রি, উইনস্টন, পিগ উলফ, ক্রিপি ব্লক, ডেথ বেল, হেয়ার স্ট্রোকার, বোন হিল, উইপিং উইমেন হয়ে তারপর নর্থ গ্রিনিচ ছাড়িয়ে — কোন লাইনের কোন ট্রেন তা আমার কিছুই খেয়াল নেই, কারণ আমার মাথা ততক্ষণে ঘুরছে প্রবল ভারটিগো থেকে, যেহেতু আমার মোশন সিকনেস আছে ছোটবেলা থেকেই—আমরা এসে নামলাম সেন্ট্রাল লাইনেরই নতুন শেষ স্টেশন ব্লাডি স্কুলে।

টেনেহিঁচড়ে আমাকে স্টেশনের বাইরে নিয়ে এলেন প্রফেসর। মেগান আছে সঙ্গে। তিনি তার আন্ডারগ্রাউন্ডের অয়েস্টার কার্ডে আমাদের তিনজনেরই ট্রেনভাড়া মেশিনে চার্জ করেছেন এক ঝটকায়। একজন পুলিশ খানিক একটু আমাদের এদিকে আসতে যাচ্ছিল, কিন্তু তিনি তার প্রফেসরিয়াল কণ্ঠস্বরে এমনভাবে তাকে বলেছেন ‘উই আর ইন আ হারি’ যে, পুলিশটা ভয়ে পিছিয়ে গেছে তৎক্ষণাৎ।

ব্লাডি স্কুল স্টেশনের বাইরের রাস্তা সুনসান। একটা মানুষ নেই কোনো দিকে। স্ট্রিট লাইটের আলোতে শুধু চকচক করছে বিষণ্ন শত শত চায়নিজ উইংনাটগাছ — অন্য কোনো গাছ নেই রাস্তার, দূরের বা কাছের, কোনো পাশে। আশ্চর্য। যাহোক, আমরা একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। তিনজন লোক মাথা নিচু করে, স্পষ্ট কাঁদতে কাঁদতে বের হলো সেই বাড়ি থেকে। কিসের জন্য অপেক্ষা করছি আমরা? ঢুকছি না কেন? মেগান প্রফেসরকে বলল, ‘লেটস গো ইন স্যামুয়েল।’ প্রফেসর মেগানের ডান গালটা টিপে দিলেন এবং এই এতক্ষণে আমার হাত ছাড়লেন তিনি, কারণ তিনি জেনে গেছেন আমিও এত কষ্টের—দীর্ঘ এক ঘণ্টার—ট্রেন জার্নি শেষে তবে তাহলে সুতরাং অতএব দেখতেই চাই তিনি যা আমাকে দেখাবেন।

প্রফেসর আমাদের দুজনকেই বললেন, ‘ওয়েট অ্যান্ড ডোন্ট মেক ফেসেস। দে আর ওয়াচিং।’ আমরা বুঝলাম বাড়ির ভেতর থেকে দেখা হচ্ছে আমাদেরকে, সম্ভবত দুরবিন দিয়ে, সম্ভবত কোনো বড় টিভি স্ক্রিনে।

‘ওয়েট, দ্য ডোর উইল ওপেন। দ্য ডোর,’ বললেন স্যামুয়েল।

দরজা খুলল। এবার একজন মহিলা বের হলেন মুখ শক্ত করে, কিছুটা উদ্ভ্রান্ত-মাথা ও বমির ভাবের মতো কী একটা করতে করতে। প্রফেসর এই খোলা দরজাপথেই আমাদেরকে ঢুকিয়ে দিলেন, নিজেও ঢুকলেন।

আমরা একটা হলরুমে। তার পেছন দেয়ালে, সোজা আমাদের থেকে দূরে, গ্রাফিতি করে হিজিবিজি আঁকা XR HQ কথাটা। মানে Extinction Rebellion Head Quarters। আমরা সেটা দেখতে পাচ্ছি, কারণ কথাটা গ্লো করছে এই অন্ধকারে ফসফরাসের মতো, তাই। কী পেইন্ট ব্যবহার করেছে তারা এটা লিখতে? কোনো দিকে কোনো লোক নেই, ঘর অন্ধকার। রাস্তায়ও কোনো লোক ছিল না, রাস্তাও অন্ধকার ছিল, কিন্তু সেখানে আলো ছিল এর থেকে কিছু বেশি। বুঝলাম আমাদের চোখ সময় নিচ্ছে এই আলোয় অভ্যস্ত হতে। হয়ে যাবে। অপেক্ষা করতে হবে। ধৈর্য ধরতে হবে। আমি আমার একটু সামনে থাকা প্রফেসরকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এরপর? এখন কী? কোন দিকে যাব? আলো জ্বালালে একটু ভালো হতো না?’ প্রফেসর ঘুরে আমাকে বললেন—-আমি খেয়াল করলাম যে আমি তার মাথা ঠিকভাবে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু তার পানিতে ভেজা ঠোঁট চিকচিক করছে কোনো এক জায়গা থেকে পড়া এক একটু খানিক আলোয় – বললেন, ‘কোনো দিকে না। এখানেই। স্টপ টকিং। সামথিং উইল টেল ইউ দ্য ট্রুথ।’

কথাটা শুনেই আমি বুঝলাম কী সম্পর্ক তিনি এ কথার সঙ্গে টানলেন পিংক বোটটার গায়ে লেখা TELL THE TRUTH বাক্যের। আর তখনই, আমার চোখ তখনো কিছু দেখতে পাচ্ছে না স্বপ্নে বা দুঃস্বপ্নে দেখা ভাসা-ভাসা জবরজং ইমেজারিগুলোর মতো কিছু ডোরাকাটা, কিছু রেখাঙ্কিত, কিছু রঙে ছোপানো, কিছু ডট-ডিমকি-ফুটকি- বিন্দু-পয়েন্টে ভরা অ্যাবস্ট্রাক্ট জঙ্গলমতো কিছু একটা বা কিছু না একটা কিছু দেখা ছাড়া, আমি বুঝেও উঠতে পারিনি যে কী দেখছি, তার আগেই মেগান চিৎকার দিয়েছে, এমন এক তীক্ষ্ণ তীব্র চিৎকার যাতে করে এই মায়া-মমতাহীন পৃথিবীর পুরো চেহারাটার, মেগানের ভয় ও কান্নার মধ্য দিয়ে যেন, একটানা রেখায় আলেখ্য নির্মাণ হয়ে গেছে। আমি মেগানকে ধরলাম, তাকে এক টানা বলতে লাগলাম, ‘মাই ডটার, মাই ডটার, স্টপ, ইটস ওকে, ইটস ওকে, স্টপ।’

একটা বড় টেবিল, দৈর্ঘ্যে কমপক্ষে পঞ্চাশ ফুট হবে। একটা সাদাসিধা, বৈচিত্র্যহীন, পরিপুষ্ট টেবিল, রং গাঢ় খয়েরি, না, খাকি রং, পীত ধূসর, কিংবা আরেকটু পরে আমার চোখ এই আলোতে অভ্যস্ত হয়ে এলে যা হয়ে যাবে পাটকিলে, ইটে রং। হতে পারে। তো, একটা বড় টেবিল, তার দৈর্ঘ্য কমপক্ষে বায়ান্ন ফুট, আর প্রস্থ আমি দেখতে পাচ্ছি তবে মাপ বুঝতে পারছি না, কিন্তু এটা পরিষ্কার যে টেবিলটা নিশ্চিত চল্লিশ-পঞ্চাশ টন ওজন নিতে পারে। এত শক্তপোক্ত তার গড়ন, এত পৃথূদর, তাগড়াই তার ভাব। তো, সেই একটা বড় টেবিল, তার পাশে আমরা তিনজন এবং আমাদের থেকে অল্প দূরে আরও চারজন, সম্ভবত চারজন এবং সম্ভবত চারজনেরই যার যার হাত বিস্ময়ে যার যার মুখে চাপা দেওয়া এবং যারা কিনা মেগানের দিকে এমনকি তাকাচ্ছেও একবার-দুবার, আর বুঝতে চেষ্টা করছে এই স্বর্ণকেশী ব্রিটিশ মেয়েটার এ রকম শ্যামলা রং এশিয়ান বাবা হয় কী করে? তো, একটা বিরাট বড় টেবিল, যা কিনা কিছু দিয়ে ঢাকা না, যাতে কিনা কোনো টেবিলক্লথ বা কোনো খবরের কাগজটাগজ পাতা আবরণ নেই, এমনকি যার রাফ সারফেস সিরিশ কাগজজাতীয় কিছু দিয়ে ঘষা ও না এবং যার ওপরে কোনো রকম কোনো রঙের প্রলেপ ও দেওয়া হয়নি কোনো দিন, সে রকম ভারসাম্যপূর্ণ ও এই স্পষ্টত মেডিকেল রুমের মতো বানানো স্রেফ কার্যোপযোগী ঘরটাতে পড়ে আছে একটা বড় টেবিল, যা দেখে আমাদের সবার রক্ত জল হয়ে গেছে, আমরা ভীতিবিহ্বল, টেরাইজড কিন্তু সামান্যখানিক পরে শোকে বিরহোৎকণ্ঠিত ও শেষে ক্রোধে প্রকম্পিত হয়ে গেছি, তো সেই একটা বড় টেবিলে রাখা আছে একটা পূর্ণাঙ্গ, সম্পূর্ণ মাপের আসল বড় তিমি, আর আমাদের কানের কাছে, আমাদের দুজনের মাথার মাঝখানে পেছন থেকে ডাক্তারের মতো মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে আমাদের উদ্দেশে নিচুস্বরে কথা বলেই যাচ্ছেন প্রফেসর স্যামুয়েল :

‘স্তন্যপায়ী গোত্রের অ্যানিমেল, ফ্যামিলি এসক্রিখটিআইডে, জেনাস এসক্রিখটিয়াস গ্রে, তোমরা যাকে গ্রে হোয়েল বলে জানো, যার বাইনোমিয়াল নাম এসক্রিখটিয়াস রোবাস্তাস, এইটা তাদেরই একটা এবং এটাই, এই এটাই পৃথিবীর শেষতম ওয়েস্টার্ন নর্থ প্যাসিফিক হোয়েল, অর্থাৎ এশিয়ান গ্রে হোয়েল। এর আগে নর্থ আটলান্টিকের গ্রে হোয়েল প্রজাতি ইউরোপিয়ান কোস্টলাইনে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল ৫০০ খ্রিষ্টাব্দে, আর আমেরিকান কোস্ট লাইনে আঠারো শতকের শুরুর দিকে। আর এটা, এই যে টেবিলের ওপরে দেখছ যেটাকে, এটা এইমাত্র বিলুপ্ত হয়ে গেল, পারমানেন্টলি চিরতরে অনাদিকালের মতো এক্সটিংকট হয়ে গেল এই ২০১৯ সালের মার্চ মাসের ২০ তারিখে এসে, মানে আজ থেকে ঠিক এক মাস এক দিন আগে।’

আমি, মেগান তখনো ভয়ে জড়িয়ে আছে আমার বাহু, গ্রে হোয়েলটার গাঢ় স্লেট-গ্রে রঙের দিকে তাকালাম। আমাদের পাশটায় ওর সারা গায়ে ধূসর সাদা ছোট-বড় ফুটকি দেখলাম প্রায় বিশটা হবে, যদিও মেগান বলল যে সে এরই মধ্যে গুনে ফেলেছে ওর শরীরের এদিকে ও রকম ফুটকি মোট আছে বাষট্টিটা। আর আমরা দেখলাম আমরা নিজেদের অজান্তেই ওর মুখের দিকে হেঁটে যাচ্ছি, যখন কিনা আমাদের বাঁয়ের সেই লোকদের দলটা ওর মুখ দেখার পরে এখন দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের ওপাশে, তিমিটার ওই পাশের চোখটার কাছে। মেগান আমাকে তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকল তিমিটার মুখের কাছ থেকে। আমি তার আগে পর্যন্ত খেয়ালই করিনি যে কখন মেগান আমাকে ছেড়ে ওখানে চলে গেছে। তিমির মুখ হাঁ করা। প্রফেসর ওর মুখের ভেতরকার ঘন লোমের চিরুনিটা দেখিয়ে আমাদেরকে বললেন যে, একে বলে বেলিন— তিমির মুখ-অভ্যন্তরের ফিল্টার-ফিডার সিস্টেম, যা তিমিদের মুখ থেকে সব পানি বেরিয়ে গেলে পরে তার অসংখ্য ঘন লোম বা ঘন চিরুনির দাঁতের মধ্যে ওই বিশাল পরিমাণের পানির সঙ্গে ঢোকা মাছটাছগুলোকে মুখগহ্বরে আটকে রেখে দেয়। ‘ওগুলো খেয়েই বাঁচে ওরা’, বললেন প্রফেসর। ‘কিন্তু এই তিমিটা মারা গেছে খাবার না পেয়ে নয়, সে মারা গেছে তার নিঃসঙ্গতা থেকে, তার বাড়ি- ঘর-পরিবেশ, শব্দ, আলো, পানির তাপ সব বদলে গেছে বলে। এখন বিশ্বাস হলো?’

এতক্ষণে আমাদের নাকে তিমিটার গায়ের গন্ধ—-কিংবা তার সারা গায়ের পচন ঠেকাতে যে ওষুধ মাখানো হয়েছে, যে তেল, যে মলম, যে প্রলেপ লাগানো হয়েছে, তার কেমন একটা বুক-শুকনো গন্ধ—ভেসে এল। মেগান আমাকে প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘বাবা ছোটবেলা আমাদের দুই বোনকে ম্যানচেস্টার থেকে অনেক তামার-কাঁসার খেলনা এনে দিতেন, যেগুলো বানাত ম্যানচেস্টারের কী যেন এক খেলনা কোম্পানি। ওহ নাম মনে আছে, “মার্শাল টয়েজ ফর বয়েজ।” মা বলতেন, তুমি মেয়েদের জন্য ছেলেদের খেলনা কেন আনো বারবার? তো, এর গায়ের থেকে সেই খেলনার কপার, ইস্পাত, পিগ আয়রনের গন্ধটা পাচ্ছি আমি। একদম সেই ছোটবেলার গন্ধ।

আমি মেগানের কথার উত্তরে কিছু বললাম না, যেহেতু কথাটা তার আসল বাবাকে নিয়ে, আর আমি হচ্ছি কিনা তার হঠাৎ ঘটে যাওয়া, হঠাৎ হয়ে যাওয়া এ মুহূর্তের বাবা। কে জানে? আর আমার ভালোও লাগছে না ফ্যামিলি, মা- বাবা, পরিবার এসব কথা শুনতে। আলথুসার বলেছেন, পরিবার একটা বড় আইএসএ, আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস, আদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র। বলেছেন, পরিবার শেষমেশ রাষ্ট্রের পারপাসই সার্ভ করে। তার মানে মা- বাবার স্নেহ-টেনেহ সব মিথ্যা। তিমিদের পরিবারের বেলায় কী বলতেন আমার আলথুসার? ভাবলাম আমি। ভেবে কোনো কূলকিনারা পেলাম না। ওদের আবার কী রাষ্ট্রযন্ত্র? সম্পূর্ণ অন্যের দয়ার ওপরে নির্ভরশীল কারও ক্ষেত্রে এই ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের’ ধারণা আদৌ কি কাজ করে নাকি? মানুষ বিষয়টাই তো ওদের জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র। না, হলো না। এত সিম্পল হতে পারে না দার্শনিক ধারণাগুলো, যার মধ্যে কিনা বিমূর্ত একটা ভাব থাকতেই হয়।

আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল মেগানের ‘উহ্-উহু-উহ্’ কান্না শুনে। সে এই মৃত তিমির টেবিলটা ধরে কাঁদছে তার বাবা ও বোনের জন্য, কিংবা মানুষের সাপেক্ষে এই ধারণা- অযোগ্য রকমের বিশাল, অর্থাৎ মানুষের কাছে একদম গোড়ায় গিয়ে অর্থহীন, প্রাণীটার জন্য।

আমরা তিমিটার দাঁত-মুখ ছেড়ে এবার ওর চোখের সামনে দাঁড়ালাম, চোখের পাশে দাঁড়ালাম। ফাইনালি। অবশেষে। আমি ওর মলিন, নিরেট কিন্তু এলানো, তবে নিশ্চিত স্ফটিকীভূত চোখের গভীরে তাকানোর বৃথা চেষ্টা করলাম শুধু। না, তিমিটার চোখ দানা বেঁধে গেছে। অতএব ওই চোখের মৃত সারফেসে তাকিয়েই আমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হলো। তবে যেই না আমি চোখ থেকে ঘুরব, কেমন একটা বুদ্বুদ দেখলাম যেন আমি ওর ওই মরা চোখের মধ্যে। ততক্ষণে মেগান ও স্যামুয়েল তিমির চোখ ছেড়ে আমার অন্য পাশে চলে যাওয়ার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ টের পেয়ে আমাকে ছেড়ে বেশ খানিকটা দূরে হেঁটে গেছে, আমি তাকিয়েই আছি সেই বুদ্বুদটার দিকে, মেগান ওই দূর থেকে আমাকে ডাকছে, ‘কাম হিয়ার, কাম হিয়ার, সি হোয়াট আ ডিজাইন অন দিস সাইড অব ইটস বডি,’ আর আমি শুনলাম তিমিটা আমাকে মোটামুটি স্পষ্ট এক গলায়, তিমিদের রীতিসম্মত এক গলায় এবং এত বড় প্রাণীর কণ্ঠের বিধানানুসারেই অনেক ক্ষীণবল ও কিছুটা মন কষাকষি ভরা এক গলায় বলল, ‘মেয়েটার জন্য তো দেখি তোমার ভালোই কুটিল মায়া। সব তাহলে একই রকম।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *