দরজার পাল্লাটা খোলাই ছিল। অধস্তন একজন পুলিশ অফিসার আর দুজন পুলিশকর্মীকে নিয়ে ঘরের ভিতর পা রাখলেন অ্যাডিশনাল কমিশনার ধৃতিমান। তখনও এ.সি. চলছে ঘরটাতে। শীতল বাতাস ঘুরে বেড়াচ্ছে বৈভবপূর্ণ ঘরটার ভিতর। ঘরের ঠিক মাঝখানে সেগুন কাঠের তৈরি একটা দামি খাট, আর তার ঠিক ওপরে সিলিং—ফ্যানের থেকে ঝুলছে একটা মেয়ে। ওড়নাটা চেপে বসেছে তার গলায়, মাথাটা একদিকে কাত হয়ে আছে, চোখের মণি দুটো যেন ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, বেরিয়ে এসেছে জিভের অর্ধেকটা।
ঝুলন্ত মেয়েটার দিকে তাকাতেই ধৃতিমানের দীর্ঘ পুলিশ জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁকে জানিয়ে দিল মেয়েটার শরীরে আর প্রাণ নেই। অন্তত ঘণ্টা তিন—চার আগে মৃত্যু হয়েছে মেয়েটার। খাটের এক পাশে একটা ছোট টুল কাত হয়ে পড়ে আছে। ঘরের ভিতর চারদিকে ঘুরে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন ধৃতিমান। বিছানার চাদরটাও টানটান করে পাতা, ঘরটাতে এমন কোনো অসঙ্গতি ধৃতিমান বা অন্য কোনো পুলিশ কর্মীদের নজরে পড়ল না যা দেখে মনে হতে পারে যে মেয়েটাকে খুন করে বা জোর করে সিলিং—ফ্যান থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এ ব্যাপারটাকে সুইসাইড বলেই মনে হল ধৃতিমানের। বডির পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট এলেই অবশ্য ব্যাপারটা আত্মহত্যা কিনা তা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
ধৃতিমান সাধারণত এ ধরনের কেসগুলোতে স্পষ্ট ভিজিট করেন না। স্থানীয় থানাই ব্যাপারগুলো দেখে। কিন্তু এই মাঝরাতে লালবাজার থেকে ধৃতিমানকেও ছুটে আসতে হয়েছে এই কারণে যে, এই ঝুলন্ত মেয়েটির বাবা অপরেশ সিংহ কলকাতার অত্যন্ত খ্যাতনামা ব্যবসায়ীই শুধু নন, হাই সোসাইটি, বিশেষত উপরতলার রাজনৈতিক মহলের সঙ্গেও তার যথেষ্ট যোগাযোগ আছে। এ কেসটা ঠিকভাবে হ্যান্ডেল না করলে পুলিশ বিভাগকে জবাবদিহি করতে হতে পারে গভর্নমেন্টের কাছে।
ধনী ব্যবসায়ীর দামি কার্পেট মোড়া ড্রইংরুম। মহার্ঘ সোফাসেট, টেবিল চেয়ার। দেওয়ালে ঝুলছে ফ্রেমে বাঁধানো অয়েল পেন্টিং, মাথার ওপর ঝাড়বাতি। একটা সোফায় বসে আছেন অপরেশ সিংহ আর মিসেস সিংহ। অপরেশ সিংহ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কার্পেটের দিকে, শূন্য দৃষ্টি। আর মিসেস সিংহ অঝোরে কেঁদে চলেছেন। তাঁকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছেন এক ভদ্রমহিলা।
সে ঘরে স্থানীয় থানার অফিসারকে নিয়ে ঢোকার পর কয়েকমুহূর্ত চারপাশের পরিবেশের দিকে তাকিয়ে নিয়ে ধৃতিমান বললেন, ‘মিস্টার সিংহ, আমি বুঝতে পারছি যে এ অবস্থায় আপনাদের পক্ষে কথা বলা খুবই বেদনাদায়ক, তবুও কর্তব্যের খাতিরে কয়েকটা প্রশ্ন আমাকে করতে হবে।’
ধৃতিমানের কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলেন অপরেশ সিংহ।
ধৃতিমান প্রথমে জানতে চাইলেন, ‘কোনো সুইসাইড নোট পেয়েছেন কি? আমাদের ব্যাপারটা দেখে প্রাথমিকভাবে অনুমান হচ্ছে এটা সুইসাইড কেস।’
প্রশ্ন শুনে অপরেশ সিংহ উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে একটা কাচের টি—টেবিল থেকে মোবাইল ফোন চাপা দেওয়া একটা কাগজ টেনে নিয়ে ধৃতিমানকে দিয়ে বললেন, ‘কিছুক্ষণ আগেই পেলাম। এ ভাবেই মোবাইল ফোন চাপা দেওয়া অবস্থাতেই এ টেবিলে রাখা ছিল। হ্যাঁ, এটা আমার মেয়ে ইপ্সিতারই হাতের লেখা।’
ধৃতিমান কাগজটার দিকে তাকালেন। খাতা থেকে ছেঁড়া একটা পাতা। তাতে মেয়েলি হাতে গোটাগোটা হরফে লেখা সামান্য কয়েকটা কথা ‘মা, বাপি, তোমরা খুব ভালো থেকো। আমার জন্য কষ্ট পেও না। আমি খুব ভালো থাকব। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।— ইপ্সিতা।’
কাগজটাতে চোখ বুলিয়ে নেবার পর ধৃতিমান জানতে চাইলেন, ‘আপনারা কীভাবে এই দুর্ঘটনার খবর জানতে পারলেন। এ ফ্ল্যাটে কে কে থাকেন?’
অপরেশ সিংহ বললেন, ‘আমি, আমার স্ত্রী, আর মেয়ে। বাইরের লোক বলতে একজন বয়স্কা পরিচারিকা। দশ বছর ধরে আমার বাড়ি কাজ করছেন। সে অবশ্য সকাল আটটায় আসে, সারাদিন থেকে রান্না, ঘর গোছানো ইত্যাদি কাজ করে রাত আটটা নাগাদ চলে যায়। আমি প্রচণ্ড ব্যস্ত মানুষ, আমার স্ত্রী ছন্দাও ইদানীং কয়েক বছর ধরে একটা বড় প্রোডাকশন হাউসে টিভি সিরিয়াল করছে। ওরও এখন খুব ব্যস্ত সিডিউল। আমাদের দুজনেরই ফিরতে বেশ রাত হয়। পরিচারিকা চলে যাবার পর মেয়ে একলাই বাড়িতে থাকে। আমরা ফিরলে মেয়েই দরজা খুলে দেয়।
আজ সারাদিন অনেক ক’টা বিজনেস কনফারেন্স ছিল আমার। আমি সারাদিনের কাজ মিটিয়ে সন্ধ্যাবেলা একটা ক্লাবে পার্টিতে গেছিলাম। এগারোটা নাগাদ সেখান থেকে বেরিয়ে টালিগঞ্জ—এর স্টুডিওতে গেলাম। ছন্দাকে নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের নীচে পৌঁছে ড্রাইভারকে গাড়ি গ্যারেজ করতে বলে আমরা ওপরে ফ্ল্যাটের দরজাতে আসি ঠিক বারোটা নাগাদ। দরজা ভিতর থেকে বন্ধই ছিল। বার কয়েক বেল দেবার পর যখন ও দরজা খুলল না, তখন ঘুমিয়ে পড়েছে মনে করে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে আমরা দরজা খুললাম। তারপর ওর ঘরে গিয়ে দেখি…।’ কথা শেষ করলেন অপরেশ সিংহ।
ধৃতিমান বললেন, ‘তার মানে আপনার পরিচারিকা চলে যাবার পরই সম্ভবত ও কাণ্ডটা ঘটায়। কত বয়স হয়েছিল আপনার মেয়ের।’
অপরেশ বললেন, ‘তিন মাস আগে সতেরোতে পড়েছে। ও আমাদের একমাত্র সন্তান ছিল।’
ধৃতিমান প্রশ্ন করলেন, ‘ও কেন এমন করল বলে আপনাদের মনে হয়? কিছু মনে করবেন না, আপনাদের স্বামী—স্ত্রীর মধ্যে কোনো অশান্তি? বা মেয়ের সঙ্গে কোনো মন কষাকষি?’
সিলিং—এর দিকে তাকিয়ে অপরেশ বললেন, ‘না, একদমই না, আমরা স্বামী—স্ত্রী নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি আর ও নিজের পড়াশোনা নিয়ে। এ বছর মেয়ের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেবার কথা ছিল। বাড়ি আসার পর আমি আর আমার স্ত্রী এতটাই ক্লান্ত থাকি যে কথা বলারই ক্ষমতা থাকে না, ঝগড়াঝাঁটি করব কখন। তাছাড়া আমাদের মেয়ে কখনও আমাদের মুখের ওপর কথা বলত না।’
জবাব শুনে একটু চুপ করে থাকার পর ধৃতিমান বললেন, ‘আপনাকে আরও একটা প্রশ্ন করছি কিছু মনে করবেন না। আজকাল এ বয়সি ছেলে—মেয়েরা অনেক সময় আবেগের বশে বন্ধুদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে। আপনার মেয়ের কোনো ফ্রেন্ডের সঙ্গে এমন ঘটনা হয়েছিল বলে জানেন?’
জবাবটা এল মিসেস সিংহর কাজ থেকে, ফুঁপিয়ে উঠে তিনি বললেন, ‘না, না, এমন কোনো ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়। স্কুলে, টিউশনের ব্যাচের সমস্ত বন্ধুদের সঙ্গেই ওর খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। ও কেন যে এমন করে বসল কিছুই বুঝতে পারছি না!’
অপরেশ তার স্ত্রী কথা শোনার পর সেই বক্তব্যকে সমর্থন করে বললেন, ‘হ্যাঁ, ও কেন যে এমন করল কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার পয়সার তো অভাব নেই। তাই ওর জন্য কোনো দিক থেকেই কোনো ত্রুটি রাখিনি। ভালো স্কুল, আসা যাওয়ার জন্য আলাদা একটা গাড়ি, ভালো খাওয়াদাওয়া, দামি পোশাক। ওকে কোনো দিন কিছু চাইতে হয়নি। এই তো ক’দিন আগে ওর জন্মদিনে আশি হাজার টাকা দিয়ে ওই মোবাইলটা কিনে দিলাম।’— এই বলে তিনি তাকালেন টেবিলের ওপর রাখা ফোনটার দিকে।
‘ও এটা তবে ওর ফোন।’— এই বলে টেবিল থেকে ধৃতিমান ফোনটা উঠিয়ে নিলেন। নামি কোম্পানির খুব দামি সেট। সেটা খোলার চেষ্টা করে ধৃতিমান বুঝতে পারলেন পাসওয়ার্ড বা স্কিনটাচ সিস্টেম দিয়ে ফোনটা লক করা আছে। তা দেখে তিনি জিগ্যেস করলেন, ‘আপনারা ফোনটা খুলতে পারবেন? পাসওয়ার্ড জানা আছে? অনেক সময় এই ফোনের মাধ্যমেই কললিস্ট বা সোশাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্ট চেক করে অনেক বিষয় জানা যায়।’
ধৃতিমানের কথা শুনে স্বামী—স্ত্রী ঘাড় নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন তাঁরা ফোনের পাসওয়ার্ড জানেন না।
একটু ভেবে নিয়ে ধৃতিমান বললেন, ‘তদন্তের স্বার্থে ফোনটা আপাতত আমি আমার কাছে রাখছি। দেখি, পুলিশ ডিপার্টমেন্টের এক্সপার্টদের দিয়ে ফোনটার পাসওয়ার্ডগুলো ব্রেক করে কোনো তথ্য সংগ্রহ করা যায় কিনা? ফোনটা পরে ফেরত পেয়ে যাবেন।’
অপরেশ সিংহ বলে উঠলেন, ‘মেয়েটাই যখন চলে গেল তখন ওই ফোন নিয়ে আমাদের আর কী হবে? হ্যাঁ, নিয়ে যান।’ —একথা বলার পর আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না ভদ্রলোক। স্ত্রী কাছে এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে তিনিও এবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
তাদের মানসিক পরিস্থিতিটা বুঝতে অসুবিধা হল না ধৃতিমানের। যে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে তারই মতো একটা মেয়ে ধৃতিমানেরও আছে। বজ্রপাতের মতো এ ঘটনা যদি কোনো বাবা—মায়ের জীবনে নেমে আসে তবে তাদের মানসিক অবস্থা কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। স্থানীয় পুলিশকর্মীদের কিছু নির্দেশ দিয়ে মোবাইলটা নিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের দিকে রওনা হয়ে গেলেন ধৃতিমান। আজ রাতে তাঁকে সেখানেই থাকতে হবে। কাল কাকভোরে দিল্লি থেকে এক ভি.ভি.আই.পি আসবেন শহরে। তাকে নিয়ে পরদিন বিকাল পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হবে তাঁকে।
২
পরদিন সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সত্যি প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে কাটল ধৃতিমানের। আর সারাদিন এই ভি.ভি.আই.পি. এসকর্টের দায়িত্বে থাকার মধ্যেই তিনি খবর পেলেন অপরেশ সিংহর কন্যা ইন্সিতার মৃত্যু নিয়ে ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে আলোড়ন তৈরি হয়েছে। টি.আর.পি বাড়ানোর জন্য চ্যানেলগুলি এ ঘটনাকে আত্মহত্যার পরিবর্তে খুন বলে সন্দেহ প্রকাশ করছে! আর সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও সংবাদ মাধ্যমের এই প্রশ্নকে ইস্যু করে কলকাতা শহরে নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্ন তুলে সরকার ও পুলিশের মুণ্ডুপাত করছে।
সারাদিন ভি.ভি.আই.পি—র ডিউটি সামলে ধৃতিমান যখন রিপোর্ট দেবার জন্য হেডকোয়ার্টারে ফিরলেন তখন প্রায় সন্ধ্যা। কমিশনারের চেম্বারে ঢুকে রিপোর্ট পেশ করার পর পুলিশ কমিশনার তাঁকে বললেন, ‘আপনি তো কাল রাতে শিল্পপতি অপরেশ সিংহর বাড়ি গেছিলেন। ওর মেয়ে ইপ্সিতার মৃত্যু নিয়ে কিছু সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক দল অযথা জল ঘোলা করার চেষ্টা করছে। পুলিশকেও দোষারোপ করা হচ্ছে। আমি খবর নিয়ে দেখেছি পোস্টমর্টেম রিপোর্টে ব্যাপারটাকে আত্মহত্যাই বলা হচ্ছে। এটা খুন নয়। হোম ডিপার্টমেন্ট থেকে ব্যাপারটা সম্পর্কে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে। আমি তাদের পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা জানিয়েছি। তবু তারা চান এবং আমিও চাই যে আত্মহত্যার প্রকৃত কারণটা যাতে জানা যায়। সেটা খুঁজে বার করার দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে। দিন কয়েকের মধ্যেই রিপোর্টটা দিতে পারলে ভালো হয়, নইলে যত দিন যাবে ততদিন মিডিয়া আর সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো গুজব ছড়িয়ে চলবে। বুদ্ধিজীবীরা মোমবাতি হাতে রাস্তায় নেমে পড়বেন।’
কমিশনার সাহেবের কথা শুনে ধৃতিমান বললেন, ‘পোস্টমর্টেম রিপোর্টের সঙ্গে আমি একমত। গতকাল বডি দেখে, সুইসাইড নোট দেখে, বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলে আমি নিশ্চিত যে ব্যাপারটা আত্মহত্যাই। তবে আত্মহত্যার কারণটা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। ইপ্সিতার মোবাইলটা আমি নিয়ে এসেছি। মোবাইলের পাসওয়ার্ডটা ব্রেক করার জন্য আমাদের সাইবার এক্সপার্টদের কাছে পাঠিয়েছি। দেখি কাজটা হয়েছে নাকি। মোবাইলটা ঘেঁটে যদি ক্লু পাওয়া যায়!’
কমিশনার সাহেব বললেন, ‘হ্যাঁ, দেখুন। বেস্ট অফ লাক।’
কমিশনার সাহেবের চেম্বার থেকে নিজের চেম্বারে ফিরে ধৃতিমান তলব করার সঙ্গে সঙ্গে একজন অফিসার ঘরে ঢুকে মোবাইলটা টেবিলে নামিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, স্যার, পাসওয়ার্ড ব্রেক করা গেছে। স্থানীয় থানাতে ফোন করে মেয়েটার বেসিক ইনফরমেশন কালেক্ট করা হয়েছিল। মেয়েটার জন্ম তারিখই ওর পাসওয়ার্ড। ফেসবুক লগ ইন করা আছে। হোয়াটস অ্যাপেও আছে। কল লিস্টে অবশ্য ওর বাবা—মায়ের ফোন নম্বর ছাড়া গত তিন—চার দিনের মধ্যে অন্য কোনো নম্বর পাওয়া যায়নি। তবে হোয়াটস অ্যাপে আর ফেসবুক মেসেঞ্জারে বেশ কিছু মেসেজ আছে। এখনও ডিটেলে সেগুলো চেক করার সময় পাইনি স্যার।’ এই বলে অফিসার ফোনের পাসওয়ার্ডটা জানিয়ে দিলেন অ্যাডিশনাল কমিশনার সাহেবকে।
ধৃতিমান বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি নিজে ওগুলো চেক করে নিচ্ছি।’
ধৃতিমানের প্রথমে মনে হল যে তখনই তিনি মোবাইলটা খুলে দেখতে শুরু করেন। কিন্তু তার পরই খেয়াল হল তাঁর বাড়ি ফেরা দরকার। গতকাল সন্ধ্যা থেকে তিনি বাড়ির বাইরে আছেন। ধৃতিমানের স্ত্রীও উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার। সরকারি কাজেই তিনি দু—তিন দিনের জন্য কলকাতার বাইরে গেছেন। তার ফিরতে আগামীকাল সন্ধ্যা হবে। ধৃতিমানের বাড়ির দরজাতে একজন পুলিশকর্মীর চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা আর বাড়িতে একজন কাজের লোক থাকলেও বাপ—মা ছেড়ে মেয়েটা বাড়িতে একলাই আছে।
ধৃতিমানের একমাত্র মেয়ে পর্ণা। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে কলেজে ঢুকেছে সে। পর্ণার কথা মনে হতেই ধৃতিমানের মনে হল, না, তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। তিনি বাড়ি ফিরেই মোবাইলটা পরীক্ষা করবেন।— এ কথা ভেবে নিয়ে টেবিল থেকে ইপ্সিতার মোবাইল ফোনটা নিয়ে চেম্বার ছেড়ে বাড়িতে রওনা হবার জন্য বোরলেন।
ধৃতিমানের বাংলো অর্থাৎ সরকারি বাড়িটা সল্টলেক অঞ্চলে। সাড়ে সাতটা নাগাদ বাড়িতে ঢুকে মাঝবয়সি যে পরিচারক বাড়িতে চব্বিশ ঘণ্টা থাকে তার কাছে ধৃতিমান জানতে চাইলেন ‘ছোট দিদিমণি’ অর্থাৎ পর্ণা কী করছে?
পরিচারক জবাব দিল, ‘দিদিমণি নিজের ঘরেই আছে। মনে হয় পড়াশোনা করছে।’
ধৃতিমান এরপর জিগ্যেস করলেন, ‘কাল রাতে আর আজ দুপুরে ও ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেছে তো?’
‘হ্যাঁ, সাহেব।’ জবাব দিল লোকটা।
জুতো খুলে ধৃতিমান এরপর এগোলেন নিজের ঘরের দিকে। ধৃতিমানের ঘরের উলটো দিকেই পর্ণার ঘর। দরজার পাল্লাটা খোলা। ভারী পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভিতর আলো জ্বলছে দেখা যাচ্ছে। ধৃতিমানের একবার মনে হল পর্দা ঠেলে দেখা করে আসেন মেয়ের সঙ্গে। কিন্তু এর পরক্ষণেই তিনি ভাবলেন পর্ণা নিশ্চয়ই মন দিয়ে পড়ছে। তার মনোসংযোগ নষ্ট করা ঠিক নয়। লেখাপড়াতে বরাবরই খুব ভালো পর্ণা। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাতে দারুণ রেজাল্ট করেছিল। বন্ধু—বান্ধব তার বিশেষ নেই। সারাদিন লেখাপড়া নিয়েই থাকে।
ধৃতিমান আর মেয়ের ঘরে না ঢুকে নিজের ঘরে ঢুকলেন। ইউনিফর্ম ছেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই মোবাইল ফোনটা নিয়ে তার স্টাডিরুমে ঢুকলেন। পরিচারক এসে চা—বিস্কিট দিয়ে গেল। বেশ তৃপ্তি করে সময় নিয়ে চা পান করে তারপর মোবাইলটা নিয়ে কাজ শুরু করলেন তিনি। প্রথমে তিনি কল লিস্টটা খুললেন। গোটা দশেক ফোন কল আছে সেখানে। তবে সবই বলতে গেলে পুরোনো। আত্মহত্যার ঘটনার পাঁচ দিন আগে শেষ কলটা এসেছিল। ‘মাম্মি’ বলে নম্বরটা সেভ করা। সম্ভবত নম্বরটা মিসেস সিংহরই হবে। ধৃতিমান এরপর তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা খুললেন। সেটা লগ ইন অবস্থাতেই ছিল। প্রোফাইলে মেয়েটার হাসি মুখের ছবি। প্রথমে তিনি স্ক্রল করে টাইমলাইনের পোস্টগুলো দেখলেন। খুব বেশি পোস্ট নেই টাইমলাইনে। তাও সব পুরোনো পোস্ট। তার মধ্যে এমন কোনো পোস্ট নেই যা কোনো সন্দেহের উদ্রেক ঘটাতে পারে। ফোটো গ্যালারিতে মাত্র কয়েকটা ছবি। আর সেগুলো সবই পারিবারিক ছবি। এরপর ধৃতিমান মেয়েটার ফ্রেন্ডলিস্ট চেক করতে লাগলেন। বন্ধু সংখ্যা মাত্র পঁয়ত্রিশ। মেয়েটা খুব বেশি ফেসবুক অ্যাডিকটেড ছিল বলে মনে হয় না। ফ্রেন্ড লিস্টে যারা আছেন তারা সবাই প্রায় মেয়েটার আত্মীয়স্বজন, চার—পাঁচজন শুধু মেয়েটার স্কুলের বান্ধবী। ধৃতিমান তাদের সঙ্গে ইপ্সিতার চ্যাট রেকর্ডগুলো দেখতে লাগলেন। সেগুলোও প্রায় দিন পনেরো আগেকার কথোপকথন। অধিকাংশ কথোপকথনই সাধারণ। মৃদু ইয়ার্কি বা স্কুলে বা টিউশন ব্যাচের খবরাখবর নিয়ে কথোপকথন।
ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর মেয়েটার হোয়াটস অ্যাপটা খুললেন ধৃতিমান। বেশ কয়েকটা আন সিন মেসেজ জমা হয়ে আছে প্রথম দিকটাতে। এক এক করে হোয়াটস অ্যাপের চ্যাটবক্সের কথোপকথন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন হঠাৎই একটা হোয়াটস অ্যাপ অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা করতে গিয়ে তিনি থমকে গেলেন। অ্যাকাউন্টে কোনো মানুষের ছবি নেই, শুধু একটা সূর্যমুখী ফুলের ছবি আছে সেখানে। অ্যাকাউন্টের নম্বরটাতেও, অর্থাৎ যে মোবাইল নম্বরে অ্যাকাউন্টটা খোলা হয়েছে, সেটাও কোনো নামে নেই। নম্বরটা শুধু দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ ফোনবুকে এই মোবাইল নম্বরটা কোনো নামে তোলা নেই। চ্যাটবক্সটা খুলতেই ধৃতিমান দেখলেন ইপ্সিতার একটা ভিডিয়ো চ্যাট হয়েছে সেই নম্বরের সঙ্গে। সময়টা দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলেন ধৃতিমান। ভিডিওতে কথোপকথনের ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা আগে, অর্থাৎ গতকাল রাত আটটা নাগাদ। অর্থাৎ এরপরই আত্মহত্যা করে মেয়েটা! কার হোয়াটস অ্যাপ অ্যাকাউন্ট এটা? কনট্যাক্ট ইনফরমেশন খুলতে ধৃতিমান দেখলেন সূর্যমুখী ফুলের ছবির নীচে বাংলাতে একটা পরিচিত গানের লাইন লেখা আছে— ‘আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি নাচিবি ঘিরি ঘিরি, গাহিবি গান।’
ধৃতিমান অনুমান করলেন, এই ফোন নম্বরের হোয়াটস অ্যাপ অ্যাকাউন্টের মালিক সম্ভবত বাঙালি আর মহিলা হতে পারেন। চ্যাটবক্সের কথোপকথন ভালো করে দেখার জন্য তিনি আবার সেটা খুললেন। ঠিক এই সময় একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে ধৃতিমান দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলেন পর্ণা এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে।
ধৃতিমান তার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘সারা দিন ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেছিলি তো?’
পর্ণা জবাব দিল, ‘হ্যাঁ।’
ধৃতিমান জানতে চাইলেন, ‘তোর মা ফোন করেছিল?’
পর্ণা জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, একবার।’
এ কথা বলার পর পর্ণা বলল, ‘তোমাকে একটা ঘটনা বলব?’
ভ্রু কুঁচকে ধৃতিমান জানতে চাইলেন, ‘তোর কলেজের বা বাড়ির ব্যাপারে কিছু?’
পর্ণা জবাব দিল, ‘না, ওসব ব্যাপারে নয়, অন্য ব্যাপারে। একটু সময় লাগবে বলতে।’
ধৃতিমানের মনটা পড়ে আছে হাতে ধরা মোবাইলটার ওপর। আটটা বেজে গেছে। বাড়ি থাকলে ধৃতিমান সাড়ে আটটা নাগাদ খাবার খেতে বসে। মেয়ের কথা শুনে ধৃতিমান বললেন, ‘সময় লাগবে বলতে? আচ্ছা একটু পর ডাইনিং—এ বসে এক সঙ্গে খেতে খেতে তোর কথা শুনব। সাধন আঙ্কেলকে খাবার গরম করতে বল।’
ধৃতিমানের কথা শুনে প্রথমে মৃদু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর ‘আচ্ছা’ বলে পর্দার ওপাশে চলে গেল পর্ণা।
ধৃতিমান আবার নিজের কাজে মগ্ন হয়ে পড়লেন। চ্যাট বক্সটা স্ক্রোল করতে করতে ধৃতিমান অবাক হয়ে যেতে লাগলেন।
এমনিতে কথোপকথন না থাকলেও প্রতিদিন অন্তত একবার করে ইপ্সিতা ভিডিওতে দেখা দিয়েছে এই অচেনা নম্বরকে। বা এই নম্বরের পিছনে যে আছে সে দেখা দিয়েছে ইপ্সিতাকে। ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমেই সম্ভবত দুজনের মধ্যে রোজ কথাবার্তা চলেছে! মেয়েটা আত্মহত্যা করার দিন কয়েক আগে, দিনের বিভিন্ন সময় তিন—চার বারও ভিডিও চ্যাটে দেখা বা কথোপকথন হয়েছে তাদের দুজনের মধ্যে! ব্যাপারটা দেখে উত্তেজিত হয়ে ধৃতিমান ক্রমশ পিছিয়ে যেতে লাগলেন প্রথমের দিকে। শেষ পর্যন্ত তিনি পৌঁছে গেলেন মাস তিনেক আগের একটা তারিখে। যেদিন এই নম্বরটার ওপারে যে আছে তার সঙ্গে প্রথম সংযোগ ঘটে ইপ্সিতার। ভিডিও চ্যাট নয়, সামান্য কিছু কথোপকথন। সেই অজ্ঞাত পরিচয়ের নারী বা পুরুষের দিক থেকেই প্রথম আসে মেসেজটা। ‘ইপ্সিতা কেমন আছো? একটু কথা বলতাম তোমার সঙ্গে।’
ইপ্সিতা জবাব দেয়, ‘আপনি কে? আমার নম্বর কেথোয় পেলেন?’
ওপাশ থেকে স্মাইলি সহ জবাব আসে, ‘নম্বর পাওয়া আর এমন কী কঠিন ব্যাপার। তোমার ফেসবুকের ইনফরমেশনেই তো তোমার মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে। তবে নম্বরটা তুমি নিজেই আমাকে দিয়েছিলে।’
‘কবে? কোথায়?’ জানতে চায় ইপ্সিতা।
জবাব আসে, ‘মাসেখানেক আগে শপিংমলে পরিচয় হয়েছিল আমাদের। তুমি সেদিন একটা নীল রঙের কুর্তি কিনেছিলে। এবার বুঝতে পারছ আমি কে?’
ইপ্সিতা বলে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এবার চিনতে পেরেছি।’
ওপাশের জন বলে ‘আমার টাইপ করে কথা বলতে অসুবিধা। তোমার রুমে অন্য কেউ কি আছেন? নইলে ভিডিও কল করতাম।’
ইপ্সিতা উত্তর দেয় স্বচ্ছন্দে। ঘরে কেন, বাড়িতেই কেউ নেই। একলা লাগছে। আমারও কারো সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলতে ইচ্ছা করছে।’
এরপর আর কোনো কথা নেই। প্রথম দিন রাত আটটা নাগাদ শুরু হয়েছিল তাদের দুজনের মধ্যে প্রথম কথাবার্তা। তারপর গত তিনমাসে প্রতিদিন ওই ভিডিও চ্যাটে কথা হয়েছে। আর যা এসে শেষ হয়েছে ইপ্সিতার মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে।
ধৃতিমান ভাবতে লাগলেন, কী হতে পারে ব্যাপারটা? তার কেন জানি বেশ দৃঢ়ভাবে মনে হতে লাগল এই অজ্ঞাত পরিচয় নম্বরের সঙ্গে ইপ্সিতার মৃত্যুর কোনো না কোনো সম্পর্ক আছে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে চলল। সাড়ে আটটা থেকে ন’টা, তারপর সাড়ে ন’টা…।
ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেই যেতে লাগলেন ধৃতিমান। এই অদ্ভুত ভিডিও কলের কারণ কী হতে পারে আর ইপ্সিতার আত্মহত্যার সম্ভাব্য নানা কারণ ভাবতে লাগলেন ধৃতিমান। ওই সূর্যমুখী ফুলের ছবি আর পরিচিত গানের লাইনটা ছাড়া আর কোনো তথ্য দেওয়া নেই অজ্ঞাত পরিচয় মানুষটার হোয়াটস অ্যাপ অ্যাকাউন্টে! অ্যাকাউন্টটা যার সে নিজের পরিচয় গোপন রেখেছে কেন? সে কি কোনোভাবে ব্ল্যাকমেল করা শুরু করেছিল ইপ্সিতাকে? সে জন্যই কি সে আত্মহত্যা করল? এ সব কথা ভাবতে ভাবতে ধৃতিমানের এক সময় খেয়াল রাত দশটা বাজে। তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন তিনি।
ডাইনিং রুমে এসে ধৃতিমান দেখলেন সাধন সেখানে একলা দাঁড়িয়ে আছে। ধৃতিমান তাকে বললেন, ‘ছোট দিদিমণি কই?’
সাধন জবাব দিল, ‘আপনার জন্য অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল দিদিমণি। তারপর আপনি এলেন না দেখে এই একটু আগে খাওয়া সেরে উঠে ঘরে ঢুকে দরজা দিয়ে দিল।’
কথাটা শুনে একটু মন খারাপ লাগল ধৃতিমানের। খাবার টেবিলে বসে মেয়েটার কথা শুনবেন বলেছিলেন তিনি। মোবাইলটা ঘাঁটতে ঘাঁটতে ব্যাপারটা ভুলেই গেছিলেন। কাল রাতের আগে মেয়ের কথাটা শোনার আর সম্ভাবনা নেই তার। কারণ, সকাল নটা নাগাদ ধৃতিমান অফিস যাবেন। পর্ণা অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে ঘুমায় বলে ঘুম ভাঙতে তার সকাল সাড়ে ন’টা বেজে যায়। তারপর সে তৈরি হয়ে দশটা নাগাদ কলেজে যায় গাড়িতে। এগারোটায় তার ক্লাস শুরু হয়।
ধৃতিমান জানতে চাইলেন, ‘কাল দিদিমণির কলেজ আছে কিনা জানো?’
পরিচারক জবাব দিল, ‘জিগ্যেস করেছিলাম। ছোট দিদিমণি বলেছে কলেজে যাবে কিনা ঠিক নেই।’
ধৃতিমান এরপর খাওয়া সেরে নিজের বেডরুমে ঘুমাতে চলে গেলেন। গত রাতে ঘুমাননি ধৃতিমান। ভি ভি আই পি ডিউটি করতে গিয়ে বেশ ধকলও গেছে। কাজেই বিছানাতে শুয়ে ইপ্সিতার আত্মহত্যার কেসটা ভাবতে ভাবতেই কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।
পরদিন সকালে ধৃতিমান যখন স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট খেয়ে অফিসে রওনা হবার জন্য ঘর থেকে বেরোলেন তখনও পর্ণার ঘরের দরজা বন্ধ। ঘুম ভাঙেনি পর্ণার। ধৃতিমান ভেবে নিলেন অফিসে পৌঁছে কাজের ফাঁকে একবার ফোন করে নেবেন পর্ণাকে।
৩
বেলা দশটা নাগাদ অফিসে পৌঁছে দেখলেন তার টেবিলে প্রতিদিনের মতোই বেশ কয়েকটা প্রথম শ্রেণির ইংরেজি—হিন্দি সংবাদপত্র রাখা রয়েছে। এক এক করে প্রতিটা কাগজ খুলতেই দেখতে পেলেন যে ইপ্সিতার ঘটনাটা আজকের সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় স্থান করে নিয়েছে। ইপ্সিতার মৃত্যু আত্মহত্যা নাকি খুন?— এক সাংবাদিকের প্রশ্নর জবাবে মিসেস সিংহ অসতর্কভাবে বলে ফেলেছেন যে, ‘আপনারা যখন অনেকে এটা খুন বলে ভাবছেন তখন খুন হতেও পারে। ওর আত্মহত্যার কোনো কারণ তো খুঁজে পাচ্ছি না।’
আর তার এই মন্তব্যকে সামনে রেখেই বাজার গরম করছে সংবাদমাধ্যম। পোস্টমর্টেম রিপোর্টের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে কয়েকটা সংবাদপত্র পুলিশের বাপবাপান্তও শুরু করেছে।
কাগজগুলো দেখার পর এক অফিসারকে ডাকলেন ধৃতিমান। ইপ্সিতার মোবাইল ফোনটা সঙ্গে করেই এনেছিলেন তিনি। হোয়াটস অ্যাপটা খুলে অফিসারকে তিনি সেই অজ্ঞাতপরিচয় ফোন নম্বরটা দিয়ে বললেন, ‘এই ফোন নম্বরটা কার তা জানার চেষ্টা করুন। আর সম্ভব হলে মোবাইল ফোনের টাওয়ার লোকেশনটাও।’
অফিসার ফোন নম্বরটা নিয়ে যাবার পর ধৃতিমানের মনে হল বাড়িতে একবার ফোন করে কথা বলতে হবে পর্ণার সঙ্গে। ধৃতিমান ল্যান্ড লাইনে ফোন করতেই সেটা ধরল সাধন। পর্ণা কোথায় জিগ্যেস করতে সাধন বলল, ‘দিদিমণি ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট খেয়ে স্নানে গেছেন। তাকে কিছু বলতে হবে?’
ধৃতিমান বললেন, ‘না, থাক। জরুরি কোনো ব্যাপার নয়। আমি পারলে ফোন করে নেব।’
ফোন রেখে এরপর ফাইলের মধ্যে ডুবে গেলেন ধৃতিমান। অন্য একটা মামলার জন্য এই ফাইলটা ঠিক করে সরকারের কাছে পাঠাতে হবে তাকে। কাজে ডুবে গিয়ে পর্ণাকে ফোন করতে ভুলেই গেলেন তিনি।
কাজ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হল একসময়। মাঝে একবার শুধু আধ ঘণ্টার জন্য কাজ থামিয়ে লাঞ্চ সেরেছিলেন ধৃতিমান। বিকাল চারটে নাগাদ ধৃতিমানের কাজ শেষ হল। আর তার পরপরই চেম্বারে প্রবেশ করলেন সেই পুলিশ অফিসার, যাকে সেই ধৃতিমান মোবাইল নম্বরটা সম্বন্ধে খোঁজ লাগাতে বলেছিলেন।
অফিসার ধৃতিমানকে বললেন, ‘মোবাইল কানেকশনটা কার নামে তা বার করা গেছে স্যার। সমর্পিতা বসু নামে একটা মেয়ের। একুশ বছর বয়স। ঠিকানা উত্তর কলকাতার একটা বাড়ি। মোবাইল ফোনটার বর্তমান টাওয়ার লোকেশনও ওই জায়গায় দেখাচ্ছে। যে ভোটার আই কার্ড দিয়ে মোবাইল কানেকশানটা নেওয়া হয়েছিল তার একটা ফোটোকপিও জোগাড় করেছি স্যার সেই মোবাইল কোম্পানি থেকে। কানেকশানটা বেশি পুরোনো নয়, মাত্র একবছরের। এই যে স্যার ভোটার আই ডি—র ফোটো কপি।’ — এই বলে তিনি একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন ধৃতিমানের দিকে।
ধৃতিমান ভোটার আইডেন্টেটি কার্ডটার ফোটোকপিটা হাতে নিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। হ্যাঁ, সমর্পিতা বসু নামের একটা অল্পবয়সি মেয়ের ছবি আছে সেখানে। তার সঙ্গে মেয়েটির বয়স, বাবার নাম আর ঠিকানা। কাগজটা ভালো করে দেখার পর ধৃতিমান বললেন, ‘ওয়েল ডান অফিসার। এবার এর পরের কথায় আসি। আমার ধারণা, ইপ্সিতার আত্মহত্যার সঙ্গে এ মেয়েটি কোনোভাবে যুক্ত। এ মেয়েটির সঙ্গে ইপ্সিতার নিয়মিত ভিডিয়ো কলে কথা হত। ইপ্সিতা আত্মহত্যা করার কিছুক্ষণ আগেও কথা বলেছিল সমর্পিতা নামের এই মেয়েটার সঙ্গে। যদি এই সমর্পিতার নামে কেউ এই মোবাইল কানেকশনটা ব্যবহার করে থাকে…।’
ধৃতিমানের কথার মাঝেই অফিসার বললেন, ‘তবে কী পুলিশ পাঠিয়ে মেয়েটাকে এখানে আনব?’
ধৃতিমান বললেন, ‘না, প্রথমেই এ কাজটা ঠিক হবে না। আগে দেখতে হবে ইপ্সিতার আত্মহত্যার জন্য এই মেয়েটি কোনো ভাবে দায়ী কিনা? সে প্রমাণ কিন্তু আমাদের হাতে নেই। আত্মহত্যার আগে কেউ কারো সঙ্গে কথা বলেছে শুধু সেই অভিযোগে তো আর কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় না। আমি আগে মেয়েটার সঙ্গে ইপ্সিতার আত্মীয়ের পরিচয়ে কথা বলতে যাব। সাদা পোশাকেই যাব। যদি দেখি মেয়েটার কথায় কোনো সন্দেহর ব্যাপার আছে তখন নয় আটক করা বা অ্যারেস্টের ব্যাপারে ভাবা যাবে।’
অফিসার জানতে চাইলেন, ‘কবে যাবেন স্যার?’
ধৃতিমান বললেন, ‘দেরি করা যাবে না। ঘণ্টা খানেক বাদেই যাব সেখানে। আপনি পাঁচ—ছ’জনের একটা ছোট টিম তৈরি করুন সেখানে যাবার জন্য। আর মনে রাখবেন সবাই ইউনিফর্ম না পরে সাধারণ পোশাকে সেখানে যাব। যাতে পুলিশ বলে প্রাথমিকভাবে আমাদের কেউ চিনতে না পারে।
৪
শীতের ছোট বেলা। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সন্ধ্যা নামতেই সাধারাণ পোশাকের একটা ছোট পুলিশকর্মীদের দল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ধৃতিমান। আলো ঝলমলে কলকাতা শহরের দিন শেষের ব্যস্ত রাস্তা। যানজট এড়িয়ে ধৃতিমানদের গাড়িটা যখন সে জায়গার কাছাকাছি পৌঁছল তখন পুরোপুরি অন্ধকার নেমে গেছে। বড় রাস্তায় গাড়িটা রেখে দুটো দলে ভাগ হয়ে গলিতে প্রবেশ করলেন তারা। রাস্তায় স্ট্রিট লাইট জ্বলছে ঠিকই, কিন্তু তাদের আলোগুলো কেমন যেন বিবর্ণ, ফ্যাকাশে ঠিক আশেপাশের বাড়িগুলোর মতোই। রাস্তায় লোকজনও খুব একটা নেই। গলি ধরে বেশ কিছুটা এগোবার পর একটা চায়ের দোকান চোখে পড়ল রাস্তার গায়ে। টিমটিমে আলো জ্বলছে। কয়েকজন বৃদ্ধ বৈকালিক ভ্রমণ সেরে দোকানের সামনে কেঠো বেঞ্চে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। ধৃতিমান ও তার সঙ্গী এক পুলিশ অফিসার তাদের কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন ‘আচ্ছা, দশ নম্বর বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?’
প্রশ্ন শুনে একজন বৃদ্ধ প্রশ্ন করলেন, ‘কেন বলুন তো? কোথা থেকে আসা হচ্ছে?’
এখনও এসব পাড়াগুলোতে বাইরে থেকে কেউ এলে খোঁজ খবর নেবার চল আছে। ধৃতিমান জবাব দিলেন, ‘বিরাটি থেকে আসছি। আমাদের একটা নিমন্ত্রণ আছে এ বাড়িতে।’
লোকটা বলল, ‘এ রাস্তা দিয়ে সোজা চলে যান, বাঁ—দিকে একটু বাঁক নিলেই এ পাড়ার যে বাড়ি ওটা। ওর পরই গঙ্গার ঘাট। তবে ও বাড়িতে কেউ থাকে না। নতুন এসেছে বুঝি?’
ধৃতিমান হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওরা নতুন এসেছেন।’ আর কথা না বলে সঙ্গীকে নিয়ে তিনি এগোলেন সামনের দিকে। চলতে চলতে তিনি চাপাস্বরে বললেন, ‘এমনও হতে পারে ফাঁকা বাড়ি পেয়ে কোনো দুষ্কৃতির দল ডেরা বেঁধেছে ওখানে। ইপ্সিতাকে ওরা ব্ল্যাকমেল করছিল। মিনিট খানেকের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেল সে বাড়িটার সামনে।
অন্য বাড়িগুলো থেকে কিছুটা তফাতে গঙ্গার একদম ধার ঘেঁসেই দাঁড়িয়ে আছে পুরোনো দিনের বিশাল বাড়িটা। পলেস্তরা খাসা। দোতলার কার্নিসের মাথায় একটা বটগাছ গজিয়েছে। দোতলার পাখিতোলা জানলাগুলো সব ভিতর থেকে বন্ধ। তবে সদর দরজা খোলা। ভিতরে আলো—আঁধারি খেলা করছে। এক ঝলক দেখলে অবশ্য বাড়িটাকে পরিত্যক্ত বলেই মনে হয়। বাড়িটার সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন ধৃতিমানরা। তাদের পিছনের দলটাকে দেখতে পেয়েই ধৃতিমান ইশারায় তাদের গলির মুখে দাঁড়াতে বললেন। গলির বাঁক আগলে দাঁড়িয়ে পড়ল তারা। সঙ্গের পুলিশ অফিসারকে নিয়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলেন ধৃতিমান। প্রথমে হল ঘরের মতো বড় ঘর। তার পাশ দিয়ে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে ওপর দিকে। পুরোনো আমলের কাঠের সিঁড়ি। ধৃতিমান আর অফিসার, দুজনের সঙ্গেই সার্ভিস রিভলবার আছে। সিঁড়ির মুখটাতে অফিসারকে পাহারায় দাঁড় করিয়ে রেখে ধৃতিমান ওপরে উঠতে শুরু করলেন।
দোতলায় উঠে এলেন তিনি। সামনে একটা লম্বা বারান্দার দু—পাশে সারবদ্ধ ঘর। কোথাও কোনো শব্দ নেই। তবে বারান্দার শেষ প্রান্তে একটা ঘরের ভিতর থেকে যেন একটা ক্ষীণ আলোকরেখা বাইরে আসছে! ধৃতিমান নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন ঘরটার সামনে। দরজার পাল্লা খোলা। একটা আলো জ্বলছে ঘরে। যদিও সেটা মাঝে মাঝে দপদপ করছে। পাল্লার আড়াল থেকে ঘরের ভিতরে তাকালেন ধৃতিমান। মাঝারি আকৃতির ঘরটার মাঝখানে একটা সোফা আর বেশ কয়েকটা চেয়ার আছে। সোফাতে একটা মেয়ে বসে আছে। পরনে চুড়িদার আর ওড়না। হাতে ধরা একটা মোবাইল ফোনে সে কী যেন দেখছে। ধৃতিমানের পুলিশের চোখ, তিনি একঝলক তার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলেন এই মেয়েটাই সে মেয়ে, যার নামে মোবাইলের সিমটা তোলা হয়েছিল। এই মেয়েটিই সমর্পিতা।
নিজের কর্তব্য ঠিক করে নিলেন ধৃতিমান। মেয়েটাকে প্রাথমিক অবস্থায় কী পরিচয় দেবেন তাও তিনি ভেবে রেখেছেন।
ধৃতিমান মেয়েটার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য দরজার পাল্লাতে মৃদু টোকা দিলেন। মেয়েটা মোবাইল থেকে চোখ তুলে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কে?’
ঘরের ভিতর মুখ বাড়িয়ে ধৃতিমান বললেন, ‘আমার নাম অজিত দে। আমি এ পাড়াতেই থাকি।’
মেয়েটা যেন বিস্মিত হল না তাকে দেখে বা পরিচয় শুনে। সে বলল, ‘আসুন আঙ্কেল। ভিতরে আসুন, বসুন।’
ঘরের ভিতর পা রেখে একটু এগিয়ে গিয়ে মেয়েটার মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে বসলেন ধৃতিমান। মেয়েটা নিজের জায়গাতে বসল। ঘরটা একবার ভালো করে দেখে নিলেন তিনি। চেয়ার—সোফা ছাড়া অন্য কোনো আসবাব নেই। তবে ধৃতিমানের মুখোমুখি আরও একটা দরজা আছে সেখানে। সেখান দিয়ে মনে হয় অন্য ঘরে যাওয়া যায়। তবে দরজার পাল্লাটা এখন বন্ধ আছে। মেয়েটা এবার জানতে চাইল, ‘বলুন আঙ্কেল, কী বলবেন?’
সরাসরি ইপ্সিতার সম্পর্কে মেয়েটাকে প্রশ্ন করার আগে মেয়েটার সম্বন্ধে কায়দা করে জেনে নেওয়া দরকার। তাই ধৃতিমান হেসে বললেন, ‘আসলে আমি এ পাড়াতে দিন কয়েক হল ভাড়া এসেছি পরিবার নিয়ে। নতুন পাড়াতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে একটু পরিচয় হয়ে থাকা ভালো। তাই পরিচয় করতে এলাম। তুমি আমার মেয়ের বয়সি। তাই তোমাকে ‘তুমি’ করেই বলছি। তোমার নাম কী? তোমরা কি এ বাড়ির বাসিন্দা?’
মেয়েটা জবাব দিল, ‘আমার নাম সমর্পিতা। না, তেমন পুরোনো বাসিন্দা নই। দক্ষিণ কলকাতাতে আমাদের একটা ফ্ল্যাট আছে। আমি সেখানে একলা থেকে পড়াশোনা করতাম। এখন বছরখানেক ধরে এ বাড়িতেই আছি। বাবা মা দুজনেই আইটি সেক্টরে বড় চাকরি করেন। বাবা আছেন নয়ডাতে আর মা বেঙ্গালুরু। তাঁরা আমার জন্য অনেক টাকা খরচ করতেন কিন্তু আমাকে সময় দিতে পারতেন না। তাই আমি এখানে চলে এলাম।’
ধৃতিমান বললেন, ‘ও। তবে এ—বাড়িতে আর কে কে থাকেন?’
প্রশ্ন শুনে সমর্পিতা হেসে বলল, ‘আমি যখন প্রথম আসি তখন এ বাড়িতে একলাই থাকতাম। এখন অবশ্য আরও বেশ কয়েকজন সঙ্গিনী জুটিয়ে নিয়েছি। অবন্তিকা, মধুরিমা, আরও বেশ কয়েকজন সহচরী। ওরা সব প্রায় আমারই বয়েসের।’
ধৃতিমান প্রশ্ন করলেন, ‘ও, তবে তোমরা সবাই মেস বানিয়ে এখানে থাকো? তোমার সহচরীরা সব কোথায়?’
সমর্পিতা জবাব দিল, ‘মেস বলতে ঠিক যা বোঝায় তা ঠিক নয়। আসলে আমরা সবাই একসঙ্গে এখানে আনন্দ করে থাকব বলে এসেছি। ওরা এখনই চলে আসবে। একজনকে আনতে গেছে। সে আজ থেকে আমাদের সঙ্গেই থাকবে।’
ধৃতিমান মৃদু বিস্মিতভাবে বললেন, ‘আনন্দ করে থাকবে বলে এখানে এসেছ মানে?’
সমর্পিতা একটু চুপ থেকে জবাব দিল, ‘আনন্দ করে মানে আনন্দ করে। এই ধরুন অবন্তিকার কথা। মাস ছয় আগে আমিই তাকে প্রথমে ডেকে আনি। ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে। তার বাবা একজন বড় ডাক্তার আর মা নাম করা ফ্যাশন ডিজাইনার। এদের ব্যস্ত জীবন। মেয়েকে সঙ্গ দেবার সময় তাদের ছিল না। বেচারা অবন্তিকা একলা গুমরে মরত বিরাট বড় তাদের সেই বাড়িটাতে। তারপর একদিন আমার ডাক পেয়ে এখানে চলে এল। এখন তার কথা বলার লোকের অভাব নেই। দিব্যি আছে। অথবা মধুরিমার কথা বলি। আমাদের মধ্যে সব থেকে সে ছোট। মাত্র তেরো বছর বয়স। বাবা—মা দুজনেরই অনেক পয়সা। কিন্তু তাদের মধ্যে বিচ্ছেদের মামলা চলছে। পরিচারিকার তত্ত্বাবধানে একলা একটা বাড়িতে থাকত সে। ডাক পেয়ে চলে এল। এখানে আমরা যারা আছি সবার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা মোটামুটি একই। টাকা—পয়সার কোনো অভাব আমাদের ক্ষেত্রে বাবা—মা—রা রাখেননি। অভাবটা ছিল কথা বলার লোকের, সঙ্গীর। কতদিন আর ফেসবুক আর হোয়াটস অ্যাপে কথা বলে একাকিত্ব কাটানো যায়?’
ধৃতিমান এবার মেয়েটার কথা বুঝতে পারলেন। একাকিত্ব কাটাবার জন্য মেয়েগুলো একসঙ্গে এখানে আছে। ধৃতিমান বললেন, ‘কিন্তু তোমরা এখানে একসঙ্গে এভাবে যে আছ তাতে তোমাদের বাবা—মারা আপত্তি করেননি? ছেড়ে দিলেন তোমাদের?’
সমর্পিতা হেসে বলল, ‘আপত্তি করবেন কীভাবে? এখানে আসার আগে আমরা তো বাবা—মা কে জানিয়ে আসিনি। জানলে তাঁরা আমাদের আসতে দিতেন না। আমরা যে এখানে আছি তা তাদের জানা নেই। আরও বেশ কয়েকজন এখানে আসব আসব করছে আমাদের ডাক পেয়ে। তবে তাদের সাহসে কুলিয়ে উঠছে না। এখানে আসাটা তো সহজ ব্যাপার নয়। আমরাও প্রথমে খুব কষ্ট হয়েছিল এখানে আসতে। যারা এখানে আসে আমার মতো তাদেরও প্রথমে খুব কষ্ট হয়। সাহস সঞ্চয় করতে হয়।’
ধৃতিমান অবাক হয়ে গেলেন সমর্পিতার কথা শুনে। তিনি বললেন, ‘তার মানে তোমরা বাবা—মাকে না জানিয়ে এখানে লুকিয়ে আছ?’
একথা বলার পর তিনি এবার সমর্পিতাকে সরাসরি ইপ্সিতার সঙ্গে তার সম্পর্কের ব্যাপারে প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন নিজের পরিচয় দিয়ে। কিন্তু ঠিক সেই সময় ধৃতিমানের মুখোমুখি দরজাটা মৃদু শব্দ করে খুলে গেল।
সমর্পিতা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ওই যে ওরা ফিরে এসেছে তাদের নতুন সঙ্গিনীকে নিয়ে।
দরজা ঠেলে ঘরের ভিতর পা রাখল চার—পাঁচজন মেয়ে। আঠারো—কুড়ি বয়স হবে তাদের, একটা বাচ্চা মেয়েও আছে সে দলে। কিন্তু সবার পিছনে যে মেয়েটা ঘরে পা রাখল তাকে দেখে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন ধৃতিমান।
তিনি প্রচণ্ড বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তুই এখানে?’
মেয়েটা ধৃতিমানের দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল, ‘হ্যাঁ, বাবা। আমি এখানে চলে এলাম।’
ধৃতিমান বলে উঠলেন ‘তোর যে এদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে আমাকে বলিসনি তো? এখানে আসবি তাও তো বলিসনি? এদের সঙ্গে কত দিনের পরিচয় তোর?’
পর্ণা প্রথমে মৃদু বিষণ্ণভাবে বলল, ‘এই তো কয়েক মাসের পরিচয়। আমি তো কাল রাতে তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম এদের কথা। খাবার টেবিলে বসে কতক্ষণ অপেক্ষাও করলাম তোমার জন্য। তুমি শুনলে না আমার কথা। কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলে। মাকেও ফোন করেছিলাম। ফোন ধরল না। আমি ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না এখানে আসব কিনা? যদিও সমর্পিতাদিরা আমাকে সাহস যোগাচ্ছিল তবুও খুব ভয় লাগছিল আমার। কাল যদি আমার কথা শুনতে তবে হয়তো বাবা এখানে আসতাম না। তোমার আর মা, দুজনেরই সময় খুব দামি।’
এ কথা বলার পর পর্ণা হেসে বলল, ‘এখন মনে হচ্ছে ভালোই হয়েছে। খুব ভালো এরা। বাড়ি থেকে সারাটা পথ কত গল্প করতে করতে এলাম। তুমি আর মা চিন্তা কোরো না। আমি খুব ভালো থাকব এখানে।’
পর্ণার কথা শুনে ধৃতিমান উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘কী বলছিস কী? তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? বুঝেছি এরা তোর ব্রেন ওয়াশ করে এখানে এনেছে। ইপ্সিতাকে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে। থানায় নিয়ে গেলেই এই সমর্পিতা আর তার দলবলের আসল মতলবটা বেরিয়ে আসবে। আর তার আগে তোকে বাড়ি পাঠাবার ব্যবস্থা করছি।’
‘কিন্তু ওর তো আর এখন বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়।’— নতুন একটা কণ্ঠস্বর শুনে ধৃতিমান দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলেন কখন যেন আরও একটা মেয়ে প্রবেশ করেছে ঘরে। সবার পিছনে দরজার ঠিক সামনেই সে দাঁড়িয়ে। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না ধৃতিমান। এই মেয়েটাকেই তো তিনি পরশু রাতে জিভ বার করা অবস্থায় ওড়নার ফাঁসে সিলিং—ফ্যানের সঙ্গে ঝুলতে দেখেছিলেন!— এ তো ইপ্সিতা! কিন্তু তা কী করে সম্ভব? ইপ্সিতার কি কোনো যমজ বোন আছে?
তিনি বলে উঠলেন, ‘তুমি কে?’
ঠিক সেই সময় ঘরের আলোটা দপ করে নিভে গেল। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার নেমে এল ঘরে। ধৃতিমান চিৎকার করে উঠলেন, ‘পর্ণা? পর্ণা? তুই কোথায়? কেউ পালাবার চেষ্টা করবে না। সারা বাড়ি পুলিশ ঘিরে রেখেছে।’
কিন্তু ধৃতিমানের কথায় কেউ কোনো সাড়া দিল না। শুধু ধৃতিমানের একবার যেন মনে হল একরাশ দমকা বাতাস অন্ধকার ঘরের মধ্যে মুহূর্তের জন্য পাক খেয়ে কোথায় মিলিয়ে গেল! তবে কি মেয়েগুলো অন্য দরজা দিয়ে ঘরের বাইরে পালিয়ে গেল?
ধৃতিমান তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা ধরে ছুটে এসে নীচে নামার সিঁড়ির মুখটাতে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘অফিসার, বাইরে যারা আছে তাদের ভিতরে ডাকুন। বেশ কয়েকজন মেয়ে আছে এ বাড়িতে। তারা আমার মেয়েকেও ভুলিয়ে এনেছে এখানে। অন্ধকারে সবাই লুকিয়ে পড়ল। কেউ যেন পালাতে না পারে। আর স্থানীয় থানাতেও খবর দিন।
অফিসার সঙ্গে সঙ্গে বাইরের দরজার কাছে গিয়ে পকেট থেকে হুইসেল বার করে বাজিয়ে দিলেন। ইঙ্গিত পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে গলির মুখের চারজন পুলিশকর্মী ছুটে এসে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করল। ধৃতিমানের নির্দেশ মতো তারা ওপরে উঠে এল। টর্চের জোরালো আলোতে বিদীর্ণ হয়ে যেতে লাগল অন্ধকার। মিনিট দশেকের মধ্যেই খবর পেয়ে আরও এক গাড়ি পুলিশকর্মী হাজির হল সেখানে। কাছেই পেট্রোলিং ডিউটিতে ছিল তারা। বাড়িটা ঘিরে ফেলে বাড়ির ভিতর শুরু হল যৌথ তল্লাশি। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর পর্ণা, সমর্পিতা বা অন্য একজন মেয়েরও সন্ধান মিলল না। পুলিশকর্মীরা ধৃতিমানকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘না, স্যার, কেউ নেই এ বাড়িতে।’
বিস্মিত ধৃতিমান বললেন, ‘তাহলে ওরা কোথায় পালাল? এ বাড়িতে দোতলা থেকে নীচে নামার তো একটাই রাস্তা। বাড়িতে ঢোকার রাস্তাও তো একটাই। আপনারা তো পাহারাতে ছিলেন!’
তারা কিছু জবাব দেবার আগেই ধৃতিমানের মোবাইলটা বেজে উঠল। ধৃতিমান পকেট থেকে ফোনটা বার করে দেখলেন তার বাড়ি থেকে ফোন এসেছে। তবে কি পর্ণাকে বাড়িতে না পেয়ে বাড়ি থেকে ফোন করেছে?’
ধৃতিমান ‘হ্যালো’ বলতেই পরিচারক সাধনের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘হ্যালো স্যার? আপনি কি অফিসে. এখনই বাড়িতে চলে আসুন।’ — সাধনের কণ্ঠস্বর যেন কেমন কাঁপাকাঁপা।
ধৃতিমান জানতে চাইলেন, ‘কেন কী হয়েছে?’
সাধন আতঙ্কিত স্বরে জবাব দিল, ‘একটু আগে ছোট দিদিমণির ঘরে গিয়ে দেখি দিদিমণি ওড়নার ফাঁস দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে! পর্ণা দিদিমণি আর বেঁচে নেই।’