আয়না – সন্মাত্রানন্দ
বেরিলী থেকে বাসে ক’রে টনকপুর যাবার রাস্তায় মাঝপথে পড়ে ‘খটিমা’ নামে একটা জায়গা। সেখানেই ফটোশুটের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলাম। কিন্তু খটিমা-তে পৌঁছানোর একটু আগেই রাস্তার দুপাশের বনের বাতাস লেগে মন পাগল হ’য়ে উঠল। অন্য যাত্রীদের গালাগালি গায়ে না মেখে আচমকা এই বনভূমির মধ্যে নেমে পড়লাম। এলোমেলো চুলগুলোর মধ্যে বাতাস আঙুল চালাচ্ছিল আর আমি চারিদিকের নয়নাভিরাম প্রকৃতির রূপ দুচোখ ভ’রে দেখে নিচ্ছিলাম। সাধে কী আর আমার স্কুলের কোলিগ প্রশান্তদা আমাকে বলেন, ‘পলাশ, বারো বছর মাস্টারি করেও ফটোগ্রাফির পাগলামিটা তোমার গেল না’? আসলে, শিক্ষকতা আমার পেশা হলেও, ফটোগ্রাফি আমার নেশা। না, আরও বেশী কিছু। আমার প্রাণ ৷ আর সেই প্রাণের টানে প্রতি বছর ত্রিপুরা থেকে গ্রীষ্মের ছুটিতে বেরিয়ে পড়ি নানাদিকে। এবার যেমন আমাকে টেনেছে উত্তরাখণ্ড ।
বনের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা শীর্ণ পথ চলেছে এঁকেবেকে। সেই পথ ধ’রে কখনো নিজের চোখ দিয়ে, কখনো ক্যামেরার চোখ দিয়ে দেখছি আর ছবি তুলছি। হলুদ পাখি, পাহাড়ি প্রজাপতি, পাইনের কোন্, আকাশের বুকে মাথা তোলা সেডার, দেওদার, রৌদ্রে ঝিলমিল ক’রে হেসে ওঠা সবুজ পাতা – কিছুই বাদ পড়ছে না। জায়গাটা উত্তরাখণ্ডের প্রবেশপথ, ভূপ্রকৃতিতে ইতিমধ্যেই হিমালয়ের ছাপ লাগতে শুরু করেছে। তবু আমার আগে ছবি তুলতে এর আগে এখানে কেউ এসেছে কিনা, বলতে পারি না ।
দুপুরে বাসে ওঠার আগেই বেরিলীতে লাঞ্চ সেরে নিয়েছিলাম। এখন চারটে ছাবিবশ। আরও কিছুক্ষণ আলো থাকবে। আপসোস হচ্ছে, আরেকটু আগে কেন এখানে পৌঁছাতে পারলাম না। দিনের বিভিন্ন সময়ের ছবিতে যে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা তৈরী হয় —এটা লক্ষ্য করেছি। আমার ফটোগ্রাফার বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজনকে দেখেছি, ক্যামেরায় চোখ রাখতে রাখতে নিজের চোখে দেখতেই ভুলে যায়। কিন্তু আমার মনে হয়, নিজের চোখে ঠিকমত দেখতে না শিখলে, ক্যামেরা আমাকে দেখতে শেখাতে পারবে না ।
হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনস্ক হয়ে লক্ষ্য করিনি, একটা অদ্ভুত অনুচ্চ টিলার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি আমি । চারপাশের প্রকৃতির সঙ্গে কেমন যেন বেমানান। টিলাটা রুক্ষ, সবুজের চিহ্ন বর্জিত। বড় বড় পাথর মাথা উঁচিয়ে আছে, পাথরের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে পাহাড়ি ফার্ন। টিলার উপরে একটা ঘুপচি মত ঘর। উপরে ওঠার জন্যে পাথর কেটে ধাপ ধাপ সিঁড়ি বানানো আছে। বনভূমি এখানেই শেষ। একটা জলধারা টিলাটাকে বেষ্টন ক’রে আছে সাপের মত। তার উপর দিয়ে একটা কাঠের নড়বড়ে সাঁকো। টিলার উপরের ঘরটা কেন জানি, আমাকে টানতে লাগল ।
সাঁকোটা পেরিয়ে পাথরের ধাপ বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম । কিছুটা উঠেছি, এমন সময় দেখি আরেকজন নেমে আসছেন। গেরুয়া কাপড় পরা একজন সন্ন্যাসী। মাথা মুখ পরিষ্কার করে কামানো। আমাকে দেখে একটু থামলেন, তারপর আমাকে অবাক ক’রে দিয়ে পরিষ্কার বাংলা ভাষায় জিগগেস করলেন, ‘কোথা থেকে আসছেন ?”
বিস্ময় কাটিয়ে উঠে আমি উত্তর দিলাম, ‘আগরতলা থেকে। আমার নাম পলাশপ্রতিম চক্রবর্তী। আমি ফটোগ্রাফার। নমস্কার।’
সন্ন্যাসী আমাকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখছেন। বড় বড় চোখ। চিবুকে একটা শার্প কাটা দাগ। মাঝারি হাইট। চোখের ভাব প্রায়ই পালটে পালটে যায়। কখনো তীক্ষ্ন, কখনো উদাস। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। ডানহাত দিয়ে ব্যাগটার পট্টিটা কাঁধের কাছে ধরে আছেন। বেশ সরু সরু সুচারু আঙুল। নৈঃশব্দ ভেঙে সন্ন্যাসী ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলেন, “তা এখানে?”
ছবি তোলার জন্যে বুঝি?’ আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। বললাম, ‘স্বামিজী, আপনি কি এখানেই থাকেন? আমি এখানে কোথাও আজ রাতটা থেকে যেতে পারি? থাকতে পারলে কাল সকালের আলোটা আমার কাজে লাগতো।’ আমার কথা শোনামাত্রই তিনি যেন গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। তারপর বললেন, ‘এখানে আর তো কোনও থাকার জায়গা নেই। আমি ওই টিলার উপরের ঘরটায় থাকি। আপনি একা থাকতে পারবেন ? রাতে খাবেনই বা কী ?’
একজন অপরিচিত লোককে এককথায় থাকতে দেওয়ার প্রস্তাবে আমি অভিভূত হয়ে যাই। লোকটি হয় উদার, নয় বাস্তবজ্ঞানহীন। যাক, সে নিয়ে অবশ্য আমার মাথা ঘামানোর কারণ দেখি না। আমার রাত্রে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই হ’লেই হ’ল।সহর্ষে ব’লে উঠলাম, “অনেক ধন্যবাদ, স্বামিজী। একা থাকতে আমার কোনোই সমস্যা নেই। আর রাতের খাবার আমি বেরিলী থেকেই ব্যাকপ্যাকে ভরে নিয়েছি। আপনার কুঠিয়াতে জল একটু পাবো তো?’ সাধুটি মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, তা পাবেন। ঘরে জল রাখা আছে। আমি কিন্তু কাল দুপুরের দিকে ফিরব। ততক্ষণ একটু অপেক্ষা করবেন। এই নিন চাবি। আর হ্যাঁ, দরোজা বন্ধ ক’রে রাত্রে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বেন । বেশী সাহস ভালো নয় ।’ শেষ কথাটা বলার সময় তিনি আমাকে একটু অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখে নিলেন। তাঁর চোখের ভাষা আমি ঠিক পড়তে পারলাম না ।
তাঁর চোখ থেকে আমার চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম, ‘অনেক উপকার করলেন, স্বামিজী। এই দেখুন, এতোক্ষণ কথা বলছি, আপনার নামটা জানা হ’ল না….’
সাধুটি হেসে বললেন, ‘আমার সন্ন্যাস নামটা বড় খটমট। আপনার মনে থাকবে না । সন্ন্যাস নেবার আগের নামটাই আপনার পক্ষে জুতসই হবে। আমার নাম শোভন মহারাজ। ওই নামেই আমাকে এখানকার লোকে চেনে। চলি।’ এই বলেই তিনি তরতর ক’রে টিলা থেকে নেমে গেলেন।
টিলার উপরে উঠে এসে দরোজার তালা খুলে ঘরে ঢুকলাম। লম্বা মত ঘরখানি। একটা খাটের উপর বিছানা, বালিশ। বিছানার মাথার কাছে একটা টেবিল। একটা হাই ব্যাকড চেয়ার। বইয়ের র্যাকে কিছু বই। ঘরের একপাশে একটা আলনাতে অল্প কিছু জামাকাপড়। টেবিলের উপর একটা পুরোনো দিনের টেবিলক্লক, দু লিটারের বড় বড় দুটো জলের বোতল আর একটা কেরোসিনের টেবিলল্যাম্প। একদিকের দেওয়ালে শিবসতীর ছবি। ধূপদানি। ঘরের বাতাসে মাদ্রাজি ধূপের সুগন্ধ ।
বাঃ! রাত্রিবাসের পাক্কা বন্দোবস্ত ! বিছানার উপর আমার ব্যাকপ্যাক থেকে বেডকভার বের ক’রে মেলে দিলাম। ঘরের বাইরে এসে কুঁয়ো থেকে জল তুলে সেই ঠাণ্ডা জলে স্নান সেরে বেশ ফ্রেশ লাগছিল। ঘরে ফিরে এসে বিছানায় একটু গড়িয়ে নিলাম। তারপর মনে হ’ল, দিনের আলো এখুনি নিভে যাবে। ক্যামেরাটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে টিলার উপর থেকে বনভূমির দুয়েকটা ছবি নিতে নিতেই ঝুপ ক’রে সন্ধ্যা হয়ে গেল।
আবার ঘরে ফিরে এসে প্রথমেই টেবিলল্যাম্পটা জ্বাললাম। যা তেল আছে সারারাত চ’লৈ যাবে। চেয়ারে বসে ক্যামেরাতে কী কী ছবি তুলেছি দেখতে লাগলাম। ভালোই হয়েছে এবারের অভিযান, সবাই চমকে যাবে ছবিগুলো দেখে, এইসব ভাবছি, এমন সময় তক্ষকের ডাকে হুঁশ হ’ল। টোক-কে, টোক-কে –এই রকম পাঁচ সাত বার ডেকে চুপ হ’ল। আর তখনই আমার মনে হ’ল, এতোক্ষণ মনের আনন্দে মশগুল থাকায় খেয়াল করিনি, জায়গাটা কিন্তু অসম্ভব নির্জন। এখানে রাত কাটাতে চেয়ে বোধ হয় একটু বেশী ঝুঁকিই নেওয়া হয়ে গেছে। তবু নির্জনবাসের কিংবা অ্যাডভেঞ্চারের নেশাটা আমার তো মিটল। ঘরের পেছনে ঝিঁঝিঁর ডাক নির্জনতাকে যেন আরও বাড়িয়ে তুলেছে। টেবিলল্যাম্পের আলোর চারিপাশে বিচিত্রদর্শন কতোগুলো পোকা অদ্ভুত শব্দ ক’রে ঘুরছে। একটা চীনেমাটির ফুলদানিতে কতোগুলো শুকনো ফুল যেন মরা চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের জানালা দিয়ে দেখলাম, বনের উপর নির্মল আকাশে তারাগুলো দপ্ দপ্ ক’রে জ্বলছে। হঠাৎ কেন জানি খুব আগরতলার কথা মনে পড়ছিল। ঘড়িতে সময় দেখলাম, সন্ধ্যা আটটা দশ। এখন নিশ্চয়ই সিটি সেন্টারে আমাদের সান্ধ্য আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। সতীশ, কুনাল, কুরচি, অশোক, শুভ্র, সায়ন্তিকা… সবাই এসে জমেছে আড্ডায়। মনে হ’ল, নির্জনবাস সম্বন্ধে যত ভালো ভালো কথাই চালু থাকুক না কেন, ব্যাপারটা আমরা যারা লোকালয়ে মানুষ হয়েছি, তাদের পক্ষে বেশীক্ষণ সুবিধেজনক নয়। এই নির্জনে এই বাঙালি সাধুটি কীসের নেশায় যে পড়ে আছে কে জানে !
ব্যাকপ্যাক থেকে খাবারের প্যাকেট বের ক’রে রাতের খাওয়া শেষ করলাম। তারপর ব্যাগ থেকে, বেরিলীতে ভাগ্যিস কিনেছিলাম, সকালের কাগজটা বের ক’রে ফের পড়ছিলাম। ভালো লাগল না। একটা ভুল হয়ে গেছে, এবার একটাও গল্পের বই সঙ্গে আনিনি। কী ক’রে এতোটা সময় কাটান যায়, ভাবছি। বইয়ের র্যাকের দিকে চোখ গেল। কাছে গিয়ে বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখলাম। কয়েকটা সংস্কৃত বই, ইংরেজী কয়েকটা বই… বাবা, এ যে দেখি কাফকার ‘মেটামরফোসিস’… হেনরি ডেভিড থোরোর ‘ওয়ালডেন’… সাধুটির সংগ্রহ কিছু অদ্ভুত, একখানা ‘হনুমান চল্লিশা’ পেলেই বরং স্বাভাবিক লাগতো… আরে এটা কী? বাঁধানো মোটা একখানা খাতা… প্রথম পাতায় লেখা ‘আনফিনিশড নোটস’। পাতা উল্টে দেখি, বাংলা হস্তাক্ষরে কীসব যেন লেখা। অন্যের খাতা খুলে পড়া ঠিক হবে? আচ্ছা, বেশ মজার ব্যাপার! কতোগুলো গল্পই যেন লিখেছেন ! ‘নদীতমা’, ‘চিত্রিতার পিতা’, ‘আদিমানবিক’ –এই সব গল্পের নামকরণ। সাহিত্যিক সাধু! আমার হাসি পাচ্ছিল । পাতা উলটে যাচ্ছি। একেবারে শেষের পাতায় একটা অসম্পূর্ণ গল্প। আরে, কী আশ্চর্য! এ যে আমি, আমার নাম… আজ সকাল থেকে যা যা ঘটেছে। আমার বেরিলী থেকে খটিমাতে আসা, মাঝপথে নেমে পড়া… ছবি তোলা… সাধুটির সঙ্গে দেখা হওয়া… চমকে উঠলাম…. উত্তেজনায় গায়ের রোমগুলো খাড়া হয়ে উঠল । এসব ইনি জানলেন কী ক’রে? …এই ঘরে আমার আশ্রয় নেওয়া অবধি এসে লেখাটা থেমে গেছে, তারপর একটা কী পোকা কাগজের মধ্যে ম’রে লেপটে আছে। গা শিউরে উঠল –এটা কী ব্যাপার হ’ল ? সাধুটি তো আমাকে চিনতেনই না, কখনো দেখাও হয়নি, আজকে আমি এখানে আসবো, সেকথা আমিই জানতাম না, তা উনি জানবেন কোথা থেকে? কোনও অলৌকিক শক্তি- টক্তি আছে নাকি? দূর, আমার এসব বিশ্বাস হয় না। অথচ, যুক্তিসঙ্গত একটা ব্যাখ্যাও কিছু খুঁজে পাচ্ছিনা। খাতাটা যথাস্থানে রেখে খাটে এসে বসলাম। বইয়ের র্যাকের খাতাটার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালাম। জল খেলাম। তারপর নিজেকেই মনে মনে বললাম, থাক, এটা নিয়ে এখন আর ভাববো না। কাল সাধুটির সঙ্গে দেখা হ’লে জিগগেস করব খ’ন। কী বলেন, দেখা যাক। আলোটা কমিয়ে শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের ধকলে দুচোখের পাতা বুজে এল ।
রাত তখন কতো হবে জানিনা, কীসের একটা ধাক্কা খেয়ে ঘুম যেন ভেঙে গেল । অন্ধকার রাত। কোনও আদিম সরীসৃপ জননীর পিচ্ছিল গর্ভপুরীর মত ঠাণ্ডা সবুজ অন্ধকার । আলোটা টেবিলে ওইরকমই কমানো। বনের ভিতর দিয়ে বাতাস ব’য়ে যাওয়ার শন্ শন্ শব্দ । আর টেবিলক্লকটা টক্ টক্ শব্দ ক’রে নৈঃশব্দের বরফ কাটছে। একটু জল খেলাম বোতল থেকে। বালিশটাকে খাটের ছতরির উপর সোজা ক’রে মাথাটা তার উপর রেখে শুতেই ঘরের কোণে একটা বিশাল মাকড়সার জাল চোখে পড়ল। কেন্দ্রে একটা বড়সড় পাহাড়ি মাকড়সা। হাতের পাঁচ আঙুলের মত বড় বড় দাঁড়া, খয়েরি শরীর, কেন্দ্রে বাদামী রঙ, শিকারের অপেক্ষায় । একটা কুঁচ ফলের মতো লাল-কালোর ছিটছিট পোকা জালে আটকা প’ড়ে ছটপট করছে। দেওয়ালের ওধার থেকে একটা ছাই রঙের টিকটিকি গুঁড়ি মেরে এগোচ্ছে পোকাটার দিকে; টিকটিকিটা লাল জিভ বের করেই মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল জিভটাকে। পোকাটাকে কেন্দ্র ক’রে মাকড়সা আর টিকটিকির প্রতিযোগিতা; কে আগে খাবে। দারুণ মুহূর্ত! আস্তে আস্তে উঠে চেয়ারে বসে ব্যাগ থেকে ক্যামেরাটা বের করলাম। টেবিলল্যাম্পটার শিখাটা বাড়িয়ে দিলাম। লাভ নেই, ফ্ল্যাশ দিয়ে তুলতে হবে ভিউ ফাইনডারে চোখ রাখলাম। টিকটিকিটা নিশ্চিত লক্ষ্যে এগোচ্ছে। জুনরিঙে হাত দিয়ে জুম ইন ক’রে ঘরের কোণটাকে খুব কাছ থেকে কেমন দেখাবে, দেখতে লাগলাম এবার মাকড়সাটা নড়তে শুরু করেছে। যাঃ, ফ্রেমের বাইরে চলে যাচ্ছে। ভিউ ফাইনভার থেকে চোখ তুলে ব্যাপারটা দেখতে গেলাম… আর তখনই ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা ঘটল… এ কী ব্যাপার! সত্যিই দেওয়ালগুলো আমার নাকের ডগায় সরে এসেছে কেন… ওহ! ছাদটাও নেমে আসছে… চারদিক থেকে দেওয়াল আর মাথার উপর থেকে ছাদটা আরও আরও আমার দিকে সরে আসছে… আমাকে চেপে মেরে ফেলবে… মাকড়সাটা তার দৈত্যাকৃতি দাঁড়ায় আমার ঠোঁট দুটো চেপে ধরছে….পাঁশুটে অক্ষিগোলক আমার কপালের উপর চেপে ধ’রে টিকটিকিটা তার লালাসিক্ত বিশাল জিভ আমার মুখের উপর বুলিয়ে দিচ্ছে… আমি চীৎকার ক’রে উঠলাম….
চেঁচিয়ে ওঠা মাত্রই ঘুম ভেঙে গেল। এতোক্ষণ ঘুম ভাঙার স্বপ্ন দেখছিলাম, এখন সত্যি সত্যি ঘুম ভেঙে দেখছি খাটের উপর শুয়ে আছি। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, হৃৎপিণ্ডটা ধক্ ধক্ ক’রে লাফাচ্ছে বুকের ভিতরে। কিন্তু এবারের এই জেগে ওঠাটাও স্বপ্ন নয়তো? এটাও ভেঙে যাবে না তো এক্ষুনি? ঢক্ ঢক্ ক’রে জল খেলাম। স্বপ্নের জল নয়, সত্যিকারের জল। নাকি এটাও একটা স্বপ্ন? খাটের উপর সোজা হয়ে ব’সে চোখ বুজে বুকের দপদপানিটা শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলাম কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে চোখ খুলে সামনে তাকানো মাত্রই বিদ্যুতের মত একটা হিমশীতল স্রোত মেরুদণ্ড চিরে নেমে গেল….
ঠিক আমার উলটোদিকে খাটের উপর, আমার মুখোমুখি বসে আছে আরেকটা লোক…. কিন্তু কে এ? টেবিলল্যাম্পের স্তিমিত আলোতে ভালো করে লোকটাকে দেখেই চমকে উঠলাম। অবিকল আমি নিজেই আমার উলটো দিকে বসে আছি! অবিকল আমি, যেন অদৃশ্য একটা বেলজিয়াম আয়নায় আমার সামনে ফুটে উঠেছে আমারই প্রতিবিম্ব। আমারই সুমুখঠেলা চোখ, আমারই মুখ, ঈষৎ উঁচু গাল, বাঁ চোখের নীচের তিল, মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল —সব আমার, সব এক, হুবহু। লোকটা নিষ্পলক ইস্পাতকঠিন দৃষ্টিতে আমার দিক চেয়ে আছে। শিউরে উঠলাম। একদৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে আজ এই ঘরটার মধ্যে! ভয়ে ভয়ে খাট থেকে পাটা কোনোরকমে নামালাম । আমার প্রতিরূপ সেই লোকটাও একই ভাবে খাট থেকে পা নামাল। আমি এই ঘর থেকে পালাব। কিন্তু সাধুটি আমাকে রাত্রে দরোজা খুলে বেরোতে বারণ করেছিলেন না ? হঠাৎ অদ্ভুত একটা শব্দ ভেসে এল। ঠিক যেন অজস্র কাগজ ফড়ফড় খস্ খস্ ক’রে বাতাসে উড়ে আসছে। এখানে এই বনের মধ্যে এতো কাগজ আসছে কোথা থেকে? বাইরে বারান্দায় কাদের যেন উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম…
আমি আমার জোড়ার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ঘরের বাইরের শব্দগুলোর দিকে কান পাতলাম। যেন আমার প্রতিরূপ ওই লোকটার থেকে চোখ সরিয়ে নিলেই সে আমার উপর ছোবল মারবে। বারান্দায় কারা যেন কথা বলছে। একটা ভারী পুরুষ কন্ঠ কাকে যেন ধমকে উঠে বলল, “আপনি কেন আমাকে মেরে ফেললেন ? আমাকে দিয়ে মেয়েটার উপর কেন অত্যাচার করালেন? বলুন, জবাব দিন।” তারপর একটা কান্নাভেজা মেয়ের গলা, “যতন জ্যাঠার কী হ’ল?” আবার আরেকটি শুষ্ক নারীকণ্ঠ, “আমার শরদিন্দুকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছ তুমি?” একটা বাচ্চা ছেলের চিকন গলা বলে উঠল, “কঙ্কালটা? ওটা জলে ভাসিয়ে দিলেই ভেবেছ তুমি নিষ্কৃতি পাবে?”
তারপর সব চুপ। কয়েক মুহূর্ত পরে নিঃস্তব্ধতা ভেঙে এবার যে গলাটা মিনতির সুরে কথা বলে উঠল, সে গলা আমার চেনা। বিকেলের সেই সাধুটির গলা, “প্লীজ, বুঝবার চেষ্টা কর। আমিই তো তোমাদের গড়েছি। গল্পকার হিসেবে আমার কি কোনো স্বাধীনতা নেই?… ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও আমার গলাটা ছেড়ে দাও…।” সেই ভারী পুরুষ কণ্ঠ ধমক দিয়ে বলে উঠল, “চোপ! আজ তোকে গলা টিপে শেষ ক’রে দিয়ে যাব। আর ঘর থেকে খাতাটা নিয়ে তোর সব স্বেচ্ছাচারিতার চিহ্ন পুড়িয়ে ছাই ক’রে দিয়ে যাব।” বলা মাত্রই বারান্দায় একটা ধস্তাধস্তির শব্দ শোনা গেল। আর সাথে সাথেই ঘরের দরোজায়, জানালায় কারা যেন বারবার ধাক্কা দিতে লাগল। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আমার প্রতিরূপ লোকটা আমার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তার চোখে চোখ রেখে আমি দেওয়ালের দিকে পিছিয়ে যেতে লাগলাম। লোকটার ঠোঁট কাঁপছে। আমার চোখে চোখ রেখে হেসে উঠে, বিড় বিড় ক’রে সে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, “আয় না, আয়… আয়…, আয় না, আয় না… আয়… আয় না…”
আমি জ্ঞান হারিয়ে মেঝের উপর লুটিয়ে পড়লাম ৷
দুদিন পর বেরিলীতে হাসপাতালের বিছানায় জ্ঞান ফিরেছিল। ডাক্তারের মুখে শুনলাম, সেই রাত্রির পরের দিন সকালে জঙ্গলে কাঠকুঠো কুড়োতে গিয়ে স্থানীয় লোকজন আমাকে টিলার নীচের জলধারাটার কাছে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পায়। তারাই আমাকে ধরাধরি ক’রে হাসপাতালে ভর্তি ক’রে দিয়ে গেছে। ডাক্তারবাবু বললেন, হঠাৎ কোনো কারণে প্রচণ্ড নার্ভাস শক পেয়ে আমি ওখানে জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিলাম। এখন সাতদিন এখানে রেস্টে থাকতে হবে।
আমার ক্যামেরাটা, মোবাইল ফোনটা সেই অভিশপ্ত ঘরেই ফেলে এসেছি। সিস্টারের মোবাইলটা চেয়ে নিয়ে আগরতলায় আমার বন্ধু অশোককে ফোনে ধরলাম। বললাম, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি।
হাসপাতালে থাকার পাঁচদিনের মাথায় অশোক এসে হাজির। আমাকে দেখেই অশোক ব’লে উঠল, তোর কী হয়েছে রে পলাশ? এই কদিনে যেন তোর বয়েস দশ বছর বেড়ে গেছে।
অশোককে সব খুলে বললাম। ও আমার কথা বিশ্বাস করতে চাইল না। শেষে স্থির হ’ল, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ওকে নিয়ে আবার যাব ওখানে। আমার দামী ক্যানন ক্যামেরাটা, সেলফোন, ব্যাগ –সব ওখানে পড়ে আছে।
সাত দিনের মাথায় হাসপাতাল থেকে রিলীজ করল। দুয়েকদিন পর সকাল দশটার দিকে খটিমা গেলাম। প্রথমে খটিমা বাজারে নেমে দোকানগুলোতে শোভন মহারাজ নামের সাধুটির খোঁজ করলাম। কেউ বলতে পারল না। খটিমাতে চা খেয়ে একটা অটো ধরে পিছিয়ে এসে বনের কাছে সেই জায়গাটায় নামলাম, যেখানে সেদিনও নেমেছিলাম। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পায়ে চলার সেই পথ দিয়ে আমি আর অশোক হাঁটতে লাগলাম । তারপর টিলাটার সামনে এগিয়ে এসে উপরে চোখ তুলে তাকাতেই চক্ষুস্থির হয়ে গেল।
রুক্ষ টিলাটার মাথায় সেই ঘুপচি ঘরটা বেমালুম উধাও। নেই। টিলাটার গা বেয়ে ওঠা সেই পাথর কেটে বানানো ধাপগুলোও নেই। শুধু জলধারাটা দিয়ে জল তিরতির ক’রে বয়ে যাচ্ছে। উজ্জ্বল রৌদ্রালোকে জল ছিটিয়ে সশব্দে স্নান করছে কতোগুলো নাম না জানা রঙ বেরঙের পাখি।
হতবাক চোখে আমি অশোকের দিকে তাকালাম। দেখলাম, সে আমার দিকে অবিশ্বাসীর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে।