আমোদ বোষ্টুমী – কমলকুমার মজুমদার

আমোদ বোষ্টুমী – কমলকুমার মজুমদার

সিঁড়ির পাশেই ঘর, তার পাশে আর একটি ঘর, জানলাগুলো বেশ নিচে বসান ; এর সামনেই খোলা লম্বা ছাদ। ছাদ কালচে কষা, মাঝে মাঝে ফাটল সারানোর আধা গোলাপী আঁকাবাঁকা জোড়। ছাদের শেষে জাম গাছ, জাঁকাল ঝাকিয়ে ওঠা, ছাদে ছায়া করেছে, ব্যাঙের পায়ের মত আক দেওয়া পাতা, ফাঁকে জেমো ছাইরঙের ডাল। অঢেল জাম হয়। জিব ভার করে মুখ কষিয়ে দেয়। তাই ছাদ কষা।

ছাদময় জাম ছেতরে একসা, ফলে এখন শীতেও কালো ছাদটা গভীর জামরঙ, কড়া রোদে কিছু ফিকে। কতক বোলতা সময়-অসময় এর ওপর দিয়ে ঘুরে যায়। তখন ভারি বাহার! রোদ এখানেই পড়ে, ওপাশে পেয়ারাফুলি গাছটার চাপান, রোদ নেই ছায়া।

এখানে দাঁড়িয়ে আমোদিনী চুল শুকোয়। পাশেই একটা ফণিমনসা। আমোদিনী অল্পবয়সী তবু সোমত্ত, স্ফীত, গর্বিত ; দশাসই তার চেহারা। দুই হাত দিয়ে চুলগুলি ছড়িয়ে ছড়িয়ে আরাম অনুভব করে, ময়লাটে কাপড়ের পাথুরে ভাঁজে রোদ রেগে রেগে আছে, বুকের কাছে রোদ আরও বদরাগী, এ কারণে যে তার সুঠাম হাত দুটি ওঠানামা করে। মুখে একটা থিতু হাসির রেখা। মুখ কাত করে ঘাড়ের কাছে আঙুল চালায়, দুটো চুল হাত নেড়ে নেড়ে উড়িয়ে দিলে। একবার সে চুলের থোক করে শুঁকলে আবার এলো করে দিলে।

এবার সে চাইলে সিঁড়ির পাশের ঘরের জানলার দিকে, কেউ নেই সেখানে, কিন্তু অনেক কিছুই ছিল। পিছনে জানলা দিয়ে রোদ, তারপর মাদুর—খোলা বইয়ের পাতা উড়ছে, খাতা, কালি, কলম, মাদুরে ছেড়ে যাওয়া একটি গোলাপী চাদর। এবার সে অকারণে নাসা স্ফীত করে সেইদিকে তাকালে।

একতলা থেকে পুরানো গলায় কেউ ডাকল, “আমুদ, তোর চুল শুকোনো হল?”

পাঁচিল থেকে ঝুঁকে বললে, “যাই গো দিদিমা।” এখান থেকে দেখা যায় একটি অপুরুষ্ট সংসারের সাজবেলে উঠন, এক পাশে মরাই, খড়ের ডাঁই ওপাশে গোয়ালঘর, গরুর পিঠ-ন্যাজ নড়ছে, মাঝে তুলসীমঞ্চ, এপাশে ভুলো বসে ন্যাজ নাড়ছে। সে পাশে আড় হয়ে খিড়কির দরজা, ভাঙা পাঁচিল, পাঁচিলে গাছ, তারপর ডোবা, তারপর ঝোপঝাড়, বাড়ি।

আমোদ হাতে দু-তিনটে কাপড় নিয়ে সিঁড়িতে কেলে পলেস্তরা খসা দেওয়ালের পাশ দিয়ে এসে দোতলায়। বারান্দার একান্তে তক্তাপোশর উপর কাপড়গুলো রেখে আবার সিঁড়ি নেমে এল।

গিন্নির পরনে কেটে, নাতির পাশে বসে, ওপাশে নাতি পিঁড়িতে বসে হাঁটু নাচাতে নাচাতে ভাত খাচ্ছে এবং মাঝে মাঝে এক এক দিকে দৃষ্টি রেখে, ইংরাজি পোয়েট সেমজ বলে কিছু বলছে।

“আমুদ, দুধটা একটু গরম করে দে বাছা হিম হয়ে গেছে বড়”, গিন্নির গলায় এক কান্নার রেশ।

“ও মা সি কি গো দুধ গরম করিনি ওকপাল,”বলেই গালে আঙুল ঠেকিয়ে ভঙ্গী সহকারে দাঁড়াল।

“করবিনি কেন, খেতে তো ওর সময় লাগে ; দুধটা এলো হিম হয়ে গ্যাচে”, বলে আঙুল ডুবিয়ে বললেন, “দেখ না বরফ।”

দুধের বাটিটা তুলে নিতে নিতে বললে, “দিদিমা, যা বলব তুমি গরম দাও আর যাই দাও—তোমার ও পুঁয়ে-পাওয়া নাতির গত্তি আর লাগবে না।”

“যা, যা তুই আর টুকিসনি বাপু—এ বয়সেই এত ওষুধ-বিষুধ জানিস তা দে না একটা, তোর কাজের মধ্যে তো ওই অষ্টপ্রহর ওর পোঁদে লাগা।”

“আমারও ভাল লাগে না ঠাকমা এরম করলে আমি ভাত ছেড়ে উঠে যাব বলে দিচ্ছি—ভাল হবে না।”

আমোদ দুধ গরম করতে করতে এ কথা শুনেছিল। মরা আঁচের উপর বাটিটা বসিয়ে গরম হতে, হাতের উপর কাপড়ে বাটিটা বসিয়ে এনে, এখানে টুক করে বসিয়ে, আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় বললে, “দেখ বাটিটা ভারি গরম।”

গিন্নি বাটিটা ছুঁয়ে বললেন, “ওরে গোরা—তা তোর খেতে খেতে ঠাণ্ডা হবেখন।”

“কেন আর বুঝি বাটি নেই বাড়িতে,” গোরাচাঁদ চেয়েছিল আমোদ আবার আসুক, সে একটু ভীত, তার কথার কোন একটি গলদে আমোদ মান করেছে, তারপর সে আবার বললে, “পোড়ারমুখীর এদিক নেই ওদিক আছে—কথায় কথায় মান!”

“তা বাপু হবে না কেন? তুই ছোট ও নয় বলেইছে তাই বলে তুই মুখ দিয়ে অমন অলুক্ষনে কথাটা বলবি ‘ভাত ছেড়ে উঠে যাব’ লেখাপড়া শিখচিস”—তারপর অন্য গলায় বললেন, “মেয়েমানুষের মনে লাগে।”

গোরাচাঁদ ভাত থেকে হাত উঠিয়ে শুনছিল, মন তার নরম হল ডাকলে, “আমোদ আমোদিনী বাটি বদলে দে মুকপুড়ি।”

আদর শেষ হঠাৎ ঝাঁজে পরিণত হল।

“উকি কথার ছিরি, তোকে বলে বলে আর পারি না, ওর বয়স হয়েছে না—এখন তুই ওকে মুখপুড়ি-টুকপুড়ি বলবি?”

দোতলায় আমোদ কাপড় কুঁচোচ্ছিল। শীতের ঠাণ্ডায় এই তপ্ত কাপড়গুলো কুঁচোতে ভাল লাগছিল। সামনে একটা দুর্গার ছবি, সেদিকে খানিক তাকিয়ে ভাবলে, এক মুহূর্ত যাকে চলে না—তার আবার। এখন চিৎকারে বাড়ি ফাটছে, সঙ্গে সঙ্গে গিন্নির গলা—”আমুদ মরেছিস নাকি!”

আমোদ নিচে নেমে হাত ধুয়ে একটা গ্যাস বাটি এনে তাতে দুধটা যত্ন করে ঢেলে দিতে দিতে বললে, “আমি দাসী-বাঁদী বলেই এত ফাটাফাটি—বউ এলে!’

“ফের পোড়ামুখী—তোর কূট হবে ওলাউঠো হবে।”

“না বাছা ঘেন্না ধরিয়ে দিলি—ছিছিঃ।”

“বলুক না—অষ্টপ্রহর কুকুর-বেড়ালের মত করে, মরি না বাবুর অসুবিধে হবে বলে, রেতে যাকে দাঁড়াতে হয় তার আবার লপচপানি!”

“আমি তোকে মাথার দিব্যি দিয়ে দাঁড়াতে বলেছি—” লজ্জায় গলাটা তার নরম হল, দুধটা চুমুক দিলে, গোঁফের কাছে দুধ লেগে, বললে, “আমোদ হাতে জল দে না।”

রকে এসে আমোদ ঘটি করে জল দিতে লাগল। “ওরে আমোদ এটোটা পেড়ে নিস।”

“এঁটো থাক আমি ওই পাতেই খাব, তোমার নাতি আমার জন্যে একরাশ ছিবড়ে রেখেছে—দাসী-বাঁদীর জন্যে আর—”

“এই ফের ওই কথা তোর মুখে কুলকুচি করে দেবো বলে দিচ্ছি—তুই না আমার সঙ্গে ঝগড়া করলি, বলেই ত রাখতে ভুলে গেলুম”, এবার আমোদর আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বললে—”ওমা কি হবে।”

“তোমার বউ এলে পাত্তে?”

“আবার!”

অন্য কথা না কয়ে আমোদ রকের শেষে, হেঁশেল থেকে গামলায় ভাত, কাঁসিতে ডাল, বড়ার ঝাল, এনামেলের থালায় একটু চচ্চড়ি বেগুনভাজা এনে এখানে রাখলে। গোরাচাঁদ ছোট চৌকিতে বসল।

গিন্নি ওপাশে সিঁড়ির তলায় রান্নাঘরের সামনে ছোট পিঁড়ি, এক ঘটি জল, বোগনো আর কাঁসি নিয়ে বসলেন, আলো চালের তপ্ত গন্ধ খর হয়ে উঠল, তিনি বললেন, “ওরে আমুদ একটু বিচিকলার ঝালের ঝোল খাবি—”

“তুমি দাও, আমি ততক্ষণ ছোটবাবুকে জল হত্তুকী দি—”

“না পান দিবি”

“সে কি গো, তুমি না সন্নিস্যি হচ্ছ”

গোরা লজ্জায় কিছু বলতে পারল না। সে কিছুদিন ধরে মোহমুদগর পড়ছে, ভারি ইচ্ছে সন্ন্যাসী হবে।

“দে বাপু অন্তত একটা বোঁটা দিয়েই সেজে দে, পান যদি না থাকে।”

“তোমার আদরেই তো গেল, কোন ইস্কুল পাটশালের ছেলে পান খায় শুনি?”

“আদর আর কি বল, যদি ওর বাপ…” বলেই বাঁ হাত দিয়ে চোখে আঁচল দিলেন। ছাইমাখা পুরাতন স্যাঁতসেঁতে কথা, শ্মশানের ছায়া। কতবার প্রায় প্রত্যহই শুনেছে, “বলা যখন পেটে তার বাপ তখন ঘোড়া থেকে পড়ে মরে গেল, দেশের লোক হাহুতাশ করলে। বলাই আমার বড় হল, তিনটে পাস দিলে, শেষ পাসের খবর যেই এল সেইদিন সামান্য জ্বর, বাত না পোয়াতে সে গেল, তো গোরা তখন দু মাসের, তার মা গেল, আমি হতভাগী সব সইতে বেঁচে রইলুম রে—শত্তুরেরও যেন এমন হয় না”

“থাম থাম রোজ রোজ ওই এক কথা ভাল লাগে না তুমি থাম—এই আমোদ বল না”

ঠাকুমার কথায় কথায় চোখে জল, কেউ কুটুম এলে গেলে তার ইস্কুল থেকে একটু ফিরতে দেরি হলে—ওরে আমার বলাই আজ বলে কান্না। সন্ধেবেলা একা একা বসে অসম্ভব আবহাওয়ার সৃষ্টি করে। আমোদ এক মনে সেখানে বসে ছোটখাট সেলাই করে। প্রদীপের শিখাটা পাগলা ঢেউ-এর নৌকার মত।

আমোদ এখন বাঁ হাতটা ডান হাতের বগলের তলায় দিয়ে খাচ্ছিল। মুখ তুলে বললে, “তুমি ব্যাটাছেলে, তোমার সব কথায় সাউকিড়ি করা দরকারটা কি শুনি? শোকতাপের বুক তোমার যদি হত তাহলে বুঝতে—কি বল দিদিমা, বলে, মেয়েমানুষের মন শিল থেকে নোড়া ছাড়া হলে হুহু করে ওঠে—”

“হুহু করে না অ্যাণ্ডা করে তোকে আর পাকামো করতে হবে না—”

“তুমি যাও না গিয়ে পড় না! তোমার না আজ বাদে কাল এগজামিন”

“দেখ আমোদ বাড়াবাড়ি করিসনি বলে দিচ্ছি। খাচ্ছিস খা আমি পড়ি না পড়ি তোর কি রে পোড়ারমুখী?” বলেই সে উঠে রাগে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল।

“হ্যাঁ আমার আর কি আমি দাসী বাঁদী…..”

“ওরে তোরা কি আমাকে শান্তিতে খেতেও দিবি না”

গোরাচাঁদ সিঁড়ি থেকে বললে, মুখটা তার দেওয়ালের দিকে—”ছুতো করে যদি ছাতে যাস তো”

“ভারি বয়ে গেছে—”

আমোদ যে কে এ সংসার ভুলেই গেছে, প্রায় ষোল সতেরো বছরই তার এখানে। ওর মা এ সংসারে ঝিগিরি করতে এল, আমোদ তখন ল্যাংটো ছোট মেয়ে, কোন মতে উঠনে বসে থাকত, ধুলো মাখত। তারপর মায়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরত। খিড়কির পাশেই একটা কাঁঠাল গাছ, সে বছর বেজায় কাঁঠাল ধরেছে, গিন্নি বললেন, ‘ও গিরি, খাওয়া-দাওয়ার পর গাছটা পালা দিস ত। শ্যালের জ্বালায় কাঁঠাল আর আটকান যাবে না।’

গিরি আগান বাগান থেকে কুলডাল কেটে পালা দিয়ে এসে জল খেয়ে শুলো, আর উঠল না। সেই হতে মা ছাড়া, মাই ছাড়া আমোদ গিন্নির কাছে কাছে। সুতরাং বড় মায়া, বিশেষ দরদ। এটা বামুনবাড়ি তবু আমোদ সব করে, যতটা পারে ঢাকে। যখন প্রকাশ পায় বলে—”তিনবার শিব শিব বললে, বামুনের সেবা যে কোন জাত করতে পারে গো—আর ও আর জম্মে আমার কেউ ছিল।”

আমোদ কিন্তু মাঝে মাঝে এ সংসার থেকে আলাদা করেই ভাবে। সব চাবিকাঠিই তার হাতে, ভালয় মন্দয় সে, তবু তার কোথায় বাধ বাধ ছিল। গোরাচাঁদ আমোদকে অনেকটা আপন বলে ভাবলেও একবার এক কুটুম্বর সামনে বলে ফেলেছিল—

“ও আমোদ”

“আমোদ মানে কে রা ও?”

“আমাদের ঝি, ঝিয়ের মেয়ে!”

আমোদ সেদিন জলস্পর্শ করেনি। গোরা সারাটা দিন চোর হয়ে রইল। উপায় নেই, শুধু অপেক্ষা কখন আবার সব ভুলে আবহাওয়াটা সহজ হবে।

আমোদের সে কি কান্না, বলেছিল যে দিকে দু’চোখ যায় চলে যাবে, ভিক্ষে করে খাবে। কিছুতেই আর সে এখানে থাকবে না। গিন্নি মাথায় হাত বুলালেন, স্নেহমমতা নূতন করে বোঝাতে প্রমাণ করতে চেষ্টা করলেন, বললেন, “ও এ বাড়ির কে, তা ছাড়া একটা পুটকে ছেলে বেফাঁস বলে ফেলেছে—না হলে ও তোকে কত ভালবাসে বল……”

আমোদের ভারি জেদ, সে খেলে না ; কিন্তু গোরার খাবার যোগাড় করেছিল চোখে জল নিয়ে। গিন্নিও ভাত স্পর্শ করেননি।

শেষে গিন্নি বললেন, “ধন্যি মেয়ে বাবু এতকালের যত্ন আত্তি সব ভেসে গেল, বলিহারি যাই—কি পাষাণ বুক বাবা”

আমোদ আপাতত প্রমাণ করল যে সত্যই তার বুক পাষাণ নয়। সেখানে কান্নাই আছে। সেই উঠতে বসতে আমোদ গোরাকে খোঁটা দেয়, এক মুহূর্তের জন্য ভুলে না। “আমি তো দাসী-বাঁদী।”

গোরা একে চোর হয়েছিল তার উপর খোঁটায় লজ্জায় এতটুকু হয়ে যেত।

কতবার অন্ধকার সিঁড়িতে, ছাদের ঘরে যে কোন নিরিবিলিতে গোরা আমোদকে বলেছে—”আমার গা ছুঁয়ে বল অমন কথা আর বলবি না।”

আমোদ ধীরে ধীরে তার গায়ে হাত দিয়েছে। বয়স হয়েছে তার, গা-টা শিউরে উঠছে। অধৈর্য হয়ে দুভাগ হয়ে যায় কিন্তু আবার মনে মনে বলেছে সে শুধু জ্বালাবার জন্যে নয়। তার কারণ তাতে, গোরা অদ্ভুত—মানসিক অবস্থায় এলোমেলো—খর-গা-টা ছোঁয়া যাবে। আর এও সে দেখেছে, সে যখন তার গা ছোঁয় তার হাতের ছোট ছোট রোমগুলি কাঁটার মত হয়ে উঠে। আমোদ হাত বুলায় আবার বুলায়—আর মাথা নাড়িয়ে বলে বলব না। তার এলো খোঁপা খুলে একপাশে ঝড়ে পড়ে। মুখে জল আসে।

খাওয়া-দাওয়ার পর আমোদ ঘাটে বাসুন মাজতে গেল। ছাইগাদার সামনে বসে হাঁটুটা বার করে আমোদ বাসুন মাজছে। এমত সময় শুনলে—

“আমোদ একটা বালিশ দিয়ে যা”

“তোমার না এগজামিন”

“লক্ষ্মীটি দে না”

“দেখতে পাচ্ছ না বালিশ ওপাশের পেয়ারাফুলির ছাদের আলসেতে।” গোরাচাঁদ পাঁচিল থেকে সরে যাবার সময় আবার মুখ তুলে আমোদ বললে, “ওগো বাবু এখন আর শুও না, একে কড়াইয়ের ডাল খেয়েছো সদ্দি হবে, গা ভার হবে।”

“সদ্দি হলে তুই আছিস টোটকা দিবি।”

টোটকায় তার নাম আছে, এখানে মতি গয়লানী ছিল দুধ দুইতে আসত। চেহারাটা ছিল অসম্ভব ভয়ঙ্কর। চোখ দুটো যেন বটপাতার মত। দশ গাঁ প্রচার সে নাকি তন্ত্রমন্ত্র জানে, অষ্ট সিদ্ধাই আছে তার। মাদুল দিত, ঝাড়ফুঁক করত, আমোদ তার কাছে সব শিখেছে। লোকের ধারণা আমোদও অনেক কিছু জানে। গোরা এক দিন বলেছিল, “আমোদ তুই নাকি কামাখ্যার মন্ত্র তন্ত্র জানিস—”

“জানলে তোমার কি?”

“তারা নাকি ভ্যাড়া করে, তুই আমায় ভ্যাড়া করে দিতে পারিস?”

“তুমি তো হয়েই আছ—কাল থেকে ঘাস দোবো”, বলতে বলতে তার একটা চোখ ছোট হয়ে গিয়েছিল।

গোরাচাঁদ এমনভাবে ধাক্কা খাবে তা জানত না। সে রেগে বলতে গেল, “আমি তোকে, আমি তোকে—”

আমোদিনীর বাসুন মাজা হয়েছিল। বাসুনগুলো এক হাতে তুলে, বুকের কাপড়টা আর এক হাতে সামলাতে সামলাতে এখন রকে আর একবার সব ভাল করে ধুয়ে বারান্দায় গুছিয়ে রাখছে। এমন সময় গিন্নি বললেন, “আমোদ আজ শনিবার না রে, যা দিকিন্ একবার তোর সদাশিবের কাছে—যাবি?”

আমোদ দেওয়ালের গজাল থেকে ফিতে, মানে কালো শাড়ির পাড় থেকে বসা আয়না, দাঁতভাঙা চিরুনি নিয়ে বসল চুলের পাট করতে। আমোদর শরীরটা দেখলে মনে হয় ভিতরে সে হন্যে হয়ে রয়েছে, পাগল হয়ে রয়েছে। অকারণে নাসা স্ফীত হয়ে উঠে, শরীর বেড়ে যায় তার উপর এক ঢাল চুল। আর কোন সময়ই তাকে এত দেখা যায় না, বুঝাও যায় না—যে সে হয় সত্যই সুন্দরী। যতটা মনে হয় তার নিত্যকার অবেলার প্রসাধনে। সে কেমনটি গুছিয়ে বসে, বাবু হয়ে বসে। ছবির মত গুছিয়ে বসে। এক হাতে চিরুনি খেলায়, চুলগুলি সোজা পাতের হয়ে যায়, চিরুনি বেরিয়ে যাওয়া মাত্র পড়ে যায়। সে যখন চুলের গোছ ধরে মাথা ঘাড়ের উপর হেলিয়ে জট ছাড়ায় ; সে যখন আবার আঁচড়ায় ; অল্প পাতা কেটে গামছা বাঁধে—সে যখন অন্যমনে পাঁচ গুচি বিনুনিকে আঙুলে দিয়ে বাঁধে, অজস্র পরিপ্রেক্ষিতকে বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে লুকিয়ে ফেলে রহস্যের সৃষ্টি করে, তখন আয়নার নিম রূপালী চৌক ছায়াটা তার মুখে। গামছা সরালে, অদ্ভুত বিস্ময়কর বিশেষ ময়লা কাপড়ের উপর মাজা ঘষা একটি মুখ। চুল বাঁধা হতেই চিরুনি থেকে জট ছাড়িয়ে থু-থু করে জানলা গলিয়ে ফেলে দিতে দিতে বললে, “দেখলে দিদিমা তোমার নাতির কোন সাড়াশব্দ নেই—নির্ঘাত ঘুমুচ্ছে, পাস হবে না হাতি হবে। পাড়ার ছেলেদের পড়ার শব্দ শুনছো তো?”

গিন্নি ঝিমোতে ঝিমোতে বললেন, “কি আর করব বাপু—তুই তো সারাদিন বলছিস—মায়ের পেটের টান—”

আমোদ এই কথাটা কখন শুনেও শোনে না ; এড়িয়ে যায়—সে সিঁড়ির রান্নার ঘরে জানলা বেয়ে আসা লম্বা হওয়া রোদের দিকে চাইল, কলসির ছায়া অদ্ভুত হয়েছে। আমোদ মাথাটা ঝাঁকানি দিয়ে কথাটা রুখলে, ভিতরে আসতে দিলে না। চিরুনি কাপড়ে মুছতে মুছতে বললে, “সদাশিবজ্যাঠাকে গিয়ে কি বলব?”

“বলবি আমি ডেকেছি—সে আসবেও বলেছিল—মিউনিসিপালটির টাক্‌সোর কথা কইব!”

আমোদ গা ধুয়ে গামছার উপরে কাচা কাপড়টা জড়ানো এক কলসি জল এনে। একমাত্র সেমিজ, একমাত্র ডুরে কাপড়টি পরে সে আসি বলে বার হল।

পঞ্চাননতলা পেরিয়ে এক ঘেরা বিশাল ভগ্ন স্তৃপ—তারপরেই একটা নূতন পিউড়ি রঙে দেওয়াল মাঝ বরাবর পাঁচিল ছেড়ে উঁচু দরজা, সবুজ রঙ করা গজালের মাথাগুলো কালো, কড়া দুটি মস্ত। হাতের চুড়ি নামিয়ে আমোদ কড়া নাড়লে।

“কে রা?” মেয়েছেলের গলা এল।

“আমি আমুদ জ্যেঠিমা।”

“ও আমুদ, ঠেলে খোল—”

ঠেলা দিতে দরজাটা খুলে গেল, এক ধাপ নেমেই বাগান। এখন অজস্র গাঁদা, টবে দুয়েকটা চন্দ্রমল্লিকা। ডান পাশে লাউমাচা, লঙ্কা, একটু পালং—ক্কচিৎ পেঁয়াজের কলি। মধ্যে টালি দেওয়া রাস্তা, তারপর লাল রক। পরপর দুটি ঘর। একপাশে সিঁড়ি, এখানেও আর একটা দরজা অন্দরে যাবার। রকে শতচ্ছিন্ন কাপড় পরে একজন এয়ো মেয়েছেলে, কাঁকে তার ছেলে। বললেন, “আয় আয়, খবর কি?”

আমোদ পায়ের ধুলো নিতেই জ্যেঠিমা চিবুক ধরে আদর করে বললেন, “থাক বাছা ঢের হয়েছে, আহা কি লক্ষ্মী মেয়ে—তারপর কি খবর রে তোদের?”

“ভাল—হ্যাঁ জ্যেঠিমা জ্যাঠামশাই বাড়ি ফিরেছেন?” বলে হাত দুটি বাড়িয়ে দিলে।

জ্যেঠিমা কাঁকের ছেলেটির আঁচল দিয়ে নাক মুছিয়ে ওর কোলে দিলেন। আমোদ তাকে কোলে করে বললে, “জ্যাঠামশাইকে খবর দি তারপর বলছি।”

আমোদ এবং জ্যেঠিমা এ ঘরে এলেন। একপাশে হাফ বোম্বাই খাট, তাতে সদাশিব শুয়ে ‘লীলাপ্রসঙ্গ’ পড়ছিলেন, চোখে নিকেলের চশমা। মশারিটা কালো হয়ে ছত্ৰীতে আটকানো, দেওয়ালে অজস্র ক্যালেণ্ডার, জ্যেঠির করা কার্পেটের কাজ ‘ল্যভ ইজ এঙ্কর অফ লাইফ’। জ্যেঠি তাকে মানে বলে দিয়েছে। বুঝিয়ে দিয়েছে। একটা বন্ধ হওয়া ঘড়ি, রকমারি আসবাব। দেয়াল-তাকে কাঁচের কাপ ডিশ গেলাস, ওষুধের শিশি বোতল। সদাশিব চোখটা সরিয়ে বললে, “কি রে হুঁড়ি কি খবর—এখন বিকেল হয়নি এর মধ্যে গটরা মারতে বেরিয়েছিস?”

আমোদ বললে, “মাথাটা তুলুন।” সদাশিব বালিশ থেকে মাথাটা একটু তুলতেই আমোদ পায়ের ধুলো নিলে। জ্যেঠিমা বললেন, “ও তেমন মেয়ে নয় গো—ওর জন্যেই তো অমন পেঁচোয় পাওয়া সংসারটা টিকে আছে গো, কি বা বয়েস! কি পয়মন্ত মেয়ে—কিছু নেই দুটো ডুমুর পেড়ে আনলে, কলমি টানলে…..যে ঘরেই যাবে তাদের বোলবোলাও হবে…..”

আমোদর নিজের প্রশংসা শুনে গলা ভিজে গেল। একটু ন্যাকা গলায় বললে, “দিদিমা আপনাকে ডেকেছেন—মিউনিসিপালটি……”

“দ্যেৎ, তোর দিদিমা এবার মাথায় কাপড় বাঁধবে বুঝলি! পাগল, বুঝলে গ্যাঁচার মা!”

গ্যাঁচার মা অর্থাৎ জ্যেঠিমা বললেন—”কেন গা—”

“আর বলে কে” বলে একটিপ র নস্যি নিতেই চোখে জল এল, একটু সমঝে নিয়ে বললে, “আরে ছোঃ ছোঃ বুড়ি বলে কি না ছোঁড়ার বিয়ে দেবে—বুঝলে—হা হা হা—”

প্রচুর হা হা তে বিয়ে কথাটা অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বিয়ে কথাটার মানে আমোদ ততটা বুঝতে পারলেও পারেনি।

জ্যেঠিমা বললেন—”ওমা সে কি গো!”

এবার লেপ ছেড়ে উঠে বসে কাপড় গোছ করে লীলাপ্রসঙ্গের মধ্যে চশমাটা রেখে বললেন, “ওই দ্যাকো, হ্যাঁ হ্যাঁ বুড়ি বলে রখো ভটচাজ ব্যাটা সিদেল চোর আজকাল পণ্ডিত হয়েছে, অষ্টপ্রহর পাঁজি খড়ি হাতে পাড়ার বুডিদের রামায়ণ পড়ে শোনায়, সেই শালা ব্যাটার ছেলে বলেছে কি না আসছে জ্যৈষ্ঠের মধ্যে যদি বিয়ে না দাও তো অমঙ্গল হবে—ওরে আমার জ্যোতিষ গণৎকারব্যাটা তুই কবে জেলে যাবি বল—বল শালা গলা আস্তে করে সাধারণ করে বলেছে কোন গ্রহ নাকি কুপিত….আচ্ছা দেখেছ কাণ্ড—বুড়ি তাকে (সপাঁচ আনা) দিয়েছে হা হা হা….” করে তুমুল হেসে উঠে নিজের ছেলেটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন।

“তা যাই বল বাপু বুড়ির কি দোষ, কি শোক-তাপটাই না পেয়েছে—তার ভয় হবে না, কি বল আমোদ?”

আমোদ এই কথাবার্তা নিয়ে ভাবতে ঠিক সাহস করছিল না, তবু তার মনটা যেমন ঘা খেয়েছে সে তার কাঁচের চুড়ির দিকে নজর রেখে এক হাত দিয়ে ঘোরাতে লাগল। এগুলো বোম্বাই বেঁকি-বেদানা রঙের চুড়ি। জ্যাঠামশাই বললেন-”ভয় পাওয়ার একটা রঙচঙ আছে—ই কি কান গেছে তো কান গেছে—দোৎ”তা ছাড়া হাত ঘুরিয়ে বললেন, “ওইটুকু ছোঁড়া হাপ টিকিটের ছোঁড়া, শালা হাতে টিপসই পর্যন্ত জানে না, তাকে ঝুলিয়ে দিলেই হল? তুমি তো গঙ্গাবিগেপার (গঙ্গার দিকে পা) তোমার আর কি?—তাছাড়া কোন ভদ্রলোক ওকে মেয়ে দেবে বল, কানা খোঁড়াও দেবে না কেউ।….হ্যাঁ যার সাতকুলে কেউ নেই পরের বোঝা—কিংবা লষ্টদুষ্টুর মেয়ে পাবে—দুৎদুর ভদ্রলোক শুনলে ঝাঁটা মারবে। সাধারণ গলায় বললেন, “গ্যাঁচার মা বল আমোদর চেহারা বেড়ে না গো—”

“ও কি হচ্ছে বলত এত বয়স হল—সবাই থাকলে আজ ১১ ছেলের বাপ হয়ে থাকতে—”

“তা বটে”, এবার মহা আহ্বাদে ছেলেকে আদর করতে লাগলেন। এবার আবার কণ্ঠস্বর ফিরে এল, “হ্যাঁ কি বলছিলুম, হ্যাঁ বুঝতুম যদি রুধির কিছু থাকত—”

“একটা ঘর তো।”

“আরে রাখো, তোমার ঘর, ওই আমাদের বংশের বিরাট ভগ্নস্তুপ, আমি গোডাউন ক্লার্ক!” বলে সেই ভাঙা স্তুপের দিকে আঙুল দেখাল। “বুঝলে গ্যাঁচারমা রুধির রুধির, সকাল ৭/৫৩ ধরতে হলে চেহারাও বেরিয়ে যাবে—শালা ঘাস জুটে না তার চুনি ভুষি—নিমাই-এর বাপ আজও বেঁচে তবু তো এখন তখন যতীন আর কতদিন? যেদিন চোখ বুজোৰে সেইদিন নোটিস পাবে—দিয়েছে থাকতে জান ভোগ করতে। কারণ যতীনের বাপকে দেখতে গিয়েই ডাক্তার, ছোঁড়ার ঠাকুরদা ঘোড়া থেকে পড়ে মারা যান—না হলে, এ ভোগ আর কদিন। যতীন আর কদিন বল?”

সদাশিব যা যা বলেছিল সে কথা সকলেই জানে। তবু একই গল্প এক এক নূতন হয়ে উঠে ; তার অর্থ অন্যরূপ হয়, সাধারণ তেলা গল্পটা এখন এই সূত্রে অর্থব্যঞ্জক হয়ে দাঁড়াল। জ্যেঠিমার মনে হয়েছিল, এবং কিছু অংশে আমোদরও মনে হয়েছিল দিদিমা পাগল। এছাড়া কিই বা ভদ্রভাবে ভাবা যায়, মানুষটাকে এরা স্পষ্টত দেখতে পেলে।

“ওরে ছুড়ি তুই এগো।” বলে ছেলেটিকে তার মার কোলে দিলেন।

“তাহলে যাই জ্যেঠিমা” আমোদের সমস্ত মনটা এখন মাথায় এসে ঠেকেছিল, একবার শুধু এতবড় গল্পে পা বদল করে অন্য পায়ে শরীরের ভারটা রেখেছিল।

“সে কি রে বসবিনি; এই এলি—কেন, কিসের এত তাড়া—এ বেলার রান্না তো সেরেছিস?—কি রাঁদলি বল সকালে?”

এ সব প্রশ্ন এখন, অযথা অসোয়াস্তির সঞ্চার করছিল তার মনে হচ্ছিল, তার যেন হাড় নেই, তার যেন মাংস নেই, সে যেন খানিক ধোঁয়াটে! এ কথায় সে শুধু বলেছিল, “হু—রুটি করব।”

জ্যেঠিমার কোলে ছেলেটি অসম্ভব কেসে উঠল। মুখ তার লাল, তিনি স্নেহভরে অত্যন্ত কাতর হয়ে তার বুকটায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, “দেখছিস তো মা, কি কাসির দাপট, বেশ আছে হঠাৎ এমনধারা হয়, কত হল কিছুতেই যাচ্ছে না, তুই তো কত জানিস একটা কিছু দে না টোটকা-টুটকি-পয়সা দেবো” বলেই একটা আনি এনে দাঁড়িয়ে আনিটা এগিয়ে দিল।

আমোদ অতি সন্তর্পণে আপনার খোঁপার আলগা কাঁটা গুঁজে দিতে দিতে বললে, “কাল এসে দেবো।”

“তাহলে বসবিনি তবে আয়, কাল আনিস কিন্তু।”

“আচ্ছা” বলে সে রক থেকে নামল। বাগান পার হবার সময়, বেড়া উচিয়ে ঝামরে পড়া গাঁদা গাছের কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে আস্তে আস্তে শুঁকতে লাগল। তার গা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। সদর দরজার ধাপে উঠতে গিয়ে হঠাৎ হোঁচট, সঙ্গে সঙ্গে জ্যেঠাইমা বললেন, “ওমা ষাট-ষাট, হ্যাঁ বাবা খুব লেগেছে?”

“না জ্যেঠিমা।” কণ্ঠস্বর এখন ভদ্র। এখানে দাঁড়িয়ে পা-টায় হাত বুলাতে গিয়ে আঁচলটা তার পড়ে গেল। হাতের গাঁদাপাতা সেখানে ঘষে দিলে। আঁচল তুলে কাপড় ঠিক দিয়ে এবার সে বার হয়ে সদর দরজা ভেজিয়ে দিলে। দরজার সামনে এমন সময় শুনলে “ওরে রাস্তাঘাট দেখে শুনে যাস শেষে অঘটন না হয় তা হলে বিয়ে হবে না।”

এখন আমাদের কোন জোর নেই, খোঁপাটার আবার যত্ন করল। ইদানীং কথাগুলো তাকে একটু কষ্ট দিল। তার জীবনে দিন ছিল রাত্র ছিল কিন্তু দুঃখ কোথায় ছিল! কেমন বুকটায় পাখির ডানা ঝাপটাতে লাগল! নিজের বেদনার মুখোমুখি দাঁড়াতে তার কোন জোর ছিল না। দু’পাশে অতি প্রাচীন কালো রাস্তা, এর মধ্যে ভগ্ন্যুপের উপর যেখানে সেখানে কুয়াশা নামছে, সামনের সজনে গাছে ফুল ধরছে, সেখানে কিছু মৌমাছি বনবন করছে। বুননা মিষ্টি আসন্ন সন্ধ্যার গন্ধ শরীরটাকে এখন মানুষের মত করে রেখেছিল। কান্নাটা তার যদি আসত সে তাহলে বেঁচে যেত। এ অভিমান সেটুকু সুযোগ দিলে না, কাঠ হয়ে রইল। এমন সময় তার কপালের কাঁচপোকার টিপ খসে পড়ল। টিপটার ময়ূরপাখা রঙটার দিকে চাইলে, তারপর সে টিপটার উপরে সজোরে এক লাথি মারল। সে নেমে খানিক এগিয়ে গেছে। আবার ফিরে এসে টিপটা তুললে। ধূলাটা হাত দিয়ে ঝাড়ল, আঁচল দিয়ে মুছে আঁচলে বাঁধল।

আরও খানিক পথ এসে সে এবার তিক্ত হয়ে উঠল, গা-টা তার রিমরিম করতে লাগল। সহজ অধিকার নিয়ে যে মানুষ বাঁচে, যার পায়ে পা দিলে লাগে তার মত ভাবল, বুড়িটা আমার সঙ্গে চালাকি খেললে?

সমস্ত স্মৃতি তার ধসে গেল ; অনেক দূরে সে চলে গেছে—এখন যেন শত্রুপক্ষ! দিদিমাকে বুড়ি ভাববার মত মন তার কখনও হয়নি কারণ তারা দু’জনে একটি মানুষকে নিয়ে ছিল।

ক্ষোভে তার ভিতরটা পুড়ছিল। এই শীতে তার ঘাম এল কপালে। শুধু মনে হচ্ছে ‘আমাকে বললে মিউনিসিপালটির ট্যাকসো। তঞ্চকতার একটা সীমা আছে।’ বড় অভিমান এখন দুর্ধর্ষ ক্রোধে পরিণত হল।

পাশ দিয়ে লোক সাইকেল সবকিছু গেছে কিন্তু সত্যি তার চোখে পড়েনি। মনে হয় পা সে বেসামাল ফেলছে। সারাক্ষণ গিন্নির কথা তাকে কাঁটা মারছে…..এমন ভাবলে কি ভয়ঙ্কর নীচ ছ্যাঁচড়া ছোটলোক। এখন সে রাসতলায় এসে পড়েছে। সামনেই লাহাদের পুকুরের পাশ দিয়েই রাস্তার শেষে তাদের বাড়ি।

ঘাটে দু-একজন, আমোদ পা-টা ডুবিয়ে দিলে পুকুরে শীতলতা, তার বুক পর্যন্ত শীতল করে দিয়েছিল, সে মাথা তুলে সন্ধ্যার কালো পুকুরটার দিকে চেয়ে দেখলে অবাক হয়েই দেখলে, বোধ হয় ভেবেছিল যার কেউ নেই তার ডুবে মরা উচিত।

কেউ নেই কথাটা সে ভেবেছিল। তুলাকার ঠোঁট সে চেপে ধরল। দুরন্ত অভিমান চোখে ঠেলে জল হয়ে আসছিল। ভাঙা বালি খসা ইটের দেওয়ালের পাশে একটু দাঁড়াল, ভুলোর বাচ্চা মেদো কুকুরটা ন্যাজ নাড়তে লাগল। সে তাকিয়ে চোখ মুছে খিড়কির দরজা ঠেললে। কুকরটা পাশেই, আমোদ বললে, “মরণ দুর হ।”

সিঁড়ি দিয়ে উঠে বালতি থেকে জল নিয়ে পা ধুয়ে গামছাটা দিয়ে পা মুছে ভিতরে এল। গিন্নি মালা জপছিলেন। তার উদ্দেশে বললে—”আসছে জ্যাঠা” বলেই সে চলে যাচ্ছিল দোতলায়, তার ধর্মক্রিয়া দেখে তার গা আরও জ্বলে গেল—তঞ্চক—আবার মালা গোনা হচ্ছে!

দিদিমা গোবিন্দ গোবিন্দ বলে বললেন, “ওরে আমোদ।”

এমন সময় উপর থেকে গোরাচাঁদ হাঁকলে, “ঠাক্‌মা আমোদ এসেছে?” বুঝা গেল তার কান খাড়া হয়ে আছে, তারপর বললে, “এক গেলাস জল দিতে বল না আর লণ্ঠনটা দিয়ে যাক।”

“যা গোরাকে জল দিয়ে আয় তারপর ধুনো গঙ্গাজল দে—”

আমোদ গেলাস নিলে, জল গড়ালে, সব কাজেই তার যেন একটু বেশি শব্দ হচ্ছে আজ। গিন্নি মালা জপতে জপতে চোখ একটু খুলে ঝাপসা দেখলেন আমোদকে।

আমোদ জলটা রেখেই চলে আসছিল, হঠাৎ গোরা বললে, “কি রে এত রাগ কেন? খিদে পেয়েছে বুঝি—আহা…..”

আমোদ কোন উত্তর দিলে না ওর দিকে চাইলে না। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে কাপড় ছেড়ে গামছাটা পরে তুলসীতলায় প্রদীপ দিয়ে এল, ঠাকুরের জায়গা—প্রদীপ দিয়ে শাঁখ বাজালে, দীপ দিয়ে ধূপ লণ্ঠন জ্বাললে তারপর ধুনুচিটা নিয়ে দুটি ঘরে দেখিয়ে লণ্ঠনটি নিয়ে উপরে তক্তপোশে বসিয়ে দিলে, ঘরে ঘরে ধুনো দেখিয়ে চলে গেল।

গোরা চোখ ফিরিয়ে বললে, “হ্যাঁরে তোর ঠাণ্ডা লাগে না? বাবা কি শীত রে, শুধু গায়ে কি করে ঘুরছিস?”

সত্যই আজ মোটে তার ঠাণ্ডা লাগছিল না। শুধু গামছায় সে আছে এ কথা তার মনে হচ্ছিল না। সে নিচে নেমে এসে গোয়ালে খড় আগুন দিয়ে চুপ করে দাঁড়াল, তার ছেঁড়া ময়লা কাপড়খানি—আর শতচ্ছিন্ন সেমিজটা পরল।

“ওরে সদাশিব আসবে চায়ের যোগাড় কর।”

কলের পুতুলের থেকেও আমোদ অন্য কিছু। শুধু মনে হচ্ছিল সে নিজেকে সামলাচ্ছে—সে যেন কখন হঠাৎ করে ফেটে পড়তে পারে। এ পাশের কুলুঙ্গি থেকে একটা জাপানী কাপ-প্লেট বার করে ধুয়ে এনে ময়দা মাখতে বসল। রাতে এ বাড়িতে ময়দাই হয়।

“ওরে আমোদ আমার কাছে আয়, ময়দা এখানে বসে মাখ, দেখ….”

বলার সঙ্গে আমোদের গা-টায় বিদ্যুৎ খেলে গেল।

“তোকে তখন ট্যাকসো বলেছিলুম ওটা বাজে কথা, বলিনি কেন জানিস তুই সব কথাই ওকে বলিস, যদি এ কথাটা বলে দিস তাই”, বলে আস্তে আস্তে সব বললেন। আমোদ চুপ, ময়দায় জল ঢেলে ময়দা ছাড়াতে লাগল। ময়ানের পাট নেই এখানে।

“বল তোর কি মত”, আবার মালা ঘুরতে লাগল। আগেকার কথাটায় যুক্তি আছে, তবু তার মন বেঁকে বসেছে। সেও খলের মত ভাবলে, “এখন তো তাই বলতেই হবে। সব কথা তো জানা যাবেই তাই।” এতক্ষণ বাদে তার একটি দীর্ঘশ্বাস কেঁপে কেঁপে পড়ল। অল্প ময়দা উড়ে গেল। গিন্নি ওর দিকে আবার চাইলেন। আমোদর জিবটা জড়িয়ে গিয়েছিল তবু কোনমতে বললে, “আমার আবার কি মত।”

“নারে ভাল করে বোঝ, ভটচাজ বললে, আমায় যদি বাপু সত্যিই জিজ্ঞেস করিস তো আমি বলব, যে ছোঁড়া এখন কাপড় পৈতে সামাল দিতে পারে না তার আবার বিয়ে কিন্তু ধর আমোদ আখেরে কখনও যদি সত্যিই সন্নিসি মন্নিসি…..”

আমোদ আর পারলে না, তেতো করে বললে, “আহা বাজে কথা বল কেন আমি আছি।” কথাটা নিজের কানে যেতেই চোখ তার বড় হল, ভ্রু কুঁচকলো সত্বর বললে, “তুমি আছ” বলে আরও তেতো আরও সহজ করে বললে, “সন্নিসি না হাতি রাত-বেরাত দাঁড়াতে হয় তিনি হবেন সন্ন্যাসী মরি…” কথাটার মধ্যে বক্রভাবে বিষ ছিল।

হঠাৎ গিন্নির গায়ে কেমন কম্পন হল, তারপর আধখোলা চোখে, যে কথা বলতে মুখ ফুটে চাইছিলেন না সেই কথাই বলতে হল “…ধর যতি অন্য কিছু হয়”, বলে চোখ মুছলেন।

আমোদ একথায় অন্যরূপ হয়ে গেল। এক নাকের নিঃশ্বাস আর এক নাকে বইল। তালুটায় যেন কুয়াশা ঢুকছে—হিম। সে বড় বড় চোখে দিদিমার দিকে কাতরভাবে চাইল। ল্যাম্পের আলোটা তার চোখে মুখে তলা থেকে পড়ে রহস্যময় করেছে। একটা ছোট লড়াই বা না হ্যাঁ কিছু হল না, বললে, “তাহলে কর।”

এটাই আমোদর মন।

ঠোঁট ঈষৎ ফাঁক করে বললেন, কথাটা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল, “ভটচাজ বলেছে পর-কপালে কল্লে রুখে যাবে” আবার কম্পন “তার জোরে দীর্ঘ পরমায়ু হবে।” চোখের জল মুখে গড়াচ্ছে।

আমোদের কানে এখন আর এসব যাচ্ছিল না, সে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে শুধু বলছে না না মত দিইনি….”ও আমি এমনি বলেছি” বেশ করেছি “বল্লেই হয় না….”

সদাশিব জ্যাঠা হাঁকলেন—”ওরে আমোদ।” আমোদ বারান্দার শেষের দরজা খুলে দিলে যেদিকে রাস্তা।

সদাশিব জ্যাঠার উলের টুপি থেকে মুখটা বার হয়ে আছে, এসে ঢুকলেন, “উঃ কি ঠাণ্ডারে—লাহাদের পুকুরটাই কাল হয়েছে। বল মাসিমা আছ কেমন হে হে….”

আটা মাখতে মাখতে শুনছিল হঠাৎ গিন্নি বললে, “তুই একটু যা তো আমোদ।”

আমোদ আর অপমানিত হল না, ভূক্ষেপ না করেই উঠে হাতটা ধুয়ে কাপড়ে মুছতে মুছতে দোতলার সিঁড়িতে উঠল। সেখান থেকে গোরার পড়ার শব্দ আর একতলার ফিসফিস, মাঝে মাঝে সদাশিব জ্যাঠার গলার এক আধটা কথা এখানে আসছিল—যেমন দ্যোৎ পাগলা কে দেবে নষ্টটষ্ট, সারমর্ম বুঝে নিতে পারছিল খুশিতে বুকের মদ্দিখানে তার ঘাম।

“গোবিন্দ বল, গোবিন্দ বল এসো আর একদিন—ও আমোদ দরজাটা বন্ধ কর বাছা।”

এতদিন বাদে লক্ষ হল গিন্নি তাকে কখনও মা বলে না বাছাই বলে। এটাতে তার আরও অভিমান হল, তাকে দাসী বাঁদী যদি নাই ভাবত তাহলে সত্যিই তাকে ‘মা’ বলত। ক্রমশ তার কাছে এ বাড়ির ব্যবহারটা অবাক করলে। সে এসে দরজা দিয়ে রুটি বেলতে বসল। কোন কথা বললে না।

গোরাচাঁদ বুঝেছিল আমোদ আর তেমন নেই। গোরাচাঁদের মন পুরাণ উদ্ভট কল্পনাবিলাসী। কেন মৃত্যু হয়, তেমন কেন তোক গম্ভীর হয়ে গেল, তাল বুঝে নিতে ঠিক পারে না। যদি এর মানে-বই কিনতে পাওয়া যেত তাহলে কারুর কাছে সে চেষ্টা চরিত্তির করত। সে অবাক হয়ে আমোদকে দেখে হাঁ করে ছেলেমানুষের মত চেয়ে থাকে। মাঝে মাঝে মুখে তার জ্যামিতির ইনানসুয়েশ্যন বলে আর চেয়ে থাকে। সে বহু বার পাশ থেকে বিবস্ত্র আমোদকে দেখেছে। তার সুন্দর সুঠাম অদ্ভুত সুকুমার দেহ দেখেছে—পিছনে এক ঢাল চুল, চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এমন কত বার বার হয়েছে, সিঁড়ি উঠতে উঠতে হঠাৎ চোখ ফিরিয়ে দেখে নিচে, বিরাট দেহের পিছনের অংশ পিঠে হাতের শেষে নেবুর কোয়ার মত পেশী, চমৎকার লম্বা ঘাড় সেখানে রোঁয়া পাক দেওয়া চুল কাঁধে নেমে এসেছে বেঁকে ছোট হাড়ে এসে শেষ সুন্দর পদদ্বয় উপর, গুরুনিতম্ব। ধনুকের মত বেঁকে উঠে গেছে মেরুদণ্ডের সোঁতা। বস্ত্রহরণে এমন ছবি সে দেখেছে, এই উলঙ্গ দেহটা যেন নগ্নতার আড়াল আবরণ, তবু পলকে দেখে সে চোখ ফিরিয়েছে। ছ্যাঁচড়া কাপুরুষতা বলেই তার মনে হয়েছে, অবাক সে হয়নি। কতবার বলেছে পোড়ারমুখী ধিংধিং করে কাপড় ছাড়িস কেন।

ঘুমে, স্নানে, প্রসাধনে, এবং সমস্ত খুঁটিনাটিতে দেখেছে কখনও অবাক হয়নি, মনে হয়েছে ও তো আমোদ আবার কে! ঠাকুমাকে আমোদের কথা সে জিজ্ঞাসা করেছিল তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি। একদিন হঠাৎ গোরা তাকে ধরল—”আমোদ শোন, তুই আমার সঙ্গে কথা বলিস না কেন। তোর কি হয়েছে রে।”

আমোদের চোখে জল এল না, অভিমান তার মধ্যে পাথর হয়ে বসেছিল, আকাশ হয়েছিল। কোন উত্তরও সে দেয়নি।

গোরা তাকে খুশি করবার জন্যে বললে, “বুঝেছি তুই পেট ভরে খেতে পাস না, আমি তো তোর জন্য সব ভাত মানে যা অনেকটা রেখে দি।”

আমোদ বেদনাভরা মুখে একটু হাসল, অনেক দিন পর এইটুকুই সে হাসল। কিশোর উত্তীর্ণ বালকের দিকে তাকালে, ফরসা সুন্দর মুখটা সে অনেকদিন পর দেখল। তবু ভিতরে অবোধ ঘৃণাটা এখন ছিল। সে চলে যেতে পারত কিন্তু না গিয়ে পাঁচিলের উপর সোজা হাত রেখে দাঁড়াল, চুল সে আজকাল বাঁধেই না। শোবার সময় ইচ্ছে হলে দড়ি জড়ায়। চুল তার হাওয়ায় উড়ছে, মুখটা তার শক্ত।

“বুঝেছি বুঝেছি” বলেই উল্লসিত হয়ে উঠে বললে, ঢোঁক গিলে বললে, “তোর বর বোধ হয় চিঠি দেয়নি না রে।”

কি যেন তরঙ্গায়িত হয়ে উঠল শরীরে, তার ঝাঁকুনি লাগল তবুও কাঠ হয়ে বললে, “তাই বোধ হয়।”

“আমি লিখে দেব, তোর বরকে। বেয়ারিং চিঠি কর নিশ্চয় পাবে—”

“দেখ ছোটবাবু সব সময় ইয়ার্কি ফাজলামি ভাল লাগে না”—কথাটা অত্যন্ত বুনোভাবে বলা হল।

গোরা বোকা বনে গিয়ে নিজের নখ কাটতে লাগল, তারপর ফিরে এসে বললে, “তুই মনমরা হয়ে আছিস বলেই জিজ্ঞেস করলাম।”

“আমি থাকি না থাকি তোমার কি এল গেল, আমরা দাসী বাঁদী আমার জন্যে তোমার এত মাথা ব্যথা কেন” বলে চলে যাচ্ছিল।

গোরা ছোট হয়ে গিয়েছিল মাথা তুলে বললে, “আমোদ।” বড় আর্ত সেই ডাক। আমোদ যেন অনেক দূর থেকে উঠে যেই দাঁড়াল এদিকের চুল গলা দিয়ে আর একদিকে, সে পাশে দাঁড়াল কিন্তু এখন গা ছোঁয়নি, বললে, “ছোটবাবু আমি আর বলব না—” তার চোখে জল এল।

অন্ধকার হয়েছে। গোরা এবার তার ডান হাতটা উঁচু করল আমোদ হাত বুলাতে বুলাতে—”হা গো ছোটবাবু আমায় কোথাও নিয়ে যেতে পারো?” আকাশের দিকে চেয়ে সে বললে।

“আমোদ আমি আর একটু বড় হই তুই যেখানে যেতে চাইবি নিয়ে যাবো…”

আমোদ এখন তার গায়ে হাত বুলোচ্ছে। তার চুল উড়ে এসে গোরার ঘাড়ে পড়ল, সে সরিয়ে দিয়ে বললে, “হ্যাঁরে কেন যেতে চাস?”

আমোদ বড় ধরা পড়ে গেল কিন্তু স্থিরভাবে বললে, “তুমি কেন সন্ন্যাসী হতে চাও…”

গোরা আমোদর সঙ্গে কথায় পারে না। আজও পারলে না তার সত্য কথাটা জানতে।

ইতিমধ্যে নিচ থেকে ডাক এল, “ও আমোদ, গরুগুনো যে খড়ের জন্যে ছটফট করছে—ধুনো গঙ্গাজল দিতে হবে না?”

আমোদ বাঁচল। কিন্তু গোরাচাঁদ ভাবনার মধ্যে পড়ল। আমোদকে সে আমোদ ছাড়া আর কিছু কখনও ভাবেনি, তার মন আছে অনুভব আছে এটাও সে ভাববার আদল তার নেই। সে শুধু কপাল কুঁচকে ঠাওর করতে চেষ্টা করলে, অন্ধকার রাতের পথচারী তবু বিপদকে নানা কায়াতে দেখে, এ ছেলেটি তাও পারলে না। বেশি ভাবতে গেলেই “হয় শকুন্তলার পতিগৃহে, নয় কান্ট্রি ক্রিকেট ম্যাচ, লেট এ প্লাস বি হোল স্কয়ার, জনমোর in 1976,” এইসব কথাই ভেসে উঠে। শীতকে গোরার শীত বলে লাগছিল, বুকে হাত দুটি কোনাকুনি করে দিয়ে ঘুরতে লাগল। এখন তার ভয় হয়নি এটাই আশ্চর্য!

ভদ্রলোক দু-চারজন সবাই একই জবাব দিয়েছে। এখন একমাত্র রখো ভটচাজ সম্বন্ধের পর সম্বন্ধ আনছে। শেষে একটি সম্বন্ধ গিন্নির চোখের ঘুম ছিনিয়ে নিলে, মেয়েটির বাপ নেই, আরামবাগে মামারবাড়ি থাকে, ৬ বিঘে জমি, কামারকুণ্ডের কাছে বাড়ি, তাছাড়া কলকাতায় একটা বাড়ির ছোট অংশ। ১৫ ভরি গহনা, ছেলের ঘড়ি, ঘড়ির চেন দেবে। গোরার সাইকেলের প্রতি লোভ আছে। তবু এ ক্ষেত্রে এত দেবে সেখানে আর সে কথা গিন্নি পাড়েননি। বলেছিলেন সদাশিবকে খোঁজখবর করতে। সদাশিব বললে সব ঠিক কথা। আহ্লাদে গিন্নির লোল চামড়া বেশি দোলে, বললেন “ওরে আমোদ ঠাকুর গোবিন্দ মুখ তুলে চাইলেন, গোরার দীর্ঘ পরমায়ু হবে আমাদের আর—তোর কি হয়েছে রে, তুই আর মুখ তুলিস না, আমি না গোরা, কারুর সঙ্গে কথা বলিস না। তুই যেন আরও কালো হয়ে গেছিস।” আহ্লাদে তাকে কাছে টানলেন।

সে যে কেন এখানে এখন আছে তা বুঝতেই পারে না। নিজেকে সে কিছু বুঝতে পারে না, ভয়ও হয় যথেষ্ট। কাজের পর কাজ করে যায়। সকালে দুধ দোয়া থেকে আরম্ভ করে যোগান দেওয়া থেকে—সব কাজই করে—আজকাল সে লক্ষ করে তার মাথায় কেমন যন্ত্রণা হচ্ছে।

ত্রিবেণীতে গঙ্গাস্নান আর মেয়ে দেখা আশীর্বাদ একসঙ্গে সারবেন, গঙ্গাস্নানে যাচ্ছেন বলেই যাবেন, গোরা জানতে পারবে না।

আমোদ সব কথা শুনেছিল। সারারাত ঘুমোয়নি, সকালে ছড়া গঙ্গাজল, দুধ দোয়া। জাব একটু গরম করে দেয়, এই হিম জিনিস গরুগুলো মুখে দিতে পারে না। কাপড় ছেড়ে যোগান দিতে গেল।

গোবিন্দ বাঁড়ুয্যের বউ ছেঁড়া গামছা পরে বারান্দা ধুচ্ছিলেন।

“দুধ।”

“আয়রে আমোদ।”

ও পাশে আমোদ দুধ দিচ্ছে এ পাশে মাঝবয়সী মোটা গতর নিয়ে বারান্দা মুছছেন। আদ-ভাঙা গির্জের ঘণ্টা হয়, মুখ তুলে বললেন—”হ্যাঁ রা—তোকে এমন এলো দেখি কেন?”

হাসল।

“তুই যেন কেমন হয়ে গেছিস।”

“সংসারে যার কেউ নেই, তার আবার কি….”

বাঁড়য্যে-গিন্নি গোল হয়ে পশুর মত ঘুরছিলেন। শুনতে পেলেন না, বললেন, “গিন্নির সঙ্গে কি কথা কাটাকাটি হয়? তোর মত মেয়ে পেলে লোকে বত্তে যেত। যাচ্ছিস…”

রক দিয়ে ডিঙি মেরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এ বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়ি।

আমোদের নিজেকেই অসম্ভব ভারী বলে বোধ হচ্ছিল। গোরাও লক্ষ করেছে আমোদ সেইদিন ছাদের ঘটনার পর তার দিকে অদ্ভুত ভৌতিক ভাবে চেয়ে থাকে। চাহনিটা শূন্যতাকে ভেদ করে আসে। কখনও বা সিড়ির উপর থেকে, কখনও রক থেকে, কভুবা বারান্দা থেকে—ঘরে সে যখন বসে থাকে, অন্যের চোখের আড়াল থেকে, বিশেষত অন্ধকার থেকে।

যখন অন্ধকার থেকে সে চেয়ে থাকে তখন অসম্ভব ; যদি গোরা সাবালক হত বুঝতে পারত, এ আমোদ আর এক অতীব দুর্ধর্ষ বলেই মনে হত। যাকে মনে হত ‘ও তো আমোদ’ এখন আর সে কথা মনে হত না…সে যেন বা ভয়ঙ্কর একটি চুম্বকের ধারালো অস্ত্র। তীক্ষ্ণ, কুটিল, ক্ষুরধার, ক্রমাগত টানছে। গোরার চোখে চোখ পড়তেই সে চকিতে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। কখনওবা নিতই না।

গোরার মন কেমন করে খানিক অন্যমন। আবার সে খেতে খেতে বলতে লাগল,—শুধু বললে—”ওরে আমোদ আমায় একটু”—বলে চুপ করে গেল, কি যে চাইবে সে এটা ওটা ভাবতে লাগল। বললে—”নারে কিছু চাই না।”

আমোদ এসে বললে—”ছোটবাবু আমায় ডাকছ?

“হ্যাঁ, এ বেটা নাপিত যদি আবার আসে ঠাক্‌মা…..”

ঠাক্‌মা এই শীতে গামছাটি পরে হি হি করে কাঁপতে লাগলেন—সারাগায়ে জল। ইশারায় আমোদকে বললেন—কাপড় দিতে। মাঝে মাঝে তাঁর হাঁফ ধরে—গোরা রূঢ় ভাবে বললে—”আমোদ দেবে না।” অবশ্য আমোদ কাপড়টা আলগোছে দিলে। উল্টোদিকে মুখ ফিরে গিন্নি কাপড় ছাড়ছিলেন, লোলদেহ শীতে কম্পিত আর নাতির গজরানো শুনছিলেন।

“ফের যদি এসব বদমাইস বাড়িতে আসে তো দেখবে মজা…আমি লাথাতে লাথাতে বার করে দেবো।”

লাথাতে কথাটা বলে নিজেই লজ্জিত হল, গোঁ হয়ে রইল। ইতিমধ্যে ঠাকুমা মুখের ইশারায়, দু ঝলক মুখ ঝাঁকুনি দিয়ে আমোদকে জিজ্ঞাসা করলেন—”কে সব? ব্যাপার কি?”

আমোদ তাঁর দিকে বোকার মত চাইল, আবার মুখ ফিরিয়ে নিলে, উত্তর নেই।

শুধু ঝিঁঝি পোকার ডাক। গোরা আলোটার দিকে স্থির হয়ে চেয়েছিল।

“কাকে বলছিস রে…..এসব কথা?”

এতক্ষণে গোরা নিজের মনকে মানিয়ে ফেলেছে, নিজের অসংযমের জবাব দিয়েছে যে, গালাগাল যাদের উদ্দেশে দিয়েছে তারা মানুষের বদনাম, ফলে ঠাকুমার কথা শুনে আরো চটে গেল—”আহা ন্যাকা সাজছে, কেন ওই ব্যাটা সিঁদেল আর নাপতিনীটা….।” “তোমরা কি আমায় পড়তে শুনতে দেবে না—?”

গোরা সব দেখেছিল। দু-চার দিন থেকে শুনছিল, আমোদের বাতাস লেগেছে। এতদিনকার বদ্ধ ধারণা এর ফলে বদলাল। লোকে জানত আমোদ মুক্তর কাছে থেকে ওষুধ ছাড়াও তন্ত্র জানত সিধাইত (সিদ্ধাই) ছিল। নাপতিনী সে ভুল ঘুচালে।

প্রদীপের সামনে নাপতিনী, তার পাশে রোঘো উবু হয়ে বসে, গিন্নি জপের মালা নিয়ে আদ-খোলা চোখে নাপতিনীকে দেখছেন আর আমোদ দিদিমার পাশে। তার মুখখানি প্রদীপের আলোয় বড় শান্ত।

নাপতিনীর মুখে আলো পড়েছে, পদ্মাসনে বসা। হাঁটুর উপর দুটি মুঠো করা হাত। চুল এলো হয়ে পড়েছে, চোখ বোজা। আস্তে আস্তে দুলতে লাগল। মাঝে মাঝে কম্পন আর ভৌতিক গোঙানি, রোঘো ঠোঁট দিয়ে জিব মুছলে, ঠাকুমার মালা থামা হাত। একমাত্র ভীত নয় আমোদ—আর সিঁড়ির উপরে দেওয়ালে ঠেস দেয়া গোরাচাঁদ। গোরাচাঁদ আঙুল দিয়ে ইশারা করে আমোদকে ডাকল কিন্তু আমোদ একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে মাথা নাড়িয়েছিল—“না।”

“আমি বসেছি”—নাপতিনী ঠোঁট ফাঁক করে বললে—”বেশিরভাগই হাওয়া….” অল্প শব্দ….।

রোঘো মাথা নাড়িয়ে হাত দুটি মাটিতে রেখে গিন্নির কানের কাছে এসে বললে—”ভর হয়েছে।”

গিন্নি ঠোঁট নাড়িয়ে মাথা উচিয়ে বললেন—”প্রশ্ন কর” কিন্তু কথাটা ঠিক কি বললেন শোনাই গেল না। রোঘো আবার উবু হয়ে বসে প্রশ্ন করলে—”সামনে মেয়ে আছে, সে কে….?”

“আমোদ” হাওয়াই কথা কয়।

“কি হয়েছে ওর—”

খিলখিল করে হেসে বললে—”কিছু না—”

“তবে ও অমন করে থাকে কেন—?”

“মনে মরেছে—”

“কেন?”

“বাতাস”, হাওয়াই কথা, আবার ভয়ঙ্কর করে বললে—”বাতাস আস্তে লেগেছে….”

সবাই মুখ চাওয়াচায়ি করলে, গোরা নির্বোধ। রোঘো বললে—”ও, ত, তন্ত্রমন্ত্র জানে…..।”

“আমোদ? হিঁ তনতর টনতর জানলে বাতাস লাগে? না বাণ লাগে? ঘোঁড়ার ডিম জানে। সরি বষ্টুমিকে আনো সেও বলবে—ও আমোদ, পাতা লতা চেনে।”

“কোথাকার বাতাস!”

“এই বাড়ির…..আমি যাই, আমি যাই” বলেই “আঃ অং বং” করে পড়ে ফিট হওয়ার মত, মাছের মত বেঁকতে লাগল। রোঘো তাড়াতাড়ি উঠে বলে—”জল, জল…..।”

এতদিন পরে আমোদ দ্রুতপায়ে জল আনতেই রোঘো বললে আমায় দে” বলে তার মুখে জলের ঝাপটা মারতে লাগল। নাপতিনী চোখ চাইলে, উঠে জল থেকে কিছুদূরে উঠে বসল, যেন সহজ মানুষটি।

গিন্নি বললেন—”ওর তাহলে বাতাস লেগেছে কি বল?”

“তাই বলেছি তো তাই।”

“আমরা পাঁচজনা ভাবতুম ছুঁড়ি মুক্তর কাছে তন্ত্রমন্ত্র শিখেছে…..”

নাপতিনী হেসে বললে—”ওগো মাথা কি কুটো বেঁধে রেখেছ? তন্ত্র জানা, ঝাড়ফুক করা চালাকি? অনেক জন্মের পুণ্য, অনেক সাধনা লাগে গো, শ্মশানে বসতেই হবে—এই আমি প্রথমটা নষ্ট হতে মায়ের ধ্যানধারণা শুরু করলুম…. ‘আদেশ হল শ্মশানে’, সেখানে গেলুম, দু-একটা মিঠাই না পেয়েছি এমন নয়, তবে কি পেয়েছি—মানুষের ভালাই ছাড়া মন্দাইয়ে নেই। হ্যাঁ, একবার শত্রুতা করে পোড়া কাঠ পড়ে পথে রেখে দিয়েছিলুম ফণীর বউ ডিঙলে, বউটার সতীসাধ্বী বলে নামডাক—ফণী গেছল আসানসোল খোঁজই নেই—মাগীর পেট হল….”

এই কথা শুনেই গোরা উপরে চলে গিয়ে ডাকলো—”আমোদ খাবার দে আমি যাচ্ছি!”

কথার সঙ্গে সঙ্গে রোঘো আর নাপতিনী বিদায় নিলে। আমোদ, এখন জায়গাটা মুছে পরিষ্কার করে ঠাঁই করলে, জল দিয়ে থালা পাতল।

বাতাস কথাটা আমোদকে বাঁচাল, সে নিজেই বুঝে পাচ্ছিল না সে এখন কি? এতদিনকার ঘনিয়ে ওঠা মনটা তার উপর থেকে যায়নি, সেটাও ছিল। এখন বাতাস কথাটা হল তার নিশ্চিন্ত আড়াল। তাকে আর কেউ অন্য চোখে দেখতে চাইবে না।

গোরা যে কাকে একথা জিজ্ঞাসা করবে, তা সে বুঝে উঠতে পারছিল না। শেষে ভেবে দেখলে, অঙ্কের ছোকরা মাস্টার ব্রজবাবু—তার কথা পরিষ্কার, যুক্তিযুক্ত।

“বাতাস বলে কিছু নেই….”

“তবে ওটা কি?”

“মনে হয় মানসিক ব্যাধি—ভাবতে ভাবতে যেমন লোকে পাগল হয়ে যায়।”

“পাগল হতে পারে?”

“নাও হতে পারে তবে কুসংস্কারে বিশ্বাস করো না, যে কথা সে বলতে পাচ্ছে না, আমরাও জানতে চাইছি না, ফলে একাই সে গুমরে মরছে…..ওদিকে মন দিও না তুমি, আর কটা দিন বাদেই এক্জামিন!”

কিন্তু একথা গোরা কিভাবে যে জিজ্ঞাসা করবে তা ভেবে পেল না। সে উপায় ভারতে গিয়ে একটু গম্ভীর হয়েছে। সে আগের দিনের মত হলে হয়ত পারত কিন্তু ইদানীং আমোদ তাকে ভীত করেছে। আমোদের ওই দূর থেকে রহস্যময় দেখা সত্যই ভীতত্রস্ত করে। এলো চুলে সে যখন দাঁড়ায় তখন ভয়ে সে, গোরা, খাবার গিলে ফেলে অথবা পালায়।

আমোদ ওইরকমভাবে তাকালেও নাপতিনীর কল্যাণে—বেশ করে ধুলা দেবার মত আড়াল পেলেও—সে কিছুতেই নিজের মনকে যাকে সঠিক ভাবে স্বার্থপরতা বলে তাকে সায় দিতে পাচ্ছিল না। কখনও মাঝরাতে উঠে সে নিজেকে বলেছে, এমন কি খোঁপাটাও ঠিক করেছে, নাঃ সে কোথাও চলে যাবে, এখানে আর এক মুহূর্তও নয়। দরজায়, বারান্দায় অন্ধকার। অন্ধকারে পৃথিবীটা বিশাল হয়ে ওঠে, এতকাল যে পৃথিবীর সীমা ছিল তার ছেড়া আঁচলের মধ্যে কানা, এদিকে লাহাদের পুকুর—খিড়কির ডোবা, আম কাঁঠাল আর একটা সেগুন গাছ—ছোটখাটো অলিগলি—

আর ওদিকে পঞ্চাননতলা। সেই চেনা পৃথিবীটা চোখ মেলে বিরাট হয়ে তাকে ভয় দেখালে। সত্যই সে অসহায়! সে ভেবেছিল ভিক্ষে করে খাবে, নামগান করবে, মন্দিরে মণ্ডপে পড়ে থাকবে—নবদ্বীপে রাধেশ্যাম করলেও দিন চলে যায়।

রাতে গোরাচাঁদ খাবার পর মুখ ধোওয়ার পর আমোদর ছেড়া আঁচলটা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললে—”জলপানি পাই তোকে আমি একটা ভাল কাপড় কিনে দোবো…..নে এখন ভাল করে আলোটা ধর আমি ওখানে যাই।”

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললে—”দাঁড়িয়ে রইলি যে মরণদশা তোকে সত্যিই ভূতে পেয়েছে নাকি?”

আমোদ কাপড় দিয়ে নাকটা মুছে বললে—”বোধ হয়, চল ধরছি আলো”, বলে লম্পটা নিয়ে এগিয়ে গেল…..এই নিভৃতে সাহস করে বলতে পারলে না—”তুমি সেই ভূত!”

কারণ এতদিনকার অন্তরঙ্গতাকে ঠেলে কিছুতেই সে উঠতে পারছিল না। অন্তরঙ্গতার মূল্যে ছেলেমানুষটিকে সত্যই খেলিয়ে তোলা যায়—সে দম্ভও সে করতে পারে, কিন্তু অষ্টাদশী আমোদ চেয়েছিল আর এক হাতছানিতে তাকে ডেকে নেবে। অন্তরঙ্গতা উঠা বসা সব কিছু—সেই হাতছানিকে গ্রাস করে ফেলেছে। গোরা কোনোদিন তাকে প্রকৃতির মাধুর্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারবে না। রোদ, ফল, রঙ, চন্দ্রালোক, বহমান ধারাকে সে তাদের নিজস্ব নামেই নেবে।

এতকাল অন্তরঙ্গতা, স্নেহ মমতা রক্তের টান, যত্ন তার কাছে অহঙ্কার ছিল এই তাস দেখিয়ে সে চায় গোরা তার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে দেখবে। আর সে অন্যপক্ষে তাকে আর এক নতুন গানে মুগ্ধ করে দেবে। সুতরাং অন্তরঙ্গতাকে সে মুচড়ে দুমড়ে ফেলে দিতে পারে এমন ক্ষমতা তার নেই, আছে বিজাতীয় ক্রোধ, দেহ তার স্ফীত হয়ে উঠে কণ্টকিত, নিজেই হাত বুলায় আর ক্ষেপে ক্ষেপে ওঠে। সে যেন লাল আলো।

যদিও জানে গোরা বয়সে ছোট, গোরা জাতে উঁচু আর সে ঝি মাত্র। তবুও তার দুর্দমনীয় আশা, চোখে তার পাপ নেই। এখন রাত কত হবে কে জানে, গোরা উঠল, মুখ ধুল আবার আলো উঠিয়ে পড়তে বসল।

কাঠের গরাদ ধরে আমোদ দাঁড়িয়ে। চুল এলো…..অবাক হয়ে গোরার চোখে মুখে আলোর দিকে তাকিয়ে। এবার একটা নিঃশ্বাস পড়তেই হঠাৎ গোরা কেঁপে উঠল, তার হাঁটু দুটো উঁচু হয়ে গেল।

“তুই, তাই বল, এমন নিঃশ্বাস ছাড়লি মনে হয় সাপটাপ হবে।”

তারপর বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললে—”হ্যাঁরে আমোদ তোর মনে হয় আমি জলপানি পাবো?”

গোরা চোখ তুলে চাইল—গরাদ আছে আর কিছু নেই, শুধু কাঠের ছিটকিনিটা দুলছে, কি যেন ভাবতে গিয়ে—আবার পাঠের গুঞ্জনে।

এক টুকরো স্বর্গ! বাতাসে আজ কি হয়েছে—ভাবে যদি আমার মধ্যে ওকে মন্ত্রবলে ঢুকিয়ে নিতে পারতাম, অথবা গিলে ফেলতে, আমোদ আরো ভাবে…..আমার ভিতরে সে থাকত ক্ৰমে ডাগর জোরে ভেবেছিল—ছোটবাবুকে আমি ছিনিয়ে নেবো। এতদিন আমার আঁচলে যেমন সে মুখ মুছেছে চিরকালই সে মুছবে।

সে বহু আগেকার যুগে ফিরে গেছে, পরনে বল্কল চামড়ার ঠেঁটি। গুহার সামনে দাঁড়িয়ে অথবা সুদূরপ্রসারী মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আকাশের তলায়। চাপড় মেরে বলেছে ‘আমি চাই’। এক পাশের চুল সামনে এনে আঙুল চালায়। ঈষায় তার বুকটা নীল, দু’হাতে বুকটা চেপে ধরে আরাম লাগে। গোরা শুধুমাত্র লোভনীয় বস্তু। ছেড়া সেলাই করতে করতে ক্ষ্যাপাটে হয়ে যায় বলে ওঠে ‘মরুক’। আবার কেমন মায়া হয়, কান খাড়া করে পড়ার আওয়াজ শোনে, সোজা হয়ে বসে।

দিদিমা এসে খবর দিলেন—”ওরে আমোদ, ছাঁচে গড়া মুখ, যেমন রঙ তেমনি পয়সা—ওকে পেলে তুই নাচবি।” রুটি বেলতে বেলতে তার চোখ ছোট হয়ে এল, পাগলের মত হয়ে ভাবলে—”মারি বুড়িকে বেলুনের এক ঘা, যাক চুকে বুকে…’ কিন্তু মারলে চাকির উপর, রুটি দুমড়ে গেল, অযথা শব্দ হল। দিদিমা প্রশ্ন করলেন—”কি হল?”

“ইঁদুর…..!”

এমন সময় গোরাচাঁদ লাফাতে লাফাতে এসে বললে—”আমোদ,আমোদিনী দুটো রুটি বেলতে সত্য ত্রেতা দ্বাপর ফেল পড়ে গেল যে।”

“নিজে বেলে নাও না”—গলার স্বরটা কড়া, কর্কশ নিম্নশ্রেণীর। কিন্তু বুদ্ধিমান হলে বুঝত পিছনে একটা কান্নার প্রলেপ আছে। ঈর্ষায় গা তার পুড়ছে, নিচু হয়ে আগুনে ফুঁ দেবার অজুহাতে মাটিতে মুখ রেখে কাঁদলে, মুছলে, চোখ লাল হল।

হাতে জল দিয়ে আমোদ চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ হেঁচকা টান পড়ল। আমোদ ফিরে দাঁড়াল—

“মিথ্যে কথা বললে পাপ হয়, বলবি না বল—”

আঁচলটা হাতে নিয়ে বললে—“না।”

“তোর চোখ লাল কেন?”

ওর দিকে চেয়ে বললে—”জগৎসংসার বুঝে সন্ন্যাসী হচ্ছিলে, আর এটুকু বুঝতে পারো না!”

“দেখ ইয়ারকি মারিসনি…”

চুপচাপ। গোরা বললে—”বল না রে কেন।”

“পরে বলব।”

আনাড়ি গোরা চুপ করে রইল।

ভুয়ো রক্তের টান—পাহাড় নামা রক্তের ঢল-এ ভেসে যাবে। সে জংলী দাঁত হয়ে আছে। সোমত্ত চেহারাই তার বিদ্রোহের নির্ঘাত হেতু, কুলটার মন কুকুরের ন্যাজের মত বেঁকেই আছে। তবু তাকে কুলটা বলা যাবে না কারণ সে তা অস্বীকার করে।

সে বলবে আমি সোমত্ত ডাগর মেয়েছেলে ডালিম-বিদার আমার গতর, আঁশজলের ছড়া দিয়ে বেড়াই না, আমি পরশেঙারী নই, আমি কাকস্থ রামকেই ভাবি—যে রাম ইদানীং গোরার মধ্যে প্রকাশ…..।

এই তার নতুন রক্তের ঢল। তার বুকটা কঁকিয়ে উঠেছে, শলাকাবিদ্ধ শুয়োরের মত। ধোপাপাড়ার মাঠে দোসাদরা যখন শুয়োর মারত সে কি সারারাতভর তাদের অসম্ভব আর্তনাদ! তারা নোটিস পেলে উঠে গেল। এতদিন পরে আবার সে আর্তনাদ আর একজনের হয়ে আওয়াজ হয়ে উঠল। এ আর্তনাদকে আঁকড়ে সে বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি। কোথায় তার জোর, সে আরক্ত! সে পাতা নয় ঘূর্ণি হাওয়ায় নখ দিয়ে যে মাটি চেপে থাকবেই।

স্নানযাত্রার দিন। ট্রাঙ্ক রোডের উপর—চাপা-পড়া কুকুরের চাহনিও তার মনে আছে, আয়ত চোখে তার ওই ছোট চোখের কাতর চাহনি উপচে পড়েছিল। কিন্তু সে অন্ধকার থেকে যখন, গোরা নামক বস্তুর দিকে চেয়ে থাকে তখন নয়। কখন-সখন অন্যমনে যখন আলোর দিকে, নিরিবিলি দৃশ্যের দিকে চেয়ে থাকে।

কিন্তু যে রমণী পাথরের অন্ধকার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে থাকে,হাড়-চিবোনর লোভ যার, দাঁত নখ বড় করে সে কখন তার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আর্তনাদ, গোঙানি, কাতর মেঘলায় চেয়ে থাকে কে সরষেপোড়াটা দিয়ে কুলোর বাতাস দিয়ে ঝেটিয়ে যেন বার করে দিয়েছে—ছেঁড়া জুতো মুখে করে চলে যাচ্ছে সে। তবুও পাঁজাকোলা করে গোরাকে ধরতে গিয়ে নখের ঘা বসাবে, কামড় লাগাবে—তা লাগুক সে তখন ধীর নিবিড় চিরকেলে অন্তরঙ্গতা দিয়ে সারিয়ে নেবে।…..আমোদ শিউরে উঠে।

আজ বুধবার, গোরা পড়তে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখলে—গিন্নি মালা জপছেন। গোরা এদিক-সেদিক চেয়ে বললে—”আমোদ কোথায় গো?”

“কে জানে বাপু, হ্যাঁ রা, তুই এবার থেকে আর সন্দে বেলা যাসনি, আমি একা থাকি, ভয়ে কাট হয়ে থাকি…মেয়েটার যে কি হল…..”।

“পাগল নাকি” বলে আলোর কাছে গিয়ে খাতা থেকে কাগজ ছিড়ে নিয়ে কয়েকটা গুলি ঢাললে—দোতলায় উঠে ডাকলে—”আমোদ।” সেখানে নিস্তব্ধ ঘর। আমোদ’ শব্দটা ঘর প্রদক্ষিণ করে ঘুরে এল। সে এবার সিড়ির ধাপে পা দিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে কি ভাবলে, তারপর দৃঢ় হয়ে উপরে উঠে গেল।

ছোট ছাদে আমোদ বসে। আদ-ছড়ান পা হাতের উপর ভর দিয়ে বসে চুল একটু উড়ছে, গায়ে ছেঁড়া সেমিজটাও নেই। গোরা বেশ কাছে এসেই বৈঠকী দেবার মত করে বসেই বলল—“ওরে আমোদ….”

এত কাছে গোরা—তটস্থ ত্রস্ত হয়ে বেশ পিছনে সরে গেল আমোদ আরো হেলে গেল। গোরাকে এত কাছে চায়নি সে। এখন তার নিজের অনেক কথাই হয়ত মনে পড়বে কবে সে অন্য বাড়ি থেকে জুতোর কালি চেয়ে এনেছে, ওর ছেড়া জুতো পরিষ্কার করেছিল। কপি ভালবাসে বলে কপি পুঁতেছে, মাহেশের রথ থেকে আনা পাতিনেবুর গাছ আজ ঝামরে উঠেছে। খশাই মল্লিকের ডোবা ছাঁচার পর সে কাদা মেখে মাছ ধরেছে, কাদা মাখা অবস্থায় উঠনে যেই দাঁড়িয়েছে এমনি সময়ে লাফ দিয়ে গোরা এসে হাতের চ্যাঙারি টান মেরে ফেলে দিয়েছে। কইমাছ পড়ে উঠনে হাঁটছে, তার মধ্যে সে ভুলো মাছগুলোকে শুঁকে শুঁকে পিছিয়ে পড়ছে আর গোঁ গোঁ করছে, সে ভেবেছিল মাছগুলো জিইয়ে রাখবে এবেলা ওবেলা দেবে। গোরা মাছ ভালবাসে, দুপুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরেছে, ইল্লিদি ফুটকড়াই বলাতে গোরা বলেছিল চাবকে সোজা করে দেবো। এখন এই সকল যত্নআত্তি তার কাছে ন্যাকামি, নিজের পরকাল খেয়েছে, সে লাথিয়ে সব ভেঙে দিয়েছে। বেসরম ন্যাকামো। গোরার সান্নিধ্য প্রত্যহ ঘটনা হাতে নিয়ে এসেছে, একটার পর একটা দেখায় স্মৃতিভ্রংশ উন্মাদকে আবার স্থিরসিকা করে তুলতে চাইল। স্যাঁৎ, স্যাঁৎ—মানতে ধরা তেলচিটে বালিশে মাথা দিয়ে তার শীতলতা অনুভব করুক এই তার শাস্তি!

“ওরে আমোদ হাঁ কর—তুই কিছু খাসনি তো?”

আমোদ অবাক হয়ে চেয়ে হাঁ করল। গোরা নিজেও খানিক হাঁ করে গুলি ঢালতে যেন নিজের মাথাটা ঢেলে দিল। চোখে চোখ ঢেলে দিলে আবার সরিয়ে নিয়ে বললে—

“দেখ আমোদ তুই আমার কথা শুনবি, তোর পায়ে পড়ি” একথা অন্য সময় শুনলে বলত “আমায় তুমি নরকে পচাতে চাও?” এখন চুপ—পুরানো কথার দাসত্ব-ভয়ে ভীত।

“তুই ওসব কথা ভাবিসনি, বাতাস ফাতাস বলে কিছু নেই, ওসব বাজে কথা। তুই উড়িয়ে দে…..”

নিজের হাতের দিকে চেয়ে মুঠো খুলে দেখলে একটা ছোট শিশি, হোমিওপ্যাথি ওষুধ ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললে—”এটা রাখ, এটা পাঁচগুলি শোবার সময় আবার কাল সকালে বাসি মুখে, রাতে শোবার সময়।”

আমোদ তেমনি বসে। গোরা বাঁ দিক দিয়ে আঁচলটা টেনে নিয়ে শিশিটা বেঁধে দিয়ে ছেড়ে দিলে।

“হ্যাঁরে তোর ঠাণ্ডা লাগে না, না সেমিজ নেই, এই একটাই?”

আমোদ চুপ।

গোরা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললে—”আমোদ একটা কথা বলি, তুই আমার মত সব সময় ভগবানকে ডাক—দারুণ জোর পাবি। দেখ, আমার ত্রিসন্ধ্যা আহ্নিক করার কথা কিন্তু করি না, শম দম ওসব পরে হবে, প্রথমে একটু ডাকা, দেখ আমার মাঝরাতে ছাদে এসে, বসে তাঁকে ডাকতে ইচ্ছে করে কিন্তু জানিস বড় ভয় করে…….মাইরি।”

“ব্ৰহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা” বলেই মৃদু হাসল আমোদ।

“তুই ঠাট্টা করছিস!” তারপর থেমে গোরা বলতে গেল সে পাসের চেষ্টায় আছে পেলেই তাকে নিয়ে যাবে। তারপর বললে—”তোর মনে পড়ে”—বালি-খসা সিঁড়ির দেওয়ালের দিকে পিঠ করে দৗঁড়াল। ফাটলের আগাছার দিকে মুখ করে কাপড় ঠিক করে দেখলে দূরে গোরাচাঁদ, আবার তার সেই দৃষ্টি ফিরে এল।

“মনে পড়ে তুই আগে” এসব কথা তার কানে বিষ ঢেলে দেয়। চকমকি ঠুকে দাবদাহ ঘটাতে সক্ষম রমণী সে। প্রিয়জনকে না পেলে যারা গলায় দড়ি দেয়, আগুনে পোড়ে, পুড়ে পুড়ে খণ্ডিত চুলে সিঁড়ি দিয়ে হাওয়ায় গড়াতে গড়াতে নামে যারা, তাদেরই অন্য পিঠ সে। অন্তরঙ্গতাকে লুটিয়ে দিয়েছে, দিয়ে বীরের মত দাঁড়িয়ে দম নিচ্ছে।

এখন তাকে গোরাকে পেতে হবেই।

ইদানীং তার পশু স্বাভাবিক রোমশ দেহটা কে যেন ক্রমাগত করকরে জিহ্বা দিয়ে লেহন করে অব্যক্ত দন্তহীন মাড়ি দিয়ে কামড়ায়। নিজেকে মনে হয় ডাইনীর মত। কোন ভয় নেই—ঝোপঝাড়ে অন্ধকারে রাতের এলো চুলে সে এটা ছেড়ে ওটা তোলে! গাছ পাতা লতা গ্রন্থের বাক্য হয়ে উঠতে চায়। কুম্ভক হলে যেমন বুকটা হয়ে থাকে, কাঁপে, তেমনি কেঁপেছিল অযথা কেন না, পাপ বিরাট ধুনীর মত নিজের রক্তকে ঘোলা করে, বোধশক্তিকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলে। চুল তার উড়ছে, শীত গ্রীষ্ম বোধ নেই, কাপড় এলোমেলো—শেষ নৈতিকতা খসে যেতে চায়, সে উলঙ্গ হয়ে যাক আদিম হয়ে যাক!

গোরা সন্দেহ করতে পারলে না, শুধু তার চেহারা আর লাল চোখ দেখে ভয়ে ভয়ে বলেছিল—”আমি বলছি রে বাতাস বলে কিছু নেই।”

শব্দটা বহুদূর থেকে এল। বিজ্ঞানের যুগ থেকে বহুদূর নখর হুঙ্কার যুগে এল বোধ হয়। আমোদ শুধু পশুর মত চিৎকার করে উঠে নিজের চুল ছিঁড়তে চেয়েছিল।

“ওরে আমোদ লণ্ঠনটায় বোধ হয় তেল নেই…..”

‘আ-ছে-’

কথার জবাবে গলা তার কেঁপেছিল।

দিনে রাত্রে এই মুহূর্তটিকে কামনা করেছিল আমোদ। নিজের রক্তকে ঘোলা করে নৈতিকতাকে উদম করে—সে তার মন্ত্রসিদ্ধি চেয়েছিল, ঝোপঝাড়, গাছ, লতাপাতার বিষাক্ত তরলতা তাকে সফলতা এনে দিয়েছিল। সত্যিই সে ছোটবাবুকে এক অন্ধকার জগতে পৌঁছে দিতে পেরেছে যেখানে সে ছাড়া আর তার পাশে কেউই থাকবে না। রোমশ দেহটা তার অন্তরঙ্গতাকে গড়িয়ে দিয়ে লুটিয়ে পড়েছে একান্তে ক্রমাগত এখন শুধু পশুর মত ও দেহে তার অসম্ভব কম্পন।

“সব ঝাপসা হয়ে আসছে….”

“সারাদিন বই মুখে করে আছিস চোখের আর দোষ কী?”

বলে বুড়ি ঠাকুমা পাশ ফিরলেন।

তখন গোরাচাঁদ আর জলপানি পাবে না। আমোদকে আর দেখতে পাবে না, সে অন্ধ!

“আমোদ আমার কি হবে….?”

“ছোটবাবু—”

“আমি…আমি….”

“এই যে ছোটবাবু আমি আছি—ভয় কি, ভয় কি…”

“তুই আমায় ছেড়ে যাবি না তো—”

“না গো ছোটবাবু…”

বাতাস পর্ব গেছে, বুনো স্ত্রীলোকের চিহ্নমাত্র নেই, শুধু বুকে অসহ্য কান্না আর ছোটবাবুকে সারাজীবন সে নিশ্চয়ই বইবে।

আমোদিনী এখন রাত থাকতে ওঠে, ঘরের ছুটা কাজ করে—ছড়াঝাটি, বাসিপাট ইতিমধ্যেই সবই সে সেরে নেয়, এরপর দুধ দোওয়া, যোগান সে পরে দেয়, পুব আকাশ তখনও অন্ধকার। কুলঙ্গি থেকে খঞ্জনীজোড়া বার করে নেয় তারপর আস্তে আস্তে সদর পেরিয়ে সে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে ; আসবার সময় ভাল করে দরজাটা বন্ধ করে দিতে ভোলে না। এবার নামগান গেয়ে আমোদ ভিক্ষে করবে, এ তার নিত্যকর্ম। গোরাচাঁদ আর কোনওদিন সংসার করতে পারবে না, এখন সংসার আমোদিনীর…..।

“ভজ গোবিন্দ কহ গোবিন্দ লহ গোবিন্দের নাম রে…ভজ গোবিন্দ….” সুললিত কণ্ঠস্বর গাঢ় হয়ে ওঠে আমোদিনীর ভালবাসার গভীরতায়। আবার শোনা যায়…..

“রাই জাগো, রাই জাগো….কত নিদ্রা যাবে…..

ওগো কালোমানিকের কোলে…..”

কুঞ্জ ভোরের এ গীতে….ছোট আকাশ তার যেমন লাল হয়ে ওঠে। পাথরে অন্ধকার ভেদ করে রমণীসক্ষম স্থির রসিকার সলাজ ভঙ্গিতে এখন প্রতীয়মান হয় যে, আমোদিনী বৈষ্ণবী ওরফে ‘আমোদ বোষ্টুমী’!

১৩৯৫ (১৯৮৮)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *