3 of 3

আমার চোখের জলের ঈদ

আমার ধর্মের নাম সোজা ভাষায় মানবতা। আমি বলি মানববাদ। বুদ্ধিজীবীরা বলেন মানবতন্ত্র। অনেকে ভাবেন আমি বুঝি ধর্মগ্রন্থ পড়ি না। সত্য কথা হলো, অনেক ধার্মিকের চেয়ে আমি ধর্মগ্রন্থ বেশি পড়ি। অনেক মুসলমানের চেয়ে কোরআন হাদিস এবং ইসলামের ইতিহাস বেশি পড়ি। অনেক মুসলমানই জানেন না কোরআন হাদিসে কী লেখা আছে। আমি কিন্তু জানি কী লেখা আছে।   আমার ধর্ম তারপরও ইসলাম নয়, আমার ধর্ম মানবতা। আমি নামাজ পড়ি না, রোজা রাখি না, কিন্তু মানুষের সেবা করি। ছোটবেলা থেকেই করি। কোনো ভিক্ষুককে কোনো দিন ফিরিয়ে দিইনি। কোনো গরিব লোক যখনই সাহায্য চেয়েছে, দিয়েছি। বিনে পয়সায় চিকিৎসা দিয়েছি। ওষুধ কেনার পয়সা নেই, কিনে দিয়েছি। জামা নেই কারো, নিজের জামা দিয়ে দিয়েছি।

বই নেই, বই দিয়েছি। এভাবেই বড় হয়েছি আমি। বড় হয়েও একই কাজ করেছি। এখনো অন্যের কষ্ট দেখে কষ্ট পাই, অন্যকে খাইয়ে আনন্দ পাই, অন্যের সুখে সুখী হই। নিজের কথা ভাবার সময়, নিজের স্বার্থ দেখার সুযোগ আমার হয় না বললেই চলে। তাই বা বলি কী করে, সময় আর সুযোগ হলেই কি আমি নিজেকে নিয়ে পড়ে থাকতাম! আমার তো মনে হয় না।

নামাজ রোজা না করলেও ঈদের সময় ঈদ করেছি। ছোটবেলার মতো ঈদের আনন্দ বড়বেলায় আর জোটেনি। রোজার ঈদকে আমরা বলতাম ছোট ঈদ, আর কোরবানির ঈদকে বড় ঈদ। ছোট ঈদের সময় বাড়ির কাজের মেয়েরা জামা জুতো পেতো, এই ব্যাপারটা আমাকে আনন্দ দিতো খুব। সারা বছর কী ভীষণ পরিশ্রম করতো, মলিন কাপড় পরতো, এক ঈদের দিনটায় দেখতাম ওদের হাসিমুখ। ছোটবেলায় আমারও যে খুব কাপড় চোপড় ছিল তা নয়, কিন্তু কাজের মেয়েদের নতুন কাপড় দেখে আমার যে আনন্দ হতো, তা নিজের নতুন কাপড় পাওয়ার আনন্দের চেয়ে বেশি ছিল। শাড়ি লুঙ্গি বিলোতাম গরিবদের, এও বড় আনন্দের— বড় ঈদে বড্ড কষ্ট হতো গরুগুলোকে জবাই করা হতো বলে, কিন্তু গরিবদের মাংস বিলোনোটা আমাকে আবার প্রচণ্ড আনন্দ দিতো।

যতদিন বাবা-মা ছিলেন, যতদিন ‘অবকাশে’ আমাদের বাড়িতে ছিলাম, ততদিনই ঈদের সময় আনন্দ হতো। মা যে কত কিছু রান্না করতেন, কত পদের যে রান্না, কী যে সুস্বাদু! কিছুই খেয়ে শেষ করতে পারতাম না। কত মানুষ যে খেত আমাদের বাড়িতে!

আমাদের ময়মনসিংহের ওই বাড়ি থেকে আমি বেরিয়ে যাওয়ার পর আমার জীবনে ঈদের সেই উৎসব আর নেই। ঈদ আসে, ঈদ যায়, কিন্তু আগের মতো আনন্দ নেই। আগের মতো বাবা-মা কাছে নেই, আগের মতো মাংস বিলোনো নেই। গরিবদের শাড়ি লুঙ্গি বিলোনো নেই। ঈদ আমার কাছে অবকাশ, বাবা মা ভাই বোনের সম্মেলন, নতুন কাপড় চোপড়, দানের উৎসব।

দিন দিন অনেক কিছু পাল্টে গেছে। রোজা বলতে আমরা ছোটবেলায় সংযম বুঝতাম। এখন চারদিকে যা দেখি, তা নিতান্তই ইফতার পার্টির রাজনীতি। দুর্নীতিবাজ লোকেরা ইফতার পার্টির আয়োজন করে নানা ব্যবসা-বাণিজ্য নাকি গুছিয়ে নেন। শুনেছি এইসব হয়। আমি রাজনীতি বুঝি কম। যদিও চিরকালই রাজনীতির শিকার। আসলে মানুষকে অসৎ আমি ভাবতে পারি না, সবাইকেই ভাল মানুষ ভাবি। মন্দ কাজ করলেও ভাবি ভুল করে ফেলেছে, নিশ্চয়ই অনুতপ্ত হয়েছে পরে।

রোজা-নামাজকেও রাজনীতির শিকার করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিম ভোট পাওয়ার জন্য রোজা-নামাজ করেন। নিরীহ মুসলিমদের ধোঁকা দিচ্ছেন তিনি। হিন্দু হয়ে মুসলিমদের ধর্ম কর্মের প্রতি তাঁর যদি আকর্ষণই এতো, তাহলে তিনি নিজের ধর্ম বদলে ইসলাম ধর্মই গ্রহণ করতেন। রোজা নামাজ যারা স্বার্থের জন্য ব্যবহার করে, তারা ভাল লোক নয় বলেই আমার বিশ্বাস। ধর্মটা কারো কাছে নৈতিক শিক্ষা, কারো কাছে রাজনীতি, কারো কাছে পাপ মোচনের অস্ত্র। ধর্মকে কে কিভাবে কী কারণে ব্যবহার করছে তা বুঝতে পারলে আমরা মানুষের চরিত্রও ঠিক ঠিক বুঝতে পারবো। ধর্ম এবং ধার্মিক নিয়ে গবেষণা খুব কমই হয়, গবেষণা হলে আমরা বক ধার্মিকদের মুখোশটাও উন্মোচন করতে পারতাম। সারা জীবন পাপ কাজ করে, মানুষ নির্যাতন করে, চুরি ডাকাতি করে পাড়ায় একটা মসজিদ গড়ে দিলেই তার সাতখুন মাফ হয়ে যায়। এ বড় ভয়ংকর— এ যেন না হয়।

ইসলামের যে জিনিসটা আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি, তা হলো জাকাত। জাকাতের নিয়ম আছে বলে গরিব দুঃখীরা কিছুটা খেতে পরতে পায়। অবশ্য আমি দারিদ্র্য সম্পূর্ণ ঘুচে যাক চাই, দরিদ্র বলতে কোনও শ্রেণিকে চাই না। কাউকে যেন অন্যের সাহায্য নিয়ে, জাকাত নিয়ে বাঁচতে না হয়। সকলের যেন থাকে অন্ন বস্ত্র শিক্ষা স্বাস্থ্যের অধিকার। সকলের যেন থাকে মত প্রকাশের অধিকার, থাকে বাক-স্বাধীনতা।

ঈদ আসছে। মনে পড়ছে আমাদের ময়মনসিংহের বাড়িটির কোলাহল। বাড়ির কেউই ধর্মান্ধ ছিল না, মা ছাড়া আর কেউ ধার্মিকও ছিল না। কিন্তু ঈদে দরিদ্রকে সাহায্য করার কাজটি সকলে খুব সিরিয়াসলি করতো। বাবা তাঁর গ্রামের গরিব লোকদের জন্য ট্রাক ভরে নতুন কাপড় চোপড় পাঠিয়ে দিতেন। আমি খুব ভাল করেই জানি, বাবা কোনও প্রতিদানের আশা করে ওসব করতেন না। ডাক্তার ছিলেন, বিনে পয়সায় গরিব রোগী দেখতেন। না, কোনো স্বার্থের জন্য নয়। পরকালে আল্লাহ তাঁকে বেহেস্ত নসিব করবেন— সে কারণে তো করতেনই না। যদি বেহেস্তের লোভ থাকতো, তাহলে তো তিনি নামাজ পড়তেন পাঁচ বেলা। আমার বাবা নামাজ পড়তে জানতেন না। সুরাও জানতেন না। জীবনে দু’বারই নামাজে দাঁড়াতেন, সে দুই ঈদের সময়। বাবার জন্য ও নামাজ পড়া ছিল না, ছিল মহৎ উদ্দেশে কোথাও শামিল হওয়া। ঈদগাহ মাঠে যেতেন, যেতেন মূলত সামাজিকতার জন্য। মাঠের ওই নামাজ পড়াটা যত না ধর্মের কারণে, তারো চেয়ে বেশি ভ্রাতৃত্বের কারণে।

সম্ভবত আজো যে আমি ঈদ এলে মানুষকে দান করতে, মানুষকে খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠি, সে আমার বাবার কাছ থেকেই শেখা। কেউ ধর্মের জন্য দান করে, কারও জন্য দান করাই ধর্ম। আমার বাবার কাছে দানটাই ছিল ধর্ম। ঈদ আসছে, বড় বেশি মনে পড়ছে আমার বাবাকে। মনে পড়ছে ছোটদাকেও, আমরা দু’জন তো বড় বড় বালতিতে করে মাংস নিয়ে এসে আমাদের বাড়ির মাঠে জমা হওয়া গরিবদের বিলোতাম দু’হাতে। সারাবছর যারা মাংস পায় না খেতে, তারা সেদিন কিছু পেতো।   পাওয়ায় কত আনন্দ জানি না, দেওয়ায় অনেক আনন্দ।

আজ আমার বাবা নেই, ছোটদা নেই। মা’ও নেই। ওদের ছাড়া আমার ঈদ ঠিক ঈদ নয়।   যদি ঈদ-ই, এ আমার চোখের জলের ঈদ।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩০ জুন, ২০১৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *