আত্মজ

আত্মজ

মা আজ চলে গেল৷ একটু আগে বৈদ্যুতিক চুল্লির গহ্বরে ঢুকে গেছে মা৷ পুড়ছে৷ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে দ্রুত৷

আমার যেন এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না৷ সকালে যখন অফিস বেরোই, তখনও তো সব ঠিকঠাক ছিল৷ যেমন থাকে৷

দিনটাও আজ শুরু হয়েছিল আর পাঁচটা দিনের মতোই৷ মাঘের শুরুতে এবার শীতটা বেশ জাঁকিয়ে এসেছে, সকালে লেপ ছেড়ে বেরোতে ইচ্ছে করছিল না যথারীতি৷ শুয়ে শুয়েই শুনতে পাচ্ছিলাম সংসার নিয়ে হুডুদ্দুম ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সুপ্তি৷ দুধ খাওয়া নিয়ে রোজকার মতোই গাঁইগুঁই করছে মামপি গোগোল, জোর কিচিরমিচির জুড়েছে, সুপ্তি কষে ধমকাল ছেলে-মেয়েকে, এক ফাঁকে চা দিয়ে গেল আমায়, মা-র আয়াকে ডেকে কী যেন নির্দেশ দিল৷ রুটিনমাফিক শব্দ বেজে চলেছে সংসারে৷ মা-র স্পঞ্জের জন্য জল গরম করছে আয়া, ঠিকেঝির সঙ্গে কী যেন কথা চালাচালি হল, সুপ্তি ছেলে-মেয়ের টিফিন বানাচ্ছে…৷ দ্যাখ না দ্যাখ মামপি গোগোলের স্কুল বাস এসে গেল, আমিও লাফ দিয়ে উঠে বাজার, ফিরেই ঝটপট দাড়ি কামানো, কনকনে জলে কাকস্নান…৷ ডাইনিং টেবিলে সুপ্তি একখানা ছোট্ট লিস্ট ধরিয়ে দিল৷ পরশু মামপিদের স্কুলে স্পোর্টস, মেয়ের জন্য লাল বর্ডার দেওয়া এক জোড়া মোজা চাই৷ ওয়াটার ম্যাট্রেসে শুয়েও টুকটাক বেডসোর বেরোচ্ছে মা-র, শয্যাক্ষতর মলম আনতে হবে৷ আর মনে করে চা৷ অফিসপাড়ার দোকানটা থেকে৷

এরপর মিনিবাসে লাইন, কান ঘেঁষে লেটমার্ক বাঁচিয়ে অফিসে প্রবেশ, বার তিনেক জি-এমের ঘরে আসাযাওয়া, ফাইল কম্পিউটার আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে সহকর্মীদের সঙ্গে মৃদু আলাপচারিতা…৷ তপনবাবু সাতচল্লিশ বছর বয়সে বিয়ে করছে, তাকে আমরা উইগ প্রেজেন্ট করব, না ফলস টিথ, তাই নিয়েও হাসাহাসি হল একচোট৷

সবই চলছিল গতানুগতিক ছন্দে৷ কিংবা নিতান্তই ছন্দহীন৷

ছবিটা বদলে গেল দুপুরে৷ হঠাৎই৷

টিফিন আওয়ারে তখন একটু ক্যারাম পিটিয়ে নিচ্ছিলাম৷ আজকাল ছুটির পর আর রিক্রিয়েশান রুমে ঢোকার জো নেই, ফিরতে সামান্য দেরি হলেই যা খিটখিট করে সুপ্তি! আমি ঘরে বন্দি, আর তুমি ফুর্তি মেরে বেড়াচ্ছ…! সত্যি তো, বেচারা এখন একদমই ঘরে আটকা৷ এক দিকে ছেলে-মেয়ে সংসার, অন্যদিকে অনন্তশয্যায় শুয়ে থাকা পক্ষাঘাতগ্রস্ত শাশুড়ি, সুপ্তির এখন একেবারে চিঁড়েচ্যাপ্টা দশা৷ এদিক ওদিক ঘোরা, সিনেমা থিয়েটার সবই তো গেছে, রুগণ শাশুড়ি ফেলে বাপের বাড়িতেই বা যেতে পারে ক-দিন৷ গেলেও প্রতি মুহূর্তে হানটান, এই ফিরতে হবে, এই ফিরতে হবে৷ অগত্যা গৃহশান্তি বজায় রাখতে আমাকেও গুহায় সেঁধোতে হয় জলদি জলদি৷

তো আজ সবে দ্বিতীয় বোর্ড খেলছি, রবীনদার ডাক, অমিত, তোমার টেলিফোন৷

রেডটা পকেটের মুখে৷ ঝুলছে প্রায়৷ স্ট্রাইকার সেট করতে করতে বললাম, কার ফোন?

—তোমার বাড়ি থেকে৷ মনে হল তোমার গিন্নি৷

শুনেই কেমন খটকা লেগেছিল৷ সুপ্তি তো তেমন দরকার ছাড়া ফোন করে না?

লাল ঘুঁটি রয়েই গেল৷ তাড়াতাড়ি এসে রিসিভার তুলেছি, হ্যালো, কী হল?

—আ্যাই শোন, মা কেমন করছেন!

—সে কী? কেন? কী হল?

—ভয়ানক নিশ্বাসের কষ্ট… চোখটোখ কেমন উল্টে যাচ্ছে৷

—সর্বনাশ, কখন থেকে?

—এই তো… আমি একটু মণিকাদিদের ফ্ল্যাটে গেছিলাম, রমা ডেকে আনল৷ বলছে গলা ভাত খাওয়ানোর পর থেকেই নাকি কেমন কেমন করছিলেন৷

—কখন খাইয়েছে?

—যেমন খাওয়ায়৷ বারোটা-সওয়া বারোটা৷

—সঙ্গে সঙ্গে বলেনি কেন?

—অতটা নাকি বুঝতে পারেনি৷…মা-র হাত-পাও কেমন ঠাণ্ডা মেরে যাচ্ছে!

—ডাক্তারবাবুকে ডেকেছ?

—এক্ষুনি আসছেন৷… তুমি চটপট চলে এসো৷ আমার কিন্তু ভালো ঠেকছে না৷

তখনও চরম কিছু ঘটার কথাটা মাথায় আসেনি৷ ট্যাক্সিতে আসতে আসতেও ভাবছিলাম এমন হল কেন? লাঙ ইনফেকশান? ডাক্তারবাবু রুটিন চেকআপের সময়ে একদিন বলছিলেন শুয়ে থাকতে থাকতে এসব রুগিদের পেশি নাকি আপনিই শিথিল হয়ে আসে, তখন ফুসফুসে খাদ্যকণা ঢুকে যাওয়া অসম্ভব নয়৷ তার থেকেই সংক্রমণ! কী একটা যেন নামও বলেছিলেন রোগটার৷ কী এক নিউমোনিয়া৷ অবশ্য ঠাণ্ডাটাণ্ডা লেগেও…৷ কতদিন রাত্তিরে পেচ্ছাপ করে মা তার ওপরেই পড়ে থাকে, রমা ওঠেও না, ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোয়৷ ক্যালাস মেয়েছেলে৷ আবার একটা আতান্তরে ফেলল৷ তেমন বাড়াবাড়ি হলে এক্ষুনি হয়তো নার্সিং হোমে রিমুভ করতে হবে৷ বাড়িতে কত টাকা আছে? আজ মাসের উনিশ, মেরেকেটে হাজার দুই৷ ওতে কী হবে? ব্যাঙ্ক তো প্রায় ফরসা… আবার ধার করব? আবার? শালা ধারে ধারে এবার ন্যুব্জ হয়ে যাব৷ কার কাছে চাওয়া যায়? প্রবীরদা একবার গেয়েছিল, দরকার লাগলে বোলো৷ সুপ্তি অবশ্য ওর দাদার কাছে টাকা চাওয়াটা পছন্দ করে না৷ খুকুদিকেও অ্যাপ্রোচ করা যায়৷ বোনঝি হলেও খুকুদি তো মা-র মেয়েরই মতন৷ খুকুদির বিয়েতে মা নিজের একটা নেকলেস ভেঙে গয়না গড়িয়ে দিয়েছিল৷ খুকুদি হয়তো ফেরাবে না, কিন্তু ফেরত দেব কোত্থেকে? ফের একটা পি এফ লোন? নাকি নার্সিং হোম না নিয়ে গিয়ে হাসপাতাল…! খরচাটা তাও একটা মাপের থাকে৷

কিছুরই প্রয়োজন হল না৷ বাড়ি এসে দেখি সব শেষ৷ আশপাশের ফ্ল্যাটের বেশ কয়েকজন ঘরে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে, সুপ্তি মার খাটের বাজু ধরে স্থির, রমা পায়ের কাছে, মামপি গোগোল তখনও স্কুল থেকে ফেরেনি৷

আমার কেমন ঘোর ঘোর লাগছিল৷ এক দীর্ঘ ক্লান্তিকর অধ্যায়ের এত আকস্মিক পরিসমাপ্তি?

টানা দু-বছর মা শয্যাশায়ী৷ সেরিব্রাল অ্যাটাকের দিনটা থেকে ধরলে তারও বেশি৷ প্রায় পঁচিশ মাস৷ নিখুঁতভাবে গুনেগেঁথে দেখলে সাতশোচুয়ান্ন দিন৷ এর মধ্যে একটি দিনের তরেও উঠে বসা দূরে থাক, নিজে নিজে নড়াচড়াও করতে পারেনি মা, পাশটুকুও ফিরিয়ে দিতে হত৷ এই পঁচিশ মাসে একটা শব্দ পর্যন্ত বেরোয়নি মা-র গলা থেকে, গোঙানির আওয়াজও না৷ আমিও ধরে নিয়েছিলাম মা এভাবেই পড়ে থাকবে৷ রোজই মনে হত মা আজকের দিনটাও রয়ে গেল, কালকের দিনটাও থাকবে, তার পরের দিনটাও…

কিংবা হয়তো আলাদা করে এত কথাও মনে হত না৷ শুধু হূদয়ের গভীরে গেঁথে গিয়েছিল একটা ধারণা— নিছক অস্তিত্ব হয়েই মা বুঝি কাটিয়ে দেবে অনন্তকাল৷ এর বাইরে অন্য কিছু ঘটা বুঝি সম্ভবই নয়৷

খবর পেয়ে আত্মীয়স্বজনরা আসছিল একে একে৷ সন্ধে নাগাদ বাড়ি ভিড়ে ভিড়৷ অনেকটা সেই নার্সিং হোমে যেমন দল বেঁধে সবাই মাকে দেখতে যেত, সেরকম৷ কিংবা তার চেয়েও বেশি৷

এরকমই বুঝি হয়৷ মানুষের কাছে বিপন্নতার দাম আছে৷ মৃত্যুরও৷ মা-র মৃত্যুসম্ভাবনাটা দড়কচা মেরে যাওয়ার পর উদবেগ ক্ষয়ে গিয়েছিল ধীরে ধীরে৷ আমাদের কাছেও৷ আত্মীয়দের কাছেও৷ শেষ দেড়টা বছরে কে ক-বার দেখতে এসেছে মাকে? ওই মাঝে মাঝে ফোনে খোঁজখবর নেওয়া, কালেভদ্রে হয়তো সশরীরে আগমন, ব্যস ওইটুকুই৷ অথচ শ্মশানেও আজ আমার পাশে, কত লোক৷ জ্যাঠতুতো দাদারা, খুড়তুতো ভাই, মাসির ছেলে, পিসির ছেলে, শালা, ভায়রাভাই বন্ধুবান্ধব…

হিমেল রাতে মাকে যন্ত্র-চিতায় চড়িয়ে এখন সবাই দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক৷ প্রবীরদা হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে খুকুদির বরের সঙ্গে৷ কিশোর আর সমু পায়চারি করছে৷ পল্টুরা চা খেতে চলে গেল৷

ঠাণ্ডাটা আজ বেড়েছে৷ নাকি খোলা জায়গা বলে বেশি লাগছে কামড়টা? চারদিকে ধোঁয়াশার পাতলা আস্তরণ, হ্যালোজেন বাতিগুলোয় কেমন মরা মরা ভাব৷ রেলিংঘেরা জায়গাটায় মরসুমি ফুল ফুটে আছে কয়েকটা, ফুলেরাও যেন মলিন এখন৷ শ্মশান বলেই কি? গর্জন করতে করতে একটা ম্যাটাডোর হানা দিল চত্বরে, বিটকেল হরিধ্বনি সহকারে খাট নামাচ্ছে একপাল যুবক৷ কে যেন চেঁচিয়ে ডাকল কাকে৷ দূরে কোথাও ছররা চলছে হাসির৷ ভেতরের হলঘরে জোর একটা কান্নার রোল উঠল৷ থেমেও গেল৷

চন্দন আর রনিদা উঠে গিয়েছিল পাশ থেকে, ফিরেছে৷ সিগারেট টানছিল রনিদা, টোকা মেরে ফেলে দিল পোড়া টুকরোটা৷ কাঁধে আলগা হাত রেখে বলল, অ্যাই, এখানে ঠাণ্ডায় কাঁপছিস কেন? চল, ভেতরে গিয়ে বসি৷

—না না, এখানেই ঠিক আছে৷ ভেতরে বিশ্রী গন্ধ, হইহট্টগোল, কান্নাকাটি… ওখানে দম বন্ধ হয়ে আসছিল৷

—তাহলে শালটা ভালো করে জড়িয়ে নে৷ কান ঢাক৷ এ-সময়ে ঠাণ্ডা লেগে যাওয়াটা মোটেই কাজের কথা নয়৷

—বলছি তো ঠিক আছি৷ তোমরা ব্যস্ত হয়ো না৷

রনিদা আর জোরাজুরি করল না৷ বসেছে পাশে, সিমেন্টের বেঞ্চিতে৷ চোখ তুলে আকাশ দেখল একটুক্ষণ৷ আবার সিগারেট ধরাল৷ লম্বা লম্বা টান দিচ্ছে৷

হঠাৎই বলল, পিসিকে আজ একেবারে অন্যরকম দেখাচ্ছিল, না রে বাবলু?

ছোট্ট একটা শ্বাস পড়ল আমার৷ বললাম, হুঁ৷

—মুখে কণামাত্র রোগের চিহ্ন নেই… হুবহু সেই আগের রং ফিরে এসেছিল৷ মনে হচ্ছিল সেই পুরোনো পিসিকে দেখছি৷

চন্দন বলে উঠল, কাকির মুখে কীরকম একটা হাসি লেগে ছিল লক্ষ করেছ রনিদা?

—হুম৷ কত কষ্টের অবসান হল৷

—বটেই তো৷ কিছু বলতে পারে না, বোঝাতে পারে না, কী খারাপ যে লাগত! এবার পুজোর পর প্রণাম করতে গিয়ে মুখের দিকে তো তাকাতেই পারছিলাম না৷ কী মানুষ তার কী হাল!

—অথচ দ্যাখো, পিসি কখনো কারও পাকা ধানে মই দেয়নি৷ মা তো সেদিনও বলছিল, ভগবান কিন্তু এটা ন্যায় করলেন না৷ এত ভালোমানুষ, তারই কিনা এই দুর্দশা!… সারা জীবন কী স্ট্রাগলটাই না করেছে পিসি৷ অসুখবিসুখ কিছু নেই, দুম করে পিসেমশাই মারা গেল… বিনা মেঘে বজ্রপাত… বাবলু তো তখন হাফপ্যান্ট৷ অত বড়ো একটা ধাক্কা সামলেও তো পিসি মাথা উঁচু করে থেকেছে৷ চাকরিবাকরি করে একাই মানুষ করেছে বাবলুকে৷ যখন নিজস্ব ঘরদোর হল, নাতিনাতনি নিয়ে একটু সুখের মুখ দেখছিল, তখনই ভগবান ডাণ্ডা মেরে দিল৷

—আমরা তো মনেপ্রাণে প্রার্থনা করতাম, কাকি চলে যাক, কাকি এবার চলে যাক৷

—রিয়েলি, ওরকম ভেজিটেবল বনে যাওয়াটা কি বেঁচে থাকা?

—পুরো ভেজিটেবল কোথায়? কাকির তো সেন্স ছিল, ইভন ইন দ্যাট হ্যাপলেস সিচুয়েশান৷ সেটাই তো আরও প্যাথেটিক৷

আঃ, কী আরম্ভ করল এরা? এসব কি এখন আলোচনা করার সময়? মা কী ছিল, আমার জন্য কত করেছে, সব তো অনেক পুরোনো কথা৷ সবাই জানে৷ আমিও জানি৷ আমিও প্রাণপণ চেষ্টা করেছি মা-র সেই ঋণ শোধ করার৷ সাধ্যের অতিরিক্ত করে করেছি৷ মা-র যখন স্ট্রোকটা হল খরচার পরোয়া না করে মাকে নিয়ে ছুটেছি বড়ো নার্সিং হোমে৷ সেখান থেকে মা ফিরল জড়বস্তু হয়ে, তবুও কি আমি হাল ছেড়েছিলাম? টানা ছ-মাস ফিজিওথেরাপি, প্রথম তিনটে মাস তো সকাল বিকেল৷ এর সঙ্গে ডাক্তার নার্স আয়া…৷ মা সন্তানকে ভালোবাসবে, তার জন্য প্রাণপাত করবে এ তো স্বতঃসিদ্ধ, কিন্তু আমিও কি মাকে কম ভালোবাসতাম? আমার উদবেগ ছিল না? নার্সিং হোমে কত রাত জেগেছি পর পর, অমুক নিউরোলজিস্টের কাছে যাচ্ছি, তমুক নিউরোলজিস্টের কাছে ছুটছি, বিরল ওষুধ খুঁজতে ঘুরে বেড়াচ্ছি শহরময়…৷ তারপরও যদি মা সুস্থ না হয় সেটা তো মা-র কপাল৷ তবু চেতনা যেটুকু ফিরেছিল সেওতো আমার চেষ্টার জোরেই৷ আশ্চর্য, আমার এই চেষ্টার দিকটা কেউ বলে না!

নার্ভের মোটর সিস্টেম প্রায় অকেজো হয়ে গেলেও মা-র মস্তিষ্ক বেশ খানিকটা সচল হয়েছিল৷ ব্যাপারটা আমার নজরে আসে মাকে নার্সিং হোম থেকে ফিরিয়ে আনার মাস তিন-চার পর৷ চৈতন্য ফেরার প্রকাশ অবশ্য ছিল মাত্র একটাই৷ চোখে৷ আমাকে দেখলেই মা-র চোখ দুটো ঘুরতে থাকত৷ যেদিকেই যাই, ডাইনে, বাঁয়ে, জানলায়, দরজায়, মা-র চোখ অনুসরণ করছে আমাকে৷ হ্যাঁ, শুধু আমাকেই৷ সুপ্তি কত সেবা করেছে মার, গোগোল মামপি তো তাদের ঠাম্মার প্রাণ ছিল৷ অথচ ওদের দেখে মা-র দৃষ্টি কিন্তু ওরকম চঞ্চল হত না৷

প্রথম প্রথম আমার গা শিরশির করত৷ কতদিন মা-র মাথার পাশে বসে প্রশ্ন করেছি, কী দেখছ মা? কিছু বলবে?

মা-র দুই মণিতে অদ্ভুত এক কাঁপন জাগত তখন৷ যেন একটা ভাষা ফুটেও ফুটছে না৷ গুমরোচ্ছে৷

ক্রমশ ওই দৃষ্টিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি৷ পরের দিকে তো দিব্যি একটা খেলায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটা৷ মাকে কেউ দেখতে এলেই বলত, ওই আলমারিটার পাশে গিয়ে দাঁড়া তো বাবলু, দেখি এবার চোখ কোনদিকে যায়…! খাটের পেছনে চলে যা, এবার আর চোখ তোকে খুঁজে পাবে না৷… ওমা দ্যাখো দ্যাখো, বাবলু বেরিয়ে যাচ্ছে ওমনি রেণুদির দৃষ্টিও… আহা রে, একেই বলে চোখে হারানো!

ইদানিং মা-র কাছে তেমন বসা হত না৷ কী করব বসে থেকে? তা ছাড়া আমারও তো ছেলে-মেয়ে বউ অফিস সংসার এসব আছে, না কী? তার মধ্যেও রুটিন করে যেতাম এক-দুবার৷ দাঁড়াতাম একটু, মার পালস দেখতাম, আয়ার কাছে হালহকিকৎ জেনে নিতাম৷ সম্প্রতি একটা প্রেসার মাপার যন্ত্রও কিনেছিলাম, নিজেই মেপে নিতাম রক্তচাপ৷ কাঁহাতক আর ওইটুকুর জন্য রোজ রোজ দশ টাকা করে গোনা যায়! রমাটা একেবারে টিপিকাল আয়া, ওর শেখার ইচ্ছেও নেই, ওকে দিয়ে ওসব কাজ হয়ও না৷ অফিস বেরনোর আগেও নিয়ম করে একবার উঁকি দিতাম মা-র দরজায়…

আজ কি দাঁড়ানো হয়েছিল? মনে পড়ছে না৷ মোজা না রুমাল কী একটা যেন খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তাড়াহুড়োয় বোধ হয়…৷ তুৎ, এত খুঁটিনাটি কি মনে রাখা সম্ভব? বিশেষ করে যে মানুষ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস একইভাবে টিকে আছে তার সম্পর্কে?

আবার একটা ডেডবডি এল৷ কাচের গাড়িতে৷ বয়স্কা মহিলা৷

রনিদা যান্ত্রিকভাবে কপালে হাত ছোঁয়াল৷ আলগাভাবে বলল, আমাদের কপালটা ভালো৷

ঘুরে তাকালাম, মানে?

—পিসিকে একেবারে জাস্ট টাইমে আনা হয়েছে৷ দেখছিস না, তার পরেই কেমন লাইন পড়ে গেল! আর দশটা মিনিট দেরি করলে তোকে তিন ঘণ্টা বসে থাকতে হত৷

এমন একটা ভার মুহূর্তেও হাসি পেয়ে গেল৷ দেরি? পঁচিশ মাস টানতে পারলাম আর তিন ঘণ্টায় কী-ই বা ফারাক হত?

সন্তুদা আর দুলু কথা বলতে বলতে আসছে৷ পঞ্চাশ পেরিয়ে যাওয়া সন্তুদার এক আশ্চর্য গুণ আছে, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কারও মৃত্যুর খবর পেলেই সন্তুদা যেখানে হাজির৷ কাজকর্ম পুরোপুরি না মেটা পর্যন্ত স্বেচ্ছায় সমস্ত দায়িত্ব তুলে নেবে কাঁধে৷ আজও টেলিফোন পেয়েই এসে পড়েছিল, বড়ো মাইমা আর রেখা বউদিকে সঙ্গে নিয়ে৷ এসেই ঝটপট সব বন্দোবস্ত করে ফেলল সন্তুদা৷ কাচের গাড়ি, ফুল খই ধূপ অগুরু…৷ মা-র বুকে গীতা রাখা হয়েছে কিনা, খইয়ের ঠোঙায় খুচরো পয়সা দেওয়া হল কিনা, প্রতিটি খুঁটিনাটিতেই সন্তুদার খর নজর৷ শ্মশানে পৌঁছেও চরকি খাচ্ছে অনবরত৷ করপোরেশানের ঘরে দৌড়দৌড়ি, পুরুতের সঙ্গে দর কষাকষি…৷ আমি যখন আগুন হাতে মাকে প্রদক্ষিণ করছি তখনও সন্তুদা আমার পাশে পাশে৷

সন্তুদার হাতে একখানা প্লাস্টিকের প্যাকেট৷ প্রবীরদাকে প্যাকেটখানা ধরিয়ে এল আমার কাছে, বাবলু, তোদের কাপড়জামা কেনা কমপ্লিট৷ প্রবীরবাবুর কাছেই রইল, চান করে পরে নিস৷

—এত ঠাণ্ডায় রাত্তিরে চান করবে কি? না না একটু গঙ্গাজল ছিটিয়ে নিলেই হবে৷

—আহা, আমি কি গঙ্গায় ডুব দিতে বলছি? বাড়ি গিয়ে তো করবে? কী রে বাবলু, পিসির জন্য এইটুকু পারবি না?

বটেই তো৷ এটুকুই তো করছি!

আমার মুখের ভাঙচুর লক্ষ করেনি সন্তুদা৷ ফের বলল, পিসির ডেথ সার্টিফিকেটটা এখন আমার কাছেই রইল, বুঝলি৷ তিন কপি জেরক্স করে দিয়ে দেব, যত্ন করে রাখিস৷ হারালে কিন্তু পিসির কিচ্ছু পাবি না৷

হায় রে, পিসির যেন কত ধনদৌলত আছে৷ রিটায়ারমেন্টের সময়ে কুড়িয়েবাড়িয়ে যা পেয়েছিল তার সিংহভাগই তো গেছে ফ্ল্যাটে৷ বারণ করেছিলাম, শোনেনি৷ ও টাকা পুষে আমি কী করব রে বাবলু! বরং যতটা পারিস ক্যাশ দিয়ে দে, তোর ব্যাঙ্ক লোন তাহলে কম হবে! রাগ করিস কেন, তোর বাড়ি তো আমারও রে, তুই কি আর আমায় তাড়িয়ে দিবি! ব্যস সঞ্চয় প্রায় সাফ৷ তাও যেটুকু তলানি পড়ে ছিল তাই দিয়ে নাতনির জন্য সোনার চেন বানাচ্ছে, দুম করে গোগোলের নামে একটা ক্যাশ সার্টিফিকেট কিনে ফেলল…৷ ওসব না করে কিছু যদি রাখত, বিপদের সময়ে তাও কাজে আসত৷

পল্টু দিপুরা কখন যেন ফিরে হলঘরে ঢুকেছিল৷ বেরিয়ে ডাকছে, বাবলুকে নিয়ে চলে আসুন৷ আমাদেরটা হয়ে গেছে৷

সন্তুদা সঙ্গে সঙ্গে টানটান, আয় আয়৷ …বেশ তাড়াতাড়িই হয়ে গেল দেখছি!

রনিদা এক দিক থেকে ধরেছে, অন্য দিক থেকে প্রবীরদা৷ আমাকে নিয়ে চলেছে মা-র ভস্মাবশেষের দিকে৷ এত জোরে হাত চেপেছে কেন? ভাবছে আমি পড়ে যাব? ভেঙে পরব?

হলঘর পেরিয়ে উঁচু বেদীমতো জায়গাটায় উঠলাম৷ আগুনে প্রবেশের অপেক্ষায় চ্যাঙারিতে শায়িত পর পর চারটে মৃতদেহ, তাদের টপকে নামছি সিঁড়ি বেয়ে৷ চুল্লি থেকে বিকিরিত হচ্ছে তাপ৷ বিচিত্র এক ওমে শরীরটা উষ্ণ হয়ে যাচ্ছে আমার৷

উষ্ণ? না হালকা?

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না৷

দুই

খাটে আধশোওয়া হয়ে চোখ বোলাচ্ছিলাম ফর্দে৷ পুরুতমশাই একটা লিস্ট ধরিয়ে গেছেন বটে৷ চাল-ডাল-তেল-নুন-সবজি-ফুল-ফল- বেলপাতা-কুশ-তিল-যব-হরতুকি-তিল-ঘি-মধু-চিনি-কলাপাতা-পান- সুপুরি-মশলা কী আছে কী নেই! দানসামগ্রীর তালিকাও নেহাত ছোটো নয়৷ থালা-বাটি-গেলাস-ছাতা-শাড়ি-ঘড়া-গামলা- পিলসুজ…৷ লেডিজ চটির পাশে সাইজ লেখা আছে, ছাতাটাও রঙিন চাই৷ তাও খাট বিছানা বালিশ লেখেননি, মূল্য ধরে নেবেন৷ কতটুকু সাশ্রয় হল কে জানে!

সব মিলিয়ে মোট কত লাগতে পারে? বাজেট ছাপিয়ে যাবে না তো? ব্যাঙ্ক থেকে শেষ ঝটতি-পড়তি দশ হাজার তুলে নিয়েছি, প্রবীরদার কাছে চেয়েছি পাঁচ, কাজকর্ম খাওয়াদাওয়া সব এতে চুকবে তো? প্যান্ডেল নেবে তিন হাজার৷ ফ্ল্যাটবাড়ির শুধু ছাদটুকু ঘিরবে, তাও সাদা কাপড়ে, এর জন্য এত যে কেন চাইছে? চেয়ার-টেবিলে ন-শো, মেরেকেটে হাজার৷ শ্রাদ্ধের দিন নববইজনের মতো খাবে৷ নববই ইনটু ফিফটিফাইভ, মোটামুটি পাঁচ হাজার৷ মৎস্যমুখের দিন তিরিশ জন৷ আশি ইনটু তিরিশ, মানে প্রায় আড়াই৷ সাকুল্যে হল সাড়ে এগারো৷ কাজে নিশ্চয়ই হাজার তিনেকের বেশি পড়বে না৷ পরশু ঘাটকাজেও কিছু খরচা আছে৷… মনে হয় টায়েটুয়ে কুলিয়ে যাবে৷ তেমন যদি হয় শ্রাদ্ধের দিন এক রকম মিষ্টি নয় কমিয়ে দেব৷ প্লেট পিছু পাঁচ টাকা বাঁচে৷ অর্থাৎ সাড়ে চারশো৷ একেবারে ফেলনা নয়৷ এভরি ফারদিং কাউন্টস৷

আচমকা হাসি পেয়ে গেল৷ কী ছেলেমানুষি ভাবনা! কলসি দিয়ে লাখো মোহর গলে গেল, এখন কানাকড়ি বাঁচাতে পুটিং-এর খোঁজ৷ শুধু নার্সিং হোমেই তো বেরিয়ে গিয়েছিল চল্লিশ হাজারের বেশি৷ ফিজিওথেরাপিস্টের পিছনে না হোক বিশ বাইশ হাজার৷ প্রথম মাস খানেক দু-বেলা দুটো নার্স ছিল৷ তারা কান মুচড়ে একশো কুড়ি একশো কুড়ি দুশো চল্লিশ দুয়ে নিত প্রতিদিন৷ খরচায় উদ্ব্যস্ত হয়েই না ধাপে ধাপে নেমেছিলেম৷ দুটো নার্স থেকে রাতে নার্স দিনে আয়া, তারপর দু-বেলা দুটো আয়া, শেষমেষ ওই রমা৷ মেয়েটা রাতদিন থাকত, খাওয়াদাওয়া নিত৷ তা নিক, মাইনেটা তো কম৷ মাসে দু-হাজার বাঁচানো, চাট্টিখানি কথা নয়৷ এত সামলে, এত টেনেটুনেও প্রভিডেন্ড ফান্ডে লোন, কো-অপারেটিভে ধার…৷ শালা, ভাবতেই ইচ্ছে করে না৷ যা খসছে খসুক, এবার একবারেই চুকে যাক৷ আশা করি আমি বা সুপ্তি কেউ ওভাবে পড়ে থাকব না৷ তেমন হলে মামপি গোগোল যে কী অভিশাপ দেবে!

সুপ্তি ঘরে ঢুকেছে৷ ঘটাং ঘটাং আলমারি খুলল৷ তাক হাতড়াচ্ছে৷

—কী খুঁজছ?

—আরে দ্যাখো না, জ্বালিয়ে মারল৷

—কে?

—রমা৷ শাড়ি শাড়ি করে আমায় পাগল করে দিল৷

—দিয়ে দাও একখানা৷

—একটা নয়, দু-দুটো দিয়েছি৷ মা-র শাড়ি৷ বললাম, সাদা খোল তো কী আছে, ছাপিয়ে নিস৷ মন উঠল না৷

—কী চায়? বেনারসি?

—ওরকমই কিছু পেলে ভালো হয়৷ সুপ্তি মুখ বেঁকাল, বলছে দিদার এত গু-মুত ঘাঁটলাম, একটা সিল্কের শাড়ি অন্তত পাব না?

দুনিয়ায় নিজের প্রাপ্য সবাই বোঝে৷ রমার কী দোষ, আমার মাই কি ছেড়েছে? কর্তব্যের পাওনাটুকু উসুল করে নেয়নি?

বিরস মুখে বললাম, ঝুটঝামেলা হঠাও৷ দিয়ে দাও৷

ঈষৎ রঙজ্বলা নিজের একটা মুর্শিদাবাদী সিল্ক বার করে নিয়ে গেল সুপ্তি৷

ফর্দখানা টেবিলে রেখে চিৎ হয়ে শুলাম৷ চোখটা আবার টানছে৷ শরীরে বেজায় ক্লান্তি৷ সকাল থেকে আজ ছুটোছুটিও গেছে বেশ৷ দুলুকে নিয়ে নেমন্তন্ন করতে বেরিয়েছিলাম৷ মানিকতলা শ্যামবাজার… উত্তর কলকাতার পাট চুকোলাম আজ৷ ফোনেই বলে দিয়েছি অনেককে, তবু এখনও তো কেউ কেউ আছে যারা মাতৃবিয়োগে ভারাক্রান্ত মুখটি না দেখতে পেলে সন্তুষ্ট হয় না৷ আড়াইটে নাগাদ বাড়ি ফিরে ঘি সহযোগে সেদ্ধভাত গলাধঃকরণ, ফলত যথেষ্ট টকে আছে গলা৷ এখনও৷

তবে ক্লান্তিটা ঠিক অম্বলের জন্য নয়৷ এ শ্রান্তি যেন একটু অন্যরকম৷ ম্যারাথন দৌড় সাঙ্গ করে শেষ ফিতে ছোঁয়ার পর যেমনটা লাগে দৌড়বীরের, এ অবসাদ যেন সেই ধাঁচের৷ মাকে পুড়িয়ে আসার পর থেকেই শরীর একদম ছেড়ে গেছে৷

চিন্তাটায় কটু গন্ধের আভাস আছে কি? ম্যারাথনাররা আমার মতোই শরীর নিংড়ে দৌড়য় বটে, কিন্তু তাদের শেষ ফিতে ছোঁয়ার সঙ্গে কি মা-র মৃত্যুর তুলনা চলে? আমি কি প্রথম দিন থেকে ওই লক্ষ্যেই পৌঁছতে চেয়েছি? না না না না, কক্ষনো না৷ বরং উল্টো পথেই তো দৌড়েছি, লড়াই করেছি মাকে বাঁচানোর জন্যে৷ কায়মনোবাক্যে চেয়েছি মা সুস্থ হয়ে উঠুক,পুরোপুরি আগের মতো না হলেও হাঁটাচলা করুক, মোটামুটি একটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরুক৷ সর্বস্ব উজাড় করেও যদি সামান্যতম উন্নতি না হয় তখন মানুষের কেমন লাগে? মনে হয় না কি রেসিংট্র্যাকটা ক্রমশ ঘুরে যাচ্ছে, পার হচ্ছি একটা লম্বা প্যাঁচালো পথ? ঘেমে নেয়ে যাচ্ছি, জিভ বেরিয়ে যাচ্ছে, ক্যালরি শেষ, তবু ছোটো৷ কাঁহাতক পারে মানুষ?

সুপ্তি আবার এসেছে, হাতে চা৷ টেবিলে কাপ রেখে খাটে বসল৷ লাল পাড় কোরা শাড়ির আঁচল দিয়ে খাটের বাজু ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, তোমার সন্তুদাই জিতে গেল৷

ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন?

—আমাদের ইচ্ছেটার তো মূল্য রইল না৷ মা-র ঘরে তো কাজ হচ্ছে না৷

—সন্তুদা তো ভুল কিছু বলেনি৷ মা-র ঘরটা তো সত্যিই ছোটো৷ ড্রয়িংহলে কাজ হলে সুবিধেই হবে, শ্রাদ্ধের সময়ে লোকজন বসতে-টসতে পারবে৷… ডেকরেটারকে বলে দিয়েছি ফরাস পেতে দেবে…

—আমার কোনো কিছুতেই আপত্তি নেই৷ তবে আমার লাগছে কোথায় জানো? তোমার ওই সন্তুদার কথাবার্তায়৷… পিসির ঘরটা খুপরি… এত চাপা… আলোবাতাস খেলে না… যেচে পড়ে এসব শোনানোর অর্থ কী? আমরা যেন ইচ্ছে করে মাকে অন্ধকূপে রেখেছিলাম!

সুপ্তির আহত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে৷ ফ্ল্যাটে আসার আগে সুপ্তি বারবার বলেছিল, মা আপনি বড়ো ঘরটা নিন৷ মা কিছুতেই রাজি হয়নি৷ এক গোঁ— আমি একা মানুষ, ওই ঘরে আমার কী প্রয়োজন! বরং বড়োঘরটা তোরা নে, মাঝেরটায় বাচচারা একটু হাত-পা ছড়িয়ে থাকুক৷

হাত নেড়ে বললাম, সন্তুদার কথা ছাড়ো৷ খেটেখুটে দিচ্ছে..? আমরা তো জানি আমরা মা-র জন্য কী করেছি৷

—সব চেয়ে ভালো হত বাড়িতে কাজটা না হলে৷ ফ্ল্যাটের সোসাইটির পারমিশন নাও, এর সামনে হাত কচলাও, ওর চাট্টি কথা শোন… আমার একদম পছন্দ হয় না৷

—কী করা যাবে? চৈতন্যমঠ গৌড়ীয়মঠ হেনামঠ তেনামঠ সবই তো ঘুরে দেখা হল৷ কোত্থাও জায়গা নেই৷ বাপ-মাকে চিতায় চড়ানোর আগেই যে লোকে শ্রাদ্ধের জায়গা বুক করে ফেলে আমি কী করে জানব?… এক দিক দিয়ে ভালোই হল৷ কেউ বলতে পারবে না মঠে টাকা ধরিয়ে মা-র কাজ সেরেছি?

—যারা কথা শোনানোর তারা ঠিক শোনাবে৷ এই তো, তোমার খুকুদি আজ কায়দা করে কত কী বলে গেল৷

—কী বলেছে খুকুদি?

—মাসিকে তোমরা ন্যাজাল ফিডিং-এ রাখতে পারতে, এই রমাটমারা কি তেমন সাবধানে খাওয়াতে পারে…! ঠারেঠোরে বলতে চাইছিল আমরা মা-র ঠিক মতো যত্ন নিইনি৷

—বলুক গে যাক৷ আমরা তো জানি আমরা কী করেছি৷ কথাটা ফের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, বাইরের লোকের কথায় কান দিয়ো না৷

—লাগে৷ বুঝলে, লাগে৷ দু-বছর ধরে সংসারের সব খরচ কীভাবে কার্টেল করে গেছি৷ ছেলে-মেয়ের ফল বন্ধ করে মাকে আঙুরের রস, বেদানার রস খাইয়েছি৷ পুজোর সময় একটার বেশি জামা দিয়েছি মামপি গোগোলকে? দেনায় দেনায় অন্ধকার… মাস গেলে কেটেকুটে ক-টা টাকা হাতে পাও সে খবর কেউ নেওয়ার চেষ্টা করেছে কখনো? শুধু ওপর থেকে আহা উহু৷ আজ বাদে কাল মামপি নাইনে উঠবে ওর জন্যে একটা ভালো টিউটর রাখা দরকার, পেরেছি রাখতে? সেই তো ঢোকাতে হল কোচিং-এর গোয়ালে৷ সুপ্তি জোরে নাক টানল, সারাক্ষণ খালি চিন্তা মা-র হরলিক্স ফুরলো কিনা, মা-র কমপ্ল্যান আছে তো…! মাকে ছেড়ে কোথাও গিয়ে দু-দণ্ড তিষ্ঠোতে পেরেছি? নতুন মাসির মেয়ের বিয়ে হল, আমি সকালে মুখ দেখিয়ে এলাম, তুমি বিকেলে৷ কেন? মা-র জন্যই তো! তার পরও তোমার জেঠিমা বলে গেলেন রেণুর যখন টান উঠল তখন তুমি বুঝি ছিলে না বউমা! বলো, শুনতে কেমন লাগে? বলো?

—বাদ দাও৷ যারা করে, তাদেরই সমালোচনা হয়৷ এ তো জানা কথা৷ আমারও একটা ছোট্ট শ্বাস পড়ল, নাও, চা খেয়ে নাও৷ জুড়িয়ে যাচ্ছে৷

চোখের কোল মুছে এক চুমুকে কাপ শেষ করল সুপ্তি৷ উঠে লাগোয়া বাথরুমটায় গেল একটু৷ বেরিয়ে শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি এখন কিছু খাবে?

সিগারেট ধরিয়েছি৷ কাঠি অ্যাশট্রেতে গুঁজে বললাম, কী খাব?

—ফল কেটে দিতে পারি৷

—চা খেয়ে ফল?

—খানিকক্ষণ পরে খেও৷

—কত ফল খাব? বাঁদরেও এত ফল খেতে পারে না৷

সুপ্তি ফিক করে হেসে ফেলল, তোমার টুসিদি সকালে আবার একগাদা কলা আপেল সবেদা দিয়ে গেছে৷ গোগোল মামপি তো দেখছে আর আঁতকে উঠছে৷ যে আসছে হাতে ফল মিষ্টি, যে আসছে হাতে ফল মিষ্টি… গোগোল, চুরি করে সন্দেশ খেত, সেও এখন ফ্রিজের ধার মাড়াচ্ছে না?

—ফেলে দাও সব৷ কাজের লোকদের বিলিয়ে দাও৷

—কত দেব?

—তাহলে নিজেই খাও বসে বসে৷ তুমি তো আপেল ভালোবাসো৷

—বাসতাম৷ এখন আর সহ্য হয় না৷

—তাহলে এক কাজ করো৷ ফলকো গোলি মারো৷ মামপি, গোগোলের জন্য তো লুচি হবেই, ক-টা বেশি করে ভাজো৷ বেলায় খেয়েছি, এখন আর কিছু না খেয়ে আমরাও বরং তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়াটা…

—তুমি লুচি খাবে?

—কী আছে? গো মাংস তো খাচ্ছি না৷

—হ্যাঁ অ্যা, হুট করে তোমার কোনো আত্মীয় এসে পড়ুক, ওমনি রটে যাবে শাশুড়ি গত হওয়ার আনন্দে সুপ্তি বরকে লুচি গেলাচ্ছে!

—হু কেয়ারস? আমরা কারও খাই, না পরি? অশৌচ মানামানিটা নিজেদের মনের ব্যাপার৷ তাও তো আমি… নেহাত মা এ সবে বিশ্বাস করত বলে… এইসব কাছা নেওয়াটেওয়া আমার যথেষ্ট অকোয়ার্ড লাগে৷

—আহা, পালন যখন করছই, পুরোটাই করো৷ আর তো মাত্র ক-টা দিন৷ এতদিন এত কিছু করলে, আর মাত্র দু-চার দিনের জন্য ধৈর্য হারিয়ে ফেলবে?

ক্যাঁ ক্যাঁ ডোরবেল বাজছে৷ একটানা৷ নির্ঘাত মামপি৷ স্কুল থেকে এসেই ছুটেছিল কোচিং-এ, ফিরল৷ গোগোল দরজা খুলতেই শুরু হয়ে গেছে লণ্ডভণ্ড কাণ্ড, ধুপধাপ আওয়াজ ড্রয়িং স্পেসে৷ গোগোলের চিল চিৎকার উড়ে এল, মামপির হিহি হিহি৷

চোখ কুঁচকে বললাম, কী নিয়ে লাগল দুজনের? এ হল্লা কীসের?

—আর কী? গোগোল কার্টুন চ্যানেল দেখছিল৷ মামপি নির্ঘাত ওর হাত থেকে রিমোট কেড়ে নিয়েছে৷

ঠাম্মার মৃত্যুর পর দু-চারদিন থমকে ছিল ভাই বোন, আবার তারা সমে ফিরছে৷ গোগোলের স্বর চড়তে চড়তে সোপ্রানোয়, পাল্লা দিয়ে বাজছে মামপির হাসি৷

সুপ্তি বিরক্ত মুখে বলল, দাঁড়াও, দিয়ে আসি ঘা কতক৷ এত ধাড়ি মেয়ে, পাঁচ বছরের ছোটো ভায়ের সঙ্গে কেমন লাগে দ্যাখো!

—থাক, কিছু বোলো না৷ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ফ্ল্যাটটায় প্রাণ ফিরুক৷ এ ক-দিনের দমচাপা ভাবটা কাটুক একটু৷

সুপ্তি অস্ফুটে বলল, এ ক-দিন? না পঁচিশ মাস?

বলেই সুপ্তি নীরব৷ আমিও আর কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না৷

বাইরে বিকেলটা মরে গেছে বহুক্ষণ৷ আমাদের বন্ধ দরজাজানলা ভেদ করে মরা বিকেলটা তবু ঢুকে পড়ছিল ফ্ল্যাটে৷ চুঁইয়ে চুঁইয়ে৷

তিন

আজ নিয়মভঙ্গ ছিল৷ ভালোয় ভালোয় চুকে গেল সব কাজ৷

নিমন্ত্রিতরা প্রায় সকলেই এসেছিল৷ দু-তিনজন ছাড়া৷ চন্দন আর চন্দনের বউ শেষ মুহূর্তে আটকে গেল৷ ওদের বাচচাটা নেহাতই দুগ্ধপোষ্য, সকাল থেকে বমি পায়খানা করে ভাসাচ্ছে৷ আর এল না সন্তুদার বউ৷ শুক্রবার তার কী সব সন্তাোষী মা-ফা থাকে, এদিন বাড়ির বাইরে তার খাওয়া নিষেধ৷

খাওয়াদাওয়ার পর দুপুরে আড্ডা হল জমিয়ে৷ এ প্রসঙ্গ সে প্রসঙ্গ, এ কথা সে কথা৷ রনিদা আজ ন-পিস তপসে মাছের ফ্রাই খেয়েছে, সন্তুদা চোদ্দোখানা রসগোল্লা— বেচারা ক্যাটারারের মুখটা কেমন আমসি হয়ে গিয়েছিল বলতে বলতে টুসিদি খুকুদির কী হাসি৷ ব্যাস, চলতে লাগল খাওয়ার গল্প৷ কে কোন নেমন্তন্ন বাড়িতে কোন সিঁটকে প্যাংলাকে আশি পিস মাছ খেতে দেখেছে, কোথায় কে কবে চার হাঁড়ি দই শেষ করেছিল, কার বাড়িতে বরযাত্রীরা নুন মাখিয়ে খেয়ে খেয়ে পুরো মিষ্টি সাবাড় করে দিয়েছিল, এই সব৷ সন্তুদার স্টকে প্রচুর মড়া পোড়ানোর স্টোরি, গুছিয়ে গুছিয়ে ছাড়ল কয়েকখানা৷ তার মধ্যেই মা-র কথাও উঠছিল হঠাৎ হঠাৎ, শ্রাদ্ধের দিনের মতোই৷ কলরোল রঙ্গরসিকতার মাঝে চাপাও পড়ে যাচ্ছিল মা৷

এমনই হয় বোধ হয়৷ শ্রাদ্ধের আড়ম্বরে মৃত মানুষটা ফিকে হয়ে যায় অনেকটাই৷ শোক থাকলেও তা তেমন প্রকট হওয়ার সুযোগ পায় না৷

আসর ভাঙল সন্ধের মুখে৷ একে একে বিদায় নিল সবাই৷

যাওয়ার সময়ে খুকুদির বর বলল, বুঝতে বাবলু, আমার মনে হয় এবার তোমাদের ক-টা দিন একটু বাইরে ঘুরে আসা উচিত৷

খুকুদি বলল, হ্যাঁ রে, পারলে কোথাও থেকে বেড়িয়ে আয়৷ মাসির জন্য তোদের যা গেল…! শরীর মন দুটোই চাঙ্গা হওয়া দরকার৷

যেতে পারলে তো ভালোই হত৷ রুগি রোগ ওষুধ ডাক্তার করতে করতে সত্যি তো হাঁপিয়ে উঠেছি৷ কিন্তু এক্ষুনি এক্ষুনি বেরোই কী করে? মা নেই বটে, কিন্তু ধারদেনাগুলো তো আছে৷

উদাস মুখে বললাম, দেখি৷ কয়েকটা দিন যাক৷

বাড়ি খালি হতেই হাতে রাশি রাশি কাজ৷ পরশু থেকে সোফা টেবিলগুলো দেওয়ালে ঠেলা রয়েছে, সন্তুদা যাওয়ার আগে কিছুটা টেনেটুনে দিয়ে গেছে৷ ধরাধরি করে ফেরালাম স্বস্থানে৷ রান্নাঘরে অবশিষ্ট খাবারদাবারে ডাঁই, ছোটো ছোটো গামলায় ঢেলে খানিক ঢোকানো হল ফ্রিজে৷ মাছ ভাজাগুলো বাইরেই রইল, শীতকালে কি আর পচবে? মেঝেটেঝেরও অকহতব্য দশা, মোটামুটি পদে আনতে হিমশিম খাওয়ার জোগাড়৷ মাঝে ক্যাটারিং-এর লোকটাও এল, হিসেবপত্র করে মিটিয়ে দিলাম তার টাকা৷ আটটা নাগাদ দুম করে চন্দন৷ বসব না বসব না করেও বসল একটুক্ষণ, জোর করে তাকে দুপুরের খাওয়াটা খাইয়ে দিল সুপ্তি৷

রাতে অবশ্য আমি কিছু ছুঁলাম না৷ সুপ্তিও না৷ আঁশটে গন্ধে চতুর্দিক ম ম, গা গুলোচ্ছিল৷ মামপি গোগোলও বেজায় ক্লান্ত, গোগোল তো সন্ধে থেকেই ঢুলছিল, চন্দনের সঙ্গে বসে যৎসামান্য খেয়ে দুই ভাইবোনই বিছানায় ধপাস৷

শোওয়ার আগে সোফায় বসে সিগারেট টানছিলাম৷ সামনে টিভি চলছে৷ স্পোর্টস চ্যানেল৷ উত্তেজক এক ফুটবল ম্যাচ হচ্ছে, সম্ভবত স্প্যানিশ লিগ৷ শব্দ কমিয়ে পর্দার দিকে তাকিয়ে আছি, দেখছি না কিছুই৷ মাথাটা কেমন জ্যাম হয়ে গেছে৷ ক-দিন ধরে যা দৌড়ঝাঁপ গেল৷

সুপ্তি মামপি গোগোলের ঘরে মশারি টাঙাতে গিয়েছিল৷ পাশে এসে বসল৷ তার চোখও খানিকক্ষণ পর্দায় স্থির৷

হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বাড়িটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেল, না?

কথাটা ঠিক বোধগম্য হল না৷ ফাঁকা কেন বলছে? ক-দিন বাড়িতে ভিড় লেগেছিল, তাই?

সুপ্তি আবার একটা শ্বাস ফেলল, যেভাবেই থাক, তবু তো মা ছিলেন৷

—হুঁ৷

—তোমার আর কী, অফিস চলে যাবে৷ একা বাড়িতে আমার যে কী করে কাটবে!

—হুঁ৷

—খুকুদি তখন ঠিকই বলছিল৷ আমাদের কোথাও থেকে ঘুরে আসা উচিত৷ বেশি দূরে নয় নাই গেলাম, কাছাকাছি যাওয়াই যায়, কী বলো? এই ধরো দিঘা কিংবা পুরী, কিংবা ঘাটশিলা মধুপুর…

—বুঝলাম৷ কিন্তু টাকা আসবে কোত্থেকে?

—আর অত টাকা টাকা করে মাথা খারাপ কোরো না তো৷ সুপ্তি দু-এক সেকেন্ড চুপ থেকে গলা নামাল, মা-র খরচটা তো কমে গেল৷… তা ছাড়া এক্ষুনি তো আর যাচ্ছি না, মামপি গোগোলের পরীক্ষাটা হোক, গরমের ছুটি পড়ুক…

টিভিতে একটা গোল হল এইমাত্র৷ কৃষ্ণকায় গোলদাতা জার্সি খুলে ফেলেছে, বিপুল উল্লাসে খালি গায়ে দৌড়চ্ছে মাঠময়৷ দর্শকরা পতাকা নাড়ছে৷ নাচছে৷ ভেঁপু বাজাচ্ছে, ক্যানেস্তারা পেটাচ্ছে আনন্দে৷

রিমোট টিপে টিভি অফ করে দিলাম৷ শব্দহীন শব্দটাও উধাও৷ অদ্ভুত এক নৈঃশব্দ্য নেমে এসেছে হঠাৎ৷ ডাইনিং স্পেসে ফ্রিজটা গোঁও করে উঠল৷ গোঙাতে গোঙাতে সে আওয়াজও বোবা হয়ে গেল আচমকাই৷

সুপ্তি উঠে দাঁড়িয়েছে৷ হাই তুলতে তুলতে বলল, শোবে না?

—চলো৷ যাচ্ছি৷

দু-পা গিয়েও ফিরে এল সুপ্তি৷ বলল, একটা কথা ভাবছিলাম, বুঝলে?

—কী?

—তোমার তো সোমবার থেকে অফিস, কাল পরশুর মধ্যে.. ভাবছিলাম… ঘরগুলোকে একটু রিওরিয়েন্ট করব৷

—কী রকম?

—মামপি গোগোল একসঙ্গে থাকলেই ঝগড়া হয়, মামপির পড়ার জায়গাটা আলাদা করে দিলে হয় না? ধরো যদি মা-র ঘরে…

—মামপি মা-র ঘরে একা থাকতে পারবে?

—আহা, থাকার কথা কে বলেছে? টেবিল চেয়ার পেতে ওটা যদি ওর স্টাডিরুম করে দিই…

—ওখানে টেবিল ঢুকবে?

—মা-র কিছু জিনিস যদি ও ঘর থেকে বার করে দেওয়া যায়… ধরো, মা-র সেলাইমেশিনটা, ছোটো মিটসেফটা, ঢাউস আলনাটা… আমি অনেকটাই সাফসুতরো করেছি, আরও কিছু মাল যদি…

—আঃ সুপ্তি৷ মানুষটা এখনও ওপারে পৌঁছল কিনা ঠিক নেই…

স্বরে বুঝি আমার ঝাঁঝ ফুটেছিল একটু৷ সুপ্তি থমকে গেছে৷ ভার ভার গলায় বলল, আমি অত ভেবে বলিনি৷ সরি৷

—ঠিক আছে৷ দেখব কী করা যায়৷

সুপ্তি তবু ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড৷ তারপর চলে গেল শুতে৷

আবার একটা সিগারেট ধরালাম৷ হাত বোলাচ্ছি মুণ্ডিত মস্তকে৷ সুপ্তি খারাপ কী বলেছে? সত্যি তো মা-র ঘর তো আর চিরকাল খালি পড়ে থাকবে না, আজ নয় কাল মামপি গোগোল কেউ একজন দখল নেবেই৷ এক্ষুনি এক্ষুনি অবশ্য পারবে না, ভয় পাবে৷ থাক, দু-চারটে মাস যাক৷ তারপর নয় পুরোনো খাট আলমারি সরিয়ে, দেওয়াল-টেওয়ালের রং ফিরিয়ে নতুন চেহারা দেওয়া যাবে খরখানাকে৷ আপাতত সুপ্তি যা চাইছে…

ভাবতে ভাবতে কখন উঠে পড়েছি৷ পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছি মা-র দরজায়৷ চিন্তাটাকে মাথায় নিয়েই ঘরের আলো জ্বাললাম৷

সঙ্গে সঙ্গে বুকটা ছ্যাঁত৷ মা একেবারে আমার মুখোমুখি৷

উঁহু, মা নয়৷ মা-র ছবি৷

বেঁটে আলমারির মাথায় জ্বলজ্বল করছে বাঁধানো ফটোখানা৷ পরশু ছবিটা ফুলে ফুলে ঢেকে ছিল৷ আজ একটাই মোটা মালা৷ রজনীগন্ধার৷ সামান্য শুকিয়েছে ফুলগুলো, তবু একটা পলকা গন্ধ যেন বিছিয়ে আছে ঘরময়৷ ছবির সামনে ধূপের ছাই, নিবে যাওয়া প্রদীপ৷

কী অদ্ভুত রকমের জ্যান্ত ছবিটা! ঠিক মনে হয় সোজাসুজি আমার দিকেই তাকিয়ে৷

সরে গেলাম একটু৷ আশ্চর্য, মা-র চোখও সরেছে৷ ডান দিকে যাচ্ছি, বাঁয়ে…৷ আমার দিকেই ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে মা-র দৃষ্টি! খাটের ওপাশটায় গিয়ে দাঁড়ালাম, চোখের মণি দুটো সেখানেও পৌঁছে গেছে! আলমারির পাশে চলে গেলাম, সেখানেও…!

অবিকল সেই বাঙ্ময় চোখ! আমাকেই দেখছে! শুধু আমাকে!

গা ছমছম করে উঠল৷ প্রাণপণে যুক্তি সাজানোর চেষ্টা করছি৷ এটা তো স্রেফ ছবি৷ ফটো৷ আমারই তোলা৷ ক্লোজ আপ৷ মামপির পাঁচ বছরের জন্মদিনে৷ কারেন্ট কোনো সিঙ্গল ফটো নেই বলে এটাকেই এনলার্জ করে শ্রাদ্ধের জন্য বাঁধিয়ে দিয়েছে সন্তুদা৷ এ ছবি তো ক-দিন ধরে বারবারই দেখছি৷ লেন্সের দিকে সরাসরি তাকালে সব চোখই এরকম লাগবে…৷

নাহ, এ আমার মনেরই ভুল৷

নিজেকে খানিকটা স্থিত করে আলো নিবিয়ে দিলাম৷ বেরিয়ে আসছি, হঠাৎই স্পষ্ট ডাক, বাবলু…?

মা-র গলা! মারই গলা!

এও কি বিভ্রম? আমার পা মাটিতে গেঁথে গেল৷ সম্মোহিতের মতো বলে উঠেছি, কী হল মা? কিছু বলবে?

চেনা স্বর কেমন দুলে দুলে গেল, আমায় মাপ করে দিস বাবলু৷ মৃত্যুটা যে আমার হাতে ছিল না রে৷

আমূল কেঁপে গেলাম৷ এই কথাটুকু উচচারণ করার জন্যই কি ছটফট করত মা? মা কি আমার ভেতরটা টের পেয়ে গিয়েছিল?

ভীষণ কান্না পাচ্ছিল আমার৷ মা-র মৃত্যুর পর এই প্রথম৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *