শমিত, কানপুরে এসে গত তিনদিন ধরে হোটেলের ঘরে বসে ঘাড় গুঁজে একটার পর একটা ফাইল আর হিসাবের কাগজপত্র নিয়ে কাজ করছে। শমিত যাতে নিরুপদ্রবে কাজ করতে পারে সে জন্য শহরের কেন্দ্রে নতুন এই হোটেলটা পবন সিং—ই ঠিক করে দিয়েছেন। প্রয়োজনীয় ফাইল ইত্যাদি তিনি হোটেলেই নিয়ে এসেছিলেন। শমিত কলকাতার যে চার্টার্ড একাউন্টেন্ট ফার্মে চাকরি করে সেই কোম্পানির পুরানো ক্লায়েন্ট চর্ম শিল্প ব্যবসায়ী পৌঢ় পবন সিং। কানপুর সহ উত্তর ভারতের বেশ কয়েকটা শহরে চর্ম সামগ্রীর ব্যবসা আছে পবন সিং—এর। তার কোম্পানির হিসাবপত্র তৈরি করার জন্য ফার্মের পক্ষ থেকে এই প্রথমবার কানপুর এসেছে চার্টার্ড একাউন্টেন্ট শমিত।
বাইরে বিকেল হয়ে আসছে। শমিত শেষ ফাইলটার কাজ সেরে সেটা পবন সিং—এর হাতে তুলে দিতে হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। তিনি বললেন, ‘এত তাড়াতাড়ি এত ভালোভাবে যে আপনি কাজ শেষ করে ফেললেন তা আমি ভাবিনি।’ শমিত স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আমিও ভেবেছিলাম অন্তত পাঁচ দিন সময় লাগবে। সে জন্য পরশু রাতের ট্রেনে কলকাতা ফেরার টিকিট কেটে রেখেছি। মাঝের একটা দিন না হয় শহরটা ঘুরেই কাটিয়ে দেব। এখানে কোন কোন দেখার জায়গা আছে বলতে পারেন?’
প্রশ্নটা শুনে পবন সিং বললেন, ‘কলকাতার মতো কানপুর পুরোনো শহর। এখানে ‘মিউটিনি’ অর্থাৎ সিপাহি বিদ্রোহ হয়েছিল জানেন তো?’
শমিতের ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ আছে। সে হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, দেড়শ বছরেরও আগে বাংলার ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে প্রথম সেই বিদ্রোহ শুরু হয়। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে দিল্লি, গোয়ালিয়র, লক্ষ্নৌ, ঝাঁসি, মিরাট ও কানপুরে।’
জবাব শুনে পবন সিং বললেন, ‘সহি বাত। নানা সাহেবের নেতৃত্বে বাগী সিপাহিরা শেষ জং লড়েছিল কানপুর থেকেই। তারপরই নিখোঁজ হয়ে যায় নানা রাও। কোম্পানির ফৌজের সেনাপতি হ্যাভলক দখল নেন কৌনপুরের, সে সময় এ জায়গার নাম কৌনপুর ছিল। তিনি কৌনপুরের দখল নেবার পর তোপের মুখে বেঁধে উড়িয়ে দিয়েছিলেন বাগী সিপাহিদের। কারণ, তারা বিবিঘরে দুশজন ইংরেজ নারী শিশুকে হত্যা করেছিল। আঠারোশো সাতান্ন সালের পাঁচ—ই মে বাগী সিপাহিরা কৌনপুরের দখল নেবার পর বিবিঘরের ঘটনা ঘটে। বিবিঘর জায়গাটার বর্তমান নাম ‘নানারাও পার্ক।’ আমরা স্থানীয় লোকরা ডাকি ‘কোম্পানী বাগ’ নামে। এছাড়া আছে ‘মেমোরিয়াল পার্ক।’ কোম্পানির আমলের সাহেবদের সমাধি আছে ওখানে। এ দুটো জায়গা গিয়ে দেখে আসতে পারেন একটা গাড়ি বা অটোরিক্সা রিজার্ভ করে। এছাড়া বিঠুর গাঁও মন্দিরেও ঘুরে আসতে পারেন। অনেক পুরানো মন্দির, গুপ্ত ডায়ানেস্টি সময়ে তৈরি।
পবন সিং—এর কথা শুনে শমিত বলল, ‘বাঃ, আপনি এখানকার ইতিহাস বেশ জানেন দেখছি। ওসব জায়গাতে যাব তবে।’
পবন সিং হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, ইতিহাস আমারও ভালো লাগে। এখানে আমাদের সাত পুরুষের বাস। বাপ—দাদাদের মুখে অনেক গল্প শুনেছি এ জায়গার পুরানো ইতিহাস সম্পর্কে। আমাদের ছোটবেলাতেও এখানে অনেক পুরানো হাবেলি ছিল কোম্পানির আমলের। স্তম্ভ, খিলান, গম্বুজ আর বিরাট বিরাট সব বাড়ি। এখন সে সব ভেঙে কারখানা আর ফ্ল্যাট হয়েছে। সামান্য কিছু সে যুগের বাড়ি টিকে আছে আতর মহল্লাতে।’
এ কথা বলার পর একটু হেসে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আর বিকালবেলা একটা সাইকেল রিক্সো নিয়ে আতর মহল্লা ঘুরে আসতে পারেন। কোম্পানির আমলের আগে থেকেই আতরের জন্য কানপুর বিখ্যাত। একসময় এই কানপুরে রইস আদমীদের বাস ছিল। তারা আতর ব্যবহার করতে ভালোবাসতেন। তাছাড়া সারা ভারতের রাজা—মহারাজা, নবাব, এমন কী দিল্লির বাদশাহর কাছেও এই কানপুর থেকে আতর যেত। আপনিও কানপুরের স্মৃতি হিসাবে আতর কিনে নিয়ে যেতে পারেন। জানেন, এমন অনেক আতর আছে, একবার তা কাপড়ে দিলে তারপর একশো বার কাপড় ধোলাই করলেও খুশবু যায়না।’
শমিত কোনোদিন আতর ব্যবহার না করলেও পারফিউম ব্যবহার করতে খুব পছন্দ করে। তাই সে কথাটা শুনে বলল, ‘আজ বিকালে তবে ঘুরে আসব আতর মহল্লা থেকে।’
পবন সিং আর তার সহ কর্মচারী এরপর ফাইলপত্র নিয়ে উঠে পড়লেন। হোটেলের ঘর থেকে বাইরে বেরোবার সময় পবন সিং বলে গেলেন, ‘সব জায়গা ভালো করে বেরিয়ে আসুন। পরশু সন্ধ্যায় আমি আসব আপনাকে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দিতে।’
পবন সিং চলে যাবার পর বিকাল হতেই শমিত হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল আতর মহল্লার উদ্দেশ্যে। পথ চলতি একটা রিক্সো ধরে রওনা হল সেদিকে। ব্যস্ত বাণিজ্যিক শহর কানপুর। লোকজন, চিৎকার—চ্যাঁচামেচি, গাড়ি ঘোড়ার ভিড়। সে সব অতিক্রম করে ঘিঞ্জি গলিপথ ধরল রিক্সো। নানাপথ ঘুরে রিক্সো তাকে নামিয়ে দিল আতর মহল্লাতে।
শমিত যে পথ ধরে এল, আতর মহল্লা সে সব জায়গার তুলনায় অন্যরকম। রাস্তার দু—পাশের অনেক বাড়িগুলোই বেশ পুরানো। থাম অলা, খিলান অলা বিরাট বিরাট প্রাচীন হাবেলি। কোনো কোনো হাবেলির মাথায় ইসলামিক স্থাপত্যের গম্বুজও আছে। আবার কোনো বাড়ির প্রবেশ তোরণের মাথায় এখনও বসানো নানা দেবদেবীর মূর্তি। দেখেই বোঝা যায় এই বাড়িগুলো যারা এক সময় বানিয়ে ছিলেন তারা বেশ ধর্মপ্রাণ এবং পয়সাওলা ছিলেন। কিছু বাড়ি অবশ্য বয়সের ভারে অতি জীর্ণ হয়ে পড়েছে। গা থেকে পলেস্তারা খসে গিয়ে চুন—সুরকির গাঁথনি বেরিয়ে পড়েছে। ছাদের গায়ে মাথা তুলেছে বট—অশ্বত্থ। তবুও এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য নিয়ে অতীত ঐতিহ্যের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই বাড়ি—হাবেলি বা মঞ্জিলগুলো। হয়তো বা এই বাড়িগুলোই মিউটিনি বা সিপাহি বিদ্রোহের সময়কার। যেমন বলেছিলেন পবন সিং। —মনে মনে শমিত ভাবল।
রাস্তাতে এই শেষ বিকালে পথচারীর সংখ্যা অন্য রাস্তাগুলো তুলনায় বেশ কম। তাদের সকলেরই পোশাক বেশ ধোপদুরস্ত। পায়ে চামড়ার বুট জুতোর ওপর ধুতি—পাঞ্জাবি জহরকোট পরিহিত অভিজাত হিন্দু লোক। নাগড়া, চুড়িদার—কুর্তা শোভিত মেহেন্দি রাঙানো দাঁড়ি, মাথায় সূক্ষ্ম সুতোর কারুকাজ করা ফেজ টুপি পরা রইস মুসলমান, —সবারই পোশাকে, চলাফেরায় কেমন যেন একটা পুরানো আভিজাত্য আছে। গলিটায় প্রবেশ করার পর কেমন যেন একটা অদ্ভুত—মিষ্টি গন্ধও এসে লাগতে থাকল শমিতের নাকে। আর তার সাথে কেমন যেন একটা পুরানো দিনের গন্ধ। গলির ভিতর ঢুকে কিছুটা এগোতেই রাস্তার দু—পাশে ছোট—বড় আকারের দোকানগুলো শমিতের চোখে পড়তে লাগল। হিন্দি—উর্দু—ইংরাজিতে দোকানগুলোর মাথায় সাইনবোর্ডে তাদের নাম লেখা আছে। আতর মহল, গুলাব বাগ, নূর জাহান, মহারাজ এসব নাম দোকানগুলোর। সন্ধ্যা নামবে বলে কিছু দোকানে আলোও জ্বলে উঠতে শুরু করেছে। শমিত প্রথমে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে থেকে দেখতে লাগল দোকানগুলো। কিছু দোকানে আধুনিকতার ছাপও আছে। কাঁচে ঘেরা ঝাঁ চকচকে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত দোকান। দরজাতে উর্দি পড়া দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার গায়ে বেশ কয়েকটা পান আর চা—এর দোকানও আছে। তারই একটাতে দাঁড়িয়ে শমিত এক ভাঁড় চা খেলো। এরপর সে দোকানিকে কোথায় ভালো আতর পাওয়া যায় জানতে চাওয়ায় লোকটা সামনের একটা দোকান দেখিয়ে দিল।
সূর্য ডুবে গেছে। শমিত ঢুকল লোকটার দেখিয়ে দেওয়া দোকানটাতে। বেশ বড়, অভিজাত আতরের দোকান এবং পুরানোও বটে। দোকানে ঢুকতেই শমিতের নাকে এসে লাগল মিষ্টি আতরের গন্ধ। দোকানের ভিতর প্রথমেই যে জিনিসটা শমিতের দৃষ্টি আকর্ষণ করল তা হল ছাদের সিলিং—এর কাছে চারপাশের দেওয়ালে টাঙানো আছে ফ্রেমে বাঁধানো নানা রাজা—মহারাজা—নবাবদের পুরানো দিনের ছবি। শমিত তাদের না চিনলেও কোন ছবির গায়ে লেখা আছে—’প্রিন্স অফ আওধ।’ কোনটার গায়ে লেখা ‘নবাব অব পাতিয়ালা!’ অথবা ‘মহারাজ অব বিকানীর।’ অর্থাৎ এইসব অতি অভিজাত মানুষেরা একসময় এই দোকানের খদ্দের ছিলেন! দোকানের শোকেসগুলো সাজিয়ে রাখা আছে ছোট হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশির আকারের থেকে শুরু করে নানা ধরনের নানা আকারের আতরের শিশি—বোতল। সেগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটা দামি কাট গ্লাসের তৈরি। দোকানের ক্যাশ কাউন্টারে বসে আছে মধ্যবয়সি ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত দোকান মালিক। মাথায় তৈল সিক্ত চুল, মোটা গোঁফ, তাম্বুল রঞ্জিত ওষ্ঠ, দু—তিনজন কর্মচারীও আছে দোকানের নানা জায়গাতে। শমিত কাউন্টারে বসা মালিকের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটা প্রথমে তার উদ্দেশ্যে বলল, ‘তসরিফ লাইয়ে জনাব। বলুন আপনার কি সেবা করতে পারি?’
শমিত বলল, ‘ভালো আতর হবে?’
লোকটা শমিতকে এবার ভালো করে জরিপ করে নিয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই হবে। তবে আমরা কিন্তু দামি আতর ছাড়া রাখি না। সবই এক্সপোর্ট কোয়ালিটির।’
লোকটা দামের প্রসঙ্গে ইঙ্গিত দেওয়ায় শমিতের আঁতে মৃদু ঘা লাগল। সে গম্ভীর ভাবে বলল, ‘বুঝলাম আপনার কথা। ভালো আতর কী কী আছে বলুন?’
লোকটা পান চিবোতে চিবোতে বললেন, ‘জান্নাতুল ফিরদউস, গজল কস্তুরী, রোজ, সব ধরনের দামি আতরই আছে।’
শমিত আবারও গম্ভীরভাবে জানতে চাইল ‘এই আতরগুলোর দাম কত?’ যদিও ইতিপূর্বে সে কোনোদিন কোনো আতরের নাম শোনেনি বা দাম জানে না।
প্রশ্ন শুনে আতর দোকানের মালিক বললেন, ‘যে আতরগুলোর কথা বললাম তাদের এক তোলা বা এক ভরির দাম মোটামুটি কুড়ি হাজার থেকে চল্লিশ হাজার। তবে গজল কস্তুরীর দামটা বেশি আশি হাজার টাকা ভরি। খাঁটি গজল কস্তুরি আতর। আরবের শেখদের জন্য আমার দোকান থেকে এ আতর যায়।’
লোকটার কথা শুনে শমিত চমকে উঠল। সে আরবের শেখদের মতো ধনকুবের বা আমীর নয়, সাধারণ চাকুরিজীবী। হাজার টাকা দামের পারফিউম হয়তো সে একটু কষ্ট করে কিনতে পারবে। কিন্তু সোনার দামের আতর কেনার ক্ষমতা তার নেই। অভিজ্ঞ দোকানদার সম্ভবত শমিতের মনের ভাব আঁচ করতে পেরে বলল, ‘মিট্টি আতর, মোগড়া বা কেওড়ার মতো সাধারণ আত আমাদের দোকানে পাবেন না। অন্য দোকানে খুঁজে দেখতে পারেন।’
শমিত এরপর আর তার সঙ্গে কথা বাড়াল না। তাড়াতাড়ি সেই দোকান থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আতর মহল্লাতে হাঁটতে শুরু করল। আতরের দাম না জানার কারণে সেই দোকানটাতে ঢুকে শমিত বিব্রত হলেও একটা সুবিধা হল তার। সাধারণ আতরগুলোর নাম জানা হয়ে গেল তার। মিট্টি—মোগড়া—কেওড়া। নামগুলো নিজের মনে মনে বলতে বলতে শমিত ভাবতে লাগল, এই আতরগুলোর দাম যদি সাধ্যের মধ্যে হয় তবে সে কিনবে। আতর মহল্লাতে আসার স্মৃতি হিসাবে একটা আতর অন্তত সে কিনে নিয়ে যাবে। কিন্তু কোন দোকানে এসব কমদামি আতর পাওয়া যাবে সে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। মনের খেয়ালে চলতে চলতে আতর মহল্লার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল শমিত। জায়গাটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা, লোকজন তেমন নেই। পথের দু—পাশে প্রাচীন সব বাড়ি। তেমনই এক বাড়ির নীচে একটা আতরের দোকান দেখতে পেল শমিত। অনেক পুরানো দোকান। দরজার মাথার ওপর সাইনবোর্ডটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। দোকানের নামটাও ঠিক পড়া যাচ্ছে না। সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। কমদামি কোনো আতর পাওয়া যায় কিনা তা খোঁজ করার জন্য এগোলো সে।
২
দোকানের ভিতর পা রেখেই শমিত বুঝতে পারল দোকানটা আগের দোকানের থেকেও বেশ পুরানো। একটা অদ্ভুত প্রাচীন গন্ধ যেন ছড়িয়ে আছে দোকানের ভিতরে। আগের দোকানটার মতো এ দোকানের কোনো চাকচিক্য নেই বরং একটু অপরিষ্কারই বটে। দেওয়ালের গায়ে যে কাঠের খোপগুলোতে এক সময় সম্ভবত আতরের শিশি রাখা থাকত সেগুলো সব ধুল মলিন কোথাও বা মাকড়শার জাল। ঘরের এক কোণায় একটা কাউন্টার মতো জায়গা। সেখানে হ্যারিকেন জ্বালাচ্ছিলেন একজন বৃদ্ধ। পরনে জোব্বা, চাপকান, মাথায় ফেজ টুপি। শমিত তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সেই ন্যুব্জ বৃদ্ধ তার দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা ডাঁট ভাঙা চশমাটা ভালো করে তুলে ধরে তাকালেন তার দিকে। বৃদ্ধর ঠিক পিছনে র্যাকের গায়ে পুরানো কিছু আতরের শিশি কেবল রাখা আছে। সেদিকে তাকিয়ে শমিত জানতে চাইল, ‘এখানে কেওড়া, মিট্টি, মোগড়ার মতো কোনো সাধারণ আতর আছে?’
বৃদ্ধ আবার দেওয়ালের চারপাশের শূন্য র্যাকগুলোর দিকে তাকিয়ে নিয়ে মৃদু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘না কোনো আতরই আর আমার কাছে নেই।’
কথাটা শুনে শমিত দোকানের বাইরে যাবার জন্য পা বাড়াতে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় বৃদ্ধ বললেন, ‘জনাব, দোকানে যখন ঢুকলেনই তখন একটু ঠান্ডা পানি খেয়ে একটু জিরিয়ে যান যদি কোনো তকলিফ না হয়।’
লোকটার কথায় এমন একটা আন্তরিক আবেদন ছিল যে শমিত বলল, ‘আচ্ছা দিন।’
কাউন্টারের এক কোণে মাটির একটা কুঁজো রাখা ছিল। বৃদ্ধ একটা কাঁসার গ্লাসে তার থেকে জল নিয়ে শমিতের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘একটা সময় ছিল যখন এ দোকানে কেউ পা রাখলেই কেশর—পেস্তার শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করা হত। পূর্বপুরুষের সেই নিয়ম আমি এখনও ধরে রেখেছি। তবে এখন তো আর শরবত দেবার ক্ষমতা নেই, তাই পানি নেই।’
বেশ ঠান্ডা জল। শমিত বেশ তৃপ্তি করে জল খেয়ে, গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বৃদ্ধর মুখোমুখি একটা টুলে বসল। এরপর চারপাশে আবার তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘দোকানটা অনেক দিনের পুরানো দেখছি?’
বৃদ্ধ বললেন, ‘হ্যাঁ, এই বাড়ি আর দোকানটা আতর মহল্লার সব থেকে পুরানো। দশ পুরুষের আতর ব্যবসা আমাদের। কোম্পানির আমলে আমাদের এক পূর্বপুরুষ আতরের ডালা নিয়ে রইস আদমিদের বাড়ি ফেরি করতেন। তারপর ধীরে ধীরে বড়ো ব্যবসা গড়ে ওঠে। আমার বয়স নব্বই হতে চলল। কুড়ি বছর আগে পর্যন্ত আমি এই ব্যবসা টেনে টেনে নিয়ে চলেছিলাম। তারপর ছেলে—নাতিরা অন্য ব্যবসা নিয়ে দিল্লিতে চলে গেল। আমি একলা হয়ে গেলাম। বয়সও হয়ে গেল, ব্যবসা বন্ধ করে দিলাম। অভ্যাসবশত এখনো দোকান খুলি। কথা বলার তো লোক নেই। আপনার মতো কেউ কখনও এলে তার সঙ্গে বাতচিত করি, ভালো লাগে।’
কথাটা বলার পর বৃদ্ধ শমিতের পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। শমিত সংক্ষেপে নিজের পরিচয় দেবার পর বৃদ্ধ মৃদু হেসে বললেন, ‘আমার নাম ফিরদৌস আলি। আপনি যে আতরগুলোর নাম বললেন তার মধ্যে কোন আতরের খুশবু আপনার বেশি পছন্দের?’
শমিত এবার হেসে বলল, ‘আসলে আমি কোনোদিন আতর মাখিনি। এই নামগুলোও জানতাম না। জানলাম এখানকারই এক দোকান থেকে। তবে তারা অবশ্য সস্তার আতর বিক্রি করেন না। দামি আতর কেনার ক্ষমতা আমার নেই। তাই এসব সস্তার আতর খুঁজছি।’
কথাটা শুনে বৃদ্ধ ফিরদৌস হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, এ সব আতর দামের দিক থেকে সাধারণ মানুষের ব্যবহারের উপযোগী। ‘আতর’ কথাটা এসেছে ফারসি শব্দ ‘ইতর’ থেকে যার অর্থ সুগন্ধি।’
এ কথা বলার পর তিনি বললেন, ‘জানেন তো, ঋতু অনুসারে বিভিন্ন আতর ব্যবহার করার নিয়ম। আপনি যে আতরগুলোর দাম বললেন সেই মিট্টি, মোগড়া, কেওড়া এসব আতর গ্রীষ্মকালে ব্যবহার করার জন্য। আবার শামীম আতর, কেশর, কস্তুরী, অ্যাম্বার, আউদ এ সব আতর শীতকালের জন্য। আতর কিন্তু শুধু সুগন্ধী হিসাবেই ব্যবহার হয় না। আতরের গন্ধে অবসাদ দূর হয়। সর্দি কমে, গেঁটে বাতের যন্ত্রণাতেও ওষুধ হিসাবে মালিশ করা হয়।’
শমিত বলল, ‘বাঃ আতরের এতো নাম, তার ব্যবহার আমার জানা ছিল না।’
বৃদ্ধ বললেন, ‘আতর মাখার মতো শৌখিন লোকের সংখ্যা এখন কমে গেছে। লোকে বিদেশি গন্ধ দ্রব্যের দিকে ছোটে। যা গায়ে মাখলে কিছুক্ষণের মধ্যে মিলিয়ে যায়। শুধু যে লোকে দামের জন্য আতর মাখে না তা নয়, মানুষের রুচিও বদলেছে। অথচ একসময় এই কানপুর শহরে রইস আদমিরা তো বটেই সাধারণ মানুষরাও আতর ব্যবহার করত।’
শমিত বলল, ‘একজন ভদ্রলোকের মুখে শুনলাম, কিছু আতরের গন্ধ নাকি একশোবার কাচলেও যায় না।’
বৃদ্ধ বললেন, ‘জনাব ঠিকই শুনেছেন। শাহী আতর ও সব। কিছু এমন আতর আছে যার গন্ধ দেড়—দুশো বছরও থাকে।’ —কথাটা বলে বৃদ্ধ জানতে চাইলেন, ‘কানপুরের কী কী জায়গা দেখলেন?’
শমিত জবাব দিল, ‘দেখিনি এখনও। ওই যে কোম্পানি বাগ— নানা রাও পার্ক নামে যে পার্ক আর একটা পুরানো চার্চ আছে বলে শুনেছি, ও দুটো জায়গা কাল দেখব ভাবছি।’
বৃদ্ধ ফিরদৌস বললেন, ‘হ্যাঁ, কোম্পানি বাগ। কোম্পানির আমলে ও জায়গার নাম ছিল বিবিঘর। সাদা চামড়ার লোকদের, সিপাহিদের বিবি—বাচ্চারা থাকত ওখানে। বাগী সিপাহিরা ওই জায়গা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে ওখানেই খুন করেছিল তাদের। তারপর জ্বালিয়ে দিয়েছিল বিবিঘর। ছেলেবেলাতে আমরা ওই বিবিঘর বা কোম্পানি বাগে খেলতে যেতাম। সে সময়তেও ওখানে কয়েক হাত মাটি খুঁড়লেই কোম্পানির আমলের বন্দুকের গুলির খোল, কামানের লোহার গোলা মিলত। ওখানে কোম্পানির আমলের একটা স্মারক স্তম্ভ ছিল। যার গায়ে লেখা ছিল মিউটিনির সময় ওই জায়গাতে নিরপরাধ ব্রিটিশ নারী—শিশুদের খুন করেছিল দেশি সিপাহিরা। স্বাধীনতার পর অবশ্য সেই স্মারকটা সরিয়ে ফেলা হয়। অবশ্য না সরালেই ভালো হত আমার মনে হয়। ইতিহাস ভালো হোক বা খারাপ হোক তা মোছার চেষ্টা করা উচিত নয়।’
ধীরে ধীরে কথাগুলো বলার পর বৃদ্ধ বললেন, ‘হ্যাঁ, দেখে আসুন ও জায়গাও। তবে কি জানেন, ও সব জায়গা দেখতে হলে ইতিহাস খোঁজার মন নিয়ে যেতে হয়। নইলে ও জায়গা একটা সাধারণ পার্ক ছাড়া কিছুই মনে হবে না। ওই বিবিঘর বা কোম্পানি বাগ, অল সোল চার্চের কবরখানা আর এই আতর মহল্লার কটা বাড়ি শুধু এখনও সেদিনকার স্মৃতি নিয়ে কোনোভাবে টিকে আছে। একশো পঞ্চাশ—ষাট বছরের মধ্যেই সব মুছে যেতে বসেছে। আমরা যারা এ শহরের পুরানো মানুষ তারা এ শহরের পুরানো যতটুকু জানি, আগামী প্রজন্ম তাও জানবে না।’ আক্ষেপের সঙ্গে কথাগুলো বলে থামলেন বৃদ্ধ।
শমিতের এরপর আরও কিছুক্ষণ কথা হল বৃদ্ধর সঙ্গে। তিনি বললেন, তার ছেলেবেলাতে দেখা এ শহরের আভিজাত্যের কথা, কত রইস আদমি এক সময় তার দোকানে আসত সে কথা, মিউটিনির সময় তার শোনা কিছু কাহিনী। একসময় শমিতের খেয়াল হল, বাইরে অন্ধকার নেমে গেছে। তাকে হোটেলে ফিরতে হবে। সে উঠে দাঁড়াল দোকান থেকে বেরোবার জন্য। তা দেখে বৃদ্ধ বললেন, ‘জনাব আমাকে মাফ করবেন আতর দিতে পারলাম না বলে।’
শমিত বলল, ‘মাফি চাওয়ার কোনো ব্যাপার নেই। আপনার থেকে যে গল্প শুনলাম সেও তো অনেক পাওয়া।’
একথা বলার পর সে ফিরদৌসকে নমস্কার জানিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ কি যেন মনে হওয়াতে বৃদ্ধ তার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘জনাব একটু দাঁড়িয়ে যান। দেখি একটা জিনিস আছে কিনা?’
শমিত তাঁর কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
বৃদ্ধর ঠিক পিছনেই একটা পুরানো আমলের লোহার সিন্দুক আছে। তিনি ঝুঁকে পড়ে সেই সিন্দুকটা খুলে কাঁপা কাঁপা হাতে কালচে লোহার পাত দিয়ে মোড়া একটা কালো রঙের কাঠের বাক্স বার করে সামনে রাখলেন। বাক্সটা দেখেই বোঝা যায় সেটা অনেক পুরানো জিনিস। ঝোলাবার জন্য গায়ে পিতলের আংটাও আছে।
ফিরদৌস বললেন, ‘আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। এই আতরের বাক্সটা মিউটিনির আমলের। এই বাক্সটাই কাঁধে ঝুলিয়ে রইস আদমিদের বাড়ি আতর ফেরি করতেন আমার সেই পূর্বপুরুষ আব্দুল। যিনি আমাদের আতর ব্যবসার পত্তন করেন দেড়—দুশো বছর আগে।
বাক্সের তালাটা খুললেন বৃদ্ধ ফিরদৌস। সঙ্গে সঙ্গে একটা পুরানো মিষ্টি গন্ধ এসে লাগল শমিতের নাকে। বাক্সের ভিতর খোপ কাটা, তার মধ্যে অনেকগুলো শিশি রাখা আছে। বৃদ্ধ কাঁপা হাতে একটার পর একটা শিশি বার করে লণ্ঠনের সামনে মেলে ধরে দেখার চেষ্টা করতে লাগলেন ছোট ছোট কাঁচের শিশির মধ্যে কিছু আছে কিনা? কিন্তু কর্কের ছিপি আটা কাঁচের শিশিগুলো শূন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা শিশি বেশ ভালো করে লন্ঠনের আলোতে দেখার পর হাসি ফুটে উঠল বৃদ্ধর বলিরেখাময় মুখে। তিনি সেটা শমিতের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেড়শো—দুশো বছরের পুরানো ‘খস গুলাব’ আতর। আব্দুল আলির আতর। এক ফোঁটা আছে এখনও। গায়ে মেখে নিন। বিক্রি নয়, এই এক ফোঁটা আতর আমার উপহার।’
শমিত মৃদু বিস্মিতভাবে বলল, ‘একফোঁটা হলেও এ জিনিস দুর্মূল্য। এ জিনিস আপনি আমাকে উপহার দেবেন!’
বৃদ্ধ হেসে বললেন, ‘আমার অনেক বয়স হয়েছে। শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। ওপর থেকে ডাক আসছে বুঝতে পারছি। তারপর এই বাক্সর কদর কেউ বুঝবে না। হয়তো বা ফেলেই দেবে বাক্সটা। তাই আপনাকে দিলাম। মেখে নিন। এই আতর মেখে পুরানো মেজাজে এই পুরানো শহরের পুরানো জায়গাগুলো দেখুন তাতে আমার মনের আরাম হবে।’
বৃদ্ধ ফিরদৌসের কথা শুনে হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশির থেকে আকারে কিছুটা বড়ো সেই কাচের শিশির কর্কের ছিপিটা শমিত খুলে ফেলল। তারপর সে শিশিটা নাকের কাছে তুলে ধরে প্রথমে গন্ধ শুকতে যাচ্ছিল, কিন্তু বৃদ্ধ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘জনাব শুনিয়ে, আতরের শিশিতে গন্ধ শুকতে নেই, ওতে আতরের গুণ নষ্ট হয়।’ একথা বলে তিনি নিজেই আতরের শিশিটা হাত থেকে নিয়ে প্রাচীন আতরের ফোঁটাটা উপুড় করে দিলেন শমিতের কোটের বুকের কাছে। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা মিষ্টি গন্ধে ভরে উঠল চারদিক! আশ্চর্য সুন্দর মিষ্টি একটা গন্ধ!
শমিত বলল, ‘বাঃ খুব সুন্দর গন্ধ তো!’
বৃদ্ধ হেসে বললেন, ‘খাটি খস গুলাব আতর। এর খুশবু আপনার সঙ্গে সঙ্গেই থাকবে।’
এবার সত্যিই হোটেলে ফেরার জন্য রওনা হতে হবে শমিতকে। জায়গাটা অচেনা। বেশি সময় থাকলে অন্ধকারে ফিরতে সমস্যা হতে পারে। কাজেই এরপর সে বৃদ্ধ আতর বিক্রেতা ফিরদৌসকে ধন্যবাদ জানিয়ে পথে নেমে পড়ল।
৩
শমিত এগোল আতর মহল্লার বাইরে যাবার জন্য। আতর মহল্লার বড় বড় দোকানগুলোর ঝাঁপ ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। ল্যাম্পপোস্টগুলো ক্ষয়াটে আলো ছড়াতে শুরু করেছে নির্জন রাস্তাতে। কোথাও কোথাও হয়তো বা দু—একজন আতর ব্যবসায়ী দিনের শেষে তাদের বন্ধ দোকানের শেডের নীচে দাঁড়িয়ে কারবারের হিসাব কষছে। নিজের মনেই গুন গুণ করে একটা বাংলা গানের কলি ভাজতে ভাজতে হাঁটতে লাগল শমিত। আতরটা গায়ে দিয়ে দোকানের বাইরে বেরোবার পর মনের মধ্যে বেশ একটা ফুরফুরে ভাব লাগছে তার। হঠাৎ তার কানে এলো, ‘আপনি কি বাঙালি?’
শমিত পিছন ফিরে দেখতে পেল একজন মাঝবয়সি লোককে। তার পরনে ধুতির ওপর পরা একটা লাল রংয়ের পুরানো কোটের মতো পোশাক। মাথার চুল ছোটো করে ছাঁটা। শরীরের গড়ন বেশ মজবুত ধরনের। লোকটাকে দেখে শমিত থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, বাঙালি। আপনি?’
সে জবাব দিল, হ্যাঁ, বাঙালি। সামনেই একটা হাবেলিতে থাকি। আপনার চেহারা দেখে, আর গানের কয়েকটা শব্দ শুনে বুঝলাম, আপনি বাঙালি। তাই কথা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না।’
শমিত হেসে বলল, চলুন যেতে যেতেই কথা বলি। আমিও তো ওদিকেই যাচ্ছি।’
পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করার পর লোকটা শমিতের উদ্দেশ্যে বলল, ‘খস গুলাব আতর মেখেছেন দেখছি! খুব পুরানো আর ভালো আতর।’
শমিত বলল, ‘হ্যাঁ, খস গুলব আতর। আপনি আতর চেনেন দেখছি!’
লোকটা হেসে বলল, ‘তা চিনি। কম বছর তো হল না এখানে আছি। কিন্তু এ আতর পেলেন কোথায়?’
শমিত জবাব দিল, ‘কিনিনি, ফিরদৌস নামের এক বৃদ্ধ দোকানদার পুরানো শিশিতে থাকা একফোঁটা আতর আমার পোশাকে লাগিয়ে দিলেন।’
লোকটা স্বগতোক্তির সুরে বলল, ‘আমি ঠিকই অনুমান করেছিলাম। ওর এক পূর্বপুরুষ আব্দুল, মিউটিনির আমলে এই আতরের ব্যবসা করত।’
কথাটা শুনে শমিত বুঝতে পারল, বৃদ্ধ ফিরদৌস মিথ্যা বলেননি তাকে। শমিত লোকটাকে বলল, ‘আপনার পরিচয়টা? এখানে কী করেন আপনি?’
লোকটা জবাব দিল, ‘আমার নাম রাজারাম দত্ত। জাতে কায়েত। এক সময় আর্মিতে ছিলাম। ফর্টি সিক্স ইনফেন্ট্রি রেজিমেন্ট। সে চাকরির সুবাদেই এখানে এসেছিলাম। তারপর এখানেই রয়ে গেছি।’
নিজের পরিচয় দেবার পর রাজারাম নামের লোকটা শমিতের পরিচয় জানতে চাইলে সেও তার পরিচয় জানিয়ে তাকে প্রশ্ন করল, ‘বাংলার কোথাকার লোক আপনি?’
রাজারাম জবাব দিলেন, ‘গঙ্গা পাড়ে নৈহাটি। ওর পাশেই ভট্ট পল্লী। সংস্কৃত পণ্ডিতরা থাকেন। নৈহাটি চেনেন?’
শমিত জবাব দিল, ‘হ্যাঁ চিনব না কেন? কলকাতা থেকে ট্রেনে মাত্র এক ঘণ্টার পথ। আমি বারকয়েক গেছিও সেখানে।’
ভূতপূর্ব সৈনিক রাজারাম বললেন, ‘কতদিন আমার সেখানে ফেরা হয়নি। জানেন, আমাদের বাড়িটা ছিল একদম গঙ্গার পাড়ে, নাম ‘শিবালয়।’ পুরানো দিনের বিরাট বাড়ি। একটা শিব মন্দির ছিল বাড়িতে। একসময় আমার এক পূর্বপুরুষ জমিদারের গোমস্তা ছিলেন, তিনিই বাড়িটা বানিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরের কয়েক পুরুষ বসে বসে খেয়ে আমোদ—ফুর্তি করে সব শেষ করেছিল। যখন আমাদের সময় এল তখন ভাড়ার সব শূন্য। বাবা মারা গেলেন ছেলেবেলায়, আমরা অনেক কটা ভাই—বোন, একবেলা খাওয়া জোটে তো আর এক বেলা না খেয়ে কাটাই। আমার তখন মাত্র আঠারো বছর বয়স। একদিন শুনলাম আর্মিতে লোক নিচ্ছে। কাউকে না বলে একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে সোজা গিয়ে হাজির হলাম কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম, চাকরিটা হয়ে গেল। ট্রেনিং শেষ করার পর আমাকে পাঠানো হল প্রথমে মিরাট। তারপর লক্ষ্নৌ হয়ে এই কানপুরে। বেশ কয়েকটা লড়াইতে অংশ নিয়েছি আমি।’—একটানা কথাগুলো বলে থামল লোকটা।
তার কথা শুনে শমিত বলল, ‘তার মানে, বেশ রোমাঞ্চকর জীবন কাটিয়েছেন আপনি!’
একটু চুপ করে থেকে রাজারাম বললেন, ‘হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। সত্যিই রোমাঞ্চকর জীবন।’
পাশে চলতে চলতে এরপর তিনি জানতে চাইলেন, ‘এ শহরে কোন কোন জায়গা দেখলেন?’
শমিত জবাব দিল, ‘না, তেমন কিছু দেখা হয়নি। তবে কলকাতা ফেরার আগে কালকের দিনটা হাতে আছে আমার। ভাবছি সকালের দিকে বেরিয়ে, বিবিঘর, মেমোরিয়াল চার্চ—এ জায়গা দুটো অন্তত দেখব।’
রাজারাম বললেন, ‘হ্যাঁ, দেখে আসুন। মিউটিনির আমলের জায়গা সব। তবে চার্চে ফিরিঙ্গিদের কবরগুলো ছাড়া, সে আমলের কোনো কিছুই আর এখন নেই।’
—এ কথাগুলো বলে দাঁড়িয়ে পড়লেন রাজারাম। লোকটা থামতেই শমিত দাঁড়িয়ে পড়ল। রাস্তার গায়েই একটা পুরানো দিনের দোতলা হাবেলি শ্যাওলা মাখা, পলেস্তারা খসা দেওয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই বোঝা যায় বাড়িটার বয়স দেড়—দুশো বছর হবে। অর্থাৎ মিউটিনির সময়কার। হাবেলিটার গায়ে একটা প্রকাণ্ড বটগাছ আছে। সে যেন তার ডালপালা দিয়ে বাড়িটাকে আঁকড়ে ধরে তাকে মাটিতে মিশে যেতে দিচ্ছে না। বাড়িটা দেখিয়ে শমিতকে রাজারাম বললেন, ‘এই যে এটা আমার বাসস্থান।’
শমিত বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এ বাড়িটাতো অনেক দিনের পুরানো বাড়ি।’
রাজারাম বললেন, ‘হ্যাঁ, এ তল্লাটের সবথেকে পুরানো বাড়ি। এ বাড়ি মিউটিনি দেখেছে। আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে বেশ ভালো লাগল। বিদেশে বাঙালি দেখলে তাকে আত্মীয় বলে মনে হয়। এবার আমি আসি।’
শমিত বলল, ‘আমারও বেশ ভালো লাগল আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে। আবার যদি কোনোদিন কানপুর আসি তবে হয়তো দেখা হতে পারে আপনার সঙ্গে।’
কথাটা শুনে রাজারাম মৃদু হেসে হাত জোড় করে তাকে নমস্কার জানিয়ে হাবেলির ভিতরে ঢোকার জন্য এগোলো, আর শমিতও আবার হাঁটতে শুরু করল। মিনিট তিনেকের মধ্যেই সে আতর মহল্লার বাইরে বেরিয়ে আলোকজ্জ্বল ঘিঞ্জি অঞ্চলটাতে পৌঁছে গেল। তারপর সেখান থেকে একটা রিক্সো নিয়ে সোজা হোটেলে ফিরে এল। হোটেলে ফিরে কোনো কাজ ছিল না তার। কাজেই ঘণ্টাখানেক হোটেলে নিজের রুমে বসে টেলিভিশন দেখার পর শমিত রাত দশটায় খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়ল।
শেষ রাতের দিকে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল শমিত। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা একটা বিশাল বাড়ির সামনের মাঠে সে দাঁড়িয়ে। চারপাশে লোকজন চিৎকার করছে। ‘বিবিঘর জ্বালিয়ে দাও। ইংরেজ সিপাহিরা ওর মধ্যেই লুকিয়েছে। মেরে ফেলো সবাইকে।’ যে লোকগুলো চেঁচাচ্ছে তাদের কারও হাতে তলোয়ার, কারও হাতে বন্দুক। উন্মত্ত স্বরে চিৎকার করছে তারা। লোকগুলোর পোশাক দেখে শমিত বুঝতে পারল, তারা সবাই দেশি সেনা। গায়ে লাল রঙের জামা। কাঁধের কাছে সুতোর ঝালর, বাহুতে বাঁধা পরিচয় নির্ণায়ক পিতলের চাকতি, ধুতি কোমরবন্ধ দিয়ে বাঁধা, পায়ে জুতো। লোকগুলোর মধ্যে কেউ কেউ গুলিও চালাচ্ছে জ্বলন্ত বিবিঘরকে লক্ষ্য করে। একবার একটা উল্লাসধ্বনি শুনে শমিত তাকিয়ে দেখল, একজন অশ্বারোহী দেশি সৈনিক ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে। ঘোড়ার জিনের সঙ্গে বাঁধা দড়ির অপর প্রান্তে এক ইংরেজ সৈনিকের মৃতদেহ। ঘোড়ার খুড়ের সাথে সাথে মাটিতে ঠোক্কর খেতে খেতে চলেছে গোরা সৈনিকের রক্ত আর ধুলো মাথা মৃতদেহটা। সৈনিকদের উন্মত্ত চিৎকার, গুলির শব্দ, ঘোড়ার খুড়ের শব্দে ভয়ংকর পরিবেশ চারিদিকে। এক সময় শমিতের চোখের সামনেই প্রচণ্ড শব্দ করে মাটিতে আছড়ে পড়ল জ্বলন্ত বিবি মহলের একটা অংশ। আর তার সাথে সাথে মাটিতে ছিটকে পড়ল বিবিঘরের মাথার ওপরের কোম্পানির পতাকা সমেত বিশাল পতাকা দণ্ডটাও। তা দেখে সম্মিলিত উল্লাসধ্বনি করে উঠল সিপাহিরা। কয়েকজন সৈনিক আগুনের মধ্যেই ছুটে গিয়ে কোম্পানির পতাকাটা পায়ে মাড়াতে লাগল। কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎই সব শব্দকে ছাপিয়ে উঠে গুম গুম করে কামানের গর্জন হল বেশ কয়েকবার। আর সেই শব্দ শোনা মাত্রই কয়েক মুহূর্তের জন্য চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এল। আর এরপরই একজন ঘোড়সওয়ার সিপাহি ছুটতে ছুটতে এসে চিৎকার করে বলল, ‘ভাগো, ভাগো! ক্যাপ্টেন হ্যাভলক এসে গেছে। সঙ্গে অনেক গোরা ফৌজ, গোলা, বারুদ। ওই তার কামানের শব্দ। আমরা বিবিঘর জ্বালিয়ে দিয়েছি, ও আমাদের সবাইকে মেরে উড়িয়ে দেবে। জলদি ভাগো, পালাও, পালাও।’
লোকটার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই দেশি সিপাহিদের উল্লাসধ্বনি বদলে গেল ভয়ার্ত চিৎকারে। ‘ভাগো’, ‘ভাগো’ চিৎকার করতে করতে যে যেদিকে পারল ছুটতে শুরু করল বেশ কিছু সিপাহি। আবার একদল সিপাহি কোম্পানির ফৌজের মোকাবিলার জন্য বন্দুক আর হাত কামান নিয়ে প্রস্তুত হল। কিন্তু শমিত কিছুতেই বুঝতে পারছে না এই বধ্যভূমি ছেড়ে কোন দিকে যাবে? কোথায় পালাবে? একে তার অপরিচিত জায়গা। হ্যাভলক সাহেবের সৈন্যদের কামানের গর্জন ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল এরপর। কিছু দেশি সিপাহিও সেদিক লক্ষ্য করে গুলি চালাতে লাগল। শমিতের কিছুটা তফাতেই একটা কামানের গোলা এসে আছড়ে পড়ল। বেশ কয়েকজন সিপাহি শমিতের চোখের সামনে নিমেষে উড়ে গেল সেই গোলার আঘাতে। হতভম্ব, আতঙ্কিত শমিত কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না সে কোথায় কোথায় পালাবে? এখানে থাকলে তার মৃত্যু নিশ্চিত। ঠিক সেই সময় হঠাৎ একজন দেশি সিপাহি এসে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি বাঙালি?’
শমিত জবাব দিল ‘হ্যাঁ, বাঙালি’।
জবাব দিয়েই শমিত চিনতে পারল লোকটাকে। সে রাজারাম! রাজারাম তাকে বলল, ‘আসুন আমার সঙ্গে। ওরা এসে পড়ল বলে। এখানে থাকলে আপনি বাঁচবেন না।’
কথাটা শোনার পর সঙ্গে সঙ্গেই শমিত রাজারামের পিছন পিছন বিবিঘরের সামনের মাঠ ছেড়ে ছুটতে শুরু করল। মাঠ ছেড়ে একটা মহল্লার মধ্যে ঢুকে পড়ল তারা। পথের দু—পাশে বিরাট বিরাট হাবেলি। কিন্তু সেখানে প্রবেশ করার পর পিছনে কাদের যেন শব্দ পেয়ে তারা বুঝতে পারল কারা যেন তাদের পিছু ধাওয়া করছে। রাজারাম বলল, ‘কোম্পানির সিপাহিরা শহরে ঢুকে পড়েছে। ওরাই আমাদের পিছনে আসছে।’ —আর এ কথা বলার পরই রাজারাম রাস্তার পাশে একটা বট গাছের গায়ে একটা বিরাট বড় বাড়ি বা হাবেলীর মধ্যে ঢুকে পড়ল। বাড়ির ভিতর চক মেলানো বিরাট উঠান, তার চারপাশে থাকার পর। তবে কোনো লোকজন নেই। সিঁড়ি বেয়ে বাড়িটার দোতলায় উঠতে উঠতে শমিত জানতে চাইল, ‘এ কার বাড়ি? লোকজন সব কোথায়?’
রাজারাম জবাব দিল, ‘এটা আতর মহল্লা। বাড়ির লোকজন সব যুদ্ধের ভয়ে শহর ছেড়ে পালিয়েছে, যেমন আরও অনেক পালিয়েছে। তবে এ বাড়িটা আমার চেনা হাবেলি।’
দোতলায় উঠে একটা ঘরে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে রাজারাম হাফাতে হাফাতে বলল, ‘যাক, আপাতত বেঁচে গেছি। ওরা আমাদের দেখতে পেলেই তোপের মুখে বেঁধে উড়িয়ে দিত বা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিত। হ্যাভলক সাহেবের এক অনুচর আছে সিম্পসন তার নাম। সাঙ্ঘাতিক লোক। ইতিমধ্যেই সে বহু বাগী সিপাহিকে তোপের মুখে উড়িয়ে দিয়েছে। রাতের অন্ধকার নামলেই আমরা কৌনপুর শহর ছেড়ে পালাব।’
শমিতের মাথাতে কিছুতেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হচ্ছে না। কীভাবে যে এই বিবি ঘরের সামনে উপস্থিত হল কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। বিস্মিতভাবে ঘরের চারপাশে তাকাতে লাগল সে। অনেক কটা চিকের পর্দা ঢাকা দরজা জানলা আছে ঘরটাতে। মেঝেতে ফরাস পাতা, মাথার ওপর ঝাড়বাতিও আছে। যা দেখে শমিতের মনে হল সম্ভবত কোনো ধনী ব্যক্তির ঘর হবে এটা। আর তারপরই নীচে একটা কোলাহল শোনা গেল। শব্দটা কানে যেতেই রাজারাম ঘরের একটা জানলার কাছে গিয়ে পাল্লাটা সামান্য ফাঁক করে নীচে তাকিয়ে উত্তেজিতভাবে বলল, ‘সিম্পসন সাহেব তার সৈন্যদের নিয়ে হাবেলি ঘিরে ফেলেছে। কিন্তু আমরা যে এই হাবেলিতে ঢুকলাম ওরা জানল কী ভাবে?’
নিজেই প্রশ্নটা করে এরপর নিজের প্রশ্নের উত্তরটা স্বগতোক্তির স্বরে রাজারাম বলল, ‘খস আতরের গন্ধটা ওদের এ বাড়িতে পৌঁছে দিল।’
শমিত বলল, ‘তার মানে?’
রাজারাম তার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের কোমর থেকে তার তলোয়ার খুলে নিল। কোলাহলের শব্দটা এরপর বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল। সৈন্যদের বুটের ভারী পায়ের শব্দ। শমিতদের ঘরের বন্ধ দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল সেই শব্দ। এবার ওরা দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকবে। রাজারাম ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একবার চাপাস্বরে বলল, ‘জয় সেনাপতি নানা সাহেবের জয়, ভারত সম্রাট বাহাদুর শাহ’র জয়।’ —এ কথাগুলো বলেই দরজার দিকে তলোয়ার উঁচিয়ে দাঁড়াল সে!’ —এ পর্যন্ত স্বপ্নটা দেখেই ঘুম ভেঙে গেল শমিতের।
কিন্তু ঘুম ভাঙার পরই ঘরের বন্ধ দরজার বাইরের করিডোরে কথাবার্তার শব্দ শমিতের কানে এল।’
বাইরে ভোরের আলো তখনও ফোটেনি। শমিতের রিস্ট ওয়াচে চারটে বেজেছে সবে। দরজার ওপাশে কথা—বার্তার শব্দ শুনে কৌতূহলবশত বিছানা ছেড়ে উঠে শমিত দরজা খুলল। হালকা আলো জ্বলছে দোতলার করিডোরে। শমিতের ঘরের দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে হোটেলের ম্যানেজার আর একজন বেয়ারা বা রুম সার্ভিসের লোক। শমিত দরজা খুলতেই কথা থামিয়ে দিল তারা। ম্যানেজার শমিতকে দেখে প্রথমে বেশ লজ্জিত স্বরে বলল, ‘মাফ করবেন স্যার, আমাদের কথার শব্দে আপনার ঘুম ভাঙল বলে দুঃখিত।’
এ কথা বলার পর ম্যানেজার তার বেয়ারার দিকে তাকিয়ে ভর্ৎসনার স্বরে বললেন, ‘রাতে নেশা করে ডিউটি করলে তোমাকে আর চাকরি করতে হবে না। অন্য কোথাও চাকরি খুঁজে নাও।’
তার কথা শুনে মাঝবয়সি সেই বেয়ারা বলল, ‘আপনি বিশ্বাস করুন স্যার, আমি ভুল দেখিনি। বারো নম্বর রুমের বোর্ডার চারটে নাগাদ আমাকে জোরে বেল বাজিয়ে তার ঘুম ভাঙিয়ে দিতে বলেছিলেন। সেজন্য আমি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠেই দেখতে পেলাম বিরাট বড়ো একটা কালো কুকুর ঠিক এখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমার পায়ের শব্দ শুনে ওই বিলাতি কুকুরটা আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যে আমি ঘাবড়ে গিয়ে আপনাকে ডেকে আনলাম।’
কথাটা শুনে ম্যানেজার রুক্ষভাবে বললেন, ‘কুকুরটা কি তবে বাতাসে মিলিয়ে গেল! আজকাল নেশা বেড়েছে তোমার!’
তাকে এ কথা বলে শমিতের থেকে আরো একবার ক্ষমা চেয়ে লোকটাকে নিয়ে চলে গেলেন ম্যানেজার। শমিত আবার নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল।
৪
সকাল ন—টা স্নান সেরে প্রাতরাশ খেয়ে শহরের দ্রষ্টব্যগুলো দেখার জন্য শমিত নিজের রুম থেকে বেরোল। নীচে নেমে রিসেপশনে রুমের চাবি দেবার সময় ম্যানেজারকে সে জিজ্ঞেস করল, ‘কি কুকুরটার খোঁজ মিলল?’
ম্যানেজার তার কর্মচারীর সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করে বললেন, ‘কুকুর দেখলে তো তার সন্ধান মিলবে। গেটম্যান সারারাত গেটে ডিউটিতে ছিল। সারারাত সে গেট খোলেনি। তাও কোন স্ট্রিট ডগ হলে না হয় বুঝতাম যে সে কোন ফাঁকে ভিতরে ঢুকেছে। আর ও যে কুকুরটাকে দেখেছে সে নাকি একটা বাঘের মতো বিলাতি কুকুর। আমি আমার কর্মচারিকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়েছি। আর যদি ও কোনোদিন নেশা করে ডিউটি করে তবে সঙ্গে সঙ্গে তাকে তাড়িয়ে দেব। ওর আচরণের কারণে ভোর রাতে আপনার ঘুম ভেঙেছে বলে খুব দুঃখিত।’
চাবি জমা দিয়ে হোটেলের বাইরে এল শমিত। একটা অটো রিক্সো পেয়ে গেল সে। ভাড়ার ব্যাপারে দরদাম করে রিক্সোতে উঠে বসল সে। রিজার্ভ করা অটোরিক্সো তাকে নিয়ে কোলাহল মুখর, জনাকীর্ণ কানপুর শহরের মধ্যে দিয়ে প্রথমে ছুটল ‘নানা রাও পার্কের দিকে। স্থানীয় লোকেরা যাকে ডাকে ‘কোম্পানি বাগ’ নামে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নানা সাহেব পার্কে পৌঁছল সে। প্রাচীন দুর্গের মতো সাজানো তোরণ দিয়ে সে পার্কে প্রবেশ করল। এখানেই একসময় ‘বিবিঘর’ ছিল। পার্কের প্রবেশ তোরণের পাশে একটা সাইন বোর্ডে এ জায়গা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখা আছে। হ্যাঁ, এই বিবি ঘরই ধ্বংস করেছিল বাগী সিপাহিরা। আর দেশি সিপাহিদের হাতে নিহত ব্রিটিশ নারী—পুরুষদের স্মারক স্থল হিসাবেই এ পার্ক প্রথমে নির্মিত হয়, যা স্বাধীন ভারতে নাম পরিবর্তিত হয়ে নানা রাও মেমোরিয়াল পার্ক হয়। শমিতের মনে পড়ে গেল ভোর রাতে দেখা তার স্বপ্নর কথা। স্বপ্নের মধ্যে সে এই জায়গাতে দাঁড়িয়ে বিবিঘর ধ্বংস হওয়া দেখেছে, গোরা সৈনিকের সঙ্গে দেশি সৈন্যদের লড়াই দেখেছে, তারপর এ জায়গা ছেড়ে পালিয়েছিলেন রাজারামের সঙ্গে। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি, গোরা সৈন্যরা তাদের পিছু ধাওয়া করে পৌঁছে গেছিল সেই হাবেলিতে। এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর স্বপ্ন। শমিত সেই ভয়ংকর স্বপ্নর ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে এ কথাই ভাবল যে, পবন সিং—এর মুখে শোনা কানপুরে সিপাহি বিদ্রোহের কাহিনি, বিবিঘর ধ্বংস করার কাহিনি, গত সন্ধ্যায় প্রাক্তন সেনাকর্মী রাজারামের সঙ্গে তার পরিচয়, কথোপকথন, বটগাছের পাশে মিউটিনির আমলের পুরানো বাড়িটা দেখা, —এসব মিলেমিশেই তার মনে ওই অদ্ভুত ভয়ংকর স্বপ্নটা তৈরি হয়েছিল।
পার্কে কোনো ভিড় নেই। এখনও কোনো লোকজন প্রবেশ করেনি সেখানে। ধীরে ধীরে পার্কটা ঘুরে বেড়াতে শুরু করল সে। উন্মুক্ত পরিবেশে নিজের পোশাকে লাগানো পুরানো খস গুলাব আতরের অদ্ভুত সুন্দর গন্ধটা টের পেতে লাগল সে। সুন্দর ফুলের বাগিচা আর ঘাসে ছাওয়া বিরাট পার্ক। নানা স্থানে রয়েছে সিপাহি বিদ্রোহের নায়কদের মূর্তি। এ দেশকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন মুক্ত করার জন্য সেই বারুদের গন্ধ আর তলোয়ারের ঝংকার মুখরিত দিনে যারা গোরা সৈন্যদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন, ফাঁসিকাঠে চড়েছিলেন তাদের মূর্তি। নানা সাহেবের মূর্তিতো আছেই আর তার সঙ্গে আছে লক্ষ্মীবাই, তাঁতিয়া টোপি সহ আরো অনেকের মূর্তি। এসব মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে শমিতের এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ অনুভব হতে লাগল অতীতের সে সব দিনের কাহিনি স্মরণ করে। সে প্রতিটা মূর্তির সামনে বেশে কিছুক্ষণ সময় ধরে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মূর্তিগুলো দেখতে দেখতে মনে মনে কল্পনা করার চেষ্টা করতে লাগল সিপাহি বিদ্রোহ বা মিউটিনির ঘটনা প্রবাহ। তবে সে যুগের অন্য তেমন কিছু পার্কে নেই। নিহত ইউরোপীয়ানদের স্মরণে কোম্পানির লোকেরা এখানে যে স্মারক বসিয়েছিলেন তা যে ওখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে তা পবন সিং—এর কাছে আগে শুনেছে শমিত। যাই হোক পার্ক দেখে সে যখন বাহিরে বেরিয়ে এল তখন ইতিমধ্যেই ঘণ্টা দুয়েক সময় কেটে গেছে। প্রায় বেলা সাড়ে এগারোটা বাজে। আবার অটোরিক্সোতে চেপে শমিত রওনা হয়ে গেল তার পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।
শহরের রাস্তার যানবাহন, হই—হট্টগোলের মধ্য দিয়ে এগোতে এগোতে বৃদ্ধ অটো চালক একবার শমিতকে প্রশ্ন করল, ‘কৌন সি আতর হ্যায় বাবু সাব? বড়িয়া খুশবু!’
প্রশ্ন শুনে শমিত জবাব দিল, ‘খস গুলাব আতর।’
অটো চালক বলল, ‘বড়িয়া আতর, রইস আদমিকা আতর। নাম শুনা থা, আব খুশবু মিলা।’
কানপুর শহরের ব্যস্ত জনপথ দেখতে দেখতে শমিত একসময় পৌঁছে গেল মেমোরিয়াল চার্চের গেটে।
জনবসতিপূর্ণ জায়গার মধ্যে মিউটিনির আমলের বিরাট চার্চটা প্রাচীর ঘেরা বিশাল অঞ্চল নিয়ে। শমিত গেটের ভিতরে প্রবেশ করতেই নিমেষের মধ্যে যেন বাহিরের জন—কোলাহল মিলিয়ে গেল। গাছ—গাছালি—বাগান সমৃদ্ধ প্রাচীর ঘেরা চার্চ আর তার চারপাশে এক অপার নিস্তব্ধতা আর শান্তি বিরাজ করছে। শমিত এগোল চার্চের দিকে। লাল ইটের তৈরি চার্চটার সামনে পৌঁছে পুরানো কানপুর অর্থাৎ মিউটিনির সময়কার অনুভূতি পেল শমিত। ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত লাল ইটের চার্চের গায়ে সময় যেন থমকে আছে। শমিত শুনেছে এই চার্চের কবরখানাটা ঠিক মিউটিনির সময়কার আর এই চার্চ তৈরি হয়েছিল তার কয়েক বছরের মধ্যেই। দু—চারজন ট্যুরিস্ট ইতি—উতি ঘুরে বেড়াচ্ছে চার্চের সামনে, চার্চ সংলগ্ন বাগানে। যে কোনো কারণেই চার্চের ভিতর প্রবেশের তোরণ বন্ধ। তা দেখে শমিত মৃদু হতাশ হল। পুরানো আমলের চার্চটার বাহিরে থেকে তার চারপাশে একবার চক্কর কাটল সে। তারপর ঘুরতে শুরু করল চার্চ সংলগ্ন অঞ্চলে, বাগানে।
শমিত ঘুরতে ঘুরতে এক সময় উপস্থিত হল এ জায়গায় প্রাচীনতম স্থানে, যেখানে বিদ্রোহের সময় বাগী সৈন্যদের হাতে নিহত ব্রিটিশদের কবর দেওয়া হয়েছিল। আজও প্রাচীন কবর বেদি রয়ে গেছে সেখানে। যদিও অনেক কবরের ওপর ঘোষিত নাম ফলক মুছে গেছে। পাথর উঠে গিয়ে ইট দাঁত বের করে আছে, কোথাও বা কবরের গায়ের পাথরের ক্রুশ হেলে পড়েছে। তবে সময় এ জায়গাটার ওপর থাবা বসালেও অতীত চিহ্নকে এখনও মুছে দিতে পারেনি। কবরস্থানটা ঘুরতে ঘুরতে শমিতের মনে হল, কোথায় সেই সাগরের ওপারের দেশ ইংল্যান্ড। আর কোথায় এই কানপুর। নিয়তি হয়তো বা এই কবরখানাতে যারা ঘুমিয়ে আছে তাদেরকে মৃত্যুর জন্য এখানে টেনে এনেছিল। এমনও হতে পারে এই কবরখানাতে কোনো নিরীহ, সিভিলিয়ান ইংরেজের কবরও আছে, বাগী সিপাহিরা যাকে হত্যা করেছিল। অবশ্য যুদ্ধের নিয়মই হল এই যে যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন উভয় পক্ষের সৈন্যদের হাতেই অনেক নিরীহ মানুষের প্রাণ যায়। যুদ্ধক্ষেত্রে কে অপরাধী কে নিরপরাধী তার বিচার খুব একটা করা হয় না।
চারপাশের কবরগুলো দেখতে দেখতে এগোচ্ছিল শমিত। হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল শমিত। কিছুটা তফাতে একটা জীর্ণ কবরের আড়াল থেকে উঁকি মারছে একটা বিরাট মিশকালো কুকুরের মাথা। কবরের আড়াল থেকে গলা বাড়িয়ে সে দেখছে শমিতকে। দেশি নয়, বিদেশি কুকুর। তার গলায় বকলসটাও দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ কুকুরটা কারও পোষা। শমিতের সারমেয় প্রীতি আছে। সে কুকুর দেখলেই ভয় পায় না। কাজেই আগ্রহবশত এরপর এগোতে যাচ্ছিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটা অদৃশ্য হয়ে গেল। আর তারপর মুহূর্তেই কাছেই একটা গাছের আড়াল থেকে একজন লোক বেরিয়ে এসে দাঁড়াল শমিতের সামনে। গতকাল সন্ধ্যার সেই রাজারাম। তবে তার পোশাকের সামান্য একটু পরিবর্তন হয়েছে। গায়ে সেই পুরানো লাল কোটের বদলে এখন শুধু একটা হাতকাটা ফতুয়া।
তাকে দেখে শমিত বলল, ‘যাক, আবার আপনার সাথে এখানে দেখা হয়ে গেল।’
শমিতের কথা শোনার পর রাজারাম তাকে মৃদু বিস্মিত করে বললেন, ‘আমি এখানে আপনার সাক্ষাত পাব জেনেই দেখা করতে এসেছি। আপনি কাল বলেছিলেন এ জায়গা দেখতে আসবেন।’
শমিত এরপর যে কবরটার আড়ালে কুকুরটা দেখেছিল সেই কবরটার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, ‘ওখানে বেশ বড়ো একটা বিলাতি কুকুর দেখলাম। আপনার কুকুর নাকি?’
রাজারাম কয়েক—মুহূর্ত সে দিকে তাকিয়ে থাকার পর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘না, ওটা আমার কুকুর নয়। তবে ও কার কুকুর আমি জানি।’
শমিত প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, ‘ও কার কুকুর?’ কিন্তু তার আগেই রাজারাম বললেন, ‘একটা বিশেষ অনুরোধ নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’
‘কী অনুরোধ?’ জানতে চাইল শমিত।
রাজারাম তার হাত দুটো প্রণামের ভঙ্গিতে বুকের কাছে জড়ো করে বললেন, ‘দয়া করে যদি আজ সন্ধ্যায় আমার বাড়ি আতিথ্য গ্রহণ করেন তবে কৃতজ্ঞ থাকি।’
প্রায় অপরিচিত একজন লোকের থেকে তার বাড়ি যাবার আমন্ত্রণ পেয়ে রাজারামকে ঠিক কী বলা উচিত তা বুঝে উঠতে না পেরে চুপ করে রইল শমিত।
লোকটা সম্ভবত তার মনের ভাব পাঠ করতে পেরে বললেন, ‘আসলে দেশ ছেড়ে এতদূরে একলা পড়ে আছি। বাঙালি দেখলে আত্মীয় বলে মনে হয়। কতদিন বাংলা ভাষায় কথাও বলিনি কারো সাথে। আপনি এলে খুব ভালো লাগবে আমার। কি আসবেন তো?’ একটা কাতর আবেদনও যেন ফুটে উঠল লোকটার কণ্ঠস্বরে।
শমিতের বিকাল বা সন্ধ্যার পর কোনো কাজ নেই। হোটেলেই সময় কাটতে হবে তাবে। তবুও সে রাজারামের অনুরোধে সাড়া দেবার আগে ইতস্তত করতে লাগল।
রাজারাম এবার তার উদ্দেশ্যে বলল, ‘আমি ফৌজ ছিলাম। দেশের জন্য লড়াই করেছি। চোর—ডাকাত নই।’
তার এ কথা শোনার পর তাকে আর না বলতে পারল না শমিত। সে বলল, ‘ছিঃ ছিঃ, আপনাকে চোর—ডাকাত ভাবতে যাব কেন? ঠিক আছে, আজ সন্ধ্যাতে আমি আপনার বাড়ি যাব।’
শমিতের কথা শুনে উজ্জ্বল হয়ে উঠল রাজারামের মুখ। তিনি বলে উঠলেন, ‘আপনাকে ধন্যবাদ জানাবার ভাষা আমার নেই। আমি সন্ধ্যা সাতটায় আতর মহল্লার মুখে আপনার জন্য অপেক্ষা করব।’
শমিত হেসে বলল, ‘ঠিক আছে। আমি ঠিক সাতটায় আতর মহল্লাতে পৌঁছে যাব।’
রাজারাম শমিতকে নমস্কার জানিয়ে বলল, ‘এবার আমি আসছি। সন্ধ্যাবেলায় দেখা হবে। তবে এ জায়গাতে আপনার এখন আর না থাকাই ভালো। এদিকটাতে কোনো লোকজন নেই। আর এই কুকুরটাও সুবিধার নয়। হঠাৎ বিপদ হতে পারে। যেদিকে লোকজন আছে সেদিকে বেড়ান।’ —এই বলে অন্যদিকে রওনা হলেন রাজারাম। সে এগোবার পর শমিতেরও মনে হল, এমন নির্জন জায়গাতে সত্যি একলা থাকা ঠিক নয়। সেও কবরখানা ছেড়ে ফেরার পথ ধরল। শমিত এরপর আরও আধঘণ্টা চার্চ চত্বরে থাকার পর বাহিরে বেরিয়ে এসে অটো রিক্সোতে চেপে বসল। ফেরার আগে বাড়তি পাওনা হিসেবে শমিতকে কানপুরের অন্যতম দ্রষ্টব্য গ্লাস টেম্পল বা জৈন মন্দিরে নিয়ে গেল অটো চালক। সেই অদ্ভুত সুন্দর মন্দির দেখে শমিত যখন বাড়ি ফিরল তখন বেলা আড়াইটে বাজে। দুপুরের খাওয়া সেরে ঘুম দিল সে।
৫
শমিতের যখন ঘুম ভাঙল তখন গঙ্গার বুকে সূর্য ডুবে গেছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার আসতে শুরু করেছে কানপুর শহরের বুকে। শমিতের রুমের জানলা দিয়ে শহরের জ্বলে ওঠা আলোক বিন্দুগুলো দেখা যাচ্ছে। ঘুম থেকে ওঠার পর চা—পান করে, স্নান সেরে বেশ ধীরে—সুস্থে নৈশ আমন্ত্রণের জন্য তৈরি হয়ে নিজের রুম ছেড়ে নীচে নেমে এল শমিত। রিসেপশনে চাবি জমা দেবার সময় ম্যানেজার হেসে বললেন, ‘কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন স্যার?’ আপনার আতরের গন্ধটা খুব সুন্দর। আপনি চলে যাবার পরও অনেকক্ষণ নাকে গন্ধ লেগে থাকে।’
শমিত হেসে বলল, ‘খস গুলাব আতর। আমি এখন একটা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আতর মহল্লাতে যাব।’
ম্যানেজার জানতে চাইলেন, ‘আপনার ডিনারের ব্যবস্থা করতে হবে স্যার?’
শমিত বলল, ‘আমি ঘণ্টা দুই সময়ের মধ্যেই ফিরব। তারপর জানাব ব্যবস্থা করবেন কিনা।’
শমিত এরপর হোটেলের বাহিরে বেরিয়ে এল। গেটের পাশেই একজন বুড়ো রিক্সো চালক বসেছিল। তার রিক্সোতে চেপে আলো ঝলমলে শহরের মধ্য দিয়ে আতর মহল্লার দিকে চলল শমিত। ঠিক সাতটাতেই আবার মহল্লার মুখে পৌঁছল সে।
রিক্সো থেকে নেমে শমিত আতর মহল্লার ভিতর প্রবেশ করল। শীতের সময়। অন্ধকার নামার পরই দোকানের ঝাঁপগুলো বন্ধ হয়ে গেছে গতদিনের মতোই। রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। কুয়াশার একটা পাতলা আবরণও যেন ধীরে ধীরে মাথার ওপর থেকে নামতে শুরু করেছে। স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোগুলোও ঘোলাটে লাগছে সেজন্য। মহল্লার ভিতর প্রবেশ করে কিছুটা এগোবার পরই একটা ল্যাম্পপোস্টের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে শমিতের সামনে দাঁড়াল রাজারাম। একটা কালো রঙের চাদর তার গায়ে। মাথাটা সেই চাদর দিয়েই ঘোমটার মতো ঢাকা। রাজারাম শমিতের উদ্দেশ্যে হেসে বললেন, ‘আমি জানতাম আপনি আসবেন। চলুন এবার?’
শমিত বলল, ‘হ্যাঁ, চলুন। অন্ধকার নামতেই আপনাদের এই আতর মহল্লা কেমন যেন নিঝুম হয়ে যায়। মনে হয় যেন অনেক রাত হয়ে গেছে।’
রাজারাম হেসে বললেন, ‘অনেক পুরানো জায়গা তো তাই এমন মনে হয়। এখনতো তাও রাস্তায় আলো দেখছেন। আমি যখন প্রথমে এখানে আসি তখন বড়োলোকদের বাড়ি লন্ঠন আর মোমবাতি জ্বলত। আর গরিবদের বাড়ি মেটে প্রদীপ বা পাটের মশাল। রাস্তার আলো তখন কল্পনার ব্যাপার ছিল।’
শমিত এরপর রাজারামের সাথে এগোল তার বাড়ির দিকে। সেদিকে এগোবার সময় প্রথমে দু—চারজন লোক তার চোখে পড়লেও যত তারা বাড়ির দিকে এগোতে থাকল ততই যেন চারপাশ আরও নিঝুম হয়ে আসতে লাগল। মানুষ কেন? একটা কুকুর পর্যন্ত নেই রাস্তাতে। নিস্তব্ধ রাস্তাতে শুধু নিজেদের পায়ের শব্দ কানে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শমিত পৌঁছে গেল রাজারামের হাবেলির সামনে। আকাশে অস্পষ্ট চাঁদ উঠতে শুরু করেছে। তার নীচে ঝাঁকড়া বটগাছটা যেন হাতের মতো ডালপালা দিয়ে ধরে রেখেছে জীর্ণ হাবেলিটাকে। বাড়িটার ভিতর প্রবেশ করার জন্য দরজাটা বর্তমানে কপাটহীন। ভিতরে খেলা করছে জমাট—বাঁধা অন্ধকার। সেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রাজারাম বললেন, ‘একটু দাঁড়ান, আলোটা জ্বালিয়ে নিই।’
হাবেলির অন্ধকারের মধ্যে ঢুকে মিনিট খানেকের মধ্যেই কাচ ঢাকা পুরানো দিনের লন্ঠন জ্বালিয়ে আনলেন রাজারাম। শমিতকে নিয়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করার আগে যেদিক থেকে তারা হেঁটে এল সেদিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে কী যেন দেখার চেষ্টা করে রাজারাম বললেন, ‘আসুন এবার।’
রাজারামের সাথে হাবেলিতে প্রবেশ করল শমিত। বাড়ির ভিতর ঢুকেই একটা বড় উঠোন। চারপাশের অলিন্দ গায়ে সার সার ঘর। কোথাও কোনো আলো নেই। তা দেখে শমিত জানতে চাইল, ‘এত বড় বাড়িতে আপনি একলাই থাকেন নাকি?’
‘হ্যাঁ, একলাই থাকি বহু বছর ধরে।’ কথাগুলো বলে চক বা উঠোন অতিক্রম করে শমিতকে নিয়ে অলিন্দ গায়ের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলেন রাজারাম। দোতলায় উঠে শমিতকে নিয়ে একটা বেশ বড় ঘরে প্রবেশ করলেন রাজারাম। ঘরের মেঝেতে একটা ফরাস পাতা। মাথার ওপর ঝাড়বাতিতে বেশ কয়েকটা মোম জ্বলছে। তার আলোতে আলোকিত ঘর। চিকের পরদা ঢাকা বেশ কয়েকটা দরজা—জানলাও আছে। হাবেলির সামনের দিকে রাস্তা, যেদিকে রাস্তা সেদিকের জানলাটার দিকে তাকিয়ে শমিতের হঠাৎই যেন মনে হল গত রাতে যে অদ্ভুত স্বপ্নটা সে দেখেছে, তার মধ্যেই এ ঘরটাকে সে দেখেছিল। বিবিঘর থেকে পালিয়ে এসে এ ঘরেই যেন লুকিয়ে ছিল তারা!
‘অদ্ভুত ব্যাপার তো!’— শমিত মনে মনে ভাবল।
শমিতকে যত্ন করে মেঝেতে বসিয়ে রাজারাম বললেন, ‘আপনার জন্য সামান্য কিছু আয়োজন করেছি, সেগুলো নিয়ে আসি। তারপর গল্প হবে।’
ঘরটাতে শমিতকে বসিয়ে রেখে চিকের পর্দা সরিয়ে পাশের একটা ঘরে চলে গেলেন রাজারাম। ঘরটার চারপাশে তাকিয়ে শমিত দেখল, ঘরের মধ্যে অন্য আসবাব, জলের কুঁজো ইত্যাদি যা রাখা আছে তা সবই পুরোনো আমলের বলেই মনে হয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরে ঢূকলেন রাজারাম। তার এক হাতে একটা রেকাবি, অন্য হাতে একটা পাথরের গ্লাস। সে দুটো তিনি শমিতের সামনে নামিয়ে রেখে বললেন, ‘নিন, খাওয়া শুরু করুন।’
রেকাবিতে রাখা আছে বিভিন্ন ধরনের ফল, মিষ্টি আর পাথরের গ্লাসে রাখা আছে দুগ্ধজাত কোনো প্রকার পানীয়। গায়ের চাদরটা খুলে শমিতের পাশে বসলেন রাজারাম। তার গায়ে একটা সোনালি জরির পিরানের মতো জামা। গলার কাছে ফিতে দিয়ে বাঁধা। জিনিসটা পুরানো হলেও জামাটাতে বেশ একটা আভিজাত্য আছে। শমিত নিজেও শৌখিন ছেলে। রাজারামের পোশাকটা দেখে এক টুকরো ফল মুখে ফেলে সে তারিফ করে বলল, ‘বাঃ আপনার জরির পোশাকটা তো বেশ। এ ধরনের পোশাক এখনও এখানে পাওয়া যায়?’
রাজারাম মৃদু হেসে বললেন, ‘সম্ভবত পাওয়া যায় না। তবে আপনি যেটা জরি বলে ভাসছেন তা আসলে হল সোনার সুতো।’
কথাটা শুনে শমিত বিস্মিতভাবে বলল, ‘সোনার সুতো। আপনি তো খুব ধনী লোক তবে। এসব জিনিস তো এক সময় রাজা—মহারাজরা পরতেন বলে শুনেছি।’
রাজারাম বললেন, ‘ঠিকই শুনেছেন, তবে আমি ধনী নই, সাধারণ সৈনিক মাত্র। আসলে এ পোশাকটার মালিক ছিলেন জয়মল নামে এক ধনী ব্যবসায়ীর। তিনি এ পোশাকটা দিয়েছিলেন এক সেনাপতিকে, আর তার থেকে আবার আমি এ পোশাকটা পাই।’
শমিত সেই দুধের পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, ‘এ বাড়িটাকে বাহিরে থেকে দেখে ভূতুড়ে বাড়ি বলে মনে হয়। কেউ যে এ বাড়িতে থাকেন বোঝাই যায় না। এত বড় বাড়িতে আপনার একলা থাকতে ভয় করে না?’ আমি ভূত—প্রেতের কথা বলছি না, চোর—ডাকাতের কথা বলছি।’
কথাটা শুনে রাজারাম বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। এই বাড়িটাকে বাহিরে থেকে ভূতুড়ে বাড়ি বলে মনে হওয়াতে লোকজন এ বাড়ির কাছে ঘেঁষে না। তাছাড়া আমি আর্মির লোক, আমাদের সাহস অন্য মানুষদের থেকে একটু বেশি। তাই একলা থাকতে ভয় করে না। তবে একলা থাকতে যে একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগে তা অস্বীকার করি না। বাড়ির বাইরে আর বিনা প্রয়োজনে কতক্ষণ ঘুরে বেড়ানো যায়। হাবেলিতে থাকি আমি।’
কথা চলতে লাগল দু—জনের মধ্যে। রাজারাম শমিতের কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলেন, শমিত ঠিক কোথায় থাকে, বাড়িতে কে কে আছেন, সে কী কাজ করে ইত্যাদি। শমিত তার কথার জবাব দিতে দিতে পালটা প্রশ্নও করতে লাগল।
অনেকটা ঘোলের মতো দেখতে সুস্বাদু পানীয়টা শমিত যখন পুরো শেষ করল, তারপর যেন একটু মাথা ঝিমঝিম শুরু হল শমিতের। নিজের গায়ের আতরের গন্ধটাও নাকে আসতে লাগল তার। শমিত তাকে জিজ্ঞাসাই করে বসল, ‘পানীয়টা কী মশাই? খাবার পর দেখছি বেশ একটা আমেজ আসছে!’
রাজারাম জবাব দিলেন, ‘মালাই দেওয়া ভাঙের শরবত। এ পানীয় আমাদের আর্মির মধ্যে এক সময় খুব চালু ছিল। অতিথি আপ্যায়নের এটা একটা পুরানো রীতি।’
পানীয়টাতে ভাঙ মেশানো আছে শুনে শমিত একটু ভয় পেয়ে গিয়ে বলল, ‘এই শরবত খেয়ে আমার কিছু হবে না তো? আমাকে কিন্তু হোটেলে ফিরতে হবে।’
রাজারাম বললেন, ‘না, হবে না। আমি যে ব্যাটেলিয়নে ছিলাম, সেখানে বড় বড় চৌবাচ্চাতে এ শরবত বানানো হত। সব সময় তো আর যুদ্ধ থাকত না, অবসরের দিনগুলোতে সবাই মিলে আমোদ করে খেতাম। এখনও সে সব দিনগুলোর কথা মনে পড়ে।’
কথা চলতে লাগল তাদের দুজনের মধ্যে। বাহিরে রাত বেড়ে চলল। এক সময় শমিত তাকে প্রশ্ন করল, ‘এই যে একলা বাংলা ছেড়ে এতদূরে পড়ে আছেন আপনার দেশে ফিরতে ইচ্ছা করে না? বাড়ির লোকের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে?’
রাজারাম প্রথমে জবাব দিলেন, ‘না, নেই। তারা আমার ঠিকানা জানে না।’
এ কথা বলার পর একটু চুপ করে থেকে রাজারাম তাকে বললেন, ‘আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে রাখবেন? যদি রাখেন তবে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব আপনার কাছে। তাতে আমার পাপস্খলন হবে।’
মৃদু বিস্মিত হয়ে শমিত জানতে চাইল, ‘কী অনুরোধ?’
আবারও একটু চুপ করে থাকার পর রাজারাম বললেন, ‘আপনাকে তো বলেইছিলাম বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে ফৌজে যোগ দিয়েছিলাম। এই সময় আমাদের পরিবারের করুণ অবস্থা ছিল। বিধবা মা, ছোট ভাই—বোন। একবেলা খাওয়া জোটে তো অন্য বেলা জল খেয়ে কাটাই। যেদিন রাতে আমি বাড়ি ছেড়েছিলাম, সেদিন আমি একটা অন্যায় কাজ করেছিলাম। সে যন্ত্রণা আমি আজও বুকে নিয়ে বেড়াই। সেই অন্যায় কাজটা হল আমার মায়ের তোরঙ্গতে তার শেষ সম্বল দুটো পুরানো রুপোর টাকা ছিল। বাড়ি থেকে পালাবার আগে সে টাকা দুটো চুরি করেছিলাম আমি। জীবনে সেটাই আমার প্রথম ও শেষ চুরি।’ হয়তো বা সেদিন ঠিক চুরি বলেও ভাবিনি। আমি ভেবেছিলাম, আমার চাকরি হবার পর যখন আমি ছুটিতে বাড়ি ফিরব তখন আমি তার দশ গুণ ফিরিয়ে দেব। কিন্তু সে ছুটি আর কোনোদিন মিলল না আমার। আজ নিজের খুব অপরাধ বোধ হয় সে কাজের জন্য। হয়তো বা আমি চলে আসার পর আমার মা, ভাই—বোনকে ভিক্ষা করে কাটাতে হয়েছে। এই রুপোর টাকা দুটো থাকলে তারা হয়তো আরও কয়েকটা দিন একবেলা খেতে পারত।’
একথা বলে একটু থেমে রাজারাম বললেন, ‘আমার অনুরোধ হল, আপনি তো আমার বাড়ির কাছাকাছিই থাকেন। আমি আপনাকে কিছু টাকা দেব। এত বছর পর আমার মা, নিশ্চয়ই আর জীবিত নেই। কিন্তু আমার পরিবারের অন্য কেউ যদি সেখানে থাকে তাদের হাতে যদি আপনি টাকাটা পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করেন তবে আমি কৃতজ্ঞ থাকি। আমার মনের যন্ত্রণা তাতে লাঘব হবে।’
রাজারামের কথা শুনে শমিত ইতস্তত করে বলল, ‘আপনি আমার হাত দিয়ে টাকা পাঠাতে চান। কিন্তু আপনি তো আমাকে ঠিক চেনেনই না। আপনি ডাকেও তো টাকাটা পাঠাতে পারতেন?’
রাজারাম বললেন, ‘ডাকে ও টাকা পাঠাতে আমি ভরসা পাই না। আপনার সঙ্গে আমার স্বল্প পরিচয় হলেও আমি মানুষ চিনি। আপনি অন্যের টাকা আত্মসাৎ করার মতো মানুষ নন। দয়া করে আপনি অনুরোধটা রাখুন। সত্যি কথা বলতে কী আপনাকে এখানে আমন্ত্রণ জানানোর পিছনে আমার মনে এ ভাবনাটাও ছিল। এতক্ষণ বলব বলব করেও ঠিক বলে উঠতে পারছিলাম না।’
শমিত বলল, ‘কিন্তু এত বছর পর যদি আমি তাদের সন্ধান না পাই তখন কী হবে? তারা তো অন্য কোথাও চলেও যেতে পারেন এতদিনে?’
ভূতপূর্ব সৈনিক রাজারাম বললেন, ‘আমার বাড়ির নাম আপনাকে বলেছি— শিবালয়। বাড়ির ভিতর শিব মন্দির আছে। ভট্টপল্লীর পাশে নৈহাটিতে গঙ্গার গায়ে পুরানো দিনের বিরাট বাড়ি। মায়ের নাম ছিল কুসুমসুন্দরী দাসী। সত্যি কথা বলতে গেলে ভাই—বোনের নাম আমার আর তেমন মনে নেই। যদি আপনি সে বাড়ির খোঁজ আর না পান, তবে টাকাগুলো কোনো অনাথ আশ্রম বা ওই ধরনের কোথাও দান করে দেবেন। আমাকে আর ও টাকা ফেরত পাঠাবার দরকার নেই। ও টাকার আজ আর কোনো প্রয়োজন নেই আমার।’
ভাঙের প্রভাব ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। মাথাটা যেন আরও বেশি ঝিম লাগছে শমিতের। কিছুটা ভাঙের ঘোরে, কিছুটা রাজারামের অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে শমিত বলল, ‘ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করব টাকাটা পৌঁছে দিতে।’
কথাটা শুনে রাজারামের মুখে হাসি ফুটে উঠল। খোলা দরজাটার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে রাজারাম বলল, ‘সে এখানে আসার আগে আমি আপনাকে টাকাগুলো বুঝিয়ে দেই। একটু অপেক্ষা করুন, আমি আসছি।’
শমিত জানতে চাইল, ‘কে আসবে?’
তার কথার জবাব না দিয়ে রাজারাম অন্য একটা দরজা দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল শমিত। এক সময় তার যেন মনে হতে লাগল যে অনন্ত সময় ধরে যেন রাজারামের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। নেশাটা বেশ চড়েছে। সে কারণে এমন মনে হচ্ছে নাকি সত্যি দীর্ঘ সময় ধরে রাজারামের ফেরার অপেক্ষায় বসে শমিত তা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না।
৬
এক সময় প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। ঘরে ঢুকলেন রাজারাম। তার হাতে একটা চামড়ার ছোটো থলি। দরজার দিকে তাকিয়ে থলিটা নিয়ে রাজারাম শমিতের মুখোমুখি বসলেন। তারপর থলিটার ফিতে খুলে সেটা উপুড় করল শমিতের সামনের ফরাসে। মৃদু ঝনঝন শব্দ করে ছড়িয়ে পড়ল, একটু ছোট আকারের আধুলির মতো মুদ্রাগুলো। শমিত একটা মুদ্রা তুলে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে বলল, ‘আরে! এত রুপোর টাকা বলে মনে হচ্ছে!’
রাজারাম হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, মিউটিনির আমলের রুপোর সিক্কা। একশো সিক্কা আছে। বহুদিন ধরে নিজের কাছে আগলে রেখেছিলাম।’
শমিত বলল, ‘একশো সিক্কা হলেও রুপোর মূল্যে এর দাম অন্তত তিরিশ হাজার টাকা হবে!’
রাজারাম দরজার দিকে চোখ রেখে বললেন, ‘তেমন যদি হয় তাহলে তো আরও ভালো!’
তার সামনে ছড়িয়ে থাকা সিক্কাগুলোর মধ্যে আরও একটা জিনিস দেখতে পেয়ে শমিত সেটা উঠিয়ে নিল। ডিম্বাকৃতি ধরনের একটা পিতলের চাকতি। ইঞ্চি তিনেকের লম্বা চাকতিটার দু—প্রান্তে সুতো বা দড়ি বাঁধার জন্য ছিদ্র আছে। শমিত প্রশ্ন করল, ‘এটা কী?’
রাজারাম বললেন, ‘যখন ফৌজে ছিলাম তখন ওটা হাতে বাঁধতাম। দেখুন ওর গায়ে রেজিমেন্টের নাম লেখা আছে।’
চোখটা একটু ঝাপসা লাগছে। শমিত পুরানো চাকতিটা চোখের সামনে তুলে ধরে লেখাটা পড়ে বলল, ‘বি.আর.ফর্টি সিক্স।’
রাজারাম বললেন, ‘হ্যাঁ, টাকাগুলোর সঙ্গে ব্যাজটাও ওদের দিয়ে দেবেন। যাতে ওরা বুঝতে পারে যে সত্যি আমি ফৌজে ছিলাম। রুপোর টাকা দুটোর মতো এক সিক্কাগুলো আমি চুরি করিনি।’ —কথাগুলো বলে রাজারাম খোলা দরজার দিকে তাকাতে তাকাতে সেই পিতলের চাকতি সমেত রুপোর সিক্কাগুলো চামড়ার থলেতে ভরে ফেললেন। তারপর সেটা শমিতের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি এটা আপনার পোশাকের ভিতর পুরে ফেলুন। সে এসে পড়ল বলে!’
শমিত সেই ছোট থলিটা কোটের ভিতর পুরে ফেলে বলল, ‘কে আসবেন? অনেক রাত হল। এবার কিন্তু আমাকে ফিরতে হবে।’
রাজারাম শমিতের কথার জবাবে বললেন, ‘ওই, যে আপনাকে অনুসরণ করে আসছে। আমি জানতাম ও আপনার পিছনে আসবে। সেজন্যই তো আপনাকে আমি এখাতে আসতে বলেছিলাম। আপনার সাথে সাথে ওকে আমার কাছে টেনে আনলাম।’
শমিত বলল, ‘আপনি কী বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!’
কিন্তু তার এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রাজারাম উত্তেজিতভাবে দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, সে আসছে! আসছে!’ কথাগুলো বলে রাজারাম উঠে দাঁড়ালেন, তারপর ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে গিয়ে চিকের পর্দার আড়ালে অন্য একটা ঘরের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
রাজারামকে অমনভাবে অন্য ঘরে অদৃশ্য হতে দেখে শমিতও উঠে দাঁড়াল। ব্যাপারটা কী হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছে না সে। শমিত এরপর রাজারামের উদ্দেশ্যে হাঁক দিতে যাচ্ছিল, ‘রাজারাম বাবু কোথায় গেলেন?’ কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার কাছে একটা অস্পষ্ট আওয়াজ শুনে সেদিকে তাকিয়ে শমিত দেখল মিশেমিশে কালো রঙের দানবাকৃতির কুকুর প্রবেশ করছে ঘরের মধ্যে।
বিলাতি কুকুরটা ঘরে ঢুকে প্রথমে থমকে দাঁড়িয়ে বাতাসের ঘ্রাণ নিল, তারপর স্থির দৃষ্টিতে তাকাল শমিতের দিকে। কুকুরটার গলাতে বকলস আছে। অর্থাৎ এটা কারও পোষা প্রাণী। কুকুরটাকে দেখেই দুপুরবেলা কবরখানাতে দেখা কুকুরটার কথা মনে পড়ল শমিতের। সম্ভবত এটাই সেট কুকুর। সে মুখ দিয়ে চকচক শব্দ করল কুকুরটার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তার পরিবর্তে কুকুরটার গলা থেকে শমিতের প্রতি ঘৃণা সূচক একটা তীব্র গর্জন বেরিয়ে এল প্রাণীটার গলা থেকে!
শমিত ব্যাপারটাতে একটু দমে গেলেও এরপর মৃদু শিষ দিল কুকুরটাকে লক্ষ্য করে। আর সেই শিষ শুনে শান্ত হবার পরিবর্তে দ্বিগুণ শব্দে গর্জে উঠে কুকুরটা তার হিংস্র দাঁতগুলো বার করল!
শমিতের মনে পড়ল, রাজারাম তাকে বলেছিলেন, কুকুরটা নাকি সুবিধার নয়!
শমিতের কথাটা মাথায় আসতেই সে ভাবল, কুকুরটাকে আর ঘাঁটানোর দরকার নেই। সে নিশ্চুপ ভাবে তাকিয়ে রইল বিশাল কুকুরটার দিকে। কুকুরটাও তাকিয়ে আছে শমিতের দিকে।
শমিত কুকুরটার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল ধীরে ধীরে শমিতের প্রতি একটা জান্তব আক্রোশ যেন সঞ্চারিত হচ্ছে কুকুরটার মধ্যে। প্রাণীটার চোখ দুটো আগুনের গোলার মতো জ্বলতে শুরু করেছে! আর এরপরই চাপা গর্জন করতে করতে মিশমিশে কালো রঙের কুকুরটা এক পা, এক পা করে এগিয়ে আসতে লাগল শমিতের দিকে! লাল লম্বা জিভ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা লালা ঝরছে প্রাণীটার। ধবধবে সাদা হিংস্র দাঁতগুলো যেন এগিয়ে আসছে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা শমিতের টুটি ছিঁড়ে ফেলার জন্য কুকুরের এমন ভয়ংকর রূপ এর আগে কোনোদিন শমিত দেখেনি! পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল শমিত। তার সাত—আট হাত দূরে এসে থমকে দাঁড়িয়ে প্রাণীটা শমিতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে তাকে যেন শেষ একবার জরিপ করে নিতে চাইল। শমিত তার একটা হাত দিয়ে নিজের গলাটা আড়াল করল। প্রাণীটা সত্যিই তার ওপর ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তে পাশের ঘর থেকে তলোয়ার হাতে ছুটে বেরিয়ে এসে তাদের দুজনের মধ্যে এসে দাঁড়ালেন রাজারাম। তাকে দেখা মাত্রই একটা বিজাতীয় আক্রোশে রক্ত জল করা একটা চিৎকার বেরিয়ে এল কুকুরটার গলা থেকে। আর তারপরই দানব কুকুরটা লাফ দিল রাজারামকে লক্ষ্য করে। শূন্যে ভাসমান অবস্থাতেই কুকুরটার মাথা তলোয়ারের কোপে আলাদা হয়ে ধড়—মুন্ডু ছিঁটকে পড়ল ঘরের দু—দিকে। মাটিতে পড়ে থাকা মুন্ডুটার দিকে তাকিয়ে রাজারাম অট্টহাস্য করে বলে উঠলেন, ‘এত দিনে আমি শান্তি পেলাম। এই দিনটার জন্য আমি যুগ যুগ ধরে প্রতীক্ষায় ছিলাম। আমি জানতাম ও আসবে, আসবেই। আমি আজ প্রতিশোধ নিলাম।’
শমিত বিস্মিতভাবে বলে উঠল, ‘কিসের প্রতিশোধ?’
কিন্তু রাজারাম কোনো উত্তর দেবার আগেই হুড়মুড় করে ঘরে প্রবেশ করল একদল লোক। লোকগুলোকে দেখে হতবাক হয়ে গেল শমিত। যেন ইতিহাস বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে তারা। গোরা সৈন্য অর্থাৎ সাহেব সৈন্যর দল। তাদের পোশাক সেই মিউটিনির সময়ের। কাঁধে সোনালী সুতোর ঝালর আর বড়ো বড়ো ধাতব বোতাম আঁটা লাল রঙের জামা, কোমরবন্ধ থেকে ঝুলছে তলোয়ার, পিঠে সঙিন বা ছুরির ফলা বসানো বন্দুক, পায়ে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা জুতো। লোকগুলো ঘরে ঢুকেই কাঁধের বন্দুক খুলে সঙিন উঁচিয়ে ঘিরে ফেলল তাদের দুজনকে। তাদের মধ্যে সেনাধ্যক্ষ গোছের যে লোকটা ছিল, সে মাটিতে পড়ে থাকা কুকুরটার ছিন্ন মুন্ডুটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘ও মাই গড! আমার কুকুরটাকে মারল কে?’
তার কথার জবাবে রাজারাম বলে উঠলেন, ‘আমি মেরেছি। তোমার নাম সিম্পসন। আর ওটা যে তোমার কুকুর তা আমি জানি।’
কথাটা শুনে সেনাধ্যক্ষ সিম্পসন রাজারামকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি কে?’
মুহূর্তর জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এল ঘরে। রাজারাম জবাব দিলেন, ‘তোমরা যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছ, আমি সেই লোক, ধুন্ধ পন্থ। লোকে আমাকে ডাকে নানা সাহেব নামে।’
কথাটা শুনে সিম্পসন সাহেব সহ ঘর শুদ্ধ লোক চমকে উঠল। চমকে উঠল শমিতও। তার চোখের সামনে যা ঘটছে, সে যা দেখছে শুনছে তা কি সত্যি? নাকি ভাঙের নেশাতে ভুল দেখছে সে?’
রাজারামের পরিচয় জানার পর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে সিম্পসন সাহেব বলে উঠল, ‘ধরো তাকে, বেঁধে ফেলো।’
সৈন্যধ্যক্ষের নির্দেশ পেয়ে চার—পাঁচ জন গোরা সৈন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজারাম অথবা নানা সাহেবের ওপর। একটা ঝটাপটি হল ঠিকই কিন্তু একজন মানুষের পক্ষে অতগুলো লোকের সঙ্গে এঁটে ওঠা সম্ভব নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজারামের হাত দুটো পিছ মোড়া করে তারা বেঁধে ফেলল। একজন লোক এরপর শমিতকে দেখিয়ে সিম্পসনকে বলল, ‘এই লোকটাকে কী করব?’
সিম্পসন জবাব দিল, ‘আগে ভয়ংকর লোকটার ব্যবস্থা করি তারপর এই নেটিভটাকে দেখছি।’
একথা বলে সিম্পসন, নিজেকে নানা সাহেব বলে পরিচয় দেওয়া রাজারামকে দেখিয়ে বলল, ‘ওকে সেনাপতি হ্যাভলকের কাছে জ্যান্ত নিয়ে যেতে পারলে ভালো হত, কিন্তু ওর লোকজন আশেপাশে লুকিয়ে থাকতে পারে। অন্ধকারের মধ্যে তারা ওকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে পারে। লোকটাকে কড়ি কাঠ থেকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দাও। তারপর ওর মুন্ডুটা কেটে নিয়ে গিয়ে সেনাপতি হ্যাভলককে উপহার দেব।’
কথাটা শুনে রাজারাম ওরফে নানা সাহেব কিছু বললেন না। তার ঠোঁটের কোণে একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল। সৈন্যধ্যক্ষের নির্দেশ পালন করতে কাজে নেমে পড়ল তার সৈন্যরা। ছাদের কড়ি কাঠের মধ্যে দিয়ে প্রথমে একটা মোটা রশি গলিয়ে দিয়ে তার এক প্রান্তে একটা ফাঁস তৈরি করে যুক্ত করে সেটা পরিয়ে দেওয়া হল রাজারামের গলাতে। তিনজন সৈনিক ধরে রইল দড়ির ওপর প্রান্ত। চোখের ইশারাতে এরপর শেষ নির্দেশ দিল সিম্পসন। সঙ্গে সঙ্গে দড়ি ধরে টানতে শুরু করল সেই তিনজন সৈনিক। মুহূর্তের মধ্যে মাটি থেকে শূন্যে উঠে গেল নানা সাহেব পরিচয় দেওয়া রাজারামের দেহটা। শূন্যে ছটফট করতে লাগল তার শরীরটা। বিভৎস দৃশ্য। ঠিক সেই মুহূর্তে সম্বিত ফিল শমিতের। সে বুঝতে পারল, পালাবার চেষ্টা করতে হবে তাকে। সিম্পসন সাহেব সহ অন্যরা তাকিয়ে আছে ছটফট করতে থাকা দেহটার দিকে, কখন তা স্থির হয়ে যায় তা দেখার প্রত্যাশাতে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়া মিউটিনির নেতা নানা সাহেবকে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে তারা! শমিতের দিকে তাদের খেয়াল নেই। আর তাদের এই অসতর্ক মুহূর্তের সুযোগ নিয়ে খোলা দরজার দিকে তীব্র বেগে ছুটল শমিত। তার বুকের ভিতর থেকে সিক্কার থলেটা ছিটকে পড়ল মাটিতে। থলের মুখ খলে রুপোর সিক্কাগুলো ঝন ঝন শব্দে ছিটকে পড়ল মাটিতে। সিম্পসন চিৎকার করে উঠল, ‘ধরো ওকে। পালাচ্ছে লোকটা।’
দুজন গোরা সৈনিক শমিতের পিছু ধাওয়া করল। সিঁড়ি বেয়ে নীচে উঠোন পেরিয়ে বাহিরে পালাবার জন্য ছুটল শমিত। তার পিছনে ধেয়ে আসছে গোরা সৈনিকরা। হাবেলির বাহিরে বেরিয়ে এল শমিত, তারপর ছুটতে শরু করল রাস্তা ধরে। একটু এগিয়েই সে দেখল, উলটো দিক থেকে কারা যেন আসছে। নিশ্চয়ই ওরাও গোরা সৈনিক হবে। এবার কোথায় পালাবে শমিত। আর এরপরই রাস্তায় পড়ে থাকা একটা পাথরের টুকরোতে হোঁচট খেয়ে ছিঁটকে পড়ল শমিত।
জলের ছিটতে জ্ঞান ফিরল শমিতের। রাস্তার মাঝখানেই সে পড়ে আছে। তবে চোখ মেলে সে দেখল তারা কেউ গোরা সৈনিক নয়। পবন সিং আর তার সঙ্গে কয়েকজন লোক। শমিত উঠে বসে একটু ধাতস্থ হবার পর পবন সিং তাকে বলল, ‘কী হয়েছে আপনার?’ রাত এগারোটার সময় হোটেলের ম্যানেজার আমাকে টেলিফোন করে বলল, ‘আপনি আতর মহল্লায় আসবেন বলে হোটেল থেকে বেরিয়েছেন, কিন্তু ঘণ্টা খানেক বাদে ফেরার কথা থাকলেও ফেরেননি। খবরটা শুনে আমি দুশ্চিন্তায় পরে লোকজন নিয়ে আপনাকে এখানে খুঁজতে এসে দেখি আপনি রাস্তার মাঝখানে পড়ে আছেন!’
শমিতের চোখের সামনে এখনও ভেসে আছে সেই দৃশ্য—নিজেকে নানা সাহেব বলে পরিচয় দেওয়া রাজারামের দেহটা শূন্যে ছটফট করছে! তার কানে বাজছে তার পিছনে ধেয়ে আসা গোরা সৈনিকদের পায়ের শব্দ! কিন্তু শমিত যা দেখল তা কি সত্যি? নাকি ভাঙের শরবতের প্রভাব? —এখনও শমিত বুঝে উঠতে পারছে না কিছু! তবে শমিতের মনে হল, পবন সিং—কে কথাগুলো বললে সে নিশ্চয়ই তাকে পাগল ভাববে। তাই সে জবাব দিল, ‘এখানে এক বাঙালি ভদ্রলোকের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছিলাম। তিনি ভাঙের শরবত খেতে দিয়েছিলেন।’
কথাটা শুনেই পবন সিং বললেন, ‘ও, ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি। হোটেলে ফিরে কাল একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমালেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাঙের নেশা ছেড়ে যাবে। আমি ভাবছিলাম আপনি কোনো চোর—ডাকাতের খপ্পবে পড়েছেন কিনা? নিন, উঠে পড়ুন।’
শমিত এবার উঠে দাঁড়াল। আতর মহল্লার প্রবেশ পথেই দাঁড়িয়ে ছিল পবন সিং—এর গাড়ি, তাঁর এবং তাঁর সঙ্গীদের সাথে শমিত সেই গাড়িতে চেপে বসল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাঝরাতে শমিত পৌঁছে গেল তার হোটেলে। তাকে হোটেলের রুমে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেবার আগে পবন সিং—তাকে জানিয়ে গেলেন, আগের কথা মতোই পরদিন সন্ধ্যায় তিনি আবার আসবেন শমিতকে রেলস্টেশনে পৌঁছে দেবার জন্য।
৭
পরদিন বেশ বেলাতেই ঘুম ভাঙল শমিতের। ঘুম ভাঙার পরই সে ভাবতে লাগল সেই বৃদ্ধ দোকানির দোকান থেকে খস গুলাব আতর মেখে বেরিয়ে রাজারামের সঙ্গে সাক্ষাত হবার পর থেকে পরবর্তী পর্যন্ত ঘটনার কথা। সে ভাবতে লাগল, এত বড় ঘটনাটা কীভাবে সম্পূর্ণ মিথ্যা হবে? তা হতে পারে না। হঠাৎ তার মনে হল এখন তো দিনের বেলা, অতএব মহল্লাতে এখন গেলে কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। বৃদ্ধ আতর বিক্রেতা ফিরদৌস হয়তো বা তাকে ওই বাড়িটার ব্যাপারে বা রাজারামের সম্বন্ধে কিছু জানাতে পারে তাকে। —এ কথা ভেবে শমিত সিদ্ধান্ত নিল যে আবার আতর মহল্লাতে যাবে। কিছুক্ষণের মধ্যে শমিত হোটেলেরই একটা গাড়ি নিয়ে রওনা হল আতর মহল্লার দিকে।
শমিত যখন আতর মহল্লাতে পৌঁছল তখন বেলা বারোটা। জমজমাট ভিড়, ক্রেতা বিক্রেতাদের হাঁকডাকে মুখরিত আতর মহল্লা। তাছাড়া গত রাতে একটা ঘটনা ঘটেছে এখানে, তা দেখবার জন্য বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে আতর মহল্লাতে। গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে এগিয়ে শমিত দেখতে পেল দৃশ্যটা! গত রাতে শমিত যে বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিল, বটগাছটাকে উপড়ে নিয়ে ভেঙে পড়েছে সেই হাবেলি! কৌতূহলী জনতার ভিড় সেই ধ্বংসস্তূপের সামনে। ভিড় সামলাতে কয়েকজন পুলিশও উপস্থিত হয়েছে সেখানে। বিস্মিত শমিত হাবেলির ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানাল ভোর রাতে সূর্যের আলো ফোঁটার ঠিক আগে নাকি প্রচণ্ড শব্দ করে ভেঙে পড়েছে অতি প্রাচীন এই হাবেলি। শমিত এরপর আর সেখানে দাঁড়াল না, সে হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণের মধ্যেই গিয়ে উপস্থিত হল বৃদ্ধ ফিরদৌসের দোকানে।
বৃদ্ধ ফিরদৌস দোকানে নিজের জায়গাতেই বসেছিলেন। শমিত দোকানে ঢোকার পর তিনি তাকে চিনতে পেরে বললেন, ‘আইয়ে জনাব আইয়ে। তসরিফ রাখিয়ে।’
শমিত বলল, ‘আজ কানপুর ছেড়ে চলে যাচ্ছি। যাবার আগে আপনাদের মহল্লাতে একটু বেড়াতে এলাম। ভাবলাম আপনার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই।’
শমিতের কথা শুনে বৃদ্ধর বলিরেখাময় মুখে হাসি ফুটে উঠল। কাউন্টারের মতো ঘেরা জায়গাটার বাইরে একটা টুল রাখা ছিল, তাতে বসল শমিত। বৃদ্ধ আতর অলা আগের দিনের মতোই শমিতকে কাঁসার গ্লাসে ঠান্ডা জল দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। জল পান করার পর গ্লাসটা নামিয়ে রেখে শমিত তাঁকে বলল, ‘আপনাদের মহল্লাতে বটগাছের পাশে যে পুরানো হাবেলিটা ছিল সেটা ভেঙে পড়েছে দেখলাম।’
বৃদ্ধ ফিরদৌস একটু হতাশভাবে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিও শুনলাম। এই মহল্লাতে আমার এই দোকানটা যেমন সবথেকে পুরানো, তেমনই আতর মহল্লার সব থেকে পুরানো বাড়ি ছিল ওটা। সিপাহি জং আমলের বাড়ি। ওকে আমরা ডাকতাম তাম ‘ইমানদার হাবেলি’ নামে। এ শহর থেকে পুরানো সব চিহ্ন একে একে মুছে যাচ্ছে।’
শমিত বলল, ‘ইমানদার হাবেলি।’ বেশ অদ্ভুত নামতো! এ নামের পিছনে কোনো গল্প আছে নাকি?’
বৃদ্ধ ফিরদৌস বলল, ‘হ্যাঁ, জনাব। আর তার সঙ্গে খস গুলাব আতরের ব্যাপারটাও জড়িয়ে আছে। ওই বাড়িতেই নাকি শেষবারের জন্য দেখা গেছিল নানা সাহেবকে। তারপর তিনি কানপুর থেকে উধাও হয়ে যান। পরবর্তীকালে কোথাও তাঁর খোঁজ মেলেনি। তবে ও বাড়িটার নাম ‘ইমানদার হাবেলি’ হয়েছিল এক ইমানদার সিপাহির জন্য।’
কথাটা শুনেই শমিত সোজা হয়ে বলল, ‘সেটা কি গল্প, বলুনতো?’
প্রশ্ন শুনে একটু চুপ করে থেকে চশমাটা একটু ঠিক করে নিয়ে বৃদ্ধ ফিরদৌস বলতে শুরু করলেন— ‘ওই পুরানো কাহানী আমি শুনেছিলাম আমার দাদা—পরদাদার মুখে। বংশ পরম্পরায় চলে আসা ঠিক মিউটিনির সময়কার কাহানী। সে সময় কানপুর সেনা ছাউনিতে থাকত ফর্টি সিক্স বেঙ্গল ইনফেন্ট্রি রেজিমেন্ট। বহু বাঙালি ছিল সেই রেজিমেন্টে। যুদ্ধ যখন সারা দেশে সেই সময় ছড়িয়ে পড়ল তখন ওই বাঙালি রেজিমেন্ট কানপুরের দখল নিল এখানে উপস্থিত হওয়া নানা সাহেবের নেতৃত্বে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আবার ক্যাপ্টেন হ্যাভলক বিশাল ফৌজ নিয়ে এসে কানপুরের দখল নিলেন। পিছু হটল বাগী সিপাহিরা। তাদের মধ্যে যারা পালাতে পারল তারা বাঁচল, আর যারা পারল না তাদের তোপের মুখে বেঁধে উড়িয়ে দিতে লাগল কোম্পানি। নানা সাহেব তখনও কানপুর শহর থেকে পালাতে পারেননি। ব্যাপারটা অনুমান করে কোম্পানির লোকেরা পাগলের মতো খুঁজে বেড়াতে লাগল কানপুর মিউটিনির মাথা নানা সাহেবকে। হাজার টাকা মাথার দাম ঘোষণা হল তাঁর। হ্যাভলক সাহেব, নানা রাওকে ধরার মূল দায়িত্ব দিয়েছিলেন সিম্পসন নামে তার অনুচরকে। সিম্পসনের একটা বিরাট বড় বিলাতি কুকুর ছিল…।’
শমিত এবার চমকে উঠল। বৃদ্ধ ফিরদৌস আবার বলতে শুরু করলেন, ‘হ্যাঁ, নানা সাহেব, তখন কানপুরেই ছিলেন। আপনি হয়তো শুনে থাকবেন, নানা সাহেব ছদ্মবেশ ধারণে পটু ছিলেন। বিভিন্ন রকম ছদ্মবেশ ধারণ করে তিনি কোম্পানির ফৌজের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে শহরের বিভিন্ন জায়গাতে আত্মগোপন করে বেড়াতে লাগলেন। একদিন তিনি জয়মল নামে এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন শহরের অপর প্রান্তে। কিন্তু সে খবর পৌঁছে গেল কোম্পানির কাছে। সিম্পসন সাহেব তার সঙ্গী কুকুরটা ও গোরা সৈন্যদের নিয়ে জয়মলের হাবেলির দিকে রওনা হল নানাজীকে ধরার জন্য। কিন্তু ভাগ্যক্রমে নানা সাহেবও জানতে পারলেন ব্যাপারটা। আঙরাখাটা খুলে তিনি জয়মলের দেওয়া একটা পোশাক পড়ে নতুন ছদ্মবেশ ধারণ করে রওনা হলেন অন্য এক আস্তানার দিকে। যেখানে বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক বিশ্বস্ত সৈন্য তার জন্য অপেক্ষা করছে। নানা সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন সে জায়গাতে গিয়ে মাঝরাত পর্যন্ত লুকিয়ে থাকার পর সেই বাঙালি যোদ্ধাকে সঙ্গী করে সে রাতে কানপুর ত্যাগ করবেন। ব্যবসায়ী জয়মলের হাবেলি ত্যাগ করে তিনি যে আস্তানার দিকে রওনা হলেন তা হল ওই ভেঙে পড়া বাড়িটা।’
নানা সাহেব শেঠ জয়মলের বাড়ি ত্যাগ করার কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে হাজির হল কোম্পানির সিম্পসন। বৃদ্ধ জয়মল প্রথমে স্বীকার করতে চাননি যে নানা সাহেব সেখানে কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন। তার থেকে কথা বার করার জন্য সিম্পসন তার তিন ছেলেকে ফাঁসিতে লটকে দিলেও তিনি চুপ করে ছিলেন। কিন্তু শয়তান সিম্পসন যখন জয়মলের বংশের শেষ প্রদীপ তাঁর পাঁচ বছরের নাতিটাকে তলোয়ারের কোপে কাটতে উদ্যত হল তখন জয়মল তার নাতিকে বাঁচাবার জন্য সত্যি কথা বলে দিলেন। হ্যাঁ, নানা সাহেব তার বাড়িতে এসেছিলেন এবং তার দেওয়া পোশাক পরে ছদ্মবেশে বেরিয়ে গেছেন। তবে তিনি কোথায় গেছেন তা তাঁর জানা নেই।
সিম্পসন ভাবতে লাগল কীভাবে নানা সাহেবের সন্ধান পাওয়া যায়। হঠাৎ ধূর্ত সিম্পসনের মাথাতে একটা বুদ্ধি এল। জয়মলের শরীরে, তার ঘরে আতরের গন্ধ ভুরভুর করছে। সিম্পসন, জয়মলকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি সব সময় আতর মাখো? কী আতর? শিশিটা দাও?’
জয়মল বলল, ‘হ্যাঁ, মাখি। আব্দুল আলির খস গুলাব আতর।’
তিনি শিশিটা তুলে দিলেন সিম্পসনের হাতে। ধূর্ত সিম্পসন সেই আতরের শিশিটা তার কুকুরকে শুকিয়ে ছেড়ে দিলেন রাস্তাতে। মালিকের ইঙ্গিত পেয়ে কুকুর ছুটল সেই আতরের গন্ধের সন্ধানে। আর তার পিছনে সিম্পসন সহ তার সৈন্যরা।
নানা সাহেব পৌঁছে গেছিলেন আতর মহল্লার হাবেলিতে। তিনি আর তার বিশ্বস্ত এক বাঙালি সৈনিক রাজারাম হাবেলিতে অপেক্ষা করছিলেন মধ্যরাত হবার জন্য। কিন্তু সে সময় আসার আগেই বাড়ির বাইরে তারা কুকুরের ডাক শুনতে পেয়ে দেখতে পেলেন সিম্পসনের কুকুরটাকে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তারা বুঝতে পারলেন কি ভাবে কুকুরটা সে হাবেলিতে পৌঁছেছে। এখন উপায়? নানা সাহেবতো এ পোশাকে যেখানে যাবেন সেখানেই আতরের গন্ধ অনুসরণ করে পৌঁছে যাবে কুকুরটা আর কোম্পানি সেনারা। কিন্তু নানা সাহেবকে বাঁচার পথ খুলে দিল সেই ইমানদার সিপাহি রাজারাম। নানা সাহেবের গায়ের আতরের গন্ধ মাখা পোশাকটার সঙ্গে নিজের পোশাক সে বদল করে নিল। রাজারামকে আশীর্বাদ করে এই হাবেলি ছেড়ে নিরুদ্দেশের পথে রওনা হলেন সিপাহি বিদ্রোহের নেতা নানা সাহেব। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হল সিম্পসন সাহেব। রাজারামকে ধরল তারা। রাজারামের পরনে সোনার সুতোয় বোনা পোশাকে আতরের গন্ধ। রাজারাম নিজের পরিচয় দিল নানা সাহেব বলে। সিম্পসন এই বাড়িতে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মুন্ডু কেটে নিয়ে গেল হ্যাভলকের কাছে। হ্যাভলক অবশ্য সেই মুন্ডু দেখে বুঝতে পারলেন সেটা নানা সাহেবের নয়। নানা সাহেব কর্ণকুন্ডল পরতেন। কাটা মুন্ডুর কানে কর্ণকুন্ডলের ছিদ্র ছিল না। মিউটিনির ইমানদার বাঙালি সৈনিক রাজারামের ইমানদারীর জন্যই প্রাণ রক্ষা হয়েছিল নানা সাহেবের। তাই পরবর্তীকালে এই বাড়ির নাম হয় ‘ইমানদার হাবেলি।’ সিম্পসন সাহেবের কুকুরটা অবশ্য এরপরও বহুদিন কানপুরের পথে ঘুরে বেড়াত নানা সাহেবের খোঁজে। কিন্তু তার আর সন্ধান মেলেনি।’ —কাহিনী শেষ করলেন বৃদ্ধ ফিরদৌস।
এ কাহিনী শোনার পর সব স্পষ্ট হয়ে গেল শমিতের কাছে। সে যা দেখেছে তা মিথ্যা নয়। সত্যি এই খস গুলাব আতরের গন্ধর ক্ষমতা আছে বটে। যা অতীতের অন্ধকার থেকে জাগিয়ে তুলেছিল সৈনিক রাজারামকে, সিম্পসন সাহেবের কুকুরটাকে! রাজারামের সিক্কাগুলো তার উত্তরাধিকারীদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হল না শমিতের পক্ষে। দেড়শো বছরেরও আগের সময়কার রাজারামের গঙ্গাতীরের সেই বাড়ি আজ খুঁজে পাওয়া যেত কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। তবে একটাই সান্ত্বনা যে ইতিহাসের পর্ব থেকে উঠে এসে শমিতের গায়ের আতরের গন্ধর সূত্র ধরে সিম্পসন সাহেবের ভয়ংকর কুকুরটাকে হত্যা করে শেষ পর্যন্ত প্রতিশোধ নিলেন সিপাহি বিদ্রোহের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক রাজারাম। যার আত্মত্যাগের কথা, ইমানদারীর কথা ইতিহাস বইতে লেখা নেই।
ফিরদৌস বললেন, ‘এই খস গুলাব আতরের গন্ধ কয়েকশো বছর পরও বেঁচে থাকে। মরা—মানুষদেরও জাগিয়ে তোলে।’
শমিত বলল, ‘হ্যাঁ, তা আমি এখন জানি।’
***