আড়িয়াল খাঁ – ৩

তিন 

তালতলী বাজারে এসে রিকশা থামল। তালতলীর নদীটার কুলকুল শব্দ শোনা যাচ্ছে কান খাড়া করলেই। জাহেদ তার বাবার কাছ থেকে শিশি-বোতলটা চেয়ে নিল এবং শরীর টান টান করে দাঁড়াল পাশের দোকানের সামনে ঝুলতে থাকা কলার কাঁদিতে তার একটা হাত রেখে। দোকানদার বললেন, ‘দেহি, দেহি, বাড়িখানার জাহেদ না?’ 

জাহেদ লজ্জা পেয়ে গেল, বলল, ‘হুম’। 

তার বাবা দোকানিকে বললেন, ‘আমার ছেলেকে চেনেন?’ 

দোকানি বললেন, ‘চিনমু না? লালটু হিরুরে কেডায় না চেনে? লালটু হিরু এইহানে আহে কাগাসুরা রোডে নদীর নামায় এত্ত বড় লাডির মাতায় আড়া লাগাইয়া ফড়িং ধরতে। হা-হা-হা। দ্যাহেন দ্যাহেন, ওই যে আপনের পোলার হাতে এহনও ফড়িং আডকাইয়া রাহা বুতোল।’ 

জাহেদ তাকে বলতে চাইল যে, ভুল, এটা ফড়িং রাখার বোতল না, এটা আড়িয়াল খাঁর বিশেষ এক পানি ধরার জাদু-আয়োজনের অংশ। কিন্তু এই দোকানি তার এত পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও সে চেপে গেল বিষয়টা। 

সে সময় কাগাসুরা রোডের দিকে খেউ-খেউ করতে করতে ছুটে কেমন মাটির ওপর দিয়ে ছেঁচড়ে চলে গেল কুকুরগুলোর দল। জাহেদ দশ পা দৌড়ে ওদের দিকে তাকিয়ে ডাকতে লাগল, ‘বইঠঠো… বুটটি…বইঠো।’ তারপর মন খারাপ করে সে তার বাবার গায়ের মধ্যে ঘেঁষে ঢুকে বাবাকে বলল, ‘বাবা, বইঠো না। বইঠোর মতো দেখতে আরেকটা। বইঠো হলে আমার সাথে কথা বলত। শামছুই ঠিক বলছে। 

শামছু হাসল বিজয়ীর হাসি। জাহেদের বাবা শামছুকে বললেন, ‘আমরা গেলাম শামছু। তুমি কি থাকবা, নাকি চইল্যা যাবা?’ 

শামছু বলল, ‘কী করব? আপনে ফেরবেন কহন?’ 

কাশেম চিন্তা করে নিয়ে বললেন, ‘এই ধরো দুই ঘণ্টা।’ 

শামছু হিসাব কষতে লাগল, ‘এহন কয়ডা বাজে? নয়টা? নাকি আটটা?’ 

কারও হাতেই ঘড়ি নেই। শামছু তালতলী বাজারের মাঝামাঝি তার রিকশার সামনের চাকা ঘোড়ার পেছনের পায়ের মতো মাটিতে বাড়ি মেরে মেরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘রাত কয়ডা হইল গো?’ 

জাহেদ তখন দাঁড়ানো অবস্থা থেকে রুকুতে যাবার ভঙ্গিতে নুয়ে হাঁটুর ওপর বোতলসহ তার এক হাত, আর অন্য হাতটা কলার কাঁদির ওপর রেখে চিৎকার দিল, ‘কয়ডা বাজে গো-ও-ও?’ 

কাশেম ছেলেকে বকা দিলেন সে বরিশাইল্যা ভাষায় ‘কয়ডা’ বলেছে বলে। জাহেদ হাসল ফিকফিক করে, কিন্তু ততক্ষণে তার হাসি ছাপিয়ে চারদিক থেকে রব উঠে গেছে, ‘আটটা পোঁইতিরিশ।’ 

দূরে কাগাসুরা রোডের মোড়ে যে বিখ্যাত চেমন আলীর ছানার দোকান, সেখানে কাজ করা ছেলেটা জাহেদের বন্ধু, নাম মৃত্যুঞ্জয়, সে তার বাঁশির মতো গলা আসমানের তাকে তাকে ভাসিয়ে দিয়ে আজব হাঁক তুলল, ‘পইইইই-তৃষ’; আবার থেমে, ‘পইইইই-তৃষ।’ 

জাহেদ তখন তার বাবা যে এখানে আছে তা ভুলে গিয়ে বলে বসল, ‘মিততুজয়ের পো মিততুন্জয়, শাউয়ার কতা কয়—পইইই-তৃষ।’

দোকানি হা-হা শব্দে প্রতিবাদ করে উঠলেন ‘হায় জাহেদ, হায় জাহেদ’ বলে। তিনি ভাবতেই পারছেন না জাহেদ এত খারাপ একটা কথা জানে। এবার তার বাবা দুপা এগিয়ে এসে তাকে এক চড় মারলেন ভালই জোরে। জাহেদ চড় খেয়ে কেঁদে ফেলবে ফেলবে করছে, ততক্ষণে দোকানি তার হাতে তুলে দিয়েছেন দু দুটো সবরি কলা, আর তাকে বলছেন, ‘খাও, খাও। পচা কথা বলে না।’ 

মৃত্যুঞ্জয় এ সময় তার কাছে এসে দাঁড়াতেই সে তার একটা কলা দিয়ে দিল মৃত্যুঞ্জয়কে, আর বলল, ‘পইষের বাচ্চা, তোর জন্য মাইর খাইলাম। তুই কলা খা।’ 

মৃত্যুঞ্জয় কলা হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে খুন। কিন্তু দোকানি জাহেদকে সাফ সাফ বলে দিল, ‘জাহেদ, সব সইজ্য করব—গালি, পচা কথা, সব। কিন্তুক মালাউনের জন্য মায়া দেহাইলে আমারডে ভেড়বা না। অগো হাত কীরকম নোংরা জানো? ক্যান নোংরা তা জানো? থাক কইলাম না। আর কইলাম না।’ 

শামছু হিসাব কষে নিয়ে বলল, ‘তাইলে ধরলাম আপনে ফেরবেন দশটা পঁইত্রিশে। দুই ঘন্টা। আমার আইতে যাইতে আড়াই কিলো আড়াই কিলো পাঁচ কিলো। পেরসিডেন্টের মরার রাইতে তো ভাড়াও পামু না ঠিকমতো। লোকে কইবে, এতো ভয়ের মইদ্দে আবার ভাড়া দেওয়াদেওয়ি কী? আর বৃষ্টিও নামতে পারে। জাহেদ, গুড়গুড় হোনতেয়াছ? কাশেম ভাই, আমি বাজারে থাইক্কাই গেলাম তাইলে। আমনেরে ফেলাইয়া গ্যালে এমনেতেও দেলে শান্তি পামু না। ভাবি যে-কান্না কানতেয়াছেন। 

কাশেম শামছুর কাঁধে এক হাত রেখে আরেক হাতে তাকে দশটা টাকা দিলেন, বললেন, ‘বাজারে খেয়ে নিও। আর শোনো’, শামছুকে তিনি টেনে আনলেন জাহেদের কাছ থেকে, তারপর ওর কানের মধ্যে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘যদি দ্যাখো যে এগারোটা বাজল, কিন্তু আমি ফিরি নাই, তাহলে তুমি সোজা যাবা মহাবাজ থানায়। পুলিশের ওই যে মুখে সাদা ছাতা পড়া এসআই আছে না রবিন? ভাল নাম যেন কী? তাকে আমি বলে রাখছি। ওকে খুঁজে বের করে বলবা, ইলতুতমিশের নৌকা নিয়ে কয়লা ওমরের সাথে আড়িয়াল খাঁ গিয়ে নিউ ভাটিখানার কাশেম মিঞায় ফেরে নাই। মনে থাকবে? চেনো তুমি রবিনকে?’ 

শামছু বলল, ‘চিনি। ছোডলোক। আস্তা ছোড়লোক। বউ পিডায়। বউ পিডাইছিন—মুস্তাফিজ রবিন।’ কথাটা ছড়ার মতো করে বলল শামছু। 

কাশেম হাসলেন, বললেন, ‘হুঁহ। মুস্তাফিজ। ভাল নাম মুস্তাফিজ। এখন তুমি একটু দেখবা ওমর আলি, হায়দার, এরা কোনদিকে?’ 

শামছু জিজ্ঞাসা করল, ‘কোন হায়দার? বর্মন রোডের বাওন হায়দার? বইয়ের দুকান আছে?’ 

কাশেম বললেন, ‘হুম।’ 

শামছু ও কাশেম মিঞা দুজনেই প্রায়ান্ধকার ও জনশূন্য বাজারের এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন, শামছু অনবরত তার রিকশার বেল বাজিয়ে যাচ্ছে টিং টিং টিং, তখন ওই সবরি কলা ও অন্য নানান ফলবিক্রেতা দোকানি—তার দোকানের সামনে তরমুজই দেখা যাচ্ছে বেশি—জাহেদকে পাশে ডেকে বললেন, ‘শোনো লাল্টু হিরু, কিছুই বোঝতেয়াছি না। তোমার বইন পারভিনে তোমাগো ভাটিখানার লুতফর রহমানের পোলা নাঈম রহমানরে নিয়া এই জায়গায় আসছিল পরপর দুইদিন। নাঈম আমারে জিগায় ‘আড়িয়াল খাঁ বেড়ামু, ঘণ্টা ভাড়ায় নৌকা কোন ঘাড়ে পাওয়া যায়?’ আমি কইলাম ‘ঘাট তো একটাই, চোখে দ্যাখো না’! নাঈমের লগে যে পোলা মোশতাক, আমি নাঈমের লগে ওরে আরও দেখছি, সে আমারে কানে কানে কয়, ‘হ্যারা পেরেম করার নৌকা খুঁজে, ছইওয়ালা দরজাওয়ালা নৌকা। সেই স্পেশাল নৌকার ঘাড়ও কি এইডা?’ বোঝলা কিছু তুমি? আমি কিন্তুক কিছুই বোঝলাম না। হেদিন পরপর দুইদিন আইল তোমার বুইনে, আবার আইজ রাত্রে আইলা তুমি ও তোমার বাপে। কী ব্যাপার চলতেয়াছে তোমাগো ফ্যামিলিতে আড়িয়াল খাঁ যাওয়া লইয়া? কুনো ঝামেলা? আমি তো তোমার বাপেরে কইতেও পারতেয়াছি না যে, তার মাইয়া দেখতে সোন্দর আছে, তাই স্যায় ওইরকম উড়াধুড়া পোলাপানের লগে নদীতে গেলে সরবোনাশ হইয়া যাবে, ভয়ের বদনামও হইয়া যাবে।’ 

জাহেদ শুনল কথাগুলো। সে তার বাবা ও রিকশাওয়ালা শামছুকে হারিয়ে ফেলেছে, ঠিক যেখানটায় মাত্র চারদিন আগে তার বোন পারভিন হারিয়ে ফেলেছিল তার প্রেমিক নাঈমকে। নাঈম ও মোশতাক দুজনে একসাথে সেদিন ঘাটের দিকে গিয়েছিল ছইওয়ালা-পর্দাওয়ালা নৌকার খোঁজখবর করতে, আর তখন পারভিন তালতলী বাজারের বিখ্যাত এপি-র দোকানে ঢুকে মিথ্যা মিথ্যা অনেকক্ষণ খোঁজখবর ও তত্ত্বতালাশ করেছিল পংকজকান্তি ক্রিম ও এপি-র মধু বিষয়ে। দোকানদার বৃদ্ধ মানুষটা একসময় তাকে বলে বসেছিলেন, ‘মা, তোমারে আর কতবার বলব যে, পংকজকান্তি ক্রিম রাতে শোবার আগে ব্যবহার করবা তো বিশেষ উপকার পাবা?’ পারভিন সময়ক্ষেপণ করার জন্য আবার যেই তাকে জিজ্ঞাসা করেছে, ‘সব তো বললেন, কিন্তু মুখের ব্রুণ পুরা যাবে কিনা তার তো গ্যারান্টি দিলেন না,’ তখন দোকানদার বৃদ্ধ বলে উঠলেন, ‘মা, তোমার বয়স আমি পার হয়ে আসছি। তুমি পংকজকান্তি কিনতে আসো নাই। তুমি আসছ আড়িয়াল খাঁয় নাগর নিয়া ঘুরতে। তোমার লাগবে রাজা কনডম, মাইন্ড কইরো না। বুড়া হইছি, এখন আর মুখে কিছু আটকায় না। আমার দোকানে এইসব নাই। এইটা এপি’র নিজের দোকান। 

পারভিন অনেক লজ্জা পেলেও বেশ খুশি হয়েছিল ওরকম সরাসরি কনডম শব্দটা শুনে। পারভিনের মাঝে মধ্যেই মনে হয়, শুধু যদি সে নাঈমকে শেখাতে পারত যে—এক শব্দের কাজ অন্য শব্দ দিয়ে চলে না, সেক্স শব্দের অর্থ ‘ওইটা করা’ শব্দের মধ্যে নেই, বুক বললে ‘স্তন’ বোঝায় না, ‘স্তন’ অন্য এক আসক্তির মৌতাত, যেখানে বুক কিনা শুধুই ছিমছাম ওয়ালপেপারের মতো এক জিনিস, যার মধ্যে কোনো গভীরতা নেই, যার পেছনভাগে আছে খালি দেওয়ালের ঠাং ইট, ঠাং সিমেন্ট। তার মানে, সে বলতে চায় যে—আহা নাঈম যদি শুধু তার এই চিন্তাগুলো বুঝতো, বুঝতো যে, কীভাবে শুধু ঠিক শব্দের জন্যই মানুষের জীবনটা রাজকীয়, জীবনটা রূপমাধুরীতে ভরা! যেমন জাহেদের বাংলা টিচার এনায়েত স্যার একদিন বললেন তাদের বাসায় বেড়াতে এসে, ‘তোমাদের বরিশালে পারভিন কী সব মানুষের নাম? নিউটন। তাকে আবার তোমরা বল, নিউটইন্যা। তোমাদের বাসার সামনে শুনলাম তোমার ভাই একজনকে ডাকছে নিউটইন্যা, হা-হা। আর জিলা স্কুলে ঘণ্টা বাজায় যে বগা, তাকে বরিশালে বলে বগাইয়া। আমি ভাবি, মানুষের নামগুলো শুধু যদি একটু প্রোডাকটিভ হতো, যেমন ধরো আমার এনায়েত নামটার অর্থ যত্ন, দয়া, দোয়া, বিবেচনা, অনুগ্রহ—প্রোডাকটিভই তো। কিংবা ধরো পারভিন, সেটাও প্রোডাকটিভই তো। পারভিন অর্থ সাত-বোন তারামণ্ডলী, ৪৪৪ আলোকবর্ষ দূরে আছে পৃথিবীর থেকে সবচেয়ে কাছের যে নক্ষত্রমণ্ডল, তার নাম পারভিন। কিন্তু বরিশাল ভরা সব মন্টু-ঝন্টু-ডগা ধরনের আনপ্রোডাকটিভ নাম দিয়ে দিয়ে। দুঃখ হয়। দুঃখ হয়। তুমি বুঝলে কিছু?’ 

পারভিনের ভাল লেগেছিল স্যারের কথাগুলো। তবে সে এটাও বুঝেছিল যে, তার ছোট ভাইয়ের প্রিয় স্যার তার রূপের প্রেমে পড়েছেন—তিনি তার ডান গালে যে-টোল পড়ে, সেই টোলের মধ্যে তার নিজের আজকের জীবনের জন্য বিরাট প্রোডাকটিভ কিছু খুঁজে পাচ্ছেন। 

স্যার এরপরে বলেছিলেন সাংঘাতিক এক কথা, সেটাও পারভিনের টোলের প্রতি তার মমতা ও আকর্ষণ থেকেই: ‘শোনো পারভিন, জাহেদ এইসব কথা বুঝবে না। কথা হচ্ছে পৃথিবী বিশৃঙ্খল এক জায়গা। কারণ পৃথিবী বিষয়ে আমাদের সব অভিজ্ঞতা বিশৃঙ্খলতার, গোলমালের। প্রায়ই দেখবা এখানে কিছু কিছু অনেক কিছু ঘটে যায় যার কোনো লজিক নেই। কিংবা সেটা নিয়ে যা তুমি সকালে ভাবছিলে, দেখবা যে দুপুরে এসে তারই উল্টোটা ভাবতে বাধ্য হচ্ছ তুমি। দেখবা প্রায়ই তোমার মনে হবে, সময় কী ধীরে যায়। আবার অন্য সময় দেখবা সময় যায় ট্রেনের মতো জোরে, ফাস্ট। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতাগুলোকে, তার মানে, পারভিন, আমরা চাই যে ওরা নিয়মমাফিক আর লজিকের শৃঙ্খলার মধ্যে থাকুক। মানে আমরা কার্যকারণ খুঁজি পারভিন, আমরা সবকিছু কার্য ও কারণ দিয়ে খুঁজি। ভাবি যে, সময় সবসময় একইরকম। ভাবি যে, জীবনের গল্পের পটভূমি বদলাবে না, জীবনের গল্পগুলো সবসময় ভালমতো বোঝা যাবে। যেমন ধরো, ভয় পেও না আমি এটা বলছি বলে’—পারভিন ভয় পাচ্ছিল না, তার ভেতরে বরং অসংখ্য ঢেউ ভাঙছিল এনায়েত স্যার তার ঠোঁট ও গালের টোলটার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিলেন তাই—’এই ধরো টয়লেট করা, গু। ভেবে দেখো, কীরকম ঘৃণা ও ওয়াক-ওয়াকভাব আমাদের মধ্যে আছে জীবনের এই সাধারণ বিষয়টা নিয়ে। মানে ওইটাকে আমাদের যেমনেই হোক সিস্টেমেটিক ওয়েতে জীবন থেকে দূর দূর করে চলতে হবে। তাই ওকে আমরা শরীর থেকে বের করি গোপন জায়গায় বসে, ওকে চোখের সামনে থেকে দূর করি যত চটজলদি পারি, অর্থাৎ তৎক্ষণাৎ। আর ওর চিহ্নকে নিশ্চিহ্ন করি যত-যত-যত দ্রুত সম্ভব। এই যে কোনো লজিক ছাড়া আমরা গু নিয়ে, আমরা তোমাদের মেয়েদের মান্থলি পিরিয়ড নিয়ে এই পরিমাণ ঘৃণা বুকে ধরে বসে আছি, তার কারণেই আমার মনে হয় যে, জীবনের সত্যগুলো চিরকাল দূরেই থেকে যায়। কারণ, তখন সেই সত্য আবিষ্কারের জায়গাটা দখল করে নেয় আমাদের মারমার-কাটকাট ঘৃণার যতো ভাবনা। আমরা তোমার এই সুন্দর হাসি, সুন্দর ঠোঁট, সুন্দর গালে টোল পড়া দেখে বলি না—এটা সত্য, এটা সুন্দর। আমরা চিন্তায় বরং ভাবতে থাকি, ‘কতক্ষণে পারভিইন্যারে বিছানায় নিয়া পাইড়্যা ফেলমু।’ হা-হা-হা। প্রোডাকটিভ নামও যেমন মানুষের কম, প্রোডাকটিভ চিন্তাও তেমন মানুষের কম। কিন্তু আমিই বা এত কথা বলার কে? হয়তো ডেস্ট্রাকটিভ চিন্তার মধ্যেই আনন্দ বেশি, হয়তো তাতেই পৃথিবীর ভাল বেশি। কে জানে, হা-হা!’

পারভিন বেরিয়ে গিয়েছিল এপি-র দোকান থেকে। কিন্তু বের হতেই সে দেখল এই জায়গাটা হঠাৎই আর তার চেনা নেই, একটু আগে নাঈম ও মোশতাকের সঙ্গে সে যেন এখানে আসেনি। সে যেখানে এসেছিল, সেটা ছিল একটা বাজার, যার দুপাশে ছিল বেশ কিছু দোকান, আর মাঝখানে বড় বড় টেবিলমতো পেতে অস্থায়ী দোকানদারেরা যেখানে বেচছিল চুড়ি, চুলের ক্লিপ, মাথার তেল, তরমুজ, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার আঠালো শরবত, হাত-পাখা ও দাঁতের জন্য নিমের মাজন। আর এখন ওসবের বদলে সে দেখছে যে, আছে দই ও ক্ষিরের পাত্র নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে নদীর ঘাটের দিকে ছোটা অসংখ্য মানুষ, তাদের আশপাশে শতখানিক ছাগশিশু, শতখানিক মেষ ও গরু এবং ওই পশুগুলোর পেছনভাগে প্রায় দু ডজন চামড়ে পুড়ে-কালো হয়ে যাওয়া রাখাল। আর চারদিকেই সমানে সবাই বিক্রি করে যাচ্ছে যৌন শক্তিবর্ধক শেয়ালের চর্বি, শেয়ালের তেল, বাগদা চিংড়ির মাথা, উটের বক্রগ্রীবা থেকে নেওয়া বিশেষ এক মাংসের টুকরো, কালবাউস মাছের পেটের ভেতরকার বিশেষ এক নাড়ি এবং ‘কস্তুরী-কস্তুরী’ বলে চিৎকার করে বিক্রি করতে থাকা মিথ্যা মৃগনাভি, যা কিনা বিক্রি হচ্ছে বেশ চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে এই কড়া গ্যারান্টি রেখে যে—বিছানায় আপনার জিনিসটা হবে চড়া ও তেজালো, হবে শিরতোলা হাঁপরে-ভাজা লৌহশাবলের মতো। 

পারভিন ঘাবড়ে গেল এত্ত আওয়াজে। ভড়কে গেল চারপাশে নতুন এই চলতে থাকা কায়কারবারে। তারপর ওড়না দিয়ে নিজের মুখ যতটা পারা যায় ঢেকে সে চলে এল আড়িয়াল খাঁর পাড়ে। আর ওখানেই দেখল ফেরির কিনারে এক ল্যাম্পপোস্টের পাশে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে মুখ করে সিগারেট খাচ্ছে নাঈম ও মোশতাক। 

পারভিন ঠিক করল, তাদেরকে আচমকা হাউ বা ভাউ দেবে সে, আর নাঈমকে বলবে, কনডম নিয়ে এপির দোকানের ম্যানেজার বৃদ্ধ তাকে কী বলেছে, হা-হা। কিন্তু কীভাবে এখানে নাঈমকে সে বলবে এইসব? ফেরি জুড়ে চারদিকে তো শুধু ছাগলের ব্যা-ব্যা, গরুর গাউ-গাউ, মহিষের গোঁ-ও-ও। 

অন্যদিকে এই অনেক আওয়াজের মধ্যে নাঈম ও মোশতাক টেরই পেল না যে, পারভিন কখন তাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে ফেরির ওই এক লোহার ল্যাম্পপোস্টের কিনারে লুকিয়ে তাদের কথা শুনছে। 

পারভিন শুনল মোশতাক নাঈমকে বোঝাচ্ছে আর বোঝাচ্ছে, ‘ভালবাসা আবার কী? নৌকায় উঠবি, ওরে করবি। কিন্তুক মাইয়ার পেট বাধাবি না, আর বাধাইলেও আমি আছি। কিন্তু তোর বাবা যে কাপড়ের ব্যবসায়ী লুতফর রহমান, আর তার ব্যবসা যেরকম বাড়তেয়াছে চকবাজারে নাঈম, আর সে যেমনে জাইন্যা গেছে যে, কুষ্টিয়ার আল্লার দরগার কাশেম মিঞার প্রথম ঘরের আছে আরও দুই মাইয়া, আর কাশেম মিঞা যত যা-ই কও জেল খাটছে, জেল তো খাটছে, সেইসাথে পারভিনের ভাই শাহেদ রাঙ্গা-নিউটন-আলমাজীগো লগে মিইল্যা হইতেয়াছে যে পাকসাই গুণ্ডা—সবডি মিলাইয়া তুই কস এই মাইয়ারে তুই বিয়া করতে পারবি? তুই না বাপের এক পোলা, এক মায়ের এক পোলা! আমি তো সেদিন পারভিনের বাপরে সোজা বইল্যা দিলাম, ‘জেলখানায় ভাল আছেলেন, খালু?’ আমার কথা শুইন্যা সে দুঃখ পাইল। জেলখানায় গতর খাইট্টা আসলে দুঃখ তো লাগবেই। তুই বোঝতেয়াছ, তুই কোনদিকে যাইতেয়াছ, মনু? আমি তাই কই—নৌকা ভাড়া ল, যা করার ফাডাইয়া দিয়া কর, দুই-চাইরদিন কর, তারপর ফিনিশ। তারপর তুই তোর বান্ধবীরে আমারে দিয়া দিবি। দোস্ত, মাইয়া মাইনষের আবার দাম কী? হ্যারা আছে খালি ঠাপ খাওনের লাইগ্যা। জীবনে খালি এই একটা শব্দ দেখলাম ‘নারী-পুরুষ’, যেইখানে তারা দেখলাম আছে পুরুষের আগে, হা-হা।’ 

পারভিন তক্ষুনি সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল নাঈমের। কিন্তু তার ওখানে আসবার আগেই নাঈম প্রচণ্ড জোরে মেরে বসেছে মোশতাককে। এবং ওইটুকুই, শুধু ওইটুকুই—ওই নাঈমের মোশতাককে আগে মেরে বসা ও সেই মারের এক সেকেন্ড পরে পারভিনের সেখানে আসার মধ্যেই ফারাক হয়ে গেছে যা কিছুর। পারভিন বুঝেছে নাঈম তাকে ভালবাসে, নাঈম তাকে দেখানোর জন্য তাকে দেখবার পরে মোশতাককে মারেনি। 

কিন্তু তবু পারভিন হতভম্ব হয়ে পড়া মোশতাককে বলেছে, ‘কথা একটাও খারাপ বলেন নাই, মোশতাক ভাই। আমি সবই শুনছি। নাঈম যদি আমাকে শুধু করার জন্য ব্যবহার করতে চায়, সেটাও ঠিক আছে। কারণ ওই করাকরি একটা দরকারি বিষয়। মোশতাক ভাই, আপনার লিঙ্গের আমি না জানি সাইজ, না জানি সেটার শক্ত অবস্থার নমুনা। তবে এতগুলো অশ্লীল কথা যে বলল, সে লোক যেহেতু সারাদিন মাস্টারবেট করে বলে ধরা যায়, তাই ধরা যায় তার কনফিডেন্স কম। অতএব আমার কাছে আসার আগে তার লাগবে শিয়ালের চর্বি খাওয়া, তেল খাওয়া, বাগদা চিংড়ির মাথা ও পুটকি খাওয়া, উটের বিচি খাওয়া, কালবাউস মাছের ভ্যাজাইনা খাওয়া। বুঝলেন? এখন যান। আমরা আড়িয়াল খাঁ যাব। আড়িয়াল খাঁ হইল আমার ভ্যাজাইনা। বোঝা গেল?’ তারপর থেমে চোখের ওপরে পড়া রোদ ওড়না দিয়ে ঠেকিয়ে সে আবার, ‘আর নাঈম, তুমি যদি আমার আড়িয়াল খাঁ-য় আমার সঙ্গে কিছু করার পরে নিরুদ্দেশ হইতে চাও, আমার তাতে কোনো আপত্তি নাই। যার জীবন তার, যার বাবা-মাকে বোঝানোর কী না-বোঝানোর ব্যাপারগুলাও তার। জোর করে রেপ হয় নাঈম, কিন্তু ভালবাসার যেসব ফ্যান্টাসিতে ভরা করাকরি, সেইটা হয় না। করা হয়, সেক্স হয়, কিন্তু লাভমেকিং হয় না। এই শব্দগুলা কতো সুন্দর নাঈম। কারা বানাইছে এসব শব্দ? লাভমেকিং! কতো প্রোডাকটিভ একটা শব্দ রে বাবা! এখন চলো আমরা নদীর ঘাটে বসে নদী দেখি। বিয়ের পার্টি যাচ্ছে, আবার পশুদের চালান যাচ্ছে স্বরূপকাঠী কী ইন্দেরহাটের দিকে।’ 

.

জাহেদ কলাওয়ালা দোকানদারকে বলল, ‘চিন্তা করবেন না, চাচা। আমার বোন আর নাঈম ভাইয়ার বিয়া সামনেই। আপনেরে দাওয়াত দিবো। তাগোরে বিয়ার আগে নদীর হাওয়া খাইয়া বিয়ার প্ল্যান পোক্ত করতে দেন।’ 

দোকানদার জাহেদকে বললেন, ‘বেশি পাইক্যা গেছ তুমি। নদীর হাওয়া খাইয়া বিয়ার প্ল্যাম পোক্ত করবে! এপি-র বুড়া দোকানদার আমারে বলছে, তোমার বুইনে দোকানে দোকানে গিয়া কনডম খোঁজতেয়াছিল। রাজা কনডম। তোমার লজ্জা করল না ওই বুইনের পখে কথা কইতে? ছি!’ 

জাহেদ উত্তর দিল না দোকানদারের ছি-টার। তার ওই কথার মধ্যেই সে আসলে দেখে ফেলেছে যে, অন্ধকারের গর্ভ ফুঁড়ে আবার মাটিতে বেরিয়েছেন তার বাবা ও রিকশাওয়ালা শামছু। বাবা তাকে দেখে বললেন, ‘জাহেদ, তুমি এইখানে? আমরা তো ভাবছিলাম তুমি ওই নকল বইঠোর পিছনে পিছনে দৌড়াচ্ছ আর দৌড়াচ্ছ।’ জাহেদ হেসে ফেলল বাবার কথা শুনে। 

আবার তখনই পানির দিক থেকে এদিকে আসতে থাকা ওমর আলিকে দেখে তার দিকে দৌড়ে গেল সে। বলতে লাগল, ‘ওমর চাচা, ওমর চাচা।’

ওমর আলির মুখ প্রচণ্ড কালো হয়ে উঠল মুহূর্তের মধ্যে-কালো, থমথমে ও মেঘভারি, যেমন মুখ থাকে বিশাল বস্তা কাঁধে তোলা ঝাঁকামুটেদের। তিনি এবার জাহেদের মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে একবার জাহেদের উদ্দেশে কথা বললেন জোরে, আরেকবার কাশেমের উদ্দেশে দাঁতে দাঁত ঘষে করকরে জলশূন্য গলায়, ‘জাহেদ, তুমি কি রিকশায় বাবার সাথে বইস্যা আসছ, নাকি রডে? তুমি তো রডে না বইস্যা আসো নাই। হা-হা। পাছা গেছে তোমার দুই ভাগ হইয়া।’ 

তারপরই, ‘কাশেম ভাই, কী মনে করে আপনি জাহেদরে সাথে আনলেন? কী মনে করে? আপনি আজব, আজব, আজব। আমরা যাচ্ছি ছোট নদী হইয়া বড় নদীতে, যাচ্ছি একটা ব্যবসার কাজে। আর আপনি জাহেদরে নিয়া আসলেন সাথে? জাহেদরে?’ 

কাশেম ওমর আলির কানে কানে বললেন, ‘সকাল থেকে বাচ্চাটা কাঁদছে আড়িয়াল খাঁ দেখবে তাই। তুমি তো ওকে চেনো ওমর। মালেক হুজুর ওর মাথা নষ্ট করছে। আমি কী করব?’ 

ওমর খেঁকিয়ে উঠলেন এবার। জাহেদ শুনতে পেল তার কথা, শামছুও শুনতে পেল, আর আশপাশের দোকানিরাও শুনল। আসলে তখন কাশেমের ওপরে ওমরের এতই রাগ যে, তার মাথার ঠিক ছিল না কোনো। ওমর বললেন, ‘আমি কী করব মানে? আগে বললে আমি তো ট্রিপ ক্যানসেল করতাম। এইটুকু ছেলে যাবে আড়িয়াল খাঁ? আজব মানুষ আপনি।’ 

তালতলী বাজার চুপ হয়ে গেল জাহেদের দুঃখে। মৃত্যুঞ্জয় বুঝল এবার আর জাহেদের কান্না থামানো যাবে না। সে তার বন্ধুর পাশে এসে দাঁড়াল। জাহেদ তাকে সামান্য ঠেলে সরিয়ে দিল তার বুকের কাছ থেকে—যেহেতু সে ঈমান না, যেহেতু তার বুকের ওই জায়গাটা শুধুই ঈমানের, অন্য কারও না। 

ওমর আলি এবার জাহেদের মুঠোয় একটা দশ টাকার নোট পুরে দিয়ে বললেন, ‘জাহেদ, তুমি বাজারের এইখানে থাকবা শামছুর সাথে। আমরা ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই ফেরত আসব। ওকে, মাই সন?’ 

জাহেদ লজ্জা ভেঙে ইংরেজিতে বলতে যাবে, ‘ওকে না, কিছুই ওকে না’, কিন্তু সে দেখল তার বাবাকে পাশে টেনে নিয়ে গেছেন ফেরি ড্রাইভার লরেন্স ডি সুজা, যার ভাই শহরের অক্সফোর্ড মিশন স্কুলের হেডমাস্টার বিখ্যাত ডি সুজা স্যার, যে স্যারেরই ছেলে আবার তাদের সদ্যমৃত বড়লোক মুরাদের বড়লোক বন্ধু অসহ্য প্রেডিক্ট ডি সুজা। জাহেদ বহু আগেই ঠিক করেছে, সে জীবনে দরকার হলে বরিশাল জেলখানার ভেতরের স্কুলটায়ও পড়বে, দরকার হলে এমনকী রোজ কীৰ্ত্তনখোলা পার হয়ে কাউয়ার চরের স্কুলেও পড়তে যাবে, তবু সে কোনোদিন অক্সফোর্ড মিশনে পড়বে না। কারণ ডি সুজাকে দেখলেই তার বুক কাঁপে, ডি সুজার নাম শুনলেই তার হাঁটু কাঁপে। লরেন্সকেও একইরকম ভয় পায় জাহেদ, যদিও লরেন্স সবসময় তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলেন, ‘সুইট বয়, ফেরির আমাদিগকে ড্রাইভার বলে না, পাইলট বলে। প্লেন চালানো যত কঠিন, ফেরি চালানোও তাই। বুঝলা?’ 

জাহেদ তার ওমর চাচার কাছ থেকে টাকাটা নেবে কি নেবে না ভাবছে, সে বুঝতে পারছে তার আড়িয়াল খাঁ যাওয়া আর এই দশ টাকা পাওয়ার ব্যাপারটা একসঙ্গে হলেই বরং বেশি ভাল হতো, মৃত্যুঞ্জয় সেসময় তার হাতে দশ টাকার নোটটা দেখে প্রায় মাথা ঘুরে পড়েই গেল বাজারের মাটিতে। এমনকী জাহেদেরও মনে হল যে, এক টাকা দিলেই তো কত্ত বেশি হতো, এক-দু টাকাতেই তো কত্ত কিছু কেনা যায়। 

জাহেদ ভাবল, কেন ওমর চাচা দশ-দশটা টাকা দিলেন তাকে? কী স্বার্থ তার? এটা ভাবতে ভাবতে সে তার চোখের কোনা দিয়ে দেখল লরেন্স ডি সুজা তার বাবাকে কানে কানে খুব করে বোঝাচ্ছেন কিছু একটা। ওমর আলি নদীর দিকে তাকিয়ে ডাক দিলেন ‘হায়দার, হায়দার’। তারপর তার বাবার দিকে ছুটে এসে বললেন, ‘কাশেম ভাই চলেন।’ 

কাশেম লরেন্সের ওখান থেকে হেঁটে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছেন ওমরের সামনে। ওমরকে তিনি বললেন, ‘ওমর, আমার ছেলে আমার সাথে যাবে। তুমি এইটা নিয়া বাড়াবাড়ি কোরো না। জাহেদ তুই টাকা তোর ওমর চাচাকে ফিরায়ে দে।’ 

ওমর আলি চারদিকে তাকালেন। তার মনে হচ্ছে, তিনি লরেন্সকে মেরেই ফেলবেন। কিন্তু তিনি মুখে শুধু বললেন, ‘লরেন্স, তোদের যিশুরে যে ইহুদিরা মারছিল, ভালই করছিল।’ 

লরেন্স হাসলেন হা-হা-হা শব্দ করে। তিনি বললেন, ‘জাহেদ, আরেকদিন আইসসো। ফেরিতে আমার রুমে নতুন কম্পাস লাগাইছি।’ 

জাহেদ ঠিক কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছে না। সে টাকা ওমর চাচাকে ফেরত দিতে দিতে লরেন্স ডি সুজার কাছে গিয়ে লাজুক কণ্ঠে বলল, ‘কম্পাস? কম্পাস দিয়ে কি বোঝা যায় আকাশে তারা থাকবে, নাকি থাকবে না?’ 

লরেন্স বললেন, ‘না। তা বোঝা যাবে কেন বোকা ছেলে?’ কথাটা বলে তিনি জাহেদের গাল টিপে দিলেন আদর করে। জাহেদ ভাবল, এ জীবনে সে আর কত গাল-টেপা খাবে, আর কত? তার গালটা দেখলে সবাই সেটা টিপতে চায় কেন, কেন টিপতে চায়? আর তাকে গাল টিপতে টিপতে কেন চাখারের কোড়ল ঠোঁটে চুমুই দিয়ে বসেছিল একদিন? জাহেদ বাধ্য হয়ে কোড়লকে তখন বলেছিল, ‘চিশতি ঈমামরে বইল্যা দেব তোমরা আমারে চুমা দেতে চাইছ।’

কোড়ল একটা বদ। সে তখন জাহেদের পাছায় তার শক্ত হাতের জোর বাড়ি মেরে বলেছিল, ‘শোনো শহরের পোলা, ঘুমাও তো পুকারের ঘাড়ের সিঁড়িতে। চিশতি ঈমামরে বললে বইল্লো, কিন্তুক বুইঝঝো যে, ঘুমের মইদ্দে তোমার অবস্তা কী হবেয়ানে।’ 

সামনের অন্ধকার নদীর দিকে তাকিয়ে জাহেদ এবার ভাবল, আজ যদি বৃষ্টি হয়, আজ যদি ঝড় হয়, তাহলে তো সব শেষ। সে লরেন্স ডি সুজাকে বলল, ‘লরেন্স চাচা, আমার কম্পাসের কাজ নাই। আপনি শুধু আমারে বলেন যে, আজ কি বৃষ্টি হতে পারে?’ 

তখনই আকাশের দূর পুব কিনারে ডান থেকে বামে ছুটে গেল একটা বিদ্যুল্লতা। সে ছুটল সোজা রাস্তায় না, ছুটল কেমন এক জাততরঙ্গ হয়ে, কেমন আকাশকল্লোল তৈরি করে করে। ওই অব্যাখ্যেয়, ওই অন্য পৃথিবীনিবাসী তড়িৎপ্রকাশের কয়েক সেকেন্ড পরেই আকাশের ভেতরঘরে—হতে পারে আকাশের কিনারে থাকা বাথরুমে বা টয়লেট ঘরে যেন কোনো লোহার বালতি পড়ে গেল ওখানকার মেঝেয়। শব্দ হল টড়াং-টড়াং, দুবার। লরেন্স ডি সুজা জাহেদকে বললেন, ‘তোমার উত্তর তো মনে হয় পেয়েই গেছ, সুইট বয়। মে-জুন মাসের আকাশের কোনো বিচার-অবিচার নাই।’ 

বিচার-অবিচার বহু কিছুর নেই জাহেদের কাছে। কেন এই লরেন্স ডি সুজার ভাতিজা প্রেডিক্ট ডি সুজা বড়লোকের ছেলে বলে ভয়ংকর এক শাসকের চেহারা নিয়ে গত বছর তার নানির মৃত্যুর দিনে এক প্রমত্ত শিয়ালের মতন করে তার গরিব বন্ধু কাইল্লা কবিরকে শাসাতে পেরেছিল যে, ‘আমার নাম প্রেডিক্ট না, যদি আমি তোরে বস্তায় ভরে দপদপিয়া ফেরির ওখানে জ্যান্ত কবর না দিছি তো!’ এত অহংকার! বড়লোকদের? তার নাম তাহলে প্রেডিক্ট না? তার মানে প্রেডিক্ট নামটা পৃথিবী চালানো খোদার নাম কোনো? 

আর গরিব লেনজাই বা কি ভাল? কীভাবে সেদিন লেনজা, তিন বেলা ভাত না খেতে পাওয়া লেনজা হিংস্র হয়ে উঠেছিল অসহায়, পাঁচ-বাচ্চা নিয়ে হিমশিম আনোয়ারার ওপরে, আনোয়ারার সামান্য এই ভেঙে পড়ে-পড়ে টিনের বাসাটার ওপরে! ট্রাক ড্রাইভার যখন বাড়িটার কাছাকাছি ব্যাক গিয়ারে যাচ্ছে তার নানির লাশ ট্রাকে তুলবার কাজে সবাইকে সুবিধা করে দিতে, তখন লেনজা, দুর্বল-উৎপীড়িত-নিগৃহীত-দরিদ্র লেনজা, সে-ও কীভাবে ধমকে উঠেছিল জালিম ও জুলুমবাজ সালাম জমিদারের মতো করে, বলেছিল, ‘ড্রাইভার, ড্রাইভার, ট্রাক দিয়া ওই বাড়ি পুরা ভাইঙ্গা দাও, ট্রাক বাড়ির উপার দিয়া চালাইয়া দাও।’ 

কী হতো তা চালিয়েই দিলে? পাঁচ-পাঁচটা দুধের বাচ্চার হতোটা কী! ভাবতে গিয়ে বিমূঢ় অবস্থা হল জাহেদের। আর যেই তার মনে পড়ল যে, ওই একইদিন বিদ্‌দুত বিশ্বাস ‘আনোয়ারা মাগির মাজার হাড্ডি’ ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন, তার মনে হল এই পৃথিবীর সবার বুকের ভেতরে বসানো মনুষ্যত্ব নামের কম্পাসটা বড় এক পাথরখণ্ড দিয়ে তৈরি, আর সেই কম্পাসের কাঁটা সবসময় মানুষের সংজ্ঞা ও মানবের গন্তব্য হিসেবে তাক করে আছে চাখারের কোড়লের দিকে—হাজত খেটে আসা কোড়ল, যে কিনা গ্রামের ঈমানকে বলেছিল, ‘ঈমান তোর পুটকি কালা, তোর শহরের বন্ধুর পুটকি লাল।’ 

ধনী-গরিব, শহর-গ্রাম, মুসলমান-হিন্দু, ভাল-মেয়েছেলে, বেহায়া মেয়েছেলে, চোর পিটানো ভদ্রলোক আর হতভাগা চোর-না, জাহেদের মাথা ঘুরতে লাগল বিশেষ করে ওমর আলির জেলখাটার কথাটা এ মুহূর্তে তার মনে পড়ে গেল বলে। কী করে ওমর আলি রাত একটা-দুটায় ঘরের দরজা খুলে দিয়েছিল তিন জানোয়ারের জন্য, যেন তারা তার বাসায় কাজ করতে আসা কাজের মেয়েটাকে রেপ করে মেরে ফেলতে পারে? তারপর কী করেছিল ওমর নিজে, যা কিনা চিট্‌টাগুড় চাচাকে বলতেই দিলেন না জাহেদের বাবা? সে কি নিজে সেটা জিজ্ঞাসা করবে তার ওমর চাচাকে? যে, চাচা ওই তিনজন যখন মেয়েটাকে ধর্ষণ করল, গলা টিপে মেরেও ফেলল, তখন কি লাশ সরানোর আগে আপনি লাশের সাথেই খারাপ কাজটা করেছিলেন? এত রাগ ছিল আপনার একটা গরিব কাজের মেয়ের উপরে? মুরাদও তো চাচা রোজ খাবলাইত তার বাড়ির কাজের মেয়ে রাজিয়ারে। এখন মুরাদ কই? যে-লোক ওই মুরাদের পুরুষাঙ্গ করাত দিয়া কেটে নিছে, সে কি আসলে খারাপ কাজ করছে কিছু? খারাপ কাজের বিপরীতে খারাপ কাজ—জাহেদের মনে হল এটাই পৃথিবী। তার এনায়েত স্যার, তার নুরুল ইসলাম স্যার যেমন তাকে বলেন, ‘তোমার ওই বাচ্চা বয়সের কবিতায় পৃথিবীর চেহারাটা বেশি আবেগ দিয়ে লেখা হলেও ভালই আসছে, জাহেদ। তুমি লেগে থাকলে, একদিন তোমার হাত দিয়ে মানুষ পৃথিবীর আসল চেহারা দেখবে, বাবা।’ 

সেদিন ভূগোলের নুরুল ইসলাম স্যার ক্লাসের শেষে জাহেদের শেষ লেখা কবিতার কটা লাইন শুনে তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি তো বাচ্চা ছেলেই, তেরো-চোদ্দ আর কত বা বয়স! তোমার লেখার ভুল ধরলে চলবে না, যদিও তোমার বানান ভুল থাকে অনেক বেশি। তো, কবিতাটা আমার অনেক ভাল লেগেছে, জাহেদ। হুম, কোনোদিন বনমানুষ হয়ো না।’ 

জাহেদের এখনও পুরো মুখস্থ ওই সামান্য ১৩ লাইনের কবিতাটুকু। আকাশের যেদিকে একটু আগে চড়চড় করে ছিঁড়েফেটে ছুটছিল আগুন, সেদিকটায় তাকিয়ে জাহেদ মনে করল তার বানান ভুলওয়ালা লেখাটার কয়েকটা লাইন: 

কেউ যদি হতে চায় বিবেকহিন চতুর্পদী
তাতে কিবা এসে যায় আমার পৃথিবীর?
আমি তো যাব না বনে, মেনে নেব রূঢ় অক্ষমতা,
পরাজিত পত্র হয়ে ঝরবনা কোনোদিন।
সেদিনই কালো রাত্রিরে যাবো বনের গভীরে
যেদিন মানুষ হবে গাছ অথবা বন হবে মানুষ, 

তবে সত্যি এটুকু- বনমানুষ হবো না কখনো। 

সেদিন স্কুল ছুটি হয়ে যাবার সাথে সাথে নুরুল ইসলাম স্যার জাহেদকে ডেকেছিলেন টিচার্স রুমে। জাহেদের হাতে ছিল তার কবিতার মেরুন রেক্সিনে মোড়া খাতা, যেটার প্রচ্ছদে এক বড় সাদা গোলাপ ফুল, যে-ফুলের আবার চারটা পাতা এবং ওই চার পাতার মধ্যখানে এক বৃত্ত, যার মধ্যে আবার দেখা যাচ্ছে একটা নৌকা, নৌকার নিচের দিকে সাগরের পানির দাগ-দাগ, তার নিচে দু লাইনে লেখা—’ডন প্রডাক্টস। Class Notes। 

জাহেদ টিচার্স রুমে ওই খাতা হাতে নিয়ে ঢুকতেই দেখল এনায়েত স্যার বসে আছেন টেবিলের ওপরে, স্যারের পা দুটো শূন্যে ঝুলছে ঘুড়ির মতো। আর নুরুল ইসলাম স্যার দূরের এক দেওয়ালের দিকে মুখ ফেরানো, তার পিঠটা দেখা যাচ্ছে শুধু, পিঠ ও পেছনের দিক। এনায়েত স্যারই কথা বললেন, ‘জাহেদ, আমাদের দুজনকেই স্কুল থেকে স্যাক করা হয়েছে।’ 

জাহেদ বলল, ‘স্যাক মানে, স্যার? 

‘মানে বরখাস্ত, মানে চাকরি নট, হা-হা।’ 

‘কেন স্যার?’ তক্ষুনি নুরুল ইসলাম ঝাঁ করে পেছনে এদিকে ফিরলেন এবং তার দীর্ঘ লাল জিভ সার্কাসের জোকারের মতো সামনে বাড়িয়ে বললেন, ‘আমরা এই পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই বনমানুষ, তাই।’ 

এরপর নুরুল ইসলাম স্যার তার ওই দুঃখভরা জোকারি রেখে হেঁটে এলেন জাহেদের দিকে এবং তার মাথায় হাত রেখে বলতে লাগলেন, ‘শোনো জাহেদ, আমাদের বিরুদ্ধে স্কুল অথরিটির অভিযোগ হল, আমি ও এনায়েত নাকি কম্যুনিস্ট মতবাদ ছড়াচ্ছি তোমাদের মতন বাচ্চা বাচ্চা ছেলেপেলের মনে। এনায়েত নাকি লোকজনকে সাইক্লোস্টাইল করে তোমার ‘শবে বরাত’ কবিতাটা বিলি করেছে। আর আমি নাকি মাও সে তুং-এর লাল বই বিলি করি স্কুলের বাচ্চাদের কাছে। এনায়েত নাকি ম্যাক্সিম গোর্কির মা ফ্রি কিনে কিনে পড়তে দেয় উঁচু ক্লাসের ছেলেদেরকে। আর শুনবা? আর আমরা দুজন নাকি কোনোদিন নামাজ পড়ি না, কোনোকালে নামাজ পড়ি না। আমরা দুজন নাকি আল্লাহকে বলি খোদা, খোদাকে বলি ঈশ্বর, আর এনায়েত নাকি তার কথার ফাঁকে ফাঁকে শুধু বলে ‘বাস্টার্ডস, বাস্টার্ডস, বাস্টার্ডস’–এইসব এইসব।’ 

এনায়েত স্যার তাকে বললেন, ‘আমি বরিশাল ছেড়ে যাচ্ছি, জাহেদ।’ 

জাহেদ জানতে চাইল, ‘কোথায় যাচ্ছেন, স্যার?’ 

‘আর পড়াব না। তোমার মতো ছাত্র পেলে বাংলা পড়াতে ইচ্ছা করে। আমি আমাদের লালমনিরহাট ফিরে গিয়ে ক্ষেতি করব, আর মানিক-বিভূতি পড়ব সারাদিন। দেখি, পলিটিক্সে অ্যাকটিভ হওয়ারও ইচ্ছা আছে। আল্লাহ মানুষের কোনো কথাই শুনবেন না বলে ঠিক করে রেখেছেন, যেমন তুমি লিখেছ তোমার ‘শবেবরাত’ কবিতায়। হুম, মানুষের ভাগ্য মানুষকেই বদলাতে হবে।’ এরপর একটু থেমে, ‘তোমার বোন পারভিনকে বোলো যে আমি চলে গেছি। বোলো যে, ওর নামের অর্থ প্লেইয়াদেস—বি-টাইপ নক্ষত্র ওরা, টরাস তারামণ্ডলীর উত্তর-পশ্চিমে থাকে। বোলো যে, রাতের আকাশে আমাদের পৃথিবী থেকে কেবল ওই পারভিনকেই স্পষ্ট খালি চোখে দেখা যায়। হা-হা।’ 

এনায়েত স্যার ও নুরুল ইসলাম স্যার দুজনেই তার ডন প্রডাক্টস খাতা খুলে তাকে ‘শবে বরাত’ কবিতাটা পড়তে বললেন। জাহেদ তার অল্প কাঁপা-কাপা, অল্প কামড়ে-কামড়ে বলা, অর্থাৎ পৃথিবীর ওপরে অল্প দাঁত ফোটানো, ঠোকর মারা, দংশানো গলায় বলতে লাগল অজস্র ভুল বানানে ভরা তো কী—’শবেবরাত’: 

শবেবরাত 

বাই এস এম জাহেদ হাসান (নিজের নামটাও বলল সে, নামের পুরোটা) 

হে মহামহান, আর কত প্রার্থনা চাও, চাও আরো কত ক্লিষ্ট গান 
শত প্রার্থনায়ও এখনও কি রবে স্তদ্ধ মূহ্যমান? 
জানি না কেন যে আমরা এখনো পাইনি তোমার কোনোই সন্ধান
দুয়ারের কোনে নেকড়ের পাল, স্তদ্ধ রবে কি হে মহামহান? 

এদিকে রুক্ষ্ম এই গ্রহে বাতাস শব্দহিন,
আগাছার নিয়ত বড়ই বিস্তার চলেছে বেড়ে, 
ওরা যেন কোন ভিনগ্রহের মানুষ তাই সম্পর্কের বিন
লুটায় সাপের ভয়াল জঠরে। 

হে মহামহান, আরো কতো পরীক্ষা নেবে? 
জন্মাবধি পরীক্ষা দিয়েই চলেছি এখনো ফলাফলহিন 
শূন্য থালায় এখনো তো বসে আছি, ফলাফল পাবো কবে?
এদিকে দরজায় নাড়াচ্ছে কড়া জীবনের শেষদিন। 

বিবর্ণ থালা হাতে ধরেই আছি বসে 
পেরোলো কতো যে এমন ফাঁপা রাত, চোখের জল 
শুকাল চোখেই, মূর্তি হলো যে হাত, শেষে 
দেখি শুন্য থালায় বেড়েই চলেছে শুন্যের ক্রম যোগ ফলাফল। 

এই রাত শেষ হয়ে যাবে, সব তবু হবে নাতো শেষ 
জানি না তো কবে এর শেষ আছে শেষেরই মতন। ক্ষয় 
হবে রুক্ষ রৌদ্রে এ রাতের লেশ 
আগামী সকালে থাকবে শুধু দু টুকরো শুকনো রুটি না পাওয়ার ভয়। 

হায়দারের সঙ্গে হেঁটে এবার নদীর দিকে যাচ্ছেন ওমর আলি। জাহেদ যাচ্ছে তার বাবার পাশে পাশে, জাহেদের হাত ধরে যাচ্ছে মৃত্যুঞ্জয়। সাইকেলের চাকায় হাওয়া দেবার দোকানটা থেকে—যেখানে ভোরে কুংফু-ক্যারাটে শিখতে আসে ভাটিখানা- আমানতগঞ্জের ছেলেরা, আসে কারণ তারা সবসময় অভিরুচি-সোনালি আর কাকলি হলে দেখে ব্রুস লি-র ছবি, দেখে শাওলিন-মাওলিন, স্নেক-স্নেক না কী জানি, আর একই কারণে সেখানে আসে জাহেদের নাঈম ভাইও—ব্ল্যাক বেল্ট সানজিদ কাজি মাথা বের করে জাহেদকে বলল, ‘জাহেদ, তোমার ভাই শাহেদরে বইললো তো আসতে। তুমি যাও কই? হাতে বোতল কীসের?’ 

জাহেদ বোতলের কথা বলল না কিছু। কিন্তু জায়গার নামটা সে এই ব্ল্যাক-বেল্ট হোল্ডারকে বলে দিল বীরত্বের সঙ্গেই, ‘যাই আড়িয়াল খাঁ।’ 

সানজিদ কাজি বলল, ‘ভুল দিনে যাইতেয়াছ। জিয়াউর রহমান মারা গেছে একদিনও হয় নাই, আর তার ডেডবডি খোঁজাখুঁজি চলতেয়াছে লাকুটিয়ার খালে। আজব লোক তো তোমরা! আজব তোমারদের সাহস। আজব তোমারদের কাফ মাসল রে বাবা! 

জাহেদ সানজিদ কাজির শেষ কথাগুলো শোনেইনি। তার খুব অবাক লাগল এটা বুঝে যে, হাঁটতে হাঁটতে ওমর ও হায়দার আসলে কথা বলছেন অন্য কিছু নিয়ে। কিন্তু একটু পরপর তারা জোরে জোরে সবাইকে শোনাচ্ছেন জমি, লাইব্রেরি, হোটেল, টাকা, দলিল, এইসব শব্দ, আর সেইসঙ্গে দুজনে হাসছেন কেমন নকল-নকল। জাহেদ তার বাবাকে নিচু হতে ইঙ্গিত দিয়ে পরে বাবার কানের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে বলল, ‘হায়দার কেমন মানুষ, বাবা? তিন ফুট।’ 

বাবা বললেন, ‘অন্য কিছু বলতে চাচ্ছিলে তুমি।’ 

জাহেদ বলল, ‘ওরা মিথ্যা-মিথ্যা হাসতেছে বাবা। বলতেছে এক কথা, কিন্তু সবাইরে শোনাচ্ছে আরেক কথা। এইটাই।’ 

বাবা বললেন, ‘হাসতেছে’ আবার কী শব্দ, জাহেদ? আর শোনো, বড়দের নিয়ে বাজে কথা বলতে নেই।’ 

.

ঘাটের শেষ দোকানটা একটা ভাতের হোটেল। ওমর আলি বললেন, ‘আসো তোমরা। ফিরতে রাত হইয়া যাবে। শামছুও আহো, সবাই মিইল্যা খাইয়া নেই। আমি ডিম ভুনা আর খাসি অর্ডার দিছি। অ্যায় বলে যে, চরমোনাইয়ের খাসি আলেদা।’ 

জাহেদের খুব লোভ হল খাসির মাংসের কথা শুনে। কতকাল সে খাসির মাংস খায়নি! বাবার আগেই সে দোকানে গিয়ে ঢুকল। ওমর আলি ওখানে খাবার টেবিল কবে থেকে সাজিয়ে রেখেছিলেন বোধহয়। তিনি এখন শুধু বললেন, ‘চেয়ার আরও দুইটা লাগাও।’ 

দোকানে কাজ করা ছেলেটা জাহেদের মোটামুটি বন্ধুই হয়। তার নাম তপন, সে ও পদম নামের আরেকটা ছেলে আসলে কাইল্লা কবিরের বন্ধু। তপন জাহেদকে কানে কানে বলল, ‘দুই চেয়ার মানে তোমার একটা আর ওই রিশকাওয়ালার একটা। হিন্দু মিতুনজয়রে কয়লা ওমরে খাওয়াইবে না। সে এক তো হিন্দু, আবার স্যাতে বেশি গরিব।’

জাহেদ এ সময় তাদের সঙ্গে নৌকায় যারা যাবে সেই আরও চার লোককে দেখল। একজনের নাম বাসেত, সে তার বাবার বয়সী; আরেকজন ছোটকাকা, সে নৌকার মূল মাঝি; মাথা ন্যাড়া লোকটা বিছা, বিছা মণ্ডল। আর চতুর্থ লোকটাকে ঠিক বোঝা গেল না সেই লোক অন্যদিকে ফিরে থাকবার কারণে। জাহেদ ওদেরকে বাদ দিয়ে হায়দার চাচার ছোট তিন-চার ফুটের শরীরটা ভালমতো দেখতে লাগল। হায়দার তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বই পড়ো জাহেদ? কাশেম ভাই, আপনার ছেলের পড়ালেখার শখ আছে?’ 

কাশেম বলতে লাগলেন, সেটাই তার ছেলের প্রধান শখ। জাহেদ লক্ষ করল তার বাবা তাকে নিয়ে অনেক কিছু বেশি-বেশি বলছেন, যেমন রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ সে এখনও পুরো পড়েনি, কিন্তু তার বাবা কিনা বললেন উল্টো কথা। সে অতএব বলতে বাধ্য হল, ‘আপনার দোকানে তিতি ও প্যাঁক আছে? চাঁদের পাহাড় আছে?’ 

হায়দার জানালেন, ‘আছে। তুমি আইসসো। আর আমরা চরে নতুন একটা বইয়ের দোকান দিব। সেখানে এইখানকার গাঁও-গেরামের ছেলেমেয়ের জন্য রাখব তোমার চাঁদের পাহাড় ও তিতি ও প্যাঁক। 

জাহেদ এই বামনের মুখে ছেলে-মেয়ে শব্দটা শুনে তাকে নিয়ে খুব-খুব অশ্লীল একটা কথা ভাবল এবং ভেবে নিজেই লজ্জায় লাল হল, তারপর দুঃখে কালো হল, আর শেষে হাসল মিটিমিটি। কিন্তু তার হাসি তখনও থামেনি, তার মনে পড়ে গেল মৃত্যুঞ্জয়ের কথা। তারা সবাই খাওয়া শুরু করতেই কোথায় চলে গেছে মৃত্যুঞ্জয়? সে একদমই খেয়াল করেনি কেন মৃত্যুঞ্জয়কে? জাহেদ তপনকে হাত তুলে কাছে ডাকল। তপন তার গায়ের মধ্যে ঘেঁষে এলে সে তাকে বলল, ‘তপন, তপন, খাওয়া তো বাঁচবে কিছু। তুই মিত্তুঞ্জয়রে খাওয়াইতে পারবি পরে?’ 

তপন বলল, ‘আমার মালিক দিবে না। সে হিন্দু পছন্দ করে না।’ 

জাহেদ অবাক হল, বলল, ‘তুই তো নিজেও হিন্দু!’ 

তপন বলল, ‘আমি মালিকরে কতা দিছি যে, ১৯৮২ সালের মইদ্দে আমি মুসলমান হব। সেজন্যই পাককি মিঞা আমারে দোকানে রাখছে। আমারে মুসলমান বানাইয়া স্যায় সোয়াব কামাইবে। পদম তো অলরেডি মুসলমান হইছে। পাককি মিঞা পদমের নাম দিছে মাকছুদার রহমান, আর বলছে ডাকনাম পরে ঠিক করবে, আপাতত পদমই থাকুক।’ 

‘কী করে পদম? কাইল্লা কবির তো আমারে কিছু বলে নাই?’ জিজ্ঞাসা করল জাহেদ। 

‘বলে নাই, কারণ এতে বলার মতো কিছু কি আছে? হিন্দুয় মোসলমান হইছে, কুমিরে তো আর মানুষ হয় নাই’, তপন বলল মুখ ঢোলতা-তোলতা করে। 

জাহেদ বলল, ‘ঠিক আছে। কিন্তু আমি জানি না, তুই যেমনে হউক মিতুঞ্জয়রে একটু চরমোনাইয়ের খাসি খাওয়াইবি, তপন।’ 

তপন বলল, ‘এক পিস তাইলে পকেড়ে ভইর‍্যা হালাই?’ 

.

নৌকা রওনা দেবে দেবে। বড় নৌকা। জাহেদ তার বাবাকে বলল, ‘এত বড় নৌকা, বাবা?’ বাবা বললেন, ‘গয়নার নৌকা।’ জাহেদ তাকিয়ে দেখতে লাগল ওই পেটমোটা, কিছুটা চালকুমড়া ধাঁচের নৌকাটাকে। নৌকার ছইতে ওরা দুই বড় বিড়ালের ছবি এঁকে রেখেছে। জাহেদের খুব ইচ্ছা হচ্ছে যে, নৌকার মাঝি ছোটকাকাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘বিড়ালের ছবি কেন? এ দুটা কি ইলতুতমিশ যে আছে তার নাতি-নাতনিদের বিড়াল?’ 

তখন ছোটকাকা বাসেত নামের লোকটাকে চিল্লিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নৌকা ছাড়মু? ইলতুত্‌মিশ কাকায় দোয়া পাড়াইছে?’ জাহেদ খেয়াল করল তিনি ইলতুত্‌মিশকে বলেছেন ইলতুত্‌মিশ। আশ্চর্য! 

বাসেত শরীর টান টান করে দাঁড়ালেন মাস্তুলের পাশে, পাশের দড়িতে হাত রাখলেন আর নদীর অন্ধকার গর্ভের দিকে তাকিয়ে এবার চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘দোয়া লইয়া আর কী হইবে? সব ভ্যাজতাইয়া গেছে।’ 

জাহেদ ভাবতে লাগল, কী ভেস্তে গেছে? কী? তার হাতে তো বোতল, পকেটে তাবিজ, মনের মধ্যে দোয়া–সবই আছে। তাহলে? শুধু আকাশে তারা দেখা যাচ্ছে না। উল্টো আকাশের দেশের পেছন দিকের মেঘের গম্বুজগুলো থেকে এখনও ওই একটু পরপর গুড়ম-গুড়ম শব্দ আসছে, ওগুলো এমন যে ওই শব্দ যেন এই পৃথিবীতে ঘটছে না, ঘটছে দূর টরাস তারামণ্ডলীর উত্তর-পশ্চিম পাশের বি-টাইপ নক্ষত্রদের দেশে, যেখানে আছে এই একইরকম নদীওয়ালা আরেক পৃথিবী। জাহেদের তবু বিশ্বাস, আড়িয়াল খাঁ আসতে আসতে আকাশে তারা ফুটবেই। কিন্তু হঠাৎ তার খেয়াল হল-বাবা তো নৌকায় নেই! 

একদম নৌকায় উঠবার মুখে কাশেমকে ধরে বসেছেন লরেন্স এবং অন্য দুই লোক, যাদেরকে জাহেদ চেনে না। জাহেদ শুনল লরেন্স তার বাবাকে বলছেন, ‘কাশেম, ওই বিছা মণ্ডল লোক ভাল না। পানি পথে মানুষের শরীর ফেলাইয়া দেওয়ার তার নাম আছে আট হাজারের ওই দিকে। ভাসানচর, লালখারাবাদের ওইদিকে। তুমি যাইয়ো না।’ 

জাহেদ দেখল হায়দার চাচা এ সময়ে তার বাবাকে একরকম টেনে নৌকায় তুললেন। জাহেদের মনে হল, এই-ই ভাল। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো! এত দূর এসে তার বাবা কী এসব অকাজের গল্প করছেন ঘাটের লোকজনের সাথে? 

ঘাটের লোকজন বলতে মোটামুটি এই তারা-ই। আর এবার জাহেদের চোখে পড়ল সেই চতুর্থ মানুষটা, যিনি অন্যদিকে ফিরে ছিলেন বলে তখন পাককি মিঞার ভাতের হোটেলে জাহেদ তাকে চিনতে পারেনি, কিন্তু এখন লরেন্সের হাতের টর্চ নদীর ঘাটে কী একটা খুঁজতে গিয়ে সেই লোকের মুখে আলো ফেলতেই জাহেদ চিনে ফেলল তাকে। তার বুক ছ্যাঁৎ করে উঠল। ‘ওমা, এ যে দেখি ফোরকানউদ্দিন, হোমিও প্রচার ভবনের মালিক ফোরকান, শয়তান ফোরকান’, মনে মনে বলল সে। 

ফোরকানউদ্দিনের এক রুমের বাড়ি ভাটিখানা রোডের বড় পূজার মণ্ডপের দিক থেকে নিউ ভাটিখানার দিকে আসবার পথে হাতের ডানে, তারই ‘হোমিও প্রচার ভবন’ সাইনবোর্ড টানানো দোকানের পেছনে। ওই সাইনবোর্ডটার এক পাশে লেখা: ‘বাসক সিরাপ – সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া ও ব্রংকাইটিসের মহৌষধ’; অন্য পাশে: ‘পৃথিবী বিখ্যাত বোরিক-এর ফর্মুলায় আর্নিকা হেয়ার অয়েল।’ 

মাত্র ক’মাস হবে মা-র জন্য ওই একটা আর্নিকা হেয়ার অয়েল কিনতে ফোরকানউদ্দিনের দোকানে গিয়েছিল জাহেদ। তখন দুপুর, একদম ভর দুপুর, যখন কিনা পুরো ভাটিখানা বইঠো ও তার ডজনখানেক বন্ধু আর বইঠোর শতভাগ খাকি রং প্রেমিকা দিলারার দখলে। জাহেদ সামনের পর্দা সরিয়ে দোকানে ঢুকে ডেকেছিল, ‘ফোরকান মামা, ফোরকান মামা।’ ফোরকানউদ্দিনকে মামা বলে ডাকে তারা সবাই, কারণ ফোরকান ছেলেপেলেকে দেখলেই জিজ্ঞাসা করেন, ‘আমার ভইন কেমন আছে? আরে বোকা, তোমার মা-র কথা জিগাই।’ 

দোকানে একটা লোকও ছিল না, এমনকী ফোরকানউদ্দিনের সঙ্গে কাজ করা কাইল্লা কবিরের বন্ধু পদমও না। জাহেদ পদম যে নেই তা বুঝেও এবার ডাকল, ‘পদম, পদম।’ একটু পরে ভেতর দিক থেকে ফোরকান মামার ডাক ভেসে এল, ‘কে? দুপারবেলায় কেডা?’ 

জাহেদ বলল, ‘আমি জাহেদ।’ 

‘কারে খোঁজতে আসছ? আমারে নাকি পদমরে? পদম নাই, পদম কাউখালি গেছে সাজ-এর লগে।’ সাজ ফোরকানউদ্দিনের ছোট ছেলে, তাকে হালকাপাতলা চেনে জাহেদ। সে বলল, ‘কাউরে খুঁজতে আসি নাই, মামা। মা-র একটা আর্নিকা তেল লাগবে। আর আপনার দোকানে তো দেখি এখন সেলাই মেশিনও পাওয়া যায়!’ 

‘ঢাকার এল মল্লিক দোকান থিকা মেশিন আনছি জাহেদ, সেলাই মেশিনের এখন অনেক ডিমান্ড। তুমি ভিতরে আও, আর্নিকা এইখানেও আছে।’ 

জাহেদ এক সরু পথ দিয়ে বাইরের কাউন্টারটা কোনোমতে পার হয়ে তারপর দুটো চেয়ার সরিয়ে, তারপর ক্যাশ বাক্সে হাতের ঠক-ঠক দুই বাড়ি মেরে দোকানের পেছন দেওয়ালের ঠিক মাঝখানের পর্দা সরাল। বলল, ‘ও মা! মামা, এইডা তো দেখি সুন্দর একটা ঘর। আপনি এইখানে থাকেন? ওইটা কার বিছানা? সাজ-এর? সুন্দর তো!’ 

ঘরটা ছোট, কিন্তু ভাল করে গোছানো। সে দেখল, তাদের বাসার মতই সেখানে নানা ধরনের পুতুল আছে একটা শোকেসের ভেতরে। তাদের বাসার পুতুলগুলোর মতোই বেশ কটা পুতুল একসঙ্গে ‘হ্যাল্লো’ বলে ডেকে উঠল জাহেদের উদ্দেশে। 

‘ঘর সুন্দর রাহে পদম। তোমার মামি মারা যাওয়ার পর থিইক্যা আর সুন্দর!’ 

জাহেদের মনে পড়ল গত বছর ঝালকাঠি বাবার বাড়ি যাওয়ার সময়ে লঞ্চ ডুবে মারা গিয়েছিলেন ফোরকানউদ্দিনের স্ত্রী। ‘হ্যাঁ, মনে আছে’, বলল সে, ‘জানেন মামা, তখন থেকে লঞ্চ আমার ভয়। তা আজ যে আবার সাজ ও পদম লঞ্চে করে কাউখালি গেল?’

হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন ফোরকানউদ্দিন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন, ‘বাদ দাও। জেবনটা বড়ই দুঃখের।’ 

জাহেদ এগিয়ে গেল তার মামার দিকে। তিনি ঘরের বড় খাটটায় শোওয়া, তার পরনে সাদা এক স্যান্ডো গেঞ্জি, আর সবুজ-কালো ফুলের ফুট-ফুট এক লুঙ্গি। জাহেদ বলল, ‘ থাক মামা, কানবেন না। আমি শুনছি পানিতে আর আগুনে যে মরে, সে বেহেশতে যায়।’ 

ফোরকানউদ্দিন জাহেদকে পাশে বসালেন, বললেন, ‘দুপুরের ভাতঘুম ঘুমাইতেছিলাম। গলা শুইন্যাই বুঝছি, এইডা আমাদের লাল-টুকটুকা পুরুষ টিয়াপাখি জাহেদ। হা-হা। শোনো, বেহেশতে গিয়া কী লাভ যদি এই সোন্দর পিরথিবিই না পাইলা? কিন্তুক তোমার মামিরে ছাড়া পিরথিবিও কী আর সুন্দর!’ 

আবার কাঁদতে লাগলেন তিনি—-ফিচফিচফিচ। জাহেদ দেখল মানুষটার দু’গাল বেয়ে পড়ছে পানি, আর তা ঝরঝর ভিজিয়ে দিচ্ছে তার বালিশ I শোকেসের ভেতরে থাকা পুতুলগুলোর মধ্যে যেগুলো সবুজ-কালো মেশানো কাপড়ের এবং তার কাছাকাছি কোনো রঙের, তারা একযোগে বলে উঠল, ‘কী দুঃখ! কী দুঃখ!’ 

জাহেদ পুতুলগুলোকে বলবে চুপ করতে, সে বিছানা থেকে উঠে দেখতে যাবে যে, সাজ-এর বালিশের ওপরে কী লেখা ওই কাগজে-’হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ… ঈদ মোবারক… আলফালফা গোল্ড টনিক ও হোমিও ভিটামিন’ লেখা মোটা তিন লাইনের নিচে ওখানে কী লেখা গুঁড়িগুঁড়ি, তখনই ফোরকানউদ্দিন মামা ঝাঁ করে তার মোটা ডান হাতটা দিয়ে ধরে বসলেন জাহেদের ডান হাত এবং সেই হাত সোজা কোনোরকম কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই টেনে নিয়ে গেলেন নিজের লুঙ্গির ওখানে, বললেন, ‘ধরো, এইটারে ধরো, জাহেদ সোনা।’ 

জাহেদ জিনিসটা লুঙ্গির ওপর থেকেই ধরল, আর প্রচণ্ড বিস্মিত হল সেটার বিশাল মোটা সাইজ অনুমান করে এবং ওই অনুমানের সাথে সাথে সে পাথর হয়ে গেল পুরোপুরি। 

ফোরকানউদ্দিন তখন বিড়ালের কাউকাউমেঁয়াওঘরঘর ধরনের এক গলায় বলে চলেছেন, ‘জাহেদ, জাহেদ, জোরে ধরো, লুঙ্গির নিচ দিয়া ধরো, এর বেশি তো আর কিছু বলি নাই, নাকি জাহেদ, আমার দোকানের সকল প্লাসটিক ফোমশিট, রাবার ফোমশিট, আহ জাহেদ মোগল হালকা চপ্পল, আরনিকা হেয়ার অয়েল, বাসক সিরাপ, ন্যাংটো মাইয়াদের ভিউকার্ড, জিনাত আমানের ভিউকার্ড, ফারাহ ফসেটের ভিউকার্ড, লুক ভ্যানিশিং ক্রিম, গ্যাকোটাচ, গ্যাকোটাচ ফ্লোরাইড ডেন্টাল ক্রিম, আহ জাহেদ গ্যাকোটাচ ফ্লোরাইড ডেন্টাল ক্রিম, আহ জাহেদ যার মইধ্যে আছে সোডিয়াম মনোফোলোরোফসফেট, আর গ্যাকোটাচ ডেন্টাল ক্রিম, সব সব তোমার জন্য ফ্রি জাহেদ, তুমি খালি শক্ত কইর‍্যা ওইটারে পাকড়াইয়া ধরো, তুমি তো বড় হইছ জাহেদ, নিশ্চিত হস্তমৈথুন তো করো, উহা অনেক ভাল জিনিস, সর্বদা ওইটা করবা, ওতে শরীর মন জাহেদ গ্যাকোটাচের মতো জাহেদ ঝরঝর হয় জাহেদ মিল্লাত ঘামাচি পাউডার জাহেদ।’ 

জাহেদের মনে পড়ল মালেক হুজুর কীভাবে তাকে চাখারে সাবধান করেছিলেন বিয়ের আগ পর্যন্ত খারাপ চিন্তা করে নিচে ওখানে হাত না দেবার ব্যাপারে—’নিজে নিজে নিজের নুনু ঘাড়াঘাড়ি পেরচণ্ড খারাপ কাম, জাহেদ। তাতে স্মৃতি নষ্ট হয়, নানা ব্যাধি হয়’, তাকে বলেছিলেন হুজুর। 

ফোরকানউদ্দিন জোরে মেঁয়াওঘরঘর করে দেহটা গড়িয়ে মুচড়িয়ে বলে উঠলেন, ‘অ্যাই পোলা, কী কইলাম? ওইডারে পাকড়াইয়া ধরো আহ্‌হা জাহেদ আহ্হা গ্যাকো গ্যাকো।’ তিনি এবারের জোর গলায় ওই ‘পাকড়াইয়া ধরো’ বলেছেন, বলে নিজের শরীর বালিশ থেকে সামান্য তুলে জাহেদকে কাছে টেনে নিয়েছেন এবং তার গালে চুমু দেবেন-দেবেন করে তার মুখটা বাড়িয়েছেন জাহেদের দিকে, সে তার হাত লুঙ্গি থেকে হঠাৎ সরিয়ে নিয়ে তার কপাল বরাবর দাঁতের এক প্রচণ্ড কামড় বসিয়ে দিল—খাঁক। শোকেসের যত পুতুল আছে সাজ ছেলেটার—উলের পুতুল, ঝিনুকের পুতুল, তুলার পুতুল, যত ত্যানা-ন্যাকড়ার সস্তাদর্শন ধুলোমাখা পুতুল, ওদের যেগুলোর রঙ সবুজ-কালো, কিছুটা সবুজ, কিছুটা কালো, কিন্তু সবগুলোই ধুলোময়লায় ধোয়া-ধোয়া রং, তারা একসঙ্গে তখুনি বলে উঠল, ‘খানকির পোলা গ্যাকোটাচ, পালা।’ 

জাহেদ ওদের এ আহ্বান শুনেই ছুটে দৌড়। সে পর্দা সরিয়ে দোকানে, তারপর দুই চেয়ার সরিয়ে কাউন্টারের কোনায়, তারপর ক্যাশ বাক্স লাফিয়ে পার হতে গিয়ে আবার সেখানে হাত দিয়ে দুই ঠং-ঠং বাড়ি, তারপর ওই দুই হাত মুখের কাছে নিতেই রক্ত। তারপর সেই রক্ত মোছার জন্য সে হাতে নিল ‘মায়া’ বড়ির একটা প্যাকেট, যার গায়ে লেখা, ‘শুভদিন খুব কাছেই। তারপর লেখা, ‘ইনি মমতার প্রতীক। কারণ স্বামী ও সন্তানের অনাবিল সুখের স্বপ্নকে ইনি পূরণ করেছেন অত্যন্ত নিপুণ এক পদ্ধতিতে- যার নাম মায়া। যেদিন থেকে…’–নাহ্ জাহেদ তার দাঁতের রক্ত, ঠোঁটের রক্ত মাখিয়ে ফেলল ওই ‘যেদিন থেকে’-র পরে, সে সব মাখিয়ে ফেলল প্যাকেটের বাকিটা জুড়ে। আর তখন ফোরকানউদ্দিন তার ডান চোখের ওপরে বেশ টিপটিপ অঝোরে নামতে থাকা কপালের রক্ত সামান্যও না-মুছে সে অবস্থায়ই জাহেদকে বলে বসেছেন, ‘তোমায় পায়ে ধরি ভাগিনা, তোমার পায়ে ধরি, কাহাকেও বলিও না, তোমার পায়ে ধরি।’ 

তার সে আকুতির মধ্যেই জাহেদ এবার রাস্তায়, যেখানে বইঠো-দিলারাদের বড় দলটা দেখা গেল উড়ে উড়ে যাচ্ছে রাস্তা ছেড়ে দোকানগুলোর ছাদ বেয়ে, এক ছাদ থেকে আরেক ছাদ, এক কার্নিশ থেকে আরেক কার্নিশ, এক ঢেউটিন থেকে আরেক ঢেউটিন, এবং বইঠো ওই দৌড়ের মধ্যেই দিলারার পাছায় ঘুরে ঘুরে যে খেউ-ক্রেঁও-ক্রেঁওটা করছে তা শোনাচ্ছে গ্যাকোটাচ-গ্যাকোটাচ মতো—আর কিছুই নয়। 

সেই ঘটনার পরে ফোরকাউদ্দিনের সঙ্গে জাহেদের আজই আবার প্রথম দেখা। সে দেখতে চাইল লোকটার কপালে কোনো কাটা দাগ আছে কি-না। লোকটাই এ সময় এগিয়ে এলেন তার দিকে, ফিসফিস করে তাকে বললেন, ‘আমি খুশি যে, তুমি কারুকেই বলো নাই। আমার সঙ্গে এইহানে দেখা হইল বলে যদি নৌকায় গ্যাকোটাচের গল্প কাউরে বলার জন্য তুমি উসখুশ করো, তা হইলে জানবা যে, তোমার বাবার লগে নদীতে আইজ রাইতে তুমিও ফিমিশ।’ 

.

নৌকা ছাড়ল। ছাউনির ভেতর দুই দিকে বেঞ্চিমতো পাতা। সেখানে একপাশে বসেছে জাহেদ, তার বাবা ও হায়দার বামন; অন্য পাশের বেঞ্চিতে ওমর আলি, বিছা মণ্ডল, ফোরকানউদ্দিন ও বাসেত। বাসেত নামের লোকটা জাহেদকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোন ক্লাসে পড়ো?’ 

জাহেদ তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বাবাকে বলল, ‘বাবা আমি ছইয়ের ভিতরে থাকব না। নদী দেখব।’ 

ওমর আলি বাসেতকে বললেন, ‘ছেলেটাকে ছইয়ের বাইরে নিয়া যাও। সে নদী দেখবে।’ 

কাশেম বললেন, ‘দাঁড়াবা না, জাহেদ। বসে বসে নদী দ্যাখো, অসুবিধা নাই।’

ওমর আলি কাশেমকে বললেন, ‘দেশের প্রেসিডেন্ট। আহা, তারে এইভাবে মারল?’ 

কাশেম বললেন, ‘আমি তো এখনও কিছুই বুঝতে পারতেছি না। মারল কারা? শুনছি তারে চিট্‌টাগাং সার্কিট হাউজে মারা হইছে। শুনছি মেরে একদম তুলা-তুলা করে দিছে।’ 

হায়দার বললেন, ‘গুলিতে মারলে তো সেইটাই হয়। আর্মি কি আর কাউরে আমাদের এইখানকার গুপ্তা পোলাপাইনের মতো দাও দিয়া মারে? আমি কি আর মানুষ কোপায়? আর্মি কি আর গলা কাটে? হা-হা।’ 

ফোরকানউদ্দিন তার গলা কেশে নিলেন এবং সেই কাশির মধ্য দিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন যে, গত রাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যার ব্যাপারে তার চেয়ে বেশি আর কিছু কেউ জানে না। কারণ তার শুধু হোমিওপ্যাথির দোকানই নেই, তার দোকানে এখন বোম্বে সুইটস-এর চানাচুর থেকে নিয়ে কাজল ব্রাদার্সের নোটবইও পাওয়া যায়। তিনি বললেন, ‘জিয়া মারা গেছে কাল রাইত চারটার দিকে। আগের দিন শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর মেজর জেনারেল মঞ্জুর ও খালেদ নামের এক মেজর মঞ্জুরের অফিসে গিয়া মিটিং করে। মিটিং হয় আমাগো বরিশালের কর্নেল দেলওয়ারের বাসাতেও। হোনেন, লেফনেন্ট কর্নেল মতি নামের একজন করলডা কী? সার্কেট হাউজে গিয়া সে পেরসিডেন্টের খোঁজ খোঁজ খোঁজ। তারে পাইল পরে ৫ নাম্বর রুমে। রুমের দরজায় এইবার সে কী লাখি। তারপর পেরসিডেন্ট দরজা খোলতেই ঠা-ঠা-ঠা-ঠা, এইরকম।’—তিনি তার হাতের অদৃশ্য মারণাস্ত্র শূন্যে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গুলি করলেন নৌকায় বসা সবাইকে এবং তার শেষ ঠা-টা থামালেন ঠিক জাহেদের মস্তক বরাবর। 

তার গল্প শুনে নৌকার সবার গা হিম হয়ে এসেছে। একটা শব্দও নেই কোনোদিকে। ওই মানুষটার মুখনিঃসৃত ঠা-ঠা-ঠা তাদের মাথায় ঠাডা বজ্র ফেলে বসেছে যেন। তাই ফোরকানউদ্দিন এ সুযোগটা ছাড়লেন না, ঝটাঝট বলে দিলেন, ‘ওই লেফনেন্ট কর্নেল মতি ফ্লোরে পইড়া যাওয়া পেরসিডেন্টের মুখের ওপরে শেষ করল পুরা একটা ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিন কী তা বোঝেন আপনেরা? গুল্লি। পুরা একটা ম্যাগাজিন! আহ জিয়া, আহ বেচারা জিয়া।’ 

জাহেদের তক্ষুনি মনে পড়ল সেদিন দুপুরে কীভাবে এই লোক তাকে বলছিলেন, ‘আহ জাহেদ, লুঙ্গির নিচ দিয়া ধরো, আহ জাহেদ, আহ জাহেদ গ্যাকোটাচ সোডিয়াম মনোফ্লোরোফ্লোরো জাহেদ।’ 

ফোরকানউদ্দিন ‘আহ জিয়া, আহ বেচারা জিয়া’ বলতে বলতে যে প্রেসিডেন্টের প্রতি প্রচণ্ড মায়ার থেকে নৌকার ডালি ও কোলবাতা ছেড়ে ধমা‍ করে একদম চালির ওপরে পড়ে গিয়েছেন, সেটার কোনো হুঁশই দেখা গেল লোকটার নেই। তিনি তখনও মুখে বলে যাচ্ছেন, ‘ঠা-ঠা-ঠা। পুরা একটা ম্যাগাজিন একটা মাইনষের মুখে, স্যায় আবার দেশের পেরসিডেন্ট।’ 

সবাই হেসে উঠেছে তার এই নৌকার চালিতে পড়ে যাওয়া দেখে। সবার হাসি দেখে হাসল এমনকী জাহেদও—তবে অতি সামান্য, অতি সামান্য, যাকে বলা যায় ঠিক হাসি না, হাসিপ্রতিম এক মুখভঙ্গী। ‘হাসিপ্রতিম’ কথাটা ভাবতেই তার মনে পড়ে গেল এনায়েত স্যারের কথা, স্যারের বলা ‘গোলাপপ্রতিম’, ‘হাঁসসদৃশ’ ধরনের শব্দগুলো। কোথায় আছেন আজ তার স্যার? আজ রাতে তারা যদি এই নৌকায় বিপদে পড়ে, তাহলে স্যার কী তার লালমনিরহাটের কম্যুনিস্ট পার্টির বাহিনী নিয়ে বাঁচাতে আসবেন জাহেদকে, পারভিন তারামণ্ডলীর ভাই জাহেদকে? 

ওমর আলি নিজে ফোরকানকে বললেন, ‘অনেক হইছে জিয়াউর রহমান। কেউই নিশ্চিত করে কিছু জানে না। সব ওইরকমই যদি হইত, তা হইলে সবাই বলত না যে, জিয়াউর রহমান পালাইয়া আসছেন বরিশালে, লুকাইয়া আছেন লাখুটিয়ার খালে। হুম। এখন ওঠো ফোরকান। সঙ একটা!’ 

তারপর আবার সবার হাসি। কাশেমও হাসলেন। কিন্তু তার বুক কাঁপা-কাঁপা হাসিটা কেউই দেখল না, কারণ তালতলী ঘাট ছাড়তেই নৌকা হঠাৎ, একদম হঠাৎ গিয়ে পড়ল এই রাত নটাতেই দুপুররাতের, রাত্রি তিনপ্রহরের তমসাবৃত সাড়হীনতার গর্ভে। 

.

জাহেদ ছইয়ের বাইরে নৌকার সামনের আন্নির দিকটায় গেল নৌকার চালির ওপরে প্রায় বসে বসে। নৌকাটা দুলছে যথেষ্টই। তখুনি তার ভয় লাগা শুরু হল, এই অনুভূতির হাতে ঘিরে পড়া শুরু হল যে, সে সাঁতার জানে না। 

ও কী অন্ধকার! জাহেদ বলল মনে মনে। খালি দূরে দূরে দু-একটা নৌকার মিটমিটে আলো দেখা যাচ্ছে। নদীর পাড় বলতে কিছুই নেই। কোত্থেকে থাকবে? কে নৌকা চালাচ্ছে তা-ই তো বোঝার জো নেই কোনো। জাহেদ বাসেতের হাত ধরে থাকল আর ভাবতে লাগল, যতো যা-ই হোক, আড়িয়াল খাঁ আসতে আসতে আকাশে তারা ঠিক উঠবে, আর তখন দেখা যাবে অঙ্গরূপাদেরকে—নদীর শুশুক, ডলফিন, সিল সব, এমনকী পাশের নৌকার যাত্রীদেরকেও। 

 নদীর মাঝখানের কোনো এক জায়গা থেকে এ সময় ডাক উঠল, ‘কার নৌকা যায়?’ 

জাহেদ তার থেকে দশ-বারো ফুট দূরত্বে শরীরের বেশ খানিক ওপরের দিকের কোথাও থেকে শুনল কে যেন উত্তর করল, ‘ইলতুত্‌মিশের নৌ-কা-আ।’ অন্য নৌকার সেই আগের জন এবার আরও দূর থেকে চিল্লিয়ে উঠল, ‘কে বায়? শিফা? নাকি জানদার? তোমাগো নৌকারে মরশুমে কোপায় ক্যান?’ 

জাহেদদের নৌকা থেকে সেই লোকই ডেকে উঠল, ‘বাই আমি। ছোটকাকা, জানদার। ভুল দ্যাখতেয়াছ। নৌকা সিড়িতে আছে-এ-এ।’ 

এরপর সব আবার চুপ। কিন্তু এই এতক্ষণে চারপাশের সবটা দেখা যাচ্ছে একটু একটু করে। জাহেদ লক্ষ করল, অন্ধকার পৃথিবী আসলে অতখানি ঘনান্ধকার না যতটা মনে হয়, যতটা এরকম একলা নদীতে মেঘগুড়গুড় রাতে মনে হতে মন চায়। কারণ—এই কারণটাই বিমোহিত করল তাকে—নদীকে ঢেকে দেওয়া, নদীকে আচ্ছন্ন করে ধরা আকাশের যে-গোল বাটি, সেই বাটিটাই এমন যে, তার কালো শেপের মাঝখানে লুকিয়ে চুরিয়ে থাকা এক আলোর ছাপ সামান্য হলেও হালকা করে বসানোই থাকে, প্রলেপের মতো। অতএব একটা আলোর আভা নদীতে পড়ছেই, যদিও চাঁদ নেই, যদিও একটা তারা নেই কোনোদিকে। একদল অদ্ভুতুড়ে পাখি এই এত রাতে তাদের নৌকার লাইন ধরে যেতে যেতে ডাক দিয়ে গেল আজব কদো কদো স্বরে। জাহেদ এ সময়ে তার পাশে এসে দাঁড়ানো তার নতুন পরিচয় হওয়া বামন হায়দার চাচাকে বলল, ‘হায়দার চাচা?’ 

হায়দার বললেন, ‘হুঁহ?’ 

জাহেদ সাহস করেই তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি বড় হন নাই কেন?’ 

হায়দার জাহেদের পিঠে হাত রাখলেন। জাহেদ বুঝল হায়দার বসে আছেন তার পাশেই, নৌকার কোলবাতায়। তিনি তার এক হাত নদীর পানিতে দিয়ে রেখেছেন, তাই জাহেদের পিঠটাও এখন সেই পানিতে ভিজে-ভিজে গেছে সামান্য। হায়দার উত্তর দিলেন, ‘আল্লাহয় চায় নাই যে আমি বড় হই, বাবা।’ 

জাহেদ নৌকার ছইয়ের গায়ে আঁকা বিড়ালদুটোর কথা মনে করে কী ভেবে বলে উঠল, ‘যেমুন আল্লাহয় চায় নাই যে, বিড়ালগুলা মানুষ হউক। যেমুন আল্লাহয় চাই নাই যে, কুকুরগুলা মানুষ হউক।’ 

হায়দার হাসলেন, বললেন, ‘তুমি তো দেহি কথা বলো শরৎচন্দ্রের নায়কদের মতোন। হা-হা। কুকুররে মানুষ বানাইতে না চাইতে পারে আল্লায়, কিন্তু আমার ওই আল্লায় আমারে অন্য সবাইর মতো মিমিমাম লম্বা করতে চাহিল না ক্যান? এর কোনো উত্তর আছে তোমার কাছে? 

জাহেদ তার যুক্তি বুঝল। সে হয়তো এবার উত্তরটার জন্যই তাকাল আকাশের দিকে, আর তারপর যেই-না লম্বা এক বজ্রবিদ্যুৎ কোনো শব্দ ছাড়া আকাশে ঝিলিক দিয়ে উঠল খাপখোলা তরবারির মতো, জাহেদ দেখল—নৌকার মাঝি ছোটকাকার পাশে তিন-চার সারি ইটের ওপরে বসে আছে বিছা মণ্ডল, আর বিছা মণ্ডলের সঙ্গে আছে আরও দুটো ছেলে। ওরা কারা? ওরা নৌকায় উঠল কখন? সে ভাবল কথাটা সে জিজ্ঞেস করবে তার হায়দার চাচাকে এবং এ কথার দারুণ বুদ্ধিতে ভরা একটা উত্তরও নিশ্চিত পেয়ে যাবে তার কাছ থেকে। সে তার মুখটা খুলতে যাবে, তখন আরেকবার বিদ্যুৎ চমকাল। এইবার বিদ্যুতের পেছন দিকে মোটা রশি দিয়ে মোড়ানো এক বান্ডেল গুড়ড়-গুড়ড় শব্দও হল আকাশের ভেতরঘরের দিকে কোথাও। ছইয়ের ওখান থেকে তখন জাহেদ শুনল তার বাবা তাকে ডাকছেন ‘জাহেদ, জাহেদ’ বলে। 

জাহেদ উত্তর দিল, ‘কী বাবা?’ আর সে হায়দারকে জিজ্ঞাসা করল, ‘প্রেসিডেন্ট জিয়াকে ওরা মারল কেন চাচা? সে কি আসলেই মারা গেছে, নাকি সে সত্যি লাকুটিয়া খালে আইস্যা পালাইছে?’ 

তার প্রশ্নের উত্তরটা দিল বিছা মণ্ডল। সে গলুইয়ের ওখান থেকে বলল, ‘লাখুটিয়া খাল পেরসিডেন্ট জিয়া নিজের হাতে কাটছে। তো, মরার সময়তে নিজের খালে নিজে পিছলাইয়া পড়বে না? হা-হা-হা।’ 

জাহেদের ভাল লাগল না বিছা মণ্ডলের এই উত্তর। সে উল্টো তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনে ইটের উপর বসা কেন? নৌকায় ইট লাগে কী করতে? আপনার পাশে অন্য দুইজন কারা? তারা দুইজন আমাদের সাথে পরিচয় হয় নাই ক্যান?’ 

আন্নির কোন উঁচু থেকে মাঝি ছোটকাকার উত্তর শোনা গেল, ‘বোঝো, এইবার বোঝো ঠ্যালা।’ 

.

জাহেদ বুঝতে পারল নৌকা বড় নদীর কাছাকাছি চলে এসেছে। উত্তেজনায় তার বুক এতই দুরুদুরু করতে লাগল যে, মনে হল বুকটা গলা দিয়ে মুখ দিয়ে বের হয়ে হাতেই উঠে আসবে। সে বাসেতকে খুঁজল। পেল না। না, পেল। এখন আর আগের মতো অত গাঢ় অন্ধকার নেই। সে দেখল, বাসেত বসে আছেন আরেকটা ইটের লাইনের ওপরে—চার পাঁচটা ইট একটার ‘পরে একটা রাখা এক স্তম্ভ মতো। জাহেদ বুঝতে পারল না বাসেতকে সে কী বলে ডাকবে, চাচা না ভাই? সে হড়বড় বলে বসল, ‘বাসেত ভাই চাচা, আমরা কি আড়িয়াল খাঁ আসছি?’

তখনই পাশের অন্ধকার থেকে একটা ভেজা হাত তার গালে ছুঁইয়ে দিয়ে বামন হায়দার তাকে বললেন, ‘সেইটা তো আমারে জিজ্ঞাসা করলেই পারো। আড়িয়াল খাঁয় ওই চর তো আমার সুম্মুন্দির। আমি প্রায়শই এইখান দিয়া যাতায়াত করি।’ 

জাহেদ লজ্জা পেয়ে গেল। বলল, ‘আমি আপনারে দেখি নাই, চাচা। আপনি কই ছিলেন এতক্ষণ? আপনি কি দেখছেন যে, ওরা নৌকায় ইট নিয়া যাইতেছে? কী জন্য? আর কতক্ষণ থেকে আমি জিগ্‌গাস করতেছি, আমরা কি আড়িয়াল খাঁ আসছি, কিন্তু কেউ কিছু বলে না।’ 

হায়দার বললেন, ‘ইট নিয়ে যাই আমারদিগের বইয়ের দোকান বানানোর কামে।’ 

জাহেদ বলল, ‘ইম্পসিবল।’ ইংরেজি ইম্পসিবল কথাটা বলে সে একরকম লজ্জাই পেল, তবু আবারও বলল, ‘ইম্পসিবল। ত্রিশটা ইট দিয়া কোনো বইয়ের দোকান, কোনো দালান হয় না। আমরা কি আড়িয়াল খাঁ আসছি চাচা? সেইটা বলেন।’ 

হায়দার ঘাবড়েই গেলেন বাচ্চা ছেলের ধমক খেয়ে। তিনি নদীর পানিতে তার হাত ডুবিয়ে, যার ফলে জাহেদের কানে শব্দ এল একটা গড়গড় মতো, বললেন, ‘ওই দিকে তাকাও। তুমি উল্টা তাকাইয়া রহিয়াছ। আমরা এখন মধ্য চরবাড়িয়া পার হইলাম। আর তুমি তাকাইয়া রহিয়াছ জিয়াউর রহমান আছে যেইদিকে। পেরসিডেন্টের জন্য এত মায়া। উইইদিকে তাকাও। আমরা এখন পার হইতেয়াছি মধ্য চরবাড়িয়া। এখন নদীর দুই পাশে খালি আমরুল, জারুল আর গাওছা লতা, আর খালি বনচাইলতা, খালি বনচাইলতা। আমার এইসব মুখাস্ত। একটু পরে নদী যাইবে কান্নি খাইয়া হালকা ডাইনে, আর তহন শুরু হইবে তেলাকুচ, তেল, জিকা আর গাব—গাব আর গাব। নারিকেল ও শুফারি তো থাকিবেই। ওই গাবের ঝাড় যেই শ্যাস হইবে, তখন তুমি বোঝবা যে আড়িয়াল খাঁ আসিয়া গেছ। উইই যে তাকাও, তাকাও।’ 

জাহেদ তাকাল। সে ভিজে যাচ্ছে হায়দার চাচার একদম ভেজা, একদম পানি ভরা হাতের ছোঁয়ায়। ভালই লাগছে তার, কারণ শত হলেও মে মাসের গরম। আর তখনই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়া শুরু হল, একদম হালকা গুঁড়ি থেকে গুঁড়ি, এবং জাহেদ দেখল দূরে সামনে কিছুটা আলো-আলো-এক বিশেষ আলোর তিন চার ধাপ-ধাপমতো জিনিসটাকে এই একবার মনে হচ্ছে ওটা তার দিকে আসছে, আবার মনে হচ্ছে তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। 

হায়দার চাচা বললেন, ‘ওই তো আমারদিগের আড়িয়াল খাঁ। দেখছ না? ওই যে আড়িয়াল খাঁ-কীৰ্ত্তনখোলার মোড়ে, যেমুন তোমারদিগের ভাটিখানা-আমানতগঞ্জের মোড়, সেমন মোড়ে বরিশাল-ঝালকাঠির লঞ্চ যায়। এখন তো রাত নয়টা পঁয়তাল্লিশ হবে, দশটাও হইতে পারে। আমার তো মনে কয়, ‘এমভি পঙ্খীরাজ’ যাইতেয়াছে। বদরুদ্দীনের লঞ্চ ওইটা। ঝালকাঠির মানুষ লইয়া সে যাইতেয়াছে বরিশাল লঞ্চ ঘাটে। বোঝলা?’ 

‘পঙ্খীরাজ’ কথাটা শুনে জাহেদের মনে পড়ল ঈমানের সেই বিখ্যাত কথা: ‘ওরে পঙ্খী রে পঙ্খী, তোর কত যে নিশানা!’ 

ছইয়ের ভেতর থেকে জাহেদের বাবার চিৎকার ভেসে এল, ‘জাহেদ, বাইরে বৃষ্টি হয়। ভিতরে আসো। তোমার ওমর চাচা তোমাকে ডাকছেন।’ 

জাহেদ উত্তর দিল, ‘না, বাবা। বৃষ্টি শেষ হলে মেঘ যাবে, মেঘ গেলে তারা উঠবে। আড়িয়াল খাঁ এসে গেছে। আড়িয়াল খাঁ দেখা যাচ্ছে। আমি মরে গেলেও এখন ভিতরে যাব না।’ 

জাহেদ শুনল তার বাবা তার ওমর চাচাকে বলছেন, ‘এই আমার ছেলে, ওমর, এই আমার ছেলে। তোমাকে জেলখানায় বলতাম না যে…’

জাহেদ এরপরের কথাগুলো শুনতে পেল না। কারণ তার হায়দার চাচা তার কানের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে ততক্ষণে বলতে শুরু করেছেন, ‘জাহেদ, আমরা এখন পার হইতেয়াছি বড় বড় সবেদা আর আকাশনিমের গাছ। তুমি বাচ্চা দিনের বেলা আসো, তাহা হইলে তোমারে গাছগুলা দেখাইতে পারতাম, আবার শুশুকও। শুশুকগুলা-ডলফিমগুলা হইল নদীর অলংকার। তারা পিঠের মধ্যে নদীর সব মাখাইয়া লইয়া পিঠ দেখাইয়া আবার নদীর নিচে চলিয়া যায়। আর সবচাইতে বড় যে-জিনিস আছে, সে পানিগরু, তবে সে ডাকে কিন্তু বলতে গেলে—মেঁয়াও মেঁয়াও। পানিগরু দেখছ কোনোকালে? একটু সামনে দুই দিকের গাওছা আর হাপরমালীর ঝোপ ঘন হইয়া আসিবে, সেই ঝোপের উপর দিয়া চলিয়া যাবে সবুজ-সবুজ ঢেঁড়সের মতোম দেখতে হাড়জোড়া লতা, সেই লতা খুবোই প্রিয় হয় পানিগরুদের। দেখবায়ানে ওই পানিগরুরা কেমন নৌকার পাশে, নৌকার নিচে ঘাউ দেয়—ভুট্‌টুত। তাহারা মাথা একটু তুলিয়াই আবার ভুট্‌টুত ডুব, আর তাহারা কেমনে তোমাকে ডাকবে ম্যাও ম্যাও। আমার ছোট সন্তানে বলে ‘প্যাঁও প্যাঁও।’ বলে, ‘বাবা, পানিগরু ডাকে প্যাঁও প্যাঁও, পানিগরু ডাকে মিচমিচমিচ। ‘ কেন বলো তো জাহেদ, কেন পানিগরু হাম্বা ডাকে না?’ 

জাহেদ উত্তর দিতে পারল না কথাটার। তবু সবটা সে এক মুহূর্তে কল্পনা করে নিয়ে দুম করে বলে বসল, ‘আমি পানিগরুর গল্প শুনতে চাই না, হায়দার চাচা। আপনি বলেন, যে-ই আমি বললাম যে নৌকায় ইট লাগবে কেন, বললাম যে বিছা মণ্ডল লোকটার সাথে অন্য দুইজন কারা, সেই দুইজন তাদের পরিচয় আমাদের দেয় নাই কেন, কেন আমাদের সাথে তারা ভাত খায় নাই পাককি মিঞার ভাতের হোটেলে, তখন কেন ছোটকাকা মাঝি, জানদার মাঝি উই গলইয়ের উঁচা থিকা বললেন যে, ‘বোঝো এইবার ঠ্যালা?’‘ 

হায়দার চাচা জাহেদকে বললেন, ‘তুমি বাচ্চা ছেলে। আমি ইট নিতাছি আমার বইয়ের দোকানের ভিতের জন্য। সেই দোকানের পার্টনার তোমার আব্বায়ও। আর তুমি কী কী উল্টাপাল্টা ভাবতেয়াছ! কী করবে ওরা ইটা দিয়া? ইটা দিয়া ওরা তোমার বাবার মাথা ফাটাইবে?’ 

জাহেদ হায়দার চাচার হাত খামচে ধরে জোর গলায় বলে উঠল, ‘ওরা দা দিয়া আমার বাবারে মারার পর তারে বস্তায় ভইর‍্যা ওই ইটা বস্তার মইদ্দে দিয়া নদীতে ফালাইবে। আমি সব বুঝি।’ 

এ কথার পরই জাহেদ চিৎকার করতে লাগল ‘আমি সব বুঝি, সব বুঝি-ই-ই’ বলে। 

.

জাহেদের চিৎকার শুনে তার বাবা ছইয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। বৃষ্টি তখনও গুঁড়িগুঁড়ি পড়ছে। তিনি বেরিয়েই বললেন, ‘সর্বনাশ। জাহেদ তোর তো জ্বর আসবে। হায়দার তুমি কী? তুমি দেখ না এতক্ষণ ধরে বৃষ্টি হচ্ছে? আহারে। জাহেদ তুই কোন দিকে?’ 

হায়দার বলতে চাইলেন, ‘কাশেম ভাই, গয়নার নৌকার এই এক সমেস্যা, সাইজে বড়, সব খুঁইজ্যা পাওয়াটি মুশকিলের। আমি আর আপনার ছেলে এই যে এইখানে,’ কিন্তু তিনি জাহেদের কথা শুনে এতই হতভম্ব হয়ে গেছেন যে, তার মুখ থেকে গোঁ-গোঁ ধরনের জোর এক ভয়ার্ত হাওয়া ছাড়া আর কিছুই বেরুল না। 

জাহেদ বলল, ‘বাবা, আমি এইদিকে। বাবা, ওমর আলি চাচা তোমারে জবাই দিতে নৌকায় আনছে। বাবা আমি বস্তা দেখছি, দা দেখছি, ইট দেখছি। ইটের উপরে বসা বিছা মণ্ডল আর দুই ছেলে। বাবা তুমি ওমর চাচারে জিগ্‌গাস করো ওরা কারা?’ 

জাহেদ কথাটা বলে শেষ করতেও পারেনি, নৌকার নিচের দিকে একটা জোর ‘গোঁওপ’ শব্দ হল। হায়দার কোনোমতে এটুকু জাহেদের কানে বলতে পারলেন যে, ‘পানিগরু।’ জাহেদ ওই পানিগরু দেখবার জন্য তার হাতের বাঁ দিকের অন্ধকারে তাকিয়েছে, আর তখনই একদম ম্যাজিকের মতো বৃষ্টির শেষ, তখনই আকাশে তারা ফুটে ওঠা শুরু হল একটা-দুটো… এবং হঠাৎই অনেকগুলো—অনেক, অনেক, অনেক। তার বাবা কাশেম তার গলা শুনে দিক আন্দাজ করে এদিকে হেঁটে আসছিলেন, আর এখন তিনি প্রায় দেখে দেখেই আসতে লাগলেন ছেলের কাছে। তিনি শেষমেশ সেখানে পৌঁছালেন, ছেলের বাড়ানো হাতটা ধরে তার পাশে বসলেন নৌকার কিনারের উঁচুতে পাছা ঠেকিয়ে, যে জায়গাটাকে বলে ডালি ও কোলবাতার মাঝখান, মানে দাসা, মানে গোছা, আর বললেন, ‘থামো, জাহেদ। অবশ্যই জিজ্ঞাসা করব, অবশ্যই জিজ্ঞাসা করব আমি। ওমর। ও-ম-র।’ 

ওমর আলি ছইয়ের ভেতরেই বসে থাকলেন। হায়দারও ডাকলেন, ‘ওমর-ওমর’ বলে। তৃতীয়বারের ‘ওমর’ ডাকটা শেষ করেই হায়দার তার অতি ছোট শরীর নিয়ে জাহেদের সামনে দাঁড়িয়ে এবার তাকে বললেন, ‘এই যে আড়িয়াল খাঁ’, তারপরই বাংলা সিনেমার মতো করে, ‘ট্যাং-ট্যা-ট্যাং।’ 

জাহেদ আড়িয়াল খাঁ দেখে সব ভুলে গেল এক মুহূর্তের জন্য। সে শুধু মনে মনে বলল, ‘বাব্বা, কত্তো বড় নদী।’ আর সে তাকাল আকাশের দিকে, দেখল যে, তারাগুলো সেখানে স্থির হয়ে ফুটে আছে। কী করে তারাদেরকে তাদের জায়গা থেকে নড়ানো যায়, নড়িয়ে এই নদীর পানিতে এনে ফেলা যায়, তা সে জানে না। তার মনে হল, মালেক হুজুরের শেখানো দোয়াটা পড়া যেতে পারে। কিন্তু পরক্ষণেই সে বুঝল যে, সেই দোয়াটা আকাশ থেকে কোনো তারা ছুটে এসে নদীর পানিতে পড়বার পরে সেই পানি বোতলে ভরে পানিকে সোনাদানায় রূপ দেওয়ার দোয়ামাত্র। হুজুর তাকে আসমানের তারা টান দিয়ে নিচে পানিতে নামানোর দোয়া শেখাননি। কেন? তো, এখন কী করবে সে? এত বড় আকাশের নিচে বসে থেকে কীভাবে তারাদেরকে সে আদেশ করবে পানির ওপরে ছুটে এসে পড়তে? জাহেদ বুঝল তার মাথা কাজ করছে না। সে খুব হতাশ বোধ করতে লাগল, কিন্তু ঠিকই মনে জোর নিয়ে জোরে বলে উঠল, ‘বাবা, আড়িয়াল খাঁ।’ 

তার বাবা বলতে লাগলেন, ‘হ্যাঁ বাবা, আড়িয়াল খাঁ। হ্যাঁ বাবা, আড়িয়াল খাঁ। ওই দ্যাখো লঞ্চ যায়।’ 

কিন্তু যেটাকে তিনি লঞ্চ বলেছেন সেটা আসলে দেখা গেল গয়নার নৌকার চাইতেও বড় এক নৌকামাত্র। তাতে অনেক আলো, মানে সেটা তাদের এই নৌকার মতো কোনো অন্ধকারের রাজত্ব নয়; আর তাতে ইঞ্জিন বসানো, সেই ইঞ্জিন থেকে শব্দ হচ্ছে ভট-ভট-ভট। আড়িয়াল খাঁতে ভয়ানক ঢেউ তুলে সেই নৌকা এবার তাদের নৌকার পথ রোধ করে দাঁড়াল আড়াআড়ি। তারপরই বাঁশি বাজল অনেক—পিড়িপ-পিডিপ-পিড়িপ শব্দ তুলে বাজতেই থাকল কী পরিমাণ যে বাঁশি! 

নদীর কালো পানি ভয়ানক কাঁপছে তখন। সেই কাঁপন থেকে তাদের নৌকা দুলছে কোনো বেতবনের বেতগাছগুলোর মাথার মতো করে। এবার ওই বড় ইঞ্জিন নৌকা থেকে বিরাট বিরাট টর্চের আলো ফেলা হল তাদের নৌকায়, আর এক লোক ওখানে দাঁড়িয়ে মুখে মাইক লাগিয়ে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন নানা প্ৰশ্ন। 

‘কার নৌকা এইডা?’ 

ছোটকাকা চার-পাঁচ টর্চের আলোর সামনে পড়ে তার চোখ দুটো হাত দিয়ে ঢেকে উত্তর দিলেন, ‘ইলতুত্‌মিশের নৌকা। আমনেরা কারা?’ 

ওই নৌকা থেকে সেই লোক বললেন, ‘আমরা নৌ-পুলিশ। তোমরা কই যাও?’

ছোটকাকা বললেন, ‘আমরা এই নদীর উজানে আট হাজার যাই। ওইহানকার থানাচারঘাটার কাছের একটা চরে যাই।’ 

‘সেইটা আজকে ক্যানো যাও? আজকে দেশের প্রেসিডেন্ট মারা গেছে, আজকে এইদিকে ক্যানো?’ 

ছোটকাকা কী উত্তর দেবেন বুঝতে পারলেন না। ওই নৌকা থেকে তখন মুহূর্তে-মুহূর্তে টর্চের আলো পড়ছে তাদের সবার মুখে এবং জাহেদের চোখের সামনে আস্তে আস্তে অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে পুলিশের বড় নৌকার লোকজনের মুখগুলো—সামনে তিনজন, আর পেছন দিকে চার-পাঁচজন। জাহেদ দেখল, পেছন দিকের লোকগুলোর হাতে বন্দুক এবং তারা সেইসব বন্দুক তাক করে আছে এই নৌকার মানুষগুলোর বুক বরাবর। আবার বাঁশির আওয়াজ উঠল বিরাট, আর পুলিশের বড় নৌকাটা সেই বাঁশির সাথে সাথে জাহেদদের নৌকাটা ঘিরে ঘুরে আসা শুরু করল। ঘুরতে ঘুরতেই এক পুলিশের প্রশ্ন উড়ে এল এইদিকে, ‘নৌকায় বাচ্চা ছেলে এইডা কেডা? সে ক্যান চরে যায়?’ 

জাহেদ বুঝল, হুম, এটাও একটা বাধা, এটাও একটা বাধা ছাড়া আর কিছুই না এবং এটাই তার আড়িয়াল খাঁর পানি থেকে গুপ্তধন তুলবার পথের শেষ বাধা। জীবনে বাধা বিষয়ে ঈমানের এক বিশেষ উপদেশ মনে পড়ল তার। ঈমান একদম বিদায়ের মুহূর্তে কাঁদতে কাঁদতে তাকে বলেছিল, ‘চরম বাধার মধ্যে যেই পড়বা, সেই শ্বাস লইবা জুরে জুরে, আর ঈমানের সাথে মুনে করবা তোমার ‘চিরকালের বন্ধু’ ঈমানরে। আমার কী যে এক শক্তি আছে জাহেদ, কী যে এক মুনের জোরের শক্তি আছে। আমি তখখন সেই শক্তি দিয়া তোমার সামনে আইস্যা হাজির হইয়া যামু তোমারে বাঁচাইতে।’ 

জাহেদ এটাও ভাবল যে, এখানে তাকে বাঁচানোর জন্য ঈমানের হাজির হওয়ার আসলে দরকার নেই কোনো। প্রথম কথা, তার মৃত্যুর এখনও বয়সই হয় নাই। আর দ্বিতীয় এই যে, তার সাথে আছে তার বাবা, আর তালতলীর নদীঘাটে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে শামছু, তাগড়াই ভাল্লুক শামছু। কিন্তু গুপ্তধন পাওয়ার পথের এই বাধাটুকু কাটাতে তারপরও সে ঠিকই মনে করল ঈমানকে এবং মনে মনে বলল, ‘ঈমান, ‘চিরকালের বন্ধু’, আমি তোমারে ঈমান দিয়া মনে করতেছি। আমার সবই রেডি। আসমানের তারাও পড়বে এক্ষুনি এই আড়িয়াল খাঁয়ের পানিতে। তুমি শুধু এই শেষ বাধাখান কাটাইয়া দাও।’ 

সে এটা মনে মনে বলে শেষ করতেও পারেনি, পুলিশের নৌকা থেকে আওয়াজ উঠল জাহেদদের পেছনের দিকে যে, ‘নৌকার পিছে রামদাও কেন? তিনখান বড় দাও?’ 

সে প্রশ্নের কেউ কোনো উত্তর করল না এই নৌকা থেকে। জাহেদ নৌকার সামনের দিকেও একটা বড় দা দেখেছে আগে। সে-ই এবার চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘পুলিশ কাকা, নৌকার সামনের দিকেও একখানা বড় দা আছে।’ 

পুলিশের নৌকা এবার পেছন দিক থেকে ঘুরে এসে দাঁড়াল তাদের নৌকার পাশাপাশি, সমান্তরাল। জাহেদ জানে এর ইংরেজি শব্দটা অনেক সুন্দর– প্যারালাল। সে ভাবল শব্দটাকে, আর গরিবের ঘরে তার জন্ম বলে হেসে উঠল একটুখানি, ঠোঁটে মুখে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের এক ঝিলিক দিয়ে। 

.

ঠিক এরকম এক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের হাসি তার চেহারায় ভেসে উঠেছিল আজ থেকে অনেকগুলো মাস আগে, যখন ওমর আলি জেল থেকে বেরিয়েছেন, বেরিয়ে তাদের বাসায় এসেছেন এবং তার মা-কে কথা দিয়েছেন যে, তিনি কাশেম ভাইকেও শীঘ্রই জেলের থেকে বের করবেন। 

সেই তিনিই একদিন জাহেদকে তার সঙ্গে নিয়ে গেলেন এক লোকের বাসায়। যাওয়ার সময় পারভিন, শাহেদ ও তার মা-কে বললেন, ‘আমরা যাই এই পুরা দক্ষিণবাংলার সবচাইতে পাওয়ারফুল মানুষটার বাসায়। দুপুরে ওইখানেই খাব, ভাবি। জাহেদরে সঙ্গে লাগবে কারণ প্রথম কথা, সে বাচ্চা ছেলে, তারে দেখে কাশেম ভাইয়ের জন্য মানুষের মনে মায়া জন্মাবে। আর দ্বিতীয় হইল, সে দেখতে টুকটুকা আর আচরণে লক্ষ্মী। পারভিনরেও লইতে পারতাম, কিন্তু আপনার মেয়ে ভাবি বেশি সুন্দর। বোঝেন তো এত পাওয়ারফুল মানুষেরা সাধারণত লোক অত ভাল হয় না, হা-হা।’ 

সেদিনই প্রথম জাহেদের কোনো প্রাইভেট কারে চড়া। ওমর চাচা বললেন, ‘এইটা নিশান গাড়ি জাহেদ, সিডান।’ 

জাহেদ বলল, ‘ও’, এবং অবাক হল বিদেশি গাড়ির এরকম বাংলা নাম রাখা হয়েছে দেখে। 

পুরো পথ ওমর চাচা তাকে বলতে লাগলেন একটাই কথা যে, ‘তোমার সঙ্গে সেই লোকের যখন কথা হবে, তখন তিনি আমারে ওই ঘরে রাখতে পারেন, না-ও রাখতে পারেন। তার মর্জি। তুমি খালি তার সামনে কানবা আর বলবা, আমার বাবা নির্দোষ, চাচা আপনি চাইলে সব হবে, সব হবে, উপরে আল্লাহ আর নিচে আপনি চাচা। বুঝছ, জাহেদ?’ 

জাহেদ বুঝেছিল কিন্তু তার শুধু এটা ভেবেই সমস্যা হচ্ছিল যে, সে মিথ্যা মিথ্যা কী করে কাঁদবে? তার মনে পড়ছিল নাটকের ডিরেক্টর মিন্টু বসু ও ‘চাঁদের হাট’-এর সভাপতি পাড়ার প্রথম বাড়ির নান্টু ভাইকে, যিনি জাহেদকে দেখলে সবসময় বলেন, ‘তুমি একদিন রাষ্ট্রপতি হবা, জাহেদ। রেমেমবার দিস, আমি নান্টু তোমাকে বলে রাখলাম, ‘সে’ করে না, ‘টেল’ করে রাখলাম’–নিশান গাড়ির ভেতরে বসে তার মনে পড়ছিল ওই দুজনের কথা। 

তারা দুজনই হযবরল নাটকের রিহার্সালের দিনগুলোয় কী সমস্যায় না পড়ে গিয়েছিলেন জাহেদকে নিয়ে, কান্নার দৃশ্যে জাহেদকে নিয়ে! নান্টু ভাই বারবার চিৎকার করে বলতেন, ‘জাহেদ, কান্না হছে না। এইভাবে কেনলে হবে না, কেনতে হবে হখখখ করে নাকের তলা দিয়ে। আর কান্নার সময় এমনই কেনতে হবে যে, তোমার চোখে সত্যিকারির পানি এসে যাবে। দেখি, আবার কান্দো।’ 

জাহেদ তখন বারবারই গোঁ ধরছিল, ‘আমি এই সিন স্টেজে একবারে করব। আপনারা চিন্তা করবেন না তো। উফফ্! আমরা কচুর দৃশ্যটা করি—’মানকচু, ওলকচু, কন্দাকচু, মুখীকচু, পানিকচু, শঙ্খকচু ইত্যাদি’। 

সঙ্গে সঙ্গে মিন্টু বসু বসে গেলেন চেয়ারে, স্ক্রিপ্ট খুললেন এবং তার অতি নাটকীয় গলায় বলতে লাগলেন: ‘বাচ্চারা, মন দিয়া গল্পটা শোনো আগে যে, কী লিখিয়াছেন সুকুমার রায়।—’একটা গোলমাল শোনা গেল। তাকিয়ে দেখি, আমার আশে পাশে চারদিকে ভিড় জমে গিয়েছে। একটা সজারু এগিয়ে বসে ভোঁৎ ভোঁৎ করে কাঁদছে আর একট শাম্‌লা-পরা কুমির মস্ত একটা বই দিয়ে আস্তে আস্তে তার পিঠ থাবড়াচ্ছে আর ফিফিস্ করে বলছে, ‘কেঁদো না, কেঁদো না, সব ঠিক করে দিচ্ছি।’ তারপর? ‘হঠাৎ একটা তকমা-আঁটা পাগড়ি-বাঁধা কোলা ব্যাঙ রুল উঁচিয়ে চীৎকার করে ব’লে উঠল-মানহানির মোকদ্দমা।’ তারপর? ‘কুমিরটা অনেক কষ্টে কাঁদ কাঁদ মুখ করে চোখের মধ্যে নখ দিয়ে খিমচিয়ে পাঁচ ছয় ফোঁটা জল বার করে ফেলল।’ 

সে-ও কি ওই ক্ষমতাবান লোকের বাসায় নিজের চোখের মধ্যে নখ দিয়ে খিমচিয়ে তার অশ্রু বওয়াবে, যদি সেখানে অশ্রু না আসে নিজ থেকে? কিন্তু কথা যেহেতু হচ্ছে তার বাবার জেল থেকে ছাড়া পাওয়া নিয়ে, তাই কে জানে হয়তো আসলে এমনিতেই সত্যি কান্না চলে আসবে তার। কিন্তু শাম্‌লা কী? শাম্‌লা-পরা কুমির? 

এসব ভাবছিল জাহেদ, আর গাড়ি এসে থেমেছিল এক বড় পাঁচতলা বাড়ির সামনে, যার সামনের ভাগে আবার বিশাল এক বাগান, যে-বাগানে কিনা সব সেই সেই ফুল আছে যা বেহেশতের বাগানে আছে। জাহেদের বিশেষ করে ভাল লাগল এরকম লাখো বাগানবিলাস দেখে—আহ, সেজন্য কেমন লাল-সাদা- হলুদের রঙিন শিখা ছড়ানো ওই বাগানজুড়ে, কিন্তু ফুল নেই। রূপ আছে, কিন্তু ফুল নেই। কোথায় ওদের ফুলেরা? ছোট ছোট টিপ-বোতাম আকারের তারা-ফুলগুলো সে দেখল লুকিয়ে আছে তাদের মঞ্জরিপত্রের ভেতরে। কীভাবে লালপাতার ওই বিস্তীর্ণ অগ্নিউঠানে কোনোদিন কারও চোখে পড়তেই চায় না ছোট আকারের এই ফুলগুলো। জাহেদ ভাবল যে, তার এনায়েত স্যার হলে বলতেন, ‘জাহেদ দ্যাখো, ফুলকে গৌণ করে কেমন অনাবিল ফুল-প্রতিম সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে বাগানবিলাসদের মঞ্জরিপত্রে। 

বাগানবিলাসগুলো পেরিয়ে লেটুসের দেখতে থালার মতো সবুজ রং মঞ্জরিপত্রের গায়ে হোঁচট খেয়ে জাহেদ প্রায় পড়েই গিয়েছিল, কিন্তু তাকে ওই পতন থেকে বাঁচালেন দুজন দেহরক্ষী। তারা তাকে ‘আপনি’ করে বললেন যে, ‘স্যার আসেন, আসেন। এইখানে ফুলের বাহার দেখিয়া সকলেই হুঁছোট খায়।’ 

জাহেদকে ওই জীবনে প্রথম কেউ বলল, ‘স্যার’। লোকের মুখে ‘স্যার’ ডাক শুনে তার অবাক লাগল খুব এবং আরও অবাক লাগল কী করে এ-বাড়িতে ঢুকেই তার ওমর আলি চাচা কেমন ভাঙাচুরা, কেমন বেঁটে ও মুখ শুকনো দাঁত বের করা এক অপ্রকৃতিস্থ ভাঁড় হয়ে গিয়েছেন, যেমনটা কিনা হয় কাইল্লা কবিরের বন্ধু পদম-সে কোথাও অনেক লোকজন দেখলে একইসঙ্গে হয়ে যায় বিরাট তেলতেলে আর বিরাট জড়োসড়ো, যেন কোনো সাপ-প্রতিম কুঁচে স্টুপিডের মতো গোল হয়ে বসে গেছে ছায়া ও রোদের কিনার ধরে, আর তখন জাহেদকে কানের মধ্যে সে ফিসফিস করে বলে, ‘আমরা হিন্দু না! ভয় লাগে। বাবায় বলছে, ভারত চইল্যা যাবে। বাবাই বলে, ‘পদম-পদম, আমরা হিন্দু না! ভয় লাগে না সবসুময়?’‘ 

এবার সেই ক্ষমতাবান মানুষের বড় অফিস ঘরটায় ঢুকল জাহেদ। দেখল ঘরটার পেছনের জানালা ধরে দাঁড়ানো এক প্রচণ্ড কেতাদুরস্ত নায়ক-নায়ক চেহারার মানুষ, পরনে তার ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি ও হাতে গোল এক বাটির মতো আংটি। আর সেই নায়কের সামনে বসা?—তিনি। বড় এক চেয়ারের পেছনে বড় এক ফুল-ফুল তোয়ালে বিছানো এবং সেটার ওপরে বসে তিনি মিউ-মিউ করে বললেন, ‘ওমর, কেমন আছ? সব খবর ভাল? এ কে, তোমার সেই কারাগারের বন্ধুর ছেলে?’ 

ওমর চাচা তাকে বললেন, ‘সালাম দাও, জাহেদ। ইনারা এই দেশের প্রতিষ্ঠাতা বললেও কম বলা হয়।’ 

জাহেদ বলল, ‘সালামালাইকুম স্যার-চাচা, সালামালাইকুম’ এবং ওই সে দেখল যে, তার সামনের বিশাল ক্ষমতাশালী মানুষটার পরনের যে-জিনিসটাকে সে এতক্ষণ ভেবেছে যে কোনো জোববা বুঝি, সেটা আসলে একটা তোয়ালে, বড় এক তোয়ালে। তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন, তোয়ালেটা খুলে ধরে আবার গায়ে জড়ালেন, আর সেই ফাঁকে জাহেদ দেখল লোকটা ভেতরে পরে আছেন শুধু এক সাদা বড় হাফপ্যান্ট…আর তার গা খালি। তিনি জাহেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘টুকটুকে পোলা, লক্ষ্মীও আছে। ওয়ালাইকুম সালাম।’ 

তারপর ঘরের মধ্যে তিন চারজন হাঁটু ভাঁজ করে বারবার এসে এসে তিন চারদিকে খাবার রেখে গেল—কত কত খাবার, ভাবল জাহেদ। ভাতও আছে, পোলাউও আছে, গরুও আছে, আবার খাসিও আছে, আবার মুরগিও আছে। তাহলে কি কচ্ছপও আছে? সে তাকাল পেছনের দেয়ালের ডান কিনারে, যেখানে এই প্রবল ক্ষমতাধর মানুষটার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের একটা ছবি, তারপর বড় এক নদীতে চলা বড় এক নৌকার পেইন্টিং, তারপর কাবা শরিফের একটা ফোর-কালার ঝলমলে বড় ফটো। জাহেদ বুঝল, কাছিম এখানে থাকতেই পারে না। উফফ্, কী আজব আজব জিনিস যে মাথায় আসে তার! মুচকি হেসে ফেলল সে, বাজারে কাছিম-কাটা মহামূর্খ হালদার ছেলেটার কথা মনে করে হাসল সামান্য। ক্ষমতাশালী স্যার-চাচা তখন বললেন, ‘কী ছেলে, হাসো ক্যানো? বাপ তো জেলে। তার মধ্যেও হাসি আসে?’ 

লজ্জা পেয়ে গেল জাহেদ, ভয়ানক বিব্রতকর লজ্জা পেয়ে গেল। মানুষটা এবার বললেন, ‘ওমর ও রঞ্জু, আমাদের দুজনরে দুটা মিনিট দাও তোমরা চুপচাপ। তারপর খানা খাইয়ো।’ 

তারা দুজন ছুটে বেরিয়ে গেলেন ঘরটা থেকে—তার ওমর চাচা বেরোনোর সময় খটাং করে হোঁচট খেলেন একটা চেয়ারের সাথে এবং জানালা ধরে দাঁড়ানো সেই নায়ক-নায়ক লোকটা তখন মুখে বললেন, ‘ভাপ্ ভাপ।’ ক্ষমতাশালী স্যার-চাচা হুংকার দিয়ে উঠলেন, ‘বিভূতি, ভিতরে আসো।’ 

ভেতরে এসে দাঁড়ালেন বিভূতি নামের এক সৌম্যদর্শন মানুষ, যার বয়স হবে জাহেদের বাবার সমান, অন্তত তাকে দেখে সেটাই মনে হল জাহেদের। বিভূতি ঘরে ঢুকেই টেবিলের ওদিকে ঘুরে গিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করলেন ক্ষমতাশালী স্যার-চাচাকে, আর তিনি তখন বললেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। দরজার ওই কিনারে দাঁড়াইয়া থাকো। তো, তুমি বলো খোকা, কী নাম বললা তোমার?’ 

‘জাহেদ।’ 

‘তোমার বাবা জেলে কেন আছে? কী মনে হয় তোমার? একদম খাড়া সত্য বলবা আমাকে। তুমি কী জানো, শুনি।’ 

জাহেদ বলল যা বলার এবং বলতে বলতে একবার ভাবল, নাহ্, হচ্ছে না, কাঁদতে হবে তাকে। কিন্তু পরমূহূর্তে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, মিথ্যা কান্না তাকে দিয়ে হবে না। 

জাহেদের গল্পটা মন দিয়ে শুনে ক্ষমতাশালী স্যার-চাচা বললেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। এবার তোমাদের বংশ পরিচয় দাও শুনি। কোথাকার তোমরা? তোমার বাবার বাবা কে? আমি চিনব? 

জাহেদের ওই মনে হল তার পক্ষে সম্ভব না এই লোককে, এই আজব ঘরে বসা এই আজব খালি গায়ে তোয়ালে পরা (নিচে হাফপ্যান্ট) মানুষটাকে এরকম একটা মুহূর্তে বলা যে, তার বাপ-চাচার কোনো পরিচয় নেই, তাদেরকে কেউ চেনে না, তারা কীভাবে ভেসে ভেসে কুষ্টিয়ার আল্লার দরগা থেকে বরিশালে আসা বহিরাগত, স্রেফ আগন্তুক। সে বুঝল, যেহেতু বংশ পরিচয় বিষয়ক প্রশ্নটা তিনি করে বসেছেন, অতএব যেইমাত্র সে এই সত্যগুলো বলবে, তক্ষুনি তিনি তার বাবাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার ইচ্ছাটা হারিয়ে ফেলবেন। ভাববেন যে, অনাহূত-ভাসমান মানুষ জেলে থাকলেই কী আর জেলের বাইরে থাকলেই কী? 

তিনি জাহেদকে আবার প্রশ্ন করার জন্য তার মুখ খুলেছেন, বিভূতি ওনার মুখ খোলা হচ্ছে-হচ্ছে দেখে নিজেও তার মুখ খুলেছেন, তিনি বিভূতির হাতের লম্বা দো-নলা বন্দুকটার দিকে তাকিয়েছেন, বিভূতি তখন নিজেও তার হাতের বন্দুকের দিকে তাকিয়েছেন, জাহেদ এসব দেখছে আর দ্রুত ভেবে নিচ্ছে তার মিথ্যা উত্তর কী হবে কী হবে—এবং ভাবছে, তার উত্তর এক্ষেত্রে মিথ্যা না হলে তার জাত নেই, পাত নেই, ভাত নেই, তার বাবারও লেজ নেই, টুপি নেই, তোয়ালে নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। তখনই ক্ষমতাশালী স্যার-চাচা তার মিউ-মিউ গলাতেই (কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় জাহেদের মনে হল, ওটা ট্যাংক চলার আওয়াজের গলা, ট্যাংক-গলা) আবার বললেন, ‘কী, বলো? কোন ফ্যামিলি?’ 

জাহেদ দুম করে বলে দিল, ‘বাজার রোডের মোহন মিয়ারা আমার চাচা হন। আমার বাবা মোহন মিয়ার ফুফাতো ভাই।’ 

‘মানে তোমার বাবা মোহন মিয়ার বাবার বোনের ছেলে? কোন বোন?’ 

জাহেদ এক মুহূর্ত দেরি না করে বলল, ‘আনোয়ারা।’ 

সে জানে না কে মোহন মিয়ার বাবার বোন, কে সেই মহিলার ছেলে। সে স্রেফ ওই বড় ব্যবসায়ীর নামটা ছাড়া এ-ও জানে না যে, মোহন মিয়ার বাবার আদৌ কোনো বোন ছিল বা আছে কি-না। কিন্তু তার মনে হল, হতে পারে, হতে পারে আনোয়ারা নামের এক নারী এ পৃথিবীর কোনো না কোনো মোহন মিয়ার কোনো না কোনো বাবার বোন। 

ক্ষমতাশালী স্যার-চাচা তখন বিভূতিকে বললেন, ‘দরজা খোলো বিভূতি। ডাকো ওদেরে।’ 

বিভূতি কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে গেলেন ঘরটা থেকে। যাবার সময় তিনি দেয়ালে দাঁড়া করিয়ে রেখে গেলেন তার দো-নলা বন্দুক, আর ছুটে ফিরে এসে আবার দখল নিলেন সেটার। 

ক্ষমতাশালী স্যার-চাচা এবার উঠে দাঁড়িয়েছেন তার চেয়ার থেকে এবং তার বিশাল টেবিলের ওপাশে দাঁড়িয়েই ধ্যাৎ বলে ছুড়ে মেরেছেন তার গায়ের বিরাট তোয়ালে। তোয়ালেটা গিয়ে পড়েছে পেছনের জানালার নিচে, আর অত্তবড় তোয়ালের বাড়ি খেয়ে সেটার সঙ্গেই মেঝেতে পড়েছে এক ছোট টুল এবং সেই টুলে রাখা এক দাবার বোর্ড, এক কাঠের প্লেন আর এক রুপোর নকশা-তোলা কলসি মতো শোপিস। কিন্তু তিনি অতকিছু নিচে পড়ার ঝুটঝামেলা থেকে বেরিয়েই এসেছেন পুরোপুরি, সাঁ করে সরে এসেছেন টেবিলের পাশ থেকে এবং স্রেফ একটা ময়লা-ময়লা হাফপ্যান্ট পরা খালি গায়ে চিৎকার করে ওমর আলিকে বলেছেন, ‘ওমর, কয়লা ওমর, তুমি বলবা না যে, এই ছেলে মোহন মিয়াদের ফ্যামিলির? এর বাবা মোহন মিয়ার ফুফাতো ভাই, আনোয়ারা মামির ছেলে। আমাকে বলবা না সেইটা? কত্তোবড় ফ্যামিলি, কী তার রক্ত! সেই ঘরের মানুষ জেলখানায়, আর তার ছেলে সাহায্যের জন্য আসে আমার কাছে? অ্যাই, তোমরা খাও, আমি গেলাম। আগে ওর বাবার কাজটা করি।’ 

জাহেদ খেয়াল করল সেই আগে জানালায় দাঁড়ানো রঞ্জু নামের নায়ক-নায়ক লোকটা এখন শুধু তার কাছে ঘেঁষে আসতে চাইছেন তার প্রেম-ভালবাসা-স্নেহের ডালি নিয়ে। এ দৃশ্য যখন চলছে, জাহেদের কিন্তু তখন নিশ্চিত করেই মনে হচ্ছিল যে, ওমর আলির পক্ষে এখন আর সম্ভব না এই মিথ্যাকে মিথ্যা বানানো। ওমর আলি, জাহেদ দেখল, তার দাঁত-জিভ-মাঢ়ি-আলজিভ বের করে ক্ষমতাশালী এই চাচা-স্যারের অফিসঘরে বসে খেতে গিয়ে ততক্ষণে জামা-টামা সব তরকারির ঝোলে মাখিয়ে ফেলেছেন। 

বিদায়ের সময় বিভূতির বিরাট বাহিনী জাহেদকে বলল, ‘বাগানবিলাস ফুল ছিঁড়িয়া দিব তোমার জন্য, খোকা? অ্যাই অ্যাই, সাবে ওরে কইছে টুকটুকা পোলা। টুকটুকা পোলার জইন্য বাগানবিলাসের একটা ঝুড়ি এক্ষুনি বানাইয়া দে।’ জাহেদের, ওই যথেষ্টই বাচ্চা কিন্তু যথেষ্টই তার বয়সের থেকে বড় জাহেদের, মুখে তখন এ পৃথিবীর আইন-কানুন-সিস্টেম-অবস্থা নিয়ে প্রচণ্ড এক শ্লেষ ও উপহাসের হাসি। 

.

পুলিশের প্রধান লোকটা এবার তাদের নৌকা এই নৌকার সমান্তরাল হতেই টর্চের সমস্ত আলো ফেললেন গলুইয়ের একটু নিচের দিকে, যেখানে ইটের ওপর বসে আছে বিছা মণ্ডল আর ওই দুই ছেলে। একজন পুলিশ চিৎকার করে বললেন, ‘জানদার, নৌকায় ইট কী কামে? বস্তা কী কামে? দা কী কামে? ছোট বাচ্চাডা কী কামে?’ 

আবার কোনো উত্তর নেই। একটু পরে উত্তর দিলেন বামন হায়দার, ‘আমি হায়দার। বগুড়া রোডে বইয়ের দোকান চালাই। ইট ওই চরে গিয়া যে বইয়ের দোকান দিব, তার ভিতের কামে। দা নিশ্চিতই চরে কাজকামের কামে। বস্তা নিশ্চিতই চরে কাজকামের কামে। কিন্তুক আমি জানি না যে, ওই দুই পোলা কেডা? আর ছোড বাচ্চাডা আমার পার্টনার কাশেম সাহেবের ছোড পোলা–জাহেদ।’ 

এবার সব আলো একটুখানিকের জন্য একবার জাহেদের মুখের ওপরে, তারপর সরে গিয়ে বাসেতদের ওখানে ন্যাড়া মাথা বিছা মণ্ডলসহ, বাসেতসহ ওই চারজনের কপালে স্থির। একজন পুলিশ একটু দূর থেকে চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘এ দুজন তো কলিজা-খাওয়া ছিলিম আর বোমারু সুড়ড়া। ওরে আল্লা। ওরা পুনরায় বাইরাইছে নদী লাল করতে? আর ছইয়ের মধ্যে ঘাপটি দিয়া বইস্যা আছে কেডা? স্যার, হেইডা জিগান।’ 

পুলিশের প্রধান লোকটা হাঁক দিয়ে উঠলেন, ‘ছইয়ের মধ্যে কে? টং-এর মধ্যে কে?’ 

ওমর আলি বের হয়ে এলেন ছইয়ের ভেতর থেকে। পাঁচ-সাত টর্চের আলো এবার সোজা ওমর আলির মুখে। পুলিশের প্রধান বললেন, ‘কয়লা ওমর? কী ঘটনা? কই যান? আট বছর সাজা খাইট্টা শিক্ষা হয় নাই?’ 

ওমর আলি বললেন, ‘ও ভাই, আমরা যাই চরের জমি কিনতে। সাথে যায় আমার বড় ভাই কাশেম। সাথে যায় আমার আরেক ভাই হায়দার, আর যায় হোমিওপ্যাথির বিখ্যাত ডাক্তার ফোরকানউদ্দিন, যার পোলা সাজ এই বাচ্চা বয়সে বডি-বিল্ডিংয়ে বরিশাল চ্যাম্পিয়ন হইল। কিন্তু নৌকায় অন্যেরা কী কেডা, তা ইলতুত্‌মিশরে জিগান, ইলতুত্‌মিশরে জিগান। 

 পুলিশের দ্বিতীয় প্রধান লোকটা তখন জাহেদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি তাদের নৌকার ডালির ওখানে দাঁড়িয়ে থেকেই এই নৌকায় জাহেদের হাতটা ছুঁয়ে দেখতে চাইছেন। জাহেদ সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেল, এটা আসলেই তার গুপ্তধন পাওয়ার পথে শেষ বাধা। না হলে কেন পুলিশ অফিসার হাত বাড়িয়ে তার কাছ থেকে তার বোতলটা নিতে চাইবেন? 

দ্বিতীয় প্রধান লোকটাই এবার কথা বললেন, ‘সব ঠিক আছে, কয়লা ওমর। কিন্তু আইজগা দ্যাশের পেরসিডেন্ট খুন হইছে। আইজগা সবই আকাটলাসের দিন। তোমাগো নৌকায় যে জিয়াউর রহমান নাই সেইডা আমরা কেমনে জানব? অ্যাই, তোমরা সবাই ওই নৌকায় নামো। সব চেক করো। আমার বিরাট সন্দেহ যে, পেরসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সাহেব ওই নৌকায় আছেন।’ 

 জাহেদ এই শেষ কথাটায় বিরাট ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেল। তার মানে প্রেসিডেন্ট জিয়া কাল রাতে চিট্‌টাগাংয়ে মরেন নাই? তিনি আসলেই ছদ্মবেশ নিয়ে পালিয়ে এসেছেন এই বরিশালের আড়িয়াল খাঁ-র কাছে তার নিজের কাটা খালপাড়ের সন্নিকটে? তিনি লুকিয়ে আছেন তাদের এই বড় গয়নার নৌকারই কোথাও, যেমন করে ওখানে লুকিয়ে ছিল ওই দুষ্ট ছেলে দুটো—কলিজা-খাওয়া ছিলিম আর বোমারু সুড়া? 

দুদ্দাড় করে পুলিশরা তাদের নৌকায় উঠে গেলেন। তারপর তারা ছইয়ের সামনের দিক, পেছনের দিক, ছইয়ের ভেতরটা, পাটাতনের নিচটা, সব দুমদাম চেক করে, ফালাফালা ছিন্নভিন্ন করে, ওলটপালট ও পালটওলট করে নৌকা থেকে নেমে গেলেন বিছা মণ্ডল, ছিলিম ও সুড্‌ডাকে সঙ্গে নিয়ে; দুদশটা ইট, বড় কয়েকটা বস্তা এবং দা-গুলো সঙ্গে নিয়ে। নেমে যাবার সময়ে দ্বিতীয় পুলিশ প্রধান লোকটা জাহেদের কাছে এসে তার মুখের ওপর টর্চ ফেলে তার গালটা বেশ জোরে টিপে দিয়ে বললেন, ‘কাশেম সাহেব, আপনার পোলাডা একখান লাল্টু পোলা। কী যে লাল্টু পোলা!’ 

জাহেদ তখন চিৎকার করে পুলিশদের জানাল, ‘আমি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাথে হাত মিলাইছি। তিনি আমাদের জিলা স্কুল ভিজিটে এসে যে কয়জনের সাথে হাত মিলাইছিলেন, আমি তার একজন। এই যে আমার ডান হাত।’ 

পুলিশের বাহিনীর এক লোক—সেই লোকের কাশির আওয়াজের ভার শুনেই জাহেদের মনে হল, তিনি এখানকার পুলিশের প্রধান লোকটারও প্রধান, মনে হল এই লোকের লেভেলই আলাদা – জাহেদের এ কথা শুনে বললেন, ‘তা ভাল কথা। কিন্তু তিনি কি ভাল মানুষ ছিলেন? শুনিয়াছি তিনি তিন বাহিনী মিলাইয়া প্রায় দুই-তিন হাজার লোকের জীবন কেড়ে লইছেন। আর এইডা কী কথা যে, ইতিহাস-পৌরনীতি-ভূগোল বই খোললেই, বাংলাদেশের জরমো চ্যাপ্টার খোললেই লেখা যে, স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া? স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে তো দেহি শেখ সাহেবের নামটাও আজকাল আর নাই। সেইদিন দেহি, শোনতেয়াছেন আপনারা?’—তিনি দুই নৌকার বাকি সবার উদ্দেশে এবার তার হ্যান্ড-মাইক্রোফোনে চেঁচিয়ে বললেন——সেইদিন দেহি আমার ছুডো মাইয়া তার বইতে পড়তেয়াছে যে, ২৬ না জানি ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান, যিনি পরেবর্তীকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, তিনি চট্টগ্রামের বেতার কেন্দ্র হইতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দান করেন এবং স্বাধীনতা রক্ষায় বেশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানান, আর সেই সাথে সারা দেশ অস্ত্র হাতে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ে।—এইডা কোনো কথা হইল? কন দেহি। মিথ্যারও তো একটা সত্যমিথ্যা সীমা থাকবে, নাকি?’ 

বামন হায়দার জাহেদের পাশ থেকে কাকে যেন ফিসফিসিয়ের চাইতে সামান্য জোরে বলে উঠলেন (জাহেদের মনে হল, হায়দার চাচা কথাগুলো বলছেন তার বাবাকে), ‘আহারে, এহন কতো বড় বড় কতা! এহন আইছে কত শেখ সাহেবের জন্য পেরেম দেহাইতে। জিয়াউর রহমানে খারাপ, এই কথাডা তো কোনো পুলিশে হ্যায় বাঁইচ্যা থাকতে কয় নাই। মারা গেলে বহুত লেকচার দেওন যায়। 

নৌকার গলুইয়ের কাছের যে জায়গার নাম ড্যাগ, নাম চণ্ডিপাঠ, সেখান থেকে এতক্ষণে চিৎকার ভেসে এল ফোরকানউদ্দিনের। তিনি পুলিশদেরকে খুশি করার জন্য কিংবা হয়তো তার ‘জ্ঞান’ দেখানোর জন্যই বললেন, ‘শুধু কী এইসব? জিয়াউর রহমানের আমলের বইতে পাকিস্তানি বাহিনীরে স্রেফ ‘হানাদার বাহিনী’ লিখিয়া কাম সারা হয় নাই? ‘পাকিস্তানী বাহিনী’ লেখতে জিয়াউর রহমানের এত সমেস্যা আছিল? আর শেখ মজিবরে যে মারা হইল ‘৭৫ সালে, আমার ছেলে সাজ বই খুইল্যা সেইটা আমার নিকট বোঝতে আসলে দেখলাম তাতে লেখা—সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী দুষ্কৃতিকারী এই কাজটা করছে। কাজটা যে করছে তখনকার সেনাবাহিনীর টপ লোকজন, কাজটা যে করছে জিয়াউর রহমানে নিজে আর হ্যার চ্যালাপ্যালারা, সেইডারে বইতে বানাইয়া দিল কতিপয় বিপথগামী দুষ্কৃতিকারী? পুলিশ ভাইয়েরা, জিয়াউর রহমানে মারছে শেখ মুজিবরে, এখন আল্লাহর বিচার নিজে মতিউর রহমান-দেলোয়ার সাজিয়া মারল তারে। বোঝতেই আছেন যে, আমি কিন্তুক হোমিওপ্যাথি ডাক্তার না। আমি বিজনেসম্যান ফোরকানউদ্দিন। সারাক্ষণ সময় পাইলেই আমি পড়াশোনা করি। আমার স্ত্রী মরিয়া গিয়াছেন ভয়ংকর লঞ্চ দুর্ঘটনায়।’ 

জাহেদের মনে হল, সে হাতে ওই হ্যান্ড-মাইক্রোফোনটা নিয়ে ফোরকানউদ্দিনের কথার সঙ্গে এ-ও যোগ করে দেয় যে, ‘আর আমি চান্স পাইলেই কম বয়সী পোলাগো হাত ধরিয়া ধরিয়া আমার সোনাতে লাগাই, কারণ তাহা হইলে আমার বড় ভাল লাগে।’ 

এ কথাটা বলার কল্পনা করেই প্রায় হো-হো হেসে উঠল জাহেদ। বামন হায়দার আবারও ফিসফিসের চাইতে একটু জোরে সেই আগের মানুষটাকেই বললেন,  ‘হোমিওপ্যাথির ফোরকানে একখাম ভণ্ড। উরে আমার জিয়াউর রহমান বিরুধী বরিশাইল্লারা!’ 

ছোটকাকা এতক্ষণ চুপ ছিলেন। কিন্তু তিনি পুলিশ প্রধানের বলা কথা যে, নৌকা উল্টো পথে ঘুরবে, সেটা শুনে কান্না শুরু করে দিলেন। পুলিশ প্রধান তার হ্যান্ড-মাইক্রোফোনে মুখ রেখে এইমাত্র বলেছেন, ‘হ্যাই হ্যাই, জানদার, তোমার নৌকা পেছন দিকে ঘুরবে। তালতলী ঘাট যাবে। আইজকা কারও নদীতে চলার কোনো পারমিশন নাই। এইখানের নদীতে তো একদমই অসম্ভব। ওমর আলির কাজকর্ম নিয়া আমাদের বিরাট সন্দেহ আছে। এদেরে জিজ্ঞাসাবাদ হবে। আইজকে দেশের পেরসিডেন্ট মারা গেছে। নৌকা তালতলী চলেক, চালক, চালক।’ 

ছোটকাকা আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘আমি জানি আমার ভাড়া পুরা পাই, ওমর সাহেব। আপনে ছোড বাচ্চাডারে নৌকায় তুলতে দিয়া সব ভেজতাইছেন, সব। আমি জানি আমার টাকা পুরা পাই কইলাম। আমি জানদার, গরিব মানুষ। আমার মালিক ইলতুত্‌মিশে সাক্ষাৎ জানোয়ার। তার কাছে কিছুর কিছু কোনো মাফ নাই।’ 

নৌকা ঘুরছে, আড়িয়াল খাঁ-র বুক থেকে উল্টো ঘুরে নৌকা ছোট তালতলী নদীর দিকে তার মুখ রাখা শুরু করেছে, জাহেদ আর নিতে পারল না। সে তীব্র চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘না-আ-আ। বাবা, না।’ 

পুলিশের টর্চগুলো জাহেদের মুখে এসে পড়ল। পুলিশ প্রধান নিজেই হ্যান্ড-মাইক্রোফোনে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হইল, বাচ্চাডার কী হইল?’ কিন্তু কথাটা বলতে গিয়ে তিনি মাইক্রোফোন তার মুখের এত সামনে নিয়ে ফেলেছেন যে, জাহেদের কাছে তার কথাটা শুনতে মনে হল—’ক্যালো ক্যালো বোড়দেনেলার ক্যালো?’ 

জাহেদ ভাবতে লাগল কী মানে হয় এই কথার? এটা কী কোনো দোয়া-তাবিজের কুফরি ভাষা? সে আকাশের দিকে তাকাল, দেখল দূরে একটা তারা ছুটে যাচ্ছে নদী পার হয়ে ওই পৃথিবীর উইই দিকে। সে তারার গন্তব্য দেখে, তারার ছুটে যাওয়ার তীরটা দেখে আবার হতাশই হল, কিন্তু পরক্ষণে ঈমানের কথা মনে করে জোরে শ্বাস নিল বুকে। তার বাবা পুলিশকে উত্তর দিলেন, ‘আমি জানি না। আমি আমার এই ছেলেকে বুঝি না।’ 

সে মুহূর্তে ওমর আলি এসে তার হাতটা রাখলেন জাহেদের মাথায়। জাহেদ টর্চের অনেক আলোর মাঝখানের গোলগুলোর পাশের অন্ধকারে ছায়ামতো দেখল ওমর আলিকে, আর তার হাত সে এক ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল তার মাথার থেকে। দ্বিতীয় পুলিশ প্রধান তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ‘না’, ছোড পোলা? কী ‘না’ বললা তুমি?’ 

জাহেদ বলল, ‘কিছু না, কিছু না।’ তার ভাল লেগেছে যে, এই পুলিশটা তাকে কথা কোনো হ্যান্ড-মাইক্রোফোনে মুখ রেখে বলেননি। সেভাবেই পুলিশটা আবার তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নাহ্, মানে, তুমি কি জানো দেশের প্রেসিডেন্ট কোথায়? আর তিনি যদি নিহত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে তুমি কি জানো তার কবর কোথায়?’ 

জাহেদ প্রশ্নটা শুনলেও উত্তর দেবার আর প্রয়োজন বোধ করল না। কারণ ততক্ষণে পুলিশের নৌকা তাদের থেকে ধাপে ধাপে একটু দূরে, দূরে, তারপর অনেক দূরে সরে গেছে। এখন তো সেটা তাদের নৌকার দূর পেছনে কোথাও, আর সেখান থেকে হ্যান্ড-মাইক্রোফোনে রাতের নদী কাঁপিয়ে পুলিশ প্রধান লোকটা বলেই চলেছেন, ‘জানদার ছোটকাকা, তালতলীইইই, তালতলী।’ তারপর একটু থেমেই, ‘লালটু পোলার হাতে বোতলডা কিসের সেইডা তো জানা হইল না। 

.

এত দূর থেকেও জাহেদ শুনল যে, পুলিশেরা হাসছে। ঠিক তখনই সে দেখল তার পেছনে আড়িয়াল খাঁ-র ঢেউ ওঠা উন্মত্ত পানির মাঝখান দিয়ে টোয়াও-টোয়াও ভেঁপু বাজিয়ে ছুটে চলেছে একটা বড় লঞ্চ। হায়দার জাহেদকে বললেন, ‘এমভি নাগেশ্বর।’ 

জাহেদ ‘নাগেশ্বর’ শব্দটার ধ্বনিসৌন্দর্যের চক্করে একটুখানিকের জন্য পড়ে থেকে তাকিয়েই থাকল তার পেছনের আড়িয়াল খাঁ-র দিকে, যেখানে সে মুহূর্তে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আকাশের ওখান থেকে ছুটে আসছে কতো না নক্ষত্র, আর কী সুন্দর তাদের সব নাম—ক্যানিসমাইনর, ডোরাডো। সে শুনল বামন হায়দার চাচা তার বাবাকে বলছেন, ‘পোলা বটে কাশেম ভাই আপনেরডা,’ কী সুন্দর তাদের সব নাম—শিশুমার, দক্ষিণ মীন। সে শুনল ওমর আলি বদমাশ তার বাবাকে বলছেন, ‘কাশেম ভাই, আমার কাছে আর টাকা ফেরত চাইবেন?’ কী সুন্দর তাদের সব নাম- বিরিশচিক, কোমাবারেনেসিস। সে শুনল এবার নৌকার মাঝি জানদার ছোটকাকা ওমর আলিকে বলছেন, ‘পেরসিডেন্ট মারা না গেলে আইজকাই আমনেরা চরের জমিনে হোডেলের গাঁথনি দেতে পারতেন, আর পরের বাইর মোরা আইয়া ওই হোডেলে থাকতে পারতাম’, জাহেদ আবার ভাবল কী সুন্দর তাদের সব নাম—মিরিগোব্যাধ, ফিনিকস্। 

জাহেদের মনে হল, আড়িয়াল খাঁ তো চেনা হয়ে গেল, চিনলে এখানে আসা কতো সোজা। আর এর পরেরবার সে এখানে আসবে সরাসরি মালেক হুজুর ও ঈমানকে সঙ্গে নিয়ে এবং তা সে আসবে এমন এক দিনে যখন দেশের কোনো প্রেসিডেন্ট মাত্র মারা যান নাই এবং যখন ওমর আলির মতো কোনো দুষ্ট লোক তার বাবাকে নদীতে নিয়ে এসে জবাই দেওয়ার প্ল্যান করে নাই। সে খুব বিরক্ত হল তার বাবা ছইয়ের ভেতরে ওমর আলির সামনের বেঞ্চিতে বসে কেমন কাঁচুমাচু হয়ে ওমর আলির চোখের দিকে ক্ষমা চাওয়ার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বলে। 

সে আরেকবারের মতো দেখে নিল ‘এমভি নাগেশ্বর’ লঞ্চটা চলে যাচ্ছে তার পেছনে হাতের বাম দিকে। এ মুহূর্তে ওই লঞ্চের পেছনভাগটাই দেখা যাচ্ছে শুধু, যেখানে কোনো আলো নেই, তবে লঞ্চটার দু পাশ ঠিকই আলো দিয়ে মোড়া, আর নিশ্চিত একদিন ওইরকম এক লঞ্চে চড়েই ডেকের পাশের গ্রিলে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে গল্প করতে করতে সে ও ঈমান যাবে তেগুচিগালপার পথে 

এ ভাবনাটা মাথায় আসতেই সে এবার নৌকার মধ্যে বসে বসে না হেঁটে, বরং সোজা দাঁড়িয়ে হেঁটে যেতে লাগল ছইয়ের দিকে, তার বাবার দিকে। সে ওখানে যেতে লাগল তার বাবাকে এটা বলতে যে, ‘বাবা, ওমর আলি চাখারের একটা মশাও না, খুব বেশি হলে সে একটা ছারপোকা। আর তোমার চার লাখ টাকা আমি যদি পাঁচ-ছয়বার ঈমানরে সাথে নিয়া শুধু আড়িয়াল খাঁ-য় আসি, তাহলেই তোমার চার লাখ টাকা আমি তোমারে তুলে দিতে পারব।’ 

সে বাবার পাশে এসে বসল তার হাতের বোতল শক্ত করে ধরে, আর কী মনে করে বাবাকে বলল না তার মনের কথাগুলো। বাইরে নৌকার কোলবাতায় বসে তখন তার বামন হায়দার চাচা চিৎকার করছেন, ‘জাহেদ, পানিগরু। জাহেদ, পানিগরু।’ 

জাহেদ শুনল, হায়দার চাচার ‘পানিগরু’ চিৎকারের মধ্যেই নদীর গর্ভে ডাক উঠেছে ডিণ্ডিম-ডিণ্ডিম-মডি-মডি-মডি। ওই ডাক সে প্রথম শুনেছিল অন্ধকারে চাখারের সেই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে, আর ভেবেছিল রাতবিরাতে গগনশিরীষেরা বুঝি ওভাবেই ডাকে। কিন্তু তারপর থেকে আজ পর্যন্ত নদী-বিল-পুকুর, যেখানেই পানি আছে সেখানেই সে ডাকটা এতবার শুনে ফেলেছে যে, তার মনে হল ওইটা পানিদের নিজস্ব ভাষা, যেমন এখন এই পানিগুলো একে অন্যকে ডিণ্ডিম-ডিণ্ডিম হোমম্‌ঙড়-হোমম্‌ঙড়-মডি-মডি বলে ঘুম থেকে তুলে বলছে, ‘ছেলেটা গুপ্তধন আজ পাইল না, দুঃখের বটে।’ 

আর তখন আরেক ঢেউয়ের আরেক পানি উত্তরে বলছে–ডিণ্ডিম-ডিণ্ডিম হোমম্‌ঙড়-হোমম্‌ঙড়-মডি-মডি, অর্থাৎ ‘দুঃখ কোরো না। আজকে যা ঘটল তার কারণেই একদিন এই ছেলে বড় লেখক হবে।’ 

তারপর দুই ঢেউ, তিন ঢেউ, চার-পাঁচ-পঞ্চাশ ঢেউ একসঙ্গে আবার আরও বেশি জোরের ডিণ্ডিম-ডিণ্ডিম হোমম্‌ঙড়-হোমম্‌ঙড়-মডি-মডি, যার অর্থ একটাই, ‘সে তো ইতিমদ্দেই কবিতা লেখে।’ 

.

জাহেদের ভাল লাগল পানিদের এই কথাবার্তা শুনে এবং সে আশ্চর্যান্বিত হল যে, পানিদের কথা এতদিনে সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে। সেটাই যদি হয়, তার মনে হল, ট্যারর-ট্যারর, তাহলে এখন থেকে সে কনস্টেবল আন্তর্জাতিক গোমেজের কথাও বুঝবে; ট্যারর-ট্যারর, পৃথিবীর সব ফোরকানউদ্দিনের সব গ্যাকোটাচ বাক্যের গূঢ়ার্থ বুঝবে; ট্যারর-ট্যারর, আর বুঝবে বৃস্টল সিগারেট ফোঁকা উত্তরবঙ্গের তথা আদিতে বরিশালের জয়ন্ত কেন স্রেফ একটা বাইট্টা ইন্দুর এবং তার সঙ্গে ঘোরা ম্যাকেনরো-র আসল পরিচয় কেন এই যে, সে আসলে একদলা গু…এবং-এবং-এবং কেন তার বাবার গায়ের পুরোনো পাতলা পাঞ্জাবিটা সত্যি সুন্দর, সত্যিই সুন্দর। 

তার হঠাৎ মনে হল, না, গুধুর নাম বদলে কুঞ্জরবদন রাখার তাহলে এ জীবনে সময় হয়ে এসেছে, আর শাহেদ ভাইয়াকেও বলার সময় হয়েছে যে, ‘ভাইয়া ভাইয়া, তুমি আলমাজী-রাঙ্গা-নিউটন ওদেরকে কোনোদিন ছেড়ো না। জাস্ট ওরা খারাপ বলে ওদেরকে ছেড়ো না। ওদেরকে বরং কাছে কাছে রাখো, কাজে লাগবে।’ 

আর তার বোন পারভিনকেও তার এটা বলে দেবার সময় হয়েছে যে, ‘পারভিন আপা, ও পারভিন আপা, তুমি যদি কোনোদিন কাঞ্চন-এলিজাদের জামবাগানে কি আড়িয়াল খাঁ-র পানসি নৌকা বা মালার নৌকায় তোমার ভাল মানুষ জান নাঈম্মিয়্যার সঙ্গে বিয়ের আগে সেক্স-টেক্স করো, তো, কনডম ব্যবহার করেই কোরো। কনডম কিনতে লজ্জা পাওয়ার এ পৃথিবীতে কিছুই নাই।’ তার এ-ও মনে হল যে, তার বাবা কাশের মিঞার আগে আরেকটা বিয়ে হয়েছিল তাতে কী! আর সেই আগের বিয়েতে তার বাচ্চা থাকলে আছে, তাতে কার বাপের কী? 

এই-যে কোনো গোনার মতো অন্যায় না করলে এ পৃথিবীর কোনোকিছুতেই যে সেভাবে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই, এই যে বন্ধুদের সঙ্গে তাকিয়ে তাকিয়ে গোলাপপ্রতিম ফুল দেখার মধ্যে আহ্লাদীভরা লজ্জা আর আঁখির মতো সুন্দর এক মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে বমিপ্রতিম গু দেখার মধ্যে ঘৃণা-ঘৃণাভরা লজ্জা—কোনোটাই যে আসলে লজ্জার না, সেটা ভাবতে জাহেদের মনে হল, চিৎকারটা তাহলে তাকে আজ দিতেই হবে। কারণ, যথেষ্ট হয়েছে। ইংরেজিতে বললে, এনাফ হয়েছে। আর সে যতই না-খাওয়া আখাউরা পরিবারের এক ছেলে হোক না কেন, ইংরেজি এনাফ বলার মধ্যে আবার লজ্জা কীসের? কারণ, তার মনে হল—এই পৃথিবী যদি হয় কোনো ব্রিটিশের, তাহলে তা সমানভাবে কোনো বুরকিনা ফাসোর লোকেরও বটে; এই পৃথিবী যদি হয় সালাম জমিদার ও মোহন মিয়াদের, তাহলে তা সমানভাবে তারও, তার ভগ্নদশা ও ভীত বাবারও এবং সার্কাসের গুয়াহাতি নামের হাতিটারও। 

জাহেদ নদী কাঁপিয়ে প্রাণপণে চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘ওমর চাচা তার কাজের মেয়েরে যেন তিন গুণ্ডা ধর্ষণ ও খুন করতে পারে তাই রাত একটায় নিজের বাসার দরজা খুলে দিছিলেন। সেই জন্যই তার জেল হইছিল আট বছর।’ 

এটা বলার পরেই জাহেদ দেখল নদীতে পর্যাপ্ত মডি-মডি আওয়াজ উঠে গেছে, আর নদীর কিনার ধরে প্রবল চিৎকার করছে এখানকার কোনো ‘লোকাল’ মাদি কুকুর দিলারা ও ‘লোকাল’ পুরুষ পুকুর বইঠো। তারা চিৎকার করে বলছে যে, কেঁওক্রেঁওও, কেউ-কেউ ঘেউ-ঘেউ-ঘেউ-এ কী অন্যায়, এ কী অন্যায়!’ 

.

নদী তীরবর্তী কুকুরদের কথাবার্তা নিয়ে এরকম কিছু ভাবছে জাহেদ, তখন সে দেখল, ফোরকানউদ্দিন নামের হোমিওপ্যাথির ওষুধসহ সবকিছুর দোকান চালানো গ্যাকোটাচ লোকটা নৌকার অন্ধকারের মধ্যেই সাক্ষাৎ ভূতের মতো বসে তার উদ্দেশে এ মুহূর্তে দু হাত জড়ো করে ক্ষমা চাইছেন আর ক্ষমাই চাইছেন, যেন সে এরপরে তার গোপন কথাটাও নৌকার সবার কাছে চিল্লিয়ে ফাঁস না করে দেয়। 

জাহেদ ফোরকানউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল – ফোরকানউদ্দিন, তোমার লিঙ্গ বড় ও মোটা হতে পারে, সেটা যে বাস্তবেও বড় ও মোটা তা আমি ধরে দেখেছি। কিন্তু বিষয় হচ্ছে, ঈমানের মতো এক লক্ষ্মী ছেলে যদি বাংগরা দাস ভাউরার লিঙ্গ খ্যাচ করে কেটে ফেলতে পারে, যদি বড়লোক মুরাদের গাল ও মাথায় ঝাঁ করে মেরে বসবার পরেই আবার হতদরিদ্র বস্তির পাঁড়গরিব কাইল্লা কবির তার আনন্দের চঞ্চু মঞ্চ নাচ নাচতে পারে, তাহলে বিষয় হচ্ছে, তুমি এই পৃথিবীর জন্য কোনো বিষয়ই না, গ্যাকো-ফোরকানউদ্দিন। 

।কারণ, জাহেদের মনে হল, এত বড় আড়িয়াল খাঁ নদী যখন পৃথিবীতে আছে, আর সেই নদী যদি একবার ‘এমভি নাগেশ্বর’সহ তার দেখা হয়েই গেছে, সেইসঙ্গে নদীর ওপরের বাটির মতো আকাশটাকেও, যে কিনা আসলেই ঝলমল করছে উত্তর কিরীট, দক্ষিণ মীন এইসব এইসব নক্ষত্র তার বিরাট মুখের হাঁয়ের মাঝখানে নিয়ে, আর সেইসঙ্গে এই রাতের নদী ধরে চলা বিয়ের বরযাত্রীদের এক নৌকাও যখন তার দেখা হল এইমাত্র, যে-নৌকার সামনের চণ্ডিপাঠে বসে বিরাট মাইকে মুখ রেখে এই এখন গান গাইছে নতুন বউয়ের পক্ষের লোক—বরপক্ষের মনু মিয়ারও সে কাছের মানুষ—তার বরগুনার বন্ধু আগুন-খাওয়া মিজান, গানটা গাইছে সে ওই নৌকায় এ মুহূর্তে জড়োসড়ো ও লাজুক-লাজুক হয়ে বসে থাকা মমতা নামের এক দীর্ঘদেহী ও দুধ-মধু গায়ের রং কনের জন্য : 

মালকা বানুর দেশে রে 
বিয়ার বাইদ্য আলা বাজে রে 
মালকার বিয়া হইব 
মালকার বিয়া হইব 
মনু মিয়ার সাথে রে– 

তো সেই পৃথিবীর কী হয় ওমর আলি, আর কী বা পানিগরু, যে কিনা পানির মধ্যে চলা ম্যাও ম্যাও ডাক দেওয়া এক বিড়ালপ্রতিম গরুই তো! অতএব জাহেদ ভাবল—নৌকার গলুইয়ের শাশ্বত আসনে খালি পায়ে বসে থেকে তখন নিশ্চিত বিশ্ববিধাতা জানেন যে, সত্য ও ঠাট্টা রচনার জন্য এ পৃথিবীর থেকে ভাল ও অনায়াস স্থান যেহেতু এই সপ্তস্বর্গ ও সপ্তপাতালে তিনি আর সৃষ্টি করেননি, তাই তিনি জানেন জাহেদের মতো একটা ছেলের এ মুহূর্তে এমনটাই ভাবার কথা যে—এই যদি হয় পৃথিবীর অবস্থা, এই যদি হয় পৃথিবীর কন্ডিশন, সুতরাং দেয়ারফোর এই যদি হয় পৃথিবীর সিচুয়েশন তো আই মিন টু সে, আই মিন টু টেল ইউ অল যে, আমি একটা বাচ্চা ছেলে হয়েও আমার বাবার সামনে বসা ওমর আলি নামের বয়স্ক মানুষটাকে এবার ধমকের সুরে বলতেই পারি যে, ‘আমার বাবার টাকা ফেরত দিয়ে দে, স্টুপিড খাচ্চর-ট্যারর ট্যারর, ঠা…ঠা…ঠা…ঠা, টাস… টাস… টাস, দ্রিম, বু-উ-ম।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *