আইন-ই-আকবরী
রাজসংসার
আকবর শা পাদশাহের ঊনচল্লিশ বার্ষিক রাজত্বকালে রাজসংসার, সৈন্য প্রভৃতি রাজ্য রক্ষার জন্য ত্রিশ কোটি একানব্বই লক্ষ ছিয়াশী হাজার পঁচানব্বই দাম ব্যয়িত হইয়াছিল অর্থাৎ সাতাত্তর লক্ষ ঊনচল্লিশ হাজার ছয়শত বাহাত্তর টাকা ব্যয় হইয়াছিল।
রাজার কোষাগার
যখন পাদশাহ রাজস্ব-ব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন, তখন আতমাদ খা নামক একজন খোঁজা রাজার এই সকল কার্যের সহায় হইয়াছিলেন। রাজার খাসমহল এবং জায়গীর-জমী পৃথক রাখা হইল। যে যে মহলের রাজস্ব এক এক কোটি দাম, সেই সকল মহলের উপর একজন করিয়া তহশীলদার নিযুক্ত হইল। তহশীলদারের অধীনে এক একজন কোষাধ্যক্ষও নিযুক্ত হইল। রাজা আদেশ দিলেন যে, প্রজা এবং কৃষাণ যে উপায়েই হউক রাজস্ব দিবে; মুদ্রা দিয়াই হউক বা তাহার ক্ষেত্ৰজাত শস্য দিয়াই হউক, যাহা দিবে তাহাই গ্রহণ করিতে হইবে। রাজস্ব আদায় হইলেই তাহার, হিসাব একটী ছাড়-কাগজে লিখিয়া, শস্য হইলে তাহা অর্থে পরিণত করিয়া, উহা রাজসংসারে পাঠাইয়া দিতে হইবে। সকল মহলের পরগণার উপর এক প্রধান কোষাধ্যক্ষ ও দারোগা নিযুক্ত হইয়াছিল। প্রাদেশিক কোষাগারে বা খাজনাখানায় একলক্ষ দামের উপর অধিক টাকা জমিলে তাহা তৎক্ষণাৎ রাজসরকারে পাঠাইয়া দিতে হইবে। প্রধান কোষাধ্যক্ষ রসীদ দিয়া অর্থ লইবেন। এতদ্ব্যতীত পেশকসের জন্য, রাজার তুলা উৎসবের জন্য এবং অন্যান্য দান-খয়রাতের জন্য কর্মচারী নিযুক্ত হইয়াছিল। এই সকল ব্যয়ের হিসাব যথারীতি লিখিয়া ও শীলমোহর করিয়া প্রধান কোষাধ্যক্ষকে দিতে হইত।
ইরাণে এবং তুরাণে কেবল একজনই প্রধান কোষাধ্যক্ষ ছিল। ইহাতে কার্যের অসুবিধা হয় বটে, কিন্তু এই দুই প্রদেশে বারোটী প্রধান কোষাগার আছে। নয়টীতে শস্যাদি রক্ষিত হয়, তিনটীতে মণিমুক্তা প্রভৃতি নিধি সঞ্চিত থাকে। দৈনিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক হিসাব দাখিল করিতে হয়, পাদশার হুকুমে বুৰ্দেয়ামগৃহে অর্থাৎ রাজপ্রাসাদের সাধারণগৃহে একজন রাজকর্মচারী কিছু স্বর্ণ ও রৌপ্য দীন-দুখীদিগকে বিতরণ করিবার জন্য রক্ষা করিয়া থাকেন। এতদ্ব্যতীত রাজপ্রাসাদের কোষাগারে এককোটি দাম সদাই মজুত থাকে। এক একটী থলেতে এক এক সহস্র দাম বাঁধা থাকে; এই সকল থলিয়ার নাম সহসাহ এবং এই সকল থলিয়া স্থূপীকৃত থাকিলে সেই স্তূপকে থলিয়া গন্দী বলে। ইহা ছাড়া আমীর-ওমরাহদিগের নিকট কিছু কিছু অর্থ সঞ্চিত থাকে। ইহারা সেই অর্থ থলিয়া করিয়া সঙ্গে লইয়া যান। সেই গেজে বা থলিয়ার নাম বেহলাহ এবং এই যে অর্থ ব্যয়িত হয়, ইহাকে খরচ-বেহলাহ বলে।
রত্নভাণ্ডার
রত্নভাণ্ডারের কোষাধ্যক্ষের নাম টেপকচী। তথায় একজন জহুরী দারোগাও থাকে। চুনী প্রথম শ্রেণীর হাজার অসরফীর মূল্যের কম নহে। দ্বিতীয় শ্রেণীর পঁচিশ আরফী মূল্যের কম নহে। তৃতীয় শ্রেণীর তিনশত আরফী মূল্যের কম নহে। এই রকমে চুনীর বারোটী শ্ৰেণী আছে। এতদ্ব্যতীত পান্না, হীরা, নীলা প্রভৃতি অন্য প্রকারের মণিমাণিক্যসঞ্চিত থাকে। তাহাদেরও বারোটী শ্রেণী আছে। মুক্তা লাল করিয়া রাখা হইত। এক একটী মুক্তার দাম ত্রিশ আরফীর কম নহে। প্রত্যেক মুক্তার মালার মুখ শীল করিয়া দেওয়া আছে। ওজন-হিসাবে মণিমাণিক্য কত ছিল, তাহার পরিমাণ বুঝাইয়া দিই। লাল এগার টাক পাত্রে থাকে বিশ রতি করিয়া ওজনে এক একটী, প্রত্যেকের মূল্য একলক্ষ টাকা। হীরক চারি রতি করিয়া ওজন পাঁচটী টাক আধারে রক্ষিত আছে, প্রত্যেকের মূল্য একলক্ষ টাকা। নীলা তিনরতি ওজনে, প্রত্যেকের মূল্য বাহান্ন হাজার টাকা। সবুজা সাড়ে সাত রতি ওজনে, প্রত্যেকের মূল্য পঞ্চাশ হাজার টাকা। মুক্তা পাঁচ আধারপূর্ণ, প্রতি আধারের মূল্য পঞ্চাশ হাজার টাকা।
টাঁকশাল
টাঁকশালের প্রধান অধ্যক্ষের নাম দারোগা। দ্বিতীয় অধ্যক্ষের নাম সরাফ। ইহারা ধাতুর গুণ জানেন, ধাতু পরিষ্কার করিতে হয় কেমন করিয়া, তাহা জানেন। পারস্যদেশে ধাতুপরিষ্কারের দশটা পৰ্য্যায় আছে; এই পর্যায়ের নাম ডিহী। ভারতবর্ষে পরিষ্কার করিবার বারোটী পৰ্য্যায় আছে; ইহাদের নাম বারবণিক। দক্ষিণদেশে হুন নামক একপ্রকার স্বর্ণমুদ্রা প্রচলিত আছে, যাহার বানী দশ পৰ্য্যায়ের, কিন্তু পাদশা আকবর শাহ পৌনে নয় পৰ্য্যায় স্থির করিয়াছেন। খসরু আলীর দিনার নামক স্বর্ণমুদ্রার বারবণিক ছিল; কিন্তু এখন উহা সাড়ে দশ বানীতেই গ্রাহ্য হয়।
বনোয়ারী
এদেশের সেরাফগণ ধাতুর রং এবং চাকচিক্য দেখিয়া তাহার বানী বলিতে পারেন। কিন্তু সেই প্রকারে বানী নির্ধারণ করা ঠিক নহে। বানোয়ারী এক রকমের যন্ত্র, যাহাতে অনেকগুলি তামার কিংবা অন্য কোন ধাতুর শীক লাগান আছে এবং প্রতি শীকের মুখে বানী হিসাবে এক একটু সোণা সংলগ্ন আছে। নূতন সোণার দর যাচাই করিতে হলে কষ্টিপাথরের উপর বনোয়ারীর মুখের Cযাণার কষি টানিতে হয়, নূতন সোণারও একটী কষি টানিতে হয়। পরে দুই কষির তুলনা করিয়া দাম ঠিক হয়। এক মাষা পরিষ্কার চাদীর সহিত একমাষা তামা মিলাইয়া নির্ধারিত ওজনের সোণার সহিত গলাইয়া এক করিলে যে সোণা হয়, তাহারই বানী সাড়ে দশ আনা। এই সোণায় এক মাষা লইয়া তাহাকে ষোলভাগে বিভক্ত করিলে প্রতিভাগের ওজন একরতি হয়। ঐ প্রকারের সাড়ে সাত রতি সোণার সহিতও উপরিলিখিত সোণার একরতি মিশাইলে তাহার বানী সওয়া দশ আনা হয় অর্থাৎ উপরকার খাদের আধরতি খাদ সোণার সহিত মিশাইলে চারি আনা বানী কমিয়া যায়।
আমীনও রাজার টাঁকশালের একজন প্রধান কর্মচারী। একজন মোসরেফ চোথা খাতায় আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখিয়া থাকেন। স্বর্ণবণি সোণা চাদী, তামা খরিদ করিয়া টাঁকশালে যোগান দিয়া থাকে, খাজাঞ্জী কোষাগার রক্ষা করিয়া থাকেন। ওজনদার মুদ্রা ওজন করিয়া থাকেন। একশত জিলালী আসরফী ওজন করিলে তিনি দেড় দাম পাইয়া থাকেন; হাজার টাকায় ছয় দাম ইত্যাদি। ঢালাইওয়ালা সোণা, রূপা গালাই ও ধোলাই করিয়া থাকেন। তামা গলাইবার সময় মুচীতে তৈল দিতে হয়। পাতওয়ালা সোণা, রূপা ও তামা পিটাইয়া পাত করিয়া থাকেন। এই পাত কাটিয়াই মুদ্রা হয়।
সোণা পরিষ্কার করিবার ব্যবস্থা
পাত তৈয়ার হইলে সেইগুলি কিরূপে পরিষ্কার করিতে হয়, তাহার ব্যবস্থা এই,–একষট্টি সুবর্ণমুদ্রা বা আসরফী কাটাই হইতে পারে, এমন আকারের সোণার পাত উপরে উপরে সাজাইয়া রাখিয়া, তাহাতে চারি সের সোরা ও চারি সের ইটের গুঁড়া মিশাইয়া দিতে হয়। এই স্কুপের উপর চারিদিকে বিলঘুটিয়া দিয়া সাজাইতে হয়। ঘুটিয়াতে আগুন ধরাইয়া দিলে ধীরে ধীরে পাতগুলি তাতিয়া উঠে। চারিদিকের বিলঘুটিয়া পুড়িয়া ছাই হইয়া গেলে সেই ছাইগুলি সযত্নে ও সাবধানে সরাইতে হয়। এই ছাইকে হিন্দিতে সেনোনীভস্ম বলে। এই ভস্মের মধ্যে সোণার খাদের যে চাঁদি, সেই চাঁদি বাহির হইয়া আইসে। ঐ পাতগুলিকে এইরূপে আরও দুইবার পোড় খাওয়াইতে হয়। পরে পাতগুলি বাহিরে পরিষ্কারজলে ধৌত করিতে হয়। আবার তাহাদিগকে ঐরূপে সাজাইয়া পোড় খাওয়াইতে হয়। এই প্রকারে ছয়বার ধুইলে ও আঠারবার পোড় খাওয়াইলে তবে স্বর্ণ বিশুদ্ধ হয়। বিশুদ্ধস্বর্ণ পরীক্ষা করিবার আর একটী উপায় আছে। হঠাৎ বিশুদ্ধস্বর্ণের পাত ভাঙ্গিলে যদি খখন শব্দ হয় তাহা হইলে বুঝিতে হইবে, উহাতে এখনও খাদ আছে। পরিক স্বর্ণ সকল স্থানেই এক ওজনে হইবে অর্থাৎ এক আকারের স্বর্ণপিণ্ড ওজন করিলে ঠিক এক ওজনই হইবে। এই সকল পরিষ্কৃত সোণার পাত গালাই করিয়া, ঢালাই করিয়া, তবে মোহরে পরিণত করিতে হয়। যাহারা মোহর কাটে, তাহাদের নাম জেরাব। ইরাণ এবং তুরাণ দেশে নানারকম যন্ত্রের উপায়ে মোহর কাটাই হইয়া থাকে কিন্তু ভারতবর্ষের কারিকরগণ হাতেই মোহর কাটিয়া দেয়। মোহর কাটাই হইলে তবে তাহার উপর পাদশাহের শীল ছাপ দেওয়া হয়। ইস্পাতের উপর শীলের অক্ষর তৈয়ারী করা হয়, সেই ইস্পাত তামার হাতলে বাঁধা থাকে। দিল্লীর মৌলানা আলী আহম্মদ, আকবর শা পাদশাহের জন্য শীল তৈয়ার করিয়া থাকেন। ইহার ন্যায় কারিকর আর অন্য কোন দেশে নাই। ইনি উজবেগীর পদ অধিকার করিয়াছেন। ইঁহার দুই পুত্র টাঁকশালে কাজ করেন; তাঁহারা প্রত্যেক মাসিক তিনশত দাম বেতন পাইয়া থাকেন। সিকুচী নামক একজন কর্মচারী দুইখানা ডাইসের মাঝখানে সোণার পাত রাখিয়া হাতুড়ীর সাহায্যে মোহর বা আসরফা তৈয়ার করিয়া থাকেন।
সুবক নামক কর্মচারী চাঁদির বাট তৈয়ার করেন। প্রথমে সীসা, দস্তা এবং তামার খাদ দেওয়া হইয়া থাকে। ইরাণ এবং তুরাণদেশে দশ ডিহী পৰ্য্যন্ত চাঁদি পরিষ্কৃত হইয়া থাকে। কিন্তু ভারতের সেরাফগণ কুড়ি বিসুয়া পর্যন্ত চাঁদি পরিষ্কার করিয়া থাকেন। চাঁদিতে কিসের খাদ আছে; তাহা জানিবার উপায় এই–চাঁদি খুব তাতাইয়া হঠাৎ জলে ফেলিলে যদি কালো হইয়া যায়, তাহা হইলে বুঝিতে হইবে, সীসার খাদ আছে; যদি লালচে রং ধরে, তাহা হইলে বুঝিতে হইবে, তামার খাদ আছে; যদি ছেয়ে ছেয়ে সাদাটে সাদাটে রং হয়, তাহা হইলে বুঝিতে হইবে, দস্তার খাদ আছে। যে উপায়ে মোহর বা আসরফী কাটা হইয়া থাকে, সেই উপায়ে রূপার টাকা, দিনার বা দাম কাটাই
চাঁদি পরিষ্কারবিধি
প্রথমে মাটীতে একটী গর্ত করিয়া সেই গর্তের মধ্যে প্রথমে বিলঘুটিয়ার ছাই ছড়াইয়া দিতে হয়। পরে বাবলাকাঠের পরিষ্কার ছাই দিয়া সেই গর্ত ভরাট করিতে হয়। তাহার পর জল ঢালিয়া ছাইগুলিকে পিণ্ডাকারে পরিণত করিতে হয়। পিণ্ড একটু কঠিন হইলে, তাহাতেই একটী বড় মুচী তৈয়ার করিতে হয়। এই মুচীর মধ্যে অপরিষ্কত চাঁদির পিণ্ড দিতে হয় এবং এক ওজনেরই সীসা ঐ চাঁদির উপরে রাখিতে হয়। পরে সেই গর্তের মুখ পৰ্য্যন্ত ভাল কয়লা (যাহাতে কাঠের অংশ নাই) দিয়া ভরাট করিতে হয়। কয়লাগুলি এমন হওয়া চাই যে, উহাতে কাঁচা কাঠের অংশ কোন আকারে না থাকে, অথচ শী পুড়িয়া ছাই না হয়। কুল, তেঁতুল, বাবলা প্রভৃতি কাঠের কয়লাই প্রশস্ত। কয়লাতে আগুন ধরাইয়া ধীরে ধীরে হাপড়ে ফুঁদিতে হয়। পরে উভয় ধাতু গলিয়া গিয়া এক হইলে উহার মধ্যে হঠাৎ জলের আছড়া দিবার সময় যদি অগ্নির সাদা জ্বালা ফুটিয়া উঠে, তাহা হইলে বুঝিতে হইবে, মধ্যের চাঁদি পরিষ্কার হইয়াছে। সেই মধ্যের চাঁদিটুকু বাহির করিয়া লইয়া তাহাকে আবার গলাইতে হয়। দ্বিতীয়বার গলাইবার সময় আর পূৰ্ব্ববৎ সীসা মিলাইতে হয় না। মুচীর গায়ে অপরিষ্কৃত চাঁদির খাদ ও সীসা জমিয়া থাকে। শেষে আবার ঐ মুচীকে গলাইতে হয়; গলাইলে এক প্রকারের সঙ্করধাতু প্রস্তুত হয়। এই সঙ্করধাতুকে হিন্দুস্থানীতে কেরেল এবং ফারসীতে কেনেই বলিয়া থাকে।
চাঁদি যাচাই করিবার ব্যবস্থা এই,-ইরাণ ও খোরাসান হইতে যে চাঁদির পাত আইসে, তাহার নাম সাহী; তুরাণ হইতে যে চাঁদি আইসে, তাহার নাম লারী এবং ইষ্কালী। এতদ্ব্যতীত নার্জিল ফিরিঙ্গী, রুমী, মামুদী মোজঃফারী এই কয়বিধ চাঁদির পাত গুজরাট এবং মালপ্রদেশে হইয়া থাকে। প্রথমে কুরশাকুব নামক একজন কর্মচারী চাঁদির বাট তাতাইয়া খুব পিটিয়া দেন। যতক্ষণ পর্যন্ত উহাতে সীসার গন্ধ থাকে, ততক্ষণ পিটাইতে হয়। পরে চাসীমিগার নামক আর কর্মচারী, যে উপায়ে স্বর্ণ পরিকৃত করা হয়, সেই উপায়ে চাঁদি পরিষ্কার করিয়া থাকেন। পরিষ্কৃত চাঁদির পাতের এক টুকরা কাটিয়া হাড়ের মুচীতে এক ভোলা সীসার সহিত গলাইতে হয়। সীসা পুড়িয়া গেলে যে চাঁদিটুকু থাকে, সেই চাঁদিটুকু পিটাই ওজন করিলে যদি একরতি ওজন কমিয়া যায়, তবে বুঝিতে হইবে, চাঁদি পরিষ্কার হইয়াছে। চাঁদি ও সোণা পোড় খাওয়ালে যে ছাই থাকে যাহার নাম সেলোনী, তাহাতে পারা দিয়া মাড়িলে সোণা ও চাঁদির টুকরা পারার মধ্যে মিশিয়া যায় এবং চাই পৃথক হইয়া যায়। ইহার পর যে ছাই অবশিষ্ট থাকে, তদ্বারা মুচী তৈয়ার হইয়া থাকে।
মোহরের ছাপ এবং প্রকার
প্রথম, স্বর্ণমুদ্রা।-–সাহেনশা; চক্রাকার ওজন একশত একতোলা, নয় মাষা, সাত রতি। লাল মোহরের একশত মোহর দাম। ইহার একদিকে লেখা আছে, “সাহেমশা পাদশা জালাল উদ্দীন আকবর; আল্লা তাঁহার রাজ্য চিরস্থায়ী করুন, তাঁহাকে চিরজীবী করুন।” এই মুদ্রা আয় কাটাই হইয়া থাকে। আর একদিকে লেখা থাকে, “আল্লা অসীম দয়াবান, তাহার দয়ায় জগৎ পরিচালিত হইতেছে। ইহারই নীচে লেখা থাকে, “আবুবের ওমান ওসমান আলী।” মৌলানা মকসুদ প্রথমে এই মোহর কাটাই করেন। পরে মৌলানা আলী আহাম্মদ নূতন মোহর তৈয়ার করিয়া সেখ ফৈজীর লিখিত এই কয়টী কথা লিখিয়া দেন;– “এই সূৰ্য্য যাহার প্রভাবে সমুদ্রগর্ভে মুক্তা ফলে, যাহার প্রভাবে কৃষ্ণ প্রস্তরে মণির প্রভা পরিস্ফুট হয়, যাহার প্রভাবে খনিজ প্ৰস্ত স্বর্ণে পরিণত হয়, এই স্বর্ণ যে আবরশা পাদশাহার নাম অঙ্কিত থাকাতে আকব্বরী মোহর বলিয়া কথিত হয়।”–এই মোহরের অপর পার্শ্বে আছে, “আল্লা হো আবর।” আর একরকম আসরফী আছে, তাহার নাম “রেহেস”, ইহা আকব্বরী মোহরের অর্ধাংশ বা আধুলী। আতেনা–আকব্বরী মোহরের সিকি। বিসেঠ-আকব্বরী মোহরের পঞ্চাংশ বা পাঁচ আনা। চতুষ্কোণ এক রকম মোহর আছে, যাহার নাম যুগল; ইহা আকব্বরী মোহরের এক-পঞ্চাশ অংশ। গির্দ গোলমোহর, তাহার একদিকে লেখা আছে, “আল্লা হো আকবর”, অন্যদিকে “অ্যায় এলাহী।” আতাবীও গোলমোহর, ওজন একতোলা, দুই মামা, পৌনে পাঁচ রতি; মূল্য বারো টাকা। এলাহী আর একরকম গোলমোহর, ওজন বারো মাষা, সওয়া তের রতি। লালজিলালী চতুষ্কোণ মোহর, ওজনে এলাহীর ওজনের ন্যায়। আদেলবুটুকা গোলমোহর, ওজন এগার মাষা, মূল্য নয় টাকা। শুদ্ধ মোহর, যাহা হইতে এ সকলের নাম হইয়াছে, যাহা পুরাকালে হিন্দুদের আমলে নিষ্ক বা স্বর্ণখণ্ড বলিয়া পরিচিত হইত, উহা আদেলবুকারই ওজন ও মূল্যও ঐরূপ। মৈনা আর এক প্রকার ক্ষুদ্র চতুষ্কোণ মোহর, লালজিলালীরই ওজন। চরূগোসে, গিদ্ধ, দেহ সেলোনী, রেবী, মুন, নিষ্কি, সেলেনী, পুঁচ, পাণ্ডব, সুমী, অষ্টশুদ্ধ, কালা, জেরা প্রভৃতি মোহরের আকারের মোহরের ওজনের পুরাকালের সুবর্ণমুদ্রারও প্রচলন আছে।
রৌপ্যমুদ্রা
রূপেয়া,–ওজন সওয়া এগারো মাষা। ইহা সেরখার আমলেই প্রথম চলিত হয়। জিলালে, চতুষ্কোণ, রূপেরারই ওজন, মূল্যও এক। দূৰ্ব্বা, চরণ, পাণ্ডব, অষ্ট, দেশা, কালা, শুকী এক ওজনেরই রৌপ্যমুদ্রা পুরাকাল হইতে এখনও প্রচলিত আছে।
তাম্রমুদ্রা
দাম,–ওজন পাঁট টাক, অর্থাৎ এক তোলা, আট মাষা, সাত রতি। চল্লিশ দামে এক টাকা হয়। পূৰ্ব্বে ইহাতে পয়সা এবং বেহোলোলীও বলিত। আধেলা, পওলা, দামুড়ী ইহা দামেরই অংশবিশেষ। আর শাহের রাজ্যের প্রথমে সর্বত্রই স্বর্ণমুদ্রা কাটাই হইত; এখন কিন্তু রাজধানী আগরায়, বাঙ্গালাদেশে আহম্মদাবাদে, গুজরাটে এবং কাবুলে মুদ্রিত হইয়া থাকে। রৌপ্য এবং তাম্রমুদ্রা এবং কয়স্থান ব্যতীত ইল্লাহাবাস, আগ্রা, উজেন, সুরট, দিল্লী, পাটনা, কাশ্মীর, লাহোর, মুলতান, তাড়া, কোচল, এই সকল স্থানে এবং আজমীর, অযোধ্যা, আটক, আলোর, বেনারস, বেহেকার, বাড়, পত্তন, জৌনপুর, জলন্ধর, সাহরাণপুর, শারঙ্গপুর, সম্বর, কনৌজ রাঠোর, হরিদ্বার, হিসাব ফিরোজে, কাল্পী গোয়ালিয়র, গোরক্ষপুর, লক্ষ্ণৌ, মা, নাগোর, সেরহিন, শিয়ালকোট ও সেরুঞ্জ এই সমস্ত স্থানে মুদ্রিত হইয়া থাকে। রাজা তোর্ডরমল রাজস্ববিভাগের যখন প্রথম ভারগ্রহণ করেন, তখন এই চারি প্রকারের মুদ্রা ব্যবহৃত ছিল;–মোহর, লালজিলালী, রূপেয়া এবং দাম। রূপেয়া গোল এবং চতুষ্কোণও ছিল। আকবর শা চতুষ্কোণ রূপয়া উঠাইয়া গোল টাকারই প্রচলন করেন। মোহর বা টাকা তিন রতি পৰ্য্যন্ত ক্ষয় হইয়া গেলে রাজ সরকারে তাহার দাম কম হইত না; কিন্তু নয় রতি কমিলে দাম বাদ দিতে হইত;–এক রতি কমিলে পাঁচ দাম, তাহার উপর দেড় রতিতে দশ দাম। যখন আজেদ্দৌলা স্বদেশে গমন করিয়াছিলেন, তখন রাজা তোড়লমল মোহরের মূল্য টাকাতেই গ্রহণ করিবার জন্য হুকুম প্রচার করিয়াছিলেন।
দেরহেম বা দিনার
ইহা এক প্রকারের মুদ্রা। বহু পুরাকাল হইতে আসিয়া-প্রদেশের নানা স্থানে ইহা প্রচলিত আছে। ইহার আকার খেজুরের আঁটির মত। খলিফা ওমার ইহার আকার গোল করেন এবং জবীরের সময় ইহার উপর “আল্লা” এবং “বরৎ” এই দুটী কথা লেখা থাকে। খলিফা ওমারের সময় বেঘালী নামে আর এক রকম দিনার প্রচলিত ছিল। দিনার নামে এক প্রকার স্বর্ণমুদ্রাও আছে; ওজন এক নিষ্ক অর্থাৎ ছিয়ানব্বই যব।
ব্যবসায়ীরা স্বণ এবং রৌপ্যমুদ্রা প্রস্তুত করিতে কিরূপ লাভ করে, তাহার একটা হিসাব দেখাইতেছি। দশ বানীতে এক তোলায় কিছু খাদ থাকিত না; পৌনে দশ বানীতে দুই রতি, সাড়ে নয় বানীতে চার রতি এবং নয় বানীতে এক মাষা; প্রত্যেক বানীর উপর তাহারা একমাষা করিয়া অধিক সোণা চড়াইয়া লইত। দৃষ্টান্ত দ্বারা বুঝাইব।–মনে করুন, একজন ব্যবসাদার একশতটা লালজিলালী মোহর প্রস্তুত করিতে একশত ত্রিশ তোলা দুই মাষা ওজনের পাঁচ বানীর সোণালয়। বাণী বাড়াইবার জন্য পোড় খাওয়াইতে বাইশ তোলা, নয় মাষা, সাড়ে সাত রতি বাদ যায়। বাকী একশত সাত তোলা, চারি মাষা পরিষ্কার সোণার একশত পাঁচটা জিলালী মোহর তৈয়ারী হয়। তবুও আধ তোলা আঁটী সোণা হাতে থাকে। ইহা ব্যতীত পোড়ের ভস্ম আছে, মুচী গালাইয়ের সোণা আছে, আর খাদের বাদ হিসাবে এগারো ভোলা, এগারো মাষা, সাড়ে চারি রাত চাঁদিও পাওয়া যায়; সুতরাং লাভের হিসাব ইহাতেই বুঝা যায়। রৌপ্যমুদ্রা কাটাইতেও ব্যবসাদারদের এই হিসাবে লাভ। তাম্রমুদ্রা কাটাইতে একমণ তামায় এক হাজার চুয়াল্লিশটা দাম তৈয়ার হয়।
ধাতুর কথা
ধাতু সাত প্রকার;–স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, দস্তা, লৌহ, সীসা এবং রুটুটিয়া। সুফয়াদরু অর্থাৎ কাসা সঙ্করধাতু। রবী,ইহাও এক প্রকার সঙ্করধাতু, চারিসের তামা ও দেড়সের সীসা মিলাইয়া ইহা প্রস্তুত হয়। এতদ্ব্যতীত পিল ও তালেকুন নামে এক প্রকারের ধাতু আছে।
হারেম বা বেগমখানা
এই হারেমের জন্য পাদশাহকে অনেক অসুবিধা ভোগ করিতে হয়; কিন্তু পাদশা অগাধ বুদ্ধিবলে হিন্দু-রাজাদের কন্যা ও ভগিনীকে বিবাহ করিয়া হিন্দুদিগকে মোগল সাম্রাজ্যের সহিত অচ্ছেদ্য বৈবাহিকসম্বন্ধে চিরদিনের জন্য আবদ্ধ রাখিয়াছেন।
একটা প্রকাণ্ড মাঠ, চারিদিকে উচ্চ প্রাচীরে ঘেরা এবং তাহার মধ্যে একদল বেগমের জন্য একটা মহল নির্মিত থাকে। দুই তিনটী মহলের মধ্যে একটী করিয়া বাগান, পুষ্করিণী ও কুয়া নিৰ্ম্মিত থাকে। এই প্রকাণ্ড মহলকে হারেম বলে। পাদশা আকবর শাহের কিছু অধিক পাঁচহাজার বেগম ও সেবিকা ছিল। প্রত্যেক বেগমের দলের উপর এক একটা কাৰ্য্যের ভার ছিল। এক একদল বেগমের উপর একজন স্ত্রী-দারোগা নিযুক্ত ছিল। এই সকল দারোগার যিনি সর্দার, তিনি হারেমের কী বলিয়া অভিহিত হইতেন। প্রত্যেক বেগমেরই মাসহারা নির্ধারিত আছে। বেগমের সর্বশ্রেষ্ঠ দলের বয়স এবং রূপগুণানুসারে এক হাজার ছয় শত দশ টাকা হইতে একহাজার আটশত টাকা পৰ্যন্ত মাসহারা নির্ধারিত ছিল। সেবিকাদের পঞ্চাশ হইতে এবং যাহারা ধাত্রী, তাহাদিগের চল্লিশ হইতে দুই শত টাকা পর্যন্ত মাসিক বেতন স্থির ছিল। অতিবৃদ্ধাগণ হারেমে স্থান পাইতেন না; তাহাদের থাকিবার জন্য স্বতন্ত্র আবাস নির্দিষ্ট ছিল। হারেমের প্রধান দরজায় মুসরেফ নামক একজন কর্মচারী অহরহ চৌকী দিতেন। তাহার দস্তখতী কাগজ ব্যতীত হারেমের ব্যয়ের জন্য একটী পয়সাও কোষাগার হইতে দেওয়া হইত না। বেগমদের মধ্যে যখন কাহারও কোন সামগ্রী প্রয়োজন হইত, তখন তিনি হারেমের কোষাধ্যক্ষের নিকট আবেদন করিতেন। কোষাধ্যক্ষ আবেদনকারিণীর মাসহারা, বয়স ও অভাবের মর্ম লিপিবদ্ধ করিয়া মুসরেফের নিটক পাঠাইতেন। মুসরেফ দস্তখত করিয়া রাজার কোষাধ্যক্ষের নিকট পাঠাইতেন। কোষাধ্যক্ষ ঐ রসীদ হারেমের হিসাবজাত করিয়া টাকা দিতেন। নগদ টাকা ব্যতীত হারেমের বেগমগণকে আর কিছু দেওয়া হইত না। সাজ-পরিচ্ছদ, পোশাক, হারেমের দারোগারা সকলে মিলিয়া পরামর্শ করিয়া পাদশাহের অভিমত জানিয়া স্থির করিতেন। হারেমের খরচের জন্য পাদশার কোষাগার হইতে যে মুদ্রা দেওয়া হইত, তাহা স্বতন্ত্ররকমের ছিল। প্রচলিত মুদ্রা হইতে তাহার একটু পার্থক্য ছিল। হারেমের প্রত্যেক মহলে চেড়ীগণ পাহারা দিত। যে গৃহে পাদশা যাইয়া শয়ন করিতেন, সেখানে সুন্দরী, নবীনা বিশ্বাসযোগ্য চেড়ী নিযুক্ত থাকিত। হারেমের বহির্ভাগে খোঁজাগণ পাহারা দিতেন। খোঁজাগণের পরে আরও একটা ঘটী ছিল, সেই ঘটীতে রাজপুতগণ পাহারা দিতেন। সময়ে সময়ে পাদশা কোন বিশেষ ওমরাহ বা আহেদীকে সম্মানিত করিবার জন্য হারেমের প্রধান দরজার রক্ষক নিযুক্ত করিতেন। বড় বড় ওমরাহ এই কাৰ্য্যের জন্য লালায়িত হইতেন।
যদি কখন কোন ওমরাহের স্ত্রী বা অন্য কোন বেগম হারেম-আবদ্ধা কোন বেগমের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহিতেন, তাহা হইলে তাহাকে বহিৰ্বারের কোন রক্ষকওমরাহ বা আমীরের নিকট আবেদন করিতে হইত। আবেদন গ্রাহ্য হইলে তবে তাহারা ভিতরে যাইতে পারিতেন। অনেকে একমাস পর্যন্ত তথায় থাকিতে পাইত। এই সকল ব্যবস্থা ব্যতীত পাদশা স্বয়ং হারেমের রক্ষণাবেক্ষণের ভার লইয়াছিলেন।
পাদশাহের সফর
পাদশাহ শীকার করিতে বা দেশভ্রমণ করিতে যাইলে যে ব্যবস্থা করা হয়, তাহার বিবরণ লিখিতেছি। গুলালবার নামক একটী স্থান আছে; শাহ পাদশা নিজের তত্ত্বাবধানে উহা তৈয়ারী করাইয়াছেন। ইহার চারি দিকে চারটী দরজা আছে, দরজায় তালা দেওয়া থাকে, পাহারাও থাকে। এই গুলালবারের ভিতর পূর্বদিকে একটী সামীয়ানা-গৃহ নির্মিত আছে। গৃহের মধ্যে ৬৪টী কক্ষ আছে; প্রত্যেক কক্ষ ২৪ গজ লম্বা এবং গজ ১৪ চওড়া। মধ্যস্থলে চৌবীন-রৌতিনামক একটী স্থান নির্মিত আছে। এই চৌবীন রৌতির চারিপাশে অন্যান্য সামীয়ানা খাড়া করা থাকে। ইহারই পার্শ্বে কাষ্ঠের একটী দ্বিতল গৃহ নির্মিত আছে। পাদশা এই কাষ্ঠগৃহে নমাজ পড়িয়া থাকেন এবং দোতলা হইতে আমীর ওমরাহগণের অভিবাদন গ্রহণ করেন। এই স্থানে স্ত্রীলোক যাইতে পারে না। ইহারই পার্শ্বে আরও ২৪টি চৌবীন-রৌতি তৈয়ার থাকে; এক একটী রৌতি কানাত দিয়া পৃথক করা আছে। এই সকল রৌতিতেই বেগমগণ বাস করেন। খাস বেগমদিগের জন্য খাস তাম্বু নির্মিত থাকে; সেই সকল তাম্বুর ভিতরে কিংখাপ, মখমল প্রভৃতি বহুমূল্য কাপড়ের উপর জরীর কাজ করা থাকে। ইহারই একদিকে ষাইট গজ দীর্ঘ্যে ও প্রস্থে একটী প্রকাণ্ড সামীয়ানা টাঙ্গান থাকে; উহারই নীচে ঐরূপ বড় একটী পারস্যদেশীয় উত্তম গালিচা বিস্তৃত থাকে। এই গালিচার উপর এবং সামীয়ানার নীচে বহুমূল্যবস্ত্রের ছোট ছোট তাম্বু খাটান থাকে। এই সকল তাম্বুর মধ্যে উর্দু বেগমসকল বাস করেন। ইহারই সম্মুখে একটী বড় ময়দান খোলা থাকে, উহা দৈর্ঘ্যে ১৫০ গজ, প্রস্থে ৪০ গজ, উহার নাম মাতাবী। এই মাতাবীর দুই পার্শ্বে দুই সারি বহুমূল্য-বস্তুনির্মিত তাম্বু খাটান থাকে, প্রত্যেক তাম্বুতেই সুন্দরী সুন্দরী বেগম ও পরিচারিকা অষ্টপ্রহর উপস্থিত থাকে। পাদশা পদচারণা করিতে করিতে শ্রান্ত-ক্লান্ত হইলে এই সকল তাম্বুর মধ্যে গিয়া বিশ্রাম করেন। এই মাতাবীর দুই পার্শ্বে খোঁজা পাহারা থাকে। মাতাবীর মধ্যস্থলে নগিরা নামক একটী সমীয়ানা খাটান থাকে, নমগিরার সামীয়ানা বহুমূল্যবস্ত্রে নির্মিত হইত; তাহার চতুষ্পর্শে মুক্তার ঝালর ঝোলান থাকিত। পাদশা সন্ধ্যার সময় এইখানে বসিতেন এবং অতি আত্মীয় ও অন্তরঙ্গ-বন্ধুর সহিত আলাপ করিতেন। এইখানেই রাজ্যসম্বন্ধীয় গুপ্ত-মন্ত্রণা হইত। গুলালবারের নিকট আর একটী গোল সামীয়ানা টাঙ্গান থাকিত, ইহার ব্যাস ৩৬০ গজ। ইহারই মধ্যস্থলে আর একটী চৌবীন-রৌতি তৈয়ারী থাকিত। এই চৌবীন রৌতির চারিদিকে আরও ৪০টী ছোট ছোট তাম্বু খাটান থাকিত। ইহাকেই বলে ওপচেকী খানা। ইহাই পাদশার স্নানাগার এবং শৌচের স্থান। ইহারই নিকট কার্পেটের একটী বড় তাম্বু খাটান থাকিত, ইহা সমচতুষ্কোণ এবং দীর্ঘ-প্রস্থে ১৫০ গজ। সকলের উপর চারিটী বড় বড় তাম্বু খাটান থাকিত, ইহা মমজামা-কাপড়ের তৈয়ারী ছিল। মাসের প্রথম দিনে এই তাম্বু এবং গৃহের গালিচা বা কার্পেট পরিবর্তন করা হইত। এই গুলালবারের চারিদিকে আবার নাফরখানা, ফরাসখানা এবং মীর মজীল তৈয়ারী ছিল। পাদশা স্থানান্তরে যাইয়া এই সকল সামগ্রী তাহার সহিত যাইত। উহা বহন করিবার জন্য ১০০ শত হাতী, ৫০০ শত উট, চারিশত গরুর গাড়ী এবং এক হাজার মুটিয়া নিযুক্ত খাকিত। ইহার বৃক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাঁচশত ঘোড়সওয়ার অষ্টপ্রহর নিযুক্ত থাকিত। ইহা খাটাইবার জন্য ইরাণ এবং তুরাণাদেশীয় এক হাজার ফরাস, পাঁচশত মজুর, একশত ভিস্তী, ৫০ জন ছুতার মিস্ত্রী, ৫০ জন তবুওয়ালা, একশত দজ্জী, ৫০ জন কাড়ওয়ালা, ৩০ জন চামার, ২০ জন কামার এবং দুইশত মেথর নিযুক্ত থাকিত। প্রত্যেকের মাসিক বেতন ছিল ২৪০ হইতে ১৩০ দাম।
স্কন্ধাবার–ফৌজের উর্দু
পাদশা কখনও নিজের সকল সৈন্য একস্থানে সমবেত করিতেন না। অল্পসংখ্যক সৈন্য লইয়াই তিনি যুদ্ধে গমন করিতেন। যেখানে তাহার ফৌজের উর্দু গাড়া হইত, সেই স্থানটী সমতল, সমচতুষ্কোণ এবং ১৫ হাজার ৩০ গজ দীর্ঘ। ইহার মধ্যে পাদশার গুলালবার ত থাকিতই, তদ্ভিন্ন সেই গুলালবারের পশ্চাতে, বামে, দক্ষিণে ও সম্মুখে একশত গজ করিয়া জমী খালি পড়িয়া থাকিত। এই খালিজমীর পর শাজাদা ও শাজাদীদিগের তাম্বু খাটান হইত। দক্ষিণে সুলতান সেলিমের তাম্বু গোড়া হইত : বৃহস্পতিবার শুক্রবার এবং শনিবারে যে সকল সেনা পাহারা দিত, তাহাদের তাম্বু ইহারই পশ্চাতে থাকিত, রবিবার ও সোমবারের পাহারাওয়ালাদের তাম্বু দক্ষিণে, মঙ্গলবার ও বুধবারের পাহারাওয়ালার তাম্বু বামে থাকিত।
দীপমালা
ভগবানের জ্যোতি ব্যতীত অন্য কোন জ্যোতি দ্বারা পাদশাহের স্কন্ধাবার আলোকিত হইত না। ঠিক দুই প্রহরকালে সূৰ্য্যকান্তি নামক হিন্দুদিগের ব্যবহার্য এক প্রকার স্ফটিকপদার্থের স্পর্শে স্বর্গের অগ্নি সংগ্রহ করা হইত। সূর্যের আলোকে আতসপাথর ধরিয়া তুলার বা শোলার আগুন ধরান হইত। এই অগ্নি একজন জ্ঞানীলোকের নিকট রক্ষা করা হইত। এই অগ্নির জ্বালা হইতেই পাদশাহের স্কন্ধাবারের আলোকমালা প্রজ্বলিত হইত। বৎসরান্তে একবার করিয়া নূতন অগ্নি সঞ্চয় হইত। যে পাত্রে অগ্নি থাকিত, তাহার নাম আগেনগার। আর একরকমের পাথর আছে, যাহার নাম চন্দ্ৰকান্তি, এই চন্দ্ৰকান্তি প্রস্তর চন্দ্রকিরণে ধরিলে বিন্দু বিন্দু জলপাত হয়। এই জল ধীরে ধীরে সঞ্চয় করিয়া রাখা হইত। পাদশা তৃষ্ণানিবারণের জন্য যে সরবৎ পান করিতেন, আশ্বমানের এই জলবিন্দু তাহাতে দেওয়া হইত।
সূর্যাস্তের পূর্বে একদণ্ড থাকিতে পাদশাকে নিদ্রা হইতে ভোলা হইত অথবা তিনি যদি অশ্বারোহণে কোন কার্যে যাইতেন, বিশেষ বাধা না ঘটিলে তাঁহাকে ঐ সময়ের মধ্যে স্কন্ধাবারে ফিরিয়া আসিতে হইবে। সন্ধ্যা হইলেই পাদশার সম্মুখই ১২টী কর্পূরের বাতী, নিরেট স্বর্ণের বাতীদানের উপর বসাইয়া ঐ আশমানীয় আগুনে প্রজ্বলিত করিয়া পাদশাহের সম্মুখে রাখা হইত। পরে বিচিত্র বসনভূষণে বিভূষিতা মোড়শী কামিনী মধুরকণ্ঠে প্রণয়-সঙ্গীত করিতে করিতে পাদশাহের সম্মুখে উপস্থিত হইত এবং বাতীদানশুদ্ধ একটী বাতী লইয়া নানা অঙ্গভঙ্গীর সহিত অপূৰ্ব্ব নৃত্য করিতে করিতে পাদশাহকে আরতি করিত; শেষে আল্লার নিকটে পাদশাহের মঙ্গলকামনা করিয়া চলিয়া যাইত। এইরূপে পৰ্য্যায়ক্রমে ১২টী নর্তকী আসিয়া পাদশাহকে আরতি করিয়া চলিয়া যাইত। রূপে, গুণে, কলাবিদ্যায় ইহাদের সমকক্ষ স্ত্রীজাতির মধ্যে আর ছিল না। এক একটী বাতীদান ওজনে কুড়িসেরের অধিক হইত। নানা প্রকারের মূর্তি বাতীদানে নির্মিত থাকিত। এক একটী বাতীদানের মূল্য দশহাজার টাকারও অধিক। এক একটা কর্পূরের বাতী তিনগজ লম্বা। পাদশাহের উচ্চ ১৬টী মশালে আলোকিত হইত। শুক্লপক্ষের প্রতিপদ হইতে চতুর্থী পৰ্যন্ত ১৬টি মশাল জ্বলিত; তাহার পর রোজ একটী করিয়া মশাল কমিয়া যাইত। পূর্ণিমার রাত্রিতে একটী মশাল জ্বলিত। পাদশার উর্দু রাত্রিকালে বহুদূর হইতে দেখিতে পাওয়া যাইবে, সেই উদ্দেশে ৪০ গজ উচ্চ একটা খুটীর উপর একটা প্রকাণ্ড মশাল একটা বড় অভ্রের লণ্ঠনের মধ্যে জ্বালা থাকিত; ইহাকে আকাশপ্রদীপ বলিত। এক একটী পদাতির বেতন দুই হাজার চারিশত দাম হইতে দুই হাজার আশীদাম নির্ধারিত ছিল।
রাজচিহ্ন
আউরঙ্গ বা রাজসিংহাসন,–ইহা নিরেট স্বর্ণ বা চাদীতে তৈয়ারী হয় এবং উহাতে বহুমূল্য প্রস্তর থাকিত। উহার আকার চতুষ্কোণ, অষ্টকোণ প্রভূতী নানা রকমের ছিল। ছত্র,রাজসিংহাসন অপেক্ষা ছত্রের মূল্য অধিক। ছত্রের ঝালের গজমুক্তা থাকিত। সৈবান,ইহা ডিম্বাকৃতি একপ্রকারের যন্ত্রবিশেষ। পাদশার পদচারণা করিবার সময় একজন আমীর ইহা এমনভাবে ধরিয়া রাখিতেন যে, পাদশা যেমনভাবে বিচরণ করুন না, তাঁহার মুখে সূর্যালোক লাগিতে পাইবে না। কউকেবা–নিফিদ, ঝাল, করতাল, শিঙ্গা, ভৃঙ্গ প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র যাইত। পাদশা নিজে গীতবিদ্যায় পারদর্শী; তিনি দুইশত রকমের নূতন সুর তৈয়ার করিয়াছিলেন। তাহার মধ্যে জুলালসাহি ও নৌরজী, এই দুই সুর অতি মিষ্ট।
শীলমোহর
পাদশার নানা রকমের শীলমোহর ছিল। তাহার একদিকে পাদশার নাম লেখা থাকিত, অপরদিকে “সাধুতাই ভগবানকে সন্তুষ্ট করিবার একমাত্র উপায়” ইহাই লেখা থাকিত। এতদ্ব্যতীত মোহরের চারিপার্শ্বে লেখা থাকিত, “যে সোজাপথে চলে, সে কখন পথ হারায় না।” এই শীলমোহরে ফরমান অঙ্কিত হইত। হারেমের জন্য একটা খাস শীলমোহর ছিল, তাহাতে লেখা থাকিত, “ভগবানই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সামর্থ্যই ভগবানের ঐশ্বৰ্য্য।”
তাম্বুলব্যবস্থা
বরগা এক বিরাট তাম্বু, ইহার নীচে কিছু কম দশ হাজার লোক দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিত। এই বরগা-তাম্বু এক হাজার ফরাস যন্ত্র-সাহায্যে সাতদিনে খাটাইতে পারে। কেবল কানাতের দাম দশহাজারের উপর। চৌবীন-রৌতি এক প্রকারের তাম্বু, দশটা খুঁটীর উপর খাড়া করা হইত। তাম্বুর নিয়ে খসখসের চাল দেওয়া থাকিত এবং তাম্বুর সহিত খসখস্ ও বেণা বোনা থাকিত। চৌবীন-রৌতির ভিতরটা অর্থাৎ এই বেণা এবং খসখসের বেড়ার উপর ভাল কিংখাপ ও মখমল আঁটা থাকিত। উপরে চন্দ্রাতপের ন্যায় লাল সুলতানী বনাত টাঙ্গান হইত। চৌবীন-রৌতি টাঙ্গাইবার জন্য রেসমের বা তসরের দড় ব্যবহার হইত।
ডুরাসানা-মঞ্জেল
ইহা দোতলা তাম্বু; আট নয়টী খুঁটীর উপর দাঁড় করান হইত। উপরতলায় পাদশা নমাজ পড়িতেন এবং সূর্যের উপাসনা করিতেন। নীচের তলায় বেগমগণ থাকিতেন। এতদ্ব্যতীত খাটগা, কানিংলী, সরাপর্দা, সামীয়ানা, মণ্ডল প্রভৃতি নানা রকমের তাম্বু ও সামীয়ানা ছিল। গুলবার নামক তাম্বুর দেওয়াল কাষ্ঠের নির্মিত। গালীম এবং কালীম এক প্রকারের গালিচাবিশেষ; এই সকল তাম্বুতে তাহাই পাতা হইত। তাকিয়া নেমীর;–ইহা এক রকম বড় উঁচু তাকিয়া, ইউরোপ হইতে এদেশে আমদানী করা হইয়াছিল। স্পেন, তুর্কী প্রভৃতি দেশে মুরগণ ইহা ব্যবহার করিতেন।
আবদারখানা বা পানশালা
সোরা দিয়া পাদশাহের পানীয়জল ঠাণ্ডা করা হইত। বালী ও মাটীর তৈয়ারী কুঁজতে জল ভরিয়া তাহার মুখে ভিজা নেকড়া কিংবা কাপড় বাঁধিয়া দিয়া একটা বড় গামলায় রাখা হইত! সেই গামলায় জল থাকিত। সেই জলে প্রচুরপরিমাণে সোরা মিশান হইত। কুঁজার গলায় তিনপাক রেসমের দড়ী দিয়া, যেমনভাবে মন্থনদণ্ড ঘোরাণ হয়, সেইভাবে কুঁজাকে ঘোরাণ হইত। খানিকক্ষণ ঘোরাইলেই কুঁজার জল খুব ঠাণ্ডা হইত। (শ্রীহর্ষচরিতে যখন হর্ষদেবের পিত্তপ্রবণ জ্বর হয় বিষম পিপাসা উপস্থিত হয়, তখন চিকিৎসকগণ এই উপায়ে জল শীতল করিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। ইহাকে গড়গড়ীর জল বলে। হর্ষচরিতে ইহার বিস্তৃত বিবরণ আছে।) পাদৃশাহের পাকশালায় গঙ্গা এবং যমুনার জল ব্যবহৃত হইত। তিনি পঞ্জাবে যাইলে হরিদ্বার হইতে জল লইয়া যাওয়া হইত; যখন আগরায় থাকিতেন, তখন প্রয়াগ হইতে সঙ্গমের জল আনা হইত।
পাকশালা
পাদশা আহোরাত্রের মধ্যে একবার আহার করিতেন। পাকশালার প্রধান কর্মচারীর নাম মীর বেকাইওয়েল। এই কর্মচারী কেবল ব্যঞ্জন চাকিতেন। ইনি চাকিয়া দিলে তবে পাদশা খাইতেন। পাদশাহের আহারের জন্য সর্বদাই মাংস, ঘি, তেল, শাকসবজী, নানা দেশের ফল, গরমমশলা এবং মিষ্টান্ন প্রস্তুত থাকিত। বৎসরান্তে পাকশালার ভাণ্ডার বিতরিত হইত। বহরাঞ্চ নগর হইতে সুখদোষ চাউল আনা হইত; বাজৌরী হইতে খঞ্জন নামক চাউল আনা হইত; হিসার হইতে ঘি এবং তেল, কাশীর হইতে নানা প্রকারের জলচর ও স্থলচর পক্ষী আনা হইত; বাবুর্চি বা পাঁচকগণ ভেড়া, ছাগল এবং মুর্গী এক স্বতন্ত্র উপায়ে মোটা ও তাজা করিয়া রাখিত। ইহাদিগকে পোলায়ের আকৃনিজল বা মাংসের কাথ খাওয়ান হইত। শাকসবজীর জন্য পাদশাহের স্বতন্ত্র বাগিচা ছিল। পাদশা স্বর্ণ, রৌপ্য, মাৰ্বল এবং অত্যুৎকৃষ্ট চীনের বাসনে আহার করিতেন। পাদশাহের জন্য যখন আহাৰ্য্য সামগ্রী পাঁচকগণ লইয়া যাইত, তখন তাহাদিগের নাসিকা ও মুখ রেসমের রুমালে বাঁধা থাকিত। স্বর্ণপাত্রসকল মুখে লাল রেসমের দ্বারা বাধিয়া তাহার মুখে মীর বকাওয়েল শীল মারিয়া দিতেন। আহাৰ্য্যসামগ্রী যখন পাদশাহের নিকট প্রেরিত হইত, তখন অগ্রে, পশ্চাতে, উভয় পার্শ্বে চোপদার, দারোগা সসৈন্যে যাইতেন। পাদশাহের সম্মুখে আহাৰ্য্যসামগ্রী রাখিয়া তাহারই সম্মুখে তাহার শীল ভাঙ্গিয়া, রুমাল কাটিয়া খাদ্যদ্রব্য বাহির করা হইত এবং প্রধান বাবুর্চী সাহেব পাদশাকে দেখাইয়া সকল সামগ্রী চাখিতেন। পাদশাহের আহার শেষ হইলে তিনি ধন্যবাদ করিতেন। পরে তাঁহার ভুক্তবিশিষ্ট সামগ্রীসহ সেই সকল স্বর্ণ ও রৌপ্যপাত্ৰ পৰ্য্যায়ক্রমে আবার বাবুর্চী-খানায় ফিরিয়া যাইত।
আহাৰ্য্যসামগ্রী
তিনপ্রকারে পাককাৰ্য পাদশাহের বাবুচখানায় হইত; প্রথম–নিরামিষ, যাহাকে ফার্সীতে বলে “সুঞ্চিয়ানা”; দ্বিতীয়পোলাও পলান্ন প্রভৃতি, তৃতীয়–মাংস ও শাক সবজী প্রভৃতি।
প্রথমপ্রকারের খাদ্য (নিরামিষ)
জর্দ-বিরিঞ্জ,–দশসের চাউল, পাঁচসের মিছরি, সাড়ে তিনসের ঘৃত, আধসের কিসমিস, একসের বাদাম, একসের পেস্তা, একপোয়া লবণ, আধপোয়া আদা, দেড় দাম জাফরাণ, আড়াই মুস্কল দারুচিনি, এই সকল একত্র করিয়া যে আহাৰ্য্যসামগ্রী প্রস্তুত হইত, তাহারই নাম জর্দ বিরিঞ্জ;–অনেকে ইহার সঙ্গে মাংসের ক্বাথও মিশাইয়া থাকেন।
খুস্কে,–দশসের চাউলের সহিত আধসের লবণ মিশাইয়া কিছুক্ষণ রাখিতে হয়। যখন চাউল লবণাক্ত হইয়া যায়, তখন উপরি-উক্ত অন্যান্য সামগ্রী মিশাইয়া রন্ধন করিতে হয়। দওজেরা ও খঞ্জনধান্যের চাউলেই এই সকল সামগ্রী উত্তমরূপে বুন্ধন হইয়া থাকে।
খিচড়ী,–পাঁচসের চাউল, পাঁচসের দাইল, (বুট, মুগ, মসুরই প্রশস্থ, মটরও চলে) পাঁচসের মৃত, সাড়ে পাঁচ ছটাক লবণ, এই সকল এক সঙ্গে রন্ধন করিলে যাহা হয়, তাহারই নাম খিচড়ী।
সের বিরিঞ্জ,–দশসের গম ভাঙ্গিয়া সাতসের কি ছয়সের ভাল ময়দা হইবে। যে পরিমাণ ময়দা হইবে, তাহার অর্ধপরিমাণ বৃত, দশ নিস্কল গোলমরিচের গুঁড়া, চারি নিষ্ফল দারুচিনি, সাড়ে তিন নিস্কল ছোট এলাচির গুঁড়া, সাড়ে পাঁচ ছটাক লবণ, ইহার সহিত কিছু দুগ্ধ ও চিনিও মিশাইতে হইবে।
চিক্হী,–দশসের ময়দা মাখিয়া গুলী পাকাইয়া বারংবার জলে ধুইতে হইবে। যখন ধুইয়া ধুইয়া আঠার মত দুইসের সামগ্রীতে পরিণত হইবে, তখন তাহাতে একসের ঘৃত, একসের পেঁয়াজ, আধদাম জাফরাণ, দারুচিনি ও ছোট এলাচি, আর এক দাম ওজনের গোলমরিচ, কাবাবচিনি ও পেঁচ।
বদিঞ্জন,–দশসের বদিঞ্জন, দেড়সের ঘৃত, দশছটাক পেঁয়াজ, অর্ধপোয়া আদা, একপোয়া লেবুর রস, গোলমরিচ ও কাবাবচিনি পাঁচ দাম, ছোট এলাচি, হিং প্রভৃতি আধদাম।
পাহেত,~-খোসা ছাড়াইয়া দশসের মুগ, মাষকলায়, আদেস্ তাহার সহিত আধসের ঘৃত, আধদাম লবণ ও আদা, এক নিষ্ফল হিং।
হালুয়া,–দশসের সুজী, দশসের মিছরী, দশসের ঘৃত, দশসের দুগ্ধ, ইহার সহিত কিসমিস, পেস্তা বাদাম ও বেদানার রস মিশাইয়া পাক করিতে হয়।
দ্বিতীয়-প্রকার – (পোলাও পলান্নপ্রভৃতি)
কাবুলী,-সাতসের মাংস, তাহার অর্ধেক পরিষ্কার মাংসের ক্বাথ (জগ-সূপ যে প্রকারে তৈয়ার করিতে হয়, মাংসের ক্বাথও সেই প্রকারে করিতে হয়, ইত্মতে জলের সংস্পর্শমাত্র নাই), সাড়ে তিনসের ঘৃত, একসের ছাড়ান নাখদ, দুইসের পেঁয়াজ, আধসের লবণ, একপোয়া কাঁচা আদা, গোলমরিচ, দারুচিনি ও ছোট এলাচি একদাম; ইহার সহিত কিসমিস্ ও বাদাম এবং অল্পপরিমাণে পেস্তা। সিদ্ধ করিবার সময় যদি জলের অভাব হয়, তবে জল না দিয়া বেদানার রস দিতে হইবে।
দে বজদ বেরিয়ান,–দশসের চাউল, সাড়ে পাঁচসের ঘৃত, দশসের মাংস, পাঁচসের আনির জল (মাংসের কৃথ) এবং আধসের লবণ, অন্য কোন মসলা ইহার সহিত মিশাইতে হইবে না।
কিমা পোলাও,~-চাউল ও মাংস দশসের করিয়া, (মাংসে হাড় থাকিবে না), চারিসের ঘৃত, আড়াইসের ছাড়ান নাখদ, দুইসের পেঁয়াজ, একপোয়া কাঁচা আদা; গোলমরিচ, ছোট এলাচি, দারুচিনি, কাবাবচিনি, জাফরাণ, বড়এলাচি একদাম ওজনের। যদি জলের অভাব হয়, তাহা হইলে আঙ্গুরের রস দিতে হইবে।
সওলা,–দশসের মাংস, সাড়ে তিনসের চাউল, দুইসের পেঁয়াজ, আধসের লবণ, একপোয়া আদা; ছোট এলাচি, গোলমরিচ, বড়এলাচি, কাবাবচিনি, দারুচিনি, জীরা, রাঁধুনী একদাম ওজনের, জাফরাণ আড়াই দাম, আধসের আঙ্গুরের রস।
বাঘরা,-দশসের মাংস, তিনসের ফুল ময়দা, দেড়সের ঘৃত, একসের নাখদ, একসের মিছরী, দেড়সের ভিনিগার, একপোয়া পেঁয়াজ, একপোয়া বিটুপালং, একপোয়া সালগম, আদা একপোয়া; জাফরাণ, ছোটএলাচি, বড়এলাচি, কাবাবচিনি, দারুচিনি, কচি মটর একসের।
কিমা সুরবা,-দশসের মাংস, একসের চাউল, একসের ঘৃত, আধসের নাখদ এবং অন্যান্য মসলা যাহা উপরে বর্ণিত হইয়াছে, এই সকল মিশাইলে কিমা সরবা তৈয়ারী হয়।
হেরেসা,-দশসের মাংস, পাঁচসের আটা, তিনসের ঘৃত, আধসের লবণ, দুই দাম কাবাবচিনি, এই কয়েকটী মসলা ব্যতীত অন্য কিছু ইহাতে মিশাইতে হইবে না।
কেশেক,–দশসের মাংস, তিনসের আটা, তিনসের ঘৃত, একপোয়া নাখদ, দেড়সের লবণ, আধসের পেঁয়াজ এবং পূর্বোক্ত মসলা, এই সকল মিশাইতে হইবে।
হালিম,–কেশেকের যে সকল সামগ্রী দরকার হয়, ইহাতেও সেই সকলই থাকিবে, তদ্ব্যতীত পালংশাক, মটরশুটী এবং অন্যান্য উপায়ে শাজী মিশাইতে হয়।
নুতব্,–ইহাকে হিন্দুরা সেম্বুসে কহে। দশসের মাংস, চারিসের ময়দা, দুইসের ঘৃত, একসের পেঁয়াজ, একপোয়া আদা, আধসের লবণ এবং পূর্বোক্ত অন্যান্য মসলা। কাবুলী ব্যতীত উপরোক্ত সকল আহাৰ্য্যসামগ্রীই হিন্দুস্থানের।
তৃতীয় প্রকারের খাদ্য
বেরিয়ান দুরস্ত গোঙ্কুদ,–দুইসের লবণ, একসের ঘৃত, একসের জাফরাণ, একসের বড়এলাচি, একসের গোলমরিচ, একসের দারুচিনি। ইহার সহিত কিছু মটরশুটি মিশাইতে হইবে।
ইয়েটনী,–দশসের মাংসের কাথ, একসের পেঁয়াজ, আধসের লবণ এবং পূর্বোক্ত মসলাসকল।
উলমে,-একটা ছাগল বা ভেড়ার বাচ্চা এমনভাবে গরমজলে সিদ্ধ করিতে হইবে, যে তাহার সমস্ত লোম উঠিয়া যায়। পরে তাহার কাথ বাহির করিতে হইবে। সেই কাথের সহিত নানা মসলা মিশাইতে হইবে। ইহা একপ্রকার পানীয়।
কাবাব,–ইহার নির্মাণকৌশল আর বলিতে হইবে না, কারণ, এখন ইহা প্রচলিত আহার্যের মধ্যেই আছে।
মেসেম্মেন,-একটা বড় মুরগীর হাড় কণ্ঠদেশ হইতে এমনভাবে বাহির করিয়া লইতে হইবে যে, তাহার দেহের মাংস যেখানকার যাহা তাহা সেইখানেই থাকে। পরে তাঁহার পেটের মধ্যেই কিঞ্চিৎ উলমের সহিত পাঁচটা ডিম ভাঙ্গিয়া দিয়া এবং আরও কিছু জাফরাণ দিয়া পেট সেলাই করিয়া দিতে হইবে। পরে উপরে কিছু লবণ এবং অল্পমাত্রায় পেঁয়াজ ও আদার রস মাখাইতে হইবে। ইহা সুসিদ্ধ হইলে এই খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত হয়।
দুনিয়াজা,–দশসের মাংস (চর্বি বেশী হইবে না), উহার সহিত দশসের পেয়াজের রস, একপোয়া লবণ, পাঁচ দাম গোলমরিচের গুড়া।
মেতেঞ্জেনা গোম্পন,–দশসের মাংস, অথবা মৎস্য, দুইসের ঘৃত, আধসের নাখদ দিয়া ইহা তৈয়ার করিতে হয়।
দমপোক্ত,–মুরগী বা ভেড়া এমনভাবে মারিতে হইবে যে, তাহার একবিন্দু রক্তও মাটীতে না পড়ে। এমন দশসের মাংশের সহিত পাঁচসের ঘূত মিশাইয়া একসের পেঁয়াজের রস দিয়া এমনভাবে কৃাথ বাহির করিতে হইবে যেন, উহাতে জলের সংস্পর্শ না থাকে।
কালিয়া,–ইহার বিবরণ অনাবশ্যক।
মলযোবা,দশসের মাংসের সহিত দশসের দধি, একসের ঘৃত, একপোয়া আদার রস, ছোটএলাচি, গোলমরিচ প্রভৃতি দুইদাম করিয়া ও বাদাম। ইহাই মিশাইয়া মলদ্বোবা প্রস্তুত করিতে হয়।
রুটী
পাদশাহের জন্য একখানি বড় রুটী তৈয়ারী হয়। দশসের ময়দা, পাঁচসের দুগ্ধ, দেড়সের ঘৃত, একপোয়া লবণ। ইহার সহিত কিঞ্চিৎ ছানার জল বা আঙ্গুর কি বেদানার রস। বাদাম, পেস্তা ও কিসমিস্ মিশান থাকিবে। ইহাই রুটীর আকারে প্রস্তুত করিয়া তন্দুরে সিদ্ধ করিতে হইবে। এতদ্ব্যতীত আমাদের চাপাটী বা রুটী, লিট্টি এবং লুচিও ব্যবহৃত হইত।
পাদশাহ নিরামিষভোজী। তিনি বলেন, “ভগবান মানুষের জন্য নানা প্রকার আহাৰ্যসামগ্রী সৃষ্টি করিয়াছেন, সে সকল থাকিতেও মানুষ যে জীবজন্তুকে নিজের পেটে কবর দেয়, ইহা বড়ই অন্যায়। কি বলিব, আমি রাজা হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছি। নানা কারণে নানা অবস্থায় পতিত হইয়া আমাকে মাংস খাইতে হইয়াছে। আমি ধীরে ধীরে মাংস ত্যাগ করিতেছি।” এই উদ্দেশ্যে পাদশা প্রথমে মাসে একবারে মাংসভোজন করিতেন না, পরে রবিবারে মাংসভোজন করিতেন না, শেষে অমাবস্যা-পূর্ণিমাতেও মাংস ত্যাগ করিলেন; গ্ৰহণাদিতেও মাংস স্পর্শ করিতেন না। নিজের জন্মমাসে নিরামিষাশী হইয়া থাকিতেন। পাদশাহকে তাঁহার বেগমেরা কখনও কখনও রন্ধন করিয়া খাওয়াইতেন।
দ্রব্যাদির মূল্যের হিসাব
বাসন্তী শস্য-এক মণের মূল্য)
গম–১২ দাম। যব–৮ দাম। মটর-৬। নাম সর্ষপ–১২ দাম।
হৈমন্তিক শস্য (একমণের মূল্য)
সুখদোষ চাউল–১০০ দাম। দেওয়ান প্রসাদ চাউল–৯০ দাম। সংজেরা চাউল-৯০ দাম।
মিছরি চাউল–৯০ দাম। দওজেরা চাউল–৯০ দাম। খঞ্জন চাউল–৮০ দাম। দেকের চাউল–৫০ দাম। ষাঠী চাউল–৮ দাম। মুগ–১৮ দাম। মাষকলায়–১৬ দাম। কড়াই–৭ দাম।
দাইল (এক মণের মূল্য)
মটরের দাইল-১৮ দাম নাখদ–১৬ দাম।
ময়দা (এক মণের মূল্য)
সাদা ফুল ময়দা–২২ দাম। আটা–১০ দাম। যবের ছাতু-১১ দাম।
সাক-সবজী–(এক মণের মূল্য) পেঁয়াজ-~-৪০ দাম। রসুন-৬ দাম। কপি-৩ দাম। আদা-~-২ দাম।
মাংস
দাগমুণ্ডী ভেড়া একটীর দাম—৬।।০০ টাকা। আফগানী ভেড়া-২ টাকা। কাশ্মীরী ভেড়া ১।।০ টাকা। বরী ছাগল–১ টাকা। হাঁস একটা–২০ দাম। অন্যান্য পাখী প্রত্যেকটা এক দাম হইতে কুড়ি দাম পর্যন্ত।
ঘৃত চিনি মসলা প্রভৃতি (এক মণের দাম)
ঘৃত-১০৫ দাম। দুগ্ধ-২৫ দাম। দধি-১৮ দাম। চিনি-~৬ দাম। মিছরি-১২৮ দাম। জাফরাণ–৪০০ দাম (একসেরের মূল্য)। গোলমরিচ–১৭ দাম (সের)। ঠ–৪ দাম (সের)। আদা-২।। (সের)। তেঁতুল–২ দাম (সের)। হিঙ্গ–১০ দাম (সের)। লবণ-১৬ দাম (এক মণ)।
চাটনী (এক সেরের মূল্য)
লেবুর রস–৬ দাম। মদের ভিনিগার–৫ দাম। চিনির ভিনিগার-১ দাম। লেবুর নিমকী—২ দাম। বাঁশের আচার–৪ দাম। কিসমিসের আচার–৮ দাম। সজিনার আচার-১ দাম। সরিষা বাটা- সিকি দাম। কুমড়ার মোরব্বা-অৰ্ধৰ্দাম।
ফল
পাদশাহ বড়ই ফলপ্রিয়। তিনি পারস্য, তাতার, কাবুল, কান্দাহার হইতে ভাল ভাল ফল বাগানের মালী আনাইয়া ভারতবর্ষে বাস করাইয়াছেন। তাহারা নানা স্থানে বিদেশীর ফলের বাগান করিয়াছে। কাবুল হইতেও ফলের আমদানী হইয়া থাকে। নাসপাতী, বাবাসেতী, আশি সেরী এলাচ, দুদ চিরাগ ফালগুণ চৈত্র মাসে আসিয়া থাকে। হিন্দুস্থানের নানা স্থানে ভাল ভাল আঙ্গুর হয়। চেরীফলও কাবুল হইতে আইসে, পাদশাহ তাহার নাম দিয়াছেন “শা-আলু”। এতদ্ব্যতীত বেদনা, পীচ, এপ্রিকট, কাবুল হইতে আইসে। পাদশাহ যখন মদ্যপান করেন, বা অহিফেন সেবন করেন, তখন তিনি ফল খাইয়া থাকেন। এই ফল সংগ্রহ করিবার জন্য মনসবদার, আহেদী প্রভৃতি লোক নিযুক্ত আছে।
ফলের মূল্য
বেদানা–১৫ টাকা মণ। কাশীরী আঙ্গুর-১০৮ দাম মণ। খেজুর-১০ দাম সের। কিসমিস-৯ দাম সের। আনারস-২, দাম (সের)। আবযোশ-৯ দাম (সের)। শোবানী-৮ দাম (সের)। মনকৃ৬ দাম (সের)। কুল–৩ দাম (সের)। বাদাম–২৮ দাম (সের)। পেস্তা-৯ দাম (সের)।
ভারতীয় ফল
আম্র–৪০ দাম (শতকরা)। আনারস প্রত্যেকটী ৪ দাম। নারাঙ্গী–৪ দাম। ইক্ষু অৰ্দ্ধদাম। কাটাল-অৰ্দ্ধ দাম। কলা-অৰ্দ্ধ দাম (একটী)। ডালিম-১০০ দাম (এক মণ)। ডাব-৪ দাম (একটী)। পিণ্ডীখেজুর–৬ দাম (সের)। সিঙ্গারা-৩ দাম (সের)। কেওর-৩ দাম (সের)। তেতুল-২ দাম (সের)। জাম–১ দাম (সের)। ফর্সা-১ দাম (সের)।
গন্ধদ্রব্যের ব্যবস্থা
পাদশাহ বড় সুগন্ধপ্রিয়, তাহার শয়নকে সর্বদা সদ্য চয়ন করা পুষ্প স্থূপীকৃত থাকে এবং স্বর্ণ ও রৌপের ধূপদানীতে ধূপ, ধুনা, গুগগুল, আম্বর, কর্পূর চন্দনকাষ্ঠ প্রজ্বলিত হয়। পাদশাহ নিজের দেহ সৰ্ব্বদাই গনধদ্রব্য অনুলিপ্ত রাখেন। মস্তকে নানা প্রকারের ফুলেতৈল মাখিয়া থাকেন।
গন্ধদ্রব্যের বিবরণ
সেন্টাক–এক তোলা চুয়া, দুই বোতল গোলাপজল এবং অন্যান্য গন্ধদ্রব্য ও গন্ধতৈল দ্বারা ইহা প্রস্তুত হয়।
আরসেজে–তিন পোয়া চন্দনকাষ্ঠ, তিন তোলা চুয়া, খেগেধ নামক এক প্রকার ঘাসের বীজ, আদমাষা কর্পূর এবং ১১ বোতল গোলাপজল। ইহা গ্রীষ্মকালে দেহে লেপন করিতে হয়।
গুলকামে–এক তোলা আম্বর, ছয়মাষা লুদান, দুই ভোলা কস্তুরী, আট ভোলা তাসিকির, এইগুলি এক সঙ্গে মিশাইয়া রৌদ্রে শুকাইতে হয়, পরে তাহাতে ভাল লেবুর ফুলের ক্বাথ মিশাইতে হয়। পুনঃ পুনঃ দশবার এই প্রকার কাথ মিশাইয়া রৌদ্রে শুকাইতে হয়। শেষে তৈলের সহিত ইহা ব্যবহার করিতে হয়।
এতদ্ব্যতীত অপতেলে–আরিরমায়া, কেশনে, বেখড় ফেতিল, বজ্জাত, বেশ্যা, এই সকল বৈদেশিক গন্ধদ্রব্যও পাদশাহ ব্যবহার করিতেন।
চুয়া-প্রস্তুতের ব্যবস্থা
এক প্রকার গাছ আছে, যাহার শিকড় কাটিয়া পুনরায় মাটির মধ্যে পুতিয়া রাখিতে হয়। যেটুকু পড়িবার, তাহা পড়িয়া যায়, যেটুকু অবশিষ্ট থাকে, তাহা এক সপ্তাহে জলে ভিজাইয়া রাখিতে হয়; পরে সেই জল একটী সংকীর্ণমুখ বোতলের মধ্যে পুরিয়া মুখটী বেশ ভাল করিয়া আঁটিয়া দিতে হয়। তাহার পর একটী তলদেশে ছিদ্রবিশিষ্ট বোতলের উপর উল্টামুখে বসাইতে হয়। সকলের নীচে একপাত্র জল থাকে এবং ইহার চারিদিকে ঘুঁটের আগুনের সামান্য তাপ দিতে হয়। এই তাপ লাগিয়া যাহা চুয়াইয়া পড়ে, তাহাই চুয়া। এই চুয়া গোলাপজলে ভাল করিয়া ধুইয়া লইতে হয়।
চন্দনের বিবরণ
চন্দন তিনজাতীয়, শ্বেত, পীত, লোহিত। চন্দন পূর্বের ভারতবর্ষে ছিল না, চীনদেশ হইতে আমদানী হইত। সিংহলে ও দাক্ষিণাত্যের নিকটে অল্প পরিমাণে শ্বেতচন্দন ও রক্তচন্দন হইত; পীতচন্দন পাদশাহ চীনদেশ হইতে আমদানী করিয়াছিলেন।
পুষ্পের বিবরণ
সুগন্ধ গোকুলা–অতি সুগন্ধপূর্ণ পুষ্প ও গুলু। ইহা ভারতবর্ষেরই সামগ্রী, অন্যত্র পাওয়া যায় না।
সেঁউতি–ইহা ছোট গোলাপের জাতি, বেশ মিষ্টগন্ধ আছে।
চামেলি, চার বেলা, মংগরা, বড় বেলা, চাপা, কেতকী, চালতে ফুল, কেওড়া, পারুল, টগর, কদম্ব, নাগকেশর, হেনা, ভূঁইচাপা, সুদর্শন, রত্নমালা, মালতী, কেরও পুষ্প, ধন্বন্তর, শিরীষ, মাধবী, কুন্দ, সূর্যমুখী প্রভৃতি পুষ্প ভারতবর্ষেই জন্মে; গোলাপ পারস্যদেশ হইতে আনীত হইয়াছে। অনেক পুষ্পবিশারদ বলেন যে, ভারতবর্ষে এতরকমের পুষ্প আছে যে, যদি প্রত্যেক পুষ্পের এক একটী করিয়া পাতা সংগ্রহ করা যায়, তাহা হইলে ওজনে ছয়মণ হইবে। পারস্যদেশে আজারবিজান, মাজেগুরান প্রভৃতি স্থানে পুষ্প জন্মে, কিন্তু এমন বহুবিধ পুষ্প ভারতবর্ষ ব্যতীত অন্যত্র নাই। পদ্ম ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ পুষ্প। বাদশাহ সাত রকমের পদ্মফুল দেখিয়াছেন এবং ব্যবহার করিয়া থাকেন। কাশ্মীর হইতে স্থলপদ্ম আনিয়া থাকেন। ইহার ন্যায় পুষ্পপ্রিয় মানব আর নাই। ইনি প্রতিদিন বিভিন্ন প্রকারের পুষ্পের মাল্য ধারণ করিয়া দরবারে যান।
পোষাক-পরিচ্ছদের কথা
পাদশাহ সকল দেশের সকল জাতির সকল রকমের পোষাক পরিচ্ছদ ব্যবহার করিয়া থাকেন। ইউরোপ, চীন, পারস্য ও ভারতবর্ষের নানা প্রদেশ হইতে ভাল ভাল কারিগর
আনাইয়া নানা প্রকার পরিচ্ছদ প্রস্তুত করাইয়া থাকেন।
কোচিয়ে-ইহা ভারতবর্ষের পোষাক। একখানি কাপড়ে প্রস্তুত হয়। লালন কাপড়েই ইহা প্রধানতঃ তৈয়ার হইয়া থাকে। ইহার মূল্য এক টাকা হইতে পাঁচ টাকা পৰ্য্যন্ত (বিবরণে বোধ হয় ইহা দরবেশ ফকিরগণের আলখেল্লারই মত পোষাক)। পাদশায়াজ, সাহাজিদে, সুজনী, কাঁচা, (সাধারণতঃ ইহাকে জামা কাম্বাদার বলে), গুদ (ইহাও এক প্রকার তুলাভরা কাবা) ফিরুজী, ফরুগুল, চকমন্ বা চাপকান, সুশুয়াট এ সকলগুলিই ভারতের পোষাক। শাল চারি রকমের, প্রথম তুস্ সাসল, দ্বিতীয় সফেদ্ আলচী; তৃতীয় জারদোজী, গুস্বতন কলগা, ছিট; চতুর্থ রোমাল পূৰ্ব্বে শাল লাল রঙের হইত না, পাদশাহ নিজে লালরঙ্গের শাল প্রস্তুত করাইয়াছিলেন। পূর্বে কাশ্মীর হইতে ভারতবর্ষে বেশী শাল আমদানী হইত না, সে সময়ে শাল এমনই মহার্ঘ্য ও উৎকৃষ্ট বলিয়া বিবেচিত হইত যে, কেহ শাল খুলিয়া গায়ে দিত না, খুলিয়া দিলে হয় ত শাল নষ্ট হইয়া যাইতে পারে, ধুলায় মলিন হইতে পারে। সেই জন্য লোকে প্রথমে স্কন্ধের উপরে একখাঁটি সামান্য চাদর দিত এবং সেই চাদরের উপরে অতি সন্তর্পণে শালখানি চারি ভাঁজ করিয়া রাখিত। শাল কাঁধে ঝুলানই তখন রীতি ছিল। পাদশাহ আকবর শাহ এদেশে দোশালা ব্যবহারের রীতি চালাইয়াছিলেন। ভারতবর্ষের লোকে পূর্বে পশমী সামগ্রী অতি কম ব্যবহার করিত; রেশমের কাপড় ও তুলাভরা জামা এবং শীতকালে বালাপোষই ব্যবহার করিত। পাদশাহই শালের চোগা, কাঁচা, জামা, পাগড়ী, গলাবন্ধ, এদেশে প্রচলিত করেন। মমল ভারতবর্ষেই প্রধানতঃ প্রস্তুত হইত, ইউরোপ ও ইরাণ হইতেও মকমল আসিত। গুজরাটের মমলই সর্বোৎকৃষ্ট ছিল। গুজরাটে কিংখাপও অতি সুন্দর হইত। রেশমের সামগ্রী যথা সাটী, রেশমের থান, গরদ, বঙ্গদেশেই ভাল হইত; তবে বঙ্গদেশ অপেক্ষা চীনদেশ হইতে আনীত সাটীনই বাদশাহ অধিক পছন্দ করিতেন। তসর দক্ষিণদেশ ও বিহারপ্রদেশ হইতে আমদানী হইত। বনাত সামান্য কিছু ইউরোপ হইতে আসিত, কিন্তু নাগোর ও লাহোরে সুলতানী বনাত নামে এক প্রকার উৎকৃষ্ট বনাত প্রস্তুত হইত। পার্বত্যপ্রদেশ হইতে পট্ট ও কম্বল আসিত। পূর্ববঙ্গে অতি সুন্দর সূতার কাপড় বা মকমলের থান তৈয়ারী হইত, ইহার উপর জরীর কাজ হইত। এই থান পাগড়ীরূপে ব্যবহৃত হইত।
পাদশাহের চিত্রশালা
লেখবিদ্যা–পাদশাহ লেখবিদ্যার বিশেষ উন্নতি করিয়াছিলেন। তাঁহার অধীনে ভাল ভাল লেখক নিযুক্ত আছে। এখন ভারতবর্ষের আট প্রকারের অক্ষর প্রচলিত। পাদশাহ সংস্কৃত হইতে অনেক পুস্তক পারস্য ও হিন্দীভাষায় অনূদিত করিয়াছেন। আর্যভট্টের ও ভাস্করাচার্যের জ্যোতিষী সারুণী, যাহা উলুকবেগ আরবীতে অনুবাদ করিয়াছিলেন, তাহাই পারস্যভাষায় অনুবাদিত হয়। আমীর ফতাউল্লা সিরাজী, শ্রীকৃষ্ণ, গঙ্গাধর, মহেশ, মহানন্দ, এই সকল লোকের সাহায্য লইয়া এই কাৰ্য্য সম্পন্ন করেন।
মহাভারত ও অন্যান্য গ্রন্থ-ইহা নকীব খা, মওলানা আবদুর কাদের এবং সেখ সুলতান তামদেরী পারস্যভাষায় অনুবাদ করেন। ইহার না পাদশা “বেজেমামা” দিয়াছিলেন। রামায়ণও ঐ সকল লোকের দ্বারা পারস্যভাষায় অনূদিত হয়। অথৰ্ব্ববেদ হাজি ইব্রাহিম সারহিন্দী পারস্যভাষায় অনুবাদ করেন। আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা সেখ ফয়জী লীলাবতী পুস্তক পারস্যভাষায় অনুবাদ করিয়াছিলেন। কাশ্মীরের ইতিহাস বা রাজতরঙ্গিণী পারস্যভাষায় মওলানা শা মহম্মদ শাহাবাদীকর্তৃক অনূদিত হইয়াছিল; হরিবংশও ইহারই দ্বারা অনূদিত হয়। নলদময়ন্তীর গল্প নাটকাকারে অতি মিষ্ট ছন্দে সেখ ফয়জী পারস্যভাষায় অনুবাদ করিয়াছেন; ইহা ঠিক লায়লা মজনুর ন্যায় মিষ্ট হইয়াছে।
চিত্রকর-মীর সৈয়দ আলী, খোঁজা আবদুল সামেদ, দেশমণ্ড (ইতি একজন পাল্কীবাহকের পুত্র) কেশব, লাল, মুকুন্দ, ফেরোখ, মধু, যোগেন, তারা, হরিবংশ, রাম, ইঁহারাই সাম্রাজ্যের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রকর ছিলেন। ইহাদের মধ্যে অনেকেই মনুষ্যের আলেখ্য চিত্রিত করিতে পারিতেন। এই বিষয়ে পালকীবাহকের পুত্র দেশমণ্ড সৰ্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। অন্য সকলে পুস্তকের চারিধার, ত্রয়মা প্রভৃতি আদেশপত্রিকা নানারঙ্গে রঞ্জিত করিয়া দিতেন।
অস্ত্রাগার
তরবারির মধ্যে খাসে তরবারিই সৰ্বশ্রেষ্ঠ। এতদ্ব্যতীত কওতল তরবারিও পাদশা স্বয়ং ব্যবহার করিতেন। আট রকমের কারেদ (ছোটছুরী), কুড়ি রকমের নেজা (বল্লম), কুড়ি রকমের বিরছা (কুঠার) ছিল। নানাপ্রকারের ধনুক, তীর বাদশাহ ব্যবহার করিতেন।
অস্ত্রের নাম-তরবারি, খাণ্ডা, গুপ্তা, কাতার, হরসিংজটা, ধনুক, তৃণ, গুরজ, ফিঙ্গে, ঢাল, ফাড়ী, জিরহে, সাদেকী, অঙ্গরক্ষা, ভাজু।
আগ্নেয়াস্ত্র-~-পাদশাহের যে প্রকার অস্ত্রশস্ত্র আছে, রুমের বাদশাহ ব্যতীত অপর কাহারও তেমন নাই। এক একটী কামান এত বড় যে, বার মণ ওজনের গোলা পর্যন্তও তাহাতে ছোঁড়া যায় এবং এই রকমের একটী কামান সাত আটটী হাতীতে টানিয়ে হইয়া যাইতে পারে। পাদশাহ নিজেও অনেক রকমের কামান তৈয়ারী করিয়াছেন। এক রকম কামান আছে, তাহা টুকরা টুক্রা করিয়া হাতীর উপর বোঝাই দিয়া লইয়া যাইতে হয়; ইহাকে গজুনল বলে। এই বিভাগে বড় বড় আমীর-ওমরাও কাৰ্য্য করিয়া থাকেন। ইহার প্রধান কর্মচারীর নাম মীর আতস।
পিলখানা
ভারতবর্ষের অধিবাসিগণ হস্তীকে এত আদর করেন যে, একটী হস্তীকে তাহারা পাঁচশত অশ্বের সমক্ষক বলিয়া বিবেচনা করেন। হস্তী বড় শান্ত জন্তু। যে করিণী বা কুনুকে হাতী হস্তীকে ধরাইয়া দেয় হস্তী কখনও তাহাকে আঘাত করে না। হস্তী তীরও হুঁড়িতে পারে। হস্তীর মূল্য একশত হইতে লক্ষমুদ্ৰা পৰ্যন্ত আছে। হস্তী চারি প্রকারের প্রথম বেহেদর, ইহারা খুব লম্বা-চওড়া, ইহাদের চক্ষু বড় এবং ইহাদের কাণের উপর দুইটী শ্বেতবর্ণের আঁচিল থাকে। ইহাকে হিন্দীভাষায় জগমাণিক বা গজমুক্তা বলে; বাস্তবিক ইহার আকার বড় মুক্তার ন্যায়। দ্বিতীয়, মুণ্ডপ; ইহাও বিশালকায় চামড়া কাল, চক্ষু হরিদ্ৰবর্ণ; ইহারা বড়ই দুর্ধর্ষ। তৃতীয় মুরগ–বর্ণ ঘন কালো নয়, একটু সাদাটে। চতুর্থ মীঢ়–ইহাদিগকে অনায়াসে শাসন করা যায়; ইহাদের বর্ণ পাংশু। রাজতুম নামে আর একরকমের হস্তী আছে, ইহারা সকল হস্তী অপেক্ষা দীর্ঘজীবী ও সংযত। পূৰ্ব্বে পালিত হস্তীকে উপগত হইতে দেওয়া হইত না, সুতরাং তাহারা সন্তান প্রসব করিত না; কিন্তু পাদশাহ সে প্রথা উঠাইয়া দিয়াছেন; এখন পোষা হাতীর অনেক বাচ্ছা হয়। আষাঢ়মাসে হস্তিনী সন্তান প্রসব করিয়া থাকে। গুৰ্ব্বিনী অবস্থায় হস্তিনী সুলকায়া হইলে বুঝিতে হইবে, গর্ভস্থ সন্তান পুংজাতীয়; যদি সে সময় দুর্বল হইয়া পড়ে, তাহা বুঝিতে হইবে, গর্ভস্থ সন্তান স্ত্রীজাতীয়। হস্তিনী একটীর অধিক সন্তান প্রসব করে না, কৃচিৎ কদাচিৎ যমজ প্রসব করিয়া থাকে। পাঁচ বৎসর পর্যন্ত হস্তীশিশু মাতৃসন্ত্য পান করে; তখন তাহাকে বালহস্তী বলে। দশবৎসরবয়স্ক হস্তীর নাম পৌত; বিশবৎসরবয়স্ক হস্তীর নাম বেক, ত্রিশবৎসরের নাম কেলরা। হস্তী নিজ প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি অনুযায়ী সকল ঋতুতেই হস্তিনীর অন্বেষণ করিয়া থাকে। কোন হস্তী শীতাগমে, কেহ বা প্রথম গ্রীষ্মে, কেহ বা বর্ষায় হস্তিনীর অন্বেষণ করিয়া থাকে। হস্তী মদোন্মত্ত হইলে তাহার রগ ফাটিয়া মদস্রাব হয়। এই মদ উৎকট-গন্ধযুক্ত এবং দেখিতে পাটকিলে রং। দূর হইতে ইহার গন্ধ কতকটা কস্তুরীর কত। হস্তী মদোন্মত্ত হইলে দেখিতে বড়ই সুন্দর হয়। মনুষ্যের ন্যায় হস্তী দীর্ঘজীবী; একশত কুড়ি বৎসর পর্যন্ত ইহাদের পরমায়ু নির্দিষ্ট হইয়াছে। নিম্নলিখিত স্থানসকলে হস্তী পাওয়া যায়;-আগরার নিকট বাগোয়ান ও নারোয়ার জঙ্গলে; এই জঙ্গল বেরার পর্যন্ত বিস্তৃত। সুবা এলাহাবাদের মধ্যে রতনপুর, নন্দপুর, শিরগোমায়, মালবপ্রদেশ আচ্ছোদ, চাদেরী, মণ্ডবাস, বিজয়গড়, হোসেঙ্গাবাদ এবঙ হরিগড়ে; সুবা বিহারে রোটারেস নিকট এবং ত্রিহুতে ঝাড়খণ্ড জঙ্গলে; সুবা বাঙ্গালা ও উড়িষ্যার ভাল হস্তী পাওয়া যায়; সপ্তগ্রামের দক্ষিণের জঙ্গলে ভাল হস্তী পাওয়া যায় এবং ত্রিপুরার হস্ত্ৰ সৰ্বশ্রেষ্ঠ। হস্তী রক্ষা করিবার জন্য দারোগা নিযুক্ত আছে। যুবক হাতীর দারোগা স্বতন্ত্র। রণহস্তীর ব্যবস্থা পৃথক্, তাহাদের জন্যও স্বতন্ত্র দারোগা নিযুক্ত আছে। যে হস্তী এখনও পাষ মানে নাই এবং যাহার পৃষ্ঠে একনও আরোহী উঠে নাই, সেই সকল হস্তী রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ও পৃথক বন্দোবস্ত আছে। প্রত্যেক মন্সবদারের একশত করিয়া হস্তী ছিল; হস্তীর পৃষ্ঠে পানীয় জল যাইত। গজঝম্প, মেঘডম্বুর, অঙ্কুশ, প্রভৃতি হস্তীর আভরণ ব্যবহৃত হইত। পাদশাহের ব্যবহারের জন্য একশত একটী হস্তী সৰ্ব্বদা প্রস্তুত থাকিত। যে সকল হস্তীতে তিনি আরোহণ করিতেন, তাহাদের আহারের জন্য বিশেষ বন্দোবস্ত ছিল। পাঁচসের চিনি, চারিসের ঘূত, আমণ চাউল, লঙ্কা ও গোলমরিচ, হস্তীদিগের আহারের জন্য নির্দিষ্ট ছিল; কোন কোন হস্তীকে আবার দেড়মণ পায়সান্ন খাইতে দেওয়া হইত। পাদশাহ যে হস্তীতে আরোহণ করিতেন, সে হস্তী তিনি নিজেই চালাইতেন, অন্য মাহুতের দরকার হইত না। একজন ওমরাহ ও একজন আমীর পাদশাহের আরোহণের জন্য হস্তীর বন্দোবস্ত করিতেন। পাদশাহ্ খাস ব্যবহারের সকল হস্তীতেই আরোহণ করিতেন; এমন কি, মদোন্মত্ত হইলেও পাদশাহ তাহার দন্তের উপর চরণ দিয়া আরোহণ করিতেন এবং এইরূপে নিজের বিচিত্র বিদ্যা দেখাইয়া অনেক হস্তীশাস্ত্রজ্ঞদিগকে চমৎকৃত করিতেন।
অশ্বশালা
পাদশাহ বড়ই অশ্বপ্রিয়। ইরাক, রুম, তুর্কিস্থান, বদকসান, সিরবান, খরগেজ তিব্বত এবং কাশীর হইতে ভাল ভাল-অশ্ব ভারতবর্ষে আমদানী হয়। পাদশাহের অশ্বশালায় সৰ্ব্বদাই বার হাজার অশ্ব প্রস্তুত থাকে। পরে আবার ভাল অশ্বের আমদানী হইলে তিনি অশ্বশালার পুরাতন অশ্ব আমীর ওমরাহদিগকে দান করিয়া আবার নূতন অশ্ব খরিদ করেন। বৎসরে বৎসরে এইরূপ দান হয়, আবার এইরূপ খরিদও হয়। ভারতবর্ষে অনেক ভাল ভাল অশ্ব আছে; অশ্ববিদ্যাবিশারদ বড় বড় পণ্ডিতও আছেন। যে ভাবে অশ্বের সেবা ভারতবর্ষে হইতেছে, তাহাতে এই ভারতের অশ্ব আরবদেশের অশ্বের সমকক্ষ হইবে। ভারতের কচ্ছপ্রদেশে অতি উত্তম অশ্ব পাওয়া যায়। কচ্ছের অশ্ব অনেকটা আরবীয় অশ্বের ন্যায় গুণসম্পন্ন এবং সুন্দর। গল্প আছে যে, বহুদিন পূর্বে একজন আরবী অশ্বব্যবসায় জাহাজে করিয়া ভারতের দিকে আসিতেছিলেন, তাঁহার জাহাজ কচ্ছপ্রদেশের উপকূলে ডুবিয়া যায়, তিনিও সমুদ্রগর্ভে প্রাণত্যাগ করেন, কিন্তু সাতটী আরবী ঘোড়া কোনরূপ রক্ষা পাইয়া কচ্ছপ্রদেশে গিয়া উপস্থিত হয়। এই সাতটী অশ্বেরই বৎশ্যবতংস সকল অশ্ব কচ্ছপ্রদেশে এখন পাওয়া যায়, তাহারাই আরবী অশ্বের ন্যায় তেজস্বী ও সুন্দর। মালবপ্রদেশে সিন্ধু এবং বেহেট নদীর মধ্যে ভাল ভাল অশ্ব আছে। এই অশ্বগুলিকে সেবাহী বলে। হিবেটপুর, বেওঘারা, টেহারা, আগরা, মেঘাত, অজমীর, উত্তরে ঘাড়োয়ান, এই কয় স্থানেই ভাল অশ্ব হয়। বাঙ্গলার উত্তরে কোচপ্রদেশে তুর্কি অশ্বের ঔরসজাত এবং পাহাড়ী ভুটিয়া অশ্বিনীর জাত একপ্রকার অশ্ব জন্মায়, যাহাকে টাঙ্গন অশ্ব বলে। এই জাতীয় অশ্ব খুব কষ্টসহিষ্ণু, দেখিতে সুন্দর এবং তেজস্বী। যে সকল ব্যবসায়ী ভারতবর্ষে অশ্ব বেচিতে আইসেন তাহাদিকে পাদশা বিশেষ আদর করিয়া থাকেন। তাঁহাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য “আমীর কারাভান সরাই” এবং “টেপ কচী” নামক দুইজন কর্মচারী নিযুক্ত করিয়া রাখিয়াছেন। পাদশাহের অশ্বশালায় দুই বিভাগ আছে;~-একটী খাস আর একটী সাধারণ। খাস আস্তা বলে আরবী, পারসী এবং কচ্ছপ্রদেশের ঘোড়াই রক্ষিত হত আর সাধারণ অশ্বশালায় অন্যান্য প্রদেশের এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের অশ্ব রক্ষিত হয়। এই সময় অশ্বযান (ঘঘাড়ার গাড়ী) ব্যবহৃত হইত না। লোকে অশ্বের উপর আরোহণ করিত। অশ্বারোহণে অপটু পুরুষ সমাজে নিন্দনীয় হইতেন। (পাদশাহ জাহাগীরের সময় যখন ইংরেজ দূত সার টমাস রো ভারতে আসিয়াছিলেন, তিনি পাদশাহকে উপঢৌকন দিবার জন্য দুই তিন রকমের ঘোড়ার গাড়ী সঙ্গে আনিয়াছিলেন। পাদশাহ জাহাগীর সেই বিলাতী গাড়ীর নকলে অনেকগুলি ঘোড়ার গাড়ি তৈয়ারী করেন। এখনও আগরায় সেই পুরাতন ঢঙ্গের ঘোড়ার গাড়ী ব্যবহৃত হইয়া থাকে। ভারতবর্ষে ঘোড়ার গাড়ীর প্রচলন এই সময় হইতেই হয়। এক্কা নামক একরকম গাড়ী বহুদিন হইতে ও দেশে ব্যবহৃত হইয়া থাকে, কিন্তু এই সকল গাড়ীতে কখনও খুব ভাল ঘোড়া জোতা হইত না। জিনিসপত্র লইয়া কোন দূরদেশে শীঘ্র যাইতে হইলে লোকে এক্কার উপরেই যাইত, নতুবা অশ্বারোহণই প্রশস্ত ছিল। হিন্দুদের সময় রথে অশ্বযোজিত হইত; কিন্তু রথের অশ্ব ও আরোহণের অশ্ব পৃথক্ ছিল।)
অশ্বের খোরাক
খাস আস্তাবলের প্রত্যেক ঘোড়া প্রত্যহ সাত সের গম ও যব, দুই সের ময়দা, আধসের চিনি এবং আধসের ঘৃত পাইত। বসন্তকালে কাঁচা গমের শীষ ৪/৫ সের ঘোড়াকে খাইতে দেওয়া হইত এবং ইরাকী এবং তুর্কী ঘোড়াসকলকে শীতকালে সাড়ে সাতসের করিয়া সিদ্ধগম ও যব দেওয়া হইত এবং তাহার সহিত একসের চিনি ও ঘি দেওয়া হইত। পাদশাহের আস্তাবলে আকতা-ঘোড়া পায়ই থাকিত না; হয় অশ্ব, না অশ্বিনী। আরবপ্রদেশের অশ্বিনীই তিনি অধিক ব্যবহার করিতেন অশ্বের দুইটী শ্রেণী ছিল;– এক ব্যবহারের জন্য অশ্ব আর এক অশ্বোৎপাদনের জন্য। এই সকল অশ্বকে অধিক পরিমাণে ঘি ও গুড় দেওয়া হইত। অশ্বের বাচ্চা হইলে উহা তিনমাসের অধিক কাল মাতৃস্তন্য পান করিতে পাইত না।
অশ্বের পোষাক
আরটেক, আলপোষ, চৌড়ী, কাজাই, লাগাম প্রভৃতি অশ্বব্যবহারে এবং অশ্বারোহণের সাজ পরিচ্ছদ আছে। পাদশাহের ব্যবহারের অশ্বের সাজপরিচ্ছদ সবই নিরেট স্বর্ণ এবং রৌপ্যের তৈয়ারী বগা বা লাগান রেশমে তৈয়ারী হইত। পাদশাহের বড় আদরের ঘোড়ার নাল অনেক সময় রূপার তৈয়ার হইত। অশ্বমালা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দারোগা, মুরেফ, চাবুক, সওয়ার (যাহারা অশ্বারোহণে অশ্বকে সায়েস্তা করিয়া থাকেন) ও বেতা (অশ্বচিকিৎসক) এই সকল কর্মচারী নিযুক্ত থাকিত।
উষ্ট্রশালা
ভারতবর্ষে এখন ইরাণ এবং তুরাণ অপেক্ষা ভাল উষ্ট্র জন্মিয়া থাকে। যাহা পাদশাহের ব্যবহারের জন্য থাকে, তাহাকে সা-পসি উষ্ট্র বলে। ভারতবর্ষে অজমীর, যোধপুর, নার্গো বিকানীর, যশশ্মীর, ভাটি, থানেশ্বর কচ্ছ, সিন্ধু এই সকল স্থানে ভাল ভাল উষ্ট্র পাওয়া যায়। অজুমীরের উষ্ট্র সর্বাপেক্ষা বেগবান, তাতার-উষ্ট্র পরিভ্রমণশীল এবং কষ্টসহিষ্ণু। আরবানে নার্গ একপ্রকার স্ত্রী উষ্ট্র অজমীরে পাওয়া যায়। বী-ঈর নামক একপ্রকার পুরুষ উষ্ট্র তাতারের সিৰ্ম্ম পাওয়া যায়। সাধারণতঃ স্ত্রী উষ্ট্রকে মায়া বলে। শীতকালেই মায়া গর্ভিণী হয়। উষ্ট্ৰব্যবহার এই সকল সাজ-পরিচ্ছদ পাদশা তৈয়ারী করাইয়াছিলেন; দম অপসার (এক রকমের জিন); শিক্ষক, সরঞ্জী, জিলাজিল। এই সকল পরিচ্ছদ বহুমূল্য; নানাপ্রকার মণিমুক্তাদি দ্বারা খচিত থাকিত।
গোশালা
পাদশাহের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ গো-শালা ছিল। বোধ হয়, এমন বৃহৎ গো-শালা পৃথিবীতে কোন নরপতির ছিল না। ভারতবর্ষে সর্বত্রই ভাল ভাল গো ও ষণ্ড পাওয়া যায়। কিন্তু গুজরাটের বলদ সর্বাপেক্ষা কষ্টসহিষ্ণু ও দ্রুতগামী। ইহারা ২৪ ঘণ্টায় ৩৬ মাইল পথ যাইতে পারে। একশত সুবর্ণমুদ্রা আসরফী এই প্রকারের একহোড়া বলদের দাম। বঙ্গদেশে এবং দক্ষিণে ভাল ভাল গরু পাওয়া যায়। যে গরু দশসের দুধ দুইবেলায় দেয়, তাহার দাম দশ টাকা।
এক একটা বলদকে প্রত্যেহ ছয় সের ছোলা এবং কচি গমের সময় কচি গম খাইতে দেওয়া হইত, তদ্ব্যতীত তিনসের ঘাস, দেড়ছটাক গুড়, একছটাক ঘি। যে গরু যত দুধ দেয়, তাহাকে ঠিক তত ওজনেরই খাদ্য দেওয়া হয় এবং দুই দাম ঘি। বেহুল নামক এক প্রকারের গাড়ী বলদে টানিয়া লইয়া যায়। ইহা দুই প্রকারের;-ছত্রদার এবং খোলা। ছত্ৰদার অনেকটা রথের মত।
অশ্বতরী বা খচ্চর
পূর্বে ভারতবর্ষে খচ্চর হইত না। কোন হিন্দু রাজাই খচ্চর তৈয়ার করিতে প্রজাগণকে অনুমতি দিতেন না। আরব এবং পারস্যদেশেই ভাল ভাল খচ্চর পাওয়া যায়। এক একটা খচ্চরের দাম একহাজার টাকা। হিন্দুরা খচ্চরে আরোহণ করে না। যদি কখন ব্যবহার করে, ও বোঝা লইয়া যাইবারই জন্য ব্যবহার করে। পাদশা হিন্দুস্থানেই এখনও খচ্চর তৈয়ার করবার ব্যবস্থা করিয়াছেন। পুকনি নামক স্থানে খচ্চর হয়। খচ্চর দুই প্রকারের এক পুরুষ অশ্ব ও গভীতে উপগত হইয়া যে খচ্চর হয়, আর গর্দভ শ্বনীতি উপগত হইয়া যে খচ্চর হয়। অশ্বের ঔরসে কুচিৎ কদাচিৎ খচ্চর হইয়া থাকে।
পাদশাহ কি উপায়ে সময় অতিবাহন করিয়া থাকেন
পাদশাহ সকলের কথাই শুনিয়া থাকেন, অতি দীনহীন প্রজা হইতে আমীর ওমরাহ পর্যন্ত তাহার কাছে দুঃখের কথা-বলিয়া থাকে। তিনি কখন কোন ধর্মের নিন্দা করেন না; নিজের ধর্মকর্মে কখন অবহেলা করেন না। তিন যথারীতি পাঁচবার নামাজ করিয়া থাকেন। তিনি মাংসাশী নহেন এবং অহোরাত্রে একবার আহার করিয়া থাকেন। রাত্রেই তিনি রাজকার্য করেন। সেই সময় বড় বড় মৌলবী-মুফতী এবং হিন্দু পণ্ডিত তাঁহার সহিত আসিয়া কথাবার্তা কহিয়া থাকেন। পাদশাহ সৰ্বসাধারণের সমক্ষে দিনের মধ্যে দুইবার উপস্থিত হন। প্রথম, প্রাতঃকালে উপাসনা করিয়া তিনি প্রজাবৰ্গকে ঝরোখা হইতে দেখা দিতেন, ইহাকে দর্শন বলিত; দ্বিতীয় বার যখন দৌলতখানায় যাইতেন। তখন পাদশা কখন দিন ৯টার সময় দৌলতখানায় যাইতেন। পাদশা সপ্তাহে একবার কি দুইবার করিয়া বিচারকার্য করিতেন। ইহাকে সেই সময়ের ভাষায় বলিত, “বারদিয়া বমা।” পাদশাহ বার দিয়া বসিবার আগে তেঁড়া দিয়া মোয়বত করা হইত। পরে রাজবংশের ছেলেরা, আমীর-ওমরা সকল কুরনিস করিয়া হাজির হইতেন।
কুরনিস্ ও তসলিম
কুরনিস্ অনেক প্রকারের আছে। সাধারণতঃ যে কুরনিস্ পাদশার সম্মুখে ব্যবহৃত হইত, তাহার নিয়ম এই–১ম প্রকারের, পাদশাহের সম্মুখে হাজির হইয়া প্রথমে মস্তক অবনত করিয়া নতজানু হইয়া বসিতে হয়। ইহাই পুরাকালের হিন্দু কুরনি। ২য় রকম,-দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করিয়া তাহার উপর মস্তক ন্যস্ত করিয়া কোমর হইতে মাথা পর্যন্ত দেহটাকে অবনত করিলে যে অবস্থা হয়, তাহাকে শাহী কুনিস বলে। আজকালকার ঝুঁকিয়া সেলাম বা আদব এই প্রকারের।
তসলিম–তসলিম অনেক প্রকারের আছে। ১ম প্রকার,-~-দক্ষিণ করের উল্টাদিকটী একেবারে গিয়া মাটীতে ঠেকাইতে হয়। অবশ্য হাত ঠেকাইতে গেলে দেহটী অনেকটা কুঞ্চিত ও অবনত করিতে হয়। তাহার পর ধীরে ধীরে সে হাতটী মাটীর উপর হইতে তুলিতে হয়। হাত তুলিতে তুলিতে গেলে দেহও ধীরে ধীরে সোজা হইয়া দাঁড়াইবে। যখন একেবারে সোজা হইবে, তখন দক্ষিণ হস্তের চেটো কপালের সহিত মিশিয়া যাইবে। পাদশাহের সহিত প্রথম সাক্ষাৎসময় তিনটা তসলিম করিতে হয়। প্রথম দর্শনে পথের মধ্যে এবং সিংহাসনের পাদদেশে উপস্থিত হইয়া আর একবার। মুনসফ জায়গীর পাইলে বা খিল্লাত পাইলে তসলিম করিতে হইত। পাদশাকে ভূমিষ্ঠ প্রণামও করা হইত। দেওয়ানখাসে মন্ত্রণা করিবার সময় মন্ত্রীগণ পাদশাহের সাক্ষাতে উপস্থিত হইয়া তুমিষ্ট প্রণাম করিতেন। পাদশাহের উদ্দেশে অনেকে মানত করিত এবং মনস্কামনা পূর্ণ হইলে মানতের সামগ্রী পাদশাহের নিকট আনিয়া উপস্থিত করিত। দুরারোগ্য রোগ হইলে রোগী একটী স্বর্ণ বা রৌপ্যপাত্রে গঙ্গা বা যমুনার জল আনিয়া পাদশাহের নিকট উপস্থিত করিত। তিনি ঐ জলে নিশ্বাস নিক্ষেপ করিলে এবং স্থিরনেত্রে সেই জলাধার দর্শন করিলে অনেকের বিশ্বাস, সেই জলপান করিয়া দুরারোগ্য রোগও আরোগ্য হয়। পাদশার দুয়ারে অনেকে আসিয়া “ধারণা” দিত এবং মনস্কামনা পূর্ণ হইলে চলিয়া যাইত। অনেক সন্ন্যাসী-ফকীর পাদশাহের কাছে দীক্ষিত হইয়াছেন। পথে পরস্পরের সহিত সাক্ষাৎ হইলে পাদশার শিষ্যগণ বলিতেন, “আল্লা হা-আকবর” অর্থাৎ ভগবান্ই সৰ্বশ্রেষ্ঠ; অপরে উত্তর দিত, “জিলে জেলালে হু” অর্থাৎ ভগবানের ঐশ্বৰ্য্যই তাহার প্রভা। পাদশার শিষ্যগণ জন্মতিথি পূজার দিন দান-ধ্যান করিতেন। তাহারা মাংস খাইতে পাইতেন না।
গৃহ নির্মাণের ব্যবস্থা
বাদশাহ রাজ্যের সর্বত্রই দুর্গ, প্রসাদ, মন্দির, মসজীদ প্রভৃতি তৈয়ার করাইয়া থাকেন। এতদ্ব্যতীত সরাই, পুষ্করিণী, কূপ, ইন্দারাও প্রস্তুত হইয়া থাকে। তিনি গৃহনির্মাণের একটী নিরিখ করিয়া দিয়াছিলেন। লালপ্রস্তরের বাড়ী তৈয়ার করিতে হইলে প্রতিমণ প্রস্তরে তিন দাম হিসাবে মূল্য দিতে হইত। ইষ্টক সে সময় তিন প্রকারের ছিল। বড় ইষ্টক ওজনে তিনসের। ইহা পোড়াইয়া প্রায় ঝামার মতনই করা হইত। ছোট চাপড়া ইষ্টক (যাহা ফরমায় ঢালা হয় না। আর কাঁচা ইষ্টক। শিশু, শিরীষ, বাকায়ন, নাজু, শাল, তুত, কুল এবং দয়েন এই কয় প্রকারের কাষ্ঠই গৃহনির্মাণের জন্য ব্যবহৃত হইত। ঘুটিং চুণই প্রশস্ত ছিল। ঝিনুকের চুণ ব্যবহৃত হইত না। প্রত্যেক গৃহের সম্মুখে একটা ঘন্টা ঝুলান থাকিত। দোরের কবজা লোহার হইলেও যাহাতে মরিচা না ধরে, তজ্জন্য টীন দিয়া কলাই করা হইত। বাতায়নপথে কাঁচের সারসীও দেওয়া হইত। যাহারা ইট তৈয়ারী করে, তাহারা প্রত্যেহ ৬ দাম পাইত, পাথরকাটাই-কারিকর প্রত্যেহ ৬ দাম পাইত, ছুতার মিস্ত্রী ৭ দাম করিয়া রোজ, করাতিয়া আড়াই দাম রোজ। কূপখনকেরা প্রতি গজে ২ দাম পাইত, যাহারা কৃপ হইতে মাটী তোলে, তাহারা শীতকালে ৪ দাম, গ্রীষ্মকালে ৩ দাম করিয়া রোজ পাইত। যাহারা ইটকাটাই করে, তাহারা ১০০ ইট কাটিলে আট দাম পাইত। যাহারা সুরকী প্রস্তুত করে, তাহারা ৮ মণ সুরকী ভাঙ্গিলে মণকরা দেড় দাম পাইত। ফরসীরা ৩ দাম করিয়া বোজ পাইত। যাহারা বাণিস করে এবং যাহারা রং দেয়, তাহারা ২ দাম করিয়া রোজ পাইত। নানা রকমের খাপড়া বা খোলা ঘর ছাইবার জন্য ব্যবহৃত হইত। চীনেমাটীর খাপড়া এবং বাঙ্গালাদেশের ও দক্ষিণের খাপড়াই সর্বোৎকৃষ্ট ছিল। বাণিস অপেক্ষা গালা দিয়াই লোকে দ্বারা-জানালা বেশী রং করিত। বার্ণিস মুসলমানেরই অধিক ব্যবহার করিতেন। হিন্দুদের গৃহ লা দিয়াই অনু-রঞ্জিত হইত। ঘরের দরজা এবং জানালায় আবলুস, বকম, রক্তচন্দন, শিশু, শাল, সালোয়ান, তুত, শিরীষ এবং হদী নামক এক প্রকার হলদে রঙের কাঠ ব্যবহৃত হইত। হিন্দুদের গৃহে রক্তচন্দন, আবলুস, বকম, চাপা, উঁত, এই সকল কাষ্ঠই ব্যবহৃত হইত।
সেনা-বিভাগ
পাদশাহের সেনা তিন ভাগে বিভক্ত;-প্রথম মনসবী, দ্বিতীয় জমীদারী, তৃতীয় খালসাহী। মসবী সেনা এক একজন মনসবদার পরিচালনা করিয়া থাকেন। যাঁহাদিগের অধীনে দশ হাজার সেনা আছে, তাহাদিগকে দশহাজারী মন্সবদার কহে; যাঁহাদিগের অধীনে আট হাজার সেনা থাকে, তাহাদিগকে আটহাজারী মনসবদার কহে; যাহাদিগের অধীনে সাত হাজার সেনা থাকে, তাহাদিগকে সপ্তহাজারী মনসবদার কহে। সর্বনিম্নশ্রেণীর মনসবদারের ধীনে ছয় শত সেনা থাকে। ইহা ব্যতীত পাদশাহের জঙ্গলী সেনা আছে। ভীল, সাঁওতাল, গোরখাগণও পাদশাহের সেনা-বিভাগে চাকুরী করিয়া থাকে। ইহারা সকলেই ধানুকী, সকলেই ধনুর্বাণ হস্তে যুদ্ধক্ষেত্রে যায়। পাদশাহের অধীনে জমীদারী সেনাই চুয়াল্লিশ লক্ষ হইবে। কৃষিজীবী, শিল্পী, ব্যবসায়ী ও যাজক সম্প্রদায় ব্যতীত পাদশাহের আর সকল প্রজাই জরাগ্রস্ত বা দুরারোগ্যগ্রস্ত না হইলে, কোন কোন সেনা-বিভাগে অন্ততঃ কিছুদিনের জন্য কার্য করিয়া থাকে। মফস্বলের গৃহস্থের পুত্রেরা সাধারণতঃ জমীদারী সেনাতেই কাৰ্য্য করে। আর রাজপুত, পাঠান, আরবী, তুরকী, ইরাণী প্রভৃতি বিদেশীয়েরা মন্সবদারের অধীনস্থ সেনা-বিভাগে কার্য করিয়া থাকে।
অশ্বারোহীর বিবরণ
অশ্বারোহী সেনার অধিনায়কের নাম আহেদী। মন্সবদারের অধীনস্থ সৈন্যদলের অশ্বসাদীর অশ্ব চিহ্নিত থাকে। এই সকল চিহ্নিত অশ্বের বিবরণ এবং সওয়ারের বৃত্তান্ত মুস্তৌফীগণ দপ্তরে লিখিয়া রাখেন। ইহাদের বেতন, ভাতা, বখসীস প্রভৃতির বন্দোবস্ত স্বতন্ত্র। যাহাদের অশ্ব চিহ্নিত থাকে, যাহাদের বিবরণ দপ্তরে লেখা না থাকে, তাহাদিগের কেবল তখার ব্যবস্থা আছে। ইরাণ ও তুরাণদেশের অশ্বসাদিগণের বেতন মাসিক ২৫ টাকা, ভারতের অশ্বসাদিগণের বেতন মাসিক ২০ টাকা। যাহারা খালসা বিভাগে কাৰ্য্য করে অর্থাৎ মালগুজারী অনায়ন প্রভৃতি ব্যাপারের রক্ষকের কাৰ্য্য করে, তাহাদের বেতন মাসিক পনের টাকা মাত্র। অচিহ্নিত অশ্বসাদিগণকে বাহার উদ্দী বলে, অর্থাৎ ইহারা খাস মন্সবের অধীন নহে। এই সকল অশ্বসাদীকে নিজের অশ্ব নিজব্যয়ে খরিদ করিতে হয়; নিজের অস্ত্র-শাস্ত্রও নিজে আনিতে হয়। যে সকল মনসবদার সেনা সংগ্রহ করিতে পারেন না, তাহাদিগের জন্য খাসবিভাগ হইতে সেনা সংগ্রহ করা হয় এবং তাহাদের অধীনস্থ সেনা ও অশ্বকে চিহ্নিত করিয়া রাখা হয়। ইহাদিগকে দাখিলী সেনা বলে। আট-হাজারী বড় মনসবদারের অধীনে আটশত সেনানায়ক মন্সবদার নিযুক্ত হইতে পারিত। সাতহাজারী সেনা-নায়ক মনসবদারের অধীনে সাতশত অশ্বারোহীর অধিনায়ক মন্সবদার নিযুক্ত হইতে পারিত। হঠাৎ বড় একটা যুদ্ধে কোন মন্সবদারের অধীনস্থ অশ্বারোহী যদি অধিক সংখ্যায় হত হইত, তখন তাহাদের স্থান অধিকার করিবার জন্য যে সকল নূতন তৎকাল-সমাহৃত অশ্বারোহী নিযুক্ত হইত, তাহাদিগের নাম কসেফী।
অশ্বের বিবরণ
পাদশাহের রাজত্বের অষ্টাদশবৎসর যুদ্ধের অশ্ব সকল চিহ্নিত হইতে আরম্ভ হয়। এবং অশ্বগণকে সাত বিভাগে বিভক্ত করা হয়, যথা–আরবী, ইরাকী, মোজনুস, তুর্কী, ইয়ার, তাজী এবং জঙ্গলী। যাহারা আরবী-অশ্বারোহী, অর্থাৎ যাহারা আরবদেশের অশ্বের আরোহণ করে, তাহাদিগের বেতন মাসিক ৭৩০ দাম ছিল, ইহাতেই অশ্বারোহী ও অশ্বের সমস্ত ব্যয় নির্বাহ করিতে হইত। যখন ৩৫ দামে এক টাকা নির্ধারিত হইল, তখন পাদশাহ আরও ৮১ দাম বাড়াইয়া দিয়াছিলেন। যাহারা ইরাকী-অশ্বে আরোহণ করিত, তাহাদের বেতন মাসিক ৬০৮ দাম ছিল, যাহারা মোজন্নস-অশ্ব আরোহণ করিত, তাদের মাসিক ৫৬০ দাম ছিল। ইরাকী ও তুর্কীর সম্মিলনে যে অশ্ব উৎপন্ন হয়, তাহারই নাম মোজন্নস্। তুর্কী-অশ্বারোহিগণের বেতন ৪৮০ দাম, ইয়াবু-অশ্বারোহী-গণের বেতন ৪০০ দাম। তাজী ও জঙ্গলী দুই প্রকারের অশ্ব ভারতবর্ষেই পাওয়া যায়। তাজী অশ্বারোহী ৩২০ দাম বেতন পাইত এবং জঙ্গলী-অশ্বারোহীর বেতন ২৪০ দাম নির্দিষ্ট ছিল। যাহারা টাটুতে আরোহণ করিয়া সংবাদবাহকের কাৰ্য্য করিত, তাহারা ১৪০ দাম বেতন পাইত।
সেনাবিভাগের হস্তী
সেনা-বিভাগের যে সকল হস্তী নিযুক্ত হইত, তাহারা সাত শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল; যথা– মন্ত, শীরগীর, সাদে, মঝোলা, কেরহে, বেঁদেরকীয়া এবং মুকল। মস্ত-হস্তীর অধিনায়কের বেতন মাসিক ১৩২০ দাম, শীরগীর অধিনায়ক ১১০০ দাম বেতন পাইতেন, সাদে ৮০০, মঝোলা ৬০০, কেরহে ৪২০, বেঁদেরকীয়া ৩০০ এবং মুকলের অধিনায়ক ২০০ দাম পাইতেন। জল লইয়া যাইবার জন্য এক একটা খচ্চরের জন্য ২৪০ দাম ব্যয় পড়িত। রসদ যোগাইবার জন্য প্রতি বলদে ১২৩ দাম পড়িত। তাম্বু, কানাত প্রতি বহন করিয়া লইয়া যাইবার শকটের ব্যয় মাসে ৬০০ দাম লাগিত।
মন্সবদার
পাদশাহের সৈন্যপরিচালনা করিবার জন্য সর্ব নিম্নশ্রেণীর অধিনায়কের নাম ছিল দহবাসী অর্থাৎ দশজন অশ্বারোহীর অধিনায়ক এবং সর্বশ্রেষ্ঠ অধিনায়কের নাম দশহাজারী মনসবদার। শাহজাদা-গণই কেবল দশহাজারী মনসবদার হইতে পারিতেন। তাঁহার আত্মীয়-কুটুম্ব বীর বলিয়া পরিচিত হইলে আটহাজারী ও সাতহাজারী মনসবদারের পদে নিযুক্ত হইতে অন্যান্য হিন্দু, মুসলমান, পাঠান রাজপুত বীরগণ সকলেই যোগ্য বিবেচিত হইলে ধর্ম ও জাতিনিৰ্বিশেষে পাঁচহাজারী মনসবদার পর্যন্ত পদ পাইতেন। যে সকল মন্সবদারের অধীনে পূর্ণসংখ্যায় অশ্বারোহী থাকিত, অর্থাৎ পাঁচহাজারী অধীনে যদি সত্য সত্যই পাঁচ হাজার অশ্বারোহী থাকিত, তাহা হইলে তাহাদিগকে সেই বিভাগের প্রথমশ্রেণীর আমীর বলিয়া পরিগণিত করা হইত। যাঁহাদিগের অধীনে নির্দিষ্টসংখ্যার অর্ধেক থাকিত, তাহাদিগকে দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত করা হইত। যাহাদিগের তৃতীয়াংশ থাকিত, তাহারা তৃতীয়শ্রেণীর আমীর হইত। সংখ্যায় কম পড়িলে পাদশাহ খাস বন্দোবস্ত করিয়া সেনা সংগ্রহ করিয়া দিতেন। সংগ্রহের ব্যয় মনসবদারগণকে পরে দিতে হইত। পাদশাহ ইচ্ছা করিলে একজন সামান্য ব্যক্তিকেও একেবারে পাঁচহাজারী মনসবদার করিয়া দিতে পারিতেন। একশত অশ্বারোহীর অধিনায়কের নাম যুজবাগী। ইহাদের বেতন মাসিক সাতশত টাকা নির্ধারিত ছিল। এগার শ্ৰেণীর যুজুবাশগী আছে; সর্বনিম্ন শ্রেণীর যুজবাশগী অশ্বারোহীগণ অশ্বে আরোহণ করিত।
মনসবদারগণের বেতন
দশহাজারী মনসবদারের মাসিক বেতন ৬০০০০ টাকা, আট হাজারীর ৫০০০০ টাকা, সাতহাজারীর ৪৫০০০ টাকা, পাঁচহাজারীর ৩০০০০ টাকা, চারিহাজারীর ২২০০০ টাকা, তিনহাজারীর ১৭০০০ টাকা, দুইহাজারীর ১২০০০ টাকা, একহাজারীর ৮২০০ টাকা, পাঁচশতের ২৫০০ টাকা, একশতে ৪১০ টাকা এবং দেহ-বাশী অর্থাৎ দশজনের অধিনায়কের মাসিক বেতন ১০০ টাকা ছিল।
মনসবদারগণের নাম
দশহাজারী,–সুলতান সেলিম, পাদশাহের জ্যেষ্ঠ পুত্র ও সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী।
আটহাজারী,শাহ্ মুরাদ, পাদশাহের দ্বিতীয় পুত্র।
সাতহাজারী,–সুলতান দানিয়েল, পাদশাহের তৃতীয় পুত্র।
পাঁচহাজারী,–সুলতান খসরু; সুলতান সেলিমের জ্যেষ্ঠপুত্র; মির্জা সুলেমান; মিরজা ইব্রাহিম; মিরজা সারোখ; মিরজা মোজঃফর হোসেন; মিরজা রোস্তম; বয়রাম খাঁ; মুনিম খাঁ; টার্ডিবেগ; খা জামান; আবদুল্লা খাঁ; একে খাঁ; খ ফেল্লাম; মির্জা সরফুদ্দীন হোসেন; ইসুফ মহম্মদ খাঁ, আদম খার পীর মহম্মদ খাঁ; খা আজম মিরজা কোকে; বাহাদুর খাঁ; রাজা বীরবল; খা জাহান; সৈয়দ খাঁ; সাহেব খাঁ; রাজা ভগবাদাস; কুতবুদ্দীন খাঁ; খাঁ খানান, আবদুল রহিম; রাজা মানসিংহ; মহম্মদ কুলী খাঁ; রসুম খাঁ; কেয়া খাঁ।
সাড়ে চারিহাজারী,–জিন খাঁ; মিরজা ইসুফ খাঁ।
চারিহাজারী,কাসিম খাঁ মেহদী; মোজঃফর খাঁ; সরিফ খাঁ কোকে; রাজা তোড়লমল; মহম্মদ কাসিক খাঁ; উজীর খ; কেলী খাঁ; সাদেক খাঁ; রাজা রায়সিংহ।
সাড়ে তিনহাজারী, শাহ কুলী খা মহররম; ইস্মাইল কুলী খাঁ;
তিনহাজারী,–মির্জা জানি বেগ; ইসকান্দর খাঁ; আসক খাঁ; আবদুল মজিদ, মজনুন খাঁ; সুজায়েত খাঁ; সা বেদাই খাঁ; হোসেন খাঁ; মুরাদ খাঁ; হাজি মহম্মদ খাঁ; অফজল খাঁ;, শা-বেগ খাঁ; খা আলম; কাসিম খাঁ; মির বহর; পাকে খাঁ; মির মোয়াজ্জলমুল; মির আলী আকবর; সরীফ খাঁ।
আড়াইহাজারী,ইব্রাহিম খাঁ; জেলালুদ্দীন মহম্মদ; হায়দর মহম্মদ খাঁ; ইয়শদ খাঁ; পিন্দর খাঁ; জগন্নাথ; মকসু খাঁ; আবুল ফজল।
দুইহাজারী, ইসমাইল কুলী খা: মির বাবস: আসরফ খা: সৈয়দ মামদ আবদুল্লা খাঁ; সেখ মহম্মদ; সৈয়দ আহম্মদ; রোস্তক খাঁ; জাহাবাজ খাঁ; দরবেশ মহম্মদ; সেখ ইব্রাহিম; আবুদল মোতালেক খাঁ; ইয়ত্ বার খা (খোঁজা); একলাস; রাজা বড়মল; বাহার খাঁ; শা ফকরুদ্দীন; রাজা রামচন্দ্র; লস্কর খাঁ; সৈয়দ আহম্মদ; আলি খা কাহার; রায় কল্যানম; তয়েব খাঁ; সা মহম্মদ খাঁ; রায় সুজনসেন; সাহেব খাঁ; আসফ খাঁ।
দেড়হাজারী,-সেখ ফরিদ; সামানজী খাঁ; টার্ডি খাঁ; মেহদী খাঁ; রায় দুর্গাদাস; মধুসিংহ সৈয়দ কাসিম; রায় শাল দত্তারী।
একহাজারী,–মোহেব আলী খাঁ; সুলতান খাজা আবদুল্লা; তাতার খাঁ; হাকিম আবুল ফেতা; সেখ জামাল জায়ার খাঁ; সা ফেহেমী; আসাদ উল্লা খাঁ; সাদক আলী খাঁ; রূপসেন বৈরাগী; ইত্মাদ খাঁ; মনসুর কাদিম খাঁ; হালি খাঁ; আদল খাঁ; গিয়াসউদ্দীন খাঁ; ময়েন খাঁ; মহম্মদ কুলী খাঁ; মেহের আলি খাঁ; খাজা ইব্রাহিম; সেলিম খাঁ; হবিবুল্লা খাঁ; জগম; উলুক; হাবসী, মকসুদ আলী খাঁ; কবুল খাঁ; ছবদল খাঁ; সৈয়দ মহম্মদ মীর আদল; রাজ বাহাদুর; মোটা রাজা অযযাধ্যা সিং; সা মির্জা নিজ্জত খাঁ; সৈয়দ হাসিম গাজি খাঁ; রুসি খাঁ; মির্জা হোসেন; হাকিম জম্বল; ফজল খাঁ; খাজা সমসউদ্দীন, জগৎসিংহ; সৈয়দ রাজু; হোসেন বেগ; সেখ আবদুল্লা; রাজা রাজসিংহ: রাজা ভোজ মির্জা মিরিখ।
এতদ্ব্যতীত রায় দর্পণদাস, বাবু, দাহির, মঙ্গল, পরমানন্দ, জগমল্ল রাওল ভীষ্ম, গণেশ বাহাদুর, রামদাস, দুর্জন সিং, সুবল সিং রামচন্দ্র রাজা মুক্তমল্ল রাজা রামাদ, জগপৎ সিং, সুচেৎ সিং, রায় মনোহর, রামচাঁদ, বঙ্কবিহারী; বলভদ্র, কেশবদাস তুলসীদাস, বাহাদুর, কৃষ্ণদাস, মানসিংহ, রায় রামদাস দেওয়ান, প্রতাপসিংহ, শক্তসিংহ, কারাবেহারা, সেকরা, মথুরাদাস, সুমিত্রা-দাস, কেল, লাল সজ্জনদাস, সংখ্য, সুন্দর, কেশবসিংহ প্রভৃতি হিন্দু মনসবদার আটশত হইতে একশত অশ্বারোহী সেনার অধিনায়করূপে পাদশাহের চাকুরী করিতেন। হিন্দুদের অধীনে হিন্দু সেপাহী থাকিত। তাঁহার যে জাতি তিনি সেই জাতীয় অশ্বারোহী নিজের অধীনে রাখিতে পাইতেন। তবে পাঁচহাজারী হিন্দু মন্সবদারের অধীনে মুসলমানেরাও কাৰ্য্য করিতেন। কিন্তু রাজা মানসিংহের অধীনে যে পাঁচ হাজার সেনা আছে, তাহারা সকলেই অম্বরের রাজপুত। রাজা মানসিংহ হিন্দুদিগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা এবং পাদশাহের সবিশেষ বিশ্বাসভাজন।
আহেদীর বিবরণ যে সকল রণনিপুণ বীর যুদ্ধক্ষেত্রে তেজস্বিতা দেখাইয়া পাদশাহের অনুগ্রহভাজন হইয়া থাকেন এবং যাহাদের বয়সের তারুণ্যবশতঃ মত্সবের অধিকার দিতে পাদশাহ সুবিবেচনা বোধ করেন না, তাহাদিগকে খাসে রাখেন এবং সেই সকল অশ্বারোহী বীরগণের নামই আহেদী। ইঁহাদের দেওয়ানী বন্দোবস্ত স্বতন্ত্র, ইহাদের বক্সীও স্বতন্ত্র। ইহাদের সেনাপতি একজন উচ্চপদস্থ আমীর। আহেদীগণের অশ্ব চিহ্নিতই থাকে এবং প্রত্যেক আহেদীর শরীরের বিবরণ ইয়াদদস্ত (Memoranda) বহিতে লেখা হয়। প্রত্যেক আহেদীর জন্য জামীনও লওয়া হয়; প্রত্যেক আহেদীর বেতন মাসিক পাঁচ শত টাকার অধিক স্থির আছে। পূর্বে প্রতি আহেদীর ব্যবহারের জন্য দশটী ঘোড় দেওয়া হইত, এখন পাঁচটীর অধিক দেওয়া হয় না। চারিমাস অন্তর আহেদী বক্সীর নিকটে গিয়া উপস্থিত হন এবং নিজেকে ও নিজের অশ্বকে সনাক্ত করিয়া লইয়া আসেন। সনাক্ত হইলে আহেদী কবজ (রসীদ) দিয়া পাওনা টাকা আদায় করিয়া লন। বৎসরে আহেদীকে দশমাসের বেতন দেওয়া হয় এবং বাকী দুইমাসের বেতন অশ্বসকলের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করিয়া, অস্ত্র-শস্ত্রাদি গণনা করিয়া পরে চুকাইয়া দেওয়া হয়। কোন আহেদী রাজকার্যে নিযুক্ত হইবার সময় তাঁহাকে প্রথম অশ্ব নিজে খরিদ করিতে হয়। যদি সেই অশ্ব মরিয়া যায়, তাহা হইলে সরকার হইতে আর একটা অশ্ব যোগাইয়া দেওয়া হয়।
পদাতি
বন্দুকচীসকল,–যাহারা বন্দুক লইয়া বন্দুকে সঙ্গীন চড়াইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়, তাহারা অন্যান্য পদাতি সেনা অপেক্ষা কিছু অধিক বেতন পাইয়া থাকে এবং রসদ ও বারুদ যোগাইবার জন্য বন্দুকচীদিগকে অশ্ব বা উষ্ট্র ব্যবহার করিতে দেওয়া হয়। পাদশাহের খাস অধীনে ১২০০০ বন্দুকচী সিপাহী আছে।
দ্বারবানসকল
পাদশাহের প্রাসাদ রক্ষা করিবার জন্য এক হাজার দ্বারবান নিযুক্ত আছে; ইহারা বন্দুক ও ভলু ব্যবহার করে। মাসিক একশত আশী দাম বেতন পাইয়া থাকে।
খিদমৎগার
পাদশাহের সেবার জন্য রাজপ্রাসাদের কক্ষে কক্ষে যে সকল দ্রব্য আছে, তাহা যথাযথ সজ্জিত রাখিবার জন্য এক হাজার খিদৃমগার নিযুক্ত আছে। ইহাদিগকে পূর্বে মাবী, বলা হইত। ইহারা জাতিবিশেষ; পুরাকালে চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করিয়া দিনযাপন করিত, কিন্তু পাদশাহ অশেষ বুদ্ধিবলে ইহাদিগের প্রধানকে রাজা খিদমত রায় উপাধি দিয়া ইহাদিগকে নিজের খাস চাকররূপে নিযুক্ত করিয়াছেন। ইহারা এখন অতি বিশ্বাসী, কাৰ্য্যতৎপর ও পরিশ্রমশীল বলিয়া বিখ্যাত।
মেওরা বা কাসীদ
মেবৎ-দেশের অধিবাসিগণ কাসীদের কর্মে নিযুক্ত হয়ে থাকে। কাসীদ অর্থে দূত বা সংবাদবাহী দূত। ইহাদের ন্যায় শীঘ্র পথ চলিতে বোধ হয় পৃথিবীর অন্য কোন জাতিই পারে না। ইহারা গোয়েন্দার কাজ অতি সুন্দররূপে করিতে পারে এবং সাম্রাজ্যের সর্বত্রই গোয়েন্দার কাজ করিয়া বেড়ায়। দূরদেশ হইতে পত্রাদি, অর্থ বা বহুমূল্য জহরাত ইহারা চতুরতার সহিত আনিয়া থাকে। এক সহস্র কাসীদ পাদশাহের অধীনে কাৰ্য্য করিয়া থাকে।
সমসেরবাজ বা কুস্তিগীর
কুস্তিগীর বা মল্লগণ কুস্তি করে, রণক্ষেত্রে শত্রুর সহিত নিকটযুদ্ধে অসীম পরাক্রম প্রকাশ করিয়া থাকে এবং তলোয়ারের খেলা ইহাদের ন্যায় আর কেহ খেলিতে পারে না। ইহারা ঢাল, লাঠী বা কেবল লাঠী লইয়া খেলা করে। যাহারা কেবল লাঠী লইয়া খেলা করে, তাহাদের নাম লকড়েইট। পূৰ্ব্বদেশবাসী মল্লগণ একখানি ছোট ঢাল লইয়া যুদ্ধ করিয়া থাকে; এই ঢালের নাম চওড়া। উত্তরদেশবাসী মল্লগণ বিরাট ঢাল লইয়া রণক্ষেত্র উপস্থিত হয়, এই ঢালকে ঢিলুয়া বলে। এই ঢিলুয়া ঢাল সম্মুখে ধরিলে অশ্ব অশ্বারোহী সকলেই ঢাকা পড়িয়া যায়। মধ্যদেশের মল্লগণ পহরাইট নামক এক প্রকার ঢাল ব্যবহার করে; এই ঢাল তিন হাত লম্বা ও এক গজ চওড়া। বনাইত নামক এক প্রকার তলোয়ার আছে, ইহার বাট এক গজ লম্বা এবং ফরক চারি অঙ্গুলী চওড়া ও দেড় গজ লম্বা। মল্লগণ প্রায়ই এই প্রকারের তলোয়ার ব্যবহার করিয়া থাকে; ইহার দুই দিকেই ধার। বান্দেবাগী নামে পূৰ্ব্বদেশের এক প্রসিদ্ধজাতীয় মলুগণ ঢাল ব্যবহার করে না, কেবল তাহারা অর্ধচন্দ্রাকৃতি বাঁকা তলোয়ার লইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়। এই তলোয়ার লইয়া ইহারা যে ভাবে খেলা করে, তাহা দেখিলে বিস্মিত হইতে হয়। এক এক তলোয়ারের ঘায়ে দুই তিনজন লোক খুন-জখম হইয়া যায়। পার্বত্যদেশীয় অনেক জাতি কেবল ছুরী ও ছোরা লইয়া যুদ্ধ করিয়া থাকে। এই প্রকারের এক সহস্র মন্ত্র পাদশাহের খাস অধীনে আছে।
চলা বা দাস
রণক্ষেত্রে, দিগ্বিজয়ে যে সকল কাফের বা ভিন্নধর্মাবলম্বীকে বন্দী করা হয়, তাহাদিগের প্রতি দাসের ন্যায় ব্যবহার করা হয়। যে যোদ্ধা যতগুলি বন্দী গ্রহণ করিবেন, তিনি ততগুলি বন্দীকে বাজারে বেচিতে পারেন বা নিজের সেবার জন্য গোলাম করিয়া রাখিতে পারেন। পাদশাহ যে সকল গোলাম পাইয়াছেন তাহাদিগকে তিনি গোলাম, বা দাস বলিয়া ডাকেন না। তাহাদের গোলাম বা দাস নাম উঠাইয়া দিয়া চেলা বা শিষ্য বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে যাহারা বিশ্বস্ত বলিয়া পরিচিত, তাহারাই পাদশাহের শরীররক্ষীরূপে কাৰ্য্য করে। যুদ্ধের সময়ে ইহারা শরীর রক্ষা করে না যুদ্ধক্ষেত্রে যায় না, কিন্তু পাদশাহ যখন নগরভ্রমণে বাহির হন, যখন সুবা বা প্রদেশ দেখিবার জন্য গমন করেন, তখন ইহারা ছায়ার ন্যায় পাদশাহের অনুগমন করে। ইহারা পাঁচ শ্রেণীতে বিভক্ত;-প্রথম,–যুদ্ধে বন্দীকৃত, দ্বিতীয়,–যাহারা স্বেচ্ছায় বা অন্নাভাবে গোলামী গ্রহণ করে; তৃতীয়, প্রথম দুই প্রকার গোলামের পুত্রাদি। চতুর্থ,–চোর যদি কোন গৃহস্থের সৰ্ব্ব চুরি করিয়া লইয়া যাইবার সময়ে ধরা পড়ে, তাহা হইলে সেই চোর হয় গৃহস্থের গোলাম হয়, না হয় সুবাদার বা পাদশাহের গোলাম হয়। পঞ্চম, কেহ যদি কাহাকেও খুন করে এবং হতব্যক্তির আত্মীয় যদি ঘাতককে ধরিয়া ফেলে, তাহা হইলে হত আত্মীয়ের শোণিতের বিনিময়ে ঘাতককে বন্দীরূপে রাখিয়া দেওয়া হয়। এমন বন্দীকে গোলামরূপে বাজারে বিক্রয় করাও চলে। শেষ দুই প্রকারের গোলাম সহজে পাদশাহের চেলা হয় না। চেলারা পদাতি-সৈন্যশ্রেণীতে নিবিষ্ট। বিশ্বস্ত চেলারা প্রত্যহ এক টাকা করিয়া বেতন পায়। বাদশাহ এমনই গুণগ্রাহী যে, চেলাগণের মধ্যেও কাহাকে সাহসী, উপযুক্ত ও তেজস্বী দেখিলে তাহাকে আমীরপদে বরণ করিতে কুণ্ঠিত হন না।
কাহার বা বেহারা
বেহারারা সকলেই ভারতবাসী। ইহারা অত্যধিক বোঝা লইয়া পর্বতোপরি বা বন্ধুর ভূমিতে গমন করতে পারে। ইহারা পালকী, সুখাগার, চতুর্দোল, ডুলী প্রভৃতি যান সকল বহন করিয়া থাকে। দক্ষিণদেশের এবং বঙ্গদেশের বেহারারাই সর্বোৎকৃষ্ট। প্রায় সাত সহস্র বেহারা পাদশাহের সেবায় নিযুক্ত আছে। বেহারাদের দল আছে। আটজন, ষোলজন, বত্রিশজন করিয়া এক এক দল। প্রত্যেক দলের সর্দার-বেহারার বেতন মাসিক তিনশত চুরাশী দাম পর্যন্ত এবং সাধারণ বেহারারা একশত ষাটি দাম পৰ্য্যন্ত মাসিক বেতন পাইয়া থাকে।
পেয়াদা বা দাখিলী
পদাতিক সেনাকে অনেক সময়ে পেয়াদাও বলা হয়। ইহারা ওমরাহদিগের অধীন থাকিলেও ইহাদের বেতন সরকারী খাজনাখানা হইতে দেওয়া হয়। প্রত্যেক মনসবদারের অধীনে যত অশ্বারোহী সেনা থাকিবে, তাহার অর্ধেকসংখ্যক পদাতি-সেনা রাখিবার ব্যবস্থা আছে। পদাতি-সেনার এক-চতুর্থাংশ বন্দুকধারী হওয়া চাই, বাকী সকলেই ধনুকধারী। ধনুকধারীদের মধ্যে মিরদেহা নামে ধানুকীগণ মাসিক একশত আশী দাম করিয়া বেতন পাইয়া থাকে।
দাগ বা চিহ্নের কথা
ঘোড়ার দাগ আছে, ঘোড়ার বিবরণও আছে। প্রত্যেক পাইক, নায়েক, অশ্বারোহী, সকলেরই বিবরণ আছে। যখন একজন অশ্বারোহী পাদশাহের কার্যে নিযুক্ত হয়, তাহার পদ ও মর্যাদা নির্ধারিত হয় এবং কত অশ্বরোহীর উপর তিনি মনসবদারী করিবেন, তাহাও যখন স্থির হইয়া যায়, তখন তাহার নিজের শারীরবিবরণ, জাতি, ধর্ম, বয়স, নিবাস এবং অন্য জাতি-কুটুম্বের পরিচয় লিখিয়া রাখা হয়।
যখন কোন ব্যক্তি পাদশাহের সেনাবিভাগে কাৰ্য্য করিবার জন্য আবেদন করে, তখন দারোগা আবেদনকারীকে সঙ্গে লইয়া পাদশাহের নিকট উপস্থিত হন। পাদশাহ সকলবিষয় বিবেচনা করিয়া তাহার পদমর্যাদা স্থির করেন। তখন তাহাকে একটা তালিকা দেওয়া হয়, সেই তালিকা লইয়া সে অন্যান্য ব্যবস্থা করিয়া থাকে। এই ব্যক্তি যত সেনার উপর মনসবদার হইবে স্থির হয়, সেই সেনার (পদাতির বা অশ্বারোহীর) সংগ্রহ তাহাকে করিতে হয়। সংগ্রহের কার্য শেষ হইলে চারি পাঁচজন কর্মচারীর নিকট তাহাকে উপস্থিত হইতে হয়। ইহারা পাদশাহের সেনা-বিভাগের খাসনবিশ। ইহারা সংগৃহীত যোদ্ধাগণের দেহ পরীক্ষা করেন, অশ্বসকল পরীক্ষা করিয়া দেখেন এবং প্রত্যেক অশ্বারোহী ও পদাতিকের বেতন নির্ধারিত করেন। বেতন স্থির হইলে দেওয়ান নাজীরের নিকট পত্র যায়; দেওয়ান-নাজীর তখন আবেদনকারীকে সঙ্গে লইয়া পাদশাহের নিকট উপস্থিত হন। পাদশাহ লোকের মুখ দেখিয়া লোকের প্রকৃতি বুঝিতে পারেন, সামান্য একটু চাল-চলন দেখিলে তাহার সামার্থ বুঝিতে পারেন–বুঝিলে পর তিনি দেওয়ান নাজীরের প্রদত্ত পত্রে পাঞ্জা-সহি করেন। সেই সপাঞ্জা পত্র ওটাকেনবীশ দস্তখৎ করিয়া মির অরজের নিকট দিতেন; মির অরজ এবং খুসকী সর্দার দস্তখৎ করিলে আবেদনকারী আগাম কিছু টাকা পাইতেন। পরে দারোগা, সকল অশ্বের উপর দাগ দিতেন। প্রথমে ফারসী অক্ষরে “শীল” প্রত্যেক ঘোড়ার উপর দেওয়া হইত, পরে এক দুই তিন করিয়া দাগ দেওয়া হইত। অনেক সেনানীকে জায়গীর দেওয়া হয়। কিন্তু যে সকল সেনানী পাদশাহের সঙ্গে সঙ্গে থাকেন, তাহারা জায়গীরের শাসনব্যবস্থা করিতে পারেন না বলিয়াই তাহাদিগকে নগদ বেতন দিয়া এবং খোরাক পোষাক দিয়ে পাদশাহের নিকট রাখা হয়। তাহারা বৃদ্ধ হইলে বা রণক্ষেত্রে দেহত্যাগ করিলে, তাহাদের নামে যে সকল জায়গীর মনোনীত আছে, পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে সেই সকল জায়গীর ভোগ করিয়া থাকেন। তবে পুত্রাদির মধ্যে যদি কেহ সমর্থ এবং কর্মঠ থাকেন, তবে তাহাকে পিতা বা পিতামহের কর্মে নিযুক্ত করা হয়। সে সকল ওমরাহ দূরদেশে থাকেন এবং যাহারা মনসবদারী পাইয়াছেন, তাঁহাদিগের অশ্ব বারবৎসর অন্তর চিহ্নিত হইয়া থাকে।
কুশেক বা চৌকী
চৌকী তিন প্রকার,মনসবদার, আহেদীসওয়ার, আহেদীসিপাহী। যে ব্যক্তি রণনিপুণ বলিয়া পরিচিত, তাহাকে কুশেকের মির-আরজপদে অভিষিক্ত করা হয়। ইহার সহিত আর একজন আমীরও কাৰ্য্য করিয়া থাকেন। এই দুইজন সেনাপতিগণের রণবিদ্যার সমাচার রাখেন, সেনাগণের রণপুটুতার সংবাদ রাখেন এবং কাহার দলে কয়টী ঘোভার অভাব, কাহার দলে কয়জন পদাতির অভাব হইয়াছে, তাহার তথ্য লইয়া অভাবমোচনের চেষ্টা করিয়া থাকেন। মনসবদারী সৈন্য–যাহারা বিদেশে কোন আমীরের সঙ্গে যুদ্ধার্থে গিয়াছেন, অথবা যাহারা কোন সুবা শাসন করিবার জন্য কোন মনসবদারের অধীনে নিযুক্ত আছেন, তাঁদের বারবৎসর অন্তর পাদশাহের সহিত সাক্ষাৎ করিতে হয়। ইহার মধ্যে সুবিধা হইলে যখন রাজধানীতে যিনি উপস্থিত হইবেন, তখন পাদশাহকে তসলিম করিতে হইবে। পাদশাহের সকল সেনা বারভাগে বিভক্ত আছে। এই দ্বাদশ-ভাগের মধ্যে কোন একটা ভাগ রাজধানীতে থাকে এবং বৎসরান্তে নূতন বিভাগীয় সৈন্য আসিয়া তাহাদিগের স্থান অধিকার করে। পাদশাহ প্রতি সপ্তাহে সৈন্যপরিদর্শন করিয়া থাকেন।
ওয়াকে নবীশ
ওয়াকে-নবীশের অধীনে দশজন টেপচী নিযুক্ত থাকেন। এতদ্ব্যতীত অনেকে আবার শিক্ষানবিশী করেন। ওয়াকে-নবীশ পাদশাহের সকল হুকুম লিখিয়া লন; পাদশাহের রোজনামচা লিখিয়া থাকেন, পাদশাহের নিকট প্রত্যহ যে সকল আবেদন উপস্থিত হয়, তাহার হিসাব ও হুকুম লিখিয়া রাখেন। এতদ্ব্যতীত পাদশাহের পানাহারের ব্যবস্থা, তাহার হারেমে যাইবার ব্যবস্থা, বরখাস, বরগা আমে যাইবার বন্দোবস্ত, শিকারের উদ্যোগ, নিত্য যে সকল নজর উপস্থিত হয় তাহার হিসাব, প্রত্যহ কত দান হয় তাহার হিসাব, চুক্তিনামা, পেস্কস্ কোথায় কত দেওয়া হইল তাহার হিসাব, কাহার নামে কয়খানা ফরমান বাহির হইল তাহার হিসাব, কোন দিন কোন্ হুকুম তামিল হইবে, কে তামিল করিবে, তাহার ব্যবস্থা, কোন দিন কোন্ ভদ্রলোক আমীর বা আমলা কি বিদেশীদূত পাদশাহের নিকট আগমন করিলেন, তাহার কথা, যে সকল যুদ্ধ দূরদূরান্তর দেশে হইয়াছে, তাহার বিবরণপত্র পাঠ করা, কোন্ দেশে কাহার সহিত কি ভাবে সঙ্গ স্থাপিত হইল, তাহার স্মারকলিপি লিখিয়া রাখা, কোন আমীরওমরাহের মৃত্যুর কথা লিখিয়া রাখা এবং মৃতব্যক্তির আত্মীয়স্বজনের ভরণপোষণের জন্য পাদশাহ কি হুকুম ফরমাইস করিলেন, তাহাও লিখিয়া রাখা, কোন দেশে কোন প্রকার উৎপাত ঘটিলে, দুর্ভিক্ষ, জলপ্লাবন, মড়ক, গো মড়ক হইলে পাদশাহী তরফ হইতে কি ব্যবস্থা হইতেছে, তাহা স্মারকলিপিতে লিখিয়া রাখা, ইহাই ওয়াকে-নবীশের কৰ্ম্ম।
পাদশাহ কোন্ কোন্ ক্রীড়া করিতে ভালবাসেন, কোন্ বেগম তাঁহার বিশেষ প্রীতির পাত্রী, কোন নূতন বেগম হারেমে আসিলেন কি না প্রভৃতি সমাচার রাখা ওয়াকেনবীশের কর্ম। ওয়াকে-নবীশ প্রতিদিন এক একটী রোজনামা লিখিয়া আনিয়া বাদশাহকে পড়িয়া শুনান। পাদশাহ তাহা অনুমোদন করিলে মির মরজ তাহাতে মোহর দিয়া নিজে দস্তখৎ করিবেন। এই দস্তখৎ কাগজকে ইয়াদদস্ত বা স্মারকলিপি বা মেমরেনডেম বলে। এই সকল ইয়াদদস্তলিপি কুশী লোকে লিখিয়া থাকে এবং এই সকল ইয়াদদস্ত অবলম্বনে পরে ইতিহাসে লিখিতে হয়। প্রতি ইয়াদদস্তে দৈনিক সকল ঘটনাই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লিখিত থাকে। এক একখানি ইয়াদদস্ত লেখাতে প্রত্যহ একশত টাকার অধিক ব্যয় হয়।
সনন্দ বা ফরমান
কোন হুকুমনামা পত্র দস্তখৎ হইয়া পাদশাহী পাঞ্জা-সংযুক্ত হইয়া থাকিলে তাহাকে সনন্দ বলৈ। সনন্দের তিনখানা নকল হয়; একখানি পাদশাহী দপ্তরে থাকে, একখানি যাহার নামে সনন্দ দেওয়া হয়, তাঁহাকে দেওয়া হয়, আর একখানি সুবেদারের নিকট পাঠাইয়া দেওয়া হয়; অর্থাৎ যে সুবায় সনন্দগ্রাহী বাস করেন, সেই সুবার সুবেদারের নিকট সনন্দের নকল যায়। এই বিভাগে বিশেষ বিশ্বাসী সুপণ্ডিত, সদ্বংশজাত ব্যক্তিই নিযুক্ত হইয়া থাকেন। দপ্তর তিন প্রকারের;–প্রথম-আবওয়াব উলমাল অর্থাৎ যে পুস্তকে মালগুজারীর হিসাব-নিকাশ থাকে এবং মাল ও গুজারীঘটিত সনন্দ থাকে; দ্বিতীয় আবওয়াব উল তহবী; অর্থাৎ যে পুস্তকে পাদশাহী আয়ের কথা লিখিত থাকে এবং আয় সম্বন্ধীয় সনন্দাদি সন্নিবিষ্ট হয় এবং যাহাতে রাজ্যের সকল খাজনাখানার হিসাব নিকাশ থাকে, আর রাজপ্রাসাদের আয়-ব্যয়, ও নজরের বিষয় লেখা থাকে, তাহাই আবওয়াব উল-তহবী তৃতীয় তৌজী-সেনা রক্ষা করিবার জন্য জায়গীর বন্দোবস্তের ব্যবস্থা, পরগণা তালুক প্রভৃতির হিসাব, জায়গীর জমিদারীর আয়ের হিসাব এবং জায়গীরদার, জমিদার, ও তালুকদারগণের নামের তালিকা এবং কে কত সেনারক্ষা করিয়া থাকেন, কাহাকে কোন্ বাবদে কত জায়গীর দেওয়া হইয়াছে, ইহা যে পুস্তকে লিখিত থাকে, তাহাকেই বলে তৌজী। প্রত্যেক সুবায়, প্রত্যেক পরগণায়, প্রতি দেওয়ানের কাছারীতে এই তিনপ্রকারের খাতা রাখিবার ব্যবস্থা আছে। সনন্দ অনেক প্রকারের আছে।
ফরমান সবতী
এই ফরমানে প্রধান প্রধান রাজমন্ত্ৰী সকলের দস্তখৎ থাকে, পাদশাহের পাঞ্জা ও মোহর থাকে এবং নিম্নলিখিত পদে কাহাকেও নিযুক্ত করিবার জন্য এই ফরমান জারী করা হয়। মন্সবদারী, সিপাই সালারী,ওয়াকাল, এতালিকা (পাদশাহের কোন্ শাহজাদার শিক্ষক পদ) আমার ওমরাই, নাহয়তী, ওজায়ত, হীগিরি এবং সদারৎ। কাহাকেও জায়গীর, সরফ বা তৃণ দান করিবার সময় এই ফরমান জারি করা হয়। কোন বিজিত দেশে সুবেদার নিযুক্ত করিবার সময় বা অন্য কোন উচ্চপদস্থ ফৌজদার নিযুক্ত করিবার সময় এই ফরমান জারী করা হয়। মিলকিয়ৎ বা সেজরগর, নির্ধারণ করিবার সময় বা দান করিবার সময় এই সনদ বা ফরমান দেওয়া হয়। পূর্ববর্ণিত তালিকা স্থির হইলে দেওয়ান বাহাদুর জায়গীর জমীর জমা ওয়াশীল নির্ধারণ করেন এবং কত তনখাদিতে হইবে, তাহারও ব্যবস্থা করেন। পরে বসীরা জায়গীর হইতে কত লোক নিযুক্ত হইতে পারে, তাহা নির্ধারণ করিয়া লিখিয়া দেন এবং তালিকা লইয়া আয়-ব্যয় ও জায়গীর রক্ষার জন্য সেনা-নিয়োগের ব্যবস্থা লিখিয়া একটী সরখৎ দেন। দেওয়ান এই সরখৎ পাইলে পাদশাহের হকুমমত বরাতজিচিঠি বাহির করেন। তৌজীতে বরাতচিঠি দাখিল হয়। পরে মৃস্তৌফা তাহাতে নিজে শীল ও দস্তখৎ করিয়া দেন, তবে ফরমান বাহির হয়। মনসবদারী ফরমানে এত হাঙ্গামা নাই, পাদশাহের বরাতী চিঠি বাহির হইলেই মন্সবের পাগড়ী তাঁহারা পাইয়া থাকেন।
বরাত লিখিবার ব্যবস্থা
বরাত লিখিতে হইলে প্রথমে একটা হিসাব লেখা হয়, তাহাতে শস্য এবং ঘাসের আয়ের কথা লেখা থাকে। বরাতের পার্শ্বে চাকর চাকরাণের খরচের হিসাব থাকে। দেওয়ান এই বরাতে হিসাবটুকু দেখিয়া তখার ব্যবস্থা করিয়া দেন এবং পার্শ্বে লিখিয়া দেন “বরাত নবীস”। মূস্তোফী মুসরেফ ইহা দেখিয়া একটী কবচ তৈয়ারী করেন। সেই কবচে যে দেয় টাকা লেখা থাকে, তাহার এক-চতুর্থাংশ কাটিয়া লওয়া হয়, পরে কবচ এবং বরাত এই উভয় পত্রেই মুসরেফ তৌজীনবীশ, মূস্তোফী, নাজীর, দেওয়ান খাসামান, মুসরেফ দেওয়ান এবং উকীল ইহাদের দস্তখৎ করা হয়। পরে পাদশাহের পাঞ্জা ও মোহর পড়ে। পাঞ্জামোহরের পার্শ্বে লেখা থাকে যে, কোন্ প্রকারের মুদ্রায় টাকা দেওয়া হইবে।
কবচ
কবচ ফারসী কথা, ইহার অর্থ কর বা হাতের তালু। এই কবচ হইতে আমাদের কব্জা কথা বাহির হইয়াছে। কবচপত্র পাইলে বুঝা গেল যে, উদ্দেশ্য হস্তগত হইয়াছে। কবচ কতকটা প্রমিসারী নোট ও রসীদ এই উভয় মিলিয়া যাহা হয়, তাহাই। এখন জমিদারে করচ বা দাখিলা দিয়া থাকেন, কিন্তু পাদশাহী আমলে কবচ আজকালকার গবর্ণমেন্ট নোটের মত ব্যবহৃত হইত।
ফরমান-বেয়াজী
অনেক সময়ে পাদশাহী হুকুম শীঘ্র দিতে হয় এবং অন্যের অজ্ঞাতেও তাহা পাঠাইতে হয়। এই সকল খাস হুকুমনামাকে ফরমান-বেয়াজী বলে। এই ফরমানী কাগজ অনেক প্রস্থে ভাঁজ করা হয় এবং শেষে ইহার দুই মুখ এক করিয়া মাঝখানে ফাঁক করিতে হয়। তাহার উপর আর একখানি কাগজ দিয়া জড়াইতে হয়; জড়াইয়া বট বা অশ্বথের আঠায় মুখ আঁটিয়া দিতে হয়। বট বা অশ্বথের আঠায় আঁটিবার উদ্দেশ্য এই যে, বটের আঠা জলে ধুইয়া যায় না। এই ফরমানবেয়াজী বিশেষ বিশ্বাসীলোকের দ্বারাই প্রেরিত হইয়া থাকে–
ফরমান লইবার পদ্ধতি
পাদশাহী সকল ফরমানই স্বর্ণবস্ত্রে মণ্ডিত হইয়া প্রেরিত হয়। যাহার নিকট পাঠান হয়, সে ফরমান আসিতেছে, এই সংবাদ শুনিলে ফরমানবাহককে প্রত্যুগমন করিয়া আদর করিয়া গৃহে লইয়া আসেন। ফরমান গ্রহণ করিবার সময় তিনি তিনবার কুর্ণিশ করিয়া ফরমানবাহকের নিকট অগ্রসর হন। ফরমান মাথায় করিয়া লইতে হয় এবং ফরমানবাহককে তাহার পদোপযুক্ত নজর দিতে হয়।
বেতন লইবার ব্যবস্থা
যদি সকল সিপাহীর বেতন দামে নির্ধারিত হইয়া থাকে, তথাপি তাহাদিগকে বেতন দিবার সময় মোহর, টাকা ও দাম তিন প্রকারেই মুদ্রা দেওয়া হয়। নয় টাকার এক মোহর এবং চল্লিশ দামে এক টাকা, এই হিসাবে প্রতি পূর্ণিমাতে বেতন দেওয়া হয়।
মুসা আদত্ বা সেনানীগণের সাহায্যব্যবস্থা
যদি কোন সেনানী বা আহেদী অর্থাভাবে কষ্ট পান, তাহা হইলে সরকার হইতে সাহায্য করা হয়। পুত্র-কন্যার বিবাহ, মাতৃপিতৃশ্রাদ্ধ এবং বাসগৃহনির্মাণ, এই কয় বাদেই সাহায্য করা হয়। এ সাহায্য ঋণের হিসাবেই করা হয়। প্রথম বৎসরে সুদ লওয়া হয় না; দ্বিতীয় বৎসরে ঋণের ষোড়শাংশ লওয়া হয় এবং তৃতীয় বৎসর অষ্টমাংশ লওয়া হয়, এই প্রকারে সুদ লওয়া হইয়া থাকে। দশবৎসর পরে আর সুদ লওয়া হয় না। রাজ্যের সকল মহাজনেরাই এই হিসাবে সুদ লইয়া থাকেন। অধিক সুদে ঋণ দিলে মহাজনকে বিশেষ বিপদে পড়িতে হয়। রাজ্যের সর্বত্র সকল সুবার ক্ষুদ্র হইতে বৃহৎ সকল চাকরকেই এই ভাবে সাহায্য করা হয়। পাদশাহের সেবক যাহাতে অন্যত্র ঋণ গ্রহণ করিতে না যায়, সে পক্ষে পাদশাহের বিশেষ দৃষ্টি থাকে। যাহাদের ঋণপরিশোধের সামর্থ্য নাই পাদশাহ তাহাদিগকে সময়ে সময়ে এককালীন দান করিয়া থাকে। এতদ্ব্যতীত পাদশাহ গোপনে সকলের সাংসারিক অবস্থার সমাচার রাখেন। যাহার যেমন অর্থাভাব, তাহাকে সেই ভাবেই অর্থসাহায্য করিয়া থাকেন। এ রকমের গোপনদান পাদশাহের অনেক আছে। পাদশাহ দরিদ্রদিগকে নিত্য দান করিয়া থাকেন, তাঁহার আশ্রিত দীনদুঃখী আতুরগণ নিত্য প্রাপ্য অথবা ভোজ্য লইয়া না গেলে পাদশাহ খানা খান না।
বাদশাহী তুলা
এ তুলা কার্পাস নহে, ইহা তুলা-ব্রত। পাদশাহকে তুলাদণ্ডের একদিকে বসাইয়া অন্যদিকে নানা বহুমূল্য সামগ্রী ওজন করিয়া দীন দরিদ্র দুঃখী, ফকির ব্রাহ্মণকে দান করাকে তুলা বলে। পাদশাহ বৎসরে দুইবার তুলাদণ্ডে ওজন হইতেন। একবার সীরসী আবলমাসের (কার্ত্তিকমাসে) প্রথমে, আর একবার রজবমাসের (বৈশাখের) প্রথমে, নওয়োজার পূর্ব দিনে আবলমাসে বা কার্তিক মাসে পাদশাহ জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তুলায় পাদশাহ এই কয়েক সামগ্রীর দ্বারা ওজন হইয়া থাকেন। ওজন দ্বাদশবার হইয়া থাকে। প্রথমবার স্বর্ণ এবং মণিমাণিক্য রজত ও বস্ত্রাদি; দ্বিতীয়বার পারদ; তৃতীয়বার কাঁচা রেশম; চতুর্থবার গন্ধদ্রব্য; পঞ্চমবার কস্তুরী; ষষ্ঠবার চন্দনকাষ্ঠ; সপ্তমবার মাদকদ্রব্য; অষ্টমবার ধৃত; নবমবারে লৌহ; দশমবারে তণ্ডুল ও দুগ্ধ; একাদশবারে ফল এবং দ্বাদশবারে লবণ। যে তুলার দিনে পাদশাহের যত বৎসর বয়স সম্পূর্ণ হয়, সেবারে হিন্দু-ব্রাহ্মণগণকে ততগুলি গোদান করা হয়, অন্য জাতিকে বলদ, মহিষ, ভেড়া, ছাগল ও মুরগী দেওয়া হয়। এই সকল জন্তু কেহ বধ করিতে পারে না, পাছে মুসলমানে গোহত্যা করে, সেইজন্য ব্রাহ্মণকে গোদান করা হইত। রজবমাসের বা নওরোজার তুলায় পাদশাহ আটবার ওজন হইতেন। প্রথমবার রজত বা চাঁদি; দ্বিতীয়ে টিন, তৃতীয়ে কার্পাসের বস্ত্র, চতুর্থে সীসা, পঞ্চমে শুষ্ক ফল যথা, বাদাম কিসমিস ইত্যাদি, ষষ্টে গন্ধতৈল, সপ্তমে শাকসবজী, অষ্টমে পানীয়। পাদশাহের পুত্র পৌত্রদিগেরও বৎসরে এক একবার করিয়া তুলা হইয়া থাকে। সকলেরই জন্মতিথিতে তুলা হয়। পাদশাহ যে পৰ্য্যায়ক্রমে তুলা ওজন হইয়া থাকেন, সেই ক্রমেই শাহজাদাগণেরও তুলা হয়।
মেজরগল বা বৃত্তি
চারি প্রকারের লোক পাদশাহের নিকট বৃত্তি পাইয়া থাকেন। প্রথম অধ্যাপক এবং বিদ্যার্থীগণ, দ্বিতীয়–সন্ন্যাসী-ফকির, তৃতীয়–অন্ধ, খঞ্জ, আতুর এবং চতুর্থ– উচ্চবংশের সন্তানসন্ততিগণ যাহারা অর্থাভাবে পদোচিত বিদ্যাশিক্ষা করিতে পারেন না; তাঁহাদের চাকুরী করিতে নাই, ব্যবসা করিতে নাই, এমন উচ্চ প্রণম্য বংশীয়গণকেও বৃত্তি দেওয়া হয়। নগদ টাকা বৃত্তি দিলে তাহাকে ওজিফা বলে আর ভূমিসম্পত্তি দান করিলে তাহাকে মদত্যাস বলে। যাহাতে পণ্ডিতের, ধার্মিকের, সঙ্কুলজাত মনুষ্যের পক্ষে অন্যের দ্বারস্থ না হইতে হয়, পাদশাহ তাহার ব্যবস্থা করিয়া থাকেন। রাজ্যের দূরদূরান্তর দেশে যে যেখানে অবস্থিতি করুক না কেন পণ্ডিতের মর্যাদা, ধার্মিকের মৰ্য্যাদা এবং মর্যাদাবানের মর্যাদা রক্ষা করিতে সকল রাজকর্মচারীই বাধ্য। জেলায় জেলায়, চালায় চালায়, কাজী ও মুফতীগণের উপর এই জন্য বিশেষ হুকুম দেওয়া আছে। পাদশাহ রাজতক্ত পাইলে পর তিনি দেখিলেন যে, এই বিভাগে অনেক চুরী, জুয়াচুরী হইয়া থাকে। তাই সেখ আবদুল নবী নামে একজন সুযোগ্য ব্যক্তিকে এই বিভাগের প্রধান কার্যকারক নিযুক্ত করিলেন। আফগানদেশের সকল মদতুমাস বাজেআপ্ত করা হয় এবং চৌধুরী-দিগের অনেক মদত্যাস ও খাও বাজেআপ্ত করা হয়। অনেক কাজীর জুয়াচুরীও ধরা পড়ে; সেই জন্য পাদশাহ অনেক কাজীকে পদচ্যুত করেন এবং সুলতান রোজাকে কাজীগণের প্রধান নিযুক্ত করিয়া প্রত্যেক সুবার হিন্দু জমিদার ও প্রধান অধিবাসীগণের উপর খাস হুকুমজারী করিয়া দিলেন। পরে পঞ্চায়েত দিগের দ্বারা সকল বিষয় নির্ধারণ করিবার জন্যও ব্যবস্থা করিয়া দিলেন।
রাজকর
পাদশাহের খাসখরচের জন্য বিঘা প্রতি দশসের করিয়া শস্য তিনি গ্রহণ করিতেন; ইহাতে তার খাসখরচ ও সৈন্যের খরচ কুলাইয়া যাইত। যাহাতে প্রজার উপর উৎপীড়ন না হয়, অত্যধিক ধান চাউল যাহাতে দেশদেশান্তরে রপ্তানী হইয়া না যায়, তাহার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করিয়া দিলেন। প্রত্যেক জমিদার, জায়গীরদার, জিলাদার, ফৌজদার ও সুবাদার অগ্রে নিজ নিজ শাসনাধীন দেশের এক বৎসরের খোরাক সঞ্চিত রাখিয়া এবং সৈন্যগণের ছয়মাসের খোরাকের অবস্থা করিয়া তবে পূর্ব পূৰ্ব্ব বৎসরের সঞ্চিত গোলাজাত শস্য এবং সেই বৎসরের অবশিষ্ট উৎপন্ন শস্য বাজারে ছাড়িতে হুকুম দিতেন। হঠাৎ কোন দেশে অজন্ম হইলে জায়গীরদার বা সুবাদার নিজব্যয়ে দীনদুঃখী অন্নহীনগণকে অন্ন যোগাইতে না পারিলে তাহাদের জায়গীর কাড়িয়া লওয়া হইত। জোতজমির এক-পঞ্চমাংশ গোচারণের জন্য ফেলিয়া রাখিতে হইত। পাঁচ বৎসর অন্তর এক একখণ্ড জমী ফেলিয়া রাখা হইত এবং সেই জমী সেই বৎসরের জন্য গোচারণের মাঠ হইত। একক্রোশ অন্তর অন্তর বড় বড় ইঁদারা এবং একশত বিঘা জমীতে একটা বড় দীর্ঘিকা খনন করাইয়া রাখা হইত। ধান্য চাউল, দাইর, গরু, বাছুর, ঘোড়া, মহিষ, ইহাদের মূল্য নিরিখ করিয়া বাঁধা থাকিত; প্রত্যেক বৎসরের জন্য নূতন নিরিখ হইত।
উৎসব
বাদশাহ ভারতবর্ষের আদিমকালের সকল উৎসবই বজায় রাখিয়াছেন। তিনি জানেন, আমোদ আহ্লাদ, উৎসব মধ্যে মধ্যে না হইলে মনুষ্য দীর্ঘজীবী হয় না। সকল জাতিই নিজ নিজ জাতীয় ব্যবহার অনুযায়ী উৎসবে মত্ত হইত। উৎসবের ব্যয় অনেক সময়ে সরকারী ভাণ্ডার হইতেই দিতে হইত। এতদ্ব্যতীত তাহার নিজ প্রতিষ্ঠিত এবং পারস্যদেশ প্রচলিত অনেক উৎসব তিনি এদেশে চালাইয়াছেন। যথা,-নওরোজ, ইহা বৎসরের প্রথম দিন হইতে ঊনিশ তারিখ পর্যন্ত থাকে; এই সময়ে নওরোজারমেলা হয়। হারেমে বা বেগমমহলে নওরোজার ভারী ধূম হয়। ইহা ব্যতীত ৩১৯ মার্চ, ৩রা এপ্রিল, ৬ই ১৩ই জুন, ৭ই জুলাই, ৪ঠা আগষ্ট, ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১০ই অক্টোবর, ৯ই নবেম্বর, ৮ই ১৫ই এবং ২৩শে ডিসেম্বর, ২রা জানুয়ারী ও ৫ই ফেব্রুয়ারীতে এক একটা উৎসব হইত। এই সকল দিনে নাচ, গান, বাজীপোড়ান, দান, ভোজ হইত। নওরোজের প্রথম তিনদিন সাম্রাজ্যের সকল নগর আলোকমালায় আলোকিত হইত। ইহা ব্যতীত প্রতিমাসে আবার আর একটা খোসরোজ ছিল; খোসরোজ অর্থ আনন্দের দিন। এই খোসরোজের দিন সকল ব্যবসায়ীর রমণীগণ নানাপ্রকারের বহুমূল্য সামগ্রী বেগম মহলে বাজার খুলিয়া বিক্রয় করিতেন। এদিন বেগম মহলের সকল রমণীই খরিদ-বিক্রয় করিতেন এবং একমাত্র পুরুষবাদশাহ ছদ্মবেশে বিচরণ করিতেন।
বিবাহ
বাদশাহ হিন্দু ও অসভ্য জঙ্গলীদিগের বিবাহ প্রথায় কখন হস্তক্ষেপ করিতেন না। তবে আদ্য ঋতুর পূর্বে বিবাহ প্রথা অপ্রশস্ত বলিয়া তিনি সকলকে পরামর্শ দিতেন। মুসলমানগণের মধ্যে তিনি বরকন্যা উভয়েরই সম্মতি আবশ্যক বলিয়া মনে করিতেন এবং বিবাহে অধিক পণ গণ লওয়া অনুচিত বলিয়া ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। মুসলমানগণ একের অধিক বিবাহ যাহাতে না করেন, সে পক্ষে তিনি বিশেষ দৃষ্টি রাখিতেন। তিনি ব্যবস্থা করিয়াছিলেন যে, পাঁচ হাজারী মনসবদারেরা অধিক গণ পণ দিবেন না, বা লইবেন না। অর্থশালী ধনবান ব্যক্তিগণ চারিমোহরের অধিক দিতে বা লইতে পারিবেন এবং সাধারণ ব্যক্তি এক মোহর। আনন্দ উৎসবে যে যত পারে, নিজ সামর্থ্য বুঝিয়া ব্যয় করিবে। তবে গণ-পণ এই বাঁধা নিরিখেই আদান-প্রদান হইবে। সাধারণ হিন্দুদিগের এই হিসাবে বারোটাকা গণপণের ব্যবস্থা ছিল।
শিক্ষাবিভাগ
সৰ্ব্বত্র সকল গ্রামে পাঠশালা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। সকল জমিদার, জায়গীরদার, জিলাদার, প্রভৃতি ভূস্বামিগণ, নিজ নিজ অধিকৃত দেশে, সকল গ্রামে ও পল্লীতে পাঠশালা রাখিতেন। মুসলমানগণ মসজিদে মৌলবী বা ইমামের নিকট করিতেন; হিন্দুগণ দেবমন্দিরে বা গ্রাম-চতুরে গুরুমহাশয়ের এবং অধ্যাপকগণের নিকট পাঠ লইতেন। সাতবৎসর বয়স হইতেই সকলকে লেখাপড়া শিক্ষা করিতে হইত এবং বিংশতি বৎসর বয়ঃক্রমেই বিদ্যাশিক্ষা করিতে হইত। বিদ্যাশিক্ষার জন্য বিদ্যার্থিগণকে কিছুই দিতে হইত না। যাঁহারা অধ্যাপক বা মৌলবী হইতেন, তাঁহারা চিরজীবন বিদ্যাচর্চা করিতেন; কিন্তু যাঁহারা সৈনিক-বিভাগে কার্য করিতেন তাহাদিগকে বিংশতি বৎসর বয়সের মধ্যেই বিদ্যোপার্জন কার্য শেষ করিতে হইত। শিক্ষার বিষয়; অঙ্কশাস্ত্র, জমিদারী ও মহাজনী হিসাবনিকাশ, কৃষিকাৰ্য্য, জ্যামিতি, জ্যোতিষ, ব্যায়নীতি, রাজ্যশাসনবিদ্যা, ধৰ্ম্মনীতি, মলুবিদ্যা, ন্যায় এবং ধর্মতত্ত্ব। যাঁহারা সেনাবিভাগে কাজ করিবেন, তাহাদিগকে ধর্মশাস্ত্রের উচ্চাঙ্গ পড়িলেও চলে না পড়িলেও চলে। তবে মল্লবিদ্যায় সকলকেই পারদর্শী হইতে হইত। অশ্বারোহণ, সন্তরণবিদ্যা, লাঠিলেখা, তীর-চালনা, বন্দুক ব্যবহার এবং ব্যয়াম সকলকেই শিক্ষা করিতে হইত। ইহাতে জাতিবিচার ছিল না; হিন্দু, মুসলমান, ব্রাহ্মণ, ইমাম সকলকেই শিখতে হইত। দুৰ্বল, চিররুগ্ন ব্যক্তি রাজদরবারে আদর পাইত না।
মিরবহর বা নৌ-সেনাপতি
নৌযুদ্ধবিদ্যার উন্নতির জন্য পাদশাহ বিশেষ বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন। ব্যবসা-বাণিজ্য চালাইবার জন্য এদেশে পূৰ্ব্ব হইতেই নৌকার প্রচলন ছিল। হাতী পারাপার করিবার জন্য বড় বড় ভড় তৈয়ারী হইয়া থাকিত। এই সকল বড় বড় ভড়ে বড় বড় তোপও রাখা চলিত এবং সেই তোপ সাহায্যে নদীতীরস্থ বিরাট দুর্গ ধূলিসাৎ করা যাইত। অর্ণবযান তুর্কীরাজ্যে এবং খৃষ্টানদেশেই ভাল তৈয়ারী হইয়া থাকে। ভারতবর্ষে বাঙ্গলাদেশে, কাশ্মীরে এবং ঢাকাপ্রদেশেই ভাল ভাল নৌকা তৈয়ারী হয়। কাশ্মীরে নৌকার উপর বাগান তৈয়ার হয়। পাদশাহ ভাল কারিগর আনাইয়া এলাহাবাদে এবং লাহোরে বড় বড় জাহাজ তৈয়ারী করাইয়াছিলেন। এই সকল জাহাজ সমুদ্রপথে যাতায়াত করিত। পূৰ্ব্বকালে সামুদ্রিক জাহাজ কেবল বাঙ্গলাদেশেই তৈয়ারী হইত। পাদশাহ বহু অর্থব্যয় করিয়া জাহাজী কারিগরদিগকে এলাহাবাদে ও লাহোরে আনিয়া বাস করাইয়াছিলেন। তবে মালবার-প্রদেশের ও চট্টগ্রামের নাবিকরাই সমুদ্রযাত্রায় দক্ষ ও সুপণ্ডিত।
নাবিকগণের পদমর্যাদা
প্রথম নাখোদা,–ইনিই জাহাজের কাপ্তেন বা প্রধান। দ্বিতীয় মালিম,ইনি রাত্রিকালে তারা দেখিয়া জাহাজ পরিচালনা করিয়া থাকেন, সকল বন্দরের ঠিক সংবাদ তাহাকে জানিতে হয়। তৃতীয় কাপ্তেন,–ইনি খালাসিদের প্রধান। পালতোলা পালসাজান ইহার কাজ। চতুর্থ সারঙ্গ,-ইনি নৌকা পরিচালনা করিয়া থাকেন। পঞ্চম ভাণ্ডারী,ইনি জাহাজের ভাণ্ডার রক্ষা করেন।–তাহার পর কেরাণী, ইনি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যয়ের হিসাব রাখেন। কর্ণধার তিনজন;-রাত্রে দুইজন কাৰ্য্য করেন এবং দিনে একজন। মালিক ও নাখোদাও অনেক সময়ে কর্ণধারের সাহায্য করিয়া থাকেন। পাঞ্জেরী, ইনি জাহাজের মাস্তুলের উপরে বসিয়া থাকেন এবং দূরে ঝড় আসিতেছে কি না, অন্য জাহাজ আসিতেছে কি না, বা তীর দেখা যাইতেছে কি না, তাহার সংবাদ লইয়া থাকেন। গুমটী, ইহারা জাহাজের খোলর জল সেচিয়া থাকে। গোলন্দাজ, ইহারা জাহাজের কামান ছোড়ে। এতদ্ব্যতীত সূত্রধর, কৰ্ম্মকার, চামার, দরজ জাহাজে কাজ করিয়া থাকে। বাঙ্গলার সপ্তগ্রাম বন্দরে নাখোদার বেতন মাসিক চারিশত টাকা, টাণ্ডেলের বেতন ১২০ টাকা, কেরাণীরা ৫০ টাকা, সারঙ্গের ২৫ টাকা, পাঞ্জেরীর ১৫ টাকা, গুটীর ১০ টাকা এবং থারাসীর বেতন ৪০ টাকা করিয়া নির্ধারিত আছে। ইহাদের আদর বেশী। কাম্বে, এচিন, মালাক্কা, পেস্ত, এই সকল স্থানে সপ্তগ্রামবন্দরের লোকের ন্যায় যোগ্যলোক না পাইলেও ভাল ভাল নাবিক-কাপ্তেন পাওয়া যায়। রাজ্যের সমস্ত বড় বড় নদীর খেয়াঘাটে পাটুনী ও একজন দারোগা নিযুক্ত আছে। সকলকে পার করিয়া দিবার নিয়ম আছে। পারের ব্যয়, একটা হস্তীর দুই দাম, ঘোড়া অৰ্দ্ধ দাম, মানুষ্য সিকিদাম। যাহারা সিকি দামও দিতে পারে না, তাহাদিগকে বিনা পয়সায় পার করা হয়। কাহারও সন্তরণ করিয়া পার হইবার ব্যবস্থা নাই। রাজ্যের নদী দিয়া মালামাল লইয়া গেলে কোন প্রকার মূল্য দিতে হয় না।
শীকার
বাদশাহ ব্যাঘ ও সিংহ শীকার করিতে বড়ই ভালবাসেন। সিংহ শীকার করিবার তিনটী ব্যবস্থা আছে। একটী–লোহার খাঁচা করিয়া তাহাতে জীবজন্তু মেষ বা ছাগ বাধিয়া রাখিতে হয়; খাঁচার দ্বার খোলা থাকে; খাঁচাটী পাতায় ঢাকা থাকে। সিংহ, ব্যাঘ্ৰ ক্ষুধার্ত হইয়া মেষ বা ছাগলকে ধরিতে আসিলে ফাঁদে পড়ে। তীর-ধনুকের ফাঁদও করা হয়। যেখান দিয়া সিংহ বা ব্যাঘ্র সচরাচর যাতায়াত করে, সেই স্থানে এমনভাবে ফাঁদ পাতিয়া রাখিতে হয় যে, সিংহ সেই পথ দিয়ে গমন করিলেই তাহার গলায় তীর লাগিয়া প্রাণত্যাগ করে। আর এক উপায় আছে;–যে পথে সিংহ সচরাচর যাতায়াত করে, সেই পথে বটের আঠা মাখাইয়া কচি ঘাস রাখা হয় এবং সেই ঘাসের নীচে দড়ীর ফাঁদ পাতিলা রাখা হয়। সিংহ কি ব্যাঘ্র সেই পথে গেলে ফাঁদে আটকাইয়া যায় এবং তাহাদের পায়ে আঠা জড়াইয়া যায়। বাদশাহ তীর দিয়াও সিংহ বধ করিয়া থাকেন। অনেক বড় বড় শীকারী তলোয়ার-হস্তে সিংহের সহিত যুদ্ধ করে। অনেক হিন্দু সিংহ পুষিয়া থাকে। এলাহাবাদের দক্ষিণে, বাঙ্গলার পশ্চিমদক্ষিণ প্রদেশ, গুজরাট গুহার প্রদেশে এবং মধ্যপ্রদেশে অমর কণ্টকের জঙ্গলে বহুসংখ্যক সিংহ আছে।
দ্বাদশ সুবার ইতিহাস
বাদশাহ আকবরের রাজত্বের চল্লিশের বৎসরে তাঁহার সমগ্র সাম্রাজ্য একশত পাঁচ সরকার বা বিভাগে বিভক্ত ছিল। এই সরকার বা বিভাগের অধীনে দুই হাজার সাতশত সাঁইত্রিশটী উপবিভাগ ছিল। এই সকল বিভাগের রাজস্ব বাদশাহ দশ বৎসরের জন্য স্থির নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছিলেন। সৰ্ব্বশুদ্ধ ৯০৭৪৩৮৮ টাঃ ২ আঃ ৫ পাই নির্দিষ্ট হইয়াছিল। প্রথম এই ব্যবস্থাই ছিল, তাহার পর এই সমস্ত বিভাগ ও উপরিভাগ দ্বাদশটী সুবার বিভক্ত হইয়াছিল এবং প্রত্যেক সুবা এক একজন সুবাদারের অধীনে ন্যস্ত হইয়াছিল। এই দ্বাদশটীসুবার নাম; এলাহাবাদ, আগ্রা, অযযাধ্যা, অজমীর, আহম্মদাবাদ, বিহার, বাংলা, দিল্লী, কাবুল, লাহোর, মূলতান এবং মালব। তাহার পর যখন বেরার, খাদেশ ও অহম্মদনগর পাদশাহের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়, তখন ঐ তিনটীও সুবার অন্তর্গত হয়; সুতরাং শেষে সৰ্বশুদ্ধ পনেরটী সুবায় পাদশাহের সমস্ত সাম্রাজ্য বিভক্ত হয়। এই সমস্ত সুবার বিশেষ বিবরণ এক্ষণে লিপিবদ্ধ করা যাইতেছে।
সুবে বাঙ্গলা
চট্টগ্রাম হইতে করহী পর্যন্ত সুবে বাঙ্গলার দৈর্ঘ্য চারিশত ক্রোশ এবং উত্তরে হিমালয় হইতে দক্ষিণে সরকার মহরণ পৰ্য্যন্ত বিস্তারে দুইশত ক্রোশ। পরে উড়িষ্যাপ্রদেশ এই সুবার অন্তর্ভুক্ত হইলে ইহার দৈর্ঘ্য তেতাল্লিশ ক্রোশ ও প্রস্থ কুড়ি ক্রোশ বৃদ্ধি হইয়াছিল। এই পরিমাণ ইংরাজী দুইমাইলে ক্রোশের হিসাবেই প্রদত্ত হইল।
সুবে বাঙ্গলার উত্তরে হিমালয় পর্বত, পূর্ব ও দক্ষিণে সমুদ্র এবং পশ্চিমে সুবে বিহার। সুই আফগান নামে এক সেনাপতি পূর্বদিকে ভাটী নামে একটী দেশ জয় করিয়া সুবে বাঙ্গলার অন্তর্ভুক্ত করেন; এই নব্যসংযুক্ত দেশের আম্রবৃক্ষসকল একজন মনুষ্যের ন্যায় দীর্ঘকায়; মনুষ্যের অপেক্ষা উচ্চ নহে। এই ভাটীদেশের সীমান্তেই ত্রিপুরার রাজার বিস্তৃতরাজ্য। এই দেশের রাজার নামে মাণিক্য উপাধি সংযুক্ত আছে এবং তাহাদের সকলের নামেই নারায়ণ’ শব্দ আছে। এই দেশের রাজার একসহস্র হস্তী ও দুই লক্ষ পদাতিক সৈন্য আছে; এ রাজ্যে অশ্বারোহী সৈন্য নাই বলিলেই হয়। সুবে বাঙ্গলার উত্তরপূর্বে কোচরাজ্য; এ রাজ্যে এক সহস্র অশ্বারোহী ও একলক্ষ পদাতি সৈন্য আছে। কামরূপ এই রাজ্যের অন্তর্নিবিষ্ট। কামরূপের অধিবাসিগণ অতি সুশ্রী এবং তাহারা ভোজবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী। এই স্থান সম্বন্ধে অনেক আশ্চৰ্য্য গল্প প্রচলিত আছে। এদেশে যে সকল পুষ্প জন্মে, তাহা তুলিয়া ঘরে রাখিয়া দিলে পাঁচ সাতমাস পৰ্য্যন্ত তাহার গন্ধ থাকে। কামরূপের নিকটেই আসামরাজ্য এই রাজ্যের রাজার অসীম ক্ষমতা। এই রাজ্যের রাজার মৃত্যু হইলে তাহার নিকট-আত্মীয় সকলকেই তাহার সহিত সমাহিত হইতে হয়। আসামের প্রান্তেই তিব্বতদেশ। তিব্বত মহাচীনদেশের পার্শ্বেই অবস্থিত। মহাচীনের রাজধানী খাঁ বালীঘ; এখানে একটী কৃত্রিম খাল আছে। গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডার এই খাল দিয়াই দেশের মধ্যে প্রবেশ করেন।
সুবে বাঙ্গলার দক্ষিণপূৰ্বে আরাকাণ রাজ্য, চট্টগ্রাম-বন্দর এই রাজ্যের অন্তর্গত। এই রাজ্যে যথেষ্ট হস্তী পাওয়া যায়, কিন্তু অশ্ব বড়ই মহার্ঘ্য। উষ্ট্র এবং গর্দভও একানে অধিকমূল্যে বিক্রীত হয়। এ দেশে গাভী বা মহিষ দেখিতে পাওয়া যায় না, এখানকার লোকে গাভী জাতীয় এক প্রকার জন্তুর দুগ্ধ ব্যবহার করে। এ দেশের লোক না হিন্দু, না মুসলমান। যমজ ভ্রাতা-ভগিনীর বিবাহ এ দেশে প্রচলিত আছে। মাতা-পুত্রে ব্যতীত আর সকলের সঙ্গে সকলের বিবাহ হইতে পারে। এ দেশের লোকে তাহাদের পুরোহিত ‘ওয়ালীর’ সম্পূর্ণ আজ্ঞাবহ। এখানকার রাজদরবারে স্ত্রীলোকেরা প্রহরী কাৰ্য্য করে, পুরুষেরা গৃহে বসিয়া থাকে। আরাকাণের নিকটই পেগু-দেশ। এই দেশে শ্বেতহস্তী পাওয়া যায়। এই দেশে অনেক বহুমূল্য প্রস্তর ও ধাতুর খনি আছে; সেই সকল খনি লইয়া ইহাদের সহিত আরাকাণবাসিগণের সর্বদাই ববাদ-বিসম্বাদ হইয়া থাকে।
বাঙ্গলাদেশের নাম পূৰ্ব্বে বঙ্গই ছিল; পরে আল শব্দ তাহাতে যুক্ত হয়। এই আল শব্দের অর্থ জল প্রতিরোধের বাঁধ। বঙ্গদেশে অনেক নিম্নভূমি আছে, সেখানে বাধ বা খাল বাঁধিতে হইত; সেই জন্য বঙ্গ শব্দের সহিত এই আল’ শব্দের যোগ হইয়া বাঙ্গাল শব্দ নিষ্পন্ন হইয়াছে। এই বাঙ্গাল শেষে বাঙ্গলাতে পরিণত হইয়াছে। বাঙ্গালাদেশের নাতিশীতোষ্ণ এপ্রিলমাসে বর্ষা আরম্ভ হয় এবং এই বর্ষা প্রায় ছয়মাস থাকে। এই সময়ে বাঁধগুলি ব্যতীত দেশের অধিকাংশই জলমগ্ন হইয়া যায়। এই প্রকারের জলমগ্ন থাকায় পূর্বে এই দেশের লোক নানাপ্রকার পীড়ায় কষ্ট পাইত; কিন্তু মহা-মহিম পাদশাহের রাজত্বসময়ে দেশের স্বাস্থ্যের অবস্থা অনেক ভাল হইয়াছিল। এপ্রিলমাস হইতেই এ দেশে মধ্যে মধ্যে ভয়ানক ঝড় হয়। সুবে বাঙ্গলায় অনেক নদী আছে। তাহার মধ্যে সর্বপ্রধান গঙ্গানদী; উৎপত্তিস্থান কেহই নির্ণয় করিতে পারেন না। হিন্দুরা বলেন যে, গঙ্গা মহাদেবের জটা হইতে বহির্গত হইয়াছে। উত্তর-হিমালয় হইতে নির্গত হইয়া গঙ্গা নদী সুবে দিল্লী, আগরা, এলাহাবাদও বিহারের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইয়া বঙ্গদেশে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। সরকার বরবকাদের অন্তর্গত কাজিহাটা সহরের নিকট হইতে গঙ্গার একটী শাখা বাহির হইয়া পদ্মাবতী নাম ধারণ পূর্বক চট্টগ্রামের নিকটে সমুদ্রে পতিত হইয়াছে। গঙ্গা, সরস্বতী ও যমুনার সঙ্গমস্থলকে হিন্দুরা ত্রিবেণী বলিয়া থাকেন এবং এই সকল স্থান তাহাদের নিকট পরম পবিত্র তীর্থ বলিয়া পৃজিত। গঙ্গা সহস্রশাখায় বিভক্ত হইয়া সাতগাঁয়ের নিকটে সমুদ্রে পতিত হইয়াছে। হিন্দু পণ্ডিতেরা এই সকল নদীর মহিমা বর্ণনা করিয়া অনেক গ্রন্থ লিখিয়াছেন; এই সকল নদী পরম পবিত্র বলিয়া তাঁহারা বিশ্বাস করেন এবং এই সকল নদীর কোন কোন স্থানকে তাঁহারা অধিকতর পবিত্র বলিয়া মনে করেন। বহু দূর হইতে লোকেরা আসিয়া এই গঙ্গাজল গৃহে লইয়া যায়। কারণ তাহাদের ক্রিয়াকলাপে এই জল বিশেষ দরকারী। গঙ্গাজল বড়ই স্নিগ্ধ এবং স্বাস্থ্যকর; এই জল অনেক বৎসর ঘরে রাখিলেও নষ্ট হইয়া যায় না। সুবে বাঙ্গলায় আর একটী বৃহৎ নদী আছে, তাহার নাম ব্রহ্মপুত্র। এই নদী মহাচীনদেশ হইতে উৎপন্ন হইয়া কোচরাজ্যের ভিতর দিয়া প্রবাহিত হইয়া সমুদ্রে পতিত হইয়াছে। সুবে বাঙ্গলার সমস্ত নদীর তীরেই নানাজাতীয় ধানের চাষ হয়; স্থানে স্থানে ভূমি এরূপ উৰ্ব্বরা যে একটী ধান্য বপন করিলে তাহা হইতে দুই তিন সের ধান্য উৎপন্ন হয়। অনেক জমীতে বৎসরে তিনটী করিয়া ফসল জন্মে। এখানকার জমীর এমন তেজ যে, যত জলই বৃদ্ধি হউক ধানের শীস তাহার উপরে থাকিবেই, সহজে ডুবিয়া যায় না। অভিজ্ঞ লোকের মুখে শুনিয়াছি যে, এই সকল শীস একরাত্রে ছয় হাত পর্যন্তও বাড়িয়া থাকে।
সুবে বাঙ্গলার অধিবাসিগণ রাজশাসনের বিশেষ বাধ্য; তাহারা আটমাসের মধ্যেই কিন্তীমত সরকারের খাজনা মিটাইয়া দেয়। এই সুবায় খাজনার টাকা আদায় হয়; অন্য সুবার ন্যায় কতক টাকা এবং অবশিষ্ট শস্যের দ্বারা আদায়ের নিয়ম প্রচলিত নাই। মহামহিম বাদশাহ এই সুবায় উপরোক্ত নিয়মই প্রচলিত রাখিয়াছেন। এ দেশের লোকের প্রধান খাদ্য ভাত ও মাছ; এখানকার লোকে যব গম স্বাস্থ্যকর খাদ্য বলিয়া মনে করেন না। ইহারা অর্পোলঙ্গ অবস্থায় থাকে, পরিধানে কেবল একখানিমাত্র ধুতি থাকে। এ দেশের স্ত্রীলোকেরা হাটেবাজারে বাহির হয়। এদেশের লোকেরা বংশনির্মিত ঘরে বাস করে; এক একখানি ঘর প্রস্তুত করিতে অনেক সময়ে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। যুদ্ধবিগ্রহ, গমনাগমন এবং মালপত্র স্থানান্তরে লইবার জন্য ইহারা নৌকা ব্যবহার করে। স্থলপথে গমনাগমনের জন্য ইহারা সুখাসন ব্যবহার করে। এই সুখাসন চতুর্দোলার মত, ইহার উপরে রৌদ্র-বৃষ্টি-নিবারণের জন্য বস্ত্রাবরণ থাকে; এই সুখাসন বাহকগণ স্কন্ধে করিয়া বহিয়া লয়। ইহাতে উপবেশন ও শয়নের যথেষ্ট স্থান থাকে। কেহ কেহ হস্তী-আরোহণেও স্থানান্তরে যাতায়াত করে; অশ্ব প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায় না। এই সুবার কোন কোন স্থানে পাটের দ্বারা এমন কার্পেট নির্মিত হয় যে, তাহা দেখিলে সেগুলি রেশমের নির্মিত বলিয়া বোধ হয়। এখানকার লোক অতিশয়। লবণপ্রিয়। হীরক, মণি, মুক্তা প্রভৃতি অন্যান্য দেশ হইতে এখানে আমদানী হয়। এ দেশে প্রচুরপরিমাণে ফল ও পুষ্প জন্মে। এদেশের লোক অধিক পরিমাণে তাম্বুল ব্যবহার করে।
জিন্নতাবাদ বহু পুরাতন সহর। ইহা একসময়ে বাঙ্গদেশের রাজধানী ছিল। ইহাকে লোকে পূৰ্ব্বে লক্ষ্মণাবতী বলিত; কতকদিন এই সহর গৌড় নামেও অভিহিত হইয়াছিল। মৃত সম্রাট এই স্থানের নাম জিন্নতাবাদ রাখিয়াছিলেন। এখানে একটী প্রকাণ্ড দুর্গ আছে; এই দুর্গের পূর্বপার্শ্বেই ছাঁটিয়া-পটিয়া একটা বৃহৎ জলাশয় আছে। বর্ষাকালে হঠাৎ যদি বাঁধ ভাঙ্গিয়া যায়, তাহা হইলে সমস্ত শহরটী জলমগ্ন হইয়া যায়। দুর্গ হইত একক্রোশ উত্তরে একটী বহু পুরাতন প্রাসাদ আছে; এখানে একটী জলাশয় আছে তাহার নাম পিয়াজবাড়ী। কোন অপরাধীর প্রাণদণ্ডাজ্ঞা হইলে তাহাকে এই গৃহে বন্ধ করিয়া রাখা হইত এবং সে তৃষ্ণার জ্বালায় অধীর হইয়া এই পিয়াজবাড়ীর দূষিত জল পান করিয়া শীঘ্রই মৃত্যুমুখে পতিত হইত। দয়াবান্ বাদশাহ এই প্রকার নৃশংস শাস্তি উঠাইয়া দিয়াছেন। মহম্মদাবাদে একটী দুর্গ আছে। এই দুর্গ জলাভূমিতে পরিবেষ্টিত। যখন শের খা এই দেশ জয় করেন, সেই সময়ে অনেকগুলি হস্তী মহম্মদাবাদের জঙ্গলে আশ্রয় লয়; সেই সময় হইতে এখানকার জঙ্গলে প্রচুর হস্তী রহিয়াছে। মরিচ উৎপন্ন হয়। খনিফাতাবাদ সরকারেও অনেক হস্তী আছে এবং এখানেও মরিচ জন্মে। বাকলা সরকার সমুদ্রতীরে অবস্থিত; এখানকার দুর্গ বৃক্ষশ্রেণীর মধ্যে নির্মিত। এখানে সমুদ্রজল শুক্ল প্রতিপদের দিন হইতে বাড়িতে আরম্ভ হয় এবং চতুর্দশী পৰ্য্যন্ত বাড়িতে থাকে; তাহার পর হইতে চান্দ্রমাসের শেষদিন পর্যন্ত কমিতে থাকে। বর্তমান পাদশাহের রাজত্বের ঊনবিংশ বৎসরে, একদিন অপরাহু তিনটার সময়ে সমুদ্রের জল বাড়িতে আরম্ভ হয়; অল্পক্ষণের মধ্যেই এমন জলপ্লাবন হয় যে, সমস্ত বাকলা সরকার জলমগ্ন হইয়া যায়। বাকলার রাজা সেদিন একস্থানে নিমন্ত্রণ গিয়াছিলেন। সমুদ্রের জল ক্রমাগত বৃদ্ধি হইতেছে দেখিয়া তিনি একখানি নৌকায় আরোহণ করেন। রাজপুত্র পরমানন্দরায় কতকগুলি অনুচরসহ একটী উচ্চ মন্দিরের চূড়ায় আরোহণ করেন। সওদাগরগণ যেখানে একটু উচ্চভূমি পাইল, সেই স্থানেই আশ্রয় গ্রহণ করিল। ক্রমাগত পাঁচ ঘণ্টা ভয়ানক ঝড়বৃষ্টি ও অশনিপাত হইয়াছিল, সমুদ্রও উত্তাল তরঙ্গ তুলিয়া সমস্ত রাজ্য গ্রাস করিয়া ফেলিয়াছিল; ঘর-বাড়ী সমস্ত ভাঙ্গিয়া চুরিয়া স্রোতের বেগে, প্রবলবায়ুর প্রকোপে কোথায় চলিয়া গেল। কেবলমাত্র দেবমন্দির ব্যতীত আর কিছুরই চিহ্ন রহিল না। প্রায় দুইলক্ষ প্রাণী জীবন বিসর্জন করিল।
ঘোড়ঘাট সরকারে যথেষ্ট পরিমাণে রেশম ও গণিবস্তা পাওয়া যায়। এইস্থান ফলের জন্য প্রসিদ্ধ; এখানকার লকেটফল সর্বোৎকৃষ্ট। বারবকাবাদ সরকারে গঙ্গাজল নামে একপ্রকার অতি উৎকৃষ্ট বস্ত্র প্রস্তুত হয়; এখানে অতি সুস্বাদু কমলা লেবু জন্মে। বাজুহা সরকারে নৌকা ও কড়িবরগা নির্মাণোপযোগী কাষ্ঠ প্রচুর পরিমাণে জন্মে। এই সরকারের অন্তর্গত একটী স্থানে লৌহের খনি আছে। সোনারগাঁ সরকারে কাসা নামে একপ্রকার বস্ত্র নির্মিত হয়; এই সরকারের মধ্যে কাটার সুন্দর নামে একটী গ্রাম আছে; সেখানে একটী জলাশয় আছে, সেই জলাশয়ের জলে মলিনবস্ত্র ধৌত করিলে তাহা তৎক্ষণাৎ শুভ্রবর্ণ ধারণ করে। শ্রীহট্ট সরকার বড়ই পৰ্বতময় স্থান; এখানে অনেক খোঁজা ক্রীতদাসদাসী পাওয়া যায়। এখানে সন্তারা নামে কমলার মত একপ্রকার সুমিষ্ট ফল পওয়া যায় এখানে যথেষ্ট পরিমাণে একরূপ ফল পাওয়া যায়; ইহা এস্থানের লোকেরা চিনিত না, অল্পদিন হইল একজন তাতারদেশয়ি লোক ইহার গুণ প্রকাশ করিয়াছেন। এই স্থানের পর্বত প্রদেশেও ঐরূপ একপ্রকার ফল পাওয়া যায়। বর্ষার শেষে এদেশের গাছ কাটিয়া মাটীতে ফেলিয়া রাখে; কিছুদিন পরে পচা অংশ ফেলিয়া দিয়া সারাংশ গ্রহণ করে। এখানকার জঙ্গলে বনরাজ নামে একপ্রকার অতিসুন্দর পাখী আছে, ইহারা অতি সহজেই যে কোন জন্তুর স্বর অনুকরণ করিতে পারে। শিবগঞ্জ নামে আর এক প্রকার সুদৃশ্য পাখীও এই জঙ্গলে দেখিতে পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম একটী সুবৃহৎ শহর, ইহা সমুদ্রতীরে ঘন বিন্যস্ত বৃক্ষশ্রেণীর মধ্যে অবস্থিত। এখানে অনেক খৃষ্টান ও অন্যান্য দেশীয় সওদাগর ব্যবসা-বাণিজ্যের উপলক্ষে বাস করে। সেরিফাবাদ শহরে বৃহকায় শ্বেতবর্ণের বলীবর্দ্ধ পাওয়া যায়; ইহাদের শরীরের এতদূর সামর্থ্য যে, ইহারা পনর মণ বোঝা অনায়াসে বহিয়া লইয়া যাইতে পারে। বোঝা লইবার সময়ে ইহারা হস্তীর ন্যায় পা ভাঙ্গিয়া বসিয়া থাকে। এই স্থান বড় বড় ছাগল ও কুকুরের জন্য বিখ্যাত। সাতগা ও হুগলী দুইটী প্রধান বাণিজ্যস্থান; এই উভয় স্থানের মধ্যে ব্যবধান এক মাইল মাত্র। এই উভয় স্থানই ইউরোপীয়দিগের অধিকৃত। মদুরান সরকারের মধ্যে হান্যে নামক স্থানে একটী হীরকের খনি আছে; এই খনি হইতে অতি অল্প পরিমাণেই প্রস্তর পাওয়া যায়।
উড়িষ্যা
এই দেশ পূর্বে স্বাধীন ছিল। তাহার পর ইহা সুবে বাঙ্গলার অন্তর্ভুক্ত হয়। এ দেশের জলবায়ু অতিশয় স্বাস্থ্যকর। উড়িষ্যা পাঁচ বিভাগে বিভক্ত;~-জলেশ্বর, দ্রক, কটক, কল্যাণদণ্ডপদ ও রাজমহেন্দ্র। এ পাঁচটী সরকারই এখন বাঙ্গলাদেশ-ভুক্ত হইয়াছে। উড়িষ্যাদেশে এক শত ঊনত্রিশটী ইষ্টকনিৰ্মিত দুর্গ আছে; এই সকল দুর্গ গজপতিগণের অধীন। এ দেশে আটমাস বর্ষা, তিনমাস শীত এবং একমাস গ্রীষ্মের প্রকোপ থাকে। এখানে অধিক পরিমাণে চাউল উৎপন্ন হয়। অন্ন মৎস্য এবং শাক-সবজীই এ দেশের লোকের প্রধান খাদ্যদ্রব্য। এ দেশের লোক গরম ভাতে জল দিয়া পরদিন আহার করে। এ দেশের লোক বড়ই ভীরু। তাহারা সকলেই অলঙ্কারপ্রিয় এবং স্ত্রী পুরুষ সকলেই চন্দনতৈল গাত্রে মর্পন করে। স্ত্রীলোকেরা অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় তাকে। তাহারা তেওয়ারগাছের পত্রনির্মিত কুটীরে বাস করে। এখানে প্রস্তরনির্মিত অনেক উচ্চ উচ্চ দেবমন্দির আছে। এ দেশের স্ত্রীলোকেরা দুই তিনবার বিবাহ করে। এখানে কাগজ কলম-কালির ব্যবহার নাই, তালপত্রের উপরে লৌহনির্মিত লেখনীর দ্বারা ইহারা লিখে। এখানে ভাল ভাল কাপড় প্রস্তুত হয়। উড়িষ্যাদেশে প্রচুর পরিমাণে উৎকৃষ্ট ফল জন্মে। এখানে কেওড়া এবং পান সৰ্ব্বত্রই পাওয়া যায়। এ দেশে কড়ির প্রচলন আছে। চারি কড়িতে এক গণ্ডা হয়, পাঁচ গণ্ডায় এক বুড়ি, চারি বুড়িতে এক পণ, খোল পথে এক কাহন এবং দশ কাহনে এক টাকা।
কটক
কটক উড়িষ্যার রাজধানী। এখানে মহানদী এবং টানজুরী এই দুই নদীর মধ্যস্থলে একটী প্রকাণ্ড প্রস্তরনির্মিত দুর্গ আছে। এই দুর্গের মধ্যে অনেক সুদৃশ্য প্রাসাদ আছে। এই স্থলেই দেশের শাসনকর্তা বাস করেন। এই দুর্গের চারি পার্শ্বে পাঁচ ক্রোশ ব্যাপিয়া স্থান এত নিম্নভূমি যে, বর্ষাকালে সমস্ত অংশ জলে ডুবিয়া থাকে। কটকে রাজা মুকুন্দদেব নির্মিত নয়তলা একটী রাজপ্রাসাদ আছে। সর্বনিম্নতলায় হস্তী, উষ্ট্র ও অশ্বাদি বাস করে। দ্বিতলে যুদ্ধসম্বন্ধীয় দ্রব্যজাত ও তাহার রক্ষকগণ বাস করে। ত্রিতলে পিয়াদা ও অন্যান্য প্রহরীগণ থাকে। চতুর্থতলে নানা প্রকারের শিল্পীগণ বাস করে। রন্ধনশালা পঞ্চমতলে অবস্থিত। ষষ্ঠতলে রাজার সভাগৃহ। সপ্তমতল গোপনীয় কার্য নির্বাহের জন্য নির্দিষ্ট আছে। অষ্টমতল অন্দরমহল এবং নবমতলে রাজা স্বয়ং অবস্থান করেন।
সমুদ্রতীরে পুরুষোত্তম-সহরে জগন্নাথের মন্দির বিরাজিত। এই মন্দিরে চারি হাজার বৎসরের পুরাতন চন্দন কাষ্ঠনির্মিত কৃষ্ণ বলরাম ও তাহাদের ভগ্নী সুভদ্রার মূর্তি স্থাপিত আছে। কথিত আছে যে, নীলকরপৰ্ব্বতের মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজধানী নির্মাণের জন্য কোন উৎকৃষ্ট স্থান নির্ণয় করিবার অভিপ্রায়ে একজন ব্রাহ্মণকে প্রেরণ করেন। ব্রাহ্মণ বহু অনুসন্ধানে এই স্থানে মনোনীত করেন। কিন্তু তাহার মনে দ্বিধা উপস্থিত হয়। এই স্থান স্থির করিবেন কি আরও অগ্রসর হইয়া অন্য কোন স্থান দেখিবেন, এই চিন্তা ব্রাহ্মণের মনে উদিত হয় এমন সময়ে তিনি দেখিলেন যে, একটী কাক সমুদ্রে স্নান করিয়া উপরে উঠিয়া সমুদ্রকে প্রণাম করিল। ব্রাহ্মণ এই দৃশ্য দেখিয়া আশ্চৰ্য্য বোধ করিলেন। তিনি কাককে প্রণাম করিয়া কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। কাক উত্তর করিলেন, “আমি দেবাংশসস্তৃত, কোন এক মুনির অভিশাপে আমি এই কাকদেহ ধারণ করিয়াছি। এই স্থান পরম পবিত্র। যদি কেহ এখানে বাস করে এবং একান্ত মনে ভগবানের আরাধনা করে, তাহা হইলে তাহার নিশ্চয়ই উন্নতি হইবে। আমি বহুদিন হইতে এখানে বসিয়া আছি। আমার শাপাবসানের সময়ও আসিয়াছে। তোমার যদি ধর্মে মতি থাকে, তাহা হইলে এই স্থানে কিছুদিন অবস্থান কর; তাহা হইলে এই স্থানের মাহাত্ম্য অবগত হইতে পারিবে।” কাকের কথা শুনিয়া ব্রাহ্মণ সেই স্থানেই দিনকয় অবস্থান করিয়া স্থান মাহাত্ম্য দর্শন করিলেন। তৎপর রাজার নিকটে গমন করিয়া সমস্ত নিবেদন করিলে রাজা ঐ স্থানে এক বিশাল পুরী নিৰ্মাণ করিলেন। রাত্রে রাজা স্বপ্ন দেখিলেন, কে যেন বলিতেছে, “অমুক দিনে অমুক সময়ে সমুদ্রের তীরে বাহান্ন ইঞ্চি লম্বা এবং দেড় হাত প্রশস্ত একখানি কাষ্ঠ ভাসিতে দেখিবে। সেই কাষ্ঠখণ্ড তুলিয়া আনিয়া সাতদিন পরে গৃহ খুলিয়া যে মূৰ্ত্তি পাইবে, তাহাই মন্দিরে স্থাপিত করিয়া পূজা করিবে।” যথাসময়ে মূর্তি পাওয়া গেল। রাজা মহা সমারোহে দেবপ্রতিষ্ঠা করিলেন। শুনিতে পাওয়া যায়, সুলেমান গুরজানির সেনাপতি বিখ্যাত কালাপাহাড় উড়িষ্যা জয় করিয়া জগন্নাথের মূৰ্ত্তি অগ্নিতে নিক্ষেপ করেন; কিন্তু অগ্নি দেবমূৰ্ত্তি দগ্ধ করিতে পারে না। পরে ঐ মূত্তি সাগরজলে নিক্ষেপ করেন। তৎপরে উড়িষ্যার রাজগণ পুনরায় সেই মূৰ্ত্তি পান। এ সম্বন্ধে নানা প্রকার অবিশ্বাস্য গল্প প্রচলিত আছে। ব্রাহ্মণেরা প্রতি দিন জগন্নাথদেবকে দুইবার স্নান করান। প্রত্যেকবারেই নূতন বস্ত্র পরাইয়া দেওয়া যায়। ছাপ্পান্নাজন ব্রাহ্মণ নানাবিধ খাদ্যদ্রব্য দেবসম্মুখে উপস্থিত করেন। এই সমস্ত দ্রব্যের পরিমাণ এত অধিক যে, তদ্বারা বিংশতি সহস্র লোকের দৈনিক আহার চলিতে পারে। প্রতি বৎসর ষোলচাকাওয়ালা রথে একবার করিয়া জগন্নাথকে চড়ান হয়। এই রথের দড়ি ধরিয়া টানিলে হিন্দুগণের সমস্ত পাপ দূর হয়। জগন্নাথ মন্দিরের নিকটে সূর্যের মন্দির আছে। এই মন্দির নির্মাণ করিতে উড়িষ্যাদেশের দ্বাদশ বৎসরের রাজস্ব ব্যয়িত হয়। এমন উৎকৃষ্ট কারুকার্য্য আর কোন মন্দির দেখিতে পাওয়া যায় না। এই সকল মন্দির পঞ্চাশ হাত উচ্চ এবং ঊনিশ হাত চওড়া দেওয়ালে বেষ্টিত। তিনটী প্রবেশদ্বার আছে। পূৰ্ব্বদিকের দ্বারে দুইটী প্রকাণ্ডকায় হস্তীর মূর্তি আছে; পশ্চিমদ্বারে দুই অশ্বারোহীর মূর্তি এবং উত্তরদ্বারে নিহত হস্তীর উপরে উপবিষ্ট দুইটী ব্যাঘমূৰ্ত্তি আছে। সিংহদ্বারের সম্মুখে কৃষ্ণপ্রস্তরনির্মিত পঞ্চাশ হাত উচ্চ একটী স্তম্ভ আছে। এই স্তম্ভে নানা প্রকার মূর্তি খোদিত আছে; ইহা সাতশত ত্রিশ বৎসর পূর্বে নির্মিত হইয়াছিল। রাজা নরসিংহদেব ইহা নিৰ্মাণ করিয়া অতুল গৌরবের অধিকারী হইয়াছেন। জগন্নাথ ও সূর্যের মন্দির ব্যতীত আরও আটাশটি মন্দির আছে। অনেকে বলেন যে, এইখানে কবির মাওহেদের সমাধি হইয়াছিল। অদ্যাপিও তাঁহার সম্বন্ধে নানা গল্প শুনিতে পাওয়া যায়। তার গভীরজ্ঞান ও ধর্মনিষ্ঠার জন্য হিন্দু ও মুসলমান উভর জাতিই তাহাকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করিত। তাঁহার মৃত্যু হইলে হিন্দুগণ তাহার মৃতদেহ ভস্মীভূত এবং মুসলমানগণ কবরস্থ করিতে চাহে; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, মৃতদেহের আবরণবস্ত্র উঘাঠিত করিয়া দেখা গেল, মৃতদেহ নাই।
সুবে বাঙ্গালায় চব্বিশটি সরকার এবং সাতশত তিরাশীটি মহল আছে। এই সুবার নির্দিষ্ট রাজস্ব ১৪১৬১৪৮২ টা, ১৫ আ. ২ পাই এবং জমীদারেরা ২৩৩৩০ জন অশ্বারোহী, ৮০১১৫৮ জন পদাতি, ১৭০টী হস্তী, ৪২৬০টী কামান এবং ৪৪০০টি নৌকা সম্রাটকে দিতেন।
সুবে বাঙ্গালার রাজগণ
এই পুস্তক লিখিত হইবার ৪০৯৬ বৎসর পূর্বে রাজা দুৰ্য্যোধনকে মহাভারতের মহা যুদ্ধে সাহায্য করিতে দিল্লীতে আসিয়া রাজা ভগীর মৃত্যুমুখে পতিত হয়। রাজা নিওর মৃত্যু হইলে লক্ষ্মণের পুত্র লাক্ষ্মণেয় সিংহাসনে আরোহণ করেন। সেই সময়ে নদীয়া বাঙ্গালাদেশের রাজধানী ছিল। এই স্থান বহু পণ্ডিতের আবাসভূমি বলিয়া বিখ্যাত। দৈবজ্ঞগণ রাজা লাক্ষ্মণেয়কে বলিয়াছিলেন যে, তিনি রাজ্যচ্যুত হইবেন এবং তাহার রাজ্য অপর এক জাতির হস্তগত হইবে। বক্তিয়ার খিলিজিই এই নূতন রাজ্য সংস্থাপন করিবেন। এই সময়ে সাহাবুদ্দীন তাঁহার সেনাপতি কুতবুদ্দীনকে হিন্দুস্থানে প্রেরণ করেন। কুতুবের সেনাপতি বক্তিয়ার খিলিজি বিহারদেশ জয় করিয়া বাঙ্গলাদেশ অভিমুখে অগ্রসর হন। রাজা লাক্ষ্মণেয় নৌকায় চড়িয়া পলায়ণ করেন। বক্তিয়ার রাজধানী নদীয়া ধ্বংস করিয়া লক্ষ্মণাবতীতে বাঙ্গালার রাজধানী স্থাপন করেন। সেই সময় হইতেই বাঙ্গালাদেশ দিল্লীর শাসনাধীন হয়। তোগলক খাঁর রাজত্ব সময়ে কদর খা বাঙ্গালার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। ফকীরউদ্দীন নামে একজন বিদ্রোহী হইয়া কদর খুঁকে নিহত করিয়া নিজেই বঙ্গ-সিংহাসন অধিকার করে এবং দিল্লীর বশ্যতা অস্বীকার করে। কদর খার সেনাপতি মল্লিক আলি মোবারক আলাহেদ্দান নাম ধারণ পূৰ্ব্বক ফকীরের বিরুদ্ধে উত্থিত হন এবং সম্মুখযুদ্ধে ফকীরকে হত করিয়া নিজেই রাজা হন।
তাহার পর হাজি আলিয়াস ইলাহি নামে বাঙ্গালাদেশের একজন সঙ্গতিশালী ব্যক্তি আরও কয়েকজন বড়লোকের সহিত ষড়যন্ত্র করিয়া আলাহাউদ্দীনকে নিহত করেন এবং নিজে সমসুদ্দীন নাম ধারণ করিয়া সিংহাসন অধিকার করেন। এইবার দিল্লী হইতে সুরনান ফিরোজ সমসুদ্দীনের শাস্তিবিধানের জন্য বাঙ্গালাদেশে আগমন করেন, সামান্য দুইএকটা যুদ্ধও হয়; অবশেষে বর্ষাঋতু সমাগত হওয়ায় সমসুদ্দীনের সহিত সন্ধিবন্ধন করিয়া ফিরোজ শা দিল্লীতে চলিয়া যান। সমসুদ্দীনের মৃত্যুর পর তাহার পুত্র সেকন্দর শা পিত-সিংহাসনে আরোহণ করেন, ইহার সহিতও ফিরোজশাহের সন্ধি হয়। সেকন্দরের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র গয়াসুদ্দীন সিংহাসন পান। ইনি কংস নামে একজন হিন্দু জমীদারের নিকট পরাজিত হন; কংস সিংহাসন অধিকার করেন। কংসের পুত্র মুসলমানধৰ্ম্ম অবলম্বন পূৰ্ব্বক জেলালউদ্দীন নামে রাজত্ব করেন। ইহার পর ফিরোজ শা, মহম্মদ শা, নসীব শা বাঙ্গলাদেশে রাজত্ব করেন। যখন সুলতান ইব্রাহিম সম্রাট বাবরের হস্তে নিহত হন, তখন ইব্রাহিমের ভ্রাতা ও আত্মীয়গণ বাঙ্গলাদেশে নসীব শাহের শরণাপন্ন হন। বাদশাহ হুমায়ুন জাহাগীর কুলী খাঁ বেগকে বাঙ্গলাদেশের শাসনভার প্রদান করেন; কিন্তু যখন বাদশাহ হুমায়ুন কয়েক বৎসরের জন্য শেরশাহ কর্তৃক তাড়িত ইন, সেই সময় শের শা এই জাহাগীর কুলি খাঁ বেগকে প্রথমে অভয়প্রদান পূর্বক শেষে নিহত করেন। যখন সেলিম খাঁ দিল্লীর সম্রাট, সেই ময়ে মহম্মদ খাঁ নামে সম্রাটের একজন কুটুম্ব বিশেষ ন্যায়পরতার সহিত বাঙ্গলাদেশ শাসন করেন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে সমরেজ খর হস্তে নিহত হইলে খিজির খা সিংহাসনে আরোহণ করেন। ইনি সিংহাসনপ্রাপ্তির পর বাহাদুর শা নাম ধারণ করেন, সমরেজ খাঁ ইহার হস্তে নিধন হন। ইহাই সে সময়ের সংক্ষেপ ইতিহাস।
বাঙ্গালাদেশের হিন্দুরাজও মুসলমান শাসনকর্তৃগণের তালিকা
প্রথম তালিকা–ক্ষত্রিয়জাতীয় ভগীরথের বংশে ২৪ জন রাজা ২৪৮ বৎসর রাজত্ব করেন। যথা–ভগীরথ ২১৮, অনঙ্গভীম ১৭৫, রণভীম ১০৮, গজভীম ৮২, দেবদত্ত ৯৫, জগসিং ১০৬, ব্রহ্মসিং ৯৭, মোহন দত্ত ১০২, বিনোদ সিং ৯০, সেলারসেন ৯৬, সুতাজি ১০১, ভূপতি ৯০, শূদ্রক ৯১, জীদ্রক ১ ২, উদয়সিং ৮৫, বিশ্বসিং ৮৮, বীরনাথ ৮১, রুকদেব ৮৩, রুকন ৭৯, যোগজীবন ১০৭, কালুদত্ত ৮৫, কামদেব ৯০, বিজয় কিরণ ৭১, সসিং ৮৯ বৎসর।
দ্বিতীয় তালিকা–কায়স্থজাতীয় ভোজগৰ্ব্ব রাজারবংশ; এই বংশের ৯ জন রাজা ৫১০ বৎসর রাজত্ব করেন। তোজগর্ব ৭৫, লাগসেন ৭০, রাজামাধব ৫৭, সুমন্তভোজ ৪৮, জগত ৬০, প্রতই ৫২, গরুড় ৪৫, লক্ষ্মণ ৫০, নন্দভোজ ৫৩ বৎসর।
তৃতীয় তালিকা—আদিশূরের বংশ, এই বংশে ১১ জন রাজা ৭১৪ বৎসর রাজত্ব করেন। আদিশূর ৭৫, জমেনিবান ৭৩, অনিরুদ্ধ ৭৮, প্রতাপরুদ্র ৬৫, ভবদত্ত ৬৯, রেকদেব ৬২, গিরিধর ৮০, পৃথুিধর ৬৮, সৃষ্টিধর ৫৮, গিরিবর ৬৩, এবং জয়ধর ২৩ বছর।
চতুর্থ তালিকাভূপালরাজার বংশ, এই বংশে দশজন রাজা ৬৯৮ বৎসর রাজত্ব করেন। ভূপাল ৫৪, ধীরপাল ৯৫, দেবপাল ৮৩, বৌপুতপাল ৭০, ধনপৎপাল ৪৫, বিজনপাল ৭৫, জয়পাল ৯৮, রাজপাল ৯৮, ভোগপাল ৫, যোগপাল ৭৪ বৎসর।
পঞ্চম তালিকা–সুখসেন রাজার বংশ। এই বংশে সাতজন রাজা ১৬০ বৎসর রাজত্ব করেন। সুখসেন ৩, বল্লালসেন (গৌড়স্থাপয়িতা) ৫০, লক্ষ্মণসেন ৭, মধুসেন ১০, কেশবসেন ১৫, শুদ্ধসেন, ১৮ নাওজে ৩ বৎসর।
৬১ জন হিন্দু রাজা ৪৫৪৫ বৎসর রাজত্ব করিলে পর বাঙ্গালাদেশ দিল্লীর অধীন হয়। সুলতান কুতবউদ্দীনের সময় হইতে সুলতান মহম্মদ তোগলক খার সময় পর্যন্ত ১৭ জন রাজা ১৫০ বৎসর রাজত্ব করেন।
ষষ্ঠ তালিকা–তোগলক খার সময় হইতে বাঙ্গলার মুসলমান শাসনকর্তা;–মল্লিক ফকিরুদ্দীন নিলাদার ২ বৎসর কয়েকমাস, সুলতান আলাহেদ্দীন ১ বৎসর কয়েকমাস, সমসুদ্দীন বাগৃগেরা ১৬ বৎসর কয়েকমাস, সেকন্দার (পুত্র) ৯ বৎসর কয়েকমাস, সুলতান গেয়াসুদ্দীন (পুত্র) ৭ বৎসর কয়েকমাস, সুলতান উলপ্তগীন (পুত্র) ১০, সমসুদ্দীন (পুত্র) ৩, কংসভৌমিক ৭, সুলতান জালালুদ্দীন ১৭, সুলতান আমেদ (পুত্র) ৬, নাহের (কৃতদাস), কেহ বলেন একসপ্তাহ, কেহ বলেন কয়েকঘণ্টা। নাসির শা (সেমসুদ্দীনের পৌত্র) ২, বারবাগসা ১৭, ইউসর শা ৭ বৎসর ৬ মাস, সেকন্দার শা অর্ধদিন, ফতে শা ৭ বৎসর ৫ মাস, বারবক্ শা ২ দিন, ফিরোজ শা ৩ বৎসর, মহম্মদ শা (পুত্র) ১, মজফর ৩ বৎসর ৫ মাস, আলাহদ্দিন ২৭ বৎসর কয়েকমাস, নসির শা ১১ বৎসর, সের খা, হুমায়ুন, সের খা, (পুনৰ্ব্বার) মহাম্মদ খা, বাদুর শা, জেলালুদ্দিন, গিয়াসুদ্দীন, তাজে খ, সুলেমান, বাইজিদ, দাউদ।
সুবে বিহার
সুবে বিহার দৈর্ঘ্যে গাহি হইতে রোটাস পৰ্য্যন্ত ১২০ ক্রোশ এবং প্রস্থে ত্রিহুত হইতে উত্তরের পর্বতমালা পর্যন্ত ১১০ ক্রোশ। ইহার উত্তর এবং দক্ষিণে পৰ্বত, পূৰ্ব্বে সুবে বাঙ্গালা এবং পশ্চিমে সুবে এলাহাবাদ ও অযোধ্যা। গঙ্গা এবং শোন এই প্রদেশের প্রধান নদী। শোণ, নর্মদা এবং চিলন করার নিকট একই স্থান হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। শোণনদীর জল শীতল, সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর। ইহা গঙ্গায় আসিয়া পড়িয়াছে। গণ্ডকনদী হিমালয় হইতে বহির্গত হইয়া হাজিপুরের নিকট গঙ্গায় পড়িয়াছে। গণ্ডকের জলপান করিলে গলগণ্ড হয়। শোণনদীতে শালগ্রামশিলা প্রচুরপরিমাণে পাওয়া যায়। এই শালগ্রামশিলা হিগণের নিকট পরম পবিত্র পদার্থ বলিয়া পূজিত, ইহাকে তাহারা নারায়ণের অবতার বলিয়া পূজা করে। কৰ্মনাশা নদী চৌসার নিকট দিয়া প্রবাহিত হইয়া গঙ্গায় আসিয়া পতিত হইয়াছে। পুনপুন নদী দক্ষিণদিক হইতে আসিয়া পার্টনার নিকট গঙ্গায় মিশিয়াছে। এতদ্ব্যতীত এই সুবার মধ্যে আরও অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদী আছে। এ প্রদেশে গ্রীষ্ম অত্যন্ত অধিক হয়; শীতের প্রকোপ তত বেশী বোধ হয় না, এখানে ছয়মাস বর্ষা থাকে। এ প্রদেশের ভূমি এমন কঠিন যে, গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড রৌদ্রের তাপে ও ভয়ানক ঝড়ের সময়েও ধূলি উড়িতে দেখা যায় না। এ প্রদেশে যথেষ্ট শস্য জন্মে। এখানকার ন্যায় নানাবিধ উৎকৃষ্ট চাউল আর কোন স্থানেই জন্মে না। এ প্রদেশে যথেষ্ট খেসারী জন্মে, ইহা একপ্রকার দাইল, সাধারণ লোকে এই দাইল ব্যবহার করিয়া থাকে। এখানে প্রচুর পরিমাণে ইক্ষুর চাষ হইয়া থাকে। এখানে দুগ্ধ যথেষ্ট পাওয়া যায় এবং মূল্যও খুব সস্তা। এখানকার কৃষকেরাও উৎপন্ন দ্রব্যের অংশ দিয়া রাজস্ব পরিশোধ করে না, এখানে টাকার দ্বারাই রাজস্ব দেওয়া হয়। এদেশের লোক টালি-দেওয়া গৃহে বাস করে, এখানে উৎকৃষ্ট নৌকা নির্মিত হয়। অশ্ব বা উট এখানে মিলে না। পায়রা ও ছাগলের জন্য বিহারপ্রদেশ বিখ্যাত, এদেশের ছাগ এত স্থূলকায় হয় যে, তাহারা নড়িতে চড়িতে পারে না। এই স্থানে কাঁচের কারখানা আছে। রাজগড় বিহারের অন্তর্গত, এখানে মার্বেলের মত এক-প্রকার প্রস্তর পাওয়া যায়; এখানে উৎকৃষ্ট কারখানা আছে। হিন্দুর প্রধান তীর্থস্থান সুবে বিহারের মধ্যে অবস্থিত; ইহাকে হিন্দুরা ব্ৰহ্মগয়া কহে। মূঙ্গেরে একটী প্রকাণ্ড প্রস্তরনির্মিত দেওয়াল আছে; এই দেওয়াল গঙ্গার তীর হইতে পৰ্বত পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত এবং ইহাই বাঙ্গালা ও বিহারের সীমা-পরিজ্ঞাপক। হাজিপুরে বড় বড় কাঁঠাল হয়; এক একটী কাঁঠাল এত বড় হয় যে, ভারি জোয়ানপুরুষেও একটী তুলিতে পারে না। চাম্পারণে একপ্রকার শস্য উৎপন্ন হয়, তাহার নাম মাস। এই শস্য বপনের জন্য জমীচাষ বা অন্য কোন বিষয়ে পরিশ্রম করিতে হয় না। ত্রিহুত হিন্দুপণ্ডিতগণের আবাসস্থান বলিয়া বহুকাল হইতে প্রসিদ্ধ; এ স্থানের জলবায়ু স্বাস্থ্যকর। এখানকার লোকে কি এক উপায়ে এক বৎসরকাল পর্যন্ত দধি রক্ষা করিতে পারে। এখানকার লোকের বিশ্বাস যে, দুগ্ধের সহিত জল মিশ্রিত করিলে মহাপাপ ও বিশেষ অনিষ্ট হয়। এখানকার জঙ্গলে যে সকল মহিষ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহারা এত বলবান্ যে, তাহারা ব্যাঘকে পর্যন্ত পরাস্ত করিতে পারে। এখানকার জঙ্গলে যথেষ্ট ব্যাঘ্র ও হরিণ দেখিতে পাওয়া যায়। রুহিদাসে বা রোটাসে একটা প্রকাণ্ড দুর্গ আছে, এই দুর্গ একটী উচ্চ পর্বতের উপরে নির্মিত। এখানকার ভূমিতে অল্প গর্ত করিলেই জল পাওয়া যায়। এই রোটাস দুর্গের মধ্যে অনেক জলাশয় আছে; এই দুর্গের সীমার পরিধি চৌদ্দ ক্রোশ। সুবে বিহারের সাতটী সরকার ১৯৯ পরগণায় বিভক্ত। মোট রাজস্ব ৫৫৪৭৯৮৫ টাঃ ১ আনা ৩ পাই। এই ১৯৯ পরগণার মধ্যে ১৩৮টী পরগণায় জরীপ হইয়া ২৪৪১২০ বিঘা জমী হইয়াছে। ৬১টী পরগণা এখনও জরীপ হয় নাই। সুবে বিহার হইতে ১১৪১৫ অশ্বারোহী, ৪৩৯৩৫০ পাতি ও ১০০ নৌকা সম্রাটের নিকট প্রেরিত হয়।
সুবে এলাহাবাদ
উত্তরে পলি জৌনপুর হইতে দক্ষিণে পৰ্বতমালা পর্যন্ত এই সুবার দৈর্ঘ্য ১৬০ ক্রোশ এবং প্রস্থ বসা হইতে হাতেমপুর পর্যন্ত ১২২ ক্রোশ। ইহার পূৰ্ব্বসীমা বিহার, উত্তরে অযোধ্যা, দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বত এবং পশ্চিমে আগরা। গঙ্গা ও যমুনা এই সুবার প্রধান নদী, এতদ্ব্যতীত অরন্দ, জিন, সরযু, বরুণা প্রভৃতি অনেকগুলি ক্ষুদ্র নদী আছে। এখানে নানা ফুলফল জন্মে; আঙ্গুর ও তরমুজও এখানে যথেষ্ট পরিমাণে উৎপন্ন হয়। এখানকার ভূমি অতিশয় উৰ্ব্বর, কিন্তু এখানে জওয়ার কি লুদেরার চাষের ব্যবস্থা নাই। বেণারস, জামিলাবাদ এবং মাওসহরের ঝেওনা ও মিরপ্ত বস্ত্র অতি উৎকৃষ্ট। জৌনপুর, নারোয়াল এবং আরও কয়েকটী স্থানে পশমী কার্পেট প্রস্তুত হইয়া থাকে। এলাহাবাদের পুরাতন নাম প্রয়াগ; পাদশাহ ইহার এই বৰ্ত্তমান নামকরণ করিয়াছেন। এখানে পাদশাহের নির্মিত একটী দুর্গ আছে। এই দুর্গের মধ্যে অনেক সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ আছে। হিন্দুরা প্রয়াগকে তীর্থের রাজা বলিয়া থাকে। কারণ, এখানে গঙ্গা, যমুনা এবং সরস্বতীর সঙ্গমস্থল। কিন্তু সরস্বতী নদীর কোন চিহ্নই এখানে দেখিতে পাওয়া যায় না। এখানে একটী অতি আশ্চর্য ঘটনা দেখিতে পাওয়া যায়। বৃহস্পতি যখন স্বাতি নক্ষত্রে অবস্থিত হন, সেই সময়ে গঙ্গানদীর মধ্যে একটা পাহাড় দৃশ্যমান হয় এবং একমাসকাল থাকে। সেই সময়ে হিন্দুরা সেই পাহাড়ের উপর গিয়া নানাপ্রকার যাগযজ্ঞ করে। বারাণসী একটী প্রকাণ্ড নগর। বরুণা এবং অসি এই দুই নদীর মধ্যস্থলে স্থাপিত হওয়ার জন্য ইহার নাম বারাণসী হইয়াছে। পুরাতন পুস্তকাদিতে এই এই স্থান কাশ্মীরনামে অভিহিত। এই শহর ধনুকাকৃতি এবং গঙ্গানদী এই ধনুকের গুণ। পূর্বে এখানে একটী মন্দির ছিল, হিন্দুরা এখানে আসিলে প্রত্যহ সেই মন্দির প্রদক্ষিণ করিত। কাশী হিন্দুপাণ্ডিত্যের মহানগরী। বহুদূরদেশ হইতে কেহ বা ধৰ্ম্মার্থে কেহ বা শাস্ত্রশিক্ষার্থিরূপে কাশীতে আসিয়া থাকেন।
সুলতান মহম্মদ গজনী এখানে আসিয়া অনেক লোককে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত করেন। তিনি দ্বিতীয়বার আসিয়া গোয়ালিয়র-দুর্গ অবরোধ করেন। কিন্তু রাজার সহিত সন্ধি হওয়ায় চলিয়া যান। তাহার পর তিনি কলিঞ্জর গ্রহণের আয়োজন করেন। কিন্তু কলিঞ্জর-দুর্গের শাসনকর্তা নন্দের বিশেষ অনুরোধ উপরোধে তিনশত হস্তী পাইয়া দুর্গজয়ের অভিপ্রায় ত্যাগ করেন। নন্দ সুলতানের প্রশংসা করিয়া কতকগুলি উৎকৃষ্ট কবিতা রচনা করেন। সেই কবিতা পাঠ করিয়া সুলতান এতদূর সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন যে, কলিঞ্জ দুর্গ তাঁহাকে দিয়ে যান। এতদ্ব্যতীত আরও চৌদ্দটি স্থান তাহার অধিকারভুক্ত করিয়া দিয়া যান। দিল্লীর সম্রাট সুলতান ফিরোজ তাহার ভ্রাতা ফকিরুদ্দিন রওনার নামে জৌনপুর সহর স্থাপন করেন। চুনারে একটী দুর্গ আছে। এ দুর্গটী প্রস্তরনির্মিত এবং একটী পাহাড়ে উপরে অবস্থিত। এই দুর্গের পাদমূল দিয়া গঙ্গা প্রবাহিতা। এই দুর্গের নিকটে একজাতি লোক আছে, তাহারা সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় থাকে। ইহারা মৃগয়া করিয়া জীবিকা নির্বাহ করে এবং বনে জঙ্গলে বাস করে। কলিঞ্জর-দুর্গ এক উচ্চ পৰ্ব্বতের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই দুর্গ কাহার নিৰ্মিত, সে কথা কেহই বলিতে পারে না। এই দুর্গের মধ্যে অনেক দেবদেবীর মূৰ্ত্তি আছে। আঠার হাত উচ্চ কালভৈববমূৰ্ত্তি সম্বন্ধে অনেক অদ্ভুত গল্প শুনিতে পাওয়া যায়। দুর্গসীমার মধ্যে অনেক ঝরণা এবং জলাশয় আছে। কলিঞ্জরের নিকট লৌহের খনি আছে। এই স্থান হইতে ২০ ক্রোশ দূরে কৃষকেরা মধ্যে মধ্যে হীরকখণ্ড পাইয়া থাকে। শুনিতে পাওয়া যায়, এই দুর্গের ভূতপূর্ব শাসনকর্তা রাজা কীৰ্ত্তিসিংহের ছয়খানি বহুমূল্য প্রস্তর ছিল। যখন কীৰ্তিসিংহ রাজত্ব করিতেন, সেই সময়ে এই প্রদেশে এক ব্রাহ্মণ বাস করিতেন। ব্রাহ্মণের একটী তোতাপাখী ছিল। এই পাখীকে যে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা যাইত, সে তাহারই সুসঙ্গত উত্তর প্রদান করিত। কেহ কেহ আবার বলেন যে, এই পাখী শ্রুতিধর ছিল। সেই সময়ে এ দেশে বক্স নামে একজন মহাপ্রসিদ্ধ গায়ক বাস করিত। রাজ অন্তঃপুরে দুইটী দাসীও উক্তৃষ্টা গায়িকা ছিল। সুলতান বাহাদুর গুজরাটী রাজার সহিত বন্ধুত্বসূত্রে আবদ্ধ হইয়া এই দুটী গায়িকা এবং বন্ধু এই তিনের মধ্যে একজনকে লইতে চাহেন। রাজা বল্লুকেই তাহার হস্তে সমর্পণ করেন। এই সংবাদ পাইয়া সের খা গায়িকা দুইটীকে চাহিয়া পাঠান। রাজা এবার অস্বীকার করেন। সের খাঁ ক্রুব্ধ হইয়া দুর্গ অবরোধ করেন। রাজা অনন্যোপায় হইয়া সমস্ত স্ত্রীলোককে অগ্নিকুণ্ডে আহুতি দেন এবং নিজেও অগ্নিকুণ্ডে ঝম্পপ্রদানপূর্বক প্রাণত্যাগ করেন। ভগবান দুষ্টের দমন করিয়া থাকেন। সেরখার অদৃষ্টে দুর্গজয়ের সুখভোগ হইল না। হঠাৎ একদিন বারুদখানায় অগ্নিসংযোগ হইল সেই অগ্নিতে তিনি পুড়িয়া প্রাণত্যাগ করেন।
এই সুবা দশসরকারে বিভক্ত। এই দশসরকারের মধ্যে একশত সাতাত্তরটী পরগণা আছে। এই সুবার রাজস্ব ৫৩০৯৫ টাঃ ৭ আনা ৯ পাই এবং ১২০০০০০ পালও রাজস্বস্বরূপ দিতে হইত। এই সুবা ১১৩৭৫ জন অশ্বারোহী, ২৩৮৭০ জন পদাতি এবং ৩২৩টি হস্তী পাদশাহ-সরকারে যোগান দিতে বাধ্য হইত।
এলাহাবাদের রাজগণের বিবরণ
এই সুবা, পূৰ্ব্ব হইতেই দিল্লীর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। ফিরোজশাহের পুত্র মহম্মদ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করিয়া তাহার একজন দাস মল্লিক সরীরকে এলাহাবাদের শাসনকৰ্ত্তা করিয়া পাঠান এবং তাঁহাকে সুলতান উসরফ উপাধিতে ভূষিত করিলেন। সুলতান উরফের মৃত্যুর পর তাঁহারই পোষ্যপুত্র মোবারক করণফুল সুবাদার হন। কিন্তু তিনি নিজের নামেই মুদ্রা প্রচার করায় এবং মসৃজীদেও নিজনামে খোত বা পরিবার আদেশ প্রচার করায় দিল্লীর সম্রাট তাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। উভয়পক্ষেই যুদ্ধ হয়, কিন্তু কাহারও কোন লাভ হয় না। সম্রাট সুলতান মামুদের মৃত্যুর পর তাহার কনিষ্ঠাভ্রাতা ইব্রাহিম সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি বিদ্রোহী করণফুলকে শাস্তি প্রদান করেন। এই সময়েই ভারত-বিখ্যাত পণ্ডিত এবং জ্ঞানী কাজি সাহেবুদ্দীন জীবিত ছিলেন। সুলতান ইব্রাহিমের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র বিকন খাঁ মহম্মদ নাম ধারণপূর্বক সিংহাসন গ্রহণ করেন। তিনি অতি নিষ্ঠুর ছিলেন। এই জন্য তাঁহার ভ্রাতা হাসেন তাহাকে রাজ্যচ্যুত করেন। ইনি প্রথমে সুশাসন করিতেন, কিন্তু কিছুদিন পরেই অত্যন্ত অত্যাচারী হইয়া উঠেন।
সুবা অযোধ্যা
এই সুবা দৈর্ঘ্যে গোরথপুর হইতে কনৌজ পর্যন্ত ১৩৫ ক্রোশ এবং প্রস্থে পৰ্বতমালা হইতে এলাহাবাদ পৰ্য্যন্ত ১১৫ ক্রোশ। ইহার পূৰ্ব্বসীমা বিহার, উত্তর হিমালয়পৰ্ব্বত। দক্ষিণে মাণিকপুর এবং পশ্চিমে কনৌজ। এখানকার জলবায়ু স্বাস্থ্যকর। ঘর্ঘরা, গোমতী ও সৈ এই সুবার প্রধান নদী। এখানে উৎকৃষ্ট চাউল জন্মে। এখানকার সুখদোষ, মারকায়, চুন্ন চাউল সর্বোৎকৃষ্ট। অন্যান্যদেশ অপেক্ষা তিনমাস পূর্বে এখানে ধানবুনানি হয়। যখন ধানের শীষ বাহির হইতে থাকে, সেই সময়ে নদীর জল বাড়িয়া সমস্ত ক্ষেত্র প্লাবিত করিয়া দেয়। ধানের শীষ যদি একবার বাহির হয়, তাহা হইলে নদীর জল যতই বাড়ুক না কেন, ধান্য ডুবাইতে পারে না। এখানে ফল-পুষ্প প্রচুর জন্মে। অযোধ্যা হিন্দুস্থানের মধ্যে একটী প্রকাণ্ড শহর। শুনিতে পাওয়া যায়, পূর্বে এই সহর লম্বায় ১৪৮ ক্রোশ এবং প্রস্থে ৩৬ ক্রোশ ছিল। ইহা হিন্দুগণের পবিত্র স্থান। এখানকার ধূলাবালি ঝাড়িলে স্বর্ণকণা দেখিতে পাওয়া যায়। ত্রেতাযুগে এইখানে রাজা রামচন্দ্রের বাড়ী ছিল। সহর হইতে এক ক্রোশ দূরে ঘর্ঘর নদীর সহিত সৈ নদী সম্মিলিত হইয়াছে। সহরের নিকটেই দুইটী সমাধিস্তম্ভ আছে, তাহার একটী দুই হাত ও আর একটী সাত হাত লম্বা। এখানকার সাধারণলোকে বলে, এই দুইটী সেখ এবং জবের সমাধি; তাঁহাদের সম্বন্ধে নানা প্রকার গল্পও আছে। অনেকে অনুমান করেন যে, রতনপুণ সহরে ধর্মাত্মা কবীরের সমাধিমন্দির আছে। কবীর সুলতান সেকেন্দর লোদর সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মহাপণ্ডিত ও সংসারত্যাগী ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁহার রচিত অতি উৎকৃষ্ট হিন্দুস্থানী কবিতা এখনও দেশে পঠিত হয়। বরৌচ অতি সুন্দর সহর। এইখানে সুলতান মসায়ু এবং রাজের মিলারের সমাধিস্থান আছে। এই দুই মহাত্মাকে সাধারণ মুসলমানেরা অতিশয় ভক্তি করে। সুলতান মসায়ূন্দ মহম্মদ গজনভির আত্মীয় এবং রাজিব শিলার দিল্লীর সম্রাট সুলতান ফিরোজের পিতা। ইহারা দুইজন অতিশয় ধার্মিক ছিলেন। উত্তরের পৰ্বত হইতে অযোধ্যায় নানাপ্রকার দ্রব্যবিক্ৰয়াৰ্থে আনীত হইয়া থাকে; তন্মধ্যে স্বর্ণ, তাম্র, সীসা, মৃগনাভি, চামর, মধু, চুক (এক-প্রকার অশ্লমিশ্রিত চাটনী) দাড়িম্ব, আঙ্গুর, ঠ, মরিচ, মম, পশমী কাপড়, কাষ্ঠ-নির্মিত জিনিস, নানা প্রকার পাখী, লবণ ও হিং প্রধান। এই সমস্ত দ্রব্যের বিনিময়ে পৰ্বতবাসীগণ মৃৎপাত্র লইয়া যাইত।
নিমখারে একটী বৃহৎ দুর্গ আছে। ইহা পরম পবিত্র স্থান। গৌরীনদী ইহার পার্শ্ব দিয়া প্রবাহিতা। এখনে অনেকগুলি হিন্দুর দেবমন্দির আছে। ইহারই নিকটে ব্রহ্মাবৰ্ত্ত কুণ্ড নামে একটী জলাশয় আছে। ইহার জল সৰ্ব্বদা চক্রাকারে ঘুরিতেছে। এই জলে যাহা নিক্ষেপ করা যায়, তাহাই প্রতিনিক্ষিপ্ত হয়। ব্রাহ্মণেরা এই কুণ্ডের পূজা করে। এই কুণ্ডে বালুকায় কখন কখন আপনা হইতেই মহাদেবের লিঙ্গমূৰ্ত্তি নির্মিত হয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই অদৃশ্য হইয়া যায়। এখানে একটী ঝরণা আছে। এই ঝরণায় আতপচাউল কি অন্যদ্রব্য নিক্ষিপ্ত হইলে তাহা দেখিতে দেখিতে অদৃশ্য হইয়া যায় অথচ ঝরণায় জল ২/৩ ইঞ্চির অধিক গভীর নহে। ইহারই নিকটে বিরামতি নামে একটী স্থান। আছে। এখানে হোলীর সময়ে মৃত্তিকা ভেদ করিয়া অগ্নিশিখা বাহির হয়। লক্ষ্ণৌ গোমতীতীরে স্থাপিত একটী প্রধান সহর। একানে সেখ মিনা নামে একজন ধর্মাত্মা মুসলমানের সমাধিস্থান আছে। এই সুবার মধ্যে সূৰ্য্যকুণ্ড নামে হিন্দুদিগের একটী তীর্থস্থান আছে। বেলগ্রামের লোকেরা সুগায়ক। এই বেলগ্রামে একটী কূপ আছে। সেই কূপের জল ক্রমাগত চল্লিশদিন পান করিলে মানুষের বুদ্ধি তীক্ষ্ণ হয় এবং চক্ষের দৃষ্টি প্রখর হয়। সুবে অযোধ্যায় পাঁচটী সরকার আছে। এই পাঁচটী সরকারে ১৩৮টা পরগণা। এই সুবায় যত ভূমি আপাততঃ জরীপ হইয়াছে, তাহার পরিমাণ এককোটি একলক্ষ একাত্তর হাজার আশীবিঘা। রাজস্বের পরিমাণ ২১৩০৭১ টাঃ ১৫ আনা। এখান হইতে ৭৬৬০ অশ্বারোহী, ১৬৮২৫০ পদাতি ও ৫৯টি হস্তী সম্রাটের নিকট প্রেরিত হত।
সুবে আগরা
সুবে এলাহাবাদের সীমান্তে ঘাতিনপুর হইতে দিল্লীর দিকে এই সুবার দৈর্ঘ্য ১৭৫ ক্রোশ, ইহা প্রস্থে কনৌজ হইতে চন্দেরী পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত। ইহার পূৰ্ব্বসীমায় ঘাতেমপুর, উত্তরে গঙ্গানদী, দক্ষিণে চন্দেরী এবং পশ্চিমে পালওয়ান। এই সুবায় অনেকগুলি নদী আছে; তন্মধ্যে যমুনা ও চম্বলই প্রধান। যমুনা হিমালয় হইতে উৎপন্ন হইয়াছে এবং চম্বল মালবদেশ হইতে বহির্গত হইয়া কাল্লীর নিকট যমুনায় আসিয়া মিলিত হইয়াছে। এখানকার ভূমি উর্বর। পান, পুষ্প ও সুগন্ধি তৈল এখানে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। তরমুজ ও আঙ্গুর ইরাণ-তুরাণের উৎপন্ন ফলের ন্যায় উৎকৃষ্ট। আগরা বৃহৎ সহর। এখানকার জলাবায়ু স্বাস্থ্যকর। আগরায় যমুনা নদীর উভয় তীর সুদৃশ্য অট্টালিকা ও উদ্যানে শোভিত। সকলদেশের লোকই এখানে বাস করিয়া থাকে। বাদশাহ এখানে রক্তপ্রস্তর দ্বারা একটী দুর্গ নির্মাণ করাইয়াছেন, এমন সুন্দর দুর্গ আর কোথাও দেখিতে পাওয়া যায় না। দুর্গের মধ্যে মধ্যে পাঁচশত প্রস্তরনির্মিত গৃহ আছে, সেই সকল গৃহ মনোহর কারুকার্যে শোভিত। দুর্গের পূৰ্ব্বাদ্বারে দুইটী প্রস্তরনির্মিত হস্তীমূর্তি আছে। পূৰ্বে আগরা সামান্য একটী গ্রাম ছিল। বাদশাহ এখানে এই সমৃদ্ধনগরী স্থাপিত করিয়াছেন। নদীর অপর পারে চারবাগ নামে একটী মনোহর স্তম্ভ আছে। এই পুস্তকলেখক যমুনার অপর পারেই জন্মগ্রহণ করেন; সেখানে তাহার পূর্বপুরুষগণের সমাধিমন্দির সকল রহিয়াছে; তাহার বিখ্যাত ভ্রাতা সেখ ফৈজির সমাধিমন্দিরও এই স্থানেই; এতদ্ব্যতীত সেখ আলাউদ্দীন মজর, মিরউদ্দীন সফরফিভী এবং আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির সমাধি এইখানেই হইয়াছে। আগরা শহরের নিকট বলে গ্রাম হিন্দুগণের পবিত্র তীর্থস্থান। তখন ইহার নাম ছিল সিরী। যখন আগরায় রাজধানী স্থাপিত হইল, তখন ফতেপুরও সমৃদ্ধশালী উঠিল এই সহর আগরা হইতে ১২ ক্রোশ দূরে অবস্থিত; এখানে একটা প্রস্তরনির্মিত দুর্গ আছে, সেই দুর্গদ্বারে দুইটী বিশালকায় হস্তীর প্রতিকৃতি আছে।
আগরা মহাসমৃদ্ধিশালী রাজধানী। বড় বড় আমীর ওমরাহগণের প্রাসাদতুল্য অট্টলিকায় সমস্ত রাজধানী সুসজ্জিত। এখানে নানা শ্রেণীর শিল্পকর সর্বদাই বাস করে; সুতরাং এখানে অনেক উস্কৃষ্ট দ্রব্য প্রস্তুত হইয়া থাকে। বিয়ানা পূর্বে একটী প্রধান সহর ছিল। এখানে একটী প্রকাণ্ড দুর্গ আছে। এখানকার আম্র অতিশয় উৎকৃষ্ট, এক একটী একসের ওজনের পর্যন্ত হইয়া থাকে। এখানে একটী কূপ আছে, সেই কূপের জল দ্বারা তাহারা চিনি মাখাইয়া গুণ্ডেরা নামে একপ্রকার মিষ্টদ্রব্য প্রস্তুত করে এবং তাহা বহুদিন ঘরে রাখিলে বা বহুদূরদেশে পাঠাইলেও নষ্ট হইয়া যায় না, অন্য কোন জলের দ্বারা গুণ্ডেরা প্রস্তুত হয় না। এখানকার নীল অতি উৎকৃষ্ট; দশ টাকা হইতে পনের টাকা মণ দরে বিক্রয় হয়। এখান হইতে তিন ক্রোশ দূরে টুডে ভীম নামে একটী স্থানে একটা জলপূর্ণ গহ্বর আছে। এই গহ্বর অতলস্পর্শ। এখানে তামের খনি আছে, কিন্তু খরচ পোষায় না, সেইজন্য কেহ আর খনি হইতে তা উত্তোলন করে না। মথুরা যমুনাতীরে একটী সুদৃশ্য সহর; এখানে অনেক হিন্দু দেবদেবীর মন্দির আছে। যমুনা নদীর উপর কালপী নামে একটী সহর আছে, এখানে উৎকৃষ্ট চিনি জন্মে। কালপীর রাজগণ দিল্লীর অধীন ছিলেন। পূৰ্ব্বকালে কনৌজ হিন্দুস্থানের রাজধানী ছিল। গোয়ালিয়রের প্রস্তরনির্মিত দুর্গ দেশবিখ্যাত; এখানকার জলবায়ু বিশেষ স্বাস্থ্যকর। এস্থান সুন্দরী রমণী ও সু-গায়কের জন্য হিন্দুস্থানে প্রসিদ্ধ। এখানে একটী লৌহের খনি আছে। বীরাট নামক স্থানে তামের খনি আছে। নারোলের পর্বতের নিকট একটী কূপ আছে; এই কূপ হিন্দুগণের প্রধান তীর্থস্থান। শুক্রবারে অমাবস্যা তিথি হইলে এই কূপের জুলা সূর্যোদয়কালে উথলিয়া উঠে। সিংহোনা, দাদিপুর ও কোট পোটলি নামক স্থানে তামের খনি আছে। সুবা তেরটী সরকারে বিভক্ত; ইহাতে ২০৩টী পরগণা আছে। সরকারী রাজত্ব ১৬১৫৬২৫৭ টাঃ ১ আনা ৬ পাই, এই সুবা হইতে ৫০৬০০ অশ্বারোহী, ৫৭৭৫৭০ পদাতি এবং ২২১টী হস্তী সরবরাহ করিতে হয়।
সুবে মালোয়া
সুবে মালোয়া কড়া হইতে বাঁশোয়ার পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ২৪৫ ক্রোশ এবং প্রস্থে চন্দেরী হইতে নদরবার পর্যন্ত ২৩০ ক্রোশ। ইহার উত্তরসীমা পর্বতশ্রেণী, পূৰ্বে বহু দক্ষিণে বোকলানে এবং পশ্চিমে গুজরাট ও আজমীর। এই সুবার মধ্য দিয়া নর্মদা, সি, কালীসিন্ধু, বেতোয়া এবং লুনী নদী প্রবাহিতা। ইহা ব্যতীত আরও ছোট ছোট অনেক নদী আছে। এই সুবায় অনেক সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা জলাশয় ও বৃক্ষবাটিকা আছে। এখানকার জলবায়ু অতি সুন্দর; শীত অধিক হয় না, এমন কি শীতকালে গরমবস্ত্র ব্যবহারেরও দরকার হয় না এবং গ্রীষ্মকালেও কোন কৃত্রিম উপায়ে জল শীতল করিতে হয় না, কিন্তু বর্ষার চারিমাস রাত্রে এত শীত হয় যে, লেপ গায়ে না দিলে থাকা যায় না। হিন্দুস্থানের অন্য সবার সহিত তুলনায় মালবদেশ উচ্চভূমিতে অবস্থিত। গম, পোস্ত, ইক্ষু, আম্র, তরমুজ, আঙ্গুর এখানে যথেষ্ট পাওয়া যায়। হাসেলপুরে বৎসরে দুইবার আঙ্গুর জন্মে; এখানকার পান অতি উৎকৃষ্ট। এ দেশের লোক শিশুদিগকে তিন বৎসর বয়স পর্যন্ত যথানিয়মে অহিফেন সেবন করিতে দেয়। কৃষক, এমন কি, দোকানদারেরা পর্যন্তও অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করিয়া থাকে। উজ্জয়িনী সিপ্রা নদীর তীরে অবস্থিত। এই নগরী হিন্দুগণের নিকট মহা পবিত্র বলিয়া বিবেচিত হয়। আশ্চর্যের বিষয়, সময়ে সময়ে উজ্জয়িনীর তলবাহী সিপ্রা নদীর জল দুগ্ধের ধারায় প্রবাহিত হয়। বর্তমান পাদশাহের চল্লিশ বৎসরের রাজত্বসময়ে, এই পুস্তকলেখক পাদৃশাহের আদেশে দক্ষিণ দেশে গিয়াছিলেন। তিনি যখন উজ্জয়িনী সহরে উপস্থিত হন, তখন শুনিতে পান যে, তাঁহার আগমনের এক সপ্তাহ পূর্বেই সিপ্রা নদী দিয়া দুগ্ধধারা বহিয়া গিয়াছে। রাত্রি আটটার সময়ে এই ঘটনা ঘটে। হিন্দু মুসলমান সকলেই এই দুগ্ধ লইয়া গিয়াছিল। ইংরেজ অনুবাদক গুডউইন সাহেব এই কথা বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত নহেন; তিনি বলেন, বিশেষ কোন কারণে কোন সময় নদীর জল দুগ্ধের ন্যায় শ্বেতবর্ণ ধারণ করিতে পারে; কিন্তু একেবারে যে দুগ্ধধারাই প্রবাহিত হয়, এ কথা যুক্তির সম্মুখে কিছুতেই টিকে না। বোধ হয়, নদীর জলের রং শ্বেতবর্ণ হইয়াছিল, তাহাই প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিকের নিকট দুগ্ধ ধারা বলিয়া বর্ণিত হইয়াছিল। উজ্জয়িনী নগরে হিন্দুগণের ৩৬০টী দেবমন্দির আছে। সহরের নিকটে কালিয়দহ নামে একটী কূপ আছে, এই কূপের জল সৰ্ব্বদাই একটা জলাশয়ে পড়িতেছে, অথচ কখনও কোন দিন সামান্য একটু জলও কমিতেছে না। চন্দেরী বহু পুরাতন সহর, এখানে একটী প্রস্তরনির্মিত দুর্গ আছে। এই সহরে ১৪ হাজার প্রস্তরনির্মিত গৃহ আছে, ৩৮৪টী বাজার আছে, ৩৬-টী সরাইখানা আছে এবং ১২০ মসজিদ আছে। বেতোয়া নদীর তীরে তুমন নামে একটী সহর আছে। এখানকার একটী হিন্দু-মন্দিরের মধ্যে ঢাক বাজাইলেও শব্দ হয় না। মান্দু একটী প্রধান সহর, এই সহরের দুর্গসীমার পরিধি ১২ ক্রোশ; মধ্যস্থলে একটী আটতলা স্তম্ভ আছে। এই সহরই পূৰ্ব্বে এই সুবার রাজধানী ছিল। এখানে একপ্রকার তেঁতুল পাওয়া যায়, তাহার ফল নারিকেলের মত বড়। হিন্দু পণ্ডিতেরা বলেন যে, এই মালব সবার মধ্যে কোন একস্থানে পরশপাথর পাওয়া গিয়াছিল, এই পাথর যাহার গায়ে স্পর্শ করা যায় তাহাই স্বর্ণে পরিণত হয়। পরশপাথরপ্রাপ্তি সম্বন্ধে নিম্নলিখিত গল্পটী প্রচলিত আছে।-বিক্রমজিতের পূৰ্ব্বে এখানে জয়সিংহদেব নামে একজন ন্যায়পরায়ণ রাজা রাজত্ব করিতেন। তাঁহার রাজত্বসময়ে একদিন একদরিদ্র ব্যক্তি ঘাস কাটিতেছিল, হঠাৎ তাহার কাস্তের গায়ে পরশমণির সংস্পর্শ হয়; তৎক্ষণাৎ তাহার কাস্তে স্বর্ণময় হইয়া গেল দেখিয়া সে অবাক হইয়া গেল; সে ত আর কখন স্বর্ণ দেখে নাই, কাজেই সে মনে করিল, হঠাৎ তাহার কাস্তেখানি পাথরের আঘাতে নষ্ট হইয়া গেল। তখন সে গ্রামের লোহার মদনের কাছে কাস্তে ও পরশপাথর হস্তে উপস্থিত হইল। মদন পরশপাথরের গুণ জানিত; সে ঐ পাথরখানি তাহার নিকট হইতে লইয়া নিজে যথাসর্বস্ব স্বর্ণ করিয়া লইল। অবশেষে তাহার মনে হইল যে, এমন দুর্লভ দ্ৰব্য রাজারই হস্তে থাকা উচিত। এই স্থির করিয়া সে ঐ পরশপাথর রাজাকে প্রদান করিল। রাজা এই পাথরের প্রসাদে প্রকাণ্ড দুর্গ নির্মাণ করিলেন। দুর্গ নির্মাণ শেষ হইলে রাজা নর্মদা তীরে এক মহা যজ্ঞের আয়োজন করিলেন। এবং কুল-পুরোহিতকে যথোচিত পুরস্কৃত করিবার অভিপ্রায়ে তাহার হস্তে ঐ পরশপাথর দিলেন। পুরোহিত এমন যজ্ঞে বহু ধনরত্নপ্রাপ্তির আশা করিয়াছিলেন; কিন্তু রাজার নিকট হইতে এই সামান্য একখণ্ড প্রস্তরমাত্র দক্ষিণা পাইয়া রাগে অধীর হইয়া তৎক্ষণাৎ ঐ পাথর নদীর জলে নিক্ষেপ করিলেন। রাজা চীৎকার করিয়া উঠিলেন এবং মূর্খ ব্রাহ্মণকে পাথরের গুণ বলিলেন। ব্রাহ্মণ তখন নদীতে নামিয়া কত অনুসন্ধান করিল কিন্তু সে পাথর আর মিলিল না। লোকে বলে, নর্মদানদীর যেখানে ঐ পরশপাথর পড়িয়াছিল, সে স্থান অতলস্পর্শ। রাজা ভোজের রাজত্বসময়ে ধারা নগরী রাজধানী ছিল। হিন্দিয়া সরকারের জঙ্গলে অনেক হস্তী পাওয়া যায়। এই সুবায় ১২ সরকারের মধ্যে ৩০১ পরগণা আছে। সরকারী রাজস্বের পরিমাণ ৬১৭৩৭৬১৫ টাকা। এখানে ২৮০৮১৬ অশ্বারোহী, ৬৭০০০ পদাতি এবং ৯০টী হস্তী আছে।
মালবদেশের রাজগণের বিবরণ
এই পুস্তক লিখিত হইবার পাদশাহের রাজত্বের চল্লিশের বৎসরের) দুই হাজার তিন শত পঞ্চান্ন বৎসর পাঁচমাস সাতাইশ দিন পূর্বে মাহম্মা নামে এক ব্যক্তি এই সুবার মধ্যে একটী অগ্নি-মন্দির নির্মাণ করিয়া সেখানে অগ্নির উপাসনা করেন। তাঁহার অনেক শিষ্য এখানে অগ্নিকুণ্ডে প্রাণত্যাগ করিয়া ধৰ্ম্মসঞ্চয় করে। বৌদ্ধগণ এই ব্যাপার অবগত হইয়া রাজার নিকট এই নিষ্ঠুর ব্যাপারের বিরুদ্ধে আবেদন করে এবং যাহাতে এই অগ্নির উপাসনা একেবারে উঠিয়া যায়, তাহার জন্য প্রার্থনা করে। রাজা এই উপাসনা বন্ধ করিবার আদেশ করিলে অগ্নি উপাসকগণ তাহাদের ধর্মহানির জন্য দেবতার নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিলেন; দেবগণ তাহাদের কাতর প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হইলেন এবং একদিন তাঁহাদের সেই মন্দিরের মধ্যে ধনজী নামে এক জোতির্ময় মনুষ্যদেহবিশিষ্ট দেবমূৰ্ত্তির আবির্ভাব হইল। তিনি শীঘ্রই দেশের রাজা হইলেন এবং মালবদেশে রাজধানী স্থাপন করিলেন। তিনি বহুকাল রাজত্ব করেন; এই বংশের রাজা পতিরাজ নিঃসন্তান হইয়া পরলোকগমন করিলে আদিত্যপন্নার নামে একজন অমাত্য রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হন। ইনিই পন্নার রাজ্যের স্থাপয়িতা। এই বংশে গন্ধৰ্ব্ব নামে এক রাজা ছিলেন। এই গন্ধর্বের পুত্র বিক্রমাদিত্য। এই বিক্রমাদিত্যের রাজত্বসময় হইতে হিন্দুগণ বিক্রমসংবৎ গণনা করিয়া থাকেন। বিক্রমাদিত্য সম্বন্ধে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। বিক্রমাদিত্যের পরে চন্দ্রপাল রাজ্য গ্রহণ করেন এবং তিনি সমস্ত হিন্দুস্থান জয় করেন। মহারাজ বিজয়ানন্দ একদিন মৃগয়া করিতে গিয়া এক বৃক্ষতলে একটী শিশুকে কুড়াইয়া পান; তিনি এই শিশুকে নিজ সন্তানের ন্যায় লালন-পালন করেন। মহারাজ বিজয়ানন্দের মৃত্যুর সময়ে তাহার পুত্র ভোজের বয়স অল্প ছিল; সেই জন্য ঐ পালিতপুত্র মঞ্জ সিংহাসন গ্রহণ করেন; কিন্তু তিনি দক্ষিণদেশে যুদ্ধে নিহত হইলে বিক্রমসংবৎ ৫৫১ অব্দে ভোজরাজা সিংহাসনে আরোহণ করেন। ভোজরাজা ভারতবিখ্যাত ছিলেন, নানা দেশ হইতে পণ্ডিতগণ তাহার রাজসভায় সমাগত হইতেন, এই পণ্ডিতগণের মধ্যে বররুচি একজন। ভোজরাজার জন্মসম্বন্ধে একটী আশ্চৰ্য্য গল্প আছে। জ্যোতির্বিদগণের গণনার দোষে অথবা যাহারা সময় নির্ণয় করে, তাহাদের ভ্রান্তিতে ভোজ যে সময়ে যে নক্ষত্রে প্রকৃত জন্মগ্রহণ করেন, তাহা নির্ণীত না হইয়া অপর নক্ষত্র নির্ণীত হয়। সেই নক্ষত্রে জন্মগ্রহণ করিলে সন্তান অকর্মণ্য হয় এবং তাহার আরও অনেক দোষ হয়। এই কথা শুনিয়া রাজা, ভোজকে বনে পরিত্যাগ করিয়া আসিতে বলেন। কিন্তু ভোজের অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন, দেবগণ তাঁহাকে লালন-পালন করেন। এদিকে রাজসভায় বিরাজ নামে আর একজন প্রধান জ্যোতির্বিদের আগমন হয়। তিনি রাজকুমারের কোষ্ঠী গণনা করিয়া বলিলেন যে, এই কুমার একজন মহাপুরুষ হইবেন, এমন রাজা হিন্দুস্থানে আর হইবে না। এই কথা শুনিয়া রাজার অপত্যস্নেহ প্রবল হইল। রাজা তখন দেশের সমস্ত পণ্ডিত একত্র করিয়া ভোজের কোষ্ঠী ভাল করিয়া পরীক্ষা করাইলেন এবং তখন পূৰ্ব্ব কোষ্ঠীর গণনার ভুল বাহির হইল। তখন অনুসন্ধান চলিতে লাগিল। এদিকে রাজার পালিতপুত্র মঞ্জ দেখিলেন, যদি রাজপুত্রকে খুঁজিয়া পাওয়া যায়, তাহা হইলে তাহার রাজ্যলাভের আর আশা থাকে না। সুতরাং ইনি রাজকুমার ভোজের অনুসন্ধান করিয়া তাহার প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র করিলেন। অনুসন্ধানকারিগণ রাজকুমার ভোজকে ধৃত করিয়াও দয়াপরবশ হইয়া ছাড়িয়া দেন। কুমার ভোজ তখন মঞ্জকে একখানি পত্র লিখেন। সেই পত্র পাঠ করিয়া মঞ্জের মন ফিরিয়া যায়। তাহার পর দক্ষিণদেশে যুদ্ধে মৃত্যু হইলে রাজা ভোজ সিংহাসনে আরোহণ করেন। ভোজের পর তাঁহার পুত্র জয়সিংহ রাজা হন। জয়সিংহের মৃত্যু হইলে পান্নার বংশে রাজা হইবার উপযুক্ত আর কেহই থাকিল না। তখন চৈতপাল নামে একজন জমিদার রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইলেন। ইনি টেনর-বংশের স্থাপয়িতা। এই বংশের পরে চৌহান-বংশ রাজত্ব করে। চৌহান মালদেবের রাজত্বসময়ে গজনী হইতে সেখ শা দাক্ষিণাত্য আক্রমণ করেন এবং মালবদেশ জয় করিয়া মুসলমানরাজ্য প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁহার মৃত্যুসময়ে তৎপুত্র আলাউদ্দীন নাবালক ছিলেন; সুতরাং এই সুযোগে তাহার উজীর ধরম রাজ রাজ্য আত্মসাৎ করেন। আলাউদ্দীন বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া ধরমরাজকে যুদ্ধে নিহত করিয়া পিতৃসিংহাসন গ্রহণ করেন। তাহার পর এই রাজ্য হিন্দুদিগের হস্তগত হয়। হিন্দুরাজ বীরসেনের রাজত্বসময়ে একজন আফগান ষড়যন্ত্র করিয়া তাহার প্রাণসংহার করে এবং জেলালুদ্দীন নাম ধারণ করিয়া সিংহাসন অধিকার করে। বীরসেনের পুত্র খড়সেন পলায়ন করেন। অনেকদেশ ভ্রমণ করিয়া খসেন কামরূপে উপস্থিত হন এবং নিজের বীরত্বে কামরূপরাজকে মোহিত করিয়া তাহার কন্যার পাণিগ্রহণ করেন। কামরূপরাজের পুত্রসন্তান না থাকায় জামাতা খসেনই রাজ্য প্রাপ্ত হন। তখন তিনি পিতরাজ্য উদ্ধারের জন্য সৈন্য সগ্রহ পূর্বক মালবদেশ আক্রমণ করেন এবং আলমশাহকে যুদ্ধে নিহত করিয়া মালবদেশে হিন্দুরাজ্য পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করেন। শক্তসিংহের রাজত্বসময়ে দাক্ষিণাত্যের রাজা বাহাদুর শাহ মালব আক্রমণ করেন। এদিকে সুলতান গয়াসুদ্দীনের মৃত্যুর পর দিল্লীতে মহা গোলযোগ উপস্থিত হয়। সেই সময়ে মালব, গুজরাট, মুলতান, জেওনপুর, মুসলমান শাসনকর্তৃগণের অধীন থাকিলেও সকলে দিল্লীর প্রাধান্য অস্বীকার করেন। তাহার পর নানা গোলযোগ উপস্থিত হয়। সে সমস্ত সবিস্তার বর্ণনা না করিয়া এ স্থলে মালবদেশের রাজগণের বিবরণ তালিকা বর্ণনা করা যাইতেছে।
মালব রাজগণের বিবরণ
প্রথম তালিকা,–ধনজীর বংশ; এই বংশে পাঁচজন রাজা ৩৮৭ বৎসর ৭ মাস ৩ দিন রাজত্ব করেন। ধনজী ১০০ব, জীতচন্দ্র ৮৬ব ৭মা ৩দি, সালবাহন ১ব, নীরবাহন ১০০ব, পাতরাজ ১০০ বৎসর।
দ্বিতীয় তালিকা,–পল্লব বংশ; এই বংশের ১৮ জন রাজা ১০৬২ বৎসর ১১ মাস ১৭ দিন রাজত্ব করেন। অদপুন্না ৭৬ব ৭মা ৩দিন, বীর মহারাজ ৩০ব ৭মা ৩দি, অতবৰ্ম ১০ব, সুদর্শন ৮০ব, হিমারত ১০০ব, গন্ধর্ব ৩৫ব, বিক্রমজিৎ ১০০ব ২মা ৩দি, চন্দ্রসেন ৮৬ব ৩মা ২দি, খসেন ৮৫৩, ছত্রকোট ১ব, কনঙ্কসেন ৮৬ব, চন্দ্রপাল ১০০ব, মহিপাল ৭ব, করমচাঁদ ১ব ১মা, বিজয়ানন্দ ৬০ব, মঞ্জ (রাজা হয় নাই), ভোজ ১০০ব, জয়চন্দ্র ১০ব ২ মাস।
তৃতীয় তালিকা,–তগর বংশ;–এই বংশে ১১ জন রাজা ১৪২ বৎসর ৩ দিন রাজত্ব করেন। জীপাল তেগর ৫ব, রাণা রাজু ৫ব, রাণা বাহু ১ব ২মা, রাণা জালু ২০ব, রাণা চন্দ্র ৩০ব, রাণা বাহাদুর ৫ব, রাণা ভকতম ৫ব, রায় সুখেন পাল ৫ব, রায় ক্ষেত্রপাল ৫ব, রায় আনন্দপাল ৬০ব, কুমারপাল ১ বৎসর।
চতুর্থ তালিকা,চৌহান বংশ; এই বংশে ১৭ জন রাজা ১৪০ বৎসর রাজত্ব করেন। রাজা জগদেব চৌহান ১০ব, হরদেব ১৫ব, জগন্নাথ ১০ব, হরদেব ১৫ব, বসুদেব ১৬ব, শ্রীদেব ১৫ব, ধৰ্ম্মদেব ১৪ব, বলদেব ১০ব, নানকদেব ৯ব, কীরাতদেব ১১ব, পিথৌরা ২১ব, মালদেব ৯ বৎসর।
পঞ্চম তালিকা,১২ জন রাজা ১৯৭ বৎসর রাজত্ব করেন। সেখ শা ৭০ব, ধরম রাজ ২০ব, আলাহেদ্দিন ২০ব, কামালুদ্দীন ১২ব, জিৎপল চৌহান ২০, ইরাদ ২০ব, কীরাশ্চাদ ২ব, উগ্রসেন ১৩, সূৰ্য্যাননু ১২ব, তিপার সেন ১০ বৎসর।
ষষ্ঠ তালিকা,–৮ জন রাজা ২২৪ বৎসর রাজত্ব করেন। জেলালুদ্দীন ২২ব, আলমশাহ ২৪ব, খঙ্গসেন ৮ব, মুরাবাহান ২০ব, বীরসাল ১৬ব, পূর্ণমন্ত্র ৩২ব, হরানন্দ ৬২ব, শক্তসিং ৬০ বৎসর।
সপ্তম তালিকা,১০ জন রাজা ১৪২ব, ২মা, ৪দিন, রাজত্ব করেন। বাহাদুরশাহ কয়েকমাস, দিলওয়ার খাঁ ২০০ব, হোসেনশাহ ৩ব, মহম্মদশাহ ১০ব কয়েকমাস, সুলতান মামুদ ৩৪ব, সুলতান গিয়াসুদ্দীন ৩২ব, সুলতান নসিরুদ্দীন ১১ব, ৪মা, ৩দি, সুলতান মামুদ ২৬, ৬মা, ৩দি, কাদেরশ ৬ব, সুজাহাত খ ১২ বৎসর।
সুবা-খান্দেশ
অসির দুর্গ জয়ের পর যখন সুলতান দানিয়েল এই সুবার শাসনকর্তা হন, তখন তিনি ইহার খাদেশ নাম পরিবর্তন করিয়া দাণ্ডিস নাম দেন। ইহার দৈর্ঘ্য উরগা হইতে আদমনগর সীমান্ত পৰ্য্যন্ত ৭৫ ক্রোশ এবং প্রস্থে বিরারের সীমা হইতে মালবের সীমা পৰ্য্যন্ত ৫০ ক্রোশ। ইহার উত্তরসীমা মালবদেশ, দক্ষিণসীমা কলনি, পশ্চিমসীমা মালব এবং পূৰ্ব্বসীমা বিরার। উত্তরসীমার পূর্বতও আছে। এই সুবার মধ্যে অনেকগুলি নদী। আছে। তাহার মধ্যে পূর্ণানদীই প্রধান। এই নদী বেরার এবং গণ্ডওয়ালার মধ্য হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। এদেশের জলবায়ু উৎকৃষ্ট। এখানে প্রচুর পরিমাণে জওয়ারের চাষ হয়। ফল, পুষ্প এবং চাউলও এখানে উৎপন্ন হয়। এই সুবা আবপথে নামক উস্কৃষ্ট বস্ত্রের জন্য প্রসিদ্ধ। অসির দুর্গে এই সুবার শাসনকর্তা বাস করেন। দুর্গ পৰ্ব্বতের উপরে নিৰ্মিত দুর্গমূলে সহর স্থাপিত। অসির হইতে তিনক্রোশ দূরে তাপ্তী নদীর তীরে বুরহানপুর নগর। এখানে অনেক উৎকৃষ্ট উদ্যান আছে। সেই সমস্ত উদ্যানে যথেষ্ট চন্দনকাষ্ঠ পাওয়া যায়। সহরে নানাজাতি লোকের বসতি। গ্রীষ্মকালে সহর যেন ধুলায় ঢাকিয়া থাকে। বর্ষাকালে কর্দমের জ্বালায় পথে চলা কঠিন হয়। আদেলাবাদ সহরের নিকটে একটী ক্ষুদ্র হ্রদ আছে। লোকে বলে, রাজা দশরথ এইখানে অন্ধমুনির পুত্রহত্যার পাপ হইতে মুক্ত হন। চঙ্গদেবী তাপ্তী এবং পূর্ণানদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। এই স্থানকে হিন্দুরা চক্ৰতীর্থ বলে। এই সহরের নিকটস্থ কোন এক গ্রামে একটী মহাদেবমূৰ্ত্তি আছে। মাহান্দের সম্বন্ধে নিম্নলিখিত একটী গল্প প্রচলিত আছে।–সেই দেশে এক ব্রাহ্মণের। একটী মহাদেবমূৰ্ত্তি ছিল। ব্রাহ্মণ যেখানে যাইত ঐ মূৰ্ত্তি সঙ্গে লইয়া যাইত। হঠাৎ একদিন এই স্থানেই মূর্তিটা হারাইয়া যায়, অনেক অনুসন্ধানেও না পাইয়া ব্রাহ্মণ বালুকার দ্বারা এই মূর্তি নির্মাণ করে। ব্রাহ্মণের দেবনিষ্ঠা দেখিয়া তাহার বালুকানির্মিত মূর্তি স্বয়ং মহাদেব প্রস্তরমূর্তিতে পরিণত করিয়া দেন। ইহার নিকটে একটী ঝরণা আছে। অনেকেই বলেন, এই ঝরণায় গঙ্গানদী প্রভাবিত। এ সম্বন্ধে একটী গল্প প্রচলিত আছে। এইখানে একজন যোগী বাস করিতেন। তিনি প্রত্যহ এই স্থান হইতে গঙ্গাস্নানে যাইতেন এবং সেইদিনেই ফিরিয়া আসিতেন। যোগীর ভক্তি দর্শনে প্রীত হইয়া গঙ্গাদেবী এক রাত্রে তাহাকে স্বপ্নে দেখা দিয়া বলিলেন, “আর তোমাকে কষ্ট স্বীকার করিয়া গঙ্গাস্নানে যাইতে হইবে না। আমি স্বয়ং এখানে আসিব।” পরদিন প্রাতঃকালেই এই ঝরণা বাহির হইল।
চৌপাড়া একটী প্রকাণ্ড সহর। ইহার নিকটে কার্ণি এবং তাপতী নদীর সঙ্গমস্থলে রামেশ্বর নামে হিন্দুদিগের প্রধান তীর্থস্থল। বহুদূর হইতে হিন্দুযাত্রিগণ এখানে পূজা দিতে আইসে। ইহারই নিকট মঙ্গল-দুর্গ। এই সুবা ৩২টী পরগণায় বিভক্ত। এখানকার কৃষকেরা কর্তব্যপরায়ণ ও পরিশ্রমী। তাহারা পুণি, ভেইব এবং গণ্ড এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। গণ্ডগণ সিংহকেও পোষ মানাইতে পারে। তাহাদের এই আশ্চর্য ক্ষমতা সম্বন্ধে অনেক গল্প প্রচলিত আছে।
খান্দেশের রাজগণের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
পূর্বে এইস্থান জনশূন্য ছিল। কেবলমাত্র অসির নামক স্থানে কতকগুলি লোক বাস করিত। শুনিতে পাওয়া যায়, বাহাদুর শাহের উচ্চতম নবমপুরুষ মল্লিক রাজি অদৃষ্টচক্রে এই দেশে আসিয়া উপস্থিত হন এবং কিরাণদিহি গ্রামে বাস করেন। কিন্তু গ্রামবাসিগণের উৎপাত অসহ্য হওয়ায় তিনি দিল্লীতে গমন করিয়া সুলতান ফিরোজের অধীনে কৰ্ম্ম করেন। বাহাদুরের তীরচালনায় অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। সম্রাট তাহার ক্ষমতাদৃষ্টে সন্তুষ্ট হইয়া, তিনি যাহা চাহিবেন তাহা দিতে স্বীকার করেন। বাহাদুর কিরাণদিহি গ্রাম জায়গীয় প্রার্থনা করেন। তাহার প্রার্থনা পূর্ণ হইলে তিনি সম্রাট সরকারের কার্য পরিত্যাগ করিয়া কিরাণদিহিতে ফিরিয়া আইসেন এবং ক্রমে মহাপ্রতাপশালী হন। অবশেষে আদেলশাহ নাম ধারণ পূৰ্ব্বক রাজত্ব আরম্ভ করেন। ১৭ বৎসর রাজত্ব করিয়া তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। তাঁহার পুত্র নাসিরশাহ সিংহাসন আরোহণ করেন। এই সময় হইতেই এই প্রদেশের নাম খান্দেশ হয়। নাসিরশাহ ২৪ বৎসর ২৬ মাস ২৬ দিন রাজত্ব করেন। তাঁহার পুত্র মিরনশাহ ৩ বৎসর ৪ মাস ৩ দিন রাজত্ব করেন। তাহার পর মোবারেক শাহ ও আদেলশাহ রাজত্ব করেন। আদেলশাহ গুজরাট নগরীর স্থাপনকৰ্ত্তা। সুলতান আহম্মদি গুজরাটের কন্যাকে বিবাহ করেন। তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার ভ্রাতা দাউদশাহ ৭ বৎসর ১ মাস ১৭ দিন রাজত্ব করেন। আদেলশাহের পুত্র দ্বিতীয় আদেলশাহ খুল্লতাতের ভয়ে পলায়ন করিয়া গুজরাটে আশ্রয় গ্রহণ করেন। গুজরাটের বাঙ্গেরা রাত্রি তাহাকে কন্যা সম্প্ৰদান করিয়া তাহার সাহায্যার্থে খান্দেশ গমন করেন এবং তাঁহাকে পিতুরাজে প্রতিষ্ঠিত করেন। আদেলশাহের দুই পুত্র ছিল। জ্যেষ্ঠ মিরণ মহম্মদশাহ এবং কনিষ্ঠ মোবারকশাহ। গুজরাটের রাজা সুলতান বাহাদুর মিরণ মহম্মদকেই রাজ্যের অধিকারী নিৰ্বাচিত করেন। তাঁহার মৃত্যুর পর মিরণশাহের পুত্র রাজি সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু মবারক তাঁহাকে রাজ্যচ্যুত করিয়া রাজা হন। মোবারকের পুত্র মিরণ মহম্মদ ৯ বৎসর ৯ মাস ১৫ দিন রাজত্ব করেন। তাহার মৃত্যু হইলে তাহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা রাজা আলি খা আদেলশাহ নাম ধারণ পূৰ্ব্বক সিংহাসন অধিকার করেন। দিল্লীর পাদশাহের অধীনে যুদ্ধ করিতে গিয়া তিনি নিহত হন। তাহার মৃতদেহ বুরাহানাপুরে সমাধিস্থ হয়। তিনি ২১ বৎসর ১০ মাস ২০ দিন রাজত্ব করেন। তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র খিজির খাঁ বাহাদুরশাহ নাম গ্রহণপূর্বক সিংহাসন আরোহণ করেন। তিনি অত্যন্ত অত্যাচারী ছিলেন। এই জন্য মহামহিম বাদশাহ তাঁহার রাজত্বের ৪৫ বৎসরে বাহাদুর শাহকে খান্দেশ রাজ্যচ্যুত করেন।
সুবে বেরার
এই সুবার পূর্ধ্বতন নাম তিনটী;-দুর্দাওত, রুদ্রদ্যোত, তিনকেনার। পুতনা হইতে বীরগড় পর্যন্ত ইহার দৈর্ঘ্য ২০০ ক্রোশ এবং বিদর হইতে হিন্দিয়া পর্যন্ত প্রস্থে ১৮০ ক্রোশ। ইহার পূৰ্ব্বসীমা বীরগড়, উত্তরে সেতারা, দক্ষিণে হিন্দিয়া এবং পশ্চিমে তেলিঙ্গনা। এই সুবার দক্ষিণে পৰ্বতদ্বয়ের মধ্যে মেখররাজ্য, ইহার এক অংশের নাম বুন্দী। ইহাতে নিম্নলিখিত কয়েকটী দুর্গ আছে–কাউয়েল, নীরনালা, মিলগড়, বেরুসা, মেহাত্তর এবং রামগড়। এই সুবার জল বায়ু নাতিশীতোষ্ণ। এখানে অনেক নদী আছে, তন্মধ্যে গঙ্গা গৌতমী বা গোদাবরী প্রধান। গঙ্গা নদী যেমন মহাদেবের, এই নদীও তেমনি গৌতমের। এই সম্বন্ধে অনেক আশ্চৰ্য্য আশ্চৰ্য্য গল্প প্রচলিত আছে। এ নদীকে হিন্দুরা গঙ্গার ন্যায়ই পবিত্র মনে করিয়া থাকে। এই নদী তারনীকের নিকট সহ্যপর্বত হইতে বহির্গত হইয়া অহমদনগর ও বিয়ারের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইয়া তেলিঙ্গনায় প্রবেশ করিয়াছে। যখন বৃহস্পতিগ্রহ-নক্ষত্রে গমন করেন, তখন দূরদূরান্তর হইতে বহু যাত্রী এই নদীতে স্নান করিয়া পুণ্যসঞ্চয় করিতে আসিয়া থাকে। তালী ও তাপ্তীও পবিত্র নদী। পূর্ণা নদী দেওয়ালগাঁয়ের নিকট হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। সিয়োদা নদী আরও দশ ক্রোশ উত্তর হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। নর্মদা নদীও দেওয়ালগায়ের নিকট হইতে উৎপন্ন হইয়াছে।
এ দেশে চৌধুরীকে দেশমুখ বলে; কানুনগোকে দেশপাণ্ডে বলে; মদমকে (প্রধান কৃষক বা মশুল) ইহারা পাটেল বলে এবং পাটোয়ারিকে কুলকুণী বলে। ইলিচপুরে এই সুবার শাসনকর্তার আবাসস্থান। এখানে উৎকৃষ্ট ভূমিচম্পক পুষ্প জন্মে। পান্নারে একটী দুর্গ আছে। কেরল রাজ্যসমতলে অবস্থিত; এই স্থান হইতে চারি ক্রোশ দূরে একটী কূপ আছে, সেই কূপে অস্থি নিমজ্জিত করিলে তাহা পবিত্র হইয়া যায়। এই প্রদেশে কয়েকজন বিখ্যাত জমীদার আছে, তাহাদের নাম ছত্ত, দাধার রাও, নাহার রাও, হস্তীয়া রাও। নারনিলাতে একটী প্রকাণ্ড দুর্গ আছে। পশুজাতীয় বিজারাও ও দুঙ্গর খাঁ নামে দুইজন জমীদার এই অঞ্চলে বাস করেন। বাল্লাদুরের নিকট দুইটী ক্ষুদ্র নদী আছে; এই নদীদ্বয়ে নানারঙ্গের পাথর পাওয়া যায়। সিপঘরের নিকট সাপুর নামে একটী নির্কর আছে; তাহার জলে কাষ্ঠ বা অন্য নরম দ্রব্য পচিয়া যায়। কালেম পুরাতন সহর; এই সহরের নিকটে বারজীনামে একজন জমীদার বাস করেন, তাঁহার দ্বিতীয় নাম চন্দ। বীরগড়ে হীরকের খনি আছে, এখানে যথেষ্ট হস্তী পাওয়া যায়। বঞ্জেরার বর্তমান জমিদার একটী স্ত্রীলোক। মাহোর-দুর্গ একটী সুন্দর পর্বতোপরি নির্মিত, এই দুর্গের নিকটে একটী দুর্গার মন্দির আছে। সরকার তেলিঙ্গনা কুতবউল মুলুকের অধীন প্রদেশ। এদেশের লোককে তেলিঙ্গবা বলে। এই দেশ অল্পদিন হইল বিরার সুবা ভুক্ত হইয়াছে। ইন্দোর ও নিরমালে অনেক খনি আছে। রামগড় একটী উৎকৃষ্ট দুর্গ। বাদশাহ এখনও এই দুর্গ হস্তগত করিতে পারেন নাই। লেনার একটী পবিত্র স্থান, ইহাকে হিন্দুরা বিষ্ণুগয়া বলিয়া থাকে। হিন্দুদের বিশ্বাস, তিনটী স্থানে শ্রাদ্ধাদি করিলে মৃত ব্যক্তির পাপমুক্তি হয় ও সে স্বর্গে গমন করে। প্রথম স্থান-বিহার দেশের অন্তর্গত গয়া, ইহা ব্রহ্মার-স্থান। দ্বিতীয়-এই গয়া, ইহাই বিষ্ণুর স্থান, এই জন্য ইহার নাম বিষ্ণুগয়া। তৃতীয়টী বিজাপুরের নিকটে। এখানে একটী জলাশয় আছে; জলাশয়টী দৈর্ঘ্যে প্রস্থে এক ক্রোশ। এই স্থানের নিকট পৰ্ব্বতের উপরে একটী নিঝর আছে, সেই নিঝর গোমুখের ন্যায় একটী স্থান দিয়া বাহির হইতেছে। সোমবারে অমাবস্যা তিথি হইলে এখানে অনেক যাত্রী সমাগত হয়। এই প্রদেশে মেদিনীরাও নামে একজন প্রতাপশালী রাজপুত জমীদার আছেন।
এই সুবা ১৩ সরকারে বিভক্ত এবং ইহাতে সৰ্ব্বশুদ্ধ ১৪২টি পরগণা আছে। এখানকার রাজস্ব শস্যের দ্বারা আদায় হয়। এই সুবার অন্তর্গত আটটী পরগণা চন্দের অধিকারভুক্ত, সুতরাং তাহার রাজস্ব পাদশাহ সরকারে জমা হয়। আরও বাইশটী পরগণার রাজস্বও পাদশাহ পান না, সে সমস্ত জমীদারগণের অধিকারভুক্ত। এই সুবা পূৰ্ব্বে দাক্ষিণাত্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুলতান মামুদের রাজত্ব সময়ে ইহার শাসনভার ফতে উল্লা আমদ উল মুলুকের হস্তে ন্যস্ত হয়; তাহার মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র আলাহেদ্দীন আজেদ উলমুলুক এ প্রদেশের ভার গ্রহণ করেন। এই প্রকার দুই তিন পুরুষ গত হইলে নিজাম উল মুলুক এই প্রদেশ অহমদনগর রাজ্যভুক্ত করিয়া লন।
সুবে গুজরাট
এই সুবা বুরহানপুর হইতে জগৎ পর্যন্ত দীর্ঘে ৩০২ ক্রোশ এবং প্রস্থে জ্বেলোর হইতে দাময়ন পৰ্য্যন্ত ২৬০ ক্রোশ। ইহার পূর্ধ্বসীমায় খান্দেশ, উত্তরে নেলোর ও ইদর, দক্ষিণে দামায়ন ও জগৎ। পশ্চিমে সমুদ্রতীরে অবস্থিত জগৎ। এই সুবারদক্ষিণ অংশ এই সুবার পর্বতসঙ্কুল। সমুদ্র গাত্রসংলগ্ন, এই সুবার মধ্য দিয়া সুবর্ণমতী, বেতারক, মাহেন্ত্রী, নর্মদা, তাপ্তী এবং সরস্বতী নদী প্রবাহিতা হইতেছে। আর দুইটী ক্ষুদ্রানিঝরিণী আছে, তাহাদের নাম গঙ্গা ও যমুনা। এখানকার ভূমি বালুকাপ্রধান। জাওয়ারী ও বাজরাই এখানকার প্রধান শস্য; মালওয়া আজমীর হইতে যব এবং গম আমদানী হইয়া থাকে। পত্তন হইতে বরোদা পর্যন্ত একশত ক্রোশ দীর্ঘ রাজপথের দুই পার্শ্ব আম্রবৃক্ষে সুশোভিত। এ দেশের আম সুমিষ্ট ও বড় বড়। এখানে এত ফলের গাছ আছে যে, শীকারের পক্ষে বিশেষ অসুবিধা হয়। এখানকার গৃহ সকলে টাইলের ছাত। এখানকার শিল্লিগণ অতি সুন্দর সুন্দর শিল্প প্রস্তুত করিয়া থাকে।
পূৰ্ব্বে পত্তনই এই সুবার প্রধান নগর ছিল, তাহার পর চম্পানিয়ার প্রধান নগর হয়, এক্ষণে আহমাবাদ রাজধানী। আহমাবাদের জলবায়ু অতিশয় স্বাস্থ্যকর। এই সহর এতদূর সমৃদ্ধিসম্পন্ন যে, এখানে পৃথিবীর সমস্ত দ্রব্যই পাওয়া যায়। আহমদাবাদে দুইটী প্রকাণ্ড দুর্গ আছে। রসুলাবাদ পাড়ায় বোখারাবাসী শাহ আলমের সমাধি আছে। এখান হইতে পাঁচ ক্রোশ দূরে সারভেজ নামে একটী স্থান আছে। সেখানে আহমদাবাদ সহরের স্থাপয়িতা সুলতান আমেদের সমাধি-মন্দির রহিয়াছে। সুলতান মামুদের প্রতিষ্ঠিত মহামদাবাদ সহর আহামদাবাদ সহর হইতে অনেক উৎকৃষ্ট অট্টালিকা আছে। সহরের বেষ্টন দেওয়াল ৭ ক্রোশ দীর্ঘ।
ইদরের জমীদার নারায়ণদাস একজন মহাসাধু পুরুষ। তিনি এমন সাধুভাবে জীবনযাপন করেন, যে গোবরের মধ্য হইতে শস্যকণা বাছিয়া লইয়া তাহাই আহার করিয়া জীবন ধারণ করেন। তাহাকে এদেশীয় ব্রাহ্মণগণ যথেষ্ট সম্মান করিয়া থাকেন এবং তিনি রাঠোরবংশের একজন প্রধান অধিনায়ক। কাম্বে ও গোগবন্দর এই সরকারের অন্তর্গত। এই গোগবন্দরে নানাদেশ হইতে জাহাজ আসিয়া থাকে। এবং এখানে নানা দ্রব্যের কারবার হইয়া থাকে। ঝালওয়ার প্রদেশ পূর্বে স্বাধীন ছিল, কিন্তু এক্ষণে গুজরাটের শাসনকর্তার অধীন। এদেশের অধিবাসীদিগকে কালা বলে। সরস্বতীনদীর তীরস্থ সিন্ধুপুর হিন্দুগণের একটী প্রধান তীর্থ। চম্পানিয়রের দুর্গ একটী উচ্চ পর্বতের উপরে নির্মিত। এই দুর্গে উঠিবার পথ অতিশয় দুর্গম ও ভয়াবহ; সুরাট ভারতবর্ষের মধ্যে একটী প্রধান বাণিজ্যস্থান। এই সহরে নিম্নদেশ দিয়া তাপ্তী নদী প্রবাহিত। পাশীগণ পারস্যদেশ হইতে পলায়ন করিয়া প্রথমে সুরাট নগরে আসিয়া বাস করে। মহামহিম পাদশাহের ধর্মবিষয়ে এতই উদার মত যে ভারতবর্ষের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জাতি ও সম্প্রদায়সকল স্ব স্ব ধৰ্ম্মানুগত ক্রিয়াকলাপ নির্বিবাদে সম্পন্ন করিয়া থাকে। এ অঞ্চলের সুবাদার এবং কর্মচারীগণের কাৰ্য্য শৈথিল্য বশতঃ এই সুবার কয়েকটী সরকার ইয়োরাপবাসিগণের হস্তগত হইয়াছে। তন্মধ্যে দামায়ুন, (সূৰ্য্যায়ুন St John) তারাপুরমাহি এবং বেসিন প্রধান। নর্মদাতীরস্থ বেরৌচ সহরে একটী সুন্দর দুর্গ আছে। সরকার সুরট পূৰ্ব্বে স্বাধীন রাজ্য ছিল। এবং ঘিলবংশীয় রাজগণ এই প্রদেশের অধিনায়ক ছিলেন। ইহার পূর্ধ্বসীমা আহমদাবাদ, উত্তরসীমা কচ্ছদেশ, দক্ষিণে এবং পশ্চিমে সমুদ্র। জলবায়ু স্বাস্থ্যকর। সুরাট এখন নয় ভাগে বিভক্ত। প্রত্যেকভাগে ভিন্ন ভিন্ন জাতি বসতি করে। প্রথম অংশের নাম নব সুরট, এখানে চুণাগড় নামে একটী প্রস্তরনির্মিত দুর্গ আছে। দ্বিতীয় অংশের নাম পত্তন, সোমনাথ ইহারই নামান্তর। সোমনাথের নিকটে নর্মদা নদীর উৎপত্তিস্থান। গৃহ্নার সোমনাথের নিকট অবস্থিত। চারি হাজার বছর পূর্বে বরুণ এবং সরস্বতীর মধ্যস্থলের বিস্তৃত ভূখণ্ডে যদুবংশীয়েরা আসিয়া বাস করেন। তাহার কিছুদিন পরে এই বংশের লোকের পরস্পর মারামারি কাটাকাটি করিয়া নির্মূল হইয়া যার। পত্তন সোমনাথ হইতে অৰ্দ্ধক্রোশ দূরে সরস্বতীনদীর তীরস্থ একটী বটবৃক্ষতলে একদিন একজন সন্ন্যাসী আসিয়া উপস্থিত হন। সন্ন্যাসী সেই স্থান হইতে সরস্বতী নদীতে ঝাঁপ দিয়া প্রাণত্যাগ করেন। এই জন্য এ স্থানের নাম পিপলশির হয়। মুলমহাদেব-সহরে মহাদেবের মন্দির আছে। সেই মন্দিরে প্রতিবৎসর কোন এক নির্দিষ্ট দিনে বিখ নামে একটী পাখী আসিয়া উপস্থিত হয় এবং কতকক্ষণ পর্যন্ত মন্দিরচুড়ায় খেলা করিয়া হঠাৎ নীচে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করে। সেই দিনে সহস্র সহস্র যাত্রীও সমবেত হয় এবং পক্ষীর শরীরের চিহ্ন দেখিয়া আগামী বৎসরের ফলাফল জানিতে পারে। মঙ্গলবালোর বা কূয়ারের মধ্যে একটী স্থান সমুদ্রের তীরে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বৎসরের মধ্যে একদিন সেই স্থানের সমুদ্রজল পরিষ্কার হয়, লবণের লেশমাত্রও থাকে না। হিন্দুরা বলেন যে, একজন লোকের একবার গঙ্গাজলের দরকার হয়; কোথাও গঙ্গাজল না পাইয়া সে এই স্থানে এক সাধুর দর্শন পায়। সাধু সেইদিন সমুদ্রের এই স্থান হইতে জল লইতে বলে এবং সেই জলই গঙ্গাজল হইবে। সাধুর কৃপায় প্রতিবৎসরে ঐ দিনে এই স্থানে গঙ্গার আবির্ভাব হয়, তাহারই জন্য এখানকার জল নিৰ্ম্মল হয়। এই দ্বিতীয় বিভাগের অধিনায়কগণ রাজপুত ও গিলহোটজাতীয়। তৃতীয় অংশের নাম শত্রুঞ্জয়। এই অংশের মধ্যে পারিম দ্বীপ। এ অংশের জমীদারেরা গৌঘিলবংশীয়। চতুর্থ অংশে মেহিয়া ও তলজাবন্দর অবস্থিত। এখানে ওয়াজে জাতীয় লোক বাস করে। পঞ্চম অংশের নাম জগৎ, ইহাকে দ্বারিকাও বলে। হিন্দুর দেবতা কৃষ্ণ মথুরা ত্যাগ করিয়া এই দ্বারিকায় আসিয়া বাস করেন এবং এখানেই প্রাণত্যাগ করেন। ষষ্ঠ অংশে বড় বড় পৰ্বত, বড়বড় নদী এবং বিশাল অরণ্য চিতোর-সম্প্রদায়ের লোকেরা এখানে বাস করিয়া থাকে। সপ্তম অংশে বাঘেলিয়া সম্প্রদায় বাস করে। এইখানে আবীর-জাতীয় কবিগণও বসতি করে। কেহ কেহ বলেন, এই জাতি আরববংশসম্ভুত। ইহারা অতিশয় অতিথিপরায়ণ; ইহারা সকল জাতির সহিত আহার করিয়া থাকে; ইহারা সকলেই সুস্থ, সবলকায় এবং সুশ্রী। এই জাতির নিকটেই আর এক সম্প্রদায়ের আহীরগণ বাস করে, তাহাদের নাম পুরঞ্জ; ইহারা জামগণের সহিত সৰ্ব্বদাই যুদ্ধে নিযুক্ত আছে। অষ্টম অংশে ঝাঞ্জীর বন্দর, ওয়াটী সম্প্রদায়ের আবাসস্থল। নবম অংশে চারণ জাতির বাসভূমি। এস্থানের লোকেরা বলে যে, মহাদেবের কপালের ঘর্ম হইতে চারণনামে একজনের জন্ম হয়; মহাদেব এই চারণের হস্তে তাহার বাহন বলদের সেবার ভার অর্পণ করেন। চারণ দিবানিশি মহাদেবের নামগান করিত এবং ভূত ভবিষ্যৎ বলিয়া দিতে পারিত। বর্তমান চারণগণ তাহারই বংশধর; সুতরাং গান করা এবং ভবিষ্যৎ গণনা করাই ইহাদের ব্যবসা। ভারতবর্ষের সকল বড় মানুষের গৃহেই একজন না একজন চারণ আছে। ইহারা নষ্টদ্রব্যও উদ্ধার করিয়া দিতে পারে। এখানে ভাট নামে আর এক জাতি আছে; ইহারাও সঙ্গীতব্যবসায়ী, কিন্তু যুদ্ধ-বিগ্রহে চারণগণের সঙ্গীত ভাটগণের সঙ্গীত অপেক্ষা অধিক কার্যকরী হয়; বিশেষ চারণগণ যুদ্ধবিদ্যায়ও পারদর্শী; তাহারা বলে, ভাট অপেক্ষা চারণ উচ্চশ্রেণীর, কারণ, চারণগণ মহাদেবের ঘর্ম হইতে উৎপন্ন হইয়াছে, আর ভাটগণ তাহার নাভি হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। পরগণা চালোয়ার অতি নিম্নভূমি, বর্ষাকালে সমুদ্রজলে ডুবিয়া যায়। তাহার পর যখন জল সরিয়া যায়, তখন এই স্থানে যথেষ্ট লবণ পাওয়া যায়। এ লবণ হইতে পাদশাহের যথেষ্ট আয় হইয়া থাকে। এইদেশের অধিকাংশই জঙ্গলময় এবং বালুকাপূর্ণ; এখানকার আম অতি উৎকৃষ্ট। এখানকার লোক দেখিতে সুন্দর; তাহারা লম্বা দাড়ী রাখে। এ অঞ্চলে আর একজন জমিদার আছেন; তাহার নাম জাম; ইনি নওনগরের স্থাপয়িতা। বর্তমান রাজা শশাল তাহার পৌত্র। এখানে বহুকাল মুসলমানধর্ম প্রচলিত ছিল। সরকার পত্তনের নিকট একটী রাজ্য আছে; সিরোহী সেই রাজ্যের রাজধানী; এখানে একটী দুর্গ আছে। গুজরাট ৯ সরকারে বিভক্ত। ইহাতে ১৯৮টী পরগণা আছে। ইহার মধ্যে ১৩টী পরগণা বন্দর। এখানকার রাজস্ব মোট ১০৯৫১২৩ টাকা ৩ আনা ১১ পাই। এই সুবায় ৬৭৩৭৪ জন অশ্বারোহী ও ১০০ পদাতিক আছে।
হিন্দুগণের পুস্তকে লিখিত আছে যে, বিক্রম সংবৎ ৮০২ বৎসরে বংশরাজ গুজরাট রাজ্য স্বাধীন করেন। কনোজের রাজা শ্রীভজদেব সামন্ত সিংহ তাহার একজন প্রজাকে হত্যা করেন এবং সর্বস্ব লুণ্ঠন করেন। সামন্ত সিংহের গর্ভবতী স্ত্রী গুজরাটে পলায়ন করেন এবং সেখানে এক অরণ্য-মধ্যে একটী পুত্রসন্তান প্রসব করেন। এই পুত্ৰই বংশরাজ। ঘটনাক্রমে উজ্জয়িনীবাসী শৈলদেব নামে একজন সন্ন্যাসী সেই অরণ্যপথে যাইতেছিলেন, অসহায়া রমণীকে সদ্যপ্রসূত শিশুসন্তান লইয়া ঘোরবিপদে পতিতা দেখিয়া সন্ন্যাসী তাহাদের রক্ষণাবেক্ষণের ভার একটী শিষ্যের উপর অর্পণ করেন। শিষ্য ইহাদিগকে লইয়া রাকণখুরে রাখে। বংশরাজ বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে দস্যুদলে প্রবেশ করে এবং ক্রমে এই দলের ক্ষমতা এতদূর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় যে, বংশরাজ একদিন কনোজগামী সরকারী রাজস্ব লুঠ করেন। অবশেষে বংশরাজ পঞ্চাশৎ বৎসর বয়ঃক্রমকালে গুজরাটের সিংহাসন অধিকার করিয়া স্বাধীনভাবে রাজত্ব করিতে থাকেন। তিনি পত্তনগর স্থাপিত করেন। কোথায় রাজধানী স্থাপন করিবেন, এই চিন্তা মনে উদয় হইলে একদিন একটী রাখাল বালক তাহাকে বলে, “আপনি যদি আমার নামে রাজধানী করেন, তাহা হইলে আমি একটী সুন্দর স্থান দেখাইয়া দিতে পারি।” রাজা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইলে রাখাল তাহাকে একটী সুন্দর স্থান দেখাইয়া দেয়। রাজা সেইস্থানে রাজধানী স্থাপন করিয়া পূৰ্ব্বপ্রতিশ্রুতি অনুসারে সেই রাখালবালকের নামে রাজধানীর নাম আনহালপুর রাখেন। জ্যোতিষী পণ্ডিতগণ ভবিষ্যৎ গণনা করিয়া বলেন যে, এই রাজধানী স্থাপিত হইবার ২৫০০ বৎসর সাত মাস নয় দিন এগার ঘণ্টার পর এই রাজধানী ধ্বংশ প্রাপ্ত হইবে। এই নগরীবিক্রম সংবৎ ৮০২ বৈশাখমাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে রবিবার সূর্যোদয়ের বাইশ ঘড়ি, পঁয়তাল্লিশ পল গতে স্থাপিত হয়। বহুদিন পরে এই নগরীর নাম পরিবর্তিত হইয়া নরওয়ালা নাম হয়, অবশেষে সে নামও উঠিয়া গিয়া পত্তন নামেই রাজধানী অভিহিত হয়। রাজা সামন্তসিংহ সোলাঙ্কিবংশীয় দিল্লীরাজপরিবারের এক যুবকের সহিত নিজ পুত্রীর বিবাহ দেন। এই বিবাহে যে পুত্র জন্মে সে মূলাযোগে জন্মগ্রহণ করায় তাহার নাম মূলরাজ রাখা হয়। সামন্তরাওয়ের আর পুত্রসন্তান না থাকায় দৌহিত্রকেই পুত্রবৎ পালন করেন এবং মূলরাজ বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে সামন্তসিংহ মূলরাজকেই রাজ্য প্রদান করিয়া নিজে বিষয়কাৰ্য্য হইতে অবসর গ্রহণ করেন, কিন্তু কয়েকদিন পরেই তাহার মতি ফিরিয়া যাওয়ায় তিনি রাজ্যদান অস্বীকার করেন। মূলরাজ তখন ষড়যন্ত্র করিয়া মাতামহের প্রাণসংহার পূর্বক সিংহাসনে আরোহণ করেন। জমিন্দের রাজত্ব সময়ে গজনীর সুলতান মামুদ গুজরাট আক্রমণ করেন এবং অনেক ধনসম্পত্তি ও রাজাকে বন্দী করিয়া লইয়া চলিয়া যান এবং গুজরাটে একজন নূতন রাজা প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু এই নূতন রাজা একদিন স্বপ্নদর্শন করিয়া সুলতানের নিকট বন্দীরাজার পুনঃ প্রেরণের প্রস্তাব পাঠান। সুলতান তাঁহাকে প্রেরণ করেন; এদিকে একদিন নূতন রাজা বনের মধ্যে নিদ্রা যাইতেছেন এমন সময়ে একটী বন্য-পাখী তাহার চক্ষু উৎপাটন করিয়া ফেলে। অন্ধ ব্যক্তি রাজা হয় না, তজ্জন্য প্রজাগণ তাহাকে পদচ্যুত করে এবং সেই সময়ে বন্দী উপস্থিত হইলে তাহাকেই রাজাসনে বসায়। তাহার রাজত্বের পর বাঘেলা-বংশীয়গণ গুজরাটের রাজা হন। এই বংশীয় রাজা কর্ণের রাজতৃসময়ে সুলতান আলাউদ্দীন গুজরাট আক্রমণ করেন; রাজা রাজ্য ত্যাগ করিয়া পলায়ন করেন; রাজ্য দিল্লীর অধিকারভুক্ত হয়। ফিরোজ-শাহের পুত্র সুলতান মহম্মদ। নিজাম মুস্তাকরেজকে গুজরাটের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন; কিন্তু ইনি অতিশয় প্রজাপীড়ন করায় সুলতান জাফর খাকে শাসনভার প্রদান করেন; জাফর যা পূর্বে ব্রাহ্মণ ছিলেন, পরে মুসলমানধৰ্ম্ম গ্রহণ করেন। এদিকে দিল্লীতে সুলতান মহম্মদের মৃত্যুর পর ঘোর বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হয়। সেই সময়ে জাফর খা শাসনভার ত্যাগ করেন এবং টার্টার খা তাহার পদে নিযুক্ত হন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই কে যেন তাঁহাকে বিষপ্রদানে নষ্ট করে। তখন জাফর খাঁ পুনরায় রাজ্যভার গ্রহণ করেন এবং দিল্লীর প্রাধান্য অস্বীকার করেন। গুজরাট আবার স্বাধীন হয়। তাতার আহম্মদ নামে তাঁহার এক পৌত্র জাফরের বংশের সমস্ত পুরুষদিগকে নিধন করিয়া নিজে সিংহাসন গ্রহণ করেন। তিনিই আহম্মদাবাদ নগরী স্থাপন করেন। তাহার পর গুজরাট রাজ্যে অনেক গোলযোগ উপস্থিত হয়। অবশেষে মজফর নামে এক ব্যক্তি স্থানীয় আমীরগণের সাহায্যে রাজ্য প্রাপ্ত হন। সুলতান মজফরের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র সেকেন্দর নামধারণ পূর্বক সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু আমেদ উল মুলুক নামে একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি সেকেন্দরকে নিহত করিয়া নিজ কনিষ্ঠ ভ্রাতা নাদিরকে সিংহাসন প্রদান করেন। দেশের বড়লোকেরা ইহাতে অসন্তুষ্ট হইয়া আমেদ উল মুলুকের প্রাণসংহারের ষড়যন্ত্র করেন। আমেদ উল মুলুক অনন্যোপায় হইয়া দিল্লীর সম্রাট বাবরের শরণাপন্ন হন এবং বাবর যদি তাহার ভ্রাতা নাদিরকে সিংহাসনে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করিতে পারেন, তাহা হইলে তিনি বাবরকে ডিউবন্দর ও অনেক অর্থদান করিবেন স্বীকার করেন। কিন্তু উন্নতমনা সম্রাট বাবর তাহার এ প্রস্তাব ঘৃণার সহিত অগ্রাহ্য করেন। তখন দেশের প্রধান ব্যক্তিগণ দিল্লী হইতে সুলতান মোজাফরের পুত্র সুলতান বাহাদুরকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনেন এবং তাহাকেই গুজরাটের অধীশ্বর করেন। তাঁহার পরে তাহার ভ্রাতা সেকেন্দর রাজ্য প্রাপ্ত হন, কিন্তু তিনি নির্বুদ্ধিতাহেতু দিল্লীর সম্রাট বাদশাহ হুমায়ুনের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করেন এবং পরাজিত হন। তাঁহার মৃত্যুর পর দেশের লোকেরা মোজাফরের ভ্রাতুস্পুত্র খান্দেশের শাসনকর্তা মিরণের হস্তে রাজ্য অর্পণ করেন; কিন্তু তিনি রাজ্যভার গ্রহণ করিবার পূর্বেই গতায়ু হওয়ায় মোজাফরের পৌত্র মহম্মদ সিংহাসনে আরোহণ করেন, কিন্তু গুরগন নামে একজন দুষ্টলোক ষড়যন্ত্র করিয়া তাহার প্রাণসংহার করে এবং রেজা উল মুলুক নামে একজনকে নামেমাত্র রাজা করিয়া নিজেই প্রকৃতপক্ষে রাজ্যশাসন করিতে থাকে।
গুজরাট রাজগণের তালিকা
প্রথম তালিকা,বংশরাজের বংশ, এই বংশে সাতজন রাজা ১৯৩ বৎসর রাজত্ব করেন। বংশরাজ ৬০ব, যেজারাজ ৩৫ব, ভীমরাজ ২৫ব, ভররাজ ২৯ব, বাহির সিং ২৫ব, রেসাদৎ ১৫ব, সামন্ত ৭ বৎসর।
দ্বিতীয় তালিকা,–সোলঙ্কীবংশীয় দশজন রাজা ২৪৪ বৎসর রাজত্ব করেন। মূলরাজ ৫৬ব, জামা ১৩ব, বল্লভ ৬ মাস, দুর্লভ ১১ব ৬মা, ভীম ১২ব, বর্ণ ৩১ ব, জয়সিং ৫০ব, কন্দরপাল ২৩ব, অজিত পাল ৩ব, লক্ষমূল ৮ বৎসর।
তৃতীয় তালিকা,বাঘোলা-বংশীয় ছয়জন রাজা ১২৬ বৎসর রাজত্ব করেন। বীরম ১২ব, বলদেব ৩৪ব ৬মা ১০ দি, ভীম ৪২ব, অর্জুনদেব ১০ব, সারঙ্গদেব ২১ব, কর্ণ ৬ব ১০মা ১৫ দিন।
চতুর্থ তালিকা,-১৪ জন মুসলমান রাজা ১৩০ বৎসর রাজত্ব করেন। সুলতান মহম্মদ ৩ব ৮মা ১৩ দি, সুলতান আমেদ ৩২ব ৬মা ২০দি, মহম্মদ শা ৭ব ৯মা ৪দি, কুতুবুদ্দীন আহমদ শা ৭ব ১৩দি, দায়ূদ শা ৭দি, মামুদ শা ৫৫ব ১ম ৪দি, সুলতান মজঃফর ১৪ব ৯মা, সুলতান সেকেন্দর ১০মা ১৯দি, নাসির খা ৪মা, সুলতান বাহাদুর ১১ ৯মা, মহম্মদ শা ১মা ১৫দি, সুলতান মামুদ ১৮ব ২মা, সুলতান আমেদ ৮, সুলতান মজফর ১২ব কয়েকমাস।
সুবে অজমীর
এই সুবা দৈর্ঘ্যে বেখর ও অম্বর হইতে বিকানীর ও যশলীর পর্যন্ত ১৬৮ ক্রোশ এবং প্রস্থে সরকার অজমীরের সীমা হইতে বাঁশওয়ারে পৰ্য্যন্ত ১৫০ ক্রোশ। ইহার পূর্বে আগরা, উত্তরে দিল্লীর কিয়দংশ, দক্ষিণে গুজরাট এবং পশ্চিমে মুলতান সরকারের অন্তর্গত প্রদেশ। এই সুবার ভূমি অত্যন্ত বালুকাপূর্ণ, অনেক বড় গর্ত করিলে তবে জল পাওয়া যায়, সুতরাং এ প্রদেশের শস্য বৃষ্টির উপর নির্ভর করে। জোয়ার, গেধেরা এবং মাওথ এখানে উৎপন্ন হইয়া থাকে। এ প্রদেশের রাজস্ব উৎপন্ন দ্রব্যের সপ্তমাংশ কি অষ্টমাংশের দ্বারা আদায় হয়, টাকা দেওয়া হয় না। এই সুবার দক্ষিণে পৰ্বতমালা। মেওয়ার, মাড়োওয়াড় ও হারাবতী এই সুবার অন্তর্গত। মেওয়ারে দশহাজার পল্লী আছে এবং সমস্ত চিতোর সরকার ইহার অধীন। ইহা ৪০ ক্রোশ দীর্ঘ এবং ৩০ ক্রোশ প্রস্থ। ইহার মধ্যে চিতোর, কমল-মীর ও মণ্ডল নামে তিনটী প্রসিদ্ধ দুর্গ আছে। এই সুবার শাসনকর্তা চিতোরে বাস করেন, চৌড়াতে লৌহের খনি আছে। মণ্ডল সরকারের অন্তর্গত জয়েনপুর ও অন্যান্য কয়েকটী স্থানে তারে খনি আছে। এই প্রদেশের অধিনায়কদিগকে পূৰ্ব্বে রাউল বলিত; এক্ষণে তাহারা রাণা নামে অভিহিত। ইহারা গিহেলাটবংশীয় এবং নওসীরবানে ইহাদের আদিপুরুষ। এই বংশের এক ব্যক্তি স্বদেশে বিপদাপন্ন হইয়া বিরার দেশে আগমন করেন এবং অবশেষে বারনালার অধিনায়ক হন। এই পুস্তক লিখিত হইবার আটশত বৎসর পূর্বে একবার বারনালা আক্রান্ত হয় এবং অনেক অধিবাসী নিহত হয়। সেই গোলযোগসময়ে বাপ্পা নামে একটী বালককে লইয়া তাহার মাতা মেওয়ারে পলায়ন করেন এবং মেওয়ারের মালিক ভীলের আশ্রয় গ্রহণ করেন। যখন বাপ্পা বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেন, তখনও তিনি আশ্রয়দাতার মেষপালনে নিযুক্ত। কিন্তু তিনি ধনুর্বিদ্যায় এমন পারদর্শী ছিলেন যে, তাহার খ্যাতির কথা মেওয়াররাজের কর্ণগোচর হইল এবং রাজা তাহাকে সরকারী কার্যে নিযুক্ত করিলেন। রাজার মৃত্যুর পর তাঁহার চারিজন ভ্রাতুস্পুত্র সিংহাসন লইয়া গোলযোগ আরম্ভ করিলেন; অবশেষে চারিজনেই এই স্থির করিলেন যে, বাপ্পাকে রাজা করা হউক; কিন্তু বাপ্পা রাজ্যভার লইতে অস্বীকার করিলেন। এই সময়ে হঠাৎ একদিন ঐ ভ্রাতুচতুষ্টয়ের একজনের অঙ্গুলি কাটিয়া রক্ত বাহির হয়; সে তৎক্ষণাৎ সেই রক্ত দ্বারা বাপ্পার কপালে ফোঁটা দিয়া দেয়। এই নরক্তের ফোঁটা দেওয়ায় বাপ্পার সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা স্থির হইয়া গেল। বাপ্পাকে বাধ্য হইয়া সিংহাসন গ্রহণ করিতে হইল। সেই দিন হইতে এই বংশে এই নিয়ম চলিয়া আসিতেছে যে সিংহাসনে আরোহণের সময় রাজাকে নররক্তের ফোঁটা কাটিতে হয়। বাপ্পা রাজা হইয়া নৃশংসরূপে ভ্রাতৃচতুষ্টয়ের প্রাণবিনাশ করেন এবং তাহাদের দয়ার সম্পূর্ণ প্রতিশোধ প্রদান করেন। শুনিতে পাওয়া যায় যে, বাপ্পার রাজা হওয়ার কিছুদিন পূর্বে তিনি একদিন বনের মধ্যে শীকার করিতে যাইয়া বন্যজন্তুভ্রমে হরভজ্ঞ নামে সন্ন্যাসীর উপর তীর নিক্ষেপ করিতেছিলেন, কিন্তু সন্ন্যাসীর চিৎকারে নিজের প্রম বুঝিতে পারিয়া সন্ন্যাসীর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সেই সন্ন্যাসীই তাহার রাজসিংহাসন প্রাপ্তির ভবিষ্যদবাণী করেন। বাপ্পা প্রথমে শিশোদিয়া গ্রামে বাস করিতেন। সেই জন্য তাঁহার বংশ শিশোদিয়া বংশ নামে অভিহিত। রেউল রতন সিংহের মৃত্যুর পর তাহার জামাতা আর্শি রাজা হন। ইনি প্রথম রাণা উপাধি গ্রহণ করেন। বর্তমান রাণা অমর সিং আশির দশম বংশধর। পূর্ববর্তী রাজগণের নাম জমির সালখা, সকুল, গুনহা, রায়মল, মস্ক, উদয় সিং, প্রতাপ সিং, অমর সিং। এই নাম কয়টী সম্বন্ধে আমাদের বিশেষ গোলযোগ উপস্থিত হইয়াছে। টডের প্রণীত রাজস্থান এবং অন্যান্য ইতিহাস দৃষ্টে জানিতে পারা যায় যে, এই দশজন রাজার নাম হামির, খয়েৎসিং, লক্ষ, মুকুজি, কুম্ভ, রায়মল, সঙ্গ, উদয় সিং, প্রতাপ সিং এবং অমর সিং। ইহাই সত্য বলিয়া মনে হয়। এই স্থলে আরও কয়েকটী ঐতিহাসিক তথ্যের আলোচনা করা কর্তব্য। বনের মধ্যে বাপ্পারাওয়ের রাজ্যপ্রাপ্তির গল্প রাজস্থানে দেখিতে পাওয়া যায় না। রাজস্থানে অন্য প্রকারের গল্প লিখিত আছে।
পূর্বতন ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, সুলতান আলাউদ্দীন খিলিজি মেওয়ারের রাজা রাওয়েল রতন সিং বা ভীমসিংহের পত্নীর অসামান্য সৌন্দর্যের কথা শুনিয়া তাহাকে চাহিয়া পাঠান। ভীমসিং পত্নীত্যাগে অসম্মত হন। আলাউদ্দীন ক্রোধভরে চিতোর অবরোধ করেন। কিন্তু সুলতান যখন দেখিলেন, চিতোর জয় সহজ ব্যাপার নহে, তখন কৌশলে কাৰ্য্যসিদ্ধি করিবার মানসে সন্ধির প্রস্তাব করিলেন। রাজা ভীমসেন সুলতানের চাতুরীতে কোন সন্দেহ না করিয়া সুলতান শিবিরে গমন করিলেন এবং বন্দী হইলেন। এদিকে রাজমহিষী স্বামীর বন্দী হওয়ার সংবাদ পাইয়া এক চাতুরী অবলম্বন করিলেন। তিনি সুলতানের হস্তে আত্মসমর্পণ করিতে সম্মত হইলেন। নির্দিষ্ট দিনে রাজমহিষী সাতশত উৎকৃষ্ট সৈনিক পুরুষকে স্ত্রীবেশে সজ্জিত করিয়া অস্ত্র সস্ত্র সহ ডুলীতে আরোহণ করিয়া সুলতানের শিবিরে গমন করিলেন এবং সুলতানের নিকট এই প্রার্থনা জানাইলেন যে, তিনি যখন চিরদিনের জন্য সুলতানের অলক্ষ্মী হইতে যাইতেছেন, তখন এই সময়ে তাহার হতভাগ্য স্বামীর সহিত একবার শেষ দেখা করিতে চাহেন। সুলতান সম্মত হইলেন। রাজমহিষী রাজার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন এবং রাজা মহিষীর চতুর্দোলে উঠিয়া অলক্ষিতভাবে নিজ দুর্গে পৌঁছিলেন। রাজা নিরাপদে মহিষীসহ দুর্গে পৌঁছিতে দেখিয়া স্ত্রীবেশী সৈন্যগণ ডুলী হইতে অবতরণ করিল। এইবার যুদ্ধ আরম্ভ হইল। সুলতান সেবার ব্যর্থমনোরথ হইয়া দিল্লীতে ফিরিয়া গেলেন। পর বৎসর আবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কিছুই হইল না। অবশেষে সুলতানের সহিত পুনরায় রাজার সাক্ষাতের বন্দোবস্ত হইল এবং বিশ্বাসঘাতকের ষড়যন্ত্রে রাজা নিহত হইলেন। সুলতান পুনরায় চিতোর আক্রমণ করিলেন। চিতোরের রমণীগণ চিতায় প্রাণত্যাগ করিলেন। এসকল বিষয়ের বিশেষ বিবরণ রাজস্থানে লিখিত আছে।
মাতোয়ার দেশ দৈর্ঘ্যে ১০০ ক্রোশ এবং প্রস্থে ৭০ ক্রোশ। সরকার অজুমীর যোধপুর, সিররাহী, নাগর এবং বিকানীর, মাড়োয়ারের অন্তর্গত। বহুকাল হইতে রাঠোরেরা এই প্রদেশে বাস করিয়া আসিতেছেন। মইজুদ্দীন শ্যাম পৃথ্বিরাজকে পরাজয় করিয়া কনোজের রাজা জয়চন্দ্রের নৌকাযোগে পলায়ন করিবার সময় গঙ্গাগর্ভে ডুবিয়া মরেন। তাহার ভ্রাতুস্পুত্র শিকা সে সময়ে সমসাবাদে যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করেন। জয়চন্দ্রের দুইটী পৌত্র ছিলেন, তাঁহাদের নাম শিরাজি এবং সৈয়েতরাম। জয় শিরাজির পুত্র অশ্বখমা ও সৈয়েদমান। ইহারা দেশত্যাগ করিয়া গুজরাটে যাইতেছিলেন, কিন্তু ততদূর না যাইয়া সুয়েতের নিকট পেলিগ্রামে বাস করেন। এই গ্রামে অনেক ব্রাহ্মণের বাস ছিল। ব্রাহ্মণগণ সর্বদাই মিনাচ নামে এক সম্প্রদায় কর্তৃক অত্যাচারিত হইত। কিন্তু এবার যখন তাহারা অত্যাচার করিতে আসিল, সেই সময়ে এই তিনজন বীরভ্রাতা তাহাদিগকে পরাস্ত করিলেন। ব্রাহ্মণেরা তাহাদিগকে উপঢৌকন দিলেন এবং আশীর্বাদ করিলেন। ক্রমে তাহাদের ক্ষমতা এতদূর বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইল যে, তাহারা গহিল জাতিকে আক্রমণ করিয়া কুম্ভির রাজ্য আত্মসাৎ করিলেন। রাজকুমার সনিং ইদরদেশ অধিকার করিলেন। ক্রমে ক্রমে এই তিন ভাতা মাড়োয়ার রাজ্য হস্তগত করিলেন। এই সুবায় অনেকগুলি দুর্গ আছে। তন্মধ্যে অজমীর, যোধপুর, বিকানীর, যশলমির ও অমরকোটের দুর্গই প্রধান। এই সুবা সাতটী সরকারে বিভক্ত। ইহাতে ১৯৭টী পরগণা আছে। জরিপী জমীর পরিমাণ ২১৪৩৫৯৬১ বিঘা। সরকারী রাজস্ব ২৮৪১৫০৭ দাম। এই প্রদেশে ৮৬৫০০ অশ্বারোহী এবং ৩৪৭০০ রাজপুত পদাতিক আছে।
সুবে দিল্লী
এই সুবা দীর্ঘে ১৬৫ ক্রোশ এবং প্রস্থে ১৪০ ক্রোশ। ইহার পশ্চিমে আগরা, উত্তরপশ্চিমে খয়রাবাদ, উত্তরে পর্বতমালা, দক্ষিণে আগরা ও অজমীর, পশ্চিমে লুধিয়ানা। গঙ্গা এবং যমুনা এই সুবার প্রধান নদী। কাগার নামে আরও একটী ক্ষুদ্র নদী এই সুবার মধ্য দিয়া প্রবাহিত আছে। বর্ষাকালে এই সুবার অনেক স্থান জলে ডুবিয়া যায়। পারস্য, তাতার ও হিন্দুস্থানের সমস্ত ফলই এখানে জন্মে। এই সুবায় অনেক ইষ্টক ও প্রস্তরনির্মিত সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা আছে। পৃথিবীর সর্বদেশের সর্বপ্রকার দ্রব্যই দিল্লীতে পাওয়া যায়। দিল্লী অতি পুরাতন নগরী। পূর্বে ইহার নাম ইন্দ্ৰপ্ৰস্ত ছিল। সুলতান কুতবুদ্দীন এবং সুলতান অলতামাস, পৃথ্বিরাজনিৰ্মিত দুর্গেই বাস করিতেন। সুলতান গিয়াসুদ্দীন বুলবন দ্বিতীয় একটী দুর্গ নির্মাণ করেন। তিনি এই আদেশ প্রচারিত করেন যে, মহা অপরাধী ব্যক্তিও দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করিলে শাস্তি হইতে অব্যাহতি পাইবে। সুলতান কৈকবাদ যমুনার তীরে গমলুখেরি নামে একটী সহর প্রতিষ্ঠা করেন। এই সহরে ম্রাট হুমায়ুনের উৎকৃষ্ট সমাধিমন্দির আছে। সুলতান তোগল তোগলকাবাদ নগরী স্থাপিত করেন। ফিরোজাবাদ সহর সুলতান ফিরোজের প্রতিষ্ঠিত। তিনি যমুনা নদী হইতে এই সহর পর্যন্ত একটী খাল খনন করেন। ফিরোজবাদ হইতে তিন ক্রোশ দূরে তিনি আর একটী রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন, তাহার নাম জাহান্নম। সের খা দিল্লী ধ্বংস করেন। সেই ধ্বংসাবশেষ এখনও পড়িয়া রহিয়াছে। সেখানে অনেক সাধুপুরুষ, অনেক মহাত্মা ফকির, অনেক সুলতান এবং শাহজাদাদের সমাধিস্থল রহিয়াছে। এমন কি, যাহারা এখন জীবিত আছেন, তাঁহারাও সেইখানে নিজ নিজ সমাধিমন্দির নির্মাণ করাইয়া রাখিয়াছেন। ইসলামাবাদের পর্বতের উপরে একটী তপ্তকুণ্ড আছে। হিন্দুরা ইহাকে প্রভাস বলেন। বাদাউনে অনেক সাধুপুরুষের সমাধিমন্দির আছে। এই সুবার উত্তরাংশের পৰ্বতময় প্রদেশের নাম কমায়ুন। কমায়ুনে স্বর্ণ, সীসা, রৌপ্য, লৌহ, তাম্র এবং ফটকিরীর খনি আছে। এই স্থানে মৃগনাভি, চমরী গুটিপোকা, উত্তম অশ্ব এবং যথেষ্ট মধু পাওয়া যায়। হাংসি এই সুবার অন্তর্গত একটী পুরাতন সহর। সুলতান ফিরোজশা হিসার নামে আর একটী নগর স্থাপিত করেন। ফিরোজশাহ অনেকগুলি খাল কাটান। সরহিন্দ সহরে অনেক সুন্দর সুন্দর উদ্যান আছে।
থানেশ্বর হিন্দুদিগের প্রধান তীর্থস্থান। ইহার নিকটেই কুরুক্ষেত্র। এই কুরুক্ষেত্রে দ্বাপরযুগে কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ হয়। হস্তিনাপুর মহারাজ ভরতের রাজধানী ছিল। তিনি এমন ধার্মিক ছিলেন যে, দেবগণ প্রসন্ন হইয়া তাঁহাকে বর প্রদান করেন যে, তাঁহার বংশ বহুদিন হস্তিনাপুরে রাজত্ব করিবে। এই বংশের অষ্টম রাজার নাম কুরু এবং কুরুক্ষেত্র তাহারই নামে অভিহিত। বিচিত্রবীৰ্য্য এই কুরুবংশে জন্মগ্রহণ করেন। বিচিত্রবীর্যের দুই পুত্র–ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু। ধৃতরাষ্ট্রের একশত এক পুত্র ছিল, সৰ্ব্বজ্যেষ্ঠের নাম দুৰ্য্যোধন। এই বংশের সাধারণ নাম কৌরব। পাণ্ডুর পাঁচ পুত্র– যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব। এইবংশের সাধারণ নাম পাণ্ডববংশ। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন বলিয়া পাণ্ডু হস্তিনাপুরের রাজা হন। পাণ্ডুর মৃত্যুর পর ধৃতরাষ্ট্র রাজ্যভার গ্রহণ করেন, পাণ্ডুপুত্রেরা সিংহাসনে বঞ্চিত হন। পাছে ভবিষ্যতে দুর্যোধনের সহিত পাণ্ডবগণের বিবাদ হয়, এই জন্য বারণাবত নামক স্থানে জতুগৃহ নিৰ্মাণ করিয়া পঞ্চপাণ্ডবের বিনাশের ষড়যন্ত্র হয়। পাণ্ডবগণ এই বিষয় অবগত হইয়া পলায়ন করেন। অনেক ঘটনার পর পাণ্ডবেরা দেশে ফিরিয়া আসেন এবং রাজ্য অৰ্দ্ধাংশ করিয়া লন। দুৰ্য্যোধন পাদশাখেলায় যুধিষ্ঠিরের সমস্ত রাজ্য জিতিয়া লন। পাণ্ডবেরা দ্বাদশ বৎসর দেশত্যাগ করিতে বাধ্য হন। তাহার মধ্যে একবৎসর অজ্ঞাতবাসেও থাকিতে হয়। দ্বাদশ বৎসর গত হইলে পাণ্ডবেরা নিজরাজ্য চাহিয়া পাঠান; কিন্তু দুৰ্য্যোধন বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র-ভূমিও দান করিবেন না বলেন। এই জন্যই কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ– অষ্টাদশদিনব্যাপী হয় এবং পাণ্ডবেরা জয়লাভ করেন। কলিযুগ আরম্ভ হইবার ১০৫ বৎসর পূর্বে দ্বাপরযুগে এই যুদ্ধ হয়। বাদশাহ আকবরের রাজত্বের ৪৮৩১ বৎসর পূর্বে মহাভারতের যুদ্ধের সময় নির্দিষ্ট হইয়াছে। এই যুদ্ধে কুরুপক্ষে একাদশ অক্ষৌহিণী এবং পাণ্ডপক্ষে সপ্ত অক্ষৌহিণী সেনা ছিল। এই যুদ্ধে উভয়পক্ষের অনেক সেনা নিহত হয়। কুরুপক্ষে কেবলমাত্র চারিজন এবং পাণ্ডবপক্ষে আটজন জীবিত থাকেন। কৌরবগণের চারিজনের নাম কৃপাচার্য্য, অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা ও সঞ্জয় এবং পাণ্ডবপক্ষের আটজনের নাম পঞ্চ পাণ্ডব, সাত্যকি, যুযুৎসু এবং স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। এই যুদ্ধের বিবরণ হিন্দুগণের লিখিত মহাভারতে সবিস্তারে বর্ণিত আছে। এই বংশের শেষ ইতিহাস মহাভারতে নাই, হরিবংশে আছে। এই সুবা আটটি সরকারে বিভক্ত। ইহাতে ২৩২টা পরগণা আছে।
দিল্লী-রাজগণের তালিকা
প্রথম তালিকা,–আনন্দপালের বংশীয় কুড়িজন রাজা ৪৩৭ বৎসর ১ মাস ২৮ দিন রাজত্ব করেন। এই স্থানে একটী কথা বলিয়া রাখা আবশ্যক। বর্তমান ইতিহাস-লেখক আবুল ফজল প্রত্যেক রাজার শাসনকাল যে কয়েক বৎসর বলিয়াছেন, তাহার সমস্তগুলি যোগ দিলে তাহার কথিত যোগফলের সহিত মিলে না, অথচ তিনি প্রত্যেক রাজার রাজত্ব সময় মাস এবং দিন পর্যন্ত হিসাব করিয়া বলিয়াছেন। বিশেষত ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহাসিকের লিখিত বিবরণে অনেক অনৈক্য দেখিতে পাওয়া যায়। আমরা এই জন্য মাস ও দিন ছাড়িয়া দিয়া কেবলমাত্র বৎসরই লিখিলাম। পাঠকগণ জানিয়া রাখিবেন যে এই সমস্ত বৃত্তান্তের ঐতিহাসিক তত্ত্ব সম্বন্ধে আমাদের অনুসন্ধান করা এক্ষেত্রে কর্তব্য নহে; কারণ আমরা কেবলমাত্র ঐতিহাসিক আবুল ফজলের লিখিত তত্ত্বই অনুবাদ করিব। অনঙ্গপাল ১৮ব, বসুদেব ১৯ব, গল্প ২১ব, পৃথ্বীমল ১৯ব, জয়দেব ২০ব, নৃপাল ১৪ব, আদির ২৬, বিষরাজ ২১ব, বিক ২২, রেখপাল ২১ব, সুখপাল ২০ব, গোপাল ১৮ব, সেলেখা ২৫ব, জয়পাল ১৬ব, কুমার পাল ১৯ব, অনঙ্গপাল ২৯ব, বেজমাল ২৪ব, মহৎপাল ২৫ব, আকপাল ২১ব, পৃথ্বীরাজ ২২ বৎসর।
দ্বিতীয় তালিকা,রাজা বলদেববংশীয় ৭ জন রাজা ৮৩ বৎসর রাজত্ব করেন। বলদেব চৌহান ৬ব, অকরগঙ্গা ৫ব, ক্ষিরপাল ২০ব, সরম ৭ব, জহর ৪ব, নাগদেব ৩ব, পিথোরা ৪৮ বৎসর।
তৃতীয় তালিকা,-ঘোরবংশীয় ১১ জন রাজা ৯৩ বৎসর রাজত্ব করেন। সুলতান মোজউদ্দীন সাম ১৪ব, কুতবুদ্দীন ৪ব, আমাম শা ১ব, সমসুদ্দীন আলতামস ২৬, রকুনুদ্দীন ফিরোজশাহ ৬ মাস, রিজিয়া বেগম ৩ব, বহরম শা ২ব, মসাউদ শা ৪ৰ, নসিবুদ্দীন ১৯ব, বুলবুল ২০ব, কৈকোবাদ ২ বৎসর।
চতুর্থ তালিকা,খিলিজি ও তোগলকবংশীয় ১৩ জন ম্রাট ১২৯ বৎসর রাজত্ব করেন। জেলাউদ্দীন ৭ব, আলাউদ্দীন ৩০ব, সাহাবুদ্দীন ১৪ব, নসিবুদ্দীন ৩মা, গেয়াজুদ্দীন তোগলফ ৪ব, মহম্মদ ২৭ব, ফিরোজ শা ২৮ব, তোগলক শা মা, আবু বেগার ১ব, সিকন্দার ১মা, মামুদ ১০ বৎসর।
পঞ্চম তালিকা,খিজির খা ৭ব, মোবারক খ ৩ব, মহম্মদ শা ১০ব, আলা উদ্দীন ৭ব, বিললাললোদী ৩৮ব, সিকন্দর লোদী ২৮, ইব্রাহিমলোদী পব, সুলতান বাবর ৫, হুমায়ুন ৯ব, সের খা শুর ৫ব, সেলিম খ ৮ব, ফিরোজ খা ৩দি, আদেলী (রাজত্ব করেন নাই), ইব্রাহিম কয়েকমাস সেকেন্দার কয়েক মাস, হুমায়ুন পুনরায় ১বৎসর।
দিল্লী-রাজগণের ইতিহাস
বিক্রম সংবৎ ৪২৯ অব্দে তেনোরবংশীয় অনঙ্গপাল দিল্লী-নগর স্থাপিত করেন। উক্ত সংবৎ ৮৪৮ অব্দে দিল্লীর নিকটে পৃথ্বীরাজ তেনোরের সহিত বলদেব চৌহানের যুদ্ধ হয়; সেই যুদ্ধে বলদেব জয়ী হইয়া দিল্লীতে চৌহান বংশের রাজত্ব স্থাপন করেন। রাজা পৃথ্বীর রাজত্বসময়ে গজনীপতি সুলতান মৌজদ্দী সাম অনেকবার দিল্লী আক্রমণ করেন কিন্তু একবারও কৃতকাৰ্য্য হইতে পারেন নাই। পর পর সাতটি যুদ্ধেই পৃথী জয়ী হন। অবশেষে অষ্টম যুদ্ধে পৃথ্বী বন্দী হন। যুদ্ধ পরাজয়ের বৃত্তান্ত এই,-রাজার অধীনে অনেক সামন্ত ছিলেন, কিন্তু এবারের যুদ্ধে একজনও উপস্থিত হন নাই। তাহার কারণ এই যে, সেই সময়ে জয়চন্দ্র নামে একজন মহা প্রতাপশীল রাজা কনোজে রাজত্ব করিতেন; তিনি এমন রাজা ছিলেন যে, পারস্য ও তাতারদেশীয় অনেক যোদ্ধাও তার অধীনে কাজ করিত। তিনি রাজসূয়যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন; সেই যজ্ঞের নিয়ম এই যে, সমস্ত কাৰ্য্যই রাজগণের দ্বারা সম্পন্ন করাইতে হয়, এমন কি, সামান্য দাসের কাৰ্য্যও রাজগণকেই করিতে হয়। এই যজ্ঞস্থলে ভারতবর্ষের সমস্ত রাজাই উপস্থিত হইয়াছিলেন, কেবল দিল্লীর রাজা পৃথ্বী উপস্থিত হন নাই। পরন্তু তিনি আগমনের উদ্যোগ করিতেছিলেন, এদিকে তাঁহার আগমনের বিলম্ব দেখিয়া জয়চন্দ্রের সভায় কথা উঠিল যে, চৌহান রাজাই রাজ-চক্রবর্ত্তী, সুতরাং জয়চন্দ্র এই রাজসূয় যজ্ঞের অধিকারী নহেন, সেই কারণেই পৃথ্বীরাজ যজ্ঞে আগমন করেন নাই। এই কথা যখন পথীর কর্ণ-গোচর হইল, তখন তিনি আর কনোজে গেলেন না। জয়চন্দ্র তখন পারিষদগণের পরামর্শে পৃথ্বীরাজের স্বর্ণময়মূর্তি নির্মাণ করিয়া সেই মূৰ্ত্তি রাজদ্বারে দ্বারীর আসনে বসাইয়া দিলেন। এই সংবাদ পাইয়া পৃথ্বীরাজ ছদ্মবেশে পাঁচশত বাছা বাছা যোদ্ধা সমভিব্যাহারে যজ্ঞক্ষেত্রে গমন করিলেন এবং অনেক রক্তারক্তি করিয়া স্বর্ণমূৰ্ত্তি লইয়া রাজধানীতে চলিয়া গেলেন। জয়চন্দ্রের কন্যা পৃথ্বীরাজের এই অসীম বীরত্বের বিবরণ অবগত হইয়া তাহাকেই বরমাল্য দিতে প্রতিজ্ঞা করিলেন, সমাগত রাজগণের মধ্যে কাহাকেও বিবাহ করিতে সম্মত হইলেন না। রাজা জয়চন্দ্র কন্যার ব্যবহারে ক্রুদ্ধ হইয়া তাহাকে কারাগারে বন্দী করিলেন। এই সংবাদ পৃথ্বীরাজের কর্ণগোচর হইলে তিনি কৌশলে জয়চন্দ্রের দুহিতালাভের ব্যবস্থা করিলেন। কবি চন্দ বা চাকবি নামে তাঁহার একজন উৎকৃষ্ট গায়ক ছিলেন; রাজা ছদ্মবেশে চাকবির সহিত জয়চন্দ্রের সভায় গান করিতে গেলেন, সঙ্গে এক শত সামন্ত ছদ্মবেশে গেলেন। সেখানে জয়চন্দ্রের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ হইল। গোবিন্দ রায় ঘিলট যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিলেন। জয়চন্দ্রের ৭০০০ সৈন্য নিহত হইল। সোলাঙ্কিবংশীয় নরসিংহদেব, টাননন্দী, শার্পল, কাছওয়াবংশীয় পল্লহনদেব ও তাহার দুই ভ্রাতাও নিহত হইলেন। পৃথ্বীরাজ জয়চন্দ্রের দুহিতাকে দিল্লীতে লইয়া আসিলেন। সেই নবপরিণীতা পত্নীর রূপলাবণ্যে মোহিত হইয়া তিনি রাজকার্যে অবহেলা করিতে লাগিলেন। এই অবসরে সাহাবুদ্দীন রাজা জয়চন্দ্রের সহিত মিলিত হইয়া দিল্লী জয় করিতে অগ্রসর হইলেন। পৃথ্বীরাজ তখন বিলাসে এতই মগ্ন যে, কেহই তাহাকে এই সংবাদ দিতে সাহস করিল না। অবশেষে চাকবি অন্দরমহলে প্রবেশ করিয়া রাজাকে এই সংবাদ দিলেন। কিন্তু পূর্বে কয়েকবার জয়ী হইয়া রাজার মনে গর্বের উদয় হইয়াছিল। তিনি মনে করিলেন, অধিক সৈন্য সগ্রহের আবশ্যক নাই। তাই অল্পসংখ্যক সৈন্য লইয়া, এমন কি, কোন সামন্তকে সংবাদ না দিয়া যুদ্ধে অগ্রসর হইলেন। যুদ্ধে তাহার পরাজয় লইল। তিনি বন্দীভাবে গজনীতে নীত হইলেন। বিশ্বস্ত অনুচর চাঁদকবি ছদ্মবেশে তাহার সঙ্গী হইলেন। চাঁদ গজনীতে যাইয়া সুলতান সাহাবুদ্দীনের প্রিয়পাত্র হইলেন। সুবিধামত একদিন পৃথ্বিরাজের সহিত সাক্ষাৎ হইল। তখন পরামর্শ স্থির হইল যে, চাঁদকবি সুলতানের নিকট পৃথ্বিরাজের ধনুর্বিদ্যার প্রশংসা করিবেন, তাহা হইলেই সুলতান তাঁহার শিক্ষাকৌশল দেখিতে চাহিবেন। সেই সময়ে তিনি যেন তাহার তীরের সদ্ব্যবহার করেন। সেই প্রকারই বন্দোবস্ত হইল। পৃথ্বীরাজের অব্যর্থ সন্ধানে সুলতান প্রাণত্যাগ করিলেন। হিন্দু ঐতিহাসিকগণ এই গল্প বলেন। কিন্তু মুসলমান ঐতিহাসিকেরা বলেন যে, পৃথ্বীরাজ যুদ্ধক্ষেত্রেই নিহত হন। এই পৃথ্বীরাজের সহিতই দিল্লীর চৌহানা রাজ বংশের বা হিন্দুরাজ্যের অবসান হইল।
সুলতানের প্রতিনিধি কুতবুদ্দীন দিল্লীর শাসনকর্তা নিযুক্ত হইলেন, অথবা বলিতে গেলে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। ইনিই দিল্লীর প্রথম মুসলমান ম্রাট। তাহার মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র আরাম শাহ রাজা হইলেন। সেই সময়ে আলটামাস নামে কুতুবুদ্দীনের একজন কৃতদাস বিশেষ প্রতাপশালী হন। তাঁহার ভয়ে আরাম শাহ পলায়ন করিলেন এবং তিনি সিংহাসন অধিকার করিলেন। আলটমাস বাল্যাবস্থায় নানাস্থানে দাসত্ব করেন। অবশেষে একজন সওদাগর তাঁহাকে কুতবুদ্দীনের নিকট বিক্রয় করেন। আলটামাসের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র সিংহাসন প্রাপ্ত হন। কিন্তু ইনি অত্যন্ত অসচ্চরিত্র হওয়ায় আমীরগণ সমসুদ্দীনের কন্যা রিজিয়া বেগমকে সিংহাসন প্রদান করেন। এই বংশীয় আলায়ুদ্দীনের রাজত্বকালে একদল মোগল বাঙ্গালাদেশে প্রবেশ করে। নসিরুদ্দীন মহম্মদ সুবিচারগুণে প্রজার বিশেষ প্রিয়পাত্র হইয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর বুলবন নামে তাঁহার শ্যালক দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। গিয়াসুদ্দীন বুলবন অতি ন্যায়পরায়ণ সম্রাট ছিলেন। তাহার পর কৈকোবাদ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। সে সময়ে কৈকোবাদের পিতা নাসিরুদ্দীন বাংলাদেশের সুবাদার ছিলেন; তিনি কৈকোবাদের সিংহাসনপ্রাপ্তির সংবাদ শুনিয়া সসৈন্যে তাঁহার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। পিতাপুত্রে রণ প্রাঙ্গণে সম্মুখীন হইলেন; কিন্তু যুদ্ধ হইল না; মন্ত্রীগণের পরামর্শে নাসিরুদ্দীন বাংলাদেশে ফিরিয়া গেলেন, কৈকোবাদ নির্বিবাদে রাজত্ব করিতে লাগিলেন। অতিরিক্ত মদ্যপানে কৈকোবাদের মৃত্যু হয়। অনেকে তাহার পুত্ৰ সমসুদ্দীনকে সম্রাট করিবার ব্যবস্থা করেন; কিন্তু তাহা হইল না। খিলজীবংশ সিংহাসন অধিকার করিয়া বসিল। রাজসরকারের বেতন-বণ্টনকারী জেলালুদ্দীন খিলজী দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। তাঁহার ভ্রাতুস্পুত্র মল্লিক আলাউদ্দীন দাক্ষিণাত্যে গিয়া প্রভূত ধনসঞ্চয়ন করেন এবং এত অধিক ধনবলে বলীয়ান হওয়ায় তাঁহার স্পর্ধা বাড়িয়া যায়; তিনি দিল্লীর আনুগত্য অস্বীকার করেন। সুলতান কাজেই তাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করে; কিন্তু বিশ্বাসঘাতকের হস্তে প্রাণ হারান। তখন আলাউদ্দিন সিংহাসনে আরোহণ করেন। যদিও রাজ্যলাভের জন্য পিতৃব্যহত্যারূপ মহাপাপে লিপ্ত হইয়াছিলেন, তথাচ সম্রাট হইয়া তিনি ন্যায়ানুগত ব্যবহার করিয়া প্রজাগণকে সন্তুষ্ট করিতেন। মোগলদিগের সহিত তাহার অনেক যুদ্ধ হয়। কিছু দিন এই ভাবে রাজত্ব করিয়া অবশেষে তাহারও মতিচ্ছন্ন ঘটে, তিনি তাহার সামান্য একজন ক্রীতদাসকে এত অনুগ্রহ করিতে লাগিলেন যে, অবশেষে তাহাকেই প্রবীণমন্ত্রীর পদে অভিষিক্ত করিলেন। সুলতানের মৃত্যুর পর এই মন্ত্রীই সুলতানপুত্র সাহবুদ্দীনকে সিংহাসনে বসান এবং তাহার জ্যেষ্ঠভ্রাতা মোবারককে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। অল্পদিন পরেই এই মন্ত্রীর মৃত্যু হয়, তখন মোবারক কারামুক্ত হইয়া ভ্রাতাকে পদচ্যুত করত নিজে কুতবুদ্দীন নাম ধারণ পূৰ্ব্বক সিংহাসনে উপবিষ্ট হন। তিনি গুজরাট ও দাক্ষিণাত্য জয় করেন; কিন্তু হাসন নামে একজন নীচজাতীয় সুশ্রী পুরুষের উপরে তাহার অধিক অনুগ্রহ হওয়ায় তাঁহার বিপদ ঘনাইয়া আসিল। এই নীচ ব্যক্তিকে তিনি খাজা খা উপাধি প্রদান করেন এবং অবশেষে এই নিমকহারামই সুলতানকে নিহত করিয়া নাসিরুদ্দীন নাম ধারণ পূর্বক নিজে সম্রাট হইয়া বসেন এবং রাজপরিবারের সকলকে শমন ভবনে প্রেরণ করেন। এই সময়ে গাজি উলমুলুক নামে একজন প্রধান আমীর দিল্লীতে বাস করিতেন। তিনি অন্যান্য আমীরগণের সহায়তায় বিশ্বাসঘাতক প্রভুহন্তাকে নিহত করিয়া নিজে গিয়াসুদ্দীন তোগলক নাম ধারণপূর্বক সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁহার পুত্র মহম্মদ খাঁ পিতার অভ্যর্থনার জন্য দিল্লী হইতে কয়েক ক্রোশ দূরে একটী রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করান এবং অনেক অনুনয়বিনয় করিয়া সম্রাটকে সেই প্রাসাদে পদার্পণ করিতে সম্মত করান। সম্রাট সেই প্রাসাদে প্রবেশ করিলে সহসা গৃহের ছাদ তাঁহার মস্তকের উপর ভাঙ্গিয়া পড়ে। তিনি প্রাণত্যাগ করেন। যদিও তারিখ-ই-ফিরোজসাহী-লেখক জয়উদ্দীন বারণী এ বিষয়ে মহম্মদ খাঁকে নির্দোষী মনে করেন, কিন্তু যে প্রকার তাড়াতাড়ি প্রাসাদ নির্মিত হইল এবং যে প্রকার নির্বন্ধাতিশয় সহকারে সম্রাটকে সেখানে লইয়া আসা হইল, তাহাতে পুত্রের কু-অভিসন্ধি ব্যতীত অন্য কোন ভাব মনে উদয়ই হয় না। যাহা হউক, সুলতান মহম্মদ পিতার সিংহাসন গ্রহণ করেন। এবং মৃত্যুসময়ে তাঁহার পিতৃব্য রাজেবের পুত্র ফিরোজকে সিংহাসনের অধিকারী করিয়া যান। ফিরোজের মৃত্যুর পর হিন্দুস্থানে মহা গোলযোগ উপস্থিত হয়। প্রথমে তোগালকগণ সম্রাট হন, কিন্তু একজন বিশ্বাসঘাতকের হস্তে তাহার জীবনশেষ হয়; তখন তাহার ভ্রাতা আবু বেকার সম্রাট হন। সুলতান মামুদের সময়ে রাজ্যমধ্যে নানা বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হয়, চারিদিকে কেবল ষড়যন্ত্র। এই সময়ে হিজরী ৮০১ সালে তৈমুর খা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেন। মামুদ গুজরাটে পলায়ন করেন। তৈমুর দেশ লুণ্ঠন করিয়া চলিয়া গেলেন। দিল্লী ঘোর অরাজকতার ক্রীড়াভূমি হইল। নসরৎ শাহ দোয়ার হইতে আসিয়া প্রথমে সিংহাসন অধিকার করেন, কিন্তু সুলতান মামুদ গুজরাট হইতে ফিরিয়া আসেন। তিনিই খিলজীবংশের শেষ সম্রাট। তাহার পর কিছুদিন দৌলত খার হস্তে রাজ্যভার পড়ে, কিন্তু সেই সময়ে তৈমুরের নিযুক্ত শাসনকর্তা খিজির খা মুলতানে ছিলেন। তিনি তাড়াতাড়ি আসিয়া সিংহাসন দখল করিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র মোবারক শা সম্রাট হইলেন। তিনি দুইজন আমীরের বিবাদ ভঞ্জন করিতে গিয়া দিল্লীর নিকটেই নিহত হন। তখন মহম্মদ শাহ সিংহাসন গ্রহণ করেন। কেউ বলেন, মহম্মদ শাহ খিজির খর পৌত্র, কেহ বা বলেন পুত্র, এ বিষয়ে স্থির জানিতে পারা যায় না। তাহার উত্তরাধিকারী সুলতান আলাউদ্দীন সম্রাট হন; কিন্তু এই ব্যক্তি অতি নীচাশয় ছিলেন। এই সময়ে বিললাললোদী একজন প্রধান ব্যক্তি। বিলোল সামান্য একজন বণিকের প্রপৌত্র; তাহার প্রপিতামহ বাণিজ্য-ব্যবসায়ের জন্য দিল্লীতে আসেন এবং খিজির খাঁর কৃপায় তিনি বিশেষ সম্মান প্রাপ্ত হন; সরহিন্দের রাজত্ব তাহার ভরণপোষণের জন্য নির্দিষ্ট হয়। বিলোল মুলতানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার জন্মসম্বন্ধে একটী আশ্চর্য্য গল্প প্রচলিত আছে। যখন তাহার মাতা আসন্নপ্রসবা, সেই সময়ে একদিন তিনি যে গৃহে ছিলেন, সেই গৃহের একখণ্ড কড়িকাষ্ঠ তাঁহার শরীরের উপরে পড়িয়া যায় এবং তাহাতেই তাঁহার জীবনশেষ হয়; চিকিৎসকগণ তাহার গর্ভ বিদীর্ণ করিয়া জীবিত শিশুকে বাহির করেন। এই বিলোল ক্ৰমে দিল্লীর সৰ্ব্বেসর্বা হইয়া উঠেন। অবশেষে তিনিই দিল্লীর সম্রাট হন। শুনিতে পাওয়া যায় যে, সম্রাট হইবার পূর্বে একদিন তাহার সহিত একজন দরবেশের সাক্ষাৎ হয়। দরবেশ বলে, “যে আমাকে এত টাকা দিবে, আমি তাহাকে দিল্লীর সিংহাসন দিব।” বিলোল তাহার প্রার্থনা পূর্ণ করেন এবং সম্রাট হইয়াও সেই দরবেশকে বিশেষ শ্রদ্ধা ভক্তি করিতেন। বিলোল জৌনপুর জয় করিয়া নিজের পুত্র বারবাককে সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। গোয়ালিয়র আক্রমণ-অন্তে দিল্লীতে ফিরিবার সময়ে পথিমধ্যে রোগাক্রান্ত হইয়া তিনি প্রাণত্যাগ করেন। তাঁহার পুত্র নিজাম খাঁ সম্রাট হন। এই সময়ে হিজরী ৯১১ অব্দে দিল্লীতে ভয়ানক ভূমিকম্প হয়, অনেক গৃহ চূর্ণ। হইয়া যায়, কতকগুলি মাটীর মধ্যে বসিয়া যায়। নিজাম খাঁ ন্যায়পরায়ণ ও ধার্মিক বলিয়া বিখ্যাত ছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র সুলতান ইব্রাহিম দিল্লীর সম্রাট হন এবং জৌনপুরের শাসনভার তাঁহার ভ্রাতা জেলাল খার হস্তে প্রদত্ত হয়। কিন্তু ভ্রাতৃবিরোধ উপস্থিত হয়; জেলাল প্রথমে গোয়ালিয়র রাজার শরণাপন্ন হন, পরে মালবদেশে গমন করে; সেখানেও বিফল মনোরথ হইয়া গণ্ডোয়ানার অভিমুখে অগ্রসর হইতেছিলেন, এমন সময়ে সম্রাটের সৈন্যদল তাহাকে ধরিয়া ফেলে এবং সম্রাট ইব্রাহিমের নিকট উপস্থিত করে; সুলতানের আদেশে তাহার প্রাণদণ্ড হয়। সুলতান ইব্রাহিমের রাজত্ব-সময়ে অনেক আমীর বিদ্রোহী হন; তাহার মধ্যে বিহারের শাসনকর্তা দরিয়া খা এবং তাহার পুত্র বাহাদুর খা দিল্লীর অধীনতা অস্বীকার করিয়া নিজ নামে মুদ্রা বাহির করিতে আরম্ভ করেন। দৌলত খা লোদী কাবুলে পলায়ন করেন। সুলতান বাবর তাহাকে সমভিব্যাহারে লইয়া হিন্দুস্থান জয় করিতে আগমন করেন।
সুবে লাহোর
শতদ্রু হইতে সিন্ধুনদী পর্যন্ত এই সুবার দৈর্ঘ্য ১৮০ ক্রোশ এবং প্রস্থ ৮৬ ক্রোশ। ইহার পূর্বসীমা সরহিন্দ, উত্তরে কাশ্মীর, দক্ষিণে বিকানীর ও অজুমীর এবং পশ্চিমে মুলতান। এই সুবার মধ্য দিয়া ছয়টী নদী প্রবাহিত হইতেছে। সটলেজ (শতদ্রু,–ইহার তীরে রূপার, মাচওয়ারে এবং লুধিয়ানা। বেয়া (বিপাশা),-এই নদী কুলুর নিকটস্থ অভয়াকুণ্ড হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। রাবী (ইরাবতী),-লাহোর এই নদীর তীরে অবস্থিত। চেনব (চন্দ্রভাগা),চন্দ্র ও ভাগা নামে দুইটী নিৰ্ব্বরের নামে এই নদীর নামকরণ হইয়াছে; বিহাত (বিতস্তা),–এই নদী কাশ্মীর হইতে উৎপন্ন হইয়াছে; শ্রীনগর এই নদীর তীরে অবস্থিত। কেহ কেহ বলেন, সিন্ধুনদ কাশ্মীর ও কাশগড়ের মধ্যে হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। আবার কেহ বলেন, সিন্ধুনদ চীনদেশ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। বাদশাহ এই সকল নদীর মধ্যস্থ স্থানসমূহের ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়াছেন। সটলেজ ও বেয়ার মধ্যস্থ ভূভাগের নাম বেতজলন্ধর; বেয়া ও রাবীর মধ্যস্থ স্থানের নাম বারী; রাবী ও চেনবের মধ্যস্থ ভূখণ্ডের নাম বেচনা; চেনব ও বিহাতের মধ্যস্থ স্থানের নাম জেলহাত এবং বিহাত ও সিন্ধুর মধ্যস্থ স্থানের নাম সিন্ধুসাগর। লাহোর সুবার বহু লোকের বসতি। হিন্দুস্থানের মধ্যে এই সুবার শীত অত্যন্ত অধিক, তবে পারস্য ও তাতারদেশ অপেক্ষা এখানকার শীত কম বটে। বাদশাহের উৎসাহে এখন এ প্রদেশে নানাদেশজাত দ্রব্য সৰ্ব্বদাই পাওয়া যায়। এখানে সারা বৎসরই বরফ কিনিতে পাওয়া যায়। অনেক স্থলে নদীর বালুকা ছাকিলে স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, টিন ও সীসা পাওয়া যায়। লাহোর সহর দোয়াব রাবীর মধ্যে অবস্থিত, এখানকার দুর্গ ইষ্টকনিৰ্মিত। লাহোর কিছুদিন হিন্দুস্থানের রাজধানী ছিল। এখানকার সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ ও উদ্যান দেখিবার সামগ্রী। নগরকোট সহর পর্বতের উপরে সংস্থাপিত, এখানকার দুর্গের নাম কাঙ্গারা। এই সহরের নিকট একটী উচ্চ পর্বতের উপর মহামায়া নামে একটী নগর আছে। হিন্দুরা বলেন, এই নগর দেবগণের প্রতিষ্ঠিত। বহুদূর হইতে যাত্রীগণ এই স্থানে তীর্থ করিতে আগমন করিয়া থাকেন। এখানে আসিয়া যাত্রীগণ তাহাদের জিহ্বা কাটিয়া ফেলিয়া দেয়, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এই স্থানের মাহাত্মে না কি দুই তিন দিনের মধ্যেই তাহাদের নূতন জিহ্বা হয়, কখনও কখনও দুই তিন ঘণ্টার মধ্যেই নূতন জিহ্বার উত্থান হয়। ফিনিসিয়ানেরা বলেন যে জিহ্বা কাটিয়া ফেলিলে পুনরায় আপনা হইতেই জিহ্বার উদগম হইয়া থাকে। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে মহামায়া মহাদেবের পত্নী, কিন্তু পণ্ডিতেরা বলেন, মহামায়া অর্থে শক্তি। এই মহামায়া তাঁহার পিতা দক্ষের গৃহে যাইয়া মহাদেবের নিন্দাশ্রবণ করিয়া প্রাণত্যাগ করেন। মহাদেব সেই সতীদেহ লইয়া উন্মত্তের ন্যায় ভ্রমণ করেন, তাহার পর বিষ্ণু সুদর্শনচক্র দ্বারা সতীদেহ বাহান্ন খণ্ডে বিভক্ত করিয়া পৃথিবীময় ছড়াইয়া ফেলিয়া দেন। সতীর মস্তক এবং আর দুই এক অংশ কাশ্মীরে পতিত হয়। যে স্থলে পতিত হয়, তাহার নাম হইয়াছে সারদা। দাক্ষিণাত্যে বিজয়পুরে একটী স্থানে কয়েক অংশ পতিত হয়, সেই স্থানের নাম তুষ্টভগিনী। এক অংশ কামরূপে পতিত হয়, তাহার নাম কামাখ্যা। অবশিষ্ট বা সমস্ত অংশই এই মহামায়া নগরে পতিত হয়। এই স্থানের নিকটেই জ্বালামুখী; যাত্রীগণ এখানে প্রজ্বলিত অগ্নিতে অনেক দ্রব্য আহুতি প্রদান করিয়া থাকে। সমসাবাদের নিকট সিন্ধুসাগরের মধ্যে কালানাথ নামে একটী গহ্বর আছে; সন্ন্যাসীগণ এখানে সর্বদাই আগমন করিয়া থাকেন। এই স্থানের নিকটে লবণ পাওয়া যায়। সওদাগরেরা এখান হইতে প্রতিমণ লবণ দুই দাম মূল্যে কিনিয়া লইয়া যায়। জমিদারের প্রত্যেক বোঝা লবণের উপর সওদাগরদিগের নিকট হইতে দশদাম করিয়া শুল্ক আদায় করিয়া থাকেন। এবং সওদাগরগণকে ম্রাট সরকারেও প্রতি আঠার মণ লবণের উপর একটাকা করিয়া দিতে হয়। এই সুবার পাঁচটী দোয়াব আছে এবং ইহা ২৩৪টী পরগণায় বিভক্ত। ৫৫৯৪৫৮৪২৩ দাম রাজস্ব দিতে হয়। এখানে ৫৪৪৮০ অশ্বারোহী ও ৪২৬০৮৬ পদাতিক আছে।
সুবে মুলতান
তাতা প্রদেশ এই সুবার অন্তর্গত হইবার পূর্বে ইহার দৈর্ঘ্য ফিরোজপুর হইতে সুইসস্থান পৰ্য্যন্ত ৪০৩ ক্রোশ এবং প্রস্থ খাটপুর হইতে যশলমীর পর্যন্ত ২০৮ ক্রোশ। ইহার পূৰ্ব্বসীমায় সরহিন্দু, উত্তরে সুর পরগণা, দক্ষিণে অজমীর সুবা এবং পশ্চিমে কচ্ছদেশ ও মেকানদেশ। লাহোরের মধ্যে বর্ণিত সেই পঞ্চনদ এই সুবার মধ্য দিয়াও প্রবাহিত। ফিরোজপুরের নিকটে বেয়া ও সটলেজ নদী মিলিত হইয়াছে; কিন্তু কিছুদূরে অগ্রসর হইয়াই আবার চারি শাখার বিভক্ত হইয়াছে, এই চারিটী শাখার নাম হর, হরি, দণ্ড ও নরণী। আবার সুলতান সহরের নিকট এই চারিটি শাখা পুনরায় মিলিত হইয়াছে। এই সুবার উত্তরাংশে পর্বত আছে। লাহোর ও মুলতান একই রকমের দেশ, তবে বিভিন্নতা এই যে, মুলতানে বৃষ্টি হয় না বলিলেই হয় এবং সেইজন্য এ স্থানে গ্রীষ্ম অতিশয় বেশী। মুলতান বহু পুরাতন নগরী। এখানে সেখ বাহারুদ্দীন জাকরিয়া ও অন্যান্য অনেক সাধু ফকিরের সমাধিমন্দির আছে। বারে একটা সুন্দর দুর্গ আছে। পূৰ্ব্বকালের পুস্তকাদিতে এ স্থানের নাম মনসুরা বলিয়া উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। পঞ্জাবের পাঁচটী ও সিন্ধু এই ছয়টি নদীই এখানে আসিবার পূর্বে এক হইয়া আসিয়াছে, কিন্তু এখানে আসিয়াই দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া এক ধারা দুর্গের দক্ষিণ দিয়া অপর ধারা উত্তরদিক দিয়া প্রবাহিত হইতেছে। সিন্ধু এবং বারের মধ্যে একটী বিস্তীর্ণ মরুভূমি আছে। এই মরুভূমিতে গ্রীষ্মকালে তিনমাস সাইমুন বায়ু প্রবাহিত হয়। এই সুবার তিনটী সরকার আছে এবং ইহা আটটি পরগণায় বিভক্ত। এখানকার রাজস্ব ১৫১৪৩৬১৯ দাম। এখানে ১৩৭৮৫ অশ্বারোহী ও ১৬৫৬০ পদাতিক আছে।
মুলতানের রাজগণের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
এই সুবা কখনওবা দিল্লীর সম্রাট, কখনও সিন্ধুদেশের সর্দারগণ, কখনও বা গজনীর রাজার অধীন থাকিত। সুলতান উমজউদ্দীন সামের সময় হৈতে হিজরী ৮৪৭ অব্দ পর্যন্ত ই প্রদেশ দিল্লীর অধীন ছিল। উপরোক্ত অব্দে আলাউদ্দীনের রাজস্বসময়ে নানা গোলযোগ উপস্থিত হয় এবং সেই সুযোগে এই প্রদেশের সামন্তগণ ধন ও বল সঞ্চয় করেন। ইহাদের মধ্যে একদল সেখ বদরুদ্দীন জেকরিয়ার মসজীদের ভত্য সেখ ইউসফ কোরেসীকে এই সুবার কৰ্ত্তা করেন, কিন্তু তিনি শীঘ্রই পদচ্যুত হন। এই ব্যক্তি পলায়ন করিয়া দিল্লীতে আগমন করেন এবং সুলতান বিলোললোদীর শরণাপন্ন হন। সুলতান কুতুবুদ্দীনের রাজত্বসময়ে সুলতান মামুদ মালব হইতে মুলতান জয় করিতে যাত্রা করেন। কিন্তু তিনি কিছুই করিতে পারেন না। কেহ কেহ বলেন, সুলতান কুতুবুদ্দীনই প্রথমে মুলতানে রাজত্ব বিস্তার করেন। সুলতান বিলোল যখন দিল্লীর সম্রাট, তখন তিনি তাঁহার পুত্র বারবাক শাহকে ইউসফ সেখের সাহায্যার্থ প্রেরণ করেন; কিন্তু তাহারা বিফলমনোরথ হইয়া ফিরিয়া আসেন। সুলতান হোসেন বৃদ্ধ অবস্থায় রাজ্যভার নিজ পুত্র ফিরোজ খার হস্তে সমর্পণ করেন; ফিরোজের উজীর আমেদ উল মুলুক তাহার খাদ্য দ্রব্যে বিষ মিশ্রিত করিয়া দিয়া তাহার প্রাণনাশ করেন; সুতরাং সুলতান হোসেন পুনরায় সিংহাসন গ্রহণ করেন; কিন্তু রাজ্যের সমস্ত কাৰ্য্যভার ফিরোজের পুত্র, তাহার পৌত্র মামুদ খার হস্তে সমর্পণ করেন। সুলতান হোসেনের মৃত্যুর পর মামুদ খাই সিংহাসনে অধিরোহণ করেন। ইহার রাজত্বকালে মোগলেরা অনেকবার হিন্দুস্থানে আগমন করেন; কিন্তু দেশ জয় করিতে পারেন নাই। কতকগুলি দুষ্ট লোকে নানা মিথ্যাকথা রটনা করিয়া দিয়া সুলতান মামুদ ও তাহার উজীর বায়জীদ আমির মধ্যে বিরোধ উপস্থিত করিয়া দেয়। তাহাতে রাজ্যে নানা বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হয়। মামুদের মৃত্যু হইলে তাহার নাবালক পুত্র সুলতান হোসেন সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই সময় তথা হৈতে মিরজা শাহ হোসেন আসিয়া মুলতান জয় করেন এবং লস্কর খার উপর শাসনভার অর্পণ করেন; মিরজা কামরান ইহাকে পদচ্যুত করিয়া নিজে শাসনভার গ্রহণ করেন। তাহার পর মুলতানরাজ্যে সের খা আধিপত্য করেন। সম্রাট হুমায়ুন এই প্রদেশ দিল্লীর সাম্রাজ্যভুক্ত করেন এবং এক্ষণে এ প্রদেশের অধিবাসিগণ বাদশাহের অধীনে সুখে স্বচ্ছন্দে বাস করিতেছে।
মুলতানের মুসলমান শাসনকর্তৃর্গণের তালিকা
ইউসফ সেখ ২ বৎসর, সুলতান মামুদ শা ১৭ব, সুলতান কুতবুদ্দীন (পুত্র) ১৬ব, সুলতান হোসেন (পুত্র) ৩০ব, সুলতান ফিরোজ (পুত্র), ১ব, সুলতান হোসেন (দ্বিতীয়বার) ৩ব, সুলতান মামুদ (ফিরোজের পুত্র) ২৭ব, সুলতান হোসেন (ফিরোজের পুত্র) ১ব, হোসেন শাহ, মিরজা কামরাণ, সের খা, সলিম খা, সেকেন্দর খাঁ।
তাতা সরকার
পূৰ্ব্বে এই প্রদেশ স্বাধীন ছিল, এক্ষণে ইহা দিল্লীসাম্রাজ্যের অধীন হইয়াছে। বকার হইতে কচ্ছ ও মেকরাণ পৰ্য্যন্ত ইহার দৈর্ঘ্য ২৫৭ ক্রোশ এবং বদায়ুন হইতে লাহারী বন্দর পর্যন্ত প্রস্থে ১৮০ ক্রোশ। ইহার পূৰ্ব্বসীমায় গুজরাট, উত্তরে বাকর ও সিউই, দক্ষিণে সমুদ্র এবং পশ্চিমে কচ্ছ ও মেকরাণ দেশ। পূৰ্ব্বকালে ব্রাহ্মণাবাদে রাজধানী ছিল, এখানে সে সময়ে প্রকাণ্ড দুর্গ ছিল, এখনও তাহার ভগ্নাবশেষ দেখিতে পাওয়া যায়। আলোরকেই এখন তাতা এবং দেবিয়েল কহে। এখানে অনেক পৰ্বত আছে, একটী পৰ্বত কান্দাহার পর্যন্ত গিয়াছে। এ প্রদেশে অনেক বেলুচী (কুফুলমানী বাস করে, ২০ হাজার বেলুচী-পরিবার এখানে বাস করে এবং তাহাদের মধ্য হইতে দশ সহস্র উৎকৃষ্ট পদাতিক সৈন্য সংগৃহীত হইতে পারে। এই প্রদেশে তেহারী নামে আরও এক সম্প্রদায়ের বেলুচীগণ আছে, তাহাদের মধ্যেও শস্ত্র-যোদ্ধা আছে। পৰ্ব্বতপ্রদেশেও অনেক বেলুচী বাস করে। এ দেশে শীতের তেমন প্রকোপ নাই, গ্রীষ্মও তেমন বেশী হয় না। এখানে আম্র প্রভৃতি ফল অতি উৎকৃষ্ট জন্মে। এখানে নানাজাতীয় পুষ্প জনে। এখানকার অধিবাসিগণ প্রধানত জলপথেই ভ্রমণ করে; ইহারা অতি সুন্দর নৌকা প্রস্তুত করিতে পারে। এ প্রদেশে কমবেশী চল্লিশ হাজার নৌকা আছে। এ দেশের কৃষকেরা রাজাকে শষ্যের ভাগ দিয়া থাকে; তুতীয়াংশ রাজাকে দেয় এবং অবশিষ্ট নিজেরা পায়। এখানে লৌহের খনি ও লবণের গৰ্ত্ত আছে। তাতা হইতে ছয় ক্রোশ দূরে পীতপ্রস্তরের খনি আছে। এ দেশের লোক প্রধানত মাছ-ভাত আহার করে। তাহারা শুষ্ক মৎস্যের কারবার করিয়া থাকে। তাহারা মাছের তৈল দিয়া নৌকা রং করে। সিউইর নিকটে মঞ্জুর নামে একটী হ্রদ আছে; এই হ্রদের বক্ষে মৎস্যজীবিগণ কৃত্রিম দ্বীপ নিৰ্মাণ করিয়াছে; এই সমস্ত দ্বীপ হইতে তাহারা চারি দিকে মৎস্য ধরিয়া বেড়ায়। এই দেশে এক আশ্চর্য ব্যাপার দেখিতে পাওয়া যায়; এ দেশের একজাতীয় লোক মন্ত্রের দ্বারা মনুষ্যের পিত্ত হরণ করিতে পারে। তাহারা নাকি কাহারও দিকে দৃষ্টি করিয়াই তাহাকে অজ্ঞান করি ফেলিতে পারে এবং শেষে তাহাদের পিত্ত বাহির করিয়া লয় এবং সেগুলি নাকি তাহাদের নিজেদের পায়ের মধ্যে লুকাইয়া রাখে। শুনিতে পাওয়া যায় এই যাদুকরগণের আশ্চর্য ক্ষমতা। এই জাতীয় স্ত্রীলোকেরা নাকি যাদুবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শিনী; তাহারা এক স্থানে বসিয়া থাকিয়াই দূর দূরান্তরের সংবাদ আনিয়া দিতে পারে এবং তাহাদের গলায় পাথর বাধিয়া জলে ফেলিয়া দিলেও তাহারা ডুবিয়া যায় না, পাথর শুদ্ধ ভাসিতে থাকে। যদি তাহাদের মধ্যের কাহারও এই অলৌকিক শক্তি নষ্ট করিবার ইচ্ছা হয়, তাহা হইলে তাহার সর্বাঙ্গ পোড়াইয়া দেয়, তাহার চক্ষে লবণ পুরিয়া দেয় এবং চল্লিশ দিন পৰ্য্যন্ত তাহাকে কোন ভূগর্ভস্থ নির্জন স্থানে ঝুলাইয়া রাখা হয়। ইহারা নানা প্রকার রোগেরও ঔষধ জানে; কখনও বা মন্ত্র দিয়াই রোগ সারাইয়া দেয়। এই জাতীয় লোকের সম্বন্ধে নানাপ্রকার আশ্চর্য্য গল্প শুনিতে পাওয়া যায়। তাতা এক্ষণে মুলতান সুবার চতুর্থ সরকার। এই সুবায় পাঁচটী সরকার এবং তাহাতে ৫৩টী পরগণা আছে।
তাতা-রাজগণের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
অনেকদিন পূর্বে এখানে সহস্রাবীশ নামে এক রাজা বাস করিতেন। আলোর নগর তাঁহার রাজধানী ছিল। তাঁহার রাজ্য কাশ্মীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পারস্য-দেশ হইতে একবার এই দেশ আক্রমণ হয়, রাজা সেই যুদ্ধে নিহত হন এবং সৈন্যগণ দেশ লুণ্ঠন করিয়া চলিয়া যায়। তখন রাজপুত্র রায় সাহী সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তাহার উপযুক্ত মন্ত্রী-রাজের সাহায্যে দেশের যথেষ্ট উন্নতি করেন। যোগ নামে একজন ব্রাহ্মণ মন্ত্রীর বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন, মন্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি মন্ত্রী হন। এই দুষ্ট মন্ত্রীর সহিত রাজমহিষীর প্রণয় হয়, অনেকে রাজাকে সতর্ক করেন, কিন্তু রাজা কিছুতেই এ কথা বিশ্বাস করেন না; রাজার মৃত্যু হইলে, এই দুই ব্রাহ্মণ বিধবা রাজমহিষীকে বিবাহ করিয়া রাজ-সিংহাসনে আরোহণ করেন। অসচ্চরিত্র হইলেও ব্রাহ্মণ রাজ্যের যথেষ্ট উন্নতি করেন এবং কচ্ছ ও মেকরাণ রাজ্য নিজ রাজ্যভুক্ত করিয়া লন। খলিফা ওসমান হিন্দুস্থানের অবস্থা অবগত হইবার জন্যে একদল লোক এ দেশে প্রেরণ করেন এবং নিজেও হিন্দুস্থান জয়ের জন্য আয়োজন করেন; কিন্তু তাঁহার প্রেরিত লোক ফিরিয়া যাইয়া সংবাদ দেয় যে হিন্দুস্থান গেলে সৈন্যগণ খাদ্যদ্রব্যের অভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হইবে; আবার অল্পসংখ্যক সৈন্য লইয়া গেলেও হিন্দুস্থান জয়ের কোন সম্ভাবনা নাই; সুতরাং খলিফার হিন্দুস্থান জয় করিবার অভিপ্রায় ত্যাগ করিতে হইয়াছিল। এ দিকে রাজা যোগ চল্লিশ বৎসর রাজত্ব করিয়া পরলোকগমন করিলে চাহার দাহির সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই সময়ে খলিফা ওয়ালিদ তাহার জ্ঞাতিভ্রাতা এবং জামাতা মহম্মদ লামিকে হিন্দুস্থানে প্রেরণ করেন। দাহিরের সঙ্গে তাহার অনেক যুদ্ধ হয়, শেষ যুদ্ধে দাহির প্রাণত্যাগ করেন এবং তাতা রাজ্য মুসলমানগণের অধিকারভুক্ত হয়। মহম্মদ কাসিম দাহিরের অনুপমা সুন্দরী কন্যাদ্বয় সুপ্রাদেবী ও বালিলাদেবীকে খলিফার নিকট উপঢৌকন প্রেরণ করেন। রাজকুমারীদ্বয় পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ গ্রহণ করিবার জন্য খলিফাঁকে বলেন যে, তাহারা খলিফার মহিষী হইবার উপযুক্তা নহেন। কারণ, কাসিম ইতিপূর্বেই তাহাদের ধর্ম নষ্ট করিয়াছে। এই কথা শ্রবণ করিয়া খলিফা ক্রোধে প্রজ্বলিত হইলেন এবং কাসিমকে চৰ্ম্মবদ্ধ করিয়া আনিবার আদেশ প্রদান করেন। এই আদেশ পৌঁছিবার সময় মহম্মদ কাসিম কনৌজরাজ হরচন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার আয়োজন করিতেছিলেন। যুদ্ধে আর যাওয়া হইল না, কাসিমের মৃতদেহ খলিফার সম্মুখে নীত হইল। দাহিরের কন্যাদ্বয় পিতৃহন্তার উপযুক্ত প্রতিফল দর্শনে আনন্দিতা হইলেন, আশ্চর্যের বিষয় এই যে, খলিফার ন্যায় এমন প্রবলপরাক্রান্ত নরপতি অপরিচিতা যুবতীদ্বয়ের মিথ্যাবাক্যে বিশ্বাস করিয়া বিনা অনুসন্ধানে, বিনা বিচারে এমন বিশ্বস্ত অনুচরের প্রাণনাশের কারণ হইলেন।
ইহার পর তমিন অনুসারীবংশ তাতার রাজত্ব করেন। তাহার পর সোমরাবংশ এই দেশে রাজত্ব করেন। ফিরোজের রাজত্বসময়ে তাহার আত্মীয় শালে-উদ্দীন বিদ্রোহী হইয়া গুজরাটে পলায়ন করেন। হিজরী ৯২৯ অব্দে সাহাবেগ সিন্ধুদেশ জয় করেন। তাহার মৃত্যুর পর, তাঁহার পুত্র রসিদ রাজা হন।
তাতা-রাজ্যের রাজগণের নাম
জামআন্ভা–৩ব, জাম জুনা ভ্রাতা-৪ব, জাম বাণভট্ট (পুত্র)-১৫ব, জাম তমাদি (ভ্রাতা)-১৩ব, জাম সেহাহুদ্দীন-১১, জাম নিজামউদ্দীন (পুত্র–২) জাম তমাদি ৬ব, জাম করম দেড় দিন, ফতে খ–১১ব, জেবগল–২৮, মোবারক-৩ দিন, সেকেন্দর-১ব, সঞ্চয়-৮, নন্দ–৬০, ফিরোজ-১২ব, সাহেবুদ্দীন–০ ফিরোজ (দ্বিতীয় বার-০১)
সুবে কাশ্মীর
কাশ্মীর, সেকেল, ভিম্ব, সিউরাঙ্গ, বিজোরা, লজ্জাহার এবং জাবুলীস্থান লইয়া কাশ্মীর সুবা সংগঠিত; পূৰ্ব্বে গজনীও ইহার অন্তর্গত ছিল; কিন্তু এক্ষণে আর কাশ্মীরের অন্তর্গত নহে। ইহা কাবুলের অন্তর্গত। এই সুবার পূর্বসীমা টীরিস্থান ও চেনাব নদী, দক্ষিণপূর্বে কনকুল এবং জম্বুর পর্বতমালা। উত্তরপূর্বে তিব্বত দেশ, পশ্চিমে পেশেলী, দক্ষিণপশ্চিমে গোখর রাজ্য, উত্তর-পশ্চিমে তিব্বতদেশ। এই সুবা উচ্চ পর্বতমালায় পরিবেষ্টিত। হিন্দুস্থান হইতে এই সুবায় প্রবেশের ছাব্বিশটী পথ আছে, তন্মধ্যে বিস্তু এবং সেখেলীর পথই উৎকৃষ্ট। কারণ, এই দুই পথে অশ্বরোহণে গমন করা যায়; বাদশাহ তিনবার; টারাপঞ্চালের পথে কাশীর-ভ্রমণে গিয়াছিলেন। এই পথের পর্বতসকলের উপরে যদি গো বা অশ্ব হত্যা করা যায়, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ ভয়ানক ঝড়-বৃষ্টি বরফপতন হয়। এই সুবায় চির-বসন্ত বিরাজমান। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। এখানকার জল উৎকৃষ্ট, নানাজাতীয় পুষ্প সৰ্ব্বদাই প্রস্ফুটিত থাকে, পৃথিবীর মধ্যে এমন সুন্দর ও মনোহর উৎকৃষ্ট স্থান আর নাই। এখানকার গৃহসকল কাষ্ঠনির্মিত। গৃহের ছাদ পুষ্পিত লতাপল্লবে আবৃত থাকে; গৃহগুলি ত্রিতল, চৌতল এবং পঞ্চতল পৰ্য্যন্তও হইয়া থাকে। এ দেশে সর্বদাই ভূমিকম্প হয়, সেই জন্যই এখানকার লোক ইষ্টক বা প্রস্তর দ্বারা গৃহ নির্মাণ করে না। কিন্তু এখানে ইষ্টক ও প্রস্তরনির্মিত পুরাতন হিন্দু-দেবমন্দির আছে, তাহার প্রস্তরগুলি মোটেই নষ্ট হয় নাই। এখানে উৎকৃষ্ট শাল প্রস্তুত হয়, এই শাল পৃথিবীর সর্বত্র নীত হয়। কাশ্মীররাজ্যের অধিবাসীর সংখ্যা অধিক হইলেও এখানে দস্যু চৌর অথবা ভিক্ষুক মোটেই নাই। চেরী ব্যতীত অন্যান্য সমস্ত ফলই এখানে যথেষ্ট পরিমাণে উৎপন্ন হয়। এখানে গুটিপোকারও চাষ হয়; এখানকার অধিবাসিগণ অন্ন, মৎস্য এবং তরকারী আহার করে, এ দেশে যবের প্রচলন আছে। এখানকার লোকে পূর্বদিনে রন্ধন করিয়া রাখিয়া পরের দিন সেই অন্ন আহার করে। শাক-সবজী গ্রীষ্মকালে শুকাইয়া রাখে এবং শীতকালে সেই সমস্ত তরকারী ব্যবহার করে। এখানে প্রচুর পরিমাণে চাউল জন্মে, কিন্তু এখানকার চাউল তত উকৃষ্ট নহে। এখানে হান্ত নামে এক প্রকার মেষ পাওয়া যায়, তাহাদের মাংস অতি সুস্বাদু। এ দেশের লোকেরা পশমীৰই সৰ্ব্বদা ব্যবহার করে। এখানকার গাভীসকল দেখিতে কুৎসিত হইলেও তাহারা প্রচুর দুগ্ধ দান করে। এ দেশের লোকেরা শিল্পকর্মে নিপুণ। কাশ্মীরদেশের চলিত ভাষা স্বতন্ত্র, কিন্তু তাহাদের পুস্তকাদি সংস্কৃতভাষায় লিখিত, তাহাদের অক্ষর দেব নাগীর হইতে কিঞ্চিৎ বিভিন্ন। ইহারা প্রধানত ভূর্জপত্রেই লিখিয়া থাকে। ভূর্জপত্র সহজে নষ্ট হয় না, পুরাতন পুথিসকল ভূর্জপত্রেই লিখিত। ইহাদের প্রস্তুত কালী এমন উৎকৃষ্ট যে, বহুদিনেও লেখা অস্পষ্ট হয় না। এখানকার অধিবাসী মুসলমানেরা সুন্নী সম্প্রদায়ভুক্ত। এ দেশে অনেক গায়ক আছে। এখানকার সভ্রান্ত অধিবাসিগণের নাম ঋষি। তাহারা ভগবানের প্রকৃত উপাসক, ইহারা অন্য ধর্মসম্প্রদায়কে ঘৃণা করে এবং মৎস্য-মাংস স্পর্শ করে না। কাশ্মীরে এই জাতীয় ব্রাহ্মণের সংখ্যা দুই হাজারেরও অধিক। হিন্দুগণ কাশ্মীরকে পবিত্র তীর্থস্থান বলিয়া থাকে। এখানে পঁয়তাল্লিশটী স্থান মহাদেবের নামে উৎসর্গীকৃত, চৌষষ্ঠীটী স্থান বিষ্ণুর অধিষ্ঠানভূমি; তিনটী ব্রহ্মার এবং বাইশটী দুর্গার অধিষ্ঠানস্থান। সাতশত স্থানে সর্পমূৰ্ত্তি আছে। এ দেশের লোক সর্পের পূজা করে।
শ্রীনগর কাশ্মীরের রাজধানী। এই নগর বহুকাল হইতে অতীব সমৃদ্ধিশালী। এখানে অনেক শিল্পীর বাস। এখানকার জুমা এবং পট্ট নামে শাল সর্বোৎকৃষ্ট। এই নগরের পূৰ্ব্বদিকে সলিমান নামে একটী পাহাড় আছে, সহরের নিকট বৃহৎ দুইটী হ্রদ আছে, এই হদদ্বয়ের জল তুলিয়া রাখিলেও অনেকদিন পর্যন্ত ভাল থাকে। বীরণ সহরের নিকট একটী জলাশয় আছে। হিন্দুগণ উহার জলকে পরম পবিত্র মনে করে। এই জলাশয় বৎসরের এগার মাস শুষ্ক থাকে, এপ্রিল মাসে দুইটী ঝর্ণা খুলিয়া যায়। এই দুইটী ঝরণার একটীর নাম সন্ধ্যাবারি, অপরটীর সত্যবারি। এই দুই ঝর্ণার জলে জলাশয়টী পরিপূর্ণ হয় এবং এপ্রিল মাস গত হইতে না হইতেই সমস্ত জল শুকাইয়া যায়। যাত্রীগণ এই দুই ঝর্ণার যে কোনটীর নামে উৎসর্গ করিয়া পুষ্প নিক্ষেপ করে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, যিনি যে ঝর্ণার নাম করিয়া পুষ্প নিক্ষেপ করেন, জল শুকাইলে দেখা যায় সেই পুষ্প সেই ঝর্ণার নিকটেই রহিয়াছে। এখানে আর একটী ঝর্ণা আছে, তাহার নাম, কুকুরনাগ। এই ঝর্ণার জলে ক্ষুধা-তৃষ্ণা উভয়ই দূর হয়। ইহারই অল্প দূরে আর একটী ঝরণা আছে, তাহার মধ্যস্থলে একটী দেবমন্দির আছে। সাধু-সন্নাসীগণ গ্রীষ্মকালে এই মন্দিরের নিকট অগ্নি প্রজ্বলিত করিয়া তাহাতে পুড়িয়া মরে। তাহাদের বিশ্বাস, এই প্রকার আত্ম-বিসৰ্জন করিলে অক্ষয় স্বর্গলাভ হয়। এখানকার আর একটী ঝর্ণার মধ্যে নাকি পরশপাথর আছে। এই প্রদেশের নন্দীমার্গ নামে একটী সুন্দর সমতল ভূমি আছে। পুনপুর নামক স্থানের নিকট দ্বাদশ সহ বিঘা জমীতে উৎকৃষ্ট জাফরাণ উৎপন্ন হয়। ফেব্রুয়ারী হইতে এপ্রিল মাস পর্যন্ত এই সকল জাফরাণ-ক্ষেত্রের এমন শোভা হয় যে, নিতান্ত কঠোরহৃদয় ব্যক্তিও সে দৃশ্য দেখিয়া মোহিত হইয়া যায়। রেবন সহরে একটী নিঝর আছে; এ দেশের লোকের বিশ্বাস যে, এই নিঝর হইতেই সর্বপ্রথমে জাফরাণের বীজ বহির্গত হয়; সেইজন্য এ দেশের লোক এই ঝরণায় দুগ্ধ ঢালিয়া পূজা করে। এই দুগ্ধ ঢালিয়া এ দেশের লোকেরা আর একটা বিষয় অবগত হয়; দুগ্ধ যদি ডুবিয়া অদৃশ্য হইয়া যায়, তাহা হইলে পূজকের মঙ্গল হয় এবং দুগ্ধ যদি উপরে ভাসিতে থাকে, তাহা হইলে তাহার অমঙ্গল হয়; এ মঙ্গলামঙ্গল অন্যবিষয়ে নহে, ক্ষেত্রে জাফরাণ ভাল জন্মিলেই মঙ্গল, ভাল না জন্মিলেই অমঙ্গল। মেরুবর্ধন গ্রাম তিব্বত-সীমান্তে অবস্থিত। ইহার নিকটে ছত্রকূট নামে একটী পৰ্বত আছে, উহা সর্পের আবাসভূমি। এখানে আর একটী পৰ্বত আছে, সেই পৰ্বতের পাদদেশে সৰ্ব্বদাই মহাদেবের লিঙ্গমূর্তিসকল দেখিতে পাওয়া যায়, অথচ সেখানে জনমানবের সম্পর্ক নাই। এই সকল তুষারময়-মূর্তি আপনা হইতেই গঠিত হয় এবং আপনা হইতেই অদৃশ্য হইয়া যায়। দক্ষিণ-পাড়ার নিকট পৰ্বতে কখনও কখনও তুষার নির্মিত অমরনাথ মহাদেবের মূর্তি দেখিতে পাওয়া যায়। অমাবস্যার দুইদিন পূর্বে এই স্থানের একটী গহ্বরে প্রথমে একটী বুদ্বুদের উদয় হয়; সেই বুদ্বুদ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়া পনের দিনে একটী বৃহৎ শিব-লিঙ্গমূর্তিতে পরিণত হয়; পূর্ণিমার পর হইতেই আবার সেই মূর্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হইতে আরম্ভ হয় এবং শেষে একেবারে অদৃশ্য হইয়া যায়। হিন্দুগণ এই মূর্তির পূজা করিয়া থাকেন। এই গহ্বরের নিকট একটী ঝরণা আছে, তাহার নাম অমরাবতী। এই ঝরণার তলদেশে মৃত্তিকা পরিষ্কার শ্বেতবর্ণের। ফাঁক পরগনায় যথেষ্ট ফুল জন্মে। ইহার নিকটে একটী হ্রদ আছে, সেই হ্রদে অনেক কৃত্রিম দ্বীপ আছে। অনেক সময়ে চোরেরা একজনের দ্বীপের কিয়দংশ কাটিয়া লইয়া জলাশয়ের এক দূরপ্রান্তে লইয়া গিয়া নিজস্ব করিয়া লইয়া থাকে। এই হ্রদের নিকটস্থ একটা ঝরণার জলপান করিলে অনেক ব্যাধি আরোগ্য হয়। এখানকার আর একটী ঝরণার জল গ্রীষ্মকালে অতিশয় শীতল এবং শীতকালে অতিশয় উষ্ণ হয়। বাজওয়ালগ্রামে একটী জলপ্রপাত আছে, তাহার নাম সবলামার, ইহা দেখিতে অতি সুন্দর। ইনিবাড়ীতে সূৰ্য্যসর নামে একটী পবিত্র নিঝর আছে, এই নিঝরের তীরে একটী প্রস্তরনির্মিত মন্দির আছে। সকরনাগের ঝরণা সমস্ত বৎসরই শুষ্ক থাকে, কিন্তু যদি কোন মাসের ৯ তারিখে শুক্রবার হয়, তাহা হইলে সেই দিন প্রাতঃকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই ঝরণায় যে জলধারা প্রবাহিত হয়, সেই দিন দূরদূরান্তর হইতে লোক ঐ জলে স্নান করিতে ও জল পান করিতে আইসে। জিলাবলগ্রামে একটী ঝরণা আছে, সেখানে লোকে মঙ্গল অমঙ্গল জানিবার জন্য ফল নিক্ষেপ করে। ফল যদি ডুবিয়া যায়, তবে অমঙ্গল এবং যদি ভাসিতে থাকে তবে মঙ্গল। বানহালে দুর্গা নামে একটী মন্দির আছে। কেহ কোন শত্রুর কৃতকাৰ্য্যতা সম্বন্ধে জানিবার ইচ্ছা করিলে চাউলপূর্ণ দুইটী হাঁড়ি লইয়া মন্দিরে যায়, একটী হাঁড়ি তাহার নিজের আর একটী তাহার শত্রুর বলিয়া চিহ্নিত করিয়া সন্ধ্যার সময় মন্দিরের মধ্যে রাখিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া চলিয়া আসে। পরদিন প্রাতঃকালে যাইয়া যাহার হাঁড়িতে চাউলের পরিবর্তে ফুল এবং জাফরাণ দেখিতে পায়, তাহারই জয় হইবে বুঝিতে পারে; অপর হাঁড়িতে আবর্জনা পূর্ণ থাকে, সে হাঁড়ি যাহার, তাহার পরাজয় নিশ্চিত। আরও একটী ব্যাপার আছে; কোন বিষয়ের অধিকার লইয়া, অথবা কোন ব্যাপারের ন্যায়-অন্যায় লইয়া দুই ব্যক্তিতে বিবাদ হইয়া তাহার যদি কোন প্রকার নিষ্পত্তি না হয়, তাহা হইলে তাহারা উভয়ে একটী করিয়া লোকের সঙ্গে দুই কুকুট ও দুইটী ছাগল মন্দিরে প্রেরণ করে; সেখানে যাইয়া উভয়েই নিজ নিজ আনীত কুকুট ও ছাগলকে বিষপান করায়; তাহার পর উভয়েই আপন আপন কুকুট ও ছাগলের গাত্র মর্দন করিতে থাকে; এই প্রকার করিতে করিতে যাহার পশু বাঁচিয়া উঠে, তাহার ন্যায়পক্ষ এবং যাহার পশু মরিয়া যায়, তাহার অন্যায়পক্ষ। কম্বরে বাণসিন্ধু নামে একটী নিঝর আছে, তাহা বৎসরে কেবলমাত্র দুইবার প্রবাহিত হয়। দেবসরোবরে জলনাগ নামে একটী জলাশয় আছে, তাহাতে স্তম্ভাকারে জলরাশি উত্থিত হইতে থাকে। কাহারও ভাগ্যগণনা করিতে হইলে সে একটী চাউলপূর্ণ পাত্রের মুখ বন্ধ করিয়া এই জলাশয়ে নিক্ষেপ করে; প্রথমে পাত্রটী ডুবিয়া যায় এবং কিয়ৎক্ষণ পরেই আবার ভাসিয়া উঠে; তখন তাহার মুখ খুলিয়া যদি দেখা যায় যে, চাউল সিদ্ধ হইয়াছে এবং তাহা হইতে সুগন্ধ বাহির হইতেছে, তাহা হইলে সৌভাগ্য এবং যদি সেই চাউলের সঙ্গে আবর্জনা মিশ্রিত দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা হইলে দুর্ভাগ্য। এখানে একটী জলপ্রপাত আছে, সাধুগণ পৰ্ব্বতের উপর হইতে ঝম্প প্রদান পূর্বক এই জলে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করে। এই প্রকার আত্মপ্রাণবিসর্জনে পরকালে সদগতি হয় বলিয়া তাহাদের বিশ্বাস। কোটহারে একটী নিঝর আছে, তাহা এগার বৎসর শুষ্ক থাকে; কিন্তু যখন বৃহস্পতিগ্রহ সিংহরাশিতে যান, তখন প্রতি শুক্রবারে এই নিঝরে জলধারা প্রবাহিত হয়; পর দিন আর জল থাকে না। বক্ষপুরের নিকটে একটী নিঝর আছে। এই নিঝরের নিকটস্থ পর্বতে কখনও বরফ পড়ে না। নাগমে নীলগান নামে একটী জলাশয় আছে, ইহা হিন্দুদিগের তীর্থস্থান। এই জলাশয়ের মধ্যে ফলনিক্ষেপ করিয়াও লোকে অদৃষ্ট গণনা করিয়া থাকে। পুরাকলে এই জলাশয়ে নীলমাহাত্ম্য নামে একখানি গ্রন্থ পাওয়া যায়; তাহাতে কাশ্মীরের ইতিহাস এবং এই পবিত্র তীর্থের বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। সেই পুস্তকে লিখিত আছে যে, এই জলাশয়ের তলদেশে একটী নগরী আছে, এবং বরীও শা নামে একজন ব্রাহ্মণ একবার সেই নগরীতে গিয়া দুই তিনদিন বাস করিয়াছিলেন; সেখান হইতে ফিরিয়া আসিয়া সেই স্থানের বিবরণ লিখিয়াছেন। পারওয়ার ঝরণায় রবিবারে স্নান করিলে কুষ্ঠরোগী রোগমুক্ত হয়। নিচ পরগণায় হালথুল গ্রামে একটী বৃক্ষ আছে, সেই বৃক্ষের অতি ক্ষুদ্র শাখার একটী ক্ষুদ্রতম পল্লব নাড়িলে সমস্ত বৃক্ষটি নড়িয়া উঠে। লারের নিকট দুইটী ঝরণা আছে, এখানে অনেক সাধু ডুবিয়া মরিয়া পুণ্যসঞ্চয় করেন। এখানকার পর্বতের মধ্যে একটী বৃহৎহদ আছে, তাহাতে এ অঞ্চলের লোকেরা মৃতব্যক্তির চিতাভস্ম নিক্ষেপ করে; ইহাতে নাকি মৃত ব্যক্তিগণ স্বর্গে গমন করে। এই জলাশয়ে মাংসখণ্ড পতিত হইলে তৎক্ষণাৎ তুষারপাত হইতে থাকে এবং ঝড়-বৃষ্টি হয়। ভূতেশ্বর নামক স্থানে মহাদেবের মন্দির আছে। যাত্রীগণ আসিলে মন্দির হইতে ঘোর কোলাহলধ্বনি বহির্গত হয়; কেহই ইহার কারণ নির্দেশ করিতে পারে না। মাচামুর নিকট একটী দ্বীপ আছে, এই দ্বীপ বৃক্ষপরিপূর্ণ। আশ্চর্যের বিষয় এই যে বাতাসে বৃক্ষ কম্পিত হইলে সমস্ত দ্বীপ কম্পিত হইতে থাকে। পরশপুরায় জাফরাণের ক্ষেত্র আছে। এই স্থানে একটী প্রকাণ্ড দেবমন্দির ছিল; সেকেন্দর শাহ সেই মন্দির ভাঙ্গিয়া ফেলেন; ভগ্নমন্দিরের মধ্য হইতে একখানি তাম্রফলক বাহির হয়, তাহাতে দেব অক্ষরে এই কথা লিখিত ছিল যে, “অদ্য হইতে এগারশত বৎসর পরে সেকেন্দর নামে এক ব্যক্তি এই মন্দির ভাঙ্গিয়া ফেলিবে।” কামরাজ পরগণার অন্তর্গত তারাগায়ে যক্ষজাতীয় রাজগণের বাসগৃহ ছিল। এখানে একটী জলাশয়ের মধ্যে বহু পুরাতন ও প্রস্তরনির্মিত একটী দেবমন্দির আছে। এই জলাশয়ে অনেক মৎস্য আছে, কিন্তু কেহ সে মৎস্য ধরিলে তাহার বিশেষ অমঙ্গল হয়। গুরগাঁয়ের নিকটে একটী গিরিপথ আছে, বৃহস্পতিগ্রহ যখন সিংহরাশিতে গমন করেন, তখন এই গিরিপথের একমুখ এমন গরম হয় যে, উত্তাপে সেই স্থানের বৃক্ষলতাদি জ্বলিয়া যায়; এমন কি, কোন পাত্রে করিয়া সেই স্থানে জল রাখিলে, তৎক্ষণাৎ সেই জল ফুটিতে থাকে। পাকলীতে স্বর্ণ পাওয়া যায়। নিম্নলিখিত উপায়ে স্বর্ণ সংগ্রহ করিতে হয়। ঐ স্থানের নদীতে লোকেরা ছাগগণের চর্ম বিস্তৃত করিয়া বাধিয়া রাখিয়া আইসে। দুই তিন দিন পরে সেই চৰ্ম্ম ঝাড়িলেই তাহা হইতে স্বর্ণরেণুসকল পড়িতে থাকে। এক একবারে দুই তিন ভোলা পৰ্যন্ত স্বর্ণ পাওয়া যায়। এই স্থানের নিকটে আর একটী গিরিপথ আছে, তাহার নাম গিলজিট। এই পথে কাশগড়ে যাওয়া যায়। এখানেও স্বর্ণরেণু পাওয়া যায়। হাহিহামু হইতে ১ ক্রোশ দূরে পদ্মাবতী নামক নদীর বালুকায় স্বর্ণরেণু পাওয়া যায়। এই নদীর তীরে একটী দুর্গামন্দির আছে; শুল্কপক্ষের অষ্টমী তিথিতে এই মন্দির আপনা হইতেই কম্পিত হইতে থাকে।
এই সুবার রাজস্ব শস্যের অংশ দ্বারা পরিশোধ করা হয়। রাজসরকার হইতে যদিও উৎপন্নদ্রব্যের তৃতীয়াংশ লওয়ার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু কৃষকেরা কোন দিনই অর্ধেকও ঘরে লইয়া যাইতে পারে না। বাদশাহ এক্ষণে নিয়ম করিয়া দিয়াছেন যে উৎপন্ন দ্রব্য ঠিক সমান দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া একভাগ রাজসরকারে যাইবে, অপর ভাগ কৃষক পাইবে; যখন কৃষকের তিন ভাগের দুই ভাগ পাইবার ব্যবস্থা ছিল, তখন অপেক্ষা এখন অর্ধেক অংশ দিয়াও কৃষকের লাভ হয়। এই সুবার রাজস্ব ৩০৬৩০৫০ খারোয়ার শস্যে আদায় হয়। কাজী আলী এই রাজস্ব স্থির করেন। এক খারোয়ারে তিন মণ আট সের হয়; দুই দাম ওজনের শস্যে এক পালি হয়, সাড়ে সাত পালিতে এক সের, চারি সেরে একমণ, চারি মণে এক তুরেক (আকবর প্রতিষ্ঠিত সের)। অনেক দিনের শস্যের মূল্যের গড় করিয়া দেখা গিয়াছিল যে, এক খানোয়ার শস্যের মূল্য ২৯ দাম এবং সেই রেটই নির্দিষ্ট হইয়াছিল। এই ব্যবস্থা অনুসারে হিসাব করিলে সমস্ত রাজস্ব ৭৪৬৭০০৪১১ দাম হয়। আসফ খ ৩০৭৯৫৪৩ খারোয়ায় রাজস্ব স্থির করেন এবং ইহার মধ্যে পূর্বোক্ত হারে ১০১৫৩৩০০ খারোয়ার শস্য টাকায় আদায় দিতে হইত। কাজী আলীর নির্দিষ্ট রাজস্ব অপেক্ষা আসফ খাঁর নির্দিষ্ট রাজস্ব ১৬৩৯২ খারোয়ার অধিক হইলেও বর্তমান রেট অনুসারে হিসাব করিলে রাজস্ব ৮৬০৩৪ ০ দাম কম হইয়াছে, কারণ কাজী টাকার রেট একটু অধিক ধরিয়াছিলেন। কাজী আলীর হিসাবে এই সুবায় ৪০ পরগণা ছিল, আসফ খার বিবরণে ৩৮টী পরগণা হয়; ইহার কারণ এই যে, কাজী আলী কামরাজ পরগণাকে দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া দুই পরগণা (করণা ও দেরু) হিসাব করিয়াছিলেন এবং সায়র মৌজা পরগণাকেও দুই পৃথক পরগণায় বিভক্ত করিয়াছিলেন। কাজী আলী ৪০টী গ্রাম হাবেলা পরগণার অন্তর্গত করিয়াছিলেন এবং কামরাজ পরগণায় আটটী গ্রাম কোন পরগণাভুক্তই করেন নাই। পূৰ্ব্বকালে কাশ্মীর কেবলমাত্র দুই ভাগে বিভক্ত ছিল; পূৰ্বভাগের নাম মিরাজ ও পশ্চিমভাগের নাম কামরাজ। কাশ্মীরে আর এখন সৈন্য নাই বলিলেই হয়।
কাশ্মীরের রাজগণের তালিকা
প্রথম তালিকা,–নিম্নলিখিত ৪৩ জন রাজা ১২৬৬ বৎসর রাজত্ব করেন। গোনা, দামোদর, বাগ গোনাৰ্দ। ইহার পর ৩৫ জন রাজার নাম পাওয়া যায় না। কাশ্মীরের প্রামাণিক ইতিহাস রাজতরঙ্গিনীতেও এই ৩৫ জনের নাম পাওয়া যায় না। রাজতরঙ্গিনী লেখক বলেন, “পঞ্চবিংশমহাবীরা মগ্না বিস্মৃতি-সাগরে।” তাহার পর লব, কুশেশয়, খগেন্দ্র, সূরেন্দ্র, গাধার, সুবর্ণ, জনক, সচীনর, অশোক, জলৌঘ, দামোদর, পুষ্প, কনিক্ষ এবং অভিমন্যু।
দ্বিতীয় তালিকা,–২১ জন রাজা ১০১৫ বৎসর ২৯ দিন রাজত্ব করেন। গোনা ৩৫ ব, বিভীষণ ৫৩ ব, ইন্দ্রজিৎ ৩৫ ব, ৭ মা, রাবণ ৩০ ব, বিভীষণ ৩৫ ব, ৬ মা, কিন্নরাধিপ বা নর ৩৯ ব, ৯ মা, সিদ্ধ ৩০ ব, উৎপলক্ষ ৩০ ব ৬ মা, হিরণ্য ৩৭ ব, ৭ মা, হিরণ্যকুল ৬০ ব, বসুকুল ৬০ ব, মিহিরকুল ৭০ ব, বেক ৬৩ ব, ক্ষিতিনন্দন ৩০ ব, ৬০ ব, বসুনন্দন ৫২ ব, ২মা, ১৩ দি, নবে ৬০ ব, অক্ষ ৬০ ব, গোপাদিত্য ৬ মাস, গোকর্ণ ৫৭, ১১ মা, নরেন্দ্রাদিত্য ৩৬ ব, ৩ মা ১০ দি, যুধিষ্টির ৪৮ ব ১০ মাস।
তৃতীয় তালিকা,-~-ছয়জন রাজা ১৯২ বৎসর রাজত্ব করেন। প্রতাপাদিত্য ৩২ ব, জলৌকা ৩২ ব, তুষ্টিনা ৩৬ ব, বিজয় ৮ ব, চন্দ্র ৩৭ ব, আৰ্যরাজ ৪৭ ব।
চতুর্থ তালিকা,~~-দশজন রাজা ৫৯২ বৎসর ১০ মা, ১ দিন রাজত্ব করেন। মেঘবাহন ৩৪ ব, প্রবর সেন ৩০ ব, হিরণ্য ৩০ ব, ২ মা, মাতৃগুপ্ত ৪ ব, ৯ মা, ১ দি, প্রবর (২য়) ৬৩ ব, যুধিষ্টির (২) ৩৯ ব, ৩ মা, লক্ষণ বা নরেন্দ্রাদিত্য ১৩ ব, কর্ণাদিত্য ৩০ ব, বিক্রমাদিত্য ৪২ ব, বলাদিত্য ৩৬ ব।
পঞ্চম তালিকা,–১৭ জন রাজা ২৫৭ বৎসর ৫ মাস ২০ দিন রাজত্ব করেন। দুর্লভ বৰ্দ্ধন ৩৬ ব, দুর্লভক ৫০ ব, চন্দ্রাপাড় ৮ ব, ৮ মা, তারাপীড় ৪ ব, ২৪ দি, ললিতাদিত্য ৩৬ ব, ৭ মা, ১১ দিন, কুবলয়পীড় ১ ব, ১৫ দিন, বজ্রাদিত্য ৭ ব, পৃথীব্যপীড় ৪ ব, ১ মা, সগ্রামপীড় ৭ ব, জয়পীড় ৩১ ব, জঘ্য কয়েক মাস ললিত-পীড় ১২ ব, সংগ্রাম পীড় ৩৭ ব, বৃহস্পতি ১২ ব, অজিতপীড় অনঙ্গপীড় ৩ ব, উৎপলপীড় ২ ব।
ষষ্ঠ তালিকা,–১৫ জন রাজা ৮৯ বৎসর ১ মাস ১৭ দিন রাজত্ব করে। অবন্তীবৰ্ম্ম ২৮ ব, ৩ মা, ৩ দি, শঙ্করবর্ম ১৮ ব, ৮ মা, ১৯ দি, গোপালবৰ্ম ২ ব, সঙ্কট ১০ দি, রাণী সুগন্ধা ২ ব, পার্থ ১৫ ব, ১০ দি, নিৰ্জিতবৰ্ম ১ ব, ১ মা, চক্ৰবৰ্ম্ম ১০ ব, ১৫ দিন, সুরবৰ্ম্ম ১ ব, পার্থ (দ্বিতীয়বার) ১’ব, ৪ মা, চক্ৰবৰ্ম (দ্বিতীয় বার) ৬ মা, শঙ্করবর্ম ৩ব, চক্ৰবৰ্ম্ম (তৃতীয়বার) ৩ ব, উনুত্তবৰ্ম্ম ২ ব, ২ মা, সুরবৰ্ম (দ্বিতীয়বার) ৬ মাস।
সপ্তম তালিকা,–দশজন রাজা ৬৪ বৎসর ৩ মাস ১৪ দিন রাজত্ব করেন। যশঙ্কর দেব ৯ ব, বর্ণাট ১ দি, সংগ্রামদেব ৬ মা ৬ মা, ৭দি, পৰ্বগুপ্ত ১ ব, ৪ মা, ক্ষেমাগুপ্ত ৮ ব, ৬ মা, অভিমন্যু ১৪ ব, নন্দগুপ্ত ১, ১মা ৯ দি, ত্রিভুবন ২ ব, ৬ দি, ভীমগুপ্ত ৪ ব, ৩ মা, ২০ দি, রাণী দিদা ২৩ ব, ৬ মাস।
অষ্টম তালিকা,–২৭ জন রাজা ৩৫১ বৎসর ৬ মাস, ১৭ দিন রাজত্ব করেন। সংগ্রাম ২ মা, হরি ২২ দিন, অনন্ত ৫ ব ৫ মা, কলাস ২৬ ব, উৎকর্ষ ২২ দি, হর্ষ ১২ ব উচ্চল ১০ ব, ৪ মা, ২ দি, রাধা এক রাত্রি ও তিন ঘণ্টা, সহলা ৩ মা, ২৭ দি, সুশল ও ব, ১০ মা, ভিক্ষাচর ৬ মা, ১২ দি, সুশল (দ্বিতীয়বার) ২ব, ৩ মা, জয়সিংহ ২৭ ব, পরমাণু ১ ব, ৬ মা, ১০ দি, অবন্তীদেব ৭ব, ২ মা, বোপদেব ৭ ব, ৪ মা, ১৭ দিন, যশদেব ১৮ ব, ১৩ দিন, জগদেব ১৪ ব, ২ মা, রাজদেব ২৩ ব, ৩ মা ৭ দিন, সংগ্রামদেব ১৬ ব, ১০ দিন, রামদেব ২১ ব, ১ মা, ১৩ দিন, লক্ষণদেব ১৩ ব, ৩ মা, ১২ দি, সিংহদেব ৯ ব, ৩ মা ২৬ দি, বিঞ্জন ১০ ব, উদয়নদেব ১৫ ব, ২ মা, ১০ দিন, রাণীকোটা দেবী ৬ মা, ১৫ দিন।
নবম তালিকা,কাশ্মীরের মুসলমান রাজগণ। ৩২ জন রাজা ২৮২ বৎসর ৫ মাস একদিন রাজত্ব করেন। সুলতান সমসুদ্দীন ২ ব, ১১ মা ২৫ দি, সুলতান জমসের (পুত্র) ১ ব, ১০ মা, আলা উদ্দীন (সমসুদ্দীনের পুত্র) ১২ ব, ৮ মা ১৩ দি, সাহাবুদ্দীন (ঐ) ২০ ব, কুতবুদ্দীন (ঐ) ১৫ ব, ৫ মা, ২ দিন, সেকন্দর (পুত্র) ২২ ব, ৯ মা, ৬ দি, আলীশাহ (পুত্র) ৬ ব, ৯ মাস, জয়নালাবদ্দীন (সেকেন্দরের পুত্র) ৫২ ব, হাজি হায়দার শা (পুত্র) ১, ২ মা, হাসন খা (পুত্র) ১ব, ২ মা ৫ দি, মহম্মদ শা (পুত্র) ২ ব, ৭ মা, ফতে শা (জয়নালের পৌত্র) ৯ ব, ১ মা, মহম্মদ শা (দ্বিতীয়বার) ৯ মা, ৯ দি, ফতে শা (দ্বিতীয়বার) ১ ব, ১ মা, মহম্মদ শা (তৃতীয়বার) ১১ ব, ১১ মা, ১১ দি, ইব্রাহিম শা (পুত্র) ৮ মা, ২৫ দি, নাজক শা (ফতে শার পুত্র) ১ ব, মহম্মদ শা (চতুর্থবার) ৩৪ ব, ৮ মা, ১০ দি, সমজদ্দীন (পুত্র) ১০ মা, ইসমাইল শা (মহম্মদের পুত্র) ২ ব, ৯ মা, নাজেক শা (দ্বিতীয়বার) ১৩ ব, ৯ মা, ইসমাইল শা (দ্বিতীয়বার) ১ ব, ৫ মা, মিরজা হায়দর গুরগণ ১০ ব, নাজেক শা (তৃতীয়বার) ১ ব, গাজী খাঁ (কাজী চকের পুত্র) ১০ ব, ৬ মা, হাসেন চক (গাজীর ভ্রাতা) ৬ ব, ১০ মাস, আলী চক (ঐ) ৮, ৯ দি, ইউসফ শা (পুত্র) ১ ব, ৮ দি, সৈয়দ মোবারক শা ২৫ দিন লুকার চক (কাজীর পৌত্র) ১ ব, ২ মা, ইউসফ শা (দ্বিতীয়বার ৫ ব, ৩ মা, ইয়াকুব খাঁ (পুত্র) ১ব, ১১ মা, সৰ্ব্বশুদ্ধ ১৯১ জন রাজা ৪১০৯ বৎসর, ১১ মাস ৯ দিন রাজত্ব করেন।
কাশ্মীর-রাজগণের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
পাদশাহ যেবার সর্বপ্রথম কাশ্মীর ভ্রমণ করিতে যান সেবার তদ্দেশবাসিগণ তাহাকে একখানি পুস্তক উপটৌকন প্রদান করে; সেই পুস্তকের নাম রাজতরঙ্গিনী। ইহা সংস্কৃত ভাষায় লিখিত এবং ইহাতে চারি হাজার বৎসরের ইতিহাস লিখিত আছে। পাদশাহ সংস্কৃত শাস্ত্রে অভিজ্ঞ পণ্ডিতগণকে এই পুস্তক পারস্য-ভাষায় অনুবাদ করিতে আজ্ঞা করেন। এই পুস্তকে লিখিত আছে যে বহুকাল পূৰ্ব্বে কাশ্মীর রাজ্য জলময় ছিল, সে সময়ে এই স্থানের নাম সতীশ্বর ছিল। এই জল সরিয়া গেলে কশ্যপ চারিজন ব্রাহ্মণ আনিয়া কাশ্মীরে বাস করান। তাহার পর ক্রমে যখন দেশে লোকসংখ্যা অধিক হইল, তখন একজন রাজার আবশ্যক হইল। তখন তাহাদের মধ্য হইতে সৰ্বগুণসম্পন্ন একজনকে তাহারা রাজা করিল। সেই সময় হইতেই কাশ্মীরে রাজতন্ত্রপ্রণালী স্থাপিত হয়। গোনার্দ বৰ্তমান সময় হইতে ৪৪৪৪ বৎসর পূর্বে রাজত্ব করেন। শ্রীকৃষ্ণের সহিত মগধরাজ জরাসন্ধের মথুরায় যে যুদ্ধ হয়, সেই যুদ্ধে কৃষ্ণের ভ্রাতা বলদেবের হস্তে গোনা নিহত হন। পিতৃহন্তাকে শাস্তি দিবার জন্য গোনার্দপুত্র শ্রীকৃষ্ণের সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়া প্রাণ হারান। সে সময়ে তাহার মহিষী গর্ভবতী ছিলেন। কৃষ্ণ সেই সন্তানের গর্ভস্থ সন্তানকেই রাজ্য দান করেন। এই পুত্রের নাম লব; ইনি লবপুর নগর সংস্থাপন করেন। রাজা জনকের ভ্রাতুস্পুত্র অশোক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম দেশ হইতে উঠাইয়া দেন এবং দেশে জৈনধর্ম প্রচলিত করেন। দামোদর একজন ধার্মিক নরপতি ছিলেন, কিন্তু একজন সাধুর অভিশাপে তিনি সর্প হইয়া যান। মিহিরকুল অতিশয় দুর্দান্ত ছিলেন। তাহার সময়ে রাজ্যের সীমাবৃদ্ধি হয়। সেই সময়ে একদিন একখণ্ড প্রকাণ্ড প্রস্তর পড়িয়া একটী নদী বন্ধ হইয়া যায়, সমস্ত দিন লোজনে পরিশ্রম করিয়া যতটুকু পাথর কাটিয়া সরাইয়া দেয়, রাত্রিতে আবার ঠিক ততটা বাড়িয়া থাকে; কিছুতেই আর পাথর কমে না। অবশেষে দৈববাণী হইল যে, সতী রমণীর হস্তস্পর্শে পাথর আপনা হইতেই সরিয়া যাইবে। রাজার আদেশে রাজ্যের স্ত্রীলোকদিগকে প্রস্তর স্পর্শ করিতে বলা হইল, কিন্তু কাহারও স্পর্শে প্রস্তর নড়িল না। রাজা এই অসতী স্ত্রীলোক এবং তাহাদের জারজ সন্তান ও অকর্মণ্য স্বামীদিগকে বধের আজ্ঞা দিলেন। তিন লক্ষ জীবের জীবন শেষ হইল। অবশেষে একটী কুম্ভকাররমণীর করস্পর্শে প্রকাণ্ড প্রস্তর অপসারিত হইল। মিহিরকুল শেষজীবনে রোগে উন্মাদগ্রস্ত হন এবং অগ্নিতে ঝম্প প্রদানপূর্বক পাপজীবনের অবসান করেন। রাজা গোপাদিত্য রাজ্য সুশাসন করেন। রাজা যুধিষ্ঠির এমন ব্যাসনাসক্ত হন যে, রাজ্যের প্রধান প্রধান ব্যক্তিগণ তাহাকে পদচ্যুত করিয়া কারাগারে নিক্ষেপ করেন। রাজা জয়েন্দ্রের একজন বিশ্বস্ত মন্ত্রী ছিলেন; কিন্তু রাজা চাটুকারগণের তোষামোদে অন্ধ হইয়া মন্ত্রীকে পদচ্যুত করেন, তাহাতেও চাটুকারগণের সাধ মিটে না, তাহারা রাজাকে বলে যে, মন্ত্রী গোপনে ষড়যন্ত্র করিতেছেন। রাজা রাগান্ধ হইয়া মন্ত্রীকে শূলে দেন। মন্ত্রী শূলে প্রাণত্যাগ করেন এবং তাহার মৃতদেহ সেই অবস্থায় থাকে। মন্ত্রীর গুরুদেব সেই পথ দিয়া যাইবার সময়ে মন্ত্রীর ললাট-লিপি দেখিতে পান; তাহাতে লেখা আছে যে, এই ব্যক্তি পুনরায় বাঁচিয়া উঠিবে এবং রাজ্যেশ্বর হইবে। গুরু তখন মন্ত্রীর দেহ সেখান হইতে লইয়া চলিয়া গেল। তাহার পর দেবগণের কৃপায় মন্ত্রী জীবন প্রাপ্ত হন এবং পরে রাজা হন। রাজা হিরণ্য নিঃসন্তান হইয়া পরলোকগমন করিলে হিন্দুস্থানের রাজা বিক্রমজিৎ কাশ্মীরের সিংহাসন অধিকার করেন। মাতৃগুপ্তনামে একজন কাশ্মীরী ব্রাহ্মণ বিক্রমজিতের কৃপায় কাশ্মীরের সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজা চন্দ্রপীড়ের রাজত্বসময়ে একজন স্ত্রীলোক আসিয়া রাজার নিকটে অভিযোগ করে যে, কে একজন তাহার স্বামীর প্রাণনাশ করিয়াছে। তাহার স্বামীর সহিত কাহারও শত্রুতা নাই; তবে একজন পণ্ডিতের সহিত দর্শনশাস্ত্রের বিচার লইয়া একটু শক্রতা আছে। রাজা সেই লোককে ডাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলে সে অস্বীকার করিল। রাজা কি করিবেন, কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না; অবশেষে স্বপ্নে তিনি এক মন্ত্র পাইলেন; সেই মন্ত্র পড়িয়া চাউলের গুঁড়ি মাটিতে ছড়াইয়া দিয়া তাহার উপর দিয়া সন্দিগ্ধ ব্যক্তিকে যাইতে বলা হইবে। যদি সেই গুঁড়ার উপর দুই রকমের পদচিহ্ন পড়ে, তাহা হইলে সেই ব্যক্তি অপরাধী। রাজা তাহাই করিলেন এবং সেই ব্রাহ্মণই হত্যাকারী বলিয়া জানিতে পারিলেন। কিন্তু ব্রহ্মহত্যা মহাপাপ। শেষে তিনি স্কন্ধহীন লৌহমূর্তি নির্মাণ করাইয়া তাহার দ্বারা ব্রাহ্মণের কপালে দাগ দিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন। সিংহদেবের সাহমির নামে একজন বিশ্বস্ত মুসলমান অনুচর ছিল। সিংহদেবের রাজত্বসময়ে রিঞ্চন নামে তিব্বতরাজের পুত্র কাশ্মীর জয় করেন। পূৰ্ব্বরাজার মুসলমান অনুচর সাহমিরের পরামর্শে তিনি মুসলমানধৰ্ম্ম অবলম্বন করেন। রাজা উদয়নদেবের মৃত্যুর পর সাহমির তাঁহার বিধপত্নীর পাণিগ্রহণ করেন এবং সুলতান সমসুদ্দীন নাম ধারণপূর্বক কাশ্মীরের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাহার পর সুলতান আলাউদ্দীন, সমসুদ্দীন কুতবুদ্দীন কাশ্মীরে রাজত্ব করেন। সুলতান সেকেন্দর গোঁড়া মুসলমান ছিলেন; যে বিধর্মী মুসলমান না হইত, তিনি তাহার শিরচ্ছেদন করিতেন। তাঁহার পর আরও কয়েকজন মুসলমান রাজা কাশ্মীরে রাজত্ব করেন। সুলতান বাবর যখন হিন্দুস্থান জয় করিতে আসেন, তখন মহম্মদ শা কাশ্মীরে রাজত্ব করিতেছিলেন। বাবর সেনাপতি প্রেরণ করিয়া কাশীর জয় করেন, কিন্তু দেশবাসিগণ তাহাদিগকে কাশীর শাসন করিতে দেয় নাই। সম্রাট হুমায়ুনের রাজত্বসময়ে মহম্মদ শা কাশ্মীরে রাজত্ব করিতেছিলেন। হিজরী ৯৪৮ অব্দে হুমায়ুন মিরজা হায়দরকে কাশীর জয় করতে প্রেরণ করেন। তিনি সমস্ত কাশ্মীর জয় করেন এবং কাশ্মীরবাসিগণ বাদশাহ হুমায়ুনের আধিপত্য স্বীকার করে। এক্ষণে সুবে কাশ্মীরের বিভিন্ন সরকারগুলির অতি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া যাইতেছে।
সরকার পাকেলী—এই সরকারের মধ্য দিয়া তিনটী নদী প্রবাহিত। এখানে যথেষ্ট ফল উৎপন্ন হইয়া থাকে। পূর্বে এখানকার রাজা কাশীররাজ্যের অধীনে করদ ছিলেন।
সরকার সোয়াত।–বিম্বর, সোয়াত ও বিজোড় লইয়া এই সরকার গঠিত। ইহার মধ্য দিয়া অনেকগুলি গিরিপথ আছে। এখানকার পর্বতগুলি সৰ্ব্বদাই বরফে আচ্ছন্ন থাকে। এই সরকারের প্রায় সমস্ত অংশই পৰ্বত ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ। এখানকার অধিবাসিগণের নাম ইউসফজী। বর্তমান বাদশাহের রাজত্বসময়ে এখানকার অনেক উদ্ধৃত ব্যক্তির উচ্ছেদ হইয়াছে এবং অনেকে সম্রাটের ভয়ে পৰ্বত-প্রদেশে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে।
সরকার দুয়াব বাণু।–এই সরকার কাবুল সীমান্ত প্রদেশে অবস্থিত। এখানে সীরাণী, গুরাণী ও জীধে জাতি বাস করে।
সরকার কান্দাহার-কান্দাহার এই সরকারের প্রধান নগর। এখানে দুইটী দুর্গ আছে। এখানে যথেষ্ট ফল-পুষ্প জন্মে। ডিসেম্বর ও জানুয়ারী মাসে এখানে শীতের এত আধিক্য হয় যে, জল পর্যন্ত জমিয়া যায়। কান্দাহার হইতে পাঁচ ক্রোশ দূরে আজদারকো নামক পৰ্ব্বতে গেমসিদঘর নামে একটী গুফা আছে; তাহার মধ্যে আলোক প্রজ্বলিত করিতে পারা যায় না। এ প্রদেশে শাহঘর নামে আরও একটী গুম্ফা আছে; এই গুফাটী প্রকাণ্ড। হিরমন্দ ও কান্দাহারের মধ্যে জিমন্দ নামে বিখ্যাত সহর। এখানকার কৃষকগণ শস্যের দ্বারা রাজস্ব প্রদান করে।
সরকার কাবুল।–এটী কাশ্মীরের মধ্যে প্রধান সরকার। এখানে ভয়ানক শীত। এ স্থান উৎকৃষ্ট ফলের জন্য বিখ্যাত। হিন্দুস্থান হইতে কাবুলে যাইবার ছয়টী পথ আছে। কাবুল সুবায় অতিকম এগারটী ভাষা প্রচলিত। অধিবাসিগণের অধিকাংশই হাজরা ও আফগানজাতীয়। আফগানেরা বলে যে, তাহারা ইসরাইলের বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছে। তাহারা বলে, ইসরাইলের তিন পুত্র ছিল; প্রথম পুত্র সারীণ হইতে সারিণীবংশ উৎপন্ন হইয়াছে; দ্বিতীয় পুত্র ঘুরঘস্ত হইতে ঘুরঘস্তী জাতির উৎপত্তি এবং তৃতীয় পুত্র তুব্বেন হইতে তবনী জাতি উৎপন্ন হইয়াছে। এই তিন আদিবংশ হইতে নানাশাখা বাহির হইয়াছে। তাহারা বলে, মৎ-আলী গৌরীর সহিত তুব্বেনের এক কন্যার গোপন প্রণয় হয় এবং শেষে কন্যার গর্ভসঞ্চার হইলে উভয়ের বিবাহ হয়। এই দম্পত্তির তিন পুত্র;–ঘিলজী, লুদী ও সিওয়ানী। ইহারা তিনজন তিনবংশের আদিপুরুষ।
কাবুল সহর।–বহুদিন হইতেই কাবুল ও কান্দাহার ভারতের দ্বারস্বরূপ হইয়া রহিয়াছে। এখানে অনেক সুন্দর সুন্দর বাগান আছে। কাবুল কুড়িটী তুমানে বিভক্ত; তন্মধ্যে তুমান বেকরাম, নেকনেহার, মন্দ্রওর, আলিসাং, বেখরাদ, চরক-বেরাকী, বনগীস ও গজনী প্রধান। সম্রাট বাবর কাবুলের রাজস্ব তিনলক্ষ কুড়ি হাজার টাকা নির্দিষ্ট করেন। এই রাজ্য প্রথমে ঘোরিরাজবংশের অধিকারে ছিল। তাহার পর উক্ত বংশের দাসগণের অধিকারভুক্ত হয়। তাহার পর থোভা রেজমা-ইনেরা এই দেশ অধিকার করে। তাহার পর খা জেঙ্গিস এই দেশ অধিকার করেন। তাহার নিকট হইতেই এই রাজ্য তৈমুরের বংশে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।
ক্রোশের মাপ
পাদশাহ আকবর শাহ স্থানের দূরত্ব-পরিমাপের জন্য সাড়ে বারোগজ বংশদণ্ডের ৪০০ দণ্ডে এক ক্রোশ স্থির করেন। এই হিসাব অনুসারে এক ক্রোশে ৫০০০ গজ নির্দিষ্ট হয়। যখন পাদশাহ কোথাও গমন করেন, তখন তাহার অগ্রে একব্যক্তি এই বংশদণ্ড লইয়া রাস্তা মাপিতে মাপিতে অগ্রসর হয়। তাহার মাপ মিলাইবার জন্য একজন দারোগা ও একজন মুসরিফ নিযুক্ত আছে। সের খা সেকেন্দারী গজের ষাটি গজে এক জেরিব নির্দিষ্ট করেন এবং তাহারই ষাটি জেরিবে এক-ক্রোশ নির্ধারিত করেন। সুবা দিল্লীতে এই ক্রোশ এখনও প্রচলিত। গুজরাটে গাভীর ডাক যতদূর হইতে শুনিতে পাওয়া যায়, ততদূরে একক্রোশ হয়। ইহা সেকেন্দারী ৫০ জেরিবের সঙ্গে মিলে। বাঙ্গলাদেশে ধাপের ক্রোশ প্রচলিত; একজন লোক একদমে তাড়াতাড়ি যতটা পথ যাইতে পারে, তাহাই একক্রোশ। আবার বাঙ্গলাদেশে কেহ কেহ ডালভাঙা ক্রেশিও স্থির করিয়া থাকেন। একজন লোক গাছের ডাল ভাঙ্গিয়া মাথায় দিয়া যতদূর গেলে ডালের পাতাসকল শুকাইয়া যায়, ততদূরেই এক ক্রোশ হয়। এই স্থানে দুইটী ক্রোশের হিসাব প্রদত্ত হইল।
প্রথম হিসাব।~-৫ চুলে ১ যব, ৬ যবে ১ ইঞ্চি, ২৪ ইঞ্চিতে ১ গজ, ৪ গজে ১ বাঘ, ১২০০০ বাঘে ১ মাইল, ৩ মাইলে ১ ফরসক, ৩ ফরসকে ১ বেরীদ।
দ্বিতীয় হিসাব।–৮ যবে (খোসাছাড়ান) ১ ইঞ্চি, ২৪ ইঞ্চিতে ১ দণ্ড, ৪ দণ্ডে ১ ধনুক, ২০০০ ধনুকে ১ ক্রোশ, ৪ ক্রোশে ১ যোজন।
হিন্দুগণের কেহ কেহ, স্ত্রীলোক পুত্ৰকক্ষে ও জলপূর্ণ কলসী মস্তকে লইয়া এক হাজার পদ গেলে একক্রোশ হিসাব করেন।
সর্বশক্তিমান ভগবানের কৃপায় বহু আয়াসে হিন্দুস্থানের সুবার ইতিহাস : সঙ্কলিত হইল।
রাজবিভাগের ব্যবস্থা
প্রত্যেক জাতিই কোন ধৰ্ম্মপরিবর্তন, কোন বিশেষ রাজবংশের সিংহাসনে আরোহণ, কোন ভয়ানক ভূমিকম্প বা জলপ্লাবন ইত্যাদি কোন না কোন স্মরণীয় ঘটনার সময় হইতে সাল গণনা আরম্ভ করিয়া থাকে। কিন্তু এই প্রকারের নানা সাল প্রচলিত থাকায় রাজকার্যের ও হিসাবনিকাশের বিশেষ অসুবিধা হয়। এই জন্য মহামান্য পাদশাহ তাঁহার রাজত্বের ঊনত্রিংশ বৎসরে এই আদেশ প্রচার করেন যে, সমস্ত প্রচলিত সাল রহিত করিতে হইবে এবং তৎপরিবর্তে একটী নূতন সাল গণনা করিতে হইবে।
পূর্বতন পণ্ডিতগণের সমবেত চেষ্টায় ও যত্নে নানাস্থানে মানমন্দির প্রতিষ্ঠিত হইয়া জ্যোতিষিগণের গণনা অনুসারে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান দেখিয়া দেশের বিভিন্ন স্থানের দূরত্ব, অবস্থিতিস্থান এবং আরও নানাপ্রকার জ্যোতিষশাস্ত্রের রহস্যের প্রচার হইয়াছিল। কিন্তু এই সকল কার্যে রাজার সহানুভূতি, সাহায্য ও অর্থব্যয়ের আবশ্যক। এই প্রকার কোন বিষয় গণনা করিয়া স্থির করিতে গেলে অন্ততঃপক্ষে ত্রিশবৎসরব্যাপী অক্লান্ত পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের প্রয়োজন। পরন্তু এ বিষয়ে যত অধিক গবেষণা হইবে, ততই ইহার অধিকতর উন্নতি হইবে। এই বিষয়ে প্রভূত পরিশ্রম করিয়া অনেক পণ্ডিত চিরস্মরণীয় হইয়া গিয়াছেন। বর্তমান সময় পর্যন্ত নিম্নলিখিত কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির দ্বারা জ্যোতিষগণনা হইয়াছিল এবং মানমন্দির স্থাপিত হইয়াছিল। ইঁহারা বর্তমান সময়ের কত বৎসর পূর্বে এই সকল মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন; তাহারও বিবরণ লিপিবদ্ধ হইল।
ইজিপটবাসী আর্কেমিডিস, এরাসটারকাস ও এবারকাস ১৭৬৯ বৎসর পূর্বে আলেকজান্দ্রিয়ার টলেমীর ১৪১০ বৎসর পূৰ্ব্বে, বাগদাদের খলিফা মামুন ৭৯৮ বৎসর পূৰ্ব্বে, দামাস্কাসের সৈয়দবেন আলী ও খালেদবেন আবদুল মালিক ৭৬৪ বৎসর পূৰ্ব্বে, রাকার নিবাতী ৬৫৪ বৎসর পূর্বে, মারাঘাবনির্মিত নাসিরুদ্দীন উসা ৩৬২ বৎসর পূৰ্ব্বে এবং সমরকন্দে নির্মিত মিরজা উলুঘবেগ (এইটীই সৰ্বোকৃষ্ট) ১৫৬ বৎসর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রায় দুইশত জ্যোতিষের সারণী আছে। প্রতিবৎসরেই এই সকল সারণী হইতে গণনা করিয়া পঞ্জিকা লিখিত হয়। হিন্দু পণ্ডিতগণ বলেন যে, জ্যোতিষশাস্ত্র ভগবকথিত; সাধু ও পবিত্ৰাত্মা ব্যক্তিগণ বহু তপস্যায় এই সকল তত্ত্ব অবগত হইতেন। এই সকল তত্ত্ব যে সমস্ত গ্রন্থে লিখিত হয়, তাহার নাম সিদ্ধান্ত। হিন্দুগণের নয়খানি সিদ্ধান্ত আছে; যথা–ব্রহ্মসিদ্ধান্ত, সূর্যসিদ্ধান্ত, সোমসিদ্ধান্ত, বৃহস্পতিসিদ্ধান্ত, গর্গসিদ্ধান্ত, নারসিদ্ধান্ত, পরাশরসিদ্ধান্ত, পৌলস্তীয় সিদ্ধান্ত এবং বশিষ্টসিদ্ধান্ত।
ইউরোপ ও তুরাণদেশে বেলা দ্বিপ্রহর হইতে পরদিন দ্বিপ্রহর বেলা পর্যন্ত একদিন গণনা হয়; চীনদেশে রাত্রি দ্বিপ্রহর হইতে গণনা হয়। কিন্তু সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায়, সূৰ্য্যাস্ত হইতেই দিন গণনা হয়। হিন্দুগণ সূর্যোদয় হইতেই গণনা করিয়া থাকেন। সকলদেশের জ্যোতিষগণই পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিকগতি স্থির করিয়াছেন। তবে গণনায় সামান্য কমবেশী সকলদেশের জ্যোতিষিগণের মধ্যেই আছে, তাহার সবিশেষ বিবরণ এখানে লিপিবদ্ধ করা অনাবশ্যক। মাসের হিসাবও দুই প্রকারে হয়–সৌরমাস ও চান্দ্রমাস। বারোমাসেই বৎসর হয় অর্থাৎ বারোমাসেই বার্ষিক গতি সম্পূর্ণ হইয়া থাকে।
হিন্দুগণের সালের বিবরণ
ব্রহ্মার একদিন চতুর্দশ মনুতে বিভক্ত। প্রত্যেক মনুতে সত্তর কল্প, প্রত্যেক কল্পে চারিটা করিয়া যুগ বা তেতাল্লিশ লক্ষ কুড়ি হাজার বৎসর। এক্ষণে ব্রহ্মার প্রথমদিনের একান্ন। বৎসর; ছয়টা মনু গত হইয়া গিয়াছেন। এক্ষণে সপ্তম মনুর সপ্তবিংশ কল্প পার হইয়া, অষ্টাবিংশ কল্পের তিন যুগ অতীত হইয়া, চতুর্থ যুগের চারিহাজার সাতশত বৎসর চলিতেছে। বর্তমান যুগ অর্থাৎ কলিযুগের আরম্ভে রাজা যুধিষ্ঠির রাজচক্রবর্তী ছিলেন, সুতরাং তাহার সময় হইতেই সাল গণনা আরম্ভ হইয়াছে। এই বৎসরে (অর্থাৎ বাদশাহের রাজত্বের চল্লিশের বৎসরে) কলিযুগের চারিহাজার ছয়শত ছিয়ানব্বই বৎসর। তাহার পর বিক্রমজিতের সিংহাসনাধিরোহণের দিন হইতে আর একটা সাল গণনা আরম্ভ হইয়াছে। তাহার ষোলশত বাহান্নবৎসরে পড়িয়াছে। শুনিতে পাওয়া যায় শালিবাহন বিক্রমজিৎকে যুদ্ধে পরাস্ত করিয়া বন্দী করেন এবং তাহার কি প্রার্থনা আছে, নিবেদন করিতে বলিলে বিক্রমজিৎ বলেন যে তাহার প্রতিষ্ঠিত সাল যেন রহিত করা না হয়। শালিবাহন তাহার প্রস্তাবে সম্মত হন, কিন্তু তিনি নিজেও তাহার সিংহাসনে আরোহণের দিন হইতে অপর একটা সালের গণনা আরম্ভ করেন। এক্ষণে সেই সালের পনেরশত সতর বৎসর চলিতেছে। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন যে, এই শালিবাহনের বৎসরগণনা ১৮ হাজার বৎসর পর্যন্ত থাকিবে। পরে রাজা বিজয়বর্ধন নূতন গণনা প্রবর্তিত করিবেন। তাহার পরে রাজা নাগার্জুন আসিয়া নূতন গণনার ব্যবস্থা করিবেন। নাগার্জুনের গণনা চারিলক্ষ বৎসর প্রচলিত থাকিবে। পরে কী অবতার গ্রহণ করিবেন।
বৎসরগণনা দুই হিসাবে হয়;–এক চান্দ্র হিসাবে, এক সৌর হিসাবে। চান্দ্র বৎসর সৌর বৎসর অপেক্ষা দশদিন তিপ্পান্ন দণ্ড, ঊনত্রিশ পল, আড়াই বিপল কম। এই পার্থক্য দুই বৎসর আটমাস পনের দিনে এক মাসে দাঁড়ায় এই একমাস হইলে তাহাকে হিন্দুরা মলমাস বলে এবং মলমাস নির্ধারণ করিয়া বৎসরে একনামে দুইটী মাস করিয়া এই পার্থক্য সামলাইয়া লওয়া হয়।
পাদশাহ আকবর এক নূতন শকের প্রচলন করিয়াছিলেন। বাদশাহ যে দিবসে ভারতবর্ষের সিংহাসনে আরোহণ করেন, সেই দিবস হইতেই এই শকের গণনা আরম্ভ হইয়াছে।
হিন্দুর মাসের নাম। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্ত্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র।
খৃষ্টানের মাসের নাম।–জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী, মার্চ, এপ্রেল, মে, জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর।
আরবী মাসের নাম।–মহরম, সফর, রবি আউয়ল, রবি দুমেম, জমাদা আউয়ল, জমাদা সুয়েম, রজব, শাবন, রমজান, সেবল, জুলকাদ, জুলহিজ।
পারস্যমাসের নাম।–ফরবরদীন, আরূদেবিহিস্ত, খোদাদ, বৃতীর, আমারদাদ, সেরিয়ার, মেহের, আব, আজের, দিউ, বহম, ইকোনদিয়ার।
রাজকর ও মালগুজারী
ভূমির উপর রাজকর ধার্য্য করিতে হইলে দেখিতে হইবে, ভূমি কেমন উৰ্ব্বরা; নিকটে জলাশয় বা জলপ্রণালী আছে কি না, নিকটে নগর আছে কি না, নগরে যাইবার জন্য পথের ব্যবস্থা কেমন, আমদানী রপ্তানী প্রভৃতি বাণিজ্যকাৰ্য্যই বা কেমনে চলে, এবং ভূমিজাত সামগ্রীর রাজারটানই বা কত। এইগুলি দেখিয়া তবে রাজকর নির্ধারিত করেন, তিনিই সাধু। আরও একটা বিষয় বিবেচনার যোগ্য আছে। যে ভূমির উপর কর বসাইতে হইবে, সেই ভূমির অধিবাসী প্রজাগণের অবস্থা কিরূপ, প্রজাগণের অবস্থা, বুদ্ধিবৃত্তি এবং ব্যবহার দেখিয়া তবে কর নির্ধারণ করা কর্তব্য। যদি অল্পভূমিতে অধিক প্রজা বাস করে। ভূমি হইতে প্রজাগণ একটী বই ফসল আদায় করিতে না পারে, যদি ভূমিতে জল সেচন করিবার জন্য বহুদূর হইতে জল আনিতে হয়, বা অতি গভীর কূপ হইতে জল তুলিতে হয়, তাহা হইলে সে সকল বিষয়েরও বিশেষ বিবেচনা করা উচিত। পাদশাহ আকবর শা প্রজাপীড়ন করিয়া কখনও রাজকর আদায় করিতে কাহাকেও অনুমতি করেন নাই। পুরাকালে হিন্দুস্থানের রাজগণ ভূমিজাত শস্যের এক-অষ্টাংশ রাজার প্রাপ্য বলিয়া নির্ধারিত করিয়াছিলেন। তুর্কীরাজ্যের কৃষকগণ এক-পঞ্চমাংশ দিত, তুরাণে ষষ্টাংশ এবং ইরাণে দশমাংশ। কিন্তু ইহার উপর আর একটা সাধারণ কর ধার্য ছিল; তাহাকে খিরাজ বলিত। পাদশাহ স্থির করিলেন যে, এমনভাবে কর নির্ধারণ করিলে কোন দেশের প্রজার পক্ষে অত্যাচার হইবে, কোন দেশের প্রজারপক্ষে বা সুবিধা হইবে। তাই তিনি তাহার শাসিত সকলদেশের কর্ষণোপযোগী ভূমির জরিপ করিলেন।
ইলাহি গজ
পূর্বে ভারতবর্ষে তিনপ্রকারের গজ ছিল;–দীর্ঘ, মধ্যম এবং কনিষ্ঠ। প্রত্যেক গজই চব্বিশ ভাগে বিভক্ত; এই এক এক ভাগকে গিরে বা তেসজ বলে। দীর্ঘ গজের এক তেসজ আট যবোদরের সমান; এবং কনিষ্ঠ গজের এক তেস ছয় যবোদরের সমান। দীর্ঘ গজ জমী, পথ, দুর্গ, জলাশয় এবং মাটীর দেওয়াল মাপিবার জন্য ব্যবহৃত হয়। মধ্যম গজ পথের ও কাঠের বাড়ী, ছাপ্পর, দেবমন্দির বা মসজীদ, কূপ এবং বাগিচা মাপিবার জন্য ব্যবহৃত হয়। কনিষ্ঠ গজ কাপড়, চর্ম, বিছানা, পালকী, কেদারা, গরুর গাড়ী প্রভৃতি মাপিবার জন্য ব্যবহৃত হয়। গজ অনেক রকমের আছে; প্রথম গজ সওদা। হারুণ অল রসীদ তাহার একজন হাবসীদাস বা গোলামের সাড়েচব্বিশ অঙ্গুলী লম্বা মাপিয়া এই গজ ঠিক করিয়াছিলেন। দ্বিতীয় কুসবে গজ; ইহা চব্বিশ অঙ্গুলী লম্বা। তৃতীয় ইসফী গজ, ইহা পঁচিশ অঙ্গুলী লম্বা। চতুর্থ সিমিয়া গজ, ইহা আটাশ অঙ্গুলী লম্বা। পঞ্চম গজ জিয়াকিয়া, ইহা ঊনত্রিশ অঙ্গুলী লম্বা। ষষ্ঠ ওমারিয়া গজ, ইহা একত্রিশ অঙ্গুলী লম্বা। সপ্তম মামুনিয়া গজ, ইহা সত্তর অঙ্গুলী লম্বা। পূৰ্ব্বে ভারতবর্ষে সেকেন্দরী বলিয়া এই রকমের মুদ্রা প্রচলিত ছিল : সুলতান সেকেন্দর লোদী এই মুদ্রার সাড়ে আটচল্লিশটী পরে পরে রাখিয়া গজ তৈয়ার করেন। অনেকে বলে যে, এই গজ পূর্বে ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল; আকবর শাহ পাদশাহ ইহার নাম সেকেন্দরী গজ রাখিলেন। ভূমি মাপিবার জন্য এই গজের ব্যবহার আছে; কিন্তু অন্যান্য কাৰ্য্যের জন্য একচল্লিশ আঙ্গুল লম্বা ইলাহী গজের ব্যবহার প্রচলন করিলেন।
বিঘা বা জরিপ
বিঘা বা জরিপ কালী করা ভূমিখণ্ডের নাম। যদি কোন জমী লম্বায়চওড়ায় সমান না হয়, তবে তাহার কালী করিতে হয়। তাহা এই-কুড়ি বিসওয়ানসেহে এক বিশোয়া হয়, কুড়ি বিশোয়াতে এক বর্গ বিঘা। নয় বিসওয়ানসে জমীর কর লওয়া হয় না, তাহা খারিজ হয়।
জমিবিভাগ
পাদশাহ গজ ও বিঘার হিসাব ঠিক করিয়া জমীর প্রকার স্থির করিলেন এবং এক একপ্রকার জমীর এক একরকম নাম দিলেন। পুলেজ জমী তাহাকেই বলে, যাহাতে সকল ফসলই উৎপন্ন হয় এবং যাহা ফেলিয়া রাখা হয় না। পারৌতী জমী বৎসরে দুই একমাস ফেলিয়া রাখিতে হয়। চেচর জমী পূর্বে তিনচারি বৎসর অকর্ষিত অবস্থায় ফেলিয়া রাখা হইত। বুঞ্জের জমী পূৰ্বে পাঁচ বৎসরের অধিককাল অকর্ষিত অবস্থায় পড়িয়াছিল। পুলেজ এবং পারৌতি জমী তিন প্রকারের আছে; উত্তম, মধ্যম এবং অধম। উত্তম, মধ্যম এবং অধম জমীর এক একবিঘাতে যত ফসল হয়, তাহাই যোগ করিয়া যাহা হইবে, তাহার তৃতীয়াংশ একবিঘা পুলেজ জমীর ফসল বলিয়া স্বীকার করিয়া লওয়া হয় এবং ইহারই তৃতীয়াংশ পাদশাহের প্রাপ্য। উত্তম পুলেজ জমী একবিঘায় আঠারো মণ গম জন্মে, আঠারো মণ যব জনন; সাড়ে দশমণ সরিষা, তেরমণ ছোলা বা মটর এবং চব্বিশ মণ কলাই জন্মে। মধ্যম পুলেজ জমীর একবিঘায় ১২ মণ গম, ১২।।০ মণ যব, ৮।।০ মণ সরিষা, ১০।।০ মণ ছোলা বা মটর এবং ১৮ মন কলাই-জনে। অধমপ্রকারের জমীতে ৮।।০ মণ গম, ৮।।০ মণ যব, ৫ মণ সরিয়া, ৮।।০ মণ ছোলা বা মটর এবং ১৪ মণ কলাই জন্মে। ইহারই মোট হিসাব করিয়া তৃতীয়াংশ ধরিলে গড়ে সাধারণ এক বিঘা পুলেজ জমীর উৎপন্ন ফসল ১২।।০ মণ গম, ১২।।০ মণ যব, ৮ মণ সরিষা, ১০ মণ ছোলা বা মটর এবং ১৮।।০ মণ কলাই হয়। সুতরাং বাদশাহের প্রাপ্য তৃতীয়াংশ দাঁড়াইতেছে বিঘা প্রতি চারিমণ গম, চারিমণ যব, ২।।০ মণ সরিয়া, ৩।।০ মণ ছোলা বা মটর এবং ৬ মণ কলাই। কিন্তু জমীতে যদি পেঁয়াজ, লেবু, বিভিন্নপ্রকারের শাক সব্জী উৎপন্ন হয়, তাহা হইলে বিঘা প্রতি নগদ টাকায় কর দিতে হইবে। এতদ্ব্যতীত, নীল, পান, তেঁতুল, গাঁজা, চুবড়ীআলু, সাকআলু, লাউ, কুমড়া, প্রভৃতি যে সকল জমীতে উৎপন্ন হয়, তাহার কর নগদ টাকায় দিতে হয়। অন্যান্য রকমের জমীর মালব্যবস্থাও এই রকমে হইয়া থাকে। কিন্তু শিল্পজাত সামগ্রী এবং ব্যবসায়ের লভ্যের উপর পাদশাহ শতকরা পাঁচ টাকা আয়কর ধার্য্য করিয়াছেন। ইহাকে জেহাত বলে। পাটোয়ারী কৃষকের পক্ষ হইতে জমীর ফসলের হিসাব রাখিয়া থাকে। কাননগো দখলী বেদখলী জমীর বন্দোবস্ত করেন এবং জরিপের কাৰ্য্য করিয়া থাকেন। প্রত্যেক পরগণায় একজন করিয়া কাননগো আছে, প্রত্যেক গ্রামে একজন করিয়া পাটোয়ারী নিযুক্ত থাকে। কাননগো মাসিক ত্রিশটাকা বেতন পায়; পাটোয়ারী কুড়ি টাকা; ইহা ব্যতীত খোরাকী বাবদে কিছু কিছু জায়গীরও পাইয়া থাকে। পাদশাহ নিম্নলিখিত কর উঠাইয়া দিয়াছেন। ১. জিজিয়া, প্রত্যেক হিন্দু বা কাফেরের উপর এই কর ধার্য ছিল। ২. মিরবেহেরী, ইহা বন্দরের কর, আমদানী রপ্তানীর উপরে এই কর নির্দিষ্ট ছিল। ৩, কিরিয়া, বিবাহ পূজা বা উৎসবাদিতে রাজাকে এই কর দিতে হইত। ৪. গৌসেমারি, গরু-মহিষাদি রক্ষার জন্য কর। ৫. সরদবক্তী, ফলবান বৃক্ষের উপর কর। ৬. পেসকস বা নজরানা, কোন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী কোন স্থানে গেলে যে দর্শনী পান। ৭. পেসে, প্রত্যেক শিল্পীর উপর যে কর ধার্য ছিল। ৮, দাবোগানা, শান্তিরক্ষার জন্য ও কোতোয়াল দারোগা প্রভৃতির বৃত্তির ব্যবস্থার জন্য যে কর ধার্য ছিল। ৯, তহসিলদারী, রাজস্ব আদায়কারীগণের বেতন দিবার জন্য কর। ১০. ফৌজদারী, ফৌজিদার বা সেনাপতিগণের রক্ষার জন্য কর। ১১. ওজেহকরিয়া, তীর্থযাত্রীগণের থাকিবার জন্য অতিবিশালার কর। ১২. খরেতিতে, দিল্লীতে নিরাপদে রাজস্ব লইয়া যাইবার ব্যবস্থায় ব্যয়নির্বাহের জন্য এই কর। ১৩. সরাফী, টাকা, মোহর প্রভৃতি বাটার জন্য কর। ১৪. হাসিলবাজার, কেহ বাজার হাট বসাইলে যে কর দেয়! ১৪. নিকাশ, গো বৎস বা গৃহাদি বিক্রয় করিলে যে কর দিতে হয়। এতদ্ব্যতীত গাঁজা, কম্বল, তৈল এবং কাঁচাচামড়ার উপরও কর ছিল। পাঠানদিগের সময়ে উপরিউক্ত কর ব্যতীত আরও অনেকগুলি কর ধাৰ্য্য ছিল; তাহা এই, ১. রাহদারী–একপ্রদেশ হইতে অন্য প্রদেশে যাইতে হইলে যাত্রীদিগকে যে কর দিতে হয়। ২. জুগ, হিন্দু মুসলমান কাফের নির্বিশেষে সকলের উপর নির্দিষ্ট কর। ৩. অগ্নিকর, অর্থাৎ যাত্রীগণ কোথায়ও বাঁধিয়া খাইলে সেই স্থানের জন্য কর। ৪. দালালী ৫. লবণকর। ৬. বিলকুটী কোন নূতন ভূমি আবাদ করিলে যে সেলামী দেওয়া হয় তাহারই নাম বিলকুটী। ৭. পটুর উপরে কর। ৮. চুণ প্রস্তুতকারীগণের উপর কর। ৯. আবগারী কর। ১০. দালালগণের আয়কর। ১১. মৎস্যের উপর কর। ১২. সোরা, বারুদ ইত্যাদির উপর কর। এই সকল করই পাদশাহ উঠাইয়া দিয়াছেন। যদি কোন ভূমি জলপ্লাবনে বা অতি বর্ষায় আবাদের অনুপযোগী হইয়া পড়ে, তাহা হইলে পাদশাহ প্রথম বৎসরে কর রেহাই দেন; দ্বিতীয় বৎসরে মোট ফসলের এক-তৃতীয়াংশের উপর কর ধার্য হয়; পরে তৃতীয় বৎসরে অর্ধেক বাদ দিয়া অপরাদ্ধের উপর যথানিয়মে কর ধার্য হয়। চতুর্থ বৎসর হইতে ষোল আনার উপর হিসাব হয়। অনুর্বর ভূমির উপর কর ধার্য্য করিবার ব্যবস্থা বিশেষ কিছু নাই; তবে ভাওলী বন্দোবস্ত করিয়া সরকারী প্রাপ্য আদায় করা হয়। উনিশ বৎসর অন্তর জমীর নূতন বন্দোবস্ত হয়, থাকবন্দী জরিপ হয়; কারণ, উনিশ বৎসর অন্তর চন্দ্রের গতি পরিবর্তন হয় এবং উনিশ বৎসর অন্তর ঋতুসকলের ব্যবস্থাও পরিবর্তিত হইয়া থাকে। পূৰ্ব্বে রাজ্যের যেরূপ জমা ছিল, সেই জমার পরিবর্তে পাদশাহের রাজত্বের পঞ্চদশ বৎসরে রাজা তোড়লমল ও মোজাফর খা নূতন জমা তৈয়ারী করেন। দশজন বড় কাননগো নিযুক্ত হন, তাহারা সুবাসুবা হিসাব করিয়া, ভাগ করিয়া প্রাদেশিক কাননগো ও পাটওয়ারীগণের নিকট হইতে নূতন হিসাব চাহিয়া পাঠান। নদীসকলের গতির পরিবর্তনে যে সকল শিকস্তী মহল লোপ পাইয়াছিল, অথবা নূতন চরভূমি সৃষ্ট হইয়াছিল, তাহারও জরিপ করিয়া নূতন বন্দোবস্ত করা হয়। ইহাকেই তসীম মূলখ বলা হয়। এই নূতন জমার হিসাবে রাজ্যের আয় কিছু কমিয়াছিল বটে, কিন্তু আদায় বাকী পড়িত না। যখন রাজ্যের বিস্তার হইল, কাবুল হইতে বাঙ্গলা পর্যন্ত ভূখণ্ড মোগলের অধিকারভুক্ত হইল, তখন বাজারদর প্রভৃতি বিষয় নিরূপণ করিতে রাজকর্মচারীগণের বিশেষ কষ্ট হইত। প্রদেশ-প্রদেশের নিরীখনামা অনুসারে শস্য সকলের দাম স্থির করা বড় শক্ত হইয়া পড়ে; সেই জন্যই এই প্রকারের নূতন বন্দোবস্ত হইল। পাদশাহের রাজত্বের পঞ্চদশ বৎসর হইতে চব্বিশ বৎসর পর্যন্ত যাহা আদায় হইয়াছিল, তাহার মোট জমা স্থির করা হইল এবং মোটেই এক-দশমাংশই রাজ্যের বার্ষিক আয় বলিয়া নির্ধারিত হইল। এখন অনেকস্থানে রাজকর টাকাতেই আদায় হয়, সুতরাং কর আদায় ব্যাপারের হাঙ্গামা অনেক কমিয়া গিয়াছে। থাকবন্দী ব্যবস্থার জন্য জমীর ফসল, আয় এবং প্রজাগণের অবস্থার বিবরণ এখন খাস সেরেস্তায়ই পাওয়া যায়। প্রজাগণ পাদশাহের এই ব্যবস্থায় সুখী ভাছে।
রাজকর্মচারীদিগের প্রতি উপদেশ, সিপা-ই-সালার
ইনি পাদশাহ সায়েন শাহার প্রতিনিধি। রাজ্যের সকল স্থানের সকল সেনার উপর হঁহার আধিপত্য আছে। সুবার ফৌজদারী প্রজাগণের উপরও ইহার আধিপত্য-বিস্তার আছে। ইনি বিচারবা ন্যায়বান এবং ঈশ্বরপরায়ণ হইলে, ইহার অধীনস্থ সকলে সুখী হইবে। ইনি নিজের অপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠ, বিদ্যায় শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীগণের সহিত পরামর্শ করিবেন। একটা কথা আছে যে, অনেক সময়ে পণ্ডিতেও মূর্খের ন্যায় কাজ করে, মূর্খও আবার জ্ঞানী-বিচক্ষণের ন্যায় পরামর্শ দেয়। প্রজার চরিত্র, প্রকৃতি এবং শিক্ষার বিষয় ইনি সৰ্ব্বদা অনুসন্ধান করিবেন। বিচারকালে তিনি কেবল প্রমাণ ও সাক্ষীদিগের কথার উপর নির্ভর করিয়া বিচার করিবেন না। আসামী ও ফরিয়াদীর চোখ-মুখ দেখিয়া এবং গোপনে সকল বিষয়ের অনুসন্ধান করিয়া, তবে বিচার করিবেন। বিচারকার্যে যেন দেরী না হয়। অপরাধীকে ইনি প্রথমে শাসন করিয়া, তাড়না করিয়া, সৎপথে আনিবার চেষ্টা করিবেন; নতুবা বিশেষ দুষ্ট হইলে অঙ্গচ্ছেদ করিতেও পারেন, কিন্তু কদাপিও যেন কাহারও প্রাণসংহার না করেন। সৈন্যদিগের শিক্ষাবিষয়ে ইহার যেন তীবদৃষ্টি থাকে। সৈন্যেরা যেন কেবল বসিয়া না খাইতে পায়; অনবরত কোন না কোন একটা কাজে নিযুক্ত থাকে। যাহাতে প্রজাবৃদ্ধি হয়, চাষবাস বাড়ে, ইহার তাহাই কর্তব্য। কৃষকের মঙ্গলকামনা ইহাকে অনবরতই করিতে হইবে। পুষ্করিণী, দীর্ঘিকা, কৃপ, জলপ্রণালী স্থানে স্থানে খনন করাইতে হইবে। নিন্দুকের কথায় যেন তিনি কদাচ বিচলিত না হন। তিনি যেন প্রতিশোধপ্রিয় না হন। বনিয়াদিবংশের প্রতি যেন তাহার শ্রদ্ধা-ভক্তি থাকে। যাহাতে সকল মুসলমান প্রজা, আহারের পূর্বে “আল্লা হো আকবর বলে, একজন উত্তরে “জেলে জালালে হু” এই কথা বলিয়া পাদশাহের মঙ্গলকামনা করে, তাহার প্রতি যেন বিশেষ দৃষ্টি রাখেন। রাজ্যে ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি জন্তু বারোমাসের অধিকবয়স্ক না হইলে যেন বধ করা না হয়। রাজ্যে প্রজারা যেন কখন গুৰ্বিণী গমন না করে। সে বিষয়ের প্রতি যেন তাহার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকে।
ফৌজদার
ফৌজদার সিপাহ-সলারের অধীনস্থ একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী। চারিটী, পাঁচটী কি ছয়টী পরগণা এক করিয়া, তাহার উপর একজন ফৌজদার নিযুক্ত করা হয়। যদি কখনও কোন জমীদার অথবা জায়গীরদার রাজকার্যে অবহেলা করে, তাহা হইলে ফৌজদার মহাশয় প্রথমে, তাহাকে মিষ্ট কথায় সংযত করিবার চেষ্টা করিবেন। যদি মিষ্টকথায় সে দুষ্ট না শুনে, তাহা হইলে জনেকলোকের সমক্ষে সে দুষ্টের ব্যবহারকথা লিপিবদ্ধ করিয়া তবে তাহাকে শাসন করিবেন। যদি অনেকগুলি জমিদার একত্র হইয়া বিদ্রোহ উপস্থিত করে, তাহা হইলে তিনি অতি সাবধানের সহিত কাজ করিবেন। যেখানে পদাতি সৈন্যের সাহায্যে কাৰ্যোদ্ধার হইবার সম্ভাবনা, সেখানে অশ্বারোহী নিয়োগ করিবেন না। কোন নূতনস্থান অধিকার করিলে লুটের সামগ্রীর পঞ্চমাংশ পাদশার সরকারে পাঠাইতে হইবে এবং বাকী সামগ্রী পদমর্যাদা হিসাবে অন্য সকলের মধ্যে বিতরিত হইবে। অশ্বারোহীর অশ্ব যুদ্ধে হত হইলে, সরকার হইতে তাহাকে অশ্ব খরিদ করিয়া দিতে হইবে। তাহার অধীনস্থ পদাতি, সিপাহী ও অশ্বারোহীগণের পোষাক-পরিচ্ছদ যাহাতে সর্বদা ভাল থাকে, সে বিষয়ে তিনি সর্বদা দৃষ্টি রাখিবেন।
মীর-আদল এবং কাজী
যদিচ বিচারকার্য পাদশাহেরই কর্তব্য, কিন্তু এত বড় সাম্রাজ্যের সকল লোকের নালিশের ব্যবস্থা করা একা পাদশাহের পক্ষে সম্ভবপর নহে। তাই পাদশাহ অপর ব্যক্তিকে বিচারের ভার দিয়া রাখিয়াছেন। প্রত্যেক পরগণায় একজন করিয়া কাজী থাকে; প্রত্যেক ফৌজদারের সদর থানায় দুইজন কাজী, দুই জন মীর আদেল, দুইজন মুফতী এবং দুইজন মুন্সী নিযুক্ত থাকে। কাজী বিচার করেন, মুন্সী জবানবন্দী লেখেন, মুফতী ব্যবহার, নিয়ম, আইন, ইহার অনুসন্ধান করেন, মৌলবী কোন্ বিষয়ে কোন্ আইন খাঁটিবে, তাহার সিদ্ধান্ত করিয়া দেন এবং মীর আদল রায় প্রকাশ করেন। অনেক সময় মুফতী গ্রামে যাইয়া, সকল বিষয়ের পুখানুপুঙ্খরূপে অনুসন্ধান করিবেন। পঞ্চায়েদিগের মতামত লইয়া, গ্রামের বর্ধিষ্ঠ, সম্মানিত লোকদিগের মতামত লইয়া তবে কোন একটা বিচার করা কর্তব্য। সাক্ষী মিথ্যা বলিলে তাহাকে নিজ গ্রাম হইতে তাড়াইয়া দিতে হইবে।
কোতোয়াল
ইনি নগরের শান্তিরক্ষক। যাহাতে নগর, দুবৃত্তের অত্যাচার দ্বারা পীড়িত না হয়, ইনি তাহারই ব্যবস্থা করিবেন। কোতোয়াল শক্তিশালী, তেজস্বী, ক্ষিপ্রবৃদ্ধি এবং কষ্টসহিষ্ণু হওয়া আবশ্যক। রাত্রিতে চারিবার চারি প্রহরে নগর প্রদক্ষিণ করা তাহার কর্তব্য। নগরের সকল গৃহের তালিকা তাহাকে রাখিতে হইবে। সকল অধিবাসীর নাম, পথ-ঘাট, রাস্তার নাম, ঘোড়া, গাড়ী, উট, হাতীর সংখ্যা, তাঁহাকে একটী দপ্তরে লিখিয়া রাখিতে হইবে। নগরকে তিনি মহলে মহলে বিভাগ করিয়া রাখিবেন। প্রত্যেক মহলে প্রধান অধিবাসীর সহিত তাহার আলাপ থাকিবে। সকল ব্যবসাদার ও শিল্পীদের মণ্ডল বা প্রধানের সহিত তাঁহার পরিচয় থাকা কর্তব্য। সকল জাতির প্রধানের সহিত পরিচয় থাকা কর্তব্য। চোরের জাতি যদি নির্ণতি হয়, তবে সেই জাতির প্রধানের সাহায্যে তাহাকে একঘরে করিতে হইবে। পরে প্রমাণাদি সগ্রহ করিয়া বিচারার্থ কাজীর নিকট প্রেরিত হইবে। বাজারে সামগ্রীপত্রের মূল্য যাহাতে অত্যধিক বৃদ্ধি প্রাপ্ত না হয়, তাহার প্রতি তাঁহার দৃষ্টি থাকা কর্তব্য। ধনী ব্যক্তি, তাঁহার প্রয়োজনের অধিক সামগ্রী যাহাতে খরিদ না করেন, সে পক্ষে তিনি দৃষ্টি রাখিবেন। প্রত্যহ তিনি বাজারের নিরিখ নামা পরীক্ষা করিবেন। মদ, আরখ, ভাঙ্গ, গঞ্জিক, চরস এই সকল মাদকসামগ্রী যাহাতে নগরে প্রকাশ্যভাবে বিক্রীত না হয়, সেই দিকে তিনি বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখিবেন। তবে গোপনে যদি কেহ গৃহে বসিয়া মাদকদ্রব্য সেবন করে, তাহা তিনি গ্রাহ্য করিবেন না। রাজপথে যদি কেহ মদ খাইয়া মাতলামী করে, তবে সে বড়ই হউক, আর ছোটই হউক, রাজকর্মচারী হউক আর দরিদ্র প্রজাই হউক, দেখিলেই তাহাকে কোড়া মরিয়া হাজতে রাখিতে হইবে। তাহার পদমর্যাদার প্রতি তিনি লক্ষ্য করিবেন না, কেন না, যিনি মদ খাইয়া পথে মাতলামী করিতে পারেন, তিনি মনুষ্যত্ব হারাইয়াছেন, পদমর্যাদা বিস্মৃত হইয়াছেন। তাহাকে পশুর ন্যায় ব্যবহার করিতে হইবে। যে কূপ, তড়াগ বা নদীর ঘাটেতে স্ত্রীলোকে স্নানাৰ্থ বা পানীয়গ্ৰহণার্থ গমনাগমন করিয়া থাকে, কোতোয়াল দেখিবেন যে, সেই সকল কূপের নিকট, বা সেই সকল তড়াগের নিকট, বা ঘাটে পুরুষে যাইতে পায়। কোন পুরুষ কুলকামিনীর প্রতি অত্যাচার করিলে তাহাকে কোতোয়াল সাহেবের হুকুমমত খোঁজা হইতে হইবে। কোতোয়াল দেখিবেন যে, সহরে যেন কোন স্ত্রীলোক প্রকাশ্যভাবে বাহির না হয়। স্ত্রীলোকে যেন অশ্বারোহণে রাজপথ দিয়া গমনাগমন মা করে। বেশ্যা-পল্লী যেন গ্রামের প্রান্তসীমায় নির্দিষ্ট থাকে। বেশ্যাপল্লীতে অধিকসংখ্যক কোতোয়ালী সিপাহী গিয়া রাত্রে হাজির থাকিবে। ভদ্রপল্লীমধ্য দিয়া কেহ যেন প্রকাশ্যভাবে বেশ্যা লইয়া গমন না করে। ভদ্রপল্লীমধ্যে কেহ যেন অশ্লীল বা প্রেমসঙ্গীত উচ্চৈঃস্বরে গীত না করে। কোতোয়াল দেখিবেন যে, কি হিন্দু, কি মুসলমান, কেহ যেন অশ্ব, মহিস এবং উহত্যা না করে। পাদশাহের হুকুমমতে পাদশাহের বিশাল সাম্রাজ্যমধ্যে কেহ গো-হত্যা করিতে পাইবে না। কসাইখানা নগর হইতে দূরে রাখিতে হইত। কোতোয়াল দেখিবেন, যাহাতে নগরে দাস-ব্যবসায় না চলে। কোন স্ত্রীলোককে তাহার ইচ্ছার বিপরীতমত স্বামীর সহিত তাহাকে সহমরণে যাইতে দিবেন না। কাহাকেও শূলে চড়াইয়া প্রাণবধের ব্যবস্থা তিনি বন্ধ করিয়া দিবেন। যাহাতে নগরের অন্য কেহ সাধু, সন্ন্যাসী, ফকির ইত্যাদিকে বিরক্ত না করে, সে বিষয়ের তিনি ব্যবস্থা করিয়া দিবেন। গোরস্থান নগরের পশ্চিম দিকে হইবে। চৈত্র এবং কার্তিক মাসে যাহাতে নগরে জীবহত্যা না হয়, তাহাতে তিনি দৃষ্টি রাখিবেন ইলাহি উৎসব যাহাতে নগরে প্রচলিত থাকে, তাহারই তিনি ব্যবস্থা করিবেন।
আমীল গুজার বা রেবেনিউ কালেক্টর
ইনি তাহার অধীনস্থ পরগণার কর আদায় করিবেন। যাহাতে প্রজারক্ষা হয়, ইনি তাহার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখিবেন। কৃষাণকে মধ্যে মধ্যে অর্থসাহায্য করিয়া, বীজ যোগাইয়া, বলদ খরিদ করিয়া দিয়া সাহায্য করিবেন। এই সকল কাবী দানের উপর তিনি সুদ লইবেন না। সুদ গ্রহণ মহা পাপ। যদি কোন জমীতে জলাশয় শুষ্ক হইয়া যায়, তাহা হইলে তিনি সরকারী তহবিল হইতে অর্থ আনয়ন করত জলাশয় পুনঃ খনন করাইয়া দিবেন। যদি কোন জমী জলপ্লাবনে বিলে পরিণত হয়, তবে খাল কাটাইয়া সে জল বাহির করিয়া দিতে হইবে। এ খরচ সরকারের। ইনি ইহার অধীনস্থ শ্রেষ্ঠ কৃষাণের নাম লিখিয়া রাখিবেন। তাহাদের শারীরিক ও আর্থিক অবস্থার সমাচার সময়মত লইবেন। প্রত্যেক গ্রামে যাহাতে কুস্তীর আখড়া থাকে, সকলেই অশ্বারোহণ এবং অস্ত্র চালনায় পটু হয়, সে বিষয়ে তিনি বিশেষ দৃষ্টি রাখিবেন। জমীর কর ধার্য্য হইবে দুই উপায়ে; এক, জমী জরীপ করিয়া, নগদ টাকায় দেয় স্থির হইবে, আর ১ম, কনফুট। ইহার অর্থ এই, জমীর উপর শস্য থাকিলে সেই শস্যক্ষেত্র দেখিয়া কত শস্য উৎপন্ন হইবে তাহার একটী সুল হিসাব করিতে হইবে; ইহারই পঞ্চমাংশ রাজসরকারে যাইবে। ২য়, বটই বা ভাওলী, অর্থাৎ ভূমিজাত শস্য ঝাড়িয়া বাছিয়া রাখিয়া তাহার ওজন করিতে হইবে। ওজন হইলে তাহার পঞ্চমাংশ রাজ-সরকারে দিতে হইবে। ৩য়, ক্ষেত বটই অর্থাৎ যে প্রজার যতটুকু জমী চাষে আছে, তাহারই পঞ্চমাংশে যাহা উৎপন্ন হইবে তাহাই সরকারের। ৪র্থ বিচালিশুদ্ধ শস্য স্তূপ করিয়া তাহারই পশ্চমাংশ সরকারের হইবে। জমীর উৎপাদিকা শক্তি বিবেচনা করিয়া, কৃষকের অবস্থা বিবেচনা করিয়া, সেই দেশের চির প্রচলিত পদ্ধতি বিচার করিয়া তবে এই চারি উপায়ের কোন উপায়ে কর ধার্য করা হইবে। গ্রামের সকল হিসাব রাখিবার জন্য মোহরার, কারকুন এবং পাটোয়ারী নিযুক্ত থাকিবে। পাটোয়ারী গ্রামের সকল কৃষকের জমীর ছাড়পত্র তৈয়ারি করিবেন, তাহার একখানি সরকারের দপ্তরে থাকিবে এবং অপরখানি কৃষকের নিকট থাকিবে। কর-সংগ্রহ বৎসরে দুই কিস্তীতে করিতে হইবে। এক দোলের, অপর দেওয়ালীর কিস্তী। দোলের সময় রবি-খন্দক্ষেত্রে থাকে, দেওয়ালীর সময় ধান্য ক্ষেত্রে থাকে, প্রত্যেক পরগণায় গ্রাম হিসাবে দু-দশ বিঘা হিসাবে চরাই জমী রাখিতে হইবে। এই সকল চরাই জমীতে সকলেই গৃহপালিত পশ্বাদি চরাই করিতে পারিবে। লাঙ্গলের বলদের জন্য প্রজাকে কিছু দিতে হইবে। যাহাতে কেহ জিজিয়া কর আদায় না করিতে পারে, সে পক্ষে ইনি বিশেষ দৃষ্টি রাখিবেন। কেতোয়ালের অভাবে আমীলই তাঁহার কাজ করিবেন। জায়গীরদার, জমীদার, যাহাতে এই পাদশাহী নিয়মের বশীভূত থাকিয়া স্বস্ব জায়গীর ও জমীদারী সুশাসন করেন, সে বিষয়ে আমীল বিশেষ দৃষ্টি রাখিবেন।
তেপ্কচী
ইহার কৰ্ম্ম এই।–ইহার অধীনে অনেকগুলি কাননগো থাকিবে। প্রতি বৎসর পৌষমাঘ মাসে কাননগোরা পরগণায় জমী জরিপ করিবে। বিশেষতঃ সিকস্তী জমীর জরিপ সাবধানে করিতে হইবে। নদীর জল বৃদ্ধি হইলে কখনও নূতন চর তৈয়ার হয়, কখনও বা বালী পড়িয়া অনেক জমী খারাপ হইয়া যায়। এই সকল জমীর জরিপ করিয়া, ইহাদের থাকবন্দীর হিসাব হইলে তিনি মনসফ, নায়েক, গ্রামের থানাদারের নিকট এই সব হিসাব পাঠাইয়া দিবেন। প্রত্যেক গ্রামে কি কি ফসল উৎপন্ন হয়, কোন্ জমীতে কোন্ ফসল ভাল হয়, কোন্ জমীতে কোন্ প্রকারের সার দিলে জমীর উর্বরতা পায়, ইনি সেই সকল সমাচার রাখিবেন। প্রত্যেক জমীর খসড়া তৈয়ার করিয়া ইনি মোহরের নিকট রাখিবেন। তিন বৎসর অন্তর তৌজীর হিসাব মিলাইবেন। জমাবন্দীর ব্যবস্থা প্রতি বৎসর দেখিবেন যদি কোন গ্রামে ডাকাইতী হয়, তাহা হইলে ডাকাইতীর দরুণ গ্রামে কত ক্ষতি হইয়াছে, ভূমিজাত শস্য নষ্ট হইয়াছে কি না, গো, বৎস, বলদাদি নষ্ট হইয়াছে কি না, সে বিষয়ের হিসাব তিনি রাখিবেন এবং সরকারী খাজনাখানা হইতে প্রজার ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করা হইবে। কারণ; চুরি, ডাকাতী, বিপ্লব, বিদ্রোহ, রাজার শাসনাভাবে হইয়া থাকে। কাজেই প্রজার এই সকল ক্ষতির প্রতি রাজার দৃষ্টি না থাকিলে প্রজার কষ্টের সীমা থাকে না। কোন প্রজা দশ বৎসরের মধ্যে তকাবী দান শোধ করিতে না পারিলে, তাহা মাফ হইয়া যাইবে।
খাজাঞ্জী
খাজাঞ্জীর গৃহ খাজনাখানার নিকট হইবে এবং খাজনাখানা ফৌজদার বা কোতোয়াল বা আমীলের কাছারী সন্নিকটে হইবে। খাজাঞ্জী প্রজার নিকট হইতে কোন খাস মুদ্রায় রাজকর দাবী করিতে পারিবেন না। যে যাহাতে পারে, টাকা, দাম, কড়ি, শস্যের অংশ, যেমন করিয়া পারে, রাজকর দিবে এবং তাহাই খাজাঞ্জী গ্রহণ করিবেন। সিকদারগণ খাজানাখানা রক্ষা করিবেন। সিকদারের অধীনে পায়েক নিযুক্ত থাকিবে। খাজাঞ্জীর নিকট খাজনাখানার একটী চাবি থাকিবে। খাজাঞ্জী প্রজাগণকে রসিদ দিবেন। সেই রসীদে খাজাঞ্জী এবং তেপকটীর দস্তখত থাকিবে। আমীল এবং কারকুনের অজ্ঞাতে খাজাঞ্জী কোন অর্থ গ্রহণ করিবেন না। দেওয়ানের হুকুম ব্যতীত কোন প্রকার খরচা হইবে না। খরচা-নামা প্রথমে দেওয়ান, পরে আমীল, শেষে অর্থ দিবার সময় খাজাঞ্জী দস্তখত করিয়া অর্থ দিবেন। দেওয়ানী বিভাগের সকল কর্মচারী হিন্দু হইত।
সাধারণ কথা
আকবর শা পাদশাহ তাঁহার শাসনের প্রথম ২০ বৎসরকাল রাজ্যবিস্তার ও শত্রুদমনেই অতিবাহিত করিয়াছিলেন। যখন তাহার রাজ্য বাঙ্গলাদেশ হইতে সিন্ধু পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত হইল, সম্পূর্ণ ভূ-খণ্ড তাঁহার করায়ত্ত হইল, তখন কিসে প্রজাগণ সুশাসনে রক্ষিত হয়, কিসে মোগলশক্তি চিরদিনের জন্য ভারতবর্ষে অটল থাকিতে পারে, এই সকল চিন্তাই তাহার মনে উদিত হইতে লাগিল। তাহার শৈশবকালের কষ্ট, পিতা হুমায়ুনের নির্যাতন তিনি কখনও ভুলিতে পারেন নাই। তিনি বুঝিয়াছিলেন যে, ব্যক্তিবিশেষের শৌর্য্য, বীৰ্য্য, পরাক্রম অবসর পাইলে ভারতবর্ষে অনায়াসে এক সাম্রাজ্য সংস্থাপন করিতে পারে। গজনী-প্রতিনিধি কুতবুদ্দীনের সময় হইতে হুমায়ুনের অধঃপতনকাল পর্যন্ত দিল্লীর সুলতানী তক্ত চক্রান্তকারী, অধাৰ্মিক, নৃশংস, কিন্তু পরাক্রমশালী ও বীৰ্য্যবানের ক্রীড়নক হইয়াছিল। রাজ্যে শান্তিরক্ষা করিতে হইলে, দেশে চিরদিনের জন্য থাকিতে হইবে; এমন লুটেরা দস্যুর মত রাজত্ব করিলে হইবে না। পাঠান, গোলাম, খিলজী, লোদী, তোগলক, সুর, এই সকল বংশীয় সুলতানগণ ভারতীয় প্রজার সহিত কখনও কোনপ্রকার ঘনিষ্ঠসম্বন্ধ হন নাই। হিন্দু প্রজা সুখে আছে কি দুঃখ আছে, গ্রাম, নগর, পল্লী, মনুষ্যশূন্য হইতেছে কি মনুষ্যপূর্ণ হইতেছে, এ সকলের চিন্তা তাহাদের ছিল না; নিজের বিলাসোপযোগী যৎসামান্য কিছু পাইলেই, দিল্লীর বাদশাহির খরচ কুলাইয়া গেলেই তাঁহারা নিজেদের কৃতার্থ মনে করিতেন। প্রজাসকল জমিদার এবং ভৌমিকগণের দ্বারা শাসিত হইত, মাঝে মাঝে এক একজন বীর মুসলমান আসাম অভিযানে যাইতেন, দক্ষিণে কুমারিকা পৰ্য্যন্ত অনেকে গিয়াছেন, মালিক কাফুর তাহার দৃষ্টান্ত। এই সকল বীর তেজস্বী মুসলমানগণ রাজ্যজয়ের জন্য কখনও যাইতেন না, দেশকে খাস শাসনাধীন রাখিবার জন্য কখনও কোন ব্যবস্থা করিতেন না, প্রজার মতিগতি বুঝিবার জন্য কখনও কোন চেষ্টা করিতেন না, ভীষণ মরুভূমিজাত সাইমুন বায়ুর ন্যায় ইহারা যে পথ দিয়া যাইতেন, সে পথ ওয়েরাণ হইয়া যাইত; আর ফিরিবার সময় লুটতরাজের সামগ্রীর ভারে অবণত হইয়াই হঁহারা ফিরিয়া আসিতেন। শাসনই বল, দুঃশাসনই বল, যাহা কিছু হইত, তাহা সুবা দিল্লী, আগরা, লাহোর, মুলতান, এই কয় সুবাতেই হইত। ইহার ফল এই হইয়াছিল যে, প্রজাদের কোন সুলতানবিশেষের উপর আসক্তি বা অনাসক্তি ছিল না। দিল্লীর মসনদে মানুষই বসুন বা বানরই বসুন, হিন্দুস্থানের প্রজা সেদিকে লক্ষ্য করিত না। সুলতানী বন্দোবস্তের প্রতি ভক্তি প্রজাদের কখনও ছিল না।
পাদশাহ সহেন শা জেলালুদ্দীন আকবর এই সকল বিষয় চিন্তা করিয়া নূতন উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা করিতে লাগিলেন। এই চেষ্টার ফলে প্রথমেই মাড়োয়াড়ের রাজপুত বীরগণের সহিত কুটুম্বিতা স্থাপনের ব্যবস্থা করিলেন। রাজপুত যোধগণকে সেনাবিভাগের সর্বোচ্চপদে অধিষ্ঠিত করিলেন; কিছু কম দুই লক্ষ রাজপুত অশ্বারোহী সেনা পাদশাহী মনসবদারী বিভাগে নিযুক্ত হইল। ইহাতে তুর্কী, খোরাসনী, আরবী এবং ইরাণী মুসলমান বীরগণ অসন্তুষ্ট হইলেন, কিন্তু পাদশাহ তাহা গ্রাহ্য করিলেন না। এই রাজপুতগণ মোগলবংশের প্রকৃত হিতাকাক্ষী হইয়া আছেন। পাদশাহের জন্য দূর দূরান্তর প্রদেশে সকল জয় করিয়া সাহী-সুলতানের অধীনে আনিয়াছেন। সকলের বিশ্বাস, যতদিন ভারতের রাজপুত যোদ্ধা থাকিবে, ততদিন তাহারা মোগলসাম্রাজ্য রক্ষা করিবার নিমিত্ত দেহের শোণিত জলের ন্যায় ব্যয় করিবে।
পাদশাহ দ্বিতীয় ব্যবস্থা করিলেন যে, হিন্দু প্রজামাত্রই যাহাতে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে মোগলের সুশাসনের মর্ম বুঝিতে পারে, তাহাই করা হউক। তিনি প্রজার মঙ্গল-কামনায় অকাতরে অর্থ ব্যয় করিতে লাগিলেন; তিনি বিদেশী স্বার্থপর, অর্থোপজীবী মুসলমান শাসকগণকে পদচ্যুত করিয়া মুসলমানধৰ্ম্মে নূতনদীক্ষিত ভারতীয় প্রজাগণের মধ্যে যাহাদিগকে যোগ্য পাইলেন, তাহাদিগকেই সেই সকল উচ্চপদে নিযুক্ত করিতে লাগিলেন। হিন্দুর সমাজ ও ধর্মে হস্তক্ষেপ করিতে তিনি সকলকে নিষেধ করিলেন; এমন কি, রাজ-সরকার হইতে অর্থ ব্যয় করিয়া হিন্দুর অনেক পুরাতন মন্দিরের জীর্ণ সংস্কার হইতে লাগিল। তিনি আরও আদেশ করিলেন যে, দিল্লীর সম্রাট ভারতবর্ষের অধীশ্বর মোগল সুলতান যেন কদাপি কোন কারণে ভারতবর্ষ ত্যাগ করিয়া অন্য দেশে গমন না করেন। আমীর ওমরাহের পদে, ফৌজদার-সুবেদারের পদে, দেওয়ান দারোগা ও আমীরের পদে তিনি নিঃসঙ্কোচে হিন্দুগণকে নিযুক্ত করিতে লাগিলেন। হিন্দুগণকে তিনি বুঝাইলেন যে, পাদশাহ তাঁহাদেরই রাজা, রাজ্যের শাসনব্যবস্থা তাঁহাদেরই আয়ত্তগত, তাঁহারাই রাজ্যরক্ষায়, পাদশাহের জীবনরক্ষার এবং পাদশাহের মান মৰ্য্যাদা-বৃদ্ধিতে বিশেষ সহায়ক। ফলে, মোগল-সাম্রাজ্যের উপর হিন্দুগণের একটা মমতৃভাব জন্মিল।
হিন্দুরাজাগণের রাজদরবারে যেমন বড় বড় পণ্ডিত যাইত, বড় বড় দেশবিখ্যাত সাধু সন্ন্যাসী গিয়া উপস্থিত হইত, মোগল-দরবারে পণ্ডিত, অধ্যাপক, গায়ক, সাধু, সন্ন্যাসী, যোগী তেমনি নিঃসঙ্কোচে এবং অবাধে যাইতে পারে, তাহারই বিশেষ ব্যবস্থা তিনি করিলেন। আগরার ১২ মাইল দূরে ফতেপুর-সরী নগরে ইবাদতখানা নাম দিয়া তিনি একটী অতি সুরম্য প্রাসাদ প্রস্তুত করাইলেন। তথায় প্রতি বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারে দেশের সকল পণ্ডিত, মৌলবী, সন্ন্যাসী, ফকির ধর্মালোচনার জন্য উপস্থিত হইতেন। পাদশাহও এই ইবাদতখানার মজলিসে নিজে উপস্থিত থাকিতেন। এই সকল সভায় তর্কবিচার শুনিয়া পাদশাহ বুঝিলেন যে, মুসলমান ফকির, মৌলবী ও মোল্লাগণের অসংযত ব্যবহার, অসংযত ভাষা এবং সঙ্কীর্ণতার জন্যই হিন্দুগণ অনেক দূরে থাকে। যাহাতে হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মবিষয়ে সমদশী ভাব হয়, ভ্রাতৃভাবের পরিস্ফুটন হয়, তাহার চেষ্টা তিনি করিতে লাগিলেন। মৌলবী ও মোল্লাগণকে হিন্দুশাস্ত্রের মর্ম, হিন্দুরীতি-পদ্ধতির উদ্দেশ্য বুঝাইবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন। পক্ষান্তরে যাহাতে হিন্দুগণ মুসলমানধর্ম গ্রহণ না করিয়াও কোরাণের মহৎ ধর্মের মর্ম বুঝিতে পারে, তাহারও ব্যবস্থা করিলেন। পাঠানী আমলে কেবল জোর করিয়া হিন্দুগণকে মুসলমান করা হইত সেই জোর-জবরদস্তীর ব্যবস্থা তিনি উঠাইয়া দিলেন। তবে পাদশাহ বুঝিতে পারিলেন যে, তিনি যেমন শাসনবিভাগের সর্বময় কর্তা হইয়া আছেন, তেমনি ধর্মবিষয়েও সর্বময় কৰ্ত্তা না হইলে মনোমত কাজ করিতে পারিবেন না। নিজে নিজেই কৰ্ত্তা বলিয়া ঘোষণা করিলে ত আর কেহ মানে না, তাই একদিন বড় মজলিসে প্রস্তাব হইল যে, পাদশাহকে মুসলমানধৰ্ম্মের সর্বপ্রধান বলিয়া মানিতে হইবে, পয়গম্বর স্থানীয় বলিয়া পূজা করিতে হইবে। বড় বড় মৌলবী, উলেমা, মোল্লা এ প্রস্তাবে ঘোরতর আপত্তি করিলেন; এমন কি, ইবাদখানায়’ মাঝে মাঝে মারামারিও হইয়া গিয়াছে। হিন্দুগণ কিন্তু বলিলেন, হিন্দুধর্ম যিনি রক্ষা করিবেন, হিন্দু সমাজকে ধ্বংস করিবার চেষ্টা না করিবেন, পুরাতন দেবদেবীর মন্দিরসকল সংস্কার করিবার জন্য যিনি অকাতরে অর্থদান করিবেন, তীর্থস্থান পবিত্র রাখিবার জন্য যিনি সুব্যবস্থা করবেন, জিজিয়াকর যিনি উঠাইয়া দিবেন, ভারতে গোহত্যা যিনি বন্ধ করিবেন, তিনি মুসলমান হইলেও হিন্দুর আরাধ্য দিল্লীশ্বর। হিন্দুর এই মতে চলিতে পারিলে হিন্দুগণ তাহাকে জগদীশ্বরের ন্যায় পূজা করিবে। মুসলমান মোল্লাগণ কিন্তু সহজে এ কথায় স্বীকৃত হইলেন না; শেষে অনেক বাগবিতণ্ডার পর পাদশাহকে তাঁহার ‘মুজতাহীদ’ বলিয়া মানিলেন; মুজতাহীদ শব্দের অর্থ ব্যবস্থাপক। যিনি আইন বদলাইতে পারেন, কানুন শোধরাইতে পারেন, মতামত স্থির করিতে পারেন, তিনিই ‘মুজতাহীদ’। পাদশাহ সিয়া সুন্নীরও ঝগড়া মিটাইয়া দিলেন। পাদশাহের উৎসাহে রাজদ্বারে চাকুরী পাইবার আশায়, পাদশাহের সেবা করিবার আশায় অনেক হিন্দু পারস্যভাষা শিখিতে আরম্ভ করিল। ইহার পূর্বে কিন্তু হিন্দুগণ পারস্যভাষা শিখিত না মুসলমানের অধীনে চাকুরী গ্রহণ করিতেন না, মুসলমানের নিম খাইত না। পক্ষান্তরে কিন্তু মুসলমানগণ সংস্কৃত বা হিন্দী ভাষা শিখিতে রাজী হইল না। বড় বড় মৌলবী ও মোল্লা যেমন কাফেরগণকে ঘৃণা করিতেন, তেমনি তাহাদের ভাষা ও ব্যবহারও অস্পৃশ্য ও অনুচার্য বলিয়া মনে করিতেন। অগত্যা পাদশাহ আবুল ফজল ও ফৈজী, এই দুই ভাইকে সংস্কৃত শিখিয়া, হিন্দী বুঝিয়া, হিন্দুর ধৰ্ম্ম-আচার ব্যবহার, রীতি-নীতি, ইতিহাস সাহিত্য ফারশীতে ভাষান্তরিত করিবার জন্য আদেশ করিলেন। তাঁহার আদেশমত আবুল ফজল আলেমী এই আইন-ই-আকবরীর। শেষখণ্ডে হিন্দুদিগের সকল বিষয়ের সংক্ষেপ বিবরণ দিয়াছেন।
ইহাতে প্রথমেই পৌরাণিক সৃষ্টিকরণ, জ্যোতিষশৃষ্টিপ্রকরণ কালদণ্ড-নিরূপণ, ভূতত্ত্ব, ভূগোল, জম্বুদ্বীপের বর্ণন, স্থানের লঘিমা-দ্রাঘিমা-নির্ণয়করণ প্রভৃতি বিষয়ে সরল পারস্যভাষায় লিখিয়াছেন। সে সকলের বিবরণ হিন্দুপাঠকগণের অনবগত নহে, বিশেষত আইন-আকবরীতে যাহা লিখিত আছে, তাহার অনেক স্থানে ভ্রম প্রমাদও আছে। আমরা ভাষান্তরিত করিয়া পুস্তক বৃথা বর্ধিত করিব না।
নানা স্থানের প্রচলিত ভাষার কথায় আবুল ফজল লিখিয়াছেন যে দিল্লী, বাঙ্গালা, আসাম, সুলতান, মাড়োয়ার, গুজরাট, কর্ণাটক, সিন্ধু, কান্দাহার, তেলিঙ্গানা, কাশ্মীর এবং আগরা এই কয় স্থানেই ভাষার বিশেষ প্রভেদ আছে। উড়িষ্যার প্রায় সকল স্থানেই তেলিঙ্গা ভাষাই ব্যবহৃত হইয়া তাকে উহাতে বাঙ্গালারও কতকটা সংমিশ্রণ আছে। মিথিলার ও বাঙ্গালার ভাষার খুব ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ, এমন কি অক্ষর পর্যন্ত এক।
শাকসবজী খাদ্যদ্রব্যের বিবরণে দেখা যায় যে, তখনও ভারতবর্ষে আলু, কপি, শালগাম, বিটপালঙ, পেঁপে, আনারস, তামাক এই কয় সামগ্রীর প্রচলন হয় নাই।
পোষাক-পরিচ্ছদের বর্ণনায় বুঝা যায় যে, এখন আমরা যাহাকে মুসলমানী পোষাক বলি, কতকটা সেই রকমের পোষাকই হিন্দুগণ চিরকালই পরিয়া আসিতেছেন। পূর্বে বোতামের ব্যবহার ছিল না অঙ্গরক্ষা, চুনকটরা চাপকান, চুড়দার পায়জামা, হরিদ্রবর্ণের বা লেবুর রঙ্গের চাদর, দেশভেদে ও ব্যবহারভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের পাগড়ী, চরণে কাষ্ঠপাদুকা (খড়ম নহে, কিন্তু কাষ্ঠের তলা উপরে চামড়ার বাঁধন; অনেকটা গাজিয়াবাদী বিনামার মত), হস্তে অস্ত্র তলোয়ার, গুপ্তা বা তীরধনুক এবং কপালে জাতিবর্ণবিশেষে চন্দনের বা জাফরাণের তিলক; ইহাই হিন্দুর পরিচ্ছদ ছিল। প্রায়শঃ হিন্দু দাড়ী রাখিত না। অন্ত্যজ শূদ্ৰজাতি ব্যতীত সকলেরই শিখা ছিল। কি বাঙ্গালী, কি হিন্দুস্থানী খালিমাথায় কেই কখন বেড়াইত না। জৈন এবং শ্রেণীবিশেষের বৌদ্ধ, কোন কোন বৈষ্ণবদল ব্যতীত সাধারণ হিন্দুমাত্রই মাংসাশী ছিল। তালের রস, লেবুর রস, বা আঙ্গুরের রস, স্থানবিশেষে যেখানে যে সামগ্রীর রস পাওয়া যায়, তাহাই চোলাই করিয়া মদ হইত হিন্দুগণ সেই মদ ব্যবহার করিতেন। ভাতের, মহুয়ার বা কোন অগ্নিপক্ক সামগ্রীর কাথের মদ হিন্দুগণ ব্যবহার করিতেন না। এ সকল মদ আদিম নীচ-জাতিরাই ব্যবহার করিত। এতদ্ব্যতীত সিদ্ধি ও গাঁজারও প্রচলন ছিল। প্রায় হিন্দুই অহিফেন সেবন করিত না। হিন্দুমাত্রই বহুবিবাহ করিত। এই প্রকারের বিবরণ দিয়া আবুলফজল সেই সময়ের হিন্দুকে মুসলমানের নিকট পরিচিত করিয়াছেন।
হিন্দুগণের তিনশত রকমের কলাবিদ্যা ছিল। হিন্দুগণ কাগজ ব্যবহার করিতেন না; হিন্দুদের সকল পুস্তকই তালপত্রে বা ভুজ্জপত্রে লিখিত। তবে সাংসারিক হিসাবপত্র কাগজেই লেখা হইত। গৃহনির্মাণ ব্যাপার, মূর্তিগঠনে, স্বর্ণ রৌপ্য ও মহামূল্য প্রস্তরের অলঙ্কার-নির্মাণে, বস্ত্রবয়নে হিন্দুর ন্যায় উপযুক্ত শিল্পী সে সময়ে পৃথিবীতে আর কেহই ছিল না। হিসাব-নিকাশে ও গণনাবিদ্যায় হিন্দু বিশেষ পারদর্শী ছিল।
ইহার পর ষড়দর্শনের বর্ণনা আছে, বেদের মর্ম লেখা আছে, জৈনদিগের ধৰ্ম্ম ও বৌদ্ধধর্মের ভ্রমপূর্ণ অনেক কথা লেখা আছে, চার্বাক ধর্মের কথা আছে, পুরাণের বর্ণনা আছে, সুশ্রুতের মৰ্ম্ম-লেখা আছে, ইন্দ্রজালবিদ্যা আছে, কামশাস্ত্র আছে, রত্নপরীক্ষা আছে, এমন অনেক কথাই আছে; কিন্তু সে সকল এত সংক্ষেপ ও এত ভ্রমপ্রমাদপূর্ণ যে তাহা আজকাল এই বিদ্যার বহুল প্রচারের দিনে প্রকাশিত করাই বিড়ম্বনা মাত্র। তবে হিন্দুস্ত্রীগণের কিরূপ আচার-ব্যবহার ছিল, তাহার সংক্ষেপ বিবরণ দেওয়া আবশ্যক মনে করি।
আবুলফজল লিখিতেছেন যে হিন্দুস্ত্রীগণ বেনী বিনাইতে এমন নিপুণা, নানান রকমের অদ্ভুত অদ্ভুত খোঁপা বাঁধিতে তাহারা এমন পারে যে তেমনটী পৃথিবীর আর কোন দেশের স্ত্রীলোকেই পারে না। হাবভাববিলাসে, যৌবনরক্ষা-ব্যাপারে, হিন্দুস্ত্রীগণ পৃথিবীর সকল রমণীর শিরোমণি। স্বর্ণ, রৌপ্য এবং মণি-মুক্তার অলঙ্কার ইহারা এত অধিক ব্যবহার করে যে, পৃথিবীতে বোধ হয়, অপর কোন স্ত্রীজাতি তেমন ব্যবহার করে না। হিন্দুস্ত্রী কুসুমপ্রিয়া; তাহারা মাথার খোঁপায় চম্পক, কুন্দ, জাতি, মালতী, এই সকল ফুলের নানাবিধ মালা জড়াইয়া রাখে। সীমান্তে সিন্দুর, খদিরবিন্দও এবং অগুরু এবং কস্তুরীর টিপ পরিয়া থাকে, নয়নে সুরমার অঞ্জন দেয়, অধরৌষ্ঠে বকমকাষ্ঠের বা মনঃশিলার লালরং মাখাইয়া থাকে। ক্ষুদ্র অঙ্গরক্ষা এবং কাঁচুলী ইহারা সদাসব্বা ব্যবহার করে। কাঁচুলী নির্মাণে এতই শিল্পচাতুৰ্য্য প্রকাশিত হর, সোনা ও রুপার তারের সহিত মণিমুক্তার হারি করিয়া এমন সুন্দরভাবে গাঁথিয়া দেওয়া হয় যে, এক একটা কাঁচুলীর দাম অন্ততঃ দশসহস্র মুদ্রাও লাগে। হিন্দুস্ত্রীগণ গীতানুরাগিণী; তাহারা সকল পৰ্ব্ব বা উৎসবে সুহেলী বা মঙ্গলগীতি গাহিয়া থাকে।
সঙ্গীতবিদ্যার বিবরণে আবুল ফজল মহাশয় দুই একটী নূতন কথা বলিয়াছেন। রাগের ভাগবিবেকে তিনি দুই তিনটা করিয়া নূতন রাগিণীর কথা দিয়াছেন। সেই সময়ে বোধ হয়, এ সকল রাগিণীর প্রচলন ছিল। যথা–শ্রীরাগের ভাগে রাগিণী ত্রিবেণী, মধুমাধবী এবং বিহারী লিখিত আছে। বসন্তরাগের ভাগে দেবগিরি এবং ললিতার কথা আছে। ভৈঁরোর ভাগে বাগিণী মধ্যামোদী, বাদরাণী, বরাটক এবং কুমনিয়া লিখিত আছে; পঞ্চমের রাগিনীর কথা আছে। বশংশিকার কথা আছে, মেঘের ভাগে কৌশিকী এবং হরশৃঙ্গারী রাগিণীর কথা আছে। নটনারায়ণের ভাগে আহিরী, শলাকা এই দুইটীর উল্লেখ আছে এবং ইহাদের সুখ্যাতিও আছে। সঙ্গীতপুস্তকের উল্লেখে তিনি সূৰ্য্যপ্রকাশ, পঞ্চজলেশ্বর, সর্বতোভদ্র, চন্দ্রপ্রকাশ, রাগকদম্ব, কুমির এবং স্বরবাৰ্তানি এই কয়খানি পুস্তকের উল্লেখ করিয়াছেন। রাজা মানসিংহের দরবারে নায়েক বসু, মঝু এবং ভাউনু এই তিনজন সুপ্রসিদ্ধ সুগায়ক ছিলেন। ইহারা অনেক দেশী সঙ্গীত ও দেশীরাগিণীর উদ্ভব করিয়াছিলেন। দেশভেদে সঙ্গীতের স্বর ও ভঙ্গিমারও ভেদ ছিল, যথা-তৈলঙ্গ ও কর্ণাটদেশে যেভাবে সঙ্গীত গীত হইত, সেই ভাবকে বলিত ধারু; বাঙ্গালায় বঙ্গিলা বলিত; জৌনপুরের চটকিলা বলিত; দিল্লী ও আগরায় খেয়াল বলিত। খেয়াল আমীর খসরু তৈয়ার করিয়াছিলেন; খেয়াল উদ্ভাবনবিষয়ে সমোমে একজন হিন্দুগায়ক ও তাতার নামে একজন মুসলমান গায়ক, উভয়ে মিলিয়া এই খেয়ালের সৃষ্টি করেন। আমীর খসরু মৃদঙ্গকে ভাঙ্গিয়া দুই ভাগে বিভক্ত করেন;–এক ডুগী, আর এক তবলা। সিন্ধুদেশের গান কামগীত বলিয়া পরিচিত। মিথিলার বিদ্যাপতির গীত ‘পছারী’ বলিয়া পরিচিত। লাহোরের সঙ্গীতকে ‘ছন্দ’ বলে; গুজরাটের সঙ্গীতকে ‘যাক্রী’ বলে; রণসঙ্গীতকে ‘কড়কা’ বলে। সঙ্গীত আলাপে রাগ আলাপে, ভাবে এবং আলাপ এই তিনটী ব্যবস্থা আছে।
সঙ্গীত,-বাদ্যবিষয়ে আবুলফজল চারিরকমের যন্ত্র বলিয়াছেন; প্রথমে তাতা, ইহাতে তার সংযুক্ত থাকে, দ্বিতীয় অনাধ্য, ইহা চামড়ায় নির্মিত; তৃতীয় ঘন অর্থাৎ করতাল আদির বাদ্য; চতুর্থ সুধির, ইহা বাঁশী প্রভৃতি। বর্তমানকালের প্রচলিত যন্ত্রের মধ্যে উল্লেখ আছে, বীণা বা বীন, কিন্নরী বীণা, স্বরবীণা, রবাব, স্বরমণ্ডল বা কানুন, সারঙ্গী অথবা সুরবুতান কিংরী, পাখোয়াজ, আওয়াজ, ঢোল, ঢাক, অৰ্দ্ধ আওয়াজ, ডফ, খঞ্জরী, করতাল, খাল, শানাই, মুরলী, মুস্ক (ব্যাগ পাইপ); উপাঙ্গ। যাহারা পুরাতন সঙ্গীতসকল গীত করে, তাহাদিগকে ‘বৈকার’ বলে আর যাহারা গীত শিক্ষা দেয়, তাহাদিগকে ‘সহকার’ বলে। যাহারা ধ্রুপদ গান করে, তাহাদিগকে ‘কলাবৎ’ বলে। নর্তকীও অনেক আছে; পাঞ্জাবী দফুজন নর্তকী, সেহলা (বিবাহবাসরের নৰ্তকী) নর্তকী এবং নটী, এই কয় শ্রেণীর নর্তকী আছে। নটী মধ্যে দুই শ্রেণী আছে–এক দেবসেবিকা বা দেবদাসী, অন্য সাধারণী। দেবদাসীগণ কেবল দেবালয়েই নৃত্য করিয়া থাকে। বাঙ্গলা উড়িষ্যা ও দক্ষিণদেশে অনেকে সুন্দরী দেবদাসী আছে; আর সাধারণী নটী সাধারণ ভাবেই নৃত্য গীত করিয়া বেড়ায়।
কীৰ্ত্তনীরা ব্রাহ্মণগণই হইতেন; ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য কেহ কীৰ্ত্তন গাহিতে পারিত না। কীৰ্ত্তনে কৃষ্ণলীলা, প্রেম, ভাব এই সকলই গীত হইয়া থাকে। কীৰ্ত্তন-সঙ্গীতে পাথোয়াজ, রবাব, করতাল এবং কানুন প্রায় ব্যবহার হইয়া থাকে। ইহা ব্যতীত ‘ভবইয়া’ গায়ক একদল আছে, যাহারা অঙ্গ-ভঙ্গীর দ্বারা গানের ভাব অভিব্যক্ত করিয়া থাকে।
ইহার পরে আবুলফজল মহাশয় রাজনীতি ব্যবহার নীতি, চতুরাশ্রমের কথা প্রভৃতি লিখিয়াছেন। সে সময়ে হিন্দুগণের মধ্যে কি কি পূজাপদ্ধতি ছিল, তাহার বিবরণ নিমে লিপিবদ্ধ হইল। ঈশ্বর-পূজা এবং কলসপূজা প্রচলিত ছিল। ঈশ্বর-পূজায় প্রতিষ্ঠিত মূৰ্ত্তির পূজা হইত। মাটীর মূর্তি তৈয়ার করিয়া একদিন না দুইদিন বা তিনদিন পূজা করিয়া পরে বিসর্জনের ব্যবস্থা তখন ছিল না বলিয়াই মনে হয়; এখনও বাঙ্গলাদেশেই মৃণায়ী পূজারই আধিক্য আছে, অন্যত্র নাই। আবুল ফজল মহাশয় যজ্ঞ ও হোমের বর্ণনাই অধিক করিয়াছেন; বোধহয়, সে সময়ে যজ্ঞ হোমের আধিক্য ছিল, পাকযজ্ঞ, যাগযজ্ঞ এই দুই যজ্ঞের অনেক উল্লেখ আছে। দানের মধ্যে তুলাদান, রত্ন-ধেনুদান, গো সহস্র দান প্রভৃতি দানের কথা আছে।