অ্যানিমেল ফার্ম – ৫

পাঁচ

দেখতে দেখতে শীতকাল এসে গেল। সবকিছু ঠিকমতই চলছে, কেবল মলি একটু ঝামেলা করছে। রোজ কাজে যেতে দেরি করে সে। অজুহাত দেখায় ‘ঘুম পেয়েছিল’ বলে। শরীরের নানান জায়গায় অদ্ভুত সব অসুখ, যদিও স্বাস্থ্যটা বরাবরই ভাল তার। এরকম নানা অজুহাতে কাজ ফাঁকি দিয়ে চলে যেত সে. পুকুরের ধারে। পানিতে মনোযোগ দিয়ে নিজের ছায়া দেখত।

একদিন দেখা গেল, উঠানে প্রফুল্ল চিত্তে লেজ নাড়িয়ে খড় চিবুচ্ছে মলি। ক্লোভার ডাকল, ‘মলি। তোমাকে কিছু বলার আছে আমার। আজ সকালে দেখলাম তুমি ফক্সউডের সীমানা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে ছিলে। মি. পিলকিংটনের একজন লোক তখন বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। অনেক দূর থেকে দেখছিলাম আমি। মনে হলো…না, আমি নিতি, লোকটা তোমার সঙ্গে কথা বলছিল। নাকে হাত বুলিয়ে আদর করছিল। এসবের মানে কি?’

‘না, এসব সত্যি নয়, আমি ওদিকে যাইনি!’ ফুঁপিয়ে উঠল মলি, সামনের দু’পা তুলে মাটি আঁচড়াতে লাগল।

‘মলি, আমার দিকে তাকাও। শপথ করে বলো তো, লোকটা তোমার নাকে হাত বুলিয়ে দেয়নি?’

‘না,’ প্রতিবাদ করল মলি। কিন্তু ক্লোভারের মুখের দিকে তাকাতে পারল না। পরমুহূর্তে লাফিয়ে উঠান ডিঙ্গিয়ে মাঠের দিকে চলল সে।

একটা ভাবনা খেলে গেল ক্লোভারের মনে। কাউকে কিছু না বলে আস্তাবলের দিকে চলল সে। মলির শোবার জায়গার খড় উল্টে দেখল। দেখল, সেখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে একদলা চিনি আর রঙিন ফিতে। এর তিনদিন পর উধাও হয়ে গেল মলি। অনেক দিন তার কোন খবর পাওয়া গেল না। কয়েক সপ্তাহ পর কবুতর খবর নিয়ে এল, মলিকে তারা উইলিংডনে দেখেছে।

ঘোড়াগাড়িতে জুড়ে দেয়া হয়েছে তাকে। গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল একটা সরাইখানার সামনে। লালমুখো মোটা একজন লোক, দেখে মনে হচ্ছিল সরাইখানার মালিক; মলিকে আদর করে চিনি খাওয়াচ্ছিল। পিঠে নতুন আচ্ছাদন আর গলায় লাল ফিতে, ভীষণ আনন্দিত দেখাচ্ছিল মলিকে। এর পর কোন জন্তু আর মলির নাম কখনও মুখে আনেনি।

জানুয়ারি মাসে আবহাওয়া ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। মাটি হয়ে উঠল লোহার মত শক্ত, জমিতে কোন ফসল জন্মাল না। বার্নে অনেকবার সভা ডাকা হলো। শুয়োরেরা ব্যস্ত রইল আগামী মৌসুমের পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজে। তারা খামারের নীতি নির্ধারণ করবে, এটা প্রায় একটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল। অবশ্য সব সিদ্ধান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদিত হতে হবে। এই নিয়মে হয়তো সব কিছু ভালই চলত, যদি স্নোবল আর নেপোলিয়নের মধ্যে বিবাদ না বাধত।

যেখানে মতানৈক্যের অবকাশ আছে, সেখানে তাদের মতৈক্যের কথা চিন্তাই করা যায় না। যদি একজন বলে এই জমিতে বার্লি লাগানো হবে, তবে অপরজন বলে, গম লাগানো হবে। যদি একজন বলে, এই জমি বাঁধা কপির জন্য উপযুক্ত, তবে অপর জনের অভিমত হচ্ছে এখানে মূলো ছাড়া আর কিছু জন্মাবেই না দু’জনেই নিজ নিজ মতে অটল থাকত আর ভয়াবহ তর্কযুদ্ধ বেধে যেত।

স্নোবল ভোট পেত তার বাকচাতুর্যে। একই সময়ে নেপোলিয়ন অন্যদের প্রভাবিত করে নিজের পক্ষে টানত। সে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করতে পেরেছিল ভেড়াদের। ভেড়াগুলো সময়ে অসময়ে চিৎকার করে উঠত, ‘চারপাওয়ালারা বন্ধু, দুইপাওয়ালারা শত্রু।’ সভা চলাকালীন সময়ে তাদের চিৎকার সভার কাজে বিঘ্ন ঘটাত। লক্ষ করলে দেখা যেত, স্নোবলের বক্তৃতা উত্তুঙ্গে পৌঁছাবার মুহূর্তেই তারা চিৎকার শুরু করত।

স্নোবল ‘কৃষক-শ্রমিক’ পত্রিকার কিছু পুরানো সংখ্যা খুঁজে পেয়েছিল ফার্ম হাউসে, সেগুলোতে লেখা ছিল নতুন নতুন যন্ত্রপাতি বানাবার কৌশল। এসব পত্রিকা পড়ে সে বিজ্ঞের মত জমিতে নালা কাটা, জন্তুদের মল থেকে সার তৈরি ও অন্যান্য নতুন নতুন পদ্ধতির কথা বলত। বুদ্ধি দিল, এখন থেকে জন্তুরা জমিতে মল ত্যাগ করবে যাতে মলকে সার হিসেবে ব্যবহার করা যায় এবং পরিবহনের সমস্যা না হয়।

নেপোলিয়নের এরকম কোন পরিকল্পনা নেই। তার মন্তব্য—স্নোবলের বুদ্ধিতে কোন কাজ হবে না। সব কিছুতেই তার ধীর ও নিশ্চিত ভঙ্গি দেখে মনে হত, সে নিজে অন্য কোন পরিকল্পনা করছে। কিন্তু উইণ্ডমিল প্রশ্নে তাদের বিতর্কের তিক্ততা অতীতের সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেল।

চাষের জমি থেকে অল্পদূরে টিলার মত একটা জায়গা। অনেক দেখেশুনে স্নোবল ঘোষণা করল, এখানেই উইণ্ডমিল তৈরি হবে। উইণ্ডমিল থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতে ডায়নামো চলবে, গোয়ালঘরে বাতি জ্বলবে, শীতকালে উত্তাপ জোগাবে। করাত, ঘাস কাটা যন্ত্র, দুধ দোয়ানোর যন্ত্রও চলবে।

জন্তুরা এসব কথা আগে কখনও শোনেনি (খামারটা ছিল পুরানো ধাঁচের)। পত্রিকার পাতায় এসব যন্ত্রপাতির ছবি দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল। বিস্মিত হয়ে শুনল, যন্ত্রপাতিই এখন থেকে তাদের সব কাজ করে দেবে। তারা কেবল মনের সুখে মাঠে চরবে আর লেখাপড়া করে সময় কাটাতে পারবে।

কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই স্নোবল উইণ্ডমিলের নকশা এঁকে ফেলল। যন্ত্রপাতির বিবরণ পাওয়া গেল, ‘গৃহস্থালির কাজের হাজার রকম যন্ত্র,’ ‘মানুষ সবকিছুর স্থপতি’ ও স্প্রারম্ভিক বিদ্যুৎ’ বইগুলো থেকে।

স্নোবল ডিম ফোটানোর ঘরটাকে পড়ার ঘর হিসেবে বেছে নিল। ঘরের মেঝেটা ছিল খুব মসৃণ, তার আঁকাআঁকির কাজের জন্য উপযুক্ত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে সে পড়াশুনা করত। পাথরের ওপর বই খুলে রেখে খুরের সাহায্যে চক দিয়ে মেঝেতে দাগ কাটত, মাঝে মাঝে উত্তেজনায় নাক দিয়ে ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করত। শেষ পর্যন্ত তার ছবিগুলো হলো খামখেয়ালী আঁকিবুকি, দেখতে কতকটা চাকার মত আজগুবি এক জিনিস।

জন্তুরা তার কিছুই বুঝত না, কেবল মুগ্ধ হয়ে দেখত। সবাই দিনে অন্তত একবার হলেও ছবিটা দেখতে আসত। এমনকি হাঁস-মুরগিরাও আসত। যদিও ছবি না মাড়িয়ে থাকা তাদের পক্ষে বেশ কষ্টকর হত। কেবল নেপোলিয়ন রইল দূরে দূরে। প্রথম থেকেই সে উইণ্ডমিলের বিরোধিতা করে আসছিল।

একদিন হঠাৎ করেই সে গেল উইণ্ডমিলের ছবি দেখতে। গম্ভীরভাবে ঘরের আশেপাশে ঘুরল, মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখে নাক দিয়ে ঘোঁত ঘোঁত করল। চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে ছবির ওপর পানি ত্যাগ করে দিল সে, তারপর সোজা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

পুরো খামার উইণ্ডমিল প্রশ্নে দু’ভাগ হয়ে গেল। স্নোবল স্বীকার করল, উইণ্ডমিল তৈরির কাজটা বেশ কঠিন। পাথরের দেয়াল বানাতে হবে, তারপর গড়তে হবে মূল কাঠামো, এর সঙ্গে জুড়ে দিতে হবে ডায়নামো ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি (এগুলো কোত্থেকে জোগাড় হবে, সে বলেনি)। সে আশা করছে এক বছরের মধ্যেই কাজটা সম্পন্ন করা যাবে।

ডায়নামো চললে জন্তুদের অনেক কাজ কমে যাবে, তখন কেবল সপ্তাহে তিনদিন কাজ করলেই চলবে। অপর দিকে নেপোলিয়নের মত হলো, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন খাদ্য উৎপাদন। উইণ্ডমিল বানানোর পেছনে সময় নষ্ট করলে নির্ঘাত না খেয়ে মরতে হবে। জন্তুরা দু’দলে বিভক্ত হয়ে গেল। একদলের স্লোগান—‘স্নোবলকে ভোট দিলে সপ্তাহে তিনদিন কাজ করতে হবে।’ অপর দলের স্লোগান হলো, ‘নেপোলিয়নকে ভোট দিলে পেটপুরে খাবার জুটবে।’

একমাত্র বেনজামিন রইল নিরপেক্ষ। সে উইণ্ডমিল বা খাদ্য উৎপাদন কোন প্রচারণাতেই বিশ্বাস করে না। উইণ্ডমিল হোক বা না হোক; সে বলত, ‘দিন যে ভাবে চলছে সেভাবেই চলবে।’ বলাই বাহুল্য, ‘খারাপ ভাবে চলবে।’

উইণ্ডমিল ছাড়াও আরেকটা বিষয় নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে, সেটা হলো খামারের নিরাপত্তা। এটা নিশ্চিত, ‘গো-শালার যুদ্ধে’ পরাজিত হলেও মানুষেরা আবার খামার দখলের চেষ্টা করবে। এই বিশ্বাসের পেছনে কারণও ছিল। মানুষের পরাজয়ের খবর আশপাশের খামারগুলোতে ছড়িয়ে পড়ায় জন্তুরা আরও একগুঁয়ে হয়ে পড়েছে। আগের মতই, নিরাপত্তার প্রশ্নেও স্নোবল-নেপোলিয়ন এক হতে পারল না। নেপোলিয়নের মতে, জন্তুদের আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করে তার ব্যবহার আয়ত্ত করা উচিত।

স্নোবলের মতে অন্যান্য খামারগুলোতে কবুতরের মাধ্যমে বিদ্রোহের খবর পাঠানো উচিত, যাতে তারাও বিদ্রোহের প্রেরণা পায়। একজন বলল, নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়তে না পারলে পরাজয় নিশ্চিত। অপরজন বলল, সব জায়গায় যদি বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে তবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ার কোন দরকার নেই। জন্তুরা প্রথমে নেপোলিয়নের কথা শুনল, তারপর শুনল স্নোবলের কথা। মনস্থির করতে পারল না কার কথা ঠিক। আসলে, যে মুহূর্তে যে কথা বলছে তারই পক্ষ নিত তারা।

অবশেষে স্নোবলের নকশা আঁকার কাজ শেষ হলো। পরের রোববার উইণ্ডমিলের কাজ শুরুর প্রস্তাবের উপর ভোট গ্রহণ করা হবে। জন্তুরা যথারীতি সভায় মিলিত হলো। স্নোবল বক্তব্য রাখার জন্য উঠে দাঁড়াতেই ভেড়ারা ভ্যাঁ ভ্যাঁ শব্দে গোলমাল শুরু করল। এই চিৎকারের মধ্যেও স্নোবল উইণ্ডমিল তৈরির স্বপক্ষে তার মতামত ব্যক্ত করল। নেপোলিয়ন উঠে দাঁড়াল পাল্টা বক্তব্য রাখার জন্যে। কঠোর স্বরে বলল, উইণ্ডমিলের পুরো পরিকল্পনাই হলো উদ্ভট। সবাইকে এর বিপক্ষে ভোট দেবার জন্য অনুরোধ করে সে বসে পড়ল।

খুব বেশি হলে আধ মিনিট সময় নিল সে; মনে হলো জন্তুরা তার কথায় বেশ প্রভাবিত হয়েছে। স্নোবল আবার উঠে দাঁড়াল, প্রথমে চিৎকার করতে থাকা ভেড়াগুলোকে থামতে বলল। তারপর আবেগ জড়িত গলায় সবাইকে উইণ্ডমিলের পক্ষে ভোট দেবার জন্য অনুরোধ জানাল। একটু আগ পর্যন্ত জন্তুদের মন দ্বিধায় দুলছিল। কিন্তু এবার স্নোবলের আবেগ আর বাকমাধুর্য তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল।

সে আবেগ জড়িত গলায় ‘জন্তু খামার’-এর ভবিষ্যৎ ছবি এঁকে দেখাল, জন্তুদের ভবিষ্যতে আর এত পরিশ্রম করতে হবে না, তার স্বপ্ন এখন ঘাস-কাটা, কিংবা শালগম তোলার মেশিন ছাড়িয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বিদ্যুৎশক্তি, সে ব্যাখ্যা করছে; মাড়াই কল চালাতে পারে, আলোয় আলোময় করে তুলতে পারে গোটা খামার। কথা শেষ হলে স্পষ্টতই বোঝা গেল, রায় তারই পক্ষে যাবে। কিন্তু সেই মুহূর্তে উঠে দাঁড়াল নেপোলিয়ন, অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল স্নোবলের দিকে তারপর উচ্চস্বরে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠল। এরকম শব্দ করতে তাকে আগে আর কেউ দেখেনি।

বাইরে বিকট শব্দ উঠল। পেতলের কলার পরা নয়টা বিশাল ভয়ঙ্কর চেহারার কুকুর ছুটে এল বার্নের দিকে। সরাসরি স্নোবলকে আক্রমণ করে বসল তারা। লাফিয়ে কোনমতে তাদের ধারাল দাঁতের কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করল স্নোবল। পরমুহূর্তে দরজার দিকে ছুটে গেল সে। কুকুরগুলোও ছুটল তার পিছু পিছু। ভয়ে স্তব্ধ জন্তুরা দরজার কাছে জড়ো হলো পরবর্তী দৃশ্য দেখার জন্য। স্নোবল সবজি খেতের মধ্য দিয়ে সোজা রাস্তার দিকে ছুটছিল।

কুকুরগুলো তাকে প্রায় ধরে ফেলেছে, এমন সময় স্নোবলের পা পিছলে গেল। মনে হলো এবার আর তার রক্ষা নেই। কিন্তু তক্ষুণি উঠে সে আবার ছুটল আগের চেয়েও দ্রুতগতিতে। কুকুর তার লেজ কামড়ে ধরল, এক ঝটকায় লেজ ছাড়িয়ে নিল স্নোবল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল সদ্য সৃষ্ট ক্ষত থেকে, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে খামারের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে সে ততক্ষণে। ঝোপের ভেতরের এক গর্তে ঢুকে মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেল সে।

ভীত জন্তুরা নিজ নিজ জায়গায় বসে পড়ল। চিৎকার করতে করতে ফিরে এল ভয়ঙ্কর দর্শন কুকুরগুলো। সবাই অবাক, কেউ বুঝতে পারছে না, এই ভয়ঙ্কর জন্তুগুলো কোত্থেকে এসেছে। শিগগিরই জানা গেল, এগুলো হচ্ছে সেই কুকুরের বাচ্চাগুলো; যাদেরকে নেপোলিয়ন মায়েদের কাছ থেকে আলাদা করে নিজের কাছে রেখেছিল। এখনও তারা পূর্ণবয়স্ক হয়নি, কিন্তু দেখতে হয়েছে বিকট ও ভয়াল। সবাই লক্ষ করল, আগে মি. জোনসকে দেখে কুকুরগুলো যেমন লেজ নাড়ত, তেমনি এরাও নেপোলিয়নের পায়ের কাছে বসে লেজ নাড়ছে।

কুকুরদের সঙ্গে নিয়ে বার্নের উঁচু প্ল্যাটফর্মে বসল নেপোলিয়ন। এখানে বসেই বুড়ো মেজর একদিন তাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। নেপোলিয়ন ঘোষণা করল—এখন থেকে রোববারে কোন সভা হবে না। এর কোন প্রয়োজন নেই। এ শুধুই সময়ের অপচয়। খামার পরিচালনার দায়িত্ব নেবে শুয়োর নিয়ে গঠিত এক কমিটি, যার নেতা সে নিজে। এই কমিটির সভা হবে গোপনে, সিদ্ধান্ত সমূহ পরে অন্যান্য জন্তুদের জানিয়ে দেয়া হবে। সভার পরিবর্তে রোববারে পতাকাকে অভিনন্দন জানানো হবে। ‘বিস্টস অভ ইংল্যাণ্ড’ গাওয়া হবে; এবং সারা সপ্তাহের কাজের নির্দেশ গ্রহণ করবে জন্তুরা। কোন বিষয়ে তর্কের কোন অবকাশ থাকবে না।

স্নোবলের বিতাড়ন সবাইকে ভীষণ নাড়া দিয়ে গেছে বলে সভা শিগগিরই মুলতবী ঘোষণা করা হলো। কয়েকজন তাদের মত প্রকাশের অধিকার ফিরে পাবার জন্য প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিল, বক্সারও ছিল সেই দলে। সে কান খাড়া করে কয়েকবার মাথা ঝাঁকাল, চেষ্টা করল ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে বলার। যদিও শেষ পর্যন্ত কিছু বলতে পারল না। গোটা চারেক শুয়োর দাঁড়াল প্রতিবাদ জানাতে, কিন্তু কুকুরগুলো তাদের ঘিরে দাঁড়াতেই সবাই চুপ হয়ে গেল। এসময় ভেড়াগুলো গগনবিদারী আওয়াজ তুলল, ‘চার পেয়েরা বন্ধু, দু’পেয়েরা শত্রু,’ চিৎকার চলল প্রায় পনেরো মিনিট ধরে। এবং কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হলো।

স্কুয়েলারকে পাঠানো হলো নতুন পরিস্থিতি সম্পর্কে সকলকে ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য। ‘বন্ধুরা,’ সে বলল। ‘আমার বিশ্বাস, সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেবার কমরেড নেপোলিয়নের এই মহৎ প্রচেষ্টার সবাই প্রশংসা করবে। বন্ধুরা, ভেব না নেতৃত্ব খুব সুখের জিনিস। এই দায়িত্ব খুব কঠিন। কমরেড নেপোলিয়ন মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন সব জন্তুই সমান। সবাই যার যার দায়িত্ব পালন করতে পারলেই তিনি সুখী হতেন। কিন্তু, তোমরা যদি কখনও ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলো, তাহলে কি ঘটবে? যেমন ধরো, তোমরা উইণ্ডমিলের প্রলোভনে ভুলে স্নোবলের কথায় চলার সিদ্ধান্ত নিলে। কিন্তু স্নোবল কে? সবাই জানে, সে দাগী আসামীর চেয়ে ভাল কিছু নয়।’

‘কিন্তু “গো-শালার” যুদ্ধে সে বীরের মত লড়েছে,’ কেউ একজন বলল।

‘বীরত্বটাই কেবল যথেষ্ট নয়,’ বলল স্কুয়েলার। ন্যায়বোধ, সততা আর আনুগত্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গো-শালার যুদ্ধে স্নোবলের ভূমিকা ছিল বেশ বাড়াবাড়ি। শৃঙ্খলা বন্ধুরা, কঠোর শৃঙ্খলা এটাই হলো আজকের মূলমন্ত্র। একটামাত্র ভুল পদক্ষেপেই শত্রুরা আমাদের গ্রাস করার সুযোগ পেয়ে যাবে বন্ধুরা, তোমরা কি আবার জোনসের যুগে ফিরে যেতে চাও?’

সবাই চুপ করে থাকল। আর যাই হোক, জন্তুরা জোনসের যুগে ফিরে যেতে চায় না। রোববার সকালের সভা যদি জোনসকে ফিরিয়ে আনে, তবে সে সভা অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত। বক্সারের ভাবনা এতক্ষণে শেষ হলো। সে মুখ খুলল, ‘কমরেড নেপোলিয়ন যা বলেন, তাই ঠিক।’ এরপর থেকে তার ব্যক্তিগত নীতি হলো দুটো—‘কমরেড নেপোলিয়ন যা বলেন, তাই ঠিক। আর আমি আরও বেশি পরিশ্রম করব।’

দিনে দিনে আবহাওয়া ভাল হতে শুরু করল, বসন্ত সমাগত প্রায়। স্নোবলের পড়ার ঘরে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হলো এবং মেঝে থেকে তার আঁকা নকশাগুলো ঘষে তুলে ফেলা হলো। জন্তুরা রোববার সকালে বার্নে জড়ো হয়ে সারা সপ্তাহের কাজের নির্দেশ নিতে শুরু করল। কবর থেকে বুড়ো মেজরের খুলি তুলে এনে পরিষ্কার করে একটা লাঠির মাথায় ঝুলিয়ে পতাকার পাশে রাখা হয়েছে। পতাকা উত্তোলনের পর জন্তুরা এক সারিতে দাঁড়িয়ে সেই খুলির প্রতি শ্রদ্ধা জানাত।

তারপর জড়ো হত বার্নে। আগের মত যার যেখানে খুশি বসার নিয়ম নেই। নেপোলিয়ন, স্কুয়েলার ও মিনিমাস নামের এক কবি শুয়োর বসে উঁচু প্ল্যাটফর্মে। তাদের ঘিরে অর্ধচন্দ্রাকারে বসে সেই নয়টি ভয়াল দর্শন কুকুর। বাকি জন্তুরা বসে বার্নের চার ধারে। নেপোলিয়ন দৃঢ়, কর্কশ কণ্ঠে সারা সপ্তাহের কর্মসূচী পাঠ করে। এরপর একবার ‘বিস্টস অভ ইংল্যাণ্ড’ গেয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

স্নোবলকে তাড়িয়ে দেবার তিন সপ্তাহ পর একটা কথা শুনে বিস্মিত হলো জন্তুরা। নেপোলিয়ন ঘোষণা করেছে সে উইণ্ড মিলের কাজ শুরু করবে। মত পরিবর্তনের কোন কারণ সে ব্যাখ্যা করল না। কেবল হুঁশিয়ার করল, এই কাজটা হবে বেশ কষ্টের। এর ফলে তাদের রেশনে ঘাটতি পড়তে পারে। এ বিষয়ে সমস্ত পরিকল্পনা করা হয়েছে। শুয়োরদের এক কমিটি প্রায় তিন সপ্তাহে একাজ সমাপ্ত করেছে। আশা করা হচ্ছে, এই কাজ বছর দু’য়েকের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।

সেদিন বিকেলে স্কুয়েলার ব্যাখ্যা করল, কমরেড নেপোলিয়ন আসলে কখনও উইণ্ডমিল তৈরির বিপক্ষে ছিলেন না। তিনিই সর্ব প্রথম এই পরিকল্পনা করেছিলেন। স্নোবল যে সব নকশা এঁকেছিল, সে সব আসলে চুরি করা। সত্যি কথা বলতে কি, উইণ্ডমিল আসলে কমরেড নেপোলিয়নেরই আবিষ্কার।

‘তাহলে তিনি এর বিরোধিতা করেছিলেন কেন?’ কে যেন জিজ্ঞেস করল।

স্কুয়েলারকে একটু লজ্জিত মনে হলো। তারপর সে বলল, ‘এটা ছিল কমরেড নেপোলিয়নের গোপন পরিকল্পনার অংশ। তিনি সব সময় চেষ্টা করেছিলেন কি করে স্নোবলকে তাড়ানো যায়। স্নোবলের উপস্থিতি কেবল এই খামারের সর্বনাশ বয়ে আনত। এখন স্নোবল নেই, সমস্ত পরিকল্পনা এগোবে নিজস্ব গতিতে। এটাই হলো স্কুয়েলারের কৌশল।’ সে বেশ কয়েকবার কথাটার পুনরাবৃত্তি করল। ‘কৌশল, বন্ধুরা, কৌশল।’ আনন্দে লেজ দুলিয়ে লাফিয়ে উঠল সে। কথাটার মানে জন্তুরা বুঝল না। কিন্তু কথাগুলো তাদের অনেকখানি প্রভাবিত করল। সেই সময় কুকুরগুলো হঠাৎ ভয়ঙ্কর গলায় ডেকে উঠল। আর দ্বিধা না করে জন্তুরা স্কুয়েলারের ব্যাখ্যা মেনে নিল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *