অ্যানিমেল ফার্ম – ৪

গ্রীষ্মের শেষাশেষি জন্তুখামার-এর ঘটনা পুরো উইলিংডন জেলায় ছড়িয়ে পড়ল। স্নোবল ও নেপোলিয়ন রোজ সকালে কবুতরদের আশপাশের খামারগুলোতে পাঠাত, বিদ্রোহের গল্প শুনিয়ে সেখানকার জন্তুদের উত্তেজিত করতে আর বিস্টস অভ ইংল্যাণ্ড শেখাতে। ওদিকে মি. জোনস সময় কাটাতেন উইলিংডনের রেড লায়ন বারে বসে। উৎসাহী শ্রোতা পেলে তার দুর্ভাগ্যের কথা শোনাতেন, খামারের পাজি জন্তুদের কথা বলতেন। অন্য কৃষকরা তাকে সান্ত্বনা দিত কিন্তু কারও কাছ থেকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি মিলত না।

আসলে সবাই মি. জোনসের দুর্ভাগ্যকে কাজে লাগিয়ে গোপনে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছিল। সৌভাগ্যের কথা হলো, জন্তু খামার-এর পাশের খামার দুটোর অবস্থা তেমন ভাল না, এদের একটার নাম ফক্স উড। বিশাল আকারের, অবহেলিত, পুরানো ধাঁচের খামার ফক্স উড। বন-জঙ্গল আর আগাছা মিলিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। মালিক মি. পিলকিংটন ফুলবাবু গাছের লোক। তার অধিকাংশ সময় কাটে মাছ ধরে আর শিকার করে।

অপর খামার পিঞ্চ ফিল্ড, আকারে ছোট্ট হলেও অবস্থা ফক্স উডের চেয়ে ভাল। মালিক মি. ফ্রেডরিক ভীষণ ধূর্ত লোক। মামলাবাজ আর দরকষাকষিতে শক্ত বলে তার নাম আছে। দুজন একে অপরকে এত ঘৃণা করে যে, নিজেদের মধ্যে কোন রকম রফায় পৌঁছানো এদের পক্ষে একেবারে অসম্ভব, এমনকি তাতে, নিজেদের স্বার্থ জড়িত থাকলেও না।

তারা দুজনেই ভেতরে ভেতরে জয় খামার-এর বিদ্রোহ দেখে ভয় পেয়ে গেছেন, নিজেদের খামারের জন্তুদের মধ্যে যাতে এই খবর না ছড়ায় সে ব্যাপারে তারা ভীষণ সতর্ক। প্রথম দিকে, জন্তুরা খামার চালাচ্ছে শুনে তাঁরা হাসতেন। বলতেন, দুএক সপ্তাহের মধ্যেই এই বিদ্রোহের অবসান ঘটবে। কে কবে শুনেছে যে জন্তুরা খামার চালাতে পারে?

ভাবতেন, ম্যানর ফার্মের জন্তুরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে আর অনাহারে মারা যাবে। সময় যায়, কিন্তু কোন জন্তুর অন্যহারে মৃত্যুর খবর আসে না। মি. পিলকিংটন ও মি. ফ্রেডরিক তাদের সুর পাল্টে ফেললেন। বলতে শুরু করলেন, ভীষণ অনাচার চলছে জন্তু খামারে। জন্তুরা নিজেদের মাংস খাচ্ছে, শাবকগুলোকে মেরে ফেলছে এবং এ হলো প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণের শান্তি।

কিন্তু তাদের এই গল্প কেউ পুরোপুরি বিশ্বাস করল না। কোন মানুষের কর্তৃত্ব নেই, জন্তুরাই সর্বময় কর্তা—এরকম একটা সুখী খামারের গল্প কি করে যেন ছড়িয়ে পড়ল আশেপাশের খামারগুলোতে। অন্যান্য খামারের নম্রভদ্ৰ ষাঁড়গুলো হঠাৎ করেই বুনো হয়ে উঠল, ভেড়াগুলো ঝোপ-ঝাড় নষ্ট করে ফেলল। গরুরা দুধের বালতি উল্টে ফেলল, শিকারি কুকুরগুলো শিকার করতে অস্বীকৃতি জানাল। বিস্টস অভ ইংল্যাণ্ডের কথা ও সুর প্রচার হয়ে গেল সর্বত্র।

বিস্ময়কর দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছিল এই গান। মানুষের কানে গেলে তারা রাগে ফেটে পড়ত। তারা একে আবোল-তাবোল শব্দ ছাড়া আর কিছু ভাবত না। বুঝতে পারছি না, তারা বলত, জন্তুরা কি করে এমন উদ্ভট সুরে গাইতে পারে? কোন জন্তুর মুখে এই গান শোনা গেলে তাকে চাবুক মারা হত। কিন্তু এত করেও বিস্টস অভ ইংল্যাণ্ডের প্রসার ঠেকিয়ে রাখা গেল না।

ব্ল্যাকবার্ড ঝোপে বসে শিস দিত, কবুতর বাকবাকুম করত এলম গাছে। সে গানের সুর এসে মিশত কামারের হাতুড়ির শব্দে আর গির্জার ঘণ্টাধ্বনিতে। মানুষ ভয়ে কেঁপে উঠত, তাদের চোখে ভবিষ্যতের অজানা আশঙ্কার ছায়া ভাসত।

অক্টোবরের শুরু–খেতের শস্য কেটে উঠানে গাদা করে রাখা হয়েছে। কিছু কিছু মাড়াইও করা হয়েছে। এমন একদিনে একদল কবুতর বাতাসে ঘুরে ঘুরে খামারের উঠানে নেমে উত্তেজনায় ফেটে পড়ল। তারা দেখল, একদল লোক নিয়ে মি. জোনস সদর রাস্তা ধরে খামারের দিকে এগিয়ে আসছেন। সবার হাতে লাঠিসোটা আর মি. জোনস সর্বাগ্রে বন্দুক হাতে তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সন্দেহ নেই তারা আসছে খামারের দখল পুনরুদ্ধার করতে।

এরকম আশঙ্কা জন্তুরা আগেই করেছিল। এজন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেয়া সারা। জুলিয়াস সীজার কে নিয়ে লেখা একটা বই পড়েছিল স্নোবল। সব রকম আক্রমণ পরিচালনা করার দায়িত্ব বর্তেছিল তারই ওপর। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সে সবাইকে তৈরি হওয়ার নির্দেশ দিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সব জন্তু নিজ নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেল।

মি, জোনসের দলবল ফার্ম হাউসের দিকে এগুতেই স্নোবল আক্রমণের সূচনা করল। কবুতরেরা অনবরত মাথার ওপর উড়ে উড়ে তাদের বিভ্রান্ত করে তুলল। ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা হাঁস-মুরগির দল হিংস্রভাবে মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আসলে এটা ছিল কেবল তাদের বিভ্রান্ত ও ছত্রভঙ্গ করার কৌশল। মানুষেরা খুব সহজেই লাঠির আঘাতে হাঁস-মুরগিদের তাড়িয়ে দিতে পারল।

দ্বিতীয় দফা আক্রমন এল তারপর, স্নোবলের নেতৃত্বে মুরিয়েল, বেনজামিন ও ভেড়ার দল মানুষদের ঘিরে ফেলে আঘাত করতে লাগল। বেনজামিন তার শক্ত খুরের সাহায্যে লাথি মারতে লাগল। কিন্তু মানুষের লোহা মারা বুটের আঘাত তারা বেশিক্ষণ সইতে পারল না। এসময় স্নোবলের কাছ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে সবাই একযোগে উল্টোদিকে ঘুরে দৌড় দিল। এটা ছিল নবোদ্যমে আক্রমণ শুরু করার পূর্ব প্রস্তুতি।

লোকজন আনন্দে চিৎকার করে উঠল। শক্রদের পিছু হটতে দেখে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে তাদের পিছু খাওয়া করল। স্নোবলও ঠিক তাই আশা করেছিল। জন্তুরা উঠানে জড়ো হলো। ঘোড়া, গরু, শুয়োরেরা গোয়াল ঘরে অবস্থান নিল। বাকি সবাই উঠানে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সময় বুঝে আঘাত হানার ইঙ্গিত দিল স্নোবল। সে নিজে আক্রমণ করল স্বয়ং মি. জোনসকে। মি. জোনস স্নোবলকে এগিয়ে আসতে দেখে বন্দুক তুলে গুলি কলেন। গুলিটা স্নোবলের ঘাড় ছুঁয়ে একটা ভেড়ার গায়ে লাগল।

ভেড়াটা সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল। একটুও ইতস্তত না করে স্নোবল তার বিশাল দেহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মি. জোনসের ওপর। মি. জোনস উল্টে পড়লেন গোবরের গাদায়, হাতের বন্দুক কোথায় ছিটকে পড়ল! বক্সার মূর্তি ধারণ করে আক্রমণ করে চলছে। লোহার নাল লাগানো দুপা তুলে স্ট্যালিয়ানের মত মহা বিক্রমে আক্রমণ করল সে ফক্সউডের এক শ্রমিককে। লোকটির খুলি কেটে গেল। কাদায় মুখ থুবড়ে তৎক্ষণাৎ যারা গেল সে।

এই দৃশ্য দেখে কয়েকজন হাতের লাঠি ফেলে পালাবার চেষ্টা করল। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল সবার মাঝে, জন্তুরা একযোগে তাদের ধাওয়া করল। লাথি, গুঁতো আর আঁচড়ের বৃষ্টি হতে লাগল মানুষের ওপর। মহাশত্রুদের হাতের মুঠোয় পেয়ে সব জন্তুই নিজস্ব কায়দায় প্রতিশোধ নিল। এমনকি বেড়ালও ছাদের ওপর থেকে একজনের ঘাড় লাফিয়ে পড়ে তাকে আঁচড়ে দিল।

লোকটি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। সদর গেটের কাছে পৌঁছাবার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করল সবাই। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই লড়াই শেষ হয়ে গেল। শুরুর সময় যেমন হয়েছিল, তেমনি পালাবার সময়ও মানুষের মাথার ওপর ওড়াউড়ি করে আতঙ্ক বিস্তার করল কবুতরের দল। আর পেছন থেকে হাঁসেরা ধাওয়া করে তাদের পালাবার গতি দ্রুততর করল।

কেবল একজন বাদে আর সবই পালিয়ে গেল। উঠানের কাদায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা লোকটিকে বক্সর পা দিয়ে ওল্টানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু লোকটির নড়ার কোন লক্ষণ দেখা গেল না।

মারা গেছে। বিষণ্ণ গলা বক্সারের। আমি কাউকে মেরে ফেলতে চাইনি। ভুলে গিয়েছিলাম যে আমার পায়ে লোহার জুতো। কেউ বিশ্বাস করবে না যে আমি ওকে ইচ্ছে করে মারিনি।

মানুষের জন্য কোনরকম সহানুভূতি নয়, বন্ধু, বলল স্নোবল। তার ক্ষতস্থান থেকে তখনও রক্ত ঝরছে। যুদ্ধ যুদ্ধই। আর একমাত্র মৃত মানুষই আমাদের জন্য নিরাপদ।

কাউকে মারার ইচ্ছে আমার ছিল না, এমনকি মানুষকেও না, বক্সার বলল। তার দুচোখে টলমলে অশ্রু।

মলি কোথায় গেল? হঠাৎ খেয়াল হলো সবার। অনেকক্ষণ থেকেই তারা মলিকে দেখছে না।

খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মলিকে। সবাই ভাবল, হয়তো আহত হয়ে পড়ে আছে কোথাও। কিংবা মানুষেরা যাবার সময় ওকে ধরে নিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত তাকে খুঁজে পাওয়া গেল খড়ের গাদার পেছনে। ভয়ে সেখানে মুখ গুঁজে পড়ে ছিল। হৈ হট্টগোল শেষ হবার পর ধীরে ধীরে মাথা তুলল সে, ততক্ষণে অন্যেরা তাকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে গিয়ে হাজির। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মলি, ভয়ে প্রায় অজ্ঞান হবার দশা। অবশ্য অল্পক্ষণের মধ্যেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল সে।

বুনো উল্লাসে ফেটে পড়ল জন্তুরা। সবাই যুদ্ধে নিজের কৃতিত্বের কথা ফলাও করে বর্ণনা করতে লাগল। বিজয় উৎসবের আয়োজন করা হলো তৎক্ষণাং। পতাকা উত্তোলন করা হলো। বিস্টস অভ ইংল্যাণ্ড গাওয়া হলো। তারপর যুদ্ধে নিহত ভেড়ার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হলো। কবরের ওপর কাঁটা ঝোপের গাছ লাগানো হলো। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে স্নোবল যুদ্ধে জীবন দানের মাহাত্ম্য সম্পর্কে বক্তব্য রাখল।

যুদ্ধে যারা বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছে, তাদের পুরস্কৃত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। বক্সার ও স্নোবলকে প্রথম শ্রেণীর জন্তু বীর উপাধিতে ভূষিত করা হলো। তাদের সম্মানসূচক পেতলের পদক (ঘোড়ার পুরানো সাজ থেকে খুলে নেয়া) দেয়া হলো রোববার ও অন্যান্য ছুটির দিনে পরার জন্য। মরণোত্তর দ্বিতীয় শ্রেণীর জন্তু বীর উপাধিতে ভূষিত করা হলো নিহত ভেড়াকে।

যুদ্ধের নামকণ নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, এই যুদ্ধের নাম হবে গো-শালার যুদ্ধ। কারণ, মূল আক্রমণ পরিচালিত হয়েছিল গোয়াল ঘর থেকেই। মি. জোনসের বন্দুকটা পাওয়া গেল কাদার ভেতর, ফার্ম হাউসে পাওয়া গেল বন্দুকের কিছু গুলি। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বন্দুকটিকে পতাকার নিচে খাড়া করে রাখা হবে। বছরে দুদিন এই বন্দুকের সাহায্যে তোপধ্বনি করা হবে। বারোই অক্টোবর গো-শালার যুদ্ধের স্মরণে আর মধ্য গ্রীষ্মে সফল বিদ্রোহের স্মরণে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *