দ্বিতীয় স্কন্ধ
পূর্বকথা
আপনার মনের প্রাণের কথা দুর্গাপ্রসাদ কাহাকেও বলিতেন না। আপাতদৃষ্টিতে তাঁহাকে খেয়ালি মনে হইলেও হ্যামলেটের ‘মেথড ইন ম্যাডনেস-এর মতো তাঁহার খেয়ালিপনার পিছনেও একটি মেথড, একটি গুপ্ত পরিকল্পনা কাজ করিত। অন্তত তাহাই আমাদের অনুমান।
বোমার হিড়িকে তাঁহার কলিকাতা-আগমনের পিছনে তাঁহার শ্বশুরমহাশয়ের যে পত্রটির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেটি নিম্নরূপ :
‘কল্যাণীয়েষু বাবাজীবন,
এখন কলিকাতায় ডাক্তারের অত্যন্ত অপ্রাতুল্য। বাড়িও অতিশয় সস্তায় পাওয়া যাইতেছে। এই সময়ে যদি আসিয়া বসিতে পার কেহ তোমার পসার আটকাইতে পারিবে না। বোমার ভয় করিলে অবশ্য স্বতন্ত্র কথা। কিন্তু নেতাজী যে কোনও মুহূর্তে তাঁহার আজাদ-হিন্দ-বাহিনী লইয়া কলিকাতা প্রবেশ করিতে পারেন। কানাঘুষায় এরূপই শুনিতেছি…।’
—‘শ্বশুর মহাশয়ের বিষয়বুদ্ধি দেখিয়াছ?’ তিনি হাসিয়া স্ত্রীকে বলিলেন।
স্ত্রী বলিলেন—‘বোঝাই যাইতেছে কথাগুলি মায়ের।’
দুর্গাপ্রসাদ—‘যাইবে নাকি?’
স্ত্রী—‘বলো কি? এত কষ্টে সংসার পাতিয়াছি। আয় ভালো হইতেছে। সমস্ত তুলিয়া…।’
দুর্গাপ্রসাদ কী কলকাঠি নাড়িলেন কে জানে, এবার তাঁহার শাশুড়ির পত্র আসিল—‘আর কতকাল প্রবাসে থাকিবি? জামাই যখন রেলের চাকুরি ছাড়িয়াই দিল তখন গ্রামে বাস করিয়া কাজ কী? ছেলেপিলেগুলিকে যথাযথ মানুষ করিতে হইবে না? আমরাই বা কী লইয়া থাকিব?’
দুর্গাপ্রসাদ বলিলেন—‘সত্যই তো, মা কী লইয়া থাকিবেন?’
তরুদেবীর সন্তানদের মধ্যে মোট তিনটি জীবিত। প্রথমা দেবহূতি। ইহাকে অনেক আশা করিয়া তিনি ডফ স্কুলে দিয়াছিলেন। মিস নর্টনও ইহার শিক্ষায় বিশেষ যত্ন লইয়াছিলেন। কিন্তু বারো পুরিতে না-পুরিতেই কেমন যোগাযোগ হইয়া গেল। তাহার বিবাহ হইয়া গেল। হইল তো হইল, জামাইটিকেও কি তাঁহার স্বামীর মতো উড়নচড়ে হইতে হইবে! তবু স্বামী শীতল প্রকৃতির, জামাইটির যেন ষাঁড়ের গোঁ! ইহার জন্মরাশি নিশ্চিত বৃষ হইবে। হউক। শাশুড়ি-জামাইয়ে বড় ভাব। তাহার উপর তরু ভরসা করেন। তাঁহার দ্বিতীয় জীবিত সন্তান, পুত্র—ভানু। কিন্তু সে সামান্য অস্বাভাবিক, আপন খেয়ালে থাকে, স্কুলে-কালেজে কখনও গিয়া কখনও না-গিয়া সে গড়াইয়া গড়াইয়া কোনওমতে আই-এ ফেল করিল। তাহাকে দিয়া তরুলতা-অনাদিপ্রকাশের কোনও আশাই পূর্ণ হয় নাই। তবে জামাইয়ের চিকিৎসায় ইতিমধ্যেই ভানুর মতিগতির কিছু উন্নতি হইয়াছে। তিনি ভাবিতেছেন পুত্রের এইবার বিবাহ দেওয়া ভালো। যুদ্ধের বাজারে কিছু-একটা কর্মসংস্থান কি আর হইবে না? এ বিষয়ে জামাতার পরামর্শ প্রয়োজন।
দেবহূতি বলিলেন—‘রেলের চাকুরি তো তুমি পূর্বেই ছাড়িয়াছ। এখন হঠাৎ মায়ের সে-কথা মনে হইল যে!’
দুর্গাপ্রসাদ বলিলেন— ‘জ্যেষ্ঠা কন্যা তো মায়ের একপ্রকার সখীই। উনি কন্যার সঙ্গ ও সান্নিধ্য কামনা করিতেছেন। ছেলেগুলির শিক্ষার কথাটিও তো ফেলিয়া দিবার নয়!’
দেবহূতি সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে চাহিয়া পিতা ও মাতার পত্রদ্বয় আবার পড়িলেন। তাহার পর বলিলেন—‘তুমি কি সত্যই আশা করো নেতাজী আসিবেন? আজাদ-হিন্দ-বাহিনী লইয়া?’
দুর্গাপ্রসাদ জবাব দিলেন না। তিনি স্থির দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকাইয়া আছেন। কিন্তু তাঁহার দৃষ্টি স্ত্রীকে ভেদ করিয়া বহু দূর চলিয়া গিয়াছে। কত সম্পর্ক ছিন্ন হইয়াও ছিন্ন হয় না! কত আশা পর্বতপ্রমাণ হতাশা ভেদ করিয়াও উঠিয়া আসে!
তরুলতার সহিত জামাইয়ের কিঞ্চিৎ মতভেদ হইল। ভানুর বিবাহের ব্যাপারে জামাই অত্যন্ত কঠোরভাবে ‘না’ বলিলেন। উপরন্তু যুদ্ধের বাজারে কর্মসংস্থানের কথা শুনিয়া তিনি চটিয়া লাল হইলেন।
—‘আপনি কী করিয়া মিলিটারিতে অর্ডার-সাপ্লাইয়ের কথা ভাবিলেন? কী করিয়া কালোবাজারের কথা ভাবিলেন?’
তরুলতা কিছুতেই তাঁহাকে বুঝাইতে পারিলেন না তিনি এসকল ভাবেন নাই। অনির্দিষ্টভাবে কিছু সুযোগ-সুবিধার কথা ভাবিয়াছিলেন মাত্র। সুতরাং হরিপালে দেশের মেয়ের সহিত যখন ভানুর বিবাহ হইয়া গেল ডাক্তার ইহাতে যোগ দিলেন না। ভানু স্ত্রীসমেত দেশেই রহিল। তাহার খুড়ামহাশয় তাহাকে বিষয়সম্পত্তির তদবির তদারকি শিখাইতে লাগিলেন। স্ত্রী-সহবাসে ভানুর কিছু উন্নতি নিশ্চয়ই হইয়াছিল, কেননা সে খাওয়ার সময়ে খাইত, শোয়ার সময়ে শুইত। খালি স্ত্রীকে সর্বসমক্ষে ছুঁইতে গেলে স্ত্রী যখন অবগুণ্ঠন দিয়া, মুখ ভেংচাইয়া দ্রুত সরিয়া যাইত, সে কোনও অলক্ষ্য ব্যক্তির প্রতি অকথ্য গালি নিক্ষেপ করিত।
ইতিমধ্যে দেবহূতির ট্রিপলেটের ছোটটি তরুলতার কাছেই প্রতিপালিত হইতেছিল। তরুর কনিষ্ঠ কানু শিশুটির মধ্যে খেলার সাথী পাইয়া ভারি আনন্দে ছিল। তরুলতা বাৎসল্যরসে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন।
দুর্গাপ্রসাদের কী লাভ হইল? কেহ আসিল না। মৈরাং-এর যুদ্ধের ক্ষণসাফল্যের পর আজাদ-হিন্দ-বাহিনী যুদ্ধবন্দি হইল। সুভাষচন্দ্রের প্লেন অ্যাকসিডেন্টে মৃত্যুর কথা ঘোষিত হইল। কোনও বাঙালি ইহা বিশ্বাস করে নাই। দুর্গাপ্রসাদও করেন নাই। কিন্তু সুভাষ যে কোনও দুস্তর অসুবিধায় পড়িয়াছেন এ বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ নাই! দেখুন পাঠক, কোনও নেতার নব্বুই বৎসর বয়স হইয়া যায়, তাহার অর্ধেক সময়ে তিনি নিরুদ্দিষ্ট, তবু আপামর জাতি তাঁহার আবির্ভাব আশা করিতে থাকে, গল্প রচিত হয়, তাঁহাকে এখানে দেখা গিয়াছে ওখানে দেখা গিয়াছে—এরূপ ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর নাই। এই অপূর্ব কিংবদন্তির শুরু করিয়া গিয়াছিলেন দুর্গাপ্রসাদরা।
লোকে বলিবেন বাঙালি একটি বাস্তববিমুখ, স্বপ্নবিলাসী, ভাবপ্রবণ, দুর্বল জাতি। নিজেদের সমস্ত অবদমিত উচ্চাকাঙক্ষার দায় সুভাষচন্দ্ৰে অৰ্পণ করিয়া তাহারা নিশ্চিন্ত হইল। এ অভিযোগ সম্পূর্ণ উড়াইয়া দেওয়া যায় না। কিন্তু লক্ষ করিবার বিষয়, অপরাপর জাতি যেখানে ধর্মীয় নেতা বা প্রফেট/নবীর সন্ধান করিয়াছে বাঙালি তখন খুঁজিয়াছে একজন সেকুলার নেতা, যিনি তাহাদের সু-নীতি, বীরত্ব ও ধর্ম-অনপেক্ষ সৌভ্রাতৃত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের অভিমুখীন করিতে পারিবেন।
যাহা হউক, দুর্গাপ্রসাদের যশোলাভ বিলক্ষণ হইল। বিত্তলাভ তেমন হইল না। দুর্গাপ্রসাদ সংসারের জোয়াল কাঁধে নিরুপায় বলদের মতো হইলেন। পূর্বে, ফসল ফলাইতেছেন, গ্রামাঞ্চলের বালকদিগকে শিক্ষালাভে সাহায্য করিতেছেন, পল্লীবঙ্গে বহুসমাদৃত ডাক্তার হইয়া জীবসেবা করিতেছেন ইহা প্রতিমুহূর্তে অনুভব করিতেন। কিন্তু শহরে মাটি নাই, আকাশ নাই, দিগন্ত নাই। মানুষ? মানুষগুলিও যেন কেমন আধা-খ্যাঁচড়া। সকলই তাহাদের ছলনা, কপটতাই যেন জীবনের মূল নীতি। বলা বাহুল্য, দুর্গাপ্রসাদ গ্রামীণ সমাজের সংকীর্ণ অন্তর্বৃত্তে বাস করেন নাই। তিনি ছিলেন ইহার আওতার বাহিরে, সম্মানিত অতিথির মতো। প্রত্যহ সকালে যখন নিজের ছেলেমেয়েগুলিকে ব্যায়াম করাইতেন, সন্ধ্যায় তারা চিনাইতেন, উদার কণ্ঠে হা-হা করিয়া হাসিতে পারিতেন। এখন হাসিবেন কী? নিজ পিতার সঙ্গে প্রতিযোগিতাতেই তিনি নাস্তানাবুদ হইলেন। দুই ডাক্তারের চেম্বার পাশাপাশি দুইটি ঘরে। পিতার একটি শাঁসালো মক্কেলকুল রহিয়াছে, পিতা হোমিওপ্যাথিতে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেন না। যখন-তখন সেই প্রসঙ্গ উঠিয়া পড়ে ধুন্ধুমার লাগিয়া যায়। আবার সেই পিতাই নিজ মক্কেলকে কনভিন্স করিয়া তাঁহার কাছে পাঠান।
—‘শিশুর জ্বর আসিয়াছে? চার-পাঁচ উঠিয়া যায়? হোমিওপ্যাথি করুন।’
—‘আজ্ঞা, ইহা অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নহে?’
—‘আরে দুর মশাই, যাইবেন তো যান, নহিলে ভিন্ন ডাক্তারের কাছে যান।’
দুর্গাপ্রসাদ যদি বলেন—‘আপনার তো বিশ্বাস নাই। আমার কাছে রোগী পাঠাইলেন যে বড়?’
শিবপ্রসাদ বলিবেন—‘আরে হোমিওতে বিশ্বাস না-ই রহিল, নিজ পুত্রের মনুষ্যত্বে তো বিশ্বাস আছে!’
ইহার পর ইনি দুষ্ট হাসি হাসিবেন, বলিবেন—‘হইবে তো হাম কিংবা পানবসন্ত, তুমিই বল না কোনটি! এগুলির কোনও ঔষধ নাই, সেবা ও পথ্যই আসল। তোমার হোমিওপাখি আর কত ক্ষেতি করিবে!’
দুর্গাপ্রসাদ রাগিয়া কাশিয়া অস্থির হইবেন, লম্ফ-ঝম্ফ করিবেন। মনোমোহিনী মাঝখানে পড়িয়া বিবাদ মিটাইবার চেষ্টা করিবেন।
—‘ছেলেকে খ্যাপানো ছাড়া কি তোমার কোনও কাজ নাই? দুগ্গি আমার বাত সারাইয়া দে তো! আমি তোর ঔষধ খাইবো…’
—‘কাহাকেও ঔষধ দিয়া আমার কাজ নাই’ —দুগ্গি সরোষে প্রস্থান করিবেন।
কলিকাতায় দুর্গাপ্রসাদের প্রথম বিখ্যাত চিকিৎসা গোয়াবাগানের বসু পরিবারে। হাতিবাগানে বোমা পড়ার পর এই বাড়ির একটি ছেলের ভয়ানক ফিটের ব্যামো হয়। দিনের মধ্যে যখন-তখন যেখানে-সেখানে সে গোঁ গোঁ করিয়া অজ্ঞান হইয়া যাইত। পড়িয়া পড়িয়া তাহার সর্বাঙ্গে কালশিটা। এই ছেলেটিকে দুর্গাপ্রসাদ সারান ইগনেশিয়া মিলিয়ন দিয়া। তিন মাসেও যখন ছেলেটির ফিট পুনর্বার হইল না, হঠাৎ ইঁহাদের খেয়াল হয়, তাই তো! ডাক্তারবাবু রোগী দেখিয়া-শুনিয়া নিজে একটি পুরিয়া খাওয়াইয়া দিয়াছিলেন। তিন দিন পর সকালে আরও একটি পুরিয়া খাওয়ানো হয় বটে। তখন তাঁহারা ডাক্তারবাবুর কাছে ছুটেন। আসলে, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় দীর্ঘদিনের অস্বস্তিকর রোগবালাইও যে কখন দূর হইয়া যায়, রোগী নিজেই বুঝিতে পারে না। যখন খেয়াল হয়, ভাবে এমনিই সারিয়া গিয়াছে। সুতরাং, হোমিওপ্যাথ নিজেই জানেন না, তিনি কতজনকে কিওর করিয়াছেন। রোগী ফিরিয়া আসিল না দেখিয়া প্রথম কথা যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয় থাকিলে মনে হয় সারিয়াই গিয়াছে। নয় তো মনে হয় বিলম্ব দেখিয়া অধৈর্য হইয়া ইহারা অ্যালোপ্যাথের শরণ লইয়াছে। দেখিবেন পাঠক। আপনি যেন ইগনেশিয়া মিলিয়ন দিয়া ফিটের ব্যামো সারাইতে যাইবেন না। ইগনেশিয়া মৃগির ঔষধ ইহা মনে করিবার কোনও কারণ নাই। হোমিওপ্যাথির রীতি হইল লক্ষণ দেখিয়া চিকিৎসা করা, আগে রোগনির্ণয় পরে চিকিৎসা নয়। এই লক্ষণ বিচার একটি অতি দুরূহ ব্যাপার। রোগীর শরীর-মনের স্বাভাবিক লক্ষণ কী, কী তাহার অতীত-ইতিহাস…ইত্যাদি নানা কারণের উপর লক্ষণনির্ণয়ের কৌশল নির্ভর করে। অতি বিচক্ষণ না হইলে ইহা করা অত সহজ নহে।
ইহারা রোগ সারিয়াছে স্বীকার করিতে ফিরিয়া আসিল দেখিয়া ডাক্তারবাবু বিলক্ষণ আশ্চর্য হইলেন। আরও এক টাকা ফি ড্রয়ারস্থ করিয়া আরও কয়েকটি গুলি মোড়কে মুড়িয়া দিলেন। বাস, আর লাগিবে না। একটি কিশোর সারা জীবনের জন্য অকর্মণ্য, জড়পিণ্ড হইয়া যাইতেছিল, সে নিজে এবং তাহার প্রিয়জনেরা এরূপ দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত হইতেছিল যাহা মৃত্যু হইতেও ভয়ংকর। মোট দুই টাকায় বিপদ হইতে উদ্ধার পাইল। ইহারা ডাক্তারবাবুকে একটি সুন্দর ওয়লক্লক উপহার দেয়। পরে অবশ্য ইহাদের মনে বড় আত্মপ্রসাদ জন্মে। মোট তিনটি পুরিয়া—ছয়টি করিয়া আঠারোটি গুলি—সব মিলিয়া একটি ফুটা পয়সাও ঔষধের দাম হইবে কী? এদিকে দুই টাকায় দুই সের চাল তো হয়! মাছ কিনিলে কোন না দু আড়াই সের হইয়া যাইবে! তাঁহাদের বিবেচনায় ডাক্তারবাবুর একটি সুদৃশ্য, মূল্যবান জর্মন দেওয়ালঘড়ি হইল। ডাক্তারের একটি দেওয়ালঘড়ি না হইলে চলে!
এক প্রৌঢ় ব্যক্তির সহসা হাঁটুতে জল হইতে শুরু করিল। মহা বেদনা। শয্যাশায়ী হইয়া পড়িলেন, যন্ত্রণায় ডাক ছাড়িয়া কঁদিতেছেন। দুই শত শক্তির গানপাউডার দিয়া ইঁহার হাঁটু সারানো দুর্গাপ্রসাদের দ্বিতীয় কীর্তি। দেখিয়া-শুনিয়া একটি মাত্র প্রশ্নই তিনি করিয়াছিলেন—‘ফুটবল খেলিতেন, না! কী? সেন্টার ফরোয়ার্ড?’
রোগী যন্ত্রণার মধ্যেও হাসিয়া ফেলিলেন—‘ডাক্তারবাবু কি জ্যোতিষচর্চা করেন নাকি?’
যৌবনের প্রাণপ্রাচুর্যের দিনগুলি স্মরণ করাইলে ক্ষণেকের জন্যও মানুষ যন্ত্রণা ভুলিয়া যায়।
কত বলিব? পাকুমার সায়াটিকার ব্যথা সারার কথা পূর্বেই বলিয়াছি। অধিক বলিলে আপনকার ধৈর্যচ্যুতি ঘটিবে। ইহা হোমিওপ্যাথির বিজ্ঞাপনী ক্রোড়পত্র বিলিয়াও মনে করিতে পারেন। কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর সেই পঙ্ক্তিটি মনে আছে? জবাব-দেওয়া একটি রোগী হোমিওপ্যাথিতে রেসপন্ড করিল। তখন লোকসমূহের বিশেষত অ্যালোপ্যাথ ও কবিরাজের মনের কথা কবি ব্যক্ত করিয়াছেন এইভাবে—‘দুজনাতেই ভাবছে ওরা বাক্য-কায়-মনে/ হোমিওপ্যাথির বাঁচা রুগী মরবে কতক্ষণে?’
সংবৃত হই। এটুকু বলিলেই চলিবে যে তুচ্ছ কতকগুলি পাউডার ও গুলির মূল্য এবং একটি-দুইটি ডোজে চুপিচুপি-সারিয়া-যাওয়া অসুখের গুরুত্ব—উভয়ই বড় হ্রাস পাইতে লাগিল রোগীদের চক্ষে। ডাক্তারবাবুর আর একটি মূঢ়তা তাঁহার গ্রাম্য অভ্যাস—‘কী রে চণ্ডে, আজ তোর ছেলে আছে কেমন? খবর দিলি না তো!’
—‘আজ্ঞে ডাক্তারবাবু, বড় ভুল হইছে। সাঁঝের বেলা ঠিক…’
—‘সাঁঝের বেলা কী রে? কাল বিকেলে তোর ওষুধ ফুরিয়েছে। এ যে-সে রোগ নয় রে, টাইফয়েড! সকালের দিকটা জ্বর কম থাকে বলে বুঝছিস না, ওষুধ খুব নিয়মমতো দেওয়া চাই। এখুনি আয়।’
এই অভ্যাস তিনি এখানেও বজায় রাখিয়াছেন।
পিতা অভিজ্ঞ মানুষ। বলেন—‘করিতেছিস কী? উহাদের আসিতে দে।’
পুত্র বলে—‘নাক্স দিয়া দোষ কাটাইয়াছি। আজি তো আসল ঔষধ পড়িবে। নহিলে উহার কপালে বিলক্ষণ দুঃখ আছে।’
পিতা বলেন—‘দুঃখ তোমার কপালেও আছে বৎস, দিব্যচক্ষে দেখিতে পাইতেছি।’
যে ডাক্তার স্বগরজে রোগীর খোঁজ লয়, স্বগরজে ফলো-আপ করে তাহাকে কে পৌঁছে? তাই-ই বোধহয় আজিকালি ডাক্তারকুল ঠেকিয়া শিখিয়াছেন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিতেই এত বিলম্ব করেন যে জানেন রোগী তাহার মধ্যেই হয় মরিবে নয় সারিবে। যতক্ষণ না দ্বিতীয় দফার পুরা দক্ষিণা লইয়া আসিতেছে ততক্ষণ রোগী বাঁচিল কি টসকাইল তাঁহারা থোড়াই কেয়ার করেন। তাঁহাদেরই বা কী বলি? যে কোনও শ্রাদ্ধবাড়িতে যান চিকিৎসার ব্যয় ও ঘটার কথা উঠিবেই উঠিবে। ‘চেষ্টার ত্রুটি করি নাই ভাই, বড় ডাক্তার ডবল ভিজিট দিয়া আনিয়াছি। অস্ত্রোপচারে তো জলের মতো খরচ হইল। ধরিয়া রাখিতে পারিলাম না!’ মৃত্যুশোক হইতে ব্যয়ের গৌরব বড় হইয়া উঠে। কাহার ছেলের জন্য শয়ে শয়ে টাকা বাহির হইয়া যাইতেছে, কাহার পরিবারের জন্য হেন বড় ডাক্তার নাই যিনি না আসিয়াছেন। একবার ডাঃ দুর্গাপ্রসাদ সিংহকে দেখান না! বলিতেছ? আচ্ছা, সবই যখন ফেইল করিল একবার ডাকি। শেষ সময়ে তো লোকে রোগীর মুখে চরণামৃতও দেয়। তা পরিবার কবে উঠিলেন, কবে বসিলেন, কবে দাঁড়াইলেন, কবে আবার উঁহার আপিসের ভাতের জন্য হাতা-বেড়ি ধরিলেন কেহ খেয়ালই করিল না। যখন করিল, তখন বলিল—‘এমনিই সারিয়া গিয়াছে। বরাবর খাঁটি দুধটা-ঘিটা খাওয়াইয়াছি! প্রকৃতির কর্ম প্রকৃতিই করিয়াছেন।’
শিবপ্রসাদ বলিলেন—‘ওরে, দুই এক ডোজে অসুখ সারাইলে, তোর আয় কী হইবে? হয় ফিজ বাড়াইয়া দে, নয় কয়েক ডোজ ভুয়া দে।’
ছেলে বলিল—‘ঈশ্বর স্বয়ং হানিম্যানের মধ্যে আপনার চিকিৎসা-তত্ত্ব প্রকাশ করিয়াছেন বাবা। ঈশ্বরের দান আলো-বাতাসের কি ভুয়া হয়? না মূল্য হয়?’
শিবপ্রসাদ বলেন—‘ভালো। তাহা হইলে ঈশ্বরের আলো মাখিয়া ঈশ্বরের বাতাস খাইয়া থাকো।’
তবে দুর্গাপ্রসাদের সর্বোত্তম কীর্তি একটি শিশুকে মেনিনজাইটিস-টাইফয়েডের কালগ্রাস হইতে ফিয়াইয়া আনা। শিশুটি হাঁটিতে, কথা বলিতে ভুলিয়া যায়। থ্যাবড়াইয়া বসিয়া থাকে। চোখে ভেড়ার দৃষ্টি। কথা কহিতে গেলে অব্যক্ত ধ্বনি বাহির হয়। তাহার সঙ্গীসাথীরা তাহার রকমসকম দেখিয়া তাহাকে বর্জন করিল। কুশ্রী, দুর্বল, পঙ্গুকে কেহ চাহে না। প্রজাপতিসদৃশ যে কালেজ-তরুণীগুলি তাহার মিষ্ট কথা শুনিবার জন্য ছুটিয়া ছুটিয়া আসিত তাহারা করুণা করিয়া বলিল—‘ইস, মেয়েটা এমন হইয়াছে?’ ব্যাস আর কেহ তাহার খোঁজ করিল না। ঝুমকো ঝুমকো চুল দুলাইয়া সে তো আর ‘ও সব যাক গে’ বলিয়া কাহারও জন্য কৌতুক উৎপাদন করিবে না! পাঠক, আপনি গাবলুগুবলু শিশু অথবা তন্বী শ্যামা শিখরিদশনা পক্কবিম্বাধরোষ্ঠীদের কথা পড়িতে ভালোবাসেন, আপিনও নিশ্চয় এই হতশ্রী শিশুটির খোঁজ লইবেন না।
না লউন। উহার মাতা সকল কাজ ফেলিয়া ব্যাঙের মতো দেখিতে ন্যাড়া মাথা শিশুটিকে লইয়া বসিয়া থাকেন। সাশ্রু নেত্রে বলেন—‘ও যে আমার কত সকাল-সকাল কথা কহিতে শিখিয়াছিল গো! কী মিষ্ট কথাগুলি, কত লাবণ্য ছিল! সেই মেয়ে আমার এমন হইয়া গেল?’
তাঁহার স্বামী নীচের ঠোঁট কামড়াইয়া ধরিয়া ঔষধের ক্যাবিনেটের সম্মুখে স্থির। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্লোবিউল কি চুর্ণ-ভরা কোহল-গন্ধ শিশিগুলিকে নীরবে জিজ্ঞাসা করেন—‘সূর্য আবার উঠিবে? পাখি আবার গাহিবে? নদী কি আর বহিবে?’
এ পৃথিবীতে মাতার ন্যায় আর কে আছে?
এ পৃথিবীতে পিতার ন্যায়ই বা আর কে আছে?
প্রথম অধ্যায় : ‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ’-১
একটা খোলা রোয়াকে বাবার বুকের ওপর শুয়ে আছি। কার্নিশে গোলাপায়রা। বক বকুম বক বকুম। বেশ বড় পালোয়ানি গোঁফ বাবার। গোঁফটা ধরে টানছি।
—বল তো বুবু, এটা কি স্বপ্ন? না স্মৃতি? বড়রা বলেন স্মৃতি। বছর দুই বয়সে আমার ডিপথিরিয়ার পর ভাগলপুরে হাওয়া বদলাতে যাওয়া হয়েছিল। আমি-তুই-পুটপুট-অংদাদা-মা-বাবা। এটা নাকি সেই বাড়ির দাওয়া। লাজপৎ পার্কের কাছে, একটা ব্লাইন্ড লেনের শেষ বাড়িটা। কিন্তু এটা আমি স্বপ্নেও দেখি। প্রায়ই। আমার মনে হয়, স্মৃতির লেন্স্টা আমার সেই সবে তৈরি-হওয়া শেষ হয়েছে। একেবারে আনকোরা নতুন, ঝকঝকে, তকতকে। সেই প্রথম ছবিটা তাই বড্ড ভালো উঠেছিল।
সন্ধেবেলা। মামার বাড়ির ভেতর-উঠোনের রোয়াকে বসে পা দোলাতে দোলাতে আমরা তিন ভাই-বোনে কানুমামুফুলের সঙ্গে বসে পায়েস খাচ্ছি। কার পা কতটা ওঠে পাল্লা দিচ্ছি। বুনবুন বেশি চালাকি করতে গিয়ে পা দুটোকে আকাশমুখখা করে দিতেই চিৎ হয়ে পড়ে গেল। বাটির পায়েস ওর ভুঁড়ির ওপর পড়ে গেছে। আমরা খুব হাসছি। ছোট্ট ছোট্ট রুপোর বাটি, দিদিভাই সিন্দুক থেকে বার করেছেন আমাদের জন্মদিনের জন্যে, মনে আছে? এটাকে কিন্তু স্মৃতি বলে বেশ স্পষ্ট চিনতে পারি। এটা ছিল আমাদের তিন বছরের জন্মদিন।
দুলারিকে মনে আছে? হীরেমোতি সাজত! হীরেমোতি সাজার লোহার হাত একটা হাতে করে বাগিয়ে, দৌড়ে সে ভয়-খাওয়া ছাগলির মতো কাটা দরজাটা ঠেলে উঠোনে ঢুকল।
—‘তৈয়ার হো যাও, ভাইয়োঁ সব তৈয়ার হো যাও,’ তার চোখ ঘুরছে।
—‘কী হল রে দুলারি। কে তৈরি হবে?’ দিদিভাই শাঁখ হাতে ভাঁড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন।
দুলারি হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠোনে আছাড় খেয়ে পড়ল। ওর মরদকে নাকি নিকাশিপাড়ার লোকেরা কেটে ফেলেছে।
দিনটা ছিল হরতাল। কেউই বাড়ির বাইরে বেরোয়নি। আমরা সকালবেলা বাড়িতে এক থালায় তিন ভাইবোনে খেয়েছি। মায়ের কাছে। রাত্তিরে মামার বাড়ি নুচি-পায়েস খাব কিন্তু! সন্ধেবেলা একটু চাখছি মাত্র। দুলারির ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে না বুঝতেই পাড়ার ভদ্রলোকরা হই-হই করতে করতে ঢুকে এলেন, তাঁদের সঙ্গে বাবা, পালক আর ই-দাদা।
বাবা দিদিভাইকে বললেন—‘বাড়িতে তালা দিয়ে চার নম্বরে চলুন সবাই।’
—‘কী ব্যাপার?’ দাদাভাই খাবার ঘরে চুপিচুপি বসে পায়েস খাচ্ছিলেন, তিনি অবাক হয়ে বেরিয়ে এসে বললেন।
—‘এখন অত বলা যাবে না। যেমন আছেন বেরিয়ে আসুন, এটা ডেঞ্জার জোন।’
সবাই মিলে সব ঘরে ঘরে জানলা বন্ধ করে তালা দেওয়া হল। ডেকচিসুষ্ঠু পায়েস ‘রেমো’র মাথায়। কাঁধে ঝোলাঝুলিতে জামাকাপড় ভরে দিদিভাই, দাদাভাই সব্বাই। আমরা সব কোলে-কাঁধে। দুলারি আমাদের মাঝখানে। আমরা সব চার নম্বরে চলে যাচ্ছি। কী মজা! দিদিভাই, বুনবুন, কানুমামুফুল সব, স-ব আমাদের বাড়ি থাকতে যাচ্ছে। আজ রাত্তিরে লুকোচুরি খেলব বেশ! মরদ কী জিনিস আমরা জানি না। দুলারির মরদ কাটা পড়েছে। গরু ছাগল কিছু হবে। ব্যাপারটা দুলারির পক্ষে নিশ্চয়ই দুঃখের অত কাঁদছে যখন, কিন্তু আমরা তাতে খুব বিচলিত নই। বুনবুন চুপিচুপি বলল—‘মরদ কী রকম ছাগল বল তো? কাটবেই তো, নইলে মাংস হবে কী করে?’
ভীষণ রেগে গেলে বাবার সেই বিচিত্র হুংকারটা মনে আছে? বুনবুনের দিকে তাকিয়ে বাবা সেই ভয়ংকর হুংকারটা দিলেন। ই-দাদার কোলে বুনবুন হিসি করে ফেলেছিল।
তারপর থেকে সমানে আমাদের চার নম্বরের ছাতে উনুন জ্বেলে গরম জল হতে থাকল। ইঁট-পাথর-নুড়ি-আধলা জড়ো হচ্ছে তো হচ্ছেই। শুধু আমাদের বাড়ি কেন, আশেপাশে সব বাড়ি। পেছনে সুধীনবাবুদের বাড়ির ছাতে যজ্ঞির মতন উনুন। মুগের ডালের খিচুড়ির সুবাসে আমাদের জিভে জল এসে যাচ্ছে।
পাড়ার ডাকাবুকো ছেলে প্রদীপদা এসে ঠাকুর্দাকে বলল—‘শিবদাদু, আপনার বন্দুকটা দিন তো!’
—‘কে বললে আমার কাছে বন্দুক আছে?’
—‘যেভাবেই হোক আমরা জানি। এ-ও জানি ওটা লাইসেন্সড্ নয়।’
—‘জানো তো চুপ করে থাকো। ওটা মাউজারের বোল্ট অ্যাকশন ম্যাগাজিন রাইফল। ব্যবহার করা অত সহজ নয়।’
—‘আপনি তো জানেন চালাতে, শিখিয়ে দিন!’
ঠাকুর্দা রাজি হচ্ছেন না।
প্রদীপদা বলল—‘ওরা এসে আমাদের কচুকাটা করে যাবে এটাই কি আপনি চান?’
—‘রাইফেল দিয়ে তোমরা কিছু করতে পারবে না প্রদীপ। মাঝখান থেকে আমরা ফ্যামিলিসুদ্ধু বিপদে পড়ে যাব।’
—‘দেবেন না তা হলে?’ —প্রদীপদা কী রকম চোখ লাল করে বলল। ঠাকুর্দার সঙ্গে অমন করে কেউ কথা বলে না।
সেই সময়ে দূর থেকে একটা কল্লোলের মতো ধ্বনি ধেয়ে আসতে লাগল। টেকন, আমাদের চাকর বাঁশপাতার মতো কাঁপতে কাঁপতে বাবার পায়ের কাছে বসে পড়ে বলতে লাগল—‘আসি গিল-অ, বাবু, আসি গিল-অ।’
বাবা চিন্তিত হলে তলার ঠোঁটটা কী রকম কামড়ে ধরতেন! সেইভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। এক ধমক দিয়ে বললেন—‘কী আসি গিল-অ, আসি গিল-অ করছিস? কাটারিখানা নিয়ে তৈরি হয়ে থাক। ওগো শুনছ, কোথায় গেলে? এই পুনপুনটাকে আমার পায়ের কাছ থেকে সরাও তো!’
আমি কৌতূহল সামলাতে পারছিলুম না। কিন্তু বাবাকে বিলক্ষণ ভয় পেতুম। তাই সঙ্গে সঙ্গে সটকে পড়ে তোদের সঙ্গে গিয়ে জুটলুম।
এই সময়ে পাকুমাদের বাড়ি থেকে ওঁদের বামুন ও চাকর দুটো মাদুর কাঁধে নিয়ে এসে উপস্থিত। টেকনকে ওরা বলল—‘মাদুর-অ আছে?’ ওদের গলার স্বর এত কাঁপছে যে কী বলছে, বোঝা যাচ্ছে না। যখন সবাই বন্দুক, কাটারি খুঁজছে, তখন এরা মাদুর খুঁজছে কেন বোঝা যাচ্ছিল না। ওরা টেকনের সিঁড়ির তলার ঘরে গিয়ে মাদুর জড়িয়ে শুয়ে পড়ে বলতে লাগল—‘মরিকিরি বঁচি যিব।’ অর্থাৎ কি না ‘মরে গেলে বেঁচে যাব।’ এতে দাদারা খুব হাসে, ওরা বলাবলি করছিল টেকনরা মাদুরের মধ্যে নিজেদের রোল করে নিয়ে ভেবেছে সবাই ওদের গোটানো মাদুর মনে করবে। কিন্তু এক ঘরে এত মাদুর কেন এ প্রশ্ন যদি আততায়ীদের মনে ওঠে, তবে!
একটা সুখবর অবশ্য এলো। যে হইচইয়ের শব্দ ভেসে আসছিল সেটা আসলে ঘটকদের বাড়ি বর আসার হইচই। যুদ্ধের সময়ে অনেক জায়গাতেই সকালবেলার বিয়েবাড়ি চালু হয়েছিল। ঘটকদের বাড়ি বিয়ের দিন অনেক আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে। বর আসবে খন্যান না কোথা থেকে। কোনও খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। এখন লাঠি ছোরাধারী বরযাত্রীরা হইচই করে এসে পড়েছে। ওরা না কি হাওড়ার ব্রিজময় লাশ দেখে এসেছে। বীভৎস। বরটা দমকে দমকে বমি করছিল। তার আর বিয়েতে প্রবৃত্তি ছিল না। সে নাকি এবারের মতো তাকে ছেড়ে দিতে বলছিল। বাবাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। ওষুধপত্র খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে তবে সে সুস্থ হয় এবং বিয়েতে বসে।
আমাদের ক’বাড়ি পরেই থাকতেন সেই হাবুলকাকু! তিনি তো রোজ সন্ধে হলেই ঠক-ঠক করে কাঁপতে-কাঁপতে বাবার চেম্বারে এসে বসতেন। অদ্ভুত অদ্ভুত খবর নিয়ে আসতেন উনি। একদিন বললেন, এদিকে টাউন স্কুল ওদিকে শ্যামবাজার এ.ভি. দুটোই মুসলমানদের হাতে চলে গেছে। রাজকেষ্ট স্ট্রিটের মসজিদে দশ হাজার মুসলিম গুণ্ডা জমায়েত হয়েছে। বাবার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে উনি বললেন—‘দুগগি, নাড়িটা একটু দেখো তো ভাই! রেটটা যেন বড্ড কমে গেছে! হার্ট হল? না কী?’
বাবা বললেন—‘হার্ট তুমি নিয়েই জন্মেছ হাবুল, হার্ট কি হঠাৎ হয়?’
তখন উনি কাঁদো-কাঁদো স্বরে বললেন—‘আমাকে গুলি করে মারতে বলো ভাই, ছোরাছুরিতে ভয়ঙ্কর কষ্ট।’
পালক হেসে বলল—‘কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করে তবে আপনাকে মারবে বোধ হয়!’
হাবুলকাকু একেবারে কেঁদে ফেলে বললেন—‘দ্যাখো তো পুলক, এই চেয়ারের তলায় কেউ আছে কি না? দাড়ি-দাড়ি মতো কী যেন একটা ঠেকল!’
অনেকেই সে সময়ে সন্ধের পর এ ঘর থেকে ও ঘর যেতে পারত না। সকালে যত মজাই লাগুক, রাতে আমরা তিনজনেই বিছানা ভেজাতুম। বাথরুমের জন্য উঠতে হলে অং-দাদা করুণ স্বরে সু-দাদাকে ডাকত। পুটপুট বুজবুজ পরস্পরকে ধরাধরি করে দালান পার হত। মা উঠলে আমরা ঠিক টের পেতুম। কাঁটা হয়ে থাকতুম একেবারে। মা বুঝি আর ফিরলেন না। মুসলমান কী তা জানি না। রাক্ষস ধরনের কিছু হবে। মা ফিরলে নিশ্বাস ফেলে একদিক থেকে আমি আর একদিক থেকে তুই ঘন করে মাকে জড়াতুম। মাকে কেউ মারলে মায়ের অঙ্গের অঙ্গ হয়ে মরে যেতেও আমাদের কোনও আপত্তি ছিল না। সে যত বীভৎস মৃত্যুই হোক।
‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ’-২
আঠারোই অগাস্ট ভোরবেলা বুনবুনদের সেই কুলসুম বুড়ি খুঁজে খুঁজে কেমন আমাদের বাড়ি দাদাভাইয়ের খোঁজে এলো। আমরা তিনজনে নাচছিলুম—‘কুলসুম এসেছে, কুলসুম এসেছে’। ও এসেছিল ছেলে কাল থেকে বাড়ি ফেরেনি বলে। এ দিকে অনেক বাড়িতে সে নাকি হাঁসের ডিমও বিক্রি করতে আসে। কেউ কী তার খোঁজ জানে? বাবা তাকে অবিলম্বে বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। কুলসুমের ডিমবেচুয়া চব্বিশ-বছুরিয়া ছেলেটি সম্ভবত নবকৃষ্ট স্ট্রিট ম্যাসাকারের প্রথম দফার মুসলিম শিকার। সে গিয়েছিল শ’বাজারের দিকে। শ’বাজারের মুসলিমরা নবকৃষ্ট স্ট্রিট দিয়ে গ্রে স্ট্রিট ধরে গোয়াবাগানের বস্তির দিকে যেতে চেষ্টা করছিল। লাঠি সোঁটা সোর্ড ছিল তাদের হাতিয়ার, ডিমবেচুয়া রসুল হয়তো তাদের সঙ্গ নিয়েছিল। এরা কেউ বাঁচেনি। নবকৃষ্ট স্ট্রিটের লড়াইয়ে আমাদের চেনাদের মধ্যে পাড়ার শান্তুদা প্রাণ হারায়। মিনুদার হাত কাটা যায়। বাকি জীবন সে নুলো মিনু নামে পরিচিত থাকে। আর একটা ঘটনা তোর মনে আছে কী না জানি না। মেটিয়াবুরুজ থেকে ইয়াসিন দর্জি পাকুমাদের বাড়ির এক বোঝা অর্ডার পিঠে নিয়ে আর সময় পেল না দাঙ্গার সময়ে আমাদের পাড়ায় এসে উপস্থিত। প্রাণভয়ে সে ঠকঠক করে কাঁপছিল। আমাদের ভিতু ভালোমানুষ দাদাভাই আর ডাকাবুকো প্রদীপদা তাকে সঙ্গে করে শ্যামপুকুর স্ট্রিট পার করে ফড়িয়াপুকুর অবধি এগিয়ে দিয়ে আসেন। প্রথমে ঠিক হয়েছিল ইয়াসিন পাকুমাদের বাড়িতেই থাকবে, গণ্ডগোল থেমে গেলে চলে যাবে। কিন্তু বুড়ো বেচারিকে কেউই রাখতে সাহস পাচ্ছিল না। কখন কোন নির্দোষ হিন্দু ছেলের খুনের খবর আসবে, মাস হিস্টিরিয়ার ব্যাপার, কে ক্ষেপে গিয়ে কী করবে বলা যায়! ইয়াসিনও যেন কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। পাকুমাকে কাকুতি-মিনতি করছিল তাকে যেন মুসলিম এলাকায় দিয়ে আসা হয়। শেষ পর্যন্ত দাদাভাইকে সে বিশ্বাস করতে পারল। মা কান্নাকাটি করায় দাদাভাই বললেন নিকাশিপাড়ার বেশির ভাগ লোকই তাঁকে ভাল করে চেনে। কেউ তাঁর ক্ষতি করবে না। সুখের বিষয় দাদাভাইয়ের কোনও বিপদ হয়নি। ইয়াসিনেরও না। এই ইয়াসিন কিন্তু সেই ষণ্ডা চেহারা হাতকাটা ইয়াসিন দর্জি নয়। সে আর একজন। দাঙ্গার সময়ে তারও হাত কাটা গিয়েছিল। আমার শার্ট প্যান্ট, তোদের ভাল ভাল ফ্রক, দিদিদের ব্লাউস তৈরি করতে হাতকাটা ইয়াসিন! ভাবলে বেশ মজা লাগে, দাঙ্গা বাধালেন হুসেন শহীদ সোরাবর্দি। তাঁকে গাঁধী আঁচলের আড়ালে লুকিয়ে রাখলেন। হাতকাটা গেল ইয়াসিন দর্জি আর মিনুদাদের। সোরাবর্দিরা হলেন স্বাধীন পাকিস্তানের হর্তা-কর্তা, মিনুদা ভদ্রলোকের ঘরের বি-কম পাস ছেলে, হয়ে গেল নুলো গুণ্ডা।
আমাদের নিস্তরঙ্গ পুঁচকে জীবনে দাঙ্গা কী উত্তেজনাই নিয়ে এসেছিল! তুই মাঝে মাঝেই এক পাক ঘুরে যাচ্ছিলি আর বলছিলি—‘কী মজা, মুসলমানরা আসবে, যুদ্ধ লড়াই হবে, কচুকাটা কর-বে।’ মুসলমান বলতে কী বোঝায়, যুদ্ধই বা ঠিক কী বস্তু আমরা কেউই জানতুম না। কচুকাটাও নিশ্চয় বুঝতুম না তেমন করে।
বুনবুন বলছিল (বাবার ধমকে হিসি করে-ফেলা বুনবুন)—‘কচুকাটা করলেই হল, আমার তীর্ধনু আছে না?’
কানুমামু গম্ভীর সবজান্তা গলায় বলল—‘তীর-ধনুকের কাজ নয়। গরমজল হাঁড়িসুদ্ধু তুলে নিয়ে ছাতের পাঁচিল থেকে সুড়সুড় করে মাথার ওপর ঢেলে দিতে হবে। দেখছিস না জল গরম হচ্ছে!’
অমনি তোর এক পায়ে বাঁই করে ঘোরাটা থেমে গেল। তুই ফ্যাকাশে মুখে বললি— ‘গরম জল ঢাললে যে পুড়ে যাবে!’ কিছু দিন আগেই চানের ফুটন্ত গরম জল অসাবধানে লেগে যাওয়ায় তোর আঙুলে ফোসকা হয়েছিল। তুই গরম জলকে খুব ভয় পেতিস৷
পুটপুট বলল—‘তুই না লড়াইয়ের কথা বলছিলি!’
তুই এ কথার কোনও উত্তর না দিয়ে চট করে ছাদ থেকে পালিয়ে গেলি।
—‘পমপম আমি ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা জলে চান করব। কলের জল। কল দিয়ে গরম জল বেরোবে না তো?’ বলতে বলতে তুই সিঁড়ি দিয়ে দুড়দাড় করে নামছিলি। নামতে নামতে তুই পড়ে গেলি। চিল-চিৎকার শুনতে পেলুম আমরা।
—‘ঋতি, দেখো তো!’ ই-দাদা বলল।
বাবা জিজ্ঞাসু টমদিদির দিকে চেয়ে বললেন—‘বরফ এখন আর কোথায় পাবে? ঠাণ্ডা জল দাও। আর্নিকা সিক্স ভুলো না।’
বাবা নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছেন। আমি ধেড়ে ছেলে সু-দাদার কোলে চড়েছি, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলছি—‘সুযযি ওদের আসতে বারণ করো। বুবু কাঁদছে, আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি।’
পালক আমার দিকে তাকিয়ে বলল—‘আমাদের সব ছেলেমেয়েদের মিলিটারি ট্রেনিং দরকার। দেশ ভ্রমণ আর মিলিটারি ট্রেনিং মাস্ট, ও দেশের মতো।’
বাবা দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে আছেন, কিছু বলছেন না। ঠাকুরদা বলছেন— ‘কথাটা হয়তো এক দিক থেকে ঠিকই বলেছ পুলক। কিন্তু একটা সভ্য দেশে সিভিল লাইফে অস্ত্রশিক্ষার দরকার হবে কেন? এ প্রশ্নের আগে জবাব দাও। রাজা, শাসক, পুলিশ এরা তা হলে রয়েছে কী করতে? সোরাবর্দি কী বলে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ডাকলে! কার অ্যাকশন? কাদের এগেনস্টে? কাফেরদের? ময়দান মিটিং-এ কীভাবে ক্ষেপিয়েছে জানো? নে এখন ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ঠ্যালা সামলা। নিজেরা থাকিস প্রাসাদে, আধা-বিলিতি কায়দায় থাকিস। এবার গদি চাই। না হলে আর চলছে না? তাই ক্ষেপিয়ে দিলি গরিবগুলোকে। গুণ্ডাগুলোকে সুযোগ করে দিলি। সোরাবর্দি-টর্দি তো রক্তে পুরো এদেশিও নয়। আর গরিবগুলো? দর্জি, ছুতোর, জেলে, জোলা, রাজমিস্তির—সেন্ট পার্সেন্ট দিশি। কোনও এক সময়ে কনভার্টেড হয়েছিল। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান? তা নে বাবা, সোরাবর্দি জিন্নার গদির জন্যে নে পাকিস্থান। যে-পাঁকে ছিলি সেই পাঁকেই থাকবি, মোল্লার উৎপাত এমন বাড়বে যে মাথা তুলতে পারবি না। মাঝখান থেকে জ্ঞাতশত্তুর বানিয়ে যাচ্ছিস। জিন্না যেমন মসনদে ছিল থাকবে, তোরা বসবি রাস্তায়।’
ঠাকুমা বললেন—‘হুসেনেরই তো ভাই ওই শাহেদ। সেবার দ্বিজুবাবুর বাড়ি দেখলুম। কত বড় বিদ্বান, ভদ্র মানুষ। ছি ছি ছি। কুলের কুলাঙ্গার এই হুসেনটা।’
বুনবুন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী, তাকে দমানো শক্ত। সে বলল—‘বাবা, মুসলমানদের কটা করে দাঁত থাকে? দাঁতগুলো বাঘের মতন না হাতির মতন?’
বাবা ঠাকুরদার সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত। জবাব দিলেন না। তখন বুনবুন বলল—
‘চুলগুলো তার কটা-কটা
হাতগুলো তার লাঠি সোঁটা
চোখগুলো আ-গুনের ভাঁটা,
দেখতে পেলেই মাথা ফাটা।’
হাতের ছোট লাঠিটা দিয়ে সে ছাদে উল্টে-পড়ে-থাকা একটা ভাঁড়ের মাথায় ঢ্যাক করে মারলো। অমনি সেটা চৌচির হয়ে গেল। সে বলল—‘এই একটা মুসলমান মারলুম। এই কানুমামু আর একটা মুসলমান এনে দে তো!’
কানুমামা হাসতে হাসতে আর একটা ভাঁড় এনে দিল। সেটাকেও ঢ্যাক ঢ্যাক করে ফাটিয়ে বুনবুন আবও মুসলমান-ভাঁড় খুঁজতে লাগল। না পেয়ে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে সে সপ্তমুখী জবার গাছটাতে এলোপাথাড়ি লাঠি চার্জ করতে লাগল।
বাবা অমনি দু’পা এগিয়ে এসে তার কান ধরলেন। কক্কড়িয়ে মূলে দিয়েছেন একেবারে। যত না ব্যথায় তার চেয়ে বেশি অপমানে বুনবুন ভ্যাঁ। ঠাকুরদাদার অমনি লেগে গেল। তিনি তাকে ভোলাতে লাগলেন কোলে করে।
—‘অমনি কি করে দাদা? দেখছ না ফুলগাছ তো, নষ্ট হয়ে যাবে না?’
ফোঁপাতে ফোঁপাতে বুনবুন বলল—‘ফুলগাছ হলেই বা, মুসলমান তো? আমাদের মারবে তো! তলোয়ারি দিয়ে, কাটারি দিয়ে, তাতে বুঝি কিছু নট্ট হবে না? তোমরাও তো ওদের মাথায় গরম জল ঢালবে, ইঁট পাটকেল ফেলবে, তাতে বুঝি কিছু নট্ট হবে না?’
—‘শোনো দাদুভাই, কথাটা তা নয়। মুসলমান মানে রাক্ষস নয়, পিশাচ নয়, আমাদেরই মতো মানুষ। এই তোমার মতো। আমার মতো।’
—‘তবে ওরা আমাদের কাটছে কেন? হিরেমোতির মরদকে কেটেছে কেন? আমরাও ওদের কাটব ও-ও।’
বাবা হঠাৎ একটা অব্যক্ত আওয়াজ করে উবু হয়ে বসে পড়লেন। দু’হাতে নিজের কপাল চাপড়াচ্ছেন।
—‘এক কী হচ্ছে চারদিকে? এ কী পিশাচের নাচ! হে ভগবান, আমাদের পরের জেনারেশন যে মনস্টার হয়ে যাচ্ছে! ছেলেপিলেগুলো যে মানুষ হবে না!…মা।’
‘মা’ শব্দটা তিনি এমন করে উচ্চারণ করলেন যে চারদিক থরথর করে কেঁপে উঠল। যেন তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছে। শেষ নিশ্বাস দিয়ে তিনি কোনও সর্বময়ী জননীকে ডাকছেন।
দাদাভাই ঠাকুর্দার দিকে তাকালেন। দুজনের চোখে চোখ রেখে কী যেন কথা হয়ে গেল। দাদাভাই গিয়ে বাবার মাথায় হাত রাখলেন, বললেন—‘বাবা দুগ্গা, এমন ভেঙে পড়লে চলবে কেন? এ দুর্বলতা কি তোমাকে সাজে! যা করবার তা তো আমাদের করতেই হবে!’
বাবা দাদাভাইকে কখনও সোজাসুজি বাবা বলতেন না, আজ বললেন—‘আপনি ভেবে দেখুন বাবা, এক মায়ের পেটের সন্তান ছিলুম আমরা এই কপুরুষ আগেই। পাণ্ডবও তো আসলে কৌরবই। কে আল্লাহ, কে ব্রহ্ম কেউই জানে না। সত্যস্বরূপে তিনি কি আল্লাই? তিনি ব্রহ্মই? তিনি কোনওটাই নন। আমাদের মনগড়া নামে তিনি ধরবেন কেন বাবা? আপনারা পণ্ডিতরা যা-ই বলুন। তবু সেইটুকু, মাত্র সেইটুকু নামের আর আচারের বিভেদের ছুতো ধরে যদি কতগুলো সুযোগসন্ধানী ক্ষমতালোভী আমাদের যখন তখন খেপিয়ে দিতে পারে, আমরা এমনি করে একে অপরকে খুন করব! আমার সত্যিই হাত পা আসছে না বাবা! সব মিথ্যে মনে হচ্ছে। যা এতদিন এত যুগ ধরে করা হল সবই বাজে…বাজে।’
ই-দাদা বলল—‘বাবা আপনি এমন করলে আমরা কোত্থেকে সাহস পাবো?’
ঠাকুর্দা বললেন—‘তা ছাড়া দুগ্গি, যা হবার তা তো হয়েই আছে। তুমি-আমি ভেবে কী করব বলো? যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি। আর কী-ই বা আছে আমাদের হাতে! যারা মরছে তাদের তিনি মেরেই রেখেছেন। ওঠো। ঝেড়ে ফেলে দাও এসব। ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের রক্ত তিনি যদি চান তো তাই হবে। জাস্টিসের জন্য, ডিফেন্সের জন্য যা করবার তা তো আমাদের করতেই হবে।’
বাবা উঠলেন। তিনি লম্বা মানুষ নন। দাদাভাই বেশ লম্বা। ঠাকুর্দাও মন্দ লম্বা নয়। কিন্তু লম্বা-লম্বা দেখাচ্ছে। বাবা বললেন—‘যদি কারও রথের চাকা বসে যায়?’
ঠাকুর্দা বললেন—‘তাকে সময় দেবে।’
—‘যদি কেউ অস্ত্র ত্যাগ করে?’
—‘সেক্ষেত্রে তোমাকে কি আমরা প্রহার করতে বলব মনে কর?’
বাবা জবাব দিলেন না। বললেন—‘যদি কেউ কেউ এসে পড়ে আমাদের মাঝখানে?’
—‘তাকে সসম্মানে ব্যুহ পার করে দেব। দিয়েছি তো আমরা। দিইনি কী?’
—‘আর মিথ্যে?’
—‘প্রাণরক্ষার জন্যে মিথ্যে বলা অন্যায় তো নয় দুগগি, প্রাণবধের জন্যে মিথ্যে তোমাকে কখনও বলতে হবে না।’
বাবা খুব দূরের দিকে তাকিয়ে বললেন—‘মনে থাকে যেন।’
যেন বাবা সে-কথা ঠাকুরদাকেও বলছেন না, দাদাভাইকেও বলছেন না, বলছেন অনেক দূরে আকাশে-দাঁড়ানো কোনও পুরুষকে, যাঁকে তিনি একাই দেখতে পাচ্ছেন, আর কেউ দেখতেও পাচ্ছেন না, অনুভব করতেও পারছেন না।
সন্ধে অনেকক্ষণ পার হয়ে গেছে। ‘আল্লা হো আকবর’, ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ‘বন্দে মাতরম্’ জাতীয় অস্পষ্ট ধ্বনি দূরের জলোচ্ছ্বাসের মতো আমাদের কানে প্রবেশ করছে। ঘুম ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। কারা যেন এসেছে। ঘাম আর রক্তের গন্ধে বাতাস দূষিত হয়ে যাচ্ছে। কারা কীসব বলাবলি করছে।
—পরিস্থিতি কনট্রোলে। নিকাশিপাড়া হটছে।’
—আমি তিনটেকে মেরেছি। একটার এমন হাড় জিরজিরে চেহারা যে মায়া হচ্ছিল। খুব বিশ্রী লাগছে।’
‘—ভাগ্যে বাচি শ্যামবাজারের মোড়ে স্টেনগান নিয়ে দাঁড়িয়েছিল! পুলিশ তো ওদের দিকে। কেউ কোত্থাও নেই।’
—‘জোড়াবাগান খুব টাফ।’
‘—নিকাশিপাড়ার চেয়েও?’
‘—অনেক। অনেক। নিকাশিপাড়া আসলে কী জানিস তো? নিকারিপাড়া। খুচরো মাছের জেলে। খুব গরিব, ওদের আসল স্ট্রেন্থ হচ্ছে গোয়াবাগান গোরুহাটার বস্তি। কালুগুণ্ডা মানে কলিমুদ্দিন, ডেনজারাস। এ রকম আরও কত আছে। শ’ বাজারের ওরা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট দিয়ে গ্রে স্ট্রিট হয়ে ওদিকে যাওয়ারই চেষ্টা করছিল। রীতিমতো আর্মড। সব ফর্সা।’
—‘কই? কাকাবাবু কখন আসবেন?’
—‘দুগ্গা-কাকা কই?’
আমি তখন পুরো জেগে উঠেছি। যদিও কাউকে জানতে দিচ্ছি না। চোখটা আদ্ধেক খুলে দেখলুম মা ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, দালানের মুখে যাচ্ছেন। মাথায় লাল পাড় মিলের শাড়ির আধ-ঘোমটা। গলায় লাল সুতোয় বাঁধা সোনার মাদুলি। হাতে দু’ গাছি রুলি, আর ক্ষয়-ক্ষয়া সোনার চুড়ি। কপালে সিঁদুরের টিপটা ধেবড়ে গেছে। মায়ের কানে ছোট্ট ছোট্ট সোনার চাকা।
—‘কাকাবাবুকে ডাকছ কেন বাবা?’
—‘উনি ছাড়া তো আমাদের লিড করার কেউ নেই। উনিই একমাত্র এ এলাকায় যিনি নেতাজির সংস্পর্শে এসেছেন।’
—‘এতক্ষণ কী করে চলছিল তোমাদের?’
—‘নিজেরা যা পারি ঝোঁকের মাথায় করেছি। এবার অর্গ্যানাইজড ওয়ার।’
—‘অবস্থা তো এখন ভালোর দিকেই।’
—‘মনে হচ্ছে। কিন্তু বলা কিছু যায় না। যদি বিহারি মুসলিমরা রাতের অন্ধকারে এসে যোগ দেয়?…ওরা আরও ফেরোশাস।’
—‘শোনো’…মায়ের গলা একটু একটু করে কাঁপছে। মা কখনও এত পাড়ার ছেলের সামনে বেরোন না, —‘এই দ্যাখো, আমার গলা খালি, হাত দেখো, যা গয়নাগাঁটি ছিল স—ব দিয়ে দিয়েছি, ওঁর অল্প বয়সটাই বরবাদ হয়ে গেছে। যাক। কিন্তু আমরা এতদিন পর্যন্ত যা করেছি সবই গোটা দেশটার জন্যে করেছি। গোটা দেশ। তোমাদের কাকাবাবু একজন বড়…মানে বড় নয় ঠিক…খাঁটি মানুষ। ওঁকে আমি দাঙ্গা মানে শুধু মারামারিতে যেতে দেব না। ওঁর খুব জ্বর এসেছে। কিন্তু শুধু সেইজন্যে না। উনি সুস্থ থাকলেও আমি যেতে দিতুম না। আমাকে মাড়িয়ে যেতে হত। ওঁকেও। তোমাদেরও। এখন উনি জ্বরের ঘোরে ভুল বকছেন। তোমরা শুনে যেতে পার কী বলছেন।’ মা যেন পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াবার মতো করে সরে দাঁড়ালেন।
ছেলেরা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। কয়েকজনের মুখে মৃদু ব্যঙ্গের হাসি।
—‘ভুল বকা শোনবার দরকার নেই কাকিমা, আমরা চলি। ইন্দ্র, সুর্য, পুলক এরা কেউ ভিজিল্যান্সে যাবে কি?’
—‘ইন্দ্র সূর্য যেতে পারে। পুলককে ছাড়ার আমার উপায় নেই।
পালক মাকে বোঝাবার চেষ্টা করছিল। মা শুধু বলছিলেন—না।’
সু-দাদা বেরিয়ে এলো। বলল—‘চলো নরেনদা। মা আমি যাই?’
মা স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে।
সুযযি মালকোঁচা মেরে ধুতি পরেছে। মাথার ওপর আধ-কোঁকড়া চুলগুলো ফুলে আছে। হাসি-ঠাট্টা মাখা মুখটা এখন সিরিয়াস। শার্টটা ঝুলছে। নরেনদা বলল—‘শার্টটা গুঁজে নিলে পারতিস।’
—‘ও ঠিক আছে’—সুযযি বলল।
ভেতরে বাবা জ্বরের ঘোরে বলছিলেন—‘আঃ শাহেদ, য়ু আসক দেম টু বি রিজনেব্ল। বিলিভ মি, ইউ ’ড অ্যাচিভ নাথিং বাই পার্টিশন। ইজ জিনাহ্ এ মুসলিম? ডোন্ট ইউ সি হোয়াই সাচ অ্যান অ্যাংলোফাইল উড ইনসাইট কমিউন্যাল ফিলিংস? পিওরলি টু ফুলফিল হিজ ওন পার্সন্যাল অ্যামবিশন।…সো ইউ হ্যাভ কাম? আই নিউ ইট অল অ্যালং!’
মা মাথার ও’ডি-কোলন দেওয়া জলপটিটা পালটালেন। বাবা চোখ বুজেই আছেন। আমার ভীষণ ভয় করছে। গলার কান্না পর্যন্ত ভয়ে শুকিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে বাবা চোখ মেলছেন, দেখতে পাচ্ছি চোখ দুটো লাল। ভীষণ লাল। বাবা আমাদের কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু ঘরে আমরা ছাড়াও আরও অনেকে আছেন। তাঁদের আমরা দেখতে পাচ্ছি না। বাবা, একমাত্র বাবাই দেখতে পাচ্ছেন। কী অদ্ভুত অলৌকিক ক্ষমতা আমার বাবার! এ তো ম্যাজিক বাবা! কিন্তু ম্যাজিক বাবা নিয়ে ভেতরে ভেতরে গর্বিত হলেও আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি। ভয় আমার গর্বের টুঁটি টিপে ধরেছে।
ঠাকুর্দা বললেন—‘শক ফিভার। আমি ওষুধ দিই বউমা!’
—‘না বাবা, উনি ফেলে দেবেন।’
—‘জ্ঞান নেই, বুঝতে পারবে না।’
মা একটু ইতস্তত করে বললেন—‘পরে আমাকে খেয়ে ফেলবেন।’
—‘পরের কথা পরে বউমা। এখন তো…’
—‘বাবা, উনি বলেন, যে-জিনিস আমি লোককে দিচ্ছি অথচ বিপদের সময়ে নিজে খাচ্ছি না, সে ওষুধ পরে আর আমার কথা শুনবে না।’
—‘ননসেন্স। কাঠ-গোঁয়ার একেবারে। ব্যাপারটা হল সায়েন্স। উনি তার মধ্যে অকাল্ট এনে ফেললেন। তা এখন যে দশা—ওষুধ-টষুধও তো বলতে পারবে না।’
—‘যখন জ্বর আসছিল তখনই বলেছিলেন বাবা, দিচ্ছি। বেলেডোনা।
বাবা তখন স্বামীজির সঙ্গে কথা বলছেন। এবার ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে।
—‘তুমি কেন বিয়ে করলে না? ইউ হ্যাড টু ডাই অ্যাট দি এজ অফ থার্টিনাইন? মার্গারেট নোবল, কি সিস্টার ক্রিস্টিনকে বিয়ে করলে পারতে। ইউ কুড হ্যাভ রেইজড এ ব্রুড অফ হিরয়িক ইউরেশিয়ানস। এ কৃষ্ণ, এ নিউ কৃষ্ণ মাইট হ্যাভ বিন বর্ন।’
বাবা চোখ বুজিয়ে বুজিয়েই হাসলেন।
—‘তোমার চারিদিকে চোখ, না? রক্তচোখ সব। ভাল ভাল। তা হলে শুয়োররাই ব্রিড করুক। শুয়ার আর ইঁদুর। ইন টেন ইয়ার্স দিস কানট্রি উইল গো টু দা ডগস। শুয়ার্স অ্যান্ড র্যাটস। সোয়াইন! ব্লাডি বাগার্স!’
বাবা গা মোড়ামুড়ি দিতে লাগলেন। যেন ভেতরে খুব যন্ত্রণা!
মা মাথা ধুইয়ে দিচ্ছেন। ঠাকুমা কেটলির নল দিয়ে জল ঢালছেন। মা বাবার ছোট ছোট চুলগুলো বিলি কেটে কেটে ভিজিয়ে দিচ্ছেন।
—‘জ্বর হলেই দুগগি ভুল বকবে’—ঠাকুমা বললেন।
মা বললেন—‘কিছু মুখে আটকাবে না,’ দুজনে যেন দুজনকে বুঝ দিচ্ছেন।
‘ব্লাডি, শুয়ার্স, বাগার্স—,’ বাবার প্রলাপ-বাক্য থেকে তিনটি শব্দরত্ন আমি সন্তর্পণে জিভে তুলে নিই। সময় সুযোগমতো প্রয়োগ করা যাবে। তুই যেমন অনেক কিছু বলে আমায় চমকে দিস, আমিও তেমনই এগুলো বলে তোকে চমকে দেব। বাবার ব্যবহারের তকমা লাগানো ছোট ছোট মুখরোচক ইংরেজি শব্দ—‘ব্লাডি, বাগার্স, শুয়ার্স (এটাও ইংরেজি)।’ ঠিক বাবার মতো করে বলতে পারছি না। আমার গলা আবার বড্ড সরু।
তোর গলাটা হেঁড়ে। তার গলায় অনেক কিছু মানায়। তবু আমি চেষ্টা করব, আপ্রাণ। ব্লাডি, বাগার্স (নিশ্চয়ই বেগার্স হবে, বেগার্স মানে ভিখারি, ঠাকুর্দা দেখতে পারেন না) শুয়ার্স, সোয়াইন। ইত্যকার অনুপ্রাস জিভ দিয়ে নিঃশব্দে চাখতে চাখতে আমি ঘুমের দেশে ভেসে যেতে থাকি। ভারী নিশ্চিন্ত। কেননা বাবার জিভে বেলেডোনা থার্টি পড়ে গেছে।
এখন পেছনের দিকে তাকিয়ে ভাবি—মানুষের তৈরি দু’ দুটি বিপাকের পরীক্ষায় পাস করা জাতক আমরা। পঞ্চাশের মন্বন্তর! ছেচল্লিশের দাঙ্গা! কী অদ্ভুত! কথাগুলো এখন ইতিহাসের পাতার ছোট্ট ছোট্ট কোণে চলে গেছে, গুরুত্বহীন শব্দ সব। থিওরি পড়ি। পোড়ামাটি নীতি, যুদ্ধকালে শত্রু সৈন্যের আসার পথে খাদ্যশস্য নষ্ট করে দেওয়া হয়। উদাহরণ—পঞ্চাশের মন্বন্তর। থিওরি পড়ি—দ্বিজাতিতত্ত্ব, তার জনক মহম্মদ আলি জিন্নাহ্। বিশ্লেষণ পড়ি—কংগ্রেস জিন্নাহকে মর্যাদা দেয়নি। তাই প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠলেন তিনি। আ রে! কে কংগ্রেস! কে জিন্নাহ! ভারতবর্ষটা কার পৈতৃক সম্পত্তি? শতাব্দীব্যাপী গৃহযুদ্ধের সেই কি শুরু নয়? শুরু পরস্পরের প্রতি ঘৃণা, ভয়, অবিশ্বাসের। গুণ্ডা, রাজনীতি আর ব্যবসায়িক স্বার্থের গলাগলিরও সেই শুরু।
আজকের ছোটরা দুঃখ করে তারা নাকি কিছু পায়নি। আমরা ছোটরা কী পেয়েছিলুম গৌরবোজ্জ্ববল স্বাধীনতার জন্মলগ্নে? আমাদের জুতোর দোকান ‘ইয়াং গ্র্যাজুয়েট’ লুট, আমাদের জামাকাপড় খেলনার দোকান ‘ওয়াজেল মোল্লা’ ধ্বংস। আমাদের দিদিদের স্কুল ‘ব্রাহ্ম বালিকা’, দাদাদের স্কুল ‘ক্যালকাটা বয়েজ’-এ যাওয়া হয়নি, মুসলিম এলাকা পার হয়ে যেতে হবে। আমরা অবাক হয়ে শুনেছি একজনের নাম। তিনি অনশন করছেন। বড়রা কাঁদছেন। তিনি জনতার জ্বলন্ত রোষ থেকে সুরাবর্দিকে বাঁচাচ্ছেন, বড়রা রেগে কাঁই। জঘন্যতম পাপীদের কি বাঁচাতে আছে? নৃসিংহ কি হিরণ্যকশিপুকে ছেড়ে দিয়েছিলেন? দেশবন্ধু পার্কে যখন বিরাট মিটিং হল, গাঁধীজি পা মুড়ে তাঁর সেই অভ্যস্ত ভঙ্গিতে বসে ভাষণ দিলেন, তখন পালক আর ইন্দ্রর কাঁধে চড়ে আমি-তুই বুনবুন একে একে গাঁধীদর্শন করলুম।
—গান্ধীঠাকুর, গান্ধীঠাকুর নমো নমঃ, নমো নমঃ!
এদিকে একদিন রাগ হতে আমি তোকে বললুম—‘তুই একটা মুসলমান।’
তুই সঙ্গে সঙ্গে বললি—‘আর তুই? তুই তো হিন্দু!’
বুনবুন বলল—‘তুই সোরাবদ্দি। বুবু পাকিস্তান।’
আমি তখন আমার সেই যুগান্তকারী প্রয়োগটি করলুম—‘তুই তবে কী?’
আমি বললুম—‘ব্লাডি, বেগার্স সোয়া (ই)ন, শুয়ার্স।’
এই মোক্ষম সময়ে ই-দাদার যমের মতো আবির্ভাব। আমার কানে তীব্র প্যাঁচ— ‘গালাগালির ফুলঝুরি বেরুচ্ছে যে অ্যাঁ? কোথা থেকে শিখেছ?’
ডান হাতের তর্জনী দিয়ে চড়াত করে এক চড় মারল ই-দাদা। আমার গালে দাগ বসে গেল। চোখের জল চেপে বললুম—‘বাবা, বাবা বলেছেন তো! গালাগালি কেন হবে? তুমি? তুমিও তো নোয়াখালি, রায়ট, দাঙ্গা।’
এক মুহূর্তে থমকে গেল ই-দাদা। সেই অবসরে আমি সরু গলায় আরও চিৎকার করে বললুম—‘তুমি গান্ধী! গান্ধী! গান্ধী!’ ই-দাদাকেও ভয় পাচ্ছি না আমি। পালক-ইন্দ্র পরস্পরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী বলছে রে! মানে কী এর?’
তারপরেই দুজনে হো হো করে হেসে উঠল।
ব্যাপারটা কিন্তু আদৌ হাসির ছিল না। আমাদের সবই গুলিয়ে গিয়েছিল। আমাদের সবই গুলিয়ে গেছে। সেই থেকে গুলিয়েই রয়েছে!
দ্বিতীয় অধ্যায় : আমরা দুটি ভাই/শিবের গাজন গাই
যি-যি-যি সুযযি। পুঁচকে বেলায় যে তান ধরেছিলুম তা আর কোনওদিন ছাড়িনি। এ যেন কেমন একটা জৈব টান। বুনবুনের প্রতি যেটা হওয়ার কথা, বুনবুনকে গোড়া থেকেই সরিয়ে নেওয়ায় সেটাই কি হয়েছিল সুযযির ওপর? সু-দাদা স্কুলে যাবে, উঁচু ক্লাসে পড়ে বাব্বাঃ, কিন্তু আমাকে খাইয়ে না গেলে আমি কান্না জুড়ব। পিসিমা বলবেন—‘এ কী আশচয্যি জুলুম! ব্যাটাছেলেতে বাচ্চাকে ভাত খাওয়ায় বাপের জন্মে শুনিনি বাপু। অনাছিস্টি!’
সুযযির একটা গোলাপি রঙের শার্ট ছিল। সেটা পরলে তাকে এত ভাল দেখাত যে আমি আর তাকে ছাড়তে পারতুম না। পাগলের মতো তার পকেট আঁকড়ে থাকতুম। সুযযি কিন্তু বকত না। বিরক্ত হত না। বলত—‘পুনপুন, একটুখানি নামো! স্কুল না গেলে তোমার জন্যে ম্যাজিক শিখে আসব কী করে?’
সুযযি আর অংশ ছিল এক জোড়া। তবে দুজনে দু’রকমের। দু’জনেই মজাদার। কিন্তু দু’রকমের মজা। সুযযি বলবে মজার মজার গল্প, সে খেলোয়াড়, তার স্বাস্থ্য ভাল। অংশু খেলাধুলোর ধারেকাছে যাবে না, বড্ড রোগা, সে খুব পড়ুয়া ছেলে, তা ছাড়াও ভীষণ খুনসুটিবাজ। ওরা দু’জনে মিলে তিনতলার একটা ছোট্ট চিলেকুঠুরিতে একটা ল্যাবরেটরি সাজিয়েছিল। টেস্ট টিউব, বিকার, বকযন্ত্র, কিপ’স অ্যাপারেটাস, ফানেল, ব্লোপাইপ-বুনসেন বার্নার···। কত রকম যে ছিল সেখানে! বোতলে বোতলে কত রকম সল্ট! কত অ্যাসিড! এ ছাড়াও সুযযির ছিল ডাকটিকিটের অ্যালবাম, অংশুর ছিল ফেটে-যাওয়া পিংপং বলের সংগ্রহ, ওদের দু’জনের যৌথ ম্যাজিক দেখাবার সরঞ্জাম ছিল। যার সব কিছু ওরা কিছুতেই আমাদের কাছে দেখাত না। ওদের ছিল অদ্ভুত-অদ্ভুত টিনের দুটো সুটকেস। তাতে পুঁচকে পুঁচকে তালা ঝুলত। কী মহার্ঘ দ্রব্য যে তাতে আছে আমরা জানতে পারতুম না।
দুই দাদা এক রোববারে ধরুন ঘরটাকে ঝেড়েপুঁছে ঝকঝকে করে সগর্বে ঘর প্রবেশপর্ব সমাধা করল, করেই খিল তুলে দিল। অমনি জানলা দিয়ে একটা ছোট্ট মুখ দেখা গেল। কার মুখ! বুবুর! আবার কার?
—‘একটু খুলে দে না রে!’ —বুবুর বিনীত প্রার্থনা।
—‘আবার তুই-তুই করছিস!’ অং-দাদা ক্রুদ্ধ।
—‘খুলে দাও না।’ —বুবু সঙ্গে-সঙ্গে নিজেকে শুধরে নিয়েছে।
ঘরের খিলের দিকে দৃষ্টিপাত করে সু-দাদা বলল— ‘না নাঃ এখন না। পরে।’
এখন দুভাই তাদের নবপরিষ্কৃত গবেষণাগারের পরিচ্ছন্নতা ও শান্তি নীরবে উপভোগ করবে। পরবর্তী কর্মসূচিও ঠিক করবে। এখন এলেবেলেদের নিয়ে খুনসুটি করার সময় নয়।
কিন্তু বুবুকেও তো ঢুকতেই হবে! সে দুই দাদার মাঝখানে হাইফেন হয়ে তাদের আলোচনায় অংশ নিতে চায়। সুতরাং সে ছাত থেকে সংগ্রহ-করে-আনা চড়ুই পাখির ভেঙেপড়া বাসার টুকরো-টাকরা জানলা দিয়ে গলিয়ে দোলায়। এ ধরনের নানা কৌশল সে পরিস্থিতি অনুযায়ী উদ্ভাবন করে থাকে। আমরা তাকে বিনা শর্তে মেনে চলি।
—‘এই কুটোটা তবে ফেলি?’ —বুবু বাসাটা দোলাতে থাকে।
—‘এই খবদ্দার, না বলছি, না!’
অংশু রেগে-মেগে দরজা খুলে বুবুকে ধরতে ছোটে। বুবুর পেছনেই আমি। সুট করে ঘরে ঢুকে যাই। ঢুকেই সু-দাদার কোলে।
—‘দেখাও, ম্যাজিক দেখাও।’
বুবুও ঢুকে এসেছে অং-দাদার কড়ে-আঙুল ধরে, ‘দেখাও ম্যাজিক!’
অতএব ওদের ম্যাজিক দেখাতেই হয়।
—‘দেখো কেমন দৈত্য বার হবে।’
একটা টেস্ট টিউবের মধ্যে সাদা সাদা নুন ফেলে সুযযি। তারপরে হলুদ হলুদ নুন ফেলে। এবার তার মধ্যে জল দেয়। এদিকে বুনসেন বার্নার জ্বালিয়েছে অংশু। চিমটে করে তার ওপর টেস্ট টিউবটা ধরে, ব্যাস লাল ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে উঠতে থাকে।
—‘ওটাই দৈত্য? যে “ধীবর ও দৈত্যে”র গল্পে বোতলে থাকে? সু-দাদা?’
—‘হ্যাঁ, সেই একই দৈত্য। ওর নাম হল— ক্রোমিল ক্লোরাইড।’
ক্রোমিল, ক্রোমিল! কী সুন্দর নাম দৈত্যের, এ যেন কোনও রাজকুমারীর নামও হতে পারত। ক্লোরাইডটা পদবি। আমি যেমন পাবন সিংঘ, দৈত্য তেমন ক্রোমিল ক্লোরাইড। পদবিটার মধ্যে একটু ভারী ভারী ভাব আছে। চোখ বড় বড় করে আমরা ভয় আনবার চেষ্টা করি হৃদয়ে। ভয় তেমন আসতে চায় না।
—‘ঘাড় মটকে দেবে? সু-দাদা?’
—‘দিতে পারে। দুষ্টু ছেলেমেয়েদের ঘাড়ের ওপর ওর ভীষণ লোভ।’
আমরা ঘাড়ে হাত বুলোই। কেননা জানি, আমরাই সেই দুষ্টু ছেলেমেয়ে যাদের ঘাড়ের ওপর দৈত্যদের লোভ হতে পারে।
—‘তবে হ্যাঁ, যদি এবার থেকে কথা শুনবে বলো তবে দৈত্যকে আবার বন্দি করা যেতে পারে।’ সু-দাদা আশ্বাস দেয়। লাল-ধোঁয়ারূপী দৈত্যকে আমরা ভয় পাইনি, কিন্তু কীভাবে সে বন্দি হতে পারে দেখতে আমাদের প্রবল ঔৎসুক্য জাগে। অতএব এবার অ-দাদা হাল ধরে। সে টেস্ট টিউবের মুখে ফুটোঅলা ছিপি দেয়। ফুটোর মধ্যে একটা বাঁকানো নল লাগায়, অনুরূপ আর একটা টেস্ট টিউবের সঙ্গে যুক্ত করে। সেখানেও কিছু বস্তু আছে। লাল ধোঁয়া দ্বিতীয় টেস্ট টিউবে যেতে থাকে। এবার হলুদ হলুদ কিছু গুঁড়ো পড়ে থাকে। দৈত্য বন্দি। ওই বেচারী হলুদ গুঁড়োগুলোর দিকে তাকিয়ে আমাদের খুব দুঃখ হয়। শেষকালে সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেলি— ‘এই দৈত্যটাকেই ধীবর ভয় পেয়েছিল, অ-দাদা?’
অ-দাদা চালাক ছেলে। আমাদের সন্দিগ্ধতার কারণটা অনুমান করে। বলে—‘ধীববের দৈত্যটা এর বড় দাদা।’
—‘যেমন ই-দাদা আমাদের? অনেক অনে-ক বড়?’
—‘তার চেয়েও বড়।’ সু-দাদা কণ্ঠে প্রত্যয় এনে বলে। ই-দাদার চেওে বড়? এবার আমাদের সম্ভ্রম জাগে। ই-দাদার চেয়েও বড় কোনও দাদা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
একেক দিন এই ঘরে পিকনিক হত। তেপায়ার ওপর বাটি চাপত তাইতে লুচি ভাজা হত। সু-দাদা বেলছে, অং-দাদা ভাজছে। লুচি, বেগুনভাজা, আলুভাজা। তাদের স্বাদই আলাদা। লম্ফর কেরোসিন-কেরোসিন গন্ধটা বেশ মিশে থাকত সবেতে। লুচিগুলো টিপি-ঢিপি, আলুভাজা ওপর-পোড়া, ভেতর-কাঁচা, বেগুনভাজা অদ্ভুত কালো। খেতে খেতে ভাবতুম—এইরকম স্বর্গীয় গন্ধ-স্বাদ যে কেন মা-পিসিমাদের রান্নায় থাকে না!
এই পিকনিকে বুজবুজ-পুটপুট অংশ নিতে এলে দুই দাদা রে রে করে উঠত। শেষকালে রফা হত—দিদিরা আচার তৈরি করবে। আচার মানে ভাঁড়ারঘর থেকে তেঁতুল, সরষের তেল, গুড়, নুন, লংকার গুঁড়ো এইসব মেখে তাল পাকিয়ে টকটক উস-আস শব্দ করতে করতে খাওয়া। এটার ভাগ আমরা পেতুম না। কান্নাকাটি করাতে একদিন বুজবুজ জিভে একটু ঠেকিয়ে দেয়, তাইতেই শিক্ষা হয়ে গিয়েছিল। ঝালের চোটে কেঁদে-রেঁদে একসা।
ছোট্ট থেকেই সু-দাদার খুব ব্যবসাবুদ্ধি ছিল। ধরুন ওকে শিব্রাম চক্রবর্তীর কিংবা হেমেন্দ্রকুমার রায়ের কোনও বই কিনে দেওয়া হয়েছে। ও সেটা আপাদমস্তক পড়ে ফেলল, তারপর সেটা ও ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে বদলাবদলি করে নেবে নীহাররঞ্জন গুপ্ত কি প্রেমেন্দ্র মিত্র কি ‘মোহন ও রমা’ ধরনের কোনও বইয়ের সঙ্গে। সেটাও পড়া হয়ে গেলে অর্ধেক দামে বিক্রি করে দেবে। সেই পয়সা জমিয়ে জমিয়ে কেমিক্যালস্ কিনবে।
সু-দাদা বোধহয় অনেকদিন আগেকার বিনিময়প্রথার দিনের লোক ছিল। ধরুন অংশু একটা খুব সুন্দর পেপারওয়েট জোগাড় করেছে। কাচের স্বচ্ছ পেপারওয়েট, তার ভেতরে লাল-নীল ফুল। সে যে কী লোভনীয়! সু-দাদার ঝোলাঝুলি সেটা ওর চাই-ই চাই। অংশু কিছুতেই দেবে না। শেষকালে সু-দাদা তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় স্ট্যাম্পের অ্যালবামটা বদলি করতে চাইল। তখন অংশু রাজি। অ্যালবামটার ওপর তার অনেক দিনের নজর। অতঃপর জিনিস বদলাবদলি হয়ে গেল। অর্থাৎ সুযযির নীল সুটকেস থেকে অ্যালবামটা অংশুর সবুজ সুটকেসে গেল, পেপারওয়েটটা সবুজ সুটকেস থেকে নীল সুটকেসে স্থানান্তরিত হল। সুটকেস দুটো দিব্যি পাশাপাশি রইল। কিছুদিন পরেই আবার সুযযির অ্যালবামের জন্য অনুশোচনা হতে লাগল, সে অ্যালবামটা ফিরিয়ে দেবার জন্য অংশুকে পীড়াপীড়ি করতে শুরু করল। অংশু দেবে কেন? শেষে তার নীল সুটকেসের যাবতীয় জিনিস দিয়ে সুযযি অংশুর কাছ থেকে অ্যালবামটা কিনে নিল। নীল সুটকেস, সবুজ সুটকেস একই রকম পাশাপাশি অবস্থান করতে লাগল। অর্থাৎ জিনিসগুলো একই জায়গায় থাকত, খালি তাদের মালিকানা বদল হত।
এই হল গিয়ে সুযযি আর অংশু। সুযযি ফুটবল খেলে। প্রায়ই দেখা যায় সে চোট খেয়েছে। চুন-হলুদ গরম করে গোড়ালিতে লাগিয়ে সুযযি নীল সুটকেসের জিনিসপত্তর খুলেমেলে দেখে। যক্ষের ধন সব। আমরা কাছাকাছি এলেই সে তার লকারের তালা বন্ধ করে দেবে। তবে হ্যাঁ, পুনপুনের ওপর তার একটু ইস্পেশ্যাল দুর্বলতা। পুনপুন যদি তার কোলে বসে পড়ে, ‘নীল সুটকেসের খোল দেখাও’ বলে আবদার করে সে বেশিক্ষণ রেজিস্ট করতে পারে না। এমনিভাবেই আমার মাঝে মাঝে সেই গুপ্তধন, যখের ধনের ঝাঁকিদর্শন হয়েছিল।
মোটা মোটা লাল নীল পেনসিল। একদিকে লাল, উল্টোদিকে নীল। কী আশ্চর্য! এক কৌটো ঝিনুক। কোনওটা জাপানি ছাতার মতো, কোনওটা কানের মতো, কোনওটা খণ্ড ৎ-এর মতো, কোনওটা চরকার মতো, গোলাপি আভাযুক্ত বোন চায়নার মতো কিছু। সে এক আরব্যোপন্যাসের আশ্চর্য কৌটো! এগুলি সুযযি বন্ধু-বান্ধবদের ভোগা দিয়ে সংগ্রহ করেছিল। বন্ধুরা কেউ হয় তত পুরী গেছে। প্রচুর ঝিনুক এনেছে। সুযযিকে বড্ড ভালবাসে বন্ধু। গোটাদশেক ঝিনুক সে সুযযিকে উপহার দিতে চায়। সুযযি বলে—‘ঠিক আছে। আমাকে বেছে নিতে দে।’ ব্যাস, বন্ধু ফাঁদে। সুযযি দেখেশুনে সবচেয়ে পছন্দসইগুলো তুলে নিল। তা সুযযিও কি তাকে বিনিময়ে কিছু দেবে না? দেবে বইকি! উদার গলায় গেয়ে দেবে—
‘ভুল করে তুই চিনলি না তোর প্রেমিক শ্যামরায়।
ঝাঁপ দিলি তুই মরণ যমুনায়।’
এমন করে ঝাঁপ দেবে সুযযি যে সব ক্ষতি পুষিয়ে যাবে।
দেশবন্ধু পার্কে সুযযিদের ম্যাচ আছে। ‘অ্যালপাইন’-এর সঙ্গে ‘বেঙ্গল টাইগার্স’ কিংবা ‘বন্ধুদল’। আমরা জানিই না। টেকন আর রামের সঙ্গে দেশবন্ধু পার্কে ঢুকে দেখি মহা উত্তেজনা। দুর্দান্ত খেলা হচ্ছে। অ্যালপাইনের একটা ছেলে নাকি খুব গোল দিচ্ছে। ভিড় ঠেলে আমি বুনবুন-কানুমামুফুল ঢুকে গেছি। গিয়েই আমার বিস্মিত চিৎকার—নীল-সবুজ জার্সি পরে ও তো আমাদের সুযযি!
—‘সুযযি! সুযযি!’ চেঁচিয়ে মাঠ ফাটিয়ে দিচ্ছি আমি।
ভিড়ের লোকগুলো—‘কাটা কাটা, এই কাটা, এগো, গো-ওল’, বলে চিৎকার দিচ্ছিল। আমার সরু গলার গলা গলানোয় ভারি রেগে যায়, বলে—‘কান ধরে বার করে দে তো! এই বাচ্চা, একদম চুপ!’
—‘সুযযি, সুযযি!’ আমি ভ্যাঁ। আমার সেই সুযযি যে এখনও আমাকে গরস মেখে ভাত খাইয়ে দেয়, যার কড়ে আঙুল ধরে আমি দ্বারিকের দোকানের ফুলকপির সিঙাড়া কিনতে যাই এবং চুপিচুপি রসমুণ্ডি খেয়ে আসি, সেই আমার সুযযি নীল সবুজ জামা পরে ওরকম অপরিচিত অন্য লোকের মতো একগাদা লোকের মাঝে বল খেলবে কেন?
আমার মাথায় কোনও প্রতিবেশীর চাঁটি পড়ে। আমি চিৎকার করে আধা-কান্না আধা-নালিশ করতে থাকি। ‘সুযযি-সুযযি।’ সুযযি উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকায়। তার গোল মিস হয়ে যায়। রেফারির হুইস্ল্ পড়ে। ‘অ্যালপাইন’ এক গোলে হেরে যায়। লোকগুলো তো আমাকে এই মারে তো সেই মারে। সুযযি ছুটতে ছুটতে এসে আমাকে উদ্ধার করে। উত্তেজনায়, রাগে উদ্বেগে তার মুখ লাল। খুব লজ্জার সঙ্গেই সে কবুল করে—‘এটা আমার ভাই।’
তখন হঠাৎ আবহাওয়াটা বদলে যায়। ব্যারোমিটার স্বাভাবিক হতে থাকে। ভীষণ আদর শুরু হয়ে যায়। বুনবুন কার কোলে চলে যায়, পুনপুন কার কোলে চলে যায়। লোফালুফি, হ্যান্ডশেক। ম্যাজিকের মতো বেলুন, চটপটি, টফি, লজেঞ্চুষ সব বেরোতে থাকে। অনেক কষ্টে ভিড়ের আদিখ্যেতার হাত থেকে আমাদের উদ্ধার করে সুযযি বাড়ি ফেরে। যতই বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছয় ততই সুযযির মুখটা কেলে হাঁড়ির আকার-বর্ণ ধারণ করতে থাকে। আমি বেশ ভয় পাই। শেষ পর্যন্ত বাড়ির চৌকাঠ পার হতে না-হতে দুম করে উঠোনের ওপর আমাকে নামিয়ে দিয়ে সুযযি গোমড়া মুখে বলে—‘আর কোনওদিন, কোনওদিন যদি আমার খেলার সময়ে মাঠে গিয়েছ তো…।’
তো কী? সেটা আর জানতে পারি না। কিন্তু অজানা শাস্তির ভয়টাই তো বেশি। এতক্ষণে অপরাধবোধ আমার মস্তিষ্কের মধ্যে থেকে চোখের দিকে আসতে থাকে। আমার জন্যেই যে সুযযির গো-ও-ল মিস হয়ে গেল অন্তরাত্মার কাছে এটা আমাকে স্বীকার করতেই হয়, সুতরাং আমার টিয়ার ডাক্টের জল বেমালুম শুকিয়ে যায়। মুখ আমসি।
ফুটবল সুযযির প্রাণ। খেলা রইল তো তার আর কোনওদিকে জ্ঞান থাকবে না। ফুটবল, ফুটবলের জন্যেই সে তার স্বাস্থ্য তৈরি করেছে, স্ট্যামিনা তৈরি করেছে। পুনপুনকেও সে ছোট্ট থেকে ফুটবলের জন্য তৈরি করতে চায়। পুনপুনটা রোগা। সেই ছোট্টবেলায় ডিপথিরিয়া হয়ে ছেলেটা একটু দুবলা হয়ে গেছে। কিন্তু তাতে কী? রোজ ভোরবেলায় মাইলখানেক দৌড়লে, পায়ের মাস্ল্ তৈরি হয়ে যাবে। পুনপুনের প্লাস পয়েন্ট এদিক থেকে তার মাথা। ঝুনো নারকোলের মতো। আর একটু বড় হোক ছেলেটা! সুযযির খেলা থাকে শুধু দেশবন্ধুর পার্কে নয়, শুধু ময়দানেই নয়, বনগাঁয়ে, রানাঘাটে, কোন্নগরে, ব্যারাকপুরে, শিলিগুড়িতে। সেসব অনেক দূর দেশ-বিদেশ। পুনপুন কল্পনাও করতে পারে না সে কত দূর, কত সুন্দর, কত অন্যরকম। একমাত্র ফুটবল খেললেই এই ধরনের বিদেশ-ভ্রমণ তার আয়ত্তের মধ্যে আসবে। ঝুনো নারকোলের মতো মাথাটা যখন তার আছেই। ইতিমধ্যে লুব্ধ, আতুর দৃষ্টিতে সে সুযযির হ্যাভারস্যাক গুছোনো দেখে। অ্যাংকলেট, জার্সি, শিনগার্ড, বুট…।
ই-দাদার মুখ গম্ভীর, পমদিদির মুখ গম্ভীরতর।
—‘আবার যাচ্ছ?’
—‘ক্লাবের খেলা, যাব না?’
—‘থিওরি না হয় পড়ে নিতে পারলে। প্র্যাকটিক্যালগুলো কামাই হলে কে তোমাকে পাস করাবে? শিখবেই বা কী? অঙ্কে তো প্রায় গোল্লা পাচ্ছ!’
—‘এবারটি, এবারটি যাই দাদা, না গেলে ঝন্টুদা ভীষণ রাগ করবেন, বড় ম্যাচগুলোতেও আর চান্স পাব না।’
—‘ভাল। তা তোমার উদ্দেশ্যটা কী? কী হতে চাও? গোষ্ঠ পাল? না ইউ. কুমার? মনে রেখো তুমি একটা এ-ওয়ান ফুটবল প্লেয়ার হলে আমরা যত খুশি হব, তার চেয়ে অনেক বেশি গর্বিত হব, একটা এম-এসসি রিসার্চ স্কলার হলে। হও সাধারণ, দারুণ কিছু একটা হতে হবে না।
—‘কথা দিচ্ছি, অঙ্কে পাস করবই। দেখো!’
সুযযি মার্টিন ট্রেনে চড়ে এর উঠোন তার দাওয়ার পাশ দিয়ে দিয়ে কোনও মজাদার গ্রামে ফুটবল খেলতে যায়। ফিরে এলে ভাইবোনেরা তাকে ঘিরে বসে। গল্প হবে। —‘বুঝলি অংশু, বুঝলি ঋতি, সে স্যাখ্খাত্তির না? জমিদার নিজে দাঁড়িয়ে খাওয়াচ্ছে। বাড়ির পাঁঠার মাংসের কালিয়া। জমজমাট রান্না। গরগর করছে একেবারে। এক একখানা লেডিকেনির সাইজ কী? টেনিস বলের মতো। পাশবালিশের মতো মাটন চপ। কোলবালিশের মতো চিত্রকূট। রুই মাছের ন্যাজার সাইজ কী?’
—‘খেতে পারলে?’—অংশুর জিজ্ঞাসা।
আমরা ঝোল টানছি। আমি-বুবু-বুনবুন।
—‘না পারার কী আছে?’ —অবহেলায় উত্তর ফেলে দেয় সুযযি।
—‘এই যে বললে যেতেই এক জামবাটি করে মুড়ি-নারকোল-ফেণী বাতাসা-শিঙাড়া, জিলিপি দিল!’
—‘দুধও। প্লাস দুধ’—সুযযি সংশোধন করে।
—‘তো তারপরও এত খেতে পারলে?’—ঋতির জিজ্ঞাসা।
—‘আমরা প্লেয়ার। আমাদের কি তোদের মতো গুবরেপোকার পেট? খাব আর হজম করব। দেদার খাব, দেদার খাটব, লোহাক্কে লোহা হজম হয়ে যাবে।’
—‘তবে হ্যাঁ, এর পর ওরা যা খাওয়ালে না, সেটা হজম করা শক্ত। নেহাৎ অ্যালপাইনের সূর্য সিংহ বলেই পেরেছি।’
—‘কী? কী?’ —আমরা এগিয়ে বসি।
—‘পেটো।’
—‘পেটো? পেটো কী খাবার? কোনও ধরনের পরোটা?’
অংশু বুঝেছে, অংশু হাসছে মিটিমিটি।
সুযযি বলছে—‘ওরা তো পাঁচ গোল খেলো। হেরে ভূত। ওদের সাপোর্টাররা তো তখনই আমাদের এই মারে তো সেই মারে। কোনওরকমে পালিয়ে ট্রেনে চড়েছি। ট্রেন তো যাচ্ছে গরুর গাড়ির মতো। আর ওরা পেটো ছুঁড়ছে। পেটো এক রকমের বোমা। প্রাণ নিয়ে এবারের মতো পালিয়ে আসতে পেরেছি, এই ঢের।’
—‘তবু কি তোমার শিক্ষা হবে?’—ই-দাদা ঠিক শুনেছে।
পালক বলল— ‘একটু-আধটু অ্যাডভেঞ্চার ভাল কিন্তু ইন্দ্র।’
পালক, ইন্দ্র, সূর্য সবাই বাড়িতে ধুতি পরত। আর বাইরে পরত ধুতি ছাড়াও থলের মতো ফুলপ্যান্ট। পালক সব সময়ে কাছা দিয়ে পরত। হিরো-হিরো লাগত দেখতে। ইন্দ্রর ঝুলন্ত কোঁচা অর্ধেক করে কোমরে গোঁজা থাকত বাবাদের মতো। আর সূর্য কী করে ধুতি পরত শুনুন। কোঁচাটা ঝুলিয়ে দিল, এবার তলার থেকে কোঁচার খুটটা তুলে নিল, এবার সেটাকে কোমরের পেছন দিয়ে বেড় দিয়ে সামনের দিকে একেবারে কোমর-ভূঁড়ির মাঝখানে গুঁজে দিল। এরকম করে ধুতি পরতে আর কাউকে জীবনে দেখিনি। যে এরকম করে ধুতি পরবে, সারা পৃথিবীতে, হলফ করে বলতে পারি সে পুনপুন-বুনবুন-বুবুদের প্রিয়পাত্র হবে। হবেই হবে। আর ধুতি ছাড়া অন্য কিছু পরে যদি পুনপুনদের প্রিয়পাত্র হতে হয় তাহলে ঝলঝলে খাকি হাফপ্যান্ট পরতে হবে। কারণ ঝলঝলে খাকি হাফপ্যান্ট পরত অংশু।
অংশু আমাদের কী পেছনেই লাগ্ত। অদ্ভুত অদ্ভুত সব ভাষা আর আদর ছিল অংশুর। —‘শোন শোন শোন’ করে সে আমাকে কাছে ডাকবে, তারপরে ‘গিজদা গিজুম’ করে দেবে। ‘গিজদা গিজুম’ কী বলুন তো? হাত দুটো মুঠো পাকিয়ে আমাদের দুই গালের ওপর থেকে নীচে ঘষটে নামাবে। কী প্রচণ্ড লাগত! কিন্তু ওটাই অংশুর আদর। হয়তো জ্বর হয়েছে, শুয়ে আছি। মুখ লাল। চোখ গরম। মেজাজ খিটখিট করছে। অংশু ঘরে ঢুকল, যেই আড়চোখে তাকিয়েছি অমনি অংশু বক দেখানোর মতো হাতটাকে তুলে, সাপের মতো সেটাকে নাচাবে আর মুখে বলবে—‘পুশ, পুশ, পুশ্। আপুনি কি কসসেন?
অমনি আমার চিলচিৎকার। সঙ্গে সঙ্গে বাবার সেই বিচিত্র হুংকার। হুংকারের সঙ্গে এবার অবশ্য কিছু বোধ্য শব্দও যুক্ত হয়েছে—‘রে অংশু!!’ সঙ্গে সঙ্গে অংশুর পলায়ন। বুবু ছিল অংশুর বিশেষ প্রিয়। আমার যেমন সুযযি, বুবুর তেমন অংশু।
—‘বুবু-মেয়েটা, বোবা মেয়েটা’ বলে বুবুকে আদর করত অংশু। আর বুবু কাঁদলেই ছড়া কাটতো :
‘সে মেয়ে কে চায় বলো কথায় কথায়|
আসে যার চোখে জল মাথা ঘুরে যায়।’
অমনি বুবুর কান্না বেড়ে যেত, সে আর্তনাদ করে আছাড় খেয়ে পড়ত —‘আমাকে কেউ চায় না।’
সব দাদা-দিদিরা তাকে তখন বোঝাতে বসত—অংশু বাজে কথা বলেছে। সে ছিঁচ-কাঁদুনি হলেও তাকে সবাই চায়।
তখন বুবু বলবে—‘আমার মাথা ঘুরে যায় না।’ অর্থাৎ কি না সে কেঁদেছে ঠিকই, কিন্তু মাথা ঘুরে যাওয়ার অপবাদটা ঠিক নয়।
দাদা-দিদিরা এবার হাসতে থাকবে।
ই-দাদা হঠাৎ হাসিতে ইস্তফা দিয়ে তড়াং করে উঠে পড়বে—‘ধুত, বাচ্চাগুলো সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাচ্ছে। কিস্যু হবে না এদের।’ ই-দাদা সোজা তীরের মতো শরীর নিয়ে পেছন ফিরে চলে যেতে থাকবে, আর সেইদিকে তাকিয়ে আমার মনে হবে— আর যে হয় হোক আমি কক্ষনও ‘সেনিনমেনাল’ হব না। কারণ তা হলে আমার কিস্যু হবে না। ‘কিস্যু’টা যে আমাদের ভবিষ্যতের ইঙ্গিতে পূর্ণ সেটা আমি অন্তত ভালই বুঝতুম। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমাদের যথেষ্টই উচ্চ ছিল। আমার উচ্চাশা সে সময়টায় ছিল হাইড্র্যান্টে মোটা পাইপ লাগিয়ে রাস্তায় জল দেব। কয়েকদিন কাজটা করলেই ওরা নিশ্চয় আমাকে পাইপটা দিয়ে দেবে। তখন কী হবে?—সপ্তম স্বর্গ লাভ হবে। বুবুর উচ্চাশার পরাকাষ্ঠা সে সময়টায় ছিল অন্ন হওয়া। ওই সব উনুন নিকোনো, ছাই অদ্ভুত কায়দায় ঝেড়ে ঝেড়ে মিহি এবং মোটা আলাদা করে ফেলা, কাঁসার বাসনগুলো ঝকঝকে করে মেজে মুছে বড় থেকে ছোট পরপর সাজানো, এই সব সে অসীম প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখত এবং অন্ন হতে চাইত। অথচ তার মধ্যে এমনই স্ববিরোধ যে অন্ন কোনওদিন কামাই করলে মা যদি সেই প্রশংসনীয় বাসন মাজার কাজটা করতে যেতেন সে রোয়াকে বসে হাপুস কাঁদত—‘না মা তুমি এক্ষুনি উঠে এসো। তুমি বাসন মাজবে না।’ এমন করে কাঁদত যেন তার বুক ভেঙে যাচ্ছে। মা বিরক্ত হয়ে বলতেন—
—‘তা হলে কে মাজবে?’
—‘পম মাজুক।’
—‘পম ঠাকুরঘরের কাজ করছে।’
—‘টম মাজুক।’
—‘টম পড়াশোনা করছে।’
—‘বুজবুজ পুটপুট মাজুক।’
—‘ওদের বুঝি স্কুল নেই?’
তখন বুবু বলত—‘ঠাকুদ্দা মাজবেন।’
অন্নর বাসন মাজার পিঁড়িতে হুঁকো হাতে বৃদ্ধ ঠাকুর্দাকে কল্পনা করুন।
অবশেষে পালক আর বুজবুজ মিলে মার সঙ্গে হাত মিলোত। পিসিমা রেগেমেগে বলতেন—‘ভিরকুট্টি! ঠাকুদ্দা বাসন মাজবেন। ওইটিই এবার বাকি আছে।’
ঠাকুমা হেসে বলতেন—‘আহা, মায়ের জন্যে মেয়ের মায়া দেখো!’
বড় মুগ্ধ, বড় করুণ ঠাকুমার হাসিটুকু।
সেদিকে একপলক তাকিয়ে পিসিমা বলতেন—‘ভিরকুট্টি!’
তবে অং-দাদার ‘ক্লাস’ হচ্ছে কান্না। অত বড় ছেলে আবার কাঁদে না কি? অন্য দাদারা মায়ের খুচরো ফরমাশের আওতার বাইরে। মা খালি অং-দাদাকে হাতের কাছে পান।
—‘অংশু, এক পো পোস্ত এনে দে তো!’
অংশু তখন আঁক কষছে। আঁক অংশুর প্রাণ। কয়েকবার ডেকে সাড়া না পাওয়ায় মায়ের গলা এবার রাগত।
—‘অংশু, শুনতে পাচ্ছ না?
—‘আমি এখন পারব না!’
—‘পারব না? মুখের ওপর কথা? দিন দিন অবাধ্য অসভ্য হয়ে যাচ্ছ।’ এই ‘অবাধ্য-অসভ্য’ বিশেষণে বিচলিত হয়ে অংশু পোস্ত এনে দিল। তারপর তিনতলার ল্যাবরেটরি ঘরে চলে গেল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
আমাদের তিনজনের ভীষণ কৌতূহল। চুপিচুপি পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে গোড়ালি উঁচু করে জানলার গরাদ প্রাণপণে আঁকড়ে আমরা দেখবার চেষ্টা করতুম অং-দাদা কী করছে।
টেবিল। সামনে চেয়ার। টেবিলে কনুই রেখে অং-দাদা মুঠি পাকিয়ে চোখের জল মুঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুছছে। ‘অবাধ্য-অসভ্য’ বিশেষণ অং-দাদার প্রাণে ভীষণ লেগেছে।
অং-দাদার জন্যে করুণায়, মমতায় আমরা দ্রব হয়ে যেতুম। তখন সবে স্নো হোয়াইট বা তুষারকণা, সিন্ডারেল্লা বা ঘুটে কুড়ুনি মেয়ের গল্প শুনেছি। সৎমার কনসেপ্টের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। এদিকে সুয়োরানি দুয়োরানি। সুয়োর ছেলে, দুয়োর ছেলেদেরও চিনেছি। আমাদের তিনজনের আলোচনা-চক্র বসত।
আমি বলতুম—‘দেখ, মা নিশ্চয়ই অং-দাদার সৎমা। নইলে অমন বকলেন কেন!’
বুবু বলত—‘য্যাঃ, অং-দাদা দুয়োরানির ছেলে। ওর ধুতি নেই, কাবলি জুতো নেই, খালি খাকি প্যান্ট, আর কালো শু জুতো।’
বুনবুন মত প্রকাশ করত—‘অং-দাদা একদিন ঠিকই পালিয়ে যাবে। যেতে যেতে যেতে যেতে এক বিরা-ট জঙ্গল। হঠাৎ একটা পক্ষিরাজ ঘোড়া এসে চিঁহি করে পিঠ নিচু করবে। তখন অং-দাদা লাফিয়ে তার পিঠে চড়বে। ঘোড়া তাকে নিয়ে ছুটবে নীচে কত কড়ির পাহাড়, হাড়ের পাহাড়, চুর হয়ে যাবে, তারপরে অং-দাদা ঘুমন্তপুরীতে গিয়ে সোনার কাঠি রূপোর কাঠি বদল করে রাজকন্যাকে জাগাবে, রাক্ষসকে মারবে, সোনার পালক দেওয়া পাগড়ি পরে, জরি দেওয়া জামা পরে, পক্ষিরাজের পিঠে চড়ে রাজকন্যা নিয়ে আমাদের চার নম্বর শিবশঙ্কর মল্লিক লেনের বাড়িতে নামবে।’
—‘তুই যাবি?’ —বুবু জিজ্ঞেস করত।
বুনবুন একটু থতমত খেয়ে বলত—‘কানু গেলে আর দিদিভাই গেলে, আর পুনপুন গেলে যাব।’
দিদিভাইয়ের মতো গুরুজন নিয়ে, এবং কানু ও পুনপুনের মতো ভাগীদার-প্রতিদ্বন্দ্বী নিয়ে রাজকন্যা-উদ্ধারে যাওয়াটা যে যুক্তিযুক্ত নয়, এটা তার মাথায় কে ঢোকাবে?
তবে অং-দাদার সবচেয়ে শ্লাঘ্য কীর্তি তার ম্যাজিক।
একদিন সুযযি আর অংশু ঘোষণা করল তারা আমাদের এক অলৌকিক ম্যাজিক দেখাবে। ল্যাবরেটরির দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তিনজনে বাইরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ বাদে দরজা খুলল। পুটপুট আমাদের টিকিট দিল (ট্রামের টিকিট), বিনিময়ে আমাদের তিনজনকে তিনটি ডবলি দিতে হল। ম্যাজিকের প্রতিটি ডিটেইল বিশ্বাসযোগ্য হওয়া চাই কি না! ঘরে মৃদু সবুজ আলো জ্বলছে। টেবিলটি আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা (বুজবুজের শাড়ি)। টেবিলের ওধারে অংশু দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এ আমাদের চেনা অং-দাদা নয়। এইটুকুনি বেঁটে হয়ে গেছে। জুতো পরা পা টেবিলের ওপর ন্যস্ত। মুখ কাঁধ সব একই মাপের। কালো কোট (বাবার) পরে আছে, তাঁর হাফপ্যান্টই এখন ফুলপ্যান্ট হয়ে গেছে। টাইও পরেছে। টেবিলের ওপর দাঁড়ানো এক অদ্ভুত অংসাহেবামন (অংশু+সাহেব+বামন)।
আমার বুকটা হু হু করছে অং-দাদার এই পরিবর্তনে। গলার কাছটা ডেলা পাকিয়ে উঠেছে। বুনবুন শক্ত করে আমার হাতের মুঠো ধরে আছে। বুবু যে কখন কালো কাপড় ভেদ করে ওপার দিয়ে ফুঁড়ে উঠেছে কেউই লক্ষ করেনি। তার হেঁড়ে গলার চিৎকারে আমরা চমকে উঠলুম।
—‘এই তো অং-দাদার গোটাটা। হাতে আবার জুতো-মোজা পরা হয়েছে,’ খিলখিল করে বুবু হাসছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে তার বিশ্বাসঘাতী শয়তানির পেছনে একটা উদ্বেগ এবং আপাতত উদ্বেগ-মুক্তি কাজ করছিল। তার অং-দাদা যদি অ্যালিসের মতন হঠাৎ ছোট হয়ে গিয়ে আর বড়সড় সাইজ-মত হতে না পারে?
সুযযি এবং অংশু এতে ভীষণ রেগে যায়। প্রতিজ্ঞা করে জীবনে কখনও আমাদের ম্যাজিক দেখাবে না। আমরা নাকি ম্যাজিক দেখাবার উপযুক্তই নই। অংশু তার মোজা-টাই এসব টেনে টেনে খুলতে থাকে। বেশ রুষ্ট। কিন্তু পুটপুট হেসে লুটিয়ে লুটিয়ে পড়ে ; ‘ঠিক হয়েছে, ঠিক হয়েছে’ বলতে বলতে তার প্রায় চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে যাবার জোগাড়। তার এত উল্লাসের কারণ, ম্যাজিকের কেন্দ্রবিন্দু অর্থাৎ বেঁটেটা সে-ই হতে চেয়েছিল। দাদারা তাকে পাত্তা দেয়নি। তা-ই তার এই অন্তর্ঘাতী হাসি।
তবে যতই রেগে যাক, অংশুকে শেষ পর্যন্ত বুবুকে কোলে নিতেই হয়। বুবু সম্ভবত স্বচক্ষে সব ধাপ্পা দেখেশুনেও উদ্বেগমুক্ত হতে পারেনি। অংশুর কোলে উঠে তার দৈর্ঘ্য এবং গোটাত্ব উপলব্ধি করে নিতে চাইছিল।
প্রচণ্ড মজার ছিল অং-দাদা। আপনারা বাজের আওয়াজকে কীভাবে ব্যক্ত করেন? ‘ক্কড় ক্কড় কড়াৎ।’ তাই তো?
অং-দাদা একটা বিশাল বজ্রপাতের আওয়াজকে এইভাবে অনুকৃত করেছিল—‘গটাফিল ডামা-ন, গুহুম, ভার্ ভার্ ভার্ ভার্ ভার্ ভার্ ভার্ ভার্।’
তৃতীয় অধ্যায় : শীত-বসন্ত
যাই বলো আর তাই বলো, ইন্দ্র তুমি ছিলে আসল জাদুকর। তুমি কিনা দেবহূতি-দুর্গাপ্রসাদের জ্যেষ্ঠ সন্তান, তাই তোমাকে তাঁরা মনের মতো করে সাজিয়েছিলেন। মাথায় তোমার বিবেকানন্দর পাগড়ি—‘হে ভারত ভুলিও না নীচ জাতি, মূর্খ দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি মেথর তোমার ভাই, সদর্পে বলো…মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই,’ গায়ে তোমার সুভাষচন্দ্রের মিলিটারি পোশাক তরুণদের সব স্বপ্ন দেখাচ্ছ, রক্তের বদলে স্বাধীনতা এনে দেবে, পায়ে গলিয়েছিলে বিদ্যাসাগরের শুঁড়তোলা ঠনঠনের চটিজোড়া, শিক্ষার জগতে তুমি বিপ্লব আনবে, সমাজজীবনে আনবে সংস্কার-মুক্তির জোয়ার, আর হাতে তোমার তাঁরা ধরিয়ে দিয়েছিলেন আইনস্টাইনের অন্যমনস্ক বেহালা। তোমার হাতে একটা জাদুদণ্ড সেটা ঘোরাচ্ছ আর তোমার চেহারা, তোমার ভূমিকা পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। অন্য সবার ভূমিকাও তো তুমিই ঠিক করে দিতে। কখনও তুমি ভাইবোনেদের যোগাসন ও আরও নানা ব্যায়াম করাচ্ছ। দুর্বল দেহে কিনা বেদান্ত বোঝা যায় না! তোমার তত্ত্বাবধানে সুযযি শরীরটাকে চাকার মতো ঘোরাতে ঘোরাতে হাতের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে চলে যাচ্ছে। অংশু পিকক হয়ে হাতে ভর দিয়ে দু’হাত চলেই দাঁড়িয়ে গেল, পমদিদি টমদিদি পদ্মাসন করে মিনিটের পর মিনিট বসে আছে। পালক বসেছে উবু হয়ে। বুজবুজ, পুটপুট টকটক করে দু’দিক থেকে তার কাঁধে উঠে পড়ে পরস্পরের দিকে হেলে গিয়ে হাত ধরাধরি করল। এইবার পালক আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াচ্ছে। হাততালিতে ফেটে পড়ছে ছাত। দি গ্রেট সিংঘিবাড়ি সার্কাস।
পিসিমার অসুখ করেছে। তুমি আর পমদিদি মাকে সাহায্য করছ। তোমার তৈরি মেনু আজকে টিক্কর আর অড়হর ডাল। দুই হাতে উল্টে পাল্টে মোটা মোটা টিক্কর গড়ছ তুমি, উবু হয়ে বসে। মা সেঁকছেন। মার মুখ ভীষণ সিরিয়াস, টিক্করের প্রতি সুবিচার করতে হবে তো? এঁচড়-ফুলকপি-মটরশুঁটির মাতৃকৃত আচার নিয়ে ঢুকলো বুজবুজদিদি। সবাইকার আসন হয়েছে, টিক্কর গরম গরম খেতে হবে, আচার আর অড়হর ডাল দিয়ে। আমাদের অবশ্য সনাতন ভাত-মাছ আছে। তবু আমরা টিক্করের জন্যে হা-পিত্যেশ করে বসে থাকি।
—ঠিক আছে, দেওয়া হবে, না খেলে কিন্তু দেখবে মজা!
মজা দেখতে আমরা রাজি। টিক্করের ভাঙা কোণা, চার ভাগের এক ভাগ করে আমাদের পাতে পড়ে। ঘন অড়হর ডাল একটু করে।
পোড়া পোড়া গন্ধটা চমৎকার লাগে, কিন্তু দাঁতে কাটতে পারি না জিনিসটা আমরা। বুবু ফিসফিস করে বলে—অড়র ডাল কী রম রে?
আমি (ফিসফিসিয়ে)—বিচ্ছিরি। আর টিক্কর?
বুবু ইশারায় দেখায় সে টিক্করের টুকরো কীভাবে থালার তলায় চালান করে দিয়েছে। আমিও অবিলম্বে তাই করি। ধরা পড়ে যাই। আমাদের মজা দেখাবার আগেই মা একটি ছোট্ট মন্তব্য করেন—‘অন্যদের থালার তলাগুলোও একটু দেখো ইন্দ্র।’ ইন্দ্র মায়ের দিকে তাকায়। মা কি হাসছেন? উঁহু! মা কখনও হাসতে পারেন! তাঁর বিদ্যাসাগর ছেলে টিক্কর গড়েছে! ঠাকুর্দার তালতলার চটির আওয়াজ পাওয়া যায়। তিনিও একখানা টিক্কর চেয়ে নিয়েছেন, ‘খাসা হয়েছে তোর টিক্কর, তবে আমার চলবে না, বুঝলি ইন্দ্র!’ আমরা ভাবি ঠাকুর্দাকেও মজা দেখাবার কথা বলছে না কেন ই-দাদা? এ ভারি অন্যায় কিন্তু! এক যাত্রায় পৃথক ফল হবে কেন?
কোনও কোনও ভোরবেলায় সকাল সকাল ঘুম ভাঙলে ছাতে গিয়ে আমরা দেখতুম সারি সারি মাটির মুণ্ডু শুকোচ্ছে। বিষ্ণু, লক্ষ্মী, সরস্বতী, অসুর, কালী। ই-দাদা আর পালক মিলে গড়েছে। মুণ্ডু এখন শুকোচ্ছে। রাত্রে একটা স্বপ্ন খুব দেখতুম, ই-দাদার কাছে দেব-দেবীরা যুদ্ধ করতে আসছেন আর ই-দাদা তাঁদের মুণ্ডু কচাকচ কেটে ফেলেছে।
ইন্দ্র, তোমার সুড়সুড়ি খাওয়ার কথা মনে আছে? তুমি কেমন উপুড় হয়ে সটান শুয়ে পড়তে, আমরা মাছির মতো তোমার চারপাশে ভনভন করতুম! তুমি গল্প বলবে বলে!
সুরুলের ধানক্ষেতের আল দিয়ে তুমি যাচ্ছ এমন সময় বিপিনবাবুর সঙ্গে দেখা। ছাতা হাতে আল ফুঁড়ে ওপরে উঠে এসেছেন। পড়বি তো পড় একবারে ইন্দ্র সিংহের মুখোমুখি। আমতা আমতা করছেন বিপিনবাবু।
—‘তুমি চিনতে বিপিনবাবুকে, ই-দাদা? আগে থেকে চিনতে?’
—‘বিপিনবাবুকে চিনব না? বিপিনবাবু রে? আমাদের বিপিনবাবু!’
—‘কোন বিপিনবাবু?’—আমরা কোনও বিপিনবাবুকে মনে করতে পারি না। আমাদের সুড়সুড়ির আঙুল থেমে যায়। ইন্দ্রর গপ্পোও থেমে যায়।
—‘সেই যে সে-ই বিপিনবাবু!’
গল্প এগোচ্ছে না দেখে এবং বিপিনবাবুকে না চিনতে পারার দরুন ই-দাদার হাসির খোরাক হচ্ছি দেখে বলি—‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ সেই বিপিনবাবু। বিপিনবাবু তো?’
ই-দাদার হাসিটা একটু বেড়ে যায়, কেন কে জানে, কিন্তু গল্প এগোয়। বিপিনবাবু কিছুতেই ইন্দ্রকে কাটাতে পারেন না। অবশেষে তাকে নিয়ে যান আলের তলায় তিনি যে পৃথিবীব্যাপী সুড়ঙ্গ তৈরি করেছেন তার মধ্যে। লাল কার্পেট দেওয়া সুড়ঙ্গে নামলে তোমাকে আর চলতে হবে না, সুড়ঙ্গই চলবে। তারপর তুমি পৌঁছে যাবে আজব দেশে যেখানে কল খুললে কমলালেবুর রস পড়ে, নদীর সামনে দাঁড়ালেই নৌকা এসে ঘাটে ভেড়ে, দেশটা ছোট ছেলেমেয়েদেরই দেশ। কত রকম খেলনায় ভরা।
—‘মা নেই ই-দাদা? বাবা নেই ওখানে?’
—‘কাদের?’
—‘ওই ছেলেমেয়েদের?’
—‘কেন? বাবা-মা চাই?’
বাবা মা চাই আবার কী? ছেলেমেয়েরা কি বাবা-মা বিনা থাকতে পারে? এ আবার কেমন প্রশ্ন?
বুবু বলে—‘চাই।’
বুনবুন বলে—‘দিদিভাইও চাই।’
—চাইলেই বাবা-মা-দিদিভাই সব পাওয়া যাবে, তবে তার সঙ্গে সঙ্গেই দাদা-দিদি, কানমলা, চড়চাপড়, এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সব এসে যাবে, স-ব। আর সঙ্গে সঙ্গে দেশটা ঠিক এই দেশটার মতো হয়ে যাবে।
কী অদ্ভুত উভয় সঙ্কট আমাদের! আজব এক ইচ্ছাপূরণের দেশও চাই, আবার বাবা-মা-দিদিভাই এইসব সম্পর্কের মাধুর্যও চাই। কিন্তু একটা হলে অন্যটা পাওয়া যাবে না। নাও এবার কোনটা নেবে! অঢেল স্বাধীনতা, অতুল ঐশ্বর্য, বিলাস, সমবয়স্ক বন্ধুবান্ধবের সাহচর্য আর মজা—এক দিকে, আর এক দিকে স্নেহ-শ্রদ্ধা-নানা সম্পর্কের স্বাদ, এক রকমের অধীনতা কিন্তু আশ্রয়ও। শাসন কিন্তু শিক্ষাও। ই-দাদা কি জেনেশুনে জীবনের এই মৌলিক উভয় সঙ্কটের মাঝখানে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল? তখনও ঠিক করতে পারিনি এই দেশ ছেড়ে বিপিনবাবুর সুড়ঙ্গপথে ঢুকব কি না, আজও পারি না। ই-দাদা, দুটো কি কিছুতেই একসঙ্গে পাওয়া যায় না? আচ্ছা, আজ পর্যন্ত কি কেউ চেষ্টা করে দেখেছে? সত্যি-সত্যি চেষ্টা?
—হ্যাঁ, ব্যাসদেব নামে ভদ্রলোক মানে লেখক চেষ্টা করেছিলেন।
—কেমন চেষ্টা? কোথায়?
—ওই তো, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর ওঁর নায়ক ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী-কুন্তী-বিদুর এঁদের সঙ্গ এবং যা চাইছিলেন সেই রাজত্ব, অতুল ঐশ্বর্য, ভাইয়েদের আনুগত্য, সহযোগিতা, প্রজাদের সন্তোষ একসঙ্গে পাননি?
—কিন্তু এই পাওয়া আর বারণাবতের জতুগৃহ থেকে পালিয়ে দিশি-দিশি ছদ্মবেশে ঘোরার সময়ে কুন্তী আর তাঁর পঞ্চপুত্রের যে নিবিড় বন্ধনের দিন—তা কি আর ফিরে এল? ভেবে দেখো পাণ্ডবদের এই সর্বতঃসুখ বারবার ছলনা করে কেমন ফিরে গেছে! ইন্দ্রপ্রস্থের দিনগুলোয় একবার পেলেন। কিন্তু রাজসূয় যজ্ঞের যে পরিকল্পনা তা-ও কি একটা ঔদ্ধত্য নয়? এই ঔদ্ধত্যই তো সর্বনাশ ডেকে আনল। আসলে, ঐশ্বর্য আর সুখ পেলেই আমরা তার বিজ্ঞাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কী দরকার ছিল দুর্যোধনের মতো হিংসুক মানুষকে উপহার-সামগ্রী গ্রহণ সংরক্ষণের ভার দেওয়ার? সৌহার্দ্যের ছলে এ কি যন্ত্রণা দেওয়া নয়?
—সে যাক গে। রাজা-রাজড়াদের ও সব করতেই হয়, রাজসূয়-টুয়? এর সঙ্গে আমাদের সাধারণ মানুষদের জীবনের তো মিল নেই? কোথায় যুধিষ্ঠির-ভীম-ভীষ্ম-অর্জুন-দুর্যোধন আর কোথায় পুনপুন-বুনবুন-ই-দাদা-বুবু-দিদিভাই…?
—না, না, ভাই মন দিয়ে দেখো ভাবো, আমরা অনেকেই একটা জঙ্গলাকীর্ণ, রুক্ষ-অনুর্বর খাণ্ডবপ্রস্থ পাই, তাকে ইন্দ্রপ্রস্থে পরিণত করবার পরই রাজসূয় যজ্ঞে আমাদের পেয়ে বসে, আর তত্ত্ব দেখবার জন্যে আমরা দুর্যোধনদের খুঁজে খুঁজে বার করি।
—আচ্ছা, ঠিক আছে। তো কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের পর তো ওঁরা পেয়েছিলেন সেই সমূহসুখ!
—ওকে কি পাওয়া বলে? বংশলোপ, আত্মীয়বধের দায়ভাগ? দিবারাত্র শোক আর পাপবোধ বহন করা! কোন আগুনে পুড়ে মরলেন ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী-কুন্তী-বিদুর? সে কি সত্যিই দাবানল? না জীবনযন্ত্রণার আগুন? পঞ্চপাণ্ডব দ্রৌপদীর মহাপ্রস্থান? সে তো সুখ-শান্তি-আনন্দ সব কিছু অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়ার গল্প? সমস্ত পার্থিব সুখ—শারীরিক, মানসিক, ঔপকরণিক একেবারে বিস্বাদ হয়ে যাওয়ার গল্প! পরমার্থের সন্ধানে যাত্রা, কেন? এত কাণ্ডের পরেও সব প্রাপ্তি নিরর্থক লাগে বলে! এই অন্তিম বিষাদযোগ থেকে ওঁদের তো কেউই আর বাঁচাতে পারল না। একে একে পড়ে যাচ্ছেন, শিথিল সত্তা সমর্পণ করছেন চূড়ান্ত অবসাদের হাতে, একমাত্র যুধিষ্ঠিরেরই এখনও আছে যন্ত্রণাভোগের সামর্থ্য, তিনি নরক দেখেন, অন্যরা একেবারে নিঃসাড়, আধিদৈবিক তুষারে জমাট শবদেহ সব।
ই-দাদা, তোমার গল্প যে এমন জীবনবাসনার রূপকে দাঁড়াবে তা কি তুমি নিজেই বুঝেছিলে? বুঝেছিলে?
ইন্দ্র আর পুলককে ছায়া-কায়া বলা হত। কে যে কায়া আর কে যে ছায়া বলা শক্ত। ভক্তি বলত ওরা সেই রূপকথার গল্পের শীত-বসন্ত। ওদের বোধহয় মাঝে মাঝেই ভূমিকা বদল হত। পুলক/পালক যে আমাদের নিজের দাদা নয় এ কথা যে কেউ কানে ধরে বলে দিয়েছিল এমন নয়। কিন্তু কীভাবে ভাগলপুরে পালকের বাবা অত্রিবাবুর সঙ্গে আমার বাবা দুর্গাপ্রসাদের ভাব হয়, তারপর কী করে আবিষ্কৃত হয় অত্রিকুমার দুর্গাপ্রসাদের আপন মামাতোভাই, দু’জনে তখন কী রকম কোলাকুলি করেন, ইন্দ্র এবং পুলক সে সময়টা কুস্তি করতে কী রকম ব্যস্ত ছিল—এ গল্প আমাদের পারিবারিক পুরাণ যা বহুবার শুনলেও আমাদের বিরক্তি আসে না, কিন্তু অন্যদের আসতে পারে। আমাদের ধারণা ছিল সব পরিবারেই একজন পালক থাকে, যে নাকি আপন দাদা নয়, কিন্তু দাদারই মতো। কারও বাড়িতে গিয়ে আমরা যদি সে-বাড়ির পালককে আবিষ্কার করতে না পারতুম তা হলে এত অবাক হয়ে যেতুম যে সে আর বলার নয়। বাড়িতে এসে আমাদের তিনজনের মধ্যে আলোচনা হত—‘কী অদ্ভুত জানিস! দেবাশিসদের কোনও পালক নেই।’
বুবু তাতে বলত—‘য্যাঃ!’ অর্থাৎ একেবারেই অবিশ্বাস্য বলে কথাটা উড়িয়েই দিত।
চৌত্রিশ সালের কুখ্যাত ভূমিকম্পে ভাগলপুরে অত্রিকাকাবাবুদের বাড়ি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল। পালক তখন আমাদের বাড়ি পিঠে খেতে এসেছিল, তাই বেঁচে যায়। পালকের ছোট বোন ও মা বাড়ি চাপা পড়ে তৎক্ষণাৎ মারা যান। অত্রিকাকাবাবু আহত অবস্থায় হাসপাতালে কিছুদিন বেঁচেছিলেন, সে সময়েই তিনি বাবা-মাকে পালকের ভার নিতে অন্তিম অনুরোধ করেন। পালককে তাই আমরা জন্ম থেকেই আমাদের একজন বলে দেখে আসছি। পালকের নাকি এক থলি গিনি ছিল। আমাদের কোনও ভাল কাজে উৎসাহিত করবার প্রয়োজন পড়লেই পালক আমাদের তার গিনির লোভ দেখাত।
—‘ভাল করে কুচকাওয়াজ করো, তা হলে একটা গিনি দেব।
—‘যে সবচেয়ে আগে কালমেঘের রস খেয়ে নিতে পারবে (সারা জীবন) তাকে আমি উইল করে গিনি দিয়ে যাব।’
এখন, গিনি মানে যে সোনার মোহর—এ আমরা জানতুম না। আমাদের পরিধিতে গিনি বলতে বোঝাত আমাদের পাড়ার একটি মেয়ে যার রঙ খুব ফর্সা, এবং যার নাক দিয়ে সব সময়ে সর্দি ঝরত। তাই গিনি যা-ই হোক, তার ওপর আমাদের তেমন আকর্ষণ ছিল না। এ কথা পালকের জানবার কথা নয়। তাই আমাদের কুচকাওয়াজ বা কালমেঘ খাওয়ার মোটিভেশন যে কেন বেশ শক্তিশালী ও ফলদায়ী হচ্ছিল না তা সে বুঝতে পারত না।
আমরা তিনটে বোকা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতুম—‘গিনি আমাদের চাই না, বল! নাকে শিকনি, বিচ্ছিরি!’
পালকের গিনি আর পাড়ার মেয়ে গিনি যে এক নয়, সেটুকু আমরা বুঝতুম। কিন্তু দুটোর মধ্যেই একটা শিকনি-জাতীয় নোংরা ব্যাপার রয়েছে—এমনই ছিল আমাদের অস্পষ্ট ধারণা। | পালক যে আলাদা, এটা বড়দের ব্যবহার থেকেও স্পষ্ট বোঝা যেত। ঠাকুর্দা যেন তাকে একটু সমীহের চোখে দেখতেন, একটু দূরের থেকে কথা বলতেন। আর ঠাকুমা তো সবার থেকেই একটু দূরের মানুষ। পিসিমার সঙ্গে পালকের আবার বড্ডই আড়াআড়ি। সুযোগ পেলেই পালক পিসিমার পেছনে লাগত। পিসিমাও তার সমুচিত জবাব দিতেন। যেটা আমাদের কাছে সৎমা না হোক সৎ-পিসিমাসুলভ ব্যবহার মনে হত। আর মা-বাবার ব্যবহারে ছিল অঢেল প্রশ্রয়। ওঁরা যেন সব সময়ে তটস্থ হয়ে থাকতেন পাছে পালকের কোনও অযত্ন হয়। আত্মীয়স্বজন যারা জানে না তাদের কাছে তাঁরা পালকের পরিচয় দিতেন সুবোধ ঘোষের ‘সুজাতা’র সেই বিখ্যাত বাক্যবন্ধের আদলে—‘ছেলে নয়, কিন্তু ছেলেরই মতো।’ বস্তুত আমার বাবা-মা এই ব্যাপারে ছিলেন সুবোধ ঘোষ মহাশয়ের পূর্বসূরী।
বাবারা যখন ভূমিকম্প বিধ্বস্ত হয়ে সুরুলে গিয়ে স্থিত হলেন তখনও বোধহয় পালকের সম্পর্কে মন স্থির করতে পারেননি। পরের ছেলের দায়িত্ব! কী ভাবে পালন করবেন? তাঁদের ছেলেমেয়েরা তাঁদের ওপর নির্ভরশীল হলেও পুলক তো তা নয়, তার বাবার রেখে-যাওয়া টাকাকড়ি কিছু আছে। তাঁরা ভেবে-চিন্তে তাকে শান্তিনিকেতনেই দিলেন, চরিত্র খারাপ হয়ে যাওয়ার ভয় থাকা সত্ত্বেও। ছেলেটির চরিত্র-রক্ষার প্রশ্ন বড় না আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী তার লালন-পালন বড় এটা নিয়ে বাবা-মা বেশ দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। ফলে আট বছরের কাছাকাছি সময় পালক শান্তিনিকেতনে শিক্ষার সুযোগ পেয়ে গেল। সে নাকি একেবারে বদলে যায়। ছিল ভীষণ দস্যি, পাজির পাঝাড়া যাকে বলে, উপরন্তু আদুরে। শান্তিনিকেতন থেকে ফেরে খুব স্বনির্ভর হয়ে। দুষ্টু, কিন্তু আর দস্যি নয়। উপরন্তু আরও কিছু বিশেষ গুণের গুণী হয়ে ওঠে। তা সত্ত্বেও বাবারা যখন কলকাতায় চলে এলেন, তাকে নিয়েই এলেন। কেননা তাকে কলেজে পড়তে হবে, তার বাবার মতো এঞ্জিনিয়ার হতে হবে। তার বাবা আজকালকার অর্থে এঞ্জিনিয়ার ছিলেন না অবশ্য। হাতে-কলমে কাজ করে করেই তিনি ‘সাহেব’দের নেকনজরে পড়ে বেশ পদস্থ হয়ে উঠেছিলেন। শিবপুর কলেজে ছেলেকে এঞ্জিনিয়ারিং পড়াবার বাসনা তিনি হয়তো দুর্গাপ্রসাদের কাছে ব্যক্ত করে গিয়েছিলেন। আমরা জন্মে থেকেই শুনছি পালক পুল তৈরি করবে, কারখানা তৈরি করবে, পালক ময়দানবের বংশধর।
কিন্তু আই এসসি-তে প্রায় ডিগবাজি খেয়ে পালক যখন নিজে নিজেই আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে এল তখন বাবা-মা ভয়ানক ধাক্কা খেয়েছিলেন। তাঁদের ছেলে ইন্দ্র জলপানি পেয়েছে, এদিকে বন্ধুর অনাথ ছেলেটির এই রেজাল্ট? তাঁরা কি তাঁদের কর্তব্যে অবহেলা করেছেন?
কারও কাছে কৈফিয়ত যেন তাঁদের দিতেই হবে। বাবা কাঁচুমাচু মুখ করে ঠাকুর্দাকে বলছেন—‘এমন কেন হল বলুন তো! নিয়মিত টিউটরের কাছে গেছে। অঙ্কে উইক, তা ইন্দ্র তো সমানে হেলপ করেছে!’
ঠাকুর্দা—‘ঘোড়াটাকে তুমি পুকুর অবধি নিয়ে যেতে পারো দুগ্গি, জলটা তো জোর করে খাওয়াতে পারো না! পারো? তা ছাড়া…’
—‘তা ছাড়া কী?’
—‘বড্ড আশকারা দিয়েছ। ভেবে দেখো, নিজের ছেলেপিলেকে যতটা শাসন করেছ, ওকে কি তা করেছ? বাজার যাবে কে?—ইন্দ্র। ফরমাশ খাটবে কে?-সুযযি। কেন? পুলক নয় কেন? যে পরিবারে রয়েছে তার জন্যে ওকে কিছু করতে দেবে না কেন? টিউটর রইল কার? না, পুলকের। এগুলো ঠিক নয়।’
—‘আপনি বলছেন শুধু সেই জন্যেই ওর হল না?’
—‘তা নয়। তবে এটা একটা কারণ বটে। মাথা নেই। বোঝাই তো যাচ্ছে।’
পালক যে ভাল আঁকতে পারত এটা বাবারা জানতেনই না। তবে ছোট্ট থেকেই পালক আমাদের আঁকত। কার্টুন ছবি। দেখে সবাই হেসে গড়াত। আমরা যখন পেনসিল ধরতে শিখলুম তখন সে আমাদের আঁকা শেখাত। কুমড়োর ফালি সোজা করে রাখলে হাসিমুখ। আর উল্টো করে রাখলে গোমড়া মুখ হয়। আড়চোখে তাকানোর জন্যে গুলি এঁকে তার ডান দিকে কিংবা বাঁ দিকে একটুখানি করে ভরাট করে দিতে হয়। ট্যারা চোখ যদি চাও তো গুলির মুখোমুখি জায়গা দুটো ভরাট করো। খাঁদা নাকের জন্য দুটো ফুটকিই যথেষ্ট। খাড়া নাক হলে একটা সোজা লাইন দু চোখের মাঝখান দিয়ে নামাতে হবে, এ সব পালক আমাদের শেখায়। কুচো কাগজে লেড পেনসিল দিয়ে ঘিজিঘিজি করে ঘষতে হবে তারপর তাই দিয়ে আঁকার কাগজে ঘষলেই ভোর কিংবা সন্ধে হয়ে যাবে। এবার ওপরে একটা গোল সূর্য এঁকে দিয়ে রবার দিয়ে সূর্য থেকে ভোরের ঘিজিঘিজি অন্ধকারের মধ্যে পর্যন্ত সোজা পুঁছতে হবে। তা হলেই সূর্যের আলো পৃথিবীতে এসে পড়েছে বোঝা যাবে। দূর থেকে দেখা নারকেল গাছ আঁকবে? তো একটা দাঁড় লাইন আঁকো, তারপর ওপরটায় কাটাকুটি করে দাও এ-ও পালকেরই শেখানো পদ্ধতি। আরও অনেক কায়দা শিখিয়েছিল পালক, তা সমস্ত আর দেখানো যায় না! তাই ইচ্ছে থাকলেও কলম সংবরণ করলুম।
তবে আমাদের ছবি পালক যা আঁকত, সে একেবারে ফাস্টো কেলাস। কাগজের পাতায় বুবুর মুখটা পুরো ফুটে উঠল ধরুন। তার থোকা-থোকা চুল, খুদে-খুদে চোখ, খাঁদা নাক, আর ফুটো পয়সার মতো ঠোঁট সমেত। আমি ফুটে উঠলুম টলগুলির মতো চোখ, মাঞ্জা দেওয়া খাড়া চুল, খণ্ড ৎ-এর মতো কান নিয়ে, বুনবুন ঠিক আমার মতো, খালি তার চুলগুলো বেশ মেরে পাট করে দেওয়া, চোখের দৃষ্টির মধ্যে আমার যদি নিরীহ নিরীহ ভাব, তো বুনবুনের চোখ দিয়ে উঁকি মারছে ফিচলেমি। ক্যারিকেচার আঁকতো পালক দু চার টানে, কিন্তু পোর্ট্রেটও সে আঁকবে। তার জন্য তার দাবি টুলে বসে, বা জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। তবে আমরা বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকবার ধৈর্য দেখাতে পারতুম না, বসতে না-বসতেই আমাদের মশা কামড়াত, হাত-পা সুড়সুড় করত, উল্টো দিকে কী আছে দেখতে ইচ্ছে হত, ফলে আমাদের ছবি অসম্পূর্ণই থেকে যেত। কিন্তু বুজবুজদিদি তো বড় হয়ে গেছে। সে তো আর মিছিমিছি উসখুস করবে না। তাই তার একটা আশ্চর্য ছবি এঁকেছিল পালক। সুদ্ধু পেনসিল স্কেচ। সেই ছবিটা দেখলেই বোঝা যেত বুজবুজদিদি ‘তুমিও একাকী আমিও একাকী’ গান গায়, খড়কে ডুরে শাড়ি পরে, আচার খেতে ভালবাসে আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছাতে বেড়ায়।
পালক যখন জানাল সে আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে এসেছে, তখন বাবা একটু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন—‘তোমার কি ছবি আঁকার অভ্যেস-টভ্যেস আছে না কি?’
আসলে, এটাই হল শান্তিনিকেতনের সেই বিশেষ গুণ। পালকের ছবি-আঁকার ক্ষমতাটাকে বাইরে টেনে বার করা, নিজেকে চিত্রকর বলে চিনতে পারার শক্তি জাগানো। জিনিসটাকে গুরুত্ব দেওয়া। তা নয়তো, ইন্দ্রও তো মূর্তি গড়ত, সে তো শিল্পী হবার কথা স্বপ্নেও চিন্তা করেনি! পড়াশোনার বাইরের জগৎটা তার কাছে তো ছিল নেশার জগৎ, হবি-র জগৎ। সূর্যর ফুটবলকেও সে এক কথায় উড়িয়ে দিয়েছিল, বুজবুজের গানকেও। শান্তিনিকেতনে রবি ঠাকুরের ইস্কুলে রবি ঠাকুরের সেই শেষ বয়সের দিনগুলোতে পড়বার সুযোগ পেলে ই-দাদা তুমি কি অন্যরকম হতে?
পালক এবার বুজবুজের ছবিটা বাবাকে দেখায়। দেখে বাবা হতবাক হয়ে বলেছিলেন— ‘তুমি এমন পোর্ট্রেট আঁকতে পারো? এ যে ফটোগ্রাফের চেয়েও সত্যি।’
পালক তার স্কেচখাতাটা টেনে নেবার চেষ্টা করলেও, বাবা জোর করে পাতা উল্টে গেলেন। নুড ছবি। নানা ভঙ্গিতে। পুরুষ এবং নারীর। ঠাকুর্দাও দেখছিলেন। বাবা গম্ভীরভাবে খাতাটা পালকের হাতে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। পালক বলল—‘আঁকা শিখতে গেলে হিউম্যান অ্যানাটমি মানে ফর্ম শিখতে হয় কাকাবাবু।’
বাবা কিছু বললেন না।
ঠাকুর্দা বললেন—‘উচ্ছন্নে যাবার পথটি খুলে গেল। কেউ আর আটকাতে পারবে না।’
যে পালকের মুখে সর্বদা খই ফুটত, তাকে একেবারে কাঁচুমাচু দেখে আমরা ছোটরা খুবই অবাক হই।
পালক আর ইন্দ্র প্রায় প্রতি শনিবারই সিনেমা দেখতে যেত। সাধারণত ইংরেজি। টার্জান, ড্র্যাকুলা, কাউবয়েদের নিয়ে ধুন্ধুমার ছবি সব। কিন্তু মাঝে মধ্যেই তারা হিন্দি দেখতেও যেত। দেখতে গিয়ে তারা মুকেশ, মধুবালা ও লতার ফ্যান হয়ে পড়ে। কী জানি কী ছবি দেখে এসে তারা একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত ‘মহল’। মধুবালার বিউটি দু’জনকেই নির্বাক করে দিয়েছিল। তারপর লতার গান। ইন্দ্র তার দৃঢ় মত জানায়—বিয়ে যদি করতেই হয়, তবে মধুবালার মতো কাউকে, সে রকম যেহেতু পাওয়া যেতে পারে না, তাই মধুবালাকেই। পালকও ভাগ্যিস মধুবালাকেই হৃদয় অর্পণ করেনি। তার মত ছিল লতা, লতা মঙ্গেশকর নামধারী সেই স্বর্ণকণ্ঠী, নাইটিঙ্গেল কণ্ঠীকেই সে বিবাহ করবে। মধুবালা এবং লতা যথাক্রমে ইন্দ্র ও পালককে গ্রহণীয় বলে মনে করলেন কি না এ চিন্তা এদের মাথায় একবারও আসেনি। ব্যোমকেশ ইন্দ্র, কালো ফ্রেমের চশমা পড়া, ভীষণ সিরিয়াস পড়ুয়া-পড়ুয়া মুখ, গালে কয়েকটা বয়ঃব্রণের ফেলে-যাওয়া দাগ, সকাল-সন্ধে যোগাসন করে—পার্ফেক্ট পদহস্তাসন, চক্রাসন, যোগনিদ্রা, আকর্ণ ধনুরাসন ইত্যাদি—তাকে মধুবালার পাশে স্থাপন করুন! মধুবালাকে তো তার পর দিনই পড়তে বসতে হত, ফিজিক্স-কেমিস্ট্রির টেক্সট বুক, অন্ততপক্ষে নেসফিল্ডের গ্রামার, ম্যাকমর্ডির ইডিয়ম, পড়া না পারলেই ডান হাতের তর্জনীর সেই চড়াত করে চড়! আর পালক? পালক নিশ্চয় লতার প্রত্যেকটি গানের প্যারডি করে তাঁর কান ঝালাপালা করে দিত। সেই স্বর্ণকণ্ঠী অষ্টাদশীর সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী হওয়া আর হয়ে উঠত না। স্রেফ বিরক্ত হয়েই তিনি গান ছেড়ে দিতেন। এইভাবে ঈশ্বর মধুবালা ও লতাকে রক্ষা করেন। কত শত ইন্দ্র, কত শত পালকের হাত থেকে ঈশ্বরই জানেন।
তবে আমাদের প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের সৌন্দর্যবোধের আওতায় মধুবালা আসতেন না। আমার কাছে অন্তত সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠা ছিল—এক নং—টিয়াদি। টিয়াদির গায়ের রঙ কালো, বাঁ দিকে সিঁথি কাটা, চৌকো চেহারা, ঠোঁট জোড়া প্রায় আকর্ণ বিস্তৃত। ইনি ছিলেন ঠাকুমার কোনও ভাইঝি। বিবাহিতা। মাঝে মাঝে পিসির কাছে থাকতে আসতেন। টিয়াদি এলেই বাড়িতে সেলাই-ফোঁড়াই-এর ধুম পড়ে যেত। পায়ের বুড়ো আঙুলে টান টান করে পাড় বেঁধে, সেই পাড়ের সুতো বার করা হত। কাঁথা সেলাই হবে। ছাঁটাফুলের আসন তৈরির পাঠ নিত বুজবুজ-পুটপুট। অনেক লাছি উল গুটোনো হত, তাই দিয়ে দিদিরা আমাদের সোয়েটার করবে—টিয়াদিদি এসেছে। সাবুদানা, জোড়াসাপ, ছাতা, পাখা, বরফি এবং আরও অনেক জটিল প্যাটার্ন তার কণ্ঠস্থ, মুখস্থ।
আর একজন ছিল পাঁকুদি। পাঁকের মতো নরম বলে পাঁকু। পাঁকুদি ছিল অবিনাশজেঠুর মেজ মেয়ে, যার বিবাহে আমরা বরযাত্রী যাই। বিয়ের কনের সাজে তুলতুলে নরম ধবধবে ফর্সা প্রায় ভুরুহীন, কটা-কটা চোখ, একেবারেই ফর্মলেস পাঁকুদি আমাদের চোখে ছিল অপ্সরীতুল্য। অর্থাৎ রঙ, চেহারা, চোখ-নাক-মুখ এ সবের ওপর আমাদের সৌন্দর্যবোধ নির্ভরশীল ছিল না মোটেই। সত্যি কথা বলতে যে কোনও নতুন বউকে দেখেই আমার অর্থাৎ পুনপুনের অদম্য বিয়ের ইচ্ছে হত। আমার বড়মামার বিয়েতে আমরা উপস্থিত থাকিনি কিন্তু সেই মামিমা যখন বারো নম্বরে থাকতে এলেন তখন তিনি কাকে খাইয়ে দেবেন আমাকে না বুনবুনকে এ নিয়ে আমাদের মধ্যে বেশ প্রতিযোগিতা পড়ে যেত। শেষে মামিমা আর কী করেন এক থালায় ভাত মেখে দুজনকেই খাইয়ে দিতেন।
‘উচ্ছে ভাজা পটল পুরি
দই তো খুরি খুরি
সন্দেশ তো ভূরি ভূরি
এখন মাছ গোটা দুই পাই
তো কপপিয়ে খাই।’
এই মতো ছিল মামিমার ছড়া। মামিমার চুড়ি-বালা-কাঁকন-পরা হাতের গরস খাবার লোভে আমরা দু’ভাই উচ্ছেও খেয়ে নিতুম, পাকা পটলের প্যাঁটপেঁটে পেট খেতেও আপত্তি করতুম না। নতুন বউয়ের এমনি ছিল মোহ। মধুবালা-টালা আমাদের কাছে পাত্তা পেত না।
তবে হ্যাঁ ‘আয়গা আনেবালা’ গানের কথা সম্পূর্ণ আলাদা। এই গান যদি কোথাও বাজত, বিশেষত সিনেমা বাক্সওয়ালাদের চলন্ত গাড়িতে, অর্থাৎ দূর থেকে কাছে এগিয়ে আসছে, আবার দূরে চলে যাচ্ছে তিনটে ‘আয়গা’—এই ভাবে, তা হলে আমরা তিনজনে যে যেখানে আছি পড়ি-মরি করে ছুটে যেতুম, ছাতের পাঁচিলের নীচের ধাপে পা রেখে বিপজ্জনকভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুণ্ডু বাড়িয়ে দিতুম, কেননা আমাদের ধারণা ছিল, এই গানে নেতাজির আগমনবার্তা ঘোষিত হচ্ছে। এ গান মন্ত্রস্বরূপ। পুরোহিত যেমন পুজোর জলে, ঘটে সর্বত্র দেবতাকে আহ্বান করেন ‘অস্মিন জলে সন্নিধিং কুরু’, ‘ইহাসনে সন্নিধিং কুরু’ বলে লতা তেমনি নেতাজিকে ডাকছেন। তিনি আসবেনই, আসবেনই, আসবেনই—এই আনন্দবার্তা জানাচ্ছেন। এবং ওই অপূর্ব মধুর মোহময় ‘আগমনী’ ব্যর্থ হবার কোনও প্রশ্নই নেই। ‘আয়গা আনেবালা’ বহু দূরে চলে গেলে যখন বাতাসেও আর সে সুরের রেশ থাকত না, তখনও আমরা তিন ‘তেমজ’ নেতাজির আবির্ভাবের আশায় রাস্তার শেষ বিন্দু, যেখানে আনন্দ লেন নবকৃষ্ণ স্ট্রিটে মিশেছে, সেই বিন্দুর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতুম। আরও আরও আরও ঝুঁকে পড়লে পালক কিংবা ইন্দ্র কিংবা সূর্য আমাদের টেনে নামাত। সকলেই ধরে নিত গান, গানের জাদুই আমাদের এমন করে টানছে। কাউকে আমরা জানতে দিতুম না আমাদের টানছে একটা নাম, একটা আশা যার স্বরূপ আমরা বুঝিই না। আমাদের রক্তে, আমাদের হৃদয়ে অজান্তেই আমরা বহন করছি এই ত্রিখণ্ড উপমহাদেশের জনসাধারণের আশা-ভরসা।
কিন্তু ইন্দ্র-পালকের আসল কেরামতি ছিল ‘ঘরোয়া’ আর ‘কেয়া’। আইডিয়াটা হয়তো পালক শান্তিনিকেতন থেকেই পেয়েছিল। বলতে পারব না। ‘ঘরোয়া’ হল একটি মাসান্তিক বৈঠক; যাতে ঠাকুর্দা থেকে আরম্ভ করে বুনবুন পর্যন্ত সব্বাইকে উপস্থিত থাকতে হবে। এবং কিছু না-কিছু করতে হবে। বয়ঃক্রম অনুসারে নয়। যার যখন ইচ্ছে হবে, আজকালকার ভাষায় অ্যাংকর হত দাদা-দিদিরা পালা করে। ইন্দ্র, পালক, ঋদ্ধি ভক্তি পর্যন্ত। এই ‘ঘরোয়া’তেই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে স্মার্ট বুনবুন একদিন হঠাৎ লাফিয়ে উঠে আবৃত্তি করল—
‘ঠাকুর্দা গো ঠাকুর্দা
তোমার ছেলে আমার বাবা
তোমার বাবা আমার বাবার ঠাকুর্দা।
দিদিমা গো দিদিমা
তোমার মেয়ে আমার মা
তোমার মা যে আমার মায়ের দিদিমা।’
তখন বুবু তার ফ্রক ছড়িয়ে বসে দু হাত জোড় করে প্রবল হেঁড়ে গলায় গাইল—
‘প্রভু রাখিও মনে
করিলে স্মরণ’—ইত্যাদি ইত্যাদি
সেই গানের এফেক্ট বুনবুনের কবিতার চেয়েও মজার হয়েছিল। সব্বাইকার মুখ চাপা হাসিতে উদ্ভাসিত হয়েছিল। সেই উদ্ভাসন ক্রমশই দাঁত-বের-করা এবং কারও কারও উচ্ছ্বসিত হাসির ক্লাইম্যাক্সে পরিণত হয়, যখন আমি আমার স্বভাবসরু গলায় গাই—
‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে তোমারে করেছে রানি-ই।’
সব্বাই শেষ পর্যন্ত হাসিতে ফেটে পড়লে গান থামিয়ে আপাদমস্তক লাল হয়ে আমি পালাবার উপক্রম করলে ঠাকুমা আমাকে খপ করে ধরে কোলে বসিয়ে নেন, এবং আমার মুখটি নিজের কোলে গুঁজে—‘চমৎকার গান করেছ দাদা, থামলে কেন?’ বলে আমাকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন।
পালকের আঁকা এবং বুজবুজের হাতের লেখা ‘কেয়া’ পত্রিকা অবশ্য অনিয়মিত বার হত। ভক্তি বা টমদিদি ছিল তার সম্পাদিকা। সহ-সম্পাদক অংশু। বুজবুজের রোমাঞ্চকর গোয়েন্দাকাহিনী ‘সুনীল সিরিজ’ ‘কেয়া’তেই বার হয়। অংশুর ‘অদ্ভুতুড়ে’গুলোর প্রকাশকও ‘কেয়া’। সুযযির ‘সত্যি অ্যাডভেঞ্চার’ ঠাকুমার ‘ছোটবেলার স্মৃতি’, পমপমের উপনিষদের অনুবাদ এবং টমটমের রোম্যান্টিক কবিতা ছিল ‘কেয়া’র বিশেষ আকর্ষণ। পুটপুট লেখে ‘কর্তা-গিন্নি’র মজাদার কাহিনী, ইন্দ্রকে প্রচুর সাধাসাধি করে লেখা বার করতে হত, তার একটা কিম্ভুত ছড়া ছিল এই রকম:
‘ফড়েপুকুরের ধা-রে
বসে থাকে ফ-ড়ে
মাথাও যা মুণ্ডুও তা
বকের কেন হল ছাঁ
বক দেয় তা
তাই তো হল ছাঁ।’
এর চেয়ে বেশি তার কাছ থেকে বার করা মুশকিল ছিল। বেশি চাপাচাপি করলে এটুকুও দেবে না।
পরে ‘কেয়া’র পরিচালনা ও সম্পাদনা আমাদের ওপর বর্তায়। তবে সে পরের কথা।
চতুর্থ অধ্যায় : তৃণাবর্ত
স্বাধীনতা-দিবসে, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট, সন্ধে-রাত্তিরে দুর্গাপ্রসাদের ছেলে পাবন হারিয়ে যায়। এর আগের বছর কলকাতা শহরে এক ভয়ঙ্কর দাঙ্গা লেগেছিল, সবাই জানেন। আত্মরক্ষার জন্য সব বাড়িতেই ছাতে ইটপাটকেল জড়ো করা হতে থাকে। ছোট্ট পাবনও ইটপাটকেল জড়ো করছিল। বারণ করলেও শুনছিল না। শুধু পাবন কেন? তার যমজ বোন বিদ্যা ওরফে বুবু আর ভাই বরুণ ওরফে বুনবুনও সোৎসাহে হাত লাগিয়েছিল। তবে এদের এক এক জনের মনোযোগ ছিল এক এক বিষয়ে। যেমন, বুবু ব্যস্ত ছিল নাচা-কোঁদা করতে, বুনবুন লাঠি-তীর-ধনুক প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র ক্ষেপণে নিযুক্ত ছিল। ইটপাটকেল কুড়ানোয় সবচেয়ে নিবেদিত ছিল পাবন। কত বিভিন্ন আকার ও আয়তনের ক্ষেপণাস্ত্র সে সংগ্রহ করেছে, তাদের রং এবং গুণাগুণ কী তার একটা হিসেবও সে রাখছিল। হঠাৎ তার হাত-পা খুব জ্বালা করতে থাকে। সে ‘জ্বলা-জ্বলা’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে তার বুজবুজদিদির কাছে আবেদন জানায়। তখন দেখা যায় তার হাতের পাতা, পায়ের পাতা বেশ কেটেকুটে গেছে। তার দাদা সুয-যি বাবার নির্দেশমতো ক্যালেন্ডুলার মলম লাগিয়ে তাকে শুইয়ে দেয় এবং পাবন প্রচুর পরিশ্রমজাত ক্লান্তি ও ‘জ্বলা’-র আরাম হওয়ায় অবিলম্বে ঘুমিয়ে পড়ে।
মাত্র একদিন আগেই তাঁর ট্রিপলেটের জন্মদিন গেছে। ঠাকুরকে পুজো দিয়ে পরমান্ন ভোগ দেওয়া হয়েছে। আর সেইদিন থেকেই এমন রক্তারক্তি কাণ্ড? চতুর্দিকে সন্ত্রাস! দুর্গাপ্রসাদের মন খুব খারাপ। পেছনে দু হাত দিয়ে পায়চারি করছিলেন তিনি। মাত্র কিছুক্ষণ আগেই একটু ঘুরে-ঘেরে এসেছেন। দেখেছেন সাধারণ নিরীহ ভদ্র পরিবারের কোমলমতি তরুণ দলও কীভাবে প্রাণের ভয়ে, খুন করতে বাধ্য হয়ে রক্তের-স্বাদ-পাওয়া নেকড়ের বাচ্চায় পরিণত হচ্ছে। এই সময়ে ঘুমন্ত পুত্রের দিকে তাঁর নজর পড়ে। মায়ের বুকের কাছে ছোট্ট বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে পাবন। মাথা এক দিকে কাত, চোখের জল গালের ওপর শুকিয়ে মুখখানি শীর্ণ দেখাচ্ছে। দু হাত দু দিকে ছড়ানো। একটি মায়ের বুকের ওপর, আর একটি পার্শ্ববর্তী বালিশে। পা দুটি কিন্তু জড়ো করা। হাতের তালুতে, পায়ের পাতার ওপরে রক্ত ফুটে রয়েছে তুলোর ওপর দিয়ে।
দুর্গাপ্রসাদ ইশারায় এই দৃশ্যটির দিকে স্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। স্ত্রী শিউরে উঠে বললেন— ‘যা দেবার সব দিয়েছ তো?’
—‘লেডাম পল দিচ্ছি, টিট্যানাসের ভয় নেই।’
—‘কী জানি বাবা, চারদিকে যা পচা মড়া, বাতাসে কত কি রোগের জীবাণু ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
ডাক্তার ভাবুক মানুষ। ধর্মপ্রাণ। সেই ধর্ম যার খোঁজে মহাভারত হন্যে হয়ে গিয়েছিল। এক দিকে বিজ্ঞান বাস্তব, অপর দিকে পুরাণ অতিবাস্তব দুইয়েরই কেমন অদ্ভুত একটা মিলমিশ রয়েছে তাঁর বিশ্বাসে। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। যা তিনি স্ত্রীকে দেখাতে চেয়েছিলেন, স্ত্রী তা দেখতে পাননি। মহামায়ার অংশ এরা। অপরকে যেমন, নিজেকেও তেমনি ভুলিয়ে রাখতে কি এদের জুড়ি আছে? মাতা মেরীর ইম্যাকুলেট কনসেপশনে তাঁর বিশ্বাস নেই। যিশু মেরী-যোসেফের বিবাহপূর্ব-প্রণয়কালীন সন্তান। যিশুর জন্মের এমন ব্যাখ্যাই তিনি মানেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী যে গর্ভাবস্থায় নূপুরধ্বনি শুনতেন, চন্দনগন্ধ পেতেন তা কি তিনি ভুলে গেলেন? এই তো সেই সময়! চতুর্দিকে অরাজকতা, ঘৃণা, নৃশংসতা, মানুষ আর মানুষ নেই, রক্তলোলুপ হিংস্র দানবে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের ভাগ্যবিধাতাগণ স্বার্থান্ধ। রোমের অধীনতায়, ইহুদি ভুলে গেছে তার জাতীয় ঐতিহ্যের শুদ্ধতা। এই সময়েই তো মসিহা আসেন। ধনী সাদ্দুকি, ফরিসিদের ঘরে তো নয়। সামান্য ছুতোরের ঘরে। ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, জমিদারের ঘরে নয়, সাধারণ গ্রাম্য পুরোহিতের ঘরে জন্মেই তো গদাধর পৃথিবী জয় করেছেন! পড়তি বংশ, সংগ্রাম, যাতনা, কারাগার … এই তো তাঁর আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট? ‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত! …’ এই ধর্ম কোনও আনুষ্ঠানিক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম তো নয়! কৃষ্ণ তো বলেননি এই দেবতা কী ওই দেবতার পূজা করছে না বলে কেউ উচ্ছন্নে যাচ্ছে! তিনি স্থিতপ্রজ্ঞর কথা বলেছিলেন। যোগস্থ হওয়ার কথা বলেছিলেন। সে সময়ে ইন্দ্র, সূর্য, অগ্নি ইত্যাদি শক্তির পরোৎকর্ষকে শ্রদ্ধা করত ভারতের মানুষ। কিন্তু এঁরাও তো বলে দিতে পারতেন না কখন কী করণীয়! এঁদেরও কেউ পরম বলে মানত না! পরাক্রান্ত, কিন্তু পরম নয়। ধর্ম বলে এক অস্পষ্ট দেবতার কথা ‘মহাভারত’ বলেছে, কিন্তু তাঁর পুত্র বলে পরিচিত যুধিষ্ঠিরকে বারবার দাঁড় করিয়ে দিয়েছে উভয় সঙ্কটের সামনে। মিথ্যা বলিয়েছে, ক্ষমা করেনি সেই মিথ্যা। ক্ষমা করেনি তো কৃষ্ণেরও অপরাধ! মিথ্যাচরণ করতে বাধ্য করেছে তাঁকে। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য মিথ্যাচরণ। এন্ডস এবং মিনসের মধ্যে সামঞ্জস্যের সেই চিরায়ত প্রশ্ন তুলে ধরেছে, অভিশাপ দিয়েছে কৃষ্ণকে, কৃষ্ণের বংশকে! বিদুর, যুধিষ্ঠির, কৃষ্ণ, কৃষ্ণা, অর্জুন, গান্ধারী এঁদের সবার চোখ দিয়ে, মস্তিষ্ক ও হৃদয় দিয়ে ‘মহাভারত’ ধর্ম খুঁজেছে। কোন মহাসংকটে কী করা উচিত। প্রচলিত আইন বড় না বিবেক বড়? গোষ্ঠী বড় না মনুষ্যত্ব বড়? অধিকার বড় না কর্তব্য বড়? এত বড় দ্বন্দ্ব, এমন দুর্মীমাংস্য উভয়সঙ্কটের কথা কে আর কবে কোথায় বলেছে?
সত্য কথা বলো তো মুসলমান, যখন পাকিস্তান চাও তোমার মধ্যে দীর্ঘদিনের মুঘল-তুর্কি শাসকের দৃঢ়মূল সংস্কার কাজ করে না? ১৮৫৭-র বিদ্রোহেও তোমাদের অশক্ত শেষ মুঘল বাহাদুর শা’র কথাই মনে হয়েছিল, কেন? এ কি সেই মুঘল সাম্রাজ্যবাদেরই তলানি অহমিকার হুংকার নয়? লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান? এ তো ‘বিনাযুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’রই রকমফের! গান্ধী তুমি কি যুধিষ্ঠির? লক্ষ্য এবং উপায়ের শুদ্ধতায় নিঃসংশয় হয়ে এসেছ এবার? বল্লভভাই তুমি গোঁয়ারগোবিন্দ ভীম বটে, আর নেহরু? তুমি কি এখনও রয়ে গেলে দ্বিধাগ্রস্ত, অস্ত্রভীরু অর্জুনের ভূমিকায়? তা হলে এই মহাভারতে কৃষ্ণ কোথায়? কোনও বিবর্তিত কৃষ্ণ, যার লক্ষ্য থাকবে উপায় ও লক্ষ্যের সুষ্ঠু সামঞ্জস্যবিধান করা? কৃষ্ণ এখন জার্মানিতে, জাপানে, রাশিয়ায়, ইতিমধ্যে কপটদ্যূতে বাজি রাখা হচ্ছে বাংলা-পঞ্জাবের ভাগ্য। তবে কি ওই ‘সম্ভবামি’ একটা অনুপ্রাণিত দিব্য মুহূর্তের ভবিষ্যদ্বাণী নয়? সৎ-সাহস জোগাবার একটা ভঙ্গিমাত্র? না কি বেমালুম আত্মম্ভরিতা?
কিন্তু একটা কথা। ‘মহাভারত’-এ তো জনগণের কোনও ভূমিকা ছিল না! তাদের রাজা যা করবে, তাদেরও তাই করতেই হবে। তারা নারায়ণী সেনা, দুর্দান্ত মার্সিনারি সৈন্য দল, তারা সংশপ্তক-সুইসাইড-বম্বার। বিরাট বিরাট সমরযজ্ঞে তারা হয়তো সরবরাহক, সেবক, হয়তো ভেরীবাদক। নানা কাজে নিযুক্ত, কিন্তু যুদ্ধটা রাজস্বার্থের জন্যই। দুর্যোধনের রাজত্বেও তারা সুশাসনে ছিল, যুধিষ্ঠিরের রাজত্বেও তারা সুশাসনেই থাকবে। নীতির বিশেষ কোনও বদল হবে না। কিন্তু এ উপমহাদেশ তো এখন আর কারও পিতার সম্পত্তি নয়? যে মুহূর্তে দেশ স্বাধীন হবে, প্রত্যেক ব্যক্তি যে যেখানে দাঁড়িয়ে সে অন্তত সেইখানে স্থিত হবার অধিকার যদি না পায়, তা হলে স্বাধীনতা কী? কার স্বাধীনতা? আমার বাপের বাড়ি কিশোরগঞ্জে, কত পুরুষ ধরে এখানে আমার বাস, হঠাৎ মূর্খ সাহেবের এক কলমের খোঁচায় আমি উৎখাত হব? আমার নাম আসাদুল্লা, মুর্শিদাবাদে মুর্শিদকুলী খানের সময় থেকে বাস করে আসছি, আজ জিন্নাসাহেব বলবেন— ‘এসো, এসো, এই করাচিতে না হোক ঢাকা-বিক্রমপুরেই তোমার জন্যে দুধ-ভাত রাখা আছে।’ হায় এই শান্তিপ্রিয় মহামূর্খদের প্রতিনিধির দরকার হয়। কে আত্মপ্রতিনিধি, আর কে অপর সকলের প্রতিনিধি বোঝবার কোনও উপায় থাকে না। তাই নেতা আসে, আর নেতা এলেই ভিন্ন চেহারায় ফিরে আসে রাজতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র, পুরোহিততন্ত্র।
শায়িত পাবনের ভঙ্গিতে ও চেহারায় ক্রুসবিদ্ধ যিশুর আদল দেখেও দুর্গাপ্রসাদের শুধু মসিহার একাদশ আবির্ভাবের আশাই হতে লাগল। ক্রুসের আশঙ্কার দিকটা তিনি তলিয়ে ভেবে দেখলেন না। আর সেই পাবন যখন ১৯৪৭-এর ১৫ই আগস্ট সন্ধে-রাত্তির হারিয়ে গেল, তখন তিনি কপালে করাঘাত করে স্বাধীনতাকে অভিশাপ দিতে লাগলেন। স্বাধীনতা তাঁর যিশুপ্রতিম পুত্রকে কেড়ে নিয়েছে।
ঘটনাটা ঘটেছিল এইরকম।
দুর্গাপ্রসাদের স্ত্রী আবদার ধরলেন চারদিকে কেমন উৎসব হচ্ছে দেখতে যাবেন। সকাল-সকাল রান্না-বান্না সেরে বাচ্চাদের খাইয়ে বার হতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ উৎসব দেখে ফেরা। কিন্তু দুর্গাপ্রসাদের মত হল না। তিনি রাগত কণ্ঠে বললেন— ‘তোমার কি ভীমরতি হল? এর নাম স্বাধীনতা? ছিঁড়ে কেটে দেশটাকে তিন টুকরো করে, নিরীহ মানুষগুলোর রক্তে রক্তগঙ্গা বইয়ে স্বাধীনতা? স্বাধীনতা মাই ফুট। নেহরু হ্যাজ ফেইলড আস, গান্ধী হ্যাজ ফেইলড আস। তিনি অনশন করতে পারতেন না? আমাদের সবাইকে অনশনের ডাক দিতে পারতেন না? এমন কি সুভাষবাবুর ওপরও আমি আর আস্থা রাখতে পারছি না। যে সুভাষবাবুকে আমি চিনতুম, তিনি এমন হেরে যাবার পাত্র ছিলেন না। হয় তিনি সত্যি মারা গেছেন, নয়তো ইংরেজ তাঁকে লোপাট করে ফেলেছে। এদিকে এরা সবাই মিলে স্বাধীনতার নামে আমাদের একটি অশ্বডিম্ব উপহার দিয়েছে। এর আবার উৎসব? জলুস? আমি এর মধ্যে নেই।’
স্ত্রী বললেন—‘সে তুমি যাই বলো, মানুষের জীবনে এরকম দিন একবারই আসে। যাব না?’
তিনি হঠাৎ কী রকম স্বাধীনা স্বাধীন হয়ে গেলেন। দিদিমণি ও সেজমাকে সঙ্গে নিলেন। ঋতি-অংশু দু ভাইবোনকে সঙ্গে নিলেন। বড়দের কাউকে বললেন না, সাধলেন না। পাবনকে নতুন চাকর খড়ধারীর কোলে দিয়ে মুগার ধাক্কা-দেওয়া লালপাড় শাড়ি পরে বেরিয়ে গেলেন।
চতুর্দিকে আলোয় আলো, বাড়ির ছাতে ছাতে তেরঙা পতাকা উড়ছে। বাজি পুড়ছে। দলে দলে লোক আনন্দে মত্ত হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে আর যাকে পাচ্ছে, বিশেষ করে ধুতি-পরারা ফেজটুপি দেখলেই আর ফেজটুপিরা ধুতি-পরা দেখলেই আলিঙ্গন করে আনন্দাশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে।
মনো বললেন— ‘ভিরকুট্টি! এমন ন্যাকা জাত আর দুটো নেই দুনিয়ায়।’
মনোমোহিনী বললেন— ‘আমায় বেলেঘাটায় নিয়ে চলো বউমা, আমি মহাত্মাকে জিজ্ঞেস করে আসি একবার—এ তিনি কেমন করে বরদাস্ত করছেন। নোয়াখালি তো তিনি স্বচক্ষে দেখে এসেছেন।’
শাশুড়ি-ননদকে সামলাতে দেবহূতি একেবারে নাজেহাল।
মাঝে মাঝেই খোলা ট্রাক ভর্তি দলকে দল হইহই করতে করতে যাচ্ছে। গোলাপজল বর্ষিত হচ্ছে পথচারী জনতার ওপর। লাড্ডু বিতরণ করছে কোনও ট্রাক। কোনও ট্রাক হাতায় করে খিচুড়ি পরিবেশন করতে করতে যাচ্ছে।
— ‘পুনপুন দ্যাখ, কী সুন্দর স্বাধীনতা লেখা হয়ে যাচ্ছে হাউইয়ে!’ কই পুনপুন? খড়ধারীই বা কই? প্রচণ্ড ভিড় রাস্তায়। যথাসাধ্য খোঁজাখুঁজি হল। পাবন সমেত খড়ধারী উধাও। রাস্তার মাঝখানে দেবহূতি দাঁড়িয়ে পড়লেন। ‘পাবনকে না নিয়ে আমি আর এক পা-ও যাব না। তিনি কাঁদো-কাঁদো মুখে বললেন। পেছনে হেদুয়ার জলে আলো ঝলকাচ্ছে, বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে বাড়িতে আলো জ্বলছে-নিবছে। ঋতি অংশু খোঁজাখুঁজি করছে। দুই মনো থমথমে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে। বিবেকানন্দ রোডের দিক থেকে উদভ্রান্ত খড়ধারীকে আসতে দেখা গেল।
—‘কী রে খড়ধারী? পুনপুন কোথায়? ছোট খোকন?’
খড়ধারী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল— ‘গাড়ি … গুড়া।’
অর্থাৎ সে গাড়ি এবং ঘোড়া দেখেছে। দেখে বিহ্বল হয়ে গেছে।
—‘খোকন কোথায় রে?’
তখন খড়ধারী বলল— ‘হইচ্ছে।’ কী যে হয়েছে তা বোঝা গেল না।
স্বাধীনতা দিবসের উৎসব দেখে আত্মবিস্মৃত খড়ধারীকে অবশেষে যখন স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনা গেল, তখন জানা গেল খোকন অর্থাৎ পুনপুন অত্যন্ত শয়তান, ভিড় দেখে খড়ধারী তো তাকে কোলে নিয়েছিল, কিন্তু সে কিছুতেই কোলে থাকতে চায়নি, নেমে হাত ধরে হাঁটছিল। তারপর খড়ধারী এই মাত্রই হৃদয়ঙ্গম করেছে যে খোকন তার সঙ্গে নেই।
অংশু তাদের সেইখানে দাঁড় করিয়ে রেখে (কেননা তার মা নড়বেন না) পুনপুনকে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে বাড়ি গিয়ে বাবাকে সঙ্গে করে ফিরে এল। দুর্গাপ্রসাদ হাত-পা কামড়াতে লাগলেন এই ভিড়ের মধ্যে এদের খড়ধারীর ভরসায় ছেড়ে দেবার জন্য। মেয়েদের সব বাড়ি ফিরতে বলে তিনি স্থানীয় থানায় খবর করতে গেলেন। থানার বড়বাবু তাঁকে বসিয়ে রেখে একটার পর একটা থানায় টেলিফোন করতে লাগলেন। একটি বছর চারের ফর্সা ছেলে, পরনে সেলরস্যুট, মাথার পেছনের চুল খাড়া-খাড়া, কোথাও জমা পড়েছে কিনা। কোনও খবরই পাওয়া গেল না। রাত এগারোটা নাগাদ হা-ক্লান্ত, উদ্বেগে মৃতপ্রায় হয়ে বাড়ি ফিরলেন দুর্গাপ্রসাদ। পাবন যেন কর্পূরের মতো উবে গেছে। একটা দুরন্ত হাওয়া, একটা টর্নেডো যেন সবার মাঝখান থেকে শিশুটিকে শুষে নিয়ে গেছে।
সারা রাত ঘরে আলো জ্বালা। ভোর হলেই আবার থানায় ছুটতে হবে। হাসপাতালে খোঁজ চলছে এখন। ডি রতন স্টুডিওয় মিছিমিছি থামের পাশে মিছিমিছি সিঁড়িতে দাঁড়ানো পুনপুনের সাম্প্রতিক একমাত্র ফটোটি পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ফটোটি অবশ্য তার একার নয়, তিন ভাই-বোনের। বুবু-পুনপুন-বুনবুন। পুনপুনকে টিকমার্কা করে দেওয়া হয়েছে। কেননা বুনবুনের সঙ্গে তাকে গুলিয়ে ফেলা খুবই সম্ভব।
পুনপুন অত্যন্ত লাজুক ছেলে। মুখচোরা। ভিড়ভাড় সে পছন্দই করে না। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। লোক দেখলে লুকোয়। কী হবে! বিশেষত ওই গাড়ি! ট্রাক! হিস্টিরিক মানুষের উচ্ছ্বসিত ভিড়! ভোর চারটের সময়ে আবার থানায় চললেন দুর্গাপ্রসাদ, সঙ্গে ইন্দ্র, পুলক। পুনপুনের মা বুবুকে বুকে জড়িয়ে মড়ার মতো শুয়ে আছেন। অসুস্থ মেয়েকে ফেলে আনন্দ করতে গিয়েছিলেন সেই পাপেই এই শাস্তি। মেয়ে তো থেকেও নেই, ছেলেও …। তিনি আর ভাবতে পারেন না।
বৈঠকখানা থানায় একটি বাচ্চা জমা পড়েছে। না, ফটোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়নি এখনও। ইন্দ্র বলল— ‘বাবা, আপনি বাড়ি যান, আমরা দেখছি।’
পাঁচটা নাগাদ বাড়ির গলিতে ঢুকে বুক ধড়াস করে উঠল। চার নম্বরের সামনে একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে। দরজা খোলা। কম্পিতবক্ষে ভেতরে ঢুকে দেখলেন, সেজমা আর বাবা সামনে দাঁড়ানো। তাঁর বাবা। তিনি বাবার খোকন। বাড়িসুদ্ধু সব উঠোনে ভেঙে পড়েছে। সদ্য-ঘুম-ভাঙা পুনপুনকে একজন যুবকের কাছ থেকে কোলে নিচ্ছেন দেবহূতি। এক দল যুবক। এরা পার্ক সার্কাসের ছেলে সব। আনন্দ করতে বেরিয়েছিল। ছোট্ট ছেলেটিকে একা-একা রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেখে নিজেদের ট্রাকে তুলে নেয়। তারা যে-যে রাস্তা দিয়ে গেছে চেঁচিয়ে ছেলেটির কথা ঘোষণা করতে করতে গেছে। বিডন স্ট্রিট দিয়ে কর্নওয়ালিসে বেরিয়ে তারা শ্যামবাজারের মোড় পর্যন্ত যায়, তারপর সার্কুলার রোড ধরে মৌলালির মোড় হয়ে ধর্মতলা ঢোকে। চৌরঙ্গি থেকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল পর্যন্ত আবার যায়। মাঝে তারা ছেলেটিকে ক্যাভেন্টার্সের দুধ খাইয়েছে, কে সি দাসের রসগোল্লা খাইয়েছে, জলি চ্যাপ আইসক্রিম খাইয়েছে। খোকা দিব্যি খেয়েছে।
বাবার নাম জিজ্ঞেস করতে খোকা বলে— দুগ্গি। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সে তার মায়ের ভালো নাম দেবু এবং খারাপ নাম— বউমা তাও জানায়। বুবুর যে অসুখ করেছে, গলায় ব্যথা বলে ভালো করে কথা বলতে পারছে না। গেলাসকে ‘গেয়াল’ এবং কাগজকে ‘কাজক’ বলছে এ তথ্যও সে উদঘাটন করেছে। আরও জানিয়েছে বুনবুন দিদিভাইয়ের কাছে থাকে এবং দাদাভাইয়ের নাম শিববাবু। খালি ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে সে চার নম্বর আর বারো নম্বর ছাড়া কোনও তথ্য দিতে পারে না। এই ভোরবেলায় এক ঘুম দিয়ে নেবার পর তার মুখ দিয়ে বেরিয়েছে শাংপুকুর আর শিবংকর মালিক লেন। ছেলেগুলি তাই শ্যামপুকুর এলাকায় খুঁজতে খুঁজতে এই ঠিকানা শেষ পর্যন্ত পেয়ে গেছে। তারা সার্টিফিকেট দিয়ে যায় ছেলেটি খুব সাহসী, স্মার্ট, বুদ্ধিমান। দু-একবার কাঁদবার উপক্রম করেছিল ঠিকই, কিন্তু কাঁদেনি।
লোক দেখলেই খাটের তলায় লুকোনো পুনপুন সাহসী? স্মার্ট? আশ্চর্যের কথা বটে! তবে বাড়িসুদ্ধু সব্বাই এবার হৃদয়ঙ্গম করে তাদের বাচ্চারা বাড়ির ঠিকানা জানে না, ঠিকানা কাকে বলে তা-ও ভালো করে জানে না। অথচ কত কী-ই তো তাদের জানা আছে। ইংরেজ রাজত্ব করছিল, চলে গেছে, জাতীয় পতাকায় তিনটে রং আছে— কমলা, সাদা, সবুজ, মাঝখানে অশোক রাজার চক্র থাকে, ষোলো আনায় এক টাকা হয়, চার পয়সায় এক আনা, স্বাধীনতাকে বলে ইনডিপেনডেন্সডে ইত্যাকার কত কী জানে এই বাচ্চারা। খালি নিজেকে পরিচিত করবার অত্যাবশ্যক তথ্যগুলোই জানে না।
এবার যথাযথ প্রশিক্ষণের ধুম পড়ে যায়।
—‘তোমার নাম কী?’
—‘পাবন-পুনপুন সিংঘ।’
—‘বাবার নাম কী? পুরোটা বলো।’
—‘দুগগাপ্রসাদ সিংঘ।’
—‘কোথায় থাকো?’
—‘চার নম্বর শিবংকর, না, না, শিবশংকর মল্লিক লেন, পি.ও শ্যামপুকুর, থানা— শ্যামবাজার, কলকাতা—চার।’
—‘বাইরে লোককে কি মায়ের নাম বলবে?’
—‘না।’
—‘কে দিদিভাইয়ের কাছে থাকে, কার অসুখ করেছে এসব খবর কি দেওয়ার দরকার আছে?’
—‘না।’
—‘ঠাকুর্দাদার নাম কী?’
—‘ডক্টর শিবপ্রসাদ সিনা।’ অর্থাৎ বাবা সিংঘ, কিন্তু ঠাকুর্দাদা সিনা।
—‘বাবা কী করেন?’
—‘মিষ্টি-ডাক্তারি।’
—‘তার মানে? ঠাকুর্দা কী করেন?’
হোমিওপ্যাথির অভিধা যদি মিষ্টি-ডাক্তারি হয়, অ্যালোপ্যাথির অভিধা তা হলে হওয়া উচিত— তেতো-ডাক্তারি। কিন্তু পুনপুনের উত্তর হল—
—‘হুঁকো খান।’
—‘চমৎকার!’
ঠাকুর্দাদার সারা সকাল রুগি দেখা, সারা বিকেল রুগি দেখা সবই তার নজর এড়িয়ে গেল। শুধু মাঝে মধ্যে হুঁকো-খাওয়াটুকুই সত্য হয়ে রইল। অন্য কোনও কর্মই আর রইল না তাঁর। তিনি সত্যি-সত্যিই এক হুঁকোমুখো হয়ে রইলেন শ্রীমান পুনপুনের রিপোর্টে।
এইভাবে পুনপুন/পাবন স্বাধীনতা দিবসে হারিয়ে যায়, ফিরে আসে, স্মার্ট হতে আরম্ভ করে এবং বাস্তব জীবন সম্পর্কে প্রভূত জ্ঞান সঞ্চয় করে। সে যে বিপদে পড়লে ভয় খায় না, নিজের ব্যক্তিত্ব হারায় না, যেটুকু সংবাদ তার গোচরে আছে জানাতে পারে, এবং হারানো মায়ের জন্য উদ্বেগে খাওয়া-ঘুম বন্ধ করে একটা স্নায়বিক সমস্যা তৈরি করে না, এটা পরিবারের কারও কারও কাছে আশাজনক মনে হল। যেমন ঠাকুর্দা-ঠাকুমা। দাদারা দোলাচল। দিদিরা উদ্বিগ্ন। পিসিমা গালে হাত দিয়ে বললেন— ‘যার-তার হাত থেকে দুধ খেলে, মিষ্টি খেলে, দিব্যি ঘুমোলে, এ তো সব্বোনেশে ছেলে গো! যতি বলো কেন তো বদলোকের খপ্পরে পড়লে, সে লোক মন্দ কিছু খাওয়ালে? এ ছেলেকে তো ছেলে-ধরা ধরলো বলে!’
ঋতির তখন মনে পড়ে অল্পতর বয়সে পুনপুন ছেলেধরাদের কাছে যাবে বলে বায়না ধরেছিল। শুধু সব্বোনেশে নয়, কিম্ভুত ছেলে এই পুনপুন। সমস্ত ব্যাপারটা একটা পারিবারিক গল্প হয়ে রইল। একটু-আধটু রং চড়তেও আরম্ভ করল। যেমন আনন্দ লেনের বস্তির লোকেরা শ্রীমতী অন্নর মুখে একটি রোমহর্ষক কাহিনী শোনে, কীভাবে পুনপুনখোকা একদল ডাকাতকে তার মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছিল, এবং ডাক্তারবাবু এই ডাকাতদের দয়া করে কেমন ছেড়ে দেন। খড়ধারীর দেশোয়ালিরা জানল তার মনিবের ছোট ছেলের ভূতেদের সঙ্গে কাজ-কারবার আছে। সে খড়ধারীকে বিপদে ফেলবার জন্যে উবে যায়। আবার তার মাকে দুঃখে প্রাণত্যাগ থেকে বাঁচাবার জন্যে দৃশ্যমান হয়। শিবশঙ্কর লেনের পরবর্তী প্রজন্মের বাচ্চাদের পাবনদাদার মতো স্মার্ট ও সাহসী হতে উপদেশ দেওয়া হবে অল্পদিন পরেই। শুধু দুর্গাপ্রসাদ স্বাধীনতা দিবসের সন্ধেবেলা পুনপুনের হারিয়ে যাওয়া এবং ফিরে আসার মধ্যে একটা বহু-প্রচলিত কাহিনীর আদল দেখতে পেলেন। কংস সেবার পাঠায় তৃণাবর্তাসুরকে। ক্রীড়ারত যশোদাদুলালকে সে বাতাসের ঘূর্ণির রূপ ধরে উড়িয়ে নিয়ে যায়। সারা ব্রজ যখন শিশুর জন্যে হায় হায় করছে তখন দেখা যায় এক বিকট অসুরের মৃতদেহের বুকের ওপর শিশুটি তার গলা জড়িয়ে হাসছে।
তবে কি এখনও আশা আছে? এই ছেঁড়াখোঁড়া হতশ্রী দেশ, চতুর্দিকে অমঙ্গলের চিহ্ন! সুভাষ মৃত বলে ঘোষিত! তবু, তবু কি সব শেষ হয়ে যায়নি? আছে? আশা?
পঞ্চম অধ্যায় : নিও-যশোদা
মানিক আমায় ডাকছে। রোজ ডাকে। ওদের তিনতলার জানলা থেকে। তারপর দোতলার জানলা থেকে, তারপর ছাতের কোণ থেকে, তারপর একবারে একতলার দেউড়ি দিয়ে ওর চোখ টুকি করে। আমার চোখ ওদের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে ওপরে চলে যায়, আবার নীচে নামে, কখন কোথায় দেখা দেবে মানিকের কোঁকড়া মাথা, টুকি চোখ। হাতের ফণা তুলে মানিক আমায় ডাকে। আমি তো আজকাল একা-একাই থাকি। বুবুকে আমি কিল মেরেছি কিনা, শিরদাঁড়ার মধ্যিখানে ভীষণ কিল। সেই থেকে বুবুর জ্বর, বুবু শুয়ে থাকে, কথা বলে না। আমরা আর দেশবন্ধু পার্কে যাই না তো! পমপমদিদি, আমি চলে যাচ্ছি, হ্যাঁ? আমার পা এগোচ্ছে কিন্তু। শেষ রাস্তাটুকু দৌড়ে যাচ্ছে পা। মানিকের মুখে হাসি, সুযযির মতো। আগেও মানিকদের বাড়ি গেছি। বাবার সঙ্গে সঙ্গে। আমি বুবু। বাবা স্টেথোস্কোপ আটকে দেবেন পাকুমার বুকে পিঠে, দেশের কথা বলাবলি করবেন। ততক্ষণ আমরা চুপিচুপি মানিকের দিকে, মানিক চুপিচুপি আমাদের দিকে…। কিন্তু ভাব হবে না। মানিককে তো বাড়ির বাইরে দেখাই যায় না। কী করে ভাব হবে?
দেউড়ি দিয়ে ওদের চৌকো উঠোনটায় ঢুকছি কিন্তু পুটপুট। আরও একটা দেউড়ি আছে। আরও একটা উঠোন। রোয়াকের ওপর পাকুমা। এখন সবে বিকেল। চারটে বাজছে ডং ডং। পাকুমার তুলো তুলো চুল। কাঁসার বাসনে রোদ্দুর ঠিকরোচ্ছে পাকুমার গায়ে। ধবধবে সাদা বসন। গলায় ছোট ছোট রুদ্রাক্ষের মালা।
পাকুমা মানে ঠাকুমা। মানিকের বাবারও পাকুমা, মানিকেরও পাকুমা, গোবর্ধন-মোক্ষদাদেরও পাকুমা, আমারও পাকুমা হন। পাকুমা চোখে হেসে আমাকে দেখছেন কেন? আমার লজ্জা পাচ্ছে যে! বাব্বাঃ, কত ছেলেমেয়ে মানিকদের বাড়িতে! নিতুদা, সুজনদা, বাচ্ছা, খোকন, পল্টু সব্বাই কী ফিটফাট! প্যান্টের ভেতর শার্ট গুঁজে বেল্ট দিয়ে পরেছে। পাকুমা ওদের জলখাবার দিচ্ছেন। টমদিদি বলেছে কারও খাবার সময়ে সেখানে থাকতে নেই। আমি গেঁড়িগুগলি গুটি গুটি পিছু হটছি।
—‘কোথায় যাচ্ছ মণি?’ পাকুমা আমাকে খপ করে ধরে ফেলেছেন। উনি আমাকে আসনে বসতে বলছেন। টমদিদি, আমি বসব? বড়রা বললে কথা শুনতে হয়, না? কী সুন্দর বাহারি বাহারি গদি গদি আসন! রুপোর থালায় আঙুর, বেদানা, কমলালেবুর কোয়া ফুল করা, খেজুর, কিসমিস। কী সুন্দর সাজানো। নিতুদা হাসছে— ‘এবার কোথায় পালাবে?’ নিতুদা গুণ্ডামতন। চোখ টেরিয়ে মিটমিট করে হাসছে।
—‘না না। ও পালাবে না, খুব লক্ষ্মী ছেলে, বাড়িতে বলে এসেছ?’ নিজে হাতে একটা একটা করে কিসমিস আমার মুখে তুলে দেন পাকুমা আমি মাথা নাড়ি। না, না। আমি কাউকে বলেটলে আসিনি। কাকে বলব? কেউ তো আর আমার দিকে নজর রাখে না। বর্মা থেকে এক জ্যাঠাবাবু এসেছেন, তিনি চুরুট খান, সাহেব সাজেন। ঠাকুর্দা-ঠাকুমা, বাবা-মা, সবাই তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত। তাঁর বাড়ির সব্বাই মারা গেছে কি না। তাঁর বউ, ছেলে, মেয়ে স—ব। বাবা নিজের ঘর তাঁকে ছেড়ে দিয়েছেন। উনি কী খাবেন, কেমন করে সুখে থাকবেন তাই নিয়ে সবাই ব্যস্ত। আমাকে আর কেউ দেখে না তো! খালি ট্রাম-রাস্তায় যাওয়াই আমার বারণ। তাই বুনবুনের কাছে আমি যেতে পারি না। যাবই বা কেন? আমি তো খুব পাপ করেছি, শুধু বুনবুনই সে কথা জানে। আমি বুবুকে খুব মেরেছিলুম তো তাইতে বুবুর জ্বর হয়ে গেল। বুনবুন যদি সবাইকে বলে দেয়?
পাকুমা কাকে যেন ডাকছেন। ও, ও তো মানিকদের বাড়ির মোক্ষদা! —‘যাও তো, ডাক্তারবাবুদের বাড়ি বলে এসো তো খোকা আমাদের বাড়ি আছে!’
মানিকদের বাড়ি আমাদের বাড়ির উল্টো দিকে। কোনাকুনি। রাস্তার দুদিকে দুটো পেঁয়াজ-খোসা রঙের ডানা বাড়িটার। জানলা দরজায় আরশুলার পিঠের মতো রং। লম্বা লম্বা বারান্দা বাড়িটাকে ঘিরে। কিন্তু সেখানে কোনওদিন কাউকে দেখা যায় না। ঘরগুলো কী উঁচু! এরা ঝুল ঝাড়ে কী করে? মানিকের ডাকে খেলতে যাবার আগে আমি জানতুমও না, এদের পেছনে একটা অত বড় বাগান আছে। এ বাড়িটাকে সবাই বলে সিংবাড়ি। সিং-বাড়ি মানে সিংহবাড়ি। কেননা এদের ছাতের ওপরে ঠিক মাঝখানটায় দুটো পাথরের সিংহ লড়াই করে। কত যে ঘর, কত যে সিঁড়ি আর কত যে দালান! কখনও সেসব ঘরের মধ্যে যাইনি। মাঝে মাঝে পর্দা উড়ে ভেতরের কার্পেট, সোফা-কৌচ, আলমারি, বিরাট বিরাট ছবি, আর অদ্ভুত সুন্দর সব শব্দ-অলা ঘড়ি, দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের খেলাধুলো রান্নাবাড়ির উঠোনে। অনেক বাচ্চা আছে এদের বাড়ি। সবাই রোজ থাকে না। কোথা থেকে আসে, কোথায় চলে যায়। যেমন ছবিরানি। বেশির ভাগই মামাবাড়ি থাকে। এই বাচ্চারা আর লোকজন আর পাকুমা— এরা এই বাড়ির জ্যান্ত মানুষ। আর সব ছায়া। ছায়ামানুষ।
এই যে গোবর্ধন পাঁউরুটির ওপর মোটা করে মাখন লাগিয়ে চিনি দিয়ে খাচ্ছে আর ন্যাজ-মোটা বেড়ালটাকে পেসাদ দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছে, বাইধর একমনে চৌত্রিশ জোড়া জুতো পালিশ করছে আর ঝুঁকে ঝুঁকে নিজের মুখ তাতে দেখবার চেষ্টা করছে কেননা ছোট খ্যান্ত বলেছে— ‘যতখন না নিজের মুখ দেখবি, ততখন জানবি পালিশ হলনি’ আর ছোট খ্যান্ত নিজে? সে রান্নাবাড়ির রকে পা ছড়িয়ে বসে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলছে— ‘এবার উঠোনটি ঝাঁট দুব, তা পর কাপড়গুনি কাচবো, তা পর চানটি করবো, তাপর নারকোলটি কুরবো…’ আর বিরিঞ্চি ঠাকুর? সে রান্নাঘর থেকে রেগে টং হয়ে বেরিয়ে এসে বলছে— ‘মোর গুণ্ডি বটুয়া? অ মা! কে নিই গিলা? কারুচি করুচি, মু বহুৎ কাম-অ করুচি, ন দব ত তাকর সমস্তে ব্ৰহ্ম অভিশাপর জ্বলি যিবে জ্বলি যিবে—।’ তাল তাল বাটনা বাটছে অনিলা, রাশি রাশি কচুর শাক কুটছেন বামুন ঠাকরুন, ছিধর ছিদাম দু ভাই বাজার থেকে ফিরে ধড়াস করে কতকগুলো মাছ এনে ফেলল উঠোনে— ‘আজ একেবারে ধড়ফড়ে কাতলা আর চন্দনা এনেছি পাকুমা, বাগদা চিংড়িও আছে। থোড়, মোচা, চিচিঙ্গা, পটল, কুমড়োশাক, ডেঙর ডাঁটা… ফর্দ মিলিয়ে সব দেখে নিন…।’ এরা আমাদের চোখের সামনে ঘোরাফেরা করে, এরা সব জ্যান্ত। আমরা জানি বিরিঞ্চি ঠাকুরের বটুয়া বাচ্ছা চুরি করে নুকিয়ে রেখেছে, ওটা এবার তাকে বার করে দিতে হবে, নইলে পাকুমার কাছে এখুনি নালিশ যাবে, আমরা এ-ও জানি, এই যে গোটা চার বড় বড় মাছ, ধড়াস ধড়াস করে পড়ল, এবার সে-সব কাটাকুটি হবে, আমাদের কুচো কাচার দলকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। পরবর্তী খেলার মাঠ— পেছনের বাগান। পেয়ারা গাছে চড়ে দোল খেতে খেতে নিতুদা বলবে— ‘জন্তি গাছ জানিস! জন্তি গাছ! ও পারের জন্তি গাছে জন্তি কত ফলে! সেই জন্তি খাচ্ছি। তোরা সব গো-জন্তি খেতে যা!’ ডাঁশা পেয়ারায় কামড় দিয়ে চোখ বুজিয়ে সে দোল খেতেই থাকবে। আমরা দল বেঁধে এখন অ্যাডভেঞ্চারে যাব। আমি, মানিক, মিন্টু, পুতুল, বাদল, বাবুই, বাচ্ছা সব। পাকুমা রান্নাবাড়ির পেছনের দাওয়ায় এসে দাঁড়িয়েছেন। লম্বা ঢলঢলে শেমিজের ওপর গেরুয়া থান এখন, কপালে চন্দনের ফোঁটা, মাথায় ঝুঁটিবাঁধা পাকুমা। যদিও চাঁদের দেশে চরকা ফেলে নেমে এসেছেন তবু কিন্তু পাকুমা একেবারে সত্যিকারের মানুষ।
আমি পাকুমাকে ভালবাসছি। আমাদের ছাতে টবের গন্ধরাজ ফুল ফুটলেই আমি ওঁর জন্যে নিয়ে যাই। বুজবুজদিদি টমটমদিদি রাগ করে— ‘দুদিনও কি গাছে ফুলগুলো থাকতে দিবি না তুই?’
মা বলেন— ‘নিক না নিক, ও বাড়ির পাকুমার জন্যে নিচ্ছে। উনি ভালবাসেন।’
টমদিদি হেসে বলবে— ‘মা, আপনিও পাকুমা বলবেন?’
—‘ওমা, তবে কী বলব? তোরা কী বলিস?’
—‘তাই তো কী বলবে? আমরা কী বলি? ডাকবার দরকার হয় না, কিন্তু উল্লেখ করতে হলে পাকুমাই তো বলি।’
ফুলের সাজি নিয়ে নীচে নামতে নামতে আমি ভাবি— কী বোকা! পাকুমাকে পাকুমা ছাড়া আবার কী বলবে? বড়দের যে কবে বুদ্ধি হবে? আমি পাকুমাকে ‘আপনি’ বলি। মানিক কিন্তু বলে না। পাকুমা আমাদের দুজনকে বলেন—জোড়মানিক, কিংবা বলেন মণি-মানিক্য, আমি যত বলি আমি পুনপুন, পাকুমা আমি পুনপুন, পাকুমা হেসে আমায় হামি খেয়ে বলেন ‘তুমি আমার মণি-মাণিক্য, তুমি আমার সাতরাজার ধন এক মানিক।’
মানিক তখন বলে—‘আর আমি? আমি?’
—‘তোমরা যে জোড়মানিক জাদু!’
—‘পাকুমা, আমি তো তোমার নিজের, আমি বেশি না?’ মানিক বলে।
পাকুমা হেসে বলেন, —‘ঠিক আছে তুমি তাহলে চোদ্দো রাজার ধন এক মানিক।’ মানিক বেশ খুশি হয়ে যায়। আমি পাকুমার দিকে চাই। উনি চোখ দুটো একসঙ্গে চট করে বন্ধ করে একসঙ্গে খোলেন। তার মানে— মিছিমিছি। মানে সাত রাজার ধনও যা চোদ্দ রাজার ধনও তা, বেশি কম নেই। মানিককে একটু ধোঁকা দেওয়া হল আর কি!
তখন পাকুমার গল্প বলার সময় হবে, ঠিক যখন গোধূলি গিয়ে সন্ধেতে মিশবে। আমাদের খেলাধুলো হয়ে গিয়ে, ঘাম-জবজবে হয়ে গেছি, আবার ঠাণ্ডা হাওয়ায় সেই ঘাম শুকিয়ে যাচ্ছে। আমরা সবাই শরবত খাবো। মিষ্টি মিষ্টি টকটক শরবত, খেলে খুব আরাম হয়, তারপর পাকুমা আমাদের গল্প বলবেন। একেবারে সত্যি গল্প।
পাকুমার প্রথম গল্প
আমি তখন ছোট্ট এই এতটুকুনি। একটা টুনটুনি পাখির মতো উড়ে বেড়াই।
—‘পাকুমা, ছোটবেলায় আপনার পাখা ছিল বুঝি?’
—‘ছিল, ছিল।’
—‘এখন কোথায় গেল?’
—‘পিঠের ভেতর গুটিয়ে রেখেছি। দরকার হলেই বার করব। তারপর শুনবি?’
—‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন। উড়ে বেড়াতেন। … তারপর?’
—‘আমাদের দেশে ভয়ানক বর্ষা হত। বর্ষার সময়ে নদী-ডাঙা সব একাকার হয়ে যেত। জলের মধ্যে খালি ভেসে থাকত, বড় বড় গাছের মাথা। সেইসব গাছের ডাল ধরে সাপ ঝুলত। বাঁদর বুকে বাচ্চা নিয়ে বসে থাকত। আর গোরু মোষ সব ভেসে চলে যেত। আমাদের অনেকের বাড়িতেই নৌকো থাকত। সোমবচ্ছর পড়ে থাকত। বর্ষার আগে রং করে, রাঙঝাল লাগিয়ে সারাই করে, তার ভেতর বেশ কয়েকদিন চলবার মতো চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ মশলাপাতি, কাঁঠাল পাতা সব বোঝাই করা হত।’
—‘কাঁঠাল পাতা কী হত পাকুমা!
—‘বাঃ ছাগলে খাবে না? আমাদের যে তিনটে ছাগলী ছিল, আর একটা ছাগল, আর কালো-ধলো দুই ছাগল ছানা। আমার বাবার কী যেন অসুখ করেছিল বলে বদ্যি বারোমাস ছাগল দুধ খেতে বলেছিলেন তাই ছাগলী আর কালো-ধলো সবসময়ে আমাদের সঙ্গে থাকত।’
—‘নাদি ফেলে নোংরা করত না পাকুমা!’
—‘করত, কিন্তু আমরা তাদের খুব ভালোবাসতুম বলে কেউ কিছু মনে করতুম না। বাবা-মা, ভাইবোন সবাই মিলে পরিষ্কার করতুম।’
—‘নৌকোতেও?’
—‘হ্যাঁ, নৌকোতেও।’
—‘তারপর?’
—‘গোয়ালঘর হত খুব উঁচুতে। সেখানেও বেশ কিছুদিনের মতো খড়, বিচালি গাদা করে রাখা হত। গরু-বাছুরের খোঁটা আলগা করে দিয়ে তবে আমরা নৌকোয় গিয়ে বসতুম। জল একটু একটু করে বাড়ত। আর আমাদের নৌকো উচু হয়ে উঠত, শেষে ভাসতে ভাসতে আগড়ের ওপর দিয়ে গাঁয়ের রাস্তায় বেরিয়ে পড়ত।’
—‘তাহলে ভীষণ মজা হত বলো!’
—‘মজাই বটে। খুব মজা। নৌকোয় বসে আমরা মাছ ধরতুম। গামছায় করে, ছিপে করে, অনেক সময়ে খালি হাতেও এত্ত বড় মাছ ধরে ফেলতুম। রাত্তিরের অন্ধকারে আকাশ আর বানের জল এক হয়ে যেত, গলাগলি করে তারা আমাদের ঘিরে ফেলত, নৌকোয় নৌকোয় লণ্ঠনের আলো টিপ টিপ করছে, জলের মধ্যে দিয়ে বড় বড় ডালপালা সুদ্ধু গাছের ডাল ভেসে যাচ্ছে, খড়ের চাল-ছাউনি ভেসে যাচ্ছে, জলের স্যাঁতা-স্যাঁতা আঁশটে গন্ধ চারদিকে। নৌকোর খোলে মাছ ভাজা হচ্ছে। আমরা মুড়ি দিয়ে মাছভাজা খাব।’
—‘কেন? মুড়ি দিয়ে কেন? ভাত দিয়ে নয়?’
—‘ওরে বাবা, অত মাছ, সে খেয়ে একটু মুড়ি খেয়ে নিলেই ঢেঁকুর উঠে যেত। অত ভাত রাঁধবার মতো শুকনো কাঠও তো নৌকোয় তোলা যেত না।’
—‘তারপর?’
—‘তারপর আমরা মুড়িসুড়ি দিয়ে ছইয়ের মধ্যে মায়ের কোল ঘেঁষটে শুয়ে পড়তুম।’
—‘কে কে মুড়িসুড়ি দিয়ে শুতেন পাকুমা?’
—‘আমি আর আমার দুটি ভাই।’
—‘তাদের নাম কী?’
—‘তাদের নাম সরল আর সুন্দর।’
—‘আপনার নাম কী?’
—‘আমার নাম সুভগা। তারপর দেশে একবার হল প্রলয়ঙ্কর বিষ্টি। সাতদিনেও বিষ্টি থামে না, থামেই না। মঙ্গলবারে আরম্ভ হল। সবাই বলল, শনির সাত মঙ্গলের তিন।’ আর সব দিন দিন। আকাশ যেন চৌ-চাকলা হয়ে ফেটে গেছে। জল ঝরছে তো ঝরছেই। ইস্কুল বাড়ি আর জমিদার বাড়ি এই দুটো মাত্র পাকা বাড়ি। তার মধ্যে অনেক লোক আশ্রয় নিয়েছে। নৌকোতে নৌকোতে ঠোকাঠুকি হয়ে যাচ্ছে এত নৌকো। কিন্তু ঝুঁঝিয়ে জল পড়ছে, নৌকো সামলানো যাচ্ছে না। সরল-সুন্দর-সুভগাদের বাড়ি ছিল একটু উঁচুতে। নৌকোতে সবাই উঠে বসেছে এমন সময় নদীর দিক থেকে কলকল করে ডাকতে ডাকতে এলো একটা বিরা-ট ঢেউ। সেই ঢেউয়ের মুখে অনেক নৌকোই উল্টে গেল। মানুষ ঝপাঝপ জলে পড়ছে আর চিৎকার করছে। রাক্ষুসে নদীর চোরা টানে সব টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আর সকলের সঙ্গে সুভগাও জলে পড়েছিল, প্রাণপণে সাঁতার দিয়ে নদীর উল্টো দিকে আসবার চেষ্টা করছিল। চেষ্টা করতে করতে তার যেন মনে হল দম বন্ধ হয়ে আসছে, বুকে ভীষণ লাগছে, চোখে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সামনে দিয়ে কী একটা ভেসে যাচ্ছে সে প্রাণপণে সেটাকে চেপে ধরে তার ওপর উঠল, তারপরে অজ্ঞান হয়ে গেল।’
—‘কে অজ্ঞান হয়ে গেল পাকুমা?’
—‘সুভগা।’
—‘আর তুমি?’ মানিকের চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে।’
—‘আরে আমিই তো সুভগা রে পাগলা।’
—‘তারপর?’ রুদ্ধ নিশ্বাসে আমি বলি।
অজ্ঞান অবস্থায় সুভগা শুনতে পেল কারা যেন কত কী কথা বলাবলি করছে। একজন বলছে— ‘আহা আহা সুভগা না অভাগা, কী হাল হল দেখো দেখি মেয়েটার?’ আর একজন বলল— ‘না না, দেখোই না, শেষ পর্যন্ত কী হয়। এত বড় পৃথিবী, তাতে এত মানুষজন, এত কাজকর্ম, এত যজ্ঞি চলছে দিনরাত্তির, এইটুকু একটা ছোট্ট মেয়ের কিছু উপায় হবে না?’ আর একজন বলল— ‘পৃথিবী তো মস্ত বড়। কিন্তু তাতে যে ক্রমশই স্থানের অকুলান হচ্ছে গো! কে আর এখন কার কড়ি ধারে!’ সারা রাত এইরকম ফিসফিসুনি চলল। ভোর রাতে যখন জ্ঞান ফিরল সুভগা দেখল সে একটা কুঁড়েঘরের চাল আঁকড়ে শুয়ে আছে, আর তার হাতের কাছে নেতিয়ে রয়েছে এক পদ্ম-গোখরো। ভয়ে শিউরে উঠল সে প্রথমটায়। তারপর চারদিকে তাকিয়ে দেখল শুধু জল, জল আর জল। কোথাও একটা বাড়িঘর গাছপালা কিচ্ছু নেই। পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে মানুষের মড়া, গরু বাছুরের মড়া। সে এক অতি ভয়ংকর দৃশ্য। তখন তার মনে হল কোথায় গেল বাবা-মা। কোথায় গেল দুটি ভাই সরল- সুন্দর, কোথায় গেল কালো-ধলো তাহলে সে-ই বা আর বেঁচে কী করবে? রাত্তিরের সেই ফিসফিসে কথাগুলো তার মনে পড়ছিল। অভাগা, অভাগা, সত্যিই সে কী ভীষণ অভাগা।
—‘এমন সময়ে কে যেন বলল— শোনো গো মেয়ে, আমি টের পাচ্ছি দূর থেকে একটা ভটভটি আসছে। তাতে লোকজন আছে। তোমাকে তুলে নেবে। আমাকে নেবে না। ভয় পেয়ে আমাকে মেরে ফেলে দেবে। তুমি আমাকে বাঁচাবে?’
—‘কে? কে বলছে কথাগুলো? চারদিক চেয়ে কাউকেই সে দেখতে পেল না।’
—‘এই যে গো, তোমার সামনে। এমন নেতিয়ে পড়েছি যে গলারও তেমন জোর নেই।’
সাপটা বলছে না কি? সুভগা একটু সাহস পেয়ে বলল—‘গোখরো, তুমি কথা বলছ? তা তোমাকে আমি কেমন করে সঙ্গে নেব? ওরা তো তোমাকে দেখে ফেলবে!’
—‘পাকুমা, সাপ কথা বলতে পারে? এখানে যখন সাপুড়ে আসে তখন তো সাপ খালি ফণা দোলায় আর হিস হিস করে।’
—‘কথা বলে কখনও কখনও, দেখাই যাচ্ছে।’
গোখরো বলল— ‘আমাকে তুমি তোমার পেট-কাপড়ে বেঁধে নাও। যখন সুবিধে পাব আপনিই নেমে যাব।’ ওমা! কী সর্বনেশে কাণ্ড! গোখরো সাপকে কোঁচড়ে করতে হবে? ভয়ে সুভগার বুক শুকিয়ে গেছে। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে দূরে ভটভটির আওয়াজ সে পেল। তখন যা থাকে কপালে বলে সেই পদ্ম-গোখরোকে সে তার কোমরের কাপড়ের ভেতরে খুঁজে নিল। জলে ভিজে ভিজে সমস্ত অঙ্গ অবশ। কোমরের কাছটা যেন হিম! দেখতে দেখতে ভটভটি এসে গেল। তার ওপর মানুষজন, সুভগা প্রাণপণে হাত নাড়ছে। একজন চেঁচিয়ে বলে উঠল— ওই তো চালের ওপর একটা বাচ্চা মেয়ে। ভটভটির ঢেউয়ে চাল ভীষণ দুলতে লাগল, তখন একটা মোটা দড়ি ওরা সুভগার দিকে ছুঁ-ড়ে দিল। সেই দড়ি ধরে কোনওমতে ভটভটিতে উঠে, সুভগা অজ্ঞান-অচৈতন্য। কিন্তু তার হাত দুটি কোমর আঁকড়ে আছে।
—‘গোখরোর জন্যে? পাকুমা?’
—‘আবার কী!’
আস্তে আস্তে তার জ্ঞান হল, রিলিফ-ক্যাম্পে শুকনো কাপড়, খাবার সব মিলল। চারদিক থেকে বানভাসা মানুষজন কত এসে উঠছে। কোথাও সরল নেই, সুন্দর নেই, মা-বাবা নেই। গাঁয়ের পরিচিত দু-একজনকে সে দেখতে পেল, কিন্তু তারাও কোনও খবর দিতে পারল না। একদিন সন্ধেবেলায়, ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে সুভগা একটু নিরিবিলি দেখে বসেছে, রেল-লাইনের ধারে একটা শিরিষ গাছে ঠেস দিয়ে। হঠাৎ তার কোমর থেকে সড়সড় করে পা বেয়ে সেই পদ্ম-গোখরো নেমে গেল। তিন হাত দূরে ফণা মেলে দুলতে লাগল সে। সুভগা শুনতে পেল সাপ বলছে— ‘তুমি খুব ভালো মেয়ে গো, আমি তোমার ওপর খুব খুশি হয়েছি। তোমার ভালো হবে। সব হবে তোমার। স-ব হবে। খালি এই পাথরটি নিজের কাছে রেখে দাও।’ বলে সাপ ছোট্ট একটি কালো মসৃণ পাথর উগরে দিল। বলল, —‘এটি সাতরাজার ধন এক মানিক, পরশমানিক। এটা তোমার কাছে যদ্দিন থাকবে তদ্দিন…’ বলে সাপ ফণা নামিয়ে সড়সড় করে চলে গেল।
—‘যদ্দিন থাকবে তদ্দিন কী পাকুমা?’
—‘তা তো জানি না ধন! সেই সময়ে কুঝিকঝিক করে ট্রেন এসে পড়ল আর তাতে ভয় পেয়ে সাপ কোথায় লুকিয়ে পড়ল।’
—‘পরশমানিক তো লোহায় ঠেকালেই সোনা হয়ে যায়, না পাকুমা?’
—‘সে রকমই বলে বটে। তবে সুভগার পরশমানিক সে রকম ছিল না।’
—‘তবে?’
—‘সুখ-সৌভাগ্য এইসব টেনে আনত সেই পাথর। চারদিকটা আলো হয়ে থাকত, সুভগা দেখতে পেত।
—‘বাবা-মা? তাদের খোঁজ পেয়েছিলে?’
—‘তাঁরা কি আর ইহলোকে ছিলেন বাবা, স্বর্গে চলে গেছিলেন।’
—‘আর সেই সরল-সুন্দর?’
মানিক বলে—‘সুভগা মানে তো তুমি? তোমার কাছে আছে সে পাথর?’
পাকুমা নীরবে কীরকম রহস্যময় হাসি হাসতেন। বলতেন— ‘বাপ রে! এসব বিষয়ে কী আর কথা বলতে আছে? বলা বারণ।’ তিনি হাত জোড় করে কপালে ঠেকাতেন। নমো নম। আমরাও দেখাদেখি নমো করতুম।
—‘আর সেই সরল-সুন্দর?’ আমি আবার বলি।
—‘তারা আছে। কোথাও না কোথাও আছে ধন। তাদের খুঁজতে খুঁজতেই তো আমার জীবন গেল!’
—‘সেই জন্যেই তুমি মাঝে মাঝে ফিটন গাড়ি করে একা-একা চলে যাও।’
—‘ঠিক ধরেছিস।’ মানিকের গালে আলতো করে চুমো দিতেন পাকুমা। হঠাৎ রান্নাবাড়ির আলোগুলো সব জ্বলে উঠত। চায়ের কাপ, চামচের ঠুং ঠাং আওয়াজ। চায়ের সুবাসে আস্তে আস্তে ভরে উঠছে রান্নাবাড়ির দাওয়া। বড় বড় ট্রেতে করে চায়ের পট, দুধের পট, চিনি, কাপ-ডিস সব সাজিয়ে, পুতুল-অলা সুন্দর ঢাকনা দিয়ে পট ঢেকে, দোতলায় তেতলায় সব চা নিয়ে যেতে আরম্ভ করত লোকজনেরা। পাকুমা উঠে রান্নাবাড়ির দক্ষিণের ঘরে ঢুকতেন। তারপরেই শাঁখের শব্দে গমগমে হয়ে যেত সিংহবাড়ির বাতাস।
বর্ষা। আকাশে প্রথম মেঘের ডাক। আস্তে আস্তে আকাশ কালো চরাচর কালো। কালো আকাশ মুখ ঝুঁকিয়ে রয়েছে, কখন ছোট ছোট গর্তে জল জমে আয়না তৈরি হবে, সে মুখ দেখবে। বিশ্বভুবন ছায়াময়। গুড়গুড় গুড়গুড় করছে থেকে থেকে। পাখি ডাকছে। কাক। গোল হয়ে একদল পায়রা উড়ে বেরিয়ে গেল। গঙ্গাফড়িং ঢুকে এসেছে একটা ঘরের ভেতরে। কাদের জানলা থেকে মিলিত কণ্ঠে বাচ্চারা ডেকে উঠল— ‘আয় বিষ্টি ঝেপে, ধান দেবো মেপে।’ জানলার দিকে তাকিয়ে পুনপুন দেখে হঠাৎ একটা ভীষণ ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা উঠতেই চড়বড় করে দু-চারটে মস্ত বড় দানার মতো বৃষ্টি ঝরে পড়ল। চড়ুইপাখির বাসা উড়ে বেরিয়ে গেল ঘুলঘুলি থেকে। ভীষণ চেঁচাচ্ছে চড়ই। শিল পড়ছে শিল। পুটপুটদিদি দৌড়তে দৌড়তে ছাতে যাচ্ছে, বুজবুজদিদিও—‘পুনপুন, শিগগিরই আয়, শিল কুড়োব, শিল…’
‘শিল শিশিতে ভরে রেখো ঋতি-ই’—মা ডেকে বলছেন।
দমাদ্দম করে শিল পড়ে, ঝমাঝ্ঝম করে বৃষ্টি পড়ে এখন সব পরিষ্কার হয়ে গেছে। ফুটফুট করছে গাছপালা। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। বেগনি গোলাপি রং ফুটছে আকাশে। ছাতের টং-ঘরে সে মন-কেমন হয়ে বসে আছে। আস্তে আস্তে আকাশ ছাই, তারপর নীল, তারপর কালচে, খুব তারা ফোটে, খুব জোছনা হয়, ছাতের গাছ থেকে যুঁইয়ের গন্ধে ভরপুর হয়ে যায় চারদিক। নীচ থেকে দিদিদের মিলিত গলার গান ভেসে আসে— ‘শ্রাবণের গগনের গায়/ বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়’…। তার সামনে আকাশে একটা বিরাট পদ্ম-গোখরো ফণা ধরে। তার লেজ কোথায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। আস্তে আস্তে দুলছে ফণা, ফণার ওপরে পদ্ম-ছাপ। চেরা জিভ বাতাসে ঝলকাচ্ছে। ফণাটা উঠতে উঠতে চলে গেল আকাশের সবচেয়ে উঁচু ফোঁটাটাতে যেখানে সূর্যঠাকুর মাঝ দুপুরে চড়েন।
—‘তুমি খুব ভালো ছেলে পাবন, কী চাও?’
—‘বুবুকে ভালো করে দিন গোখরো-ঠাকুর।’
সাপ আস্তে আস্তে একটা চকচকে কালো পাথর উগরে দিচ্ছেন। অনেক উঁচু থেকে পড়ছে সেই পরশমানিক। পড়ছে, পড়ছে। কিন্তু যতই পড়ক, এত নিঃসীম সেই আকাশ যে পাথর যেন একই জায়গায় থমকে আছে। সে তার ঠিকোরনো আলো দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু তার হাতের নাগালে সেই পাথর কিছুতেই আসতে চাইছে না। কিছুতেই না।
রূপ-তরাসী
বুকজল ঠেলে সে এগোয়। কালো, ময়লা, ভারী জল। পাশ দিয়ে নোংরা ভেসে যায়। মড়ার হাত, মড়ার পা, ছিন্ন মুণ্ডু, খোবলানো নাক-মুখ নিয়ে বিকট মুখ ব্যাদান করে ভাসতে ভাসতে চলে যায়। সে প্রাণপণে কাত হয়ে যায়, মুণ্ডু তাকে ধরে ধরে ধরতে পারে না, নোংরা জলে হাবুডুবু খেয়ে সে আবার উঠে দাঁড়ায়। সে কিনা আধখানা, আর তার ভাইয়েরা দুজনে মিলে আধখানা। তিনজনে মিললে তবে একজন হবে, বেশির ভাগটা তার হাতে, তাই তাকে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না, চলবে না। রাক্ষসীর প্রাণভোমরা তার কাছে। সে সন্তর্পণে বুকের কৌটোয় বয়ে নিয়ে চলেছে। ভিমরুল-ভিমরুলি জীয়নকাঠি মরণকাঠি। সেই এক সোনার তালগাছ ছিল। তার ওপরে তালপত্র খাঁড়া ছিল। সেই খাঁড়া নিয়ে সে স্ফটিকস্তম্ভ ভেঙেছে, সাতফণা সাপের খোঁজ পেয়েছে, সে সাপকে বুকের ওপর রেখে এক ফোঁটাও রক্ত পড়তে না দিয়ে মারা কি সোজা কাজ? কোন ঘনঘোর ঘুমের মধ্যে সে এই ভয়ঙ্কর শক্ত কাজটা করে ফেলেছে, নইলে এই জীয়নকাঠি মরণকাঠি তার হাতে এল কী করে? এত রাক্ষস মরল কী করে? এই পাতালগঙ্গার জলে যেসব বিকট বিকট হাত পা ভেসে আসছে সেসব কি সেই রাক্ষসদেরই নয়? পাশ দিয়ে যেতে যেতে কাটা হাত আঙুল বাগিয়ে তাকে খিমচে দেবার চেষ্টা করে, কাটা পা তাদের গোছ চাগিয়ে গোড়ালি বাগিয়ে তাকে লাথি মারতে আসে, কাটা মুণ্ডু তাঁকে গেলবার জন্যে হাঁ করে। কিন্তু সে তো সার সার করে বেঁচে যায়। সে জানে এ সব-ই সেই ‘মরিতে মরিতে মরণ কামড়ি’। দাঁত বিকটী রাক্ষসী—এইবার নিপাত যাও।
সে শুধু সার সার করে সরে যেতেই পারে। বুকের ভেতরে যে রাক্ষসীর জীয়নকাঠি-মরণকাঠি এতটা পথ বয়ে আনল, তাদের তো বুকের কৌটো থেকে সে বার করতে পারছে না। পারেনি তো! তা হলে কে বার করে দিল? ও এ তা হলে সেই পক্ষিরাজ ঘোড়া। কোথায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু পক্ষিরাজের চিঁহি তো সে শুনতে পাচ্ছে না? পক্ষিরাজের তো হাতও নেই। কী করে তুলবে? মুখ দিয়ে তুলতে পারে অবশ্য। ও পক্ষিরাজ, তুমি কি তোমার অত বড় বড় দাঁতওলা মুণ্ডুটা আমার মাথার মধ্যে দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছ? দেখো আবার জীয়নকাঠি মরণকাঠির কৌটো তুলতে গিয়ে আমার ফুসফুস আমার হৃৎপিণ্ড আমার প্রাণ তোমরা তুলে নিও না। কামড়ে ধরো না দাঁতে করে!…ও তুমি? সন্নিসি ঠাকুর: সেই কবে থেকে আমার পিছু নিয়েছ? এত দয়া তোমার বুবুর ওপরে? সন্নিসি বলেন—‘সেই যে একজন দুগগি ছিল, সেই দুগগির যে একজন দুষ্টু মেয়ে ছিল, যার ঝুঁটি ঝুঁটি চুল, গুলি গুলি চোখ, মিটি মিটি হাসি, আর দুষ্টুমি ঢাকবার জন্যে ভীষণ যে গম্ভীর হয়ে যায় মাঝে মাঝে, সেই মেয়ের যে এক বাবা ছিল, সেই বাবাই আমাকে একটা ছোট্ট শিশি থেকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বার করেছে, কী করে না এসে পারব, বলো?’
—‘সে কী? দুগগি তো আমার বাবা, আর আমার বাবা-ই তো দুগগি!’
—‘তাই তো তাই।’
জল তার কোমরের কাছে চলে এসেছে। আরও ভারী এখন। পায়ের তলার মাটি ভীষণ পেছল। কাদাগোলা জলের মধ্যেও সে দেখতে পায় হাজার হাজার ছেলে হাজার হাজার মেয়ে নুড়ি পাথর হয়ে ডুব গেলে রয়েছে। সে দাঁড়ায় না। এগিয়ে চলে। পেছন থেকে কারা ডাকে—‘রাজকুমারী রাজকুমারী ফিরে চা-ও রাজকুমারী রাজকুমারী কোথা যাও।’ সে পেছন ফেরে না, কেননা সে তো রাজকুমারী নয়। আরও খানিকটা যেতে আশে-পাশে রব ওঠে—‘আমি কুঁঠে আমাকে ফেলে যেও না।’
—‘আঁমি কুঁজো বড় কষ্ট, যেও না’, কে বলে—‘আমরা কতদিন খেতে পাইনি—যেও না।’ কে বলে…। কিন্তু বললে কী হবে? সে তো জেনে গেছে এই সব কুঠে সাজা-কুঠে, সত্যিকারের কুঠে হলে এমন আর করতে হচ্ছে না। সে জানে এই কুঁজোও সাজা কুঁজো। পিঠে একটা তুলোর বস্তা বেঁধে কুঁজো সেজেছে। যে বলছে খেতে পাইনি, সে পেটপুরে খেয়ে এসেছে, কত মানুষের হাড়গোড়, মাংসমজ্জা চুষে চুষে খেয়ে এসেছে, এ সবই মায়া। তাই সে আশে তাকায় না, পাশে তাকায় না, সোজা বুকের কৌটোয় নিজের প্রাণভোমরা নিয়ে জল ঠেলতে থাকে ঠেলতে থাকে। চারিদিক থেকে দৈত্যদানা, বাঘ ভালুক, সাপ, হাতি, সিংহ, মোষ, ভূত পেত্নীতে এসে তাকে ঘিরে ধরে।
এ ডাকে—
‘হাম হুম হাঁই।
আয় তোকে খাই।’
ও বলে—
‘হুম হাম হিলি।
আয় তোকে গিলি।’
জলের তলায় বাজনা বাজে—
‘তা কাটা ধা কাটা ধাং
রাজকন্যের কেটে নে রাং।
ত্রেকেটে ধিনি ধিনি ধ্যাং।
রাজকন্যের কেটে নে ঠ্যাং।
থই থই ত্রেকেটে তা-থা
রাজকন্যের কেটে নে মা-থা।’
কিন্তু সে এখন দেখতে পাচ্ছে দূরে তীরভূমিতে ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছেন মা। সে শুনতে পাচ্ছে বাবা ডাকছেন—
চি তো তো চিত্ত চিত্ত বিনো-দন
একটু আরও কষ্ট কর আর একটু-এ-গোও ধন
বিনোদন বিনোদন।
চি তো তো চিত্ত বিনোদনচিত্ত
মৃত্যুও সনাতন জী-বনও নিত্য
তার ওপরে জী-বন বড়-ই প-বিত্র।
বড্ড পবিত্র।
বড্ড প-বিত্র…
পাড়ের কাছে পৌঁছতে না-পৌঁছতেই বাবা টেনে নেন। মায়ের কোলে সোনার খাটে গা, আর বাবার কোলে রুপোর খাটে পা সে খুব আরামে শুয়ে থাকে। চৈতন্যের মধ্যে থেকে অআকখ এক দুই তিন চার পালং টেবিলচেয়ার দেরাজ সব মুছে গেছে। মাঝে মাঝে জলের মধ্যে থেকে ঘাই দিয়ে ওঠে—ওর নাম পম দিদি না? ওই যে ওই ছেলেটা আমায় কোলে নিয়েছে ওকে বোধহয় সুযযি বলে। কে যেন চলে যায় দরজার সামনে দিয়ে চুল দুলিয়ে ও কে? পম পম টম পমটম না টমটম? টমটম একটুখানি এসো না, কিন্তু কাছে এলে সে ভয় পায়। এ বুজবুজের ছদ্মবেশে কোনও রাক্ষসী নয় তো? কি পুটপুটের বেশ ধরে সেই সাপটা? সেই রাক্ষস খোক্কস কালনাগ রাক্ষসী আর সেই নানা রকমের জ্বর তার মাথার মধ্যে অহর্নিশি হট্টগোল করতে থাকে। একমাত্র মা, বাবা, আর পুনপুন-বুনবুনকে বিশ্বাস করতে তার অসুবিধা হয় না। তবে সেই বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের কথা তো সে ভাল করে জানাবার মতো ভাষা আয়ত্ত করেনি।
অংদাদা তাকে আদর করতে এসে তার হরলিক্স খেয়ে যায়, সে কি খোক্কস নয়?— তাই সে চিৎকার করে অংদাদা ঘরে ঢুকলেই। তার চিৎকার শুনলেই বাবা চেঁচিয়ে উঠবেন—‘রে অংশু!!’ পিসিমা শুনতে পেলে বলবেন—‘হ্যাঁ রে, সেজখোকা, রোগা মেয়েটাকে না কাঁদালে তোর ঘুম হয় না, না?’ —এই কথাটা অনেকবার শুনতে শুনতে বুবু বলে—‘সেজ? রোগা না কাঁদলে তোর ঘুম নেই, না?’
পমদিদি বলে—‘আর একবার আসুক না, দেখাচ্ছি মজা! খাক না হরলিক্স। বুবুর হরলিক্স খেয়ে যাওয়া?’
বুবুও বলে—‘আসুক না, দেখাচ্ছি মজা!’
সে পুনপুন-বুনবুনের জন্যে অপেক্ষা করে। কিন্তু বুবু কালনাগকে যত ভয় পায়, পুনপুন বুবুকে তার চেয়েও বেশি ভয় পায়। সে একটা গণ্ডির আশেপাশে ঘুরঘুর করে, তার ভেতরে ঢোকে না। যেন কে মন্ত্র পড়ে দিয়েছে। দরজার চৌকাঠ থেকে সে উঁকি মারে, জানলার গরাদ ধরে সে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, মাঝে মাঝে টেরিয়ে টেরিয়ে তাকায় বুবুর দিকে, যেই বুবুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়, অমনি তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সে সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
বুবুর কেমন একটা অব্যক্ত কষ্ট হয়। কী তার হয়েছে যে, পুনপুন তার কাছে আসে না! কে বারণ করে দিয়েছে? পুনপুন কেন তার ওপর রাগ করেছে? রাগও না, রাগের চেয়েও বেশি, ঘেন্না। পুনপুন বুবুর ঘরের মধ্যে পা রাখে না! এত অভিমান হয় বুবুর যে, সে হাত তুলে ইশারায় তাকে ডাকে না পর্যন্ত। এবং যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণ পুনপুনের প্রতীক্ষা করে থাকে। যদিও মুখে তার বিপরীতটাই দেখায়। পুনপুনের নাম-মাত্র না করে সে চেঁচায়—
‘টেকন কেন আসছে না-আ-আ!’
টেকন খুব খুশি হয়ে এসে যায়। খুকি তাকে ডেকেছে, রোগশয্যায় শুয়ে। মরতে-মরতে বেঁচে-ওঠা খুকি আর কাউকে নয় তাকে, টেকনকে ডাকলো? কিন্তু টেকন এসে দাঁড়ালেও বুবুর ব্যথা যায় না, সে টেকনের হাতও মাথার ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
বুনবুন অবশ্য ব্যুহ ভেদ করে ঢুকে পড়ে। চৌকাঠের বাইরে থেকে সে হুড়ুম করে লাফিয়ে ভেতরে পড়ে।
—‘এই হনুমান সাগর পার হল।’
এবার সে আর এক লাফে টেবিলে ওঠে—‘এই হনুমান লংকার মাথায় উঠল’, তারপরে সে বুবুর বিছানায় লাফিয়ে পড়ে —‘এই হনুমান অশোকবনে এসে গেল।’
এই রকম লাফিয়ে পড়ায় তক্তপোশের বিছানায় একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং বুবু সেটা সহ্য করতে না পেরে কাঁদতে থাকে।
তখন বুনবুন—‘সীতা কাঁদছে, সীতা কাঁদছে’ বলে রে রে করে ছুটতে ছুটতে বাইরে চলে গিয়ে, এক দমে সিঁড়ি লাফিয়ে নীচে ঠাকুর্দার চেম্বারে ঢুকে যায়।
—‘সীতা কাঁদছে, সীতা কাঁদছে’— সামনে কোনও রোগী বসে রয়েছেন, বুনবুনের দৃকপাত নেই। ঠাকুর্দা অমনি রোগীর কথা ভুলে বুনবুনের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে যান—
—‘কে সীতা?’
—‘ওই যে মায়ের ঘরে যে মে’টা শুয়ে থাকে!’
—‘ও, আর তুমি?’
—‘আমি হনুমান।’
—‘তো ন্যাজ কই?’
প্যান্টের পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে পাকিয়ে পাকিয়ে টেবিলে রাখে বুনবুন।
—‘এইটুকু ন্যাজ? তা এ দিয়ে কি আর লংকা ধ্বংস করা যাবে ভাই? —হ্যাঁ কী বলছিলেন? গাল ফুলে যাচ্ছে? দেখি। দেখি…’ রুগীকে টিপে-টুপে ঠাকুর্দা বলেন—‘এ তো মাম্পস হয়েছে, দেখছি!’
—‘আমার তেতাল্লিশ বছর বয়স হল, এখন মাম্পস্?’
ঠাকুর্দা মুচকি হেসে বলেন— ‘হয়তো আপনার বয়স কমে যাচ্ছে মশাই। শিগগিরই ছেলেপুলের সঙ্গে খেলা করতে পারবেন।’
—‘ওই তো রাবণ।’ রুগিমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বুনবুন অবলীলায় ঘোষণা করে। তারপর ঠাকুর্দার কোলে উঠে, কাঁধ খামচে বলে—‘আর এই হল রাম।’ তাঁকে রামের রোল দেওয়ায় স্পষ্টতই ঠাকুর্দা খুব খুশি হয়ে যান, জিগগেস করেন—‘লক্ষ্মণটি কে?’
ঠাকুর্দার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বুনবুন চুপিচুপি বলে ‘দুগগি লক্ষ্মণ। কাউকে বলো না।’
রুগি প্রথমটা হাসে। রাবণ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় একটু অপ্রতিভ বোধ করে। তারপরে মনে মনে ভাবে— ‘এই বুড়ো ডাক্তারের কাছে আসাটাই ঝকমারি। এখন শুরু হল নাতির সঙ্গে আদিখ্যেতা।’
পুনপুন বুঝতে পারে বুবু হয়তো তার কিল মারার কথাটা অসুখের মধ্যে ভুলে গেছে। তবে তার মনে হয় সে খুব সামনাসামনি গেলে কথাটা বুবুর মনে পড়ে যেতেও পারে। কিন্তু যেটা সে বুঝতে পারে না, সেটা হল—বুনবুন ব্যাপারটা খেয়াল করেছে কি না, মনে রেখেছে কি না। একদিনও বুনবুন এ বিষয়ে তাকে কিছু বলেনি, কিন্তু বুনবুন যেমন দুষ্টু, হঠাৎ একদিন সব্বাইকার মাঝখানে বলে দিতে পারে কথাটা, তখন? তখন কী হবে? পুনপুন তাই বুনবুনের থেকেও আলাদা হয়ে যায়। মন খুলে তার সঙ্গে খেলা করতে পারে না।
তা ছাড়া বুনবুন যদি কাউকে না-ও বলে দেয়, তাতেই কি পুনপুনের পাপ যাবে? কোনও দিন যাবে না। পাপীদের নরকে নিয়ে যায়। মস্ত উনুনের ওপর মস্ত কড়ায় সেখানে মানুষভাজা হয়, যেমন কুমড়োভাজা, পটলভাজা। পুনপুনকে ঝপাং করে সেই কড়ার তেলে ফেলে দেওয়া হবে। উঃ! ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চমকে ওঠে পুনপুন। আর তার চেয়েও বড় শাস্তি হবে যদি বুবু মরে যায়। রোগা কাঠির মতো, ন্যাড়া-মাথা বুবুকে দেখলে মনে হয় সে এক্ষুনি মরে যাবে। সেদিন পাড়ার একজন জ্যাঠাইমা তাকে দেখতে এসেছিলেন, বললেন— ‘ও দেবু, মেয়ের এ কী ছিরি হয়েছে গো? ওকে বিয়ে দেবে কী করে?’
মা সে সময়ে চুপ করে দেয়ালের দিকে চেয়েছিলেন। পালক তখন এক লাফে বুবুকে কোলে তুলে নিয়ে চলে গেল। পুনপুন আতঙ্কিত হয়ে পালককে জিগগেসই করে ফেলেছিল—‘পালক, বুবুকে বিয়ে দেওয়া যাবে না? কেউ বিয়ে করবে না?’
পালক তাতে হেসে বলল—‘আরে পুঁটকে। তোর এত ভাবনা কেন? তারপরে তার চোখে জল দেখে, ঠোঁট ফুলছে দেখে পালক তাকে আদর করে বলল—‘আচ্ছা ঠিক আছে, আর কেউ বিয়ে না করলে, আমিই বিয়ে করে নেবো ওকে। তা হলে তোর দুশ্চিন্তা যাবে তো?’
কিন্তু পুনপুন ঠিকই বোঝে তার দায়িত্বটা যাচ্ছে না। পিসিমার ভাষায় সে ‘দায়িক’ থেকে যাচ্ছে বুবুর এই দুর্গতির জন্য।
ষষ্ঠ অধ্যায় : অঘাসুর
অঘাসুর নগাসুর করালবদন
সড়সড়ি আসে যেথা হাসে বৃন্দাবন।
আকাশপাতাল বিন্ধি বদন ব্যাদিয়া
যোজনপ্রমাণ দেহ রহে বিস্তারিয়া।
ল্যাজামুড়া কোথা তার জঠরকন্দরে?
দংষ্ট্রাগুলি চূড়া যেন গিরিশিরোপরে।
চক্ষুগুলি দাবানল নিশ্বাসে গরল
অঘাসুর নগাসুর ফোঁসে অবিরল।
ব্রজের রাখাল সবে খেলিতেছে খেলা
শিখিপাখা বান্ধি কেশে গলে গুঞ্জামালা।
সর্পজিহ্বে পথ ভাবি হরষ উপজে
নাগের জঠরে সবে কুতুহলে পশে॥
‘এই পুনপুন, পুনপুন, আয় না, আয়!’ —মানিক ডাকছে, পেছনে বাচ্চা, কাতু, নিতুদা, বাবুই।
—আশ্বিন মাসের দুপুরবেলা। সারা সকাল পাখি ডেকেছে, সারা দুপুর পাখি ডাকছে। শিউলি ফুটেছে মানিকদের বাগানে। ওই ফুল দেখলে আমার ভীষণ আনন্দ হয়। কিন্তু মানিক না ডাকলে আমি যাই না তো! একদিন ধরো গেলুম, খেলা করলুম, আবার দুদিন গেলুম না। তার পরের দিন মানিকের মুখটা আবার ওদের তেতলার বারান্দায় দেখা যাবে। ঝুঁকে পড়বে। —‘এই পুনপুন, পুনপুন, আয় না!’ তখন আমি আবার এক পা এক পা করে এগোই। কেন এমন করি আমি তো জানি না! ওই বাড়িটা আমার কেমন লাগে, ঠিক যেন এক ভুতুড়ে বাড়ি। রাত্তির বেলায় যেন সব জেগে উঠল। খাওয়া-দাওয়া, হই-হল্লা, নাচ-গান, আবার হঠাৎ ভোজবাজির মতো সব উবে যায়। একদিন পুটপুটদিদি বুজবুজদিদিকে ডেকে বলছিল— ‘সেজদি, সেজদি, দেখে যাও সিং-বাড়ির ছাতে ওদের মেম-বউ উঠেছে।’ বুজবুজদিদির সঙ্গে আমিও পাঁচিলের ফোকরে চোখ রেখে দেখলুম নীল রঙের গাউন পরা, বাদামি চুল, ঝাঁঝালো ফর্সা একজন সিঁদুরপরা মেমসাহেব। এক ঝলক দেখলুম তারপরই যেন হাওয়ায় উবে গেল। টমদিদি বলল—‘ছিঃ বুজবুজ, ওভাবে পরের বাড়ির দিকে দেখো না, টের পেলে কী ভাববে বলল তো! কক্ষনও ওরকম করো না।’ কিন্তু আমি ভাবলুম—করলেই বা কী! ও কি আর এ পৃথিবীর? হয় বিলেত থেকে হাওয়ায় শাঁ করে আসা-যাওয়ার মন্তর জানে, আর নয়তো এক্কেবারে খাঁটি মেমভূত।
একদিন দেখি ওদের বিরাট সাদা স্টুডিবেকার গাড়িটা এসে রাস্তা জুড়ে দাঁড়ালো। ভেতর থেকে খুব লম্বা, সাহেব-সাজা ছোট্ঠাকুর্দা মানে পাকুমার ছোট ছেলে আর কোঁচানো ধুতি গিলে-গিলে পাঞ্জাবি পরা রাঙাজেঠু মানে পাকুমার মেয়ের বড় ছেলে নেমে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন। ছোট্ঠাকুর্দা লম্বা, রোগা, টিয়ে-টিয়ে নাক, ফ্যাকাশে রঙ, চোখে সোনা-চশমা। আর রাঙাজেঠু একটু মোটা থপথপে, চোখের তলায় কালচে থলি, চিবুকের তলায়ও কয়েক থাক। কিন্তু মুখটা হাসিতে জ্বলজ্বলে। ওঁরা যেখান দিয়ে চলে গেলেন একটা ঝাঁঝালো-বুনো-বুনো গন্ধও ওঁদের পেছন পেছন চলে গেল। মানিককে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করলুম— ‘কিসের গন্ধ রে মানিক?’ বলেই বুঝতে পারলুম জিজ্ঞেস করতে নেই। কিন্তু মানিক বলল— ‘তুইও পেয়েছিস? ছোটঠাকুর্দা আর রাঙাজেঠু একসঙ্গে গেলেই আমি এই গন্ধটা পাই। কেউ একা গেলে কিন্তু পাই না। কী আশ্চর্য, না?’ আমাদের কথা শুনতে পেয়ে গোবর্ধনের ছেলে নিতাই বলল— ‘কিসের গন্ধ শুনবে দাদাবাবু? আমি জানি। কাউকে বলবে না কিন্তু। ও হল ঘোড়ার পেচ্ছাবের গন্ধ।’ আমরা কাউকে বলিনি। কিন্তু দায়ুদ মাস্টারের কানে চলে গিয়েছিল কথাটা। দায়ূদ গোবর্ধনকে দশ ঘা বেত মেরেছিল, বাগানে খেলতে খেলতে আমরা মুখবাঁধা গোবর্ধনের চাপা চিৎকার শুনতে পেয়েছিলুম। গোবর্ধন কি না দায়ুদের দেশের লোক, গোবর্ধনের ছেলে বেসহবৎ হলে তাই গোবর্ধনকে দায়ুদের হাতে মার খেতে হয়। কিন্তু ছোট্ঠাকুর্দা বা রাঙাজেঠুকেও আমরা রোজ দেখতে পেতুম না। ছোট্ঠাকুর্দা তো বাড়ির ছোট ছেলেদের চিনতেন কি না সন্দেহ।
মানিক আমাকে ডাকছে। আমি যাচ্ছি। ওদের ভেতর-উঠোন এখন কেমন ঝিমঝিমে। কাউকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আমরা লুকোচুরি খেলছি এখন। উবু দশ, কুড়ি, তিরিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি, নব্বই, শ’— এমনি করে গুনে বাবুই চোর হয়েছে। চোখ বোজ, চোখ বোজ বাবুই, আমরা সব যে যেদিকে পারি দৌড়ে নুকোচ্ছি। মানিক বলল আমি দোতলায় যাচ্ছি, তুই তিনতলায় চলে যা—বাবুই খুঁজে পাবে না।
ওদের সিঁড়িতে কার্পেট পাতা থাকে, শব্দ হয় না, আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়েছি, এমন নুকোব না! বাবুইকে আর খুঁজে-পেতে হচ্ছে না। ওরা সব সময়ে আমাকে খুঁজে বার করে আর আমাকেই তখন চোর দিতে হয়। আমি ওদের কী করে খুঁজে পাবো? এই বাড়ির কোণ-কানাচ তো আমি চিনি না! একটা পর্দা-ফেলা বেশ অন্ধকার ঘর। আমি টুক করে ঢুকে আলমারির ওপাশে নুকিয়ে পড়েছি। প্রথমটায় তো ঝোঁকের মাথায় ঢুকেছি, তার পরে ভয় হচ্ছে। বাপরে এটা কোনও ভূতের গুহা নয় তো! ভূতটা হয়তো তার হাঁ পেতে রেখেছিল আমার জন্যে। বেরোতে যাব, দেখি খাট। খাটের ওপর নতুন কাকু মানে রাঙাজেঠুর ভাই আর মানিকের এক কাকিমা। কোন কাকিমা আমি বলতে পারব না। দুজনে গলা জড়াজড়ি করে শুয়েছিলেন। মুখ তুলে নতুনকাকু শব্দ করে চুমো খেলেন ওই কাকিমাটাকে। সেই শব্দে আমি দাঁড়িয়ে গেছি। এরপর হঠাৎ কাকু কাকিমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ভয়ের চোটে আমার মুখ দিয়ে কী যেন শব্দ বেরিয়ে গেল। অমনি নতুন কাকু বলে উঠলেন ‘কে? কে ওখানে?’ বলতে বলতেই নীচে নেমে তিনি অন্ধকার কোণ থেকে আমাকে কান ধরে টেনে বার করলেন। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি। নতুনকাকু আমার কান পেঁচিয়ে বললেন— ‘ডাক্তারদের বাড়ির ছোঁড়াটা না? পাকা পকান্ন একেবারে। এখানে ঢুকেছ কেন?’ আমি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে বললুম— ‘লুকোচুরি খেলছি।’
—‘লুকোচুরি? বার করছি তোমার লুকোচুরি খেলা। বড়দের ঘরে ঢুকে ইয়ার্কি?’ বলে একটানে আমার হাফ-পেন্টুল খুলে আমাকে আলমারির মাথায় তুলে দিলেন। শাসিয়ে বললেন— ‘যদি টুঁ আওয়াজ করিস টুঁটি টিপে মেরে ফেলব।’ বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে নতুন কাকু চলে গেলেন। এখন আমি কী করে ছাড়া পাই? সারা জীবন মানিকদের বাড়ির অন্দরমহলের তেতলার ঘরের আলমারির মাথায় শুকিয়ে মরব? অনেক, অনেক কাল পরে আমার ছোট্ট কঙ্কাল এখান থেকে পাওয়া যাবে? ‘কাকিমা আ’আমি কান্না গলায় বললুম। ওই কাকিমা যাঁকে আমি খুন হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচালুম তাঁকেই আমি ডাকছি। কিন্তু কী আশ্চর্য, ঘরের মধ্যে তো কোনও কাকিমা নেই! ছাত থেকে যেমন মেম-বউ উঠে গিয়েছিল, ঘর থেকেও কাকিমা তেমনি একেবারে অদৃশ্য, তবে কি ভুল দেখেছি? এ-ও কি ভূতের কারসাজি?
অনেকক্ষণ পরে ভয়ে ভয়ে কিন্তু যৎপরোনাস্তি কাতর গলায় ডাকলুম—‘পাকুমা-আ।’ তারপরে আরও জোরে, গলায় কান্না মিশিয়ে—‘পাকুমা-আ!’ তারপর একেবারে কেঁদে ফেলে ভেউ ভেউ করে ‘পাকু ম্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ।’
ঘরের দরজা খুলে গেল।
বিকেলের পড়ন্ত আলো পেছনে নিয়ে পাকুমা দাঁড়িয়ে। অন্ধকারে তিনি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না। আমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছি। বরাভয়দাত্রী দেবী দুর্গা স্বয়ং যেন বা। যদিও তাঁর হাতে প্রহরণ নেই, তাঁর আলুলায়িত কেশ একেবারে ধবধবে সাদা। পরনে সাদা থান, বৃদ্ধ মুখ। সুইচ টিপে তিনি আলো জ্বাললেন। আমি এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। পেছন থেকে তীরবেগে নতুনকাকুর প্রবেশ। তিনি আমাকে আলমারি থেকে নামিয়ে নিলেন।
পাকুমা বললেন— ‘এ কী কাণ্ড নতুন? ও এখানে কী করে এলো?’
—‘আরে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে ঢুকবি তো ঢোক একেবারে বাঘের গুহায় ঢুকে বসে আছে। তাই বাঘ একটু রসিকতা করছিল।’
—‘এ কী রকম রসিকতা নতুন? ছোট শিশুর সঙ্গে?’
—‘ছোট শিশু? পরের জন্মে ও আবার ছোট শিশু হবে।’
—‘ওর প্যান্ট কোথায়? তুমি খুলে দিয়েছ? ছি! ছি!’
নতুনকাকু জিভ কেটে বললেন— ‘দিব্যি গেলে বলছি পাকুমা আমি খুলিনি, ছোঁড়াটা এমন আলগা পেন্টুল পরে এসেছে যে যেই আলমারির মাথায় তুলতে গেছি, খোসার মতো পেন্টুলটা পড়ে গেল।’
নতুনকাকু খুঁজেপেতে আমার প্যান্টটা বার করলেন— ‘আয় পরিয়ে দিই।’
প্যান্টটা তাঁর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে পাকুমা বললেন, ‘মিথ্যে কথা বলো না নতুন, তোমার স্বভাব আমি জানি।’
পাকুমার পেছন থেকে তীব্র একটা দৃষ্টি হেনে আমাকে শাসিয়ে নতুন কাকু দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন। ফোঁপাতে ফোঁপাতে পাকুমার কাছে প্যান্ট পরে নিয়ে আমি সিঁড়ির দিকে দে-দৌড় দিলুম।
কিন্তু নতুনকাকুর হাত থেকে অত সহজে রেহাই পাই কি আমি? আমরা আর তো ওপরে যাইনি। বাগানে খেলি, উঠোনে খেলি, কিন্তু যেখানেই খেলি নতুনকাকু ঠিক কোথা থেকে উদয় হন। লাল ঠোঁটে হাসি নিয়ে লালচে মুখ ঝাঁকিয়ে আমাকে হাত নেড়ে নেড়ে ডাকেন তিনি। নিতুদাদা বলে—‘নতুনকাকু কতক্ষণ ধরে তোমাকে ডাকছেন পুনপুন, যাও না। বড়দের কথা শুনতে হয় জানো না?’
আমি পায়ে পায়ে পিছিয়ে যাই, আর নতুনকাকু পকেট থেকে একটুখানি বার করে হার্সেস চকলেট দেখান। —‘দেব, আমার সঙ্গে আয়।’
আমি পেছন ফিরে দৌড়তে যাই। তখন হঠাৎ খপ করে আমাকে পাঁজাকোলা করে নতুনকাকু দৌড়ন। পেছনে আমার খেলার সাথীরা মজা পেয়ে হাসতে থাকে। আমি হাত-পা ছুঁড়ছি। কিন্তু চিৎকার করতে পারছি না। আমার মাথাটা নতুনকাকুর পেটের ওপর প্রচণ্ড জোরে আটকে আছে। পেছনের ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে একেবারে সেই তিনতলার ঘরে নিয়ে গেলেন নতুনকাকু। দরজা বন্ধ করে দিচ্ছেন। আমি হাঁ করছি। নতুনকাকু দৌড়ে এসে আমার হাঁ বুজিয়ে দিচ্ছেন।
—‘ভয় পাচ্ছিস কেন? একদম ভয় পাবি না। আমি একটা ভীষণ ভা-লোক। আর তুই ভী-ষণ ভা-ছেলে। নয়? মোটেই তোকে আলমারির ওপর তুলে দেবে না ভা-লোকটা। বলতে বলতে তিন-চারটে চকলেট আমার হাতে গুঁজে দিচ্ছেন নতুনকাকু।
—‘মৌরি লজেন্স খাবি? টফি? দাঁড়া।’
পকেট থেকে রঙিন কাগজে মোড়া কান মোচড়ানো টফি বার করতে লাগলেন নতুনকাকু, আর ঠোঙা ভর্তি মুড়ি লজেন্স। তাদের নীল, লাল, হলুদ, গোলাপি, বেগুনি রঙে আমার চোখে ধাঁধা লেগে গেল। তা হলে নতুনকাকু আমায় ক্ষমা করে দিয়েছেন! তা ছাড়া আমিও তো ভোজবাজিই দেখেছি। নতুনকাকু তা হলে একটা ভী-ষণ ভা-লোক? অনেক সাধ্য-সাধনার পর সেই মুড়ি লজেন্স মুখে দিয়ে তার সুগন্ধে বিভোর হয়ে আছি। নতুনকাকু বিদ্যুদ্বেগে আমার প্যান্ট খুলে নিলেন। আমি নিচু হয়ে নিজেকে ঢাকতে গেছি, নতুনকাকু হেসে বললেন— ‘তোর জন্যে সুন্দর প্যান্ট এনেছি, মিকিমাউজের ছবি দেওয়া গেঞ্জি এনেছি হগ মার্কেট থেকে, এই প্যান্টটা ডাক্তারবাবু কোত্থেকে কিনেছে? তোর মতো সুন্দর ছেলেকে মানায়? এই দ্যাখ’ বলে স্পঞ্জের মতো কেমন একরকমের কাপড়ের অদ্ভুত সুন্দর একটা লাল রঙের প্যান্ট, আর হলুদ রঙের মিকিমাউজ আর ডোনাল্ড ডাক ছাপ দেওয়া হাত-অলা গেঞ্জি বার করলেন তিনি। আমি কেন নতুনকাকুর প্যান্ট নেব? এ রকম নিতে নেই। কিন্তু নতুনকাকু দেবেনই। তাঁর সঙ্গে কি আমি জোরে পারি? প্যান্টটা আমাকে পরাতে পরাতে নতুনকাকু প্যান্টের নীচে আমার ছোট্ট চুটকিটা হাতড়াতে চটকাতে লাগলেন, আমার গা সিরসির করতে লাগল। আমি হাঁ করে চ্যাঁচাতে যেতেই তিনি আমার মুখে সশব্দে একটা চুমো খেলেন। আর ফোঁস ফোঁস করে বলতে লাগলেন— ‘জিনি বউদির থেকে অনেক, অনেক সু তুই, পুনপুন। আবার আসবি। আমি তোকে কত কী জিনিস দোব, ধারণাও করতে পারবি না, এই নে তোর পুরনো প্যান্টটা পরে নে। নতুন জামাগুলো প্যাকেটে করে নিয়ে যা। আবার আসবি। ডাকলেও আসবি, না ডাকলেও আসবি, অ্যাঁ!’ আমাকে দু হাতে উঁচু করে তুলে ধরে, বেশ করে চুমু খেয়ে নতুনকাকু ছেড়ে দিলেন, আর আমি সেই প্যাকেট ঘোরানো সিঁড়ির ধাপে ফেলে রেখে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নতুনকাকুর থুতু মুছতে মুছতে পালিয়ে এলুম। এইটেই কি আমার পাপের শাস্তি?
তারপর অনেক দিন। অনেক অনেক দিন যাইনি মানিকদের বাড়ি। প্রথমটা ভয় হয়েছিল আমি আর কোনওদিন হিসু-পায়খানা করতে পারব না। প্রথমবার হিসু পেতেই ভয়ে লাল হয়ে গেছি। ঘামছি। পমদিদি বলল—‘ও কি পাবন, এরকম লাল হয়ে যাচ্ছিস কেন? কোঁতাচ্ছ কেন? কী হয়েছে?’
আমি কেঁদে ফেলে বলি—‘পমপম আমি ছোট-বাইরে করতে পারছি না।’
পমপম বলল—‘সে কী? একটু পরে বাবাকে নিয়ে মা ও পমপমের প্রবেশ। বাবা বললেন—‘খেলাধুলো করতে গিয়ে বোধহয় অনেকক্ষণ চেপে ছিল, তাইতেই… দাঁড়াও একটা ক্যানথারিস দিচ্ছি। পাবন, একটু চুপটি করে শুয়ো থাকো তো!’
বাবা ওষুধ দিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরে বুঝতে পারলুম আমার প্যান্ট ভিজতে শুরু করেছে। দৌড়, দৌড়, কলঘরের দিকে দে দৌড়। মুক্তিতে স্বস্তিতে আমার মুখ চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে। মানিকদের বাড়ি আমি আর যাব না। মানিক ডাকলেও না। এমন কি পাকুমা ডাকলেও না।
সপ্তম অধ্যায় : শিব-পুরাণ
কিন্তু মানিকদের বাড়ি না গেলে কী হবে? পাকুমার গল্প আমায় তাড়া করে। সে যে কতদিন আগেকার গল্প-কথা সব, কোনও অন্য দেশের, চেনা অথচ অচেনা মানুষদের গল্প। পাকুমা বলবেন, অনেকটা হয়ে যাওয়ার পর আমাদের মনে হবে(ওমা, এ তো সত্যি! গল্প কখনও সত্যি হয়? সত্যি কখনও গল্প হয়? পাকুমা সেই গল্প-হলেও-সত্যি আমাদের বলেন।
পাকুমার দ্বিতীয় গল্প
সে একজন মানুষ ছিলেন। ঠাকুরদেবতা, শাস্তরের বিধান, ভূতপ্রেত, ওঝা-ঝাড়ফুঁক। সন্নিসি-মন্নিসি কিছুতেই বিশ্বাস করতেন না। তাঁকে ঘিরে ছিল এক চৌ-মহলা পড়ো বাড়ি আর মা আর ছোট্ট বউ। বাড়ির আঙনে এক শিবমন্দির, ভেতরে শুধু ত্রিশূল পোঁতা। লোহার সেই ত্রিশূলে মরচে ধরেনি কখনও। এমনি আশ্চর্যি। সবাই বিশ্বাস করত ত্রিশূলেশ্বর জাগ্রত দেবতা, দূর-দূরান্ত থেকে লোকে মানত করতে আসত। পুজো দিত, সিধে দিত, প্রণামী দিত, গরিব-গুরবো লোকে যে যেমন পারে। তাঁর মা সেইসব জড়ো করে সংসার চালাতেন। দুবেলা মাছ-ভাত, মোটের ওপর দাসী-চাকর, জামা-কাপড়-গামছা, ছেলের লেখাপড়ার খরচা এসবের কোনও ভাবনা ছিল না। ছেলে কলকাতায় থেকে পড়তেন। আর ছুটি-ছাটাতে বাড়ি আসতেন। এসে মায়ের কাজকর্ম দেখতেন আর গুম হয়ে যেতেন। একদিন মা আর বউ প্রণামীর বাক্সের টাকা-পয়সা গুনে-গেঁথে তুলছে আর টাকা, আটানি, চারানি, ফুটো পয়সা সব থাক দিয়ে দিয়ে সাজিয়ে রাখছে, এমন সময়ে ছেলে এসে বলল— কী হচ্ছেটা কি? বলি হচ্ছেটা কী?
মা বললেন—‘দেখতেই তো পাচ্ছিস।’
—‘আর কতদিন এই বুজরুকি চলবে?’
—‘বুজরুকি? কী বলছিস রে শিবু?’
—‘ঠিকই বলছি। বোকা অজ্ঞ লোকে একটা লোহার কাঠিকে ভক্তিভরে পয়সা দিয়ে যায়, তুমি সেইগুলো …’
—‘চুপ কর রে শিবু চুপ কর। ত্রিশূলেশ্বর শুনতে পেলে আর রক্ষা থাকবে না।’
ছেলে তখন অট্টহাসি হেসে বললে—‘ও তোমার ঈশ্বর তাহলে এই বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেটায় শুনতে পান, তার বাইরে আর কান চলে না।’
মা তো ভয়ে চুপ।
—‘শোনো মা, ওসব শিব-ফিব নেই। বোকা লোকে নিজেদের ঠকাতে পারে কিন্তু তুমি শিবশঙ্করের মা হয়ে তাদের ঠকাতে পারো না।’
—‘আমি তো কিছু চাই না বাবা, মানত করে যায় সব, মনস্কামনা পূর্ণ হলে কিছু না-কিছু দেয়। কে পাঁচ আনা, কে সোয়া চার আনা, কে পাঁচটা টাকা, কে একটা গিনি।’
—‘কাকে দেয়?’
—‘বাবা ত্রিশূলেশ্বরকে।’
—‘তো তুমি কেন আত্মসাৎ কর?’
—‘আত্মসাৎ কী পাকুমা?’
—‘তুই বড্ড বিরক্ত করিস পুনপুন, পাকুমা তারপর?’
মা বললে—‘আমি বাবার পুজোর ব্যবস্থা করি, মন্দির পরিষ্কার রাখি, ভোগের ব্যবস্থা করি।’
—‘ত্রিশূল খায়?’
—‘ত্রিশূলেশ্বর খান।’
—ত্রিশূলেশ্বর যদি সত্যি দেবতা হতেন তোমার ভোগের অপেক্ষা রাখতেন? বিশ্বসংসারে তাঁর আর খাবার জুটত না?’
(আমাদের বাড়িতে পমপমও পুজো করে। পমপমও ভোগ দেয়, সকালে সন্দেশ আর রাত্তিরে বাতাসা। হরির লুঠ হয় একেক দিন ‘হরির লুঠ পড়েছে আনন্দের আর সীমা নাই/ চাঁদবদনে হরি বলো ভাই।’ আমাদের ঠাকুরঘরে কৃষ্ণঠাকুরের মূর্তি আছে, চকচক করে, আর বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ঠাকুর আর ভোলাগিরি ঠাকুর আর মহাত্মা কাঠিয়া বাবা আর বালানন্দ ব্রহ্মচারী। একেক দিন যেমন জন্মাষ্টমীতে নুচি, ক্ষির, এইসব ভোগ দেওয়া হয়। আমি ভাবি কৃষ্ণ আর বিজয়কৃষ্ণ আর ভোলাগিরি সব এক পাতে খাচ্ছেন, যেমন বুবু বুনবুন- পুনপুন খায়। কিন্তু অতজন মিলে খেলেও অনেক থেকে যায়, আমাদের আধখানা করে নুচি-ক্ষির পেসাদ হয়ে যায়। পেসাদের জন্যে কতক্ষণ আরতি দেখতে হয়, ভজন শুনতে হয়।)
—‘জোটে তো নিশ্চয়ই’—শিবশঙ্করের মা বললেন, ‘তবে তাঁকে দিয়ে আমাদের তৃপ্তি।’
—‘কিসের তৃপ্তি? পরিবারবর্গ নিয়ে খ্যাঁট হচ্ছে তার তৃপ্তি?’
—‘যা তা বলিস নে শিবু’, এবার মা রেগে গেছেন —‘জানিস আমার ত্রিশূলেশ্বর জাগ্রত ঠাকুর, কত বছর ধরে তাঁর গায়ে এতটুকু মরচের দাগও পড়েনি!’
—‘তেল দিয়ে রোজ নাওয়াও না, বেশ চুকচুকে করে?’
—‘না নাওয়ালেও মরচে পড়বে না।’
—‘দিল্লিতে একটা মৌর্যযুগের লোহার স্তম্ভ আছে। তাতেও মরচে পড়েনি। সেটাকে কিন্তু কেউ স্তম্ভেশ্বর বলে না। বরং সেটা নিয়ে দেশ-বিদেশের লোক গবেষণা করছে।’
—‘তাতে কী হল? আমার ত্রিশূলেশ্বর স্বয়ং কল্যাণময় শিব। তাঁর দয়া না হলে আজ আর বেঁচে থাকতে হত না। জ্ঞাতিরা তো সমস্ত জমিজমা হাত করে নিয়েছে। নিরাশ্রয়টা তো করতে পারেনি!’
—‘এর পরে কোনওদিন বলবে ছেলে ডাক্তারি পাস করেছে ঠাকুরের দয়ায়। নাতিপুতি হচ্ছে ঠাকুরের দয়ায়। আমি ওর মধ্যে নেই। আজ থেকে তোমার ওই বুজরুকির অন্ন আমি খাবো না।’
(নাতিপুতি তো ঠাকুরের দয়াতেই হয়। শিবশঙ্কর এটা যে কেন বুঝলেন না! আমার মা তো ছাতে কোল পেতে বসে বসে একটার পর একটা পমপম, টমটম, ইন্দ্র, সূর্য চেয়েছেন, পুনপুন-বুনবুন বুবু চেয়েছেন তাই আমরা সবাই এসেছি। আমরা ‘তেমজ’ কী করে হলুম বলো তো? মা তিনবার বলেছিলেন—‘চাই, চাই, চাই।’ প্রথম ‘চাই’টা খুব জোরে বলেছিলেন তাই বুবু হল মোটাসোটা, তারপরের ‘চাই’ দুটো আস্তে হয়ে গিয়েছিল বলে আমি আর বুনবুন রোগা হই।)
—‘তো কী খাবি? তোর ডাক্তারি পড়ার খরচ আমাদের খোরাকি সব জুটবে কোত্থেকে?’
—‘শিবোহহম। শিব যদি এখানে কেউ থাকে তো সে আমি। তুমিও শিব। কিন্তু তুমি মূর্খ, বৃদ্ধ, মেয়ে-শিব বলে তোমায় ছেড়ে দিচ্ছি। তোমার বউমাও বালিকা, অজ্ঞ, ভীরু শিব। আস্তে আস্তে চৈতন্য হলেই সাহসী শিব হয়ে উঠবে। আজ থেকে নোটিস টাঙিয়ে দেবে মন্দিরে কেউ প্রণামী দিতে পারবে না। আমার নিজের খরচ আমি যেমন করে পারি চালিয়ে নেবো।’
(আমাদের তে-রাস্তার মোড়ে একটা শিবমন্দির আছে। শিবরাত্রির দিনে সেখানে মেয়েদের খুব ভিড় হয়। মা-ঠাকুমা-পিসিমা সারাদিন উপোস করে পুটপুট দিদি আর আমাকে সঙ্গে নিয়ে পুজো দিতে যান তো। ভেতরে শিবলিঙ্গ আছে, সামনে মাটিতে একটা ত্রিশূল পোঁতা আছে। শিবলিঙ্গের গায়ে চন্দ্রবিন্দু আছে। ডাব আর বেল, ডাব আর বেল পুজো পড়ে। মেয়েরা দুধ ঢালে শিবের মাথায়, তখন আমার খুব ভালো লাগে, আমাদের খাওয়ার দুধগুলোও কেন যে মা শিবের মাথায় ঢেলে দেন না! শিবলিঙ্গের গৌরীপটে অনেক পয়সা পড়ে থাকে। সামনেও। এই সব প্রণামী। একজন বুড়োমতন মানুষ বসে থাকেন ভেতরে। খুব চুপচাপ, গম্ভীর। খালি থেকে থেকে বলেন, ‘একটু ধৈর্য ধরুন, মা একটু ধৈর্য ধরুন।’ তিনি চ্যাঙারির পুজো শিবলিঙ্গের গায়ে ঠেকিয়ে ফেরত দেন। আমি জানি উনিই আসল শিব। লোকে বুড়ো শিব বলে না? ঠাকুর তো মানুষের মতো, একটা পাথরের হামানদিস্তের ডাঁটি তো আর আসল ঠাকুর হতে পারে না! শিবশঙ্করের ধারণার সঙ্গে আমার ধারণা কোথাও কোথাও মিলে যাচ্ছে।)
নোটিস নিজ হাতে টাঙিয়ে শিবশঙ্কর কলকাতা চলে গেলেন। মা ভেবে ভেবে সারা। তখন আমি বুজিয়ে সুঝিয়ে বললুম—‘ভাবছো কেন মা? ভাবতে বারণ করেছেন যখন তখন নিশ্চয়ই কোনও ব্যবস্থা হয়েছে। বরং এসো, আমরা আমাদের ব্যবস্থা আরম্ভ করি। আমরাও তো শিব গো! তো আমাদের যা বুদ্ধি আসবে মাথায় সে-ও শিবের বুদ্ধি৷’
প্রণামী বন্ধ হলে কী হবে! মানতের জিনিস তো আর বন্ধ হল না। ঠাকুরকে কাঁচা সিধে দিত সব। সে তো বন্ধ হল না। গোয়ালা শিবঠাকুরের জন্যে দুধ দিত, শিবকে নমো নমঃ করে আমরা সব পেট্টায় করতুম।’
—‘আপনি সেখানে কোত্থেকে এলেন পাকুমা?’
—‘আরে শিবশঙ্করের সেই ছোট্ট বউটাই তো আমি?’
—‘তুমি? সুভগা? সরল-সুন্দরের যে দিদি বানের জলে ভেসে গিয়েছিল?’
—‘যে পরশমানিক পেয়েছিলেন গোখরোর থেকে?’
—‘হ্যাঁ রে হ্যাঁ, আমিই সেই।’
—‘তারপরে?’
তারপরে শিবশঙ্কর তো দিব্য পাস-টাস করে গ্রামে এসে বসল। বলল—‘ইংরেজ সরকারের চাকরি করব না।’
—‘তবে প্র্যাকটিস কর!’
—‘সে অনেক টাকার ব্যাপার। দেখা যাক কী হয়!’
শেষে একদিন এক রাজ-এস্টেটে চাকরি হল শিবশঙ্করের। সে চাকরি পাওয়াও ভারি মজার ব্যাপার। সদরের দোকানে ভালো দরজিকে চোগা চাপকান তৈরি করতে দিলে শিবশঙ্কর। ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে রাজামশাইয়ের দেওয়ানের কাছে। আগের দিন গিয়ে দেখে—চাপকানটা হয়নি। ব্যস তক্ষুনি সেটা ফেরত নিয়ে চলে এলো। মাকে বলল— ‘বাবার একটা চাপকান ছিল না তোরঙ্গে?’
—‘সে তো ছেঁড়া। পচা!’
—‘বারই করো না!’
সেই চাপকানটারই আগাগোড়া সেলাই খুলে ফেললেন শিবশঙ্কর। আস্তর টাস্তর সবসুদ্ধু। তারপর তার মাপে বসিয়ে বসিয়ে কাপড় কাটলেন। এক রাত্তিরের মধ্যেই সেই চাপকান হাতে সেলাই করে তার পরদিন সকালের ট্রেনে রওনা হয়ে গেলেন।
মা কিছুতেই ত্রিশূলেশ্বরকে ছেড়ে যেতে চাইলেন না। তখন স্ত্রী আর ছোট্ট ছেলেটিকে নিয়ে শিবশঙ্কর রাজ এস্টেটে চলে গেলেন। সেই রাজ্যে শিবশঙ্করের মস্ত বড় দোতলা বাড়ি, দাস-দাসী, কত আসবাব, কত ঐশ্বর্য, কালো ওয়েলার ঘোড়ার টমটম গাড়ি। শিবশঙ্করের সেখানে এমন সুনাম হল যে রাজামশাইয়ের অনুমতি নিয়ে তিনি সাধারণ লোকেদেরও চিকিৎসা করতে লাগলেন।
এদিকে হল কি, শিবশঙ্কর তো মায়ের কাছে নিয়মিত টাকা পাঠাচ্ছেন, আর মা সেই টাকা দিয়ে একটু একটু করে, সেই চৌমহলা সারিয়ে তুলছেন। একবার ঘটল এক কাণ্ড। রাজামশাইয়ের মা রানিমার পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। শিবশঙ্কর দেখে বললেন, পাথরি। পিত্তথলিতে অস্ত্র করতে হবে। আয়োজন করুন। আমি জিনিসপত্রের সব ফর্দ করে দিচ্ছি, শহর থেকে আনান। অস্ত্র করলেই ভালো হয়ে যাবেন।’ তা পুরনো এক রাজবৈদ্য মাথা নেড়ে বললেন, —‘মেয়েমানুষের পেটে পাথর হয় জীবনে কখনও শুনিনি।’ আশেপাশের রাজ্যে যত বৈদ্য যত ডাক্তার ছিলেন, ওই একই কথা বললেন। তখন রাজামশাই একটু ভয় খেয়ে বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, কলকাতা থেকে একজন সাহেব ডাক্তার আনাই, কী বলেন? আর একজনের কথা শোনা ভালো।’
—‘আনান,।’
তা কলকাতার সাহেব ডাক্তার এসেও ওই একই কথা বলল।
—‘গল ব্লাডারে স্টোন হয়েছে, অপারেশান করাতে হবে।’
রানিমা উঠে বসে বললেন—‘আমি তখনই বলেছিলাম, ডাক্তারবাবুর ভুল হতে পারে না। আমি ওঁর হাতেই অপারেশান হব।’
রাজা তো স্বয়ং গাড়ি নিয়ে ছুটলেন।
—‘কী গাড়ি পাকুমা, স্টুডিবেকার না টমটম?’
—‘সে এক মস্ত হাওয়া-গাড়ি তার নাম রোলসরয়েস।’
দেখেন ডাক্তারবাবুর গাড়িতে মাল উঠছে। তোরঙ্গ, সুটকেস, বোঁচকা-বুঁচকি।
—‘এ কি ডাক্তারবাবু, কোথায় চললেন?’
—‘দেশে যাচ্ছি রাজাবাবু।’
—সে কি? মায়ের অপারেশান করতে হবে না?’
—‘ডাক্তার তো এসেছেন, তাঁকে দিয়েই করান।’
—‘রাগ করেছেন ডাক্তারবাবু?’ রাজামশাই থতমত।
(এইখানে আমার আর মানিকের মনে দুটো প্রশ্ন জাগে। আমরা তর্ক বাধিয়ে দিই। মানিক বলে—ডাক্তারবাবুর রাগ করার কী আছে? লোকের পেট কাটার মতো বিচ্ছিরি কাজ থেকে কেউ যদি অব্যাহতি পেয়ে যায় সে তো ভালো কথা! আমি ডাক্তারের ছেলে, ডাক্তারের নাতি, আমি রক্তের মধ্যে ডাক্তারদের মান-অভিমানের ব্যাপারটা বুঝি, তাই মানিকের সঙ্গে সহমত হই না। আমার আবার অন্য একটা ব্যাপারে সংশয় জাগে। রাজামশাইরা থতমত খান? খান নাকি?)
—‘তোরা কি শুনবি?’ পাকুমা বললেন। তিনি আরও বললেন— ‘সাহেব ডাক্তারের শ্রেষ্ঠত্বে রাজামশাই বিশ্বাস করেছিলেন বলেই শিবশঙ্কর আরও রেগে যান। আমাকে তিনি বলেন—রাজামশাইরাও অবশ্যই থতমত খান। সব রাজাই কি আর ইংরেজদের মতো ত্যান্ডাই ম্যান্ডাই!
যাই হোক, হাজার সাধাসাধিতেও শিবশঙ্করকে নড়ানো গেল না। তিনি বললেন— ‘রাজামশাই, ডাক্তার বিজ্ঞান মেনে চিকিৎসা করেন ঠিকই। কিন্তু তার আত্মবিশ্বাসের অনেকটাই আসে রোগী ও তার আত্মীয় পরিজনের বিশ্বাস থেকে। আমাকে ছুটি দিন। খোলা মনে আমি ছুরি ধরতে পারব না।’
দেশে ফিরে এসে শিবশঙ্কর দেখেন চৌমহলা বাড়ির দু মহলা মা ভেঙে ফেলে দিয়েছেন। সেখানে সেগুন চারা লাগানো হয়েছে। আর বাকি দু মহল সারাই ঝালাই হয়ে ঝলমল করছে। বাপ-পিতেমোর আমলের আসবাবগুলি পালিশ পেয়ে জ্বলজ্বলে, ঝাড়লণ্ঠন, দেওয়ালগিরি, নতুন গদী, নতুন বিছানা। শিবমন্দির ধবধবে সাদা, ভেতরে ত্রিশূলেশ্বর তেলচানের পর এবার দুধচান করছেন। কাতার দিয়ে লোক এসেছে ঠাকুর দর্শন করতে।
শিবশঙ্কর বললেন, ‘মা, এ কী?’
মা বললেন—‘শিবোহহম। তুইও শিব, আমিও শিব বাবা। তুই শিব যা পারিস করেছিস। আমি শিবও করেছি আমার বিবেকবুদ্ধিতে যা বলে।’
(এইখানে মানিক আর আমি মুখে হাত চাপা দিয়ে খুকখুক করে হাসি৷ ‘শিবোহহম’টা দুবার দুজনের মুখে শুনেই প্রধানত আমাদের হাসিটা পায়।)
—‘বিবেকবুদ্ধি? না বিষয়বুদ্ধি?’(শিবশঙ্কর গর্জন করলেন।
মা বললেন—‘ভেতরের শিব যা বুদ্ধি দিয়েছেন তাই করেছি বাবা, বিবেক না বিষয় অত মাথা ঘামাইনি। তবে ত্রিশূলেশ্বরের পুজো বন্ধ করবার চেষ্টা করলে এবার দশ গাঁয়ের লোকে তোকে দেশছাড়া করবে তা বলে দিলুম।’
তখন শিবশঙ্কর রেগেমেগে বললেন—‘ঠিক আছে। তুমি বিষয়বুদ্ধিতে মূর্খ লোকের কাছ থেকে আত্মসাৎ করেছ, আমি তা যতদূর পারি ফিরিয়ে দিই।’
তিনি দেশে গ্যাঁট হয়ে বসলেন। বিনি পয়সার ডাক্তারি। কোনও রাজ এস্টেটের ডাক্তার অমুক গাঁয়ে এসে বসেছেন, এ-ও ত্রিশূলেশ্বরের আরেক দয়া বলে দশ গ্রামের লোক ডাক্তারবাবুর কাছে উপুড় হয়ে পড়ল। ডাক্তারবাবু পয়সাকড়ি তো নেন না। ওষুধের দাম সচ্ছল অবস্থার রুগিদের কাছ থেকে নেন শুধু তবে লোকে তাদের ভক্তি-ভালোবাসার চিহ্নগুলি অন্দরে মা-ঠাকরুন, বউ-ঠাকরুনের কাছে দিয়ে যায়। ক্রমে গাঁয়ের লোকেদের চেষ্টাতেই এঁদের যে বিশাল বাগানগুলো বেহাত হয়ে গিয়েছিল সে সব এঁরা ফিরে পেলেন।
কিন্তু শিবশঙ্করের স্ত্রী খালি খুঁতখুঁত করে। ছেলেরা মানুষ হবে না? বাবার মতো ডাক্তার হবে না? শিবশঙ্কর বলেন—‘ডাক্তার হতে হবে না, ওরা চাষ-আবাদ শিখুক। এত জমি জায়গা!’
ভালোভাবে চাষবাস করুক, ভদ্দল্লোক বলেই সব গ্রাম ছেড়ে শহরে যাবে, চাষ-আবাদের কাজে গা দেবে না—এ ভাল নয়। তারপরে দেখা যাক না কী হয়। মায়েরও তাই মত। খালি বউয়ের মনের খুঁতখুঁতনি যায় না। শিবশঙ্কর কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে পড়েছেন, রাজ-এস্টেটে কাজ করেছেন, কত তাঁর দাপট, কত তাঁর পালিশ, ওরকম ব্যক্তিত্ব কি আর জগৎসংসারে পাঁচটা জিনিস না দেখলে-শুনলে হয়! ছেলেগুলো যেন গেঁয়ো ভূত হয়ে যাচ্ছে দিন-কে-দিন। না সত্যিকারের চাষী, না ঠিকঠাক ভদ্দল্লোক।
(আমরা ভালো হয়ে বসি। ঠিকঠাক ভদ্দল্লোক হতে হবে তো? ঠিকঠাক ভদ্দল্লোক মানে বাবা, ঠাকুর্দা, দাদাভাই। আমি বাবু হয়ে বসে বাঁ হাতটা ত্রিভুজের মতো করে বাঁ হাঁটুতে স্থাপন করি। দাদাভাই এমনি করে বসে খান। এইটাই বোধহয় ভদ্দল্লোকের সবচেয়ে বড় লক্ষণ। মানিকও আমার দেখাদেখি ওইরকম করতে যায়।)
এই সময়ে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। শিবের থানে এক বিদেশি বিধর্মী মহিলার ভর হল।
—‘ভর কী পাকুমা?’
—‘বামুন ঠাকুরনের ওপর মঙ্গলচণ্ডীর ভর হয়, দেখিসনি?’
—‘ওইরকম চোখ লাল করে ঘোরাবে আর হারানো জিনিস কোথায় আছে বলে দেবে?’
—‘ঠিক। ওইরকম।’
ভদ্রমহিলা সাদা রঙের পোশাক পরা এক মেমসাহেব। জার্মানির য়িহুদি। তিনি শিবমন্দিরের চাতালে বসে পড়ে বলতে থাকলেন—ইয়াওয়ে বলেছেন সব ধ্বংস হয়ে যাবে। জার্মানি ধ্বংস হয়ে যাবে, য়িহুদিরা নিঃশেষ হয়ে যাবে। তারা ইউরোপ থেকে পালিয়ে যাক। তিনি বলছিলেন জার্মানে আর ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে। লোকে তাই শিবশঙ্করকে ডেকে আনলো। শিবশঙ্করের বাড়ির দুই ইয়া ইয়া চেহারার দাসী তাঁকে চ্যাংদোলা করে তুলে এনে অন্দরবাড়িতে শোয়ালো। মুখে-চোখে জলের ঝাপটা, শিবশঙ্কর ইনজেকশন দিলেন। ভদ্রমহিলা ঘুমিয়ে পড়লেন। ওমা অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে-টুমিয়ে উঠে তিনি চেঁচাতে লাগলেন—‘চ্যান্নামিট্টা চ্যান্নামিট্টা।’ অনেক চেষ্টা করে বোঝা গেল তিনি ত্রিশূলেশ্বরের চরণামৃত চাইছেন।
—‘পাকুমা, আমার পিসিমা বলেন চন্নামিত্তির, ঠাকুমা বলেন চরণামৃত, ঠাকুদ্দা বলেন চরণামিত্র, কোনটা ঠিক?’
মানিক পাকুমাকে বলতে দেয় না। সে বলে—‘চরণামিত্রটাই ঠিক। আর মেয়েরা তো সব কথাই ভুল বলে তাই পিসিমা-ঠাকুমারটা ভুল। মেয়ে বলে চলে যায়।’
পাকুমা বোধহয় একটু বিপদে পড়ে যান। আমার গুরুজনদের ভুল-ঠিক বিচার করার ভার তাঁকে দেওয়ায় তিনি ভারি অস্বস্তিতে পড়েছেন। তিনি বললেন(‘গল্পটা শুনবি তোরা? না খালি বাধা দিবি?’
—‘আচ্ছা, আচ্ছা, বলুন/বলো,’ আমরা সমস্বর।
শিবশঙ্কর কঠোরভাবে বললেন—‘আপনি একজন শিক্ষিত ইউরোপীয় হয়ে এসব বাজে বুজরুকিতে বিশ্বাস করেন?’
বলতে না বলতেই, তাঁর মা তুলসীপাতা দেওয়া দুধ-মেশানো এক চামচ জল তাঁর মুখে ঢেলে দিলেন, তিনিও কোঁৎ করে সেটা গিলে নিলেন। তারপর বললেন—ছ মাস আগে এই মায়ের কাছে চ্যান্নামিট্টা খেয়েই তিনি ইউরোপ ভ্রমণে যান, এবং তখন থেকেই তাঁর এই অলৌকিক ক্ষমতা হয়েছে। মাঝে মাঝেই তাঁর ভর হয়। এবং তিনি ভবিষ্যৎ দেখতে পান। সেমিটিক জাতির খুব দুর্দিন আসছে এ তিনি জার্মানির হাইডেলবার্গ শহরে বসে বলেছিলেন। আর এইজন্যেই তিনি তাঁর একমাত্র মেয়েকেও ইন্ডিয়ায় রাখতে চান। এখানকার স্কুলেই সে পড়বে তাকে আর জার্মানি যেতে হবে না।
শিবশঙ্কর বললেন—‘তোমার হিস্টিরিয়া হয়েছে। ছ মাস আগে হঠাৎ এখানে এসেছিলে কেন?’
—‘আমার স্বামীর দুরারোগ্য অসুখ হয়েছিল, সব কিছু করা হল, কিছু হল না, তখন এ দেশীয় কজন বন্ধু আমাদের ত্রিশূলেশ্বর শিবের কথা বলেন। আশায় আশায় মানত করি।’
—‘তোমার স্বামী বেঁচে উঠেছেন?’
—‘না। আমি স্বামীর জীবন প্রার্থনা করিনি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যন্ত্রণাহীন মৃত্যুকামনা করেছিলাম। তাই হয়েছিল।’
—‘কেন? ত্রিশূলেশ্বরের কাছে মানত করলে যদি সবই মেলে তো স্বামীর জীবন চাইলেই তো পারতে?’ শিবশঙ্কর শ্লেষ করে বললেন। (‘শ্লেষ’ কেন বললেন পাকুমা? কথাটা তো ‘শ্লেষ্মা’, ঠাকুর্দা বলেন। শিবশঙ্কর কি ঘড়ঘড়ে গলায় কথা বলেছিলেন?)।
—‘না, তা কী করে চাইব? গ্যাংগ্রিনে আমার স্বামীর হাঁটু পর্যন্ত কাটা পড়েছিল। দুটো পা-ই বাদ। বেঁচে থেকেই বা তিনি কী জীবন যাপন করতেন? তাঁর ইচ্ছা অনুসারেই তাঁর মৃত্যু চেয়েছিলাম। মাস ছয়েক আগে সেই প্রার্থনা পূর্ণ হওয়ায় মন্দিরে মানতের অর্ধাংশ দিয়ে গেছি। আর অর্ধাংশ আনতে ইউরোপে গিয়েছিলাম।
—‘কী দিয়ে গেছো? শিবশঙ্কর অবাক হয়ে জানতে চাইলেন।’
—‘আমার সম্পত্তির দলিল।’
—‘তার মানে—
শিবশঙ্কর তাঁর মার দিকে চাইলেন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে।
মা বললেন—‘আমি তো কিছু জানি না বাবা!’ তখন প্রণামীর বাক্স উপুড় করে তলায় সেই দলিল পাওয়া গেল।
শিবশঙ্কর বললেন—‘এ সব কী করেছেন? এ তো পাগলামি৷’
—‘না। ওই সম্পত্তি তোমাদের পরিবারকে আমি দানপত্র করেছি। মেয়েকে আনতে গিয়েছিলাম। মেয়েকেও তোমাদের দিয়ে দিয়েছি। সে-ই আমার মানতের দ্বিতীয় অর্ধ।
শিবশঙ্কর রেগে কাঁই হয়ে বললেন—‘এরকম দান করা যায় না। এ সব পুতুলপুজো না তোমরা ঘৃণা করো?’
—তুমি বললেই হল?’—ইহুদি মহিলা বললেন—‘আমরাও এক সময়ে পৌত্তলিক ছিলাম। বাল, লট এইসব কত দেবতার পুজো করতাম। যাগযজ্ঞ করতাম, বলি দিতাম। এখন অবশ্য করি না। কিন্তু এইটুকু বুঝি যে ইয়াওয়ে সর্বভূতে আছেন। সাধনা-একাগ্রতার ফলে তিনি কোথাও কোথাও জাগ্রত হয়ে ওঠেন। যেমন তোমাদের এই ত্রিশূলেশ্বর। এ তো পুতুল নয় একটা প্রতীক। আমরাও তো গ্রন্থ পুজো করি। যাই হোক, এখানে যে ইয়াওয়ে জাগ্রত হয়েছেন তাতে আমার কোনও সন্দেহ নেই। আমি এখানেই থাকবো। তোমাদের বাড়িতে থাকতে না দাও, আমার স্বামীর যেটুকু টাকাপয়সা আছে তাই দিয়ে এখানে কুটির বেঁধে থাকবো। মেয়েকে তো তোমাদের নিতেই হবে, সে ত্রিশূলেশ্বরের সেবা করবে।’
শিবশঙ্কর বললেন—‘তোমার সম্পত্তি আমরা নেব না। মেয়েকে দেওয়া আবার কী? জন্মেও এরকম বিদঘুটে কথা শুনিনি। আমি তোমার চিকিৎসা করছি। স্বামীর রোগ আর মৃত্যুর শোকে তোমার গুরুতর নার্ভের অসুখ হয়েছে। তবে ভালো হয়ে যাবে।’
মহিলা বললেন—‘চিকিৎসা করো তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু সম্পত্তি না নিলে আমি না খেয়ে মরব। ওষুধ তো দূরস্থান, জলগ্রহণ পর্যন্ত করব না। আর মেয়েকে দেওয়াই বা হবে না কেন? আব্রাহাম কি আইজাককে বলি দিতে যাননি? আমি ভগবানের সেবায় দিচ্ছি…’
শিবশঙ্কর এবার রেগে জ্ঞানহারা হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
(আমার আর মানিকের চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে। মেমসাহেবের মেয়েকে কখন বলি দেবে। জানতে আমরা উৎসুক)।
শিবশঙ্করের স্ত্রী বলল—‘আচ্ছা মেমসাহেব, তুমি তো দিলে, কিন্তু তোমার মেয়ে তো ঘটিবাটি নয়। সে তো একজন মানুষ, তারও তো মতামত আছে। সে যদি রাজি না হয়?’
মেমসাহেবের নাম অ্যালিস। সে ভাবিত হয়ে বলল,—‘সে সম্ভাবনা যে একেবারে নেই তা নয়। কিন্তু আমার মেয়ে অত্যন্ত লক্ষ্মী মেয়ে, যা বলব তাই শুনবে বলেই মনে হয়।’
তখন শিবশঙ্করের বউ বললে—‘তার চেয়ে এক কাজ করলে হয় না! ডাক্তারবাবুর চিকিৎসায় তুমি অন্তত মাস ছয়েক এখানে থাকো। তারপরেও যদি তোমার মত না বদলায়, তুমি আমার এক ছেলের সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ে দাও।’
—‘ঠিক বলেছো, ঠিক বলেছো’—অ্যালিস উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল।
ছ মাস কেটে গেল। অ্যালিসের আর ভর হয় না। কিন্তু সে তার সংকল্পে অটল। অনশনে প্রাণত্যাগ করবে তবু দানপত্র ফেরত নেবে না।
অবশেষে ঠিক হল শিবশঙ্করের স্ত্রী ওই সম্পত্তি দিয়ে কলকাতায় একটা বাড়ি কিনবেন। সেখানে শিবশঙ্করের তিন ছেলে ও অ্যালিসের মেয়ে তাঁর তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করবে। তাই হল। অ্যালিস দেশে বিদেশে তীর্থযাত্রা করেন, আর কলকাতার বাড়িতে বিশ্রাম করতে আসেন। গ্রামে যান না শিবশঙ্করের গালাগালি খাবার ভয়ে।
শিবশঙ্কর এত রেগে গেলেন যে তাঁর স্ত্রী ছেলেদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করলেন। তাঁদের একটি মেয়েও ছিল। রাগ করে মেয়েটির বিয়ে দিয়ে দিলেন। আর কালক্রমে অ্যালিসের মেয়ে নেলীর সঙ্গে শিবশঙ্করের বড় ছেলের বিয়ে হল।
পাকুমা এতক্ষণ যেন ঘোরে ছিলেন। এবার বললেন—‘বলো তো মণিমাণিক্য কাজটা ঠিক হল না ভুল হল।’
—‘কোন কাজটা?’
—‘এই যে শিবশঙ্কর “না” করা সত্ত্বেও তাঁর বউ ছেলেদের শহুরে শিক্ষার জন্য অ্যালিসের কথা মেনে নিয়ে কলকাতায় বাড়ি করে থাকতে লাগলেন! শিবশঙ্কর তো আর তাঁর সঙ্গে সম্পর্কই রাখলেন না! বলো তো মানিক ঠিক হল কি না!’
মানিক বলল, —‘ঠিকই তো হয়েছে, না হলে ছেলেরা শহরের ইস্কুলে পড়বে কী করে?’
আমি বললুম, —‘তা ছাড়া, নইলে তো অ্যালিস অনশনে প্রাণত্যাগ করত পাকুমা!’
—‘তবে?’ পাকুমা অন্যমনস্ক হয়ে বললেন। বলে বসেই রইলেন।
—‘পাকুমা ও পাকুমা শাঁখ বাজাবেন না?’ আমি তাঁকে আলতো করে ঠেলি।
(ত্রিশূলেশ্বর, তুমি যদি সত্যকারের ঠাকুর হও, তাহলে বুবুকে আগের মতন করে দাও।)
পাকুমা কথা বলেন না। উঠে পড়েন। একটু পরেই ঠাকুরঘর থেকে শাঁখের আওয়াজ ভেসে আসে। আমি এক শাঁখের আওয়াজ থেকে আর এক শাঁখের আওয়াজে ভেসে যাই। পাকুমার শাঁখ থেকে মায়ের শাঁখ। সিংবাড়ি থেকে সিংহবাড়ি। মেমসাহেবের ভর হওয়ার অদ্ভুত দৃশ্য চোখে নিয়ে। রাত্তিরে, খাবার সময়ে, যখন খুব ঢুল এসেছে, তখনই একবার মনের মধ্যে চিড়িক করে খোঁচা মারে একটা কথা—আরে, শিবশঙ্করের বউই তো পাকুমা, পাকুমাই তো সুভগা! তাহলে? সেই অ্যালিস, সেই নেলী, সেই তিন ছেলে, তারা কি এই সিংবাড়িতেই বাস করেছিল? এই বাড়িটায়? আমাদের সামনে?
অষ্টম অধ্যায় : মাঠে-গোঠে
পুনপুন মানিকদের বাড়ি যাবে না নতুন কাকুর ভয়ে, বারো নম্বরে যাবে না বুনবুনের ভয়ে, তাহলে পুনপুন কোথায় যাবে?
শীত-শীত রবিবারের সকালে উঠে দাঁত মাজতে মাজতে পুনপুন তাই ছোট চৌবাচ্চায় নিজের ছায়া দেখে। একবার করে কুলকুচি করে আর জলে ইঁ করে দাঁতের ছায়া দেখে, কিছুতেই আর পছন্দমতো হয় না। তাই সে বাঁ হাতের পাতায় সাদা মাজন আর একটু ঢেলে নেয়, ডান হাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে আবার বারকয়েক ঘষে ঘষে মাজে। তারপর আবার ঝুঁকে পড়ে চৌবাচ্চায় নিজের ছায়া দেখে, মুখ থেকে টুপ করে এক ফোটা সাদা-মাজন ফেনা-থুতু চৌবাচ্চার জলে পড়ে। পুনপুন এদিক-ওদিক তাকিয়ে মগে করে সেটা তুলে ফেলে দেয়। সবটা কি আর পারে? খানিকটা চৌবাচ্চার জলে মিশে যায়। এই ভাবে পুনপুন স্রেফ অনবধানতায় তার দ্বিতীয় পাপ করে ফেলে। এটা যে পাপ সেটা তার গোড়াতে মনে হয়নি অবশ্য। পিসিমা যখন রান্নাঘর থেকে উঁকি মেরে বললেন— ‘পুনু, চৌবাচ্চার কাছ থেকে সরে গিয়ে দাঁত মাজ, এক্ষুনি ছিষ্টি নোংরা করবি। নোংরা জলে হাত ধুয়ে তারপর চোদ্দো পুরুষ নরকস্থ হোক,’ তখন পুনপুনের জ্ঞান হয়।
চোদ্দোপুরুষ মানে সে জানে। ঠাকুর্দা, বাবা, পালক, ই-দাদা, সু-দাদা, অংদাদা, সে, বুনবুন, কানু মামুফুল, দাদাভাই, বড়মামা, বর্মার জ্যাঠাবাবু আর টেকন— এই চোদ্দোজন তাদের বাড়ির চোদ্দোটি পুরুষ, এরা সবাই নরকস্থ হবে। সেই কড়া, সেই তেল, সেই ছ্যাঁক-ছোঁক করে যমদূতের মানুষ-ভাজা। কিন্তু পাপ সম্পর্কে সচেতন হবার পরও তার এমন সৎসাহস হয় না যে সে স্বীকারোক্তিটা করবে। চৌবাচ্চার জলটা ছেড়ে দেওয়া উচিত। সে অবশ্য এখানে চার হাত পা মেলে শুয়ে শুয়ে সাঁতার কাটে। কিন্তু এখন খুব গা সিরসির করছে শীতে, তা ছাড়া চৌবাচ্চার মধ্যে ডুবে গেলে, গর্তের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে হড়হড়ে মতো ছিপিটা খুলতে হবে ভাবলেই তার ভীষণ ভয় করছে। ওপর থেকে দেখছো জল, বেশি গভীরও নয়। কিন্তু ডুব গেলে যদি সে দেখে এ আরও গভীর। যদি অক্টোপাস, তিমি, হাঙর তাকে তেড়ে আসে? এরা তো বড় বড় জীব, কিন্তু এমন কি ভোঁদড়, জলসাপ, এরাও তো থাকতে পারে। তা ছাড়া এই চৌবাচ্চার ভেতরে সে আর বুবু কতবার জলহস্তীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। অত ঘোর যুদ্ধ হল, জলহস্তীর লাল হাঁ তারা দুজনে দুদিক থেকে টেনে চিরে দিল একবারে। অথচ সেই জলহস্তী একটা দুটো গজিয়ে যাবে না চৌবাচ্চায় তা কখনও হতে পারে? অনেক ভেবে-চিন্তে সে তাদের নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলের মাস্টারমশাই রবার্ট ভজহরি বিশ্বাসের মতো বুকে ক্রস আঁকে তারপর ঝুপ করে চোখ বুজে চৌবাচ্চায় নেমে পড়ে। চোখ খোলে না সে, জলহস্তী দাঁত বসাতে এলেই সে পিছলে পিছলে হস্তীটার গলার দিকে চলে যাবে ঠিক করে। হড়কে তারপর একেবারে তার পাকস্থলিতে…। চোখ মেলে এবার সে জলের ওপর থেকে জলের ভেতরের বাস্তবতা নিরীক্ষণ করে। কী সুন্দর সবুজ রঙের শ্যাওলা, পুতুলদের মাঠ, সেইখান থেকে বুড়বুড় করে ওপর দিকে বুড়বুড়ি উঠছে। সাহস করে হাতটা আর একটু বাড়ায় পুনপুন, চোখ বুজিয়ে ছিপির সুতলিতে টান দেয় আর অমনি হুড়হুড় করে জল পড়া শুরু হয়ে যায়। জলের আওয়াজে ভেতর-উঠোনের দরজার কাছে জড় হয়ে যায় চোদ্দোপুরুষের বেশ কজন, নারীর সংখ্যাও নেহাত মন্দ নয়।
বুবু অনেকদিন পরে হাসছে। হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠল— ‘জলপ্রপাত! জলপ্রপাত!’
বাবা বললেন, ‘যাঃ, জলটা ছেড়ে দিলে? কালই… বুবু কী বলল?’
বুবু ছুটে আসছিল, কেননা তার ক্ষীণভাবে মনে পড়ছিল এই জলপ্রপাতের তলায় আঙুল পেতে অনেক রঙিন নুড়ি পাওয়া যায়, রঙিন মাছও পাওয়া যেতে পারে। এমন কি জলকন্যা পেয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়। এইসব প্রত্যাশা কোন অতল থেকে ভেসে উঠছে সে জানে না।
মা তাকে খপ করে ধরে ফেলে বলেন— ‘কোথায় যাচ্ছ বিদ্যা। তোমার মুখ ধোওয়া হয়ে গেছে না? যাও একটা সোয়েটার পরে এস আগে।’
বুবু হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে—‘ট্রাম, ট্রেন, ট্রাঙ্ক, সোয়েট্রা,’—সে ভেবেছে সে ‘সোয়েট্রা’ বলতেও পারবে না, বুঝতেও পারবে না, তাই মা ভেঙে ‘সোয়েটার’ বললেন। জলপ্রপাত বলবার পরেও যে কেন মায়ের এই ভুল ধারণাটা রইল! তাই ক্ষোভে, নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদে সে সব টয়-এ রফলা পরপর উচ্চারণ করে। ‘ট্রাম, ট্রেন, ট্রাঙ্ক, সোয়েট্রা।’
আর যায় কোথায় একতলার দালানে উৎসব শুরু হয়ে যায়। বাবা মধ্যমণি। বুবুকে কোলে তুলে নিয়েছেন। হাততালি দিয়ে বলছেন ‘ট্রয়, ট্রাক, ট্রিপ, ট্রাই।’ বুবুও দাগা বুলোচ্ছে—‘ট্রয়, ট্রাক, ট্রিপ, ট্রাই’, লজ্জায় সে বাবার কোলেই কোমর মোচড়াচ্ছে পিসিমা মুখে কাপড় দিয়ে বলছেন ‘রগড় দেখো,’ মা হাসছেন। বর্মার জ্যাঠাবাবু হাততালি দিচ্ছেন। দাদা-দিদিরা সব এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে গেছে, কার কাঁধে গামছা, কার হাতে খবরের কাগজ, কে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। বাবা নাচছেন।
বুবুটা ট্রয় ট্রিপ
বুবুটা ট্রাক ট্রাই
বুবু যাবে ট্রেনে চড়ে
ব্লো সবাই বাই বাই
সোয়েটার সোয়েট্রা হলে
কোয়ার্টারও কোয়াট্রা হয়
ওয়াটারকে ওয়াট্রা বলো
কম্ফর্টার কি কম্ফর্ট্রা নয়?
বুবু অধোবদন। পুনপুনও অধোবদন। বুবু বাবার একটা মজার ছড়ার বিষয় হয়েছে, সব্বার হাসির কারণ, এর পরেও তারা অধোবদন হবে না? বুবু লজ্জার বিষয় হলে পুনপুনকেও অগত্যা লজ্জা পেতেই হয়।
এইবার মঞ্চ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। পুনপুনের দ্বিতীয় পাপ স্খলন হয়ে গেল ফাঁকতালে। সে একটু একটু করে বুবুর দিকে এগোয়। আঙুলে ডাব-ভাব নিয়ে। কড়ে আঙুলে থুতনির নীচে রেখে দু-তিন বার টেনে নিলেও আড়ি হয়। কিন্তু সেই বুড়ো-আঙুলই যদি আবার আরেকজনের বুড়ো আঙুলে ঠেকিয়ে ডাব বলো, তো তাকে ভাব বলতে হবে, ভাব করতে হবে। বুবুর বুড়ো আঙুলে পুনপুনের বুড়ো আঙুল ঠেকে যায়। সে বলে ডাব। হায়, বুবু ভুলে গেছে কী বলতে হয়। পুনপুন তখন বলে—‘বল্ “ভাব, ভাব!” বুবু বলে ভাব। তখন পুনপুন ফিসফিস করে বলে—‘তোর কি খুব খু-উব লেগেছিল?’
বুবু কিছুই বুঝতে পারে না। কেন লাগা, কিসের লাগা। কিন্তু কিছু একটা বুঝতে পারছে না— এটা জানান দিতে সে চায় না। কিছু বলবার আগে সে সমস্তটার মহড়া দিয়ে নেয় মনে মনে, সে বলে— ‘না।’
ব্যাস, পুনপুনের বুকের ভেতর থেকে একটা বিরাট বোঝা হুশ করে নেমে যায়। বুবু সেরে গেছে, তার কিলে বুবুর লাগেনি, বুবু ‘ট্রাম ট্রেন, জলপ্রপাত’ বলেছে….. ভাবও করেছে। সুতরাং পুনপুন নিজেদের ঠাকুরঘরে গিয়ে চুপিচুপি নমো করে বলে— “ত্রিশূলেশ্বর ঠাকুর ওং শ্ৰী শ্ৰী, নমো, নমোঃ। ওং শ্রী শ্রী গোখরো ঠাকুর নমো নমঃ।’ তাদের ঠাকুরঘরের বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, বালানন্দ ব্রহ্মচারী এঁরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকেন।
আকাশ রোদে রোদ। ছাত নীলে ভেসে যায়। কুলো, নতুন কাপড়ের টুকরো, বড় থালা, তেল, ডালবাটার গামলা নিয়ে বাহিনী উঠবে এবার ছাতে। মা বুজবুজ, পুটপুট, পুনপন, বুনবুন, বুবু। বড়ি দেওয়া হবে। ছাত পরিষ্কার করে ঝাঁট দিয়ে গেছে টেকন। মা কুলো উল্টে রাখলেন। তার ওপর নতুন কাপড়ের টুকরো দিয়ে ঢেকে দিলেন। কাঁসার বড় থালা তেল মাখিয়ে রাখলেন। এই থালায় কী বড়ি হবে বলুন তো?—কাঁচা বড়ি। তার মানে ওর ওপর বড় বড় বড়ি দিয়ে ঘণ্টা দুই তিন কষে রোদ খাইয়ে নেওয়া হবে। তারপর তেলমাখা থালা থেকে বড়িগুলো তুলে ফেলতে হবে সাবধানে। বাইরেটা শুকিয়ে যত টেনে যাবে, ভেতরটা তত নরম থাকবে—এইবার একে সর্ষের তেলে ভেজে, সর্ষে-বাটা দিয়ে কাঁচালঙ্কা দিয়ে ঝাল করুন। অতি চমৎকার খেতে। বড়ির ডাল মা গোটা মুঠো ডুবিয়ে দিয়ে ফটাফট শব্দে ফেনান আর থাপুস-থুপুস বড়ি দেন। হাতের পাঁচ আঙুলের কায়দায় মন্দিরের চুড়োর মতো ছুঁচলো করে তুলে দেন বড়ির ডগা, তারপর সবচেয়ে বড় বড় দুটো বড়ির মাথায় পড়বে ধান দুর্বো সিঁদুর। এদের নাম বুড়ো-বুড়ি। মা যতই ওদের নাক টেনে তোলেন, ততই ওরা খাঁদা হয়ে যায়। কিন্তু ওদের দেখলে ঠিক মনে হবে, সাদা চুলে মাথা ভরা এক বুড়ো আর পাকা মাথায় সিঁদুর এক বুড়ি আসনসিঁড়ি হয়ে বসে আছে। শীতের প্রথম আলু কপি মটরশুঁটির ঝোলে এই বড়ি পড়বে। বুড়োটা বাবা খাবেন। আর বুড়িটা মা। বাবা মা আর কোনও জিনিস একা-একা খান না তো! বাবা দুপুরবেলা খেতে বসে বলবেন—‘আহাহা, ইলিশ মাছের এই জোড়া পেটি কেন আমায় দিলে? শ্রদ্ধা, ঋতি মাঝখানে গর্ত মাছ মাঝখানে গর্ত মাছ করে।’
পিসিমা বলবেন—‘ওদের দেওয়া হয়েছে।’
—‘ভেটকি মাছের ন্যাজা? অংশু খেতে ভালোবাসে, আমাকে দিলে কেন?’
—‘ছ্যাঁচ্ড়াতে যে মুড়ো দিয়েছ তার গোটাটাই তো আমাকে দিলে দেখছি—ইন্দ্র-পুলকের আর রইল না।’
পিসিমা বলবেন—‘এত বড় সংসারের ছ্যাঁচড়া কি একটা মুড়োয় হয় দুগগি? শান্তি করে দুটো খা না!’
—‘দুধের সর? সেজমাকে দাও, মাছ খায় না।’
—‘ধোঁকা চারটে দিয়েছ কেন?’ —দুটো বাবা তুলে রেখে দেবেন। জানেন এ সব জিনিস অন্যদের বঞ্চিত করে কর্তাদের পাতে বেশি বেশি দেওয়া হয়ে থাকে।
বুড়ো-বুড়ি রান্নার সময়ে পুনপুনরা হুড়মুড় করে রান্নাঘরে ঢুকে যাবে। পিসিমা মোটেই বরদাস্ত করবেন না সেটা। ‘যা পালা পালা,’ বুড়োবুড়ির রান্না এমনই একটা পবিত্র অনুষ্ঠান যে বালখিল্যদের উপস্থিতি পর্যন্ত তাকে অপবিত্র করে দিতে পারে।
বাবার অভ্যেস প্রথমে খানিকটা ঝোল চুমুক দিয়ে খেয়ে নেওয়া। খানিকটা খেয়ে তারপর বাবা টের পান মস্ত কাঁসার বাটির তলার দিকে শ্রীলশ্রীযুক্ত বুড়ো মহাশয় বসে আছেন। শিরে ধান-দুর্বো সহ৷ বাবা তাদের লোভের কথা জানেন।
—‘এঃ, আগে বলবে তো! এঁটো করে ফেললুম!’
পিসিমা বলেন— ‘ওদের সব্বাইকার আচে, তুই খা, ওটা তোকে খেতে হয়।’
—‘তা ঠিক।’ —বাবা ক্ষুন্ন মুখে তাঁর প্রিভিলেজের সদ্ব্যবহার করতে থাকেন। কিন্তু বুড়ির সদ্গতির সময়ে বুবু-পুনপুন, বুনবুন যদি থাকে তো তারও ডাক পড়ে। শ্রীযুক্তা বুড়িকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে মা তিন ছেলেমেয়ের মুখে তুলে দেন। কী অপূর্ব স্বাদ! সেই একই ডালবাটা, একই কুলো, একই রোদ, কিন্তু বাচ্চা-কাচ্চা বড়ির থেকে বুড়ো-বুড়ির স্বাদ আলাদা।
এ মা, কাউকে বলো না, বুনবুনের মনে হয় মা বাবা ঠাকুর্দা-ঠাকুমাকে খাচ্চেন। বুড়ো-বুড়ির সঙ্গে ঠাকুর্দা-ঠাকুমার সাদৃশ্যটা বড্ডই বেশি। দিদিভাইও বুড়ো-বুড়ি বড়ি দেন, সেই বুড়ো-বুড়ি দাদাভাই আর দিদিভাই খান, তখন কিন্তু মনে হয় ওগুলো বড়িই, আর কিছু না। কিন্তু চার নম্বরে এলেই সব কেমন বদলে যেতে থাকে। বুবু বলে মে’টা বন্দিনী সীতা হয়ে যায়, দুগ্গি লক্ষ্মণ, পুনপুন কেন কে জানে বিশ্বামিত্র মুনি, ই-দাদা জনক রাজা… এবং বুড়োবুড়ি ঠাকুর্দা-ঠাকুমা। চার নম্বরটা এইভাবে রূপকের রাজ্য। এখানের চৌবাচ্চা চৌবাচ্চা নয়, সমুদ্র একেবারে প্রশান্ত আটলান্টিক মহাসাগর, দালান দিয়ে হারুন-অল-রশিদ প্রজাদের অবস্থা দেখতে ছদ্মবেশে বেরোন, পিসিমার ভাঁড়ার ঘরে আলাদিনের প্রদীপটা পড়ে আছেই—এটা বুনবুন পুনপুন জানে। পিসিমার যে একদিনও জ্বর হয় না। হলেই ওরা প্রদীপটা বার করে নিতে পারে। দৈত্যকে পুনপুনের ভয় করে, বুনবুনের করে না।
—‘কী দিদি! বড়ি-হাত করলেন?’ পাশের ছাত থেকে অবিনাশ জেঠি বলছেন। পাঁচিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দুই বাড়ির গিন্নির কিছুক্ষণ বিশ্রম্ভালাপ চলে। কী ভীষণ টেকনিক্যাল সব বিষয়ে কথাবার্তা হয়, বড়দের কথা সব—আলুর দর কত, ঘি কত করে যাচ্ছে, একরকম ভেজিটেবল ঘি উঠেছে। সস্তা। চিনি কন্ট্রোলে না উঠলে কী বিপদ! ইত্যাদি ইত্যাদি। বুবুর কানে গিয়ে ধাক্কা দেয় শব্দগুলো। কী ভীষণ প্রশংসনীয়ভাবে শক্ত কথাগুলো। এইরকম সব কথা বলা তার জীবনে হবে কি? মায়ের মতো ফটাফট শব্দে ডাল ফেঁটাতেই কি সে কোনওদিন পারবে? মায়ের মতো বেশ চুড়ি ঝমঝম করতে করতে সে কুটনো কুটত! বঁটির ওপর তোমার আঙুল পড়ছে, অথচ আঙুল কাটছে না। চুলও কী বড়! নিজের কানের কাছ অবধি গজানো চুলগুলোয় হাত বুলোয় সে। মা কুটনো কুটছেন, বড়ি দিচ্ছেন, চুল লুটিয়ে রয়েছে মেঝেতে। একটু-একটু পাকা মেশানো চুল। এই-ই উচ্চাকাঙক্ষার পরাকাষ্ঠা এখন বুবুর। কিন্তু অত লম্বা চুলও তার হচ্ছে না। অমন করে আলুর খোসা ছাড়ানোও তার আর এ জন্মে হতে হচ্ছে না।
আগে সে একসময়ে ভেবেছিল পিনুদিদিকে চু-কিতকিত খেলায় হারিয়ে দিতে পারলেই তার একটা কাজের মতো কাজ করা হবে। কিন্তু সে উচ্চাশা ইদানীং তাকে বিসর্জন দিতে হয়েছে। সে তো আর খেলতে পারে না। হাতে পায়ে বড্ড আলস্য। সঙ্গীসাথীরা তাকে ঠকায়। এই তো সেদিন রুবি বলল—‘ভগবান দেখবি?’
ভগবান দেখতে বুবুর বড্ডই ইচ্ছে। সে ঘাড় হেলায়। ভগবান মানে কী? মা কালী? কৃষ্ণঠাকুর? বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী? এইরকম কতকগুলো প্রশ্ন তার মনে না উঠে পারে না। কিন্তু না, মনের মধ্যে খুব চুপিচুপি তার ধারণা কৃষ্ণ ঠাকুর কৃষ্ণ ঠাকুরই, কালীমাও কালী মা-ই। আর বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীকে যতই ভক্তিভরে পুজো করা হোক না, অত ভুঁড়ো-পেটা, অতখানি ছারপোকা উকুন-অলা জটা মাথায় কেউ ভগবান হতে পারেন না, পমপম যতই বলুক। ভগবান অন্যরকম কিছু, অন্যরকম কেউ। তা রুবি যদি ভগবান দেখার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারে তো ভালো তো! সে রাজি হয়ে যায়। রুবি বলে—‘একশোবার গুনে গুনে কপালের মাঝখানটা ঘষ, ওই খান দিয়ে দেখতে পাবি।’
বুবু তো এখন আর একশো গুনতে পারে না, সমস্ত সংখ্যা সমস্ত অঙ্ক তার মাথায় তালগোল পাকিয়ে গেছে। রুবিই গুনে দিল, তারপর বলল—‘এইবার একফোঁটা জল দে।’
ওরে বাবা, সে কী জ্বলুনি। রুবি ফিকফিক করে হাসতে হাসতে যেতে যেতে বলছে— ‘ভেলভেটিটা তু তু তু তু ভেলভেটিটা তু তু তু তু’, রাগেও বটে, কষ্টেও বটে। ‘ভেলভেটিটা’ বললে বুবু ভীষণ ক্ষেপে যায়। পালিয়ে যাচ্ছে। বুবু হাপুস নয়নে হাতে করে মুখ ঢেকে ছটফট ছটফট করে।
টমদিদি বলে—‘কাঁদছিস নাকি? বুবু? দেখি কী হল?’
বুবু প্রাণপণে মুখ ঢেকে থাকে। দেখাবে না, সে দেখাবে না। জোর করে হাত সরিয়ে টমদিদি বলে—‘এ কী হয়েছে রে? এমন করে নুনছাল উঠে গেল কী করে?’ —বুবু কিচ্ছু বলে না। সে কেন বোকা! তাই-ই তো তাকে সবাই ঠকায়।
একদিন খেলাঘরের রান্না হচ্ছে। ছোট ছোট চাকিতে ছোট ছোট লুচি বেলা হয়েছে। পিনুদিদি সেই কাঁচা লুচি মিছিমিছি ভেজে বুবুকে খেতে দিল। বেগুনের বোঁটার দিকটা কেটে এনেছে।
—‘নে, নুচি-বেগুনভাজা খা বলছি।’
পিনুদিদিকে সব্বাই ভয় করে। যখন-তখন এক চড় মেরে দিতে পারে। চুলের ঝুঁটি না ধরে ঠাস করে চড়। কাজেই, পিনুদিদি যখন বলেছে তখন খেতেই হবে।
পুতুলের ছোট্ট কাঠের থালায় কাঁচা লুচি নিয়ে বুবু হিম শরীরে বসে থাকে। —‘কী হল? খেলি না?’
হঠাৎ পুনপুন বলে—‘ওগুলো তো কাঁচা, ও কী করে খাবে?’ মরিয়া হয়ে বলে ফেলেছে পুনপুন। নয়তো এমন বিদ্রোহ করা তার সাহসে কুলোয়ই না।
—‘ঠিক আছে যা, খেতেও হবে না, খেলতেও হবে না’—পিনুদিদি দূরদূর করে তাদের তাড়িয়ে দিল।
তাই লোভ হলেও বুবু পারতপক্ষে কোথাও যায় না। না খেলে খেলে গা ব্যথা করে, তবু সে জানলার গরাদ আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সিংবাড়ি আর সেনবাড়ির মাঝখান দিয়ে রায়চৌধুরীদের এক জটলা সুপুরি গাছ দেখা যায়। অন্য সব গাছের মাথা দুলবে, ডালপালা দুলবে, পাতা কাঁপবে, শুধু সুপুরি গাছ পিনুদিদির মতো একটা তালঢ্যাঙা মেয়ে গাছেদের সংসারে, সে একেবারে তলা থেকে পুরোটা দোল খাবে। দেখতে দেখতে বুবুও দোল খায়, দোল খায়, দোল খায়।
সেনগুপ্তদের বাড়ির পেছনে, তারও পেছনে, অনেক দূরে গোলাপি ছাতের একটা বাড়ির ওপর একটা ঢ্যাঙামতন লোক দাঁড়িয়ে থাকে। মাথায় টুপি, গায়ে আলখাল্লা। যখন সূর্য ডোবে লোকটার পেছন দিয়ে তখন ওকে কালো চৌকোমতন দেখায়। বুবু দূর থেকে ওর সঙ্গেই ভাব করে। রুবি ঠকাবে, পিনুদিদি মারবে, পুনপুন মানিকদের বাড়ি যাবে, তা হলে সে কী করবে? সে তাই ওই লোকটার সঙ্গে ভাব করে।
—‘থিনুবাবু, থিনুবাবু, কেমন আছেন?’
লোকটার নাম নিশ্চয় থিনুবাবু, কেননা ওকে থিনুবাবুর মতোই দেখায় ঠিক।
—‘থিনুবাবু, থিনুবাবু আপনারও কি অসুখ করেছিল?’
থিনুবাবু উত্তর দেন না। তাঁকে বড় বিষগ্ন দেখায়।
—‘এখন কেমন আছেন?’
থিনুবাবু কিছু বলেন না, কিন্তু বুবু বুঝে নেয় থিনুবাবু ভালো নেই।
—‘আপনাকেও কি কেউ ঠকিয়েছিল? কেউ কাঁচা লুচি খেতে দিয়েছিল? ও থিনুবাবু!’
রকম দেখে মনে হয় ঠকানোর চেয়েও, কাঁচা লুচি খাওয়ানোর চেয়েও খারাপ কিছু কেউ করেছে থিনুবাবুর ক্ষেত্রে। থিনুবাবু তাই স্থাণু হয়ে গেছেন। গোলাপি ছাতে পাঁচিল ঘেঁষে স্ট্যাচু হয়ে রয়েছেন। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই বুবুর পশ্চিমের জানলায় ছুটে যাওয়া চাই। হ্যাঁ, ঠি-ক। থিনুবাবু দাঁড়িয়ে আছেন।
—‘থিনুবাবু, আপনি কি সারারাত দাঁড়িয়েছিলেন? ঘুমোতে যাননি?’
জবাবের দরকার হয় না, বুবু বুঝতে পারে থিনুবাবু সারারাত ঘুমোননি।
—‘আপনার মা বকেননি থিনুবাবু?’ —বলতে গিয়ে সামলে নেয় বুবু। থিনুবাবুর মতো হ্যাট কোট পরা লোকেদের কি মা থাকেন? থাকলেও কি বকেন?
তার মা তো তাকে দুপুরবেলাও জোর করে শুইয়ে রাখেন। সে-ও ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু মাঝদুপুরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়, সে বলে— ‘থিনুবাবু, আপনি কি এখনও দাঁড়িয়ে আছেন? দুপুরবেলা একটু ঘুমিয়ে নিন না।’ মা বলেন, ‘কী বিড়বিড় যে করে মেয়েটা ঘুমের ঘোরে!’
মাঘ মাসে সেবার হাহা করে বৃষ্টি পড়ে। ছুঁচের মতো সরু ধারালো ফলার বৃষ্টি উপেক্ষা করে বুবু সবার চোখ এড়িয়ে দৌড়ে ছাতে চলে যায়। ঠিক। থিনুবাবু ভিজছেন।
পমদিদি তাকে ধরে নিয়ে আসে। ভিজে চুল মুছিয়ে দেয়। ভিজে জামা ছাড়তে ছাড়তে বুবু নিজের মনকে বোঝায়, থিনুবাবু তো আসলে একটা লাঠির ডগায় একটা ঝুড়ি। আর লাঠিটাতে একটা কী যেন কাপড়ের মতো আটকে আছে। ভিজলেও থিনুবাবুর কিছু হবে না। কিন্তু তবুও তার বুকের মধ্যেটা হু হু করে—থিনুবাবু সত্যি-সত্যি না থাকলেও থিনুবাবু সত্যি-সত্যিই আছেন। কিসের এত অভিমান থিনুবাবুর? কেন রোদে জলে দিনে রাতে ঝাঁঝে হিমে থিনুবাবু একঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন? কেন বাড়ির ভেতর যান না? ঘুমের মধ্যে সে বিড়বিড় করে—‘থিনুবাবু, থিনুবাবু, এবার ঘরে যান, রাগ করে আর ভিজতে হবে না, আপনাকে কেউ আর ভেলভেটিটা তু তু তু তু বলবে না।’
নবম অধ্যায় : শ্রীদাম-সুদাম-সুবল সখা
পাকুমা এসেছেন আমাদের বাড়ি। সঙ্গে মানিক। আমি বুনবুনের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলছি। মা ডাকছেন। আমরা দু-ভাই গেছি। পাকুমা অবাক হয়ে দেখছেন।
—‘আশ্চর্য! কোনটা পুনপুন?’
ঠাকুমা হাসছেন—‘আপনিই চিনে নিন না।’
পাকুমা তাকাচ্ছেন আমাদের দিকে। ভালো করে দেখছেন। এবার আমাকে খপ করে ধরে কাছে টেনে নিলেন।
—‘ঠিক হয়েছে,’ মা-ঠাকুমা বলছেন, মুখে হাসি।
—‘কী করে চিনলেন!’
—‘বাঃ, আমার মণি-মাণিক্য আমি চিনব না,’ পাকুমার রহস্য নিশ্চয় কেউ বুঝতে পারল না।
আমি তো ছোট নই। পাকুমা আমাকে কোলে বসিয়েছেন বলে আমার লজ্জা করছে। বুনবুন পরে ঠিক আমাকে ক্ষ্যাপাবে। পাকুমা বুনবুনকে ডাকছেন।
—‘এসো, তুমিও এসো। তোমাকে কী বলব? সোনা?’
বুনবুন পাকুমার হাত ছাড়িয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
মানিক বলল ‘কেন রে পুনপুন, কত দিন যাস না।’
পাকুমার মুখে হাসি, কিন্তু দৃষ্টি স্থির আমার মুখের ওপর। চোখের ভেতর দিয়ে একেবারে মাথার ভেতর, বুকের ভেতর চলে যাচ্ছে।
মাণিক বলল— ‘জানিস তো মেজদিমণির বিয়ে। কী মজা যে হবে! সারা হপ্তা মজা। খালি মজা করব। মাস্টারমশাইদের ছুটি করে দিতে বলেছি। মাসিমণি, পুনপুনের মাস্টারমশাইকেও ছুটি দিতে বলুন। বলুন না?’
মা হাসছেন—‘হ্যাঁ, হ্যাঁ তোমার মেজদিমণির বিয়ে যখন তখন তো ওরও ছুটি হওয়া চাই-ই! কিন্তু ইস্কুলে কি মাস্টারমশাই ছুটি দেবেন?’ মায়ের হাতে পত্তর। পাকুমা নিজে এসেছেন নেমন্তন্ন করতে। ডাক্তারবাবুর বাড়ি বলে কথা। যে ডাক্তারবাবু পাকুমার সায়াটিকার ব্যাথা সারিয়েছেন। ছোটদের কৃমি, টনসিল, গ্ল্যান্ড, মাম্পস, হামজ্বর স-ব যাঁর কাছে এক্কেবারে কাবু হয়ে গেছে!
মানিক বুনবুনকেও সাধাসাধি করছে। ‘চল না, চল না।’
আমার নিজের লোক এতগুলো, আমার একটু সাহস হয়।
বুনবুনের আগে পুনপুন এই ভাবে হাত ধরাধরি করে ওরা রাস্তা পার হয়। এখন পুনপুন লিড করছে, কেননা সিং বাড়িটা পুনপুনেরই চেনা এলাকা।
দীপুদা এসেছে, দীপুদা এলে সে মেজর-জেনারেল। ‘সৈন্যগণ তোমরা নিশ্চয় জানো তোমরা আজাদ হিন্দ ফৌজ। মেয়েরা তোমরা ঝাঁসীর রানি বাহিনী। আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চল দিয়ে মাতৃভূমি ভারতবর্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। চলো ইম্ফল। লাইন আপ বয়েজ অ্যান্ড গার্লস।’
আমরা সব বাইরের উঠোনে সার বেঁধে অ্যাটেনশনে দাঁড়িয়ে গেছি। ‘স্ট্যান্ড অ্যাট ইজ’, স্ট্যান্ড ইজি’, বুনবুনের প্রত্যেকটা করতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। একবার দীপুদার বেটনের বাড়ি খেল। আমি শিউরে উঠছি। বুনবুন কাঁদবে না তো! দীপুদা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে বলছে ‘ডোন্ট মাইন্ড, আ অ্যাম নেতাজি ফলো মি।’ বুনবুন কাঁদো কাঁদো হয়ে ছিল। কান্নাটা গিলে নিয়েছে।
—‘ভাই সব’ দীপুদা/নেতাজি চিৎকার করে বলল ‘চারদিকে ভী-ষ-ণ যুদ্ধ। বোমারু বিমান ঘোরাফেরা করছে আকাশে দলবেঁধে, আমরাও অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান নিয়ে রেডি আছি। ক্যাপটেন শাহনাওয়াজ,’ বুনবুনের দিকে তাকিয়ে বলল দীপুদা ‘গেট রেডি’। ওঁ-ওঁ-ওঁ-ওঁ-ওঁ। বাস খেলা শুরু হয়ে গেল।
আমরা বাইরের উঠোন থেকে ভেতরের উঠোন। ভেতরের উঠোন থেকে অন্দরে, দোতলায়। আজকে আর কোথাও কোনও বাধা নেই। মানিকের বাবার ঘরে টেবিলের ওপর মস্ত বড় চাদর বিছিয়ে দিয়েছি আমরা, বিছানা থেকে তুলে। চারদিকটা ঝুলে পড়ে টেবিলের তলাটা তাঁবু হয়েছে। আমি মানিক আর বেলী সেখানে। চাদর ফাঁক করে দীপুদা একবার দেখে গেল, খুব খুশি, বলল—‘বাঃ, গুড, ঠিক আছে। কিন্তু ক্যাপটেন ধীলন, হবিবুর রহমান, লক্ষ্মী স্বামীনাথন তোমরা বলো এটা কী?’
আমরা বলি—‘তাঁবু, টেন্ট।’
—‘উঁহু, এটা ট্রেঞ্চ। সোলজার্স, শিগগিরই কিন্তু শেল ফাটবে তখন তোমরা মরে যাবে।’ পকেট থেকে একটা হুইসেল বার করে দীপুদা ফু দিল তাতে। জোরসে।
ব্যাস আমরা ট্রেঞ্চের ভেতরে ঢুকে গেলুম।
গায়েহলুদের তত্ত্ব এসেছে। সারা দালানটা ভরে গেছে। ‘ছেলেরা খাবার নিয়ে খাও।’ ট্রে থেকে তুলে তুলে আমাদের হাতে ইয়া ইয়া খাবার তুলে দিলেন মানিকের বড় জেঠিমা। খাস্তানিমকি, শিঙাড়া। বড় জেঠিমার শাড়ির পাড়ে বড় বড় হাতি চরে বেড়াচ্ছে। চুড়ি ঝমঝমে মোটা মোটা হাত। ছোট ছোট পুতুলের বালিশ তাঁর হাতের পাতায়। গায়েহলুদের তত্ত্ব এখনও আসছেই আসছেই। লাল ডুরে-শাড়ি-পরা দাসীতে দালান ঝমঝম করছে।
জেঠিমা বললেন, ‘আমাদের—এর ডবল যাবে।’
একজন কাকিমা বললেন—‘এস্টেটের পয়সায় এখন কত লপচপানি করবে করে নাও দিদি, আমাদের ছেলেমেয়েগুলোর বেলায় ফক্কা।’
—‘মুরোদ থাকে তো বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে এলেই হয়’, কে একজন ঝংকার দিলেন।
—‘কার বাপের বাড়ির কিসের পয়সা জানা আছে।’
এ বলল—‘আমারও জানা, সকলেরই জানা, আমার বাবা ইয়ের টাকায় বড়লোক নয়।’
ও বলল—‘যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? ঠাকুমা তুলছো?’
সে বলল—‘থামো থামো, জিনুর উনি তো ঠাকুমা নন, পিসিমা। বড় লোকের ধাইগিরি করে অনেক পয়সা …’
এই রকম কথা ছোঁড়াছুঁড়ি চলতেই থাকল, আমরা টেবিলের তলায় শেল ফেটে মরে গিয়ে শুনতেই থাকলুম শুনতেই থাকলুম। মাঝখানে নিমকি, শিঙাড়া, কচুরিগুলো নিয়ে এসে আবার মরে গেছি। দীপুদা যদি এসে দ্যাখে মরবার নাম করে আমরা কচুরি-নিমকি খাচ্ছি, কী করবে বলা শক্ত। হঠাৎ তিন চারটে শাঁখের শব্দ। হুড়মুড় করে ছুটেছি সবাই। নীচে উঠোনে আলপনা, আলপনার মধ্যে শিল, চার দিকে কলাগাছ নিয়ে হলুদ হলুদ ডুরে শাড়ি পরে মানিকের মেজদিমণি চান করছে। কপালময় জবজবে তেল-হলুদ।
চারিদিকে মেয়ে মেয়ে খালি মেয়ে। মেয়েতে মেয়েতে ছয়লাপ। খিলখিল করে হাসতে হাসতে নামছে, উঠছে এ ওর গায়ে হেসে হেসে ঢলে পড়ছে। মেয়েগুলো ভারি ঢঙি হয়। পিসিমা বলেন—‘ঢঙি, ধিঙ্গি, ভিরকুট্টি।’ কতরকম রঙের শাড়ি, চুলের কী বাহার। গয়না ঝমঝম করছে। এত সাজতে হয় নাকি? ছিঃ আমাদের দিদিরা তো কখনও খোঁপা করে না। সব সময় বিনুনি। পাকা পাকা মেয়েরা খোঁপা করে। না রে বুনবুন? বুনবুন দেখ, ওরা কেমন মেঝেতে আলপনা আঁকছে, চুল আঁচল লুটিয়ে রয়েছে, ওদের শাড়িতেও আলপনা। কী ভালো লাগছে না রে? আমরা যেমন পেঁয়াজ রসুনের উগ্র গন্ধ সহ্য করতে পারি না, তেমনি বেশি সাজ, বেশি গয়নার মেয়েও সইতে পারি না। ভেতরটা কুঁকড়ে যায়। বুনবুনকে আমি মনে মনে জিজ্ঞেস করি, বুনবুন মনে মনে উত্তর দেয়। তার পর যেই আমরা দুজনে দুজনের দিকে তাকাই আমনি বুঝতে পারি বুনবুন কী বলছে, বুনবুন বুঝতে পারে আমি কী বলছি। এখন সুগন্ধ উঠছে চারদিকের বাতাসে। কেশতৈলের সুবাস, সেন্টের সুবাস। নিতুদা থেকে থেকে আমাদের গায়ে গোলাপ জল দিয়ে যাচ্ছে। আরও কত নতুন নতুন খেলুড়ি আসছে। ওই যে গোলাপি পাঞ্জাবি আর ধুতি পরা গালফুলো হাবলুহুবলু ছেলেটা ও মানিকের পিসির ছেলে রথীন। বেনারসি ফ্রক পরা চুলে বো করে ফিতে বাঁধা যে মেয়েটা খালি একটা ঘরে ঢুকছে আর পান খেয়ে আসছে ও চামেলি, বেলীর দিদি। দীপুদার ছোট ভাই হীরুদার হাতেও একটা হুইসেল। মাঝে মাঝেই সেটা পকেট থেকে বার করে জোর ফুঁ দিয়ে দেয়। তার মানে স্ট্যাচু। আমরা যে যেখানে আছি দাঁড়িয়ে পড়েছি। কেউ সিঁড়ির এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে পা বাড়িয়ে, কেউ উঠোনে তিড়িং তিড়িং নাচের মাঝখানে, কেউ হা হা করে হাসছে সেই অবস্থায়।
শানাই বাজছে সমানে। শানাই বাজলে আমার কান্না পায়। দীপুদা বলেছে সন্ধেবেলায় আর খেলা নয়। ফিটফাট হয়ে অনেক কাজ করতে হবে। পদ্য বিলি করা, গোলাপফুলের বোকে আর বেলকুঁড়ির মালা দেওয়া। গোলাপজল স্প্রে করা। আমি গোবর্ধনকে ফুলের বোকে দিয়ে বকুনি খেয়েছি। নিতুদা সেই সক্কাল থেকে একটা গোলাপপাশ হাত করেছে। কিছুতেই হাতছাড়া করছে না। একদল ভদ্রলোকের ওপর দ্বিতীয়বার স্প্রে করতে একজন চোখ রাঙিয়ে বললেন—‘আঃঃঃঃ!! কী হচ্ছেটা কী?’ মানিকের নামে পদ্য হয়েছে। একজন ভদ্রলোক মানিককে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন—‘বারে মানিক বাঃ বেশ লিখেছিস তো! বল দিকিনি পদ্যটা একবার।’ মানিক খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে কোঁচা গুটিয়ে দে ছুট। মানিক জানে না ও কী পদ্য লিখেছে? কী বোকা রে বাবা?
কিন্তু এতসব লোকের মধ্যে আমি নতুন কাকুকে খুঁজছি। আমার ভয় নতুন কাকু পেছন থেকে আমাকে খপ করে ধরে তুলে নিয়ে যাবেন। তার চেয়েও ভয় আমাকে নয়, বুনবুনকে আমি ভেবে, ধরে নিয়ে যাবেন। তখন বুনবুন পেচ্ছাপ আটকে মরে যাবে। আমি বুনবুনের দিকে তাকাই, বুনবুন ধুতি আর লাল সিল্ক সিল্ক পাঞ্জাবি পরেছে। বুনবুন পুনপুনের দিকে তাকায়, পুনপুন ধুতি আর সবুজ সিল্ক সিল্ক পাঞ্জাবি পরেছে। পুনপুন ভাবে বুনবুন নতুন কাকুর ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু বুনবুন মোটেই বুঝতে পারেনি, কেননা ও তো নতুন কাকুকে দেখেইনি। মানিক আমায় বলছে—‘ভয় পাচ্ছিস কেন? নতুন কাকু তো নেই। দেশের জমি-জমা দেখাশোনা করতে পাকুমা নতুন কাকুকে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। এত কাজ যে বিয়েবাড়িতেও আসতে পারেননি৷’ বলে মানিক এক রকম অদ্ভুত মুখ টিপে হাসি কান্নার মাঝামাঝি মুখ করে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি মানিক নতুন কাকুকে ভয়ের কারণটা জানে। কী করে জানল? নতুন কাকু বলেছেন? যেদিন নতুন কাকু আমাকে নিয়ে দরজা দিয়ে দিয়েছিলেন সেদিন কী মানিক আগে থেকেই আলমারির পেছনে লুকিয়ে ছিল?
রান্নাবাড়িতে মিষ্টির ঘরের সামনে চেয়ার পেতে কর্তামাকে বসে থাকতে দেখলুম। কর্তামাকে চেনেন না? উনি পাকুমার মেয়ে। এই মোটা! ভীষণ ফর্সা। চুলগুলো কুঁচি কুঁচি কুঁচি দেওয়া, সাদা-কালো ধবধবে সিল্কের থান কাপড় পরে হাতে কালো ভেলভেটের বটুয়া নিয়ে বসে আছেন। হঠাৎ খুব হই-চই কাণ্ড। রাঙাজেঠু, কর্তামার ছেলে বরযাত্রীদের মাঝখানে হাততালি দিয়ে নাচছেন, মুখ লাল, মুখের ফোলা জায়গাগুলো আরও ফুলে গেছে। কাছাকোঁচা খোলা আবস্থা। গোবর্ধন আর দায়ুদ চ্যাংদোলা করে শেষে রাঙাজেঠুকে নিয়ে যাচ্ছে। মানিকের বাবা বরযাত্রীদের বলছেন —‘ওই সব নানান পোষ্য, জ্ঞাতগুষ্টি রয়েছে, বুঝলেন না?’
কর্তামা দেখি ফোঁস-ফোঁস করে কাঁদছেন। এতক্ষণে পাকুমার দেখা মিলল। পাকুমা বলছেন—‘অনেক দিনই তোমায় বলেছি উমা, ছেলেদের বিলাস-ব্যসনের মধ্যে ডুবিয়ে না রেখে মানুষ করো, এখন কাঁদলে কী হবে?’
কর্তামা বললেন—‘তাই বলে পাঁচজনের সামনে চিনতে চাইবে না? পোষ্য-টোষ্য বলে হাত ধুয়ে ফেলবে? অ্যাতো অপমান?’
—‘এর চেয়েও বেশি অপমান কাজ-কর্ম না করে বসে থাকা। কিন্তু সে তো তুমি বুঝবে না!’
—‘শুধু একটা করে বিয়ে দিয়ে দাও ছেলে দুটোর আমার….. এ কথা তোমাকে বলে বলে আমার মুখ পচে গেল মা, শুনলে আর এমন অবস্থা হত না।’
রাঙাজেঠু তো আমার বাবার চেয়েও বড়? রাঙাজেঠুর বিয়ে? শুনে আমার ভীষণ হাসি পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পাকুমা হাসছেন না, গম্ভীরভাবে বলছেন—‘কর্মহীন, উদ্যমহীন পুরুষের বিয়ে দিয়ে কোনও মেয়ের নাককাটা আমার দ্বারা হবে না বীথি।’
কর্তামা এক থলো চাবি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন —‘এই নাও তোমার মিষ্টির ঘরের চাবি।’
পাকুমা কোনও কথা না বলে দক্ষিণের ঘরে ঢুকে গেলেন। এদিক ওদিক চেয়ে কর্তামা আবার চাবিখানা তুলে নিচ্ছেন, চোখ মুছে ভারিক্কি হয়ে বসছেন চেয়ারে।
মানিকের এক কাকিমার মেয়ে ছবিরানি। একেবারে গোরিলার মতো মোটা। তার ভুরু নেই। চোখের পাতা নেই। নাক নেই। সমস্ত থাক থাক মাংসর তলায় যেন চাপা পড়ে আছে। ছবিরানি আমাদের থেকে বড়। কিন্তু কেন জানি না আমাদের দাদা বলে। আজকে বেগনী বেনারসী কাপড়ের কী একরকম মুসলমানী পোশাক পরে গড়গড়িয়ে গড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তার ভুরু ধনুকের মতো করে আঁকা, ঠোঁটে লাল টুকটুকে লিলিস্টিক, গাল গোলাপি হয়ে আছে রং দিয়ে। নিশ্চয়ই ছবিরানিকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, তাই না? তার গলায় কত মালা, হার, কত রকম। কানে ঝুমকো। পায়ে ঝুমঝুম করছে মল। ছবিরানির সঙ্গে এক দিনেই আমার খুব ভাব হয়েছে। বলল, —‘একটা জিনিস দেখবে’সো পুনপুনদা-বুনবুনদা। এসো না, এসো।’ দোতলার কোণে ওদের ঘর। ঘরে কেউ নেই, খালি ছবিরানির খাস দাসী ক্ষ্যান্ত আছে। ছবিরানি বলছে—‘এই ক্ষ্যান্ত, এই দাদাদের দেখা তো আমার সব জিনিস!’ ক্ষ্যান্ত আঁচল থেকে চাবি বার করে খটাস করে একটা ট্রাঙ্ক খুলে ফেলল ভেতরে শুধু কাচের চুড়ি, রকম রকম কত রকম।
ছবিরানি বলল—‘সব আমার বিয়ের তত্ত্বে যাবে।’ বড় ক্ষ্যান্ত খটাস করে আর একটা ট্রাঙ্ক খুলল—তাতে শুধু মুক্তোর গয়না।
ছবিরানি বলল—‘দেখেছো? কত্ত? ক্ষ্যান্ত দেখা দেখা আরও দেখা!’
ক্ষ্যান্ত বলল—‘এমনি কত আছে। সোনা, হীরে, পান্না, চুণি সে সব বউদিমনির হুকুম না পেলে দেখাতে পারবে না।’
আমি বললুম—‘থাক আর দেখব না।
বুনবুন বলল—‘থাক দেখব না। মে’দের গয়না দেখে কী করব?’
ঘরের একদিকে পরপর দশ বারোটা ট্রাঙ্ক। ছবিরানি বলল—‘আলমারিতে আরও কত আছে। মা ছুঁচের কাজ করছে কত বালিশের ওয়াড়, কত চাদর, বেড কভার, টেবিল কভারে। সব আমার বিয়ের তত্ত্বে যাবে। একদিন মার সময় হলে দেখাব।’
হাসতে হাসতে ছবিরানি দরজার দিকে গড়াতে লাগল। পেছন থেকে বড় ক্ষ্যান্ত বলল— ‘বারো বছর বয়স হলেই তো মরে যাবে, কার ভোগে এ সব লাগবে কে জানে? ছবির দিদি তো দু বছর আগেই গেছে। তার আগেরটি গেল তা বছর পাঁচ তো হবেই। শাঁপ আছে, শাঁপ!’
বুনবুন বলল—‘মে’গুনো মরে যায়? আর ছেলেগুনো?’
—ব্যাটাছেলে পেটে ধরতে পারে না গো। যাও পালাও দিকিনি, আমি এখন যক্ষির ধন আগলাই,’ বলে ক্ষ্যান্ত ডিবে থেকে পান নিয়ে মুখে দিল।
অনেক অনেক লোকের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে খেতে চলেছি, এক পাশে মানিক আর এক পাশে ছবিরানি মাঝে আমরা দু ভাই। বুনবুনকে আমি একবারের জন্যও কাছছাড়া করছি না। নতুন কাকু না থাকতে পারেন, কিন্তু এই বাড়ির পেটের ভেতরে অনেক গা-ছমছমে ব্যাপার আছেই আছে। ভুতুড়ে মেমসাহেব বউ, ভ্যানিশ-কাকিমা। আমার দায়িত্ব বুনবুনকে রক্ষা করা।
মানিক বলল—‘আমি শুধু প্যাটিস আর আইসক্রিম খাব, ছবি তুই?’
ছবিরানি বলল—‘আমি শুধু নুচি আর চপ। শেষকালে চাটনি দিয়ে পোলাও মেখে খাব, আর পাঁপর ভাজা। পুনপুনদাদা তুই?’
আমি বললুম—‘আমি চপ, কাটলেট, প্যাটিস স-ব খাব।’
বুনবুন বলল—‘আমি খালি মাংস খাব, মাংস। তোদের মাংসতে ঝাল দেয় না তো রে? আর আইসক্রিম।’
ছবি তার চুল ঝুলিয়ে বলল—‘আর পান? পান খাবি না?’
—‘নাঃ। সারা দিন পান খেয়েছি। এখন আমার দাঁত ব্যথা করছে। জিভ কেমন অসাড় ঠেকছে। আর পান খাব না।’
—‘আমিও আর পান খাব না’, ছবিরানি আমার হাত ধরে নাচতে নাচতে বলল— ‘আমারও সারাদিন ধরে পান খেয়ে খেয়ে গলা ব্যথা করছে, দাঁত যেন অসাড় ঠেকছে।’
রাত্তির বারোটার সময়ে যখন বর-কনে উলু দিয়ে দিয়ে বাসর ঘরে গেল তখনও চোখ টেনে টেনে জেগে থেকেছি। বাজি, বাজি হবে। বাবা বাড়িতে সাবান-নীল দিয়ে কাচা ধুতি পাঞ্জাবি পরে নেমন্তন্ন খেয়ে গেছেন। চুনোট করা ধুতি আর গিলে করা পাঞ্জাবি পরা লোকেদের আমার ভালো লাগে না। আমারে বাবাকে ভালো লাগে। কিন্তু এটাও ঠিক, এত লিলিস্টিক-রুজ মাখা লোকগুলোর মাঝখানে বাবাকে একটু বেমানান দেখায়। আমার মনে হয় বাবাকে আড়াল করে থাকি। বাবাকে মলিন দেখালে আমি সইতে পারি না।
বাজি আরম্ভ হল। কে যেন বলল—‘ভাগ্যিস বৃষ্টিটা হয়নি।’ আরেক জন ভারী গলায় বলল—‘রূপেন রায় বাজি পোড়াবে ঠিক করেছে, বৃষ্টি হবে?’
বাজির আলোয় হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পাচ্ছিলুম দক্ষিণের ঘরের সামনে পাকুমা দাঁড়িয়ে। চুপটি করে। মুখটা বড্ড গম্ভীর। গম্ভীর না দুঃখী-দুঃখী? হঠাৎ মনে হল পাকুমা তো আসলে সুভগা যার সরল-সুন্দর দুটি ভাই হারিয়ে গেছে, পাকুমা তো আসলে শিবশঙ্করের বউ, যাঁর সঙ্গে শিবশঙ্কর রেগেমেগে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। পেছন থেকে বাবা এসে খপ করে আমায় তুলে নিয়েছেন। বুনবুন বাজির লোভ ছেড়ে অনেক আগেই চলে গেছে। বাবার কোল থেকে দেখছি আকাশে আগুনের অক্ষরে লেখা হয়ে যাচ্ছে—গুডবাই, ফেয়ার ওয়েল।
সকাল বেলা। বর-কনে ভোরবেলা চলে গেছে। অনেক দূরে যেতে হবে। আমাদের রাস্তাটার কী বিশ্রী দশা হয়েছে। কলাপাতা, মাটির গেলাস, খুরি, আর লোকের ফেলে যাওয়া উচ্ছিষ্টের পাহাড়, তার ওপর বাসি ফুল, ভিখারি আর কুকুর জড়ো হয়েছে কত। পেছনের দরজা দিয়ে কাঙালি বিদায় হচ্ছে। যা-যা সব বেঁচেছে কাঙালিরা পাচ্ছে। কিন্তু গন্ধে আমার গা-বমি করছে। কার যেন কী অসুখ, বাড়াবাড়ি হয়েছে। পাকুমা ডেকে পাঠিয়েছেন বাবাকে।
বাবা বললেন—‘পাবন এখন যেও না, কাজে যাচ্ছি।’
মা বললেন—‘যাক না। ছটফট করছে তখন থেকে। ও তো মানিকের সঙ্গে….’
বাবা তাঁর ওষুধের ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছেন। এর ভেতরে খোপ খোপ কাটা আছে তাতে রকমারি ওষুধ সাজাননা। বাবার গলায় স্টেথোস্কোপ।
ছবিরানির বাবার অসুখ। তাই আমার ভীষণ কৌতূহল। মানিককে নিয়ে আমি ছবিরানির বাবার ঘরে ঢুকেছি। ট্রাঙ্কের ঘরটার পাশে। বিরাট ঘর! নিচু খাটে ছবিরানির বাবা শুয়ে। কী বিচ্ছিরি চেহারা। দাড়ি গোঁফ। গায়ে ঢাকা দেওয়া। বাবা একটা ওষুধ দিলেন।
পাকুমা বললেন—‘ভাল হবে তো? ডাক্তারবাবু!’
বাবা খুব গম্ভীর! দেয়ালের দিকে চেয়ে বলছেন (‘এ রোগ তো আপনার অনেক দিনের। কখনও ইনজেকশন নেননি? ওষুধ পালা কিছু করেননি? ছিঃ ছিঃ!’ ছবিরানির মা কাঁদছেন। এই প্রথম ওঁকে দেখলুম। ছবিরানি ঠিক যতটা মোটা, ওর মা ঠিক ততটাই রোগা।
—‘ছেলেমেয়ে হয়েছে?’ বাবা জিজ্ঞেস করছেন।
পাকুমা জবাব দিচ্ছেন—‘মেয়ে হয়, বেশ হয়, যত বড় হতে থাকে কেমন যেন হয়ে যায়। তারপর দশ-বার বছর বয়স হলেই…।’
—‘হুঁ’, বাবা বললেন ‘আপনি যদি বলেন ওঁকে, মানে ওঁর স্ত্রীকে আমি একটু ওষুধ দেব, এবারের সন্তানটি স্বাভাবিক হবে, মারা যাবে না।’ বাবা ওষুধের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন।
পাকুমা বলছেন—‘রুগিকে ওষুধ দিলেন না?’
—‘দেব। হয়তো কষ্ট একটু কমবে, কিন্তু পাকুমা…বুঝতেই পারছেন…আপনারা বিধান রায় মশাইকে একটা কল দিয়ে দেখুন। কিন্তু ওঁর স্ত্রীর জন্য যে পুরিয়া দিয়ে যাচ্ছি, তা নিয়মিত খাওয়াবেন। নইলে আমাকে আর ডাকবেন না।’
ছায়ার মতো আমি আর মানিক সরে গেছি পেছনে। ছবিরানির মা বললেন ‘অসুখের ঘরে ছোট ছেলেদের থাকতে নেই। কেন এসেছ?’
সত্যিই তো? কেন এসেছি? কিসের টানে? রোগ, যন্ত্রণা, মৃত্যুর টানে? না ছবিরানির মা বাবাকে দেখবার জন্য, যে ছবিরানির বিয়ের গয়না আর কাপড়ে একটা পুরো ঘর ঠাসা! না, বোধহয় মৃত্যুর টানেই! ছবিরানি আর মৃত্যু এক। দিন সাতেকের মধ্যেই মানিক ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল, ছবিরানি মারা গেছে। এত মোটা হয়ে গিয়েছিল যে ফেটে গিয়ে মারা গেছে। আমি ছবিরানির শব দেখতে পাইনি। খালি ওর বাবা-মার চোখ দেখেছিলুম। বাবা চোখ বুজিয়ে শুয়েছিলেন, আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না ছবিরানি নেই। মরে গেলেও কোথাও না কোথাও আছেই। খাটের তলায়, আলমারির কোনায়। আমার দৃষ্টি ছিল খাটের তলায়। হঠাৎ ওর বাবা ফটাস করে চোখ দুটো খুললেন, আবার ফটাস করে চোখ বন্ধ করলেন, যেন বাক্সের ডালা বন্ধ করা হল। ছবিরানির মা মেঝের ওপর একটা জরিপাড় ডুরে শাড়ি পরে বসেছিলেন। চোখ দুটো খোলা, কিন্তু যেন কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না।
ছবিরানির বাবা ঠিক কবে মারা গেলেন, আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু পরে যখনই ও ঘরে গেছি দেখেছি কেউ নেই। বিছানা সুজনি দিয়ে ঢাকা, ঘরে এত ধুনো-গুগগুল দেওয়া হচ্ছে যে সুগন্ধ ধোঁয়ায় ঘরে টেকা যায় না। শাদা কাপড় পরা রোগা মাকে দালান দিয়ে আস্তে আস্তে নিয়ে যাচ্ছে ক্ষ্যান্ত দাসী। তারপর একদিন নিউ ইন্ডিয়ান স্কুল থেকে ফিরতে মানিক ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিলে ছবিরানির মায়ের একটা খোকা হয়েছে। খোকা দেখতে অমনি ছুটেছি। ডাক্তারবাবু, নার্স, সাদা এপ্রন পরে বাইরে বেরিয়ে এলেন, পাকুমাকে বললেন—‘ভয় নেই। উনি ভালো আছেন। বাচ্চা সেন্ট পার্সেন্ট নর্ম্যাল।’
পাকুমা হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বললেন—‘ডাক্তারবাবুর দয়া।’
ডাক্তার হেসে বললেন—‘দয়া-টয়া কিছু নয় মা, সায়েন্স, মেডিক্যাল সায়েন্স।’
পাকুমা বিষন্ন হাসি হাসছেন। আমি বুঝতে পেরেছি উনি এই ডাক্তারবাবুর কথা বলছেন না। আমার বাবার কথা বলছেন। পেছন ফিরে আমায় দেখে মাথায় হাত রাখলেন পাকুমা।
—‘খোকা দেখবে?
—‘হ্যাঁ, পাকুমা।’
—‘ক্ষ্যান্ত, দেখাও তো!’ ক্ষ্যান্ত কোলের ওপর ধবধবে সাদা তোয়ালে-জড়ানো, মুখ-কুঁচকোন, লোমশ একাটা সাদা মতন বাচ্চা দেখাল। কাঠি কাঠি হাত পা।
—‘কেমন, ভালো?’
মানিক বলল—‘বিচ্ছিরি, বাঁদরের মতন।’
আমি বললুম—‘বেরালছানা ভিজে গেলে এরকম হয়।’
ক্ষ্যান্ত হেসে বললে—‘তিন চার মাস যেতে দাও তখন এই বাচ্চাকে দেখে দেখেই আর তোমাদের আশ মিটবে না, ঘর আলো করা খোকা হয়েছে, আহা।’
এ তো গেল জন্মকথা। মৃত্যু কিন্তু ছবিরানির সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত যে দুটোকে আলাদা করতে পারতুম না। তাই কিছুদিন পরে যখন আমার ঠাকুর্দা মাঝরাতে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মারা গেলেন, তখন আমি চোখের সামনে যেন দেখতে পেলুম সাদা, পিপের মতো, মাখনের মতো, ভুরুহীন, চোখের পাতাহীন, ছবিরানি মুসলমানি পোশাক পরে গড়াচ্ছে, গড়াতে গড়াতে ফুলে যাচ্ছে, আরও ফুলে যাচ্ছে, তার পর দুম করে ফেটে গেল। ব্যাস আমার ঠাকুর্দাও মারা গেলেন। এই ছবিরানি। এই-ই মৃত্যু।
দশম অধ্যায় : নাচিকেত
পুনপুনের মৃত্যুবোধ আর বুনবুনের মৃত্যুবোধ কিন্তু কখনওই এক নয়। কী করে হবে? এক ডিম ভেঙে দুজনে তৈরি হলে হবে কী! পুনপুন দেখেছে ছবিরানিকে তার মৃত্যুময় জীবনকে, বুনবুন তো এত সব দেখেনি, তাই তার চিৎ-মণ্ডলে ভিন্ন ছবি সৃষ্টি হল। বুনবুনের জীবনে কতকগুলো সমকেন্দ্রিক বৃত্ত আছে। সবচেয়ে কেন্দ্রীয়, ছোট্ট বৃত্তটাতে দিদিভাই ও কানুমামা, সেখান থেকে লাফ দিয়ে সে ঢুকে পড়ে দ্বিতীয় বৃত্তটাতে যার মধ্যে অহর্নিশি ঘুরে যাচ্ছে পুনপুন, বুবু। রুলেতের বলটার মতো কী এক অজ্ঞাত রহস্যময় টানে পুনপুন, বুবু, ঘেঁষে ঘেঁষে আসে ঘনিষ্ঠ বৃত্তের খোপে আবার আরও রহস্যময় কোনও কারণে ছিটকে যায় পরিধির দিকে। তৃতীয় বৃত্তটাতে মা, ঠাকুর্দাদা, দাদাভাই। তার পরের বৃত্তগুলোতে বাড়ির আর সবাই। ভেতর থেকে এমনি করে বাইরে ছড়িয়ে যাচ্ছে সে। অবশ্যই চতুর্থ, তার পরে পঞ্চম বৃত্তেই পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কের অনুভূতি শেষ হয়ে যাচ্ছে না তার জীবনে। পঞ্চমের বাইরেও রয়ে যাচ্ছে কত খেলুড়ি, কত দাসদাসী, প্রতিবেশী, মাটি ও গাছ। বৃষ্টি রোদ হিম স্যাঁতা। তারপরেও বৃত্ত ছড়ায়। অনেকটা পরমাণুর গঠনের মতো জিনিসটা। কতটুকুই বা ভর এই সব কিছুর, তবু চৌম্বক টানে মহাশূন্যের গায়ে সব ঠিকঠাক লগ্ন থাকে এবং তড়িৎ সৃষ্টি হয়। কিন্তু ঠাকুর্দা যে মুহূর্তে মারা গেলেন বুনবুনের বৃত্ত নিচয়ে একটা ভ্যাকুয়াম সৃষ্টি হল। এই ভ্যাকুয়ামটার নামই মৃত্যু।
খেলনার আলমারির মাথায় চড়েছিল সে। কানুমামু বারণ করছিল। সে শুনছিল না। কেননা কানুমামু যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছে সেখানটা তো আসলে হেদুয়ার পুকুর, আলমারির মাথাটা ডাইভিং বোর্ড। তাকে ডাইভ খেতে হবে তো! না কি হবে না! তা সেও ডাইভ খেলো, আলমারিও ডাইভ খেলো। ডাইভিং বোর্ডের এই জাতীয় ধৃষ্টতায় বিরক্ত হয়ে সে জল ঝাড়ার মতো কাচের টুকরো গা থেকে ঝেড়ে ফেলেছিল। এবং আবিষ্কার করেছিল হেদুয়ার পুকুরের তলদেশে কতরকম মণিমুক্তো। পোর্সিলিনের মেমসাহেব, এখন মুণ্ডুভাঙা, হাতির দাঁতের এক্কাগাড়ি খুব ছুটেছে, ফুটিফাটা কৃষ্ণনগরের ফলের ঝুড়ি, পাখা হাতে কিমোনো পরা জাপানি পুতুল কী মন্ত্রবলে বেঁচে গেছে, জয়পুরী পেতলের ফুলদানি, মোষের শিং-এর জোড়া বক আরও কত কী! এগুলো যখন আলমারির মধ্যে ছিল, স্বপ্নের কুহেলির মধ্যে ছিল, বাইরে ছড়িয়ে পড়ে আছে এখন যেন স্বপ্নগুলো সব কেলাসিত হল। সেই মণিমুক্তো কুড়োতে গিয়ে সে দেখে হাত নাড়তেই পারছে না। ডাক্তার সুতরাং হাত সেট করে স্লিং-এর মধ্যে হাত ঝুলিয়ে দিলেন। কোন ডাক্তার? সেই ডাক্তার যিনি হুঁকো খান। অর্থাৎ ঠাকুর্দা।
পরদিন খুব ভোরবেলায় দিদিভাই তাকে ডেকে দিচ্ছেন। মুখ গম্ভীর। চোখ ছলছল।
কানুমামা লাফিয়ে কী বলতে যাচ্ছিল। দিদিভাই বললেন, ‘থাক ছোটকু, আমাকে বলতে দাও, তুমি চুপ করো।’
কানুমামার হাঁ বুজে যাচ্ছে। দিদিভাই বলছেন, ‘দাঁত মেজে নাও।’ ‘দাঁত মেজে নাও তো সোনা,’ এমন নয়, ‘দাঁত মেজে নাও।’ এই নির্দেশের মধ্যে কোনও সুর নেই। বেসুরো, বেতালা নয় ঠিক। কিন্তু সুর আর বেসুরের মধ্যে একটা অস্বস্তিকররকম ফাঁকা জায়গা আছে। সেই জায়গাটাকে ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে দিদিভাইয়ের অদিদিভাই কণ্ঠস্বর, ‘দাঁত মেজে নাও।’ এইটা মৃত্যু।
জামাকাপড় পরিয়ে দিচ্ছেন দিদিভাই, স্লিং-এ হাত ঝুলিয়ে থরথর মুখে দুধ খেয়ে দাদাভাইয়ের-দিদিভাইয়ের মাঝখানে চার নম্বরে যাচ্ছে বুনবুন—এইটা মৃত্যু। আরও কতবার কতরকমভাবে এই একই মানুষদের সঙ্গে যাওয়া তো আছে! কিন্তু এই যাওয়াটার সময়ে যে চারিদিকে একটা শীতালো হাওয়া, একটা প্রয়োজনীয় কিন্তু আবার বৃথা যাওয়ার বোধ, সেটা, সেটাই মৃত্যু।
চার নম্বরে থিকথিক করছে লোক। কিন্তু শব্দ নেই। উঠোনে নামানো ফুলসাজানো খাটে কে একজন অচেনা লোক শুয়ে আছে। বুনবুন দাদাভাইয়ের হাত ছাড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে দোতলায়, ঠাকুর্দার ঘরে। খাটটা শূন্য। কয়েকটা ফুল ছড়িয়ে রয়েছে, অ্যান্টিসেপটিকের গন্ধ, খাটের ওপাশ থেকে বাবা উঠে দাঁড়াচ্ছেন, অদ্ভুত সোজা হয়ে, মুখটা মুখোশের মতো—এইটা মৃত্যু।
অসংখ্য উৎসব, অসংখ্য মজা হইহট্টগোলে ভরা জীবনের মাঝখানে এইরকম একটা অচেনা, সোজা, মুখোশের মতো ব্যাপার থাকে।
জীবনে কখনও ঘুমন্ত ঠাকুর্দাকে বোধহয় দেখেনি সে। হয় রুগি দেখছেন, নয় অনেকের সঙ্গে গল্পগাছা করছেন, গম্ভীর মুখে খটখট করে বেড়াচ্ছেন, দিদিভাই বা দাদাভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হা হা করে হাসছেন, হুঁকো টানছেন। কিন্তু ঘুমন্ত ঠাকুর্দা? নাঃ, দেখা হয়নি তাই মৃত্যুঘুমন্ত ঠাকুর্দাকে তার একেবারেই চেনা লাগেনি, লাগেনি, লাগেনি।
ব্যস। সেই যে দেখলো, আর কখনও ঠাকুর্দার কথা জিজ্ঞেস করেনি সে। কেন, প্রশ্ন করলে সে ভাল করে বলতে পারবে না। কীরকম একটা জটিল অনুভূতি। তার মনে হয়েছিল কেউ ডাকতে এসেছিল ঠাকুর্দাকে, তিনি কাউকে কিছু না বলে চলে গেলেন, কাজটা ঠিক করলেন না। আবার এমনও মনে হয়, মৃত্যুটা অতর্কিতে লাফিয়ে পড়েছে ঘুমন্ত ঠাকুর্দার ওপর এবং ঠাকুর্দা বিষয়ে আলোচনা করলে সেও ওই মৃত্যুর আওতার মধ্যে এসে যাবে। ঠাকুর্দার নেই হয়ে যাওয়াটা ভীষণ দুঃখের, কিন্তু আলোচনা করলে তিনি যদি ফিরে আসেন? আকাশ থেকে খটখট খটাস খটাস করতে করতে, কিংবা ধরো বুনবুন যেখানে ঠাকুর্দার কথা বলছে বা ভাবছে সেইখান থেকে মেঝে ফুঁড়ে উঠে আসেছেন। মেঝের মার্বেলের টালি মাথায় নিয়ে, তবে? সে মহা-আতঙ্কও বুনবুন সহ্য করতে পারবে না। ঠাকুর্দা তো অবিকল আগের মতো ফিরে আসতে পারবেন না, কোথাও কিছু একটা পরিবর্তন তাঁর ঘটে যাবেই। হয় তো দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু যদি বুনবুনকে আদর করতে গেলে, ঠাকুর্দার আঙুল বুনবুনের এক পাশ দিয়ে ফুঁড়ে আর এক পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়! কিম্বা ঠাকুর্দা বুনবুনের মুঠোটা হুঁকোর মতো করে ধরে মুখের কাছে নিয়ে গেলেন, গুড়ুক গুড়ুক শব্দ হচ্ছে, আর বুনবুনের আঙুল, নখ, হাতের পাতা সব ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
অথচ সে কি ঠাকুর্দাকে ভালোবাসছে না আর? তাঁর অভাবে কষ্ট পাচ্ছে না? ভালোবাসছে। কষ্ট পাচ্ছে অথচ ঠাকুর্দা ফিরে আসুন এটাও সে চাইছে না। একই সঙ্গে এই ভালোবাসা আর ভয় কী, কেন, সে কাউকে বোঝাতে পারবে না।
এর কিছুকাল পরেই যখন তার আর কানুমামার একসঙ্গে টাইফয়েড হল, ঝিমঝিমিয়ে মাথার মধ্যে প্রায় সবসময়েই সে একটা ডাক শুনতে পেত। মাঝে মাঝে চমকে উঠত একেবারে এত স্পষ্ট ডাকটা। কোথায় যেন এই ডাকটার একটা দৃশ্যরূপ সে দেখেছে, ক্ষীণভাবে হাতড়াত সে। সর্বক্ষণ তাদের কাছে বসে থাকতে থাকতে একবার সংসারের কাজে গেছেন দিদিভাই, দাদাভাইকে বলে গেছেন দেখতে, দাদাভাই পড়ছেন, সে বারবার উঠে পড়ছে, চিঁ চিঁ করছে তবু উঠে পড়া চাই, সেই সময়ে দাদাভাই অন্যমনস্ক হয়ে তার চুলের মুঠি ধরে বসে পড়ছিলেন। সে চেঁচাচ্ছিল, তখন এক ঝলকের জন্যে বুনবুন ঠাকুর্দাকে দেখতে পায়। ফ্যানের তলায় ঠাকুর্দা ভেসে উঠলেন। চোখ খুব সামান্য ফাঁক হয়ে রয়েছে, আধখোলা চোখ ঠাকুর্দা, তখন বুনবুন প্রাণপণে চিৎকার করে উঠেছিল। দিদিভাইয়ের কানে ঠিক গেছে, তিনি ছুট্টে এসে দেখেন, বুনবুন অজ্ঞান, দাদাভাই বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েই যাচ্ছেন, তাঁর হাতে বুনবুনের চুল মুঠো করে ধরা।
—‘এ কী করছ? ওর চুল ধরেছ কেন অমন করে?’
—‘উঠে উঠে পড়ছিল যে!’
—‘তাই তুমি চুল ধরে শুইয়ে রাখবে?’
কিন্তু কই বুনবুন মারা যায়নি তো! আসলে, ঠাকুর্দার মূর্তিটা মৃত্যু নয়। কানুমামুর হাঁ বুজে যাচ্ছে, দিদিভাই বলছেন, ‘দাঁত মেজে নাও।’ এইরকম আর একবার ঘটলেই আর একটা মৃত্যুও ঘটে যাবে।
আপাতত মৃত্যু নেই। মৃত্যুর বিপ্রতীপ কিছু বোনা হচ্ছে তার সামনে। শীর্ণ, মাথা-ন্যাড়া বুনবুন আর কানু পাশাপাশি দুটো পিঁড়িতে বসে আছে। অদূরে দিদিভাই চুবড়ির পেছন দিকে ঘষে ঘষে তালের লেই বার করছেন। এর সঙ্গে চালের গুঁড়ো মেশানো হবে, গুড় মেশানো হবে, ছাঁকা ভাসা তেলে তালের বড়া ভেজে তুলবেন দিদিভাই। মামিমা উনুনে হাওয়া দিচ্ছেন, মস্ত কড়া বসেছে, তাতে তেল কলকল করে ডাকছে। তেল হল স্নেহপদার্থ। সেই স্নেহ এখানে উষ্ণ হচ্ছে। উষ্ণতার আশ্রয়ে ফুলে উঠবে তালের বল। প্রকৃতি সমস্ত আয়োজন করে রেখেছে, জোগাড় দিয়েছে, এবার নিজের মনের মশলা দিয়ে মায়েরা, দিদিমারা তৈরি করুন খাদ্যসুখ। মুখের মধ্যে যাবে, যতদূর নামবে ততদূর অবধি স্নেহ তার কাজ করতে থাকবে।
বড়মামু দোতলা থেকে নেমে এসেছেন। একটা হাই তুললেন, দুটো তুড়ি দিলেন। তারপরে বললেন, ‘মা, এত আর্শি কী হবে?’
—‘কীসের আর্শি? কী বলছে ভানু, বউমা?’
মামিমা মুখ টিপে হাসছেন, খানিকটা অবজ্ঞা, খানিকটা মজা-পাওয়া হাসি।—‘ওই যে মেজকাকাবাবু বিজনেস করতে বলেছেন না? আর্শির বিজনেসের কথা হচ্ছে।’
—‘তা ভাল তো! কিছু করা ভাল।’
বড়মামা আঙুল মটকে বললেন—‘সি টু এ ট ন। বুঝলে?’
—‘কী বুঝব?’
—‘সি টু এ ট ন। ধরো এক হাজার আর্শি বিককিরি করলুম। এক হাজারটা মানুষ ক্রয় করল। তারপর? কবে সেই আর্শি ভাঙবে, তবে আবার বিক্রিবাটা। সবাইকার ঘরেই কি আর এই বুনটুর মতো দুরন্ত ছেলেপিলে আছে? বছরে যদি দশখানা আর্শি ভাঙল তো দশটা ব্যবসাদার হামলে পড়ল, তখন? তখনকার কথা কে ভাববে? আমি ধরো এগারো নম্বর সাপ্লায়ার, তো দশ বাই দশ কী হচ্ছে? এক। পার সাপ্লায়ার একটা করে আর্শি। আমার ভাগে? সোজা হিসেব—শূন্য।’
—‘কোন ঘরে যাবে, কখন ভাঙবে, কটা লাগবে—এসব ভেবে আবার ব্যবসা করা যায় নাকি? তোমার তো অতশত ভাববার দরকার নেই! কতগুলো অর্ডার পাচ্ছ সেই অনুযায়ী তুমি তৈরি করবে।’ দিদিভাই বললেন।
বড়মামা কথাগুলো কানেও তুললেন না। বললেন—‘শিলনোড়ার কথা ভাবলে তো আমি তাজ্জব হয়ে যাই। তালের বড়া আমারও আছে নাকি? ধরো শিলনোড়া তো দু-তিন জেনারেশন চলে যায়। যায় কি না? মা? বলো না!’
—‘আমি জানি না। যাঃ।’
—‘আঃ! আমাদের শিলনোড়া কবেকার সেটাই বলো না।’
—‘আমি কিনিনি, এইটুকু বলতে পারি।’
—‘তবে?’ বড়মামা হাঁটুতে চাপড় মেরে লাফিয়ে উঠলেন —‘শিলনোড়ার ব্যবসা চলে কী করে?’
দিদিভাই উত্তর দিলেন না। গরম গরম তালের বড়া এক বাটি এগিয়ে দিলেন বড়মামার দিকে।
বড়মামা বললেন, ‘মওলানা তমিজুদ্দিন আহমেদ। বেশ মুচমুচে হয়নি তো বড়াগুলো!’
—‘একটু ঠাণ্ডা হলে হবে।’
—‘তবে এখন দিলে কেন?’ বাটি রেখে দিয়ে বড়মামা উঠে গেলেন।
—‘মার্গিজ, ম্যাকলাউড, উট্রাম।’ বড়মামা পরপর বলে গেলেন। কাটা দরজা খোলার শাঁই শব্দটা পাওয়া গেল।
—‘সি টু এ ট ন’ বড়মামা বেরিয়ে গেলেন।
মামিমা আর হাসি চাপতে পারছেন না। তালের বড়া ভাজার ঝাঁঝরি নামিয়ে রেখে লাল মুখে ভাঁড়ার ঘরে ঢুকে যাচ্ছেন। এর মধ্যে হাসির কী হল বুনবুন বুঝতে পারে না। সত্যিই তো, শিলনোড়ার ব্যবসাদারদের কী হবে? বুনবুনের আর কানুমামুর আর অন্যান্য সব ছেলেদেরই আরও আরও অনেক দুরন্ত হওয়া উচিত ছিল। দিদিভাইয়ের শিলনোড়াটা যদি মাসে একবার করেও ভাঙতে পারা যেত, ব্যবসাদারদের একটু সুরাহা হত। বাজারের ঠাস-দোকানে-বসা শিলনোড়ার দোকানদারদের হতাশ মুখচ্ছবি বুনবুনের চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
কানুমামু বলল—‘সিটু য়েটন।’ বলে এমন হাসতে লাগল যে দিদিভাই তাকে এক ধমক দিলেন।
ছ্যাঁক ছ্যাঁক ছ্যাঁক মনে মনে ল্যাখ—আমি চোখ বুজিয়ে ছ্যাঁক ছ্যাঁক গুনতে থাকি। এক কুড়ি এক কখন ছাড়িয়ে গেছে। আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। কিন্তু সেটা আমি জানি না। জানিস বুবু, আমি ভাবছি আমি জেগে আছি। দিদিভাই বড়া ভেজে চলেছেন, কড়া কলকল করে চলেছে, মামিমা হেসে চলেছেন, কানুমামু বকুনি খেয়ে ঘাড় গুঁজে বসে রয়েছে। বিকেলের পাতিলেবু রঙের আলো ক্রমে কমলালেবু রঙের হয়ে চলেছে। এটা ঠিক ক’সেকেন্ড তা তো আমি জানি না। এই রকমই চলবে, এই বড়া ভাজা, এই হাসি, এই চলন-ফেরন, আমার দুর্বল শরীরে শক্তি না এলেও ক্ষতি নেই, ন্যাড়া মাথায় চুল নাই গজালো। কীরকম একটা আরাম আমি বলে বোঝাতে পারব না।
ঢুল এসে ঘাড়টা ঝাঁকিয়ে দিতেই চমকে দেখি সত্যিই ঝাঁঝরিতে করে বড়া ভেজে চুবড়িতে রাখছেন দিদিভাই, মামিমা ভাঁড়ারঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন, কমলালেবু আলো…। তাহলে আমি কি ঘুমিয়েছিলুম? না জেগেছিলুম? আপনারাই বলুন। এ রকমও তো হতে পারে যে আমার মস্তিষ্কের কিছু অংশ ঘুমিয়ে পড়েছিল, কিছু জেগেছিল। কিন্তু চোখ? চোখ তো বুজে গিয়েছিল। তাহলে? কিছুক্ষণ আগে যা দেখেছি, আধো ঘুমের মধ্যে তার স্মৃতিই কি ভেতরে ভেতরে কাজ করছিল?
যে মৃত তার দিক থেকে যদি মৃত্যু এমন হয়! তুলসীপাতার তলায় ঠাকুর্দার চোখ আধখোলা ছিল। ঠাকুর্দা কি তাহলে এখনও তাঁর ঘুমের সময়কার দৃশ্যটার মধ্যে বুঁদ হয়ে আছেন? ঠাকুমা আলনায় কাপড় কুঁচিয়ে রাখছেন, উত্তরের জানলা দিয়ে ঠাণ্ডা চাঁদ দেখা যাচ্ছে, তালতলার চটির ওপর একটা মথ এসে বসেছে, ঘোর বেগুনি রঙের মথটা! আমি যেমন চটকা ভেঙে আবার জেগে উঠেছি, এবার ভিন্নতর দৃশ্যের দিকে চলে যাব, ঠাকুর্দার বেলায় সেটা ঘটছে না, ওই একটাই দৃশ্যের মধ্যে থেকে যাবেন তিনি। কিন্তু আমি জেনে গেছি কী ভীষণ আরাম ওইরকম থেকে যাওয়ায়। শুধু দৃশ্যটা তো থাকছে না, মেজাজটাও থাকছে। তাই ঠাকুর্দার মনের ভেতরে ফিরে আসবার কোনও তাড়া নেই। হারানোর দুঃখ নেই। ওরা তো সব আছেই…বুনবুন যে নীলবর্ণ হয়ে জন্মেছিল, যে ঠিকঠাক অষ্টম গর্ভ, ডাক্তার হবে, ঠাকুর্দার সবচেয়ে ভরসা যার ওপরে, পুনপুন, যাকে ঠাকুর্দা ‘ফিক’ বলে ডাকেন সে ফিকফিক করে হাসে বলে, বুবু যে নাকি যোগমায়া, যদিও তার যোগ সব মেনিনজাইটিসে কেড়ে নিয়ে গেছে খালি মায়াটি ফেলে রেখে, এবং দুগগি যার মনুষ্যত্বে তাঁর বিশ্বাস ছিল, বুদ্ধিসুদ্ধিতে ছিল না, যে দুগগির হোমিওপ্যাথি তিনি আনসায়েন্টিফিক বলে সহ্য করতে পারতেন না, এখন বুবু সেরে ওঠার পর তাঁর তর্কাতর্কি যে দুগগির সঙ্গে প্রায় শেষ হয়ে গেছে বললেই হয়। ছোটগিন্নি, মনো, বউমা, নাতি-নাতনিরা, বেয়ানঠাকরুন সবাই আছে। আছেন যে যার কাজে ঠাকুর্দা তাই খুব নিশ্চিন্তে তাঁর ঘরের নৈশদৃশ্যে স্থির হয়ে আছেন।
বুবু, বুবু, ঠাকুর্দা যখন মারা গেলেন, তুই বুঝতে পেরেছিলি?
কিছু বুঝতে পারিনি, কী বুঝতে পারছি তা বুঝতে পারিনি।
কে যেন ভাঙা ভাঙা ফ্যাঁসফেঁসে গলায় সুর করে বলছিল—
(ও) জ্ঞানহীন হয়েছে টলতে টলতে চলেছে
জ্ঞানহীন হয়েছে টলতে টলতে চলেছে…
ঠাকুর্দার শ্রাদ্ধ উপলক্ষে যখন কালীদাদু কঠোপনিষদ পড়ছিলেন, তখন আরও একটা ঘরে গীতাও পড়া হচ্ছিল, আর একটা জায়গার উঠোনে ম্যারাপ বেঁধে কীর্তনও হচ্ছিল। শ্রাদ্ধকৰ্মও চলছিল ঠাকুর্দার চেম্বারে। কালীদাদুর কঠোপনিষদ শুনছিল খালি চারজন—বুবু-পুনপুন-বুনবুন আর ঠাকুমা। কেন? কেননা ঠাকুর্দার অবর্তমানে কালীদাদুই ঠাকুর্দার একমাত্র বিকল্প। পাঠটা শুধু পাঠ থাকেনি, ঠাকুমা কালীদাদুকে প্রশ্ন করছিলেন, কালীদাদু উত্তর দিচ্ছিলেন। তাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে সহজ কথায় গল্প করে ব্যাখ্যা করছিলেন কালীদাদু।
নচিকেতা বাজশ্রবসের ছেলে।
ভ্যাঃ, নচিকেতা ঘোষ যিনি গান করেন তো? উনি তো সনৎ ডাক্তারবাবুর ছেলে হন! বাবার বন্ধু সনৎ ডাক্তারবাবু!
—বিশ্বজিৎ যজ্ঞ হচ্ছিল।
—যজ্ঞ কী কালীদাদু!
—এই যেমন আজকে এখানে হচ্ছে। দীয়তাং, ভুজ্যতাং, দান-ধ্যান-পূজা।
বুবু বলল; আর গান!
মেঘের কী গো চূড়া আছে?
ও বুড়িমাঈ বুড়িমাঈ, বুড়িমাঈ
মেঘের কী গো চূড়া আছে?
—কীর্তনবাসরের গান তাকে বড়ই স্পর্শ করেছিল, সে উদ্ধৃত করল।
—হ্যাঁ, ঠিক এমনি। বাজশ্রবস দক্ষিণা দিচ্ছেন, দক্ষিণা দিচ্ছেন।
—দক্ষিণা কী ওদের বুঝিয়ে দিন ঠাকুরপো—
—দক্ষিণা মানে উপহার, দান। আজকেও দেখবে অধ্যাপকদের উপহার দেওয়া হবে, পণ্ডিতদের উপহার দেওয়া হবে।
উপহার কী রকমের হার? বুবু ক্ষীণভাবে ভাবল। কিছু বলল না। আড়চোখে পুনপুন-বুনবুনের দিকে তাকিয়ে দেখল ওদের চোখে কোনও প্রশ্ন নেই। ওরা জানে। সুতরাং বুবু তার অজ্ঞতা প্রকাশ করে বোকামি করবে না। পরে অবশ্য অধ্যাপকদের দেওয়া পেতলের ঘড়া উঁকি মেরে দেখে সে ভালভাবেই বুঝতে পেরে যায় উপহার = ঘড়া, ≠ হার। এবং কিছুদিন পরেই সে তার সদ্যলব্ধ জ্ঞান সবাইকে জানাবার উদ্দেশ্যে পিসিমার ‘উপহার’ থেকে জল খেতে চায়।
পিসিমা সদর্পে বলেন, ‘উপহার না আরও কিছু! গ্যাঁটের কড়ি দিয়ে কেনা।’ বুবু আবার অথৈ জলে পড়ে যায়।
যাই হোক,
নচিকেতা বলল— ‘বাবা, আমাকে কাকে দেবেন?’
বারবার জিজ্ঞেস করতে, বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘যমকে।’
ঠাকুমা বললেন— ‘তা ঠাকুরপো এক অর্থে সব পিতাই তো সব পুত্রকে যমের কাছে দিয়েই রেখেছেন, তাই নয় কি? আদি পিতা যিনি, তিনিই তো সৃষ্টি করলেন মৃত্যু। করে তাকে পাঠিয়ে দিলেন প্রাণীর পৃথিবীতে। যে মুহূর্তে জন্ম দিচ্ছেন, পিতামাতা তো মৃত্যুর কাছে সত্যবদ্ধ হয়ে থাকছেন। দেব, দেব তোমাকেই দেব। তবু দেবার সময়ে কত কান্না, কত অনুনয়!’
কালীদাদু বললেন, —‘এই প্রশ্ন এই ব্যাখ্যা এই সবই প্রকৃত নাচিকেত অগ্নি, বউঠান। সত্যিই, মৃত্যু হচ্ছে জীবনেরই ধর্ম, জীবনেরই স্বভাব।’
কিন্তু সে সময়ে পুনপুন একটা অস্বস্তিতে আর বুনবুন একটা আশ্চর্য স্বস্তিতে ভুগছিল। পুনপুন ভাবছিল—বাবা তো তাহলে তাকে যমকে দিয়ে দিতে পারেন! যজ্ঞ হলেই অতএব সে নুকিয়ে পড়বে। বহুদিন পর্যন্ত পুনপুনের এই উৎসবে-যোগ-না-দেওয়ার স্বভাব থেকে যায়।
অপরপক্ষে বুনবুন ভাবে—ভাগ্যিস, সে বাবার কাছে থাকে না। দিদিভাইরা তো আর বুনবুনদের যমের কাছে দেন না। তেমন কোনও শাস্ত্রীয় নজির পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং সে অকুতোভয়ে ঘোরাফেরা করতে পারে। তবে আজকের দিনটা বাবার কাছ থেকে দূরে থাকাই নিরাপদ।
তিনজনেই উৎকর্ণ হয়ে শোনে নচিকেতার প্রশ্ন—মানুষ মরে গেলে তার কী হয়।
—দেহের মধ্যে আছে আত্মা। আত্মা মরে না। আত্মার বিশেষ রূপ নেই। আগুন, হাওয়া, এদের মতো। আত্মা দেহ নয়, মন নয়, প্রাণ নয়, বুদ্ধি নয়, আত্মা এগুলোকে ছেয়ে থাকে, কিন্তু এগুলির বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে সে বিনষ্ট হয় না।
—‘এ কথা আপনি মানেন ঠাকুরপো!’
—‘না মেনে উপায় কী, বউঠান!না মানলে জীবনের কী অর্থ আপনি দেবেন, বলুন! বেশ তো আপনার উপলব্ধি কী বলে?’
—‘উপলব্ধি? উপলব্ধি কিছু নেই। তবে কেমন মনে হয় শুধু শুধু একেবারে মিছিমিছিই এমন একটা প্রকাণ্ড ব্রহ্মাণ্ড হল? শেষ পর্যন্ত তো সবই বৃথা? বৃথা বোধ যেতে চায় না ঠাকুরপো। বৃথার বাইরে যেতে পারি না।’
বুনবুন ভাবে—ঠাকুর্দার আত্মা, যা নাকি আগুনের মতো, হাওয়ার মতো তা তাহলে যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও রূপ ধরতে পারে। বুনবুনের কাছে রূপ ধরে অনবরতই আসতে থাকবে নাকি?
পুনপুন ভাবে—মৃত্যুও গড়াচ্ছে, ঠাকুর্দাও গড়াচ্ছেন, গড়াতে গড়াতে একসময়ে ঠাকুর্দা আগুন হয়ে জ্বলে উঠলেন, ব্যস ছবিরানি আর তাঁকে ধরতে পারল না।
বুবু ভাবল—তার বুদ্ধি নেই। না থাকলে কী হবে। আত্মা আছে। সে আগুনের মতো, হাওয়ার মতো, সূর্যের মতো। ক্রমে এমন দিন আসবে যখন সে ইচ্ছেমতো রূপ ধরতে পারবে। কেমন রূপ সে ধরবে ভাবতে ভাবতে বুবু কঠোপনিষদের ঘরে ঘুমিয়ে পড়ে।
একাদশ অধ্যায় : পিণ্ডদানম্
অনেক দিন পরে এসেছি মানিকদের বাড়িতে। এক মাস, তিরিশ দিন, চল্লিশ দিন। আমাদের অশৌচ ছিল তো? ময়লা জামাকাপড়, খালি পা, তাই আসিনি। আজ মা বললেন—‘যা না পাবন, যা! বিকেলবেলায় ঘরে বসে থাকা ভাল নয়।’ মানিক আর আমি পায়ে পায়ে ঢুকলুম ভারী ভেলভেটের পর্দা সরিয়ে। এই হল মানিকদের বিখ্যাত গানঘর। এখানে গান হতে আমি দেখিনি। শুনেছি যখন আমি খুব ছোট তখন পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের গান হয়েছিল, ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের গান হয়েছিল। পণ্ডিতে আবার গান গায় নাকি? সাহেবে আবার গান গায় নাকি? পিসিমা বলেন—‘একটা মিনি আর একটা হুলো মাঝরাতে চেঁচালে যেমন হয়, তেমনি। তার চেয়ে একটা ময়নাডালের কীর্তন দিক না।’
বাবা বললেন ‘তা যদি বলো দিদিমণি, ময়না ডালেও মিনির ডাক হুলোর ডাক আছে। তখন কী করবে?’
তা সে যা-ই হোক, ঘরটা ফুটবল মাঠের মতো বড়। যেমনি লম্বা তেমনি চওড়া। মেজদিমণির বিয়ের সময়ে এ ঘরে বর, বরযাত্রী সব বসেছিল। এইখান থেকেই রাঙাজেঠু গাল ফুলিয়ে নাচতে নাচতে বেরিয়েছিলেন। বন্ধই থাকে ঘরটা। মাঝে মাঝে খোলা হয়, ঝাড়-পোঁছ করে, হাওয়া খেলিয়ে আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আজকে খোলা দেখে ঢুকে পড়েছি। চকচকে কালো মেঝে। ঘরটা আঁধার-আঁধার হলে কী হবে, কোথায় যেন আলো জ্বলছে, আমার পায়ের কাছে মেঝেতে অস্পষ্ট আমার ছবি পড়েছে। মানিক বলল—‘এই দ্যাখ, আমারও পড়েছে।’ শার্ট, মুখের খানিকটা, একটা কান, যেন এঁকে কে হাত দিয়ে ঘষে ঘষে দিয়েছে। মেঝের ওপর মাঝে মাঝে গোল পদ্ম করা। বিরাট বিরাট তিনটে ঝাড়বাতি ঘরটায়। মানিক সুইচ টিপে জ্বালিয়ে দিল ঝাড়বাতিগুলো, একটা… দুটো… তিনটে অমনি ঘরটা ঝলমল করে উঠেছে। দেয়ালে দেয়ালে কত ছবি! মাঝে মাঝে বড় বড় সোফা রয়েছে, পিঠ উঁচু গদি-আঁটা কত চেয়ার দেয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো রয়েছে। কী কাজ চেয়ারের পিঠে, পায়ায়, হাতলে! সব ঝকঝক করছে!
আমরা ছবি দেখতে এসেছি। বিরাট বিরাট সব রঙিন ছবি। দেখলে আর চোখ ফেরে না। সামনেই অয়েল পেন্টিং, ঈশ্বরী ধ্রুববালা দেবী, জপের মালা নিয়ে গাল তুবড়োনো মুখ কুঁচকোনো এক বুড়োমানুষ, গেরুয়া-গেরুয়া সিল্কের থান পরেছেন, হাতে জপের মালা।
আমি বললুম— ‘তোর ঠাকুমা নাকি রে?’
ধুত! মানিক বলল—‘এ তো বাবু শিবশঙ্করের মা, দেখছিস না পেছন দিকে ত্রিশূল আঁকা আছে।’ অমনি আমার মনে পড়ে গেল সেই বিরাট সব কাণ্ডকারখানা। ধবধবে সাদা মন্দিরের মধ্যে ত্রিশূলেশ্বরের তেলচান, দুধচান, কাতারে কাতারে লোক দাঁড়িয়েছে— ‘জয় ত্রিশূলবাবাকি জয়’ বলে কারা চেঁচিয়ে উঠল। কী সব কাণ্ড হচ্ছে সেখানে!
এই ধ্রুববালা দেবীই সেই শিবশঙ্করের মা। যাঁরা দুজনেই বলেছিলেন— শিবোহহম্? তবে তো গল্পটা সত্যি! ছবি রয়েছে যখন!
তারপর দেখি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুর। একটু ঠোঁট ফাঁক, ভেতরে খয়া খয়া দাঁত দেখা যাচ্ছে, চোখগুলো ঢুলুঢুলু, হাতে বুজবুজদিদির মতো নাচের মুদ্রা করেছেন। আমি ফিক করে হেসে ফেলেছি। মানিক বলল—‘হাসলি কেন রে?’
আমি—‘এত বড় লোক নাচ করে?’
মানিক— ‘নাচ করবে কেন? ভগবানকে ডাকছে। ওই যে মুখ ফাঁক দেখছিস— বিড়বিড় বিড়বিড় করে ভগবানকে আসতে বলছে।’
আমি—‘কোন ভগবান রে?’
মানিক—‘কালী ভগবান।’
আমরা দু জন ওং নমো করি।
মানিক বলে—‘রামকৃষ্ণ ঠাকুর বক উড়ে যাওয়া দেখে মাঠের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।’
শীতের শুরুতে আমাদের আকাশ দিয়েও তো বক উড়ে যায়, খুব সুন্দর লাগে দেখতে। আমি তো অজ্ঞান হয়ে যাই না? মানিক তুই যাস? না? একদিন অজ্ঞান হয়ে দেখতে হবে কেমন লাগে।
পরেরটায় দেখি স্বৰ্গত ডক্টর শিবশঙ্কর রায়চৌধুরী। কালো চাপকান পরা, পকেট থেকে সোনার ঘড়ির চেন উঠে রয়েছে। ঠোঁটের ওপর আশুতোষের মতন গোঁফ, চোখে খুব রাগী রাগী দৃষ্টি, চশমাটা হাতে ধরা, একটা থামে হাত দিয়ে আড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বাপ্ রে ইনি ছুরি হাতে এসে দাঁড়ালে তো আমি ভয়ে চিৎকার করবো! এইটাই পাকুমার বর? পাকুমার নিশ্চই খুব ভয় করত বলেই কলকাতায় পালিয়ে এসেছিলেন। আমরা দুজনে তর্কাতর্কি করতে লাগলুম এটা সেই চাপকানটা কিনা যেটা তিনি সারারাত ধরে সেলাই করেছিলেন।
মানিক বলল—‘সেটাই।’
আমি—‘রাজ এস্টেটে কাজ করবার সময়ে তো আরও কত চাপকান তৈরি করিয়েছিলেন। আর এই ছবিটা যখন হয়েছে তখন তো আগের চাপকানটা ছিঁড়ে গেছে।’
মানিক গোঁয়ারের মতো বলল—‘না, চাপকান ছেঁড়ে না ছবি তোলবার জন্যে উনি সেই প্রথম চাপকানটাই পরেছিলেন।’
আমি দেখতে লাগলুম একটা চাপকান ভাঁজ করে ধপাস করে হলের ভেতর পড়ল, তারপর আরেকটা, আরেকটা। পৃথিবীর যত লোকে যত চাপকান পরছে, সে সব আর ছিঁড়ছে না। হলটা উপছে পড়ছে চাপকানে। পৃথিবীময় খালি চাপকান। আমার যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। বঙ্কিমচন্দ্রের চাপকান, দ্বারকানাথের চাপকান, রামমোহনের শিবশঙ্করের সবাইকার চাপকান আমার ওপর চেপে বসছে।
একরকম ছুট্টেই আমি পরের ছবিটার দিকে চলে যাই। স্বামী বিবেকানন্দ। মাথায় গেরুয়া পাগড়ি, গায়ে গেরুয়া…এটাও কি চাপকান? কোমরে কষে উড়ুনি না কী বাঁধা, জ্বলজ্বলে চোখ, খুব ভালো লাগে এই ছবিটা আমার। সব সময়ে যেন ঘাড় ফিরিয়ে দেখছেন। কী মস্ত মস্ত চোখ? অত বড় চোখ মানুষদের হয়? ও তো ঠাকুরদের থাকে!
এই বারের ছবিটা দেখেই চিনতে পেরেছি। লাল পাড় শাড়ি পরা, চুল সব সামনে এলানো, কপালে সিঁদুর টিপ, হাতে চুড়ি বালা কত রকম, গলা থেকেও ঝুলছে কত রকম। পাকুমা। এখনকার পাকুমা নয়। অনেক ছোট, তবু চিনতে পেরেছি। এই মুখটাই শুকোতে শুকোতে শুকোতে শুকোতে, এই চুলগুলোই সাদা হতে হতে হতে হতে, এই গয়নাগুলোই খসে যেতে যেতে যেতে যেতে এখনকার পাকুমা হয়েছেন। এমন দিন তা হলে ছিল যখন পাকুমা প্যাঁশনে লাগিয়ে বই পড়তেন না? কালো চুল মেলে লাল পাড়ের ঘোমটা দিয়ে ঘুরে বেড়াতেন? কী সুন্দর!
মানিক কিন্তু বলল—‘দূর। এখনকার পাকুমাই বেশি সুন্দর। পাকুমাদের আবার অত ছোট হলে ভালো লাগে না কী?’
আমি আর মানিককে বললুম না আমাদের বাড়ির অ্যালবামে বাবার একটা ছোট্টবেলার ছবি আছে। এক্কেবারে ন্যাংটাপুটো। আমার কিন্তু সেই ছবিটা খুব ভালো লাগে। বাবাকে যখন গম্ভীর থাকবার সময়ে ভয় করে তক্ষুনি আমি সেই ছবিটা ভেবে নিই।
এমা, তলায় দেখি নাম লেখা আছে ধরিত্রী দেবী। সে কি রে? ইনি তাহলে নিশ্চয় পাকুমার বোন হবেন। পাকুমার নাম তো সুভগা।
মানিক ঠোঁট উল্টে বলল— ‘কি জানি বাবা! আমরা তো এটাই পাকুমার ছবি বলে জানি। সুভগা হয়ত খারাপ নাম ছিল৷’
অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকি ধরিত্রী দেবীর ছবি। যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছেন। আবার ভালো করে দেখতে গেলেই দেখি আমাদেরও পেছনে কার দিকে, কাদের দিকে তিনি তাকিয়ে। পেছন ফিরে বারবার দেখি কেউ আছে কি না। কই, কেউ তো নেই?
—‘পেছন ফিরে কী দেখছিস!’—মানিক জিজ্ঞেস করে।
আমি বলি—‘কার দিকে তাকিয়ে পাকুমা হাসছেন বল তো? পেছনে কে আছে?’
মানিক বলে—‘ধুত। পেছনে আবার কে থাকবে? পাকুমা তো আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে! এর আগেও আমি ছবিটা দেখেছি। সব সময়ে পাকুমা আমার দিকে তাকিয়ে হাসে।’
আমি আর কথা বাড়াই না। পাকুমা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। কিন্তু সে কথা বললে মানিক তো বিশ্বাসই করতে চাইবে না। মিছিমিছি একটা ঝগড়া ঝগড়ি, কান্নাকাটি লাগবে। হাজার হোক পাকুমা তো আগে মানিকের, পরে আমার!
মানিক বললে—‘এই দ্যাখ পুনপুন আমার ঠাকুর্দা।’
হ্যাট কোট পরা একজন খুব সুন্দর দেখতে মানুষ, ঠোটের ওপর সরু গোঁফ। চোখ দুটো যেন কত দূরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
—‘ঠাকুর্দা ইংরিজিতে কবিতা লিখতেন, জানিস তো? কবিতার খাতা আমার জ্যাঠামশাইয়ের কাছে আছে।’
ঠাকুর্দার পরে রবি ঠাকুরের ছবি। এ তো আমি খুব ভালো করেই চিনি। আবার নমো করি। রবি ঠাকুরও তো একরকমের ঠাকুরই। যেমন দুগগা ঠাকুর, শিবঠাকুর, রামকৃষ্ণঠাকুর।
তার পরেই মানিকের মেজ ঠাকুর্দা। খুব গাঁট্টাগোঁট্টা মুখে আলবোলা, গায়ে সবুজ কাজ করা চাদর, পাঞ্জাবি। বসে আছেন, মুখে মোটা গোঁফ। খুব গম্ভীর মানুষ।
তার পর মানিক বলল—‘দ্যাখ চিনতেই পারবি না।’
আমি আন্দাজে বললুম— ‘ছোট্ঠাকুর্দা।’
ওমা, ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু সত্যিই চেনা যায় না। মোগল বাদশাহদের মতন সাজপোশাক। লাল লাল গাল, কী সুন্দর, কী সুন্দর, যেন রূপকথার রাজকুমার।
তার পরের ছবিটা দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। নীল শাড়ি পরা ভীষণ ফর্সা, বাদামি চুল একজন সিঁদুর পরা মেমসায়েব, বড় বড় নীল চোখ। এঁকেই তো আমি আর পুটপুট-বুজবুজ ছাতের ঘুলঘুলি দিয়ে দেখেছিলুম! হঠাৎ দুম করে উধাও হয়ে গেলেন?
ছবির তলায় লেখা—স্বর্গীয় লীলাময়ী দেবী।
মানিক বলল—‘আমার ঠাকুমা। ত্রিলোকেশ্বর রায়চৌধুরীর বউ।’
—‘কী বললে? কে ত্রিলোকেশ্বর?’
আমরা চমকে পেছন ফিরে চাইলুম। মানিকের ছোট ঠাকুর্দা। সেই ফ্যাকাসে ফর্সা রঙ। টিঁয়ে পাখির মতো নাক। সাহেবি স্যুট।
—‘হী ওয়জ এ ড্যাম্ড্ ফুল। লীলাময়ীর মালিক হওয়া অত সোজা না। আই, আই শিবশম্ভু রয়চৌড্রি নো দ্যাট।’
ছোট ঠাকুর্দার চোখ দুটো জ্বলছিল। মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। একটু একটু যেন কাঁপছেন। কোথা থেকে হাওয়া আসছে এত? ছোট ঠাকুর্দার কি জ্বর হয়েছে?
—‘তোমরা কে? এখানে কী করছো?’
—‘আমরা চলে যাচ্ছি’— মানিক ভয়ে ভয়ে বলল।
—‘এটা কি আমার কথার উত্তর হল?’ বলে তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকালেন উনি।
আমি ঢোঁক গিলে বললুম—‘আমি ডাক্তারবাবুর ছেলে। ছবি দেখতে এসেছি।’
—‘হুইচ ডাক্তারবাবু? আমিও তো ডাক্তারবাবুর ছেলে।’
আমি প্রায় কেঁদে ফেলে বলি—‘শিবশঙ্কর ডাক্তারবাবু নয়, আমি দুগ্গাপসাদ ডাক্তারবাবুর ছেলে।’
—‘অ, দ্যাট দুগ্গাপ্রসাদ! আমার হাঁটুর বাতটার খুব ভালো চিকিচ্ছে করেছে। ছবি দেখতে এয়েচো? ডাক্তারবাবুর ছেলে? বাঃ। এসো, এসো, আমি ছবি দেখাচ্ছি।’
আমার কাঁধ না ধরে কয়েকটা ছবি পার হয়ে উনি এসে দাঁড়ালেন আর একজন মেমসাহেবের ছবির সামনে।
—‘চেনো?’
—‘ন?’ আমি ছোট্ট করে বলি ভয়ে ভয়ে।
সিসটার নিবেদিতাকে চেনো না? মহীয়সী মহিলা। আমাদের এই হতভাগা দেশের জন্যে নিজের সব স-ব, মানমর্যাদা পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত খুনের দায়, সম্পত্তি লিখিয়ে নেবার চার্জ! সে স-ব তিনি দিয়ে গেছেন ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের উন্নতির জন্যে। আহা।’
‘আমরা, আমরা তাঁকে দেখেছি, তাঁর বক্তৃতা শুনেছি। সেসব দুর্লভ সৌভাগ্যের ব্যাপার। তোমরা এখনকার শিশুরা তো তাঁর নামই জানো না দেখছি। এইসব মহান মানুষ আত্মবিসর্জন দিয়ে গেলেন যার জন্যে, সেই স্বাধীনতা এলো মিডনাইটে চোরের মতো? একটা বাঁটকুল লোকের হাত ধরে, ছ্যা ছ্যা ছ্যা।’
আর একটা ছবির কাছে টেনে নিয়ে গেলেন আমাকে—‘এঁকে চিনতে পারছো?’
—‘হ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ।’
—‘কে বলো তো?’
—‘সিসটার…’ আমি ইতস্তত করছি। ঘর ফাটিয়ে হা হা করে হেসে উঠলেন ছোট ঠাকুর্দা— এঁকে তুমি চিনতে পারো না হে ছোকরা। ইনি হলেন দেখো লেখা আছে নীচে; পড়তে পারো? —শ্রীমতী অ্যালিস রবসন।’ আমি ভয়ে ভয়ে চেয়ে দেখি সাদা গাউন পরা, ধবধবে ফর্সা এক মেমসাহেব। লীলাময়ীরই মতো, তবে অনে-ক বুড়ো, সিসটার নিবেদিতার চেয়েও বুড়ো, মাথায় ধবধবে চুল, মুখে এতখানিক হাসি। ইনি সাহেবদের পাকুমা নিশ্চয়ই।
ছোট ঠাকুর্দা বলছেন—‘ইনিও একজন মহীয়সী। শুধু কারও প্রতিভায় বিশ্বাসী হয়ে, শুধু এক অলৌকিক কৃতজ্ঞতায় নিজের সর্বস্ব কেউ বিদেশি বিধর্মীকে দান করে দিতে পারে? শিবশঙ্করকে একেবারে স্বয়ং শিব বলে চিনেছিলেন তিনি। শিবও যে, যেহোভা-ও সে। কিন্তু মহীয়সী হলেও মানুষ, মাটির মানুষ তো? ভুল, ভুল করে ফেলেছিলেন প্রথমেই। প্রচণ্ড ভুল—’ গর্জন করে উঠলেন ছোট্ ঠাকুর্দা—‘নেলী, ও নেলী। মাই হার্টস ডিজায়ার, দি ইটারন্যাল উন্ড আপন মাই সোল, আ অ্যাম ব্লীডিং, স্টিল ব্লীডিং, আ উইল ব্লীড টিল টাইমস এন্ড্।’
বৃদ্ধ সাহেব নিজের বুকে হাত চেপে অপূর্ব অভিনয় করতে লাগলেন।
মানিক আমায় ইশারায় বলল—‘পালা।’ পেছন ফিরে দুজনে ভোঁ দৌড়। —‘দ্যাট মা, দ্যাট পাকুমা অফ দিস কার্সড্ ফ্যামিলি, শী’ল ডিসাইড ফর এভরিবডি, ড্যাম হার, ওহ্ ড্যাম হার, ড্যাম হার….’ শব্দগুলো আমাদের পেছনে ছুটে আসছে।
—‘কী বলছিল রে ছোট ঠাকুর্দা?’
আমি বললুম —‘অত কী আমি বুঝতে পারি? কিন্তু পাকুমার ওপর খুব রেগে গেছেন।’ ফিসফিস করে বলি—‘ড্যাম তো একটা খারাপ কথা।’
মানিক গম্ভীর হয়ে বলল—‘আমার বাবা কী বলে জানিস তো? বলে ছোট্ ঠাকুর্দা পাগল।’
দ্বাদশ অধ্যায় : পাকুমার তৃতীয় গল্প
এক আলো-আঁধারির শীতের বেলার ভর-সন্ধেয় ওরা পাকুমার তৃতীয় গল্প শুনেছিল। বুবু-পুনপুন-বুনবুন।
এক যে ছিল সওদাগর-কন্যা। তার এমন রূপ যে সে যেখান দিয়ে যায় স-ব আলো হয়ে যায় (পাঁকুদির চেয়েও? টিয়াদির মতো? রাধাদিদিকে দেখেছেন পাকুমা? ওই রকম)। কাঁদলে চোখে মুক্তো ঝরে। হাসলে হীরে ঠিকরে পড়ে (স্যাকরারা কি কন্যার কাছ থেকেই হীরে মুক্তো আনে? একটা হুমদো-মতো লোক সব সময়ে বাটি নিয়ে নিয়ে কন্যার পেছন পেছন ঘুরছে। কখন সে হাসবে, কখন কাঁদবে, হীরেমুক্তো ভরে নিতে হবে, তা-ই)। একবার সওদাগর যাবেন ভিনদেশে বাণিজ্য করতে (বুজবুজও যেতে চায় বাণিজ্যে, কিন্তু সেটা ভিনদেশ নয়, ‘নীলের কোলে শ্যামল সে দেশ’) মেয়েকে বললেন— কী আনবো মা? তখন মেয়ে বলল— কী আর আনবে বাবা, সবই তো আছে আমার। তুমি বরং একটা বাচ্চা তিমি এনো, পুষবো। সদাগর বললেন— আচ্ছা। (আমাদের বাবাও বেশ বাণিজ্যে গেলে পারেন, আমাদের জিজ্ঞেস করলে আমরাও জিনিস চাইবো— পুনপুন চাইবে জাগুয়ার, যে জানোয়ারটির নাম সে সম্প্রতি শুনেছে। বুনবুন চাইবে ঘোড়া, ঘোড়ায় চড়ে অনেক কিছু করা যায়, আর বুবু চাইবে—কী—কী—কী একটা ঝিনুক তার থেকে পদ্ম উঠেছে, পদ্মের পাপড়ির মধ্যে টুলটুলে মুখ ফুল-তুকতুক এক রাজকন্যে)।
দিন যায়, দিন যায়। সদাগর তাঁর সপ্তডিঙা ভর্তি করে বাণিজ্য করে ফিরছেন। এমন সময়ে তাঁর মনে পড়ল—তাই তো, তিমি চাই তো! তখন তিনি জাহাজ একটু ঘুরিয়ে মেরুসাগরের দিকে চললেন। মেরুসাগরে তিমিদের আঁতুর-ঘর। সেখানে হাজার হাজার তিমি জন্মায়, একটু বড় হলে মায়েরা তাদের জলে ভেসে বেড়াতে আর শিকার করতে শেখায়। (তিমিদের সঙ্গে আমাদের এত তফাত যে কেন? জলে ভাসা ছেড়ে, আমরা যখন কলের নীচে সব গামছা জড়ো করে চার দিক ঘিরে দিয়ে পুকুর করি আর তাতে সাঁতার কাটি, তখনও কি মা বলেন না, আর নয় পুনপুন-বুনবুন, আর না বুবু, চলে এসো!)। কিন্তু তিমির বাচ্চা ধরতে গিয়ে সদাগরের দুটি পা-ই তিমিমাছে খুবলে খেয়ে গেল। দারুণ অসুস্থ হয়ে তিনি কোনওক্রমে বাড়ি পৌঁছেই মারা গেলেন (বুবু-পুনপুন বুনবুনের জাগুয়ার-ঘোড়া-ঝিনুকের দরকার নেই)। তখন সদাগরের স্ত্রী শোকে দুঃখে আকুল হয়ে বুক চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন—আমার সমস্ত ধনরত্ন আমি বিলিয়ে দোব। কিচ্ছুটি আর রাখব না আর তুমি মেয়ে, তোমাকেও আমি সকাল হলেই যে দুয়ারে এসে দাঁড়াবে তাকেই দিয়ে দেব। মেয়েও শোকে দুঃখে কাতর হয়ে ভাবলো সত্যিই বাবার মৃত্যুর জন্যে তো সে-ই দায়ী, তার বিলিয়ে যাওয়াই ভালো।
এখন হবি তো হ এক ভালো মানুষের তিন পুত্তুর সেদিন ভোরবেলা বেড়াতে বেরিয়েছে। বেড়াতে বেড়াতে তারা সদাগরের দরজায় এসে ঘা দিল। বড্ড তেষ্টা পেয়েছে। দরজা খুলে তিন ভাইকে এক সঙ্গে দেখলেন সদাগরনী। কী করেন, তিনজনের সঙ্গে তো আর মেয়ের বিয়ে দিতে পারেন না। মেয়েকে ডেকে বললেন, এদের মধ্যে একজনকে বেছে নাও (পুনপুন ভাবলো সে আগেই লুকিয়ে পড়বে মেয়ে যাতে তাকে দেখতে না পায়, বুনবুন ভাবলো মে বড্ড হাঙ্গামার, সে দিলেও নেবে না, বুবু উদ্গ্রীব হয়ে আছে….তিন পুত্তুরের বিষয়ে সব কথা শুনে তবে সে ঠিক করবে কাকে নেবে।)।
মেয়ে দেখলো—বড়টি যেন দেবতার মতো, মুখে মধুর হাসি, চোখে যেন কোন সুদূরের স্বপন, কণ্ঠে তার গান। অপূর্ব বাঁশি বাজিয়ে গান করে সে কন্যাকে অভিভূত করে দিল। বলল এমন গান গাইবো যে মনে হবে নন্দনকাননে বসে পারিজাতের গন্ধবহ বাতাসে কান পেতে স্বর্গের মন্দাকিনীর কলতান শুনছ। বড়টির চোখে চোখ আটকে আছে এমন সময়ে সদাগর কন্যার কানের পাশ দিয়ে শনশন করতে করতে তীর ছুটে গেল; কন্যা দেখলো— মেজপুত্তুর বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ যেন বাঘের সাহসে জ্বলছে, পেশীতে পেশীতে ঢেউ খেলিয়ে যাচ্ছে, হাতে ধনুর্বাণ, কোমরে তরোয়াল। মেজকুমার বলল—যদি অনুমতি করো তো একটার পর একটা বাণ বিঁধিয়ে লম্বা একটানা পথ করে দিতে পারি তোমার জন্যে। যদি কখনও বিপদে পড় তো তোমার বিপদের বুকে সঙ্গে সঙ্গে বিঁধে যাবে আমার তরোয়ালের ফলা। আমি পাশে থাকতে তিনভুবনে কোনও যক্ষ রক্ষ কাউকে তোমার ভয় নেই। কন্যা মুগ্ধ হয়ে দেখলে— কী বীরপুরুষ! কী বীরপুরুষ! তীর-ধনুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে যেন বা রাম। দেখছে তো দেখছেই এমন সময়ে তার আঁচলে টান পড়লো, কন্যা ফিরে দেখে ছোটকুমার। কুমার তো নয় রাজকুমার। কন্যার চোখে আর পলক পড়ে না, ছোটকুমার বলল আমি হাজার রকম খেলা জানি। আমরা যাব বনে, পাহাড়ে, আমরা ঝাঁপ দেব সমুদ্রে, সারা পৃথিবী জুড়ে আমরা আমাদের খেলাঘর পাতব। কন্যা অবাক হয়ে দেখল কুমারের চোখ দুটি বালকের মতো, সে শিশুর মতো হাসে, তার হাতে এক চমৎকার বল, সেটা সে বিদ্যুদ্বেগে আকাশে ছুঁড়ে দেয়, আর বিদ্যুদ্বেগে তাকে ধরে ফেলে। (বুবুর তিন জনকেই পছন্দ, এখন কন্যে কী করে দেখা যাক!)
এখন সেই কন্যের ছিল খুব বুদ্ধি। সে ভাবলো বিপদে তো আর সবসময়ে পড়তে হচ্ছে না, আর পড়লে তো মেজকুমার আছেই, আর ছোটর মতো খেলুড়িকেও খেলার সময়েই দরকার, তো তখন দেখা যাবে’খন। কিন্তু স্বর্গীয় গান শুনিয়ে সব সময়ে তাকে সে নন্দনকাননের আনন্দে রাখবে সেই বড় কুমারকে বেছে নেওয়াই ঠিক হবে (যুক্তিটা বুবুর মনে ধরেছে, পুনপুন ভাবছে ছোট কুমারই সবচে’ ভালো, বুনবুন ভাবছে মেজকুমার)।
সে যে-ই বড়কুমারের হাত ধরেছে অমনি অন্ধকার হয়ে গেল দুই কুমারের মুখ। দেখে কন্যার বড় কষ্ট হল। বলল— ‘তোমরা ভাবছ কেন? আমি তো রইলামই। তোমাদের তিনজনকেই তো আমি ভালোবাসি?’
তখন তিন কুমার সাদরে সদাগর কন্যাকে নিয়ে নিজেদের বাড়িতে তুলল। আর সদাগরনী সব টাকাকড়ি বিলিয়ে দিয়ে হলেন বনগামী। এদিকে সদাগর-কন্যা তার সংসার যত সহজ ভেবেছিল ততটা হল না। সে যখন বড়কুমারের সঙ্গে গান গেয়ে, গান শুনে সময় কাটায় অন্য দুজন রাগে ফোঁসে। সে যখন মেজকুমারের ঢাল-তলোয়ার আর তীর-ধনুকের কসরৎ তারিফ করতে ব্যস্ত থাকে, তখন বড়কুমারের মুখ মলিন হয়ে যায়, ছোটকুমার ধুলোয় গড়াগড়ি খায়। আর ছোটকুমারের সঙ্গে যখন খেলে, তখন আর দুই কুমার ঘোড়ায় চড়ে টগবগ টগবগ করতে করতে ঝড়ের মতো দুজনে দুদিকে চলে যায়।
অবশেষে একদিন বড় বলল— ‘কন্যা, তোমায় সময় দিচ্ছি, তুমি মনস্থির করো, তোমায় একজনকে বেছে নিতে হবে।’ বলে সে অনেক দূরের দেশে চলে গেল। মেজকুমারও বলল— ‘তোমায় সময় দিচ্ছি, তুমি একজনকে বেছে নাও।’ বলে সে যুদ্ধ-বিগ্রহ-বিপ্লবে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আজ কারাগারে যায়, কাল অজ্ঞাতবাসে যায়, পরশু আবার সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে নেবে পড়ে। সৈন্যসামন্ত রথী-মহারথীতে বাড়ি ভরে যায়, কন্যা তাদের সেবাযত্ন করে, কিন্তু মেজকুমারের দেখা আর পায় না।
কেউ নেই আর বাড়িতে। তখন ছোটকুমার বলল— দেখছ তো কন্যে, তোমার স্বর্গের দেবতাও তোমায় ফেলে চলে গেল আর তোমার বীরপুরুষও কোথায় উধাও হয়ে গেল। তুমি আমাকেই বরণ করো।
কন্যা কী করে, সে দিনরাত প্রার্থনা করে বড়-মেজ ফিরে আসুক, আর ছোটর সঙ্গে খেলা করে অরণ্যে, পাহাড়ে, সমুদ্রে। এইরকম ভাবে অনেক দিন চলে গেল, বড় কুমার ফিরে এসে দেখলো পুরী খাঁ খাঁ, দাস-দাসীদের জিজ্ঞেস করল কেউ কিছু বলতে পারল না। তখন মনের দুঃখে বড়কুমার মাথায় পাথরের বাড়ি মেরে মরে গেল। কন্যা ঘরে দুয়ার দিল। ছোটকুমারের হাজার ডাকেও দুয়ার খুলল না। কিন্তু একদিন দরজায় দুমদাম ঘা শুনে দরজা খুলে দেখে মেজকুমার। সে বলল—‘কন্যা, অত্যাচারী রাজার সেনাদলকে মেরে এসেছি; আমার আর রক্ষা নেই, বিদায় দাও’, বলে সে হাতের তলোয়ারটা নিজের বুকে বিঁধিয়ে দিল।
তখন সদাগরের সেই মেয়ে নিজের ওপর রাগে, ছোটকুমারের ওপর রাগে দুঃখে প্রাণ বিসর্জন দিল।
গল্প শেষ। পাকুমার মুখ গম্ভীর। চোখ চকচক। আমরা রুদ্ধ নিশ্বাসে শুনছিলুম। মানিক বলল— পাকুমা সদাগর কন্যার নাম তো বললে না?
পাকুমা উত্তর দিলেন না।
আমি বললুম আমি বলব? সদাগরের মেয়ের নাম লীলাময়ী।
ভীষণ চমকে উঠলেন পাকুমা। যেন তাঁকে কেউ চাবুক মেরেছে। তারপর আমার দিকে চেয়ে বললেন— এ নাম তোমার মনে হল কেন, বাবা?
—কেন তা তো জানি না পাকুমা।
মানিক বলল—ও কিছু জানে না পাকুমা। লীলাময়ী তো আমার ঠাকুমার নাম। কন্যাদের ওরকম নাম হয় না কী?
ঠিক বলেছ। কী রকম নাম হয়?
বুনবুন বলল —কাঞ্চনমালা কাঁকনমালা।
মানিক বলল—মণিমালা, শঙ্খমালা।
—ঠিক। পাকুমা উঠে পড়েছেন। এবার চুল বাঁধবেন, বরফ রঙের চুল, এবার গা ধোবেন, হিম-ঠাণ্ডা জলে, তারপর দুধগরদের কাপড় পরবেন, তারপর তুষার ধবল শাঁখে ফুঁ।
ত্রয়োদশ অধ্যায় : পিতামহ
ছোট্ ঠাকুর্দা আমাকে ডেকেছেন। মানিক খবর দিল।
আমি চমকে গেছি। ভয়ে ভয়ে বললুম—‘কেন রে?’
—‘তা তো জানি না। তোকে একেবারে তিনতলার ঘরে নিয়ে যেতে বলেছেন।’
—‘তুইও থাকবি তো?’ আমার গলা কেঁপে যাচ্ছে।
—‘হ্যাঁ। আমাকেও তো যেতে বলেছেন!’
মানিকের পেছন পেছন ভেতর বাড়ির কার্পেট পাতা সিঁড়ি দিয়ে উঠি। আমি যেতে চাইনি। এই তিনতলা ভীষণ ভয়ের। কিন্তু আমি যদি না যাই, ছোট্ ঠাকুর্দা আমাকে সারা পৃথিবী ঢুঁড়েও খুঁজে বার করতে পারেন, সে আমি জানি। তুমি ধরো ভূতের ভয়ে পালাচ্ছ। অনেক দূরে, অনেক অনে-ক দূরে একেবারে মায়ের কোলের ভেতর বসে আছ। চার পাশে তোমার বাবা, তোমার পিসিমা সব আপনজনেরা। নিশ্চিন্ত হয়ে হাসছ তুমি৷ হঠাৎ ওপর থেকে একটা মোটা, লোমশ, কড়া মতন হাত নেমে এসে তোমায় সবার মাঝখান থেকে তুলে নিয়ে গেল। এমন কি আর হয় না? তাই ছোট্ ঠাকুর্দাকে অমান্য করবার সাহস নেই আমার।
তখন বিকেলবেলা। সিঁড়ির অনেকটা পশ্চিমের জুড়িয়ে-যাওয়া রোদে ছেয়ে রয়েছে।
পাকুমা রান্নাবাড়ি পার হয়ে উঠোনে এসে বললেন—‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস মানিক?’
—‘ছোট্ ঠাকুর্দা ডেকেছেন পুনপুনকে, তাই নিয়ে যাচ্ছি।’
—‘ছোট্ ঠাকু … পুনপুনকে?’ পাকুমার গলা দিয়ে বিস্ময় ঝরে পড়ছে। আমি দু-তিনটে সিঁড়ি এক লাফে পার হয়ে, ছুট্টে উঠোনে গিয়ে পাকুমাকে জড়িয়ে ধরেছি।
—‘পাকুমা, আমি ছোট্ ঠাকুর্দার কাছে যাব না। আমায় ভীষণ মারবেন, পাকুমা আমায় যেতে দেবেন না।’
পাকুমা আরও অবাক হয়ে আমার মুখটা দু হাতে তুলে নিয়ে বললেন—‘কেন? মারবে কেন?’
—‘আমরা গানঘরে ছবি দেখছিলুম, তাই। ভীষণ রাগ করেছেন।’
—‘ছবি দেখছিলে এতে রাগের তো কিছু নেই! ছবি দেখাটা দোষের হবে কেন?’
—‘আপনাদের গানঘরে তো ছোটদের ঢোকা বারণ পাকুমা, না?’
—‘কেন? এ গানঘর তো আর নাগেদের আমলের নয়’… পাকুমা আপন মনে বললেন। তারপরে বললেন—‘কত সুন্দর সুন্দর ছবি টাঙানো রয়েছে। তেজেনবাবুর আঁকা, আলিসাহেব, জে. টি. মর্গ্যান … সেসব তো দেখবার জিনিসই। না মণি ছবি দেখতে গিয়ে তোমরা কোনও দোষ করনি। আর, যে কোনও কারণেই হোক, বিরক্ত হলে ছোট ছেলেকে ডেকে মারবে, এমন ছেলে শম্ভু কেন, আর কেউই এ বাড়িতে নেই, তুমি নিশ্চিন্তে যাও। ছোট্ ঠাকুর্দার নিশ্চয় তোমাকে খুব ভাল লেগেছে। যাও, ভয় নেই। তা ছাড়া, আমি তো নীচে রইলুমই।’
সত্যিই তো, ছিটকিনি খুলে নতুন কাকুর ঘর থেকে কে আমায় উদ্ধার করেছিলেন? পাকুমাই তো!
মানিক বলল—‘দেখলি তো! চল এখন! কত দেরি হয়ে গেল বল তো!’
লম্বা-চওড়া দালান। তার দুদিকে ঘর। ডানদিকে দ্বিতীয় ঘরটা ছোট্ ঠাকুর্দার। আমরা দরজায় টোকা দিই।
—‘এসো, ভেতরে ঢুকে এসো’— ছোট্ ঠাকুর্দার সেই গলা। ভেতরে ঢুকতে পা কাঁপছে।
দেখি একটা গোল মার্বলের টেবিল। তার ওপরে চায়ের বাসন, এত পাতলা কাপ যে ভেতরে চা দেখা যাচ্ছে, ট্রের ওপর চায়ের পট, চিনি দুধ। একটা বেতের চেয়ারে নরম গদির মধ্যে ডুবে বসে আছেন ছোট্ ঠাকুর্দা, শাদা শার্ট-প্যান্ট পরা। আরেকজন ফরসা মতো কুঁচিয়ে থান পরা মানুষ তাঁকে চা ঢেলে দিচ্ছেন।
—‘এসো এসো, এসো ভাই, এইখানে বসো।’
হেসে তিনি বললেন—‘মানিকজোড় একেবারে।’
আমরা জড়সড় হয়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছি তো!
ছোট্ ঠাকুর্দা বললেন—মেজ বউদি এদের চা দাও।’
আমি চা খাই না। মানিককেও কখনও খেতে দেখিনি। কিন্তু না বলতে সাহস হল না। মেজ বউদি বললেন—‘কেক খাও, আমি নিজে করেছি।’
কিসমিস-বাদাম দেওয়া, ডিমের গন্ধে ভুরভুর, চৌকো কেক, তারপর সুন্দর কাপে সুন্দর গন্ধ অলা চা খেলুম। চা যে আবার এমন ভাল একটা খাবার জিনিস তা কিন্তু আমি জানতুমই না।
ছোট্ ঠাকুর্দা বললেন—‘এই ছেলেটির কথাই তোমায় বলছিলুম। মেজ বউদি। দুগ্গা গো, দুগ্গা ডাক্তারের ছেলে। চমৎকার, না?’
মেজ বউদি মুখ টিপে হেসে বললেন—‘চমৎকার! বলে চমৎকার! অতি চমৎকার।’
চমচমের মতো ভাল হলে তাকে চমৎকার বলে এতে আমার কোনও সন্দেহই রইল না। কেন? তা তো জানি না!
ছোট্ ঠাকুর্দা চা শেষ করে পাইপের মধ্যে তামাক ভরতে লাগলেন, তারপর পাইপ ধরালেন। পাইপের কড়া গন্ধে ঘরটা ভরে গেল।
—‘এই যে আমার মেজ বউদিকে দেখলে, চা ঢেলে দিচ্ছেন, কেক তৈরি করে খাওয়াচ্ছেন, ইনি কে জান?’
—মেজ বউদি উঠে দাঁড়ালেন, বললেন—‘আহা, এসব আবার কেন?’
—‘বা আজকালকার ছেলেরা ইতিহাস জানবে না? এখনও কিছু ইতিহাস চলে ফিরে বেড়াচ্ছে মেজ বউদি, এরপর তো সবই একেবারেই ইতিহাস হয়ে যাবে!’
আমরা হাবলার মতো চেয়ে আছি।
মেজ বউদি বললেন—‘আমি যাই ভাই। মানিকজোড় না জোড়মানিক! তোমাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে পরে। কেমন?’
ছোট্ ঠাকুর্দা বললেন—‘সেই যে তোমাদের সিস্টার নিবেদিতার ছবি দেখালুম, সেই নিবেদিতার কাছে ইনি পড়েছেন ছোটবেলায়, ঘরে ঘরে ঘুরে ঘুরে মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। সিস্টার নিবেদিতার মহৎ কাজ তো একটা নয়। তিনি যেমন ভারতীয়, বিশেষত বাঙালিদের মধ্যে বীরত্ব জাগাতে চেয়েছেন, দে-চম্পট কাপুরুষের জাত তো আমরা! তেমনি আবার মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে, তাদের মধ্যে চেতনা জাগিয়ে দেশটাকে জাগিয়ে দিতেও চেয়েছিলেন। চেতনা জাগানো মানে কী বল তো?’
আমি চুপ। মানিক চুপ৷ ‘চেতনা’ কথাটা বাড়িতেও মাঝে মধ্যে শুনতে পাই। যেন কার্নিশে বসে-থাকা একটা গোলা পায়রা। পাখার ফটাফট শব্দ করে নেমে পড়ল ‘চেতনা’, ওই উড়ে যাচ্ছে ‘চেতনা’ আবার গিয়ে বসবে কার্নিশের কাছে ঘুলঘুলিতে। ‘চেতনা’কে লুফে নিলেন বাবা, উড়িয়ে দিলেন, সেটা গিয়ে বসল পমপমের কাঁধে। কাঁধ থেকে কোলে নেমে পড়ছে ‘চেতনা’, নিচু হয়ে ‘চেতনা’কে তুলে নিল ই-দাদা, এবার কি সুযযির দিকে পাঠিয়ে দেবে?
—‘চেতনা মানে নিজের ভেতর-বাহির সবটা সম্পর্কে জ্ঞান, সতর্কতা। যেমন ধরো রাস্তায় আবর্জনা ফেলতে নেই, থুতু ফেলতে নেই যেখানে সেখানে। আমাদের মেয়েরা দেখবে এক বালতি কুমড়োর খোসা, শাকের ডাঁটা, মাছের আঁশ, ছাই সব নিয়ে এসে ধড়াস করে পাশের বাড়ির দরজার গোড়ায় ফেলে দেবে। চেতনার অভাব। আবার দেখবে রাস্তায় যেতে যেতে কেউ প্যাচ করে পানের পিক ফেলল। চেতনা নেই। তো নিবেদিতা এই সব শেখাতেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বাইরে-ভেতরে। আমার মেজ বউদি ছিলেন তাঁর প্রকৃত শিষ্যা। বুঝলে?’
আমরা বুঝলুম।
—‘আমার মেজদা, এই মানিকের মেজ ঠাকুর্দা ছিলেন গুপ্ত বিপ্লবী। গুপ্ত মানে বোঝো?’ আমরা মাথা নাড়ি৷ ‘গুপ্ত’ মানে ‘চুপি চুপি’। কেন জানব না?
—‘বাইরে ছিলেন দুঁদে পুলিশ অফিসার। কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিপ্লবী। মেজ বউদির লেখা ডায়েরি যদি প্রকাশ করা যায় না, বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অদ্যাবধি অজানা অধ্যায় উন্মোচিত হবে। আমাদের বাগানে একটা ঘর আছে দেখেছ তো? ওইখানে কত যে বিপ্লবী লুকিয়ে থেকেছেন তার ঠিক নেই।’
—‘ওইটুকু ঘরে?’ মানিক বলল।
—‘ঠিক কোথায় কেমন করে সে একদিন তোমাদের দেখাব এখন,’ ঠোঁটে পাইপ নিয়ে ছোট্ ঠাকুর্দা উঠে দাঁড়ালেন।
—‘যে জন্যে তোমাদের ডেকেছি। ছবি দেখতে ভালবাস, দেখ।’
টেবিলের ড্রয়ার খুলে উনি একটা বড় বাক্সর মতো অ্যালবাম বার করলেন। অ্যালবামের পাতা খুলে ছবি দেখাতে লাগলেন আমাদের মাঝখানে বসে।
—‘এই দেখো, কে বলো তো?’
আমি বললুম —‘গুপ্ত বিপ্লবী।’
‘হা হা হা হা’—অট্টহাস্য হাসতে লাগলেন ছোট্ ঠাকুর্দা।
—‘গুপ্ত বিপ্লবীই বটে। শিশির ভাদুড়ির নাম শুনেছ? এটা ওই শিশির, আমাদের বাড়ির পুজোয় নাটক হচ্ছে, শিশির সেজেছে কৃষ্ণ। এই দেখো পাশে এটা আমি, শিবশম্ভু রায়চৌধুরী কর্ণ করছি। কর্ণর নাম শুনেছ তো? না, তাও শোননি?’
আমি উৎসাহে এগিয়ে বসে বলি—‘হ্যাঁ, চাকা বসে গিয়েছিল তো৷ কবচকুণ্ডল গা কেটে দিয়ে দিলেন যিনি!’
—‘ঠিক। আহাহা কী চরিত্র! কী মানুষ! মহিমা কী! অমন যে কৃষ্ণ, সেই কৃষ্ণও তাঁর কাছে পরাভূত। দৈহিক শক্তির কাছে নয়, চরিত্রশক্তির কাছে। আচ্ছা বলো তো ‘মহাভারতে’র গল্পে কাকে তোমাদের সবচেয়ে ভাল লাগে?’
মানিক তাড়াতাড়ি বলেছে—‘কর্ণ।’
আমিও বলছি—‘কর্ণ।’ বড়রা এরকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেই একটা ‘কেন’ জিজ্ঞেস করেন। কর্ণের বেলায় বলতে পারব চরিত্রশক্তির জন্য। তাই কর্ণ বললুম। আসলে কর্ণ নয়। আমার প্রিয় অর্জুন।
—‘আহাহা হা! এই দেখো গিরিশচন্দ্রের জনা, আমি প্রবীর, এই ডি. এল. রায়ের “চন্দ্রগুপ্তয়” আমি চন্দ্রগুপ্ত।’
পরপর পাতা উল্টে যান ছোট্ ঠাকুর্দা। দেখতে থাকি।
—‘এই দেখো শেক্সপীয়রের “অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা”, আমি অ্যান্টনি আর এই দেখো আমার বড় বউঠাকরুন ক্লিওপেট্রা সেজেছেন।
আমরা অবাক হয়ে দেখি—অ্যান্টনি একেবারে ছবির বইয়ের রোম্যান সাহেব, আলগা আলখাল্লার মতো পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছেন। টুকটুক করছে লাল চেহারা। আর ক্লিওপেট্রার শাদা ফুরফুরে পোশাক, মাথায় ক্রাউন জ্বলজ্বল করছে, কানের ওপর ফাঁপানো চুল, এক হাত সটান সামনে বাড়িয়ে কী যেন আদেশ করছেন ক্লিওপেট্রা। ও রকম সুন্দর কোনও মেয়ে আমি কখনও দেখিনি।
—‘ছোট্ ঠাকুর্দা, আপনি খুব সুন্দর ছিলেন, না?’ মানিকের প্রশ্নে আমার চমক ভাঙে।
—‘সুন্দর?’ ছোট্ ঠাকুর্দা কেমন অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলেন—‘শুধু সুন্দর, লিট্ল বয়? আমি পাবলিক স্টেজে নামলে আজ শুধু শিশির ভাদুড়ি শিশির ভাদুড়ি, অহীন্দ্র চৌধুরী অহীন্দ্র চৌধুরী করত না লোকে’ বলেই তিনি গদগদ গলায় আবৃত্তি করতে লাগলেন:
‘জন্ম-জন্ম—একমাত্র রন্ধ্রপথ ছিল
ওইখানে! তাই আজ ওরে ও মরণ!
ভগ্ন-রথে পৃষ্ঠ দিয়া, সমস্ত ভুলিয়া
বসে আছি। ওরে ও মরণ—বিস্মরণে
জন্ম তোর! তুই এলি—জন্মের লাঞ্ছনা
স্মৃতি মুছাতে নারিলি! চারিদিকে শূন্য,—
মধ্যে আমি। আমার অন্তরে প্রবেশিয়া
ব্যঙ্গ করে বিরাট শূন্যতা
এ রকম কখনও শুনেছো?’ শুধু গর্ব নয়, কেমন দুঃখের সঙ্গেও যেন বললেন ছোট্ ঠাকুর্দা।
আমরা সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এ রকম গলা, মাঝে মাঝে কান্নায় থর থর করছে, মাঝে মাঝে বীরত্ব ফুটে উঠছে, এরকমটা আমরা কখনও শুনিনি। কখনও না। গলার আওয়াজটাও যেন কেমন অন্য রকম। ছোট্ ঠাকুর্দার কথা বলার গলা আর আবৃত্তির গলা আলাদা? যখন আবৃত্তি করছিলেন, চেহারাটাও যেন কেমন বদলে গিয়েছিল। একটা। মানুষের মধ্যে আসলে দুটো মানুষ আছে না কি? ততক্ষণে ছোট্ ঠাকুর্দা ইংরিজিতে আবৃত্তি করছেন—‘এজ ক্যানট উইদার হার, নর কাস্টম স্টেল হার ইনফিনিট ভ্যারাইটি।’ এ আবার আরেক রকম আবৃত্তি, যেন আপন মনে বলছেন।
হঠাৎ ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন ছোট্ ঠাকুর্দা—‘ওফ্ফ দ্যাট ধরিত্রী দেবী: শি ডিডনট অ্যালাও মি টু জয়েন দা পাবলিক স্টেজ। হোয়েনেভার আই ওয়ান্টেড টু ডু সামথিং, শি স্টুড ইন মাই ওয়ে। শি স্টুড দেয়ার লাইক আ মিলিয়ন-ইয়ার-ওল্ড পিরামিড … অ্যান্ড আই ওয়জ লস্ট! লস্ট! লস্ট! মাই অক্যুপেশন ওয়জ গন, গন, গন। … শোনো … লিস্ন বয়েজ, তোমাদের মধ্যে যদি কোনও সাধ থাকে, যা অত্যন্ত শক্তিশালী, যদি কোনও প্রতিজ্ঞা থাকে, তা সে যা-ই হোক না কেন, এনি ড্যাম থিং ইন দিস ওয়র্ল্ড, তা হলে কারুর পরোয়া করবে না। কারুর কথা শুনবে না, ফলো ইওর ওন ট্যালেন্ট টু দা গ্রেভ…।’
‘অভিনেতা, অভিনেতা হতে চেয়েছিলাম … সার গ্যারিক। গিরিশ ঘোষ মদ খেত, মেয়েমানুষে মজত… সো হোয়াট? শিশির অ্যাক্টর সে-ও মদ … সো হোয়াট?’ বজ্রগর্জনে চেঁচিয়ে উঠলেন ছোট ঠাকুর্দা। তারপর হঠাৎ সুর নরম করে বললেন— ‘আমি কখনও মদ ছুঁইনি, স্বদেশির যুগের ছেলে আমরা … আমি কখনও মেয়েমানুষ স্পর্শ করিনি। আমার চোখের সামনে চিরকাল ছিল সে, একমাত্র সে। আর কেউ নয়, কেউ তার কাছে কিসসু নয়। আমায় যদি দ্যাট বাংলিং ইন্টারফিয়ারিং ফুল অফ এ লেডি অভিনয়টা করতে দিত! আমি তার জন্য আমার যা কিছু ব্যথা বেদনা বিরহ প্রেম ভক্তি সব উজাড় করে দিতে পারতুম, একটা আউটলেট পেতুম, আমার বুকের মধ্যে জমে থাকা তুষার, জমাট লাভা … সেই সব স-ব আমি প্রকাশ করে দিতে পারতুম। অন্যভাবে। কে আমার অভিনয় অমন প্রাণস্পর্শী করেছিল! নাগেদের বাড়ির দুর্গোৎসবে আমি রাম করিনি? শিশিরের চেয়েও ভাল করিনি? কেন করেছিলুম, কেউ জানে না, আমি জানি, আমি জানি।…এত রূপ এমন ক্ষমতা সমস্ত সমস্ত নষ্ট করে দিলে। আর এখন? এখন আমি এক বৃদ্ধ, নখদন্তহীন বৃদ্ধ শার্দুল। করার কোনও কাজ নেই, ভাবার কোনও বিষয় নেই, গোর একটা, অজানা, অচেনা কবর…অপরাধ করলুম, করে ফেললুম,— সে চলে গেল, আমার ওপর অভিমান করে, তিন তিনটে মানুষ চলে গেল…।’
অ্যালবামটা টেনে নিলেন ছোট্ ঠাকুর্দা, অন্যমনস্ক, পাতা উল্টে যাচ্ছেন। ডেসডিমোনার ছবি একটা। লীলাময়ী ডেসডিমোনা বলে একটা মেয়ে সেজেছেন। আলোছায়ায় মাখা ছবিটা, ছায়ার মধ্যে থেকে বড় বড় চোখ চেয়ে রয়েছে কার দিকে। মুখে হাসি নেই। বিষণ্ণ। ভীষণ করুণ। ছবিটার দিকে অপলকে চেয়ে থাকতে থাকতে ছোট্ ঠাকুর্দা পকেট থেকে শাদা ধবধবে রুমাল বার করলেন।
কাপড়ের খসখস শব্দ না? পাকুমা পুজোর কাপড় পড়ে এসে দাঁড়িয়েছেন দরজার কাছে।
—‘শম্ভু!’
ছোট ঠাকুর্দা জবাব দিচ্ছেন না। মুখ নিচু করে রুমাল দিয়ে মুখ চোখ মুছছেন।
—‘দু যুগ তিন যুগ পার হতে চলল, শম্ভু এখনও তোমার কষ্ট গেল না?’
—‘দু যুগ? তিন যুগ?’ ছোট্ ঠাকুর্দা মুখ তুলে তাকালেন, ‘লক্ষ যুগ পার হয়ে গেলেও যায় না মা, বুকের মধ্যে লাভা আটকে রেখে গুমরে মরনি তো, তুমি বুঝবে না। কোনওদিন বোঝনি, আজও বুঝবে না। একটা বাঁধা সড়ক চিনে এসেছ চিরকাল। পয়সা ছিল, বুদ্ধির জোর ছিল, সেই পথে নিজে চলেছ, সব্বাইকে চালিয়ে এসেছ, না না, তুমি বুঝবে না। এ তোমার বোঝার জিনিস নয়।
ছোট্ ঠাকুর্দা না হয় পার্ট বলছেন। কিন্তু পাকুমাও যে কেন ধরতাই দিয়ে যাচ্ছেন সেটাই বুঝতে পারছি না।
—‘বাঁধা সড়কে চলে এসেছি আমি? কী বলছ তুমি?’
—‘হ্যাঁ হ্যাঁ ওটাও বাঁধা সড়কই মা। তোমার ছেলেরা, নাতিরা ডাক্তার হবে, জজ হবে, ব্যারিস্টার হবে, আবার দেশ উদ্ধারও করবে, তুমি ধর্মের ঠাট-বাট মানবেও, আবার মানবেও না। বিধর্মীর সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিয়েছ বলেই তুমি কি নিজেকে ঠাকুর রামকৃষ্ণ ঠাউরেছ না কি? অত সোজা নয় মা, অত সোজা নয়। তোমার সড়কও বাঁধা সড়কই। একটা কাজও ওই বাঁধাবাঁধির বাইরে করতে পারনি, করতে চাওনি। আমি যে আজ একটা ধ্বংসস্তূপ, ঘরেরও নই, পারেরও নই, আমি যে একটা প্যারাসাইট, একটা পাপী, তা তোমার চেয়ে বেশি আর কে জানে মা? কে আমাকে এমন করেছে?’
—‘তোমার অহঙ্কার, তোমার তামসিকতা শম্ভু। নয়তো এত কাল গড়িয়ে গেল, তুমি কেন নিজেকে গড়ে নিতে পারলে না? তোমাকে হার্ভার্ডের মতো জায়গায় পাঠালুম, তুমি দুটো পাশের পরেই স্নায়ুবিকারের রুগি হয়ে ফিরে এলে। সে কি আমার দোষ? সুযোগ কি তোমাকে দেওয়া হয়নি?’
—‘আ অ্যাম দা লাস্ট পার্সন টু ব্লেম ইট অন এনিবডি। বাট মাদার, তুমি জান না, বুকের মধ্যে আগুন পুষে রেখে যেন কিছুই হয়নি, এমনিভাবে সাংসারিক কাজকর্ম করা যায় না।
আর অহঙ্কার! অহঙ্কারই তো আমাদের গড়েছে মা। নইলে তুমি কেন তুমি আর আমি কেন আমি? কোনও কোনও তামসিকতা সর্বস্বত্যাগের তামসিকতা মা জননী। একদিন বুঝবে, যে সন্তান তোমাদের সবার অপরাধের বোঝা নিয়ে জীয়ন্ত শবদেহের মতো শুধু কালক্ষেপ করে গেল, সে ইচ্ছে করলে সব ভেঙে চুরে দিতে পারত, কেড়েকুড়ে নিতে পারত। ভাঙেনি, নেয়নি। সব স-ব ত্যাগ করেছে, তমোমগ্ন হয়ে থেকেছে, অন্ধকারে ঢাকা, ভেতরে আগুন আছে বলে। আর তুমি? তুমি মনে করছ, চার পুরুষ ধরে চৌধুরীবাড়ির হালটি ধরে নিষ্কাম কর্ম করে যাচ্ছো মা ফলেষু হয়ে। একদিন, একদিন বুঝবে এ তোমার কোন গুণের গুণপনা, মা গো, একদিন বুঝবে?’
আমি অনেকক্ষণ ধরেই বুঝতে পারছিলুম এখানে আমাদের আর থাকা ঠিক নয়। ছোট্ ঠাকুর্দা আর পাকুমা পার্ট বলছেন না, তর্কাতর্কি করছেন, আমাদের বাড়ি বাবাতে আর ঠাকুর্দাতে যেমন হত, পমপম আর ই-দাদার মধ্যে যেমন হয়, কিংবা ই-দাদা আর পালক। তর্ক করতে করতে ওঁরা আমাদের কথা ভুলেই গেছেন। কিন্তু আমার অন্তত পা যেন আটকে গিয়েছিল। ছোট্ ঠাকুর্দার সেই পার্ট বলার মতো কথা বলা, পাকুমা যেন পাকুমা নয়, সবই আমাকে অভিভূত করে দিচ্ছিল।
হঠাৎ পাকুমা বেরিয়ে গেলেন। ছোট্ ঠাকুর্দা আমাদের দিকে ফিরে হঠাৎই যেন আবিষ্কার করলেন আমাদের।
—‘কে? আরে মণি-মাণিক্য না জোড় মানিক না? খুব ভয় পেয়েছ তো? চল তোমাদের দেখাই কোথায় বিপ্লবীরা লুকিয়ে থাকত।’
আমাদের দু জনের কাঁধে হাত দিয়ে ছোট্ ঠাকুর্দা নীচে চললেন। বাগানের ছোট্ট ঘরটাতে যেখানে দায়ুদ গোবর্ধনকে মেরেছিল সেইখানে এসে উনি আমাদের এক দলা কাঁটাগাছ দেখালেন।
—‘ওই দেখো, ওই যে ক্যাকটাসের ট্রেটা রয়েছে ওটা সরালেই একটা দরজা পাবে, ওই দরজা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে যেতে হয়। এবার চলো এর উল্টো দিকে।’
দুটো উঠোন পার হয়ে আমরা বারবাড়িতে এলুম। ছোট্ ঠাকুর্দা গান ঘরের দরজা খুললেন। আজ ঘরটায় দরজা-জানলা সব বন্ধ রয়েছে—ভ্যাপসা গন্ধ। সব আলোগুলো জ্বালিয়ে দিলেন ছোট্ ঠাকুর্দা, ঘর ঝলমল করে উঠল। ছবিগুলো জ্বলজ্বল করছে, যেন হাসছে। ঘরের একদম শেষে একটা দেয়াল-আলমারি। দেয়াল জোড়া একেবারে। ডান দিকের ভাঁজ করা পাল্লা খুলে উনি পেছনের দেয়ালে একটা কড়া ধরে হ্যাঁচকা টান মারলেন, আলমারির পাল্লার মতো খুলে গেল দেয়াল। সেই ফাঁক দিয়ে আমরা তিনজন একটা অন্ধকার জায়গায় ঢুকলুম। ছোট্ ঠাকুর্দা বোধহয় কোনও সুইচ টিপলেন। আলো জ্বলে উঠল। এটা একটা ঘর, ভ্যাপসা, নোংরা, অনেক দিনের ঝুল জমে আছে কড়িকাঠে। কয়েকটা কাপড়-ঢাকা সোফা কৌচ, টেবিল তক্তপোষ রয়েছে ঘরটাতে। এখানে জানলা নেই, আছে খালি বড় বড় কাচ ঢাকা ঘুলঘুলি।
ছোট ঠাকুর্দা বললেন—‘বয়েজ, এই ঘর একটা ঐতিহাসিক ঘর। কী আর পড়বে তোমরা ইতিহাসে? কতটুকু? এই ঘরে এক সময়ে আমার বউঠাকরুনরা কত বিপ্লবীকে লুকিয়ে রেখেছেন। আমার মা তাঁদের সেবা করেছেন, এইখানে কত প্ল্যান আঁকা হয়েছে, কত ম্যাপ আঁকা হয়েছে স্বাধীন ভারতবর্ষের।’
মানিক বলল—‘একটা ম্যাপও কি আর নেই?’
—‘না’, মানিকের মাথায় হাত রেখে হাসলেন ছোট্ ঠাকুর্দা—‘একটা ম্যাপও নেই।’
গুপ্ত কুঠুরির দরজা বন্ধ করে দিয়ে উনি বললেন—‘এই ঘর এ বাড়ির সবচেয়ে পবিত্র ঘর, এই ঘরে পা রেখেছেন অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ, সিস্টার নিবেদিতা, এখানে এসেছেন অমরেন্দ্র চাটুজ্যে, ভূপেন দত্ত, আর সবচেয়ে বেশি এসেছেন যাঁরা তাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামের অখ্যাত গুপ্ত সৈনিক সব। তাঁদের নাম করতে গেলে আজকের রাত ফুরিয়ে যাবে। তাঁদের গল্প তোমাদের আর এক দিন শোনাব।’
তারপর ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন—‘আর এই গানঘর? এ-ও কিছু কম পবিত্র নয়। এখানে গান করে গেছেন পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ, ফৈয়জ খাঁ সাহেব, বদল খাঁ সাহেবের সারেঙ্গি শুনেছি এইখানে। কত ভাল ভাল নাটকের রিহার্স্যাল দেখেছি, করেছি। আমার কাছে এই ঘরও পবিত্র। আ হোলি রুম। মাই চার্চ।’
এর কয়েকদিন পর একটা রবিবার সকালে সেই অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটল।
চতুর্দশ অধ্যায় : প্রপিতামহী
রবিবার সকালে আমরা দ্বারিকের হিঙের কচুরি খাই তো! হালুয়া দিয়ে। খোসাসুদ্ধু আলুর তরকারি দিয়ে। ছোট্ট ছোট্ট কচুরি। আমার ভাগে দুটো আছে। যদি খেতে পারি মা আরেকটা দেবেন বলেছেন। আমি তাড়াতাড়ি দু নম্বরটা মুখে পুরছি, দেখি মানিক। ছুটতে ছুটতে এসেছে। হাঁপাচ্ছে। আজকে ওর সঙ্গে গোবর্ধনও নেই। একলা এসেছে মানিক।
—‘পুনপুন, পুনপুন, শিগগিরই আয়। আমাদের বাড়ি পুজো হচ্ছে। পাকুমা ঠাকুর হয়ে যাচ্ছে।’
মা বললেন—‘কী হয়েছে? পাকুমার কিছু হয়েছে? অসুখ?’
—‘অসুখ নয়, পুজো। দেখবি আয়? আয় না?’—মানিক আমার হাত ধরে টানাটানি করছে। হাতটা ছিঁড়ে ফেলবে নাকি?
মা বললেন—‘যাও, আগে দুধটা খাও, খেয়ে নিয়ে যাবে।’ তারপর পিসিমার দিকে তাকিয়ে বললেন—‘কী বলুন তো দিদিমণি?’
পিসিমা বললেন—‘সত্যনারায়ণ হচ্ছে বোধহয়, পুন্নিমে তো!’
আমি ততক্ষণে মানিকের হাত ধরে হাওয়া।
মানিকদের গানঘর খোলা হয়েছে। ভালো করে ঝাড়পোঁছ করা হয়েছে। ঝকঝক করছে ঘরখানা। মাঝখানের পদ্মটার কাছ ঘেঁষে মেঝেতে বিছানা। পাকুমা সেখানে গরদের কাপড় পরে বসে আছেন। কপালে চন্দনের ফোঁটা, হাতে জপের মালা। সবাই বলছে পাকুমা প্রায়োপবেশন করছেন।
পদ্মর ওপর বালি। তার ওপর চৌকো পাত্তর। সেখানে কাঠের আগুন জ্বলছে, একজন টিকি-মাথায় পুরোহিত আগুনে ঘি ঢালছেন। আর অংবং করছেন, অংবং করছেন আর ঘি ঢালছেন। ধুনো-গুগগুলে ঘরের ওই জায়গাটা সরস্বতীপুজোর মতো আবছা। খুব পুজো-পুজো গন্ধ বেরোচ্ছে। ঘরের মধ্যে মানিকদের বাড়ির সবাই। সব্বাই। শুদ্ধ কাপড় পরে জড়ো হয়েছে সব। সবাইকার মুখ থমথম। কেউ কেউ কাঁদছেন। হাউ-হাউ করে নয়। চোখ দিয়ে জল পড়ছে শুধু। মানিকদের বাবা, কাকা, জেঠারা; কর্তামা, মা, কাকি-জেঠিরা, পিসি-পিসেমশাইরা স-ব বোধহয় এসেছেন। এঁদের সবাইকে আমি চিনি না। মেজদিমণির বিয়েতে কাউকে কাউকে দেখেছি বলে মনে করতে পারছি যেন।
পুজো শেষ করে ঠাকুরমশাই শান্তির জল দিয়ে উঠে গেলেন। তারপর মানিকের বাবা পাকুমার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন—‘পাকুমা তুমি এ কী করছ? কেন করছ। এ সব মতলব ছেড়ে দাও, আমি বলছি। তুমিই বলো আমি তোমার ছেলেরও বাড়া। পাকুমা, মা জানিনি কোনওদিন, তোমার কাছেই মানুষ হয়েছি, আমার কথাও কি তুমি শুনবে না?’
পাকুমা বললেন—‘ভুতু, একটা সৎ-সংকল্প করেছি, তা থেকে আমায় টলাবার চেষ্টা কেন করছ বাছা। অমন করে না।’
—‘সৎ-সংকল্প? তুমি তো আত্মহত্যা করছ? আত্মহত্যা তো পাপ?’
—‘পাপ-পুণ্য বলে এ সংসারে সেভাবে কিছু নেই ভুতু। যখন যেটা একান্তভাবে প্রয়োজন, তখন সেটাই করতে হয়।’
—‘তার মানে এইটা, তোমার মৃত্যুটা প্রয়োজন হল?’
—‘হল ভুতু। আমার তো অনেক দিন আগেই চলে যাওয়ার কথা। চিন্তা করে দ্যাখো তোমার ঠাকুর্দা কবে কোনকালে চলে গেছেন। তোমার বাবা, মেজকাকা, মা সব্বাই কত কাল হল গত হয়েছেন। তোমাদের বাবা-কাকাদের সন্তানদের মধ্যেই কি সব কটি বেঁচে আছে?’
—‘সেই কথা ভেবে হঠাৎ আজকে তুমি আত্মহত্যা করবে? মা-বাবার অবর্তমানে তুমিই আমাদের দু হাতে আগলে রেখেছ, এখনও রেখেছ, তুমি যা বলো তাই আমরা মেনে চলি।’
—‘না, চলো না ভুতু। তবে সেসব কথা থাক। একদিন না একদিন তো যেতেই হয়। এখন তোমরা ভব্যিযুক্ত সাবালক হয়েছ, তোমাদের নিজেদের ভরা সংসার। সবই তো সামলাচ্ছ। বুঝিয়েও দিয়েছি সব। আমার কোনও দায় নেই ভাই।’
—‘স্বাভাবিকভাবে চলে গেলে তো কিছু বলার থাকত না পাকুমা। এভাবে যাচ্ছ মানে কোনও কারণ আছে। নিশ্চয় কোনও কারণ আছে। আমাদের বলো কী অপরাধে আমাদের আজ এইভাবে…কী কথা শুনি না!’
পাকুমা বললেন—‘কারণ একটা আছে। তবে সেটা তোমাদের অপরাধ নয়। আমারই অপরাধ। নিতান্তই যদি শুনবে তো শোনো। আমার বহুমূল্য মণিটি হারিয়ে গেছে।’
আমার কান খাড়া। মানিক আমার দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে আছে।
—‘মণি? কী মণি? কোনওদিন তো শুনিনি?’ মানিকের বাবা আকাশ থেকে পড়েছেন।
—‘শোননি আমি বলিনি বলে। বলার কথা নয়। অনেকদিন আগে, তোমাদের ঠাকুর্দার সঙ্গে বিয়েরও আগে আমি এক মন্ত্রপূত মণি পাই। পরশমানিক বলেই তাকে জানতুম। ছোট্ট কালো পাথরের টুকরো একটা। সেই মানিক আমি হারিয়ে ফেলেছি।’
—‘কী করে হারালে? এ তো আশ্চর্য কথা!’
—‘মানিকটা থাকত আমার আলমারিতে। আলমারি খুললেই চারদিকে একটা আভা দেখতে পেতুম। কদিন আগে আলমারি খুলে দেখি ভেতরটা কেমন ম্যাড়ম্যাড় করছে। তখন বাক্স খুলে দেখি মণিটা নেই। তখনই বুঝেছি আমায় এবার চলে যেতে হবে।’
মানিকের বড় জ্যাঠামশাই বললেন—‘কী বলছ পাকুমা? কোনওদিন তো বলোনি! অত দামি একটা পাথর হারিয়ে যাবে, খোঁজাখুঁজি না করে তুমি প্রায়োপবেশনে বসে পড়লে? আশ্চর্য! কেউ নিশ্চয় চুরি করেছে তোমার আলমারি থেকে। এত বড় কথাটা তুমি চেপে যাচ্ছিলে?’
পাকুমা হাত তুলে বড় জ্যাঠাকে থামালেন—‘কাতু, সে পাথর দেখতে খুবই সাধারণ। একটা কালো পাথরের টুকরোকে খুব ঘষে ঘষে মসৃণ করে ফেললে যেমন হয় তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। তার যে কোনও অসাধারণত্ব আছে দেখলে বোঝা যায় না ভাই। হীরে-জহরত তো নয় যে কেউ চুরি করবে। আমিই কোথাও হারিয়ে ফেলেছি।’
—‘বেশ তো হারিয়ে থাকে, খুঁজে বার করবো।’
—‘মন্ত্রপূত সে পাথর নিজের ইচ্ছেয় আসে, ইচ্ছেয় যায় বাছা, পারবি না।’
—‘পারি কিনা দেখো।’
—‘বেশ দেখো। তবে খামোখা লোকজনদের উত্ত্যক্ত করো না, আর শোনো খুব শুদ্ধ কাপড়ে, শুদ্ধ চিত্তে ছাড়া ও পাথর খুঁজে কোনও লাভ নেই, পাবে না। পেলেও আর তার গুণ থাকবে না। আমি বলছি কাতু, হারিয়ে গেছে এটা মেনে নেওয়াই ভালো।’
—‘মোটেই না। হারিয়ে গেছে, আবার খুঁজে পাওয়া যাবে। ঠিক আছে, তুমি যে ভাবে বলছ সে ভাবেই খুঁজব। কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে খুঁজে বার করতে পারলে তোমাকে উঠতে হবে। এসব প্রায়োপবেশন-টেশন চলবে না। কথা দাও।’
পাকুমার মুখে কী সুন্দর হাসি! বললেন—‘ঠিক আছে, কথা দিলুম।’
বড় জ্যাঠামশাই সবাইকার দিকে তাকালেন—‘সবাই শুনলে তো? পাঁচ দিন সময় নিই আমরা। এর মধ্যে মেয়েরা সব সক্কালবেলায় চান করে গরদের কাপড় পরে নেবে। গীতাপাঠ চলবে। এ ক’দিন বাড়িতে মাছ মাংস পেঁয়াজ রসুন ঢুকবে না। আমরাও সব পুজোর কাপড় পরে থাকব, একাহারী হব, যে যার সাধ্যমতো খুঁজব।’
সবাই চলে গেলেন আস্তে আস্তে। খালি আমি আর মানিক পাকুমার মাথার কাছে। ঘর চুপচাপ হয়ে গেলে পাকুমা বললেন—‘শিয়রে কে রে? মানিক?’
ভিতু ভিতু গলায় মানিক বলল—‘আমি আর পুনপুন। আমি যাব না পাকুমা, আমি এখানেই থাকব।’
আমি বললুম—‘পাকুমা, আপনার পরশমানিক হারিয়ে গেছে? সত্যি?’
—‘সত্যি নয় তো কী?’
আমি বললুম—‘আমি খুঁজে দেব পাকুমা?’
—‘পারবি?’ হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে পাকুমা বললেন, ‘তোরা দুটোতে এদিকে একবার আয় দিকিনি।’
আমরা সামনে গিয়ে পাকুমার মুখের সামনে বিছানার ওপর হাঁটু গেড়ে বসলুম। পাকুমা বিছানায় বসতে আমাদের বারণ করলেন না তো? পিসিমা কিন্তু আমাদের বিছানা ছুঁতে দেন না। বুবুকে যদি বা দেন। আমাকে একবারে নয়। বলবেন—‘এই পুনু খবর্দার আমার জিনিস ছুঁবি না!’
ঠাকুমা বলবেন—‘আহা একটা একফোঁটা বই তো নয়, মনো!’
পিসিমা বলবেন—‘কলাইয়ের বীজ একফোঁটা হলেও কলাই সেজমা, ব্যাটাছেলের ঝাড়ে ব্যাটাছেলেই জন্মায়। তোমার কথা আলাদা তুমি পাকা মাথায় সিঁদুর পরেছ। কিন্তু আমি একটা জন্মশুদ্ধ মানুষ…’
পিসিমা আমাকে ব্যাটাছেলে বলেন। এ মা! ব্যাটাছেলে তো একটা খারাপ কথা! আমি কখনও পিসিমার জিনিস ছোঁব না। ছোঁবই না!
পাকুমা আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। পাকুমার মুখটা কি হাসি-হাসি? না কাঁদো-কাঁদো আমি একদম বুঝতে পারছি না।
পাকুমা বললেন—‘আগে ভাবতুম, রায়চৌধুরী বংশের কেউ ছাড়া ও জিনিস পায়ও না, কী ভুল? পরশমানিক কি কোনও বংশের একচেটে হতে পারে? তুমি, হ্যাঁ মণি তুমিও পেতে পার বইকি? তবে খুব ভালো, খুব সাহসী, খুব দয়ালু হতে হবে বাবা, যতটা বুদ্ধি চাই ততটাই হৃদয় চাই।’
আমি তাড়াতাড়ি বলি—‘পাকুমা, বাবা বলেছেন আমি খুব সাহসী। স্বাধীনতার দিন আমি হারিয়ে গিয়েছিলুম। কিন্তু একটুও কাঁদিনি। রাস্তার দাদাদের কাছে ঠিকানা বলে বাড়ি আসতে পেরেছিলুম। আর পাকুমা, আমার খুব দয়াও আছে। আমি ভিখারিদের পয়সা দিই, চাল দিই। নিতাই আমার লাট্টু চাইলে আমি দিয়ে দিয়েছিলুম। এতে হবে না পাকুমা? পারব না?’
মানিক অমনি বলল—‘আমিও তো খুব ভালো পাকুমা। আমি তো পরীক্ষায় টুকলি করি না। ফড়িং-এর ডানা ছিঁড়ি না প্রজাপতি দেশলাইয়ের বাক্সে পুরে রাখি না বাচ্ছার মতো। আমি পারব না?’
পাকুমা আমাদের দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। পাকুমার বুকে রোজ সুন্দর গন্ধ পাই। আজকের গন্ধটা আরও সুন্দর। সরস্বতী পুজোর মতো। পাকুমা তাহলে সত্যি-সত্যি ঠাকুর হয়ে যাচ্ছেন! এখনই আর্ধেকটা হয়ে গেছেন, আর আর্ধেকটা হলেই মাথার চারপাশ দিয়ে জ্যোতি বেরোবে।
পাকুমা বললেন—‘কেন পারবি না বাবা, নিশ্চয় পারবি। চেষ্টা কর। তবে বড়রা যেখানে খুঁজছে সেখানে খুঁজতে যাসনি। মন্ত্রপূত পাথর তো! তেমন করে খুঁজতে পারলে হয়তো দেখবি তোদের পেনসিলের বাক্সে লুকিয়ে বসে আছে। কিংবা হয়তো দেখবি তোদের প্যান্টের পকেট থেকে বেরোলো।’
—‘তা হলে তুমি আর পারোপবেশন করবে না তো? মানিক বলল।’
আমি পাকুমার দিকে তাকিয়ে আছি। মানিক বুঝতে চাইছে না, কিন্তু আমি বুঝে গেছি পাকুমা কিছুতেই আর এই বিছানা ছেড়ে উঠবেন না, সে আমরা পাথর খুঁজে পাই আর না পাই। চোখ দুটো উনি আস্তে আস্তে বুজে ফেলছেন, বলছেন—‘তোরা দুটোতে আমার কাছে কাছে থাকতে পারবি? ওই কোণে যে কৌচগুলো রয়েছে তাতে শুয়ে থাকবি রাত্তিরবেলায়, পারবি না মানিক? পারবি না মণি?’
—‘যদি জেঠুরা আসতে না দেয়!’
—‘আমি বলে দেব সবাইকে। তবে মণি তোকে বাবা-মার কাছ থেকে অনুমতি আনতে হবে বাবা।’
মানিক পাকুমার কাছে থাকবে, এ আর বেশি কথা কি? কিন্তু আমি তো পাকুমার আসল নাতকুড় নয়! কর্তামা গোবর্ধনের সঙ্গে মানিককে পাঠালেন আমাদের বাড়ি। আমি বসে আছি পাকুমার কাছে। আজ পাকুমা গল্প বলছেন না, তবুও আমার ভালো লাগছে বসে থাকতে। আমি ছবি দেখছি, ঘর দেখছি, আমি সেই গুপ্ত ঘরের দরজা-ঢাকা আলমারিটার দিকে তাকাচ্ছি…।
ওমা, দেখি বাবাও এসেছেন, মা-ও এসেছেন। ওঁরা পাকুমাকে প্রণাম করছেন।
পাকুমা বললেন—‘ডাক্তারবাবু, আপনিই এ ক’দিন আমার চিকিৎসা করবেন। আর কারও ওষুধ আমি ছোঁবো না, কাতু-ভুতু তোমরা শুনে রাখো। আর আপনার এই ছেলেটি যদি আমার কাছে কাছে থাকে, যতক্ষণ জ্ঞান থাকবে ততক্ষণ…।’
বাবা বললেন—‘আপনি এ সব কী বলছেন? প্রায়োপবেশন আবার আজকালকার দিনে কেউ করে নাকি? আপনি তো এ রকম…’
—‘কী? কুসংস্কারের কথা বলছেন তো? কথাটা কী জানেন ডাক্তারবাবু মাঝে মাঝে আত্মশুদ্ধির দরকার হয়ে পড়ে।’
—‘কার আত্মা মা? আপনি যদি না-ই থাকলেন তো শুদ্ধি কার? সে নিয়ে আপনার হবেই বা কী?’
—‘কার আত্মা, কার শুদ্ধি, আপনি নিজেকেই জিজ্ঞেস করুন ডাক্তারবাবু। ধরুন যতীন দাস যে জেলে প্রায়োপবেশন করলে সে কার শুদ্ধির জন্যে? সুভাষ যে গৃহত্যাগ করে চলে গেলেন অশেষ কষ্ট সয়ে আজ নিরুদ্দেশ সে কার জন্যে?’
—‘কিন্তু মা, সে তো…’
—‘আমি একটা উদাহরণ দিলুম, ডাক্তারবাবু, তুলনা করছি না।’
আমার মার চোখ দিয়ে জল পড়ছে।
পাকুমা বললেন—‘নাত-বউ চোখ মোছো মা, চোখের জল ফেলবার সময় এটা নয়। আমি খুব সুখী, খু-উ-ব। না ডাক্তারবাবু, আমি যা ঠিক করি, তা করি। এটুকু আমার এখনও আছে। সময়মতো এসে আমার নাড়ি-টাড়িগুলো দেখে যাবেন। নাকে নল দিয়ে কি ছুঁচ ফুটিয়ে কিছু খাওয়াবার বা জিইয়ে রাখবার চেষ্টা যেন কেউ না করে। ছেলেটিকে আমার কাছে থাকতে দেবেন তো?’
—‘আপনি চাইছেন আর এটুকু আমি দেব না! আপনার কাছে যে আমি কতভাবে ঋণী!’
—‘ঋণ? কিসের ঋণ আবার? মানুষ হয়ে জন্মালে পরস্পরকে দেখাশোনার দায় আপনি বর্তায়। ঋণের কথা উচ্চারণ করলে আপনি ছেলেকে বাড়ি নিয়ে যান।’
বাবা মাথা নিচু করে রইলেন। মা বললেন—‘পাকুমা, ও তো আপনার মানিকেরই মতো! আপনার কাছে রাখবেন এ তো ওর সৌভাগ্য।’
পাকুমা বললেন—‘রাতের খাওয়া-দাওয়া ও এখানেই করবে। সকালটা বাড়িতে থাক। স্কুলে যাক। সন্ধেবেলায় পড়ার বই-টই নিয়ে আমার কাছে চলে আসবে। কেমন?’
পঞ্চদশ অধ্যায় : মহাপ্রস্থান
প্রথম রাত্তির—দুটো পাশাপাশি কৌচে ছোট ছোট চৌকো বালিশ নিয়ে আমরা শুয়েছি। এগুলো সাহেবি বালিশ। লাল মখমলের। একে বলে কুশন। সন্ধেবেলায় আমরা রুপোর থালা করে প্রসাদ খেয়েছি, পাকুমার থেকে একটু দূরে বসে। তারপরে অঙ্ক কষতে হয়েছে। আমি ভাগ শিখে গেছি তো! মানিক শেখেনি, পাকুমা বললেন ওকে শিখিয়ে দিতে। তারপরে গ্রামোফোনে গান বাজতে লাগল—মীরাকে প্রভুর গান। শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। কখন জানি না, আমার ঘুম ভেঙে গেছে। এত বড় মাঠের মতো ঘরে কখনও থাকিনি তো! ঠিক যেন মনে হচ্ছে, ঘরের মধ্যে কে আকাশ পুরে দিয়েছে। চারদিকে আকাশ মাঝখানে আমি ভাসছি।
ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে পাকুমার মাথার কাছে। সারা দিন ধূপ-ধুনো জ্বলছে, টাটকা ফুল পেতলের ফুলদানিতে, পাথরের থালায়। খুব গন্ধ।
—‘মা, ঘুমোলে?’
চমকে উঠেছি। ছোট্ ঠাকুর্দার গলা না! এ ঘরে খুব আস্তে কথা বললেও গমগম করে। ছোট ঠাকুর্দা ফিসফিস করে বলছেন। কিন্তু আমি শুনতে পাচ্ছি।
—‘না, বাবা, কিছু বলবি?’
—‘তুমি শেষ পর্যন্ত আমার ওপর অভিমান করে চলে যাচ্ছ মা?’
—‘কে বললে এ কথা!’
—‘কে আবার বলবে? পেটের ছেলেকে ঠকাতে পারো মা? আমি সে-দিনের সব কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি। আমার ভাগ্যে যা হবার হয়েছে। সত্যি তো আমি জোর করিনি কখনও, রোখ ছিল না। বাবা বললেন, অ্যাকটো করতে নামলে ত্যাজ্য পুত্র করবেন। রাজভোগটি আর অক্লেশে জুটবে না, স্ট্রাগল করতে হবে বুঝে ফিরে এলুম। এ তো তোমার দোষ নয় মা! নেলীকে না পেয়ে যে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলুম, সে-ও তো আমারই ব্যক্তিগত ব্যাপার। কোনও কিছুতেই কোনওদিন বিচক্ষণতা দেখাতে পারিনি মাগো। তুমি তো আমাকে বারবার সুযোগ দিয়েছ। আমি পারিনি। আমিই পারিনি। নেলী যখন দাদাকে ছাড়তে রাজি হল না, আমি তো এ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারতুম। যাওয়াই তো উচিত ছিল। যাইনি সহজ জীবনের লোভে, লড়াইয়ের ভয়ে। জীবনসংগ্রামে অক্ষম, কাপুরুষ সন্তান তোমার প্যারাসাইট, উচ্ছিষ্ট। কাপুরুষের স্বভাবই এমনি, নিজের দায় অন্যর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়, মা, আমায় মাফ করো।’
—‘শম্ভু, আমি তো চিরটা কাল তোকে প্রাণভরে আশীর্বাদই করেছি বাবা। তুই তো জানিস, তোর বাবার গোঁড়ামি আমার ছিল না। তাঁর টাকাপয়সার মুখাপেক্ষীও আমি ছিলুম না। তুই যদি অ্যাকটিং করতিস তেমন জোর করে, খুশি না হলেও সাহায্য আমি করতুম। তোর মধ্যে যে ক্ষমতা রয়েছে তা যে অতি অসাধারণ তা কি আর আমি বুঝতুম না? তবে সত্যি কথাই, তোর ওই ক্ষমতাকে আমি তিলুর লেখাপড়া কি কালীর শক্তি-সাহস-দেশপ্রেমের চেয়ে বড় করে দেখিনি। আজ এত কাল পরে বুঝতে পারি তুই ওদের কারও চেয়ে কিছু কম ছিলি না।’
—‘আহ্, বলো মা বলো, আরেকবার বলো। চিরকাল শুনে এসেছি আমি এ বাড়ির প্রডিগ্যাল, আমি ব্ল্যাক শিপ, তুমি আরেকবার বলো মা বুকটা জুড়োক।’
পাকুমা খুব তুলতুলে আদর ভরা গলায় বললেন—‘তুই সত্যিই ওদের কারও থেকে কিছুমাত্র কম ছিলি না শম্ভু। হয়তো বেশিই ছিলি। তিলু কী করলো শেষ পর্যন্ত! তার কী ভাষা, কী বক্তৃতা, মঞ্চে একবার উঠলে লোকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত, অত বড় ব্যারিস্টার হল, মাঝখানে এসে লীলার সঙ্গে কী কথাবার্তা হল আজও জানি নে। সেই যে গেল আর ফিরলোই না! আমার ছেলে ত্রিলোকেশ্বর…সে বিদেশে বিভুঁয়ে ঈশ্বর জানেন কী পরিবেশে কীভাবে হতভাগার মতো অকালে চলে গেল! এ কি পুরুষমানুষের কাজ!’
—‘মাগো, দাদা নেলীকে শুধু একটাই প্রশ্ন করেছিল—ছোটর সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক লীলা? নেলী অভিমানে জবাব দেয়নি। চুপ করে ছিল। দাদা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঘোড়ায় চড়ে ময়দানের দিকে বেরিয়ে গেল। সাত দিনও গেল না আবার বিলেত চলে গেল। দাদার দোষ ছিল না মা। পুরুষমানুষ কি শুধু বীর্যে হয়? প্রেমেও হয় মাগো, ঈর্ষায়ও হয়।’
একটা নিশ্বাসের শব্দ শুধু শুনতে পেলুম। নিশ্বাসটা ওপরে উঠে পাক খাচ্ছে যেন।
ছোট ঠাকুর্দা আবার বললেন— ‘একেকটা মানুষ প্রকৃতিতে এত রিচ হয় মা যে অন্য মানুষ তার পরিমাপ করতে পারে না। ওই রকম একটা মেয়েকে তোমাতে অ্যালিসেতে মিলে আমাদের তিন জনের মাঝখানে বসিয়ে দিলে। সে কথা কইত একজনের সঙ্গে, কাজকর্ম করত আরেক জনের সঙ্গে, আমার সঙ্গে তার যত হাসি গল্প, থিয়েটার, গান কৌতুক। সে যদি তিনজনকেই তিন রকম করে ভালোবাসে, কী করা যাবে? তুমি তার দিক থেকে ভাবো। আমি অর্বাচীন সে কথা না বুঝে যদি অপরাধ করে ফেলে থাকি মা তবে আমাকেই কি দোষ দিতে পার? সে চলে গেল। আমার অপরাধে সে চলে গেল। আমারই অপরাধে দাদাও…’ ছোট ঠাকুর্দার গলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পাকুমা কথা বলছেন না। একটা হাত দেখছি উঁচু, ছোট ঠাকুর্দার মাথার ওপর। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়েছি কখন।
তৃতীয় রাত্রি
চাপা রাগত গলা—‘মা, ও শয্যে থেকে তুমি ওঠো। তুমি নয়, আত্মঘাতী আমারই হওয়া উচিত।’
—‘কেন উমা?’ —পাকুমার গলা।
—‘কেন তুমি জানো না? তোমার নাতিরা চতুর্দিকে মণি খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমার কাছে আলমারির চাবি চাইছে। আমার আলমারি, নতুনের আলমারি, রাঙার আলমারি স-ব খুঁজে দেখবে।’
—‘তাতে কী? দিয়ে দাও না চাবি!’
—‘দিয়ে দোব? বাঃ! রাঙা জ্যাকপট জিতে এতগুলো টাকা পেয়েছে সে সব তো আলমারিতে। দেখলে কাতু ভুতু সতু সব কী মনে করবে তুমি জানো না?’
—‘ওরা যাই মনে করুক তুমি সত্যি কথা বলো না, কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না!’
—‘খুব সোজা, না? আশ্রিতকে কে কবে বিশ্বাস করেছে?’
—‘আশ্রিত হয়ে আছ কেন উমা, আমি তো রাঙা আর নতুনকে জমি দিয়ে বসত করাবার কথা কবে থেকে বলছি।’
—‘চিরকাল শহরে মানুষ এখন এতখানি বয়সে আর গ্রামগঞ্জে গিয়ে থাকতে পারে? বললেই হল? নতুনকে তো একরকম নির্বাসন দিয়েছ।’
—‘এখনও সে রায়চৌধুরীদের বিষয়ই দেখাশোনা করছে, এ-ও কিন্তু স্বাধীন হওয়া হল না।’
—‘কী চাও তুমি মা? দুটো বুড়ো ছেলে নিয়ে আমি গঙ্গায় ডুবে মরি। একটা মাতাল জমিদারের অকালকুষ্মাণ্ডর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল সে কি আমার দোষ?’
—‘তুই বিধবা হয়ে আসবার পর তোকে আমি ভিক্টোরিয়া স্কুলে ভর্তি করে দিইনি উমা! গেলে না কেন? ছেলেরা মামাবাড়ির আদরে গোল্লায় যাচ্ছিল, বোর্ডিং-এ পাঠাবার বন্দোবস্ত করলুম কেঁদে কেটে অনর্থ করলে। তখন আমার কথা শুনলে তুমি আজ নিজের পায়ে দাঁড়ানো ভব্যিযুক্ত মানুষ, তোমার ছেলেরা আর কিছু না পারুক নিজেরটা নিজে চালিয়ে নেবার শিক্ষাটুকু পেত।’
—‘শোকাতাপা মানুষকে হঠাৎ লেখাপড়া শেখার কথা বললে সে রাজি হয়? ছেলেদের কোলছাড়া করতে চাইলে রাজি হয়?’
—‘কিসের শোক উমা? দিগিন মারা যেতে তার জমিদারি যখন নিলামে উঠল, আমি তো তোমার বিষয়ের শোক যত দেখেছি, মানুষটার জন্যে তত দেখিনি।’
—‘একটা দুশ্চরিত্তির শয়তান ছিল, সদরে আর একটা সংসার করেছিল, তার জন্যে কি আমায় অন্নজল ত্যাগ করতে হবে নাকি?’
—‘না, তা হবে না। তাই তো বলেছিলুম পড়াশোনা করো। বাড়িতে গভর্নেস পর্যন্ত রাখলুম, তুমি তো কিছুই শিখতে চাইলে না উমা। দিগিনকে জামাই করে তোমার ঠাকুমা ভুল করেছিলেন। কিন্তু সে ভুল শোধরাবার জন্যে চেষ্টা তো আমি কম করিনি।
—‘বেশ। তো সে কথা শুনিনি বলেই কি আজ জলে ভাসিয়ে দিতে চাইছ?…’
—‘না। কখনোই না। এইটুকু বলছি—যা হয়ে গেছে, গেছে। ছেলেদের এবার বুঝতে দাও, তাদের যা সাধ্য সেইমতো স্বাধীনভাবে থাকাই তাদের পক্ষে সম্মানের। তোমার মাসোহারা তুমি বরাবর পাবে। কিন্তু ছেলেদের বলো, যেন দেশে গিয়ে তাদের নামে যে জমি লিখে দিয়েছি, তার দেখাশোনা করে। মামাবাড়ির আশ্রয়ে আর না থাকে। যদি জ্যাকপটের টাকা পেয়ে থাকে তো খুব ভালো। সেগুলো আর ঘোড়া আর মদের পেছনে না উড়িয়ে, স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচুক।’
—‘এ বয়সে আর কি কেউ ফিরতে পারে মা? তুমি অসম্ভব আবদার করলে কী হবে!’
—‘আমি চলে গেলে সব হবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
—‘তোমার অনাথ বিধবা মেয়েকে তার অমানুষ ছেলেদের হাতে হাড়ির হাল হতে রেখে যাচ্ছ মা? তুমি কী নিষ্ঠুর! আমি ভাবতেও পারিনি, একমাত্র মেয়ের ওপর তুমি এত নিষ্ঠুর হতে পারবে।’
—‘উমা, আমার বয়সটা ভাব। আর কতদিন আমি বেঁচে থাকব আশা করিস? তুই? তুই-ই বা আর কতদিন বাঁচবি? ছেলেদের, বউয়ের অকালমৃত্যু সহ্য করেছি। নাতি-পুতিগুলোও পট পট করে চলে যাচ্ছে। আমি আর কত দেখব? … তুই আয়, আমার পাশে একটু শো মা, আমি তোর গায়ে হাত বুলিয়ে দিই।’
কিছুক্ষণ চুপচাপ। চাপা-চাপা কান্না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। বুবু স্বপ্ন দেখে এমনি করে কাঁদে। কর্তামা কি আজ রাত্তিরবেলায় বুবু হয়ে যাচ্ছেন?
ফোঁপাতে ফোঁপাতেই কর্তামা একসময়ে বললেন— ‘তা হলে মণির কথা সব মিছে? আর ভালো লাগছে না বলে চলে যেতে চাইছ?’
—‘উঁহুঃ! মণির কথা একদম নির্জলা সত্যি। তবে ভালো না লাগাটাও মিথ্যে নয়।’
—‘সংসার যদি ভালো না লাগে তো কাশী, বৃন্দাবন, হরিদ্বার যেখানে ইচ্ছে গিয়ে থাকো না মা, আমিও তোমার সঙ্গে থাকব, অ্যালিস যেমন মুক্ত স্বাধীন ঘুরে বেড়ায়!’
—‘কথাটা যে ভাবিনি তা নয়। কিন্তু কাশী বৃন্দাবনেও যে ভালো লাগবে তেমন তো কোনও কথা নেই। ভালো না লাগারই কথা। মূর্খামি আর শক্তির অপচয় আমি সইতে পারি না সে তো তুই জানিস। তুই যদি অ্যালিসের সঙ্গে থাকতে চাস তো সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
—‘আমার ছেলেগুলোর কী হবে?’
—‘থেকেই কি ওদের কিছু করতে পারছিস? ওরা তোর কথা শোনে? মানে?’
নিশ্বাস ফেলে কর্তামা বললেন— ‘আমাকে কেউই মানে না মা। এসব আমার নিজেরই টান। যদি ওদের নিজেদের সংসার থাকত তা হলে হয়তো এত উতলা হতুম না।’
আধো অন্ধকারে যতক্ষণ জেগে রইলুম, দুটি মাথা কাছাকাছি ঘেঁষাঘেঁষি দেখতে পেলুম, কর্তামা বোধহয় সারা রাতটাই মায়ের কাছে কাটালেন।
পঞ্চম রাত
এসেছিলেন মানিকের এক কাকা। এঁর মুখ চিনতুম, কিন্তু বেশি দেখিনি বাড়িতে। উনি আস্তে করে ডাকলেন—‘পাকুমা!’
—‘কে? কে রে?’
—‘আমি জিতু, পাকুমা।’
—‘কিছু বলবি?’
—‘তোমার মণি খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে, বড় মারাত্মক জিনিস বেরিয়েছে মা জিনার আলমারি থেকে। তাড়া-তাড়া চিঠি মা। লভ লেটার। এখন আমি কী করি? বলো, কী করি?’
—‘জিনিয়া জানে?’
—‘সরাবার সময়েই তো ধরা পড়ে, বড়দা হুকুম দিয়েছিল কেউ আলমারি ছোঁবে না, চাবি সব বড়দার জিম্মায়। জিনা চাবি সরিয়ে আলমারি থেকে চিঠির তাড়া সরাচ্ছিল শাড়ির মধ্যে লুকিয়ে, মেজদা-বড়দা সব দেখেছে, একেবারে নাতে-হাতে…কী লজ্জা! কী অপমান! পাকুমা, উঃ কী অপমান!’
—‘নাম সই আছে তলায়?’
—‘নাঃ। কিন্তু হাতের লেখা দেখে মেজদা-বড়দা চিনতে পেরেছে মনে হয়। নতুনদা দেশ থেকে নিয়মিত হিসেব-পত্র পাঠায় … কী অশ্লীল, চিন্তা করা যায় না এত নোংরা, পাকুমা আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। কী করবো আমি? কী করবো? উফ্ফ্!’
—‘কি করবি জিতু তুই-ই বল।’
—‘তুমি আমার ওপর ছেড়ে দিচ্ছো? আমি তো তোমারই পরামর্শ নিতে এসেছি।’
—‘তোর বউ, তোর যন্ত্রণা জিতু, তুই যা ঠিক করবি, তাই হবে।’
—‘যদি মেরে ফেলি? যদি এখুনি এক গুলিতে ওকে ঝাঁঝরা করে আরেক গুলিতে নিজে ঝাঁঝরা হয়ে যাই!’
—‘তাই যদি তোর ঠিক মনে হয় তাই করিস, আমি বাধা দোব না।’
—‘পাকুমা, এর পর আর এখানে থাকা যায় না। আমি জাহাজের চাকরি ছেড়ে দোব। অন্য কোথাও থাকবো। জিনুকে আমি ছাড়তে পারবো না, ও বিষ আমায় চিরকাল বয়ে বেড়াতে হবে।’
—‘ছাড়বি কেন? তবে ওকে পাহারা দেবার জন্য যদি চাকরি ছাড়িস খু-ব ভুল করবি জিতু।’
—‘না, না। কিছু একটা ব্যবসা ধরবো।’
—‘অনাথ-আশ্রম-টাশ্রম থেকে দেখে শুনে একটা পোষ্য নে না।’
—‘বলছো? তাতে হবে?’
—‘হতে পারে।’
—‘তো তুমি জিনুর সঙ্গে একটু কথা বলো—বলবে পাকুমা? ওকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি।’
—‘নিয়ে আয়। কিন্তু ওর সঙ্গে কথার সময়ে তুই থাকতে পাবি না।’
—‘কেন? … ও … আচ্ছা।’
কিছুক্ষণ পর কাপড়ের খসখস শব্দ। চুড়ি বালার ঠুনঠুন। জিনা কাকিমা এসেছেন। চুপ করে মাথা নিচু করে বসে আছেন।
—‘জিনিয়া, কিছু বলবি?’
—‘আমি কাল সকালেই মার কাছে চলে যাবো পাকুমা।’
—‘বেশ তো, যাস।’
—‘এখানে আর কোনওদিন ফিরব না।’
—‘না-ই ফিরলি। কিন্তু জিতু যে অন্যত্র বাসা নেবার কথা কি বলছিল …’
—‘যাবো না। ও সারা জীবন আমার ওপর অত্যাচার করবে, খোঁটা দেবে সইতে পারবো না। আমার তো কোনও পিছটান নেই!’
—‘না, খোঁটা দেবে না। তুই ওকে সাঙ্ঘাতিক কষ্ট দিয়েছিস। কিন্তু ও এখনই তোকে মাফ করে দিয়েছে। এত ভালোবাসে তোকে। তোর বাপের বাড়ির নানা বদনাম সত্ত্বেও বড্ড ভালোবাসতো বলে বিয়েটা জোর করে করেছিল, তুইও করেছিলি। এটা একটা দায়িত্ব। ঝেড়ে ফেলতে পারিস না। জিতুর ভালো-মন্দর দায় তোর।’
—‘আমি বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে বন্ধ থাকতে ভালোবাসি না পাকুমা। আমার স্বামী সারা বছর জলে, জলে। অনেক দিন এ জীবন সহ্য করেছি। আর পারছি না।’
—‘আমি তো ওকে একটা দত্তক নিতে বলছিলুম।’
—‘দত্তক? কেন? আমার নিজের হবে না?’
—‘সে তোরা জানিস। বারো বছর হয়ে গেল’
—‘ও কিছু না। ও আমার হাতে …’
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে পাকুমা বললেন—‘যা ভালো বুঝিস কর জিনা। তবে দুজনে মিলে আলোচনা করে, সব দিক ভালো করে বুঝে শুনে, ঝোঁকের মাথায় নয়। তোর মায়ের কাছে গেলে স্বাধীনতা হয়তো পাবি, শান্তি পাবি না। স্বস্তিও পাবি না। একমাত্র কোনও বড় কাজের জন্যেই স্বামী-সন্তান পরিবার এ সবের মায়া ত্যাগ করা চলে। অনেক বড় কাজ।’
কাকিমা হঠাৎ কর্কশ গলায় বললেন— ‘আপনি তো সব জানতেন, তাহলে নতুনদাকে সামলাননি কেন?’
—‘কে বললে আমি সব জানতুম!’
—‘নইলে নতুনদাকে দেশে সরিয়ে দিলেন কেন?’
—‘তোমার নতুনদার অনেক রকম বিকৃতি ছিল জিনিয়া। আয়েসের জীবন, কাজ-কর্ম নেই, স্বভাব ক্রমশই খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। তুমি ভাবছো তুমিই ওর একমাত্র। তা কিন্তু নয়।’
—‘নয়?’— জিনা কাকিমা কী রকম অদ্ভুত গলায় বলে উঠলেন।
—‘না, নয়। ওর অনেক রকম হয়েছিল। একেবারে পশুর মতো হয়ে যাচ্ছিল। তাই, যাতে কাজের মধ্যে থাকে সেই জন্যে পাঠিয়েছি।’
জিনা কাকিমা কোনও কথা না বলে হঠাৎ দুম করে উঠে চলে গেলেন।
পাকুমার পাশে কালো পাথরের একটা ছোটখাটো ঢিপি তৈরি হয়ে গেছে। বাড়ির যে যেখানে আছে, যেখান থেকে পেরেছে খুঁজে পেতে এনেছে। পাকুমা সবগুলোই বাতিল করে দিয়েছেন।
পঁচিশ দিনের দিন আমাদের ভীষণ ভয় করতে লাগলো। এতদিন ভাবছিলুম বেশ একটা মজা হচ্ছে। এখন বুঝতে পারছি এ মজা নয়। পাকুমা বিছানার সঙ্গে মিশে গেছেন। কথা বলেন না। মাঝে মাঝে খালি দীর্ঘনিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই। সারা দিন ধরে, সারা রাত ধরে … কাকা জেঠা কাকিমা জেঠিমা, দাদা বউদিরা, মেজবউদি, কর্তামা ছোট্ ঠাকুর্দা আনাগোনা করেন, পিসতুতো ভাইবোনেরা, পিসিমারা আসেন, কান্নাকাটি করেন। বাবা পাকুমার নাড়ি দেখতে আসেন, মুখ নিচু করে বসে থাকেন।
ছোট্ ঠাকুর্দা বলেন—‘কী ডাক্তার, কেমন দেখলে?’
বাবা বলেন—‘যেমন দেখার কথা …’
বাবা আমার দিকে একবার আনমনা চোখে তাকান, কী যেন বলবো-বলবো করেন, তারপর চলে যান।
মানিক বলল—‘পুনপুন, পাকুমা কি তাহলে সত্যি-সত্যি মরে যাবে না কি?’
আমি বললুম—‘আমরা পাকুমাকে মরে যেতে দোব না, মানিক চ’ আমরা গিয়ে বলি…’
সেই সন্ধেবেলায় বাবা পাকুমার নাড়ি দেখে গেছেন। সারা সকাল বড় বড় বই থেকে পাঠ হয়েছে। ছোট্ ঠাকুর্দা বাইবেল পড়েছেন আমরা বসে বসে শুনেছি, তারপরে ‘লাইফ ডিভাইন’ পড়েছেন, ঠাকুরমশাই এসে গীতা পড়ে গেছেন, ‘কথামৃত’ পড়েছেন কর্তা মা, জিনা কাকিমা গান করেছেন, মেজবউদিদি, মেজদিমণি গান করেছেন, ধূপধুনো জ্বলেছে। সন্ধের শাঁখ বাজার পর থেকে পাকুমা নেতিয়ে পড়েছেন। এখন রাত হচ্ছে, আমাদের লুচি-আলুরদম-পায়েস খেতে ভালো লাগেনি, ছবিরানীর মা বসে বসে জোর করে খাইয়েছেন, বাগানের ঘরের কোটর থেকে কুটুরে প্যাঁচা কাঁ কাঁ করে ডেকেছে, গান ঘরে এসে দেখি বাচ্ছা ওর কালো টলগুলিটা পাকুমার মাথার কাছে আস্তে রাখছে। আমাদের দেখে বললে—‘এইটাই যদি পরশমানিক হয়, রাঙাদা?’
মানিক বলল— ‘দুর, ওটা তো মাৰ্বল, ওটা কেন পরশমানিক হতে যাবে!’
—‘কিন্তু যদি হয়, যদি হয়ে যায়!’
মানিক বলল— ‘কী রে পুনপুন, হতে পারে?’
আমি বললুম—‘নাঃ এ গুলি তো কারখানায় তৈরি হয়। আর পরশমানিক সাপের পেটে ভগবান তৈরি করে দিয়েছেন।’ তখন বাচ্ছা পকেট থেকে আর একটা কালো গর্ত-গর্ত মতন পাথর বার করে বলল— দ্যাখ তো পুনপুন দাদা, এটা হতে পারে। আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পাথরটা দেখি, বলি—‘এটা কোথায় পেলি’
—‘আমার মা এটা দিয়ে পা ঘষে!’
মানিক বলল— ‘দূর ওটা তো ঝামাপাথর।’
তখন বাচ্ছা খুব রেগে যায়, কে রাঙাদাকে বলে গেছে যে ঝামা পাথর পরশমানিক হতে পারে না।
তখন আমি বললুম —‘যদি হয়ও, পায়ে ঘষার জন্যে ওই পাথরের গুণ নষ্ট হয়ে গেছে।’
বাচ্ছা তখন কালো মুখে চলে গেল৷ মানিক বলল —‘পুনপুন তোর পকেটটা দেখ তো! আমিও আমার পেনসিল বক্সটা খুঁজছি। পাকুমা বলেছিল না!’
মানিক ওর পেনসিল বক্স, আমি আমার পকেট উল্টে পাল্টে খুঁজি, আমার পকেট থেকে একটা কালো রঙের প্যান্টের বোতাম বেরোয়, মানিকের পেনসিল বক্স থেকে একটা পুরনো, শক্ত, কালো হয়ে যাওয়া রবার।
মানিক ফ্যাকাসে মুখে বলে— ‘পরশমানিকটা হয় রবার হয়ে গেছে, নয় বোতাম হয়ে গেছে।’
আমি বলি —‘তুই শিওর?’
মানিক বলে— ‘শিওর না? আগেও তো পেনসিল বক্স দেখেছি এই রবারটা কোনওদিন ছিল না। তোর পকেটের বোতামটা দেখেছিস আগে?’
আমি বলি— ‘আমার দুটো কালো প্যান্ট আছে, কিন্তু সে গুলোতে তো সব বোতামই আছে! বোতাম ছিঁড়ে গেলেই বুজবুজদিদি সেলাই করে দেয়।’
মানিক বলে—‘তাহলে?’
আমি বলি— ‘পরশমানিক তো একটা। রবার, বোতাম মিলিয়ে তো দুটো। হয় বোতাম, নয় রবার, বুঝলি’ আবার মানিক ভেবে-চিন্তে বলে, এ-ও হতে পারে, পরশমানিকটা দু ভাগ হয়ে আমাদের দুজনের কাছে এসেছিল।’
আমি —‘এসেছিল যদি পাল্টে গেল কেন?’
মানিক—‘আমরা নিশ্চয়ই কিছু দোষ করেছি। তুই ছোটবাইরে করে হাত ধুয়েছিলি?’
আমি— হ্যাঁ-অ্যা। আমি তো আর বাচ্ছার মতো না। তুই খেয়ে ভালো করে পুলকুচি করেছিলি? পায়েস খেয়ে তুই তো কক্ষনও মুখ ধুতে চাস না!’
মানিক— ‘ভেবে দেখতে হবে, মনে হচ্ছে ধুয়েছি। কিন্তু না ধুলেই বা কী? পাকুমা বলেছিল মনে মনে শুদ্ধ হতে হবে, ভুলে গেলি। মন দিয়ে তো আর আমরা ছোটবাইরে করি না, মন দিয়ে খাইও না যে মনের মধ্যে জল নিয়ে কুলকুচি করতে হবে। এই পুনপুন তুই পুলকুচি বলিস কেন রে? কথাটা হল কুলকুচি।’
আমি— ‘ভ্যাট। কথাটা পুলকুচি,’
মানিক ‘কক্ষনও না, কথাটা কুলকুচি।’
তখন ঠিক হল পাকুমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
পাকুমা চোখ বুজিয়ে নেতিয়ে রয়েছেন। আমরা ছুট্টে গিয়ে পাকুমার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ডাকলুম। ‘পাকুমা, পাকুমা।’ ফট করে পাকুমার চোখের পাপড়ি খুলে গেল। আর সেই ঘোলাটে কাচের মতো চোখের দিকে তাকিয়ে আমরা আমাদের মতভেদের কথা ভুলে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লুম— ‘পাকুমা, তুমি মরে যাবে না, কিছুতেই মরতে পারবে না, আমরা তোমাকে যেতে দেব না, পাকুমা তুমি মরে গেলে আমরাও আর বাঁচব না, সত্যি বলছি আমরাও তা হলে পারোপবেশন করবো।’
পাকুমা যেন অনেক দূরে চলে গিয়েছিলেন, ফিরে এলেন। অনেক কষ্টে বললেন— ‘আমি মরে গেলেই কি আর মরে যাবো, বোকা ছেলে। ঠিকই বেঁচে থাকবো কোথাও না কোথাও…’
কে যেন পাকুমার মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখ তুলতে অবাক হয়ে দেখি, অ্যালিস, সেই অ্যালিস রবসন ছবি থেকে বেরিয়ে এসে নেমে দাঁড়িয়েছেন। শাদা ধবধবে গাউন-গাউন পোশাক পরা, হাতে লম্বা মালার পুঁতি ধরে আছেন, মাথায় তুলো তুলো চুল ঠিক আলোর মতো ফর্সা।
অ্যালিস বললেন —‘ধরিত্রী, আই হ্যাভ কাম টু গিভ ইউ মাই ফেয়ারওয়েল কিস’, নিচু হয়ে তিনি পাকুমার শুকনো গালে চুমু খেলেন, তারপরে উঠে দাঁড়িয়ে দু হাত জোড় করে বললেন —‘মে ইয়োর সোল ডিপার্ট ইন পিস।’ আমার মাথায় পাকুমার হাত, বললেন, ‘জল দাও তো মানিক।’ আমি কোষাকুষির জল নিয়ে পাকুমার হাঁ-এ ঢেলে দিলুম। অ্যালিস বললেন, ‘ই ডিপার্টেড সোলস, দ্যাট ওয়ার ডিয়ার টু হার ইন হার এক্সপেরিমেন্ট উইথ লাইফ কাম অ্যান্ড টেক হার টু দি অ্যাবোড অফ শি ভা, শি ভা, শিভা।’ আস্তে আস্তে সমস্ত ঘরটা মানুষজনে ভরে গেল। কত কত মানুষ, তাদের যেন চিনি আবার চিনি না, পাকুমার শয্যা ঘিরে সব দাঁড়িয়েছেন। একবার যেন বাইরে বিদ্যুৎ চমকালো। এক ঝলকে আমি লীলাময়ী ও ত্রিলোকেশ্বর রায়চৌধুরীর মুখ দেখতে পেলুম। তারপর কালীকিঙ্কর, শিবশঙ্কর, ধ্রুববালাদেবী, সিসটার নিবেদিতা, বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ সব, সব, সবাই।
ভোরবেলায় যখন ঘুম ভাঙলো, দেখলুম ঘর ভর্তি লোকজন। মা আমাকে কোলে তুলে নিয়েছেন। বাবা পাকুমার ডান হাতখানা আস্তে আস্তে নামিয়ে রাখলেন। পায়ের ওপর উপুড় হয়ে প্রণাম করলেন। অত ভিড়, সবাই মাথা নিচু করে আছে কেউ কথা বলছে না।
হঠাৎ ছুটতে ছুটতে ভিড় ঠেলে নতুনকাকু ঢুকলেন, পাকুমার পায়ের ওপর একটা গোঙানির মতো শব্দ করে আছড়ে পড়লেন। আমার আর নতুনকাকুকে ভয় করছে না। মা, বাবা আমাকে, মানিককে বাচ্ছাকে নিয়ে চলেছেন আমাদের বাড়ি। ছবিরানি থাকলে ছবিরানিও গড়াতে গড়াতে যেত।
বেলা প্রায় এগারোটার সময়ে বিশাল এক মানুষের মিছিলের মাঝখানে পাকুমা নাতিদের মাথায় চড়ে চলে গেলেন। যাবার অনেকক্ষণ পর পর্যন্তও রাস্তায় খই আর ফুটো পয়সা ছড়িয়ে রইল, চন্দনের গন্ধ বেরোতে লাগল ভুরভুর করে, সব চলে গেলে এক জন লম্বা মেমসাহেব, মাথায় তুলোর কুন্ডুলী, পিঠে একটা বোঝা, উল্টো দিকের রাস্তা ধরে একা একা চলে গেলেন।
মানিক বলল —‘দ্যাখ পুনপুন, দ্যাখ —অ্যালিস!’
॥ দ্বিতীয় স্কন্ধ সমাপ্ত ॥