১
সীমানা ভেবেছিল শেষ পর্যন্ত বুঝি ট্রেনটা ধরতেই পারবে না। কিন্তু পেয়ে গেল। রাত্রি ন’টা ত্রিশের লোকাল ট্রেনটা ছাড়তে একটু লেটই করেছিল। পরের ট্রেনটা অর্থাৎ শেষ লোকাল ট্রেনটা রাত এগারোটা পনেরোয়।
রাত নটা ত্রিশে ছাড়ার কথা, শেষ পর্যন্ত ছাড়লো দশটা চল্লিশে। ইলেকট্রিক ইঞ্জিনের নাকি কি যান্ত্রিক গোলমালই ট্রেনটা লেটে ছাড়ার কারণ। যা হোক শেষ পর্যন্ত ছাড়ল ট্রেনটা।
সীমানা কাচ-তোলা জানলাটার সামনে বসেছিল অন্যমনস্কভাবে আলোকিত প্ল্যাটফর্মটার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন অন্যমনস্ক শূন্যদৃষ্টিতে।
মাঘের মাঝামাঝি—শীতটা বেশ কনকনে। কনকনে শীতটা অবিশ্যি মাত্র কটা দিন হলো পড়েছে। তাহলেও কিন্তু সীমানার শীত লাগছিল না। অনেকটা পথ, শেষ ট্রেনটা ধরবার জন্য তাড়াতাড়ি হেঁটে এসেছিল, বুকের কাছে ও কপালে বেশ ঘাম জমে উঠেছিল। খোলা জানলার ধারে বসে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটাটা যেন বেশ লাগছিল।
শীতের রাত—শেষের দিকের লোকাল ট্রেনগুলোতে যাত্রীর ভিড় তেমন কিছু একটা থাকে না। নেহাৎ যারা কাজে আটকা পড়েছে বা ঐ শেষের দিকের ট্রেনে ফেরা বড়া উপায় নেই, তারাই ঐ সব ট্রেনের যাত্রী, তবে আজ যাত্রীর কিছু ভিড় ছিল বোধ করি, শনিবার বলেই।
যাত্রীদের মধ্যে বেশীর ভাগই ব্যবসায়ী—মাল বেচা-কেনা করে। ছোটখাটো দোকানের মালিক, শনিবার শনিবার কলকাতায় আসে দোকানের চাহিদামত মালপত্র কিনে নিয়ে যাবার জন্য। সারাটা হপ্তা ধরে বেচবে তারপর আবার পরের শনিবার মাল কিনতে বেরুবে পাইকারী বাজারে ঘুরে ঘুরে প্রয়োজনমত।
ইচ্ছা করেই নির্জন একটা ফার্স্ট ক্লাস কামরা বেছে নিয়ে উঠেছিল সীমানা।
প্রথমতঃ শেষ ট্রেনে বড় একটা চেকার ওঠে না—উঠলেও ফার্স্ট ক্লাসে বড় একটা তারা আসে না। আজ মাসের এগারো তারিখ। অথচ টাকার অভাবে মান্থলিটা রিনিউ এখনও করা হয়নি। ধরা পড়লে বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণের জন্য জেলও হয়ে যেতে পারে শেষ পর্যন্ত। তা সত্ত্বেও গত পাঁচ দিন ধরে প্রত্যহই সীমানা দুপুরের ট্রেনে কলকাতায় যাচ্ছে ও শেষ লোকাল ট্রেনটায় ফিরছে বিনা টিকিটেই।
সুধন্যকে কিছুতেই ধরতে পারছে না। সুধন্যর কলকাতার বাসার ঠিকানাটা জানে না সীমানা, জানবার প্রয়োজনও বোধ করেনি গত তিন বৎসরে।
শ্যামবাজার অঞ্চলে কোথায় যেন থাকে, কোন এক অখ্যাত সরু গলির মধ্যে, এইটুকুই কথায় কথায় একদিন জানতে পেরেছিল সুধন্যর কাছ থেকে এই মাত্র। সুধন্যর বাসায় যাবার কোনদিন প্রয়োজন হয়নি—যায়ওনি কখনো। যাবার কথাও বুঝি ভাবেওনি।
মীরা পারফিউমারির অফিসে দুজনেই সেলসম্যানের চাকরি করে। মাইনে কোন কিছু বাঁধাধরা নয়—সেলের উপর কমিশন। বাঁধাধরা নয় বলেই গত তিন বৎসরে কোন কোন মাসে কমিশন বাবদ দুশো টাকাও সে পেয়েছে মাস গেলে।
বি. এ. পাস করার পর কটা মাস ধরে কলকাতার অফিসে অফিসে ঘোরাঘুরি করেছিল সীমানা একটা চাকরির জন্য যে কোন মাইনেয় একটা ক্লারিক্যাল পোস্ট, কিন্তু যোগাড় করতে পারেনি একটা চাকরি। হতাশ হয়েই শেষ পর্যন্ত মীরা পারফিউমারিতে লেডী সেলসম্যানের চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে একটা দরখাস্ত করে দিয়েছিল।
চাকরিটা হয়ে গেল। কোন বাঁধাধরা মাইনে নয়—বিক্রীর উপরে কমিশন। চাকরির শর্ত ছিল আড়াইশ টাকার মত একটা সিকিউরিটি কোম্পানিতে জমা রাখতে হবে।
শর্তটা শুনেই দমে গিয়েছিল সীমানা প্রথমে। কোথায় পাবে অতগুলো টাকা সিকিউরিটির জন্য। দুশো ছেড়ে দশ টাকা দেবারও তো তার ক্ষমতা নেই। ম্যানেজার রাধেশ চক্রবর্তী বলেছিলেন, টাকাটা জমা দিয়েই আপনি কাজ শুরু করতে পারবেন।
অর্থাৎ টাকাটা জমা দেওয়ার দিন থেকেই তার চাকরি শুরু।
মৃদু সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে ম্যানেজারের ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল সীমানা। অনেকখানি আশা নিয়ে এসেছিল সীমানা।
ম্যানেজার রাধেশ চক্রবর্তীর সঙ্গে কথাবার্তা বলে প্রথমটায় মনে হয়েছিল, ধরাবাঁধা কোন মাইনে যখন নেই—মাল বিক্রীর উপরে কমিশন অর্থাৎ তার কাজের যোগ্যতা প্রমাণিত হলেই চাকরি, তখন হয়ত চাকরিটা হয়েও যেতে পারে। কিন্তু রাধেশ চক্রবর্তীর পরবর্তী কথাটা শুনেই বুঝতে পারল, ঐ চাকরি পাওয়ার তার কোন আশাই নেই।
মার সঞ্চয় থেকে কোনমতে একটি টাকা ট্রেন-বাস ভাড়া বাবদ চেয়ে নিয়ে সকাল বেলা চারটি ভাতে-ভাত খেয়ে বের হয়ে পড়েছিল সীমানা, মীরা পারফিউমারিতে ইন্টারভিউ দেবার জন্যে।
আসতে ট্রেনভাড়া ছ আনা লেগেছে—বাসে দশ পয়সা গিয়েছে—এখন হেঁটে গিয়েই শিয়ালদহে তাকে ট্রেনটা ধরতে হবে। হাঁটতে সে অরাজী নয়, কিন্তু মার মুখটা মনে পড়ে সীমানার। তার কথায় মাও অনেকখানি আশা নিয়ে বসে আছে। গিয়ে যখন সে বলবে, হলো না চাকরি—মার মুখখানা চুপসে যাবে।
কটা বছর দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে দিনরাত্রি মা যেন কেমন বুড়িয়ে গিয়েছে। মাথার চুল অর্ধেক পেকে গিয়েছে—কপালে ভাঁজ পড়ে গিয়েছে অনেকগুলো। সমস্ত দেহটা কেমন শীর্ণ। অথচ মা তাদের কি সুন্দরই না দেখতে ছিল কয়েক বছর আগে—
কোনমতে বর্ডার ক্রস করে বাবার সঙ্গে যখন ওরা দুই ভাই ও দুই বোন কলকাতা শহরে এসে পা দিয়েছিল,——সে আর কটা বছর আগেরই বা ব্যাপার?
বাবা তার এক বিপ্লবী বন্ধুকে ধরে, যিনি পরবর্তীকালে কংগ্রেসে ঢুকে স্বাধীনতার পরে বিশেষ পরিচিত একজন হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর সুপারিশে কলকাতার এক মার্চেন্ট অফিসে কাজ পেয়ে গিয়েছিলেন মাস পাঁচেকের মধ্যেই।
তারপরই তারা কলকাতার বাসা ছেড়ে হাবড়ার উদ্বাস্তু কলোনীতে গিয়ে ডেরা বাঁধে। ওদের গ্রামের অনেকেই গিয়ে তখন সেখানে ডেরা বেঁধেছে নতুন করে বাঁচবার আশায়। সামান্য দেড়শ টাকা মাত্র মাইনে, কিন্তু সেই টাকাতেই মা সংসারটাকে যেন নতুন করে কোনমতে আবার গুছিয়ে নিয়েছিল জোড়াতালি দিয়ে।
সে আর দাদা সৈকত স্কুলে ভর্তি হলো—আশেপাশে ধারেকাছে তেমন কোন স্কুল ছিল না বলে দুজনেই কলকাতার স্কুলে ভর্তি হয়েছিল।
ক্রমে দুজনে স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষা দিল, সৈকত পাস করতে পারল না কিন্তু সীমানা প্রথম বিভাগে পাস করে কলেজে ভর্তি হলো।
বাবা সৈকতকে আবার পরীক্ষা দেবার জন্য বার বার বলেছিলেন কিন্তু সৈকত পড়া ছেড়ে দিল। বললে, সে আর পড়বে না।
বেলেঘাটার কি একটা কারখানায় ঢুকে গেল নিজের চেষ্টাতেই ঘোরাঘুরি করে। প্রথম প্রথম বছর দুই বাড়ি থেকেই যাতায়াত করেছিল সৈকত, তারপর কলকাতায় বাসা নিল। কলকাতায় বাসা নিলেও সপ্তাহে দুই তিন দিন বাড়িতে যেতো বছরখানেক—ক্রমশ আসাটা কমে আসতে লাগল। এবং কমতে কমতে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল একসময়।
সীমানা সেবারে বি. এ. পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
বাবা হরেনবাবু তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র সৈকতের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। স্ত্রী সুহাসিনীকে বলেছিলেন, ওর আশা আর করো না সুহাস।
মা সুহাসিনী বরাবরই কম কথা বলে, কোন কথাই বলেনি স্বামীর কথার জবাবে। সীমানা কিন্তু তখনো বিশ্বাস করতে পারেনি যে সৈকত সত্যিসত্যিই তাদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছে বা ফেলতে পারে। আঠারো মাসের ছোট-বড় দুই ভাই—বোন। বলতে গেলে একরকম তো পিটোপিটিই। একই সঙ্গে হেসেছে খেলেছে পড়াশুনা করেছে—বড় হয়ে উঠেছে ক্রমশ।
তবে সৈকত চিরদিনই একটু স্বার্থপর প্রকৃতির। নিজের কথাটা—নিজের চিন্তাটাই তার কাছে বড় কথা, ও বড় চিন্তা। লেখাপড়ায় যে সৈকত খুব খারাপ ছিল তা নয়—পড়াশুনা করলে যে পাস করতে পারত না তাও নয়, কিন্তু শহরে আসার পর ক্রমশ যেন দিনকে-দিন কেমন হয়ে গেল সৈকত। বেশীর ভাগ বাইরে বাইরেই ঘুরে বেড়াত নতুন একদল বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে। কথা বলার ঢং ও শব্দ যেন ক্রমশ কেমন বদলে যেতে লাগল, সেই সঙ্গে ব্যবহারটাও। মা বাবাকে শ্রদ্ধা করে না—তাদের কোন কথারই কোন গুরুত্ব দেয় না—কিছু বললে কেমন যেন ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসে। চোখে-মুখে একটা অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের ভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চেহারাটাও কেমন যেন চোয়াড়ে চোয়াড়ে হয়ে ওঠে। চুলের ছাঁট থেকে পরনের পোশাকটা পর্যন্ত কেমন যেন বদলে গেল ক্রমশ।
সৈকত যেন ওদের বাড়ির আর সকলের থেকে কেমন পৃথক হয়ে গেল একেবারে। বাড়ির একজন হয়েও যেন বাড়ির কেউ নয়। ও যেন পৃথক স্বতন্ত্র। কারো সঙ্গেই বাড়ির বড় একটা কথা বলে না। তখনো স্কুল যায়—তবে সীমানা জানত স্কুলের খাতায় সৈকতের ঐ নামটাই আছে—স্কুলের সঙ্গে কোন সম্পর্কই নেই তার। স্কুলের গেট পর্যন্তও হয়ত যায় না।
বাবা হরেনবাবু তাঁর কর্তব্য তখনো করে চলেছিলেন। মাসের প্রথমে স্কুলের মাইনেটা দিতেন, হাত পেতে সৈকত নিতও, কিন্তু সে টাকা শেষ পর্যন্ত বেশীর ভাগই স্কুলের খাতায় জমা পড়ত না। শিয়ালদহের মোড়ে এক চায়ের কেবিনে, সিগ্রেটে ও সিনেমার ম্যাটিনী শোতে সে টাকাটার কটা দিন ধরে সদ্গতি হতো। তবু আশ্চর্য, প্রমোশন ঠিক পেত উপরের ক্লাসে এবং টেস্ট পরীক্ষাতেও শেষ পর্যন্ত এলাউ হয়েছিল।
পরে অবিশ্যি জানা গিয়েছিল আসল ব্যাপারটা—পরীক্ষার সময় সোজা চাদরের তলায় বই নিয়ে গিয়ে টুকে দিয়ে আসত। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্কুল ফাইন্যাল পাস করতে পারেনি। তিনটি বিষয়ে ফেল করে গেল। পরীক্ষার মাসখানেক আগে একদিন সীমানা বলেছিল সৈকতকে, দাদা একদম পড়ছিস না—পরীক্ষা দিবি কি করে?
রোয়াবি করতে হবে না তোকে—নিজের কাজ নিজে করে যা। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে জবাব দিয়েছে সৈকত।
সীমানা জানত পরীক্ষার সময় বই নিয়ে গিয়ে টোকে সৈকত। বললে, এ তোর স্কুলের পরীক্ষা নয় দাদা, রীতিমত গার্ড দেয় পরীক্ষার হলে।
অমন সব শালা গার্ডদের দেখা আছে। বেশী ত্যাঁদরামি করতে এলে এমন ধোলাই দেবো যে বাপের নাম ভুলিয়ে ছেড়ে দেবো—চেনে না তো এ শর্মাকে! মুখে ইদানীং সৈকতের সব ঐ ধরনের কথাবার্তা। সীমানা চুপ করে গিয়েছে।
স্কুলের মাইনে অনেক বাকি পড়ে আছে—পরীক্ষাতেই হয়ত বসতে দেবে না সৈকত ভেবেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি গোলমাল হয়নি—একসঙ্গে এক বছরের প্রায় বাকী মাইনে ও ফিস হরেনবাবুকে জমা দিতে হয়েছিল। সৈকত পরীক্ষাও দিয়েছিল টুকে, কিন্তু পাস করতে পারল না। পরীক্ষার ফলাফল যেদিন বেরুল সেদিন সৈকত বাড়িতেই এলো না। তাদের ‘জাগরণী ক্লাবে’ সেদিন ফিস্ট। কাদের সঙ্গে তাদের জাগরণী ক্লাব জিতেছে ফুটবল ম্যাচে তারই উৎসব—পরের দিন বেলা দশটা নাগাদ যখন এলো সৈকত বাড়িতে, হরেনবাবু বাড়িতেই ছিলেন রবিবার অফিস ছুটে বলে—মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল বাপ-ছেলের।
কোথায় ছিলি সারারাত?
ক্লাবে। যেন কিছুই নয় ব্যাপারটা, অত্যন্ত স্বাভাবিক—এমনি মেজাজে জবাব দেয় সৈকত।
পরীক্ষায় ফেল করে লজ্জা করে না—ছোট বোনটা পাস করে গেল আর বড় হয়ে ফেল করলি! কুলাঙ্গার অপদার্থ—
বেশী কপচাবেন না।
কি বললি হারামজাদা?
মুখ সামনে কথা বলবেন। বাপ হয়ে একেবারে মাথা কিনে নিয়েছেন নাকি!
ছেলেটা বয়ে গিয়েছে সেটা যে বুঝতে পারেননি হরেনবাবু তা নয়, কিন্তু সে যে এতদূর পর্যন্ত গিয়েছে সেটাই বুঝি কল্পনাও করতে পারেননি তিনি। ছেলের শেষের কথাটায় তাই মুহূর্তের জন্য যেন তিনি বাক্শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছিলেন।
বাপ ও ছেলের কথা কাটাকাটির সাড়া পেয়ে ইতিমধ্যে সুহাসিনী ও সীমানা ঘরের সামনে বারান্দাটায় এসে দাঁড়িয়েছিল। তারাও যেন কেমন থতমত খেয়ে গিয়েছে।
কয়েকটা মুহূর্ত থমকে থেকে সহসা চিৎকার করে উঠেছিলেন হরেনবাবু, বেরিয়ে যা—বেরিয়ে যা এই মুহূর্তে আমার বাড়ি থেকে—
ভয় দেখাচ্ছেন কি? আপনার বাড়ি ছাড়াও থাকবার আমার জায়গা আছে জানবেন।
তাই যা—বেরো—
ওঃ, বাপগিরি ফলাতে এসেছেন! দুটো বই কিনে দেবার মুরোদ নেই—একটা ভাল জামা দেবার ক্ষমতা নেই—দু’বেলা খানিকটা শাকপাতা সিদ্ধ—ডাল আর ভাত—তার আবার গর্জন! লজ্জা করা উচিত আপনার। তেমন করে মানুষই যদি না করতে পারবেন ছেলেকে তো জন্ম দিয়েছিলেন কেন?
বোবা পাথর হয়ে যেন দাঁড়িয়েছিলেন হরেনবাবু। কি বলছে ও, কি শুনছেন উনি! পায়ের নীচের মাটিটা যেন তখন দুলছে।
সহসা সুহাসিনী চিৎকার করে উঠেছিল কঠিন ঋজুকণ্ঠে ছেলের দিকে তাকিয়ে, খোকা!
মা’র গলার স্বরে এমন একটা কিছু ছিল যেটা সৈকতকে হঠাৎ পরিস্থিতিটা সম্পর্কে সজাগ করে তুলেছিল। কিংবা হয়ত তার মনে হয়েছিল, ভদ্রলোককে একটু বেশীই বলা হয়ে গিয়েছে। সে আর দাঁড়ায় না—বারান্দা থেকে নেমে ছোট উঠানটা পার হয়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়।
হরেনবাবুর সমস্ত দেহটা তখন কাঁপছে। সীমানা তাড়াতাড়ি এসে দু’হাতে বাপকে জড়িয়ে ধরে বলে, চলুন বাবা——ঘরে চলুন। হরেনবাবু তখনো বোবা। মেয়ে কোনমতে বাপকে ধরে ঘরে এনে চৌকিটার ওপর বসিয়ে দেয়।
তারপর সাত দিন সৈকত বাড়ি আসেনি। সাত দিন পরে রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ এসে ঢুকেছিল বাড়িতে। নিঃশব্দে গিয়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করেছিল।
আর কেউ না বুঝতে পারলেও সীমানা কিন্তু বুঝতে পেরেছিল, বাড়ির সঙ্গে সৈকতের সম্পর্কটা ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। সামান্য যে ক্ষীণ সুতোর একটা বন্ধন ছিল সৈকতের সঙ্গে ঐ সংসারের সেটা ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। আর কোনদিনই সেটা নতুন করে জোড়া লাগবে না, লাগলোও না।
.
যেদিন ঐ ঘটনাটা ঘটেছিল সেদিন অনেক রাত্রে সীমানা যখন নিদ্রাহীন অস্বস্তিতে শয্যায় এপাশ-ওপাশ করছে, হরেনবাবুর কয়েকটা কথা কানে এসেছিল। লেখাপড়ায় অসাধারণ মেধাবী ছাত্র ছিলেন হরেনবাবু। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বি. এ. পরীক্ষাটা আর দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি—দেশোদ্ধারের স্বপ্নে বিপ্লবীদের দলে ভিড়ে যাওয়ায়। বিয়ে করতে হয়েছিল বি. এ. পড়ার সময়ই বাপের আদেশে। বাপ যোগজীবন চাটুয্যে ছেলের মতিগতি জানতে পেরে সুন্দরী একটি মেয়ে দেখে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু হিসাবে যে তাঁর মস্ত ভুল হয়ে গিয়েছে সেটা বুঝতে যোগজীবনের খুব দেরি হয়নি। বিয়ের মাস আষ্টেক বাদে ছেলে বাড়ি থেকে উধাও হলো। সুহাসিনীর গর্ভে তখন সৈকত এসেছে।
বছর দেড়েক বাদে আবার তিনি মাস কয়েকের জন্য বাড়ি এলেন এবং বছরখানেক বাদে আবার উধাও হলেন। সেই সময়েই সীমানা সুহাসিনীর গর্ভে আসে।
সীমানা যখন মাস চারেকের সেই সময় ঢাকায় এক শ্বেতাঙ্গ ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যার ষড়যন্ত্রে হরেন্দ্রনাথ গ্রেপ্তার হলেন। যোগজীবনবাবু নামকরা উকিল ছিলেন। নিজে ছেলের হয়ে দাঁড়ালেন এবং দীর্ঘ এক বছর মামলা চলার পর হরেন্দ্রনাথের মুক্তি মিলল।
হরেন্দ্রনাথের মুক্তির পর মাস দুইও গেল না, অকস্মাৎ যোগজীবনবাবু সন্ন্যাস রোগে মারা গেলেন। হরেন্দ্রনাথের মাথার উপরে সমস্ত সংসারের ভারটা এসে পড়ল।
বিধবা মা—স্ত্রী—ছোট ছোট দুটি সন্তান এবং অবিবাহিত তিনটি বোন। হরেন্দ্রনাথকে যেন কতকটা বাধ্য হয়েই এবার রোজগারের চেষ্টা দেখতে হলো। কিন্তু বিপ্লবী দলের সঙ্গে যে দীর্ঘদিন ধরে যোগাযোগ ছিল, তাতেই চাকরি পাওয়া কোন সরকারী সংস্থায় দুর্ঘট হয়ে উঠলো।
অথচ যা হোক একটা চাকরির দরকার—অবশেষে কুমিল্লার এক স্কুলে চাকরি মিলল—সেকেণ্ড টিচারের চাকরি।
চাকরিতে জয়েন করার পর মাস দুই বাদে সবাইকে নিয়ে হরেন্দ্রনাথ কুমিল্লায় চলে গেলেন। সেখানেই আর এক ছেলে সৌজন্য ও ছোট মেয়ে সূচনার জন্ম। নিজের সন্তানদের নাম হরেন্দ্রনাথ নিজেই রেখেছিলেন—সৈকত, সীমানা, সৌজন্য ও সূচনা।
সুহাসিনী নাকি একদিন বলেছিল সৈকতের নাম রাখার সময়, ও কেমন নাম হলো আবার!
ওদের নামকরণের মধ্য দিয়েই আমি ওদের ভিতরকার সত্তাকে জাগিয়ে তুলতে চাই—ওদের মনুষ্যত্ব ওদের ব্যক্তিত্ব—ওরা যে আর দশজনের মত নয় সেই বিশেষ দৃষ্টিটি। হরেন্দ্রনাথের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেবার মধ্যেও একটা বিশেষত্ব ছিল। তাদের নিজেদের ইচ্ছা ও মন স্বাভাবিকভাবে যেদিকে ঝোঁকে সেই দিকেই তাকে এগিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন বরাবর। ওরা নিজের নিজের মত করে গড়ে উঠুক, বড় হয়ে উঠুক। নিজের বিশ্বাসে নিজেকে দৃঢ় করে তুলুক।
কুমিল্লায় যতদিন ছিলেন হরেন্দ্রনাথ, কখনো ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে কোন হতাশা তাঁর মনের মধ্যে প্রকাশ পায়নি। হয়ত ঠিক যেমননি চেয়েছিলেন ওরা তেমনটি ঠিক হয়নি, তবু সেজন্য কোন ক্ষোভ মনের মধ্যে দেখা দেয়নি, কারণ যা আশা করা যায় সব সময় তো ঠিক তেমনটি হয় না। যাহোক কখনো সন্তানদের এতটুকু শাসন করেননি—তাদের স্বাধীনতাকে বরং কিছুটা প্রশ্রয়ই দিয়েছেন। সুহাসিনী বরং সময়ে সময়ে বলেছে স্বামীকে, মাঝে মাঝে শাসন করো একটু।
হরেন্দ্রনাথ হাসতে হাসতে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছেন, কেন বল তো?
কেন আবার কি! ছোটদের একটু-আধটু মাঝে মাঝে শাসন না করলে তারা বিগড়ে যায়।
অনন্ত বিশ্বাস ছিল নিজের সন্তানদের প্রতি হরেন্দ্রনাথের। বলেছিলেন জবাবে, আমার সন্তানদের আমিই জন্ম দিয়েছি, দেখো এমন কিছু করবে না যাতে করে তারা যে আমারই সন্তান সে পরিচয় দিতে আমার কোন লজ্জার কারণ হবে কখনো।
এসব কথা সীমানার জানার কথা নয়, সে জানতও না। কিন্তু সে-রাত্রে নিদ্রাহীন শয্যায় শুয়ে পাশের ঘরে হরেন্দ্রনাথের অস্ফুট যে কথাগুলো তার কানে এসেছিল এবং সে কথাগুলোর মধ্যে কত বড় ব্যথা যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, সীমানা সেটা বুঝতে পেরেছিল বৈকি।
হরেন্দ্রনাথ বলছিলেন, সৈকত এমন হয়ে গেল কেন সুহাস বলতে পার?
ওসব নিয়ে আর চিন্তা করো না, সুহাসিনী জবাব দিয়েছিল।
চিন্তা নয় সুহাস, আমি কেবল ভাবছি এত দ্রুত সব কেমন করে পাল্টে গেল, আর কেনই বা পাল্টে গেল! এতকালের ধ্যানধারণা নীতি সব কিছু যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে!
ওর কথা থাক। ও একেবারে গোল্লায় গিয়েছে। সুহাসিনী আবার বলে।
শ্রদ্ধা নেই, সম্মান নেই, কোন বাধ্যবাধকতা, কোন নীতি নেই—
সুহাসিনী আবার তার পূর্বের কথাটারই পুনরাবৃত্তি করে, একেবারে গোল্লায় গিয়েছে! লেখাপড়ার সঙ্গে পাট তো কবেই তুলে দিয়েছে—কেবল আড্ডা আর আড্ডা! সিগারেট ফুঁকছে—
কত আশা করেছিলাম—কত স্বপ্ন দেখেছিলাম ও যখন জন্মালো। নাম রেখেছিলাম সৈকত—বোধ হয় আমারই দোষ। দেশ-বিভাগের ফলে এখানে ছিটকে এসে পড়লাম, ভাল করে ওর দিকে নজরও দিতে পারিনি। দোষ ওর নয় সুহাস—সবই আমার দূরদৃষ্ট আর কর্মফল। ঠিকই বলেছে ও, বাপের কোন্ কর্তব্যটাই বা আমি ওর প্রতি পালন করতে পেরেছি!
তাই তো তোমাকে কতবার বলেছি একটু-আধটু শাসন কর। অমন করে রাশ আলগা দিও না।
হ্যাঁ, তুমি বলেছিলে সুহাস, কথাটা যে আমারও মনে হয়নি তাও নয়, কিন্তু ভয়ে আমি পিছিয়ে এসেছি।
ভয়ে?
হ্যাঁ—তোমাকে বলিনি, বলতে পারিনি। তুমি ওর মুখের দিকে হয়ত তাকাওনি—তাকালে দেখতে পেতে, ওর দু-চোখের দৃষ্টিতে কি গভীর ঘৃণা আর তাচ্ছিল্য! কি অসন্তোষ আর অস্থিরতা! ভয়ে তাই সরে এসেছি।
কি যে তুমি বল?
কথাটা যে আমার মিথ্যে নয়—আশঙ্কাটা অহেতুক নয়, তা তো দেখলে আজ! কিন্তু এখনো ভেবে পাচ্ছি না কিসের ঘৃণা, কিসের তাচ্ছিল্য—কেন ঐ অসন্তোষ আর কিসেরই বা অস্থিরতা—কি ও সত্যি চায়? ও কি বুঝতে পারছে না ওর সমস্ত ভবিষ্যৎ কি গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে ক্রমশ তলিয়ে যেতে বসেছে। আমি না হয় ওর প্রতি বাপের দায়িত্ব পালন করিনি, কিন্তু ও নিজের প্রতি নিজের দায়িত্বটাই কি পালন করছে? সে কথাটাও কি একবারও ওর মনে পড়ছে না?
যাক যা হবার হবে—ওসব আর তুমি ভেবো না।
তোমার মত যদি নিশ্চিন্ত হতে পারতাম সুহাস! একটা বড় রকমের দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে যেন হরেন্দ্রনাথের কথাটা হারিয়ে গেল।
২
ঐদিনকার ঐ ঘটনার পর হরেন্দ্রনাথ আর ছেলেকে কোন কথা বলেননি।
সৈকত স্কুলে আর গেল না। পড়াশুনায় ইস্তফা দিয়ে নিজের ইচ্ছা ও খেয়ালখুশি মত ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। কখন বাড়ি আসে, কখন বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে তার কোন ঠিকঠিকানা নেই। কি করে কি না-করে হরেন্দ্রনাথ বা সুহাসিনীর যেন সে সম্পর্কেও আর কোন উদ্বেগ বা চিন্তা নেই।
এক-একবার মনে হয়েছে সীমানার, তাদের মা ও বাবার তাদের পুত্রের প্রতি ঐ নির্লিপ্ততাই হয়ত সৈকতের গৃহের সঙ্গে সমস্ত বন্ধন ও আকর্ষণের ক্রমশ একেবারে সমাপ্তি ঘটিয়েছিল, আবার মনে হয়েছে সৈকতকে সত্যিই বুঝি আর ধরে রাখবার কোন উপায় ছিল না। কোন চেষ্টাতেই আর কিছু হতো না।
কিন্তু দাদা সৈকতের কথাটাই সীমানা ভাবছে—তার নিজের কথাটা তো একবার সে
ভাবছে না। সে তো গৃহের সঙ্গে মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়নি—আজও সে সকালে বের হয়ে রাত্রেই আবার গৃহে ফিরে আসে, কিন্তু কতটুকু সম্পর্কই বা আজ আর তার আছে ঐ পরিচিত গৃহ ও মানুষগুলোর সঙ্গে! আজও কি হরেন্দ্রনাথ ও সুহাসিনীর ব্যথা বেদনা আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সে পূর্বের মত জড়িত আছে? তাদের কথা সে ভাবে বা ভাববার অবকাশ পায়?
আজ অবিশ্যি সংসারটার ব্যয়ভারের বেশীর ভাগটা তাকেই বহন করতে হয়, কিন্তু ঐটুকু ছাড়া তার সংসারের সঙ্গে কতটুকু সম্পর্ক আছে। তার যা কিছু চিন্তা-ভাবনা স্বার্থ ভালবাসা সবটাই তো তার নিজেকে কেন্দ্র করেই। সৈকত দূরে চলে গিয়ে সমস্ত ছেদ করেছে আর সে কাছে থেকেও কোন সম্পর্ক রাখেনি। সৈকতের মধ্যে তবু একটা স্পষ্টতা আছে—কিন্তু তার মধ্যে তো সেটুকুও নেই। চলে যাবার কথা সেও তো কত দিন ভেবেছে। নিজের একটি ঘর—সংসার। যেখানে সে সর্বময় কর্ত্রী।
নিজের হাতে সাজাবে গোছাবে—মমতায় যত্নে। সে আর সুধন্য। নতুন করে যেন হঠাৎ আবার সুধন্যর কথাটা মনে পড়ে গেল সীমানার। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে খোলা জানলাপথে বাইরের দিকে তাকাল। অন্ধকারে একটা ঝোপের মাথায় কতকগুলো জোনাকি আলো জ্বলা আর আলো নিভানোর লুকোচুরি খেলছে যেন।
কিন্তু ট্রেনটা থেমে আছে। কেন থেমে আছে ট্রেনটা? কতক্ষণই বা থেমে আছে কিছুই তো এতক্ষণ খেয়াল হয়নি সীমানার? নিজের মধ্যে নিজে যেন ডুবে ছিল।
চোখ ফিরিয়ে সীমানা কামরার মধ্যে দৃষ্টিপাত করল। গাড়ির কামরার মধ্যে যখন উঠেছিল তখন কামরার মধ্যে দ্বিতীয় কোন যাত্রী তার নজরে পড়েনি, কিন্তু এখন নজরে পড়ল আরো একজন যাত্রী আছে।
সেই যে ডাক্তারী পড়ে যুবকটি! ইতিপূর্বে আগেও কয়েকবার যুবকটিকে এই শেষ গাড়িতে যেতে দেখেছে—সুট পরা—কোটের সাইড পকেট থেকে স্টেথোটার একটা অংশ উঁকি দিচ্ছে। থার্ড ক্লাসেই ওকে যেতে দেখেছে বারবার সীমানা। আজই প্রথম দেখলো ওকে ফার্স্ট ক্লাসে।
রোগা পাতলা চোহারা। শ্যামবর্ণ। মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করা। যুবকটি কোলের উপর একটা বই রেখে পড়ছিল গভীর মনোযোগের সঙ্গে। হাতে ধরা একটা জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেটের অর্ধেকটা প্রায় পুড়ে গিয়েছে। কেমন যেন অন্যমনস্কভাবে চেয়ে চেয়ে দেখে সীমানা যুবকটিকে। রোমশ জোড়া ভ্রু। নাকের উপর কালো সেলুলয়েডের ফ্রেমে চশমা খাড়া নাক। ঠোটের ফাঁকে সামান্য দাঁতের আভাস।
হঠাৎ যুবকটি চোখ তুলল এবং সীমানার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। সীমানা সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় তার চোখের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। ট্রেনটা কিন্তু তখনো থেমে আছে। খোলা জানালাপথে কামরায় ঠাণ্ডা হাওয়া আসছিল।
জানালার কাচটা তুলে দিন না?
যুবকটির কণ্ঠস্বরে সীমানা ঘুরে তাকাল ওর দিকে। দুজনে আবার চোখাচোখি হলো। যুবকটি আবার বললে, ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে, আপনার দিকের জানালার কাচটা তুলে দিন না।
সীমানা কোন জবাব না দিয়ে হাত বাড়িয়ে জানালার কাচটা তুলে দেবার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। উঠে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে কাচটা তোলবার চেষ্টা করে, কিন্তু তবু কাচটা ওঠে না। ট্রেনটা ছেড়ে দিল আবার ভোঁ দিয়ে ঐ সময়।
কি হলো—উঠছে না কাচটা? কথাটা বলতে বলতে যুবকটি ওর বেঞ্চের দিকে এগিয়ে এলো ওকে বুঝি সাহায্য করবার জন্যই।
সরে দাঁড়াল সীমানা। বললে, না, কাচটা জাম হয়ে রয়েছে—
যুবক এবার ঝুঁকে পড়ে কাচটা তোলবার চেষ্টা করে, কিন্তু সেও টানাটানি করে কাচটা তুলতে পারে না। কাচটা না তুলতে পেরে কাঠের পাল্লাটা টেনে তুলবার চেষ্টা করে যুবকটি, কিন্তু তাও পারে না। সেটাও টেনে তোলা যায় না। চোখেমুখে একটা স্পষ্ট বিরক্তির চিহ্ন ফুটে ওঠে যেন যুবকটির। বলে, যেমনি সব গাড়ির কামরা তেমনি সব ব্যবস্থা! যুবকটি ফিরে গেল তার সীটে।
সীমানা তখনো দাঁড়িয়েই ছিল। খুব জোরে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছিল চলন্ত গাড়ির খোলা জানালাটা দিয়ে। এতক্ষণ খেয়াল হয়নি, এখন কিন্তু সেই ঠাণ্ডা হাওয়ায় সীমানার বেশ শীত-শীত করে। গায়ের ছোট আলোয়ানটা একটু ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নেয় সীমানা। অতঃপর নিজের জায়গায় আবার বসে পড়ে।
যুবকটি পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে নতুন একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে, ওদিকে বসতে পারবেন না, এদিকে এসে বসুন
সীমানাও ভাবছিল কথাটা মনে মনে। সে উঠে এসে যুবকটির বেঞ্চেই বসলো।
হাতের কাঠিটা ফুঁ দিয়ে নিবুতে নিবুতে যুবকটি সীমানার দিকে তাকিয়ে বলে, আপনাকে মধ্যে মধ্যে এ লাইনের ট্রেনে যেতে দেখি—
আমিও আপনাকে দেখেছি আগে, মৃদু গলায় সীমানা জবাব দেয়।
আপনি আমাকে দেখেছেন?
হ্যাঁ—তারপরই একটু হেসে বলে, আপনি ডাক্তারী পড়েন, তাই না?
যুবকটি খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে বললে, কি করে বুঝলেন?
আপনার পকেটে ঐ যে—
ও হ্যাঁ—হ্যাঁ—যুবকটি আবার হাসল, তারপর বললে, ডাক্তারী আমি গত বছরেই পাস করেছি—তারপর একটু থেমে বলে, আপনি বোধ হয় কোন অফিসে চাকরি করেন?
চাকরি করি তবে অফিসে নয়, মৃদু হেসে জবাব দেয় সীমানা।
তবে কোথায় চাকরি করেন?
অবিশ্যি চাকরিও ঠিক সেটা নয়—
মানে?
মানে যারা চাকরি করে তারা যেমন করেই হোক মাস গেলে একটা ধরা-বাঁধা মাইনে পায় কিন্তু আমি তা পাই না—
চাকরি করেন অথচ মাইনে পান না, সে কি রকম?
মীরা পারফিউমারিতে স্নো-পাউডার-ক্রীম-নেলপলিস দোকানে দোকানে বিক্রী করে বেড়াই—বিক্রীর ওপর কমিশন একটা দেয়—
কোন ফিক্সড্ স্যালারি নেই?
না।
তাহলে তো খুব মুশকিল!
মুশকিল আর কি?
মুশকিল নয়, সেল সেরকম না হলে তো কমিশনও ভাল হয় না?
তা অবিশ্যি হয় না।
আজ বুঝি খুব ঘুরেছেন, ফিরতে এত দেরি হয়ে গেল?
সীমানা কোন জবাব দেয় না, মৃদু হাসে।
আজকাল তো কত অফিসে মেয়েদের চাকরি হচ্ছে, কোন অফিসে একটা চাকরি যোগাড় করে নিলেন না কেন?
অনেক চেষ্টা করেছি, প্রায় দেড় বছর ধরে—
হলো না?
না।
ইতিমধ্যে ট্রেনটা এসে বারাসাত জংশনে থামে। কল্যাণ রায় জানালার সার্সীটা তুলে বাইরে ঝুঁকে একবার দেখে নিল।
কোন্ স্টেশন? সীমানা শুধায়।
নামটা পড়া যাচ্ছে না।
অশোকনগর নয়ত!
না। আপনি বুঝি অশোকনগরে নামবেন? হ্যাঁ—আপনি?
আমি হাবড়া—বাইরে আজ খুব ঠাণ্ডা পড়েছে—
ক’টা বাজলো বলুন তো?
কল্যাণ নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললে, এগারোটা দশ—মা জানে আমি রাত সাড়ে দশটার মধ্যে পৌঁছে যাবো—পৌঁছতে পৌঁছতে সেই রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা হবে—এই ঠাণ্ডার রাত্রে জেগে বসে থাকবে, একে কয়েকদিন ধরে অ্যাজমার টানটা বেড়েছে—, শেষের কথাগুলো তখন কতকটা আত্মগতভাবেই বলে গেল কল্যাণ।
আপনি বুঝি রোজ রাত্রে বাড়ি যান?
না না,—ছুটি পাওয়া যায় না—এই তো প্রায় দশ দিন পরে বাড়ি যাচ্ছি। মা একা একা থাকে—
কেন বাড়িতে আর কেউ নেই?
আছে—ছোট একটি ভাই আছে, কিন্তু সে বাড়ি থাকে নাকি—তার কলেজ আর স্টুডেন্ট ইউনিয়ন ও পার্টি নিয়েই আছে সর্বক্ষণ! অথচ ভাল করে যদি পড়াশুনা করত রীতিমত ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করতে পারত।
কি পড়ছে?
বি. এ. পড়ে। কলেজে নামটাই আছে কেবল। পাসও করবে কিন্তু ওকে ওর পার্টির নেশা এমন ভাবে পেয়ে বসেছে, আর কিছুকাল পরে হয়ত আমাদের সংসারের সঙ্গে কোন সম্পর্কই থাকবে না। যাক গে ওসব কথা। কল্যাণ হেসে ফেলে, নিজের কথাই কেবল বলে চলেছি—
না না—তাতে কি হয়েছে—
আমার কথা তো শুনলেন, এবার আপনার কথা বলুন।
আমার কথা! আমার কথা কি শুনবেন আর–বাবা মা আর আমরা দুই ভাই আর দুই বোন। দাদা আমি আর ছোট ছোট দুই ভাই-বোন।
দাদা কি করেন?
লেখাপড়া করে নি—কি একটা ফ্যাকট্রিতে চাকরি করে।
কিন্তু ওদের কথা আর বেশীদূর এগুতে পারে না—ট্রেনটা অশোকনগরে থামে।
অশোকনগর—চলি! কল্যাণ উঠে দাঁড়াল। আবার দেখা হবে নিশ্চয়ই?
সীমানা হাসে।
কল্যাণ গাড়ির দরজা খুলে নেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ট্রেনটাও ছেড়ে দিল।
দরজাটা খোলাই রইলো। সীমানার উঠে গিয়ে দরজাটা আর বন্ধ করতে ইচ্ছে করে না। হাওয়ায় দরজাটা খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে আপনা থেকেই।
হু-হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে দরজাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই। একবার মনে হয় সীমানার, উঠে দরজাটা বন্ধ করে দেবে কিন্তু আবার মনে হয় কি হবে বন্ধ করে –এর পরের স্টেশনই তো হাবড়া—ও নামবে। আবার তো তখন দরজাটা খুলতে হবে। তার চেয়ে খোলাই থাক দরজাটা। কল্যাণেরই উচিত ছিল দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া নামবার সময়। হয়ত তাড়াতাড়ি ছিল কিংবা হয়ত ভুলে গিয়েছে। অথবা খেয়ালই হয়ত হয়নি। কত সময় তো তারও এমন হয়। যা করা উচিত তা করে না।
কল্যাণ তো ডাক্তার। কয়েকদিন আগেই না ওর যে কোন একজন ডাক্তারের কথা মনে হচ্ছিল? ওদের পাড়ার শচীন ডাক্তারের কথাও মনে হয়েছিল, কিন্তু তখুনি সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছে সীমানার শচীন ডাক্তারকে দিয়ে কাজ হবে না।
প্রথমত পাড়ার ডাক্তার, হয়ত সবারই জানাজানি হয়ে যাবে। তাছাড়া শচীন ডাক্তারকে কেন যেন ওর একটুও ভাল লাগে না। দ্বিতীয়ত দু-একবার বাবার হার্টের প্যালপিটেশনটা বেশী হলে শচীন ডাক্তারকে ছোট ভাই মনু ডেকে এনেছে।
কেমন করে যেন চেয়ে চেয়ে দেখে ওর দিকে—চোখ দুটো ট্যারা করে। কালো মোটা বেঁটে। লোকটার হাতে পায়ে অত্যধিক লোম—বোঝা যায় ওর শার্টের ফাঁক দিয়ে গলার কাছটায় নজর পড়লে। নিশ্চয়ই ও নিয়মিত দাড়ির সঙ্গে সঙ্গে বুকের খানিকটা অংশও কামিয়ে ফেলে। খুব প্র্যাকটিস কিন্তু লোকটার ঐ তল্লাটটা জুড়ে, যদিও আরো দুজন ডাক্তার আছে। তাদের কিন্তু শচীন ডাক্তারের মত প্র্যাকটিস নেই।
আরো একজন আছে হিমানীশ ডাক্তার—হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। ওর কাছে নাকি কি অব্যর্থ ঔষধ আছে—এক পুরিয়াতেই কাজ হয়, কার কাছে যেন শুনেছিল একবার সীমানা।
সীমানার চিন্তার জালে ছেদ পড়ল।
ট্রেনটা থেমে গেছে। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে সীমানা। দরজাটা ঠেলে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়ে। আরো জনা চার-পাঁচ যাত্রী নামলো। লোকগুলোর আপাদমস্তক যেন আলোয়ানে ‘আবৃত।
টিকিট নেবার জন্য গেটে কেউ নেই। থাকেও না বড় একটা—তাছাড়া এত রাত্রে এই শীতের মধ্যে থাকবে তো নাই-ই।
৩
গেট দিয়ে বের হয়ে রাস্তায় পা দিল সীমানা। সাইকেল-রিকশা এত রাত্রে একটাও নেই। স্টেশনের আশেপাশে প্রায় সব দোকানগুলোই বন্ধ, নর্তকী রেস্টুরেন্ট ও মোহনের বিড়ি—সিগারেটের দোকানটা ছাড়া। শেষ ট্রেনটা পর্যন্ত ওরা দোকান খোলা রাখে বোধ হয়। আজ যে শেষ ট্রেনের আগের ট্রেনটাই এত লেট ওরা হয়ত জানেও না।
স্টেশনের কাছটায় কিছু আলোর ব্যবস্থা আছে, তাছাড়া দোকানের আলো থাকায় কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু কিছুটা এগুলেই অন্ধকার। আলোর কোন ব্যবস্থাই নেই। রাস্তা এখনো পাকা হয়নি। ইট বিছিয়ে খোয়া পিটিয়ে দু’পাশের জমি থেকে রাস্তাটা উঁচু করা হলেও জায়গায় জায়গায় ইট বের হয়ে থাকায় অন্ধকারে চলতে চলতে প্রায়ই ঠোক্কর খেতে হয়। সাবধানে চলতে হয়। কিন্তু চলার সময় কারোরই সেটা বড় একটা মনে থাকে না। হঠাৎ একটা ঠোক্কর খেলে তবে সাবধান হয় কিছুটা।
দু’পাশে মাঠ। প্রথমে তো একেবারে ধু-ধু করত মাঠটা—এখন মধ্যে মধ্যে দূরে দূরে ঘর দেখা যায়। কিছু ছুতোর কামার ও নমঃশূদ্র ঘর তুলেছে। মাঠের মধ্যে কিছু বাবলা ও আকন্দ ফুলের গাছ।
দেহ ও মন অত্যন্ত ক্লান্ত থাকলেও একটু জোরেই হেঁটে চলেছিল সীমানা। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। ঠাণ্ডা উত্তুরে হাওয়া দিচ্ছে। সীমানা শাড়ির আঁচলটা তুলে মাথায় ঘোমটা দিয়ে নিল। কান দুটো ভাল করে ঢেকে দিল।
কলোনির মধ্যে এসে যখন পড়ল সীমানা, কয়েকটা কুকুর ডাকতে শুরু করে। শীতের রাত, সবাই প্রায় দরজা-জানালা এঁটে শুয়ে পড়েছে। নিস্তব্ধ একেবারে চারিদিক। কলোনির ভিতরের রাস্তাগুলো কিন্তু অনেকটা ভাল। গোটাকয়েক আলোর ব্যবস্থাও আছে। একেবারে অন্ধকার না। অনেকগুলো পাকা বাড়ি হয়ে গিয়েছে কয়েক বছরে।
শচীন ডাক্তার কিছুদিন হলো তার দোতলা তুলছে। নীচের তলায় রাস্তার উপরের ঘরটায় তার ডিসপেনসারি। ডিসপেনসারির আলোও আজ নিভে গিয়েছে।
দূরে একটা আলো দেখা গেল, শোনা গেল সাইকেলের ঘণ্টি! সাইকেল-আরোহী ওর দিকেই আসছে। কাছাকাছি সাইকেলটা এসে পড়ায় একপাশে সরে দাঁড়াল সীমানা। সাইকেলটা কিন্তু পাশ কাটিয়ে গেল না—ওর কাছাকাছি এসে ব্রেক কষে থেমে গেল।
কে? ভারী কর্কশ গলায় প্রশ্ন আসে।
গলাটা চিনতে সীমানার দেরি হয় না। শচীন ডাক্তারের গলা। সীমানা জবাব দেয় না।
কে গো! কথা বলছো না কেন? আবার প্রশ্ন।
আমি। মৃদু গলায় এবারে জবাব দেয় সীমানা।
আমি কে?
শচীন ডাক্তার সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিল, একটু সামনের দিকে ঝুঁকে আবার যেন প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয়।
আমি সীমানা।
হরেনবাবুর মেয়ে না?
হ্যাঁ।
তা এত রাত করে ফিরছো! তোমার বাবা তো খুব অসুস্থ—তাঁকে দেখেই আসছি আমি—
কি হয়েছে বাবার?
বুকে ব্যথা। মনে হয় করোনারি—একটা পেথিডিন সিকুইল ইনজেকশন দিয়ে এলাম। একটা ইলেকট্রো কারডিওগ্রাম করা দরকার—পার তো কাল সকালেই তোমার দাদাকে একটা খবর দিও।
একটানা কথাগুলো বলে শচীন ডাক্তার সীমানার দিকেই তাকিয়ে থাকে। যাবার কোন ইচ্ছাই নেই যেন। অন্ধকারে শচীন ডাক্তারের চোখের মণি দুটো যেন জ্বলছিল। সীমানা বাড়ি যাবার জন্য পা বাড়ায়।
সাইকেলের হ্যাণ্ডেলটা ধরে শচীন ডাক্তার তখনো দাঁড়িয়ে। সীমানাকে উদ্দেশ করে বললে, শোন, যা ইনজেকশন দিয়ে এসেছি এখন হয়ত ঘুমোচ্ছেন তোমার বাবা, তবে দরকার হলে আমাকে খবর দিও—
সীমানা কোন জবাব দিল না, ফিরেও তাকাল না, বাড়ির দিকেই হেঁটে চলেছে তখন। তার মনের মধ্যে তখন অন্য চিন্তা দেখা দিয়েছে, হাতে তো একটা পয়সাও নেই—মা’র হাতেও কিছু আছে বলে মনে হয় না। সে তো এ-মাসে কিছুই এখনো পায় নি। দাদা মধ্যে মধ্যে মাকে এসে গোটা চল্লিশ-পঞ্চাশ করে টাকা দিয়ে যায়, তা গত চার মাস আসেও নি—কিছু দেয়ও নি।
শচীন ডাক্তারের ভিজিট ও ঔষধের দাম দিতে হবেই, এখনই না দিলেও। কাল একবার রাধেশ চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করতে হবে।
গত মাসে তেমন কিছুই সেল করতে পারে নি, আর এ মাসের একটা দিন তো বিক্রীর কোন চেষ্টা করেই নি—দেখা করলেও অতএব বিশেষ তেমন কোন সুবিধা হবে বলে মনে হয় না। লোকটা একের নম্বরের চামার। দয়া-ধর্ম বলে কোন পদার্থই নেই দেহে। কাল দাদার ফ্যাক্টরীতে গিয়ে যেমন করে হোক একবার দেখা করতেই হবে।
দাদা এ বাড়ির বড় ছেলে, দায়িত্ব তো তারই—সেই বা কেন এসময় সাহায্য করবে না? এতদিন কোন কথা বলে নি সীমানা কিন্তু কাল বলবে। স্পষ্টাস্পষ্টিই বলবে, তুই ভেবেছিস কি দাদা? সংসারের সব দায়িত্ব কি চিরটা দিন আমিই বয়ে বেড়াব? কেন? তোর বুঝি কোন দায়িত্ব নেই?
.
বাইরের দরজাটা খোলাই ছিল তবে ভেজানো, একটু ঠেলতেই খুলে গেল। শচীন ডাক্তার চলে যাবার পর সুহাসিনী বোধ হয় ইচ্ছে করেই বন্ধ করে নি বাইরের দরজাটা, তাছাড়া সীমানা তখনো ফেরে নি।
ছোট উঠানটা পার হয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল সীমানা।
জোরজবরদস্তি করে দখল করা জায়গায় হরেনবাবুই একটা ডেরা গড়ে তুলেছিলেন, পাকা মেঝে পাকা দেওয়াল, টালীর ও টিনের ছাদ। টাকার অভাবে মাথার উপরে ছাদটা পাকা করতে পারেন নি। খানতিনেক মোটে ঘর। ছোট একটা বারান্দা, রান্নাঘর টিনের, ঘেরাও উঠানে বাথরুম ও একটা টিউবওয়েল। তবে টালীর ও টিনের ছাদ হলেও ইলেকট্রিকের ব্যবস্থা ছিল। ইলেকট্রিকের ব্যবস্থাটা অবিশ্যি বছরখানেক আগে হয়েছিল, তার আগে কেরোসিনের আলোই ছিল অবলম্বন।
বড় ঘরটায় বাবা-মা থাকে—মাঝেরটায় ওরা তিন ভাইবোন, অন্য ঘরটায় দাদা থাকত। দাদা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর খালিই পড়ে আছে।
ছোট ভাই সৌজন্য—মনু ও ছোট বোন সূচনা—সূচি ঐ ঘরে বসে দিনে-রাত্রে পড়াশুনা করে ইদানীং। পরীক্ষার আগে পর্যন্ত সীমানাই ঐ ঘরটা পড়াশুনার জন্য দখল করে ছিল, এখন ওরা দখল করেছে। সীমানা ঐ ঘরে ঢোকেও না, প্রয়োজনও হয় না আজকাল আর। সোজা এসে নিজের ঘরে ঢোকে। একপাশে একটা কাঠের আলমারি আছে, তারই লাগোয়া একটি কাঠের আলনা। তিন ভাইবোনের জামাকাপড় ঐ আলনাতেই থাকে। আলমারিটা ছোট দুই ভাইবোনের দখলে। উপার্জন করবার পর একটা সুটকেস কিনেছে সীমানা, তার কিছু জামাকাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র ঐ সুটকেসেই থাকে।
বাবা-মা’র ঘর থেকে আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে—দরজাটা ভেজানো—ঈষদুন্মুক্ত দরজাপথে আলোর আভাস পাওয়া যায়। একবার একটু ইতস্তত করল, তারপর সোজা পায়ের স্লিপারটা দরজার গোড়ায় ছেড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকল।
সুহাসিনী স্বামীর শিয়রের সামনে চুপটি করে বসেছিল চৌকির উপর। হরেন্দ্রনাথ শয্যায় শুয়ে, গলা পর্যন্ত লেপটা টানা। চক্ষু দুটি মুদ্রিত। বোঝা যায় ঘুমোচ্ছেন।
গৃহের সমস্ত কাজই করতে হয় সুহাসিনীকে। সব কিছুই নিঃশব্দে সে একহাতে করে যায়। কোন্ সকালে যে সুহাসিনী শয্যাত্যাগ করে সীমানা জানেও না। বাসী ঘর-দুয়ার সাফ করে, রান্নাঘরে উনুন ধরিয়ে, টিউবওয়েলের জলে স্নান করে নিতে-নিতেই সূচনার স্কুলে যাবার সময় হয়। সে চলে যাবার পরেই হরেন্দ্রনাথেরও ঘুম ভাঙে। চা তৈরী করে সুহাসিনী স্বামীকে দেয়, সীমানাকে দেয় ও ছোট ছেলেকে ডেকে তুলে চা দেয়। নিজে কোন দিনও আজ পর্যন্ত সুহাসিনী চা পান করে নি। তারপরই রান্না। সীমানা সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই খেয়ে বের হয়ে পড়ে কারণ তাকে সকাল ন’টা-বিশের ট্রেনটা ধরতেই হবে। সৌজন্য গোবরডাঙা কলেজে ভর্তি হয়েছে, সেও দিদির সঙ্গেই খেয়ে বইখাতা নিয়ে বের হয়ে পড়ে। খুব ভোরে স্কুল বলে সূচনাও ভোর পাঁচটাতেই বের হয়ে পড়ে। ঘুঘুডাঙা স্কুলে পড়ে সূচনা।
সুহাসিনী সারা দুপুরে একটু বিশ্রাম নেয় না। সেলাইয়ের কাজ, ভাঁড়ার গোছানো, তেঁতুল কাটা, আচার দেওয়া বা বড়ি দেওয়া, ঝাড়াপৌঁছা, কাপড় সিদ্ধ করে কাচা—একটা-না-একটা কিছু করেই।
সারাটা দুপুর সূচনা বাড়িতে থাকে, কিন্তু তার কোন সাহায্যই পায় না সুহাসিনী। মেয়ে হয় নভেল পড়া বা পাড়ায় বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেড়ায়। ছোট দুটি ভাইবোনের কারোরই পড়াশুনায় এতটুকু মন নেই। সৌজন্যর বয়স হলো সতের আর সুচনার পনের।
সুহাসিনীও কোন দিনই ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার ব্যাপার নিয়ে কখনো মাথা ঘামায় নি, আজও ঘামায় না। সে তার নিজের সংসারের কাজ ও স্বামী ও সন্তানদের সেবা ও দেখাশোনার ব্যাপার নিয়েই ব্যস্ত সর্বক্ষণ। ওরা যতদিন স্কুলে পড়ত, ও আর দাদা সৈকত, বাবা ওদের পড়াশুনার ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতেন, কিন্তু সৈকত ফেল করে পড়াশুনা ছেড়ে দেবার পর থেকে মানুষটা যেন একেবারে চুপ করে গিয়েছেন। পড়াশুনা কেন, কোন ব্যাপারেই যেন আর তার কোন আকর্ষণ বা স্পৃহা ছিল না। সারাটা সকাল খবরের কাগজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া। বছরখানেক হলো দুপুরে ওখানকারই একটা নতুন স্কুলে চাকরি নিয়েছিলেন। দু মাস তিন মাস অন্তর কখনো কখনো মাইনে পেতেন আবার পেতেনও না এবং পেলেও কখনো পুরো মাইনে পেতেন না। সকাল দশটায় খেয়েদেয়ে স্কুলে চলে যান, ফেরেন সেই সন্ধ্যায়।
তারপর আবার খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে বসা। সাড়ে আটটার মধ্যেই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েন। কারো কোন সংবাদ বা খোঁজখবর নেওয়া—কিছু নয়। কথাও কারো সঙ্গে বড় একটা বলেন না, একমাত্র মায়ের সঙ্গে ছাড়া। গৃহে থেকেও যেন আর তিনি গৃহের একজন নন—বিশেষজন তো ননই।
ছেলেমেয়েরাও বাপকে এড়িয়েই চলে। এমন কি সীমানাও। সত্যি কথা বলতে কি, গত একটা বছর সেলসম্যানের চাকরি নেওয়া অবধি ‘মীরা ফার্মেসী’তে বাপের সঙ্গে চোখাচোখিও বুঝি বড় একটা হয় নি সীমানার। কাজেই বাপের মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়েও সে বুঝি দেখে নি। দেখবার কথাই কি মনে হয়েছে? তাও হয় নি। সে-ও তার কাজ নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে।
কেন? শুধুই কি কাজ? তার নিজের চিন্তা, ভাবনা, ব্যবহার, আচার-আচরণ সবই কি একটু একটু করে একেবারে বদলে যায় নি? সীমানাই কি আগের সেই সীমানাই আর আছে? দু’বছর আগেকার সীমানাকে আজ কি দু’বছর পরে বর্তমান সীমানার মধ্যে কোথাও সে আর খুঁজে পাবে!
বাড়ির বাইরে যেদিন সে পা ফেলেছে, সেই দিন সেই মুহূর্ত থেকেই পরিবর্তন ফে শুরু হয়েছিল তার নিজেরও তা সে জানে না। জানতে পারেও নি।
আগেকার দিন আর অবস্থা থাকলে হয়ত একদিন তার বিয়ে হয়ে যেত—ছেলেপিলের মা হয়ে যেত—স্বামী-সংসার ছেলে-মেয়ে নিয়ে তার মায়ের মতই সংসারে জড়িয়ে পড়ত। কিন্তু আজকের দিনে মেয়েদের সে জীবনের সঙ্গে পরিচয় হবার সুযোগও নেই, হয়ও না। বিশেষ করে তাদের মত মেয়েদের জীবন, যাকে বাঁচবার জন্য উপার্জন করতেই হবে। করতে হয়েছে তাকেও।
প্রথমটায় হয়ত সেইটাই বড় কথা ছিল, কিন্তু আজ—এই এক বছরে যেন আর সে কথাটা আসল আর নেই। সেটা যেন কখন একসময় গৌণ হয়ে গিয়েছে। আজ সব কিছুর ভিতরে তার নিজের চিন্তাটাই সব চাইতে বড় চিন্তা হয়ে উঠেছে। তার বর্তমান—তার ভবিষ্যৎ—সেই চিন্তাটাই।
সবার কথা সে ভাবে না আর—নিজের কথাই ভাবে। সংসারে আছে বলে যেটুকু করেছে, যেন কোন একটা পুরাতন অভ্যাসের বশেই করে চলেছে। যেটুকু সে দিচ্ছে যেন অভ্যাসের বশেই দেওয়া। নচেৎ কোন মমতা কোন আকর্ষণও নেই আর সংসারের কিছুর প্রতি তার যেন, কোন দায়িত্ববোধের পীড়াও আর নেই।
বাপের ঘুমন্ত মুখখানার দিকে চেয়ে তাই বুঝি চমকে ওঠে সীমানা।
কৃশ রুগ্ন ভাঙা গাল, ছোট ছোট দাড়ি—ঐ কি তার বাপ হরেন্দ্রনাথ! চোখ ফেরাতে পারে না সীমানা বাপের মুখের দিক থেকে
সুহাসিনীরও বুঝি একটু বসে থাকতে থাকতে ঝিম্ এসেছিল, মেয়ের ঘরে পদার্পণটা সে টের পায়নি প্রথমটায়।
সীমানাই দু’পা এগিয়ে এলো। মৃদুকণ্ঠে ডাকে, মা
সুহাসিনীর তন্দ্রাটা ভেঙে গেল, ফিরে তাকাল মেয়ের দিকে, সীমু? কখন এলি?
এই তো—কি হয়েছে বাবার?
ঘণ্টা-দুই আগে বুকের একটা ব্যথায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল—বাড়িতে কেউ নেই, কি করি ভেবে পাই না—
কেন মনু-সূচি ওরা কোথায় ছিল?
ওরা বাড়িতে ছিল নাকি? মনু তো এখনো ফেরে নি, সূচি আসতে তাকেই শচীন ডাক্তারকে ডাকতে পাঠাই।
মনু কোথায়?
জানি না।
এখনো ফেরে নি—কিছু বলে যায় নি তোমাকে?
না তো।
কিছু বলে যায় নি?
না।
সীমানা আর কোন কথা বলে না।
মাকে যেন অনেক দিন বাদে দেখছে সীমানা। মা যেন কখন ইতিমধ্যে বেশ বুড়ো হয়ে গিয়েছে। মাথার দু’পাশের চুল কত পেকে গিয়েছে, মুখটা কেমন ভেঙে গিয়েছে। সমস্ত চেহারাটার মধ্যে যেন একটা সংগ্রামের ছাপ পড়েছে। বেশীক্ষণ মা’র মুখের দিকে চেয়ে থাকতে পারে না সীমানা। ইচ্ছাও করে না। কোন সহানুভূতি কোন মমতাই যেন বোধ করে না।
তোর ফিরতে এত দেরি হলো যে সীমু!
কাজ ছিল। কোনমতে ছোট্ট সংক্ষিপ্ত জবাবটা দিয়ে ঘরের বাইরে যাবার জন্য পা বাড়াল সীমানা। ঘরের মধ্যে যেন কেমন একটা শ্বাসরোধকারী অবস্থা।
খাবার তো সব ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে, সুহাসিনী বলে, তুই হাত-মুখ ধুয়ে নে—আমি খাবারগুলো গরম করি। মেয়ের পিছনে পিছনে সুহাসিনীও ঘর থেকে বের হয়ে আসে। সীমানা ঘরে এসে দেখলো, ছোট বোন সূচনা ঘুমিয়ে পড়েছে।
৪
বাইরের শাড়িটা ছেড়ে আটপৌরে একটা শাড়ি পরে বাইরের বালতিতে রাখা ঠাণ্ডা জলে হাত মুখ ধুয়ে নিল সীমানা।
রান্নাঘরে ঢুকে একটা পিঁড়ি পেতে বসল, সারাটা দিন পেটে কিছু পড়ে নি কাপ দুই—চা ছাড়া—কিন্তু তবু যেন এতটুকু ক্ষিধে ছিল না। অসহ্য ক্লান্তিতে শরীরটা কেমন যেন অবসন্ন বোধ হচ্ছিল। সুহাসিনী সেই কখন সন্ধ্যাবেলায় তৈরী রুটি উনুনের আঁচে গরম করে ঠাণ্ডা তরকারির সঙ্গে একটা থালায় করে এগিয়ে দিল সীমানার সামনে।
রুটি আর আলুকুমড়োর একটা তরকারি। রাত্রে বেশীর ভাগ ঐ আহার্য। কখনো—সখনো এক-আধ টুকরো মাছ, আধখানা ডিম বা কালেভদ্রে মাংস এলে দুটো টুকরো মাংস—নচেৎ খাবারের মেনু বড় একটা বদলায় না। রুটি ছিঁড়ে তরকারির সঙ্গে মুখে দিয়ে চিবুতে থাকে সীমানা—কিন্তু কেমন যেন বমি-বমি ভাব।
মাইনে পেয়েছিস?
বমির ভাবটা চাপবার চেষ্টা করছিল সীমানা, মায়ের কথায় তার মুখের দিকে না তাকিয়ে নিঃশব্দে মাথাটা একবার নাড়ল।
সুহাসিনী বুঝলো মাইনে এখনো মেয়ে পায়নি।
হাতে তো আর কিছুই নেই রে
দেখি কাল একবার চেষ্টা করব, সীমানা জবাব দেয়।
না। খেতে পারবে না সীমানা। খাওয়ার চেষ্টা করলে সবই ঠেলে বমি হয়ে বের হয়ে আসবে। সীমানা একটু জল খেয়ে উঠে পড়ল।
ওকি রে, উঠে পড়লি—খেলি না কিছুই?
ভাল লাগছে না মা।
থাক্ তবে—এত রাত্রে কি আর কিছু খেতে ভাল লাগে?
কলতলায় হাত-মুখ ধুতে এসে কিন্তু যেটুকু খেয়েছিল সীমানা তাও বমি হয়ে গেল। কোনমতে নিঃশব্দে বমি করে মা যাতে শুনতে না পান চোখে মুখে জল দিয়ে ফিরে এলো সীমানা। মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। ঘরের আলোটা নিভিয়ে শয্যায় গা ঢেলে দিল সীমানা। সুহাসিনী রান্নাঘরে সব গোছগাছ করে রাখছে—তারই ঠুকঠাক শব্দ কানে আসে।
ক্লান্তিতে শরীরটা যেন এলিয়ে পড়ছিল, ভেবেছিল শয্যায় শুয়ে পড়লেই বুঝি ঘুম আসবে কিন্তু ঘুম আসে না সীমানার চোখের পাতায়। রান্নাঘরের শব্দ থেমে গিয়েছে। সুহাসিনী বোধ হয় ঘরে ফিরে গিয়েছে।
গত মাসেও সীমানা দেড়শত টাকার বেশী দিতে পারে নি। এ মাসেও এখনো একটা পয়সা দিতে পারে নি। দু’মাস দাদা একটা পয়সাও দেয় না। সত্যিই তো সুহাসিনীর টাকার প্রয়োজন। আজকের দিনে পাঁচটা প্রাণীর খাওয়া খরচ যেমন তেমন করেও তো নেহাৎ কম নয়।
হরেন্দ্রনাথ গত দু’মাস একটা টাকাও স্কুল থেকে পান নি, দাদাও কিছু দেয় নি, আসেও না চার মাস হলো। তবু কোনমতে সীমানাই গত দু’মাস ধরে সংসারটা চালিয়ে গিয়েছে। সংসারের খরচ, ছোট ভাই-বোন দুটির পড়ার খরচ, তার নিজেরও খরচা।
কাল একবার অফিসে তাকে যেতেই হবে। গত মাসের শেষের দিকে তেমন কিছু সেল দেখাতে পারে নি কাজেই প্রাপ্য কমিশন হয়ত তেমন কিছুই হয় নি। আর এ মাসেরও দশ তারিখ আজ হয়ে গেল কোন কাজই হয় নি। সুধন্যর সন্ধানেই ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছে পাগলের মত।
শেষ দেখা তার সুধন্যর সঙ্গে গত মাসের আগের মাসের সাত তারিখে—মীরা পারফিউমারির নতুন স্নো ও পাউডার দুটো নিয়ে সে আর সুধন্য রানাঘাট ও কৃষ্ণনগর ঘুরতে গিয়েছিল। পরের দিন কলকাতায় ফিরে সে গিয়েছিল বাড়ি আর সুধন্য গিয়েছিল অফিসে।
ঐ দিনই দুপুরের ট্রেনে নাকি অফিসের কাজে সুধন্য আসাম অঞ্চলে চলে গিয়েছিল দিন পনের-কুড়ির জন্য। কথা ছিল মাসের প্রথম দিকে ফিরবে। ফিরেও এসেছিল, অফিসে রিপোর্ট করে পরের দিন বিকেলের দিকে আবার আসবে বলে সেই যে চলে গিয়েছে আর আসে নি। কুড়ি-বাইশ দিন হয়ে গেল তার আর কোন পাত্তাই নেই।
রাধেশ চক্রবর্তী অবিশ্যি প্রথমটায় বলেছিল, হয়ত অসুখ-বিসুখ করেছে—তাই আসছে না। কিন্তু এক সপ্তাহ অপেক্ষা করেও যখন এলো না, তার বাড়ির ঠিকানায় একজন পিয়নকে চিঠি দিয়ে পাঠানো হয়েছিল অফিস থেকে। পিওন ফিরে এসে জানিয়েছে যে-ঠিকানায় তাকে পাঠানো হয়েছিল সেখানে নাকি সুধন্য মল্লিক নামে কেউ থাকে না—কোন দিন ছিলও না।
কথাটা শুনে সীমানা অবিশ্যি খুব একটা আশ্চর্য হয় নি কারণ সুধন্যই একদিন কথায় কথায় তাকে বলেছিল, অফিসে তার যে ঠিকানা দেওয়া আছে সে ঠিকানায় সে থাকে না। তার বাসার আসল ঠিকানা ও আসল পরিচয় অফিসে সে দেয় নি। চাকরির সময় একটা পরিচয় ও সিকিউরিটির প্রয়োজন ছিল—সিকিউরিটির টাকাটা ধার দিয়েছিল তার এক বন্ধু আর তার বাসার ঠিকানাটাই সুধন্য দিয়েছিল ঐ বাড়িরই ছেলে পরিচয়ে।
বন্ধুটির কথা প্রায়ই সুধন্য বলত, সে না থাকলে নাকি সুধন্যর ঐ চাকরি জুটতো না কোন দিনই। সুধন্যর বন্ধুটি থাকলে সীমানা একবার যেমন করেই হোক খোঁজ করে তার কাছে গিয়ে সুধন্যর খোঁজ নিত। কিন্তু সুধন্যর মুখেই ও শুনেছে সেই বন্ধুটি নাকি বছর খানেক হলো মধ্যপ্রদেশে কি একটা চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছে।
কিন্তু অফিস না জানলেও সে তো জানত সুধন্য কলকাতার কোন্ অঞ্চলে থাকে। সুধন্য তাকে কতবার তার বাসায় যাবার জন্য বলেছেও কিন্তু সীমানাই যায় নি। এমন কি কখনো বাসাটা ঠিক কোথায়—কত নম্বর সেটুকু জানবারও ইচ্ছা তার কখনো হয় নি। রোজই তো দেখা হয় বলতে গেলে, বাসার ঠিকানাটা জেনে আর কি হবে! আশ্চর্য, কেন যে কখনো একবারও মনে হয় নি গত দেড় বছরে সুধন্যর ঠিকানাটা কোন একদিন তার প্রয়োজন হতে পারে সেটা জেনে রাখা উচিত, নিজের কাছে নিজেরই যেন সেটা দুর্বোধ্য। ঠিকানাটা জানা থাকলে তো তাকে আজ এমন করে পাগলের মত সুধন্যর সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে হতো না সারাটা শহর। তাও কলকাতার মত শহর।
কিন্তু সুধন্য গেলই বা কোথায়? গত মাসের মাইনে সে নিতে আসে নি বটে কিন্তু চাকরিতে ইস্তফাও দেয় নি। তবে কি সুধন্য অন্য কোথাও চাকরি নিল! অন্য কোন চাকরি অন্য কোন আপিসে বেশী মাইনেয়? গত দুই মাস থেকেই সুধন্য আর কমিশন বেসিসে মীরা পারফিউমারিতে কাজ করছিল না, মাস মাইনে হিসাবেই কাজ করছিল। সেলস অরগানাইজার হয়েছিল মীরা পারফিউমারির।
কিন্তু হঠাৎ অন্য কোন চাকরি যদি সুধন্য নিয়েই থাকে এভাবে নিপাত্তা হবার মানে কি? কোন কারণ তো নেই। মীরা পারফিউমারির নতুন পাউডার ও ক্রীমটা নিয়ে মাস দেড়েক আগে সুধন্য আর সে রানাঘাট ও কৃষ্ণনগর অঞ্চলটা ঘুরে আসতে গিয়েছিল একদিনের জন্য।
সেলস ম্যানেজার বিজনবাবু বলেছিলেন, ঐ অঞ্চলটা একবার ভাল করে দেখতে হবে, যদি সেরকম বোঝা যায় তো একটা সাব-এজেনসি ওখানে দেওয়া যেতে পারে।
বিজনবাবু সুধন্যকেই কাজের ভারটা দিয়েছিলেন কিন্তু অফিসে বলে সীমানাকে সঙ্গে নিয়েছিল সুধন্য—টি. এ. বাবদ সীমানার কিছু উপরি আয় হয়ে যাবে ভেবে। কথা ছিল ভোরের ফার্স্ট ট্রেনে রওনা হবার কিন্তু তা সম্ভব হয় নি, সকাল আটটার ট্রেনে ওরা রওনা হয়েছিল। রানাঘাটে নেমে সেখানকার বাজার ঘুরে কাজ সেরে কৃষ্ণনগরে পৌঁছেছিল দুজনে বেলা তিনটে নাগাদ। শীতের ছোট বেলা। কৃষ্ণনগরের দোকানগুলো ঘুরতে ঘুরতে রাত আটটা হয়ে গেল।
শেষ দোকানটা থেকে বের হয়ে সুধন্য বললে, রাত আটটা তেত্রিশের ট্রেনটাতেই যেতে হবে আমাদের—কিন্তু কলকাতায় পৌঁছে তুমি হয়ত শেষ লোকাল ট্রেনটা ধরতে পারবে না সীমা।
কথাটা যে সীমানারও মনে হয় নি তা নয় কিন্তু অনেক টাকার অর্ডার সংগ্রহ হওয়ায় সারাদিনে মনটা খুশীই ছিল, ভাবছিল যাক এ মাসে কমিশনটা ভালই পাওয়া যাবে।
কাপড়জামা সবারই প্রায় ছিঁড়ে গিয়েছে, গত দু’মাস ধরেই মা মধ্যে মধ্যে কথাটা বলছিল। সীমানা বলেছিল, দেখি কি করতে পারি।
মা বলেছিল, একবার খোকার কাছে সময় করে একদিন যা না!
ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল সীমানা। বলেছিল, পারবো না আমি তোমার ছেলের কাছে যেতে—যেতে হয় তুমি যাও।
সুহাসিনী চুপ করে গিয়েছিল।
লজ্জা করে না তোমার, যে ভুলেও তোমার খোঁজ নেয় নি গত দু’মাসে একটিবার—তার কাছে গিয়ে হাত পাততে?
কেন যেন আজকাল সীমানা দাদার নামটা পর্যন্ত সহ্য করতে পারে না। তাই ভাবছিল এ মাসে বেশী কিছু পেলে কাপড়জামাগুলো কিনে দেবে। সুধন্যর কথার জবাবে তাই বলে, না পারলে আর কি হবে! বিদ্যাসাগর স্ট্রীটে বীণা থাকে তার ওখানেই না হয় রাতটা কাটিয়ে দেবো। মা চিন্তা করবেন অবিশ্যি—
সুধন্য বলে, তাই না হয় করো। কিন্তু আপাতত যা ক্ষিধে পেয়েছে, পেটের মধ্যে ইঁদুর যেন ডন দিচ্ছে—চল কোন একটা হোটেল থেকে কিছু খেয়ে নেওয়া যাক।
খেতে গেলে আবার ট্রেন ধরতে পারব তো?
এখনো তো অনেক সময় আছে—কেন পারব না!
সীমানা আর কোন কথা বলে নি। দুজনে গিয়ে হাই স্ট্রীটের একটা হোটেলে ঢোকে।
হোটেল থেকে যখন দুজনে বেরুল ট্রেনের তখন আর মিনিট কুড়ি আছে। একটা সাইকেল-রিকশা ডেকে দুজনে উঠে বসে। বাইরে বেশ শীত, যেন কাঁপুনি লাগায়। সকালে তাড়াতাড়িতে বেরুবার সময় মাত্র কার্ডিগানটা গায়ে চাপিয়ে নিয়েছিল, এখন রিকশায় বসে মনে হয় সীমানার স্কার্ফটা সঙ্গে নিয়ে এলে ভাল হতো।
কৃষ্ণনগর শহরটা সুধন্যর খুব ভাল করেই চেনা। এককালে কৃষ্ণনগর স্কুলে ও পড়েছিল বছর তিনেক কিন্তু যুদ্ধের পর শহরটা যেন আশ্চর্যরকম বদলে গিয়েছে। অবিশ্যি কলকাতার কয়েক মাইলের মধ্যে অবস্থিত জায়গাগুলো সবই বদলে গিয়েছে, নতুন নতুন রাস্তা ঘরবাড়ি দোকানপাট—মানুষের ভিড়। বিশেষ করে দেশবিভাগের পর জনসংখ্যা উদ্বাস্তুদের জন্য যেন চতুর্গুণ হয়ে গিয়েছে। গিজগিজ করছে একেবারে মানুষ যেন।
হোটেলটায় বেশ ভাল খাওয়ার ব্যবস্থা, কি বল সীমানা? একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করতে করতে সুধন্য বলে।
সীমানা শীতে একেবারে জড়োসড়ো হয়েছিল—সারাটা দিন ঘুরে ঘুরে ক্ষিধেও প্রচণ্ড পেয়েছিল—ভরপেট খেয়ে দু’চোখের পাতা যেন ভারী হয়ে আসছিল।
সীমানা মৃদু স্বরে কেবল বলে, হুঁ।
শহরের দোকানপাট ইতিমধ্যে সবই প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে, দু’একটা পান সিগারেটের দোকান ছাড়া। রীতিমত শীত বাইরে। কনকনে হাওয়া দিচ্ছিল আবার ঐ সঙ্গে। যথাসম্ভব সীমানা সুধন্যর গা ঘেঁষে বসেছিল।
সুধন্য বলে, কি শীত রে বাবা এখানে! কলকাতার ডবল শীত মনে হচ্ছে—তাই না?
সীমানা মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয়, হুঁ।
সুধন্য ডান হাতটা দিয়ে সীমানাকে নিজের আরো কাছে টেনে নেয়। রাস্তাঘাটও নির্জন—খালি রাস্তা বলতে গেলে।
শেষ পর্যন্ত কিন্তু ওরা ট্রেনটা ধরতে পারল না। স্টেশনে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই শেষ ট্রেনটা ছেড়ে গেল।
সর্বনাশ! ট্রেন চলে গেল সুধন্য! সীমানা বলে।
তাই তো দেখছি।
কি হবে এখন? আর ট্রেন নেই? রিকশাওয়ালাকেই সীমানা জিজ্ঞেস করে।
রিকশাওয়ালা বলে, কোন্ দিকে যাবেন?
কলকাতায়।
এখন তো আর কোন ট্রেন নেই—আছে সেই রাত তিনটে নাগাদ। রিকশাওয়ালা বলে।
তাহলে কি হবে সুধন্য? এই শীতের রাত্রে থাকবো কোথায়?
তাই তো ভাবছি—
তোমার জন্যই ট্রেনটা মিস করলাম!
আমার জন্য কি রকম?
নয়ত কি! না খেতে গেলেই হতো হোটেলে! দেখ তো এখন কি মুশকিল হলো!
অত চিন্তারই বা কি আছে। জলে তো আর পড়ি নি আমরা। চল হোটেলেই ফিরে যাই—রাতটা না হয় ওখানেই কাটানো যাবে।
হোটেলে!
তবে কি এই শীতের মধ্যে রাত তিনটে পর্যন্ত স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে থাকবে? একে তো ওয়েটিং রুমগুলো যে অবস্থায় থাকে—কখনো ভুলেও পরিষ্কার করে না—দুর্গন্ধে পেটের ভাত ঠেলে বের হয়ে আসে, তার উপরে কৃষ্ণনগরের মশা তো জান না, ঝাঁকে ঝাঁকে এসে ছেঁকে ধরবে। কথাগুলো বলে সীমানার কোন জবাবের জন্য আর অপেক্ষামাত্র না করে রিকশাওয়ালাকে বললে, চল—হোটেলেই ফিরে চল।
.
সীমানা আর সুধন্য হোটেলেই ফিরে গিয়েছিল সেরাত্রে।
খাওয়ার ব্যবস্থা যত পছন্দসই হোক থাকবার ব্যবস্থাটা কিন্তু দেখা গেল তেমন রুচিকর নয়। দোতলার যে ঘরটা ওদের থাকবার জন্য হোটেলের মালিক দিল—নামেই ডবল—সীটেড রুম—আসলে দুটো নেয়ারের খাট পাশাপাশি পড়বার পর আর জায়গাই নেই ঘরে। শয্যাও তেমন কিছু নয়। পাতলা তোশকের উপর একটা করে সুজনী পাতা। মশারীর ব্যবস্থা অবিশ্যি ছিল, কিন্তু ময়লা মশারি থেকে এমন একটা বিশ্রী বোঁটকা গন্ধ ছাড়ছিল যে সীমানা কথাটা না বলে পারে নি।
কি গন্ধ রে বাবা মশারিটায়!
আরে বাবা একটা রাত তো—কেটে যাবে কোনমতে।
কিন্তু কম্বল-টম্বল কোথায় সুধন্য—কিছু দেখছি না।
হোটেলের ছোকরা চাকরটা ঐ সময় দুটো পাতলা কম্বল নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল।
শেষরাত্রে ট্রেনটা ধরতে হবে—ঘরের দরজা বন্ধ করে সুধন্য ঐ মশারি ফেলেছে এবং সীমানা মশারি না ফেলে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে।