তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৪ – অরণ্যের প্রতিশোধ – শামসুদ্দীন নওয়াব – সেবা প্রকাশনী – প্রথম প্রকাশ : ২০১০
১
বাঁ হাত চেপে ধরে এক ছুটে রান্নাঘরে ঢুকলাম। হাতের তালু থেকে বেরিয়ে আছে একটা রেযর ব্লেড। ব্লেডের চারপাশ ঘিরে রক্ত, আমার কব্জি থেকে চুঁইয়ে পড়ছে সরু ধারায়।
চাচী! মুখ বিকৃত করে হাতটা তুলে ধরলাম।
আমার হাতের দিকে এক ঝলক চাইল মেরি চাচী, তারপর আবারও চুলোয় চাপানো গরুর মাংসের প্যানে চোখ ফিরল।
বেশ ভাল দেখাচ্ছে। তবে এবার নিশ্চয়ই সব কেচাপ শেষ। করিসনি?
হতাশায় গুঙিয়ে উঠলাম। চাচীর হয়েছেটা কী? কিচেন লাইটের আলোয় ঝিকোচ্ছে রেযর ব্লেডটা।
ওটা গেঁথে রয়েছে আমার হাতে। ব্যথায় জান যাচ্ছে আমার।
চাচী, এবারেরটা কেচাপ নয়, সত্যিকারের রক্ত! কব্জি চেপে ধরলাম যাতে ফ্যাকাসে হয়ে যায় হাত, যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলাম।
চকিত চাউনি বুলাল চাচী।
হাত ধুয়ে খেতে বস।
চাচী, রক্ত পড়ে মারা যাচ্ছি আমি! টলে উঠে বললাম।
এ সময় হাসি মুখে কিচেনে প্রবেশ করল রাশেদ চাচা।
কীরে, তোর হাতে কী?
হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। সাদা মেঝেতে টপ টপ করে রক্ত পড়ছে।
চাচা, হাত কেটে ফেলেছি!
আমার কাছে এসে হাতটা নিজের হাতে নিল চাচা।
হুঁ, খুব খারাপ অবস্থা দেখতে পাচ্ছি। আয় অপারেশন করে দিই! আমাকে টেনে নিয়ে এল কিচেন কাউন্টারের কাছে। তারপর এক টানে ড্রয়ার খুলে একটা ঝকঝকে ছুরি বের করল।
চাচী! চেঁচিয়ে উঠলাম। শরীর মুচড়ে সরে যাওয়ার। করলাম, কিন্তু চাচা ছাড়ল না। ছুরিটা দোলাচ্ছে। ঝলসে উঠল ফলাটা। চাচী! চেঁচালাম আবারও।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাচী ঘুরে দাঁড়াল আমাদের দিকে।
চাচী এবার তোকে বাঁচাতে পারবে না! চোখ বিস্ফারিত চাচার। আমি সত্যি ছুটতে চেষ্টা করছি, কিন্তু কিচেন কাউন্টারে আমার বাহু। চেপে ধরল সে। কব্জির কাছ থেকে কেটে ফেলতে হবে। মাথার উপরে ছুরিটা সাঁই করে তুলে ধরল।
ছুরিটার দিকে চাইলাম। চাচা হঠাৎই হেসে উঠল।
পড়ে গেল ছুরিটা।
কাঠের কাউন্টারে এতটাই জোরে গেঁথে গেল, চমকে উঠলাম আমি। হেসে ফেলল চাচা।
ডিনার তৈরি। খুনোখুনি বাদ দিয়ে খেতে এসো, এসময় ডাকল। চাচী।
চাচীর দিকে চাইলাম আমরা। দুবাহু ভাঁজ করে রেখেছে বুকের কাছে। এক হাতে বার্গার-টার্নার ধরা।
চাচা আমার উদ্দেশে চোখ টিপে, ছুরিটা সরিয়ে রাখতে গেল।
ওটা আর আমার নাইফ ড্রয়ারে রেখো না, চাচী বলল। গাজর কাটতে গিয়ে রক্ত চলকে বেরোক চাই না আমি। হেসে ফেললাম। আমি। এবার আমার দিকে দৃষ্টি পড়ল চাচীর। ডিনারের পর সব কাজ সারবি। তারপর আটটার আগে হোমওয়ক করে ফেলা চাই, বুঝলি?
ঘাড় কাত করে সায় জানালাম। কিচেন থেকে বেরিয়ে বাথরূমে গেলাম হাত ধুতে।
চাচীর কাছে কোনও পাত্তাই পেলাম না। পুরো একটা ঘণ্টার চেষ্টা পানিতে গেল।
ব্লেডটা আসল না, রবারের। তবে দেখতে একদম আসলের মতন। ফলায় রূপালী-ধূসর রঙ মাখিয়ে কোনাগুলোকে দেখতে চকচকে আর ধারাল করে তুলেছিলাম। অপর প্রান্তটা এমনভাবে কেটে ফেলেছিলাম, দেখে যাতে মনে হয় আমার হাতে গেঁথে গেছে। স্পিরিট গ্লু দিয়ে আটকে রেখেছিলাম। কর্ন সিরাপ আর রেড ডাই। ছিল বিকল্প রক্ত হিসেবে।
এসবই রাশেদ চাচার জিনিস। চাচা ইদানীং ছায়াছবির স্পেশাল এফেক্টসের কাজ করছে।
একটু পরে, ডিনারে বসলাম আমরা।
এবারের হ্যালোউইনে কী কস্টিউম চাস তুই? জিজ্ঞেস করল চাচা।
খাওয়ার সময় বিরক্তিকর আলোচনা না করলে হয় না? বলল চাচী।
হেসে ফেলল চাচা।
এবার নতুন কিছু চাই আমি, সোৎসাহে বলে উঠলাম। নিজেই কিছু একটা করব। এমন কিছু যাতে স্কুলের ছেলে-মেয়েরা দেখে ভিরমি খায়। আমি আসলে বিচিত্র কিছু একটা করে এমনকী চাচাকেও চমকে দিতে চাই।
তোমার কী মনে হয়, ও পারবে নিজের আইডিয়া দিয়ে তোমাকে ভয় দেখাতে? চাচী জিজ্ঞেস করল।
চাচা চাইল চাচীর দিকে।
পারা তো উচিত, ডিনার খেয়ে নে, আমি তোকে কিছু স্কুইব দেখাব। তারপর দুজনে মিলে আলোচনা করে কিছু একটা আইডিয়া বের করে ফেলব।
দুটো সবুজ বিন জোর করে গিলোম। তারপর প্লেটটা নিয়ে গেলাম সিঙ্কের কাছে। গার্বেজ ডিসপোসালে এঁটো-কাঁটা ফেলে চাচার স্টাডির দিকে পা বাড়ালাম।
কই যাস? চাচীর কণ্ঠ থামিয়ে দিল আমাকে। কাজগুলোর কী হবে?
ঘুরে দাঁড়ালাম।
ওহ, চাচী, চাচা আমার জন্যে বসে আছে।
আর আমি সারা বিকেল বসে আছি তুই কাঠ নিয়ে আসবি বলে। আগুন নেই, টোস্টেড মার্শম্যালোও নেই, সাফ জানিয়ে দিল চাচী।
আমি মার্শম্যালো পছন্দ না করলেও চাচা করে। কাজেই রাজি হতে হলো।
ঠিক আছে, যাব।
পিছনের উঠনে চলে এলাম। বিস্তর আগাছা জন্মেছে। চাচা মো করার সময় পায় না, কাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত, আমার দুএক সপ্তাহ লেগে যাবে আগাছা সাফ করতে।
উঠনে ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে গাছের পাতা। স্ট্রীটলাইটের হলদে আলো এখান অবধি পৌঁছয়নি। পিছনের বারান্দায় বাতিটাকে ঘিরে ঘুমাক খাচ্ছে কুয়াশা। ধূসর আঙুল দিয়ে যেন সব কিছু আঁধার আর স্যাঁতসেঁতে করে তুলেছে।
ঠাণ্ডায় শিউরে উঠলাম। বাতাসের দোলায় কুণ্ডলী পাকিয়ে গেল কুয়াশা। শুকনো পাতা খটখটিয়ে উঠল শুকনো হাড়ের মতন। বুকের কাছে দুবাহু ভাজ করে কাঠের গাদার উদ্দেশে এগোলাম।
চাচা কদিন আগে ট্রাক ভর্তি কাঠ এনেছে। আমাদের সাধারণত কাঠের দরকার হয় না। কিন্তু আজকে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। ফলে, চাচী চাইছে চাচার স্টাডিতে আগুন জ্বেলে, কিছু একটা পড়বে-টড়বে। আর আমি দেখব চাচা কী করে।
পাতার স্তূপে পা চালালাম। পাতা ভেদ করে চলে গেল পা। আগাছা ঘষা খেল আমার জিন্সে, মনে হলো আঁকড়ে ধরতে চাইছে বুঝি। চারদিক নিঃশব্দ। হৃৎস্পন্দনের শব্দও শুনতে পাচ্ছি। বাড়ির দিকে চকিত চাউনি বুলালাম। আলো জ্বলছে দেখে স্বস্তি পেলাম। এবার কেঁপে উঠে আলোর কাছ থেকে দূরে হেঁটে গেলাম।
পিছনের ফেন্সের কাছে জমাট বেঁধেছে অন্ধকার। স্ট্রীটলাইট কিংবা বারান্দার আলো এখান অবধি পৌঁছয়নি। কাঠের গাদার চারপাশে ঘাসহীন। ফেন্সের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা কাঠের পটাকে ভীতিকর দেখাল আমার চোখে। গাদা করা গুঁড়িগুলোকে দেখে কাঠ নয়, সাপ বলে ভুল হতে পারে।
ছোট ডালগুলোর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম। আবছা আলোয় দেখে মনে হচ্ছে কিলবিল করছে, গা মোচড়াচ্ছে।
চোখ পিটপিট করে, আবছায়া আর গুঁড়িগুলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইলাম।
এসময় নড়ে উঠল কী যেন।
একটা গুঁড়ি দুলে উঠেছে। শাণিত নখের খটাখট শব্দ কানে এল। কিছু একটা কর্কশস্বরে ককিয়ে উঠল। তারপর সব চুপচাপ।
গুঁড়িতে পায়ের ডগা দিয়ে ঠেলা দিলাম। ইঁদুর-টিদুর ঢুকল নাকি? মনে মনে আশা করছি মাকড়সার দল এখানে জাল বোনার সময় পায়নি। কাঠ তুলতে গিয়ে হাতে ঝুল লেগে গেলেই মেজাজ বিগড়ে যায় আমার।
একটা কাঠ তুলে নিতে ঝুঁকলাম। সই করে বা বাহুতে তুলে নিলাম ওটা। রুক্ষ বাকলে ছড়ে গেল চামড়া। দ্বিতীয়টা তুলতে যেতেই নড়ে উঠল হাতের কাঠটা। মনের ভুল আরকী।
পরমুহূর্তে, কীসে যেন কামড়ে দিল আমাকে।
২
চেঁচিয়ে উঠলাম। হাত থেকে কাঠটা ফেলে দিয়ে লাফিয়ে পিছু হটলাম। বাহু যেন পুড়ে যাচ্ছে। চামড়া জ্বালা করছে। যেখানটায় কামড় খেয়েছি চেপে ধরলাম। বাহুতে আর আঙুলে লেপ্টে গেছে চটচটে কী যেন। হাতটা টেনে সরিয়ে আনলাম। আঙুলগুলো জুড়ে গেছে। নাকে আসছে পচা গন্ধ।
মাটিতে পড়ে থাকা গুঁড়িটার দিকে চাইলাম। কী লেগে ছিল ওতে?
লাথি মারলাম ওটায়। নড়ে উঠল। আঁধারে চোখ সয়ে এসেছে। কোনও কিছু গুঁড়িটার কাছ থেকে সরে যায় কিনা লক্ষ করলাম। কিছুই নড়াচড়া করল না। খসে পড়েছে কামড়ে দেওয়া প্রাণীটা। পায়ের পাতা দিয়ে উল্টে দিলাম গুঁড়িটাকে। এবার পিছনে সরে এলাম। কলিজা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
আঁধারে দেখলাম, গুঁড়ির বাকলটা দেখতে বাকলের মত নয়। মুখের চেহারার মত। পুরানো, মৃত এক মুখ। চোখজোড়া বোজা। সরু-সরু দাগগুলো নাক, জ্ব, দাড়ি এসব ইঙ্গিত করছে। মানুষের মুখের মত নয়। বিকৃত। মুখগহ্বরের কাছে একটা গর্ত, তরল জাতীয় কিছু একটা গলগল করে মাটিতে পড়ছে।
_ আমার ধারণা হলো আঁধারে চোখে ভুল দেখছি আমি। গুঁড়িটাকে আবারও জুতোর ডগা দিয়ে উল্টে দিলাম।
উল্টে গেল ওটা। দীর্ঘশ্বাসের মত এক শব্দ কানে এল। মুখ তুলে চাইলাম। বাতাসের শব্দ। চোখ নামিয়ে মুখটাকে আবারও দেখার চেষ্টা করলাম। মুখের বদলে বাকল আর করাত দিয়ে যেখানটায় ছোট-ছোট ডাল-পালা কাটা হয়েছে সে দাগগুলো চোখে পড়ল।
কষে লাথি মারলাম গুঁড়িটাকে। মাটিতে দাপালাম পা। এটা স্রেফ একটা কাঠের গুঁড়ি। মোটেই নড়েনি। নিশ্চয়ই কোনও পোকা-টোকা আমাকে কামড়েছে। কিন্তু চামড়ায় বসে যাওয়া তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো এখনও অনুভব করছি আমি।
বাহু ঘষে খানিকটা আঠা খসালাম। দুর্গন্ধ। জিনিসটা মেখে রয়েছে আমার বাহু আর আঙুলে-যেতে চাইছে না।
জিন্সে হাত মুছে আরেকটা গুঁড়ি নিতে হাত বাড়ালাম। আমার আঙুল স্পর্শ করার আগেই পড়ে গেল ওটা। অন্যগুলোর উপর ধাক্কা খেয়ে আমার দিকে গড়িয়ে এল। সভয়ে পিছু হটলাম। অল্পের জন্য আমার পায়ে পড়েনি। পায়ের ডগা দিয়ে নাড়লাম গুঁড়িটাকে। সামান্য নড়ে উঠে নিথর পড়ে রইল।
আরও গোটা দুই গুঁড়ি টেনে বের করলাম। তিনটে হয়ে গেলে হনহনিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। বারবার পিছু ফিরে কাঠের স্তূপটার দিকে চাইছি। পরশুদিন হ্যালোউইন। তাই কেমন জানি গা ছমছম করছে।
পিছনের দরজায় পৌঁছে সবচাইতে খারাপ ভুলটা করলাম। বারান্দার আলোয় পা রেখে হাতের গুঁড়িগুলোর দিকে চোখ নামিয়ে চাইলাম।
এক জোড়া মৃত, শূন্য চোখ পাল্টা চাইল আমার উদ্দেশে। টলে উঠলাম। হাত থেকে খসে পড়ে গেল কাঠ। কী দেখলাম! এটা গাছ। স্রেফ একটা মরা গাছ। মরা কাঠ। আর কিছু নয়। চোখ বুজে ফেলেছি।
চোখ যখন মেলোম, চোখ নয় কাঠের গুঁড়ি পড়ে থাকতে দেখলাম ঘাসের উপর। যে গাঁটগুলো থেকে ডাল কাটা হয়েছে সে। জায়গাগুলো দেখতে খানিকটা শূন্য কোটরের মত লাগছে। অতটা ভয় পাওয়া আমার উচিত হয়নি। আসলে বারান্দায় ম্লান আলো ভুতুড়ে করে তুলেছে পরিবেশ। ফলে, মরা কাঠ দেখেই ভড়কে গেছি আমি।
ঘেমে গেছে শরীর। হয়তো কোন জাতের মাকড়সা কামড়ে দিয়েছে আমাকে। হয়তো বিষের কারণে চোখে ভুল দেখছি। মোটকথা, শরীর খারাপ করছে আমার।
গুঁড়িগুলো ফেলে রেখেই, বাড়ির ভিতরে পা বাড়ালাম। গায়ের চামড়া ঠাণ্ডা, অথচ ভিতরে ভিতরে পুড়ে যাচ্ছে।
চাচী! চেঁচিয়ে উঠলাম। দড়াম করে লাগিয়েছি পিছনের দরজা। হঠাৎই আলো দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলাম। চাচা-চাচীকেও কাছে পেতে চাইছি।
বাহুর দিকে চাইলাম। কিছু নেই, না কোনও ক্ষত, না আঁচড়ের দাগ। ব্যথার জায়গায় একটা আঙুল রাখলাম ধীরে ধীরে। স্বচ্ছ, হলদে এক ধরনের রস। বেরিয়ে এল আঙুলের চাপে। প্রচণ্ড জ্বলুনি।
চাচী! চেঁচালাম আবারও। বাহুতে হাত চাপা দিয়ে দৌড়ে গেলাম তাকে খুঁজতে।
চাচার স্টাডিতে ঢুকতেই চাচা-চাচী মুখ তুলে আমার দিকে চাইল। সব কথা গড়গড় করে বলতে শুরু করলাম। চাচী আমার হাত সরিয়ে বাহুর দিকে চাইল।
কই, ফোলা-টোলা কিছুই তো নেই, অবিশ্বাসের সুরে বলল।
কিন্তু আমাকে কামড় দিয়েছে, ব্যথা করছে…
সব কাজ না করার ফন্দি…
না, চাচী, আমাকে কীসে যেন কামড়েছে!
ভ্রু কুঁচকে গেল চাচীর। সটান উঠে দাঁড়াল।
স্প্রে লাগাবি চল। তারপর কাঠ নিয়ে আসবি। এবার আর কোনও অজুহাত শুনতে চাই না।
চাচী আমার কথা বিশ্বাস করেনি।
কিশোর, ওখানে কিছুই নেই। তুই আমার গার্ডেনিং গ্লাভস পরে কাজটা সেরে ফেল, বলল।
কাঁধ ঝুলে পড়ল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে এলাম। চাচীর গ্লাভস লণ্ডি রূম থেকে বের করে সঙ্গে একটা ফ্ল্যাশলাইট নিলাম। বাইরে ঠাণ্ডা। অন্ধ ভূতের মতন নেচে বেড়াচ্ছে ফ্ল্যাশলাইটের আলো। কপাল থেকে ঘাম মুছে আগাছার জঙ্গলে পা রাখলাম।
কাঠ এখানেই ফেলে রেখে গেছিলাম, এখন দেখতে পাচ্ছি না। চারদিকে আলো বুলিয়ে আগাছা যেখানে চেপ্টে গেছে সেখানটায় ধরলাম। ওখানে গুঁড়ি পড়ে থাকার কথা।
এ সময় কী যেন খসখস করে উঠল আমার পিছনে।
পাঁই করে ঘুরে দাঁড়ালাম।
শব্দটা থেমে গেছে। কেউ যেন আগাছার মধ্যে চলাফেরা করছিল। বিড়াল হতে পারে।
শেষমেশ যেখানে ফেলেছিলাম তার দশ ফুট দূরে খুঁজে পেলাম একটা গুঁড়ি। অতদূরে গেল কী করে?
গুঁড়িটার দিকে চোখ রেখে পায়ে পায়ে পিছনের দরজা দিয়ে সেঁধিয়ে পড়লাম।
চাচী এবার আর আমাকে কাঠ আনিনি দেখেও কিছু বলল না।
কিশোর, তোর মুখ শুকনো কেন? শরীর খারাপ নাকি? উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন করল।
মাথা ঝাঁকালাম। চাচীকে বলতে চাইলাম গুঁড়িটার নড়াচড়া সম্পর্কে। কিন্তু আমি নিজেই তো বিশ্বাস করি না নিজে থেকে নড়েছে। ওটা। চাচীকে কী বলব?
চাচী, মাকড়সার কামড়ে কি মানুষ উল্টোপাল্টা দেখে?
আমার হাত থেকে ফ্ল্যাশলাইটটা নিল চাচী।
না। এখন শুয়ে থাকগে যা।
মাথা ঝাঁকিয়ে পা বাড়ানোর আগে এক ঝলক চাউনি বুলালাম পিছনের দরজার দিকে।
পরদিন সকালে বাহুটা সামান্য আড়ষ্ট ঠেকল।
কিশোর, চাচী ডাকল। নাস্তা খেতে আয়।
বিছানা ছাড়লাম। সোয়েটশার্ট আর জিন্স পরে নিলাম। মুখে ছিটালাম পানি।
বাহুতে এখন আর ব্যথা নেই। তবে বড় চুলকাচ্ছে। শার্টের হাতা গোটালাম।
একী! হাত থেকে কনুই পর্যন্ত, আমার চামড়া রুক্ষ বাকলের মত দেখাচ্ছে। হলদে রস চুঁইয়ে বেরোচ্ছে কিনারাগুলো দিয়ে।
৩
চাচী! ডাক ছাড়তে গিয়ে ককিয়ে উঠলাম। গলা শুকিয়ে কাঠ। কাঁপা-কাঁপা আঙুলে চামড়া স্পর্শ করলাম। চামড়া বলে মনে হলো না। রুক্ষ। কাঠের মত।
বাথরূমে গিয়ে সিঙ্কের উপর ঝুঁকে পড়লাম। মখের দিকে চাইলাম। অন্যরকম কিছু লাগল না। সামান্য একটু ফ্যাকাসে শুধু। বাহুর দিকে চোখ নামালাম। 1 জিনিসটা কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত ছেয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে বাকল সেঁটে রয়েছে বাহুতে।
আমার ধারণা, সামান্য সাবান ঘষলেই উঠে যাবে। লম্বা করে শ্বাস টানলাম।
ব্রাশ নিয়ে, সিঙ্কো গরম পানি ভরলাম। এবার ঘষতে শুরু করলাম। খানিকটা উঠে এল। বাকলের নীচ থেকে চুঁইয়ে বেরোল দুর্গন্ধময় আরও হলদে আঠা। ঘষা থামিয়ে ঘৃণায় মুখ সরিয়ে নিলাম।
কিশোর, স্কুলে যাবি না?
বাহুর দিকে চাইলাম। জিনিসটা কী বুঝতে পারছি না। কিনারাগুলো চুলকোচ্ছে আর পুড়ছে। আঁচড়াতে সাহস হলো না। জিনিসটা যা-ই হোক, ছড়াচ্ছে।
পানি বন্ধ করে, একটা তোয়ালে জড়ালাম বাহুতে। এবার কিচেনের উদ্দেশে পা বাড়ালাম।
চাচী? ডাকলাম।
আমার দিকে চাইল চাচী। নাস্তা তৈরি করছিল।
বাহু থেকে তোয়ালেটা সরিয়ে দিলাম।
মুহূর্তের জন্য, ফ্যাকাসে হয়ে গেল চাচীর মুখের চেহারা। এবার ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। ঘুরে দাঁড়িয়ে কাজে ব্যস্ত হলো, সিঙ্কে ডিশ রাখছে।
এবার বুঝতে পারলাম কেন এত দেরি। কস্টিউম নিয়ে পড়ে ছিলি। মেকআপটা ভাল হয়েছে, কিন্তু এসব নিয়ে পড়ে থাকলে হবে?
এটা মেকআপ নয়। কাল রাতে আমাকে কীসে যেন কামড়েছে। এখন দেখতে পাচ্ছি হাতটা অন্যরকম হয়ে গেছে, চুলকাচ্ছে।
চাচী ঘুরে দাঁড়াল আমার দিকে। এগিয়ে এসে একটা হাত রাখল কপালে।
জ্বর নেই। কাজেই স্কুল মিস করার কোন কারণও নেই। তুই কি কস্টিউমটা নিয়ে কাজ করতে চাস বলে বাড়িতে থাকতে চাইছিস? জিজ্ঞেস করল।
না, চাচী, সত্যি সত্যিই আমার শরীর খারাপ। ডাক্তার দেখানো দরকার!
চাচী বাহু ভাঁজ করে জ কুঁচকাল।
এর আগেরবার খামোকা ডাক্তার হপকিন্সকে ভুগিয়েছিলি। মনে নেই, তোর চাচার লাল কলম দিয়ে হাম বানিয়েছিলি? ভদ্রলোক এখনও মনে করে রেখেছেন ঘটনাটা।
কিন্তু এবারেরটা মিথ্যে নয়! নিজেই দেখো! চাচীর দিকে বাহু বাড়িয়ে দিয়ে এক টুকরো কাঠ তুলে নিলাম। পচা পাতার হলদে দুর্গন্ধময় রস বেরিয়ে এল।
চাচী নাক-মুখ চেপে ধরে অন্যদিকে চাইল।
তোর মাথায় এরচেয়ে ভাল কস্টিউমের আইডিয়া এল না? তুই ঠিক তোর চাচার মত হয়েছিস। যাকগে, লাঞ্চ নিতে ভুলিস না। আর স্কুলের কোন মেয়েকে তোর স্টান্টবাজি দেখাতে যাস না যেন।
চাচী আমার হাতে একটা বাদামি ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে, ঠেলে দিল। পিছনের দরজার দিকে।
অনেক বলে-কয়েও বাহুর দিকে চাচীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলাম না।
এখন স্কুলের সময়। সন্ধেয় তোর কাজ দেখব। এখন আর কোন অজুহাত নয়, সাফ জানিয়ে দিল চাচী।
আমার পিঠের উপর দরজা লেগে গেল দড়াম করে। চাচাকে বলে দেখা যেতে পারে। আচ্ছা, চামড়ার জিনিসটা যদি আরও ছড়ায়? যদি সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে তখন কী হবে? আমার সারা মুখ গাছের মত হয়ে যাবে না তো?
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাস স্টপে চলে এলাম।
বাসে একাকী বসে রইলাম। বাহু ঢাকা পড়েছে সোয়েটশার্টের তলায়। গোটা বাহু চুলকাচ্ছে, আর পুড়ে যাচ্ছে। বাকল ঘিরে মনে। হচ্ছে লাল পিঁপড়ে কামড়ে বেড়াচ্ছে। বাকলের নীচের অবস্থা আরও খারাপ। হাড় ব্যথা করছে। মাংসপেশী আড়ষ্ট। মুঠো শক্ত করতে কষ্ট হচ্ছে। আঙুলগুলো আঁকড়ে আসছে।
বাসে বসে রয়েছি, এক টুকরো বাঁকা কাঠের ছোট টুকরো বেরিয়ে এল নখের নীচ দিয়ে। বাঁ হাতের উপর ডান হাত চাপিয়ে দিলাম।
মুখ তুলে চাইতেই দেখি, এক ছেলে আমার দিকে চেয়ে। চোখ সরিয়ে নিল ও। মুখের চেহারা ছাই বর্ণ।
শার্টের হাতায় হাত ঢেকে বাসের জানালা দিয়ে বাইরে চাইলাম।
বুকের মধ্যে ধড়াস-ধড়াস করছে হৃৎপিণ্ড। এসব কী ঘটছে। আমার সঙ্গে?
স্কুলে পৌঁছে, সোজা নার্সের অফিসে গিয়ে ঢুকলাম।
কী, কিশোর, তোমার এবারের কস্টিউম কী? মমির অভিশাপ? নাকি পোড়া মুখ? নাকি আরও ভয়ংকর কিছু?
এক পা থেকে অপর পায়ে ভর সরালাম।
আমার শরীর খারাপ করছে।
আমাকে বসতে দিলেন নার্স। আমার তাপমাত্রা নিলেন। জিভ বের করতে বললেন। হার্টবিট কান পেতে শুনলেন। এবার আমার দিকে চাইলেন।
একদম সুস্থ।
বড় করে ঢোক গিলে বাহু বাড়িয়ে দিলাম। তারপর শার্টের হাতা গোটালাম। বাহুতে ছড়িয়ে পড়েছে শক্ত, বাদামি বাকল। শিকড়ের
কিলবিলে কী সব যেন বেরিয়ে এসেছে নখের তলা দিয়ে।
মিসেস গিলক্রিস্ট পিছু হটলেন। আমার বাহুর দিকে দুমুহূর্ত চেয়ে থেকে দরজার কাছে হেঁটে গেলেন।
ক্লাসে যাও। এসব স্টান্ট দেখিয়ে ছুটি পাবে না।
কিন্তু…
আর কোনও কথা নয়। তুমি কি চাও তোমার বাসায় ফোন করে কমপ্লেন করি?
অগত্যা হাতা টেনে বেরিয়ে এলাম।
ক্লাসে সবার শেষে ঢুকলাম আমি। চুপচাপ ডেস্কে গিয়ে বসলাম।
রবিন ঝুঁকে পড়ল ওর ডেস্ক থেকে।
বাসের কয়েকটা ছেলের কাছে তোমার কস্টিউমের কথা শুনলাম। কই, দেখি?
মিসেস হকিন্স আমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেন। চুপ করে গেল রবিন। পরে, বলল। ক্লাস শুরু হলো।
মিসেস হকিন্সের কোন কথা আমার কানে ঢুকছে না। বাহুর চুলকানিটা বন্ধ হয়েছে। এবার কাঁধে শুরু হয়েছে। চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে পোকা হাঁটছে চামড়ার উপর দিয়ে। ডেস্কের নীচে বা হাত রাখলাম। সোয়েটশার্টের হাতা দিয়ে ঢেকে রেখেছি। দেখতে চাই না আমি।
লাঞ্চ বেল বাজলে মুসা আর রবিন উঠে এল আমার কাছে।
কই, দেখি? বলল রবিন। তুমি করেছ নাকি রাশেদ চাচা করে দিয়েছেন?
উঠে দাঁড়িয়ে শার্টের হাতা গোটালাম।
ঠাট্টা নয়, সত্যি।
তাই বুঝি? দেখাও না। বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা। লাঞ্চ বেঞ্চির উদ্দেশে এগোলাম।
বেঞ্চে বসে বন্ধুদের দিকে চেয়ে রইলাম। ব্যাগ থেকে আপেল বের করে কামড় দিল মুসা। ওরা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবে আমার কৃথা। করলে পাশে কাউকে পাব আমি।
চারধারে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে শার্টের হাতা টেনে উঠালাম।
রবিনের চোখ ছানাবড়া। মুখ হাঁ।
খাইছে! বলে উঠল মুসা। আপেল নামিয়ে রাখল। ধরে দেখি?
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলাম।
আঙুল দিয়ে আমার বাহুতে মৃদু খোঁচা দিল ও।
হঠাৎই কান্না পেয়ে গেল। ওর স্পর্শ অনুভব করিনি আমি। ভারী ঠেকছে বাহু, ওটা যেন আর আমার নয়।
এটাই তোমার সেরা কস্টিউম…
মুসা, এটা কিন্তু সত্যিসত্যিই হয়েছে! চোখ কটমট করে চেঁচিয়ে উঠলাম।
হাত সরিয়ে পিছনে সরে গেল ও।
খেপছ কেন? তুমি এটা দেখিয়ে সবাইকে বোকা বানাতে চাও, আমি তোমাকে সাহায্য করব।
বোকা কোথাকার, বললাম তো এটা স্টান্ট নয়-সত্যি। তুমি তো হাত দিয়েই দেখলে। কাঠের মত। আমার সারা শরীর গাছ হয়ে যাচ্ছে। কাল রাতের ঘটনা ওদেরকে খুলে বললাম। কাঠ আনতে গিয়ে কীভাবে কামড় খাই। বাহুর দিকে তাকালাম। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল।
আমি একটু ছুঁয়ে দেখি, বলল রবিন। পরমুহূর্তে শিউরে উঠল।
আমার মনে হয় গুঁড়িটা আমাকে কামড়ে দিয়েছে, বললাম।
দুর্দান্ত হয়েছে এবারের কস্টিউমটা, বলল রবিন।
তোমরা কেন বিশ্বাস করছ না? মরিয়ার মত বলে উঠলাম।
রবিনকে হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলাম। কিচকিচ করে উঠল বাহু, কনুই ভাঁজ করতে পারছি না।
মুসা আর রবিন অন্যান্য ছেলে-মেয়েদেরকে আমার কস্টিউমের। কথা বলতে গেল। একটু পরে দেখতে পেলাম আমাকে দেখিয়ে ওরা কী সব বলাবলি করছে।
খিদে নেই, বড্ড তেষ্টা পেয়েছে। আরেকটা টেবিলে গিয়ে বসলাম। খানিক বাদে উঠে দাঁড়ালাম। খেলার মাঠের এক কিনারে গিয়ে বসে পড়লাম।
ওদিকে, টেবিলে বসে ছেলে-মেয়েরা আলোচনা করছে। হ্যালোউইনে তারা কী পরবে। বানোয়াট সব পোশাক। ধুলোয় আঙুল চালালাম। মিথ্যে সব কিছু এমুহূর্তে অসহ্য লাগছে আমার। ঘৃণা হচ্ছে হ্যালোউইনকে। এ ঘটনা বছরের অন্য কোন সময় ঘটলে এখন আমি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতাম। কিন্তু এখন হ্যালোউইনের আগে কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না।
এক মুঠো ধুলোমাটি ছেড়ে দিলাম আঙুলের ফাঁক দিয়ে। কালো মাটির দলা পড়ল মাঠে। এক দলা মাটি আটকে গেল আমার দু আঙুলের ফাঁকে। মুখে আঙুল পুরে মাটি চাটলাম।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক মুঠো মাটি চালান হয়ে গেছে, আমার মুখের ভিতরে। ঝুঁকে পড়ে থু-থু করে ফেলে দিলাম। মুখ মুছে নিলাম। তবে তাতে কোন লাভ হলো না। মাটির স্বাদ ভাল লেগেছে আমার।
যে দ্রুত গতিতে রূপান্তর ঘটছে আমার, হ্যালোউইনের পর পর্যন্ত অপেক্ষা করলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।
৪
স্কুল কেমন হলো? কাগজ থেকে চোখ তুলে প্রশ্ন করল রাশেদ চাচা। কিচেনে ঢুকেছি আমি।
চাচাকে বাহু দেখাতে ইচ্ছে করছে না। যদি বিশ্বাস না করে? কিন্তু করতে হবে। স্টান্ট দেখিয়ে চাচাকে ধোকা দেওয়া সম্ভব নয়। চাচা নিশ্চয়ই বুঝবে আমারটা আসল।
সোয়েটশার্টের হাতা তুলে বাহু বের করলাম।
চাচা, দেখো।
চাচা এক ঝলক চাইল বাহুর দিকে, তারপর মৃদু হেসে শিস দিয়ে উঠল। কাগজটা নামিয়ে রেখে আমাকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকল।
কী এটা?
আমার বাহুটাকে এমুহূর্তে কাঠের গুঁড়ির মতন দেখাচ্ছে। বাকলটা আরও শক্ত হয়েছে। আঙুলের তলা দিয়ে বেরনো শিকড়গুলো আরও জড়িয়ে-পেঁচিয়ে গেছে। এখন আর টান দিয়ে বাকল তোলা সম্ভব হচ্ছে না, শুধু কিনারাগুলো ছাড়া। বাকল ছড়িয়ে পড়েছে ঘাড় থেকে পিঠ অবধি। চিড়চিড় করে জ্বলছে। পিঠ চুলকোতে গেলে বাহুতে ব্যথা লাগছে।
আঙুলের গাঁট দিয়ে আমার বাঁ বাহুতে টোকা দিল চাচা। ঐ কুঁচকে গেছে।
ব্যাপারটা সিরিয়াস।
মাথা ঝাঁকালাম। চোখভরে পানি আসছে। কাঁদতে চাই না। চাই চাচা একটা কিছু করুক।
গুঁড়িটা আমাকে কামড়ে দিয়েছে, চাচা। আমাকে বদলে দিচ্ছে।
আমার দিকে ভ্রূ তুলে চাইল চাচা।
আধা মানুষ আধা গাছ, এভাবেই রাখবি? নাকি পুরোটাই করবি?
চাচা! এটা সত্যিকারের কাঠ। বাহু তুলে ধরলাম। আঙুলগুলো নাড়তে গেলে শব্দ করে উঠল। একটা আঙুলও ঠিকমত নড়ল না।
নিশ্চয়ই। আইডিয়াটা ভাল। সত্যিকারের কাঠ লাগিয়ে একেবারে তাক লাগিয়ে দিয়েছিস। সারাদিন ধরে আঠা দিয়ে এক টুকরো এক টুকরো করে লাগিয়েছিস, তাই না? কোন্ আঠা ব্যবহার করছিস তুই? আমার ঘাড়ের কাছের বাকল খুঁটল চাচা। তারপর নাক কুঁচকে সরে গেল। এহ, পচা গন্ধ। তোর চাচী খুব খেপাবে।
অতি কষ্টে নিজেকে সামলালাম। চাচাকে বিশ্বাস করাতে হবে আমার কথা।
এটা আঠা নয়, চাচা, রস। জিনিসটা আমাকে গাছ করে দিচ্ছে!
আমার কাঁধে হাত রাখল চাচা। তার দিকে চাইলাম। মাথা। ঝকাল চাচা, মুখের চেহারা গম্ভীর।
আমি কাউকে বলব না এটা বানোয়াট। আমি তোর কাজ দেখে গর্ব বোধ করছি।
চাচা, আমার ডাক্তার দেখানো দরকার! উদ্গত অঞ চেপে বললাম।
তা হলে তো গাছের ডাক্তার ডাকতে হয়। বলে আমার উদ্দেশে। চোখ টিপে আবার কাগজ নিয়ে বসল চাচা।
পা টেনে টেনে নিজের ঘরে চলে এলাম। দরজা লাগিয়ে দিলাম। সজোরে। বিছানায় গা ছেড়ে দিয়ে পড়ে রইলাম। বালিশে মুখ গুঁজে রেখেছি। চাচা সত্যি আমার কথা বিশ্বাস করেনি। কেউই করেনি। সবার ধারণা, হ্যালোউইনের জন্য দুর্দান্ত এক কস্টিউম নিয়েছি আমি। অথচ অপুর্ব(!) এই কস্টিউম ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে আমার দেহ।
কী করব এখন? পিঠ চুলকোচ্ছে, গায়ের থেকে যেন খসে পড়বে চামড়া।
শুয়ে থেকে বাহুর দিকে চাইলাম। নিজের বাহু বলে মনে হলো। না। কেটে ফেলতে ইচ্ছা করছে এটাকে। এটা আমার শরীরের অংশ নয়। আমার মাংসপেশী আটকা পড়েছে গাছের বাকলের নীচে। নড়াচড়া করতে পারছে না।
ফাঁদে পড়ে গেছি আমি!
জিনিসটা বুকের কাছে চলে এলে কী হবে? আমার শ্বাস-প্রশ্বাস কি থেমে যাবে? হৃৎপিণ্ডের কী অবস্থা হবে? মুখের ভিতরে পৌঁছে। গেলে কি আর কথা বলতে পারব? খিদে পেয়েছে আমার। কিন্তু এ খিদে অন্য খিদে।
মাটি খেতে সাধ হচ্ছে! জিভে জল আসছে মাটি খাওয়ার কথা ভাবলে। কিন্তু সেটা সম্ভব না! বালিশ এতটাই জোরে চেপে ধরলাম, ফ্যাকাসে হয়ে গেল আঙুলের গাঁট।
উহ্, এখানে এত গরম কেন? মনে হচ্ছে গরমকাল এখনও ফুরোয়নি।
উঠে গিয়ে বাথরূমের কল ছাড়লাম। ঝুঁকে পড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলাম পানিতে। পানি গিলছি। পেট ফুলে ওঠা না পর্যন্ত একটানা পান করলাম। মাটি খাওয়ার চাইতে এ-ও বরং ভাল।
এবার সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে চাইলাম।
ঘাড় থেকে মুখের দিকে চলে এসেছে বাকল।
ঘাড়ের কাছ থেকে সোয়েটশার্ট সরিয়ে দিলাম। এখানটায় এত গরম লাগছে কেন? আহা, নকুল ক্ষতের মত যদি এটাকে টেনে তুলে ফেলতে পারতাম! কিংবা যদি কেটে ফেলা যেত। কিন্তু কাজটা করতে সাহস হলো না। যদি দেখা যায় বাকলের নীচে শুধু হলদে দুর্গন্ধময় আঠা? কেটে ফেললে আবারও যদি গজায়? কিংবা গজাল না, কিন্তু হলদে তরল চুঁইয়ে চুঁইয়ে বেরোতেই থাকল, তখন?
এবার মাথায় অন্য একটা বুদ্ধি এল।
এটার হাত থেকে বাঁচার হয়তো আরেকটা উপায় আছে। পিছনের উঠনে এখনও পড়ে রয়েছে গুঁড়িগুলো।
সন্তর্পণে বাইরে বেরিয়ে এসে গ্যারেজে ঢুকলাম। আমার হাতে চাচার কুঠার। এবার পা বাড়ালাম কাঠের গাদার উদ্দেশে। গুঁড়িগুলো আমার দুরবস্থার জন্য দায়ী। ওরা মৃত নয়। কিন্তু আমি যদি ওদেরকে মেরে ফেলতে পারি তা হলে হয়তো ওরা থামবে।
সূর্য ডুবে গেলেও আলো রয়েছে যথেষ্ট। ভারী, ভেজা কুয়াশা নেমে আসছে আকাশ থেকে। চারধারে চোখ বুলিয়ে, আগাছা ভেদ করে এগোলাম। ষষ্ঠেন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে কেউ আমার অলক্ষে লক্ষ করছে আমাকে। আমি জানি কী সেটা।
কাঠের স্তূপের কাছে পৌঁছলাম। গুঁড়িগুলোকে মানুষের মুখের চেহারার মতন লাগছে। একটা গুঁড়িতে লাথি মারতেই গড়িয়ে গেল। আমি ওদের মুখ দেখতে চাই না।
এসব বন্ধ করো! চেঁচিয়ে উঠলাম। ভীত। ঠোঁট ভিজিয়ে নিলাম। দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছি কুঠারটা। এবার এক কাঁধের উপর তুলে সজোরে নামিয়ে আনলাম। কোন্ গুঁড়িটায় আঘাত হানলাম জানতে চাই না আমি। শুধু চাই ওদের মৃত্যু। মুক্তি চাই ওদের হাত থেকে চিরদিনের জন্য।
কুঠারটা গেঁথে গেল কাঠে, দেবে গেল বাকলের ভিতরে।
পরমুহূর্তে, অসহ্য যন্ত্রণা করে উঠল আমার বাঁ বাহুটায়।
৫
বহু চেপে ধরলাম। কুঠার ফেলে দিয়ে পড়ে গেলাম হাঁটুর উপরে। তীব্র ব্যথা। মিনিটখানেক মাটিতে পড়ে রইলাম নিথর। তারপর কোনমতে উঠে দাঁড়াতে পারলাম। পিছনের দরজার কাছে গিয়ে বাড়ির গায়ে হেলান দিলাম।
হলদে রস বেরিয়ে আসছে বাহুর এক দাগ থেকে। সদ্য জন্মানো দাগটা দেখে মনে হচ্ছে কুঠারের কাটা বুঝি। হাত চাপা দিয়ে ব্যথা কমাতে চেষ্টা করলাম। বাহু থেকে পিঠ অবধি ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র যন্ত্রণা।
মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছি, হেলান দিলাম পিছনে। চাচী যদি আজকে আগুন জ্বালতে চাইত তা হলে কী হত? গুঁড়ি পোড়াতে যদি চাইত? অসুস্থ বোধ করলাম। কাঠ পোড়ালে হয়তো আমার গায়েও আগুন ধরে যেত।
আজ রাতে আগুন জ্বালতে দেওয়া যাবে না। আমার সঙ্গে যা ঘটল তার পর তো প্রশ্নই ওঠে না।
ভিতরে গেলাম আমি।
চাচা-চাচী লিভিংরূমে। তাদের নিচু গলার কথা-বার্তার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। কাছিয়ে গেলাম যাতে শুনতে পারি।
কিশোর বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছে না তো? চাচীর কণ্ঠ ক্লান্ত আর উদ্বিগ্ন শোনাল।
উঁকি মেরে দেখি সোফায় বসে চাচী। তার পাশে চাচা।
মজা করছে করতে দাও। আমিও প্রথম প্রথম করেছি। শীঘ্রি থেমে যাবে, চাচা জবাবে বলল।
চাচার বাহুতে হাত রাখল চাচী।
তোমাদের দুজনের মধ্যে কার স্টান্ট যে বেশি ভয়ঙ্কর বুঝি না, বাবা!
মৃদু হাসল চাচা।
কে জানে, এই গুণ কাজে লাগিয়ে ও একদিন হয়তো অনেক বড় হবে।
চাচীর মুখেও স্মিত হাসি ফুটল।
হ্যালোউইন পর্যন্ত কিছু বলব না আমি। তারপর কিন্তু এসব বন্ধ করতে হবে। এই প্রথম ওর কস্টিউম দেখে ভয় পেয়েছি আমি। আমি এসব আর দেখতে চাই না।
চাচী আর চাচার গলা খাদে নেমে গেল। সরে এলাম আমি। অন্ধকার হল-এ এসে বাহুর দিকে চাইলাম। আমিও এসব আর দেখতে চাই না। কিন্তু কীভাবে মুক্তি পাব এটার হাত থেকে? হাসপাতালেও কি এর চিকিৎসা আছে? মনে তো হয় না।
বাকল এখন আমার বুকে ছড়িয়েছে। চামড়া বেয়ে গুঁড়ি মেরে পায়ের দিকে চলেছে। আর কদিন সময় আছে আমার হাতে? একদিন? হয়তো। কিন্তু হ্যালোউইনের পরে কতখানি বাকি থাকবে আমার? আসল আমার কথা ভাবছি।
কিছু একটা করতে হবে, এবং দ্রুত। কাঠগুলো কোত্থেকে এসেছে জানতে পারলে হয়তো কোন সমাধান পেতে পারি। জঙ্গল। সম্পর্কে জানে এমন কেউ হয়তো আমাকে সাহায্য করতে পারবে।
হল ধরে এগিয়ে চাচার স্টাডিতে ঢুকলাম।
স্টিলের বাক্সে মেকাপের সরঞ্জাম রাখে চাচা। সার বেঁধে ওগুলো রাখা হয়েছে তার ডেস্কের পাশে। একগাদা কাগজ ছেয়ে রেখেছে। ডেস্ক, ফোন আর অন্যান্য সব কিছু।
ডেস্কের উপর ঝুঁকে পড়ে কাগজগুলোয় চোখ বুলালাম। বেশির ভাগই বিলের মতন দেখাল। কয়েকটা হলদে পোস্ট-ইট নোটে হিজিবিজি করে লেখা: মো লন। শেষমেশ খুঁজে পেলাম।
গোলাপি এক স্লিপে লেবেল সাঁটা: শেরিংহ্যাম নার্সারি, কাঠের অর্ডার দেয়া হয়েছিল এখানে। বিলটা ভাঁজ করে পকেটে রাখলাম। কাল স্কুলের পর ওখানে গিয়ে খোঁজ-খবর নেব।
ডিনারে, চাচা-চাচী এমন সহজ আচরণ করল, আমার বাহু নিয়ে যেন কোন সমস্যা নেই। ডিনারের পর সিঙ্কে প্লেট নিয়ে গেলাম। চাচী আমার চুল এলোমেলো করে দিল।
আজ রাতে আগুন জ্বাললে কেমন হয়? কয়েকটা মার্শম্যালো, কিছু চকোলেট আর গ্রাহাম ক্র্যাকার রয়ে গেছে, বলল।
চাচী, ভয়ানক গরম লাগছে।
আমার দিকে চাইল চাচী।
কোথায় গরম?
তুমি আগুন জ্বাললে আমি পুড়ে যাব। ঠাট্টার ভঙ্গিতে বলতে চেষ্টা করলেও গলা ধরে এল। কথাটা তো আক্ষরিক অর্থেই সত্যি।
চাচী চাচার দিকে এক ঝলক চাইল।
ঠিক আছে…
আজ রাতে না, বলে উঠলাম আমি। হাসার চেষ্টা করলাম।
আগুন জ্বাললে আমার আঠা গলে যাবে।
এবার হাসি ফুটল চাচীর মুখে।
বুঝেছি। ঠিক আছে, আমরা না হয় আরও দুএকদিন আগুন জ্বালব না।
খানিক পরে নিজের ঘরে চলে এলাম।
বাহুতে আর কোন অনুভূতি নেই। ঘাড় আর মুখে চুলকানি, জ্বালা-পোড়া। কালকে আমাকে কেমন দেখাবে তা নিয়ে ভাবতে চাই না। শুধু কামনা করছি নার্সারিতে পৌঁছবার আগে পর্যাপ্ত সময় পাব।
ঘুম ভাঙতে, মুখে হাত বুলিয়ে ছুটে গেলাম।
বা চোখ ঢাকা পড়েছে বাকলের নীচে। পাজামা টপ খুললাম। বুকেও ছড়িয়েছে জিনিসটা। বাঁ পা-টা কেঠো, আড়ষ্ট ঠেকছে। বাঁ হাতের দিকে চাইলাম।
আঙুলগুলো লম্বা হয়ে গেছে। ডাল-পালার মত বাঁকা। এমনকী বাঁকাতেও পারছি না। ডান বাহুতে এমন জ্বলুনি শুরু হয়েছে। হাতে সময় বেশি নেই।
কাপড় পরতে অনেক সময় লেগে গেল। ঢোলা জিন্স পরতে হলো। শার্টের হাতায় বাঁ হাত ঢোকাতেই কাঁচ-কোচ শব্দ হলো। তুলে ধরে রাখতে ভাল লাগল।
এবার দেখতে পেলাম উঁচিয়ে রাখলে গাছের ডালের মত দেখায়। ডান হাতে বাঁ হাতের কব্জি চেপে ধরে বাহুটাকে নীচে নামিয়ে আনলাম। নামতে চাইছিল না, টেনে নামাতে হয়েছে। সামনে কঠিন সময়।
পা টেনে টেনে কিচেনের পাশে এলাম।
চাচী আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই তার মুখের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। রেযর ব্লেডের স্টান্টের সময় তার কাছ থেকে এই বিস্ময় আশা করেছিলাম আমি। এখন নয়, কেননা এবারেরটা তো সত্যি।
কিছু বললাম না। বলার চেষ্টাও করলাম না। মুখের ভিতরটায় চুলকানি আর জ্বালা-পোড়া শুরু হয়েছে। মুখের ভিতরে পিঁপড়ে যেন পিলপিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এবারের ফার্স্ট ইযটা তুই-ই পাবি, বলল চাচা। কিচেনে এসে ঢুকেছে। যদি বলিস তো তোকে আজকে নিয়ে আসতে পারি।
মাথা নাড়লাম। একটা পরিকল্পনা এসেছে মাথায়।
রবিনের বাসায় যাব স্কুলের পরে, বললাম। কণ্ঠস্বরটা নিচু আর ভারী শোনাল। গলায় একটা হাত রাখলাম। মুখের ভিতরটা শুকনো ঠেকছে। মুখের অর্ধেকটা ঢেকে দিয়েছে বাকল।
চাচী আমার দিকে চাইল।
কিশোর, এই পোশাকে খেতে পারবি তো?
খিদে নেই। কেমন জানি জড়িয়ে গেল কথাগুলো।
কমলার রসে ঐ রাখল চাচী।
তা হলে অন্তত এটা খেয়ে যা।
তেষ্টা পেয়েছিল। পান করলাম। বিস্বাদ লাগল। বাইরে তাকাব না পণ করেছি। মাটির টান অনুভব করছি দস্তুর মত-গতকাল কী ভালই না লেগেছিল মাটির স্বাদ।
গাড়ি করে স্কুলে যাওয়ার পথে চাচা কয়েকবার জিজ্ঞেস করল কীভাবে পোশাকটা বানিয়েছি। জড়ানো, অস্পষ্ট স্বরে উত্তর দেওয়ার। পর চাচা বলল, এ নিয়ে পরে কথা বলবে।
সে সময় পেলে হয়, বললাম মনে মনে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করেছে।
বাইরে কুয়াশা, আঁধার-স্যাঁতসেঁতে ভাব। চাচার পরনে মোটা সোয়েটার। অথচ সাধারণ শার্ট আর জিন্সেই ঘেমে নেয়ে যাচ্ছি। আমি।
গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম।
এই পোশাকে ঠিকমত নড়াচড়া করতে পারবি তো? চাচার প্রশ্ন।
ঝুঁকে পড়ে জানালার কাঁচ ভেদ করে চাইলাম। হাসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মুখের বা পাশটা নড়ল না। অস্পষ্ট জবাব দিয়ে চাচার দিকে চেয়ে রইলাম। অদ্ভুত এক ভুতুড়ে অনুভূতি-এবারই হয়তো শেষ দেখা-তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে বাধ্য করল। এবার মাথা ঝাঁকিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা।
স্কুলে গোটা দুই ভ্যাম্পায়ার আমার পাশ দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। দুটো গোলাপি ভূত চেয়ে রইল আমার দিকে, আমি এখন খোঁড়াতে খোঁড়াতে উঠন পেরোচ্ছি। বাঁ পা চুলকাতে শুরু করেছে। দাপাতে ইচ্ছে করছে, এতটাই চুলকাচ্ছে আর জ্বালা-পোড়া করছে। কিন্তু হাটু ভাঁজ করতে পারলাম না।
অ্যাই, কিশোর!
ঘুরে দাঁড়াতে রবিনকে দেখতে পেলাম। বুকের উপর রুপোলী এক ট্র্যাশ ক্যান পরেছে ও। মুখের রং রুপোলী। হাতে কুঠার। ধারাল ফলা দেখে সরে দাঁড়ালাম একপাশে।
আমি টিনের কাঠুরে! কুঠার দুলিয়ে বলে উঠল ও। লক্ষ করলাম কুঠারটা রবারের। স্বস্তির শ্বাস ছাড়লাম। দাঁত বের করে হাসল রবিন। আজকে রাতে সবাইকে ভড়কে দেব!
আরও কয়েকটা ছেলে-মেয়ে ঘিরে ধরল আমাকে। ওদের একজন হাত বাড়িয়ে আমার বাহু স্পর্শ করল।
আমি কাউকে ভয় দেখাতে চাই না, আওড়ালাম। অবাক চোখে। সবাই চেয়ে রইল আমার দিকে। রবিন হাসল আবারও।
তুমি তো এর মধ্যেই সবাইকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ, বলল।
মেজাজটা সহসাই বিগড়ে গেল। এরা মনে করছে আমি হ্যালোউইনের পোশাক পরেছি। এদেরকে এমন ভয় দেখাব যাতে চিরদিন মনে থাকে। ওদেরকে ভয় দেখিয়ে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ব। ওদের বুঝিয়ে দেব এমন ঘটনা ওদের জীবনেও ঘটতে পারে।
মুখের কাছে হাত এনে নাকের বাকল টেনে তুললাম। দুটো মেয়ে আর্তনাদ ছাড়ল। আরও দুজন ছেলে পিছু হটল। মুখে হাত ঘষে মাখিয়ে নিলাম হলদে রস। এবার হাতটা বাড়িয়ে দিলাম ওদের উদ্দেশে।
তোমাদেরকে আমার মত করে দেব! চেঁচিয়ে উঠলাম।
মেয়ে দুটো ঘুরেই দিল দৌড়। বেল বাজলে সবাই ক্লাসের উদ্দেশে ছুটল। আমি বাহুটা নামিয়ে ফেললাম।
দুর্দান্ত! বলে রবিন ঠং-ঠুং শব্দ তুলে হেঁটে এল আমার কাছে।
তোমারটাই সেরা। সবাই যা ভয় পাবে না! আমার দিকে চেয়ে। চওড়া হাসল। একবার শুধু চামড়া তুললেই হলো।
ডান কাঁধ ঝুলে পড়ল আমার।
এসব দেখাব কখন? আমার আরও কাজ আছে।
ভ্রূ কুঁচকে চাইল নথি।
বলো কী? নতুনদেরকে ভয় দেখাতে হবে না?
আচ্ছা, মুসা কোথায়? শ্রাগ করে জিজ্ঞেস করলাম।
দেখছি না তো। হয়তোঁ আছে কোথাও, জানাল রবিন।
ক্লাসের দিকে পা বাড়ালাম আমরা।
স্কুল আগে আগে ছুটি দিলেও আমার মনে হচ্ছিল সময় যেন আজ আর ফুরোচ্ছেই না। সেরা কস্টিউম আমারটাই হলো। মিসেস হকিন্স আমার ডান হাতে রিবন বেঁধে দেওয়ার সময় অদ্ভুত চোখে চাইলেন। স্কুল থেকে বেরিয়েই রিবনটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।
রবিনের মাকে অনুরোধ করলাম আমাকে নার্সারিতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। ওঁকে বললাম চাচার সঙ্গে ওখানে দেখা হবে আমার। রবিন আমার উপর অভিমান করে রয়েছে। কথা বলল না। গাড়ি থেকে নেমে ওদেরকে চলে যেতে দেখলাম।
কাউন্টারের পিছনে বসা মহিলা আমার দিকে চেয়ে হাসল। প্রশংসা করল আমার কস্টিউমের। অতিকষ্টে জিজ্ঞেস করতে পারলাম কে বেচেছিল কাঠগুলো। মহিলা এমনভাবে হাসল যেন কৌতুক করেছি আমি।
রীড তোমাকে হেল্প করতে পারবে। ও পিছনে আছে।
পিছনে চলে এলাম। মাটিতে গাঁথা গাছগুলোকে দেখে জিভে জল এল আমার।
সোনালীচুলো এক যুবক কাঠ গাদা করছিল। কাঠগুলোর দিকে চাউনি বুলালাম। কোন চোখ-মুখ নেই, কাজেই কাছিয়ে গেলাম।
রীড? ডাকলাম। শব্দটা আড়ষ্ট শোনাল।
কাজ থামিয়ে আমার দিকে ঘুরে তাকাল লোকটা। একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে, আপাদমস্তক জরিপ করে নিল। এবার এক পা এগিয়ে এল।
চমৎকার কস্টিউম পরেছ।
ত্যাগ করলাম।
ধন্যবাদ।
একটা দস্তানা খুলে আমার মুখে হাত বুলাল ও। কোন অনুভূতি হলো না আমার।
দারুণ। আসল বাকল। গাছ থেকে খুলতে নিশ্চয়ই কয়েক ঘণ্টা সময় লেগেছে। গাছটাকে মেরে ফেলনি তো?
না, জানালাম।
স্কুলে লেখা নোটটা বের করে ওর হাতে দিলাম। চাচার স্টাডি। থেকে জোগাড় করা বিলটাও দিলাম।
নোট আর বিলটা এক পলক দেখে নিয়ে আমার দিকে চাইল ও।
এমন অদ্ভুত কথা আমি আগে কখনও শুনিনি। এই কাঠগুলোর জন্যে এত চিন্তা করছ কেন?
নোটটার দিকে আঙুল তাক করলাম।
আরও খানিকদূর পড়ে মাথা নাড়ল ও।
ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট? রিপোর্ট করবে? মাথা ঝাঁকাল, ও। আমরা আমাদের সময় বুক রিপোর্ট করতাম। তুমি জানতে চাইছ তোমাদের কেনা কাঠ কোথা থেকে এসেছে? এবং এর মধ্যে স্পেশাল কোন ব্যাপার আছে কিনা। বিলটা দেখে নিয়ে মাথায় হাত বুলাল ও। গত সপ্তাহে কাটা হয়েছে। নিশ্চয়ই বুড়ো অ্যাশ হবে।
আমার বাহুর দিকে চাইল আবারও।
বুঝেছি। অ্যাশের বাকল কোত্থেকে পেয়েছ বুঝতে পারছি। ওই গুঁড়িগুলো থেকে। গাছও ছিল বটে একখান। আশি ফুট লম্বা। ওরেগন অ্যাশ। ল্যাটিফোলিয়া বলা হয়। শীতে গান ঋরে। গাছটা কাটার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু কী করব-আধমর ছিল, পরের ঝড়টা এলেই পড়ে যেত।
কথা বলেই চলল ও, বেশির ভাগই আমার জন্য অপ্রয়োজনীয়। শেষমেশ জিজ্ঞেস করতে পারলাম, কোথায়?
কথাটা জড়িয়ে গেল। আমার দিকে চেয়ে রইল ও।
ও, আচ্ছা, জিজ্ঞেস করছ ওটা কোথায়? তুমি হয়তো চেনো জায়গাটাকে। মাথায় হাত বুলাল আবারও। পার্ক স্ট্রীটের পুরানো কবরগুলোয় যে অ্যাশ গাছগুলো আছে ওটা তারই একটা।
৬
গোরস্থানে যখন পৌঁছলাম, সূর্যটা তখন অগ্নিগোলার মত ফেটে পড়তে চাইছে। আকাশের বাদবাকি অংশ ঢাকা পড়েছে ছায়ার আড়ালে। লনেও বিস্তৃত হয়েছে ছায়া-শুকনো বাদামী পাতার অনেকখানি অবধি গ্রাস করেছে।
রীড আমাকে আর কিছু বলেনি। গাছ-পালা নিয়ে অনেক কথা বলেছে। আমার প্রশ্নগুলোয় চোখ বুলিয়েছে। কারও চামড়া বাকলের মত হয়ে গিয়েছে কিনা-প্রশ্নটা পড়ে হেসেছে।
পার্ক স্ট্রীট শহরের পুরানো এলাকায় পড়েছে। কবরস্থানের অন্ধ গলি ওটা।
এ শহরের অন্যপ্রান্তে নতুন এক কবরস্থান বানানো হয়েছে। সেটা পার্ক স্ট্রীটের মত ভুতুড়ে না। পার্ক স্ট্রীটটা গা ছমছমে বলেই আমরা সব সময় এখানে আমাদের হ্যালোউইন শেষ করি।
ভূতের গল্প বলি আমরা। ক্লাসের নতুন ছেলে কিংবা মেয়েটিকে কবরগুলোর মাঝখান দিয়ে দৌড়তে বলি।
রবিন আর মুসা আজকে এখানে আসবে কিনা কে জানে।
এক কিনারে এক সার গাছ। লোহার বেড়া দিয়ে ঘেরা বাদবাকি অংশ।
কবরগুলোর দিকে চাইলাম। মার্কারগুলোকে পাত্তা দিলাম না। কিন্তু অস্তরাগের, পটভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা, প্রাচীন গাছগুলোকে পছন্দ হলো না আমার।
মরচে ধরা লোহার গেট দিয়ে ঢুকে, গাছ-গাছালির উদ্দেশে পা চালালাম। দানবের মত দাঁড়িয়ে ওরা। আশি ফুট লম্বা, নার্সারির লোকটা বলেছিল। আশপাশের বাড়ি-ঘরের চাইতেও লম্বা। কবে থেকে ওগুলো এখানে আছে কে জানে।
পা ব্যথা করছে। জুতো খুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে, তবে অতটা ঝুঁকতে পারব কিনা জানি না। এসময় শব্দটা কানে এল। ১. চোখ নামিয়ে চাইলাম। শেষ বিকেলের আলোয় পায়ের কাছে। কিলবিলিয়ে উঠল গাছের শিকড়। এবার ঘুরে গিয়ে ঢুকে পড়ল মাটির গভীরে। ঝটকা মেরে পা সরালাম। লাফিয়ে সরে আসতেই এক গোছা ঘাস উঠে এল।
বসে পড়ে, পা তুলে মাটি থেকে শিকড়টা টেনে বের করতে চেষ্টা করলাম। প্রান্তগুলো, তখন কিলবিল করছে। থাবড়া মারলাম। মনে প্রাণে চাইছি এ অবস্থা থেকে যাতে মুক্তি পাই। শেষমেশ আমার স্নিকার্স পেঁচিয়ে ধরল শিকড়গুলো। চিত হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম। ভাল চোখটা বন্ধ করলাম। আমি আগের মত হতে চাই। মনে হলো বুকের উপর চেপে বসেছে জিনিসটা। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কী হবে?
উঠে দাঁড়িয়ে লন ধরে আবারও পা বাড়ালাম। যদূর সম্ভব মেটো পথ ধরে চলেছি। দ্রুত হাঁটছি। পায়ের দিকে চাইছি না, কিন্তু গজিয়ে ওঠা কিলবিলানো শিকড়গুলোকে অনুভব করতে পারছি।
ডান পা আর বাহুতে ছড়িয়ে পড়েছে চুলকানি। বুকের ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে। পেটও। শরীরের বা পাশটা পুরোপুরি অবশ।
আমার সামনে সারিবদ্ধ সৈন্যের মত দাঁড়িয়ে এক সার গাছ।
মাঝখানে ফাঁকা একটু জায়গা। ওখানে, সমতল এক গুঁড়ির অংশবিশেষ।
কাছিয়ে গেলাম। মাটিতে ছায়া ফেলেছে গাছগুলো। বিষণ্ণ পরিবেশ। কুয়াশা উঠছে মাটি থেকে।
পশ্চিমা বাতাস বইছে। থমকে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে চাইলাম। সূর্য ডুবে গেছে। আকাশে চাঁদ নেই। একটা তারাও চোখে পড়ল না। কী করছি এখানে নিজেও জানি না। মনে পড়ছে না। কী করতে এসেছিলাম?
ভুলে গেছি। কী যেন খুঁজতে এসেছিলাম এখানে, তাই না?
গাছগুলো মৃদু মর্মরধ্বনি করছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড় দিতে চাইলাম, কিন্তু শিকড় গেঁথে গেছে মাটিতে। পা তুলতে পারছি না। কান্নার মত ককিয়ে উঠে বাঁ পা চেপে ধরে টান দিলাম।
গাছের রুক্ষ বাকল যেন মোলায়েম হয়ে বদলে গেছে। মুখ উদয় হয়েছে। মানুষের মুখ নয়। প্রাচীন মুখ। ঘৃণায় বিকৃত। পটাপট খুলছে চোখ। মাটিতে পড়ে যাওয়ার জোগাড় হলো আমার। শূন্য কোটর। শুধু নিখাদ অন্ধকার।
মাথার উপরে চাবুক কষল ডাল-পালা। তবে বাতাস থেমে গেছে।
আমার চারপাশে ঘিরে দ্রুত উঠে আসছে কুয়াশা। ভারী, ঘন নিঃশব্দ।
পায়ের দিকে চোখ নামালাম। পা নয়, শিকড়ের দিকে। আতঙ্কে বুকের ভিতরে আর্তচিৎকার তৈরি হলো। আমি এখানে এসেছি মাটিতে শিকড় গাঁথতে, কে যেন মাথার ভিতরে বলল। কণ্ঠস্বরটা নিচু আর ভারী-এবং ভীতিকর।
গুঁড়ি ককিয়ে উঠল। গাছগুলো ঝুঁকে পড়ল আমার উপরে। ওদের নগ্ন ডাল ফিসফিস করছে, নড়ছে, মরা পাতা ঝরছে আমার চারপাশে।
এখানেই থাকো, কণ্ঠস্বরটা বলল আবারও। অন্য কণ্ঠগুলো গলা মেলাল-এখানেই থাকো।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাঁ হাতটা তুললাম। না! প্লিজ, যেতে দাও আমাকে! চিৎকার ছাড়তে চাইলাম। কিন্তু মুখ খোলে কার সাধ্য। শুধু ফুঁপিয়ে উঠলাম, কেঁদে ফেললাম, গাছটা যখন আমাকে গ্রাস করতে শুরু করল। মাথার উপরে উঠে গেল আঙুলগুলো। বেড়ে চলেছে। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠতে চাইলাম। যতক্ষণ না কিছু একটা, ওগুলোকে টানা বন্ধ করল, বাড়তেই লাগল।
আমাদের সঙ্গে থাকো। শেষ শব্দটা ফিসফিস করে আমার চারধারে ঘুরতে লাগল। মাটি থেকে উঠে এসেছে কথাটা। আমার জায়গা এখন এখানে। কুঠারের ঘায়ে কাটা পড়েছে যে গাছটা আমাকে তার জায়গা নিতে হবে। শিউরে উঠলাম। ঝাঁকুনি খেল আমার ডাল-পালা।
আমার পিছনে ঝনঝন করে উঠল কিছু একটা। বহুদূর থেকে এল যেন শব্দটা। ক্রমেই কাছিয়ে আসছে। অন্য কোথাও শুনেছি এই একই শব্দ।
বহু কষ্টে ঘুরে দাঁড়াতে পারলাম। পিঠটা কাঁচ-কোচ করে উঠল। ডান চোখে খুব সামান্যই দেখতে পাচ্ছি। শব্দটা জোরাল হতেই দেখতে পেলাম ওদেরকে। চারটে কিশোর এদিকেই আসছে। একজনের পরনে রুপোলী পেপাশাক। রবিন। মুসাকেও দেখতে পাচ্ছি।
আমার চারপাশ ঘিরে থাকা গাছগুলো নড়ে উঠল। খটখটিয়ে উঠল ডাল-পালা। কুঠার। ওদের চারজনের মধ্যে একজনের হাতে। কুঠার। খেপে উঠেছে গাছগুলো। আমি মাথা নোয়ালাম। ভয় পাচ্ছি ওদের উগ্র মেজাজকে।
একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠল, দৌড়ে গিয়ে গাছগুলোকে ছুঁতে পারবে? আমার কুঠারটা দিয়ে হিট করে আবার দৌড়ে ফিরে আসবে!
গলাটা পরিচিত লাগল। রবিন? রবিন-মুসারা অন্যান্যদের সঙ্গে প্রতিবারের মত এখানে এসেছে। একে অন্যকে ভয় দেখাতে।
মনে পড়ে গেল আমি এখানে শিকড় নামাতে আসিনি। উপায় খুঁজতে এসেছি যাতে ব্যাপারটা এড়াতে পারি। ভয়, জেঁকে বসল বুকে। আমাকে পালাতে হবে। এখুনি সরে না পড়লে আর পারব না। কাঠের ভিতরে বন্দি হয়ে পড়েছি সত্যিকারের আমি।
মাথার উপরে, গাছগুলো আরও দীর্ঘ দেখাচ্ছে। বিনা বাতাসে দোল খাচ্ছে ওরা। ফট করে উঠল একটা ডাল। পিছনে হেলে মুখ। তুলে চাইলাম। আমার পাশের গাছটার একটা ডাল আলগা হয়ে ঝুলছে। পড়ে যাবে যেন যে কোন মুহূর্তে। আলো পড়তেই সরে গেল বাকল, মুখটা দেখতে পেলাম। ওরা ঠিক এভাবেই আটক করেছে আমাকে। নিজেদের একটা করে ডাল ফেলে দিয়েছিল আধ-মরা গাছটার উপর, কাটা হয়েছিল যেটাকে। এবার ওরা রবিন, মুসা আর অন্যদের পিছনে লেগেছে।
না! মাথার মধ্যে শব্দটা তৈরি হলো, কিন্তু আমার তো মুখ নেই যে প্রকাশ করব।
টিনের কাঠুরের পোশাক পরা রবিন আরও কাছিয়ে এল।
ঠিক আছে, আমি করে দেখাচ্ছি তোমাদেরকে।
রীতিমত কসরৎ করে পা দুটো তোলার চেষ্টা করলাম। ওকে সতর্ক করতে হবে। ওদেরকে ভয় দেখিয়ে তাড়াব এখান থেকে। ওরা আহত হওয়ার আগেই। ওরা কামড় খেয়ে আমার মত কাঠের বাকলে মুড়ে যাওয়ার আগেই কাজটা করতে হবে।
অতিকষ্টে ডান পা তুলতে পারলাম, ফলে ঘুরে দাঁড়ানো গেল।
রবিন থমকে দাঁড়াল। মুখটা হাঁ। ওর মুখের চেহারা দেখে বুঝলাম ও টের পায়নি ওটা আমি। সশব্দে ডান হাতটা নীচে নামিয়ে গেটের দিকে ইঙ্গিত করলাম।
চলে যাও! কথাগুলো বলতে চেয়েও পারলাম না। তার বদলে ককিয়ে উঠল আমার ডালগুলো। বুকের গভীর থেকে উঠে এল হাহাকার।
রবিনের মুখের চেহারা ছাই বর্ণ। নকল কুঠারটা ফেলে দিয়ে ঘুরেই দৌড় দিল।
ওর বুকের টিনটা ঠং-ঠং করে উঠল। মুসা আর অন্যান্যরাও আর্তনাদ ছেড়ে ওর পিছু নিল। আমার পিছনে মুখওয়ালা ডালটা ফটাস করে ভেঙে পড়ল। রবিন কুঠারটা যেখানে ফেলে গেছে ঠিক তার উপরে। মুখটা বেঁকে গিয়ে কামড় বসাল কুঠারটায়।
ঘুরে দাঁড়ালাম। দেহ আড়ষ্ট। এতটাই ক্লান্তি বোধ করছি, নড়ার সাধ্য নেই। ওরা জিতে গেছে। আমি মারা যাচ্ছি ভিতরে ভিতরে। একমাত্র চোখটা বুজে ফেললাম।
দুনিয়াটা পাল্টে গেছে। বাতাস, মাটি আর আকাশটা অনুভব করছি আমি। অন্যান্য গাছগুলো ঝুঁকে পড়েছে আমার উপরে। ডালগুলো অশুভ ভঙ্গিতে নিচু হয়ে দোল খাচ্ছে আমার উদ্দেশে।
আমি থাকব এখানে, যদি থাকতেই হয়। আমি এখানে অন্য কারও জায়গা নেব। কিন্তু অন্যদেরকে তোমাদের ছেড়ে দিতে হবে। অন্যদের কোন ক্ষতি তোমরা করতে পারবে না-গাছগুলোকে মনে মনে বললাম।
আমার ছড়ানো আঙুলের ফাঁক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বাতাস। গাছগুলো আমার কথা শুনতে পাচ্ছে কিনা জানি না। কিন্তু আমি ওদের কথা শুনতে পাচ্ছি। ওদের মরা পাতা ফিসফিস করছে আমার সঙ্গে। মাথার ভিতরে ওদের কণ্ঠস্বর-হারানো বন্ধু সম্পর্কে কথা বলছে ওরা।
আমার পায়ের পাতা থেকে মাটির গভীরে দেবে যাচ্ছে শিকড়। বুকের বাকল শক্ত হচ্ছে ক্রমেই। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন থেমে গেছে, সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে হলদে রস।
মাথা কাত করে রস বইতে দিলাম। এবং আমি হয়ে গেলাম ওদের একজন।
ঠাণ্ডা লাগছে।
ধীরে ধীরে, এক চোখ মেলার চেষ্টা করলাম। এবার অপরটা। চারদিকে অন্ধকার। দৃষ্টি চলছে না। কেঁপে উঠলাম। বেশ কয়েক দিন ঠাণ্ডা লাগছে না আমার। সেই সেদিন থেকে…
সহসা উঠে বসলাম।
আঁধারে চেয়ে থেকে, মুখের সামনে হাত রাখলাম। আমার হাত! আঙুল বন্ধ করলাম, তারপর আবারও খুললাম। হাত নামিয়ে পায়ের মাংসপেশী আর হাড় অনুভব করলাম, ছেঁড়া জিন্সের উপর দিয়ে। মরা পাতা আমার পা ছেয়ে রেখেছে। হাত ঝাঁপটিয়ে ঝেড়ে ফেলে দিলাম। দুটো পা। বাকল ছাড়া দুটো পা কাঁপা-কাঁপা হাতে মুখ স্পর্শ করলাম। চামড়া মসৃণ, স্বাভাবিক ত্বক। পায়ের পাতায় হাত বুলোলাম। গাঁটওয়ালা, বাঁকা শিকড় উধাও। একেবারে স্বাভাবিক। মানুষের পা।
ঝরা পাতার বিছানায় শুয়ে চিৎকার ছাড়লাম। হা-হা করে হাসছি। খুশিতে গড়াগড়ি দিলাম।
ওরা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। ওদের মত পরিবর্তন হয়েছে! কিন্তু এর পরপরই অন্য এক চিন্তা ঘাই মারল মাথায়। ওরা কি সত্যি সত্যি ছাড় দিয়েছে আমাকে? নাকি পুরো ব্যাপারটা আবার শুরু হবে? গড়াগড়ি বন্ধ করে হাঁটুর উপর বসলাম। আঁধারে চোখ সইয়ে নিতে চেষ্টা করছি।
আমার সামনে প্রাচীন, মোটা গুঁড়ির সারি। নীরব। অনড়। সটান। উঠে দাঁড়িয়ে ওদের কাছে হেঁটে গেলাম। আঁধারে, কালো আকাশের পটভূমিতে ওরা ডাল-পালা বাগিয়ে ধরল বিশাল ছায়ার মতন। আমাদের পায়ের কাছে ঘুরপাক খাচ্ছে কুয়াশার কুণ্ডলী।
গাছগুলো নড়ে উঠল। পাতা আর ডালের শব্দ পেলাম। বাতাসে নড়ছে। চোখ বুজলাম। কোন কণ্ঠস্বর আমার ভিতরে কথা বলছে না। কিছু অনুভব করলাম, ভারী কমলের মত কিছু একটা মুড়ে ফেলছে আমাকে।
চোখ খুলে, কেটে ফেলা গাছের গুঁড়িটার দিকে চেয়ে রইলাম একদৃষ্টে। এবার অন্যান্য গাছের দিকে চোখ ফিরালাম। কিছুক্ষণের জন্য আমি ছিলাম ওদেরই একজন। কিg এরমধ্যেই স্বপ্নের মত সব ভুলে গেছি! শুধু একটা অনুভূতি রয়ে গেছে আমার সঙ্গে। এমন এক অনুভূতি, তুমি যেন তোমার প্রিয়জনদের সঙ্গে রয়েছ। আমার ধারণা, বন্ধুদেরকে রক্ষা করতে চেয়েছি বলে ওরা ছেড়ে দিয়েছে আমাকে।
এগিয়ে গিয়ে মরা গুঁড়িটায় হাত রাখলাম। এইসব গাছেরা জানে বন্ধুকে কীভাবে রক্ষা করার চেষ্টা করতে হয়। সেজন্যই ওরা রক্ষা করেছে আমাকে নিজেদের প্রতিশোধের হাত থেকে। নতুন বন্ধুদের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরলাম বাড়ির পথে।