অভিযাত্রা

অভিযাত্রা

আজ বুঝি অমাবস্যা। এমন ঘুরঘুট্টি যে, দুহাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। এরি মধ্যে ওরা ছুটছে প্রাণপণ জোরে, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। পায়ের নিচে কাদা-প্যাচপেঁচে মাঠ না রাস্তা কে জানে, উঁচু-নিচু খানা-খোন্দলে ভরা। ওদের খেয়াল নেই যে কোথা দিয়ে ওরা ছুটছে। শুধু ছুটছে। পেছনে এখনো চাইনিজ অটোমেটিক রাইফেলের গুলির শব্দ হচ্ছে। তবে ওরা যে গুলির রেঞ্জের বাইরে চলে এসেছে, সেটা খেয়াল হতে-হতে আরো বোধহয় মাইলখানেক পেরিয়ে তবে থামল। এখন আর পায়ের নিচে কাদা নেই, শুকনো মাঠ। একটু সামনে অন্ধকার ঘন হয়ে আছে, আন্দাজে বুঝল ওখানটায় বাঁশঝাড়। ওরা সবাই প্রথমে ধপাস্ করে বসে পড়ল, জোরে-জোরে নিশ্বাস নেবার সঙ্গেসঙ্গে সবার বুক হাপরের মতো ওঠা-নামা করছে। সবার গা-মাথা-মুখ ভিজে জবজবে। ওরা আস্তেআস্তে মাঠেই গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল।

মাথার ওপর নিকষ কালো আকাশে ছোট-ছোট তারা হাজারবুটির মতো ফুটে ঝিকমিক করছে। একটুক্ষণ পরে সবার নিশ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল, গায়ের ঘাম আধাশুকো। হাজার তারার মিটিমিটে আলো চারপাশের আঁধারকে পাতলা করে তুলেছে। ওরা সবাই উঠে বসল। রকিব চারদিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল, ‘কোথায় এলাম?’ লতিফ বলল, ‘মনে হয় যুগীপাড়া গ্রাম।’

শান্টু বলে উঠল, ‘উরেব্বাসরে। ক্যাম্প ছাড়িয়ে বহুদূর চলে এসেছি।’

মোহন আস্তেআস্তে উঠে দাঁড়াল—’মাইল দেড়েক মাত্র। চল, আস্তে আস্তে হেঁটে চলে যাই।’

সবাই একে-একে উঠে দাঁড়াল। মোহন চারদিকে তাকিয়ে দিক ঠিক করে হাঁটা দেবার আগে চাপাস্বরে বলল, ‘কে কে আছ, নাম বল।’

‘আমি রকিব।’

‘আমি লতিফ।’

‘রমাপদ।

‘শান্টু। ‘আসাদ।’

‘শিবেন।’

আর কোনো কণ্ঠস্বর শোনা গেল না। মোহন বলল, ‘আমি নান্টু। তাহলে আরো ছয়জন নেই। হয়তো অন্যপথ দিয়ে ক্যাম্পে চলে গেছে, বা যাবে।’

মোহন অগ্রসর হল। বাকি ছয়জন নীরবে তাকে অনুসরণ করল।

.

ক্যাম্প মানে রুহিতপুর গ্রামের উপকণ্ঠে বিরাট ঘন বাঁশঝাড়টার গা ঘেঁষে একটা চালাঘরে অস্থায়ী গোপন আস্তানা। অপরদিকে অনেকটা জায়গা ঘিরে সবজি-ক্ষেত—বর্তমানে বিরাণ। গ্রামের সম্পন্ন-অধিবাসী নবী মিয়ার সবজি-ক্ষেত আর বাঁশঝাড় পাহারা দেবার জন্য এই চালাঘরটা তোলা হয়েছিল কতকাল আগে যেন। পাহারাদারও একটা ছিল মাইনে-করা। এখন কেউ নেই। নিজেদের জান পাহারা দিতেই শশব্যস্ত সবাই, ঝাড়-ক্ষেত পাহারা দেবে কে? তাছাড়া সবজিই নেই ক্ষেতে। নবী মিয়া নিজের গ্রাম ছেড়ে শ্বশুরবাড়ির গ্রামে গিয়ে বসে রয়েছে।

চালাঘরের আগলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল মোহন, তার পিছে বাকি ছয়জন। মোহন খুব আস্তে একটা শিস্ দিল, ঘরের ভিতর থেকে অনুরূপ শিসের ধ্বনি শোনা গেল। মোহন দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘নাম বল।’

‘আমি সুলতান।’

‘আমি হাসান।’

‘আবদুল্লা।’

‘মমিন।’

‘রডারিক।’

পাঁচটা নামের শব্দ অন্ধকারে হালকাভাবে ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল। তারপর নীরবতা। মোহন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ‘শুধু আমিন বাকি।’

মোহনের পিছুপিছু সবাই ঘরে ঢুকে খড়-বিছানো মেঝেতে বসে পড়ল। শান্টু বলে উঠল, ‘যা জব্বর খিদে একখানা পেয়েছে। হাশিমুদ্দি আছ নাকি ঘরে?’

মমিন হি-হি করে হেসে বলল, ‘থাকলে তো নামই বলত!’

রমাপদ বলল, ‘হয়তো জল সারতে গেছে কাছে কোথাও। এসে যাবে এক্ষুনি। এই ফাঁকে হাত-মুখ ধুয়ে এলে হত না?’

সবজি ক্ষেতের ওপাশে একটা ছোট ডোবা— সেইখানেই এরা সবাই ধোয়া-পাখলা, গোসল, কাপড়-কাচা—সবই সারে।

মোহন বলল, ‘দুজন করে যাবে। দু-মিনিটের বেশি সময় নেবে না। সাবধানে চারদিকে খেয়াল রেখে বেরোবে।’

শিবেন ঘরের একটা কোণে উঠে গেল। ওইখানে মাটিতে উবু হয়ে বসে দেয়ালের কোণায় মুখ লুকিয়ে দেশলাই জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাল। রাত্রিবেলা চালাঘরের ভেতরে কুপি, মোম বা দেশলাই জ্বালানো নিষেধ। ভাঙাচোরা বেড়ার ফাঁক দিয়ে, জানালার ফোকর দিয়ে আলোর আভাস বোঝা যাবে দূর থেকে। তাহলে বিপদ আসতে পারে। রুহিতপুরে শান্তি কমিটির মেম্বার, রাজাকার ভর্তি। গ্রামের সবাই জানে এটা পোড়ো চালাঘর—কেউ থাকে না এখন।

শিবেন সিগারেট হাতের মুঠোয় আড়াল করে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে টানতে লাগল। রমাপদ, লতিফ আর রকিব ওর দুইপাশে গিয়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে মাটিতে বসে পকেট থেকে সিগারেট বের করে শিবেনের সিগারেটের আগুন থেকে ধরিয়ে নিল। মোহন, শান্টু, আসাদ সিগারেট খায় না। মোহন বলল : শান্টু, আসাদ তোমরা হাতমুখ ধুয়ে এস। কুইক। হাশিমুদ্দির ফিরতে দেরি হলে তোমরা খাবার বেড়ে দেবে সবাইকে।’

শান্টু বলল, ‘হাশিমুদ্দি কোথায় কী রেখেছে, অন্ধকারে খুঁজে পাব কী ক’রে?’

মোহনের গলায় অসহিষ্ণুতা ফুটে উঠল, ‘আমি জানি কোন্ জায়গাটায় খাবার থাকে। পেনসিল-টর্চ আছে না!’

শান্টু, আসাদ নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। মোহন তখনি উঠে মেঝেয়-রাখা একটা ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে পেনসিল-টর্চ বের করে ঘরের একটা বিশেষ জায়গায় দেয়ালের কাছে সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে এল। এইখানে মেঝেয় কয়েকটা ইট পাতা আছে। সেখানে একটা ভাতের ডেকচি, কয়েকটা টিনের থালা, গেলাস, গুঁড়ো দুধের টিন, একটা মাটির কলসি—এসব থাকে। এখানে এসে মোহন মাটির দিকে লক্ষ করে পেনসিল-টর্চের বাতি ফেলল। ভাতের ডেকচিটার ঢাকনা খোলা এবং ভেতরটা শূন্য। অর্থাৎ বিকেলে সূর্যডোবার আগে হাশিমুদ্দি ভাত রেঁধে রাখেনি। কেন? কী ঘটল যে ভাত রাঁধতে পারেনি? মোহনের পেটের ভেতরটা হঠাৎ পাক দিয়ে উঠল, একই সঙ্গে খিদেয় এবং অজানা আশঙ্কায়। হাশিমুদ্দিই বা গেছে কোথায়? তার তো সন্ধের পর থেকে এই ক্যাম্পের ভেতরেই থাকবার কথা। তাকেই আপাতত ওরা এখানকার পাহারাদার বানিয়েছে। গ্রামের সন্দিগ্ধ-চিত্ত কেউ যদি হঠাৎ এদিকে এসে পড়ে, হাশিমুদ্দি যাতে বলতে পারে যে নবী মিযা তাকে পাহারা দেবার জন্য এখানে থাকতে বলেছে। নবী মিয়া তো গ্রামে নেই, কে আর যাচাই করবে।

ডেকচির আশেপাশেও টর্চের আলো পেলে দেখল অন্য কোনো খাবার আছে কিনা। না নেই— না মুড়ি, না চিঁড়ে, না কিছু। একটা টিনে শুধু খানিকটা আখের ঝোলাগুড়। তার মানে, সেই-যে সকালে ভাত খেয়ে বেরিয়েছিল, সেইটের কথা মনে ক’রেই পেট চাপড়ে থাকতে হবে আজ রাতটা। কিছুটা চাল এখনো আছে ঘরে। কিন্তু এত রাত্রে চুলো জ্বেলে রাঁধবার উপায় নেই। রাতের অন্ধকারে দূর থেকে গ্রামের চৌকিদারের চোখে পড়লে বিপদ হবে।

শান্টুরা ফিরে এসে দুঃসংবাদটা নীরবেই গ্রহণ করল। তারপর মোহনের নির্দেশে দুজনে দুটো থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল তুলে নিয়ে জানালা আর দরজার সামনে সেন্ট্রি-ডিউটিতে দাঁড়িয়ে গেল। মোহন বলল, ‘আমিন এখনো ফিরল না। হাশিমুদ্দিরই বা কী হল?’

শিবেন কোণা থেকে উঠে এসে মোহনের সামনে মেঝেতে বসল। বলল, ‘ছুটতে ছুটতে কোন্ দিকে গেছে, হয়তো অন্য কোথাও রাত কাটিয়ে ভোরে এসে হাজির হবে। রাতটা তাহলে হরি-মটর? শুয়ে পড়া যাক। ‘

মোহন বলল, ‘শুয়ে পড়া কি ঠিক হবে? হাশিমুদ্দির উধাও হওয়াটা আমার ভালো ঠেকছে না। সে গ্রামে গিয়ে কোথাও ধরা পড়ল কিনা, তাতো আমরা জানি না। তারপর আমিন। তার কী হল? জখম না-হলে বা মরে না-গেলে তার ক্যাম্পে অবশ্যই ফিরে আসার কথা। সে যদি অমন ছুটতে ছুটতে গ্রামের ভেতরে কোনো রাজাকারের সামনে গিয়ে পড়ে, তাহলে—’

শিবেন ছটফটিয়ে বলে উঠল, ‘এখনই পালানো উচিত। আর দেরি করা ঠিক হবে না।’

শান্টু দরজার কাছ থেকে মুখ ঘুরিয়ে কাতরকণ্ঠে বলল, ‘এত খিদে নিয়ে এখন মোটেই হাঁটতে পারব না। পায়ে একফোঁটা জোর নেই।’

হঠাৎ দরজার বাইরে মৃদু শিস্ শোনা গেল। মুহূর্তে ঘরের মধ্যে সবাই স্তব্ধ হয়ে যে-যার অস্ত্র হাতে তুলে নিল। শান্টু বিদ্যুৎগতিতে রাইফেলের মুখ দরজার বাইরে তাক করে টানটান হয়ে দাঁড়াল। অন্ধকারে হাশিমুদ্দির গলা শোনা গেল, ‘আমি হাশিমুদ্দি’; তারপরই সে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। শান্টু জোরে একটা নিশ্বাস ফেলে উদ্যত-রাইফেল নামিয়ে নিল। ঘরের ভেতরে প্রায় চার-পাঁচজনে একসঙ্গে বলে উঠল, ‘কী ব্যাপার? কোথায় হাওয়া হয়েছিলে? এদিকে আমাদের তো বারোটা বেজে গেছে।’

.

সবাই ঠাণ্ডা হলে হাশিমুদ্দি জানাল, ব্যাপারটা কিছুই নয়। সে হাওয়া হয়নি। গ্রামের ভেতরে খালার বাড়ি গিয়েছিল কিছু ডাল আর আলু জোগাড় করে আনতে। ক্যাম্পে তো চাল ছাড়া আর কিছুই নেই। গেছিল তো সেই দুপুরেই। কিন্তু খালার বাড়ি গিয়ে ফেঁসে গেল। খালার ছোট মেয়েটার হঠাৎ এমন জ্বর উঠে গেল, চোখ উলটে খাবি খেয়ে যায়-যায় অবস্থা। তখন খালাকেই সামলাবে, না মেয়ের মাথায় পানি ঢালবে, না দোকানে খালুকে খবর দেবে—হাশিমুদ্দি আর দিশে-ভিশে পায়নি। কখন যে সন্ধে হয়ে গেছে। খালা আবার ভাত না খেয়ে আসতে দিল না-

মোহন থামিয়ে বলল, ‘থাক, থাক, বুঝেছি। আর বলতে হবে না। তা গ্রামে কোথাও কোনো উত্তেজনা দেখেছ কি? আমিন ফেরেনি। সে ওদিক পানে যায়নি তো?’

হাশিমুদ্দি খানিক চিন্তা করে তারপর মাথা নেড়ে বলল, না, গ্রামে কোথাও কোনরকম উত্তেজনা সে দেখেনি। আমিন গ্রামের ধারেকাছেও যায়নি। গেলে একটা হৈচৈ অবশ্যই পড়ে যেত। আর সেটা অবশ্যই হাশিমুদ্দির চোখে পড়ত।

মোহন বলল, ‘রাতটা তাহলে এখানেই কাটানো যেতে পারে। কাল একদম সুবেসাদেকের সময় ক্যাম্প ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে হবে। এখন শোবার আগে মিটিংটা সেরে নিই। সবাই কাছে এসে গোল হয়ে বস। হাশিমুদ্দি তুমি শান্টুর রাইফেলটা নিয়ে দরজায় দাঁড়াও।’

নীরবে এবং নিঃশব্দে সবাই এসে মোহনের চারপাশ ঘিরে বসল। মোহন বলল, ‘আজকের অ্যামবুশের সময় আমার সিগন্যাল পাবার আগেই আমাদের মধ্যে কেউ একজন নার্ভাস হয়ে গুলি করে বসে। তার ফলেই আজকের বিপর্যয়টা ঘটে। আমি কাউকে দোষারোপ করার জন্য জিজ্ঞেস করছি না। আজকের আমবুশের দোষত্রুটিগুলো আলোচনা করতে চাই, যাতে ভবিষ্যতে এইরকম ভুল আর না করি। কার বন্দুক থেকে গুলি ছুটে গেছিল, সে শুধু বলুক।’

কেউ জবাব দিল না। সবাই চুপ করে সূর্যাস্তের পরের দুর্ঘটনাটার কথা স্মরণ করল।

তিসি নদীর পাড় ঘেঁষে আখের ক্ষেত, সেই ক্ষেতে তারা তেরোজনে উপুড় হয়ে শুয়ে পজিশন নিয়েছিল। সকালে ওইপথ দিয়ে ঘর-পোড়া লঞ্চটা উত্তরদিকে গেছে। কে জানে, কোন গ্রাম পোড়াতে। ওটা আসলে স্পিডবোট, ওইরকম স্পিডবোটে করে পাকিস্তানী সৈন্যরা ছোট-ছোট খালের মতো নদী দিয়ে গ্রামে ঢোকে, গ্রাম পোড়ায়— তাই ওরা ওগুলোর নাম দিয়েছে ঘর-পোড়া লঞ্চ। সূর্যাস্তের সময় এই পথ দিয়েই ফিরবে। ওরা সূর্য ডোবার সঙ্গেসঙ্গেই ফিরে যায়, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আজ একটু দেরি হচ্ছিল। সূর্য ডুবে পাতলা আঁধার ছড়িয়ে পড়ছে। মোহনের নির্দেশ ছিল সে সংকেত না-দেওয়া পর্যন্ত কেউ গুলি ছুড়বে না। সংকেত মানে প্রথম গুলিটা সে ছুড়বে, তারপর অন্যরা। সাতজনের হাতে সাতটা থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, পাঁচজনের হাতে গ্রেনেড, মোহনের হাতে রাইফেল ও একটা ফসফরাস-গ্রেনেড। গ্রেনেড হাতে ছেলেরা মোহনের কাছাকাছি ছিল।

মোহনের প্ল্যানটা এ-রকম ছিলঃ স্পিডবোডটা কাছাকাছি এলে প্রথমে তারা মোহনের হাতের নির্দেশে গ্রেনেড ছুড়বে। সঙ্গেসঙ্গে মোহন ফায়ার ওপেন করবে এবং তখন অন্যরা গুলি করা শুরু করবে। ফসফরাস-গ্রেনেডটা মোহন রেখেছিল সবশেষে ছোড়বার জন্য, যাতে স্পিডবোটটা আগুন লেগে পুড়ে যায়। স্পিডবোটটা আজ ফিরতে দেরি করছিল। সেইজন্যই বোধহয় সবাই উদ্বেগে উচাটন হয়ে ছিল। হঠাৎ একটু দূরে স্পিডবোটটার ভটভট আওয়াজ শোনা গেল। মোহনের শরীর টানটান হয়ে ওঠে। সে স্পিডবোটটা আরো সামনে এগিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ সে একটা গুলির শব্দ শুনে চমকে উঠল। বুঝল তার দলের কেউ একজন ঘাবড়ে গিয়ে মোহনের নির্দেশের কথা ভুলে গুলি করে বসেছে। ভুলটা মোহন বুঝতে পারলেও রাইফেল হাতে অন্যান্য ছেলেরা ভাবল ওটা মোহনেরই গুলি। সবাই তৎক্ষণাৎ গুলি করতে শুরু করে। কিন্তু পাক-সৈন্যদের ঠিক অতর্কিতে বাগে পাওয়া গেল না। তারাও সঙ্গেসঙ্গে সতর্ক হয়ে গুলি চালায়। গ্রেনেড হাতে ছেলেরাও কয়েক মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত হয়ে যায়, ফলে তাদের নিক্ষিপ্ত গ্রেনেডগুলোর কয়েকটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সলিল সমাধি লাভ করে। তবে মোহনদের কপাল ভালো, তাদের গুলিতে প্রথমেই ঘায়েল হয়ে পড়ে যায় যার হাতে এলএমজি ছিল সেই সৈন্যটা এবং স্পিডবোটের চালকটা। ফলে স্পিডবোটটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নদীর ওইপাড়ে ধাক্কা খেয়ে পাড়ের মাটিতে কাত হয়ে যায়। তখন মিলিটারিরা হুড়মুড় করে বেরিয়ে ওইদিককার আলে পজিশান নিয়ে গুলি করতে শুরু করে। কিন্তু তার আগেই অর্থাৎ স্পিডবোটটা কাত হওয়ার পরে সৈন্যগুলোর নেমে আলে পজিশান নিতে যে কয়-সেকেন্ড সময় লাগল, সেইফাঁকেই মোহন ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে ফসফরাস-গ্রেনেডটা ছুড়ে মারল এবং একই সঙ্গে চাপাকণ্ঠে সবাইকে উঠে পালাতে নির্দেশ দিল।

পুরো ঘটনাটা মোহন ধীরস্বরে আবার বর্ণনা করে বলল, ‘প্রথম গুলিটা আমি ছুড়িনি। আমার সংকেত পাবার আগেই অন্য একজন ভয় পেয়ে ছুড়েছিল। আর সেটা ঘটেছিল ঘর-পোড়া লঞ্চটা আমাদের ফায়ারিং-রেঞ্জের ভেতরে আসার আগেই। সামান্য কয়েক মিনিট সময়ের হেরফেরে আমাদের অ্যামবুশটা ব্যর্থ হয়ে গেল। তা না হলে আমরা আজ অনেকগুলো শয়তান মারতে পারতাম। লঞ্চে শুধু পাকসেনাই ছিল না, রাজাকারও ছিল। আমি জানতে চাই, কে গুলি ছুড়েছিলে? বল।

সবাই চুপ করে রইল। মোহন বলল, ‘আরো একটা ব্যাপার বোধহয় তোমরা কেউ খেয়াল করনি। আজ আমরা সবাই ওদের গুলিতে মারা যেতে পারতাম। ওদের সঙ্গে এলএমজি ছিল একটা, বাকিগুলো চাইনিজ অটোম্যাটিক রাইফেল। আমাদের গুলিতে প্রথমেই ওই এলএমজি-ম্যান আর লঞ্চের সারেং মারা না পড়লে আমাদের বাঁচার কোনো আশ’ ছিল না। ওই দুজনের মারা পড়াটা নিতান্তই আকস্মিক ঘটনা। বুঝতে পারছ তো, কমান্ডারের নির্দেশ অক্ষরে-অক্ষরে না মানলে কী ভয়ানক বিপদ হতে পারে?’

শিবেন বলল, ‘আমিনের হাতেও রাইফেল ছিল। সে আসুক’- বলে চুপ করে গেল।

মোহন আর কথা না-বাড়িয়ে শুয়ে পড়ল। বাকিরাও একে-একে শুয়ে পড়ল। খানিক পরে মোহন মৃদুস্বরে বলল, ‘হাশিমুদ্দি, কাল খুব ভোরে উঠে ভাত রান্না করবে। আমিন ভোরের মধ্যে না-ফিরলে শিবেন, শান্টু, লতিফ, রকিব, আবদুল্লা আর আমি যাব খুঁজতে।’

মমিন বলল, ‘আমিও যাব।’

মোহন কড়াসুরে বলল, ‘না, তুমি হাশিমুদ্দিকে রান্নায় সাহায্য করবে।’

মমিন আমিনের ভাই। শান্টু চমৎকৃত হল মোহনের দূরদর্শিতায়। যদি আমিনের কিছু হয়ে থাকে, মমিনের তাদের সঙ্গে না-থাকাই ভালো।

.

আখক্ষেতের ভেজামাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে ছিল আমিন। পেছন থেকে গুলি ঢুকেছে সরু হয়ে, সামনের দিকে ছিঁড়েখুঁড়ে বিরাট গর্ত — নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে ছত্রখান হয়ে পড়েছে। তার পেছনে কিছুটা দূর পর্যন্ত রক্তের রেখা মাটিতে। বোঝা গেল, গুলি খাবার পরও সে খানিকটা পথ ছুটে এসে তারপর মুখ থুবড়ে পড়েছে। তার দেহের নিচে রক্ত গড়িয়ে কাদাপানিতে মিশে আখের ঝোলাগুড়ের মতো দেখাচ্ছে। জায়গায় জায়গায় রক্ত জমে থকথকে হয়ে রয়েছে। আমিন মাটিতে মুখ গুঁজে পড়েছে একেবারে সোজা সটান। ফলে দেহটা শক্ত হয়ে গেলেও তাকে বয়ে আনতে মোহনদের বিশেষ কষ্ট হয়নি। খুঁজে পাবার পর কয়েকটা মিনিট সবাই যেন পাথরের মূর্তির মতো হয়ে গিয়েছিল। তারপর দ্রুত তিনজন করে লাশের দু-পাশে দাঁড়িয়ে হাতে-হাতে তুলে বয়ে নিয়ে চলে আসে ক্যাম্পে।

তখনো ভোরের আলো ভালো করে ফোটেনি। মোহন পুকুরপাড়ে থেমে বলল, ‘লাশ এখানেই নামাও। পুকুরে একেবারে ধুয়ে নিই। শান্টু, শিবেন, হাত ধুয়ে ভেতরে গিয়ে মমিনকে ঘরে ঢুকিয়ে ফেলো— যেন চিৎকার দিতে না পারে। রফিক, লতিফ, তোমরা হাত ধুয়ে তাড়াতাড়ি এই বাঁশঝাড়ের গোড়ায় একটা কবর খুঁড়ে ফেলো। একঘণ্টার মধ্যে লাশ দাফন করে, খাওয়া শেষ করে ক্যাম্প ছাড়তে হবে। মিলিটারিরা সূর্য-ওঠার ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে বেরিয়ে এসে এ-গ্রাম পোড়াবে। কাল ওদের লঞ্চ নষ্ট করেছি, কয়েকজনকে মেরেছি। তার শোধ আজ তুলবে। আফশোস, সবগুলো শয়তানকে মারতে পারলাম না। ‘

শিবেন চট করে চোখ নামিয়ে ফেলল। মোহন একমুহূর্ত স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইল, তারপর অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, ‘সবাই তাড়াতাড়ি কর। অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পারছ তো?’

শান্টু, শিবেন যতটা আশঙ্কা করেছিল, মমিন সে-রকম কান্নাকাটি করল না। একবার মাত্র ‘ভাইগো’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠে নিজেই নিজের মুখ চেপে ধরল। তারপর ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘আমি ওকে গোসল দেব। আমার এই চাদরটা দিয়ে কাফন পরাব।

খুব দ্রুত লাশ দাফন করে সবাই পুকুরে গোসল করে নিল। সবার মুখ শক্ত, কেউ কাঁদছে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভাঙচুর হয়ে যাচ্ছে। ততক্ষণে হাশিমুদ্দি ভাত রান্না করে ঘরের মধ্যে নিয়ে গেছে। সবাই ঘরে ঢুকতে হাশিমুদ্দি বলল, ‘আজ শুধু ভাত আর গুড়। ডাল, আলু কিছু নেই গো।’

কেউ কোনো জবাব দিল না। মাঝেমাঝেই এ-রকম ভাত, নুন আর আখের ঝোলাগুড় মেখে খেতে হয় ওদেরকে। খাওয়ার জন্য তো খাওয়া নয়। চলার জন্য, অপারেশান-অ্যাকশান-অ্যামবুশ করার জন্য, কোনোমতে পেটে কিছু ঠেসে পোরা। রাইফেলে গুলি পোরার মতো। গুলি না পুরলে রাইফেল চলবে না। পেটে ভাত না পুরলে দেহ চলবে না।

মমিন শুদ্ধ শান্তভাবে ভাতের থালা নিয়ে বসে গেল। কিন্তু ঐ বসা পর্যন্তই। সবাই ভাতের সঙ্গে নুন আর গুড় চটকে নিয়েছে কিন্তু কেউ খেতে পারছে না। এত প্রচণ্ড খিদে পেটে, গতকাল সকালের পর থেকে আর খাওয়া জোটেনি। তবু কেউ যেন মুখে তুলতে পারছে না, সবাই চটকাচ্ছে। সবার ভেতরে প্রচণ্ড কান্না উথালপাতাল করছে। কিন্তু কেউ চোখে একফোঁটা পানি আসতে দিচ্ছে না। সাদা ভাতে ঝোলাগুড় মাখার ফলে কেমন একটা লালচে রং হয়েছে। শান্টুর মনে হল আখের ক্ষেতে পড়ে-থাকা আমিনের দেহের চারপাশে গড়ানো রক্ত-কাদায় মাখামাখি হয়ে এইরকম দেখাচ্ছিল। হঠাৎ তার পেট গুলিয়ে উঠল। সে দ্রুত উঠে ঘরের বাইরে গিয়ে বমি করে ফেলল। মোহন একবার গম্ভীর মুখ তুলে দরজার দিকে তাকাল, তারপর যেন জেদ করেই গপাগপ ভাত মুখে তুলতে লাগল। এই ছেলেগুলো এখন যদি দুই-তিন গ্রাস করেও পেটে দিতে না পারে, তাহলে পালাবার জন্য বেশিক্ষণ দৌড়োতে পারবে না। তারও বমি পাচ্ছিল, কিন্তু অন্য ছেলেদের কথা ভেবেই সে ভাত মুখে তুলতে লাগল।

মমিন এতক্ষণ চুপ করে ভাত চটকাচ্ছিল, হঠাৎ তার কী যে হল, ভাতমাখা হাত নিয়েই সে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল মোহনের ওপর। হিহিস্ করে বলতে লাগল, আয়, তোকে জন্মের খাওয়া খাওয়াই।’ তার দেহের ভারে মোহন কাত হয়ে গড়িয়ে পড়ল, মমিন তার থালা থেকে মুঠোভর্তি করে ভাত তুলে মোহনের নাকেমুখে ঠেসে ধরল। অমনি রকিব, লতিফ, রমাপদ সবাই হা হা করে ছুটে এসে মমিনকে ছাড়িয়ে নিল, একজন মোহনকে তুলে বসিয়ে তার নাকমুখ থেকে ভাত পরিষ্কার করতে লাগল। মোহন খাবি খেয়ে, নাক ঝেড়ে, কোনোমতে সুস্থির হয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল পুকুরে হাতমুখ ধোয়ার জন্য। তারপর ফিরে এসেই কড়াকণ্ঠে নির্দেশ দিল, ‘পনের মিনিটের মধ্যে সব গুছিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে ডবল মার্চ। নদীর উলটো দিকে ছুটতে হবে। প্রথমে বেলতলীর ক্যাম্পে যাব। তারপর দুই নম্বর সেক্টর। কতটা যে ঘুরপথ হবে, কে জানে।

লতিফ বলল, ‘বেশ ঘুরপথ হবে। তবে যদি অমত না কর, মাঝপথে বিশ্রাম করার ব্যবস্থা হতে পারে। উত্তর-পূর্ব কোণা দিয়ে হেঁটে সিকিমাইল গেলে একটা ছোট জঙ্গলের মতো পড়বে। ওই পর্যন্ত দৌড়ে যাই, চল। তারপর জঙ্গল পেরিয়ে হাওর, জন-মনিষ্য খুব কম। ওটার পরে রতনপুর গ্রামে আমার চাচা থাকে। তার বড়জামাইও যুক্তিযোদ্ধা। গ্রামের লোকগুলো খুব ভালো। চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষের লোক। ক’মাস আগে মিলিটারিরা তাদের পাড়া জ্বালিয়ে দিয়েছিল, তাই তারা বেজায় খাপ্পা ওদের ওপর। মুক্তিযোদ্ধা দেখলেই আশ্রয় দেয়, খাওয়ায়।’

মোহন রাজি হল। বিশ্রামের চেয়েও বেশি দরকার ডাল-ভাতের। গতকাল সকালের পর থেকে তো খাওয়া নেই। চাচার বাড়িতে খেয়ে একটু গড়িয়ে তাহলে রাতেই আবার রওনা দিতে পারবে।

ওরা জঙ্গল পর্যন্ত ছুটতে ছুটতে গেল। ততক্ষণে চারদিকে সকালের আলো ফুটে উঠেছে। জঙ্গলের পর হাওর—তারপরে রতনপুর গ্রাম। একবার পোড়ানো হয়ে গেছে, অতএব এ গ্রামে অন্তত আজকে মিলিটারি আসার ভয় নেই।

লতিফের চাচার বাড়ি পৌছতে পৌঁছতে দুপুর পেরিয়ে গেল। ততক্ষণে ও-বাড়িতে সবার খাওয়া হয়ে গেছে। লতিফের চাচা সোলেমান মিয়া ওদের দেখে একই সঙ্গে খুশি হলেন এবং ব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি মোরগ জবাই করতে বললেন। শান্টু বলে উঠল, ‘না চাচা, মোরগ রান্না হতে সময় লাগবে। দুটো চুলোতে শুধু ডালভাত বসিয়ে দিতে বলুন। ওতেই আমাদের হবে। কাল থেকে কেউ খাইনি।’

সোলেমান মিয়া হেসে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘কী যে বলে ছেলে। ব্যস্ত হোয়ো না, সব হবে। তাড়াতাড়িই সব দেবনে। তোমরা বাবারা হাতমুখগুলো ধুয়ে একটু ঠাণ্ডা হয়ে বসো দিকিনি। ওই-যে পাশে পুকুর আছে যাও, সব হাতমুখ ধুয়ে নাও।’

হাতমুখ ধোবে কী, সবাই পুকুরের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল গোসল করার জন্য। গত সন্ধ্যার অমন রাম-ছোটার সময় কত-যে কাদামাটি লেগেছিল গায়ে পায়ে, ডোবার পানিতে হাত-পা ধুয়েও সেগুলো যায়নি। তাছাড়া আজ এতখানি পথ হেঁটে-আসা বোঁচকাকুঁচকি ঘাড়ে করে। সবাই ঘেমে একসা। অনেকক্ষণ ধরে ঝাঁপাই-ঝুড়ি করে গোসল সেরে ওরা দহলিজ-ঘরে ঢুকে দ্যাখে তক্তপোষের ওপর জগ-ভর্তি সরবত, কয়েকটা গেলাস আর একটা বেতের ধামিতে কয়েকটা মুড়ির মোয়া।

সোলেমান মিয়া বললেন, ‘এখন বেশি কিন্তু দিলাম না ভাতের খিদে মরে যাবে বলে। শুধু একটা করে মোয়া খেয়ে সরবতটুকু গলায় দাও। একঘণ্টার মধ্যেই ভাত দেবনে।’

সত্যিসত্যিই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ওদের ডাক পড়ল ভাত খাবার জন্য। ভেতর-বাড়ির চওড়া বারান্দায় পাটি পেতে জায়গা করা হয়েছে। সার-সার থালার সামনে তিন-চারটে বড় বড় গামলায় ভাত, মাছভাজা, মোরগের ঝোল, ডাল, লাউ-ভাজি নিয়ে লতিফের চাচী রহিমা বিবি বসে আছেন। ওরা একে-একে ঢুকতেই তিনি মাথার কাপড়টা আরো একটু সামনে টেনে দিয়ে নড়েচড়ে বসলেন। ওরা পাটিতে বসার পর চোখ পড়ল ভাত-তরকারি ভর্তি গামলাগুলোর দিকে। দেখে ওদের চক্ষু স্থির। শান্টু হাঁ-ক্ করে নিশ্বাস টেনে বলে উঠল, ‘করেছেন কি চাচাজান? একঘণ্টার মধ্যে এত-ত আয়োজন।’

সোলেমান মিয়া খুশির হাসি হেসে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘কিছু না বাবারা, এইসব কিছু না। তোমরা রোদে-বৃষ্টিতে, কাদায়-পাঁকে এমন কষ্ট করছ আর বাড়ির মধ্যে এতগুলো আকামের ধাড়ি বসে-বসে খাচ্ছে, এইটুকু রেঁধে দিতে পারবে না? কইরে বেলী, ফুলী, হেনা, বকুল—কই তোরা, খাবার দে ছেলেদের পাতে।’

এতক্ষণে ‘আকামের ধাড়িদের’ দেখা গেল। তিনটি কিশোরী মেয়ে এগিয়ে এসে ওদের পরিবেশন করতে শুরু করল। সব ছোটটি মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। রহিমা বিবি বসে বসে তদারক করতে লাগলেন, ‘ওই পাতে মাছভাজা দে। এইখানে ভাত লাগবে। খাও বাবারা খাও, লজ্জা কোরোনা। আবার কতখানি পথ না-জানি হাঁটতে হবে।’

ওরা সবাই মাথা নিচু করে পরম তৃপ্তির সঙ্গে পেট ভরে খেল। সোলেমান মিয়া বললেন, ‘তোমরা দলিজঘরে শুয়ে একটু জিরিয়ে নাও।’

মোহন বলল, ‘যদি ঘুমিয়ে পড়ি, সন্ধের সময় জাগিয়ে দেবেন। আজ রাতেই বেলতলী পৌঁছোতে হবে।’

সোলেমান মিয়া বললেন, ‘তোমার শরীর গতি বিশেষ সুবিধের ঠেকছে না। একটু বিশ্রাম দরকার। আজ রাতটা এখানে থেকে গেলে হত না?

সামান্য একটু স্নেহের সুর। একজন প্রবীণ পিতার স্বাভাবিক উৎকণ্ঠা ও দরদ। মোহনের বুকের ভেতর উথাল-পাথাল করে উঠল। ভেতরের সব আবেগ যেন বাষ্প হয়ে দুইচোখের কূলে এসে জমা হতে চায়। অনেক কষ্টে নিজেকে সম্বরণ করে মোহন বলল, ‘না চাচা, আজ রাতেই বেলতণী পৌছনো খুবই জরুরি। আমাদের গুলি আর বেশি নেই। আমিনের রাইফেলট। খোয়া গেল। বেলতলীর ক্যাম্পকমান্ডারের কাছে গিয়ে সব জানাতে হবে। আরো অস্ত্র নিতে হবে। দিনের বেলা বেলতলী যাবার রাস্তাটা নিরাপদ হবে না। আপনি ভাববেন না, বেলতলী পৌঁছে ভালো করে ঘুমিয়ে নেব।’

.

কমান্ডার রফিক বলল, ‘আমাদের অস্ত্রশস্ত্রও খুব কমে গেছে। আমাকেও নির্ভয়পুরে যেতে হবে। এখানকার ক্যাম্পটা বোধহয় আর রাখা যাবে না। চারপাশে হঠাৎ এত রাজাকার বেড়ে গেছে।’

শুনে মোহনের একটু দুঃখ হল। নির্ভয়পুর সাব-সেক্টর থেকে ট্রেনিং নিয়ে সে প্রথমে এই বেলতলীর গোপন আস্তানায় এসে উঠেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের খুব শক্ত একটা ঘাঁটি ছিল এটা, বলা যেতে পারে। চারপাশের গ্রামগুলোয় তখনো বিশেষ মিলিটারি হামলা হয়নি। গ্রামের লোকরাও যেন দেখেও দেখত না—রসুল মিয়ার বাড়িতে এত ‘আত্মীয়-স্বজনের’ আনাগোনা কেন! এই আস্তানায় সে প্রায় পনের দিন ছিল। রফিকের সঙ্গে নানা অপারেশনে গেছে। তারপর রফিকেরই নির্দেশে সে বারোজনের দল নিয়ে রুহিতপুরের উপকণ্ঠে অস্থায়ী গোপন আস্তানা গেড়েছিল। তা তিসি নদীর লঞ্চ-অ্যামবুশের ব্যর্থতার ফলে সে আস্তানাও ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে। খবর পেয়েছে, পরদিনই মিলিটারিরা রুহিতপুর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে।

রফিক বলে চলল, ‘আমার দলেরও দুটো ছেলে শহীদ হয়েছে। ছেলে দুটো অবশ্য কাছাকাছি কোনো গ্রামের নয়, তাই এই এলাকাটায় হৈচৈ হয়নি। কিন্তু রসুল মিয়াকে আজকাল গ্রামের অনেকেই অনেক কথা জিজ্ঞেস করছে। আমরা কালই নির্ভয়পুর রওনা দেব।’

মোহন রফিকের কথায় বিপদের গন্ধ পেল। নির্ভয়পুর থেকে বেরিয়ে বর্ডার পার হলে সবচেয়ে কাছে হয় বেলতলীর এই গোপন আস্তানা। ওখান থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলারা দেশের ভেতরে ঢুকে অনেকেই প্রথমে এই বেলতলী ক্যাম্পে আসে। এখন আর এই আস্তানা নিরাপদ নয়। যে-কোনোদিন মিলিটারির হামলা হতে পারে। একবার এই আস্তানা রেইড হলে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়ে যাবে। তারচেয়ে ক্যাম্প বন্ধ করে সাব-সেক্টরে গিয়ে রিপোর্ট করাই ভালো। সাব-সেক্টর থেকেও মানা করে দেওয়া হবে, কেউ যেন আর বেলতলীর দিকে না যায়।

.

ক্যাপ্টেন মাহবুব খুব নির্লিপ্তভাবে সমস্ত রিপোর্ট শুনলেন। তারপর শুধু বললেন, ঠিক আছে রফিক। তোমরা অনেক পথ হেঁটে এসেছ। খুব ক্লান্ত নিশ্চয়? যাও, বিশ্রাম করো গে। দেখ, খাবার-দাবার কিছু আছে নাকি। কাল সকালে কথা হবে।

রফিক স্যালুট করে পেছন ফিরল। তার পেছনে বাকিরা যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তারাও পেছন ফিরল।

সন্ধে সাতটা বাজতে বাজতে ক্যাম্পের সবার খাওয়ার পাট চুকে যায়। কিচেনে হাঁড়ি-ডেকচি সব ধুয়ে উপুড় করে রাখা। তবু খাওয়া জুটে গেল। সাব-সেক্টরের ছেলেরা তাদের ব্যক্তিগত সঞ্চয় থেকে পাউরুটি, বিস্কুট, কলা, যে-যা পারে, চেয়ে-চিন্তে জোগাড় ক’রে ওদের খেতে দিল। খাবার পর্যাপ্ত ছিল না। পেট না ভরলেও তারপরে গ্লাস-ভর্তি পানি পেটের শান্তি আনতে কিছুটা সহায়তা করে।

ছেলেদের থাকার জন্য তাঁবু আর লম্বা বাঁশের-ব্যারাক। রফিকের সঙ্গে আগত চব্বিশজন গেরিলাকে সবাই ভাগ-ভাগ করে বিভিন্ন ব্যারাকে ও তাঁবুতে শোবার ব্যবস্থা করে দিল। মোহন আর শান্টু পাশাপাশি শুয়েছে। দলের অন্যান্যরা যে-যার পুরনো বন্ধুর কাছাকাছি শুয়েছে। শান্টু ফিসফিস করে বলল, ‘ক্যাপ্টেন বেজায় রেগেছে, তাইনা মোহন?’ মোহনও ফিসফিস করে বলল, ‘কিসে বুঝলে?’

‘একটাও কথা বলল না যে। অল্প রাগলে বকে ভূত ছাড়িয়ে দেয় না? বেশি রাগলে চুপ মেরে যায়। রাগবেই তো। আমরা কেউই এবার ভালো করিনি।’

মোহন চুপ করে রইল। ক্যাপ্টেন মাহবুব এইরকমই। গম্ভীর আর কড়া প্রকৃতির মানুষ কথা কম বলে, মনের ভাব বোঝা খুব শক্ত। ছেলেদের হাতে ধরে গেরিলা-টেনিং দেয়—অনেক কঠোরতা এবং অনেক যত্নের সঙ্গে। ছেলেদের জান বেরিয়ে যায়। খালি শেখায়, খাটায়, কিন্তু ছেলেরা ভালো করলে সহজে প্রশংসা করে না। আবার ভুল করলে বকে-বকে ভূত ছাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ছেলেরা ওকে ভয়ানক ভালোবাসে। অসম সাহসী, দুর্ধর্ষ ক্যাপ্টেন মাহবুবের সঙ্গে অপারেশনে যাবার জন্য ছেলেরা একপায়ে খাড়া থাকে, কিন্তু সে-কথা মুখ ফুটে কারো বলার সাহস নেই। মাহবুব যাকে-যাকে বাছবে, কেবল তারাই যাবে। কোনো ছেলে যদি মুখ ফুটে তার অ্যাকশানের সঙ্গী হবার বাসনা প্রকাশ করে, তবে তার বারোটা বেজে গেল। মাহবুব পরবর্তী দুদিন ধরে তাকে হয় ফেটিগ্ নাহয় সেন্ট্রি ডিউটিতে দিয়ে দিল। কোনো নতুন ছেলে সাব-সেক্টরে এলে তার ব্যাপারেও প্রথমে এই প্রেসক্রিপসন! ফেটিগ্‌ খাটাও। মোহন আর শান্টু আসার পর একসপ্তাহ কেবল কাঠ কেটেছিল আর ক্যাম্পের মাঠের আগাছা সাফ করে এবড়োখেবড়ো মাঠ কোদাল দিয়ে কুপিয়ে সমান করেছিল। শান্টু দুদিনেই হাঁপিয়ে উঠেছিল কিন্তু মোহনের মুখে রা-টি ছিল না। একাগ্র মনোযোগে সে প্রতিটি কাজ সম্পন্ন করত। একসপ্তাহ পরে শুরু হল তাদের গেরিলা-ট্রেনিং। তখন দলে পেল এই শিবেন, রমাপদ, আসাদ, লতিফ, রফিক, আমিন, মমিন, সুলতান, হাসান—এদেরকে। এরা সবাই নতুন রিক্রুট।

একমাসের ট্রেনিঙের সময়ে প্রতিটি বিষয়ে মোহন ফার্স্ট। তাকে একবার শুধু দেখিয়ে দিলেই হয়, সেটা যেন সঙ্গেসঙ্গে তার মাথায় গেঁথে যায়। তারপর অবসর সময়ের সবটুকু সে বারবার প্র্যাকটিস করেই ব্যয় করে। তার শ্রান্তি নেই, ক্লান্তি নেই, একঘেয়েমি নেই। অন্য ছেলেদের মতো স্বাধীন বাংলা বেতারে বা টেপরেকর্ডারে গান শোনার আগ্রহ নেই। খাওয়ার পরে ব্যারাকে সবাই মিলে বসে যখন আড্ডা দেয়, গান করে—তখনো সে কিছু-একটা প্র্যাকটিস করছে।

তার এইরকম অধ্যবসায় দেখে ক্যাপ্টেন মাহবুব যে খুব প্রীত হলেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেল— প্রায় সবগুলি অ্যাকশানেই তিনি মোহনকে সঙ্গে নিতে শুরু করলেন। মোহনের প্রতি ক্যাপ্টেনের এই সস্নেহ প্রশ্রয়ে অবশ্য সাব-সেক্টরের কোনো ছেলেই হিংসে বা মনখারাপ করে না, কারণ অ্যাকশানের সময় মোহনের মতো ওইরকম জান বাজি রেখে শত্রুর পানে ধেয়ে যাবার বুকের পাটা অন্যদের একটু কমই আছে। আর মোহন এইরকম দুঃসাহসী, এত করিতকর্মা হওয়া সত্ত্বেও তার কোনো কথা নেই, কারো সঙ্গে বাদানুবাদ সেই, খাওয়া-শোওয়া নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই—এ-রকম ছেলেকে অপছন্দ বা হিংসে করবে কে?

.

পরদিন সকালে রফিক তার নির্দেশ পেল। বেলতলীর ক্যাম্প বন্ধ। পীরগঞ্জে হামিদ আলীর বাড়িতে আপাতত গোপন আস্তানা হোক। রফিকদের আরো কয়েকটা থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল দেওয়া হল, আর বলা যায় ওদের প্রত্যাশামাফিকই প্রচুর গুলি। মোহন অনেকক্ষণ থেকে উসখুস করছিল একটা কথা বলার জন্য। ঠিক সাহস পাচ্ছিল না। ক্যাপ্টেন মাহবুব টের পেয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ইয়েস?’ মোহন সাহস করে বলেই ফেলল, ‘একটা স্টেন কিংবা এলএমজি সঙ্গে থাকলে—’

তার কথা শেষ হতে না দিয়েই ক্যাপ্টেন মাহবুব বলে উঠলেন, ‘অবকোর্স! একটা স্টেন কিংবা এলএমজি সঙ্গে থাকলে অনেক সহজে খানসেনা মারা যায়। সঙ্গে থাকা উচিতও। ওদেরকে মেরে একটা ছিনিয়ে নাও না?’

খুব সহজ গলাতেই বললেন ক্যাপ্টেন মাহবুব। কিন্তু শোনামাত্র মোহনের মুখচোখকান সব ঝাঁ-ঝাঁ করতে লাগল। মনে হল এক্ষুনি মাটির ভেতর সেঁধিয়ে যায়। ছিঃ ছিঃ, একে তো অ্যাকশান করতে গিয়ে মার খেয়ে ফিরে এসেছে, তার ওপর কোন্ আক্কেলে মুখ ফুটে চাইতে গেল? সত্যিই তো, তাদের তো এইরকমই দাপট দেখানো উচিত। খানসেনা মেরেই এলএমজি ছিনিয়ে নিতে হবে।

এইসঙ্গে মনের কোণে একটা আফশোসও জেগে উঠল। তিসি নদীর লঞ্চ-অ্যামবুশের দিনেই এলএমজিটা হাতে এসে যেত। শুধু যদি শিবেনটা নার্ভাস হয়ে আগে গুলি করে না বসত।

সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথাটা উঁচু করে বলল, ‘অবকোর্স স্যার।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *