৫
ডায়েরি খুলে আবার পড়তে শুরু করল দুজন…
আমি আর সৌরভ দুই ভাই হলেও তার চেয়ে বেশি ছিলাম বন্ধু। আমার এক বছরের ছোট কিন্তু পড়াশোনা থেকে শুরু করে সবকিছুই ছিল একসাথে। ছোটবেলা থেকেই একই ক্লাসে পড়েছি, একই জামাকাপড় শেয়ার করেছি। একই মেয়ের পেছনে লাইন মেরেছি (মানসী তখন বাচ্চা মেয়ে ছিল, ভালোবাসার কথাও ভাবিনি)। আমরা দুই ভাই যেভাবে বড় হয়ে উঠেছি জানি না সেই জীবনের স্বাদ আর কয়জন পেয়েছে। বাবা-মা কখনো কোনো কিছুতে বাধা দেয়নি। মা যদিও একটু নরম মনের মানুষ আর কিছুটা ভীতু। ওই আরকি, সব মায়েরা যেমন হয় তেমনই। আমরা যতক্ষণ বাইরে থাকতাম মা প্রাণটা হাতে নিয়ে বসে থাকত। তবু বাবা সবসময় বলত আমার ছেলেরা বড় হবে বাঁধনছাড়া।
আমরা ছিলাম ভীষণ অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। শুধু আমরা দুজনই না, আমাদের সাথে এরকম আরো কয়েকজন পাগল বন্ধু ছিল। আমরা কত রকম অ্যাডভেঞ্চার যে করতাম! সাইকেল নিয়ে সারা বাংলাদেশ ঘোরার স্বপ্ন ছিল একসময়। স্বপ্নপূরণের নেশায় সাইকেল নিয়ে কোথায় কোথায় চলে যেতাম! সাঁতার কেটে পার হয়েছি বিশাল বিশাল কত নদী। আমাদের আরেকটা পছন্দের কাজ ছিল রাতের ঢাকায় সাইকেল চালানো। কী মজার যে ছিল ব্যাপারগুলো ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। মাঝরাত পর্যন্ত খালি রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে তারপর বাসায় ফিরতাম। আর আড্ডাবাজি তো ছিলই। মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর অবশ্য এসব পাগলামি একটু কমাতে হয়েছে। পড়াশোনা করেই কূল পেতাম না। তবে একেবারে ছেড়ে দিইনি কখনোই। বাসায় ফিরতে ফিরতে আমার বেশ রাত হয়ে যেত। সৌরভ অবশ্য বিয়ের পর আমাদের দলে আর ছিল না।
তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসার কারণে সবসময়ই বন্ধুদের ঠাট্টা টিটকিরির শিকার হতে হয়েছে ওকে। তবে সেটা আমাদের মতো সব বারমুখো পুরুষ মানুষকেই কোনো না কোনো কারণে হতে হয়, বিশেষ করে বউ-এর জন্য। মেয়েরা ওই বেশি রাত করে বাড়ি ফেরাটা যে কেন মানতে পারে না তা শুধু ওরাই জানে আর বিধাতা জানে।
আমার মানসী কিন্তু ওরকম ছিল না। সব ক্ষেত্রেই ও অন্য মেয়েদের থেকে আলাদা ছিল। অনেকটা সাধারণের মধ্যে অসাধারণ। ঝগড়া করত, চিৎকার করত, অভিমান করত আবার মূর্তির মতো অনুভূতিহীন হওয়ার ভাণও করত কিন্তু রাগ করতে পারত না। আর আমার রাত করে বাসায় ফেরা নিয়েও ওর বলার কিছু ছিল না কখনো। হতে পারে ছোটবেলা থেকেই আমাকে এভাবে দেখে আসছে তাই কিংবা ও এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবার মতো মেয়েই না। কোথায় গেলাম কী করলাম কিছুই জিজ্ঞেস করত না কখনো। কিন্তু আমি নিজ থেকে যখন বলতাম খুব আগ্রহ নিয়ে শুনত।
আমার কাছে মেইন গেটের তালার ডুপ্লিকেট চাবি থাকত। তাই আমার বাসায় ঢুকতে কোনো সমস্যা হতো না। আর বাসায় ঢুকেই যে দৃশ্য দেখতাম তা দেখে সারা জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়। মানসী আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। কখনো খাওয়ার টেবিলে মাথা দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে, কখনো সোফায় হেলান দিয়ে টিভি দেখতে দেখতে, টিভি চলছে। আমি ওকে কত বলেছি,
“এসবের কোনো মানে হয়? তুই কেন আমার জন্য জেগে থাকিস? তুই ঘুমিয়ে পড়তে পারিস না?”
ও বলত,
“আমি ঘুমালে তোমাকে খেতে দেবে কে?”
“দেওয়ার কি আছে? টেবিলে সব ঢেকে রেখে দিবি। আমি এসে নিয়ে খাব।”
“বিড়াল মনে হয় তোমার বন্ধু লাগে? যে তোমার জন্য সব রেখে দেবে? তাছাড়া তুমি তো ঠাণ্ডা ভাত খেতে পারো না। আমি ঘুমালে গরম ভাতটা কোথায় পাবে? শুনি।”
“কে বলেছে পারি না। অবশ্যই পারি, এখন থেকে আমি ঠাণ্ডা ভাতই খাব।”
“না গো, এ কথা বলো না। আমি জানি, ঠাণ্ডা ভাত তোমার গলায় আটকে যায়। দুপুরে তো ক্যাম্পাসেই থাকো আর হাবিজাবি খাও। সারাদিন পর গরম ভাত দেখলেই তোমার চোখে মুখে যে একটা তৃপ্তি দেখতে পাই সেটা থেকে আমাকে বঞ্চিত করো না।”
ওর এই না গো, হ্যাঁ গো বলাটার মধ্যেও অন্যরকম একটা ব্যাপার ছিল। নরমালি এসব যদি অন্য কারও মুখে শুনতাম হয়তো হেসে গড়াগড়ি খেতাম, ব্যাকডেটেড বলতাম। কিন্তু ওর মুখে কেমন যেন মানিয়ে যেত আর স্বাভাবিক লাগত। তারপর আমি বলতাম,
“আচ্ছা বুঝলাম, কিন্তু অন্তত ঘুমিয়ে তো থাকতে পারিস। আমি এসে না হয় ডেকে নিলাম।”
“ঘুমিয়েই তো থাকি!”
“সেটা তো ইচ্ছে করে না। চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রেখে, সোফায় বসে থেকে অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়া। ঘরে গিয়ে বিছানায় আরাম করে ঘুমিয়ে থাকা যায় না?
“ইশ, আমি যেন চিনি না তোমাকে! ওভাবে ঘুমালে তুমি জীবনেও আমাকে ডাকতে পারবে না, মায়া লাগবে।”
আমি অবাক হয়ে বলতাম,
“মায়া তোর জন্য! হাসালি।”
“হয়েছে হয়েছে, আর ঢং করতে হবে না। তোমার সবটাই আমার জানা।”
কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে গেছি! যাই হোক, একদিন আমাকেও ঘরমুখো হতে হলো। ঘটনাটা খুব মনে পড়ছে আজ। সাইকেল ট্রিপে গিয়েছিলাম গাজীপুর। ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ২টা বেজে গিয়েছিল। বাসায় ঢুকে খুব অবাক হলাম, সব অন্ধকার। প্রতিদিন বাইরের লাইট জ্বালানো থাকে, ড্রইং রুমের লাইট জ্বালানো থাকে। আজ কী হলো!
জুতা খুলতে খুলতে এসব ভাবছিলাম। হঠাৎ ডাইনিং রুমের লাইট জ্বলে উঠল আর আমি মানসীকে দেখতে পেলাম। এক পলকেই খেয়াল করলাম ওর চোখ ফোলা, কেঁদেছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তার মানে বাসায় কিছু হয়েছে। কিন্তু কী হয়েছে? আমি কিছু বলার আগেই ও বলল,
“ফ্রেশ হয়ে এসো। খেতে দিচ্ছি।”
আমি আর কোনো কথা না বলে তাই করলাম। খেতে বসে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই নিচ্ছিস না কেন?”
“আমি খেয়েছি, তুমি খাও।”
“তুই যে আমাকে রেখে খাস না সেটা তো জানি। মিথ্যে বলছিস কেন?”
“কখনো খাইনি বলে যে কখনো খেতে পারব না এমন তো না।”
“তা ঠিক, কিন্তু তুই খাসনি তা আমি খুব ভালো করে জানি। আয় আমার কাছে, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না তো।”
“কেন?”
“এমনি।”
“কী হয়েছে বল তো।”
“কিছু হয়নি।”
“তাহলে কেঁদেছিস কেন?”
“কেঁদেছি তোমাকে কে বলল?”
“কারো বলা লাগবে কেন? তোর চোখ দেখেই তো বুঝতে পারছি।” মানসী কোনো কথা বলল না, অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, “সব লাইট অফ ছিল কেন?”
“সেটা সকাল হলেই বুঝতে পারবে।”
কেন, এখন বলতে তোর অসুবিধা কী?”
“খালামণি লাইট অফ করে দিয়ে আমাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলেছে। আর তোমার জন্য প্রতিদিন এভাবে বসে থাকতে নিষেধ করেছে।”
“হুম, কিন্তু মা এত ক্ষেপলো কেন? আমার দেরি করে ফেরাটা তো নতুন কিছু না। রোজই তো দেরি করে ফিরি।”
“কখনো কিছু বলে না মানে কি তোমার এই কাজগুলো তার খুব পছন্দ?” আমি চুপ করে রইলাম। ও আবার বলতে শুরু করল,
“সকালে নাকি কাকে মেরেছো। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে এসে বিচার দিয়ে গেছে খালামণির কাছে।”
“শালার এত বড় সাহস আর বাড়িতে এসেছিল। কাপুরুষের বাচ্চা তাও এসেছে যখন আমি বাড়িতে নেই।”
“বাহ! মেরে খুব পুরুষত্ব দেখানো হয়েছিল না?”
“আরে বাবা ও কি ক্লাস টু এর বাচ্চা নাকি যে মার খেয়ে বিচার দেবে? পুরুষ হলে তো পাল্টা মার দিত। বিচার দিত না।
“তুমি কি আরো ঝামেলা চাচ্ছো?”
আমি চুপ করে রইলাম। ও আবার বলল,
“দেখো, ছেলের সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য শুনতে কোনো মায়েরই ভালো লাগে না।”
“কী করব বল? আমি তো ছোটবেলা থেকেই এরকম।”
ও অন্যদিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিল। আমি ভাত মেখে ওর মুখের সামনে ধরে বললাম,
“আচ্ছা যাই হোক, এখন খেয়ে নে।”
“তুমি খাও, আমার ইচ্ছে নেই।”
ওর এ কথায় আমার প্রচণ্ড রাগ হলো, তাই না খেয়েই উঠে যাচ্ছিলাম।
ও আমাকে থামিয়ে বলল,
“সরি, এসো আমাকে খাইয়ে দাও।”
আমি আবার বসলাম। ওকে খাইয়ে দিতে দিতে বললাম,
“সবই তোদের স্বভাবের দোষ। জল ঘোলা করে না খেলে ভালো লাগে না।
ও আর কিছু বলল না, চুপচাপ খেয়ে নিল। ওকে খাইয়ে দিতে দিতে আমিও খেয়ে নিলাম। খাওয়া শেষ হলে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
“সবই তো বুঝলাম, মা রাগ করেছে কিন্তু তোর কান্নার রহস্যটা কি শুনি?”
“আমার কান্নার কোনো রহস্য নেই।”
“আমার কাছে মিথ্যে বলিস না। সত্যি কথাটা এক্ষুনি বল, না হলে এখানেই সারারাত দাঁড়িয়ে থাকব।”
“উফ তুমি এত পাগলামি কেন করো?”
আমি একটু ধমকের সুরে বললাম,
“আমি সত্যিটা বলতে বলেছি।”
ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“খালামনি চায় যেন আমি তোমাকে এসব করতে নিষেধ করি, শাসন করি। তার ধারণা আমি চাইলেই তোমাকে ঘরমুখো করতে পারি কিন্তু করি না। কিন্তু আমি তোমাকে কন্ট্রোল করার কোনো চেষ্টা করি না।”
“তো এটুকু কথায় কান্নার কী আছে?”
“তুমি বুঝবে না।”
“বুঝিয়ে বল, না হলে কী করে বুঝব?”
“কাল বুঝিয়ে বলব, এখন ঘুমাতে যাই।”
“আচ্ছা, আমার ঘরে চল।”
“কেন?”
“কেন আবার কি? আজকে আমার সাথে থাকবি, তাই।”
“না, আজ না।”
“না কেন? তুই আমার বিয়ে করা বউ। সবসময় মোনার সাথে কেন থাকতে হবে?”
“আজ আমাকে ছেড়ে দাও।
“নাহ, আজকে আমার ঘরেই তোকে থাকতে হবে আর তোর পেটের
সব কথা তোকে বলতেও হবে। কেঁদে একদম চোখ ফুলিয়ে ফেলেছিস! এত কষ্টটা কিসের তোর?”
“উফ, চিৎকার করো না। খালামণি উঠে যাবে।”
“আমি জানতে চাই তুই আমার ঘরে যাবি কিনা?”
ও ভালো করেই জানত, কথা না শুনলে আমি আরো রেগে যাব তাই অবশেষে আমার রাগের কাছে হার মেনে আমার ঘরে চলে এল। ওর দুটো হাত দুহাতে ধরে ওকে মুখোমুখি বসিয়ে বললাম,
“সবটা খুলে বল আমাকে, না বললে যে বুঝতে পারি না।”
“কী বলব? খালামণির ধারনটাই বোধহয় ঠিক।”
“কোন ধারণাটা?”
ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ওই যে, উনি মনে করেন আমি ইচ্ছে করলেই তোমার রাত করে বাসায় ফেরাটা বন্ধ করতে পারি, ইচ্ছে করলেই তোমার সিগারেট খাওয়া বন্ধ করতে পারি। ইচ্ছে করলেই তোমার সব বাউন্ডুলেপনা আমি ছাড়াতে পারি। কিন্তু আমি কিছুই বলি না তোমাকে। কারণ আমি তোমার ভালোবাসায় অন্ধ। এতটাই অন্ধ যে ঠিক-ভুল কিছু বুঝি না। তুমি যা করো তাই ঠিক মনে করি।”
“যে ছেলে মায়ের কথা শোনে না সে ছেলে বউ-এর কথা শুনবে? তাছাড়া মা তো জানেও না আমাদের বিয়ের কথা!”
মানসী আমার দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে বলল,
“বিয়ের কথা না জানলেও সম্পর্কের কথা তো জানে। সবাই পারে, শুধু আমিই পারি না। খালামণি আগেও অনেকবার বলেছে এসব, আর বলবেই বা না কেন? অনন্যা তো পেরেছে। সৌরভদা একসময় তোমারই মতো ছিল। এখনো কি আছে? নেই তো। অনন্যা তো ঠিক পেরেছে। আমি পারিনি এটা আমার ব্যর্থতা।”
কথাগুলো বলতে বলতেই কেঁদে ফেলল মানসী। এবার আমি বুঝতে পারলাম সমস্যাটা আসলে কোথায়! ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম,
“কাঁদিস না, প্লিজ।”
সাথে সাথে ও আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল। ব্যস, দিশেহারা লাগল আমার। এর চেয়ে বড় অস্ত্র আর কী লাগে? ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম,
“এতদিন এসব ব্যাপারে বলিসনি কেন কিছু? সব নিজের মধ্যে চাপিয়ে রাখিস। জানিস তো না বললে কিছু বুঝতে পারি না। তবু কেন বলিস না?”
“আমার তো সেই ক্ষমতাটাই নেই।”
মানসী আমাকে আরো শক্ত করে ধরে কাঁদতে লাগল। কতদিনের জমানো কান্না ছিল কে জানে! আমি ওর কপালে একটা চুমু খেয়ে বললাম,
“কাল থেকে তাড়াতাড়ি ফিরব, সিগারেটটা এখনি ছাড়তে পারব না। তবে কমিয়ে দেব প্রমিস! আর এখন থেকে সব কথা আমাকে বলবি I এবারের মতো মাফ করে দে। আমি বুঝতে পারিনি।”
সত্যিই আমি ওকে কখনো বুঝতে পারিনি। ও যে এত অভিমানী তা যদি আগে বুঝতাম তবে সব ছেড়েছুড়ে আমি শুধু ওকে বোঝার চেষ্টা করতাম!
কবে, কখন থেকে আমাদের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল তা আমরা নিজেরাও জানতাম না। প্রথমে কিন্তু কেউ কাউকে বলিওনি ভালোবাসার কথা তবু এই না বলা কথাটি আমরা দুজনেই হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। সেই ১৫ বছর বয়স থেকে ও মায়ের কাছ থেকে আমার পছন্দের সব রান্না শিখেছে। আমি অসুস্থ হলে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার ঘরে এসে সারারাত আমার পাশে বসে কেঁদেছে, অদ্ভুত! এমন তো না যে ও কাঁদলেই আমি সুস্থ হয়ে যাব, তবু কেঁদেছে। অথচ ও অসুস্থ হলে আমি বিন্দুমাত্র বিচলিত হইনি। কেন কে জানে!
আসলে ও আমার জন্য কী কী করেছে, কী রকম করে ভালোবেসেছে তা আমি লিখে শেষ করতে পারব না। সত্যি ওর মতো মেয়ে যার জীবনে আসবে তার মতো সৌভাগ্যবান ব্যক্তি আর নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে পাগলিটা যতদিন আমার কাছে ছিল আমি বুঝতে পারিনি যে আমি কতটা সৌভাগ্যবান। যত্ন করিনি ওকে। যত্ন করব কী! ওকে যে কতটা ভালোবাসি তা তো ওকে হারিয়ে বুঝেছি। কিন্তু যে মানুষটা আমাকে ওইভাবে ভালোবেসেছে, একটা দিন চোখের আড়াল হলে পাগল হয়ে গেছে, আমার বাহুতে মাথা রেখে না ঘুমালে যার ঘুম হয়নি সে মানুষটা আমাকে ছেড়ে কীভাবে আছে এতগুলো বছর? মেয়েরা বোধহয় এমনই যখন যেখানে থাকে সেখানেই মানিয়ে নিতে পারে!
নীরব ইশতিয়াক
১৮ মার্চ, ২০১৬
৬
তখন আমার ফাইনাল ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। রাত জেগে পড়তাম বলে মানসী আমার ঘরে আসত না। ও আর মোনালিসা একসাথে থাকত। আমার ঘরের পাশের ঘরটাই ওদের ছিল। দুই ঘরের একটা কমন বারান্দা ছিল। সেই নতুন বারান্দা দিয়েই আমার আর ওর সম্পর্কের যত চোরাকারবারি চলত। মোনালিসা টের পেলেও কাউকে কখনো বলেনি।
সেদিন খুব মিস করছিলাম ওকে। তাই বারান্দায় গেলাম ডাকতে। গিয়ে দেখি ও বারান্দায় অদ্রিকে বুকে শুইয়ে হাঁটাহাঁটি করছে। রাত তখন প্রায় পৌনে তিনটা বাজে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“এত রাতে হাঁটছিস! ঘুমাসনি কেন?”
ও ফিসফিসিয়ে বলল,
“ইশ, আস্তে কথা বলো। অদ্রি উঠে যাবে, কত কষ্টে ঘুম পাড়িয়েছি জানো?”
“ভালো করেছিস। এখন ওকে রেখে আয়। পড়তে পড়তে বোর হয়ে গেছি। এখন আমার তোকে দরকার।”
“পাগল হয়েছ? ওকে বুকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘুম না পাড়ালে ও ঘুমায় না। আর ঘুমানোর পর কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় শোয়ালে চিৎকার করে সারা বাড়ি মাথা তুলবে। ও যতক্ষণ ঘুমায় কোলেই ঘুমায়। খুব কোল চিনেছে পুঁচকুটা!”
একথা বলেই অদ্রির মাথায় একটা চুমু খেলো মানসী। আমি ওকে বললাম,
“এত কোল চিনলে ওর মায়ের কাছে দিয়ে আয়। তোর এত দায় কিসের?”
কী বলছ তুমি? তুমি জানো না? অনন্যা ওকে ঘুম পাড়াতে পারে না। এই
কাজটা খালামণি না হয় আমাকেই করতে হয়।”
“মা যখন হয়েছে সব পারবে। না পারলে মা হয়েছে কেন?”
“ছিঃ কি কথার ছিরি! এসব বলছ কী করে?”
“কেন বলব না? দিন নেই রাত নেই সবসময় দেখি তুই এইটাকে কোলে নিয়ে টিক টিক করে ঘুরঘুর করিস! মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি। এইসব ন্যাকামি আমার একদম পছন্দ না।”
“ছিঃ কী পচা হয়ে গেছ তুমি! কী ভীষণ স্বার্থপর! একটা রাত বউকে কাছে পাবে না বলে এরকম কথা বলছ?”
“দ্যাখ মানসী, আমি তোকে ডাকতে এসেছিলাম ঠিকই কিন্তু তার মানে এই নয় যে অদ্রির জন্য তুই যেতে পারবি না, তাই আমি এসব বলছি।”
“তাহলে কেন বলছ?”
“পরের বাচ্চা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করাটা ঠিক না। পরে ওর মা কিছু বললে প্রচণ্ড কষ্ট পাবি, সেজন্যই বলেছি।”
“তুমি যে কী বলো না! অনু কী বলবে আবার?”
“অনেক কিছুই বলতে পারে। যেমন ধর হয়তো বলবে, অদ্রি তোর বাচ্চা না আমার বাচ্চা। কিংবা ধর, একটা বাচ্চার জন্ম দিয়ে দেখেছিস কেমন লাগে? মা তো হোসনি, বুঝবি কী করে এইসব।”
“যাহ, তুমি একটা পাগল। অনু বুঝি সেরকম মেয়ে? তাছাড়া ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ওর বাচ্চা আমার বাচ্চা এবং আমার বাচ্চা ওর বাচ্চা সব একই কথা।”
আমি মানসীর পেছনে দাঁড়িয়ে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে কানের কাছটায় একটা চুমু খেয়ে বললাম,
“এসব কথা বলতে সেরকম মেয়ে হওয়া লাগে না। পরিস্থিতি সেরকম হলে এসব কথা তুমিও বলতে পারো। মেয়েরা বড্ড পজেসিভ হয়।”
“আমাকে তুমি করে বললে কেন?”
“মাঝে মাঝে বললে কী হয়?”
“তোমাকে কতবার বলেছি, তুমি করে বললে আমার ভালো লাগে না। মনে হয় যেন দূরে সরে যাচ্ছ।”
“দূরেই তো সরিয়ে দিচ্ছিস। তাও আবার পরের বাচ্চার জন্য। নিজের বাচ্চা হলে না জানি তুই কী করতিস।”
ও রেগে গিয়ে বলল,
“নীরবদা, তুমি কি বলো তো? একটা বাচ্চাকে হিংসে করছ?”
“আচ্ছা বাবা, সরি। আপনি কি এখনো হাঁটবেন? নাকি একটু শোবেন?”
“শোব, কিন্তু ওকে বুকে জড়িয়ে রাখতে হবে। শরীরের ওম না পেলে ও ঘুমাতে পারে না।”
“সে তো আমিও পারতাম না। তোর এই পুঁচকু এসে আমার সম্পত্তিতে ভাগ বসাল।”
“মোটেও না, তোমার পরীক্ষা বলেই আমি তোমার ঘরে খুব একটা আসি না। “যাতে আমার ডিস্টার্ব না হয়?”
“হ্যাঁ।”
“আর তুই আমার কাছে না থাকলে তোর কথা ভেবে ভেবে যে আমার পড়ার ডিস্টার্ব হয় তখন?”
“আমার কথা এত ভাবতে হবে কেন? আমি কি ভেগে যাচ্ছি নাকি?”
“আচ্ছা বাদ দে তো। এখন চল, আজকে আমার ঘরে ঘুমাবি। সমস্যা নাই তোর বাচ্চা তোর বুকেই থাকবে।”
“অদ্রিকে নিয়ে তোমার ঘরে ঘুমালে তোমার তো কোনো লাভ নেই। এক সেকেন্ডের জন্য ওকে কোল থেকে নামাতে পারব না।”
“আপাতত দীর্ঘমেয়াদি লাভ না হলেও চলবে। তোর চুলের আর শরীরের ঘ্রাণ পেলেই আমার ঘুমটা আরামের হবে। লাভ এই একটাই। এত রাত পর্যন্ত পড়ার পর একটু আরামে ঘুমানো দরকার।”
তারপর লাইট অফ করে সেদিন ও আমার পাশে শুয়ে পড়েছিল। আমিও একটু একটু করে ওর কাছে গিয়ে ওকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলাম যাতে অদ্রির ঘুমটা না ভেঙে যায়। অন্ধকারেও আবছা আলোয় টের পেলাম ও মিটমিট করে হাসছিল। কিন্তু কেন হাসছিল? ও কি তবে এরকম কিছুই চাচ্ছিল!
তার বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা। ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখছিলাম। পাশেই মানসী অদ্রিকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। আর অনন্যা পাশে বসেই মায়ের কাছে সোয়েটার বোনা শিখছে।
অদ্রি এত দুষ্টুমি করছিল, খেতে তো চাইছিলই না উল্টো মানসীকে হাঁপিয়ে তুলেছিল। হঠাৎ মানসী রেগে গিয়ে অদ্রিকে একটা চর মেরে বলল,
“আমাকে আর কত জ্বালাবি তুই?”
অদ্রি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। কিছু বোঝার আগেই অনন্যা লাফিয়ে পড়ে অদ্রিকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
“আমার বাচ্চাকে মারার সাহস তুই কোত্থেকে পেলি? ওর খেতে ইচ্ছে করলে খাবে, ইচ্ছে না করলে খাবে না। এখানে তুই বলার কে? তোর হাতে দিয়েছি বলে তুই যা ইচ্ছা তাই করবি? কোনো জানোয়ারও তো এইটুকু বাচ্চার গায়ে হাত তুলতে পারবে না। খবরদার বলছি এরপর থেকে আমার মেয়ের কোনো ব্যাপারে নাক গলাতে আসবি না।”
এক দমে কথাগুলো বলে অনন্যা অদ্রিকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। মানসী এতক্ষণ হাঁ করে চেয়ে কথাগুলো শুনছিল। অনন্যা চলে যেতেই হাঁটুতে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলল। মা আর আমি ওর কাছে গিয়ে বসলাম। মা ওর মাথায় হাত রেখে বলল,
“কাঁদছিস কেন মা? সংসারে এরকম কত কী হয়! কাছের মানুষরাই আমাদের বুঝে না বুঝে কষ্ট দেয়। এসব নিয়ে মন খারাপ করলে চলে না।”
মানসী ওর স্বভাবসুলভ চুপচাপ কেঁদে গেল। কোনো কথা বলল না। মা আবার বোঝালো,
“লক্ষ্মী মা আমার, কাঁদিস না। ও ছোট মানুষ বুঝতে পারেনি। হ্যাঁ বয়সে তো তোরা সমান তবে তোর মতো ম্যাচিউরিটি তো ওর আসেনি। তাছাড়া ওর মেয়েকে মেরেছিস ওর তো একটু খারাপ লাগবেই।”
মানসী কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
“আমি কি অত জোরে মেরেছি নাকি? অদ্রি তো দুপুরে কিছু খায়নি, এখনো না খেয়ে থাকলে আমি তো খেতে পারতাম না। আর বাচ্চাদের কি শুধু আদর করলেই হয়? প্রয়োজনে শাসনও তো করা লাগে।”
আমি এতক্ষণ চুপ করেই ছিলাম। এবার বললাম,
“তোর এই কান্নাটা দেখতে চাইনি বলেই সেদিন ওই কথাগুলো বলেছিলাম।”
নীরব ইশতিয়াক
২১ মার্চ, ২০১৬
এতক্ষণ পড়ছিল বলে কেউ কারো দিকে তাকায়নি। পড়া শেষ করে অদ্রির দিকে তাকিয়েই অৰ্পি চমকে উঠল। অদ্রি কাঁদছে!
৭
অৰ্পি বলল,
“আপ্পি, কাঁদছিস কেন?”
“ঠিক বুঝতে পারছি না কেন এত কান্না পাচ্ছে। যে মানুষটা আমাকে এত আদর করত, তার সম্পর্কে কিছুই জানি না সেজন্য নাকি অন্য কিছু!”
অর্পি বোনকে কাঁদতে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে, কী বলবে বুঝতে পারছে না। বলল,
“আপ্পি, রাত আড়াইটা বাজে, তুই এভাবে কাঁদলে তো পড়ে শেষ করতে পারব না।”
“আমি ঠিক আছি! পরের পৃষ্ঠায় যা।”
অৰ্পি পৃষ্ঠা উল্টালো…
দিহান বড় হচ্ছে। আমি বাবা হিসেবে সব দায়িত্বই পালন করছি, ওকে সময়ও দিচ্ছি কিন্তু ওর সাথে বাপ-ছেলের কোনো আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে না। দিহান আমাকে ভয় পায়, পারতপক্ষে ধারেকাছে আসে না। আমি দিহানকে প্রচণ্ড ভালোবাসি অথচ কেন যেন প্রকাশ করতে পারি না। ও যেদিন পৃথিবীতে এসেছিল সেদিন আমি ওকে কোলে নেয়ার পর দিতিয়া বলেছিল,
“বলো তো তোমার কোলে কে?”
আমি হেসে বলেছিলাম,
“কে আবার দিহান।”
“ওর আসল পরিচয় জানো?”
“মানে?”
দিতিয়া বলেছিল,
“ওর আসল পরিচয় হলো ও দিতিয়া, মানসী এবং নীরবের ছেলে। দিতিয়া, মানসী আর আমার সন্তান! কনসেপ্টটা কি দারুণ না? ওকে কোলে নিয়ে সেদিন আমার এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। যা বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই।
“আমার সন্তান–এই কথাটা ভাবলে আমার দিহানের আগে তুলতুলের কথা মনে হয়। তুলতুল আমার প্রথম সন্তান সেজন্যই বোধহয়।”
এই পর্যন্ত পড়ে অর্পির চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। বলল,
“তুলতুলটা কে?”
“পড়লি তো, চাচ্চুর মেয়ে।”
“তাহলে সে এখন কোথায়?”
“উফ অৰ্পি, তুই যতটুকু পড়েছিস আমিও তো ততটুকুই পড়েছি। তাই না? চুপচাপ পড় তো।”
ওরা আবার পড়া শুরু করল…
তুলতুল আমার মেয়ে, আমার আর মানসীর মেয়ে। ওকে এই পৃথিবীতে আসার ভিসা আমরা দিতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু ওর অস্তিত্ব তখনও ছিল। এখনো আছে।
মানসী খুব বাচ্চাকাচ্চা পছন্দ করত। আমাকে সবসময় বলতো, আমাদের একটা মেয়ে হবে। এমন হবে, তেমন হবে। ওকে নিয়ে আমরা এটা করব, ওটা করব। এভাবে সাজাব, ওভাবে সাজাব। একসময় ওর এসব প্ল্যানিং-এ নিজের অজান্তে আমিও যোগ দিলাম।
একদিন বিকেলবেলা বিছানায় হেলান দিয়ে বই পড়ছিলাম। বইয়ে এতই মগ্ন ছিলাম মানসী যে কখন এসে আমার পাশে বসেছে খেয়ালই করিনি। হঠাৎ শুনতে পেলাম ও বলছে,
“বইটা কি আমার থেকেও সুন্দর?”
আমি হেসে বললাম,
“তা এই সুন্দরী এতক্ষণ কোথায় ছিল?”
“শোনো না, বইটা একটু রাখো তো। তোমার সাথে খুব ইম্পরট্যান্ট একটা কথা আছে।”
“বল, শুনছি।”
“থাক, তোমার শুনতে হবে না। তুমি বই পড়ো।”
“আরে কই যাচ্ছিস? এই রেখে দিলাম, এবার বল।”
একটু গালটা টিপে দিয়ে বললাম,
“খালি রাগ না?”
মানসী খুব সংকোচ করে যেটুকু বলল তা হলো,
“না মানে, একটা কথা আরকি! তোমার সাথে শেয়ার করা দরকার।”
“এত আমতা আমতা করছিস কেন? বল কি বলবি?”
মানসী লজ্জা পাচ্ছিল। আমার মাথায় কিছু আসল না, যে মেয়েটা সারারাত আমার বুকে লেপ্টে থাকতে ভালোবাসে, যার অজানা কিছুই নেই আমার, তার এমন কী কথা থাকতে পারে যা বলতে লজ্জায় একেবারে মরে যাচ্ছে! আমি ওর একটা হাত আমার বুকে চেপে ধরে বললাম,
“আমাকে এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে? পাগলি! বল তো।”
“কই লজ্জা পাচ্ছি না তো।”
“লাল হয়ে গেছিস অলরেডি।”
“কালোরা লজ্জা পেলে লাল হয় না।”
“অহেতুক কথা বলিস না, যেটা বলতে এসেছিস সেটা বল।”
“নাহ মানে, থাক আরেকদিন বলব।”
এই বলেই ও উঠে যাচ্ছিল। আমি ওকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
“এখন আই কন্টাক্ট হবে না। তাই লজ্জার কোনো কারণ দেখছি না। এবার তো বল।”
“আমাকে একটু ভালো করে দেখো না। আই মিন চেকাপ করো।”
“কেন তোর আবার কী হলো? কোনো সমস্যা?”
“হ্যাঁ”
“কী সমস্যা?”
“অনেক সমস্যাই হচ্ছে। আমার কেমন যেন লাগছে গো। একটু ভালো করে দেখো না আমার পেটে বাচ্চা এল কিনা!”
হাসতে হাসতে আমার দম বন্ধ হবার জোগাড়! কোনোরকমে বললাম, “তোর এমন কেন মনে হচ্ছে?”
মানসী খুব অভিমান করে বলেছিল,
“সবকিছুতেই তোমার ঠাট্টা। আমার ওরকম মনে হলো বলেই তো বললাম। যাও, কথাই বলব না।”
“আচ্ছা বাবা সরি, শোন শোন…তোর তো বাচ্চাকাচ্চা খুব পছন্দ তাই এসব মনে হয়। তার ওপর তোর বেস্ট ফ্রেন্ড এক বাচ্চার মা হয়ে গেছে, তোরও তাই…”
আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মানসী বলল,
“আন্দাজে কথা বলছ কেন? খুব বড় ডাক্তার হয়ে গেছ?”
“আন্দাজে বলব কেন? তুই প্রেগন্যান্ট হলে তোকে দেখেই বুঝব আমি। তাছাড়া আমি বাপ হচ্ছি কিনা সেটা আমি জানব না?”
মানসী চুপ। আমি আবার বললাম,
“লক্ষণ যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা অন্য কারণে। দুদিনে ঠিক হয়ে যাবে।”
ও এবারো কিছু বলল না। চুপ করে আমার বাহুডোরে বসে রইল। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম,
“খুব মা হতে ইচ্ছে করে বুঝি?”
“তুমি বোঝো না কিছু।”
আমি হেসে বললাম,
“আমার ইন্টার্নশিপ তো প্রায় শেষ। এরপর একটা চাকরি হয়ে গেলেই সবাইকে জানিয়ে আবার বিয়ে করব। তারপর আর তোর মা হওয়া আটকায় কে!”
“ধেৎ, তুমি না…!”
“পাগলি এই কটা দিন অপেক্ষা করতে পারবি না?”
“তোমার জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারব।”
“হুহ…এগুলো সব আবেগের কথা, তোর বাপ তোকে একটা ধমক দিলে তুই সেকেন্ডের মধ্যে আমাকে ভুলে যাবি।”
“ছিঃ কক্ষনো না। আমি বাবাকে ভয় পাই ঠিকই, কিন্তু তার চেয়ে বেশি ভয় পাই তোমার থেকে দূরে থাকা। আমি বাবাকে ঠিক ম্যানেজ করে ফেলব দেখো। আর খালামণি তো আছেই, তার কথা বাবা কিছুতেই ফেলতে পারবে না।”
আমি ওর গাল টিপে আদুরে গলায় বললাম,
“হুম তাও তো ঠিক।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মানসী হঠাৎ বলে উঠল,
“এই শোনো, আমাদের একটা মেয়ে হলে নাম রাখব তুলতুল
“তুলতুল? এটা আবার কেমন নাম?”
“এটা ডাক নাম। ভালো নাম তুমি কিছু একটা রেখো। কিন্তু ডাকনামটা তুলতুলই হবে।”
“আচ্ছা কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।”
“কী?”
“ওর গালগুলো যদি তোর মতো তুলতুলে হয় তাহলেই ওর নাম তুলতুল রাখতে দেব।”
মানসী হেসে বলল,
“সব বাচ্চাদের গালই তুলতুলে হয়। শুধু গাল কেন, পুরো শরীরই নরম তুলতুলে হয়?”
“তোর মতো?”
একথা বলতেই ও আমাকে অসভ্য বলে মারতে লাগল।
আগে যেমন আমরা বলতাম আমাদের একটা বাচ্চা হলে ওকে নিয়ে এই করব সেই করব…সেদিন নাম রাখার পর থেকে আমরা তুলতুলের নাম ধরেই বলতাম। সত্যি তুলতুল জন্ম না নিয়েও খুব ইম্পরট্যান্টলি আমাদের মধ্যে ছিল।
নীরব ইশতিয়াক
২ এপ্রিল, ২০১৬
ডায়েরির পৃষ্ঠা উল্টাতেই অদ্রি অর্পির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। পুরো ডায়েরিটাতে আর কোথাও কিচ্ছু লেখা নেই!
৮
সারারাত জেগে সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেছিল অদ্রির। সকাল থেকেই ভাবছে মানসীর কথা। কে ছিল উনি? সবাই যখন ওনার কথা জানত তাহলে এরকম কেন হলো? চাচ্চু যখন ওনাকে বিয়েই করেছিল তাহলে বিয়েটা ভাঙল কী করে? আর কেনই বা ভাঙল? দুজন তো দুজনের জন্য পাগল ছিল, তাহলে? কী এমন ঘটতে পারে যার জন্য আজ দুজনে আলাদা? অনেকগুলো প্রশ্ন মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। কোনো হিসেব মিলছে না। ছোটবেলাটা যার কোলে কোলে কাটিয়েছে তার কোনো অস্তিত্বই জানে না অদ্রি। কী অদ্ভুত এই দুনিয়া।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে এসব ভাবছিল অদ্রি। অর্পি ঘরে ঢুকে ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে ক্রসবেল্ট খুলতে খুলতে বলল,
“আপ্পি কোনো ক্লু বের করতে পারলি?”
অদ্রি বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“কিসের?”
“মানসীর।”
“না।”
“জানিস আপ্পি, ক্লাসে একদম মনোযোগ দিতে পারিনি। শুধু ভেবেছি বাকিটা কী করে জানব!”
“কোনো উপায় নেই।”
“তা বললে তো হবে না। উপায় একটা বের করতেই হবে এট এনি কষ্ট।”
অদ্রি কিছু বলল না। অর্পিই আবার বলল,
“বাবা তো অনেক ফ্রেন্ডলি। চল বাবাকে জিজ্ঞেস করি?”
“পাগল হয়েছিস? বাবা যখন জিজ্ঞেস করবে এসব ব্যাপার আমরা জেনেছি কোত্থেকে, কী বলবি? চাচ্চুর ডায়েরি পড়েছি?”
অর্পি দাঁতে জিভ কেটে বলল,
“তাইত! কিন্তু আমরা জানব কী করে?”
“ভাবতে হবে। যদিও আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে জানার কোনো উপায় নেই কিন্তু নাথিং ইজ ইম্পসিবল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। এন্ড আই বিলিভ ইট।”
অর্পি অদ্রির গলাটা জড়িয়ে ধরে বলল,
“দ্যাটস লাইক মাই বিগ সিস।”
সন্ধ্যাবেলা অদ্রিকে দাদুর ঘরের সামনে দেখে অৰ্পি বলল, “দাদুকে নিয়ে কি কোনো প্ল্যান করছিস?”
অদ্রি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
“হুম।”
“কী প্ল্যান?”
“এদিকে আয়, বলছি।”
এই বলে অদ্রি অর্পিকে টেনে ঘরে নিয়ে গেল। তারপর দরজা লাগিয়ে দিয়ে বলল,
“শোন, যেহেতু দাদুর একটা বোন ছিল। সেহেতু দাদুর অবশ্যই বোনের ব্যাপারে একটা দুর্বলতাও আছে। এটাকেই আমাদের কাজে লাগাতে হবে।”
“হুম, কিন্তু অতটা দুর্বলতা নাও থাকতে পারে। গ্যাঞ্জাম কিছু একটা হয়েছিল সে ব্যাপারে তো আমরা সিওর। ছোটবেলা থেকে কখনো দেখেছিস ওদেরকে? মানলাম ওরা কানাডা থাকে তাই আসে না। কিন্তু ফোন টোনও তো আসে না।”
“দুর্বলতা হয়তো চাপা পড়ে আছে।”
“মানে?”
“তুই যখন আমার সাথে রাগ করিস, তখন কি আমার সাথে কথা বলিস?”
“না।”
“কষ্ট কিন্তু ঠিকই হয়। রাত্র বেলা কাঁদিসও।”
“হুম, তুই তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তুই আমার সব থেকে আপন। তাই তোর সাথে ঝগড়া হলে খুব কষ্ট হয়।”
“তেমনি সব বোনেদেরই ছোটবেলা এভাবেই কাটে। কিন্তু বিয়েশাদি হলে দূরত্ব বাড়ে, সংসার আর ক্যারিয়ারের ঝামেলায় ব্যস্ত হয়ে যায়। তারপরেও অনুভূতিগুলো রয়েই যায়। আর আমাদেরকে সেটাই খুঁচিয়ে বের করতে হবে।”
“বাহ! তাহলে তুই দাদুর ঘরের সামনে থেকে চলে আসলি কেন?”
“আরে বাবা এখন হঠাৎ করে কিছু বললে তো সন্দেহ করবে। সুযোগ বুঝে খোঁচা মারতে হবে। এই ধর দাদুর সামনে এনি হাউ আমরা দুবোন আমাদের দুজনের প্রতি ভালোবাসা দেখাবো। তারপর দাদু নিশ্চয়ই কিছু বলবে। তোর মনে নেই আমাদের ঝগড়া দেখলেই দাদু বলে ঝগড়া করো না বোন হলো সবচেয়ে কাছের মানুষ। বা বেশি খাতির দেখলেও বলে এরকমভাবে চিরকাল থেকো। এরকম কিছু বললেই আমরা দাদুকে তার বোনের কথা জিজ্ঞেস করব।”
“ওকে কিন্তু কবে? কীভাবে? আমি তো আর অপেক্ষা করতে পারছি না রে আপ্পি!”
“একটু ধৈর্য তো আমাদের ধরতেই হবে রে বোন।”
রাত্রে যখন সবাই খেয়ে উঠে গেল অর্পি তখননো খাচ্ছে, অর্পির খেতে অনেক সময় লাগে। আজ অদ্রির প্ল্যানমতো আরো বেশি দেরি করে খাচ্ছে। কারণ একটু পরেই দাদু সারা রাতের জন্য পানি নিতে আসবে। আর তখন অদ্রি অর্পির অভিনয় শুরু হয়ে যাবে। অর্পি বলল,
“কিরে আপ্পি? আজ কি দাদু পানি নিতে আসবে না? ভাত নিয়ে কতক্ষণ বসে থাকব? নাকি আগেই নিয়ে গেছে?”
“আরে দাঁড়া না। আরেকটু দেখি।”
কিছুক্ষণের মধ্যে দাদু আসছে টের পেয়ে অদ্রি অর্পিকে খাইয়ে দিতে শুরু করল। দাদু ওদেরকে দেখতে পেয়ে বলল,
“কী ব্যাপার? আমার দাদু মনিরা এখনো খাচ্ছে?”
অদ্রি বিরক্তিভরা কন্ঠে বলল,
“আর বলোনা দাদু, এই মেয়েটার খেতে যে এত সময় লাগে। আবার বলছে আমি না খাইয়ে দিলে খাবে না।”
দাদু বলল,
“তো দাও না দাদু। বড় হয়ে গেলে কে কোথায় চলে যাবে তার কোনো ঠিক ঠিকানা আছে? তখন তো এসবই স্মৃতি হয়ে থাকবে।”
হঠাৎ অৰ্পি বলে উঠল,
“আচ্ছা দাদু, তোমার না একটা বোন ছিল?”
অদ্রি মনে মনে রেগে গেল। অর্পিটা কিচ্ছু বোঝে না। এভাবে নয়, অন্যভাবে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। উফ মেয়েটা সাহস দেখিয়ে সব ডোবাবে।
দাদু কেমন আনমনা হয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ছিল ছোটবোন একটা। খুব আদরের বোন ছিল।”
অদ্রি জিজ্ঞেস করল,
“সে এখন কোথায়?”
“এখন কানাডাতে থাকে। ওর মেয়ে বিয়ের পর কানাডা চলে যায়। তারপর ওর স্বামী মারা যাওয়ার পর মেয়ে ওকেও কানাডাতে নিয়ে যায়। আর তো ছেলেপুলে নেই কার কাছেই বা থাকবে।”
অৰ্পি বলল,
“ওহ ওনার সাথে তোমার যোগাযোগ নেই? কই ফোন করতে দেখিনি তো কখনো।”
“নারে, ওর সাথে আর আমার কোনো যোগাযোগ নেই। ওর তো অনেক রাগ আমার ওপর।”
একথা বলেই উদাস হয়ে গেল দাদু। এই উদাসীনতাকেই কাজে লাগাতে হবে। অদ্রি বলল,
“কিসের রাগ দাদু?”
“সে তোরা বুঝবি না। বড়দের অনেক সমস্যা। বড় হোসনে বোন, বড় হোসনে।”
একথা বলতে বলতে দাদু কেঁদে ফেলল। অদ্রি অর্পি কী করবে বুঝতে পারল না। দাদু এক বোতল পানি নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। অদ্রি বলল,
“বিষয়টা খুব সেনসিটিভ। তা না হলে দাদু এভাবে কেঁদে ফেলত না। দাদুকে আর কক্ষনো এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না।”
অর্পি অদ্রির হাতটা ধরে বলল,
“আপ্পি আমাদের ছেলেমেয়েরা যদি প্রেম করে আমরা তবে মেনে নেব ওকে? কারণ আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারব না। যতই ঝগড়া করি আমি তোকে খুব ভালোবাসিরে আপ্পি।”
অদ্রি অর্পির মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে বলল,
“পাগল!”
অর্পি একটু থেমে বলল,
“আচ্ছা আপি তাহলে তো দাদুকে আর জিজ্ঞেস করা যাবে না। আমরা বাকিটা জানব কী করে?”
অদ্রি হাত ধুতে ধুতে বলল,
“এখানে কথা বলাটা ঠিক হবে না। ঘরে চল বলছি।”
ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে অদ্রি বলল,
“আমাদের বাকি কাহিনীটা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কারণ
বাকিটা ওই ডায়েরি পড়েই জানতে হবে।”
“সেটা কী করে সম্ভব? ডায়েরি তো ফাঁকা।”
“এখন ফাঁকা। কিন্তু কদিন পর তো ফাঁকা নাও থাকতে পারে।”
“তুই কী বলতে চাচ্ছিস বুঝতে পারছি না।”
“আমার বিশ্বাস চাচ্চু আবারও লিখবে। পুরো কাহিনীটাই লিখবে। বেশি সময় তো পায় না, তাই হয়তো অল্প অল্প করে লেখে। কিন্তু লিখবে।”
“তুই কী করে এত সিওর হচ্ছিস?”
“তুই খেয়াল করেছিস প্রত্যেকটা লেখার পর সিগনেচার আর তারিখ দেয়া আছে। তারিখগুলো কিন্তু কিছুদিন আগের। শেষ লেখাটা ২ এপ্রিল, ২০১৬ মানে গতকালকের। তার মানে কাল চাচ্চু এটাই লিখছিল। এখন আমাদের শুধু নজর রাখতে হবে কবে চাচ্চু লাইব্রেরিতে অনেকটা সময় কাটায়। তাহলেই বুঝব চাচ্চু লিখেছে।”
“আপ্পি তুই খেয়াল করেছিস চাচ্চু প্রতিটা লেখা লিখেছে কোনো না কোনো স্মৃতি মনে করে।”
“হুম। এটাও একটা প্লাস পয়েন্ট। আর চাচ্চু এই কথাগুলো কারো সাথে শেয়ার করতে পারছে না বলেই ডায়েরিতে লিখছে, তাতে মন হালকা হচ্ছে। আর একবার যখন লিখতে শুরু করেছে শেষ নিশ্চয়ই করবে। তাছাড়া মন হালকা হবে না।”
“আর যদি চাচ্চু না লেখে তাহলে কি সব অজানাই রয়ে যাবে?”
“আরে দেখি না কী হয়। এত অস্থির হলে কী করে হবে?”
“কী করব? আমি যে বড্ড অস্থির রে আপ্পি।
৯
দেখতে দেখতে দুটি সপ্তাহ কেটে গেল। কিন্তু চাচ্চু আর লাইব্রেরিতে ঢোকেনি। অনেক রাতে বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ এক বৃহস্পতিবার রাতে অদ্রি-অর্পি খেয়াল করল চাচ্চু সারারাত লাইব্রেরিতে কাটাচ্ছে। শুক্রবার রাত্রেও চাচ্চুকে লাইব্রেরিতে দেখা গেল। শনিবার ওরা জানতে পারল চাচ্চু অসুস্থ, কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছে। ছুটির ম্যাক্সিমাম সময়টা চাচ্চু লাইব্রেরিতেই কাটাল। চাচ্চু বাসায় থাকাতে লাইব্রেরিতে যাওয়ার সাহস ওদের কারো নেই। এক সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে শনিবার চাচ্চু হসপিটালে গেল।
সেদিন অর্পি স্কুল থেকে ফেরার পর থেকেই অপেক্ষা করতে লাগল কখন সবার লাঞ্চ শেষ হবে আর ওরা লাইব্রেরিতে যাবে। দুপুরবেলা লাঞ্চের পর যখন সবাই ঘুমাতে গেল তখন অদ্রি অর্পি লাইব্রেরিতে ঢুকল। ড্রয়ার তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফেলল, কিন্তু কোথাও চাবি পাওয়া গেল না।
অৰ্পি বলল,
“আপ্পি, আমার কান্না পাচ্ছে। এতদিন অপেক্ষা করলাম আর এখন কিনা পড়তে পারব না!”
অদ্রি বলল,
“আরে দাঁড়া না। চাবিটা ভালোভাবে খুঁজতে হবে, হয়তো অন্য কোথাও রেখেছে।”
“যদি চাবিটা চাচ্চু সাথে করে নিয়ে যায়?”
“উঁহু। তা করবে না। চাচ্চু ভালো করেই জানে এ ঘরে কেউ আসে না। আর চাচ্চুর মধ্যে লুকোচুরিরও কিছু নেই। থাকলে চাবি প্রথম থেকে ড্রয়ারে ফেলে রাখত না। হয়তো ড্রয়ারের মতোই খুব সিম্পল কোনো জায়গায় রেখেছে, হাতের কাছেই। আমাদের জাস্ট খুঁজতে হবে।”
“আচ্ছা আপ্পি এই আলমারিটা তো টেবিলের কত কাছে, এর ড্রয়ারে রাখেনি তো?”
ওরা আলমারির ড্রয়ারে খুঁজে দেখল কিন্তু পেল না। অদ্রি বলল,
“আচ্ছা আমরা একটু আমাদের মতো করে চিন্তা করি তো, আমরা হলে চাবিটা কোথায় রাখতাম।”
অৰ্পি বলল,
“আমি তো অবশ্যই আমার ব্যাগে রাখতাম।”
“হুম, মেয়েরা সবকিছুই ব্যাগে রেখে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, কিন্তু ছেলেরা না।”
ওরা আস্তে আস্তে সারা ঘরের সমস্ত ড্রয়ার, বক্স সবকিছু খুঁজে ফেলল। কোথাও নেই চাবিটা। শেষমেষ পেন হোল্ডার থেকে পেনগুলো উঠাতেই চাবির ছড়াটা চোখে পড়ল অর্পির। আর চোখেমুখে খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ল।
ড্রয়ার খুলে ডায়েরিটা হাতে নিয়েই অর্পি বলল,
“আপ্পি আমার বুকটা দুরুদুরু কাঁপছে দেখ।”
“কেন?”
“যদি দেখি ডায়েরির লেখা ঐ পর্যন্তই!”
“আরে না পাগল, তাহলে চাবির জায়গা চেঞ্জ হতো না। আর চাচ্চুও এতদিন ধরে দিনরাত লাইব্রেরিতে পড়ে থাকত না। আর যদি লেখা নাও থাকে, অন্যভাবে জানার চেষ্টা করব। জানতে তো আমাদের হবেই।”
এই বলে ডায়েরিটা অর্পির হাত থেকে নিয়ে খুলল অদ্রি। একটা পাতায় মাত্র কয়েকটা লাইন। খুব ছোট্ট চিঠির মতো। সেখানে লেখা,
মানসী,
কদিন যাবৎ শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তোর হাতের একটু স্পর্শ খুব দরকার। একবার শুধু একটাবার।
নীরব ইশতিয়াক
২১ এপ্রিল, ২০১৬
পৃষ্ঠা উল্টাল অৰ্পি। সেখানে অনেকটা লেখা পাওয়া গেল…
ইন্টার্নশিপের পর পরই আমাদের মেডিকেল কলেজেই আমার চাকরি হয়। খবরটা প্রথম মাকে দিয়েছিলাম। তারপর মানসীকে খুঁজতে লাগলাম
খবরটা দেয়ার জন্য। কিন্তু সারা বাড়িতেও খুঁজে পেলাম না। শেষে মাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ও ছাদে গেছে। ওর নাকি মন খারাপ। আমিও ছাদে গেলাম। মানসী আমাদের ছাদের ছোট্ট কৃষ্ণচূড়া গাছটার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সূর্যটা ডুবে যাচ্ছিল, কন্যাসুন্দর আলো এসে পড়েছিল মানসীর মুখে। কী মায়া!
আমি মানসীর পেছনে দাঁড়িয়ে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে বললাম, “আমার সোনা বউটার নাকি মন খারাপ?”
মানসী আমার দিকে ফিরে বলল,
“কখন এলে?”
“এইমাত্র।”
“দুপুরে কোথায় খেয়েছ?”
“ওসব পরে হবে। আগে বল তোর মন খারাপ কেন?”
“খারাপ খবর আছে, শুনলে তোমারও মন খারাপ হবে।”
“হুম, আর আমার কাছে একটা ভালো খবর আছে, খারাপ খবরের দুঃখটা না হয় ভালো খবর দিয়ে ঢেকে দেব। বল কী হয়েছে?”
“বাবা-মা ঢাকায় আসছে।”
“ওহ এটা কোনো খারাপ খবর নাকি? আসছে আসুক। ঢাকা তো আর আমাদের একার না।”
“ফাজলামো রাখো। বাবা-মা পার্মানেন্টলি চলে আসছে। বাবা ঢাকায় ট্রান্সফার হয়েছে। আর আমার বাবা-মা যদি ঢাকায় থাকে তাহলে তো আমাকেও তাদের সাথেই থাকতে হবে তাই না? আমি তোমাকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেও পারি না। কখনো কি থেকেছি তোমাকে ছাড়া!”
“কবে আসছে?”
“সামনের মাসের এক তারিখ।”
আমি মানসীর মুখটা দুহাতে তুলে ধরে বললাম,
“আমি সেদিন আমাদের মেডিকেল কলেজের হসপিটালে জয়েন করছি।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ, মাত্র কটা দিন আমাদের কষ্ট করতে হবে। আমি চেষ্টা করব দুএক মাসের মধ্যেই সব গুছিয়ে নিয়ে বিয়েটা করে ফেলতে। তুই টেনশন করিস না।”
“এই সুখবরটাই কি দিতে চেয়েছিলে?”
“হ্যাঁ। তুই খুশি হোসনি?”
“খুব খুশি হয়েছি গো খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু তুমি এখনই চাকরি নিলে যে? কিন্তু হায়ার স্টাডিজের জন্য বাইরে যাবে না?”
“আরেব্বাস। এখনই নাকি? ওসব বুড়ো বয়সে হবে।”
“কী বলছ এসব?”
আমি এবার একটু সিরিয়াস হলাম। ওকে ছেড়ে পাশের কার্নিশে বসলাম। ওর হাতটা ধরে বললাম,
“শোন, তুই তো জানিস আমি ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় কতটা সিরিয়াস ছিলাম। সেজন্যই সৌরভের বিয়ের সময় বিয়ে করতে চাইনি। তখনো পর্যন্ত সবকিছু ঠিক ছিল। আমার এইম, আমার অ্যাম্বিশন, আমার ড্রিম সবকিছু। অনেক বড় ডাক্তার হবো। অনেক পড়াশোনা করব। কিন্তু এখন আর সেসব ইচ্ছে নেই। এখন মনে হয় কী হবে এসব করে?”
মানসী অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। আমার কথা শেষ হতেই বলল, “কী হয়েছে তোমার? সত্যি করে বলো।”
“দ্যাখ, তোর কাছে লুকানোর তো কিছু নেই। বিয়ের পর আমার সবকিছু তোর দিকে কেমন ডাইভার্ট হয়ে গেছে। পড়াশোনা করতে আর ভালো লাগে না। মনে হয় টাকা আয় করতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। সেই ছোটবেলা থেকে সম্পর্ক আমাদের। কখনো এরকম ফিলিংস হতো না। আর বিয়ে হয়েছে ১ বছরও হয়নি তবু চিন্তাভাবনা কতটা পাল্টে গেছে। বিয়ের আগে অনেক বাইন্ডিংস ছিল যা বিয়ের পর আস্তে আস্তে সরে গেল। আর তারপর থেকেই আমার তোর প্রতি দায়িত্ববোধ বেড়ে গেল। এখন তো শুধু একটাই চিন্তা কবে সবাইকে জানিয়ে আবার তোকে বিয়ে করতে পারব। কবে তুলতুল আসবে আমাদের মাঝে। সেজন্যই তো এত তাড়াতাড়ি চাকরি নিলাম। চাকরির কথা শুনে মা খুব একটা খুশি হয়নি। মা বলছিল হায়ার স্টাডিজের জন্য বাইরে যেতে। কিন্তু আমি মাকে বোঝাতে পেরেছি। আর আমার এই চাকরিটা তো খারাপ না। যেখান থেকে পড়াশোনা করে সেখানে চাকরি করার ভাগ্য কয়জনের হয় বলত?”
মানসী কোনো কথা বলছিল না। চুপ করে আমার কথা শুনছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“কিরে চুপ করে আছিস কেন?”
“কোনো মানুষ কি তার বউকে এতটা ভালোবাসতে পারে?”
মানসীর গলা কাঁপছিল। চোখে পানি। আমি ওর হাত ধরে টেনে আমার পাশ থেকে সামনে নিয়ে এলাম। ওর দুটো হাত ধরে বললাম,
“চোখে পানি এনেছিস ভালো কথা। কিন্তু কাঁদিস না। তুই কাঁদলে আমার ভালো লাগে না।”
মানসী এবার খুব শক্ত হয়ে বলল,
“নীরবদা শোনো, তুমি একটু আগে যে অলক্ষুনে কথাগুলো বলছিলে ওগুলো আমি আর কক্ষনো শুনতে চাই না। চাকরিটা তুমি করবে না। বাইরে চলে যাও পড়তে। ততদিনে আমার পড়াশোনাও শেষ হয়ে যাবে। তারপর নাহয় আমাদের বিয়ে হবে।”
আমি হেসে বললাম,
“কেন রে? হাতুরে ডাক্তার স্বামী দিয়ে চলবে না? এদেশে কত মানুষ শুধু এমবিবিএস দিয়ে ডাক্তারি করছে না?”
“তোমার কোয়ালিফিকেশন দেখে তো তোমাকে ভালোবাসিনি। তাই তুমি যেমনই হও আমার তাতেই চলবে। বরং অন্য আর কাউকে দিয়ে চলবে না। কিন্তু তুমি যা বললে তাতে এটাই দাঁড়াচ্ছে যে তোমার এই অবস্থার জন্য একমাত্র আমি দায়ী। কিন্তু আমি তো এমন ভালোবাসা তোমার কাছে চাইনি। তোমার আমাকে এত ভালোবাসা লাগবে না। তুমি নিজেকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে নাও। আমি কখনো চাইনি আমার ভালোবাসায় বা আমাকে ভালোবাসতে গিয়ে তোমার কোনো অবনতি হোক। আমাকে ছুঁয়ে বলো তুমি আরো পড়াশোনা করবে। অনেক বড় ডাক্তার হবে।”
“তোর ডায়ালগটা কিন্তু বাংলা সিনেমাকেও হার মানায়।”
মানসী বিরক্ত হয়ে আমার হাত ছেড়ে দিতে চাইল। কিন্তু পারল না, আমি ওর হাত দুটো ছেড়ে কোমর ধরে ওকে কাছে টেনে আনলাম। বললাম,
“আচ্ছা তোর সব কথা রাখব। কিন্তু এখন না। তার চেয়ে তুই গ্রাজুয়েশনটা শেষ কর ততদিন আমি এই চাকরিটাই করি। তারপর তোকে নিয়েই বাইরে চলে যাব।”
“আমার যাওয়ার কথা আসছে কেন?”
“গত ১২/১৩ বছর একসাথে আছি। তুই যখন বাবা মায়ের কাছে গেছিস বড়জোর এক সপ্তাহ আলাদা থেকেছি। তারপর তো ঠিকই ফিরে এসেছিস। এখন আর তোকে ছেড়ে থাকতে পারব না।”
“ইশ ঢং কত! সারাদিন তো থাকো বাইরে! আমার কাছে তো আর থাকো না।”
“সারাদিন বাইরে থাকলেও রাতে এসে তোর মুখটা দেখতে তো পারি। সারারাত তোকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাতে তো পারি।”
মানসী আবার মন খারাপ করে বলল,
“১ তারিখ থেকে তো সেটাও পারবে না।”
“হ্যাঁ, তবে সেটা মাত্র কিছুদিনের জন্য। জাস্ট ১/২ মাস তার মধ্যে তোর বাবাকে পটিয়ে তোকে বিয়ে করে নিয়ে আসব দেখিস!”
“ও আর এটা বুঝি বাংলা সিনেমার ডায়ালগ হলো না?”
তারপর আমরা দুজনেই হেসে দিলাম। আমি বললাম,
“তোর বাপ বাংলা সিনেমার চৌধুরী সাহেব টাইপ হলে আমি আর কী বলব বল!”
“কী বললে তুমি? আমার বাবা চৌধুরী সাহেব টাইপ?”
মানসী আমাকে মারতে এল। কিন্তু তার আগেই আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর বললাম,
“সত্যি তোকে ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হবে। এখন আমার এমন অবস্থা হয়েছে যে তোর নিঃশ্বাসের শব্দ, চুলের ঘ্রাণ, আর শরীরের স্পর্শ না পেলে ঘুম আসে না আমার। এগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি।”
মানসী আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমার এই শক্ত মানুষটা এত নড়বড়ে হয়ে গেল কী করে?”
“জানি না। তবে…
“তবে কী?”
“আমার ভয় করে।”
মানসী আমাকে ছেড়ে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল,
“কিসের ভয়?”
“তোকে হারানোর ভয়।”
“কেন? আমি তো তোমারই।”
“তোর বাবা যদি না মানে? তোর বাবা যদি অন্য কারো সাথে তোর বিয়ে দিয়ে দেয়! এই একটাই ভয় আমার। সেজন্যও এখন কোথাও যেতে চাচ্ছি না। পড়তে গেলে তো হুট করে চলে আসতেও পারব না।”
“কী যে বলো না! তোমার যত আজেবাজে চিন্তা। মাত্র তো ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। এখনই বাবা আমাকে বিয়ে দিতে চাইবে কেন?”
“জানি না। শুধু জানি আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারব না। মানসী আবার আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,
“আমি বুঝি পারব তোমাকে ছাড়া থাকতে? কক্ষনো পারব না।”
আমি ওর কপালে একটা চুমু খেয়ে আরো শক্ত করে ধরে রইলাম। যেন এক্ষুনি কেউ নিয়ে যাবে।