অভিমানিনী – ২৫

২৫

দিতিয়াকে ওভাবে জড়িয়ে ধরেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ও কখন উঠেছে টের পাইনি। নাশতার টেবিলে দেখা হলো। প্রচণ্ড কান্নার জন্যই বোধহয় ওর চোখ ফুলে আছে। আর পুরো মুখটা অস্বাভাবিক লাল হয়ে আছে। ব্যাপারটা নিশ্চয়ই সবাই খেয়াল করছে! কী ভাবল সবাই কে জানে! ওকে দেখে মনে হচ্ছিল ওর মধ্যে অন্যরকম একটা জড়তা কাজ করছিল। তারপর হসপিটালে যাওয়ার জন্য যখন আমি রেডি হচ্ছি তখন ও ঘরে এল। আমি বেল্ট খুঁজছিলাম, পাচ্ছিলাম না। ও বলল,

“কী খুঁজছ?”

“বেল্ট পাচ্ছি না একটাও।”

ও আলমারি থেকে একটা বেল্ট এনে দিল। বললাম,

“আমি খুঁজেছিলাম ওখানে।”

ও একটু হাসল। হাসিটা মলিন ছিল। ও দাঁড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাচ্ছে। আমি বললাম,

“কিছু বলবে?”

ও মৃদু স্বরে বলল,

“হ্যাঁ।”

“বলো।”

“আমি পড়াশোনা করেছি ঠিকই কিন্তু সবসময় তো বাসায়ই থাকতাম। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি আর বাসা ছাড়া কোথাও যাইওনি কখনো। তেমন কিছুই চিনি না, জানি না।”

“আচ্ছা, কোথাও গেলে মা বা অনন্যাকে নিয়ে যাও। আমি তো ব্যস্ত থাকি, সময় দিতে পারব না।”

“না, আমি কোথাও যাব না।

“ও তাহলে?”

“ডিভোর্সের ব্যবস্থাটা তুমিই করো, আমি রাজি আছি। কীভাবে কী করতে হয় আমি তো জানি না।”

আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও অবশ্য অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। আমি বললাম,

“ভেবে বলছ?”

“হ্যাঁ।”

“কাল রাতেই তো কত কিছু বললে!”

“হুম। আসলে তখন হঠাৎ শুনে মেনে নিতে পারছিলাম না। পরে অনেক ভেবে দেখলাম আমি থাকলে মানসীর বাবা-মা তো আর তোমার সাথে ওকে বিয়ে দেবে না। আর মানসীও বোধহয় চাইবে না। আর যেভাবে চলছে সেভাবে চললে আমরা তিনজনের কেউই সুখী হতে পারব না।”

আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। ও আবার বলল,

“আর ডিভোর্সের পর এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেও মানুষগুলোর সাথে আমার সম্পর্ক রাখতে তো কোনো বাধা নেই।”

“হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কোথায় যাবে? চাচার বাড়িতে?”

“এখনো ঠিক করিনি কোথায় যাব তবে ওবাড়িতে যাব না।”

“দিতিয়া তুমি কীভাবে চলবে সেটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি প্রতি মাসে তোমার পুরো খরচ দেব।”

“না না। তা কেন করবে? যদি পারো আমাকে একটা চাকরি জোগাড় করে দিও। তাহলেই আমার খুব উপকার হবে।

“আচ্ছা তবে তাই হবে। কিন্তু তুমি কি একা থাকবে?”

“আমার একা থাকার অভ্যাস আছে। চাচা-চাচি, চাচাতো ভাই-বোনদের মধ্যে থাকলেও ছোটবেলা থেকেই আমি তো একাই ছিলাম। আমার একা থাকতে অসুবিধা হয় না।”

“বিয়ে করো। আমি তো বিয়ে করার জন্যই ডিভোর্স নিচ্ছি।”

“আপাতত ইচ্ছে নেই, যদি কোনোদিন মনে হয় তবে করব।”

“কিন্তু এই ৯০ দশকেও আমাদের সমাজে একটা মেয়ের একা থাকাটা প্ৰায় ইম্পসিবল।”

“বাদ দাও না এসব কথা। বরং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি ডিভোর্সের ব্যবস্থা করো। আর হ্যাঁ, ব্যাপারটা মাকে কিছুতেই জানতে দিও না। তাহলে মা এটা হতে দেবে না।”

দিতিয়া চলে যাচ্ছিল ঘর থেকে। আমি ডাকলাম,

“শোনো…”

ও ফিরে তাকালো। আমি বললাম,

“আমি বোধহয় অমানুষের মতো একটা কাজ করতে চলেছি। আমাকে ক্ষমা করো, মানসীকে ছাড়া আমি….”

“ছি ছি একথা কেন বলছ? আমি তোমার অবস্থাটা বুঝি। ভালোবাসার মানুষকে না পেলে কতটা কষ্ট হয় তা আমি খুব ভালো করে জানি।”

“মানে? তুমিও কাউকে ভালোবাস?”

দিতিয়া মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। আমি বললাম,

“তাহলে তার কাছেই যাও। আর তখন চাচা-চাচির জোরাজুরিতে বিয়ে না করে তার কাছেই চলে যেতে পারতে।”

“বিয়ের আগে তো ভালোবাসিনি। ভালোবেসেছি বিয়ের পরে। কেমন করে, কবে থেকে তা জানি না।”

ওর একথার পর কিচ্ছু বলতে পারিনি। শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। একটা ম্লান হাসি মুখে নিয়ে ও ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

২৬

বিকালবেলা হসপিটাল থেকে বেরিয়ে ডিভোর্সের ব্যাপারে উকিলের সাথে কথা বলে একবারে বাড়িতে ফিরলাম। কেবল সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামল। ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালাতেই দেখি দিতিয়া ঘুমিয়ে আছে। রাতে বোধহয় কান্নাটা থামালেও ঘুমাতে পারেনি ও। তাই এই অসময়ে ঘুমাচ্ছে। দিতিয়া প্রতিদিন শাড়ি পরে। কিন্তু শাড়ি পরে ঘুমাতে পারে না বলে রাত্রে সালোয়ার-কামিজ পড়ে। এই অবেলায় হয়তো প্ল্যান করে ঘুমায়নি। তাই শাড়ি পরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আর সেই সুবাদে আঁচলটা সরে গিয়ে ওর মেদহীন হালকা গোলাপি মসৃণ পেট বের হয়ে আছে। এই দৃশ্য দেখে আমার প্রায় মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। সাথে সাথে আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম কিন্তু যে দৃশ্য একবার দেখে ফেলেছি তা আমাকে চুম্বকের মতো টেনে নিল। আমি ওর কাছে গিয়ে বেহায়ার মতো তাকিয়ে ছিলাম। ও আল্লাহর নিজ হাতে গড়া, তা না হলে একটা মানুষ কী করে এত সুন্দর হয়?

আমি সাজগোজ পছন্দ করি বলেই বোধহয় রাতে আর সকালে চোখে একটু কাজল, কপালে একটা ছোট টিপ আর ঠোঁটে হালকা কোনো লিপস্টিক থাকে। কিন্তু এখন এসব কিচ্ছু নেই। একদমই ন্যাচারাল। আর তাতে ওকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। ওর কপালের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো ফ্যানের বাতাসে উড়ছে। নিঃশ্বাসের সাথে সাথে ওর বুক, নাভি, কোমরের ঢেউ ওঠানামা করছে। এসব দেখে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।

যদিও ও আমার স্ত্রী কিন্তু আমি ওকে ভালোবাসি না। তাই চিন্তাটা অন্যদিকে ঘোরার আগেই আমি গোসল করতে ঢুকে গেলাম।

এটুকু পড়ে অর্পি বলল,

“ধুর আমি ভাবলাম চাচ্চু বুঝি এখন একটু আদর করবে চাচিকে!”

অদ্রি ধমক দিয়ে বলল,

“সকালে দেখলি না আদর করতে? এখন না জ্বালিয়ে চুপচাপ পড়।”

ওরা আবার পড়া শুরু করল,

গোসল করে বেরিয়ে দেখি দিতিয়া বিছানা গোছাচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম, ভাগ্যিস মেয়েটা জানে না কিছুক্ষণ আগেই কি লোভাতুর চোখে আমি ওর গুপ্ত সম্পত্তি দেখেছি। আমাকে দেখতে পেয়ে ও বলল,

“কখন এলে? আমাকে ডাকলে না যে?”

“ডাকলে কী হতো?”

“কিছু না, এমনি…তোমার কিছু লাগবে? কিছু খাবে?”

“না তবে শুধু চা দিতে পারো।”

দিতিয়া চা নিয়ে এলে চাটা হাতে নিয়ে আমি বললাম, “উকিলের কাছে গিয়েছিলাম।”

“ওহ!”

“কিন্তু একটা সমস্যা আছে। বিয়ের ১ বছর হওয়ার আগে ডিভোর্স নেয়া যাবে না।”

“ও! তা দেখতে দেখতে কেটে যাবে। ৭ মাস তো হয়েই গেল। আর তো মাত্র ৫ মাস।”

“হুম। আমার কোনো তাড়াও নেই, মানসীর গ্রাজুয়েশন শেষ হতে প্রায় ৩/৪ বছর লাগবে এখনো। তার আগে ওর বাবা ওকে বিয়েও দেবে না।”

“ও…”

ও একটু থেমে আবার বলল,

“এই ৫ মাস আমি কি এ বাড়িতে থাকতে পারি?”

“হ্যাঁ, কেন পারবে না? অবশ্যই পারবে।”

ও আর কিছু বলল না।

আমি চা শেষ করে বেরিয়ে মায়ের ঘরে ঢুকলাম। মায়ের সাথে বসে গল্প করলে মা খুব খুশি হয়। ঘরে ঢুকে দেখি মা-বাবা কেউ ঘরে নেই। অনন্যা আর দিতিয়া ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখছিল। আমি বললাম,

“অনন্যা…মাকে দেখছি না?”

“কোথায় যেন গেল। তুমি আসার আগেই গেছে।”

“ও।”

আমি আবার ঘরে ঢুকছিলাম। ও ডাকল,

“দাদা শোনো না…”

আমি ঘুরে তাকিয়ে বললাম,

“কিছু বলবি?”

“আগে প্রায় সন্ধ্যায় তুমি আমাদের সবাইকে আইসক্রিম, ফুচকা খেতে নিয়ে যেতে।

“হুম জানি তো, যেতাম।”

“আর নতুন সিনেমা আসলেই তুমি আমাদের সবাইকে দেখতে নিয়ে যেতে। আর এখন টাইটানিক বাংলাদেশে রিলিজ হয়েছে, তোমার কোনো খবরই নেই।”

“কী খবর চাস?”

“নিয়ে যাবে?”

“সৌরভকে বল।”

“ধুর! তোমার ভাইয়ের সাথে মুভি দেখতে গিয়ে কোনো মজা নেই। তাছাড়া ওকে বললে শুধু আমাকেই নিয়ে যাবে। দিতিয়া ভাবি, মোনা ওরা বঞ্চিত হবে।”

“মোনা এমনিতেও বঞ্চিত হবে। ওর ১৮ বছর হতে এখনো অনেক বাকি। বাই দ্য ওয়ে তোর ১৮ বছর হয়েছে তো? ১৮ বছরের ছোট শিশুদের নিয়ে যাওয়া কিন্তু নিষেধ। আমি পোস্টারে দেখেছি।”

অনন্যা আহ্লাদ করে বলল,

“দাদা আমার ২০ বছর পার হয়ে গেছে।

“ও তাই? কবে হলো?”

“উফ দাদা, কিপ্টামি কেন করছ?”

“আমি কিপ্টামি করছি? আর তুই যে নির্লজ্জের মতো বড় ভাশুরকে বলছিস টাইটানিকের মতো সিনেমা দেখতে নিয়ে যেতে সেটা কিছু না?”

অনন্যা চোখ বড় বড় করে বলল,

“কেন এমন কী সিনেমা?”

সেটা আবার আমার মুখে শুনতে চাচ্ছিস? আসলেই নির্লজ্জ হয়ে গেছিস রে ভাই।”

এবার অনন্যা প্রায় কেঁদে ফেলার ঢঙ করল। আর খেয়াল করলাম দিতিয়া অবাক হয়ে দেখছে আমাদের। অনন্যা কান্নার ভঙ্গি করে প্রলাপ শুরু করে দিল,

“অ্যা…এখন আমার কী হবে গো!”

“আচ্ছা আচ্ছা ভেংচির মা কান্দিস না। তোকে আমি তকলেত দেব।” অনন্যা হেসে ফেলল। আমি বললাম,

“রেডি হয়ে নে। ৯টার শো দেখব…’

আবার মনে পড়ায় জিজ্ঞেস করলাম,

“মোনা কই?”

“মোনা বাবা-মা সবাই একসাথেই বেরিয়েছে।”

“ও, আর ভেংচির বাপ কই?”

“ও আছে ঘরেই।”

“আচ্ছা তাহলে তোরা রেডি হয়ে নে। সাজতে আবার এক ঘণ্টা লাগাস না, তাহলে সব ভেস্তে যাবে।”

“আজকেই? তাহলে অদ্রিকে কার কাছে রেখে যাব?”

“আরে অদ্রিকে নিয়ে যাব। অদ্রি ১৮ এর নিচে হলেও পাকার মতো বয়স হয়নি।”

এটা বলে আমি আমার ঘরে চলে গেলাম। ঘরে ঢুকতেই শুনতে পেলাম দিতিয়া বলছে,

“এ আমি কী দেখলাম অনন্যা?”

“কী?”

“তোমার দাদা এত মজা করতে পারে?”

“এটাই দাদার আসল রূপ। ইশ আগে আমাদের সময়গুলো যে কী মজায় কাটত ভাবি চিন্তা করতে পারবে না। তোমাদের বিয়ের কিছুদিন আগে থেকে মানে সমস্যাগুলো যখন থেকে শুরু হয়েছে তখন থেকেই দাদা অন্যরকম হয়ে গেল। সারাদিন যে মানুষটা এত কথা বলত এত মজা করত সে কীভাবে চুপসে গেল। দেখলে না আমাকে কী রকম ক্ষ্যাপাতে লাগছিল? আমার বিয়ের আগে থেকে যখন মানসীর সাথে এ বাড়িতে আসতাম তখন থেকে এরকম করে আমার সাথে, সবসময়ই। খুব ভালো লাগত আমার। কয়টা মেয়ে এমন ভাশুর পায় বলো তো?”

“হুম। আর ও তোমাকে ভেংচির মা বলল কেন?”

“হি হি… দাদা আমাকে ক্ষ্যাপানোর জন্য ওই নামে ডাকত।”

“ওহ! নামটা কিন্তু মিষ্টি!”

“হুম, আচ্ছা শোনো তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। দেরি হলে বকবে কিন্তু।”

“যাচ্ছি।”

ও আসছে তাই আমি সরে গিয়ে আলমারি খুললাম। শার্ট, প্যান্ট বের করলাম। ওকে বললাম,

“তাড়াতাড়ি রেডি হও।”

ও শাড়ি নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে দেখে জিজ্ঞেস করলাম,

“কোথায় যাচ্ছ?”

“মায়ের ঘরে গিয়ে শাড়িটা পরে আসি।”

“ওহ। আচ্ছা যাও।”

সৌরভ, অনন্যা, অদ্রি, দিতিয়া আর আমি গেলাম সিনেমা দেখতে। তখনকার যুগে সিনেপ্লেক্স ছিল না। তবে সেরা সিনেমা হল ছিল মধুমিতা। টাইটানিক একমাত্র ওখানেই রিলিজ দিয়েছিল। টিকিট ছিল ৩০ টাকা করে। কী দিন ছিল!

রিক্সায় উঠে দুজনেই চুপ। আমিই বললাম,

“হলে সিনেমা দেখতে তোমার কেমন লাগে?”

“আমি কখনো হলে সিনেমা দেখিনি।”

“ও”

“নিয়ে যাওয়ার মতো কেউ ছিল না।”

“হুম!”

আবার কথা হারিয়ে গেল। কী বলব, মানসীকে খুব মনে পড়ছে! আগে সিনেমা দেখতে যাওয়ার সময় মানসী থাকত সাথে। আজ মানসীর রিপ্লেসমেন্টে দিতিয়া। ও আজকে আমার দেয়া সেই শাড়িটা পরেছে। নতুন ভাঁজভাঙা শাড়িটাতে ওকে খুব সুন্দর লাগছে। ইশ যদি মানসীকে একবার দেখতে পারতাম! একই শাড়ি তো ওকেও দিয়েছিলাম। শাড়িতে মানসীকেও খুব সুন্দর লাগত। শাড়ি পরা মানসীর দিকে কত যে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে থেকেছি তার হিসেব নেই। সারা জীবনের দেখা কি আমি একবারেই শেষ করে ফেলেছিলাম যে এখন আর দেখার সুযোগ পাই না? নাকি সুযোগ আবার আসতে চলেছে! ডিভোর্সের সবকিছু তো রেডি। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। আল্লাহ যেন আমাকে সেই সময়টুকু দেন। এমনই কপাল যে মানসীর সাথে কোনো যোগাযোগও করতে পারছি না। আমি যে ডিভোর্সের সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। সেটা তো ওকে জানাতে হবে। এসব ভাবনার অবসান হলো রিকশওয়ালার ডাকে। আমরা চলে এসেছি।

টিকিট কেটে দেখলাম আরো ১ ঘণ্টা বাকি। তাই অনেকদিন পর সবাই মিলে বাইরে খেলাম। কিন্তু আগের মতো হৈচৈ আর হলো না। আমি আর সৌরভ পুরো সময়টা আমাদের যার যার হসপিটালের গল্প করে কাটালাম। আর অনন্যা দিতিয়া ওদের মতো গল্প করে। তারপর সিনেমা দেখে ফেরার পথে সৌরভকে বললাম,

“ভাই তোর বউটাকে একটু ধার দে।”

সৌরভ বলল,

“আচ্ছা যা দিলাম। বাসায় গিয়ে ফেরত দিয়ে দিস কিন্তু। ভাবি তুমি এসো আমরা আলাদা যাই, এরা আলাদা যাবে।”

আমি অনন্যার কোল থেকে অদ্রিকে নিয়ে রিকশায় উঠলাম। অনন্যা বলল, “দাদা, আমাকে কিছু বলবে?”

“হ্যাঁ, তুই কী চাস বল তো। দিতিয়ার সাথে তো ভালোই খাতির দেখি। আবার মানসীরও জানের জান।

অদ্রি মানসীর নাম শুনতেই বলতে লাগল,

“আম্মা আম্মা আম্মা।”

অনন্যা অদ্রিকে বলল,

“হ্যাঁ, তোমার আম্মা।”

অদ্রি আবার বলতে লাগল,

“আম্মা দাবো আম্মা দাবো।”

অনন্যা অদ্রিকে বোঝাল,

“হ্যাঁ মা আমরা আম্মার কাছে যাব তো।”

তারপর আমাকে বলল,

“দাদা, আমি নিজেও কনফিউজড! মানসী আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, বোনের চেয়েও বেশি। আমার জীবনে সৌরভ যতটা গুরুত্বপূর্ণ, মানসীও ততটা। এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরও আমার মনে হয়েছে মানসী আর তুমি মেড ফর ইচ আদার। তোমরা এক না হলে বিশ্বাস করব আল্লাহ সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষদের মেলানোর জন্য কিছুই করেন না। উনি যা করেন সবসময় ভালোর জন্য করেন না। আবার যখন তোমার প্রতি দিতিয়া ভাবির ভালোবাসা আর ধৈর্য দেখি তখন মনে হয় তোমার ভালোবাসা পাওয়ার অযোগ্য হওয়ার মতো কোনো পাপ তো ও করেনি। ওকে আল্লাহ এভাবে বঞ্চিত করবে কেন? যা হয়েছে তাতে তো ওর করার কিছুই ছিল না। বিয়ের মতো এত পবিত্র একটা বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরেও কেন ও এতটা কষ্ট পাবে?”

“সবাই ওদের দুজনের কথা ভাবে, কেউ আমার কথা ভাবে না। আমিও তো একটা মানুষ নাকি?”

“ভুল বললে দাদা, তোমার কথাও ভেবেছি। জানি তোমার কষ্টটাও ওদের দুজনের চেয়ে কম না। আল্লাহ যে কেন তোমাদের তিনজনকে এরকম পরিস্থিতির সামনে এনে ফেলেছেন তা তিনিই শুধু জানেন।”

“কাল তোদের ক্লাস আছে?”

“আছে, কিন্তু মানসী এখন নিয়মিত ক্লাসে আসে না। আজ ক্লাসে আসেনি। কাল আসবে কিনা বুঝতে পারছি না।”

“আচ্ছা, যদি আসে তো ওকে বলবি যে আমার আর দিতিয়ার ডিভোর্সের সবকিছু রেডি। জাস্ট আমাদের বিয়ের ১ বছরের আগে ডিভোর্স সম্ভব না। ১ বছর হতে আরো ৫ মাস বাকি। ৫ মাস পর আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে।

অনন্যা অবাক হয়ে চেয়ে রইল। আমি কিছু বললাম না। ও একটু পর বলল,

“দাদা, তাহলে ভাবির কী হবে?”

“ওকে আমি সব খরচ দেব। ও বলেছে একটা চাকরি জোগাড় করে দিতে, সেটাও দেব। আর আমি যেকোনো দরকারে ওর পাশে থাকব।”

“তার মানে ভাবি জানে সব? ও রাজি?”

“হ্যাঁ, রাজি।”

“আমি হলে জীবনেও রাজি হতাম না। নিজের স্বামীর দাবি এভাবে ছেড়ে দেয়া অত সোজা না।”

“তুই মানসীকে কথাটা জানিয়ে দিস প্লিজ।”

“ঠিক আছে।”

আর কোনো কথা বললাম না। এখন অনন্যাও আমাকে স্বার্থপর ভাবছে। ভাবুক আমি তো স্বার্থপরই। মানসীর জন্য সারা পৃথিবীর কাছেও খারাপ হতে আপত্তি নেই আমার

বাসায় ফিরতে ফিরতে ১টা বেজে গেল। ফিরে যে যার মতো শুয়ে পড়ল। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় বসে রইলাম। হাজার রকমের ভাবনা কেমন যেন গোলমাল পাকিয়ে যাচ্ছে মাথার মধ্যে। দিতিয়া এসে দরজায় দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করলাম,

“কিছু বলবে?”

“ঘুমাবে না? তোমার তো সকালে উঠতে হয়।”

“তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আমার দেরি হবে। “আমি কিছুক্ষণ তোমার পাশে বসি?”

“না।”

“ও, ঠিক আছে।”

দিতিয়া ঘরে চলে গেল। বোধহয় মন খারাপ হলো ওর। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। সন্ধ্যাবেলা ঘরে ঢুকে যে দৃশ্য দেখেছি তা এখনো চোখের সামনে ভাসছে…এখন ওর পাশে গিয়ে শোবার সাহস আমার নেই। কখন যে নিজের ওপর কন্ট্রোল হারিয়ে অন্য সব পুরুষের মতো হয়ে উঠব তা আমি নিজেও জানি না। সৌন্দর্য কেবল চোখে নেশা ধরাতে পারে, মনে নেশা ধরাতে পারে না।

২৭

দুদিন বাদে হসপিটালে দুপুরবেলা লাঞ্চ করছি এমন সময় পিয়ন এসে বলল,

“স্যার, আপনার সাথে একজন দেখা করতে আসছে।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম,

“কে, নাম বলেছে?”

“নাম তো বলেনি। একটা মেয়ে।”

“আমার চেম্বারে বসাও, আমি আসছি।”

খাওয়া শেষ না করেই উঠে পড়লাম। অনন্যা নিশ্চয়ই মানসীর কাছে ডিভোর্সের খবরটা কোনোভাবে পাঠিয়েছে। আর খবর পেয়েই ও এসেছে জ্ঞান দিতে কিন্তু আমি জানি মনে মনে স্বস্তি পেয়েছে মেয়েটা।

আমার চেম্বারে ঢুকতেই আমি অবাক! মানসী নয়, অনন্যা বসে আছে। আমি বললাম,

“অনন্যা? কিরে কী হয়েছে? হঠাৎ তুই এখানে? সব ঠিক আছে?”

“তুমি বাসায় ফিরলে এই ব্যাপারে কথা বলার জন্য সুযোগ খুঁজতে হবে তাই ক্লাস শেষ না করেই চলে এসেছি। কথাগুলো আজই বলতে হবে।”

“হ্যাঁ…তো বল।”

“পরশুর আগেরদিন যে আমরা সিনেমা দেখতে গেলাম তখন তোমাকে বলেছিলাম না মানসী ঐদিন আসেনি ক্লাসে।”

“হুম!”

আমার বুকের ধুকধুকানি বেড়ে গেল। না জানি কী বলবে অনন্যা! ও বলল,

“তারপর থেকে একদিনও আসেনি আজ পর্যন্ত! আমি তো চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। ফোন করেও পাচ্ছিলাম না। লাইন কাটা বোধ হয়। তাই আজ ইউনিভার্সিটি যাওয়ার পথে সাহস করে চলেই গিয়েছিলাম ওদের বাসায়। ওম্মা খালামণি আমাকে ঢুকতেই দিল না।”

“মানে? ঢুকতে কেন দেবে না?”

“শোনোই না। যখনই বললাম আমি মানসীর সাথে দেখা করতে এসেছি। উনি বলল, ‘মানসীর সাথে দেখা হবে না। ও বাসায় নেই।’ আমি বললাম, ‘এত সকালে ও কোথায় গেল?’ বলে কিনা মানসী ওর দাদুর বাড়িতে গেছে। তারপর খালামণি কী বলল শুনলে তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না।”

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,

“উফ! বলবি তো কী বলল।”

“খালামণি বলল, সামনে মানসীর বিয়ে, বিয়ের আগ পর্যন্ত ও ওখানেই থাকবে।”

“বিয়ে মানে?”

“মানসীর নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

“কী বলছিস সব? ওর কেন বিয়ে হতে যাবে? ওর পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগে খালু-খালামণি ওর বিয়ে দেবে না। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত। তারা সবসময় এমনটাই বলে এসেছে।”

দাদা, আল্লাহ জানে কী হয়েছে! কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল মানসী বাড়িতেই ছিল, ইচ্ছে করে দেখা করতে দিল না। আমি বললাম, ‘কার সাথে বিয়ে? কবে ঠিক হলো? কিছুই তো জানি না।”

খালামণি বলল, “বড় আপার কাছ থেকে জেনে নিও। আমি একটু ব্যস্ত আছি। এখন আসতে পারো!”

“তার মানে মা সব জানে?”

“কী জানি দাদা! মা তো কিছুই বলল না!”

আমার মাথার ওপর পুরো পৃথিবীটা ঘুরতে লাগল। কী হচ্ছে আমার লাইফে? একদিক গোছাই তো আরেকদিক ভেঙে যায়। আর কত কী দেখতে হবে আমাকে কে জানে! অনন্যা চলে গেল। আমি আর কোনো কাজই করতে পারলাম না সেদিন। ডিউটি শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরে সোজা মায়ের ঘরে ঢুকলাম। বাবা আর মোনাও ছিল। ঘরে ঢুকে বললাম,

“আমার একটু কথা আছে তোমাদের সাথে।”

বাবা বললেন,

“মোনা, তুমি এখন নিজের ঘরে গিয়ে পড়তে বসো।”

মোনা ফোঁসফোঁস করতে করতে বেরিয়ে গেল। মুখে বলছিল,

“যেখানেই যাও, সেখানেই…মোনা, তুমি বাইরে যাও, মোনা তুমি ভেতরে যাও, মোনা তুমি ঘরে যাও। কোনো কিছু জানার কোনো অধিকার আমার নেই।”

মা ওকে বকতে যাচ্ছিল। বাবা বললেন,

“বাদ দাও না। নীরব কী বলতে এসেছে শোনো।” আমি কোনো ভূমিকা ছাড়াই বললাম, “মা মানসীর নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?”

মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

“হ্যাঁ।”

“বাহ! তোমরা জানো আর আমাকে কেউ জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না?”

বাবা বললেন,

“এখন তোকে জানিয়ে কী হবে বল? বিয়ে তো ঠিক হয়েই গেছে আর তুই নিজেই তো বিবাহিত। জেনেই বা কী করবি?”

“তো, তোমরা কিছু করো। আটকাও ওর বিয়েটা। এভাবে মেয়েটার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে আর তোমরা চেয়ে চেয়ে দেখবে?”

মা বললেন,

“নষ্ট কেন হবে? ছেলেটা খুব ভালো, আর্কিটেক্ট! দেখতে শুনতে হ্যান্ডসাম! বাবার নিজের ব্যবসা আছে কানাডাতে। ফুল ফ্যামিলি ওখানেই থাকে।

ছেলেকে বিয়ে করাতে দেশে এসেছে, বিয়ের পর মানসীকেও নিয়ে যাবে। ছেলের বাবা মানসীর বাবার কলিগ ছিল একসময়। মানসী ওখানে ভালো থাকবে।

“মা, মানসী আমি ছাড়া আর কারো কাছে ভালো থাকবে না। তোমরা কিচ্ছু জানো না, কিচ্ছু না।”

“তোর বিয়ের পরেও মানসী তোর সাথে সম্পর্ক রেখেছে, সেটা কীভাবে যেন জেনে গিয়েছিল মানসীর বাবা। তারপর থেকেই ছেলে দেখছিল ওর জন্য।”

“মানেটা কী? আমার বিয়ের পর থেকে আমরা পুরোপুরি ডিসকানেক্টেড। কোনো সম্পর্ক দূরের কথা যোগাযোগটাও তো নেই।”

“ওর জন্মদিনের দিন ও তোর হসপিটাল যায়নি? তুই ৪-৫ দিন আগে মানসীদের বাসায় যাসনি?”

“গিয়েছি তো কী হয়েছে? ওর সাথে কথা ছিল তাই গিয়েছিলাম।’ “হ্যাঁ, ওর জন্য আগেই ছেলেটাকে ঠিক করে ফেলেছিল কিন্তু অন্তত এখনই বিয়ে দিত না যদি সেদিন ওভাবে না যেতি। কারণ, এমন সময় গিয়েছিস যখন মানসী বাসায় একা ছিল। তুই বলেছিস খেতে গিয়েছিস, মানসী ঘাবড়ে গিয়ে কিছুই বলতে পারেনি। তোর খালামণি জিজ্ঞেস করেছে তুই খেয়েছিলি কিনা মানসী বলেছে খাসনি। এটা ভালো দেখায় না নীরব! তোর খালামণি তো এই নিয়ে আমাকে অনেক কথা শুনিয়ে ছেড়েছে।”

“আমার মনে কোনো দোষ ছিল না মা, তোমার বোন যদি মনে এত দোষ নিয়ে থাকে তাতে আমার কিছু করার নেই।

বাবা বললেন,

“নীরব, এসব কী কথা! মাথা ঠাণ্ডা কর।”

আমি চিৎকার করলাম,

“মাথা ঠাণ্ডা করার মতো কী হয়েছে বাবা? আমি তো আর সহ্য করতে পারছি না। একটা মানুষের নেওয়ারও তো একটা সীমা থাকে।”

মা কাঁদতে শুরু করে দিল। আমার রাগটা আরো বেড়ে গেল। পাছে আবার উল্টাপাল্টা কিছু বলে না বসি তাই ঘরে চলে এলাম।

ঘরে ঢুকতেই দিতিয়া জিজ্ঞেস করল,

“কী হয়েছে? তোমার মুখটা ওরকম লাগছে কেন?”

আমি রাগটা ওর ওপর ঝেড়ে দিলাম,

“কী হয়েছে সেটা তোমাকে বলতে হবে? এত প্রশ্ন করো কেন? এতবার বলেছি আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলতে আসবে না। তাতে লজ্জা হয় না তোমার? লজ্জাশরম কি সব বাপের বাড়িতে রেখে এসেছ?”

দিতিয়া কিছু বলল না। মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ও বলেই বোধহয় এরকম নিশ্চুপ ছিল। অন্য কোনো মেয়ে হলে উচিত জবাব পেয়ে যেতাম সাথে সাথে। বাবা-মা মরা মেয়েকে বাপের বাড়ির কথা বলে খোঁটা দিতে জানোয়াররাই শুধু পারে। আর আমি তখন জানোয়ারই হয়ে গিয়েছিলাম। মানসী অন্য কারো হয়ে যাচ্ছে, আমি মানুষ কীভাবে থাকব!

আমার চিল্লাচিল্লি শুনে মা এলেন,

“দিতিয়ার সাথে কেন এত খারাপ ব্যবহার করছিস? ওর কী দোষ? আমি দোষ করেছি, আমার সাথে যা ইচ্ছে কর।”

আমি মায়ের কথায় পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি আর ভাবছি কী করব! আমার সবকিছু এভাবে শেষ হয়ে যাবে! কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। শেষমেশ হুট করে মানসীদের বাসায় চলে গেলাম। রাত প্রায় ১১টা। খালু দরজা খুলে এত রাতে আমাকে দেখে বেশ অবাক হলেন।

দরজার বাইরে থেকেই বললাম,

“খালু, আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।”

“ভেতরে এসো।”

আমি ভেতরে ঢুকলাম। খালু বললেন,

“বসো।”

আমি বসলাম। উনি বললেন,

“বলো কী বলবে। তোমাকে জাস্ট ১০ মিনিট সময় দেয়া হলো কারণ আমি ১১টায় ঘুমাতে যাই প্রতিদিন। ১১টা বাজতে আর ১০ মিনিট বাকি।”

খালু ঠাণ্ডা মাথার খুব সিরিয়াস মানুষ। হাতে সময়ও কম, তাই আমি সরাসরি বললাম,

“আমি মানসীকে ভালোবাসি। মানসীও আমাকে ভালোবাসে। গত ৭-৮ বছর মানসীর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল। মায়ের জন্যে আমি বাধ্য হয়েছি বিয়ে করতে। কিন্তু আমি ডিভোর্সের সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। জাস্ট বিয়ের ১ বছর আগে ডিভোর্স সম্ভব না তাই ৫ মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ডিভোর্সের পরই আমি মানসীকে বিয়ে করব। প্লিজ মানসীকে অন্য কোথাও বিয়ে দেবেন না। ও আমাকে ছাড়া অন্য কারো সাথে সুখী হবে না।”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করলাম। মানসীর বাবা খুব স্বাভাবিকভাবে আমার কথাগুলো শুনল। তারপর বলল,

“তোমার কথা শেষ?”

আমি উত্তর দেয়ার আগেই মানসী খালুকে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকল। ঘরে ঢুকে আমাকে দেখেই অবাক হয়ে চেয়ে রইল। এর মধ্যেই খালামণি এল। খালামণি এসে আমাকে দেখেই মানসীকে ঘরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। খালু বললেন,

“দাঁড়াও, মানসী এখানে থাক। ওর ব্যাপারেই কথা হচ্ছে। ওর জানার অধিকার আছে। আর তুমি চলে যাও। তোমার ব্যাপারে কথা হচ্ছে না।”

খালামণি চলে গেল। তারপর উনি খুব ঠাণ্ডা গলায় বললেন,

“শোনো, ধরে নেই ৮ না ৭ বছর ধরেই তোমাদের সম্পর্ক চলছে। তার মানে মানসীর তখন ১৩ বছর বয়স, একদমই বাচ্চা। ১৩ বছর বয়সে কোনো মেয়ে ভালোবাসা বোঝে না। আর তোমার তখন ২০-২১ বছর বয়স। তুমি তখন তাগড়া যুবক। তুমি কী করে একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়ালে আমি বুঝতে পারিনি। কোনো ভালো ছেলের পক্ষে এটা সম্ভব না। তারপর গত ১/২ বছর ধরে ওর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিয়ের নামে ওকে তুমি ভোগ করেছ।

খালুর কথা শুনে আমি অবাক থেকে আরো অবাক হচ্ছিলাম। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিলাম, নিজেকে অমানুষ বলেই মনে হচ্ছিল। মানসী বলল,

“বাবা আমি ওকে জোর করেছিলাম বিয়ে করার জন্যে।”

খালু মানসীকে বললেন,

“তোমাকে এখানে কিছু বলার জন্য রাখা হয়নি। শুধু শোনার জন্যে রাখা হয়েছে। যদি আর একটা কথাও বলো তাহলে এখানে থাকতেও পারবে না।”

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“যখন আমার পোস্টিং ঢাকার বাইরে হয় তখন মানসী ক্লাস ফোরে পড়ে। ওর স্কুলের প্রিন্সিপাল অনুরোধ করেছিল যাতে ওকে স্কুল থেকে নিয়ে না যাই। আর তোমার মা বলেছিল আমি আর মানসীর মা দুজনেই চাকরি করি, মানসীর দেখাশোনা করতে পারব না। ওনার কাছে থাকলে দেখে রাখতে পারবে। এমন দেখাই দেখেছে যে আমার মেয়ের সর্বনাশের কিছু বাকি রাখেনি। আর তোমার মায়ের দোষ দিয়েই বা কী হবে? উনি তো আর তোমার আসল মা না।”

আমি চমকে তাকালাম খালুর দিকে। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন,

“তুমি তো তাদের পালক ছেলে। জানো নীরব তুমি কিন্তু একদম তোমার বাবার মতো হয়েছ। নিজের জন্মদাতা বাবার মতো। সেও তো তোমার নিজের মাকে বিয়ের নামে ভোগ করে চলে গিয়েছিল। তোমার তো কোনো জন্ম পরিচয়ই নেই।”

আমার বুক ফেটে কান্না আসছিল কথাগুলো শুনে। কিন্তু সে যোগ্যতা তো আল্লাহ আমাকে দেননি। মাথা নিচু করে বসে রইলাম অপরাধীর মতো। কী বলব আমি? খালুর কথার প্রতিবাদ করার মতো কোনো ভাষা ছিল না আমার। মানসী অনবরত কেঁদে যাচ্ছে।

খালু একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন,

“আর তোমার মা। তার কথা আর কী বলব? তোমার বাবা তোমার মাকে ফেলে চলে গিয়েছিল বলে সেও তোমাকে বড় আপা-দুলাভাইয়ের কাছে ফেলে নাচতে নাচতে চলে গেল বিয়ে করতে। সেই সংসারও তো টেকাতে পারল না। আরে পারবে কীভাবে? চরিত্রে সমস্যা ছিল তো। আর তোমার হলো রক্তে সমস্যা। তোমার বাবা-মায়ের রক্তই তো বইছে শরীরে। আমার কালো মেয়েটাকে ওর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ২ বছর ধরে ভোগ করে সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে করে ফেললে। এখন আবার ৬-৭ মাস যেতে না যেতেই বউ পুরোনো হয়ে গেল? তাকে বুঝি এখন আর ভালো লাগছে না? তাই আমার মেয়েকে ভালোবাসার কথা বলতে এসেছ!”

আমি তখন কিছু বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু বলতে পারিনি। গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে আসছিল। মানসী উঠে এসে ওর বাবার পা জড়িয়ে ধরে বলল,

“বাবা মাফ করে দাও বাবা। ওকে আর কিছু বলো না, প্লিজ। তোমার সব কথা আমি মেনে নিয়েছি। আল্লাহর দোহাই লাগে বাবা, ওকে ছেড়ে দাও।”

খালু খালামণিকে ডাকল। খালামণি প্রায় সাথে সাথেই এল। খালু বললেন,

“মানসীকে এখান থেকে নিয়ে যাও।”

খালামণি মানসীকে টেনে নিয়ে গেল। মানসী যেতে যেতে চিৎকার করে বলল,

“বাবা মাফ করো বাবা। ওকে আর কিছু বলো না।

খালামণি ওকে নিয়ে চলে যেতেই খালু বলল,

“এতকিছুর পরেও আমি তোমাকে কিছু বলতে যাইনি। আজ তুমি নিজে এসেছিলে তাই এসব শুনলে। ইউ ডিজার্ভ ইট নীরব। আমি তো তোমার সাহস দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। এতকিছু করে তোমার সাহস কীভাবে হয় ভালোবাসার কথা বলার?”

আমি এরপরেও কোনো কথা বলতে পারিনি।

খালু বললেন,

“আমার মেয়ের অনুরোধে আমি তোমাকে এতদিন কিছুই বলিনি। ছেড়ে দিয়েছিলাম। বিয়েতে কোনো ঝামেলা করার চিন্তাও করো না। তাহলে তোমাকে আর তোমার পাতানো বাপ-মাকে আমি ছাড়ব না।”

তারপর দরজা খুলে দিলেন,

“এবার আসতে পারো।”

আমি বেরিয়ে গেলাম। খুব অসহায় লাগছিল সেদিন। মনে হচ্ছিল, এই এত বড় একটা পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। কোনো পরিচয় নেই আমার। আমি শুধুমাত্র কারো ফেলে যাওয়া সন্তান আর কারো পালিত সন্তান। খুব কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল একটু যদি কাঁদতে পারতাম তাহলে হালকা হতাম। কিন্তু পারিনি!

নীরব ইশতিয়াক
২৫ এপ্রিল, ২০১৬

২৮

অদ্রি অৰ্পি কাঁদতে কাঁদতেই পৃষ্ঠা উল্টাল…

সেদিন সারারাত বাসায় ফিরিনি, পরেরদিন হসপিটালেও গেলাম না। সারাদিন রাস্তায় একা একা হাঁটলাম। রোদের প্রখর উত্তাপও টের পাচ্ছিলাম না। মানসীর গতকালের মুখটা বারবার মনে পড়ছিল। কীভাবে কাকুতি মিনতি করছিল ওর বাবার কাছে! আমার জন্য, শুধুমাত্র আমার জন্য! কতকিছু বলে বোঝাতে চেয়েছিলাম খালুকে, উল্টো সেই আমাকে আমার না বোঝা অনেক কিছু বুঝিয়ে দিল।

অনেক রাতে বাসায় ফিরলাম, ১/২টা তো হবেই। সঠিক মনে নেই। বেল বাজাতেই অনন্যা দরজা খুলল। আমি কিছু বলার আগেই অনন্যা বলল,

“দাদা কোথায় ছিলে? সেই যে কাল রাতে রাগ করে বের হলে তারপর আর খবর নেই। তোমার চিন্তায় মায়ের প্রেশার উঠে কী অবস্থা দেখো গিয়ে। কী করব কিছু বুঝতে পারছি না। সৌরভকে যে জিজ্ঞেস করব কীভাবে, ওর নাইট ডিউটি আজ, ফোনেও পাচ্ছি না। আমরা পুরো দিশেহারা।”

আমি মায়ের ঘরে ঢুকলাম, আমার পেছন পেছন অনন্যা আর দিতিয়া এল। মা শুয়ে ছিল, পাশে বাবা বসা ছিল। মা আমাকে দেখেই উঠে বসে কান্না শুরু করে দিল। আমি মাকে আবার শুইয়ে দিয়ে বললাম,

“একি অবস্থা মা? আমার কাজ ছিল তাই কাল ফিরিনি। আর এটা তো নতুন না। আগেও তো কতবার না বলে দূরে দূরে চলে গেছি। তখন তো এমন করতে না, এখন এত টেনশন কিসের তোমার?”

মা কাঁদতে কাঁদতেই বলল,

“কাল তো রাগ করে চলে গিয়েছিলি।”

“রাগ করে চলে গিয়েছিলাম তো কী হয়েছে? মাকে রেখে ছেলে যাবে আর কোথায়, ফিরে তো আসবেই তাই না?”

তারপর বাবাকে বললাম,

“তুমি কি মাকে একটু বোঝাতে পারো না?”

বাবা বলল,

“তোর মাকে তুই বোঝা, আমি কে? ৩১ বছর ধরে সংসার করছি, আজও আপন হতে পারলাম না।”

অভিমানের আভাস পেয়ে আর কথা বাড়ালাম না। সত্যি মানুষ বয়স হলে বাচ্চাদের মতো অবুঝ হয়ে যায়। মাকে আমি হুমকি দিলাম,

“কান্না থামাও নাহলে আবার চলে যাব।”

মা চোখ মুছে বলল,

“চল তোকে খেতে দেই।”

“তুমি খেয়েছ?”

“হ্যাঁ।”

“সত্যি করে বলো।”

অনন্যা বলল,

“আমি আর ভাবি মিলে একটু আগে যুদ্ধ করে খাইয়েছি।”

আমি বললাম,

“আচ্ছা তুমি এখন ঘুমাও। আমাকে খেতে দেয়ার মানুষ এ বাড়িতে অনেক আছে।”

“আমার ঘুম আসছে না রে বাবা।”

“হুম জানি, আমি একটা ইনজেকশন দিয়ে দিচ্ছি। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও।”

মা বাচ্চাদের মতো ভয় পায় ইনজেকশনকে। তবু মায়ের অস্থিরতাটা কাটিয়ে ঘুমানোর জন্য একটা ইনজেকশন দিয়ে দিলাম।

তারপর নিজের ঘরে ঢুকে গোসল করলাম। গোসল করে বের হয়ে সোজা আমার প্রিয় বারান্দাটায় চলে গেলাম। পুরো বারান্দাটায় গ্রিল দেয়া, দেয়াল নেই তাই অনেক বড় বড় মনে হয়। বারান্দার ফ্লোরে বসে একটা সিগারেট ধরালাম। দিতিয়া বারান্দার দরজায় এসে দাঁড়াল। আমি বললাম,

“কী আমার পাশে বসতে চাও?”

ও মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। আমি বললাম,

“বোসো।”

ও বসল কিন্তু কিছু বলল না। আমিও চুপ করে রইলাম। একটা সিগারেট শেষ করে আরেকটা ধরিয়ে বললাম,

“কিছু বলতে চাচ্ছিলে মনে হয়। ভয় পাচ্ছ কেন, বলো কী বলবে।”

“খেতে দিয়েছি, না বোলো না প্লিজ। তোমার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি সারাদিন না খেয়ে আছ। তোমার হাঁটার ভঙ্গিতেও দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে।”

আমি ওর দিকে তাকাতেই ও বলল,

“আমাকে বকো, মারো, কাটো যা ইচ্ছে করো। তাও না খেলে ছাড়ব না আজকে।”

হঠাৎ খেয়াল হলো আমি গতকাল দুপুরে খাওয়া ছেড়ে উঠে গিয়েছিলাম মানসী এসেছে ভেবে। তারপর থেকে আর খাওয়া হয়নি। মনে পড়তেই ক্ষিদে অনুভব করলাম এবং খেতে বসলাম। বললাম,

“আর কাউকে দেখছি না যে?”

দিতিয়া ভাত প্লেটে তুলে দিতে দিতে বলল,

“সবাই আগেই খেয়ে নিয়েছে, মা অসুস্থ বলে জেগে ছিল। মাকে তো ঠাণ্ডা করা যাচ্ছিল না।

“ও…তুমি খাচ্ছ না কেন?”

“এইত নিচ্ছি।”

আমি খাওয়া শুরু করলাম। ভাত মুখে দিতেই পেটে মোচড় দিয়ে উঠল, মনে হলো মাটি খাচ্ছি, তাও খাচ্ছিলাম কারণ প্রচণ্ড ক্ষিদে পেয়েছিল। কিন্তু কেমন যেন মনে হচ্ছিল হজম হবে না কিছু। খেতে খেতেই হঠাৎ বমি এসে পড়ল। তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে বেসিনে বমি করে দিলাম। জ্ঞান হবার পর কখনো বমি করেছি বলে মনে পড়ে না। তাই এই তিক্ত অভিজ্ঞতাটা ছিল না আমার। মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরে পড়ে যাব। দিতিয়া খাওয়া ছেড়ে দৌড়ে এসে হাত ধুলো। তারপর আমার মাথার দুপাশে দুহাত দিয়ে চেপে ধরে রাখল। আমি যতক্ষণ পর্যন্ত বমি করছিলাম ততক্ষণ ধরে রইল। নিজের বমির গন্ধে আমি নিজেই অস্থির, আর ও কী স্বাভাবিক! ওর মতো মেয়েরাই পারে!

বমি করার পর আমার শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ল। ও আমাকে ধরে ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর আমার গলায় আর বুকে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

আমি চোখ বন্ধ করে রইলাম। ও বলল,

“যেটুকু খেয়েছিলে তার চেয়ে বেশি বেরিয়ে গেছে। এখন আবার কিছু খেতে হবে। কী খাবে বলো, আমি এনে দিচ্ছি।”

“আমি কিছু খাব না।”

“কিছু একটা খাও। এসিডিটির কারণেই এই অবস্থা। পেট খালি রাখা ঠিক হবে না। তুমি তো ডাক্তার মানুষ, আমি আর তোমাকে কী বলব?”

“আমি বমির ডাক্তার না, হার্টের ডাক্তার।

“আচ্ছা বেশ! এক গ্লাস দুধ খাও।”

“দুধ খাই না আমি। খেলে আবার বমি হবে। দুধের গন্ধ সহ্য করতে পারি না।”

“তাহলে কী খাবে?”

“কিছু না, এন্ড ফর গড সেক চুপ থাকো একটু।”

ও আর কোনো কথা বলল না। সারারাত আমার মাথার পাশে বসে বুকে হাত বুলিয়ে দিল, চুলেও হাত বুলিয়ে দিল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি।

.

প্রায় এক সপ্তাহ পর সেই দিনটি এল। মানসীর বিয়ে! কীভাবে এই ক’দিন পার করেছি তা আল্লাহ জানে আর আমি জানি। একেকটা দিন একেকটা পাহাড়সমান কষ্ট বইতে হয়েছে নির্বিকারভাবে। সেদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার বিয়ের দিন মানসী কতটা কষ্ট পেয়েছিল।

আমাদের বাসা থেকে কেউ যাবে না মানসীর বিয়েতে। খালামণির সাথে মায়ের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে আমাদের জন্য। দিনটি শুক্রবার ছিল। আমার অফ ডে। আমি ঘরেই শুয়ে ছিলাম। আমার আর তো কিছু করার নেই। যা ঘটেছিল, একটু দিতিয়ার চোখে বলি। মানে ওখানে আমি ছিলাম না তাই দিতিয়ার কাছ থেকে যা শুনেছি তাই লিখছি…

বিকেলবেলা মা নিজের ঘরে ছিল। অনন্যা, দিতিয়া ডাইনিং রুমে কাজ করছিল। বাবা আর সৌরভ ড্রইং রুমে কিছু একটা করছিল। হঠাৎ বেল বেজে উঠল। বেলের শব্দে মা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। অনন্যা দরজা খুলতেই মানসীকে দেখতে পেল। একদম লাল বেনারসি পড়ে বউ সাজা। মানসী ভেতরে ঢুকতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে খালামণি ওকে ধরে ফেলল। বলল,

“ফাজিল মেয়ে কোথাকার! একটু সুযোগ পেয়েই একবারে এখানে? দেখছিলি না আমি পেছন পেছন দৌড়াচ্ছিলাম, থামছিলি না কেন? অসভ্য মেয়ে! বলেছি না সারাজীবন এ বাড়ির ছায়াও মাড়াতে পারবি না!”

মানসী ওর মায়ের হাত ছাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,

“নীরবদা কোথায়?”

স্পেসিফিক কাউকে জিজ্ঞেস করেনি, একজন উত্তর দিলেই হয়। দিতিয়াই বলল,

“ও ঘরেই আছে।”

মানসী দৌড়ে আমার ঘরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিল। খালামণি পেছন পেছন আসছিল কিন্তু আসার আগেই মানসী দরজা লাগিয়ে দিতে পেরেছিল। আমি দরজার দিকে তাকাতেই অবাক! লাল বেনারসি শাড়ি, গা ভর্তি গয়না, মাথায় ঘোমটা! আর দুচোখ ভর্তি কান্না! এক লাফে উঠে ওর কাছে যাচ্ছিলাম, তার আগেই ও ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার বুকে। আমিও ওকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। দরজায় অনবরত টোকা দিচ্ছে খালামণি, এমনকি আমার মাও। সেদিকে আমাদের দু’জনের কারোরই ভ্রুক্ষেপ নেই। একসময় মানসী আমাকে ছেড়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

“আজ আমার বিয়ে। দেখো, সুন্দর লাগছে না আমাকে?”

ওর চোখ বেয়ে জল পড়ছে। আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। ও বলল, “আমি বউ সাজব আর আমার তুলতুলের বাবা দেখতে পারবে না তা কি হয় বলো?”

আমি উত্তেজনায় কথা বলতে পারছিলাম না। ও আমার বুকে হেলান দিয়ে বলল,

“কেমন লাগছে বলো?”

আমি ওর মুখটা দুহাতে তুলে ধরে বললাম,

“খুব সুন্দর লাগছে। খুব খুব। সারাজীবন তোকে এভাবে দেখতে ইচ্ছে করছে।”

তারপর আবার দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুই আসলি কী করে?”

“বিউটি পার্লার থেকে বাসায় ফেরার সময় গাড়ি থেকে নেমে এক দৌড়ে চলে এসেছি।”

বলেই মানসী হেসে দিল। চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়ছে, আর মুখে হাসছে মেয়েটা। আমি বললাম,

“চল পালিয়ে যাই।”

“তা হয় না। বাবাকে কথা দিয়েছি তোমার সাথে সম্পর্ক রাখব না। আজ তো কার না কার সাথে বিয়ে হয়ে চলেই যাব শ্বশুরবাড়ি। দু’দিন পর কানাডা। আর কখনো দেখা হবে কিনা জানি না তাই দেখা করতে এলাম। আর দেখাতে এলাম তোমার বউকে বউ সাজলে কেমন লাগে।”

একথা বলে মানসী আবার হাসল। তারপর আমার শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে বুকের মধ্যে কামড় দিল। প্রচণ্ড ব্যথা পেলাম। ও মুখটা সরিয়ে নিতেই দেখলাম ওর দাঁতের ধারে ভয়ঙ্করভাবে কেটে গেছে আমার বুকের অনেকটা অংশ। আর সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে। ও আবার হেসে বলল,

“এই দাগ সারাজীবন থাকবে। দেখবে আর আমার কথা মনে করবে।”

আমিও হাসলাম। ও বলল,

“শোনো, দিতিয়াকে ছেড়ো না। অন্য কোনো মেয়ের সাথে তোমাকে সহ্য করতে পারব না আমি। ওর সাথে পারব, ওকে নিজের আপন কেউ মনে হয়। আর ওর কাছে তোমাকে ভরসা করে দিতেও পারব, যেভাবে অন্য কারো কাছে পারব না। তাই ওকে ছেড়ো না, ওর সাথেই থেকো।”

আমি কিছু বললাম না। ও বলল,

“এই শোনো, তোমার আর দিতিয়ার মেয়ে হলে নাম রাখবে তুলতুল। আর ছেলে হলে রাখবে দিহান। আমার মেয়ে হলেও নাম রাখব তুলতুল, ছেলে হলে দিহান। যেমনটা আমরা ঠিক করে রেখেছিলাম।”

কথা শেষ করে আবার হাসল মানসী। খিলখিলিয়ে হাসছিল। আমিও ওর হাসিতে যোগ দিলাম। কিন্তু ওর চোখে জল ছিল, আমার চোখে ছিল না। ধাক্কাধাক্কিতে দরজা ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হলো! সেদিকে খেয়াল করার সময় আমাদের নেই। ও বলল,

“শোনো, তোমাকে একটা কথা কখনো বলা হয়নি আজ বলব, আজ না বললে আর বলা হবে না।”

“কী বল?”

“তুমি যে আমার কানে চুমু খেতে সেটা আমার খুব পছন্দ ছিল। খুব ভালো লাগত।”

আমি সাথে সাথে ওর বাম কানে চুমু খেলাম। ও শিউরে উঠল। তারপর বলল,

“তোমার কোলে উঠতে আমার খুব ভালো লাগত।”

আমি সাথে সাথে ওকে কোলে তুলে নিলাম। ও আমার ঘাড় জড়িয়ে ঝুলে ঝুলে হাসতে লাগল। আর বলল,

“আজ আমি অনেক খুশি।”

আমি ওর চুলের ঘ্রাণ নিচ্ছিলাম। ও বলল,

“আরো বেশি করে নাও। যেন তোমার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত এই ঘ্রাণ পাও।”

আমি তাই করলাম। তারপর একসময় বলল,

“এবার আমাকে যেতে হবে। তা না হলে বাবার কাছে ধরা খাব। আর সময়মতো চলে যেতে পারলে বাবাকে বলার সাহস মা করতে পারবে না। যেতে দাও।”

আমি ওকে কোল থেকে নামালাম। ও আবার আমার গলা জড়িয়ে বলল,

“আই লাভ ইউ।”

“আই লাভ ইউ টু সোনাবউ।”

ও আবার ওর সেই বিখ্যাত হাসিটা দিল। চোখের জলও সাথে আরো দুফোটা গড়াল। মানসী দরজার কাছে গিয়ে লকে হাত দিয়ে ঘুরে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর আবার ছুটে এল আমার কাছে। পাগলের মতো আমার ঠোঁটে চুমু খেলো। ওর চোখের জল টপটপ করে পড়ছিল আমার গালে, ঠোঁটে। তারপর যখন সরে যাচ্ছিল আমি ওর হাত ধরে থামিয়ে বললাম,

“আরেকটা কান্নাচুমু দিবি অনেকক্ষণ ধরে?”

কথা শেষ হতেই আমার আবদার রাখল মানসী। আমি একই সাথে পান করছিলাম ওর ঠোঁটের অমৃত আর চোখের জলের নোনাবিষ!

নীরব ইশতিয়াক
২৬ এপ্রিল, ২০১৬

২৯

অদ্রি-অৰ্পি দুজনেই কাঁদছিল। অদ্রি ডায়েরিটা অর্পির হাত থেকে নিয়ে বলল,

“আর পরব না,”

অৰ্পি কাঁদতে কাঁদতেই বলল,

“কেন? শেষটা না জানলে মরেই যাব।”

“শেষই তো। কীভাবে মানসী আন্টির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তা তো জানলামই। যার বিয়ে হয়ে গিয়েছে তার জন্য তো আর বসে থেকে লাভ নেই। তাছাড়া সে তো বলল, ‘দিতিয়াকে ছেড়ো না’ তাই চাচ্চুর সাথে চাচির ডিভোর্সটা আর হয়নি।”

“হ্যাঁ, কিন্তু চাচির সাথে ভালোবাসা কী করে হলো, সেটা জানব না? তাছাড়া ডায়েরিটাতে তো আরো কত কী লেখা আছে। আমি সবটা না পড়লে শান্তি পাব না।”

“তাহলে তুই একাই পড়। আমি আর পারছি না। আমার নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে।”

“সত্যি আপ্পি, আমারও বুকের মধ্যে কেমন জানি করছে! কী অদ্ভুত ভালোবাসা ছিল ওদের। ভালোবাসা যে এমন হয় আমি জানতাম না, অথচ ভাবতাম ভালোবাসার সবই বুঝি আমি।”

“এটা না পড়লে জানতামই না ভালোবাসা কী! কী করে ভালোবাসতে হয়! কিন্তু আমার আর ক্ষমতা নেই এসব নেয়ার মতো। পাগলের মতো ভালোবাসত দুজন দুজনকে অথচ শুধুমাত্র ফ্যামিলির কথা চিন্তা করে স্যাক্রিফাইস করে গিয়েছে।”

অৰ্পি চোখ মুছে বলল,

“ওরা পালিয়ে গেলেই ভালো হতো রে আপ্পি।”

“তা হয়তো হতো, কিন্তু ১০% হয়তো ভালোবেসে পালায় তাদের কথা

শুনে আমরা কেউ কেউ বলি খুব ভালো কাজ করেছে, কেউ কেউ বলি খুব খারাপ কাজ করেছে। কিন্তু বাকি ৯০% যারা নিজের ফ্যামিলির কথা ভেবে পালিয়ে যায় না তাদের কষ্টের কথা আমরা জানতেও পারি না।”

“আসলেই।”

হঠাৎ দরজার বাইরে টোকা পড়ল। তারপর অনন্যার গলা পাওয়া গেল,

“অৰ্পি? অৰ্পি?”

অর্পি চমকে বলল,

“মা কেন?”

তারপর বাইরের দিকে চোখ পড়তেই দেখল ভোর হয়ে গিয়েছে! কখন যে রাত পার হয়ে গেল টেরই পায়নি ওরা।

আবার অনন্যার ডাক,

“অর্পি ওঠ, তাড়াতাড়ি। আজকেও স্কুলে যেতে দেরি হলে তোর স্কুল বন্ধ করে একটা রিক্সাওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দেব।”

অর্পি ডায়েরিটাকে নিজের ড্রয়ারে চালান করে দিল। অদ্রি বিছানায় শুয়ে পড়ল। তারপর অর্পি গিয়ে দরজা খুলে ঘুমের ভান করল। অনন্যা বলল,

“দশ মিনিটে রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট করতে আসবি। লেট লতিফ কোথাকার!”

একথা বলেই অনন্যা রান্নাঘরে চলে গেল।

অর্পি স্কুলে যাওয়ার সময় ড্রয়ারের চাবি নিয়ে চলে গেল। বলল,

“চাবি আমি নিয়ে যাচ্ছি যাতে তুই একা না পড়তে পারিস! আমি ফিরি তারপর দুজনে একসাথে পরব।”

.

সকাল ১০টা নাগাদ অদ্রি উঠল ঘুম থেকে উঠল। ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট নিয়ে ড্রইং রুমে গিয়ে টিভি ছাড়ল। দিতিয়া কাজ করতে করতে বলল,

“কী ব্যাপার! আমার আম্মুর চোখমুখ ফোলা লাগছে কেন?”

অদ্রি ভেবে পেল না কী বলবে! রাত জেগে কান্নাকাটি করায় চোখমুখ ফুলে গেছে বোধহয় কিন্তু সেটা তো বলা যাবে না। বলল,

“আর বলো না, ঘুম হয়নি ঠিকমতো। অর্পি বারবার গায়ে পা তুলে দিচ্ছিল।”

দিতিয়া হেসে বলল,

“ভালোই তো।”

“ধুর কিসের ভালো? খুব বাজে অভ্যাস!”

দিতিয়া কিছু বলল না। অদ্রিই একটু পরে বলল,

“বাই দা ওয়ে, আম্মু কোথায়? দেখছি না যে?”

“বাইরে গেল তো।”

“কোথায়?”

“জানি না।”

দিতিয়া ভেতরে চলে গেল। অদ্রির খাওয়া প্রায় শেষ। এমন সময় দিতিয়া ঝুড়ি নিয়ে বেরোচ্ছে। তার মানে বাগানে যাচ্ছে। বাগানে অনেক সবজি গাছ আছে। দিতিয়া ওখান থেকে কিছু আনবে বোধহয়। দিতিয়া একা, সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। পিছু পিছু গেল অদ্রি।

দিতিয়া বলল,

“ওরে বাবা! আম্মু দেখি বাগানে।”

“হুম! উইদাউট অর্পি বাসাটা খুবই বোরিং, তোমরা তো সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকো। তুমি বাগানে আসছ দেখে এলাম।”

“খুব ভালো করেছিস।”

চাচি করল্লা গাছ থেকে করল্লা ছিঁড়ছিল। অদ্রি হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,

“আচ্ছা চাচি, তোমার আর চাচ্চুর লাভস্টোরিটা একটু শোনাও না।”

“আমাদের আবার লাভস্টোরি কী? আমাদের তো অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছিল।”

“তো? অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে বুঝি কোনো ডে অফ লাভ থাকে না? বিয়ের দিন থেকেই দুজন দুজনকে ভালোবাসো?”

“নাহ, তা নয়।”

“তাহলে? তোমাদের সেই ডে অফ লাভের কাহিনী শুনতে চাই।”

চাচি লজ্জা পেয়ে বলল,

“ধুর! কী যে বলিস না। আমাদের সেরকম কাহিনী নেই।”

অদ্রি দিতিয়ার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,

“বলো না, এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে? আমরা তো বন্ধুর মতো। মা কত্ত বলে তাদের লাভস্টোরির কথা। বাট ওটা শুনতে শুনতে বোর হয়ে গিয়েছি।”

“আচ্ছা তা হঠাৎ আমাদের লাভস্টোরি শুনতে মন চাইল কেন?”

“সত্যি কথা বলব? রাগ করবে না তো?”

“আমি কখনো রাগ করেছি কোনো কিছু নিয়ে?”

“না তা করোনি, কিন্তু এটা তো পারসোনাল ব্যাপার!”

“কী!”

“আগে বলো মাকে বলবে না।”

“আচ্ছা বাবা আচ্ছা বলব না।”

“গতকাল বিকেলে আমি অনিচ্ছাকৃতভাবে একটা দৃশ্য দেখে ফেলেছি। তাই খুব আগ্রহ হচ্ছে তোমাদের লাভস্টোরিটা শোনার জন্য।”

“কী দৃশ্য?”

“চাচ্চু তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। বারান্দায় গিয়েছিলাম কাপড় আনতে। বাতাসে পর্দাটা সরে যাওয়ায় আমার চোখ পড়েছিল।”

দিতিয়ার চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল। তা দেখে অদ্রি বলল,

“বিশ্বাস করো আগে জানলে তাকাতামও না ওদিকে। আমি অবশ্য সাথে সাথে চলে এসেছিলাম। তারপর চাচ্চু প্যারিস চলে যাওয়ার পর থেকেই তোমার কী মন খারাপ!”

মুহূর্তের মধ্যে দিতিয়া লজ্জায় লাল হয়ে গেল। অদ্রি বলল,

“আসলে এটা কমন দৃশ্য, বাবা-মাকে অসংখ্যবার দেখেছি কিন্তু কখনো এরকম ফিল হয়নি।”

“কারণ, তোমার চাচ্চু একটু অন্যরকম। অনেকের কাছে বোরিং। তাকে বাইরে থেকে দেখে অনুভূতিহীন মনে হয়, কিন্তু সেও একটা মানুষ, তারও অনুভূতি আছে। তবে সবার মতো তা প্রকাশ করতে পারে না এখন আর।”

“তার মানে আগে পারত?”

“হুম, শুনেছি আগে ও খুব চঞ্চল আর মজার মানুষ ছিল।”

“তাহলে এখন এরকম হয়ে গেল কেন?”

“বয়সের সাথে সাথে মানুষের মধ্যে অনেক চেঞ্জ আসে।”

অদ্রি মনে মনে ভাবল, ইশ চাচি কত ভালোবাসে চাচ্চুকে। চাচ্চুর দোষটা ঢেকে রাখল। ওর সামনে চাচ্চুকে ছোট করল না। কিন্তু মানুষ তো সুযোগ পেলে ভালোবাসার মানুষের দোষ বলতে ছাড়ে না। ওর বেস্ট ফ্রেন্ডই তো পাগলের মতো ভালোবাসে বয়ফ্রেন্ডকে। অথচ সারাটা দিন খালি তার দোষগুলো বলতে থাকে। এত দূরেই বা যাচ্ছে কেন! ওর মাও তো বাবাকে অনেক ভালোবাসে। তারপরেও বাবার কাছ থেকে কোনো কষ্ট পেলে ভুলে যায় না, ঠিকই সুযোগমতো বলে বসে, তোর বাবা এই করেছে সেই করেছে। অমুক জিনিসটা চেয়েছিলাম আজও দেয়নি অথচ এত অবহেলা, আর খারাপ ব্যবহারের পরেও চাচির মুখে কোনো অভিযোগ নেই! অদ্রি বলল,

“চাচি চাচ্চু কি রোমান্টিক?”

চাচি হেসে ফেলল। অদ্রি বলল,

“আহা বলোই না।”

“সদ্য প্রেমে পড়েছিস বলে এসব জানতে চাচ্ছিস তাই না? খুব বুঝতে পারছি।”

অদ্রির মনে হলো সেদিন ডায়েরি হাতে ধরা খেয়ে অর্পি যে মিথ্যাটা বলেছিল তা ভালোই কাজে দিচ্ছে। অদ্রি হেসে বলল,

“বলো না। যেভাবে তোমাকে দূর থেকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল তাতে তো আমার মনে হয়েছিল খুব রোমান্টিক।”

“ওটাকে যদি রোমান্টিসিজম বলিস তাহলে বলব ও রোম্যান্টিক। কিন্তু সত্যি বলতে রোমান্টিসিজম কী তাই আমার কাছে ঝাপসা। ওই আমার জীবনে প্রথম পুরুষ। ও যেমন, তেমনভাবেই ওর প্রতি আমার ভালোবাসা হয়েছে। তেমনভাবেই ওকে চেয়েছি। তেমনভাবেই পেয়ে আমি অনেক সুখী।”

ও। আচ্ছা, প্রায়ই তো শুনি চাচ্চু তোমার বার্থডে এনিভার্সারি ভুলে যায়। তুমি রাগ করো না কেন?”

“আমি তো জানি তোদের চাচ্চু একটু ভুলোমনা। তাছাড়া কত ব্যস্ত থাকে!”

“হুম। কিন্তু ভুলে গেলে তো গিফটও দেয় না, তখন মন খারাপ হয় না তোমার?”

“ও আমাকে কী দিতে কম রেখেছে বলো? আর যখনই কোথাও যায় আমার জন্য তো কত গিফট নিয়ে আসে।”

“সে তো সবার জন্যই আনে। তোমার জন্য স্পেশালি তো না।”

“স্পেশাল গিফট! সারাজীবনের জন্য কত বড় একটা স্পেশাল গিফট তো দিয়েই রেখেছে। এর চেয়ে বেশি স্পেশাল আর কী হতে পারে?”

“কী?”

“দিহান।”

অদ্রি হেসে আবার চাচিকে জড়িয়ে ধরল,

“ওহ! সো সুইট অফ ইউ চাচি!”

চাচি হেসে বলল,

“পাগলি। ছাড়! কাজ করছি না?”

অদ্রি চাচির গলা ছেড়ে দিল। তারপর চাচি আবার কাজ করতে শুরু করে দিল। অদ্রি বলল,

“ইশ কত্তো ভালোবাসো তুমি চাচ্চুকে।”

“সব মেয়েরাই তাদের স্বামীকে ভালবাসে।”

“কক্ষনো না। সবাই হয়তো তাদের স্বামীকে ভালোবাসে কিন্তু এভাবে না। আচ্ছা চাচি বলোই না একটা মানুষের সাথে তোমার বিয়ে হলো যাকে তুমি চেনো না জানো না, তারপর তার প্রতি এতটা ভালোবাসা হলো কী করে? নিশ্চয়ই কোনো একটা দিন কোনো একটা ঘটনা ঘটার পরেই ভালোবাসাটা হয়েছিল। সেই ডে অফ লাভের কথাই জানতে চাচ্ছি। বলো না চাচি প্লিজ প্লিজ প্লিজ!”

“সেই হিসেব করলে আমাদের ডে অফ লাভ তিনটা।”

“তিনটা? হাও ইজ ইট পসিবল?”

“একটা হচ্ছে তোমার চাচ্চুকে যেদিন থেকে আমি ভালোবেসেছি। আরেকটা তোমার চাচ্চু আমাকে যেদিন থেকে ভালোবেসেছে! আরেকটা হলো যেদিন থেকে দুজনেই দুজনার ভালোবাসার কথা জেনেছি।”

“পুরো গুলিয়ে গেল। একটু বুঝিয়ে বলো না সুইটহার্ট। তিনদিনের ঘটনাই বলো।”

চাচি হেসে বলল,

“ঘটনা বিশেষ কিছু না। তবে ওকে আমি আগে ভালোবেসেছি। আমাদের বিয়ের দু’তিন মাস পরেই হুট করে একদিন মনে হয়েছিল আমার কপালের গুণে ওর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। ওর সাথে সারাজীবন না থাকতে পারলে আমার জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে।”

“সারাজীবন না থাকতে পারার কথা বলছ কেন? তোমাদের তো বিয়েই হয়ে গিয়েছিল।”

অদ্রি ইচ্ছে করেই খোঁচাটা মারল। চাচি কী বলে সেটা দেখার জন্য। দিতিয়া বলল,

“কথার কথা বললাম।”

অদ্রি মনে মনে ভাবল, ‘চাচি এবারও চাচ্চুকে ছোট করল না। কীভাবে মানুষ এতটা ভালোবাসতে পারে?’ তারপর বলল,

“আচ্ছা তারপর বলো কী কারণে এরকম মনে হয়েছিল?”

“কী জানি! ভালোবাসা কি আর বলেকয়ে হয়? হঠাৎ করেই হয়ে যায়।”

“আর চাচ্চুর হয়েছিল কবে?”

“তা তো আমি জানি না তোমার চাচ্চুই বলতে পারবে।”

“আচ্ছা আর দুজনে জানলে কবে? কী করে জানলে?”

“আমাদের বিয়ের প্রায় ৮ বছর পর।”

“সেকি! ৮ বছর!”

“হুম!”

“কে আগে বলল? তুমি না চাচ্চু?”

“ডিরেক্টলি কেউই কিছু বলিনি।”

“না বললে বুঝলে কী করে?”

চাচি হেসে বলল,

“ভালোবাসলে ঠিকই বোঝা যায়।”

“ও, আচ্ছা তারপর কবে প্রথম আই লাভ ইউ বললে?”

চাচি আবার হাসল,

“ডিরেক্টলি কখনোই বলিনি। আমাদের সময়টা তোমাদের সময়ের মতো ছিল না। আজকাল দেখি কথায় কথায় মানুষ আই লাভ ইউ বলে। কথাটা অনেক সস্তা হয়ে গিয়েছে। যাকে তাকে যখন তখন বলে দিচ্ছে। অথচ একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম এটা না বলে।”

“সেটা অবশ্য ঠিক কিন্তু আজকাল এটা না বললে ঝগড়াও হয় জানো?”

“তাই?”

“হ্যাঁ।”

দিতিয়ার সবজি তোলা শেষ। এবার বাসার ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে দিতিয়া বলল,

“পারেও আজকালকার ছেলেমেয়েরা!”

দাদু সামনে পড়ায় অদ্রি আর কোনো কথা বের করতে পারল না!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *