২০
আমি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। নতুন চাকরিতে জয়েন করলাম। এখানে কাজের চাপ বেশি। একা অনেক কিছু সামলাতে হয়। তবে আগের হসপিটালের চেয়ে এই হসপিটালে আমার বেশি ভালো লাগতে শুরু করল। কাজেও মন বসাতে পারলাম। একদিন দুপুরের ওটি করে আমার চেম্বারে ঢুকলাম লাঞ্চ করতে। ঢুকেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। মানসী বসে আছে, পরনে আমার আর ওর বিয়ের দিনের সেই লাল জামদানি শাড়িটা। লম্বা চুলগুলো বেনি করে তাতে বেলি ফুলের মালা লাগিয়েছে। কপালে লাল টিপ, হাতভর্তি কাচের চুড়ি। আর বিয়ের দিন আমার দেয়া সেই নাকফুলটা, ডিভোর্সের দিন খুলে ফেলেছিল। তারপর ওকে আর ওটা পরতে দেখিনি। বিয়েতে নাকি বউকে নাকফুল দিতে হয়। তখন ইনকাম ছিল না কোনো, তবু জমানো টাকা দিয়ে ওটা আমি ওর জন্য কিনেছিলাম। দিয়ে বলেছিলাম, “আমার যখন অনেক টাকা হবে আমি তোকে গয়না দিয়ে ঢেকে ফেলব।” ও বলেছিল, “তখনো তোমার সেই অনেক গয়নার চেয়ে এই নাকফুলটা আমার কাছে সবচেয়ে দামি থাকবে।”
যাই হোক সব মিলিয়ে মনে হলো স্বপ্ন দেখছি। আমাকে ঢুকতে দেখেই ও হেসে দিল। আমি বললাম,
“তুই হঠাৎ? এত সাজগোজ?”
“বাজে লাগছে?”
“না, সাজিস না তো সচরাচর। তাই হঠাৎ সাজলে অবাক হতে হয়।”
ও হাসল। আমি আবার বললাম,
“কিন্তু আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না যে মেয়েটা আমার সামনেও আসতে চায় না। এমনকি বাড়িতে আসলে তখনই আসে যখন আমি বাসায় থাকি না। আজ কিনা সে আমার অফিসে! সূর্য কোনদিকে উঠেছে বল তো?”
“সূর্য তো পূর্বেই উঠেছিল।”
একথা বলে ও আবার হাসল। আজ প্রথম থেকেই ওর মুখটা হাসি হাসি দেখে নিঃশ্বাস নিতেও কেমন যেন স্বস্তি বোধ করছি। হঠাৎ ও উঠে এসে আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। ও সব সময়ই টিপিক্যাল ব্যাকডেটেড মহিলাদের মতো বিশেষ দিনে আমাকে শুয়ে হাত দিয়ে সালাম করত। প্রথম প্রথম আমার খুব অস্বস্তি আর লজ্জা লাগত। পরে একসময় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ওর মাথায় হাত রেখে বললাম,
“কিরে হঠাৎ সালাম? বিয়েটিয়ে করতে যাচ্ছিস নাকি?”
মানসী আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল,
“আমাকে উইশ করো, আজকে আমি ২০ বছরে পা দিলাম।”
আমি জিভ কেটে বললাম,
“ইশ, আমার মতো অমানুষ দুনিয়ায় আর একটা নেই। আমি তোর বার্থডে ভুলে গেলাম! ভেরি সরি। আমাকে ভুল বুঝিস না। শুভ জন্মদিন।”
একথা বলে আমি ওর কপালে একটা চুমু দিলাম। ও বলল,
“ভুল বুঝবো কেন? এখন তুমি কত ব্যস্ত থাকো! তাছাড়া কত রকমের ঝামেলার মধ্যে দিন কাটাচ্ছ! মনে না থাকলেও সেটা দোষের কিছু হবে না। আর আমার জন্মদিন ভুলে গেলেও আমাকে যে এক মুহূর্ত ভুলতে পারো না, তা আমি খুব ভালোভাবে জানি।”
আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। ও বলল,
“দরজাটা লক করে দেবে একটু?”
“কেন?”
“সমস্যা হবে?”
আমি দরজার কাছে যেতে যেতে বললাম,
“নাহ, এম্নিতেও লাঞ্চ টাইম। না ডাকলে কেউ আসবে না।”
একথা বলে ঘুরতেই ও দ্রুত হেঁটে আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। সাথে সাথে আবেশে আমার চোখটা বন্ধ হয়ে গেল। কী শান্তি! কী শান্তি! পৃথিবীর আর কোথাও নেই, আর কিছুতে নেই। একসময় ও আমাকে ছেড়ে দিল। তারপর বলল,
“দেখো, আজ আমি নিজ হাতে তোমার জন্য রান্না করে এনেছি। তোমার পছন্দের সব খাবার।”
আমি বললাম,
“বাহ! বার্থডে তোর আমার উচিত তোকে খাওয়ানো, গিফট দেয়া। উইশ তো করিইনি, মনে ছিল না তাই গিফটও কেনা হয়নি। এখনই ভাবছিলাম ছুটি নেব। তারপর তোকে নিয়ে বের হব, বাইরে লাঞ্চ করব। এখন দেখছি এটাও করতে দিবি না। তাহলে আজকের এই বিশেষ দিনে আমি কী করব বল তো তোর জন্য? কী গিফট চাস বল?”
ও আমার কাছে এসে এমন এক অদ্ভুত মাদকময় চাহনি দিল যে আমার বুকের ভেতর উথালপাথাল ঢেউ খেলতে লাগল। তারপর বলল,
“বিশেষ দিনের বিশেষ গিফট আমি নিয়ে নিতে জানি!”
বলেই আমার গলা জড়িয়ে ধরে আমার ঠোঁটে চুমু খেলো। মনে হচ্ছিল পুরো পৃথিবীটা আমার হাতের মুঠোয়। ও একটু থামল, সরে যেতে চাইল, আমি তো তখন নাছোড়বান্দা। ও বলল,
“শোনোই না…
অগত্যা আমি ওকে ছাড়লাম ঠিকই কিন্তু কোমর জড়িয়ে ধরে রইলাম। বললাম,
“বল…”
“আরেকটা গিফট চাই আমার।”
ততক্ষণে নেশা ধরে গেছে আমার। আর কোনো কথা বলতে বা শুনতে ইচ্ছে করছিল না। তবু যখন ও গিফট-এর কথা বলছে, সেটা তো শুনতেই হবে। জিজ্ঞেস করলাম,
“কী?”
“এত সুন্দর করে আদর করো তুমি। নিজেকে ধন্য মনে হয়। এতদিন আমি তা বেহিসাবি পেয়েছি।”
“আদর আবার হিসাব করে করা যায় নাকি? আর শুধু আমি কেন সবার স্বামীই তাদের বউদের এত সুন্দর করেই আদর করে।
“নাহ, দিতিয়ার স্বামী তো ওকে আদর করে না।”
অন্য সময় হলে হয়তো একথায় রাগ করতাম। কিন্তু কেন যেন রাগ উঠল না। মাথায় দুষ্টমি ভর করল। বললাম,
“এই চার মাসে এতগুলো রাত এক ঘরে, এক বিছানায় কাটিয়েছি। তার ওপর বিয়ে করা বউ। তোর কি মনে হয় ওর সাথে কিছুই করিনি আমি?”
“ঢং করো না, ও আমাকে বলেছে ওকে একবারের জন্য স্পর্শও করোনি তুমি।”
“ধুর, বলে দিল! মেয়েটা বড্ড বোকা।”
“বোকা নয় বলো ভালো। আমাকে ইনিয়েবিনিয়ে অনেক কিছু বলতে পারত কিন্তু বলেনি।”
“আচ্ছা, তুই তো গিফটের কথা বলছিলি।”
“হ্যাঁ, আমি এটাই গিফট হিসেবে চাই যে তুমি দিতিয়াকে ওর প্রাপ্যটা দাও। এসব আদর তো ওরই প্রাপ্য।”
“ওকে আদর করলে তোর লাভ কী?”
“লাভ অনেক আছে। তোমাকে বোঝাতে পারব না। দেখো আমরা তো আর এক হতে পারব না। কোনো উপায় নেই। আর তোমাদেরও তো বিয়েটা হয়েছে। এভাবে আর কতদিন চলবে বলো তো?”
কী বলব ওকে বুঝতে পারছিলাম না। ও বলল,
“জানো, ডিভোর্সের পর থেকে আমার কেমন জানি মনে হয় তোমার কাছে আসলে আমার পাপ হবে। এখন তো আমরা আর স্বামী-স্ত্রী নেই। আর তুমিও বিবাহিত। তাই এখন আরো আসতে পারি না। শুধু আজই কেন জানি পারলাম এসব কোনো অনুভূতিকে পাত্তা না দিতে। তুমিই বলো আমাদের সম্পর্ক আর কোনো দিকে টেনে নেয়ার মতো অবস্থায় কি আছে? এটা নিয়ে বসে না থেকে
আমাদের কি উচিত না সব ভুলে সামনের দিকে আগানো? যে কারণেই হোক, বিয়েটা তো হয়েছে, সেটা তো আর মিথ্যে নয়। দিতিয়ার মতো মেয়ে পাশে আছে তোমার। দেখবে তুমি পারবে।
আমি খুব সিরিয়াস হয়ে বললাম,
“আমি অন্য কাউকে কখনো ভালোবাসতে পারব না।”
“আমাদের চারপাশে যত হাজবেন্ড-ওয়াইফ আছে তারা সবাই কি সবাইকে ভালোবাসে?”
“সেটা আমার দেখার দরকার নেই।”
“আছে, অনেক সম্পর্কের মধ্যেই ভালোবাসা নেই। তারা কি একসাথে থাকছে না বছরের পর বছর?”
“তুই আমাকে আপোষ করতে বলছিস?”
“হ্যাঁ, একটু করেই দেখো দিতিয়া তোমার জন্য কী করে। আমি অলরেডি ওর চোখে তোমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি। দেখো আমার যদি তোমাকে ফেরত পাওয়ার কোনো চান্স থাকত তাহলে আর এসব বলতাম না। যেহেতু নেই তাই আমি চাই তুমি দিতিয়ার সাথেই ভালো থাকো। অন্য কোনো মেয়ে হলে বলতাম না, কিন্তু দিতিয়ার ওপর ভরসা করে তোমাকে দেয়া যায়। ও তোমার অনেক যত্ন করবে।
“তুই পারবি আমি ছাড়া অন্য কারো সাথে বিয়ে করে তার সাথে সুখে সংসার করতে?”
“হুম, পারব। সময় সব ঘা শুকিয়ে দেয়।”
“দাগটা কিন্তু রয়ে যায়।”
“চাঁদেরও তো কলংক থাকে।”
এ ব্যাপারে আর কথা বাড়ালাম না। বললাম,
“আমরা আজ এই মুহূর্তে এই আলাপ বাদ দিই? আজ তো তোর পাপ বোধ হচ্ছে না তাই না?”
মানসী মিষ্টি করে হাসল। আমরা সেদিন ওইটুকু সময়ের মধ্যেই ঝড়ের বেগে পাপবোধহীন অনেকটা পাপ করলাম।
.
সেদিন আমাকে ও নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছিল। যাওয়ার সময় আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলেছিল “তোমার জন্য একটা বিশাল সারপ্রাইজ আছে।”
“জন্মদিন তোর আর সারপ্রাইজ আমার জন্য?”
“হ্যাঁ।”
“কী সারপ্রাইজ?”
“যখন পাবে তখনই বুঝতে পারবে।”
২১
সেদিন মানসী চলে যাওয়ার পর বিকেলে হসপিটাল থেকে কয়েক ঘণ্টার ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে ব্যাংকে গেলাম টাকা তুলতে। কত টাকা তুলব বুঝতে না পেরে এক মাসের পুরো স্যালারিটাই তুলে ফেললাম। তারপর মার্কেটে গেলাম। মানসীর জন্য একটা উপহার কেনা দরকার। কী কিনব বুঝতে পারছি না। তাই আন্দাজে ঘোরাঘুরি করছি। তারপর মনে হলো ওর শাড়ি খুব পছন্দ। শাড়ির দোকানে ঢুকলাম। কিন্তু কোনো শাড়ি পছন্দ হলো না। বেরিয়ে এলমেলো হাটাহাটি করছি। শাড়ি ছাড়া কি নেয়া যায় ভাবছি এরই মধ্যে একটা শাড়ি চোখে পড়ল। সোনালী রঙের জামদানি শাড়ি। মানসী জামদানি শাড়ি খুব পছন্দ করে। এই আমাকে নিয়েই শপিং করতে এসে এই রঙের জামদানি অনেক খুঁজেছিল, কিন্তু পায়নি। আজ যদি এটা আমি ওকে উপহার দেই নিশ্চয়ই খুব সারপ্রাইজড হবে আর খুশিও হবে। শাড়িটা একরকম লুফে নিলাম। তারপর মনে হলো দিতিয়ার জন্য একটা নিই। নিশ্চয়ই খুশি হবে। মানুষ অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু পেলে তো খুশি হয়ই। ভালোবাসা তো আর কখনো দিতে পারব না। নাহয় একটা শাড়িই দিলাম। হুবহু একরকম দুটো শাড়ি নিলাম। পুরো এক মাসের স্যালারি থেকে মাত্র ১০০ টাকা রইল দুটো শাড়ি কিনে। জামদানি শাড়ি যে কেন এত দাম! যাই হোক বউটাও তো দামি। এসব ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেল যে আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। তারপরেও মানসীকে বউ বলে ভাবছি। সারা জীবনই হয়তো ভাবব। ভাবনার রাজ্যে বাধা দেয়ার সাধ্য কারো নেই।
মার্কেট থেকে বের হয়ে ফুল, কার্ড আর চকলেট কিনলাম। কার্ডে লিখলাম,
“এরকম আরো ১০০০ জন্মদিন আসুক তোর জীবনে, যাতে ততবার আজকের মতো আদর পাই! ভালোবাসি…”
তারপর টেলিফোন বুথে ঢুকে বাসায় ফোন করলাম। রিং হচ্ছে… “হ্যালো।”
“কে মা?”
“হ্যাঁ।”
“সৌরভ আছে বাসায়?”
“না ও তো হসপিটালে। কেন কী হয়েছে?’
“তেমন কিছু না। ওর সাথে একটু দরকার ছিল। আচ্ছা তুমি অনন্যাকে দাও।”
“আচ্ছা, দিচ্ছি ধর…”
মায়ের গলাটা অনন্যা অনন্যা ডাকতে ডাকতে দূরে সরে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনন্যার গলা পাওয়া গেল।
“দাদা…বলো।”
“মা আছে সামনে?”
“না।”
“যাক বাঁচা গেল। আমার কথা শোন…মানসীর জন্য আমি একটা শাড়ি কিনেছি। ওটা তোকে ওর বাসায় পৌঁছে দিতে হবে।”
“আচ্ছা।”
“আজই।”
“হুম সেটা তো বুঝতেই পারছি। জন্মদিন বলে কথা! দাদাও তো আমাদের বাসায়ই এখন।”
“তাই? কখন এসেছে?”
“কিছুক্ষণ আগে। তুমি আসবে কখন?”
“আমার দেরী হবে। কিন্তু শাড়িটা আজই পাঠাতে হবে। তুই একটু বের হতে পারবি? আমি রাস্তার মোড়ে থাকব। তুই এসে নিয়ে যাবি।”
“পারব। কিন্তু মাকে কী বলে বের হব?”
“জানি না, তোকে বের হতেই হবে।”
“আচ্ছা, এক কাজ করি। বলি যে সৌরভ আমাকে রাস্তার মোড়ে যেতে বলছে ওর কোনো একটা জিনিস নিয়ে। আর ওকেও ফোন করে বলে দিই যাতে এর মধ্যে ও ফোন না দেয়।”
“ওকে, থ্যাংকস।”
“শুকনো থ্যাংকস বললে হবে না। আইসক্রিম চাই।”
আমি হেসে বললাম,
“আচ্ছা, আয়…কিনে দিচ্ছি।”
অনন্যাকে শাড়ি দিয়ে আবার হসপিটালে চলে গেলাম। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে বারোটা বেজে গিয়েছিল। ভেতরে ঢুকে দিতিয়াকে দেখে চোখ সরাতে পারছিলাম না। মানসী যেভাবে সেজে আজ আমার অফিসে গিয়েছিল ঠিক সেভাবে সেজে আছে দিতিয়া। সেই লাল জামদানি শাড়িটা পরেছে। সেভাবেই চুল বেনি করে বেলি ফুল লাগিয়েছে। কপালে লাল টিপ, হাতভর্তি কাচের চুড়ি। দিতিয়া এমনিতেই আমাকে ভয় পেত। আর ঐভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওর ভয়টা আরো বেড়ে গেল। কাঁচুমাচু হয়ে বলল,
“আমি এরকমটা করতে চাইনি। মানসী আমাকে জোর করে এভাবে সাজিয়ে দিল।”
আমি হাসলাম। তারপর নিজের ঘরে ঢুকলাম। আমার হাসি দেখে ও বুঝি একটু স্বস্তি পেল। আমার পেছন পেছন ঘরে ঢুকে বলল,
“হাসছ যে?”
আমি শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললাম
“শাড়িটা কি তোমার?”
“না। আবার হ্যাঁ…মানসী এটা দিয়ে বলল আজ রাতে যেন এটা পরি। তারপর আবার নিজেই পরিয়ে দিয়ে গেল। সেই রাত ৯টায় আমাকে এভাবে সাজিয়ে দিয়ে গেছে। মেয়েটা খুব নাছোড়বান্দা। তখন থেকে এভাবে বসে আছি।”
আমি আবারও হাসলাম। তারপর শার্টটা খুলে ফ্লোরে ফেললাম আর ও সেটা কুড়িয়ে ঝুড়িতে রাখল। আমি বাইরে থেকে ফিরে ডেইলি এই অকাজটা করি আর ও প্রতিদিন এভাবেই কাজটা করে। ও বলল,
“এত হাসছ কেন? এটা কি কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস?”
“দুপুরে যা দেখেছি, এখন আবার তার ডুপ্লিকেট দেখছি তো তাই হাসছি।”
“মানে?”
“মানসী আজ আমার হসপিটালে গিয়েছিল। এই শাড়িটা পরে এভাবেই সেজে গিয়েছিল।”
হঠাৎ আমার চোখ পড়ল দিতিয়ার নাকফুলটার দিকে। এটাই সেই নাকফুলটা যেটা আমি মানসীকে দিয়েছিলাম। কী আশ্চর্য! আমার স্মৃতিগুলো কি রাখতে চায় না নাকি? আমি নিজেই অজান্তেই বলতে নিলাম,
“নাকফুলটা…”
তারপর আবার থেমে গেলাম, বললাম না। দিতিয়া বলল,
“এটা মানসী আমাকে দিয়েছে। কি একটা ব্যাপার বলো তো। ওর জন্মদিন কই আমি ওকে উপহার দেব তা না ওই এসব দিয়ে গেল।”
“এই নাকফুলটা আর শাড়িটা আমি ওকে আমাদের বিয়ের সময় দিয়েছিলাম। ও বোধহয় আমার কোনো স্মৃতি নিজের কাছে রাখতে চায় না। অথচ এতদিন বলেছিল এগুলো ওর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস। এগুলোকে ও মরণের আগ পর্যন্ত কাছছাড়া করবে না।”
দিতিয়া আমার একটু কাছে এসে বলল,
“অভিমান হয়েছে? থাক, আর অভিমান করতে হবে না। এবার আসল ঘটনাটা শোনো।”
“আসল ঘটনা আবার কী?”
“এই নাকফুলটা আজ আমি ওর নাকে দেখে বললাম, ‘বাহ খুব সুন্দর তো। কোত্থেকে কিনেছ?’ ও ঠিক তখনই ওর ব্যাগ থেকে হুবহু আরেকটা নাকফুল বের ‘এটা করে আমাকে দিল। সাথে এই শাড়িটাও। আমি তো অবাক! বললাম, কার?” বলে, ‘তোমার জন্য এনেছি।’ আমি কিছুতেই নিতে চাচ্ছিলাম না। কারণ জন্মদিনটা ওর। আমারই কিছু দেয়া উচিত। তখন ও কী বলল জানো?”
“কী?”
“একটা শাড়ি দেখিয়ে বলল, ‘এটা তোমার বর আজ আমাকে দিয়েছে। ও যখন দিয়েছে তখন তোমাকে আর দিতে হবে না। আর এটা আমার কাছে অনেক স্পেশাল। অনেক দিন ধরে খুঁজেছি এই শাড়িটা। আর আজ ও আমাকে দিল। আজ আমি খুব খুশি।’ তারপর জোর করে এগুলো আমাকে দিয়ে গেল। শুধু যে দিল তা না একেবারে পরিয়ে সাজিয়ে দিয়ে গেল। খুব অদ্ভুত একটা মেয়ে। আর খুব ভালো।”
আমি হেসে বললাম,
“হুম, সেকথা আমি ছোটবেলা থেকেই জানি।”
ওর জন্য কেনা শাড়ির প্যাকেটটা ঘরে ঢুকেই বিছানার ওপর রেখেছিলাম সেটা উঠিয়ে ওর হাতে দিয়ে বললাম,
“দ্যাখো তো এটা একটু।”
ও শাড়িটা দেখে চমকে উঠল,
“ওমা, এই শাড়িটাই তো ওকে দিয়েছ! এটাই তো দেখাল।”
“এটা না, এরকম দেখতে অন্য আরেকটা। ওটা মানসীর আর এটা তোমার।”
খুশিতে দিতিয়ার চোখে জল এসে গেল। অন্যমনস্কভাবেই বলে ফেলল,
“আমার! আমার জন্য এনেছ?”
“হ্যাঁ, কিনতে গিয়ে একটা কিনতে পারলাম না।”
“কিন্তু এত দামি শাড়ি এখন দেয়ার কী দরকার ছিল? আমার তো আর জন্মদিন না।”
“সমস্যা নেই, তোমার জন্মদিনে আবার দিব, দুজনকেই।”
বলেই হেসে ফেললাম। ও কিছু বলল না। আমি দুষ্টুমি করে বললাম,
“কী করব বলো দুটো বউ থাকলে এই হয় সমস্যা।”
ও অবাক হয়ে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। তারপর বলল, “তুমি আমাকে বউ মানো?”
দিতিয়ার চোখে জমে থাকা জলটা এবার গড়িয়ে পড়ল। মায়া হলো আমার। আমি কাছে গিয়ে ওর চোখের জল মুছে দিয়ে বললাম,
“এটুকুতেই এত খুশি?”
“এটা এটুকু ছিল না, অনেকটা ছিল। একবারের জন্য হলেও বউ তো বলেছ।”
আমি বললাম,
“দেখো, মানসী খুব কাঁদত। আর মাও কান্নাকাটিতে ওস্তাদ। কিন্তু কান্না জিনিসটা খুব অস্বস্তি দেয় আমাকে। আর কখনো কাঁদবে না।”
ও চোখ মুছে হাসল। আমি গোসল করতে ঢুকলাম। আমি প্রতিদিন হসপিটালে যাওয়ার সময় গোসল করে যাই, আবার যত রাতই হোক ফিরেও গোসল করি। প্রতিদিনের অভ্যাস। কিন্তু আজ গোসল করতে গিয়েই মনে হলো, মানসীর স্পর্শ লেগে আছে গায়ে। আজ নাইবা গোসল করলাম। ফ্রেশ হয়ে বের হলাম। তারপর বিছানায় শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ মনে হলো, আজ আমি দিতিয়ার সাথে অনেক ভালো ব্যবহার করলাম। ওর জন্য কষ্টও হলো কিন্তু কেন? মানসী বলেছে বলেই? নাকি আজ আমি নিজে অনেক শান্তিতে আছি তাই! নাকি ওর জন্য আমার মনে কোনো জায়গা হতে শুরু করেছে? না না সেটা কী করে হয়? আমি নিজেই নিজেকে নিয়ে কনফিউজড হয়ে গেলাম। কিন্তু আমার মনে তো দিতিয়ার জন্য কোনো জায়গা নেই। সবটা জুড়েই তো মানসী। নাকি নিজের অবচেতন মনেই দিতিয়াকে জায়গা দিয়ে ফেলেছি! কিন্তু এক সাথে কি দুজনকে ভালোবাসা যায়? দিতিয়াকে ছাড়তে পারব না ফ্যামিলির জন্য। আর ছাড়লে মেয়েটা যাবেই বা কোথায়? আর মানসীকে ছাড়া বেঁচে থাকাটা দূর্বিষহ। কী করা উচিত এখন আমার?
এসব আবোলতাবোল ভাবনার অবসান ঘটাল দিতিয়া,
“কী হলো? না খেয়ে শুয়ে পড়লে যে?”
আমি কিছু না বলে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটা সত্যি অনেক সুন্দর। ও বলল,
“প্লিজ, আজ না খেয়ে ঘুমিয়ো না। আজ একটা ভালো দিন। আর আজ মানসী তোমার জন্য রান্না করেছে।”
“মানসীর রান্না বলে খাওয়াতে হবে না। আজ খুব ক্ষিদে পেয়েছে, এমনিতেই খাব। রেডি করো, আমি আসছি।”
খেতে বসে অবাক হলাম। গরম ধোঁয়া উঠছে ভাত থেকে। বললাম,
“এত রাত্রে গরম ভাত কোথায় পেলে?”
“রান্না করেছি কিছুক্ষণ আগেই।”
“এত রাত্রে রান্না করতে গেলে কেন? রাতের ভাত ছিল না?”
“আমি জানতাম না যে তুমি গরম ভাত পছন্দ করো। জানলে প্রতিদিন রান্না করে দিতাম। আজ মানসী বলে গেল গরম ভাত তোমার খুব পছন্দ।”
আমি হেসে বললাম,
“ওর সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। সেটা তোমার মধ্যে ট্রান্সফার করার চেষ্টা করছে।”
“ভালো কিছু ট্রান্সফার হলে ক্ষতি কী? সত্যি হঠাৎ চকলেট পেলে বাচ্চাদের চেহারার যে অবস্থা হয় তোমার চেহারারও এখন সেই অবস্থা হয়েছে।”
আমি খেতে খেতে বললাম,
“তোমার আর মানসীর কথাবার্তা শুনলে মনে হয় তোমাদের যেন কতদিনের বন্ধুত্ব। অথচ তোমাদের যে সম্পর্ক আর যে পরিস্থিতি তাতে তোমাদের একজন আরেকজনের চুল ছেঁড়ার কথা।”
“হয়তো তাই করতাম যদি মানসী এমন না হতো।”
“ও তো বলেছে, তুমি না হলে ও অন্য কারো কাছে আমাকে ছাড়তে পারতো না।”
একথা শুনে দিতিয়া আমার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। আমি বললাম,
“বাই দ্য ওয়ে…মিথ্যে বলার দরকার ছিল না। আমি এমনিতেই খেতাম আজ। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল।”
“কী মিথ্যে বললাম আবার?”
“ওই যে বললে মানসী রান্না করেছে। সব তো মানসী করেনি। শুধু মাংসটা
মানসী করেছে। ভর্তাগুলো মা করেছে, বাকিগুলো তুমি বা অনন্যা কেউ হবে।
“বাপরে! রান্না খেয়েই বলে দিতে পারো রাঁধুনি কে?”
“সবারটা পারি না।”
“বাকিগুলো আমি করেছি।”
“বাহ, তোমার রান্না তো বেশ ভালো।”
“আমি কিছুই পারতাম না। মা শিখিয়েছে, এখনো শিখছি।”
“কেন, বাড়িতে কখনো রান্না করোনি?”
“না, চাচি রান্নাঘরে ঢুকতে দিত না। বলত আমি অপয়া। আমি বাড়ির অন্য কাজ করতাম।”
কথাটা শুনে খারাপ লাগল, ওরও হয়তো বলে খারাপ লাগছে। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললাম,
“রান্না শিখছ ভালো করছ। স্বামী যার এত পেটুক, রান্না তো তাকে শিখতেই হবে।”
কথাটা বলেই বোকা হয়ে গেলাম। কী বলছি এসব? আমি তো নিজেকে ওর স্বামী বলে স্বীকারই করি না। ওর চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ল। বলল,
“তুমি বুঝি পেটুক! প্রায় রাতেই তো খাও না।
“আসলে মন মেজাজ ভালো না থাকলে কিছুই খেতে ইচ্ছে করে না। আগে তো প্রচুর খেতাম। মানসী বলেনি?”
“বলেছে তুমি খেতে ভালোবাস, পেটুক তো বলেনি।”
“আমার সম্পর্কে কখনো ও নেগেটিভ কিছু বলবে না, নেগেটিভ হলেও পজেটিভ শব্দ ব্যবহার করে বলবে। তাই পেটুকটাকেই শ্রুতিমধুর করে খেতে ভালোবাসে বলেছে।”
কথা বলতে বলতেই খেয়াল করলাম ও মুগ্ধ চোখে দেখছে আমাকে। তাই ওর দিকে তাকিয়ে আমি আর ওর মুগ্ধতা নষ্ট করলাম না। ও বলল,
“মানসী তো তোমার সম্পর্কে আরো অনেক কথা বলেছে আমাকে। তুমি নাকি সারাক্ষণ দুষ্টুমি করো, হাসতে থাকো, হাসাতে থাকো। আমি তো ভাগে পেলাম শুধু রাগটা।”
আমি বললাম,
“ভুল বললে, আমার অনেক রাগ এটা ঠিক, কিন্তু সবচেয়ে বেশি রাগ দেখিয়েছি আমি মানসীর সাথে। আর ওরকম রাগ ইহজনমে আরো কারো সাথে দেখাতে পারব না। আরেকটু ভাত দাও তো।”
ভাত দিতে দিতে দিতিয়া বলল,
“কেন পারবে না?”
“রেগে গেলে আমি হিংস্র হয়ে যাই। সেই হিংস্রতা মানসী ছাড়া আর কেউ সহ্য করতে পারবে না।”
“হিংস হয়েই দেখো না, সহ্য করতে পারি কিনা।”
“পারবে না। একটু ধমক দিলেই তো সারারাত ধরে কাঁদো।”
“আমি তোমাকে ঠিক বুঝতে পারি না। তবে এটা ঠিক এতদিন তোমাকে যেরকম দেখেছি আজ তার সাথে কোনো মিল পাচ্ছি না।”
আমি হঠাৎ খেয়াল করলাম ও খাচ্ছে না। বললাম,
“তুমি খাচ্ছ না যে?”
“ও হ্যাঁ, খাচ্ছি।”
.
বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। একটু পর খেয়াল করলাম দিতিয়া কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকছে। আমি বললাম,
“শাড়ি পরে ঘুমাতে পারো না?”
“না, কেন?”
“এই শাড়িটাতে তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। আজকে নাহয় নাইবা চেঞ্জ করলে। অনেক মেয়েই তো শাড়ি পরে ঘুমায়। তুমিও চেষ্টা করে দেখতে পারো।”
।দিতিয়া চেঞ্জ করল না। ফিরে এসে বিছানার অন্য প্রান্তে আমার পাশে বসেই চুলের বেনীটা খুলতে খুলতে বলল,
“তোমায় আজ বড্ড অচেনা লাগছে।”
আমি দুষ্টুমি করে বললাম,
“কেন সিগারেট তো রোজই খাই।”
একথা শুনেই ও হেসে ফেলল। হাসির শব্দ শুনে ওর দিকে তাকাতেই দেখলাম চুল খোলার পর ওকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। কেমন ভয় হলো নিজেকে নিয়ে। আমি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি না তো?”
তাড়াতাড়ি সিগারেটটা নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম,
“গুড নাইট, লাইটটা অফ করে দাও, ঘুম পাচ্ছে।”
মুখে ঘুম পাচ্ছে বললেও খুব বুঝতে পারছিলাম আজ রাতে আর ঘুম হবে না আমার। মানসীর ওপর রাগ হচ্ছিল। ও কেন দিতিয়াকে এভাবে প্রেজেন্ট করল আমার সামনে? আর কেনই বা আমার কাছে এসে আমার ভেতরের মানুষটাকে জাগিয়ে দিয়ে গেল!
দিতিয়া লাইট অফ করে আমার পাশে শোয়ামাত্র জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলো ওর মুখে পড়ল। আরো মায়াবী লাগল ওকে। ওর কাছে এগিয়ে ওর গালে একটা হাত রাখলাম। চোখে চোখ রাখলাম। ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেল। চোখ ভরে উঠল জলে। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পারছিলাম দুজন দুজনকে। তারপর হঠাৎ আমি ওর ঠোঁটে চুমু খেলাম, অনেকক্ষণ ধরে! ও জড়িয়ে ধরল আমাকে। হঠাৎ মনে হলো মানসীর স্পর্শ পেলাম। মানসীর মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। স্পষ্ট দেখলাম যেন মানসী কাঁদছে। সাথে সাথে ওকে ছেড়ে দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বারান্দায় চলে গেলাম। আরেকটা সিগারেট ধরালাম। কিছুক্ষণ পর দিতিয়াও বারান্দায় এল। বলল,
“এত প্রেশার নিচ্ছ কেন? তোমার যা ইচ্ছে হবে তাই করবে, যা ইচ্ছে হবে না তা করবে না। কেউ তো তোমাকে জোর করেনি।”
আমি কিছু বললাম না। ও বলল,
“আমি জাস্ট আজকের হাসিখুশি নীরবকে দেখতে চাই। তাতে যদি আমাকে দূরে থাকতে হয় তবে তাই থাকব। শুধু তুমি ভালো থাকো।”
আমি আকাশের চাঁদটার দিকে তাকিয়ে সিগারেট টেনে গেলাম। ওর দিকে তাকানোর আর সাহস পেলাম না। নিজেকে আমার অচেনা লাগছে।
নীরব ইশতিয়াক
২৪ এপ্রিল, ২০১৬
২২
মানসীর জন্মদিনের বেশ কিছুদিন পর হসপিটালে অবসর সময় কাটাচ্ছিলাম। ইচ্ছে হলো মানসীকে ফোন করি, খুব মনে পড়ছিল ওকে। ফোন করতেই ওপাশ থেকে মানসীর গলা পাওয়া গেল,
“হ্যালো…”
“কেমন আছিস?”
“তুমি? ফোন করেছ কেন? যদি অন্য কেউ ধরত?”
“তাহলে কি হতো?”
“কী বলতে?”
“কিছুই বলতাম না। ফোন নামিয়ে রাখতাম। আগেও এমন করেছিলাম। কেমন আছিস বললি না তো!”
“ভালো, তুমি কেমন আছ?”
“আমি আছি বোধহয় ভালোই।”
“ওহ, জন্মদিনের উপহারগুলো ভালো ছিল। শাড়িটা তো অসাধারণ ছিল।”
“হুম, আচ্ছা সেদিন ওরকম করলি কেন?”
“কী রকম? তোমার হসপিটালে যেটা করেছি? সরি আসলে ওই দিন পুরোনো জন্মদিনের স্মৃতিগুলো এত মনে পড়ছিল নিজেকে সামলাতে পারিনি।”
“আমি যে সেই ব্যাপারটা বলিনি তা তো খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছিস। ঢঙ করছিস কেন?”
“তাহলে কি ঐ সারপ্রাইজটার কথা বলছ?”
“হ্যাঁ, তবে ওটা আসলে সারপ্রাইজ ছিল না।”
“কেন? সত্যি করে বলো তো দিতিয়াকে ওভাবে দেখে তোমার ভালো লাগেনি?”
“লেগেছে কিন্তু আমি খুব অস্বস্তিবোধ করেছি। আমি ওর মধ্যে তোকে দেখতে পাচ্ছিলাম। এটা অন্যায়। ওর প্রতি এবং তোর প্রতিও।”
“আমার প্রতি তোমার আর কোনো কিছুতে অন্যায় নেই নীরবদা। ওর প্রতি অন্যায় হতে পারে।”
“এভাবে কথা বলছিস কেন?”
“কীভাবে কথা বলছি? যা সত্যি তাই তো বলছি। আচ্ছ বাদ দাও তো, এই বলো না ওকে আদর করেছিলে?”
“এই প্রশ্নের মানে কী?”
“ওহ সরি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে ফেলেছি। থাক বলতে হবে না। আমিও কিসব প্রশ্ন যে করি। ছিঃ কী নির্লজ্জ আমি!”
ওর এ কথা শুনে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। রাগে, দুঃখে, অভিমানে আমি ফেটে পড়ছিলাম। বললাম,
“আমি ২০ মিনিটে আসছি…রাখি।”
“এই শোনো শোনো…”
“কী?”
“আসছি মানে কোথায় আসছ?”
“তোদের বাসায়।”
“মাথা খারাপ?”
“তোর মাথা কতটা খারাপ হয়েছে সেটা দেখতেই যাচ্ছি।”
“আরে প্লিজ এসো না, যা আছে বাসায়।”
“তাতে আমার কিছু যায় আসে না। খালামণিকে আমি ভয় পাই না। তাকে সামনে রেখেও কথা বলতে পারব।”
“আমার ভুল হয়েছে। দুষ্টুমি করে বলেছি ওসব কথা, এত রেগে যেও না প্লিজ।”
“রাখছি, জাস্ট ২০ মিনিট।”
২০ মিনিটও লাগেনি পৌঁছতে। বেল দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ও দরজা খুলতেই আমি ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে ওর একটা হাত ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে আমার কাছে এনে বললাম,
“কী বলছিলি তখন?”
ও ভয় পেয়ে বলল,
“সরি।”
“আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে মনে?”
“না।”
“ওকে, আমার চরিত্র খারাপ। আমি সেদিন দিতিয়াকে খুব আদর করেছি। সারারাত ধরে আদর করেছি। ওর সারা শরীরে…”
আমি এটুকু বলতেই মানসী দুহাত দিয়ে কান চেপে ধরল। আমি ওর কান থেকে জোর করে ওর হাত সরিয়ে বললাম,
“এখন শুনতে খারাপ লাগছে কেন? শুনতেই তো চেয়েছিলি! আরো শোন। কী কী করেছি সব শোন…একদম ডিটেইলে বলব।”
“মাফ করো। আমি ওভাবে বলতে চাইনি।”
আমি চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম,
“তুই ওকে ওভাবে প্রেজেন্ট করলি কেন আমার সামনে?”
“আমি ভেবেছিলাম তোমার ভালো লাগবে।”
“ভালো লাগলে কী হবে?”
ও আর কোনো কথা বলল না। আমি ওকে ছেড়ে দিয়ে সোফায় বসে বললাম, “আমি তো ওকে বিয়ে করতে চাইনি। মা আর তোর জন্যই তো রাজি হতে হয়েছে। আর তুই কী করেছিস? তোকে বলেছিলাম না চল পালিয়ে যাই অনেক দূরে। শুনেছিস তখন আমার কথা? এখন এত কষ্ট পাওয়া কেন?”
ও আমার সামনে বসে বলল,
“সরি। বিশ্বাস করো আমি কোনো কষ্ট পাইনি। তুমি ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করো, এটা তো ঠিক না। ওর তো কোনো দোষ নেই, তাই আমি চেয়েছিলাম যাতে তোমাদের সম্পর্কটা একটু স্বাভাবিক হয়। তুমি আর ওর সাথে খারাপ ব্যবহার না করো। সেজন্যই আমি ওভাবে সেজেগুজে তোমার কাছে গিয়েছি আর ওকেও ওভাবে প্রেজেন্ট করেছি।”
“আমি কি তোদের হাতের খেলনা? একবার মা খেলে, আরেকবার তুই। আমারও তো ধৈর্যের একটা লিমিটেশন আছে।”
“মাথা ঠাণ্ডা করো প্লিজ।”
“কীভাবে মাথা ঠাণ্ডা করব? তুই যা যা করতি সব শিখিয়ে দিয়ে এসেছিস। তোর মতো করে সাজিয়ে দিয়ে এসেছিস। তুই তো ওকে মানসী বানিয়ে দিয়ে খালাস। ওকে ওভাবে দেখে আমার ওপর দিয়ে কতটা মানসিক চাপ যাবে তা তো ভাবিসনি। আমি তো একটা মানুষ। আমি তো যন্ত্র না।”
মানসী মাথা নিচু করে রইল। কোনো কথা বলল না। হঠাৎ মনে পড়ায় আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
“আচ্ছা, তুই তখন যে বললি আমি দিতিয়ার সাথে খারাপ ব্যবহার করি। তোকে কে বলেছে একথা?”
ও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
“কই কেউ না। আমি আন্দাজ করেছি।”
“মানসী প্লিজ ডোন্ট ট্রাই টু বি ওভারস্মার্ট! কে বলেছে বল?”
“কেউ বলেনি।”
“মা, অনন্যা তা না হলে দিতিয়া নিজে।”
“দিতিয়া ওরকম মেয়েই না। ওকে তুমি এখনো চেনোনি।”
“মেয়েমানুষদের না চেনাই ভালো। অনেক বছর পর চেনা মানুষটা যখন অচেনা হয়ে যায় তখন বড্ড কষ্ট হয়।”
তারপর আমরা দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। তারপর ও একসময় বলল,
“কিছু খাবে? লাঞ্চ করেছ?”
“লাঞ্চ করিনি, আর এখন কিছু খাবও না।”
“একটু খাও। আমি রান্না করেছি।”
“ইচ্ছে করছে না। আর তোকে আমি ভালোবাসি বলেই মা, তুই, দিতিয়া সবাই মিলে তোর নাম করে ব্ল্যাকমেইল করে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করবি, তাও তো ঠিক না।
মানসী বলল,
“আমার ওপর রাগ করে থেকো না। আমি শুধু চেয়েছিলাম তোমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়ে যাক। সারাজীবন যখন একসাথে কাটাতেই হবে তখন এসবের কোনো মানে হয় না।”
“কোন দুঃখে আমি দিতিয়ার সাথে সারাজীবন কাটাব?”
এসব বলো না, তুমি ওর স্বামী। তুমি ছাড়া ওর আর কেউ নেই। অনেক ছোটবেলায় ওর বাবা-মা মারা গেছে। চাচা-চাচির সংসারে কী অবহেলায় ছিল ভাবতেও পারবে না। ও পড়াশোনায় অনেক ভালো ছিল। পড়তে তো টাকা লাগতই না উল্টো ও স্কলারশিপের টাকা পেত। সেই টাকার লোভে ওকে ওর চাচা পড়াত। কী লোভী ভাবতে পারছ? আর ওর চাচি ওকে দিয়ে ঘরের সব কাজ করাতো। ঠিকমতো খেতে দিত না। এভাবে বড় হয়েছে দিতিয়া। এখন তুমি যদি ওকে ছেড়ে দাও ও কোথায় যাবে বলো? হ্যাঁ, পড়াশোনা যখন করেছে, চাকরি করে নিজে চলতে পারবে। কিন্তু সারাজীবন কি একা থাকবে? কেউ তো ওকে বিয়েও করবে না। এখনো আমাদের দেশে ডিভোর্সি মেয়েদের খারাপ চোখে দেখা হয়। ওর জীবনটা কি এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে?”
“সবার পরিস্থিতি বোঝার দায় কি তোর আর আমার? নিজের কথা ভাবতে পারিস না?”
“নিজের কথা ভাবার কী আছে? আমার কথা ভাবার জন্য আমার বাবা-মা সবাই আছে। তাছাড়া আমার আর তোমার বিয়ের কথা তো কেউই জানে না। চুপচাপ ডিভোর্সও হয়ে গেছে। আমার বিয়ে হতে কোনো সমস্যাই হবে না। আমার বাবা আমার জন্য তোমার চেয়েও ভালো ছেলে নিয়ে আসতে পারবে।”
কথাটা শুনে বুকটা ছিঁড়ে গেল আমার। বললাম,
“তুই পারবি আমি ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে?”
“কেন পারব না! আমি চাইলেও সারাজীবন তোমার স্মৃতি নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারব না। আমার ফ্যামিলি সেটা হতে দেবে না।”
“তুই এখন কী সহজে কথাগুলো বলছিস! অথচ আমার বিয়ের আগে ঠিক এইখানে দাঁড়িয়েই বলেছিলি, নীরবদা কিছু একটা করো। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না।”
“তখন আবেগে বলেছিলাম, আসলে কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচবে না কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারবে না এগুলো প্রেমের সময় মনে হয় কিন্তু আসলে এগুলোর মতো ভিত্তিহীন কথা আর হয় না। কত মানুষ এসব কথা বলার পরও তাদের ভালোবাসার মানুষকে ছাড়াই থাকে, ছাড়াই বাঁচে আজীবন। আমরাও নাহয় তাদের মতোই রইলাম।”
“বাহ, খুব ভালো কথা। সত্যি মেয়েরা সবকিছুর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।”
মানসী সত্যি মানিয়ে নিয়েছিল সব। এত ছিচকাঁদুনে একটা মেয়ে সেদিন এক ফোঁটাও কাঁদেনি। খুব অবাক হয়েছিলাম সেদিন। ওর সাথে আর কথা না বলে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। খুব ইচ্ছে করছিল যাওয়ার আগে একবার ওকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু ধরিনি কারণ, তার আর কোনো মানে হয় না। বাসা থেকে বের হতেই রাস্তায় খালামণির সাথে দেখা হলো। আমি রাগের চোটে ভুলেই গিয়েছিলাম আসার আগে মানসী বলেছিল খালামণি বাসায়। তার মানে মানসী মিথ্যে বলেছিল যাতে আমি না আসি! মানুষ কত বদলে যেতে পারে! খালামণি আমাকে দেখেই বলল,
“নীরব তুই এ সময়ে?”
“এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। খুব ক্ষিদে পেয়েছিল তাই।”
“ওহ, খেয়েছিস তো পেট ভরে?”
“হ্যাঁ, খালামণি খেয়েছি।”
“আচ্ছা আসিস আবার।”
সাথে সাথেই বাসায় এলাম। কিচ্ছু ভালো লাগছিল না। এসেই শুয়ে পড়লাম। বিকেল বেলা দিতিয়া আমাকে বাসায় আসতে দেখে বলল,
“আজ এত তাড়াতাড়ি? শরীর খারাপ করেনি তো?”
“না।”
“তাহলে এত তাড়াতাড়ি তো তুমি কক্ষনো আসো না। কী হয়েছে?”
“কিছু না।”
“ওহ। খেয়েছ দুপুরে?”
আমি উঠে বসে চিৎকার করে বললাম,
“বিয়ের সময় কি আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেব?”
দিতিয়া অবাক হয়ে চেয়ে রইল। কোনো কথা বলল না। আমি বললাম,
“অধিকার ফলাতে আসছ? টেক কেয়ার করা হচ্ছে? খবরদার বলে দিচ্ছি আমার কোনো ব্যাপারে নাক গলাতে আসবে না।”
ও কোনো কথা বলল না। দৃষ্টি নামিয়ে নিল : আমি বললাম,
“আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও।”
.
এই পর্যন্ত পড়তেই হঠাৎ শুনতে পেল,
“অদ্রি অর্পি, কী করছিস তোরা এখানে?”
ওরা ডায়েরিটাতে এতই ডুবে গিয়েছিল যে টেরই পায়নি দিতিয়া কখন এসে দাঁড়িয়েছে লাইব্রেরির দরজায়!
২৩
চাচিকে দেখে অদ্রি নার্ভাস হয়ে গেল। কিন্তু সাহস রাখল অৰ্পি ছোট হলেও, কম বুঝলেও সাহস বেশি। কোনো অকাজ করে ধরা পড়লে মিথ্যে বলে এমনভাবে সামলায় যে কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারে না। ও নিশ্চয়ই কিছু বলে এই পরিস্থিতিটাও সামলে নিতে পারবে। অৰ্পি বলল,
“এই তো, আপ্পি আর আমি গল্প করছিলাম।”
হঠাৎ চাচির নজর পড়ল ওই ডায়েরিটাতে। বলল,
“ডায়েরিটা, এটা তোদের চাচ্চুর না?”
অর্পি অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
“চাচ্চুর ডায়েরি? এটা তো আপ্পির ডায়েরি।”
“ওহ। এরকম একটা ডায়েরি তোদের চাচ্চুরও আছে। আমি ওকে লিখতে দেখেছিলাম বোধহয়।”
অর্পি ডায়েরিটা রেখে চাচির কাছে যেতে যেতে বলল,
“ও হতে পারে!”
তারপর চাচিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“জানো সুইটহার্ট, এটাতে আপ্পি লাভস্টোরি লিখেছে।”
বলেই অর্পি হেসে দিল। চাচি বলল,
“ওমা তাই আমাদের অদ্রি এত বড় হয়ে গেল কবে! এর মধ্যেই লাভস্টোরি?”
অদ্রি কিছু বলতেও পারল না। সইতেও পারল না। তাও ভালো মানুষটা দিতিয়া চাচি। কাউকে কিছু বলবে না। চাচি আবার বলল,
“ছেলেটি কে হুম?”
“বলব চাচি। সময় হলেই বলব।”
অৰ্পি বলল,
“আরে ওর কথা আর বোলো না। সেই কবে ছেলেটা ওকে প্রোপজ করেছে আর ও তাকে কিছুই বলেনি। এদিকে ডায়েরিতে তার কথা লিখে ভরে ফেলছে।
“তার মানে এখনো কিছু শুরু হয়নি?”
“ওই আর কি! শুরু হয়েছে তবে মনে মনে।”
“তাহলে এখন মনে মনেই রাখ। আরেকটু বড় হ তারপর দেখা যাবে, কেমন?”
একথা বলে চাচি একটা বইয়ের আলমারির দিকে গেল। তারপর চাচ্চুর একটা বই বের করতে দেখে অর্পি জিজ্ঞেস করল,
“এই বই তুমি পড়বে?”
“নাহ, তোমার চাচ্চু পড়বে।”
“চাচ্চু এত তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসেছে?”
“হ্যাঁ।”
চাচি বইটা নিয়ে বের হয়ে গেল। অদ্রি যত দ্রুত সম্ভব ডায়েরিটা জায়গামতো রেখে দিল। তারপর ড্রয়ার লক করে চাবি যেখানে ছিল সেখানেই রেখে বেরিয়ে গেল লাইব্রেরি থেকে। নিজেদের ঘরে গিয়ে অর্পি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল,
“চাচির জায়গায় চাচ্চু এলে কী হতো বল তো?”
“এক চড় মারব তোকে। এখন এই কথা মনে পড়ছে? যখন তোকে বলেছিলাম দরকার নেই এসবের মধ্যে যাওয়ার তখন শুনেছিলি?”
“বকছিস কেন? তুইও তো পড়েছিস।”
“তোর জেদের জন্যই তো এই ডায়েরি পড়ার শুরু।”
“না পড়লে কি আর জানতে পারতাম এত কিছু?”
“না জানলেই ভালো হতো। উফ কী কষ্ট!”
“আচ্ছা আপি তোর কার জন্য বেশি কষ্ট হচ্ছে?”
“চাচ্চুর জন্য।”
“ওহ, আর আমার প্রথমে কষ্ট হচ্ছিল মানসীর জন্য আর এখন কষ্ট হচ্ছে চাচির জন্য।”
“চাচির জন্য কষ্ট হবে কেন, চাচি তো চাচ্চুর সাথেই থাকতে পারছে। আর বেচারা মানসী আন্টি সেই কত দূরে কানাডায় থাকে। চোখের দেখাও দেখতে পায় না। সবচেয়ে বেশি কষ্ট চাচ্চুর। লেখাগুলো পড়েও বুঝিস না?”
“হুম, তা ঠিক। কিন্তু আপ্পি…এখন বাকিটা জানব কী করে?”
“রাত হলে গিয়ে পড়তে হবে। এছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই।”
হঠাৎ অৰ্পি বলল,
“চল দুধের সাধ ঘোলে মিটাই।”
“কী?”
“সিনেমার মতো ফ্ল্যাশব্যাকের পর আবার প্রেজেন্ট টাইম দেখি।”
“কী বলতে চাচ্ছিস?”
“আমাদের এই ঘরটা আগে কার ঘর ছিল বল?”
“মোনা ফুপির ঘর ছিল।”
“তাহলে এই ঘরেই মানসী আন্টি থাকত। সেই জয়েন্ট বারান্দাটা কিন্তু এখনো আছে।”
“এই অৰ্পি, তুই কি চাচ্চু-চাচির ঘরে উঁকি মারার প্ল্যান করছিস?”
অর্পি অদ্রিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“এজন্যই আমি তোকে এত্ত ভালোবাসি আপ্পি।”
অদ্রি অর্পিকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“দূর হ…ছিঃ”
“ছিঃ বললে পরে বলিস, এখন চল। আমি একা উঁকি মারব তা হবে না।”
অর্পি একরকম জোর করে নিয়ে গেল অদ্রিকে।
বারান্দায় গিয়ে দেখল যথারীতি চাচ্চুদের দরজাটা লাগানোই আছে। জানালার পর্দার ফাক দিয়ে তাকালো…
চাচ্চু ঘরে নেই। চাচি একটা সুটকেস গোছাচ্ছে। অদ্রি ফিসফিসিয়ে বলল,
“চাচ্চু বোধহয় যাবে কোথাও।”
“হুম।”
চাচি সুটকেসটা গুছিয়ে বিছানা থেকে নামিয়ে আলমারির পাশে রাখল। এর মধ্যেই চাচ্চুকে দেখা গেল টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বের হলো। চাচি বলল,
“তোমার সুটকেস গুছিয়ে দিয়েছি। যা যা বলেছ সব দিয়েছি। আর কিছু মনে পড়লে বলো।”
“মনে পড়লে বলব। আর না মনে পড়লেও ওখানে মার্কেট আছে তো! কিনে নিতে পারব। তুমি অযথাই টেনশন করো।”
চাচি চুপ করে রইল। চাচ্চু টাওয়ালটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে বলল,
“কি মন খারাপ করছ কেন?”
চাচি বলল,
“মন খারাপ কেন করব?”
চাচ্চু চাচির হাত ধরে কাছে নিয়ে কপালে একটা চুমু দিল, তারপর জড়িয়ে ধরলো। চাচিও চাচ্চুর বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরল। চাচি খুব বেশি লম্বা না। অপরদিকে চাচ্চুর উচ্চতার কারণে চাচির মাথাটা ঠিক চাচ্চুর বুকের ওপর পড়ে আছে। আহা! অদ্রির মনে হলো এর চেয়ে মধুর দৃশ্য ও কখনো দেখেনি।
চাচ্চু বলল,
“আমি নিজেই আগে জানতাম না, তোমাকে কীভাবে বলব বলো? এই সেমিনারে আমার যাওয়ার কথা ছিল না। ড. কবিরের যাওয়ার কথা ছিল। এখন হঠাৎ সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমার যেহেতু ভিসার মেয়াদ আছে হসপিটাল অথরিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমাকে পাঠাবে। পরশুর পরের দিন সেমিনার শুরু। আজকে রওনা না দিলে হবে কীভাবে বলো?”
“আমি কি কিছু বলেছি?”
“বলেছ আর কবে? কখনোই তো কিছু বলো না। কিন্তু আমি তো বুঝি। হঠাৎ করে বিনা নোটিশে এত দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি এটা তোমার মন মানতে চাইছে না।”
চাচি চুপ করে রইল। চাচ্চু বলল,
“আমি অনেক টায়ার্ড। একটু শুতে চাচ্ছিলাম। ছাড়বে না নাকি?”
চাচি লজ্জা পেয়ে সরে গিয়ে বলল,
“চা বা জুস কিছু খাবে?”
“কফি দাও।”
“আচ্ছা।”
চাচি বেরিয়ে যেতেই অর্পি নিজের দুই গালে হাত দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“ওহ মাই গড! চাচ্চু এখনো কি রোমান্টিক!”
“উফ তুই একটু চুপ করবি?”
“কেন চুপ করব?”
“কারণ, আমরা যেটা করছি সেটা ঠিক করছি না। ওরা আমাদের চাচা-চাচি।”
“নো আপ্পি, ওরা এখন আর আমাদের কাছে চাচা-চাচি না। একটা ট্রায়াঙ্গল লাভস্টোরির হিরো হিরোইন।”
অর্পির এসব আবোলতাবোল তর্কের শেষ না হতেই চাচি কফি নিয়ে এল। চাচ্চু এতক্ষণ শুয়ে ছিল। এবার উঠে বসে কফির মগটা হাতে নিল। চাচি বলল,
“আচ্ছা তোমার একটা নীল রঙের ডায়েরি আছে না?”
“নীল রঙের তো কতগুলো ডায়েরিই আছে। কেন বলো তো?”
“নীল মানে নেভি ব্লু!”
চাচ্চু কী যেন একটু ভাবল। অদ্রি অৰ্পি ভয়ে চুপসে গেল। চাচ্চু বলল, “কেন কী হয়েছে ওটার?”
“তেমন কিছু না। কদিন আগে তোমাকে কী যেন লিখতে দেখলাম। আজ আবার অদ্রির কাছে দেখলাম ওরকম একটা ডায়েরি। তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
“ওহ, তাহলে ঠিক আছে। ওটা সৌরভের হসপিটালের ডায়েরি। ওই আমাকে দিয়েছিল। হয়তো ওর মেয়েকেও দিয়েছে। আর আমারটা তো তালা মারা আছে।”
“ও।”
“আচ্ছা, বললে না তো প্যারিস থেকে তোমার জন্য কী আনব?”
“আমার কিচ্ছু লাগবে না। তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।”
“বাপরে! এখন তো মাত্র এক মাস, যখন সাত বছর আমি ইউএসএ ছিলাম তখন কী করে থেকেছিলে?”
“তখনকার কথা আলাদা।”
“তো?”
“কিছু না।”
“তখন তো কোনো আশা ছাড়া সাতটা বছর বিনাবাক্যে কাটিয়েছ, আর এখন তো মাত্র এক মাস।”
চাচি এবারও শুধু বলল,
“হুম।”
“আর এখন তো আরো সহজ হওয়ার কথা। কারণ, এখন দিহান আছে তোমার কাছে। ওকে নিয়ে সময় কেটে যাবে।”
চাচি বলল,
“হুম, খুব ভালো সময় কাটবে।”
“এই দেখো, আবার মন খারাপ করছে। আচ্ছা…তোমার স্বামী পৃথিবীর কত বড় বড় ডাক্তারদের সামনে স্পিচ দেবে। তোমার প্রাউড ফিল হচ্ছে না?”
“হ্যাঁ তা তো হচ্ছেই। তোমাকে নিয়ে সব সময়ই আমি প্রাউড ফিল করি।”
“অন্য কোনো লোক তোমার স্বামী হলে তোমাকে নিয়েও প্রাউড ফিল করত।”
“কেন? আমি আবার এমন কী!”
“তুমি সুন্দরী।”
“সুন্দর দিয়ে দুনিয়ায় কিছু হয় না।”
“হয় তো। অনেক পুরুষদের কাছে সৌন্দর্যটাই সব।”
“কার কাছে কী তা দিয়ে আমার কী যায় আসে?”
চাচ্চু কী ভেবে যেন হাসল। চাচি বলল,
“হাসছ যে?”
“এমনি।”
চাচ্চু একটু আগে যে ভেজা তোয়ালেটা বিছানায় ছুড়ে ফেলেছিল, চাচি সেটাকে তুলে বারান্দার দিকে আসছে দেখে অদ্রি অর্পি দৌড়ে ওদের ঘরে ঢুকে গেল।
রাত্রেই ফ্লাইটে নীরব প্যারিস চলে গেল। অদ্রি অর্পি রাত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ওরা খুব ভয়ে ভয়ে আছে, চাচ্চুকে লাইব্রেরিতে ঢুকতে দেখেছিল। ডায়েরিটা নিয়ে যায়নি তো আবার? যদি নিয়ে যায় তাহলে তো এক মাস অপেক্ষা করতে হবে তারপর কী হয়েছিল জানার জন্য।
২৪
রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর অদ্রি অর্পি লাইব্রেরিতে গেল। রুমে ঢুকেই অৰ্পি বলল,
“আবার চাবি খুঁজতে গিয়ে কত কাহিনী করা লাগবে কে জানে!”
“যেখানে রেখে গেছি, সেখানেই দেখি আগে।”
কিন্তু পেনহোল্ডারে চাবি পাওয়া গেল না। অৰ্পি বলল,
“উফ! দেখ চাচ্চু আবার চাবি নিয়ে গেল কিনা। তাহলে আমি মরেই যাব রে আপ্পি। মানসী আন্টি কানাডা চলে গেল কেন? আর চাচ্চু চাচিকে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলল তারপর কী হলো? পুরোটা জানতেই হবে আমার।”
অদ্রি এবার ড্রয়ারে খুঁজতে খুঁজতে বলল,
“অর্পি একটু চুপ থাকতে পারিস না?”
অর্পি চুপ করল কিন্তু অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগল। অদ্রি চাবিটা ড্রয়ারেই পেয়ে গেল,
“গট ইট।”
অর্পি দৌড়ে এল। ডায়েরির ড্রয়ারটাতে চাবি ঘোরাতেই অর্পি অদ্রির হাত ধরে বাধা দিল।
“আপি ড্রয়ারটা খুলিস না প্লিজ।”
“কেন?”
“যদি দেখি ডায়েরিটা নেই তাহলে আমি মরেই যাব।”
অদ্রি বিরক্ত হয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিল। তারপর ড্রয়ারটা খুলতেই ডায়েরিটা পেয়ে গেল। অর্পির মুখে হাসি ফুটে উঠল। অর্পি ডায়েরিটা হাতে নিয়ে খুলতেই অদ্রি বলল,
“এখানে পড়াটা রিস্কি মনে হচ্ছে আজ। ডায়েরিটা নিয়ে আমাদের ঘরে চলে যাই চল।”
“ঠিক বলেছিস।”
ডায়েরি নিয়ে ড্রয়ার তালা মেরে ওরা চাবি জায়গামতো রেখে দিল। তারপর চোরের মতো নিজেদের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে ডায়েরিটা খুলল। অদ্রি বলল,
“কোন পর্যন্ত যেন পড়েছিলাম? একটা পৃষ্ঠার মাঝখানে ছিলাম না?” অদ্রি খুঁজতে লাগল। অর্পি মনে করিয়ে দিল,
“হ্যাঁ, ওই যে চাচ্চু বলছিল…অধিকার ফলাতে আসছ? ঘর থেকে বের হয়ে যাও না যেন কী!”
“এই তো পেয়েছি।”
যেখানে রেখেছিল সেখান থেকেই দুজনে পড়তে শুরু করে দিল…
“অধিকার ফলাতে আসছ? টেক কেয়ার করা হচ্ছে? খবরদার বলে দিচ্ছি দিতিয়া আমার কোনো ব্যাপারে নাক গলাতে আসবে না।”
দিতিয়া কোনো কথা বলল না। দৃষ্টি নামিয়ে নিল। আমি বললাম,
“আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও।”
ও ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমার কিছু ভালো লাগছিল না। খুব অস্থির লাগছিল। আমার সুন্দর করে গোছানো জীবনটা নিমিষেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আর আমি কিছুই করতে পারলাম না।
দিতিয়া আর ঘরে এল না। রাতের খাবারের সময় মা এসে খাইয়ে দিয়ে গেল। মাকে কেন যেন না করতে পারতাম না। মা যা করেছিল তার জন্য খুব অনুশোচনায় ভুগত আর সেটা আমাকে খুব কষ্ট দিত। তাই সব জানার পর থেকে আমি তার সামনে স্বাভাবিকই থাকার চেষ্টা করতাম, তার মুখের দিকে চেয়ে সবই করতে পারতাম। শুধু পারতাম বলছি কেন এখনো পারি।
যাই হোক, রাত প্রায় ১টা বেজে যাচ্ছিল কিন্তু দিতিয়া ঘরে আসছিল না। ও কি ভয় পেল? নাকি ঘৃণা? তা যেটাই হোক পরের মেয়েকে বারবার ঘর থেকে বের করে দেয়াটা ছোটলোকি কাজ, যেটা মাথা গরম হয়ে গেলেই আমি করতাম। আমার ইচ্ছেয় হোক অনিচ্ছায় হোক, আমার সাথে বিয়ে হয়ে ও এ বাড়িতে এসেছে। তাই এখন এ ঘরের অর্ধেকটা ওরও। আমি ঘর থেকে বের হয়ে ওকে খুঁজতে লাগলাম। সবাই সবার ঘরে বোধহয়, কারণ কাউকেই ড্রয়িং ডাইনিং রুমে দেখতে পেলাম না। অদ্ভুত মেয়েটা গেল কোথায়! খারাপ কিছু হলে তো আবার আমার ঘাড়ে এসে পড়বে। খুব বিরক্ত লাগছিল। এখনকার মতো মোবাইল থাকলে তো ফোন করেই খুঁজে নিতে পারতাম। কিন্তু তাও তখন ছিল না। হঠাৎ মনে হলো ছাদে যায়নি তো? আমি ছাদে গেলাম কিন্তু না এখানেও নেই। উফ তখন বিরক্তিতে মনে হচ্ছিল মেয়েরা খালি গ্যাঞ্জাম পাকাতেই জানে! ছাদ থেকে নেমে আসব তখন ছাদ থেকেই দিতিয়াকে দেখতে পেলাম বাগানে দাঁড়িয়ে আছে। ডাকতে গিয়েও ভাবলাম এত রাতে এখান থেকে ডাকলে মা যদি জেগে যায়! নিচে নেমে দেখলাম ও পায়চারি করছে। পেছন থেকে ডাক দিলাম।
“দিতিয়া…”
ও ফিরে তাকালো। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম,
“সাহস কি বেশি নাকি? এত রাতে বাগানে কী?”
ও অপরাধীর মতো চুপ করে মাথা নিচু করে রইল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“কী সমস্যা? কথা বলো না কেন?”
“এমনি হাঁটছিলাম।”
“হাঁটার কী আছে? তুমি তো স্লিমই আছ!”
ও চুপ করে রইল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“আমি কি তোমাকে ঘরে ঢুকতে নিষেধ করেছিলাম?”
“না।”
“তো বাইরে বাইরে ঘুরছ কেন?”
ও চুপ। আমি এবার বললাম,
“ঘরে এসো।”
ও আমার পেছন পেছন এসে ঘরে ঢুকল। আমি দরজাটা লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম। ও লাইট অফ করে দিল। তারপর জানালার কাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরে চেয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর বললাম,
“আমি কি তোমাকে আমার বিছানায় শুতে নিষেধ করেছি?”
“না।”
“তো দাঁড়িয়ে আছ কেন ওখানে?”
ও কোনো কথা বলল না। আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ল। আমি আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর বললাম,
“দিতিয়া…ঘুমিয়ে পড়েছ?”
“নাহ।”
“আমার বিকালের ব্যবহারের জন্য আমি লজ্জিত। আসলে…”
আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ও বলল,
“রাগ উঠলে তোমার হুঁশ থাকে না।”
“এক্সাক্টলি।”
“আমি কিছু মনে করিনি।”
“থ্যাংকস!”
কেউ কোনো কথা বললাম না আর। কিন্তু আমার ঘুম আসছে না। আমি উঠে বালিশে হেলান দিয়ে বসলাম। তারপর হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বালালাম। আলো জ্বালাতেই দিতিয়া তাকালো। চোখাচোখি হতেই আমি বললাম,
“আমি তোমার কাছে কিছু চাই।”
ও কখনোই বেশিক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারত না। ইভেন এখনো পারে না। চোখ নামিয়ে সরিয়ে উঠে বসে বলল,
“বলো?”
“আমাকে ডিভোর্স দেবে?”
একথায় ও চমকে তাকালো আমার দিকে। মুহূর্তের মধ্যে ওর দুচোখ জলে ভরে উঠল। হয়তো চোখের জল লুকানোর জন্যই চোখ নামিয়ে নিল এবার। বলল,
“দিলে?”
“আমি মানসীকে ছাড়া থাকতে পারছি না। শুধু একটা প্রেম ছিল না আমাদের মধ্যে। অনেক কিছু ছিল। সবটা তোমাকে বলে বোঝাতেও পারব না।”
“আমি বুঝি। কিন্তু আমি তোমাকে ডিভোর্স দিলেই কি তুমি ওকে পেয়ে যাবে?”
“চেষ্টা করব। তাছাড়া তোমার সাথেও আমি প্রতিনিয়ত অন্যায় করছি। এটাও তো ঠিক না। বিশ্বাস করো আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না।”
দিতিয়া চুপ করে রইল। আমি বললাম,
“তখন মা কী কারণে তোমার আমার বিয়েটা দিয়েছিল তা তো আমরা এখন সবাই জানি। এখন তো আর ওসব নিয়ে মায়ের মনে কোনো ভয় নেই।”
ও এবারও কিছু বলল না। আমি বললাম,
“দেখো, তোমার আমার সম্পর্কটা এভাবেই চলতে থাকবে। তুমিই বলো এর কি কোনো মানে হয়? তোমার মতো একটা মেয়ের জীবন এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে কেন?”
ও এবারও কিছু বলছে না দেখে আমি বললাম,
“কিছু তো বলো। না বললে বুঝব কী করে যে তোমার মনের মধ্যে কী চলছে? তোমার মনের সব কথা আমাকে খুলে বলো। কোনো সংকোচ করো না প্লিজ। আমাদের এসব নিয়ে কথা বলা উচিত।”
ও আমার দিকে না তাকিয়ে বলল,
“একটা মানুষের তো দুটো বউ থাকতেই পারে। তুমি মানসীকে আবার বিয়ে করে নিয়ে এসো। আমি কোনো আপত্তি করব না।
“সেটা কী করে হয়?”
“কেন হবে না? হবে, আমি কালকেই মায়ের সাথে কথা বলব। যেভাবে পারি আমি মাকে রাজি করাব।”
এবার বোধহয় আমার অবাক হবার পালা। মেয়েটা বলে কী? আমি বললাম,
“কিন্তু তুমি এখানে পড়ে থাকতে চাচ্ছো কেন? কী পাবে? নতুন করে শুরু করো না লাইফটা।”
প্রাণপণে কান্নাটা চেপে রাখতে চেষ্টা করেও আর পারল না দিতিয়া। বারবার নিজের হাত দিয়ে চোখ মুছে নিচ্ছে। কিন্তু যতই চোখ মুছছে ততই আবার চোখের পানিতে গাল ভিজে একাকার অবস্থা।
“প্লিজ, কান্নাকাটি করো না। এভাবে কান্নাকাটি করলে তো কথাই বলতে পারব না।”
দিতিয়া চোখ মুছে নিচ্ছে ঠিকই কিন্তু কান্না থামাতে পারছে না। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
“ছোটবেলা থেকে আমি কখনো আমার বাবা-মাকে পাইনি। এ বাড়িতে এসে বুঝেছি বাবা কেমন হয়, মা কেমন হয়। তোমার ভালোবাসা না পেলেও বাবা, মা, সৌরভ, অনন্যা, মোনা সবার ভালোবাসা পেয়েছি। এদেরকে পেয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো মনে হয়েছে আমিও একটা মানুষ। এদের থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না প্লিজ।”
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। ও একটু থেমেই বলল,
“তোমার কাছে কোনোদিন কিচ্ছু চাইব না। কাজের লোকের মতো থাকব এ বাড়িতে।”
“আরে! কী যা তা বলছ! স্টপ ক্রাইং!”
“না না শোনো, তোমার ধারেকাছেও আসব না। কাল থেকে তোমার বিছানায়ও শোব না। এমনকি এ ঘরেও থাকব না আমি। তোমার চোখের সামনেই আর আসব না। এবাড়িতে তো আর কোনো ঘর খালি নেই, আমি নাহয় মোনার সাথেই থাকব। আর মোনার যদি কোনো আপত্তি থাকে তাহলে আমি রান্নাঘরে শোব। তাও তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিও না প্লিজ।”
মেয়েটা পুরো পাগল হয়ে গিয়েছিল। এমনভাবে কাঁদছিল যে আমারও খারাপ লাগছিল। কী করব আমি? মানসীকে ছাড়াও থাকতে পারছি না। আবার দিতিয়ারও একটা ব্যবস্থা করতে পারছি না। ও থাকতে তো মানসীকে কখনো পাব না। মেয়েটা কেঁদেই চলেছে। আমি কখনোই মানুষের কান্না সহ্য করতে পারি না। আর আল্লাহ আমার কাছেই সবাইকে কাঁদতে পাঠায়। কী করব আমি? কী বলে সান্তনা দেব? কিছু ভেবে না পেয়ে বললাম,
“আচ্ছা আচ্ছা…এখন এসব বাদ দাও, ঘুমাও।”
আমি লাইট অফ করে শুয়ে পড়লাম। ও একইভাবে কাঁদতে থাকল। অদ্ভুত তো! এই মেয়ে কান্না থামায় না কেন? কী হবে কী না হবে তা না ভেবে আমি ওর হাতটা ধরে ওকে কাছে টেনে এনে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। কিছু বললাম না। শুধু ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম অনেকক্ষণ ধরে। এটুকু আমি করলাম শুধুমাত্র একজন মানুষ হিসেবে। ও আমাকে ধরল না। কেমন জড়োসড়ো হয়ে রইল। একসময় ওর কান্নাটা থেমে গেল। পুরুষ মানুষকে আল্লাহ দুটো ক্ষমতা অনেক বেশি করে দিয়েছেন। এক নারীকে কাঁদানোর ক্ষমতা আর দুই নারীর কান্না থামানোর ক্ষমতা!