অভিমানিনী – ১৫

১৫

হসপিটাল থেকে ফিরে শুয়ে আছি, কিছুই ভালো লাগছে না। সেই যে মানসীর বাসায় গিয়ে দেখা করে এসেছিলাম তারপর ৬টা দিন পার হয়ে গেছে। ওর সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি। একবার কথাও হয়নি। কী যে কষ্ট হচ্ছিল কাউকে বোঝানো সম্ভব না। কখনো কল্পনায়ও ভাবিনি এরকম কোনোদিন আসতে পারে। অনেকবার শুনেছি একটা কথা…জীবনের একটা সময়ে খুব কষ্ট করলে বাকিটা জীবন সুখের হয়। আমার হয়েছে উল্টো। সুখের কি কোনো সীমা ছিল? এত এত সুখ করে ফেলেছিলাম যে বাকিটা জীবন পাহাড়সমান কষ্ট সইতে হবে!

পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়ে ফিরে তাকাতেই মাকে দেখতে পেলাম। মা একটা কাগজ এগিয়ে দিল। কাগজটা খোলার পর মনে হলো বুকের ভেতর ছুরি বসিয়ে দিয়েছে কেউ। ডিভোর্স পেপার, মানসী সাইন করে দিয়েছে। কেন করল? কেন আবার? মা নিশ্চয়ই ওর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সাইনটা আদায় করেছে। আমি মাকে বললাম,

“মা প্লিজ আমাকে খুলে বলো না কেন এমন করছ? কী হয়েছে?”

“কিছু হয়নি তো। এই নে এখানে সাইনটা কর।”

“মা আমি মানসীকে ডিভোর্স দেব না।”

“তা বললে তো হবে না বাবা, মানসী তোকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে, এবার তুইও দে।”

“মানসী একটা ভিন্ন মানুষ, আমি একটা ভিন্ন মানুষ। ওর যা ইচ্ছে হয়েছে ও করেছে, আর আমার যা ইচ্ছে হবে আমি তাই করব।”

মা কিছু না বলে ডিভোর্স পেপার আর কলম এগিয়ে দিল আমার দিকে। আমি মায়ের হাত থেকে ওগুলো নিলাম। কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে বললাম,

“আমি মানসীকে ডিভোর্স দেব না আর অন্য কাউকে বিয়েও করব না। ডিসিশান ফিক্সড এন্ড ফাইনাল।”

“আর একবার জিজ্ঞেস করছি, ভেবে বল।”

“একবার কেন আর একশ বার জিজ্ঞেস করলেও আমি এই একই কথা বলব মা।”

মা কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আমি চুপচাপ বসে ভাবছিলাম এত কষ্ট হচ্ছে, বুকের মধ্যে পাথর জমে আছে তবুও কাঁদতে পারছি না কেন? কাঁদলে নিশ্চয়ই একটু হালকা হতে পারতাম। মেয়েদেরই ভালো। কিছু থেকে কিছু হলেই কান্না আর সবকিছুতে জয়! হঠাৎ খুব হৈচৈ-এর আওয়াজ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। এর মধ্যেই অনন্যা ছুটতে ছুটতে এল। কাঁদতে কাঁদতে কি যে বলল কিছুই বুঝলাম না। মায়ের ব্যাপারে কিছু বলছে বুঝে দৌড়ে গেলাম মায়ের ঘরে। গিয়ে দেখি মা ফ্লোরে পড়ে আছে। রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে।

মাকে হসপিটালে নেয়া হলো। মা তখন ছিল বাঁচামরার মাঝখানে। অনেক রক্ত লেগেছিল। মায়ের রক্তের গ্রুপ ছিল সৌরভ, মানসী আর খালামণির। ওরা রক্ত দিল। কিন্তু তাতেও হলো না। তারপর আমার আর সৌরভের কিছু বন্ধুদের সাহায্যে রক্ত জোগাড় করা হয়েছিল। উফ সে কী দুর্বিষহ পরিস্থিতি। কারণ আমি জানি এবং সবাই জানে যা ঘটল তা শুধু আমার জন্যই ঘটলো।

আমি হসপিটালের লবিতে বসে ছিলাম। মানসী কোত্থেকে এসে আমার পাশে বসল। তারপর বলল,

“কেন আর এমন করছ বলো? আমরা দুজন দুজনের জন্য না। মেনে নাও না এটা।”

“আমি মানতে পারছিলাম না।”

“আশা করি এখন মানতে পারবে।”

“মা যে এমনটা করবে আমি ভাবতেও পারিনি। আর তুই… তুই আমাকে ডিভোর্স দিলি কোন সাহসে?”

“এছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না তখন।”

আমি কিছু বলার আগেই মানসী আমার হাত ধরে বলল,

“তুমি বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যাও। তোমার পায়ে পড়ি।”

“কী বলছিস তুই?”

“তুমি একদিন আমাকে বলেছিলে না তুমি তোমার মাকে আমার থেকেও বেশি ভালোবাস? আমার তো সেদিন খুব গর্ব হয়েছিল। আজ কেন অন্যথা করছ? আজ খালামণির কিছু একটা হয়ে গেলে সব দোষটা তো তোমার উপরেই এসে পড়বে। তোমার ওপর কেউ আঙুল তুললে আমি সহ্য করতে পারব না। আর খালু কতটা ভেঙে পড়েছে দেখেছ? জীবনের জন্যই তো ভালোবাসা। ভালোবাসার জন্য তো জীবন না।”

“আমি বুঝতে পারছি না আমি কী করব!”

“অনেক মিরাকল তো ঘটে। সবটা ছেড়ে দাও না আল্লাহর হাতে। হয়তো আমার কপালে তুমি নেই। আর যদি আমার কপালে তুমি থাকো শেষ মুহূর্তে হলেও আমি তোমাকে পাব।”

সেবারের মতো আর মানসীর আমাকে পাওয়া হলো না। মা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে এল। তারপর চুপচাপ ঘরোয়াভাবে কজন আত্মীয়স্বজন নিয়ে আমি মায়ের পছন্দ করা মেয়ে দিতিয়াকে বিয়ে করলাম।

বিয়ের রাতে দিতিয়াকে বললাম,

“আমি তো আপনাকে বিয়ের আগেই বলেছিলাম সব। আমি শুধু মায়ের জন্য বিয়েটা করেছি। হ্যাঁ, মানসীর সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু আমি ওকে ভালোবাসতাম, আজীবন ভালোবাসব। আমার কাছ থেকে আপনি প্লিজ কিছু আশা করবেন না।”

দিতিয়া মাথা নিচু করে আমার সব কথা শুনল। কথাগুলো বলে আমি বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। ও ডাকল,

“শুনুন।”

আমি ঘুরে তাকালাম। ও বলল,

“আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি নিরুপায় ছিলাম। আমার যদি ক্ষমতা থাকত তাহলে আমি এই বিয়েটা করতাম না।

ওর কথা শেষ হতেই আমি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। বাইরে গিয়ে মেইন গেটের সামনে গিয়ে মনে হলো পেছন থেকে কেউ আমায় ডাকছে। আমি উপরের দিকে তাকাতেই যে দৃশ্য দেখতে পেয়েছিলাম তা মনে পড়লে আজও বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। মানসী বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওড়নায় মুখ চেপে কাঁদছে। ও এত দিন যত তুচ্ছ কারণেই কাঁদুক না কেন যখনই কাঁদত আমি বুকে জড়িয়ে ধরতাম, চোখ মুছে দিতাম। কত আদরই না করতাম। আর আজ সত্যি অনেক বড় কারণে কাঁদছে। কিন্তু আমি দূর থেকে দেখছি শুধু। আমি কি অমানুষ! সেই মুহূর্তেও একটু কাঁদতে পারিনি।

১৬

আমার আর দিতিয়ার বিয়ের পর থেকে আমি প্রতিদিন ড্রিংক করে অনেক রাতে বাসায় ফিরতাম। হসপিটালে অনেক ভুল করতে লাগলাম, তাই চাকরি ছেড়ে দিলাম। অফুরন্ত সময়, সারাদিন যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে চলে যেতাম। রাত হলে কোনোদিন ফিরতাম কোনোদিন ফিরতাম না। আমাদের বিয়ের প্রায় ৩ মাস পরের ঘটনা…

সেদিন রাত ১টার সময় ড্রিংক করে বাসায় ফিরলাম। ফিরে দেখি দিতিয়া খাবার নিয়ে বসে আছে। আমি নিশ্চিত ও নিশ্চয়ই কারো কাছে শুনেছে যে মানসী এই কাজটা করত। হয়তো মা বলেছে কিংবা অনন্যা। আর মানসীও বলতে পারে ওকে বিশ্বাস নেই। আমি একটা জিনিস খেয়াল করেছি মানসী যা যা করত দিতিয়াও ইদানীং ঠিক তাই তাই করে। এসবের কোনো মানে হয়? মানসী হওয়া কি এতই সোজা!”

আমি না খেয়েই শুয়ে পড়লাম। দিতিয়া এসে বলল,

“শুয়ে পড়লে যে? খাবে না?”

“নাহ।”

“কেন?”

আমি ওর দিকে ঘুরে বললাম,

“তোমার কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে?”

“না না তা কেন? আমি না খেয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”

“আমি কখনো বলেছি আমার জন্য না খেয়ে বসে থাকতে?”

ও কিছু বলল না, চুপ করে রইল। আমি বললাম,

“শোন দিতিয়া, আমি তোমাকে আগেও বলেছি আমার জন্য কখনো অপেক্ষা করবে না। আমি একটানা ৩/৪ দিন বাড়ি ফিরিনি এমন অনেক হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে, তখনো কি এভাবে ৩/৪ দিন না খেয়ে বসে থাকবে?”

দিতিয়া আর কিছু বলল না। একটু পর আমি বললাম,

“লাইটটা বন্ধ করে দাও চোখে লাগছে।”

ও লাইট বন্ধ করে দিল। আমি ঘুমানোর অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু কোনো লাভ হলো না। বারবার মানসীর কথা মনে পড়তে লাগল। প্রতিদিন রাতে মেয়েটা কতই না আহ্লাদ করত! সারাদিন খুব বড়দের মতো ভাব করত। আর রাতে আমার কাছে এলে বাচ্চা হয়ে যেত। আমি একটু আদর করলেই গলে পড়ত। ওর সাথে সেসব মধুর মুহূর্তের কথা একটার পর একটা মনে পড়তে লাগল। আর তাই মানসীকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সেটা আর কোনোদিনও সম্ভব না ভাবতেই বুকের ভেতরটায় নিঃশ্বাস আটকে যেতে লাগল। পকেট খালি হয়ে যাওয়ায় সেদিন বেশি ড্রিংক করতে পারিনি অথচ অনেক বেশি ড্রিংক করা উচিত ছিল, যাতে কোনো চেতনাই না থাকে। তা তো হলোই না উল্টো চেতনা জাগ্রত হয়ে গেল!

অনেকক্ষণ পর উল্টো দিকে ফিরতেই আবছা আলোয় দেখলাম দিতিয়া দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। মেয়েটা ঘুমায়নি কেন এখনো? তারপর খেয়াল করলাম ও নীরবে কাঁদছে। উফ! বিরক্তির সীমা রইল না আমার। এতদিন যে ছিল সেও কাঁদত, আর এখন যে এসেছে সেও কাঁদছে। এত কাঁদে কীভাবে মেয়েরা? অসহ্য! পানির কল যেন চোখে লাগানোই থাকে। বেড সুইচ দিয়ে লাইট জ্বালালাম। চমকে উঠল দিতিয়া। আমি বললাম,

“কাঁদছ কেন?”

ও কোনো কথা বলল না। অন্যদিকে ফিরে চোখ মুছে নিল। আমি বললাম, “সমস্যা কি তোমার? কথার জবাব দাও না কেন?”

ও কী বলবে ভেবে পেল না। খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। কোনোরকমে বলল, “না কাঁদছি না, আমার ঘুম আসছিল না তাই এখানে বসেছিলাম।”

আমি হাত তুলে বললাম,

“একটা চড় মারব মিথ্যে বললে। এত কান্না আসে কোত্থেকে? সব বলেছিলাম না বিয়ের আগে? তাও তো লাফাতে লাফাতে বিয়ে করলে।”

ও কেঁপে উঠল। ভয়ের ছাপ ওর চেহারায় ফুটে উঠল। আমি হাত নামিয়ে নিলাম। তারপর বললাম,

“আমার ঘরে বসে ন্যাকা কান্না কাঁদলে চলবে না। ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে কাঁদো যাও।”

ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই রইল। আমার রাগ আরো বেড়ে গেল। বললাম,

“এক্ষুনি বেরিয়ে যাও আমার ঘর থেকে। যাও বলছি।”

ও বলল,

“সরি।”

আমি ওর সরিকে পাত্তা না দিয়ে ওর বাহু ধরে ওকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। তারপর আবার লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলাম সব স্বাভাবিক। দিতিয়া যে সারারাত ঘরের বাইরে ছিল সেটা কি বাড়ির কেউ টের পায়নি? টের পেলেই বা আমার কি! কিন্তু আমার খারাপ লাগতে লাগল। দিতিয়ার তো কোনো দোষ নেই। মেয়েটার বাবা- মা ছিল না। চাচার বাড়িতে কত কষ্টই না করেছে। এখানে এসে নিজের বাবা-মার মতো বাবা-মা পেয়েছে বটে কিন্তু যার হাত ধরে এ বাড়িতে ঢুকেছে তাকেই পায়নি। আর কখনো পাবেও না। কিন্তু তা বলে কাল রাতের মতো এত অমানুষিক ব্যবহার করা উচিৎ হয়নি। আমি অন্যের রাগ ওর ওপর ঝেড়েছি, তাও খুব বিশ্রীভাবে। কাজটা খুব খারাপ হয়েছে।

বিকালবেলা আমি বের হব তাই রেডি হচ্ছিলাম। ও কী জন্য যেন ঘরে এল।

আমি বললাম,

“দিতিয়া শোনো…”

ও খুব স্বাভাবিকভাবে বলল,

“হ্যাঁ বলো।”

“কাল রাতের ব্যবহারের জন্য সরি।”

“তুমি ড্রাংক ছিলে, আমি কিছু মনে করিনি।”

“নাহ, কালই বরং আমি ড্রাংক ছিলাম না।

“আমি বুঝি তোমার কষ্টটা। বিশ্বাস করো আমি কিছু মনে করিনি।”

এই কথার পর আমার আরো লজ্জা লাগতে লাগল। আমি কোনোদিন কোনো মেয়ের সাথে এত খারাপ ব্যবহার করিনি। আর কাল কী করলাম! তাও এমন একজনের সাথে যে আমার সমস্যাগুলো বুঝতে পারে। আমি কিন্তু ওর সমস্যা বুঝতে পারিনি। হাস্যকর হলেও আরেকটা সত্যি কথা হলো আমি এরপরেও ওর সাথে আরো অনেক অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি, আর ও নির্বিকার ছিল।

কী লিখতে গিয়ে কী লিখছি! দিতিয়ার সাপোর্ট আর ত্যাগের কথা অন্য কোনোদিন লেখা যাবে। না লিখলেও তো হবে না। ও তো আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু আজ যে কথা লিখবো বলে ঠিক করেছি সেটাই লিখব।

দিতিয়াকে সরি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রইংরুমে গিয়ে দেখি মা দরজায় দাঁড়িয়ে এক মহিলাকে বলছে,

“তুই এখন যা। আমি নিজে গিয়ে তোর সাথে দেখা করব, তখন তোরা যা বলবি সব শুনব…প্লিজ।”

ওই মহিলা বলছিল,

“না, আজকে আমি তোর কোনো কথাই শুনবো না। আজ আমি নীরবের সাথে দেখা করবই।”

আমি খুব অবাক হলাম। আমার সাথে দেখা করতে এসেছে উনি? কিন্তু আমি তো ওনাকে চিনিই না। মা বলল,

“প্লিজ, তোর সব কথাই তো আমি শুনেছি। তাহলে তুই কেন তোর কথা রাখছিস না? তুই চলে যা শ্যামা প্লিজ।”

মহিলা বলল,

“তোর বাসায় থাকার জন্য আমি আসিনি। কাজ শেষ করেই চলে যাব। আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছিস না কেন? এ কেমন ব্যবহার?”

এবার আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। বললাম,

“কী হচ্ছে এখানে? মা, উনি কে? আমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে, কী ব্যাপার?”

আমাকে দেখে মায়ের মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মাকে ঠেলে মহিলা ভেতরে ঢুকে বলল,

“তোমার সাথে আমার একটু দরকার আছে। বাসার অন্যদেরও অবশ্য লাগবে। তুমি বাসার সবাইকে একটু ডাকবে?”

সেদিন শুক্রবার ছিল। বাবা অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে, তাছাড়া সবাই বাসায়ই ছিল। আমাকেও ডাকতে হলো না। উনি নিজেই ভেতরে ঢুকে সবাইকে ডেকে নিল। সবাইকে নিয়ে ড্রইংরুমে বসে বলল,

“আজ আমি তোমাদেরকে একটা গল্প বলব, আমার নিজের জীবনের গল্প!”

১৭

মা আর কিছুই বলল না। কেমন একটু মিইয়ে গেল। ভদ্রমহিলা গল্প বলতে শুরু করলেন,

“আমার নাম শ্যামা। হাতে সময় বেশি নেই তাই আমি গল্পটা খুব ছোট করে বলছি। আমি ইন্টারের পর গ্রাম থেকে ঢাকায় আসি ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য। ইউনিভার্সিটির হলেই থাকতাম। বেশ কিছুদিন পর আমার একজনের সাথে সম্পর্ক হয়। ওর নাম সিফাত। আমাদের ইউনিভার্সিটিরই দুই বছরের সিনিয়র ছিল। ও ছিল বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। ওর বাবা অস্ট্রেলিয়াতে থাকত। উনি হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিল সপরিবারে ওখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবে। সিফাত আমাকে খুব ভালোবাসত, আমাকে ছেড়ে যাবে না আর তখনো গ্রাজুয়েশন শেষ হয়নি, আমার কথা তখন বলতেও পারবে না বাসায়। তাই পড়াশোনা ও নানান অজুহাত দিয়ে দেশে রয়ে গেল সিফাত। ওর বাবা-মা, ছোটবোন সবাই চলে গেল অস্ট্রেলিয়া। তারপর ও একা হয়ে গেল। যতক্ষণ ইউনিভার্সিটি থাকত, আমার সাথেই থাকত। বাসায় গেলে বড্ড খারাপ লাগত ওর, তখন তো এখনকার মতো ফোন অ্যাভেইলেভেল ছিল না। তাই আমরা একটা পাগলামি করলাম। হঠাৎই আমরা বিয়ে করে ফেললাম। ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া করে আমরা সংসার শুরু করলাম। খুব সুখে ছিলাম আমরা।

একদিন খবর এল সিফাতের মা খুব অসুস্থ। ওর বাবা কিছুদিনের জন্য ওকে যেতে বলল। ও আমাকে একা রেখেই চলে যেতে বাধ্য হলো। যাওয়ার আগে ওর খুব মন খারাপ হলো। যাওয়ার আগে আমাকে বারবার করে বলে গেল…মন খারাপ করো না, আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসব। ও গিয়ে চিঠি পাঠাল। এরপর থেকে আমরা নিয়মিত দুজন দুজনকে চিঠি লিখতাম। ও যাওয়ার এক মাসের মধ্যেই আমি বুঝতে পারলাম আমি আর একা নেই। বুঝতে পারলাম আমি মা হতে চলেছি। সিফাতকে জানাতেই ও ভীষণ খুশি হলো। বলল যেভাবেই হোক ও বাবাকে রাজি করিয়ে আসছে। কিন্তু এক মাস দু মাস তিন মাস কেটে গেল। সিফাত আর এল না। আমার চিঠিগুলো ফেরত আসতে লাগল। কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। আমি আমার ফ্যামিলিতেও কিছু জানাতে সাহস পেলাম না। তখন সিফাতের ক্লাসের এক বান্ধবীকে সব বলতেই ও নিজের মতো করে সিফাতের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। এই অবস্থায় আমার একা থাকা ঠিক হবে না বলে আপুটা আমাকে ওর বাড়িতে নিয়ে গেল। ওদের ছোট্ট সংসার, ও আর ওর হাজবেন্ড। ওদের বাড়িতে থেকেই আমার বাচ্চাটা হলো। আমি পরীক্ষা আর নানান ছুতোয় গ্রামে গেলাম না ওই কয় মাস। আমার পড়াশোনার জন্য বাড়ি থেকে যে টাকা পাঠাতো তাতে একটা বাচ্চার কিছুই হতো না। তখন আপুর তিন বছর হয়েছে বিয়ের, কিন্তু ওদের কোনো বাচ্চা ছিল না। কারণ ও কখনো মা হতে পারবে না। সেজন্যই বোধহয় আমার বাচ্চাকে ওরা দুজনই খুব আদর করত। শুধু আদর কেন, বাবুর সব খরচও ওরাই চালাতো।”

আমরা কেউ কোনো কথা বলছিলাম না। সবাই মনোযোগ দিয়ে ওনার গল্প শুনছি। উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

“এর মধ্যে হঠাৎ করে আমার বাবা এসে আমাকে নিয়ে গেল। ইউনিভার্সিটি থেকেই নিয়ে গেল। আমি যাওয়ার আগে বাবুকে একবার দেখতেও পারলাম না। আপুকেও কিছু জানাতে পারলাম না। বাড়িতে গিয়ে শুনি বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। যাওয়ার আগে কিছুই জানতে পারিনি। কিছুই আর করার থাকল না। আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিল। কোনোভাবে আমি আপুকে একটা চিঠি দিয়েছিলাম আমার অবস্থার কথা লিখে। আরো লিখলাম আমার এখন আর কিছুই করার নেই। ওর তো একটাই কষ্ট যে ও কখনো মা হতে পারবে না, ও যেন আমার বাবুকেই নিজের বাচ্চার মতো পালে। আমি আমার বাবুকে ওদেরকে দিয়ে দিয়ে দিলাম। সেই বিয়েটা টিকল না আমার। কারণ আমার বাবু হওয়ার সময় কিছু সমস্যা হয়েছিল তাই আমি মা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম। এত ঝামেলার মধ্যে আমি আমার বাবুর কোনো খোঁজ নিতে পারিনি। তখনকার দিনে যোগাযোগ ব্যবস্থা বড্ড খারাপ ছিল। আমার ডিভোর্সের পর আমি ঢাকায় এসে আপুর বাসায় গেলাম। ততদিনে পাঁচটি বছর পার হয়ে গেছে। গিয়ে দেখি ওরা ওখানে আর নেই। শত খুঁজেও ওকে আর পাইনি। খুব কষ্টে একটা চাকরি জোগাড় করে থেকে গিয়েছিলাম ঢাকায় আপুকে খোঁজার জন্য। আপুকে আর বাবুকে না পেলেও হঠাৎ একদিন সিফাতকে পেলাম। জানতে পারলাম ওর বাবাকে আমাদের বিয়ের কথা বলার পর ওর বাবা ওকে আটকে ফেলে। বাড়ি বিক্রি করে অন্য বাড়িতে চলে যায় যাতে আমার চিঠি না পায়। তারপর একসময় ওর বাবাকে মানিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসে। পাগলের মতো খুঁজতে থাকে আমাকে। এরপর থেকে আমরা দুজনে মিলে আপুকে খুঁজতে থাকি, আমার বাবুকে ফিরে পাওয়ার আশায়। তোমাদের মাই আমার সেই আপু, আমার হাজবেন্ডের ফ্রেন্ড। আর নীরব আমার ছেলে।”

আমার মুখ দিয়ে আচমকা বেরিয়ে গেল।

“মানে? আপনি কী বলছেন এসব?”

আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি মা কাঁদছে। সৌরভ বলল,

“যত্তসব গাঁজাখুরি কাহিনী। আপনি তো বললেন আপনার আপু কখনো মা হতে পারবে না। কিন্তু আপনার কথা যদি সত্যি ধরেও নেই তাহলে আমি আর আমার বোন কোত্থেকে আসলাম?”

সৌরভের কথার জবাব দেয়ার সময় পেল না উনি। তার আগেই আমি আমার মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,

“মা কী বলছে উনি?”

মা চোখ মুছতে মুছতে বলল,

“সব সত্যি। তোকে আমি জন্ম দিইনি। ও তোকে জন্ম দিয়েছে।”

ওই মহিলা আমার মায়ের কাছে এসে বলল,

“তোর তো আরো দুটো ছেলেমেয়ে আছে আপু। আমার তো একটাই ছেলে। মানছি আমিই ওকে তোর কাছে ফেলে গিয়েছিলাম। সেজন্যই তো আজ সবার সামনে আমি আমার সব দোষ স্বীকার করে নিলাম।”

মা কোনো কথা বলল না। অনবরত কাঁদতেই থাকল। আমি ওনাকে বললাম, “আমি আমার মায়ের অবস্থা দেখেই বুঝতেই পারছি আপনার কথাগুলো সত্যি। তাই এখন মনে হয় আমার আপনাকে কিছু কথা জানানো দরকার। আমি ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের কোনো কথা শুনিনি। আমি সবসময়ই দস্যি ছিলাম, জেদী ছিলাম। এসব সবাই জানে কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ জানতে পারেনি যে ছোটবেলায় মায়ের সাথে শপিং-এ গেলে মা যখন কালো শার্টটা দেখিয়ে বলত, এই কালো শার্টটা তোকে খুব মানাবে। তখন আমি আমার পছন্দের সাদা শার্টটার কথা মাকে বলিনি। কারণ, আমার মনে হয়েছে মা যখন বলছে তখন আমাকে কালোটাই ভালো লাগবে। ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট খেলা শিখেছি, খেলেছি কারণ মায়ের ক্রিকেট খেলা পছন্দ ছিল। মা চাইত আমি ক্রিকেট খেলি। তাই আমি কোনোদিন বলতে পারিনি যে আমার ফুটবল খেলা খুব পছন্দ। মায়ের স্বপ্ন ছিল আমরা দুই ভাই ডাক্তার হব। তাই আমি জার্নালিস্ট হবার প্রবল ইচ্ছেটাকে পাত্তা না দিয়ে ডাক্তারি পড়েছি। এরকম হাজারো ঘটনা ঘটেছে যা কেউ জানতে পারেনি। আমি কেন এরকম করেছি জানেন? বিকজ শি ডিজার্ভ ইট। এতটাই ভালোবাসা সে দিয়েছে আমাদেরকে। আর সে আমাদের জন্য যে যে ত্যাগ স্বীকার করেছে তার কাছে এগুলো কিচ্ছু না।”

সবাই চুপ করে আছে। আমার দুই মা অনবরত কাঁদছে। আমার এক ফোঁটাও কান্না পাচ্ছে না। খারাপও লাগছে না। এমন একটা ফিলিং হচ্ছিল যে একদম সেই কাজটাই করছি যা আমার করা উচিত। খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি আমার মানসীর ডিভোর্স এবং দিতিয়ার সাথে বিয়ে এই দুটো ঘটনার সাথে এই ঘটনার কোনো যোগাযোগ রয়েছে। আমি আবার বলতে শুরু করলাম,

“একটা মেয়ে আছে, যার জন্মের পর আমি বলেছিলাম আমি ওকে বিয়ে করব। সাত বছরের বাচ্চা ছিলাম তখন আমি। সবাই হেসেছিল আমার কথা শুনে। কিন্তু বড় হয়ে আমি সত্যি তাকে বিয়ে করেছিলাম। বুঝুন কবে থেকে সম্পর্ক। আমার শরীরের প্রতিটা রক্তবিন্দুতে মিশে আছে ও। আমার প্রাণটা আছে ওর মধ্যে। সেই মেয়েটাকে ডিভোর্স দিয়ে আমি আরেকটা বিয়ে করেছি। কেন জানেন? আমার মায়ের জন্য।”

কথা শেষ করে দেখলাম সবাই কাঁদছে। অনন্যা, দিতিয়া, মোনা সবাই। কী অদ্ভুত! এমনকি সৌরভেরও চোখে জল। সেই মুহূর্তেও আমার চোখে এক ফোঁটা জল আসেনি। ওই মহিলা বলল,

“নীরব, আমি বুঝতে পারছি তোমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলাম বলে তুমি রাগ করছ। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি নিরুপায় ছিলাম। আমাকে মাফ করো বাবা।”

“আপনার কোনো দোষ ছিল না, সেটা আমি জানি। আপনি নিরুপায় ছিলেন সব ঠিক। কিন্তু আপনার দোষ ছিল সেই সময় সবাইকে না জানিয়ে বিয়ে করা এবং একটা জীবন পৃথিবীতে নিয়ে আসা, এই কথাটা বলব না ভেবেছিলাম, কিন্তু আপনি দোষগুণের বিচার করছিলেন তাই বলতে বাধ্য হলাম। আর কী যেন বলছিলেন…হ্যা আপনার ওপর রাগ করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না কারণ প্রথমত, আপনার জন্যই আমি এমন মা পেয়েছি। আর দ্বিতীয়ত, আমি সবার সাথে রাগ করি না।”

একথা বলে আমি একটু থামলাম। তারপর বললাম,

“আর একটা কথা, আমি আমার মাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। বেটার হয় আপনি যদি আপনার সময়টা এখানে নষ্ট না করেন।”

এই বলে আমি বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। কদিন আগে মা যেভাবে আমাকে বিয়েতে রাজি করিয়েছে তাতে আমি মনে মনে মায়ের ওপর খুব অভিমান করে ছিলাম…খানিকটা রাগও। আজ সব রাগ, অভিমান দূর হয়ে গেল। আসলেই আমি খুব খারাপ। কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করলে খুব বেশিই খারাপ ব্যবহার করতে পারি। হোক সে মানসী, দিতিয়া কিংবা নিজের গর্ভধারিণী মা।

১৮

পরেরদিন সকালে বাবার ডাকে ঘুম ভাঙল। আমি উঠে বসে বললাম,

“বাবা.. কখন এলে?”

“কাল রাতের ট্রেনে উঠেছিলাম। আজ সকালেই বাসায় আসলাম।”

“ওহ!”

“তুই এক কাজ কর, উঠে তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে নে। তোর সাথে কথা আছে।”

“হুম, এখনই বলো। ব্রেকফাস্ট পরে করা যাবে। ক্ষিদে পায়নি এখনো।”

“ওকে, কাল শ্যামা এসেছিল শুনলাম।”

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। বাবা বলল,

“একদিকের কথা শুনেছিস। তোর মা তো নার্ভাস হয়ে কিছুই বলতে পারেনি শুনলাম। সব যখন জেনেই ফেলেছিস তখন দুই দিকের কথাই তো জানা উচিত।”

“আমার কিছুই জানার নেই বাবা। আমি কালকের দিনটা ভুলে যেতে চাই।”

“হুম, তবু তো কিছু কথা জানাটা জরুরি।

আমি চুপ করে রইলাম। বাবা বলল,

“একদিন শ্যামা ইউনিভার্সিটি গিয়ে আর ফিরল না। আমরা তো চিন্তায় পড়ে গেলাম, তোর বয়স তখন ২ মাস মাত্র। তোর মা ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে জানতে পারল শ্যামাকে ওর বাবা নিয়ে গেছে। আর তখন তোর মা তোকে নিজের ছেলের মতোই পালতে শুরু করল। তারপর যখন আমরা জানলাম শ্যামার বিয়ে হয়ে গেছে, তখন তোর মা বলল আল্লাহ মুখ তুলে চেয়েছে। কারণ তখন আমরা জানতাম ও কখনো মা হতে পারবে না। এই একটাই দুঃখ ছিল ওর। তোকে পেয়ে সব ভুলে গেল। একদিন হঠাৎ কী হলো যখন তোর ১ বছর প্রায় তখন ও আমাকে বলল বাড়ি বিক্রি করে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য। তোর প্রতি এত মায়া জন্মে গিয়েছিল যে ভয় পাচ্ছিল যদি শ্যামা এসে কখনো তোকে ফেরত চায়, মরে গেলেও তো তোকে ফেরত দিতে পারবে না। তারপর আমার মধ্যেও কীভাবে যেন এই ভয়টা ঢুকে গেল। আমি সত্যি সত্যি বাড়ি বিক্রি করে এখানে চলে এলাম। এই বাড়িটা কিনলাম। তারপরই তো মিরাকলের মতো সৌরভ হলো। অনেক বছর পর আবার মোনাও। কিন্তু তোর প্রতি তোর মায়ের একচোখা ভালোবাসা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছিস সবসময়। সবাই খেয়াল করেছে আর ভেবেছে প্রথম সন্তান তাই তার জন্য সবকিছুই বেশি বেশি।”

“বাবা, কোনোদিন আমি কল্পনাও করিনি এমনটা।

“আমরা তো একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম।”

আমি চুপ করে রইলাম। বাবাও কিছুক্ষণ চুপ। তারপর বলল,

“তোর মা খুব ভেঙে পড়েছে।”

“কেন?”

একে তো তোকে ওভাবে জোর করে বিয়ে দিয়েছে, তার ওপর কাল জানলি ও তোর নিজের মা না। দিতিয়ার সাথে তোর বিয়ের পরই তোর সাথে তোর মায়ের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। এখন যদি দূরত্বটা আরো বেড়ে যায় সেই ভয়েই সে অস্থির হয়ে আছে।”

“তা কেন হবে বাবা? মায়ের ওপর একটা অভিমান ছিল ঠিকই তবে মায়ের সাথে দূরত্ব তৈরি হওয়ার মতো কিছু হয়নি।”

তারপর হঠাৎ মনে পড়ায় জিজ্ঞেস করলাম,

“বাবা আমার আর দিতিয়ার বিয়ের সাথে কি ওই মহিলার কোনো সম্পর্ক আছে? ওনাকে মা বলছিল…তুই যা বলেছিস আমি করেছি। এখন তুই তোর কথা রাখ, এই ধরনের কিছু কথা। আমি পেছন থেকে শুনে ফেলেছিলাম।”

“হ্যাঁ, মূলত এই কথাটা বলতেই আমি তোর কাছে এসেছি।”

“কী?”

“কিছুদিন আগে হঠাৎ মার্কেটে শ্যামা তোকে আর তোর মাকে দেখতে পেয়েছিল। তোর মাও তোকে নাম ধরে ডেকেছিল সেটা শুনেই ও বুঝে গিয়েছিল তুই ওর ছেলে। কারণ নীরব নামটা ওরই দেয়া ছিল। যাই হোক, সেদিন শ্যামা তোদের সামনে আসেনি। ফলো করে এসে বাসা চিনে গিয়েছিল। তারপর তোর মায়ের সাথে কোনোভাবে যোগাযোগ করে তোকে ফেরত চায়। তোর মা তো দেবে না। উল্টো জিজ্ঞেস করল এতদিন পর কেন তোকে চাচ্ছে! ছোটবেলায় তো তোকে একেবারেই দিয়েছিল। সেই চিঠিটা তোর মা অনেক যত্নে রেখে দিয়েছিল। সেটাও দেখাল। তারপর শ্যামা ওর সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা বলল। কীভাবে ওর বাবা ওকে জোর করে বিয়ে দিয়েছিল। কীভাবে সেই বিয়ে ভাঙলো, কীভাবে আবার সিফাতকে ফিরে পেল সব বলল। সব শুনেও তোর মা তোকে দিতে রাজি হয়নি। তারপর সিফাতও তোর মায়ের সাথে দেখা করে অনেক অনুরোধ করল। আসলে ওদের আর কোনো সন্তান নেই তো। কিন্তু তোর মা কিছুতেই রাজি হলো না। উল্টো বোকামি করে বলল, তোকে ছাড়া আর যা চাবে তাই দেবে। আজীবনের বোকা তোর মা। ওরাও বলল, যদি তোকে দিতিয়ার সাথে বিয়ে দেয় তাহলে আর তোকে চাইবে না।”

“মানে কী? এটা কেমন কথা! এটার সাথে ওটার কী সম্পর্ক? আর দিতিয়া ওদের কে হয়?”

“আরে বাবা, বলছি তো…সবটা ধৈর্য ধরে শোন।”

“আচ্ছা বলো।”

“এসব কথা বলার পর তোর মা বলল তুই মানসীকে বিয়ে করেছিস।”

“বাবা তুমি আমার আর মানসীর বিয়ের কথা জানতে?”

“নাহ, আজই জানলাম।”

আমি কিছু বললাম না আর। বাবা আবার বলতে শুরু করল,

“ওরা তখন বলল…বিয়ের কথা তো কেউ জানে না। আর এটাকে বিয়েও বলা যায় না, এটা আসলে ছোটকালের ভুল। ডিভোর্স করে নিলেই মিটে গেল।”

আমি অবাক হয়ে সব শুনতে লাগলাম। বাবা বলল,

“তোর মা যে একটা ইমোশনাল ফুল তা আমি আগে থেকে জানতাম। তবে এতটাও জানতাম না। এইসব ঘটনা ওদের তালে পড়ে ওদের শর্ত মেটাতে করেছে, অথচ একবার আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি! কারণ ওরা মানা করেছে আমাকে জানাতে। আমি আন্দাজ করছিলাম কিছু হয়েছে তবে এত বড় ধরনের একটা গণ্ডগোল তা টেরই পাইনি। আমি যদি টের পেতাম তাহলে এটা হতে দিতাম না।”

“বাবা, কী বলছ এসব? মা ওদের কথায় এসব করেছে? একবার ভাবলো না আমার কথা? মা কী করে ভাবলো এত বছরের সম্পর্ক শেষ করে দিয়ে আমি চলে যাব? অতটা অমানুষ কি বানিয়েছো তোমরা আমাকে?”

“আমি জানলে এটা হতে দিতাম না। আর সেটা ওরা খুব ভালোভাবে জানে বলেই তোর মাকে ভয় দেখিয়েছে ওদের কথা না শুনলে কিংবা আমাকে কিছু জানালেই ওরা তোকে সব জানিয়ে দেবে। সেই ভয়েই তোর মা মরতে বসেছিল কিন্তু মুখ খোলেনি।”

“আমি জানলে কী হতো বাবা? এখন তো জেনেছি! কই মাকে ছেড়ে, তোমাদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছি ওদের পিছু পিছু?”

“না চলে যাসনি ঠিকই, কিন্তু অনেক দূরে সরে গিয়েছিস। কাল সবকিছু জানার পর একবারও গিয়েছিস মার কাছে?”

এবার আমার বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা লাগল। সত্যি তো যাইনি মায়ের কাছে। যাইনি কারণ খুব অস্বস্তি লাগছিল কাল সব জানার পর থেকে। সেটাই বললাম বাবাকে। বাবা বলল,

“হুম, আর তোর মাও তো সেই কারণেই তোর কাছে আসতে পারেনি। ঠিক এই কারণেই তোর মা চায়নি কোনোভাবে তুই জানতে পারিস যে তুই আমাদের ছেলে না। যেকোনো মূল্যেই হোক সে এই কথাটা গোপন রেখেছে। ও বোকা ঠিকই…না বুঝে অনেক ভুল করে ফেলে। কিন্তু ওর ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই।”

“বাবা, আমি জানি। এসব কথা কি তোমার বলতে হবে? আমার মাকে আমি চিনি না? কিন্তু ওরাই বা কেন এমনটা করতে গেল?”

“কারণ ওরা ভেবেছিল এসব করে তোর আর তোর মায়ের সম্পর্কটা খারাপ করে দেবে। তারপর একদিন না একদিন সব জেনে তুই ওদের কাছে ফিরে গেলেও যেতে পারিস। আর আলটিমেটলি ওরা কিছুটা সাকসেসফুল হয়েছে। তোর আর তোর মায়ের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। ইভেন তুই ইদানীং তোর মাকে দেখানোর জন্য ড্রিংকও করছিস।”

“সরি বাবা। আমি এক্ষুনি মায়ের কাছে গিয়ে সব ঠিক করে দিচ্ছি, তুমি জাস্ট দেখো।”

“দাঁড়া, আমি কথা শেষ করে নিই। তারপর যা।”

“আচ্ছা বলো।”

“তখন জিজ্ঞেস করলি না, দিতিয়া ওদের কে হয়?”

“ও…হ্যাঁ।”

“দিতিয়া ওদের কেউই হয় না। ও একটা অসহায় মেয়ে যাকে শুধুমাত্র ইউজ করেছে শ্যামা-সিফাত। আর দিতিয়ার চাচাও নাকি অনেক টাকা খেয়েছে ওদের কাছ থেকে।”

“সেকি!”

“হ্যাঁ। নীরব একটা অনুরোধ করছি। যা হয়েছে তাতে দিতিয়ার কোনো দোষ নেই। ওকে কষ্ট দিস না, খুব লক্ষ্মী একটা মেয়ে। জানি তোর মানতে কষ্ট হচ্ছে। শুধু তুই কেন, আমিই তো এখনো ভাবতে পারি না মানসী আর বউ হয়ে আসবে না এ বাড়িতে। কিন্তু যেভাবেই হোক, কপালে যা ছিল তা হয়ে গেছে। এবার তো আমাদের সবকিছু মেনে নেয়া উচিৎ।”

আমি অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,

“মেনে তো নিয়েছি বাবা।”

“নাহ, তুই মেনে নিতে পারিসনি। মেনে নিলে তোর আর দিতিয়ার সম্পর্কটা স্বাভাবিক হতো।”

“আমাদের সম্পর্ক তো স্বাভাবিকই বাবা।”

“তাহলে মেয়েটার মুখে হাসি নেই কেন?”

“সেটা আমি কী করে বলব? ও বোধহয় হাসে কম।”

আমার এ কথায় বাবা হো হো করে হেসে দিল। বলল,

“ভালো বলেছিস। কিন্তু বাবা, বিয়ে যখন করেই ফেলেছিস তখন বউয়ের প্রতি কিছু দায়িত্বও তো পালন করতে হবে।”

“বিয়ে তো মানসীকেও করেছিলাম বাবা। কিন্তু কোনো দায়িত্বই পালন করতে পারিনি।”

“সেটা তো তোর মায়ের জন্য।”

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,

“বাবা, বাদ দাও না। চলো মায়ের কাছে যাই।”

বাবাও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“হ্যাঁ, চল।”

বাবা-মায়ের ঘরের সামনে যেতেই বাবা বলল,

“আমি যাব না…তুই যা।”

আমি ঘরে ঢুকে দেখি মা জানালায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ডাকলাম,

“মা।”

মা বোধহয় কাঁদছিল। লুকিয়ে চোখ মুছে পেছনে ফিরলো। আমি মায়ের কাছে গিয়ে মায়ের একটা হাত ধরে বললাম,

“মা আমাকে মাফ করে দাও। আমি সব না জেনে না বুঝে এতদিন তোমার সাথে অভিমান করেছিলাম। প্লিজ মা আমাকে মাফ করো। আমি তোমাকে ছেড়ে কোনোদিনও কোথাও যাব না। আমার একটাই মা। আমি এতদিন জেনে এসেছি তুমিই আমাকে জন্ম দিয়েছ, তুমিই আমাকে মানুষ করেছ। তুমিই আমার সব। আজীবন তাই জানব। তাই বিশ্বাস করব।”

মা কিছুই বলতে পারল না। কেঁদে বুক ভাসাতে লাগল। আমি মাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে রইলাম। কাঁদুক একটু। এই কান্নার সাথে সাথে সব কষ্ট ধুয়ে যাক।

নীরব ইশতিয়াক
২৩ এপ্রিল, ২০১৬

১৯

আমি টেবিলে বসে কিছু একটা লিখছিলাম। হঠাৎ মানসী এসে আমার পেছনে দাঁড়াল। আমার কাঁধে হাত রেখে বলল,

“এই কিসব হাবিজাবি লিখছো বলো তো।”

“আরে বাবা, হাবিজাবি না। কাজ করছি।”

“ওটা বুঝি আমার থেকেও বেশি মূল্যবান?”

আমি ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম,

“নাহ তোর থেকে মূল্যবান আমার কাছে আর কিছু আছে?”

ও আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলল,

“তাহলে এসব রাখো এখন। আমার খুব ঘুম পেয়েছে আর আমি তোমার কোলে ঘুমাব।”

আমি ওসব ওভাবেই রেখে উঠে গেলাম। তারপর ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,  

“নরম বিছানা রেখে আমার সোনাবউটা আমার শক্ত কোলে ঘুমাবে?”

“হ্যাঁ, ঘুমাবে। কারণ, এই শক্ত কোলটাই আমার স্বর্গ!”

আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম। ও ভয় পেয়ে বলল,

“তুমি কি পাগল হলে? আমি কোলে চড়তে চাইনি। তোমার কোলে ঘুমাতে চেয়েছি।”

“আমি কোলে নিতে চেয়েছি, তাই নিলাম।”

“ইশ, আমি এখন কত্ত ভারী হয়ে গিয়েছি। কেন নিলে? প্লিজ আমাকে নামাও। বড্ড ভয় লাগছে।”

আমি ওকে কোল থেকে নামালাম না। ওভাবেই হেঁটে হেঁটে বিছানার কাছে নিয়ে গেলাম। তারপর বিছানায় শুইয়ে দিলাম। ও হাফ ছেড়ে বাঁচল যেন। বলল,

“তুমি না বড্ড জেদি…ভাল্লাগে না।”

আমি ওর পাশে বসে ওর গালে চুমু খেয়ে বললাম,

“আমার খুব ভালো লাগে।

আমি শুয়ে পড়লাম। তারপর বাচ্চাদের মতো ও আমার কোল ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। তারপর ও আমার হাতটা ওর পেটের ওপর রেখে বলল,

“দেখো আমাদের তুলতুল কত্ত বড় হয়ে গেছে।”

“হুম, এখন যে এত আহ্লাদ করছিস! সামনের মাসেই যখন ও চলে আসবে তখন তো আমার কাছেও আসবি না। ওকে নিয়েই পড়ে থাকবি।”

ও আমার গলা জড়িয়ে ধরে নাকে নাক ঘষে বলল,

“ইশ! কক্ষনো না। ও আমার কোলে থাকবে আর আমি তোমার কোলে থাকব।”

আমি সেই সুযোগে ওর ঠোঁটে চুমু দিলাম। ও বলল,

“এখন ও পেটের ভেতর আছে তাই তোমাকে কিছু বললাম না। যখন ও চলে আসবে তখনও কিছু বলব না। কিন্তু ও একটু বড় হলে এসব অসভ্যতামি চলবে না, বুঝেছ?”

আমি খুব অবাক হওয়ার ভান করলাম,

“অসভ্যতামি! এগুলো অসভ্যতামি নাকি? আরে এই অসভ্যতামিগুলো না করলে ও আসতে পারত নাকি?”

একথা বলতেই ও আমাকে মারতে লাগল,

“ছিঃ তুমি খুব খারাপ…খুব খারাপ।”

মার খেতে খেতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মরার চোখ দিয়ে তো এক ফোঁটা পানি বের হয় না। হঠাৎ করে এমন স্বপ্ন কেন দেখালাম! উফফ অসহ্য!

বিছানা থেকে না উঠেই হাত বাড়িয়ে ওয়ালেটটা নিলাম। ওয়ালেট খুলে তাকিয়ে রইলাম আমার আর মানসীর ছবিটার দিকে। দিতিয়া, আমার বিয়ে হয়েছে তিন মাস হয়ে গেছে। এতদিন ওকে না দেখে আছি। ছবিগুলোই ভরসা। কত ভালো লাগে ওকে আমার সাথে! পৃথিবীর আর কাউকে মানাবে না আমার সাথে, আর কাউকে না।

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ পেয়ে চোখ তুলে তাকালাম। দিতিয়া ঘরে ঢুকল। আমি ওয়ালেট রেখে উঠে পড়লাম। বারান্দায় গিয়ে টাওয়াল নিয়ে ফ্রেশ হতে যাব এমন সময় দিতিয়া বিছানা গোছাতে গোছাতে বলল,

“জানো, মানসী এসেছে।”

আমি চমকে তাকালাম। বললাম,

“কখন?”

“অনেকক্ষণ।”

মন চাইল এক্ষুনি ছুটে বের হয়ে যাই ওর কাছে। কিন্তু পারলাম না। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে স্বাভাবিকভাবেই বের হলাম। আমার চোখদুটো চারপাশে খুঁজে ফিরছে ওকে। কিন্তু কোথাও দেখলাম না। ব্রেকফাস্ট করতে বসলাম। খাচ্ছি ঠিকই কিন্তু কেমন যেন! মনে হচ্ছে লোহা খাচ্ছি! হজম হবে না!

দেরিতে ঘুম থেকে উঠেছি, এতক্ষণে সবার খাওয়া শেষ। একাই খাচ্ছিলাম। তবুও অনন্যা এসে পানি ঢেলে দেয়ার ছুতোয় ফিসফিসিয়ে বলল,

“মানসী বাগানে আছে। তোমাকে ডাকছে।”

আমার বুকের ধুকপুকানি আরো বেড়ে গেল। যেন এই প্রথম প্রেমে পড়েছি। কখনো দেখা হয়নি ওর সাথে। আমার সদ্য হওয়া প্রেমিকা আমায় ডাকছে। আমি উঠে পড়লাম,

“আমার খাওয়া হয়ে গেছে।”

.

বাগানে যেতেই দেখতে পেলাম মানসীকে। চোখে চোখ পড়তেই ওর চোখের ভেতর দিয়ে ওর অস্থিরতাটা দেখে ফেললাম। ও আর মোনা গাছ লাগাচ্ছিল। আমি বললাম,

“মোনা একটু ভেতরে যা তো।”

মোনা চলে গেল। মানসী হাত ধুতে ধুতে বলল,

“অনেক শুকিয়ে গেছ দেখছি।”

“আমি মৃদু হাসলাম। তারপর বললাম,

“এতদিন একবার আসতে তো পারতি।”

“নাহ, পারলে আসতাম। আজ মা নিজেই নিয়ে এল।”

“ওহ। খালামণি কোথায়?”

“মা বোধহয় খালামণির ঘরে।”

“ওহ..”

আমি কোনো কথা খুঁজে পেলাম না। হাঁ করে চেয়ে থাকলাম শুধু। জানি না কী কারণে ও আমার দিকে তাকাচ্ছেই না। তাকালেও জাস্ট এক সেকেন্ডের জন্য। তারপরই ওর দৃষ্টি এদিক-ওদিক ঘুরছে। অথচ এই আমরাই একসময় কতটা কাছে ছিলাম দুজন দুজনের। ঠিক কিছুক্ষণ আগের স্বপ্নটার মতোই। খুব ইচ্ছে করল ওই অদ্ভুত স্বপ্নটার কথা ওকে বলতে। কিন্তু সেটাও বলতে পারলাম না। কারণ, আমি ওকে আর কাঁদাতে চাই না। হঠাৎ ও নীরবতা ভেঙে বলল,

“এখন নিশ্চয়ই খালামণির উপরে আর রাগ নেই?”

“না নেই। তুই কার কাছে জানলি?”

“প্রথমে অনন্যা বলেছিল ইউনিভার্সিটিতে। আর খালামণিও আজ সবটা বলে মাফ চাইল।”

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। ওই বলল,

“রাগ যখন নেই আর ড্রিংক করো না প্লিজ।”

সব পাচারকারী যে অনন্যা তা বুঝতে সমস্যা হলো না। বললাম,

“যেদিন সব জেনেছি তারপর আর ড্রিংক করিনি তো।”

“ওহ!”

“তোর পাচারকারী এটা বলেনি তোকে?”

ও হেসে দিল। আমি বললাম,

“ভেরি ব্যাড! কিন্তু তোর তো তাও একজন পাচারকারী আছে। আমার তো তাও নেই।”

“কী হবে রেখে?”

আমি কথা বাড়ালাম না। এটা তো কোনো তর্ক করার বিষয় হতে পারে না। ও বলল,

“তুমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছ কেন? পুরুষ মানুষের ক্যারিয়ারটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”

“আমার ক্যারিয়ার দিয়ে আর কী হবে?”

“এটা কী ধরনের কথা? জীবনে যা কিছুই ঘটে যাক পড়াশোনা আর ক্যারিয়ারে তার প্রভাব পড়তে দেয়া যাবে না।

আমার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। ও কেন এসব বলছে! ও না বুঝলে কে বুঝবে আমাকে? আমি বললাম,

“অন্য কথা থাকলে বল।”

“ভাবির সাথে আজ অনেক কথা হলো। খুব ভালোমানুষ ও।”

বুঝলাম ও কি বলতে চাচ্ছে। তবু বলার জন্যই বললাম,

“ভাবিটা আবার কে?”

“দিতিয়া।”

“ওকে ভাবি বলার কী আছে? নাম ধরে ডাকলেই হয়।”

“কীভাবে হয়? ও আমার চেয়ে অনেক বড়। আমি নাম ধরে ডাকতেই মা বকা দিল। বলল ভাবি বলতে।

“গাটা জ্বলে যায় এদের ঢং দেখলে। বলার হয় ওদের সামনে বলবি। আমার সামনে না।”

“বাদ দাও তো। জানো, ওই আগ বাড়িয়ে কথা বলল। বারবার বলছিল, আমি নাকি অনেক ভাগ্যবতী তাই তোমার অমন ভালোবাসা পেয়েছি। আর আমি বলেছি ও অনেক ভাগ্যবতী তাই ও তোমাকে পেয়েছে!”

একথা শুনে আমার রাগ আরো বেড়ে গেল। কিন্তু কিছু বললাম না। ও আবার বলল,

“ওকে আমার সব কথা ওভাবে না বললেও পারতে।”

এবার আমার রাগ চরমে উঠল। আমি আর রাগ ধরে রাখতে পারলাম না। বললাম,

“এত জ্ঞান দিচ্ছিস যে? এই গুরুদায়িত্বটা তোকে কে দিল?”

“রেগে যাচ্ছ কেন? চলেই তো যাব। আবার কবে দেখা হবে তাও তো জানি না।”

“দেখা করলেই দেখা হয়। তুই ইচ্ছে করেই দেখা করিস না।”

“কীভাবে যোগাযোগ করব? বাসার টিএনটি লক করা থাকে সবসময়। আর তোমাদের বাসায় আমার আসা নিষেধ ছিল এতদিন। আজ তো মা নিয়ে এল বলে আসতে পারলাম। তাছাড়া কী হবে এখন আর দেখা করে? এখন সম্পর্ক, মায়া এসব না বাড়ানোই ভালো।”

এসব শুনে রাগ সামলানোর জন্যই আমি চুপ করে রইলাম। ও বলল,

“দিতিয়া অনেক ভালো মেয়ে। আমি ওর হাজবেন্ডের এক্স গার্লফ্রেন্ড এক্স ওয়াইফ। তবু সব জেনেশুনে কী ভালো ব্যবহার করল আমার সাথে। কোনো জড়তা ছাড়াই আমার সাথে তোমাকে নিয়ে আলোচনা করল। কি অদ্ভুত লক্ষী মেয়ে!”

“তুই কি ওর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর?”

“ছিঃ কী বলো তুমি এসব?”

“এত গুণগান করছিস তাই বললাম।”

“যা সত্যি তাই বলেছি। অন্য কোনো মেয়ে হলে…”

“আবার সেই…”

আমিও কথা শেষ করলাম না। গটগট করে বেরিয়ে গেলাম বাসা থেকে। কারণ, ওর সাথে রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। যা হয়েছে তার জন্য ও দায়ী নয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *