১০
শুরু হয়ে গেল রাধা-কৃষ্ণের বিরহ। খালু ট্রান্সফার হয়ে ঢাকায় এল, আর মানসী চলে গেল ওদের বাসায়। ওদের বাসাটা আমাদের বাসার কাছেই ছিল কিন্তু একসাথে তো না। নতুন চাকরি, তাই দিনটা বেশ ব্যস্ততায় কেটে যেত, কিন্তু রাতগুলো কাটতে চাইত না। আজকালকার মতো মোবাইল ফোনের প্রচলন তখন ছিল না। টিএনটি ফোন অবশ্য ছিল। কিন্তু আমি ফোন করতে পারতাম না। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মানসী লুকিয়ে ফোন করত, সেই অপেক্ষায় আমাকে বসে থাকতে হতো। তারপর রাত জেগে ড্রইং রুমে বসে মশার কামড় খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলত। সারারাত কথা বলতাম। ফজরের আজান পড়লে খেয়াল হতো এবার ঘুমানো উচিত। সকালে উঠে আবার হসপিটালে যেতে হতো। সকাল হলেই আবার দুপুরের জন্য অপেক্ষা। কারণ দুপুরবেলা মানসীর ইউনিভার্সিটি শেষ হতো আর ও আমার সাথে দেখা করতে হসপিটালে আসত। মাঝে মাঝেই আমার জন্য এটা সেটা রান্না করে নিয়ে আসত। সারাদিনে ওই একবারই দেখা হতো আমাদের। যেদিন কোনো কারণে আসতে পারত না সেদিন খুব কষ্টে কাটত।
শুধু আমি না সবাই মিস করত মানসীকে। আমাদের বাসার সবার কাছের মানুষ হয়ে ছিল ও। যার যার সাথে তার তার মতো করে মিশত। ও খুব ভালো চা বানাত। বাবা ভুলে হঠাৎ হঠাৎ বলে উঠত, “আম্মু এক কাপ চা দে তো।” তারপর নিজেই লজ্জা পেয়ে যেত। মাও মিস করত তার রান্নার সঙ্গীকে। অনন্যা টিভি দেখা নিয়ে ঝগড়া করার মানুষ পেত না। মোনালিসাকেও নিজ হাতে খেতে শুরু করতে হলো ও চলে যাওয়ার পর।
অদ্রি কেবল কথা বলতে শুরু করেছে। দুএকটা শব্দ বলতে পারত, অনন্যাকে বলত মা আর মানসীকে বলত আম্মা। মানসী চলে যাওয়ার পর ছোট্ট সেই অদ্রিটাও খালি কাঁদত আর বলত “আম্মা দাবো” “আম্মা দাবো” মানে আম্মার কাছে যাব।
সবকিছু বদলে যায়। বদলে যায় সময়, বদলে যায় পৃথিবী। সত্যি সবকিছু বদলে গেছে। বাবা-মার চুল পেকেছে, বয়স হয়েছে। এলমেলো অনন্যাও কেমন সংসারী হয়ে গেছে। স্কুল যাওয়া মোনালিসাও পড়াশোনা শেষ করে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। আবার ভালো চাকরিও করে। ছোট্ট অদ্রি কদিন পর কলেজে যাবে। ফ্যামিলিতে নতুন সদস্য হিসেবে এসেছে অৰ্পি ও দিহান।
বদলে গেছি আমিও। যেই নীরব একটা দিনও মানসীকে না দেখে থাকতে পারত না সে দিব্যি আছে বছরের পর বছর। যে নিরব মানসীর নিঃশ্বাসের শব্দ, শরীরের ঘ্রাণ না পেলে একটা রাত ঘুমাতে পারতো না সে তো ঠিকই এখন তার ছেলের মাকে জড়িয়ে রাতের পর রাত পার করে দেয়। এই পৃথিবীতে সবই সম্ভব!
১১
মানসীর কথা লিখতে গিয়ে সবসময় খেই হারিয়ে ফেলি। কোথা থেকে শুরু করব, কোথায় গিয়ে শেষ করব কিছুই বুঝতে পারি না। আজও একই অবস্থা। খুব লিখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখব! যাই হোক, আমার জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনাগুলোর মধ্যে একটা ঘটেছে কয়েক মাস আগে।
সেদিন আমি একটা ইমার্জেন্সি অপারেশনের জন্য হসপিটালে আটকে গিয়েছিলাম। দিতিয়া, অনন্যা আর সৌরভ বাচ্চাদের নিয়ে অনন্যার বাবার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। বাসায় মা-বাবা একা ছিল। অগত্যা মাকেই ফোন করে জানালাম বাসায় ফিরতে দেরি হবে, আমি রাতে খেয়ে ফিরব, যাতে মা জেগে না থাকে। অনেক রাতে বাসায় ফিরে নিজের চাবি দিয়ে দরজা খুললাম। দরজার পাশের সোফায় বসে জুতা খুলছি, এমন সময় খেয়াল করলাম আমার ঘরে মৃদু ভলিয়্যুমে বাজছে…
“চোক্ষে আমার তৃষ্ণা..
আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন..
সন্তাপে প্রাণ যায়… যায় যে পুড়ে…
চোক্ষে আমার তৃষ্ণা…”
বুকের ভেতর ছ্যাত করে উঠল। দিতিয়ার তো রবীন্দ্রসংগীত শোনার কথা না, তাছাড়া দিতিয়া তো বাসায়ই নেই। কে বাজাচ্ছে আমার ঘরে এই গান? আগে প্রতি রাতে মানসী ঘুমানোর সময় রবীন্দ্রসংগীত শুনত। এখন তো কেউই শোনে না। তার ওপর এখন কেউ বাসায়ও নেই। রাত বাজে ২টা। এত শীতে মা জেগে থাকলে বকা খাবে তা তো ভালো করেই জানে। তবে? আমার উৎকণ্ঠা বাড়তেই লাগল। যত ঘরের কাছে যাচ্ছি আওয়াজটা স্পষ্ট হচ্ছে। আমার হাত-পা কাঁপছিল। মনে হলো ঘরের দরজা খুললেই আমি দেখতে পাবো মানসীকে। যেমনি দেখতে পেতাম ১৬-১৭ বছর আগে। কিন্তু এখন তা কী করে সম্ভব। দরজাটা খুলতেই জানালা দিয়ে আসা পূর্ণিমার আলোয় যা দেখলাম তাতে আমার মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। তরতর করে ঘামছিলাম আমি। কে শুয়ে আছে আমার বিছানায় কম্বলমুড়ি দিয়ে? কে?
বেশি নার্ভাস লাগছে কারণ মানসী যখন ওদের বাসায় থাকতে শুরু করেছিল তখন একদিন ঠিক এরকমই একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেদিনও আমি হসপিটাল থেকে অনেক রাতে ফিরেছিলাম। ঠিক আজকেরই মতো জুতা খুলতে খুলতে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে পেয়েছিলাম। গান অবশ্য এটা ছিল না। যাই হোক, সেদিনও ঘরে ঢুকে দেখেছিলাম আমার বিছানায় কেউ ঠিক এভাবেই কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়েছিল। সেদিন আমি লাইট জ্বালাতেই মানসী উঠে বসেছিল,
“এই যে তুলতুলের বাবা, সেই কখন এসেছি আমি। আর এই তোমার আসার সময় হলো?”
“একটা পেশেন্টের কন্ডিশন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমরা তো শুধু চাকরি করি না। অনেক দায়দায়িত্ব থাকে। কিন্তু তুই যে আসবি তা তো বলিসনি আগে?”
“আমি তো ডেইলি আসি।”
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
“হুম বাবা, আসিস তো কিন্তু থাকিস তো না। আমি ফেরার আগেই চলে যাস। রাতে তো থাকিস না।”
“সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম তোমাকে, তাই জানাইনি। ধেৎ, রাতের অর্ধেকটাই চলে গেল।”
“কেন, পুরো রাতের প্ল্যান নিয়ে এসেছিলি নাকি? প্রব্লেম নাই, এখনো যে রাত আছে তাতে ওডিআই না হোক টি-টুয়েন্টি খেলা যাবে।”
এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মানসী আমাকে ছেড়ে দূরে গিয়ে বলল, “ছিঃ তুমি যে কী অসভ্য! এমন নোংরা কথা আমাকে আর কক্ষনো বলবে না। ছিঃ…”
“আরে বাপরে! তুই বলেই পাত্তা দিলি না বুঝলি! কেট উইন্সলেট হলে ঠিকই মর্ম বুঝত, এই দামি কথাটার জন্য ইন্সট্যান্ট পুরস্কারও হয়তো দিয়ে ফেলত।”
“উফ তোমার আউলা কথা বন্ধ করো। খুব জরুরি কথা বলতে এসেছি আজকে আমি। খুব বোঝাপড়া হবে আজ তোমার সাথে।”
“কী বোঝাপড়া আবার? এই আমি কিন্তু সুন্দরী মেয়েদের দিকে তাকাই না এখন আর।”
“উফ, তুমি একটু চুপ করবে। আমাকে বলতে দাও। আর প্লিজ ফাজলামো বন্ধ করো।”
আমি এবার সিরিয়াস হলাম,
“আচ্ছা বল।”
“এখন না। আগে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও। আমারও বড্ড খিদে পেয়েছে।”
“আজও আমার জন্য না খেয়ে বসে আছিস? পারিস কী করে তুই?”
“এত কথা বলো কেন তুমি? ফ্রেশ হয়ে এসো প্লিজ।”
“না, এখনই বল কী বলবি। খাওয়া-দাওয়ার পর আমার আর সময় হবে না।”
“কেন?”
“আবার জিজ্ঞেস করছিস কেন? বাচ্চা হয়ে গেছিস নাকি? যা মায়ের পেটের মধ্যে ঢুকে যা।”
মানসী বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,
“ধুর!”
আমি পাত্তা না দিয়ে ওকে আবার কাছে টেনে আনলাম। বললাম, “এতদিন পর আমার সোনাবউটাকে কাছে পেয়েছি। ছেড়ে দেব ভেবেছিস? সারারাত জ্বালিয়ে মারব।”
“শোনো, আমি খুব সিরিয়াস কথা বলতে এসেছি। এসব মিষ্টি কথায় চিড়ে ভিজবে না।”
“না ভিজলে পানি দিয়ে ভেজাব।”
“উফ, প্লিজ একটু সিরিয়াস হবে তুমি? একটা প্রশ্ন ছিল আমার। উত্তর চাই।” আমিও এবার সত্যি সিরিয়স হলাম। আমার বউ লজ্জা না পেয়ে উল্টো ধমকাচ্ছে, তার মানে পুরো ডালই কালা। আমি বললাম,
“ওকে সরি। বল কী বলবি।
“তুমি ভিয়েনার স্কলারশিপটা নিলে না কেন? আর তোমার এত বড় অ্যাচিভমেন্টের কথাটা কাউকে জানাওনি কেন তুমি? আমার কাছে কী করে গোপন করলে?”
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার জোগাড়! এসব কথা ও কী করে জানলো। মানসী আবার জিজ্ঞেস করল,
“কী হলো উত্তর দাও। চুপ করে থাকতে তো পারবে না আজ।”
“কে বলেছে তোকে এসব কথা?”
“কে বলেছে সেটা বড় কথা না। আর পাল্টা প্রশ্ন করার আগে উত্তর দাও তুমি।”
“মা জানে? আই মিন মাকে বলে দিসনি তো?”
“না।”
“সৌরভ জানে?”
“না।”
“হুম সেটা বুঝতেই পারছি। ও জানলে আমার সাথে কথা না বলে তোকে বলত না।”
“হ্যাঁ তা তো হবেই, ভাইকে তো ওরকমই বানিয়েছ।”
“আমি বানাইনি। ও নিজে থেকেই ওরকম। ইটস আ ট্র ব্রাদারশিপ। তুই বুঝবি না। বাই দ্য ওয়ে, তুই না বললে কোনো প্রব্লেম নেই, এটা বুঝতে পারছি আমার বন্ধুদের কেউ বলেছে। আমার সব ফ্রেন্ড জানেও না। সো কে বলেছে তা বের করতে আমার দুদিন লাগবে জাস্ট। ওকে বলে দিস আমার সামনে যেন না আসে। গুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়ব।”
“ছিঃ কী মুখের ভাষা।”
“আমার মাথা গরম হলে অনেক খারাপ কথা আমি বলতে পারি, ইউ নো দ্যাট ভেরি ওয়েল।”
“আচ্ছা ঠিক আছে, এবার বলো তো স্কলারশিপটা ক্যান্সেল করেছ কেন?”
“আমার পক্ষে এখন দেশের বাইরে যাওয়ায় অসুবিধা আছে। ওসব পরেও করা যাবে। যার যোগ্যতা আছে সে যেকোনো সময় স্কলারশিপ পেতে পারে।”
“কেন, এখন বাইরে যাওয়া সম্ভব না কেন?”
“এই কেনর উত্তর আগে দিয়েছি আমি তোকে। এক কথা বারবার বলতে আমার ভালো লাগে না। দয়া করে খেতে দে এখন। খিদেয় মরে যাচ্ছি।”
তখন মানসী আমার ছিল তাই হঠাৎ হঠাৎ আমার ঘরে পেতাম ওকে, ঠিক স্বপ্নের মতো। কিন্তু আজ? এখন তো আর মানসী আসে না আমার কাছে। তবে কে?
লাইট জ্বালালাম। নাহ সেদিনের মতো উঠে বসল না কম্বলমুড়ি দেয়া মানুষটা। খুব আতঙ্ক নিয়ে কম্বল সরাতেই দেখতে পেলাম আমার ছোট বোন মোনালিসা ঘুমিয়ে আছে। ওর মাথায় হাত রাখতেই ওর ঘুম ভেঙে গেল। সাথে সাথে উঠে বসে বলল,
“ওহ, দাদা তুই। এত দেরি হলো যে!”
“হ্যাঁ, মাকে ফোন করে বলেছিলাম তো।”
“মা আমাকে বলেছে, বাট এত রাত হবে বুঝিনি।”
“কখন এলি?”
“সন্ধ্যার পর এসেছি।”
“বাসার সবাই ভালো আছে?”
“হ্যাঁ ভালোই আছে। ওরা সব বেড়াতে গেছে, মা-বাবা একা আছে শুনে এলাম।”
“অফিস কেমন চলছে?”
“চলছে আর কি!”
“তুই খেয়েছিস?”
“সন্ধ্যায় খেয়েছি দাদা। এখন আর খাবো না। দেখো না কেমন মুটিয়ে যাচ্ছি।”
আমি হেসে বললাম,
“এটা কিন্তু ঠিক না। রাতে না খেলে কেউ শুকায় না…”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে মোনা বলল,
“থাক, তুই ডাক্তার আমরা সবাই জানি। এখানেও ডাক্তারি করিস না প্লিজ।”
আমরা দুজনেই হেসে দিলাম। তারপর আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“তুই রবীন্দ্রসংগীতও শুনিস নাকি?”
“না, কিন্তু অ্যালবামগুলো লাইব্রেরিতে পেয়ে শুনতে মন চাইল। হঠাৎ মানসী আপুর কথা মনে পড়ে গেল। ও প্রতিরাতে ঘুমানোর সময় শুনত। ওর সাথে ঘুমাতাম বলে আমারও শোনা হতো।”
আমি কিছু বললাম না। চুপ করে রইলাম। ও জিজ্ঞেস করল,
“তুই এগুলো শুনিস দাদা?”
“নাহ শুনি না, মানসীর স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি।”
“জানিস দাদা, আজ যখন বিছানায় শুয়ে গানগুলো শুনছিলাম মনে হচ্ছিল মানসী আপু আমার পাশেই শুয়ে আছে। যদি ভয় পাই তাহলেই ছোটবেলার মতো করে জড়িয়ে ধরে বলবে, “ভয় কিসের বনু? আমি আছি তো!”
কথাগুলো বলতে বলতেই মোনা কেঁদে ফেলল। আমি বললাম, “মোনা, কী হচ্ছে এসব?”
“জানিস দাদা আজ আমি আরো বেশি করে টের পেলাম তোর কষ্টটা।”
“ধুর পাগলী, কাঁদিস না তো। আমার আবার কিসের কষ্ট? ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারলে আমি পারব না? আর দিতিয়া, ওর মতো বউ থাকলে কি কেউ খারাপ থাকতে পারে?”
“জানি তুই এখনো যতটা আছিস দিতিয়া ভাবির জন্যই আছিস। কিন্তু মানসী আপু তো আমার বোন ছিল। ছোটবেলা থেকে বেড শেয়ার করেছি। শুধু বেড কেন? কত কি শেয়ার করেছি। ওর কথা মনে পড়লে আমি নিজেকে সামলাতে পারি না দাদা।”
“মনে করিস কেন তাহলে? কাঁদিস না আর। কাঁদলেই তো আর ও চলে আসবে না। যে আমাদের কথা ভাবেনি তার কথা আমরা কেন ভাবব?”
.
এই পাতা শেষ হতেই ডায়েরিটা রেখে অর্পি অদ্রির গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “আপ্পি, কেন এমন হলো?”
অদ্রি কোনো কথা বলতে পারল না। ও তো আগে থেকেই কাঁদছিল। কান্না যে বড্ড ছোঁয়াচে।
১২
অর্পি কান্না থামিয়ে বলল,
“আপ্পি চাচ্চু এত ভালোবাসত, সবাই সবকিছু জানত। তাহলে ওরা আলদা হয়ে গেল কেন?”
অদ্রিও চোখ মুছে বলল,
“এই প্রশ্নটা তো প্রথম থেকেই। জানিস অর্পি, চাচ্চুর জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে। চাচ্চুকে আমরা সবসময় চুপচাপ, গম্ভীর দেখে এসেছি। অথচ মানুষটা কি প্রাণোচ্ছল ছিল। আর এখন কোনো প্রাণ নেই।”
অৰ্পি বলল,
“হুম, আর আমার কি মনে হয় জানিস? মানসী আন্টির বাবা-মা চলে এসেছিল না? বোধহয় ওদের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। চাচ্চু তো এই ভয়টাই পাচ্ছিলো, তাই তো স্কলারশিপ নেয়নি।”
“হুম, তাছাড়া ওনার বিয়ে না হলে চাচ্চু বিয়ে করত না। অপেক্ষা করত আমি ১০০% সিওর এ ব্যাপারে।”
“হুম, আচ্ছা আপ্পি তুই নাকি ওনাকে আম্মা বলে ডাকতি!”
“চাচ্চু যখন লিখেছে তখন নিশ্চই ডাকতাম, কিন্তু আমার কিচ্ছু মনে পড়ছে না!”
এ কথা বলেই আনমনা হয়ে গেল অদ্রি।
“স্বাভাবিক। তখন তো তুই ছোট্ট ছিলি।”
অদ্রি কিছু বলল না। আপ্পি আমার আর পড়তে ইচ্ছে করছে না, মনে হচ্ছে কেউ যদি বলে দিত সব। পড়তে তো অনেক টাইম লাগবে, শুনলে অল্প টাইম লাগত।”
“আচ্ছা আমরা কথা বলে সময় নষ্ট না করি। বাকিটা পড়লে হয়তো জানা যাবে সবটাই। চল পড়ি।”
ডায়েরি খুলে ওরা আবার পড়তে শুরু করল…
এক ছুটির দিনে আমি ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখছি এমন সময় মা এসে বলল, “নীরব, তোর সাথে আমার কথা আছে।”
“হ্যাঁ মা, বলো।”
“এখানে না। তুই একটু আমার ঘরে আয়।”
আমি টিভি বন্ধ করে মায়ের পিছু পিছু গেলাম। আমি ঘরে ঢোকার পর মা দরজা বন্ধ করছে দেখে হাসতে হাসতে বললাম, “কী ব্যাপার মা, খুব গোপন কিছু নাকি?”
“হ্যাঁ, আর একটু সিরিয়াস। হাসি ঠাট্টা করিস না। আমি সিরিয়াস হলাম,
“ওকে, বলো।”
“কীভাবে বলব ঠিক বুঝতে পারছি না।”
আমি বেশ অবাক হলাম,
“আরে মা, তুমি বলো না। আমার সাথে কথা বলতে তোমাকে এত ভাবতে হবে? কী হয়েছে বলো? কোনো সমস্যা?”
“একটা কাজ করতে হবে, কিন্তু কোনো প্রশ্ন করতে পারবি না।”
ওকে। তুমি জাস্ট বলো কী করতে হবে আমাকে।
“মানসীর সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দে।”
মায়ের কথাটা আমার নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না। মুখ দিয়ে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে গেল,
“মানে?”
“বলেছিলাম কোনো প্রশ্ন করবি না।”
“হ্যাঁ মা। কিন্তু এ কথা কেন বলছ? তুমি মজা করছ তাই না মা?”
“না মজা করছি না। তুই ওর সাথে সব সম্পর্ক ত্যাগ করবি।”
“কেন?”
“আগেই তো বললাম কোনো প্রশ্ন করবি না।”
আমি কোনো কথা বললাম না আর। ভাবতে লাগলাম কী এমন হলো যে মা এমন কথা বলছে, অদ্ভুত! ছোটবেলা থেকে মানসীর সাথে আমার সম্পর্ক। মা প্রথম থেকেই জানত। কত হেল্প করেছে, আর আজ! মা বলল,
“আমি তোর বিয়ে ঠিক করেছি। মেয়ে দেখা হয়ে গেছে। তোর পছন্দ না হলেও আমার কিছু করার নেই, এই মেয়েকেই তোর বিয়ে করতে হবে।”
“আমি মানসীকে বিয়ে করেছি মা।”
“সেই বিয়ের কথা তো কেউ জানে না।”
“তো? যাকে বিয়ে করেছি তার প্রতি আমার দায়িত্ব আছে না?”
“ওরকম বিয়ে প্রতিদিন ভূরি ভূরি হয়, যা টেকে না। তোরা অপরিণত বয়সে বিয়ে করেছিস তাও গোপনে। ভুল করলে মাসুল তো দিতেই হবে।”
“মা তুমি কী বলছ এসব?”
“যা শুনছিস তাই বলছি। সামনের শুক্রবার আমরা মেয়ের বাড়িতে যাব এঙ্গেজমেন্টের জন্য।”
“আমি মানসীর জীবনটা এভাবে নষ্ট করতে পারি না মা।”
“নষ্ট কেন হবে? ও কি দেখতে খারাপ? না ওর গুণের অভাব? আর ওর বাপের টাকা, ক্ষমতা কোনোটারই অভাব নাই। ওর বাবা অনেক ভালো বিয়ে দিতে পারবে ওর। আমার ভাগ্নি আমি বুঝব। তোকে ভাবতে হবে না।”
“তোমার ভাগ্নি হতে পারে, আমার তো বউ। আমি ভাববো না?”
“আমি অত কিছু জানি না। ডিভোর্সের ব্যবস্থা আমিই করবো। তোরা সাইন করে দিবি।
“মা তোমার কি খালামণি বা খালুর সাথে কোনো ঝামেলা হয়েছে?”
“নাহ।”
“কেন এরকমটা বলছ মা? তুমি জানো না ওকে কতটা ভালোবাসি আমি? সেই কবে থেকে আমাদের সম্পর্ক। সৌরভ-অনন্যার বিয়ের সময় তো তুমি আমাদেরও বিয়ে দিতে চেয়েছিলে।”
“তখন চেয়েছিলাম কিন্তু এখন চাচ্ছি না। এটা আর কখনো সম্ভব না।”
“মা প্লিজ এমন কথা বলো না। এ কাজ আমি করতে পারব না।”
“তাহলে আমাকে মেরে ফেল।”
“মা! কী বলছ এসব?”
মা আর কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
প্রথমে আমি ভেবেছিলাম খালামণি-খালুর সাথে মায়ের সমস্যা হয়েছে কিছু। পরে দেখলাম সেসব কিছুই না। দিব্যি খালামণি আমাদের বাসায় আসছে, মা যাচ্ছে। আসল ব্যাপারটা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মাঝখান দিয়ে আরেক বিপদ হলো মানসীকে নিয়ে। ওর সাথে কোনোভাবে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। টিএনটিতে ফোন দিলে মানসী ধরে না, নিজেও কল দেয় না। হসপিটালেও দেখা করতে আসে না। বাসায় আসাও বন্ধ করে দিয়েছে। এরকমটা আগে কখনো হয়নি। সে এক অদ্ভুত দম বন্ধ করা অনুভূতি।
নীরব ইশতিয়াক
২২ এপ্রিল, ২০১৬
১৩
সেই ঘটনার ২ দিন পর রাতে হসপিটাল থেকে ফেরার পর অনন্যা এল আমার ঘরে,
“দাদা আসব?”
“আয় আয়, কিছু বলবি?”
অনন্যা একবার দরজার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল,
“মানসী তোমার জন্য একটা চিঠি দিয়েছে আমার কাছে।”
“ও বাসায় এসেছিল? নাকি ইউনিভার্সিটিতে?”
“নাহ, কদিন ধরে বাসায় আসছে না, ইউনিভার্সিটিও তো বন্ধ। ফোন করেছিলাম, কেউ ধরল না তাই মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। মা বলল জানে না তাই কোনো খোঁজ না পেয়ে আজ গিয়েছিলাম ওদের বাসায়। তখনই ইন্সট্যান্ট লিখে দিল।”
“ওহ। কোথায় চিঠিটা?”
অনন্যা আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাখা চিঠিটা বের করে দিল আমাকে। তারপর বলল,
“দাদা আমি গেলাম।”
বুঝলাম অনন্যা মাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছে। একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, “ভাগ্যিস তুই ছিলি।”
অনন্যাও আমার মতো একটু হাসার চেষ্টা করল। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলাম। চিঠিটা ছিল এরকম,
“নীরবদা,
কেমন আছ? এমনি ফর্মালিটি করে জিজ্ঞেস করলাম। আমাদের বাসার ফোন লক করা থাকে, ফোন করতে পারি না। খালামণি তোমাদের বাসায় যেতে নিষেধ করেছে। এখন ইউনিভার্সিটি বন্ধ, বাইরে যেতে পারি না। তাই দুপুরে তোমার হসপিটালে যেতে পারি না, একদিন সুযোগ করে সকালে গিয়েছিলাম কিন্তু তোমাকে পাইনি। তুমি কি কাল দুপুরের পর আমাদের বাসায় আসতে পারবে? ওই সময় বাসায় কেউ থাকে না। জানি তোমার তুলতুলের মা হওয়ার সৌভাগ্য আমার আর হবে না। তবু আমি আর একটা বার তোমার সাথে দেখা করতে চাই। যদি আসো বাকি কথা কাল হবে।
—মানসী”
পরদিন দুপুরের পরপর হসপিটাল থেকে ছুটি নিয়ে মানসীদের বাসায় গেলাম। দরজা খুলতেই আমি ওর বিধ্বস্ত মুখটা দেখতে পেলাম। ভেতরে ঢুকতেই ও দরজাটা লাগিয়ে দিল। তারপর আলতো পায়ে হেঁটে আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। ওর খুব লজ্জা ছিল, বিয়ের পরেও নিজ থেকে এসে আমাকে কোনোদিন জড়িয়ে ধরেনি। আজ কিন্তু লজ্জা পায়নি। হারানোর সময়টা বোধহয় এমনই। ইচ্ছে করে শরীরের সবটা শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখি। আমি ওকে আরো শক্ত করে ধরে বললাম,
“আমি তোকে ছাড়তে পারব না।”
আমার এ কথায় ওর যে কী হলো! কোনো শব্দ হলো না কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে ওর চোখের পানিতে আমার শার্ট ভিজে গেল। আজ আর ওকে কাঁদতে নিষেধ করতে পারলাম না। চুপ করে রইলাম। কিছুক্ষণ পর ও ভেজা গলায় বলল,
“কী করবে তাহলে? খালামণি তো তোমাকে বিয়ে দেবে, মেয়ে ঠিক করেছে।”
“বিয়ে ঠিক করলেই তো হলো না। আমি বিবাহিত, আমি কেন বিয়ে করতে যাব আবার?”
“দেখো আমরা তো আগে থেকেই জানি আমার বাবা আমাদের সম্পর্কটা মানবে না তাই খালামণির উপরেই ভরসা করে ছিলাম এতদিন। কিন্তু খালামণিই এখন আমাদের সাথে নেই। এখন আর আমরা কী করব বলো?”
“পালিয়ে যাব।”
মানসী আমাকে ছেড়ে পাশের সোফায় বসল। তারপর বলল,
“নাহ, আমি কখনোই পারব না এ কাজ করতে।”
আমি ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসলাম। বললাম,
“কেন?”
“বাবা-মা খুব কষ্ট পাবে। তাছাড়া খালামণি আমার কাছে এসেছিল। বলেছিল তোমাকে ডিভোর্স দিতে। আমি কারণ জানতে চাইলে সে কিছুই বলল না। যখন বললাম আমি এটা করতে পারব না তখন সে যা করল তাতে লজ্জায় আমি মরে গিয়েছি।”
“কী করেছে?”
“আমাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে হঠাৎ করেই আমার পা জড়িয়ে ধরল।”
“কি বলছিস!”
“হ্যাঁ, আমি তো তাড়াতাড়ি বসে পড়ে খালামণির হাত ধরে ফেললাম। তুমি কল্পনা করতে পারবে না খালামণি কি কান্নাটাই না কাঁদল। কোনো কারণে খালামণি খুব কষ্ট পাচ্ছে না হলে ওইভাবে কাঁদতো না।”
“আমারও মনে হচ্ছে ঘটনা কিছু আছে। কিন্তু কী তা তো বুঝতে পারছি না, মাকে এত করে জিজ্ঞেস করলাম কিছুই বলল না।”
“আরেকটা কথা শুনলে তুমি আরো অবাক হয়ে যাবে।”
“কী?”
“বলে তোমাকে ডিভোর্স দেয়ার বিনিময়ে আমি যা বলব তাই নাকি করবে। ইভেন আমি যদি বলি তাহলে নাকি খালুকে ডিভোর্স দিতে তাতেও উনি রাজি। কিন্তু যে করেই হোক তোমার বিয়েটা দিতেই হবে। আর বারবার বলছিল যা করছে তোমার ভালোর জন্য করছে।”
“মা পাগল হলো নাকি! তারপর তুই মাকে কী বললি?”
“বলেছি খালামণি যা চাইবে তাই হবে।”
“এ কথা কেন বলেছিস?”
ও বলল,
“যে মানুষটার কাছ থেকে ছোটবেলা থেকে মায়ের আদর পেয়েছি, যে মানুষটা নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে, গোসল করিয়েছে, জ্বরে কাতর হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলে সেই ছোট্ট তপ্ত দেহটাকে নিজের ঠাণ্ডা বুকে রেখে যে আমাকে শান্তি দিয়েছে সেই মানুষটাকে ফিরিয়ে দিতে পারিনি আমি। আমি তাকে কথা দিয়েছি তার ছেলেকে তার কাছ থেকে আমি আলাদা করব না।”
“আলাদা করার কথা আসছে কোত্থেকে?”
“আমরা পালিয়ে গেলে তো আলাদাই হবে, তাই না?”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মা এতটা ভেবেছে! মনে মনে ভাবলাম বাবার সাথে কথা বলা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এর মধ্যেই মানসী আবার বলল,
“আমি ভেবেছিলাম তোমার সাথে আর যোগাযোগ করবই না কিংবা খুব খারাপ ব্যবহার করব তারপর আবার ভেবেছি তাতে লাভ কী? তাই সব কথা তোমাকে সরাসরি বললাম।”
“খুব ভালো করেছিস।”
তারপর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। হঠাৎ মানসী বলল,
“খালামণি বলেছে পরশু দিন ডিভোর্স পেপার নিয়ে আসবে।”
“তুই সাইন করবি না।”
“তাহলে আমি কী করব? সব তো শুনলে!”
মানসীর কান্নার বেগ বাড়ল। আমি উঠে ওকে কাছে টেনে নিলাম। ওর মাথাটা আমার বুকে জড়িয়ে বললাম,
“তুই চিন্তা করিস না। আমি তোকে ডিভোর্স দিচ্ছি না। তুই বোকা তাই মা তোকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করতে পেরেছে, আমাকে পারবে না। একটা বিবাহিত ছেলেকে জোর করে বিয়ে দেয়া অত সোজা না, আর বাবার সাথে কথা বলছি আমি। সব ঠিক করে দেব।”
ওর কান্না আরো বেড়ে গেল। এবার বলল, “আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি খুব।”
আমি ওর কপালে চুমু খেয়ে বলেছিলাম,
“জানি তো আমি। পাগলি! কাঁদিস না সব ঠিক করে দেব…আমি আছি তো।”
১৪
আমার ও মানসীর সম্পর্কের কথা বাবা হয়তো কিছুটা জেনেছিল মায়ের কাছ থেকে, কিন্তু আমাদের বিয়ের কথা জানত না। বাবার সাথে আমি খুব একটা ফ্রি ছিলাম না। তবু সাহস করে গেলাম তার কাছে। জানি বাসায় বাবার সাথে এ বিষয়ে কথা বলা যাবে না। মা খুব চোখে চোখে রাখছে। তাই কথা বলার জন্য বাবার অফিসে গেলাম। আমি ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছিলাম। বাবা রুমে ঢুকে আমাকে দেখে চমকে উঠেছিল,
“তুই এখানে? কোনো সমস্যা?”
“হ্যাঁ বাবা, মানে…একটু কথা ছিল যা বাসায় বলা সম্ভব না।”
“এমন কী কথা, বল তো।”
“বাবা আমি বিয়েটা করতে পারব না।
“সেকি! কেন? আর তোর মা যে বলল আমরা কাল মেয়ে দেখতে যাব? আর দেখাদেখিও তো না। তোর মা তো সব ঠিকই করে ফেলেছে, কাল নাকি আংটি পরিয়ে আসবে, আর তোরও তো মত আছে শুনেছি। এখন এই কথা কেন বাবা?”
“আমার মত আছে তোমাকে কে বলল?”
“তোর মা বলেছে। আরে মেয়েটার ছবি যেদিন দেখাল, আমার তো খুব পছন্দ হয়েছে। আমি মত দিয়েছিলাম আর বলেছিলাম ছেলের মত আছে কিনা জেনে নাও। তখন তো তোর মা বলল মেয়েকে নাকি তোর পছন্দ হয়েছে।”
“আমার মুখ থেকে তো শোনোনি!”
“আমার বাসায় যেতে যেতে এত রাত হয়ে যায়, সংসারের কোনো খোঁজই তো রাখতে পারি না কখনো। তোর মায়ের উপরেই তো সব ছেড়ে দিয়ে রেখেছি। আচ্ছা যাই হোক, তোর মত নেই কেন? মেয়ে তো খুবই সুন্দরী, ইংলিশে অনার্স করেছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে, নম্র ভদ্র। অপছন্দ হওয়ার মতো তো কিছু দেখছি না।”
“বাবা আমি মানসীকে ভালোবাসি।”
বাবা খুব অবাক হয়ে বলল,
“আমিও তো তাই জানতাম। কিন্তু তোর মা তো বলল তোদের সম্পর্ক ভেঙে গেছে।”
“সম্পর্ক ভাঙা তো দূরের কথা, ওর সাথে আমার কোনো ঝগড়া কিংবা কথা কাটাকাটিও হয়নি।”
“তাহলে?”
মা আমাকে আর মানসীকে যা যা বলেছে পুরো ব্যাপারটা বাবাকে খুলে বললাম। সব শুনে বাবা বলল,
“কোনো একটা ভুল হচ্ছে, তোর মা তো এরকম না। তোদের সম্পর্কের কথা সে প্রথম থেকেই জানত। তোদের বিয়ে নিয়ে কত প্ল্যান করত। তাছাড়া মানসী তো ওর আদরের ছিল। আমি সব গুলিয়ে ফেলছি।”
আমি বাবাকে বললাম,
“বাবা প্লিজ তুমি কিছু একটা করো। মানসীর সাথে এই অন্যায়টা তুমি হতে দিয়ো না। মেয়েটা বুঝতে শেখার আগে থেকে আমাকে ভালোবাসে। আর আমিও ওকে ছাড়া অন্য কারো সাথে ভালো থাকতে পারব না। এখন তুমি ছাড়া আর কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। একমাত্র তুমিই পারবে মাকে বোঝাতে।”
“আচ্ছা আচ্ছা আমি দেখছি, তুই চিন্তা করিস না।”
পরদিন শুক্রবার আমাদের মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা। সকাল থেকেই টেনশন করছিলাম বাবা কি আদৌ মাকে কিছু বোঝাতে পেরেছে? বিকালবেলা মা এসে বলল,
“তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। আমরা আধা ঘণ্টার মধ্যে বের হব।”
আমি কিছু বলার আগেই মা আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি ঘর থেকে বের হব এমন সময় বাবা এসে ঢুকল। বলল,
“আমি তোর মাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। আমাকে বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করছে। ছিঃ ছিঃ, ওর মতো মানুষকে এরকম করতে দেখে আমি খুব অবাক হয়েছি। আমার মনে হচ্ছে তোর মা কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এত জিজ্ঞেস করলাম কিছু বলছেই না। উল্টো কিসব যা তা বলছে। এত বছর একসাথে থেকে তারপর ওর এই নতুন রূপ আমি নিতে পারছি না।”
“মাকে তো বলতে হবে কী সমস্যা হয়েছে! তাছাড়া আমরা সমস্যা সমাধান করব কীভাবে?”
“জানি না। সারারাত এক ফোঁটা ঘুমায়নি সে, আর কি কান্না! তুই প্লিজ এখন চল। গিয়ে মেয়েটাকে আলাদা নিয়ে কথা বলবি। বলবি তুই রাজি না এ বিয়েতে। শিক্ষিত মেয়ে, বুঝিয়ে বললে অবশ্যই বুঝবে।”
“কিন্তু বাবা…
“রেডি হয়ে আয়। আর ঝামেলা বাড়াস না। তোর মায়ের এখন মাথা ঠিক নেই।”
বাবাই তুলেছিল কথাটা,
“ওদেরকে একটু আলাদা কথা বলতে দেয়া উচিত। একটু বুঝে নিক দুজন দুজনকে।”
মা সাথে সাথে বলে উঠল,
“না না, কী দরকার? দুদিন পর তো বিয়েই। তখন তো দুজন দুজনকে বোঝার জন্য সারাটা জীবন পাবে।”
তখন ওই বাড়ির কেউ একজন বলল,
“সমস্যা কি? বলুক না।”
আমাদের দুজনকে যখন আলাদা ঘরে কথা বলতে দেয়া হলো তখন মেয়েটা মাথা নিচু করে বসে ছিল। আমি বললাম,
“আপনার কি এই বিয়েতে মত আছে?”
মেয়েটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। নরম স্বরে বলল,
“মানে?”
“মানে আমি জানতে চাচ্ছি আপনার সম্মতিতে কি হচ্ছে এই বিয়েটা?”
মেয়েটা বোধহয় আস্তেই কথা বলে। সেভাবেই বলল,
“আমার পরিবার আমার জন্য যা ঠিক করবে আমি তাতেই রাজি।”
আমি একটু থেমে বললাম,
“ভালো, কিন্তু আমার এই বিয়েতে মত নেই।”
মেয়েটা চমকে তাকাল আমার দিকে। আর এই প্রথম মেয়েটার মুখ দেখলাম। সত্যি বলছি এত সুন্দর মেয়ে আমি আগে কখনো দেখিনি। বিধাতা বোধহয় কোনো ছুটির দিনে অফুরন্ত সময় নিয়ে নিজ হাতে ওকে বানিয়েছে। একটা সুন্দর ফুল দেখলে যেমন বলা যায় ফুলটা সুন্দর, একটা সুন্দর পাখি দেখলে যেমন বলা যায় পাখিটা সুন্দর, তেমনভাবেই বলছি সে সুন্দর। কিন্তু তাকে বিয়ে কী করে করব? আমি তো মাদকাসক্ত ছিলাম। আমার মানসী হোক সে কালো, হোক সে সাধারণ! সেই ছিল আমার মাদক!
মেয়েটাকে আমি বললাম,
“আমি আসলে একজনকে ভালোবাসি। একদম ছোটবেলা থেকে আমাদের সম্পর্ক। তাকে ছাড়া আমি অন্য কারো সাথে ভালো থাকতে পারব না। তাই বলছি আমি এ বিয়েটা করতে পারব না।
মেয়েটা আবার মাথা নোয়ালো। বলল,
“কথাটা আমাকে না বলে আপনার বাবা-মাকে বললে বোধহয় ভালো হতো।”
“হুম, বলেছি। কোনো কাজ হয়নি। তাই আপনাকে বলছি। আপনি যদি আমাকে একটু সাহায্য করেন।”
“আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি?”
“বলবেন যে আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি।
“দেখুন, আমার বাবা-মা নেই। চাচা-চাচির কাছেই বড় হয়েছি। ওনারা না থাকলে আমি ভেসে যেতাম। ওনাদের পছন্দের ওপরে আমার আর কিছু বলার সাহস নেই। আর যদি বলিও তারা সেটা শুনবে না। আমার চাচাতো বোনরা আমার ছোট। আমার বিয়ে না হলে ওদের বিয়ে দিতে পারছে না।”
মেয়েটা কিছু বলল না। আমি আকাশ পাতাল অনেক কিছু ভেবে শেষে বললাম,
“তাহলে বলবেন আমি আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি।”
মেয়েটা রীতিমতো চমকে গেল। বলল,
“মানে?”
অসহায় লাগল আমার। কী বোঝাব আমি এই মেয়েকে? তারপর উপায় না দেখে বললাম,
“আমি বিবাহিত।”
“সে কথা চাচা আমাকে জানিয়েছে। এটাও জানিয়েছে যে আপনার এখনো ডিভোর্স হয়নি। কিছুদিনের মধ্যে হয়ে যাবে। এজন্যই তো চাচা আপনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। নয়তো আপনার মতো ছেলের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে ঠিক না করে আমার বিয়ে ঠিক করত না।” মেয়েটার এই কথার পর কিছুই বলার ছিল না আর আমার!
এ পর্যন্ত পড়ে অর্পি জিজ্ঞেস করল,
“আপ্পি চাচ্চু কয়টা বিয়ে করেছে?”
“করেছে একটাই। অন্যটা করেনি, জোর করে করানো হয়েছে।”
“অন্যটা বলছিস কেন? বল অন্যগুলো।”
“উঁহু, আমার তো মনে হচ্ছে এই মেয়েটাই দিতিয়া চাচি।”
“ওম্মা, এটা দিতিয়া চাচি হলে মেয়েটা মেয়েটা লিখতো? দিতিয়া লিখত না?”
“দিতিয়া চাচি কিন্তু ইংলিশে স্টাডি করেছিল, ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে। চাচির বাবা মা ছোটবেলায় মারা গেছে সেটাও মিলে গেছে।”
“তাই তো, আমি তো খেয়ালই করিনি।”
“আর চাচ্চু সৌন্দর্যের কথা কী লিখেছে খেয়াল করিসনি?”
“হ্যাঁ, তাইতো। চাচি এখনো যেই ভয়ানক সুন্দরী, এক ছেলের মা হয়ে গেছে, এখনো কী চেহারা! কী গায়ের রং! কী ফিগার… শাড়ি পড়লে হাঁ করে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে! ১৬ বছর আগে কী ছিল জাস্ট থিংক আপ্পি! চাচ্চুর জায়গায় আমি হলে প্রথম দেখায় বিয়েতে রাজি হয়ে যেতাম। এমন একটা সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করার লোভ সামলানো যায় নাকি?”
“ভাগ্যিস তুই ছেলে হোসনি।”
অর্পি অবাক হয়ে বলল,
“কেন?”
“কারণ তুই ভালোবাসা বুঝিস না, সৌন্দর্য বুঝিস শুধু।”
অর্পি দাঁত কেলিয়ে হাসল। কিন্তু সেকেন্ডেই মধ্যেই হাসিটা মিলিয়ে গেল। বলল,
“আপ্পি, তার মানে বিয়েটা আটকানো যায়নি? তাহলে মানসী আন্টির কী হয়েছিল? আর দাদুই বা কেন এমনটা করেছিল তা কি চাচ্চুরা আর জানতে পারেনি?”
“তোর সমস্যা কী অর্পি জানিস? সবকিছু নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করছিস। যেন সব উত্তর আমার জানা আছে।”
“সরি।”
“কিন্তু অৰ্পি…চাচ্চু, দাদা সবাই সন্দেহ করছিল দাদুর কোনো মানসিক সমস্যা হচ্ছে যার কারণে চাচ্চুকে বাধ্য করছে এই বিয়েটাতে। আর সবাইকে যখন ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করছিল তখন কারণ তো নিশ্চয়ই একটা কিছু ছিল। এখন আমার সেই কারণটা জানার জন্য বড্ড অস্থির লাগছে। কী এমন হতে পারে!”
“আমার তো মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে নারে আপ্পি।”
“আচ্ছা বাদ দে, এসব কথা বলে সময় নষ্ট করছি, সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগেই আমাদের এই রুম থেকে বের হতে হবে। আরো লেখা আছে চল পড়ি।”