অভিমানিনী – ১

বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হতে চলল। ভয়ংকরভাবে ঝড়ো হাওয়া বইছে। জানালার কপাটগুলো বারি খাচ্ছে বারবার। এবছর বৈশাখ আসার আগেই কালবৈশাখী শুরু হয়ে গিয়েছে। অনন্যা চিৎকার করে বলল,

“অদ্রি, অর্পি দৌড় দিয়ে সব ঘরের জানালাগুলো বন্ধ কর।”

“যাচ্ছি মা।”

তারপর অনন্যা ছাদে চলে গেল কাপড় আনতে। অদ্রি দাদা-দাদুর ঘরে আর অর্পি লাইব্রেরি ঘরে জানালা বন্ধ করতে গেল। এই লাইব্রেরিটা বানিয়েছে বড় চাচ্চু। সব ধরনের বই আছে এখানে। তিন দিকের দেয়ালে তিনটি বইয়ের আলমারি, আর একটি দেয়ালে ঘরে ঢোকার দরজা আর একটি বড় টেবিল আর দুটি চেয়ার। অর্পি ছাড়া আর কারোরই বই পড়ার নেশা নেই, অদ্রি মাঝে মাঝে পড়ে কিন্তু নেশা নয়। তবে এই ঘরে অর্পির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো তালা দেয়া আলমারিটি। এখানকার ঐ একটি আলমারিই তালা দেয়া। ১৮ বছর হওয়ার আগে অর্পি ঐ বইগুলো পড়ার অনুমতি পাবে না।

লাইব্রেরিতে ঢুকতে গিয়েই দেখল বড় চাচ্চু টেবিলে বসে কিছু লিখছে। চাচ্চু একটু অন্য ধাঁচের মানুষ। বয়স ৪১/৪২-এর মতো হবে। কম কথা বলে, গম্ভীর আর প্রচণ্ড রাগী। নামটাও তেমন, নীরব! কেন যেন সবাই একটু ভয় পায় তাকে। দাদুর মুখে শুনেছে বড় চাচ্চু যেমন চুপচাপ তেমনি রাগলে নাকি মারাত্মক। কিন্তু ব্যাপারটা আজও বোঝাই হয়নি, কারণ ওরা কখনো সেরকম কিছু দেখেনি। চাচ্চু খুব বড় ডাক্তার, বাসায় থাকেই না বলতে গেলে। সকালে বেরিয়ে যায় আর রাতে ফেরে। তো বাসায় থাকলে না রাগারাগি করবে আর ওরা দেখবে।

আজ ছুটির দিন তাই চাচ্চু বাসায়, মাঝে মাঝে অবশ্য ছুটির দিনেও থাকে না। অর্পির বাবা সৌরভও ডাক্তার, তবে এমন রসকষহীন না, বাবা খুব মজার। ভাগ্যিস চাচ্চু ওর বাবা না। তাহলে যে কী হতো! আহারে দিহানটা ওর বাবাকে একটুও কাছে পায় না। অর্পিকে দেখেই চাচ্চু বলল,

“অৰ্পি কিছু বলবে?”

“না মানে চাচ্চু…আসলে আম্মু পাঠিয়েছে জানালা বন্ধ করার জন্য।”

“তাহলে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ভেতরে এসো।”

ভেতরে ঢুকে অর্পি জিজ্ঞেস করল,

“চাচ্চু, জানালাগুলো বন্ধ করব?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, বন্ধ করে দাও।”

জানালা বন্ধ করতে লাগল অর্পি। দিহান ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,

“বাবা, দাদা তোমাকে ডাকছে।”

“কেন?”

“ঠিক জানি না।”

“আচ্ছা চলো, যাচ্ছি।”

নীরব আর দিহান বেরিয়ে গেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল অর্পি। ও প্রতিবারই ভাবে, ধুর এত ভয় পাওয়ার কী আছে? চাচ্চু মোটেই ভয়ংকর না, তবু কেন যেন সামনে এলেই ভয় লাগে। জানালা বন্ধ করে ফেরার সময় টেবিলে একটা ডায়েরির ওপর চোখ পড়ল অর্পির। বাহ ডায়েরিটা কী সুন্দর! নীল রঙের মলাট! নীল খুব প্রিয় অর্পির। কাছে গিয়ে দেখল ডায়েরিতে বাবার হসপিটালের লোগো! তার মানে এটা ওর বাবার হসপিটালের ডায়েরি! এত সুন্দর ডায়েরিটা বাবা ওকে দেয়নি কেন? ভেতরটা দেখার জন্য ডায়েরিটা খুললো অর্পি। এরপর উদ্দেশ্যহীনভাবেই প্রথম পাতার লেখাটায় চোখ চলে গেল…

.

ছোটবেলা থেকে এক ছাদের নিচে থাকতে থাকতে কবে থেকে যে দুজন দুজনকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম তা বলতে পারব না। প্রথমে কেউই ভালোবাসি কথাটি বলিনি কিন্তু তবু এই না বলা কথাটি আমরা দুজনেই হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম।

কী দিন ছিল! সবসময় একজন আরেকজনের পেছনে লেগে থাকতাম। মারামারি করতাম, দুষ্টুমি করতাম, আরো কত কী! তবে ভালোবাসতাম প্রচণ্ড, দুজনেই। ওর গায়ের রঙ কালো ছিল, সেজন্য খুব দুঃখও ছিল তার। কিন্তু ওর মুখে ছিল একটা অদ্ভুত মায়া। সেই মায়া মায়া চেহারাটাই আমাকে শেষ করে চলে গেছে।

আচ্ছা ও কি ভালো আছে আমাকে ছাড়া? ও কি ভুলতে পেরেছে আমাকে? সত্যিই কি আমার কোনো খোঁজখবর কি রাখে না ও? কই আমি তো এত বছরেও ভুলতে পারিনি। ওর স্মৃতিগুলো আমাকে এখনো পোড়ায়। টুকরো টুকরো এই স্মৃতিগুলো তো কোনো শাসন মানে না। মানে না কোনো নিয়ম

নীরব ইশতিয়াক
৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

দাদা-দাদুর ঘরের জানালা বন্ধ করে অদ্রি নিজেদের ঘরের জানালা বন্ধ করল। তারপর বাবা-মার ঘরে গিয়ে দেখল সেখানকার জানালাগুলোও খোলা, বন্ধ করতে করতে ভাবলো, অর্পি সেই যে লাইব্রেরিতে জানালা লাগাতে গেল, ও কি এখনো ওখানে এতক্ষণ ধরে? তারপর চাচ্চুর ঘরের জানালা বন্ধ করে দিহানের রুমের জানালা বন্ধ করল। তারপর রান্নাঘরের জানাল বন্ধ করতে গেল। দিতিয়া চাচি কী যেন রান্না করছে। ওকে দেখেই হেসে বলল,

“রান্নাঘরের জানালা আমি বন্ধ করে দিয়েছি।”

“ও, তুমি কী বানাচ্ছ চাচি?”

“উমম, আজকে আমি তোর পছন্দের নাস্তা বানাচ্ছি।”

“কী?”

আগ্রহ নিয়ে বলল অদ্রি। দিতিয়া বলল,

“নাগেট।”

“ওহ গ্রেট! হতে কতক্ষণ লাগবে?”

“এই তো হয়ে যাবে। আর একটু অপেক্ষা কর?”

“আচ্ছা।”

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে অর্পির খোঁজে লাইব্রেরিতে ঢুকল অদ্রি। দেখল অর্পি একটা ডায়েরি হাতে নিয়ে পড়ছিল, কেউ আসছে ভেবে লুকিয়ে ফেলেছিল। ওকে দেখেই আবার বের করল। বলল,

“আপ্পি তুই? আমি আরো ভাবলাম কে না কে!”

“ভয় পেয়ে লুকিয়ে ফেলেছিলি কেন? এটা কার ডায়েরি? কী লেখা?”

অর্পি ফিসফিসিয়ে বলল,

“আপ্পি, এটা বড় চাচ্চুর ডায়েরি।”

আঁৎকে উঠল অদ্রি,

“তোর তো সাহস কম না, বড় চাচ্চুর জিনিস ধরেছিস!”

“এটা শুধু জিনিস না, গোপন জিনিস।”

দুষ্ট হাসি দিল অৰ্পি। অদ্রি বলল,

“গোপন জিনিস মানে?”

“চাচ্চুর লাভ স্টোরি।”

“কী বলছিস?”

“ঠিক বলছি।”

“লাভ স্টোরি হলে তো লুকিয়ে রাখত। কোথায় পেয়েছিস এটা?”

“একটু আগে চাচ্চু এখানে ছিল না? তখন বোধহয় লিখছিল, কিংবা আগের লেখা পড়ছিল। দাদা ডাকতেই টেবিলের ওপর রেখে চলে গেছে।”

“তার মানে আবার আসবে, এক্ষুনি রেখে দে বলছি।”

“না আপ্পি, প্লিজ। বাকিটা না পড়লে আমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে। কী ইন্টারেস্টিং স্টোরি না পড়লে বুঝবি না। আর চাচ্চু কী সুন্দর করে যে লিখেছে!”

“এক থাপ্পড় দিয়ে তোর দাঁতগুলো সব ফেলে দেব, অসভ্য মেয়ে কোথাকার! লুকিয়ে লুকিয়ে বড়দের ডায়েরি পড়া হচ্ছে?”

“উফ তুই না বড্ড ভিতু রে আপ্পি। তোকে না জানিয়ে লুকিয়ে পড়া উচিত ছিল।”

“তাই তো করছিলি।”

“নারে আপ্পি, পরে তো তোকে বলতামই। তোকে কিছু না বলে কি আমি থাকতে পারি? পেট ফেটে মারা যাব না?”

এমন সময় দিতিয়ার গলা পাওয়া গেল,

“অদ্রি, অৰ্পি, দিহান নাস্তা রেডি। তোরা কোথায়?”

অর্পি সাথে সাথে ডায়েরিটা যেভাবে রাখা ছিল সেভাবে রেখে বলল,

“আচ্ছা চল আপ্পি।”

.

সন্ধ্যার পর অর্পি পড়তে বসেছে, ও ক্লাস টেনে পড়ে। আর অদ্রি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। অদ্রির পড়া না থাকলেও অর্পির পাশে বসে থাকতে হয় তা না হলে ও পড়ে না। তাই একটা গল্পের বই নিয়ে বসেছে অদ্রি। অৰ্পি পড়তে পড়তেই হঠাৎ বলে উঠল,

“আপ্পি, চাচ্চু মেয়েটাকে অনেক ভালোবাসত।”

“তুই ভালোবাসার কী বুঝিস?”

“না বোঝার কী আছে? আমার এখন ১৫ বছর। আমার ক্লাসের সব মেয়েরা প্রেম করে, তুই জানিস?”

“প্রেম আরো ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও করে যারা ভালোবাসা বোঝে না।”

করতে পারে, কিন্তু আমি বুঝি।”

“ঘোড়ার ডিম বুঝিস তুই, বউ আছে বাচ্চা আছে সে নাকি অন্য কাউকে ভালোবাসবে, তাও আবার সে কে? সে বড় চাচ্চু।”

“হ্যাঁ আমি মানছি বড় চাচ্চু একটু অন্যরকম। কিন্তু তাই বলে তার মনে প্রেম থাকতে পারবে না তা তো নয়।”

“হয়তো দিতিয়া চাচির কথাই লিখেছে।”

“না আপ্পি, চাচির কথা না। কারণ যার কথা লিখেছে সে কালো, চাচি তো ফরসা। এত ফরসা যে লাল দেখায়। তাছাড়া যার কথা লিখেছে সে চাচ্চুকে ছেড়ে চলে গেছে।”

“এসব লিখেছে?”

“হ্যাঁ।”

“আর সেটা পড়ার জন্য তুই মরে যাচ্ছিস?”

“আপ্পি তুই পড়লে বুঝবি। আর সবচেয়ে বেশি পড়তে ইচ্ছে করছে মেয়েটা কে ছিল তা জানার জন্য। কারণ ঐ মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই এই বাসায় থাকত।”

“কী বলছিস? এই বাসায় এমন কে ছিল?”

“জানি না, আচ্ছা আপ্পি আমরা যদি দাদুকে জিজ্ঞেস করি?”

“নাহ, খবরদার। এই ভুল করা যাবে না। মা জানতে পারলে মেরে ফেলবে।”

“কিন্তু আপ্পি আমি মাত্র এক পাতা পড়ছি, পুরোটা না পড়লে তো শান্তি নেই। পুরোটা কোথায় পাব? চাচ্চু ওটা কোথায় রাখবে তা তো জানি না। আর মেয়েটা কে ছিল জানতে না পাড়লে আমার পেটের মধ্যে গুড়গুড় করবে।”

“আচ্ছা কী করা যায় আমি চিন্তা করে দেখছি। তুই ততক্ষণে হোমওয়ার্কগুলো করে ফেল, নাহলে কাল স্কুলে মার খাবি।”

“আচ্ছা করছি, কিন্তু…”

“আর কোনো কথা না, এখন হোমওয়ার্ক কর।”

অর্পি আবার হোমওয়ার্ক করতে শুরু করল, কিন্তু মন পড়ে রইল নীল মলাটের ডায়েরিটায়।

রাত বাজে ১টা। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। অদ্রি আর অর্পি চোরের মতো গিয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকলো। তারপর তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেলল সারা ঘর। নাহ, কোথাও নেই ডায়েরিটা। টেবিলে তিনটা ড্রয়ার রয়েছে। নিচেরটা খোলা। আর উপরের দুটো তালা দেয়া। অদ্রি বলল,

“আমার মনে হয় এই দুটো ড্রয়ারের কোনো একটাতে আছে ডায়েরিটা।”

“চাচ্চু যদি ডায়েরিটা নিজের রুমে নিয়ে যায়?”

“তা নেবে না, কারণ ওখানে চাচি দেখে ফেলার একটা চান্স থাকে। যেহেতু এখানে চাচি বা অন্য কেউই আসে না তাই এখানেই থাকার সম্ভাবনা বেশি।”

“তা ঠিক, আর তাছাড়া চাচ্চুকে যখনই কিছু লিখতে দেখেছি, এখানেই দেখেছি।”

“হুম। তুই বরং ওই ডায়েরির কথা ভুলে যা। সারা ঘর তো খুঁজলাম।”

“না আপ্পি, প্লিজ এমন কথা বলিস না।”

“তো কী করব আমি?”

“আচ্ছা, তুই না ক্লিপ দিয়ে লক খুলতে পারিস?”

“গাধা এগুলো কি ওই লক? এগুলো ওভাবে খোলা যায় না।”

“তাও একটু ট্রাই কর না, প্লিজ প্লিজ প্লিজ…”

“আচ্ছা যা একটা ক্লিপ নিয়ে আয়। একবার চেষ্টা করি।”

সঙ্গে সঙ্গে এক দৌড়ে একটা ক্লিপ নিয়ে এল অর্পি। অদ্রি খুব মনোযোগ দিয়ে চেষ্টা করল, কিন্তু খুলতে না পেরে হাল ছেড়ে দিল।

তারপর বলল,

“বললাম না এই লক ক্লিপ দিয়ে খোলা যায় না।”

অর্পি মন খারাপ করে বলল,

“তাহলে?”

“তাহলে কী? কিচ্ছু না, ঘুমাতে চল।”

“আচ্ছা শোন না আপ্পি, নিচের ড্রয়ারটা একবার খোল, ডায়েরিটা তো ওখানেও থাকতে পারে।”

“তোর মনে হয় চাচ্চু ডায়েরিটা এভাবে সামনে রেখে দেবে?”

“আহা রাখতেও তো পারে। পুরোনো প্রেম, সবারই থাকে, এত লুকিয়ে রাখার মতো কিছু তো না। তাছাড়া এ ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ কি আসে? আর আসলেও তো বই নিয়ে চলে যাই, চাচ্চুর কোনো কিছুতে হাত দিই না। যেরকম জিনিস সেরকমই থাকে, তো খোলা ড্রয়ারে রাখতেও পারে।”

.

অদ্রি নিচের ড্রয়ারটা খুলল এবং যথারীতি হতাশ হলো। টর্চ লাইট, ব্যাটারি, মোম, লাইটার, কলম, পেন্সিল, স্কেল, কেঁচি, ছুরি এই টাইপ টুকিটাকি জিনিস। কয়েকটা চাবিও চোখে পড়ল। উজ্জল হয়ে উঠল অর্পির মুখ,

“আপ্পি এই চাবিগুলোর মধ্যে ড্রয়ারের চাবি নেই তো?”

“কী জানি! দাঁড়া দেখি খোলে কিনা।”

কয়েকটা চাবি দিয়ে চেষ্টা করার পর মাঝখানের ড্রয়ারটা খুলে গেল। বিজয়ের হাসি ফুটল দুজনের মুখে। কিন্তু ড্রয়ারে পাওয়া গেল রবীন্দ্রনাথের একগাদা গানের সিডি। তারপর উপরের ড্রয়ারটা খোলার চেষ্টা চলতে থাকল। একসময় খুলেও গেল এবং পাওয়া গেল ওদের কাঙ্ক্ষিত ডায়েরিটা। সাথে পাওয়া গেল আরো একটি ডায়েরি ও মোটা কাগজের একটি বক্স। সঙ্গে সঙ্গে নীল মলাটের ডায়েরিটা লুফে নিল অর্পি। অদ্রি অন্য ডায়েরিটা খুললো। ডায়েরিটা বড্ড পুরোনো। ১৯৯৬ সালের ডায়েরি। তবে তাতে যত্নের ছাপ স্পষ্ট। খুলেই বলল,

“অৰ্পি দেখ…”

অর্পি তাকালো। ডায়েরিতে একটা ছবি লাগানো। গায়ের রঙ কালো তবে খুব মিষ্টি একটা মেয়ে, বয়স অর্পির সমান বা তারও ছোট হতে পারে। ছবিটা পেছন থেকে তোলা। মনে হচ্ছে মাত্রই কেউ ওকে পেছন থেকে ডাকল, আর কে ডেকেছে সেটা দেখার জন্যই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়েছে। দৃষ্টিটা এতটাই মোহময় যে বুকের ভেতর কেমন একটা করে ওঠে। ছবিটার নিচে লেখা…

“সেদিন চৈত্র মাস ছিল কিনা জানি না, তবে তোর এই দৃষ্টিতেই আমার সর্বনাশের শুরু।”

নীরব ইশতিয়াক
১৩ জুন, ১৯৯৬

ছবির নিচে তারিখ দেখে অদ্রি অর্পি একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। ২০ বছর আগের তারিখ! আবার পৃষ্ঠা উলটাতেই ওই মেয়েটারই আরেকটা ছবি দেখতে পেল। স্কুল ড্রেস পরা, দুই বেণি ধরে মাথাটা বাঁকা করে হাসছে। নিচে একটা শব্দ লেখা…. “মিষ্টি”।

আবার পৃষ্ঠা উল্টালো অর্পি। এর পরের ছবিটায় চাচ্চুকে চিনতে কষ্ট হলো না ওদের। চাচ্চু মেয়েটাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটছে। চাচ্চুর মুখ গোমড়া আর মেয়েটা হাসছে। ছবির নিচে লেখা…

“কথা ছিল বাজিতে হারলে তোকে কাঁধে নিয়ে যেতে হবে বাকিটা পথ। তাই করছিলাম আর সেই সুযোগে সৌরভ ছবিটা তুলে ফেলল। কী বকাটাই না দিয়েছিলাম এই ছবিটা তোলার জন্য। কিন্তু তুই জানিস না আড়ালে গিয়ে এই ছবিটা তোলার জন্য আমি ওকে দুই প্যাকেট সিগারেট ঘুষ দিয়েছিলাম।”

অর্পি অবাক হয়ে বলল,

“এই ছবিটা বাবা তুলেছে!”

“হুম, তার মানে বাবা সবই জানত।”

“মেয়েটা এই বাসাতেই থাকত বলেছিলাম না তোকে?”

এরকম অসংখ্য ছবি ডায়েরিটায় পাওয়া গেল। কোনোটা সিংগেল, কোনোটা চাচ্চুর সাথে। পরের ছবিগুলোতে মেয়েটাকে একটু বড় মনে হচ্ছিল। অবশ্য প্রত্যেকটা ছবিতেই তারিখ দেওয়া আছে। তা থেকেও বোঝা যাচ্ছে পরের ছবিগুলো যথাক্রমে ১৯, ১৮ ও ১৭ বছর আগের।

একটা ছবিতে দেখা গেল মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে, বুকের ওপর একটা বাচ্চা, দুহাত দিয়ে ধরে রেখেছে। বাচ্চাটাও ঘুমিয়ে আছে। ছবিটা দেখেই চমকে উঠল অৰ্পি।

“আপ্পি তুই।”

অদ্রি অন্য পাতার ছবিটা দেখছিল। অর্পির কথা শুনে বলল,

“আমি মানে?”

“দেখ ভালো করে, কোলের এই বাচ্চাটা তুই। তোর ছোটবেলার ছবির সাথে পুরো মিলে যাচ্ছে।”

অদ্রি অবাক হয়ে বলল,

“তাই তো, এটা তো আমি।”

ছবির নিচে লেখা…

“মনে হচ্ছে অদ্রি তোরই মেয়ে। ও আসার পর থেকে আমার ভালোবাসা ভাগ হয়ে যাচ্ছে। যাই হোক, তোর এই মা মা রূপটাও বড্ড ভালো লাগে।”

অদ্রি বলল,

“কিন্তু আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। এরকম কেউ আছে তাই তো জানি না। কখনো শুনিনি।”

“হুম, আমাদের বাসায় থাকত, তোকে এত আদর করত অথচ তার কথা আমরা শুনিনি, জানি না। একটা ছবি আমাদের ফ্যামিলি ফটো অ্যালবামে নেই ব্যাপারটা একটু কেমন না? আপ্পি আই থিংক ডায়েরিটা পড়লে অনেক কিছু জানা যাবে।”

“ড্রয়ারে একটা বক্সও আছে। ওটাতে কী আছে দেখি।”

“হ্যাঁ বের কর।”

বক্সে একটা সাদা রঙের টিস্যুপেপার ছাড়া আর কিছু নেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে টিস্যুতে কিছু মোড়ানো রয়েছে। অদ্রি টিস্যুটা খুলল। টিস্যুতে একটা নাকফুল পেল। দুজনই প্রচণ্ড অবাক হলো কারণ হুবহু একই ডিজাইনের একটা নাকফুল ওদের দিতিয়া চাচির আছে!

ডায়েরির প্রথম পাতাটা অর্পি সন্ধ্যায় পড়েছে। কিন্তু অদ্রি পড়েনি, তাই ওর পড়া হতেই দ্বিতীয় পাতা পড়া শুরু করল দুজন। অল্প কিছু কথা লেখা…

আজ শুক্রবার, মানসীর সাথে কাটানোর দিন। ওর কথা ভেবে ভেবে কাটানোর দিন। ওর সাথে কাটানো দিনগুলো রিভাইস করতে খুব ভালো লাগে। ইচ্ছে করে ওর হাতের কোমল ছোঁয়ার ঘুম ভেঙে উঠেও ঘুমের ভান করে থাকতে। এটা খুব করতাম আমি। মানসী এসে ডাকত,

“নীরবদা, ও নীরবদা ওঠো।”

আর আমি ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতাম। ও আবার ডাকত,

“এই তুমি কি সারাদিন ঘুমিয়েই থাকবে?”

আমি সুযোগ বুঝে ওর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বুকের মধ্যে নিয়ে

বলতাম,

“হ্যাঁ সারাদিন ঘুমাব, সাথে তুইও থাকবি।”

“ইশ, শখ কত! ডাকাত কোথাকার।”

একথা বলেই ও পালাত। এখন সেইসব দিনগুলো হারিয়ে গেছে। আগের মতো ঘুম আর নেই। একা একাই ঘুম ভেঙে যায়।

নীরব ইশতিয়াক
১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

পৃষ্ঠা উল্টালো অদ্রি, অর্পি। আবার পড়তে শুরু করল…

একদিন সকালে মানসী চা বানাচ্ছিল। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে পেছন থেকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওকে দেখছিলাম আমি। চারপাশে চোখ বুলিয়ে কাউকে না দেখে ঢুকে পড়লাম রান্নাঘরে, চোরের মতো গিয়ে ওর কোমরটা জড়িয়ে ধরলাম। চমকে লাফিয়ে উঠল ও, হাত থেকে পরে একটা কাপ ভেঙে গেল। শব্দ শুনে মা ছুটে এল,

“কী হয়েছে? কী ভাঙলো?”

আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,

“মা, ও কাপটা আমার হাতে দিচ্ছিলো, আর আমি টাইমলি নিতে পারিনি, হাত ফসকে পড়ে গেল।”

মা বলল,

“তুই এখানে কী করছিস?”

“আমি চা নিতে এসেছি।”

“চা বানানো হয়ে গেলে তো দেয়াই হবে, রান্নাঘরে আসার দরকার কী? আরেকটু হলেই তো মেয়েটার পায়ে পড়ত। যদি পুড়ে যেত?”

“ওর দেরি হচ্ছিল তো।”

মা বলল,

“তোর মতলব আমার জানা আছে, যা এখান থেকে।”

মায়ের ঝাড়ি খেয়ে সুরসুর করে চলে এলাম। মা কিন্তু আমাদের সম্পর্কের কথা জানত, সমর্থনও করত বটে তবে ওই মুহূর্তে একটু ইগোতে লেগেছিল আমার। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল মানসীর ওপর। মানসী অসংখ্যবার আমাকে বলেছে ও শুধু আমার, তাই যদি হয় তাহলে ছুঁলেই ওরকম লাফিয়ে উঠবে কেন? আমি যখনই ওকে একটু কাছে টেনে আদর করতে চাই তখনই ও দূরে সরে যায়। তাহলে কি ও আমাকে বিশ্বাস করে না?

বিশ্বাসঘাতকদের আবার বিশ্বাস অবিশ্বাস! যে বিশ্বাসঘাতকতা ও আমার সাথে করেছে তার তো কোনো তুলনাই হয় না। তবুও যে কেন ভুলতে পারি না! শত চেষ্টা করলেও পারি না। কিন্তু মানুষ তো চেষ্টা করলে সব পারে। আমি কি তবে মানুষ নই? অমানুষ আমি?

নীরব ইশতিয়াক
১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

আজ খুব বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি আমার কোনো কালেই পছন্দ ছিল না। এর প্রধান কাজ হচ্ছে রাস্তাঘাট ভিজিয়ে কাদায় মাখামাখি করে দেয়া। সঙ্গে আবেগী মানুষজনের মন ভেজাতেও এদের জুড়ি নেই। এইসব আবেগী মানুষদের মধ্যে অন্যতম ছিল মানসী। বৃষ্টি নামলেই পাগল হয়ে যেত ভেজার জন্য, শুধু যে নিজে ভিজবে তাই নয়, সঙ্গে ওর আশেপাশের সবাইকে ভেজাবে। তার অন্যতম শিকার ছিলাম আমি। আর আমার কখনোই ভিজতে ইচ্ছে করত না, কিন্তু শুধু ওকে খুশি করার জন্যই।ভজতে হতো। দিনের বেলায় বাইরে থাকার কারণে অনেক সময় বেঁচে যেতাম। কিন্তু রাতে বৃষ্টি হলে আর রেহাই নেই, ভিজতেই হতো। তখন অবশ্য আপত্তি করতাম না, কারন তখন শুধু আমি আর ও। ওকে কাছে পাওয়ার একটা লোভ তো সবসময়ই কাজ করত।

এমনই একটা বৃষ্টির দিনে মানসী, সৌরভ, অনন্যা, মোনালিসা আর আমি ঝুম বৃষ্টিতে ভিজছিলাম। মোনালিসা আমার একমাত্র ছোট বোন, আমার আর সৌরভের কলিজার টুকরা। অনেক ছোটো, তবু আমাদের সবকিছুতেই ওকে রাখতে হতো। না হলেই গাল ফুলাতো।

তখন অনন্যা প্রেগন্যান্ট ছিল। তাই ভিজতে ভিজতে বেশ অনেকক্ষণ পর হঠাৎ মানসী অনন্যাকে বলল,

“অনু, তুই আর ভিজিস না। ঠাণ্ডা লেগে যাবে। এ সময় অনেক সাবধানে থাকতে হয়।”

আমি সুযোগ পেয়ে মানসীকে ক্ষ্যাপানোর জন্য বললাম,

“অনন্যা, ওর কথা শুনছিস না কেন? দশটা বাচ্চার মা হয়েছে, ওর কত অভিজ্ঞতা!”

সবাই হাসতে লাগল, আর মানসী তেড়ে আসলো আমাকে মারার জন্য। আমি কিন্তু দাঁড়িয়ে থেকে ওর মার খাচ্ছিলাম। কারণ যতক্ষণ ও আমাকে মারবে ততক্ষণ আমি ওর স্পর্শ পাব। আমি ওর একটু ছোঁয়া পেলেই মরিয়া হয়ে উঠতাম আরেকটু পাওয়ার জন্য। যেন একটু স্ফুলিঙ্গ থেকে আমার সারা শরীরে দাউদাউ করে জ্বলে উঠত আগুন। আর আজ সেই জ্বলন্ত নীরব কত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এখন যদি একবার মানসী এসে আমাকে দেখে যেত কত অবাকই না হতো! ওর কি আমাকে একটু দেখতেও ইচ্ছে করে না?

নীরব ইশতিয়াক
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

পৃষ্ঠা উল্টাতে গেল অদ্রি। অৰ্পি বলল,

“আচ্ছা আপ্পি, মেয়েটা কে ছিল সেটা তো কোথাও লেখা নেই কিন্তু আমার অস্থির লাগছে জানার জন্য।”

“আমারও লাগছে, কিন্তু লেখা যখন নেই তখন তো আর কিচ্ছু করার নেই, তাই না?”

“না, আমাকে জানতেই হবে।”

“আচ্ছা, পড়ে দেখি সামনে তো থাকতেও পারে। তবে হ্যাঁ সে যেই হোক আম্মুর সাথে একটা ভালো সম্পর্ক ছিল।”

“তুই কী করে বুঝলি? বৃষ্টিতে ভিজতে না করছিল বলে?”

“নাহ, আম্মুকে অনু বলে ডাকছিল। আম্মুকে কিন্তু কেউ অনু বলে ডাকে না, সবাই অনন্যা বলেই ডাকে। তাই যেহেতু অনু বলছে আদর করেই বলছে এবং এরকম একটা সম্পর্কই ছিল আম্মুর সাথে, আর বয়স হিসেব করে দেখ একই বয়সী হবে। কারণ প্রেগন্যান্ট মানে আমি পেটে ছিলাম, তখন তো আম্মুর বয়স অনেক কম ছিল। আর আমাকে কোলে নিয়ে ওনার যে ছবিটা ওটাতে ওনার বয়স ওরকমই ছিল।”

“হুম, তুই ঠিক বলেছিস।”

“কালো হলেও দেখতে খুব মিষ্টি, তাই না?”

“হুম, তবে দিতিয়া চাচির মতো সুন্দর না।”

“দুজন দুরকম সুন্দর।”

“না চাচি বেশি সুন্দর। তবে নামটা সুন্দর… মানসী।”

“হুম।”

“তবে আপ্পি, চাচ্চুর ওপর খুব রাগ হচ্ছে আমার।”

“কেন?”

“এতই যদি ভালোবাসে ওই মেয়েটাকে তাহলে দিতিয়া চাচিকে বিয়ে করেছে কেন? চাচিকে ঠকানো হলো না?”

“এমন তো হতে পারে চাচি সব জানে।”

“না হতে পারে না।”

“এত জোর দিয়ে বলছিস কিভাবে?”

“জানি না, আমার মনে হচ্ছে।”

“দেখ, প্রথম কথা হচ্ছে, মেয়েটা চাচ্চুকে ছেড়ে চলে গেছে। যেহেতু ব্রেকাপ হয়ে গেছে সেহেতু তার কথা ভেবে সারা জীবন একা কাটানো যায় না, বিয়ে করতেই হয়। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, চাচি আমাদের অনেক আদর করে তাই কাহিনী চাচির বিপক্ষে যাচ্ছে বলে আমাদের গায়ে লাগছে। কিন্তু এসব পড়তে গিয়ে পারসোনাল সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে নেই। লেখক যেভাবে লেখে সেভাবেই ভাবতে হয়।”

“হইসে জ্ঞান দিস না। পরের পৃষ্ঠায় যা।”

অদ্রি পৃষ্ঠা উল্টালো…

মানসী তখন কলেজে পড়ত আর আমি মেডিকেল ফাইনাল ইয়ারে পড়ছিলাম। বয়সের ডিফারেন্সটা নেহাৎ কম না, তবে ভালোবাসার কমতি ছিল না কোনো। তখনই সৌরভ-অনন্যার বিয়ে হয়েছিল। হঠাৎ করেই হলো ব্যাপারটা। অনন্যাকে ওর বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলো, ১৮ বছর তখনো হয়নি। অবশ্য সে আমলে বয়স টয়স মেনে কেউ বিয়ে দিত না। অনন্যা মানসীর স্কুলফ্রেন্ড ছিল। তখন থেকেই মানসীর সাথে অনন্যা আমাদের বাসায় আসত। এই আসা-যাওয়ার মধ্যেই কেমন করে সৌরভের সাথে ওর প্রেমটা হয়ে গিয়েছিল। অনন্যার বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ায় আমরা সবাই বাবা মাকে জানালাম। বাবা-মাকে রাজি করানোর জন্য সৌরভের অনশন আর মানসীর কান্নাকাটিই যথেষ্ট ছিল। তারপর তারাই সৌরভ- অনন্যার বিয়ের ব্যবস্থা করল।

মায়ের অনেক আগে থেকেই ইচ্ছে ছিল আমাদের দুই ভাইয়ের বিয়ে একসাথে দেবে। আর মানসীর সাথে আমার সম্পর্কের কথা মানসীর ফ্যামিলির কেউ না জানলেও আমার ফ্যামিলির সবাই জানত, তাই আমাদের বিয়ের কথাও উঠেছিল। কিন্তু আমি বললাম,

“অন্তত আমার পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগে আমি বিয়ে করব না। এত তাড়া কিসের? মানসীর তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না।”

মায়ের পাগলামির কাছে বাবা সবসময় হার মানতো কিন্তু বাবাও এরকমটা চাচ্ছিল না তাই সে আমাকে সাপোর্ট দিল।

সেবার সৌরভ-অনন্যার বিয়েটা ঠিকই হয়েছিল। কিন্তু আমাদেরটা হলো না। মানসীর খুব ইচ্ছে ছিল। মানসী খুব বায়না করছিল, “চলো বিয়ে করে ফেলি। এমন করছ কেন?” আমার ঝাড়ি খেয়ে থেমেছিল। মেয়েরা যে কেন এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চায় তা আমার মাথায় ঢুকছিল না তখন। রেগে গিয়েছিলাম মানসীর ওপর। পরে অবশ্য বুঝেছিলাম প্রত্যেকটা মেয়ের জীবনেই এমন একটা সময় আসে যখন খুব বউ হতে ইচ্ছে করে, ঘর-সংসার করতে ইচ্ছে করে। সময়টা হয়তো একেক মেয়ের জীবনে একেক বয়সে আসে। মানসীর বোধ হয় সেই সময়টা এসে গিয়েছিল।

সৌরভ-অনন্যার বিয়ের দিন রাতে একটা ঘটনা ঘটলো। অনন্যাকে বউ সাজে দেখে মানসীর মন খারাপ লাগছিল। তাই হয়তো কোনো না কোনো ভাবে একই কথা বারবার বলছিল,

“ইশ, তুমি চাইলে আজ আমাদের বিয়েটাও হতে যেত।”

খুব রগচটা ছিলাম। বলে বসলাম,

“এত বিয়ে বিয়ে করছিস কেন? শরীরে জ্বালা ধরে গেছে? বললেই তো পারিস, বিয়ে করা লাগে?”

কথাটা শুনে মানসী হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল আমার দিকে। হঠাৎ মনে হলো কথাটা খুব বিশ্রী হয়ে গেল। এরকম কথা তো বন্ধুদের সাথে হরহামেশাই বলা হয়। কিন্তু মানসী তো আমার মুখে এসব শুনে অভ্যস্ত নয়। ও কি রাগ করল না লজ্জা পেল তা বোঝার আগেই এক দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল। উসখুস করতে লাগলাম। ওকে কি সরি বলা উচিত? আমি কাউকে এত সরি টরি বলি না কিন্তু মানসীর কথা ভিন্ন। ওর পা ধরে মাফ চাইতেও আমার কোনো সংকোচ নেই। তাই মাফ চাইতে গেলাম। ওর ঘরে ঢুকে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এভাবে কাঁদছে কেন মেয়েটা! বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে। কান্নাটা আটকে রাখতে চাচ্ছে ও, সেজন্যই এই অবস্থা। বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। আমি কাছে গিয়ে ওর পাশে বসে মাথায় হাত রাখলাম। বললাম,

“এই পাগলি কাঁদছিস কেন?”

ও কোনো কথা বলল না। আমি আবার বললাম,

“তাকা আমার দিকে।”

ও তাকালো না। যেভাবে ছিল সেভাবেই রইল। তবে কান্না থামানোর ব্যর্থ চেষ্টাটা ঠিকই করল। আমার খুব মায়া হলো। আমি ওকে দুহাতে ধরে কোলে তুলে নিলাম। বাচ্চা মেয়েটার অভিমান ভাঙাতে হবে তো। ও অবশ্য কাঁকড়ার মতো বালিশটাকে ধরে দূরে থাকতে চাইল, কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হলো না। আমি বললাম,

“সরি, আমি কথাটা মজা করে বলেছি, রাগ করে না। এত কাঁদিস না, তুই কথাটা এত সিরিয়াসলি নিবি বুঝিনি। তুই কাঁদলে আমার ভালো লাগে বল? তাছাড়া তোকে কাঁদিয়েছি টের পেলে মা আমাকে আস্ত রাখবে না।”

কে শোনে কার কথা। ও কেঁদেই যাচ্ছে। আমি ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম,

“আমার দুষ্টু দুষ্টু বাচ্চাদের লক্ষ্মী আম্মু, কাঁদিস না।”

ও আমাকে জড়িয়ে ধরল, শক্ত করে। ওর গায়ে এত জোর আগে বুঝিনি। কান্নার বেগ আরো বাড়ল। এটাকে বলে আহ্লাদের কান্না, তাই আর থামানোর চেষ্টা করলাম না। তাছাড়া যতক্ষণ কাঁদবে ততক্ষণ আমার বুকে থাকবে। এই লোভটা সামলানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

কিছুক্ষণ পর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,

“একই কথা বারবার শুনলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। তোর এখনো বিয়ের বয়স হয়েছে, বল? এখনই বিয়ে করার কী দরকার! এই যে কত সুন্দর প্রেম করছি, লুকোচুরি করছি। এরও তো একটা মজা আছে। আগেভাগে বিয়ে করে বুড়ি হওয়ার কোনো মানে আছে?”

ও কোনো কথা বলল না। আমি চোখটা বন্ধ করে ওকে আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে ধরলাম। কতক্ষণ ওভাবে ছিলাম বলতে পারব না। শুধু মনে আছে পরদিন আমি গোসল পর্যন্ত করিনি। মানসীর শরীরের ঘ্রাণ, স্পর্শ আমার শরীরে লেগে আছে। তা কি ধুয়ে ফেলা যায়?

নীরব ইশতিয়াক
১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

আজকের দিনটা ছিল আমার জীবনের মোড় পাল্টে দেয়ার একটা দিন। দিনটা সবচেয়ে সুখের না বেদনার, প্রাপ্তির না হারানোর তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না। এই পৃথিবীটা এমনই এক অদ্ভুত খেলাঘর যেখানে সবচেয়ে সুখের কারণটাই সেকেন্ডের মধ্যে দুঃখের কারণে রূপ নিতে পারে।

মানসী কি আজকের দিনেও আমাকে মনে না করে থাকতে পারে? কীভাবে পারে? নাকি আমার মতোই কিছু করতে পারে না, অসহায়তা নিয়ে পুড়ে মরে?

মানসী একটু অন্যরকম ছিল। অল্প বয়সেই যেন অনেক বেশি ম্যাচিওর। বাবা-মাকে ছেড়ে দূরে থাকার কারণেই নাকি কে জানে। ও অনেক কথাই চেপে রাখতো যা বোঝার সাধ্য কারোই ছিল না, আমারও না। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ সেই চেপে রাখা ব্যাপারগুলো কোনোভাবে বেরিয়ে আসলে নিজেকে অনেক বড় আহাম্মক মনে হতো। এরকমই একদিন হঠাৎ বলে বসল,

“নীরবদা, তুমি খুব নিষ্ঠুর, জানো?”

আমি ওর একটা হাত নিয়ে খেলতে খেলতে বললাম,

“কেন রে? আমি কি তোকে বিষ খাইয়েছি? নাকি তোর শাশুড়িকে সুইসাইড করার বুদ্ধি দিয়েছি?”

“উফ, কী সব হাবিজাবি যে বলতে পারো তুমি। কখনো কি একটু সিরিয়াস হতে পারো না?”

আমি খুব সিরিয়াস এমন একটা ভাব নিয়ে বললাম,

“আচ্ছা যা, আর কোনো ফাজলামো না। তুই বল নীরব কী নিষ্ঠুরতা করেছে তোর সাথে। পিটিয়ে ব্যাটার হাড়গোড় ভেঙে দেব।”

“ধুর, আবার সেই অহেতুক কথা।”

আমি হেসে বললাম,

“আচ্ছা আচ্ছা সরি, এই কান ধরলাম। এবার বল আমি কী করেছি?”

“কিচ্ছু করোনি? সৌরভদার বিয়ের সময় খালামণি আমাদেরও বিয়ে দিতে চাইল। তুমিই তো রাজি হলে না। তখন বিয়েটা হয়ে গেলে কত্ত ভালো হতো।”

ওর এই কথাটার অর্থ বোঝার কোনো চেষ্টাই সেদিন করিনি। রাগের চোটে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম সেদিন। কারণ মনে হলো মানসী যে এখন আবার এসব বলছে তাহলে কাকে কি বুঝিয়েছিলাম ওদের বিয়ের দিন রাতে। ওর কি আমার ওপর বিশ্বাস নেই নাকি! রাগের মাথায় বললাম,

“সেদিন বড় ভুল হয়ে গিয়েছিল। আজ বিয়ে করতে রাজি আছি, করবি?”

রাগ হলে সাধারণত আমি চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলতাম, একটু বেশিই উত্তেজিত হতাম। কিন্তু তখন শান্তভাবে জিজ্ঞেস করাতেই বোধহয় ও আমার রাগটা ধরতে পারল না। ও রাজি হয়ে গেল এবং আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম ওর যখন আমার ওপর বিশ্বাসই নেই বিয়ে করেই ফেলি। এই একটা বিয়ে নিয়ে বারবার কথা শুনতে ভালো লাগে না। তার পরেরদিন আমার কয়েকজন বন্ধু আর সৌরভ, অনন্যাকে নিয়ে কাজী অফিসে গিয়ে আমরা বিয়ে করে ফেললাম। অল্প বয়সের ভুল যাকে বলে এই বিয়েটাও সেরকমই কিছু ছিল। এরকম ভুল করতে বোধহয় কোনো যুক্তি লাগে না। লাগে না কোনো কারণ। লেগেছিল শুধু একজনের প্রচণ্ড অন্ধ রাগ আরেকজনের প্রচণ্ড আবেগময় কিছু স্বপ্ন।

হ্যাঁ আজ থেকে ১৮ বছর আগে ঠিক এই দিনেই বিয়ে করেছিলাম আমরা। মানসীর বয়স তখন ১৮ আর আমার ২৫ পেরিয়েছিল। বিয়ের পর আমার আর মানসীর মধ্যে কেমন একটা দূরত্বের সৃষ্টি হলো। আমি এমনিতেও বাসায় কম থাকতাম। তখন আরো বেড়ে গেল আমার বাইরে থাকা। রাত করে বাসায় ফিরে ও ওর সাথে কথা বলতাম না আগের মতো। মানসীও বুঝতে পারল আমি শুধু রাগের মাথায়ই ওকে বিয়ে করেছি। তা না হলে দূরে দূরে কেন থাকব!

আসলে একসময় রাগটা কেটে গিয়েছিল কিন্তু তখন আবার কিছু ভয়, দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তা জেঁকে ধরল আমাকে। মাকে কী জবাব দেব তার ভয়, মাকে লুকিয়ে এই প্রথম কিছু করলাম। কিন্তু দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তা কেন কাজ করছিল তা আজও জানি না আমি।

এভাবেই কেটে গেল ৫ দিন। এরপর বাবা অফিসের কাজে বাইরে গেল। মাও বাবার সঙ্গে গেল। বাসায় তখন আমরা তিন ভাইবোন, অনন্যা আর মানসী। প্রথম দিনই চাইলাম যেহেতু বাবা-মা বাড়িতে নেই তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরব। কিন্তু নানান কাজে দেরি হয়েই গেল। অবশ্য বেরই হয়েছিলাম সন্ধ্যায়। সৌরভ যেহেতু বাসায় আছে তাই আমি নিশ্চিন্তে আমার কাজ শেষ করে রাত ১০টা নাগাদ বাসায় ফিরলাম।

বাসায় ঢুকেই দেখলাম সৌরভ-অনন্যা টিভি দেখছে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে মানসীকে না দেখে নিজের ঘরে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসতেই অনন্যা বলল,

“দাদা, তোমাকে ভাত দিয়ে দিই?”

আমি অবাক হয়ে বললাম,

“এত তাড়াতাড়ি?”

“হ্যাঁ, আসলে মা বাসায় নেই, বাসাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আমাদের কারোই ভালো লাগছে না। তাই তাড়াতাড়ি ঘুমাব।”

“মানসী কোথায়?”

“মানসীর প্রচণ্ড মাথা ধরেছে, ও শুয়ে পড়েছে।”

“আচ্ছা, প্রব্লেম নেই, তোরা শুতে যা তো। আমি নিয়ে খেতে পারব।”

“না দাদা, আমি এটা করতে পারব না। মানসী প্রচণ্ড মাথা ব্যথা নিয়েও তোমার জন্য বসে ছিল। ওর ওই অবস্থা দেখে আমি জোর করে ওকে ঘুমাতে পাঠিয়েছি। কাল যদি জানতে পারে আমি তোমাকে খেতে দিইনি, তুমি নিজে নিয়ে খেয়েছ তাহলে কেটে ফেলবে আমাকে।”

“আরে ধুর, ওর কথা বাদ দে। তোর অসুস্থ শরীরে এত কষ্ট করতে হবে না। আমি নিয়ে খাব।”

“উফ, কিসের অসুস্থ! তোমাদের ভাব দেখলে মনে হয় পৃথিবীতে আমি প্ৰথম মেয়ে যে মা হচ্ছে।

আমি হেসে বললাম,

“আচ্ছা দে এখনি খেয়ে নিই। না হলে তো তুই ছাড়বি না।”

অনন্যা চলে গেল ভাত বাড়তে। সৌরভ বলল,

“বুঝলি দাদা, শাশুড়ির শোকে তার বউদের এতই দুরবস্থা যে আমাদের ১০টার আগে ডিনার করতে হচ্ছে!”

আমি হেসে বললাম,

“কী আর করা, কয়েকদিনই তো। আয় খেয়ে নিই।”

“আমাদের সবার খাওয়া হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ, তুই খা। গুড নাইট—”

একথা বলে সৌরভ চলে গেল নিজের ঘরে।

আমি খেয়েদেয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখলাম। তারপর ১২টার দিকে শুতে গেলাম। ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালাতেই চমকে উঠলাম। আমার বিছানার ওপর মানসী বউ সেজে বসে আছে। আমার বুঝতে বাকি রইল না যে বাসায় আসার পর থেকে যা ঘটেছে তার সবকিছুই পূর্বপরিকল্পিত ছিল। খুব সম্ভব ওরা খেয়াল করছিল আমি মানসীর ওপর রেগে ছিলাম, আর আমার রাগ ভাঙাতেই মানসীকে এভাবে আমার সামনে উপস্থাপন করল। বিছানায় গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো ছিল। আর বিছানার পাশের সেন্টার টেবিলে ফুলদানিতে এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা। তবে এসব কিছু নয়, আমি শুধু দেখছিলাম মানসীকে। ও খুব সেজেছিল সেদিন, এর আগে ওকে কখনো এত সাজতে দেখিনি। তাই হয়তো জানা হয়নি ওকে সাজলে এত ভালো লাগে। আমি ওর কাছে গিয়ে ঠিক ওর সামনেই দাঁড়ালাম।

আমাকে দেখে ও কী ভাবছিল কে জানে। তবে উঠে দাঁড়িয়ে ভয় ভয় কন্ঠে বলেছিল,

“আমি কিছু করিনি। এসব সৌরভদা আর অনন্যার প্ল্যান। আমি ওদের অনেক নিষেধ করেছিলাম।”

মানসীর এসব কথা শোনার মতো অবস্থায় আমি ছিলাম না। আমি শুধু মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ওকে দেখছিলাম। যেন শৈলচূড়ার সূর্যোদয়ের সমস্ত আলো এসে ঠিকরে পড়েছিল ওর গায়ে। ওর একটা গালে হাত রেখে বললাম,

“তোকে অন্যরকম লাগছে। এত সেজেছিস!”

ও হয়তো এতেই বুঝে গিয়েছিল আমি আর রেগে নেই। তাই ওর ভয় কেটে গেল। আহ্লাদি কন্ঠে বলল,

“ভালো লাগছে না তো? আমি জানি আমাকে সাজলে ভালো লাগে না। সৌরভদাকে এত্তবার করে বললাম আমি এত সাজব না। শুনলোই না আমার কথা।”

আমি ওর মুখটা দুহাতে ধরে বললাম,

“তাই মনে হচ্ছে? তাহলে কি আমি এমন ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকতাম তোর দিকে? তোরা মেয়েরা নাকি ছেলেদের দৃষ্টি দেখলেই বুঝতে পারিস কোন ছেলে কেন তাকাচ্ছে?”

ও কোনো কথা বলল না। আমিই আবার বললাম,

“পাগলি, তোকে আজ পরীর মতো লাগছে। তুই যে এত সুন্দর আগে তো কখনো খেয়াল করিনি।”

“এটা ফলস সৌন্দর্য, সেজেছি বলেই। আমি তো সত্যি সত্যিই এত সুন্দর নই।”

“কেউ যদি সুন্দর না হয়, সাজ তাকে সুন্দর করতে পারে না। সাজের কাজ হলো লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্যর বহিঃপ্রকাশ ঘটানো।”

ও লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল। বলল,

“হয়েছে হয়েছে, আর মিথ্যে বলে আমাকে খুশি করতে হবে না।”

আমি ওকে ছেড়ে বিছানার একপাশে বসে বললাম,

“আমার কি দায় পড়েছে যে তোকে খুশি করতে যাব? তুই তো আমারই, আজীবন মেয়াদ। তার ওপর কদিন ধরে আবার রেজিস্ট্রিকৃত। তোকে পটানোরও আর দরকার নেই।”

ও কাছে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

“তাই? তাহলে এখন থেকে কী করবে?”

“অন্য মেয়েদের পটাব, নিত্যনতুন।”

একথা শুনেই মানসী আমার চুল খামচে ধরল। বলল,

“একটা চুলও যদি রেখেছি আজকে তোমার!”

আমি ওকে থামালাম না। শুধু মাথাটা তুলে এক দৃষ্টিতে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার সেই দৃষ্টিতেই এমন কিছু ছিল যে হঠাৎ ও আমার চুলগুলো ছেড়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, অদ্ভুত দৃষ্টিতে! এ যেন এক আত্মসমৰ্পণ।

আমার মনের ওই খুঁতখুঁতে দুশ্চিন্তা কোথায় উবে গেল কর্পূরের মতো! যেন আগুন পেয়ে গলে যাচ্ছে মোম। ওর শরীরের ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম, কী মিষ্টি একটা ঘ্রাণ! নেশা নেশা। সত্যি ওই ঘ্রাণটার নেশা হয়ে গিয়েছিল আমার। নেশা এখনো আছে কিন্তু নেশা করা হয় না আর।

নীরব ইশতিয়াক
২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

ডায়েরি বন্ধ করে অৰ্পি বলল,

“এটা কীভাবে সম্ভব? চাচ্চু মেয়েটাকে বিয়ে করেছিল! সবাই সবকিছু জানত আর এখন এরকম কারো কথা আমরা জানিও না।”

অদ্রি চিন্তিত মুখে বলল,

“আমার কী মনে হয় জানিস? চাচ্চু খুব বেশি ভালবাসত মেয়েটাকে। লেখাগুলো অন্তত তাই বলছে। ব্রেকাপের ব্যাপারটা বোধহয় মানতে পারেনি তাই সবাইকে বলে দিয়েছে ওর কোনো চিহ্ন না রাখতে। ওর ব্যাপারে কোনো আলোচনা না করতে।”

“সেটা হতে পারে কিন্তু তাই যদি হয় নিজেই কেন তার ব্যাপারে এত কথা লিখবে?”

“হয়তো সবাইকে বোঝাতে চায় সে ভালো আছে। তাছাড়া নিজের মন হালকা করারও একটা ব্যাপার আছে। হয়তো কাউকেই বলতে পারে না তাই নির্বাক ডায়েরিতে লিখছে।”

“হুম, তাও ঠিক। একটা জিনিস খেয়াল করেছিস, দাদুকে মেয়েটা খালামণি বলত।”

“হ্যাঁ, সেটা আমিও খেয়াল করেছি। কিন্তু দাদুর তো একটাই বোন। যে কানাডাতে থাকে তার মেয়ের কাছে।”

চোখমুখ উজ্জ্বল করে অর্পি জিজ্ঞেস করল,

“হ্যাঁ। আচ্ছা আপ্পি, ওই মেয়েটাই মানসী নয়তো? হতেই পারে। নিজের আপন বোনের মেয়ে বলেই এত আদর করত। চাচ্চু কোথায় যেন লিখেছে না মানসী কাঁদছে এটা টের পেলে দাদু চাচ্চুকে আস্ত রাখবে না, এ ধরনের কিছু।”

অদ্রির কপালে চিন্তার ছাপ। বলল,

“তুই একদম ঠিক বলেছিস। সে হতে পারে। আমরা কিন্তু কখনো তাকে দেখিনি, এমনকি দাদুর বোনকেও দেখিনি। কখনো আমাদের বাড়িতে আসেনি অথচ দাদুর আপন বোন। এমনটা তো হতেই পারে যে নিজেদের ছেলেমেয়েদের প্রেম-বিয়ে এসব নিয়ে দুই বোনের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে। চাচ্চু কিন্তু এক জায়গায় লিখেছে যে ওদের বিয়েটা ছিল ছোট বয়সের ভুল।”

“হ্যাঁ আপ্পি, আর চাচ্চুর সাথে ব্রেকাপের পর সে কানাডাতে চলে গেছে।”

“হুম, কিন্তু সে আমাদের বাসায় কেন থাকত সেটাই মাথায় ঢুকছে না।”

“কোন কারণ হয়তো ছিল। বাদ দে সে কথা, অবশেষে তার পরিচয় তো পাওয়া গেল।”

বিজয়ের হাসি ফুটল অর্পির মুখে। অদ্রি ঘড়িটা দেখে নিয়ে বলল,

“রাত কত হয়েছে খেয়াল করেছিস? ১:৪০ বাজে। নিজেরা আলোচনা না করে পরের পাতাগুলো পড়ি। আরো অনেক কিছুই জানতে পারব।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *