অবস্থান – বাণী বসু

অবস্থান – বাণী বসু

ওয়াজিদ? ওয়াজিদ আলি শা? খিদিরপুরে থাকেন বললেন না?— কেমন উৎসাহিত উত্তেজিত গলায় বলল খুকিটি। ছুট্টে গিয়ে আজকালের সব টেপটাপ হয়েছে, সেই একখান চালিয়ে দিল— বাবুল মেরা নৈহার ছুট হি জায়— ঘুরে ঘুরে মিহিন সানাইয়ের স্বরে গাইতে লাগল টেপটা।

—ভাল লাগছে? আপনার ভাল লাগছে এ গান? জ্বলজ্বল চোখে খুকি বলে।

কী করবে? মাথাটা তালে তালে নেড়ে দেয় সে। ভাল আসলে লাগছে না ততটা। কিন্তুক অত উৎসাহের আগুনে ঢুস করে পানি ঢালা যায় কি? খুকি অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে।

—আপনার পূর্বপুরুষের লেখা গান। জানেন তো? নবাব ছিলেন ওয়াজিদ আলি শাহ। ঠিক আপনার নাম। একেবারে হুবহু।

এত উৎসাহ, উত্তেজনা, গান-ফানের কিছুই বোঝে না সে।

—ওয়াজিদ নয় খুকি, আমার নাম ওয়াজির, ওয়াজির…। আলি নয়, শা নয়, মোল্লা— থেমে থেমে বলে সে। গলার আওয়াজটা বড়ে গোলামের মতো না হলেও বেশ জোয়ারিদার।।

—মোল্লা? ওরে বাবা— খুকি যেন চমকে ওঠে।

—কেন? ‘ওরে বাবা’ কেন?

—সে আমি বলছি না— জেদি ঘাড় দোলায় খুকি।

—আমি বুজতে পেরেছি— ওয়াজির মোল্লা দাঁড়ির ফাঁকে হাসে।

—বুঝতে পেরেছেন তো?— খুকির গলায় সোয়াস্তি। বস্তুত দু’জনেই হাসে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ষড়যন্ত্রীর হাসি।

—কিন্তু আমি আপনাকে ওয়াজিদ আলি শা সাহেব বলেই ডাকব। কেমন?

—এটা কিন্তুক বুজলুম না খুকিসাহেব। ওয়াজির মোল্লা মন দিয়ে পাকা পুডিং, রজন জ্বাল দেয়। নুটি ঠিক করে মার্কিনের টুকরোর মধ্যে ঝুরো তুলে ভরে।

—খুসাকিসাহেব? —খুকিটি ভীষণ হাসি হাসতে থাকে। লুটিয়ে লুটিয়ে পড়ছে একেবারে।

এত হাসি! ওয়াজির মোল্লা তার পালিশের নুটি নিয়ে অপ্রস্তুত। এত কিছু মজাদারি আছে নাকি কথাটায়: নাকি সিরেফ জওয়ানি! যৌবনই এমন বাঁধভাঙা হাসি হাসায়!

খুকির বাবা একটুকুন আগে অফিস চলে গেছেন। এবার মা যাচ্ছেন। নাম্বা নাম্বা ইাস্ট্র্যাপের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে খুটখুট করে ছ্যাকরা গাড়ির ঘোড়ার মতো, না না ছ্যাকরা গাড়ির ঘোড়া হতে যাবেন কেন? কত বড়মানুষ: এতগুলিন সামানে ল্যাকর পালিশ দিবেন বাপ্‌রে সেন্টের গন্ধে ভেসে যাচ্ছে চাদ্দিক। চকচক কচ্ছে চামড়া। কত ল্যাকর কত জলুসের জান। ছ্যাকরা গাড়ির ঘোড়া কেন হতে যান! ইনি হলেন গিয়ে ভাল জেতের রেসের ঘুড়ি। যেমনটি কুইনের পার্কের পাশে ঘোড়দৌড়ের বাজির মাঠে দেখা যায়! অতটা নাম্বাই-চওড়াই নেই। তা না-ই থাকল।

উনি বললেন— অত কী বকবক করছিস খুকি! কাজটা হবে কখন?

—আমার হাত কামাই নেই! দিদিসাহেব— নুটি চালাতে চালাতে মোল্লা বলে।

—তা হোক, খুকি, বড্ড বিরক্ত করছ!

—না মা। ইনি একজন বিশেষ মানুষ। হিস্ট্রির লোক। এঁর নাম জান? ওয়াজিদ, ওয়াজিদ আলি শাহ্। খিদিরপুরে থাকেন।

—তা-ই-ই! ভীষণ অবাক আবিষ্কারের চোখে কর্ত্রী তাকালেন। —চেহারাটাও। দেখেছিস! খুকি আবার হাসতে থাকে! — তুমি তো আমজাদের চেহারার কথা ভেবে বলছ। আসল মানুষটা তো নয়! তোমার যা হিষ্ট্রির সেন্‌স!

—আহা, আমরা লেম্যান তো ওইভাবেই জেনেছি! এ মিলটাও কি কম আশ্চর্যের!

ওয়াজির মোল্লা জানে না, কেন এই আশ্চর্য, কেনই বা আবিষ্কার। কীসের মিল। কেন মিল। ভুল নাম নিয়ে কেনই বা এত কচলাকচলি! তবে সে আর শুধরে দেয় না। কী দরকার! রুজি যাদের কাছে, একটু-আধটু ভুলভাল বলে তারা যদি খুশি থাকে, থাক।

—আমার মাকে দিদিসাহেব ডাকলেন কেন?

কর্ত্রী চলে যেতে খুকিটি আবার জিজ্ঞেস করে। প্রশ্নের তার শেষ নেই।

—কেন? ভুল হয়েছে কিচু?

—না, ভুল নয়। সবাই তো মা, বউদি এ সব বলে। ও আপনাদের ‘বউদি’ নেই, না? ওয়াজির মোল্লা কাঁধের কিনার দিয়ে চিবুক চুলকাতে চুলকাতে ভাবতে থাকে।—তাই তো? দিদিসাহেব কেন? এই ডাকগুলান মুখ দিয়ে আপ্‌সে বেরিয়ে যায়। এখন তার কার্যকারণ বাতলাও এই কৌতূহলী বালিকার কাছে।

মাথায় সিন্দুর নাই। ঘোমটা নাই। খাটো চুল গুছি গুছি পিঠ ঝেঁপে আছে। ঝুলঝুলে দুল। গলায় ঝুটো পাথরের দেখনাই হার। হাতেই বা কী? একটা হাতঘড়ি। একটা কাঠ না কীসের বালা। এমন ধারা শো হলে মা ডাকটা ঠিক হয় না। দিদিই ঠিক। কিন্তু এসব কথা খুকিকে বলা যাচ্ছে না। সে খানিকটা প্রশ্নের উত্তর বেমালুম উড়িয়ে-এড়িয়ে বলে— সাহেব মানে একটা মান, একটা সন্‌ভ্ৰম, সন্‌ভ্রম বোঝ তো? খুকি আবারও প্রচুর হাসে। সন্‌ভ্ৰম? কী বললেন? সন্‌ভ্রম?

খুকি বলতে ঠিক যতটা বাচ্চা হওয়া দরকার, এই খুকিটি কি ততটা? উলিথুলি চুল। চক্ষু দুটি ডাগর। তাতে ভাসে কৌতুক, কুতুহল, কোশ্চেন, ছোট্টখাট্ট, সবই ঠিক। কিন্তু খুকি-খুকি শো থাকলেও এঁর সোমথ বয়স হয়েছে। ঢলেঢলে কামিজ, তবু বোঝা যায়। তা ছাড়াও, চলন-বলন ছোটন-দাঁড়ন, কাজ-কম্মের একটা গোছ ধরন সবই ওই কথাই বলে।

—তুমি ইস্কুলে যাবে না?

—আমি কলেজে পড়ি, সেকেন্ড ইয়ার।

—ওরে বাবা! সেকেন কেলাস একেবারে? তবে তো খুব ভুল হয়ে গ্যাছে খুকিসাহেব? তা আপনি কলেজ যাবেন না!

—টেস্ট হয়ে গেছে, এখন আর যেতে হয় না।

—বা বা। বাহবাটা কেন দেবে মোল্লা তা জানে না।

শীতের বাতাসে বেশ আঁচ লেগেছে। শুখুটে শুখুটে দিনগুলো। পুরনো সামান সব ঘষেমেজে, বাটালি দিয়ে চেঁছে ফেলে, নতুনের সঙ্গে তাকে মানিয়ে-গুনিয়ে কাজ। দরজার এড়ো, ক্যাবিনেটের পাওট্‌ সব নতুন করে বাদাম কাঠ মাপসই করে করা। এখন আর সব মিস্তিরি, জব্বর, গোপাল, মুন্না—সব ক’টিকে বিদেয় করে দিয়েছে। একটু একটু করে সাজিয়ে তুলতে হবে এখন সব। একা একা অভিনিবেশ চাই। না কী? শীতের শুখো থাকতে থাকতে সারতে হবে।

যবে থেকে একলা কাজ করছে আপন মনে, খুকিটি সেই ইস্তক সেঁটে আছে। অবিশ্যি সেঁটে বলতে ঠিক সেঁটে নেই। মাঝে মাঝে একেবারে অদর্শন হয়ে যায়। তারপর ঘুরছে ফিরছে, কাছে এসে বসছে, এটা ওটা নাড়ছে চাড়ছে। আর ফুলঝুরির মতো কোশ্চেন।

—আরে সব্বনাশ, ও ঢাকা খুলেন না, খুলেন না।

—কেন?

—ইস্প্রিট সব ভোঁ হয়ে যাবে। পড়ে থাকবে পানি। জল।

—জল? স্পিরিটে জল?

—একটু আধটু ভেজালি এ লাইনে সবাই দিচ্ছে খুকি, কাকে ফেলে কাকে ধরবেন?

—কী করে বুঝলেন জল আছে?

—এই দ্যাখেন, —নিজের মোটা মোটা খসখসে আঙুলগুলি মেলে ধরে ওয়াজির। —চামড়া কেমন কুঁকড়ে উঠেছে দেখেছেন? এই হল গিয়ে পানির নিশানি।

মনোযোগ গিয়ে দেখে খুকি।

—স্পিরিট শুদ্ধ থাকলে কী হত?

—পেলেন থাকত চামড়া— স্পিরিটের মধ্যে গালা ঢালে ওয়াজির।

—কী দিলেন ওগুলো?

—গালা, কুসমি গালা, খুকিসাহেব।

—কুসমি? কুসমি কেন?

—ডিমের কুসুম দেখেন তো? তলতলে কাঁচা সোনা কাঁচা সোনা বর্ণ? সেইমতো হল গিয়ে বাজারের সেরা গালা। ফার্নিচারে মারলে কাঠের ওরিজ্‌ন্যাল রঙটিই ধরবে। এমন ঝিলিকদার হবে যে, এদিক থেকে লাইট মারলে ওদিকে পিছলে পড়বে।

—তা অ্যাত্তো সব হাঁড়ি-কুড়ি বাটি-ঘটি নিয়ে কী করছেন?

—খেলা করছি। রান্নাবাড়ি— ছোট ছেলেরা খেলে না?

—খেলাই তো!

—খেলা, কিন্তু কেমন জানেন? পরাণপণের খেলা।

—কেন? এর মধ্যে আবার প্রাণপণের কী হল?

—ও আপনি বুজবেন না, খুকিসাহেব। এ হল গিয়ে রং ফেরাবার খেলা, রঙে রং মেলাবার খেলা। একেকটি খোরায় জানের এক এক টুকরো ধরে রাখছি।

—দেখি দেখি, কেমন আপনার জানের রং!

—তো দ্যাখেন, এই রং মেহগনি, ডার্ক ব্রাউনের সঙ্গে ভুযো কালি, একটু এই অ্যাতোটুকু সিন্দুর..

—সিন্দুর?

—বাঃ, আপনারা সাজেন আর আপনাদের ফার্নিচার সাজবে না! সিন্দুরে, আলতায়, কাজলে, সুর্মায় সাজবে বই কী! তারপর কাপড় পড়বে ঝা-চকচক।

—কী কাপড়? সিনথেটিক তো? নাইলন! এতক্ষণে খুকি খেলাটা ধরতে পেরেছে।

—না খুবিসাহেব, ওরে কি কাপড় কয়? পরবে বেনারসি, তসর, মুগা, বিষ্ণুপুরের বালুচরি।

—ওরে বাবা! কই বেনারসি, তসর এসব কই?

—বানাচ্ছি। খাপি মিহিন খোল। এমন গ্লেজ দেবে যে সিল্কের সঙ্গে তফাত করতে পারবেন না। চোখে ঝিলিক মারবে।

—সবই তো দেখছি একরকম!

—আরে সাহেব, সবই একরকম হলে কি আর এত ছাবাছোবার দরকার হত? এই দ্যাখেন এরে কচ্ছে ওয়ালনাট। বড় বড় হৌসে এই রং লাগায়। আই সি আই, আই টি সি, টাটা স্টিল…। ওয়ালনাটেরই কি আর এক রকম! তিন-চার রকম আছে খুকি। আপনারা হয়তো দেখে কইবেন মেহগনি। যে জন জানে সে জন বুজবে।

খুকি একটা কাঠের টুকরো তুলে নিল, বলল— বাঃ, খুব সুন্দর তো ধরিয়েছেন রংটা।

—ধরাব না? আপনার মা-বাবা এসে স্যাংশন দিবেন তবে না? কাঠের পিসে সবরকমের ধরতাই দিয়ে রাখছি।

—এতে কী দিয়েছেন?

—কিচ্ছু না, কুসমি গালার রসের সঙ্গে এই অ্যাট্টুকুনি বেগনি রং।

—তাতেই?

—তারপর আছে ঘষামাজা। আপনারা মাথা ঘষেন না? একবার দু’বার। তারপর মুখে কিরিম দাও, মোছো, আবার মাখো, আবার মোছো… এই সুন্দরীদেরও তেমনি। মাখবেন, তুলবেন, মাখবেন, তুলবেন। তবে না গ্লেজ আসবে। মুণ্ডু ঘুরবে দেখনদারের। এই তো সাইডটায় হাত দিয়ে দেখেন!

—সত্যি তো! কী স্মুথ করে ফেলেছেন।

—আরও করব খুকিসাহেব। তারপর ফেরেঞ্চ চক মাখাব। পাউডার মাখবেন সোহাগী আমার। তেমন তেমন লাগসই উপমাগুলো ওয়াজির মোল্লা খুকির সামনে বলা উচিত মনে করে না। —যত্ত চিকনচাকন হবে দেহখানি বিবির পালিশ তত্ত খুলবে, না কি? তা এইটুকু শুনেই খুকির মুখ সামান্য লাল হয়। সে বলে ওঠে— দাঁড়ান, দাঁড়ান, আপনার চা-টা হল কি না দেখে আসি।

বড় গেলাসের চায়ে পাঁউরুটি ডুবিয়ে ডুবিয়ে তৃপ্তি করে খায় ওয়াজির মোল্লা।

—এ মা, বর্ডারগুলোতে কেলে দিলেন কেন?

—উ হুঁ হুঁ। কালো নয়। কালো বলেন না। ও হল ডার্ক মেহগনি। যত শুকোবে তত খোল তাই হবে। হাসতে থাকবে। এই যে ভেতরে? সব ওয়ালনাট ফিনিশ দিইছি। দেখে ন্যান, ধারে ধারে একটু অন্যতম রং চাই, বুজলেন? অন্যতম কিছু। আবার ধরুন আপনাদের শয়নের ঘরে একরকম, তো বসার ঘরে বিকল্প চাই। সবখানেই ওয়ালনাট মেহগনি হলে হবে না। রোজউড দেব ক্যাবিনেটটাতে, দেখবেন চোখ যেন স্তম্ভিত হয়ে থাকতে চাইবে। একেবারে বিকল্প।

খুকি অনেকক্ষণ ধরেই হাসছিল, বলল— আপনি লেখাপড়া জানেন, না?

—কই আর জানলুম খুকি!

খুকির বাবা এসে ডাকেন— মিস্ত্রি।

—জি!

—নতুন রং করা চেয়ারে বসলাম, গ্লেজ তো উঠে গেল।

—তা তো যাবেই সাহেব।

—সে কী! তাহলে এত কষ্ট করে খরচা করে পালিশ করার মানে কী!

—আহা এখনও তো ফিনিশ হয়নি। শেষ অন্তে ল্যাকার পালিশ চড়াব। চক্ষে ধাঁধা লেগে যাবে।

—গ্লেজ?

—উঠবে না সাহেব। দশটি বচ্ছর চোখবুজে থাকতে পারবেন।

—পারলেই ভাল— সাহেব গটমট করে চলে যান।

—হ্যাঁ, কী যেন বলছিলেন! খুকি সুযোগ পেয়ে কাছিয়ে আসে।

—কী আবার!

—ওই যে অন্যতম, বিকল্প… ভাল ভাল কথা বাংলা রচনা বই থেকে?

—ওই সেই কথা? এই যেমন ধরুন, খুকিসাহেব, আপনারা আজকালের মেয়েরা সব ম্যাচিং দ্যান না? ফলসা রঙের শাড়ি, তো সেই রঙের সায়া, সেই রঙের জামা। মনে কিছু করবেন না, সরবো চেহারা লেপেপুঁছে খেঁদিকুঁচি লাগে।

খুকি আর হাসি সামলাতে পারে না।

—আপনি হাসছেন? আমি যখন একেকটি ফার্নিচার সাজাই, তাকে জামা পরাই, সায়া পরাই, কাপড় পরাই, তখন আমার ওই লেপাপোঁছা মনে ধরে না। একটা কিছু অন্যতম খুঁজি। কেমন জানেন? লাহা বাড়িতে কাজ করতে গেছলুম। সে কি আজকার কথা! সে এক তান্যতম কাল! তা সে বাড়ির মেয়েরা সব হুরি রূপুসি। আশি নম্বর, একশো নম্বর কাগজ দিয়ে ঘষে ঘষে ঘষে ঘষে তবে তেমনতর তেলা চামড়া হয় খুকি, তারপর খালি সবেদা দিয়ে সাদা গালার পোঁচা, সর-হলুদ বাটা আর কমলালেবুর খোসা, —গ্লেজ কী! চোখ পিছলে যায়।

—পিছলে যায়? আটকে থাকে না? খুকি হাসি চেপে দুষ্টু প্রশ্ন করে।

—উঁহু, রজন পাইল দিলে চিটে হবে, নইলে পিছলে যাবে, ওইখানেই তো পালিশের সরবো কারিগরি।

—আহা পালিশ নয়, ওই লাহা বাড়ির সুন্দরীদের কথা কী যেন বলছিলেন?

—ও হ্যাঁ, তা ওনারা পরতেন ধবধবে সাদা খোলের কাপড়। তাতে ভোমরা-কালো, কিংবা খুনখারাবি লাল রঙের পাড়। জামা পরতেন ছিটের। লালের মধ্যে হলুদ কালো সবুজ চিকিমিকি। আর সায়াটি থাকত ধোয়া গোলাপি।

—এ মা! কী বিচ্ছিরি!

হাঁ হাঁ করে ওঠে ওয়াজির মোল্লা। —না না। একেবারে বিকল্প। ওই যে সবটি লেপাপোঁছা হল না, অন্যতম রঙের খোয়াব রইল, তাতেই রূপগুলি বিকল্প হয়ে উঠত। এই যে বর্ডার দিচ্ছি, একটা জমিনকে আলে আলে বেঁধে দিচ্ছি; এতে করে আপনার আপন হয়ে যাচ্ছে দ্রব্যটি। উদোম মাঠ নয়, যেটা বারোয়ারি। একটা ধরুন শস্যক্ষেত্র। কেমন? নয় কি?

খুকি এখন আর হাসছে না। অভিনিবেশ সহকারে শুনছে। একটু পরে সে উঠে গেল। বাড়িটি চমৎকার সেজে উঠেছে। ওয়াজির মোল্লাসাহেব দেখছেন। ঘরের মধ্যে যেন চাঁদনি। এমন ধারা চাঁদনিতে মানুষের প্রকৃত মুখটি এই ধরা পড়ে, তো এই পড়ে না। একঘর আলো, তা বুঝি তার কতকগুলান উঁচার দিকে মুখ। মানুষগুলিকে মনে হয় খোয়াবে দেখা হুরি পরি জিন জাদুকর। হ্যাঁ জাদুকরও আছে। মোল্লাসাহেব বড় আয়নায় দেখেছেন, তিনি নিজেই যেন জাদুর মানুষ। ভুষো কালি আর শ্বেত গালাতে মিলে মিশে ছোট দাড়ি। হাতের কালচে চাম ইম্প্রিটের অ্যাকশনে উঠে উঠে যাচ্ছে, কাজের লুঙি আর গেঞ্জিটি আলাদা করে রাখলেও ছাপছোপ পুরোপুরি এড়াতে পারেননি। পেন্টুলে নানা রঙের একটু-আধটু পোঁচ লেগেছে। হলঘরটি যেন সিনেমা হল। তার মধ্যে ফার্নিচারে আলো ঠিকরোয়, ভাল গোমেদ পাথরের কাটিং যেন।

দুটি হাঁড়ি ওপর ওপর বসানো। ফর্সা পুরনো কাপড়ে বেঁধে দিচ্ছেন কর্ত্রী।

—মিস্ত্রিসাহেব, ছেলেমেয়ে বিবিদের দেবেন গিয়ে।

—কী আছে মা এতে? দাত্রী রমণীকে আজ মা ডাকতে ইচ্ছে যায়।

—লেডিকেনি আছে। আর রসগোল্লা… ভালবাসেন তো?

—হ্যাঁ মা… চমৎকার ভালবাসি সব।

—সন্ধে হয়ে গেল আজ শেষ দিনে আপনার… আর এই শাড়িখানা… পছন্দ হয়?

—আপনার পছন্দ হয়েছে মা— ওয়াজির চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখেন, দেখান।

—খু-ব। আবার দরকার পড়লে ডাকব আপনাকে।

—খোদা করুন, ডাকবার দরকার না হয় মালিক। বিশ বচ্ছরের কাম ফতে করে গেছি। রাখতে যদি পারেন। পানি আর রোদ্দুর এই দুই হল পালিশের দুশমন। পাতলা কাপড় দিয়ে মোলায়েম করে মুছে দেবেন, বাস। আর পাড়া-পড়োশান, ভাই-বহেন এঁদের কাছে যদি সুপারিশ করেন তো… আজকাল তো পালিশ লোকে করায় না, সব তেল রং আর পেলাস্টিক রং, হাউহাউ চিৎকার করছে। পালিশের কদর ওই বনেদি বাবুরাই করেন। বিকল্প কিছু…।

শাড়িটা প্যাকেট থেকে খুলে বার করেন মোল্লাসাহেব। ছাপের কাপড়। নানান রঙের হোরিখেলা। বিবি পরবেন ভাল। মোল্লাসাহেবের তত মনোমত হয় না। কিন্তু তিনি বলেন, সুন্দর, চমৎকার। হেসে উঠছে কাপড়, আপনার এই বাড়ির মতো। সালাম, সালাম। কাঁধে ঝোলাঝুলি নিয়ে নীচে নেমে যান মোল্লাসাহেব।

—ও ওয়াজিদ আলি শা সাহেব… একটু দাঁড়ান, একটু দাঁড়ান।

হাঁফাতে হাঁফাতে ছোট্ট জমি দিয়ে ছুটে আসে খুকিসাহেব।

ঘাসের জমিতে সবুজ টিলটিল করছে। বেগুনি আভা সাঁঝের গায়ে। মিহি কাঞ্চন রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছে খুকি। চওড়া জাম রঙের পাড়। ভেতরে জরির সুতো, কালো সুতো চমকাচ্ছে। আর জামাতে বেশ খলখলে হাসকুটে কালো, কালো না মেহগনি, বুঝি খুঁকিও ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছে। কোনও উৎসবে যাবে বোধহয়।

—‘অন্যতম’ হয়েছে?

হাসি দাড়ি বেয়ে টাপুর টুপুর ঝরে।

—হয়েছে, হয়েছে।

—আর ‘বিকল্প?’

চতুর্দিকে হাতড়ান মোল্লাসাহেব। ‘বিকল্প’টি কি ঠিক হল? ‘বিকল্প’ বলে কি তিনি সবসময়ে এক কথাই বোঝাতে চান? ‘বিকল্প’ মানে এখন, এখানে ‘অবিকল্প’। সেরকমটি হয়েছে কি? খুকি রিনঠিন করে হাসে। বোঝার চোখে তাকায়।

—বিকল্পটা ঠিক হল না, না শা সাহেব?

—হল না কি?—হাঁ হাঁ করে ওঠেন ওয়াজির মোল্লা— এখন একেবারে বেগমসাহেবা। হানডেড পার্সেন। দু’জনেই ষড়যন্ত্রীর মতো হাসতে থাকেন। একটা যে রঙ্গ হয়ে গেল সেটা উভয়েই বুঝেছে। শিল্পীর চোখে বিকল্প অর্থাৎ অবিকল্প? তাও কি সম্ভব?

—আচ্ছা চলি বেগমসাহেবা…

—আবার আসবেন ওয়াজিদ আলি শাহ সাহেব…

ওয়াজির মোল্লা কিছু দূর চলে গিয়েছিলেন! ঘুরে দাঁড়ান।

—ওয়াজিদ নয় কিন্তুক। ওয়াজির… ওয়াজির মোল্লা। খিদিরপুরে বাস নয়, কাজ-কাম করি ওখানে, নাহারবাবুদের ফ্যাকটরিতে। সাকিন ন’পাড়া বাগনান, সাউথ ইস্টার্ন রেলোয়ে।

নিজস্ব শিল্পভাবনার অবিকল্প নিশানখানা কাঁধের ওপর প্রশান্ত গর্বে তুলে ধরে নতুন পাড়ার দিকে রওয়ানা দ্যান ওয়াজির মোল্লা। কোনও ইতিহাস, পুরাণ, কিংবদন্তির সঙ্গে অন্বিত হতে চান না। কিছুতেই।

৩০.০৪.১৯৯৫

লেখক পরিচিতি

বাণী বসু: ১১ মার্চ ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জন্ম। আনন্দমেলা ও দেশ পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। প্রথম উপন্যাস ‘জন্মভূমি ও মাতৃভূমি’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৭-র শারদীয় আনন্দলোক পত্রিকায়। ‘মৈত্রেয় জাতক’ তাঁর প্রসিদ্ধ উপন্যাস। ১৯৯৭ সালে আনন্দ পুরস্কার। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিম পুরস্কার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *