১৩
একটা মিলিটার গান-বোট চলছে ভুমধ্যসাগর ধরে পূর্বে ফিলিস্তিন উপকূলের দিকে।
গান বোটের ড্রাইভিং চেয়ারে আহমদ মুসা। তার সামনে পার্টিশন আনফোল্ড করা উন্মুক্ত কেবিনে বসে আছে এমিলিয়া ও নিনা নাদিয়া পাশাপাশি। পাশেই একটু সরে বসে আছে খতিব আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান।
মিলিটারি গানবোটটি অত্যাধুনিক।
ডেকের দু’পাশেই ক্ষেপণাস্ত্র লাঞ্চার। আর কেবিনের ছাদে বিমান বিধ্বংসি কামান।
বোটটি দখল করে রাত সাড়ে তিনটায় তারা বোটে উঠেছে।
মিলিটারি বোটটি বাঁধা ছিল প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের একটা ছোট্ট গোপন জেটিতে। জরুরি অবস্থায় ব্যবহারের জন্যে এ ধরনের বোট প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের উপকূলে আরও কয়েকটি আছে।
সব সময় একজন সেনা অফিসার ও সেনা-ক্রু থাকে জরুরি অবস্থায় দায়িত্ব পালনের জন্যে।
নিনা নাদিয়াই এ বোটটা দখল করেছিল।
সে ঘাটে গিয়ে তার কার্ড দেখিয়ে সেনা অফিসার ও সেনা ক্রুকে ডাকে। তারা এলে নিনা নাদিয়া রিভলবার তাদের দিকে তাক করে বলে আপনাদের এ্যারেষ্ট করা হলো।
এ সময় আহমদ মুসা সেখানে আসে এবং তাদের দু’জনকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে। মুখে কাপড় গুজে তাদের চিৎকার করার পথ বন্ধ করে দেয়।
আহমদ মুসা গানবোটে উঠে সব পরীক্ষা করে দেখে বলে, সব ঠিক আছে। জ্বালানিও যথেষ্ট রয়েছে। আমরা ষ্টার্ট করতে পারি।
নিনা নাদিয়া এমিলিয়াকে হাত ধরে গানবোটে তুলে দেয়। শেখ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমানকে সম্মানের সাথে বোটে তুলে নেয় আহমদ মুসা।
নিনা নাদিয়া দাঁড়িয়েছিল নিচে।
আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে ছিল বোটে। তার পেছনে এমিলিয়া ও শেখ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান।
নিনা নাদিয়ার মুখ ভারী। চোখে-মুখে একটা বিমূঢ় ভাবও। চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল সে।
দাঁড়িয়ে কেন, উঠুন তাড়াতাড়ি। বলেছিল আহমদ মুসা।
আমি উঠব? কোথায় যাব আমি? বলেছিল নিনা নাদিয়া। ভাঙা, কান্নারুদ্ধ কণ্ঠ তার।
কেন আমাদের সাথে, আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে! বলেছিল আহমদ মুসা।
কিন্তু এখানেই তো আমার সব। বলেছিল নিনা নাদিয়া। কাঁপছিল তার কণ্ঠ।
আহমদ মুসা একটু ভাবে। বলে ‘মিস নিনা নাদিয়া, আপনি এখন আর সে নিনা নাদিয়া নন। এখানে যারা আছে, ইতোমধ্যেই তাদেরকে আপনি পরিত্যাগ করছেন। প্লিজ আপনি আসুন।
দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলেছিল নিনা নাদিয়া। কাঁদতে কাঁদতেই বলেছিল, আমি আমারই বিরুদ্ধে গিয়েছি।
না মিস নিনা নাদিয়া, বিরুদ্ধে নয়, আপনি নিজের পক্ষে কাজ করেছেন। আপনি যা করেছেন নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে কেউ তা করতে পারে না। বলেছিল আহমদ মুসা নরম সুরে।
নিনা নাদিয়া পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। তারপর কোন কথা না বলে ধীরে ধীরে উঠে এসেছিল বোটে।
এখন একেবারেই স্বাভাবিক নিনা নাদিয়া।
নানা রকম গল্প চলছিল এমিলিয়া ও নিনা নাদিয়ার মধ্যে। মাঝখানে দু’একটা কথা বলছিল আহমদ মুসা।
শেখ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান ফজরের নামাযের পর তসবি নিয়ে বসেছিল। ঘণ্টা খানেক পর সহজ হয়ে বসে। মাঝে মাঝেই আহমদ মুসার সাথে কথা বলছিল সে।
এক সময় শেখ আব্দুল্লাহ আব্দুর রহমানই নিনা নাদিয়াকে প্রশ্ন করল, তোমার সম্পর্কে কিছুই জানা হলো না মা।
নিনা নাদিয়া তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
মিস নাদিয়া সম্পর্কে আমিই বলছি জনাব।
বলে আহমদ মুসা নিনা নাদিয়ার সাথে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে প্রিজন সেলে প্রবেশ পর্যন্ত সব কথা বলল।
নিনা নাদিয়ার দিকে এমিলিয়ার বিস্ময় মিশ্রিত সম্মান ও শ্রদ্ধার দৃষ্টি।
শেখ আব্দুল্লাহ আব্দুর রহমান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, মা তুমি আল্লাহর তরফ থেকে আমাদের জন্যে সাহায্য হিসেবে এসেছ। তুমি এখন আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ মা। আল্লাহ তোমার মহান কাজের জন্যে অশেষ জাজাহ দান করুন।
শুভ্র চুল, শুভ্র দাড়ি এবং শক্ত দৈহিক গড়নের মানুষ শেখ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান। চোখ-মুখ থেকে পবিত্রতা যেন ঠিকরে পড়ছে। মনে স্বর্গীয় ভাব জাগায় এই চেহারা।
নিনা নাদিয়া মাথা নিচু করে বাউ করে শ্রদ্ধা জানাল শেখ খতিবকে। বলল, জনাব প্রার্থনা করুন, আমি যা ছেড়ে দিয়েছি, যা আমি গ্রহণ করেছি তা যেন আমাকে শান্তি দেয়। ভারী কণ্ঠ নিনা নাদিয়ার।
আল্লাহ তোমাকে, তোমার ইচ্ছাকে কবুল করুন মা। বলল শেখ খতিব আব্দুল্লাহ।
নিনা নাদিয়া আবার বাউ করে শ্রদ্ধা জানাল শেখ খতিব আব্দুল্লাহকে।
মিস নিনা নাদিয়া, আমার একটা কৌতুহল। বলল আহমদ মুসা।
নিনা নাদিয়া তাকাল মুগ্ধ দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে। বলল, কি কৌতূহল বলুন?
আমি আপনাকে বাঁচিয়ে ছিলাম, আমাকে আপনি বন্দী দশা থেকে মুক্ত করলেন। কিন্তু মুক্ত করার পর ধরিয়ে দেয়ার জন্যে নিরাপত্তা বিভাগকে আমার কথা বলে ছিলেন। পরে আবার মৃত্যুর মুখ থেকে আমাকে বাঁচালেন এবং এমিলিয়া ও খতিব মহোদয়কে উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করলেন। কেন আপনি এমনটা করলেন, খুব কৌতূহল আমার এটা জানার জন্যে।
গম্ভীর হলো নিনা নাদিয়া। বলল, আপনার কৌতুহল খুবই স্বাভাবিক। আমি আন্তরিকতার সাথে আপনাকে মুক্ত করেছিলাম। কিন্তু যখন শুনলাম আপনি আমাদের বন্দীদ্বয়কে মুক্ত করতে চান এবং আমার কাছ থেকে বন্দীরা কোথায় আছে জেনে নিলেন; তখন একটা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল আমার মনে। আমার মনে অপরাধ বোধ সৃষ্টি হয়েছিল এই ভেবে যে, আমাদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে দু’জন বন্দী, যাদের বিনিময়ে বড় কিছু পাব আশা করছি তাদেরকে মুক্ত করতে সাহায্য করেছি। এই চিন্তাতেই আমি বিষয়টা তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দেয় ‘সিনবেথ’-এর প্রধান জেনারেল শামিল এরফানকে। তারপর আবার আপনাকে বাঁচিয়েছি বলছেন, কিন্তু আমি তখন আপনাকে বাঁচাইনি, বাঁচিয়েছি আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসাকে বাঁচিয়েছি, সেজন্যে বন্দীদের উদ্ধারের জন্যে আহমদ মুসাকেই সাহায্য করেছি। বলল নিনা নাদিয়া।
বিস্ময় আহমদ মুসার চোখে। অপার বিস্ময় এমিলিয়ার চোখেও। বলল সে, বুঝলামনা তোমার কথা। তুমি তাঁকে বাঁচাওনি, বাঁচিয়েছ আহমদ মুসাকে। তিনি ও আহমদ মুসা তো ভিন্ন সত্তা নন।
তা ঠিক। কিন্তু তাঁকে আমি বাঁচাতে যেতাম না যদি তার নাম আহমদ মুসা না শুনতাম। বলল নিনা নাদিয়া।
বিস্ময় সবার চোখে। আহমদ মুসার চোখেও। বলল আহমদ মুসা, নামটাকে আপনি বাঁচাতে গেলেন কেন?
নিনা নাদিয়া তার মুখ নিচু করল। বলল, আহমদ মুসা নামের সাথে আমার জীবনের একটা মর্মান্তিক স্মৃতি জড়িত।’ তাই মৃত্যুর মুখে উপস্থিত তাঁর নাম যখন আহমদ মুসা শুনলাম, তখন সেই স্মৃতি এসে আমাকে পাগল করে তুলেছিল। সব কিছু ভুলে আমি তাকেই বাঁচাতে গিয়েছিলাম এবং আক্রমণে আসার জন্যে তাকে রিভলবার সরবরাহ করেছিলাম।
খুব কৌতূহল সেই স্মৃতি সম্পর্কে, যার সাথে আহমদ মুসার নাম জড়িত। আমি কি এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারি বোন? বলল এমিলিয়া।
না জিজ্ঞেস করতে পারার মত ওটা কোন প্রাইভেট ব্যাপার নয়।
বলে থামল নিনা নাদিয়া। মাথা নিচু করল। বলল, সে আমার জীবনের এক দুর্ভাগ্যের কাহিনী। ইসরাইলে আমার জন্ম। আমি মুসলিম পিতা ও ইহুদি মাতার সন্তান। বড় হয়ে জেনেছি আমার পিতা ওমর আব্দুল্লাহ ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের একজন আন্ডার গ্রাউন্ড কর্মকর্তা ছিলেন। আর মা ছিলেন ইসরাইল গোয়েন্দা সংস্থার একজন অফিসার। পরিকল্পনা করেই মা’কে আমার পিতার প্ল্যান্ট করা হয়। পিতার মাধ্যমে ফিলিস্তিন জনশক্তি ও নানা গোপন তথ্য যোগাড় করে ইসরাইলী গোয়েন্দা বিভাগকে সরবরাহ করাই ছিল আমার মায়ের কাজ। আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছি, মা সর্বদা আমাকে আমার পিতা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছেন। শিশুকালে আমার মা আমাকে রেখেছেন ডে-কেয়ার সেন্টারে। একটু বড় হলে আবাসিক কিন্ডার গার্টেনে। আরও বড় হলে মা আমাকে পাঠিয়ে দেন তেল আবিবে। আমি তেল আবিবে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা করি। ছুটিতে বাড়ি যেতাম, তখনও দেখেছি আমি পিতার সাথে গল্প-গুজব করার মত এক্সক্লুসিভ সুযোগ পাইনি। সে সুযোগ মা আমাকে দেননি। কার্যত মা আমাকে ইহুদি হিসেবেই গড়ে তোলেন। আমার পিতা সব সময় বাইরে ব্যস্ত থাকতেন বলে এসব কোন খবর তিনি রাখতেন না, মায়ের ওপরই নির্ভর করতেন সব ব্যাপারে। আমার চিন্তা ও মন-মানসিকতা ছিল ইহুদিদের পক্ষেই। মুসলমানদের আজাদী চিন্তা আমার বিদ্রোহ বলে মনে হতো। পিতা এ সবের কিছুই জানতেন না। তিনি আমাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। আমার বেপরোয়া খরচে মা অনেক সময় রাগ করতেন। পিতা-মাকে বুঝাতেন, নাদিয়াই তো আমাদের সংসার। সংসারের সবকিছু তো তার জন্যে। ওর মনে কোন কষ্ট দিও না। পিতার এই ভালবাসাকে কোন দিনই মূল্য দেইনি।
তারপর এল সেই মর্মান্তিক দিন।
আমি সেদিন বাড়িতে ছিলাম।
পিতা শরীর খারাপ লাগছে বলে ঘুমাতে গিয়েছিলেন। মা ও আমি বসে টিভি দেখছিলাম।
মা’কে একটু অস্থির বলে মনে হচ্ছিল। একটু পরপর ঘড়ি দেখছিলেন তিনি।
এক সময় বলে উঠলেন। মা তুমি ঘুমাতে যাও। আমাকে একটু অফিসে যেতে হবে।
আমি জানতাম মা একটি তথ্যকেন্দ্রে কাজ করেন। তথ্যকেন্দ্রের কাজ ২৪ ঘণ্টা চলে। পরে জেনেছিলাম তথ্য কেন্দ্রটি আসলে গোয়েন্দা অফিস।
মা চলে গেলে আমি শুতে চলে গেলাম।
চিৎকার ও কথাবার্তায় আমার ঘুম ভেঙে গেল।
তাড়াতাড়ি উঠে বাইরে গেলাম।
বাড়ির ভেতরে আমার পিতা হাত-পা বাঁধা অবস্থায়। তার উপর অমানুষিক নির্যাতন চলছে। তার দেহ রক্তাক্ত। তার হাতে পায়ের আঙুলে সুচ ফোটানো হচ্ছে। চাকু দিয়ে তার গায়ের চামড়া কেটে নেয়া হচ্ছে। একজন তাকে অবিরাম জিজ্ঞাসা করে চলেছে, ‘মুসলিম কমান্ডোদের যে গোপন তালিকা তুমি আজ পেয়েছ এবং নেটওয়ার্কের যে প্ল্যান পেয়েছ, সেটা আমাদের দাও। আমরা তোমাকে ছেড়ে দেব।’ অন্যদিকে আমার পিতা বলে চলেছেন, ‘সে তালিকা ও নেটওয়ার্ক প্ল্যান তোমরা পাবে না। তোমরা যা ইচ্ছা কর।’
পিতার ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে চলল।
আমি ছুটে গেলাম আম্মার ঘরে তিনি আছেন কিনা দেখার জন্যে। দেখলাম তার বেড শূন্য। অর্থাৎ তিনি তখনও ফেরেননি।
আমি কি করব ভেবে পেলাম না। দেখলাম বাইরে বেরোনোর গেটে চারজন ইসরাইলী পুলিশ।
আমি গিয়ে কিছু বলতে পারবো না তা আমার কাছে পরিষ্কার। রাগ হলো পিতার প্রতিই। কেন তিনি মুসলমানদের জন্যে কাজ করেন, কেন তিনি তালিকাটা ও নেটওয়ার্ক প্ল্যান ওদের দিয়ে দিচ্ছেন না? এদিক থেকে আমার পিতাকে তারা অপরাধী মনে করে, বিদ্রোহী ও ষড়যন্ত্রকারী বলে মনে করে। সুতরাং শাস্তি তো তারা দেবেই।
একজন চিৎকার করে উঠল, ‘চেষ্টা করে লাভ নেই। হারামজাদা মুখ খুলবে না। শেষ করে দে তাকে।’
একজন ক্রুব্ধ মানুষ ছুড়ি নিয়ে ছুটে গিয়ে আমার পিতাকে এলোপাতাড়ি কোপাতে লাগল। আরেকজন গিয়ে তার বুকে ছুরি বসিয়ে দিল।
আমি চিৎকার করে চোখ বুঝলাম। শুনতে পেলাম পিতার কণ্ঠ। তিনি সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলছে, ‘তোমাদের দিন শেষ ইসরাইলিরা। আহমদ মুসা এসেছে, আহমদ মুসা, আহমদ মুসা। তিনি আল্লাহর তরফ থেকে সাহায্য স্বরূপ এসেছেন। তিনি বিজয়ী হবেন; তোমরা পরাজিত হবে। শোন, তোমরা শোন, শুনে যাও, আহমদ মুসা বিজয়ী হবেন। তিনি নতুন প্রভাত আনবেন।’
এক সময় থেমে গেল পিতার কণ্ঠ।
আমি ভয়ে ভয়ে চোখ খুললাম। দেখলাম, ওরা কেউ কোথাও নেই।
নেতিয়ে পড়ে আছে আমার পিতার দেহ।
আমি ছুটে গেলাম।
পিতা তখন জীবিত নেই।
আমি আছড়ে পড়লাম পিতার রক্তমাখা বুকের উপর। হঠাৎ মনে হলো, পিতাকে আমি খুবই ভালবাসি।
কিন্তু একথা শোনার জন্যে তখন তিনি বেঁচে নেই।
কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে নিনা নাদিয়ার। তার দু’চোখ থেকে নীরবে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল অবিরামভাবে। এবার সে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
সবারই চোখ ভিজা। অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল আহমদ মুসার চোখ থেকেও। কে কাকে সান্তনা দেবে!
একটু পর চোখ মুছে মাথা তুলল নিনা নাদিয়া।
বলতে লাগল ভাঙা কণ্ঠে, পিতার মৃত্যুর পর আমরা স্থায়ীভাবে উঠে গেলাম তেলআবিবে। লেখাপড়া শেষ করে মায়ের তাকিদেই ইসরাইলী গোয়েন্দা বিভাগে যোগ দিলাম। মা বিয়ে করলেন একজন গোয়েন্দা অফিসারকে।
সব ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার সৎ পিতা গোয়েন্দা প্রধানের মুখে আহমদ মুসার নাম শুনলাম, তখন ভুলে যাওয়া পিতা আমার সামনে হাজির হলেন। ‘আহমদ মুসা বিজয়ী হবেন’-এই শব্দ আমার কানে বজ্রের মত বাজতে লাগল। যখন দেখলাম আমার পিতার সেই আহমদ মুসা মৃত্যুর মুখে এবং পরাজিত হতে চলেছে আমারই সৎ পিতা গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল শামিল এরফানের হাতে, তখন আমি যেন পাগল হয়ে গেলাম। মনে হলো, আমার পিতার সেই আহমদ মুসাকে বাঁচানো, তাকে বিজয়ী করা আমার একমাত্র কাজ, পিতার দেয়া কাজ তার সন্তানের একমাত্র দায়িত্ব। মনে হলো, আমি মুসলিম মুক্তি সংগ্রামী ওমর আব্দুল্লাহরই সন্তান, আমার আর কিছু পরিচয় নেই। এই পরিচয়ের কথা মনে হতেই আমি গুলী করেছিলাম আমার সৎ পিতা জেনারেল শামিল এরফানকে। আবেগ-রুদ্ধ হয়ে থেমে গেল নিনা নাদিয়ার কণ্ঠ।
ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স (সিনবেথ) প্রধান জেনারেল শামিল এরফান আপনার সৎ পিতা? বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
হ্যাঁ। আমার পিতার মৃত্যুর এক বছর পর আমার মা তাঁকে বিয়ে করেন। বলল নিনা নাদিয়া। কণ্ঠ তার ভারী।
এমিলিয়া নতমুখী নিনা নাদিয়ার কাঁধে হাত রাখল। বলল, একটা অসম্ভব কাজ আপনি করেছেন। আপনার মা বেঁচে আছেন নিশ্চয়।
হ্যাঁ, বেঁচে আছেন। তিনি গোয়েন্দা বিভাগের একজন সিনিয়র অফিসার। আমি পেরেছি কারণ আমার সৎপিতা ও তার গোয়েন্দা বিভাগই আমার পিতাকে খুন করেছে নৃশংসভাবে। আমি সেদিন না বুঝলেও পরে বুঝেছি, আমার মা জানতেন সেদিন রাতে আমার পিতাকে হত্যা করা হবে। তাই তিনি পরিকল্পিতভাবেই বাড়ির বাইরে চলে গিয়েছিলেন।
আলহামদুলিল্লাহ। মা নাদিয়া, আল্লাহ তোমার প্রতি খুশি হোন। তারই দয়ায় তোমার আসল পরিচয়ে ফিরতে পেরেছ। এ রকম বড় ঘটনা খুব কমই ঘটে। আলহামদুলিল্লাহ। বলল শেখ খতিব আব্দুল্লাহ।
নিনা নাদিয়া শেখ খতিবকে বাউ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাল। বলল, মুহতারাম হযরত, আমি আমার পরিচয় ফিরে পেয়েছি সবকিছু হারিয়ে। পিতার কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ আমি পাইনি। এমন হল যে, আমার মাও আমাকে কোনদিন ক্ষমা করবেন না। ভারী হয়ে উঠেছিল নিনা নাদিয়ার কণ্ঠ।
মিস নিনা নাদিয়া, সবকিছু হারানোর পর সবকিছু পাওয়ার সময় আসে, এটাই সৃষ্টির একটা নিয়ম। আহমদ মুসা বলল।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল নিনা নাদিয়া। কিন্তু তার পকেটের মোবাইল বেজে ওঠল এই সময়।
নিনা নাদিয়া চুপ করে গিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করল। মোবাইলের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে মোবাইল আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরে বলল, জনাব, আপনার টেলিফোন।
আহমদ মুসা মোবাইলটি নিল।
আহমদ মুসা গানবোটে উঠেই ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মাহমুদের কম্যুনিকেশন কক্ষে আহমদ মুসারা ফিরে আসছে এ খবর জানিয়ে তার কনট্যাক্ট পয়েন্ট হিসেবে নিনা নাদিয়ার নাম্বার দিয়েছিল। এর অল্প পরেই প্রধানমন্ত্রী কল ব্যাক করে আহমদ মুসাকে। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে ও আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলে যে, তাদের স্বাগত জানানোর জন্যে তারা আসছেন।
আহমদ মুসা সালাম দিতেই ওপার থেকে মাহমুদের কণ্ঠ পেল। বলল, আপনারা কোথায় আহমদ মুসা ভাই?
আহমদ মুসা গানবোটের ড্যাশ বোর্ডের লোকেশন চার্টের দিকে চেয়ে তাদের অবস্থানের অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ বলে দিল।
ওপার থেকে মাহমুদ বলল, আপনারা আমাদের জল সীমায় এসে গেছেন। আমরাও এসে গেছি।
অল্পক্ষণের মধ্যেই জংগী বিমান, হেলিকপ্টারের শব্দ শোনা গেল।
কয়েক মুহূর্ত পরেই আকাশে তিনটি জংগী বিমান দুটি হেলিকপ্টার দেখা গেল। ওগুলো গানবোটের উপরে টহল দিতে লাগল।
আর কিছুক্ষণ পরে এল দুটি নৌ যুদ্ধ জাহাজ।
জাহাজ দু’টি দু’দিক থেকে আহমদ মুসাদের গান বোটের দিকে এগিয়ে এল। গান বোট থেকে জাহাজে প্রথম উঠে এল শেখ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান দের ইয়াসিনি। তাকে স্বাগত জানাল প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ।
তারপর একে একে নেমে এল নিনা নাদিয়া ও এমিলিয়া। সব শেষে জাহাজে উঠল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরল প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ। কথা বলতে গিয়েও মাহমুদ কথা বলতে পারল না। আবেগে ভেঙে পড়ল তার কণ্ঠ। দু’চোখ থেকে তার নেমে এল অশ্রুর ঢল, কৃতজ্ঞতার অশ্রু, আনন্দের অশ্রু।
পাশে দাঁড়িয়েছিল এমিলিয়া, নিনা নাদিয়া। তাদের চোখেও অশ্রু টলটল করছে।
শেখ আব্দুল্লাহ আব্দুর রহমান আগেই বসেছেন একটা ডেক চেয়ারে। বলল ধীর কণ্ঠে, মাহমুদ কৃতজ্ঞতার অশ্রু দিয়ে আহমদ মুসাকে দুর্বল করো না। আল্লাহর সৈনিক হিসেবে যা করার সেটাই তো করেছে।
নিনা নাদিয়া তাকাল শেখ আব্দুল্লাহ আব্দুর রহমানের দিকে। চোখের সামনে ভেসে ওঠল তার পিতার অন্তিম দৃশ্য। তিনি জীবন দিয়েছেন, কিন্তু মুসলিম কমান্ডোদের তালিকা ও তাদের নেটওয়ার্কের বিবরণ শত্রুর হাতে অর্পণ করেননি। তিনি আল্লাহর এমন একনিষ্ঠ সৈনিক ছিলেন! গর্বে ফুলে ওঠল নিনা নাদিয়ার বুক।