অন্ধকার যখন নামল

অন্ধকার যখন নামল

পিচরাস্তার দু-পাশে কোথাও দিগন্তবিস্তৃত ফাঁকা জমি, কোথাও আবার বুনো গাছের জঙ্গল। অনেক দূরে দূরে কখনও কখনও গ্রামের প্রান্তদেশের দু-একটা বাড়ি-ঘর দেখা যাচ্ছে। শীতের দুপুর হলেও রোদ বেশ কড়া। গাড়ির ভিতর বসে বেশ একটু গরমও অনুভূত হচ্ছে। গায়ের থেকে ইতিমধ্যে সোয়েটর, জ্যাকেট এসব খুলে ফেলেছে তারা। এমনও হতে পারে যে টানা পাঁচ ঘণ্টা গাড়িটার মধ্যে তীর্থের অ্যালসেশিয়ান কুকুরটা সমেত তারা পাঁচজন ঠেসাঠেসি করে বসে আছে বলেই তাদের গরমটা বেশি লাগছে। রৌনকদের এই পুরোনো গাড়িটাতে আবার এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবস্থা নেই।

রৌনককেই এতটা পথ গাড়িটা চালিয়ে আনতে হচ্ছে। গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতে বলল, ”কী রে সুপর্ণ, তোর ‘সবুজ গ্রাম’ কোথায় রে? চারপাশে তো জনমানবের চিহ্ন নেই!” ইন্দ্র কথাটা শুনে বলল, ‘তোরা আর পিকনিক করার জায়গা খুঁজে পেলি না! বেলা একটা বেজে গেছে, অথচ সে জায়গাতে এখনও পৌঁছতে পারলাম না! এদিকে আমার পেট খিদেতে চুঁইচুঁই করছে।’

তাদের পাঁচজনের মধ্যে বিকাশই একমাত্র ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে। গাড়িতে উঠলেই ঘুমিয়ে পড়া তার স্বভাব। যেন পিকনিকে নয়, ঘুমোবার জন্য সে বেরিয়েছে!

নদিয়া জেলার প্রান্তসীমায় ‘সবুজ গ্রাম’ নামে জায়গাটাতে পিকনিক করার প্রস্তাবটা প্রথমে দিয়েছিল সুপর্ণই। রৌনকের প্রশ্ন, আর ইন্দ্রর কথার খোঁচা শুনে সে আমতা আমতা করে বলল, ‘আর একটু এগিয়ে দেখ না? নিশ্চয়ই পৌঁছে যাব।’

তার এ কথায় ইন্দ্র বেশ উষ্মা প্রকাশ করে বলল, ‘কত আর এগোব! এগোতে এগোতে তো এবার মনে হয় বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছে যাব। এর থেকে কলকাতার কাছে বারাসতের দিকে কোনো বাগানবাড়িতে পিকনিকে গেলেই হত। সুপর্ণ আর কোথাও যাবার জায়গা খুঁজে পেল না! মোবাইল নেটওয়ার্কও চলে গেছে! লোকেশন ম্যাপ দেখারও উপায় নেই!’

কথাটা কানে যেতেই সুপর্ণ খেপে উঠে বলল, ”আমার এখানে দোষটা কোথায়? যে ভ্রমণ ম্যাগাজিনে পিকনিক স্পটের কথাটা লেখা ছিল সেটা তো তোদের সবাইকে দেখিয়েই ছিলাম। তোরাই তো তখন বললি, হ্যাঁ, এখানেই যাব। নতুন জায়গা। গাছগাছালি, নদী, সবকিছুই আছে। বেশি পিকনিক পার্টি যায় না বলে আমাদের কেউ ডিস্টার্বও করবে না। এখন আবার আমার ওপর দোষ চাপাচ্ছিস কেন? আমি কি তোদের পায়ে ধরেছিলাম ‘সবুজ গ্রামে’ যাবার জন্য?”

সুপর্ণর কথার জবাবে ইন্দ্র কিছু একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু কথোপকথন ঝগড়ার দিকে এগোচ্ছে দেখে তাদের থামাবার জন্য তীর্থ তাদের ধমকে উঠে বলল, ‘তোরা সবাই চুপ কর। ঝামেলা করলে এখানেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ব। আর কিছুটা এগিয়ে দেখা যাক।’

তীর্থের কথা শুনে তার পায়ের কাছে বসা কুকুরটা—গুন্ডাও ধমকের স্বরে ডেকে উঠল।

তীর্থকেই এই বন্ধুদের গ্রুপের দলপতি বলা যায়। সে অন্যদের থেকে কিছুটা ডাকাবুকো ধরনের। অন্যদের বিপদে সে সবসময় ঝাঁপিয়ে পড়ে, আবার স্কুলজীবনে পড়াশোনা—খেলাধুলাতেও বরাবর সে অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকত। বন্ধুরা প্রত্যেকেই তার কথা শুনে চলে। কাজেই তার কথা শুনে থেমে গেল সবাই। আগের মতোই চলতে থাকল গাড়ি। কিছুটা এগোবার পর দূর থেকে তারা দেখতে পেল রাস্তা দু—দিকে ভাগ হয়ে গেছে। তা দেখে রৌনক বলল, ‘এবার কোন রাস্তা ধরতে হবে কে জানে?’

কিন্তু রাস্তা যেখানে ভাগ হয়েছে তার কাছাকাছি সুপর্ণ সামনে তাকিয়ে বলল, ‘ওই দ্যাখ! আমরা কাছাকাছি পৌঁছে গেছি!’

পথ যেখানে দু—ভাগে ভাগ হয়েছে তার ঠিক মাঝখানের জমিতে পোঁতা বাঁশের মাথায় একটা টিনের সাইনবোর্ড ঝুলছে। তাতে আঁকা—বাঁকা হরফে কালো রং বা আলকাতরা দিয়ে লেখা—’সবুজ গ্রাম’। আর তার ঠিক নীচেই বাঁশের গায়ে পেরেক দিয়ে পোঁতা একটা কাঠের তির সবুজ গ্রামের পথনির্দেশ করছে। ডানদিকের রাস্তা ধরতে হবে সবুজ গ্রামে পৌঁছতে হলে।

শুধু সুপর্ণই নয়, সাইনবোর্ডটা দেখে তীর্থ সহ সবাই উল্লাসধ্বনি করে উঠল। এমনকি বিকাশও ঘুম ভেঙে উঠে বলল, ‘আমরা পৌঁছে গেলাম নাকি!’

রৌনক ‘সবুজ গ্রাম’ যাবার নির্দেশিত পথে, ডানদিকের রাস্তাতে গাড়ি ঢুকিয়ে দিল। ক্লান্তি মুছে আবার নতুন উদ্যমে এগোতে থাকল তারা। রাস্তার দু—পাশের ঝোপঝাড় কিছুক্ষণের মধ্যেই বদলে যেতে লাগল বড় বড় বড় গাছে। পথের দু—পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো দু—দিক থেকে তাদের ডালপালা প্রসারিত করে যাত্রাপথের মাথার ওপর চাঁদোয়া রচনা করেছে। রোদের আলো ঝিলিক দিচ্ছে তাদের ফাঁক দিয়ে। একসময় মাথার ওপরের সেই পাতা—ডালপালার চাঁদোয়ার আস্তরণ যেন আরও ঘন হয়ে এল। ছায়াময় হয়ে উঠল পথটা। এগিয়ে চলল তারা।

কিন্তু বেশ অনেকটা পথ এগোবার পরও কোনো লোকালয়ের দেখা মিলল না! আবারও কেমন যেন আশঙ্কার দানা বাঁধতে শুরু করল সবার মনে। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে রৌনক বলল, ‘এদিকেও তো পথ শেষ হচ্ছে না।’ ঠিক এই সময় তারা দেখতে পেল কিছুটা তফাতে রাস্তার পাশের জঙ্গলের ভিতর থেকে একজন লোক বেরিয়ে গাড়িটার উদ্দেশে হাত তুলে দাঁড়াল। রৌনক তার সামনে পৌঁছে ব্রেক কষে গাড়িটা দাঁড় করাল।

গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল লোকটা। মাঝবয়সি একজন লোক, তীর্থ ভালো করে তাকাল লোকটার দিকে। লোকটার একটা চোখ কানা। চোয়াল আর মুখের গড়ন কেমন যেন ছুঁচোলো ধরনের! নাকের নীচে ঝাঁটার কাঠির মতো কয়েকটা গোঁফ। খালি গা, খালি পা, পরনে শুধু একটা খাকি হাফপ্যান্ট। লোকটার রোমশ বুকে, হাতে ঝুরো মাটি—ধুলো লেগে আছে। তাকে দেখলেই মনে হয় স্থানীয় গ্রামীণ মানুষ।

তীর্থ লোকটার উদ্দেশে বলল, ‘আমরা পিকনিক করতে যাচ্ছি সবুজ গ্রামে। সে জায়গা আর কত দূর? গাড়ি থামালে কেন?’ হলদেটে দাঁত বার করে হাসল লোকটা। তারপর বলল, ‘আপনারা ভুল পথে এসেছেন বাবু। ও জায়গা এখান থেকে বিশ মাইল পিছনে রাস্তা যেখানে দু—ভাগে ভাগ হয়েছে সেখান থেকে বামদিকের পথ। আপনারা ভুল পথে এসেছেন বুঝতে পেরে গাড়ি থামালাম।’

কথাটা শুনে তীর্থ বিস্মিতভাবে বলে উঠল, ‘কিন্তু সেখানে কাঠের তিরচিহ্ন দিয়ে এ পথটাই তো দেখানো ছিল!’

তীর্থের কথায় লোকটা বলল, ‘অমন হয় মাঝে মাঝে। বাতাসে তিরটা অন্যদিকে ঘুরে যায়।’

লোকটার কথা শুনে আঁতকে উঠল সবাই। ভুল পথে চলে এসেছে তারা! বেলা তো প্রায় দুটো বাজতে চলেছে! গাড়ি ঘুরিয়ে কখনই বা তারা সে পথে পৌঁছবে? তারপর রান্নাবান্না করে কখনই বা খাবে? নাকি চড়ুইভাতি না করেই কলকাতার পথে রওনা হতে হবে তাদের?

গাড়ির পিছনের অংশে হাঁড়ি, কড়াই, বাজার ইত্যাদি মালপত্র রাখা আছে। সেগুলো দেখতে পেয়ে আর সম্ভবত তীর্থদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে লোকটা এরপর তাদের উদ্দেশে বলল, ‘বাবুরা ইচ্ছা করলে এখানেই চড়ুইভাতি করতে পারেন। গাছগুলোর আড়ালে বেশ সুন্দর ফাঁকা জায়গা আছে।’

লোকটার কথা শুনে ইন্দ্র অন্যদের উদ্দেশে বলল, ‘কথাটা কিন্তু মন্দ নয়। আর কোথাও গিয়ে কাজ নেই। এখানেই নেমে পড়ি।’

রৌনক বলল, ‘তা নয় বুঝলাম। কিন্তু রান্না হবে কীভাবে? ভ্রমণের বইটাতে লেখা ছিল সবুজ গ্রামের পিকনিক স্পটে গ্যাসের সিলিন্ডার, ওভেন এসব পাওয়া যায়। সে কারণে আমরা তো গ্যাস সিলিন্ডার, ওভেন এসব সঙ্গে আনিনি।’

কথাটা কানে গেল লোকটার। এক চোখে তাকিয়ে সে বলল, ‘উনুনের ব্যাপারে চিন্তা করবেন না বাবুরা। আমি উনুন খুঁড়ে দেব। জঙ্গল থেকে কাঠ আনা, বাসনপত্র ধোয়ামোছা, সব কাজ আমি করে দেব।’

লোকটার কথা শুনে সবাই তাকাল তীর্থের দিকে। সে এই দলের মাথা। তার সিদ্ধান্তের ওপর সব কিছু নির্ভর করছে। অবস্থা বিবেচনা করে তীর্থ বুঝতে পারল, তাদের যদি চড়ুইভাতি করতেই হয় তবে এখানেই নামতে হবে। শীতের ছোট বেলা। পাঁচটা—সাড়ে পাঁচটা নাগাদই অন্ধকার নেমে যাবে। সবুজ গ্রামে গিয়ে রান্নার আয়োজন করতে না করতেই হয়তো সূর্য ঢলে যাবে।

তীর্থ লোকটাকে প্রশ্ন করল, ‘এসব কাজের জন্য তোমাকে কী দিতে হবে?’

লোকটা হেসে বলল, ‘তেমন কিছু নয়। পিকনিকে যখন এসেছেন তখন নিশ্চয়ই সঙ্গে মাংস এনেছেন? দুটো মাংস খেতে দিলেই হবে।’

তীর্থ লোকটার কথা শুনে অনুমান করল লোকটা নিতান্তই গরিব মানুষ। মাংস কিনে খাবার ক্ষমতা তার নেই। তাই দুটো মাংস—ভাত খাবার লোভে তাদেরকে সাহায্য করতে চাইছে।

তীর্থ লোকটার উদ্দেশে প্রথমে বলল, ‘হ্যাঁ, মাংস আমাদের সঙ্গে এনেছি। আর খাবার যা বাঁচবে তাও তোমাকে দেব আর কিছু বকশিশও দেব।’

এ কথা বলার পর তীর্থ সঙ্গীদের উদ্দেশে বলল, ‘চল তবে এখানেই নেমে পড়ি।’

গুন্ডা শুয়ে ছিল তীর্থের পায়ের কাছে। তীর্থ তার গলাতে পরানো নাইলনের ফিতেটা ধরে টানতে কুকুরটা প্রথমে উঠে দাঁড়াল। তারপর গাড়ির জানলার বাইরে লোকটাকে দেখতে পেয়েই তীব্র গর্জন করে উঠল।

কুকুরটাকে আগে দেখতে পায়নি বাইরে দাঁড়ানো লোকটা। গুন্ডাকে দেখতে পেয়ে আর তার উদ্দেশে গর্জন শুনে লোকটা সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে ছিটকে দূরে সরে গেল। বিস্ময় মাখানো মৃদু ভয়ার্তভাবে সে বলে উঠল, ‘আপনাদের সঙ্গে কুকুর আছে!’ কুকুরের ভয়ে লোকটা চলে গেলে মুশকিল হবে। লোকটার উদ্দেশে গর্জন করেই চলেছে গুন্ডা! তীর্থ গুন্ডার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে লোকটাকে আশ্বস্ত করার জন্য বলল, ‘তোমার কোনো ভয় নেই। ও কাউকে কোনোদিন কামড়ায় না। তোমাকে নতুন লোক দেখে অমন করছে।’

গাড়ি থেকে নেমে পড়ল সবাই। তীর্থ, গুন্ডার গলার বকলসের ফিতেটা ধরে গাড়ি থেকে নামতেই সে লোকটার উদ্দেশে গর্জন করে এগোতে গেল। তীর্থ ফিতেটা ধরে গন্ডাকে নিয়ে গাড়ি থেকে কিছুটা তফাতে সরে গিয়ে আবারও লোকটাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘ভয় পেয়ো না। একটু পরই ও তোমাকে চিনে ফেলবে। তখন আর ডাকবে না। আমি ধরে আছি ওকে। তোমার নাম কী?’

তীর্থের কথা শুনে লোকটা মনে হয় সাহস পেল। সে বলল, ‘হ্যাঁ, ওকে বেঁধেই রাখবেন। আমি কুকুর ভয় পাই। আমার নাম বুজরুক।’

অন্য সবাইও গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। গাড়ির ভিতর থেকে রান্নার বাসনপত্র, বাজার, জলের ব্যারেল, শতরঞ্চি এসবও নামানো শুরু হল। গুন্ডাকে নিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে কাজের তদারকি করতে লাগল তীর্থ। গুন্ডা তখনও ডেকেই চলেছে লোকটার উদ্দেশে। জিনিসপত্র নামিয়ে ফেলা হল গাড়ি থেকে। তার মধ্যে সব থেকে ভারী জিনিস হল পলিথিনের চল্লিশ লিটারের জলের ব্যারেলটা। বিকাশ থেকে রৌনক মিলে ধরাধরি করে সেটা গাড়ি থেকে নামাতেই বুজরুক নামের লোকটা একাই সেটা কাঁধে তুলে নিল। তা দেখে তীর্থরা বুঝতে পারল গ্রাম্য লোকটা বেশ পরিশ্রমী আর তার শরীরে শক্তিও আছে। জলের পাত্রটা কাঁধে তুলে নিয়ে ইশারাতে সে তীর্থদের অনুসরণ করতে বলল তাকে। সবাই অন্য মালপত্র নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে তার পিছনে এগোল। সবার পিছনে তীর্থ চলল তার কুকুরের গলার নাইলনের ফিতে ধরে।

কুড়ি—পঁচিশ পা হেঁটেই রাস্তার গায়ের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা সুঁড়িপথ। সেখানে ঢুকে পড়ল লোকটা, আর তার পিছন পিছন অন্যরা। সে পথে কিছুটা এগোতেই তীর্থদের সামনে থেকে গাছের প্রাচীর সরে গেল। উন্মুক্ত হল একটা ডিম্বাকৃতি ফাঁকা জমি। তার চারপাশের বড় বড় গাছ আর তাদের পাদদেশের ঝোপঝাড়গুলো যেন প্রাচীরের মতো ঘিরে রেখেছে মাঠটাকে। শীতের দুপুরের নরম রোদ খেলা করছে ফাঁকা জমিটাতে। তবে মাঠটা চারপাশের গাছের বেষ্টনী থেকে কয়েক পা নীচে। ঢালু পথ বেয়ে জমিটাতে নেমে পড়ল বুজরুক। অন্যরাও নামতে থাকল। সবার শেষে নামল তীর্থ। কিন্তু গুন্ডা জমিটাতে নেমেই মাটিটা একবার শুঁকল। আর তারপরই মুখ ফিরিয়ে পিছু হটার চেষ্টা করল। সে যেন আর এগোতে চায় না। তীর্থ তার বকলসের ফিতে ধরে সামনে টানার চেষ্টা করতে লাগল। তাই দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল অন্যরা। বুজরুকও পিছন ফিরে তাকাল তীর্থের দিকে। তীর্থর মনে হল তাকে আর গুন্ডাকে দেখে এবার ভয় নয়, কেমন যেন একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল বুজরুকের ঝাঁটার মতো গোঁফের নীচে ছুঁচোলো ঠোঁটে। তীর্থের উদ্দেশে সে বলল, ‘কুকুরটাকে বরং আপনি গাড়িতেই রেখে আসুন। কুকুরটা বাঘের মতো দেখতে হলেও মনে হয় ও ভীতু। অচেনা জায়গাতে আসতে ভয় পাচ্ছে।’

বুজরুকের কথা শুনে সুপর্ণ, ইন্দ্র হেসে ফেলল। বুজরুকের কথায় আর বন্ধুদের হাসি দেখে আঁতে ঘা লাগল তীর্থের। বন্ধুমহলে তার বেশ গর্ববোধ আছে গুন্ডা নামের তার এই বিরাট সারমেয়টিকে নিয়ে। বুজরুক নামের লোকটার উদ্দেশে মৃদু ধমকে উঠে তীর্থ বলল, ‘ওকে কোথায় রাখব তা নিয়ে ভাবতে হবে না। তুমি এগোও।’

ধমক শুনে লোকটা আবার সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করল। অন্যরা এগোল। আর তীর্থও তার কুকুরটাকে টেনে—হিঁচড়ে নিয়ে চলল মাঠের ভিতর দিকে। তীর্থ খেয়াল করল মাঠের মধ্যে বেশ কয়েকটা জায়গাতে ছোট—বড় উনুনের গর্ত আছে। বুজরুকের পিছন পিছন সবাই গিয়ে উপস্থিত হল জমিটার বিপরীত দিকে জঙ্গলের গায়ে একটা বড় গাছের সামনে। জলের পাত্রটা সে মাটিতে নামিয়ে রেখে বলল, ‘এখানে আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না। দাঁড়ান, আমি আগে কাঠ নিয়ে আসি, তারপর চট করে উনুন বানিয়ে দেব।’

বুজরুক যে জায়গাতে এনে তাদের দাঁড় করাল, তার কাছাকাছিও মাটির মধ্যে বেশ কয়েকটা ছোট—বড় গর্ত আছে। দু—একটা গর্তের সামনে পোড়াকাঠও আছে। তা দেখে রৌনক লোকটাকে প্রশ্ন করল, ‘এত উনুনের গর্ত কেন?’

প্রশ্ন শুনে লোকটা হেসে চারপাশের গর্তগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনাদের মতো ভুল করে অনেকে অনেক সময় এখানে চলে এসে এখানেই চড়ুইভাতি করে। তাদেরই উনুনের গর্ত। আমিই খুঁড়ে দিয়েছি। আপনাদের জন্যও নতুন গর্ত খুঁড়ে দেব। নতুন গর্তে ভালো আগুন জ্বলবে।’— কথাগুলো বলে জমিটার গায়ে বনের মধ্যে ঢুকে গেল বুজরুক।

গাছটার কাছেই ফাঁকা জমিতে জিনিসপত্র নামিয়ে শতরঞ্চি বিছানো শুরু হয়ে গেল। কোথাও অন্য কোনো লোকজন নেই। জঙ্গল থেকে শুধু পাতা খসার খসখস শব্দ ভেসে আসছে। মাঠের ভিতর বেশ ঠান্ডা বাতাস থাকলেও দুপুরের রোদে একটা মিঠে আমেজ অনুভূত হচ্ছে! সুপর্ণ বলল, ‘জায়গাটা কিন্তু বেশ লাগছে! কেমন নিরিবিলি! বিরক্ত করার কেউ নেই। অন্য পিকনিক স্পটগুলোর মতো লাউড স্পিকারের কান ফাটানো অত্যাচারও নেই।’

ইন্দ্র বলল, ‘ঠিক তাই। চারপাশের জঙ্গলগুলো দেখে মনে হচ্ছে এবার আমরা সত্যিই বনভোজন করতে এসেছি!’

তীর্থ তাদের কথা শুনে হাসল। কিছু সময় আগে চলন্ত গাড়িতে এদের দুজনের মধ্যেই ঝগড়া বাধার উপক্রম হচ্ছিল। মিনিট পনেরোর মধ্যেই শুকনো কাঠ—ডালপালার বিরাট বোঝা নিয়ে বেরিয়ে এল বুজরুক। যেখানে শতরঞ্চি বিছানো হয়েছে তার কিছুটা তফাতে মাঠের মধ্যে কাঠগুলো নামিয়ে রেখে একটা ছুঁচোলো কাঠের টুকরো নিয়ে লোকটা গর্ত করার কাজ শুরু করতে যেতেই গুন্ডা তার উদ্দেশে আবার ভয়ংকর চিৎকার শুরু করল। তীর্থ তার গলার ফিতে খুলে দিলেই যেন সে লাফিয়ে পড়বে লোকটার ওপর! বুজরুক একবার তাকাল গুন্ডার দিকে। তারপর মাটি খোঁড়ায় মন দিল। প্রথমে ছুঁচোলো কাঠের টুকরোর কয়েক ঘা দিয়ে কিছুটা মাটি উঠিয়ে নিল সে। তারপর কাঠটা ফেলে দিয়ে দু—হাত দিয়েই মাটি সরাতে লাগল সে। তার মাটি খোঁড়ার ভঙ্গি দেখে তীর্থের মনে হল, যেভাবে কুকুর—বিড়াল জাতীয় প্রাণীরা মাটি খোঁড়ে ঠিক সেভাবেই যেন দু—হাতে মাটি খুঁড়ে চলেছে লোকটা! বুজরুকের গর্ত খোঁড়া দেখতে দেখতে আরও একটা জিনিস এবার খেয়াল করল তীর্থ। লোকটার হাতের নখগুলোও বেশ বড় বড়! সেজন্যই ওভাবে গর্ত খুঁড়তে পারছে সে। যতক্ষণ বুজরুক গর্ত খুঁড়ল ততক্ষণ ডেকেই চলল গুন্ডা। তারপর সে কেমন যেন অদ্ভুত নিশ্চুপ হয়ে গেল।

গর্ত খুঁড়ে, কাঠ দিয়ে উনুন সাজিয়ে ফেলল বুজরুক। বিকাশ এরপর উনুনটা ধরিয়ে ফেলল। হাতে বেশি সময় নেই। তাই শুধু মাংস—ভাত রান্না হবে বলেই ঠিক হল। চাল ধুয়ে প্রথমে ডেকচিতে ভাত বসানো হল। তারপর শতরঞ্চিতে তাস নিয়ে আড্ডা দিতে বসল সবাই। তীর্থও এগিয়ে গেল শতরঞ্চির দিকে। কিন্তু গুন্ডা কিছুতেই বসতে চাইল না শতরঞ্চিতে। বারবার উঠে দাঁড়িয়ে সে তাকাতে লাগল চারদিকে। অগত্যা কিছুটা বাধ্য হয়েই তীর্থ তাকে নিয়ে গিয়ে কাছেই একটা সরু গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বেঁধে এল। তারপর অন্যদের পাশে বসল। তীর্থ শতরঞ্চিতে বসতেই বুজরুক তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। দাঁত বার করে সে বলল—’বাবুরা তালের রস খাবেন? খাঁটি তালের রস?’

রৌনক জানতে চাইলো, ‘তালের রস তুমি কোথায় পাবে?’

বুজরুক বলল, ‘জঙ্গলের মধ্যে গাছ আছে। আমিই হাড়ি ঝুলিয়েছি। কিনতে হবে না। আনি?’

তীর্থরা সবাই শহরে মানুষ। তালের রসের কথা শুনলেও তা চেখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কাজেই রৌনক বলল, ‘যাও যানো, দেখি কেমন খেতে?’

তাদের সম্মতি পেয়ে বুজরুক জঙ্গলে ঢুকে কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা মাটির হাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এসে সেটা রাখল তীর্থদের সামনে। হাড়িতে ফেনা ওঠা তালের রস। ঝাঁঝালো মিষ্টি গন্ধ বেরোচ্ছে। তীর্থ একটা প্লাস্টিকের গ্লাসে রস ঢেলে নিয়ে চাখল। স্বাদটা তার ভালো লাগল না। কিন্তু অন্য তিন জনের বেশ লাগল তালের রস। ধীরে ধীরে তারা হাড়ি শেষ করে ফেলল।

এরপর তারা তাস আর আড্ডায় মাতল। সূর্য দ্রুত এগোতে লাগল বিকেলের দিকে। গল্প করতে করতে কখন যে ভাত ফুটে গেছে তা খেয়ালই ছিল না তীর্থদের। বুজরুকের কথাতে সংবিৎ ফিরল তাদের— ‘বাবু, চাল রান্না হয়ে গেছে।’

তীর্থ দেখল ঘড়িতে কখন যেন চারটে বেজে গেছে। সে আর সুপর্ণ তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে ভাতের ডেকচিটা নামিয়ে নিল। এরপর উনুনে ডেকচি বসিয়ে সুপর্ণ যখন তাতে পাঁঠার মাংসগুলো ছাড়তে যাবে, ঠিক সেই সময় বুজরুক বলে উঠল, ‘বাবুদের একটা কথা বলি? আমাকে তো আপনারা মাংস দেবেনই। যদি এখনই তা দিয়ে দেন?’

ইন্দ্র কথাটা শুনতে পেয়ে বলল, ‘কাঁচা মাংস নিয়ে তুমি কী করবে?’

বুজরুক একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ঘরের জন্য নিয়ে যাব। ছেলে—মেয়েদের দেব।’

তীর্থের কথাটা শুনে বেশ মায়া হল লোকটার প্রতি। গরিব মানুষ এই লোকটা। মাংস কিনে খাবার ক্ষমতা নেই। তাই কাঁচা মাংস বাড়ি নিয়ে গিয়ে রান্না করে ছেলেপুলে নিয়ে একসঙ্গে খেতে চাইছে!— এ কথা ভেবে তীর্থ রৌনককে বলল— ‘ও যখন বলছে তখন কাঁচা মাংসই দিয়ে দে ওকে।’

হাসি ফুটে উঠল বুজরুকের মুখে। কয়েকটা বড় পাতা কুড়িয়ে আনল সে। রৌনক তীর্থের কথামতো কাঁচা মাংসই দিল। একটু বেশি পরিমাণেই দিল।

মাংস চাপিয়ে আবার শতরঞ্চিতে আড্ডা দিতে বসল তারা। বিকেল হবার সঙ্গে সঙ্গেই রোদ মরে আসতে শুরু করেছে। শীতের বিকেল দ্রুত শেষ হয়েই ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই অন্ধকার নামবে। মাংস রান্না হয়ে গেলেই খাওয়া সেরে তারা রওনা হয়ে যাবে কলকাতার দিকে। বিকাশ বলল, ‘এ জায়গাতে যদি বেলা থাকতে থাকতে আসা যেত তবে জঙ্গলের মধ্যেও ঘেরা যেত।’

নিজেদের মধ্যে নানা ধরনের গল্প, হাসি—মশকরা চলতে লাগল। একসময় ধীরে ধীরে মাংসের গন্ধও ছড়াতে শুরু করল।

তখন মাংস রান্না প্রায় হয়ে এসেছে। হঠাৎ যেন বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর কুকুরটা আবার ডাকতে শুরু করল। না, ঠিক গর্জনের মতো ডাক নয়, অদ্ভুত একটা গোঙানির মতো শব্দ করতে লাগল সে। গুন্ডাকে এমনভাবে আগে কোনোদিন ডাকতে শোনেনি তীর্থ। কিন্তু কুকুরটা একইভাবে ডেকে চলল। গুন্ডার ডাকে মাঝে মাঝে আড্ডায় ছেদ পড়তে লাগল। তীর্থ বুঝতে পারল গুন্ডার আচরণে স্পষ্ট বিরক্তবোধ করছে বন্ধুরা। রৌনক একসময় তীর্থকে বলেই ফেলল, ‘তুই বরং আমার থেকে গাড়ির চাবিটা নিয়ে ওকে গাড়িতে রেখে আয়। আর তো ঘণ্টাখানেকের ব্যাপার মাত্র। কোনো কারণে ওর এ জায়গা পছন্দ হচ্ছে না।’

রৌনক বলল, ‘হ্যাঁ, সেটাই ভালো। ও যেমনভাবে চেঁচাচ্ছে তাতে শান্তিতে খেতে দেবে না। রান্না তো প্রায় হয়েই এল। সামান্য সময় ও ঠিক গাড়িতে থাকতে পারবে।’

গুন্ডার আচরণে বন্ধুরা বিরক্তবোধ করছে দেখে কুকুরটাকে গাড়িতে রেখে আসবার জন্য রৌনকের থেকে গাড়ির চাবিটা নিয়ে শতরঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তীর্থ। বুজরুক মাঠের মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে তীর্থ গুন্ডার কাছে গিয়ে গাছের গা থেকে তার ফিতেটা খুলে নিল। তারপর গুন্ডাকে নিয়ে মাঠ পেরিয়ে উল্টোদিকে গাছের আড়ালে রাস্তায় যেখানে গাড়িটা রাখা আছে সেদিকে যাবার জন্য এগোল। গুন্ডা চিৎকার থামিয়ে এগোল তার সঙ্গে। সন্দিগ্ধভাবে মাঠের চারপাশে তাকাতে তাকাতে, জমি শুঁকতে শুঁকতে এগোতে লাগল সে। মাঠের ঠিক মাঝখানে পৌঁছে হঠাৎই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে দাঁত বার করে গড়গড় করে উঠল গুন্ডা। কিছুটা তফাতেই একটা উনুনের গর্ত। সেদিকে তাকিয়েই দাঁড়িয়ে পড়েছে সে। ভালো করে গর্তটার দিকে তাকিয়ে তীর্থের একটা জিনিস চোখে পড়ল। গর্তের ঠিক মুখটাতেই এক টুকরো কাঁচা মাংস পড়ে আছে! বুজরুক নামের লোকটা মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার কাছ থেকেই নিশ্চয়ই অসাবধানতায় মাংসটা খসে পড়েছে গর্তের মুখে। এ কথা ভেবে নিয়ে গর্তটার পাশ কাটিয়ে গুন্ডাকে নিয়ে তীর্থ এগোল। জঙ্গলের আড়ালে সূর্য ঢলতে শুরু করেছে। দিনের আলো দ্রুত ফুরোতে চলেছে। বেশ কিছুটা জমি পেরোবার পর রাস্তার কাছাকাছি জঙ্গলের গায়ের প্রায় সামনে পৌঁছে আবারও একটা গর্তের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে ঠিক আগের মতোই গর্জে উঠল গুন্ডা। সেই গর্তটার দিকে তাকিয়ে এবার সত্যিই বেশ আশ্চর্য হয়ে গেল তীর্থ। এ গর্তটার ঠিক মুখে আছে কাঁচা মাংসের টুকরো! তবে কি বুজরুক নামের ওই লোকটা নিজেই মাঠের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে মাংসের টুকরো ছড়াচ্ছে? লোকটা পাগল নাকি? অদ্ভুত লোক তো! তীর্থ তাকাল তার বেশ কিছুটা দূরে মাঠের মাঝখানে তার দিকে পিছন ফিরে ঘুরতে থাকা বুজরুকের দিকে। হাত দুটো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার। খালি হাত! যাক গে! সে তার ভাগের মাংস নিয়ে যা করেছে করুক!— এ কথা ভেবে নিয়ে তীর্থ এরপর মাঠ ছেড়ে উঠে সুঁড়িপথ ভেঙে এগোল রাস্তার দিকে। গাড়ির দরজা খুলতেই এক লাফে ভিতরে ঢুকে পড়ল গুন্ডা। গাড়ির একটা জানলার কাচ কিছুটা নামিয়ে দরজা বন্ধ করে ফেরার পথ ধরল তীর্থ। সে যখন মাঠে নামল তখন সূর্য বনের আড়ালে চলে গেছে। অন্ধকার নামার আগেই খাওয়া সেরে মালপত্র গুছিয়ে তাদের ফিরতে হবে। তীর্থ তাই দ্রুত এগোল মাঠের অন্য প্রান্তে তার বন্ধুদের দিকে।

সে যখন তার বন্ধুদের কাছে পৌঁছোল তখন মাংস রান্না হয়ে গেছে। উনুনের ওপর মাংসের ডেকচিতে খুন্তি নাড়াবার পর বিকাশ সেটা শতরঞ্চির কাছে নামিয়ে আনছে। কিছুটা তফাতে উবু হয়ে বসে আছে বুজরুক নামের লোকটা। তীর্থের একবার মনে হল মাংস ফেলার ব্যাপারটা সম্বন্ধে প্রশ্ন করে লোকটাকে। কিন্তু এরপরই তার মনে হল ব্যাপারটা তার বন্ধুদের কানে গেলে হয়তো তারা পয়সা দিয়ে কেনা দামি মাংস এভাবে নষ্ট করার জন্য ঝামেলা বাধিয়ে দেবে লোকটার সঙ্গে। বাসনপত্র মাজিয়ে নিতে হবে লোকটাকে দিয়ে। তাই শেষবেলাতে ঝগড়াঝাঁটির সম্ভাবনা এড়াতে তীর্থ আর কোনো প্রশ্ন করল না লোকটাকে।

তীর্থরা যখন খেতে বসল, তখন বনের আড়ালে সূর্য সত্যিই ডুবে গেছে। বাতাস বেশ ঠান্ডা হয়ে এসেছে। সন্ধ্যা নামার প্রস্তুতিতে মাঠের ওপর পাতলা কুয়াশার চাদর ভাসতে শুরু করেছে।

বেশ তৃপ্তি করেই ভাত—মাংস খেল সবাই মিলে। খাওয়া শেষ করে যখন তারা উঠে দাঁড়াল, তখন সন্ধ্যা নামতে চলেছে।

তীর্থ বলল, ‘চল এবার তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে আমাদের।’

বুজরুকও এবার উঠে দাঁড়িয়েছে। সে তাদের বলল, ‘বাবুরা মুখ—হাত ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিন। আপনাদের চিন্তা নেই। আমি বাসনপত্তর ধুয়ে, সব কিছু গুছিয়ে গাড়িতে তুলে দেব।’

খাবার পর হাত—মুখ ধুয়ে তীর্থ ছাড়া অন্যরা শতরঞ্চিতে বসে পড়ল। ইন্দ্র ঢেকুর তুলে বলল, ‘যা ভরপেট খেলাম তাতে সত্যিই একটু বসে নেওয়া দরকার। ভাত খাবার আগে থেকেই রসটা খাবার পর থেকেই কেমন যেন ঝিমুনি লাগছে!’

রৌনক বলল, ‘আমারও একই অবস্থা। দশ মিনিট না বসলে চলবে না।’

তাকে সমর্থন করে বিকাশ বলল, ‘হ্যাঁ, আমারও ঘুম—ঘুম ভাব আসছে।’

সবাই শরীর এলিয়ে বসল, তীর্থ ছাড়া। তাকে এবার শেষ কাজটুকুর তদারকি করতে হবে।

বুজরুক নামের লোকটা এরপর তার কথামতোই জিনিসপত্র গোছানো, বাসন ধোয়ার কাজ শুরু করল। কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে তীর্থের মনে হতে লাগল যেন অতি ধীরে হাত—পা—নাড়িয়ে কাজ করছে লোকটা!

এদিকে দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে। সূর্য ডুবে গেছে বেশ কিছু সময় আগে। জঙ্গলের ভিতরের অংশ ইতিমধ্যেই ডুবে যেতে শুরু করেছে গাঢ় অন্ধকারের আড়ালে।

তীর্থ তাকাল তার বন্ধুদের দিকে। তালের রস তারপর ভরপেট মাংস—ভাত খেয়ে কেমন একটা ঝিমুনি এসেছে তাদের মধ্যে। বুজরুক নামের লোকটার প্রতি তাদের কোনো খেয়ালই নেই। বাসনপত্রগুলো যেন লোকটা মেজেই চলেছে। তীর্থ তার উদ্দেশে বলল, ‘তাড়াতাড়ি করো। আমাদের ফিরতে হবে। এত ধীরে কাজ করলে হয়? দুটো হাঁড়ি—ডেকচি মাজতে আর কত সময় লাগবে?’

লোকটা বলল, ‘এই তো বাবু, এখনই হল বলে।’

বুজরুক মুখে কথাটা বলল ঠিকই, কিন্তু তীর্থের মনে হল আগের থেকেও যেন শ্লথ হয়ে এল লোকটা হাত! বাসনগুলোর গায়ে অতি ধীরে হাত বোলাতে বোলাতে চারপাশে তাকিয়ে বুজরুক নামের লোকটা যেন কোনো কিছুর জন্য প্রতীক্ষা করছে। জঙ্গলের অন্ধকার এবার মাঠের ভিতরও প্রবেশ করতে শুরু করেছে!

না, আর দেরি করা চলে না। এই সামান্য কটা বাসন মাজতে কি এত সময় লাগে? একসময় তীর্থ বাধ্য হয়ে লোকটার উদ্দেশে বলল, ‘থাক। যথেষ্ট হয়েছে। আর কাজ করতে হবে না।’

কথাটা শুনে বুজরুক উঠে দাঁড়িয়ে হেসে বলল, ‘হ্যাঁ। আর কাজ করতে হবে না।’

তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই যেন কেউ একটা কালো চাদর বিছিয়ে দিল সেই অচেনা মাঠে। আর এর পরমুহূর্তেই চারদিক থেকে একটা বীভৎস শব্দ উঠল! সম্মিলিত শিয়ালের ডাক। কেমন যেন অতিপ্রাকৃত রক্ত—জল—করা বীভৎস সেই শব্দ। আচম্বিতে সেই শব্দ শুনে তীর্থের সঙ্গীদের তন্দ্রাচ্ছন্ন, শিথিল ভাবটা সামান্য হলেও কেটে গেল। উঠে দাঁড়াল তারা। আর এরপরই তীর্থ দেখতে পেল বিন্দু বিন্দু আলো যেন মাটির ভিতর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে সেই আলোক বিন্দুগুলো। তারা যখন একদম কাছে এগিয়ে এল তখন তীর্থরা বুঝতে পারল ওই জোড়া জোড়া আলোকবিন্দুগুলো আসলে শিয়ালের চোখ! তাদের শরীরের দুর্গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। অন্ধকারের মধ্যে তীর্থের বন্ধুদের মধ্যে কে যেন বলে উঠল, ‘এই প্রাণীগুলো এভাবে এগিয়ে আসছে কেন?’

প্রত্যুত্তরে যেন একটা হাসি শোনা গেল কাছ থেকে। বুজরুক যেন অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেছে! তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তীর্থের মনে হল হাসিটা যেন বুজরুক নামের লোকটাই হাসল!

আর এরপরই যে ঘটনা ঘটল তার জন্য তীর্থরা কেউই প্রস্তুত ছিল না। পালে পালে শিয়ালের দল তখন তাদের গর্ত থেকে উঠে এসেছে! অন্ধকারকে আলোড়িত বিদীর্ণ করে জান্তব আক্রোশে একবার সম্মিলিত উল্লাসধ্বনি করে উঠল সেই শ্বাপদের দল। তার পরক্ষণেই তারা ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল একসঙ্গে উঠে দাঁড়ানো তীর্থের সঙ্গীদের ওপর! মুহূর্তের মধ্যেই এক নারকীয় ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টি হল চারদিকে। মানুষের আর্তনাদ আর হিংস্র প্রাণীগুলোর ঝটাপটির শব্দে ভরে উঠল অন্ধকার অচেনা প্রান্তর। হিংস্র প্রাণীগুলো সোজা এসে কামড় বসাচ্ছে মানুষগুলোর শরীরে! তাদের একটাকে আঘাত করে দূরে সরালে তার পরক্ষণেই তিনটে প্রাণী গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মাংস খুবলে নিচ্ছে! তীর্থের দিকেও এগিয়ে এল বেশ কয়েকজোড়া হিংস্র চোখ। একটা প্রাণী তার উদ্দেশে লাফাতে যেতেই তীর্থ প্রচণ্ড জোরে লাথি কষাল তাকে লক্ষ্য করে। কয়েক হাত দূরে প্রাণীটা মাটির ওপর আছড়ে পড়ে একটা আর্তনাদ করে উঠল। আর সেই আর্তনাদ শুনে শিয়ালের দল প্রচণ্ড আক্রোশে সম্মিলিতভাবে বীভৎস চিৎকার করে উঠল। তীর্থের মনে হল মাঠের চারদিকের অন্ধকারের মধ্যে থেকে জোড়া জোড়া জ্বলন্ত চোখ এবার যেন তাকে লক্ষ্য করেই ছুটে আসছে। তীর্থ বুঝতে পারল, বাঁচতে হলে পালাতে হবে তাদের। বন্ধুদের উদ্দেশে সে বলে উঠল, ‘পালা, পালা, মাঠ ছেড়ে রাস্তার দিকে পালা!’

কথাগুলো বলেই মাঠের মধ্যে দিয়ে রাস্তার দিকে ছুটতে শুরু করল সে। বিকাশ আর রৌনক ততক্ষণে মাটিতে পড়ে গেছে। শিয়ালের দল খুবলে খেতে শুরু করেছে তাদের শরীর। সুপর্ণ আর ইন্দ্র কোনোরকমে ছুটতে শুরু করল তীর্থের কথা শুনে। আর একদল শিয়ালও ছুটতে শুরু করল তাদের পিছনে। মাঝমাঠে পৌঁছে একটা গর্তের মধ্যে পা ঢুকে মাটিতে পড়ে গেল সুপর্ণ। মুহূর্তের মধ্যে মৌমাছির পালের মতো তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পিছনে ছুটে আসা শিয়ালদের একটা দল। সুপর্ণ কোনো আর্তনাদ করারও সুযোগ পেল না। আর বাকিরা ছুটে চলল তীর্থ আর ইন্দ্রের পিছনে। প্রথমে ছুটছে তীর্থ, তার কিছুটা তফাতে ইন্দ্র আর তার পিছনেই উন্মত্ত হিংস্র শিয়ালের দল।

তীর্থ যখন মাঠ ছেড়ে ওপরে উঠে জঙ্গল ভেঙে রাস্তার দিকে ছুটে যাচ্ছে তখন ইন্দ্রর শেষ আর্তচিৎকার শুনতে পেল তীর্থ। সে বুঝতে পারল হিংস্র প্রাণীগুলো ধরে ফেলল ইন্দ্রকে! তীর্থ এও বুঝতে পারল যে ইন্দ্রকে সাহায্য করতে যাবার চেষ্টা করা বৃথা। খালি হাতে এই উন্মত্ত হিংস্র প্রাণীগুলোর সঙ্গে লড়াই করতে গেলে তাকেও ছিঁড়ে খাবে পশুগুলো! তাই তীর্থ আর পিছু না ফিরে ঝোপজঙ্গল ভেঙে ছুটল রাস্তার দিকে।

কোনোরকমে রাস্তায় পৌঁছে গেল তীর্থ। তাদের গাড়িটা একই জায়গাতে রয়েছে। একছুটে গাড়ির কাছে পৌঁছে গেল তীর্থ। তাকে দেখেই ডেকে উঠল গুন্ডা। তীর্থের কাছেই চাবি ছিল গাড়ির। কোনোরকমে দ্রুত চাবি দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ফেলল সে। তীর্থ যখন ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছে ঠিক তখনই পিছনে একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে পিছনে তাকিয়ে সে দেখল তার গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে একজন লোক। সম্ভবত লোকটা তার পিছনেই ছুটে এসেছে। অন্ধকার হলেও তার অবয়ব দেখে তাকে চিনতে অসুবিধা হল না তীর্থের। লোকটা তীর্থের কোনো বন্ধু নয়, সে বুজরুক! সেও কি তবে শিয়ালদের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এল, নাকি অন্য কোনো ব্যাপার? গাড়িতে উঠতে গিয়েও তার দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল তীর্থ। লোকটা গাড়ির আরও কাছে এগিয়ে এল। তীর্থর মনে হল কানা বুজরুকের একটা চোখ যেন শিয়ালগুলোর চোখের মতোই জ্বলছে! আর এরপরই প্রভুকে বাঁচাবার জন্য খোলা দরজা দিয়ে নেমে পড়ল গুন্ডা। বিশাল কুকুরটা তীর্থকে পাশ কাটিয়ে তিরবেগে ছুটে গিয়ে বিজাতীয় আক্রোশে গর্জন করে লাফ দিল বুজরুককে লক্ষ্য করে। অতবড় কুকুরটা লাফ দিয়ে তার বুকের ওপর পড়তেই টাল সামলাতে না পেরে লোকটা মাটিতে পড়ে গেল। তার গলা থেকেও বেরিয়ে এল একটা চিৎকার। তবে সেই চিৎকার মানুষের নয়, শিয়ালের ডাক। আর সেই চিৎকার করা মাত্রই তার জবাবে সেই মাঠের দিক থেকে ভেসে এল অনেকগুলো শিয়ালের রক্ত—জল—করা চিৎকার। মাঠ ছেড়ে রাস্তার দিকে শিয়ালের ঝাঁক ছুটে আসতে লাগল চিৎকার করতে করতে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তীর্থ আর সময় নষ্ট না করে গাড়ির ভিতর উঠে দরজা বন্ধ করে চাবি দিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট করে গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে দিল। আর সেই আলোতে তীর্থ গাড়ির ভিতর থেকে দেখল প্রবল বিক্রমে লড়ে চলেছে গুন্ডা। তবে যার সঙ্গে সে মরণপণ লড়াইতে অবতীর্ণ হয়েছে সে কোনো মানুষ নয়, বিরাট বড় একটা শিয়াল। তারা দুজনেই আঁচড়ে, কামড়ে পরস্পরকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করার চেষ্টা করছে! আর এরপরই সেখানে এসে হাজির হয়ে গেল সেই শিয়ালের দল! জোড়া জোড়া হিংস্র জ্বলন্ত চোখ। তাদের একদল ঝাঁপিয়ে পড়ল লড়তে থাকা কুকুরটার ওপর, আর একদল চারপাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল গাড়ির ওপর, কাচ ভেঙে তীর্থকে বাইরে টেনে নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলার জন্য। তাদের শরীরের আঘাতে থর থর করে কেঁপে উঠতে লাগল গাড়িটা। কয়েকটা শিয়াল লাফিয়ে উঠল গাড়ির বনেটে। তাদের হিংস্র দাঁত আর তীর্থের শরীরের মধ্যে শুধু একটা কাচের চাদরের ব্যবধান। গাড়িটাকে গিয়ারে দিয়ে শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিল তীর্থ। প্রাণীগুলো ছিটকে পড়ল গাড়ির ওপর থেকে। তীর্থ সামনের রাস্তা ধরে তিরবেগে ছুটিয়ে দিল তার গাড়ি। সেই মাঠে পড়ে রইল তার চার বন্ধু— রৌনক, ইন্দ্র, বিকাশ, সুপর্ণ, আর সেই হিংস্র শিয়ালের দল।

পরদিন তীর্থ যখন আবার সেই মাঠের কাছের রাস্তাটায় উপস্থিত হল, তখন সূর্য মাথার ওপরে অনেকটাই উঠে গেছে। গত রাতে রাস্তা ধরে এগিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা গ্রামে পৌঁছে গেছিল তীর্থ। রাতে আর এ জায়গাতে ফিরে আসার মতো পরিস্থিতি ছিল না তীর্থের। আতঙ্ক কাটিয়ে একটু সুস্থ হতেই অনেক সময় লেগে গেছিল তার। সকাল হতেই একদল গ্রামবাসী প্রথমে তাকে থানায় নিয়ে গেছিল, সেখান থেকে পুলিশের গাড়ি নিয়ে এ জায়গায় আসতে বেলা প্রায় দশটা হয়ে গেছে। গ্রামবাসীদের নিয়ে তীর্থের গাড়ি আর পুলিশের গাড়িটা এসে ঠিক সেই জায়গাতে দাঁড়াল, যে জায়গাতে গতকাল ছিল তীর্থদের গাড়িটা। তীর্থসমেত সবাই গাড়ি থেকে নেমে প্রথমেই দেখতে পেল রাস্তার একপাশে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে গুন্ডার মৃতদেহ। শিয়ালের দল ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করেছে গুন্ডাকে। গ্রামবাসী বা পুলিশের কাছে তীর্থ সব কথা বললেও পাছে তারা তাকে পাগল ভাবে সেজন্য সেই ভয়ংকর কথাটা বলেনি তীর্থ। সে তাদের বলেনি যে সে তার চোখের সামনে বুজরুক নামের সেই কানা লোকটাকে শিয়ালে পরিণত হতে দেখেছে! তীর্থ শুধু তাদের বলেছে সে যখন গাড়িতে উঠে পালাচ্ছিল তখন তার কুকুরটা লড়াই করছিল একটা বিরাট শিয়ালের সঙ্গে।

গুন্ডার অন্তিম পরিণতি দেখার পর একজন পুলিশ অফিসারের নেতৃত্বে, পুলিশকর্মী আর গ্রামবাসীদের সঙ্গে তীর্থ মন শক্ত করে সেই মাঠের দিকে এগোল আরও ভয়াবহ কোনো দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার জন্য। জঙ্গলের বেড়া ভেঙে তারা মাঠের সামনে এসে দাঁড়াল। না, কোথাও কোনো অন্ধকার নেই, নেই আর্তনাদ বা শিয়ালদের সেই বীভৎস চিৎকার। আলো ঝলমল করছে মাঠটাতে। সবাই মিলে মাঠে নেমে পড়ল। কিছুটা তফাতে তফাতে জেগে আছে সেই গর্তগুলো। গতকাল সেই গর্তগুলো ভালো করে খেয়াল করেনি তীর্থরা। ভালো করে গর্তগুলো খেয়াল করলেই তারা দেখতে পেত গর্তের ভিতর থেকে সুড়ঙ্গ চলে গেছে মাটির গভীরে। একটা গর্তের দিকে তাকিয়ে তীর্থ ভয়ার্তভাবে বলল, ‘এই গর্তগুলোর ভিতর থেকেই উঠে এসেছিল প্রাণীগুলো। আমরা এ গর্তগুলোকে উনুনের গর্ত ভেবে ভুল করেছিলাম। একমাত্র আমার কুকুরটা ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিল। আমরা তার আচরণে আমল দিইনি।’

তীর্থের কথা শুনে পুলিশ অফিসার বললেন, ‘গর্তগুলোর মুখগুলো কিন্তু উনুনের গর্তের মতোই। যেন মানুষের হাতেই খোঁড়া।’

পুলিশ অফিসারের কথা শুনে একজন বৃদ্ধ গ্রামবাসী বলল, ‘গর্তগুলো মানুষের হাতেই খোঁড়া। এই বাবু যে কানা বুজরুকের কথা বলছেন, সে—ই এই গর্তগুলো খুঁড়েছিল উনুন বানাবার জন্য। শীতকালে অনেক সময় নিরিবিলি জায়গাতে চড়ুইভাতি করার জন্য এখানেও আসত শহরের মানুষরা। সবুজ গ্রামের পিকনিকের জায়গা তখনও তৈরি হয়নি। বুজরুক তাদের জন্য মাঠে উনুনের গর্ত খুঁড়ে দিত। সেই গর্তগুলোর মধ্যেই সুড়ঙ্গ তৈরি করে বাসা বানিয়েছিল শিয়ালের দল। কিন্তু বুজরুক যে এখনও বেঁচে আছে, এই বাবুর মুখে তার কথা না শুনলে আমরা জানতামই না!’

মাঠের অপর প্রান্তে যেখানে তীর্থরা শতরঞ্চি বিছিয়ে পিকনিক করেছিল, সেদিকে এগোতে এগোতে পুলিশ অফিসার লোকটার কথা শুনে প্রশ্ন করলেন, ‘লোকটা যে বেঁচে আছে তা জানতেন না কেন?’

চলতে চলতে সেই গ্রামবাসী বলল, ‘এ জায়গাতে একটা ঘটনা ঘটেছিল বেশ কয়েক বছর আগে। শুধু শীতের সময় এখানে লোকজন পিকনিক করতে আসত। বুজরুক তাদের জন্য প্রত্যেকবার নতুন উনুনের গর্ত খুঁড়ে দিত। কারণ শীত শেষ হলেই গর্তের মধ্যে বাসা বাঁধত শিয়ালের দল। বুজরুক ব্যাপারটা জানত। সেবার শহর থেকে একটা বাস ভর্তি করে এখানে পিকনিক করতে এসেছিল একদল উচ্ছ্বঙ্খল যুবক। বুজরুক তাদের জন্যও উনুনের গর্ত খুঁড়েছিল। কিন্তু কীভাবে যেন সেই ছেলে—ছোকরার দল বুঝতে পেরেছিল যে মাঠের অনেক গর্তের মধ্যে শিয়াল থাকে। শিয়াল এমনিতে ভীতু প্রাণী। দিনের বেলাতে তারা বাইরে বেরোয় না। গর্তে শিয়াল আছে বুঝতে পেরে নিষ্ঠুর মজা করার জন্য সেই অসভ্য লোকগুলো গরম জল ঢালতে থাকল গর্তগুলোর ভিতর। আতঙ্কিত, নিরীহ প্রাণীগুলো পুড়ে যাওয়া অবস্থাতে গর্ত থেকে বাইরে বেরিয়ে ছোটাছুটি করতে লাগল। আর তা দেখে আমোদ পেতে লাগল নিষ্ঠুর লোকগুলো। তারপর বনভোজন করে ফিরে গেছিল তারা।’

এ কথা বলার পর লোকটা বলল, ‘ওই ঘটনার পর থেকে কয়লা বুজরুককে আর কেউ কোনোদিন দেখেনি। সে সময় একটা খবর রটেছিল। বুজরুক বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও যখন সেই শয়তান মানুষগুলো জল ঢালা থামাল না, তখন নাকি বুজরুক অসহায় নিরীহ প্রাণীগুলোর ওপর লোকগুলোর অত্যাচার আর সহ্য করতে না পেরে একটা লোক শিয়ালের গর্তে গরম জল ঢালতে যেতেই সেই গরম জল লোকটার গায়েই ঢেলে দিয়েছিল। আর তারপরই নাকি লোকগুলো বুজরুককে পিটিয়ে মেরে মাঠের কোথাও পুঁতে দিয়েছিল তার দেহ।’

গল্পটা শুনে পুলিশ অফিসার বললেন, ‘কিন্তু এই ভদ্রলোকের কথায় যখন জানাই যাচ্ছে যে বুজরুক বেঁচে আছে, তখন তাকে খুঁজে বার করা দরকার। তার থেকে জানতে হবে কেন এমন ঘটল।’

তীর্থরা পৌঁছে গেল সেই নির্দিষ্ট জায়গাতে। শতরঞ্চিটা আগের মতোই একই জায়গায় মাটির ওপর বিছানো আছে, জিনিসপত্রগুলোও ছড়িয়ে—ছিটিয়ে পড়ে আছে, কিছুটা তফাতে বুজরুকের খোঁড়া তীর্থদের উনুনের গর্তটাও আছে, কিন্তু তীর্থের সঙ্গীদের কোনো চিহ্ন নেই!

অফিসার বললেন, ‘শিয়ালের দল লোকগুলোকে খেয়ে ফেলেছে নাকি! চারপাশে খুঁড়ে দেখো যদি তাদের কোনো চিহ্ন মেলে। আর দেখো ওই বুজরুক কোথাও লুকিয়ে আছে কি না?’

তীর্থ আর পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে রইলেন শতরঞ্চির কাছে। আর অন্য পুলিশকর্মী আর গ্রামবাসীরা তল্লাশি শুরু করল মাঠ আর তার পাশের জঙ্গলে।

বেশ অনেকক্ষণ ধরে খোঁজ করার পর পুলিশকর্মী আর গ্রামবাসীরা আবার তীর্থদের কাছে ফিরে এল। না, মাঠ বা জঙ্গল, কোথাও তীর্থের সঙ্গীদের বা বুজরুকের চিহ্ন মেলেনি।

অফিসার বললেন, ‘তবে এখানে থেকে আর কোনো লাভ নেই। চলুন, থানায় ফিরে যা ব্যবস্থা নেবার নিতে হবে।’

অগত্যা ফেরার জন্য পা বাড়াতে যাচ্ছিল সবাই। ঠিক সেই সময় একটা অস্পষ্ট শব্দ ভেসে এল শতরঞ্চিটার কাছ থেকে।

শব্দটা শুনে একজন পুলিশকর্মী শতরঞ্চিটা মাটি থেকে উঠিয়ে ফেলতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল তীর্থসহ সকলের! সদ্য খোঁড়া বেশ বড় একটা গর্তে গুটিসুটি মেরে একসঙ্গে শুয়ে আছে চারটে পূর্ণবয়স্ক শিয়াল। তাদেরই নড়াচড়ার শব্দ কানে গেছিল তীর্থদের। সূর্যের আলো গর্তের মধ্যে পড়তেই চোখ বন্ধ করে ফেলল প্রাণীগুলো। তাদের মধ্যে কোনো হিংস্রতা নেই। বরং এতগুলো মানুষের কণ্ঠস্বর শুনে কাঁপতে লাগল ভীরু প্রাণীগুলো। বেশ অসহায় দেখতে লাগছে তাদের। কিছুক্ষণ তাদের দেখার পর গর্তটার ওপর আবার শতরঞ্চি ঢাকা দেওয়া হল। সে জায়গা ছেড়ে তীর্থদের উনুনের গর্তটার পাশ দিয়ে হেঁটে ফেরার পথ ধরল সবাই।

তীর্থরা যদি সেই উনুনের গর্তটা ভালো করে খেয়াল করত, তবে বুঝতে পারত সেই গর্তটাও সুড়ঙ্গের আকার নিয়েছে। তার গভীর অন্ধকারে যেখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করছে না সেখানে শুয়ে তীর্থদের কথাবার্তা শুনছিল একটা কানা শিয়াল। মনে মনে সে বলছিল, ‘শিয়ালের সংখ্যা আরও চারটে বাড়ল। আবারও নিশ্চয়ই পথ ভুল করে মানুষ আসবে এখানে, যেমন তারা আসে। বাড়তে থাকবে শিয়ালের সংখ্যা, যেমন বেড়ে চলেছে। তারপর একদিন আমরা দিনের আলোতেই গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব মানুষদের ওপর। টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলব নিষ্ঠুর পৃথিবীর নিষ্ঠুর মানুষগুলোকে।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *