অন্ধকারের নায়ক

অন্ধকারের নায়ক

০১.

কর্নেলের হাতে টলিউডের নায়িকার ছবি

দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিস থেকে কেটে পড়েছিলুম সন্ধ্যা সাতটায়। তারপর পার্ক স্ট্রিটে যেতে যেতে গাড়ির জ্যাম দেখে অগত্যা ফ্রি স্কুল হয়ে সোজা হাজির হয়েছিলুম ইলিয়ট রোড এলাকার সানি লজে। দারোয়ান গেট খুলে দিয়ে। মুচকি হেসে বলেছিল–কর্নিল সাবের অ্যাপার্টমেন্টে আভি টিকটিকি বাবু আসলেন। কুছু গড়বড় হুয়া মালুম হোতা। বুঝলুম কর্নেলের পরিচারক ষষ্ঠীচরণের। কাছে সে টিকটিকি বাবু কথাটা শিখেছে। টিকটিকি বাবু মানেই গোয়েন্দাপ্রবর কে কে হালদার অর্থাৎ আমাদের প্রিয় হালদারমশাই। কিন্তু কী গড়বড় হয়েছে, দারোয়ান খুলে বলল না। গাড়ি লনের পাশে পার্ক করে তিনতলায় উঠে যেতে যেতে ধরেই নিয়েছিলুম, এই অসময়ে হালদারমশায়ের আবির্ভাবের নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ কারণ থাকবারই কথা। ইদানীংকালে তাঁর গণেশ অ্যাভিনিউয়ে অবস্থিত প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে নাকি কেসের বড় অভাব। তাই অনুমান করা চলে, তিনি কোনও কেস হাতে পেয়েই তার কর্নেলস্যারের সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছেন। কিন্তু গড়বড় কী?

ডোরবেলের সুইচ টেপার একটু পরে ষষ্ঠীচরণ দরজা খুলে দিয়ে মুচকি হেসে চাপাস্বরে বলল–টিকটিকিবাবুর কপালে আর হাতের আঙুলে ব্যান্ডেজ বাঁধা। কোথায় মারামারি করে এসেছেন।

কথাটা বলেই ষষ্ঠী পাশের করিডর দিয়ে কিচেনের দিকে চলে গেল। আমি ছোটো ওয়েটিং রুমের ভেতর দিয়ে সাবধানে ড্রইংরুমের পর্দা তুললুম। তারপর দেখলুম ষষ্ঠীর কথা মিথ্যা নয়। হালদারমশাই সোফার একপ্রান্তে বসে চাপাস্বরে তার মাতৃভাষায় কিছু বলছেন এবং কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চুরুট টানছেন। সেন্টার টেবিলে ট্রেতে দুটো নিঃশেষিত কফির পেয়ালা। সত্যি একটা গড়বড় হয়েছে বোঝা গেল। আমাকে দেখামাত্র হালদারমশাই সোজা হয়ে বসলেন, তারপর বললেন–আয়েন জয়ন্তবাবু, এখনই আপনার কথা হইতাছিল। কর্নেলস্যারেরে কইলাম আপনারে ফোন করি। কিন্তু উনি কইলেন, ওয়েট করুন। আমার মন কইতাসে, জয়ন্ত আইয়া পড়বে। সোফায় বসে অবাক হয়ে বললুম–কর্নেল কি দিব্যচক্ষে আমার আসা দেখতে পাচ্ছিলেন? আমি তো নেহাত খেয়ালে চলে এসেছি। কর্নেল চোখ খুলে বললেন–হ্যাঁ জয়ন্ত, আজ সন্ধ্যায় তুমি যে আসবে তা আমি ধরেই নিয়েছিলুম। কারণ আজ শনিবার। শনিবারে তুমি অফিস থেকে শিগগির কেটে পড়ো এবং বিশেষ করে পার্ক স্ট্রিটে জ্যাম দেখলে শর্টকাট করতে গিয়ে এই বৃদ্ধকে দর্শন দিয়ে যাও।

বললুম–পার্ক স্ট্রিটে তো জ্যাম দেখলুম না।

হালদারমশাই বলে উঠলেন–তা হইলে পুলিশ কাজ শেষ কইরা থানায় ফিরছে।

এই সময়েই ষষ্ঠীচরণ আমার জন্য কফি রেখে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে বললুম–ব্যাপারটা তো বড্ড গোলমেলে ঠেকছে। কর্নেল বললেন পার্ক স্ট্রিটে জ্যাম আর হালদারমশাই বলছেন পুলিশ কাজ সেরে ফিরে গেছে। এদিকে হালদারমশায়ের কপালে আর আঙুলে ব্যান্ডেজ বাঁধা।

কর্নেল একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে মিটিমিটি হেসে বললেন–জয়ন্ত, আজ হালদারমশাই একটা বড়ো কীর্তি করেছেন। চন্দ্র জুয়েলার্সের দোকানে ডাকাতি হচ্ছিল। ডাকাতেরা এমন বেপরোয়া যে প্রকাশ্যেই দোকানের বাইরে কয়েকটা বোমা ফাটিয়েছিল। দৃশ্যটা কল্পনা করো। তিনদিকে তোক আর যানবাহনের ভিড়। ট্রাফিক পুলিশ ভয় পেয়ে দূরে দাঁড়িয়ে আছে আর এদিকে ট্যাক্সি চেপে হালদারমশাই আসছিলেন। ব্যাপারটা দেখামাত্র তিনি ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে তখনই রণক্ষেত্রে ঝাঁপ দিলেন।

হাঁ করে শুনছিলুম। বললুম–তার মানে উনি জেনেশুনে ডাকাত ধরতে গেলেন? হালদারমশাই উত্তেজিত ভাবে বললেন–মশায়, চৌত্রিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করসি, এমন কখনও দেখি নাই যে শয়ে শয়ে লোক খাড়াইয়া মজা দেখতাসে। পুলিশের পাত্তা নাই। জুয়েলারির দোকানের সামনে মুখে কালো কাপড় বাইন্ধা দুই ছ্যামড়া হাতে পিস্তল লইয়া নাচতাছে। আর

তার কথার ওপর বলে উঠলম–তা আপনি গিয়ে তাদের সঙ্গে কুস্তি লড়লেন?

কুস্তি, কন কি জয়ন্তবাবু আমার হাতে লোডেড সিক্স রাউন্ডার ফায়ার আর্মস। একখান ফায়ার করতেই এক ছ্যামড়ার পায়ে লাগল আর অন্যজনেরে আমি ধইরা ফেললাম আর সেই সঙ্গে চিকুর ছাইড়া হাঁক দিলাম পুলিশ পুলিশ। ভেতরে যারা ডাকাতি করতাছিল তারা বেগতিক দেইখ্যা পলাইয়া গেল।

-কিন্তু আপনার মাথায় আর হাতের আঙুলে কে মারল?

-যে ছ্যামড়ারে ধরছিলাম সে তার দিশি পিস্তলখান আমার কপালে মারল, বলে গোয়েন্দা প্রবর খিকখিক করে হেসে উঠলেন।–পিস্তলে আর গুলি ছিল না, থাকলেও আমার হাতে ফায়ার আর্মস। ঘটনাটা কইতে যতক্ষণ লাগল ঘটছিল তার দশভাগের একভাগ সময়ে। জিজ্ঞেস করলুম–যার পায়ে গুলি করেছিলেন তার কী অবস্থা হল?

–ততক্ষণ দোকানের লোক বারাইয়া আইছিল। তারাই অরে ধরল আর আমার কপালে যে মারছিল সে ভ্যানিশ হইয়া গেল।

–পুলিশ আসেনি?

হালদারমশাই গর্বিত মুখে বললেন–পাঁচ মিনিট পরে পুলিশ আইছিল। তারা আমারে দেইখ্যা কয় ফায়ার আর্মস হাতে লইয়া ডাকাতটা খাড়াইয়া আসে আর তারে আপনারা ধসেন না। দোকানের লোকেরা কইল, না, উনি আইয়া না পড়লে ডাকাতরা আরও অলঙ্কার চুরি কইরা পলাইত।

হাসতে হাসতে বললুম–তা আপনি পুলিশকে নিজের পরিচয় দিলেন না?

হালদারমশাই সগর্বে বললেন–হঃ। পকেট থেইক্যা আমার আইডেনটিটি কার্ড বার কইরা কইলাম আই অ্যাম এ রিটায়ার্ড পুলিশ ইনস্পেকটার অ্যান্ড নাও আই অ্যাম এ প্রফেশনাল ডিটেকটিভ।

এই সময়ে কর্নেল বলে উঠলেন-তবু হালদারমশায়ের ফাড়াকাটেনি। ওঁকে থানায় যেতে হয়েছিল। তারপর হালদারমশাই আমার নাম বলাতে ও সি অমিত মজুমদার আমাকে ফোন করেছিলেন।

হালদারমশাই আবার খিকখিক করে হেসে উঠলেন–পুলিশ জিপে কইর‍্যা আমারে কর্নেলস্যরের বাড়ির গেটে পৌঁছাইয়া দিছে।

বললুম–তাহলে দেখছি একটা সাংঘাতিক ঘটনার হাতে গরম খবর পাওয়া গেল। কিন্তু সমস্যা হল এই খবর লিখতে আবার যদি আমি কাগজের অফিসে যাই বিপদে পড়ব। কর্নেল বললেন–চন্দ্র জুয়েলার্সে ডাকাতির চেয়ে তোমার সামনে আরও একটা রোমাঞ্চকর খবর অপেক্ষা করে আছে জয়ন্ত।

আমি একটু অবাক হয়ে বললুম–বলেন কী। কথাটা বলেই পরক্ষণে মনে পড়ে গেল হালদারমশাই ট্যাক্সি চেপে কর্নেলের কাছে আসছিলেন। মানে তিনি কোন রোমাঞ্চকর রহস্যের কেস হাতে নিয়ে কর্নেলস্যরের কাছে পরামর্শ করতে আসছিলেন। তাই বললুম –হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি। হালদারমশাই নিশ্চয়ই একটা জব্বর কেস হাতে পেয়ে গেছেন। শুধু পথিমধ্যে একটু দুর্ঘটনা ঘটে আহত হয়েছেন। যাই হোক হালদারমশাই, আমাকে আপনার কেসের আভাস দিতে কি আপত্তি আছে?

হালদারমশাই একটিপ নস্যি নিয়ে নোংরা রুমালে নাক মুছে, বললেন কর্নেলস্যর আপনারে সব কইবেন।

-কেন আপনার বলার মুড নেই?

হালদারমশাই বললেন–নাঃ, রাত নটায় আমার ক্লায়েন্টের লগে দেখা করার কথা আছে। আমি উঠি। কর্নেলস্যার, তা হইলে আমি কাইল মর্নিং-এর ম্যাডামেরে লইয়া আপনার কাছে আসতাছি।

কর্নেল বললেন–ঠিক আছে। যেন বেলা ন-টার মধ্যে আসবেন। আর একটা কথা, আপনি চন্দ্র জুয়েলার্সে ডাকাতির কথা আপনার মক্কেলকে বলবেন না।

হালদরমশাই চমকে উঠে বললেন–ক্যান একথা কইলেন কর্নেলস্যার?

কর্নেল একটু হেসে বললেন–আপনার কপালে এবং আঙুলে কীভাবে চোট লেগেছে তা উনি যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে বলবেন বাসের হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে যাচ্ছিলেন ঝাঁকুনি খেয়ে পড়ে গেছেন।

গোয়েন্দাপ্রবরকে কেমন যেন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। তিনি চাপা শ্বাস ছেড়ে বললেন তা হইলে যাই গিয়া। জয়ন্তবাবু, চলি।

বললুম–আবার দেখা হবে।

হালদারমশাই কোনও জবাব না দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

কর্নেল চুরুটটা অ্যাশট্রেতে ঘষে নিবিয়ে রাখলেন। তারপর হাঁক দিলেন ষষ্ঠী–আমরা আর একবার কফি খাব। একপ্লেট স্ন্যাক্স দিয়ে যাবি। তোর দাদাবাবুর খিদে পাওয়ার কথা।

হাসতে হাসতে বললুম–খিদে পাবে কি, ঘটনার ঘনঘটায় আমি যেন ঘুরপাক খাচ্ছি। কর্নেল বললেন–ঘুরপাক আমিও খাচ্ছি, কারণ হালদারমশায়ের ক্লায়েন্ট যে ভদ্রমহিলা তাঁর একমাত্র ছেলে কুসংসর্গে পড়ে নাকি নিজের মাকে বিপদে ফেলেছে।

–বিপদটা কীসের?

কর্নেল চাপাস্বরে বললেন–ভবানীপুরে জনৈক প্রয়াত এম. পির ছেলের বেডরুমে তার বিধমা মা একটি ছোটো হাতব্যাগে অনেকগুলো সোনার গয়না এবং বিশেষ করে হিরে মুক্তো চুনি পান্না খচিত একখানা জড়োয়া নেকলেস আবিষ্কার করেছেন। ছেলেকে তিনি ভয় পান। তাছাড়া এই লুকিয়ে রাখা অলঙ্কারের খোঁজে যদি পুলিশ হানা দেয়। আরও বিপদ আছে তার ছেলের দুবৃত্ত বন্ধুরাও তার কোনো ক্ষতি করতে পারে, এইসব ভেবে তিনি ভীষণ উদ্বিগ্ন। কর্নেল গম্ভীরমুখে সাদা দাড়িতে হাত বুলোতে লাগলেন। একটু পরে ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে দু পেয়ালা কফি অর একপ্লেট চানাচুর এবং পটাটো চিপস এনে রাখল। সে হাসি মুখে বলল টিকটিকিবাবু খামোকা পথেঘাটে লোকের সঙ্গে ঝামেলা করেন।

কর্নেল তার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে বললেন–ঝামেলা তো তুইও। কম করিস না, এই সন্ধেবেলাই ওই ছাইপাঁশ না এনে একপ্লেট পকোড়া ভেজে আনতে পারতিস।

ষষ্ঠী হাসতে হাসতে বলল–বুঝেছি বাবামশায়ের পকোড়া খাবার ইচ্ছে হয়েছে। ঠিক আছে পরের বার কফির সঙ্গে পকোড়া দেব।

সে চলে যাবার পর বললুম–সাড়ে আটটা বাজে। পকোড়া খাবার সৌভাগ্য আমার আর হল না।

কর্নেল বললেন–হবে, এমনি কি আজ এখানে তোমার ডিনারেরও নেমন্তন্ন।

বললুম–আপনি আমাকে আটকে রেখে বলির পাঁঠা করতে চান। হালদারমশায়ের রোমাঞ্চকর রহস্যের ব্যাপারে আমাকে কেন্দ্র করে নিজের চিন্তাভাবনা চাঙ্গা করতে চান।

কর্নেল হেসে উঠলেন। তারপর বললেন–তা আমাকে দু-চারটে প্রশ্ন করে তোমার মতামতও চাইতে পারি।

এই সময়ে টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন তারপর ক্রমাগত হুঁ এবং হ্যাঁ করে থামলেন, শেষে বললেন–ঠিক আছে নরেশবাবু, আপনি বরং কাল দুপুরের দিকে আসুন। বলে রিসিভার রেখে আমার দিকে অর্থপূর্ণ চোখে তাকালেন। বললুম–নরেশবাবু মানে লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের নরেশ ধর? তাহলে তো রহস্য ইতিমধ্যে ঘনীভূত। অতএব আজ রাত্রে আপনার সঙ্গে ডিনার খাচ্ছি।…

.

০২.

মাঝে মাঝে আমাকে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে রাত কাটাতে হয় বলে আমার একসেট পোশাক অর টুকিটাকি সরঞ্জাম একটা ঘরে রাখতে হয়। সে রাতে আর সল্টলেকে আমার ফ্ল্যাটে ফিরে যাইনি। কারণ কর্নেলের হাতে হালদারমশাই একটা রহস্যময় কেস এনে দিয়েছেন। কাজেই আমার পেশার স্বার্থে কর্নেলের কাছাকাছি থাকা দরকার এবং বরাবর তাই থাকি।

পরদিন সকাল নটায় কর্নেলের জাদুঘর সদৃশ ড্রইংরুমে অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছিলুম। কর্নেলের অবশ্য কোনো চাঞ্চল্য লক্ষ্য করিনি। তিনি নির্বিকার মুখে চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। আমি সোফার এককোণে বসে সেদিনকার খবরের কাগজগুলোতে চোখ বুলোচ্ছিলুম। পার্ক স্ট্রিটে চন্দ্র জুয়েলার্সে ডাকাতির খবর কোনো কাগজেই তত গুরুত্ব দিয়ে ছাপেনি। তবে হালদারমশায়ের বদলে পুলিশের গুলিতে আহত একজন ডাকাতের ধরা পড়ার কথা আছে। হালদারমশায় এতে। মনঃক্ষুণ্ণ হবেন বলে মনে হয়। একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভের এই কীর্তি খবরে প্রচারিত হলে পেশার দিক থেকে তার লাভই হত। ঘড়িতে তখন ন-টা দশ। এমন সময়ে ডোরবেল বাজল এবং কর্নেল যথারীতি হাঁক দিলেন ষষ্ঠী। একটু পরে গোয়েন্দা প্রবরের আবির্ভাব ঘটল। তার সঙ্গে একজন প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা। তাঁর চেহারায় আভিজাত্য আছে। হালদারমশাই বললেন–আয়েন ম্যাডাম, এখানে বয়েন। ইনিই হইলেন গিয়া আমাগো কর্নেল স্যর, আর কর্নেলস্যার ইনি হইলেন গিয়া আমার ক্লায়েন্ট মিসেস সুরঞ্জনা রাচৌধুরী। আর ম্যাডাম! ইনি হইলেন গিয়া সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী। জয়ন্তবাবুর কথা আপনারে কইছিলাম।

সুরঞ্জনা, কর্নেল এবং আমাকে নমস্কার করলেন তারপর মৃদুস্বরে বললেন কর্নেল সাহেব! আপনার পরিচয় আমি মি. হালদারের কাছে পেয়েছি। খবরের কাগজে মি. হালদারের প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির খোঁজ পেয়ে আমি তার শরণাপন্ন হয়েছিলুম কিন্তু ঘটনাটা এমন বিপদজ্জনক এবং অস্বস্তিকর তা বলার নয়। আমার প্রায়াত স্বামী বীরেন রায়চৌধুরী ছিলেন একজন এম. পি। তাছাড়া ওঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন জমিদার। এমন পরিবারের ছেলে দুবৃত্তদের পাল্লায় পড়েই হয়তো তাদের ডাকাতি করা অতসব দামি অলঙ্কার লুকিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে।

হালদারমশাই বলে উঠলেন–একটা কথা কর্নেলস্যার! আইজ সকালে আমি ম্যাডামের পোলা পারিজাতেরে দেখছি। মোটর সাইকেল হাঁকাইয়া বারাইয়া গেল কিন্তু চেহারা দেইখ্যা মনে হইল বেশ ভদ্র। তাছাড়া এক্কেরে ফিল্ম স্টারের মতো মুখের গড়ন।

কর্নেল ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে জিজ্ঞেস করলেন–আপনার সঙ্গে তার আলাপ হয়নি?

হালদারমশাই বললেন না, তবে গেটের দারোয়ানেরে সে কইয়া গেল আমার ফিরতে দেরি হইব। মা-রে কইয়া দিয়ো দুপুরে এক বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্ন আছে। কর্নেলস্যার! কথাগুলান শুইন্যা মনে হইল খুব ভদ্র পোলা। সুরঞ্জনা বললেন–হা, পারুকে বাইরে থেকে দেখে বোঝা যাবে না কিছু। আমার সঙ্গেও স্বাভাবিক ব্যবহার করে। কিন্তু গত সপ্তাহে ওর বেডরুমে বালিশের তলায় রাখা অলঙ্কার-ভর্তি ব্যাগটা আবিষ্কার করে ভীষণ ভয় পেয়েছিলুম। পারু তখন বাইরে ছিল। ফিরে এলে যেই ওটার কথা জানতে চেয়েছি অমনি ভীষণ আশ্চর্য ব্যাপার কর্নেলসাহেব! আমার ছেলে–যাকে আমি এতটুকু থেকে নিজের হাতে মানুষ করেছি তারপর কলেজ অবধি পড়িয়েছি সেই পারু একেবারে বদলে গেল। চোখদুটো যেন জ্বলে উঠল। রুক্ষ স্বরে সে বলল–যা দেখেছ তা নিয়ে ভবিষ্যতে আর একটা কথা আমাকে জিজ্ঞেস করবে না। করলেও জবাব পাবে না। আর এ নিয়ে যদি বাড়াবাড়ি করো আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। ওর এই মূর্তি আর কণ্ঠস্বর আমার অপরিচিত। আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। কী করব বুঝে উঠতে পারলুম না।

কথাগুলো বলতে বলতে মিসেস রায়চৌধুরীর কণ্ঠে কান্না এসে গেল। তার চোখ থেকে জল ঝরছিল। হালদারমশাই তাকে সান্ত্বনা দিলেন–চিন্তা করবেন না ম্যাডাম! কর্নেলস্যর সব প্রবলেম সলভ কইরা দিবেন।

এই সময় ষষ্ঠীচরণ চার পেয়ালা কফি ট্রেতে রেখে গেল।

 কর্নেল বললেন–মিসেস রায়চৌধুরী!

আপনি একটা গুরুতর সমস্যায় পড়েছেন তা আমি বুঝতে পেরেছি কিন্তু আপনাকে আপাতত শান্ত এবং শক্ত থাকতে হবে। এবার প্লিজ কফি খান।

সুরঞ্জনা রুমালে চোখ মুখ মুছে ততক্ষণে আবার স্বাভাবিক হয়েছেন। তিনি বললেন–আমি তো কফি খাই না। আমার স্বামী কফির ভক্ত ছিলেন। ওঁকে রাত জেগে কাজ করতে হত তাই বারবার কফি খেতেন।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–কফি ঝিমিয়ে পড়া নার্ভকে চাঙ্গা করে বিশেষ করে কোনো দুর্ভাবনার সময় কফি খেলে সতেজ থাকা যায়। আর শুনেছেন বোধহয় আমিও মি. রায়চৌধুরীর মতো কফির ভক্ত।

হালদারমশাই সুযোগ পেয়ে বলে উঠলেন–হঃ। ম্যাডামেরে তা জানাইয়া দিছি। কফি খান ম্যাডাম। দ্যাখবেন নার্ভ এক্কেরে চাঙ্গা হইয়া গেছে।

সুরঞ্জনা অনিচ্ছা অনিচ্ছা করে কাপপ্লেট তুলে নিয়ে কফিতে চুমুক দিলেন তারপর মৃদুস্বরে বললেন–পারুর বাবার তাগিদে আমাকে কখনও কখনও কফি খেতে হয়েছে।

কর্নেল বললেন–আপনার স্বামীর নামটা আমার চেনা মনে হচ্ছে।

কথাটা বলার পর কর্নেল চোখ বুজে এক মিনিট কিছু স্মরণ করার চেষ্টা করলেন তারপর বলে উঠলেন–মাই গুডনেস! বীরেন রায়চৌধুরীর সঙ্গে আমার আলাপ ছিল। আমার যতদূর মনে পড়ছে একটা বড়ো রকমের আর্থিক কেলেঙ্কারি উনি ফাঁস করে দিয়েছিলেন। সেই সময়েই ওঁর স্বভাবত কিছু শত্রু সৃষ্টি হয় তারপর উনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু আমি শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হই। সুরঞ্জনা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিলেন। এবার বলে। উঠলেন–পাঁচবছর আগের কথা। কিষণলাল ভগলাল নামে একটা কোম্পানিকে সরকারের অর্থদপ্তরের এক অফিসার বেআইনিভাবে অনেকগুলো ইমপোর্ট লাইসেন্স পাইয়ে দিয়েছিলেন। সেই অফিসার ছিলেন পারুর বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

কর্নেল বললেন–ওই বন্ধুটার ফাঁদে পড়েই শেষ অব্দি মি. রায়চৌধুরীকে নিজেই ফেঁসে যেতে হয়েছিল। আমাকে উনি ওই গোপন বন্ধুটার কথাটা যদি জানাতেন তার পরিণাম অমন শোচনীয় হত না।

সুরঞ্জনা এবার কেন যেন নির্বিকার হয়ে উঠলেন। শান্তভাবে বললেন–ঘটনাটা। ঘটেছিল দিল্লিতে। খবর পেয়ে আমি প্লেনে দিল্লি গিয়েছিলুম।

এতক্ষণে আমি জিজ্ঞেস করলুম–মি. রায়চৌধুরীর কী হয়েছিল?

কর্নেল বললেন–এক আততায়ীর গুলিতে মি. রায়চৌধুরী মারা যান। কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোকে আমি সাহায্য করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তারা আমাকে গ্রাহ্য করেনি। যাই হোক, এ এক আকস্মিক যোগাযোগই বলব। আমার একটি ব্যর্থতা, দুঃখ আমি আজও ভুলিনি। মিসেস রায়চৌধুরী! আপনি এসেছেন এটা আমার কাছে একটা আশ্চর্য প্রাপ্তি।

সুরঞ্জনা চুপচাপ কফি শেষ করলেন। তারপর বললেন–আমার এইমাত্র মনে পড়ল পারুর বাবার ডায়েরি বইয়ে ইংরেজিতে কর্নেল সরকার নামটি দেখেছি।

গোয়েন্দাপ্রবর এতক্ষণ চুপচাপ বসে কথা শুনছিলেন। তাঁর গোঁফের দুই সুচোলো ডগা উত্তেজনায় যথারীতি তিরতির করে কাঁপছিল এবং চোখদুটিও গুলিগুলি হয়ে উঠেছিল। তিনি এতক্ষণে বলে উঠলেন–কী আশ্চর্য! অ্যারেই কয় নিয়তি। তা না হইলে আপনার পোলায় বা ক্যান অমন অদ্ভুত কাম করব আর আপনি আমার সাহায্য চাইলেন।

কর্নেল নতুন একটা চুরুট ধরিয়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। চুরুটের নীল ধোঁয়া তার প্রশস্ত উজ্জ্বল টাকের ওপর ঘুরপাক খেতে খেতে মিলিয়ে যাচ্ছিল। সেই অবস্থায় থেকেই তিনি বললেন–মিসেস রায়চৌধুরী। এবার আমার কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিন।

সুরঞ্জনা বললেন–বলুন। আমার স্বামী এবং তাঁর জীবনের শোচনীয় পরিণামের সঙ্গে আপনার যখন যোগাযোগের কথা শুনেছি তখনই মনে হয়েছে এখন পৃথিবীতে আপনি আমার আপনজন। আমি আপনাকে কোনো কথা গোপন করব না।

কর্নেল বললেন–আপনার বাড়িতে কে কে থাকে?

সুরঞ্জনা বললেন–পারুর বাবার আমলের দারোয়ান রাম সিংহ আর তার স্ত্রী সুশীলা থাকে। ওদের ছেলেমেয়ে নেই তাই একটা কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েকে দত্তক নিয়েছিল। এতে আমার স্বামীর অনুমতি ছিল। সেই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আমার অনুমতিতে মেয়ে জামাই ওদের সঙ্গেই থাকে। তবে ওদের জামাই কোথায় চাকরি পেয়েছে সেখানেই এবার বউকে নিয়ে যাবে। এ একটা ঝামেলা কিন্তু রাম সিংহ আর সুশীলা খুব বিশ্বাসী। সুশীলা আমার বাড়ির সব কাজ করে দেয়।

এছাড়া আর কে থাকেন?

–আগে একজন কর্মচারী ছিলেন। বাড়ির বাজার সরকার বলা যায়। তাকে বিদায় দিতে হয়েছে। অর্থাভাব এর একটা কারণ। সদর রাস্তার দিকে গ্রাউন্ড ফ্লোরগুলো ভাড়া দিয়েছি। শুধু দোতলার ঘরগুলো রেখে দিয়েছি।

-এবার বলুন, আপনার ছেলে পারিজাত কি তার বন্ধুদের নিজের ঘরে ডেকে এনে আড্ডা দেয়?

–না, পারু তার বন্ধুদের দোতলার বসার ঘরে এনে আড্ডা দেয়।

 –আড্ডার কি কোনো নির্দিষ্ট সময় আছে?

–না, তবে বেশির ভাগ সময়েই সন্ধ্যা থেকে রাত আটটা ন-টা অবধি ওর বন্ধুরা থাকে।

-কোন হইহল্লা বা সঙ্গীতচর্চা..

–না, ওরা হইহল্লা করে না। বরং কোনো কোনো দিন লক্ষ্য করেছি ওরা চাপা গলায় কীসব আলোচনা করছে। অবশ্য ওই আড্ডার জন্য সুশীলাকে পারু দু-তিনবার করে চা আনতে বলে।

–আচ্ছা সুশীলা কি আপনার ছেলে সম্পর্কে কোনো বিশেষ গোপন কথা আপনাকে কোনোদিন বলেছে?

-না তেমন কোনো বিশেষ গোপন কথা সুশীলা বলেনি তবে সে ওর বন্ধুদের পছন্দ করে না। সুশীলার কাছ থেকে আমি জানতে পেরেছিলুম ওই ছেলেগুলো ভালো নয়। সুশীলা ওদের কে কোথায় থাকে জানে না কিন্তু তার মতে ছেলেগুলোর হাবভাব এবং কথা বলার রীতি দেখে তার মনে হয়েছে ওরা সবাই বখাটে ছেলে।

একটু চুপ করে থাকার পর কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন–আপনার ছেলে সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে না থাকলে কখন বাড়ি ফেরে?

এবার সুরঞ্জনার মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠল। তিনি চাপাস্বরে বললেন–গতমাস থেকে পারু কোনো কোনো দিন অনেক রাত্রে বাড়ি ফেরে। ওর জন্য আমাকে আর সুশীলাকে জেগে থাকতে হয়।

-পারুর শোবার ঘরের দরজা কি সে নিজে লক করে রাখে?

-আগে রাখত না কিন্তু গত সপ্তাহে ওর বালিশের তলায় অলঙ্কারের ব্যাগ দেখার পর থেকে পারু বেডরুমের দরজা নিজেই লক করে রাখে।

কর্নেল বললেন–এবার শেষ প্রশ্ন। পারুর ঘরে কি নিজস্ব টেলিফোন আছে?

-না। তবে ওর একটা মোবাইল ফোন আছে।

 –নাম্বারটা আপনি জানেন?

–জানি। আমি মি. হালদারকে নাম্বারটা দিয়েছি।

–আচ্ছা হালদারমশাই! আপনি কি ওই নাম্বারে কখনও ফোন করেছেন?

 হালদারমশাই বললেন–হাতে এই ক্যাসখান পাইয়াই আমি অফিস থেইক্যা ফোন করছিলাম। কিন্তু লাইন পাই নাই। তারপর আরও কয়েকবার ফোন করছি কিন্তু ফোন য্যান লক করা আছে।

কর্নেল বললেন–এখন আপনি আমার টেলিফোন থেকে ওই নম্বরে ফোন করুন। যদি সাড়া পান আমাকে দেবেন। হালদারমশাই উঠে গিয়ে কর্নেলের টেলিফোন নম্বরটা ডায়াল করলেন। অমনি কর্নেল তার হাত থেকে রিসিভারটা নিয়ে কানে রাখলেন। তারপর বোঝা গেল তিনি সাড়া পেয়েছেন কারণ তিনি বললেন–পারিজাত রায়চৌধুরী? …তুমি আমাকে চিনবে না। আমি তোমার বাবার একজন বন্ধু। একটা বিশেষ কাজে তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই… না শোনো আমি জানতে পেরেছি তুমি খুব বিপদের মধ্যে আছ। তাই আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই।

তারপর বোঝা গেল পারু লাইন কেটে দিয়েছে। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–একটা চাল দিলুম। এর কী ফলাফল হয় তা মিসেস রায়চৌধুরী ছেলের হাবভাব দেখলে আঁচ করতে পারবেন। তারপর তার প্রতিক্রিয়া আমার এই নম্বরে ফোন করে জানাবেন।

সুরঞ্জনা ব্যাকুল কণ্ঠে বললেন–কর্নেলসাহেব! আপনি আমার স্বামীর বন্ধু ছিলেন। আমার ছেলেকে যেভাবে হোক আপনি বাঁচান। আমার সন্দেহ ওর দুবৃত্ত বন্ধুরা কোথাও ডাকাতি করে ওই জিনিসগুলো ওকে লুকিয়ে রাখার দায়িত্ব দিয়েছে কারণ ওরা জানে প্রাক্তন এম. পি-র ছেলের কাছে ডাকাতি করা অলঙ্কার লুকোনো আছে তা পুলিশ কল্পনাও করতে পারবে না। এরপর কর্নেল তার নেমকার্ড সুরঞ্জনা দেবীর হাতে দিলেন। সুরঞ্জনা বললেন–আমার ঠিকানা ফোন নাম্বার সব মি. হালদারের কাছে পেয়ে যাবেন। এবার আমি চলি।

.

০৩.

হালদারমশাই তার ক্লায়েন্টকে নিচে পৌঁছে দিতে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি ফিরে এসে বললেন–ম্যাডামের গাড়ি আছে। তার স্বামীর গাড়ি। নিজেই ড্রাইভ করতে পারেন।

সোফায় বসে তিনি এবার কর্নেলকে একটা ছোটো প্যাডের কাগজে তার। ক্লায়েন্টের নাম ঠিকানা এবং ফোন নাম্বার লিখে দিলেন। তারপর বললেন–যাউক গিয়া। আমি একখান ঝামেলা থেইক্যা বাঁচলাম। যা করার তা কর্নেলস্যারই করবেন।

একটা প্রশ্ন করার জন্য অনেকক্ষণ থেকে তাগিদ আসছিল কিন্তু করার সুযোগ পাইনি। এতক্ষণে পেলুম। বললুম–আচ্ছা হালদারমশাই! মিসেস রায়চৌধুরী তার ছেলের বেডরুমে লুকোনো যে জুয়েলারি দেখেছিলেন তা কি আপনাকে উনি দেখিয়েছেন?

হালদারমশাই নস্যি নিচ্ছিলেন। যথারীতি নোংরা রুমালে নাক মোছার পর মাথা নেড়ে বললেন–না। আমি কি কইর‍্যা সে চান্স পামু? উনার পোলা তার। বেডরুমের চাবি নিজের কাছে রাখছে।

হাসতে হাসতে বললুম তাহলে সেই জুয়েলস ম্যাডামের ছেলের বেডরুম থেকে উধাও হয়ে গেছে।

গোয়েন্দাপ্রবর চমকে উঠেছিলেন। বললেন–কথাটা ঠিক কইছেন। এটা আমার মাথায়ও আসা উচিত ছিল। পোলাটা যখন জানতে পারল তার মায়ের চোখে তার দুষ্কর্ম ধরা পড়েছে তখন সে মালটা অন্য কোথাও লুকাইয়া রাখতে পারে। না তার নিজের বেডরুমে নয়ই অন্য কোথাও সরাইয়া ফেলছে। কর্নেল চুপচাপ চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। তিনি বললেন–তা যদি হয় এবং ওটা হওয়া সম্ভবও বটে। তাহলে হালদার মশাই, আপনার কাজটা কী? ম্যাডামকে এ বিষয়ে খোলাখুলি প্রশ্ন করে জেনে নেওয়া উচিত ছিল।

হালদারমশাই বললেন–আমারে উনি কইছিলেন তাঁর পোলা কোথায় এত জ্বলেয়স পাইল সেই ব্যাপারটা আমারে জানতে হইব। আমি আবার হাসতে হাসতে বললুম– তাহলে তো আপনাকে ছদ্মবেশ ধরে পারুবাবুর গতিবিধির দিকে, সারাক্ষণ নজর রাখতে হয় এদিকে তার মোটর সাইকেল আছে। আপনার তো তাকে ফলো করাই কঠিন।

হালদারমশাই এতক্ষণে একটু মুষড়ে পড়লেন যেন। তিনি বললেন–হঃ, আপনি ঠিক কইছেন। সেইজন্যই তো আমি ওনারে কর্নেলস্যারের কাছে আনছিলাম। কর্নেলস্যারই এখন আমার ভরসা।

কর্নেল এতক্ষণে ইজিচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর উঠে গিয়ে স্টিলের একটা আলমারির দেরাজ টেনে কিছুক্ষণ খুঁজে একগোছা খবরের কাগজের ক্লিপিং বের করলেন। তারপর ফিরে এসে ইজিচেয়ারে বসে বললেন–হঠাৎ একটা কথা আমার মনে পড়ে গেল। উত্তর কলকাতার একটা বনেদি পরিবারের বাড়িতে দু সপ্তাহ আগে একটা সাংঘাতিক চুরি হয়েছিল। সেই খবরটা আমি কেটে রেখেছিলুম কারণ পরিবারের কর্তা আমার অনেক দিনের বন্ধু। খবরটা পড়ে তাকে ফোন করেছিলুম। তার নাম অরিন্দম। যাই হোক আমাকে তিনি যেতে বলেছিলেন। তবে ওই ধরনের চুরির পেছনে এমন কিছু রহস্য থাকে না যে তার পেছনে আমাকে দৌড়োতে হবে। অরিন্দমবাবু শুধু বলেছিলেন পুলিশ মহলে প্রভাব খাঁটিয়ে আমি যেন এ বাজারে প্রায় কোটি টাকার জুয়েলারি উদ্ধারের ব্যবস্থা করে দিই। এক মিনিট, আমি খবরটা আবারর দেখে নিই। ওটার সঙ্গে একটা স্লিপে. আমার কিছু কথাও লেখা আছে।

এই বলে কর্নেল স্লিপগুলো খুঁজতে খুঁজতে ইঞ্চি ছয়েক লম্বা দু-কলমের একটা নিউজ ক্লিপ বের করলেন। সেটাতে চোখ বুলিয়ে দেখার পর পেছন দিকে আঁটা একটা কাগজে তার হাতের লেখাগুলো পড়তে থাকলেন। পড়া শেষ হলে বললেন–এখানে একটা অনেক রকম দামি রত্নখচিত জড়োয়া নেকলেসের কথা লিখেছে। মিসেস রায়চৌধুরীর কাছে যে বর্ণনা শুনলুম তা মিলে যাচ্ছে।

জিজ্ঞেস করলুম–পুলিশ সেগুলো উদ্ধার করতে পারেনি?

হালদারমশাই উত্তেজিতভাবে বললেন–পারলে কর্নেলস্যার নিশ্চয়ই জানতেন।

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ, পুলিশ উদ্ধার করতে পারলে অরিন্দমবাবু আমাকে নিশ্চয়ই তা জানাতেন।

জিজ্ঞেস করলুম–ওগুলো চুরি গিয়েছিল কীভাবে?

কর্নেল বললেন–এটাই আশ্চর্য সেদিন অরিন্দমবাবুর বাড়িতে তার নাতনির জন্মদিন ছিল। অনেক লোককে নেমন্তন্ন করেছিলেন। দোতলার একটা বড়ো ঘরে অনুষ্ঠান চলছিল আর অলঙ্কারগুলো ছিল অরিন্দমবাবুর নিজের ঘরে। দেয়ালে আঁটা ছোটো লোহার আলমারিকে আয়রন চেস্ট বলা হয়। একালে এসব-আর কেউ ব্যবহার করে না। সেই আয়রন চেস্টের ভেতরে একটা ব্যাগে অলঙ্কারগুলো রাখা ছিল। ওটার চাবি লুকিয়ে রাখা হত দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে একটা গণেশমূর্তির পেছনে। সেটা জানতেন শুধু অরিন্দমবাবুর স্ত্রী প্রভাদেবী। এখন সমস্যা হল জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অরিন্দমবাবুর ঘরের দরজা খোলা ছিল। কিন্তু বাড়ির কোন কাজের লোকের পক্ষে ওই সময়ে আয়রন চেস্ট খুলে ব্যাগটা চুরি করার কথা ভাবাও যায় না। বাড়ির রান্নার ঠাকুরমশাইও ব্যস্ত।

হালদারমশাই জিজ্ঞেস করলেন-অলঙ্কার চুরি যাওয়ার কথা ওঁরা কখন জানতে পারলেন?

পরদিন ভোরে। অরিন্দমবাবুর অভ্যেস ছিল ঘুম থেকে উঠে কুলুঙ্গিতে গণেশকে প্রণাম করে পেছনের দিকে হাত দিয়ে চাবির অস্তিত্ব জেনে নেওয়া। সেদিন হাত দিয়ে চাবির অস্তিত্ব টের পাননি। নিচেই দেওয়ালে আটকানো আয়রন। চেস্ট। সেদিকে তাকিয়েই তিনি চমকে ওঠেন। চাবিটা আয়রন চেস্টের তালায় আটকানো আছে। ব্যস, তখনই আয়রন চেস্ট খুলে তার মাথা খারাপ।

আমি জিজ্ঞেস করলুম-চাবির কোনও ডুপ্লিকেট ছিল না?

–ছিল। সেটা লুকোনো থাকত প্রভাদেবীর কাছে। তিনি চাবিটা আরও একগাদা চাবির সঙ্গে মিশিয়ে পালঙ্কের কোনার দিকে একটা বিশেষভাবে তৈরি খোপের মধ্যে রেখে দিতেন। সেই ডুপ্লিকেট চাবিটা অবশ্য ঠিক জায়গায়ই ছিল।

আমি বললুম–তাহলে বাড়ির লোকেরই কাজ। অরিন্দমবাবুর ছেলেমেয়ে ক-জন?

–দুটি ছেলে একটি মেয়ে। এক ছেলে এবং মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোটো ছেলে কলেজে পড়ে। তার নাম অনিরুদ্ধ। ডাকনাম আনু। একটু ডানপিটে টাইপের ছেলে। পাড়ার ক্লাবের দিকেই পড়াশোনার চেয়ে বেশি ঝোঁক। তাছাড়া পাড়ার পুজোপার্বণেও সে উৎসাহী।

হালদারমশাই বললেন–হঃ বুঝছি। কর্নেলস্যার! এক কাম করলে হয়।

কর্নেল নিউজ ক্লিপের দিকে চোখ রেখে বললেন–বলুন হালদারমশাই।

গোয়েন্দাপ্রবর চাপাস্বরে বললেন–পুলিশ বাড়ির লোকেরে নিশ্চয়ই জেরা করছিল?

-হ্যাঁ। এক্ষেত্রে যেমন হয় তাই হয়েছে। কাজেই আপনি যা জানতে চাইছেন, অনিরুদ্ধকে জেরা করা হয়েছিল কি না, তা ঠিক। যেহেতু অনিরুদ্ধকে ও এলাকার থানা সুনজরে দেখে না তাই তাকেই স্বভাবত বেশি জেরা করা হয়েছিল।

কর্নেল নিউজ ক্লিপগুলো যথাস্থানে রাখতে উঠে গেলেন।

হঠাৎ আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ভেসে এল। বললুম–আচ্ছা কর্নেল, আপনার বন্ধু অরিন্দমবাবুর পদবি কী?

কর্নেল এসে ইজিচেয়ারে বসার পর বললেন–হঠাৎ পদবির কথা তোমার মাথায় এল কেন? বললুম–পদবি জানা না থাকলে কারও পুরো নাম জেনে তাকে আইডেন্টিফাই করা যায় না। কর্নেল ভুরু কুঁচকে বললেন–তুমি কি অনিরুদ্ধ নামের কাউকে চিনতে?

বললুম–আহা পদবিটা বলুন না। চিনতেও তো পারি।

 কর্নেল বললেন অরিন্দম সোমের কনিষ্ঠ পুত্রের নাম অনিরুদ্ধ সোম। জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম অনির্বাণ সোম। কন্যার নাম অনিন্দিতা সোম।

হালদারমশাই বললেন–সক্কলেই অ।

আমি বললুম–হালদারমশাই, আমি আপনার কর্নেলস্যারের সঙ্গগুণে রহস্যের দু-একটা ছোটো জট খোলার চেষ্টা করি। আপনি এক কাজ করতে পারেন, আপনার ক্লায়েন্ট মিসেস রায়চৌধুরীর কাছে জেনে নিতে পারেন অনিরুদ্ধ সোম নামে কোনো যুবক তার ছেলের পরিচিত কি না। এমনও হতে পারে ওই নামের কেউ তার ছেলের সঙ্গে আড্ডা দিতে যেত।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন–তোমার আইডিয়াটা মন্দ নয় জয়ন্ত। অবশ্য সবসময় দুয়ে দুয়ে চার হয় না।

হালদারমশাই গুলি গুলি চোখে তাকিয়েছিলেন। এবার পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করে একটিপ নস্যি নিলেন এবং যথারীতি নোংরা রুমালে নাক মুছে বললেন–কর্নেলস্যার, চেষ্টা কইরা দ্যাখতে ক্ষতি কি? আমি এখনই আর ম্যাডামেরে, ডিস্টার্ব করুম না। বৈকালে তার বাড়ি যামু। এই পয়েন্টটা আমার ইম্পর্ট্যান্ট ঠেকতাছে কারণ আপনার বন্ধুর বাড়ির হারানো অলঙ্কারের লিস্টের সঙ্গে ম্যাডামের দেখা অলঙ্কারগুলির মিল আছে। এই বলে গোয়েন্দাপ্রবর সবেগে বেরিয়ে গেলেন।

.

০৪.

কিছুক্ষণ পরে টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল চোখ বুজে কিছু ভাবছিলেন। বললেন–জয়ন্ত! ফোনটা ধরো তো। সোফার কোণের দিকে সরে গিয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে সাড়া দিলুম। অমনি কানে ভেসে এল লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের অফিসার নরেশ ধরে কণ্ঠস্বর। জয়ন্তবাবু নাকি?

রসিকতা করে বললুম–কে আপনি? কাকে চান?

লালবাজারে গোয়েন্দা অফিসারের হাসি ভেসে এল।–জয়ন্তবাবু! এই নরেশ ধরের কানকে ফাঁকি দেওয়া সোজা নয়।

হাসতে হাসতে বললুম–আপনার তো দুপুর বারোটায় আসার কথা।

-আপনার কর্নেলসাহেবের ওয়াল ক্লকের দিকে তাকিয়ে দেখুন। সব ঘড়ি ভুল সময় দেয় কিন্তু ওই ঘড়ি কর্নেলসাহেবের মতোই একেবারে কাঁটায় কাঁটায় ঠিক চলে। যাক গে, কর্নেলসাহেবকে বলুন আমি পনেরো-কুড়ি মিনিটের মধ্যে আসছি। হ্যাঁ, আর একটা কথা। ওখানে আপনাদের হালদারমশাই কি আছেন?

–তিনি তো সকাল নটা থেকে ছিলেন কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছেন।

কী মুশকিলে না পড়েছি। ভদ্রলোকের ফ্ল্যাটে ফোন যতবার করি বেজেই যায়। তাকে গতরাত থেকে খুঁজে হয়রান হচ্ছি।

হালদারমশাই কাল সন্ধ্যায় পার্ক স্ট্রিটে চন্দ্র জুয়েলার্সের দোকানে ডাকাতির সময় একজন ডাকাতের পায়ে নাকি গুলি করেছেন।

আবার নরেশ ধরের হাসি ভেসে এল। পায়ে গুলি? ততকিছু না, গুলি ঠিকই করেছিলেন তবে হতভাগা ডাকুর বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলের নকখানা শুধু উপড়ে গেছে। আচ্ছা ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি।

রিসিভার রেখে বললুর্ম–নরেশবাবু আসছেন। কিন্তু হালদারমশাই কাল সন্ধ্যায় বলেছিলেন এক ডাকাতের পায়ে গুলি করেছেন কিন্তু নরেশবাবু বললেন হালদারমশায়ের গুলি লোকটার পায়ের বুড়ো আঙুলের নখটাই উপড়ে দিয়েছে।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–হালদারমশাইকে নিয়ে যতই ঠাট্টা তামাশা করো জয়ন্ত, ওঁর এই কাজটাতেই বোঝা যাচ্ছে এখনও একজন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসারের হাত তার আছে। এর বেশি আহত হলে হালদারমশাইকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অন্যপক্ষের অ্যাডভোকেটের জেরায় ক্ষতবিক্ষত হতে হত। এসব ক্ষেত্রে একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভের গুলি করার অধিকার নেই। অবশ্য আত্মরক্ষার খাতিরে তিনি কাউকে একটু আধটু আহত করতে পারেন বটে।

বলে কর্নেল হাঁক দিলেন–ষষ্ঠী! আর এক রাউন্ড কফি রেডি কর। এবার তোর নালবাজারের টিকটিকিবাবু আসছেন।

ষষ্ঠীচরণের এই গ্রাম্যতা এখনও রয়ে গেছে। সে ল কে কখনও কখনও ন করে ফেলে। লালবাজারের ডি. সি. ডি. ডি ওয়ান অরিজিৎ লাহিড়ীকে সে এখনও নালবাজারের নাহিড়ী সাহেব বলে।

নরেশবাবু ঠিক কুড়ি মিনিটেই এসে গেলেন। গায়ে একটা যেমন-তেমন শার্ট। পরনেও তেমনই প্যান্ট। কাঁধে শুধু একটা ব্যাগ। তিনি সোফায় ধপাস করে বসেই বললেন–ওঃ আর পারা যায় না। গণ্ডগোল তত বেশি বাড়ত না। হঠাৎ কাল সন্ধ্যাবেলা ঘটনাস্থলে আপনাদের প্রিয় হালদারমশাই যদি দৈবাৎ উপস্থিত না থাকতেন এবং থাকলেও গুলি না ছুঁড়তেন। কর্নেল একটু হেসে বললেন–নেহাত। তো বুড়ো আঙুলের নখটুকুই নিয়েছেন হালদারমশাই। তাছাড়া উনি না থাকলে ডাকাতরা চন্দ্র জুয়েলার্সের আরও অনেক গয়না লুঠ করে পালাত। তার চেয়ে বড়ো কথা হালদারমশায়ের জন্যই একজন ডাকাত ধরা পড়েছে এবং তার মুখ থেকেই আপনারা দলটার পুরো নাম ঠিকানা পেয়ে যাবেন, হয়তো পেয়েও গেছেন। নরেশবাবু রুমালে কপালের ঘাম মুছে বললেন–পেয়েছি। আসলে চন্দ্র জুয়েলার্সের মালিক এক মন্ত্রীমশায়ের আত্মীয়। কাজেই কেসটা থানার হাত থেকে গতরাতেই আমরা নিয়ে নিয়েছি। যাই হোক, সে জন্য আপনার কাছে আসতে চেয়েছিলুম বলছি। আগে আপনার ষষ্ঠীচরণের শ্রীহস্তের কফি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিই।

ষষ্ঠী কফি আনতে দেরি করল না। অক্টোবরের এই দুপুরবেলায় আমার আর কফি খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু কফি না খেলে ষষ্ঠী দুঃখ পাবে।

নরেশবাবু কফি খাওয়ার পর বললেন–আপনার কাছে আসতে হল আপনার স্নেহধন্য লাহিড়ী সাহেবের নির্দেশে। আপনার মনে পড়বে বাগবাজার এরিয়ায় গত সপ্তাহে আপনার বন্ধু মি. সোমের বাড়ি থেকে চুরির ব্যাপারে আপনি লাহিড়ীসাহেবকে তাগিদ দিয়েছিলেন। এদিকে গতরাত্রে ধরা পড়া ডাকাত শেখ কাল্লু জেরার মুখে একটা অদ্ভুত কথা বলেছে। সে বলেছে, দলের সবাইকে সে চেনে না। কিন্তু তার দলে জনা-তিনেক ভদ্রলোকের ছেলে আছে। তাদের নাম সে জানে না। তবে একজনকে সে দলের লিডারের হুকুমে বাগবাজারের একটা বাড়িতে ডাকতে গিয়েছিল। বাড়িতে তখন কিসের ধুমধাম চলছিল। বাড়ির একটা লোক ভদ্রলোকের ছেলেটিকে ডেকে দেয়। তারপর ছেলেটি কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে আসে। দলের লিডারের বাড়ির কাছে কাল্লুকে নামিয়ে দিয়ে সে বলে অপেক্ষা করতে, আধঘণ্টার মধ্যে আমি আসছি। অবশ্য আধঘণ্টা পরেই সে লিডারের বাড়িতে পৌঁছে যায়। এবার বুঝতেই পারছেন, বাগবাজারের ছেলেটি কে।

-বুঝেছি। বলে একটু চুপ করে থাকার পর কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন লিডারের বাড়িটা কোথায় তা বলতে আপত্তি না থাকলে বলে ফেলুন।

নরেশবাবু বললেন–কালীঘাট এরিয়ায়। ঠিকানা চাইলে আমি দিতে পারি। তবে ওদের লিডারটি মহাঘুঘু। ফাঁদে ফেলা সহজ নয়। বাড়িতে এক বিধবা পিসিমা আর তার স্কুলে পড়া মেয়ে থাকে।

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন–সেই লিডারের নামটা কী?

নাম অনেকগুলো, তবে বাপি নামেই পাড়ায় পরিচিত। ওর বাবা ছিলেন রেলের গার্ড। কাজেই বাবার সঙ্গে নানা ঘাটের জল খেয়েছে। বাবার মৃত্যুর পর ঠাকুরদার বাড়িতে এসে ঠাকুমার কাছে আশ্রয় নিয়েছিল।

–লেখাপড়া?

–হ্যাঁ জেনেছি, বি এ অবধি পড়েছিল।

–বাড়ি সার্চ করেছেন তো?

–হ্যাঁ সার্চ তো করতেই হয়েছে। কিন্তু তেমন কিছু মেলেনি যাতে ওকে কোনো কেসে ফাঁসানো যায়। আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার কর্নেল, লোকাল থানায় বাপি ব্যানার্জির নামে কোন ক্রাইম রেকর্ডই নেই। তবে একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার কথা জেনেছি।

আমি বললুম–কাল্লু মিথ্যা বলেনি তো?

নরেশবাবু বুকপকেট থেকে ছোটো ডায়েরি বের করে পাতা ওলটাতে ওলটাতে বললেন–কাল্লু মিথ্যা বলেনি তার কারণ ও বাপির বাড়ি এবং তার চেহারা সম্পর্কে যে সব বিবরণ দিয়েছিল তা মিলে গেছে। তাছাড়া বাপির পিসিমার কাছে জানতে পেরেছি তিনি কাল্লুকে চেনেন। কথাটা বলে নরেশবাবু কর্নেলের টেবিল থেকে ছোটো প্যাডটা টেনে নিলেন তারপর তাতে কিছুক্ষণ ধরে লেখালিখির পর বললেন–কর্নেলসাহেব! কালুর মুখে বাপিসহ যে তিনজন ভদ্রলোকের ছেলের নাম-ঠিকানা পেয়েছি তা এখানে লিখে দিলুম।

কর্নেল হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিয়ে নাম-ঠিকানাগুলো পড়লেন। তারপর প্যাডটা টেবিলের ড্রয়ারে রেখে বললেন–বুঝতে পারছি তোমাদের লাহিড়ীসাহেব বেশ চাপের মুখে পড়েছেন। চন্দ্র জুয়েলার্সের মালিক কোন মন্ত্রীর আত্মীয়। কাজেই এটা স্বাভাবিক।

নরেশবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–লাহিড়ীসাহেব বাগবাজারের অরিন্দম সোমের বাড়িতে চুরির ঘটনায় আপনি যে ইনটারেস্টেড তা জানেন, কাজেই তিনি আপনার সাহায্য চান। কর্নেল একটু হেসে বললেন–অরিজিৎ কি সোজাসুজি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে সংকোচ বোধ করছে?

নরেশবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–এই জন্যই আমরা বলি আপনার মাথার পেছনে আর একটা চোখ আছে। লাহিড়ীসাহেব ঠিক এই কথাটাই আমাকে বলেছেন। ওঁর ধারণা এই অক্টোবরে আপনি দুর্লভ প্রজাতির প্রজাপতি, অর্কিড, ক্যাকটাস বা পাখির খোঁজে বনে-পাহাড়ে পাড়ি জমান। এমন একটা সময়ে আপনাকে সাধারণ একটা গয়না চুরির কেসে জড়িয়ে ফেলতে ওঁর দ্বিধা আছে। হ্যাঁ, আর একটা কথা। বাগবাজারের ছেলেটির ব্যাপারে আমরা এখনই পা বাড়াচ্ছি না। লাহিড়ীসাহেব আপনার সঙ্গে পরামর্শ করতে চান বলে, নরেশবাবু বেরিয়ে গেলেন।

তারপর কর্নেল রিসিভার তুলে ডায়াল করে বললেন–আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি… হ্যাঁ, আমি অরিজিৎ-এর সঙ্গে কথা বলতে চাই…এইমাত্র বেরিয়েছেন? আপনি তাকে বলবেন আমাকে যেন একবার রিং করে।

রিসিভার রেখে কর্নেল ঘড়ির দিকে তাকালেন। সর্বনাশ! একটা বাজতে চলল। আজ আমার স্নানের দিন। জয়ন্ত কি স্নান করবে?

বললুম–হ্যাঁ, আমার মাথাটা ঝিমঝিম করছে।

স্নান করে আজ লাঞ্চে বসতে পৌনে দুটো বেজে গেল। তারপর আমি ড্রইংরুমে এসে ডিভানে শুয়ে অভ্যাসমত ভাতঘুমের চেষ্টা করলাম।

কর্নেল তার ইজিচেয়ারে বসে হেলান দিয়ে চুরুট টানতে থাকলেন। একটু কাত হয়ে লক্ষ্য করলুম তাঁর হাতে সেই ছোটো প্যাডটা। তিনি নাম-ঠিকানাগুলো জপ করছেন।

তারপর কখন ঘুমিয়ে গেছি। সেই ঘুম ভাঙল ষষ্ঠীচরণের ডাকে। তার হাতে এককাপ চা। বুঝলুম চারটে বাজে। উঠে বসে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম–তোমার বাবামশাই কি ছাদের বাগানে?

ষষ্ঠীচরণ মুখ টিপে হেসে বলল বাবামশাই আপনার প্যান্টের পকেট থেকে আপনার গাড়ির চাবি বের করে নিয়ে বেলা তিনটেয় কোথায় গেছেন। বলে গেছেন তোর দাদাবাবু উঠলে চা দিয়ে বলবি আমি গাড়ি চুরি করিনি। ঘণ্টা তিনেকের জন্য ধার নিয়েছি।

এরকম ঘটনা নতুন কিছু নয়। কর্নেলের একটা লালরঙের ল্যান্ডরোভার গাড়ি ছিল। সেকেলে পুরোনো গাড়ি। রাগ করে সেটা বেচে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে কখনও ট্যাক্সি কখনও আমার গাড়িই ব্যবহার করেন। নিচে ওঁর গ্যারাজঘরে আমার গাড়িটা রাত কাটায়। চা খাওয়ার পর ষষ্ঠীকে কাপ প্লেট দিয়ে এলুম। সেই সময়ই টেলিফোন বাজল। রিসিভার তুলে সাড়া দিলুম। কেউ বলল–এটা কি কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের বাড়ি?

বললুম–হ্যাঁ। আপনি কে বলছেন?

আমি কর্নেলসাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চাই?

একটু বুদ্ধি খাঁটিয়ে বললুম–আপনি কে বলছেন এবং কোত্থেকে বলছেন না জানালে কর্নেলসাহেবকে পাওয়া যাবে না।

এবার ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বরে অন্যপক্ষ বলল–আপনি কে বলছেন?

–আমি ওঁর কর্মচারী। কর্নেলসাহেব এখন ব্যস্ত।

আজেবাজে কথা বলবেন না। আমি জানি কর্নেলসাহেবের কোনো কর্মচারী নেই।

নেই মানে? তাহলে আমি কে?

অপরপক্ষ আরও চটে গিয়ে বলল-বুঝেছি আপনি সেই ধান্দাবাজ সাংবাদিক। কর্নেলসাহেবের নামে আবোল-তাবোল লিখে বাজার মাত করেন। আপনি ষষ্ঠীচরণকে দিন।

আমি ইচ্ছে করেই গোঁ ধরে বললুম–আপনি যদি নাম না বলেন তাহলে ফোন রেখে দেবকী মুশকিল? আমি জরুরি কাজে ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইছি। মনে হচ্ছে উনি বাড়িতে নেই। ষষ্ঠীচরণ বেরিয়ে এসে টেলিফোনের বাক্যালাপ শুনছিল। সে চাপাস্বরে বলল–মনে হচ্ছে উনি হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট কানাইবাবু। আপনি আমাকে টেলিফোন দিন।

অগত্যা ষষ্ঠীর হাতে রিসিভার দিলুম। সে বলল–আজ্ঞে কানাইবাবু, আমি ষষ্ঠীচরণ বলছি। বাবামশাই তো কী আপনি কানাইবাবু নন? তাহলে আপনি কে? …কী বললেন স্পষ্ট করে বলুন…হ্যালো হ্যালো হ্যালো।

ষষ্ঠীচরণ রিসিভার রেখে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল–গলা শুনে মনে হল কানাইবাবু, কিন্তু কানাইবাবু হলে তো আমার সঙ্গে এরকম করবেন না।

বললুম–যা হওয়ার হোক। দরকার থাকলে আবার ফোন করবে। কিন্তু লোকটার আচরণ অদ্ভুত মনে হচ্ছে। নিজের নামটা বলতে আপত্তি কিসের বুঝলুম না।

ষষ্ঠী বলল–এরকম কত ফোন বাবামশায়ের কাছে আসে। তিনি না থাকলে আমাকেই হ্যাপা সামলাতে হয়।

এই সময়ই ডোরবেল বাজল। ষষ্ঠী দরজা খুলতে গেল। তারপর ঘরে ঢুকলেন কর্নেল এবং গোয়েন্দাপ্রবর কে কে হালদার।

হালদারমশাই ঘরে ঢুকে সোফায় বসে বললেন–আইজ সারাদিন ঝামেলা আর ঝামেলা।

কর্নেল ঢুকেই সোজা ভিতরের ঘরে চলে গিয়েছিলেন। জিজ্ঞেস করলুম কর্নেল আপনাকে কোথায় পেলেন হালদারমশাই? হালদারমশাই বললেন– ভবানীপুরে আমার ক্লায়েন্টের বাড়িতে।

-কর্নেল তাহলে মিসেস রায়চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন?

–হঃ। মিসেস রায়চৌধুরী আমারে ডাকছিলেন। তারপর ওঁর বাড়ি গেছিলাম। তারপর মিসেস রায়চৌধুরী কর্নেলস্যারেরে টেলিফোনে ডাকছিলেন।

জিজ্ঞেস করলুম–ব্যাপারটা কী?

কর্নেল ভেতর থেকে আসতে আসতে বললেন–আপাতত ব্যাপারটা কফি।

.

০৫.

কফি খাওয়ার পর চুরুট ধরিয়ে কর্নেল বললেন–যেহেতু জয়ন্তর গাড়ি প্রায় চুরি করেই ব্যবহার করেছি অতএব জয়ন্তকে বলতেই হয়। কোথায় গিয়েছিলাম এবং কেন গিয়েছিলাম। হালদারমশাই বললেন–মিসেস রায়চৌধুরীর পোলা হঠাৎ নিখোঁজ। এখান থিক্যা ফিরিয়া উনি দ্যাখেন ওঁর পোলা একখান চিঠি সুশীলার কাছে দিয়া গ্যাছে। লিখছে, আমি কয়েক দিনের জন্য বাইর যাইতাছি, কবে ফিরব ঠিক নাই। তুমি চিন্তা কইরো না। আমি যেখানে থাকুম, সেখানে থেইক্যা তোমারে ফোন করুম। বোঝেন অবস্থা!

কথাটা শুনে চমকে উঠেছিলুম। চন্দ্র জুয়েলার্সের ডাকাতির ঘটনায় পারিজাত সম্ভবত জড়িত ছিল। তাই সে গা ঢাকা দিয়েছে।

তা কর্নেল! এই সুযোগে পারিজাতের ঘর খুলে আপনারা সার্চ করতে পারতেন। সেই অলঙ্কারের ব্যাগ আছে না সে নিয়ে গেছে তা জানতে পারতেন।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–তুমি যা ভাবছ, পারু তত নির্বোধ নয়। ওর ঘরের চাবি না রেখে গেলেও ঘরের দরজাটা যে চেষ্টা করলে ভোলা যায় তা সে জানে। তাই আরও একটা তালা এঁটে দিয়ে গেছে।

বললুম–আপনি তো যে কোন তালা খুলতেই এক্সপার্ট।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–সেটা করার কিছু অসুবিধা ছিল। সুশীলা আর তার স্বামী জেনে যেত। তাদের চোখে দৃশ্যটা কল্পনা করো। আমি, হালদারমশাই আর মিসেস রায়চৌধুরী তার ছেলের ঘরের তালা ভাঙবার জন্য কিংবা কৌশলে খোলবার জন্য কসরত করছি এই দৃশ্যটা ওদের স্বামী-স্ত্রীর চোখে খুব উপভোগ্য হত? তারপর পারু ফিরে এলে ব্যাপারটা কী ঘটতে পারে তা চিন্তা করো। তার মা নিজে তালা ভাঙলে বা খুলে ফেললে সে হয়তো রুষ্ট হত না কিন্তু বাইরের দুই বেয়াড়া চেহারার লোক তার ঘরের তালা খুলেছে এবং ঘর সার্চ করেছে বুঝতে পেরে সে হয়তো নিজের মাকে ক্ষমা করতে পারত না।

বললুম–তাহলে আপনারা ভদ্রমহিলাকে শুধু সান্ত্বনা দিয়েই চলে এলেন?

হালদারমশাই কী বলতে যাচ্ছিলেন কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন– হালদারমশাই এখন রহস্যটা রহস্যই থাক। জয়ন্ত অবশ্য তার গাড়ি ব্যবহারের জন্য ওটা দাবি করতেই পারে কিন্তু তার জন্য হাতে অঢেল সময় আছে। বললুম–ঠিক আছে। এবার আমার মুখে রহস্যময় ঘটনা শুনুন।

কর্নেল বললেন–ষষ্ঠীর কাছে মোটামুটি সবটাই শুনেছি। কানাইবাবু নামে একজন পাগলাটে স্বভাবের অ্যাডভোকেট আছেন, তা ঠিক। মাঝে মাঝে তিনি অকারণে নিজের কল্পিত কোন রহস্যময় ঘটনার পেছনে আমাকে লড়িয়ে দিতে চেষ্টাও করেন। তবে তিনি আর প্র্যাকটিস করেন না।

বললুম–ষষ্ঠী ফোন ধরেছিল। সে বলেছে, গলার স্বর মোটেও কানাইবাবুর মতো নয়। কর্নেল বললেন–ষষ্ঠীর ভারসান আমি শুনেছি। এবার তোমার ভারসান শোনা যাক।

আমি টেলিফোনের ঘটনাটা কর্নেলকে সবিস্তারে শোনালুম। এমনকী যিনি ফোন করেছিলেন তার কথা বলার ভঙ্গিও অনুকরণ করলুম।

কর্নেল বললেন–কণ্ঠস্বর শুনে তার বয়স কি অনুমান করতে পেরেছ?

বললুম–কণ্ঠস্বর কোনো যুবকের নয় বয়স্ক ভদ্রলোকের।

কর্নেল তখনই হাত বাড়িয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুললেন। ডায়াল করার পর সাড়া এলে বললেন–আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি…নমস্কার নমস্কার মি. সোম… আমি ভালোই আছি। আপনার খবর কী? কথাটা বলেই কর্নেল হেসে উঠলেন। আপনি বেচারা জয়ন্তকে একেবারে কুপোকাত করে ছেড়েছেন…হ্যাঁ জয়ন্ত বড় বাড়িয়ে লেখে যাকগে এবার বলুন, কেন ফোন করেছিলেন?

এরপর কর্নেল ক্রমাগত হুঁ দিতে থাকলেন। প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে কথা শোনার পর তিনি বললেন–আপনি বরং এক কাজ করুন, অনিরুদ্ধের চিঠিটা বিশ্বস্ত কারও হাতে খামের মধ্যে পুরে আঠা দিয়ে মুখ সেঁটে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। আপনার শরীর এবং স্বাস্থ্যের যা অবস্থা তাতে আপনাকে কষ্ট করে এখানে আসতে হবে না। আমারই যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু একটা কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছি…ঠিক আছে, কোনও চিন্তা করবেন না। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব।

রিসিভার রেখে কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন–একেই বলে রহস্য ঘনীভূত। হওয়া। বাগবাজারের অরিন্দম সোমের কনিষ্ঠ পুত্র অনিরুদ্ধ দত্ত ভবানীপুরের পারিজাতের মতোই একটুকরো চিঠি লিখে রেখে নিখোঁজ হয়ে গেছে। অরিজিৎ। বুদ্ধিমান। এখনই অনিরুদ্ধের ব্যাপারে পুলিশ পা বাড়ালে ছেলের স্নেহে বাবা কী করবেন বলা যায় না।

উত্তেজনায় নড়ে বসলুম। বললুম–কর্নেল! আমার মনে হয় এই কেসে লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের সাহায্য আপনার নেওয়া উচিত। কারণ দু-দুটো দুবৃত্ত ছেলে একইভাবে বাড়ি ছেড়ে আজ অজ্ঞাতবাসে চলে গেছে। তারা কোথায় আছে সে খবর জানার মতো ব্যবস্থা ওদেরই আছে।

হালদারমশাই সায় দিয়ে বললেন–জয়ন্তবাবু ঠিক কইছেন। খড়ের গ্যাঁদায় সুই খুইজ্যা পাওয়া সহজ কথা না।

কর্নেল চোখ বুজে কী ভাবছিলেন। চোখ খুলে তিনি বললেন– হালদারমশাই! উড়ো পাখির পেছনে দৌড়ে কোনও লাভ হবে না। কাল সন্ধ্যায় চন্দ্র জুয়েলার্সে ডাকাতির পর কাল্লু নামে একজন ধরা পড়েছে। অতএব অঙ্কের হিসেবে মনে হওয়া স্বাভাবিক ওই কারণেই অনিরুদ্ধ আর পারিজাত, ওদিকে কালীঘাটের বাপি বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে গেছে এটা ঠিক কিন্তু কাকতালীয় যোগ বলে একটা কথা আছে কাক উড়ে এসে তালে বসল আর তালটা খসে পড়ল, এতে মনে হতেই পারে তাল পড়ার কারণ ওই হতচ্ছাড়া কাক।

হালদারমশাই সায় দিয়ে বললেন–হঃ। সেটাও একটা কথা। সবসময়ই সব অঙ্ক মেলে না।

হালদারমশাই কথাটা বলে একটিপ নস্যি নিলেন।

আমি বললুম–এই কেসের মূল পয়েন্ট কিন্তু বাগবাজারের মি. সোমের বাড়ি থেকে চুরি যাওয়া অলঙ্কার। এ বাজারে ওগুলোর দাম হয়তো কোটি টাকা হবে। এখন কথা হল সঙ্গে কোটি টাকা দামের অলঙ্কার নিয়ে ধরা যাক অনিরুদ্ধ, পারিজাত আর বাপি কোথায় গেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওই অলঙ্কারের দাম পেলে তিনজনের মধ্যে ভাগাভাগি নিয়ে সংঘর্ষ অনিবার্য।

হালদারমশাই এই সময় হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন–কর্নেলস্যার আমার মাথায় একখানা আইডিয়া আইছে। কর্নেল বললেন–বলুন।

–আমি বরং ভবানীপুরে আমার ক্লায়েন্টের বাড়ির পেছন দিকে একখান পোড়ো জমি দেখছি সেখানে গোড়া বাঁধানো বটের গাছ আছে, আমি সাধুবাবার ছদ্মবেশে কাইল মর্নিং-এ সেখানে গিয়া ধুনি জ্বালুম। আমার ধারণা ম্যাডামের পোলারে কোন এক সময়ে বাড়ি ফিরতেই হইব। ফিরলেই আমি আপনারে খবর দিমু। আপনি কি কন?

কর্নেল সহাস্যে বললেন–আপনার প্লানটা খাসা তবে পারুর বাড়ি ফেরার সময় কিন্তু অনিশ্চিত।

হালদারমশাই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–আমি দুইদিন বইয়া অপেক্ষা করুম। আমার ক্যান মনে হইতাছে ওরা বাইরে বেশিদিন থাকব না।

কর্নেল বললেন–আপনার পক্ষে এ ধকল সহ্য করা নতুন কিছু নয়, কাজেই আপনি আপাতত এই কাজটাই করুন। মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে আমাকে টেলিফোনে খবর দেবেন।

গোয়েন্দাপ্রবর সবেগে বেরিয়ে গেলেন।

উনি বেরিয়ে যাওয়ার পর বললুম–হালদারমশাই বিপদে না পড়েন। আমার মনে হচ্ছে উনি একটু বেশি রিস্ক নিচ্ছেন।

কর্নেল চোখ বুজে চুপচাপ চুরুট টানতে থাকলেন।

কিছুক্ষণ পরে ডোরবেল বাজল। কর্নেল যথারীতি হাঁক দিলেন ষষ্ঠী।

একটু পরে যিনি ঘরে ঢুকলেন তাকে দেখে আমি অবাক। লাল টুকটুকে টি-শার্ট আর ছাইরঙা প্যান্ট পরে ঘরে ঢুকলেন ষষ্ঠীচরণের সেই লালবাজারের লাহিড়ী সাহেব। তিনি থমকে দাঁড়িয়ে বললেন–আমার হাতে খবর ছিল আপনার টিমের সেরা খেলোয়াড় হালদারমশাইও আছেন।

কর্নেল বললেন–তোমার ফোন করার কথা ছিল অরিজিৎ।

লালবাজারের ডি.সি.ডি.ডি. ওয়ান অরিজিৎ লাহিড়ী সোফায় বসে বললেন–কথাটা ঠিক নয় কর্নেল। আমি বলিনি যে আপনাকে ফোন করব। আপনি আমার পি.এ.-কে বলেছিলেন আমি যেন আপনাকে ফোন করি।

কর্নেল বললেন–ওঃ অরিজিৎ! আমি একেবারে তর্কবাগীশ হয়ে উঠেছ। ওরে ষষ্ঠী! তোর নালবাজারের নাহিড়ী সাহেবকে এক্ষুণি কফি খাইয়ে দে।

মিস্টার লাহিড়ী বললেন–হ্যাঁ শ্রীমান ষষ্ঠীচরণের হাতের কফি খাব বলেই ফোন না করে সরাসরি হাজির হয়েছি। তা জয়ন্তবাবু! হালদারমশাইকে আপনারা কোথায় পাঠালেন?

একটু হেসে বললুম–সন্ন্যাস আশ্রমে।

মিস্টার লাহিড়ী হাসতে হাসতে বললেন–বুঝেছি। কিন্তু বাগবাজার তল্লাটে সম্প্রতি এক সাধুবাবা ছেলে চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছেন বলে গণধোলাই খেয়েছেন। আমার হাতে খবর আছে ইদানীং ওই এরিয়ায় গঙ্গার ধারে আর সাধুবাবাদের দেখা যাচ্ছে না।

কর্নেল বললেন–জয়ন্ত ভুল বলেছে। আমি ওঁকে কোথাও পাঠাইনি। উনি স্বেচ্ছায় সাধুবাবা সাজতে গেছেন।

মি. লাহিড়ী ভ্রু কুঁচকে বললেন–ভবানীপুরে নয়তো? ওখানে কিন্তু সাদা পোশাকে আমাদের লোক অলরেডি বহাল করা হয়েছে। হালদারমশায়ের খামোখা কষ্ট হবে।

এইসময় ষষ্ঠীচরণ আবার তিন পেয়ালা কফি আর সম্ভবত তার নালবাজারের নাহিড়ীসাহেবের খাতিরে তৈরি হাতে গরম একপ্লেট পকৌড়া নিয়ে এল। সেন্টার টেবিলে ট্রে রেখে সে করজোড়ে নমো করে বলল–ভালো আছেন তো স্যার? অনেকদিন পরে আপনার দর্শন পেলুম।

মি. লাহিড়ী সকৌতুকে বললেন–না ষষ্ঠী, আমি মোটেও ভালো নেই। যখন ভালো থাকি না, তখন তোমার বাবামশায়ের কাছে ওষুধ খেতে আসি।

ষষ্ঠী হাসি চেপে তখনই চলে গেল। কারণ লক্ষ্য করছিলুম কর্নেল চোখ কটমটিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন।

কফি খেতে খেতে মি. লাহিড়ী বললেন–ভাবনীপুরের জনৈক প্রয়াত এম. পি.-সাহেবের একমাত্র ছেলে এই কেসে জড়িয়ে গেছে। খবরটা নিশ্চয়ই কর্নেলসাহেব পেয়ে গেছেন। কর্নেল ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললেন–তুমি এত সহজে হাতের তাস দেখিয়ে দিলে। কাজেই বুঝতে পারছি তুমি কেন ফোন না করে সোজা চলে এসেছ। সরকারি গোয়েন্দা প্রধান কফিতে চুমুক দিয়ে মৃদু হেসে বললেন–কান টানলে মাথা আসে। প্রয়াত মি. রায়চৌধুরীর ছেলে পারিজাতের এক বন্ধু নীলাঞ্জন। যে কোনও কারণে হোক, পারিজাতের ওপর খাপ্পা। সে ওই এরিয়ায় আমাদের একজন পোষ্য সোর্সকে একটা গুপ্ত কথা জানিয়ে দিয়েছে। পারিজাতের হাতে নাকি এককোটি টাকা দামের মাল এসেছে। মালটা বেচে ওরা যে টাকা পাবে, সেই টাকা দিয়ে নাকি একটা ফিল্ম কোম্পানি করবে। এ ব্যাপারে পারিজাতরা নাকি বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে। আমাদের সোর্সের মুখে জানতে পেরেছি ওরা নাকি ফিল্ম মহলে একজন ডাইরেক্টরের সঙ্গে কথাও বলেছে। ওদিকে সেই ডাইরেক্টর মোট খরচের একটা বাজেট তৈরি করে ফেলেছে। কিন্তু সমস্যা হল ফিল্ম মহলে খোঁজখবর করেও সেই ডাইরেক্টরের নাম জানতে পারিনি।

কর্নেল কফি শেষ করে চুরুট ধরালেন তারপর মুচকি হেসে বললেন–তোমার সশরীরে আগমনের কারণ বুঝতে পেরেছি। তুমি আমাকে স্টুডিও পাড়ায় পাঠাতে চাও। আমার তো একটাই সোর্স। জয়শ্রী সিনে স্টুডিওর ম্যানেজার গোপাল কুণ্ডু। গোপালবাবু কি তোমাদের কাছে মুখ খোলেননি?

মি. লাহিড়ী বললেন–না। এ ধরনের কোনো খবর ওঁর জানা নেই। কিন্তু আপনি তো ভালোই জানেন গোপালবাবু প্রকৃতপক্ষে ফিল্ম মহলের আনাচেকানাচে যা কিছু ঘটে সব খবরই রাখেন। আসলে কথায় বলে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা।

কথাটা বলে মি. লাহিড়ী জোরে হেসে উঠলেন। কর্নেল বললেন–তোমাদের অঙ্কটা যদি ঠিক হয় তাহলে শেষাবধি আমি গোপালবাবুর কাছ থেকে অন্তত ডাইরেক্টরের নামটা আদায় করে নেব। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এ সবের পেছনে কোনো একজন দুঃসাহসী লোক বসে আছে।

–তা থাকতে পারে কিন্তু আমি আপনার কাছ থেকে এই সাহায্যটুকু আশা করছি। বলে তিনি ঘড়ি দেখলেন এবং উঠে দাঁড়ালেন।–চলি কর্নেল! জয়ন্তবাবু আবার দেখা হবে।

বললুম–রহস্য যেমন ঘনীভূত তাতে একবার কেন আমার মনে হচ্ছে আপনার সঙ্গে আরও কয়েকবার দেখা হবে।

মি. অরিজিৎ লাহিড়ী বেরিয়ে যাওয়ার পর কর্নেল বললেন–এখন গোপালবাবুকে টেলিফোন করে লাভ নেই কারণ এখন ওঁর পেটে প্রচুর হুইস্কি।

বললুম–লাহিড়ীসাহেব এসে রহস্যটা আর জটিল করে ফেললেন।

কর্নেল সায় দিয়ে বললেন–ঠিক বলেছ।

.

০৬.

পরদিন সকাল নটায় ব্রেকফাস্ট করে কর্নেল আমাকে নিয়ে বেরুলেন। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে জিজ্ঞেস করলুম আমরা কি স্টুডিওপাড়ায় যাচ্ছি?

— কর্নেল বললেন–না। ভবানীপুরের মিসেস রায়চৌধুরীর বাড়ি যাচ্ছি।

গেট পেরিয়ে গিয়ে বললুম–ভালো। সাধুবেশী হালদারমশাইকে দূর থেকে দর্শন করে আসব। আমার ধারণা উনি ভোরবেলাই ওঁদের বাড়ির পেছনে সেই বটতলায় ধুনি জ্বেলে বসে পড়েছেন।

কর্নেল একটু পরে বললেন–অরিজিৎ এসে আমার অঙ্কটা গোলমাল করে দিয়েছে। কাজেই হালদারমশাইকে কষ্ট করে সাধুবাবা সেজে বসে থাকার দরকার দেখছি না। ওঁকে … অন্য দায়িত্ব দেব।

তখনও রাস্তাঘাটে তত বেশি যানবাহনের ভিড় ছিল না তবুও কর্নেলের নির্দেশে বড়ো রাস্তা থেকে অনবরত গলি রাস্তা দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছিলুম। একসময় জিজ্ঞেস করলুম–আমার মনে হচ্ছে কোনো গাড়ি আমাদের ফলো করে আসছিল। তাই কি?

কর্নেল বললেন–পার্ক স্ট্রিট থেকে চৌরঙ্গিতে পড়ার সময় লক্ষ্য করেছিলুম আমার বাড়ির পাশের রাস্তায় একটা কালো মারুতি দাঁড়িয়েছিল। সেটা চৌরঙ্গিতে আমাদের পিছনে আসছে। তাই একটু সতর্ক হতে হয়েছে। আমার দেখায় ভুল থাকতেও পারে তবু সতর্ক হওয়া ভালো।

এযাবৎকাল দেখে আসছি কলকাতা এক শহরতলির রাস্তা ও গলির মানচিত্র কর্নেলের মুখস্থ। একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে মোটামুটি একটা প্রশস্ত রাস্তার বাঁকে পৌঁছেলুম। সামনে একটা বাড়ির গেট দেখা যাচ্ছিল। কর্নেল আস্তে বললেন–হর্ন বাজাও। হর্ন শুনে একটা তাগড়াই চেহারার প্রৌঢ় কর্নেলকে দেখামাত্র সেলাম ঠুকে গেট খুলে দিল। বাড়ির লনটা এবড়োখেবড়ো। পাশে একটা ফুলবাগান আছে।

কর্নেল বললেন–গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে রাখো, কারণ আমরা হয়তো বেশিক্ষণ এখানে থাকব না।

কর্নেল আগেই নেমে গেলেন। গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে রেখে যখন আমি মাটিতে পা দিলুম, দেখি হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসছেন সুরঞ্জনা রায়চৌধুরী। তার মুখে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। মনে হল রাতে ভালো ঘুম হয়নি। তিনি কর্নেলকে নমস্কার করে বললেন–ভোরবেলায় আপনার টেলিফোন পেয়ে তখন থেকেই আমি পথ তাকিয়ে বসে আছি।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–জয়ন্তের ঘুম থেকে উঠতে বড্ড দেরি হয়। আজ ওকে সঙ্গে নিয়ে আসব বলেই একটু দেরি করে ফেলেছি। সুরঞ্জনা এবার আমাকেও নমস্কার করে আস্তে বললেন–আপনারা বসুন।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা হলঘর। ভিতরটা পুরোনো আসবাবে সাজানো এবং দেওয়ালে কয়েকটা বিবর্ণ পেন্টিং। হলঘর থেকে সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। দোতলায় গিয়ে একটা ঘরে দরজা চাবি দিয়ে সুরঞ্জনা খুলে দিলেন। তারপর বললেন–আপনারা ভেতরে বসুন।

ভেতরে ঢুকে দেখলুম এটা সুরঞ্জনা দেবীর বেডরুম। একধারে মেহগনি কাঠের কারুকার্যখচিত উঁচু পালঙ্ক। জানলার ধারে কয়েকটা গদি আঁটা চেয়ার এবং একটা নিচু টেবিল। দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি। কোণের দিকে একটা হাফ সেক্রেটারিয়েট টেবিল এবং রিভলভিং চেয়ার টেবিলের মাঝখানে যে রঙিন। ছবি সেটি নিশ্চয়ই তার স্বামীর। চাপাস্বরে বললুম–ম্যাডামের ছেলের ছবি কি এ ঘরে আছে? কর্নেল বললেন–ছিল। সেটা আমি নিয়ে গিয়ে গতরাত্রে তুমি যখন। ঘুমোচ্ছিলে তখন ওটার একটা কপি প্রিন্ট করে নিয়েছি। এখন ছবিটা ম্যাডামকে ফেরত দিতে হবে।

বলে তিনি পিঠে আঁটা কিটব্যাগের একটা চেন খুলে ল্যামিনেট করা একটা মাঝারি আকারের রঙিন ছবি বের করলেন। ছবিটা আমার হাতে তিনি দিলেন।

ছবিটা দেখেই অবাক হলুম। আমার হিসেবে বড়োজোর একুশ-বাইশের মধ্যে বয়স, নিষ্পাপ এবং সুন্দর চেহারার এক যুবক। কিন্তু একটাই চোখে পড়ার মতো ব্যাপার, তার মুখে কোনো হাসি নেই। ছবিটা আমার হাত থেকে কর্নেল নিলেন। এই সময়েই সুরঞ্জনা দেবী ঘরে ঢুকলেন। তার পিছনে শক্ত-সমর্থ গড়নের মধ্যবয়সি একটি মেয়ে। তার হাতে ট্রে। ট্রেতে কফির পট, দুধ, চিনি, চামচ ইত্যাদির সঙ্গে একপ্লেট সন্দেশ আর একপ্লেট পটাটো চিপস।

মেয়েটি চলে গেলে বুঝলুম এই সেই সুশীলা। কর্নেল বললেন–ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি। কাজেই শুধু কফি খাব আর এই নিন পারুর ছবি।

সুরঞ্জনা ছবিটা নিয়ে পালঙ্কের মাথার দিকে একটা র‍্যাকের ওপর রাখলেন। তারপর ফিরে এসে আমাদের মুখোমুখি বসলেন।

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে চাপাস্বরে বললেন–সেই ভদ্রলোক কি আজ সকালের দিকে আপনাকে আবার ফোন করেছিলেন? সুরঞ্জনা মৃদুস্বরে বললেন–হ্যাঁ। আবার ফোন করেছিলেন। আপনারা আসার আধঘণ্টা আগে। উনি কিছুতেই বলতে চাইলেন না পারুর সঙ্গে ওঁর কী দরকার। কাল রাত সাড়ে এগারোটায় যখন ফোন করেছিলেন তখন উনি বলেছিলেন পারুর সঙ্গে ওঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। কিন্তু কী ব্যাপার তা আমাকে বলতে চাননি। ফোন পাওয়ার পরেই আমি উদ্বিগ্ন হয়ে কথাটা তখনই জানিয়েছিলুম।

বুঝলুম গতরাতে সুরঞ্জনা দেবী যখন ফোন করেন তখন আমি বেঘোরে ঘুমুচ্ছিলাম।

কর্নেল কিছুটা কফি খাওয়ার পর বললেন–প্লিজ, সেই অ্যাশট্রেটা দিন। চুরুট না টানলে আমার নার্ভ পুরো চাঙ্গা হয় না।

সুরঞ্জনা দেবী সেই সেক্রেটারিয়েট টেবিল থেকে সুদৃশ্য একটা অ্যাশট্রে আনলেন। একটু হাসবার চেষ্টা করে তিনি বললেন–পারুর বাবা চেইন স্মোকার ছিল। যতবার বাইরে যেত একটা করে অদ্ভুত গড়নের অ্যাশট্রে নিয়ে আসত।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন–আমি একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েও এসেছি। পারুর ঘরটা খুলে দেখার অনুমতি চাইছি। প্লিজ, মিসেস রায়চৌধুরী আপনি আর আপত্তি করবেন না।

সুরঞ্জনাদেবী চোখ নামিয়ে হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে মৃদুস্বরে বলেন–আপনি যদি মনে করেন পারুর কোনও ক্ষতি হবে না তাহলে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু দু-দুটো তালা না ভাঙলে তো ওর ঘরে ঢোকা যাবে না।

আমি মুচকি হেসে বললুম–আপনি জানেন না একসময় কর্নেল ছিঁচকে চোর ছিলেন। শুধু তাই নয় কোন চোর গুরুর কাছে কী ফুসমন্তর শিখেছিলেন, উনি ফুঁ দিলেই সব তালা খুলে যেত।..

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–আসলে আমার সামরিক জীবনের গোড়ার দিকে কতকগুলো বাড়তি বিষয় শেখানো হত। বুটের আঘাতেও যে দরজা খুলছে না তা খোলার জন্য বিশেষ করে তালা খোলারও ট্রেনিং নিতে হত। তালার গড়ন যেমনই হোক, ওর ভিতরকার সিস্টেমে কিন্তু খুব বেশি তফাত নেই। মোট একশো চল্লিশ রকমের তালার কলকবজা আছে।

কথা বলতে বলতে কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সুরঞ্জনা দেবী বললেন–আমি এক কাজ করে আসি। সুশীলা আর রাম সিংহকে কোনও কাজে লাগিয়ে আসি। যাতে ওরা এদিকে লক্ষ্য রাখার সুযোগ যেন না পায়।

ঘর থেকে তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পর কর্নেল তার পিঠে আঁটা কিটব্যাগের চেন খুলে মাস্টার কী বের করলেন। ওটা বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি। ওটার কীর্তিকলাপ স্বচক্ষে দেখে আমি অবাক হয়েছি।

আমরা দুজনে বেরোতে যাচ্ছি, সেইসময় ওর পালঙ্কে রাখা উঁচু টুলের ওপর টেলিফোনটা বেজে উঠল। কর্নেল দ্রুত এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। তারপর নিজের কণ্ঠস্বর একেবারে বদলে দিয়ে মিনমিনে গলায় বললেন–আজ্ঞে স্যার, মামণি তো এখানে নেই।….

আমি? আমি ওঁর কাজের লোক স্যার। কিছু বলার থাকলে আমাকে বলুন। মামণি ফিরলে জানিয়ে দেব।

…হ্যাঁ স্যার, আমি মামণির খুব বিশ্বাসী লোক। উনি আমাকে না জানিয়ে কোনও কাজ করেন না…আজ্ঞে হ্যাঁ বলুন।

কর্নেল কয়েকবার হুঁ দিয়ে তারপর রিসিভার রেখে আমার দিকে তাকালেন। চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলুম–সেই অচেনা ভদ্রলোক নাকি?

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন–লোকটা পারুর জন্য অধীর হয়ে উঠেছে। পারুর সঙ্গে নাকি আজ সকালে ওর হোটেল এশিয়াতে দেখা হওয়ার কথা ছিল। যদি আজ বারোটার মধ্যে পারু না ফেরে তাহলে সে ফিরে যাবে। তাতে পারু বিপদে পড়বে।

আমরা বারান্দায় গেলুম। সেইসময়ে সুরঞ্জনাদেবী ফিরে এলেন। বুঝতে পারলুম উনি টেলিফোনের শব্দ শুনতে পাননি। তিনি বললেন রাম সিংহকে বাজারে পাঠিয়ে এলুম আর সুশীলাকে কোবরেজমশায়ের কাছে ওষুধ আনতে পাঠালুম, আসুন।

আমরা বারান্দা ধরে এগিয়ে দুটো ঘরের পরের ঘরটার সামনে দাঁড়ালাম। দরজার পুরু কাপড়ের দামি রঙিন পর্দা ঝুলছিল। সুরঞ্জনাদেবী পর্দা সরিয়ে বললেন–এই দেখুন, এই তালাটার তলায় আছে ল্যাচ কি! এখন দেখুন তালা না ভেঙে দরজা খুলতে পারেন নাকি।

কর্নেল একহাঁটু মুড়ে বসে মাস্টার-কি দিয়ে মাত্র মিনিট তিনেকের মধ্যে প্রথম তালাটা খুলে ফেললেন। তারপর কিটব্যাগের ভিতর থেকে দুটো দুরকম সাইজের। ক্ত ডাইভার বের করে ল্যাচ-কি টা খোলার চেষ্টা করতে থাকলেন। এবার সময় একটু বেশি লাগল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার ল্যাচ-কি-র গোল মাথাটা চাপ দিয়ে ঘোরাতেই দরজা খুলে গেল। আমরা তিনজনে ভিতরে ঢুকে গেলুম। সুরঞ্জনাদেবী দরজার পর্দা টেনে দিয়ে এলেন। এ ঘরটা তত বেশি প্রশস্ত নয়। একটা ডাবল বেড খাট আছে, একেলে খাট, দুটো বালিশ এবং তার ওপর বেড কভার চাপানো আছে। সুরঞ্জনা বালিশ দুটো তুলে বললেন– ব্যাগটা তো নেই। পারু অন্য কোথাও ওটা লুকিয়ে রেখেছে। কর্নেল কিন্তু দেওয়ালে এঁটে রাখা রঙিন ছবিগুলো খুঁটিয়ে দেখছিলেন। একটা প্রায় ফুট দুয়েক লম্বা এবং এক ফুট চওড়া রঙিন সুন্দরী যুবতীর কাট-আউট দেখতে দেখতে তিনি বললেন–মিসেস রায়চৌধুরী! যদি কিছু না মনে করেন, দেওয়ালে আঁটা এইসব মেয়েদের ছবি বিশেষ করে এই বড়ো কাট আউটটা লক্ষ্য করুন। আপনার কি চেনা মনে হয়?

সুরঞ্জনাদেবী ঈষৎ দ্বিধার সঙ্গে বললেন–আমি পারুর ঘরের কোনও ছবির দিকে কখনও মুখ তুলে তাকাইনি।

কথাটা বলে তিনি কাট-আউটটার দিকে তাকালেন। তারপরই তার মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। তিনি বললেন–এই মেয়েটিকে তো দেখেছি। একদিন পারুর সঙ্গে এসে আমাকে প্রণাম করেছিল। ওর নাম ঠিকানা আমি লিখে নিয়েছিলুম কারণ ভেবেছিলুম মেয়েটির সঙ্গে পারুর ভাব হয়ে থাকে তো ভালোই হবে। পারুর বিয়ে দেবার চেষ্টা অনেক করেছি। কিন্তু ওকে রাজি করাতে পারিনি। একমিনিট। আমি মেয়েটির নাম ঠিকানা নিয়ে আসছি।

বলে সুরঞ্জনা দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। সেই সময় কর্নেল একটা অদ্ভুত কাজ করে ফেললেন। তিনি কাট-আউটটা একপাশে অনেকটা ঠেলে দিতেই দেখলুম। পেছনের দেওয়ালে একটা কুলুঙ্গি। সেটার ওপরে একটা চারকোণা কালো কাগজ আঁটা আছে। কর্নেল কাগজের নিচের দিকটা তুলে ভিতর থেকে একটা চৌকো ব্যাগের মতো জিনিস বের করলেন। পরক্ষণেই বুঝতে পারলুম, এটা আসলে ব্যাগ নয়, জুয়েলারির দোকানে অলঙ্কার কিনলে এই ধরনের বাকসো দিয়ে থাকে। কর্নেল সেটা তার পিঠের কিটব্যাগের ভিতরে ঢুকিয়ে রেখে চেন এঁটে দিলেন। তারপর আমার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে ঠোঁটে আঙুল রাখলেন। অর্থাৎ আমার টু শব্দটি করা চলবে না।

তারপর তিনি কালো কাগজটা আগের মতো কুলুঙ্গির নিচের দিকে সেঁটে দিলেন। বোঝা গেল কাগজে এক ধরনের পেস্ট লাগানো আছে যা দেওয়ালের সঙ্গে সেঁটে যায়। কাট-আউটটা আগের মতো রেখে দিয়ে কর্নেল ক্যামেরায় একটা ছবি তুললেন। তারপর তিনি ঘরের এককোণে দাঁড় করানো একটা স্টিলের আলমারির সামনে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলুম-এবার আলমারিটা খুলবেন নাকি?

এই সময়েই সুরঞ্জনাদেবী ফিরে এলেন। তার হাতে একটুকরো কাগজ। কাগজটা তিনি কর্নেলের হাতে দিলেন। বললেন–এই নাম ঠিকানাটা আপনি রাখুন। আমি আমার নোটবইয়ে এটা টুকে রেখে এলুম।

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন–আমি আলমারিটা খুলতে চাই না। পারু অলঙ্কারের ব্যাগ হয়তো এই আলমারিতেই লুকিয়ে রেখেছে। ওটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আপাতত আপনি যে ঠিকানাটা দিলেন, এটাই আমার কাছে অলঙ্কারের ব্যাগের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চলুন এবার বেরোনো যাক। চিন্তা করবেন না। তালাদুটো আমি ঠিকই আটকে দেব তবে এদুটো কেউ খুলেছিল কি না তা বুঝতে হলে পারুকে একটু বেশি ধুরন্ধর হতে হবে।

ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে সুরঞ্জনা দেবী বললেন–পারু একেবারে বোকা। বোকা না হলে ওই বজ্জাত ছেলেগুলোর সঙ্গে সে মেশে, না তাদের কথামতো চলে। এই ডবল তালা দেওয়াটাই ওর বোকামির লক্ষণ কি না বলুন? দৈবাৎ পুলিশ জানতে পারলে ডবল তালা দেখেই তো সন্দেহ হবে তাই না?

কর্নেল আবার একহাঁটু মুড়ে বসে ল্যাচকি এবং দ্বিতীয় তালাটা আংটার ভেতরে ঢুকিয়ে আটকে দেওয়ার কাজে মন দিলেন।

আমি বললুম–আপনি ঠিকই বলেছেন মিসেস রায়চৌধুরী! পারুর মধ্যে গোঁয়ার্তুমি থাকতে পারে কিন্তু সে তত চালাক নয়। বজ্জাতদের পাল্লায় পড়ে একটা কুকীর্তি করে ফেলেছে, এই যা।

এরপর কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন–এবার চলি। আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার ছেলের কোনো বিপদের কারণ নেই।

ফেরার পথে কর্নেল বললেন–জয়ন্ত পারুকে বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিলুম। এবার চলো টালিগঞ্জপাড়ায় গোপালবাবুর কাছে যাওয়া যাক।

.

০৭.

জয়শ্রী সিনে স্টুডিওর অফিসে কর্নেলকে দেখে ম্যানেজার গোপাল কুণ্ডু সহাস্যে বললেন–আমি আপনার আবির্ভাবের জন্য প্রতীক্ষা করছিলুম। বসুন। আগে চা-ফা খান তারপর কথা হচ্ছে।

কর্নেল এবং আমি তার মুখোমুখি বসলুম। কর্নেল বললেন–লালবাজার আপনাকে জ্বালাতন করছে তা বুঝতে পেরেছি।

গোপালবাবু চাপাস্বরে বললেন–আমি আপনার কাছে যাব ভেবেছিলুম। কিন্তু আপনি এসে গিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন। কারণ, আজ তিনটে ফ্লোরেই শু্যটিং চলছে। বলে তিনি টেবিলে আটকানো কলিংবেলের সুইচ টিপলেন। একজন। কিশোর এসে কর্নেলকে সেলাম দিয়ে বললেন–স্যার! আজ স্টুডিওতে খুব

ধুমধাম চলছে। বলিউডের হিরোইন এসেছে।

গোপালবাবু তাকে ধমক দিয়ে বললেন–এই গ্যাঁদা! ফুকুরি করলে ছুঁড়ে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেব। কর্নেলসাহেবদের জন্যে শিগগির চা নিয়ে আয়। কফি তো আজ পাওয়া কঠিন হবে।

গ্যাঁদা হেসে বলল–না ম্যানেজারবাবু! পন্টুদা বলিউডের হিরোইনের খাতিরে চাফির ব্যবস্থা করেছে।

গোপালবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন–অ্যাঁ! চাফি কী রে?

 আমি বললুম–কর্নেলের পাল্লায় পড়ে একবার কেষ্টনগরে আমি চাফি খেয়েছিলুম। চমৎকার ড্রিঙ্ক। চা প্লাস কফি মানে চাফি। এই নামটা কিন্তু কর্নেলই দিয়েছিলেন। কিন্তু এখানে কার মাথায় এই নামটা বেরুল?

ততক্ষণে গ্যাঁদা চলে গেছে। গোপালবাবু মুচকি হেসে বললেন–হ্যাঁ মনে পড়ে গেছে। এই অফিস ঘরে একবার কর্নেলসাহেব এসে নিজেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন এখানকার ক্যান্টিনের কফি খেয়ে তার মুখে স্বাদ বিগড়ে যাবে বরং একভড় চায়ের সঙ্গে একটুখানি কফির লিকার মিশিয়ে দিলে ভালো হয়। চা এবং কফি কাজেই চাফি। বুঝলেন জয়ন্তবাবু। কর্নেলের এই চাফি খেয়ে আমি আমাদের ক্যান্টিনে পন্টুর কাছে চালান করে দিয়েছিলুম।

কর্নেল বললেন–চাফি আসার আগে কথাটা সেরে নিতে চাই।

গোপালবাবু ব্যস্তভাবে বললেন–পুলিশ জানতে চাইছিল কোন ডাইরেক্টর নাকি ক-জন আলালের ঘরের দুলাল অর্থাৎ বড়োলোকের ছেলেদের আবদারে একটা নতুন ছবির বাজেট তৈরি করে দিচ্ছেন কিংবা দিয়েছেন। আমি তাকে চিনি কি না।

কর্নেল তার কথার ওপর বললেন–না। বম্বে থেকে বলিউডের কোনো ভদ্রলোক এখন হোটেল এশিয়াতে এসে উঠেছেন কি না, এ বিষয়ে আপনার হাতে কোনও খবর আছে? গোপালবাবু নড়ে বসলেন। তারপর টেবিলের উপর একটু ঝুঁকে খুব চাপাস্বরে বললেন–গতকাল দুপুরবেলায় আমাকে কালীঘাট এরিয়ার চেনা একজন রাজনীতিওয়ালা ফোন করে হুকুম দিয়েছিলেন হোটেল এশিয়ার ২৩৩ নম্বর সুইটে এন. দাশগুপ্ত নামে একজন ফিল্মমেকার এসেছেন, আমি যেন বাড়ি ফেরার পথে তার সঙ্গে একবার দেখা করি।

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন-কালীঘাট এরিয়া রাজনীতিওয়ালা মানে ঝন্টুবাবু? অর্থাৎ কাজল সেন?

গোপালবাবু বললেন–ঠিক ধরেছেন। স্টুডিওপাড়ায় কাজলবাবুর হাতে গড়া ইউনিয়ন আছে। কাজেই আমি কাল এখান থেকে একটু সকাল সকাল বেরিয়েছিলুম। তা মানে তখন রাত প্রায় আটটা। কাজলবাবু আমাকে ফোন নাম্বার দিয়েছিলেন। ফোনে যোগাযোগ করেই গিয়েছিলুম।

এই সময়ে গ্যাঁদা একটা ছোটো টিনের ট্রেতে তিনটে মাটির ভাড় ভর্তি চাফি রেখে বলল–পন্টুদাকে এই স্যারের কথা না বললে দেরি করত।

গোপালবাবু দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললেন–এই স্যারকে তুই চিনিস?

গ্যাঁদা ফিক করে হেসে বলল–আপনার ঘরে কতবার ওনাকে দেখেছি। স্যার তো কর্নেলসাহেব। আপনার মুখেই শুনেছি। আর পন্টুদাও আপনার মুখে শুনেছে।

গোপালবাবু হাত তুলে বললেন–এবার বেরো। কর্নেলসাহেবদের চাফি খেতে দে। গ্যাঁদা হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল।

মাটির ভাঁড় হাতে নিয়ে বুঝলুম প্রচণ্ড গরম। অগত্যা হালদারমশায়ের মতো ফুঁ দিয়ে দিয়ে চাফি পান শুরু করলুম। কর্নেল কিন্তু দিব্যি ওই প্রচণ্ড গরম পানীয়ে চুমুক দিতে থাকলেন। গোপালবাবু আগের মতো চাপাস্বরে বললেন–তো যা বলছিলুম। হোটেল এশিয়াতে গিয়ে দেখি ২৩৩ নম্বর সুইটের সেই ভদ্রলোক নিচের লাউঞ্জে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। কর্নেলসাহেব, আপনি জিজ্ঞেস করবেন আমরা পরস্পরকে চিনলুম কী করে। এন. দাশগুপ্ত যে আসলে ঘনশ্যাম বাঁড়ুজ্জে তা তো আমার জানাই। ক-বছর আগে আমাদের টলিউডে এক প্রোডিউসারে কয়েক লাখ টাকা হজম করে গা ঢাকা দিয়েছিলেন। তার নামে এখনও পুলিশের হুলিয়া জারি আছে।

আমি জিজ্ঞেস করলুম–তাহলে কোন সাহসে উনি এসে আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন? গোপালবাবু মুখে করুণভাব ফুটিয়ে বললেন–আমি যে ঢোঁড়া সাপ তা টলিউডে সবাই জানে। ঘনশ্যামবাবু তা জানেন। তাছাড়া রাজনীতিওয়ালা কাজলবাবু ওঁর মুরুব্বি। কাজেই ভদ্রলোক জানেন আর যে পারে পারুক আমি তাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিতে পারব না।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন–এবার সংক্ষেপে বলুন তার সঙ্গে আপনার কী কথা হল। গোপালবাবু এতক্ষণে চাফির ভঁড়ে চুমুক দিয়ে তেমনই চাপাস্বরে বললেন–ঘনশ্যামবাবু আমাকে প্রথমে ভয় দেখালেন। তিনি যে কলকাতায় এসেছেন, এ বিষয়ে আমি যেন মুখ বুজে থাকি। তারপর একটা ঠিকানা লিখে দিয়ে বললেন–এই ভদ্রলোক একটা ছবি করতে চান। ইনি কাজলবাবুর মাধ্যমে বোম্বতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। ছবিটা হবে হিন্দিতে। ছবির স্টোরিও আমাকে ইনি জানিয়েছেন। সেইমতো একটা বাজেট তৈরি করে ইনি আমাকে কলকাতা আসতে বলেছিলেন। কিন্তু এসেই তার বাড়ি গিয়ে দেখি তিনি কোথায় গেছেন কেউ জানে না। তখনই ঘনশ্যামবাবু কাজলবাবুর বাড়ি যান। তার কথা শুনে কাজলবাবু বলেন, একটা গন্ডগোল হয়ে গেছে। আপনি বরং ওর এই বন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করবেন। কিন্তু সেই বন্ধুরও পাত্তা নেই। খামোখা আমাকে একগাদা টাকা খরচ করে আসতে হল। এইসব কথা বলার পর ঘনশ্যামবাবুকে জিজ্ঞেস করলুম–আমাকে কী করতে হবে তাই বলুন। তখন ওই বজ্জাতটা আমাকে বলল, তাঁর ধারণা, সে কোনও কারণে গা ঢাকা দিয়েছে আমি যেন তার বাড়ির লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওঁকে টেলিফোনে সব খবর জানাই।

কর্নেল বললেন–কেন? ঘনশ্যাম বাড়ুজ্জে এই দায়িত্ব তো কাজলবাবুকেই দিতে পারত।

গোপালবাবু বললেন–কাজলবাবুকেই তিনি দায়িত্বটা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কাজলবাবু এই কাজটা করতে চাননি। কেন করতে চাননি তা খুলেও তিনি বলেননি। শুধু বলেছেন আপনি জয়শ্রী সিনে স্টুডিওর গোপালবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। নানা স্তরের লোকের সঙ্গে তার পরিচয় আছে। কাজেই আমিই নাকি এই কাজটা ভালো পারব।

কর্নেলকে গোপালবাবু পাঞ্জাবির ভেতর-পকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজ দিলেন। কর্নেল সেটা খোলার আগেই বলে উঠলেন–নাম ঠিকানাটা নিশ্চয়ই বাপি সেনের।

গোপালবাবু চমকে উঠে বললেন–কী সর্বনাশ! আপনি তাহলে ঘনশ্যামবাবুর গন্ধ পেয়েই আমার কাছে হাজির হয়েছেন? কিন্তু প্লিজ কর্নেলসাহেব, আপনাকে অনুরোধ করছি এখন ওই হোটেল থেকে ফেরারি আসামী ঘনশ্যাম বাড়ুজ্জেকে পুলিশ যদি পাকড়াও করে তাহলে তার গার্জেন কাজলবাবু আমার ভবলীলা সাঙ্গ করে দেবেন।

কর্নেল কাগজটা পকেটে ভরে চুরুট ধরিয়ে বললেন–আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। আমি তেমন কিছু করব না। আমার হাতে কোনও ঘনশ্যামবাবু-সংক্রান্ত কেস নেই। আমার কেস এই বাপি সেনের অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে। ফেরার পথে বললুম –আচ্ছা কর্নেল! হোটেল এশিয়ার ম্যানেজার মি. রঙ্গনাথন আপনার পরিচিত এবং তিনি অনেক কেসে আপনাকে সাহায্য করেছেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে আপনি–

আমাকে থামিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন–বুঝেছি, আজ দুপুরের মধ্যে কিংবা বিকেলে ঘনশ্যামবাবু হোটেল থেকে চেক-আউট করেছেন কি না, এই খবর নেওয়ার কথা বলছ তো?

আমি বললুম–হ্যাঁ। তাছাড়া গোপনে বাপি বা পারু ঘনশ্যামবাবুর সঙ্গে দেখা করেছে কি না, এটাও জেনে নিতে পারেন। আপনি বলবেন রঙ্গনাথন ওদের দুজনকে চেনেন না, কিন্তু উনি অন্তত একথা বলতে পারবেন ঘনশ্যামবাবুর সঙ্গে আজ সারাদিনের মধ্যে কেউ বা কারা দেখা করেছে কি না। হোটেলে এশিয়ার নিয়ম তো জানি। ভিজিটিং রেজিস্টারে সাক্ষাৎকার প্রার্থীদের নাম ঠিকানা এবং সময়ের কথা লিখে দিতে হয়।

কর্নেল এবার আমার কথার কোনও জবাব দিলেন না। বললেন–একটা বাজতে চলল। আগে উদরের সেবা তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে পা বাড়াব।

অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছোনোর পর কর্নেল বললেন–ষষ্ঠী! কোনও ফোন এসেছিল?

ষষ্ঠীচরণ বলল–কিছুক্ষণ আগে টিকটিকিবাবু ফোন করেছিলেন। উনি বললেন, যেখানে উনি ছিলেন সেখানে থাকা যাচ্ছিল না তাই উনি ফেলাটে ফিরে এসেছেন। আপনাকে উনি ফোন করতে বলেছেন।

কর্নেল বললেন–ফোন করছি। তুই আমাদের খাবার ব্যবস্থা কর। আজ আর আমরা স্নান করব না।

বলে তিনি টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। সাড়া এলে উনি বললেন–আমরা এইমাত্র বাড়ি ফিরেছি হালদারমশাই। আপনি নাকি বটতলায় বসে থাকতে পারছিলেন না।… কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–আপনাকে পাড়ার ছেলেরা পাগল ভাবল কেন? নিশ্চয়ই এমন কিছু করেছেন… আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি যখন আমাদের দেখতে পেয়েছিলেন তখন গেটের সামনে এসে। দাঁড়ালেই পারতেন।…আচ্ছা, আপনি তিনটের মধ্যে চলে আসুন। রিসিভার রেখে কর্নেল বললেন–হালদারমশায়ের ভুলেই গন্ডগোলটা হয়েছে। উনি কাচ্চাবাচ্চাদের জিভ বের করে ভেংচি না কাটলেই পারতেন। সাধুবাবা ভেংচি কাটলে ছোটোরা তাকে পাগল ভাববেই। থাকগে। ভালোই হয়েছে। ওকে ওখানে কষ্ট করে গোয়েন্দাগিরি করানোর মানে হয় না। অন্তত এখন যা পরিস্থিতি।

দেড়টার মধ্যে লাঞ্চ খেয়ে আমরা ড্রইংরুমে এলুম। তারপর যথারীতি আমি ডিভানের ওপর শুয়ে পড়লুম। আর কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চুরুট টানতে থাকলেন।

সবে আমার ভাতঘুমের টান এসেছে এমন সময়ে ডোরবেল বেজে উঠল। কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বললেন–ষষ্ঠী খেতে বসেছে। জয়ন্ত, তুমি গিয়ে দ্যাখো কার আবির্ভাব হল। অগত্যা উঠে গিয়ে সদর দরজা খুলেই দেখি লালবাজারের ডিটেকটিভ অফিসার নরেশ ধর এবং তাঁর সঙ্গে একজন অভিজাত চেহারার ভদ্রলোক এসেছেন। তার পরনে সিল্কের পাঞ্জাবি এবং উজ্জ্বল সাদা ধুতি আর তার একহাতে একটা ছড়ি।

নরেশবাবু মুচকি হেসে বললেন–জয়ন্তবাবুর ভাতঘুমের সময় এটা। কাজেই আমাদের আবির্ভাবে আপনার বিরক্ত হওয়ারই কথা। কিন্তু সুখবর এনেছি। চলুন, ভেতরে গিয়ে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আপনাদের আলাপ করিয়ে দেব।

ড্রইংরুমে ঢুকে নরেশবাবু কিছু বলার আগেই কর্নেল ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন–আপনি চন্দ্র জুয়েলার্সের অন্যতম মালিক যদুপতিবাবু, তাই না?

ভদ্রলোক করজোড়ে নমস্কার করছিলেন। এবার চমকে উঠে বললেন–তাহলে আমার জ্যাঠামশাই হরনাথ চন্দ্র যা বলতেন তা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল। আপনি সত্যিই অন্তর্যামী। নরেশবাবু বললেন–আসলে কর্নেলসাহেবের মাথার পেছনে একটা চোখ আছে।

কর্নেল বললেন–আপনারা বসুন।

 দুজনে সোফায় বসলেন। আমি একটু তফাতে বসলুম।

কর্নেল বললেন–আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ডাকাতি হয়ে যাওয়া অলঙ্কার যেভাবে হোক চন্দ্রমশাই ফিরে পেয়েছেন।

এবার যদুপতিবাবুর চোখ দুটো বড়ো হয়ে গেল তিনি সবিস্ময়ে বলে উঠলেন–কী আশ্চর্য নরেশবাবু বললেন–রহস্য ক্রমশ জটিলতা হয়ে গেল কর্নেলসাহেব। আজ ভোরবেলা যদুপতিবাবু অন্য দিনের মতো গাড়ি চেপে বাবুঘাটে গঙ্গাস্নানে গিয়েছিলেন। স্নান করে ফেরার পর ওঁর ড্রাইভার রামভগৎ একটা প্যাকেট দেখিয়ে ওঁকে বলে, কিছুক্ষণ আগে মোটর সাইকেলে চেপে দুজন যুবক এসেছিল তারা রাম ভগতের হাতে প্যাকেটটা দিয়ে বলে, এটা যদুপতিবাবুকে দেবে। সেইসঙ্গে হুমকি দিয়ে বলে, তুমি এটা খোলবার চেষ্টা কোরো না, সাবধান। আমরা কাছেই থাকছি। দেখতে পেলে মাথার খুলি ফুটো করে দেব।

যদুপতিবাবু দুই হাত জোড় করে কপালে বারবার ঠেকিয়ে বললেন–ঠাকুরের কৃপা তা না হলে এমন অসম্ভব ঘটনা কি ঘটতে পারে? বাড়ি ফিরে ডাকাতি হওয়া অলঙ্কারের লিস্টের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলুম প্রত্যেকটি জিনিস ফেরত দিয়েছে।

কর্নেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টে তাকিয়েছিলেন। এবার একটু হেসে বললেন–ঠাকুরের কৃপা নিশ্চয়ই হয়েছে কিন্তু আমার ধারণা এই জিনিসগুলো যে কিনতে চেয়েছিল সে গা-ঢাকা দিয়েছে এবং এমনও হতে পারে সে ডাকাত দুজনকে চিঠি লিখে হোক বা টেলিফোনে হোক জানিয়ে দিয়েছিল পুলিশ তাদের নাম জেনে গেছে এবং কে কিনবে তাও জেনে গেছে।

নরেশবাবু সায় দিয়ে বললেন–আপনার থিয়োরি এক্কেবারে কারেক্ট। আসলে আমাদের লাহিড়ীসাহেব আপনাকে যে হিন্ট দিয়ে গিয়েছেন তা সত্য।

কর্নেল বললেন–ফিলমের প্ল্যান এবং বাজেট? যদুপতিবাবু বলে উঠলেন–সে আবার কী? নরেশবাবু বললেন–সে আপনি বুঝবেন না। কর্নেল বললেন–নরেশবাবু! ক্রেতা কে একথা নিশ্চয়ই আপনারা খবর পেয়ে গেছেন?

নরেশবাবু বললেন–পেয়েছি। তবে এই ডাকাতির ফয়সালা করে ফেলার জন্য সব কৃতিত্ব কিন্তু আমাদের সবার প্রিয় হালদার মশায়ের। তিনি শেখ কালুর বুড়ো আঙুলের নখ গুলি করে উড়িয়ে না দিলে আমাদের অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে হত। যাই হোক এবার যে জন্য যদুপতিবাবুকে সঙ্গে নিয়ে আপনার কাছে এসেছি, তাই বলি।

কর্নেল জিগ্যেস করলেন–বলুন নরেশবাবু, তবে এখন কি কফি খাবেন না চা?

নরেশবাবু বললেন–কফি বা চা কিচ্ছু না। কথাটা বলেই আমি চলে যাব। আমি মি. চন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে এখানে এসেছি তার আসল কারণ লাহিড়ীসাহেবের একটা নির্দেশ। মিস্টার চন্দ্রের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সেই মিনিস্টার ভদ্রলোক লাহিড়ীসাহেবকে বলেছেন আজ সকালে গঙ্গার ঘাটে যে ঘটনাটা ঘটেছে তা যেন চাপা থাকে আর এই কেসটা নিয়ে আমরা যেন আর না এগোই।

তার কথার ওপরে যদুপতি চন্দ্র বললেন– খবরটা আমি সকালেই আমার পিসতুতো দাদা সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ দত্তকে ফোনে জানিয়েছিলুম। সব শুনে উনি বলেছিলেন যে কোনো কারণেই হোক কয়েক লক্ষ টাকার অলঙ্কার যখন ওরা তোমাকে ফেরত দিয়েছে তখন তোমার পক্ষ থেকে কেস চালিয়ে গেলে ওরা খাপ্পা হবে। তা দেখুন কর্নেলসাহেব, আজকাল দেশের যা অবস্থা চাকরি না পেয়ে শিক্ষিত বেকার ছেলেদের পক্ষে ডাকাতি করা ছাড়া আর উপায় কী। এই অবস্থায়। হয়তো অনুতাপ বশে ওরা আমাকে যখন গয়না ফেরত দিয়েছে তখন আর ওদের। শাস্তি দিয়ে লাভ কী। আমি বললুম–কিন্তু শেখ কাল্লু? ওর ব্যাপারটা চাপা দেবেন কী করে?

যদুপতিবাবু একটু হেসে বললেন–ধরুন এমন তো হতে পারে সে ডাকাতির সময়ে আমার দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ ডাকাতদের গুলিতেই তার। পায়ে আঘাত লেগেছে। কী বলেন নরেশবাবু? আপনারা কেসটা এভাবে সাজালেই তো ঝামেলা চুকে যায়।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–চন্দ্রমশাই বুদ্ধিমান। তাছাড়া কাল শনিবার ল্প ধরা পড়েছে আর আজ রবিবার আদালতের ছুটি। কালুকে কাল আদালতে হাজির না করে ছেড়ে দিলেই হয়।

নরেশবাবু গম্ভীর হয়ে কী ভাবছিলেন। তিনি বললেন–কর্নেলসাহেব! প্লিজ আপনি আপনার স্নেহভাজন লাহিড়ীসাহেবকে এই পরামর্শটা দিলে ভালো হয়। আমরা উঠি হা–আর একটা কথা ওঁকে বললেন মন্ত্রীমশাই এটাই চান।

.

০৮.

নরেশবাবু এবং যদুপতি চন্দ্র বেরিয়ে যাওয়ার পর বললুম–ব্যাপারটা আমার খুব অদ্ভুত মনে হচ্ছে। বাপি সেনের যা ব্যাকগ্রাউন্ড শুনেছি, আমার মনে হয় সে এমন কাজ সমর্থন করতেই পারে না। এমনটা পারে শুধু পারিজাত আর অনিরুদ্ধ। কারণ ওরা দুবৃত্তদের সঙ্গে মিশলেও পেশাদার ডাকাত নয়। আমার ধারণা পারিজাত তার বান্ধবী মেয়েটিকে ফিমে নামাতে চেয়েছিল আর অনিরুদ্ধরও তাতে সায় ছিল। ওদিকে বাপী সেন তাদের বন্ধু হলেও প্রকৃত ক্রিমিনাল। কাজেই ছবি করার খেয়ালটা বাপী উসকে দিয়ে পুরো ডাকাতি করা মাল হজম করতে চেয়েছিল। এটাই কিন্তু আমার থিয়োরি।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন–চারটে বাজে। এখনই ষষ্ঠী তোমার জন্য চা আর আমার জন্য কফি নিয়ে আসবে। অবশ্য হালদারমশাইও এসে পড়তে পারেন। বলে তিনি হাঁক দিলেন–ষষ্ঠী! এককাপ চা আর এককাপ কফি দিয়ে যা।

ষষ্ঠীচরণ যেন তৈরিই ছিল। তখনই আমার জন্য চা আর কর্নেলের জন্য কফি রেখে গেল। চায়ে চুমুক দিয়ে বললুম–কর্নেল! আমার থিয়োরি সম্পর্কে আপনি কোনো মতামত কিন্তু দিলেন না।

কর্নেল বললেন–তোমার থিয়োরিটা ঠিকই আছে। বাপির মতো দুবৃত্ত ডাকাতি করে মাল ফেরত দেবার পাত্র নয়। তবে আড়ালে কী ঘটেছে না জানা অবধি কোনো থিয়োরি দাঁড় করিয়ে লাভ নেই।

কফি খেতে খেতে কর্নেল হাত বাড়িয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে একটা নাম্বার ডায়াল করলেন। তারপর সাড়া এলে বললেন–প্লিজ পুট মি টু ম্যানেজার মিস্টার রঙ্গনাথন…কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

একহাতে রিসিভার কানে রেখে তিনি কফি খাচ্ছিলেন। প্রায় মিনিট তিনেক পড়ে সাড়া এল। কর্নেল বললেন–গুড আফটারনুন মিস্টার রঙ্গনাথন…।

না না, তেমন কিছু না। জাস্ট একটা কথা জানতে চাইছি। স্যুইট নম্বর ২৩৩-এ যে ভদ্রলোক উঠেছেন, তিনি কি চেক-আউট করেছেন? করেননি? এবার একটা কথা জানতে চাই। আজ কেউ কি ওঁর সঙ্গে মিট করতে এসেছিল?… হা ধরছি। আপনি ভিজিটার্স বুক দেখে বলুন।

আবার মিনিট তিনেক পরে সাড়া এল। কর্নেল টেবিল থেকে ছোটো প্যাড আর ডট পেন টেনে নিয়ে বললেন–বলুন। রানা রায়চৌধুরী? হ্যাঁ বলে যান… বিজন চন্দ্র? …হা বলে যান। …এরা মর্নিং-এ এসেছিল? এবার থার্ড ম্যান যে সাড়ে বারোটায় এসেছিল? শচীন্দ্রনাথ ঝা। ঠিকানা বলুন…এই লোকটিকে রিসেপশনের কেউ নিশ্চয়ই দেখেছে? প্লিজ মিস্টার রঙ্গনাথন। তখন ডিউটিতে যারা ছিল, তাদের কাছে জেনে নিন মিস্টার ঝা বয়সে তরুণ না প্রবীণ। হা আমি ধরছি।

আবার মিনিট তিনেক পরে সাড়া এল। কর্নেল বললেন–থ্যাংকস মি. রঙ্গনাথন।… না, না! আপনার চিন্তার কোনও কারণ নৈই। আপনি শুধু একটু লক্ষ্য রাখবেন, আজ রাত নটা অবধি আর কেউ দেখা করতে আসছে কি না। ওটাই আপনাদের লাস্ট ভিজিটিং টাইম তাই না? …আপনাকে আমি পরে ফোন করব। রাখছি। থ্যাংকস।

কর্নেল ততক্ষণে কফি শেষ করেছেন। এবার চুরুট ধরালেন। বললুম–প্রথম দুজন নিশ্চয়ই অনিরুদ্ধ এবং পারু। ফিল্ম করতে তারাই ইন্টারেস্টেড। কিন্তু এই তৃতীয়জন কি বাপি? কর্নেল বললেন–না, শচীন্দ্রনাথ ঝা। বয়সে প্রবীণ। মুখে প্রকাণ্ড গোঁফ আছে। মাথার চুল গোঁফ সব সাদা। পরনে টাই-সুট। হাতে একটা ব্রিফকেস ছিল। জয়ন্ত! আমার ধারণা এই হল আড়ালের লোক, যাকে আমি মনে মনে অন্ধকারেরর নায়ক বলে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। অবাক হয়ে বললুম–মনে পড়ছে আপনি এসবের আড়ালে থাকা একজন লোকের কথা বলেছিলেন বটে। কিন্তু এই কেসে তার ভূমিকাটা কী?

কর্নেল কিছুক্ষণ চুপচাপ চুরুট টানার পর যেন আপন মনে বললেন–ফিল্ম করার প্ররোচনা–এমনকী তার জন্য শিখিয়ে পড়িয়ে কোনো সুন্দরী স্মার্ট মেয়েকে পারিজাতের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া–তারপর বাপী সেনের মতো পেশাদার দুবৃত্তকে ওদের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া–আমি এরকম একটা থিয়োরি গোড়া থেকেই মনে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। তার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল, বাগবাজারের বনেদি পরিবার অরিন্দম সোমের পূর্বপুরুষের রক্ষিত মূল্যবান অলঙ্কার। মেয়েটির সাহায্যে পারিজাতকে ট্র্যাপ করার পর পারিজাতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অনিরুদ্ধকে ট্র্যাপ করাটা সোজা ছিল। জয়ন্ত! আমার মনে হচ্ছে ওই সুন্দরী মেয়েটি ফিমের টাকা জোগাড় করার জন্য পারু আর আনুকে প্ররোচনা দিয়েছিল। সোম পরিবারের ওই অলঙ্কার তাদের গৃহদেবতা রাধাকৃষ্ণকে ঝুলন পূর্ণিমার দিন পরানো হয় বাকি সময়টা। আয়রন চেস্টে লুকোনো থাকে। মেয়েটি এখবর পেয়েছিল তার গার্জেন অর্থাৎ অন্ধকারের নায়কের কাছ থেকে। আমার মনে হচ্ছে জয়ন্ত, এই শচীন্দ্রনাথ ঝা তার আসল নাম নিশ্চয়ই ওটা নয়, ঠিকানাটাও ভুয়ো। সে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল কেন চুরি ও ডাকাতি করা জিনিসগুলো নিয়ে তার সামনে আসার পথে কী অসুবিধা হচ্ছে। কারণ মেয়েটিই তো তার গার্জেনের প্ল্যানমতো ওদের জিনিসগুলো নিয়ে গোপনে ক্রেতার কাছে ওদের পৌঁছে দেবে। এবং সে নিজেই তখন ক্রেতার ভূমিকা নিত। তারপর কী ঘটত তা বুঝতেই পারছ।

কথাগুলো শুনতে শুনতে আমি উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলুম। বললুম–কর্নেল! আপনার থিয়োরির পেছনে যুক্তিগুলো খুব শক্ত মনে হচ্ছে। আপনি ঠিকই বলেছেন। অন্ধকারের নায়ক অধৈর্য হয়ে শেষাবধি তার অন্য এক সহচর ওই ঘনশ্যামের কাছে খবর নিতে এসেছিল। কিন্তু একটা পয়েন্ট আমার কাছে গোলমাল ঠেকছে। আজ মর্নিং-এ কেন পারু আর আনু ঘনশ্যামের কাছে এসেছিল? আর কেনই বা তারা তারপর গঙ্গার ঘাটে গিয়ে যদুপতিবাবুর ড্রাইভারকে জিনিসগুলো ফেরত দিল?

কর্নেল বললেন–তুমি ঠিক বলেছ। এর একটাই উত্তর হতে পারে। কোনও কারণে সম্ভবত বাপি এবং পরে ঘনশ্যামের কথাবার্তায় তাদের সন্দেহ জেগেছিল। কিন্তু কেন ওরা ডাকাতি করা গয়না ফেরত দিল তার জবাব পেতে দেরি হবে।

এইসময় ডোরবেল বাজল এবং কর্নেল যথারীতি হাঁক দিলেন–ষষ্ঠী। তারপর গোয়েন্দা প্রবর হালদারমশাই সবেগে ড্রইংরুমে ঢুকে ধপাস করে সোফায় বসলেন। তারপর বললেন–আপনার টেলিফোন কি অনেকক্ষণ এনগেজড ছিল? ক্যান কি, ম্যাডাম আপনারে ফোন কইরা পান নাই, তখন আমারে ফোন। করছিলেন। বেশিক্ষণ আগে না। ওঁর ফোন পাইয়াই আমি ট্যাক্সি কইরা আইয়া পড়লাম।

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন–আপনার ক্লায়েন্ট আপনাকে কী বলেছেন?

উত্তেজিত হালদারমশাই বললেন–বেলা আড়াইটা নাগাদ হঠাৎ ম্যাডামের পোলা বাড়ি ফিরছে। তারপর সে তার ঘরের তালা খুলতে গিয়ে টের পাইছে কেউ। সেই তালা খুলছিল। ম্যাডাম তার লাফালাফি দেইখ্যা তারে কন আইজ মর্নিং-এ পুলিশ আইয়া তার ঘরে ঢুকছিল। ম্যাডামেরে ভেতরে ঢুকতে দ্যায় নাই। তারা ঘর সার্চ কইরা কী লইয়া গেছে তিনি জানেন না।

এই সুযোগে আমি বলে উঠলুম-ওদের বাড়ির কাছাকাছি সাদা পোশাকের পুলিশ মোতায়েন ছিল। তাদের চোখ এড়িয়ে পারু কী করে বাড়ি ঢুকল।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন–জয়ন্ত! তুমি ভুলে যাচ্ছ, অরিজিতের নির্দেশে দুপুরের মধ্যে ওখান থেকে সাদা পোশাকের পুলিশ সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ তুমি স্বকর্ণে শুনেছ মন্ত্রীমশায়ের চাপে ডাকাতির কেসটা কর্পূরের মতো উবে গেছে।

এইসময় ষষ্ঠী, হালদারমশায়ের জন্য কফি আনল। তার কপালে তখনও অবশ্য ব্যান্ডেজ বাঁধা এবং হাতের আঙুলেও ব্যান্ডেজ। ফুঁ দিয়ে কফি পান করতে করতে হালদারমশাই বললেন–কী কইলেন কর্নেলস্যার? ডাকাতির ক্যাস কী হইছে য্যান?

কর্নেল বললেন–সব বলব। কফি খেয়ে নিন।

আমি বললুম–ম্যাডাম আপনাকে বলেননি পারু এখন কোথায় আছে?

হালদারমশাই বললেন–পুলিশের কথা শুইন্যা ভয় পাইয়া আবার গা-ঢাকা দিছে।

কর্নেল বললেন–হালদারমশাই আপনি জিজ্ঞেস করছিলেন ডাকাতির কেসের কী হল। কেসটা কর্পূরের মতো উবে গেছে। কী হয়েছে এবার তা শুনুন।

এরপর কর্নেল গঙ্গার ঘাটে যদুপতি চন্দ্রের গাড়িতে ডাকাতি করা অলঙ্কার ফেরত দেওয়ার ঘটনাটি সবিস্তারে তাকে শোনালেন। হালদারমশাই একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন –এটা ক্যামন হইল য্যান। বাপি সেন তো বজ্জাতের বজ্জাত।

কর্নেল বললেন–বোঝা যাচ্ছে ডাকাতি করা জিনিসগুলো বাপি নিজের কাছে রাখতে ভরসা পায়নি। আনু আর পারু দুজনেই বনেদি পরিবারের ভদ্রলোকের ছেলে। পুলিশের খাতায় তাদের নাম নেই। কাজেই এটা চোখ বুজেই বলা যায় এই দুজনের কারও কাছেই বাপি ওগুলো রাখতে দিয়েছিল।

গোয়েন্দাপ্রবর খিঃ খিঃ হেসে বললেন–খুব ভালো খবর। কিন্তু বাপি যখন জানতে পারবে কী ঘটছে, তখন কুরুক্ষেত্র শুরু হইয়া যাইবে। প্রত্যেকের কাছে চোরা ফায়ার আর্ম আছে। কাজেই যুদ্ধ বাধলে তিনখান বডিই পড়বে। এরপর কর্নেল চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চুপচাপ চুরুট টানতে লাগলেন।

হালদারমশাই বললেন–আমার এখন একবার ম্যাডামের কাছে যাওয়া দরকার। উনি খুব ভাইঙ্গা পড়ছেন মনে হইতাছিল। কর্নেলস্যর! আপনি কী কন?

কর্নেল একই অবস্থায় থেকে চোখ না খুলে বললেন–হ্যাঁ। আপনার একবার যাওয়া দরকার। আপনার ক্লায়েন্ট, কাজেই ম্যাডামকে আপনার সান্ত্বনা দেওয়া দরকার।

হালদারমশাই উঠে দাঁড়ালেন। তারপর কোনও কথা না বলে সবেগে বেরিয়ে গেলেন।

ততক্ষণে ষষ্ঠী ড্রয়িংরুমে আলো জ্বেলে দিয়েছে। কর্নেল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিয়ে বললেন–চলো জয়ন্ত, আমরা বাগবাজার ঘুরে আসি। শিগগির পোশাক বদলে নাও। তোমার প্যান্টের পকেটে লোডেড ফায়ার আর্মস এমনভাবে রাখবে যাতে দ্রুত ওটা দরকার হলে ব্যবহার করতে পারো। না–আমি বলছি না তুমি কাউকে গুলি করে মারবে, কিন্তু পথেঘাটে বিপদ-আপদ ঘটলে শূন্যে এক রাউন্ড ফায়ার অনেক কাজ দেয়।

কিছুক্ষণ পরে দুজনে সেজেগুজে বেরিয়ে পড়লুম। দেখলুম কর্নেল তার পিঠে যথারীতি কালো রঙের সেই কিটব্যাগটা আটকে নিয়েছেন।

কর্নেলের নির্দেশে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছিলুম। শ্যামবাজারের মোড় দিয়ে ঘুরে বাগবাজারে যখন ঢুকলুম তখনও কর্নেল সিটে হেলান দিয়ে একেবারে নিশ্চুপ। মনে হচ্ছিল কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিছুটা এগিয়ে তিনি ডানদিকে একটা গলির ভেতর গাড়ি ঢোকাতে বললেন। বাঁক নিতে নিতে গলিটা বাঁদিকে ঘুরে মোটামুটি চওড়া একটা রাস্তায় পৌঁছেছে। সেখানেই কর্নেল আমাকে গাড়িটা একপাশে পার্ক করে রাখতে বললেন। বাঁদিকে একটা পুরোনো আমলে তৈরি বাড়ি। কিন্তু বাড়ির গেটের ভেতর থেকে তালা আঁটা। কোনও দারোয়ান নেই। গেটের ডানদিকে একটা ঘরে দরজা। কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে ওই দরজার কাছে উঠে কর্নেল কলিংবেলের সুইচ টিপলেন। দুবার সুইচ টেপার পর পরনে হাফপ্যান্ট এবং গায়ে লাল গেঞ্জি, হোঁতকা মোটা একটা ফো লোক কর্নেলকে দেখেই স্যালুট ঠুকে বলল–কর্তামশাই আজ সকাল থেকে আপনার কথা বলছেন। আসুন আসুন, ভিতরে আসুন।

ভিতরে ঢুকে কর্নেল বললেন–তোমার কর্তামশাই একটা ফোন করলেই তো পারতেন। লোকটা বলল–ফোনের লাইন সকাল থেকে খারাপ। খবর দিয়েছি। কিন্তু কারও পাত্তা নেই। একটু বসুন স্যার। আমি কর্তামশাইকে খবর দিয়ে আসছি।

ঘরের ভিতর ঢুকে লক্ষ্য করেছিলুম উত্তর কলকাতার বনেদি কালচারের ছাপ এখানে প্রকট। মেঝের অনেকটা জায়গা জুড়ে তক্তপোশের ওপর গদি এবং পুরোটাই সাদা কাপড়ে ঢাকা। তার ওপর ইতস্তত ছড়ানো অনেকগুলো কোলবালিশ। এখনও এ বাড়িতে বাবুমশাইরা এভাবে পা দুমড়ে বসেই আড্ডা দেন। ইচ্ছে করলে কেউ শুয়েও আড্ডা দিতে পারেন। একপাশে সার দিয়ে কয়েকটা গদি-আঁটা চেয়ার আছে। আমরা বসলুম।

কর্নেল বললেন–বুঝতে পারছ তো জয়ন্ত, এঘরে এখনও ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের বাবু কালচার চালু আছে।

সেই হোঁতকা মোটা লোকটি এসে বিনীতভাবে বলল–কর্তামশাই আপনাদের আসতে বললেন আঁজ্ঞে। ওঁর শরীরে তেমন কিছু অসুখ নেই কিন্তু কিছুদিন থেকে কেমন যেন হয়ে গিয়েছেন। মনে সুখ নেই। আসলে আনু দাদাবাবু হঠাৎ নিখোঁজ হবার পর এই অবস্থা কর্নেল বললেন–আনু আজও বাড়ি ফেরেনি?

–আজ্ঞে না, স্যার।

এবার আমরা চওড়া বারান্দার পাশে দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে পা রাখলাম। মার্বেলের পাথরে বাঁধনো সিঁড়ির অবস্থা একটু জীর্ণ মনে হল। ওপরের বারান্দায় উঠে লোকটা একটা ঘরের দরজার পর্দা সরিয়ে দিয়ে বলল–কর্তামশাই, কর্নেলস্যরকে নিয়ে এলুম।

ঘরের ভিতরে উজ্জ্বল আলো। একপাশে উঁচু প্রকাণ্ড পালঙ্ক। ঠিক যেমনটি পারুদের বাড়িতে দেখেছিলাম। একটা গোলাকার প্রকাণ্ড টেবিলের চারপাশ ঘিরে গদিআঁটা চেয়ার সাজানো আছে। একটা চেয়ারে বসেছিলেন একজন রোগাটে গড়নের ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বৃদ্ধ ভদ্রলোক। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বললেন–কী সৌভাগ্য, আজ সারাদিন শুধু আপনার কথা ভেবেছি। বিকেলে ভাবছিলুম ফটিককে গাড়ি বের করতে বলি।

কর্নেল তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন–জয়ন্ত! ইনি বাগবাজারের বিখ্যাত সোম পরিবারের মি. অরিন্দম সোম।

অরিন্দমবাবু আমার দিকে তাকিয়ে নমস্কার করে বললেন–আমি কিন্তু আপনার রিপোর্টাজের খুব ভক্ত জয়ন্তবাবু। কর্নেলসাহেবকে আমি এতকাল কতটুকুই বা চিনেছি, আপনি ওঁকে অনেক বেশি চিনিয়ে দিয়েছেন।

ইতিমধ্যে আমরা অরিন্দমবাবুকে অনুসরণ করে অন্যপাশে একটা সেকেলে রীতিতে তৈরি সোফায় বসলুম। তারপর কর্নেল বললেন–জয়ন্ত, তো গল্প লেখে। কাজেই আমাকে নিয়ে ইচ্ছেমতো বাকচাতুরী করে।

অরিন্দমবাবু ডাকলেন–ওরে হরেন!

সেই লোকটি পর্দা তুলে ভিতরে এল। কর্নেল দ্রুত বললেন–অরবিন্দমবাবু! আমরা কফি বা চা কিছু খাব না কারণ বিকেল থেকে অনেকবার খেয়েছি। কথাটা বলে তিনি হরেনের দিকে অদ্ভুত একটা ভঙ্গি করে হাতের ইশারায় তাকে সম্ভবত কিছু বললেন।

অমনি হরেন মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল। অরিন্দমবাবু হাসতে হাসতে বললেন– আজকাল চোখে ভালো দেখতে পাই না। চোখের অপারেশন ভালো হয়নি। তাই হরেন আমাকে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা পড়ে শোনায়। আজ রোববারের কাগজে শুনছিলুম যদুপতি চন্দ্রের পার্ক স্ট্রিটের জুয়েলারি দোকানে ডাকাতি হয়েছে। ওর জ্যাঠা না কাকা হরনাথ চন্দ্রের সঙ্গে আপনার চেনা ছিল তাই না?

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। আপনার মনে আছে দেখছি।

থাকবে না কেন? হরনাথের আমলেই তো আমাদের পরিবারের বিয়ে বা নানা উপলক্ষে ওদের দোকান থেকে অলঙ্কার কেনা হত। কর্নেল এবার ওঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললেন–আপনাদের গৃহদেবতার অলঙ্কার কি চন্দ্র জুয়েলার্স থেকে কেনা?

অরিন্দমবাবু কর্নেলের হাত চেপে ধরে বললেন–কর্নেলসাহেব। আপনি তো জানেন আমারই ঔরসজাত এক কুলাঙ্গার গৃহদেবতাকে একেবারে উলঙ্গ করে অভিশাপ কুড়িয়েছে।

কর্নেল আবার তেমনই চাপাস্বরে বললেন–আপনার কুলাঙ্গার পুত্র মানে আনুর কথা বলছেন তো? আপনাদের গৃহদেবতা তাকে এমন ভয় দেখিয়েছেন সে আজ দিনদুপুরে সেই কোটি টাকা দামের অলঙ্কার বাক্স সমেত আমার হাতে গুঁজে দিয়ে পালিয়ে গেছে। এই নিন। এগুলো এবার আরও নিরাপদ জায়গায় রেখে দিন।

বলে তিনি পিঠে আঁটা কিটব্যাগের চেন খুলে ভেলভেটে মোড়া অলঙ্কারের লাল ছোটো বাক্সটি তার হাতে গুঁজে দিলেন।

বাক্সটা পেয়ে খুলে দেখার পর অরিন্দমবাবু ছেলেমানুষের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কর্নেল বললেন–প্লিজ অরিন্দমবাবু! কেউ যেন টের না পায়। আমরা উঠছি। আপনি ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে ওটা আপাতত কোথাও লুকিয়ে রেখে দিন। আপাতত কিছুদিন আপনার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ যেন একথা জানতে না পারে। আর একটা কথা, এরপর অনিরুদ্ধ বাড়ি ফিরে এলে তাকে যেন ক্ষমা করে দেবেন।

–একটা কথা জানতে পারলে ভালো হত। আনু কেন এটা চুরি করেছিল বলেনি?

–এগুলো বিক্রি করে এক বজ্জাত তাকে সিনেমায় নামাতে চেয়েছিল। এই বলে কর্নেল হতবাক অরিন্দমবাবুকে বসিয়ে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমিও তাকে অনুসরণ করলুম।

.

০৯.

ফেরার পথে কর্নেল আমাকে কথা বলার কোনও সুযোগ দেননি। অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে কফি খেতে খেতে বললুম–তাহলে চন্দ্র জুয়েলার্সের মতো বাগবাজারের অরিন্দমবাবুও হারানো জিনিস নির্বিবাদে ফিরে পেলেন। কিন্তু আমি ভাবছি, পারু আর আনু মিলে আজ সকালের দিকে গঙ্গার ঘাটে যে কীর্তি করেছে তা নিশ্চয়ই ওদের গুরু বাপি সেন জানে না। কর্নেল বললেন–অন্ধকারের নায়ক যে কিনা একজন সুন্দরী মেয়ের টোপ ফেলে সিনেমার নাম করে এতসব গয়না হাতাতে চেয়েছিল সে বাপি সেনকেও তার মতলবের কথা কখনই. জানাবে না এবং জানায়নি।

এবার একটু অধৈর্য হয়ে বললুম–আপনার এই অন্ধকারের নায়কটি কে?

কর্নেল কফি শেষ করার পর চুরুট ধরিয়ে বললেন–জয়ন্ত! এই লোকটি এখনও আমার থিয়োরির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তার পিছন দিকটা অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি।

বললুম–হোটেল এশিয়ায় ঘনশ্যামের সঙ্গে যে প্রবীণ লোকটি করতে গিয়েছিল সেই লোকটি নয়তো?

কর্নেল একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে বললেন–তুমি শচীন্দ্রনাথ নামের লোকটিকে অন্ধকারের নায়ক বানাতে চাও? তা হতেও পারে আবার নাও পারে। এক মিনিট, আমি আর একবার হোটেল এশিয়ায় ম্যানেজার মিঃ রঙ্গনাথনকে ফোন করে দেখি, তিনি কী বলেন।

বলে তিনি রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন সাড়া পেয়ে নিজের নাম বলার পর হোটেলের ম্যানেজারকে চাইলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাকে পেয়ে গেলেন–হ্যালো মিঃ রঙ্গনাথন, আবার একটু বিরক্ত করছি। আপনাদের সুইট নম্বর ২৩৩ হোল্ডার আছেন না চেক-আউট করেছেন? …আছেন? এবার জানতে চাই সেই শচীন্দ্রনাথ, নামের ভদ্রলোক কি আবার তার কাছে গিয়েছিলেন? ..দুজন এখন লাউঞ্জে বসে আছেন? বাঃ শুনুন মি. রঙ্গনাথন, আমি আর জয়ন্ত এখনই একবার আপনার হোটেলে গিয়ে দুজনকে দর্শন করতে চাই। …না, না, ওঁদের জানতেই দেব না যে আমি ওঁদের দর্শন করতে যাচ্ছি। লাউঞ্জে ঢুকলে আপনি আমাদের কাছে এসে শুধু ওঁদের দেখিয়ে দেবেন, ব্যস।..হ্যাঁ। কোনও দুর্ঘটনা ঘটবে না।

কর্নেল রিসিভার রেখে দিলেন। তারপর বললেন–ফেরার পথেই ভেবেছিলুম হোটেল এশিয়া হয়ে আসব কিন্তু ইতিমধ্যে কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করছে কি না দেখার জন্য বাড়ি ফিরতে হল।

আমরা সবে উঠে দাঁড়িয়েছি, এমন সময় ষষ্ঠীচরণ এঁটো কাপপ্লেট নিতে এসে জিভ কেটে দাঁড়িয়ে গেল।

কর্নেল বললেন–কি রে তুই হঠাৎ মা কালি সেজে দাঁড়িয়ে গেলি?

ষষ্ঠী কাঁচুমাচু মুখে বলল–বাবামশাই বড্ড ভুল হয়ে গেছে। লালবাজারের সেই টিকটিকিবাবু আপনাকে ফোন করেছিলেন। উনি আপনাকে ফিরে আসামাত্র ফোন করতে বলেছেন।

কর্নেল বিরক্তমুখে টেলিফোন তুলে ডায়াল করলেন। সাড়া পেয়ে বললেন–কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। নরেশবাবুকে দিন।…হ্যালো নরেশবাবু। কিছুক্ষণের জন্য বেরিয়েছিলুম। আবার বেরতে যাচ্ছি ষষ্ঠী বলল আপনি আমাকে ফোন করতে বলেছেন। নিশ্চয়ই কোনও অঘটন ঘটেছে? …ঘটেছে? বলুন শুনি …আউট্রাম ঘাটের কাছে? কখন, কে প্রথম ডেডবডিটা দেখতে পেয়েছিল? ট্রাফিক গার্ডের অফিসের কাছে? ..বডি শনাক্ত হয়েছে? নিশ্চয় বাপি সেনের বডি? …তাহলে আনু বা পারুকে দায়ী করা হচ্ছে না। বিশেষ করে প্রত্যক্ষদর্শী লোকেরা যখন বলেছে…আচ্ছা! আমার তাড়া আছে। বেরুচ্ছি। সাক্ষাৎ পাবেন কাল মর্নিং-এ …না, আমি ঘটনাস্থলে যাব না। গিয়ে কোনো লাভ নেই। আপনারা অভিজ্ঞ ডিটেকটিভ অফিসার… আচ্ছা রাখছি। আমি হতবাক হয়ে শুনছিলুম। বাপি সেনকে কে মারল? কর্নেলের মুখে শুনলুম অনিরুদ্ধ বা পারিজাতকে এই খুনের জন্য দায়ী করা যায় না। বোঝা যাচ্ছে প্রত্যক্ষদর্শীরা আততায়ীর যে বর্ণনা করেছে তা থেকেই নরেশবাবুদের এই সিদ্ধান্ত।

ততক্ষণে কর্নেল পা বাড়িয়ে হাঁক দিয়েছেন-ষষ্ঠী! আবার বেরুচ্ছি। শিগগির ফিরব।

নিচে গিয়ে গাড়ি কর্নেলের গ্যারাজ থেকে বের করতে হল। অবশ্য তখনও দারোয়ান গেটে তালা দেয়নি।

গাড়িতে যেতে যেতে বলুম-প্লিজ কর্নেল! ঘটনাটা শুনতে অস্থির হয়ে উঠেছি। আপনি না বললে হয়তো অ্যাকসিডেন্ট করে ফেলব। কর্নেল আমার বাঁ বাহু খপ করে চেপে ধরে বললেন–জয়ন্ত! আজকের রাতটা আমাদের বেঁচে থাকা খুব দরকার।

-তাহলে বলুন, আউট্রাম ঘাটে কী ঘটেছে। কর্নেল যা বললেন, তা সংক্ষেপে এই : আজ সন্ধ্যায় কোনো এক সময়ে বাপি সেন আউট্রাম ঘাটের কাছে রেললাইন পেরিয়ে একটা চেয়ারে বসেছিল। সম্ভবত কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে আসার কথা ছিল। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন হঠাৎ একটা লোক রেললাইন পেরিয়ে এসে বাপির মাথায় একরাউন্ড গুলি করে। লোকেরা ভয়ে ওখান থেকে সরে যায়। আততায়ী বাপির পিঠে পা রেখে ঝুঁকে পড়ে তার মাথায় আর একবার গুলি করে। তারপর সে রেললাইন ডিঙিয়ে যায়। সেই সময় প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখতে পান রাস্তার ধারে একটা মোটর সাইকেল দাঁড় করানো আছে। আততায়ী সেই মোটর সাইকেলে চেপে পালিয়ে যায়। লোকটার পরনে ছিল নীল রঙের স্পোর্টিং গেঞ্জি আর প্যান্ট। ওখানে যেটুকু আলো ছিল তাতে বোঝা গিয়েছে লোকটার মুখে গোঁফ ছিল। কেউ বলেছেন লোকটার বয়স পঞ্চাশ হতে পারে, আবার কেউ বলেছেন তারও বেশি। হোটেল এশিয়ার গেটে গাড়ি ঢুকিয়ে পার্কিং জোনে লক করে রাখলুম। তারপর কর্নেলকে অনুসরণ করলুম। হোটেলের বিশাল দরজা দু’জন উর্দিপরা লোক দুদিক থেকে টেনে খুলে দিল। ভেতরে প্রশস্ত লাউঞ্জ। মেঝে পুরোটাই কার্পেটে ঢাকা। কর্নেলকে দেখে মিস্টার রঙ্গনাথন এগিয়ে এলেন। তারপর চাপাস্বরে বললেন–কর্নেল সরকার! আপনার আসা ব্যর্থ হল কারণ মিনিট দশেক আগে শচীন্দ্রনাথ বেরিয়ে গেছেন।

কর্নেল জিগ্যেস করলেন–আপনাদের বোর্ডার মিঃ এন, দাশগুপ্ত?

মিঃ রঙ্গনাথন বললেন–উনি আছেন।

কর্নেল আবার জিগ্যেস করলেন–শচীন্দ্রনাথ ঠিক কখন এসেছিলেন, আপনি বলতে পারেন? মিঃ রঙ্গনাথন একটু হেসে বললেন–আপনার কথা শোনার পর থেকেই ২৩৩ সুইটের ভদ্রলোকের দিকে আমার লক্ষ্য ছিল। শচীন্দ্রনাথ ভিজিটিং বুকে সই করেছেন আটটা পাঁচে। তারপর ওপর থেকে দু’জনে নেমে এসেছেন মিনিট পনেরো পরে। আর লাউঞ্জে বসে কথা বলেছেন প্রায় আধঘণ্টা। আপনি তো জানেন বোর্ডারদের সঙ্গে ভিজিটারদের মিট করার লাস্ট টাইম রাত নটা।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন–নটা বাজতে আর দুমিনিট। কাজেই আমি নিয়মভঙ্গ করে আপনার বোর্ডারের সঙ্গে দেখা করছি না। কিন্তু প্লিজ মিস্টার রঙ্গনাথন আপনাদের বোর্ডার মিঃ এন. দাশগুপ্ত যেন কিছুতেই না জানতে পারেন আমরা এখানে এসেছিলুম।

-ওঃ সিওর! তবে এসেছেন যখন আমার ঘরে বসে অন্তত কফি খেয়ে যান।

কর্নেল তার সঙ্গে করমর্দন করে বললেন–ধন্যবাদ। আমরা এখনই কফি খেয়েই বেরিয়েছিলুম। চলি।

অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কর্নেল বললেন–আর কফি টফি নয়। আজ খুব ক্লান্ত বোধ করছি। বরং দেখি পারুর ঘরে যে মেয়েটির কাটআউট থেকে একটা ছবি ক্যামেরাবন্দি করেছিলুম সেটা প্রায় ঘন্টা আষ্টেক ধরে শুকোচ্ছে। ছবিটা ভালই উঠেছে। বলে কর্নেল মিটিমিটি হাসলেন, সত্যিকার ফিল্মটা শেষ না হলেও এই হিরোইনকে কেন্দ্র করে অন্য একরকম ফিল্ম এখনও শেষ হয়নি। আমরা অন্ধকার হলঘরে বসে আছি।

বললুম প্লিজ কর্নেল! কথা না বাড়িয়ে ছবিটা আনুন।

কর্নেল ভিতরের ঘরে ঢুকে গেলেন। তারপর প্রায় মিনিট দশেক পরে একটা ছবি হাতে নিয়ে ফিরে এলেন। বললেন–এই রিলটাতে অনেকগুলো প্রজাপতি আর অর্কিডের ছবি ছিল। সেগুলো গতমাসে বিহারের ভীমগড় থেকে তুলে এনেছিলুম। এই নায়িকার ছবির পর আরও অন্তত দুতিনটে ছবি তোলা যেত। কিন্তু উপায় ছিল না।

তিনি ছবিটা আমার হাতে দিয়ে ইজিচেয়ারে বসলেন। ছবির দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠেছিলুম। এই সুন্দরীকে তো আমি চর্মচক্ষে না দেখলেও এই মহানগরীর অনেক পোস্টারে দেখেছি। সুতরাং এই নায়িকার খ্যাতির তো সীমা নেই। সে কেনই বা পারিজাতের মতো ছেলের সঙ্গ ধরেছিল?

কর্নেল দাঁড়িয়ে হাত বুলিয়ে বললেন–ছবিটা তোমার নিশ্চয়ই চেনা মনে হচ্ছে?

বললুম–হ্যাঁ। খুবই চেনা। এর নামটাও আমার জানা মনে হচ্ছে। এক মিনিট মনে পড়ে গেছে। এই নায়িকার নাম চান্দ্রেয়ী।

–কিন্তু চান্দ্রেয়ী নিজেকে অনিন্দিতা বলে পরিচয় দিয়েছিল পারুর কাছে। জয়ন্ত–এই চান্দ্রেয়ীর পিছনের লোকটিই হল অন্ধকারের নায়ক। তুমি চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে এইরকম একজন হিরোইনকে কোটি কোটি টাকা দামের রত্ন আত্মসাতের জন্য সে ব্যবহার করেছিল। কাজেই সে নিতান্ত সাধারণ লোক নয়। সে যেমন ধুরন্ধর তেমনই শক্তিমান।

বললুম–টলিউডের ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারে এমন একজন শক্তিমান লোক তো রাজনীতিওয়ালা কাজলবাবু। বাপি সেনের গার্জেন।

কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললেন–না। কাজলবাবু সম্পর্কে যতটা জানি, তিনি ট্রেড ইউনিয়নের নেতা। তার রোজগারের অন্য অনেক সোর্স আছে। আমার থিয়োরি বলছে, এই শক্তিমান লোকটি ফিল্ম লাইনেই ঘোরাফেরা করে। এমনও হতে পারে সে কোনও কারণে চুরি ডাকাতি করা অর্থ আত্মসাত করে ছেলেগুলোকে বোকা বানিয়ে কেটে পড়ত। যাকগে, যত ভাববে তত রহস্য জট পাকিয়ে যাবে। আজ রাত্রিটা কেটে গেলে আগামিকাল আশা করছি একটু কিছু করে ফেলতে পারব।

কিছুক্ষণ ধ্যানস্থ থাকার পর কর্নেল বললেন–আজ সাড়ে ন’টার মধ্যেই ডিনার খেয়ে শুয়ে পড়া যাক। ষষ্ঠী! আমরা এবার খেতে যাচ্ছি। যষ্ঠী পর্দার ফাঁকে মুখ বের করে বলল–সব রেডি আছে বাবামশাই।

আমরা উঠতে যাচ্ছি টেলিফোন বাজল। কর্নেল বিরক্ত মুখে বললেন–জয়ন্ত! টেলিফোনটা ধরো তো। অচেনা কেউ হলে বলবে, কর্নেল নেই, কাল সকাল আটটায় তিনি এসে দেখা করতে পারেন।

রিসিভার তুলতেই সাড়া এল-কর্নেল সাহেব! আমি সুরঞ্জনা রায়চৌধুরী বলছি। মাউথপিসে হাত চেপে রেখে বললুম–সুরঞ্জনা দেবী। কর্নেল রিসিভার আমার হাত থেকে প্রায় কেড়ে নিলেন। তারপর কিছুক্ষণ ধরে শুধু হু আর হ্যাঁ বলতে থাকলেন।

কর্নেল টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রেখে একটু হেসে বললেন–পারু তার মাকে টেলিফোনে বিকেল তিনটেতে জানিয়েছে, তার মোটর সাইকেলটা চুরি গেছে।

জিজ্ঞেস করলুম–কোথা থেকে কী ভাবে চুরি গেছে?

-পারু আর আনুর আশ্রয় ছিল পারুর বান্ধবী সেই অনিন্দিতা অর্থাৎ চান্দ্রেয়ী। তার বাড়ি নিউ আলিপুরের পশ এরিয়াতে। সেখানেই থাকেন চান্দ্রেয়ীর প্রোমোটার এবং গার্জেন তার দূর সম্পর্কের এক জ্যাঠামশাই জয়দীপ ঘোষ। পারু তার মাকে খুলে বলেছে। সেই ঘোষজ্যেঠুই পারু ও আনুকে ফিল্মে নামার সুযোগ করে দিতে চেয়েছিলেন। তবে দেড়কোটি টাকা না হলে ফিল্ম করা যাবে না নিজেদের টাকায় ফিল্ম করলে ইচ্ছেমতো রোলে অভিনয় করা যাবে। কিন্তু পারুরা। অত টাকা পাবে কোথায়? অবশেষে ঘোষজেঠু রাজনীতিওয়ালা কাজলবাবুর সাহায্যে বাপি সেনকে ডেকে দুজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন।

-রহস্যের পর্দা একটু সরে গেল তাহলে। কর্নেল হাসলেন–পর্দা সরলেও এখনও ভেতরে অন্ধকার। শুধু নায়ক বা খলনায়কের পিঠটা দেখা যাচ্ছে। যাইহোক জয়দীপ ঘোষকে জয়শ্রী সিনে স্টুডিয়োর গোপালবাবুর চেনার কথা। কাল সকালে ওঁকে স্টুডিয়োতে যাওয়ার পথে আমার সঙ্গে দেখা করে যেতে বলব। জিজ্ঞেস করলুম-পারু বলেনি তার বন্ধু আনু এবং সে কেন চন্দ্র জুয়েলার্সের ডাকাতি করা অলঙ্কার ফেরত দিয়েছে?

কর্নেল চোখ কটমট করে বললেন–এনাফ জয়ন্ত! এবার ডিনারে বসব। তারপর আজ রাত্রে আর কোনও কথা নয়।

হাসতে হাসতে বললুম–ওকে বস! ডিনারের পরই শুয়ে পড়ব।…

.

১০.

পরদিন সকালে গোয়েন্দাপ্রবর হালদারমশাই কর্নেলের ড্রয়িংরুমে সবেগে প্রবেশ করলেন। তখন সবে কর্নেল ছাদের বাগান পরিচর্যা করে নিচে এসেছেন এবং ষষ্ঠীর কফির জন্য অপেক্ষা করছেন।

হালদারমশাই বললেন–এখনই কমু না কি কফি খাইয়া কমু? কর্নেল স্যর কী কন?

কর্নেল বললেন–আপনাকে খুব সতেজ দেখাচ্ছে। নিশ্চয়ই কোনও খুশির খবর এনেছেন? তবে এখন আমার মুখে কফির ছোঁয়া না লাগলে শোনার মুড আসবে না। তখনই ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি আর স্ন্যাকস রেখে গেল। হালদার মশাইয়ের কপালের ব্যান্ডেজটা আছে তবে হাতের আঙুলের ব্যান্ডেজটা খুলে ফেলেছেন। তিনি অভ্যাসমত ফুঁ দিয়ে দিয়ে বেশি দুধ মেশানো তার স্পেশাল কফি-পানে মন দিলেন।

আমি কৌতূহল চাপতে না পেরে বললুম–হালদারমশাই! কফি কর্নেলের মুখ অনেকবার ছুঁয়েছে, কাজেই এবার আপনি শুরু করুন। হালদারমশাই মুচকি হেসে বললেন–কাইল রাত্রে আমার ক্লায়েন্ট মিসেস রায়চৌধুরী ফোন করছিলেন। ওঁর সঙ্গে য্যান সকাল সাতটার মধ্যে দেখা করি।

কর্নেল বললেন–তাহলে সেখান থেকেই কোনো সুসংবাদ এনেছেন।

–হঃ। বলে হালদারমশাই আরও কয়েকবার কফিতে চুমুক দিলেন। তারপর বললেন–কাইল রাত্রে ওঁর পোলা বাড়ি ফিরছে। কাইল বিকালে একবার সে বাড়ি গিছল।

কর্নেল বললেন–জানি। কালরাত্রে ম্যাডাম আমাকে ফোন করেছিলেন। পারু যেখানে থাকত সেখান থেকে নাকি ওর মোটর সাইকেল চুরি গেছে।

হালদারমশাই তাঁর কথার ওপরে বলে উঠলেন–চুরি গিছল, কিন্তু রাত্রে মোটর সাইকেল পাইয়া গেছে।

আমি জিজ্যেস করলুম–কোথায় পেল?

গোয়েন্দা প্রবর খি খি করে হেসে বললেন–আসলে পারু লুকিয়ে থাকত অনিন্দিতার বাড়িতে। রাত্রে সে নিচে নাইম্যা দ্যাখে তার মোটর সাইকেল ঠিক জায়গায়ই আছে। তার বান্ধবী তারে কইছে গাড়িটা চুরি যায় নাই। তার জ্যাঠামশাই–কী য্যান নামটা কইছিল,

– জয়দীপ ঘোষ।

 হালদারমশাই চমকে উঠে বললেন–আপনি তারে চেনেন?

-হ্যাঁ। নামটা শুনেছি। কারণ অনিন্দিতা আসলে কে আপনি এই ছবিটা দেখে চিনতে পারেন কি না বলুন।

বলে কর্নেল টেবিলের ড্রয়ার থেকে ফিল্ম অভিনেত্রী চান্দ্রেয়ীর ছবিটা বের করে হালদারমশাইকে দিলেন।

হালদারমশাই ছবিটা দেখতে দেখতে বললেন–এরে য্যান কোথায় দেখছি। খুব চেনা চেহারা।

আমি বললুম–সারা কলকাতায় সিনেমার পোস্টারে এই ছবি নিশ্চয়ই আপনার চোখে পড়েছে। এর আসল নাম কিন্তু চান্দ্রেয়ী।

গোন্দোপ্রবর কিছুক্ষণ যেন কথা বলতে পারলেন না। তার গোঁফের দুই ডগা তির তির করে কাঁপছিল। তাঁর চোখদুটো গুলি গুলি হয়ে উঠেছিল। এটা তার উত্তেজনার লক্ষণ। এই সময় আবার ডোরবেল বাজল। কর্নেলও যথারীতি হাঁক দিলেন–ষষ্ঠী!

এবার ড্রইংরুমে প্রবেশ করলেন জয়শ্রী সিনে স্টুডিওর ম্যানেজার গোপাল কুণ্ডু। তিনি থমকে দাঁড়িয়ে বললেন–ওরে বাবা! এ যে দেখছি একেবারে নক্ষত্র সমাবেশ।

কর্নেল বললেন–আসুন গোপালবাবু! বসুন। গোপালবাবু সোফার একপাশে বসার পর তার চোখে পড়ল হালদার মশায়ের হাতে ধরা ছবিটায়। তিনি সবিস্ময়ে বলে উঠলেন –কী ব্যাপার! মিঃ হালদারের হাতে একালের উঠতি হিরোইন চান্দ্রেয়ীর ছবি?

বলে তিনি হালদারমশায়ের হাত থেকে ছবিটা নিলেন। একটুখানি পরীক্ষা করে দেখার পর তিনি আবার বললেন–এটা তো সেই কাট-আউট। সেই কাট-আউটটা থেকে ছবিটা ক্যামেরায় তোলা হয়েছে। কর্নেল সাহেব! ব্যাপারটা খুলে বলুন তো।

কর্নেল বললেন–আমি আপনাকে ডেকেছিলুম এই ছবির ব্যাপারেই। তবে এটা কার ছবি তা আমি ইতিমধ্যেই জানতে পেরেছি। এবার একটা কথার সত্যমিথ্যা আপনার কাছে যাচাই করে নিতে চাই। জয়দীপ ঘোষকে আপনি চেনেন?

গোপালবাবু বললেন–চিনি না মানে। জয়দীপবাবুই তো চান্দ্রেয়ীর গডফাদার। নিউ আলিপুরে চান্দ্রেয়ীর অ্যাপার্টমেন্টের পাশেই তার অ্যাপার্টমেন্ট।

কর্নেল বললেন–জয়দীপবাবুর বয়স কত, জানেন?

–তা সিক্সটি পেরিয়ে গেছে। গোঁফ, মাথার চুল একেবারে সাদা। এখনও খুব শক্তসমর্থ মানুষ। কিন্তু তাকে আপনি চিনলেন কী করে?

–অন্যের মুখে তার কথা শুনেছি। এবার একটা কথা বলুন তো গোপালবাবু। জয়দীপবাবুর লাস্ট ফিল্ম কি প্রচণ্ড ফ্লপ হয়েছিল?

গোপালবাবু হাসতে হাসতে বললেন–ফ্লপ মানে? দেনার দায়ে একেবারে ভদ্রলোকের মাথার চুল বিকিয়ে গেছে। তাই আমাকে মাঝে মাঝে বলতেন আবার ছবি করতে চান, আমি যেন একজন প্রোডিউসার দেখে দিই। কারণ কর্নেল সাহেব তো জানেন হঠাৎ হাতে বাড়তি টাকা এসে গেলে এমন অনেক লোক আছে যারা ফিল্ম লাইনে এসে জোটে। উদ্দেশ্য ফিল্মের জগতের মেয়েদের সঙ্গে একটু মেশামেশির সুযোগ লাভ। এরকম অনেকে আমার কাছে আসে একথা সত্যি। কিন্তু তাই বলে জেনেশুনে জয়দীপবাবুর পাল্লায় তাদের কাউকে ছেড়ে দেওয়া অধর্ম। জ্ঞান করি।

কর্নেল বললেন–এবার বলুন টলিউড থেকে টাকা মেরে ফেরার হওয়া সেই ঘনশ্যামের সঙ্গে জয়দীপ ঘোষের কেমন সম্পর্ক ছিল? যষ্ঠীচরণ গোপালবাবুর জন্য কফি দিয়ে গেল। গোপালবাবু কফির কাপ হাতে নিয়ে চাপাস্বরে বললেন–একজন কায়া অন্যজন তার ছায়া। জয়দীপ ঘোষই ঘনশ্যামকে খারাপ পথে ঠেলে দিয়েছিলেন। তিনি গুরু আর ঘনশ্যাম তার চেলা। কী বললুম তা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন কর্নেল সাহেব!

কর্নেল একটু হেসে বললেন–হ্যাঁ। ব্যাপারটা এবার স্পষ্ট হয়ে গেল।

গোপালবাবু কফি খেতে খেতে আবার চাপাস্বরে বললেন–চান্দ্রেয়ীর বাবা-মা বেঁচে নেই। শুধু তার মাসি বন্দনা রায়। এই ভদ্রমহিলা কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন। খুব দজ্জাল প্রকৃতির মেয়ে। এখন মজার ব্যাপার হল জয়দীপবাবুর উৎসাহে বোনঝিকে তিনি ফিল্মে অভিনয় করতে দিয়েছিলেন বটে কিন্তু এখনও জয়দীপবাবু ওঁকে সমঝে চলেন। নিজের দাপট তো আছেই তার ওপর তার প্রয়াত স্বামীর ছোটভাই হোমরাচোমরা পুলিশ অফিসার। কফি শেষ করে ঘড়ি দেখে গোপালবাবু বললেন–আমার তাড়া আছে কর্নেল সাহেব! আর কিছু জানতে চান?

কর্নেল বললেন–গোপালবাবু! আমাকে আপনি চান্দ্রেয়ী অরা জয়দীপবাবুর ঠিকানা লিখে দিন। বলে তিনি টেবিল থেকে সেই ছোট্ট প্যাড আর ডটপেনটা তার হাতে তুলে দিলেন।

গোপালবাবু তার ব্রিফকেস খুলে একটা মোটা নোটবই বের করলেন। তারপর সেটার পাতা উল্টে দেখে নিয়ে ঠিকানা দুটো লিখে দিলেন। উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন–একটা অনুরোধ কর্নেল সাহেব। দেখবেন যেন যা সব বললুম যেন আপনাদের তিনজন ছাড়া আর কেউ না জানতে পারে।

কর্নেল বললেন–আপনার কোনও চিন্তা নেই। কেন আমি আপনার সাহায্য নিলুম তা যথাসময়ে একমাত্র আপনিই জানতে পারবেন। গোপালবাবু ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেলেন। এবার কর্নেল টেলিফোনের রিসিভার তুলে একটা নাম্বার ডায়াল করলেন। তারপর সাড়া এলে বললেন–কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি… ম্যানেজার মিঃ রঙ্গনাথনের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

কর্নেল রিসিভার ধরে রাখলেন। হালদারমশাই জিগ্যেস করলেন–উনি কি দিনরাত্রি চব্বিশ ঘন্টাই হোটেলে থাকেন?

আমি বললুম–আপনিও তো ওঁকে ভাল চেনেন। কত কেসে উনি আমাদের সাহায্য করেছেন। হোটেলেই উনি সপরিবারে থাকেন। কর্নেল বাঁ হাত আমাদের দিকে তুলে চুপ করতে বললেন। এতক্ষণে তিনি ম্যানেজারের সাড়া পেয়েছেন। বোঝা গেল।

কর্নেল বললেন–মর্নিং মিঃ রঙ্গনাথন। আবার একটু বিরক্ত করছি। হোটেল এশিয়ার ২৩৩ সুইটের ভদ্রলোক কি চেক আউট করেছেন? ..করেননি? আর একটা কথা, ওঁর সেই বন্ধু শচীন্দ্রনাথবাবু কি আজ সকালের দিকে ওঁর সঙ্গে মিট করতে এসেছিলেন? … তাহলে এখনও দুজনে সুইটে আছেন? ঠিক আছে। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। দৈবাৎ কিছু ঘটলে আশা করি আপনি ঠান্ডা মাথায় থাকবেন… হ্যাঁ। ঘটতে পারে। তবে খুনোখুনি নয়। এগেন থ্যাঙ্কস!

রিসিভার রেখে কর্নেল বললেন–আজ ভোরবেলা অরিজিৎকে আমি উঠিয়েছি। অরিজিতকে আজকাল মার্কিনদের মত জগিং-এর অভ্যাস পেয়ে গেছে। যাই হোক হোটেল এশিয়ার এতক্ষণ সাদা পোশাকের পুলিশ মোতায়েন হয়ে গেছে। নরেশবাবু ফোনের অপেক্ষা করছি। তার ফোন পেলেই আমরা সদবলে হোটেল এশিয়ার দিকে ছুটে যাব। এতক্ষণে আমার বোধবুদ্ধির বন্ধ দুয়ার যেন খুলে গেল। এবার চমকে উঠে বললুম–কর্নেল! তাহলে ছায়া-কায়া দুটিতেই যুগলবন্দী হয়ে লালবাজারের শ্রীঘরে ঢুকতে চলেছে? কর্নেল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন–নটা বেজে গেছে। যেখানে যা কিছুই ঘটুক। এখন ব্রেকফাস্ট। তারপর অন্য কিছু। হালদার মশাই! আমাদের সঙ্গে আপনিও যোগ দিতে পারেন। গোয়েন্দা প্রবর ব্যস্তভাবে হাত নেড়ে বললেন–ম্যাডামের ঘরে ছয়খান লুচি, একপ্লেট আলুর দম আর দুইখানা সন্দেশ খাইছি।

উঠে যেতে যেতে কর্নেল বললেন–ম্যাডামের ছেলের সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?

হালদার মশাই গম্ভীর মুখে বললেন–পোলাটা আমার লগে আলাপ করতে চায় নাই। ম্যাডাম অরে অনেক সাধছিলেন কিন্তু সে নাকি ভীষণ টায়ার্ড।

ব্রেকফাস্টের পর ড্রইংরুমে ফিরে দেখি হালদারমশাই চান্দ্রেয়ীর সেই ছবিটা হাতে নিয়ে বসে আছেন এবং বিড়বিড় করে আপন মনে কী বলছেন। আমার কানে এল শুধু কিছু কথা–এমন সুন্দর মাইয়াটা, সে কিনা পড়ছে এক দানোর পাল্লায়। ঠিক য্যান আরব্য রজনীর স্টোরি।

কথাটা কর্নেলেরও কানে গিয়েছিল। তিনি ইজিচেয়ারে বসে সহায্যে বললেন–ঠিক বলেছেন হালদারমশাই! আরব্য রজনীর অন্ধকারে এবার আলো পড়তে চলেছে।

কর্নেল সবে চুরুট ধরিয়েছেন, টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল দ্রুত রিসিভার তুলে সাড়া দিয়ে বললেন নরেশবাবু! খবর বলুন। …এরই সুযোগ পেলুম না। এত তাড়া কিসের ছিল? …তাই বলুন। ঠিক আছে। ঘনশ্যাম আর তার গুরু জয়দীপ ঘোষকে স্বচক্ষে দর্শনের ইচ্ছে আর করছে না! শুধু বলুন, তাদের দুজনের কাছে কোনও ফায়ার আর্মন্স পেয়েছেন কিনা।…এবার শুনুন নরেশবাবু, জয়দীপ ঘোষের পকেটে যে আগ্নেয়াস্ত্রটা পেয়েছেন, ওটা দিয়েই সে কাল সন্ধ্যায় বাপি সেনকে খুন করেছে। আমার ধারণা বাপি জয়দীপকে উল্টে ব্ল্যাকমেল করতে গিয়েছিল। বাপি সম্ভবত জানত না কাজলবাবুর সঙ্গে জয়দীপের সম্পর্ক কী ধরনের। আচ্ছা হিস্ট্রি নিয়ে যাবেন।

কর্নেল রিসিভার রেখে চুরুটের একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন–জয়দীপ সম্ভবত আঁচ করেছিল তার পেছনে পুলিশ লেগেছে কারণ ডাকাতি করা গয়নাগুলো তার হাতে এখনও পৌঁছয়নি এবং কেন পৌঁছয়নি এব্যাপারে পারু বা আনু তাকে কিছু বলে থাকবে।

আমি বললুম–সরাসরি জয়দীপকে না বলে ওরা চান্দ্রেয়ীকে হয়তো এমন কিছু বলে থাকবে যাতে চান্দ্রেয়ী তার জ্যেঠুকে সতর্ক করে দিয়েছিল।

কর্নেল সায় দিয়ে বললেন–তাও হতে পারে। তবে বাপির ওপর জয়দীপের রাগের আরও একটা কারণ অনুমান করা যায়। জয়দীপ নিশ্চয়ই খদ্দের ঠিক করে রেখেছিল অথচ মাল তার হাতে বাপি এখনও পৌঁছে দিচ্ছে না।

হালদার মশাই বলে উঠলেন–হঃ। তার ওপর আবার জয়দীপের সে ব্ল্যাকমেল। করতাছে। কাজেই বাপিকে সে আউট্রাম ঘাটের কাছে কোনও অছিলায় অপেক্ষা করতে কইছিল। কর্নেল মুচকি হেসে বললেন–আপনি তো অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার এবং এখন একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আপনিই বলুন তো অছিলাটা কী হতে পারে?

গোয়েন্দাপ্রবর বলল উঠলেন–ব্ল্যাকমেল। বোঝলেন না কর্নেল স্যর! জয়দীপ বাপিরে কইছিল তোমারে টাকা দিমু তবে এখানে নয়, আউট্রাম ঘাটের কাছে বইয়া ওয়েট করবা, আমি সেখানে তোমারে টাকা দিমু।

আমি হাততালি দিয়ে বললুম–চমৎকার হালদার মশাই! আপনার থিয়োরিতে যুক্তি আছে।

এইসময় ডোরবেল বাজল। তারপর ষষ্ঠী দেখে এসে বলল একটা হোঁৎকা মোটা ষণ্ডামার্কা লোক বাবামশাই-এর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। মুখে গোঁফ দেখলে চমকে উঠতে হয়। তার ওপর গায়ে লাল কলারওলা গেঞ্জি। আবার দুবার বেল বাজল। কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন–হতভাগা কিছুদিন তোকে হালদার মশায়ের চেলা করে দেব। তুই গোয়েন্দাগিরিটা আরও ভাল শিখতে পারবি! এখন যা গিয়ে ষণ্ডামার্কা লোকটাকে নিয়ে আয়। আমি হাসতে হাসতে বললুম–লোকটা নিশ্চয়ই বাগবাজারের অরিন্দমবাবুর পরিচালক বা ড্রাইভার সেই হরেন।

তারপরই সত্যিই হরেন ড্রইংরুমে ঢুকে করজোড়ে নমস্কার করে বলল–কর্তা মশাই নিজে আসতে পারলেন না। এলেও তিনতলায় উঠতে পারতেন না ওদিকে টেলিফোনের লাইন খারাপ, তাই আমাকে পাঠালেন।

কর্নেল সোফার পাশে একটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন–বোসো হরেন!

হরেন কাচুমাচু মুখে বলল–আজ্ঞে তা কি আমি পারি? আমি শুধু দুটো কথা বলেই চলে যাব।

কর্নেলের তাগিদেও সে কিছুতেই বসল না। একটু হেসে বললুম–কর্নেল! এটা নিশ্চয়ই উনিশ শতকের বাবু কালচারের জের, যা এখনও উত্তর কলকাতায় চালু আছে।

কর্নেল বললেন–বলো হরেন! তোমার কর্তামশাই কী খবর পাঠিয়েছেন।

হরেন হালদার মশাইয়ের দিকে সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল–এখানে বলব? কর্তামশাই বলেছেন আপনাকে গোপনে যেন বলি।

কর্নেল বললেন–এঁরা দুজনেই আমার কাছের লোক। তুমি এঁদের সামনে বলতে পারো।

হরেন চাপাস্বরে বলল-আজ্ঞে, গতরাত্রে আনুবাবু বাড়ি ফিরেছেন। মায়ের পায়ে ধরে খুব কান্নাকাটি। উনিও কাঁদছিলেন। তারপর কর্তামশাই বেরিয়ে গিয়ে বললেন– ওরে আনু! তুই নিমিত্তমাত্র। আমাদের পরিবারের গৃহদেবতার সব অলঙ্কার আবার কর্নেল সাহেবের হাত দিয়ে ফেরত এসেছে। একটাও খোয়া যায়নি। তুই শিগগির মায়ের সঙ্গে গিয়ে ঠাকুরবাড়িতে রাধামাধবকে প্রণাম করে ক্ষমা চেয়ে নে।

হরেন চুপ করলে কর্নেল বললেন–আর কিছু?

হরেন একটু হেসে বলল–সে আর তার এক বন্ধু দুজনে মিলে এক ঠগের পাল্লায় পড়েছিল।

-আর কিছু?

–আজ্ঞে না। এবার আমি চলি কর্নেল সাহেব? ফোন ঠিক হলে কর্তামশাই আপনাকে ফোন করবেন।

হরেন চলে যাবার পর আমি বললুম–আচ্ছা হালদারমশাই! আপনার ক্লায়েন্ট মিসেস রায়চৌধুরী তার ছেলেকে কর্নেল সম্পর্কে কোনও কথা বলেছেন?

গোয়েন্দাপ্রবর তড়াক করে সোজা হয়ে বসলেন। তারপর বললেন–কী কাণ্ড! এক্কেরে ভুইলা গেছি! ম্যাডাম আমারে কইছেন ওঁর পোলা যাতে ভয় পায়। সেজন্য তিনি তারে কইছেন তার বাবার বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার তাঁর ডাকে এ বাড়িতে এসেছিলেন। তিনি পারুর বাবার বিপদে আপদে অনেক সাহায্য করতেন। তিনি ডিটেকটিভদের গুরু। তিনিই পারুর সেফটির জন্য তার ঘরের তালা খুইলা সার্চ করছিলেন।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–হালদার মশাই! এবার আপনি যান, গিয়ে আপনার ক্লায়েন্টকে বলুন, পারুর বন্ধু অনিরুদ্ধ সোমের চুরি করে আনা গৃহদেবতার অলঙ্কার আমি নিজের হাতে অনিরুদ্ধের বাবাকে কাল পৌঁছে দিয়েছি।

হালদারমশাই উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন–শুধু একটা কথা বোঝলাম না। সেই শেখ কালু যার পায়ে গুলি করছিলাম, তার কী অবস্থা?

কর্নেল বললেন–সে পুলিশের খাতায় দাগী। কাজেই তার নামে একটা পেটি কেস দিলে সে জামিন পেয়ে যাবে এবং কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে বাঁচবে।

হালদারমশাই এবার আস্তেসুস্থে বেরিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে আমি বললুম– সবই বোঝা যাচ্ছে। পারু আর আনু চান্দ্রেয়ীর প্রেমে পড়ে এমন কান্ধ হয়ে গিয়েছিল যে তারা তার সঙ্গে ফিল্ম নামতে চেয়েছিল। চান্দ্রেয়ী স্বভাবত তার। জয়দীপ জেঠুকে কথাটা জানিয়েছিল এবং তার এই সাংঘাতিক জেঠু হদ্দ বোকা ছেলেদুটোকে এক দুবৃত্ত বাপি সেনের সঙ্গে ভিড়িয়ে দিয়েছিল। চন্দ্র জুয়েলার্সের ডাকাতির ঘটনাটা অবশ্য বাপির নেতৃত্বেই হয়েছিল। বাপিও পুলিশের খাতায় দাগী। অতএব ডাকাতি করা অলঙ্কার সে আনুকে রাখতে দিয়েছিল। কিন্তু আমি এখনও বুঝতে পারছি না, কী এমন ঘটনা ঘটল যে গতকাল সকালে বাবুঘাটে আনু আর পারু মোটর সাইকেলে চেপে সেই গয়না যদুপতি চন্দ্রের ড্রাইভারকে দিতে গিয়েছিল?

কর্নেল বললেন–আমার থিয়োরিটা যাচাই করার জন্য আমি বরং হালদার মশায়ের ক্লায়েন্টকে একটা ফোন করি। হালদার মশায়কে কথাটা আমি বলিনি কারণ উনি সব ঘটনা এখনও জানেন না।

বলে কর্নেল রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন এবং সাড়া এলে বললেন–কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি… মিসেস রায়চৌধুরী বলছেন?… আপনার পুত্রের মেজাজ কি এখন শান্ত হয়েছে?… তাকে বলুন তার নামে। পুলিশের কোনও কেস নেই। এমন কি তার বন্ধু অনিরুদ্ধের নামেও কোনও কেস নেই। আর বলুন আমি তার সঙ্গে শুধু একটা কথা বলব… বাঃ। তাহলে ওকে টেলিফোনটা দিন। বলুন, ওর বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ওর সঙ্গে কথা বলবেন। কর্নেল রিসিভার ধরে থাকার প্রায় পাঁচ মিনিট পরে সাড়া এল। কর্নেল বললেন–পারু! তুমি আমাকে খুব ছোটবেলায় দেখেছ। তাই তোমার আমাকে মনে নেই। আমি তোমার বাবার বন্ধু.. হ্যাঁ। আমি শুধু জানতে চাইছি চন্দ্র জুয়েলার্সে বাপির ডাকাতি করা অলঙ্কারগুলো সে তোমার বন্ধু অনিরুদ্ধের কাছে লুকিয়ে রাখতে দিয়েছিল তাই না? হ্যাঁ। আনু আমাকে না বললেও আমি বিশ্বস্ত সূত্রে তা জানতে পেরেছি। তো আমি জানতে চাই, কাল তোমরা ওই অলঙ্কারগুলো। কেন বাবুঘাটে চন্দ্র মশায়ের ড্রাইভারের কাছে ফেরত দিতে গিয়েছিলে? এই প্রশ্নটার উত্তরের ওপর তোমারও নিরাপত্তা নির্ভর করছে।…অনিন্দিতা অর্থাৎ ফিল্ম অ্যাক্ট্রেস চান্দ্রেয়ী তোমাদের সতর্ক করে দিয়েছিল? …বাঃ? চান্দ্রেয়ী তাহলে বুঝতে পেরেছিল ওই বজ্জাত জয়দীপ ঘোষের হাত থেকে তাকে মুক্তি পেতেই হবে? তাহলে বোঝা যাচ্ছে, মেয়েটি বুঝতে পেরেছিল তাকে টোপ করে দুবৃত্ত জয়দীপ বঁড়শি ফেলেছিল। আর তোমরা তো সাদাসিধে বুদ্ধির ছেলে। তোমাদের কোনও দোষ নেই। যাই হোক শোনো! সময়মতো গিয়ে তোমার সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলে আসব। তখন পুরো ঘটনাটা যা তোমরা জানো না, আমি তোমাকে জানাব… হ্যাঁ টেলিফোন করেই যাব। এবার তোমার মাকে দাও…মিসেস রায়চৌধুরি? মিঃ হালদার আপনার কাছে যাচ্ছেন… না, তেমন কিছু না। তার সঙ্গে পারুর আলাপ করিয়ে দেবেন। হালদার মশাই তাকে নেপথ্যের ঘটনার অন্তত খানিকটা জানাতে পারবেন। রাখছি।…

রিসিভার রেখে কর্নেল বললেন– জয়ন্ত! অন্ধকারের নায়ক এবং তার ছায়া এখন পুলিশের হাতে নাকানি-চোবানি খাচ্ছে। মনটা হালকা হয়ে গেল। চলো সোনারপুরে মা-লক্ষ্মী নার্সারিতে একবার ঘুরে আসি। নার্সারির মালিক মোহনবাবু বলেছিলেন কয়েকটা বিদেশি ক্যাকটাস এনেছেন। সেগুলো দেখে আসি। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হঠাৎ একটু হেসে বললেন–একটা মারুতি গাড়ি আমাদের ফলো করত। গাড়িটা কার তা বোঝাই যাচ্ছে। গাড়ির নাম্বার আমার মুখস্থ হয়ে আছে। ওটা যে জয়দীপের গাড়ি সে বিষয়ে আমি সিওর। তবে সে হয়তো নিজে নয়, তার কোনও চেলা আমাদের ফলো করত। যাই হোক। আজ কোনও গাড়ি আমাদের আর ফলো করবে না। ওঠো! পোশাক বদলে নাও। আজ আমরা সোনারপুরে মোহনবাবুর বাংলোয় লাঞ্চ খাব।