(৪)
এর দিন কয়েক পরেই আমাদের গৃহস্বামী অথবা কয়েদকারীরা— কী নামে তাদের ডাকব, এই সংশয় মাঝে মধ্যেই দেখা দিত মনের মধ্যে— আমাদের নিয়ে গেল সাগরতলের এক অভিযানে। ছ-জন এসেছিল আমাদের সঙ্গে— ম্যান্ডা ছিল তাদের মধ্যে। যে প্রস্থান-কক্ষে আমরা প্রথমে জড়ো হয়েছিলাম সমুদ্রের তলা থেকে প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফেরবার পর, জড়ো হলাম সেই ঘরেই। ঘরটাকে খুঁটিয়ে দেখবার ফুরসত পেয়েছিলাম তখনই। জায়গাটা বিশাল, এক-এক দিকে একশো ফুট তো বটেই, দেওয়ালগুলো সবুজ হয়ে গেছে শ্যাওলা আর সামুদ্রিক উদ্ভিদের প্রতাপে। শুধু সবুজ নয়, স্যাঁতসেঁতেও বটে। সারবন্দি খোঁটা পোঁতা ঘরের চার দেওয়ালে। প্রতিটি খোঁটা থেকে ঝুলছে কাচের মতন অর্ধস্বচ্ছ পোশাক, আর একজোড়া কাঁধ ব্যাটারি যার দৌলতে শাসপ্রশ্বাস চালানো যায় স্বচ্ছন্দে। চাকা চাকা পাথর দিয়ে বাঁধানো মেঝের বহু জায়গায় গোল গোল গর্ত হয়ে গেছে বহু বছর ধরে হাঁটা চলার ফলে, জল জমে রয়েছে সেই সব গর্তে। কার্নিশের ধারে ধারে বসানো ফ্লোরেসেন্ট টিউব আলোর দৌলতে আলোয় আলো হয়ে রয়েছে অতবড় ঘরটা। অধস্বচ্ছ কাচ-পোশাকে আমাদের মুড়ে দেওয়ার পর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল একটা করে হালকা ধাতু দিয়ে তৈরি ছুঁচোলো মুখ দণ্ড। তারপর ম্যান্ডা-র আদেশ অনুযায়ী চেপে ধরলাম দেওয়াল বরাবর বসানো রেলিং— নিজেরাই আগে রেলিং খামচে ধরে দেখিয়ে দিল কী করতে হবে আমাদের। কারণটা বোঝা গেল অচিরে। কেননা, একটু পরেই বাইরের দরজাটা একটু একটু করে খুলতেই এত তোড়ে জল ঢুকতে লাগল ভেতরের রেলিং খামচে ধরে না থাকলে জলের তোড়ে ঠিকরে যেতাম। জল উঠতে লাগল দ্রুত, ছাড়িয়ে গেল আমাদের মাথা, সেই সঙ্গে কমে এল জল চাপ। দরজার দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল ম্যান্ডা, সদলবলে ফের বেরিয়ে গেলাম সমুদ্রতলে, দরজা খোলা রইল আমাদের ফিরে আসার জন্যে।
কেঁপে কেঁপে যাওয়া শীতল প্রেতালোকের মধ্যে তাকিয়েছিলাম আশপাশে! গভীর সমুদ্রতল আলোকিত হয়েছিল অস্পষ্ট বিবর্ণ প্ৰেতালোকে। দেখতে পাচ্ছিলাম সব দিকের সিকি মাইল পর্যন্ত। অবাক হয়েছিলাম একটা অত্যুজ্জ্বল দ্যুতি দেখে যা দেখা যাচ্ছিল আমাদের দৃষ্টিসীমার ঠিক বাইরে। দলনায়ক পা চালিয়ে চলেছেন সেই দিকেই, লাইনবন্দি অবস্থায় দলের বাকি সবাই ছিল তার পেছনে। যেতে হচ্ছিল খুবই আস্তে আস্তে, কেননা জলের বাধা তো ছিলই, তার ওপরে প্রতি পদক্ষেপে পা বসে যাচ্ছিল নরম কাদাপাঁকের মধ্যে। একটু পরেই সুস্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম উঁচু জায়গার সেই আলোক সংকেতের স্বরূপ। আমাদের সেই ইস্পাত-কক্ষ, পার্থিব জীবনের শেষ ক-টা ঘণ্টা কাটিয়েছি যে স্টিল বক্সের মধ্যে, সেটি কাত হয়ে পড়ে আছে বহুদূর বিস্তৃত এক প্রাসাদের একটা গম্বুজের ওপর— জ্বলছে সবক-টা আলো। তিন-চতুর্থাংশ জলে ভরে গেছে, কিন্তু বন্দি বাতাস তখনও টিকিয়ে রেখেছে সেই অংশটা যেখানে রয়েছে আমাদের ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি। চমৎকৃত হয়েছিলাম সেই দৃশ্য দেখে। অতি পরিচিত অভ্যন্তরের সোফা আর কলকবজা যেখানে যেখানে ছিল, সেখানে সেখানেই আছে, বেশ কয়েকটা বড় সাইজের মাছ খেলে বেড়াচ্ছে সেখানে যেমন করে অ্যাকোয়ারিয়ামে রঙিন মাছের দঙ্গল ঘুরপাক খায়। একে একে আমরা খোলা অবস্থায় থাকা মেঝের লৌহকপাট দিয়ে প্রবেশ করেছিলাম ভেতরে। জলে ভাসছিল অনেক কিছু লেখা ম্যারাকটের একটা নোটবই— তিনি তৎপর হয়েছিলেন সেটি তুলে নিতে। স্ক্যানলান আর আমি নিয়েছিলাম ব্যক্তিগত খানকয়েক জিনিস। জনা দুই সঙ্গী নিয়ে ম্যান্ডাও ঢুকেছিল ভেতরে! ভীষণ আগ্রহে দেখে যাচ্ছিল ব্যাথোমিটার, থার্মোমিটার, আরও অনেক যন্ত্রপাতি যা লাগানো ছিল দেওয়ালে। থার্মোমিটারটা আমরা দেওয়াল থেকে খুলে নিয়ে কাছে রেখেছিলাম। মর্তের বৈজ্ঞানিকরা বিস্মিত হতেন থার্মোমিটারের তাপাঙ্ক দেখে। সমুদ্রের গভীরতম অঞ্চলে— পৃথিবীর মানুষ এই প্রথম যেখানে নেমেছে সেখানকার তাপাঙ্ক চল্লিশ ডিগ্রী ফারেনহাইট, কি তারও একটু বেশি কাদা পাঁকের রাসায়নিক পচনের জন্যে, যা সমুদ্রের ওপরের দিকের তাপমাত্রার চেয়ে ঢের বেশি।
ছোট্ট এই অভিযানের উদ্দেশ্য শুধু আমাদের ইস্পাত কক্ষের শেষ পরিণতি দেখানোর জন্যেই নয়। আমরা খাদ্য শিকার করে যাচ্ছিলাম। মাঝে মধ্যেই দেখছিলাম সঙ্গীরা ছুঁচোলো সড়কি দিয়ে চ্যাপটা বাদামী মাছ গাঁথছে, পায়রাচাঁদা মাছ টারবটের মতন দেখতে, দলে দলে এই মাছ টহল দিয়ে যাচ্ছিল গোটা অঞ্চলটা জুড়ে, কিন্তু কাদামাটির খুব কাছাকাছি থাকার ফলে অভ্যস্ত চোখ ছাড়া তাদের ঠাহর করা যাচ্ছিল না। একটু পরেই দেখা গেল, সঙ্গীদের প্রত্যেকের কোমরবন্ধনীতে এই রকমের দু-তিনটে মাছ। স্ক্যানলান আর আমিও শিখে গেলাম মৎস্য শিকারের কায়দা এবং দু-জনের প্রত্যেকেই ধরলাম দুটো করে মাছ। ম্যারাকট কিন্তু হেঁটে গেলেন যেন স্বপ্নাচ্ছন্ন অবস্থায়, মাঝে মাঝে উচ্ছ্বসিত মন্তব্যও করে গেলেন যা কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হল না মোটেই। দেখতে পেলাম শুধু চক্ষু ইন্দ্রিয় দিয়ে ওষ্ঠযুগলের চকিত নৃত্য।
প্রথম প্রথম সব কিছু একঘেয়ে লাগলেও একটু পরেই বৈচিত্র্যের বাহারে মন জুড়িয়ে গেল। সমুদ্রতলের এই ধু-ধু প্রান্তরে একঘেয়েমি নেই মোটেই, আছে বিবিধ বৈচিত্র্য। নিতল স্রোত ফল্গুনদীর মতোই ধারাস্রোত দিয়ে প্রান্তরকে ভেঙেচুরে ঢেউ খেলিয়ে রকমারি রূপ দিয়ে গেছে। নরম কাদা পাঁক ফেটে ফেটে তলার মাটি বের করে দিয়েছে। সেখানকার মেঝেতে রয়েছে লালচে কাদা, যা দিয়ে গড়ে উঠেছে সাগরতলের সব আকৃতি, লাল কাদায় বেরিয়ে আছে খোঁচা খোঁচা সাদাটে বস্তু— প্রথমে দেখে মনে হয়েছিল ঝিনুক, কাছে গিয়ে চোখ চালিয়ে দেখলাম— জিনিসগুলো তিমির কানের হাড়, হাঙরের এবং অন্যান্য সাগর দানবদের ধারালো দাঁত। একটা দাঁত তুলে নিয়ে মেপে দেখেছিলাম পনেরো ইঞ্চি লম্বা, শিহরিত হয়েছিলাম সমুদ্রপৃষ্ঠে এইরকম দাঁতের কেরামতি কল্পনা করে নিয়ে। ম্যারাকট পরে বলেছিলেন, এ দাঁত ডলফিন জাতীয় বৃহৎ সামুদ্রিক জীব গ্র্যামপাস অথবা ওরকা মল্লবীরের। উদাহরণস্বরূপ বলেছিলেন, মিচেল হেজেস-এর পর্যবেক্ষণ বৃত্তান্ত। তিনি দেখেছিলেন, সমুদ্রের অতিশয় ভয়াবহ হাঙরের গায়ে এমন সব দন্তক্ষত দেখা গেছে যা থেকে বোঝা যায় তাদেরকে লড়ে যেতে হয়েছে তাদের চেয়েও বড় আর ভয়ংকর প্রাণীদের সঙ্গে।
সমুদ্রতলের একটা বৈশিষ্ট্য দাগ রেখে যায় পর্যবেক্ষকের মনের পরতে। আগেই বলেছি, বিস্তর জৈব পদার্থের পচনের দরুন সমুদ্রতল শতল প্রভায় সদা স্বতঃদীপ্ত। তার ওপরেই কিন্তু সব কিছুই ঘোর অমানিশার কৃষ্ণকালো। শীতার্ত দিনে পৃথিবীর ওপরে বিদ্যুৎগর্ভ কৃষ্ণকালো মেঘ চেপে থাকার মতো ব্যাপার। তমাল প্রতিম এই চাঁদোয়া থেকে অনবরত ঠিকরে যাচ্ছে খুদে খুদে সাদাটে কণিকা, নিষ্প্রভ পটভূমিকায় যা বেশ বিষন্ন। এরা সবই সমুদ্র শামুকের রাশি রাশি খোলা, অন্য অন্য খুদে প্রাণীদের খোলস। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পাঁচ মাইল নিচের সমুদ্রতলের মধ্যেকার অঞ্চলে এদের নিবাস এবং মৃত্যু হয় বলেই তাদের খোলস নিচে এসে পড়ে কবরস্থ করেছে বিশাল দূরবিস্তৃত শহরকে— যে শহরের ওপরদিকের উঁচু অঞ্চলে ঠাঁই পেয়েছি আমরা তিনজনে।
পায়ের তলার পৃথিবীর সঙ্গে শেষ সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে আমরা জলতল জগতের মধ্যে দিয়ে আরও এগিয়ে গিয়ে পড়েছিলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে। নড়াচড়ার চিহ্ন দেখেছিলাম। চোখের সামনে। অর্ধস্বচ্ছ কাচ আবরণে শরীর ঢেকে চলেছে দলে দলে মানুষ, টেনে নিয়ে চলেছে স্লেজগাড়ি ভরতি কয়লা। খুবই মেহনতের কাজ। স্লেজ যারা টানছে হাঙরের চামড়া দিয়ে তৈরি দড়ি ধরে, তারা ঝুঁকে বেঁকে পড়ছে অত বোঝা টেনে নিয়ে যেতে গিয়ে। প্রত্যেকটা দলে রয়েছে কর্তৃত্বব্যঞ্জক একজন করে পুরুষ— হুকুমদার— সুস্পষ্ট দেখলাম দলপতি এক জাতের মানুষ, গোলামরা অন্য জাতের মানুষ। গোলামরা দীর্ঘাকায়, ফর্সা, নীলচক্ষু, শক্তিময় বপুর অধিকারী। অন্যান্যরা, আগেই বলেছি, কৃষ্ণকায়— প্রায় নিগ্রো ধরনের চৌকোনা চওড়া বপুর অধিকারী। সেই মুহূর্তে এই রহস্যের জবাব আমরা পাইনি— তলিয়ে ভাববার অবসরও ছিল না, কিন্তু সুস্পষ্ট মনে হয়েছিল বংশ পরম্পরায় একটা জাতি আর একটা জাতির ওপর কর্তৃত্ব চালিয়ে গোলাম বংশ টিকিয়ে রেখেছে। ম্যারাকট বলেছিলেন, গোলাম যারা, তারা গ্রিক বন্দিদের বংশধর— যাদের দেবীকে আমরা দেখে এসেছি দেবালয়ের নিচের ঘরে।
কয়লার খনিতে এসে পৌঁছোনোর আগে দেখলাম এই রকম গোলামদের বেশ কয়েকটা দল। প্রত্যেকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে স্লেজ গাড়ি ভরতি কয়লার চাঙড়। তারপরে এসে পৌঁছোলাম কয়লার খনিটায়। এই জায়গাটার গভীর সমুদ্রের তলানি আর বালির স্তূপ চেঁছে সাফ করে ফেলা হয়েছে। মস্ত একটা কয়লার খনি মুখ ব্যাদান করে রয়েছে। সেখানে রয়েছে কয়লার স্তরের পরেই কাদার স্তর, তারপরেই কয়লার স্তর; পর্যায়ক্রমে কয়লা আর কাদার স্তর। বহু আগের যে জগৎ এখন ধ্বংস হয়ে গেছে, আটলান্টিকের জলতলে বিরাজ করছে সেই অবস্থা আর ব্যবস্থা। সুবিস্তীর্ণ এই খননভূমির বেশ কয়েক জায়গায় দেখলাম গোলামের দল চাঁই চাঁই কয়লা কেটে স্তূপাকারে সাজাচ্ছে, অন্যান্যরা সেই স্তূপ থেকে কয়লা তুলে চুপড়িতে সাজাচ্ছে, সেই চুপড়ি অথবা ছোট ছোট বাক্স কয়লাশুদ্ধ টেনে ওপরে তোলা হচ্ছে। পুরো কয়লার খনিটা এতই বিরাট যে আমরা অপর প্রান্তটা দেখতেই পেলাম না— পুরুষানুক্রমে গোলামরা কয়লা কেটে কেটে খনি অঞ্চল বাড়িয়েই চলেছে। এই কয়লা পরে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ শক্তিতে— যে শক্তি চালিকাশক্তি হয়ে জলতলের সুবিস্তীর্ণ আটলান্টিয়ান কলকবজা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখের দরকার বলেই জানাচ্ছি, এই ব্যাপারটা যখন ম্যান্ডা-কে বলা হয়েছিল, তখন সে বিপুল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছিল। অন্যান্যদের অবস্থাও দাঁড়িয়েছিল সেইরকম। আমরা যে এত খবর জানি, তা ওদের পিলে চমকে দিয়েছিল। তারপর সবেগে মস্তিষ্ক চালনা করে বলেছিল, সব সত্যি, সব সত্যি। আমরা যা বলছি, তা খাঁটি কথাই বটে, আজগুবি কপোল কল্পনা নয়।
সুবিশাল কয়লার খনি পাশ কাটিয়ে ডানদিকে গিয়ে আমরা এসে গেলাম সারবন্দি আগ্নেয় টিলার মধ্যে। পৃথিবীর জঠর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসবার সময়ে তাদের গা যেমন চকচকে পরিচ্ছন্ন ছিল, এখনও রয়েছে সেইরকম, শীর্ষদেশ কিন্তু কয়েকশো ফুট উঁচুতে উঠে গিয়ে হারিয়ে গেছে চোখের নাগালের বাইরে। এইসব আগ্নেয় টিলাদের পাদদেশ সমাকীর্ণ এবং আচ্ছাদিত হয়ে রয়েছে গভীর সমুদ্রের নিরেট জঙ্গলে— যাদের অভ্যুত্থান ঘটেছে পার্থিব আমলের প্রবাহের কঙ্কাল থেকে। ঘন বসতির কিনারা বরাবর অনেকক্ষণ ধরে আমরা হেঁটে গেছিলাম, সঙ্গীরা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে মজা করবার জন্যে বের করে আনছিল অসাধারণ রকমের বিবিধ প্রজাতির মীন মহাশয়দেরকে, মাঝে মাঝে ছুঁচোলো শিক দিয়ে গেঁথে গেঁথে তুলে আনছিল খানকয়েক, পাত সাজিয়ে উদরপূর্তির জন্যে। এই রকম মজা করতে করতে আমরা প্রায় এক মাইল কি তারও বেশি হেঁটে যাওয়ার পর হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেছিল ম্যান্ডা, বেশ খানিকটা ভীতি আর বিস্ময়বোধ নিয়ে তাকিয়েছিল চারধারে। জলতলের অঙ্গভঙ্গীই তো একটা ভাষা ওদের মধ্যে। অর্থটা নিমেষের মধ্যে বুঝে নিয়েছিল সাঙ্গপাঙ্গরা। চমকিত চিত্তে বুঝলাম আমরাও তারপরেই! অদৃশ্য হয়ে গেছেন ডক্টর ম্যারাকট।
কয়লার খনিতে তো ছিলেন আমাদের সঙ্গেই। আগ্নেয় টিলা পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গে এসেছিলেন। এগিয়ে নিশ্চয় যাননি, গেলে দেখা যেত। তাহলে নিশ্চয় পেছিয়ে পড়েছেন— ফেলে আসা জঙ্গলের মধ্যে কোথাও থেকে গেছেন। বিচলিত হয়েছিল আমাদের বন্ধুবর্গ। আমরা কিন্তু হইনি। আমরা যে জানি তাঁর অন্যমনস্ক স্বভাব! একটু খুঁজলেই নিশ্চয় দেখব, সমুদ্রতলের কোনও এক প্রাণীর আকর্ষণে আবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন কোথাও। দল বেঁধে ফিরে গেছিলাম মাড়িয়ে আসা পথ বেয়ে, একশো গজ যেতে না যেতেই দেখতে পেয়েছিলাম তাঁকে।
কিন্তু উনি যে ভাবে দৌড়চ্ছেন, ওই বয়েসে অমন দৌড় তো অসম্ভব তাঁর পক্ষে। তবে কি, দৌড়বাজ মোটেই নয়, এমন মানুষও ভয় পেলে দৌড়োয় পাঁইপাঁই করে। উনি দৌড়াচ্ছেন দু-হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে, মুহুর্মুহু হোঁচট খেয়ে পড়ছেন হুমড়ি খাচ্ছেন তড়িঘড়ি এলোমেলোভাবে চম্পট দিতে গিয়ে। এমন উন্মত্তের মতো দৌড়োনোর কারণও আছে। ভয়ালদর্শন তিনটে প্রাণী তাঁকে তাড়া করেছে। বাঘা কাঁকড়া, আগাগোড়া সাদা-কালো ডোরাকাটা, প্রত্যেকটার সাইজ নিউফাউন্ডল্যান্ড কুকুরের মতন। ডক্টরের কপাল ভালো এই কারণে যে তিন যমদূতের স্পিড তেমন বেশি নয়, খুবই মন্থরগতি, কাদাটে পাঁকানো জমির ওপর ডাইনে বাঁয়ে হেলে দুলে তারা যে স্পিডে আসছে, তা ডক্টরের স্পিডের চেয়ে সামান্য বেশি।
সব মিলিয়ে তাদের গতিবেগ ঈষৎ দ্রুততর হওয়ার মিনিট কয়েকের মধ্যেই কাঁকড়া মহাশয়দের কড়া দাঁড়া খামচে ধরে ফেলত ম্যারাকট মশায়কে, যদি না আমরা ঠিক সময়ে গিয়ে পৌঁছোতাম। আমাদের সঙ্গে যারা গেছিল, তারা তৎপর হয়েছিল তৎক্ষণাৎ। ছুঁচোলো লাঠি নিয়ে তেড়ে গেছিল সামনের দিকে, ম্যান্ডা ফ্লাস মেরেছিল শক্তিশালী একটা ইলেকট্রিক লণ্ঠন থেকে যা ঝোলানো ছিল কোমরের বেল্টে। ফোকাস মেরেছিল গা ঘিনঘিনে দানোগুলোর মুখের ওপর, সঙ্গে সঙ্গে তারা ছিটকে গিয়ে চম্পট দিয়েছিল জঙ্গলের মধ্যে, চলে গেছিল চোখের আড়ালে। কমরেড ম্যারাকট ঝুপ করে বসে পড়েছিলেন একটা কয়লার চাঁইয়ের ওপর। মুখ দেখে বোঝা গেছিল, দম ফুরিয়েছে একদম। নিতান্তই পরিশ্রান্ত— অ্যাডভেঞ্চারের দাম দিতে হয়েছে বিলক্ষণ। পরে আমাদের বলেছিলেন জঙ্গলে ঢোকার কারণটা। ইচ্ছে ছিল ধরে নিয়ে যাবেন গভীর জলের একটা কিমেয়্যার্যা— যা কিনা কল্পিত অগ্নিবর্ষী দৈত্যবিশেষ, যার মুণ্ড সিংহের মতন, লেজ সাপের মতন, আর শরীরটা ছাগলের মতন। ভুল করে ঢুকে পড়েছিলেন ভীষণ হিংস্র টাইগার-কাঁকড়ার বাসার মধ্যে। তাড়া খেয়েছিলেন তৎক্ষণাৎ। অনেকক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর যাত্রা শুরু করার দম ফিরে পেয়েছিলেন।
আগ্নেয় পাথরের ঝুঁকে পড়া একটা পাহাড়ের খাড়া দিক ঘুরে পেরিয়ে আসবার পর পৌঁছেছিলাম গন্তব্যস্থানে। সামনের ধূসর প্রান্তরে দেখেছিলাম এলোমেলো ছোট-ছোট ঢিবি আর খুব উঁচু ঠেলে বেরিয়ে আসা উদগত পাঁকের ঢিবি, যা থেকে বুঝে নিয়েছিলাম পায়ের তলায় রয়েছে এককালের সেই বিরাট শহর। হারকিউলেনিয়াম যেভাবে এক্কেবারে ডুবে গেছে লাভার মধ্যে, অথবা পম্পেই শহর ছাইয়ের মধ্যে— সেই ভাবেই চিরকালের মতো পাঁকের মধ্যে ডুবে থাকত পেল্লায় এই শহর, যদি না মন্দিরের মধ্যে ঢুকে গিয়ে যারা টিকে গেছিল, তারা খোঁড়াখুঁড়ি করে বেরিয়ে আসবার পথ নিজেরা বানিয়ে নিত। এখানকার প্রবেশপথ লম্বাটেভাবে নিচের দিকে কেটে বের করা হয়েছে, সেই পথ নেমে গিয়ে মিশেছে একটা প্রশস্ত রাজপথে— দু-পাশে ঠেলে বেরিয়ে আছে সারবন্দি বাড়ি। মাঝে মধ্যেই ফেটে গেছে অথবা ভেঙে পড়েছে এই সব বাড়িগুলোর দেওয়াল, মন্দিরের দেওয়ালের মতো নিরেট গঠন মজবুত নয় বলে, কিন্তু ভেতরকার যা কিছু সে সব প্রায় যেমন তেমনি থেকে গেছে মহাপ্রলয়ের সময়ে, পরিবর্তন ঘটিয়ে গেছে শুধু সাগরের জল, কোথাও সুন্দর আর দুর্লভভাবে, কোথাও ভয়ংকরভাবে পালটে পালটে দিয়েছে ঘরগুলোর চেহারা। প্রথমদিকের সৌধগুলোয় পথ প্রদর্শকরা আমাদের ঢুকতে না দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে গেছিল সামনের দিকে— অবশেষে পৌঁছেছিলাম প্রকাণ্ড সেই প্রাসাদের সামনে যেটাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে গোটা শহরটা। দেখবার মতো সেই প্রকাণ্ড ইমারতের মোটা মোটা অনেক উঁচু স্তম্ভশ্রেণী, খোদাই করা কার্নিশ আর তার নিচের কারুকাজ, সুবিশাল সোপার্ণ শ্রেণী— এমন সৌধ পৃথিবীর কোথাও কখনও দেখিনি।
এই সবের সঙ্গে নিকট সাদৃশ্য আছে বলা যেতে পারে মিশর দেশের লাক্সার-এর গার্নাক মন্দিরের। আরও অদ্ভুত এই কারণে যে যাবতীয় কারুকাজ আর অর্ধেক মুছে যাওয়া খোদাইকর্মের সঙ্গে নীলনদের পারের বিরাট ধ্বংসস্তূপের খোদাই কর্ম আর কারুকাজ করা শীর্ষদেশ তো একই রকমের। ছোট ছোট পাথর দিয়ে বাঁধানো রয়েছে বিশাল বিশাল হল ঘরের মেঝে, চারদিকে দাঁড়িয়ে মস্ত উঁচু পাথরের মূর্তি। আমরা স্তম্ভিত দৃষ্টি মেলে এইসব যখন দেখছি, তখন মাথার ওপর দিয়ে, আশপাশ দিয়ে কিলবিল করে ছুটে যাচ্ছিল সুবিশাল রুপোলি বান মাছ, আমাদের দিক থেকে ধেয়ে যাওয়া আলোর সামনে থেকে। মুগ্ধ বিস্ময়ে টহল দিয়ে গেছি এক ঘর থেকে আর এক ঘরে, দেখেছি বহু বিলাস-দ্রব্য আর লাম্পট্যের দোষ, বহুকালের কিংবদন্তী অনুসারে যে সবের জন্যে ঈশ্বরের অভিশাপ নেমে এসেছিল এই দেশের ওপর। ছোট্ট একটা ঘরকে ভারি সুন্দরভাবে বাহারি করে তোলা হয়েছে ঝিনুকের মধ্যেকার শক্ত চকচকে রামধনু রঙের পদার্থের মিনা কারুকাজ দিয়ে। এমনই সুন্দরভাবে যে এত বছর জলের মধ্যে থেকেও জ্যোতির্বিকাশী বর্ণ বিচ্ছুরণ করে চলেছে আলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে। এক কোণে রয়েছে একটা কারুকাজ করা পালঙ্ক হলদে ধাতু দিয়ে তৈরি, একই ধাতু দিয়ে তৈরি কারুকার্যময় একটা আরামকেদারা রয়েছে এক কোণে, নিশ্চয় কোনও এক রানির শয়নকক্ষ, কিন্তু এখন আরামকেদারার পাশে অবস্থান করছে গা ঘিনঘিন করার মতো বপু নিয়ে একটা স্কুইড, নোংরা দেহ মৃদু ছন্দে উঠছে আর নামছে, অভিশপ্ত প্রাসাদের কেন্দ্রস্থলে এখনও যেন স্পন্দিত হয়ে চলেছে জঘন্য এক হৃৎপিন্ড। এমন একটা ভয়ানক জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে আমি যেমন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম, একই রকম স্বস্তির ভাব দেখেছিলাম সঙ্গীদের চোখে মুখে। তারপর দেখেছিলাম চকিতের জন্যে বৃত্তাকার অট্টালিকার মতো সিঁড়িওলা আসন সমেত একটা রঙ্গস্থল— এক কথায় আমরা যাকে বলি অ্যাম্ফিথিয়েটার— এখন যা ধ্বংসপ্রাপ্ত; দেখেছিলাম সাগরের তরঙ্গবেগ আটকানোর জন্যে পাথরের খিলেনওলা বাঁধ, পাশেই একটা লাইটহাউস— যা দেখে বুঝেছিলাম, এই শহর এক সময়ে ছিল সমুদ্রবন্দর; অশুভ লক্ষণ সমন্বিত অভিশপ্ত এই সব জায়গা ছেড়ে অচিরেই বেরিয়ে এসেছিলাম আমরা, ফের এসে গেছিলাম সমুদ্রতলের প্রান্তরে।
অ্যাডভেঞ্চারের ইতি ঘটেনি তখনও। পিলে চমকানো ভয়ানক একটা ব্যাপারের সামনাসামনি হতে হয়েছিল সবাইকেই। ঘরমুখো রওনা হওয়ার একটু পরেই জনৈক সঙ্গী সভয়ে আঙুল তুলে দেখিয়েছিল ওপর দিকে। দেখেই তো ভয়ে কাঠ হয়ে গেছিলাম তাদের মতো আমরাও। অপলকে সেদিকে তাকিয়ে থেকে দেখেছিলাম অসাধারণ এক দৃশ্য। অন্ধকারময় জলরাশির মধ্যে থেকে অতি বিশাল কৃষ্ণকায় একটা বস্তু বেরিয়ে এসে দ্রুত নেমে আসছে নিচের নিকে। প্রথমে দেখে মনে হয়েছিল আকারবিহীন একটা কিছু, কিন্তু অতি দ্রুত আলোর আওতার মধ্যে চলে আসবার পর দেখলাম, বস্তুটা একটা দানবিক মাছের মৃতদেহ— ফেটে যাওয়ায় নাড়ি ভুঁড়ি ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে ওপর দিকে পতনের সঙ্গে সঙ্গে। গ্যাস জমে যাওয়ার দরুন নিশ্চয় ভাসিয়ে দিয়েছিল সাগরের ওপর এলাকায়, সেখানে তাকে ঠুকরে ঠুকরে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে হাঙরের দল, এখন নেমে আসছে গুরুভার মৃতদেহটা, সাগরের মেঝে লক্ষ করে। এতটা পথ হেঁটে আসবার সময়ে এরকম প্রাণীদের বিরাট কঙ্কাল দেখেছিলাম এর আগেই— ভেতর দিয়ে যাতায়াত করছে মাছের দল অজস্র ছেঁদা বানিয়ে নিয়ে, এই প্রাণীটা কিন্তু এখনও সেই রকমের অন্তিম অবস্থায় পৌঁছোয়নি সাগর দানবদের হানা শুরু না হওয়ায়। মৃতদেহটা যেখানে এসে পড়বে, সে জায়গা থেকে আমাদের টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে নিয়ে গেছিল সঙ্গীরা— একটু তফাতে দাঁড়িয়ে গেছিল মাথার ওপরে পতনের আর কোনও সম্ভাবনা না থাকায়। অর্ধস্বচ্ছ হেলমেট মাথায় থাকার দরুন জিনিসটা যখন আছড়ে পড়েছিল সমুদ্রতলে, তখনকার সেই আওয়াজ শুনতে পাইনি বটে, তবে মৃত সাগরিকাদের দেহাবশেষ সমন্বিত কাদাপাঁক যখন ছিটকে ছিটকে উঠে গেছিল ওপর দিকে বিশাল সেই কলেবর আছড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে, তখনই দেখে নিয়েছিলাম জিনিসটা কী। একটা স্পার্ম তিমির মৃতদেহ। লম্বায় পঁচাত্তর ফুট। জলতলের বাসিন্দাদের উত্তেজিত অঙ্গভঙ্গী দেখে বুঝেছিলাম, বিশাল এই কলেবর থেকে তারা সংগ্রহ করতে পারবে বিস্তর পরিমাণ তিমির মাথার চর্বি, একশব্দে যাকে বলা হয় স্পার্ম্যাসিটি, আর তিমির শরীরের বিপুল পরিমাণ চর্বি। এ থেকে বানিয়ে নেবে অনেক বাতি, অনেক দাওয়াই, অনেক কিছু। মৃত তিমির ছিন্নভিন্ন মড়া সেইখানেই রেখে দিয়ে সেই সময়ে অবশ্য আমরা প্রত্যাবর্তন করেছিলাম আমাদের কারুকার্যময় খিলেনের তলার প্রবেশ কক্ষে, নিরাপদে দাঁড়িয়ে গেছিলাম জল বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত, খুলে ফেলেছিলাম অর্ধস্বচ্ছ পোশাক আর হেলমেট।
সময়ের হিসেব যেভাবে রেখেছিলাম, সেই হিসেবের বলে দিন কয়েক পরে, আগের দেখানো সেই সিনেমা দৃশ্যের মতো আর এক প্রস্থ সিনেমা দর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল আমাদের অবগতির জন্যে। সাগরতলের এই মানুষদের অতীত যাতে সুস্পষ্ট হয়ে যায় আমাদের কাছে, এই উদ্দেশ্যে। সে বড় আশ্চর্য ইতিহাস। অত্যাশ্চর্য সেই মানুষদের ওয়ান্ডারফুল অতীত কাহিনি। এই আয়োজন করা হয়েছিল শুধু আমাদের জন্যে, আমাদের জ্ঞান তৃষ্ণা মিটোনোর উদ্দেশ্যে এমন কথা আমি বলছি না। অতীত যেন ভুলে না যায় বর্তমানের সাগরতলের বাসিন্দারা, এই উদ্দেশ্যেই মাঝে মধ্যে নাটকীয় এই আয়োজন করা হত, এই প্রদর্শনী ঘটানো হত— ভাগ্যক্রমে আমরা তখন হাজির ছিলাম এই রকম একটা সুদীর্ঘ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আসরে। ঠিক যেরকম দেখেছিলাম এবার তা বলা যাক।
বিশাল যে হল ঘরটায় স্ক্রিনের ওপরে ম্যারাকট আমাদের অ্যাডভেঞ্চার প্রদর্শন করেছিলেন, সেই হল ঘর অথবা থিয়েটার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আমাদের। সাগরতলের সমস্ত মানুষ জড়ো হয়েছিল সেখানে। আলোকময় পর্দার সামনে আমাদের নিয়ে গিয়ে দেওয়া হয়েছিল একই রকমের সম্মান। প্রথমে অনেকক্ষণ ধরে গাওয়া হয়েছিল একটা গান। হয়তো তা দেশাত্মবোধক স্তোত্রপাঠ। তারপর এগিয়ে এসেছিল খুবই বয়োবৃদ্ধ শ্বেতকেশ এক পুরুষ। হয়তো তাদের ইতিহাস প্রণেতা। হাততালি পড়েছিল প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে। হাততালির মধ্যে দিয়েই সে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ফোকাস পয়েন্টে। ঝকঝকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিল স্বজাতির উত্থান পতনের ইতিহাস পরম্পরা। সুস্পষ্ট সেই ছায়াছবির নাটকীয়তা মর্মস্পর্শী। সময় আর স্থান জ্ঞান বিস্মৃত হয়েছিল আমার দুই ছায়াসঙ্গী। ডুবে গেছিল দৃশ্য পরম্পরার আকর্ষণী শক্তির মধ্যে। বিষম বিচলিত হয়েছিল দর্শকবৃন্দ। বিয়োগান্তক নাটক যখন ধাপেধাপে ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছেছে, তখন তারা গুঙিয়ে উঠে কেঁদেও ফেলেছে। দৃশ্য পরম্পরার মধ্যে দিয়ে সুস্পষ্টভাবে উন্মোচিত হয়ে গেছিল সুদূর অতীতের সেই ইতিহাস— পিতৃভূমির বিনাশ হওয়ার ইতিবৃত্ত, স্বজাতি ধ্বংসের মর্মন্তুদ কাহিনি।
ছায়াছবির প্রথম সিরিজে দেখেছিলাম সুপ্রাচীন সেই মহাদেশের গৌরব কাহিনি যার ঐতিহাসিক ধারাবিবরণী স্মৃতির মণিকোঠায় থেকে পুরুষানুক্রমে চলে এসেছে পিতা থেকে পুত্রের মধ্যে। অত্যুন্নত এক সভ্যতার ছায়াছবি উন্মোচিত হয়ে গেল আমাদের অবাক চাহনির সামনে। উড়ন্ত পাখির চোখ দিয়ে দেখার মতো সেই দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে দেখলাম সুবিস্তীর্ণ সুমহান এক জনপদ, সেখানে জলসিঞ্চনের নদী-নালা-পরিখা অতিশয় সুপরিকল্পিত, কৃষিকার্যের মধ্যে বিদ্যমান বিলক্ষণ বুদ্ধিমত্তা, দেখলাম জল সিঞ্চনের অভিনব পরিকল্পনা, বিশাল বিশাল শস্যভান্ডার, তরঙ্গায়িত উদ্যানের পর উদ্যান, লাভলি নদী, বনময় পর্বত, কাকচক্ষু জলের হ্রদ, মাঝে মাঝে ছবির মতো পাহাড়। এ সবেরই মাঝে মাঝে রয়েছে অলঙ্কার প্রতিম গ্রাম, গোলাবাড়ি, বিউটিফুল বাসভবন, তারপরেই আমাদের নজর টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাজধানীর ওপর, সমুদ্রের ধারের সে এক চমকপ্রদ জাঁকজমকময় মহানগর, বন্দরে গিজগিজ করছে রকমারি জলপোত, বাণিজ্য জাহাজগুলো ভরতি হয়ে রয়েছে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীতে, পোতাশ্রয় সুরক্ষিত রাখা হয়েছে সুউচ্চ প্রাচীর আর প্রশস্ত বৃত্তাকার পরিখা দিয়ে, সবই নির্মিত হয়েছে সুবৃহৎ মাপকাঠিতে। বাড়িগুলো চলে গেছে সাগর থেকে দেশের ভেতর দিকে অনেক মাইল পর্যন্ত, আর শহরের ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে খাঁজ কাটা পাঁচিল আর বুরুজওলা একটা কেল্লাপ্রাসাদ— এমনই সুবিশাল আর হুকুমদার যে মনে হয় যেন স্বপ্ন দিয়ে গড়া। তারপর আমাদের দেখানো হল সেই সব মানুষদের মুখচ্ছবি যারা একসময়ে জীবন কাটিয়ে গেছে সেই স্বর্ণযুগে, বিজ্ঞ, প্রবীণ, শ্রদ্ধেয় পুরুষ, দুর্মদ যোদ্ধা, ঋষিপ্রতিম পুরোহিত, রূপবতী সম্রান্ত আকৃতি রমণী, ফুটফুটে বাচ্চাকাচ্চা, মনুষ্যজাতির চরম পূর্ণতা।
তারপরেই এসে গেল অন্যান্য সব ছবি। দেখলাম যুদ্ধ, বিরামবিহীন সংগ্রাম, স্থলে লড়াই, জলে লড়াই। দেখলাম অসহায় উলঙ্গ মানুষদের পদদলিত অবস্থা, দেখলাম তাদের ভূলুণ্ঠিত শরীরগুলোর ওপর দিয়ে বেগে চালনা করা হচ্ছে বিশাল বিশাল রথ-শকট, অথবা ঘোড়ার পায়ের লাথিতে ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে মাটির সহায়হীন মানুষরা। দেখলাম, যুদ্ধবিজেতাদের সামনে স্তূপীকৃত সম্পদ, এত ঐশ্বর্য লুঠ করা সত্ত্বেও পশুত্ব আর নিষ্ঠুরতা প্রকট হয়ে রয়েছে তাদের মুখাবয়বে। দেখলাম, তাদের অবক্ষয় আর অবনতি, এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে স্থূল বস্তুর প্রতি বেশি আদর, সূক্ষ্মতার বিনাশ। ধাপে ধাপে অবনতি, অপসংস্কৃতির অগ্রগতি। বিবেকের বিনাশ, আর উজ্জ্বল উৎকট আমোদ প্রমোদের উল্লাস। এককালে যারা ক্রীড়া প্রতিযোগিতাকে উচ্চ স্থানে নিয়ে গেছিল, সেখান থেকে আর এক প্রজন্ম সেই সুস্থ খেলার জগতকে নিয়ে এল প্রকট পশুত্বের পর্যায়ে। পারিবারিক জীবনেও নেই আর আগেকার সেই সুস্থ, শান্ত, অনাবিল সরল ধারায় জীবন যাপনের অভ্যাস, মনের ঊর্ধ্বমুখী উচ্চচিন্তার অবকাশ— সে জায়গায় এসেছে নীচ মনোবৃত্তির প্রবণতা— এক নীচতা থেকে আর এক নীচতার দিকে ধেয়ে যাওয়া, ঐহিক আনন্দের আশার পারত্রিক মনোচর্চা বিসর্জন, কদর্য উল্লাসের নিবৃত্তি ঘটছে না কিছুতেই, না পাওয়া বিকট আমোদের আশায় ধেয়ে যাচ্ছে অধিকতর কদর্য আমোদপ্রমোদের দিকে। একদিকে উত্থান ঘটেছে অতি ধনী এক সম্প্রদায়ের যারা শুধুই ইন্দ্রিয় সুখ লালসায় উন্মত্ত, আর একদিকে ভূলুণ্ঠিত মাটির কাছের এক দল মানুষ এই কুবের সম্প্রদায়ের সেবায় আহুতি দিয়ে চলেছে নিজেদের জীবন।
আর ঠিক এই সময়ে এল প্রগতির নতুন এক তরঙ্গ। সমাজ সংস্কারকরা কৃষ্টি আর সংস্কৃতির নবীন তরঙ্গ আনতে প্রয়াস পেল সমাজের সত্য অবক্ষয়ের মধ্যে। নর্দমার পথে প্রবহমান সমাজকে তুলে নিয়ে যেতে চাইল সুদূর অতীতের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের আদতে গড়া সমাজধারায়। পর্দার বুকে চোখের সামনে দেখতে পেলাম সেই সব মহীয়ান পুরুষদের, গম্ভীরবদন আত্যন্তিক প্রয়াসী আগ্রহী মহাপুরুষদের, দুর্নীতির কবলস্থ মানুষদের অপসংস্কৃতির পরিণাম বুঝিয়ে দিচ্ছে যুক্তি দিয়ে, কাকুতি মিনতি করে সুপথে ফিরিয়ে আনতে চাইছে, কিন্তু অপমানিত হচ্ছে, টিটকিরি শুনে যাচ্ছে। বিশেষ করে অপকর্মের পুরোধা হিসেবে দেখলাম ‘বাল’ পুরুতদের, যারা বাহ্য উৎসব আর উৎকট প্রদর্শনীর মারফত উপাসনা পদ্ধতির মোড় ফিরিয়ে দিয়েছে নিঃস্বার্থ আধ্যাত্মিক প্রগতি থেকে জাঁকজমক আর লোক দেখানো প্রদর্শনী ভিত্তিক পূজা পদ্ধতির দিকে। সংস্কৃতির বাহক যারা, সংস্কৃতির ধারক যারা— এই সব ভণ্ড পুরুতরা হেয় করে যাচ্ছে তাদেরকে। কিন্তু পশুশক্তি আর টিটকিরি বিদ্রুপ দিয়ে কৃষ্টিমান মানুষদের দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। একনাগাড়ে তারা চেষ্টা চালিয়ে সাধারণ মানুষের আধ্যাত্মিক আর সামাজিক প্রগতির উন্নয়নে বদ্ধপরিকর, পরিণাম হচ্ছে অতি ভয়ংকর। হুঁশিয়ারি আর আক্রমণ আসছে নানাদিক থেকে। এতদ্সত্ত্বেও প্রগতির ধারক আর বাহকরা সতর্ক করে দিচ্ছে অধোগামী মানুষদের এই বলে যে, শেষের সেদিন ভয়ংকরতম হতে চলেছে— যে ভয়ানক পরিণতি থেকে পরিত্রাণ নেই কারোরই। অতি ভয়ংকর শেষদিনের সেই ছবির পূর্বাভাস তারা পাচ্ছে তাদের অতীন্দ্রিয় অতি অনুভূতি দিয়ে। শ্রোতাদের কেউ কেউ ভীত হয়ে নিবৃত্ত হতে চাইছে নিম্নগামী জীবনধারা থেকে, অন্যান্যরা হেসেই উড়িয়ে দিয়ে অধিকতর পাপ কাজে নিমগ্ন থাকছে। মহাপ্রলয়ের পথকে প্রশস্ততর করে তুলছে। গোটা দেশটার আসন্ন দুর্ভাগ্যকে দ্রুততর করে যাচ্ছে।
তারপরেই দেখলাম অদ্ভুত একটা দৃশ্য। এগিয়ে এলেন এক সমাজ সংস্কারক। রীতিমতো শক্তিমান, মনের আর শরীরের দিক দিয়ে। নেতৃত্ব দিলেন প্রগতিবাদীদের। তাঁর ছিল ঐশ্বর্য, প্রভাব প্রতিপত্তি আর ক্ষমতা— পরে দেখা গেছিল সেই শক্তি পুরোপুরি পার্থিব শক্তি নয়। তাঁকে দেখতে পেলাম যেন ধ্যান নিমগ্ন সম্মোহিত অবস্থায় উচ্চতর বিদেহীদের সঙ্গে কথোপকথন করে যাচ্ছেন, যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছেন। দেশব্যাপী সমস্ত বিজ্ঞানের অভ্যুত্থান ঘটেছিল এঁরই দৌলতে— সে বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে থাকা বিজ্ঞান, সমসাময়িক বৈজ্ঞানিকদের নাগালের অনেক বাইরের বিজ্ঞান, এঁরই প্রচেষ্টায় নির্মিত হল একটা মহাপোত আসন্ন দুর্দিনের সময়ে রক্ষা পাওয়ার নিমিত্তে। দেখতে পেলাম, অগণিত মানুষ সচেষ্ট রয়েছে সেই মহাপোত নির্মাণের মহাকর্মে। দেখলাম, গাঁথা হচ্ছে অনেক উঁচু উঁচু দেওয়াল— মূর্খ অবিশ্বাসীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখছে আর ব্যঙ্গবিদ্রুপের মন্তব্য করে যাচ্ছে— যেন আহাম্মকরা বৃথাই খেটে মরছে এই মহাযজ্ঞে। দেখতে পেলাম, বেশ কিছু ব্যক্তি সেই মহামানবকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চাইছে, মহাপ্রলয়ের ভয়ে এত কাণ্ড না করে নিরাপদ কোনও জায়গায় চম্পট দিলেই তো হয়। অযথা এত এলাহি কাণ্ডকারখানার প্রয়োজনটা কী! তাঁর জবাব, যতদূর অনুধাবন করতে পারলাম তা এই: শেষ মুহূর্তে বেশ কিছু মানুষকে রক্ষা করা প্রয়োজন। এ ছাড়াও, নতুন দেবালয় যাতে সুরক্ষিত থাকে, সে ব্যাপারটাও তো দেখতে হচ্ছে তাঁকে। সেই মন্দিরে থেকেই তো পরিত্রাণ পেয়ে যাবে তাঁর নির্বাচিত অনুগামী কিছু মানুষ। ইতিমধ্যে সেইসব ভক্তদের তিনি জড়ো করে রেখে দিলেন নতুন গড়া দেবমন্দিরের মধ্যে— কেননা, শেষের প্রহর ঠিক কোন সময়ে, তা তাঁর নিজেরই জানা ছিল না। নিশ্চিতভাবে কিন্তু জানতেন মরলোকের মানুষদের আওতার বাইরের এক মহাশক্তি এই মহাপ্রলয় ঘটিয়ে দেবে অচিরে। তাই মহাপোত নির্মাণ যখন সমাপ্ত হয়েছিল, জল নিরোধক কপাট তৈরি যখন শেষ হয়েছিল, যাচাই-পর্ব সমাপ্ত হয়েছিল, তখন তিনি তার আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব, চাকর বাকর আর অনুগামীদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই মহাপোতের অভ্যন্তরে।
শেষের সেদিন এল তারপর ভয়ানক ঘনঘটার মধ্যে দিয়ে। শিহরিত হয়েছিলাম সেই দৃশ্য পর্দার ছবির মধ্যে দর্শন করেও। ঈশ্বর জানেন আদতে তা কী। প্রথমে দেখলাম জিলজিলে পাতলা একটা পর্বত অবিশ্বাস্য উচ্চতায় উঠে গেল প্রশান্ত সমুদ্র থেকে বেরিয়ে এসে। তারপর দেখলাম ভয়ানক গতিবেগে একটা আকাশচুম্বী চকচকে পর্বত ধেয়ে যাচ্ছে জনপদের পর জনপদের ওপর দিয়ে, মাইলের পর মাইল, ফেনার মুকুট মাথায় দিয়ে, ক্রমশ বর্ধমান গতিবেগ নিয়ে। তুষারধবল সেই পর্বতচূড়ার সন্নিকটে এসে তলিয়ে গেল দু-খানা কাঠের জাহাজ। তারপরেই দেখলাম, সেই পর্বত উপকূলে ধাক্কা মেরে অগ্রসর হয়ে চলেছে মাইলের পর মাইল ধরে অগণিত জনপদের ওপর দিয়ে। টর্নেডোর সামনে যেমন তাসের বাড়ির মতো উড়ে যায় বাড়ি-ঘরদোর, ঠিক তেমনি অবস্থা হচ্ছে লোকালয়গুলোর। আমরা দেখলাম, বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আতঙ্ক প্রকট চোখমুখ নিয়ে বহু মানুষ বিহ্বলভাবে দেখে যাচ্ছে আগুয়ান প্রলয়ঙ্কর আতঙ্ককে। এরাই সেই সব মানুষ যারা সতর্কবাণী উপেক্ষা করে বিদ্রুপের হাসি হেসে মহামানবকে এক সময়ে বিস্তর হেনস্থা করেছিল। এখন তারা করজোড়ে ব্যাকুল মুখে ভয়ার্ত চোখে আবেদন জানাচ্ছে আগুয়ান ধ্বংস দূতকে। মহাপোতের কাছে পৌঁছোবার সময় আর নেই, সে জাহাজ ভাসছে শহর থেকে অনেক তফাতে, এতদ্সত্ত্বেও হাজারে হাজারে মানুষ ধেয়ে যাচ্ছে বন্দর-নগরে। পেল্লায় কেল্লা প্রাসাদ গিজগিজ করছে তাদের ভিড়ে। আর তারপরেই আচমকা শুরু হল সমস্ত কেল্লাপ্রাসাদের জলে তলিয়ে যাওয়া। মাটির মধ্যেকার অলিগলি দিয়ে জল ঢুকে গেছে কেল্লা-প্রাসাদের মস্ত চুল্লি যেখানে— সেইখানে, ক্ষণপরেই প্রবল এক বিস্ফোরণে রেণু রেণু হয়ে গেল গোটা প্রাসাদের ভিত। প্রাসাদ ডুবছে, সেই সঙ্গে ডুবছে সমস্ত মানুষ। মাটির তলায় তলায় জল ঢুকে যেতেই কেন্দ্রীয় চুল্লি ফেটে উড়ে গেল, ডুবে যেতে লাগল গোটা শহরটা। ভয়ানক সেই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে উঠেছিলাম আমরা তিনজনে, আমাদের সঙ্গে সঙ্গে প্রেক্ষাগৃহের প্রত্যেকে। মস্ত বন্দরটা ভেঙে দু-টুকরো হয়ে তলিয়ে গেল নিমেষের মধ্যে। যেন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া হল অত বড় জাহাজঘাট। মস্ত উঁচু আলোকস্তম্ভ দু-টুকরো হয়ে ছিটকে গেল দু-দিকে। ডুবছে শহর, ডুবছে— ডুবছে জলতলে— যা দেখে শুধু আমরা ক-জনেই চেঁচিয়ে উঠিনি— চেঁচিয়েছিল প্রেক্ষাগৃহের প্রত্যেকে। ভয়ানক সেই দৃশ্য স্বচক্ষে দেখলেও যে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। সারি সারি ভবনগুলোর ছাদ কিছুক্ষণের জন্যে জেগেছিল জল থেকে ঠেলে ওঠা দ্বীপসমূহের মতো— তারপর সে সব বস্তু জলতলে অন্তর্হিত হল অবশেষে। সুবিশাল সেই কেল্লা-প্রাসাদের শীর্ষদেশ কিছুক্ষণের জন্যে হেলে পড়ে জলপৃষ্ঠ থেকে ডুবন্ত দ্বীপের মতো মাথা উঁচিয়ে ছিল বটে, ক্ষণপরেই তাকেও অন্তর্হিত হতে হল জলের মধ্যে— দেখা গেল শুধু ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা অগণিত মানুষের ব্যাকুলভাবে শেষ হাতনাড়া। শেষ হয়ে গেল লোমহর্ষক নাটক, গোটা মহাদেশটার ওপর উন্মত্ত নৃত্য করে গেল থই থই সমুদ্র— যে সমুদ্রে প্রাণের সাড়া নেই কোথাও— ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কেবল অগণিত আসবাবপত্র সমেত অবিশ্বাসী মহাপাপী মানুষদের আর অসহায় জীবজন্তুদের। আস্তে আস্তে সে সবেরও শেষ হয়ে যাওয়া দেখলাম, অবশেষে রইল শুধু দিগন্তব্যাপী থইথই মহাসমুদ্র— এত কিছু গ্রাস করেও যে পরম প্রশান্ত। ঈশ্বরের দণ্ড এমনই অকরুণ। পরিত্রাণ নেই অবিশ্বাসী কোনও মহাপাপীর।
সমাপ্ত হল সুদূর অতীতের কাহিনি। সবই দেখা হয়ে গেল, প্রশ্নের জন্যে অবিশিষ্ট রইল না কিছুই। বাকিটুকু কল্পনা করে নিজেদের মগজ খাটিয়ে কল্পনাকে কাজে লাগিয়ে, বুঝে নিলাম কীভাবে একটু একটু করে জলতলে নিমজ্জিত হয়েছে মস্ত মহাদেশ আগ্নেয় উদ্গিরণের তালে তালে জলতলে, যাদের শীর্ষদেশ আজও রয়েছে উচ্চাবস্থায়। মনের চোখ দিয়ে দেখে নিলাম সুবিস্তৃত সেই মহাদেশ পতিত হয়ে রয়েছে যে মহাসাগরের তলদেশে, তার নাম আটলান্টিক মহাসমুদ্র। দেখতে পেলাম চুরমার হয়ে যাওয়া শহরের একপ্রান্তে আজও টিকে আছে মহামানব নির্মিত সেই উদ্বাস্তু কলোনি যা তিনি গড়ে দিয়েছিলেন দূরদৃষ্টির দৌলতে— যাঁর বিজ্ঞান আজও বহাল তবিয়তে রেখে দিয়েছে মুষ্টিমেয় ভক্তবৃন্দের বংশধরবৃন্দকে। সংখ্যায় তখন তারা ছিল পঞ্চাশ-ষাট জন— পুরুষানুক্রমে আজ তারাই নিমজ্জিত আটলান্টিস মহাদেশের বাসিন্দা। সারবন্দি এইসব ছবি থেকে জানা গেল পৃথিবীর কোনও গ্রন্থাগারে বসে মস্তিষ্ক চর্চা করলেও তা জানা যেত না। নিয়তির মার এমনই অমোঘ। একদিন হয়তো নিয়তির নির্দেশেই আর এক ভূগর্ভ উত্থানের ফলে নিমজ্জিত এই মহাদেশ জলতল থেকে উঠে আসবে জলপৃষ্ঠে, সূচিত হবে আর এক মহা-ইতিহাস।
একটা বিষয়ই কেবল নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি— বিয়োগান্তক এই পরিণতি ঘটতে লেগেছিল কত সময়। মোটামুটি একটা হিসেব বের করার পদ্ধতি মাথায় এনেছিলেন ডক্টর ম্যারাকট। বিশাল সৌধ সংলগ্ন বহু লাগোয়া মস্ত অট্টালিক্কার একটার নিচে আছে সুবিশাল একটা পাতাল প্রকোষ্ঠ— নিঃসন্দেহে দলপতিদের কবরখানা। মিশর আর ইউকাটান-এর মতো এখানেও মমিকরণ পদ্ধতি চলে এসেছে যুগ যুগ ধরে, মাটির তলার এই টানা লম্বা প্রকোষ্ঠের দেওয়ালের খাঁজে খাঁজে গর্ত কেটে রক্ষিত ছিল সারবন্দি সীমাহীন মমিদেহ— অতীতের বুকচাপা দুঃস্বপ্নের স্মৃতি স্বরূপ। ম্যান্ডা সগর্বে দেখিয়েছিল দেওয়াল খাঁজের সব শেষ কোটরটা, বুক ফুলিয়ে জানিয়ে ছিল— এ জায়গা বিশেষভাবে রাখা হয়েছে তারই মরদেহের শেষকৃত্যের জন্যে।
পেশাদারি ঢঙে বলেছিলেন ম্যারাকট, ‘ইউরোপীয় নৃপতিদের গড় আয়ু হিসেব করলে দেখা যাবে, তাঁরা এক শতাব্দীতে পাঁচজনের বেশি। একই হিসেব প্রয়োগ করা যেতে পারে এখানেও। বৈজ্ঞানিক সঠিকতা না পেতে পারি, তবে একটা আন্দাজি হিসেব পেতে পারি। মমিদের সংখ্যা আমি শুনেছি— চারশো জন।’
‘সময়ের হিসেবে তাহলে আট হাজার বছর?’
‘এগজ্যাক্টলি। তাতেই প্লেটোর আন্দাজি হিসেব কিছুটা মিলে যাচ্ছে। মহাপ্রলয়ের সূচনা ঘটেছিল মিশরীয় নথি লিখনের আগে, সে সময়টা আজ থেকে ছয় আর সাত হাজার বছর আগে। তবে কি, এরকম বিস্তীর্ণ সভ্যতা গড়ে তুলতে সময় লেগেছিল নিশ্চয় বহু হাজার বছর। এই হিসেবের ভিত্তিতেই আমার দাবি পেশ করছি আপনাদের সামনে— ইতিহাস রচয়িতারা কেউ যা করতে পারেননি, আমি তা করতে পেরেছি— ইতিহাস শুরুর সঠিক সময় নির্ধারণ করতে পেরেছি।’