অগ্নিপুরুষ ২

মাসুদ রানা ১৩৬ – অগ্নিপুরুষ ২ – কাজী আনোয়ার হোসেন – সেবা প্রকাশনী

প্রথম প্রকাশ : জুন ১৯৮৬

০১.

পায়ের কাছে স্যুটকেস, ফেরি বোটের টপ ডেকে দাঁড়িয়ে আছে মাসুদ রানা। নামের সাথে চেহারার কোন মিল নেই, বোটটা দেখতে বরং অনেকটা কাছিমের মত–মাল্টা আর গোজোর মাঝখানে সাগর মাত্র দুমাইল, শুধু এই পানি পথেই লোকজন আর যানবাহন নিয়ে চলাচল করে ডলফিন।

খুদে দ্বীপ কোমিনোকে পাশ কাটিয়ে এল বোট, পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রাচীন ওয়াচটাওয়ার। পানি এখানে স্বচ্ছ নীল, তলার বালি পরিষ্কার দেখা যায়– লেগুন। বেশ কবছর আগে, অথচ রানার মনে হল এই তো সেদিন রেমারিক আর জেসমিনের সঙ্গে এখানে সাঁতার কেটেছে ও।

সামনে, গোজোর দিকে তাকাল রানা। সাগর থেকে হঠাৎ প্রায় খাড়াভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সবুজ দ্বীপটা। পাহাড়গুলোর মাথায় মাথায় মুকুটের মত সাজানো গ্রাম। পাহাড়ের গা থেকে মাটি কেটে বিশাল আকারের ধাপ তৈরি করা হয়েছে, প্রতিটি ধাপ এক একটা খেত, নিচের খেতটা সাগরের কিনারা ছুঁয়েছে।

প্রথমবার গোজোয় এসে দ্বীপটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল রানা। গোজোর। সমাজে ছোট-বড় ভেদ নেই, সবাই সমান। ভূমিহীন কষক বা একেবারে গরীব জেলে লোকটাও জানে তার অধিকার আর স্বাধীনতা গোজোর সবচেয়ে ধনী লোকটার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। সারাদিন খেটে যা সে রোজগার করে তা দিয়ে সংসারের ভরণ-পোষণ ছাড়াও হাতে কিছু থাকে, ইচ্ছে করলে অনেকের মত। সে-ও রুচিতাস-এ বসে সন্ধে থেকে মাঝরাত পর্যন্ত আকণ্ঠ মদ খেতে পারে। অন্যদের চেয়ে নিজেকে কারও বড় মনে করার প্রবণতা থাকলে গাজোকে তার। এড়িয়ে চলা উচিত। গোজোর লোকেরা হাসিখুশি আর ফুর্তিবাজ, তোমাকে ওদের পছন্দ হলেই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবে।

ফেরি জেটিতে ভিড়তেই পেঁয়ো লোকগুলো শোরগোল তুলে নামতে শুরু করল।

পাহাড়ের খানিকটা ওপরে উঠে দ্বীপের একমাত্র বার রুচিতাস-এর সামনে এসে দাঁড়াল রানা। মান্ধাতা আমলের বিল্ডিং, সাগরের দিকে মুখ করা একটা স্কুল বারান্দা আছে। রেমারিক বলে দিয়েছে, জেসমিনের বাবাকে ফোন করতে হবে এখান থেকে। বারের ভেতরটা ঠাণ্ডা, সিলিং থেকে ঝাড়বাতি ঝুলছে, দেয়ালে আঁকা পাহাড় আর নদীর ছবি। দরজার কাছে সুটকেস রেখে কাউন্টারের দিকে এগোল রানা, মগভর্তি বিয়ার- দেখে অনুভব করল গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। গোলগাল চেহারার বারটেণ্ডার জিজ্ঞেস করল, এক পাইন্ট, নাকি অর্ধেক?

এক পাইন্ট, ধন্যবাদ। উঁচু টুলে বসে কাউন্টারের ওপর এক পাউণ্ডের একটা নোট রাখল রানা। খুব ঠাণ্ডা বিয়ার, প্রাণ জুড়িয়ে গেল। বাকি টাকা কাউন্টারে রাখল বারটেণ্ডার, রানা জিজ্ঞেস করল, পাজেরো তাজার ফোন নাম্বার দরকার আমার, দিতে পারবে?

বারটেণ্ডার শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল।

পাজেরো তাজা, আবার বলল রানা। নাদুরের কাছে তার একটা ফার্ম আছে।

কাঁধ ঝাঁকাল বারটেণ্ডার। তাজা একটা কমন নাম, আর গোজোয় তো অনেকেরই ফার্ম আছে, বলে অন্য এক লোককে বিয়ার দেয়ার জন্যে সরে গেল

বিরক্ত না হয়ে লোকটার আচরণ মনে মনে অনুমোদন করল রানা। গোজো ছোট্ট একটা দ্বীপ, লোকটা পাজেরো তাজাকে না চিনেই পারে না। কিন্তু এই দ্বীপবাসীদের বৈশিষ্ট্যই হল নিজেদের সমস্ত ব্যাপার বাইরের লোকদের কাছে গোপন করে রাখা। অচেনা আগন্তুকের পরিচয় আর উদ্দেশ্য না জেনে মুখ খুলবে না।

 খানিক পর আরও এক পাইন্ট বিয়ার চাইল রানা। বারটেণ্ডারকে বলল, ভিটেলা রেমারিক পাঠিয়েছে আমাকে। পাজেরো তাজার বাড়িতে কিছুদিন থাকব। বলে এসেছি।

বারটেণ্ডারের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আচ্ছা, তুমি তাহলে ওই পাজেরো তাজার কথা বলছ! কৃষক–নাদুরের কাছে? মাথা ঝাঁকাল রানা। কয়েক সেকেণ্ড। ওকে খুঁটিয়ে দেখার পর হাসল লোকটা, হাত বাড়িয়ে দিল। আমি সাকো। টেবিলে বসা এক যুবককে ইঙ্গিতে দেখাল সে। আমার ভাই, টাগলিয়া। তারপর দেখাল রোগা-পাতলা চেহারার এক লোককে, মুখের নিচের অংশ ঢাকা পড়ে আছে। লম্বা-চওড়া কালো গোঁফে। টাফি। আরও দুজন যুবককে দেখাল সে, বলল, মিলানো আর আলফানসো–ওরাই ফেরি চালায়।

মিলানো আর আলফানসোকে চিনতে পারল রানা, ফেরিতে দেখেছে। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বারটেণ্ডার বুঝিয়ে দিল, গোজোয় এখন আর ও আগন্তুক নয়। ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করল সাকো, মাল্টিজি ভাষায় দুচারটে কথা, বলল। রিসিভার রেখে দিয়ে রানার দিকে ফিরল সে। নিড়ো তোমাকে নিতে আসছে।

রানার সামনে মগভর্তি বিয়ার রাখল টাগলিয়া, ইঙ্গিতে গোঁফওয়ালা টাফিকে দেখাল। গোজোবাসীদের এই রীতিটা মনে পড়ে গেল রানার। একবার যদি পরস্পরকে বিয়ার কিনে খাওয়াতে শুরু করে ওরা, পালা করে সবাই সবাইকে খাওয়াতে কখনও কখনও দেড়-দুদিন লেগে যায়। পরিবেশটা শান্ত আর স্বস্তিকর লাগল, সহজেই এদের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়া যাবে। বেয়াড়া কোন প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে না ওকে, কারও সাথে ব্যক্তিত্বের সংঘর্ষ বাধবে না।

গোজোবাসীদের বন্ধুত্বে কোন কৃত্রিমতা নেই। গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে না এলে সবাই তোমাকে আপনজন বলে মেনে নেবে। শুধু তোমার যখন পালা, কিপটেমি কোরো না। আর ডাঁট দেখিয়ো না–গর্ব করা গোজোয় সবচেয়ে বড় পাপ। লম্পট, খুনী, ডাকাত বা পকেটমারকেও হয়ত সহ্য করা হবে, তারা যদি নিজের পাপ স্বীকার করে ক্ষমা চায়, কিন্তু সে যদি কোন ব্যাপারে ডাঁট দেখায়, এ দ্বীপে তার ঠাঁই হবে না।

মগ খালি করে সাকোর দিকে তাকাল রানা। এগিয়ে এসে মগটা আবার ভর্তি করে দিয়ে রানার সামনে থেকে টাকা নিল সাকো। রানা জিজ্ঞেস করল, তুমি?

গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল সাকো। এত সকালে আমার চলে না।

দশ মিনিট পর সাকোর মুখে হাসিটা ফিরে এল, রানার সামনে থেকে গুনে গুনে দশ সেন্ট তুলল সে। ক্ষতি কি! বলে নিজের জন্যে মগভর্তি করে বিয়ার ঢালল।

রানার জানা নেই, এটাই সাকোর অভ্যেস। কেউ অফার করলে প্রথমে সাকো সেটা প্রত্যাখ্যান করবে, তারপর দশ মিনিট থেকে আধ ঘন্টা পর সহাস্যে এগিয়ে এসে বলবে, ক্ষতি কি!

গোজোয় প্রত্যেকেরই একটা করে ডাকনাম আছে, বলাই বাহুল্য, সাকোকে ক্ষতি কি বলে ডাকা হয়। সেই রকম টাফিকে বলা হয় গুফো, আর সাকোর ভাই টাগলিয়াকে কিন্তু। টাগলিয়াকে কিন্তু বলার কারণ শব্দটা অতিমাত্রায় ব্যবহার করে সে। মিলানোর ডাকনাম হাজির আর আলফানসোর অক্লান্ত। মিলানো ফেরি থেকে নেমে সোজা রুচিতাস-এ চলে আসে, এসেই ঘোষণা দেয়, আমি হাজির। আর আলফানসোর বিয়ার খেতে কোন ক্লান্তি নেই, যত দেবে তত খাবে, আজ পর্যন্ত কেউ তার রেকর্ড ভাঙতে পারেনি। কিন্তু, ক্ষতি কি, গুফো, অক্লান্ত, বিদ্রোহী, হাজির–এদের মধ্যে এই মুহূর্তে বিদ্রোহী অর্থাৎ কার্লো ছাড়া আর সবাই রয়েছে বারে। এরা গোজোর ছয় ব্রত, দ্বীপটাকে আনন্দ-মেলা বানিয়ে রেখেছে।

বাইরে তোবড়ানো একটা ল্যাণ্ড-রোভার এসে থামল। লাফ দিয়ে নামল উনিশ-বিশ বছরের এক যুবক, মাথায় কোকড়া কালো চুল। বারে ঢুকে রানার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে। হাই, আমি নিডো। ওয়েলকাম, হাসান ভাই।

জেসমিনের ভাইকে অস্পষ্টভাবে চিনতে পারল রানা, প্রায় আট বছর আগে দেখেছে। করমর্দন করার সময় অনুভব করল নিডোর হাত লোহার মত শক্ত। কোন তাড়া নেই তো? হাসিমুখে রানাকে জিজ্ঞেস করল সে। মৃদু হেসে মাথা নাড়ল রানা। ইতিমধ্যে নিডোর সামনে বিয়ার রেখে গেছে সাকো। এক চুমুকে মগের অর্ধেকটা খালি করে ফেলল নিডো। সারাদিন রোদে দাঁড়িয়ে বস্তায় জলপাই ভরেছি, তেষ্টায় একেবারে ফেটে যাচ্ছে ছাতি।

ছোটখাট একটা উৎসব জমে উঠল, একের পর এক বিয়ারের ক্যান খুলল সাকো। গোজোর দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজি, আরবী আর ইটালিয়ানও কমবেশি জানে সবাই। ওদের কথাবার্তা বুঝতে বা হাসি-তামাশা উপভোগ করতে রানার কোন অসুবিধে হল না। একটু পর জেলেরা বারে ঢুকতে শুরু করল, মাথার ওপর সূর্য নিয়ে সারাদিন ভোলা লোটে কাজ করে সবাই খুব তৃষ্ণার্ত। মিলানো আর আলফানসো উঠল, আজকের মত শেষবার ফেরি নিয়ে মাল্টা থেকে ঘুরে আসলো ওরা। বেশিরভাগ লোক লাগার বিয়ার থেকে কড়া মদের দিকে ঝুঁকছে, এই সময় হাতঘড়ির দিকে তাকাল নিডো কি সর্বনাশ, এরই মধ্যে ছটা! রানার দিকে তাকাল সে। চল, চল–দেরি করায় মা আজ আমার কান ছিঁড়ে নেবে!

ল্যাণ্ড-রোভার নিয়ে পাহাড়ে চড়ল ওরা, খুদে গ্রাম কালার ভেতর দিয়ে উল্টো দিকে চলে এল, তারপর নিচে নেমে এসে বাঁক নিয়ে নাদুরের পথ ধরল।

ঘেরা উঠনের মাঝখানে পাথরের তৈরি ফার্মহাউস। বাড়ির একটা অংশ নতুন। বাইরে থেকে আলাদা সিঁড়ি উঠে গেছে সেখানে। কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো মোটাসোটা, তেল চকচকে এক প্রৌঢ়া। একই মানুষ, কিন্তু অন্য চেহারা, রানাকে চিনতে না পারলেও ভূত দেখার মত চমকে উঠল না, শুধু ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল রানা। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রৌঢ়া অনোরিয়ার পেশীতে ঢিল পড়ল, উজ্জ্বল হল তার চোখ জোড়া, সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল হাসি। এগিয়ে এসে রানাকে আলিঙ্গন করলো সে, চুমো খেল গালে। ওয়েলকাম, রানা। অনেকদিন পর এলে। ছেলের দিকে কটমট করে তাকাল সে। এতক্ষণ রানার পিছনে গা ঢাকা দিয়ে ছিল নিডো।

মাসুদ ভাইয়ের তেষ্টা পেয়েছিল, মা, আমি কি করব! রানার উদ্দেশে এক চোখ টিপল নিডো।

মাসুদের সুটকেস দোতলায় রেখে আয়, হুকুম করল অনোরিয়া। চপ্পল জোড়া নিয়ে আসবি। রানার একটা হাত ধরে কিচেনে ঢুকল সে।

বড়সড় একটা ঘর। রানার মনে পড়ল, খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে পারিবারিক আড্ডা সব এখানেই চলে। ডাইনিংরূম আর লাউঞ্জ ব্যবহার করা হয় শুধু কোন মেহমান এলে।

জুতো খুলে বস, বাবা, অনোরিয়া বলল। রানার সামনে পট ভর্তি কফি আর কাপ-পিরিচ রাখল সে। তিনটে স্টোভে রান্না হচ্ছে, মাংস আর মশলার গন্ধে ভারী হয়ে আছে বাতাস। নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠল অনোরিয়া, কিন্তু মুখ বন্ধ নেই।

রেমারিক কেমন আছে? রানা কি জানে, স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে ভায়োলার? ডাইভোর্সের জন্যে আবেদন করা হয়েছে, কিন্তু সেটা মঞ্জুর হতে কত বছর লাগবে কেউ বলতে পারে না। ইটালিতে বিবাহবিচ্ছেদ অত্যন্ত জটিল আর ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। ছুটি নিয়ে বাড়ি আসবে ভায়োলা, টেলিফোন করে জানিয়েছে তার নাকি খুব শখ মাসুদ ভাইকে চিংড়ি মাছের কোপ্তা বেঁধে খাওয়াবে।

পরিবেশটা ঘরোয়া, অনোরিয়া রানার ব্যক্তিগত কোন প্রসঙ্গ না ভোলায় ওর পেশীতে ঢিল পড়ল। খানিক পর খেত থেকে ফিরল পাজেরা তাজা। হাসি খুশি একহারার শক্ত-সমর্থ পুরুষ, কথা বলে কম। রানাকে দেখে মাথা আঁকাল সে, জিজ্ঞেস করল, সব ঠিক?

মাল্টায় সবার মুখে এই শব্দ দুটো শুনতে পাওয়া যাবে। এ শুধু কুশল জানতে চাওয়া নয়-দরদভরা সহানুভূতি প্রকাশের সাথে সাথে সাহায্য করার প্রস্তাবও। বিদায়, শুভেচ্ছা আর অভ্যর্থনা জানাবার জন্যেও শব্দ দুটো ব্যবহার করা হয়। সব এক, জবাব দিল রানা। ওর সামনে একটা চেয়ারে বসে অনোরিয়ার হাত থেকে এক কাপ কফি নিল তাজা। হাতে বানানো সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে টান দিল।

সবাই ওকে এমনভাবে অভ্যর্থনা জানাল যেন আট বছর নয়, শুধু এক রাত বাইরে কাটিয়ে ঘরে ফিরে এসেছে।

সামনে লম্বা পাচিলের মত দাঁড়িয়ে আছে নিচু পাহাড়, একটানা দৌড়ে এসে দম নেয়ার জন্যে মাথায় উঠে থামল রানা। এখানে দাঁড়ালে অনেক দূর পর্যন্ত উপসাগর দেখতে পাওয়া যায়। ঘামে ভিজে ওর ট্র্যাক স্যুটের রঙ গাঢ় হয়ে গেছে। সুর্য তখনও দিগন্তরেখার কাছাকাছি, উপসাগরে পাহাড়ের ছায়া। নিচু পাচিলের ওপর বসে হাঁপাতে লাগল রানা। সারা শরীরে ব্যথা, প্রতিটি পেশী আড়ষ্ট। বাড়াবাড়ি করা ঠিক হবে না, জানে ও। একটা শিরায় টান পড়লে কয়েক দিন বা কয়েক হপ্তা পিছিয়ে যাবে ওর প্রোগ্রাম।

ভোর হবার অনেক আগে ঘুম থেকে উঠেছে রানা। টেরেসে বেরিয়ে এসে এক ঘন্টা ব্যায়াম করেছে। প্রথম দিকে শুধু হালকা ব্যায়ামগুলো, ইনস্ট্রমেন্ট ব্যবহার করবে আরও পরে। এরপর ঠাণ্ডা পানিতে শাওয়ার সেরে নিচে নেমে আসে। এত সকালে কিচেনে অনোরিয়াকে দেখে অবাক হয় ও।

ওর প্রশ্ন শুনে মৃদু, ম্লান হেসে প্রৌঢ়া বলল, পাপ করার বেলায় সবাই আছে, কিন্তু প্রার্থনার বেলায় কেউ নেই, তাই আমাকেই যেতে হয় চার্চে।

মিটি মিটি হেসে রানা বলল, তাহলে আমার জন্যেও একটু প্রার্থনা কর, মা।

সে কি তোমাকে বলে দিতে হবে, বাবা! রানাকে মগভর্তি কালো কফি বানিয়ে দিল অনোরিয়া। কাপে চুমুক দিচ্ছে রানা, এই সময় কাজে যাবার কাপড় পরে কিচেনে ঢুকল তাজা আর নিডো।

রানা গোজোয় পৌঁছবার আগে শ্বশুরের সঙ্গে বারকয়েক টেলিফোনে কথা বলছে রেমারিক। রানার শারীরিক অবস্থা এবং মিলানে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা সম্পর্কে সব কথাই তাকে জানিয়েছে সে। তবে রানার ভবিষ্যৎ প্ল্যান সম্পর্কে কিছু বলেনি।

জেসমিনকে বিয়ে করার পর থেকে প্রতি মাসে শ্বশুরবাড়িতে কিছু কিছু টাকা পাঠায় রেমারিক, জেসমিন মারা যাবার পরও টাকা পাঠানো বন্ধ করেনি। প্রথম দিকে বাড়ির সবাই প্রতিবাদ জানিয়েছিল, কারণ তাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ নয়। কিন্তু রেমারিককে থামানো যায়নি, এখানে টাকা পাঠালে তার নাকি ইনকাম ট্যাক্সের বোঝা কমে। সেই টাকা দিয়েই বাড়ির সঙ্গে একটা দোতলা তৈরি করা হয়েছে, রেমারিক বেড়াতে এলে আরাম করে নিরিবিলিতে থাকতে পারবে। সেই খুদে দোতলার সবটুকু ছেড়ে দেয়া হয়েছে রানাকে।

কাল রাতে ডিনারে বসে কথা হয়েছে, রানার দৈনন্দিন প্রোগ্রাম সম্পর্কে জানে তাজা। রানাকে সে বলল, দৌড় আর সাঁতার শেষ করে পাহাড়ে চলে এস।

রাখ তোমার পাহাড়, স্বামীকে বাধা দিয়ে বলল অনোরিয়া। রানার দিকে ফিরল সে, বলল, সাঁতার শেষ করে সোজা বাড়ি ফিরে আসবে তুমি। নাস্তা করে বিশ্রাম নেবে, তারপর যেখানে খুশি যেয়ো।

, নতুন একটা পাহাড় কিনেছে ওরা, পাথর কেটে মাটি বের করা হয়েছে। প্রথমে পাহাড়ের দুপাশে পাথরের পাঁচিল দেয়া হবে, তারপর মাটি কেটে তৈরি করা হবে বিশাল সব ধাপ, সেই ধাপে চাষাবাদ হবে।

ওরা তিনজন একসাথে বাইরে বেরুল। সাগরের দিকে একটা পাহাড় দেখিয়ে তাজা বলল, সাঁতার কাটতে হলে ওদিকে যেয়ো। ছোট্ট একটা ইনলেট আছে ওখানে, পাহাড় থেকে সরাসরি নামা যায়। পানি খুব গভীর, আর একেবারে নির্জনবোটে করে, আর নাহয় আমার জমির ওপর দিয়ে যাওয়া যায়।

দম ফিরে পেতেই প্রচণ্ড খিদে অনুভব করল রানা। কিন্তু বাড়ি ফেরার আগে সাঁতার কাটতে হবে। পাঁচিল থেকে নেমে ঘোড়ার মত দুলকি চালে ছুটল ও।

তিন দিক ঘেরা সাগরের খুদে একটা অংশ, প্রাণের কোন চিহ্ন নেই কোথাও গভীর তলদেশ, কাঁচের মত স্বচ্ছ পানি। পাহাড়ের গা থেকে সমল একটা কার্নিস সাগরের ওপর ঝুলে আছে। কাপড় খুলে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা। একশ মিটারের মত সাঁতরে উত্তর কোমিনো চ্যানেলে চলে এল ও, খুদে দ্বীপটা এত কাছে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আসলে কিন্তু দ্বীপের সবচেয়ে কাছের প্রান্তটা এক মাইলের কম দূরে নয়। কদিন অভ্যেস হোক, তারপর ওখানে যাবে রানা। তারও কদিন পর বিরতি না নিয়ে ফিরে আসবে। আগের শক্তি ফিরে এলে একটানা চার পাঁচ বার আসা-যাওয়া করতে পারবে ও।

ব্রেকফাস্টের বিশাল আয়োজন করেছে অনোরিয়া। মুরগির সুপ, সেদ্ধ ডিম, ভুনা গরুর মাংস, তন্দুরে সেঁকা গরম রুটি আর স্বচ্ছ মধু। প্লেটের ওপর রুটির পাহাড়, অনোরিয়ার কঠোর নির্দেশে সবগুলো গিলতে হল। সবশেষে এক মগ ধূমায়িত কফি।

রানার খাওয়া দেখছে, আর আট বছর আগের কথা ভাবছে অনোরিয়া। তখনও এই রকম চুপচাপ থাকত রানা। টেলিফোনে রেমারিক যদি ওঁর ছদ্মবেশের, কথা না জানাত, রানাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠত ওরা। মাত্র আট বছরে তরতাজা, প্রাণচঞ্চল একটা যুবক আধবুড়ো হতে পারে না। শুধু যে ছদ্মবেশ নিয়ে আছে তাই নয়, মৃত্যুর দরজা থেকে একটুর জন্যে ফিরে এসেছে রানা, স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে।

মেয়ে মারা গেলেও, জামাই রেমারিককে এখনও ছেলের মত ভালবাসে অনোরিয়া। বিয়ের আগের দিন ওদের সাথে কথা বলতে এসেছিল রেমারিক। নিজের অতীত সম্পর্কে বিস্তারিত বলে সে, ভবিষ্যতে ভাল-মন্দ কি ঘটতে পারে না। পারে সে-সম্পর্কে একটা আভাসও দেয়। সবশেষে রেমারিক ওদের বলে, তার যদি কোন বিপদ ঘটে, জেসমিনের যদি কোন সাহায্য দরকার হয়, তারা যেন রানাকে খবর দেয়। রানার কয়েকটা ঠিকানাও ওদেরকে দিয়েছিল রেমারিক।

জেসমিন মারা যেতে অনোরিয়াই টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিল ঢাকায়। রেমারিকের বন্ধু, কাজেই রানাকেও নিজের ছেলের মত দেখে অনোরিয়া। ছেলেটা যাতে তার স্বাস্থ্য ফিরে পায় তার জন্যে সম্ভাব্য সব কিছু করবে সে। ব্যায়াম আর কঠিন পরিশ্রম, এ-দুটোই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করবে, তার কাজ প্রচুর তাজা খাবার যোগান দেয়া।

নাস্তার পর পাহাড়ে চলে এল রানা। গায়ের শার্ট খুলে তাজার পাশে দাঁড়িয়ে। কাজ শুরু করল। শুকনো, আলগা পাঁচিল তৈরি করতে অভিজ্ঞতা লাগে। মাপমত সঠিক পাথর বাছাটাই আসল, পাথরের ওপর ঠিকমত পাথর বসানও কম গুরুত্বপূর্ণ। নয়। প্রৌঢ় তাজ অবাক হয়ে দেখল, আনাড়ি ভাবটা দ্রুত কাটিয়ে উঠছে রানা। এক ঘন্টাও পেরোয়নি, অথচ প্রথমবারেই সঠিক পাথরটা বেছে নিতে পারছে ও।

বার বার ঝুঁকে কোমরে ব্যথা ধরে গেল রানার, পাথরের ঘষা খেয়ে ছড়ে গেল। তালুর চামড়া। বেলা দুটোর দিকে রানার অবস্থা দেখে মায়া হল তাজার, থামতে বলল সে। খুদে ইনলেটে এসে সাগরের লোনা পানিতে হাত ধুল রানা।

ভেজিটেবল সুপ দিয়ে শুরু হল দুপুরের খাওয়া। মাছ দিয়ে রান্না ভাত, তন্দুরে। সেঁকা রুটি, মুরগি আর গরুর মাংস, সালাদ, সবশেষে ফল। খাওয়া দাওয়ার পাট চুকলে দিনের সবচেয়ে গরম সময়টা সবাই ছোট্ট একটা করে ঘুম দিয়ে নিল। পাথরের চওড়া দেয়াল, উঁচু সিলিং, ঘরের ভেতরটা তাই ঠাণ্ডা। শরীরে ব্যথা থাকলেও- ভাল ঘুম হল রানার। চারটের দিকে জাগল ও, শরীর আড়ষ্ট, হাতের, ক্ষতগুলো ব্যথা করছে। শুয়ে-বসে থাকতে ভাল লাগবে এখন, ঝোঁকও চাপল, কিন্তু নিষ্পাপ এক কিশোরীর মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠতেই বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল, পাহাড়ে এসে আবার দাঁড়াল তাজার পাশে।

এক ঘন্টা কাজ করার পর থামতে হল ওদের, বালতি করে বরফ আর বিয়ার নিয়ে এসেছে অনোরিয়া। রানার হাতের অবস্থা দেখে শিউরে উঠল প্রৌঢ়া, রাগের। সাথে ফিরল স্বামীর দিকে, তোমার আক্কেল বলি, এই হাত দিয়ে কেউ ওকে কাজ করতে দেয়?

কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাজা বলল, এবার নাহয় তুমিই বারণ করে দেখ!

রানার হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে পরীক্ষা করল অনোরিয়া।

এ কিছু না, বলল রানা। সন্ধের দিকে সাঁতার কাটবলোনা পানি ওষুধের কাজ করবে।

পরের তিন দিন খুব ভুগল রানা, রোজ রাতে বিছানায় এল যেন আহত একটা

তবে ছক বাঁধা একটা রুটিন দাঁড়িয়ে গেল। ভোর অন্ধকারে ঘুম থেকে উঠে ব্যায়াম, তারপর দৌড়, দৌড় শেষে সাঁতার, প্রতিবার আগের দিনের চেয়ে বেশি সময় নিয়ে, এরপর পাহাড়ে গিয়ে মাটি কেটে ধাপ তৈরি করার কঠিন কাজ, সন্ধ্যার দিকে আরও একবার সাঁতার, তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে ঘুম। শোবার আগেও কিছুক্ষণ যোগ ব্যায়াম করে ও।

এই রুটিন মেনে চলতে প্রথম দিকে খুব কষ্ট হল, আড়ষ্ট শরীর নিয়ে বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করত না। কিন্তু এই আড়ষ্ট ভাব আর ব্যথা সারাক্ষণ ওকে লুবনার কথা মনে করিয়ে দিল, মনে করিয়ে দিল ওকে নিয়ে জানোয়ারগুলো কি করেছে। প্রচণ্ড ঘৃণা আর প্রতিশোধ নেয়ার উগ্র বাসনা ভুলিয়ে দিল.সমস্ত ব্যথা আর যন্ত্রণা।

রানার এই ঘৃণা হঠাৎ একদিন চাক্ষুষ করে ঘাবড়ে গেল তাজা। ডিনারের পর বাইরে খোলা উঠনে বসেছিল ওরা তিনজন, ব্র্যাণ্ডি মেশানো কফি খাচ্ছিল। কালো সাগরের ওপর কোমিনোর ঢাউস আকৃতি, আরও দূরে আলো ঝলমলে মাল্টা দেখা যাচ্ছিল। মাল্টার এই আলো নেপলসে আসার কথা মনে করিয়ে দিল রানাকে। ভাবল, অনেকগুলো মাস পেরিয়ে গেছে। লুবনার কথা মনে পড়ল।

আকাশে অনেক তারা জ্বলছে, তার মধ্যে সবচেয় উজ্জ্বল তারাটা দৃষ্টি কেড়ে, নিল রানার। কান পাতলে কোকিলের ডাকও হয়ত শুনতে পাবে। বাগান থেকে ভেসে এল মিষ্টি ফুলের গন্ধ। ফুরফুরে বাতাস এলোমেলো করে দিল ওর চুল। কিন্তু। তবু অন্তরে সেই গানটা বেজে উঠল না।

ভিটো আভান্তির বাড়ি থেকে রানার ব্যক্তিগত জিনিস-পত্র নিয়ে এসেছিল রেমারিক, সেগুলোর মধ্যে লুবনার প্রেজেন্ট করা গানের ক্যাসেটটাও ছিল। নেপলস থেকে একটা রেকর্ড-প্লেয়ার কিনেছে রানা। কিন্তু লুবনার ক্যাসেটটা ও আর বাজায় না।

 উজ্জ্বল তারাটার দিকে তাকিয়ে হাসপাতালের কথা ভাবছে রানা। রেমারিক এসে ওকে বলল, লুবনা নেই।

 কি যেন বলার জন্যে রানার দিকে ফিরল তাজা, রানার চেহারা দেখে গায়ের। পশম খাড়া হয়ে গেল তার, মুখ থেকে আওয়াজ বের হল না। দেখল, মানুষটার। সমগ্র অস্তিত্ব থেকে উথলে উঠছে ঘৃণা, ঠাণ্ডা সাগর থেকে কুয়াশা ওঠার মত।

হঠাৎ উঠে দাঁড়াল রানা, ওদেরকে শুভরাত্রি জানিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।

বাবার দিকে ফিরল নিডো। তাজার হাসিখুশি চেহারায় গাম্ভীর্য আর উদ্বেগ। নিডো বলল; মাসুদ ভাই মাঝে মাঝে কেমন যেন হয়ে যায়।

মাথা ঝাঁকাল তাজা। ওর ভেতর একটা আগুন জ্বলছে, বলল সে। ওই আগুনে কেউ না কেউ পুড়ে মরবে।

খুক করে কেশে একটু হাসল নিডো, পরিবেশটা হালকা করার চেষ্টা করল। উঠে দাঁড়াল সে, হাতঘড়ি দেখল, তারপর বলল, আমার ভেতরেও একটা আগুন। জ্বলছে, তবে ঐ আগুন সে আগুন নয়। আমি বারবেরালায় যাচ্ছি। শুক্রবারের রাত, টুরিস্ট মেয়েগুলো আমাকে না পেলে হোটেল থেকে বেরুতেই চাইবে না।

মৃদু হেসে ছেলেকে উৎসাহ দিল তাজা। কিন্তু সাবধান করে দিয়ে বলল, বেশি রাত কোরো না, খেতে কাল অনেক কাজ। আর, খবরদার, বেশি গিলবে না–তোমার মা তাহলে আস্ত রাখবে না।

মাকে গোপন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল নিডো, বেরুবার সময় সামনে পড়ে গেলে বিদেশী মেয়েদের চরিত্র সম্পর্কে লেকচার শুনতে হবে। সুজুকিতে চেপে স্টার্ট দিল সে।

.

শনিবার বাড়ি এল ভায়োলা।

 কিচেন টেবিলে বসে আছে মেয়েটা, ওরা তিনজন লাঞ্চের জন্যে ভেতরে ঢুকল। মেয়েকে দেখিয়ে অনোরিয়া জিজ্ঞেস করল, মাসুদ, ভায়োলাকে চিনতে পার?

একটু একটু, জবাব দিল রানা। ভায়োলাকে বলল, তখন তুমি বেণী বাঁধতে।

 আড়ষ্ট একটু হাসি দেখা গেল ভায়োলার মুখে। বড় বোন জেসমিনের বিয়ের  সময় তার বয়স ছিল চোদ্দ, আট বছর পর রানাকে দেখে চিনতে পারল না সে। মার মুখ থেকে ওর সব কথা শুনেছে, জানে চেহারা আর বয়স দুটোই নকল।

 ভায়োলাই ওদেরকে পরিবেশন করল। কাল অনেক রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরেছিল নিডো, সকালে ঠেলা ধাক্কা দিয়ে তার ঘুম ভাঙানো হয়েছে। কোন মেয়ের খপ্পরে পড়েছিস বুঝি?ঠাট্টা করে জানতে চাইল ভায়োলা। কিন্তু মা নিডোকে বকাঝকা শুরু করতে ভাইয়ের পক্ষ নিল সে।

রানাকে ভায়োলা জিজ্ঞেস করল, রেমারিক কেমন আছে? এ-বছর কবে আসবে কিছু বলেছে? তার কণ্ঠস্বর সুরেলা, মিষ্টি।

ভাল আছে। না, মাস তিন-চারের আগে আসতে পারবে বলে মনে হয় না।

একহারা, লম্বা, সুন্দরীই বলা যায় ভায়োলাকে। রানা ভাবল, রেমারিকের সঙ্গে ভায়োলার কোন ব্যাপার আছে কিনা। বোধ হয় নেই, থাকলে রেমারিক তাকে বলত। মেয়েটা সম্পর্কে অনোরিয়ার কাছে অনেক কথা শুনেছে রানা, সব জেনে দুঃখবোধ করেছে। তিন বছর আগে সুদর্শন এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয় ভায়োলার, বিয়ের দুমাস পরই ভায়োলা জানতে পারে তার স্বামীর একাধিক ভাগীদার আছে। তারা যদি মেয়ে হত, তাদের খপ্পর থেকে স্বামীকে বের করে আনার চেষ্টা করত সে, কিন্তু তাগড়া চেহারার কয়েকজন পুরুষের সাথে কিভাবে সে প্রতিযোগিতা করে!

বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন কবে মঞ্জুর, হবে কেউ বলতে পারে না। ভ্যাটিকানের ধর্মযাজকরা বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘোর বিরোধী, কারণ বিয়ে অত্যন্ত। পবিত্র এক বন্ধন, ছিড়লে পাপ হয়। দশ-পনেরো বছর পার হয়ে গেছে অথচ বিচ্ছেদের আবেদন বিবেচনা করা হয়নি, এমন ঘটনা ভুরি ভুরি।

বাড়ির সবাই জানে, ভায়োলার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। বিবাহ-বিচ্ছেদের। আবেদন মঞ্জুর হলেও, গোজো এমন একটা সমাজ, কোন মা তার ছেলের জন্যে ভায়োলার মত একটা মেয়েকে বউ হিসেবে মেনে নেবে না। তাছাড়া, দ্বিতীয়বার বিয়ে করার কোন ইচ্ছে ভায়োলারও নেই। মাল্টার একটা হোটেলে রিসেপশনিস্টের চাকরি করে সে, বছরে দুবার লম্বা ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে। বাড়ির সবাই তার দুঃখে দুঃখী, তার কোন কাজে কেউ কখনও বাধা দেয় না।

শেষ বিকেলের দিকে সুইমস্যুট নিয়ে খুদে ইনলেটের পথ ধরল ভায়োলা। সমতল পাথরে কাপড় দেখল সে, সাগরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল সাঁতার। কাটছে রানা।

চারশো মিটারের মত সাঁতার দিয়ে ফিরে এল রানা।

আমি ভাবলাম তুমি বোধহয় কোমিনা পর্যন্ত যাবে, রানাকে পানি থেকে উঠতে দেখে বলল ভায়োলা।

আগামী হপ্তায়। ভায়োলার পাশে বসে দম নিচ্ছে রানা।

রানার উদোম শরীরের দিকে তাকিয়ে আছে ভায়োলা, চোখ ফেরাতে পারছে, না। রানা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে লজ্জা পেল সে।

নামবে নাকি? জিজ্ঞেস করল রানা।

হ্যাঁ। তুমি পেছন ফের, কাপড় বদলাই।

এক মিনিট পর ওয়ান-পিস সুইমস্যুট পরে পানিতে লাফিয়ে পড়ল ভায়োলা। এক ডুবে অনেকটা দূরে চলে গেল সে, মাথা তুলে রানার দিকে তাকাল, হাসছে। একটা হাত তুলে ডাকল সে। এক সেকেণ্ড ইতস্তত করে ডাইভ দিল রানা।

ইনলেট থেকে চ্যানেলে বেরিয়ে এল ওরা। ভায়োলা ভাবল, কোমিনো পর্যন্ত যাওয়া রানার উচিত হবে কিনা। চ্যানেলের মাঝখানে প্রচণ্ড স্রোত, গোজোর দক্ষ সাতারুরাও অনেকে কোমিনো পর্যন্ত যেতে সাহস পায় না। তীরের কাছাকাছি রয়েছে ওরা, অথচ স্রোতের টান বেশ ভালভাবেই অনুভব করছে। রানাকে সাবধান। করে দেয়া উচিত ভেবে মুখ খুলতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সামলে নিল নিজেকে। একটা মেয়ের উপদেশ ওর হয়ত পছন্দ হবে না।

পানি থেকে উঠে পাথরের ওপর পাশাপাশি শুয়ে থাকল ওরা, শেষ বিকেলের নিস্তেজ রোদে চকচক করছে ভেজা গা। রেমারিক আর ফুরেলার কথা জানতে চাইল ভায়োলা, কিডন্যাপ আর গোলাগুলি প্রসঙ্গের ধার দিয়েও গেল না। ইটালির খবরের কাগজে ঘটনাটা সম্পর্কে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু আরও অনেক কিছু। জানতে চায় ভায়োলা–তবে এখুনি নয়।

.

তোবড়ানো ল্যাণ্ড রোভার নিয়ে শেষ ফেরিতে চড়ল রানা। সেন্ট এলমো থেকে গোজোয় ফিরছে ও। পিওতর মেনিনোর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে ওর।

 দুদিন আগে এক সন্ধ্যায় কাগজে একটা খবর পড়ছিল তাজা, ধারণাটা তখনই মাথায় আসে রানার পশ্চিম জার্মানীতে একটা প্লেন হাইজ্যাকের চেষ্টা করা। হয়, কিন্তু স্পেশাল অ্যান্টি টেরোরিস্ট স্কোয়াড় হাইজ্যাকারদের কোণঠাসা করে ফেলে। তাজা বলল, মাল্টায়ও এ-ধরনের একটা স্কোয়াড আছে। তার ভাইপো, পিওতর মেনিনো, পুলিসের একজন ইন্সপেক্টর, ওই স্কোয়াডের কমাণ্ডার। কথা প্রসঙ্গে রানা বলল, সুযোগ পেলে পুরানো ট্রেনিংটা ঝালাই করে নিলে ভাল হত। পরদিনই ভাইপোকে টেলিফোন করে তাজা, রানাকে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিতে রাজি হয় মেনিনো।

 ব্রিটিশ আর্মির ফেলে যাওয়া অস্ত্র পাতি ব্যবহার করছে ওরা। স্টার্লিং সাবমেশিন গান আর বিভিন্ন ধরনের হ্যাণ্ডগান। রানার সাথে মেনিনোর কথা হল পুরানো দুর্গে বসে, এ্যাণ্ড হারবারের প্রবেশ পথটা পাহারা দিচ্ছে এই দুর্গ। দুর্গের ভেতরই চমৎকার একটা রেঞ্জ আছে ওদের, অনেক দিন পর অস্ত্রশস্ত্রের ছোঁয়া উপভোগ করেছে রানা। ফায়ারিং রেঞ্জে, ঘন্টাখানেক ছিল ও; বুঝেছে, লক্ষ্যভেদে আগের মত দক্ষতা ফিরে পেতে কয়েক হপ্তা সময় লাগবে। এরপর স্কোয়াডের পনেরো জনের সঙ্গে জিমনেশিয়ামে যায় ও, ওখানে আনআমড কমব্যাট এ্যাকটিস। করে। স্কোয়াডটা মাত্র গঠন করা হয়েছে, এখনও সরাই অনভিজ্ঞ, কিন্তু শেখার আগ্রহ কারও চেয়ে কারও কম নয়। পিওতর মেনিনো লম্বা চওড়া, হাসি-খুশি পুলিস অফিসার, রানাকে আন্তরিকতার সঙ্গে অভ্যর্থনা জানিয়েছে। কিন্তু খানিক পরই ভুরু কুঁচকে ওঠে তার, চিন্তিত দেখায় তাকে। রানার অস্ত্রপাতি নাড়াচাড়ার। ভঙ্গি দেখে বুঝে নিয়েছে সে, এ লোক সাধারণ কেউ নয়।

বিদায় নিয়ে দুর্গ থেকে বেরিয়ে পড়ল রানা, অমনি চাচাকে ফোন করল মেনিনো। চাচা, তুমি জান কি ধরনের লোককে মেহমান হিসেবে রেখেছ, বাড়িতে?

কেন, বাবা? উদ্বিগ্ন হল ভাজা। রেমারিকের বন্ধু ও–কোন অসুবিধে করেছে, নাকি?

না না, তা নয়। কিন্তু চাচা, হাসান প্রফেশনাল একজন সত্যিকার এক্সপার্ট। মাল্টায় ও ঠিক কি করছে বল তো?

লুবনার কিডন্যাপ আর রানার আহত হওয়ার ঘটনা বর্ণনা করল তাজা, বলল, আমাদের এখানে এসেছে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্যে।

মেনিনো হাসল, বলল, যাক, তুমি তাহলে সামরিক অভ্যুত্থানের কোন প্ল্যান করছ না!

তাজাও হাসল। মনে হচ্ছে কু্য করার জন্যে একজন লোক আমি পেয়েছি। ও কি সত্যি অতটা ভাল?

এক মুহূর্ত পর জবাব দিল মেনিনো, ইংল্যাণ্ড আর ইটালিতে ট্রেনিং নিয়েছি। আমি, ওর মত দক্ষ লোক আর দেখিনি। এমনভাবে আর্মস নাড়াচাড়া করছিল যেন। মায়ের পেট থেকে প্র্যাকটিস করে এসেছে। আরও কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর সে প্রস্তাব দিল, চাচা, আমাকে তুমি ডিনারের দাওয়াত দাও। হাসান সম্পর্কে সব কথা জানতে চাই আমি। আমাদের এখানে ইনস্ট্রাকটরের অভাব রয়েছে, কথা। বলে দেখব ওকে কোন কাজে লাগানো যায় কিনা। অবশ্যই আনঅফিশিয়ালি।

ভাইপোকে শনিবারে ডিনারের দাওয়াত দিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখল তাজা।

ফেরি থেকে সবার শেষে নামল রানা, ল্যাণ্ড রোভারে ওর পাশের সিটে উঠে বসল মিলানো। রুচিতা’স-এর দরজায় পৌঁছেই মিলানো ঘোষণা করল, আমি হাজির!

বড়সড় বার, লোকজনে প্রায় ভরে গেছে। প্রকাণ্ডদেহী বিদ্রোহীকেও দেখল রানা, চেয়ারটা সম্পূর্ণ ঢেকে দরজার দিকে মুখ করে বসে আছে। চোখাচোখি হতে হাসল গরিলা। ওর সঙ্গে আগেই পরিচয় হয়েছে রানার। বিশাল আকৃতি, এমনিতে গোবেচারা আর সরল, কিন্তু কোথাও কাউকে অন্যায় করতে দেখলে স্থান-কাল পাত্র জ্ঞান থাকে না, তীব্র প্রতিবাদ করে বসে। তার প্রতিবাদ জানাবার ধরনটা অদ্ভুত। সম্ভব-অসম্ভব নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক লোক ভোটে জিতল একবার, কিন্তু ছমাস পেরিয়ে যাবার পরও সে তার একটা প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করল না। ইতিমধ্যে বার দুয়েক তাকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে বিদ্রোহী, কোন কাজ হয়নি। একদিন রাজনীতিকের অফিসে গিয়ে উঠল সে, কাজ শুরু করল সামনের ঘরটা ধরে। এক এক করে প্রতিটি টেবিল, চেয়ার মেঝেতে আছাড় দিয়ে ভাঙল। সে। বাধা দিতে এসে আহত হল ছয়জন কর্মচারী। খবর পেয়ে পিছনের জানালা গলে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল রাজনীতিক। সেদিন তার অফিসের প্রতিটি ফার্নিচার গুঁড়িয়ে দিয়ে এসেছিল সে। পরদিনই তাকে গ্রেফতার করে পুলিস। ভাগ্য ভাল। বলতে হবে মাননীয় বিচারক রাজনীতিকদের পছন্দ করতেন না, মাত্র তিন মাসের জেল খেটে রেহাই পায় বিদ্রোহী। এই রকম ঘটনা তার জীবনে আরও অনেক আছে।

গুঁফোর পালা চলছিল, সবাইকে বিয়ার খাওয়াচ্ছিল সে। রানা আর মিলানোর সামনেও বিয়ার ভর্তি দুটো মগ রাখল। কামরায় এক কোণ থেকে রানার উদ্দেশে। হাত নাড়ল নিডো। ভায়োলাকেও দেখল রানা, আলফানসোর বউয়ের সঙ্গে একটা টেবিলে বসে আছে। কাছাকাছি হল না ওরা, দূর থেকে নিঃশব্দে হাসল দুজনেই।

প্রায় রোজই ওরা দুজন একসঙ্গে সাঁতার কাটে। ব্যক্তিগত কোন প্রসঙ্গ তুলে রানাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে না ভায়োলা, নিজের দুঃখের কথা বলে সহানুভূতি। আদায়ের চেষ্টাও তার মধ্যে নেই। রানাকে সঙ্গ দিতে পেরেই খুশি সে। তার যেন ধারণা, ওর সঙ্গ রানার দরকার আছে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে রানা, ওর কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে মেয়েটা। কখন কি দরকার হয় রানার। অনোরিয়ারও এতে সমর্থন আছে। রানার কি লাগবে না লাগবে জানার জন্যে মেয়েকেই পাঠায় সে।

টাগলিয়া রানার সামনে এসে দাঁড়াল। আমি কিন্তু আগেই বলে রাখছি, বারোটার আগে কেউ আজ ফিরতে পারবে না। ওর মুখেই রানা শুনল, সর্বশেষ মামলায় রায় দেয়া হয়েছে বিদ্রোহী নিরপরাধ। রাত দশটার পর বিদ্রোহীর তরফ থেকে সবাইকে বিয়ার খাওয়ানো শুরু হবে।

কাউন্টারে টাকা রেখে অপেক্ষা করছে রানা। ইতিমধ্যে অফার দেয়া হয়েছে। সাকোকে, কিন্তু বরাবরের মত প্রত্যাখ্যান করেছে সে। মিনিট পনেরো পর ফিরে এসে কাউন্টার থেকে গুনে গুনে দশ সেন্ট তুলল সাকো, সহাস্যে বলল, ক্ষতি কি!

.

ডিনারের পর বাইরের উঠনে বসে আছে রানা আর পিওতর মেনিনো। ওদেরকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে নিডোকে নিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেছে তাজা। ভায়োলা ওদেরকে কনিয়্যাক মেশানো কফি দিয়ে কিচেনে ফিরে গেল। কালো রঙের ঢাউস একটা পাইপ ধরাল মেনিনো, চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, আপনি জানেন। দ্বীপগুলোর সিকিউরিটি আমার দায়িত্ব?

মৃদু হেসে পাল্টা প্রশ্ন করল রানা, আসলে আপনি জানতে চাইছেন আমি একটা সিকিউরিটি রিস্ক কিনা, তাই তো?

মাথা নাড়ল মেনিনো। না। আপনি এখানে কি করছেন চাচা আমাকে বলেছে। তাছাড়া, আপনার সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য ইতিমধ্যে যোগাড় করেছি আমি। আড়ষ্ট একটু হাসি দেখা গেল তার মুখে। কাল সকালে প্যারিসে একটা টেলেক্স পাঠিয়েছিলাম, আজ সকালে তার উত্তরও পেয়ে গেছি।

আর প্যারিসে?

হ্যাঁ–ইন্টারপোলে। সমস্ত মার্সেনারি সম্পর্কে তথ্য রাখে ওরা। আমার ইনকোয়ারি ছিল সি গ্রেডের, তাই খরচ কম পড়েছে। এ গ্রেডের ইনকোয়ারি হলে আপনার সম্পর্কে ওদের জানা সমস্ত তথ্য পেয়ে যেতাম আমি, কিন্তু অত সব জানার আমার দরকার ছিল না।

কৌতুক বোধ করল রানা। জিজ্ঞেস করল, তা কি জানতে পারলেন?

জেনেছি আপনি একজন দুর্ধর্ষ মার্সেনারি, একজন মেজর, ইন্টারপোল জানে বর্তমানে আপনি কোথায় আছেন।

প্রতিক্রিয়া?

না, আপনার অনুরোধ আমরা প্রত্যাখ্যান করছি না, বলল মেনিনো। স্কোয়াডের ফ্যাসিলিটি আপনি ব্যবহার করতে পারবেন। অবশ্যই আনঅফিশিয়ালি। কেন আপনি লুকিয়ে আছেন, জানতে চাইব না।

আমি কৃতজ্ঞ।

মুচকি একটু হাসি দেখা গেল মেনিনোর ঠোঁটে। কিন্তু একটা শর্ত আছে– তেমন কঠিন কিছু না। আপনি অত্যন্ত অভিজ্ঞ লোক, আমরা আপনার ওই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাই।

কিভাবে?

পাইপ নিভে গেছে, সেটা আবার ধরিয়ে কথা বলতে শুরু করল মেনিনো।

হাইজ্যাকার আর টেরোরিস্টদের মোকাবেলা করার জন্যে গঠন করা হয়েছে। এই স্কোয়াড আজকাল প্রায় সব দেশেই এ-ধরনের একটা করে স্কোয়াড আছে। কিন্তু ওদের এই স্কোয়াডে যারা রয়েছে তাদের অভিজ্ঞতা বলতে গেলে একেবারেই নেই। আমড ফোর্সেস অব মাল্টায় এমন অফিসারের সংখ্যা খুব কম যারা। কমাণ্ডোদের ট্রেনিং দিতে পারে। যা-ও দুএকজন আছে, তারা আরও জরুরি দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। ফলে ছক বাধা নিয়ম ধরে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে, প্র্যাকটিক্যাল অভিজ্ঞতা ছাড়া যার কোন দামই নেই। আসল কথা ইনস্ট্রাকটরের অভাব। ইচ্ছে করলে রানা এই অভাব অনায়াসে পূরণ করতে পারে।

চেষ্টা করে দেখব কতটুকু কি করতে পারি, রাজি হল রানা। অস্ত্রপাতি যা দেখলাম, ওগুলো ছাড়া আর কি কি আছে আপনাদের?

ট্রেনিঙের টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে মাঝরাত পর্যন্ত আলোচনা করল। ওরা। রানার ব্যক্তিত্ব মুগ্ধ করেছে মেনিনোকে, আর ট্রেনিংটা ঝালাই করে নেয়ার সুযোগ পেয়ে রানা খুশি।

*

খুদে ইনলেট থেকে কোমিনোয় এল রানা, কোন বিরতি ছাড়াই তিনবার আসা যাওয়া করল ও। পাহাড়ের ওপর বাড়ি, নিজের শোবার ঘরের জানালা থেকে চোখে বিনকিউলার লাগিয়ে রানাকে দেখছে ভায়োলা। খুদে বে-তে পৌঁছুল রানা, হোটেল জেটির দিকে সাঁতার কাটছে। নিচ তলায় নেমে এসে নিড়োকে ফোন। করল ভায়োলা। গত তিন দিন থেকেই রোজ সকালে কোমিনোর হোটেলে। নিডোকে পাঠায় সে, প্রচণ্ড স্রোতের মধ্যে পড়ে রানার কোন বিপদ হলে বোট আর জেলেদের নিয়ে নিভো যাতে তাকে সাহায্য করতে যেতে পারে। আর কোন কাজ নেই তোর, নিডো, ছুটি, বলে কানেকশন কেটে দিল ভায়োলা, তারপর ফোন করল তার এক বান্ধবীকে। মেয়েটা হোটেল কোমিনোর রিসেপশনিস্ট।

খালি পা আর ভেজা গা নিয়ে হোটেলের পাশ দিয়ে হেঁটে আসছে রানা, ধাপ কটা টপকে রাস্তায় নেমে এল মেয়েটা। তার এক হাতে একটা পাস্টিকের ব্যাগ, আরেক হাতে বরফ দেয়া শরবত। রানাকে সে বলল, কমপ্লিমেন্টস অভ। ভায়োলা।

হেসে উঠল রানা, সাগরের ওপর দিয়ে ভায়োলাদের বাড়ির দিকে তাকাল। রোদ লেগে ঝিক করে উঠল বিনকিউলারের লেন্স। গ্রাস ধরা হাতটা মাথার ওপর তুলে নাড়ল রানা।

ব্যাগের ভেতর থেকে বেরুল একটা জিনস প্যান্ট, একটা সাদা টি-শার্ট, এক জোড়া রাবার স্যাণ্ডেল–সব নতুন। একটা তোয়ালেও আছে, তাতে পিন দিয়ে। আটকানো একটা চিরকুট।

মনে রাখতে হবে এই দেশটা ক্যাথলিকদের, পড়ল রানা। আধ-ন্যাংটো হয়ে চলাফেরা করা উচিত নয়।

মেয়েটা হাত তুলে দেখাল। ওই ওদিকে একটা আড়াল আছে, ব্লু লেগুনে যাবার পথেই পড়বে। হাতঘড়ি দেখল সে। চল্লিশ মিনিট পর ছাড়বে ফেরি।

ধন্যবাদ জানিয়ে খালি গ্লাসটা ফিরিয়ে দিল রানা।

জিনস আর টি-শার্ট মাপমতই হল। ওর সব কিছু খুঁটিয়ে লক্ষ করে ভায়োলা, ভাবল ও। কিন্তু দিনে দিনে যেভাবে ওর দিকে ঝুঁকে পড়ছে মেয়েটা, একটা জটিলতা সৃষ্টি হওয়া বিচিত্র কিছু না। রেমারিককে ব্যাপারটা জানাবে? না, তারচেয়ে নিজেরই আরও সাবধান হওয়া উচিত।

সে-রাতে ডিনারে বসেছে ওরা, নেপলস থেকে ফোন এল রেমারিকের। আমি আগে কথা বলে নিই, বলে কিচেন থেকে লাউঞ্জে বেরিয়ে এল ভায়োলা। রেমারিকের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টার সম্পর্ক তার, কিন্তু আজ সে সিরিয়াস। এক এক করে। রানা সম্পর্কে অনেকগুলো প্রশ্ন করে গেল ভায়োলা। লোকটার ভবিষ্যৎ কি? এখান। থেকে কোথায় যাবে ও-কেন?

কি ঘটতে যাচ্ছে, মুহূর্তে বুঝে নিল রেমারিক। ভায়োলাকে সে বলল, তোমার এ-সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার ধারণা ব্যাপারটা একতরফা, ঠিক কিনা?

-প্রান্তে চুপ করে থাকল ভায়োলা। খানিক পর রেমারিকই আবার বলল, শুধু শুধু সময় নষ্ট, ভায়োলা। ওর হাতে একটা কঠিন কাজ রয়েছে। তাছাড়া, এমনিতেও ওকে তুমি বাঁধতে পারবে না।

বাঁধতে যে পারব না তা আমিও কিভাবে যেন বুঝেছি, বলল ভায়োলা। বাঁধতে চাই, তাই বা তোমাকে বলল কে?

তাহলে এত কথা জানতে চাওয়া কেন?

যদি বলি, বাঁধতে চাই না, কিছু পেতেও চাই না, শুধু কিছু দিতে চাই? আমাকে নির্লজ্জ ভাববে?

এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল রেমারিক, তারপর বলল, না। ভাবব তুমি সাক্ষাৎ দেবী। কিন্তু আমি যদি বলি যাকে দিতে চাও তাকে ভুল করে দিতে চাও?

মানে?

ওকে তুমি চিনতে পারনি, ভাই, বলল রেমারিক।

কিন্তু আমার তো কোন প্রত্যাশা নেই!

 ওরও তো নেই, কাজেই তুমি দিলেই বা ও নেবে কেন?

তুমি ওর এমন একটা ছবি দিচ্ছ আমাকে, ও যেন দেবতা, ব্যঙ্গ করে বলল ভায়োলা। যেন কোন মেয়ের পক্ষে ওকে টলানো সম্ভব নয়।

কথা না বলে সশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রেমারিক।

এরপর রানাকে ডেকে দিল ভায়োলা। রানা আর রেমারিকের মধ্যে আভাসে ইঙ্গিতে কথা হল। রানা বুঝল, মার্সেলেসে যোগাযোগ করা হয়েছে গগলের সাথে, সাহায্য করার জন্যে তৈরি হয়ে আছে সে। অন্যান্য প্রস্তুতি কাজও সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে চলেছে। রানা আভাস দিল, তিন-চার হস্তার ভেতর রওনা হবে ও। রেমারিককে বলল, ওদিকের কাজ শেষ হলে সে যেন একটা চিঠি লিখে জানায় ওকে।

.

০২.

লোকটা মোটাসোটা, লম্বা, আঁটসাট ক্যামোফ্লেজ ইউনিফর্ম পরে আছে। কোমরের বেল্ট থেকে ঝুলছে ট্রানসিভার আর গ্রেনেড, হাতে স্টার্লিং সাবমেশিনগান। পাথুরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দম নিচ্ছে, খোলা উঠনের ওপর দিয়ে ছুটে এসে হাঁপিয়ে, গেছে।

দোতলা একটা বাড়ি, ওপর তলায় উঠতে হবে তাকে। করিডর ধরে একটু একটু করে বাঁকের দিকে এগোল সে। জানে, বাকের পর আবার লম্বা একটা করিডর, শেষ মাথায় সিঁড়ি। কোণে এসে দাঁড়াল সে, তারপর নিচু হয়ে লাফ দিল। সামনে, স্টার্লিঙের ট্রিগার টেনে ধরেছে আঙুল।

গুলির একনাগাড় আওয়াজে গোটা বাড়ি কেঁপে উঠল।

সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে লোকটাকে আসতে দেখল রানা, তীক্ষ্ণ চোখে খুঁটিনাটি সবকিছু লক্ষ করছে। সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে আবার দেয়ালে হেলান দিল লোকটা। খালি একটা ম্যাগাজিন পড়ল মেঝেতে, ক্লিক করে জায়গামত বসল। নতুন আরেকটা। মুখের কাছেট্র্যানসিভার তুলে বলল সে, ওপরে যাচ্ছে। রানার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে ধাপ বেয়ে উঠতে শুরু করল। তাকে অনুসরণ করল। রানা। বাড়ির চারদিক থেকে ব্রাশ ফায়ারের আরও আওয়াজ আসছে, মাঝে মধ্যে গ্রেনেড় ফাটছে দুএকটা।

.

এক এক করে পনেরোজনই বাগানে বেরিয়ে এল ওরা, পরনে এখনও সবার ক্যামোফ্লেজ গিয়ার, কথা বলছে উত্তেজিতভাবে। সবার পিছু পিছু এল পিওতর মেনিনো। নিচু একটা পাঁচিল দেখিয়ে সবাইকে বসতে বলল সে।

পাঁচ মিনিটের এক্সারসাইজ, কিন্তু ভিব্রিফিঙে সময় লাগল এক ঘন্টা। হামলার প্রতিটি মুহূর্ত নিয়ে কথা বলল মেনিনো, কারও সমালোচনা করল, কারও প্রশংসা। পনেরোজনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে, পাশে রানা। স্কোয়াডের সবাই উৎসাহে ভরপুর, এটাই তাদের প্রথম ফুল-স্কেল এক্সারসাইজ, বিস্ফোরণের আওয়াজ আর ছুটোছুটি ওদেরকে অনুপ্রাণিত করে তুলেছে। কথা শেষ করে রানার দিকে ফিরল। মেনিনো। এনি কমেন্ট?

সামনে এগোল রানা, স্কোয়াডের সবাই কিছু শুনতে পাবার আশায় স্থির হয়ে গেল।

সব মিলিয়ে ভাল, বলল রানা। খুশি হয়ে হেসে উঠল সবাই।

কিন্তু সত্যিকার যুদ্ধে, আট থেকে দশ জন মারা যেতে তোমরা, না হয় আহত হতে। মুছে গেল মুখের হাসি।

লম্বা মোটাসোটা যুবকের দিকে হাত তুলল রানা। মারাঞ্জানো, করিডর ধরে। আসার সময় দেয়াল ঘেষে ছিলে তুমি–ভুলে গিয়েছিলে ওটা একটা পাথরের। দেয়াল। শক্ত দেয়ালে বুলেট ঢোকে না, পিছলে যায়–সেজন্যেই বারবার, করিডরের মাঝখানে থাকতে বলা হয়েছে সবাইকে। মাঝখানে থাকলে তোমার মনে হবে শত্রু তোমাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু তবু মাঝখানে থাকাই। নিরাপদ। বাকটা ঘোরার সময় নিচু হয়ে ছিলে তুমি, কিন্তু তারপরই সিধে হয়ে গেলে। আরেকটা কথা, কোমর-সমান উঁচুতে লক্ষ্যস্থির করছিলে তুমি। শত্রু মেঝেতে শুয়ে থাকতে পারে, বাতাসে ওড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, কাজেই সব সময় নিচের দিকে গুলি করতে হবে।

মাথা ঝাঁকাল মারাঞ্জানো, হতভম্ব দেখাল তাকে। কিন্তু রানা তাকে এখনও রেহাই দেয়নি।

আমি টেরোরিস্ট হলে, এতক্ষণে মরে ভূত হয়ে যেতে। ম্যাগাজিন বদলাতে অনেক বেশি সময় নিয়েছ। ওটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়, তোমার সবচেয়ে দুর্বল মুহূর্ত। সবাইকে বলছি, আরও প্র্যাকটিস কর। বাঁচতে চাইলে এর কোন বিকল্প নেই।

মাঝারি আকৃতির এক যুবকের দিকে ফিরল রানা। ডেগা, জোনাথনের পিছু পিছু দুনাম্বার কামরায় ঢুকলে তুমি। অথচ উচিত ছিল করিডর থেকে তিন আর চার নাম্বার কামরার দরজা কাভার দেয়া। কি আশা করেছিলে, দুনাম্বার কামরায় তোমার জন্যে কোন মেয়ে অপেক্ষা করছে?

হাসির হররা বয়ে গেল। সবাই জানে, ডেগা একজন রোমিও, মেয়ে দেখলে। পিছু ছাড়ে না।

স্কোয়াডের প্রায় সবার সঙ্গে কথা বলল রানা। সারাক্ষণ চুপচাপ থাকল মেনিনো, দোষ-ক্রটি আবিষ্কার আর সম্ভাবনার নতুন নতুন দিক উন্মোচনে রানার কৃতিত্ব দেখে বিস্মিত। তার লোকেরা সবাই ওর কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে, কারণ একজন অভিজ্ঞ লোক কর্তৃত্বের সাথে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে কোথায় গলদ। ওরা সবাই রানাকে স্টার্লিঙের ম্যাগাজিন পাল্টাতে দেখল বিদ্যুৎ খেলে গেল হাতে, একটানা গুলিবর্ষণে বিরতি পড়ল কি পড়ল না। রানাকে হ্যাণ্ডগান, এস-এম জি আর কারবাইন চালাতেও দেখল ওরা–দক্ষ, আত্মবিশ্বাসী, দ্রুত। এর আগে তারা আন-আর্মড কমব্যাট প্র্যাকটিস করতে দেখেছে ওকে, ওর গতি আর রিফ্লেক্স দেখে মুগ্ধ হয়েছে। পনেরো জনের কারও বয়সই পঁচিশের বেশি। নয়, সবাই শক্ত-সমর্থ, কিন্তু জানে রানার সঙ্গে কেউ ওরা পারবে না। কাজেই ওর কথা মন দিয়ে শুনল সবাই।

সবশেষে মেনিনো, ধন্যবাদ জানাল রানাকে। বলল, বিল্ডিংটা আরও এক মাস আমাদের দখলে থাকবে, আমি চাই আরও দুটো এক্সারসাইজে আপনি থাকুন। এয়ার মাল্টার সাথে কথা হয়ে গেছে, দুঘন্টার জন্যে ওরা আমাদের একটা বোয়িং ধার দেবে। হাইজ্যাক অ্যাসল্টের মহড়া আপনি পরিচালনা করবেন।

রাজি হল রানা।

ওর আগের স্বাস্থ্য আর শক্তি ফিরে এসেছে, ফিরে পেয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের দক্ষতাও। নিয়মিত প্র্যাকটিস করে এখন শুধু ওগুলো ধরে রাখা।

.

একটা রুটিন করে নিয়েছে ভায়োলা।

ভোর অন্ধকার থাকতে ঘুম ভাঙে তার, দোতলায় উঠে রানার দরজায় টোকা। দেয়। রানার সাড়া পেলে নিচে নেমে কফি তৈরি করে সে। আবার দোতলায় উঠে।

আসে, দেখে, ব্যায়াম শুরু করেছে রানা। বিছানায় বসে রানাকে ঘেমেনেয়ে উঠতে  দেখে সে। তারপর চেয়ারে বসে কফি খায় রানা। তখনও. সূর্য ওঠে না, গোটা বাড়ি নিস্তব্ধ। চুপচাপ থাকে ওরা, দুএকটা কথা হয় কি হয় না। কফি শেষ করে, দৌড়াতে যায় রানা–এখন একটানা দশ মাইল দৌড়ায় ও। দৌড় শেষ করে খুদে ইনলেটে চলে আসে, এসে দেখে ভায়োলা সেখানে আগেই হাজির হয়েছে, ওর জন্যে কিছু একটা ঠাণ্ডা পানীয় আর তোয়ালে নিয়ে অপেক্ষা করছে। ডাইভ দিয়ে। পানিতে নামে রানা, তিন বার কোমিনো হয়ে ফিরে আসে। তারপর সমতল পাথরে আধ ঘন্টা শুয়ে থাকে, ওর পাশে বসে বা শুয়ে থাকে ভায়োলা।

ব্রেকফাস্ট সেরে পাহাড়ে চলে যায় রানা, তাজা আর নিডোর সঙ্গে মাটি কাটার কাজ করে।

সন্ধের সময় আবার রানার সঙ্গে দেখা হয় ভায়োলার, খুদে ইনলেটে সাঁতার। কাটে দুজন। তখন ওদের মধ্যে কিছু কিছু কথাবার্তা হয়। ব্যক্তিগত কোন প্রসঙ্গ কেউ তোলে না, অতীত আর ভবিষ্যতের কথা দুজনেই সচেতনভাবে এড়িয়ে। যায়। আভাসে জানিয়ে দিয়েছে ভায়োলা, তার কোন প্রত্যাশা নেই, কিন্তু ভাল লাগা আছে, আছে সমর্থন আর সহানুভূতি। সেবা, শুশ্রূষা আর সঙ্গ দিয়ে নিজেই তৃপ্তি পেতে চায় সে; অনুরোধ–নারীসুলভ তার এই আচরণকে যেন অন্য চোখে দেখা না হয়।

মাঝে মধ্যে রানাকে হাসতে দেখে ভায়োলা, অদ্ভুত একটা তৃপ্তিতে ভরে ওঠে। তার অন্তর। রেমারিকের কাছে শুনেছে সে, অসহনীয় একটা যন্ত্রণায় কাতর হয়ে। আছে এই লোকের মন। রেমারিকের সাথে আরও কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে। তার, রানার ভবিষ্যৎ প্ল্যান সম্পর্কে এক-আধটু আভাস পেয়েছে সে।

প্রথম দিকে একটু ধাঁধা লাগলেও, এখন রানা ভায়োলাকে বুঝতে পারে। অসাধারণ, বুদ্ধিমতী সে, মনটা ফুলের মত কোমল। কথাবার্তা থেকে বোঝা যায়, সত্যিকার পৌরুষ আছে এই রকম পুরুষ মানুষের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ বোধ করে, সে। হতে পারে স্বামীর সঙ্গে যে-কারণে ঘর করতে পারেনি, এ তারই প্রতিক্রিয়া।

সময় বয়ে চলল, কিন্তু ওদের সম্পর্ক আগের মতই থাকল। ভায়োলা সব সময় রানার কাছাকাছি আছে, কিন্তু আরও ঘনিষ্ঠ হবার কোন চেষ্টা নেই তার। নাগালের মধ্যে রয়েছে ভায়োলা, কিন্তু কখনও হাত বাড়াবার কোন প্রবণতা রানার মধ্যে দেখা যায় না।

রানা একদিন মৃদু কণ্ঠে বলল, আর দিন দশেক পর রওনা হব আমি। মার্সেলেসে যেতে হবে আমাকে। দেখি আজ যদি পারি জাহাজের শিডিউল চেক করে আসব।

সে তো আমিই পারি, বলল ভায়োলা। ভ্যালেটায় একটা ট্রাভেল এজেন্সি আছে, আমার এক বান্ধবী কাজ করে। যতদূর মনে পড়ছে, হপ্তায় একটা করে জাহাজ যায়–বন পুয়ারো।

পরদিন রেমারিকের চিঠি পৌঁছুল।

স্পষ্ট, খুদে হস্তাক্ষরে চার পৃষ্ঠা চিঠি লিখেছে রেমারিক। প্রথম পৃষ্ঠায় একটা টিকেটের অর্ধেক পিন দিয়ে আটকানো। মার্সেলেন্স রেলওয়ে স্টেশনের। ব্যাগেজরূমের টিকেট ওটা।

সে-রাতে দুটো চিঠি লিখল রানা। প্রথমটা ঢাকায়, মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খানের কাছে। চিঠিতে সি. আই. এ-র মতিগতি কি রকম জানতে চাইল সে। লিখল, শুধু ভাল কোন খবর থাকলে বি. সি. আই রেমারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। আর, একটা ইকুইপমেন্টের জন্যে অনুরোধ করল রানা, মার্সেলেসে, পোস্ট রেসতাত-এ পাঠাতে হবে।

দ্বিতীয় চিঠিটা লিখল ফেঞ্চ আর্মির একজন জেনারেলকে। এই ফ্রেঞ্চ জেনারেল কিছু ব্যাপারে রানার প্রতি দুর্বল। লেবাননে পাঠানো জাতিসংঘের শান্তি বাহিনীতে ছিলেন তিনি, খ্রিস্টান ফ্যালাঞ্জিস্টদের গুলি খেয়ে গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন। রানা তাকে কাঁধে তুলে নেয়, তিন ঘন্টা হেঁটে, পৌঁছে দেয় হাসপাতালে। এই জেনারেলকেও একটা পার্সেলের জন্যে লিখল রানা।

.

কাল সকালে গোজো ছেড়ে চলে যাবে রানা।

স্কোয়াডের শেষ মহড়াটাও পরিচালনা করল ও। সবারই যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে, মেনিনো আর রানার সামনে আত্মবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়াল ব্রা, নিন্দার চেয়ে প্রশংসাই বেশি জুটল কপালে।

রানার এটা শেষ সেশন, তাই ফেয়ারওয়েল ড্রিঙ্কের জন্যে জেদ ধরল ওরা। ফেরি ধরতে পারবে না বলেও এড়াতে পারল না রানা, ওর জন্যে আগেই মাল্টা। নেভির একটা পেট্রল বোট তৈরি রাখা হয়েছে, গোজোয় পৌঁছে দেবে ওকে। মেনিনো বলল, নিডোকে ফোন করেছিলাম, তাকে না পেয়ে ভায়োলার সাথে কথা। হয়েছে আমার। আপনাকে ফেয়ারওয়েল জানাবার জন্যে রুচিতাস-এ অপেক্ষা করবে সবাই।

স্কোয়াডের অনুষ্ঠান শেষ হতে রাত আটটা বেজে গেল। এক সময় রানাকে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে মেনিনো বলল, মাল্টায়, বিশেষ করে গোজোতে আপনার অনেক বন্ধু রয়েছে, মি. হাসান। আপনি যে কাজে যাচ্ছেন, তার ফলাফল যাই হোক, কথাটা কিন্তু ভুলবেন না।

ভুলব না,বলল রানা। অসংখ্য ধন্যবাদ।

গোজোয় পৌঁছে রানা দেখল আলফানসো আর মিলানো ওর জন্যে জেটিতে অপেক্ষা করছে, ওকে রুচিতাস-এ নিয়ে যাবে। বারের কাছাকাছি পৌঁছে হতবাক হয়ে গেল রানা। বারের ভেতর একশো জনের ওপর লোক ধরে, অথচ জায়গা না পেয়ে বহু লোক বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। ওকে দেখেই উমো এসেছে, উমো এসেছে বলে একটা চাপা গুঞ্জন উঠল ভিড়ের ভেতর থেকে।

উমো এসেছে মানে? জিজ্ঞেস করল রানা।

তোমার ডাক নাম, বলল আলফানসো।

 মানেটা জিজ্ঞেস করতে হল না, জানে রানা ইটালিয়ান ভাষায় উমো মানে, পুরুষ। সেই সঙ্গে মনে পড়ল, বহিরাগত কাউকে ডাকনাম দেয়া হয় না।

 রানার সাথে যাদের বন্ধুত্ব হয়েছে তারা তো আছেই, গোজোর কৃষক আর জেলেরাও দলবেধে ফেয়ারওয়েলু জানাতে এসেছে রানাকে। কোথায় যাচ্ছে ও, কেন যাচ্ছে, কি করতে যাচ্ছে, কিছুই কাউকে বলেনি রানা, অথচ সবাই যেন সব কিছু জানে। প্রসঙ্গটা কেউ তুলল না বটে, কিন্তু হাবভাব দেখে বোঝা গেল, রানার প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থনও আছে।

দরজার কাছে একটা টেবিলে বসেছে নিডোভায়োলা, অনোরিয়া আর তাজা। বারটেণ্ডার সাকো মগভর্তি বিয়ার ধরিয়ে দিল রানার হাতে, বলল, আমার তরফ থেকে।

রানা জিজ্ঞেস করল, তুমি?

ক্ষতি কি!

হাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। চেয়ার ছেড়ে উঠল ভায়োলা, তার কাঁধে একটা। ব্যাগ। রানার হাতে একটা টেলিগ্রাম ধরিয়ে দিল সে। প্যারিস থেকে জেনারেল। পাঠিয়েছেন। রানার অনুরোধ রক্ষা করেছেন তিনি।

খানিক পর বিদ্রোহী এসে ওর কাঁধে হাত রাখল, বলল, একটু বাইরে। আসবে? তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে।

বার থেকে বেরিয়ে নির্জন একটা জায়গার খোঁজে বেশ কয়েক পা হেঁটে আসতে হল ওদেরকে। কি ব্যাপার, কালো?জানতে চাইল রানা।

রানার সামনে ছোটখাট একটা পাহাড়ের মত লাগল বিদ্রোহীকে। উমো, ভারি গলায় বলল সে, কখনও যদি তোমার সাহায্য দরকার হয়, আর প্রথমে যদি। আমাকে না ডাক, আমি কিন্তু ভীষণ রাগ করব, হ্যাঁ।

রানা হাসল। তোমাকেই প্রথমে ডাকব, কথা দিলাম।

মাথা ঝাঁকাল বিদ্রোহী। স্রেফ রুচিতা’স-এ একটা তার পাঠিয়ে দেবে, সাকো জানে কোথায় আমাকে পাওয়া যাবে।

আবার বারে ফিরে এল ওরা। এরপর একে একে কিন্তু, ক্ষতি কি, গুঁফো, অক্লান্ত আর হাজির একইভাবে আড়ালে ডেকে নিয়ে একই কথা বলল রানাকে। সবাই ওরা সাহায্য করতে চায় রানাকে।

শেষবার বারে ফিরে এসে পাজেরো তাজাকে একপাশে ডেকে নিল রানা, বলল, তুমি আমার কাছে টাকা পাও, তাজা।

প্রৌঢ় অবাক হয়ে তাকাল, কিসের টাকা?

 তোমার বাড়িতে এতদিন থাকলাম, খেলাম–এ-সবে টাকা লাগে।

একগাল হাসল তাজা। তা ঠিক। বেশ, হপ্তায় পনেরো পাউণ্ড চার্জ করলাম। আমি–এদিকে ফার্ম লেবাররা ওই পনেরো পাউণ্ডই মজুরি পায়, তারমানে কাটাকাটি হয়ে গেল। কথা শেষ করে বার কাউন্টারের দিকে চলে গেল সে। অসহায়ভাবে কাধ ঝাঁকাল রানা।

রাত বারোটার আগেই নিডো আর অনোরিয়াকে নিয়ে চলে গেল তাজা। ল্যাণ্ড রোভারটা ভায়োলা আর রানার জন্যে থাকল। বিদায় সম্বর্ধনা শেষ হতে দুটো বাজল। সবার কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিল রানা, আবার একবার করে সবাইকে কথা দিতে হল, সাহায্য দরকার হলে প্রথমে গোজোর বন্ধু-বান্ধবদের স্মরণ করবে ও। সবশেষে ভায়োলা ওর হাত ধরল, টেনে বের করে আনল বার। থেকে। পিছন দিক থেকে কে যেন বলল, জোড়া কিন্তু দারুণ মানিয়েছে, তাই না?

পাহাড়ী পথ ধরে ধীরে ধীরে উঠছে ল্যাণ্ড রোভার, ভায়োলাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছে রানা। প্রচুর বিয়ার খেয়েছে ও, কিন্তু নেশা হয়নি। ভায়োলা খুব বেশি খায়নি, কিন্তু বারে থাকতেই তার চোখে ঢুলু ঢুলু একটা ভাব লক্ষ করেছে ও। গভীর রাত, চারদিকে নির্জন বন-জঙ্গল, আর নিস্তব্ধ পাহাড়। শুধু কৌতূহল নয়, সেই সাথে পুলক অনুভব করল রানা। ভাবল, কি ব্যাপার, এভাবে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেন ভায়োলা?

আর ভায়োলা ভাবছে, দিন তো বেশ কটা কাটল, এখনও আমার মন বুঝতে পারেনি ও? অনেক বছর পর একজন পুরুষ আমাকে মুগ্ধ করেছে, কিন্তু সে কি সত্যি নির্লোভ দেবতা? নাকি ভালবাসতে জানে না, শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে? এত কাছাকাছি থাকি, কিন্তু স্পর্শটুকুও পাই না–একি ওর ভদ্রতা, নাকি অনীহা? কিন্তু আমি তো অসুন্দরী নই! আমাকে পাবার জন্যে কত লোকই তো পাগল। তবে কি অহঙ্কারী ও? আশা করছে, প্রথম নিবেদন আমার তরফ থেকে আসুক?

পাহাড়ের মাথায় উঠে এল ল্যাণ্ড রোভার। ভায়োলার দৃষ্টি এখনও অনুভব করছে রানা। ভাবছে, ও কিছু বলে না কেন? কি করে বুঝব আমি ওকে কাছে টানলে ফোঁস করে উঠে ফণা তুলবে না? ওদের পরিবারের সবাই খুব সরল, আমার সাথে ওর এই ঘনিষ্ঠতা হয়ত সেই সরলতারই প্রকাশ, এর মধ্যে হয়ত আর কিছু নেই। হাত বাড়াতে দেখলে যদি চরিত্রহীন বলে গাল দিয়ে বসে?

পাহাড়ের মাথা থেকে নিচে নেমে এল ল্যাণ্ড রোভার। ডান পাশে সাগর, খানিকটা দূরে, পাথরে ঢেউ আছড়ে পড়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। দুজনই ওরা আড়ষ্ট, ঘামছে একটু একটু, ঢোক গিলছে।

এভাবেই হয়ত বাড়ি ফিরত ওরা, বুকভরা বঞ্চনা আর অতৃপ্তি নিয়ে। কিন্তু ওদেরকে সাহায্য করল একটা জানোয়ার।

রাস্তা পেরোতে গিয়ে গাড়ির সামনে পড়ে গেল একটা শিয়াল। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক করল রানা। মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল শিয়ালটা, তারপর ঘুরে যেদিক। থেকে এসেছিল সেদিকেই ছুটে পালাল। ঝাঁকি খেয়ে রানার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ভায়োলা। গিয়ার পাল্টে আবার গাড়ি ছাড়তে গিয়ে অনুভব করল ও, ভায়োলার দুই হাত ওকে ছেড়ে না দিয়ে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে। হাত দুটো স্টিয়ারিং হুইল থেকে নামিয়ে নিল রানা।

এঞ্জিন বন্ধ হল। খুলে গেল মনের দুয়ার।

রানার কাঁধের ওপর মাথা রাখল ভায়োলা, ভায়োলার পিঠের ওপর ভাঁজ করা কনুই আর কাঁধের ওপর হাত রাখল রানা। কিছুক্ষণ কেউ নড়ল না। তারপর কাঁধে। রানার হাতের চাপ অনুভব করল ভায়োলা। রানার কাঁধ থেকে মুখ তুলল সে, ঠোঁট জোড়া ফাঁক হয়ে আছে। তাকে বুকে টেনে নিল রানা, দুই জোড়া ব্যাকুল ঠোঁট এক হল।

প্রথমে দীর্ঘ একটা চুমো–প্রচণ্ড তৃষ্ণায় এক ফোঁটা বৃষ্টির মত। তারপর মুষলধারে শুরু হল, উন্মত্ত আবেগে দুজনেই দিশেহারা।

তারপর এক সময় থামল ওরা। একবার যখন জ্বলেছে, এ আগুন নেভাতেও হবে।

শুনতে পাচ্ছ? ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করল ভায়োলা।

কিসের কথা বলছে ভায়োলা বুঝতে না পারলেও, আন্দাজ করতে পারল রানা, অস্ফুটে বলল, হ্যাঁ। সাগর আমাদের ডাকছে। কিন্তু সাথে যে সুইমস্যুট নেই?

দরকার কি। বলেই রানার বুকে মুখ লুকাল ভায়োলা।

কেউ দেখলে চোখ কপালে উঠত তার, জড়াজড়ি করে গাড়ি থেকে নামার সময় কিম্ভূত আকৃতির দুমুখো একটা প্রাণী মনে হল ওদেরকে, যেন প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়াল একটা।

 খুদে ইনলেটে চলে এল ওরা। পানির ওপর ঝুলে থাকা পাথরে দাঁড়িয়ে থাকল, দুটো শরীর পরস্পরের সাথে সেঁটে আছে। ডাইভ দিল না, ঢালু পাথরের ওপর থেকে গড়াতে গড়াতে দুজন একসাথে ঝুপ করে পড়ল সাগরে।

পাহাড়ের এক কোণ থেকে সবই দেখল চাঁদ মামা। কানের পাশে ফিস ফিস করে সায় দিল ফুরফুরে বাতাস। গম্ভীর, ভরাট আওয়াজ তুলে একের পর এক ছুটে এল ঢেউগুলো, পিঠে তুলে নিল প্রকৃতির দুই নগ্ন সন্তানকে।

সাগর থেকে উঠে পাথরের ওপর পাশাপাশি শুয়ে থাকল ওরা। দম ফিরে। পেতে একটু সময় নিল দুজনেই। সাগর থেকে উঠে সমতল পাথরের ওপর শুয়ে থাকল ওরা। দম ফিরে পেয়ে প্রথমে কথা বলল ভায়োলা।

অনেক কথা বলতে চাই, কিন্তু কিভাবে বলতে হয় জানি না।

আমি তোমাকে ভালবাসি, এভাবে শুরু করতে পার, মুচকি হেসে উৎসাহ দিল রানা।

কিন্তু হাসল না ভায়োলা, তবে সিরিয়াস দেখাল। একবার ঠকেছি, আর নয়–নিজেকে কারও সাথে বাধব না, কাউকে বিয়ে করব না, এভাবে যদি শুরু করি?

তাহলে জিজ্ঞেস করব, কাছে এলে কেন, কেন টানলে?

ভাল লেগেছে, তাই, ভায়োলার সরল জবাব। যতদিন তোমাকে ভাল লাগবে, আমি তোমার। কাছে গেলে যদি বুকে টেনে নাও, খুশি হব, কৃতজ্ঞবোধ করব। যদি ফিরিয়ে দাও, আহত হব, কিন্তু অভিশাপ দেব না ভালবাসার দাবি নিয়ে তোমাকে দখল করতে চাই না।

কিন্তু জীবন? ভবিষ্যৎ?

সে তো তোমাকে দেখার আগেই একটা ছকে ফেলে সাজিয়ে রেখেছি, বলল ভায়োলা। বিয়ে নয়, বাঁধন নয়, মুক্ত-স্বাধীন জীবন। আর ভবিষ্যৎ? হ্যাঁ, ভবিষ্যৎও ঠিক করা আছে, তবে তোমাকে দেখার পর একটু বদলাবে। আগের প্যানে কারও জন্যে অপেক্ষা ছিল না, এখন থাকবে। জানি, চলে যাবে তুমি। আর হয়ত কোন দিন দেখা হবে না। কিন্তু তবু আমি অপেক্ষা করব। যদি কখনও ফের, নিজেকে নিবেদন করে ধন্য হব। আর যদি না ফের, চলতে থাকবে অপেক্ষার পালা, শেষ হবে. সেই যেদিন মৃত্যু এসে ডেকে নিয়ে যাবে আমাকে।

কাছের ঝোপটা হঠাৎ নড়ে উঠতে দুজনেই ওরা চমকে উঠে তাকাল। সেই। ধাড়ী শিয়ালটা ঝোঁপের আড়াল থেকে মুখ বের করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।

দেখছ, কি রকম বিরক্ত হয়েছে ব্যাটা?

কেন, বিরক্ত হবে কেন? চোখ বড় বড় করল ভায়োলা।

ওদের মধ্যে বোধহয় এত দেরি করার রীতি নেই, হাসি চেপে বলল রানা। আমরা শুধু কথা বলে সময় নষ্ট করছি, আসল কাজের নামও নিচ্ছি না, বিরক্ত হবে না তো কি!

 হাত মুঠো করে কিল তুলল ভায়োলা, ঝট করে ভায়োলারই বুকের ভেতর মুখ লুকাল রানা। কিলটা পড়ল রানার চওড়া, ভিজে পিঠে। ভায়োলার বুকের ভেতর আরও একটু সেঁধিয়ে গেল রানার নাক-মুখ।

হুক্কা-হুয়া করে একটা ডাক ছাড়ল শিয়ালটা, তারপর ঝোপ টপকে ছুটল। বোধহয় সঙ্গিনীর খোঁজে।

রানা আর ভায়োলা তখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত।

.

কি যেন জিজ্ঞেস করল ভায়োলা, অন্যমনস্ক ছিল বলে শুনতে পায়নি রানা। চাঁদের আলোয় ওদের নগ্ন শরীর ঘামে চকচক করছে। রানার পাশেই ভাঁজ করা হাঁটুর উপর চিবুক ঠেকিয়ে বসে আছে ভায়োলা। শান্ত, মৃদু কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করল রানা।

বলল কোথায় যাচ্ছে ও, কেন যাচ্ছে। নেপলসে যখন এল তখন ওর মানসিক আর শারীরিক অবস্থা কি ছিল। রেমারিক আর রিসো কিভাবে ওকে যোগাড় করে দিল কাজটা। প্রথম দিকে লুবনার সঙ্গে কি রকম কঠোর ব্যবহার করেছিল ও, কিন্তু। ছোট্ট মেয়েটা কিভাবে ধীরে ধীরে তার মন জয় করে নেয়।

এসব কথা ভায়োলাকে কেন বলছে রানা, ও নিজেও বোধহয় ভাল করে জানে না। কারণ হয়ত ভায়োলার নিঃস্বার্থ আত্মনিবেদন, কিংবা হয়ত রাতের নির্জন। পরিবেশটাই এমন যে বিদায় লগ্নে মনের সমস্ত ভার লাঘব করার একটা অবকাশ তৈরি করে দিয়েছে।

লুবনাকে নিয়ে পিকনিকে যাবার ঘটনাটাও বলল রানা। সেদিন লুবনা ওকে ছোট্ট একটা কোরান শরিফ উপহার দিয়েছিল। ওর নির্বাচিত শব্দগুলো জ্যান্ত করে, তুলল লুবনাকে, চোখের সামনে মেয়েটাকে পরিষ্কার যেন দেখতে পেল ভায়োলা। চঞ্চল, কৌতূহলী, কথায় কথায় ঠোঁট ফোলায়, আবার অকারণ আনন্দে খিল খিল করে হেসে ওঠে।

তারপর, শেষ দিনটা। কিডন্যাপাররা লুবনার পথরোধ করে দাঁড়াল। গুলি খেয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে আছে রানা, চিৎকার করে ওর নাম ধরে ডাকল লুবনা সেই হাহাকার ধ্বনি আজও পরিষ্কার শুনতে পায় রানা। জ্ঞান ফিরল হাসপাতালে, জানে না বাচবে কিনা, কিন্তু বাঁচার প্রচণ্ড একটা আকুতি রয়েছে। এরপর রেমারিক এসে জানাল, লুবনা নেই। জানাল, কিভাবে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে।

আর বলল সেই গানের কথা; যে গান ওকে ঘুমাতে দেয় না।

ভাঁজ করা হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে ভায়োলা, তার লম্বা কালো চুলে। ঢাকা পড়ে আছে মুখ। অনেকক্ষণ হল চুপ করে গেছে রানা। পাথরের গায়ে বাড়ি খাওয়া বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর ছোট ছোট ঢেউ ভেঙে পড়ার আওয়াজ, মনে হল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে প্রকৃতি। মুখ তুলল ভায়োলা, চাঁদের ম্লান আলোয় তার চোখে পানি চিকচিক করতে দেখল রানা। দাতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলাবার। চেষ্টা করল ভায়োলা, রুদ্ধস্বরে বলল, মার, রানা! ওদের তুমি খুন কর! এমন, প্রতিশোধ নাও, মানুষ যেন শিউরে ওঠে!

ভাঁজ করা হাঁটুতে আবার মুখ ঢাকল ভায়োলা, তার পিঠ ফুলে ফুলে উঠল। লুবনার জন্যে কাঁদছে সে। উঠে বসেছে রানা, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাগরের দিকে, নির্বাক।

এক সময় শান্ত হল ভায়োলা। চোখ মুছে জিজ্ঞেস করল, যে-কাজে তুমি যাচ্ছ, ফিরে আসার সম্ভাবনা কতটুকু?

জানি না, অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল রানা। খুব কম, নেই বললেই চলে।

কিন্তু ফিরে তোমাকে আসতেই হবে…।

ভায়োলার বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল, মুখ ফিরিয়ে ওর দিকে তাকাল রানা। দেখল, ভায়োলার ঠোঁটের কোণে একটু ক্ষীণ হাসি লেগে রয়েছে।

ফিরে আসতে হবে, তোমার কাছে?

হ্যাঁ, হাসিটা আরও একটু বড় হল ভায়োলার মুখে। আমার কাছে। আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করব।

হেসে ফেলল রানা। চেষ্টার কোন ক্রটি করব না, কথা দিলাম।

যতদিন তুমি না ফের, রোজ সকালে চার্চে যাব আমি, অস্ফুটে বলল ভায়োলা। তোমার জন্যে প্রার্থনা করব।

.

০৩.

ভিনসেন্ট গগলের অফিস কামরায় একা দাঁড়িয়ে রয়েছে রানা, দেয়ালে সাঁটা অস্ত্রশস্ত্রের ছবি দেখছে। রিসেপশনে দুজন ক্রেতার সঙ্গে আলাপ করছে গগল, ওদেরকে বিদায় করে কথা বলবে রানার সাথে। অস্ত্র চোরাচালানের ব্যবসা আগের মতই চালু রেখেছে গগল, তবে আর্মস ডিলারের লাইসেন্স যোগাড় করে এখন সে ব্যবসাটাকে একটা বৈধ আবরণ পরিয়ে নিয়েছে।

কি চাই? ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল গগল। তীক্ষ্ণ চোখে রানার আপাদমস্তক লক্ষ করল সে। রানাকে চিনতে পারেনি। দেখল, ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে অচেনা লোকটা, আত্মবিশ্বাস, শরীর থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে শক্তি আর সাহস।

আমি মাসুদ রানা।

সামনে সাপ দেখলেও বোধহয় এতটা আঁতকে উঠত না গগল।

যা যা চেয়েছি সব যোগাড় হয়েছে? সরাসরি কাজের কথা পাড়ল রানা, বিস্ময় প্রকাশের কোন সময়ই দিল না গগলকে।

ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িতে হাত বুলিয়ে মাথা ঝাঁকাল গগল। হ্যাঁ। ঢালাও অর্ডার। দিয়েছিলে, কিছু কিছু আইটেমের বিকল্প যোগাড় করে রেখেছি, পছন্দমত বেছে নিতে পারবে। হাতঘড়ি দেখল সে। আগে লাঞ্চ সেরে নিই, তারপর ওয়্যারহাউসে যাব। ইতিমধ্যে ফোন করে দিলে আমার লোকেরা তোমার দেখার জন্যে সব বের করে রাখবে।

ঠিক আছে, বলল রানা।

অপেক্ষা করছে গগল, তার মনে হল আরও কি যেন বলবে রানা।

জাল কিছু কাগজ-পত্র লাগবে আমার, বলল রানা। ভাবছি…

পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, এই সব?

হ্যাঁ।

কঠিন কিছু না। কোন দেশের?

ফ্রেঞ্চ, কানাডিয়ান বা আমেরিকান, বলল রানা। ফ্রেঞ্চ আর ইংরেজি জানি, কাজেই তিন দেশের যে-কোন একটা হলে চলবে। সমস্যা অন্যখানে, ওগুলো। আমার খুব তাড়াতাড়ি দরকার–চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে।

আঙুলের গিঁট গুনতে শুরু করল গগল, অন্যমনস্ক। ফ্রেঞ্চ কাগজ হলে যদি চলে, এই সময়ের মধ্যে সম্ভব।

গুড।

ফটো?

জ্যাকেটের ভেতরের পকেট থেকে একটা এনভেলাপ বের করল রানা। বারোটা ফটো আছে এতে। সাধারণ একজন ফরাসী বিদেশে যেতে চাইলে যে-সব। কাগজ-পত্র লাগে, সব আমার দরকার হবে।

রানার হাত থেকে এনভেলাপটা নিয়ে একটা দেরাজে রাখল গগল। পাবে। অস্ত্রশস্ত্র বা কাগজ-পত্র কেন দরকার রানার জানতে চায়নি সে, চাইবেও না। রানাকে সে চেনে, কোথাকার পানি কোথায় গড়াবে অর্ডার দেখে আন্দাজ করে। নিয়েছে।

এ সবের জন্যে প্রচুর খরচ হবে তোমার, বুলল রানা। চেক বা…

ভেব না এসব তোমাকে আমি দান করছি, রানার একটা হাত ধরে দরজার দিকে এগোল গগল। সময় হলে ঠিকই আমি কিছু চাইব, বিনিময়ে। চল, লাঞ্চটা সেরে আসি।

কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই, জানে রানা। অস্ত্র আর কাগজ-পত্রের জন্যে কোন পয়সা নেবে না গগল। ভবিষ্যতে সুযোগ হলে এই ঋণ শোধ করতে হবে ওকে।

.

পরও রাতে বন পোয়ারোয় চড়ে মার্সেলেসে পৌচেছে রানা।

ট্যাক্সি নিয়ে সোজা রেলওয়ে স্টেশনে চলে এসেছে, ব্যাগেজ রূম থেকে কালো রঙের লেদার ব্রিফকেসটা সংগ্রহ করেছে। রেস্তোরাঁয় ঢুকে নির্জন এক কোণে বসে, কফির অর্ডার দিয়ে পকেট থেকে বের করেছে রেমারিকের চিঠিটা।

নাম্বার মিলিয়ে কমবিনেশন লক খুলেছে রানা। ভেতরে একটা বড়সড় ম্যানিলা এনভেলাপ, তাতে এক গোছা চাবি, একটা রোডম্যাপ আর দুইসেট কাগজ-পত্র। এক সেট কাগজ বিনো গারবান্ডির নামে–তার পাসপোর্ট, পরিচয় পত্র ইত্যাদি। লোকটা আমালফিতে বাস করে, তরি-তরকারি আমদানির ব্যবসা। আছে। দ্বিতীয় সেট কাগজ টয়োটা ভ্যানের জন্যে। রোড ম্যাপটা খুলল রানা। ম্যাপের গায়ে এখানে-সেখানে কালো কালি দিয়ে বৃত্ত রচনা করা হয়েছে, মার্জিনে লেখা রয়েছে বেশ কিছু নির্দেশ। দেখা শেষ করে আবার সব ব্রিফকেসে ভরে তালা লাগিয়ে দিল ও।

কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে রানা, কাঁচের পার্টিশন ভেদ করে প্ল্যাটফর্মে চলে গেছে ওর দৃষ্টি, কিন্তু ভাবছে রেমারিকের কথা। ওর সাহায্য ছাড়া এতসব আয়োজন করা কঠিন হত। ও জানে, বিনো গারবান্ডি বাস্তবেও একজন ব্যবসায়ী। হবে, ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি তার নাম আর পরিচয় ধার করা হয়েছে। পাসপোর্ট এবং অন্যান্য কাগজও নেপলসের সেরা জালিয়াতকে দিয়ে জাল করানো হয়েছে, কারও সাধ্য নেই খুঁত বের করে। রানা জানে, নেপলসে পৌঁছে সে দেখবে সব একেবারে তৈরি অবস্থায় আছে। এক হপ্তা পর শুরু হবে আগুন নিয়ে খেলা।

ভ্যানটা সম্ভবত ফুরেলা চালিয়ে নিয়ে এসেছে মার্সেলেসে, আন্দাজ করল রানা। ফুরেলার নিরাপত্তার ব্যাপারটা নিয়ে রেমারিকের সঙ্গে আলাপ করতে হবে, নিজেকে মনে করিয়ে দিল ও।

রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে পোস্ট অফিসে এল রানা, ঢাকা আর প্যারিস থেকে আসা পার্সেল দুটো সংগ্রহ করল। বিনো গারবান্ডির নাম ভাড়িয়ে একটা হোটেলে উঠল ও।

পাথরের মেঝে, অনেক ওপরে ইস্পাতের সিলিং, ওদের পায়ের আওয়াজ প্রতিধ্বনি তুলে ফিরে আসছে। চারদিকে পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে আছে কাঠের বাক্স, সার সার বাক্সের মাঝখানে গোলকধাঁধা তৈরি করেছে অসংখ্য প্যাসেজ। নাকে পরিচিত একটা গন্ধ ঢুকল–মেটালের সাথে গ্রিজের মাখামাখি হলে এই তামাটে গন্ধ পাওয়া যায়। ইস্পাতের ভারি একটা দেয়াল ওয়্যারহাউসটাকে দুভাগে ভাগ করে রেখেছে, দেয়ালের মাঝখানে পাঁচ সের ওজনের বড় একটা তালা। তালা খুলে একটা বোতামে চাপ দিল গগল। মাথার ওপর এক সঙ্গে জ্বলে উঠল ডজনখানেক নিয়ন টিউব। দুটো স্টীল টেবিল দেখা গেল; একটা খালি, অপরটা নানা ধরনের অস্ত্রশস্ত্র আর ইকুইপমেন্টে ঢাকা পড়ে আছে।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকল গগল, তাকে পাশ কাটিয়ে দ্বিতীয় টেবিলের সামনে চলে এল রানা। আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর ওপর প্রথমে একবার চোখ বুলিয়ে নিল ও, তারপর এক এক করে পরীক্ষা করল। প্রথম সেট, পিস্তল। ওর পাশে এসে দাঁড়াল গগল।

ছোট, হালকা আর ফরটি-ফাইভ ক্যালিবার চেয়েছিলে তুমি, বলল সে। বেছে নাও।

বিভিন্ন দেশের তৈরি বারোটা পিস্তল রয়েছে টেবিলে, সাইলেন্সর রয়েছে। কয়েক ধরনের। একটা কোল্ট, উনিশশো এগারো, আর একটা ব্রিটিশ ওয়েবলি, পয়েন্ট থ্রি-টু, হাতে নিল রানা। দ্বিতীয়টা ওকে হাতে নিতে দেখে একটু যেন বিস্মিত হল গগল।

জানি, বলল রানা। সেকেলে। কিন্তু এটার ওপর নির্ভর করা যায়। পিছনের খালি টেবিলে পিস্তল দুটো রাখল ও। এরপর এক জোড়া সাইলেন্সর বাছল, সে দুটোও রাখল পিস্তলের সঙ্গে। প্রতিটার জন্যে পঞ্চাশ রাউণ্ড করে গুলি লাগবে।

ছোট্ট একটা প্যাড আর বল-পয়েন্ট পেন বের করে লিখতে শুরু করল গগল। রানা ওদিকে সাবমেশিনগান পরীক্ষা করছে। চার ধরনের সাবমেশিনগান রয়েছে ইসরায়েলি উজি, ব্রিটিশ স্টার্লিং, ডেনিশ ম্যাডসেন, ইনগ্রাম মডেল টেন। দ্রুত হাতে শেষেরটা তুলে নিল রানা। মেটাল বাট ভাজ করা অবস্থায় রয়েছে, গোটা অস্ত্রটা মাত্র সাড়ে দশ ইঞ্চি লম্বা। সাবমেশিনগান, কিন্তু দেখতে বড় একটা। পিস্তলের মত, ফায়ারিং রেট প্রতি মিনিটে এগারোশো।

আগে ব্যবহার করেছ? জানতে চাইল গগল।

মাথা ঝাঁকাল রানা। এর সবচেয়ে বড় সুবিধে, ছোট। এর জন্যে সাপ্রেসর লাগবে, আছে?

দিন দুয়েকের মধ্যে যোগাড় হয়ে যাবে।

এরপর স্নাইপার রাইফেল। গগলের কালেকশনে রয়েছে এম ফোরটিন এর উন্নত সংস্করণ, সাথে উইভার সাইট। আর রয়েছে ব্রিটিশ এল-ফোর-এ-ওয়ান, সাথে স্ট্যাণ্ডার্ড থারটি টু সাইট। এম ফোরটিন বেছে নিল রানা। বলল, কারট্রিজের স্ট্যাণ্ডার্ড একটা বাক্স আর দুটো স্পেয়ার ম্যাগাজিন।

রকেট লঞ্চারের দিকে সরে এল ওরা। রানা বলল, আর. পি. জি. সেভেন দরকার আমার।

নিঃশব্দে হাসল গগল, বেঁটে আর মোটাসোটা একটা টিউব তুলে নিল হাতে। যোগাড় করতে পারলে লাখ দশেক বিক্রি করতে পারতাম। টিউবের দুই প্রান্ত। ধরে মোচড় দিল সে, মাঝখানে খুলে গেল সেটা। সন্তুষ্ট হয়ে মাথা আঁকাল রানা। চমৎকার, স্ট্রোক ডি। মিসাইলের স্ট্যাণ্ডার্ড প্যাকিং কি রকম?

দুরকম বাক্স, আটটা আর বারোটা ধরে, বলল গগল। লঞ্চারটাকে জোড়া। লাগিয়ে ইনগ্রামের পাশে শুইয়ে রাখল সে।

তাহলে আটটার একটা বাক্স দাও। গ্রেনেডের সামনে এসে দাঁড়াল রানা। ব্রিটিশ ফ্র্যাগমেন্টেশন থারটি সিক্স আর ফসফরাস এইটি সেভেন বেছে নিল ও। গ্রেনেডের প্যাকিং স্ট্যাণ্ডার্ডের চেয়ে ছোট হলে ভাল হয়, এক-একটা বাক্সে গোটা পনেরো ধরলেই চলবে। মোট ত্রিশটা।

ঠিক আছে।

এরপর রানা একটা ডাবল ব্যারেল শটগান তুলল, ব্যারেল আর স্টক ছোট করা হয়েছে। ব্রিচ খুলে আলোর সামনে ধরল ও, পরীক্ষা শেষে বন্ধ করে রেখে। দিল গ্রেনেডগুলোর পাশে। একজোড়া এস. এস. জি.-র বাক্স। প্যাডে লিখে নিল, গগল।

নেড়েচেড়ে দেখে একটা ট্রাইলাক্স নাইট সাইট, খাপে ভরা একটা কমান্ডো নাইফ আর কয়েক ধরনের ওয়েবিং নির্বাচন করল রানা। সবশেষে, টেবিলের শেষ। মাথায় পৌঁছে, গভীর একটা মেটাল ট্রে-র তলা থেকে খুদে আকৃতির কয়েকটা জিনিস তুলে মনোযোগের সাথে পরখ করল।

ওগুলো একেবারে লেটেস্ট, রানার কাঁধের কাছ থেকে বলল গগল। এর আগে বোধহয় দেখনি?

রানার হাতে হোট একটা সার্কুলার টিউব। টিউবের এক প্রান্ত থেকে, সরু একটা সূঁচ আধ ইঞ্চি বেরিয়ে আছে।

এ-ধরনের ডিটোনেটর ব্যবহার করেছি, বলল রানা। কিন্তু টাইমারটা এই প্রথম দেখছি।

আরেকটা মেটাল টিউব তুলে নিল গগল। এটার এক জোড়া কাঁটা রয়েছে, ইলেকট্রিক প্লাগের মত। স্কু খুলে রানাকে ক্যাডমিয়াম সেল ব্যাটারি, আর দুটো ডায়াল দেখাল. সে। তরপের ডিটোনেটরে টাইমারের প্রাগ ঢুকিয়ে দিল। জোড়া লাগানো জিনিসটা মাত্র দুইঞ্চি লম্বা, আর ডায়ামিটারে পৌনে এক ইঞ্চি। ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে বলল সে, ইলেকট্রনিক্সের বদৌলতে এ-সব একেবারে পানির মত সহজ হয়ে গেছে। রেমারিক এক কিলো প্লাস্টিক-এর কথা বলেছিল। যোগাড় হয়েছে, কিন্তু রেখেছি আরেক জায়গায়।

গুড, বলল রানা। ঘাড় ফিরিয়ে দ্বিতীয় টেবিলের দিকে তাকাল ও। আর দরকার নেই আমার।

টেবিলের দিকে গগলও তাকাল। বন্ধুর চাহিদা মেটাতে পেরে সে তৃপ্ত।

ওয়েবলির জন্যে হালকা একটা শোল্ডার-হোলস্টার দিতে পারবে? জিজ্ঞেস করল রানা। আর কোল্টের জন্যে একটা বেল্ট হোলস্টার?

পারব, বলল গগল। কোল্টের জন্যে স্ট্যাণ্ডার্ড ইস্যু ক্যানভাস।

 চলবে। একটা টেপ মেজার আর নোট বুক বের করল রানা। স্কেল আছে?

আছে, বলে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল গগল। টেপ মেজার নিয়ে কাজ শুরু করল রানা।

.

রোড ম্যাপে চোখ রেখে ড্রাইভারকে বলল রানা, রুসেন্ট অনুরির মোড়ে নামবে ও। হোটেলে গিয়ে কাপড় বদলে এসেছে, পরনে এখন ডেনিম জিনস আর শার্ট। শহরের মাঝখান দিয়ে পুব দিকে যাচ্ছে ট্যাক্সি। মার্সেলেসকে একটা কারণে ওর। পছন্দ, রাস্তাঘাট লোকে লোকারণ্য-যে-কোন লোক পরিচয় গোপন করে এই ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে। এই শহরের লোকেরা নিজেদের চরকায় তেল। দিতে পছন্দ করে, কারও সাতে-পাচে নেই। আর্মস আর ড্রাগস স্মাগলারদের জন্যে এটা একটা আদর্শ শহর।

পেভমেন্টের পাশে থামল ট্যাক্সি, ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নামল রানা। বাঁক নিয়ে দশ মিনিট হাঁটল ও, পৌঁছে গেল রু কাটিনাট-এর মোড়ে। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রাস্তাটা ভাল করে দেখে নিল ও।

শহরের বাইরে, শ্রমিকদের আবাসিক এলাকা। রাস্তার দুপাশে পাঁচ-সাত তলা। বিল্ডিং, নিচে ছোটখাট ওয়র্কশপ, কারখানা আর গ্যারেজ। ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করল রানা। দশ মিনিট পর তালা দেয়া একটা গ্যারেজের সামনে থামল ও, দুপাশে আরও কয়েকটা করে গ্যারেজ রয়েছে, সবগুলো বন্ধ। গ্যারেজের দরজায় লেখা নাম্বারটা দেখল-দশ। কোন দিকে না তাকিয়ে চাবি বের করল ও, তালা। খুলে ভেতরে ঢুকল। আলো না জ্বেলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, কিন্তু কোন শব্দ পেল না।

আলো জ্বালার পর দেখল, গ্যারেজের বেশিরভাগ জায়গা দখল করে নিয়েছে এক টয়োটা ভ্যান। গাঢ় খয়েরি রঙ করা, এক পাশে বড় বড় অক্ষরে লেখাটা ঝাপসা হয়ে গেছে বিনো গারবান্ডি, ভেজিটেবল ডিলার।

 পুরানো আর তোবড়ানো হলেও রানা জানে, ভ্যানের এঞ্জিন আর, সাসপেনশনে কোন খুঁত নেই। পিছনের দরজা খুলল ও। সামনেই ভ্যানের। মেঝেতে রয়েছে ইলেকট্রিক্যাল কর্ডের একটা কয়েল, প্রাগ সহ। আপন মনে একটু হাসল ও, বুদ্ধি করে আলোর ব্যবস্থাও করে রেখেছে রেমারিক। ভ্যানে চড়ল রানা, প্রাগটা তুলে নিয়ে দেয়ালের গায়ে ফিট করা সকেটে ঢোকাল। বাবটা জ্বলে উঠে আলোকিত করে তুলল বাকি সব জিনিস। লম্বা সাইজের কিছু কাঠ, তুলো ভরা। কয়েকটা বস্তা, ফেল্টের লম্বা একটা রোল, কাঠের একটা বেঞ্চ আর একটা টুলবক্স।

এক এক করে ভ্যান থেকে সব নামাল রানা। তারপর কমপার্টমেন্টের সামনে। এসে প্যানেলিংটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল, এই প্যানেলিং-ই ড্রাইভারের সিটের পিঠ হিসেবে কাজ করছে। টুলবক্স থেকে একটা স্ক্রু-ড্রাইভার নিয়ে এল ও, প্যানেলের রঙ নাচটিয়ে গর্তে লুকিয়ে থাকা বারোটা ভ্রু খুলল। আস্তে করে খসে পড়ল ফলস। প্যানেল, সামনে দেখা গেল এক ফুট গভীর আর লম্বা-চওড়ায় কমপার্টমেন্টের। সমান একটা ফাঁকা জায়গা। গুড, বিড়বিড় করে বলল রানা, প্যানেলটা ভ্যান। থেকে নামিয়ে গ্যারেজের দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখল। এরপর টেপ মেজার আর নোটবুক বের করে চোরা-কুঠরির নিখুঁত মাপ নিল ও।

আগে নোট করা মাপজোখের সঙ্গে চোরা কুঠরির মাপ মিলিয়ে দ্রুত হাতে একটা নক্সা আঁকল রানা, গ্যারেজের দরজায় সেঁটে দিল সেটা। পরবর্তী দুঘন্টা কোন বিরতি ছাড়াই কাজ করে গেল ও। টেপ মেজার দিয়ে মাপ নিল, তারপর ছোট একটা পাওয়ার স দিয়ে কাটল কাঠগুলো।

কাজটা উপভোগই করছিল রানা, কিন্তু বন্ধ গ্যারেজের ভেতর গুমোট হয়ে উঠল পরিবেশ। বাইরে ইতিমধ্যেই অন্ধকার নেমেছে, খোলা বাতাসে দশ মিনিট হেঁটে ছোট একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকল ডিনার খাবে বলে।

পরদিন সকাল আটটায় গ্যারেজে ফিরে এল ও, কাজ করল দুপুর পর্যন্ত। সেই ছোট রেস্তোরাঁতেই লাঞ্চ সারল, ওর মত একই ধরনের নোংরা কাপড় পরে আরও অনেকে খেতে এসেছে।

বিকেল নাগাদ কাজটা শেষ করল রানা। কাঠের একটা ভারি ফ্রেম তৈরি করেছে ও, চোরা কুঠরিতে সেটা ঢুকিয়ে দেয়া হল। ফ্রেমের গায়ে অনেকগুলো ঘর। রয়েছে, আলগা কাঠের টুকরোগুলো বসে গেল খাপে খাপে। পিছিয়ে এসে হাতের কাজটা খুঁটিয়ে দেখল ও। বাচ্চাদের খেলনা, অসমাপ্ত একটা গোলকধাঁধার মত দেখাল কমপার্টমেন্টটাকে। খোপগুলো বৃহস্পতিবারে ভরবে ও।

.

বৃহস্পতিবার।

একজন গার্ডকে সাথে নিয়ে অপেক্ষা করছে গগল। রাস্তায় আর কেউ নেই। রাত দশটা পাঁচে গাঢ় নীল রঙের একটা ভ্যান বাঁক নিয়ে এগিয়ে এল, থামল একশো মিটার দূরে। হেডলাইটের আলো দুবার জ্বলে উঠে নিভে গেল, আর জ্বলল না।

ওই মোড়ে গিয়ে অপেক্ষা কর, গার্ডকে বলল গগল। ভ্যান চলে গেলে তবে ফিরবে। অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল গার্ড, এবার ভ্যানটা এগিয়ে আসতে শুরু করল।

সব ঠিক? ক্যাব থেকে লাফ দিয়ে নামল রানা।

ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকিয়ে ওয়্যারহাউসের তালা খুলল গগল। দরজার কাছেই। একটা ফর্ক লিফটের ওপর তিনটে কাঠের প্যাকিং কেস রয়েছে–এ. বি. আর. সি. লেখা। এক এক করে তিনটের দিকেই আঙুল তাক করল গগল। অ্যামুনিশন, উইপনস, আদার ইকুইপমেন্টস। দুমিনিটের মধ্যে বাক্সগুলো ভ্যানে তোলা হল, রানাও উঠে বসল ক্যাবে।  

মুখ তুলে রানার দিকে তাকাল গগল। কাল বিকেলে আমার অফিসে এসে কাগজ-পত্রগুলো নিয়ে যেয়ো।

ঠিক আছে, বলে ভ্যান ছেড়ে দিল রানা।

শহরের ভেতর চল্লিশ মিনিট ভ্যান নিয়ে ঘুরল ও বারবার স্পীড কমাল আর বাড়াল, অপ্রত্যাশিতভাবে বাঁক নিল কয়েকবার। না, কেউ ওর পিছু নেয়নি। রু কাটিনাটে পৌঁছে গ্যারেজটাকে পাশ কাটাল রানা, আরও পঞ্চাশ মিটার এগিয়ে। তারপর থামল। এঞ্জিন বন্ধ করল ও, আলো নেভাল, চুপচাপ আধ ঘন্টা বসে থাকল ড্রাইভিং সিটে–তীক্ষ্ণচোখে চারদিকটা দেখছে, কান দুটো সজাগ। এরপর স্টার্ট। দিয়ে পিছিয়ে আনল ভ্যান, দাঁড় করাল গ্যারেজের দরজার সামনে। বাক্সগুলো। গ্যারেজে রেখে তালা দিল দরজায়, ভ্যান নিয়ে রওনা হল হোটেলের দিকে। ধীর। গতিতে ভ্যান চালাল ও, একটা চোখ থাকল রিয়ার ভিউ মিররে।

সকালে ভাড়া করা ভ্যানটা ফেরত দিয়ে গ্যারেজে চলে এল রানা। বাক্স তিনটে খুলল ও। এক এক করে আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ আর গ্রেনেড বের করে। যার যার বরাদ্দ করা জায়গায় খাপে খাপে বসিয়ে দিল। ফ্রেম আর ইকুইপমেন্টের মাঝখানে যেখানে যত ফাঁক-ফোকর দেখল, সব তুলো দিয়ে ভরল ও। এরপর গোটা ফ্রেমের সামনে ফেল্টের একটা পর্দা ঝুলিয়ে দিল। ফলস্ প্যানেলটা ভ্যানে। তুলল ও, জায়গামত বসিয়ে এক এক করে এটে দিল বারোটা স্কু। কাজ সেরে প্যানেলের গায়ে কয়েক বার ঘুসি মারল ও। ফাপা নয়, নিরেট আওয়াজ হল। সন্তুষ্ট এবার রানা। ওর অস্ত্রের বাহন এখন তৈরি।

.

রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে দোল খাচ্ছিল গুগল, ভেতরে ঢুকল রানা। ওকে দেখে সিধে হয়ে বসল গগল, চোখ-ইশারায় সামনের একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলল। কফি?

না।

গগল আর দ্বিতীয়বার সাধল না। ডেস্ক থেকে একটা এনভেলাপ তুলে বাড়িয়ে দিল রানার দিকে। কাগজগুলো অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করল রানা। তারপর মুখ তুলে বলল, খুবই ভাল হাতের কাজ।

গগলের ঠোঁটে ক্ষীণ একটু তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। খানিক ইতস্তত করে জানতে চাইল সে, তোমার আর কি কাজে লাগতে পারি আমি?

মাথা নাড়ল রানা। আর কিছুর দরকার নেই আমার। ভাল কথা, এই পাসপোর্ট আর কাগজগুলোর ব্যাপারে রেমারিকও যেন কিছু না জানে।

এবার সরাসরি প্রশ্ন করল গগল, মস্ত বড় একটা ঝুঁকি নিতে যাচ্ছ তুমি, কিন্তু কারও সাহায্য চাইছ না কেন?

চাইছি না মানে? রেমারিক আর তুমি সাহায্য করছ না?

আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছ তুমি, বলল গগল। এসব যোগান দেয়ার মধ্যে কোন বিপদ নেই। আমি বলতে চাইছি।

চেয়ার ছেড়ে উঠল রানা। এ আমার একার যুদ্ধ, গগল।

দুই বন্ধু পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর মাথা ঝাঁকাল গগল। রানা কি বলতে চায় উপলব্ধি করেছে সে।

বিদায়ের মুহূর্তে করমর্দনের জন্যে হাত বাড়াল গগল, রানাও তাকে ধন্যবাদ জানাল না। উপকার, উপকারের বিনিময়ে উপকার, এরই ওপর ভিত্তি করে ওদের বন্ধুত্ব। পরস্পরকে ওরা শ্রদ্ধা করে, কেউ কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলায় না। অদ্ভুত একটা সম্পর্ক, কিন্তু এমনই মজবুত যে ভেঙে যাবার নয়।

.

০৪.

চোখে বিনকিউলার নিয়ে বোর্ডিং হাউসের টেরেসে দাঁড়িয়ে আছে রেমারিক। নীল আর সাদা রঙের ফেরি ডকে ভিড়ল। জাল কাগজ-পত্রের ওপর আস্থা আছে। রেমারিকের, কিন্তু মার্সেলেস থেকে আসা গাড়িগুলো প্রায়ই তন্ন তন্ন করে সার্চ করা। হয়।

তিনটে লাইন ধরে ফেরি থেকে নামতে শুরু করল গাড়ি। একটা লাইনে কয়েকটা ট্রাক আর একটা কন্টেইনার-ট্রেলর দেখা গেল। তারপর খয়েরি রঙের ভ্যানটা। ক্যাব থেকে রানাকে নামতে দেখল, রেমারিক। ভ্যানের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল রানা, চেহারায় নির্লিপ্ত ভাব। ওর পরনে ডেনিম ওভারঅল, হাতে একটা বড় ম্যানিলা এনভেলাপ। অলস ভঙ্গিতে পায়ে বাড়ি মারছে এনভেলাপটা দিয়ে।

বিশ মিনিট পর রানার সামনে একজন কাস্টমস অফিসার এসে দাঁড়াল। ইতিমধ্যে টেরেসে রেমারিকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ফুরেলা।

উনি পৌচেছেন? জানতে চাইল সে।

হ্যাঁ, ডকের দিক থেকে চোখ না সরিয়ে জবাব দিল রেমারিক।

রানার কাগজ-পত্র খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল অফিসার, তারপর ভ্যানের পিছন দিকে হেঁটে এল। ভ্যানের দরজা খুলে দিল রানা, ওর হাতে এনভেলাপটা ফিরিয়ে দিয়ে ভ্যানে চড়ল অফিসার।

রেমারিকের মনে হল অনন্তকাল ধরে ভ্যানের ভেতর রয়েছে অফিসার। তারপর এক সময় বেরিয়ে এল সে, দুহাত দিয়ে কি যেন একটা বুকের কাছে ধরে রয়েছে। শিউরে উঠল রেমারিক, ভাল করে দেখার জন্যে কাঁপা হাতে বিনকিউলারটা অ্যাডজাস্ট করল। এবার অফিসারের হাতে ধরা জিনিসটা চিনতে পারল। সশব্দে নিঃশ্বাস ফেলল সে।

কি ওটা? জানতে চাইল ফুরেলা।

তরমুজ-বেজন্মা শালা একটা তরমুজ চায়!

হেসে ফেলল ফুরেলা।

খয়েরি ভ্যান সিকিউরিটি গেটের দিকে এগোল। গেটে মুহূর্ত কয়েকের জন্যে থামল মাত্র, তারপরই রাস্তায় উঠে এল রানা। চোখ থেকে বিনকিউলার নামিয়ে হাতঘড়ি দেখল রেমারিক। এক ঘন্টার মধ্যে ফোন করবে ও। লাঞ্চ খেতে বেরিয়ে যাব আমি–এদিকটা তুমি সামলাতে পারবে তো?

পারব, বলল ফুরেলা। ওঁকে আপনি আমার শুভেচ্ছা জানাবেন।

.

হাতে একটা ক্যানভাস ব্যাগ নিয়ে রেস্তোরাঁয় ঢুকল রেমারিক। ভেতরে ঢুকেই দাঁড়িয়ে পড়ল ও, রোদ থেকে এসে অল্প আলোয় ভাল দেখতে পাচ্ছে না। ধীরে ধীরে প্রসারিত হল দৃষ্টিসীমা, খদ্দের বলতে একমাত্র রানাকেই এক কোণে একটা। টেবিলে বসে থাকতে দেখল সে। বারোটাই বাজেনি এখনও, নেপলসের লোকেরা। এত তাড়াতাড়ি লাঞ্চ খায় না।

দুই বন্ধু পরস্পরকে আলিঙ্গন করল। রানাকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল রেমারিক, ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, গোজো তোমার বয়স কমিয়ে দিয়েছে দশ বছর।

মৃদু হাসল রানা। ওরা সবাই তোমাকে ভালবাসা জানিয়েছে।

বসল ওরা। ওয়েটারকে ডেকে হালকা লাঞ্চের অর্ডার দিল রানা।

ওয়েটার সরে যেতে রেমারিক জিজ্ঞেস করল, মার্সেলেসে কোন অসুবিধে হয়নি তো?

না।

ভায়োলা কেমন আছে?

মৃদু হাসল রানা। ভাল। বলেছে, কাজ শেষ করে ফিরতে হবে ওর কাছে।

মুচকি একটু হেসে অন্য প্রসঙ্গে চলে এল রেমারিক। ফুরেলাকে আমি মার্সেলেসে পাঠিয়েছিলাম। বেশিরভাগ লেগওঅর্ক ওকে দিয়েই করিয়েছি, রোম। আর মিলানোও গিয়েছিল ও।

ও খুব কাজের ছেলে, মন্তব্য করল রানা।

ওয়েটার লাঞ্চ দিয়ে গেল।

খেতে শুরু করে রানা বলল, ফুরেলার বিপদ হতে পারে।

জানি, বলল রেমারিক। তুমি শুরু করলেই ওকে আমি গোজোয় পাঠিয়ে দেব। গোটা ব্যাপারটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওখানেই থাকবে ও।

গুড, বলল রানা। ওকে ছাড়া ম্যানেজ করতে পারবে তো? 

প্রেজো ফিসো বন্ধ করে দিচ্ছি,বলল রেমারিক। শুধু যারা রেগুলার, তাদের জন্যে লাঞ্চ আর ডিনারের ব্যবস্থা থাকবে। ক্যানভাস ব্যাগ খুলে পাঁচ গোছ চাবি বের করল সে, সাথে একটা রোড ম্যাপ, আর একটা ফোল্ডার। চাবির গোছাগুলো রানার দিকে বাড়িয়ে দিল, প্রতিটির সঙ্গে একটা করে ট্যাগ আছে। বলল, মিলানের অ্যাপার্টমেন্ট, ভাইজেনটিনোয় কটেজ, একটা আলফেটা জি. টি., রোমে অ্যাপার্টমেন্ট, আর রোমে একটা রেনল্ট টোয়েন্টি।

চাবি নিয়ে হাসল রানা। আমার দেখছি প্রচুর সম্পত্তি!

ভাড়া করা, জবাব দিল রেমারিক। এগুলো সবই তিন মাসের জন্যে ভাড়া নেয়া হয়েছে, মাস শুরু হয়েছে দশ দিন আগে।

খোঁজাখুঁজি শুরু হলে তোমার নাম বেরিয়ে আসবে না তো?

মাথা নাড়ল রেমারিক। অসম্ভব। অ্যাপার্টমেন্ট দুটো আর কটেজটা ব্রাসেলসের একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাড়া করেছে। আর গাড়ি দুটো ভাড়া নিয়েছে বিনো গারবান্ডি।

আচ্ছা, বিনো কি…?

প্রেমিকাকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় বেড়াতে গেছে সে, ফিরতে মাস কয়েক দেরি হবে। রোড ম্যাপ খুলে কালো কালি দিয়ে আঁকা দুটো বৃত্ত দেখাল রেমারিক। মিলানের অ্যাপার্টমেন্ট, আর এটা এখানে বাংলোটা। এরপর এক এক করে। গ্যারেজ, রোমের অ্যাপার্টমেন্ট, আরেকটা গ্যারেজ, সব দেখিয়ে দিল রানাকে। অ্যাপার্টমেন্ট আর বাংলোয় টিনের খাবার পাবে। ফোল্ডারে টোকা দিল সে। এতে সবগুলোর ঠিকানা আছে।

ভেরি গুড, সন্তুষ্ট হয়ে বলল রানা। চার্জার?

মুচকি একটু হেসে ব্যাগের ভেতর থেকে চকচকে দুটো সিলিণ্ডার বের করল রেমারিক। একটা হাতে নিয়ে সাবধানে পরীক্ষা করল রানা।

জিনিসটা অ্যানোডাইজড অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি। সাড়ে তিন ইঞ্চির মত লম্বা, ডায়ামিটারে পৌনে এক ইঞ্চি, প্রান্ত দুটো ঢালু। দুদিক ধরে ঘোরাতেই মাঝখানে। খুলে গেল সিলিণ্ডারটা। গর্ত দুটো দেখল রানা, বাইরের মত ভেতরের দিকও মসৃণ।

এগুলো আমি লোকাল মেশিনশপে তৈরি করিয়েছি, বলল রেমারিক। সিলিণ্ডার দুটো ব্যাগে ভরল সে। এগুলো সাধারণত আরেকটু বড় হয়–নিশ্চয়ই। কষ্টকর, আমার ধারণা।

ক্ষীণ একটু হাসি দেখা গেল রানার ঠোঁটে যত খুশি আপত্তি জানাতে পারে ব্যাটা, আমিও সহানুভূতি জানাব।

ফোল্ডার ছাড়া বাকি সব ব্যাগে ভরে রাখল রেমারিক। আমার রেস্তোরাঁয় এক লোক খেতে আসে, নাম ডেরিক। সিসিলিতে ডন বাকালার হয়ে কাজ করেছে এককালে। সারাক্ষণ বক বক করে লোকটা, দুনিয়ার সব ব্যাপারে তার অভিযোগ। সিসিলির গল্প করতে ভালবাসে।

আমার সম্পর্কে কিছু জানে?

মাথা নাড়ল রেমারিক। কিছুই জানে না। আসল কথা, ডন বাকালার ওপর ভারি চটা সে, ডন নাকি তার ওপর অন্যায় করেছে। ভিলা কোলাসি আর, ওখানের। সেট আপ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন না করেই তার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পেরেছি, লিখে এই ফোল্ডারে ভরে রেখেছি–তোমার কাজে লাগবে।

ফোল্ডার খুলে দেখল রানা। ভিলার একটা স্কেচ ম্যাপ রয়েছে, আর কয়েক পাতা নোট। মুখ তুলল ও, বলল, চমৎকার, আমার অনেক খাটনি কমিয়ে দিলে।

ওয়েটারকে ডেকে কফি দিতে বলল রেমারিক। ওয়েটার চলে যেতে বলল, ভিলা কোলাসিতে ঢোকা খুব কঠিন হবে তোমার জন্যে। গড ফাদার ডিলা থেকে বেরোয় না বললেই চলে।

রানা হাসল। যখন জানবে সে-ও টার্গেট, একেবারেই বেরুবে না।

কিভাবে ঢুকবে, কোন বুদ্ধি পেয়েছ?

কয়েকটা উপায়ের কথা ভেবে রেখেছি, বলল রানা। কোনটা বেছে নেব। সেটা নির্ভর করে আর কি তথ্য পাই তার ওপর। আসলে ভিলা কোলাসিতে কিভাবে ঢুকবে রানা, ঠিক করা হয়ে গেছে। তিন মাস আগে পালার্মোয় গিয়েছিল ও, তখনই বুদ্ধিটা আসে মাথায়। ব্যাপারটা নিয়ে রেমারিকের সঙ্গে আলোচনা না করার একটা কারণ আছে।

কফি এল, কাপে চুমুক দিয়ে প্রসঙ্গে ফিরে এল রানা। রোমে আতুনি। বেরলিংগারের পর, আমি সম্পূর্ণ একা মুভ করব। কারও সঙ্গে কোন যোগাযোগ বা নির্দিষ্ট কোন ঘাঁটি থাকবে না। ততদিনে গাড়ি দুটো আর ভ্যানটা আমার কাছে থাকবে না–কেন বুঝতে পারছ তো?

মাথা ঝাঁকাল রেমারিক। কারণ ততদিনে পুলিস আর ডন বাকালা হিসেব। কষে বের করে ফেলবে কাজগুলো কার। তোমাকে চিনলে আমাকেও চিনতে সময়। লাগবে না। ওরা আমাকে জেরা করতে আসবে, কিন্তু আমি যা জানি না তা। ওদেরকে বলব কিভাবে?

রানা গম্ভীর হল। তুমি না জানলে, ওরাও বুঝতে পারবে তুমি জান না। কাজেই এদিক থেকে তুমি নিরাপদে থাকছ। ইতিমধ্যে আমি যদি যোগাযোগ। করতে চাই, কিভাবে করব? ফোন ব্যবহার করতে চাই না।

ফোল্ডারটা দেখাল রেমারিক। সামনের পৃষ্ঠায়। নেপলস পোস্ট অফিসের একটা নাম্বার আছে–ফোন নাম্বার আর সময় জানিয়ে একটা তার পাঠিয়ে দিয়ো, বাইরে কোথাও থেকে ডায়াল করব আমি।

ফোল্ডার খুলে পোস্ট বক্স নাম্বারটা পড়ল রানা। ঠিক আছে। সব যদি ভালভাবে এগোয়, কোন যোগাযোগই আমি করব না–পুরো কাজ শেষ না হওয়া। পর্যন্ত।

এরপর অনেকক্ষণ ওরা কেউ কথা বলল না।

রেমারিক এক সময় জিজ্ঞেস করল, কবে শুরু করছ?

সামনের দিকে ঝুঁকল রানা। নিচু গলায় জানাল।

 আজই মিলানে যাবে রানা। কাল খুব সকালে বাংলোয় পৌঁছুবে ও। অগাস্টিন আর এলি প্রথম শিকার, কিন্তু ওদের শুধু একজনের সঙ্গে কথা বলার দরকার হবে। রানার–সম্ভবত অগাস্টিনের সঙ্গে। দেখে তো মনে হয় পেশীসর্বস্ব একটা মূর্খ, এলির চেয়ে ওকেই সহজে ভাঙা যাবে। দুএকদিন নজর রাখবে রানা, তারপর একদিন তুলে নিয়ে আসবে।

ফোল্ডারটা টেবিল থেকে তুলে ব্যাগে ভরল রেমারিক। বলল, তুমি আগে বেরিয়ে যাও।

দাঁড়াল রানা। ফুরেলাকে আমার ধন্যবাদ দিয়ো।

দেব, বলল রেমারিক। ও তোমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে।

দাঁড়াল রেমারিক। ওর কাঁধে হাত রাখল রানা, চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ব্যাগটা নিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেল।

.

০৫.

কাজের মধ্যে রয়েছে গিয়াকোমো অগাস্টিন। কাজটা মোটেও কষ্টকর কিছু না। গত দুঘন্টা ধরে এক এক করে পুব মিলানের অনেকগুলো বারে ঢুকেছে সে, বেরিয়ে এসেছে দুএক মিনিট পর, প্রতিবার আরও ভারি হয়েছে হাতের লেদার ব্যাগটা। আজ বৃহস্পতিবার, আর বৃহস্পতিবার মানেই তার বসের টাকা জমা নেয়ার দিন।

ষাড় আকৃতির শরীরে ঘোড়া আকৃতির মুখ, স্বভাবটা গোঁয়ার-গোবিন্দ গণ্ডারের মত। একটু রাগ হলেই হাত চালিয়ে দেয়, লোকজনকে পিটিয়ে আনন্দ পায় সে। এই কাজের জন্যে উপযুক্ত লোক সে, কাজটা করেও নিখুঁতভাবে। তবে, একটু ধীরগতি; আর সব সময় একই রুটিন ধরে করে কাজটা।

মাঝরাতের দিকে বারগুলো থেকে টাকা আদায় শেষ করল অগাস্টিন। এবার ক্লাবগুলো ধরতে হবে। ঢিলে একটা জ্যাকেট পরে আছে সে, ফলে প্রকাণ্ড ধড় আরও বড় দেখাচ্ছে। জ্যাকেটের ভেতর, বগলের নিচে, শোল্ডার হোলস্টারে একটা বেরেটা পিস্তল রয়েছে। লেদার ব্যাগটা লম্বা, চেইন টেনে বন্ধ করা, এরই মধ্যে ভরে গেছে অর্ধেক।

পিসমেকার নাইটক্লাবের সামনে, নো, পার্কিং জোনে ল্যানসিয়া থামাল অগাস্টিন। নড়েচড়ে ওঠায় দুলতে শুরু করল গাড়ি, নেমে পেভমেন্টে দাঁড়াল সে। এই গাড়ি নিয়ে তার ভারি গর্ব। রঙটা মেটালিক সিলভার, স্টিরিও আছে, আছে মিউজিক্যাল হর্ন। ব্যাক-সিটের পিছনে, কার্নিসে বসে আছে একটা খেলনা পুতুল, গাড়ি আঁকি খেলে পুতুলের মাথা ওঠা-নামা করে, মনে হয় ঘন ঘন উঁকি দিয়ে পিছনের রাস্তা দেখছে। প্রিয় বান্ধবীর দেয়া উপহার।

এত দামি একটা গাড়ি, গাড়িটার ওপর তার এত দুর্বলতা, তবু দরজায় তালা দেয়ার বা ইগনিশন থেকে চাবি সরাবার গরজ নেই অগাস্টিনের। মিলানের প্রতিটি চোর-ছ্যাচড় জানে কে এই গাড়ির মালিক, জানে কেউ ছুঁলে তার আর রক্ষে নেই।

শিস দেয়া বন্ধ করে ক্লাবে ঢুকল অগাস্টিন, গলাটা সত্যি শুকিয়ে গেছে। কাজে বেরিয়ে সব সময় এই ক্লাবেই প্রথমবার গলা ভেজায় সে। ক্লাবের মালিক তাকে দেখেই বারটেণ্ডারের উদ্দেশে দ্রুত মাথা ঝাঁকাল। অগাস্টিন বারের সামনে পৌঁছুবার আগেই বারটেণ্ডার তার জন্যে কাউন্টারে আধ গ্লাস স্কচ হুইস্কি রাখল। গ্লাসে আয়েশ করে চুমুক দিল অগাস্টিন, ঠাণ্ডা চোখে এদিকে ওদিক তাকাল।

পিয়ানোর মৃদু শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কয়েক জোড়া নারী-পুরুষ ধীর লয়ে নাচছে। পুরুষরা প্রায় সবাই মধ্য-বয়স্ক, ব্যবসায়ী; মেয়েগুলো হয় তাদের সেক্রেটারি, নয়ত গোপন প্রেমিকা–কারুরই বয়স পঁচিশের বেশি নয়। অত্যন্ত দামি ক্লাব এটা, শুধু ধনীলোকদের জন্যে। সুন্দরী কলগার্লরাও খদ্দের ধরার জন্যে আসে এখানে।

পাউডার রূম থেকে একটা মেয়েকে বেরিয়ে আসতে দেখল অগাস্টিন। বেশ লম্বা, মাথায় সোনালি চুল, খালি একটা টেবিলে বসে শ্যাম্পেনের গ্লাসে ছোট্ট করে। চুমুক দিল। ছোট করে কাটা ব্লাউজ, ব্রা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে স্তন। মেয়েটাকে আগে কখনও দেখেনি অগাস্টিন। ঠিক করল, কাল বিকেলে ওর সঙ্গে শোবে সে।

গ্লাসে শেষ চুমুক দিল অগাস্টিন, এক তাড়া নোট নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল ক্লাব-মালিক। তাড়াটা নিয়ে নোটগুলো গুনল অগাস্টিন, ব্যাগ খুলে টাকা রাখল ভেতরে, চেইন টেনে বন্ধ করে দিল ব্যাগ। মুখ তুলে টেবিলে বসা সুন্দরী। মেয়েটার দিকে চিবুক তাক করল সে, তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ক্লাব-মালিকও মেয়েটার দিকে তাকাল।

খাসা জিনিস! নতুন, না?

হ্যা..মানে…জ্বী!

আমার ওখানে পাঠিয়ে দিয়ো। কাল বিকেল তিনটের সময়। মনে থাকবে?

বিনয়ে বিগলিত হয়ে গেল ক্লাব মালিক। সিনর!

পেভমেন্টে বেরিয়ে এসে তাজা বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিল অগাস্টিন, ল্যানসিয়ার দিকে এগোল। আরও একটু বেশি আলো থাকলে, কিংবা আরও যদি একটু সতর্ক থাকত সে, দেখতে পেত পুতুলের মাথাটা একটু একটু দুলছে।

গাড়িতে উঠে বসল অগাস্টিন, হাত বাড়াল ইগনিশনের দিকে। হঠাৎ ঘাড়ে শীতল ধাতব স্পর্শ পেয়ে স্থির হয়ে গেল হাতটা। ঠাণ্ডা একটা কণ্ঠস্বর শুনল সে, নোভড়া না!

ভয় নয়, রাগও নয়, কৌতুক মেশানো বিস্ময় বোধ করল গিয়াকোমো অগাস্টিন। তুমি জান আমি কে?

গিয়াকোমো অগাস্টিন। আর যদি একটাও কথা বল, ওটাই তোমার শেষ কথা হবে।

একটা হাত পিছন থেকে এগিয়ে এসে তার বা বগলের তলায় সেঁধিয়ে গেল, হোলস্টার থেকে বের করে নিল পিস্তলটা। একেবারে পাথর হয়ে গেছে অগাস্টিন, এতক্ষণে, ভয় পেয়েছে। পিছনের লোকটা তার পরিচয় জানে, টাকা ভরা ব্যাগটা সে নিতে আসেনি। উদ্দেশ্য ডাকাতি নয়। হয়ত গামবেরি গ্রুপের সঙ্গে গোলমাল। বেধেছে।

ভাবনা-চিন্তায় বাধা পড়ল। শান্ত, কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠস্বর শোনা গেল আবার, এঞ্জিন স্টার্ট দাও, আস্তে আস্তে গাড়ি চালাবে। কারও দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা কোরো। কখন কোন দিকে যেতে হবে আমি বলব। কোন রকম চালাকি করতে গেলে সাথে সাথে মারা যাবে।

খুব সাবধানে গাড়ি চালাল অগাস্টিন। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে সতর্ক করে দিয়েছে, এ লোক মিথ্যে হুমকি দিচ্ছে না। নির্দেশ পেয়ে দক্ষিণ দিকে গাড়ি চালাল সে, শহর ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে চলে এল। ধাক্কাটা সামলে নিয়েছে সে, দ্রুত চিন্তা ভাবনা চলছে মাথায়। এলাকার দখল নিয়ে যুদ্ধ বেধে থাকলে এতক্ষণে মারা যেত। সে, হয় ক্লাবের ঠিক বাইরে, নাহয় এইমাত্র পেরিয়ে আসা নির্জন শহরতলির কোথাও। গলার আওয়াজটা তাকে বিমূঢ় করে তুলেছে। ক্ষীণ একটু নিয়াপলিটান সুর আছে, আরও কি যেন আছে অথচ ধরতে পারছে না সে। আন্দাজ করল, লোকটা ইটালিয়ান নয়। তার চিন্তা নতুন খাতে বইতে শুরু করল। মাস কয়েক আগে তার বস, হিনো ফনটেলার সঙ্গে ইউনিয়ন কর্স-এর একটা গ্রুপের বিবাদ। বেধেছিল। মার্সেলেসের ওই গ্রুপের অভিযোগ ছিল, ড্রাগ শিপমেন্টে ফনটেলা নাকি কারচুপি করেছে। ওদের অভিযোগ কানে তোলেনি ফনটেলা, হুমকি দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছিল। ওরা হয়ত হুমকি গ্রাহ্য করার বান্দা নয়। এতদিনে হয়ত তৈরি হয়েছে, এবার একহাত দেখাতে চায়। কিন্তু নিয়াপলিটান সুর কেন তাহলে?

আর অল্প দূরেই ভাইজেনটিনো! ওখানে পৌঁছবার আগেই একটা সাইড রোড ধরার নির্দেশ এল। এরপর মেঠো পথ। গাড়ি থেকে ওরা যখন নামবে, একটা ঝুঁকি নেয়া যায় কিনা দেখবে অগাস্টিন। তখন ওর ঘাড়ের ওপর পিস্তল থাকবে না। লোকটা কি জানে, তার এই বিশাল শরীরেও প্রয়োজনে বিদ্যুৎগতি খেলে যায়?

হেডলাইটের আলোয় নিচু একটা বাংলো দেখা গেল। এ-ধরনের সৌখিন কটেজ সাধারণত মিলানিজরা তৈরি করে, ছুটিছাটাতে এর্সে মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করবে বলে। নির্দেশ পেয়ে বাংলোর পিছন দিকে গাড়ি নিয়ে এল অগাস্টিন। চাকার নিচে কাকর পেষার আওয়াজ।

থাম এখানে। হ্যাণ্ডব্রেক দাও। ইগনিশন অফ কর।

সামনের দিকে ঝুঁকল অগাস্টিন, ঠাণ্ডা পিস্তল তবুও ঘাড়ে লেগে থাকল। ধীরে ধীরে সিটে হেলান দিল সে। হঠাৎ করেই ঘাড়ের ওপর থেকে সরে গেল চাপটা। তার পেশীতে টান পড়ল, পরমুহূর্তে বিস্ফোরিত হল তার দৃষ্টি।

.

ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে এল তার, মাথার পিছনে ব্যথা, দপ দপ করছে। ব্যথার জায়গাটা হাত দিয়ে স্পর্শ করার চেষ্টা করল সে, কিন্তু হাতটা নাড়তে পারল না। তার চিবুক বুকে ঠেকে আছে, দৃষ্টি পরিষ্কার হতে দেখল, বাঁ হাতটা চেয়ারের হাতার সঙ্গে টেপ দিয়ে আটকানো। অনেক কষ্টে মাথাটা ডান দিকে ফেরাল সে, একইভাবে টেপ দিয়ে আটকানো ডান হাতটাও। সারা শরীর একটা ঝাঁকি খেল, এক নিমেষে সব কথা মনে পড়ে গেছে। সন্ত্রস্ত, সেই সঙ্গে সতর্ক হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে মাথা তুলে প্রথমে একটা কাঠের টেবিল দেখল। টেবিলের ওপর ছাড়াছাড়া ভাবে কয়েকটা জিনিস রাখা রয়েছে। একটা হাতুড়ি, বড় সাইজের দুটো ইস্পাতের পেরেক, পেরেকের পাশে ভারি একটা ছুরি, এক ফুট লম্বা একটা মেটাল রড। রডের এক প্রান্ত থেকে একটা ইলেকট্রিক কর্ড বেরিয়ে এসে টেবিলের কিনারা দিয়ে নেমে চোখের আড়ালে চলে গেছে। চোখ দুটো আরও একটু ওপরে তুলল সে। টেবিলের ওপারে, একটা চেয়ারে বসে আছে লোকটা। বয়স্ক লোক, চল্লিশ পয়তাল্লিশ বছর বয়স, চোখ দুটো কুঁচকে আছে। এই লোককে কোথায় যেন দেখেছে সে!

লোকটার সামনে, টেবিলের কিনারায়, খোলা একটা নোটবুক আর কলম রয়েছে, কলমের পাশে চওড়া এক রোল অ্যাডহেসিভ টেপ।

আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

মাথা ঝাঁকাল অগাস্টিন, ব্যথাটা বেড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। যেই হও তুমি, এর জন্যে তোমাকে ভুগতে হবে।

তার কথা অগ্রাহ্য করে টেবিলের জিনিসগুলো ইঙ্গিতে দেখাল লোকটা। ভাল করে দেখ তোমার সামনে এগুলো কি রয়েছে, তারপর মন দিয়ে শোন।

কে তুমি? হিস হিস করে জিজ্ঞেস করল অগাস্টিন, ব্যথা সহ্য করার জন্যে। দাতে দাঁত চেপে আছে সে।

জবাব না দিয়ে লোকটা, বলল, অনেকগুলো প্রশ্ন করব। প্রতিটি প্রশ্নের পুরোপুরি উত্তর দেবে, আর সত্যি কথা বলবে।

ইউনিয়ন কর্স? অস্থির হয়ে জানতে চাইল অগাস্টিন। এ-ধরনের পরিস্থিতিতে শত্রুর পরিচয় না জানার চেয়ে বড় অশান্তি আর নেই।

উত্তর যদি মিথ্যে আর অসম্পূর্ণ হয়, টেপ খুলে তোমার বাঁ হাত টেবিলে রাখব, তারপর হাতুড়ি দিয়ে বুকে একটা পেরেক গাঁথব উল্টো পিঠে।

শিউরে উঠল অগাস্টিন। তোমাকে আমি আগে কোথাও দেখেছি–কোথায়?

তারপর ছুরিটা দিয়ে তোমার আঙুল কাটব, লোকটা বলে চলেছে, একটা। একটা করে।

ছুরির দিকে তাকাল অগাস্টিন।

ভয় নেই, রক্ত পড়ায় তুমি মারা যাবে না, বলল লোকটা। একটা আঙুল। তুলে মেটাল রডটা দেখাল সে। এটা একটা শোল্ডারিং-আয়রন। কাটা আঙুল জোড়া লাগিয়ে ঝালাই করে দেব ক্ষতগুলো।

দরদর করে ঘামছে অগাস্টিন। লোকটা সাপের মত ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে, চেহারায় নির্লিপ্ত ভাব।

তবু যদি কথা না বল, তোমার ডান হাত ধরব। এরপর পা, প্রথমে…

অনেক নিষ্ঠুর লোকের মত, গিয়াকোমো অগাস্টিনও আসলে কাপুরুষ। লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে উপলব্ধি করল, শুধু ভয়। দেখাচ্ছে না, এই লোক প্রতিটি কাজ করে দেখাবে। কিন্তু কেন? কে ও? কোথায়। ওকে দেখেছে সে?

অসহায় বোধ, করল অগাস্টিন, রেগে উঠে ভয় তাড়াবার চেষ্টা করল। জাহান্নামে যাও তুমি! খেঁকিয়ে উঠল সে, অশ্লীল গাল পাড়তে শুরু করল। কিন্তু আচমকা চুপ মেরে গেল সে, লোকটা উঠে দাঁড়িয়েছে।

টেপের রোল হাতে নিল লোকটা। খানিকটা খুলে ছিঁড়ল, এগিয়ে এল টেবিল ঘুরে।

কিছু বলার জন্যে মুখ খুলল অগাস্টিন, কিন্তু আওয়াজ বেরুবার আগেই তার। মুখে চেপে বসল টেপ। আলোর একটা ঝলকের মত লাগল লোকটার ডান হাত, পেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করল অগাস্টিন, চোখে শর্ষে ফুল দেখল। দ্বিতীয় ঘুসিটা লাগল চোয়ালে, চেয়ারের পিঠে থেঁতলে গেল আহত মাথা।

কোনরকমে জ্ঞানটুকু থাকল তার, সারা শরীর অবশ, স্নায়ুগুলো ভোতা। অস্পষ্টভাবে বুঝল তার বাঁ হাত মুক্ত করা হয়েছে, টেনে লম্বা করা হয়েছে সামনের দিকে। এক মুহূর্ত পর অসহ্য যন্ত্রণায় তার শরীর ধনুকের মত বেঁকে গেল, জ্ঞান। হারাল সে।

দ্বিতীয়বার জ্ঞান ফেরার পর মাথার দপদপে ব্যথাটা অনুভব করল না। অগাস্টিন। মনে হল বা হাতে আগুন জ্বলছে। চোখ খুলে হাতের দিকে তাকাল সে, টেবিলের ওপর চিৎ করে রাখা। তালু ফুটো করে টেবিলে গেঁথে রয়েছে পেরেকটা। আঙুলের ফাঁক গলে গড়িয়ে নামছে রক্ত, টেবিলের ওপর কয়েক জায়গায় জমেছে। বেশ অনেকটা করে।

চোখে দেখা দৃশ্যটা অবিশ্বাস করতে চাইল তার মস্তিষ্ক, কিন্তু এক চুল নড়তেই তীব্র ব্যথার পাগল করা ঢেউ একের পর এক আছড়ে পড়তে শুরু করল সারা শরীরে। টেপ দিয়ে মোড়া মুখ থেকে ভোতা একটু গোঙানির আওয়াজ বেরুল। চোখ দেখে বোঝা যায়, আতঙ্ক তাকে গ্রাস করেছে। নিষ্ঠুরতা নয়, অগাস্টিনকে আতঙ্কিত করে তুলেছে লোকটার শান্ত-নির্লিপ্ত ভাব-ভঙ্গি–একজন মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে অথচ সে-ব্যাপারে তার কোন অনুভূতি নেই, এমনকি ব্যাপারটা উপভোগও করছে না।

 ঠাণ্ডা চোখ দুটোর দিকে আবার তাকাল সে। পলক নেই, একবারও পলক, ফেলতে দেখেনি ওকে। এখনও কোন ভাব নেই চেহারায়। আবার লোকটা চেয়ার ছাড়ল, টেবিল ঘুরে এগিয়ে এল। শিউরে উঠে আহত পশুর মত পিছিয়ে আসার ব্যর্থ চেষ্টা করল অগাস্টিন। লক্ষণ দেখে বোঝা যায়, বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে তার। ঘন। ঘন মাথা নাড়ার মানে হল নিঃশব্দে করুণা ভিক্ষা চাইছে। গলার ভেতর ঘড়ঘড় আওয়াজ। লোকটা মুঠো করে ধরল তার মাথার চুল। মাথাটা স্থির করে রেখে একটানে খুলে নিল মুখের টেপ। বমি করতে শুরু করল অগাস্টিন; কিন্তু সেদিকে খেয়াল না দিয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল ও।

থরথর করে কাঁপছে অগাস্টিন, ভয়ে আর ব্যথায়।

একটু শান্ত হতে অনেক সময় নিল ঘোড়ামুখো। ঘাম, চোখের পানি, বমি আর রক্ত, তার শরীর থেকে তরল পদার্থ বেরিয়ে যাচ্ছে। পেরেক গাঁথা বা হাত, শোল্ডারিং-আয়রন, আর ছুরি–পালা করে এই তিনটের দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার। দৃষ্টি। মুখের থুথু আর ফেনা গিলে নিয়ে কথা বলল সে, কোন রকমে শোনা গেল, কি চাও তুমি?

নোটবুক টেনে নিয়ে কলমটা খুলল ও। লুবনা কিডন্যাপিং দিয়ে শুরু কর।

মুহূর্তে চেহারাটা মনে পড়ল অগাস্টিনের।

.

এক ঘন্টার বেশি ধরে জেরা চলল। শুধু একবার, হিনো ফটেলার প্রসঙ্গ উঠতে, ইতস্তত করল অগাস্টিন; কিন্তু হাতের কলম রেখে রানা আবার চেয়ার ছাড়তে যাচ্ছে দেখে গড় গড় করে জবাব দিতে শুরু করল সে।

কিডন্যাপের ঘটনা দিয়ে শুরু করল সে। গাড়িটা চালাচ্ছিল অগাস্টিন। প্রথমেই সে হড়বড় করে বলে নিল, বডিগার্ডকে গুলি করেছিল এলি, সে নয়। বাকি দুজন ছিল চারিন আর সাইমিয়ানো, গুলি খাবার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়।

দাবি করা টাকা সম্পর্কে কিছুই জানে না অগাস্টিন। ওদেরকে শুধু নির্দেশ দেয়া হয়, নির্দিষ্ট একটা সময়ে, নির্দিষ্ট একটা জায়গা থেকে মেয়েটাকে তুলে নিয়ে এসে নিগুয়াডা-র একটা বাড়িতে আটকে রাখতে হবে।

শুরুতেই গোটা ব্যাপারটা লেজেগোবরে হয়ে যায়। হিনো ফনটেলা ওদেরকে অভয় দিয়ে বলেছিল মেয়েটার সুঙ্গে একজন বডিগার্ড থাকবে বটে, কিন্তু সে তেমন। কোন কম্মের নয়, ওদের জন্যে, কোন সমস্যার সৃষ্টি করবে না। চারিনের ওপর নির্দেশ ছিল, ফাঁকা দুটো গুলি করবে সে, তাহলেই বডিগার্ড ভয় পেয়ে পালাবে। কাজেই ওরা সবাই কাজটাকে হালকাভাবে নিয়েছিল, কেউই তেমন সতর্ক ছিল না।

মেয়েটাকে রেপ করল কে?

এলি, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল অগাস্টিন। চারিন মারা যাওয়ায় তার মাথায় আগুন ধরে যায়, ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল ওরা। তাছাড়া, ছোট মেয়েদের ওপর বরাবরই তার খুব লোভ। এই মেয়েটা আবার ধস্তাধস্তি করার সময় তার মুখে খামচি দেয়… নার্ভাস ভঙ্গিতে জিভের ডগা দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাল সে।

আর তুমি? শান্ত সুরে জিজ্ঞেস করল রানা। তুমি ওকে রেপ করনি?

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল অগাস্টিন, তারপর অনেকটা যেন নিজের অজ্ঞাতসারেই ওপর নিচে মাথা দোলাল, কথা বলার সময় কাঁপা কাঁপা লাগল তার কণ্ঠস্বর, হ্যাঁ…মানে, এলির পর। ভাবলাম যা হবার তা তো হয়েই গেছে, তাই আমিও… টেবিলের ওপর দিয়ে যমদুতের দিকে তাকাল সে। স্থির পাথর হয়ে আছে রানা। অগাস্টিনের মনে হল, লোকটার মন যেন এখানে নেই, অন্য কোথাও চলে গেছে। আবার শুরু হল জেরা।

আর কেউ?

মাথা নাড়ল অগাস্টিন। মেয়েটার সঙ্গে আমরা এই দুজনই ছিলাম। সময় কাটতে চাইছিল না, সাংঘাতিক একঘেয়ে লাগছিল–আমরা ভেবেছিলাম দুএক দিনের মধ্যে সব ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু দাবির টাকা নিয়ে কি যেন একটা গোলমাল দেখা দেয়, বাড়িটায় আমরা দুহপ্তা আটকা পড়ে গেলাম।

তাই তোমরা ওকে বারবার রেপ করলে?

ধীরে ধীরে নিচু হল অগাস্টিনের মাথা, চিবুক বুকে ঠেকল, ঘামে চকচক করছে চওড়া কপাল। অস্ফুট, কর্কশ শোনাল তার গলা, হ্যাঁ..মানে, তেমন কিছু করার ছিল না আমাদের আর মেয়েটা ছিল খুব সুন্দরী…।

ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে এল তার কণ্ঠস্বর, মুখ তুলে দেখল টেবিলের ওপার থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে মৃত্যুদূত।

ফনটেলা? সে কি বলল?

উনি খেপে যান। মেয়েটা মারা গেল, সে তো আমাদের কোন দোষ না, স্রেফ  একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু উনি কোন কথাই শুনলেন না। প্রত্যেকের আমাদের দশ। মিলিয়ন লিরা করে পাবার কথা ছিল, কিন্তু উনি আমাদের কিছুই দিলেন না।

নরম সুরে জিজ্ঞেস করল রানা, টাকা দিল না–ব্যস, এইটুকুই শাস্তি?

অগাস্টিনের চিবুক থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঘাম পড়ছে বুকে, মাথা ঝাঁকাল। সে। একদিক থেকে আমরা ভাগ্যবান, কারণ বস্ ফনটেলার ভাগ্নে হয় এলি। আমাকে শাস্তি দিলে ভাগ্নেকেও দিতে হয়, তাই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলেন না।

কলম তুলে নিল রানা। হ্যাঁ, মৃদু গলায় বলল ও। ভাগ্যবানই বটে। এবার এলি সম্পর্কে বল।

এলি সম্পর্কে যা কিছু জানে অগাস্টিন, সব বের করে নিল রানা। কারা তার বন্ধু, তার গতিবিধি, তার অভ্যেস কিছুই বাদ দিল না। এরপর হিনো ফনটেলা। প্রসঙ্গ। একে একে সব জেনে নিল রানা।

জেরার এক পর্যায়ে অগাস্টিন অভিযোগ করল, হাতের ব্যথা সে আর সহ্য করতে পারছে না।

আর বেশি দেরি নেই, আশ্বাস দিয়ে বলল রানা। এবার ডন বেরলিংগার আর ডন বাকালার কথা বল।

কিন্তু এই মহারথীদের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না অগাস্টিন। যতদূর শুনেছে, ডন বাকালা তার ভিলা কোলাসি থেকে কদাচ বের হন। না, অগাস্টিন তাঁকে কখনও দেখেনি।

তবে আমার বস সিনর ফনটেলা ভিলা কোলাসিতে ঘন ঘন যান, প্রতি মাসে একবার তো বটেই। বসু রোমেও যান, ডন বেরলিংগারের কাছে।

আর কোন প্রশ্ন নেই। নোটবুক বন্ধ হল, ক্যাপ লাগানো হল কলমে।

অগাস্টিনের আতঙ্ক মাথাচাড়া দিতে শুরু করল। আবার সে কথা বলছে, বক বক করে যাচ্ছে বেরলিংগার আর বাকালাকে নিয়ে, কিন্তু তার কথায় রানার আর। কোন আগ্রহ নেই। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল ও, হাত ঢোকাল জ্যাকেটের ভেতর। ওর হাতে পিস্তল দেখে অগাস্টিনের বকবকানি থেমে গেল। এখন সে তার শরীরে কোথাও কোনরকম ব্যথা অনুভব করছে না। তার সামনে দাঁড়িয়ে পিস্তলের মাজলে। সাইলেন্সর ফিট করছে রানা, সম্মোহিতের মত সেদিকে তাকিয়ে আছে সে। টেবিল। ঘুরে এগিয়ে এল রানা। ওর চেহারায় কোন ভাব নেই, ঠাণ্ডা চোখে নির্লিপ্ত দৃষ্টি।

সাইলেন্সর লাগানো পিস্তলটার দিকে তাকিয়ে থাকল অগাস্টিন, ওটাকে তার বেটপ আর কুৎসিত লাগল। দেখল, পিস্তলটা ওর দিকে ভোলা হল। এগিয়ে। আসছে, এগিয়ে আসছে!

চোখের পাপড়িতে পিস্তলের স্পর্শ পেল অগাস্টিন। চোখ বন্ধ করল সে। তার বন্ধ ডান চোখের ওপর চেপে বসল ঠাণ্ডা ইস্পাত। শেষবারের মত ভারি কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে।

নরকে যাচ্ছ, অগাস্টিন-ওখানে তোমার সঙ্গে আর সবার দেখা হবে।

.

গিদাস-এ ভিড় দেখলে মনে হবে, সুপুরুষ আর সুন্দরীদের মেলা বসেছে। শুক্রবার দুপুরের পরিচিত পরিবেশ, ঢিলেঢালা ভাব নিয়ে লাঞ্চে বসে ভোজন রসিকরা গালগল্প করছে।

পিছনের অ্যালকোভ টেবিলে একা বসে খাচ্ছেন বার্নাদো গুগলি। বাইরে। কোথাও খেতে বসলে সংখ্যায় দুজন হওয়া চাই, প্রাচীন এই আপ্তবাক্যে বিশ্বাসী। তিনি–কিন্তু, খাচ্ছেন আজ একা।

 সুদর্শন চেহারাই তাকে আর সবার চেয়ে আলাদা করে তোলে। কাপন ম্যাগ্রো, খাচ্ছেন তিনি, অন্যান্য টেবিল থেকে রূপসী মেয়েরা চোরা চোখে বারবার দেখে নিচ্ছে তাঁকে। সুন্দরভাবে কাটা গাঢ় খয়েরি স্যুট পরে আছেন, আকাশি নীল শার্ট, সঙ্গে চওড়া তামাটে লাল সিল্ক টাই। কাফ লিঙ্ক আর প্যাটেক ফিলিপ হাতঘড়ি থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে আলো।

একটু সরু, রোদে ঝলসানো মুখ; প্রায় ঈগলের মত খাড়া নাক। এমনকি পুরুষরাও একবার তাকালে দ্বিতীয়বার না তাকিয়ে পারছে না। সবার মনেই কৌতূহল, কি উনি? সফল একজন অভিনেতা, প্রখ্যাত কোন ফ্যাশন ডিজাইনার, নাকি ইন্টারন্যাশনাল প্লে-বয়?

আসলে তিনি একজন পুলিস অফিসার। যদিও তার মা, একজন অভিজাত মহিলা, কথাটা শুনে নাক কোঁচকাবেন, তড়িঘড়ি শুদ্ধ করে দিয়ে বলবেন, কারাবিনিয়ারিতে ও একজন কর্নেল। কথাটা সত্যি। মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে এই পদে খুব কম অফিসারই উঠতে পারে।

বার্নাদো গুগলি পুলিসের চাকরি বেছে নেয়ায় সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছিলেন তার মা। ছেলেকে তিনি চেনেন, জানেন রাজনীতি বা ব্যবসার লাইনে গেলে ছেলে তার জাদু দেখিয়ে দিত। একইভাবে তার বড় ছেলেও তাকে হতাশ করে। ডাক্তারী পড়া শেষ করে। সে এখন একজন সফল সার্জেন। মায়ের ধারণা, পেশাটা মন্দ নয়, কিন্তু বড়ই নিরস। এরচেয়ে পুলিসের চাকরি তবু ভাল। বার্নাদো গুগলি নিজেও মাঝে মধ্যে ভাবেন, কারাবিনিয়ারিতে তিনি কেন এলেন। হয়ত তার অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় মনই এর জন্যে দায়ী। কিংবা অন্যায়ের ভেতর কখনও কখনও ন্যায় থাকলেও সেদিকে কারও কোন খেয়াল থাকে না দেখে তার বিবেক বিদ্রোহ করে ওঠে, তাই এ পথ বেছে নিয়েছেন–সাধ্যমত চেষ্টা করে দেখবেন এ ব্যাপারে কিছু করা যায় কিনা।

তাঁর শত্রুরাও একবাক্যে স্বীকার করবে, তিনি একজন ভাল পুলিস অফিসার। সততা, এবং ব্যক্তিগত বিশাল সয়-সম্পত্তি থাকায় দুর্নীতি তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ক্ষুরের মত ধারাল বুদ্ধি, অঢেল প্রাণচাঞ্চল্য, আর মানুষের মন বোঝার। দুর্লভ ক্ষমতা তাঁকে একজন সফল পুলিস অফিসার হিসেবে গড়ে তুলেছে।

তাঁর জীবনের চারটে দুর্বলতার একটা হল এই চাকরি। বাকি তিনটে–ভাল। খাবার, সুন্দরী মহিলা, আর ব্যাকগ্যামন। বার্নাদো গুগলির দৃষ্টিতে আদর্শ একটা দিন বলতে বোঝায়ঃ দিনের শুরুতেই তদন্তে নেমে চমকপ্রদ একটা সূত্র আবিষ্কার, দুপুরে মিলানের সেরা কোন রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ, বিকেলে অফিসে বসে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল পাঠ, তারপর রাতে মনের মত ডিনারের জন্যে নিজের হাতে রান্নাবান্না, সেই রান্না মনের মত কোন সুন্দরী মেয়েকে খাওয়ানো, সেই মেয়ের অন্তত এইটুকু বুদ্ধি। থাকতেই হবে যাতে ব্যাকগ্যামন খেলায় দুএকবার সে তাকে ভড়কে দিতে পারে এবং সবশেষে, মেয়েটিকে নিয়ে বিছানায় যাওয়া।

গত চার বছর চাকরি জীবন তার ভালই কেটেছে। তিনি অনুরোধ করেছিলেন, কর্তৃপক্ষ সাড়া দিয়ে তাঁকে নতুন একটা ডিপার্টমেন্টে বদলি করেছেন। এই ডিপার্টমেন্ট সংঘবদ্ধ অপরাধীদের পিছনে লেগে আছে। অর্গানাইজড ক্রাইমের ধরন, আর মাহাত্ম বোঝার জন্যে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তিনি, মাসের পর মাস ফাইল পড়েছেন, এবং মাফিয়া চক্রের জটিল সাংগঠনিক গোপনীয়তা সম্পর্কে যতই জেনেছেন ততই বিস্মিত হয়েছেন।

তাঁর প্রথম তিন বছর কেটেছে গবেষণায়। তথ্য সংগ্রহ করেছেন, সেগুলো যাচাই করেছেন, ভুল হলে বাতিল করেছেন, একটার সঙ্গে আরেকটা মিলিয়েছেন, তথ্যের সঙ্গে যোগ করেছেন নাম আর চেহারা। দক্ষিণ এবং উত্তরের শহরগুলো থেকে আসা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে মিল খুঁজেছেন–মিলানের একটা নারী ব্যবসায়ী। চক্রের সঙ্গে কালাব্রিয়ার মদ চোলাইকারী দলের বা নেপলসের ড্রাগ-স্মাগলারদের। কি সম্পর্ক জানতে চেষ্টা করেছেন।

তিন বছর পর ইটালিয়ান মাফিয়া সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলেন বার্নাদো গুগলি। মাফিয়ার বাইরে থেকে মাফিয়া সম্পর্কে তার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। তাঁর সহকারী, ক্যাপ্টেন কোসিমা পাধানি একবার ঠাট্টা করে বলেছিল, তিনি যদি কখনও দল বদল করেন, প্রথম দিনই নতুন কাজের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন।

গত এক বছর ধরে এই জ্ঞান কাজে লাগাচ্ছেন গুগলি। হুকুমদখল করা জমির ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত একটা জালিয়াতির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে রেগিয়োর ডন। ব্যামবিনো ফেটুচিনিকে তিনি কোণঠাসা করে ফেলেন। এক শ্রেণীর সরকারী কর্মচারীর যোগসাজশে গরীব মানুষদের বিস্তর জমি হুকুমদখল করায় ফেটুচিনি, তাদেরকে নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়, তারপর সমস্ত জমি আরও একশো গুণ কম দরে নিলামে কিনে নেয় সে। দুবছরের জেল হয় তার। মাস কয়েক ধরে। মিলানের প্রধান দুটো পরিবারের ওপর নজর রাখছেন গুগলি, এ-দুটোর কর্তা হল। ডন গামবেরি, আর ডন ফনটেলা। নারী-ব্যবসা, ড্রাগ স্মাগলিং, আর ছিনতাই, এই তিন ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত ওরা। ধীরে ধীরে প্রমাণ আর সাক্ষী যোগাড় করছেন গুগলি। ওদের টেলিফোনে আড়িপাতা যন্ত্র ফিট করেছেন, ওদের দলে ঢুকিয়ে দিয়েছেন নিজের লোক, কর্তাদের ওপর নজর রাখার ব্যবস্থা করেছেন। দুএক বছরের মধ্যে তার হাতে যথেষ্ট প্রমাণ জমা হবে, আশা করছেন দুচারটে রুই-কাতলাকে আটকাতে পারবেন তিনি, তাদের মধ্যে সম্ভবত গামবেরি আর। ফনটেলাও থাকবে।

এদের বিরুদ্ধে লেগে থাকা তার জন্যে অনেক সহজ হয়ে গেছে, কারণ সাধারণ মানুষ এখন অত্যাচারী মাফিয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার। যদিও অনুকূল পরিবেশ তৈরি হতে এখনও অনেক দেরি। কারাদণ্ড এদের জন্যে কোন শাস্তিই নয়, অর্থাৎ আইন পাল্টানো দরকার। সাক্ষী পাওয়া এখনও সাংঘাতিক কঠিন, আরও, কঠিন সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তবে, একটু একটু করে পরিস্থিতি ভাল হচ্ছে। বড় ধরনের কোন অপরাধ হতে দেখলেই মাফিয়ার বিরুদ্ধে আরও একটু বেশি খেপছে মানুষ।

লাঞ্চের পর তরুণী এক অভিনেত্রীর কাছে যাবেন। কাল সন্ধের এক পার্টিতে মেয়েটির সঙ্গে পরিচয়। জাপানী পুতুলের মত গড়ন, ছোটখাট, চোখ ধাঁধানো রূপ। খুশির খবর, মেয়েটি ব্যাকগ্যামন খেলে। তাঁকে দাওয়াত দিয়েছে, দুএক দান খেলা হবে। সেই আনন্দেই আজ তিনি লাঞ্চে বসে ডেজার্টের জন্যে জিলাটো ডি টুটি ফুটি-র অর্ডার দিয়ে ফেললেন।

মিষ্টি খাবার মুখ তাঁর, বিশেষ করে ফল আর আইসক্রীমের সঙ্গে মিষ্টি খেতে খুবই ভালবাসেন। কিন্তু যে লোক শরীরের যত্ন নেয়, সে কখনও পেটে চর্বি জমতে দিতে পারে না, তাই হপ্তায় মাত্র রোববারে ডেজার্ট খান তিনি। সত্যি বলতে কি, নিজেকে তিনি চিট করছেন, কারণ আজ মাত্র শুক্রবার। আসলে বিকেলে মেয়েটার সঙ্গ পাবেন এই আনন্দে উদার হয়ে পড়েছেন তিনি।

হেডওয়েটার এগিয়ে এল। কিন্তু ডেজার্টের বদলে তার হাতে ফোনের রিসিভার। আপনার অফিস, কর্নেল।

কথা বলল কোসিমো পাধানি, তাঁর সহকারী। কিছুক্ষণ শোনার পর তিনি বললেন; আধ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাব ওখানে। টেবিলে রিসিভার রেখে হেড ওয়েটারকে ডাকলেন তিনি, গাম্ভীর্যের সঙ্গে ডেজার্টের অর্ডার বাতিল করে দিলেন। এরপর তিনি ফোন করলেন তরুণী অভিনেত্রীকে, আজ ওঁদের দেখা হচ্ছে না। মেয়েটার কথায় মনে হল, মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে সে। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে গুগলি। জানালেন, রোববারে তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে ওর জন্যে নিজের হাতে ডিনার তৈরি করবেন তিনি। বিল মেটাবার সময় হেডওয়েটারকে বললেন, কাপন ম্যাগ্রোতে রোজমেরী একটু বেশি হয়ে গেছে।

.

মিলান তুরিন মটর ওয়ের পাশেই একটা ডোবা, রাস্তা থেকে ত্রিশ মিটার দূরে। অনেকগুলো নর্দমা চারদিক থেকে এসে নেমেছে এই ডোবায়। আবর্জনার ওপর চিৎ হয়ে ভাসছে গিয়াকোমো অগাস্টিনের লাশ। রাস্তার পাশে একটা অ্যাম্বুলেন্স আর কয়েকটা পুলিস কার দেখা গেল। স্ট্রেচারের ওপর ভাঁজ করা রয়েছে বড়সড় কালো একটা প্লাস্টিক ব্যাগ। একজন পুলিস ফটোগ্রাফার ঘুরেফিরে ছবি তুলছে।

সহকারী পাধানির পাশে দাঁড়িয়ে লাশের দিকে তাকিয়ে আছেন গুগলি, ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গ মেশানো ক্ষীণ একটু হাসির রেশ। একজন কালেক্টরকে কালেক্ট করা হয়েছে, তাই না?

কাল রাতে কোন এক সময়, বলল পাধানি। লাশ পাওয়া গেছে ঘন্টাখানেক আগে।

চোখে একটা মাত্র বুলেট, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন গুগলি। ব্যস, ফুরিয়ে গেল সব।

হ্যাঁ একেবারে ক্লোজ রেঞ্জ থেকে। লাশের মুখের দিকে আঙুল তুলল। পাধানি। চোখের চারপাশে পোড়া দাগ। ঠিক পাতার ওপর মাজল চেপে ধরে ট্রিগার টানা হয়েছে।

এ যেন খুনীর ব্যক্তিগত প্রতিশোধ। ওর হাতে কি হয়েছিল?

তীক্ষ্ণ চোখে লাশের হাতের দিকে তাকাল পাধানি। ফুটো করা হয়েছে। হাতটা। কাঁধ ঝাঁকাল সে। কি দিয়ে বলতে পারব না।

ফটোগ্রাফার এসে তার প্রাথমিক কাজ শেষ করল। একজন পুলিস এগিয়ে এসে জানতে চাইল, কর্নেল, লাশ এবার নিয়ে যেতে পারি?

হ্যাঁ, বললেন গুগলি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্যাথোলজিস্টের রিপোর্ট চাই আমি।

পানির ওপর আধ হাত পুরু হয়ে আবর্জনা জমে আছে, লাশ তাই ডোবেনি। ডোবার কিনারায় দাঁড়িয়ে একজন অ্যাম্বুলেন্স কর্মী প্লাস্টিক ব্যাগের ভেতর লাশ ঢোকাতে শুরু করল। নিজের গাড়ির দিকে এগোলেন গুগলি, পিছু নিল পাধানি।

আপনার কি ধারণা, স্যার, আবার একটা যুদ্ধ শুরু হল?

গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন গুগলি, মনে মনে এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাখ্যা পাবার চেষ্টা করছেন। তিনটে সম্ভাবনা দেখতে পেলেন তিনি। এলাকার দখল নিয়ে যুদ্ধ শুরু করতে পারে ফনটেলা আর গামবেরি। এর সম্ভাবনা খুবই কম, কারণ। ব্যবসায়িক স্বার্থেই শহরটাকে তারা নিজেদের মধ্যে নিখুঁতভাবে ভাগ করে নিয়েছে, কেউ কারও ব্যাপারে নাক না গলিয়ে চুটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে ওরা। তাছাড়া, যুদ্ধ করতে হলে প্রথমে বেরলিংগার, তারপর বাকালার সম্মতি আদায় করতে হবে ওদের, কিন্তু এই মুহূর্তে তারা কোন যুদ্ধ চায় না। আরেকটা সম্ভাবনা, আদায়করা টাকা হয়ত মেরে দিচ্ছিল অগাস্টিন, ব্যাপারটা ফাস হয়ে যায়। কিন্তু এ-ও প্রায় অসম্ভব। পনেরো বছর ধরে এই কাজ করছে অগাস্টিন। লোকটা হয়ত বোকা ছিল, কিন্তু তার বিশ্বস্ততা সম্পর্কে কখনও কোন প্রশ্ন ওঠেনি। আরেক হতে পারে, কাজটা বাইরের কারও।

কে সে?

কেন?

কাঁধ ঝাঁকালেন গুগলি, গাড়িতে উঠে বসলেন। সহকারীর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, অগাস্টিনের ফাইল চাই আমি। গত বাহাত্তর ঘন্টায় আড়িপাতা যন্ত্রে। যা ধরা পড়েছে সব লিখে আমার কাছে পাঠাবে।

হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল পাধানি।

গুগলি বললেন, সন্ধেয় কোন প্রোগ্রাম থাকলে বাতিল করে দাও। তার। চেহারায় অস্বস্তির একটা ছায়া পড়ল। আমারটা আমি আগেই বাতিল করে দিয়েছি। এক সেকেণ্ড চিন্তা করলেন তিনি। রেড লিস্টে যারা আছে তাদের ওপর নজর রাখার ব্যবস্থা আরও জোরদার কর।

এঞ্জিন চালু হল। জানালা দিয়ে মুখ বের করে বললেন, অফিসে দেখা হবে।

একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে গাড়িটার চলে যাওয়া দেখল পাধানি। তিন বছর ধরে ওঁর সহকারী হিসেবে কাজ করছে সে। প্রথম দিকে, প্রায় পুরো একটা বছর ধরে, এই মানুষটার কাছ থেকে পালিয়ে যাবার একটা ঝোঁক ছিল তার মধ্যে। কিন্তু বদলি হতে চাইলে সঙ্গত কারণ দেখানো চাই।

কর্নেল গুগলিকে যে সে পছন্দ করেনি তা নয়। ভদ্রলোক তাকে শুধু ভয়ঙ্কর। একটা অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু বদলির আবেদন জানাবার জন্যে। কোন কারণই সে খুঁজে বের করতে পারেনি। তার শ্লেষ মেশানো মন্তব্য, হঠাৎ কঠোর হয়ে ওঠা, নায়কসুলভ সুন্দর চেহারা, এমনকি বংশ গৌরবও পাধানির জন্যে কোন সমস্যার সৃষ্টি করেনি। তার অস্বস্তি লাগার কারণ ছিল, একজন সিনিয়র কারাবিনিয়ারি অফিসারকে যা কিছু মানায় না বলে তার ধারণা, সেগুলো সবই রয়েছে কর্নেলের মধ্যে। বলা কঠিন পাধানি হয়ত নিজেও জানে না যে সে সম্ভবত ঈর্ষা করে তাঁকে।

দুটো কারণে পালিয়ে যাবার ঝোঁকটা তার মন থেকে দূর হয়ে যায়। এক বছর। কাজ করে হঠাৎ পাধানি তার বসের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর অসাধারণ স্মরণশক্তির পরিচয় পেয়ে যায়। এই গুণ দুটো কর্নেলের মধ্যে আগে থেকেই ছিল, কিন্তু এতদিন তার চোখে পড়েনি। দ্বিতীয় কারণ ছিল, তার বোন। ডাক্তারী পড়ার জন্যে কাটানযারো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে চায় সে, তার রেজাল্টও ভাল, কিন্তু ওপর মহলের কারও সঙ্গে ওদের পরিবারের দহরম-মহরম ছিল না। তার আবেদন। বিবেচনা না করেই বাতিল করে দেয়া হয়। পাধানির ঠিক মনে নেই, কথায় কথায় অফিসে হয়ত ঘটনাটা বলেছিল সে। কোথাও কিছু নেই, এক হপ্তা পর পাধানির বোন ইউনিভার্সিটি থেকে একটা চিঠি পেল, কর্তৃপক্ষ তাদের সিদ্ধান্ত বদলেছেন। ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস শুরু করার পরই শুধু তার বোন জানতে পারে, কে এক প্রফেসর গুগলি, নেপলসের কারদারেলি হাসপাতালের সিনিয়র সার্জেন, তার ব্যাপারে নাকি সুপারিশ করেন।

প্রসঙ্গটা একদিন তুলল পাধানি।

বিস্মিত দেখাল কর্নেলকে। বললেন, কি আশ্চর্য! তুমি আমার সঙ্গে কাজ কর, তোমার সুবিধে-অসুবিধে আমি দেখব না তো কে দেখবে!

বদলি হবার চিন্তাটা সেই মুহূর্তে বাতিল করে দেয় পাধানি। কর্নেল উপকার করেছেন বলে নয়। তাঁর প্রকাশভঙ্গিটা ওর ভাল লেগেছিল। তুমি কাজ কর আমার সঙ্গে, আমার জন্যে নয়।

তারপর দুবছর ধরে চমৎকার একটা টিম হিসেবে কাজ করছে ওরা। এখনও আগের মতই আছেন কর্নেল, তাঁর বিদ্রুপাত্মক মন্তব্যের ধার এতটুকু কমেনি, মাঝেমধ্যে অসম্ভব একগুঁয়ে হয়ে ওঠেন, এবং কোনরকম দ্বিধা না করেই বলা যায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আরও যেন সুপুরুষ ও সুদর্শন হয়ে উঠেছেন তিনি। কিন্তু। ভেতরের মানুষটাকে এখন বুঝতে পারে পাধানি, সেই সঙ্গে তাঁর কিছু কিছু অভ্যেস আর আচরণ অনুকরণ করতে চেষ্টা করে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আগের চেয়ে খুঁতখুঁতে হয়ে উঠেছে, বেশি ভাড়া দিয়ে ভাল ফ্ল্যাটে থাকে, সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে নরম ব্যবহার করে। শুধু ব্যাকগ্যামন খেলাটা তার ধাতে সয় না।

.

প্যাথোলজিস্টের রিপোর্টটা জটিল পরিভাষার সাহায্যে লেখা, তাই প্রথমে একবার পড়ে নিয়ে সহজ করে পরিবেশন করছে পাধানি। মৃত্যুর সময়ঃ মাঝরাত থেকে সকাল ছটা, তেরো তারিখ।

রিভলভিং চেয়ারে দোল খেতে খেতে গুগলি জানতে চাইলেন, পিসমেকার থেকে মাঝরাতে বেরোয় ও, ঠিক?

মাথা ঝাঁকাল পাধানি, ডেস্কের এ-ধারে একটা চেয়ারে সিধে হয়ে বসে আছে। সে। তাই তো বলছে ওরা। কিন্তু রেডসানে পৌঁছায়নি সে। পিসমেকার থেকে ওখানেই তার যাবার কথা ছিল।

পড়।

 মৃত্যুর কারণঃ বুলেট ঢুকে ব্রেন ছাতু করে দিয়েছে। গুলি করা হয় ডান। চোখের ওপর পিস্তল ঠেকিয়ে। চোখের চারপাশে গানপাউডারের দাগ ছিল। মাথার পিছন দিকে বড় একটা গর্ত করে বেরিয়ে গেছে বুলেট, তারমানে বড় ক্যালিবারের। নরম নাকের বুলেট ছিল ওটা।

হাতের কথা কি লিখেছে? আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন গুগলি।

ধারাল, কিংবা উঁচাল কিছু হাতের উল্টো পিঠে গাঁথা হয়, সেটা তালু ফুটো করে অপরদিকে বেরোয়। কাঠের সূক্ষ্ম গুড়ো পাওয়া গেছে তালুতে, সম্ভবত সমতল কোন টেবিলে চেপে ধরা হয়েছিল হাতটা (কাঠের গুঁড়ো ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে)। জমাট বাঁধা রক্তের পরিমাণ দেখে আন্দাজ করা যায়, মৃত্যুর দুঘন্টা আগে ফুটো করা হয় হাত।

চেয়ারে হেলান দিলেন গুগলি, ঠোঁটে বিদ্রূপ মেশানো ক্ষীণ একটু হাসি। যীশুর মত ক্রুশ বিধে মরার মধ্যে গৌরব আছে, একটুর জন্যে সেই গৌরব থেকে বঞ্চিত হয়েছে অগাস্টিন।

মুচকি একটু হেসে রিপোর্টের ওপর চোখ বুলাল পাধানি। লাশের হাত-পা, আর মুখে আঠা পাওয়া গেছে, সম্ভবত অ্যাঢেসিভ টেপ লাগানো হয়েছিল। কাগজটা ভাঁজ করল সে।

 চোখ বন্ধ করে বসে আছেন গুগলি, গভীর চিন্তায় মগ্ন। মন্তব্য শোনার জন্যে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে পাধানি।

পিসমেকার ছেড়ে বেরুবার পরপরই অগাস্টিনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, বললেন গুগলি। নির্জন কোথাও নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসিয়ে টেপ দিয়ে আটকানো হয় হাত-পা। নিশ্চয়ই কিছু প্রশ্ন করা হয় তাকে, জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে হেঁদা করা হয় তার হাত। সব কথা আদায়ের পর ওরা তাকে গুলি করে, তারপর লাশটা ডোবায় ফেলে চলে যায়।

মন দিয়ে শুনছে পাধানি।

ঝুঁকে ডেস্কের ওপর থেকে একটা ফাইল টেনে নিয়ে খুললেন গুগলি, চোখ। বুলালেন কাগজে। সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছে আজ বেলা দুটোয় অগাস্টিনের। ল্যানসিয়া পাওয়া গেছে, তাতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না, শুধু একটা ওয়ার্নিং সিস্টেম বাদে।

ভুরু প্রায় কুঁচকে উঠল পাধানির। ওয়ার্নিং সিস্টেম, স্যার?

জাপানি পুতুলটার কথা বলছি। ওটা একটা স্প্রিং লাগানো পুতুল, গাড়িতে কেউ চড়লে ঘন ঘন ওপর-নিচে দোলার কথা। ক্লাবে বেশিক্ষণ ছিল না অগাস্টিন, কাজেই যখন বেরিয়ে এল, তখনও একআধটু দুলছিল পুতুলটা। আততায়ী মাত্র। কিছুক্ষণ আগে উঠেছিল তার গাড়িতে।।

কিন্তু অগাস্টিন পুতুলের দোল খাওয়া লক্ষ করেনি…

ভুলের খেসারত কিভাবে দিয়েছে দেখলেই তো। মাফিয়া সদস্যরা। টেলিফোনে কে কি আলাপ করেছে জানার জন্যে আরেকটা ফাইল খুললেন গুগলি। বেশি কিছু আশা করেন না তিনি, কারণ ফোনে আড়িপাতা যন্ত্র ফিট করা গোটা দেশেই আজকাল অতি সাধারণ একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, ফলে যাদের ফোনে জিনিসটা ফিট করা হয় তারাও ব্যাপারটা জেনে ফেলে।

ফাইলের কাগজে চোখ বুলাচ্ছেন গুগলি, পাধানি মৃদু কণ্ঠে বলল, তেমন কিছু নেই–আজ সকালে শুধু অগাস্টিনের খোঁজে ওরা সবাই সবাইকে ফোন করতে শুরু করে।

ফাইলটা বন্ধ করে রেখে দিলেন গুগলি। একটাই সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি ইউনিয়ন কর্স। ড্রাগসের চালান নিয়ে ওদের সঙ্গে ফনটেলার একটা গোলমাল বেধেছিল। হুমকি-ধামকি দিয়ে ফনটেলা ওদেরকে চুপ করে যেতে বাধ্য করলেও, রাগ পুষে রেখেছিল ওরা। সুযোগ পেয়ে ছোবল দিয়েছে। এ যদি সত্যি হয়, খুন এখন একটার পর একটা ঘটতেই থাকবে, আর ঘটবে নির্দিষ্ট একটা প্যাটার্ন নিয়ে। গ্রুপের খুদে একটা খুঁটিকে তুলে নিয়ে গিয়ে বড়গুলোর গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য আদায় করেছে ওরা। যে-কোন মুহূর্তে ব্যাপক হামলা শুরু হয়ে যেতে পারে।

পাধানি কিছু বলতে যাবে, তাকে বাধা দিলেন গুগলি। কিন্তু একটা জিনিস মিলছে না, পাধানি। চোখে গুলি করল কেন? এ তো ব্যক্তিগত আক্রোশের পরিচয়। ওই চোখ দিয়ে অগাস্টিন কিছু দেখেছিল, তার এই দেখাটা যেন পছন্দ করেনি খুনী। উঁহু, এর সঙ্গে ইউনিয়ন কর্সের সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না…।

ব্যক্তিগত শত্রুতার জের বলছেন? সংশয় প্রকাশ করল পাধানি। কিন্তু সার্ভেইল্যান্স রিপোর্ট হল, আজ সকাল থেকে ফনটেলা আর তার লোকেরা সাংঘাতিক সতর্ক হয়ে গেছে। প্রত্যেকের জন্যে আরও বেশি করে বডিগার্ড, আস্তানাগুলোয় কড়া পাহারা, বাইরে কেউ এক রকম বেরুচ্ছেই না…।

হ্যাঁ। চিন্তিত দেখাল কর্নেলকে। এ-সব লক্ষণ দেখে বোঝা যায়, ইউনিয়ন কর্সকেই ভয় পাচ্ছে ওরা। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। মশিয়ে দ্য জিলাম্বুকে ফোনে পাওয়া যায় কিনা দেখ দেখি।

ইটালিতে যেমন মাফিয়া, ফ্রান্সে তেমনি ইউনিয়ন কর্স। ইউনিয়ন কর্সের প্রধান ঘাঁটি মার্সেলেসে। কর্নেল গুগলির মত একই পদমর্যাদার পুলিস অফিসার দ্য জিলাম্বু দক্ষিণ ফ্রান্সে কাজ করেন। দুজনের মধ্যে ভাল সম্পর্ক রয়েছে, অনেকদিন থেকে পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে আসছেন। বেশ কয়েকটা কনফারেন্সে দেখা-সাক্ষাৎও হয়েছে ওদের।

কিন্তু দ্য জিলাম্বু কোন সাহায্য করতে পারলেন না। কিছুই শোনেননি তিনি। তবে বললেন, এর পিছনে যদি ইউনিয়ন কর্স থাকে, তারা সম্ভবত কর্সিকা থেকে গানম্যান ভাড়া করেছে। প্রতিশ্রুতি দিয়ে বললেন, তিনি সজাগ থাকবেন, কিছু টের পেলেই সঙ্গে সঙ্গে জানাবেন কর্নেলকে।

.

এ ইউনিয়ন কর্স না হয়েই যায় না, ডন বাকালার গম্ভীর, কর্কশ গলা গমগম করে উঠল।

পালার্মোয় আতুনি বেরলিংগারের সঙ্গে বৈঠকে বসেছে ডন বাকালা। রোম থেকে এইমাত্র এসে পৌচেছে বেরলিংগার। ডন বাকলার স্টাডিরূমে তার দুজন প্রধান উপদেষ্টাও রয়েছে, ট্যানডন আর বোরিগিয়ানো। ডন আতুনি বেরলিংগারকে একটু চিন্তিত আর আড়ষ্ট দেখাচ্ছে–কারণ, মিলান সরাসরি তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, ওখানে কিছু ঘটলে সব দায়-দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হবে।

কিছুদিন থেকে একের পর এক ভুল করে যাচ্ছে ফনটেলা, বলল সে। আমি তাকে বলেছি,-ড্রাগস স্মাগলিঙের ব্যাপারটায় ফরাসীদের ঠকানো বোকামি হয়ে গেছে তার। ওকে নিয়ে মুশকিল হল, মাঝে-মধ্যে অতি চালাক হয়ে ওঠে। ওটাই শেষ শিপমেন্ট ছিল, এরপর ব্যাংকক থেকে ড্রাগস আনার ব্যবস্থা হবে, মোটা একটা দাও মারার সুযোগটা তাই ছাড়েনি।

ট্যানডন মন্তব্য করল, কোন কাজই সুষ্ঠভাবে করতে পারছে না। কিডন্যাপিঙের ঘটনাটা ভাবুন একবার। একে একে সবার দিকে তাকাল সে। নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের–আভান্তি পরিবারের মেয়েটার কথা বলছি। তাকে, রাস্তা থেকে তুলে আনার সময়ই গোটা ব্যাপারটা লেজেগোবরে হয়ে গেল। তারপর, কি অন্যায়, গাড়ির ভেতর মারা গেল মেয়েটা। সাধারণ মানুষ এধরনের ঘটনা খুব খারাপভাবে নিচ্ছে। ঘটনাটার পর চারদিক থেকে চাপ আসতে শুরু করে।

এবার বোরিগিয়ানোর পালা। হ্যাঁ, বিশেষ করে ওই কাজটা সুষ্ঠুভাবে সারা উচিত ছিল। আর, যারা দায়ী, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত ছিল তাদের। ওদের একজন ফনটেলার ভাগ্নে, তাই সে কোনরকম শাস্তি না দিয়ে শুধু টাকার ভাগ থেকে বঞ্চিত করল ওদের। চেহারায় বিষাদ নিয়ে মাথা নাড়ল সে। ব্যবসার মধ্যে শৃংখলা না থাকলে চলে কি করে! আমার মনে হয় ফনটেলা বোধহয় নরম হয়ে পড়েছে।  

বেরলিংগার মাথা ঝাঁকাল। ওই কাজটায় অগাস্টিনও ছিল। সত্যি কথা বলতে কি, ওটা ছিল একটা বোকা পাঠা।

সবাই যে যার কথা শেষ করে এবার ডন বাকালার দিকে ফিরল, উনি এখন কি বলেন। ডন বাকালা মানুষটা মাঝারি গড়নের, কিন্তু ধড়টা চওড়া আর নিরেট। বুলেট আকৃতির মাথায় ছোট করে ছাটা কাঁচাপাকা চুল। এই মুহূর্তে তার চেহারায় কোন ভাব নেই। ভারি, কর্কশ কণ্ঠস্বর, কিন্তু শান্ত। নির্দেশ দেয়ার সময় কখনও তাকে উত্তেজিত হতে দেখা যায় না।

ট্যানডন, তুমি যদি ফ্রান্সে গিয়ে বেলোরির সাথে কথা বল, আমি খুশি হব। এটা যদি ওরা শুরু করে থাকে, আমি চাই ওদের সাথে তুমি একটা সমঝোতায় আসবে। ব্যাখ্যা করে বলবে, লোক ঠকানর ব্যবসায়ে আমরা নেই। ফনটেলা যদি কোন অন্যায় করেই থাকে, ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হবে তাকে। হঠাৎ একটু তীক্ষ্ণ হল তার কণ্ঠস্বর, কিন্তু ক্ষমা চাইবে না। বুঝিয়ে দেবে আপস করতে চাইছি ভয়ে নয়, আমরা সম্মানিত লোক বলে, আর ব্যবসায় কারচুপি পছন্দ করি না বলে।

কালই আমি রওনা দেব, রোম হয়ে, বলল ট্যানডন।

কিন্তু নেতাদের নেতা মাথা নাড়ল। না। দুতিন দিন অপেক্ষা করে। ওরা যেন ভেবে না বসে গোলমাল শুরু হতে না হতেই নাভসি হয়ে পড়েছি আমরা।

বোরিগিয়ানোর দিকে ফিরল বাকালা। মিলানে গিয়ে ফনটেলার সাথে কথা বল তুমি। তাকে বলবে, আমরা অসন্তুষ্ট। ভবিষ্যতে যেন তার কাজে বিশৃঙ্খলা না দেখি। আর, বেলোরিকে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

বাকালা এবার বেরলিংগারের দিকে ফিরল। সিনর, আমি জানি, ফনটেলা আপনার সরাসরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবু অন্তত এই ব্যাপারে ধমকটা তার আমার কাছ থেকেই পাওয়া দরকার।

সায় দিয়ে সামান্য একটু মাথা দোলাল বেরলিংগার।

 বাকালা আবার ট্যানডনের দিকে ফিরল। কাজটা তুমি গোপনে সারবে। আমি চাই না গামবেরি জানুক ফনটেলা এখন আর আমাদের গুড বুকে নেই। জানলে তার মাথায় হয়ত কুবুদ্ধি গজাবে। তাছাড়া, সব মিলিয়ে মিলানের পরিস্থিতি ভালই। কথা শেষ করে বেরলিংগারের দিকে তাকাল, সমর্থন জানিয়ে আবার সামান্য একটু মাথা দোলাল বেরলিংগার।

বলল, পরস্পরের ব্যাপারে ওরা নাক গলায় না, সেজন্যেই মিলানের পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে সেটা নষ্ট করা ঠিক হবে না।

বৈঠকের ফলাফলে ডন বাকালা খুশি। উঠে গিয়ে কর্কটেল কেবিনেটের সামনে দাঁড়াল সে। নিজের হাতে সবাইকে স্কচ হুইস্কি পরিবেশন করল। মার্টিনি হলে ভাল হত, ভাবল বেরলিংগার। কিন্তু ডন বাকালা তার গ্লাসে বিষ ঢেলে। দিলেও হাসিমুখে সেটুকু তার গিলতে হবে।

.

নেপলস, শনিবার সকাল। টেরেসে বসে কফি খাচ্ছে রেমারিক। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ফেরাল সে, দেখল, খবরের কাগজ নিয়ে এগিয়ে আসছে ফুরেলা। টেবিলের ওপর কাগজটা রাখল ছেলেটা, আঙুল দিয়ে একটা খবরের দিকে রেমারিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। অগাস্টিন নামে এক লোক খুন হয়েছে, গুলি করে মারা হয়েছে তাকে। ধারণা করা হচ্ছে, অর্গানাইজড ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত ছিল লোকটা। মাত্র এই কলাইনের খবর। খুন-খারাবির শহর মিলান, দুএকজন খুন হলে কাগজগুলো তেমন গুরুত্ব দেয় না। পড়া শেষ করে মুখ তুলল রেমারিক, বলল, তারমানে ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। জিনিস-পত্র সব গুছিয়ে রাখ, কাল তুমি গোজোয় চলে যাচ্ছ।

.

০৬.

দুবার গড়ান দিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল সিনেল এলি, মাথার ওপর হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙল। বেডসাইড টেবিল থেকে হাতঘড়ি নিয়ে ডায়ালে চোখ বুলাল–মাত্র দশটা বেজেছে। ন্যাংটো অবস্থাতেই জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। পর্দা সরিয়ে নিচের অন্ধকার রাস্তায় তাকাল। তার কালো আলফা রোমিও ঠিক নিচেই পার্ক করা রয়েছে, এতটা ওপর থেকে শুধু বারুন-এর ভাঁজ করা কনুই সহ। হাতের, খানিকটা দেখা যায়, ড্রাইভারের জানালা দিয়ে বেরিয়ে আছে। সন্তুষ্ট হয়ে পর্দা ছেড়ে দিল সে, জানালার দিকে পিছন ফিরল। বিছানায় শুয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। চোখাচোখি হতে জিভের ডগা সামান্য একটু বের করে। এদিক-ওদিক নাড়াল এলি।

কেমন লাগছে, লক্ষ্মী সোনা? আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করল সে। তোমাকে খুশি করতে পেরেছি তো?

যাহ, অসভ্য! লালচে হয়ে উঠে বলল মেয়েটা, এলির সুঠাম নগ্ন শরীরের ওপর চোখ। তোমার কি এখুনি না গেলেই নয়? জানতে চাইল সে। বড়জোর এক ঘন্টা, তার বেশি কোন দিন থাক না–একা একা থাকতে কি যে একঘেয়ে। লাগে আমার!

 তোমার মত মেয়ে না থাকলে জীবনটা আমার কাছেও একঘেয়ে লাগত, ভাবল এলি। মনে মনে খুশি আর তৃপ্ত সে, আবার একই সঙ্গে একটা অস্বস্তিও বোধ করছে। খুশি এইজন্যে যে এই বয়সেও পনেরো বছরের একটা মেয়েকে সন্তুষ্ট করতে পারে সে। আর অস্বস্তির কারণ হল, এমন ভাব দেখাচ্ছে মেয়েটা যেন তার। ওপর ওর একটা অধিকার জনে গেছে।

কাপড় পরতে শুরু করে এলি ভাবল, কেউ যদি অল্পবয়েসী গার্লফ্রেণ্ড পছন্দ করে, এ-ধরনের ছেলেমানুষি আচরণ মেনে না নিয়ে তার কোন উপায়ও নেই। কাপড় পরে বিছানায় বসল সে, মেয়েটার বুকে হাত দেয়ার জন্যে ঝুঁকল। কিন্তু একটা গড়ান দিয়ে দূরে সরে গেল মেয়েটা। অস্বস্তি আরও একটু বাড়ল এলির।

সুখে থাকলে ভূতে কিলায়, বলল সে। এত সুন্দর একটা জায়গায় রেখেছি। তোমাকে, প্রচুর টাকা দিচ্ছি খরচ করতে–নাকি বেটোলায় ফেরত যেতে চাও?

মেয়েটার কোন জবাব নেই। বিছানা থেকে উঠে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল এলি। চট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, এটাকে বাদ দিয়ে নতুন আরেকটা যোগাড় করতে হবে। অর্গানাইজড ক্রাইমের এমন একটা পজিশনে রয়েছে সে, নারীদেহ উপভোগের রাক্ষুসে ক্ষুধা মেটানো তার জন্যে কোন সমস্যাই নয়। মামা। ফনটেলার অনেক রকম ব্যবসা, তার মধ্যে নারী-ব্যবসাটা সে-ই দেখাশোনা করে।

 দেশের সব জায়গা থেকে বড় শহরগুলোয় আসে ওরা। আসে টাকা, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আর উত্তেজনার লোভে। পনেরো থেকে বিশের মধ্যে বয়স ওদের, দুনিয়া সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। এখানে-সেখানে ধাক্কা খেয়ে শেষ পর্যন্ত বোকা। মেয়েগুলো এলি আর তার সহকারীদের খপ্পরে পড়ে। মেয়েগুলোকে ওরা বার, ক্লাব আর ব্রথেলে চাকরি দেয়–সব চাকরির একটাই শর্ত, দেহদান করতে হবে। এই শর্ত সহজে কেউ মেনে নিতে চায় না, কিন্তু পরিস্থিতির চাপে পড়ে সবাইকেই এক সময় মেনে নিতে হয়। এদের মধ্যে থেকে কাউকে মনে ধরলে, সে যদি খুব সুন্দরী আর অল্পবয়েসী হয়, নিজের ব্যবহারের জন্যে তাকে আলাদা করে রাখে এলি। কিছুদিন তাকে নিয়ে মৌজ করে, তারপর বাতিল করে আরেকটা খুঁজে নেয়।

কালই এটাকে মিজানোর হাতে তুলে দেবে সে, ঠিক করল এলি। মিজানো পাকা লোক, হপ্তাখানেকের মধ্যে মেয়েটাকে ড্রাগে আসক্ত করে তুলবে–তখন। অর্গানাইজেশনের ওপর ভরসা না করে আর উপায় থাকবে না সুন্দরীর।

নিজের ওপর সন্তোষ বোধ করল, এলি। ভাবাবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারাটা জরুরি। একটা সমস্যা অবশ্য তৈরি হল নতুন একটা মেয়ে। যোগাড় করতে হবে। এবারেরটা আরও কমবয়েসী হলে ভাল হয়। বয়স যত বাড়ছে, ততই আরও অল্প বয়েসী মেয়েদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে সে। ওরা যে মেয়েটাকে কিডন্যাপ করেছিল, তার কথা মনে পড়ল..হ্যাঁ, শালা, মেয়ে ছিল বটে একখানা! কচি বলে কাকে! শরীরটা সবে মাত্র টসটসে হতে শুরু করেছিল। দেখ কাণ্ড, ওর কথা ভাবতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছে সে। মুহূর্তের জন্যে ইচ্ছে হল, আবার বিছানায় ওঠে। কিন্তু না, মামা তাকে এগারোটার সময় তৈরি থাকতে বলে। দিয়েছে। পালার্মো থেকে বোরিগিয়ানো এসেছে, নিশ্চয়ই অগাস্টিনের খুন হওয়া নিয়ে আলোচনা করবে। ফরাসীরা খেপেছে, তাদেরকে ঠাণ্ডা করার ব্যাপারটা নিয়েও আলাপ হবে।

বিছানার কিনারায় বসে জুতো পরছে এলি। ইউনিয়ন কর্স-কে নিয়ে ভাবছে। সে। কি যে একটা উটকো ঝামেলায় পড়া গেল! অন্তত কিছুদিন সবাইকে সাবধানে থাকার নির্দেশ দিয়েছে মামা। তারমানে বডিগার্ড ছাড়া চলাফেরা করা যাবে না। সঙ্গে একটা লেজুড় রাখা ভারি অস্বস্তিকর। তবে তার ভাগ্যটা ভাল, বারুন তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় না। তাছাড়া, বারুনকে তার বডিগার্ড। হিসেবে পাঠানয় বোঝা গেল, দিনে দিনে তার গুরুত্ব আর মর্যাদা বাড়ছে। আত্মপ্রশংসায় কয়েক মুহূর্ত বুঁদ হয়ে থাকল এলি। তার ধারণা, এই উন্নতির মূলে। রয়েছে তার বুদ্ধি। অগাস্টিনের চেয়ে অনেক বেশি চালাক-চতুর সে। ওটা তো ছিল। এক নাম্বার গবেট আর ভোতা। দুহপ্তা একটা বাড়িতে অগাস্টিনের সঙ্গে আটকা পড়েছিল সে, ঘটনাটা মনে পড়ায় গম্ভীর হয়ে উঠল এলি। লুবনা নামের সেই কচি মেয়েটা ছাড়া একঘেয়েমি দূর করার আর কোন উপকরণ ছিল না।

উঠে দাঁড়িয়ে শোল্ডার হোলস্টার পরল এলি, তাতে পিস্তল ভরল। জ্যাকেট পরার সময় দেখল, মেয়েটা তাকিয়ে আছে তার দিকে।

আবার কখন আসবে তুমি? অভিমানের সুরে জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।

বিছানার ওপর ঝুঁকে পড়ে মেয়েটার ঠোঁট আলতোভাবে চুমু খেল এলি। কাল, মুখে হাসি টেনে বলল সে। আজ বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না, কাল তার ক্ষতিপূরণ দেব–বাইরে লাঞ্চ খেতে নিয়ে যাব তোমাকে। তারপর, আমার এক বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।

ছোট অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুলল সে, বেরিয়ে এল ল্যাণ্ডিঙে। ভারি একটা কণ্ঠস্বর শুনল, এলি। ঘুরতে শুরু করল এলি, জ্যাকেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। সত্যিই বুদ্ধি রাখে সিনেল এলি। দেখার সঙ্গে সঙ্গে জিনিসটা চিনতে পারল সে–একটা শটগানের কালো ব্যারেল, একেবারে চোখের সামনে। তারপরই সাদা আর হলুদ রঙের রিস্ফোরণ ঘটল।

.

ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে বার্নাদো গুগলির। অভিনেত্রীর ভাগ্য অস্বাভাবিক ভাল। মেয়েটা খেলে চমৎকার, খেলার সূক্ষ্ম কিছু কলা-কৌশলও জানা আছে তার, এ-সবই তিনি স্বীকার করেন, কিন্তু তার সঙ্গে পাঁচটা খেলার তিনটেতেই জিততে হলে অবশ্যই ভাগ্য দরকার। ছক্কাগুলো নেড়ে সবুজ পশমী আচ্ছাদনের ওপর ফেললেন তিনি, বিড়বিড় করে বললেন, ছক্কা! কিন্তু একটা দুই, আর একটা এক হল। ধেত্তেরি! হতাশায় তার চেহারা কালো হয়ে গেল। চেহারায়। সহানুভূতি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসল মেয়েটা-দক্ষ একজন অভিনেত্রী।

এবার মেয়েটার পালা। দাতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করছেন গুগলি। সবগুলোয় জিততে না পারলেও, ছয়টা খেলায় তিনটেয় জিতে সমান সমান তাকে হতেই হবে, তা না হলে ওকে নিয়ে বিছানায় ওঠার প্রশ্নই ওঠে না। অহঙ্কারে ঘা লাগছে, মর্যাদা হুমকির সম্মুখীন হাজার হোক তিনি একজন এক্সপার্ট। চট করে একবার ঘড়ির ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন। প্রায় এগারোটা।

সন্ধেটা কিন্তু শুরু হয়েছিল সুন্দরভাবে। মেয়েটা যখন ঘরে ঢুকল, মনে হচ্ছিল আগুনের লাল শিখা তাকে জড়িয়ে আছে। ড্রেসটা পছন্দ হয় তার–ছোট করে। ছাটা, একটু ঢিলেঢালাভাবে গায়ে ফিট হয়েছে। ছক্কা ফেলার জন্যে যতবার ঝুঁকেছে মেয়েটা, প্রতিবার তার ভরাট স্তনের অনেকটা দেখতে পেয়েছেন তিনি। দেখেছেন, আর মনে মনে অস্থিরতায় ভুগেছেন। এই অস্থিরতার জন্যেই প্রথম দিকের খেলাগুলোয় মন লাগাতে পারেননি।

রান্নাবান্না আগেই সেরে রেখেছিলেন। কচি ভেড়ার মাংসের সঙ্গে ডিম আর। লেমন সস। শ্যাম্পেন আর হুইস্কি। ভোজন পর্ব শেষ হয়, স্বভাবতই জিলাটো ডি। টুটি ফুটি দিয়ে। তার হাতের রান্না খেয়ে এক কথায় মুগ্ধ হয় তরুণী অভিনেত্রী। তার ভাব দেখে গুগলি উপলব্ধি করেন, এরপর শুধু যদি তিনি ব্যাকগ্যামন খেলায় জিততে পারেন তাহলেই কেল্লা ফতে, ওকে বিছানায় ভোলা কোন সমস্যাই হবে না।

তার পালসের গতি বেড়ে গেল। ছয় দরকার ছিল মেয়েটার, কিন্তু ছক্কায় দেখা যাচ্ছে তিন আর এক। এখন শুধু যদি তার একটা ছয় পড়ে, জেতার সম্ভাবনা। শতকরা আশি ভাগ। আর এবার জিততে পারলে, দশ মিনিট লাগবে ওকে বিছানায় তুলতে…

অনেকক্ষণ ধরে নেড়ে ছক্কা ছুঁড়লেন তিনি। ছক্কা! উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলেন। কিন্তু তার চিৎকার চাপা পড়ে গেল টেলিফোনের কর্কশ আওয়াজে।

.

আলফা রোমিওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে পাধানি। সামনেই একটা পুলিস ভ্যান, জেনারেটার সহ। গোটা দৃশ্যটা ফ্লাডলাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। গাড়ি থেকে নামলেন গুগলি। অত্যন্ত অসন্তুষ্ট দেখাচ্ছে তাঁকে। পনেরো মিনিট আগে যখন তিনি ফোনে কথা বললেন, তখনকার মতই বদরাগী লাগল। পাধানির। সঙ্গে চোখাচোখি হতে হুম করে একটা শব্দ করলেন, যেন সবকিছুর জন্যে পাধানিই দায়ী।

গাড়ির ভেতর উঁকি দিলেন গুগলি।

 বারুন, তাঁর পাশ থেকে পাধানি বলল, এলি ওপরে।

 এভাবেই ওকে পাওয়া গেছে? গুগলি জানতে চাইলেন।

না, জবাব দিল পাধানি। হুইলের পিছনে, ড্রাইভিং সিটে বসানো ছিল লাশ, জানালা দিয়ে বেরিয়ে ছিল ভাজ করা কনুই। টহলে এসে একজন পুলিস তাকে গাড়ি থেকে বেরুতে বলে। যখন বেরুল না, লোকটা তখন দরজা খোলে। লাশটা তার গায়ের ওপর ঢলে পড়ে, ইউনিফর্মে রক্ত লেগে যা তা অবস্থা।

আলফা রোমিওর ভেতর আবার তাকালেন গুগলি। সামনের সিটের ওপর। পড়ে আছে লাশ, ওদিকের দরজায় ঠেকে রয়েছে মাথা। সিট, ড্যাশবোর্ড আর মেঝেতে রক্ত দেখা যাচ্ছে। বারুনের চিবুকের নিচে, গলায়, বিশাল একটা গর্ত, সেটা থেকে এখনও একটু একটু রক্ত ঝরছে।

চোখ-মুখ বিকৃত করে ঘুরে দাঁড়ালেন গুগলি। কি করুণ মৃত্যু, অথচ এ ধরনের মৃত্যু এদের প্রাপ্য নয় সে-কথা বলা যাবে না। চল, ওপরে যাই।

একপাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট, তাকে আবার কাজ শুরু করার ইঙ্গিত দিয়ে বসের পিছু নিল পাধানি।

তিন তলার ল্যাণ্ডিঙে চিৎ হয়ে পড়ে রয়েছে এলি। একটা তোয়ালে দিয়ে তার কাধ আর মাথা ঢেকে রাখা হয়েছে, এক সময় তোয়ালেটা সাদা ছিল। পুলিস। বিভাগের ফটোগ্রাফার তার ক্যামেরা খাপে ভরে ঘুরে দাঁড়াল।

অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খোলা, ল্যাণ্ডিং থেকে বেডরূমে দৃষ্টি চলে। বিছানায়, একটা মেয়েকে বসে থাকতে দেখলেন গুগলি। মেয়েটার পরনে কিছু আছে বলে মনে হল না, গাঁয়ে শুধু একটা চাদর জড়ানো। তার পাশে বসে একজন পুলিস। নোটবুকে কি যেন লিখছে। লেখার ফাঁকে ফাঁকে চাঁদরের ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকাচ্ছে সে, তবে কারও চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে খুব সাবধান।

মেয়েটাকে দেখিয়ে পাধানি বলল, গার্লফ্রেণ্ডের সাথে সময় কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল এলি।

বিড়বিড় করে গুগলি বললেন, তাহলে তো বলতে হয় আমার চেয়ে ভাগ্যবান। ও। ঝুঁকে তোয়ালের একটা কোণ তুললেন তিনি। তা বোধহয় না, আবার অস্কুটে বললেন, ছেড়ে দিলেন তোয়ালের কোণ। এলির ক্ষতবিক্ষত চেহারা দেখে মাথার ভেতরটা ঝা ঝা করে উঠল।

শটগান, বলল পাধানি। একেবারে কাছ থেকে।

 মাথা ঝাঁকালেন গুগলি, রক্ত-লাল তোয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন। ক্ষীণ। একটু হাসির রেখা ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। প্যাথোলজিস্টের রিপোর্টে কি লেখা হবে বুঝতে পারছি–ম্যাসিভ ব্রেন ড্যামেজ…ঘাড় ফিরিয়ে একবার বেডরূমের দিকে তাকালেন তিনি। কি জান তুমি?

 যা জানে, সব বলে গেল পাধানি। এই অ্যাপার্টমেন্ট ছিল এলির-প্রেম নিকেতন। অ্যাপার্টমেন্টটা অনেক দিন থেকে ভাড়া নিয়ে রেখেছিল এলি, কিন্তু মেয়ে বদল হত ঘন ঘন। এখানে সে প্রায় রোজ রাতেই একবার করে আসত। কিছুদিন হল, অগাস্টিন খুন হবার পর থেকে, বারুনকে বডিগার্ড হিসেবে নিয়ে। আসত, তার জন্যে গাড়িতে অপেক্ষা করত বারুন। বারুনের গলা এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত কেটে ফেলে খুনী, তারপর লাশটাকে ড্রাইভিং সিটের ওপর খাড়া করে বসিয়ে দেয়। রাস্তাটা ওখানে অন্ধকার, পথিকরা গাড়ির দিকে তাকালেও কিছু বুঝতে পারার কথা নয়। বারুনকে খুন করে এখানে উঠে আসে খুনী, এলির জন্যে অপেক্ষায় থাকে। লোকটা সম্ভবত ঢোলা একটা কোট পরে ছিল, শটগানটা তারই নিচে লুকানো ছিল। এলি দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই তার মুখের ওপর দুটো ব্যারেল বিস্ফোরিত হয়।

মেয়েটা কিছু দেখেনি? জানতে চাইলেন গুগলি।

না, বলল পাধানি। বয়স একেবারেই কম, কিন্তু খুব একটা বোকা নয়। বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা মাত্র বালিশের তলায় মুখ লুকিয়েছিল, পুলিস না। আসা পর্যন্ত ওভাবেই শুয়েছিল। ওপরতলার দিকে একটা আঙুল তাক করল সে। আওয়াজ শুনে চারতলা থেকে এক মহিলা নেমে এসেছিলেন, ল্যাণ্ডিঙে এলিকে ৬ পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার জুড়ে দেন। স্বাভাবিক। মাথার অর্ধেকটাই উড়ে গেছে এলির। এই তো মাত্র মিনিট কয়েক আগে মহিলার চিৎকার থেমেছে। আমাদের কে যেন আছে তার সঙ্গে, শান্ত করার পর একটা জবানবন্দি নেবে।

ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং, মন্তব্য করলেন গুগলি।

জ্বী?

একটু আগে তুমি একবচন ব্যবহার করে বললে-খুনী একজন কেন? দুজন, বা আরও বেশি লোক নয় কেন?

কাধ ঝাঁকাল পাধানি। কি জানি এ স্রেফ আমার একটা অনুভূতি। কেন যেন মনে হচ্ছে, অগাস্টিন, আর এদের দুজনকে একই লোক খুন করেছে।

স্রেফ অনুভূতি, কিন্তু অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত, বলে খোলা দরজা দিয়ে অ্যাপার্ট মেন্টের ভেতর ঢুকলেন গুগলি। তরুণ পুলিস তাকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল, এগিয়ে এসে থামল তার সামনে, নোটবুকে চোখ রেখে পড়তে শুরু করল।

পাননা বেলি, বয়স পনেরো, বেটোলা থেকে এসেছে–সম্ভবত বাড়ি থেকে পালিয়ে। ছয় হপ্তা আগের হারানো বিজ্ঞপ্তিতে নামটা থাকতে পারে, এলির সঙ্গে তখন থেকেই ছিল ও।

মেয়েটার দিকে তাকালেন গুগলি। ভাজ করা হাঁটুর ওপর চিবুক ঠেকিয়ে বিছানায় বসে আছে, চেহারায় সন্ত্রস্ত একটা ভাব। ওকে বল জিনিস-পত্র গুছিয়ে নিয়ে তৈরি হোক, হেডকোয়ার্টারে যেতে হবে। ওর সম্পর্কে আরও জান, তারপর ওকে হারানো মেয়েদের বিভাগে পাঠিয়ে দাও। মিলানে যতদিন থাকবে, চব্বিশ ঘন্টা প্রোটেকশন দিতে হবে ওকে।

বেডরূম থেকে বেরিয়ে এলেন গুগলি, তার পিছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা। কি মনে করে আবার তিনি বেডরুমের দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিলেন, তরুণ পুলিস লোকটাকে শুকনো গলায় বললেন, তুমি বরং বাইরে দাঁড়িয়ে ওর জন্যে অপেক্ষা কর। হতাশ তরুণ মুখ কালো করে বেরিয়ে এল বাইরে।

পাধানি তার পাশে এসে দাঁড়াল। মনে হয় পুরোদস্তুর একটা যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে।

মাথা ঝাঁকালেন গুগলি, অন্যমনস্ক। ইউনিয়ন কর্স–শটগান আর ছুরি ওদের প্রিয় অস্ত্র। তবু একটা কিন্তু থেকেই যায়।

কিন্তু, স্যার?

এরকম হবার কথা নয়। বড় বেশি রিয়্যাক্ট করছে ওরা। যতটা না উদ্বিগ্ন তারচেয়ে বেশি বিমূঢ় দেখাল তাকে। চারদিক থেকে হামলা শুরু হয়ে গেলে অবস্থা কি দাঁড়াবে ভাবতেও ভয় হয়। এলির লাশের দিকে তাকালেন তিনি। ওকে কোথায় পাওয়া যাবে অগাস্টিনের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল ওরা। ভাবছি। আর কি জেনেছে…।

যা জানতে চেয়েছে সবই গড়গড় করে বলে গেছে…।

আমার হাতে পেরেক গাঁথলে আমিও বলতাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন গুগলি। কিন্তু ওদের প্রশ্নগুলো কী ছিল?

 এলির লাশ প্রাস্টিক ব্যাগে ভরা হল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল ওরা। তারপর ঘুরে দাঁড়ালেন গুগলি, কাঁধের ওপর দিয়ে বললেন, অফিসে এসো, অনেক কাজ।

.

এবার খবরের কাগজগুলো আগ্রহী হয়ে উঠল। বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে তিনটে খুন, গুরুত্ব না দিয়ে আর পারা যায় না। বার এবং বিছানা থেকে ডেকে নেয়া হল ক্রাইম রিপোর্টারদের, ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য যোগাড় করে রিপোর্ট তৈরির নির্দেশ পেল তারা। সবাই অন্ধকারে রয়েছে, কাজেই সবচেয়ে সহজ সিদ্ধান্তে পৌঁছুল খুনগুলোর জন্যে ইউনিয়ন কর্সই দায়ী। পরদিন সকালের কাগজগুলোয় বড় বড় হেডিংয়ে ছাপা হল, ইটালিয়ান মাফিয়া চক্রের সঙ্গে ফ্রেঞ্চ ইউনিয়ন কর্সের যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধের নিন্দা করা হল। সম্পাদকীয়তে লেখা। হল, আইন শৃংখলা পরিস্থিতির এই অবনতি মেনে নেয়া যায় না।

ওপরমহল থেকে বার্নাদো গুগলির ওপর চাপ আসতে শুরু করল। জেনারেল, তার বস, বললেন, কিছু একটা করা দরকার। ইটালিয়ান ক্রিমিন্যালরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করবে, সেটা যথেষ্ট খারাপ; কিন্তু অন্য দেশের লোকেরা এসে ওদেরকে মেরে রেখে যাবে, এ অত্যন্ত মর্যাদা হানিকর।

গোজোয়ও পৌঁছুল খবরটা। বিশালদেহী বিদ্রোহী হাতে একটা কাগজ নিয়ে রুচিতাস-এ ঢুকল। কিন্তু, ক্ষতি কি, গুফো, অক্লান্ত, হাজির–ওরা সবাই রয়েছে। বারে। ওদেরকে ইঙ্গিতে কাছে ডাকল বিদ্রোহী। সবাই এক জায়গায় জড়ো হতে হাতের কাগজটার ভাঁজ খুলে টেবিলের ওপর ফেলল সে। হুমড়ি খেয়ে পড়ল সবাই।

তারপর জল্পনাকল্পনা শুরু হল। এখানেই কি এর সমাপ্তি? প্রতিশোধ সম্পূর্ণ। হয়েছে হাসানের?

নেপলসে রেমারিক, আর মার্সেলেসে গগলও খবরটা পড়ল। ওরা জানে, মাত্র শুরু করেছে রানা।

.

উদ্বিগ্ন তো বটেই, প্রচণ্ড রেগেও আছে হিনো ফনটেলা। উদ্বিগ্ন এই জন্যে যে তার লোকদের মেরে ফেলা হয়েছে। আর রেগে গেছে ডন কালার ধমক খেয়ে। গোটা ব্যাপারটা তার মনে গভীর বিতৃষ্ণার জন্ম দিয়েছে। ডন বাকালাকে কোনদিনই পছন্দ হয়নি তার। লোকটা নেতাদের নেতা হলে কি হবে, মাফিয়া সাম্রাজ্যের ভালমন্দে তার তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ অবদান বা ত্যাগ নেই। পালার্মোর কাছে। নিজের ভিলায় বসে থাকে, কালেভদ্রে বের হয় কি হয় না, কোন রকম বিপদের ভাগিদার হতে রাজি নয় সে, কিন্তু সব কিছু থেকে লাভের ভাগিদার হওয়া তার। চাই-ই। ফনটেলা ভাবল, বেজন্মা রাজনীতিকদের সঙ্গে ওই হারামজাদার কোন পার্থক্যই নেই।

গাড়িতে বসে দাঁতে দাঁত চাপল ফনটেলা, ট্যানডনের মেসেজটা মনে পড়ে গেছে আমরা তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট। বেজন্মা, বুড়ো শিয়াল, মনে মনে গাল। পাড়ল সে। বাকলার সঙ্গে বেরলিংগারের খাতির রয়েছে, তা না হলে কড়া একটা পাল্টা জবাব দিত সে। মুশকিল হল, কূটনীতির চাল চেলে ইটালির প্রায় সবগুলো মাফিয়া পরিবারকে হাত করে রেখেছে বাকালা। তার বিরুদ্ধে কথা বললে কারও সমর্থন পাওয়া যাবে না। শালা বানচোত সত্যিকার একজন পলিটিশিয়ান।

বুধবারের রাত, বিয়ানকো গ্রামে যাচ্ছে ফনটেলা, মায়ের সঙ্গে বসে ডিনার খাবে। মায়ের সুপুত্র সে, বুধবার রাতে মাকে একবার দেখতে যাবেই। কোন কারণে যদি যেতে না পারে, আরেক বুধবার পর্যন্ত অপরাধ বোধে জর্জরিত হয়। না গেলে মা-ও খুব রেগে থাকে, আর মা রেগে গেলে ফনটেলার মত লোকও তাকে সামলাতে পারে না।

সতর্কতা অবলম্বনে কোন খুঁত রাখা হয়নি, অন্তত ফনটেলার সেই রকমই। ধারণা। তার গাড়ির সামনে আর পিছনে বডিগার্ড ভর্তি আরও দুটো গাড়ি রয়েছে। ওরা সবাই সশস্ত্র, জানে, যে-কোন মুহূর্তে যে-কোন দিক থেকে বসের ওপর হামলা হতে পারে।

আর শালার ওই নোংরা ইউনিয়ন কর্স, ভাবল ফনটেলা। সামান্য চল্লিশ মিলিয়ন লিরার শোকে একেবারে উন্মাদ হয়ে উঠেছে। যাই হোক, টাকাটা নিয়ে তার লোক খুব তাড়াতাড়ি মার্সেলেসে যাচ্ছে, ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়ে গেলে তাকে আর কোন টেনশনে ভুগতে হবে না।

ঝড়ের বেগে বিয়ানকো গ্রামে ঢুকল কনভয়টা। টেরেস সহ বিশাল বাড়ি, ফনটেলার মা এত বড় বাড়িতে একাই থাকে। তৃপ্তি আর গর্ব অনুভব করল ফনটেলা, মা জননীকে সুখে রেখেছে সে। বুড়ি মার যত্ন নেয়ার জন্যে চার-পাঁচজন চাকরাণী আছে, মার নিজের পছন্দ করা মেয়েলোক তারা, কারও বয়সই পঞ্চাশ পঞ্চান্নর কম নয়। গাড়িগুলো থামতেই লাফ দিয়ে নামল বডিগার্ডরা, রাস্তায় পা ফেলার আগেই জ্যাকেটের ভেতর হাত ঢুকে গেছে। অতি নাটুকে আচরণ, ভাবল ফনটেলা। এমনকি ইউনিয়ন কর্সের ইতর জানোয়ারগুলোও ব্যবসায়িক জটিলতার মধ্যে পরিবারগুলোকে টেনে আনে না।

সবাই এখানে অপেক্ষা কর, নির্দেশ দিল সে, এতগুলো সশস্ত্র বডিগার্ড সঙ্গে নিয়ে মার সঙ্গে দেখা করতে এসে অস্বস্তি বোধ করছে সে। দুঘন্টার বেশি লাগবে না আমার।

লোকটা ছোটখাট, কিন্তু অবাধে চর্বি জমতে দিয়েছে শরীরে, সিঁড়ির ধাপকটা টপকাতে রীতিমত হাঁপিয়ে উঠল সে। করিডর ধরে ধীর পায়ে এগোল, জানে, ছেলেকে একান্তভাবে কাছে পাবার জন্যে চাকরাণীদের ছুটি দিয়ে দিয়েছে মা। প্রতি বুধবারেই তাই দেয়। দরজা খোলাই রয়েছে, কিন্তু কবাট ভিড়ানো।

রাগে কটমট করে তাকাল মা। কিছু বলার চেষ্টা করল না, কারণ তার মুখ। টেপ দিয়ে আটকানো রয়েছে। একটা চেয়ারে বসে রয়েছে বুড়ি, চেয়ারের সাথে টেপ দিয়ে হাত আর পা-ও আটকে রাখা হয়েছে। বয়স্ক এক লোক, চোখে কঠিন। দৃষ্টি নিয়ে, দাঁড়িয়ে রয়েছে চেয়ারের পাশে। লোকটার হাতে একটা শটগান। ব্যারেলটা ছোট, সেটা বুড়ির কাঁধে ঠেকে আছে। আর মাজুল জোড়া বুড়ির বা কান ছুঁয়ে আছে।

একটু শব্দ কর, শান্ত সুরে বলল লোকটা। সাথে সাথে এতিম হয়ে যাবে।

ফনটেলাকে নির্দেশ দেয়া হল, দেয়ালের দিকে মুখ কর, হাত দুটো দুদিকে লম্বা করে দেয়ালে তালু ঠেকাও, পা ফাঁক করে দাঁড়াও। নির্দেশ পালন করল। ফনটেলা। লোকটা এগিয়ে এল, কিন্তু পায়ের আওয়াজ হল না। ফনটেলা ভাবল, কে হতে পারে লোকটা? শটগানের ব্যারেল সজোরে আঘাত করল তার মাথায়, জ্ঞান হারাল সে।

হিসেব করা বাড়ি, খানিক পরই জ্ঞান ফিরে এল ফনটেলার। মাথায় অসহ্য ব্যথা অনুভব করল সে, কিন্তু কাতর শব্দগুলো গলা থেকে বেরুতে পারল না, মুখে টেপ লাগানো রয়েছে। এরপর দুই হাঁটু, আর দুই গোড়ালি এক করে টেপ জড়ানো হল। বাড়ির পিছন দিকটা একবার দেখে এল রানা, ফিরে এসে ডন ফনটেলাকে তুলে নিল কাঁধে।

বাড়ির পিছনে নেই কেউ। অশ্লীল গালিগালাজ করল ফনটেলা–নিজেকে। এমন বোকামি মানুষ করে! অপমান লাগছে তার, রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। একজন। মাত্র লোক তাকে কাবু করে ফেলল! সে যেন অবোধ, অসহায় একটা শিশু, কাঁধে। করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে!

বাড়ির পিছনে কাঁকর ছড়ানো রাস্তা, রাস্তার ওপর খয়েরি রঙের একটা ভ্যান, পাশের দরজাটা ভোলা। ফনটেলাকে ছুঁড়ে ফেলা হল ভ্যানের ভেতর। আরামখেকো শরীরটা থেতলে গেল। দরজা বন্ধ করল রানা, কোন আওয়াজ হল না। কয়েক সেকেণ্ড পর স্টার্ট না নিয়েই গড়াতে শুরু করল ভ্যান। ফনটেলার মনে পড়ল, ঠিক এখানটা থেকেই ঢালু হয়ে নেমে গেছে রাস্তাটা। অতি নাটুকে দেহরক্ষীদের কথা ভাবল সে। কত কাছে রয়েছে ওরা, কিন্তু কিছুই টের পেল না। নিজেকে অভিশাপ দিল সে। এখন আর রাগ নয়, ভয় হচ্ছে। তার চোখ বাঁধা। হয়নি। ভ্যানের গায়ে লেখাটা দেখেছে সে–বিনো গারবাল্ডি, ভেজিটেবল ডিলার। লেখাটার বিশেষ কোন তাৎপর্য আছে কিনা ধরতে পারেনি সে, তবে লেখাটা। তাকে দেখতে দেয়ায় বুঝতে পারছে, এটা একটা ওয়ান ওয়ে জার্নি; যাচ্ছে, কিন্তু ফিরে আসবে না সে।

অনেকটা দূরে, অনেকটা নিচে নেমে এসে স্টার্ট নিল ভ্যান। এতদূর থেকে দেহরক্ষীরা এঞ্জিনের আওয়াজ শুনতে পাবে না, পেলেও কিছু সন্দেহ করার নেই তাদের। সময় বয়ে চলল। ভ্যান ছুটছে–খুব একটা দ্রুতগতিতে নয়, আবার শম্বুকগতিও বলা চলে না। এখনও গ্রাম এলাকায় রয়েছে ওরা, তবু লোকটা কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় না।

হাত-পা আড়ষ্ট হয়ে এল ফুনটেলার। তারপর ব্যথা করতে শুরু করল। ভ্যানের মেঝেতে কতক্ষণ পড়ে আছে সে, বলতে পারবে না। মাত্র দুঘন্টা, পেরিয়েছে, অথচ তার মনে হল সকাল হতে আর বেশি দেরি নেই। সারারাত ধরে গাড়ি চালিয়ে কোথায় তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? এখন আর তার হাত-পায়ে ব্যথা নেই, অসাড় হয়ে গেছে। ফনটেলার বুদ্ধি লোপ পায়নি, কিন্তু মাথা ঘামিয়েও উদ্ধারের কোন উপায় দেখতে পাচ্ছে না সে।

এক সময় থামল ভ্যান। বন্ধ হল এঞ্জিন। পাশের দরজা খুলে গেল। খুব শান্তভাবে, এবং সহজ ভঙ্গিতে আবার তাকে কাঁধে তোলা হল। চারদিক অন্ধকার হলেও, আকাশের গায়ে বড় বড় গাছের কাঠামো, সাদা চুনকাম করা ছোট একটা বাংলো দেখতে পেল সে। তাকে কাঁধে নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল কিডন্যাপার। পায়ের ঠেলা দিয়ে দরজার কবাট খুলল। মেঝেতে নামানো হল তাকে, মোটেও যত্নের সঙ্গে নয়। খুট শব্দের সঙ্গে জ্বলে উঠল আলো। ফনটেলা নড়ল না, শুনতে পেল তার কিডন্যাপার ঘরের ভেতর হাঁটাহাঁটি করছে। কয়েক মিনিট পর পায়ের আওয়াজ এগিয়ে এল, পাজরে লাথি খেয়ে চিৎ হয়ে গেল ফনটেলার শরীর। সিলিঙের দিকে মুখ করে আছে সে, পাশে দাঁড়ানো কিডন্যাপারকে প্রায় সিলিং পর্যন্ত লম্বা বলে মনে হল তার। হাঁটু মুড়ে তার পাশে বসল লোকটা, ফনটেলার পা। থেকে জুতো জোড়া খুলে নিলু। তারপর খুলল হাঁটু আর গোড়ালির টেপ। ইচ্ছে বা শক্তি, কোনটাই অবশিষ্ট নেই, ধস্তাধস্তির চিন্তা বাদ দিয়ে অসাড় পেশী ডলে রক্ত চলাচল সহজ করার চেষ্টা করল সে। পিঠের নিচে টেপ দিয়ে আটকানো হাত দুটো চাপা পড়ে আছে, সারা শরীরে টনটনে ব্যথা। এবার শুধু ভয় নয়, অজানা একটা আতঙ্ক গ্রাস করতে উদ্যত হল তাকে। তার বেল্ট খুলে নিল কিডন্যাপার, চেইন। টেনে ঢিলে করল ট্রাউজার। কিডন্যাপারের একটা হাত তার পিছনে চলে গেল, সামান্য একটু উঁচু করা হল তার শরীর, টেনে কোমর থেকে নামানো হল ট্রাউজার। আর আণ্ডারপ্যান্ট। কিডন্যাপার উঠে দাঁড়াল। আবার একটা লাথি খেয়ে উপুড় হল, ফনটেলা। তার পা দুটো যথাসম্ভব দুদিকে টেনে ফাঁক করা হল। কি ঘটতে যাচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছে না ফনটেলা। তার আতঙ্ক বাড়তেই থাকল। নিতম্বে। কিডন্যাপারের হাতের স্পর্শ পেল সে। দুই নিতম্ব টান দিয়ে ফাঁক করা হচ্ছে। তীক্ষ্ণ একটা ব্যথায় কুঁকড়ে গেল সে, গোঙানির ভেতা আওয়াজ হল গলার ভেতর, পা দুটো মেঝের ওপর ঘন ঘন আছাড় খেতে লাগল।

একটু পরই স্থির হয়ে গেল ফনটেলা। কানের পিছনে ঘুসি খেয়ে জ্ঞান হারিয়েছে সে।

.

আবার জ্ঞান ফিরল ফনটেলার। তীক্ষ্ণ কোন ব্যথা অনুভব করছে না, শুধু আড়ষ্ট একটা ভাব, ভীষণ অস্বস্তিকর।

তার সামনে কাঠের একটা টেবিল। টেবিলের ওপর, ঠিক মাঝখানে নয়, একটু বা দিক ঘেঁষে, খুদে একটা ফুটোকে ঘিরে শুকনো, কালচে দাগ দেখল ফনটেলা। সেই রিপোর্টটা মনে পড়ে গেল–অগাস্টিনের হাতে পেরেক গাঁথা হয়েছিল। শিউরে উঠল সে। দরদর করে ঘামছে। টেবিলের ওদিকে বসা কিডন্যাপারের দিকে তাকাল। লোকটার চেহারায় কোন ভাব নেই, শুধু চোখে কঠিন দৃষ্টি। কিডন্যাপারের সামনে টেবিলের ওপর খোলা নোটবুক ছাড়াও আরও কয়েকটা জিনিস রয়েছে, পুরানো আমলের একটা অ্যালার্ম ঘড়িও দেখা যাচ্ছে।

ঘড়িতে বাজে নয়টা দুই।

আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

অস্বস্তিকর আড়ষ্ট ভাব নিয়ে মাথা দোলাল ফনটেলা। তার হাত আর পা চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা থাকলেও, মুখ থেকে খুলে নেয়া হয়েছে টেপ। কিন্তু তবু সে কথা বলল না–বয়স আর অভিজ্ঞতা, দুটোই অগাস্টিনের চেয়ে বেশি তার।

সামনের দিকে ঝুঁকে টেবিল থেকে একটা মেটাল সিলিণ্ডার তুলে নিল কিডন্যাপার, জিনিসটার দুপ্রান্ত ঢালু। প্যাঁচ ঘুরিয়ে সিলিণ্ডারটা খুলল ও, দুই অংশের গভীর গর্ত দুটো ফনটেলাকে দেখাল। এটা একটা চার্জার। সাধারণত কয়েদীরা দামি কিছু জিনিস লুকাবার কাজে ব্যবহার করে টাকা, ড্রাগস, এই সব। শরীরের ভেতর লুকানো থাকে এটা–রেকটামে।

চেয়ারে বসা অবস্থায় আরও একটু কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেল ফনটেলা। আড়ষ্ট ভাব..কারণটা মনে পড়ে গেল। খয়েরি রঙের কি যেন একটা হাতে নিল কিডন্যাপার, দেখে মনে হল প্লাস্টিসিন। বলল, প্ল্যাস্টিক-হাই এক্সপ্লোসিভ। জিনিসটা সিলিণ্ডারের এক অংশের গর্তে ভরল সে, আঙুলের চাপ দিয়ে ভাল করে ভেতরে ঢোকাল।

এটা একটা ডিটোনেটর। কিডন্যাপারের হাতে ছোট একটা, গোল, ধাতব বস্তু দেখল ফনটেলা, এক প্রান্ত থেকে একটা সূচ রেরিয়ে আছে। সঁচটা প্লাস্টিকের ভেতর গেঁথে দেয়া হল। আর এটা একটা টাইমার। আরেকটা গোল জিনিস, দুটো কাটা সহ। কাটা দুটো ডিটোনেটরের বাইরের দুই সকেটে ঢোকানো হল, তারপর সিলিণ্ডারের দুই অংশ এক করে প্যাঁচ লাগানো হল।

সিলিণ্ডারটা দুআঙুলে ধরে একটু ওপরে তুলল কিডন্যাপার। এটা আর এখন শুধু একটা চার্জার নয়, বোমাও। খুব ছোট, কিন্তু ভারি শক্তিশালী।

বোকার মত তাকিয়ে আছে ফনটেলা। একবার মনে হল, এসব সত্যি নয়, স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু স্বস্তিকর ভুলটা এক সেকেণ্ডও টিকল না। একটা ঢোক গিলল সে, কপাল বেয়ে ঘামের একটা ফোঁটা চোখে পড়ায় মাথা ঝাঁকাল।

বোমাবাজিতে অভিজ্ঞ লোক তুমি, তোমাকে আর নতুন কি শেখাব আমি। বুঝতেই পারছ, জিনিসটা আধুনিক বিজ্ঞানের অবদান। দশ বছর আগে এ-ধরনের একটা বোমার ওজন হত এক কিলোরও বেশি। কিডন্যাপারের ঠাণ্ডা, কঠিন দৃষ্টি ফনটেলার মুখের ওপর যেন গেঁথে আছে। ঠিক এই রকম একটা বোমা পেছন দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছি তোমার শরীরের ভেতর। সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে, দশটার সময় ফাটবে।

ঝট করে অ্যালার্ম ক্লকের দিকে তাকাল ফনটেলা। নটা সাত।

শান্ত সুরে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করল কিডন্যাপার। ফনটেলাকে কিছু প্রশ্নের। উত্তর দিতে হবে। উত্তরগুলো সে যদি সঠিকভাবে দেয়, দশটা বাজার আগে, তাহলে হয়ত বোমাটা শরীর থেকে সরিয়ে ফেলার অনুমতি পাবে সে।

কিন্তু ফনটেলা বুঝল, তাকে মিথ্যে আশ্বাস দেয়া হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তাকে খুন করা হবেই।

কিডন্যাপার আরও বলল, আর সবার মত হয়ত ফনটেলাকে মেরে ফেলা হবে।, তাকে হয়ত ওর পরে অন্য কাজে লাগবে। ফনটেলা বিশ্বাস করল না। অগত্যা, নির্লিপ্ত একটা ভাব দেখিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল কিডন্যাপার, চুপ করে বসে। থাকল–যেন তার কোন তাড়া নেই।

অ্যালার্ম ক্লক কিট কিট করছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে ফনটেলা। ঘরে আর কোন শব্দ নেই। পেটের ভেতর মোচড় অনুভব করল সে, ল্যাট্রিনে গিয়ে পেট খালি করতে পারলে ভাল হত। কিন্তু কিডন্যাপারকে বললে লোকটা হাসবে। মোচড়টা বাড়তে বাড়তে এক সময় অসহ্য হয়ে উঠল, শরীরের আর সব ব্যথার কথা মনে থাকছে না। নটা বাইশ মিনিটে মচকাল ফনটেলা। ভেবে দেখেছে, উত্তর দিলে নতুন কিই-বা তার হারাবার আছে।

বল, কি জানতে চাও।

কলমটা তুলে নিয়ে ক্যাপ খুলল কিডন্যাপার। আতুনি বেলিংগার, আর বাকালা সম্পর্কে জানতে চাই আমি। কিন্তু সবচেয়ে আগে জানতে চাই, একজন বুদ্ধিমান লোক হয়ে ওই মেয়েটাকে কিডন্যাপ করতে গেলে কেন তুমি? ওর বাপের হাতে তখন টাকা ছিল না জেনেও?

নটা তিপ্পান্ন মিনিটে উত্তর দেয়া শেষ করল ফনটেলা। কলমে ক্যাপ লাগাল। কিডন্যাপার, নোটবুক তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। কয়েক সেকেণ্ড ফনটেলার দিকে তাকিয়ে থাকল সে, তারপর পিছন ফিরে দরজার দিকে এগোল। ফনটেলার ইচ্ছে হল পিছু ডাকে, বলে, আমি তো তোমার সব প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছি, এবার বোমাটা আমাকে বের করতে দাও। কিন্তু অভিজ্ঞ লোক, জানে, শত অনুরোধেও এই লোককে নরম করা যাবে না।

একটু পর ভ্যানের আওয়াজ পেল ফনটেলা। তার আরেকবার মনে হল, এ সব স্বপ্ন। ভ্যানের আওয়াজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল দূরে। এখন শুধু অ্যালার্ম ক্লকের টিক টিক শোনা যাচ্ছে।

ফনটেলা চেঁচাল না, বা ধস্তাধস্তি করল না। স্রেফ শক্ত হয়ে বসে থাকল চেয়ারে, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ডায়ালের দিকে। নটা আটান্ন মিনিটে পাগল হয়ে। গেল ফনটেলা, তার মন আর মাথা কাজ করছে না। কিন্তু বোমাটা ঠিক সময়েই কাজ করল। বিদ্যুৎবেগে সিলিঙের দিকে উঠে গেল ডন ফনটেলা।

রানা তখন ভ্যান নিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে, বিস্ফোরণের আওয়াজ ওর কানে পৌঁছল না। তবে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে কাটায় কাটায় দশটা বাজতে দেখে ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ একটু হাসি ফুটে উঠল। বিড়বিড় করে বলল ও, আমি জেগে আছি, লুবনা, আমি জেগে আছি।

.

অন্ধকার বারান্দা। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তরুণী। পাশে বার্নাদো গুগলি, অভিনেত্রীর একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিলেন তিনি। ছোট্ট, নরম ফুল। একটু চাপ দিলেন, কিন্তু পাল্টা সাড়া পেলেন না। হতাশার একটা ঢেউ বয়ে গেল সারা শরীরে, একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলেন।

বশীকরণের সমস্ত মন্ত্র, মন ভোলানর যাবতীয় কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। কোন সন্দেহ নেই, অভিনেত্রীকে মুগ্ধ করতে পেরেছেন তিনি। তরুণী নিজের মুখেই স্বীকার করেছে, কোন পুরুষমানুষের মধ্যে এতগুলো গুণ একসঙ্গে দেখেনি সে। অথচ আসল কাজের বেলায় ওর তরফ থেকে কোন সাড়া পাচ্ছেন না তিনি। অসাধারণ সুন্দরী মেয়ে, ভয়টা সেখানেই, এদের দেমাকের কথা কেউ কিছু বলতে পারে না। তিনি প্রস্তাব দিলে হঠাৎ যদি খেপে যায়, যদি খারাপভাবে নেয় ব্যাপারটাকে! তাই চাইছেন, প্রস্তাবটা ওর তরফ থেকে আসুক। এ-সব বিষয়ে। সরাসরি কথা হয় না, তিনি জানেন। আভাসে-ইঙ্গিতে, ঠারেঠোরে সারে মানুষ। সেজন্যই সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছিলেন তিনি–এইবার নিয়ে তিনবার তিনি ওর হাতে হাত রাখলেন।

কিন্তু কই, ওঁর হাতের ভেতর মেয়েটা তো একটা আঙুলও নাড়ল না।

সন্ধেটা চমৎকারভাবে শুরু হয়েছিল। আজ আবার দাওয়াত করে নিজের। বাড়িতে আনিয়েছেন তিনি অভিনেত্রীকে। নিজের হাতে রান্না করে পরিতৃপ্তির সঙ্গে খাইছেন ওকে। মেয়েটা রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে দেখে তার মনের আশা, তুঙ্গে উঠে যায়। এরপর ব্যাকগ্যামন খেলায় দ্রুত পর পর তিন বার জিতে নিঃসন্দেহে ধরে নেন, একবার শুধু আভাস দিলেই তার সঙ্গে বিছানায় উঠবে অভিনেত্রী।

হতাশায় ভুগছেন গুগলি, এই সময় তার হাতের ভেতর নড়ে উঠল অভিনেত্রীর হাত। সামান্য একটু চাপ, কিন্তু কি পরম সুখ! তিনিও আবার একটু চাপ দিলেন, পরীক্ষা করে নিঃসন্দেহ হতে চাইলেন। পাল্টা চাপ দিয়ে মেয়েটা বলল, চল, ঘরে যাই!

গর্ব আর সুখ অনুভব করলেন গুগলি। মেয়েটার, হাত ধরে ঘরে ফিরে এলেন তিনি। একবার সুইচবোর্ডের দিকে তাকালেন, তারপর মেয়েটার চোখে–আলো নেভাবার অনুমতি চাইছেন। অভিনেত্রী তাঁর গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তার ঠোঁটের দিকে মুখ নামালেন গুগলি। এই সময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ঝন ঝন শব্দে বেজে উঠল ফোনটা।

.

০৭.

উঁহু, ইউনিয়ন কর্স হতেই পারে না, জোর দিয়ে বললেন বার্নাদো গুগুলি, প্যাথোলজিস্টের রিপোর্টের ওপর চোখ বুলাচ্ছেন। ডেস্কের ওধারে একটা হাতলহীন চেয়ারে বসে রয়েছে পাধানি।

এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন কি করে, স্যার? জানতে চাইল সে।

রিপোর্টের ওপর মধ্যমা দিয়ে টোকা দিলেন গুগলি। এ-ধরনের কল্পনাশক্তি ওদের নেই। ক্ষীণ একটু হাসি দেখা গেল তার ঠোঁটে। ছুরি, হ্যাঁ; শটগান, হ্যাঁ; রিভলভার, হ্যাঁ; বোমা, হ্যাঁ–কিন্তু রেকটামে নয়। এদিকে-ওদিকে মাথা নাড়লেন তিনি। এ বুদ্ধি সম্পূর্ণ অন্য এক ধরনের মাথা থেকে বেরিয়েছে।

ফনটেলার লাশ পাওয়ার পর দুদিন পেরিয়ে গেছে। প্রতিদিন ওপরমহল। থেকে চাপ আসছে তার ওপর, রহস্যের মীমাংসা কর। কাগজগুলো পুলিস আর কারাবিনিয়ারের অযোগ্যতা নিয়ে যা তা লিখছে। ফনটেলার হত্যাকাণ্ড এমন। ফলাও করে ছাপা হয়েছে, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

ফ্রেঞ্চ পুলিস অফিসার দ্য জিলাম্বুর সঙ্গে টেলিফোনে আবার আলাপ করেছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে একমত হয়ে দ্য জিলাম্বু জানিয়েছেন, ইটালিতে যে হত্যাকাণ্ড ঘটছে তার সঙ্গে ইউনিয়ন কর্স জড়িত নয়, অন্তত সে-ধরনের কোন তথ্য তাঁর জানা নেই। মার্সেলেসের ইউনিয়ন কর্স গ্রুপ পুলিস এবং ডন বাকালার প্রতিনিধি বোরিগিয়ানোকে বিশ্বাস করাতে পেরেছে, খুনগুলোর সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই।

ইটালির মাফিয়া পরিবারগুলোর মধ্যে দাবাগ্নির মত ছড়িয়ে পড়ছে সন্দেহ আর অবিশ্বাস। যাকে কখনও উত্তেজিত হতে দেখা যায় না, সেই ডন বাকালা। নাকি টেবিলে ঘুসি মেরে তার উপদেষ্টাদের ঘাবড়ে দিয়েছে। দুই দশকের অটুট, নিস্তরঙ্গ শান্তিময় পরিবেশ নষ্ট করছে কেউ একজন। কে সে?

আর আশা করা হচ্ছে, ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী কর্নেল গুগলি, সবার আগে এই প্রশ্নের উত্তর যোগাতে পারবেন। দুদিন ধরে অফিস থেকে বলতে গেলে বেরই। হননি তিনি। বের হবার জরুরি কোন প্রয়োজনও অবশ্য দেখা দেয়নি–অভিনেত্রীর। সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে।

সব কিছুর একটা সীমা আছে, মেয়েটা বলেছে তাঁকে। এরই মধ্যে প্রায়। প্রতিষ্ঠিত নায়িকা সে, তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে সবাই আশাবাদী, তার সৌন্দর্যের গুণগানে সবাই পঞ্চমুখ। এ-ধরনের বাধা আমার জন্যে অবমাননাকর, জানিয়ে দিয়েছে সে।

কাজেই গুগলি এখন কাজে মন বসাতে পারছেন। যারা খুন হয়েছে, আরও একবার করে তাদের প্রত্যেকের ফাইল পড়লেন তিনি। অগাস্টিন, বারুন, এলি আর ফনটেলা। মোট চারজন। যোগফল থেকে বারুনকে বাদ দিতেই যোগাযযাগটা কিসের সঙ্গে, ধরে ফেললেন তিনি। বোকামির জন্যে তিরস্কার। করলেন নিজেকে-বারুনের হত্যাকাণ্ড স্রেফ একটা দুর্ঘটনা, বা বাধা অপসারণ। মাত্র। সে এলিকে পাহারা দিচ্ছিল।

লুবনা কিডন্যাপিং!

তার সাথে এর কি সম্পর্ক? চোখে প্রশ্ন আর বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইল। পাধানি।

কিসের আবার, প্রতিশোধের! গুগলির ইচ্ছে হল আবিষ্কারের আনন্দে বগল বাজান। অগাস্টিন আর এলি এই কিডন্যাপিঙের সাথে ছিল। আয়োজনটা ছিল ফনটেলার।

 পরবর্তী এক ঘন্টা ভীষণ ব্যস্ত থাকল ওরা। দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন গুগলি, আভান্তি পরিবার সরাসরি এ-সব খুনের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে না, তবে ভিটো আভান্তি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য টাকা দিয়ে লোক ভাড়া করে থাকতে পারে। এরপর তিনি লুবনার বডিগার্ডের দিকে মনোযোগ দিলেন। প্রথম দিকে হাসান। তেমন কোন গুরুত্ব পেল না। লোকটা ছিল প্রিমিয়াম বডিগার্ড। বয়স খুব বেশি, তার ওপর অ্যালকোহলিক। কিন্তু ফোনে হাসপাতালের সঙ্গে কথা বলার পর গুগলির পালস রেট বেড়ে গেল। সিনিয়র একজন সার্জেনের সঙ্গে কথা বললেন তিনি, ভাগ্যই বলতে হবে সে ভদ্রলোক তাঁর বড় ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গুগলি জানলেন, আহত বডিগার্ড এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে যে হাসপাতালের সবাই রীতিমত অবাক হয়ে যায়। প্রায় মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় তাকে। লোকটা বেঁচে ওঠে শুধু প্রচণ্ড ইচ্ছেশক্তির জোরে। প্রাণধারণের তীব্র আকুতি ছাড়া ও-ধরনের গুরুতর জখম নিয়ে কারও পক্ষে বেঁচে ওঠা সম্ভব নয়। এরপর গুগলি ফোন করলেন এজেন্সিতে, এই এজেন্সিই, আভান্তি পরিবারে বডিগার্ডের কাজটা যুগিয়ে দিয়েছিল লোকটাকে। জানা গেল, বডিগার্ড এক সময় মার্সেনারি ছিল। জরুরি টেলেক্স পাঠানো হল প্যারিসে। ইন্টারপোল থেকে উত্তরের আশায় অপেক্ষা করছেন তিনি, ইতিমধ্যে খোঁজ নিয়ে বডিগার্ডের সঙ্গে জনৈক ভিটেলা রেমারিকের সম্পর্কের ব্যাপারটাও জানতে পারলেন। এই রেমারিক বডিগার্ডের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নেপলসে তার একটা বোডিং হাউস-কাম-রেস্তোরাঁ আছে, নাম প্রেজো ফিসো।

পদ, খ্যাতি আর যোগাযোগ, তিনেট অস্ত্রই কাজে লাগালেন গুগলি। চারদিক থেকে হুড়মুড় করে তার প্রশ্নের জবাব আসতে শুরু করল। রোম ইমিগ্রেশনের ডিরেক্টরকে সরাসরি ফোন করলেন তিনি, ডিপার্টমেন্টের কমপিউটর থেকে পাওয়া তথ্য প্রকাশ করে ডিরেক্টর জানালেন, বডিগার্ড অমুক তারিখে মাল্টার উদ্দেশে ইটালি ত্যাগ করে।

তারমানে, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার ছয় দিন পর। কিন্তু মাল্টা ছেড়ে আবার ইটালিতে ফিরে এসেছে কিনা, সে সম্পর্কে কোন তথ্য কমপিউটরে জমা নেই।

এরপর মাল্টায়, বন্ধু মেনিনোর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন গুগলি। মেনিনোর। সঙ্গেই রোমে ট্রেনিং শেষ করেছেন তিনি, দুই পুলিস অফিসারের মধ্যে খাতির আছে। অল্প কিছুক্ষণ কথা বলে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন গুগলি, চিন্তিতভাবে বললেন; অবাক কাণ্ড!

স্যার?

বডিগার্ডের মাল্টায় পৌঁছুনর সময়টা কনফার্ম করল মেনিনো, বলল তিন হপ্তা হল জাহাজে করে মার্সেলেসে চলে গেছে।

ব্যস, আর কিছু না?

না।

কিন্তু আপনি বললেন অবাক কাণ্ড …

গুগলি হাসলেন। মাল্টিজি পুলিস দক্ষ, ব্রিটিশদের ঐতিহ্য বজায় রেখেছে ওরা। তাই বলে এতটা দক্ষ নয় যে প্রত্যেক টুরিস্ট সম্পর্কে খবর রাখবে– ওদের। ডাটা কমপিউটারাইজডও নয়। অথচ তথ্যগুলো মুখস্থ করা ছিল মেনিনোর, জিজ্ঞেস করতেই গড়গড় করে বলে ফেলল। মানেটা কি? মানে, বডিগার্ডের প্রতি ব্যক্তিগত ইন্টারেস্ট ছিল তার, বা এখনও আছে। তারপর, আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম, লোকটা সম্পর্কে আর কিছু তুমি জান কিনা, উত্তরে কি বলল জান? বলল, বছরে পাঁচ লক্ষ লোক বেড়াতে আসে মাল্টায়, কজনের খবর রাখবে তারা! নিশ্চয়ই কিছু গোপন করছে সে। কি হতে পারে সেটা? কেনই বা গোপন করবে?

প্যারিস থেকে টেলেক্সের জবাব এল। তিন ফিট লম্বা কাগজের রোল পড়া শেষ করে গুগলি গম্ভীর হয়ে উঠলেন। বললেন, মানুষ নয়, এই হাসান একটা কিলিং মেশিন। ঘুণাক্ষরেও তিনি টের পেলেন না, এইমাত্র যার ডোশিয়ে পড়া শেষ করেছেন তিনি, সে মারা গেছে।

উঠে দাঁড়ালেন গুগলি। চল, কোমো থেকে একবার ঘুরে আসি। ভিটো। আভান্তির সঙ্গে কথা বলে দেখা যাক আরও কিছু জানা যায় কিনা।

.

স্বামী-স্ত্রী ডিনারে বসেছে। টেবিলের এক প্রান্তে লরা। আগের চেয়ে রোগা হয়েছে লরা, তবে তার রূপ টসকায়নি। ভিটো আগের মতই আছে, কিছুই বদলায়নি। তার। মেয়ে মারা যাবার পর উপলব্ধি করেছে লরা, কি হারিয়েছে সে। কিন্তু মেয়ে মারা গেলেও, ভিটোর আরেকটা অবলম্বন আছে–স্ত্রী।

দরজা খোলার শব্দে ওরা দুজনই ঘাড় ফেরাল, ডেজাট নিয়ে আথিয়ার। ঢোকার কথা। দেখল দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে লুবনার সেই বডিগার্ডহাসান।

স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রানা, দুজনকে দেখছে। ওরাও তাকিয়ে আছে, চোখে ভাষাহীন বোবা দৃষ্টি।

প্রথমে সামলে উঠল ভিটো। কি চান আপনি? তীক্ষ্ণ সুরে জিজ্ঞেস করল সে,, ভাবটা যেন রানা এসে ভারি অন্যায় করে ফেলেছে।

এগিয়ে এসে একটা চেয়ার ধরল রানা, ঘুরিয়ে নিয়ে বসল তাতে, হাত দুটো থাকল চেয়ারের পিঠে। ভিটোর দিকে তাকাল ও। তোমার স্ত্রীর সাথে কথা বলব। তুমি যদি নড়ো বা বাধা দাও, সঙ্গে সঙ্গে খুন হয়ে যাবে। জ্যাকেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ভারি একটা পিস্তল বের করে টেবিলের ওপর রাখল ও। এতে গুলি ভরা আছে।

পিস্তলটা দেখে কেমন যেন কুঁকড়ে গেল ভিটো। লরার দিকে তাকাল রানা। ওর চেহারা থেকে কঠিন ভাব একটু যেন শিথিল হল।

কেন আপনি কেন কি চান..? কোন প্রশ্নই পুরোটা উচ্চারণ করতে পারল না লরা। তার মনে পড়ল, এই লোককে প্রথম দিন দেখেই সে ভয় পেয়েছিল।

আপনাকে একটা গল্প বলব আমি, বলল রানা। নিজের মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার কাহিনী। তারপর শুরু করল।

এসব ফনটেলার কাছ থেকে জেনেছে রানা। লুবনার কিডন্যাপিং প্রথম থেকেই ছিল একটা সাজানো ব্যাপার। ইলুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে টাকা আদায় করার একটা কূটকৌশল। লণ্ডনের লয়েডস-এর কাছ থেকে দুই বিলিয়ন লিরার একটা পলিসি কেনে ভিটো। চুক্তি ছিল, বীমা কোম্পানির কাছ থেকে টাকাটা পেয়ে অর্ধেক টাকা ভিটোকে ফেরত দেবে ফনটেলা। ভিটো আর ফনটেলার মাঝখানে। দালাল হিসেবে কাজ করে আলবারগোলোরান। অর্গানাইজড ক্রাইমের সঙ্গে তার যোগাযোগ বহুদিনের। তার স্বার্থ ছিল, এই টাকা থেকে কমিশন পাবে সে। গোটা ব্যাপারটা গড়গড় করে বলে গেল রানা, মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। শোনার সময়। রানার মুখ থেকে একবারও চোখ সরল না লরার। শুধু রানার কথা শেষ হবার পর। স্বামীর দিকে তাকাল সে। তার সমগ্র অস্তিত্ব থেকে যেন উথলে পড়ছে ঘৃণা। পিঠ বাকা করে আরও কুঁকড়ে গেল ভিটো। একবার মুখ খুলল, আবার সেটা বন্ধ করল। চোরের মত লাগছে তাকে। মাথা নিচু করে নিল সে, অন্য দিকে তাকাল।

বাকি সবাই? কাজটা যারা করেছিল? আপনিই কি ওদের খুন করেছেন?

মাথা ঝাঁকাল রানা। এ থেকে যারা লাভবান হয়েছে তাদের প্রত্যেককে আমি খুন করব।

ডাইনিংরূমে আবার নেমে এল নিস্তব্ধতা। অনেকক্ষণ পর কথা বলল লরা, অনেকটা আপন মনেই, ও আমাকে সান্ত্বনা দেয়। বলে পরস্পরের জন্যে আমরা তো এখনও আছি-কেটে যাচ্ছে দিন। পরমুহূর্তে যেন বাস্তবে ফিরে এল সে, কঠিন হয়ে উঠেছে দৃষ্টি, রানার দিকে তাকাল। আপনি বললেন ওদের সবাইকে?

টেবিল থেকে পিস্তলটা তুলে নিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল রানা। আমি ওকে খুন করতে এসেছি।

মুখ তুলে তাকাল ভিটো, রানার দিকে নয়, স্ত্রীর দিকে। ঘামে চকচক করছে তার মুখ। চোখ দুটো যেন অনন্তের দিকে মেলে দেয়া একজোড়া গরাদহীন জানালা।

পিস্তলটা সরিয়ে রাখল রানা, উঠে দাঁড়াল। ওকে আপনার হাতেই ছেড়ে দিলাম।

হ্যা! বোধহয় স্বস্তিতেই বিকৃত দেখাল লরার চেহারা, কাঁপা গলায় বলল, আমার হাতে ছেড়ে দিন–প্লীজ!

দরজার দিকে এগোল রানা, কিন্তু লরার কণ্ঠ বাধা দিল ওকে। লোরানের ব্যাপারে কি করছেন?

মাথা নাড়ল রানা। তার কথা আপনাকে ভাবতে হবে না।

ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রানা, ওর পিছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

.

লেকের পাশ দিয়ে চওড়া রাস্তা, বার্নাদো গুগলির গাড়ি ছুটে চলেছে কোমের দিকে। গুগলি ড্রাইভ করছেন, পাশে বসে আছে পাধানি। নীল রঙের একটা আলফেটা পাশ দিয়ে চলে গেল উল্টো দিকে।

.

পেন্ট হাউস অ্যাপার্টমেন্টে ডিনারে বসতে যাবে আলবারগোলোরান, ফোন এল। ভিটোর। লোরান রিসিভার তুলতেই চেঁচাতে শুরু করল ভিটো, কি বলছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

একটু অপেক্ষা কর, লোরান বলল তাকে। আমি আসছি।

ব্যস্ত হাতে জ্যাকেট পরল লোরান। স্ত্রীর চোখে বিস্ময় দেখে বলল, হঠাৎ একটা ঝামেলা দেখা দিয়েছে, ফিরতে দেরি হতে পারে তার।

বেসমেন্ট গ্যারেজে নেমে এল লোরান। মার্সিডিজে চড়ল। ইগনিশন কী ঘোরাতেই বিস্ফোরিত হল আধ কিলো বিস্ফোরক। হাড়-মাংস ছাতু হয়ে গেল আলাবারগো লোরানের।

.

খুই প্রভাবিত হলেন বার্নাদো গুগলি। আরাম করে চেয়ারে হেলান দিলেন তিনি, পরম তৃপ্তিতে একটা ঢেকুর তুললেন, দরাজ গলায় মন্তব্য করলেন, এমন স্বাদের। ফ্রিটো মিসটো জীবনে কখনও খাইনি–আই রিপিট–জীবনেও না।

নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল রেমারিক। এ আর এমন কি, আমার মায়ের হাতের রান্না খেলে আপনি পাগল হয়ে যাবেন।

আপনিও কি আমাকে পাগাল হতে বাকি রাখছেন? মুচকি হেসে বললেন গুগলি। একজন প্রাক্তন ক্রিমিন্যাল, প্রাক্তন কয়েদী, প্রাক্তন মার্সেনারি, তার রান্নার হাত এত ভাল হয় কি করে? আচ্ছা, আপনি ব্যাকগ্যামন খেলেন না, না? নাকি তাও খেলেন?

বিমূঢ় দেখাল রেমারিককে। খেলি, কিন্তু ব্যাকগ্যামনের সাথে কিসের কি সম্পর্ক?

রহস্যময় হাসি দেখা গেল কর্নেলের ঠোঁটে। সম্পর্ক আমার সাথে। এখানে সময়টা আমার আনন্দেই কাটরে বলে মনে হচ্ছে।

কিন্তু আমি তো আপনাকে বলেছি, বোর্ডিং বন্ধ হয়ে গেছে–আপনি কোন হোটেলে উঠুন।

কথা না বলে শ্যাম্পেনের গ্লাসে ধীরেসুস্থে চুমুক দিলেন গুগলি। অনেকক্ষণ পর যখন মুখ খুললেন, তার গলা গম্ভীর, পরিস্থিতির গুরুত্ব কেউ যদি বোঝে তো সে আপনি। খুনগুলো কে করছে ডন বাকালা এখন তা জানে। খবর পাবার। সুযোগ-সুবিধে আমার চেয়ে খারাপ নয় তার। আপনি হাসানের বন্ধু, এটা জানতে খুব বেশি সময় লাগবে না ওদের। আপনই বলুন, তখন কি হবে?

রেমারিক চুপ করে থাকল।

মাফিয়ানদের সম্পর্কে আমি আর আপনাকে নতুন করে কি বলব, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন গুগলি। কয়েকজন টাফ লোককে পাঠাবে ওরা। আপনাকে তুলে নিয়ে যেতে পারে, কিংবা এখানেই মেরে রেখে যেতে পারে–মারার আগে। হাসান সম্পর্কে সব আপনার কাছ থেকে জেনে নেবে ওরা।

কাধ ঝাঁকিয়ে রেমারিক বলল, নিজেকে কিভাবে রক্ষা করতে হয় আমি জানি। তবে কর্নেলের যুক্তিটা অস্বীকার করতে পারল না সে। মাত্র ঘন্টা খানেক আগে ফোন করেছিল রিসো। তার অফিসে সুবেশী দুজন লোক এসেছিল, জানতে চায় হাসানের সঙ্গে রিসোর কি সম্পর্ক, কেন রিসো হাসানের ব্যাপারে সুপারিশ করেছিল। রিসোর সুপারিশেই এজেন্সি থেকে আভান্তি পরিবারে বডিগার্ডের চাকরির জন্যে পাঠানো হয়েছিল হাসানকে। লোক দুজন রিসোকে প্রচ্ছন্ন হুমকিও দেয়। এরকম কিছু একটা ঘটতে পারে, সেটা আন্দাজ করেছিল রেমারিক। তাই ভাইকে সে আগেই শিখিয়ে দিয়েছিল কি বলতে হবে। শেখানো কথাই লোক দুজনকে বলেছে রিসো, সে তার বড় ভাইর অনুরোধে সুপারিশ করেছিল।

কোন সন্দেহ নেই, ইতিমধ্যে রওনা হয়ে গেছে লোক দুজন, ঘন্টা কয়েকের মধ্যে টোকা পড়বে রেমারিকের দরজায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, কারাবিনিয়ারির একজন কর্নেল যদি থাকে এখানে, মাফিয়ানরা কেউ বোর্ডিং হাউসের ত্রিসীমানায় ঘেঁষবে না। ঠিক আছে, এতই যখন জেদ করছেন, থেকে যান-খুলে দিচ্ছি একটা ঘর, বলল রেমারিক। কিন্তু বিছানায় ব্রেকফাস্ট পাবার আশা থাকলে ভুলে যান।

হাত নেড়ে অভয় দিলেন গুগলি। বিশ্বাস করুন, আমি কোন সমস্যাই নই। দেখবেন, আমার সাথে গল্প করে সময়টা আপনার ভালই কাটবে।

সারাদিন গাড়ি চালিয়ে মিলান থেকে আজ সন্ধের সময় এখানে পৌচেছেন। গুগলি। গাড়ি চালাতে পছন্দ করেন তিনি, কারণ চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ। মেলে। পথে পুরো হপ্তার ঘটনা এক-এক করে স্মরণ করেছেন তিনি। শুধু মুগ্ধ হননি, স্তম্ভিত হয়েছেন দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী একদল লোককে মাত্র একজন লোক কেমন আতঙ্কিত করে তুলেছে। লোকটার প্রতি শ্রদ্ধায় তার মাথা নত হয়ে আসতে চেয়েছে। যদিও, মুহূর্তের জন্যেও ভোলেননি, তিনি একজন, পুলিস অফিসার, আইনের রক্ষক-অপরাধীকে ভক্তি করা তাকে মানায় না।

আভান্তি পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে তাঁর। সাক্ষাৎকারের ঘটনাটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। স্মার্ট, সুদর্শন ভিটো আভান্তিকে চেনাই যাচ্ছিল না, কেউ যেন ছাই ঘষে দিয়েছে তার চেহারায়, আক্ষরিক অর্থেই কাপছিল লোকটা। তার স্ত্রী, লরা আভান্তি–সুন্দরী, কিন্তু বরফের মত ঠাণ্ডা।

প্রথমে ভিটো দেখা করতেই চায়নি। দেখা যা-ও বা করল, কথা বলতে চায়। তারপর একটু নরম হল, বলল, আমার আইন-উপদেষ্টা আসছেন, এলে কথা। বলব। এই সময় খবর এল ভিটোর আইন-উপদেষ্টা আলবারগো লোরান বোমা বিস্ফোরণে বেসমেন্ট গ্যারেজে মারা গেছে। আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা গেল ভিটোর, মধ্যে। খবরটা শুনেই গুগলির গায়ে ঢলে পড়ল সে। হড়বড় করে যা বলল, তার অর্থ দাঁড়ায়, পুলিসই এখন তার মা-বাপ, তারাই তাঁকে রক্ষা করতে পারে। এরপর প্রশ্নের উত্তর পেতে কোন অসুবিধে হয়নি কর্নেলের। ভিটো নিজের বোকামি আর লোভের কথা অকপটে গড়গড় করে বলে গেল। গুগলির সবচেয়ে খারাপ লাগল, যখন দেখলেন, ভিটো তার কাছ থেকে সহানুভূতি পাবে বলে আশা করছে। যে। লোক নিজ মেয়েকে পুজি করে ব্যবসা করতে চায়, সুস্থ একজন মানুষ তাকে। সহানুভূতি জানায় কি করে!

 ভিটো যা বলল, খস খস করে সব লিখে নিল পাধানি। বোবা হয়ে বসেছিল লরা, চোখ দুটো একবারও স্বামীর মুখ থেকে সরেনি। স্বামীর প্রতি মহিলার ঘৃণা। উপলব্ধি করে মনে মনে শিউরে উঠেছিলেন গুগলি।

 ভিটোর সঙ্গে কথা বলে তার মস্ত একটা লাভ হয়েছে, তিনি আবিষ্কার করেছেন কিলিং মেশিন চারজনকে খুন করেই থামছে না, তার তালিকায় আতুনি। বেরলিংগার তো আছেই, আছে মোড়ল পরিবারের মাথা ডন বাকালাও। এই তথ্য, হতভম্ব করে দেয় কর্নেলকে। তার মনে হল, এ লোক কিলিং মেশিনও নয়, সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে পাঠানো মূর্তিমান অভিশাপ। তিনি ভেবেছিলেন, ফনটেলাকে খুন করার পর প্রতিশোধের আগুন নিভে যাবে। ধরে নিয়েছিলেন, ফনটেলাকে খুন করেই সীমান্তের দিকে খিচে দৌড় দিয়েছে বডিগার্ড, জান। বাঁচাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে। কিন্তু না! এ লোক মূর্তিমান খোদার মার, আগে চিনতে পারেননি।

ভিটো আভান্তির বিরুদ্ধে আইনগত কি ব্যবস্থা নেয়া যায় সে-সম্পর্কে পাধানিকে পরামর্শ দিয়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গিয়েছিলেন কর্নেল, নিরিবিলিতে বসে চিন্তা-ভাবনা করবেন বলে।

পরিস্থিতিটা তাকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে।

একদিকে, বডিগার্ড আঘাত হেনেছে মাফিয়ার ঠিক হার্টের ওপর–একেবারে গর্বমূলে। একটা মাত্র লোক। এভাবে যদি চালিয়ে যায় সে, মারতে পারে আতুনি বেরলিংগারকে, মাফিয়ানদের ভেতর এমন সব বিশৃংখলা দেখা দেবে যে আবার সব গুছিয়ে আনতে সময় লাগবে দশ বছর। আর যদি অকল্পনীয় ঘটনাটা ঘটে, বডিগার্ড যদি বাকালাকে খুন করতে পারে, স্রেফ মুখ থুবড়ে পড়বে মাফিয়া চক্র। _ বেরলিংগার আর বাকালার সম্প্রীতি আসলে একটা প্রাচীর, মাফিয়া চক্রকে সম্ভাব্য সমস্ত বিপদ থেকে আড়াল করে রেখেছে। এই প্রাচীর ভেঙে পড়লে। দিকবিদিক ছুটোছুটি শুরু করবে মাফিয়ানরা, শুরু হয়ে যাবে মহা গোলমাল। সেই সুযোগে তিনি, গুগলি, অন্যান্য বসূদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগতে পারবেন। ফলে। দুই দশকের আগে মাফিয়ানরা কোনভাবেই আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। ওদের সম্পর্কে তার কোন ভুল ধারণা নেই। এই দানবকে তিনি চিরকালের জন্যে ধ্বংস করতে পারবেন না। শুধু এর আকৃতি কেটেছেটে ছোট করতে পারবেন। সে সুযোগ একশো বছরে এক আধবার আসতে পারে, না-ও আসতে পারে। তার ভাগ্য, সেই দুর্লভ সুযোগটাই তাঁকে এনে দিয়েছে বডিগার্ড লোকটা।

আরেক দিকে, তার দায়িত্ব হল খুনীকে গ্রেফতার করে কোর্টে চালান দেয়া, যে-কারণে বা যাকেই খুন করুক সে। সংকট তার বিবেককে নিয়ে খুদে একটা ইস্পাত মোড়া বাক্সে যতের সঙ্গে নিজের বিবেককে তালা দিন নাখতে পেরেছেন বলে গর্ব অনুভব করেন গুগলি।

সংকট ঔচিত্যবোধকে নিয়ে। তাঁর দর্শন হল, আইন অবশ্যই থাকতে হবে, কিন্তু সেই সঙ্গে আইনকে বাঁকা করার সুযোগও থাকা চাই; আর শুধু আইনের রক্ষকদেরই থাকবে আইনকে বাঁকা করার অলিখিত অধিকার। কাজেই বডিগার্ড লোকটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে তার মনে। অপূর্ব একটা সুযোগ এনে দিয়েছে সে, কিন্তু সেই সঙ্গে কর্নেল গুগলির ঔচিত্যবোধের ওপর একটা আঘাত হেনেছে। প্রায়। সারারাত এই বোধের সঙ্গে মনে মনে কুস্তি লড়লেন তিনি, তারপর একটা সম্মানজনক আপসে পৌঁছুলেন। খুব সকালে তার বস, জেনারেলের কাছে ছুটে গেলেন তিনি। সব ঘটনা খুলে বললেন তাকে, নিজের সঙ্গে কিভাবে আপস করতে চান তা-ও ব্যাখ্যা করলেন। জেনারেল গুগলিকে বিশ্বাস করেন, তার ওপর আস্থার কোন অভাব নেই। দুজনে একমত হলেন, কেসটার পুরো দায়িত্বে শুধু গুগলিই থাকবেন। প্রেসকে কিছুই জানানো হবে না, যদিও, দুচারদিনের মধ্যেই গন্ধ শুকে সব কিছু জেনে যাবে তারা।

ঠিক হল, মিলানের কাজ সেরে রোমে চলে যাবে পাধানি, আতুনি বেরলিং গারের কাছাকাছি থাকবে। আর গুগলি আসবেন নেপলসে। নেপলসে রেমারিক রয়েছে, বডিগার্ডের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গুগলি আগেই সন্দেহ করেছেন, রহস্যের, অন্তত একটা চাবি এই রেমারিক, সম্ভবত প্রস্তুতির কাজে এই লোক বডিগার্ডকে সাহায্যও করেছে। নিদের্শ দেয়া হল, প্রেজো ফিসো বোর্ডিং হাউসের টেলিফোনে আড়িপাতা যন্ত্র ফিট করতে হবে, খুলে দেখতে হবে সমস্ত চিঠি-পত্র। গুগলি বডিগার্ড সম্পর্কে সব কিছু জানতে চান–তার যোগ্যতা, চরিত্র, আদর্শ, বাধন। শুধু রেমারিকই তার কৌতূহল মেটাতে পারে।

মিলান থেকে নেপলসে আসার জন্যে রওনা হলেন গুগলি, দুঘন্টা পর মিলান কারাবিয়ানরির রেকর্ড ডিপার্টমেন্টের একজন অফিসার একটা কনফিডেনশিয়াল মেমোর কপি ফাইল বন্দি করল, কিন্তু তার আগে মেমোটা বার বার পড়ল, মুখস্থ না হওয়া পর্যন্ত থামল না। সন্ধের পর এক বন্ধুর সঙ্গে ডিনার খেল সে, সেই সঙ্গে টাকা ভর্তি একটা ভারি ব্যাগ হাতবদল হল। গুগলি যখন রেমারিকের রান্না করা ফ্রিটো মিসটোর স্বাদ আস্বাদন করছেন, রোমে বসে বেরলিংগার তখন ফোনে। গামবেরির কথা শুনছে, অবিশ্বাসে ছানাবড়া হয়ে উঠেছে তার চোখ। বলাই বাহুল্য, ফনটেলার অনুপস্থিতিতে গামবেরিই এখন মিলানের সর্বময় কর্তা।

গামবেরির তথ্যে কোন গলদ নেই, শুধু কর্নেল গুগলির মত সে-ও রানার আসল পরিচয় জানতে পারল না। ওকে তারা দুজনই মার্সেনারি হাসান বলে ভুল করছে। হাসানের অতীত ইতিহাস জানাবার সময় গামবেরিকে তেমন উৎকণ্ঠিত বলে মনে হল না। কারণ বডিগার্ডের মৃত্যু তালিকায় তার নাম নেই।

কয়েকটা নির্দেশ দিয়ে ফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখল বেরলিংগার, তারপর চিন্তা করতে বসল। খানিক পর বিশেষ একটা নাম্বারে ডায়াল করে পালার্মোর সঙ্গে যোগাযোগ করল সে, কথা বলল ডন বাকালার সঙ্গে। হত্যাকারীর পরিচয় সম্পর্কে একটা কথাও বলল না, জানে, ডন বাকালা তা ইতিমধ্যে জেনেছেন। পুলিস আর কারাবিনিয়ারি বলতে গেলে খুনীর বিরুদ্ধে কোন অ্যাকশনই নিচ্ছে না। জেনারেল অ্যালার্ট পর্যন্ত ইস্যু করা হয়নি। কেসটার সমস্ত দায়িত্ব নাকি কর্নেল গুগলির হাতে তুলে দেয়া হয়েছে, কিন্তু কর্নেল মিলান ছেড়ে চলে গেছে আজ সকালে, কোথায়। গেছে কেউ জানে না। বোঝাই যাচ্ছে, এর সঙ্গে রাজনীতি জড়িত। সবশেষে বেরলিংগার বলল, বেজন্মারা আমাদের দুরবস্থা দেখে খুশিতে বগল বাজাচ্ছে।

ডন বাকালার সঙ্গে কথা বলার পর বেরলিংগারকে আগের চেয়েও চিন্তিত দেখাল। কারণ, সে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে, ডন বাকালা ভয় পেয়েছে। জোরাল। কোন আশ্বাস তো দিলই না, স্পষ্ট কোন নির্দেশও এল না। গডফাদারকে কেমন। যেন দ্বিধাগ্রস্ত বলে মনে হল। উল্টো বেরলিংগারের কাছ থেকে পরামর্শ চাইল সে। বেরলিংগার অবশ্য কার্পণ্য করেনি, যথা সম্ভব অভয় দিয়েছে। পুলিসও যদি বডিগার্ডকে সাহায্য করে, মাফিয়ানদের হাত থেকে তবু তার নিস্তার নেই। পরিচয় যখন জানা গেছে, ঘন্টা কয়েকের মধ্যে খুঁজে বের করা হবে তাকে। অর্গানাইজেশনের প্রতিটি স্তরে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে এরই মধ্যে।

কিন্তু বেরলিংগার ভাবছে, ডন বাকালার প্রতিক্রিয়া এরকম হবে কেন! সন্দেহ নেই, খুনী ভয়ঙ্কর একটা হুমকি। একেবারে একা হয়েও এতগুলো লোককে খুন করে কেটে পড়া, তার অসাধারণ বুদ্ধি আর বিস্ময়কর যোগ্যতার পরিচয়ই বহন করে। কিন্তু তাই বলে ডন বাকালার মত একজন সম্রাট নিঃসঙ্গ একজন খুনীকে ভয় পাবে কেন? বেরলিংগার ধারণা করল, বাকালার এই প্রতিক্রিয়া আসলে একজন রাজনীতিকের প্রতিক্রিয়া। সে নিজে এই সম্মানজনক অবস্থায় পৌচেছে খুন-খারাবির সাহায্যে। প্রচুর মৃত্যু দেখেছে সে। কিন্তু ডন বাকালার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা, সে উঠেছে কূটনীতির সাহায্যে। খুন-খারাবির নির্দেশ দিয়েছে বটে, কিন্তু নিজের হাতে কখনও রক্ত লাগতে দেয়নি। আমি যদি একজন সৈনিক আর জেনারেল হই, ভাবল বেরলিংগার, বাকালা তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান। বাকালার ভয়। পাবার আরও একটা কারণ খুঁজে পেল সে এই প্রথম কেউ তার জন্যে হুমকি হয়ে। দেখা দিল। এর আগে সরাসরি কেউ তাকে খুন করবে বলে ভয় দেখায়নি। হয়ত এ-লাইনে অভিজ্ঞতার অভাবই ডন বাকালাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

গোটা ব্যাপারটার মধ্যে প্রচুর সম্ভাবনা দেখতে পেল বেরলিংগার। ব্যাপারটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা দরকার, আর নজর রাখা দরকার এরপর কি ঘটে। সবশেষে, বিছানায় যাবার আগে, নিজের ব্যক্তগত নিরাপত্তার ব্যাপারে কিছু নির্দেশ দিল সে। এই দশ তলা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙের সে-ই মালিক, পেন্টহাউসে থাকে সে। বেসমেন্ট গ্যারেজ থেকে টপ ফ্লোর পর্যন্ত সিকিউরিটির ব্যবস্থা আরও কড়া, আরও নিচ্ছিদ্র করতে হবে, গার্ডদের অগোচরে একটা পিঁপড়েও যেন ঢুকতে না পারে। একই নির্দেশ দেয়া হল তার অফিসের বেলায়, সে বিল্ডিংটাও তার নিজস্ব।

এক বিল্ডিং থেকে আর এক বিল্ডিঙে আসা-যাওয়ার ব্যাপারে কোন দুশ্চিন্তা নেই। তার একটা বিস্ময়কর ক্যাডিলাক আছে। তিন ইঞ্চি পুরু আর্মার প্লেটিং, বুলেটপ্রুফ জানালা। এই গাড়িটাকে নিয়ে বেরলিংগারের গর্বের অন্ত নেই। গত কবছরে দুবার তার গাড়িকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়, একবার হেভী ক্যালিবার পিস্তল দিয়ে, আরেকবার সাবমেশিনগান দিয়ে। দুবারই গাড়িতে ছিল সে, কিন্তু তার গায়ে আঁচুড়টিও লাগেনি। তবু, নতুন একটা নির্দেশ জারি করল সে। এখন থেকে গাড়ি ভর্তি বডিগার্ড ক্যাডিলাকের পিছু নেবে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও খাবে না সে। জানে, যত মাফিয়ান বস্ মারা যায় তাদের। বেশিরভাগই মরে রেস্তোরাঁয়–কিন্তু ফুড পয়জনিঙে নয়।

.

সত্যি ভয় পেয়েছে ডন বাকালা। এ তার কাছে সম্পূর্ণ এক নতুন অনুভূতি। দুর্ধর্ষ একজন খুনী তাকে খুন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এই চিন্তাটাই তাকে অসুস্থ করে তুলেছে।

বেরলিংগার অবশ্য আশ্বাস দিয়েছে আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পর বিপদ কেটে যাবে। কিন্তু তবু খুব একটা ভরসা পাচ্ছে না বাকালা। প্যানেল লাগানো স্টাডিতে ডেস্কের পিছনে বসে আছে সে, কেমন যেন ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা লাগছে তার। কাগজ-কলম টেনে নিয়ে লিখতে বসল, ভিলা কোলাসির নিরাপত্তার জন্যে জরুরি ভিত্তিতে কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। ভিলাটাকে সে দুর্গম একটা দুর্গ বানাতে চায়।

নির্দেশগুলো লেখা শেষ হল না, ফোন বাজল। নেপলসের বস্ জানাল, প্রেজো। ফিলোর মালিকের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না। সেই বজ্জাত কর্নেল গুগলি পাহারা দিচ্ছে ভিটেলা রেমারিককে।

ডন বাকালার ভয় আরও একটু বাড়ল।

.

পশমের আচ্ছাদনের ওপর ছক্কা ফেলল রেমারিক। দুটো চার। ব্যস্ত হাতে কলম। তুলে নিয়ে দ্রুত হিসেব করল সে। বলল, পচাশি হাজার লিরা।

ক্ষীণ একটু কষ্টসাধ্য হাসি দেখা গেল কর্নেলের ঠোঁটে। আপনি ঠিক বুদ্ধিই দিয়েছিলেন, কোন হোটেলেই ওঠা উচিত ছিল না আমার।

আজ তিন দিন প্রেজো ফিসোতে আছেন তিনি। ভোজন রসিক মানুষ, কিচেনে সাহায্যও করেছেন রেমারিককে। রেগুলার কাস্টমারদের কোন ধারণাই নেই যে তাদের সালাদ আজ একজন পুরোদস্তুর কর্নেল তৈরি করেছেন। ব্যাকগ্যামনে এ-পর্যন্ত তিনশো হাজার লিরা হেরেছেন বটে, কিন্তু রেমারিকের সঙ্গে চমৎকার সময় কেটেছে। সত্যি কথা বলতে কি, রেমারিকের প্রতি শ্রদ্ধা এসে গেছে তার, ব্যাকগ্যামনে ও একটা জিনিয়াস।

কিন্তু শুধু শ্ৰদ্ধা নয়, মধুর একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠছে। এর একটা কারণ এই হতে পারে, বিপরীত চরিত্রের প্রতি আকর্ষণ। দুজন মানুষের মধ্যে এর চেয়ে বেশি অমিল থাকতে পারে না। রেমারিক গম্ভীর, মিতভাষী, সতর্ক, তার নাক ভাঙা। গুগলি হাসিখুশি, সদালাপী, লম্বা, সুদর্শন। তবু এই নিয়াপলিটান লোকটাকে দারুণ ভাল লেগে গেল কর্নেলের। আড়ষ্ট ভাবটা দূর হবার পর রেমারিক যখন মুখ খুলল, বোঝা গেল নিজের সমাজ আর দুনিয়াদারি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখে সে। শুকনো এক ধরনের রসিকতাবোধও আছে তার মধ্যে। রেমারিকের অতীত সম্পর্কে। অনেক কিছুই জানেন তিনি, সেজন্যই বর্তমান পেশায় সে সন্তুষ্ট কিনা বারবার জানতে চান। এভাবে জীবন কাটাতে একঘেয়ে লাগে না?

মাথা নেড়ে, মৃদু হেসে জবাব দিয়েছে রেমারিক, উত্তেজনা দরকার হলে অতীত রোমন্থন করে সে। তাছাড়া, মাঝে-মধ্যে দুএকটা দুর্লভ সুযোগ আসে, তখন উত্তেজনার কোন অভাব থাকে না–এই যেমন, ব্যাকগ্যামন খেলায় অতি শিক্ষিত পুলিস অফিসারকে হারিয়ে দেয়া।

প্রথম দিকে কর্নেলকে একটা ধাঁধা বলে মনে হয়েছিল রেমারিকের। তারপর ভদ্রলোকের বিদ্রূপ মেশানো মন্তব্য, দিল খোলা হাসি, খেলায় গো-হারা হেরেও প্রতিপক্ষকে প্রশংসা করার ধরন, ইত্যাদি দেখে ভেতরের সরল আর সৎ। মানুষটাকে চিনতে পারে সে। দ্বিতীয় রাতে কর্নেলের বড় ভাই ডিনার খেতে এসেছিলেন। তিনজন মিলে একটা উৎসব মত করেন। অত বড় সার্জেন, কিন্তু তার মধ্যে গর্ব বা অহমের ছিটেফোঁটাও দেখেনি রেমানিক। দুভাইয়ের দরাজ গলার হাসির সঙ্গে তাকেও হাসতে হয়েছে। তিনজন ওরা দুবোতল মদ সাবাড় করে ফেলে।

দুভাইয়ের মধ্যে গভীর ভালবাসা রয়েছে। পারিবারিক আলোচনায় তারা। রেমারিককে ভিড়িয়ে নিল। তারপর এক সময় লুবনার বডিগার্ডের প্রসঙ্গও উঠল। কর্নেলের বিশ্বাস, বডিগার্ডের সঙ্গে রেমারিকের কোন না কোন যোগাযোগ আছে। কিন্তু স্বীকার করার জন্যে রেমারিককে চাপ দিলেন না তিনি। দিনে কয়েকবার করে রোমে টেলিফোন করেন, কথা বলেন সহকারী পাধানির সঙ্গে। প্রতিবারই পাধানি তাঁকে জানায়, রেমারিকের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ কোন ফোনকল আসেনি। চিঠিগুলোর ব্যাপারেও একই কথা। আড়িপাতা যন্ত্রে শুধু আপনার-আমার কথা টেপ হয়েছে।

তবে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে আপত্তি নেই কর্নেলের। সাংবাদিকরা ইতিমধ্যে আসল ঘটনা প্রায় জেনে ফেলেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন কাগজে বডিগার্ডের পরিচয় ছাপা হয়নি। অসৎ শিল্পপতিকে গালাগাল করছে কাগজগুলো, যে-লোক টাকার লোভে নিজের মেয়েকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়, তার মত হীন চরিত্র ব্যক্তির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। নামকরা ল-ইয়ার আলবারগো লোরানকেও ছেড়ে কথা বলছে না তারা। এক সম্পাদকীয়তে লেখা হল, এ-ধরনের শিক্ষিত লোকগুলো আসলে সমাজের বিষফোঁড়া; কে জানে, হয়ত বিস্ফোরণের সাহায্যে এদেরকে উৎখাত করাই সবার জন্য মঙ্গল।

এ-সব ঘটনা জোড়া দিয়ে একটা গল্প দাঁড়িয়ে গেছে, আসল কাহিনীর সঙ্গে তার পার্থক্য সামান্যই। গুগলি মনে মনে ভাবেন, সব যখন ফাঁস হয়ে যাবে, দেশের সাধারণ মানুষ কিভাবে নেবে সেটাকে? মানুষ জানবে, ব্যাপারটার ইতি ঘটেনি, নিকট ভবিষ্যতে আরও রোমহর্ষক ঘটনা ঘটবে। কি ভাববে তারা, তাদের প্রতিক্রিয়া কি হবে?

বডিগার্ডকে নিয়ে অনেক কথা ভাবেন গুগলি। একটা আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ করেছেন তিনি, রেমারিক কখনও ভুলেও তার নাম উচ্চারণ করে না। ও, বন্ধু, এইসব বলে। রেমারিকের কথা শুনে বডিগার্ডের একটা ছবি কল্পনা করে নিয়েছেন। তিনি। লুবনার প্রতি লোকটার ভালবাসা তিনি উপলব্ধি করেন। লুবনার রক্ষক ছিল সে, কিন্তু তাকে রক্ষা করতে পারেনি। লোকটার প্রতি সহানুভূতি বোধ করেনতিনি। এমনকি তার এই প্রতিশোধ স্পৃহাও মনে শ্রদ্ধার ভাব এনে দেয়।

রেমারিক বলেছে, বন্ধুকে সে শেষবার দেখেছে হাসপাতালে। গুগলি তর্ক করেননি, কাঁধ ঝাঁকিয়ে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যাই ঘটুক, তাঁর ব্যক্তিগত কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই। বেরলিংগার আর বাকালা ভুগুক না দুশ্চিন্তায়।

কিন্তু আসল কথা, ব্যাকগ্যামন খেলায় তিনি হারছেন। যথেষ্ট হয়েছে, রেমারিক আরেক দফা খেলার আয়োজন করছে দেখে বললেন তিনি। আর নয়। পাবলিক সার্ভেন্ট হয়ে প্রতিদিন এক হপ্তার বেতন হারার সামর্থ্য আমার নেই।

টেরেসে বসলেন গুগলি, অন্যমনস্ক। তাঁকে শ্যাম্পেন অফার করল রেমারিক। সূর্য দিগন্তরেখা ছুঁই ছুঁই করছে। একটু পর ডিনার তৈরি করার জন্যে কিচেনে গিয়ে ঢুকবে রেমারিক।

আধঘন্টা পর মিলান থেকে একটা ফোন পেলেন গুগলি। কথা শেষ করে কিচেনে ঢুকলেন তিনি। ভিটো আভান্তি, মৃদু কণ্ঠে বললেন। আত্মহত্যা করেছে।

ঠিক জানেন, আত্মহত্যা? জিজ্ঞেস করল রেমারিক।

মাথা ঝাঁকালেন গুগলি। সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আটতলার অফিসে ছিল সে, জানালা দিয়ে কার্নিসে নেমে পড়ে। মনস্থির করার আগে ওখানেই আধ ঘন্টা বসেছিল।

মাংস কাটায় ব্যস্ত হয়ে উঠল রেমারিক। তারপর, হঠাৎ হাত থামিয়ে মুখ তুলল, ওর স্ত্রীকে আপনি চেনেন?

একবার দেখেছি, বললেন গুগলি। কোন কথা হয়নি। সাক্ষাৎকারের ঘটনাটা বর্ণনা করলেন তিনি।

রেমারিক বলল, প্রথম দিকে তার আচরণ অন্য রকম ছিল। সব দোষ আমার বন্ধুর ঘাড়ে চাপিয়েছিল সে।

রেমারিককে সাহায্য করার প্রস্তাব দিলেন গুগলি। নিস্তব্ধতা ভেঙে এক সময় বললেন, ভিটো যখন মনস্থির করার চেষ্টা করছে, পুলিস তখন কোন উপায় না দেখে তার স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলে। সে যেন বুঝিয়ে-শুনিয়ে স্বামীকে ক্ষান্ত। করে। জানেন, লরা-আভান্তি কি বলেছে?

কি?

মাথা নাড়লেন গুগলি। কিছুই না–কিচ্ছু বলেনি, শুধু খিলখিল করে হেসেছে ফোনে।

আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠল ওরা। খানিক পর বিড়বিড় করে গুগলি বললেন, আশ্চর্য এক মহিলা–কিন্তু ভারি সুন্দরী।

ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকাল রেমারিক, কিছু বলতে গেল, কিন্তু তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে চুপ করেই থাকল সে।

.

০৮.

 ইউরোপের প্রতিটি রাজধানীতে একটা করে অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাস আছে, আর প্রতিটি দূতাবাসের পাশের রাস্তায় পার্ক করা অবস্থায় পাওয়া যাবে হাউজ-ট্রেইলর ও মোবাইল হোম। সাধারণত গরম কালে, দিনের বেলা দেখা যায় ওগুলোকে। সবই সেকেণ্ড হ্যাণ্ড, বিক্রি করার জন্যে। কিন্তু শুধু অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাসের কাছে। কেন, কেউ তা জানে না।

রোমও এর ব্যতিক্রম নয়, কিন্তু সময়টা শেষ গ্রীষ্ম বলে ভেহিকেল দেখা গেল মাত্র একটা-বেডফোর্ড চেসিসের ওপর একটা মোবেক্স।

সুসান আর রকি, প্রেমিক প্রেমিকা। একজন খদ্দেরের আশায় অপেক্ষা করছে ওরা।

রকির বয়স আটাশ। তার চেহারার একমাত্র বৈশিষ্ট্য কটা রঙের চুল। মাথা থেকে ফুলেফেপে নেমে এসে চুলগুলো তার ঘাড়, গলা, কাঁধ, পিঠ আর বুক ঢেকে ফেলেছে। চুলের রাজ্য থেকে পিট পিট করছে বুদ্ধিদীপ্ত একজোড়া খুদে আকারের চোখ। পরনে ডেনিম ওভারঅল, মিউজিয়ামে পাঠিয়ে দিলে ধুলে কসের ময়লা। বের হবে তাই নিয়ে দেশ জুড়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যাবে।

সুসানের বয়স পঁচিশ। আগাগোড়া বিশাল তার আকৃতি। মোটা নয়, স্রেফ বড় বেশি বাড়। দেখতে খারাপ নয় সুসান, কিন্তু তার বিশাল কাঠামো ঠিক নারীসুলভ নয়।

ওরা অস্ট্রেলিয়ান, ওদের গল্পও প্রবাসী আর সব অস্ট্রেলিয়ানদের মত। দেশে। অধ্যাপনা করছিল রকি, একটা কলেজে প্রবাসী ইটালিয়ানদের ইংরেজি পড়াত। একই কলেজের একজিকিউটিভ সেক্রেটারি ছিল সুসান। মন দেয়া-নেয়া চলছিল আগে থেকেই, হঠাৎ দুজন ঠিক করল, এই নিরানন্দ জীবন ভাল্লাগছে না, জ্ঞান বাড়াবার জন্যে দুনিয়াকে একবার ঘুরে দেখে আসতে পারলে হয়। যেই ভাবা সেই কাজ, ব্যাংকে যা ছিল সব তুলে জাহাজে চেপে বসল ওরা। চলে এল ইটালিতে। কিন্তু দুনিয়া দেখার সাধ তাদের মিটল না, কারণ ইটালিতে একমাস কাটিয়ে তাদের পকেট খালি হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে প্রচুর শিক্ষা হয়েছে ওদের, মোবেক্সটা। বিক্রি করে এখন ওরা ঘরের সন্তান ঘরে ফিরতে পারলে বাঁচে।

তিন দিন কেটে গেল এখানে, অথচ খদ্দেরের দেখা নেই। মোবেক্স বিক্রি করতে না পারলে জাহাজের টিকেট কেনা হবে না। দুজনেই খুব উদ্বিগ্ন। এই সময় একজন সম্ভাব্য খদ্দের পেয়ে ভীষণ খুশি হয়ে উঠল সুসান।

বয়স্ক একজন লোক, কিন্তু হাবভাবে প্রাণচঞ্চল তরুণ। দেখে মনে হয়। বিদেশী, কিন্তু বিশুদ্ধ ইটালিয়ান ভাষায় জিজ্ঞেস করল, এটা কি বিক্রির জন্যে?

রকি চিরকালই একটু বেয়াড়া টাইপের, এদিক ওদিক মাথা নাড়ল সে, বলল, না, এখানে এটাকে রেখেছি লোককে দেখাবার জন্যে। এ কথা না বলে, লোকটা ঘুরেফিরে ভাল করে দেখল ভেহিকেলটা। চাপা। উত্তেজনা নিয়ে পেভমেন্ট থেকে উঠে দাঁড়াল সুসান, বিশাল পশ্চাদ্দেশ থেকে ধুলো। ঝাড়ল হাত চাপড়ে। সত্যি তোমার কেনার ইচ্ছে আছে? জানতে চাইল সে। তার কণ্ঠস্বর কিছুটা পুরুষালি।

এ লোকটা তার দিকে তাকাল, মাথা ঝাঁকাল ছোট্ট করে। অমলিন হাসি দেখা গেল সুসানের মুখে। রকিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হল।

এঞ্জিনটা দেখতে পারি?

মোবেক্সের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করছে সুসান, ওদের পিছু পিছু ঘুরছে রকি। তারপরই সুসান প্রস্তাব দিল, ভেতরে বসে ঠাণ্ডা বিয়ার খাওয়া যাক। মোবেক্স মাত্র দুবছরের পুরানো, দশ হাজার মাইল চলেছে। দর কষাকষিতে সুসানকে টলানো খুব কঠিন, বুঝতে পেরে বেশি জেদ করল না লোকটা। শেষ পর্যন্ত দশ মিলিয়ন। লিরায় রফা হল। লোকটা জানতে চাইল, ট্রান্সফার পেপার তৈরি আছে তো?

আছে, বলল সুসান। পুলিস স্টেশনে গিয়ে রেজিস্ট্রি করিয়ে নিতে হবে। ফর্মটা পূরণ করা হল। ক্রেতা নিজের নাম লিখলঃ বদিয়ের মন্টি। জাতীয়তাঃ ফ্রেঞ্চ।

তিন দিন পর ডেলিভারি নেব আমি, ছোট ফোল্ডিং-টেবিলের ওপর কাগজটা। ঠেলে দিয়ে বলল লোকটা।

 সন্দেহের চোখে তাকাল সুসান। অ্যাডভান্স করছ তো?

এরপর ওরা একটা ধাক্কা খেল। জ্যাকেটের পকেট থেকে টাকার বড় একটা তাড়া বের করল লোকটা, নোটগুলো এক লক্ষ লিরার। গুনে গুনে একশো নোট তাড়া থেকে আলাদা করে টেবিলের ওপর রাখল সে। কিন্তু কাগজগুলো তার। আগেই রেজিস্ট্রি কোরো না।

অনেকক্ষণ কথা বলল না কেউ। নিস্তব্ধতা ভাঙল রকি, তুমি দেখছি সরল ভাবে বিশ্বাস করলে আমাদের। টাকা আর মোবেক্স নিয়ে আমরা যদি পালিয়ে। যাই?

খুদে চোখ জোড়ার দিকে তাকাল লোকটা। কিছু বলল না, শুধু হাসল।

 সুসান জানতে চাইল, এখান থেকে ডেলিভারি নেবে তো?

মাথা নাড়ল নোকটা। পকেট থেকে রোমের একটা রোড ম্যাপ বের করে। ভাঁজ খুলল, আঙুল রাখল একটা ক্রস চিহ্নে। জায়গাটা শহরের বাইরে, পুব অটোস্ট্র্যাডার কাছাকাছি। মন্টি অ্যান্টিনি ক্যাম্পসাইটটা…ওখানেই বিকেলের দিকে গিয়ে বুঝে নেব। কোন অসুবিধে নেই তো?

না, অসুবিধে কি, বলল সুসান। ইতিমধ্যে আমরা আমাদের ব্যাগগুলো রেলওয়ে স্টেশনে রেখে আসতে পারব।

কোন দিকে যাচ্ছ তোমরা?

ব্রিন্দিসি, বলল সুসান। ওখান থেকে ফেরি ধরে গ্রীসে। চট করে একবার রকির দিকে তাকাল সে, ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল রকি। লোকটার কাছ থেকে বেশ কিছু বেশি টাকা আদায় করা গেছে, কাজেই গ্রীস হয়ে দেশে ফিরতে কোন অসুবিধে নেই এখন।

বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিল লোকটা, চারদিকে আরেকবার চোখ বুলাল। মোবেক্সের ভেতরটা ছোট, কিন্তু আরামদায়ক। কি যেন ভাবছে। সুসান, তারপর। রকির দিকে তাকাল সে। নিঃশব্দে দেখল দুজনকে। অবশেষে মুখ খুলল, আমিও দক্ষিণ দিকে যাচ্ছি। চাইলে তোমাদেরকে লিফট দিতে পারি।

প্রস্তাবটা নিয়ে আলোচনা করল ওরা। মন্দ কি, বলল সুসান। রকি খানিক। ইতস্তত করে মাথা ঝাঁকাল। লোকটা ব্যাখ্যা করে বলল, তার কোন ব্যস্ততা নেই। তিন থেকে চার দিন পথেই থাকবে সে। কথা প্রসঙ্গে বলল, তাহলে ব্রিন্দিসিতে না। পৌঁছুনো পর্যন্ত রেজিস্ট্রি করার দরকার নেই।

লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে, কাজেই লোকটাকে আরও কিছুক্ষণ থেকে যেতে। বলল সুসান। টিনের খাবার রান্না করল সে, আরও বিয়ারের ক্যান খুলল রকি।

রানা চলে যাবার পর রকি মন্তব্য করল, ফেঞ্চ না ছাই, ডাহা মিথ্যে কথা বলে গেল।

কি করে জানলে?

 গায়ের রঙ দেখলে না?

কেন, ফ্রান্সে তো ওর চেয়েও কালো লোক আছে।

অপ্রতিভ দেখাল রকিকে। মোট কথা, লোকটাকে আমার ফেঞ্চ বলে মনে হয়নি, তেমন সুবিধের বলেও মনে হয়নি। কেমন উদ্ভট আচরণ, লক্ষ করেছ? একটা ঠিকানা পর্যন্ত না দিয়ে স্রেফ উঠে চলে গেল।

কাঁধ ঝাঁকাল সুসান। তা যাক গে, পুরো টাকা তো দিয়ে গেছে। খানিক পর আবার বলল, চেহারা দেখে আজকাল লোক চেনা কঠিন, তা ঠিক।

এই বয়সেও কেমন শক্ত-সমর্থ লক্ষ করেছ? কিভাবে হাঁটে দেখেছ? মনে হয়। বাইশ বছরের শরীরে বাহান্ন বছরের চেহারা। বাজি রেখে বলতে পারি, তুমিও ওর সাথে পারবে না। দাঁত বের করে হাসতে লাগল রকি।, সুসানও হাসল। আমার কিন্তু লোকটাকে খারাপ লাগেনি। বেশি দরদাম করেনি। স্বভাবটা খুঁতখুঁতে নয়। এর বেশি কি দরকারই বা আমাদের?

.

নিঃশব্দে টেরেসে বেরিয়ে এল রেমারিক। হঠাৎ একটা পরিবর্তন দেখা দিয়েছে তার মধ্যে, কর্নেল গুগলির দৃষ্টি এড়ায়নি। একটা চেয়ার টেনে বসল, কর্নেলের দিকে না তাকিয়ে পট থেকে চা ঢালল কাপে। তার চেহারায় দ্বিধা আর উদ্বেগ। ফোনটা এসেছে প্রায় এক ঘন্টা আগে, দশ মিনিট কথা বলার পর রিসিভার নামিয়ে রাখে রেমারিক। তারপর থেকেই গম্ভীর সে, একটা কথাও বলেনি। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছেন গুগলি। ফোনে কোন তাৎপর্যপূর্ণ আলাপ হয়ে থাকলে এক ঘন্টার। মধ্যে পানির কাছ থেকে জানতে পারবেন তিনি।

কফি খেতে খেতে মনস্থির করে ফেলল রেমারিক। আমার বন্ধু যদি আপনার কাছে আত্মসমর্পণ করে, কি ঘটবে?

কর্নেলের পালস রেট বেড়ে গেল। ফোন কলটার তাহলে সত্যিই তাৎপর্য আছে। গম্ভীর হলেন তিনি, বললেন, জেলে তাকে অবশ্যই যেতে হবে। তবে, যে ধরনের লোকদের সে খুন করেছে, আর তার যে মোটিভ, সাজাটা হবে, বড়জোর বছর পাঁচেকের। বিশেষ ব্যবস্থাও করা সম্ভব। ধরুন, সব মিলিয়ে বছর আড়াইয়ের মধ্যে ছাড়া পেয়ে যাবে সে।

কিন্তু ওকে কি জেলখানার ভেতর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে?

কি বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি, বললেন গুগলি। ইটালির জেলখানা। মাফিয়ার দখলে, সত্যি কথা। কিন্তু দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই, আপনার বন্ধুকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে। রোমের বাইরে নতুন একটা জেলখানা তৈরি করেছি আমরা, শুধু কারাবিনিয়ারির লোকজন কাজ করছে ওখানে। আপনার বন্ধুর নিরাপত্তার ব্যাপারে গ্যারান্টি দেব আমি। আসলে, তার বিপদ শুরু হবে জেলখানা থেকে বেরুবার পর।

আত্মসমর্পণের কথা ভুলে যান, বলল রেমারিক। আপনাকে যদি অনুরোধ করা হয়, আমার বন্ধুকে নিরাপদে ইটালি ত্যাগ করার ব্যবস্থা করে দিন, আপনার প্রতিক্রিয়া কি হবে?

আগে জানতে হবে অনুরোধটা কে করছে।

 ধরুন, আপনার বস, জেনারেল যদি করেন?

কাঁধ ঝাঁকালেন গুগলি। তার নির্দেশ আমি খুশি মনে শিরোধার্য বলে মেনেনেব।

সেই নির্দেশই পেতে যাচ্ছেন আপনি, বলল রেমারিক। হাতঘড়ি দেখল সে। আর বেশি দেরি নেই।

চটে উঠলেন গুগলি। মানে?

আরও কয়েকটা তথ্য দিই আপনাকে, বলল রেমারিক। তার আগে বলুন, মাসুদ রানা নামটা আগে কখনও শুনেছেন?

মাসুদ রানা…মাসুদ রানা–হ্যাঁ, শুনেছি। বাংলাদেশের একজন দুর্দান্ত পাই।

আপনি যাকে লুবনার বডিগার্ড হিসেবে জানেন, যাকে হাসান নামে চেনেন, আমার বন্ধু, সে ওই মাসুদ রানা–মার্সেনারি হাসানের ছদ্মবেশ নিয়ে আছে।

ব্যাপারটা হজম করতে তিন সেকেণ্ড সময় নিলেন গুগলি। মাই গড! রেমারিকের দিকে ঝুঁকলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ সব গড়গড় করে বলে ফেলছেন, ব্যাপারটা কি?

রানার এখন খুব বিপদ, বলল রেমারিক। ডন বাকালা তার পরিচয় জেনে ফেলেছে। কিছুই গোপন নেই, ফাস হয়ে গেছে সব। রানার বর্তমান চেহারার একটা ছবিও তার হাতে পৌচেছে, ভোশিয়ে সহ।

কিভাবে? ভুরু কুঁচকে উঠল কর্নেলের। আমরা কিছুই জানতে পারলাম না, অথচ…

রানার পরিচয় ফাঁস হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, বলল রেমারিক। আপনি জানেন, মার্কিন মাফিয়া আর ইটালিয়ান মাফিয়ার মধ্যে সেই আদি কাল থেকেই যোগাযোগ আর সম্পর্ক আছে। এখানে বন্ধুদের বিপদ দেখে ওখানের ডনেরা চুপ করে বসে নেই। বাংলাদেশে টেলেক্স পাঠিয়ে হাসান সম্পর্কে খোঁজ-খবর শুরু করে ওরা, আর তাতেই ফাস হয়ে যায়। হাসান মারা গেছে মাস কয়েক আগে। তদন্ত আরও জোরেশোরে শুরু হয়, বেরিয়ে পড়ে বডিগার্ডের আসল পরিচয়।

কিন্তু মাসুদ রানার মত একজন এসপিওনাজ এজেন্ট বডিগার্ডের চাকরি…?

কোন একটা কারণে সি. আই. এ.-এর চোখকে ফাঁকি দেয়ার দরকার পড়ে। ওর, তাই…

ও, আচ্ছা, বুঝেছি, হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ায় চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল গুগলির। এয়ারকিং হাইজ্যাক করে নিয়ে এসে সি. আই.এ.-কে চটিয়ে দেয় আপনার বন্ধু। কিন্তু বিপদটা কি ধরনের? কে ফোন করেছিল আপনাকে?

ফোন করেছিল ব্রিগেডিয়ার সোহেল নামে রানার এক বন্ধু, বলল রেমারিক, ঢাকা থেকে। আর রানার বিপদটা হল, ওর চেহারা আর পরিচয় ফাস হয়ে যাবার পর, ঢাকা ভাবছে, মাফিয়ানদের হাতে ধরা না পড়ে ওর কোন উপায় নেই। সেজন্যেই ওর বস ওকে জরুরি নির্দেশ দিয়েছেন।

কি সেই নির্দেশ?

স্টপ ইট! লিভ ইটালি ইমিডিয়েটলি!

কাঁধে একটা দায়িত্বের বোঝা নতুন করে অনুভব করলেন কর্নেল গুগলি। চেয়ার ছেড়ে পায়চারি শুরু করলেন তিনি। আর কি জানেন, সব বলুন আমাকে।

বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে, মাফিয়ার ওপর আঘাত হানায় সি. আই. এ. নাকি রানার ওপর থেকে মৃত্যু-পরোয়ানা তুলে নিয়েছে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চাইছে। ওরা। ডন বাকালার নিরাপত্তার জন্যে গেরিলা ট্রেনিং পাওয়া বারোজন মার্কিন মাফিয়ান ইটালিতে আসছিল, সি. আই. এ. খবর পেয়ে আটজনকে এয়ারপোর্টে আটক করে। কিন্তু বাকি চারজন আগের দিন রওনা হয়ে যায়। ইতিমধ্যে সম্ভবত ডন বাকালার ভিলা কোলাসিতে পৌঁছে গেছে তারা। ঢাকা থেকে আরও খবর আসে–ভিলা কোলাসি এখন একটা দুর্গম দুর্গ, কোন মানুষের সাধ্য নেই ভেতরে ঢোকে। সেজন্যেই রানার বস নির্দেশটা পাঠিয়েছেন।

এখন আমরা কি করব?

আপনার বসের টেলেক্স আসছে। না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করব।

আপনি বলতে চাইছেন, ঢাকা থেকে আমার বুকে অনুরোধ করা, হয়েছে?

আপনি জানেন না, আপনার বস আর রানার বস, খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওঁরা।

মেজর জেনারেল রাহাত খান? হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে বসকে তাঁর কথা বলতে শুনি। বটে। চিন্তিত দেখাল কর্নেলকে। ঠিক আছে, টেলেক্স পেলাম। তারপর?

তারপর আমরা রোমে যাব, বলল রেমারিক। নির্দেশটা পৌঁছে দেব রানাকে।

রোমে পৌঁছুতে অনেক সময় লাগবে আমাদের, গুগলি বললেন। তারচেয়ে। আমার সহকারী পাধানিকে ফোন করি আমি। দশ মিনিটের মধ্যে রানাকে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাবে সে।

হেডকোয়ার্টারে? সতর্ক চোখে তাকাল রেমারিক।

না, মানে…নিরাপদ একটা সেফ হাউসে, তাড়াতাড়ি বললেন গুগলি। তারপর ওখান থেকে তার দেশ ত্যাগের ব্যবস্থা করা হবে।

 মাথা নাড়ল রেমারিক। রানা যদি পাধানি, আর দশ বারোজন পুলিসকে খুন। করে বসে, তাকে আপনারা দেশ ছেড়ে চলে যেতে দেবেন?

যুক্তিটা বুঝলেন গুগলি। রানাকে আপনি ফোন করতে পারেন না?

ওখানে কোন ফোন নেই।

তাহলে দেরি করা বোকামি হচ্ছে, চলুন বেরিয়ে পড়ি।

টেলেক্স না পেয়েই?

গাড়িতে ব্যবস্থা আছে, বললেন গুগলি। পাধানির সাথে যোগাযোগ করব আমি।

বোর্ডিং হাউস থেকে নিচে নামল ওরা। কর্নেলের গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে, মটরসাইকেলে চড়ে একজন পুলিস এসে থামল সামনে। কর্নেলের হাতে একটা নয়, দুটো টেলেক্স ধরিয়ে দিল সে।

গাড়ি চালাচ্ছে রেমারিক। মেসেজ পড়ছেন গুগলি। তার বস বলেছেন, খুনী ধরা পড়লে তার শাস্তির ব্যবস্থা না করে উপায় নেই। কিন্তু সে যদি ইটালি ছেড়ে পালিয়ে যায়, কিচ্ছুটি করার নেই আমাদের। ব্যবস্থা কর। শেষ কথাটার বিশেষ তাৎপর্য বুঝতে পেরে মুচকি একটু হাসলেন গুগলি।

এরপর তিনি দ্বিতীয় মেসেজটা পড়তে শুরু করলেন। হোলি মাদার অভ গড! হঠাৎ আঁতকে উঠে বললেন তিনি।

কি হল? জানতে চাইল রেমারিক।

হাতে ধরা টেলেক্স মেসেজটা ইঙ্গিতে দেখালেন গুগলি। ব্যাখ্যা করে বললেন, তিনি আন্দাজ করেছিলেন রানা মার্সেলেসে গিয়েছিল ইকুইপমেন্ট যোগাড় করার। জন্যে। ফ্রেঞ্চ পুলিসকে দিয়ে আর্মস ডিলারের ওপর চাপ সৃষ্টি করায় কয়েকটা তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

গগল সব ফাঁস করে দিয়েছে? চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তাকাল রেমারিক।

কিছুই সে বলেনি, গুগলি বললেন। নির্দিষ্ট একটা সময়ের ভেতর যা যা বিক্রি করেছে, তার একটা তালিকা আদায় করেছে ফ্রেঞ্চ পুলিস। আচ্ছা, আর. পি. জি. সেভেন স্ট্রোক ডি জিনিসটা কি বলুন তো?

গম্ভীর একটু হাসি দেখা গেল রেমারিকের মুখে। অ্যান্টিট্যাঙ্ক রকেট লঞ্চার। মার্সেনারিরা ওটাকে জুয়িশ বাজুকা বলে।

ইসরায়েলি অস্ত্র?

না। রাশিয়ান। কিন্তু রকেট লোড করার পর জিনিসটা দেখতে হয় সারকামসাইজড় পেনিসের মত।

গুগলি হাসলেন না। রানা ওটা ব্যবহার করতে জানে?

কোনটা?

এবার না হেসে পারলেন না গুগলি। মাংসপেশী নয়, আমি ইস্পাতটার কথা জিজ্ঞেস করছি। রানা ওটা চালাতে জানে?

অনেকের চেয়ে ভালভাবে।

কিন্তু, বিস্মিত দেখাল কর্নেলকে, মাফিয়াদের প্রায় সব কিছুই আছে, ট্যাঙ্ক, আছে বলে তো শুনিনি!

নেই, বলল রেমারিক। শুধু ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে নয়, অন্য কাজেও ওটা ব্যবহার করা যায়। ধরুন, কেউ যদি বিল্ডিং ভাঙতে চায়, কিংবা স্টীল গেট খুলতে চায়? ওটার ক্ষমতা জানেন? বারো ইঞ্চি পুরু আর্মার প্লেট ভেদ করতে পারে। মুচকি হাসি দেখা গেল তার ঠোঁটে।

সন্দেহ নেই, চামড়ার অস্ত্রের চেয়ে একটু বেশিই পারে।

গলা ছেড়ে হেসে উঠল রেমারিক।

হঠাৎ গম্ভীর হলেন কর্নেল। রানাকে ওর বস থামতে বলায়, আমার ধারণা, আপনাকে হতাশ দেখাবার কথা। কিন্তু তা তো দেখাচ্ছে না। বরং …

রেমারিক হাসল না। রানা এই পর্যায়ে এসে কারও কথা শুনবে কিনা সেটাই হল প্রশ্ন।

.

ঠিক সেই মুহূর্তে রানার কাঁধে রয়েছে ইসরায়েলি বাজুকা, রোমের রাস্তা ধরে ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে ও। ক্যানভাসের ব্যাগে শুধু আর. পি. জি. সেভেন স্ট্রোক ডি নয়, সঙ্গে এক জোড়া রকেটও রয়েছে। ব্যাগটা যে খুব একটা বড় তা-ও নয়, রকেট লঞ্চারটা সাধারণ একটা টিউবের মত দেখতে, সাঁইত্রিশ ইঞ্চি লম্বা, সহজে বহন করার জন্যে প্যাঁচ ঘুরিয়ে মাঝখানে খোলা যায়। জিনিসটার ওজন মাত্র পনেরো পাউণ্ড। এক একটা রকেটের ওজন পাঁচ পাউণ্ডের কিছু কম।

.

বুড়ো-বুড়ি সবেমাত্র লাঞ্চ শেষ করে সুখ-দুঃখের গল্প শুরু করেছে, দরজায় নক হল। দুজনেরই বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে, বুড়ির পায়ে বাত, কাজেই বুড়োকেই দরজা খুলতে যেতে হল। প্রথমেই একটা পিস্তল দেখল সে, ভয় পেল সাংঘাতিক। লোকটার চেহারা দেখে ভয় তার বাড়ল বৈ কমল না। কিন্তু লোকটা কথা বলল। নরম সুরে, আপনাদের কোন বিপদ হবে না। আমি ডাকাতি করতে আসিনি। ধীরে ধীরে সামনে এগোল সে, একটু একটু করে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করল। বুড়োকে।

কয়েক মিনিটের মধ্যে বুড়ো-বুড়িকে চেয়ারে বসিয়ে টেপ দিয়ে আটকে ফেলা হোল। ওদের মুখেও টেপ লাগাল লোকটা, সারাক্ষণ অভয় দিয়ে কথা বলছে সে। ওদের বাড়িটা কিছুক্ষণের জন্যে ধার নিচ্ছে। কোন ভয় নেই, তাদের কোন ক্ষতি করা হবে না।

একটু একটু করে ভয় কাটিয়ে উঠল বুড়ো-বুড়ি। দুজনেই আগ্রহের সঙ্গে লোকটার কাজকর্ম দেখতে লাগল। ব্যাগ থেকে মোটা আকৃতির দুটো টিউব বের করল সে, দুটোকে এক করে জোড়া লাগাল। কয়েক মুহূর্ত পর বুড়ো বুঝল, লোকটার হাতে ওটা একটা টেলিস্কোপ লাগানো রকেট লঞ্চার সেনাবাহিনীতে ছিল সে। তবে এ-ধরনের রকেট লঞ্চার আগে কখনও দেখেনি। জিনিসটা খুবই সফিসটিকেটেড বলে মনে হল। লঞ্চারে একটা মিসাইল ফিট করল লোকটা। এরপর দ্বিতীয় একটা মিসাইল, আর একজোড়া গগলস বের করল। শান্তভাবে বাড়ির পিছন দিকে, উঠনে চলে গেল সে। ভোলা জানালা পথে তাকে দেখতে পেল বুড়ো-বুড়ি-নিচু পাঁচিলের ওপর দিয়ে রাস্তা দেখছে। এই পাঁচিলটাই রাস্তা আর উঠনটাকে আলাদা করেছে।

.

উল্টোদিকের বিল্ডিঙের পেন্টহাউসে অতুনি বেরলিংগারও এইমাত্র তার লাঞ্চ শেষ করল।

ঠিক দুটো ত্রিশ মিনিটে বেসমেন্ট গ্যারেজে নেমে এল এলিভেটর। দরজা খুলে গেল, বেরিয়ে এল বেরলিংগার, পিছনে তার পার্সোনাল বডিগার্ড। ক্যাডিলাক অপেক্ষা করছে, এঞ্জিন সচল। ক্যাডিলাকের ঠিক পিছনেই রয়েছে কালো একটা ল্যানসিয়া, তাতে বসে আছে চারজন বডিগার্ড। ক্যাডিলাকের ব্যাক সিটে উঠে। বসল বেরলিংগার, দরজা বন্ধ করে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসল বডিগার্ড। ঢাল বেয়ে একই সঙ্গে রওনা হল গাড়ি দুটো।

ঢালের মাথায় উঠে আসতে রাস্তা দেখা গেল, কড়া রোদ লেগে ধাধিয়ে গেল সবার চোখ। সবাই চোখ কুঁচকে আছে, তবু চওড়া রাস্তার শেষ মাথায়; নিচু পাঁচিলের ওপারে লোকটাকে দেখতে পেল ওরা। ধীরে ধীরে সিধে হল লোকটা।

তার মুখ ভাল করে দেখা গেল না, গগলসে বেশিরভাগটাই ঢাকা পড়ে আছে। মোটাসোটা একটা টিউব রয়েছে ডান কাঁধে। সবই বুঝল ওরা, কিন্তু কিছু করার সময় পেল না। টিউবের পিছন থেকে উথলে উঠল বিরাট একটা অগ্নিশিখা, তার ভেতর থেকে আলাদা হয়ে বেরিয়ে এল কালো একটা জিনিস। জিনিসটা চোখের পলকে কাছে চলে এল, আর আকারে বড় হয়ে উঠল। চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। বেরলিংগার, ব্রেকের ওপর দাঁড়িয়ে পড়েছে ড্রাইভার। ভারি গাড়িটা সামনের দিকে ঝুঁকল, তারপর রিএনফোর্সড স্প্রিঙের ধাক্কা খেয়ে পিছনের চাকার ওপর খাড়া হতে শুরু করল। গাড়িটার উত্থান হঠাৎ প্রচণ্ড এক ঝাঁকির সঙ্গে আরও দ্রুত হয়ে। উঠল–মিসাইলটা র‍্যাডিয়েটরের মাঝখানে আঘাত করেছে। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হল। এঞ্জিন, ভেতরের সব কিছুতে আগুন ধরে গেল। মুহূর্তের জন্যে রিয়ার ফেণ্ডারের ওপর খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে থাকল ক্যাডিলাক, এই সময় পৌঁছুল দ্বিতীয় মিসাইল।

ফ্রন্ট অ্যাকসেলের ঠিক নিচে আঘাত করল মিসাইল। দশ টন ওজনের গাড়িটা  পিছন দিকে ছিটকে পড়ল, ল্যানসিয়ার ওপর।

তাৎক্ষণিক মৃত্যুকে এড়িয়ে যেতে পারল মাত্র একজন। ল্যানসিয়া চিড়ে চ্যাপ্টা হতে শুরু করেছে, পিছনের দরজা বিস্ফোরিত হল, হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল একজন বডিগার্ড। বেরিয়ে এল আগুনের মাঝখানে। চামড়া আর মাংস পোড়ার গন্ধে ভারি হয়ে উঠল বাতাস।

.

গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছেন কর্নেল গুগলি। উত্তেজনায় টান টান হয়ে আছে তার পেশী। বার বার টাইয়ের নট ঠিক করছেন, ভাবছেন একটা আয়না পেলে চেহারাটা একবার দেখে নেয়া যেত।

কিন্তু রেমারিক একা ফিরে এল। তার চেহারায় স্বস্তির ছাপ।

আপনার বন্ধু, মাসুদ রানা?

নেই, বলল রেমারিক। বোধহয় অপেক্ষা করাই উচিত, কি বলেন?

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করার সুযোগ হল না। মাত্র তিন মিনিট পর জ্যান্ত হয়ে উঠল রেডিও। ক্যাপ্টেন পাধানি কর্নেল গুগলিকে ডাকছে– আর্জেন্ট কল।

.

গ্যারেজের বাইরে, ঢালের মাথায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন কর্নেল গুগলি আর পাধানি। দুজনের কারও মুখে কথা নেই। চোখের সামনে যা দেখছেন গুগলি, এ তার অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ বাইরে। অবশেষে রেমারিকের দিকে ফিরলেন তিনি। রেমারিক ওদের দিকে পিছন ফিরে রাস্তার দিকে মুখ করে রয়েছে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে গোল আকৃতির কালো পোড়া দাগ, দেখতে পেলেন গুগলি, চুনকাম করা বাড়ির দেয়ালে।

জিজ্ঞেস করলেন, আর. পি. জি. সেভেন স্ট্রোক ডি?

ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথা ঝাঁকাল রেমারিক। বলেছিলাম না, অন্য কাজেও ব্যবহার। হয় ওটা!

বিধ্বস্ত, আগুনে পোড়া গাড়ি দুটোর দিকে তাকিয়ে গুগলি বললেন, কি? না, শেষ পর্যন্ত সারকামসাইজড পেনিসের আঘাতে মারা গেল দুর্ধর্ষ বেরলিংগার! তার ঠোঁটে বিদ্রূপ মেশানো হাসির রেখা ফুটে উঠল।

.

০৯.

 বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস।

উদ্ধৃতিটা জানা আছে ডন বাকালার, এর সত্যতাও চাক্ষুষ করেছে সে। কিন্তু বন্দুকের একটা টার্গেট তো থাকতে হবে! নিজেকে তার সেই ভারোত্তোলনকারীর মত লাগল, তোলার মত কিছু পাচ্ছে না যে।

হতাশা আর নৈরাশ্য ভয়টাকে হৃষ্টপুষ্ট করে তুলল। বেরলিংগার ছিল ডান হাত, তার কূটনীতির একটা হাতিয়ার। বেরলিংগার খুন হওয়ায় একেবারে নিরস্ত্র, অসহায় লাগছে নিজেকে। ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে সে, কিন্তু ট্যানডন আর বোরিগিয়ানোর চোখকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব নয়। ডেস্কের ওধারে বসে টান টান। পরিবেশ থেকেই যা বোঝার বুঝে নিচ্ছে তারা। ডন বাকালার ভয় আর অসহায় বোধ হতভম্ব করে তুলেছে তাদেরকে, গভীর দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে তারা।

কিন্তু তবু বাকালা তাদের বস্। যা কিছু আছে তাদের ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, সম্পদ, উচ্চাশা–সবই বাকালার ক্ষমতার সঙ্গে এক সুতোয় বাঁধা। তাদের অন্য, কোন গতি নেই।

নির্দেশগুলো মন দিয়ে শুনছে তারা। ভিলা কোলাসির সিকিউরিটি আরও জোরদার করতে হবে। দুদিন আগে হলে বসের এই নির্দেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিত না। ভিলা কোলাসি বিশাল কোন ব্যাপার নয়, ছয়জন সশস্ত্র গার্ডের পাহারা দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু আতুনি বেরলিংগারের মৃত্যু, মৃত্যুর ধরন, তাদের একটা চোখ। খুলে দিয়েছে। আরেকটা চোখ খুলেছে ডেস্কে পড়ে থাকা মোটাসোটা ডোশিয়েটা। একজন লোক সম্ভব-অসম্ভব, কত বিচিত্র কৌশলে ধ্বংস সাধন করতে পারে, কি ভয়ঙ্কর প্রত্যয় নিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে যে-কোন মাপের প্রতিরোধ ব্যবস্থা, ওই ডোশিয়ে না পড়লে বিশ্বাস করা কঠিন। ধ্বংস, বিনাশ, হত্যা আর রক্তপাত নিয়েই তাদের কারবার, কিন্তু এই লোকের তুলনায় তারা যেন এখনও মায়ের কোলে পড়ে দুধ খাচ্ছে।

বাইরে পাঁচিল, তার ওপাশে আরও দুশো মিটার জায়গায় ফ্লাডলাইটের আলো। চাই। আশেপাশে যত বিল্ডিং আছে সব কেনা শেষ, এবার ওগুলোকে বুলডোজার। দিয়ে মাটির সঙ্গে সমান করে দিতে হবে। ভিলার ভেতর প্রতি ইঞ্চিতে টহল পার্টির পা পড়বে, পালা করে রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা পাহারায় থাকবে ওরা। নিউ ইয়র্ক থেকে যে চারজন এক্সপার্ট গেরিলা এসেছে, প্রত্যেক টহল পার্টির সঙ্গে ওদের একজন করে থাকবে। কুকুর জোড়া আজই এসে পৌঁছুবে, ভিলার সবার গন্ধ নিতে দেয়া হবে ওগুলোকে। যার গন্ধ চিনতে পারবে না, ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে। ফেলবে তাকে। সব মিলিয়ে বিশ বাইশ জন বডিগার্ড, তিন শিফটে কাজ করবে। ওরা। গেটে দুজন গার্ড থাকবে, তাদের একজন হবে মার্কিন গেরিলা। ভিলার গেট থেকে আধ কিলোমিটার দূরে একটা রোডব্লক থাকবে। তল্লাশি ছাড়া কোন। গাড়ি ওই রোডব্লক পেরোতে পারবে না। রোডব্লকে ছজন লোক থাকবে, দুজন। গাড়ি সার্চে এক্সপার্ট। কোন গাড়ি ভিলার ভেতর ঢুকতে পারবে না। অন্য কোন। ডন বা তাদের প্রতিনিধি ভিলায় ঢুকতে চাইলে, আধ ঘন্টার ভেতর একজনের বেশি ঢুকতে পারবে না, তাদের প্রত্যেককে নিখুঁতভাবে সার্চ করতে হবে কাপড়চোপড় খুলে নিয়ে। তারা ভিলার ভেতর ঢুকলেও, বাকালার সঙ্গে দেখা। করার জন্যে খাস কামরায় বা কামরার কাছাকাছি তাদের নিয়ে আসা যাবে না– যদি না বাকালা অনুমতি দেয়। পাচিলের ভেতর পঁচিশটা ফলের গাছ রয়েছে, সব কেটে ফেলতে হবে।

এবার পরিস্থিতির আরেক দিক নিয়ে চিন্তা-ভাবনা। সিসিলিতে ঢোকার প্রতিটি পয়েন্টে কড়া নজর রাখতে হবে। নগণ্য জেলেদের গ্রাম থেকে শুরু করে প্রতিটি পোর্ট, প্রতিটি এয়ারস্ট্রিপ, প্রতিটি ট্রেন আর প্রতিটি রাস্তায় সশস্ত্র লোক থাকবে। সন্দেহজনক কাউকে দেখলেই আটক করতে হবে, বাধা দিলে গুলি। প্রতিটি ফেরিতে, প্রতিটি ফেরিঘাটে লোক চাই।

বাকালার বুলেট আকৃতির মাথায় খাড়া হয়ে আছে চুল, চোখ কুঁচকে কর্কশ গলায় জানতে চাইল, পুলিস? কারাবিনিয়ারি? এখনও তারা কিছু করছে না?

একে করা বলে না, জবাব দিল ট্যানডন। বেরলিংগার খুন হবার পর রোমে। নামমাত্র রোডব্লক দেখা গেছে–তা-ও ঘন্টা কয়েক পর। পুলিসকে সর্তক থাকতে। বলা হয়েছে, বাঙালিটার চেহারার বর্ণনাও পেয়েছে তারা। কিন্তু তার আসল পরিচয় প্রকাশ করেনি, ফটোও ইস্যু করেনি।

বাস্টার্ডস! খেঁকিয়ে উঠল বাকালা। বানচোত গুগলিটার শয়তানি বুদ্ধি এসব। আমাদের বিপদে খুব মজা পাচ্ছে শালারা। বাস্টার্ডস!

আজ সকালে পালার্মোয় পৌচেছে সে, বোরিগিয়ানো বলল।

সাথে পাধানি, আর সেই নিয়াপলিটানটা, বাকলা দাঁতে দাঁত চাপল। বাস্টার্ডর্স! ওই শালা রেমারিকটাকে কোনভাবে ধরে আনা যায় না?

বোরিগিয়ানো দ্রুত মাথা নাড়ল। হিলটনের একই স্যুইটে তিনজন রয়েছে, রেমারিককে মুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল করে না ওরা। ওকে ধরে আনতে হলে গুগলি আর পাধানিকে মারতে হবে।

তা সম্ভব নয়, প্রশ্নই ওঠে না, তীব্র প্রতিবাদ জানাল ট্যানডন। পুলিসের গায়ে হাত দেয়া মানে গোটা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা–একবার শুরু হলে তার আর শেষ নেই।

চেহারায় অনিচ্ছার ভাব নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল বাকালা। গুগলিও ব্যাপারটা বোঝে।

বোঝে বলেই তো এই সুযোগে খোঁচা দিচ্ছে, বলল বোরিগিয়ানো। সে পালার্মোয় বসে থাকলে কি হবে, তার লোকেরা সারা দেশ জুড়ে আমাদের ঘাটিতে হানা দিচ্ছে। জেরা করার জন্যে এমনকি গামবেরিকেও নিয়ে গিয়েছিল ওরা। নার্ভাস বোধ করছে সে।

পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে গুগলি, বলল ট্যানডন। উত্তরে আর. রোমে। বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। আমাদের লোকদের মধ্যে গুজব ছড়াচ্ছে গুগলি, তাদের মাথা কাটা গেছে, অথচ প্রোটেকশন দেয়ার জন্যে নেই কেউ।

সামনের দিকে ঝুঁকে ডোশিয়েটা খুলল বাকালা। রানার একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি খুঁটিয়ে দেখল। ঠোঁট, জিভ, টাকরা, গলা, সব শুকিয়ে গেছে তার। ছবির ওপর টোকা দিয়ে বলল, এ লোক মারা না যাওয়া পর্যন্ত সমস্যা শুধু বাড়তেই থাকবে। মুখ তুলল সে, উদাত্ত আহ্বান জানাবার ভঙ্গিতে বলল, একে যে খুন করবে, তার কোন অভাব থাকবে না–জীবনের সমস্ত সাধ বিনা আয়াসে ভোগ। করতে পারবে সে। আমি তাকে সাত রাজার সম্পদ দান করব। বুঝতে পারছ তোমরা?

নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল ট্যানডন আর বোরিগিয়ানো।

আমার এই ঘোষণা প্রচার করে দাও, নির্দেশ দিল বাকালা। ওদের জন্যে আরও একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। ডোশিয়ে থেকে রানার ছবিটা বের করে ডেস্কের উপর ছুঁড়ে দিল সে। কাল সকালের সবগুলো কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় এই ছবিটা দেখতে চাই আমি।

প্রথমে সামলে উঠল ট্যানডন। ডন বাকালা! ওরা তাহলে পুরো ঘটনাটা জেনে ফেলবে–সেটা কি চাই আমরা?

শেষ পর্যন্ত জানবেই ওরা, গডফাদার বলল। এরইমধ্যে প্রায় সবটা জেনে। ফেলেছে। শুধু গুগলি আর তার ডিপার্টমেন্ট চেপে রেখেছে বলে পুরোটুকু ফাস হতে দেরি হচ্ছে। ছবিটার দিকে আরেকবার তাকাল সে। শালার চেহারায়। বৈশিষ্ট্য আছে, চোখ দুটো দেখ, কাটা দাগগুলো দেখ–দেখলেই চিনতে পারবে মানুষ। আমাদের নিজেদের লোক থাকবে রাস্তাঘাটে, কয়েক হাজার তাদের চোখকে ফাঁকি দেবে কিভাবে? সবখানে ছবিটা পৌঁছুতে এক দিন লাগবে। আমাদের হয়ে কাগজগুলোই করবে কাজটা।

আপনি ওকে হিরো বানিয়ে ছাড়বেন, সাবধান করে দিয়ে বলল ট্যানডন।

হিরো মারা যাবে, ধমকের সুরে বলল বাকালা। মরা লোককে বেশিদিন মনে রাখে না কেউ।

এ-প্রসঙ্গে আর কোন আলোচনা হল না। ট্যানডন বলল, এই শালা বাঙালির বস যে নির্দেশ দিয়েছে…

বাকালা বাধা দিয়ে বলল, সেটা তার কাছে পৌঁছায়নি। রোমে গুগলিকে নিয়ে গিয়েছিল রেমারিক, কিন্তু দেখা পায়নি তার।

আমি আশা করেছিলাম, বলল বোরিগিয়ানো। সি. আই. এ. যখন শালার ওপর খেপে আছে, ওর পরিচয় ফাস হয়ে যাবার পর ওরাই আমাদের হয়ে কাজটা করে দেবে। কিন্তু এখন দেখছি…

ইটালিতে আমরা বিপদে পড়েছি দেখে গোটা মার্কিন প্রশাসন আনন্দে বগল বাজাচ্ছে, বলল বাকালা। কংগ্রেস আর সিনেটের কিছু প্রভাবশালী সদস্য চাপ দেয়ায় সি. আই. এ. কর্মসূচী পাল্টাতে বাধ্য হয়েছে। ওরা আশা করছে ওদের কাজ আমরাই করে দেব, আর আমরা যদি খতম হয়ে যাই তাহলে তো আরও ভাল।

ইনফরমেশন আরও একটা আছে, গম্ভীর সুরে বলল ট্যানডন। পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার জানা যায়নি, তবে আভাস পাওয়া গেছে, প্রয়োজনে বাঙালিটাকে যুক্তরাষ্ট্রে লুকিয়ে থাকার সুযোগ দেয়া হবে–আনঅফিশিয়ালি। আরও গুজব, বিশ্ব ব্যাংক নাকি কি একটা প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হয়ে আছে, লোকটা কোথায়। জানতে পারলেই…

গুজব নয়, বলল বাকালা। ওপর মহল থেকে নির্দেশ পেয়ে সি. আই. এ.-ই ব্যবস্থাটা করেছে। প্রস্তাবটা সরাসরি সি. আই. এ. দিলে গ্রাহ্য না-ও হতে পারে, তাই বিশ্ব ব্যাংকের মাধ্যমে দেয়া হবে প্রস্তাব। ওকে ওরা মাথায় তুলতে যাচ্ছে। বিশেষ কি একটা দায়িত্ব দেয়া হবে। আসলে…

প্রস্তাবটা কি জানা গেছে? জিজ্ঞেস করল বোরিগিয়ানো।

নিশ্চয়ই প্রোটেকশনের অফার, বলল বাকালা। আমাদের নাগাল থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবার প্ল্যান।

তারমানে ওদেরও ধারণা আমাদের হাত থেকে নিস্তার নেই তার। একটু সন্তুষ্ট দেখাল বোরিগিয়ানোকে।

কিন্তু বাকালা আগের মতই গভীর আর উদ্বিগ্ন।

*

মোবেক্স থেকে বেরিয়ে এল সুসান, বিশাল কাঠামোটা লম্বা করে আড়মোড়া। ভাঙল। লম্বা হওয়ার অনেক অসুবিধে, তার মধ্যে একটা হল গাড়িতে করে কোথাও যাওয়া–হাত-পা মেলতে না পারায় আড়ষ্ট শরীর টনটন করতে থাকে। সুসানের পিছু পিছু নামল রকি। পিছন ফিরে মোবেক্সের ভেতর তাকাল সে। জিজ্ঞেস করল, তোমার কিছু লাগবে নাকি?

মাথা নাড়ল রানা। পেট পুরে খেয়ো। যদি বল, তোমাদের আমি ফিরিয়ে আনতে পারি।

না, আমরা একটু হাঁটতে চাই, বলল সুসান। কিছু কেনাকাটাও করব। চিন্তা। কোরো না, এ জায়গা আমরা ঠিকই খুঁজে বের করব।

পুব উপকূল ধরে পেসকারা থেকে বারি-তে পৌঁচেছে ওরা। সুসান ভেবেছিল, তিন দিন টিনের খাবার খেয়ে নিশ্চই অরুচি ধরে গেছে ফ্রেঞ্চ লোকটার, কাজেই সে-ও ওদের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় বসে খেতে চাইবে। কিন্তু প্রস্তাবটা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে রানা। শহরের দক্ষিণ প্রান্তে, ক্যাম্পসাইটে মোবেক্স পার্ক করেছে ওরা। কিন্তু বাইরে খুব একটা বেরোয়নি ও।

কৌতূহল চেপে রাখতে পারেনি সুসান। এক-আধটু ফ্রেঞ্চ জানে সে, প্রথম রাতে রানাকে পরীক্ষা করার জন্যে দুএকটা প্রশ্ন করে সে। মুচকি একটু হাসে। রানা, ফ্রেঞ্চ ভাষায় অনর্গল জবাব দেয়। এরপর সুসান ভাষা বদল করে, কিন্তু ইংরেজিতেও চমৎকার কথা বলে রানা, মুচকি হাসিটুকু ঠোঁটে লেগেই ছিল। ইংরেজিতেই রানা জিজ্ঞেস করে, তুমি কি আমাকে পরীক্ষা করছ?

না, একটু অপ্রতিভ দেখায় সুসানকে। তবে তোমাকে আমার কেন যেন ঠিক ফরাসী বলে মনে হয় না।

ধমক লাগাল রকি, সুসানকে বলল, এত বকবক কোরো না তো। কিন্তু সুসানের কৌতূহল থেকেই গেল।

রোমের ক্যাম্পসাইটে পায়ে হেঁটে পৌচেছিল রানা, এক হাতে প্রকাণ্ড লেদার স্যুটকেস, আরেক হাতে একটা ক্যানভাস ব্যাগ। সরু দরজা দিয়ে ওগুলো ঢোকাবার সময় ওকে সাহায্য করল রকি। পরে সে সুসানকে বলে, স্যুটকেসটায় কি আছে কে জানে, অসম্ভব ভারি।

ওদের সঙ্গে বিশেষ কথাও বলে না লোকটা। তবে তার উপস্থিতি অস্বস্তিকর লাগে না।

.

ওখানে, দেখ, একটা বুটিক। ব্যস্ত রাস্তার ওপারে সার সার দোকান, সেদিকে হাত তুলল রকি।

আর ওখানে একটা রেস্তোরাঁ, বলল সুসান, তার দৃষ্টি আরও খানিকটা সামনে। আগে খাব, খিদেয় মরে যাচ্ছি। তাছাড়া, খাওয়াদাওয়ার পর আমার হয়ত আরও বড় সাইজ দরকার হবে।

এরচেয়ে বড় সাইজ তৈরি হয় না, বলেই কাঁধ আর মাথা সরিয়ে নিল রকি, জানে, ঠাট্টার ছলে যে কিলটা মারবে সুসান, রোগা শরীরটা ছিটকে পড়ে যেতে পারে ফুটপাথের ওপর।

কিন্তু সুসান কিল তুলল না। একটা নিউজস্ট্যাণ্ডের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আছে ওরা; সেদিকে তাকিয়ে আছে সুসান, চোখ দুটো রিস্ফারিত। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে রকিও তাকাল।

রানার বয়স্ক চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকল ওরা। প্রায় বারোটা দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে ছবিটা।

এক ঘন্টা পর। দুজন মহাতর্ক জুড়ে দিয়েছে। রকির একই কথা, বিপদ থেকে দূরে সরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।

 তোমার ব্যাগে টাকা আছে, পাসপোর্ট আছে, আর কি চাই? জিজ্ঞেস করল। সে। সোজা রেলস্টেশনে যাই চল, ট্রেনে উঠে কিছু মুখে দিয়ে নেব। যা কিছু কেনার, ব্রিন্দিসিতে গিয়ে কিনলেই হবে। কাল সকালে ফেরিতে উঠে রওনা হয়ে যাব গ্রীসে।

কিন্তু সুসানেরও একই জেদ। আমি কোথাও যাচ্ছি না।

রাস্তা থেকে খানিকটা দূরে, ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ওরা। হাঁটতে হাঁটতে কোথায় চলে এসেছে, জানে না। সুসান, এই ভাবাবেগের কোন মানে হয় না, বলল রকি। লোকটা খুনী। আমরা তার কাছে কোনভাবে ঋণী নই। টাকা দিয়েছে, বদলে মোবেক্স পেয়েছে। বুঝতে পারছ না, ও আমাদেরকে কাভার। হিসেবে ব্যবহার করছে!

আবার মাথা নাড়ল সুসান। হাতের কাগজটা সুসানের চোখের সামনে ধরল। রকি। ভাল করে দেখ চেহারাটা। ওকে এখন হাজার হাজার লোক খুঁজে বেড়াচ্ছে। যখন খুঁজে পাবে, ওর সঙ্গে আমাদের থাকা উচিত হবে না। এই সহজ কথাটা তুমি বুঝতে পারছ না?

রকি ওয়াট, তোমার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই, থমথমে গলায় বলল। সুসান।

একাই হাঁটা ধরল সে। অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে তার পিছু নিল রকি। আবার ওরা ব্যস্ত শহরে ফিরে এল। একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকল সুসান, পিছু পিছু রকি। বেয়ারাকে ডেকে দুজনের জন্যে খাবার অর্ডার দিল সুসান।

খাওয়া শেষ হবার পর বিস্ফোরিত হল সে। রকির দিকে ঝুঁকে চাপা গলায় বলল, হ্যাঁ, সত্যি কথা, লোকটা আমাদেরকে ব্যবহার করছে। কিন্তু কেন করবে না বলতে পার? ওর পিছনে কি একটা সেনাবাহিনী আছে? নেই। সরকার ওকে সাহায্য করছে? না। লোকটা কি গুণ্ডাদলের সর্দার, তার শিষ্য আছে কয়েক হাজার? না, নেই। লোকটা কি দেবতা? না। তাহলে কি সে? কে সে? একজন। মানুষ, সাধারণ একটা লোক। স্রেফ একা। কি করছে সে? একটা অতি জঘন্য, অতি ঘৃণ্য, অতি নিষ্ঠুর অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ওকে খুনী বললে পাপ হবে, রকি। গলা ধরে এল সুসানের। বলল, হাজার হাজার লোক খুঁজছে ওকে। পুলিসের কথা ভুলে যাচ্ছ কেন? বুঝতে পারছ না, ওর সাহায্য দরকার। আর কারও কথা জানি না, আমি ওকে সাহায্য করব। বিপদের কথা বলছ? ওকে সাহায্য করতে গিয়ে যদি মারাও যাই, দুঃখ কিসের, স্বর্গে তো যাবই যাব। হ্যাঁ, বলতে পার. খানিকটা পুণ্যের লোভেই ওকে আমি সাহায্য করতে চাইছি। এইটুকুই আমার স্বার্থ।

অন্য দিকে তাকিয়ে আছে রকি, নির্লিপ্ত। আসলে চোখের পানি লুকাচ্ছে সে।

ভেবে দেখ, রকি, কচি মেয়েটাকে শুধু খুন করেনি ওরা, দুজন মিলে যখনই ইচ্ছে হয়েছে বারবার রেপ করেছে। ওর জায়গায় আমাকে কল্পনা কর। তেরো। বছর বয়স আমার, দুনিয়াদারি ভাল বুঝি না। আমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে রেপ করতে করতে মেরে ফেলা হল।

সুসানের দিকে তাকাল রকি, নিঃশব্দে হাসছে, চিক চিক করছে খুদে চোখ দুটো। ঠিক আছে, বীরাঙ্গনা হস্তিনী, এবার একটু শান্ত হও।

ভুরু কুঁচকে রকিকে কয়েক সেকেণ্ড দেখল সুসান। তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি রাজি?

হ্যাঁ।

হঠাৎ এই পরিবর্তন কেন?

কাঁধ ঝাঁকাল রকি। হঠাৎ নয়। সাহায্য আমিও করতে চাই, কিন্তু এতে বিপদ। আছে। একজন পুরুষকে যা মানায়, একটা মেয়েকে তা মানায় না।

হাত বাড়িয়ে রকির কটা রঙের চুল এলোমেলো করে দিল সুসান। ওরে শয়তান! আমাকে গ্রীসে পাঠিয়ে দিয়ে ওর কাছে ফিরে যাবার মতলব ছিল তোমার!

রাস্তায় বেরিয়ে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল রকি। আচ্ছা, আমরা সব কথা জানি, টের পেলে ওর প্রতিক্রিয়া কি হবে? আমরা বেঈমানী করতে পারি ভেবে ও যদি কোন ব্যবস্থা নেয়?

রকির কোমর জড়িয়ে ধরল সুসান। সে-ধরনের কিছু ঘটবে না। আমরা মন্দ লোক নই, ও বুঝবে। আর, যতই বদরাগি বা নিষ্ঠুর হোক, ওকে আমি ভয় পাই না।

ভয় পাও না? রকির চোখে অবিশ্বাস।

সুসান হাসতে লাগল। ভয় পাব কেন? আমাকে দেখার জন্যে তুমি আছ না!  

ফোনের রিসিভার নামিয়ে রেখে পাধানি আর রেমারিকের দিকে ফিরলেন গুগলি। কাজটা বাকালার, বললেন তিনি। সবগুলো কাগজ একই সময়ে ইনফরমেশনটা পেয়েছে।

কিন্তু কেন? জানতে চাইল রেমারিক।

উত্তর যোগাল পাধানি, এ থেকে বাকালার মনের অবস্থা টের পাওয়া যায়। সবাইকে রানার চেহারা দেখাবার এটাই ছিল সবচেয়ে সহজ উপায়। কর্নেলের দিকে ফিরল সে। এখন আমরা কি করব, স্যার?

গুগলি ইতস্তত করছেন।

প্রাইভেটলি কথা বলতে পারলে বোধহয় ভাল হত, স্যার, বলল পাধানি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেমারিকের দিকে তাকালেন গুগলি, মাথা নাড়লেন। তার কোন দরকার নেই, পাধানি। ওদের দিকে পিছন ফিরে ফোনের রিসিভার। তুললেন, ডায়াল করলেন রোমে, কারাবিনিয়ারি হেডকোয়ার্টারের নাম্বারে। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে নির্দিষ্ট কয়েকটা নির্দেশ দিলেন তিনি। তারপর রিসিভার রেখে দিয়ে রেমারিকের দিকে ফিরলেন।

আপনাকে বিশ্বাস করা আমার উচিত হয়নি, ঝঝের সঙ্গে বলল রেমারিক। রেগে গেছে সে।

হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন গুগলি। এতে কিছু এসে যায় না। রানাকে যদি বাকালার লোকেরা খুঁজে না পায়, আমাদের লোকেরাও পাবে না।

কিন্তু আপনার ওপর নির্দেশ আছে, ওকে দেশত্যাগ করার সুযোগ করে দিতে হবে, বলল রেমারিক। অথচ আপনি নির্দেশ দিলেন ওকে দেখা মাত্র গ্রেফতার করে হেডকোয়ার্টারে…

যার জন্যে চুরি করি সেই বলে চোর! আবার ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন গুগলি। নিচু কফি টেবিলে একটা খবরের কাগজ মেলা রয়েছে, সেটার দিকে ঝুঁকে পড়লেন তিনি। মাথা গরম না করে, আসুন, ওর অবস্থাটা ভেবে দেখি। সত্যি কথা বলতে কি, মেজর জেনারেল রাহাত খানের সাথে আমি একমত, রানার এখন আর কোন সুযোগ নেই। ওর এই নকল চেহারা লুকিয়ে রাখার নয়, লোকে দেখলেই চিনে ফেলবে। বাকালা পুরস্কার ঘোষণা করেছে–কি কি দেয়া হবে? নিউইয়র্কে একটা বাড়ি, সিসিলিতে একটা চালু রেস্তোরাঁ, নগদ এক বিলিয়ন লিরা। যা-শালা…আমারই তো লোভ হচ্ছে! সারা জীবন আর কাজ না করলেও চলবে। তাই বলছি, আসুন, চেষ্টা করি, ওদের আগে আমরা যাতে ওকে খুঁজে পাই।

কথা না বলে খোলা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রেমারিক। নিচের ব্যস্ত রাস্তার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।

রেমারিক, বিশ্বাস করুন–রানার এখন বাঁচার আশা খুব কম। ওকে গ্রেফতার করার জন্যে এখন আমরা সাধ্যের বাইরে চেষ্টা করব, কথাগুলো প্রায় আবেদনের সুরে বললেন গুগলি। বসূকে পাধানি আগে কখনও এভাবে কথা বলতে শোনেনি। কিন্তু এ-ও জানি, গ্রেফতার এড়াবার সব রকম চেষ্টা করবে সে। সেজন্যেই নির্দেশ। দিয়েছি, দরকার হলে পায়ে গুলি করা যাবে।

ওদের দিকে না ফিরেই রেমারিক বলল, এখন তো গ্রেফতার করবেনই। মাফিয়া জগতটাকে প্রায় গুঁড়িয়ে দিয়েছে ও, মস্ত উপকার করেছে আপনাদের, কিন্তু সে-কথা মনে রাখার দরকার নেই। গুলি করুন ওকে, গ্রেফতার করে জেলে পাঠান, সবাই আপনার কৃতিত্ব দেখে হাততালি দেবে। কর্নেল থেকে জেনারেল। হবেন আপনি…

 কর্নেলকে কঠোর দেখাল। কে তাকে খুন করার জন্যে উৎসাহ দিয়েছে? আমি? কে তাকে অস্ত্র যোগান দিয়েছে? আমি? জাল কাগজ-পত্র, ট্রান্সপোর্ট, সেফ-হাউসের ব্যবস্থা কে করেছিল? আমি? বলুন, জবাব দিন!

ঘুরে গুগলির দিকে তাকাল রেমারিক। দুজুনই উত্তেজিত, এই প্রথম। ঠিক। আছে, স্বীকার করছি! বলল রেমারিক। হ্যাঁ, ওকে আমি সাহায্য করেছি, আর। সেজন্যে আমি অনুতপ্তও নই। পরিস্থিতি অন্য রকম দেখে আপনাকে আমি বিশ্বাস করি। ভেবেছিলাম আপনি কথার মর্যাদা রাখতে জানেন। কিন্তু এখন দেখছি। আমারই ভুল হয়েছিল।

এতক্ষণে মুখ খুলল পাধানি, আপনি ভুল করছেন, রেমারিক। খুব বড় ভুল করছেন। রানার ব্যাপারে কর্নেলের ব্যক্তিগত কোন দায়-দায়িত্ব নেই। কিন্তু, আমি। জানি, তার প্রতি কর্নেলের সহানুভূতি আছে। তার জন্যে, তার ভালর জন্যে সম্ভাব্য সব কিছু করবেন উনি। সব কিছু।

 একটু নরম হল রেমারিক। রানা আপনাদের উপকার করেছে, এ-কথা তো সত্যি?

মাথা ঝাঁকালেন গুগলি। হ্যাঁ–মস্ত উপকার করেছে। অন্য কারও কাছে এ কথা আমি স্বীকার করব না। বেরলিংগারকে খুন করে আমাদের কাজ পানির মত সহজ করে দিয়েছে সে। আমি কল্পনাই করিনি, বাকালা এতটা ঘাবড়ে যাবে। রানা। যদি এখন তাকে না-ও ছুঁতে পারে, তবু তার ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যাবে। অর্গানাইজেশনের মেইনল্যাণ্ড শাখাগুলো এরই মধ্যে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। শুধু এখানে, সিসিলিতে, এখনও তার ক্ষমতা টিকে আছে, কিন্তু তা-ও দিনে দিনে কমতে থাকবে।

একটা সিগারেট ধরাল রেমারিক, তার হাত এখন আর কাঁপছে না।

এদিকে আসুন, রেমারিক, নরম সুরে ডাকলেন গুগলি। এখানে বসুন। রানার খোঁজ পাওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু আপনিই তার মন বোঝেন। সে এখন কি করবে, ভেবে বের করুন। কিভাবে হামলা করবে সে? কোন পথে পৌঁছুবে?

ধীর পায়ে এগিয়ে এসে টেবিলে বসল রেমারিক। প্ল্যানটা আবার আমাকে দেখতে দিন।

দৈনিকটা সরাতেই নিচে দেখা গেল ভিলা কোলাসির বড় একটা স্কেল প্ল্যান। ভিলার আশপাশের এলাকাও বেশ কিছুটা দেখানো হয়েছে স্কেচে। তিনজনেই ঝুঁকে পড়ল ওরা। প্ল্যানে একটা আঙুল রাখলেন গুগলি।

আজ সকালে আমরা জেনেছি, বাগান আর পঁচিলের মাঝখানে অনেকগুলো গাছ কেটে ফেলেছে বাকালা, একটা প্যাসেজ তৈরি করার জন্যে। সেই সঙ্গে ফ্লাডলাইটের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। পাঁচিল থেকে বাইরের দিকে কয়েক শো মিটার এলাকায় দিনের মত আলো থাকবে।

পাঁচিলের ভেতর দিকে? জিজ্ঞেস করল রেমারিক।

মাথা নাড়লেন গুগলি। না। বোঝাই যাচ্ছে, ভিলাটাকে আলোকিত করতে চায় না। রাতের বেলা বাগান, উঠন, লন, সব অন্ধকার থাকবে। সিকিউরিটিতে কোন খুঁত নেই। দুটো গার্ড-কুকুর আমদানি করা হয়েছে–ডোবারম্যান-শিকারি কুকুর, খুন করার ট্রেনিং পাওয়া।

পাধানি বলল, এতগুলো বাধা পেরিয়ে ভেতরে ঢোকা সম্ভব নয়। গেটে থাকবে দুজন গার্ড, প্রত্যেকের কাছে সাবমেশিনগান। পঁচিলের ভেতর সব মিলিয়ে বিশজন, তাদের হাতেও ওই সাবমেশিনগান। কোন গাড়িকে ভিলার কাছেপিঠে ঘেঁষতে দেয়া হবে না।

গম্ভীর এক চিলতে হাসি দেখা গেল রেমারিকের ঠোঁটে। এ-সব বাধা আশা করছে রানা। ভিলা, আর গ্রাউণ্ডের লে-আউট জানা আছে তার। সে একজন সৈনিক এবং একজন গুপ্তচর; আর বাকালা একটা গর্দভ। ঘোরাঘুরির মধ্যে থাকলে অনেক বেশি নিরাপদে থাকত সে, কিন্তু তা না করে ছোটখাট একটা জায়গায়। আটকে রেখেছে নিজেকে। ভিলার ভেতর ছোটখাট একটা সেনাবাহিনী থাকবে, তা রানাও জানে। একবার যদি ভেতরে ঢুকতে পারে ও, ওই সেনাবাহিনী বাকালাকে রক্ষা করতে পারবে না।

কিন্তু ভেতরে সে ঢুকবে কিভাবে? জানতে চাইলেন গুগলি।

তা আমি জানি না, বলল রেমারিক। তবে প্ল্যান একটা নিশ্চয়ই আছে তার। এইটুকু বলতে পারি, সেটা সাধারণ কোন প্ল্যান হবে না।

পাধানি বলল, অগাস্টিন মারা গেল পিস্তলে, এলি গেল শটগানে, ফনটেলা মরল বোমায়, বেরলিংগার ধ্বংস হল অ্যান্টিট্যাঙ্ক মিসাইলে, কর্নেলের দিকে তাকাল সে, এখন প্রশ্ন, বাকালাকে কি দিয়ে মারবে সে?

সবাই চিন্তামগ্ন। প্রথমে নড়েচড়ে বসলেন কর্নেল গুগলি। ক্ষীণ একটু হাসির রেখা দেখা গেল তার ঠোঁটে। বললেন, কি জানি! তবে নেতাদের নেতা এখন যদি মাটি খুঁড়ে ফলআউট শৈলটার তৈরিতে হাত দিয়ে থাকে, একটুও অবাক হব না।

.

ওই আরেকটা!

এইমাত্র একটা আলফা রোমিও ওভারটেক করল ওদের, সেটার দিকে হাত তুলল সুসান। আলফা রোমিওর পিছনের জানালায় একটা স্টিকার লাগানো রয়েছে, তাতে তিনটে শব্দ ছাপা রয়েছে, এগিয়ে যাও, রানা!

প্রথম ঢেউটা উঠেছে ইটালিতে নয়, আমেরিকায়। ইটালিতে মাফিয়ার কিছু হলে বা মাফিয়া কিছু করলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খবর চলে যায় মার্কিন মুলুকে ওখানকার মাফিয়া, সরকারী প্রশাসন, আর জনসাধারণের মধ্যে দ্রুত প্রতিক্রিয়াও দেখা দেয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এর একটাই কারণ, ওখানেও মার্কিন সরকার আর জনসাধারণ মাফিয়াদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে আছে। আনি। বেরলিংগার মারা যাবার পর সবগুলো টেলিভিশন আর রেডিও স্টেশন নির্ধারিত অনুষ্ঠান বন্ধ করে খবরটা প্রচার করে। ওখানকার মাফিয়া মহলে বিষাদের ছায়া। নামে, আর আক্ষরিক অর্থেই জনসাধারণের মধ্যে নামে আনন্দের ঢল। রাতারাতি স্টিকার ছাপাবার ধূম পড়ে যায়। যুব সংগঠনগুলো চাদা তোলার জন্যে রাস্তায় নেমে আসে, প্রতিটি দলের সঙ্গে একটা করে ব্যানার, তাতে লেখা একজন নিঃসঙ্গ মানবদরদীকে সহায়তা করুন–সে আহত হলে তার চিকিৎসা লাগবে, গ্রেফতার হলে আইনগত সহায়তা দরকার হবে। চার্চগুলো মাফিয়ার ওপর সবচেয়ে বেশি খ্যাপা, একশো একজন প্রিস্ট এক যুক্ত আবেদনে বললেন, দেশবাসী যেন এই শোকাভিভূত লোকটার জন্যে প্রার্থনা করে। দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী দেশ, প্রথম দিনেই কয়েক লক্ষ ডলার চাঁদা উঠল। একজন আর্মস ব্যবসায়ী ঘোষণা করল, সে একাই আড়াই লাখ ডলার দান করবে। সম্ভবত ব্যবসার সূত্রে যে পাপ সে কামিয়েছে, উপুড়-হস্ত হয়ে এটা তার খানিকটা খণ্ডাবার প্রয়াস। তার। দেখাদেখি আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী এগিয়ে এল, ঘোষণা করল মোটা অঙ্কের চাদা। বলতে গেলে, কে কত বেশি চাদা দিতে পারে, তার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল।

কিন্তু মুশকিল হল, কেউ জানে না, কোথায় পাঠাতে হবে, টাকা। বেশিরভাগ যুব সংগঠন তাদের টাকা পাঠিয়ে দিল সংবাদপত্র অফিসে। ব্যবসায়ী রানার নামে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলল, কেউ কেউ সুইস ব্যাংকগুলোয়।

তবে ইটালির মানুষ আরও কল্পনাশক্তির পরিচয় দিল। স্টিকার তো ছাপা হলই, রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিশাল আকৃতির তোরণ নির্মাণ করল তারা। তোরণের। মাথায় সোনালি জরি আর কাগজ দিয়ে কিছু না কিছু লেখা হল। একটা তোরণে পাড়ার ছেলেরা লিখল, বাঙালি বীর, লহ সালাম! রোমের সবচেয়ে চওড়া চৌরাস্তায় যে প্রকাণ্ড তোরণটা তৈরি করা হল, তার মাথায় বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকলঃ লুবনার জন্যে আমরাও কাদি!

ইটালি জুড়ে রাতারাতি গজিয়ে উঠল মাসুদ রানা ফ্যানস ক্লাব। গত দুদিন ধরে সবগুলো জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠার অর্ধেকটাই খালি থাকছে, মাসুদ রানা। ফ্যানস ক্লাবগুলো ভাগাভাগি করে কিনে নিয়েছে ওই আধ পৃষ্ঠা স্পেস। খালি জায়গার মাঝখানে ছোট অক্ষরে শুধু ছাপা হল, এই ফাঁকা জায়গা শুধু মাসুদ রানা। ব্যবহার করতে পারবেন। তার কিছু বলার থাকলে সংবাদপত্র অফিসে লিখে পাঠালে বা ফোন করলেই হবে। কিন্তু কোন দৈনিকের অফিসেই রানার কোন মেসেজ এল না।

কোথাও কোথাও বিশৃঙ্খলা, আর এক-আধটু উত্তেজনাও দেখা দিল। মিলানে খবর ছড়াল, রানা আহত হয়েছে। ছোটবড় সবগুলো হাসপাতালের সামনে প্রচণ্ড ভিড় করল মানুষ। না, হাসপাতালে রানা আছে কিনা জানতে আসেনি তারা। এসেছে রক্ত দান করবে বলে। ভিড় হটাবার জন্যে অবশেষে লাঠি চার্জ করল পুলিস, কাঁদানে গ্যাস ছাড়ল। আহত হল বেশ কয়েকজন।

এ-পর্যন্ত বত্রিশটা তোরণ দেখতে পেয়েছে ওরা। তোরণ আর স্টিকারের। লেখাগুলো একটা কাগজে টুকে রাখছে সুসান। ব্রিন্দিসি ছাড়িয়ে শহরতলীতে চলে এসেছে মোবেক্স।

খবরের কাগজে রানার ছবি ছাপা হবার পর তিন দিন পেরিয়ে গেছে। মোবেক্সে ঢুকে কাগজটা রানার সামনে মেলে ধরে সুসান, বলে, দেখ তো, কার ছবি চিনতে পার কিনা।

নিজের ছবির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মুখ তুলল রানা।

সবগুলো দৈনিকে ছাপা হয়েছে, বলল রকি। পুরো গল্পটা সহ। তোমার এই কদর্য চেহারা ইটালির যেখানেই দেখাবে, সাথে সাথে চিনে ফেলবে সবাই। টিভিতেও নিশ্চই দেখানো হচ্ছে।

কোন কথাই বলল না রানা। পালা করে শুধু ওদের দুজনকে দেখল।

ফ্রেঞ্চম্যান না ছাই! ঝাজের সঙ্গে বলল সুসান। আমরা প্রথমেই ধরেছিলাম। তুমি ইউরোপিয়ান নও!

ক্ষীণ একটু হাসি দেখা গেল রানার ঠোঁটে।

উত্তেজনা একটু হালকা হল। সাহায্যের প্রস্তাবটা এল সুসানের কাছ থেকে, ওরা দুজনেই রানার নিরাপত্তার জন্যে কিছু করতে চায়। কিন্তু মাথা নাড়ল রানা, সে রাজি নয়। পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। বিপদ এখন খাড়ার মত মাথার ওপর ঝুলছে। আমি যা বলছি তাই হবে, বলল রানা। ব্রিন্দিসিতে পৌঁছে ট্রেন। ধরবে তোমরা, তারপর ফেরিতে উঠে গ্রীসে চলে যাবে। আমার পথ আমি ঠিকই বের করে নেব। আমার সাথে তোমাদের কোন সম্পর্ক নেই।

কিন্তু কে শোনে কার কথা। সুসান আর রকি কোন যুক্তি মানতে রাজি নয়। রানার সঙ্গে এক ঘন্টা তর্ক করল ওরা। রানা একা হয়ে গেলে, ওকেই মোবেক্স। চালাতে হবে–লোকের চোখে না পড়ে উপায় থাকবে না ওর। কিন্তু সঙ্গে ওরা। থাকলে, সমাবেক্সের ভেতর লুকিয়ে থাকতে পারবে রানা, ইটালির যে-কোন। জায়গায় ওকে পৌঁছে দিতে পারবে তারা। অবশেষে ওদের জেদের কাছে হার। মানতে হল রানাকে। ও শুধু রেগিয়ো পর্যন্ত যেতে চায়, তবে তিন দিনের মধ্যে। নয়। ওকে রেগিয়োতে পৌঁছে দিয়ে সমাবেক্স নিয়ে চলে যাবে ওরা–ওটা তখন। আর ওর দরকার হবে না।

জোর করে টাকা ফেরত দিতে চাইল ওরা, কিন্তু.এবার রানার জেদের কাছে। হার মানতে হল ওদেরকে। সাহায্যের বিনিময়ে মোবেক্সটা রানার উপহার হিসেবে নিতে হবে ওদের। এটাই তার শর্ত।

বারির ক্যাম্পসাইটে আরও দুটো দিন ছিল ওরা। রাতে ব্যায়াম করার সময় ছাড়া মোবেক্স থেকে একবারও নামেনি রানা-সে-সময় সুসান আর রকি পাহারায় থেকেছে। সিসিলিতে কিভাবে ঢুকবে ও, ওদেরকে বলেনি। কথা দিয়েছে, রেগিয়োতে গিয়ে বলবে। ওরা ফেরি ধরার আগে রানার হয়ত আরেকটু সাহায্য লাগতে পারে।

চুল ছাড়া কেমন লাগবে রকিকে? জানতে চেয়েছে রানা। মানে, ছোট চুলে?

চোখ কপালে উঠে গেছে সুসানের। কোন ধারণা নেই–নিশ্চয়ই ভীতিকর একটা কিছু দেখাবে।

বাজে কথা বলবে না! চটে উঠেছে রকি। আমি দেখতে খারাপ নাকি! আমার এই চুল আর দাড়ি রাখার একটাই কারণ, মেয়েরা যাতে আমার পিছু না। নেয়। তা, আসল ব্যাপারটা কি?

কিন্তু ফাঁস করেনি রানা, মৃদু হেসে বলেছে, রেগিয়োয় পৌঁছে বলব।

গাড়ি চালাচ্ছে রকি, পাশে বসে আছে সুসান। রানার কথা ভাবছে ওরা।

যাই বল, আশ্চর্য একটা মানুষ, মন্তব্য করল সুসান। তোমার ভেতর এই বোধ কখনও জন্ম নেবে? অমন প্রচণ্ড ঘৃণা, যার ফলে ওর মত কিছু করার শক্তি পাবে মনে?

রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে সুসানের দিকে তাকাল রকি। সুসান সিরিয়াস। ব্যাপারটা নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল রকি। অনেকের মনেই এই বোধ জন্ম নিতে পারে। শুধু ঘৃণা থাকলেই তো হচ্ছে না, যোগ্যতাও থাকতে হবে, এখানেই পার্থক্যটুকু। কাগজে ওর কথা পড়েছ তুমি। ওর মত মানুষ আর কটা আছে। রাস্তায়?

তোমার কি মনে হয়, জিজ্ঞেস করল সুসান। পারবে ও? ওখানে ঢোকা সম্ভব?

ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করল রকি। পারতেও পারে। অনেক বাধা পেরিয়ে অনেক দূর চলে এসেছে–তবে, ভাগ্যটা ভাল হতে হবে। ভাগ্য অবশ্য ভালই ওর–যেমন, আমাদের সাথে দেখা হয়েছে।

রকির দিকে তাকিয়ে হাসল সুসান, তৃপ্তির হাসি।

কিছুক্ষণ পর নিস্তব্ধতা ভেঙে জিজ্ঞেস করল রকি, কি ভাবছ?

ভাবছি, আবার হাসিটা দেখা গেল সুসানের ঠোঁটে, চুল ছোট করলে কেমন দেখাবে তোমাকে।

.

১০.

কয়েকশো বছরের পুরানো দেয়াল, বুলডোজারের ধাক্কায় আধ ঘন্টার মধ্যে ফার্ম হাউসটা মাটির সঙ্গে মিশে গেল।

গরুর গাড়ির পাশে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাইকেল এগেল, সংসারের যাবতীয় জিনিস-পত্ৰ এইমাত্র গাড়িতে তোলা শেষ করেছে সে। স্ত্রী এরই মধ্যে উঠে বসেছে গাড়োয়ানের এক পাশে, তার দিকে তাকাতে পারছে না এগেল।

ভিলা কোলাসির পাঁচিলটা এখান থেকে দেখা যায়, চোখে রাজ্যের ঘৃণা নিয়ে সেদিকেই তাকিয়ে আছে এগেল। পাহাড়ের নিচে এই ছোট্ট পাথুরে জায়গাটায় কয়েক পুরুষ ধরে বসবাস করছিল ওরা। ঘরের তৈরি ঘি, পনির, মাখন ভিলার মালিককে নিয়মিত পাঠিয়েছে, অত্যাচারী লোকটা যাতে তাদের ওপর সন্তুষ্ট থাকে।

কথাটা প্রথম শুনে বিশ্বাস করেনি এগেল। ভিলার মালিক এই রকম নিষ্ঠুর কাজ কেন করবেন। গার্ডদের হাতে-পায়ে ধরেছে সে, ওদের মালিকের সঙ্গে তাকে একবার দেখা করতে দেয়া হোক। তার কাকুতিমিনতি কানে তোলা হয়নি। ভিলার মালিক নাকি কারও সঙ্গেই দেখা করছে না। শেষ কথা জানিয়ে দিয়ে চলে গেল ওরা–চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ফার্মহাউস ছেড়ে চলে যেতে হবে। কোথায় যাবে, সেটা ভিলার মালিকের মাথাব্যথা নয়।

বাপ-দাদার ভিটে থেকে উচ্ছেদ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে এগেল পরিবার। কোথায় যাবে জানে না। হাতে নামমাত্র টাকা গুঁজে দিয়ে কাগজ পত্রে সই করিয়ে নিয়েছে ওরা, ফার্মহাউসের ওপর তার কোন অধিকার নেই। ফার্মহাউসই নেই, তার আবার অধিকার।

গরুর গাড়িতে উঠে বসল এগেল, এখনও সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ভিলার পাচিলের দিকে। তার দুই চোখ থেকে উথলে উঠছে ঘৃণা। বিড়বিড় করে বলল, গো উইথ গড, মাসুদ রানা।

.

দর নিয়ে বচসা শুরু হয়ে গেল। চুল দাড়ি কাটার জন্যে সাত হাজার লিরা, মগের মুলুক পেয়েছে নাকি! কিন্তু নাপিত ব্যাটা গোঁ ধরে বসে আছে। এত চুল দাড়ি নাকি কোন বনমানুষের শরীরেও থাকে না। একঘন্টার কমে সারতে পারবে না সে। সাত হাজার লিরার এক পয়সা কমে, সে রাজি নয়।

হাতে অনেক কাজ, সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হবে, অগত্যা রাজি হতে হল রকিকে।

আসল রহস্য এখনও তার জানা হয়নি। ক্যাম্পসাইটে কাল রাতে পৌচেছে ওরা, ডিনারে বসে রানা. কি চায় ব্যাখ্যা করে বলেছে ওদেরকে। কিন্তু কেন চায়, তা বলেনি। একটু একটু করে জান, সেটাই সবার জন্যে নিরাপদ।

প্রথমে রকিকে চুল-দাড়ি কামাতে হবে। তারপর ভাল দাম দিয়ে কয়েকটা জিনিস কিনতে হবে–লেদার সুটকেস, ব্রিফকেস, বিজনেস স্যুট, সাদা শার্ট, একরঙা টাই, ফিতে লাগানো জুতো। নতুন কাপড়-চোপড় পরে হোটেল গ্র্যাণ্ডে উঠতে হবে তাকে, সবচেয়ে দামি সুইটে, তিন দিনের ভাড়া অ্যাডভান্স করবে সে। এরপর একটা গাড়ি ভাড়া নেবে রকি, ওই তিন দিনের জন্যে, সবচেয়ে ভাল যে মডেলটা পাওয়া যায়। রাতে হোটেলের ডাইনিংরূমে ডিনার খাবে সে, ওয়েটারকে সবচেয়ে দামি ওয়াইন দিতে বলবে, তারপর কফির সঙ্গে কনিয়্যাক খাবে।

তারমানে তুমি চাও রকিকে যেন একজন ধনী ব্যবসায়ী বলে মনে হয়? জিজ্ঞেস করেছে সুসান।

হ্যাঁ, ঠিক তাই।

এ যেন রূপকথার মত লাগছে, চোরা চোখে রকির দিকে একবার তাকিয়ে মন্তব্য করল সে। কাদার ব্যাঙ হঠাৎ সোনার কাঠির ছোঁয়া পেয়ে রাজপুত্র হয়ে উঠবে।

থামলে! চোখ রাঙাল রকি।

জানি, নিজেকেই চিনতে পারবে না!

চেহারায় গাম্ভীর্য আর ব্যক্তিত্ব আনার চেষ্টা করল রকি-এসবের দরকার হবে, এখন থেকে চর্চা করা ভাল।

 রাজকীয় ডিনারের পর হোটেলে নিজের সুইটে ফিরতে হবে রকিকে, ওখান থেকে ফোন করতে হবে অস্ট্রেলিয়ায়–পুরানো কোন বন্ধু, বা যে-কোন একজনের কাছে করলেই চলবে। তবে কথা বলতে হবে বিশ থেকে পঁচিশ মিনিট, তার কম নয়। রাতটা হোটেলেই কাটাতে হবে তাকে, সকালে ক্যাম্পসাইটে এসে ওদের সঙ্গে দেখা করবে।

.

রকি যখন রেগিয়োর এ্যাণ্ডে ডিনার খাচ্ছে, কর্নেল গুগলি তখন পালার্মোর হিলটনে, রেমারিক আর পাধানিকে নিয়ে গ্রিলড লামপুকা সাবাড় করছেন।

তোমার কি মনে হয়? পাধানিকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

রানা বোটে করে আসবে, বলল পাধানি। সম্ভবত ফিশিং বোটে করে– কালাব্রিয়ার কোথাও থেকে বোট যোগাড় করা তেমন কঠিন হবে না…

অসহিঞ্চু দেখাল কর্নেলকে। প্লেটের দিকে আঙুল তাক করলেন তিনি। আমি মাছের কথা জিজ্ঞেস করছি।

হাসি চাপল পাধানি; মাঝেমধ্যে বসূকে বিরক্ত করে মজা পায় সে। মন্দ নয়–তবে, একটু বেশি ভাজা হয়ে গেছে।

সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকালেন গুগলি, রেমারিকের দিকে ফিরলেন, সম্ভাবনা আছে, কোন নিশ্চয়তা আছে তা বলছি না, ক্ষীণ একটু সম্ভাবনা আছে, একদিন হয়ত পাধানি প্রমোশন পেয়ে কর্নেল হতে পারবে।

আপনি বুঝি যোগ্যতার পরীক্ষা নিলেন? জানতে চাইল রেমারিক। কিন্তু ভাল খাবারের সমঝদার হওয়ার সঙ্গে যোগ্যতার কি সম্পর্ক?

সব কিছুর সম্পর্ক, জবাব দিলেন গুগলি। মানে একটা থাকতেই হবে, তা হলে শুধু বুদ্ধিমান আর নিবেদিতপ্রাণদের বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দিতে শুরু করবে ওরা। তা যদি ঘটে, সর্বনাশ হতে বাকি থাকবে না!

তারমানে কি আপনি কর্পোরাল পদে নেমে যাবেন?

 মুচকি হেসে পাধানিকে বললেন গুগলি, দেখলে তো, আমাদের নিয়াপলিটান বন্ধুর সেন্স অভ হিউমার কি ভয়ঙ্কর?–কেন, ফিশিং বোটের কথা মনে হচ্ছে কেন?

কাধ ঝাঁকাল পাধানি। আর কি হতে পারে? কনভেনশনাল ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করার প্রশ্নই ওঠে না। প্রত্যেকটা প্লেন, ফেরি আর ট্রেনের ওপর নজর রাখা হবে। ছদ্মবেশ নেয়ায় ঝামেলা আছে, সে সুযোগ তার আছে বলেও মনে হয় না–তাছাড়া, ছদ্মবেশ নিয়ে ওই চেহারা খুব বেশি আড়াল করা যাবে না।

 আপনার কি ধারণা? রেমারিকের দিকে ফিরলেন গুগলি।

 কি জানি; বলল রেমারিক। আন্দাজ করার চেষ্টা বৃথা। অনেক ভেবেছি, কিন্তু উত্তর পাইনি। তবে একটা কথা ঠিক, এই চেহারা ও কোথাও দেখাতে পারবে না কোথাও না।

হ্যাঁ, ইটালিতে ওটা বোধহয় এখন সবচেয়ে পরিচিত মুখ। মানুষ যেভাবে নিল ব্যাপারটাকে–কল্পনাই করিনি। দেশের বাইরে থাকলে, এখানে এসব ঘটছে। শুনলে বিশ্বাস করতাম না। শুধু গতকালই দৈনিকগুলোর অফিসে এক বিলিয়নের ওপর লিরা পৌচেছে। রোমে মেয়ারা, টি-শার্ট পরছে, রানার ছবিসহ ছাপা রয়েছে, এগিয়ে যাও, রানা। ইটালির মানুষ সবাই ওর পক্ষে। কাগজগুলোর ছাপা। তিন গুণ বেড়ে গেছে, তারপরও নাকি চাহিদা মেটাতে পারছে না। এই পরিস্থিতিকে কোনমতেই স্বাস্থ্যকর বলা যায় না। মোটেও শুভলক্ষণ নয়।

এ অনিবার্য ছিল, বলল পাধানি। মাফিয়ার অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সরকারও ওদের সাথে পারে না। কাজেই এই লোককে হিরো মনে করছে। মানুষ। তাছাড়া, বীরপূজা সব সমাজেই চালু রয়েছে এখনও। যা ঘটছে, এর মধ্যে অন্তত যুক্তির কোন অভাব নেই।

আমার জন্যে সবচেয়ে বড় ধাঁধা হল, গুগলি বললেন। রানা থাকছে কোথায়? সে একা, অথচ, কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না, কি করে তা সম্ভব? রেমারিকের দিকে ফিরলেন তিনি। আপনি ঠিক জানেন, রোমের পর তার আর কোন সেফ-হাউস নেই?

আমার জানামতে নেই, বলল রেমারিক। রোমের পর কি করবে, আমাকে বলেনি। কেন, বুঝতেই পারেন।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন গুগলি। বিষণ দেখাল তাকে। আমার দুর্ভাগ্য।

দুর্ভাগ্য কেন? শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল রেমারিক। তাকে খুঁজে বের। করার এত কেন গরজ আপনার?

 গুগলি গম্ভীর হলেন। রেমারিক, বিশ্বাস করুন। আপনার বন্ধু মারা যাক, এ আমি দেখতে চাই না। আমাদের জন্যে অনেক করেছে সে। ইঙ্গিতে বেয়ারাকে ডেকে ডেজার্টের অর্ডার দিলেন। বেয়ারা চলে যেতে রেমারিকের হাতে হাত রাখলেন তিনি। কথাটা সত্যি। আপনার বন্ধুর কাছে আমি ঋণী। কি বলব, লোকটা আমাকে মুগ্ধ করেছে। একজন লোক একার চেষ্টায় এতটা করতে পারে, কেউ বললে হাসতাম। কি ঘটছে জানি, তবু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। বিশেষ করে যেভাবে সে বেরলিংগারকে মারল।

ডেজার্ট দিয়ে গেল বেয়ারা।

পাধানি জিজ্ঞেস করল, আপনি তো তার বন্ধু, আপনি বলতে পারবেন। মানুষ তো আমরা সবাই, কিন্তু ওর মত অসাধারণ কজন? কি আছে তার মধ্যে, কিসের গুণে অসাধারণ সে?

তুমি তো তার ডোশিয়ে দেখেইছ, বললেন গুগলি। আসলে, অভিজ্ঞতা আর ট্রেনিং, আর সম্ভবত, আরও কি যেন কি একটা। চোখে প্রশ্ন নিয়ে রেমারিকের দিকে তাকালেন তিনি।

হ্যাঁ, আরও কি যেন কি একটা, একমত হল রেমারিক। এ অনেকটা সেক্স অ্যাপিলের মত-ছোঁয়া যায় না। হয়ত সমস্ত গুণ আর দক্ষতা আছে, তবু এই জিনিসটার অভাব থাকতে পারে একজন মানুষের টেকনিক্যালি যতই কিনা সে। ভাল হোক। হঠাৎ কোথাও এরকম লোক দেখতে পাওয়া যায়, যার মধ্যে জিনিসটা আছে। তাকে দেখেই অনেক সময় আলাদা বলে চেনা যায়। হতে পারে জিনিসটা আর কিছু না, ইচ্ছাশক্তি আর ভাগ্যের কমবিনেশন। অভিজ্ঞ ট্রেনিং পাওয়া এক প্লাটুন সোলজার ঠিক জায়গায় পজিশন নিতে ব্যর্থ হল। অথচ একজন লোক, কি যেন কি একটা আছে তার মধ্যে, প্রথমবারই ঠিক পজিশনে দাঁড়াল।

জিনিসটা কি আপনার মধ্যে আছে? নরম সুরে জানতে চাইলেন গুগলি।

হ্যাঁ, জবাবে বলল রেমারিক। কিন্তু রানার মধ্যে আছে অঢেল–ওটাই তাকে এতদূর নিয়ে এসেছে। আর হয়ত ভিলা কোলাসির ভেতরেও নিয়ে যাবে।

ওটা কি তাকে ভিলা থেকে বের করেও আনবে? দ্রুত জানতে চাইলেন। গুগলি।

কে জানে! প্রশ্নটা অস্বস্তি আর উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দিল রেমারিককে। তার বিশ্বাস, ভিলায় ঢোকার প্ল্যান নিশ্চই আছে রানার, কিন্তু বেরুবার প্ল্যান আছে কিনা কে জানে!

.

ভাড়া করা ল্যানসিয়া মোবেক্সের পাশে থামাল রকি। ধাপে বসে তাকে নামতে দেখল সুসান। ল্যানসিয়ার দরজা বন্ধ করে ফিরল রকি, নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল সুসানের দিকে। অনেকক্ষণ কেটে গেল, এক চুল নড়ল না সুসান। তারপর সে তার বিশাল ছাতির ওপর হাত বেঁধে আগুপিছু দোল খেতে শুরু করল, হাসির প্রবল আওয়াজটা এল আরও এক মুহূর্ত পরে।

সুসানের পিছনে উদয় হল রানা। রকির দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল ও, হাসল। ধাপ থেকে পিছলে নেমে গিয়ে ঘাসের ওপর গড়াগড়ি খেতে শুরু করল। সুসান। তার অদম্য হাসি নির্জন ক্যাম্পসাইটের সবখানে ছড়িয়ে যাচ্ছে।

মেয়েমানুষ এমন জঘন্য হয়! ক্ষোভ প্রকাশ করল রকি।

তাকে সমর্থন করে রানা বলল, সত্যিকার সৌন্দর্যের কদর নেই।

ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে বসল সুসান, হাঁটু জোড়া দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে। রকি ওয়াট, কাদার ব্যাঙ ডাঙায় উঠেছে, কিন্তু সেই ব্যাঙই আছ তুমি রাজপুত্র হওয়া তোমার কপালে নেই। গালভরা হাসি, কিন্তু এখন আর তার হাসিতে কোন আওয়াজ নেই।

ঘন নীল স্যুট পরে রয়েছে রকি, হাতে একটা কালো ব্রিফকেস, দাঁড়িয়ে আছে। ল্যানসিয়ার পাশে। সুসানকে সে গ্রাহ্য করল না। রানাকে জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে?

নিখুঁত, বলল রানা। সুসানের দিকে ফিরল ও। ওকে যদি ব্যাঙের মতই লাগবে, কাল রাতে তাহলে কাঁদছিলে কেন?

বাজে কথা! উঠে দাঁড়াল সুসান। ওর জন্যে কাঁদতে আমার বয়েই গেছে, চোখে বালি পড়েছিল। কিন্তু এগিয়ে এসে রকিকে আলিঙ্গন করল সে।

আঁতকে উঠল রকি, ব্যস্ত হয়ে বলল, আহ, করো কি! ছাড়ো, স্যুটের ভাঁজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে!

সবাই ওরা মোবেক্সে চড়ল, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ছোট টেবিলে বসল। রানার। নির্দেশগুলো কিভাবে পালন করেছে, বিশদ ব্যাখ্যা করে বলল রকি, তারপর জানতে চাইল, এবার কি?

পিছনে হাত দিয়ে ম্যাপটা বের করল রানা, ভাঁজ খুলে ছোট এয়ারফিল্ডটা দেখাল। রেগিয়োর ফ্লাইং ক্লাবের হেডকোয়ার্টার এটা। ওখানে গিয়ে একটা প্লেন। চার্টার করবে তুমি। ওদের বলবে, সিসিলির পশ্চিম উপকূল,ট্রাপানিতে যাবে।

রকি আর সুসান দৃষ্টি বিনিময় করল।

এতক্ষণে তোমার প্ল্যান জানা গেল, বলল সুসান। কিন্তু প্লেন নিয়ে ভিলায় তুমি নামবে কিভাবে?

মুচকি হাসল রানা। প্লেন নিয়ে নামব, আমি বলেছি?ওর প্রথম প্ল্যানটা কি ছিল, ব্যাখ্যা করল ও। টেলিফোনে একটা নাইট ফ্লাইট চার্টার করত, তারপর। দরকার হলে প্লেন হাইজ্যাক করত। রকি সাহায্য করতে চাওয়ায় ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে গেছে।

কিভাবে কি করতে হবে, রকিকে সব বুঝিয়ে দিল রানা। ফ্লাইং ক্লাবে গিয়ে রকি বলবে, সে একজন ব্যবসায়ী, রেগিয়োতে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটছে তার। কয়েকটা মীটিং আছে, সেগুলো শেষ হওয়া মাত্র ট্রাপানির উদ্দেশে রওনা হতে চায়। ফ্লাইং ক্লাব বা আর কোথাও থেকে কেউ যদি চেক করে, জানবে শহরের। সবচেয়ে দামি হোটেলের সবচেয়ে খরচবহুল সুইটে উঠেছে সে, খাওয়াদাওয়ার। পিছনে খরচ করছে প্রচুর, স্রেফ গল্প করার জন্যে সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় ফোন করে। মোটা বিল দেয়। সংক্ষেপে, রকির মধ্যে ভুয়া কিছু পাবে না তারা।

ফ্লাইং ক্লাবকে রকি জানাবে, ঠিক কখন যে সে রওনা হতে পারবে, আগে থেকে তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে ছঘন্টা আগে নোটিস দেবে সে। বেশিরভাগ সম্ভাবনা, শেষ সন্ধের দিকে রওনা হতে চাইবে সে, পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে যে-কোন একদিন।

নির্দিষ্ট একটা সময় ঠিক করতে পারছ না কেন? জানতে চাইল রকি।

কারণ ব্যাপারটা নির্ভর করছে আবহাওয়ার ওপর।

তাহলে তিন দিনের মধ্যে কেন?

কারণ এই তিন দিন চাঁদ থাকবে না, বা থাকলেও খুব অল্প সময়ের জন্যে।

রকির কৌতূহল না মিটলেও, প্রশ্নটা চেপে রাখল সে। রানা ব্যাখ্যা করে বলল, ফ্লাইং ক্লাবে চারটে প্লেন আছে, তার মধ্যে একজোড়া সেসনা ওয়ান-সেভেন। টু। রকিকে একটা সেসনা চার্টার করতে হবে, অন্য কোন প্লেন হলে চলবে না। কারণ জানতে চাইলে রকি বলবে, আগেও এই প্লেনে চড়েছে সে, নিরাপদ বোধ। করে। পুরো টাকা অ্যাডভ্যান্স করবে রকি, নগদ।

সেসনা হতেই হবে, কেন?

রানা বলল, কারণ সেসনার রয়েছে হাই উইং কনফিগারেশন।

লাভ?

লাভ, সহজে জাম্প করা যায়।

কৌতূহল মিটল রকির।

.

গোটা ভিলাটা চক্কর দিচ্ছে ট্যানডন আর বোরিগিয়ানো। সব আয়োজন নিজের চোখে দেখেছে ওরা, তারপর এক জায়গায় থেমে নিজেদের মধ্যে আলোচনা। করছে।

মেইন গেটের বাইরে গার্ডদের সঙ্গে আলাপ করল ওরা, তারপর বাগানের পথ ধরে ফিরতে শুরু করল।

এভাবে আর যদি এক হপ্তা কাটে, আমি পাগল হয়ে যাব, বলল ট্যান্ডন।

তোমার পাগল হওয়ায় কিছু এসে যায় না, মন্তব্য করল বোরিগিয়ানো। ভাবো গডফাদারের কি অবস্থা হবে।

হুম। ট্যানডনের গম্ভীর চেহারায় দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ।

তুরিনের খবর শুনেছ নিশ্চই? জানতে চাইল বোরিগিয়ানো। নাইটক্লাব থেকে হপ্তার টাকা তুলতে গিয়ে আমাদের তিনজন লোক মারা গেছে। পাবলিক খেপে গেলে কি অবস্থা হয় জানই তো। উন্মত্ত মানুষ ওদের ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছে পুলিস, কাউকে গ্রেফতার পর্যন্ত করেনি।

রোমে নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার ভাগ নিয়ে চারটে পরিবার মারামারি শুরু করেছে, বলল ট্যান্ডন। ছজন মারা গেছে এরই মধ্যে। এমনকি কালাব্রিয়াতেও গোলমাল শুরু হয়েছে। জেল থেকে আইন-শৃঙ্খলার জন্যে আবেদন জানিয়েছে ডন। ব্যামবিনো ফেটুচিনি, পরদিনই তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়। অথচ আমাদের গডফাদার কিছুই করছে না, কাউকে একটা নির্দেশ পর্যন্ত দিচ্ছে না সে।

গামবেরি আসছে কাল, পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে চায়, বলল বোরিগিয়ানো। গডফাদারের অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে যাবে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ট্যানডন। আজ বিশ বছর ডন বাকালার সঙ্গে আছে সে। বিপদের সময় এই লোক ছাড়া আর কারও ওপর ভরসা করতে শেখেনি। সেজন্যেই এতটা অসহায় লাগছে তার।

হঠাৎ বোরিগিয়ানো ট্যানডনের একটা হাত খামচে ধরল। শিউরে উঠে। পাথরের মূর্তি হয়ে গেল দুজন।

কোন শব্দ না করে কালো এক জোড়া ছায়া অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল। একেবারে কাছে চলে এল ওগুলো, ঘন ঘন নাক কোচকাচ্ছে, তারপর যেমন নিঃশব্দে এসেছিল তেমনি নিঃশব্দে অদৃশ্য হয়ে গেল।

বেজন্মা কুকুরগুলোকে দেখলেই আমার ল্যাট্রিনের বেগ চাপে, অভিযোগের সুরে বলল বোরিগিয়ানো।

ভয় পাবার কোন কারণ নেই, হেসে উঠে বলল ট্যানডন। আমাদের গন্ধ চেনে ওরা।

কোন কারণে যদি ভুল হয়, যদি চিনতে না পারে? শিউরে উঠল। বোরিগিয়ানো। কি জানি কি আছে কপালে!

কিচেনের দরজা দিয়ে ভিলায় ঢুকল ওরা। বিশাল কামর, পাথরের দেয়াল। অতিরিক্ত বডিগার্ডদের জন্যে ক্যানটিন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কামরাটাকে। আটজনকে দেখা গেল, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে কফি খাচ্ছে, আর টেলিভিশন দেখছে। কাঠের টেবিলে এটো বাসনকোসন পড়ে রয়েছে এখনও। ছটা সাবমেশিনগান আর দুটো শটগান দেখল ওরা, সবগুলো হাতের কাছে রাখা। কিচেন থেকে একটা প্যাসেজ ভিলার মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেছে। প্রথম কামরায় কাঠের বাক্স তৈরি করা হয়েছে, বডিগার্ডরা বিশ্রাম নেবে এখানে। কয়েকজনকে দেখা গেল ঘুমাচ্ছে, কেউ কেউ বসে গল্প করছে। ওদের টহলের পালা শুরু হবে। মাঝরাতে।

প্যাসেজের শেষ মাথায় একটা সিঁড়ি। দোতলায় উঠে গেছে সেটা, সেখানেই ডন বাকালার স্টাডি আর বেডরূম। ট্যানডন আর বোরিগিয়ানোর বেডরূমও ওই দোতলায়। বডিগার্ডদের সঙ্গে দুএকটা কথা বলে, সিঁড়ি বেয়ে ওপরতলায় উঠে এল ওরা।

স্টাডির বাইরে ডন বাকালার পার্সোনাল বডিগার্ড একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছে, কোলের ওপর সাবমেশিনগান। ওদেরকে দেখে উঠে দাঁড়াল সে, দরজায়। টোকা দিল দুবার, কবাট মেলে ধরল। রিপোর্ট করার জন্যে ভেতরে ঢুকল ওরা।

.

দুদিন পর দমকা বাতাস নিস্তেজ হয়ে পড়ল। চব্বিশ ঘন্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকবে। আকাশে ছোটখাট মেঘ জমতে পারে, পুবদিক থেকে হালকা বাতাস বইবে, উত্তর সিসিলির দুএক জায়গায় অল্প বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা।

তৈরি হল রানা।

সন্ধে নামতে বড়, চওড়া স্যুটকেস খুলে একটা পার্সেল বের করল ও, ফরাসী জেনারেল মার্সেলেসে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এটা। বাইরে, ঘাসের ওপর বসে, ওর। দিকে তাকিয়ে আছে সুসান আর রকি। পার্সেল খুলে বিশাল একটা কালো কাপড়ের ভাঁজ করা থান বের করল রানা।

দেখে তো প্যারাস্যুট বলে মনে হচ্ছে না, অবাক হয়ে বলল রকি।

বরং অনেকটা ডানার মত, বলল রানা। লাফ দাও, তারপর ভাগ্যের ওপর নির্ভর কর, সেদিন ফুরিয়েছে। এটা ফ্রেঞ্চ মিস্ট্রাল। ভাল ট্রেনিং পাওয়া একজন প্যারাএমনকি বাতাসের উল্টো দিকেও এটা নিয়ে ফ্লাই করতে পারবে, টার্গেটের কয়েক গজের মধ্যে ল্যাণ্ড করা আজকাল কোন সমস্যাই নয়।

কর্ডগুলো একটা নকশার মত করে বিছাল রানা, ওরা তাকে সাহায্য করল। তারপর পিছিয়ে এসে দেখল কিভাবে রানা দক্ষতার সঙ্গে বাঁধল কর্ডগুলো। সবশেষে ক্যানোপিটা ভাঁজ করল আবার।

প্যারাস্যুট প্যাক করে মোবেক্সের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখল রানা। রকির দিকে ফিরে বলল, আধ ঘন্টার মধ্যে রওনা হব আমি।

কোন সাহায্য লাগবে? জিজ্ঞেস করল রকি।

না, নিজেই করতে পারব। এখানেই অপেক্ষা কর তোমরা।

মোবেক্সের ভেতরে এসে দ্বিতীয় পার্সেলটা খুলল রানা, ঢাকা থেকে মেজর জেনারেল রাহাত খান পাঠিয়েছিলেন এটা। পার্সেল খুলতে সোদা একটা গন্ধ ঢুকল। নাকে, অনেকদিন ব্যবহার না করলে কাপড় থেকে এই গন্ধটা বেরোয়। রানার পুরানো একটা ক্যামোফ্লেজ কমব্যাট ইউনিফর্ম। কাপড় ছেড়ে ইউনিফর্মটা পরল ও।

মোবেক্সের বাইরে যখন বেরিয়ে এল, চারদিক প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে। ল্যানসিয়ার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রকি আর সুসান। দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল রানা। চাপা গলায় ফুঁপিয়ে উঠল সুসান।

রানা কে, কি করতে কোথায় যাচ্ছে, সবই জানে ওরা, কিন্তু ওকে তৈরি হয়ে। বেরিয়ে আসতে দেখে এই প্রথম ধাক্কাটা খেল।

অতিরিক্ত ফোলানো বেলুনের মত লাগছে রানাকে। বুটি বুটি দাগ আর ছোপ, লাগানো ওভারঅল পরে আছে ও, নিচের দিকটা কালো আর লম্বা বুটের ভেতর। গোঁজা। ইউনিফর্মের দুটো পায়ে অনেকগুলো পকেট, ফুলে আছে সবগুলো। বুকের কাছে অনেকগুলো কর্ড আর একজোড়া পকেট। এই পকেট দুটোও ফুলে। আছে, ভেতরে গ্রেনেড। কোমরের কাছে বড়সড় একটা পাউচ। বেল্টের ডান দিকে একটা ক্যানভাস স্ন্যাপ-ডাউন হোলস্টার, সেটার পাশে আর পিছনে ছোট ছোট আরও অনেকগুলো পাউচ। গলা থেকে একটা স্ট্র্যাপের সঙ্গে ঝুলছে ইনগ্রাম সাবমেশিনগান, স্ট্র্যাপের লুপে ঢুকে আছে ডান, কনুই। বাঁ হাতে রয়েছে কালো, নিটেড, স্কালক্যাপ।

প্যারাস্যুট তুলে নিয়ে ল্যানসিয়ার দিকে এগোল রানা, মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, তোমরা রেডি?

মাথা ঝাঁকিয়ে কিছু বলতে গেল রকি, কিন্তু আওয়াজ বেরুল না। দরজা খুলে এক পাশে সরে দাঁড়াল সে। প্যারাস্যুটটা ভেতরে ছুঁড়ে দিয়ে সুসানের দিকে ফিরল রানা। কিছু বলার নেই, সুসান; সবই তো জানো।

নাক টানল সুসান, প্রকাণ্ড হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছল, তারপর রানার দিকে তাকাল। আমারও কিছু বলার নেই, রানা। শুধু একটা কথা জেনো, আড়াল থেকে সব দেখতে পাচ্ছে, লুবনা। ওর আর কোন কষ্ট বা দুঃখ নেই।

শক্ত পাথর হয়ে উঠল রানার চেহারা। পরমুহূর্তে শিথিল হল মুখের। রেখাগুলো। সুসানের কাঁধে একটা হাত রাখল ও। আমার জন্যে কোন দুশ্চিন্তা কোরো না। এসব কাজ আগেও আমি করেছি–পানির মত সহজ।

অবিরাম ধারায় সুসানের গাল বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। হঠাৎ রানাকে আলিঙ্গন করল সে তারপর ছেড়ে দিয়ে পিছন ফিরল, মোবেক্সের ভেতর ঢুকে বন্ধ করে দিল দরজা।

.

এয়ারফিল্ড বিশ মিনিটের পথ। পিছনের সিটে শুয়ে আছে রানা, রাস্তা থেকে কেউ ওকে দেখতে পাবে না। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবে ওরা।

রকি জানতে চাইল, তুমি বেরুবে কিভাবে?

বাতাসের দিকেও সেসনার দরজা খোলা যায়, বলল রানা।

না, ভিলা কোলাসির কথা জিজ্ঞেস করছি আমি। ভেতরে ঢুকবে জানি, কিন্তু বেরুবে কিভাবে?

পরবর্তী প্রশ্নের অবকাশ না রেখে, ছোট্ট করে জবাব দিল রানা, ঢোকার পথ। থাকলে বেরুবারও পথ আছে।

খানিক পর জানতে চাইল রানা, সব কথা তোমার মনে আছে তো, রকি? কি। করতে হবে না হবে?

আছে, বলল রকি।

আজ রাতে?

 হ্যাঁ, মোবেক্স নিয়ে রওনা দেব আমরা।

এক মিনিটও দেরি করবে না, বলল রানা। চারদিকে নানা রকম গোলযোগ শুরু হয়ে যাবে, কিন্তু সকালে তোমাদের ওই ফেরিতে ওঠা চাই।

জানি, বলল রকি। সামনে এয়ারফিল্ড বাইরে শুধু দুটো গাড়ি দেখতে পাচ্ছি। অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ছে না।

হ্যাঙ্গারের পিছনে ল্যানসিয়া থামাল রকি। হাতে স্যুটকেস নিয়ে নেমে পড়ল। পিছন দিকে একবারও তাকাল না সে, বলল, গুড লাক, রানা।

ধন্যবাদ, রকি।

.

স্টার্ট-আপ চেক শেষ করল ভেলুচি ডেলু। এই চার্টারের মেয়াদ শেষ হলে খুশি হয়। সে। এয়াফোর্স থেকে ট্রেনিং পাওয়া পাইলট, নিয়ম ভাঙতে অভ্যস্ত নয়। ছঘন্টা ধরে স্ট্যাণ্ড-বাই থাকায় গলায় এক ফোঁটা মদ ঢালতে পারেনি সে। ঠিক করেছে রাতটা ট্রাপানিতেই থেকে যাবে, বন্ধুদের নিয়ে মদ খাবে সকাল পর্যন্ত। ওখানে তার অনেক বন্ধু আছে।

আড়চোখে ডান পাশের সিটে বসা অস্ট্রেলিয়ান লোকটার দিকে তাকাল সে। লোকটাকে একটু নার্ভাস, লাগছে। এরকম নার্ভাস লোক দেখে অভ্যস্ত ডেলু। আমরা রেডি, বলল সে।

গুড। মাথা ঝাঁকাল আরোহী।

জ্যান্ত হয়ে উঠল সেসনার এঞ্জিন। অয়েল প্রেশার গজের দিকে তাকাল ডেলু। আরোহী, টোকা দিল তার কাঁধে। এঞ্জিনের আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠল তার গলা, পৌঁছুতে কতক্ষণ লাগবে?

এক ঘন্টার কিছু কম, বলল ডেলু। তার দৃষ্টি ডায়ালের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে।

প্লেনে টয়লেট নেই? আবার জিজ্ঞেস করল আরোহী।

মাথা নাড়ল ডেলু।

 কিন্তু আমার যে টয়লেটে একবার না গেলেই নয়!

ক্ষীণ একটু হাসল ডেল। এ লোক সত্যি নার্ভাস। হাত বাড়িয়ে ডান দিকের দরজাটা খুলে দিল সে। যান। সাবধানে নামবেন।

সিট বেল্ট খুলে প্লেন থেকে নেমে গেল আরোহী। আবার ডায়ালের দিকে মন দিল ডেলু।

দুমিনিট পর দরজায় একজনকে দেখা গেল। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই পাথর হয়ে গেল পাইলট। প্রথমেই চোখ পড়ল পিস্তলটা। তারপর লোকটাকে দেখল।

তোমার কাজ তুমি কর,বলল রানা। কোন ভয় নেই।

বেল্ট দিয়ে নিজেকে আটকাল না রানা। সিটে বসে সামনের দিকে ঝুঁকে থাকল শুধু, ডান হাতটা ইনস্ট্রমেন্ট প্যানেলের মাথায়, শরীরটা পাইলটের দিকে বাঁকানো। হাতের পিস্তল নিচু করা, পাইলটের পাজরের কাছাকাছি।

 চেক কমপ্লিট কর, বলল রানা। নিয়ম ধরে করবে। সেসনা চালাতে জানি আমি। রেডিও প্রসিডিউরও জানা আছে। বোকার মত কিছু করতে যেয়ো না।

স্থির হয়ে বসেই থাকল পাইলট। হাত দুটো হাঁটুর ওপর। মাথার ভেতর দ্রুত চিন্তা চলছে। নতুন আরোহী তার চিন্তায় বাধা দিল না, চুপচাপ বসে থেকে অপেক্ষা করছে। অবশেষে মনস্থির করল ডেলু। কিছুই বলল না সে, নিঃশব্দে টেকঅফের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল।

দশ মিনিট পর। মেসিনা প্রণালীর চার হাজার ফিট ওপরে উঠে এসেছে সেসনা। সামনে দেখা যাচ্ছে সিসিলির আলো। আরও ওপরে উঠছে ওরা।

.

পিস্তলটা তুমি সরিয়ে রাখতে পার। আমি জানি তুমি কে। আমিও আছি তোমার পাশে!

মাত্র এক মুহূর্ত চিন্তা করল রানা, তারপর ক্যানভাস হোলস্টারে ভরে রাখল কোল্ট। দুই সিটের মাঝখানে হাত গলিয়ে পাইলটের চার্টটা তুলে নিল ও। ট্রাপানির রুট পেন্সিল দিয়ে দাগানো রয়েছে। ভিলা কোলাসি থেকে তিন মাইল দক্ষিণের পথ ধরে যাবে ওরা। টারমিনি ইমেরেসি বীকন পেরোবার পর, আমি চাই, একটু ঘুর-পথে যাবে তুমি, বলল রানা।

গম্ভীর একটু হাসি দেখা গেল পাইলটের মুখে। এই চার্টারের জন্যে আরও বেশি টাকা চাওয়া উচিত ছিল আমার।

কম–তোমার আরোহী সবটুকু পথ যাচ্ছে না।

ভাগ্যই বলতে হবে পুরোটা অ্যাডভান্স পেয়ে গেছি, বলল ডেলু। নিন, ব্রিফ করুন।

ম্যাপ নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকল রানা। দেখতে না পাওয়ার কোন কারণ। নেই। পালার্মো থেকে দক্ষিণ দিকে পাঁচ কিলোমিটার, মনরেলা থেকে পুব দিকে তিন কিলোমিটার। আলোয় ক্রিসমাস ট্রি-র মত ঝলমল করছে। ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলের দিকে তাকাল ও। পাঁচ হাজার ফিট ওপরে রয়েছে সেসনা। এখনও উঠছে। সাধারণত কহাজার ফিটে সিধে কর প্লেন?

সাত হাজারে।

গুড। বীকন না পেরোনো পর্যন্ত ওই হাইটেই থাক। তারপর আবার উঠতে শুরু করবে, বারো হাজার ফিট পর্যন্ত।

অবাক হয়ে রানার দিকে তাকাল ডেলু।

হাই অলটিচ্যুড, লো ওপেনিং, ব্যাখ্যা করল রানা।

ব্যাপারটা বুঝতে পারল ডেলু। আমরা ওটাকে ডিলেইড ফ্লোট বলি। প্যারাস্যুট খুলবেন কহাজার ফিটে?

দুহাজার, তার আগে নয়–অবশ্য নির্ভর করবে আমার ফ্রি ফল ডিফটের ওপর। বাতাস পুব দিকে বইছে, দশ নটে।

প্যারাস্যুট প্যাকের দিকে তাকাল পাইলট। কি ধরনের ওটা?

একটা ডানা-ফেঞ্চ মিন্ট্রাল।

আপনার ভাগ্যই বলতে হবে, ডিউটিতে আজ আমি ছিলাম, বলল ডেলু। ওদের অত্যাচারে আমাদের পরিবার অনেক ভুগেছে। আপনি যা করছেন, আমরা। ইটালিয়ানরা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।

অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকল ওরা। তারপর রানা জানতে চাইল, তুমি কি তারপর ট্রাপানিতে যাবে?

না। রেগিয়োতে ফিরে যাব–সেটাই নিরাপদ। অস্ট্রেলিয়ান লোকটা কে?

ককপিটের ম্লান লালচে আলোয় রানার চেহারা নরম দেখাল। তোমার মতই একজন।

*

হিলটনের বারে রয়েছেন কর্নেল গুগলি, খোলা জানালার দিকে পিছন ফিরে কাউন্টারের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন-হাতে ককটেল গ্লাস, চোখে সুন্দরী রমণী। খুবই খোশ-মেজাজে আছেন তিনি, তার হাতের ককটেল একটা হাইবল। দেহ-মনে ফুর্তি এনে দিয়েছে স্বর্ণকেশী আমেরিকান মেয়েটা। এক কোণের একটা টেবিলে ওরা দুই বান্ধবী, বসে আছে, অপরজন নিগ্রো যুবতী। চোরা চোখে লেডিকিলার কর্নেলের দিকে প্রায়ই তাকাচ্ছে শেতাঙ্গিনী, চোখাচোখি হতে একটু লজ্জা পাচ্ছে, দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়ার আগে ক্ষীণ একটু হাসির রেখা ফুটে উঠছে তার ঠোঁটে।

কর্নেলের সঙ্গেই কাউন্টারে দাঁড়িয়ে রয়েছে রেমারিক আর পাধানি। রেমারিক অন্যমনস্ক। কিন্তু পানি শুধু ব্যাপারটা টেরই পায়নি, উপভোগও করছে। আটত্রিশ বছর বয়স কর্নেলের, কোন মেয়ে এখনও তাকে বাঁধতে পারল না, সেজন্যে দুঃখের অবধি নেই পাধানির। আসলে কর্নেলেরই কপাল খারাপ। যখনই সুন্দরী কোন মেয়ের দিকে ঝুঁকবেন তিনি, তখনই জরুরি কাজের ডাক আসে, মেয়েটাকে হতাশ করে কর্তব্যের পিছনে ছুটতে হয় তার। শুধু এই একটা কারণে কত মেয়ে যে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, গুনে শেষ করা যাবে না।

কর্নেল আর আমেরিকান মেয়েটাকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করে পানি উপলব্ধি করল, ওদের যদি মিলন হয়, আদর্শ একটা দম্পতি হতে পারবে ওরা।

কি যেন বলল পাধানি, রেমারিক শুনতে পেল না। কয়েকদিন থেকেই প্রচণ্ড একটা টেনশন অনুভব করছে সে। রানার কথা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না।

সাধারণ একটা রেডিও, মানুষের মাথা থেকে বেরিয়েছে, দুনিয়ার সবখানে আর মহাশূন্যের কোটি কোটি মাইল দূরে সিগন্যাল পাঠাতে পারে। তাহলে এ-ও বাস্তব বলে মনে হয় যে মাথাটাও, রেডিওর চেয়ে অনেক বেশি নিখুঁত আর সফিসটিকেটেড, নিশ্চয়ই সিগন্যাল পাঠাতে পারে, পারে আরেক মাথার সঙ্গে যোগাযোগ করতে।

এসব কথা ভাবছে না রেমারিক। কিন্তু তার মন গাইছে, সে আসছে–রানা। আসছে। আর বেশি দূরে নেই। আশ্চর্য একটা অস্থিরতা বোধ করছে সে। মনে হচ্ছে, কি যেন একটা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করা দরকার তার। তা না হলে রানার আগমন টের পাবে না।

বারটেণ্ডারকে আরও ড্রিঙ্কের জন্যে বললেন গুগলি। খুক করে কেশে আবার রেমারিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল পাধানি। মেয়েটার ব্যাপারে রেমারিকের মন্তব্য শুনতে চায় সে।

এত উদাস কেন? মৃদু কণ্ঠে জানতে চাইলেন গুগলি।

না, অন্যমনস্কভাবে জবাব দিল রেমারিক।

মেয়েটাকে দেখেছেন? জিজ্ঞেস করলেন গুগলি। ঠিক বুঝতে পারছি না, কাকে পছন্দ করছে ও। প্রতি মিনিটে বিশ সেকেণ্ড করে আমাদের তিনজনকেই দেখছে,। কি বুঝব? 

ঘড়ি আমার হাতেও আছে, কর্নেল, পাধানি বলল। হিসেবে ভুল করছেন আপনি।

তাই? একটু যেন থতমত খেয়ে গেলেন গুগলি। কি রকম?

হঠাৎ কর্নেলের একটা হাত খামচে ধরল রেমারিক। শুনুন! চাপা গলায় বলল সে, তার হাত কাঁপছে।

খোলা জানালা দিয়ে অত্যন্ত অস্পষ্ট একটা যান্ত্রিক গুঞ্জন ভেতরে ঢুকছে। মনে, হল অনেক দূর দিয়ে একটা প্লেন যাচ্ছে।

রানা!

কর্নেল আর ক্যাপ্টেন হতভম্ব, তাকিয়ে আছে রেমারিকের দিকে।

 রানা! আবার ফিসফিস করে বলল রেমারিক। এসে গেছে ও!

ক্যাপ্টেনের দিকে তাকালেন কর্নেল।

ঝট করে উঠে দাঁড়াল রেমারিক, টেবিলে একটা ধাক্কা খেল। কর্নেলের দিকে ঝুঁকল সে, চোখ দুটো বিস্ফারিত। ও একজন প্যারাটু পার কমাণ্ডো, কাঁপা গলায় বলল সে। প্লেন ছাড়া আর কিসে করে আসবে ও! দরজার দিকে ছুটল সে।

কর্নেল দাঁড়ালেন, দেখাদেখি পাধানিও। স্বর্ণকেশীর দিকে তাকালেন কর্নেল, তাঁর চোখে বিষাদের ছায়া দেখল পাধানি।

এসো, বললেন গুগলি। লোকটার সময়জ্ঞান আগের মতই আছে, একটুও বদলায়নি।

.

ঠেলে সরিয়ে দেয়া হয়েছে দরজা। ফাঁকটার মাঝখানে রানার মুখ আর কাঁধ দেখা যাচ্ছে। রাবারের সোল লাগানো বুট জোড়া আণ্ডারক্যারিজের অবলম্বনের ওপর স্থির হয়ে আছে। খুলি কামড়ে বসে আছে কালক্যাপ, মুখের নিচের অংশ রঙ লাগিয়ে কালো করা হয়েছে। চোখ দুটো অপলক স্থির হয়ে আছে পাইলটের ওপর।

দক্ষ হাত, গভীর মনোযোগের সঙ্গে প্লেন চালাচ্ছে ডেলু। আস্তে ধীরে প্লেনটাকে কাত করল সে, ডানে-বামে ঘন ঘন তাকাচ্ছে, বেয়ারিংগুলো দেখে নিয়ে কমপাসের সঙ্গে মিলিয়ে কোর্স ঠিক রাখছে। তার বাঁ পা রাডারে উঠে এল, চাপ দেয়ার জন্যে তৈরি। তার ডান হাত শূন্যে উঠে পড়ল। চালিয়ে যাও, মাসুদ রানা! আমরা আছি তোমার…

ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ডেলু। দরজা খালি।

.

ভিলা কোলাসির সব কটা জানালা বন্ধ।

দোতলার একটা জানালা খুট শব্দ করে খুলল, সামান্য একটু ফাঁক হল কবাট। ধীরে ধীরে, এক চুল এক চুল করে সরল পর্দা। লাল টকটকে একটা চোখ দেখা গেল পর্দার ফাঁকে।

অন্ধকার বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকল ডন বাকালা। বাগান আর লন পুরোপুরি অন্ধকার নয়, পাচিলের বাইরে থেকে ফ্লাডলাইটের আলো না এলেও, আলোর আভা আসতে বাধা পায়নি। গত কয়েক দিনে তার মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটেছে। ভয়ের জায়গা দখল করে নিয়েছে হতাশা, আর রাগ। যুগ যুগ ধরে যারা অনুগত ছিল, সেই পা-চাটা কুকুরগুলো এখন তার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এমনকি যারা তার চারপাশে থাকে। মুখে কিছু না বললেও ওদের চেহারা দেখে সে বুঝতে পারে সব। তার এই স্টাডিতে বসে নির্লিপ্ত একটা ভাব দেখিয়ে গেছে গামবেরি। কি দুঃসাহস!

উন্মাদ লোকটা মারা যাক, তারপর সে ওদের দেখে নেবে। তখন ওরা বুঝবে, কতটুকু তার ক্ষমতা। বুলেট আকৃতির নিচে চওড়া মুখটা কঠোর হয়ে উঠল। দৃঢ় একটা প্রতিজ্ঞায় ঠোঁট জোড়া পরস্পরের সঙ্গে শক্তভাবে সেঁটে আছে। পর্দা টেনে দিয়ে ডেস্কের দিকে ফিরল সে।

কয়েক সেকেণ্ড পর পাচিলের ওপর দিয়ে প্রকাণ্ড একটা কালো, পোয়াতি বাদুড়ের মত উড়ে এল রানা।

.

১১.

বাগানের পাশে ঘাসের ওপর ল্যাণ্ড করল রানা। পা মাটির স্পর্শ পেতেই ভাঁজ হয়ে গেল হাঁটু, কয়েকটা ডিগবাজি দিয়ে ছোট্ট এক লাফে সিধে হয়ে দাঁড়াল-রিলিজ হ্যাণ্ডেল টান দিয়ে আগেই প্যারাসুট থেকে মুক্ত করে নিয়েছে নিজেকে। একটা গাছের গায়ে কালো আবরণের মত ঝুলে আছে প্যারাস্যুট।

ব্যস্ত হাতে বেরিয়ে এল কোল্ট আর সাইলেন্সার। আঙুলে বিদ্যুৎ খেলে গেল, প্যাঁচ ঘুরিয়ে ফিট করল সাইলেন্সর। সামনের দিকে ঝুঁকল রানা, একটা গাছের দিকে পিছন ফিরে আছে। বুকের একটা পাউচ থেকে নাইট সাইট বের করল।

বাঁ দিক থেকে ডান দিকে, পুরো লনের ওপর চোখ বুলাল, ভিলার একপাশ ঘুরে বেরিয়ে আসতেই দেখতে পেল ওগুলোকে। এক জোড়া নিচু, কালো আকৃতি, পাশাপাশি, ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে। কোল্ট আর নাইট সাইট একই সরল রেখায় স্থির রয়েছে। গভীর করে শ্বাস টেনে আরও একটু ঝুঁকল রানা। ডোবারম্যান নিঃশব্দে হামলা চালায়, খুন করে নিঃশব্দে।

ওগুলো মরলও নিঃশব্দে। প্রথমটা দশ মিটার দূরে, বুকে আর গলায় বুলেট নিয়ে। দ্বিতীয়টা হার্টে গুলি খাবার আগে পাঁচ মিটারের মধ্যে চলে এল, গুলি খাবার পরও তার গতি পুরোপুরি রুদ্ধ হল না, রানার পায়ের কাছে এসে একটা হেঁচকি তুলে মারা গেল।

কিচেনে ওরা ফুটবল খেলা দেখছে। জুভেন্টাস বনাম নেপলস। সবার চোখ আঠার মত আটকে আছে টিভির পর্দায়। জানালা বিস্ফোরিত হওয়ার শব্দে সবাই ঘাড় ফেরাল, দেখল, অশ্লীল আকৃতির একটা গ্রেনেড জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকছে।

তিন জন মারা গেল সঙ্গে সঙ্গে। দুজন চিরকালের জন্যে অচল হয়ে গেল শাপনেলের আঘাতে। বিস্ফোরণের আঘাত থেকে রক্ষা পেল চারজন, বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে। লাথি মেরে খোলা হল দরজা, তখনও অস্ত্রের দিকে হাত বাড়াবার। মত হুশ ফেরেনি ওদের।

বুকের কাছে সাবমেশিনগান ধরে দরজায় দাঁড়াল রানা। চোখ দুটো চঞ্চল, কিছু নড়ে কিনা দেখছে। সাদা আগুনের শিখা বেরুল ইনগ্রাম থেকে। ঘরের ভেতর। থেমে গেল প্রাণস্পন্দন।

যেন কোন ব্যস্ততা নেই, অথচ দ্রুত, এগোচ্ছে রানা। খোলা দরজার পাশে দাঁড়াল ও, বাইরে প্যাসেজ। পাথুরে মেঝেতে ছিটকে পড়ল খালি একটা ম্যাগাজিন। ক্লিক শব্দে নতুন আরেকটা বসাল জায়গামত। আবার ককু করল। ইনগ্রাম। দরজার পাশের দেয়ালে পিঠ, কান দুটো সজাগ।

প্যাসেজের মাঝখান থেকে কর্কশ চিৎকার ভেসে এল, আরও অস্পষ্ট হৈ-চৈ এল ওপরতলা থেকে। কি ঘটছে, জানতে চাইছে ওরা। এক এক করে অনেকগুলো দরজা খোলার আওয়াজ হল। কোমর বাঁকা করে নিচু হল রানা, ঝট করে দাঁড়াল খোলা দরজার সামনে, ইনগ্রাম নিচের দিকে তাক করা, অগ্নি উদগীরণ করছে।

প্যাসেজে তিনজন লোক। একজন পিছিয়ে গিয়ে কামরার ভেতর ঢুকে পড়তে পারল। বাকি দুজন বুলেটের ধাক্কা খেয়ে নির্দিষ্ট একটা ছন্দে পিছিয়ে যেতে শুরু করল, সেই সঙ্গে লম্বায় ছোট হতে থাকল দ্রুত।

আবার এগোল রানা, আবার খালি ম্যাগাজিন ছিটকে পড়ার আওয়াজ হল পাথুরে মেঝেতে। এ যেন এক ধরনের উঁচু দরের তাল লয় সহ বিশুদ্ধ নৃত্য শিল্প। ছন্দোবদ্ধ, সুচারু, সুনিপুণ; প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে তাল ও লয়ের মিল থাকছে। নৃত্যের সঙ্গে মিল রেখে সঙ্গীত-আর্তচিৎকারকে চাপা দিয়ে উচ্চকিত হয়ে ওঠা। গানফায়ার, খরচ হয়ে যাওয়া কান্ট্রিজের টুনটুন বোল।

খোলা দরজার সামনে দাঁড়াল না রানা, বাঙ্কগুলোর মাঝখানে একটা গ্রেনেড ছুঁড়ে দিল শুধু। প্যাসেজ ধরে কয়েক পা এগিয়ে এল, বিস্ফোরণের আওয়াজে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল পিছন দিকে। বিস্ফোরণের ধাক্কায় প্যাসেজে বেরিয়ে এসেছে লোকটা, গোঙাচ্ছে, হামাগুড়ি দিচ্ছে মেঝেতে। শটগানটা আটকে গেছে কাপড়ে, চেষ্টা করেও তুলতে পারছে না। ট্রিগারে চাপ পড়ল, ইনগ্রাম থেকে আধ সেকেণ্ড গুলি বেরুল। আবার ঘুরল রানা, পৌঁছে গেল সিঁড়ির গোড়ায়, দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল, বুকের কাছে ইনগ্রাম, কান দুটো সজাগ।

.

ল্যাণ্ডিঙের ওপরে, স্টাডির দরজায় ডান হাতে একটা পিস্তল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডন বাকালা। বাঁ হাত দিয়ে পার্সোনাল বডিগার্ডের শার্টের আস্তিন আঁকড়ে ধরেছে সে।

থাকো এখানে! খেঁকিয়ে উঠল বাকালা, ঘামে ভেজা চেহারায় আতঙ্ক। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্যানডন, বোরিগিয়ানো, আর গামবেরি। পিস্তলগুলো নিচের দিকে তাক করা। ট্যানডনের গায়ে শার্ট নেই, তার বুক আর পিঠ ঢাকা আছে কালো লোমে। নিচে নামো!

ঘাড় ফিরিয়ে ডন বাকালার দিকে তাকাল ওরা। সবাই ইতস্তত করছে। ঘৃণায়, রাগে, ভয়ে বিকৃত হয়ে উঠেছে বাকালার মুখ। নিচে নামো!কর্কশ গলায় আবার গর্জে উঠল সে, হাতের পিস্তলটা তুলল।

নড়ে উঠল ট্যানডন, সাপের মত এগোল তার পা, এক ধাপ নিচে নামল। তার শরীরের ওপরের অংশটুকু শুধু দেখতে পাচ্ছে বাকালা, এই সময় কানে তালা লাগিয়ে দিল সাবমেশিনগানের একটানা আওয়াজ। বাকালা দেখল, একটা ঝাঁকি খেয়ে শূন্যে উঠল ট্যানডন, কালো লোমের মাঝখানে কাঁচা লাল গর্ত দেখা গেল। পরমুহূর্তে চোখের আড়ালে পড়ে গেল সে। আওয়াজ শুনে বোঝা গেল লাশটা নিচের দিকে গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে।

 পিছিয়ে সিঁড়ির মাথায় উঠে আসছে বোরিগিয়ানো আর গামবেরি। নিচে নামবে না ওরা। দুজনেই ডান দিকে তাকাল, দশ মিটার পিছনে প্যাসেজে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাকালা, বডিগার্ডের পিছনে গা ঢাকা দিয়ে আছে। আবার যখন ওরা। সিঁড়ির দিকে ফিরল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। দুজনের ঠিক মাঝখানে। বিস্ফোরিত হল গ্রেনেডটা। ল্যাণ্ডিঙের কোণ আড়াল করে রাখায় বাকালা আর বডিগার্ড বেঁচে গেছে।

গ্রাস করল নিখাদ আতঙ্ক। বডিগার্ডের পিঠে ধাক্কা দিয়ে পিছিয়ে স্টাডির ভেতর ঢুকে পড়ল বাকালা। দড়াম করে দরজা বন্ধ করল, হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে গিয়ে দাঁড়াল জানালার সামনে। খোলার ধৈর্য হল না, পিস্তলের বাঁট দিয়ে কাঁচ ভেঙে, এক টানে ছিঁড়ে ফেলল পর্দা। তারপর বাইরে মুখ বের করে চিৎকার জুড়ে দিল, কোথায় তোমরা? ওপরে উঠে এসো! ওপরে উঠে এসো!

.

সিঁড়ির মাথায় থামল রানা, বিধ্বস্ত শরীরগুলোর ওপর চোখ বুলাল। প্যাসেজের গা। ঘেষে এগোল ও, বাকালার উন্মত্ত চিৎকারু পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে।

ইনগ্রামটা ডান হাতে, বা হাত দিয়ে একটা গ্রেনেড বের করল। গ্রেনেড ধরা। হাতটা নিচু করে ইনগ্রামের পাশে আনল, ডান হাতের কড়ে আঙুল দিয়ে খুলে নিল পিন। স্পিঙ রিলিজ করল, মাথার ভেতর ঘড়িটা টিক টিক করল দুবার, আঙুলগুলো ছড়াতে শুরু করল। হাত থেকে ছুটে গেল গ্রেনেড, কোণ ঘুরে মেঝেতে ড্রপ খেল দুবার, ঠক করে বাড়ি খেল স্টাডির দরজায়।

বিস্ফোরণের আওয়াজে জানালার দিকে পিছন ফিরল বাকালা। দেখল, ওক কাঠের মজবুত দরজা কজা সহ ভেতর দিকে ছিটকে পড়ছে। দরজার সঙ্গে তার। পার্সোনাল বডিগার্ডের লাশও আছড়ে পড়ল কার্পেটে।

নেতাদের নেতা দাঁড়িয়ে থাকল–আড়ষ্ট। রক্ত-মাংসের দলা পাকানো পিণ্ডটার। ওপর স্থির হয়ে আছে চোখ। মুখ খুলল সে, কিন্তু কোন আওয়াজ হল না। তার ব্রেন অচল হয়ে গেছে।

তারপর, নিচে থেকে ভেসে আসা চিত্তার শুনতে পেল সে। এতক্ষণে আসছে। ওরা! দরজার দিকে তাকাল, তাকিয়ে থেকেই কুঁজো হল ভারি ডেস্কের পিছনে, পিস্তল ধরা হাতটা লম্বা করা। বুকের ভেতর তড়পাচ্ছে হৃৎপিণ্ড, থেমে থেমে দমকা বাতাসের মত নিঃশ্বাস পড়ছে।

দোরগোড়া থেকে ডাইভ দিয়ে ভেতরে ঢুকল রানা, কার্পেটে পড়েই গড়িয়ে। দিল শরীরটাকে। লাশের ওপর দিয়ে ডিগবাজি খেয়ে ঘরের ঠিক মাঝখানে চলে। এল, উঠে দাঁড়াল এক লাফে। দুবার গুলি করল বাকালা। কাঁপা হাতের গুলি, তবে একটা বুলেট লাগল। ঝাঁকি খেয়ে পাশে, আর পিছন দিকে সরে গেল রানা। দেখতে পেয়ে ডেস্কের পিছনে সিধে হল বাকালা, উল্লাসে দুর্বোধ্য আওয়াজ বেরিয়ে এল গলা থেকে। পরপর আরও দুবার গুলি করল সে–সেই কাঁপা হাতের গুলি।

তার অভিজ্ঞতা নেই। শুধু ভাগ্যই যথেষ্ট নয়।

রানার ডান কাঁধে গুলি লেগেছে, হাতটা কোন কাজে আসছে না। ইনগ্রামটা এখনও গলা থেকে ঝুলছে, বাঁ হাতে ধরে আছে সেটা। ডেস্কের দিকে এক ঝাঁক গুলি ছুটে গেল ওটা থেকে।

ধীরে ধীরে দাঁড়াল রানা, কাঁধের অসহ্য ব্যথায় দাঁতে দাঁত চেপে ধরেছে। ইনগ্রাম সিধে করে সাবধানে ডেস্কের দিকে এগোল ও।

কার্পেটে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছে বাকালা। একটা হাঁটু শরীর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। হাত দিয়ে তলপেটে চেপে ধরে আছে সে, আঙুলের ফাঁক দিয়ে সাদা চর্বি দেখা যাচ্ছে, লাল রক্তের স্রোত মাঝেমধ্যে ঢেকে দিচ্ছে সাদা রঙটাকে। মুখ। তুলে রানার চোখে তাকিয়ে আছে সে। তার দৃষ্টিতে ভয়, ঘৃণা আর আবেদন। তার সামনে দাঁড়াল রানা, জখমগুলো লক্ষ করল, বুঝল বাচবে না। ডান পা-টা তুলল। ও। ঘামে ভেজা বাকালার গলার ওপর রাখল বুট। তুমি এখনও বেঁচে আছ। সেজন্যে আমি খুশি, মৃদু কণ্ঠে বলল রানা। বাকালার গলায় চাপ দিল ও। নিচু গলায় কথা বলছে, নরম সুরে লুবনার মত, বাকালা। ওর মত তুমিও দম আটকে মারা যাবে। ডান পায়ের ওপর শরীরের সমস্ত ভার চাপিয়ে দিল সে।

*

গেটের গার্ড দুজন ভয়ে ভয়ে, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এগোল। কিচেন হয়ে। প্যাসেজে এল তারা, সিঁড়ি বেয়ে উঠল দোতলায়। এমন কিছু দেখল না যাতে মনে জোর পাওয়া যায়। ট্যানডন আর বোরিগিয়ানোর লাশ আরও মন্থরগতি করে তুলল তাদেরকে। গেরিলা ট্রেনিং পাওয়া আমেরিকান লোকটা অকারণেই হাপাতে শুরু করেছে। যদিও দুজনের মধ্যে তার সাহসই বেশি। প্যাসেজে দাঁড়িয়ে বাকালার স্টাডির ভেতর তাকিয়ে আছে সে, একটু পিছনে দ্বিতীয় লোকটা। দলা পাকানো লাশটা দেখে বুঝল, বাকালার পার্সোনাল বডিগার্ড। অস্পষ্ট, প্রায় শোনা যায় না, গোঙানির আওয়াজ পেল তারা। স্টাডি থেকেই বেরিয়ে আসছে।

তারপর হঠাৎ করেই থেমে গেল আওয়াজ।

দুজনের কেউই প্রথমে ঢুকতে চায় না, কাজেই যুক্তি করে একসঙ্গে, পাশাপাশি, এগোল। ওকে ওরা ডেস্কের পিছনে দেখতে পেল, নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে গুলি করল ওরা।

দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেল রানা, দেয়ালে ঘষা খেতে খেতে কার্পেটে নেমে আসছে শরীর। আবার গুলি হল, এবার ইনগ্রাম থেকে। ঘরের এক দিক থেকে আরেক দিকে ছুটে গেল ঝাঁক ঝাঁক বুলেট।

গেটের বাইরে ঘ্যাঁচ করে থামল পুলিস কার। প্রথমে লাফ দিলেন গুগলি, তারপর পাধানি। গেটটা ভেতর থেকে বন্ধ। গেটের ডান দিকে ছোট একটা জানালা, সেটাও তালা দেয়া। জানালার কপাটে লাথি মারছে পাধানি, বেলের হাতল ধরে ঘন ঘন নাড়তে শুরু করলেন গুগলি।

হঠাৎ ওদের পিছনে তীক্ষ্ণ শব্দ করে উঠল হর্ন। লাফ দিয়ে এক পাশে সরে। গেলেন গুগলি, পাধানি আর একটু দেরি করলেই ধাক্কা খেত। ভারি পুলিস কারটা খ্যাপা হাতির মত ছুটে এল গেটের দিকে।

গেটের এক পাশে গাড়ি তাক করল রেমারিক। সংঘর্ষের আওয়াজ হল প্রচণ্ড, কাজের কাজও হল। গেট নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেও, দেয়াল থেকে খুলে বেরিয়ে গেল কজা সহ ইস্পাতের খানিকটা পাত–মাথা গলিয়ে ভেতরে ঢোকার জন্যে যথেষ্ট।

মুহূর্তের মধ্যে ফাঁকটা গলে ভেতরে ঢুকে গেল রেমারিক, কাকর ছড়ানো গাড়ি-পথ ধরে ছুটল ভিলার দিকে।

চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া পুলিস কারের দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন গুগলি, কিন্তু সংবিৎ ফিরে পেয়ে এরই মধ্যে ফাঁকের ভেতর মাথা গলিয়ে দিয়েছে পাধানি। কাঁধ ঝাঁকিয়ে তার পিছু নিলেন কর্নেল।

রেমারিককে ওরা দেখতে পেলেন ভিলার সদর দরজায়, তারপর সে বিল্ডিঙের কোণ ঘুরে ছুটল, অদৃশ্য হয়ে গেল কিচেনের দিকে।

পাধানিকে নিয়ে গুগলি যখন কিচেনে ঢুকলেন, রেমারিককে কোথাও দেখা গৈল না। দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে তাকালেন তিনি। প্রথমে নড়ে উঠল পাধানি, ঘুরে দাঁড়িয়ে বমি শুরু করল সে। তাকে সামলে ওঠার জন্যে খানিকটা সময় দিলেন গুগলি, তারপর রক্তের ওপর দিয়ে সাবধানে পা ফেলে এগোলেন। প্যাসেজের লাশ দেখে থামলেন একবার, উঁকি দিয়ে ঘরের ভেতর তাকালেন। সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে আবার থামলেন, ধাপের ওপর পড়ে থাকা লাশটা চিনতে অসুবিধে হল না।

ট্যানডন, পাধানিকে বললেন তিনি। বাকালার ডান হাত।

সিঁড়ির মাথায় আবার একবার থামলেন গুগলি। লাশ দুটোর দিকে তাকিয়ে মুচকি একটু হাসলেন তিনি। বাজি ধরবে?

নিঃশব্দে মাথা নাড়ল পাধানি। আপনি হারবেন।

চিনতে পারছ? চোখে অবিশ্বাস নিয়ে সহকারীর দিকে তাকালেন গুগলি। কিন্তু কিভাবে? তেমন কিছুই তো অবশিষ্ট নেই।

গামবেরি আর বোরিগিয়ানো, বলল পাধানি। ওদের কিমা বানিয়ে ফেললেও চেনা যায়।

যাই বল, আমাদের হাতে আর কোন কাজই থাকল না–সব আবর্জনা সাফ!

স্টাডিতে ঢুকলেন গুগলি। তিনটে লাশ। ডেস্কের পিছনে হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছে রেমারিক। ওদের পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ফেরাল সে। কুইক! ফোপানো গলায় ডাকল রেমারিক। একটু সাহায্য করুন! কুইক!

ডেস্কের পিছনে এসে ঝুঁকলেন গুগলি। রানার মুখের দিকে তাকালেন। তাহলে সত্যি ফেরেশতা নয়! যেন মস্ত একটা ধাক্কা খেয়েছেন তিনি। তাহলে এত কিছু সম্ভব হল কি করে?

ইউ বাস্টার্ড! সব ভুলে গাল দিল রেমারিক।

কর্নেলকে স্পর্শই করল না। ক্ষীণ, বিদ্রূপ মেশানো হাসি লেগে রয়েছে তার। ঠোঁটে। রানার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি, রানার চোখ খোলা, সে-ও তাকিয়ে। আছে। দুজনের কারও চোখেই পলক নেই। ব্যথায় গাল কুঁচকে আছে রানার, কপালে চিটচিটে ঘাম। চোখ নামিয়ে রক্ত আর ছেঁড়া মাংসের দিকে তাকালেন গুগলি। রানার বগলের নিচে রেমারিকের একটা হাত ঢুকে গেছে, আরেক হাতে রানার হাত চেপে ধরে আছে সে। আপনার ডান হাত, জরুরি আবেদন জানাল রেমারিক। এখানে চেপে ধরুন, আমার হাতের পাশে!

হাঁটু মুড়ে বসলেন গুগলি। হাত বাড়ালেন। তার হাতটা ধরে জায়গা মত বসিয়ে দিল রেমারিক।

আর্টারি ছিঁড়ে গেছে। আঙুল দিয়ে চেপে ধরুন।

নির্দেশ পালন করে নিচের দিকে, গুঁড়িয়ে যাওয়া কব্জির ওপর চোখ রাখলেন গুগলি। গল গল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে।

আরও জোরে! চেঁচিয়ে বলল রেমারিক। এখন আর ফোঁপাচ্ছে না সে।

আরও জোরে চাপ দিলেন গুগলি, পেশীর ভেতর তাঁর আঙুল ডেবে গেছে। এখন আর আগের মত রক্ত বেরুচ্ছে না, গতি শ্লথ হয়ে এসেছে।

আমি? আমি কি করব? পিছন থেকে অস্থির কণ্ঠে জানতে চাইল পাধানি।

ফোনে কথা বল। ওরা আসছে, কিন্তু বলে দাও সমস্ত ইকুইপমেন্ট যেন সঙ্গে নেয়। আর, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানে আমি একটা হেলিকপ্টার চাই।

ব্যস্ততার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে পাধানি, রেমারিক জখমগুলোর ওপর দ্রুত হাতে পট্টি বাঁধছে। ডান দিকে তাকিয়ে বাকালার লাশ দেখতে পেলেন গুগলি আধ হাত জিভ বেরিয়ে আছে। রানার দিকে ফিরলেন। রূপোর একটা চেইনের সঙ্গে গলায় ঝুলছে খুদে একটা বই। রেমারিকের কাছে শোনা গল্পটা মনে পড়ে গেল। লুবনার দেয়া পবিত্র উপহার বুকে নিয়ে রওনা দিয়েছিল রানা। রক্তে ভিজে গেছে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। আবার তিনি লোকটার মুখের দিকে তাকালেন। চোখ দুটো। এখন বন্ধ। কান পেতে শুনলেন, বিড় বিড় করে বলছে রানা, এবার আমি ঘুমাব, লুবনা। এবার একটু ঘুমাব।

কর্নেলের আঙুলগুলো ব্যথা করতে শুরু করল, তবু চাপ এতটুকু ঢিল হতে দিলেন না। এই লোকের জীবন আক্ষরিক অর্থেই এখন তার হাতে। কিছু শব্দ ঢুকল তার কানে। সাইরেনের একটানা বিলাপ, অতি ব্যস্ত রেমারিকের নাক দিয়ে। গোঙানির মত আওয়াজ।

চোখ বন্ধ করে রানা যেন ঘুমাচ্ছে। মুখে ব্যথা-বেদনার কোন চিহ্ন নেই, চেহারায় পরম প্রশান্তি। এদিক-ওদিক মাথা নাড়লেন কর্নেল গুগলি, খুবই যেন হতাশ হয়েছেন।

.

১২.

জানাজায় প্রচুর লোক হল।

দিনটা ঠাণ্ডা, আকাশে মেঘ। নেপলসের পাহাড় ছুঁয়ে একটানা দখিনা বাতাস। বইছে। ইটালির সবগুলো দৈনিক থেকে রিপোর্টাররা এসেছে। বিদেশী রিপোর্টারও সংখ্যায় অনেক, পঞ্চাশ জনের কম হবে না। বাকালা মারা যাবার পরদিন থেকে, গত একটা মাস এই একটা খবরই হেডিং ছিল কাগজগুলোয়। এই একটা মাস বেঁচে থাকার জন্যে যেন নিয়তির সঙ্গে যুদ্ধ করেছে রানা, তার ভাল-মন্দের খবর। বশেষ বুলেটিন আকারে ছাপা হয়েছে সকাল-সন্ধ্যায়।

নিষ্ফল একটা যুদ্ধ, শেষ পর্যন্ত হেরে গিয়েছে বেচারা।

প্রথমে রানাকে রাখা হয় পালার্মোয়, ইনটেনসিভ কেয়ারে। মেডিক্যাল বোর্ড থেকে সাংবাদিকদের বলা হল, ওর বেঁচে থাকার ক্ষীণ একটু আশা থাকলেও থাকতে পারে, মারা যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে বেঁচে থাকল রানা, প্রাণ ধরে ঝুলে থাকল। দুহপ্তা পর কারাবিনিয়ারির বিশেষ একটা প্লেনে করে নেপলসে নিয়ে আসা হল ওকে। প্রস্তাব এবং ব্যবস্থা, সবই কর্নেল গুগলির। পালামোর হাসপাতালের চেয়ে নেপলসের কারাদারেলি হাসপাতালে। অনেক ভাল ইকুইপমেন্ট আছে, অনেক বেশি নিরাপদও।

ডাক্তাররা সবাই জান-জীবন দিয়ে লড়ল। অবশেষে একটু আশার আলোও দেখল তারা। কিন্তু জখমগুলো খুবই মারাত্মক, বেঁচে থাকার প্রচণ্ড আকুতি থাকলেও শেষ পর্যন্ত কি হয় বলা যায় না।

সত্যি বলা যায়নি। মাসের শেষের দিকে দিনে দিনে খারাপের দিকে যেতে লাগল রানার অবস্থা। ভিজিটর একেবারে নিষিদ্ধ। ইটালি জুড়ে সাধারণ মানুষ। প্রার্থনা করল ওর জন্যে। মেজর জেনারেল রাহাত খান ঢাকা থেকে নেপলসে চলে এলেন, সঙ্গে তিনজন বাংলাদেশী ডাক্তার। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। মারা যাবার আগের দিন ছাপা হল কাগজে, কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান ফিরে পেয়েছিল মাসুদ রানা, ইটালীর জনসাধারণকে ধন্যবাদ জনিয়েছে সে। পরদিন সকালে চিরবিদায় নিল মহান বাঙালি যুবক।

রানাকে মৃত বলে ঘোষণা করলেন কর্নেল গুগলির বড় ভাই। সার্জেন ভদ্রলোক মেডিক্যাল বোর্ডের ডিরেক্টর নির্বাচিত হয়েছিলেন। জানপ্রাণ দিয়ে খেটেছেন গত একটা মাস।

আজ সাংবাদিকরা নাটকের শেষ দৃশ্যটা দেখতে এসেছে। খোলা কবরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অনেক গণ্যমান্য মানুষ। জানাজা পড়িয়েছেন নেপলস শাহী মসজিদের ইমাম সাহেব। নেপলসের সমস্ত নারী-পুরুষ হাজির হয়েছে গোরস্থানে।

মা আর ভাইকে নিয়ে কবরের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে রেমারিক। ওদের মা। কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, লাঠির ওপর ভর দিয়ে। তার পরনে কালো পোশাক, বুকের কাছে ক্ৰশটা মুঠোয় নিয়ে বিড়বিড় করে বাইবেলের অংশ বিশেষ পড়ছে। ওদের পাশে জুলিয়ানা, তার পাশে ফুরেলা। জুলিয়ানার চোখ দুটো লাল। কবরের। উল্টো দিকে রয়েছেন কর্নেল গুগলি আর পাধানি, ওদের মাঝখানে লরা আভান্তি। খানিক আগে পর্যন্ত তাকেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখা গেছে। এখনও কাঁদছে, তবে আওয়াজ নেই, শুধু দুগাল বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। যাক, এতদিনে শান্তি হল মেয়েটার; লুবনার পাশেই কবর দেয়া হচ্ছে মাসুদ রানাকে। প্রভু, শান্তি হোক মহৎ-হৃদয় লোকটার মহান আত্মার।

কবরের ভেতর নামানো হল লাশ। কফিন নামাচ্ছেন মেজর জেনারেল রাহাত খান। আগেই কবরে নেমে দাঁড়িয়েছেন তিনি। তাঁর চোখে পানি নেই। শুধু খানিকটা উদভ্রান্ত, খানিকটা ভাষাহীন দৃষ্টি। কাঁচাপাকা ভুরুতে মাটি লেগে আছে। কবরে নামার সময় একটু পিছলে গিয়েছিলেন। কর্নেল গুগলির পাশে দীর্ঘদেহী এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে রয়েছেন, উনি ফ্রেঞ্চ জেনারেল। মাসুদ রানাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে পুরোদস্তুর ইউনিফর্ম পরে এসেছেন তিনি। জেনারেলের পাশে থমথমে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভিনসেন্ট গুগল।

কবরে মাটি চাপা দেয়ার পর ফ্রেঞ্চ জেনারেল স্যালুট করলেন। সবাই ঘুরে দাঁড়াল, শুধু মেজর রাহাত খান দাঁড়িয়ে থাকলেন, আর দাঁড়িয়ে থাকল লরা আভান্তি।

রেমারিক আর পাধানি দেখল, রাহাত খানের দিকে এগোতে শুরু করেও কি ভেবে দাঁড়িয়ে পড়লেন কর্নেল গুগলি, তারপর কবর ঘুরে লরা আভান্তির পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাকে নিয়ে কবরস্থানের গেটের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। গেটের বাইরে বেরিয়ে এসে লরাকে তার গাড়িতে উঠতে সাহায্য করলেন। তারপর নিজেও উঠে তার পাশে বসলেন।

রেমারিক আর পাধানির দিকে চোখ পড়তে হাত নাড়লেন কর্নেল। তারপর। গাড়ি ছেড়ে দিলেন।

সেইদিন সান্ধ্য-দৈনিকে ছাপা হল মাসুদ রানার মৃত্যু-সংবাদ। একটি পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হলঃ এদেশের মিষ্টি এক মেয়ে একটা গান উপহার দিয়েছিল বাংলাদেশের এক দুঃসাহসী যুবককে। বলেছিল, একদিন ছাড়াছাড়ি হবে, তখন যেন আমার কথা ভুলে যেয়ো না। এক সময় থেমে যাবে সমস্ত কোলাহল, ঘুমিয়ে। পড়বে ধরণী। আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটা মিটমিট করলে বুঝবে আমি। তোমায় ডাকছি। সে রাতে তুমি জেগে থেকো, বন্ধু, ঘুমিয়ে পোডড়া না। আর হ্যাঁ, ফুলের গন্ধ পেলে বুঝে নিয়ে আমি আসছি। আর যদি কোকিল ডাকে, ভেবো আমি আর বেশি দূরে নেই। তারপর হঠাৎ ফুরফুরে বাতাস এসে তোমার গায়ে। লুটিয়ে পড়লে বুঝবে আমি এসেছি। সে-রাতে তুমি জেগে থেকো, বন্ধু, ঘুমিয়ে পোড়ো না!

 এই পবিত্র ভালবাসার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে সেই বিদেশী যুবক।

কামনা করি, তার চিরনিদ্রা শান্তিময় হোক। আমেন।

.

১৩.

মাঝরাত পেরিয়ে যাচ্ছে।

গোজোর পাহাড়ে পাহাড়ে বাতাসের ফিসফিসানি।

চাপা স্বরে কী সব জল্পনা-কল্পনা।

গ্রামগুলো অন্ধকার, কিন্তু ঘুমিয়ে নেই।

রুচিতাস-এর ঝুল-বারান্দায় একজোড়া ভারি বুট দেখা গেল, লোমশ একটা ভারি হাত পড়ল রেলিঙের ওপর। বিদ্রোহীর চোখ পড়ে আছে জেটির দিকে। তার পিছনে দরজা খুলে গেল, পাশে এসে দাঁড়াল ক্ষতি কি! ক্ষতি কি-র হাত থেকে বিয়ারের একটা গ্লাস নিল বিদ্রোহী। দুজনেই সাগরের দিকে তাকিয়ে।

ফেরিবোট ডলফিন বাতাসের ধাক্কায় পানির ওপর মৃদুমন্দ দুলছে, জেটির সঙ্গে বাঁধা রয়েছে ওটা। ব্রিজের ডানায় দাঁড়িয়ে রয়েছে অক্লান্ত। সে-ও অপেক্ষা করছে, চুমুক দিচ্ছে বিয়ারের গ্লাসে।

হাজির আর গুঁফো রয়েছে পাহাড়ের মাথায়, দুজনের চোখে দুটো বিনকিউলার।

পুলিস-লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে আছে পুলিস অফিসার মেনিনো। বন্দরের শান্ত পানি কেটে সাবলীল গতিতে এগিয়ে আসছে লঞ্চ। জেটি আর বেশি দূরে নেই।

রুচিতাস-এর পিছনের রাস্তায় হ্যাণ্ডব্রেক রিলিজ হল, ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল ল্যাণ্ড-রোভার। গড়াতে গড়াতে জেটির শেষ প্রান্তে এসে থামল সেটা। ওখানটা অন্ধকার। একমাত্র বালবটা কি করে জানি ফিউজ হয়ে গেছে।

জেটিতে ভিড়ল লঞ্চ। আবার ডেকে বেরিয়ে এল মেনিনো। দশ মিটার দূরে। পার্ক করা রয়েছে ল্যাণ্ড-রোভার। আবছা অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি কোন রকমে। দেখতে পেল সে। মূর্তিটা দরজা খুলে নিচে নামল। ভাল করে দেখার পর মেনিনো বুঝল, ওটা একটা নারীমূর্তি।

পিছন দিকে হাত নাড়ল মেনিনো। হুইল হাউস থেকে বেরিয়ে এল মানুষটা, মেনিনোকে পাশ কাটিয়ে জেটির দিকে এগোল। ধীর পায়ে হাঁটছে সে। লম্বা। শরীর, হাঁটার ভঙ্গিটা অদ্ভুত, প্রথমে মাটি ছোঁয় পায়ের বাইরের অংশ।

মেয়েটা এগিয়ে এসে আলিঙ্গন করল লোকটাকে।

সিগন্যাল দিল মেনিনো। এঞ্জিন থেকে জোরাল আওয়াজ বেরুল। মুখ ঘুরিয়ে। খোলা সাগরের দিকে ছুটল পুলিস-লঞ্চ।

পিছনে তাকিয়ে অস্পষ্টভাবে এখনও দেখতে পাচ্ছে মেনিনো, দুটো ছায়া এক হয়ে আছে।

গোজোর পাহাড়ে পাহাড়ে বাতাসের ফিসফিসানি।

চাপা স্বরে কী সব জল্পনা-কল্পনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *