অকাল কুষ্মাণ্ড
কুষ্মাণ্ডের সাধারণ অর্থ কুমড়া বা কাঁকুড় (কর্কোটিকা, শসা জাতীয় লতাফল)। কুষ্মাণ্ডের আরেক অর্থ গণদেবতা। শিবের একশ্রেণীর দানব (?) অনুচরদেরও কুষ্মাণ্ড বলা হয়। আমাদের আলোচ্য অকাল কুষ্মাণ্ড একটি প্রবাদ হিসেবে এদেশে প্রচলিত। এর অর্থ অকালে বা অসময়ে উৎপন্ন কুমড়ার মতো অকেজো, অনুপযুক্ত, মূর্খ কিংবা পরিবার ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর মানুষ। প্রবাদটির উৎস খুঁজতে আমাদের যেতে হয় মহাভারতের কাহিনীতে।
গান্ধার (আফগানিস্তানের কান্দাহার) দেশের রাজা সুবলের মেয়ে গান্ধারীর (গান্ধার দেশের কন্যা বলে তার এই নাম) সাথে বিয়ে হয়েছিল ধৃতরাষ্ট্রের। তিনি কুমারী থাকাকালে শিবের কাছে শতপুত্রের মা হবার বর পেয়েছিলেন। ধৃতরাষ্ট্রের সাথে বিয়ে হবার পর বেদব্যাস মুনির কাছে একই বর পান তিনি।
একই সময়ে গর্ভবর্তী হলেও ছোটজা পাণ্ডুপত্নী কুন্তি আগে পুত্রসন্তান লাভ করায় গান্ধারীর প্রচণ্ড হিংসে হয়। দীর্ঘ দু’বছর গর্ভধারণ করার পরও যখন তার সন্তান প্রসব হলো না তখন তিনি রেগেমেগে নিজের পেটে আঘাত করে গর্ভপাত ঘটালেন। ফলে তার গর্ভ থেকে নির্গত হলো লোহার মতো কঠিন এক মাংসপিণ্ড। বিরক্তি সহকারে গান্ধারী ঐ মাংসপিণ্ড ফেলে দিতে উদ্যত হলেন। সে সময় উপস্থিত হলেন ব্যাসদেব। গান্ধারী মুনিকে বললেন, ‘আপনি আমাকে শতপুত্রের জননী হবার বর দিয়েছিলেন। এই মাংসপিণ্ডই কি আমার সেই শতপুত্র?’
মনোযোগ সহকারে মহামুনি বেদব্যাস গান্ধারীর ক্ষোভ ও দুঃখের কথা শুনলেন। অতঃপর শান্তভাবে বললেন, ‘আমার কথার নড়চড় হবে না। নিরালা জায়গায় একশোটি ঘিয়ে পূর্ণ কলসি স্থাপন কর। তার আগে মাংসপিণ্ডটি শীতল জলে পরিষ্কার কর।’
কথামতো মাংসপিণ্ডটি শীতল জলে পরিষ্কার করার পর ব্যাসদের তা একশো ভ্রূণে বিভক্ত করেন এবং একশোটি কলসিতে এক এক করে সেগুলো রাখলেন। পরে আরেকটি কলসি স্থাপন করা হলো আলাদাভাবে। অতঃপর কলসির মুখ ঢেকে রাখা হলো। এর একবছর পর প্রথম কলসির ঢাকনা খুলে দেখা গেল নবজাত দুর্যোধনকে। অতঃপর পরবর্তী একবছর এক মাসের মধ্যে একে একে জন্ম হলো দুঃশাসন, দুঃসহ ইত্যাদি নিরানব্বই পুত্র ও দুঃশলা নামে এক কন্যার। ধৃতরাষ্ট্রের এই একশো পুত্র ও এক কন্যার নাম উদ্ধৃত করছি, যদিও কোথাও কোথাও কিছু কিছু নামে হেরফের লক্ষ করা যায়। মহাভারতের আদিপর্বের ৬৭তম ও ১১৭তম অধ্যায়ে ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে গান্ধারীর একশো পুত্র ও এক কন্যার নাম পাওয়া যায়। নামগুলো হচ্ছে—
১. দুর্যোধন, ২. দুঃশাসন, ৩. দুঃসহ, ৪. দুঃশল, ৫. জলসন্ধ, ৬. সমন, ৭. সহন, ৮. বিন্ধ, ৯. অনুবিন্ধ, ১০. দুর্ধর্ষ, ১১. সুবাহু, ১২. দুষ্প্রধর্ষণ, ১৩ দুমর্ষণ, ১৪. দুর্মুখ, ১৫. দুষ্কর্ণ, ১৬. কর্ণ, ১৭. বিকর্ণ, ১৮. সল, ১৯. সুলোচন, ২০. চিত্র, ২১. উপচিত্র, ২২. চিত্রাক্ষ, ২৩. চারুচিত্র, ২৪. শরাসন, ২৫. দুর্মদন, ২৬. দুর্বিগাহ, ২৭. বিলিৎসু, ২৮. বিকটানন (বিকটিনন্দন), ২৯. ঊর্ণলাভ, ৩০. সুনাভ, ৩১. নন্দ, ৩২. উপনন্দ, ৩৩. চিত্রবাণ, ৩৪. চিত্ৰবৰ্মা, ৩৫. সুবর্মা, ৩৬. দুর্বিমোচন, ৩৭. অয়োবাহু, ৩৮. মহাবাহু, ৩৯. চিত্রাঙ্গ, ৪০. চিত্রকুণ্ডল, ৪১. ভীমবেগ, ৪২. ভীমবল, ৪৩. বালাকি, ৪৪. বলবর্ধন, ৪৫. উগ্রায়ুধ, ৪৬. সুষেণ, ৪৭. কুণ্ডাধর, ৪৮. মহোদর, ৪৯. চিত্রায়ুধ, ৫০. নিষঙ্গী, ৫১. পাশী, ৫২. বৃন্দারক, ৫৩. দৃঢ়বর্মা, ৫৪. দৃঢ়ক্ষত্র, ৫৫. সোমকীর্তি, ৫৬ অনুদর, ৫৭. দৃঢ়সন্ধ, ৫৮. জরাসন্ধ, ৫৯. সত্যসন্ধ, ৬০. সহস্রবাক, ৬১. উগ্রশ্রবা, ৬২. উগ্রসেন, ৬৩. সেনানী, ৬৪. দুষ্পরাজয়, ৬৫. অপরাজিত, ৬৬, কুণ্ডশায়ী, ৬৭. বিশালাক্ষ, ৬৮. দুরাধর, ৬৯. দৃঢ়হস্ত, ৭০. সুহস্ত, ৭১. বাতবেগ, ৭২. সুবর্চা, ৭৩. আদিত্যকেতু, ৭৪. বহ্বাশী, ৭৫. নাগদত্ত, ৭৬. উগ্ৰশায়ী, ৭৭. কবচী, ৭৮. ক্রধান, ৭৯. কুণ্ডী, ৮০. ভীমবিক্রম, ৮১. ধনুর্ধর, ৮২. বীরবাহু, ৮৩. উগ্র, ৮৪. ভীমরথ, ৮৫. অলোলুপ, ৮৬. অভয়, ৮৭. দৃঢ়কর্মা, ৮৮. দৃঢ়রথ, ৮৯. অনাধৃষ্য, ৯০. কুণ্ডভেদী, ৯১. বিরাবী, ৯২. প্রমথ, ৯৩. প্রমাথী, ৯৪. দীর্ঘলোচন, ৯৫. দীর্ঘরোম, ৯৬. দীর্ঘবাহু, ৯৭. সুজাত, ৯৮ কনকধ্বজ (কাঞ্চনধ্বজ), ৯৯. কুণ্ডজ (কুণ্ডশায়ী), ১০০. ব্যুঢ়োরু।
একমাত্র কন্যার নাম দুঃশলা। নানা স্থানে চিত্রক, মহাবাহু, সুবীর্যবান, অমাপ্রমাথী, বিবিংশতি, রৌদ্রকর্মা ইত্যাদি নাম পাওয়া যায় যা উপরোক্ত কোনো নামের নামান্তর বলে মনে হয়। তাছাড়া নামের ক্রমিকে কিছুটা গড়মিল এখানে থাকতে পারে বলে মনে হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে, গান্ধারীর শতপুত্রের জন্ম অস্বাভাবিক বলে মনে হলেও তা নাকি আধুনিককালের ‘Reproductica through in vitro fertilisation’ পদ্ধতির মতো। মহাভারতের আদিপর্বের ১১৪ অধ্যায়ের ১৭ সংখ্যক শ্লোকে বলা হয়েছে—
‘অতঃপর ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী গান্ধারী এক টুকরা মাংসপিণ্ড প্রসব করেন যা ব্যাস ১০০ টুকরায় বিভক্ত করেন এবং প্রত্যেক টুকরা এক একটি পাত্রে রাখেন। যথাসময়ে প্রতিটি টুকরা থেকে এক একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয়।’
অন্যায় ষড়যন্ত্র, কুরুক্ষেত্রের ১৮ দিনব্যাপী মহাযুদ্ধ এবং কুরুবংশ ধ্বংসের মূল হোতা হিসেবে গান্ধারীর শতপুত্রকে দায়ী করা হয়। তাদের রাজ্যলোভ, অন্যায় আচার-আচরণ, মাত্রাতিরিক্ত বিলাস এবং ভোগস্পৃহা ভারতযুদ্ধের মতো ভয়াবহ পরিণতি এনেছে বলে অকালজাত কৌরব- ভ্রাতাদের অকাল কুষ্মাণ্ড বলা হয়। আমাদের সমাজে আমরা এ প্রবাদকে প্রায় একই অর্থে ব্যবহার করি অপদার্থ, দুষ্কর্মা, ক্ষতিকর ও অনিষ্টকারীদের বুঝাতে।