1 of 3

০৪৪. লিভিং রুমের ঠিক মাঝখানটায়

বেলা দুটোর সময়ে চারুশীলা তার লিভিং রুমের ঠিক মাঝখানটায় কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত বিরস মুখে চারদিকে চেয়ে দেখে নিয়ে ঘোষণা করল, বাড়িটার আর্কিটেকচারাল ডিজাইন ভীষণ সেকেলে আর যাচ্ছেতাই। তোমারও নিশ্চয়ই তাই মনে হয় ঝুমকি? কী বিচ্ছিরি সব কোণ আর খাজ! জানালাগুলো যথেষ্ট প্যানোর্যামিক নয়। ফ্লাশ ডোরের চেয়ে অনেক ভাল কি জানো? ডেকোরেটিভ ডাবল ডোর। আর ফ্লোরিংটাও দেখা। এ তো আর আসল মার্বেল নয়, অনেকটা মার্বেলের মতো দেখতে। নাঃ, আর একটা মডার্ন বাড়ি করতেই হবে মনের মতো।

চারুশীলার বরের একটা পারসোনাল কম্পিউটার আছে। সেটা বিশেষ ব্যবহার হয় না। ভদ্রলোক দেশ ও বিদেশে এত বনাবন কর ঘুরে বেড়ায় যে নিজের বাড়িতে থাকার বা জিনিসপত্র ব্যবহার করার সুযোগই হয় না বড় একটা। এই পিসি-তে প্রায়ই এসে প্র্যাকটিস করে ঝুমকি। চারুশীলাই বলেছে, রোজ দুপুরের দিকে চলে আসবে। তোমার প্র্যাকটিসও হবে। আর আমিও কথা কয়ে বাচবো।

ঝুমকির আত্মসম্মানবোধ প্রবল। একটু অনাদর বা উপেক্ষা বুঝতে পারলেই সে হাজার হাত তফাত হয়ে যায়। হয়তো অভিমান আর হীনম্মন্যতা থেকেই সে এরকম। অন্তত তার বাবা একদিন এরকমই বলেছিল তাকে। তবু ঝুমকি তার নিজেরই মতো। চারুশীলার পাগলামি এবং অপচয় দেখে সে অবাক হয়। অনেক টাকা আছে চারুশীলাদের, কিন্তু টাকার অহংকার নেই। চারুশীলা পাগলের মতো টাকা খরচ করে। ঝুমকি আসছে যাচ্ছে মাত্র কয়েক মাস হল। তার মধ্যেই সে অন্তত বার পাঁচেক দেখল, চারুশীলা জলের দরে পুরনো আসবাব কিছু না কিছু বিক্রি করে নতুন আসবাব আনছে। পাল্টে ফেলছে সোফার কভার, জানালার পর্দা, বাসনপত্র। বাইরের ঘরের মেঝের পুরনো মার্কেল টালি তুলে ফেলে নতুন টালি পাতা হল এই তো সেদিন।

এখন বাড়িটাও পাল্টাতে চায় দেখে ঝুমকি একটু অবাক হয়ে বলল, কেন মাসি, এ বাড়ির ডিজাইন তো ভীষণ মডার্ন। সেকেলে বলছি কেন?

চারুশীলা চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখে নিতে নিতে বলল, আমার কাছে বড্ড পুরনো হয়ে গেছে। একরকম প্যাটার্ন কি রোজ দেখতে ভাল লাগে?

ঝুমকি একটু হাসল, তোমার অনেকগুলো বাড়ি থাকা উচিত ছিল। ঘুরে ঘুরে থাকতে পারতে। চারুশীলা ঝুমকির দিকে চেয়ে ভ্ৰা ওপরে তুলে বলল, আরে, ঠিক তো! এজন্যই আগের দিনের লোকেরা অনেকগুলো করে বাড়ি করত। আসুক তোমার মেসো, কথাটা বলতে হবে তো! এত এত বাড়ি তৈরি করে দিচ্ছে লোককে, নিজের কেন তবে একখানা মোটে বাড়ি?

ঝুমকি ঠাট্টা করে বলে, কটা বাড়ি চাও? গোটা দশেক?

আরে না। করপোরেশনের কী সব আইন-টাইন আছে বোধ হয়। অতগুলো করতে দেবে না।

দেবে। শুনেছি নিজেদের বাড়ি থাকলে সরকারি ফ্ল্যাট বা বাড়ি পাওয়া যায় না।

বেজার মুখ করে চারুশীলা বলে, সেইজন্যই তো সল্ট লেক-এর প্লটটা নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকি। ওটা আমার নামে। এটা তোমার মেসোর নামে। সবাই ভয় দেখাচ্ছে, টের পেলে নাকি জমি কেড়ে নেবে। আমি অবশ্য সল্ট লেকে যেতে চাই না।

কেন মাসি, ফ্যান্টাস্টিক জায়গা তো!

মোটেই নয়। ভাল ডিজাইনের বাড়ি করব, দেখবে কে বলো! কটা লোক ওখানে? তা ছাড়া ওখানে থাকলে কেউ যাবে না।

কেন, নির্জনতা তোমার ভাল লাগে না? আমার তো খুব ভাল লাগে।

ও বাবা, নির্জনতা আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। আমি চাই সবসময়ে হই-চইয়ের মধ্যে থাকতে। নির্জনে থাকলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে, কান্না পায়। আরও একটা ব্যাপার আছে। শুনলে তুমি হাসারে।

কী গো মাসি?

হাসবে না তো! নির্জনে আমার ভীষণ ভূতের ভয় হয়।

ঝুমকি হেসে ফেলল, কলকাতায় আর ভূত কোথায় মাসি? তারা সব আলো আর শব্দের ঠেলায় পালিয়ে গেছে।

ভয়ের জন্য কি ভূতের দরকার হয়? ভূত নেই তা জানি, কিন্তু তার ভয়টা তো আর নেই হয়ে যায়নি। ফাঁকা বাড়িতে একা থাকলে আমার দিনের বেলাতেও ভূতের ভয় করে। আমাকে কেমন একা থাকতে হয় জানো তো। কর্তা হিল্লি-দিল্লিলন্ডন-নিউ ইয়র্ক করে বেড়াচ্ছেন। ছেলেমেয়েরা ইস্কুলে, তখন কী রকম যে লাগে! এই, আমি তোমাকে ডিস্টার্ব করছি না তো!

না, না। আমি তো তোমার সঙ্গে গল্প করতেই আসি।

রোজ আসবে। আমি তো ভীষণ বকবক করতে ভালবাসি।

তুমি সিনেমা করা ছেড়ে দিলে কেন?

চারুশীলা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, বিয়ের পর আর করতে দিল কই? আর আমারও ভীষণ বোরিং লাগত। মোটিভেশন ছিল না তো! ভাল অভিনয় করব, টাকা রোজগার করব, সবাইকে অ্যাট্রাক্ট করব–একটা কোথাও অ্যাম্বিশন তো থাকবে! আমার কিছুই ছিল না। তার ওপর আমাদের বাড়িটাও তো খুব কনজারভেটিভ। আমার এক কাকা ডিরেক্টর ছিলেন, তিনিই নামিয়ে দিয়েছিলেন।

মোট কটা ছবি করেছিলে?

চারটে। দুটোয় নায়িকা। সে দুটোই ফ্লপ। আর দুটোতে সাইড রোল। সে দুটোও চলেনি।

এই বলে চারুশীলা খুব হাসল।

ঝুমকি বলল, আমি একটাও দেখিনি।

দেখবে কি করে? সুপার ফ্লপ যে। রি-রান তো হয় না।

তুমি যদি আজও সিনেমা করতে তাহলে একজন নায়িকার সঙ্গে পরিচয় আছে বলে গল্প করতে পারতাম বন্ধুদের কাছে।

আমার কিন্তু ভাই একদম ভাল লাগত না। বড্ড একঘেয়ে। শুটিং-এর মতো বোরিং জিনিস হয় না। তার ওপর আবার নায়িকাদের পাবলিক লাইফ নেই। দোকানে বাজারে যেতে পারে না, রাস্তায় বেরোতে পারে না।

তোমার হয়েছে সেরকম?

চারুশীলা মুচকি হেসে বলে, নায়িকা বলে নয়, তবে এককালে রাস্তায় বেরোলে সবাই তাকাত।

এখনও তাকায়। তুমি এখনও যা সুন্দর! কী ফিগার!

যাঃ। কত মুটিয়ে গেছি!

একটুও মুটিয়ে যাওনি।

তোমাকে আর মন-রাখা কথা বলতে হবে না। কত বয়স হল বলো তো!

তোমার বয়স বোঝাই যায় না।

খুব যায়। আয়নায় যখন নিজেকে দেখি তখন দেখতে পাই মুখের চামড়া কত লুজ হয়ে গেছে।

ওটা তোমার সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার। মোটেই চামড়া লুজ হয়নি। তুমি তো মোটে আর্লি থার্টিজ।

মিড থার্টিজ। এখন আর হিসেব করি না। ভয় করে। কর্তা কী বলে জানো? আমার একটা চুল পাকলেই নাকি ডিভোর্স করবে।

ওটা তো ঠাট্টা।

পুরুষমানুষদের বিশ্বাস নেই ভাই। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, কত সুন্দরীদের দেখছে।

ঝুমকি লজ্জার হাসি হেসে বলে, যাঃ। মেসো তোমাকে যা ভালবাসে!

একটা জিনিস শিখে রাখো, পুরুষমানুষকে বেশী একা ছেড়ে দিতে নেই।

তুমিই-বা ছাড়ো কেন? সঙ্গে থাকলেই পারো!

আগে সঙ্গেই থাকতাম। সঙ্গে সঙ্গে সারা পৃথিবী ঘুরে বেরিয়েছি। এখন ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ছে, আমার হাত-পা বাঁধা। বিয়ে হলে বুঝবে।

বিয়েতে আমার কোজ নেই বাবা।

চারুশীলার ভ্রূ হঠাৎ কুঁচকে গেল। চিন্তিত মুখে হঠাৎ একটা চেয়ার টেনে এনে ঝুমকির মুখোমুখি বসে বলল, আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় যে ওরা দুজনে দুজনের প্রেমে পড়েছে?

কারা মাসি?

আহা, আমার ভাই হেমাঙ্গ আর রশ্মি। কী মনে হচ্ছে?

অবাক হয়ে ঝুমকি বলে, কি করে বলব বলো তো!

কিছু মনে হয় না। ওদের দেখে?

তোমার ভাই মেয়েদের বেশ ভয় পায়।

আর রশ্মি?

রশ্মি খুব চালাক।

একটু দমে গিয়ে চারুশীলা বলে, তাহলে কি ব্যাপারটা হয়ে ওঠেনি বলছ!

আমি বুঝতে পারি না মাসি। দুজনেই হাইলি এড়ুকেটেড, দুজনেই অ্যাডাল্ট, আন্ডারস্ট্যান্ডিং।

চারুশীলা হতাশ গলায় বলে, আমারও কি রকম মনে হয়, ওরা ঠিক প্রেমে পড়ছে না। দেয়ার ইজ এ সুইট রিলেশন, বাট নাথিং মোর দ্যান দ্যাট। কিন্তু কেন বলো তো? ওরা প্রেমে পড়ছে না-ই বা কেন?

এমনভাবে বলছি যেন প্রেমে পড়া আর জলে লাফিয়ে পড়া একই ধরনের ব্যাপার। লাফ দিয়ে পড়লেই হল!

চারুশীলা একটু হাসল, তোমরা এ-যুগের ছেলেমেয়েরা কিরকমভাবে প্রেমে পড়?

আমরা মোটেই সহজ পাত্ৰপাত্রী নই। কত টেনশন আমাদের! কেরিয়ার আছে, প্ল্যানিং আছে, তারপর অ্যাডজাস্টমেন্ট, টেম্পারামেন্ট এসব ফ্যাক্টর আছে।

দূর! অত ফ্যাকরা থাকলে কি প্রেম হয়?

হয়। তবে আবেগটা বেশী থাকে না।

প্ৰেম তো একটা আবেগাই। তোমার নেই?

আছে হয়তো। তবে বুঝতে পারি না।

তুমি এ পর্যন্ত কারও প্রেমে পড়নি?

ঝুমকি ভীষণ লজ্জা পেয়ে বলে, প্রেমে পড়তে খুব ভয় পাই। আমি পড়লেও সে হয়তো পড়বে না। আমার তো চেহারা নেই!

কী নেই?

চেহারা।

তোমার মাথা! বলে চারুশীলা হেসে ফেলে, রোগা বলে বলছ? রোগা হওয়ার জন্য কত মেয়ে কত সাধ্যসাধনা করে। তা জানো? গায়ে একটু মাংস লাগলেই তুমি তো ভীষণ সুন্দরী!

যাঃ।

তা হলে দেখবে?

কী দেখব?

আমি আজ থেকে তোমার খাওয়ার চার্ট করে রোজ তোমাকে খাওয়াবো। সাত দিনের মধ্যেই তুমি আর তোমাকে চিনতে পারবে না।

মুখটা বিষণ্ণ করে ঝুমকি বলল, আমি তো খেতেই পারি না। মায়ের সঙ্গে খাওয়া নিয়েই তো আমার রোজ ঝামেলা হয়। মা বলে আমার পাকস্থলীটা নাকি একটা হাঁসের ডিমের মতো ছোট্ট।

চারুশীলা বলে, তোমাদের বয়সী রোগা মেয়েদের তো ওইটেই ভীষণ দোষ। খেতে চাও না।

ঝুমকি মৃদু হেসে বলে, মোটাসোটা হলেও আমি মোটেই সুন্দরী হয়ে উঠবো না। আমার ফেস কাটিং ভাল নয়।

চারুশীলা হঠাৎ আনমনা হয়ে গেল। ঝুমকি সুন্দর কিনা সেই পয়েন্ট নিয়ে আর মাথা ঘামাল না। কিন্তু ঝুমকির আর একটু শুনতে ইচ্ছে করছিল। চারুশীলা বলল, আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় না ঘটনাটা ঘটা উচিত ছিল?

কোন ঘটনা মাসি?

হেমাঙ্গ আর রশ্মির একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং। ওদের তো বেশ ভালই মানাত।

তা মানাত, একটু ধৈৰ্য ধরো, হয়েও যেতে পারে।

হবে? বলে চারুশীলা খুব হতাশা মাখানো মুখে খানিকক্ষণ বসে থেকে বলে, যদি না হয়? না হলে আমার একটা হার হয়ে গেল।

হার কেন মাসি?

মনে মনে যে আমি একটা প্ৰতিজ্ঞা করেছিলাম, আমার ওই হাঁদা ভাইটার একটা গতি করেই ছাড়বো।

এমন কিছু বয়স তো আর হয়ে যায়নি।

চারুশীলা মাথা নেড়ে বলে, বয়সটা বড় কথা নয়। আসল কথা হল অ্যাটিচুড। ও মেয়েদের ভীষণ ভয় পায় এবং অপছন্দ করে। নরম্যালি বিয়ে দেওয়া প্ৰায় অসম্ভব। কিন্তু যদি প্ৰেমে-ট্রেমে পড়ত তাহলে হয়ে যেত। রশ্মিকে দেখে আমার মনে হয়েছিল, হয়তো হয়েই যাবে। রশ্মি কিন্তু ওর ওপর একটু উইকনেসও দেখাচ্ছে।

ভালই তো মাসি। এবার তুমি একটু ধৈর্য ধরো না!

হেমাঙ্গ যে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কিছুতেই রশ্মির সঙ্গে দেখা করাতে পারছি না।

হি হি করে হেসে ফেলে বলে, তোমার যে কী সব অদ্ভুত প্রবলেম। কে কার প্রেমে পড়ছে না বলে তোমার চোখে ঘুম নেই! তুমি কিন্তু খুব অদ্ভুত।

চারুশীলা একটু লজ্জা পেয়ে বলে, ঠিকই বলেছ। আমার সব সামান্য সামান্য ব্যাপার নিয়ে অকারণে টেনশন হয়। কেন বলো তো! এটা কি কোনও নার্ভ ডিজিজ?

ডিজিজ নয়। আসলে তোমার হাতে অনেকটা ফাঁকা সময় থাকে। কিছু কাজ করতে হয় না। তাই আবোল-তাবোল ভাবনা আসে।

কী করব বলো তো!

বেরিয়ে পড়বে। খুব ঘুরে বেড়াবে। সিনেমা থিয়েটার দেখবে, গান শুনবে, এগজিবিশনে যাবে। ইচ্ছে করলে কোনও একটা ট্রেনিং ও নিতে পারো।

সিনেমা থিয়েটার আমার বেশি ভাল লাগে না। তার চেয়ে জীবনে সিনেমা বা নাটকের মতো কিছু ঘটিয়ে তুলতেই আমার বেশি ভাল লাগে। ধরে একজনের সঙ্গে আর একজনের একটা প্ৰেম ঘটিয়ে দিলাম বা বন্ধুত্ব করে দিলাম বা বিয়ে—যা হোক একটা কিছু।

ও বাবা! তুমি তো সাংঘাতিক। ঝগড়া লাগিয়ে দাও না তো!

না রে মেয়ে। আমি বুঝি ততটাই খারাপ? আচ্ছা হ্যাঁ, তোমার প্রেমে সত্যিই কেউ পড়েনি?

ঝুমকি মুচকি হেসে বলে, তুমি ঘটাতে চাও নাকি একটা?

আগে বলো, কেউ পড়েছে

না, কেউ কখনও আমার প্রেমে পড়েনি।

চিঠি দেয়নি? পিছু নেয়নি? কথা বলার চেষ্টা করেনি?

না। একদম না।

বাজে কথা। সত্যি করে বলো তো!

সত্যিই বলছি।

হতেই পারে না।

কেন হতে পারে না মাসি? পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতী আছে, সবাইকেই কি প্রেমে পড়তে হবে? ওটা ছাড়া বুঝি তাদের আর কোজ নেই?

যৌবনের একটা ধর্ম আছে তো!

যৌবনের ধর্ম অনেক বড়। প্রেমটা কোনও ফ্যাক্টরই নয়।

চারুশীলা ভ্রূ কুঁচকে ঝুমকির দিকে চেয়ে বলে, তাহলে যুগটা সত্যিই খুব পাল্টে যাচ্ছে।

যাচ্ছে নয়। গেছে। তা বলে প্রেম করা লোপাট হয়নি। আছে। তবে তোমাদের আমলের মতো নেই।

তুমি তাহলে বলছি যে আমি সেকেলে হয়ে গেছি?

ঝুমকি ফের মুচকি হাসল, চেহারায় বুড়ি হওনি, কিন্তু মনে মনে বড্ড প্রবীণা হয়েছ।

দাঁড়াও, তোমার ব্যবস্থাও হচ্ছে।

রক্ষে করো। আমার এখন সবচেয়ে বড় চিন্তা বাবার পাশে দাঁড়ানো।

বাবাকে নিয়ে অত ভেব না। উনি ভাল হয়ে গেছেন।

গেছেন ঠিকই, তবে আমি চাই বাবাকে একটু নিশ্চিন্ত করতে। হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর থেকেই বাবার একটা দুশ্চিন্তা হয়েছে, যদি, দুম করে মরে যাই তাহলে আমার পরিবারটার কী হবে! আমি একটা চাকরি পেলে মনে হয় বাবা মনের দিক থেকে একটু রিলিফ পাবে।

চারুশীলা হঠাৎ সচকিত হয়ে বলে, আচ্ছা, তোমার চাকরির চেষ্টা হেমাঙ্গরই তো করার কথা ছিল? করেনি কিছু?

ঝুমকি চাপা হাসি হেসে বলে, পারলে করতেন নিশ্চয়ই, তুমি ব্যস্ত হয়ে না।

ছিঃ ছিঃ। ভীষণ পাজি তো! দাঁড়াও, এখনই টেলিফোন করছি।

না মাসি, না। ওসব করতে যেও না।

চারুশীলা বলল, কেন করব না? আমাদের একটা প্রেস্টিজ নেই? এত করে চিঠিপত্র দিয়ে, ষড়যন্ত্র করে তোমাকে পাঠালাম ওর কাছে, ও পাত্তা দেবে না কেন?

হয়তো পেরে উঠছেন না। চাকরি কি গায়ের জোরে হয়?

খুব হয়। ওর অনেক কানেকশন। দাঁড়াও তো।

এই বলে চারুশীলা উঠে গেল।

এই উজবুক, তুই এরকম কেন রে?

ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেমাঙ্গ বলে, কি রকম?

তুই এত গেতো, এত পাজি কেন?

দুনিয়ায় সবাই কি ভাল হয়?

ভাল না হোস, কথার দাম নেই কেন?

তোকে আবার কি কথা দিয়েছি?

তুই ওকে বলিসনি ওর জন্য চাকরির চেষ্টা করবি?

চাকরি কি ছেলের হাতের মোয়া?

হ্যাঁ, মোয়া, তুই চেষ্টা করলেই হয়ে যেত। তুই চেষ্টাই করিাসনি। আচ্ছা, একটা এত ভাল মেয়ে কম্পিউটার জানে, ভাল ছাত্রী, কী দারুণ সুন্দর স্বভাব, ওর একটা চাকরি হতে পারে না?

এগুলো কোনও কোয়ালিফিকেশন নয়। কম্পিউটার হাজার হাজার ছেলেমেয়ে জানে। চাকরির জন্য আরও কিছু শেখার দরকার ছিল।

তুই চেষ্টা করেছিস? সেরকমভাবে করিনি। তবে করলেও লাভ হত না। ওই কোয়ালিফিকেশন নিয়ে ভদ্র মাইনের চাকরি পাবে না। হয়তো

কোনও ফার্মে ঢুকিয়ে দিতে পারব, কিন্তু ওরা খাঁটিয়ে খাঁটিয়ে জান শেষ করে দেবে। যা খুশি মাইনে দেবে।

তাহলে তোর কিসের ক্ষমতা?

আমি খুব ক্ষমতাবান নাকি?

ওসব আমি শুনতে চাই না। এক মাসের মধ্যে ঝুমকির একটা চাকরি ঠিক করে দিতে হবে।

কেন, ওর হঠাৎ হল কি? এত জরুরি দরকার কেন?

দরকার আছে।

আচ্ছা, তাহলে কাল যেন অফিসে এসে দেখা করে।

কখন যাবে?

না থাক। অফিসে আসতে কষ্ট করতে হবে। তার চেয়ে বরং তোর বাড়িতে যেন আসে কাল সন্ধেবেলা। আমি তোর বাড়িতে যাবো।

উঃ, বাঁচালি! হবে তো!

তা বলতে পারি না।

এক কাজ কর না, এখনই চলে আয়। সুমকি এখানেই আছে।

এখনই!

কেন, তোর এমন কী কাজ? নিজেরই তো ফার্ম বাবা, চলে আয় না। বিকেলটা তাহলে তিনজনে মিলে কোথাও গিয়ে কাটিয়ে আসি। ডিনার সেরে ফেরা যাবে।

জ্বালালি!

আর না লক্ষ্মী ভাই আমার! আসবি?

দেখছি।

দেখছি-টেখছি নয়। আধাঘন্টার মধ্যে চলে আয়। গাড়িতে বেশী করে তেল ভরে নিস।

আচ্ছা।

বাঁচালি। থ্যাঙ্ক ইউ।

ফোনটা রেখে উজ্জ্বল মুখে চারুশীলা বলল, আসছে।

কিন্তু খবরটায় যেন ভীষণ ঘাবড়ে গেল ঝুমকি। বলল, এত ঝামেলা করতে গেলে কেন মাসি? উনি আমাকে ন্যাগিং বলে ভাববেন। চাকরির জন্য বেশি উমেদারি করা কি ভাল?

যাঃ, ওর কাছে আবার অত ফর্মালিটি কিসের? হেমাঙ্গ এমনিতে বোকা হলেও, এ নাইস ম্যান।

আমার ভাল লাগছে না মাসি।

ভাল লাগবে। দাঁড়াও, তোমার মাকে একটা ফোন করে দিই। যেতে দেরি হবে।

না মাসি, ডিনারে তোমরা যাও। আমি যাবো না।

তাই কি হয়? তিনজন না। জুটলে আনন্দই হবে না।

আমি খুব লজ্জা পাই মাসি।

অত লজ্জা কিসের? একটু স্মার্ট হও তো!

ব্যাপারটা ঝুমকির একদম ভাল লাগছিল না। কারও কাছে এভাবে চাকরির দরবার করতে তার বড় অপমান লাগছে। কিন্তু চারুমাসি একটু অবুঝ, খামখেয়ালী। মনে মনে ঝুমকি স্থির করল, হেমাঙ্গ চাকরি দিলেও সে নেবে না। বিনীতভাবে প্ৰত্যাখ্যান করে দেবে।

হেমাঙ্গর এসে পৌঁছতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। এসেই বলল, আজ বেরোনো অসম্ভব। মিছিলে মিছিলে সব রাস্তা জ্যাম। গলিখুঁজি দিয়ে অতি কষ্টে এসেছি।

চারুশীলা বলল, বেরোবি না! আমি যে সাজগোজ করলাম!

তুই তো সবসময়ই সেজে থাকিস। নিষ্কর্মাদের আর কীই বা কাজ।

মারব থাপ্পড়। বাড়ির অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নেই বুঝি?

অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন! হাসালি। তোর সংসার তো চালায় চাকর ঠাকুররা। তাদের মোটা রোজগার আর উপরি হয়। কোথায় কোন জিনিসটা আছে তা জানিস?

চারুশীলা একটু থমকে হেসে ফেলল, বলল, জানি ঠিকই। তবে মনে থাকে না। আমি তো তোর মতো বস্তুবাদী নই।

আসল কথাটা হল প্র্যাকটিক্যাল নোস। তোর মতো বোকা সুন্দরী বড়লোক মেয়েরা হয়ও না। যাক গে, মেয়েটা কোথায়?

ওকে একটু সাজতে পাঠিয়েছি। ভিতরের ঘরে। একদম সাজতে চায় না।

সাজের দরকারই বা কী? তুই সবাইকে নিজের মতো বানাতে চাস কেন?

কিন্তু সাজেরও যে রকমফের আছে, প্রয়োজন আছে, সেটা ঝুমকি ঘরে এসে দাঁড়াতেই হঠাৎ টের পেল হেমাঙ্গ। সাজোইনি বলতে গেলে, শুধু নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়েছে। তাতেই রোগা মেয়েটা যেন ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *