তোর জন্যে দেরি করবার পারনু না রে তমিজ। বেল গেছে কুটি, তোর বাড়িত আসার সময় হলো এখন?
কথা বললে বৈকুণ্ঠের মুখের সামনে চিবানো মুড়ির কুয়াশা ওঠে। ধুতির কোঁচড় থেকে হাতের মস্ত মুঠি ভরে সে মুড়ি তোলে, মুখের ভেতরে মুড়ি ফেলতে ফেলতেও কথা বলা তার থামে না, কথা বলতে বলতেই মাটির ওপর কলাপাতায় রাখা গুড়ের টুকরা তুলে নেয় ডান হাতে।
ডোবার উরুপানিতে কোনোমতে একটা ড়ুব দিয়ে তমিজ ভেতরের বারান্দায় কেরামতের পাশে বসে আড়চোখে তাকায় বৈকুণ্ঠের দিকে : কাল অনেক রাত্রি পর্যন্ত মুড়ি ভাজছিলো কুলসুম, শালা গিরির বেটা এসেছে সেগুলোর সদগতি করতে। আবার তার পাশেই কেরামত আলি; তমিজের বাপ তার পাতে থাবা থাবা ভাত তুলে দিচ্ছে হাঁড়ি থেকে। এতো ভাত! এতো মুড়ি!-তার জমির ধানটা তো মনে হয় এরাই শেষ করবে। ওদিকে তমিজের বাপের মুখ তো বন্ধই, পাতের কোণে খলসে মাছের দিকে নজর দিয়েই সানকি সানকি ভাত সে উজাড় করে ফেলবে। এরকম পেটে পেটে ধামা ধামা চাল চালান হয়ে গেলে তমিজের গোরুই বা হয় কোথেকে, আর হালই বা সে কেনে কী করে? রাগটা সে ঝাড়ে কুলসুমের ওপর যখন সে দফায় দফায় তার পাতে ভাত তুলে দেয়, ভাতগুলো সব খেতে খেতেই তমিজ ধমকে ওঠে, কতো ভাত দাও গো? মানষে বলে এতো ভাত খাবার পারে? এতে অবশ্য তমিজের বাপের কি কেরামত আলির ভাত গেলা কিংবা বৈকুণ্ঠের মুড়ি চিবানোের ব্যাঘাত ঘটে না।
খাওয়া দাওয়ার পর বৈকুণ্ঠের জর্দার নেশা-ধরা গন্ধে ছোটো বারান্দাটা আরো চাপা হয়ে আসে। এমন কি ছোটো উঠানটাও উঠে আসে ধানের তুষের গন্ধ নিয়ে। তারপর তমিজের বাপের ঘরটাও এই বারান্দায় আসন পাততে চাইলে তমিজের পা ছুঁয়ে যায় কেরামতের হাটুর সঙ্গে। তমিজের পা শিরশির করে : লোকটা কাল সকালে হুরমতের বাড়ি গিয়ে তার বৌয়ের সঙ্গে কথা বললেই তো তমিজের জলজ্যান্ত মিছা কথাগুলো সব ফাঁস হয়ে পড়বে। তারপর তমিজ ফুলজানের সামনে আর যাবে কী করে?
এবার তুমি একটা গান ধরো বাপু! না হয় ফকিরের গানই করো। বৈকুণ্ঠের কথার শেষ দিকটা বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাসের ভেতর দিয়ে, ফকির নাই! ফকিরের গান আর কুনোদিন শুনবার পারমু না গো! তার দীর্ঘশ্বাসে পানির ঝাপটা; নোনতা হাওয়া বইয়ে দিতে দিতে সে বলে, সারাটা জেবন হামরা ঘুরিছি ফকিরের পাছে পাছে। আর তাই মরলো তোমার হাতের উপরে। ভগবানের লীলা!
ভেতর থেকে চাপা গোঙানি বারান্দা ও বাড়ির সামনের ছোটো উঠানের নোনা বাতাসকে ভারী করে তুললে তমিজ দরজা দিয়ে উঁকি দেয় ভেতরে। সারা গায়ে কাঁথা জড়িয়ে মাচায় শুয়ে রয়েছে কুলসুম। কান্না চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় তার শরীর কুঁকড়ে কুঁকড়ে আসছে।
বারান্দা থেকেই বৈকুণ্ঠ বলে, ও কুলসুম, কান্দিস না, কান্দিস না, খায়া লে। ঠাকুদ্দা কি কারো সারা জেবন থাকে রে দিদি? তার গলা ভারী হয়ে আসে এবং ভারী গলায়, সে এবার দেয় অন্যরকম নির্দেশ, কান্দ, বুক খুল্যা কান্ রে দিদি, পরান ভরা কান্। খবরটা শোনার পর থ্যাকা তো কথাই কলু না। এখন ক্যান্দা বুকটা হালকা কর। কান্দ।
কুলসুম বৈকুণ্ঠের কোনো নির্দেশই মানে না। সে থামেও না, আবার প্রাণ খুলে কাদার কোণো লক্ষণও তার নাই। তমিজের বাপ চুপচাপ হ্রকা টানে। বাইরের উঠানে রোদ পড়ে আসার সাথে ঘরে বারান্দায় শীতশীত করে। ডোবার ওপারে রাস্তায় লোকজন খুব কম। রাস্তার ওপারে ধানশূন্য মাঠ আকাশ পর্যন্ত যেতে যেতে হাপশে গিয়ে ঢুকে পড়েছে শেষ বিকালের খাপের ভেতরে। অকাশও এখন ঝাপসা।
কেরামত আলি আস্তে আস্তে বলে, ফকির কয়, কেরামত, করতোয়ার পুবে ছয় কোশ পথ গেলে গোলাবাড়ি হাট, হাটের দক্ষিণে কোশখানিক হাঁটলেই গিরিরডাঙা গাঁও। হামার লাতনি থাকে, হামাক বড়ো মায়া করিছে গো। কোনোদিন যাও তো হামার খবরটা দিও। একটু থেমে সে ফের বলে, তমিজের বাপের কথা কয়, জামাই সাধাসিধা মানুষ। গাঁয়ের মানুষ কয় আবোর, হাবা। হলে কী হয়, তার মধ্যে জিনিস আছে, ছাইচাপা আগুন। এই বারি দম্পতি সম্বন্ধে চেরাগ আলি ফকিরের শেষ মন্তব্য জানিয়ে কেরামত মাথা নিচু করে বসে থাকে। তার এই সব কথার ঝাপটায় কুলসুমের গোঙানি পায় মিহি কান্নার গড়ন, সে একটানা কেঁদেই চলে। দাদা তো তার বহুদিন। চোখের আড়ালে। সে কতোকাল হয়ে গেলো! তার ছেঁড়াখোঁড়া ওই কী ছাইয়ের বইটার গন্ধ ছাড়া তার আর কিছু ছুঁয়ে দেখার সম্ভাবনাও তো ছিলো না। সেই দাদার মরার খবর শুনে কুলসুমের নাক চোখমুখ একবারে কোচকালো না পর্যন্ত। খবরটা নিয়ে-আসা কেরামত আর কেরামতকে সঙ্গে নিয়ে-আসা বৈকুণ্ঠকে পেট ভরে খাওয়াবার পর ঘরের মাচায় উঠে দাদার বইয়ের গন্ধ বুক ভরে নিতে নিতে নাক ভিজে আসে, তারপর ভেজে তার চোখ। তখন নাকের জলে চোখের জলে ড়ুবে প্রথমে তার গলায় আসে গুনগুন ধ্বনি, বৈকুণ্ঠের কথায় সেই গুঞ্জন এখন টানা কান্নার স্রোত হয়ে বাড়ির বাইরের উঠানের ধারে বসা মানুষগুলোকে ভিজিয়ে দিতে শুরু করেছে। বৈকুণ্ঠ গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের গলা শুকাতে চেষ্টা করে বলে, ফকিরের একটা গান ধরো না বাপু!
মরার আগে ফকির একটা গান কয়দিন খুব করলো। ভালো মনে নাই। কেরামত দোনোমনো করলে বৈকুণ্ঠ মিনতি করে, মনে করা গাও গো। তুমি আরম্ভ করলে হামি : বাকিটা তোমাক মনে করায়া দিমু। ফকিরের ব্যামাক গানই হামি জানি।
চেরাগ আলি ফকিরের শেষ গান মনে করার জন্যে কেরামত আলি ধ্যানে বসার মতো সোজা হয়ে বসে চোখ বন্ধ করে থাকে। তার এই ধ্যান মূর্তিতে আর তিনজনে একেবারে চুপ করে যায় এবং এই নীবরতার সুযোগে কুলসুমের একটানা কান্না চেপে বসে গোটা বাড়িতে, বাড়ির সামনের ডোবা এবং ডোবারও ওপারে রাস্তা, রাস্তা ডিঙিয়ে শেষ বিকালের ধানকাটা জমিও সেই কান্নার কবজা হয়ে একটি অখণ্ড পিণ্ডের আকার নেয়। একটু একটু ভয়ে এবং অনেক অনেক আশায় তমিজের বাপ তাকায় ওপরের দিকে : মুনসির বেড়জাল কি আজ সন্ধ্যা না লাগতেই ছড়ানো শুরু হয়ে গেলো? বিলের গজার মাছগুলো কি ভেড়া হয়ে ভাসতে ভাসতে ডাঙায় উঠে গুটিগুটি পায়ে চলে আসবে এই গিরিরডাঙা গায়ে? কিন্তু তার আগেই কুলসুমের কান্নার স্বর ফুটে ওঠে কেরামত আলির গলায় :
গোল করিও না তোমরা ফকিরে ঘুমায়।
ও ও ও ও গোল করিও না তোমরা ফকিরে ঘুমায়।।
গানের সুরে তাল দিয়ে ঘরের অন্ধকার ভেতর থেকে ওঠে দোতারার টুংটাং। কেরামতের বিরল সুর এতে ছক পায়, ঘাড় ঝাকাতে ঝাকাতে সে গায়, গোল করিও না তোমরা ফকিরে ঘুমায়।
কিন্তু দোতারা বাজাচ্ছে কে? এখানে দোতারা বাজাবে কে মনে হতেই তার গলা শুকিয়ে আসে ভয়ে। বৈকুণ্ঠ তার সঙ্গে গলা মেলাচ্ছিলো, কিন্তু কেরামত থামতেই তার স্বরও থমকে পড়ে। এতে গান কিন্তু থামে না। চেরাগ আলির মোটা গলায় গান শোনা যায় ঘরের ভেতর থেকে। তমিজের বাপ ও বৈকুণ্ঠ মাথা নিচু করে থাকে, বহুকাল পর চেরাগ আলীর গলা শুনে দুজনেই চোখের পানিতে একাগ্রচিত্ত হয়। আর উসখুস করে কেরামত আলি। চেরাগ আলি আসবে কী করে? এরা কি তার মরণের খবরটা অবিশ্বাস করছে? কেরামত নিজেও ধন্দে পড়ে, তা হলে পাঁচবিবির উত্তরে নাজির মণ্ডলের বাড়ির পালানে সে দাফন করে এসেছে কার লাশ? সেই মানুষকে গান গাইতে শুনে কেরামতের চোখে গাঁথা হয়ে যায় পাঁচবিবি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে গাইতে গাইতে আস্তে করে বসে-পড়া চেরাগ আলি, বসতে বসতে তার গানের লয় ধীর হয়। প্ল্যাটফর্মেই শুয়ে পড়ার ঘণ্টা দুয়েক পর চেরাগ আলি মরলো, কেরামত ঠিক ওই সময়ে গিয়েছিলো ভাত খেতে। কিন্তু চেরাগ আলি মারা গেছে তার হাতের ওপর মাথা রেখে এটা বলতে বলতে এমন হয়েছে যে, কখনো ঘুমের মধ্যে নিজের ডান হাতের তালুতে তার ভার ভার ঠেকে। এটা চেরাগ আলির মাথার ভার ছাড়া আর কী? কিন্তু এখন তার হাত একেবারে খালি। কারণ ঘরের ভেতর মাচায় বসে মোটা গলায় ধীর লয়ে গান করে চলেছে চেরাগ আলি ফকির। ওটা কি চেরাগ আলি? না-কি তার নাতনি কুলসুম? কুলসুম। যদি হবে তো দোতারা বাজায় কে?—এইসব খটকার খোঁচায় খোঁচায় গানের কথা, গানের সুর, লয় ও তাল আরো স্পষ্ট হতে থাকে।
ওই চারজন পুরুষমানুষের কেউ ঘরের ভেতরে তাকিয়ে এবং কেউ কেউ না তাকিয়েও ঘরের ভেতরে মাচায় চেরাগ আলির গান শুনতে পায় ঠিকই :
গোল করিও না তোমরা ফকিরে ঘুমায়।
গলা ঝাঁঝরা কোম্পানির কামানের গোলায়।
নিন্দের সোয়ারি ফকির ধীরে দাড় বায়।
বাবরি চুলের ছইখানি ওপরে চেরাগদানি
চেরাগে আতশ নাই নাও ড়ুবে যায়।
দেহ জখম কোম্পানির কামানের গোলায়।।
গোল করিও না সাগরেদ ফকিরে ঘুমায়।।
রৌদ্রে ফাটে ঝাঁঝরা গলা তামাম নদীর পানি ঘোলা
আঁজলা ভরা পানি তাহার পিয়াস না মিটায়।
নিন্দের সোয়ারি ফকির ধীরে দাঁড় বায়।
গোল করিও না বান্দা ফকিরে ঘুমায়।।
গানের শেষের দিকে এসে আওয়াজ চলে যায় দূরে। বাড়ির সামনের খুলি পার হয়ে ডোবার কোমর পানিতে অল্প একটু বুদবুদ তুলে বুদবুদের টুপটাপ বোল নিজের শরীরে বরণ করে আওয়াজটি রাস্তা ডিঙিয়ে ওই বোলের সবটাই ঝেড়ে ফেলে শিশির পড়ার ফিসফিসানি মেনে নিয়ে ঢুকে পড়ে সন্ধ্যার খাপের মধ্যে এবং কুয়াশা ঝোলানো কালচে গোলাপি আসমানকে মিশমিশে কালো করে আসমানকে তো বটেই, ওই সঙ্গে নিজেকেও একেবারে আড়াল করে দেয়। বলতে কী, চেরাগ আলি ফকিরের গানের গড়িয়ে চলাতেই গিরিরডাঙায় সেদিন রাত্রি নামলো একটু আগেই।
সেই সঙ্গে ঘুম নামে তমিজের বাপের গতর জুড়ে। চেরাগ আলির গান ডোবার কোমর পানি ডিঙাবার আগেই দরজার চৌকাঠে মাথা রেখে ঘরের মেঝেতে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়েছে তমিজের বাপ। ঘুমের মধ্যে তার তমিজের মায়ের আমলের উরুর ঘা এবং কুলসুমের আমলের হাঁটুর ঘা চুলকায়, গানের স্পন্দনে চলতে থাকে তার ঘুমের মধ্যে বাইরে যাবার আয়োজন।
গানের আওয়াজ বাইরের অন্ধকার আকাশে মিশে যাবার পরপরই ঘরের মাচায় কাঁচকাচ শব্দ শুনে তমিজ, বৈকুণ্ঠ ও কেরামত আলি ওদিকে চোখ ফেরায়। গায়ে মাথায় কাঁথা জড়ানো কুলসুম মাচার ওপরেই পাশ ফিরলো। দমক দমক কান্নার রেশ তার আর গানচাপা নাই। তবে তার ঘুমের ভেতর এই কান্নায় চেরাগ আলির গানের রেশ কানে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়।
গোলাবাড়ি ফেরার সময় বৈকুণ্ঠের হাঁটার তালে তালে ফকিরের গানের নেশা ঘন। হতে থাকে। আর কেরামত আলির শিরশির করা গায়ে লাগে চেরাগ আলি ফকিরের চোখের ছটফটে চাউনি। গোলাবাড়ি হাটে বৈকুণ্ঠের সঙ্গে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসবার পর আলিম মাস্টারের জায়গিরবাড়ি পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে, এমন কি ওখানে পৌঁছেও সেই চাউনি থেকে তার চোখ রেহাই পায় না। কেরামতের ঘুম হয় না। ভোর হতে না হতে সে চলে যায় গোলাবাড়ি হাটে মুকুন্দ সাহার গদিতে।
বটতলায় বৈকুণ্ঠের সঙ্গে চিড়াগুড় খেতে খেতেও কেরামতের ভয় কাটে না। আস্তে আস্তে বলে, ফকির মনে হয় কাল নাতনির ওপর আসর করিছিলো। সে নিশ্চিত, কুলসুম কিছুতেই ওই গলায় গাইতে পারে না। চেরাগ আলির গলা মোটা এবং একটু রুখা, মাঝে মাঝে কর্কশও বটে। কিন্তু শুনলে কিছুক্ষণের মধ্যে সারা শরীর জেগে ওঠে, মানুষ এই গান থেকে সরে যেতে পারে না। কেরামত হাজার চেষ্টা করলেও তার মোলায়েম গলায় ওই স্বর আনতে পারে না। আর কুলসুমের গলা তো রীতিমতো মিষ্টি, তার পক্ষে কি গোল করিও না তোমরা ফকিরে ঘুমায় গাইবার সময় শ্রোতাকে ওইভাবে ধমক দেওয়া সম্ভব?–চেরাগ আলি নির্ঘাৎ কাল ভর করেছিল কুলসুমের ওপর।
কিন্তু কেরামতের ধারণা নস্যাৎ করে দেয় বৈকুণ্ঠ, একটু রাগ করেই সে বলে, ইগলান কী কথা কও? আসর করবি কিসক? মাচার উপরে ফকিরেক হামরা দেখনু না? ফকির না আসলে দোতারা বাজালো কেটা? কেমরামতের চোখ থেকে তবু সন্দেহ যায় না দেখে তার রাগ বাড়ে, রাগের চোটে সে এক গ্রাসে মুখে অনেকটা চিড়া ফেলে এবং শুকনা চিড়া গলায় আটকে যাওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বলে, হামার চোখ এখনো লষ্ট হয় নাই, বুঝলা? তোমাগোরে জাতের যা তা খাওয়ার অভ্যাস, তোমাগোরে লাকান হামরা যা তা খাই না, বুঝলা? হামি বলে লিজের চোখে দেখনু, মাচার উপরে খ্যাতা মুড়ি দিয়া বস্যা মাথা ঝুঁকায়া কুঁকায়া ফকির গান করিচ্ছে। গানের মধ্যে স্বপনের কথা কলো, কিছু বুঝিছো? তোমরা হলা যমুনার মধ্যেকার চরুয়া চাষা, মুনসির বিত্তান্ত তুমি কী বুঝবা?,
না বোঝার কী হলো? ফকির লিজের মরার কথা আগাম কয়া গেছে। নিন্দের সোয়ারি—।
মুখ ভরা চিড়া নিয়ে বৈকুণ্ঠ হাসে, বোঝা অতো সোজা লয়। শোনো ফকিরে লিজের কথা কয় না। তার লিজের কী পরের কী? কালাহার বিলের চারো পাশের ব্যামাক মানুষ জানে, ওই ফকিরের খুঁটি হলো পাকুড়গাছের মুনসি। বুঝিছো?
তুমি ঠিক জানো? কেরামতের এই প্রশ্নে সন্দেহের চেয়ে বরং আত্মসমর্পণের লক্ষণ দেখে বৈকুণ্ঠ মহা উৎসাহে কোঁচড়ের বাকি চিড়ার সদ্ব্যবহার করে, কলপাড়ে গিয়ে টিউবওয়েলের জল খায় আঁজলা আঁজলা এবং মুখে জোড়া পান ঢুকিয়ে জানায়, ইগলান কথা আমি জানি না তো জানে কোন শালা? এরপর সে ব্যাখ্যা করে তার অধিকারের কথা।-আরে সে হলো গিরিবংশের মানুষ, তার রক্তে দশনামার এক নামা গিরির রক্ত টগবগ করে ফুটছে। এই যে দেখো গিরিরডাঙা, নিজগিরিরডাঙা; এই যে গোলাবাড়ির হাট, পোড়াদহের মেলার মাঠ, এসব তো ছিলো তাদেরই রাজত্ব। ভবানী পাঠকের মানুষ তারা, তার হুকুমে যুদ্ধ করেছে কোম্পানির গোরাদের সঙ্গে। কোম্পানির কামানের গোলায় ভবানী পাঠক দেহ রাখলো মানাস নদীর জলে, তার দলের লোকজন সব ছিটকে পড়লো এদিক ওদিক। কেন, কেরামত এতো ঘুরেছে, সে কি মাহীখালির জমিদার বুলন গিরি গোঁসায়ের নাম শোনে নি?—ওই লোকটার ঠাকুর্দার বাপ না-কি তারও ঠাকুর্দা,-কোন শালা তার খবর রাখে,-সে ছিলো ভবানী পাঠকের লাঠিয়াল। ওই শালাকে ঠাকুর ন্যস্ত করেছিলো বৈকুণ্ঠের ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার বাপ, না-কি তার বাপের হাতে, তা ওই নেমকহারামটা কোম্পানির কোন ম্যাজিস্টরের হাতে পায়ে ধরে জমিদারি হাতিয়ে নিয়ে গোরাদের চাকর বনে গেলো। আর বৈকুণ্ঠের ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা, না-কি তার বাপ, না-কি তারও ঠাকুর্দা—সেই সন্ন্যাসী সরে পড়লো সেরপুরের দক্ষিণে। সেখানে তখন ঘন জঙ্গল, বাসিন্দাদের মধ্যে এক বাঘ আর সিংহ আর জংলি হাতির পাল। জঙ্গল সাফ করে, বাঘ সিংহ মেরে হাতিগুলোকে নিজেদের বশ করে তারা জোত করলো, জমি করলো; আখুন্দিয়া, মীর্জাপুরে তাদের বিঘা বিঘা জমি। বৈকুণ্ঠের ঠাকুর্দার সম্ভাইদের চক্রান্তে তার বাপ গরিব হয়ে গেলো, বাপ মরলে বৈকুণ্ঠ হলো ঘরছাড়া। সে এখন তেলি সাহাদের গদিতে সামান্য চাকরি করে খায়। তারা হলো সন্ন্যাসী, তাদের ক্ষত্রিয় ধর্ম, জাতে সন্ন্যাসী। তার আজ এই হাল!তবে এখানে সে পড়ে আছে কি এমনি এমনি? সে আজ মামলা করে তো তার জ্ঞাতিরা কালই বাপ বাপ করে তার জমি জিরেত সব। তাকে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। এখানে থাকার কারণ আছে। অন্য কারণ আছে।
কেরামতের চোখের মুগ্ধ কৌতূহলে তৃপ্ত বৈকুণ্ঠ তার এখানে বাস করার কারণটি বলবে কি-না তাই নিয়ে ভাবনায় পড়ে। তুমি ভিন জাতের মানুষ, তোমাক কি কওয়া যাবি? কিন্তু না বলে তার এখন আর উপায় নাই। তাই সে জানায়, এই যে পোড়াদহের মেলা, এই মেলা প্রথম চালু করে ভবানী পাঠক, আহা বড়ো সখের মেলা তার। দেহ রাখার পর তিনি প্রস্থান করেছেন কৈলাসে, কিন্তু বছরকার একটি দিন তাকে এখানে দেখা যায়। কে দেখে? যে সে জাতের মানুষ কি আর দেখতে পারবে? এদিকে এখন সব মোসলমান আর সাহা আর কুমার আর কামার আর মাঝি আর কলু, ঠাকুরকে তারা দেখবে কোথেকে? বামুন কায়েতকেও ঠাকুর দর্শন দেবেন না। দেবতা হলে কী হয়, বামুন কায়েতরাও ওই যুদ্ধের সময় দাসখত লিখে দিয়েছিলো গোরাদের পায়ে।-সন্ন্যাসী জাতের মানুষ যদি শুদ্ধ বস্ত্রে, শুদ্ধ চিত্তে মেলার আগের দিনে ব্রাহ্ম-মুহূর্তে মোষের দিঘির উঁচু পাড়ে তালগাছের তলায় দাঁড়ায় তো ঠাকুর তাকে দর্শন দিলেও দিতে পারে। বৈকুণ্ঠের স্বর্গীয় পিতৃদেব তাকে বারবার বলে দিয়েছে, এখানে যদি সে চারদিকে একটু দৃষ্টি রাখে তো তার খাওয়া পরার অভাব হবে না, লোকালয়ে সবার সম্মান সে পাবে এবং পরজন্মে কী পাবে না পাবে তা আর নাই বললো। সেটা জানে শুধু ঠাকুর।
বৈকুণ্ঠের এই ব্যাখ্যায় কেরামতের বিভ্রান্তি কাটে না। ভবানী পাঠকের সঙ্গে চেরাগ আলি ফকিরের মরণোত্তর গান গাওয়ার সম্পর্ক কী? যমুনার পশ্চিম পারে সে বরং দেখেছে মজনু শাহের দাপট। যমুনার-পেটে-যাওয়া মাদারিপাড়ার মানুষজনের ভাবসাব দেখে মনে হতো, ওরা সবাই মজনু শাহের একেকটা পালোয়ান। শালারা খেতে পায়, পাছায় কাপড় নাই, এক ছটাক জমি নাই, এদিকে গলার তেজ ষোলো আনা। লাঠি হাতে করে ভিক্ষা করে, ভিক্ষা না দিলে শাপমণ্যি করে, ভয় দেখায়। চেরাগ আলি তো ওই পালোয়ানদের গুষ্টির মানুষ। কেরামত তার মুখেই শুনেছে, করতোয়ার পুবে পশ্চিমে সবই ছিলো মজনুর দাপটে, গোরারা জবর দখল করিছে।
কথা ঠিক। বৈকুণ্ঠ খানিকটা মেনে নেয়, মুনসি আছিলো ভবানী পাঠকের সেনাপতি। গান শোনো নাই, ভবানী নামিল রণে, পাঠান সেনাপতি সনে, এই সেনাপতিটা কও তো কেটা?
কেরামতের নীরবতায় তার অজ্ঞতা প্রমাণিত হয়েছে ভেবে বৈকুণ্ঠের আত্মবিশ্বাস বাড়ে, পাকুড়গাছের মুনসি হলো ওই সেনাপতি। মজনু শাহের লিজের মানুষ আছিলো তাই। এখনো কালীপূজার আত্রে ভবানী পাঠকের আদেশে মুনসি কাত্রা ভাসায়া দেয় বিলের মধ্যে, ওই কাত্রার মধ্যে কালা পাঁঠা বলি দিবার পারে তো তোমার সর্ব পাপ মোচন হবি। আরে এই খপর তো এটিকার ক্যাচলা ছোলও জানে।
কেরামত জানে, কিন্তু ফকির কতোবার কছে, গানের মধ্যেও কছে, মুনসি আছিলো মজনু শাহের খাস মানুষ।
এতেও বৈকুণ্ঠের আপত্তি নাই, কথা ঠিক। ভবানী পাঠকের কাছে মজনু বার্তা পাঠালো। কী? না-তোমার আছে আলি, হামার আছে কালি; তোমার তাকত আলির হাতত আর হামার শক্তি আছে মা কালির কাছে; ঠিক কি-না?–হামরা একত্তর হই। আলি আর কালি একত্তর হলে কোম্পানি এক ঘড়ি খাড়া হয়া থাকবার পারে?—তা হলে বোঝো। তখন দুইজনের মানুষ আর আলাদা থাকলো না। মুনসি তখন ভবানী সন্ন্যাসীর হুকুম শুনবি না কিসক? দৃষ্টান্ত পর্যন্ত দেয় বৈকুণ্ঠ, না হলে এখনো মুনসি বিলের মধ্যে কাত্যা ভাসায় কিসক?
এই প্রমাণ দাখিলের পর আর কথা বলা নিরর্থক। এর মধ্যে মুকুন্দ সাহাও এসে। পড়েছে দোকানে। কিন্তু বৈকুণ্ঠ তবু বলেই চলে, চেরাগ আলি ফকির থাকলে ইগলান। মীমাংসা হয়া গোলে নি। কাল গানের মধ্যে শুনলা না? স্বপনের বিত্তান্ত কলো ক্যাংকা করা, বুঝছো না?
ফকিরের গতকালের গানে স্বপ্নের বৃত্তান্ত কোথায়?–কেরামতের অজ্ঞতায় বৈকুণ্ঠ ঠোট বাঁকায়, লিজে তুমি গান বান্দো, ইগলান কথা বোঝো না? বাবরি চুলের ছইখানি, তার উপরে চেরাগদানি। মানে লাওয়ের উপরে প্রদীপ আছে, সেটা জ্বলে না। কিসক? আগুন নাই, জ্বলে ক্যাংকা করা? লাও ডোবে, মাঝি ঘোলা জল খায়। কোম্পানির সেপাইয়ের গুলি খায়া মুনসি মরলো, তার আগে আগে উগলান স্বপন দেখিছে। ফকির কছে, মানষে মরার আগে স্বপনে ইশারা পায়।
দোকানের দিকে পা ফেললে কেরামত তার পিছু ছাড়ে না, বলে, চেরাগ আলি মরার আগে মনে হয় লিজেই উগলান স্বপ্ন দেখেছি। তাই ওই গান বান্দিলো।
তোমার বাপু মাথা মোটা! বিরক্ত হয়ে বৈকুণ্ঠ দাঁড়ায়, আরে ফকির তো গান বান্দে নাই, তার গান সব পাওনা শোলোক। ফকির লিজের কথা কবি কিসক? মুনসিক বাদ দিয়া কি লিজের কথা কবার পারে? তোমাগোরে লাকান বেয়াদব আছিলো না তাই। তুমি তাক কয়দিন দেখিছো? হামরা তার পাছে পাছে ঘুরিছি, তার সাথে বস্যা থাকিছি। মানুষে আসিছে, স্বপনের কথা কছে, ফকির তার মঙ্গল অমঙ্গল কয়া দিছে। হামরা। শুনিছি। বলতে বলতে মুকুন্দ সাহার দোকানের বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে সে বলে, এখন মনে হয় তমিজের বাপ কিছু জানে। ফকিরের বইখানও তো দিয়া গেছে তমিজের বাপেক। সেটা কি এমনি এমনি? রহস্য বোঝে না?
দোকানের ভেতর থেকে মুকুন্দ সাহা হাঁক ছাড়ে, বৈকুণ্ঠ, সকালবেলা দোকানে ঢোকার আগে কার সাথে কি খায়া আসলু রে? সাতসকালে বেজাতের মানুষের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে দোকানে কারো প্রবেশ.সে অনুমোদন করে না।
বৈকুণ্ঠ বলে, আসিচ্ছি বাবু।
বটতলায় এসে কেরামত আলি ওপরের দিকে তাকালে বটগাছের পাতার ফাঁকে ফাকে অজস্র লাল ফল চোখে পড়ে। প্রত্যেকটি ফলে চেরাগ আলির মণি-ছেড়া চাউনি। এখানে এসে চেরাগ আলি নাকি প্রথম গান করে এই বটতলায় দাঁড়িয়েই। বটতলা বড়ো পয়মন্ত জায়গা। ফকিরের পসার তো কম হয় নি। ওদিকে গেলে জয়পুর, পাঁচবিবি, আক্কেলপুর, আদমদিঘি, হিলি, পাহাড়পুর, এমন কি শান্তাহার জংশনে পর্যন্ত চেরাগ আলির গান শুনতে মানুষের ভিড় জমে গেছে। মানুষটা অনেক জানতো, কেরামত তাকে নিয়ে ঠাট্টা করতো, কিন্তু কৈ, চেষ্টা করেও তার গলার রুখা স্বরটা তো সে রপ্ত করতে পারলো না। তারপর চেরাগ আলি খোয়বের সব বৃত্তান্ত বলতে পারতো। তারপর কী যে হলো, কেউ জানে না, কেবল বৈকুণ্ঠ একদিন বলেছে, মুনসি নাকি ওকে নিষেধ করায় খোয়বের খোঁড়াখুঁড়ি ছেড়ে সে দেশান্তরি হয়ে গেলো। পাঁচবিবিতে এই মুনসির কথা ফকির তাকে কয়েকবার বলেছে। কেরামত পাত্তা দেয় নি, উগলান কথা থোও বাপু। তোমার মুনসি কও আর জিন কও আর দেও কও, তার সাথে তোমার যতোই খাতির থাকুক, তারা তোমাক শোলোক কয়া দিবি না। তোমার শালোক লেখা লাগবি তোমাক লিজে। হামার গান বান্দি হামি লিজেই।-এইসব ঠাট্টা শুনে চেরাগ আলি কিন্তু জবাব দেয় নি। একদিন কেবল তার শেষ গানটা শুনে বিহ্বল কেরামতের চোখে চোখ রেখে বলেছিলো, এই গান লেখবার পারবা? না হামি পারমু? গান বান্দা এক কথা আর পাওনা শোলোক আরেক জিনিস। সে নিজেই বলেছে তার নাকি খোয়বের বৃত্তান্ত লেখা বইও একটা আছে, সেটা রেখে এসেছে নাতনির কাছে। তা তার নাতজামাইটাকে তো কেরামত দেখলো। ওটা কি মানুষ নাকি? দাদাশ্বশুরের মরার খবর শুনে তার তো কিছুই হলো না, মরা মানুষ এসে ঘরের অন্ধকার কোণে দোতারা বাজিয়ে গান করে আর ওই হাবাটা মেঝেতে শুয়ে ভেঁস ভেঁস করে ঘুমায়। আর সেই মানুষের আছে কি-না গচ্ছিত থাকে চেরাগ আলির খোয়াবের বই। চালাকচতুর বরং ফকিরের নাতনিটা। ঘোমটার আড়ালে তার মুখ যেটুকু দেখা গেলো তাতেই বোঝা যায়, সুন্দরী মেয়ে। তার কালো হাতের আঙুলগুলো কী সুন্দর লম্বা লম্বা। দাদার মৃত্যুসংবাদ শুনে তার যেন কোনো ভাবান্তরই হলো না। তাদের জন্যে পাকশাক করলো, কতো যত্নআত্তিই না করলো। আবার চেরাগ আলিকে নিয়ে কেরামত যাই বললো সবই শুনলো সে দুই কান খাড়া করে। তারপর সবাইকে খিলানদিলান করিয়ে ঘরের অন্ধকার কোণে মাচায় শুয়ে শুরু করলো চাপা কান্না। এমনি কান্না যে মনে হয়, মাচার ওপর থেকে নয়, মাটির অনেক নিচে গাছপালার শেকড়বাকড় যেন পানির অভাবে মরার আগে শেষ কান্না কেঁদে বিদায় নিচ্ছে। এই মেয়েটিকে নিয়ে একটা বড়ো পদ্য লিখতে পারলে কেরামত আলির জীবনের আর অন্য কিছু লেখার দরকার হতো না। ওই বইয়ের রোজগারে তার সারা জীবন চলে যায়। ফকিরের বইটা দেখলে হয় একবার। তমিজের বাপ না জানে লেখা না জানে পড়া। একে জাহেল মানুষ, তাইতে আবার হাবা। আবার সে নাকি ঘুমের মধ্যে হেঁটে হেঁটে চলে যায় কোথায় কোথায়। তাইতেই বৈকুণ্ঠ একেবারে মুগ্ধ। আরে, ঘুমের মধ্যে মানুষ যদি কাজকাম সব সারতে পারবে তো আল্লা এতো বড়ো একটা সুরুজ দিয়েছে কেন আর সেই সুরুজের এতো রোশনাই বা থাকবে কেন?
কিন্তু তমিজের বাপকে ঘরে পাওয়া যায় না। সারারাত্রি কোথায় কোথায় ঘুরে এসে–ভোররাত্রির দিকে সে নাকি একটুখানি ঘুমিয়েছিলো। ঘরের ভেতর থেকে কুলসুম জানায়, ঘুম থেকে উঠে একটু আগে বেড়জাল হাতে সে চলে গেছে পুবের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে গেছে কালাম মাঝির ভাগ্নে। ফিরবে পোড়াদহেল মেলা সেরে।।
কুলসুম কথা বলে ঘরের ভেতর থেকে। কাল মাথায় ঘোমটা দিয়ে হলেও সবাইকে এতো আদর যত্ন করলো, আর তার এতো পর্দা করার দরকার কী? কেরামত তবু দাঁড়িয়ে বলে, তমিজ নাই? তার সাথে কথা আছিলো। এতে একটু কাজ হয়। শরীর সম্পূর্ণ দরজার কপাটের আড়ালে রেখে একটা সিঁড়ি বার করে দিয়ে কুলসুম বলে, বাড়ির খুলিত বসেন। তার বেটা আসবি।
বাইরের উঠানে ঘরের দরজা ঘেঁষে পিঁড়িতে বসে কেরামত জোরে জোরে বলে, ফকির চেরাগ আলি মিয়া তোমার কথা খুব কছে। তোমাক ওই কথাগুলা কওয়া দরকার। মরার আগে উনি কি অসিয়ত করলো, তোমাক কওয়া আমার ফরজ। দাদার শেষ উপদেশ কিংবা বাণী শুনতে কুলসুম তেমন আগ্রহ দেখায় না। কিন্তু কর্তব্য পালনের তাগিদে কেরামতকে বলতেই হয়, ফকির তোমার জন্যে আফশোস করিছে। কছে, একটাই ফরজন্দা আমার। বাপ-মা মরা মেয়ে। এবার দরজার ঠিক ওপাশেই এসে দাঁড়িয়েছে কুলসুম, বুঝতে পেরে কেরামত গলা একটু নামায়, তমিজের বাপ তো মানুষ খুব ভালো, মনটা একেবারে সাদা। কিন্তু তোমার দাদা কছে, আমি জানি না, তোমার দাদাই কছে, তমিজের বাপের বয়েসটা একটু বেশি। বুদ্ধিশুদ্ধিও আল্লা তাক একটু কমই দিছে। লেখাপড়াও তো করে নাই। মাঝির ঘরে লেখাই কী আর পড়াই কী? ওটা তো কোনো দোষের কথা নয়। কিন্তু ফকির চেরাগ আলি মিয়া তার বই নাকি থুয়া গেছে তারই কাছে। তমিজের বাপ কি ওই বই কিছু পড়বার পারে? কুলসুম কিছুই না বললে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কেরামত ফের বলে, বইটা একবার দেখবার চাইছিলাম। ফকির সাহেব বলিছে, কেরামত তুমি বই লেখো, আমার বইয়ের রহস্য তুমি বুঝবা। আমি বই লেখি, হাটে বাজারে মেলায় বই পড়ি, মানুষ খুশি হয়া কেনে, পাইকাররা কিন্যা নেয়। আর ফকিরের বইয়ের শোলোক সব পাওনা গান, আগিলা জমানার শোলোক, কেউ লেখে নাই। তা বইখান একবার দেখলে হয়–।
বই তো এখন দেওয়া যাবি না, কুলসুম ভেতর থেকে জবাব দেয়, ঘরের মানুষ আসুক। কেরামত তবু উঠতে চায় না। এখানে আসার পর থেকে চেরাগ আলির কথা এখানে শুনতে শুনতে তার কানে তালা লেগে গেলো। বৈকুণ্ঠ কেরামতের গান খুব শুনতে চায়, কিন্তু তার মন সম্পূর্ণ পড়ে থাকে চেরাগ আলির গানের দিকে। কেরামতের একটা গান শুনে সে হয়তো বুদ হয়ে আছে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে গুনগুন করতে শুরু করে অন্য কোনো গান। তার বুদ হওয়াটা তখন সমর্পিত হয় চেরাগ আলির শোলোকে। কেরামতের গানে খুশি আলিম মাস্টার। কিন্তু বলে, ইগলান গান এদিকে এখনো মানুষে লিবি না। এটিকার মানুষ এখনো জোতদারের পিছে লাগে নাই। অথচ জোতদারের লোকদের হাত থেকে ফসল ছিনিয়ে নেবার সময় পাঁচবিবির জয়পুরের আধিয়ার চাষাদের গা গরম হতে তো তারই শোলোক শুনে। ধলাহারে পালামি বর্মণের মায়ের হাতে লাগলো জোতদারের ভাড়াটে পুলিসের গুলি, কনুই থেকে রক্ত রেবুচ্ছে ফিনকি দিয়ে, বুড়ি মাটিতে পড়ে গিয়ে কেরামতকে সামনে দেখে বলে, বাপ, তুই গাহান বন্ধ করিছিস কেনে? গান ক, গাহান ক বাপ। অথচ পুলিসের ভয়ে এদিকে এসে কেরামত তার গানের আর ভক্ত পায় না। এদিকে তার কাছে পয়সাকড়ি নাই। আলিম মাস্টারের সঙ্গে থাকে। মাস্টার তো জায়গির থাকে নিজেই, তাও এক আধিয়ার চাষার বাড়িতে। জমির কাছে চাষার সঙ্গে হাত লাগায় বলেই না তাকে থাকতে দিয়েছে। তার খাতিরে কেরামত এখন পর্যন্ত দুইবেলা দুই মুঠো খেতে পাচ্ছে। এই খাতির টিকবে কতোদিন? নতুন ধান উঠেছে, খেতে দিচ্ছে। কয়েক মাস পর চাষার নিজের ভাত জুটবে
, তখন মাস্টার তার মাসের বেতনও যদি ওই লোকের হাতে তুলে দেয় তো কেরামত সেখানে পাত পাততে পারবে?—তার চেয়ে বৈকুণ্ঠের কথা মতো সে যদি ফকিরের গান গায়, তবে পেটটা চলে। সেসব তো এই এলাকার গান, যে কেউ গাইতে পারে, তাতে দোষের কিছু নাই। বৈকুণ্ঠ বলে ওইসব গান চালু থাকলে ফকিরের আত্মাটা শান্তি পায়। আরে ফকিরের আত্মার শান্তি ফকির নিজেই জোগাড় করুক। আপাতত তার বইটা পেলে কেরামত না হয় উল্টেপাল্টে একটু দেখে।
তাই তো দুই দিন বাড়িত আসবি না। আপনে না হয় মেলা পার করা দিয়া আসেন। ভেতর থেকে কুলসুম এই নির্দেশ ছাড়লে কেরামতকে উঠতেই হয়। তবু যাবার আগে একবার বলে, পিয়াস লাগিছে, পানি খাওয়া যাবি?
মাটির খোরায় পানি এনে কুলসুম রেখে দেয় দরজার বাইরে। তার কালো হাতের একটু ফ্যাকাশে লম্বা আঙুলগুলো দেখে কেরামতের পিপাসা চড়ে তার সর্বাঙ্গ জুড়ে। পানি খেয়ে রাস্তায় নেমে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে নিজের গান গাইবার পিপাসা বাড়তে থাকলে তার শরীরের পিপাসার আর সীমা পরিসীমা থাকে না। কেরামত এখন করবেটা কী?
ফুলজানের কাছে যেতে তমিজের বেশ দেরিই হয়ে গিয়েছিলো।
বাপের ঘরের অন্ধকার কোণ থেকে গাওয়া চেরাগ আলির গান শুনে সে ভয় পায় নি, আবার এতে দিওয়ানা বনে যাবার মানুষও সে নয়। চেরাগ আলি হলো কালাহারের মুনসির খাস লোক, জিন্দা হোক মুর্দা হোক অনেক কিছুই সে করতে পারে। গানের পর কাঁথা মুড়ি দিয়ে কুলসুম শুয়ে পড়েছিলো ফোঁপাতে ফোঁপাতে। হাঁড়িতে আর ভাত ছিলো না এক দানা। খালি পেটে ঘুম আসতে দেরি হয় তমিজের, আবার ভোরবেলা ঘরের দরজায় হাঁক ছাড়ে গফুর এ তমিজ, তমিজ। তাড়াতাড়ি হাটোত আয়। কাদের ভাই যাবার কছে রে। মেলা কাম আছে।
হাটে গেলে কাদের তাকে লাগিয়ে দিলো গফুর কলুর সঙ্গে। এ কেমন কথা গো? কলুর হুকুম তামিল করতে হবে তাকে? বলতে গেলে, কলুর বেটাকে এড়াতেই সে কাদেরের পিছে পিছে কাঁধে বাঁক নিয়ে চললো লাঠিডাঙা কাচারিতে। কাচারি থেকে চেয়ার, লাল সালু, সামিয়ানার কাপড় বয়ে নিয়ে এলো গোলাবাড়ি।
পরশু পোড়াদহের মেলা। মেলা উপলক্ষে আশেপাশের মেয়েরা এসে গেছে বাপের বাড়ি, জামাইরা এখনো আসছে। পোড়াদহের চারদিকে গ্রামগুলো মানুষজনে গিজগিজ করছে। ইসমাইল এই সুযোগটা ছাড়তে চায় না। মেলার একদিন আগে গোলাবাড়ি হাটে মুসলিম লীগের সভা। ইসমাইল হোসেন তো বলবেই, শামসুদ্দিন ডাক্তার কথা দিয়েছে খান বাহাদুর সাহেবকে নিয়ে আসার জন্যে সে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবে, বাকি আল্লার ইচ্ছা। বটতলা ঘেঁষে মঞ্চ তৈরি হবে, মঞ্চের জন্যে তক্তপোষ পাওয়া গেছে মুকুন্দ সাহার কাছ থেকে, চেয়ার দেবে নায়েববাবু।
নায়েববাবু চেয়ার তো দিলোই, খান বাহাদুর আসবে শুনে সামিয়ানাটা পর্যন্ত বরাদ্দ করলো নিজে থেকেই। এমন কি কাদেরকে চেয়ারে বসতে বললো পর্যন্ত, আরে বসো, বসো। খান বাহাদুর সাহেব আমাদের বাবুর বড়ো ছেলের বাল্যবন্ধু, কলকাতায় ওঁদের ওঠাবাসা সব একসঙ্গে। তা তিনি এলে আমাকে তো একবার যেতেই হয় বাপু।
তারপর গলা নামিয়ে নায়েববাবু বলে, তোমার তো পাকিস্তান পাকিস্তান করছে। করো। জমিদারি নাকি থাকবে না। তাও না হয় নিয়েই নিলে। কিন্তু নিজেদের জমিজমা ঠিক রাখতে পারবে তো? নিজের জমির ফসল যদি না পাও তো জমিও যা, জঙ্গলও তাই। জয়পুর পাঁচবিবির ঘটনা তো জানোই। ওইটা ঠেকাতে না পারলে কিন্তু ঝাড়েবংশে শেষ হয়ে যাবে। ওদিকে সব চাষারা জোতদারদের গোলা লুট করলো, কাল জোতদারের মেয়ে বিয়ে করতে চাইবে। কথাটা খেয়াল রেখো বাপু।
কাঁধে বাঁক থাকায় তমিজকে চলতে হয় দুলকি চালে, সে গোলাবাড়ি পৌঁছে যায় বেশ তাড়াতাড়ি। সে অবশ্য চলছিলো অতিরিক্ত জোর কদমে, পা ফেলছিলো চাপ দিয়ে দিয়ে।-এটা কি ফুলজানের বেটাকে টাউনে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে বলে, না-কি জয়পুর পাঁচবিবির চাষাদের ধাক্কায় তা ঠিক করে বলা মুশকিল।
গোলাবাড়ি হাটে কাদেরের দোকানের সামনে ভার রেখে কাউকে কিছু না বলেই তমিজ সোজা হাঁটা দেয়। কয়েক পা চলার পরেই আকাশের দিক তাকিয়ে দেখে বেলা উঠেছে অনেক দূর। তবে সময় আছে। ফুলজান তো তৈরী হয়েই থাকবে। কাজের মেয়ে, খামাখা বসে বসে ঝিমায় না। এমন মেয়ের কপালে এতো দুঃখ? কাল তমিজ যা দেখে এসেছে তার বেটার যে আজ কী হলো আল্লা মালুম। মা বেটাকে নিয়ে গোলাবাড়ি পর্যন্ত এসে না হয় টমটম নেবে একটা। সকালে বাড়ি থেকে তমিজ বেরিয়েছে পুরো সাড়ে ছয় টাকা হাতে নিয়ে। টমটম ভাড়া, ওষুধপত্র সব মিটিয়েও পয়সা নিশ্চয়ই বাঁচবে। টাউনে পৌঁছে না হয় রিকশা নেবে একটা। রিকশায় জড়াবার জন্যে ফুলজানকে শাড়িও একটা নিতে বলবে। রিকশা না নিলে দুই আনা পয়সা তার বাচে, কিন্তু বিমারি ছেলেকে কোলে নিয়ে ফুলজানের যদি হাঁটতে কষ্ট হয়? প্রশান্ত কম্পাউনডারের হাতে পায়ে ধরলে পয়সা নাও নিতে পারে। অবশ্য পায়ে পড়লেও অন্তত আধ হাত দূরে থাকতে হবে, ছুঁয়ে ফেললে আবার একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসবে। তারপর রোগী দেখানো শেষ হলে ফুলজানকে সিনেমা হলের সামনে থেকে নকুলদানা কি বাদামভাজা কিনে দেওয়া যায়। জীবনে এই প্রথম টাউনে গিয়ে ফুলজান কি একটু বেড়াবার সখ করবে না? খিয়ার এলাকা থেকে ধান কেটে ফেরার পথে টাউনে নেমে ঘুরতে ঘুরতে তমিজ একবার মস্ত একটা বাগানের সামনে দাঁড়িয়েছিলো, টাউনের লোকেরা পার্ক না কী যেন বলে, ভেতরে কতো ফুলে গাছ, বসার জায়গা। ভেতরে ঢোকার সাহস হয় নি। না, ওদিকে না ঢোকাই ভালো। ঢুকতে না দিলে মেয়েছেলের সামনে বেইজ্জতি।
হুরমতুল্লার ভিটায় উঠে তমিজ গলা খাকারি দিলেও কেউ সাড়া দেয় না। অথচ ভেতরে কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। হুরমতুল্লা কি মেয়েকে মরিচের জমি নিড়াতে যেতে বলছে নাকি?–এবার থেকে এসব বন্ধ করা হবে!-না কি ফুলজানের বেটার অসুখ বাড়লো? ডাক্তারের কাছে যাবার সময় হবে তো?-মণ্ডলদের পিছে পিছে ঘুরে তার জেবনটা বরবাদ হয়ে যাবে?
ভয়ে ভয়েই তমিজ কলাপাতার পর্দা তুলে ভেতরের উঠানে ঢোকে। ঘরের কথাবার্তা এবার স্পষ্ট। ফুলজান কার সঙ্গে কথা বলে? ঘরের সামনে দাঁড়িয়েই তমিজ থমকে দাঁড়ায়। ঘরের ভেতরে মাচায় বসে রয়েছে সে নিজে, তার কোলে ফুলজানের বিমারি বেটা এবং পাশে ফুলজান। পলকের ভেতর তমিজ গতকাল থেকে ফিরে আসে আজকে এবং নিজের আসনে দেখতে পায় কেরামত আলিকে। আর সব কালকের মতোই।
তাকে দেখে ফুলজান ঘোমটা টেনে বসে মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে কেরামত আলি অবাক হয়ে তাকায়, তুমি? কী সোমাচার? তারপর তার গলায় আসে শ্বশুরবাড়ির অধিকার, আসো আসো। তোমার বাড়িত গেছিলাম গো। তুমিও নাই, তোমার বাপও বলে গেছে পুবে। মাছ ধরবার গেছে, না?
ঘোমটার ভেতর থেকেই ফুলজান আস্তে করে বলে, মাঝি মানুষ মাছ ধরবার যাবি। না? তারপর ঘরের বাইরে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়ে সে কেরামতকে বলে, মাঝির বেটাক সর্যা খাড়া হবার কন।
তমিজ সরে দাঁড়ালে ফুলজান উঠানে যায়, সেখান থেকে রান্নাঘরে।
কোলে শোয়ানো ছেলের কপালে হাত বুলাতে বুলাতে কেরামত বলে, আমার বেটাটার অসুখ খুব বেশি। গাঁয়ের মধ্যে ডাক্তার কোবরাজ তো কিছু নাই। এরা তো চিকিচ্ছা করবার জানে না। খালি হেলা করে। টাউনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো বুদ্ধি দেখি না। এখন করি কী? দুশ্চিন্তায় কপাল তার কুঁচকে যায়, আমি করি কী? গোলাবাড়ি হাটে আজ সভা, সভাত আবার গান গাওয়া লাগবি। এতোগুলা মানুষের আবদার, না-ও করবার পারি না। তার কথাবার্তা ও ভাবসাবে মনে হয় না, বৌবেটার সঙ্গে আজ তার দেখা কয়েক বছর পর। তমিজ তার দিকে সরাসরি তাকাতে পারে না। ফুলজান কী সব বলে দিয়েছে নাকি? কিন্তু তার কথাবার্তা শুনে বোঝা যায়, তার তালাক টালাক নিয়ে তমিজের মিছে কথাগুলো ফুলজান তাকে কিছুই জানায় নি।
তুমিও তো মণ্ডলের জমি বর্গা করলা, না? তাই তো খন্দের ভাগ তোমাক কমই দিছে।
তমিজ কথা বললো এতক্ষণে, কেটা কলো?
সবই জানি। আমার জানা লাগে। ফুলজানের বাপ সাদাসিধা মানুষ, মণ্ডল যা দেয় তাই নেয়। উগলান চলবি না। খিয়ারের খবর তো শুনিছো?
ওইসব খবর শুনতে তমিজের উত্তেজনা হয় ভয়ও লাগে। সে জিগ্যেস করে, পরামাণিক কুটি?
আমার শ্বশুর গেছে তার শ্বশুরবাড়ি। আরে, শ্বশুর গেছে শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুরবাড়ির পানশুপারি। দাঁত নাই তাই খাইতে নারি। মুখোত মারো হামানদিস্তার বাড়ি। ছড়াটি বলে কেরামত খুব হাসে। তারপর ব্যাখ্যা করে, পোড়াদহ মেলার সময় বাড়িত জামাই আসিছে, বুঝলা না? শ্বশুর গেছে আমার শাশুড়ি আর শালিক আনতে। আরে শালি না থাকলে মানষে কি আর শ্বশুরবাড়ি আসে? বোঝো না, বৌ হলো ডালভাতের থালি। রসের হাঁড়ি জোয়ান শালি। রসিকতা সম্পন্ন করে সে ফের আনে ফসলের প্রসঙ্গ, তুমি বলে মেলা ধান করিছো? আরে ধান তো করলা, ভাগ পাছো কেমন? আদ্দেকও তো পাও নাই। জয়পুর পাঁচবিবি আক্কেলপুরের চাষারা কিন্তু দুই ভাগ পালে জোতদারের গোলা নিজেরাই সাফ করিচ্ছে। খবর রাখো?