ধ্রুব আর নোটন যখন স্টেশনে এসে পৌঁছাল তখন চারদিক বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। বাগানবাড়ি থেকে স্টেশন মাইলখানেক। তারা হেঁটেছেও ধীরে। দুজনেই একটু ক্লান্ত।
ছুটির দিন বলেই বোধহয় স্টেশন ফাঁকা, শব্দহীন। শীতার্ত কুয়াশায় চারদিক আচ্ছন্ন। স্টেশনটাকে ভারী ভুতুড়ে আর অলীক বলে মনে হয়। আজকাল কলকাতা আর তার কাছাকাছি সব অঞ্চলে জনসংখ্যা এত বেড়েছে যে এরকম নির্জনতা প্রায় অপ্রাকৃত বলে মনে হয়। সব জায়গাতেই গায়ে গায়ে লোক, সবরকম যানবাহনেই ঠাসাঠাসি, গুঁতোগুঁতি।
নোটন জিজ্ঞেস করল, বসবে না? প্ল্যাটফর্মে বেঞ্চগুলো একদম ফাঁকা।
খোলা জায়গায় বসবি? আজ বেশ ঠান্ডা।
হোক। প্ল্যাটফর্মটা নির্জন। দুজনে কথা বলা যাবে।
তোর আর কত কথা আছে রে নোটন?
অনেক অনেক। এক জন্ম ধরে বললেও ফুরোবে না।
তা নাই ফুরোক। কিন্তু সেসব কথা আমার কানে না ঢাললেই নয়?
তুমি ছাড়া আমার কে আছে আর বলো!
নাটকে এই ডায়ালগ তোকে প্রায়ই দিতে হয় বোধহয়?
তোমার সঙ্গে নাটক? আর যেখানেই করি এই একটা জায়গায় নোটন কেবল নোটন।
তাই বুঝি! অতিভক্তি কীসের লক্ষণ জানিস?
অতিভক্তি হবে কেন? ভক্তি করতে তো দিচ্ছই না।
আর ভক্তিতে কাজ নেই।
শোনো, চলো ওখানে গিয়ে নির্জনে বসি। একটু ঠান্ডা লাগে লাগুক। তোমাকে আবার কবে এইভাবে পাব ভগবান জানেন। হয়তো আর দেখাই হবে না।
ধ্রুব হেসে বলল, রোমান্টিক আবর্জনা ঢালবি তো কানে? ঢালিস। তার আগে একটা প্র্যাকটিক্যাল কাজ সেরে নিই। টিকিটটা কেটে ট্রেনের সময়টা জেনে আসি। তুই এগো।
জনহীন কাউন্টারে গিয়ে ধ্রুব দুটো কলকাতার টিকিট কাটল। ট্রেনের টাইম যা জানল তাতে সময় হয়ে গেছে। ট্রেন এল বলে।
ধ্রুব খোলা প্ল্যাটফর্মে এসে প্রথমে নোটনকে দেখতেই পেল না। তারপর দেখল, কাছেরটা ছেড়ে বেশ দূরে অন্ধকারমতো এলাকায় একটা বেঞ্চে বসে আছে নোটন। তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল।
ধ্রুব কাছে গিয়ে পাশে বসে বলল, ট্রেনের সময় কিন্তু হয়ে গেছে।
একটা ট্রেন ছেড়ে দাও না।
বলিস কী? এরপর হয়তো ঘণ্টাখানেক বাদে আর-একটা আসবে।
হোক গে। পায়ে পড়ি।
তোর অত কথা কীসের রে নোটন? অনেক তো বলেছিস।
কোথায় আর বললাম? শুধু নিজের সংসারের দুঃখের গল্প শোনালাম। ও কি কথা?
আর কী বলার আছে?
আছে। বলব। তার আগে তুমি বলো।
আমার কথাই আসে না।
বউদির কথা বলো। ছেলের কথা বলো।
খুব হাসল ধ্রুব। তারপর বলল, হিংসে?
মোটেই না।
তবে জেনে কী হবে? বউদি খুব ভাল মেয়ে এই পর্যন্ত বলা যায়। তবে আমার সঙ্গে বনে না।
কেন বনে না?
আমার সঙ্গে কারওরই বনার কথা নয়, জানিস তো আমার স্বভাব।
খুব জানি। তোমাকে জানতে আবার আলাদা বিদ্যে লাগে নাকি?
কী জানিস?
তুমি নিজেকে যা প্রমাণ করতে চাও তা তুমি মোটেই নও।
কী প্রমাণ করতে চাই?
প্রমাণ করতে চাও যে তুমি খুব খারাপ, চরিত্রহীন, মাতাল।
তা নই?
মোটেই না।
কিন্তু লক্ষণগুলি তো মেলে।
একটুও মেলে না। মেয়েরা আর কিছু না বুঝুক ছেলেদের চোখ বোঝে।
আমার চোখে কী আছে রে নোটন?
খুব মায়া আছে। নইলে আমাকে তুমি ঘেন্না করতে পারতে। মায়াটুকু বাধা দিচ্ছে।
বেশ বললি তো! কোন নাটক থেকে দিলি এটা?
নোটন হেসে ফেলে বলল, এটা মিলে গেছে কিন্তু। নাটকেরই ডায়লগ। তা বলে কথাটা মিথ্যে নয়।
চালিয়ে যা।
নোটন মাথা নেড়ে বলে, ভীষণ ইয়ার্কি করে যাচ্ছ তখন থেকে। বলো না!–বলে নোটন খুব ধীরে ধ্রুবর বাহু স্পর্শ করল। একটু কাছে সরে এল।
ধ্রুব মৃদু হেসে বলল, গুড প্রগ্রেস। এরপর কাঁধে মাথা রাখার নিয়ম না?
রাখলে তুমি বকবে?
বকার কিছু নেই। রাখতে পারিস। তবে আমার কাধ ভীষণ ঠান্ডা।
কাঁধ ঠান্ডা মানে?
মানে তোর বুঝে কাজ নেই। এবার ঘোমটা ফেলে স্বাভাবিক হ।
ঘোমটা কেন ফেলব? লোকে তোমাকে আর আমাকে বর-বউ ভাববে ভয়ে? ভাবুক। আমি তাই চাই।
বেশ তো৷ কিন্তু ভাববার মতো কয়েকটা লোকও তো চাই। এখানে যখন কাউকেই দেখা যাচ্ছে না তখন কাকে আর ঘোমটা দেখাবি?
কেন? তুমি তো আছ! তুমি দেখো। দেখে ভাবো।
কী ভাবব?
আমাদের বর-বউ বলে ভাবো।
বাড়াবাড়ি করছিস, নোটন।
বাড়াবাড়িকে কি নাটকের পেশাদার মেয়েরা ভয় খায়? না তুমিই ভয় খাও?
ধ্রুব হাল ছেড়ে হেলান দিয়ে বসল। বলল, যা খুশি কর। তবে জেনে রাখ আমি এ গাড়িটা ধরব।
না, ধরবে না।
ধরবই।
ধরলেও কলকাতায় পৌঁছোতে পারবে না, ধ্রুবদা।
কেন পারব না?
কারণ আমি তা হলে গাড়িটার তলায় পড়ব। রান ওভারের কেস হলে ট্রেন সহজে নড়বে না।
সব মেয়েই পুরুষদের একটা ভয় খুব দেখায়। মরার ভয়।
আর কোন অস্ত্র আমাদের দিয়েছ বলো!
কেন? জিব! ওটা কি কম?
নোটন খুব কাছে সরে এল। ধ্রুব সরল না, নির্বিকার বসে রইল। নোটন কানের কাছে মুখ এনে বলল, এবার কাঁধে মাথাটা রাখছি। প্লিজ, সরে যেয়ো না।
ধ্রুব সরল না। নোটন কাঁধে মাথা রাখল। একটা হাত ধ্রুবর একখানা করতল তুলে নিল।
ধ্রুবদা! নাটক করলাম বলে ভাবছ!
কী জানি কী! তোর তো আমার ওপর এত টান থাকার কথা নয় রে নোটন?
কেন থাকবে না?
তোর সবরকম অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। তারপরও কি আর হৃদয় থাকে?
নোটন মাথাটা কাঁধে একটু ঘষে বলল, থাকে না তো জানোই। আমারও হয়তো নেই। কিন্তু আজ সারাক্ষণ তোমাকে কাছে পেয়ে কেমন যে হয়ে গেছি, ভারী অস্থির লাগছে।
কীরকম অস্থিরতা রে নোটন? শরীর।
না গো ওরম বোলো না। শরীর দিয়ে কি তোমাকে বোঝা যায়?
তবে কী?
নাটক করি, সিনেমা করি, আরও অনেক খারাপ কাজ করি, অস্বীকার করছি না। জীবনে একজন কেউ নেই আমার। সেই একজন কেউ হতেও পারবে না কোনওদিন।
সেই একজন কে?
জানি না। কিন্তু তুমি হতে পারতে।
আমার হওয়ার কথা ছিল না তো।
সেও জানি। সব ভুল। এই যে বসে আছি কাঁধে মাথা রেখে, ঘোমটা দিয়ে, এও ভুল। কাল থেকেই হয়তো আর এমন অস্থির লাগবে না। তবু আজ যে লাগছে তাতে বুঝতে পারছি এখনও একটু নোটন আছি। সেই আগের নোটন। তাই না?
আগের নোটনটাকেও তো আমি ভাল চিনতাম না রে।
তুমি চিনতে না। আমি তোমাকে চিনতাম। স্বামী বলে, ইহকাল পরকালের দেবতা বলে।
ধ্রুব শব্দ করে হেসে উঠল।
নোটন বলল, চুপ। জানি ওসব বাজে কথা। কিন্তু আজ হেসো না।
চালিয়ে যা।
শোনো। একটা জিনিস দেবে?
আবার কী? কাধ পর্যন্ত পৌঁছে গেছিস। আবার কী?
একটা চুমু দেবে? একটা। পায়ে পড়ি। কাউকে কখনও বলব না। একবার।
ধ্রুব একটা ঝাঁকি দিয়ে সোজা হয়ে বসে।
কী হল ধ্রুবদা! রাগ করলে?
না। গাড়ি আসছে।
গাড়ি!—নোটন যেন কথাটা বুঝতেই পারেনি এমনভাবে স্বপ্লেখিতের মতো চারদিকে তাকাল। বলল, গাড়ি দিয়ে কী হবে? আমরা তো এখন যাব না।
তা হলে তুই বসে থাক। আমি চলি।
নোটনের পক্ষে স্বাভাবিক হত ধ্রুবর হাত চেপে ধরা এবং জোরাজুরি করা। নোটন তার কিছুই। করল না। চুপচাপ বসে চেয়ে রইল সামনের দিকে। একটু নড়ল না, বাধা দিল না।
ধ্রুব উঠে কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিল। হলুদ একটা আলো নিঃশব্দে এগিয়ে আসছিল। প্ল্যাটফর্মে সেই আলোয় কয়েকজন লোককে দেখা গেল। দাঁড়িয়ে আছে। নাটকটা কি তারা দেখেছে?
গাড়ি এল। খুব ফাঁকা। এত ফাঁকা ট্রেন বড় একটা দেখা যায় না। ধ্রুব একটা কামরার হ্যান্ডেল ধরে মুখ ফিরিয়ে চাইল। একই জায়গায় একই ভঙ্গিতে নোটন বসে আছে। যেন মৃতদেহ।
তার হাত থেকে হাতলটা বিনীতভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে ট্রেনটা চলে গেল। ধ্রুব ধীর পায়ে ফিরে এসে নোটনের পাশে বসে বলল, উইল পাওয়ার আছে নাকি তোর।
নোটন মৃদু একটু হেসে বলে, পারলে না যেতে?
কই আর পারলাম।
শোনো ধ্রুবদা, চুপ করে বোসো। ভয় পেয়ো না, আমি তোমাকে খেয়ে ফেলব না।
কেউ খেলে খাদ্য হতে আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু মেয়েমানুষকেও আমার আজকাল ভাল লাগে না।
মেয়েমানুষ! আমি কি তোমার কাছে শুধু মেয়েমানুষ! আর কিছু নয়?
আবার কী?
আসার সময় সারা রাস্তা একটিও কথা বলেনি। ঘাড় শক্ত করে চোখ অন্য দিকে ফিরিয়ে রেখেছ। মনে মনে আমি অপমানে পুড়ে গেছি, জানো?
তা হয়তো গেছিস।
একবার তো অন্তত রিকগনাইজ করতে পারতে।
করা উচিত ছিল বুঝি?
কেন করবে না? নষ্ট হয়ে গেছি বলে কি সব পরিচয় মিথ্যে হয়ে যায়?
নষ্ট তো আমিও হয়েছি।
তুমি হওনি। বলে হঠাৎ একটু আবেগবশে দুই শীতল নরম করতলে নোটন ধ্রুবর দুটো গাল চেপে ধরল।
ধ্রুব মুখটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, নষ্টামির কী আছে? এ দেশের যে বিপুল অধঃপতন ঘটেছে তাতে মেয়েদের শরীর বেচে খাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার।
নোটন একটু বিষ হাসি হেসে বলে, শরীর বেচে খাই বুঝি? না গো, অতটা নয়। তবে সতীও নই ঠিকই। থাকা সম্ভব নয়।
আমার অত শুচিবায়ু নেই, নোটন। তবে তোকে এদের দলে দেখে আমি ভারী অস্বস্তি বোধ করছিলাম। সেটা ঘেন্না নয়, অপমান করাও নয়।
সত্যি বলছ?
বলছি। সত্যি বলতে আমার কোনও বাধা নেই।
ঘেন্না করো না তো!
না, করি না।
তা হলে দাও। একবার। একটিবার।
তৃষিতের মতো নোটন তার মুখখানা এগিয়ে দেয়। ঠোঁট দুটি একটু ফাঁক করা। চোখ স্তিমিত আলোতেও স্বপ্নাচ্ছন্ন দেখায়। তার পরিষ্কার শ্বাস এসে লাগে ধ্রুবর মুখে।
ধ্রুব মৃদু স্বরে বলে, একটা কথা তোকে বলি, নোটন। এখনও প্রকাশ্যে এ দেশে মেয়ে পুরুষ চুমু খায় না। খেতে নেই।
কেউ তো নেই।
অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু প্ল্যাটফর্মে দু-চারজন থাকেই। ঘাপটি মেরে আছে।
কিন্তু আর যে সুযোগ হবে না!
কেন হবে না?
কে কোথায় চলে যাব।
কেন চাস?
তোমাকে কি সব বোঝানো যাবে?
যাবে না কেন? বাংলা ভাষাতেই তো বলবি।
সব ভাব যে কথায় আসতে চায় না।
চেষ্টা কর, হবে।
আবার বলবে না তো নাটকের ডায়ালগ দিচ্ছিস?
তা বললেই কী! নাটক তো জীবন থেকেই আসে।
চাই, তার কারণ ওটা আমার চিহ্ন হয়ে থাকবে। আমার পরিণতি কী হবে জানি না, কিন্তু মরণ পর্যন্ত মনে থাকবে, স্পর্শ থাকবে। দাও।
ধ্রুব খুব করুণ দৃষ্টিতে মুখখানার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। আবহাওয়ায় নোটনের মুখখানা যেন সীমানা ছাড়িয়ে চারিদিককার আলোছায়ার মধ্যে প্রসারিত হয়ে যাচ্ছিল। চোখে জল। বড় সুন্দর।
কেন চিহ্ন রাখতে চাস, নোটন? আমি তোর কে?
কে তা জানো না?
ওরকম ভাবতে নেই। তোর একদিন ভাল বিয়ে হয়ে যাবে। বরের ঘর করবি, ভালবাসা হবে। কেন একটা চিহ্ন চাস? পৃথিবীতে কেউ কারও নয়। ওরকম ভাবাই ভুল।
এটা বুঝি নাটকের ডায়ালগ নয়?
হতে পারে। আমি নাটক বহুকাল দেখিনি।
আচমকাই নোটন ধ্রুবর গলাটা দুহাতে জড়িয়ে ধরল। ধ্রুব বাধা দেওয়ার আগেই নোটনের ঈষদুষ্ণ এবং ভেজা ঠোঁট চেপে বসে গেল তার ঠোঁটে। কিছুক্ষণ নোটনের বুকের ধকধক নিজের বুকে শুনল সে। বাধা দিল না।
শুচিবায়ু এবার গেল তো!–নোটন ঠোঁট সরিয়ে নিয়ে মুখের দিকে চেয়ে বলে।
ধ্রুব সামান্য তেতো গলায় বলে, এত লিপস্টিক মাখিস কেন? বিশ্রী আঠা-আঠা ভাব।
কত দাম জানো এই লিপস্টিকের?
দাম দিয়ে কী হবে? বিশ্রী।
নোটন তার রুমাল দিয়ে ঠোঁট মুছে নিয়ে বলল, এবার দাও।
আবার কী? এই তো হল।
তুমি তো দাওনি। আমি দিয়েছি।
ফল তো একই।
মোটেই নয়। আমি চাই তুমি নিজে থেকে দাও।
একটা সিন ক্রিয়েট না করেই ছাড়বি না।
আমার এটা জীবন-মরণের প্রশ্ন, ধ্রুবদা। সিনের কথা ভাবছ তুমি? ভেবো না। পৃথিবীতে কোনও সিনই চিরদিন থাকে না। মুছে যায়।
ধ্রুব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বুঝলাম। কিন্তু যদি দিই সেটাও যে নিজের ইচ্ছেয় দেব এমন তো নয়। তুই বলছিস বলেই।
তা হলেও বরফ ভাঙুক।
ধ্রুব চারদিক চেয়ে দেখে নিল। কেউ নেই। খুব কোমল হাতে সে জড়িয়ে ধরল নোটনকে। তারপর মুখখানা একটু ভাল করে দেখে খুব আলতো ঠোঁট ছোয়াল ঠোঁটে। একটু চেপে ধরল। তারপর মুখখানা সরিয়ে নিয়ে বলল, হয়েছে তো!
নিজের গলার স্বর ভারী অন্যরকম শোনাল ধ্রুবর কানে। স্বাভাবিক নয়। তার বুকে একটা অস্থিরতা শুরু হয়েছে। স্বাসকষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সেটা শারীরিক কোনও কারণে নয়। তার গলাটাই কেমন যেন অন্যরকম।
নোটন জবাব দিল না। চোখ বুজে পিছনে হেলান দিয়ে সে স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো বসে ছিল।
ধ্রুব নোটনের দিকে বেকুবের মতো চেয়ে রইল। কী করবে তা বুঝতে পারল না। নোটন বড় দূরের মানুষ হয়ে গেছে হঠাৎ।
উলটোদিকের একটা ট্রেন এসে থামতেই কিছু লোকজন দেখা গেল। তারপর আবার চুপচাপ হয়ে গেল স্টেশন।
নোটন চোখ মেলে বলল, মুখে যতই বলল তোমার শুচিবায়ু নেই, তোমার সতীত্বে বিশ্বাস নেই, তুমি খুব মুক্তমনা, আসলে ভিতরে ভিতরে তুমি ভীষণ শুচিবায়ুগ্রস্ত, প্রাচীনপন্থী, মর্যালিস্ট।
এই বুঝলি?
বুঝব কেন, জানি। তোমাকে ছেলেবেলা থেকে এত ধ্যান করেছি যে তোমার কিছুই আর আমার অজানা নেই।
ধ্যানে জেনেছিস? ভাল।
ঠাট্টা করছ? ধ্যান বলে কি কিছুই নেই?
থাকতে পারে। আমি জানি না। তবে তুই আবার ধ্যানও শিখেছিস জেনে হাসি পাচ্ছে। একটা লোককে ধ্যান করার কী?
এ তো সাধুদের ধ্যান নয়। আমার ধ্যান। এক-এক মানুষের এক-এক ধ্যান থাকে।
আমার ওপর তোর এত টান হল কবে থেকে, কীভাবে–সেটাই তো রহস্য।
তা হলে সেটা রহস্যই থাক। তুমি বিশ্বাস করবে না জানতাম।–বলে একটু হাসল নোটন।
ধ্রুব একটা খাস ফেলে বলল, না, আমার কিছু সহজে বিশ্বাস হয় না।
নোটন তার একটা হাত মৃদু ধরে বলল, কিন্তু কী সুন্দর আদর করলে আজ আমাকে। মনে হচ্ছিল আমার ভিতরটা পর্যন্ত ধুয়ে যাচ্ছে। কী যে সুন্দর লাগল, কী যে ভাল।
ধ্রুব আপনমনেই একটু লজ্জা পেল। এরকম সে কদাচিৎ করে।
নোটন বলল, আজ বউদির কাছে যখন ফিরে যাবে কীরকম লাগবে তোমার নিজেকে?
কীরকম আর লাগবে? রোজ যেমন লাগে।
নিজেকে অপবিত্র মনে হবে না? বিশ্বাসঘাতক মনে ভাববে না?
মোটেই না।
ভেবো। তাতে ক্ষতি নেই। আমি আজ যত পেলাম, তোমার তত হারায়নি গো। পুরুষ মানুষ হীরের আংটি।
এত বকবক করিস কেন বল তো!
চুপ করে থাকব?
থাক না একটু।
তা হলে কাঁধে মাথা রাখতে দাও।
রাখ। তবু চুপ কর।
নোটন হাসল। কাছে সরে এসে কাঁধে মাথা রেখে নিজম হয়ে বসে রইল।
গাড়ির সময় যে কখন হল তা টেরও পায়নি তারা। হঠাৎ ফের কুয়াশায় স্নান করা স্নান হলুদ আলোয় চারপাশ যখন অন্ধকার থেকে ভেসে উঠল তখন একটু চমকে উঠল তারা।
ওঠ, নোটন। গাড়ি আসছে।
সময় হয়ে গেল?
হল।
ইস! আর একটু দেরি করা যায় না?
পাগল!
কেন? তোমার জন্য বউদি ভাববে?
দূর। তোর বউদি ভাবে না, কেউ ভাবে না।
তা হলে?
আমার আর ভাল লাগছে না। স্টেশনে কি এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা যায়?
যায়, যদি ভালবাসা থাকে। তোমার তোত নেই।
এখন ওঠ।
উঠছি।
ট্রেন এল। দুজনে মোটামুটি একটা ফাঁকা কামরায় উঠে বসতে না বসতেই ছেড়ে দেয় ট্রেন।
খোলা জানলা দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা বাতাস আসছিল। নোটনের চুল উড়ছে। সে খুব মন দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে ছিল।
ধ্রুব বলল, ঠান্ডা লাগাচ্ছিস কেন? জানালাটা ফেলে দিই বরং!
না থাক।
কী দেখছিস?
বাইরেটা।
বাইরে দেখার কিছু নেই।
অন্ধকার তো আছে। খুব ইচ্ছে করছে অন্ধকারে ড়ুবে যেতে।
কত পাগলামি করবি এক বিকেলে? তোর কোটা ফুরোয় না?
না। আজ একটা অন্যরকম দিন।
তাই নাকি?
আজ আমি মরব।