2 of 3

০৮২. ধ্রুব, বাপ হয়েছিস শুনলাম

ধ্রুব, বাপ হয়েছিস শুনলাম। সেলিব্রেট করবি না!

ধুস শালা, বাপ সবাই হয়, সেটা কোনও ইভেন্ট নাকি! দেখিস না, ফুটপাথে অবধি বিয়োচ্ছে। ভিখিরিরা!

তবু এই প্রথম বাপ হলি, ফান্ডাই আলাদা।

সরকার বেশি বাপ হতে বারণ করেছে না! এই বাঁধাবাঁধির যুগে বাপ হয়ে তো আমার লজ্জাই লাগছে।

তুই মাইরি বেশ বলিস। তবে বেশি বাপ আর তুই হলি কোথায়! সেই কবে মান্ধাতার আমলে একটা বিয়ে কেলিয়েছিলি, তারপর বাপ হতে হতে তো বুড়ো মেরে গেলি, বাবা!

বাপ আরও একবার হতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সেবারটা টসকে গেল।

যেটা টসকে গেছে সেটা তো হিসেবের মধ্যে নয়। এটা হিসেবের মধ্যে। আজ একটা ব্ল্যাকনাইট দুজনে মিলে উড়িয়ে দিই আয়। দাম আমি দেব।

কেন? তুই দিবি কেন? বাপ তো হলাম আমি, তুই তো নয়।

আরে ওই হল। তুই বাপ হলে আমিও বাপ। তুই আর আমি কি আলাদা! এক পাঁইট ব্ল্যাকনাইট পেঁদিয়ে ঝুম হয়ে বসে থাকি আয়। মুরগিব রয়্যাল খুমে নিবি একটা?

না, আমার কেমন ইচ্ছে হচ্ছে না।

তুই কি শেষে ফিলজফার হয়ে যাবি, ধ্রুব? না কি সাধু-টাধু?

বকিস না অত।

মাইরি বলছি, তোর লক্ষণ আমার ভাল ঠেকে না কোনওদিন। শালা মিনিস্টারের ঘরে রুপোর চামচে মুখে করে জন্মেছিস, তোর শালা কত আপ খেয়ে বসে থাকার কথা। কেন যে শালা ডাউন ব্যাটারির লোকদের সঙ্গে মিশে মিশে বখে গেলি। তা বখবি তো ভাল করে বখ। তা না আবার মাইরি কী যে সব উলটোপালটা বলিস মঙ্গলগ্রহের ভাষায় কিছু বোঝা যায় না। ব্ল্যাকনাইট আবার ইচ্ছে করছে না কী রে?

তুই শালা আগের জন্মে শুড়ির নাতি ছিলি। দুনিয়ায় যাই ঘটুক সেই অকেশন ধরে তোর খানিকটা গেলা চাই। মামার গোয়ালে গাই বিয়োলেও ব্ল্যাকনাইট, ধ্রুব চৌধুরীর ছেলে হল বলেও ব্ল্যাকনাইট–

তুই মাইরি বেশ বলিস। আসল কী জানিস, একটা অকেশনে খেলে আর খুঁতখুঁতুনিটা থাকে না। আমার তো আবার ডাক্তারের বারণ। মাল খেতে গেলেই কেমন বুকটা খচ করে ওঠে। একটা অকেশন পেলে আর সেটা হয় না। তখন মনে হয়, নেশার জন্য তো নয়, এই একটা আনন্দের ব্যাপার ঘটল তাই একটু ফুর্তি করা আর কী।

তুমি হচ্ছ মালের গেঁড়ে। সবই বোঝে তবু নিজের সঙ্গে লুকোছাপাও করা চাই।

বাপু এই সাঁঝবেলাটায় আর এড়ুকেট করিস না আমাকে। এই সময়টায় আমি ভারী মাতৃহারা ছেলের মতো হয়ে যাই। ভিতরটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। আমার জীবনটা যে কীরকম ট্র্যাজিক তা তো জানিস।

পাছায় দুটো লাথ কষালে তোর দুঃখ এখন কোথায় যাবে রে গেঁড়ে?

তুই কি মদ্যপান নিবারণী সভা তৈরি করতে লাগবি রে শেষ অবধি, ধ্রুব? আমি তোর লক্ষণ যে ভাল দেখছি না।

আমার ভিতরে এখন অনেক দুশ্চিন্তা।

আবার দুশ্চিন্তা কী? ছেলে ভূমিষ্ঠ হয়েছে, দি ক্যাট ইজ আউট অফ দি ব্যাগ। বউ টিকিট কাটতে বসেছিল, শেষ অবধি ব্যাক করানো গেছে। ইউ আর এ হ্যাপি ম্যান।

আই অ্যাম নেভার এ যাপি ম্যান।

সেই জন্যই তো বলি, ধ্রুবটা কি শেষ অবধি ফিলজফার হয়ে যাবে? তোর জন্য বড্ড ভাবনা হয় রে।

লাথি খাবি।

মাইরি তুই-ই বল দোস্ত, তোর হ্যাপি না হওয়ার কারণটা কী? একে তো রাজা-গজার বংশ, তার ওপর খোদ একটা মিনিস্টারের ছেলে, লেখাপড়া শিখেছিস, চাকরি ধড়াধ্বড় ছাড়ছিস ধরছিস, মেয়েছেলে চাইলেই পাস, তোর শালা দুঃখ-টুঃখ কি সইবে রে?

তুই মাল খাওয়া ছাড়া দুনিয়ার আর কী বুঝিস বল তো? দুনিয়ায় বহুরকম দুঃখ আছে। তোর মতো মাতাল সেটা বুঝবে না।

মাতালও লোকে দুঃখ থেকেই হয়। দেবদাসের কথা ভুলে যাচ্ছিস দোস্ত! তবে আমি অনেক ভেবে-টেবে দেখেছি ফিলজফার হওয়ার কোনও মানে হয় না, নেতা হওয়ার মানে হয় না, কিছু হওয়ারই কোনও মানে হয় না। কারণ, কেউ কিছু করতে পারবে না এই দেশের। চারদিকে মাইরি এত দুঃখ ঢেউ দিচ্ছে যে আমার সারাক্ষণ বুকটা হু হু করে। তাই ঝুম হয়ে থাকি। মাল খেয়ে যাওয়া। ছাড়া কারও কারও কিছু করার নেই, বুঝলি?

বুঝলাম। তুই তো দেখছি আমার চেয়ে ঢের বড় ফিলজফার।

ফিলজফারও কি মালের কথা বলে মাইরি?

কেন? তুই তো একসময়ে ফিলজফিতে এম এ চমকেছিলি। তুই জানিস না?

ওসব বাত ছোড়ো দোস্ত। মরা ইতিহাস। কবে ঘি খেয়েছিলাম তার গন্ধ কি আজও লেগে আছে আঙুলে? ব্ল্যাক নাইটটা কি হবে, দোস্ত?

কালও আমার পেটে একটা বিচ্ছিরি ব্যথা হয়েছিল। তুই তো জানিস মদ জিনিসটা আমার কোনওকালে সয় না। জোর করে খেয়ে যাই মাত্র। না খেলে কোনও কিছু ফিলও করি না।

দ্যাখ ধ্রুব, তুই কিন্তু আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছিস।

কেন? তোর রাগের কী হল?

আমি মালের বিরোধিতা সইতে পারি না।

তুই খা না!

আমি তো খাবই। আমি মাল খেয়ে মরার জন্যই জন্মেছি। কিন্তু তুই শালা কি ভাল হয়ে যাবি, ধ্রুব? এরকম তো কথা ছিল না।

আমার ভাল হওয়ার কোনও চান্স নেই।

কেন নেই, দোস্ত? এই যে দেখছি মাল খেতে চাইছিস না। এ তত ভাল লক্ষণ নয়! আমারও যে শালা এসব দেখলে কনফিডেন্স নষ্ট হয়ে যাবে।

আরে আমি ভাল হবটা কী করে? জন্মেছি সামন্ততান্ত্রিক পরিবারে, গরিবের রক্তচোষা পয়সা খেয়ে বড় হয়েছি। তার ওপর বাপ মিনিস্টার, সে আর-এক কেলো। মিনিস্টার মানেই করাপশন। আমার রক্তে সেইসব বীজ কিলবিল করছে। আমার ভাল হওয়া কি সোজা?

কিন্তু তুই তা হলে এরকম করছিস কেন? মাল খাবি, রাজা উজির সাজবি, নর্দমায় ফুটপাথে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবি, তবে না লাইফ! ভাল হোস না ধ্রুব, প্লিজ। তোর পা ধরতে রাজি আছি।

তা ধর। কিন্তু ভয় পায় না। আমার মাথাটা আজ টিপটিপ করছে।

বাঃ! তা হলে তো ভাল লক্ষণ। দুফোঁটা পড়লে টিপটিপ একদম নেমে যাবে।

তা নামবে। কিন্তু আরও কথা আছে।

কী কথা?

আমার ব্রেনটা ভাল কাজ করছে না।

সে কীরকম?

ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। কাল আর-একটা কেলো করতে বসেছিলাম।

কী কেলো?

তা তোকে বলা যাবে না। কাল রাতেও অনেকক্ষণ টেনেছি। কিন্তু দেখছি গোলমাল হচ্ছে।

গোলমাল না হলে মাল খায় কোন বুরবক, এত দাম দিয়ে কিনে খাওয়ার মানেটা কী? সব গোলমাল করে দাও, মা কারণেশ্বরী! দুঃখ ভুলিয়ে দাও মা, জ্বালা জুড়িয়ে দাও মা, চারদিকটা স্বপ্নের মতো করে দাও, মা।

আমার কেসটা একটু অন্যরকম।

তুই নিজেই অন্যরকম রে, ধ্রুব। তোর সঙ্গে মেশা আমার উচিত হয়নি।

দেখ প্রশান্ত, আমার প্রবলেম অনেক সিরিয়াস।

তোর কোনও প্রবলেম নেই, ধ্রুব। কেন ওসব বানাচ্ছিস? দেশের দিকে চেয়ে দেখ। চারদিকে দেখ কী দুঃখ! লোকে খেতে পাচ্ছে না, পরতে পাচ্ছে না, মাগ-ভাতারে বনিবনা হচ্ছে না, ভিখিরি, খরা, লোডশেডিং, করাপশন, আবর্জনা, অসুখ। মাইরি দম বন্ধ হয়ে আসছে। ওঃ।

লাথিটা এবার ঝাড়ব? নে শালা পিছু ফের।

লাথি আজকাল আর লাগে না রে। ইমিউনিটি এসে গেছে তো! ভাগ্যের লাথি, পুলিশের লাথি, বউয়ের লাথি, কুকুর ইঁদুরের লাথি, লাথিতেই তো আমার জীবনটা ভরা। লাথি মেরে কিছু শেখাতে পারবি না রে বাপ।

মাজাটা তো ভাঙতে পারব।

মাজা নেই, মেরুদণ্ড নেই, ওসব নেই রে ধ্রুব। কে যেন বলছিল তোর মিনিস্টার বাবা তোকে পুনা না বরোদা না নাসিক কোথায় যেন পাঠাবে!

কথা একটা আছে।

যাবি, ধ্রুব?

হয়তো যেতে হবে।

কলকাতার গা ছেড়ে যাবি? যা। শুনেছি, ওসব জায়গা নাকি অনেক ভাল হয়ে গেছে। ঝা-চকচকে রাস্তা, দারুণ ডিসিপ্লিন, ট্রামে বাসে ভিড় নেই, ট্যাকসি পাওয়া যায় আর অঁড়িরা মালে জল মেশায় না। যা। ভাল থাকবি।

ভাল থাকা অত সস্তা নয়। বিস্তর ঝঞ্ঝাট আছে।

কীসের ঝঞ্ঝাট?

সেসব ফ্যামিলি ম্যাটার। তোকে বলা যাবে না।

কে শুনতে চাইছে? ফ্যামিলি ম্যাটার শুনলেই আমার মাথা ধরে। ফ্যামিলি লাইনটা কী বল তো! যাচ্ছেতাই একেবারে।

আমারও তাই মনে হয়। কে বলে তুই ফিলজফার নোস?

আজ একটু হয়ে যাক, দোস্ত। তুই চলে যাচ্ছিস। একটা ফেয়ারওয়েল নিয়ে নে। ব্ল্যাক নাইট।

রে প্রশান্ত, আজ থাক। আমার আজকাল কেমন হাঁসফাস লাগে। কাল সকালে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম হঠাৎ।

অজ্ঞান! বলিস কী?

তাই তো বলছি। আমার শালা দেখতে পেয়েছিল ভাগ্যিস। নইলে রাস্তার লোক হাসপাতালে চালান করে দিত।

তোর কোন শালা? যাদের বাড়িতে গিয়ে আমরা হুজ্জোত করেছিলাম?

হ্যাঁ। সে-ই।

সে এখনও তোর সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছে?

ঠিক রাখতে চায় না। তবে বিপদে পড়ে রেখেছে।

তোর কপাল রে, ধ্রুব! আমার যত রিলেটিভ আছে কেউ মাইরি ভয়ে আর সম্পর্ক রাখে না।

তোকে ভয় কীসের?

ওই যে মাঝে মাঝে একটু বেহেড হয়ে যাই। জীবনটা আমার বড় ট্র্যাজিক রে ধ্রুব। এই দুঃখে হয়ে যাবে নাকি এক হাত ব্ল্যাকনাইট?

তুই টাকা পেলি কোথায় বল তো!

কেন শালা, আমি কালোয়ারের ছেলে, আমার পকেটে টাকা থাকতে নেই?

তা আছে। কিন্তু হঠাৎ এত ব্ল্যাকনাইট-ব্ল্যাকনাইট করছিস কেন? তুই তো খাস পেঁচো কালীর পেচ্ছাপ। কালীমার্কা।

মাঝে মাঝে একটু ফিনফিনে নেশা করতে ইচ্ছে হয় না?

আজ ইচ্ছেটা হয়েছে কেন?

বড় দুঃখ রে! একটু মুরগির রয়্যাল দিয়ে মুখবন্ধন করে নিলে বড় ভাল জমত ব্যাপারটা।

তোর কি এখনও খিদে পায় প্রশান্ত? আমার পায় না।

আমার পায়।

আমার মনে হয় পেটে একটা গজকচ্ছপ ঢুকে বসে আছে। গ্যাস হচ্ছে।

দিনে বারোটা করে অ্যান্টাসিড খাবি।

তোর মাথা!

মাতালদের রেডবুকে লেখা আছে রে। বারোটা অ্যান্টাসিড।

 

***

আপনাকে দারুণ ফ্রেশ দেখাচ্ছে।

রেমি কথাটা শুনে তরুণী নার্স মেয়েটির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। কথাটা ঠিক বুঝতে পারছে না। বলল, আমি কি ভাল আছি?

ওমা! ভাল নেই? একদম ভাল হয়ে গেছেন আপনি।

রেমির মনে হচ্ছিল তার শরীরের ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেছে। একতাল ময়দার মতো তাকে ঠেসে মেখে ছেনে তারপর দলা পাকিয়ে ফেলে গেছে কে যেন। মৃত্যুর এক আবছা অন্ধকার জগৎ থেকে ফিরে এসেছে সে, কিন্তু এখনও সেই মৃত্যুর একটু শীতল স্পর্শ, মাথার ভিতরে এখনও কয়েক ফোঁটা মৃত্যুর অন্ধকার রয়ে গেছে। এখনও দুই জগতের এক মধ্যবর্তী মানসিক অবস্থায় রয়েছে রেমি। ঠিক স্বাভাবিক নয়।

নার্স মেয়েটি তা জানে। দীর্ঘকাল সংজ্ঞাহীনতার পর এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক, সে রেমির আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্যই বলল, অসুস্থতার কোনও চিহ্নই আপনার মুখে নেই।

রেমি ক্ষীণ গলায় বলল, আমার শরীর বড় দুর্বল।

ও তো একটু হবেই।

ছুঁচের বড় ব্যথা।

কমে যাবে। আর কয়েকটা দিন।

রেমি হাসল না। বড় বড় দুই চোখে অনির্দিষ্টভাবে চেয়ে রইল। তার দৃষ্টি স্থির নয়, স্বাভাবিক নয়। শ্বস ক্ষীণ, নাড়ি ক্ষীণ, শরীর সাদা, শীর্ণ, শিরা-উপশিরার নীলাভ সরীসৃপ চামড়ার নীচে দৃশ্যমান।

আপনার হাজব্যান্ড এসেছিলেন।

কখন?

আজ সকালে। না দুপুরে বোধহয়।

আমার ছেলে?

কাল সকাল থেকে এ ঘরে বেবিকে দেওয়া হবে। আপনার হাজব্যান্ড দেখে গেছেন বেবিকে।

আমি একবার দেখব। দেখাবেন?

নিশ্চয়ই।–বলে নার্স মেয়েটি আয়াকে ডেকে বেবি আনতে বলে দেয়।

আপনার হাজব্যান্ড কিন্তু খুব হ্যান্ডসাম।

রেমি হাসে না। খুশি হয় না। জবাব দেয় না।

ইনজেকশনটা দিয়ে দিই এবার।

দিন। আমার আর ব্যথা লাগে না।

নার্স ইনজেকশন দেয়। রেমি নির্বিকার চেয়ে শুয়ে থাকে। উঁচটা বের করে নিয়ে নার্স বলে, লাগল না তো!

আমার আর লাগে না। বললাম না! কত ব্যথা গেল কদিন। ইনজেকশন সে তুলনায় কিছুই নয়।

আপনি আমাদের খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।

কেন বলুন তো।

এমন কাণ্ড বাঁধালেন! হেমারেজ থামে না। এখন-তখন অবস্থা। ডাক্তাররা তো হাল ছেড়ে দিয়েছিল।

মরলেই বা কী হত?

ও বাবা! আপনার কিছু হলে আমাদের গর্দান থাকত নাকি?

কেন? গর্দানের ভয় কী?

নার্সিংহোম ভরে গিয়েছিল লোকে। ভি আই পি-দের ফোনে ফোনে আমরা অস্থির। স্বয়ং কে কে চৌধুরী মানে আপনার শ্বশুরমশাই সারারাত্রি লবিতে বসে ছিলেন।

খুব হইহই হয়েছিল?

সাংঘাতিক। নার্সিংহোমে একজন হোমিওপ্যাথ, একজন কবিরাজ এবং একজন তান্ত্রিককেও আনা হয়েছিল।

বলেন কী?

তাই তো বলছি আপনার কিছু হলে মিস্টার চৌধুরী আমাদের গর্দান নিতেন।

উনি আমাকে একটু বেশি ভালবাসেন।

ভি আই পি-দের আমরা এমনিতেই একটু বেশি যত্ন নিই। কিন্তু আপনার ব্যাপারে আমাদের নাওয়া-খাওয়া ছাড়তে হয়েছিল।

ইস। আমার ভীষণ লজ্জা করছে।

লজ্জার কিছু নেই, মিসেস চৌধুরী। আপনি যে ভাল হয়ে গেছেন সেইটেই আমাদের সান্ত্বনা।

রেমি একটু ভাবল। অজ্ঞান অবস্থায় সে সারাক্ষণ যেসব অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছে তার মধ্যে এক অচেনা পুরুষ ছিল। সেই পুরুষ কে তা সে জানে না। তবু সেই পুরুষের সঙ্গে একজনের সুন্দর একটা আদল ছিল।

রেমির রক্তহীন মুখে ক্ষীণ একটু লাল রং দেখা গেল। সে জিজ্ঞেস করল, ও ছিল না?

ও কে? কার কথা বলছেন?

আমার হাজব্যান্ড!

আপনার হাজব্যান্ড ছিলেন কি না ওই ভিড়ের মধ্যে লক্ষ করিনি। ছিলেন নিশ্চয়ই। সবাই ছিলেন।

রেমি একটু চেয়ে থাকে মেয়েটির দিকে।

মেয়েটা বলে, আপনার হাজব্যান্ড কিন্তু খুব স্মার্ট। দারুণ।

আমাদের বাড়ির কেউ কি এখন আছে বাইরে?

আছে। জগা বলে একজন।

তার কথা বলছি না। আর কেউ?

খোঁজ করব?

দেখুন না একটু। আমার বাপের বাড়ির কেউ আসতে পারে।

তারা অনেকক্ষণ আগে এসে দেখে গেছে।

আচ্ছা।

রেমি চোখ বোজে। দীর্ঘ একটা সময় চেতনাহীনতায় কাটিয়ে এখন তার প্রিয়জনদের দেখতে ইচ্ছে করছিল।

আয়া বাচ্চাটাকে নিয়ে এসে মৃদুস্বরে ডাকে, বউদি! এই যে দেখুন। রাজপুত্তুর। সোনার বাউটি দিতে হবে কিন্তু।

রেমি নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে বাচ্চাটার দিকে। তার। তার। একমাত্র তার বত্রিশ নাড়ি-ঘেঁড়া ধন। লাল, তুলতুলে, মোটাসোটা, ন্যাড়ামাথা। তবু যেন জন্মজন্মান্তরের চেনা। লক্ষ বছর এই শিশু তার গর্ভে বাস করেনি কি? বুক জুড়ে বাৎসল্যের মেঘ পুঞ্জীভূত হয়ে এল। কোথায় ছিল এই অসম্ভব অদ্ভুত অনুভূতি! একটু আগেও তো একে দেখেনি সে!

রেমি হাত বাড়ায়। একটু ছোঁয় তার ছেলেকে।

ও কি ঘুমোচ্ছ?

হ্যাঁ, বউদি। খুব ঘুমোচ্ছ।

তা হলে রেখে এসো। আর শোনো, ফরসা কাপড় দিয়ে জড়িয়ে।

আয়া খুব হাসে, ফরসা কাপড় কী গো! ওর দাদু যে ডজনখানেক দামি নরম তোয়ালে দিয়ে গেছেন। বাচ্চার কি অভাব আছে নাকি কিছুর?

রেমি লজ্জা পায়। কৃষ্ণকান্ত যে একটা তুলকালাম কিছু করবেন এ তো তার জানাই ছিল।

ওর দাদু কি আজ এসেছিল?

আসেনি আবার! তিনবেলা হানা দিচ্ছেন গো! আমরা সব ভয়ে জড়োসড়ো।

রেমি মিষ্টি করে বলে, উনি খুব ভাল। ভয় পেয়ো না।

আপনাদের সবাই ভাল। বর ভাল, শ্বশুর ভাল, ছেলে ভাল। বাউটি না নিয়ে কিন্তু ছাড়ব না।

রেমি একটা শ্বাস ফেলে চোখ বুজল।

তারপর একটু অন্ধকার পেরোল রেমি! শরীর এত দুর্বল যে চোখ বুজলেই ঘুমের আঠায় জড়িয়ে যায় চোখ। বোধহয় ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে তাকে।

বিছানায় মিশে থাকা রেমি তার আঘো-ঘুমের মধ্যে আবার দৃশ্যাবলী দেখতে পাচ্ছিল। একজন লোক একা একটা বিশাল রোদে-পোড়া মাঠ পেরোচ্ছে। দুবগলে ক্ৰাচ, গায়ে শতচ্ছিন্ন পোশাক। কোথায় চলেছে?

ধ্রুব না? রেমি কেঁপে ওঠে ভয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *