ধ্রুবর যে একটা কিছু হয়েছে তা আশঙ্কা করেছিল জয়ন্ত। তাই সতর্কতাবশে সে রেস্টুরেন্টের দরজার বাইরে এসে ধ্রুবকে দেখছিল হাঁটার ভঙ্গিটা কিছু অস্বাভাবিক। যেন জল ভেঙে হাঁটছে। পদক্ষেপ সমান মাপের নয়। শরীরটা একটু ঝুঁকে আছে।
ধ্রুব যখন পড়ল তার আগেই জয়ন্ত লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে গেছে তার দিকে।
ধ্রুবর জ্ঞান ছিল না। কপালটা ঠুকে গেছে ফুটপাথের শানে। একটু রক্ত পড়ছিল ক্ষতস্থান থেকে।
এত সকালে রাস্তায় বিশেষ লোকজন থাকে না বলে একটা সিন হল না। জয়ন্ত ধ্রুবকে চিত করে শুইয়ে হাইড্রাস্টের নোংরা জল তুলে ঝাপটা দিল চোখে। কয়েকবার ঝাপটা দিতেই ধ্রুব তাকায়। আস্তে আস্তে উঠেও বসে। তবে চোখের দৃষ্টি কাচের মতো ভাবলেশহীন, মুখ সাদা।
জয়ন্ত জিজ্ঞেস করে, এখন কেমন লাগছে?
বেটার। কী হয়েছিল বলো তো? পড়ে গিয়েছিলাম নাকি?
আপনার ডাক্তার দেখানো দরকার।
বার বার ওকথা বলছ কেন? আমার কিছু হয়নি।
জয়ন্ত একথার জবাব না দিয়ে ধ্রুবকে ধরে আস্তে আস্তে দাড় করাল। তারপর বলল, একটা ট্যাকসি ধরে দিই, বাড়ি চলে যান।
বাড়ি! —বলে ধ্রুব কিছুক্ষণ ভাববার চেষ্টা করে। কিন্তু তার চিন্তাশক্তি ভাল কাজ করছে না। মাথাটা শূন্য। একটু ভাববার চেষ্টা করে হাল-ছাড়া গলায় বলল, তাই করি তা হলে। আমি কেন যে নিজের ওপর গ্রিপ হারিয়ে ফেলছি!
সকালবেলায় ট্যাকসি সহজলভ্য। জয়ন্ত একটা ট্যাকসি ধরল এবং ধ্রুবকে তুলে নিজেও উঠে বসল পাশে।
চলুন, পৌঁছে দিয়ে আসি।
রেমির কী হবে?
যা হচ্ছে তা আপনাকে ছাড়াই তো হচ্ছে। কেউ তো আপনার সাহায্য চায়নি।
ধ্রুব কথাটার জবাব দিল না প্রথমে একটু বাদে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, তা বটে। আমার এক ফোঁটা রক্তও নেওয়া হয়নি রেমির জন্য।
বাড়ির সামনে ধ্রুবকে নামিয়ে দেয় জয়ন্ত, নিজে নামে না। ট্যাকসি থেকে মুখ বাড়িয়ে বলে, গিয়ে গরম জলে স্নান করে ভরপেট কিছু খেয়ে নিন।
ধ্রুব ফটক খুলে বাড়িতে ঢোকে। লোকজন, চাকরবাকর আজ চোখেই পড়ল না। নিজের ঘরে এসে ধ্রুব কিছুক্ষণ চুপচাপ বিছানায় পড়ে থাকে। কাল রাতে সে মদের দোকানে ভাঙচুর করেছে। তখনও সে বেশ ফিট ছিল। তারপর পুলিশের খপ্পর থেকে পালাতে দৌড়েছে অনেকটা পথ। তারপর বাড়ি ফিরে রেমির খবর পেয়ে গেছে নার্সিংহোমে। সব ঘটনাগুলো ভেবে দেখল সে। কোথাও কোনও অস্বাভাবিকতা ছিল না তার। অসুস্থতা তো নয়ই। তা হলে কী হল? জ্ঞানবয়সে সে কখনও অজ্ঞান হয়েছে বলে মনে পড়ে না।
শরীরটা যে ভীষণ দুর্বল তা একটু নড়াচড়া করতে গেলেই সে টের পাচ্ছে। মাথাটা বড্ড বেশি ফাঁকা।
কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকতে থাকতে কখন টুপ করে ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেল সে, টেরও পেল না।
যখন ঘুম ভাঙল তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। শীতের বেলা প্রায় শেষ হয়ে এল। রোদের আভায় লালচে রং ধরে গেছে।
ডাকছিল লতু, এই ছোড়দা, ওঠ! খাবি না!
ধ্রুব খুব কষ্টে চোখ খোলে। কিন্তু জেগে উঠতে আরও খানিকক্ষণ সময় লাগে তার। কিছুক্ষণ সে নিজের ঘর, জিনিসপত্র বা লতুকেও চিনতে পারে না। মাথাটা পরিষ্কার হয়ে যেতে সে পাশ ফেরে। কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে মাথাটা তুলে ঘড়ি দেখে। তিনটে।
লতু বড় বড় চোখ করে তাকে দেখছিল। বলল, কখন এসেছিস কেউ টের পায়নি তো! বাবা ভীষণ ভাবছেন। বোধহয় থানাতেও খবর দেওয়া হয়েছে।
ধ্রুব বহুক্ষণ কিছু খায়নি। সম্ভবত কাল বিকেলের পর থেকে তার পেটে খাবার পড়েনি। এখন পেটের ভিতরে একটা ওলট-পালট হচ্ছে। সে লতুর দিকে চেয়ে বলে, সকালেই এসেছি।
কাউকে ডাকিসনি কেন?
ডাকব কী করে? ঘুমোচ্ছিলাম না!
খবরটা দিবি তো যে বাড়িতে এসেছিস!
আমি একটু স্নান করব। গরম জল দিতে বল তো।
কেন? বাথরুমে গিজার তো আছেই।
তুই চালিয়ে রেখে যা। তোর কি শরীর খারাপ?
হ্যাঁ, উইক লাগছে।
হবেই। কাল থেকে কিছু খাসনি বোধহয়। তার ওপর ওই টেনশন।
এবার বিদ্যুৎ চমকের মতো রেমির কথা মনে পড়ল ধ্রুবর। টেনশন কথাটাই মনে পড়িয়ে দিল। নইলে–আশ্চর্য রেমির কথা তার মনেই ছিল না। সে লতুর দিকে চেয়ে বলল, রেমির কী খবর?
লতু মাথা নাড়ল, ভাল।
কীরকম ভাল?
অপারেশন হয়েছে। ব্লিডিং বন্ধ।
তার মানে বাঁচবে?
হ্যাঁ, বাঁচবে না কেন? তুই ওঠ। আমি গিজার চালিয়ে দিচ্ছি।–বলে লতু বাথরুমে গিয়ে গিজার চালিয়ে ঘরে এসে বলল, আবার যেন ঘুমিয়ে পড়িস না। আমি খাবার তৈরি রাখতে বলে যাচ্ছি ঠাকুরকে। বাবাকে ফোন করে তোর খবর দিতে হবে। ওপরে যাচ্ছি।
বাবা কোথায়?
দুপুর পর্যন্ত নার্সিংহোমে ছিলেন। তারপর রাইটার্সে গেছেন। একটুও বিশ্রাম করেননি আজ। ভয় হচ্ছে অসুস্থ হয়ে না পড়েন। বউদির জন্য যা কান্নাকাটি করেছেন আর যা টেনশন গেছে তাতে কাল রাতেই স্ট্রোক হয়ে যেতে পারত।
ধ্রুব উঠল এবং টের পেল, তার শরীরের গ্লানি অনেকটা কম। দুর্বলতা আছে তবে তা মারাত্মক নয়। তবু নিজেকে তার ভারী শিশু-শিশু লাগছে আজ। লতু তার সঙ্গে কদাচিৎ এত ভাল ব্যবহার করে। এই যে তাকে স্নান করে খেয়ে নিতে বলে গেল লতু, ঠিক এরকমটা ওর কাছে প্রত্যাশিত নয়। মনে মনে লতু তাকে ঘেন্না করে এবং সবচেয়ে বড় কথা, তাকে পাত্তা দেয় না। আজ দিচ্ছে। এতে কি খুশি হবে ধ্রুব? না কি কোনও প্রতিক্রিয়া ঘটানোর মতো নয় ব্যাপারটা?
সে উঠে হালকা কিছু ব্যায়াম করল। তার শরীর নমনীয় এবং সুগঠিত। সহজে কোনও অসুখ করে না। কিন্তু যখন করে তখন ভোগায়। ধ্রুব অসুখ-বিসুখকে বড় ভয় পায়। কারণ অসুখ মানেই এক ধরনের বন্দিত্ব। বন্দিত্ব তার অসহ্য।
গরম জলে কষে স্নান করল সে। শরীর অনেক ঝরঝরে লাগতে লাগল। ঘরে আসতেই ঠাকুর উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, খাওয়ার ঘরে যাবেন, না এখানে খাবার দিয়ে যাব?
খাওয়ার ঘরে।
ধ্রুব, পায়জামা আর পাঞ্জাবির ওপর শাল জড়িয়ে নেয়। গরম জলে স্নান করার পর শীতটা একটু বেশি লাগছে।
ঠাকুর গরম ভাত বেড়ে দিয়েছে টেবিলে। ধ্রুব ভাত ভাঙল। তারপর ঠাকুরের দিকে চেয়ে বলল, বউদি কেমন আছে জানো?
ঠাকুর শশব্যস্তে বলল, ভাল।
ঠিক জানো?
হ্যাঁ দাদাবাবু। আমি তো দুপুরেই নার্সিংহোমে গিয়েছিলাম।
নিশ্চিন্ত হল ধ্রুব। লতুর কথা যে তার বিশ্বাস হয়নি তা নয়। তবে এমন হতে পারে যে, কোনও অশুভ কিছু ঘটে থাকলে লতু হয়তো সত্যি খবরটা তাকে দিতে চায়নি।
পেট ভরে খাওয়ার পর ধ্রুব ঘরে এসে একটা সিগারেট ধরায়। পেট ভরার পর এক ধরনের আলসেমি জড়িয়ে ধরেছে তাকে। একবার নার্সিংহোমে যাওয়া উচিত সে বুঝতে পারছে। কিন্তু উৎসাহ পাচ্ছে না।
জানালা দিয়ে সে বাড়ির পিছনকার ছোট্ট বাগানটার দিকে চেয়ে থাকে। রাঙা রোদে নম্র ও স্বপ্নময় হয়ে আছে জায়গাটা। পপি ফুল ফুটেছে অনেক। নিঃশব্দ এক প্রাণের খেলা চলছে এই এক টুকরো বাগানের পরিধিতেও।
ধ্রুব সিগারেটটা শেষ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে বিছানায়। ভাল লাগে না। এবকম শুয়ে বসে। সময় কাটানোর মানেই হয় না কিছু। বিকেলবেলা ঘরে থাকতেও পারে না সে।
ধ্রুব উঠল। চটি পরে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। তারপর হাঁটতে লাগল। এমন উদ্দেশ্যহীন ভাবে বহুকাল সে হাঁটেনি। কিন্তু কিছুক্ষণ হাঁটবার পর সে বুঝতে পারে, এটারও কোনও মানে হয় না। হেঁটে যদি কোথাও যাওয়ার না থাকে তবে হাটবাব মানে কী?
আসলে ভীষণরকম একঘেয়ে লাগছে তার বিকেলটা। এরকম তো লাগে না। আজ লাগছে। কেন?
গা গরম করা এবং সময় কাটানোর মতো একটা জিনিস আছে। মদ। কিন্তু গতকালের অভিজ্ঞতা তার ভাল নয়। আজ সকালে অল্পক্ষণের জন্য হলেও সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল রাস্তায়। না, আজ সে মদ খাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। শরীরের ভিতরে যদি কোনও গোলমাল ঘটে গিয়ে থাকে তবে সেটাকে একটু থিতোনোর সময় দেওয়া ভাল।
তার দুরকম বন্ধু আছে। একরকম–জুয়াড়ি, মদ্যপ, বদমাশ, লোচ্চা এবং গুন্ডা। আর একদল ভদ্র, শিক্ষিত, মধ্য বা উচ্চবিত্ত। কারও সঙ্গেই বস্তুত তার খুব ঘনিষ্ঠতা নেই। থাকার কথাও নয়। সে কাউকেই খুব বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না। নিয়মিত কোথাও সে আড্ডা দেয় না। তার অনেকগুলো ঠেক আছে। কোনওটা মেসবাড়ি, কোনওটা শুড়িখানা বা জুয়ার আড্ডা, একজন নষ্ট মেয়েমানুষের ঘর অবধি, আর আছে কফি হাউস, ধারার ফ্ল্যাট, দুটো ক্লাব ইত্যাদি। যখন যেটায় খুশি যায় বা যায় না। মাঝে মাঝে ধ্রুব একা-একা ঘুরে বেড়ায় ভূতগ্রস্তের মতো। কখনও কলকাতার বাইরে পাড়ি দেয়।
শিগগিরই, যদি তার বাবা কৃষ্ণকান্তর চাল খেটে যায়, তবে তাকে যেতে হবে নাসিকে। জায়গাটায় সে গেছে। ভাল নয়, খারাপও ন্য। কৃষ্ণকান্তর এক বন্ধুর ফার্ম আছে সেখানে। তার সঙ্গে ব্যাবসাতে জুড়ে দেওয়া হবে তাকে। কিন্তু মুশকিল হল, কৃষ্ণকান্ত সেটা পেরে উঠবে কি না সেটাই। প্রশ্ন।
তার বাবাকে সবাই সমীহ করে, একথা ঠিক। একথাও ঠিক বাংলাদেশের এনিমি প্রপার্টির ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকাও আইনত কৃষ্ণকান্তর প্রাপ্য। কিন্তু কথাটা সবাই মেনে নিচ্ছে না। তার দাদু হেমকান্ত অন্য দুই ছেলেকে বঞ্চিত করে ছোট ছেলের নামে সব বিষয়-সম্পত্তি উইল করে ন্যায্য কাজ করেননি একথা ধ্রুবও মানে। এই উইলের ফলে রাগ করে বহুকাল আগে তার জ্যাঠা। কনককান্তি কলকাতার বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, আর কখনও এ বাড়ির চৌকাঠ মাড়াননি। সেই জ্যাঠা এবং সেজো জ্যাঠার ছেলেরা বড় হয়েছে। তারা ফুসছে। এনিমি প্রপার্টির টাকা বড় কম নয় এ বাজারে। প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকা দাবি করেছেন কৃষ্ণকান্ত। কাটছাট হওয়ার সম্ভাবনা কম, কারণ তিনি প্রাক্তন মন্ত্রী এবং সম্ভাব্য এম পি। এত টাকা যদি পেয়েই যান কৃষ্ণকান্ত ৩বে আত্মীয়রা তার ভাগ আশা করবে না কেন? কৃষ্ণকান্তকে তারা এত স্বার্থপর হতে কেনই বা দেবে?
কৃষ্ণকান্ত কী চান তা ধ্রুব খানিকটা আঁচ করতে পারে। তিনি আপাতত ধ্রুবকে দূরে সরিয়ে দিয়ে একটা লাগাতার দুশ্চিন্তা থেকে অব্যাহতি পেয়ে রাজনীতিতে নতুন কোনও খেলা শুরু করবেন। এনিমি প্রপার্টির টাকার কিছু ধ্রুবকে দেবেন, বাকিটা ঢালবেন রাজনীতিতে। সাধ্বী নারীর সতীত্ব, ধার্মিকের সততা, নেতার আদর্শ থেকে শুরু করে সবকিছুই আজকাল ক্রয় বা বিক্রয়যোগ্য।
কিন্তু আশ্চর্য এই, ধ্রুব কৃষ্ণকান্তর এই শেষ প্রচেষ্টায় বাধা হতে চায় না।
কেওড়াতলার কাছে আদিগঙ্গার ওপর কংক্রিটের ব্রিজে এসে দাঁড়ায় ধ্রুব। অবিরল পোড়া ঘিয়ের গন্ধ সমেত মড়া পোড়ানো ধোঁয়া এসে নাকে লাগছে। অনির্বাণ চিতার আলো জ্বলছে শ্মশানে। ধ্রুব সেইদিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না আজ।
কৃষ্ণকান্তর জীবনে যে এটাই শেষ উদ্যোগ হবে তা ধ্রুব ভাল করেই জানে। আত্মিক জোর বহুকাল আগে শেষ হয়ে গেছে কৃষ্ণকান্তর, ছেড়ে গেছে নীতিবোধ, ছিল শুধু অফুরন্ত শারীরিক ক্ষমতা। এখন বোধহয় সেটাও শেষ হয়ে আসছে। আর বেশিদিন নয়।
ধ্রুব সরে যেতে চায় আরও একটা কারণে। সে বুঝতে পারছে, কলকাতা শহরের আবাল্য পরিবেশে সে আর মনের খাদ্য পায় না। কেমন স্তিমিত হয়ে আসছে সব উৎসাহ, উদ্দীপনা, যৌবনের উচ্ছলতা। তার উচ্চাশা নেই, ডেভ পর্যন্ত হয় না কিছুতে। রোজ বার বার এক ঠেক থেকে আর-এক ঠেক, এক চেনা মুখ থেকে আর-এক চেনা মুখ, এইরকম ফুর্তি বা ফুর্তির চেষ্টা করতে করতে তার মনে হয় যেন সে বিভিন্ন দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে ফিরে আসছে। কোনও মানে হয় না এরকম জীবনের। নাসিক তাকে এরকম জীবনযাপন থেকে মুক্তি দিতে পারে। আর এক মুক্তি ঘটবে রেমির কাছ থেকে। এমন নয় যে রেমিকে সে ঘৃণা করে। তা নয়। তবু রেমি এক জগদ্দল বোঝার মতো চেপে আছে ঘাড়ে। সে মেয়েদের সঙ্গে ভাবালুতার কথা বলতে পারে না, কোনও মেয়েকেই একনিষ্ঠ গাড়লের মতো ভালবেসে যাওয়াও তার পক্ষে সম্ভব নয়। ওরকম প্রতিভা তার কোনও দিনই ছিল না। তাই যৌনতা ছাড়া রেমির সঙ্গে সে ঘনিষ্ঠতর কোনও সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেনি। আর কে না জানে, যৌনতা বড় অগভীর এক অভ্যাস মাত্র। তা দুই নর-নারীর সম্পর্ককে কখনও দৃঢ় করে না।
ভরসা এই, কৃষ্ণকান্ত তার মতো দায়িত্বজ্ঞানহীনের সঙ্গে নবজাতক সহ স্নেহের বউমাটিকে কিছুতেই ছাড়বেন না। রেমিও তো নতুন খেলনা পেল। ছেলে। এবার ধ্রুবর মুক্তি।
আস্তে আস্তে ব্রিজটা পেরোয় ধ্রুব। চেতলায় পা দিয়ে আদিগঙ্গার ধার ধরে উত্তরমুখো রাস্তায় হাঁটতে থাকে। মিনিট পাঁচ-সাত হাঁটার পর গলিটা ঠাওর পায়। অন্ধকার গলি, স্যাতদাঁতে, ঘিঞ্জি। শেষ প্রান্তে অন্য দুটো বাড়ির সঙ্গে জড়ামরি করে একটা লাল ছোট দোতলা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। খুব পুরনো বাড়ি। প্রায় ত্রিশ বছর আগে বাড়িটা এক দেউলিয়া মক্কেলের কাছ থেকে খুব সস্তায় কিনে নেন কৃষ্ণকান্ত। তারপর এক মহিলাকে দানপত্র লিখে দেন। সেই ঘটনার ফলে এক প্রচণ্ড শোরগোল উঠেছিল আত্মীয়মহলে। কিন্তু কৃষ্ণকান্ত গ্রাহ্য করেননি। এই মহিলা কোনওদিন কালীঘাটে তাদের বাড়িতে আসেননি, তবে তাঁর ভাইপো-ভাইঝিদের কেউ কেউ আসে। মাঝে মাঝে।
ছেলেবেলা থেকেই ধ্রুব গুজবটা শুনেছিল। এই মহিলা নাকি তার দাদু হেমকান্তর গুপ্ত প্রণয়সঙ্গিনী ছিলেন। সোজা কথায় রক্ষিতা। অন্য মতে হল, ইনি হেমকান্তর দ্বিতীয় স্ত্রী, অর্থাৎ ধ্রুবর ঠাকুমা।
তখন ধ্রুবর মা বেঁচে ছিল। এই মহিলাকে নিয়ে একদিন খাওয়ার টেবিলে মা ও বাবার একটু তর্কাতর্কি হয়েছিল। কী বিষয় নিয়ে তা ধ্রুব জানে না। সম্ভবত মা কৃষ্ণকান্তর বাবার চরিত্র নিয়ে কোনও কটাক্ষ করে থাকবে। মায়ের এই স্বভাব ছিল। মাকে ভালবাসত ধ্রুব, কিন্তু এটাও লক্ষ করেছে যে, সুযোগ পেলেই তার মা নানা ছুতোয় তার বাবাকে হেয় করার চেষ্টা করত। বোধহয় সেরকমই কোনও দাম্পত্য বাদানুবাদ হয়েছিল সেই রাত্রে।
কৃষ্ণকান্ত হঠাৎ একটা হুংকার দিয়ে চাকরকে ডাকলেন। বললেন, ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে আয়।
তারা তিন ভাই তখনও ছোট, লতু নিতান্তই বাচ্চা। চারজনকে খাবার টেবিলের চারধারে বসালেন কৃষ্ণকান্ত। তারপর সকলের মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, শোনো। ভবিষ্যতে একটা বিষয় নিয়ে কথা উঠতে পারে বলে তোমাদের আজ আমি একটা জিনিস পরিষ্কারভাবে জানাতে চাই। চেতলার বাড়িতে রঙ্গময়ি নামে যে মহিলা থাকেন তিনি তোমাদের ঠাকুমা। আমি তাকে ছেলেবেলায় পিসি বলে ডাকতাম। তার বাবা ছিলেন আমাদের পুরোহিত। আমার বাবা তাকে পরে ধর্মমতে বিবাহ করেন। আমি তাকে আমার মা বলে স্বীকার করেছি। ভবিষ্যতে তার সম্পর্কে যদি কেউ কোনও নোংরা বা খারাপ ইঙ্গিত করে তোমরা তার প্রতিবাদ করবে। তোমরা বলবে যে, তিনি তোমাদের ঠাকুমা। ধর্মত এবং বৈধ ঠাকুমা। বুঝলে? এখন যাও।
তারা কিছুই বোঝেনি। তবে ঘাড় নেড়ে চলে এসেছিল। বুঝেছিল পরে। বড় হয়ে।
চেতলার ঠাকুমার তেজ ছিল সাংঘাতিক। আজও আছে। ধ্রুবর মা আগুনে পুড়ে মরার পব সে। বেশ কিছুদিন একটানা চেতলার ঠাকুমার কাছে ছিল। তাকে তার ছোট ভাই আর লতুকে এখানে দিয়ে গিয়েছিলেন কৃষ্ণকান্ত নিজে।
বড় বড় তীক্ষ্ণ চোখ ও ক্ষুরধার মুখশ্রী বিশিষ্ট এই ঠাকুমাকে ধ্রুব বরাবর পছন্দ করেছে। প্রচণ্ড স্বাবলম্বী ও পরিশ্রমী। দারুণ দাপট আর শাসনে সবাই ঢিট থাকে সব সময়ে। যেটা শাসনে হয় না সেটা হয় তার ভালবাসার তীব্রতায়। এমন স্বার্থশূন্য মানুষ ধ্রুব খুব কম দেখেছে।
ধ্রুব গলিটায় ঢুকে বাড়ির কড়া নাড়ল। নীচের তলাটা আজকাল ফাঁকা থাকে। ঠাকুমার ভাইপোরা তফাত হয়েছে, নাতি-নাতনিও বড় কেউ কাছে থাকে না। ঠাকুমার নাতনিদের মধ্যে একজন ছিল বিজয়া। ধ্রুবর প্রথম ভিকটিম। অর্থাৎ বিজয়া তার প্রেমে পড়েছিল। সে পড়েনি। ধ্রুব কোনওদিনই কেন কারও প্রেমে পড়তে পারল না? কেন পারল না?
এই নিদারুণ প্রশ্নটা নিয়ে যখন সে হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে আছে বন্ধ দরজার সামনে, তখন ওপাশ থেকে প্রশ্ন এল, কে?
আমি ধ্রুব। কালীঘাটের ধ্রুব।
ও! ধ্রুবদা!
দরজা খুলে একটি কিশোরী হাসিমুখে দাঁড়ায়।–তোমার ছেলে হয়েছে জানি। মিষ্টি আনলে না?
ঠাকুমার এই নাতনির নাম নবা।
ধ্রুব একটু লাল হয় লজ্জায়। বলে, ঠাকুমা কী করছে?
বসে বসে বকবক করছে। আর কী করবে? এসো।
ধ্রুব ওপরে উঠে আসে। পুরনো বাড়িটাকেও ঘষে মেজে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হয় সবসময়। অপরিচ্ছন্নতা রঙ্গময়ির ভীষণ অসহ্য। ধ্রুব এমন পরিপাটি গোছানো সংসার বড় একটা দেখেনি।
রঙ্গময়ি এখন বয়সের ভারে কিছু শ্রান্ত। নাম ভুলে যান, কথার খেই হারিয়ে ফেলেন। তবু সারাদিন প্রায় আশি বছরের শরীরটাকে এতটুকু বিশ্রাম দেন না। এখনও নিজে রাঁধেন, ঘর ঝট দেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা জপতপ করেন। বললে বলেন, খাটি বলে বেঁচে আছি।
বেঁচে থাকা যে রঙ্গময়ির কাছে খুব সুখকর এমন নয়। তবে রঙ্গময়ি বেঁচে ছিলেন বলেই এদের সংসারটা জোড়াতাপ্পি দিয়ে চলেছিল। অনেক শিশু বেঁচে গিয়েছিল অকালমৃত্যুর হাত থেকে, নিবারিত হয়েছিল সংসারের কিছু অনিবার্য ভাঙন।
রঙ্গময়ি দোতলার সিঁড়ির মুখের চাতালে একটা মোড়া পেতে বসা। ধ্রুবকে দেখেই বলে উঠলেন, এই, তোর অশৌচ না! সদ্য ছেলের বাপ হয়েছিস, আঁতুর-মাখা!
তা হলে চলে যাব নাকি?
তাই বললাম বুঝি? পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করিস না। তফাতে বোস।
তোমার বড় বাতিক।
তা তো বটেই। ছেলে কেমন হল?
ভাল করে দেখিনি। সব বাচ্চাই একরকম।
বাচ্চা একরকম হলে কি হয়! বংশের ধারা যখন পাবে তখন দেখবি কেমন অন্যরকম হয়! এই নবা, ওকে একটা চেয়ার দে।
ধ্রুব বসল।
রঙ্গময়ি বললেন, খুব কষ্ট পেল মেয়েটা।
কোন মেয়েটা?
তোর বউটা। আবার কে! বেঁচে যে আছে সেই ঢের। ও মরলে কৃষ্ণটাও বুঝি বাঁচত না। আমি দিনরাত ভগবানকে ডেকেছি।
সব খবরই রাখো তা হলে?
খবর রাখব না? কেন? বিলেতে থাকিস নাকি!
ধ্রুব চুপ করে থাকে। রঙ্গময়ির কাছে সে কেন এসেছে তা ঠিক বুঝতে পারে না। কিন্তু এসে তার খারাপ লাগছে না। এ যেন একটা প্রাচীন গাছের কাছে বসে থাকা। এ যেন পিদিমের আলোয় এক প্রাচীন পুঁথি পাঠ।