কৃষ্ণকান্ত এক জ্বালাভরা চোখে সূর্যোদয় দেখছিল। রাঙা আকাশ থেকে রক্তের স্রোত মিশছে ব্রহ্মপুত্রের জলে। ভোরবেলার শান্ত সুন্দর শ্রী আজ সে অনুভব করতে পারছিল না। আজ বুকের জ্বালা, অক্ষম রাগ আর এক গভীর বেদনায় এমন সুন্দর ভোরবেলাটিকে তার ছাইয়ের মতো বিবর্ণ বোধ হচ্ছিল।
অপঘাতে তার কাকা মারা গিয়েছিল। সেই কাকাকে ভাল করে মনেও নেই তার। কিন্তু সে জানে, এই বংশের মুখোজ্জ্বলকারীদের তিনি ছিলেন একজন। ব্রহ্মচারী, দেশভক্ত সেই মানুষটিকে কে বা কারা খুন করেছিল ব্রহ্মপুত্রের ওপর। সেই মৃত্যুর জন্য এক থম-ধরা শোক আছে কৃষ্ণকান্তর। ফের তার নিরীহ বাবার ওপর এই বর্বর আক্রমণ তাকে উত্তেজিত করছে একটা কিছু করে ফেলতে। একটা মারাত্মক কিছু।
কৃষ্ণকান্ত একা একা অনেকক্ষণ ছাদে ঘোরাফেরা করল। কখনও জোরে, কখনও ধীরে। রাত্রি জাগরণের জন্য তার কোনও ক্লান্তি বোধ হচ্ছে না। তার ক্ষুধা-তৃষ্ণার বোধও লুপ্ত। মাঝে মাঝে নিজের তপ্ত মাথাটা চেপে ধরছে দুহাতে। বাবা কি বাঁচবে? বাবা যদি না বাঁচে তবে কৃষ্ণকান্তর মধ্যে। একটা বিপুল কিছু ঘটে যাবে। হয়তো সে পাগল হয়ে যাবে। যদি তা না হয় তবে সে হয়তো হয়ে উঠবে এক সাংঘাতিক খুনি, গুন্ডা বা ডাকাত। একটা লন্ডভন্ড কিছু সে করবেই।
রোদ বেশ চড়া হয়ে ওঠার পর কৃষ্ণকান্ত থমথমে মুখে নেমে আসে নীচে। তালা দেওয়া একটা ঘরের সামনে দুদণ্ড দাঁড়ায়। চাবি কোথায় আছে তা সে জানে। একটু দ্বিধা করে সে গিয়ে হেমকান্তর ঘরে ডেস্কের দেরাজ খুলে চাবির গোছা নিয়ে এসে দরজাটা খুলে ঢোকে।
এ ঘর আজকাল ভোলা হয় না বলে একটা বদ্ধ বাতাসের গন্ধ। কৃষ্ণকান্ত দুটো জানালা খুলে দেয়। চার-পাঁচটা বন্দুকের বাক্স র্যাকের ওপর সাজানো। চেস্ট অফ ড্রয়ার্সটা খুলে ভিতরে উঁকি দেয় সে। প্রথম ড্রয়ারে কিছু তেমন নেই। শুধু চারটে টোটার বাক্স। দ্বিতীয় ড্রয়ারটায় বন্দুকের তেল, লোহার লম্বা শিকে লাগানো বুরুশ, যা দিয়ে ব্যারেল পরিষ্কার করা হয়। তিন নম্বর ড্রয়ারে নেপালি কুকরি, জৌনপুরি ছোরা হ্যান্টিং নাইফ এবং আরও কয়েকরকম শৌখিন বিলিতি ড্যাগার রয়েছে। পরের ড্রয়ারটা খুলে অভীষ্ট বন্দুকটা পেয়ে যায় কৃষ্ণকান্ত। চার-পাঁচ রকমের গুপ্তি, বহু টোটার বাক্স এবং নানাবিধ টুকরো-টাকরা জিনিসের মধ্যে ন্যাকড়ায় জড়ানো চামড়ার খাপে সাবধানে লুকিয়ে রাখা একটা জার্মান মাউজার পিস্তল। জিনিসটা যে আছে এটা সে জানত। কিন্তু কোনও দিন চোখে দেখেনি। হেমকান্ত অস্ত্রশস্ত্র পছন্দ করেন না। এ ঘর তিনি কদাচিৎ খুলেছেন।
কৃষ্ণকান্ত পিস্তলটা জামার তলায় রেখে ড্রয়ারটা বন্ধ করে। দরজায় তালা দিয়ে চাবি যথাস্থানে রেখে সে চলে আসে বার বাড়িতে নিজের ঘরে। তোশকের তলায় খাপসুদ্ধ পিস্তলটা রেখে সে বেরিয়ে আসে।
শচীন হাসপাতাল থেকে এল আটটা নাগাদ। কৃষ্ণকান্ত তখন দালানের সিঁড়িতে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন। পিস্তল হাতে এলেও টোটা তার হাতে নেই। সে প্রথম ড্রয়ারটা হাঁটকে দেখেছে। সেখানে শুধু বন্দুকের টোটা আছে। পিস্তলটা বহুকাল ব্যবহৃত হয়নি।
শচীন এসে সাইকেল থেকে নামতেই কৃষ্ণকান্ত মগ্নতা ভেঙে টান টান উঠে দাঁড়ায়।
শচীনদা, বাবা?
শচীন একটু হেসে বলে, ভয় নেই। ভাল আছেন।
জ্ঞান ফিরেছে?
হ্যাঁ হ্যাঁ। ইনজুরিটা খুব কম নয়। তবে জ্ঞান আছে। তোমার কথা খুব বলছেন।
আমি যাব।
যাবে। আমিই নিয়ে যাব। তবে এ বেলাটা থাক।
কেন?
এখনও দুর্বল তো। তোমাকে দেখলে যদি উত্তেজিত হন বা উঠে বসার চেষ্টা করেন তবে ব্লিডিং হবে।
কৃষ্ণকান্ত মানমুখে বলে, তবে থাক।
ডাক্তাররা বলছে, ভিজিটারা এখন না এলেই ভাল।
বাবা বাঁচবে তো!
বাঁচবেন না কেন? ইনজুরি ফ্যাটাল নয়। নিশ্চিন্ত থাকে।
আপনার সঙ্গে বাবার দেখা হয়েছে?
একবার। এখন আর দেখা করতে দিচ্ছে না। শুনলাম, ঘুমোচ্ছেন। ভাল আছেন। তোমাকে ওরকম দেখাচ্ছে কেন বলো তো! কেমন যেন রেগে আছ!
কৃষ্ণকান্ত জবাব দিল না। একটু হাসবার চেষ্টা করল মাত্র।
শচীন বলল, যাও, স্নান করে কিছু খাও, অত ভাবতে হবে না।
বাবাকে কারা মেরেছে, শচীনদা? জানেন?
না। পুলিশ খোঁজ করবে।
পুলিশ করবে জানি। আপনার কিছু সন্দেহ হয় না?
শচীন মাথা নেড়ে বলল, এ তো ভাবনা-চিন্তার অতীত। হেমকান্তবাবুর মতো নির্বিরোধী লোক আমি তো অন্তত দেখিনি। ওঁর কেউ শত্রু থাকতে পারে বলে কল্পনাও করা যায় না। আমার মনে হয় কেউ ভুল করে এ কাণ্ড করেছে। হয়তো অন্য কাউকে মারতে চেয়েছিল।
কৃষ্ণকান্ত বলল, তা নয় শচীনদা। আমার ইস্কুলের একটা ছেলে কদিন আগেই বলেছিল, আমার বাবাকে নাকি স্বদেশিরা মারবে।
কেন মারবে? তাঁর অপরাধ?
স্বদেশিদের ধারণা বাবা শশীদাকে ধরিয়ে দিয়েছে।
শচীন একটু হতভম্ব হয়ে যায়। তারপর খুব বিস্ময়ের সঙ্গে বলে, সে কী? একথা তো আগেও হয়েছে। আমি নিজে শশিভূষণের সঙ্গে কথা বলেছি। সেও তো এরকম সন্দেহ করে না। এমনকী উনি দারোগা রামকান্তবাবুব অনুরোধেও নিজেকে বাঁচানোর জন্য কোনও স্টেটমেন্ট দেননি।
কিন্তু লোকে তো বাবাকে ভাল বলে না।
শচীন একটু ভাবে। তারপর বলে, আচ্ছা, দেখা যাক। খুনি যদি ধরা পড়ে তবে তার কাছ থেকেও তো কিছু জানা যাবে। তোমার স্কুলের সেই ছেলেটি কে বললো তো!
কেন? তাকে ধরিয়ে দেবেন।
দেওয়াই তো উচিত।
কৃষ্ণকান্ত মাথা নেড়ে বলল, তার দরকার নেই। আমি আজ স্কুলে গিয়ে নিজেই ব্যবস্থা করব।
মারপিট করবে নাকি?
কৃষ্ণকান্ত একটু হেসে বলে, দরকার হলে করতেও পারি। তবে আপনি কিছু ভাববেন না।
শচীনকে একটু চিন্তিত দেখাল। সে বলল, আজই স্কুলে যাবে?
যেতেই হবে, শচীনদা।
শচীন চিন্তিত মুখে খানিকক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলে, তোমার বাবার জন্য তোমার রাগ হতেই পারে। কিন্তু রাগের বশে হুট করে কিছু করে ফেললা না কৃষ্ণ। তোমার বয়স অল্প।
কৃষ্ণকান্ত মাথা নেড়ে বলল, আমি তেমন কিছু করব না, শচীনদা। শুধু জেনে নেব, ছেলেটা কোথা থেকে শুনল যে আমার বাবাকে স্বদেশিরা খুন করবে।
তার চেয়ে ছেলেটার নাম আমাকে বলো। আমি গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলব।
কৃষ্ণকান্ত লাজুক হেসে বলে, সেটা ভাল দেখাবে না। শত হলেও সে আমার স্কুলের বন্ধু। তার নাম আপনাকে বলে দিলে বিট্রে করা হবে। আমিই ওর কাছ থেকে জেনে নেব।
শচীন খুব ভাল করে কৃষ্ণকান্তর মুখটা দেখল। দেখে তার মনে হল, পাত্রটি খুব সহজ নয়। এইটুকু ছেলে ঠিক এরকম আত্মপ্রত্যয় নিয়ে কথা বলে না। কৃষ্ণর রকম-সকম একটু আলাদা।
শচীন চিন্তিত মুখেই বলল, ঠিক আছে। তবে মুশকিলে পড়লে আমাকে সব বোলো। মনুদিদি কি ভিতর বাড়িতে আছে?
হ্যাঁ। দোতলায়। ছোড়দিও আছে। যান না।
কথাটায় কিছু ছিল না, তবু একটু লাল হল শচীন। কম্পিত বুক ও উদীপ্ত এক আনন্দ নিয়ে সে ওপরে ওঠার সিঁড়ি ভাঙতে লাগল।
বিশাখা ভেঙে পড়েছে অনেক আগেই। সারা রাত কান্নার পর সকালের দিকে অবসন্ন বিশাখা বিছানায় তেড়াবেঁকা হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে কখন। রঙ্গময়ি ঘুমোয়নি। তার বুকের জ্বালা তাকে ঘুমোতে দেয়নি। স্নান করে সে দোতলায় ভেজা শাড়ি মেলছিল।
শচীন ওপরে এসে ডাক দিল, মনুদিদি!
কী খবর শচীন?
ভাল।–একটু হাসিমুখে শচীন বলে, ঘুমোচ্ছন।
আমাদের দেখা করতে দেবে না?
আজ নয়।
তবে কবে? আমার যে হাতে-পায়ে বল নেই। অত রক্ত গেল।
অত ঘাবড়াবেন না। হেমকান্তবাবু তো দুর্বল লোক নন। একটু রক্ত গেলেও ক্ষতি কিছু হয়নি। সামলে উঠছেন।
ডাক্তাররা কী বলছে?
এমনিতে ভয় নেই। একমাত্র যদি ক্ষত বিষিয়ে ওঠে বা ধনুষ্টঙ্কার হয়। ওরা সব ব্যবস্থাই করছে।
বিষিয়ে ওঠার লক্ষণ কিছু দেখা গেছে নাকি?
আরে না! আপনিও যদি অত উতলা হন তবে কী করে চলবে? আমি আপনাকে আর-একটা কথা বলার জন্য ওপরে এসেছি। কৃষ্ণর দিকে একটু লক্ষ রাখবেন।
কেন বলো তো!
একটু ইতস্তত করে শচীন বলে, ও একটু অন্য ধাতের। স্কুলে কোনও ছেলে নাকি কদিন আগে ওকে বলেছে যে, ওর বাবাকে স্বদেশিরা মারবে। ও আজ স্কুলে যাচ্ছে সেই ছেলের সঙ্গে মোকাবিলা করতে। একটা হাঙ্গামা বাধাতে পারে। আপনি বরং বিশ্বাসী কোনও দারোয়ানকে ওকে না জানিয়ে স্কুলে মোতায়েন রাখবেন। গণ্ডগোল হলে গিয়ে যেন ছাড়ায়।
কৃষ্ণ স্কুলে যাবে কী? ওর বাবার এই অবস্থা?
স্কুলে যাবে ক্লাস করতে নয়, ওই ছেলেটাকে ধরতে।
কোন ছেলের কথাটা বলেছে জানো?
না, আমাকে বলেনি।
ঠিক আছে, আমি দেখছি।
আমি তা হলে যাই?
যাবে কেন? মোড়াটায় বোসো। তোমার ধকল গেছে সবচেয়ে বেশি। বেলের পানা করতে বলেছি। একটু মুখে দিয়ে যাও। হাসপাতালে আমাদের কে কে আছে?
ওরে বাবাঃ, সে অনেক লোক।–শচীন হেসে বলল, শহর সুদ্ধ ভেঙে পড়েছিল মাঝরাতে। এখন প্রজারা আছে বেশ কিছু কর্মচারীও আছে।
ওঁকে সবাই কত ভালবাসে।–বলে রঙ্গময়ি উদাস নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, ভাল হয়ে ফিরে এলে আর এখানে এক দণ্ড থাকতে দেব না।
কোথায় যাবেন?
যেখানেই হোক। কলকাতায় পাঠিয়ে দেব। কনকের কাছে গিয়ে থাকবে। কী বলল, ভাল হবে না?
শচীন একটু হেসে প্রগল্ভের মতো বলে ফেলল, আপনি কাছাকাছি না থাকলে ওঁকে দেখবে কে? উনি কি পারবেন আপনাকে ছাড়া?
একথায় রঙ্গময়ির যেমন আপাদমস্তক লজ্জায় শিউরে ওঠা উচিত ছিল তেমন কিছুই হল না। কথাটা যেন লজ্জাজনক বলেই মনে হল না তার কাছে। উদাস চোখে বারান্দার বাইরে দিগন্তের দিকে চেয়ে বলল, দরকার হলে আমিও থাকব। আমার কার জন্য বেঁচে থাকা বলো!
শচীন রঙ্গময়ির এই কথায় চোখ নামিয়ে নিল। আশ্চর্য এই, রঙ্গময়িকে তার খুব নির্লজ্জ বলে মনে হল না। বহুকাল ধরেই কৃষ্ণকান্ত আর রঙ্গময়িকে নিয়ে যে গুজব প্রচলিত আছে তা সবই সে জানে। কিন্তু দুজনের কাউকেই তার কখনও অপবিত্র মনে হয়নি। রঙ্গময়ির এই সত্য ভাষণে তাই সে নির্লজ্জতার কোনও চিহ্ন পেল না।
রঙ্গময়ি ধীর স্বরে বলল, এমন মানুষ তো খুব বেশি পাবে না। কেবল আপন মনে ঘরে বসে ভাবেন, কারও অনিষ্ট চিন্তা করেন না, বিষয় চিন্তা করেন না। যেসব ভাবনা ভাবেন সেগুলোও আধ্যাত্মিক ভাবনা। পৃথিবীতে কী ঘটে যাচ্ছে সে খেয়ালও নেই। এরকম মানুষকে কে মারতে পারে বলল তো! ওদের কি হাত ওঠে?
প্রজাদের কেউ হতে পারে কি মনুদিদি?
রঙ্গময়ি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, না। ওঁর প্রজারা তো কেউ দুঃখে নেই।
তবে কি কৃষ্ণর বন্ধু যা বলেছে তাই সত্যি?
স্বদেশিরা? হতে পারে। শশীকে নিয়ে তো কম গুজব ছড়ায়নি। যে-ই মারুক তার দশবার ফাঁসি হওয়া উচিত। স্বদেশিরা আসল কাজ ফেলে যদি এসব করতে থাকে তবে আন্দোলনের বারোটা বাজতে দেরি হবে না। বোসো, আমি আসছি।
রঙ্গময়ি চলে গেলে বারান্দায় রাখা হেমকান্তব আরামকেদারায় বসে ফুরফুরে হাওয়ায়। ব্রহ্মপুত্রের দিকে চেয়ে থাকে শচীন। পালতোলা নৌকো রুপোলি জল কেটে মন্থর গতিতে চলেছে। ওপরে ছিন্ন মেঘ ভাসছে ভেলার মতো। বহু দূর পর্যন্ত অবারিত মুক্ত পৃথিবী। দেখতে দেখতে শচীনের তন্দ্রা চলে এল। ক্লান্ত মাথাটা একটু কাত হয়ে গেল ডানদিকে।
ভারী কোমল ও নরম একটা দেহগন্ধ, খুব অস্পষ্ট একটু গয়নার টুংটাং আর শাড়ির খসখস তার চটকা ভাঙিয়ে দেয়। চোখ চাইতেই দুটি অপরূপ চোখে আটকে যায় সে।
বিশাখা খুব কেঁদেছে। চোখের কোল ভারী। মুখখানা থমথমে। তবু একটু রক্তাভ উজ্জ্বলতা দেখতে পায় ওর মুখে শচীন। সে উঠে বসে। বিশাখা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলে, উনি ভাল আছেন। কোনও ভয় নেই।
বিশাখা চোখ নত করে বলে, মনুপিসির কাছে শুনলাম।
তোমরা এবার নেয়ে খেয়ে একটু বিশ্রাম নাও। সারা রাত খুব ধকল গেছে তোমাদের।
আপনার তো তারও বেশি।
আমার জন্য ভেবো না। আমি তো প্রায়শ্চিত্ত করছি।
কীসের প্রায়শ্চিত্ত?
তোমার কাছে এবং তোমাদের পরিবারের কাছে আমার অনেক দোষ জমা হয়ে আছে। সাধ্যমতো চেষ্টা করছি সেগুলো স্পালন করতে। প্রায়শ্চিত্ত কথাটার মানে জানো?
না। আমাকে তো কেউ কিছু শেখায়নি।
প্রায়শ্চিত্ত কথাটার মানে পুনরায় চিত্তে গমন।
তার মানে কী?
মানুষ যখন কোনও অন্যায় করে তখন সে তার স্বাভাবিক চিত্তবৃত্তি থেকে পতিত হয়ে যায়। সেই পতিত মনটিকে আবার স্বস্থানে স্থাপন করাই প্রায়শ্চিত্ত।
ওসব শক্ত কথা আমি বুঝি না। তবে আপনার কাছেও আমার অনেক দোষ জমা হয়ে আছে। কাটাকাটি করে নিলেই হয়।
হয়? সত্যি বলছ?
একটু রাঙা হয়ে বিশাখা বলে, সত্যি না তো কী? আপনাকে আর কাশী গয়া বৃন্দাবন করে বেড়াতে হবে না।
শচীন একটু হেসে বলে, ওটা তো বেড়াতে যাওয়া, প্রায়শ্চিত্ত করতে নয়। আমি তো ঠিক করেছিলাম তোমাকে আর মুখ দেখাব না।
আমারও মুখ না দেখানোই বোধহয় উচিত ছিল!
কাশী রওনা হওয়ার আগে তোমাকে একটা চিঠি দিয়েছিলাম। তুমি তার জবাব না দেওয়ায় মনে বড় কষ্ট হয়েছিল।
আর আমি যে সুফলাকে দিয়ে আপনাকে অত বলে কয়ে ডেকে পাঠালাম আপনি তো গ্রাহ্যও করলেন না!
সুফলাকে দিয়ে? কই সে তো বলেনি আমাকে!
বলেনি! কী পাজি মেয়ে! আমি ওকে ডাকিয়ে এনে বলে পাঠালাম, শচীনবাবুকে বলিস একবার যেন দেখা করে যান। আমি খুব আশা করে থাকব।
শচীন মৃদু হেসে বলে, বোধহয় হিংসেতে বলেনি। মেয়েরা একটু ওরকম হয়। তোমার ওপর সুফলার একটু রাগও থাকতে পারে। যাক গে, তোমার জবাব তা হলে গিয়েছিল, একটু অন্যভাবে।
হ্যাঁ। আপনি রাগ রাখবেন না।
না। কিন্তু সেদিন ডেকে পাঠিয়ে কী বলতে বলল তো!
বলতাম, আপনি কাশী যাবেন না, আমি আপনার ওপর রাগ করিনি।
একটুও করোনি?
না। আমাকে কেউ কখনও শাসন করেনি বলেই নাকি আমি একটু কেমনধারা হয়ে গেছি। কৃষ্ণও বলে।
বলে নাকি?
হ্যাঁ। ওই তো বলেছিল, আমার নাকি মাঝে মাঝে একটু শাসন হওয়া দরকার।
শচী হেসে ফেলে বলে, দরকার? তা হলে…
তাহলে কী?
শাসনের জন্য একজন লোক তো চাই।
বিশাখা মুখ নত করল। হাসি নেই মুখে, তবে একটু স্মিত ভাব। পরমুহূর্তেই সংযত আর গম্ভীর হয়ে বলে, বাবা সত্যিই ভাল আছেন তো?
সত্যিই ভাল আছেন। অন্তত প্রাণের ভয় নেই।
আমি একটু পুজো দিতে যাব কালীবাড়িতে।
যাও না!
খুব ধীরে ধীরে বিশাখা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। একদৃষ্টে চেয়ে রইল শচীন। কী অপূর্ব, কী অপার্থিব সৌন্দর্য এই মেয়েটির।