বরিশালের জেলে সতীন্দ্রনাথ সেনের অনশন নিয়ে চারদিকে একটা তুমুল উত্তেজনা বয়ে যাচ্ছিল। একশো দিন পার করেও সতীন সেন খাদ্য, পানীয়, ওষুধ কিছুই গ্রহণ করছেন না। গায়ের তাপ ধীরে ধীরে নেমে আসছে। নাড়ির গতি ক্ষীণ হয়ে আসছে। খবরের কাগজে যে বিবরণ থাকে তা সাংঘাতিক। সতীন সেনের নিদারুণ শয্যাক্ষত হয়েছে, পেটে একটা মাংসের দলা পাকিয়ে উঠেছে, অসহ্য যন্ত্রণায় মরণোন্মুখ বিপ্লবী ছটফট করছেন। তবু কিছুতেই অনশন ভাঙছেন না। সতীন সেনের এই অনশনের ঘটনা এবং তার বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে এত হইচই হচ্ছিল যে শশিভূষণের ঘটনাটা চাপা পড়ে গেল।
খবরের কাগজ এলেই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে কৃষ্ণকান্ত। সতীন সেনের খবরের পর সে সাগ্রহে পড়ে নেয় মীরাট ষড়যন্ত্রের মামলার খবর, সুভাষ বসু বা মহাত্মা গাঁধীর বক্তৃতা। তার ভিতরটা গমগম করতে থাকে এক অদ্ভুত উত্তেজনায়। এক বৃহৎ দেশের অগণিত দুঃখী মানুষের সঙ্গে সে নিজের এক গভীর আত্মীয়তা অনুভব করতে থাকে। একদিন সে গিয়ে জনসভায় আলম সাহেবের বক্তৃতাও শুনে এল।
রঙ্গময়ি সংস্কৃত পড়াতে বসে একদিন বলল, তোর কী হয়েছে বল তো! সব সময় কী যেন ভাবিস।
কিছু হয়নি, পিসি।-বলে কৃষ্ণকান্ত একটু চুপ করে থেকে বলে, সতীন সেন কি মারা যাবেন?
কৃষ্ণকান্ত কেন অন্যমনস্ক তা এই কথা শুনে রঙ্গময়ি বুঝতে পেরে যায়। সতীন সেন কে তা। রঙ্গময়ি ভালই জানে। তবু না জানার ভান করে বলে, সতীন সেন কে রে?
তুমি খবরের কাগজ পড়ো না, পিসি? সেই যে বরিশালের জেলে যিনি অনশন করছেন! কয়েকদিন আগে সুখেন্দু দত্ত নামে কংগ্রেসের এক ভলান্টিয়ারকে চট্টগ্রামে খুন করা হয়েছিল। সুখেন্দুর বয়স ছিল মাত্র ষোলো বছর। কংগ্রেসের ভিতরকার দলাদলি আর গণ্ডগোলে পণ্ড হয়ে যাওয়া একটা মিটিং থেকে যখন সে ফিরছিল তখন তাকে ছুরি মারা হয়। দেশের বড় বড় নেতারা এই খুনের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সেই থেকে রঙ্গময়ির মনটা খারাপ। সে বলল, শোন বোকা, স্বদেশি করতে চাইলেই হয় না। ওসব গণ্ডগোলে এখনই যাওয়ার দরকার নেই। বড় খুনোখুনি বাবা।
খুনোখুনি জিনিসটা কৃষ্ণকান্তর খুব অপছন্দ নয়। খুনোখুনি না থাকলে স্বদেশি করার ব্যাপারটা কি আলুনি হয়ে যায় না? দেশের জন্য খুন করে ফাঁসি যাওয়ার ব্যাপারটা মোটামুটি সে নিজের ভবিষ্যৎ হিসেবে স্থির করে নিয়েছে। ক্ষুদিরামের মতো।
কিন্তু মুশকিল হল স্বদেশিওলাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটছে না। স্কুলে সে বহুজনকে বলে রেখেছে। কিন্তু স্বদেশিদের ঠিকানা কেউ তাকে দিতে পারেনি। কিংবা দিতে চায়নি। একদিন একটা ছেলে বলে ফেলল, তোর বাবা তো বিপ্লবী শশিভূষণকে ধরিয়ে দিয়েছিল। ওরা তোর বাবাকেও খুন করবে।
একথায় খুব চমকে যায় কৃষ্ণকান্ত। এরকম একটা ধারণা অনেকের আছে বলে সে শুনেছে। কিন্তু ঘটনাটা সত্য নয়। তবে কৃষ্ণকান্ত তাই নিয়ে ছেলেটার সঙ্গে তর্ক বা ঝগড়া করল না। গুম হয়ে রইল।
বাড়ি ফিরে সে সোজা হেমকান্তর কাছে গিয়ে বলল, বাবা, শশীদাকে ধরিয়ে দিয়েছিল কে জানেন?
হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, কেউ ধরায়নি। পুলিশই ধরেছে।
কিন্তু কেউ না কেউ অবশ্যই পুলিশকে খবর দিয়েছিল। নইলে শশীদা যে আমাদের বাড়িতে লুকিয়ে আছে তা পুলিশ জানল কী করে?
হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, শশী খুব একটা লুকিয়ে ছিল এমন কথা বলা যায় না। আমরা তো তাকে ঠিক লুকিয়ে রাখিনি। বাড়িতে এতগুলো কর্মচারী, দাসদাসী, তারা নিশ্চয়ই এ নিয়ে আলোচনা করেছে। পুলিশের স্পাইরাও সজাগ। কে খবর দিয়েছে তা বলা অসম্ভব।
আপনি কোনও স্পাইয়ের কথা জানেন?
হেমকান্ত অবাক হলেও প্রিয় পুত্রের মুখের দিকে চেয়ে হেসে বললেন, স্পাই যে কে আর কে নয়, তা ভাবনার বিষয়। স্বদেশিরা বোধকরি আমাকেও পুলিশের স্পাই বলে মনে করে।
কৃষ্ণকান্ত রেগে গিয়ে বলে, মনে করবে কেন? ওরা কি বোকা?
তা নয় বাবা। আমার দোষ হল, আমার বাড়িতেই শশী ধরা পড়ে। ফলটা হল ভারী অদ্ভুত। স্বদেশিওলারা ভেবে নিল আমি ধরিয়ে দিয়েছি, আর পুলিশ ধরে নিল আমি জেনেশুনে ওকে লুকিয়ে রেখেছি। উভয়সংকট কথাটার মানে আজ টের পাচ্ছি। কিন্তু তুমি এ নিয়ে ভাবছ কেন?
আপনার সম্পর্কে কেউ খারাপ কিছু বললে আমার খুব রাগ হয়।
হেমকান্ত অবাক হয়ে বললেন, কেউ কি কিছু বলেছে?
স্কুলে সেই ছেলেটির সঙ্গে ঝগড়া করেনি বটে কৃষ্ণকান্ত, কিন্তু রাগ ও অভিমান তার বুকের মধ্যে জমা ছিল। হেমকান্তর শান্ত কণ্ঠ ও নির্বিরোধী নিরীহ স্বভাব এবং অসহায় মুখ দেখে হঠাৎ তার ভিতরটা উথাল-পাথাল করে উঠল। চোখের জল রাখতে পারল না, কান্নাও চাপা রইল না।
হেমকান্ত একটু হতভম্ব হয়ে ছেলেকে দুহাতে জাপটে ধরে ব্যস্ত হয়ে বললেন, আরে! তুমি কাঁদছ কেন? কখনও তো তোমাকে কাঁদতে দেখিনি? কী হয়েছে?
কী হয়েছে তা বলবে কী করে কৃষ্ণকান্ত? শুধু বাবার বিশাল বক্ষপটে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল সে। কান্নাটাকে জোর করে গলা টিপে মারল। স্বদেশিরা যদি তার নিরীহ বাবাকে খুন করেই তা হলে কৃষ্ণকান্তর হাতে একদিন কয়েকজন স্বদেশি মরবেই। বাবাকে ছুঁয়ে থেকে সে নিঃশব্দে এই প্রতিজ্ঞা করল।
পরদিন সকালে ইরফান মিঞার সঙ্গে লাঠি খেলার সময় কৃষ্ণকান্ত যে বিপুল বিক্রম, বাড়তি তেজ ও তৎপরতা দেখাল তা প্রায় গুরুমারা বিদ্যে। ইরফান অবাক হয়ে বলে, ছোটকর্তা যে ওস্তাদের মতো লড়ছেন আজ! উরে বাবাঃ, লাঠি যে কথা কয় আপনের হাতে!
এই ঘটনার পর থেকে বাড়তি বিক্রম প্রায় সব ব্যাপারেই প্রকাশ পেতে লাগল তার। মুগুর ভঁজা, ডন-বৈঠক, ধ্যান ও লেখাপড়া সব কিছুতেই। পরীক্ষায় সে ডবল প্রমোশন পেল। বন্দুকের নিশানা হতে লাগল অব্যর্থ। শরীরটা লকলক করে বেড়ে উঠে উপচে পড়তে লাগল প্রাণশক্তি ও উদ্যমে। গরিব প্রজাদের যেসব ছেলেকে জড়ো করে সে দল পাকাত তারা আরও বশংবদ হয়ে উঠতে লাগল তার। গম্ভীর, ধীর, সাহসী ও বিচক্ষণতা মিশিয়ে বেশ একটা ব্যক্তিত্ব তৈরি হতে লাগল তার।
লাহোর কংগ্রেসে যে বড় রকমের একটা পরিবর্তন ঘটে গেল সেটা বেশ ধাক্কা দিল তাকে। উনিশশো ত্রিশের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। লোকের মুখে মুখে মাস্টারদার নাম।
এইসব ঘটনা কৃষ্ণকান্তর ভিতরে উপর্যুপরি বিস্ফোরণ ঘটাতে লাগল। অন্তর্গত এক উত্তেজনায় সে সর্বদা অস্থির চঞ্চল। গৃহবাস প্রায় অসহনীয় হয়ে উঠতে লাগল। প্রতি মুহূর্তেই তার ইচ্ছে করে সব ছেড়েছুড়ে ঝাঁপিয়ে পডতে।
ঠিক এই সময়ে একদিন হেমকান্ত কোকাবাবুদের বাড়িতে একটা অন্নপ্রাশনের নিমন্ত্রণ থেকে ফিরছিলেন। নিমন্ত্রণ ছিল দুপুরে। কিছু কথাবার্তা বলতে বলতে এবং সান্ধ্য জলসায় এক বড়। গায়কের ঠুংরি শুনতে গিয়ে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল।
যখন ফিরছেন তখন বেশ ঘোরালো অন্ধকার। সন্ধ্যাবেলা কিছু জল-ঝড় হয়ে গেছে। বৃষ্টি এখনও পড়ছে ঝিরঝির করে। রাস্তায় লোক চলাচল নেই বললেই হয়। ঘোড়ার গাড়িটার শব্দ ফাঁকা রাস্তায় বেশ জোরালো হয়ে কানে আসছে।
পাশের জানালাটা খুলে হেমকান্ত ব্রহ্মপুত্রের দিকে চেয়ে ছিলেন। এই নদীর প্রতি তার আবাল্য। আকর্ষণ। প্রবহমানতার মধ্যে তিনি আদি-অন্তহীন এই জীবনের ছায়া দেখতে পান।
মৃত্যু-চেতনা বাস্তবিক তাকে আজও ছেয়ে আছে। সাংসারিক কোলাহলে মাঝে মাঝে একটু পলিমাটির আস্তরণ পড়ে তার ওপর। কিন্তু শয়নে স্বপনে জাগরণে ভিতরে ভিতরে ঘুণপোকার মতো মৃত্যুকীট তাকে ক্ষয় করে চলেছে, তিনি অনুভব করেন। আজ এই অন্ধকারে বৃষ্টিধৌত আবহের ভিতর দিয়ে আবছায়া নদীটির দিকে চেয়ে তার ভিতরে এক করুণ সুর বাজতে লাগল।
একথা ঠিক, মানুষের মৃত্যু হলেও সে সর্বাংশে মরে না। তার কিছু থেকে যায়। কিন্তু জাগতিক পরিচয়ে নয়। সে এক ভিন্ন অস্তিত্ব, এক ভিন্ন জগৎ।
মৃত্যুর পরবর্তী সেই ভিন্ন জগৎ আর ভিন্ন অস্তিত্বের কথাই বিবশ হয়ে ভাবছিলেন হেমকান্ত। আজকের আবহাওয়া এইসব চিন্তা-ভাবনার তানুকুল। এক মৃদু-কোমল বৃষ্টির অসংখ্য প্রেতহাত চরাচরকে এক রহস্যময় অস্পষ্টতা দিয়েছে। নদীর বিস্তারটি আবহাওয়ায় আধেকলীন। পার্থিবতায় লেগেছে পরলোকের আলো-আঁধারি। ঘোড়ার গাড়ির চলমানতাও যেন পৃথিবী ছেড়ে এগিয়ে যাচ্ছে অলৌকিকতায়।
হেমকান্তর চোখে পলক পড়ছিল না। বৃষ্টির ঘঁটে অল্প অল্প ভিজে যাচ্ছেন। কিন্তু গ্রাহ্য করছেন না।
কালীবাড়ি ছাড়িয়ে গাড়িটা এগোতেই আচমকা লাগামে টান পড়ল। গাড়োয়ান চেঁচিয়ে উঠল, হোশিয়ার!
হেমকান্ত সামান্য টাল খেয়ে সোজা হয়ে বসতে না বসতেই পাদানিতে কে যেন লাফিয়ে উঠল। দরজার হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে এক ঝটকায় খুলে ফেলল পাল্লাটা। হেমকান্তর মাথায় তখনও পরলোকের ঘোর। বাস্তবতায় নেমে আসতে পারেননি। একটু বিরক্ত হয়েছেন চিন্তাসূত্রে এরকম বাধা পড়ায়।
একজন লোক পাদানি থেকে ঝুঁকে পড়ল ভিতর দিকে। তার মুখে কালো কাপড় জড়ানো। হাতটা প্রসারিত করে দিল ভিতর দিকে।
ঘটনাটা স্পষ্ট দেখলেন হেমকান্ত। কিন্তু তার মস্তিষ্কে অসংগতিটা তখনও ধরা পড়ছিল না। তবে আগন্তুকের হাতটা যখন বিদ্যুৎবেগে তার বুকের দিকে নেমে এল তখন তিনি ঘোড়ার গাড়ির ভিতরকার অন্ধকারেও ইস্পাতের শানানো ঝিলিক লক্ষ করলেন। একটা অস্ফুট ভয়ার্ত চিৎকার তার কণ্ঠ থেকে আপনিই নির্গত হল। তিনি নন, তার শরীরই বোধহয় আত্মরক্ষার তাগিদে একটা হাত তুলেছিল। শরীরটা যতদূর সম্ভব সরে যেতে চেয়েছিল আঘাত থেকে।
ছোরাটা বিঁধল তাই সঠিক বুকে নয়। একটু ওপর দিকে কাঁধের কাছ বরাবর। যেখানটায় বিঁধল সেখানটা যেন আচমকা অবশ হয়ে ঝিনঝিন করতে লাগল। ছপাৎ করে ছিটকে বেরোল গরম রক্ত।
ঘটনাটা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না হেমকান্ত। কী হচ্ছে এসব? কেন হচ্ছে? এরকম কিছু প্রশ্ন তার ঠোঁটে খেলা করল, কিন্তু উচ্চারণ করার মতো অবকাশ হল না। আততায়ি তার ব্যর্থতা বুঝতে পেরে ছোরাটা টেনে নিল এবং আবার একবার হাতটা আঘাতে উদ্যত হল।
হেমকান্ত এবার নিজের সর্বনাশ বুঝতে পারলেন। তিনি ভিতু, নিরীহ, নির্বিরোধী বটে, কিন্তু অচল অথর্ব নন। এখনও তার শরীরে মত্ত হাতির বল। এখনও তিনি যথেষ্ট গতিবেগসম্পন্ন। ডান হাতটা বাড়িয়ে তিনি ছোরাসুদ্ধ হাতটা চেপে ধরলেন। ঠিক এই সময়ে ঘোড়ার গাড়ির মাথা থেকে তার গাড়োয়ান গাজী মিঞা সপাটে চাবুকটা চালাল আততায়ির পিঠে।
হেমকান্ত অবশ্য হাতটা ধরে রাখতে পারলেন না। বরং অত্যন্ত ধারালো সেই দোধার ছোরায়। তার হাতের তেলো চড়াৎ করে ফেড়ে গেল। ফোয়ারার মতো রক্ত ঝরতে লাগল হাত দিয়ে।
কিন্তু আততায়ি আর দ্বিতীয় চেষ্টা করল না। গাড়িতে একটা দুলুনি তুলে বেড়ালের মতো লাফিয়ে পড়ে এক দৌড়ে মিলিয়ে গেল পরকালের আবছায়ায়।
গাজী নেমে এল নীচে, হেমকান্তর অবস্থা দেখে ড়ুকরে উঠল, কর্তা! কী হল কর্তা?
হেমকান্ত অস্ফুট স্বরে বললেন, তাড়াতাড়ি কর! খুব তাড়াতাড়ি। আমাকে মনুর কাছে পৌঁছে দে।
গাজী এক মুহূর্ত দেরি করল না। নিজের আসনে উঠে ঘোড়াদুটোকে প্রায় নিংড়ে যতদূর সম্ভব দ্রুত গতিতে এবড়োখেবড়ো রাস্তায় গাড়ি ছুটিয়ে দিল।
যখন বাড়ির দেউড়িতে গাড়ি পৌঁছোল তখনও হেমকান্ত জ্ঞান হারাননি বটে, কিন্তু অত্যধিক রক্তপাতে অবসন্ন হয়ে পড়েছেন। চোখ আধবোজা, ঠোঁট সাদা, রক্তে ভেসে যাচ্ছেন। বিড়বিড় করে শুধু বলছেন, মনু। কৃষ্ণকে দেখো! আমার কৃষ্ণকে দেখো।
খবরটা ছড়িয়ে পড়তে দেরি হল না। বাড়ি ভিড়ে ভিড়াকার হয়ে গেল দেখতে না দেখতে। তিনজন ডাক্তার হেমকান্তর পরিচর্যা করতে লাগলেন। দারোগা রামকান্ত রায় অন্তত দশ বারোজন কনস্টেবলকে নিয়ে এসে হাজির হলেন।
হেমকান্ত মারা গেছেন এরকম একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ায় পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেল। প্রজারা বিলাপ করে কাঁদতে লাগল বারবাড়ির উঠোনে জড়ো হয়ে। দাঙ্গাবাজ কিছু লোক লাঠি, বল্লম আর মশাল নিয়ে বিভিন্ন দিকে ধাওয়া করে গেল।
রামকান্ত রায় গাড়োয়ানের জবানবন্দি নিতে নিতে চারদিককার উত্তেজনা ও শোক লক্ষ করে মৃদু একটু হাসলেন। হেমকান্তর ওপর এই আক্রমণে তিনি অখুশি হয়েছেন বলে মনে হল না।
গাজী তার জবানবন্দিতে বলল, কালীবাড়ি ছেড়ে এসে পড়তেই নির্জন রাস্তায় আচমকা একটা লোক লাফিয়ে পড়ে ঘোড়ার বলগা টেনে ধরে। কাজটা খুবই বিপজ্জনক। কারণ জমিদারবাবুর গাড়ির দুটো ঘোড়াই ওয়েলার এবং শক্তিশালী। তবে গাজী লোকটাকে পাগল ভেবে নিজেই লাগাম টেনে গাড়ি থামায়। কিন্তু গাড়ি থামবার আগেই আর-একজন পাদানিতে উঠে দরজা খুলে কর্তাবাবুকে ছোরা মারে। লোকদুটোর মুখে কালো কাপড় বাঁধা ছিল, রাতটাও ছিল অন্ধকার, ফলে তাদের চেনা যায়নি। তবে দুজনেরই বয়স কম। হোকরা বলেই মনে হয়।
জবানবন্দি নিয়ে রামকান্ত রায় তার ঘোড়ায় চেপে রওনা হয়ে গেলেন। কিছু লোক তাঁর দিকে বিষাক্ত চোখে চেয়ে রইল।
প্রচুর রক্তপাতের ফলে হেমকান্ত সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিলেন। আঘাত খুবই গুরুতর। তবে মৃত্যু যে নিশ্চিত এমন কথা বলা যায় না। চারজন ডাক্তার রোগীকে ভালভাবে পরীক্ষা করার পর নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করতে লাগলেন।
রঙ্গময়ি হেমকান্তের শিয়রের কাছে বসে শূন্য চোখে চেয়ে ছিল সামনের দিকে। বিশাখা রক্ত দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। তাকে তার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অত্যন্ত অস্থির পায়ে রক্তাভ মুখে বারান্দায় উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল কৃষ্ণকান্ত। খালি গা, পরনে ফেরত দিয়ে পরা একটা ধুতি। চোখ দুটো লাল টকটকে। তার নিরীহ, নির্বিরোধ বাবার এই অবস্থা কে করল? স্বদেশিরা? হায় ভগবান, সে যে নিজে মনে মনে ঘোর স্বদেশি!
রাতটা উদ্বেগের মধ্যে কাটতে লাগল।
শেষরাত্রের দিকে হেমকান্তকে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে।
রঙ্গময়ি আর কৃষ্ণকান্ত দুজনেই সঙ্গে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ডাক্তাররা নিষেধ করায় যাওয়া হয়নি।
হেমকান্তকে হাসপাতালে নেওয়ার পর বিশাখার ঘরে বসে ছিল তিনজনে। কৃষ্ণকান্ত, রঙ্গময়ি আর বিশাখা। উপবাস ও উদ্বেগে তিনজনের চেহারাতেই গভীর ক্লান্তির ছাপ। বিশাখার চোখ-মুখ কেঁদে কেঁদে ফুলে উঠেছে। রঙ্গময়ির চোখদুটিও লাল, তবে সে দাঁতে দাঁত চেপে কান্না রুখেছে। কৃষ্ণকান্তের চোখে এক গভীর শূন্যতার চাউনি।
বিশাখা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, কী হবে পিসি? বাবা কি বাঁচবে?
রঙ্গময়ি একটা শ্বাস ছেড়ে বলে, বাঁচবে। সাহেব ডাক্তার দেখছে হাসপাতালে। ভাবিস না তো!
তুমিও তো ভাবছ। আমাকে ভোলাচ্ছ, না?
তোকে ভোলাব কী রে? আমাকে ভোলায় কে? সারাটা জীবন একজনের মুখ চেয়ে বেঁচে আছি না? তোর তো সে বাবা, আমার কী জানিস? আমার কাছে সে-ই ভগবান। তুই বুঝবি না।
বিশাখা রঙ্গময়ির এই অস্পষ্ট স্বীকারোক্তি শুনে এই শোকের সময়েও অবাক হয়ে চেয়ে রইল।
উঠোনে এখনও বিস্তর লোকের জমায়েত। সারা রাত কেউ ঘুমোয়নি। এক-আধজন পাজি লোক রটাতে চেয়েছিল, কাণ্ডটা কোনও মুসলমানের। সেই শুনে একটা উত্তেজনার সঞ্চার হয়েছিল বটে, কিন্তু কিছু প্রবীণ মানুষ গুজবটিকে চাপা দিয়েছেন। এটা যে স্বদেশিদের কাজ সে বিষয়ে এখন মোটামুটি সকলেই নিশ্চিন্ত। লাঠি আর বল্লম নিয়ে যারা আততায়িদের খুঁজতে বেরিয়েছিল তারা ফিরে এসেছে। এখন কী কর্তব্য তাই নিয়ে কথাবার্তা আলোচনা চলছে চাপা গলায়।
শচীন হাসপাতাল থেকে খবর নিয়ে ফিরল। হেমকান্তর অবস্থা খারাপ। তবে এ যাত্রা বেঁচে যেতে পারেন। শুনে উঠোনে জমায়েত লোকজন একটু স্বস্তির শ্বাস ফেলে।
শচীন ধীর পায়ে দোতলায় উঠে আসে। সিঁড়ির মুখেই উদ্বেগাকুল মুখে কৃষ্ণ, বিশাখা আর রঙ্গময়ি।
শচীন একটু হাসল। বলল, ভয় নেই। একটু ভাল আছেন।
বিশাখা বলল, সত্যি কথা বলছেন তো?
সত্যি। জ্ঞান ফিরেছিল।
কিছু বলেছেন তখন?
একটাই কথা বারবার বলছেন। মনু, কৃষ্ণকে দেখো।
রঙ্গময়ি কৃষ্ণকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে একটু ধরা গলায় বলে, বড্ড ভাবে ছেলের কথা।
কৃষ্ণ কোনও কথা বলল না। পাথরের মতো রঙ্গময়ির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল।
শচীন বলল, আপনারা একটু ঘুমিয়ে নিন বরং। আমি আবার হাসপাতালে যাচ্ছি। সব সময়ে খবর নেব। চিন্তা নেই।
রঙ্গময়ি বলে, ঘুম কি আসবে? অমন নিপাট ভাল লোককে যারা মারে তারা কেমন লোক, শচীন?
শচীন একটু হেসে বলে, তারা খারাপ কি ভাল তা জানি না। তবে তাদের সিদ্ধান্ত যে ভুল এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমার মনে হয়, ওঁর পক্ষে এ জায়গা আর নিরাপদ নয়। একটু সুস্থ হলেই ওঁকে কলকাতা বা অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া উচিত।
একথা শুনে তিনজনেই চুপ করে রইল।
সেই নীরবতায় দুজোড়া চোখ আর দুজোড়া চোখের ওপর নির্নিমেষ হয়ে ছিল। শচীন আর বিশাখা।