যে সময়টায় রেমির পেটে ছেলেটা এল সেটা এক অদ্ভুত সময়। তার আর ধ্রুবর মধ্যে এক বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ত্যাগ ও গ্রহণের টানাপোড়েন। ভারী অনিশ্চিত তাদের দাম্পত্য জীবনেব ভবিষ্যৎ। রাজা তখনও হানা দেয় টেলিফোনে, বলে, চলো রেমি, তোমাকে একটা ভদ্র জীবনযাপন করার পথ করে দিই। ও বাড়িতে আর থেকো না। ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে।
এ প্রস্তাবের জবাবে রেমি তখন কিছুই স্থির করে বলতে পারে না। সে কিছুতেই তার পরিচিত ছক, তার চেনা গণ্ডি ছাড়তে সাহস পায় না আর।
লতু যদিও ভীষণ বাচ্চা মেয়ে এবং বাড়িতেও বেশিক্ষণ থাকে না তবু একদিন সে তার বউদিকে লক্ষ করল। বলল, তোমার কী হয়েছে বলো তো!
কী আবার হবে! কিছু না।
ছোড়দার সঙ্গে তোমার হ্যাকনিড সম্পর্কটার কথা জানি। সেটা তো নতুন কিছু নয়। কিন্তু তোমাকে খুব ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে আজকাল। কী গো?
ভারী লজ্জা পায় রেমি। ননদকে লজ্জার কিছু নেই। তবু পায়।
লতুর মারফত কথাটা অতএব প্রচার হয়ে গেল।
আগের বার কৃষ্ণকান্ত পক্ষে ছিলেন না। সম্ভবত কূট সন্দেহবশে তারই আভাসে ইঙ্গিতে পেটের বাচ্চাটা নষ্ট করা হয়েছিল। কিন্তু এবার তিনি রেমির পক্ষ নিলেন। একদিন সস্নেহে ডেকে বললেন, কোথাও গিয়ে একটু ঘুরে-টুরে আসবে? স্বাস্থ্যকর কোনও জায়গায়?
রেমি অবাক হয়ে বলে, কেন বাবা? আমি তো এখানেই বেশ আছি।
রোগা হয়ে গেছ মা, তাই বলছিলাম। মনটাকে সর্বদা উঁচুতে রেখো। ঠাকুর-দেবতার কথা ভেবো। পবিত্র চিন্তা কোরো। এরকমই নিয়ম।
পবিত্র চিন্তা কীরকম তা জানে না রেমি। তবে সে কোনও অপবিত্র চিন্তাও করে বলে মনে পড়ল না। সে মাথা নেড়ে বলল, আচ্ছা।
এসব পুরনো প্রথার কোনও কার্যকারিতা আছে কি না আমি জানি না। তবে না জেনে কিছু ভেঙে ফেলতেও আমার মন সরে না। আমার এক বুড়ি মাসি আছে। তাকে খবর দিয়েছি। এখানে এসে কিছুদিন থাকবে। এ সময়ে বাড়িতে একজন বয়স্কা অভিভাবিকার দরকার।
সময়টা একরকম ভালই কাটছিল রেমির। কৃষ্ণকান্তর মাসি মানুষটি খুবই শুচিবায়ুপরায়ণা। তবে মানুষটা হাসিখুশি। রেমির তাকে খারাপ লাগল না। কৃষ্ণকান্ত একজন মেয়ে গায়েনাকোলজিস্টকে সাপ্তাহিক চুক্তিতে নিয়োগ করলেন, সে এসে প্রতি রবিবার রেমিকে দেখে যায়। পুষ্টিকর খাবার, ওষুধপত্র ইত্যাদির এক বেশ রাজসূয় আয়োজন হল! তাকে নিয়ে ছোটখাটো একটা হইচই!
ধ্রুব আর সে আজকাল একসঙ্গে থাকে নীচের ঘরে। ধ্রুব যে তাকে আগের চেয়ে কিছু বেশি ভালবেসেছে তা নয়। তবু পেটে বাচ্চাটা আসার পর থেকে আর দূর-দূরও করছে না আগের মতো। মায়া! হবেও বা।
ধ্রুব নিজেই একদিন রেমিকে বলল, আটকে গেলে, রেমি। বাঁধা পড়ে গেলে।
তার মানে?
এই যে ছেলের মা হতে চলেছ, খুব জটিল হয়ে গেল সবকিছু।
তাই নাকি? আমার তো কিছু জটিল মনে হচ্ছে না! এরকমই তো হওয়ার কথা।
স্বাভাবিক নিয়মে হওয়ারই কথা বটে, কিন্তু আমি তো সাধারণ নিয়মে চলি না।
তা হলে তুমি তোমার নিয়মেই চলল। আমি চলি আমার নিয়মে।
খুব চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শিখেছ দেখছি।
সবকিছুর মধ্যে অত জটিলতা দেখো কেন?
জটিল বলেই জটিল দেখি। তোমার মতো বোকা তো নয়।
তুমিও একরকম বোকা। স্বাভাবিক কিছুই তোমার ভাল লাগে না।
শোনো খুকি, তুমি বাস করো কৃষ্ণকান্তর পুরনো মূল্যবোধের জগতে। ওই লোকটাও যুগেব সঙ্গে নিজেকে তেমন বদলে নিতে পারেনি। পারেনি বলেই মন্ত্রিত্ব গেছে, রাজনীতিতে প্রভাব কমে যাচ্ছে, কেউ তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। কিন্তু তোমরা শ্বশুর-পুত্রবধু যে জগতে বাস করো তা তত আর বাস্তবিকই নেই। সমাজ একটা স্থাণু জিনিস নয়। বারবার নানা চাপে পড়ে, নানা নতুন চিন্তাভাবনার ফলে তার বিবর্তন হয়। ব্যক্তিগত ধ্যান-ধারণাও পালটে যায়।
বাইরের সমাজে কী হচ্ছে তা দিয়ে আমার কী?
তোমার কিছুই নয়?
না। আমি বেশ আছি।
ধ্রুব হেসে মাথা নেড়ে বলে, না, তুমি বেশ নেই। আমি তোমাকে এত নিশ্চিন্ত থাকতে দেবও না।
কেন দেবে না?
তোমাকে আমার মতো করে জগৎটাকে দেখতে হবে, কৃষ্ণকান্তর মতো করে নয়।
বাবার নাম ধরছ?
ধরার জন্যই নাম। এতে যে চমকে উঠলে ওটাও সংস্কার। জানো, বিদেশে আজকাল মা বাপের নাম ধরে ডাকাটাই রেওয়াজ?
মা গো! ভাবতেও পারি না।
পারো। অভ্যাসে মানুষ সব পারে। পুরনো ধ্যান-ধারণা ছেড়ে একটু ঝরঝরে মন নিয়ে ভাবতে শেখো। তোমার বাস্তবিকই ব্রেনওয়াশ হয়ে গেছে।
মোটেই না। ব্রেনওয়াশ হয়ে থাকলে তোমারই হয়েছে। এমন সব কিস্তৃত কথা বলো যে পিত্তি জ্বলে যায়।
ধ্রুব একটু হেসে বলে, তুমি তো খুব ঘর-সংসার সম্পর্ক সতীত্ব ইত্যাদিকে মানো। তুমি কি জানো যে আমাদের পূর্বপুরুষরা যখন জঙ্গলে বাস করতেন তখন বিয়ে-টিয়ে ছিল না, সম্পর্ক মানা হত না, ঠিক পশুসমাজের মতোই যে-কোনও নারী-পুরুষ মিলিত হত। আমরা তাদেরই বংশাবতংস নানারকম কৃত্রিম নিয়ম-কানুন বানিয়ে ব্যাপারটাকে ছেলেমানুষি করে তুলেছি। জানো এসব?
জানি। তোমাকে আর বক্তৃতা দিতে হবে না। আমি তোমার পছন্দমতো নিজেকে বদলাতে পারব না।
ধ্রুব একটু হতাশার ভাব প্রকাশ করল। তবে হাসলও। বলল, তুমি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়তে না?
আহা, জানো না যেন।
জানি, কিন্তু তোমার হাবভাব দেখে বিশ্বাস হতে চায় না। তোমার শ্বশুর তোমাকে এরকম হিপনোটাইজ করল কী করে বলো তো! আমাকে তো পারেনি। ইন ফ্যাক্ট আমাদের তিন ভাইয়ের কেউই ওই বুড়োর দলে নই। দাদা একজন ডিভোর্সিকে বিয়ে করেছে, বুড়োর খোতা মুখ ভোতা করে দিয়েছে।
তুমি পারোনি বলে দুঃখ হচ্ছে?
আমি অন্যভাবে চেষ্টা করেছিলাম। এ বংশে যা আজও হয়নি সেই ডিভোর্স করে কৃষ্ণকান্তর মুখটাকে যথার্থ কৃষ্ণকান্ত করে দিতাম যদি তুমি একটু কো অপারেট করতে। রাজার সঙ্গে যদি বোম্বাই পালিয়ে যেতে রেমি, তবে সোনায় সোহাগা হত।
আর লিভিং টুগেদার! সেটার কথা বললে না! সেই যে মেয়েটা—
ধ্রুব একটু গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করে, ফিলিং জেলাস?
একটুও না। যাও না তার কাছে, যাও।
যাব?
এক্ষুনি যাও।
খুব যে তাড়া দেখছি! এত উদার হলে কবে থেকে?
কেন? আমি কি খুব পজেসিভ? যদি তাই হতাম তা হলে আমার কাছে তুমি অন্য মেয়ের কথা বলতে পারতে?
তা বলে তুমি উদারও নও।
সব উদারতাই কি ভাল? কতবার তো তোমাকে বলেছি আমাকে একবার মেয়েটাকে দেখতে দাও। কই, দেখাওনি তো! তুমিও তো নও তা হলে?
তুমি তো মেয়েটাকে পারলে খুন করবে!
না, করব না। তোমার পছন্দের মেয়েকে খুন করব কেন? এখন দেখাও। দেখি তুমি আমার চেয়ে কত বেশি উদার।
ঠিক আছে। দেখাব।
কবে?
দেখাব একদিন।
এখানে নিয়ে আসবে?
ধ্রুব একটুও হাসছিল না এখন। মাথা নেড়ে বলল, না। তবে ভেবো না, কথা যখন দিয়েছি ঠিকই রাখব।
একটু বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছিল রেমি। ধ্রুব দেখাবে! সত্যি? কিন্তু তখন কি সহ্য করতে পারবে সে? একটু ঘন শ্বাস পড়ছিল তার। বুক ধড়ফড় করছিল।
ধ্রুব আনমনে অন্য দিকে চেয়ে বলল, কিন্তু কোনও সিন কোরো না। মেয়েটার প্রতি আমার কোনও দুর্বলতা নেই। একটুও না। আমি শুধু এক্সপেরিমেন্ট করছি একটা।
কীসের এক্সপেরিমেন্ট?
একজন নারী ও পুরুষের সম্পর্ক কতটা নির্বিকার হতে পারে। বিশেষ করে যেখানে প্রেম নেই, অধিকারবোধ নেই, আবেগ নেই, অথচ সম্পর্ক আছে।
রেমি বলল, তুমি একটা পাগল। পাগল। ওরকম কিছু হয় না। আর যদি হয়ই তবে আমার সঙ্গেই কেন ওরকম করো না। যা কিছু এক্সপেরিমেন্ট তা আমার ওপরেই হোক।
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, না রেমি। এর জন্য দু’জনেরই মানসিক প্রস্তুতি চাই। ট্রেনিং চাই। তোমার তো নেই।
নেই আবার! এত উপেক্ষা এত অবহেলা আর নিষ্ঠুরতা সইলাম তবু কি ট্রেনিং হয়নি? আর কত চাও?
ধ্রুব একথার জবাব দিল না। কিন্তু আচমকা রেমিকে আদর করল। খুবই উষ্ণ, খুবই আন্তরিকভাবে। মিষ্টি অবসাদে যখন দু’জনেই শরীর এলিয়ে দিল তখন রেমি জিজ্ঞেস করল, তোমার আনন্দ হয় না? থ্রিল হয় না?
কীসের আনন্দ?
এই যে বাবা হবে।
ধ্রুব একটু হাসল। বলল, হয়। কিন্তু সে তোমার আনন্দের মতো নয়।
তুমি কি মঙ্গলগ্রহের মানুষ? কিছুই আমাদের মতো নয়?
বোধহয় তাই। এই পৃথিবীতে বহু গ্রহান্তরের লোক বসবাস করে। তারাই একদিন সংস্কার ও গোঁড়ামিমুক্ত, বুদ্ধি ও যুক্তিগ্রাহ্য একটি সমাজ ব্যবস্থা চালু করবে। সেদিন তুমি আর তোমার শ্বশুরের মতো লোক যাবে নির্বাসনে।
আঃ, ফের বড় বড় কথা। ছেলে হবে, আনন্দ হচ্ছে কি না সেইটে বলো।
বললাম তো, হচ্ছে।
তোমার মুখ দেখে কিন্তু বোঝা যায় না। কেমন গোমড়া হয়ে থাকো।
বাচ্চা হওয়া কি একটা সাংঘাতিক ঘটনা নাকি? ভিখিরিদেরও হচ্ছে তো।
তোমার তো বলতে গেলে প্রথম। একটাকে তো খুন করেছ।
ধ্রুব চুপ করে গেল। তারপর রেমিকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে খুব ভালবাসল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, এখনও সেজন্য দুঃখ পাও, না?
পাব না! কী নিষ্ঠুর তুমি!
বাচ্চাটা কি আমারই ছিল, রেমি?
তোমার নয় তো কার? কী করে যে সমীরকে তোমার সন্দেহ হল! ছিঃ!
ধ্রুব মাথা নাড়ল, আমার নয়। সন্দেহ ছিল তোমার শ্বশুরের। আমি নিমিত্ত মাত্র।
তখন কেন রুখে দাঁড়াওনি? এত যে তুমি মুক্তমনা মানুষ তখন সাহসটা কোথায় ছিল?
সাহস আজও নেই। সেকথা থাক। আমি নিজে উদ্যোগী হয়ে বাচ্চাটা নষ্ট না করলে কী হত জানো?
কী হত?
তোমার শ্বশুর কিছুতেই তোমাকে বাচ্চা নষ্ট করার প্রস্তাব দিতে পারত না। শ্বশুর হয়ে সেটা তো সম্ভব নয়। অথচ তার সন্দেহ ছিল বাচ্চাটা তার বংশের নয়। সেক্ষেত্রে উনি আরও ক্রুড কোনও পস্থা নিতেন। সেকথা তোমার না শোনাই ভাল। হয়তো বিশ্বাসও করবে না।
করব। বলো।
হয়তো একদিন জগাদা বা তোমার শ্বশুরের বশংবদ আর কেউ সিঁড়িতে তোমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিত অসাবধানতার ভান করে। কিংবা তোমার বাথরুমে তেল ঢেলে পিছল করে রাখা হত। কিংবা তোমার খাবারে মিশিয়ে দেওয়া হত কোনও ওষুধ। তোমার নিরাপত্তার কথা ভেবে আমিই অগ্রণী হয়ে নিরাপদে ব্যাপারটা করে ফেলি।
এতটা?–খুব অবাক হয়ে রেমি বড় বড় চোখ করে ধ্রুবর দিকে চেয়ে থাকে। চোখে ভয়।
ধ্রুব খুব নিবিড়ভাবে বুকে আরও চেপে ধরে রেমিকে। বলে, আমাকে বিশ্বাস করবে না তুমি, জানি। শ্বশুরমশাই তোমাকে প্রাণাধিক ভালবাসেন এও সত্য রেমি, কিন্তু বংশমর্যাদা ওঁর কাছে আরও অনেক বড়। আমার মাকে মরতে হয়েছিল শুধু ওই জেদি লোকটার অদ্ভুত কিছু ধারণার জন্য।
বলল, আমি শুনব।
না, একদিনে এত নয়। তোমার মাথা দুর্বল। এত নিতে পারবে না। পেটে বাচ্চা রয়েছে, এ সময়ে এসব বিষন্ন কাহিনি তোমার পক্ষে ভালও নয়।
আমাকে যদি জগাদা ধাক্কাই দিত তা হলে নয় পড়ে মরতামই, তুমি কেন আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলে? তুমি তো আর আমাকে ভালবাসো না।
আমি তোমাকে এক রকম ভালবাসি, রেমি। রকমটা আলাদা। তোমাকে অনেকবার বলেছি, তুমি বুঝতে পারেনি। আমি তোমাকে একজন পৃথিবীবাসী হিসেবেই ভালবাসি।
আর কিচ্ছু নয়?
আর কী চাও, রেমি?
আমি যে কী চাই জানি না। কিন্তু তোমার চোখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি মিথ্যে কথা বলছ। তুমি আমাকে তার চেয়ে একটু বেশি ভালবাসো।
না, রেমি। আমি ভাল না বাসার চেষ্টা করছি। আমি চেষ্টা করছি আমার ভালবাসাকে ব্যক্তিবিশেষে সীমাবদ্ধ না রেখে সকলের প্রতি সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে। তোমার প্রতি তাই আমার বিশেষ দুর্বলতা থাকতে নেই।
সেটা তো থিয়োরেটিক্যাল কথা। আসল কথাটা?
আসল কথা!–ধ্রুব একটু ভাবল। তারপর রেমিকে ছেড়ে দিয়ে নিরুত্তাপভাবে চিত হয়ে শুয়ে মশারির চালের দিকে চেয়ে থেকে বলল, তোমার প্রতি আমার একটু আসক্তি ছিল। কবে কেমন করে সেটা হল তা বলতে পারব না। হয়তো আমার প্রতি তোমার টান দেখেই রেসিপ্রোকাল একটু টান আমারও হয়েছিল। সেটা ভাঙতেই আমি আর-একটা মেয়েকে আমদানি করেছে। সে তোমার। প্রতিপক্ষ নয়। সে আসলে আমাকে একটা ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করছে। তাই বলছিলাম তাকে তোমার হিংসে করার কিছু নেই।
রেমি বড় অবাক হল। ধ্রুবর পাগলামি কোথায় পৌঁছেছে তা ভেবে একটু ভয়ও পেল সে। গাঢ়স্বরে বলল, ওগো, পায়ে পড়ি। আমাকে বরং ভালবেসো না। কিন্তু ভারসাম্য আনতে গিয়ে তুমিই যে ব্যালান্স হারিয়ে ফেলছ! এসব কী হচ্ছে বলো তো!
খুব অদ্ভুত! না?
ভীষণ অদ্ভুত। এ যে পাগলামি!
এর চেয়ে নরম্যাল আর কী হতে পারে, রেমি? আজ পাগলামি বলে মনে হলেও ভবিষ্যতের মানুষ যদি কখনও আমার এক্সপেরিমেন্টের কথা জানতে পারে তা হলে বলবে বিংশ শতাব্দীতে এই একটা সত্যিকারের নরম্যাল লোক ছিল।
ওই মেয়েটাও কি তোমার মতো পাগল?
মেয়েটা! ওঃ, মেয়েটার কথা যে তুমি কেন ভুলতে পারছ না!
ভুলব? কী সর্বনেশে সব কাণ্ড করছ তুমি, এ কি ভোলা যায়?
তোমাকে অনেকবার বলেছি রেমি, মেয়েটা কোনও ফ্যাক্টর নয়। মেয়েটা অ্যাকচুয়ালি নন-এনটিটি।
কেন নন-এনটিটি হবে? সেও তো একটা মানুষ?
মানুষ তো বটেই। কিন্তু তোমার প্রতিপক্ষ নয়। আবার বলছি আমি তার প্রেমে পড়িনি। আমি একটা সার্বজনীন ভালবাসা আয়ত্ত করার চেষ্টা করছি।
তুমি পাগল।
এই বলে রেমি অনেকক্ষণ কাঁদল। ধ্রুব বাধা দিল না। চুপ করে শুয়ে রইল।
এই ঘটনার কিছুদিন পরে এক দুপুরে একটি মেয়ে টেলিফোনে রেমিকে চাইল। রেমি গিয়ে ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে মেয়েটি বলল, আমি ধারা।
ধারা! কে ধারা?
আমি আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।
কেন বলুন তো!
দরকার আছে। একটু এক জায়গায় আসতে পারবেন?
রেমি অস্বস্তিতে পড়ে বলে, না, সেটা সম্ভব নয়।
কেন? বাড়ির রেস্ট্রিকশন আছে?
তাও আছে। আমার শরীরও ভাল নয়।
আপনি যে প্রেগন্যান্ট তা আমি জানি। কিন্তু বেশি দূর নয়।
আপনিই আসতে পারেন তো! আমার শ্বশুরমশাই আমাকে বেরোতে নিষেধ করে গেছেন।
আমি আসব?–মেয়েটা যেন অবাক হয়ে বলে, সেটা কি ভাল দেখাবে?
আপনি কে বলুন তো! ধারা নামে কাউকে আমার মনে পড়ছে না তো!
আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। ধ্রুব কি আপনাকে কিছু বলেনি?
ও কী বলবে?
আমার পরিচয়।
না। ও কি চেনে আপনাকে?
মেয়েটি একটু হাসল, চেনে। তা হলে আমিই কি আসব?
আপনার ইচ্ছে।
ধ্রুব বলছিল আপনি আমাকে দেখতে চান।
একথায় রেমি হঠাৎ চমকে ওঠে। তারপর স্তব্ধ হয়ে যায়।
মেয়েটি আবার বলে, আমি কি সত্যি আসব?
রেমির মাথাটায় গণ্ডগোল লাগতে থাকে। ধ্রুব কথা রেখেছে, কিন্তু সে নিজে কেন মাঝখানে নেই? এখন কী বলবে রেমি? তার পা কাঁপছে। বুক কাঁপছে।
রেমি অত্যন্ত বিতৃষ্ণার সঙ্গে বলে, আপনার ইচ্ছে।
আমার তো ইচ্ছে নেই। আপনার ইচ্ছে বলেই যাওয়া।
ঠিক আছে, আসুন।
এখন গেলে আপনার কোনও অসুবিধে নেই তো।
না, অসুবিধে কীসের?
তা হলে উইদিন ফিফটিন মিনিটস! কেমন?
ঠিক আছে।
পনেরোটা মিনিট কী করে যে কাটল রেমির তা আজ আর সে বলতে পারবে না। ওই পনেরো মিনিট তার কাছে পৃথিবীটা একদম শূন্য হয়ে গিয়েছিল। কোনও অনুভূতি, রাগ, হিংসে, জ্বালা কিছুই বোধ করেনি সে। বোধ করেনি শীত বা তাপ। যা সন্দেহের মধ্যে ছিল, অনুমানের রাজ্যে ছিল, যা ছিল চোখের আড়াল এবং যাকে শেষ পর্যন্ত চোখমুখ বুজে ভুলে থাকা যেত সেটা এমন রূঢ় বাস্তব হয়ে আসছে দেখে বড় অসহায় হয়ে গিয়েছিল রেমি। দু’চোখ দিয়ে অজস্র ধারায় শুধু জল বেয়ে পড়ল কোলের ওপর। পায়ের তলা থেকে বাস্তবিকই মাটি সরে যাচ্ছে।
একজন চাকর এসে বলল, আপনার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছেন। ড্রয়িংরুমে বসিয়েছি।
রেমি আর চমকাল না। উঠে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গেল। চোখ মুছে একটু পাউডার দিল মুখে। চুলটি আঁচড়ে নিল। তারপর কলিং বেল টিপে চাকরকে ডেকে বলল, মেয়েটাকে এ ঘরে নিয়ে আয়।
মেয়েটি ঘরে ঢুকতেই ঘরটা যেন ভরে গেল স্নিগ্ধ রূপে। রেমি আশা করেছিল, ধ্রুব যেমন বলেছে তেমনই হবে বোধ হয় মেয়েটা। কালোটালো, কুচ্ছিত, তা মোটেই নয়। আদ্দিকালে যেমন পানপাতার মতো মুখের কথা শোনা যেত এর মুখটাও তেমনি ভরাট, নিটোল, চোখের মণি একটু খয়েরি, কিন্তু মস্ত মস্ত দুটো চোখা ঠোঁট পুরন্ত। ডগমগ করছে শরীর। চোখের দৃষ্টি অতি উজ্জ্বল। মুখে মিষ্টি ভদ্র হাসি। পরনে মণিপুরি কাজ করা তাঁতের দারুণ শাড়ি। রেমি একটু হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল দেখে।